দ্বিতীয় অধ্যায় – বাঙালি সমাজে অনুসৃত প্রধান ধর্মসমূহ (The Major Religions Practised in the Bangali Society)
হিন্দু ধর্ম (Hinduism )
হিন্দুধর্মের উৎপত্তি কখন কীভাবে— এ সম্পর্কে যেসব গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায় তা এখনও তর্কাতিত নয়। তবে নিত্য ধর্মের আচার-আচরণীয় বিষয় বলে একে সনাতন ধর্ম বলা হয়। হিন্দু ধর্ম আর্য প্রাগার্য সমন্বয়ে একটি ধর্ম আদিবাসীদের ধর্ম ও যাযাবর আর্যদের সঙ্গে নিয়ে আসা ধর্মের মিলনজাত ধর্ম হল হিন্দু ধর্ম। এদিক থেকে হিন্দু ধর্মকে আদি সনাতন ধর্মও বলা যায়। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু ধর্ম আর্যধর্ম নামে পরিচিত। এর উৎসস্থল ‘স’ কে ‘হ’ উচ্চারণ করতেন। সুতরাং ‘সিন্ধু’ শব্দ থেকেই ‘হিন্দু’ শব্দটির উৎপত্তি হয়। হিন্দু ধর্মকে বৈদিক ধর্ম বলে। চতুর্বেদ ধর্মের মূল বিষয়। বস্তু ঋষি, মুনি, আচার্য ও ভক্তের বিচিত্র ধর্মীয় ও নৈতিক অভিজ্ঞতা ও উপদেশই হিন্দু ধর্মের ভিত্তি। হিন্দু ধর্মকে দুভাগে ভাগ করা যায়। একটি সামান্য ধর্ম অন্যটি বিশেষ ধর্ম। নীতিসম্মত আচার আচরণের কর্তব্যসমূহকে সামান্য ধর্ম বলা যায়। যেমন ধৈর্য, দান, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, ধীবিদ্যা, সততা এবং আক্রোধ প্রভৃতি। এদের মাধ্যমে চিত্তের বিশুদ্ধ আনয়ন করা যায়। অপরদিকে কাল সময় অবস্থা অথবা মানব ভেদে যেসব নীতি অবশ্যই করণীয় সেগুলি হল বিশেষ ধর্ম।
হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। বেদ শব্দের অর্থ ‘জানা’ (To Know) আর সামষ্টিক জানাকে বলা হয় বেদান্ত। যে সকল মহাপ্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ ‘বেদ’ আবিস্কার করেছেন তাঁরা ‘ঋষি’ নামে পরিচিত। ঋষিগণকে মন্ত্রদ্রষ্টারূপে অভিহিত করে ভবিষ্যদর্শীও বলা হয়। পৃথিবীতে প্রচলিত বৃহৎ ধর্মসমূহের মধ্যে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ দৃশ্যত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। হিন্দুধর্মে যে সকল গ্রন্থকে পবিত্র বলে জ্ঞান করা হয় তার মধ্যে বেদ হচ্ছে অন্যতম প্রধান। সংস্কৃত ‘বিদ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন বেদ শব্দের প্রতীকী অর্থ ‘বেদ’ তথা জ্ঞান। জ্ঞান বলতে ঈশ্বর, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে পারমার্থিক জ্ঞানই বুঝায়। সৃষ্টি যেমন অনাদি ও অনন্য, ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞানও তেমন অনাদি অনন্ত। ঈশ্বর ও সৃষ্টি সম্পর্কে এই শাশ্বত ও অফুরন্ত জ্ঞান কলেবর পবিত্র বেদগ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে। এক কথায় বলা চলে বিশ্ব চরাচরে বিরাজমান এই অপরিমেয় জ্ঞানরাশির যে সামান্যাংশের সন্ধান হিন্দু তত্ত্বদ্রষ্টাগণ পেয়েছিলেন তারই লিপিবদ্ধকরণ হচ্ছে বেদ। পবিত্র বেদের সন্ধান পাওয়া সকল ঋষিগণের নাম জানা যায়নি। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ, বিশ্ববারা ও লোপমুদ্রার ন্যায় চার পুরুষ ও দুই নারী ঋষির প্রসিদ্ধি আছে। বেদের চারটি খণ্ড রয়েছে— ১. ঋকবেদ ২. যজুর্বেদ, ৩. সামবেদ, ৪. অথর্ববেদ।
বেদ ঐশ্বরীয় না মনুষ্য সংকলিত এর বিভাজনের পূর্বাপর ইতিহাস নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ আছে। ইতিহাসের অভিজ্ঞানেও দেখা যায়, কুমারী মৎসগন্ধ্যার গর্ভে পরাশর মুনীর ঔরশজাত দ্বৈপায়ন (মহাভারত দ্রষ্টব্য) নামক পুত্র (যিনি দেবব্যাস নামে পরিচিত) বেদকে ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব এই চার খণ্ডে ভাগ করেন। ব্যাসের চারজন শিষ্য পৈল, বৈশ্বম্পয়ন, জৈমিনি ও সুমন্তকে যথাক্রমে উপরোক্ত ভাগ চতুষ্টয় শিক্ষা দেয়া হয় যাতে তারা স্মৃতিতে ধারণ করতে পারে। ব্যাসদেব কর্তৃক বেদভাগ বণ্টনটি নিম্নরূপ : পৈল প্রাপ্ত হলেন ঋকবেদ, জৈমিনি, প্রাপ্ত হলেন সামবেদ, বৈশ্বম্পয়ন প্রাপ্ত হলেন যজুর্বেদ, আর সুমন প্রাপ্ত হলেন অথর্ববেদ। চতুর্বেদের প্রত্যেকটি পাঠের বিশেষ পদ্ধতি আছে।
ক. ঋগ্বেদ : সূর্য, অগ্নি, ঊষা, বায়ু, বরুন প্রভৃতি প্রাকৃতিক পদার্থের উদ্দেশ্যে রচিত প্রার্থনাবাণী সমূহের গদ্য ছন্দে রচিত অংশ এতে স্থান পেয়েছে। গদ্য ছন্দযুক্ত বাক্যকে ঋক বলে। ঋগ্বেদ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন
খ. সামবেদ : সাম অর্থ গান। যে সব মন্ত্র সুরসহযোগে পঠিত হয় তা এতে স্থান পেয়েছে। এতে যজ্ঞাদি ও বিধিনিষেধ বর্ণিত।
গ. যজুর্ব্বেদ : যজন অর্থ পূজার্চ্চনা, যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতি। এতে যজন-যাজনাদি সংক্রান্ত মন্ত্রগুলি সন্নিবেশিত। মন্ত্রগুলো ‘কাড়ী’ ছন্দে রচিত। যজু অর্থ ‘কাড়ী’ সমষ্টি। এগুলো সন্ধির নিয়মে পাঠ করা যায়, কিন্তু ঋগ্বেদে তা নিষিদ্ধ।
ঘ. অথর্ববেদ : ‘অথর্ববেদ’ই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, এটি সন্ধি’র নিয়মে রচিত। এর ছন্দ ঋক ও যজুর্বেদের মত নয়। বরং ‘ভর’ নামক বিশেষ ছন্দে রচিত। অন্য সব বেদের তুলনায় অথর্ববেদে তাদের অনুরাগ, অল্প এর অধিকাংশ অংশকে বিলুপ্ত বলে মনে করা হয়েছে।[৪]
বেদকে আবার চার অংশে ভাগ করা হয়েছে। যথা : সংহিতা, ব্ৰাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ হল কর্মকাণ্ড, যাগযজ্ঞ, দেবতাদের স্তুতি ও প্রার্থনা, আর ‘আরণ্যক’ ও ‘উপনিষদ’ ভাগে রয়েছে জ্ঞানকাণ্ড সম্পৰ্কীয় মন্ত্রসমূহ। এই ‘উপনিষদ’ই হল বেদের অন্ত বা সার ভাগ যে কারণে একে বেদান্তও বলা হয়। বেদের আনুষঙ্গিক ছয় প্রকার শাখা আছে যাদের বেদাঙ্গ বলে। ব্রাহ্মণের সংখ্যা ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদে ২টি করে, সামবেদে ৮টি ও অর্থববেদের মাত্র ১টি। ‘স্মৃতি’ নামে বেদ হতে উৎপন্ন একটি বিধিনিষেধ পুস্তকও বিদ্যমান।
উল্লেখ্য যে, বেদকে হিন্দুরা ঐশী গ্রন্থরূপে জানে এবং এর রচনাকে কারো প্রতি আরোপ করে না। ব্যাসকে তারা ‘বেদ’-এর সংকলক ও বিভাজক বলে, রচয়িতা নয়। ‘বেদ’ ব্যতীত তাদের অন্য সকল ধর্মগ্রন্থ কোন-না-কোন রচয়িতা’র প্রতি আরোপ করা হয়। অবশ্য ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’কে প্রতিটি হিন্দুই সাক্ষাৎ ভগবানের মুখ নিঃসৃত বাণী বলে বিশ্বাস করে। সর্বসাধারণের নিকট বেদের শিক্ষা প্রচার ও এর মর্মকথা উদ্ঘাটনে যেসব গ্রন্থ বিদ্যমান তন্মধ্যে বেদান্ত সূত্র ও এই ভগবৎ গীতাই সুপ্রসিদ্ধ।
ভারতের প্রাচীন ধর্মীয় পুস্তক হিসেবে সনাতন ধর্মের অনুসারী আর্যরা যে পুস্তক ব্যবহার করত, তা ঋকবেদ। এতে ১০২৮টি স্তোত্র বিধৃত ছিল। যা সম্ভবত ১৫০০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত ও গ্রন্থিত। পরে যে তিনটি বেদ রচিত হয়, তা মূলত ঋকবেদেরই ধারক ও বাহক। যেমন, সামবেদ ঋকবেদের কয়েকটি স্তোত্র সংকলিত আছে, যা ঐতিহাসিকদের কাছে মূল্যহীন। যজুর্বেদ (ঋকবেদের দুই শতাব্দী পরে সংকলিত) ঋকবেদের বলিয়ান বিষয়ক বিস্তৃত ব্যাখ্যা ও প্রক্রিয়া। আর অথর্ববেদ হল পুরোহিতদের ব্যবহারিক বিধানমালা।
ঋগ্বেদে বেশ কয়েকজন দেবীর বর্ণনা আছে। যেমন, পৃথ্বী, অদিতি, উষা, রাত্রি ও অরণ্যানী (বনদেবী)। পরবর্তীসময়ে আর্যজাতির আর একটি শাখা যখন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে, তখন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে গ্রিক জিউস ও রোমান জুপিটারের ধারায় পুরুষ প্রকৃতিকে ধরে মাতৃদেবীর স্থলে পিতৃদেব স্থান পায় এবং স্বর্গদেবতা দাউসের আবির্ভাব হয় যা পরবর্তীকালে ইন্দ্রের রূপ ধারণ করে। তারপর বায়ু, সূর্য, বিষ্ণু, অগ্নি, অশ্বিনী ইত্যাদির কথা এবং আনুষঙ্গিক আরও সব।
ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মতে, ‘হিন্দুধর্মের মূলভিত্তি বেদ। ঋগবেদ অর্থাৎ ঋকসংহিতা জগতের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ, যা তিলকের মতে ৪৫০০ খ্রি. পূর্বে রচিত। এখানে একটি মহাদেবের অর্থাৎ মহাদেবতা উপাসনার কথা আছে। ঋকবেদের পুরুষসুক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রে রয়েছে : ‘পুরুষ এবেদং সবম যদ্ ভূতম যশ্চভম্যম’ অর্থাৎ বর্তমানে যা আছে, অতীতে যা ছিল এবং ভবিষ্যতে যা হবে, সে সমস্তই পুরুষ। দীর্ঘতমা ঋষির মন্ত্রে ‘একং সদ্বিপ্রা বহুদা বদন্তি’–এই দেবতা একই, বিপ্রগণ বহু বলেন।
পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেন, ‘অনেক হিন্দু মনে করেন বেদ একটি প্রেরিত পুস্তক। ‘বিদ’ শব্দ থেকে ‘বেদ’— উৎপত্তি। এটি সেকালের চলমান জ্ঞানের সংকলন মাত্র। সেকালে কোন পৌত্তলিকতা ছিল না, দেবতাদের জন্যও কোন মন্দির ছিল না। আস্তে আস্তে ঈশ্বর সম্বন্ধে মানুষের মনে ধারণা জন্ম নেয়। প্রথমে অলিম্পিয়ানদের মত ঈশ্বরের অবস্থান ছিল, পরে একেশ্বরবাদ, তারপর এর ধারণা বা মনিবাদের জন্ম। এসব ঘটনা ঘটতে প্রায় একশো বছর লেগে যায়। তারপর বেদের শেষে অবস্থা। অর্থাৎ বেদযুক্ত অন্ত থেকে বেদান্ত দর্শনের উৎপত্তি। আদিম বেদের কালে আর্যদের জীবন সম্পর্কে বেশি সচেতনতা ছিল, আত্মার প্রতি তত দৃষ্টি দেয়ার সময় ছিল না। পরে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মৃত্যুর পর জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে, অর্থাৎ পুনর্জন্মবাদের উৎপত্তি হয়।’ (Discovery of India, page 59) ।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে উপনিষদ বেদের সমান্তরাল না হলেও সন্নীকটবর্তী। উপনিষদ শব্দের অর্থ হল অতি নিকটে থেকে যে বিদ্যা গ্রহণ করতে হয়, একে ‘গুহ্যজ্ঞান’ও বলা হয়ে থাকে। ঈশ্বর কোথায় এবং কীভাবে বিরাজমান, মানুষ ও জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক নিয়ে উপনিষদের মুখ্য আলোচনা। যে জ্ঞানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সন্ধান পাওয়া যায় তাকেই উপনিষদ বলে। উপনিষদ হচ্ছে বেদের সারাংশ এবং বেদের সেই অংশ যেখানে শুধুমাত্র পারমার্থিক জ্ঞান নিয়েই উপদেশাবলী দেয়া হয়েছে। উপনিষদে দেবতাদের কোন স্থান নেই, একমাত্ৰ ব্ৰহ্মই বা ঈশ্বরই এর প্রধান আলোচ্য বিষয়। উপনিষদে বলা হয়েছে যে জগতের মূলে আছেন এক ব্ৰহ্ম। তিনি সত্য, চৈতন্যময় ও জ্ঞেয়; আর অন্য সমস্ত অসত্য, জড় ও অজ্ঞেয়। জীব এবং ব্রহ্ম এক, এই দুইয়ের কোন পার্থক্য নেই।, ব্রহ্মের সাক্ষাৎ পেলেই জীবের মুক্তি হয়। ব্রহ্মপ্রাপ্তিই হচ্ছে জীবের একমাত্র কামনা। উপনিষদের মোট সংখ্যা এগারো। যেমন- ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ড্যক, মাণ্ডুক্য, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক ও শ্বেতাশ্বর
বৈদিক যুগের ধর্মদর্শনসমূহ খুবই কঠিন ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার কারণে সাধারণ ধর্মানুসারীগণ হিন্দুধর্মের প্রকৃত আশ্বাদ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। বৈদিক যুগে অর্থাৎ যে সময়কালে বেদ প্রকাশিত হয়েছিল তখন পুজা অর্চনায় কোন মূর্তি বা দেবদেবীর প্রতিকৃতি ছিল না। হিন্দু ধর্মাচারসমূহকে অনুসারীগণের মধ্যে সহজবোধ্য করার লক্ষ্যে গল্প কথায় ধর্মকে সাধারণের কাছে পরিচিতকরণের কাহিনী রূপককেই পুরাণ বলা হয়। পুরাণ গ্রন্থে সাহিত্যের মধ্যে ধর্ম প্রকাশ পেয়েছে।
পুরাণ গ্রন্থসমূহের মূল সংখ্যা আঠারো। এগুলি যথাক্রমে ব্রহ্ম পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, শিব পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ, গরুড় পুরাণ, নারদীয় পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবদ পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, বামন পুরাণ, বরাহ পুরাণ, মৎস পুরাণ, কুর্ম পুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। এ গ্রন্থগুলোর রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে সপ্তম খ্রিষ্টাব্দ সময়ের মধ্যে পৌরাণিক যুগে অর্থাৎ যে সময়ে পুরাণ রচিত হতে শুরু হয় তখন সনাতন ধর্মের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হতে দেখা যায়। বৈদিক ধর্ম ও দর্শনকে লোকায়ত চেতনার অনুসঙ্গী করার প্রচেষ্টায় পুরাণের উদ্ভব ঘটে। বৈদিক আর্যদের প্রধান ধর্মানুষ্ঠান ছিল দুশ্চর যজ্ঞকেন্দ্রিক। কিন্তু পুরাণ প্রণয়নকালে সেই ধর্মানুষ্ঠানকে পূজা-পার্বণ ও ব্রতকেন্দ্রিক করা হয়। পুরাণেই দেবদেবীদের মানবায়ন ও জীবের আকৃতি দেওয়া হয়। পুরাণেই হিন্দুধর্মের এখনকার বর্তমান প্রচলিত পৌত্তলিকতার বীজ রোপিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেদ ও উপনিষদ বহির্ভূত বহু সংখ্যক দেবদেবীর কল্পনা, মূর্তি বা প্রতিমা নির্মাণ, বর্তমান পদ্ধতিতে তাদের পূজার্চনার পদ্ধতির উদ্ভাবন প্রভৃতি পুরাণেরই অবদান। অনুসন্ধানে দেখা যাবে যে, পুরাণের শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই হিন্দু সমাজের বর্তমান কাঠামোটি গড়ে উঠেছে। আবুল হোসেন ভট্টাচার্য মনে করেন, ‘মূর্তিপূজার সূচনা এখন থেকে পাঁচ হাজার বছরের ঊর্দ্ধে নয়’ (মূর্তিপুজার গোড়ার কথা)। আল বেরুনী তাঁর ভারত-তত্ত্ব গ্রন্থে হিসেবে করে দেখিয়েছেন যে মুলতানের রক্তবর্ণের চর্মাকৃত এবং রক্তবর্ণের চক্ষু-তারকা বিশিষ্ট আদিত্য (সূর্য) দেবের কাষ্ঠমূর্তিটি ‘কৃত্য’ যুগের শেষে নির্মিত হয়ে থাকলে এখন থেকে তার সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় ২,১৬,৪৩২ বছর। পুরাণ সমূহের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বিশ্বকোষের অভিমত : Purans disorderd geneologis of kings compounded with legends, put in present from fourth century A. D. and latter (W. L. Lenger)। ডব্লিউ এল লেঙ্গারের মতে, যিশুখ্রিষ্টের ৪০০ বছর পরে অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে পুরাণ রচিত হয়েছে। ডক্টর বেদপ্রকাশ উপাধ্যায়ের মতে, পুরাণ রচনার সময়কাল প্রায় ২,৫০২ খ্রি.পূ. ২৫৬৩ খ্রি. পূর্বের মধ্যকাল (‘বেদ ও পুরাণের ভিত্তিতে ধর্মীয় ঐক্যের জ্যোতি’)। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৩৫০০, ৪০০০ বছর পূর্বে পুরাণ রচিত হয়েছে। যাই হোক ‘বেদব্যাস মুনি কর্তৃক পুরাণ সমূহ প্রণীত হয়েছে’– এই দাবি সত্য হলে পুরাণ সমূহের বয়স পাঁচ হাজার বছরেরও কম সাব্যাস্ত করাই সমীচীন। তবে ভারতীয় ধর্ম দর্শনে পুরাণের চেয়ে উপনিষদের প্রভাবই বেশি। যার অনেক অনুকৃতিই আজ রাষ্ট্রীয় আদর্শেরই অঙ্গিভূত হয়েছে।
ভারতের প্রাশাসনিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বহু উপনিষদীয় বাক্য। ভারতের রাষ্ট্রচিহ্ন অশোক চক্রের নিচেই সন্নিবেশিত হয়েছে উপনিষদীয় বাণী ‘বহুজনহীতায়, বহুজনসুখায়’। ভারতীয় বীমা করপোরেশনে গৃহীত হয়েছে ‘যোগ ক্ষেমং বহাম্যহম্’। নৌবাহিনীর আদর্শ স্থির হয়েছে ‘সং নো বরুণঃ’। লোকসভার অধ্যক্ষের আদর্শ স্থির হয়েছে ‘ধর্মচক্রাপ্রবর্তনায়’। লোকসভার দ্বারে লিখিত হয়েছে ‘ন সা সভ্য যত্র ন সন্তি বৃদ্ধা, ন তে বৃদ্ধাঃ যেন বদন্তি ধর্মম।’ পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায়ও এই শ্লোকটি পুরো উৎকীর্ণ হয়েছে। ডাক তার বিভাগের আদর্শ স্থির হয়েছে ‘অহর্নিশ সেবামহে।’ দার্জিলিং-এ হিমালয়ে আরোহণের কেন্দ্রের আদর্শ সংস্থানেও স্থিরীকৃত হয়েছে উপনিষদীয় বাক্য। শুধু ভারতবর্ষ নয় থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের লোকজীবনের নৈতিক আদর্শ উপনিষদ, গীতা, মহাভারত ও রামায়ণ প্রভাবিত। যেমন : হিতোপদেশ-এর বাক্যটি…
অয়ং নিজঃ পরো বেতি গণনা লঘুচেতসাম্।
উদারচরিতানান্তু বসুধৈব কুটুম্বকম্।
অর্থাৎ লঘুচিত্তের মানুষেরাই আপন-পর গণ্য করে, কিন্তু উদারচিত্তের মানুষ বিশ্বের সকলকেই আপন করে নেয়। এই উপমহাদেশের সর্বধর্মচর্চা ও গবেষণার প্রাচীন প্রতিষ্ঠান চেন্নাইয়ের থিওসফিক্যাল সোসাইটিরও আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছে উপনিষদীয় ‘সত্যানাস্তি পরোধর্মঃ’—সত্যের চেয়ে বড়ো কোন ধর্ম নেই— এই বাক্য।
হিন্দুধর্মে সহায়ক স্তরের ধর্মগ্রন্থসমূহকে বলা হয় ‘স্মৃতিশাস্ত্র’। সংস্কৃত ‘স্মৃতি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে স্মরণ বা ইংরেজিতে Memory। এতে হিন্দুদের জীবন প্রণালী নির্বাহের দিক-নির্দেশনা আছে। ঋষি, মনু, যাজ্ঞবল্ক্য ঋষিগণ স্মৃতি থেকে হিন্দু জীবন কীভাবে কাটাতে হবে সে সম্পর্কে বর্ণনাই হচ্ছে স্মৃতিশাস্ত্র।
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের বড় সাহিত্য হল বেদ। পরিপূর্ণ দশ হাজারের বেশি শ্লোকের সমাহার। সমাজ জীবনের সম্পূর্ণ চিত্রও মেলে বেদে। মানুষে মানুষে প্রকারভেদ আজও তেমন কোন তারতম্য ঘটেনি। মানব প্রকৃতির চিত্রও এক। ‘সাংমনস্য’ শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে রচিত সূত্র পারিবারিক, অর্থাৎ তখনও সব পরিবারে নিরন্তর সুখ, শান্তি ছিল না। যা আজও তেমনই আছে। বৈদিক চরিত্রগুলিও ছিল বিশ্বাসযোগ্য। বেদে বহু তথ্য আমরা পাই। উদ্ভিজ, প্রাণিজ, খনিজ কর্মবিভাগ, জাতিভেদ, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস সবই পাই বেদে। প্রকৃতি, সমাজ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন সাধনার সন্ধানও মেলে। দুঃখ দারিদ্র্যও স্মরণ করতে হলে ঋষি বামদেবের কথা বলা যায়। তিনি বলছেন, ‘অভাবে কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খেয়েছি।’ চণ্ডালের পরিত্যক্ত ওই নাড়িভুঁড়ি খেতে হয়েছে ঋষিকে। অর্থাৎ বেদে ক্ষুধা, অনাহারের কথা বহু বহুবার উচ্চারিত— যা আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বৈদিক সমাজব্যবস্থার বিশেষ বিশেষ অংশে বর্তমানের সঙ্গে সাযুজ্য আছে।
বেদের পঁচাত্তরভাগ সূক্তই (শ্লোকসমষ্টি) প্রার্থনা নির্ভর। বাকি পঁচিশ ভাগের মধ্যে বেশ কিছু অংশ উন্নত চিন্তার পরিচায়ক। সে অর্থে, সবদিক থেকেই বেদ প্রাচীনকালের অনবদ্য প্রতিরূপ। বেদেই প্রথম ভারতীয় ভাষায় সাহিত্য চিন্তাধারার বিকাশ। এক কথায় বেদ এক অপরিহার্য উত্তরাধিকার।
অধিকাংশ হিন্দুর গার্হস্থ্য জীবনে অনুসৃত এক মহাকাব্যিক আখ্যান রামায়ণ। রচয়িতা কে ও রচনা-কাল কখন? ডক্টর সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতে : ‘রচনাকালের দিক থেকে দেখলে রামায়ণ খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় দশকের মধ্যে রচিত; মহাভারত রচনা সম্ভবত শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতক থেকে এবং শেষ হয় খ্রিষ্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ বুদ্ধের পরের আট বা ন-শ বছরের মধ্যে এ দুটি মহাকাব্য রচিত হয়; এদের মধ্যে মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়, রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়; আগে পূর্ণকলেবর মহাকাব্যের রূপ পায় বলেই সম্ভবত এর নাম আদিকাব্য। মনে রাখতে হবে, রামায়ণ শেষ হবার কাছাকাছি সময়ে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে : কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাৎস্যায়নের কামসূত্র, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং মনুসংহিতা এই ক্রান্তিকালের রচনা এবং এর কিছু পরেই শুরু হয়ে যায় পুরাণগুলির রচনা। রামায়ণ ও মহাভারতে পরবর্তী সংযোজিত অংশগুলি অভিপৌরাণিক অর্থাৎ পুরাণে প্রতিফলিত যে সামাজিক মূল্যবোধ ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সমাবেশে ভারতীয় ধর্মচিন্তা, তার বিবর্তিতরূপে ক্রমে ‘হিন্দুধর্ম’ বলে অভিহিত হল, এই অভিপৌরাণিক অংশেই আমরা সেগুলির সাক্ষাৎ পাই।
ম্যাক্স মুলারের মতে, খ্রিষ্টের জন্মের ১০০০ বৎসরেরও পূর্বে রচিত ঋগ্বেদই সমগ্র সভ্য জগতের আদি গ্রন্থ। ‘On thing is certain; there is nothing more ancient and primitive, not only in India, but in whole Aryan world that the hymns of the Rig-Veda”? (Max muller, The Origin and Growth of Religion) ।
বেদ এবং গীতায় চার শ্রেণির মানুষের কথা বলা হয়েছে। তারা হল— আর্ত, অর্থার্থী, ভক্ত ও জিজ্ঞাসু। যে আর্ত সে বিপদ থেকে পরিত্রাণের প্রত্যাশায় স্রষ্টার আরাধনা করে। যে অর্থার্থী সে অভাব বা ইচ্ছা (পরীক্ষায় পাশ, মামলায় জয়লাভ, রোগমুক্তি, চাকরিপ্রাপ্তি প্রভৃতি) পূরণের প্রয়োজনে স্রষ্টাকে স্মরণ করে। যে ভক্ত সে বিনা শর্তে স্রষ্টাকে স্মরণ করে। আর যে জিজ্ঞাসু সে তার অনুসন্ধিৎসা মিটানোর জন্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্রষ্টার মহিমাকে উপলব্ধি করতে চায়।
সুদূর অতীতে জরা-মৃত্যু, রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারি, প্লাবন, ভূমিকম্প, সাধারণ শত্রু, হিংস্র শ্বাপদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির আক্রমণে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষদের মন ভীত-সন্ত্রস্ত্র ও দিশেহারা হয়ে পড়ত, বাঁচার তাগিদে তাদের মন আর্তনাদ করে উঠত। বেদজ্ঞরা এদের এই মানসিকতা ‘আর্ত মানসিকতা’ বলে অভিহিত করেছেন। এই আর্ত মানসিকতা নিয়ে বৈদিক ঋষিগণ ইন্দ্র, অগ্নি, রাত্রি, বরুণ প্রভৃতিকে উপাস্য কল্পনা করে ত্রাণ লাভের কাতরতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দেবমন্ত্ৰ রচনা করেছেন। তাই বেদের প্রাথমিক মন্ত্রসমূহে এই আর্ত মানসিকতার পরিচয় সুস্পষ্ট। পরবর্তী সময়ে কৃষির উদ্ভাবন যাযাবর বৃত্তির অবসান ঘটায়, স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য গৃহ নির্মাণ ও সমাজগঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। এইভাবে খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তার দিকে অগ্রগতি সাধিত হয়। তখন প্রচুর শস্য, দুগ্ধ, মধু, সোমরস, পশুসম্পদ প্রভৃতি লাভের জন্য মন ব্যাকুল ওয়ে ওঠে। বেদজ্ঞরা তাদের এই মানসিকতাকে ‘অর্থার্থীর মানসিকতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই সময়ে রচিত বেদ মন্ত্র সমূহে ঊষা, পর্জন্য, বনস্পতি, অশ্বিনীকুমারদ্বয় প্রভৃতির উদ্দেশ্যে ওসব সম্পদ প্রদানের জন্য প্রার্থনা নিবেদনের দৃষ্টান্ত আছে। এইভাবে ‘অন্ন চিন্তার’ একটা সুরাহা হওয়ার ফলে সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষ ‘অন্য চিন্তার’ সুযোগ লাভ করে। ফলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কীয় নানা জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন তাদের মনে ভিড় জমাতে থাকে। সেই কারণে বেদজ্ঞরা তাদের এই মানসিকতার নাম দিয়েছেন ‘জিজ্ঞাসার মানসিকতা’।
মূলত যোগ, কর্ম, জ্ঞান এবং ভক্তি— এ চারটিই হিন্দু ধর্মের পথ। কর্ম হিসেবে সকাম এবং নিষ্কাম এ দুভাগে বিভক্ত। সকাম ভোগের পথ, আর নিষ্কাম ত্যাগের পথ। ভোগ হল প্রবৃত্তি মার্গ আর ত্যাগ হল নিবৃত্তি মার্গ। ঋগ্বেদে একাধিক দেব-দেবীর উল্লেখ পাওয়া গেলেও অতি অতি প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুধর্মে একেশ্বরবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। তবে বৈদিক যুগের পর পৌরাণিক যুগের এ ধর্মে বহু দেব-দেবীর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। পুরাণে ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু পালন কর্তা শিব সংহারকর্তা।
পরম সত্তাকে হিন্দু ধর্মে এক পরম পুরুষরূপে কল্পনা করা হয়েছে। ঈশ্বর হলেন পুরুষোত্তম। ঈশ্বর সর্বজ্ঞ। ঈশ্বর ভগবান। ঈশ্বর অন্তবর্তী হলেও অতিবর্তী। তিনি পরম সুন্দর। তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনিই রক্ষক, তিনিই ত্রাণকর্তা। হিন্দুধর্মে একেশ্বরবাদ, অদ্বৈতবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, অবতারবাদ ইত্যাদি কল্পনা করা হয়েছে। বিশিষ্ট ধর্মতত্ত্ববিদ, M. Vendata Ratnam বলেন : ‘হিন্দু ধর্ম বহু ধর্মের সমন্বয়, যেমন : শৈবধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, বহুদেববাদ, একেশ্বরবাদ, পৌত্তলিকতাবাদ প্রভৃতি।’ বেদের অনুবাদক ম্যাক্স মূলার (Max Muller) একটি উক্তির মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের দেবতাতত্ত্ব ও বহু ঈশ্বরবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিলেন : ‘আসলে বেদের যে দেবতা তত্ত্ব তাকে বহু ঈশ্বরবাদ (Polytheism ) বলে আখ্যায়িত না করে, এক পরম সত্তার বহু দেবতার মিল (Henothism) বলাই শ্রেয়’।
হিন্দু ধর্ম আত্মাবাদকে স্বীকার করে। এতদ্সঙ্গে সত্তার পুজন্মকেও স্বীকৃতি দেয়। বর্ণাশ্রমকে হিন্দু ধর্ম খুবই প্রাধান্য দেয়। সমাজের মানুষদের তাদের কর্ম বা পেশা হিসেবে (Division of Labour ) দেখানো হয়েছে। যথা : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। এই চারটি বর্ণকে এক কথায় বললে বলা যায়- সংস্কৃতির ধারক ও সংরক্ষক হল ব্রাহ্মণ, রাজ্য শাসন ও শত্রু নিধনের কাজ হল ক্ষত্রিয়ের, সমাজের অর্থনীতি সুরক্ষা ও উন্নতি সাধন বৈশ্যর কাজ; আর এই তিন শ্রেণির লোককে সেবা করা শূদ্রের কাজ। প্রাচীন হিন্দু সমাজের এই কর্মবিভাজন থেকেই সমাজ ও শ্রেণি বৈষম্যের উৎপত্তি ঘটে। আধুনিক বিশ্বে প্রত্যেক ক্ষেত্রে যে কর্মবিভাজন দেখা যায় তা এ থেকেই সৃষ্ট। হিন্দু ধর্মের পরম ও চরম প্রাপ্তি ব্রহ্ম এবং মোক্ষ লাভ।
বৌদ্ধ মত বা দর্শনে মূর্তি পূজার কোন অবকাশ নেই। তবে কথিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারিরা বুদ্ধ মূর্তি পূজা করে থাকেন। এখানে মনে রাখা দরকার বৌদ্ধ ধর্ম কথিত বৌদ্ধ অনুসারীদের সৃষ্টি কিন্তু বৌদ্ধ মত বা বৌদ্ধ দর্শন বুদ্ধেরই। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম আর বৌদ্ধ দর্শন এক কথা নয়।
যেমনটা আমরা দেখতে পাই সনাতন ধর্মে বা হিন্দু ধর্মে। হিন্দু ধর্মানুসারীরা নানা দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ করে সেই মূর্তিতে অৰ্চনা দেয়। যেন ভাবটা এমন যে, এই পূজা-আর্চনার কারণেই দেবতা তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করবে পূজারিকে। যদিও ‘বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করা বা তাঁদের সেবা করা ভগবদ্গীতাতে অনুমোদন করা হয়নি।’ গীতার সপ্তম অধ্যায়ের বিংশতি শ্লোকে বলা হয়েছে—
কামৈস্তেস্তৈহৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তংতং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।। (ভগবদ্গীতা : ৭/২০ )
অর্থাৎ— যাদের মন জড় কামনা বাসনার দ্বারা বিকৃত, তারা অন্য দেব দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে।
এখানে পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে যে, যারা কামনা বাসনার দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সেবা না করে বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা করে। এই শ্লোকের তাৎপর্য হল— ‘যারা সর্বোতভাবে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, তারাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করে তাঁর প্রতি ভক্তিযুক্ত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত জীব জড় জগতের কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে না পারছে ততোক্ষণ সে স্বভাবতই অভক্ত থাকে। কিন্তু তবুও বিষয়বাসনার দ্বারা কলুষিত থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ ভগবানের প্রতি উন্মুখ হয়, তখন সে তাঁর বহিরাঙ্গ প্রকৃতি-মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয় না; যথার্থ লক্ষ্যের প্রতি উত্তরোত্তর অগ্রসর হতে হতে সে শীঘ্রই প্রাকৃত কাম-বিকার থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে তাই বলা হয়েছে—
অকামঃ সর্বকামো বা মোক্ষকাম উদারধীঃ
তীব্রেণ-ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম।। (ভগবদ্গীতা : ২/৩/১০)
অর্থাৎ— যেসব স্বল্পবুদ্ধি মানুষের পারমার্থিক জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারাই বিষয়-বাসনার তাৎক্ষণিক পূর্তির জন্য দেবতাদের শরণাপন্ন হয়।
সাধারণত এই স্তরের মানুষেরা ভগবানের শরণাগত হয় না, কারণ রজ ও তমোগুণের দ্বারা কলূষিত থাকার ফলে তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনার প্রতি অধিক আকৃষ্ট থাকে এবং দেবোপাসনার বিধি-বিধান পালন করেই তারা সন্তুষ্ট থাকে। বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসকেরা তাদের তুচ্ছ অভিলাষের দ্বারা এতই মোহাচ্ছন্ন থাকে যে, তারা পরম লক্ষ্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ থাকে। ভগবানের ভক্ত কিন্তু কখনই এই পরম লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হন না।
শ্রীমদ্ভাগবতে তাই বলা হয়েছে—
সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।’।। (ভগবদ্গীতা : ১৮/৬৬)
অর্থাৎ— ‘সবকিছু পরিত্যাগ করে আমার শরণাগত হও।’
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে বলা হয়েছে—
‘একলা ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্য’ (আদি ৫/১২৪)।
তাই শুদ্ধ ভক্ত কখনো তাঁর বিষয়-বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য অন্যান্য দেব-দেবীর কাছে যান না।
বৌদ্ধ ধর্ম (Buddhism)
গৌতমবুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে তাকেই বৌদ্ধধর্ম বলা হয়। বৌদ্ধদের ধর্মশাস্ত্রের নাম ত্রিপিটক। ত্রিপিটক চারটি বৌদ্ধ সংগীতি বা মহাসমাবেশের সারসংক্ষেপ। ত্রিপিটকে তিনটি প্রধান ভাগ রয়েছে— বিনয়, সূত্ত বা সূত্র ও অভিধম্ম বা অভিধর্ম। বিনয় ভাগটিতে রয়েছে সংঘের ভেতর বসবাস করার জন্য পালনীয় অনুশাসনাবলী। সূত্ত ভাগটি মূলত গৌতম জীবনচরিত। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর (ধর্মের ভাষায় পরিনির্বাণ) প্রায় ২০০ বছর পর খ্রি. পূ. ৮৮-৭৬ এর দিকে সম্রাট অশোকের আমলে পালি ভাষায় রচিত ত্রিপিটক সর্বপ্রথম সংকলনের সূচনা হয়। পালিভাষায় ‘তিপিটক’ আর সংস্কৃত ভাষায় ‘ত্রিপিটক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সংগ্রহ। বিজ্ঞজনের উপলব্ধির ধর্ম বলে পরবর্তীকালে এ ধর্মের নাম হয় ‘বৌদ্ধ ধর্ম’। গৌতম বুদ্ধের জীবন ও বাণীই বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের নেপাল ও বিহারের সীমান্তবর্তী রাজ্যে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজ শুদ্ধোধন।
অন্য এক স্থানে আছে, Five hundred and sixty years before Christ a religious reformen appeared in Bengal-Buddha (Buddha and Early Buddhism)। কথিত আছে, বুদ্ধদেব মায়াদেবীর দক্ষিণাংশ ভেদ করে বের হয়ে আসেন। তাঁর জন্মের সাতদিন পরে মায়াদেবীর মৃত্যু হয়। বুদ্ধের পারিবারিক নাম ছিল গৌতম। শাক্যবংশের গৌরব বা সিংহসদৃশ মহাপুরুষ বলে আর এক নাম ছিল শাক্যসিংহ। এছাড়া শাক্যমুনি, সুগত, জিন (বিজয়ী), ভার্গব এরূপ আরও অনেক নাম ছিল
বুদ্ধদেবের জন্মের পূর্বে কুমারী মহামায়ার কাছে এক দেবদূত এসে বললেন : দেখ বাছা, তুমি এমন একটি সন্তান ধারণ করবে যে রাজকীয় বংশের কুমার হয়েও সংসারধর্ম ছেড়ে ‘বুদ্ধ’ হবেন এবং মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করবেন।
মহামায়া লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘হে দেবদূত, আমি তো কুমারী, বিবাহিত নই-সুতরাং…।’
দেবদূত বললেন, ‘চিন্তার কোন কারণ নেই ভদ্রে, সবই প্রজাপতির ইচ্ছা। তুমি সৌভাগ্যবতী।’ এই বলে দেবদূত অন্তর্হিত হলেন।
বুদ্ধের জন্মের সময় সেই নির্দিষ্ট তারকার আবির্ভাব হয়েছিল এবং স্বর্গ থেকে বহু দেবদেবী নেমে এসে তার জন্মোৎসবে মেতেছিল। বলা হয়েছিল : A hero, glorious and incompatible, has been born, a saviour unto all nations of the earth (Aryan Sun-Myths) ।
বুদ্ধদেব জন্ম নিলেন ২৫ ডিসেম্বর, যখন নতুন সূর্য ওঠে। ডিসেম্বরে মকর রাশি (২১ ডিসেম্বর-১৯ জানুয়ারি)-কে হস্তীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। ঋকবেদেও মার্তণ্ডের শিশুকে সূর্য বলে ধরা হয়। যেমন, সেখানে বলা হয়েছে The elephant (Marttanda of Rig-Veda) is the symbol of his son, the solar God- man; therefore Buddha comes to earth in the form of an elephant (প্রাগুক্ত)।
কথিত আছে, বিশাখা তারা থেকে বোধিসত্ত্ব শুভ্র হস্তী শাবকের আকারে নেমে এসে মহামায়ার শরীরের দক্ষিণদিকে প্রবেশ করে। এ ঘটনা মহামায়া ও স্বপ্নে দেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, বোধিসত্ত্ব প্রবেশের সঙ্গে একটা পদ্মফুলের আবির্ভাব হয়, যা ব্রহ্মার প্রতীক।
বর্ণিত আছে যে, ভগবান বুদ্ধ এবং পূর্বজন্মে হস্তীদের রাজা ছিলেন। তাঁর দুই রাণী ছিল সুভদ্রা। মহাসুভদ্রা ছিল বুদ্ধের প্রিয় রাণী। সেই জন্য সুভদ্রা তাকে হিংসা করত। ইতোমধ্যে সুভদ্রা মারা গেল এবং পরজন্মে কাশীর মহারাণীরূপে জন্মলাভ করল। একদা সে এক শিকারীকে হাতির দাঁত আনার জন্য বনে পাঠাল। শিকারী খুঁজে খুঁজে হস্তীরূপী বুদ্ধকে বের করল। তার নিকট সব কথা শুনে বুদ্ধ নিজেই তাঁর দাঁত কেটে শিকারীকে দিলেন। কিন্তু যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি মারা যান। এই গল্পটির নাম ‘ছন্দক দাতক’। সাঁচী স্তূপের পশ্চিম তোরণে সহচরসমেত হস্তীরূপী বুদ্ধের চিত্র খোদাই করা আছে। বুদ্ধ তাঁর মত প্রচারের পূর্বে রুদ্রক ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎ পান এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তারপর তিনি উরুভেলায় তপস্যা শুরু করে উপবাস করেন। পরে নিরঞ্জন নদীতে স্নান করেন। তিনি যখন তপস্যা শুরু করেন, তখন ‘মার’ অর্থাৎ দুষ্ট প্রকৃতির শয়তান তাঁকে প্রলুব্ধ করে ফেরাতে চেয়েছিল। কিন্তু বেদের মন্ত্রের জোরে শয়তান তার চেষ্টায় সফল হয়নি। বুদ্ধত্ব লাভের পর দেবদূতেরা তাঁকে অভিবাদন জানায়।
পবিত্র ডুমুর বৃক্ষের তলে বুদ্ধ তাঁর শিষ্য সংগ্রহ শুরু করেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে জুদাস-এর মত (যে শিষ্য যিশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল) এক শিষ্য ছিল- দেবদত্ত। এই দেবদত্ত বুদ্ধকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি।
বুদ্ধ সঙ্গানদীর উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে গেছেন। তিনি রুগ্ন ব্যক্তিদের স্পর্শের দ্বারা আরোগ্য করেছেন। কিন্তু সন্দেহবাদীর ভ্রম নিরসনে বুদ্ধদেব গভীর নদীর উপর দিয়ে হেঁটে গেছেন। অথচ তাঁর পায়ে একফোঁটা জল স্পর্শ করেনি। এক দুষ্কৃতকারী রাজা তার এক শিষ্যের পা কেটে দিলে তিনি তা জোড়া দিয়ে সবল করেন। তাঁর দর্শনে রোগীদের রোগ সেরে যেত, অন্ধ তার দৃষ্টি ফিরে পেত এবং বধির ফিরে পেত তার শ্রবণশক্তি। তাঁর শিষ্যেরাও মোজেজা দেখাতে পারত। যেমন, এক জাহাজডুবির ফলে এক ভক্ত বিপদাপন্ন হলে তাঁর এক শিষ্য মন্ত্রের প্রভাবে তাকে উদ্ধার করে। এমনকি তাঁর শিষ্যেরা বিদেশী ভাষা বুঝতে ও বলতে পারার ক্ষমতাও অর্জন করেছিল।
সংস্কারক হিসেবে বুদ্ধদেব যা করেছিলেন, তা হল, তিনি পুরোহিতশ্রেণির ক্ষমতা খর্ব করেন, জাতিভেদ প্রথার উচ্ছেদ সাধনে প্রয়াসী হন, বহুবিবাহ ও দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, নারীদের তিনি পুরুষের সমান অধিকার দেন এবং আধ্যাত্মিক জীবনে যে তাদেরও অধিকার আছে, এর স্বীকৃতি দেন, রক্তক্ষয় বন্ধ করেন।
বুদ্ধদেবই প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রতিবাদ করে বলেছিলেন যে, অনুষ্ঠান ও পশুবলির মাধ্যমে পুণ্যলাভ করা যায় না। আত্মশুদ্ধির জন্য সংযম ও অনুশীলনের প্রয়োজন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রচারকদের মাধ্যমে ধর্মপ্রচার করে মানুষের চেতনা জাগাতে প্রয়াসী হন।
বুদ্ধদেব প্রায় ৪৫ বছরকাল ধর্মপ্রচার করেন এবং খ্রি. পূ. ৪৮৩ অব্দে দেহত্যাগ করেন। বুদ্ধের মৃত্যুর অনেক পরে (খ্রিষ্টের জন্মের একশ বছর পর) রাজা কণিষ্কের সময় কয়েকজন বৌদ্ধ পণ্ডিত মহাযান বলে বৌদ্ধধর্মের এক নতুন শাখা প্রবর্তন করেন। এরা বলেন, বুদ্ধত্ব বা নির্বাণ লাভ করলে মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়। যে প্রাণী বুদ্ধত্ব লাভের চেষ্টা করছেন, অথচ সম্পূর্ণরূপে বুদ্ধ হননি, তিনিই পৃথিবীর যথার্থ উপকার করতে পারেন। এ প্রাণীর নাম বোধিসত্ত্ব। সুতরাং ধর্ম উপার্জন করতে হলে বুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে বোধিসত্ত্বকে পূজা ও ভক্তি করা এবং বোধিসত্ত্বদের মত লোকসেবা করা উচিত। অতি সংক্ষেপে এটাই মহাযানদের মত। যারা মহাযান মত মানতেন না, তাদের হীনযান বলা হত। চীন-জাপানের বৌদ্ধরা মহাযানী, আর শ্যাম, সিংহল প্রভৃতি দেশের লোকেরা হীনযানী।
বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর শিষ্যগণ তাঁর মৃতদেহ জ্বালিয়ে দিলে বৃষ্টি হয়। ফলে তাঁর হাড়গুলো রক্ষা পায়। ভক্তগণ এই হাড়গুলো আটভাগে ভাগ করে আটটি পাত্রে রেখে একেকটি স্তুপ নির্মাণ করেন। কথিত আছে, সম্রাট অশোক (খ্রি. পূ. ২৬৯-২৩২) এই আটটি স্তুপ ভেঙে হাড়গুলো বের করে নেন এবং এগুলো ভাগ করে ৮৪,০০০ স্তুপ নির্মাণ করেন।
বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হবার পর প্রায় ৪০০-৫০০ বছর পর্যন্ত বৌদ্ধগণ মূর্তিপূজা করতেন না। এমনকি বুদ্ধের কোন ছবিও আঁকা হয়নি। বুদ্ধের জন্ম দেখবার দরকার হলে একটি পদ্ম এঁকে দেখানো হত। সম্ভবত খ্রিষ্টের প্রথম শতক হতে বৌদ্ধধর্মে মূর্তিপূজা শুরু হয়। গান্ধার ছাড়া মথুরা প্রভৃতি অঞ্চলে বহু মূর্তি পাওয়া গেছে। এসব অঞ্চলে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব ব্যতীত আরও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, তারা প্রভৃতি।
ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিষ্টাব্দ ৩২০-৫৪৫ কুমার গুপ্ত পর্যন্ত) সময় থেকে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যায় এবং খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতক থেকে এর প্রাধান্য লোপ পায়। তবে সনাতন ধর্মে বুদ্ধকে বিষ্ণুর এক অবতার বলে মেনে নেয়া হয়েছে। জয়দেবের ‘দশাবতার স্তোত্র’-এ আছে :
‘নিন্দসি যজ্হবিধেরহহ শ্রুতি জাতং
সদয় হৃদয় দর্শিত পশুঘাতম্।
কেশব ধৃত বুদ্ধশরীর
জয় জগদর্শী হরে।’
অর্থাৎ যজ্ঞের নিয়ম যে সকল বেদবাক্য দেয়া আছে, তুমি তার নিন্দা করো; কারণ যজ্ঞে পশুবধ দেখে তাদের হৃদয় করুণায় গলে যায়; হে বুদ্ধরূপী কৃষ্ণ, তোমার জয় হোক।
বুদ্ধদেব ভগবান মানতেন না। কিন্তু তাঁর অনুসারী ও ভক্তগণ তাঁকে ভগবান বানিয়ে ছেড়েছে। সূর্যপুরাণের মাহাত্ম্য এখানেই। আর্থার লিলি তাই বলেছেন : A new Sun-Myth had to be made for Buddha, and not a Buddha for a Sun-Myth. (Buddha and Early Buddhism) ।
বুদ্ধদেবের দশটি প্রধান উপদেশবাণী হল :
কাউকে হত্যা করবে না।
কোন জিনিস কেউ না দিলে গ্রহণ করবে না।
অবৈধ যৌনকর্মে লিপ্ত হবে না।
মিথ্যা কথা বলবে না।
নেশাগ্রস্ত হবে না অর্থাৎ মাদকদ্রব্য সেবন করবে না।
দুপুরের পর খাদ্যগ্রহণ করবে না।
জাগতিক আমোদ-প্রমোদে মত্ত হবে না।
অলংকার ও সুগন্ধিদ্রব্যে ভূষিত হবে না।
উঁচু ও গদিযুক্ত আরামদায়ক বিছানায় শোবে না।
স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য গ্রহণ করবে না।
সিদ্ধার্থ বাল্যকাল থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে বিচলিত হন এবং দুঃখকে কীভাবে অতিক্রম করা যায় সে সম্বন্ধে ভাবেন। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু এই বিষয়গুলি যে সকল জীবের জন্য সত্য তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। শুধু মানুষ কেন অন্যান্য জীবের মধ্যে কি জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু নেই? এ সকল বিষয় চিন্তা করে চারটি সত্যের পথ (চতুরায্য সত্য) আবিষ্কার করে তিনি ‘বুদ্ধ’ হলেন? ‘বুদ্ধ’ কোন্ চারটি সত্যের পথ (চতুরায্য সত্য) আবিষ্কার করে তিনি ‘বুদ্ধ’ হলেন। ‘বুদ্ধ’ কোন ঐশ্বরিক কিছু নয়, অলৌকিক অথবা অতীন্দ্রিয়ও নয়। ‘বুদ্ধ’ ছিলেন একজন জ্ঞানী; যিনি জীবন ও জগতের সকল বাস্তব ধর্মকে সম্যকভাবে জেনেছেন স্বপ্রজ্ঞায় ও স্বপ্রচেষ্টায়।
বুদ্ধ ‘সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত করেন। এটি একটি অদ্বৈত আদর্শ। এ আদর্শ ব্যক্তি তথা সমাজের বহুজনকে একত্র করাই শিক্ষা। ‘সংঘ’ একটি শক্তি। ঐক্য ও সংহতি। বুদ্ধের এ আদর্শ দেখে যিশু প্রচার করেন ‘ঈশ্বরের রাজত্ব’। এটি একটি সামাজিক আদর্শ। বৌদ্ধ ধর্ম এবং খ্রিষ্ট ধর্ম-এর এ আদর্শকে দেখে দার্শনিক হফডিং (Hofding) তাঁর Philosophy of Religion গ্রন্থে মন্তব্য করে বলেন : ‘যিশু যেখানে ইয়োরোপকে বিশালতর করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, বুদ্ধ সেখানে সমগ্র এশিয়াকেই আলোকিত করেছেন।’ বৌদ্ধ ধর্মের জন্য এর চেয়ে শ্রেষ্ঠতম মন্তব্য আর কী হতে পারে? এদিক দিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম এক যুগান্তকারী ধর্ম।
বুদ্ধ যুগ এবং এবং প্রাক্ বৌদ্ধ যুগের ঐতিহাসিক বিচারে দেখা যায় পরস্পর- বিরোধী নানান মতবাদ, প্রথা, আত্মা, ঈশ্বর, জগৎ ইত্যাদি সম্বন্ধে অপ্রচ্ছন্ন ধারণা সে যুগের জনজীবনকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। ফলে সৃষ্টি হত সূক্ষ্ম তর্ক যুদ্ধের। একদিকে ছিল বেদ, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার, অন্যদিকে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের প্রাণিহত্যা ইত্যাদি অনুষ্ঠান-সর্বস্বতা। ছিল নিগ্রহ, ছিল জড়বাদী ধ্যান ধারণা, ছিল অবিশ্বাসী নানা ধরনের প্রচলিত বিশ্বাস। চিন্তা জগতে এসেছিল এক সর্বনাশা এবং সর্বগ্রাসা অরাজকতা— তখনই বুদ্ধ প্রচার করলেন অহিংসা, মৈত্রী করুণার বাণী। প্রচার করলেন দুঃখ-সমুদয়, দুঃখ নিরোধমার্গের কথা। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (আটটি বিশুদ্ধ বা সম্যক পথ), কর্মবাদ, প্রতীত্যসমু্যুৎপাদবাদ (কার্যকারণবাদ), পঞ্চস্কন্ধ ইত্যাদি বিজ্ঞানভিত্তিক মতবাদ।
বুদ্ধ প্রদর্শিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (eight fold paths) হল :
১. সম্যক দৃষ্টি (right belief or knowledge or right perception) ২. সম্যক সংকল্প বা সম্যক চিন্তা (right thought)
৩. সম্যক বাক্ (right speech)
৪. সম্যক কর্ম (right action)
৫. সম্যক আজীব (right means of livelihood)
৬. সম্যক ব্যায়াম (right exertion or endeavour )
৭. সম্যক স্মৃতি (right concentration or meditation )
এই আটটি একত্রে অষ্টাঙ্গিক পথ। এই পথে সাধন করে সাধক সত্যে উপনীত হতে পারেন।
বুদ্ধ এমন একটি পথ আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, যা মানুষকে জাগতিক দুঃখের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে, তাকে প্রকৃত সুখ ও শান্তির সন্ধান দেবে। তাই তিনি ধর্মচক্র প্রবর্তন-এ (প্রথম ধর্ম প্রচার) চারটি ‘আর্যসত্য’ পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আর্যসত্যগুলি হল— ১. জীবন বা অস্তিত্ব দুঃখের, ২. কামনা-বাসনা (তন্হা-তৃষ্ণা), আসক্তি ইত্যাদি জাগতিক অস্তিত্ব সমুদয়ের মূল কারণ, ৩. কামনা-বাসনা (তৃষ্ণার) অবসানের উপায় বা পথ বর্তমান। এই পথ বা মাৰ্গ হল ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ।’
ঈশ্বরের ধারণা বৌদ্ধ ধর্মে স্থান পায়নি। কর্মবাদকে ঈশ্বরের স্থানে বসানো হয়েছে। বৌদ্ধ কর্ম, ঈশ্বর কিংবা দেবতার ইচ্ছা নয় কর্ম নৈর্ব্যক্তিক। এটি একটি মৌল ধারণা। ঈশ্বর বা খোদার দোহাই দিয়ে বুদ্ধ মানুষের অর্জন এবং মনন শক্তিকে খাটো করতে চাননি। বুদ্ধ প্রমাণ করতে চেয়েছেন ঈশ্বর, খোদা, (God) অথবা দৈবশক্তির চেয়েও মানুষের আত্মশক্তি, সৃষ্টিশক্তি অথবা প্রজ্ঞাশক্তি অনেক অনেক বড়। সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার বৌদ্ধ ধর্মে স্বীকৃতি পেয়েছে। একমাত্র গৌতম বুদ্ধই শ্রেণি বৈষম্য এবং জাতিগত বাধা ভেঙে দিয়ে পরিত্রাণের পথ দেখিয়েছেন সকল শ্রেণির মানুষকে।
অন্যান্য ধর্মের মত বৌদ্ধ ধর্মেও বিভক্তিকরণ দেখা যায়। বৌদ্ধধর্ম প্রথমত হীনযান এবং মহাযান এ দুভাগে এবং পরে আঠার ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এ বিভক্তি সংঘের ঐক্য, সংহতি ও অদ্বৈত আদর্শকে বিনষ্ট করেছে। সংঘের বিভিন্ন মত, ধ্যান ধারণা এবং বিশ্বাস মেনেই এই বিভক্তিকরণের উদ্ভব ঘটেছে। শীল, সমাধি, প্রজা-এ তিনটি বৌদ্ধ ধর্মের সার সংক্ষেপ। একজন মানুষের পরিপূর্ণতা আসে এ তিনটির মধ্য দিয়েই। এর মধ্যদিয়েই বিমুক্তজীবন, এর মধ্য দিয়েই নির্বাণ। ‘নির্বাণ’ বৌদ্ধ ধর্মের পরম এবং শ্রেষ্ঠতম স্থান।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে পাল শাসন ছিল বুদ্ধের শিক্ষায় আলোকিত। এ শিক্ষা বিস্তার লাভ করেছিল আরব, গ্রিস, এশিয়া মাইনর সমগ্র মধ্য এশিয়া হয়ে চীন-জাপান পর্যন্ত। আজ দুনিয়ার যেখানেই লুপ্ত বৌদ্ধ সভ্যতার সন্ধান মিলছে সেখানেই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বৌদ্ধ বিহারের। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের। যা অপরাপর সভ্যতার ক্ষেত্রে খুবই বিরল। যাই হোক, মহান বুদ্ধের শিক্ষায় কোথাও মূর্তিপূজার কোন স্বীকৃতি নেই, পূজা কেন থাকবে? কারণ তাঁর শিক্ষায় তো ঈশ্বরই ছিল অনুপস্থিত; ‘তিনি ছিলেন, নিরীশ্বরবাদী। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, প্ৰথা- সর্বস্বতা, যাগ-যজ্ঞের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন।’ বুদ্ধদেব ছিলেন মূর্তিপূজার ঘোরতর বিরোধী। তিনি চাইতেন না কেউ তার পূজা করুক। আমাদের জানা কালের মধ্যে বুদ্ধদেবই প্রথম মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। (কিন্তু) তার এই বিদ্রোহ সহিংস ছিল না। ছিল একেবারে অহিংস। কখনো কোথাও তিনি বলেননি মূর্তি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তিনি তার ধর্মমতে স্থান দেননি মূর্তিপূজাকে। তাই সম্রাট অশোকের আমলে (২৭৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) বৌদ্ধ ধর্ম যখন তার প্রাধান্যের চরম শিখরে পৌছালো তখনও বুদ্ধদেবের মূর্তি পূজার শুরু হয়নি। এমনকি তখনও বুদ্ধের কোন মূর্তি তৈরি করা হয়নি। ধর্মের নিষেধের কারণে। ফলে কাকে পূজা অৰ্চনা দেবে? তবে হ্যাঁ, মহান বুদ্ধের তিরোধানের প্রায় ৩০০ বছর পরে মথুরা অঞ্চলে পাথরের বুদ্ধ মূর্তি বানানো শুরু হয়। এই সময় থেকেই বুদ্ধ মূর্তির পূজা চলতে থাকে। পরে ভক্তকুল তাদের আপনজনের বিচ্ছেদের ব্যথা ভুলে থাকার জন্য যেমন সংগ্রহ করেছিল বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শনসমূহ তেমনি অতিভক্ত অনুসারীদের কেউ কেউ স্বয়ং বুদ্ধকেই প্ৰভু জ্ঞান করে প্রভু বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণপূর্বক তাতে ভজতে আরম্ভ করে। এভাবেই পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মন বা বৌদ্ধ মত পরিণত হয় বৌদ্ধ ধর্মে আর নিরশ্বরবাদী বুদ্ধ স্বয়ং বনে যান ‘ঈশ্বর’।
আধুনিকযুগে আবার বৌদ্ধধর্ম গুরুত্ব পেতে থাকে এবং ভারতীয় জীবনবোধের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীলংকার বৌদ্ধ ভিক্ষু অনাগরিক ধর্মপাল (১৮৬৪-১৯৩৩) কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মহাবোধি সোসাইটির সকল সদস্যদের ব্যক্তিগত জীবন বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে আনা এবং তার আদর্শ সদস্যদের আত্মীয় ও পরিজনদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এই সোসাইটি ভারত ও শ্রীলংকার সকল বৌদ্ধ সৌধগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুনর্নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়। এ সময়ের অপর একটি বৌদ্ধ সংগঠন ছিল ভারতীয় বুদ্ধ মহাসভা।
সমাজে খাপ খাওয়াতে না পেরে বঞ্চিত শ্রেণির মানুষেরা বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রয়াত বি. আর. আম্বেদকার এবং তাঁর শিষ্যদের এই ধর্মগ্রহণ করার ঘটনা থেকে। মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায়ের সকল মানুষ এবং কিছু তফশিলী জাতিভুক্ত মানুষও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
গৌতম বুদ্ধ জন্মেছিলেন জম্বুদীপের (পরবর্তীকালে ইন্ডিয়া নামে পরিচিত, ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্থান) এক শ্রেণিবিভক্ত সমাজে। তিনি সমকালীন ভারতীয় মানসলোক চিনতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন জীবনের অশান্তির রূপকে প্রত্যক্ষ করতে। তাই তিনি মানুষের দুঃখের কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন। সে ব্যাপারেই তিনি ‘বোধি’ লাভ করেছিলেন। সাধারণ মানুষকে জীবনধারণের নতুন পথরূপে ‘মধ্যম’ পথের সন্ধান দিয়েছিলেন, যে পথ বর্তমান দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়া ও বহির্বিশ্বেও প্রাসঙ্গিক। রাজনীতি, ধর্মীয় ও সামাজিক অবনমন থেকে এর মাধ্যমেই মুক্তিলাভ করা যায়। তাই একদা প্রায় অবসিত বৌদ্ধধর্ম বাঙালি সমাজ তথা বর্তমান বিশ্বে আজও প্রাসঙ্গিক।
খ্রিষ্ট ধর্ম (Christianity)
বিশ্বের ধর্মগুলির মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম অন্যতম এবং সবচেয়ে প্রচারমুখী ধর্ম। খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি নাজারাতের যিশুর জীবন ও বাণীকে ভিত্তি করে। ইসলামের দৃষ্টিতে হজরত ঈশা (আ.) পয়গম্বরদের মধ্যে একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে হজরত ঈশাই (আ.) ক্রাইস্ট এবং তাঁর জন্ম হয়েছে অলৌকিকভাবে, কোন পুরুষের ঔরস থেকে নয়। আল্লাহর নির্দেশে ঈশ্বরের দূত মরিয়মের কাছে শুভবার্তা বহন করে নিয়ে গিয়েছিল এবং বলেছিল : ‘তোমার প্রতিপালক তো আমাকে পাঠিয়েছেন তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য।’
মরিয়ম বলল : কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যাভিচারিণীও নই।
সে বলল : ‘এইভাবেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এ আমার জন্য সহজ, আর আমি তাকে সৃষ্টি করব মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আল্লাহর তরফ থেকে এক আশীর্বাদ হিসেবে। এ তো এক নির্ধারিত সিদ্ধান্ত।’
তারপর মরিয়ম গর্ভে সন্তান ধারণ করল ও তাঁকে নিয়ে দূরে চলে গেল এক জায়গায়। প্রসববেদনা তাঁকে এক খেঁজুরগাছের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। সে বলল, ‘হায়! এর আগে যদি আমার মরণ হত, আর কেউ মনে না রাখত।’
ফেরেশতা গাছের নিচ থেকে ডেকে বলল : ‘তুমি আমার দিকে খেজুর গাছের ডাল ঝাঁকাও, তোমাকে পাকা-তাজা খেজুর দেবে। সুতরাং খাও, পান করো ও চোখ জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি তুমি দেখো, তখন বলো আমি করুণাময়ের উদ্দেশে মৌনতা পালনের মানত করেছি। তাই আমি কিছুতেই কোন মানুষের সঙ্গে কথা বলব না। তারপর সে (মরিয়ম) তাঁকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে হাজির হল। ওরা বলল : মরিয়ম! তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছে। ওহে হারুণের বোন! তোমার পিতা তো খারাপ লোক ছিল না আর তোমার মা-ও তো ব্যাভিচারিণী ছিল না। তারপর মরিয়ম শিশু ঈশার দিকে ইঙ্গিত করল। ওরা বলল, কোলের শিশুর সঙ্গে আমরা কেমন করে কথা বলব?
সে (শিশু ঈসা) বলল : আমি তো আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে আশিস ভাজন করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামাজ ও যাকাত আদায় করতে এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আর তিনি আমাকে উদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি। আমার শান্তি ছিল যেদিন আমি জন্মলাভ করেছিলাম ও শান্তি থাকবে যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমার পুনরুত্থান হবে।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘এই-ই মরিয়ম পুত্র ঈশা, যে বিষয়ে ওরা তর্ক করে।’ (সুরা মরিয়ম ১৬-৩৫)
আল্লাহর নির্দেশে হজরত ঈসা (আ.) মৃত ব্যক্তির প্রাণদান করতে পারতেন। মাটির পাখির মধ্যে জীবন সঞ্জার করতে পারতেন। তাছাড়া আল্লাহর কৃপায় তিনি অন্ধকে দৃষ্টিদান ও কুষ্ঠগ্রস্ত রোগীদের সুস্থ করে তুলেছিলেন।
পবিত্র কুরআনে হজরত ঈসা (আ.)-এর নাম পঁচিশ স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ‘ইবনে মরিয়ম’, ‘মসিহ’, ‘আবদুল্লাহ’, ‘রাসূলুল্লাহ’। এছাড়া তাঁকে ‘ঈশ্বরের বাণী’, ‘রুহুল্লাহ’, ‘ঈশ্বরের চিহ্ন’ এবং অন্য নামে ১৫টি বিভিন্ন সুরায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে ‘জেসাস’-কে ‘ঈসা’ বলা হয়েছে। হিব্রু ‘ঈসাও’ থেকে আরবীতে ‘ঈশা’ হয়েছে, লাতিনে হয়েছে ‘জেসাস’ তার ক্ল্যাসিক্যাল নাম ‘জোশুয়া’ থেকে। ‘ইসাও’ হিব্রুদের একটা সাধারণ নাম। এই নামটি ষাটবারেরও বেশি ব্যবহার করা হয়েছে বাইবেলের প্রথম পুস্তক জেনেসিস-এ।
হাস্টন স্মিথ বলেন, খ্রিষ্ট ধর্ম মূলত একটি ঐতিহাসিক ধর্ম। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস যিশুখ্রিষ্টের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটেছে। যিশুর মৃত্যুর ৩০০ (তিনশত) বছর পর রাজা কনস্তান্তিনোপলের পৃষ্ঠপোষকতায় ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে নাইসিয়াতে সম্মেলনের (Nicen Council) মধ্যদিয়ে বর্তমান খ্রিষ্টধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই নাইসিয়া সম্মেলনের মাধ্যমেই রচনা করা হয় আজকের বাইবেল-এবং এরই মধ্যদিয়ে তারা প্রতিষ্ঠিত করে ‘ত্রিত্ববাদ’। ত্রিত্ববাদ এখন খ্রিষ্টধর্মের বৈশিষ্ট্য; পবিত্র পিতা, পবিত্র পুত্র এবং পবিত্র আত্মা— এই ত্রয়ীর মিলিত রূপই হচ্ছেন ঈশ্বর; তারা হাজির করল, তিনে এক একে তিন তত্ত্ব; এবং এই নোতুন রচিত বাইবেলকেই শাশ্বতজ্ঞান করে দুনিয়ার খ্রিষ্ট অনুসারিদের মান্যপুস্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়; আর পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয় বিগত দিনের সমস্ত গসপেলসমূহ। বাইবেল খ্রিষ্টদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। প্রচলিত বাইবেলের দুটি ভাগ: একটি পূর্ব খণ্ড (Old Testament) অন্যটি অন্তখণ্ড (New Testament)।
উইলিয়াম কেরী (Dr. William Carey, 1761-1834) ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে শ্রীরামপুর থেকে প্রায় ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় খ্রিষ্টধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। কেরী পরবর্তী অনুবাদগুলিতে বাংলা পরিভাষয় নানা বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। এসব অনুবাদে God এর বাংলা পরিভাষা ঈশ্বর থেকে ক্রমশ আল্লাহ, খোদা, ভগবান এবং যিশু খ্রিষ্টের বাংলা পরিভাষায় প্রভু যিশু, ঈসা মাসীহ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। গ্রিক (biblion), ল্যাটিন (biblia) ও ইংরেজি (bible) শব্দটির অর্থ গ্রন্থাবলি বা গ্রন্থমালা। মূল গ্রিক বাইবেল বা ক্যাথলিক বাইবেলের পুস্তকের সংখ্যা ৭২টি। প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার : (Martin Luther, 1529 AD) ৭টি পূর্ণ বইকে জাল বলে বাতিল করেন। বাকি বইগুলি থেকেও অনেক অধ্যায় ও আয়াত জাল বলে বাতিল করেন। এজন্য প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে বইয়ের সংখ্যা ৬৬টি। ক্যাথলিক বাইবেল বাংলায় ‘পবিত্র বাইবেল : জুবিলী বাইবেল’ নামে অনূদিত এবং বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী ১৯৯৯, ২০০৬ কর্তৃক প্রকাশিত। বাংলা বাইবেলের কেরীর অনুবাদই মূল ইংরেজির নিকটবর্তী, কিন্তু ভাষা দুর্বোধ্য। মুসলমানী অনুবাদগুলিতে মূলত মুসলিমদের ধর্মান্তর করার দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি সর্বশেষ বাইবেলকে ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ নামে প্রকাশ করেন। এতে বাইবেলের বইগুলির নামও পরিবর্তন করা হয়। বাংলাদেশে খ্রিষ্টান প্রচারকগণ ‘ইঞ্জিল শরীফ’ নামের একটি পুস্তক প্রচার করেন। এটি বাইবেলের ‘নতুন নিয়ম’কে ‘ইঞ্জিল’ নামকরণ। ইঞ্জিল শব্দটির ইংরেজি ইভানজেল (evangel)। শব্দটি প্রাচীন গ্রিক (euagglion/euaggelos) থেকে গৃহীত। এর অর্থ সুসংবাদ। ইংরেজিতে একে গসপেল (Gospel) ও বলা হয়। খ্রিষ্টান বাইবেলের দ্বিতীয় অংশ ‘নতুন নিয়ম’ (the New Testament) এর মধ্যে মোট ২৭টি পুস্তক বিদ্যমান। এগুলির মধ্যে মাত্র ৪টি পুস্তককে খ্রিষ্টীয়মণ্ডলী ‘ইঞ্জিল’ বলে স্বীকার করেন। মূল গ্রিক বা ইংরেজি বাইবেলে এগুলির নাম হল :
১. The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Matthew / The Gospel According To St. Matthew : সাধু মথির মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল।
৩. The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Mark/The Gospel According To St. Mark : সাধু মার্কের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল।
৩. The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Luke / The Gospel According To St. Luke : সাধু লুকের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল।
8. The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. John / The Gospel Accroding To St. John : সাধু যোহনের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল।
‘খ্রিষ্টান’ বা Christian শব্দটির প্রথম ব্যবহার শুরু হয় এখনকার সিরিয়ার এন্টিয়াক Antioch শহরে ৩৫ থেকে ৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ইহুদি ও অইহুদিদের সমন্বয়ে একটি নতুন ধর্মবিশ্বাসীদের পরিচয় সর্বসমক্ষে উপস্থাপনের মাধ্যমে। যিশুখ্রিষ্টের প্রতি অকৃত্রিম ও পূর্ণ বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই এই খ্রিষ্টান ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ যাত্রা। গ্রিক ভাষায় Christo খ্রিষ্ট শব্দটি হিব্রু ‘মেসাইয়াহ্’ শব্দের ভাষান্তর। ঈশ্বর কর্তৃক মানবজাতির জন্য প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহ পূরণে ঈশ্বরের পছন্দের কোন প্রেরিত পবিত্র ব্যক্তিকে ‘মেসাইয়াহ্’ (Messish) বলা হয়। ইহুদিদের বিশ্বাস ছিল যে তাদের জাতীয় মুক্তিদাতারূপে এক মেসাইয়াহ্’র আগমন ঘটবে। নাজারাথের যিশুকে সেই প্রত্যাশিত আগমনকারী নবী ও পথপ্রদর্শকরূপে গণ্য করে যিশুর মৃত্যুর অব্যবহিত পর থেকেই এই নতুন ধর্ম আন্দোলনটি বিস্তৃত হতে থাকে।
খ্রিষ্টান ধর্ম আন্দোলন যতই বিস্তৃত হতে থাকে যিশুর নামের সঙ্গে ‘খ্রিষ্ট’ উপনামটি ততই জোরালো হয়ে এক পর্যায়ে ‘খ্রিষ্টান ধর্ম’ ও ‘যিশুখ্রিষ্ট’ শব্দ দুটি সমার্থক শব্দে পরিণত হয়। যদিও এই ধর্ম বিশ্বাসে ‘খ্রিষ্ট’ নামটিতেই মূল বিশ্বাস আবর্তিত।
খ্রিষ্টানদের চিহ্নিতকরণে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যে খ্রিষ্টান ধর্ম আন্দোলনের মূল নিহিত রয়েছে প্রাচীন ইস্রাইলিদের জীবনাচার ও বিশ্বাসে। এখানে শুধুমাত্র হিব্রু ‘মেসাইয়াইহ্’ শব্দটির গ্রিক ভাষায় অনুদিত হয়েই নতুন খ্রিষ্ট শব্দ থেকে খ্রিষ্টানদের উত্থান হয়েছে। এখন পৃথিবীতে খ্রিষ্টান ধর্মের যে বহুমুখীতা দেখা যায় তা মুখ্যত এ কারণে যে, এই আন্দোলনটি যে যে স্থানে পৌঁছেছে সেখানকার ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সংশ্লেষরূপেই নতুন আবহে পরিচয় বৈচিত্র্য নতুন হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস ব্যঞ্জনায় তা অপরিবর্তনীয় রয়েছে।
খ্রিষ্টধর্মের প্রথম দিকে খ্রিষ্টানরা ছিল ইহুদি। তারা ইহুদি তোরাহ্ পাঠ ও অনুসরণ করত। অচিরেই খ্রিষ্টধর্ম অইহুদিদের মধ্যে একটি ধর্ম আন্দোলনের রূপ নিলেও খ্রিষ্টানরা ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুসরণ করতে থাকে তাদের ধর্মশিক্ষা ও ধর্মালোচনাকে যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে। এভাবেই ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তোরাহুর নাম হয় ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ওল্ড কভন্যান্ট-যাকে বাংলায় বলা হয় প্রাক্তন সন্ধি বা পুরাতন নিয়ম। এই অংশে খ্রিষ্ট পূর্ববর্তী সময়কালে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যকার সংলাপই স্থান পেয়েছে।
অন্যদিকে যিশুখ্রিষ্টের জন্ম, তাঁর কর্মসমূহ প্রবাহিত ধর্মোপদেশ এবং এই সকলকে ঘিরে যিশু অনুসারী বা অ্যাপস্টলদের লিখিত বর্ণনাসমূহের সংকলিত প্রকাশকে বলা হয় নিউ টেস্টামেন্ট বা নতুন সন্ধি। নিউ টেস্টামেন্টে স্থান পেয়েছে চার প্রকারের বর্ণনা যথা— যিশুর আগমন, উদ্দেশ্য, শিক্ষা এবং উপদেশ— যা সুসমাচার (Gospeles) নামেও পরিচিত। জেরুজালেমে যিশুর প্রচারিত বাণী, অন্যপ্রকার অলৌকিক ঘটনা এবং যিশুর অনুসারীগণের প্রচারিত ধর্মকথার সারাংশ নিয়ে নিউ টেস্টামেন্ট সংকলিত হয়েছে। এই নতুন ও পুরাতন সন্ধির সংযুক্ত প্রকাশকে বাইবেল বলা হয়।
বাইবেলের প্রথম খণ্ড তথা বৃহত্তর অংশটি হচ্ছে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ, যাতে যিশু পূর্ববর্তী সময়কালে ঈশ্বর ও ইস্রাইল জাতির বিভিন্ন দিকসমূহ স্থান পেয়েছে। হিব্রু ও এ্যারামাইক ভাষায় (এ্যারামাইক ভাষা সিরিয়ার আঞ্চলিক ভাষা) ৩৯টি পুস্তক নিয়ে ওল্ড টেস্টামেন্ট সংকলিত হয়েছে। এই ওল্ড টেস্টামেন্ট[৫] সংকলিত বাইবেলের প্রথম খণ্ডটি মূলত ইহুদি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও ইহুদি ধর্মের বিধানাবলী নিয়েই লেখা।
নিউ টেস্টামেন্টের ২৭টি পুস্তকের মধ্যে চারটি পুস্তক গোস্পেল নামে পরিচিত। চারটি গোস্পেল লিখেছিলেন মথি, মার্ক, লুক এবং যোহন ৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী ৫০ বছরে। এই চারটি পুস্তকেই যিশু খ্রিষ্টের জীবন ও শিক্ষাসমূহের দালিলিক বিবরণ পাওয়া যায়। গোস্পেল শব্দটির অর্থ হচ্ছে সুসমাচার— যা মূলত গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল। কেননা সেই সময়কার মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ অঞ্চলই ছিল রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন আর সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের ব্যবহৃত অভিন্ন ভাষা ছিল গ্রিক। এই বাইবেলে রয়েছে যিশুখ্রিষ্টের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরূপে পরিচিত অ্যাপস্টালগণের দেয়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রচারিত ধর্মবাণীর সংক্ষিপ্তসারও।
নতুন-পুরাতন টেস্টামেন্ট সমন্বয়ে বাইবেলের প্রতি খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস থাকলেও ইহুদিরা শুধুমাত্র পুরাতন অংশ যেখানে শুধুমাত্র ইস্রাইলি জাতির বিষয়টিই স্থান পেয়েছে সেটুকুতেই বিশ্বাস স্থাপন করে। ইহুদিদের বিশ্বাস বাইবেলের প্রথমখণ্ডই শেষ। অন্যদিকে খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ঈশ্বরের পছন্দের জাতি ইস্রাইলিদের ধর্ম ও আবাসভূমির প্রতিশ্রুতি পূরণে মেসাইয়া যে উল্লেখ রয়েছে, যিশুখ্রিষ্ট সেই প্রতিশ্রুত মহামানব।
যিশুকে মানব জাতির ত্রাতা হিসেবে ইহুদিরা মনে করতেন। নাজারথে যিশুর ভক্তদের প্রথমে খ্রিষ্টান নামে অভিহিত করা হয়। যিশু নিজে ইহুদি ছিলেন। তবে তিনি ইহুদি বা হীব্রু ধর্মের অনুষ্ঠান-সর্বস্বতা ও পুরোহিতদের প্রাধান্য পছন্দ করতেন না। যিশু প্রচার করলেন ক্ষমা, প্রেম ও প্রীতির ধর্ম। তাঁর মতে সকল মানুষ এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের পুত্র। যিশু বলেছেন ‘তোমাদের পিতা এক, তোমরা সকলে ভাই’। যিশুর মতে ঈশ্বরই পরম পিতা। তিনিও মনে করতেন, ঈশ্বর অসীম, সর্বশক্তিমান ও করুণাময়। তাঁর করুণা সর্বব্যাপী বিস্তৃত। খ্রিষ্ট ধর্মের বক্তব্যের মধ্যে ইসলামের একাকত্ববাদের সাদৃশ্য আছে। অন্যদিকে ভ্রাতৃত্ব প্ৰেম- প্রীতির দিক থেকে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে কিছুটা মিল লক্ষণীয়। তবে বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা, সাম্য ও প্রেম আরও মহৎ এবং ব্যাপক। খ্রিষ্টধর্মে ক্ষুদ্র বৃহৎ সরল মানুষের জীবনসহ অনাগত প্রাণীর সুখ এবং শান্তি কামনা করা হয়েছে।
প্রতিহিংসা বা প্রত্যাঘাতের কথা যিশু বলেননি। বরং তিনি বলেছিলেন ‘এক গালে চড় মারলে অন্য গালটি পেতে দিও। তবুও আঘাতের প্রতিদানে আঘাত করো না। অপরাধীকে ক্ষমা করো।’ বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রধান পার্থক্য হল : যিশু জগৎ ও সমাজকে অসার বা মিথ্যা বলে স্বীকার করেননি। সামাজিক কর্তব্য, দায়িত্ব এবং সচেতনতাকে তিনি খুব বড় করে দেখেছেন। যেখানে বৌদ্ধ ধর্ম লৌকিকতা বা সামাজিক মূল্যবোধকে পারমার্থিক ক্ষেত্রে বেশি বড় করে দেখেননি। বুদ্ধের মত তিনি (God) বা ঈশ্বর সম্পর্কে কোনদিন মৌন ছিলেন না বরঞ্চ ঈশ্বরকে জগতের একমাত্র কর্তা বলে স্বীকার করেছেন। যেখানে গৌতম বুদ্ধ চেয়েছেন মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার করতে। ত্রিত্ববাদ (Trinity) খ্রিষ্ট ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই ত্রিত্ববাদের অর্থ হল ঈশ্বরের তিনরূপ পিতা (God the father), পুত্ৰ (God the son) ও পবিত্র আত্মা (God the Holy spirit)। এর মূল কথা হল ‘তিনে এক একে তিন’। খ্রিষ্ট ধর্ম কৃচ্ছ্রতাবাদ সমর্থন করে না। খ্রিষ্ট ধর্ম জড়বাদ, দ্বৈতবাদ এবং উন্মেষবাদের বিরোধী। ‘ঈশ্বরের রাজত্ব খ্রিষ্ট ধর্মের প্রধান আদর্শ’ তথাগত বুদ্ধ যেখানে তাঁর প্রিয় শিষ্য আনন্দকে উপদেশ দিচ্ছেন। ‘হে আনন্দ! তুমি তোমার আলোকবর্তিকা হও, তুমি তোমারি আশ্রয় হও। বাইরে কোন সাহায্য বা আশ্রয় তুমি কামনা কর না।’ অন্যদিকে যিশু বলেছেন : “হে খ্রিষ্ট পুত্রগণ, যত শ্রান্তভ্রান্তের দল তোমরা আমার আছে এসো, আমি তোমাদের বিশ্রাম দেব।’ এ দুটি উপদেশের মধ্যে রয়েছে বিষম ব্যবধান। বুদ্ধের বাণীতে পাওয়া যাচ্ছে আত্মনির্ভরশীলতার কথা, আর খ্রিষ্ট বাণীতে পাওয়া যাচ্ছে ঈশ্বর নির্ভরশীলতার উপদেশ।
খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল ইহুদি উপজাতিদের উপর রোমান সাম্রাজ্যের বারংবার নৃশংস অত্যাচারের ফলে। সশস্ত্র প্রতিরোধে বারংবার ব্যর্থ হয়ে ইহুদিদের এক অংশ পরলোকে মুক্তির সন্ধান করে। এই পরিস্থিতিতে ডেড সি অঞ্চলে সম্ভবত ইসিন (Essen) সম্প্রদায়ের মধ্যে খ্রিষ্ট ধর্মের জন্ম হয়। ইহুদিদের মধ্যে থেকে এভাবে খ্রিষ্ট ধর্মের উদ্ভবের পেছনে সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল। অশোকের দ্বারা প্রেরিত বৌদ্ধ ধর্মযাজকেরা যে এই অঞ্চলে তৎপর ছিলেন তা ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। তাছাড়া যে অহিংসার তত্ত্ব নিয়ে খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল, তার কোন পুরানো ঐতিহ্য ইহুদিদের মধ্যে ছিল না। ডেড সি অঞ্চল থেকে পাওয়া প্যাপিরাস পাণ্ডুলিপিগুলো থেকেও স্পষ্ট হয়েছে যে বৌদ্ধ ধর্মের সংগঠন ও তাত্ত্বিক আদর্শের সংগে আদি খ্রিষ্ট ধর্মের অনেক মিল ছিল। অবশ্য ডেড সি স্ক্রোলগুলো আবিষ্কৃত হবার অনেক আগেই কোন কোন পণ্ডিত এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে ইসিনদের মধ্য থেকে খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল।
খ্রিষ্ট ধর্ম প্রধান দুভাগে বিভক্ত। একটি ক্যাথলিক (Catholic) এবং অন্যটি প্রটেস্ট্যান্ট (Protestant)। ক্যাথলিকরা কুমারী মেরীকে যিশুর মাতা বলে স্বীকার করেন। অন্যদিকে প্রটেস্ট্যান্টরা তা বিশ্বাস করেন না। আধুনিক খ্রিষ্ট ধর্মে আরও কিছু নতুন বিভক্তিকরণ দেখা যাচ্ছে। যিশুর বেশ কয়েকজন শিষ্য ছিলেন যারা তাঁর বাণী প্রচার করেছেন। সেইন্ট পল (St. Paul) তাঁদের মধ্যে প্রধান। অন্যরা হলেন পল, লিউক ও মার্ক। খ্রিষ্ট ধর্মে মোক্ষের কথা থাকলেও সেই মোক্ষ বৌদ্ধ ধর্মের মোক্ষের মত নয়। কারণ সেই মোক্ষ (God) কিংবা পিতার ধারণা সঙ্গে যুক্ত।
উল্লেখ্য যে, মুহম্মদ (সা.)-এর জন্মের ৭৫ বছর পূর্বে পোপ প্ৰথম গেলাসিয়াস এর সময়ে খারাপ বিশ্বাস ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী গ্রন্থাবলির যে তালিকা তৈরি হয়েছিল ‘ইঞ্জিল বারনাবাস’ ও তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিপূর্বে খ্রিষ্টান গির্জায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত বারনাবাসের ইঞ্জিল প্রচলিত ছিল। একে নিষিদ্ধ করা হয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে। বাইবেলে যে ৪ খানা ইঞ্জিলগ্রন্থকে আইনসম্মত ও নির্ভরযোগ্য ঘোষণা করে সামিল করা হয়েছে তার মধ্যে একখানা গ্রন্থের লেখকও ঈসা (আ.)-এর কোন সাহাবি। লেখকদের একজনও এই দাবি করেননি যে, তিনি হজরত ঈসা (আর.)-এর সাহাবিদের কাছ থেকে তত্ত্ব ও তথ্য নিজের ইঞ্জিলে সামিল করেছেন। তারা যেসব উপায় ও সূত্র হতে তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার পরিচয়ও তারা দেননি। এর মূল বর্ণনাকারী নিজ চোখে যেসব ঘটনা দেখেছেন এবং যেসব কথা নিজের কানে শুনেছেন বলে তিনি বর্ণনা করেছে, কিংবা এক বা একাধিক সূত্রের মাধ্যমে সেই কথাগুলো তার কাছে পৌঁছেছে, এ বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। এটি একটি মৌলিক ত্রুটি। কিন্তু ‘ইঞ্জিল বারনাবাস’ এই সব দোষ ও ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এই ইঞ্জিল রচয়িতা নিজেই বলেছেন, আমি নিজে হজরত ঈসা মসীহের প্রাথমিক বারোজন হাওয়ারীর একজন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি নিজে হজরত ঈসা মসীহের সঙ্গে রয়েছি। আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনাবলি ও নিজের কানে শোনা কথা এবং বাণীসমূহ আমি এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি I
এই বারনাবাস কে ছিলেন? বাইবেলের কার্যাবলি (প্রেরিতদের কার্য) এ নামের এক ব্যক্তির বার বার উল্লেখ এসেছে। এই ব্যক্তি ছিলেন ইহুদি পরিবারের লোক খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার ও ঈসা মসীহর অনুসারিদের সাহায্য সহযোগিতার করার ব্যাপারে তাঁর অবদানের খুব বেশি প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু সে কবে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল তা কোথাও বলা হয়নি। প্রাথমিক ১২ জনের যে তালিকা তিনখানা ইঞ্জিলে দেওয়া হয়েছে তাতে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়নি। কাজেই এই ইঞ্জিলের লেখক সেই বারনাবাস কিংবা অন্য কেউ তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। মথি ও মার্ক শিষ্যদের যে তালিকা দিয়েছেন, বারনাবাসের দেয়া তালিকার সাথে মাত্র দুটি নামের পার্থক্য। একজনের নাম হল তুমা। এর পরিবর্তে বারনাবাস নিজের নাম উল্লেখ করেছেন। লুক ইঞ্জিলে এই ২য় নামটিও রয়েছে। একারণে এরূপ ধারণা করার যৌক্তিকতা আছে যে, পরবর্তীকালে কোন এক সময় হাওয়ারি শিষ্যদের তালিকা থেকে বারনাবাসকে বহিষ্কৃত করার উদ্দেশ্যে তুমা’র নাম শামিল করা হয়েছে, যেন বারনাবাসের ইঞ্জিল থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা যায়।
উল্লেখ্য যে, ৪টি ইঞ্জিলের অসংলগ্ন কাহিনির তুলনায় এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক বর্ণনাবলি অধিক সুসংবদ্ধ। হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রদত্ত শিক্ষাবলি চার ইঞ্জিলের তুলনায় এই গ্রন্থটিতেই অধিক স্পষ্ট, বিস্তারিত ও মর্মস্পর্শীভাবে বিবৃত হয়েছে। চারটি ইঞ্জিলের উদ্ধৃত তাঁর বহু বাণী ও কথার মধ্যে যে বিরোধ ও অসংগতি সুস্পষ্ট, এই গ্রন্থটিতে তার কোন প্রমাণ চিহ্ন রাখা হয়নি। এই ইঞ্জিলে হজরত ঈসা (আ.)-এর জীবন ও তাঁর শিক্ষাবলি একজন নবীর জীবন ও শিক্ষাবলির মতই পুরাপুরিভাবে মনে হবে। তিনি এতে একজন নবী হিসাবেই নিজেকে উপস্থাপিত করেছেন। বারনাবাসের ইঞ্জিলের নানা স্থানে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর আগমন সম্পর্কে স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী উদ্ধৃত হয়েছে। আর এই কারণেই খ্রিষ্টানরা বারনাবাস প্রণীত ইঞ্জিল গ্রন্থটি প্রত্যাখ্যান করেছে বলে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের অভিমত।
ঈসা (আ.)-এর প্রথম যুগের অনুসারিরা তাকে একজন নবী মাত্র জানতেন। মূসা (আ.)-এর প্রবর্তিত শরিয়ত মেনে চলতেন। আকিদা-বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম ও ইবাদত-বন্দেগির ব্যাপারে নিজেদেরকে অন্যান্য নবী ইসরাইল হতে কিছু মাত্র ভিন্ন, স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন মনে করতেন না। ইহুদিদের সাথে তাদের মতবিরোধ ছিল শুধু এ ব্যাপারে যে, এরা হজরত ঈসা (আ.) কে মসীহ মানতে অস্বীকার করেছিল। যখন সেন্ট পল এই দলে শামিল হলেন, তখন তিনি রোমান, গ্রিক ও অন্যান্য অ-ইয়াহুদি লোকদেরকে ও অ-ইসরাঈলী লোকদের মধ্যেও এই দ্বীনের প্রচার ও প্রসার শুরু করলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি নতুন দ্বীন রচনা করলেন।
এই দ্বীনের আকিদা-বিশ্বাস, মূলনীতি ও আদেশ-নিষেধ হজরত ঈসা (আ.)- এর পেশ করা দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ও অন্যরকম ছিল। এই ব্যক্তি হজরত ঈসা (আ.)-এর কোন সাহচর্য পাননি। বরং তিনি ঈসা(আ.)-জীবদ্দশায় তার চরম বিরোধি ছিলেন। তারপর কয়েক বছর পর্যন্ত তার অনুসারীদের শত্রু হয়ে ছিলেন। পরে এই দলে শামিল হয়ে তিনি যখন একটা নতুন ধর্মমত রচনা করতে শুরু করলেন, তখন তিনি হজরত ঈসা (আ.)-এর কোন কথার সনদ পেশ করেননি। তিনি ভিত্তি করেছেন নিজের কাশফ ও ইহলাম এরই উপর। এই নূতন ধর্ম রূপায়ণে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, ধর্ম এমন হতে হবে যা সাধারণ অ-ইয়াহুদি জগৎ গ্রহণ করবে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, খ্রিষ্টানরা ইয়াহুদি শরীয়তের বাধ্যবাধকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। পানাহারের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের সকল বিধান তিনি খতম করে দিয়েছিলেন। খতনা করার বিধানও তিনি নাকচ করে দেন। আর এ সকল বিধান অ-ইয়াহুদিদের কাছে অসহ্যের ব্যাপার ছিল। এমনকি তিনি মসীহর ইলাহ হওয়া, খোদার পুত্র হওয়া এবং শূল বিদ্ধ হয়ে প্রাণদান করার মাধ্যমে আদম সন্তানের জন্মগত পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাওয়ার আকিদাও রচনা করেন। কিন্তু যে দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন, তা থেকে অ-ইয়াহুদি খ্রিষ্টানদের একটি বিরাট বন্যা প্রবাহ এই ধর্মে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ লাভ করল। ফলে সেন্ট পল বিরোধি মুষ্টিমেয় লোক এর মোকাবেলায় মুহূর্তের তরেও টিকতে পারল না। এ স্বত্ত্বেও খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর সমাপ্তিকাল পর্যন্ত হজরত ঈসার ইলাহ হওয়ার ধারণাকে অস্বীকার করে এমন বহু লোকই বর্তমান ছিল।
চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে (৩২৪ খ্রি.) নাইসিয়ার কাউন্সিল সেন্ট পল প্রবর্তিত আকিদাকে সর্বসম্মত খ্রিষ্টান ধর্মমত রূপে মনোনীত করে নিল। পরে রোমান সম্রাট ও সাম্রাজ্য নিজ থেকেই খ্রিষ্টান হয়ে গেল। এরপর এই ধর্মমতের বিপরীত আকিদা পেশ করার সমস্ত গ্রন্থাদি পরিত্যাক্ত ও বে-আইনি ঘোষিত হল এবং এই আকিদার অনুকূল সমস্ত গ্রন্থাদি নির্ভরযোগ্যরূপে গৃহীত হল। পরে ৩৮২ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ডেমাসিয়াস (Damasius)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তার সত্যতা স্বীকার (Ratification) করে নিল। পঞ্চম শতকের শেষে পোপ গেলাসিয়াস এ গ্রন্থ সমষ্টিকে সর্বসম্মত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে অসমর্থিত গ্রন্থাবলিরও একটি তালিকা রচনা করে দিল। অথচ পল প্রবর্তিত যে সব আকিদা- বিশ্বাসকে ভিত্তি রূপে গ্রহণ করে ধর্মীয় গ্রন্থাবলির নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সে সম্পর্কে কোন খ্রিষ্টান পণ্ডিত কখনও এই দাবি করতে পারেনি যে, তার মধ্যে কোন একটি আকিদা-বিশ্বাস ঈসা (আ.) নিজে শিক্ষা দিয়েছিলেন। বরং গ্রহণীয় কিতাবগুলোর মধ্যে যে সকল ইঞ্জিল গণ্য তাতে হজরত ঈসা (আ.)-এর নিজের উক্তি বলে এই সব আকিদার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বারনাবাস এর ইঞ্জিল খ্রিষ্টধর্মের সরকারি আকিদার সম্পূর্ণ বিপরীত আকিদা পেশ করে বিধায়, একে অগ্রহণীয় ও অসমর্থিত গ্রন্থাদির মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। এই গ্রন্থকার গ্রন্থের ভূমিকায় এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেছেন, ‘সেই লোকদের মতাবলির সংশোধন করিতে হইবে, যাহারা শয়তানের প্রতারণায় প্রতারিত হইয়া ঈসা মসীহ’কে খোদার পুত্র বলিয়া মনে করিতে শুরু করিয়াছে, খাতনা করা অপ্রয়োজনীয় মনে করে। সেন্ট পল এই প্রতারিত দলের একজন।’[৬]
তবে যিশু বা ঈসা (আ.)-এর নিজের সঠিক অবস্থা ও তাঁর প্রদত্ত আসল শিক্ষাবলি জানার নির্ভরযোগ্য সূত্র সেই ৪ খানা ইঞ্জিল নয়, যেগুলোকে খ্রিষ্টান গির্জা নির্ভরযোগ্য ও সর্বসমর্থিত ইঞ্জিলরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে। বরং তার জন্য সর্বাধিক বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য উপায় হল সেই ‘ইঞ্জিল বারনাবাস’! যাকে গির্জা বেআইনি, সন্দেহজনক ও অপ্রমাণিক বলে চিহ্নিত করেছে। খ্রিষ্টানরা এই ইঞ্জিল লুকিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা-যত্ন করেছে। শত শত বছর পর্যন্ত তা দুনিয়ায় অপরিচিত ও অপ্রকাশিত হয়ে রয়েছে। ষষ্ঠদশ দশকে এর ইতালীয় অনুবাদের মাত্র একখানা বই এই গ্রন্থাগারে পাওয়া যেত, তা অন্য কারও পাঠ করার অনুমতি ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সেটা ডন টোলেগু নামক একজন ব্যক্তির হস্তগত হয়। অতএব বিভিন্ন হাত ঘুরে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তা ভিয়েনা ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে পৌঁছে। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ অক্সফোর্ডের ক্লে’রিন্ডন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তা প্রকাশিত হওয়ার পরই খ্রিষ্টান জগত অনুভব করতে পারল, যে-ধর্মমতকে হজরত ঈসা (আ.)-এর নামে চালানো হচ্ছে, এই বই সেই ধর্মের মূল শিকড় কেটে ফেলে। এ কারণে ঐ মুদ্রিত বইগুলো বিশেষ ব্যবস্থাপনায় লুকিয়ে ফেলা হয়। এরপর তা আর কখনও প্রকাশিত হতে পারেনি। অপর একখানা বই এই ইতালিও অনুবাদ হতে স্পেনীয় ভাষায় তা অষ্টাদশ শতকে পাওয়া যেত। জর্জ সেল তার কুরআনের ইংরেজ অনুবাদের ভূমিকায় এর কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাও কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ফলে বর্তমানে সেটারও কোন নাম-চিহ্ন কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত এর ইংরেজি একটা কপি একজন মুসলিম পণ্ডিতের হস্তগত হয় ফলে শতশত বছর ধরে লুকায়িত সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে। খ্রিষ্টানদের বই-পুস্তকে যেখানেই এই ইঞ্জিলের উল্লেখ আসে, তখন তাকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়ে যে, এটা জাল ইঞ্জিল! কিন্তু তাদের এই কথা পরবর্তীকালের গবেষণায় মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
ইসলাম ধর্ম (Islam)
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ছয়টি ধর্মের মধ্যে সময়ের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ, কিন্তু অনুসারীদের সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় বৃহৎ ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় একশত পঞ্চাশ কোটি এবং দেশ হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ ব্যাপী বিশাল এলাকায় বিস্তৃত ৫৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের কথা বাদ দিলেও বিশ্বের অবশিষ্ট প্রায় সকল দেশেই কমবেশী ইসলামের অনুসারী রয়েছে। খ্রিষ্ট ধর্মের প্রায় ছ’শত বছর পরে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব। আরবের মক্কা নগরে কোরেশ বংশে জন্ম নেয়া বিশ্বের সর্বাধিক সফল এবং প্রভাবিত মহামানব হজরত মুহম্মদ স. (৫৭০-৬৩৩) ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই ধর্ম প্রচার করেন।
আরবে তখন চলছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও শোষণ ও নিপীড়নের এক অন্ধকার যুগ যাকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বলা হয়। আরবের সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় জীবন নিয়ন্ত্রিত হত বহু দেবদেবীর দ্বারা। মক্কার মূল উপাসনাগারে ছিল ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি। একেকটি মূর্তি একেকটি গোষ্ঠীর ভাগ্যের প্রতিরূপে চিহ্নিত হত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লাত, মানাত ও উজ্জা। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির উপায় সন্ধানকল্পে হজরত মুহম্মদ (দ.) পবিত্র হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে আত্মনিয়োগ করেন। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ৪০ বছর বয়সের সময় তিনি স্বর্গীয় দূত জিবরাইলের মাধ্যমে আল্লাহর ঐশী বাণী বা ‘ওহী’ প্রাপ্ত হন। এই ঐশী নির্দেশাবলিই পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের মূল বিধান হিসেবে গ্রন্থাকারে পবিত্র কুরআন হিসেবে সন্নিবেশিত হয়।
কুরআন নাজিল হয় ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার হেরা পর্বতের গুহায়।[৭] আল্লার আদিষ্টে জিব্রাইল কর্তৃক এর প্রথম বাক্য ছিল : ‘একরা বিসমে রাব্বেকাল লাজি খালাক’– অর্থাৎ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ পরে আল কুরআনের ৯৬ নং সুরার প্রথম আয়াত (বাক্য) হিসেবে সংকলিত হয়। এর প্রথম শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘ইকরা’-যার অর্থ পড় ( Read), পুনরাবৃত্তি কর (Repeat), তেলাওয়াত কর (Recite) অনুশীলন কর ( Rehearse ) এবং গবেষণা কর (Research)। 5 Rs তথা জ্ঞানার্জন কর। কুরআন নাজিল হয় রমজান মাসের ২৭ তারিখে ‘লাইলাতুল কদর’-এর রাত্রিতে। হজরত মুহম্মদ (স.)-এর উপর যখন কুরআন নাজিল হয় তখন তার বয়স ৪০ বৎসর। নাজিলের সময়সীমা ছিল ১৩ বছর। সর্বমোট ১১৪টি সুরার ৯২ মক্কায় এবং ২২টি মদিনায় অবতীর্ণ হয়। এতে ৭টি মনজিল, ৩০টি পারা এবং ৪৫৮টি রুকুতে বিভক্ত হয়। কুরআন সংকলিত হয় ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে।[৮]
ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী ‘মানুষ (আদিতে) ছিল একজাতি। পরে মানুষেরাই বিভেদ সৃষ্টি করল। অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন; এবং মানুষের মধ্যে যে বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছিল, তার মীমাংসার জন্য তিনি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন, এবং যাদের তা দেওয়া হয়েছিল, স্পষ্ট নিদর্শনাদি তাদের নিকট আসার পর তারা শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত বিরোধিতা করত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৩)। পবিত্র কুরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলগণকে অবিশ্বাস করে আর ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ ও রাসুলদের মধ্যে পার্থক্য করে এবং বলে যে আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি এবং এদের মধ্যবর্তী এক পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই অবিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।’ (সুরা নিসা, আয়াত ১৫০-১৫১)। অর্থাৎ সকল নবীকে মান্য করেও মাত্র একজনকেও যদি অস্বীকার করা হয়, তাহলে তা পূর্ণ বিশ্বাস বলে গণ্য হবে না। এই হিসেবে ইসলাম ধর্ম চরিত্রগতভাবে উদার ও অসাম্প্রদায়িক।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মহম্মদ (দ.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর মদিনায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তা-ও ছিল অসাম্প্রদায়িক। উক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে মদিনার ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের মধ্যে যে আন্তঃসম্প্রদায় চুক্তি (যা ইসলামের ইতিহাসে ‘মদিনার সনদ’ নামে পরিচিত) সম্পাদিত হয়, তাতে বলা হয় : প্রত্যেক ব্যক্তি (সে ইহুদি হোক, খ্রিষ্টান হোক, সাবিয়্যিন হোক বা মুসলিম) তার নিজস্ব ধর্ম পালন করার অধিকার পাবে এবং রাষ্ট্রের মূল কাঠামো হবে গণতান্ত্রিক, সেখানে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হবেন সাধারণ জনগণ দ্বারা। আর সংখ্যালঘুকে দেয়া হবে সংখ্যাগুরুর মতো সমস্ত অধিকার। মানবজীবনে যে সব মূল্যবানের সৃষ্টি হবে, তার আলোকে মানুষ তার জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করবে। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’ (সা’দ উল্লাহ, ধর্ম, রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা; ২০১০)
ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মুসলিম নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে যা ৮০০ মিলিয়নেরও অধিক। উত্তর আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ৪৫টি মুসলিম রাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপ মহাদেশে ৯ মিলিয়ন মুসলিম রয়েছে। নবম শতাব্দী থেকে ইসলামী শাসন ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ শুরু হলে তা এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে এসকল মহাদেশে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য ঘটে যা আরবদের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। একসময় মসলিম সম্প্রদায়ের আধিক্য দেখা যায় ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, ও পাকিস্তান ও ভারতে। এদেশগুলোর জনসংখ্যা সমগ্র আরব বিশেষ জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়।
ইসলাম শব্দটি ‘আসলামা’ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে যার অর্থ হল শান্তি। আর ‘মুসলমান’ শব্দের অর্থ হল আত্মসমর্পণকারী। যিনি আল্লাহর নিকট সামগ্রিকভাবে আত্মসমর্পণ (To surrender) করেন তাকেই বলা হয় মুসলমান।[৯] ‘কোরআন’ ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ। Encyclopaedia of Britannica গ্রন্থে এর অর্থ করা হয়েছে ‘কোর’ মানে পড়া; ‘আন’ অর্থ সর্বক্ষণ বা নিত্য। আভিধানিক দিক থেকে কোরআন-এর অর্থ হল ‘নিত্য পাঠ কর’। কলেমা, নামাজ রোজা, হজ্ব ও জাকাত— এই পাঁচটি ইসলাম ধর্মের মূল স্তম্ভ।
কোরআন উৎপত্তির প্রেক্ষিত সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মরু ভাস্কর হজরত ছিলেন স্বীয় পত্নী খাদিজার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় অরাকা-বিন-নওফেল (যিনি তৌরাত ও ইঞ্জিল আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন) এর প্রত্যক্ষ ছাত্র। এখান থেকেই তিনি জানতে পারেন সৃষ্টি জগতের তত্ত্ব; দর্শন, সমাজ ও জীবনাচারের খুঁটিনাটি। এছাড়া বাল্যকাল হতে মহম্মদ সেমিটিক জনপদের একাধিক স্থানে ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের সময় তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় নেষ্টরীয় খ্রিষ্টান পণ্ডিত ‘বহিরা’র সাথে। এই সাক্ষাতের মাধ্যমেই তিনি সত্যকার পরিচয় পান খ্রিষ্টান ধর্মের গূঢ় রহস্যের। এ সময় দূর দূরান্তের ব্যবসায়িক কাফেলায় ও অসংখ্য আলোচনার টেবিলে অংশ নেন তিনি। মহম্মদ যথার্থই অনুধাবন করেন; আর তা হল, সকল বিষয়েই উন্নত অভিজাত আরব জাতির একটিই দুর্বলতা ‘একজন নবী এবং পবিত্র গ্রন্থ’র অভাব। কেননা আলোচনার টেবিলে অন্যেরা যখন তাদের নবী ও পবিত্র গ্রন্থের উদ্ধৃতি ব্যবহার করতেন আরবরা তখন মুখ হয়ে যেতেন। মহম্মদ সে কারণে আরব জাতির অপরাপর সমস্যার পাশাপাশি ওই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা সমাধানের জন্য জীবনের প্রতিমুহূর্তে চিন্তিত থাকতেন; ভাবতেন, নির্জনে- নীরবে-নিভৃতিতে ধ্যানে বসতেন। অবশেষে মহম্মদ একটি ঐতিহাসিক প্ৰয়োজনকে বাস্তবায়িত করলেন। তিনি ইসলামের মত একটি ধর্মের, একটি বৃহৎ আদর্শের জন্ম দিলেন। মহম্মদ এ কাজে এগিয়ে না এলে অন্য কেউ অবশ্যই এগিয়ে আসতেন। সমাজ সংস্কারক অথবা ধর্ম প্রচারক অথবা আরব সংগঠকের জায়গা দখল করতেন, কেননা তা ছিল ঐতিহাসিক প্রয়োজন। মহম্মদ সেই সময়কার সচেতন আরবদেরই একজন প্রতিনিধি। এভাবেই ৪০ বছর বয়সে নবী ওহি প্ৰাপ্ত হন। কথিত আছে, ওহি নাজেল হত কাবিলা মাজারদের ভাষায়। এই ভাষা ছিল হজরতের পৈত্রিক ভাষা। ‘মাজার’ ছিলেন হজরতের পরদাদাদের একজন। তাঁর নামানুসারেই গোত্রের নাম হয়েছে কাবিলা মাজার। এই কাবিলা মাজারের ভাষাই ছিল কোরাইশদের ভাষা; মূলত তা ছিল আরবেরই একটি আঞ্চলিক ভাষা। কিন্তু কোরআন ভাষ্যকাররা বলে থাকেন, তা ছিল আল্লাহর ভাষা।
ইসলাম ধর্ম বিশেষত সিমেটিক (Semetic) এবং এমন কি আরবীয় চরিত্রটিকে প্রকাশ করেছে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তিনি সৃষ্টিকর্তা। তিনি সবকিছু করেন, করান- এই ধারণা ইসলাম ধর্মকে একেশ্বরবাদী করেছে। ইসলামে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর একত্ব সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। ভারতীয় চার্বাক দর্শনের মত ইসলামে ভোগের প্রাধান্য খুব বেশি। ত্যাগের কথা বলা হলেও সেই ত্যাগ-মহিমা বৌদ্ধ বা খ্রিষ্ট ধর্মের মত নয়।
ইসলাম ধর্ম শিয়া-সুন্নি এ দুটি ভাগে বিভক্ত। পরবর্তীকালে সুফি, আশারিয়া, কাদেরিয়া, জাকারিয়া এবং মুতাজিলা ইত্যাদি এই সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের ইসলাম বিভক্ত হয়ে পড়ে। আধুনিক যুগে ইসলামের আরও দুটি শাখার সৃষ্টি হয়েছে। একটি বাহাই সম্প্রদায়, অন্যটি আহমদিয়া সম্প্রদায়।[১০] এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের অনুশাসনে অনুসৃত হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী নামে চারটি মযহাব (School of Thoughts)। আরও আছে আহলে সুন্নাত আল জামাত। আছে আহলে হাদীস[১১] অনুসারিবৃন্দ। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং আল্লাহর সর্বশক্তিময়তা বা যথেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে ইসলামের মধ্যে মতপার্থক্য বা যথেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে ইসলামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মুতাজিলাবাদীরা মানুষের স্বাধীনতা এবং আল্লাহর শক্তি ও স্বরূপের মধ্যে ঐক্য স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে, আছে স্বাধীন চিন্তা ক্ষমতা। তাছাড়া আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ, তিনি পাপাচারীকে কখনও ক্ষমা করেন না। কিন্তু রক্ষণশীল মুসলিমেরা এই মতের তীব্র বিরোধিতা করেন। বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে এখানে একটা বড় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইচ্ছার স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা বৌদ্ধ ধর্মকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।
ইসলাম বিশ্বের নবীনতম ধর্ম হওয়াতে প্রাক্ অথবা অন্য ধর্মসমূহ হতে অনেক দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, নীতি, মতবাদ এবং উপদেশ পরোক্ষ অথবা প্রচ্ছন্নভাবে গ্রহণ করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের অনেক নীতি বা আদর্শ ইসলাম ধর্মে দেখা যায়। যেমন– বৌদ্ধ ধর্মের পঞ্চশীল ইসলামের পাঁচটি মৌল বিষয়ে বিশ্বাস, বৌদ্ধ ধর্মের ত্রৈমাসিক উপবাত, ইসলামের একমাস রোজা উপবাসব্রত, বৌদ্ধ ধর্মের উপাসক পাসিকাকে প্রতি অষ্টমীতে সেখানে বিহার যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ইসলামের বিধান হল প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার একবার মসজিদে গিয়ে জুম্মাহর নামাজ আদায় করার কথা বলা হয়েছে। আবার কোন কোন ধর্মীয় বিধানকে উল্টোভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগের শিক্ষা, ইসলামে ভোগের শিক্ষা, বৌদ্ধ ধর্মে যুদ্ধ পরিহারের শিক্ষা, ইসলামে যুদ্ধ গ্রহণ করার শিক্ষা ইত্যাদি। ফানা-ফিল্লাহ এবং বাক্কা-বিল্লাহ ইসলামের চরম এবং পরম লক্ষ্য।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলামের অনুসৃত সর্বাধিক উদার মত সুফিবাদ। (বিস্তারিত পাঠের প্রয়োজনে দেখুন : ষষ্ঠদশ অধ্যায়)
বাঙালি সমাজে অনুসৃত আরও কতিপয় ধর্ম
কোন একটি ভৌগোলিক এলাকায় দীর্ঘকাল বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সুদীর্ঘকাল ধরে আচরিত জীবনাচার, অভ্যাস, বিশ্বাস, সংস্কার ও জীবনবোধের ঘনীভূত বা জমাটবদ্ধ রূপই কালে ধর্ম নামে চিহ্নিত হয়। ধর্মের অস্তিত্ব নেই বা ছিল না, এমন কোন মানবসমাজের কথা জানা যায় না। ধর্ম মানুষের সমাজজীবনে, রাজনৈতিক জীবনে, অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বস্তুত সকল সমাজের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বস্তুত সকল সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ধর্ম এবং এটা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সর্বোতভাবে ভূমিকা পালন করে। উইকিপিডিয়া প্রদত্ত তথ্য ও ইউনেস্কো জরিপসূত্রে বলা যায় বর্তমান বিশ্বে ৪২০০টি ধর্মমত প্রচলিত আছে। এগুলি আবার ২৭০টি শাখা-প্রশাখা ও বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভক্ত। অনুসারিদের সংখ্যার ভিত্তিতে এসব ধর্ম থেকে কয়েকটি ধর্ম প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হিসেবে বিবেচ্য। তারপরও বলা যায় পৃথিবীর কোন ধর্মই সর্বজনীন নয়। একে অন্যের পরিপূরক। তাই মানবিক প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে একেকটি নতুন ধর্ম। আর নব সৃষ্ট ধৰ্মই মানব সমাজে নানা জনপদে নানাভাবে মানুষের জীবনাচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণের বিধিবদ্ধ বিধান তৈরিতে যেসকল মহাপুরুষ অবদান রেখেছেন— তাঁরাই একেক জনপদে স্ব-সম্প্রদায়ের কাছে নমস্য হিসেবে পূজিত হয়ে আসছেন। এই মান্যতা থেকেই বিভিন্ন ধর্ম চিন্তকদের উপলব্ধি বোধই একেকটি নতুন ধর্মরূপে আবির্ভূত হয়। মানুষের মনেই ধর্মের জন্ম। খ্রি. পূ. পাঁচ শতকে গ্রিক দার্শনিক প্রোটোগোরাস সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেন Man is the measure for everything’ । বাংলায় মানুষ বা মানববোধের গুরুত্ব সূচিত হয় পালযুগ বা চর্যাযুগ থেকে। পরবর্তীকালে তা বিকশিত হতে থাকে নাথসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণবসাহিত্য, সুফিসাহিত্য, শাক্তপদ, বাউলগান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। বৌদ্ধ সহজিয়া ভিক্ষুবৃন্দের রচিত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে রয়েছে এই নিদর্শন। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মানুষ। মানবকুলের বৈষম্যহীন সমাজে এক অনুপম রূপকল্প এই চর্যাপদ। চর্যাগীতির মানব বন্ধনার ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের (১৩৩৯-১৩৯৯) আবির্ভাব। মানববৈরী ধর্মবৃত্তির চেয়ে হৃদয়বৃত্তিকে উঁচুতে আসন দিয়ে চণ্ডীদাস দৃপ্ত ঘোষণা দিলেন- ‘শুন হে মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।
বাংলার এই জনপদে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব বাঙালি জনজীবন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধান্য পেলেও এখানে রয়েছে আরও অনেক ধর্ম সম্প্রদায়। এখানে আছে বাহাইধর্ম,[১২] শিখধর্মসহ[১৩] অসংখ্য সমাজ ও সম্প্রদায়। এ যেন সত্যের সাধনায় বহুমুখী স্রোতধারা। এই স্রোতধারায় মিশে আছে গোরক্ষনাথ প্রতিষ্ঠিত নাথধর্ম, শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম, আউলচাঁদ প্রবর্তিত কর্তাভজা ধর্ম, রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্মসহ এরকম আরো অনেক উপধর্ম। এই উপধর্মের স্রোতবাহী ধারায় আরো রয়েছে দুঃখীরাম প্রবর্তিত সাহেবধনী সম্প্রদায়, কালাচাঁদ বিদ্যালঙ্কার প্রবর্তিত কিশোরীভজা সম্প্রদায়, বলরাম হাড়ি প্রবর্তিত বলাহাড়ি সম্প্রদায়, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পরিবর্ধিত সৎসঙ্গ সম্প্রদায়, শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়া সম্প্রদায়, শ্রী ঠাকুরবাণী প্রবর্তিত ঠাকুরবাণী সম্প্রদায়, শ্রী বসন্ত সাধু প্রবর্তিত মা-দাদা সম্প্রদায়, মনোমোহন দত্ত প্রবর্তিত দয়াময় সম্প্রদায়, করমশাহ প্রবর্তিত পাগলা-পন্থা সম্প্রদায়, রামবল্লভ প্রবর্তিত মহানাম সম্প্রদায়, শ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত প্রবর্তিত মাধব গৌড়ীয় সম্প্রদায়, স্বামী স্বরূপানন্দ প্রবর্তিত অখণ্ডমণ্ডলী, শ্রীল ভক্তিবেদান্ত প্রভুপাদ প্রবর্তিত ইসকন ইত্যাদি। (বিস্তারিত পাঠের জন্য দেখুন, তৃতীয় অধ্যায় : বাংলার লোকধর্ম)।
এ ছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে চর্মশিল্পী সম্প্রদায়ের মধ্যে আচরিত সন্ত রুইদাস। রবিদাস প্রতিষ্ঠিত রবিদাস সম্প্রদায়। বৈষ্ণব ধর্মের উজ্জীবন পরবর্তী বাংলাদেশে ভিক্ষু ত্রিদণ্ডি প্রমোদ মুনি প্রচারিত মাধ্ব গৌড়ীয় সম্প্রদায়। বাংলাদেশের বরেন্দ্র ভূমির পণ্ডিত নাঢ় ও তাঁর সহধর্মিণী জ্ঞানডাকিনী নাঢ়ী প্রবর্তিত নেড়ানেড়ী সম্প্রদায়। উৎকল থেকে আগত সরাক সম্প্রদায়। বাংলাদেশে মধুপুর অঞ্চলে প্রচলিত সাংসারেক সম্প্রদায়। বৌদ্ধ সহজিয়া থেকে উৎপন্ন দরবেশ সম্প্রদায়। শিব বা মহেশ্বর পূজিত শৈব সম্প্রদায়। লিঙ্গ সৃষ্টির প্রতীক বিবেচনায় এই ধারায় অস্তিত্ব আছে লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় নামে অপর একটি সম্প্রদায়। বাংলাদেশে বৌদ্ধতান্ত্রিক সমাজে আছে সখীভাবক সম্প্রদায়। বৌদ্ধ মরমিয়া ধারায় কৌলশাস্ত্র (প্রজ্ঞাশক্তির পাঁচ রূপ/পঞ্চকুল বা পঞ্চতথাগত) অর্থাৎ কূলতত্ত্ব অনুসৃত কৌল সম্প্রদায়। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ অনুসৃত অবধূত সম্প্রদায়। মহাযানী বৌদ্ধমত অনুসৃত রাউল/রাউলী সম্প্রদায়। বাংলাদেশের মধুপুর অঞ্চলে প্রচলিত জলছত্রের গুরুসত্য সম্প্রদায়। রংপুর ও দিনাজপুর জেলার সতিমন ডাঙ্গিও সত্যমন ঠাকুররূপী সত্যপীর/সত্যনারায়ণরূপী হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজে প্রচলিত পিরালী সম্প্রদায়। পাবনা জেলায় প্রচলিত ঋষিপুরুষ শম্ভুচাঁদ প্রবর্তিত শম্ভুচণ্ডী সম্প্রদায়। বাংলাদেশে খ্রিষ্টধর্মের মরমিয়াবাদ অনুসৃত সাধু হৃদয়রঞ্জন সমাদ্দার প্রবর্তিত সহভাগিতা সম্প্রদায়। এ ছাড়াও বাংলাদেশে অবলেট সম্প্রদায়, জ্যাভেরিয়ান সম্প্রদায়, ব্যাপটিস্ট সম্প্রদায়সহ আরো অনেক সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আছে।
অসংখ্য ধর্মমতের মধ্যে নিমজ্জিত এই বিশ্ব মানবসমাজ। বাঙালি সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। সাধারণত ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বধর্মে নিষ্ঠাবান। কেউ কেউ হয়ত মনে করে তাঁর অনুসৃত ধর্মটিই ঠিক। এমতাবস্থায় কোন গবেষক যদি তাঁর ধর্মের দুর্বলতা চিহ্নিত করেন সেটা স্বধর্মে নিষ্ঠাবানের জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার নয়। এই ব্রিতকর পরিস্থিতির মধ্যে কোন নতুন সন্ধিৎসার অনুগামি হওয়া কিংবা ধর্মচিন্তায় পরিবর্তন ঘটানো এবং সেই সাথে সমাজে ভিন্ন ধর্মানুসারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুরক্ষা করা একটি কঠিন বাস্তবতা। যদিও একেশ্বরবাদী শাস্ত্রীয় মতে বহু ধর্মের অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়। ধর্ম একটাই। স্রষ্টা একজনই। এখানে সৃষ্টি বৈচিত্র্যের মধ্যে স্রষ্টার বহুত্বের উপলব্ধি অজ্ঞতাপ্রসূত বিষয়। তারপরও পরিত্রাণ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় যেসব ধর্মমত মানবসমাজে প্রচলিত আছে তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য উন্মোচন ধর্মগবেষকদের কাছে সহজ হলেও জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মপালনকারীর জন্য সহজ নয়। ইসলাম অনুসৃত সাধারণ ধর্মানুসারিও অসংখ্য পয়গম্বর— নবী, রসূলের সন্ধান পান। ইসলাম ধর্ম মতে, বিভিন্ন সময়ে মানব জাতিকে সতর্ক করার প্রয়োজনে পৃথিবীতে সত্তর হাজার মতান্তরে এক লাখ চব্বিশ হাজার পয়গম্বরের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩১৩ জন মতান্তরে ৩১৫ জন রাসূল এবং অবশিষ্ট সবাই নবী ছিলেন। নবী ও রসূলের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যের অন্যতম হল— যেসব নবীদের কাছে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাঁরা নবী ও রাসূল— এই সমন্বিত মহিমায় অভিষিক্ত এবং অপরাপর সবাই নবী মর্যাদায় অভিষিক্ত। সনাতন ধর্মের গীতায় ঘোষিত হয়েছে দুষ্কৃতিদের শাস্তিপ্রদান এবং সাধুদের পরিত্রাণ প্রাপ্তির জন্য যুগে যুগে স্বয়ং স্রষ্টা অবতাররূপে আবির্ভূত হন। তবে তা স্বমূর্তিতে নয় (দ্র. পৃ. ৩৬৮-৬৯)। নিরাকার অবয়বে তাঁরই প্রতিনিধি হয়ে সাধারণ মানুষ থেকেই নির্বাচিত হয় এই পরিত্রাণসহায়ক প্রতিনিধি। তাই বলে এঁরা নিজেরাই স্রষ্টা নন– স্রষ্টার প্রতিনিধি। আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এঁরা লোকধর্মের প্রবক্তা পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত। পরবর্তী তৃতীয় অধ্যায়ে এঁদের ধর্মচিন্তার বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত হবে।
—
৪. বেদ পাঠ ও শ্রবণে ব্রাহ্মণ ছাড়া আর অন্য কারও অধিকার নেই, ব্ৰাহ্মণ ব্যতীত বৈশ্য, শূদ্র ও অন্যান্য সকলের জন্য বেদমন্ত্র উচ্চারণ বা পাঠ এমনকি শ্রবণাধিকার ও নেই। অন্যদের শ্রবণ বা পঠনে অমানুষিক শাস্তি যেমন, জিহ্বা ছেদন, কর্ণে গলিত সীসা ঢেলে দেয়া ইত্যাদি বিধান বিদ্যমান, এমনকি যাতে কেউ বৃক্ষের অন্তরালে, অন্ধকারে আত্মগোপন করে, বায়ু প্রবাহে কর্ণপাত করে দূর হতে শুনতে না পায় তজ্জন্য মেঘাচ্ছন্ন দিনে, ঝড়ের সময়, বৃক্ষের ছায়ায়, শস্যক্ষেত্রে বা গ্রামে ও অরণ্যে বেদ পাঠ নিষিদ্ধ করা হয়। (অথর্ববেদ ৭ম কাণ্ড, ৬ষ্ঠ অনুবাক, ২য় সুক্ত, ৭ম মন্ত্ৰ)
৫. ওল্ড টেস্টামেন্ট ইহুদিদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। নিউ টেস্টামেন্ট তাদের কাছে গ্রাহ্য নয়, তাই খ্রিষ্টানদের দেওয়া ওল্ড টেস্টামেন্ট নামটির তারা বিরোধী। তাদের মতে টেস্টামেন্ট একটি-ই। তাকে ওল্ড এবং নিউ বলে ভাগ করা চলে না, এবং এই (ওল্ড) টেস্টামেন্টই সম্পূর্ণ বাইবেল। তবে খ্রিষ্টানদের বাইবেলের সাথে এর পার্থক্য বোঝাবার জন্য তারা একে ওল্ড টেস্টামেন্টের বদলে হিব্রু বাইবেল আখ্যা দিতে আগ্রহী, কারণ হিব্রু জাতি থেকেই ইহুদিদের উৎপত্তি এবং মূল টেস্টামেন্ট হিব্রু ভাষাতেই লিখিত। 5. Ten Commandments / দশ আজ্ঞা)
৬. এই প্রসঙ্গে হজরত ঈসা (আ.)-বিস্তারিত ভাষণ উদ্ধৃতি করেছেন। তাতে তিনি কঠোর ভাষায় এই সব ভুল বিশ্বাসের প্রতিবাদ করেছেন। এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ার দরুণ তিনি নিজে যে বিব্রত ও কাতর হয়ে পড়েছিলেন, নানা স্থানে তার বর্ণনাও দিয়েছেন। এতদ্ব্যতীত হজরত ঈসা মসীহ শূলে প্রাণ ত্যাগ করেছেন— সেন্ট পল রচিত এই ভ্রান্ত আকিদারও তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে এই গ্রন্থে। গ্রন্থকার তার প্রত্যক্ষ বিবরণে বলেছেন, ‘ইয়াহুদ ইস্কারিউতি যখন ইয়াহুদিদের সরদার পাদ্রির নিকট হইতে ঘুষ গ্রহণ করিয়া হজরত ঈসাকে গ্রেফতার করাইবার জন্য সিপাহীদের লইয়া আসিল, তখন আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে চারজন ফেরেশতা তাহাকে তুলিয়া লইয়া গেলেন এবং ইস্কারিউতির আকৃতি ও কণ্ঠস্বর হজরত ঈসার মতই বানাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। এবং তাহাকেই শুলে চড়ানো হইয়াছিল-হজরত ইসাকে নয়।’ এভাবেই এই ইঞ্জিল গ্রন্থটি সেন্ট পল রচিত খ্রিষ্টধর্মের শিকড় উৎপাটন করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কুরআন নাযিল হওয়ার ১১৫ বছর পূর্বে এই গ্রন্থটির এই বর্ণনা সমূহের কারণেই খ্রিষ্টান পাদ্রিগণ তাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
৭. একদা গভীর নিশীথে ২৭ রজমান (৬১০ খ্রি.) পারান পর্বতের ‘হেরা’ নামক গুহায় হজরত মুহম্মদ (স.) স্বর্গীয় দূত হজরত জিব্রাইলের সাক্ষাৎ লাভ করেন। জিব্রাইল (আ.) তাঁকে স্বর্গীয় মহাগ্রন্থ কুরআনের ‘আলাক’ সুরার প্রথম পাঁচটি শ্লোক শিক্ষাদান করে অন্তর্হিত হন। হজরত কম্পিত কলেবরে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন এবং প্রিয়তমা সহধর্মিণী খাজিদা (রা.) এর নিকট আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বিবৃত করেন। খাদিজাই সর্বপ্রথম তাঁকে আল্লাহর ‘রসূল’ বলে বিশ্বাস জ্ঞাপন করেন। কিছুদিন পর হজরত (স.) আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রত্যাদেশ ও প্রিয়তমার উৎসাহবাক্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে থাকেন।
৮. সূরাগুলির ক্রমধারা হল : ১. ফাতিহা (উদ্ঘাটিক/প্রারম্ভিকা) ২. বাকারাহ (গাভী) ৩. আলই-ইমরান (ইমরানের সন্ততি) ৪. নিসা (নারীগণ) ৫. মায়েদাহ (অন্নপাত্র) ৬. আ’ন আ’ম (গ্রাম্য পশু) ৭. আ’রাফ (স্বর্গ ও নরকের মধ্যবর্তী স্থান) ৮. আনফাল (যুদ্ধে লব্ধ সামগ্রী) ৯. তওবা (অনুশোচনা) ১০. ইউনুস (এক পয়গম্বরের নাম) ১১. হুদ (এক পয়গম্বরের নাম) ১২. ইউসুফ (এক পয়গম্বরের নাম) ১৩. রা’দ (ব্রজধ্বনি) ১৪. ইব্রাহীম (এক পয়গম্বরের নাম) ১৫. হিজর (বিচ্ছেদ) ১৬. নাহল (মধুমক্ষিকা) ১৭. বনি ইস্রাঈল (ইস্রাঈল সন্তানগণ) ১৮. কাহাফ্ (গর্ত) ১৯. মরিয়ম (এক ধার্মিকা নারীর নাম) ২০. ত্বা হা (ব্যবচ্ছেদক শব্দ) ২১. আম্বীয়া (স্বৰ্গীয় সংবাদ বাহকগণ) ২২. হজ (মক্কা তীর্থের ব্রতবিশেষ) ২৩. মোমেনূন (বিশ্বাসীগণ) ২৪. নূর (জ্যোতি) ২৫. ফুরকান (কুরআন) ২৬. শোয়ারা (কবিগণ) ২৭. নমল (পিপীলিকা) ২৮. ক্বাস্বাস্ (উপাখ্যানাবলী) ২৯. আনক্বাবুত (ঊর্ণনাভ) ৩০. রূম (রাজ্যবিশেষ) ৩১. লুকমান (ব্যক্তিবিশেষের নাম) ২৩. সিজদাহ্ (প্রণিপাত) ৩৩. আহযাব (দলসমূহ) ৩৪. সা-বা (দেশবিশেষ) ৩৫. ফাত্বির (সৃষ্টিকর্তা) ৩৬. ইয়াসীন (ব্যবচ্ছেদক শব্দ) ৩৭. সাফ্ফাত্ (শ্রেণিবদ্ধকারিগণ) ৩৮. স্বোয়াদ (ব্যবচ্ছেদক বর্ণবিশেষ) ৩৯. যুমার (মানুষের দল) ৪০. মুমিন (বিশ্বাসী) ৪১. ব্লু-মীম্ সিজদাহ্ (ব্যবচ্ছেদক বর্ণবিশেষ ও প্রণিপাত) ৪২. শূরা (মন্ত্রণাসকল) ৪৩. যুখরোফ (সুর্বণ) ৪৪. দোখান (ধূম্র) ৪৫. যাষীয়া (জানুপরি বসা) ৪৬. আহ্কাফ (স্থান বিশেষের নাম) ৪৭. মোহাম্মদ (ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহাপুরুষের নাম) ৪৮. ফাতাহ্ (বিজয়) ৪৯. হুজোরাত (কুটীর সকল) ৫০. ক্বাফ (ব্যবচ্ছেদ বর্ণ) ৫১. যারীয়াহ্ (বিক্ষিপ্তকারী বায়ুরাশি) ৫২. তূর (পর্বতবিশেষ) ৫৩. নাজম (নক্ষত্র) ৫৪. ক্বামার (চন্দ্র) ৫৫. রাহমান (আল্লাহর নাম বিশেষ) ৫৬. ওয়াকিয়াহ (সংঘটনীয়) ৫৭. হাদীদ (লৌহ) ৫৮. মুজাদালা (পরস্পর বিবাদ) ৫৯. হাশর (একত্র হওন) ৬০. মুমতাহানা (পরীক্ষিত) ৬১. স্বা-ফ্ (শ্রেণি) ৬২. জুমআ (শুক্রবার) ৬৩. মুনাফেকূন (কপটগণ) ৬৪. তাগাবোন (পরস্পর ক্ষতি করা) ৬৫. ত্বালাক (বর্জন), ৬৬. তাহ্রীম (অবৈধকরণ) ৬৭. মূল্ক (রাজত্ব) ৬৮. ক্বালাম (লেখনী) ৬৯, হাক্বাক্বাহ্ (বাস্তবিক) ৭০. মায়ারেজ (সোপান শ্রেণি) ৭১. নূহ (এক পয়গম্বরের নাম) ৭২. জ্বিন (দানব) ৭৩. মোজাম্মেল (কম্বলাবৃত) ৭৪. মুদাষির (বস্ত্রাবৃত) ৭৫. কিয়ামাহ্ (প্রলয় ঘটনা) ৭৬. দাহর (কাল) ৭৭. মুরসালাত (প্রেরিতগণ) ৭৮. নাবা (সংবাদ) ৭৯. নাযেয়া’ত (আকর্ষণকারী) ৮০. আবাসা (ভ্রূ কুঞ্চিত করা) ৮১. তাকভীর (বেষ্টিত হওন/আবরণ) ৮২. ইনফিত্বার (বিস্ফোরণ) ৮৩. তাত্ক্ষীক্ (ন্যূন করা/পরিমাণ হ্রাস করা) ৮৪. ইনশিকাক্ব (বিদীর্ণ হওন) ৮৫. বুরুজ (গ্রহ বা রাশিচক্র) ৮৬. তারেক (নৈশ আগন্তুক) ৮৭. আ’লা (মহত্তম) ৮৮. গাষীয়াহ্ (আচ্ছন্নকারী/প্রলয় ঘটনা) ৮৯. ফাজর (প্রাতঃকাল) ৯০. বালাদ (নগর) ৯১. শাম্স (সূর্য) ৯২. লায়িল (রাত্রি) ৯৩. জোহা (দিবসের প্রথম প্রহর) ৯৪. ইনশেরাহ্ (বিদারণ) ৯৫. ত্বীন (আঞ্জির ফল বা যয়তুনের গাছ) ৯৬. আলাক্ব (ঘণীভূত শোণিত) ৯৭. ক্বাদার (সম্মান) ৯৮. বায়য়্যেনা (নিশ্চিত প্রমাণ) ৯৯. যিলযাল (ভূমিকম্প হওয়া) ১০০. আ’দীয়াত (দ্রুতগামী অশ্ব) ১০১. ক্বারীয়াহ্ (ভীষণ বিপদ), ১০২. তাকায়ুর (প্রাচুর্যের গর্ব করা) ১০৩. আস্বর (কাল, অপরাহ্ন) ১০৪. হোমাযাহ্ (অপবাদ দেওয়া) ১০৫. ফীল (হস্তী) ১০৬. কুরাইশ (আরবের একটি গোত্র। এই গোত্রে হজরত মহম্মদ জন্মগ্রহণ করেন) ১০৭. মায়ুন (পরস্পরের সাহয্য দানের বস্তু) ১০৮. কাওষার (স্বর্গস্থ সরোবর বিশেষ, অমৃত) ১০৯. কাফেরূন (ধর্মদ্রোহিগণ/অবিশ্বাসীগণ) ১১০. নাম্বর (সাহায্য) ১১১. লাহাব (শিখাময় বহ্নি) ১১২. ইখলাস (নির্মলতা/বিশুদ্ধ) ১১৩. ফালাক্ব (ঊষা) ১১৪. নাস (মনুষ্য)। (কুরআন শারীফ, মাওলানা মোবারক করীম জওহর অনুদিত ও আবদুল আযীয আল-আমান কর্তৃক হরফ প্রকাশনী, কলকাতা থেকে প্রকাশিত, ১৯৯৫)।
৯. হজরত নূহের প্লাবনের পর কা’বা শরীফ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিন হজরত ইব্রাহীম, হজরত মুহম্মদের (সা.) জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। এই সময়েই তিনি আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং দুই পুত্রসহ (ইসমাইল ও ইসহাক) উভয়কেই ‘মুসলিম’ (আত্মনিবেদিত) বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণা বাণী থেকেই ইব্রাহীমের বংশধরগণ মুসলিম বা মুসলমান বলে পরিচিত হন।
১০. আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমদ (১৮৩৫-১৯০৮)। তিনি কোরআনে উল্লিখিত হজরত মহম্মদ (স.) কে ‘খাতামাল আম্বিয়া’ শব্দের অর্থ শেষ নবী অর্থে অনুসরণ না করে নবীদিগের মোহর (সকল নবী থেকে শ্রেষ্ঠ) অর্থে অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। পূর্ব পাঞ্জাবের কাদিয়ান অঞ্চলে জন্ম বলে তিনি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নামে পরিচিত। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম কিশতিয়ে নূহ। তিনি মনে করেন ওহির দরজা এখনও খোলা আছে। তাঁর অনুসারীরা তাঁকে প্রতিশ্রুত মসীহ ও ইমাম মাহদী (আ.) হিসেবে দাবি করেন। মির্যা গোলাম আহমদ এর অনুসারিরা নিজেদের ‘আহমদীয়া আল জামাত’ নামে পরিচয় দেন। তবে মুসলিম সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এদের ‘কাদিয়ানী’ নামে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশে ঢাকার বকশী বাজারে আহমদীয়া আল জামাত-এর প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
১১. আহলে হাদীস কথাটি ফার্সি ও উর্দু সম্বন্ধপদ। মূলত আরবী ভাষা ‘আহলুল হাদীস’ থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। আহলে হাদীস ও আহলুল হাদীস উভয় উচ্চারণের অর্থ একই হয়। আহলুন শব্দের অর্থ বংশধর বা অনুসারী। আর হাদীস অর্থ কথা বা বাণীকে হাদীস বলা হয়। তাই আহলে হাদীস অর্থ হচ্ছে হাদীসের অনুসারী। অনেকে মনে করেন রসুল (স.)-এর কথা বা কাজকেই শুধু হাদীস বলে। অথচ আল্লাহ নিজের কুরআন মাজীদে তাঁর কথাকে হাদীস বলেছেন। যেমন : আল্লাহু নায্যালা আর্সানাল হাদীস। অর্থাৎ আল্লাহ অতি উত্তম হাদীস অর্থাৎ কুরআন। (সুরা যুমার- ২৩ নং আয়াত) অন্য আয়াতে আছে— আফারিমন হা-যাল হাদীসি তা’জাবউন। অর্থাৎ তোমরা কি এই হাদীস তথা কুরআন শুনে আশ্চর্যবোধ করছ? (সুরা : আনজম ৫৯ নং আয়াত) এরূপভাবে মোট ১৪টি আয়াতে কুরআন তথা আল্লাহর কথাকে হাদীস বলা হয়েছে। যারা কুরআন ও হাদীসকে সরাসরি অনুসরণ করে তারাই আহলে হাদীস। কুরআন ও সুন্নাহ বা ইসলাম যাদের মাযহাব (চলার পথ) তারাই আহলে হাদীস।
১২. ইরানের শিরাজনগরের মির্জা হোসেন আলী নূরী বাহাউল্লাহ প্রবর্তিত বাহাই ধর্ম (Baha’ism)। এটি একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। মূলত মানবজাতির আত্মিক ঐক্য হচ্ছে এই ধর্মের মূল ভিত্তি। আরবি ‘বাহা’ থেকে বাহাই শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ মহিমা বা উজ্জ্বল দীপ্তি। বর্তমান বিশ্বে এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ৭০ লাখ। বাংলাদেশেও বাহাই অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। ঢাকার নিউ ইস্কাটনে বাঙালি বাহাই ধর্মানুসারিদের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
১৩. ১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাবের গুরু নানক প্রবর্তিত শিখধর্ম (Shikhism)। এটি একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। শিখ শব্দটি সংস্কৃত মূলশব্দ শিষ্য বা শিক্ষা থেকে আগত। এই ধর্মের মূল ভিত্তি গুরু নানক দেব ও তাঁর দশ জন শিখ গুরুর ধর্মোপদেশ। এই দশ জন গুরু পরম্পরা হল : গুরু নানক, গুরু অঙ্গদ, গুরু অমরদাস, গুরু রামদাস, গুরু অজুর্নদেব, গুরু হরগোবিন্দ, গুরু হররায়, গরু হরক্ষিণ, গুরু তেগবাহাদুর, গুরু গোবিন্দ সিংহ, শ্রী শ্রী গুরু গ্রন্থসাহিব ও পন্থ খালসা। এই ধর্মে ঈশ্বরের অবতারতত্ত্ব স্বীকৃত নয়। বর্তমান বিশ্বে অনুসারীর সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ। বাংলাদেশেও শিখ ধর্ম অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন শিখ গুরুদুয়ারা নানকশাহী বাঙালি শিখ ধর্মানুসারিদের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
—
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
Shorter Encyelopeadia of Islam, Leiden, 1960
Encyclopeadia of Religion and Ethics, Edinburgh, 1964
J.S. Trimingham, Islam in West Africa; Oxford, 1876
T.W. Arnold, Preaching of Islam, Oxford University Press, 1896
Martin Palmer, The Times World Religions : A History of Faith, Times Book, London
Gonga Somany, World Religions; Calcutta, India
Fazlur Rahman, Islam, The University Press, Chicago, Illinois, USA 1966
মোহাম্মদ মতিওর রহমান (সংকলিত) ঐতিহাসিক অভিধান; বাংলা একাডেমী ঢাকা ১৯৯৬
কোরান শরিফ, মোহাম্মদ আলী হাসান (অনূদিত), ওসমানিয়া বুক ডিপো, ঢাকা পূর্ব পাকিস্তান। কোরআনুল করীম, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (অনুবাদ ও সম্পাদনা), খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহাদ কোরআন মুদ্ৰণ প্ৰকল্প, মদীনা মোনাওয়ারা।
বঙ্গীয় খ্রীষ্ট্রীয় পরিষেবা : অধ্যয়ন ও গবেষণা বিভাগ, সহস্রাব্দের সমীক্ষা (প্রথম খণ্ড) কলকাতা, ২০০১
ক্ষিতিমোহন সেন, হিন্দুধর্ম; আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ২০০৮
মোহাম্মদ আবদুল হাই, বিদেশীদের সংস্কৃত ও বাংলা ভাষাচর্চা; সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৮
ড. মো. শাজাহান কবির, বিশ্বের ধর্ম পরিচিতি; দিক দিগন্ত, ঢাকা, ২০০৯
মোহাম্মদ আবদুল হাই সম্পাদিত বাঙালির ধর্মচিন্তা; সূচীপত্র, ঢাকা, 2012
শানজিদ অর্ণব, ধর্মকোষ; দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১২
শরদিন্দু শেখর চাকমা, গৌতম বুদ্ধ ও তার ধর্ম; অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৮
ড. জিতেন্দ্রলাল বড়ুয়া, মহামানব গৌতমবুদ্ধ; অন্যধারা, ঢাকা, ২০১৯