২. বাইশের কোঠা ছাড়িয়ে

এমনি যখন মনের অবস্থা, বয়স যখন বাইশের কোঠা ছাড়িয়ে গিয়েছে, তখনই এসেছিল তারকা। তার আগেও যে তারকদা আসেনি, তা নয়। পাড়ার ছেলে, প্রতিবেশী। ছেলেবেলা থেকে অনেক বারই দেখেছে তারককে। তারকদের অবস্থা তেমন ভাল না হলেও, কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। তারকদা নিজেও বলত, লোকেরাও জানত, কলকাতায় সে চাকরি করে। সপ্তাহে একদিন করে বাড়ি আসত। অন্যান্য ছুটিতেও, গ্রামে যাওয়া-আসা লেগেই ছিল।

চাকরিটা যে তারকদা ভালই করত, সেটা বোঝা যেত তাকে দেখে। তার পোশাক-আশাক, চাল-চলন, খরচের বহর দেখেই অনুমান করা যেত, কলকাতায় সে বেশ ভালই আছে। তারকদা গ্রামে এলে, গ্রামের বন্ধুরা খুশি হয়ে উঠত। গ্রাম তো ঠিক বলা যায় না আর। শহরই বলতে হবে। তবু, পুরনো অধিবাসীদের কাছে, শহরের পরিচয়ও গ্রামই। গ্রাম বলতেই তাদের ভাললাগে। তাতে যেন নিজেদের অধিকারটা অনেক বেশি অনুভূত হয়। শহর বললে, নিজেদের অধিকার ঠিক তেমন করে প্রতিপন্ন হয় না।

তারকা দেশে এলে, শুধু তার ছেলেবেলার বন্ধুরাই খুশি হত না। কলকাতা থেকেও তার সঙ্গে দল বেঁধে বন্ধুরা আসত। তখন পাড়ায় রীতিমতো সাড়া পড়ে যেত। তারকদার কলকাতার বন্ধুরা খাওয়া-দাওয়া, পুকুরে সাঁতার কাটা,হইহল্লা করে মাতিয়ে তুলত। সবাই খুশি হত না। কেউ কেউ বিরক্ত হত। সেটা নিতান্তই ঈর্ষা। গ্রাম্য নীচতা। কাউকে একটু সচ্ছল সুখী দেখলেই, যাদের চোখ টাটায়, মন পীড়িত হয়, তারাই বিরক্ত হত। তারা বলাবলি করত, বেথা হয়নি, আইবুড়ো বয়সের রোজগার। এ সবই দুদিনের। চাপ পড়লেই বাপ বলতে হবে এর পরে। তখন কোথায় যাবে এত সব র‍্যালা।.ইত্যাদি।

একটু দুর্নামও যে না ছিল, তা নয়। শোনা যেত, তারকদা মদ খায়। হয়তো খেত। অনেকেই তো খায়। কিন্তু অনেকের মতো তারকাকে কেউ কখনও মাতলামি বা অভদ্র আচরণ করতে দেখেনি। আরও একটা দুর্নাম ছিল তার নামে। কোনও কোনও বাড়িতে নাকি, তারকদার যাতায়াত বেশি এবং সেই সব বাড়িতে, তারকদা রীতিমতো টাকা-পয়সা খরচ করে। তাদের অর্থসাহায্য করে। বিনা স্বার্থে নয়। উপলক্ষ সেই সব পরিবারের মেয়েরা।

এ সংবাদের কতখানি রটনা, কতটা সত্যি মিথ্যে, হলপ করে বলবার কেউ ছিল না। কথাটা শোনা যেত, এই পর্যন্ত। যে সব বাড়ির বিষয়ে শোনা যেত, সে সব বাড়িতে মেয়েরাও ছিল, যাদের খুব সুনাম ছিল না। তাদের সঙ্গে তারকাকে এখানে সেখানে বেড়াতে বা সিনেমায় যেতেও দেখা গিয়েছে। তার থেকেই যতটুকু আন্দাজ মেলে। এই যদি অন্যায়, তবে অন্যায়। এর বেশি কেউ কোনওদিন চাক্ষুষ করেনি।

সব মিলিয়ে, তারকার মধ্যে নানান আকর্ষণ ছিল। তার কলকাতার জীবন, টাকা-পয়সা, পোশাক-আশাক, ব্যবহার, সেই সঙ্গে চেহারাও। তারকদা দেখতেও খারাপ নয়। কেবল, তার চোখ দুটোর ভাবের যেন কোনও হদিস পাওয়া যেত না। বড় বড় চোখ দুটিতে, সেই দৃষ্টিকে যে কী বলে, শুভা কোনওদিন বুঝতে পারত না। যখন মনে হত, তারকদা মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে, শুভা লজ্জা পেয়ে মুখ ফেরাতে যেত, তখনই মনে হত, দৃষ্টিটা যেন অন্য কোথায় চলে গিয়েছে। অনেক দূরে, অন্য কোথাও। কেমন একটা অন্যমনস্কতা চোখে।

কখনও মনে হত, শুভাকে এক মুহূর্ত না দেখলে থাকতে পারবে না। যেন কোনও একটা আকাঙ্ক্ষায়, মানুষটা জ্বলে যাচ্ছে। সে সময়ে, মানুষটাকে প্রায় খারাপ বলে মনে হত। যেন সব কিছুতেই, একটা লোভের নেশায় চোখ দুটো জুলজুল করছে। সে জন্যে যে একটা ভীষণ আঘাত, গভীর কষ্ট, তা মনে হত না। কিংবা নিজের অধিকারবোধে, সমস্ত কিছুই ছিঁড়ে দিয়ে, গ্রাস করবে সেরকমও নয়। একটা অন্য ভঙ্গি। তারিয়ে তারিয়ে, খাবার মতোই, তারিয়ে তারিয়ে দেখা। খুব খারাপভাবে বললে, শ্মশানের কুকুরের মতো চোখ।

কিন্তু, সেই চোখেই হঠাৎ এমন নিরাসক্তি দেখা দিত, যেন সবকিছুর ব্যাপারেই, সে একেবারে নির্বিকার হয়ে গিয়েছে। তখন তাকে অন্যরকম মানুষ বলে মনে হত। এই দুয়ে মিলিয়ে, তারকা সম্পর্কে কেমন যেন একটা কৌতূহলের সৃষ্টি হত। যেন মানুষটাকে ঠিক চেনা হয়নি। কী যেন রয়ে গিয়েছে, কখনওই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লোকটার চলা-ফেরার সীমানা যেন অন্তঃহীন। যে-অন্তঃহীন। সীমানা পিছনে ফেলে, শুভাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু এ সব চিন্তা অনেক পরে এসেছে। যখন মেলামেশা বেড়েছে। প্রথম প্রথম তো কেবল দেখাশোনাই ছিল। হঠাৎ বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় হয়তো, বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একটু দাঁড়িয়ে দু-একটি জিজ্ঞাসা, কেমন আছেন শৈলেনকাকা?…হ্যাঁ, যা দিনকাল পড়েছে। কলকাতায়ও জিনিসপত্রের দাম খুব। চালের কথা আর বলবেন না।…ওই চলে যাচ্ছে কোনও রকমে…আচ্ছা চলি।…এমনি কথার পৃষ্ঠে দু-একটি কথা।

কখনও হয়তো শুভার সঙ্গেও এখানে সেখানে দেখা হয়ে গিয়েছে। সেইরকমই দু-একটি কথা, কোথায় যাচ্ছ শুভা! কেমন আছ? শৈলেনকাকা ভাল আছেন?

তারপরে সেই ঘোর সন্ধ্যায় একদিন দেখা। বাড়ির বাইরে রাস্তার দিকে, বারান্দায় থাম ধরে দাঁড়িয়ে ছিল শুভা। মা গিয়েছিল গা ধুতো ভাই-বোনেরা সবাই, কেউ খেলায়, কেউ গল্পে নিজের নিজের ব্যাপারে মেতে ছিল। কিন্তু আশেপাশে কেউ ছিল না। শুভা সবে মাত্র সন্ধ্যা বাতি দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাইরের দিকের ঘরটার দরজা খোলা, অন্ধকার। একটু পরেই, সেখানে বাবার ছাত্ররা আসতে আরম্ভ করবে। চট মাদুর পাতাই আছে। ছেলেরা এলে শুভা বাতি জ্বালিয়ে দেবে। বাবা একটু বেরিয়েছিল। ফিরে আসবার সময় হয়ে এসেছিল প্রায়।

সেই ফাঁকেই, শুভা ওদের সেকালের বাড়ির পলেস্তারা খসে যাওয়া পুরনো ইট বের করা থামের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। চারদিকটা অসম্ভব নিঝুম লাগছিল। ওদের বাড়ির সামনে তখনও কিছু ফাঁকা জমি ছিল। দু-চারটি গাছপালা সেই ফাঁকা জমিতে। তার ওপারেই, নতুন নতুন কয়েকটা বাড়ি উঠছে। একটু দূরেই, শহরের বড়রাস্তাটা কতগুলো বাড়ির আড়ালে ঢাকা। সেখান থেকে মাঝে মাঝে সাইকেল-রিকশার ভেঁপু বেজে উঠছিল।

ওদের বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো আসেনি। আশেপাশে দু-একটা বাড়িতে এসেছিল। সেখানে আলো জ্বলছিল। কিন্তু শুভার চারপাশেই, ঘোর সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার। তখন ওর মনের অবস্থাটা যেন কোনও এক অতল গভীরের অন্ধকারে ডুবে গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়েছিল।

সেইদিনই নতুন নয়। প্রায়ই ওরকম হত। বিশেষত সন্ধ্যার ঝোঁকে, যখন চারদিক চুপচাপ হয়ে যেত, কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না, তখন যেন, সংসারের সবকিছুর নীচে, সহসা ও ডুবে যেত। কোথায় তলিয়ে যেত। তারপরে, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে হঠাৎ থমকে দাঁড়াত। কোথায় এল, কেন এল, কোথায় যাবে, কিছুই বুঝতে পারত না। একটা শিরশির করা ভয় ওর শিরদাঁড়ার কাছে যেন তিরতির করে কাঁপত। বুকের কাছে কেমন একটা যন্ত্রণার মতো হত। মনে হত, কেঁদে ফেলবে। কিন্তু কান্না পেত না। তার ভিতরটাই যেন একটা বাতাসহীন অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে থাকত।

বারান্দার সামনে রাস্তাটায় দূর থেকে কে যেন হেঁটে আসছিল। চোখ না ফিরিয়েও, একটা মূর্তির হেঁটে চলা টের পাচ্ছিল। পাড়ারই কেউ হবে, এই ভেবেছিল। হয়তো হালদারদের বাড়ি পুজো করতে যাচ্ছে গাঙ্গুলিখুড়ো। সে সময়েই তার যাবার কথা। নারায়ণ মিত্তির হয়তো বাড়ি ফিরছে। এমনি দু-একটা কথা ভাসা ভাসা মনে হয়েছিল। তার বেশি কিছু না। মূর্তির দিকে সে ফিরেও চায়নি।

মূর্তি শুভকে পার হয়ে, কয়েক পা গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কে শুভা নাকি?

শুভা চমকে উঠেছিল। কেন যে এত চমকে উঠেছিল, শুভা জানে না। ও যেন কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল। আর সেই যে একটা শিরশির করা ভয়ের ভাব, সেই ভাবটা যেন ঝনঝনিয়ে বেজে উঠেছিল। যেন ওর গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। গলার স্বরটা, সেই মুহূর্তে ওর চেনা মনে হয়নি। তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতরে চলে যাবার জন্যেই, একবার নড়ে উঠেছিল।

 তখন গলার স্বর আর এক বার শোনা গিয়েছিল, শুভা নাকি রে?

শুভা বুঝতে পারছিল গলার স্বরটা তারকদার। তবু, এমন অপরিচিত অচেনা মনে হয়েছিল, জবাব দিতে পারেনি। হঠাৎ এত ভয় পেয়েছিল কেন, অবাকই বা হয়েছিল কেন, আজও শুভা বুঝতে পারে না। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই গলার স্বরের মধ্যে, ওর বর্তমানের নিয়তির ডাক শোনা গিয়েছিল। তখন বুঝতে পারেনি। কিন্তু সেই ঘোর সন্ধ্যায়, তার নিয়তিই, সেই অস্পষ্ট এক মূর্তিকে সামনের রাস্তায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাকে ডাক দিয়ে, প্রথম এই জীবনের হাতছানি দিয়েছিল। হাতছানির ভাষা আর ভঙ্গিটা ছিল অন্যরকম। তাকে ঠিক চেনা যায়নি।

তারক আবার জিজ্ঞেস করেছিল, শুভাই তো মনে হচ্ছে, না কি?

শুভা তখন জবাব দিয়েছিল, হ্যাঁ আমি।

আমি ভাবলাম, এমন অন্ধকারে কে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। শৈলেনকাকা বাড়ি নেই?

না, একটু বেরিয়েছে। বাবা এখুনি ফিরবে। কিছু বলছিলেন?

না। এমনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ, তাই।

 তারক চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল। শুভার মনে হয়েছিল, একটু বসতে বলতে হয়। কিন্তু বলতে পারেনি। বাবা নেই, মা গা ধুতে গিয়েছিল। তারকাকে বসতে বলে, সে কী করবে? কী কথা বলবে? মা-ও হয়তো অসন্তুষ্ট হবে। কী না কী ভেবে বসে থাকবে।

কিন্তু তারকদা যায়নি। যাবার জন্যে ফিরেও আবার দাঁড়িয়েছিল। অনেকটা যেন নিজের মনেই বলেছিল, কত বাড়ি যে হয়ে যাচ্ছে এ-পাড়ার দিকে। আমাদের এদিকটাও রীতিমতো শহর হয়ে গেল।

শুভা যেন সে কথার কী জবাব দেবে, ভেবে পায়নি। অথচ চলে যেতেও পারছিল না। সে সময়েই মায়ের গলা শোনা গিয়েছিল, কে রে ওখানে, কার সঙ্গে কথা বলছিস?

শুভা জবাব দেবার আগে, তারকই বলেছিল, আমি কাকিমা, আমি তারক।

মার গলায় সঙ্গে সঙ্গেই আপ্যায়নের সুর বেজে উঠেছিল, অ। তা বাবা ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? উঠে এসো, বসো। কলকাতা থেকে কবে এলে?

আজ সকালেই। কাল সকালেই আবার যাব।

তারকদা উঠে এসেছিল। শুভার মনে হয়েছিল, তারকদা অন্ধকারেও তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। মা বলেছিল, শুভা, বাতি জ্বেলে দে।

শুভা বাতি জ্বালিয়ে নিয়ে বাইরের ঘরে এসেছিল। সেখানে তারক বসেছিল। বাতির আলোয়, তারকের চোখের দিকে তাকিয়েই, হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠেছিল। তারকা ওর দিকে, অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি, চোখে মুগ্ধতা। সে চাউনি, একেবারে অচেনা নয় শুভার কাছে।

কিন্তু, তারকদার কাছ থেকে কোনওদিন, সে দৃষ্টি আশা করেনি। সেই মুহূর্তে, মনটা গুটিয়ে বিমুখ হয়ে উঠেছিল। লজ্জাও পেয়েছিল। তারকা বলে উঠেছিল, তুমি কি কারুর জন্যে অপেক্ষা করে ছিলে?

শুভা অবাক হয়ে বলেছিল, না তো। আমি ভাবলাম, তুমি কারুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছ। যেভাবে চুপ করে ছিলে, যেন ভয় পেয়েছিলে বা লজ্জা হয়েছিল…।

কথাটা যেন শেষ করেনি। একটা জিজ্ঞাসা, কথার সুরে উহ্য ছিল। তখনও তারকা তাকিয়ে ছিল শুভার দিকে। মুগ্ধতার মধ্যে একটা অনুসন্ধিৎসাও ছিল চোখে।

কথাটা শুনতে শুনতে, হঠাৎ যেন লজ্জাতেই শুভার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। কথাটা ভেঙে না বললেও, ও বুঝতে পেরেছিল, তারকদার আসল প্রশ্নটা কী। কোনও ছেলের অপেক্ষায়, শুভা দাঁড়িয়েছিল কি না, সেটাই তার জিজ্ঞাস্য ছিল। শুভা হঠাৎ মুখে আঁচল চেপেছিল। হাসি পায়নি। যেন মুখটাই ঢাকতে চেয়েছিল। একটু পরে বলেছিল, না, কারুর অপেক্ষায় দাঁড়াইনি।

কথাটা বলার পরে, তারকার চোখের দিকে তাকিয়ে ওর হাসি পেয়ে গিয়েছিল। আর একই সঙ্গে, ওর মনের কোথায় একটা স্তব্ধ ধারার উৎসমুখ যেন সহসা খুলে যাচ্ছিল। তারকার চোখের দিকে চেয়ে, যত অবাক হচ্ছিল, কৌতূহল বোধ করছিল ততই যেন, একটা খুশির ধারা গলতে শুরু করেছিল।

মায়ের কথায়, তারকাকে চা করে দিয়েছিল শুভা। একটু পরে বাবা এসেছিল। বাবার সঙ্গে দু-চার কথা বলে, চলে যাবার সময়ে, শুভার দিকে কেমন একরকম করে যেন তাকিয়েছিল তারকা। যেটা বিশ্বাস করতে বাধছিল, অবাক লাগছিল। অথচ ছেলেদের সেই চাহনিটা মেয়েরা কখনও ভুল বোঝে না।

পরের দিন দুপুর ঘেঁষে, আবার তারকাকে আসতে দেখে, শুভা চমকে উঠেছিল। অবাক যত হয়েছিল, একটা সন্দেহও মনের মধ্যে কূট প্রশ্ন তুলেছিল। আর একই সঙ্গে, লজ্জাজড়িত সংশয়ে কেমন যেন থমকে গিয়েছিল। প্রশ্নটা মনে জেগেছিল, কারণ সেইদিন সকালেই তারকা কলকাতা চলে যাবে বলেছিল। অথচ যায়নি। আগের দিন রাত্রি থেকে, অনেক বারই তারকার সেই মুগ্ধ কৌতূহলিত দৃষ্টির কথা শুভার মনে পড়েছে। পরের দিন, দুপুর ঘেঁষে, তারকদার আসবার কয়েক মুহূর্ত আগেও সে কথা মনে পড়ছিল।

সে জন্যেই শুভা চমকে উঠেছিল? কেঁপে উঠেছিল বলা যায়। একটা লজ্জাজড়িত সংশয়ের কারণ ছিল এই ভেবে, শুভার দিকে আবার তেমনি করে তাকাবার জন্যেই কি তারকা, কলকাতায় না গিয়ে ফিরে এসেছিল।

তখনকার মতো, সে কথা জানবার উপায় না থাকলেও, আগের দিনের মতোই তারকদা তাকিয়েছিল। আবার শুভার বুকের মধ্যে রক্ত চলকে উঠেছিল। অবাক হয়েছিল। ইচ্ছে করে, মনে মনে খুশি হওয়া যায় না। ও চাক বা না চাক, মনে মনে খুশির ঢেউও লেগেছিল।

তারকদা জানিয়েছিল, প্রায় দুপুরে অসময়ে আসার কারণ আর কিছু নয়। বলেছিল সকালেই কলকাতা চলে যাবে। যায়নি। তাই বলতে এসেছিল। মিথ্যে কথার যুক্তিটা তেমন প্রবল হয়নি। কারণ, তার মতো লোক যদি একটা কথা বলেই থাকে, কৈফিয়ত দেবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। সে যে, কলকাতায় যায়নি বলে, আবার দেখা করতে এসেছে, তাতেই শৈলেন মাস্টারের পরিবার অনেকখানি কৃতার্থ হয়েছিল। এবং শুভার মা যে বেশ খুশি হয়েছিলেন, তাও বোঝা গিয়েছিল। মা তারকদাকে বাবা বাছা করে বসিয়েছিল। শুভকে চা করে দিতে বলেছিল। বাবা তখন ইস্কুলে গিয়েছিল।

তারকা বাড়ির সকলের সঙ্গে, বিশেষ করে বোনদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেও সেই একই দৃষ্টিতে অনেক বার শুভার দিকে তাকিয়েছিল। ব্যাপারটা নতুন বলেই বিস্ময়ের। বিস্ময়ের সঙ্গে, থেকে থেকেই লজ্জার ছটায়, শুভার মুখের রং বদলে যাচ্ছিল। অথচ কেমন যেন একটা বিরক্তি এবং রাগে, মনে মনে হাসিও পাচ্ছিল। এ আবার কী অদ্ভুত রঙ্গ! এরকম মনে হয়েছিল শুভার। কখনও বা একটা উদাসী ভাবও সমস্ত ব্যাপারটাকে যেন তুচ্ছ করে দিচ্ছিল। কত ছেলেই তো এমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছে, হেসেছে, কৌতূহলিত হয়ে শুভার ভিতরটা দেখতে চেয়েছে। তারকদাও সেইরকমই। এতেই বা কী আসে যায়।

এসে গিয়েছিল। সেবারে তারকা সাত দিন গ্রামেই ছিল, কলকাতায় যায়নি। প্রতি দিন শুভাদের বাড়ি যেত। কোনও কোনওদিন দুবেলাই। এবং সেবারেই শেষ দিনে, রাত্রে শুভাদের বাড়ি থেকে চলে আসার সময়, তারকদা অন্ধকার আড়ালে পেয়ে, শুভাকে শুধু বলেছিল, আমার যে কী হল, তা জানিনে। এবার আর কলকাতায় যেতে ইচ্ছে করছে না। কেন বলো তো?

শুভা অনেকটা অবুঝের মতোই বলেছিল, কেন?

তারক শুভার হাত ধরেছিল। বলেছিল, তুমি জানো না, কেন?

আর জবাব দিতে পারেনি শুভা। কিন্তু তারকার হাত ধরা, গলার স্বর ও সুর কোনও বোঝা-ই বাকি রাখেনি। তারকা তখনই শুভকে কাছে টেনে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। শুভার পক্ষে, তারকদার সঙ্গে এতটা পাল্লা দেওয়া সম্ভব ছিল না বলে, ও ঘাড় হেঁট করে মুখ নামিয়ে নিয়েছিল।

.

কিন্তু সে মুখখানি তুলতে, শুভার বেশি দেরি হয়নি। তারপরে, তারকা প্রতি সপ্তাহেই কলকাতা থেকে এসেছে। এলেই, শুভাদের বাড়ি। তারকদার আসাটা যেন ছিল, গঙ্গার বান ডাকা জোয়ারের মতো। প্রবলবেগে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাসিয়ে দেবার মতো। সব দিক থেকে, সকলের দিক থেকেই। বাবা মা খুশি হত। ভাইবোনেরাও। কারণ তারকদার হাতটা দরাজই ছিল সকলের জন্যে। প্রথম প্রথম শুভার লজ্জা করত। কোথায় যেন আটকাত। কিন্তু ব্যাপারটা, সবটুকুই তার নিজের হাতে ছিল না। অন্যদের ইচ্ছাটাও কম ছিল না।

আর তারকদার চলে যাওয়াটা ছিল, ভাঁটার টানে ঢল নেমে যাবার মত। যেন, দুপাড় জুড়ে কেবল পলি পাঁকে জল নেমে যাওয়া শূন্যতা।

এই জোয়ার-ভাঁটার টানের অনুভবটা, শুভার মনে এসেছিল বেশ কয়েক মাস পরে। তার মধ্যে অনেক জল এসেছিল, গিয়েছিল। কবে যেন, সেই যাওয়া আসার মধ্যে, নিজের ইচ্ছা, বাসনা, আকাঙ্ক্ষাগুলো মেশামিশি হয়ে গিয়েছিল। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সেই ঘনিষ্ঠতার প্রতিটি মুহূর্তেই, শুভার চোখের সামনে কলকাতার হাতছানি ভেসে উঠেছে।

হাতছানি শুধু চোখে নয়। হাতছানি নানা সুরে বেজেছে মনে মনে। নানা তরঙ্গে ঢেউ দিয়েছে রক্তে রক্তে। কলকাতায় চলো, কলকাতায় চলো। সেখানে অনিশ্চয়ের সকল নিশ্চয়তা। সবকিছুরই মুশকিল আসান। বিবাহ, সংসার। শান্তি, ভালবাসা নিজের ঘর, প্রেমিক স্বামী। অভাব অনটনের কোনও প্রশ্ন নেই।

তখনই কেন বিয়ের কথা তারকদা বলছিল না?

বলা সম্ভব ছিল না। সেটাই সবথেকে আশ্চর্য। মানুষের কত যে মন। যতই দিন যাচ্ছিল, শুভা যতই তারকার ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, ততই বাড়ির আবহাওয়া যেন বদলাতে আরম্ভ করেছিল। তলে তলে, কোথায় যেন একটা প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। অথচ, প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, তারকাকে নিয়ে কারুর মনে কোনও দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা নেই।

কিন্তু ছিল। জাতের কথা উঠেছিল। শুভারা কায়স্থ, তারকা তার চেয়েও ছোট। যদিও, জাতের কথাটা, আগে কখনও কারুর মনে হয়নি। শুধু তার টাকা, কলকাতার অদৃশ্য আশ্চর্য জীবনের কথাই মনে হয়েছিল। তা হোক, তবু তার সঙ্গে সম্পর্ক পাতানো যায় না। অতএব প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। বাবা মায়ের মুখে ক্রমে তারকার সম্পর্কে কটু কথা শোনা যাচ্ছিল। বাড়িতে আসা অপছন্দ হয়ে উঠছিল।

কিন্তু, শুভা যেন তখন অনেক দূর ভেসে গিয়েছে। তারকাকে কতখানি ভালবেসেছিল, সেটা যাচাই করতে পারেনি। জীবনের একটা স্বাদ বদল হয়েছিল। অন্তহীন নিরাশার মধ্যে, আশা পেয়েছিল। বাবা-মা সংসার, কোনও কিছুর প্রতিই ওর আর সে মূল্যবোধ ছিল না। নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ত জীবনের চিন্তাই, রঙিন স্বপ্নের মতো ওকে ঘিরেছিল। তার নামই ভালবাসা ওর কাছে। জাতের বিচার করে কী লাভ। বাড়ি থেকে যদি বিয়ে দেওয়া না হয়, তবে পালিয়ে গিয়েই করতে হবে।

নদীতে টান ছিল। ঘাটের খুঁটিতে যার জোর নেই, মাঝি নেই যে নৌকার, একটা অশক্ত দড়ির টানে কত দিন আর সে-নৌকা ঘাটে থাকে। একদিন তার নোঙর ছিঁড়ে যায়। যে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তার সঙ্গেই ভাসে। শুভার ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকমই। তবু তো এক কূল ভেঙে, আর এক কূল গড়ে উঠবে। কোনও কূল না থাকার থেকে, যে কোনও একটা কূল থাকা ভাল। শুভা তারকার সঙ্গে পালানোই স্থির করেছিল। কারণ, পালানো মানেই বিয়ে। বিয়ে মানেই, স্থিতি। একটি মেয়ের, একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের মেয়ের সকল উদ্বেগের অবসান। ঘর, সংসার, নিরাপত্তা। তাও, তারকদার মতো লোকের সঙ্গে, কলকাতার সেই আশ্চর্য নায়কটি।

নরেশও শুভাদের গ্রামেই মানুষ। তবে, নরেশের দেখা পাওয়া যেত কালে ভদ্রে। সেখানে সে পারতপক্ষে যেতই না। তারকার সঙ্গেই তাকে কয়েক বার গ্রামে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তারকের সঙ্গে যে নরেশের সম্পর্কটা কী, কেউ-ই সঠিক জানত না। নরেশের সম্পর্কে সবাই জানত, সে কলকাতায় বড় ব্যবসা করে। গ্রামের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চায় না। গ্রামের লোক কাউকে কখনও সে ডেকে কথাও বলত না। গ্রামে সে অনেকটাই বিদেশি। এখনকার মানুষেরা, অনেকে তাকে চেনেই না।

শুভাও সেরকম কিছু চিনত না। তারক তাকে যখন এখানে এনে তুলেছিল, তখনই একমাত্র জানতে পেরেছিল, দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শুধু তা-ই নয়। তারক নরেশের ঘাড়ের বোঝা।

বিয়ে? স্বামী ঘর সংসার নিরাপত্তা? দাঁড়া, ওরে মুখপুড়ি মেয়ে, একটু দাঁড়া, একটু থাম। এক নিশ্বাসে, ওই শব্দগুলো এমন করে উচ্চারণ করিসনে। সংসার কি তোকে এটুকু শিক্ষাও দেয়নি? শব্দগুলো যত সহজে উচ্চারণ করা যায়, জীবনের ক্ষেত্রে তার প্রাপ্তি একেবারে কানাকড়ি।

.

কোথায় যেন পেটা-ঘড়িতে ঘণ্টা বাজে, এক দুই তিন। বাইরে ঠাণ্ডার রাত্রি হিমে জড়সড়, কাঁপে। অনেকে ঘরে, গরম বিছানার ঢাকায় ওম করে। পাশের ঘরে, কেবল মাত্র দ্রব্যের উষ্ণতায়, নরেশও ঘুমায়। আর এঘরে, একটা সামান্য মাদুরের ওপরে শুয়ে, শুভা এপাশ ওপাশ করে। ওর শীত করে না। কঠিন মেঝেতে লাগে না। পুরনো চিন্তা, নতুন জীবন, পিছনে অন্ধকার, সামনে অন্ধকার, সব মিলিয়ে ওকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে থাকে।

এখানে এসে, মাত্র সাত দিনের মধ্যে ও জানতে পেরেছিল, তারক একটা শূন্য, তার কিছুই নেই। নানান জনের, নানান ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িয়ে, তার বৃত্তি একমাত্র উঞ্ছবৃত্তি। বন্ধুদের করুণা আর দয়াই তার সম্বল। এমনকী, একটা বাঁধা মাইনের চাকরি পর্যন্ত নেই লোকটার। জামাকাপড় বাসস্থান, সবই পরের করুণা।

কলকাতায় আসার পরে, কয়েক দিন বন্ধু বান্ধব পরিচয়, খানাপিনা, গাড়ি চড়া, বেড়ানো, সিনেমা থিয়েটার দেখা, সবই বন্ধুদের দয়ায়। সে সব বন্ধুরাও, বিচিত্র অস্পষ্ট সব লোক। কার যে কী কাজ, কার যে কী ব্যবসা, কিছুই বুঝতে পারত না শুভা। আজও বোঝে না। এমনকী, এত দিন হয়ে গেল, ও আজও জানে না, নরেশের কী কাজ, কীসের ব্যবসা। এত টাকা তার কোথা থেকে কী উপায়ে আসে।

তবে, এটুকুই শুভা বুঝেছিল, ন্যায়ের পথে, পরিষ্কার কিছু নেই ওদের। ওরা সবাই কলকাতা শহরের, এক ভিন্ন জগতের লোক।

কিন্তু তারকদা পুরোপুরি সেই জগতের লোকও ছিল না। তার জগৎটা, সবটাই পরের মুখাপেক্ষী। একেবারে সম্পূর্ণ দায়দায়িত্বহীন, এক ধরনের বেকার ভবঘুরে বলা যায়।

তবু যেন, একটু ভাল। অন্য জগতের পুরোপুরি বাসিন্দা হওয়ার থেকে, তাও যেন ভাল। নরেশদের সঙ্গে, কোনও সম্পর্ক না থেকে, যদি সাধারণ একটা বেকার ভবঘুরে তোক হত, তাতেও যেন ভাল ছিল। কিন্তু, তারকাকে যতটুকু শুভা চিনতে পেরেছে, তাতে বুঝতে পেরেছে, এ জগৎ, কোনও কিছুর প্রতিই, তার সঠিক কোনও টান নেই। কখনও কখনও এক-একটা ঝোঁক আসে। সেই ঝোঁকের টাল খেয়ে, যেদিকে যতক্ষণ গড়িয়ে চলে। ঠেকে গেলেই, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, আবার অন্য আর এক দিকে যাত্রা শুরু। শুভাও তেমনি একটা ঝোঁকের টানে গড়িয়ে যাবার সীমা।

তবু একটু থমকে যেতে হয় শুভকে। এ কথা কি, সবটুকু সত্যি? তারকদা কি ওকে একটু ভালবাসেনি? কত দিনের কত কথাই যে মনে পড়ে যায়। ছোটখাটো অনেক ঘটনা। সে সবই কি মিথ্যা? এমন তো কখনও মনে হয়নি, তারকদা ওকে ছেড়ে যেতে চায়। তাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। নরেশ ক্রমে ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। প্রথম প্রথম, হেসে বিদ্রূপ করত তারকদাকে, রাজকন্যে তো নিয়ে এলি, তোর রাজত্ব কোথায়? তারপরে হাসতে হাসতে কপাল ব্যথা। বিদ্রূপ ক্রমে রাগে পরিণত হয়েছিল। রাগের সঙ্গে বিদ্বেষ। বিদ্বেষের মধ্যে ঈর্ষা। ঈর্ষার সঙ্গে ঘৃণা।

তারপরে আর তো কোনও ঢাকাটকি আড়াল থাকতে পারে না। নিজেকে একবার প্রকাশ করে ফেললে, আর কোনও কিছু দিয়েই তা গোপন করা যায় না। নরেশ সে জাতের লোকও নয়। তখন তারকাকে একটা শর্তে আসতে হয়েছিল। সে চলে যাবে চাকরির খোঁজে। মাসখানেকের মধ্যেই যা হোক একটা ব্যবস্থা করে, বাসা ভাড়া করে, শুভাকে নিয়ে যাবে।

শুভা ভয় পেয়েছিল। তবু রাজি হয়েছিল থাকতে। রাজি না হয়েই বা কী উপায় ছিল ওর। তারকা চলে গিয়েছিল। এক মাস কবেই পেরিয়ে গিয়েছে। তারকদা আসেনি। একটা খবরও পাঠায়নি। আর কোনওদিন ফিরে আসবে বলেও বিশ্বাস হয় না।

তবে আর শুভার মন থমকায় কেন? তারকদার সবটুকু মিথ্যা বা সত্যি এ বিষয়ে ভেবে লাভ কী। আগাগোড়াই যার মিথ্যা, তার সম্পর্কে কিছু ঘটনা নিয়ে কিছুই প্রমাণ হয় না। অসহায় ভেবে হয়তো একটু করুণার উদ্রেক হয়। কিন্তু তারকদা অসহায় নয়। ওটাই তার চরিত্র। দায়-দায়িত্বহীন ভেসে চলা মানুষ। নিজের জীবনের প্রতিও বোধ হয় তার কোনও টান নেই। মানুষের কোনও কিছুরই স্থিরতা নেই। নরেশের অপমানে, তার যদি সে আত্মসম্মানবোধ থাকত, শুভার প্রতি টান থাকত, শুভার অসম্মানের উদ্বেগ থাকত, তা হলে যেখানেই হোক শুভকে নিয়ে যেত। এভাবে ফেলে যেতে পারত না।

না, তারকদা পর্বটা শুভার জীবনে শেষ হয়ে গিয়েছে। শুভার আর কোনও আশা নেই। বরং আজ শুভা নিজেকে ভয়ে ও দ্বিধায়, মনে মনে জিজ্ঞেস করে, সে নিজে কি তারকাকে ভালবেসেছিল? বাবা মা ভাই বোন সব ছেড়ে চলে আসার মধ্যে কি ভালবাসাই ছিল? না কি, চারদিকে হতাশার অন্ধকার থেকে, ছুটে এসেছিল একটা ঠিকানাহীন আলোর পিছনে। যে আলো আলেয়া কি না, সেটা পর্যন্ত লোভী অবুঝ মন, পরখ করে দেখবার অবকাশ পায়নি।

এখন নিজেকেও ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে। এমন করে, নিজের মুখ সে কী করে পোড়াল। এখন, এই অন্ধকার ঘরে, চোখের জলের কী মূল্য। সামনের অথৈ অন্ধকার পাথার। চোখ ভিজে, বুক ভেসে গেলেও, দুঃসীম পাথারের কোনও কিনারা মিলবে না। মুখে যতই তর্জন-গর্জন করুক, নরেশের এই আস্তানা ছেড়ে বেরুবার আগে, ওকে আরও হাজার বার ভাবতে হবে।

নরেশের নাক ডাকার শব্দ এখনও সমানে চলেছে। শুভা জানে, নরেশের এটা ঠিক ঘুম নয়। নেশায় অচেতন হয়ে আছে সে। নেশা ভেঙে গেলে, একবার সেজাগবে। হাজার বার ভেবেও, এখানে শুভার থাকা সম্ভব নয়।

অথচ, এ কথা সত্যি, তারকা চলে যাবার পরে, এক মাস পর্যন্ত নরেশ শুভার সঙ্গে কোনওরকম খারাপ ব্যবহার করেনি। এক মাস ধরে, সে-ও যেন তারকদার ফিরে আসবার জন্যে অপেক্ষা করেছিল। তারপর যতই দিন গিয়েছে, ততই নরেশের চেহারা বদলেছে। ভাব-ভঙ্গি ভাষা বদলেছে। শুভা জানত, নরেশ কী চায়। নরেশের বিষয়ে কিছু কিছু কথা সে শুনেছিল। নরেশের নিজের মুখ থেকেই শুনেছিল। এমনি স্বাভাবিক অবস্থায় নয়। মাতাল অবস্থায়, নরেশ দুঃখ করে জানিয়েছিল, তার বউ তাকে কীভাবে ত্যাগ করে চলে গিয়েছে। বলেছিল, দেখ শুভা আমাদের কারুরই বিয়ে করা উচিত নয়। আমার না, তারকেরও না। তারকের হয়তো পয়সাকড়ি নেই। আমার তো তা বলা চলবে না। বাড়ি হয়তো করিনি। করতে পারি যে কোনও সময়েই, সে টাকা আমার আছে। গাড়ি আছে আমার। এ পাড়াতে ভাল ভাড়া দিয়েই থাকি। তবু বউ থাকল না। থাকবে কেন বলো? সভাবে ব্যবসা করি না, সবসময়েই একটা লুকোচুরি খেলা। কখন কীভাবে কোথায় ধরা পড়ে যাই। অবিশ্যি, সে জন্যে লোকজন সবই আছে। তবু একটা ভয়ে ভয়ে থাকি। তাতে যে ধকল যায়, মদ না খেয়ে পারি না। তাও কি একটু-আধটু। দেখতেই তো পাচ্ছ। আমাদের বন্ধুবান্ধবও ভাল নয়। সবাই সবাইকে টেক্কা মারবার জন্যে সবসময়ে চেষ্টা করছে। আমাদের মতো লোকদের ঘরে কখনও বউ থাকে। আমরা কি সংসার করতে পারি। বন্ধুরাই ফুসলে ফাসলে, বউকে বের করে নিয়ে গেল। বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু করবার কিছুই ছিল না।..

কথাগুলো শুনে, শুভার কষ্টই হয়েছিল। বলেছিল, বুঝেছিলে তো সাবধান হওনি কেন? কেন ভাল করে সংসার করলে না? চোর-ডাকাতেরও তো বউ-ছেলেমেয়ে থাকে।

থাকে, সেরকমই থাকে। তবে হ্যাঁ, আমরা যাদের থেকে মাল চুরি করি, তাদেরই আবার বিক্রি করি। ফলে অফিসারদের ঘুষ তো দিতেই হয়, যা চায়, তা-ই দিতে হয়। মদ মেয়েমানুষ পর্যন্ত। নিজেকেও ঘেন্না লাগে, ওদেরও ঘেন্না করি। সবাইকে শুধু ঘেন্নাই করি।..

এরকম করে বললে, সে মানুষকে খানিকটা চেনা যায়। বোঝা যায়। নরেশের সেই চেহারাটা কিছুটা জানে শুভা। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল, তারকদার ফিরে আসার আশা নষ্ট হয়ে যেতে লাগল, ততই সে অন্যরকম হয়ে যেতে লাগল। সে জন্যে যে নরেশকে খুব একটা দোষী ভাবা যায়, তা নয়। নরেশ যে রকম মানুষ, তার যা চরিত্র, তাতে সে যে এক মাসের ওপর ভাল ব্যবহার করেছে, সেটাই অনেকখানি। তারকা চলে যাবার পরদিনই যদি সে শুভার ওপরে হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তা হলেই বা বলার কী ছিল। সে ব্যবসায়ী হিসাবে দুষ্কৃতকারী, মাতাল, পাপের পরিবেশে ঘোরাফেরা করে, বউ পালিয়ে গিয়েছে। এমন লোক রাত্রে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে, রোজই একটি যুবতাঁকে দেখবে, অথচ তাকে পাবে না, এতখানি সহ্যশক্তি তার নেই। বিশেষ, যে মেয়ের অবস্থা শুভার মতো। কজনেরই বা সে শক্তি আছে। মুখের কথা তো নয়। প্রতিদিনের ঘর করতে গিয়ে, সে শক্তির পরিচয় হয়তো অনেকেই দিতে পারবে না। নরেশ তো কোন ছার।

কিন্তু শুভা তা কোনওদিনই হতে দিতে পারবে না। তারকদা হয়তো তাকে ঠকিয়েছে। কিংবা, তার হতাশার বেড়াজাল থেকে, ভুল ঠিকানায় দৌড় দেবার উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছে। তবু, নিজেকে তো সে একটা দেহোপজীবিনী মাত্র ভাবতে পারে না। নরেশের দাবি সে কোনওরকমেই, কোনওদিন মেটাতে পারবে না। অতএব

এই শুভা, শুভা!

পাশের ঘর থেকে নরেশের গলা শোনা যায়। ঘুম-ভাঙা মোটা গলা। কিন্তু মত্ততা তেমন নেই। নেশার ঘোর কাটল এতক্ষণে। কখন তার নাক ডাকানো থেমেছে, টের পাওয়া যায়নি।

দরজায় শব্দ হল। জোরে নয়, আস্তে আস্তে। এ নরেশ, ঠিক সে নরেশ নয়। ডাকল, শুভা, আমি জল খাব, দরজা খুলে দাও।

শুভা উঠল না। কোনও জবাবও দিল না। নরেশ যদি বুঝতে পারে, শুভা জেগে আছে, তা হলে দরজা খোলাবেই। ও ঘরেও জল আছে। বাতি জ্বাললেই জল পাবে।

কয়েক বার দরজায় ধাক্কা পড়ল। ডাকাডাকি করল। তারপরে নিজের মনেই বলল, ধ্যাৎ, আমার আর এ সব ভাল লাগে না। কিছু শালা মনেও করতে পারছি না। এবার আমিই চলে যাব এখান থেকে…।

পাশের ঘরে গলার স্বর থেমে যায়। আর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। যাবেও না। এখন নরেশ শুয়ে পড়বে। এবং আবার আগামীকাল রাত্রের আগে, কোনও গোলমাল চিৎকার মাতলামি কিছুই হবে না। নরেশ সকালবেলা চা খেয়ে সেই যে বেরিয়ে যাবে, আর ফিরবে রাত্রে। সকালবেলা সে বিশেষ কোনও কথা বলবে না। বড়জোর, তারকের কোনও খবর পেলে? এ কথা জিজ্ঞেস করবে। কিংবা, গম্ভীর হয়ে বলবে, কী যে করা যায়, আমার মাথায় কিছু আসছে না। অথবা, আর আমি তো একটা মাতাল লোক, আমার কাছে এভাবে দিনের পর দিন থাকবেই বা কেমন করে!

ঠিক চলে যেতে বলে না। অথচ, একরকম তাই বলে। তার কথার ভাবের মধ্যে, ইঙ্গিত পরিষ্কার। হয় নরেশের রক্ষিতা হয়ে শুভা থাকুক, না হয়, চলেই যাক। তবে, সকালবেলা নরেশ একেবারে শান্ত গম্ভীর ভদ্রলোক।

শুভা এখন একটা ব্যাপার বুঝতে পারে। প্রতিটি সকালেই, ওই ধরনের কথা বলে, নরেশ যখন বেরিয়ে যায়, সে একটা আশা নিয়ে যায়, শুভা হয়তো তার কথায় সম্মত হয়েছে। এই আশা নিয়ে যায়, সারাদিন সেই আশা, নানান কল্পনায়, আকাঙ্ক্ষাকে আরও উদগ্র করে তোলে। পেটে মদ পড়ে, সমস্ত ভারসাম্য হারিয়ে, মত্ত হাতির মতো এসে দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এ অবস্থায়, নরেশের বাসা ছেড়ে চলে যাওয়াই সব দিক থেকে উচিত। উচিত–কিন্তু, কোথায়? সত্যি কি বাড়ি ফিরে যেতে পারে শুভা।

নিজের মনেই ঘাড় নাড়তে থাকে ও। না না, আর কোনওদিনই না। তারকদা ওকে বিয়ে করে, আধপেটা খাইয়ে, ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে রাখলেও, বাবা-মাকে মুখ দেখাবার একটা সম্ভাবনা ছিল। তাতেও সম্মান ছিল। আজ যদি ও বাড়ি ফিরে যায়, কী পরিচয় নিয়ে যাবে? ও কে? ওর কী পরিচয়? শৈলেনমাস্টারের মেয়ের পরিচয় অনেক দিন আগেই হারিয়েছে। অথচ নতুন কোনও পরিচয়ে ওর নবজন্ম হয়নি। ও কি একটা স্বেচ্ছাচারিণী মাত্র? স্বৈরিণী? তবে বাড়িতেই বা ঠাঁই হবে কেন?

তবে কোথায় যাবে শুভা। ঘরের অন্ধকার যেন দুলে ওঠে। অন্ধকারের মধ্যে, আর একটা অন্ধকারের হাঁ যেন ওকে গিলতে আসে। মৃত্যু। তারই হাতছানি সেখানে। গলায় দড়ি দিয়ে, গায়ে আগুন লাগিয়ে, যেভাবে হোক, সেই একটা জায়গাই এখন আছে। যেখানে গিয়ে, শুভার সবকিছু শেষ হতে পারে। সেটা কি এমনই কঠিন।

দু হাত দিয়ে মাদুরটাকে আঁকড়ে ধরে, বুক চেপে, অন্ধকারের গভীরে, নিজেকে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় যেন ঝুলতে দেখে। ওর শেষ ছবি।…তবু জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ে, চোখের কোল ভেসে যায়। একটা কোনও মুখও যেন ওর এখন আর মনে পড়ে না।

.

কলিং বেল বেজে উঠতেই, শুভার ঘুম ভেঙে গেল। এত সত্ত্বেও, এ পোড়া চোখে, এখনও ঘুম আসে। মরার কথা ভাবতে ভাবতেই, কখন ঘুম এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তবু যদি একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যেত, আর ঘুম না ভাঙত। তেমন ঘুম কি আসে না একবার।

কিন্তু বসে থাকা চলে না। ঝিটা এসেছে। সে-ই কলিং বেল বাজিয়েছে। অবাঙালি ঝি। সকালে বিকালে দুবার আসে। মধ্যবয়স্কা ঝিয়ের নাম বিহানী। কী তার মানে, কে জানে।

আবার সেই রাত্রের পলাতকের কথা মনে পড়ে যায়। এখন যেন ও বিশ্বাস করতেই পারছে না, গত রাত্রে, সত্যি একটা অচেনা লোক, একটা চোর ওখানে, ওর চোখের সামনেই লুকিয়েছিল। অথচ এখনও চোখের সামনে, লোকটা ভাসছে। কুড়িয়ে পাওয়া সেই অদ্ভুত লোহার জিনিসটার কথাও ওর মনে পড়ে যায়। আবার কৌতূহলিত হয়ে ওঠে। জিনিসটা দেখতে ইচ্ছা করে।

কিন্তু এখন আর সে সময় নেই। নরেশ চলে যাবে, ঝিও চলে যাবে, তারপরে আর এক বার সেই জিনিসটা ও দেখবে। যদিও সত্যি জানে না, জিনিসটা কী বা ওটা কার। নরেশের না সেই লোকটারই।

শুভা মাদুরটা রেখে দরজা খুলে দেয়। বিহানী চকিতে এক বার শুভার আপাদমস্তক দেখে নেয়। তারপরে, এ পাড়ার আদব অনুযায়ী, কপালে হাত ঠেকিয়ে সেলাম করে। বলে, সেলাম মেমসাব।

সম্বোধনটা শুনতে খুবই খারাপ লাগে শুভার। মেমসাহেব আবার কী! ছি! প্রথম প্রথম এরকমই মনে হত। অবাক লাগত, লজ্জা হত। ভাল তো লাগতই না, বরং শুভার চিরদিনের অন্য মনে, একটা সংশয় হত, এই ডাকের মধ্যে কোথায় একটা ইতরতার ইঙ্গিত রয়েছে যেন। এটা ওর কুসংস্কার বা যা-ই হোক, ভাল লাগত না। কিন্তু এখানকার আদব-কানুন আলাদা। শুভা শুনে গিয়েছে, মুখ ফুটে বলেনি কিছু। এখন অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে শুনে। মনোভাবটা সেরকমই আছে। ও কেবল বলে, এসো।

ঝি ঘরে ঢুকে নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর এক বার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। যেন চোখের দৃষ্টিতে আর গন্ধে, সমস্ত ব্যাপারটা আঁচ করে নিতে চায়। প্রথম যখন শুভা এসেছিল তখন এই বিহানী, কেমন একটা সন্দিগ্ধ কৌতূহলে ওর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখত। শুভার চোখে চোখ পড়ে গেলেই, চোখ ফিরিয়ে নিত। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত। বিহানীর কথার মধ্যে, তখন একটা অশ্রদ্ধা থাকত। যদিও স্পষ্টভাবে নয়। কথাবার্তার ধরন-ধারণ ছিল আলাদা, নোংরা, ইঙ্গিতপূর্ণ। ঠিক শুভাকে নয়, অপরের তুলনা দিয়ে। যেমন সে বলত, আমার আর কী করবার আছে মেমসাব, খাঁচায় যখন যে চিড়িয়া আসবে, আমি তারই সেবা করব।

ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে ছিল না। শুভার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করত, নরেশের এই খাঁচায় কত পাখি বিহানী দেখেছে। কিন্তু কেনই বা জিজ্ঞেস করবে। শুভ তো নরেশের খাঁচার পাখি নয়।

তারপরে বিহানী, অনেকটা শুভার সইয়ের ভূমিকা নিতে চেয়েছিল। নানা রকম ঠাট্টা-তামাশা হাসির গল্প বলত। অধিকাংশই এই পাড়ার গল্প, যে গল্পগুলোর মধ্যে পরিবারের কেচ্ছা, মেয়েদের নোংরামি, পুরুষদের বদমাইশি। শুভা গা দিত না, এড়িয়ে যেত।

কয়েক মাস দেখে দেখে, বিহানী এখন অনেকটা সহজ হয়েছে। শুভার সম্পর্কে তার ধারণাটা কিছু পালটেছে। এখন সে জিজ্ঞেস করে, তারকার কোনও খবর এল কি না। আর নিজের পরিবারের কথা বলে। ছেলে মেয়ে স্বামী সংসার। মাঝে মাঝে মেমসাবের জন্য তার মনটা কেন যেন খারাপ হয়ে যায়। একটু ভয় ভয়ও লাগে। মেমসাব একটু হাসেও না। বিহানীর নিজেরও তো বড় বেটি আছে। সে এ পাড়ার আরও নানান গল্প বলে। পারিবারিক কেচ্ছা নয়। অন্যান্য গল্প। কার ছেলে হয়েছে, কে মারা গেল, কার বিয়ে হল। কাদের মারামারি হয়েছে, কোথায় গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে, এমনি বহুতর গল্প।

এখন বিহানীকে অনেক সহজ লাগে। শুভা নিজেও অনেকটা সহজ। সকালে বিকালে, দুবেলা সে আসে। বাসনপত্র পরিষ্কার করে, ঘর দরজা সাফ করে। ধোয়া কাঁচার কিছু থাকলে, ধুয়ে দিয়ে যায়।

বিহানী ঘরে ঢুকে, প্রথমেই দেখে নেয়, পাশের ঘরের দরজা এদিক থেকে বন্ধ। সে জানে, ভিতরে নরেশ আছে। এবার তাকেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে হবে। নরেশ যতক্ষণ এ ঘরে না আসছে, ততক্ষণ শুভা পাশের ঘরে যাবে না।

দরজাটা খোলবার আগেই, বিহানী বলে ওঠে, মেমসাব, কাল রাতে চোর এসেছিল জানেন?

 জানি।

শুভা নিজের চোখে চোর পালানোর যে দৃশ্য দেখেছিল, বিহানীর কাহিনী তার চেয়ে অনেক বেশি লোমহর্ষক, আরও ভয়ংকর। কারণ, চোরটা নাকি পিস্তলের গুলি ছুঁড়েছিল, এবং হাওয়া হয়ে যাবার মন্ত্ৰও জানে। শুধু হাওয়া হয়ে যাবার নয়, চাবি ছাড়াই, যে কোনও আলমারি খোলার মন্ত্র জানে লোকটা। কলকাতায় সেই চোরের নাম সবাই জানে। ওকে বলে তালাগুনিন। অর্থাৎ সব তালাকেই যে গুন করতে জানে। আজ পর্যন্ত তালাগুনিন মাত্র এক বার ধরা পড়েছে। কিন্তু কলকাতায় এখনও যে সব বড় বড় কোম্পানির চাবি খুলে চুরি হয়, সবই তার কাজ, অথচ ধরা পড়ছে না। হাতেনাতে ধরা খুবই মুশকিল। চুরি হচ্ছে, অথচ চোর ধরা পড়ছে না। এতেই বোঝা যায়, লোকটা মন্ত্র জানে। তোমার সামনেই সে দাঁড়িয়ে থাকবে, অথচ তুমি তাকে দেখতে পাবে না। বিহানীর মতে, চোরটা নিশ্চয়ই বিড়াল বা ইঁদুর বা চুহায় রূপান্তরিত হতে জানে। তা নইলে এক বারও ধরা পড়ছে না কেন। গতকাল রাত্রে তো সে, স্রেফ চিড়িয়া হয়ে, আটতলা ছাদ থেকে উড়ে গিয়েছে।

গতকাল রাত্রে সে, ভোরাফ্ল্যাটে এসেছিল। ভোরারা খুব বড়লোক, তাদের সিন্দুকে মেলাই টাকা। কিন্তু তালাগুনিন একটা খবর জানত না, ভোরাদের সিন্দুকে চাবি ঘোরালেই টুং টাং করে বাজনা বেজে ওঠে। তাইতেই টের পেয়ে গিয়েছিল। সিন্দুক খোলাই পড়ে ছিল, কিছু নিতে পারেনি। তার আগেই পালিয়েছে।

বিহানী আরও খবর দিল এই চোর নাকি বছরে দুবার চুরি করে। কখন কোথায় চুরি করবে, কেউ বলতে পারে না। কোথায় সে থাকে, তাও কেউ জানে না। সবথেকে মজা হচ্ছে, পুলিশ কিছুতেই তার নামে কোনও কেস্ দিতে পারছে না। প্রমাণ দিতে না পারলে, সাজা হবে কেমন করে।

অতএব, মেমসাব যেন খুবই সাবধান থাকে। দৈবের কথা কিছুই বলা যায় না। শুভকে সাবধান করে সে মাঝখানের দরজা খুলে দেয়। দেখা যায়, নরেশ তখনও শুয়ে আছে। শুভার চোখের ওপর ভেসে ওঠে, কাল রাত্রে দেখা সেই মুখ। সে কি তবে সেই তালাগুনিনের নাকি! লোকটা মন্ত্র জানুক বা না জানুক, হাওয়া হতে জানে ঠিকই। যদি, এ লোকটাই সেই কাল রাত্রের পলাতক চোর হয়ে থাকে!

কিন্তু বেশিক্ষণ ভাববার অবসর পাওয়া যায় না। বিহানীর কাজকর্মের সাড়া-শব্দে নরেশের ঘুম ভেঙে যায়। শুভা জানে, বিহানী ইচ্ছা করেই, কাজে কর্মে, জোরে শব্দ করে, যাতে তার সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়। নরেশ উঠে বসে। একটু সময় চুপ করে বসে থাকে। তারপরে সোজা এ ঘরে চলে আসে। ঘরের এক পাশে দাঁড়ানো শুভার দিকে এক বার মাত্র তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, বাথরুমে ঢুকে যায়।

 শুভা জানে, এখন আর কোনও সমস্যা নেই। সে পাশের ঘরে চলে যায়। নরেশ এখন স্নান করে, জামাকাপড় পরে বেরিয়ে যাবে। তার গাড়ির গ্যারেজ অন্য জায়গায়। একটু পরেই তার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসবে। আগে, বিহানীই সাহেবের চা-জলখাবার দিত। আপাতত শুভাই দেয়। শুভা সেই ব্যবস্থাই দেখতে যায়।

কিন্তু মনের ভিতরের, পথহীন অনির্দিষ্ট অন্ধকার পাক খেতেই থাকে। যদিও দিনের বেলা একরকম, রাত্রি আসে আর এক রকম ভাবে, তবু তার যোগসূত্রটা ছিঁড়ে যায় না। দিনের বেলা যা স্তব্ধ, রাত্রে তা-ই ভয়ংকর শব্দে আছড়ে পড়ে। কোনওটাই শুভার কাম্য নয়, সহ্যও হয় না আর। অথচ একটা ভয় যেন দূর থেকে স্থির-দৃষ্টি অজগরের মতো ওকে সম্মোহিত করতে থাকে। নড়তে পারে না, পালাতে পারে না, ভিতরটা কেবল থরথর করতে থাকে। কী করবে, বুঝতে পারে না।

জলখাবার খেয়ে, বেরুবার আগে, নরেশ যেন একটু কৌতূহলিত গাম্ভীর্যে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, তারক কি লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে?

শুভা বলে, না।

নরেশ শক্ত মুখে, চুপ করে ভাবে। তারপরে বলে ওঠে, তবু এত সাহস কী করে হয়।

কথাটা যে কার সম্পর্কে বলে, কথার সুরে ঠিক বোঝা যায় না। যেন নিজের মনেই বলে। তারপরে মাথা নাড়ে নিজের মনে। চলে যেতে যেতে বলে, এভাবে আর চলে না।

ঘরের কাজকর্মের পর, বিহানী বাজার করে দেয়। একলা শুভা রান্না করে, খায়। কতটুকুই বা দরকার। ভাতে-ভাত হলেই চলে যায়। বিহানী আবার সেটা মেনে নিতে পারে না। সে একটু আনাজপাতি, মাছ, সবরকমই এনে দেয়। রাত্রে, নরেশের খাবারও তো করতে হয়। খাওয়া হোক বা না-হোক।

তারপরে সারাদিন ফাঁকা। ঘর দুটো প্রকাণ্ড। এত বড় ঘর এর আগে শুভা দেখেনি। আজকাল এরকম দুটো ঘরের মতো জায়গায়, ছকামরার দশতলা বাড়ি করা যায়। এঘর থেকে ওঘর যেন অনেক দূর, দুটো আলাদা বাড়ির মতো। শুভা রান্না করে, স্নান করে। যতটুকু ইচ্ছা করে, খায়। শুয়ে ঘুম আসে না। বাইরে যাবার কোথাও নেই। কোনও জায়গা চেনে না। তারকদা থাকতে বেরিয়েছে। বেড়িয়েছে, সিনেমা থিয়েটার দেখেছে। নরেশের সঙ্গে কোনওদিন তা যায়নি। বিহানী হয়তো কখনও কখনও বলেছে, তার সঙ্গে পার্কে ময়দানে বেড়াতে যেতে। তাও যায়নি। শুভার ভয়, বাইরে বেরুলেই অনেক চেনা লোকের সঙ্গে ওর দেখা হয়ে যাবে। কে কী বলবে, কোনও জবাব দিতে পারবে না। নিজেকে সব সময়ে ওর লুকিয়ে রাখতেই ইচ্ছা করে। চেনা অচেনা, কাউকেই যেন এ মুখ আর দেখানো যায় না।

বিকালে এসে বিহানী কাজ করে চলে যায়। তারপরে, শুভা গিয়ে দাঁড়ায় সেই জানালায়। সেখান থেকে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়িগুলোকে দেখা যায়। জানালায় বারান্দায় লোকজন, অনেক দৃশ্য। কোনও কোনওদিন, বাইরের দরজা খুলে, বাঁ দিকে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ছাদেও ওঠে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। নিজেকে যেন হাটের মাঝে এসেছে বলে মনে হয়। তখন আশেপাশের সবাই তাকে দেখতে পায়। সেই হোটেল বাড়িটার নানা দৃশ্য চোখে পড়ে। আসলে, হোটেল নয়, মেয়েদের দেহ ব্যবসায়ের আড্ডা। তা ছাড়া, আশেপাশের লোকজন এমন করে তাকিয়ে থাকে, যেন গিলে খাবে। তাই তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসে।

শুভা গিয়ে জানালায় দাঁড়ায়। অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। শীতের দিন, অনেক আগেই বেলা চলে যায়। সব জায়গায় বাতি জ্বলে উঠেছে। ছবির মতো নানা দৃশ্য দেখতে থাকে। আবার সেই মধ্যরাত্রের প্রতীক্ষা। সেই মার্তণ্ডের আবির্ভাব। দু হাত বাড়িয়ে, শুভাকে অন্য জীবনে টেনে নিয়ে যাবার সেই বীভৎস আকাঙ্ক্ষা হাঁ করে আসবে। কিন্তু কই, রাত পোহাল, দিন যেমন যাবার, চলেও গেল, শুভা তো তবু কোথাও গেল না। এভাবে কত দিন সে, এই পরিস্থিতিকে ঠেকিয়ে রাখবে। তারকদা কি আর আসবে। সে কি বেঁচে আছে এই পৃথিবীতে। বাড়ি ফিরে গেলে, বাবা-মা কী বলবে? শুভা কি যেতে পারবে। না কি, সত্যি অপঘাত মৃত্যুই আছে ওর কপালে।

কতক্ষণ এমনি দাঁড়িয়েছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। শুভা চমকে ওঠে। একটু অবাক হয়। কে হতে পারে? এখন তো মোটে, রাত্রি আটটার মতো হবে। এ সময়ে তো নরেশ আসে না। সে এলেও, কলিং বেল বাজায় না। জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দেয়। বিহানীও চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। অবিশ্যি, মাঝে মাঝে নরেশের ড্রাইভার আসে। নানারকম জিনিসপত্র রেখে যায়। তাও কালে-ভদ্রে।

শুভা সামনের ঘরে গিয়ে, দরজার কাছে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। এ সময়ে ভয়ের কিছু নেই। রাত্রি কিছুই হয়নি। সে ছিটকিনিটা খুলে দেয়। কিন্তু দরজা খোলবার সময় পায় না। বাইরের থেকে, কেউ যেন, ঠেলেই ঘরে ঢুকে পড়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা নিজেই আটকে দিয়ে, শুভার দিকে ফিরে তাকায়।

শুভার বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। যে মূর্তি ওর সামনে, যার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়, সে আর কেউ নয়, গতকাল রাত্রের সেই পলাতক লোকটা। শুভা চমকে উঠে, আরও কয়েক পা পেছিয়ে দাঁড়ায়। লোকটার চোখ থেকে, চোখ নামাতে পারে না। অথচ কিছু জিজ্ঞেস করতেও, ওর গলায় কথা সরে না।

গতকালের সেই পোশাকই লোকটার গায়ে। গাঢ় সবুজ রঙের গোটা হাত ঢাকা, গলা পর্যন্ত সোয়েটার। কালো রঙের প্যান্ট, পায়ে জুতো। মাথার চুলগুলো কপালের কাছে রুক্ষু হয়ে এসে পড়েছে। দরজাটা বন্ধ করেই, শুভার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। সে-ও চোখ নামায় না শুভার চোখ থেকে।

কয়েক মুহূর্ত পরে, লোকটা বলে ওঠে, ভয় নেই, আমি কিছু করব না।

 কথাগুলো যেন ধারালো আর স্পষ্ট। বলে সে এক পা এগোয়। শুভা তৎক্ষণাৎ পাশের ঘরের দরজার কাছে ছুটে যায়। লোকটা চকিতে এক বার চারিদিকে দেখে নেয়। আবার বলে, ভয় নেই।

শুভার মনে হয়, ওর প্রাণটা বোধ হয়, গলার কাছে এসে ঠেকেছে। এখুনি মুখ দিয়ে, একটা তীব্র শব্দে বেরিয়ে যাবে। লোকটা ইতিমধ্যে, পাশ ফিরে সেই ঢাউস আলমারিটার কাছে চলে যায়। যেখানে গত রাত্রে লুকিয়েছিল, সেখানে গলা বাড়িয়ে দেখল। মাদুরটা হাতে নিয়ে, আরও নিচু হয়ে দেখল। তারপরে যেন খুবই হতাশ হয়েছে, এমনিভাবে, মাদুরটা ছুঁড়ে ফেলে দিল কোণে। মেঝেতে একেবারে মাথা পেতে, আলমারির তলাটাও দেখল।

সেই মুহূর্তেই, শুভার চোখের সামনে, সেই লোহার পাতের অদ্ভুত জিনিসটা ভেসে উঠল। যন্ত্রের মতো সেই জিনিসটা। লোকটা কি তা হলে সেটাই খুঁজতে এসেছে? সহসা যেন ওর ভয় একটু কমে গেল, আর ঠোঁটের কোণ দুটো শক্ত হয়ে উঠল। লোকটা যদি নিজের থেকে ড্রয়ার খুলে খুঁজে না পায়, তা হলে কিছুতেই ও বলবে না।

লোকটা দাঁড়িয়ে, শুভার দিকে ফিরে তাকাল। লোকটা নয়, একটা ছেলে। তারকাদের থেকে ছোট। ছাব্বিশ-আটাশ হতে পারে। বলল, ভয়ের কিছু নেই। কাল আমাকে খুব বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আমি একটা দরকারে এসেছি।

কথা স্পষ্ট, কিন্তু খুব দ্রুত। শুভার চোখে অবিশ্বাস, ভয়। কথা বলল না। বিহানীর সেই কথা ওর মনে পড়ে গেল, তালাগুনিন। এই কি সেই লোক! এই লোকই গত রাত্রে ওভাবে পালিয়েছিল?

সে জিজ্ঞেস করল, আলমারির ওখানে কিছু পাওয়া গেছে?

প্রথমেই শুভার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, জানি না।

লোকটা জুতোর ওপর চাপ দিয়ে, শরীরটাকে একটু একটু দোলাতে থাকে। বলে, বললাম তো, ভয়ের কিছু নেই। আমি একটা জিনিস খুঁজতে এসেছি খালি। মনে হয়, ওটা আমি এখানে ফেলে গেছি।

অবিশ্বাস আর ভয়ের মধ্যেও, শুভা জিজ্ঞেস করে, কী জিনিস?

লোকটা বাঁ হাতের তালুটা এক বার ঘোরায়। বলে, এই একটা লোহার পাতের যন্ত্রের মতো। গোল পাতের ওপর তিনটে মুখ। একটা হাতল আছে। এরকম কিছু পাওয়া গেছে? এই আলমারিটার পাশে?

শুভা যেন হঠাৎ জবাব দিতে পারে না। এক লহমায়, একটা মিথ্যে কথা বলতে, কেমন আটকে যায়। সেই ফাঁকেই, সে বলে ওঠে, পাওয়া গেছে, না? কোথায় সেটা?

এতক্ষণ ধরে, লোকটার উপস্থিতি ও চোখের দিকে চেয়ে থেকে, শুভার ভয়টা যেন অনেকখানি কমে আসে। যদিও বিশ্বাস করতে পারে না কিছুতেই। কিন্তু ওর কৌতূহলের মাত্রা একটু বাড়ে। বলে, জিনিসটা কী, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

লোকটা কথা বলে না। কিন্তু শুভার চোখ থেকে চোখ সরায় না। যেন শুভার ভিতরটা পর্যন্ত দেখে নিতে চায়। এক বার যেন লোকটার চোখের কোণ দুটো কুঁচকে উঠল। মুখটা শক্ত দেখাল। শুভা ভয় পেল আবার। পাশের ঘরে ঢুকে, দরজাটা বন্ধ করে দেওয়াই, ওর নিরাপদ হওয়ার একমাত্র রাস্তা। সেইজন্যে ও দরজার কাছাকাছিই দাঁড়িয়েছিল।

লোকটার দৃষ্টি চারপাশে আর একবার ঘুরে গেল। বলে, তা হলে পেয়েছেন?

না।

তবে জিনিসটা কী তা জানতে চাইলেন কেন?

এমনভাবে কথা বলছে, যেন লোকটা চোর বা ডাকাত নয়। যেন কাল রাত্রে পালিয়ে এখানে আসেনি। এমনি এসেছিল। কিছু ফেলে গিয়েছে, তারই খোঁজে এসেছে। শুভার মুখ থেকে, আপনিই প্রশ্ন বেরিয়ে আসে, তুমি কে?

লোকটার ঠোঁটের কোণে একটু হাসির ঝিলিক দেখা গেল। বলল, আমাকে আপনি চিনবেন না।

শুভা বলে ওঠে, তুমি চোর, আমি জানি।

লোকটা এক বার ভুরু কোঁচকায়। শুভা আবার বলে, কাল রাত্রে তুমি এপাড়ায় ঢুকেছিলে, ভোরাদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলে। তারপর পালিয়েছিলে।

লোকটার ভুরু আর চোখের মণি যেন জোড়া লেগে যায়, এমনভাবে তাকায়। তবু কোনও কথা বলে না। শুভা ধারণা করে, লোকটা ধরা পড়ে যাচ্ছে বলে, কথা বলতে পারছে না। সাহস পেয়ে ও আরও বলে ওঠে, তুমি তালাগুনিন।

লোকটার ঘাড়টা আর একটু বেঁকে ওঠে। বলে, সে আবার কে?

তুমি জান না?

লোকটা ঘাড় নাড়ে। আর মুহূর্তেই শুভা দেখতে পায়, লোকটা যেন চোখের নিমেষে, ভিতর ঘরের মাঝখানের দরজায় এসে পড়ে। শুভা ভয় পেয়ে, চিৎকার করতে যেতেই, একটা শক্ত হাত ওর মুখ চেপে ধরে। পিছনে ঘাড়ের কাছেও তেমনি শক্ত থাবা।

শুভা হাত দিয়ে, মুখের থেকে হাত সরাতে যায়। সাঁড়াশির মতো সে হাত একটুও সরাতে পারে না। চকিতে এক বার লোকটার মুখের দিকে চায়। লোকটা বলে ওঠে, আগেই বলেছি, ভয়ের কিছু নেই। বাজে কথা শুনতে আসিনি আমি এখানে। কোথায় আছে সেটা?

শুভা সমস্ত শক্তি দিয়ে, মুক্তি পাবার চেষ্টা করে। লোকটার স্পর্শ যেন তাকে আরও শিউরে তোলে।

লোকটা বলে, চেঁচাবেন না, ছেড়ে দিচ্ছি। চেঁচালে, ব্যাপারটা খুব সুবিধের হবে না।

ছেড়ে দিয়েই, পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয় সে। বলে, বলুন, সেটা কোথায়?

শুভা ততক্ষণে, অনেকখানি সরে গিয়ে, ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আঁচল দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে, লোকটার দিকে তাকায়। ওর চোখে ভয় আছে, কিন্তু রাগের উত্তেজনা তার থেকে কম নয়। এবং সবথেকে আশ্চর্য, তবু ও ভেঙে পড়ে না। বললে, আমি কী করে জানব, কোথায় কী ছিল।

আমি কি এ ঘরে ছিলাম নাকি?

তবে কে ছিল?

 যার ঘর, সে-ই ছিল।

 ও, সেই মাতালটা, যে কাল আপনাকে নিয়ে টানাটানি করছিল?

সত্যি কথাটা শুনতে যে এত খারাপ লাগে, আগে যেন শুভার জানা ছিল না। ও বলে ওঠে, সে যেই হোক, তাতে তোমার কী?

আমার কিছুই না। তবে, লোকটা আপনার স্বামী নয়, তা বুঝতে পেরেছি। আপনি তো

 হঠাৎ থেমে যায় লোকটা। গলার স্বর বদলে বলে, যাক গে, ও সবে আমার দরকার নেই। তবে, লোকটা বদমাইশ। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। কী যেন নাম, নরেশ, হ্যাঁ নরেশ। তা হলে, সে-ই ছিল এ ঘরে?

বলতে বলতে কয়েক পা এগিয়ে আসে সে। ঢাউস আলমারিটা দেখিয়ে বলে, এর চাবি কোথায়?

যার জিনিস, তার কাছে।

হুম। আর এই আয়রন সেন্টার চাবি?

 তার কাছেই।

লোকটা হঠাৎ নরেশের বিছানাটা টেনে একেবারে উলটে দেয়। বালিশের তলায় দেখে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার টেনে খোলে, আবার বন্ধ করে। তারপর শুভার দিকে এক বার তাকিয়ে, বাথরুমের দরজাটা খুলে রেখে, ভিতরে ঢুকে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার ফিরে আসে। শুভা মনে মনে ভেবেও মুহূর্ত কটির সুযোগ নিয়ে, কোনওদিকে যেতে পারল না। বরং মনে মনে লোকটার কথা ভেবে অবাক হচ্ছিল, নরেশকে মাতাল বদমাইশ বলতে শুনে। নরেশের ওপরে লোকটার রাগের কথা শুনে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেই বলল, পাশের ঘরে চলুন, একবার দেখব।

শুভা বলে, তুমিই দেখ না!

আপনি তা হলে বাইরে গিয়ে চেঁচাবেন। আসুন আসুন, তাড়াতাড়ি আসুন, আমার সময় নেই।

একে স্পর্ধা বলে না। যেন কতই স্বাভাবিক একটা কথা বলছে। কিংবা যেন শুভার চেনা লোক। শুভা বলে ওঠে, আমি আবার পালাব কোথায়?

লোকটা থমকে যায়। বলে, তাও তো বটে। আপনার তো আবার পালাবারও উপায় নেই। চোরের থেকেও খারাপ অবস্থা।

একটু যেন হাসির ঝিলিক দেখা যায় লোকটার মুখে। তাও বাঁকা ঝিলিক। যেন বিদ্রূপ করছে। আবার বলে, নিজের দোষেই তো ফাঁদে পড়েছেন। কাল যা শুনলাম, তাই মনে হল। তা সে যাক গে, অন্য কোথাও না পালান, ঘরের বাইরে গিয়ে চেঁচাতে পারেন। ও সব ঝুট ঝামেলা বাড়াতে আমার ভাল লাগে না। চলুন।

শুভা যেন ভুলে যায়, ও কার সঙ্গে কথা বলছে। একটা অপমানবোধ ওকে হঠাৎ জ্বালিয়ে দেয়। কেঁজে বলে ওঠে, আমার কথায়, তোমার মতো একটা চোরের কোনও দরকার নেই। কী দেখতে চাও, দেখে নাও।

শুভা রাগে ও উত্তেজনায়, দ্রুত পাশের ঘরে যায়। এই মুহূর্তে ভয়ের কথাও ওর মনে থাকে না যেন।

কিন্তু লোকটা অতিরিক্ত মাত্রায় সচেতন আর সতর্ক। শুভা পাশের ঘরে ঢুকে পাছে দরজা বন্ধ করে দেয়, সেই জন্যে প্রায় শুভার গায়ে গায়ে ঘেঁষে পাশের ঘরে যায়। পাশের ঘরে গিয়েও, শুভা যত সরে যেতে চায়, লোকটা ততই ওর পাশ ঘেঁষে থাকে। বলে, উঁহু, অতটা দূরে থাকবেন না। আমার কাছে কাছে থাকুন।

শুভা ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, কেন?

বলা যায় না, ছিটকে ও ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আর আমিও আটকা পড়ে গেলাম।

শুভা রাগে ও বিদ্রুপে, ঝলসে ওঠে, তাতেই বা তোমার কী। কাল রাত্রে জানালা দিয়ে যেভাবে ধরা পড়ার ভয়ে এসে ঢুকেছিলে, সেই জানালা দিয়েই পালাবে।

লোকটা যেন ভারী নিশ্চিন্ত হয়ে, এমনি একটা কথার কথা বলে, সেটা ঠিক হবে না। সবাই দেখতে পাবে, আর

শুভা বলে ওঠে, অমনি ধরা পড়ে যাবে, আর সবাই ইঁদুর-পেটা করে তোমাকে মেরে ফেলবে, সেই ভয়।

লোকটা ঘাড় কাত করে এক বার তাকাল শুভার দিকে। শুভার মনে হল, লোকটার মুখটা কী রকম বদলে গিয়েছে। ঠিক এরকম মুখ এক বারও দেখেনি। রাগ বা গম্ভীর না, একটা অন্যরকম ভাব। যেটা ও বুঝতে পারে না, কিন্তু ওর বুকের মধ্যে, বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো একটা চমক লেগে যায়। ভয়ে ওর শিরদাঁড়ার কাছটা কী রকম শিরশিরিয়ে ওঠে।

লোকটা বলে, স্টিলের আলমারিটা খুলুন।

 শুভা বলে, খোলাই আছে।

ওর গলায় আর তেমন ঝাঁজ নেই। লোকটা মুখ ফিরিয়ে নেয়। শুভার নতুন করে সন্দেহ বাড়তে থাকে। লোকটা কি খালি সেই জিনিসটাই নিতে এসেছে। নাকি আর কোনও মতলবে। চাউনিটা যেন কী রকম বিচ্ছিরি লাগল। শুভার গা-টা এখনও যেন ছমছম করছে।

লোকটা আলমারিটা খুলে, তন্ন তন্ন করে দেখল। হাত দিয়ে যত দেখে, তার চেয়ে চোখ দিয়ে, অনেক তাড়াতাড়ি দেখে নেয়। আলমারিটাতে শুভার জামাকাপড়, ব্যবহারের দু-চারটে অন্যান্য জিনিস ছাড়া কিছুই নেই। আলমারিটা দেখা হয়ে যেতেই, এ ঘরের খাটের বিছানা উলটে, বালিশের তলা, সবই দেখল। তারপরে ডাক দেয়, আসুন, বাথরুমে আসুন।

বাথরুমে?

হ্যাঁ।

কেন?

ও লোকটার চোখের দিকে প্রায় ভয়ার্ত জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। লোকটা তা লক্ষ না করে বলে, বললাম তো, আপনাকে দূরে রাখলে চলবে না। আপনি বাথরুমে দাঁড়ান, আমি একটু দেখে নিই।

শুভা তবু খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এক বার ভাবে, বলে দেয় কোথায় আছে জিনিসটা। কিন্তু লোকটার কথার মধ্যে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না। ও আবার লোকটার চোখের দিকে তাকায়। তারপর বাথরুমে ঢুকে, দরজার পাশেই দাঁড়ায়।

এখানে বিশেষ কিছু দেখবার জায়গা ছিল না। দু-একটা তাক, একটা ডালা বন্ধ কাঠের বাস্কেট। তাও দেখল সে। তার মধ্যেই দুবার শুভার দিকে দেখে নিয়েছে। আশ্চর্য, এই লোকটাই কি সত্যি গতকাল পাইপ বেয়ে পার হচ্ছিল। আর, শুভাকে নিয়ে তার এত ভয়। আসলে বিশ্বাস করতে পারছে না।

ওরা কেউই কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কোনও কারণও নেই। শুভা যদি পারত, তা হলে নিশ্চয়ই বাথরুমের দরজাটা চকিতে টেনে, বন্ধ করে দিত। কিন্তু ওর সাহসে কুলোল না।

লোকটা বেরিয়ে এল। এ ঘরের চারিদিকে আর এক বার চোখ বুলিয়ে পাশের ঘরে গেল। শুভা মাঝখানের দরজায় দাঁড়াল। লোকটা আর এক বার ঢাউস আলমারিটার পাশে, কোণের দিকে উঁকি দিল। তারপর নিজের মনেই বলল, তা হলে, কী যেন নাম, নরেশ না কী, কালকে রাত্রের সেই মাতালটা, ওর হাতেই পড়েছে। আর এতক্ষণে, পুলিশের কাছে হয়তো জমাও দিয়েছে। এবার আপনাকেই ধরবে। পুলিশ এলে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

শুভা আবার ভয়ের কথা ভুলে যায়। বলে, আমাকে?

 লোকটা একটা চিরুনি বের করে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, হ্যাঁ। নরেশবাবু তো সবসময় বাড়ি থাকে না। ওটা কী করে এ ঘরে এল, জিজ্ঞেস করবে না? আপনিই তো সব সময় এই ফ্ল্যাটে থাকেন। কিছু একটা হলে, আপনার জানবার কথা।

শুভা কোনও জবাব দিতে পারল না। কথাটা সেদিক থেকে একেবারে মিথ্যে নয়। যদিও ওর সে ভয় নেই। নরেশ কোনওদিনই সে জিনিসটা দেখতে পাবে না, জানতেও পারবে না।

লোকটা পুলওভারটা টেনে টেনে বলে, তবে, আমি এসে খুঁজে গেছি, এ কথা বললেও আমার কিছু যাবে আসবে না। আচ্ছা, চলি।

লোকটা শুভাকে অবাক করে দিয়ে, সত্যি দরজার কাছে গিয়ে, ছিটকিনিতে হাত দেয়। শুভার মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে যায়, এমন কী জিনিস সেটা, যার জন্যে পুলিশ পর্যন্ত এসে পড়বে?

লোকটা ফিরে বলে, বললাম তো কী জিনিস।

কী হয় ওটা দিয়ে?

 চিচিং ফাঁক।

বলতে বলতে, লোকটার ঠোঁটের কোণে যেন একটু হাসির রেখার ঝিলিক দেখা যায়। হাতের ভঙ্গিতে চাবি ঘোরাবার মতো করে বলে, সব রকমের তালা-চাবি খোলা যায়। সবাই তাই বলে পারে না। হাতের গুণ থাকা চাই।

শুভা বলে ওঠে, চোরের হাতের গুণ।

লোকটা ঘাড় নেড়ে বলে, হুম।

 শুভা আবার বলে, কাল রাত্রেই জানতাম, তুমি একটা চোর।

তবু নরেশবাবুকে বললেন না কেন?

সে অবস্থা থাকলে, নিশ্চয়ই বলতাম। তোমার হাতে ছুরি ছিল। বললে তুমি কী করতে, তা জানি। চোর-ডাকাতদের বিশ্বাস কী।

লোকটা ছিটকিনি খোলবার জন্যে মুখ ফেরাল। হঠাৎ আবার এদিক ফিরে বলে উঠল, আমি চোর। আর নিজে কী?

মানে?

কথাটা বুঝে উঠার আগেই, শুভার গায়ে যেন আগুনের ঝাপটা লেগে যায়। শুধু মুখ নয়, ওর চোখেও রক্ত ছুটে আসে।

লোকটা ছিটকিনি খুলে ফেলল। বেরিয়ে যাবার আগে বলে, মানে, নিজেরই তো ভাল জানা আছে।

লোকটা অদৃশ্য হয়ে যায়। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যায়। শুভা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ওর মাথার মধ্যে যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অসহায় রাগে দাঁতে দাঁত চেপে, ও যেন নিশ্চল পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকে। তারপরে, দুঃসহ প্রতিকারহীন রাগই যেন, একটা অসহ্য কষ্টে পরিণত হতে থাকে। বুকের মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয়। দরজার চৌকাঠ শক্ত করে ধরে। এক সময়ে হঠাৎ ওর শরীরটা কাঁপতে থাকে। মুখে হাত চাপা দিয়ে ধরে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠে।

কতক্ষণ এভাবে কেটে যায়, খেয়াল থাকে না শুভার। এক সময়ে নিজেরই দীর্ঘশ্বাসে, নিজেই চমকে ওঠে, সংবিৎ ফিরে পায়। ও নড়েচড়ে ওঠে। লোকটার কথাগুলো আবার ওর মনে পড়ে। লোকটার ওপর এখন ওর আর তেমন রাগ হয় না। কিন্তু একটা চোর হয়ে, নোকটাও তাকে এভাবে নোংরা ইঙ্গিত করে গেল। তারপর আস্তে আস্তে, নিজের জীবনের ভাবনাই, ওকে আর এক পাথারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

লোকটা চোর বলে হয়তো, শুভার এতখানি লেগেছে। কিন্তু চোর ছাড়াও যে কেউই জানবে, সে-ই তো তাকে এই ইঙ্গিত করবে। ইঙ্গিত কেন, মুখ ফুটেই বলবে। নরেশ তো বলছেই। কোনও কথাই তো তার মুখে আটকায় না।

কিন্তু লোকটা যেন শুধু চোরের মতো কথা বলেনি। চোরেরা কি অমনি করে কথা বলে। লোকটার কথা যেন তার চেয়েও বেশি। কথা বলার ভাব-ভঙ্গি, সবকিছুর মধ্যে একটা অবহেলা, অথচ তীব্রতা। নরেশ চেঁচিয়ে চিৎকার করে যত উত্তেজিত করতে না পারে, লোকটা আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কথা বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি পারে। লোকটা লোকটা বলা ঠিক নয়। একটা ছেলেই, হয়তো শুভার থেকে খুব বেশি বড় হবে না, বা সমবয়সিই। এ ঠিক চোর তো? তা হলে চোর বলাতে এত রাগ কীসের।

শুভারই বা এত রাগ কীসের। চোরকে না হয় চোর বললে রাগ হয়। শুভাও কি তাই। শুভা হাঁটতে হাঁটতে সামনের ঘরের মাঝখানে আসে। আসলে, চোরটা ঠিক চোরের মতো আচরণ করেনি। শুভা যে সব ভয় পেয়েছিল, তার কিছুই ঘটেনি যেন, খুব সহজভাবে এল, গেলও সহজভাবেই। শুধু নিজের প্রয়োজনটা মেটাবার জন্যে।

ওর সহসা খেয়াল হয়, বাইরের দরজাটা খোলা। শুভা তাড়াতাড়ি লাগাতে গিয়ে থমকে যায়। আস্তে আস্তে দরজাটা খোলে। সামনের বারান্দায় আলো জ্বলছে। নিশ্চয়ই নীচের দারোয়ান সন্ধ্যাবেলাতেই জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। শুভা বারান্দায় যায়। সামনের রেলিংয়ের সামনে দাঁড়ালে, নীচে দিয়ে যে রাস্তাটা গেটের দিকে গিয়েছে, সেটা দেখা যায়। গেটের পাশ দিয়ে রাস্তায় নোক-চলাচল করছে, তাও দেখা যায়।

রেলিংয়ের কাছে যেতে গিয়েও, শুভা থমকে যায়। ও তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। দিয়েই ঢাউস আলমারিটার টানা খুলে, সেই অদ্ভুত জিনিসটা বের করে। কী বলছিল যেন লোকটা? চিচিং ফাঁক। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা শুভার কথায় বিশ্বাস করল কেমন করে। শুভা বলল, আর তা-ই মেনে নিল, সত্যি আলমারিটা বন্ধ আছে! চোরের আবার এমন মতিগতি হয় নাকি। তার তো অবিশ্বাস করে, সবই টেনে টেনে দেখা উচিত ছিল।

শুভা লোহার পাতের অদ্ভুত অবয়ব বস্তুটি চোখের সামনে এনে দেখতে থাকে। খুব যে একেবারে মিহি করে কাটা তা নয়। হয়তো লোকটা নিজের হাতেই তৈরি করেছে। এবার শুভার লক্ষ পড়ে, চাবির মতো লম্বা লম্বা তিনটি ডাঁটি ছাড়া, গোল অংশের বাদবাকি ভয়ংকর ধারালো। তেমন করে মারলে দেহের ছোটখাটো অংশ কেটে ফেলা যায়।

কিন্তু এটা দিয়ে কি সত্যি সব রকমের আলমারি আর তালাচাবি খোলা যায়? ভাবতেই, শুভার দৃষ্টি পড়ে নরেশের বিখ্যাত কোম্পানির তৈরি আয়রন সেফে। কৌতূহলিত হয়েও সত্যি এগিয়ে যায় আয়রন সেফের কাছে। তিন দিকের তিনটি চাবিই ভিতরে ঢোকাবার চেষ্টা করে। দুটো ঢুকলই না। একটা খানিকটা ঢুকেই আটকে গেল। শুভা বলে উঠল, মিথ্যুক! চোর!

নিতান্ত কৌতূহল বশেই ও এক বার পরখ করল। তারপরে ধারালো জায়গা, গলার কাছে এক বার ছোঁয়াল। চোখ বুজে চুপ করে রইল। তারপরে নামিয়ে নিয়ে এল। মনে মনে বলল, আমি যদি নরেশের সিন্দুক ভেঙে চুরি করি বা গলা কেটে মরি, কিছুতেই কিছু যায় আসে কী?

ভাবতে ভাবতে ওর চোখে আবার আসন্ন মধ্যরাত্রের সেই অসহায় উদ্বেগ ফুটে ওঠে। আস্তে আস্তে পাশের ঘরে গিয়ে, বিছানায় এলিয়ে পড়ে। হাতে থাকে সেই অদ্ভুত জিনিসটা, যার নাম চিচিং ফাঁক। কিন্তু ওর মন চলে যায় অন্যখানে। বাবা মা ভাই বোন আর–আর তারকা। তারকদা কি সত্যি আর কোনওদিন আসবে!…

২. বাইশের কোঠা ছাড়িয়ে

২. বাইশের কোঠা ছাড়িয়ে

এমনি যখন মনের অবস্থা, বয়স যখন বাইশের কোঠা ছাড়িয়ে গিয়েছে, তখনই এসেছিল তারকা। তার আগেও যে তারকদা আসেনি, তা নয়। পাড়ার ছেলে, প্রতিবেশী। ছেলেবেলা থেকে অনেক বারই দেখেছে তারককে। তারকদের অবস্থা তেমন ভাল না হলেও, কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। তারকদা নিজেও বলত, লোকেরাও জানত, কলকাতায় সে চাকরি করে। সপ্তাহে একদিন করে বাড়ি আসত। অন্যান্য ছুটিতেও, গ্রামে যাওয়া-আসা লেগেই ছিল।

চাকরিটা যে তারকদা ভালই করত, সেটা বোঝা যেত তাকে দেখে। তার পোশাক-আশাক, চাল-চলন, খরচের বহর দেখেই অনুমান করা যেত, কলকাতায় সে বেশ ভালই আছে। তারকদা গ্রামে এলে, গ্রামের বন্ধুরা খুশি হয়ে উঠত। গ্রাম তো ঠিক বলা যায় না আর। শহরই বলতে হবে। তবু, পুরনো অধিবাসীদের কাছে, শহরের পরিচয়ও গ্রামই। গ্রাম বলতেই তাদের ভাললাগে। তাতে যেন নিজেদের অধিকারটা অনেক বেশি অনুভূত হয়। শহর বললে, নিজেদের অধিকার ঠিক তেমন করে প্রতিপন্ন হয় না।

তারকা দেশে এলে, শুধু তার ছেলেবেলার বন্ধুরাই খুশি হত না। কলকাতা থেকেও তার সঙ্গে দল বেঁধে বন্ধুরা আসত। তখন পাড়ায় রীতিমতো সাড়া পড়ে যেত। তারকদার কলকাতার বন্ধুরা খাওয়া-দাওয়া, পুকুরে সাঁতার কাটা,হইহল্লা করে মাতিয়ে তুলত। সবাই খুশি হত না। কেউ কেউ বিরক্ত হত। সেটা নিতান্তই ঈর্ষা। গ্রাম্য নীচতা। কাউকে একটু সচ্ছল সুখী দেখলেই, যাদের চোখ টাটায়, মন পীড়িত হয়, তারাই বিরক্ত হত। তারা বলাবলি করত, বেথা হয়নি, আইবুড়ো বয়সের রোজগার। এ সবই দুদিনের। চাপ পড়লেই বাপ বলতে হবে এর পরে। তখন কোথায় যাবে এত সব র‍্যালা।.ইত্যাদি।

একটু দুর্নামও যে না ছিল, তা নয়। শোনা যেত, তারকদা মদ খায়। হয়তো খেত। অনেকেই তো খায়। কিন্তু অনেকের মতো তারকাকে কেউ কখনও মাতলামি বা অভদ্র আচরণ করতে দেখেনি। আরও একটা দুর্নাম ছিল তার নামে। কোনও কোনও বাড়িতে নাকি, তারকদার যাতায়াত বেশি এবং সেই সব বাড়িতে, তারকদা রীতিমতো টাকা-পয়সা খরচ করে। তাদের অর্থসাহায্য করে। বিনা স্বার্থে নয়। উপলক্ষ সেই সব পরিবারের মেয়েরা।

এ সংবাদের কতখানি রটনা, কতটা সত্যি মিথ্যে, হলপ করে বলবার কেউ ছিল না। কথাটা শোনা যেত, এই পর্যন্ত। যে সব বাড়ির বিষয়ে শোনা যেত, সে সব বাড়িতে মেয়েরাও ছিল, যাদের খুব সুনাম ছিল না। তাদের সঙ্গে তারকাকে এখানে সেখানে বেড়াতে বা সিনেমায় যেতেও দেখা গিয়েছে। তার থেকেই যতটুকু আন্দাজ মেলে। এই যদি অন্যায়, তবে অন্যায়। এর বেশি কেউ কোনওদিন চাক্ষুষ করেনি।

সব মিলিয়ে, তারকার মধ্যে নানান আকর্ষণ ছিল। তার কলকাতার জীবন, টাকা-পয়সা, পোশাক-আশাক, ব্যবহার, সেই সঙ্গে চেহারাও। তারকদা দেখতেও খারাপ নয়। কেবল, তার চোখ দুটোর ভাবের যেন কোনও হদিস পাওয়া যেত না। বড় বড় চোখ দুটিতে, সেই দৃষ্টিকে যে কী বলে, শুভা কোনওদিন বুঝতে পারত না। যখন মনে হত, তারকদা মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে, শুভা লজ্জা পেয়ে মুখ ফেরাতে যেত, তখনই মনে হত, দৃষ্টিটা যেন অন্য কোথায় চলে গিয়েছে। অনেক দূরে, অন্য কোথাও। কেমন একটা অন্যমনস্কতা চোখে।

কখনও মনে হত, শুভাকে এক মুহূর্ত না দেখলে থাকতে পারবে না। যেন কোনও একটা আকাঙ্ক্ষায়, মানুষটা জ্বলে যাচ্ছে। সে সময়ে, মানুষটাকে প্রায় খারাপ বলে মনে হত। যেন সব কিছুতেই, একটা লোভের নেশায় চোখ দুটো জুলজুল করছে। সে জন্যে যে একটা ভীষণ আঘাত, গভীর কষ্ট, তা মনে হত না। কিংবা নিজের অধিকারবোধে, সমস্ত কিছুই ছিঁড়ে দিয়ে, গ্রাস করবে সেরকমও নয়। একটা অন্য ভঙ্গি। তারিয়ে তারিয়ে, খাবার মতোই, তারিয়ে তারিয়ে দেখা। খুব খারাপভাবে বললে, শ্মশানের কুকুরের মতো চোখ।

কিন্তু, সেই চোখেই হঠাৎ এমন নিরাসক্তি দেখা দিত, যেন সবকিছুর ব্যাপারেই, সে একেবারে নির্বিকার হয়ে গিয়েছে। তখন তাকে অন্যরকম মানুষ বলে মনে হত। এই দুয়ে মিলিয়ে, তারকা সম্পর্কে কেমন যেন একটা কৌতূহলের সৃষ্টি হত। যেন মানুষটাকে ঠিক চেনা হয়নি। কী যেন রয়ে গিয়েছে, কখনওই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লোকটার চলা-ফেরার সীমানা যেন অন্তঃহীন। যে-অন্তঃহীন। সীমানা পিছনে ফেলে, শুভাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু এ সব চিন্তা অনেক পরে এসেছে। যখন মেলামেশা বেড়েছে। প্রথম প্রথম তো কেবল দেখাশোনাই ছিল। হঠাৎ বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় হয়তো, বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একটু দাঁড়িয়ে দু-একটি জিজ্ঞাসা, কেমন আছেন শৈলেনকাকা?…হ্যাঁ, যা দিনকাল পড়েছে। কলকাতায়ও জিনিসপত্রের দাম খুব। চালের কথা আর বলবেন না।…ওই চলে যাচ্ছে কোনও রকমে…আচ্ছা চলি।…এমনি কথার পৃষ্ঠে দু-একটি কথা।

কখনও হয়তো শুভার সঙ্গেও এখানে সেখানে দেখা হয়ে গিয়েছে। সেইরকমই দু-একটি কথা, কোথায় যাচ্ছ শুভা! কেমন আছ? শৈলেনকাকা ভাল আছেন?

তারপরে সেই ঘোর সন্ধ্যায় একদিন দেখা। বাড়ির বাইরে রাস্তার দিকে, বারান্দায় থাম ধরে দাঁড়িয়ে ছিল শুভা। মা গিয়েছিল গা ধুতো ভাই-বোনেরা সবাই, কেউ খেলায়, কেউ গল্পে নিজের নিজের ব্যাপারে মেতে ছিল। কিন্তু আশেপাশে কেউ ছিল না। শুভা সবে মাত্র সন্ধ্যা বাতি দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাইরের দিকের ঘরটার দরজা খোলা, অন্ধকার। একটু পরেই, সেখানে বাবার ছাত্ররা আসতে আরম্ভ করবে। চট মাদুর পাতাই আছে। ছেলেরা এলে শুভা বাতি জ্বালিয়ে দেবে। বাবা একটু বেরিয়েছিল। ফিরে আসবার সময় হয়ে এসেছিল প্রায়।

সেই ফাঁকেই, শুভা ওদের সেকালের বাড়ির পলেস্তারা খসে যাওয়া পুরনো ইট বের করা থামের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। চারদিকটা অসম্ভব নিঝুম লাগছিল। ওদের বাড়ির সামনে তখনও কিছু ফাঁকা জমি ছিল। দু-চারটি গাছপালা সেই ফাঁকা জমিতে। তার ওপারেই, নতুন নতুন কয়েকটা বাড়ি উঠছে। একটু দূরেই, শহরের বড়রাস্তাটা কতগুলো বাড়ির আড়ালে ঢাকা। সেখান থেকে মাঝে মাঝে সাইকেল-রিকশার ভেঁপু বেজে উঠছিল।

ওদের বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো আসেনি। আশেপাশে দু-একটা বাড়িতে এসেছিল। সেখানে আলো জ্বলছিল। কিন্তু শুভার চারপাশেই, ঘোর সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার। তখন ওর মনের অবস্থাটা যেন কোনও এক অতল গভীরের অন্ধকারে ডুবে গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়েছিল।

সেইদিনই নতুন নয়। প্রায়ই ওরকম হত। বিশেষত সন্ধ্যার ঝোঁকে, যখন চারদিক চুপচাপ হয়ে যেত, কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না, তখন যেন, সংসারের সবকিছুর নীচে, সহসা ও ডুবে যেত। কোথায় তলিয়ে যেত। তারপরে, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে হঠাৎ থমকে দাঁড়াত। কোথায় এল, কেন এল, কোথায় যাবে, কিছুই বুঝতে পারত না। একটা শিরশির করা ভয় ওর শিরদাঁড়ার কাছে যেন তিরতির করে কাঁপত। বুকের কাছে কেমন একটা যন্ত্রণার মতো হত। মনে হত, কেঁদে ফেলবে। কিন্তু কান্না পেত না। তার ভিতরটাই যেন একটা বাতাসহীন অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে থাকত।

বারান্দার সামনে রাস্তাটায় দূর থেকে কে যেন হেঁটে আসছিল। চোখ না ফিরিয়েও, একটা মূর্তির হেঁটে চলা টের পাচ্ছিল। পাড়ারই কেউ হবে, এই ভেবেছিল। হয়তো হালদারদের বাড়ি পুজো করতে যাচ্ছে গাঙ্গুলিখুড়ো। সে সময়েই তার যাবার কথা। নারায়ণ মিত্তির হয়তো বাড়ি ফিরছে। এমনি দু-একটা কথা ভাসা ভাসা মনে হয়েছিল। তার বেশি কিছু না। মূর্তির দিকে সে ফিরেও চায়নি।

মূর্তি শুভকে পার হয়ে, কয়েক পা গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কে শুভা নাকি?

শুভা চমকে উঠেছিল। কেন যে এত চমকে উঠেছিল, শুভা জানে না। ও যেন কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল। আর সেই যে একটা শিরশির করা ভয়ের ভাব, সেই ভাবটা যেন ঝনঝনিয়ে বেজে উঠেছিল। যেন ওর গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। গলার স্বরটা, সেই মুহূর্তে ওর চেনা মনে হয়নি। তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতরে চলে যাবার জন্যেই, একবার নড়ে উঠেছিল।

 তখন গলার স্বর আর এক বার শোনা গিয়েছিল, শুভা নাকি রে?

শুভা বুঝতে পারছিল গলার স্বরটা তারকদার। তবু, এমন অপরিচিত অচেনা মনে হয়েছিল, জবাব দিতে পারেনি। হঠাৎ এত ভয় পেয়েছিল কেন, অবাকই বা হয়েছিল কেন, আজও শুভা বুঝতে পারে না। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই গলার স্বরের মধ্যে, ওর বর্তমানের নিয়তির ডাক শোনা গিয়েছিল। তখন বুঝতে পারেনি। কিন্তু সেই ঘোর সন্ধ্যায়, তার নিয়তিই, সেই অস্পষ্ট এক মূর্তিকে সামনের রাস্তায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাকে ডাক দিয়ে, প্রথম এই জীবনের হাতছানি দিয়েছিল। হাতছানির ভাষা আর ভঙ্গিটা ছিল অন্যরকম। তাকে ঠিক চেনা যায়নি।

তারক আবার জিজ্ঞেস করেছিল, শুভাই তো মনে হচ্ছে, না কি?

শুভা তখন জবাব দিয়েছিল, হ্যাঁ আমি।

আমি ভাবলাম, এমন অন্ধকারে কে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। শৈলেনকাকা বাড়ি নেই?

না, একটু বেরিয়েছে। বাবা এখুনি ফিরবে। কিছু বলছিলেন?

না। এমনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ, তাই।

 তারক চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল। শুভার মনে হয়েছিল, একটু বসতে বলতে হয়। কিন্তু বলতে পারেনি। বাবা নেই, মা গা ধুতে গিয়েছিল। তারকাকে বসতে বলে, সে কী করবে? কী কথা বলবে? মা-ও হয়তো অসন্তুষ্ট হবে। কী না কী ভেবে বসে থাকবে।

কিন্তু তারকদা যায়নি। যাবার জন্যে ফিরেও আবার দাঁড়িয়েছিল। অনেকটা যেন নিজের মনেই বলেছিল, কত বাড়ি যে হয়ে যাচ্ছে এ-পাড়ার দিকে। আমাদের এদিকটাও রীতিমতো শহর হয়ে গেল।

শুভা যেন সে কথার কী জবাব দেবে, ভেবে পায়নি। অথচ চলে যেতেও পারছিল না। সে সময়েই মায়ের গলা শোনা গিয়েছিল, কে রে ওখানে, কার সঙ্গে কথা বলছিস?

শুভা জবাব দেবার আগে, তারকই বলেছিল, আমি কাকিমা, আমি তারক।

মার গলায় সঙ্গে সঙ্গেই আপ্যায়নের সুর বেজে উঠেছিল, অ। তা বাবা ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? উঠে এসো, বসো। কলকাতা থেকে কবে এলে?

আজ সকালেই। কাল সকালেই আবার যাব।

তারকদা উঠে এসেছিল। শুভার মনে হয়েছিল, তারকদা অন্ধকারেও তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। মা বলেছিল, শুভা, বাতি জ্বেলে দে।

শুভা বাতি জ্বালিয়ে নিয়ে বাইরের ঘরে এসেছিল। সেখানে তারক বসেছিল। বাতির আলোয়, তারকের চোখের দিকে তাকিয়েই, হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠেছিল। তারকা ওর দিকে, অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি, চোখে মুগ্ধতা। সে চাউনি, একেবারে অচেনা নয় শুভার কাছে।

কিন্তু, তারকদার কাছ থেকে কোনওদিন, সে দৃষ্টি আশা করেনি। সেই মুহূর্তে, মনটা গুটিয়ে বিমুখ হয়ে উঠেছিল। লজ্জাও পেয়েছিল। তারকা বলে উঠেছিল, তুমি কি কারুর জন্যে অপেক্ষা করে ছিলে?

শুভা অবাক হয়ে বলেছিল, না তো। আমি ভাবলাম, তুমি কারুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছ। যেভাবে চুপ করে ছিলে, যেন ভয় পেয়েছিলে বা লজ্জা হয়েছিল…।

কথাটা যেন শেষ করেনি। একটা জিজ্ঞাসা, কথার সুরে উহ্য ছিল। তখনও তারকা তাকিয়ে ছিল শুভার দিকে। মুগ্ধতার মধ্যে একটা অনুসন্ধিৎসাও ছিল চোখে।

কথাটা শুনতে শুনতে, হঠাৎ যেন লজ্জাতেই শুভার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। কথাটা ভেঙে না বললেও, ও বুঝতে পেরেছিল, তারকদার আসল প্রশ্নটা কী। কোনও ছেলের অপেক্ষায়, শুভা দাঁড়িয়েছিল কি না, সেটাই তার জিজ্ঞাস্য ছিল। শুভা হঠাৎ মুখে আঁচল চেপেছিল। হাসি পায়নি। যেন মুখটাই ঢাকতে চেয়েছিল। একটু পরে বলেছিল, না, কারুর অপেক্ষায় দাঁড়াইনি।

কথাটা বলার পরে, তারকার চোখের দিকে তাকিয়ে ওর হাসি পেয়ে গিয়েছিল। আর একই সঙ্গে, ওর মনের কোথায় একটা স্তব্ধ ধারার উৎসমুখ যেন সহসা খুলে যাচ্ছিল। তারকার চোখের দিকে চেয়ে, যত অবাক হচ্ছিল, কৌতূহল বোধ করছিল ততই যেন, একটা খুশির ধারা গলতে শুরু করেছিল।

মায়ের কথায়, তারকাকে চা করে দিয়েছিল শুভা। একটু পরে বাবা এসেছিল। বাবার সঙ্গে দু-চার কথা বলে, চলে যাবার সময়ে, শুভার দিকে কেমন একরকম করে যেন তাকিয়েছিল তারকা। যেটা বিশ্বাস করতে বাধছিল, অবাক লাগছিল। অথচ ছেলেদের সেই চাহনিটা মেয়েরা কখনও ভুল বোঝে না।

পরের দিন দুপুর ঘেঁষে, আবার তারকাকে আসতে দেখে, শুভা চমকে উঠেছিল। অবাক যত হয়েছিল, একটা সন্দেহও মনের মধ্যে কূট প্রশ্ন তুলেছিল। আর একই সঙ্গে, লজ্জাজড়িত সংশয়ে কেমন যেন থমকে গিয়েছিল। প্রশ্নটা মনে জেগেছিল, কারণ সেইদিন সকালেই তারকা কলকাতা চলে যাবে বলেছিল। অথচ যায়নি। আগের দিন রাত্রি থেকে, অনেক বারই তারকার সেই মুগ্ধ কৌতূহলিত দৃষ্টির কথা শুভার মনে পড়েছে। পরের দিন, দুপুর ঘেঁষে, তারকদার আসবার কয়েক মুহূর্ত আগেও সে কথা মনে পড়ছিল।

সে জন্যেই শুভা চমকে উঠেছিল? কেঁপে উঠেছিল বলা যায়। একটা লজ্জাজড়িত সংশয়ের কারণ ছিল এই ভেবে, শুভার দিকে আবার তেমনি করে তাকাবার জন্যেই কি তারকা, কলকাতায় না গিয়ে ফিরে এসেছিল।

তখনকার মতো, সে কথা জানবার উপায় না থাকলেও, আগের দিনের মতোই তারকদা তাকিয়েছিল। আবার শুভার বুকের মধ্যে রক্ত চলকে উঠেছিল। অবাক হয়েছিল। ইচ্ছে করে, মনে মনে খুশি হওয়া যায় না। ও চাক বা না চাক, মনে মনে খুশির ঢেউও লেগেছিল।

তারকদা জানিয়েছিল, প্রায় দুপুরে অসময়ে আসার কারণ আর কিছু নয়। বলেছিল সকালেই কলকাতা চলে যাবে। যায়নি। তাই বলতে এসেছিল। মিথ্যে কথার যুক্তিটা তেমন প্রবল হয়নি। কারণ, তার মতো লোক যদি একটা কথা বলেই থাকে, কৈফিয়ত দেবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। সে যে, কলকাতায় যায়নি বলে, আবার দেখা করতে এসেছে, তাতেই শৈলেন মাস্টারের পরিবার অনেকখানি কৃতার্থ হয়েছিল। এবং শুভার মা যে বেশ খুশি হয়েছিলেন, তাও বোঝা গিয়েছিল। মা তারকদাকে বাবা বাছা করে বসিয়েছিল। শুভকে চা করে দিতে বলেছিল। বাবা তখন ইস্কুলে গিয়েছিল।

তারকা বাড়ির সকলের সঙ্গে, বিশেষ করে বোনদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেও সেই একই দৃষ্টিতে অনেক বার শুভার দিকে তাকিয়েছিল। ব্যাপারটা নতুন বলেই বিস্ময়ের। বিস্ময়ের সঙ্গে, থেকে থেকেই লজ্জার ছটায়, শুভার মুখের রং বদলে যাচ্ছিল। অথচ কেমন যেন একটা বিরক্তি এবং রাগে, মনে মনে হাসিও পাচ্ছিল। এ আবার কী অদ্ভুত রঙ্গ! এরকম মনে হয়েছিল শুভার। কখনও বা একটা উদাসী ভাবও সমস্ত ব্যাপারটাকে যেন তুচ্ছ করে দিচ্ছিল। কত ছেলেই তো এমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছে, হেসেছে, কৌতূহলিত হয়ে শুভার ভিতরটা দেখতে চেয়েছে। তারকদাও সেইরকমই। এতেই বা কী আসে যায়।

এসে গিয়েছিল। সেবারে তারকা সাত দিন গ্রামেই ছিল, কলকাতায় যায়নি। প্রতি দিন শুভাদের বাড়ি যেত। কোনও কোনওদিন দুবেলাই। এবং সেবারেই শেষ দিনে, রাত্রে শুভাদের বাড়ি থেকে চলে আসার সময়, তারকদা অন্ধকার আড়ালে পেয়ে, শুভাকে শুধু বলেছিল, আমার যে কী হল, তা জানিনে। এবার আর কলকাতায় যেতে ইচ্ছে করছে না। কেন বলো তো?

শুভা অনেকটা অবুঝের মতোই বলেছিল, কেন?

তারক শুভার হাত ধরেছিল। বলেছিল, তুমি জানো না, কেন?

আর জবাব দিতে পারেনি শুভা। কিন্তু তারকার হাত ধরা, গলার স্বর ও সুর কোনও বোঝা-ই বাকি রাখেনি। তারকা তখনই শুভকে কাছে টেনে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। শুভার পক্ষে, তারকদার সঙ্গে এতটা পাল্লা দেওয়া সম্ভব ছিল না বলে, ও ঘাড় হেঁট করে মুখ নামিয়ে নিয়েছিল।

.

কিন্তু সে মুখখানি তুলতে, শুভার বেশি দেরি হয়নি। তারপরে, তারকা প্রতি সপ্তাহেই কলকাতা থেকে এসেছে। এলেই, শুভাদের বাড়ি। তারকদার আসাটা যেন ছিল, গঙ্গার বান ডাকা জোয়ারের মতো। প্রবলবেগে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাসিয়ে দেবার মতো। সব দিক থেকে, সকলের দিক থেকেই। বাবা মা খুশি হত। ভাইবোনেরাও। কারণ তারকদার হাতটা দরাজই ছিল সকলের জন্যে। প্রথম প্রথম শুভার লজ্জা করত। কোথায় যেন আটকাত। কিন্তু ব্যাপারটা, সবটুকুই তার নিজের হাতে ছিল না। অন্যদের ইচ্ছাটাও কম ছিল না।

আর তারকদার চলে যাওয়াটা ছিল, ভাঁটার টানে ঢল নেমে যাবার মত। যেন, দুপাড় জুড়ে কেবল পলি পাঁকে জল নেমে যাওয়া শূন্যতা।

এই জোয়ার-ভাঁটার টানের অনুভবটা, শুভার মনে এসেছিল বেশ কয়েক মাস পরে। তার মধ্যে অনেক জল এসেছিল, গিয়েছিল। কবে যেন, সেই যাওয়া আসার মধ্যে, নিজের ইচ্ছা, বাসনা, আকাঙ্ক্ষাগুলো মেশামিশি হয়ে গিয়েছিল। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সেই ঘনিষ্ঠতার প্রতিটি মুহূর্তেই, শুভার চোখের সামনে কলকাতার হাতছানি ভেসে উঠেছে।

হাতছানি শুধু চোখে নয়। হাতছানি নানা সুরে বেজেছে মনে মনে। নানা তরঙ্গে ঢেউ দিয়েছে রক্তে রক্তে। কলকাতায় চলো, কলকাতায় চলো। সেখানে অনিশ্চয়ের সকল নিশ্চয়তা। সবকিছুরই মুশকিল আসান। বিবাহ, সংসার। শান্তি, ভালবাসা নিজের ঘর, প্রেমিক স্বামী। অভাব অনটনের কোনও প্রশ্ন নেই।

তখনই কেন বিয়ের কথা তারকদা বলছিল না?

বলা সম্ভব ছিল না। সেটাই সবথেকে আশ্চর্য। মানুষের কত যে মন। যতই দিন যাচ্ছিল, শুভা যতই তারকার ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, ততই বাড়ির আবহাওয়া যেন বদলাতে আরম্ভ করেছিল। তলে তলে, কোথায় যেন একটা প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। অথচ, প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, তারকাকে নিয়ে কারুর মনে কোনও দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা নেই।

কিন্তু ছিল। জাতের কথা উঠেছিল। শুভারা কায়স্থ, তারকা তার চেয়েও ছোট। যদিও, জাতের কথাটা, আগে কখনও কারুর মনে হয়নি। শুধু তার টাকা, কলকাতার অদৃশ্য আশ্চর্য জীবনের কথাই মনে হয়েছিল। তা হোক, তবু তার সঙ্গে সম্পর্ক পাতানো যায় না। অতএব প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। বাবা মায়ের মুখে ক্রমে তারকার সম্পর্কে কটু কথা শোনা যাচ্ছিল। বাড়িতে আসা অপছন্দ হয়ে উঠছিল।

কিন্তু, শুভা যেন তখন অনেক দূর ভেসে গিয়েছে। তারকাকে কতখানি ভালবেসেছিল, সেটা যাচাই করতে পারেনি। জীবনের একটা স্বাদ বদল হয়েছিল। অন্তহীন নিরাশার মধ্যে, আশা পেয়েছিল। বাবা-মা সংসার, কোনও কিছুর প্রতিই ওর আর সে মূল্যবোধ ছিল না। নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ত জীবনের চিন্তাই, রঙিন স্বপ্নের মতো ওকে ঘিরেছিল। তার নামই ভালবাসা ওর কাছে। জাতের বিচার করে কী লাভ। বাড়ি থেকে যদি বিয়ে দেওয়া না হয়, তবে পালিয়ে গিয়েই করতে হবে।

নদীতে টান ছিল। ঘাটের খুঁটিতে যার জোর নেই, মাঝি নেই যে নৌকার, একটা অশক্ত দড়ির টানে কত দিন আর সে-নৌকা ঘাটে থাকে। একদিন তার নোঙর ছিঁড়ে যায়। যে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তার সঙ্গেই ভাসে। শুভার ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকমই। তবু তো এক কূল ভেঙে, আর এক কূল গড়ে উঠবে। কোনও কূল না থাকার থেকে, যে কোনও একটা কূল থাকা ভাল। শুভা তারকার সঙ্গে পালানোই স্থির করেছিল। কারণ, পালানো মানেই বিয়ে। বিয়ে মানেই, স্থিতি। একটি মেয়ের, একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের মেয়ের সকল উদ্বেগের অবসান। ঘর, সংসার, নিরাপত্তা। তাও, তারকদার মতো লোকের সঙ্গে, কলকাতার সেই আশ্চর্য নায়কটি।

নরেশও শুভাদের গ্রামেই মানুষ। তবে, নরেশের দেখা পাওয়া যেত কালে ভদ্রে। সেখানে সে পারতপক্ষে যেতই না। তারকার সঙ্গেই তাকে কয়েক বার গ্রামে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তারকের সঙ্গে যে নরেশের সম্পর্কটা কী, কেউ-ই সঠিক জানত না। নরেশের সম্পর্কে সবাই জানত, সে কলকাতায় বড় ব্যবসা করে। গ্রামের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চায় না। গ্রামের লোক কাউকে কখনও সে ডেকে কথাও বলত না। গ্রামে সে অনেকটাই বিদেশি। এখনকার মানুষেরা, অনেকে তাকে চেনেই না।

শুভাও সেরকম কিছু চিনত না। তারক তাকে যখন এখানে এনে তুলেছিল, তখনই একমাত্র জানতে পেরেছিল, দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শুধু তা-ই নয়। তারক নরেশের ঘাড়ের বোঝা।

বিয়ে? স্বামী ঘর সংসার নিরাপত্তা? দাঁড়া, ওরে মুখপুড়ি মেয়ে, একটু দাঁড়া, একটু থাম। এক নিশ্বাসে, ওই শব্দগুলো এমন করে উচ্চারণ করিসনে। সংসার কি তোকে এটুকু শিক্ষাও দেয়নি? শব্দগুলো যত সহজে উচ্চারণ করা যায়, জীবনের ক্ষেত্রে তার প্রাপ্তি একেবারে কানাকড়ি।

.

কোথায় যেন পেটা-ঘড়িতে ঘণ্টা বাজে, এক দুই তিন। বাইরে ঠাণ্ডার রাত্রি হিমে জড়সড়, কাঁপে। অনেকে ঘরে, গরম বিছানার ঢাকায় ওম করে। পাশের ঘরে, কেবল মাত্র দ্রব্যের উষ্ণতায়, নরেশও ঘুমায়। আর এঘরে, একটা সামান্য মাদুরের ওপরে শুয়ে, শুভা এপাশ ওপাশ করে। ওর শীত করে না। কঠিন মেঝেতে লাগে না। পুরনো চিন্তা, নতুন জীবন, পিছনে অন্ধকার, সামনে অন্ধকার, সব মিলিয়ে ওকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে থাকে।

এখানে এসে, মাত্র সাত দিনের মধ্যে ও জানতে পেরেছিল, তারক একটা শূন্য, তার কিছুই নেই। নানান জনের, নানান ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িয়ে, তার বৃত্তি একমাত্র উঞ্ছবৃত্তি। বন্ধুদের করুণা আর দয়াই তার সম্বল। এমনকী, একটা বাঁধা মাইনের চাকরি পর্যন্ত নেই লোকটার। জামাকাপড় বাসস্থান, সবই পরের করুণা।

কলকাতায় আসার পরে, কয়েক দিন বন্ধু বান্ধব পরিচয়, খানাপিনা, গাড়ি চড়া, বেড়ানো, সিনেমা থিয়েটার দেখা, সবই বন্ধুদের দয়ায়। সে সব বন্ধুরাও, বিচিত্র অস্পষ্ট সব লোক। কার যে কী কাজ, কার যে কী ব্যবসা, কিছুই বুঝতে পারত না শুভা। আজও বোঝে না। এমনকী, এত দিন হয়ে গেল, ও আজও জানে না, নরেশের কী কাজ, কীসের ব্যবসা। এত টাকা তার কোথা থেকে কী উপায়ে আসে।

তবে, এটুকুই শুভা বুঝেছিল, ন্যায়ের পথে, পরিষ্কার কিছু নেই ওদের। ওরা সবাই কলকাতা শহরের, এক ভিন্ন জগতের লোক।

কিন্তু তারকদা পুরোপুরি সেই জগতের লোকও ছিল না। তার জগৎটা, সবটাই পরের মুখাপেক্ষী। একেবারে সম্পূর্ণ দায়দায়িত্বহীন, এক ধরনের বেকার ভবঘুরে বলা যায়।

তবু যেন, একটু ভাল। অন্য জগতের পুরোপুরি বাসিন্দা হওয়ার থেকে, তাও যেন ভাল। নরেশদের সঙ্গে, কোনও সম্পর্ক না থেকে, যদি সাধারণ একটা বেকার ভবঘুরে তোক হত, তাতেও যেন ভাল ছিল। কিন্তু, তারকাকে যতটুকু শুভা চিনতে পেরেছে, তাতে বুঝতে পেরেছে, এ জগৎ, কোনও কিছুর প্রতিই, তার সঠিক কোনও টান নেই। কখনও কখনও এক-একটা ঝোঁক আসে। সেই ঝোঁকের টাল খেয়ে, যেদিকে যতক্ষণ গড়িয়ে চলে। ঠেকে গেলেই, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, আবার অন্য আর এক দিকে যাত্রা শুরু। শুভাও তেমনি একটা ঝোঁকের টানে গড়িয়ে যাবার সীমা।

তবু একটু থমকে যেতে হয় শুভকে। এ কথা কি, সবটুকু সত্যি? তারকদা কি ওকে একটু ভালবাসেনি? কত দিনের কত কথাই যে মনে পড়ে যায়। ছোটখাটো অনেক ঘটনা। সে সবই কি মিথ্যা? এমন তো কখনও মনে হয়নি, তারকদা ওকে ছেড়ে যেতে চায়। তাকে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। নরেশ ক্রমে ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। প্রথম প্রথম, হেসে বিদ্রূপ করত তারকদাকে, রাজকন্যে তো নিয়ে এলি, তোর রাজত্ব কোথায়? তারপরে হাসতে হাসতে কপাল ব্যথা। বিদ্রূপ ক্রমে রাগে পরিণত হয়েছিল। রাগের সঙ্গে বিদ্বেষ। বিদ্বেষের মধ্যে ঈর্ষা। ঈর্ষার সঙ্গে ঘৃণা।

তারপরে আর তো কোনও ঢাকাটকি আড়াল থাকতে পারে না। নিজেকে একবার প্রকাশ করে ফেললে, আর কোনও কিছু দিয়েই তা গোপন করা যায় না। নরেশ সে জাতের লোকও নয়। তখন তারকাকে একটা শর্তে আসতে হয়েছিল। সে চলে যাবে চাকরির খোঁজে। মাসখানেকের মধ্যেই যা হোক একটা ব্যবস্থা করে, বাসা ভাড়া করে, শুভাকে নিয়ে যাবে।

শুভা ভয় পেয়েছিল। তবু রাজি হয়েছিল থাকতে। রাজি না হয়েই বা কী উপায় ছিল ওর। তারকা চলে গিয়েছিল। এক মাস কবেই পেরিয়ে গিয়েছে। তারকদা আসেনি। একটা খবরও পাঠায়নি। আর কোনওদিন ফিরে আসবে বলেও বিশ্বাস হয় না।

তবে আর শুভার মন থমকায় কেন? তারকদার সবটুকু মিথ্যা বা সত্যি এ বিষয়ে ভেবে লাভ কী। আগাগোড়াই যার মিথ্যা, তার সম্পর্কে কিছু ঘটনা নিয়ে কিছুই প্রমাণ হয় না। অসহায় ভেবে হয়তো একটু করুণার উদ্রেক হয়। কিন্তু তারকদা অসহায় নয়। ওটাই তার চরিত্র। দায়-দায়িত্বহীন ভেসে চলা মানুষ। নিজের জীবনের প্রতিও বোধ হয় তার কোনও টান নেই। মানুষের কোনও কিছুরই স্থিরতা নেই। নরেশের অপমানে, তার যদি সে আত্মসম্মানবোধ থাকত, শুভার প্রতি টান থাকত, শুভার অসম্মানের উদ্বেগ থাকত, তা হলে যেখানেই হোক শুভকে নিয়ে যেত। এভাবে ফেলে যেতে পারত না।

না, তারকদা পর্বটা শুভার জীবনে শেষ হয়ে গিয়েছে। শুভার আর কোনও আশা নেই। বরং আজ শুভা নিজেকে ভয়ে ও দ্বিধায়, মনে মনে জিজ্ঞেস করে, সে নিজে কি তারকাকে ভালবেসেছিল? বাবা মা ভাই বোন সব ছেড়ে চলে আসার মধ্যে কি ভালবাসাই ছিল? না কি, চারদিকে হতাশার অন্ধকার থেকে, ছুটে এসেছিল একটা ঠিকানাহীন আলোর পিছনে। যে আলো আলেয়া কি না, সেটা পর্যন্ত লোভী অবুঝ মন, পরখ করে দেখবার অবকাশ পায়নি।

এখন নিজেকেও ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে। এমন করে, নিজের মুখ সে কী করে পোড়াল। এখন, এই অন্ধকার ঘরে, চোখের জলের কী মূল্য। সামনের অথৈ অন্ধকার পাথার। চোখ ভিজে, বুক ভেসে গেলেও, দুঃসীম পাথারের কোনও কিনারা মিলবে না। মুখে যতই তর্জন-গর্জন করুক, নরেশের এই আস্তানা ছেড়ে বেরুবার আগে, ওকে আরও হাজার বার ভাবতে হবে।

নরেশের নাক ডাকার শব্দ এখনও সমানে চলেছে। শুভা জানে, নরেশের এটা ঠিক ঘুম নয়। নেশায় অচেতন হয়ে আছে সে। নেশা ভেঙে গেলে, একবার সেজাগবে। হাজার বার ভেবেও, এখানে শুভার থাকা সম্ভব নয়।

অথচ, এ কথা সত্যি, তারকা চলে যাবার পরে, এক মাস পর্যন্ত নরেশ শুভার সঙ্গে কোনওরকম খারাপ ব্যবহার করেনি। এক মাস ধরে, সে-ও যেন তারকদার ফিরে আসবার জন্যে অপেক্ষা করেছিল। তারপর যতই দিন গিয়েছে, ততই নরেশের চেহারা বদলেছে। ভাব-ভঙ্গি ভাষা বদলেছে। শুভা জানত, নরেশ কী চায়। নরেশের বিষয়ে কিছু কিছু কথা সে শুনেছিল। নরেশের নিজের মুখ থেকেই শুনেছিল। এমনি স্বাভাবিক অবস্থায় নয়। মাতাল অবস্থায়, নরেশ দুঃখ করে জানিয়েছিল, তার বউ তাকে কীভাবে ত্যাগ করে চলে গিয়েছে। বলেছিল, দেখ শুভা আমাদের কারুরই বিয়ে করা উচিত নয়। আমার না, তারকেরও না। তারকের হয়তো পয়সাকড়ি নেই। আমার তো তা বলা চলবে না। বাড়ি হয়তো করিনি। করতে পারি যে কোনও সময়েই, সে টাকা আমার আছে। গাড়ি আছে আমার। এ পাড়াতে ভাল ভাড়া দিয়েই থাকি। তবু বউ থাকল না। থাকবে কেন বলো? সভাবে ব্যবসা করি না, সবসময়েই একটা লুকোচুরি খেলা। কখন কীভাবে কোথায় ধরা পড়ে যাই। অবিশ্যি, সে জন্যে লোকজন সবই আছে। তবু একটা ভয়ে ভয়ে থাকি। তাতে যে ধকল যায়, মদ না খেয়ে পারি না। তাও কি একটু-আধটু। দেখতেই তো পাচ্ছ। আমাদের বন্ধুবান্ধবও ভাল নয়। সবাই সবাইকে টেক্কা মারবার জন্যে সবসময়ে চেষ্টা করছে। আমাদের মতো লোকদের ঘরে কখনও বউ থাকে। আমরা কি সংসার করতে পারি। বন্ধুরাই ফুসলে ফাসলে, বউকে বের করে নিয়ে গেল। বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু করবার কিছুই ছিল না।..

কথাগুলো শুনে, শুভার কষ্টই হয়েছিল। বলেছিল, বুঝেছিলে তো সাবধান হওনি কেন? কেন ভাল করে সংসার করলে না? চোর-ডাকাতেরও তো বউ-ছেলেমেয়ে থাকে।

থাকে, সেরকমই থাকে। তবে হ্যাঁ, আমরা যাদের থেকে মাল চুরি করি, তাদেরই আবার বিক্রি করি। ফলে অফিসারদের ঘুষ তো দিতেই হয়, যা চায়, তা-ই দিতে হয়। মদ মেয়েমানুষ পর্যন্ত। নিজেকেও ঘেন্না লাগে, ওদেরও ঘেন্না করি। সবাইকে শুধু ঘেন্নাই করি।..

এরকম করে বললে, সে মানুষকে খানিকটা চেনা যায়। বোঝা যায়। নরেশের সেই চেহারাটা কিছুটা জানে শুভা। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল, তারকদার ফিরে আসার আশা নষ্ট হয়ে যেতে লাগল, ততই সে অন্যরকম হয়ে যেতে লাগল। সে জন্যে যে নরেশকে খুব একটা দোষী ভাবা যায়, তা নয়। নরেশ যে রকম মানুষ, তার যা চরিত্র, তাতে সে যে এক মাসের ওপর ভাল ব্যবহার করেছে, সেটাই অনেকখানি। তারকা চলে যাবার পরদিনই যদি সে শুভার ওপরে হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তা হলেই বা বলার কী ছিল। সে ব্যবসায়ী হিসাবে দুষ্কৃতকারী, মাতাল, পাপের পরিবেশে ঘোরাফেরা করে, বউ পালিয়ে গিয়েছে। এমন লোক রাত্রে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে, রোজই একটি যুবতাঁকে দেখবে, অথচ তাকে পাবে না, এতখানি সহ্যশক্তি তার নেই। বিশেষ, যে মেয়ের অবস্থা শুভার মতো। কজনেরই বা সে শক্তি আছে। মুখের কথা তো নয়। প্রতিদিনের ঘর করতে গিয়ে, সে শক্তির পরিচয় হয়তো অনেকেই দিতে পারবে না। নরেশ তো কোন ছার।

কিন্তু শুভা তা কোনওদিনই হতে দিতে পারবে না। তারকদা হয়তো তাকে ঠকিয়েছে। কিংবা, তার হতাশার বেড়াজাল থেকে, ভুল ঠিকানায় দৌড় দেবার উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছে। তবু, নিজেকে তো সে একটা দেহোপজীবিনী মাত্র ভাবতে পারে না। নরেশের দাবি সে কোনওরকমেই, কোনওদিন মেটাতে পারবে না। অতএব

এই শুভা, শুভা!

পাশের ঘর থেকে নরেশের গলা শোনা যায়। ঘুম-ভাঙা মোটা গলা। কিন্তু মত্ততা তেমন নেই। নেশার ঘোর কাটল এতক্ষণে। কখন তার নাক ডাকানো থেমেছে, টের পাওয়া যায়নি।

দরজায় শব্দ হল। জোরে নয়, আস্তে আস্তে। এ নরেশ, ঠিক সে নরেশ নয়। ডাকল, শুভা, আমি জল খাব, দরজা খুলে দাও।

শুভা উঠল না। কোনও জবাবও দিল না। নরেশ যদি বুঝতে পারে, শুভা জেগে আছে, তা হলে দরজা খোলাবেই। ও ঘরেও জল আছে। বাতি জ্বাললেই জল পাবে।

কয়েক বার দরজায় ধাক্কা পড়ল। ডাকাডাকি করল। তারপরে নিজের মনেই বলল, ধ্যাৎ, আমার আর এ সব ভাল লাগে না। কিছু শালা মনেও করতে পারছি না। এবার আমিই চলে যাব এখান থেকে…।

পাশের ঘরে গলার স্বর থেমে যায়। আর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। যাবেও না। এখন নরেশ শুয়ে পড়বে। এবং আবার আগামীকাল রাত্রের আগে, কোনও গোলমাল চিৎকার মাতলামি কিছুই হবে না। নরেশ সকালবেলা চা খেয়ে সেই যে বেরিয়ে যাবে, আর ফিরবে রাত্রে। সকালবেলা সে বিশেষ কোনও কথা বলবে না। বড়জোর, তারকের কোনও খবর পেলে? এ কথা জিজ্ঞেস করবে। কিংবা, গম্ভীর হয়ে বলবে, কী যে করা যায়, আমার মাথায় কিছু আসছে না। অথবা, আর আমি তো একটা মাতাল লোক, আমার কাছে এভাবে দিনের পর দিন থাকবেই বা কেমন করে!

ঠিক চলে যেতে বলে না। অথচ, একরকম তাই বলে। তার কথার ভাবের মধ্যে, ইঙ্গিত পরিষ্কার। হয় নরেশের রক্ষিতা হয়ে শুভা থাকুক, না হয়, চলেই যাক। তবে, সকালবেলা নরেশ একেবারে শান্ত গম্ভীর ভদ্রলোক।

শুভা এখন একটা ব্যাপার বুঝতে পারে। প্রতিটি সকালেই, ওই ধরনের কথা বলে, নরেশ যখন বেরিয়ে যায়, সে একটা আশা নিয়ে যায়, শুভা হয়তো তার কথায় সম্মত হয়েছে। এই আশা নিয়ে যায়, সারাদিন সেই আশা, নানান কল্পনায়, আকাঙ্ক্ষাকে আরও উদগ্র করে তোলে। পেটে মদ পড়ে, সমস্ত ভারসাম্য হারিয়ে, মত্ত হাতির মতো এসে দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এ অবস্থায়, নরেশের বাসা ছেড়ে চলে যাওয়াই সব দিক থেকে উচিত। উচিত–কিন্তু, কোথায়? সত্যি কি বাড়ি ফিরে যেতে পারে শুভা।

নিজের মনেই ঘাড় নাড়তে থাকে ও। না না, আর কোনওদিনই না। তারকদা ওকে বিয়ে করে, আধপেটা খাইয়ে, ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে রাখলেও, বাবা-মাকে মুখ দেখাবার একটা সম্ভাবনা ছিল। তাতেও সম্মান ছিল। আজ যদি ও বাড়ি ফিরে যায়, কী পরিচয় নিয়ে যাবে? ও কে? ওর কী পরিচয়? শৈলেনমাস্টারের মেয়ের পরিচয় অনেক দিন আগেই হারিয়েছে। অথচ নতুন কোনও পরিচয়ে ওর নবজন্ম হয়নি। ও কি একটা স্বেচ্ছাচারিণী মাত্র? স্বৈরিণী? তবে বাড়িতেই বা ঠাঁই হবে কেন?

তবে কোথায় যাবে শুভা। ঘরের অন্ধকার যেন দুলে ওঠে। অন্ধকারের মধ্যে, আর একটা অন্ধকারের হাঁ যেন ওকে গিলতে আসে। মৃত্যু। তারই হাতছানি সেখানে। গলায় দড়ি দিয়ে, গায়ে আগুন লাগিয়ে, যেভাবে হোক, সেই একটা জায়গাই এখন আছে। যেখানে গিয়ে, শুভার সবকিছু শেষ হতে পারে। সেটা কি এমনই কঠিন।

দু হাত দিয়ে মাদুরটাকে আঁকড়ে ধরে, বুক চেপে, অন্ধকারের গভীরে, নিজেকে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় যেন ঝুলতে দেখে। ওর শেষ ছবি।…তবু জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ে, চোখের কোল ভেসে যায়। একটা কোনও মুখও যেন ওর এখন আর মনে পড়ে না।

.

কলিং বেল বেজে উঠতেই, শুভার ঘুম ভেঙে গেল। এত সত্ত্বেও, এ পোড়া চোখে, এখনও ঘুম আসে। মরার কথা ভাবতে ভাবতেই, কখন ঘুম এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তবু যদি একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যেত, আর ঘুম না ভাঙত। তেমন ঘুম কি আসে না একবার।

কিন্তু বসে থাকা চলে না। ঝিটা এসেছে। সে-ই কলিং বেল বাজিয়েছে। অবাঙালি ঝি। সকালে বিকালে দুবার আসে। মধ্যবয়স্কা ঝিয়ের নাম বিহানী। কী তার মানে, কে জানে।

আবার সেই রাত্রের পলাতকের কথা মনে পড়ে যায়। এখন যেন ও বিশ্বাস করতেই পারছে না, গত রাত্রে, সত্যি একটা অচেনা লোক, একটা চোর ওখানে, ওর চোখের সামনেই লুকিয়েছিল। অথচ এখনও চোখের সামনে, লোকটা ভাসছে। কুড়িয়ে পাওয়া সেই অদ্ভুত লোহার জিনিসটার কথাও ওর মনে পড়ে যায়। আবার কৌতূহলিত হয়ে ওঠে। জিনিসটা দেখতে ইচ্ছা করে।

কিন্তু এখন আর সে সময় নেই। নরেশ চলে যাবে, ঝিও চলে যাবে, তারপরে আর এক বার সেই জিনিসটা ও দেখবে। যদিও সত্যি জানে না, জিনিসটা কী বা ওটা কার। নরেশের না সেই লোকটারই।

শুভা মাদুরটা রেখে দরজা খুলে দেয়। বিহানী চকিতে এক বার শুভার আপাদমস্তক দেখে নেয়। তারপরে, এ পাড়ার আদব অনুযায়ী, কপালে হাত ঠেকিয়ে সেলাম করে। বলে, সেলাম মেমসাব।

সম্বোধনটা শুনতে খুবই খারাপ লাগে শুভার। মেমসাহেব আবার কী! ছি! প্রথম প্রথম এরকমই মনে হত। অবাক লাগত, লজ্জা হত। ভাল তো লাগতই না, বরং শুভার চিরদিনের অন্য মনে, একটা সংশয় হত, এই ডাকের মধ্যে কোথায় একটা ইতরতার ইঙ্গিত রয়েছে যেন। এটা ওর কুসংস্কার বা যা-ই হোক, ভাল লাগত না। কিন্তু এখানকার আদব-কানুন আলাদা। শুভা শুনে গিয়েছে, মুখ ফুটে বলেনি কিছু। এখন অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে শুনে। মনোভাবটা সেরকমই আছে। ও কেবল বলে, এসো।

ঝি ঘরে ঢুকে নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর এক বার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। যেন চোখের দৃষ্টিতে আর গন্ধে, সমস্ত ব্যাপারটা আঁচ করে নিতে চায়। প্রথম যখন শুভা এসেছিল তখন এই বিহানী, কেমন একটা সন্দিগ্ধ কৌতূহলে ওর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখত। শুভার চোখে চোখ পড়ে গেলেই, চোখ ফিরিয়ে নিত। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত। বিহানীর কথার মধ্যে, তখন একটা অশ্রদ্ধা থাকত। যদিও স্পষ্টভাবে নয়। কথাবার্তার ধরন-ধারণ ছিল আলাদা, নোংরা, ইঙ্গিতপূর্ণ। ঠিক শুভাকে নয়, অপরের তুলনা দিয়ে। যেমন সে বলত, আমার আর কী করবার আছে মেমসাব, খাঁচায় যখন যে চিড়িয়া আসবে, আমি তারই সেবা করব।

ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে ছিল না। শুভার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করত, নরেশের এই খাঁচায় কত পাখি বিহানী দেখেছে। কিন্তু কেনই বা জিজ্ঞেস করবে। শুভ তো নরেশের খাঁচার পাখি নয়।

তারপরে বিহানী, অনেকটা শুভার সইয়ের ভূমিকা নিতে চেয়েছিল। নানা রকম ঠাট্টা-তামাশা হাসির গল্প বলত। অধিকাংশই এই পাড়ার গল্প, যে গল্পগুলোর মধ্যে পরিবারের কেচ্ছা, মেয়েদের নোংরামি, পুরুষদের বদমাইশি। শুভা গা দিত না, এড়িয়ে যেত।

কয়েক মাস দেখে দেখে, বিহানী এখন অনেকটা সহজ হয়েছে। শুভার সম্পর্কে তার ধারণাটা কিছু পালটেছে। এখন সে জিজ্ঞেস করে, তারকার কোনও খবর এল কি না। আর নিজের পরিবারের কথা বলে। ছেলে মেয়ে স্বামী সংসার। মাঝে মাঝে মেমসাবের জন্য তার মনটা কেন যেন খারাপ হয়ে যায়। একটু ভয় ভয়ও লাগে। মেমসাব একটু হাসেও না। বিহানীর নিজেরও তো বড় বেটি আছে। সে এ পাড়ার আরও নানান গল্প বলে। পারিবারিক কেচ্ছা নয়। অন্যান্য গল্প। কার ছেলে হয়েছে, কে মারা গেল, কার বিয়ে হল। কাদের মারামারি হয়েছে, কোথায় গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে, এমনি বহুতর গল্প।

এখন বিহানীকে অনেক সহজ লাগে। শুভা নিজেও অনেকটা সহজ। সকালে বিকালে, দুবেলা সে আসে। বাসনপত্র পরিষ্কার করে, ঘর দরজা সাফ করে। ধোয়া কাঁচার কিছু থাকলে, ধুয়ে দিয়ে যায়।

বিহানী ঘরে ঢুকে, প্রথমেই দেখে নেয়, পাশের ঘরের দরজা এদিক থেকে বন্ধ। সে জানে, ভিতরে নরেশ আছে। এবার তাকেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে হবে। নরেশ যতক্ষণ এ ঘরে না আসছে, ততক্ষণ শুভা পাশের ঘরে যাবে না।

দরজাটা খোলবার আগেই, বিহানী বলে ওঠে, মেমসাব, কাল রাতে চোর এসেছিল জানেন?

 জানি।

শুভা নিজের চোখে চোর পালানোর যে দৃশ্য দেখেছিল, বিহানীর কাহিনী তার চেয়ে অনেক বেশি লোমহর্ষক, আরও ভয়ংকর। কারণ, চোরটা নাকি পিস্তলের গুলি ছুঁড়েছিল, এবং হাওয়া হয়ে যাবার মন্ত্ৰও জানে। শুধু হাওয়া হয়ে যাবার নয়, চাবি ছাড়াই, যে কোনও আলমারি খোলার মন্ত্র জানে লোকটা। কলকাতায় সেই চোরের নাম সবাই জানে। ওকে বলে তালাগুনিন। অর্থাৎ সব তালাকেই যে গুন করতে জানে। আজ পর্যন্ত তালাগুনিন মাত্র এক বার ধরা পড়েছে। কিন্তু কলকাতায় এখনও যে সব বড় বড় কোম্পানির চাবি খুলে চুরি হয়, সবই তার কাজ, অথচ ধরা পড়ছে না। হাতেনাতে ধরা খুবই মুশকিল। চুরি হচ্ছে, অথচ চোর ধরা পড়ছে না। এতেই বোঝা যায়, লোকটা মন্ত্র জানে। তোমার সামনেই সে দাঁড়িয়ে থাকবে, অথচ তুমি তাকে দেখতে পাবে না। বিহানীর মতে, চোরটা নিশ্চয়ই বিড়াল বা ইঁদুর বা চুহায় রূপান্তরিত হতে জানে। তা নইলে এক বারও ধরা পড়ছে না কেন। গতকাল রাত্রে তো সে, স্রেফ চিড়িয়া হয়ে, আটতলা ছাদ থেকে উড়ে গিয়েছে।

গতকাল রাত্রে সে, ভোরাফ্ল্যাটে এসেছিল। ভোরারা খুব বড়লোক, তাদের সিন্দুকে মেলাই টাকা। কিন্তু তালাগুনিন একটা খবর জানত না, ভোরাদের সিন্দুকে চাবি ঘোরালেই টুং টাং করে বাজনা বেজে ওঠে। তাইতেই টের পেয়ে গিয়েছিল। সিন্দুক খোলাই পড়ে ছিল, কিছু নিতে পারেনি। তার আগেই পালিয়েছে।

বিহানী আরও খবর দিল এই চোর নাকি বছরে দুবার চুরি করে। কখন কোথায় চুরি করবে, কেউ বলতে পারে না। কোথায় সে থাকে, তাও কেউ জানে না। সবথেকে মজা হচ্ছে, পুলিশ কিছুতেই তার নামে কোনও কেস্ দিতে পারছে না। প্রমাণ দিতে না পারলে, সাজা হবে কেমন করে।

অতএব, মেমসাব যেন খুবই সাবধান থাকে। দৈবের কথা কিছুই বলা যায় না। শুভকে সাবধান করে সে মাঝখানের দরজা খুলে দেয়। দেখা যায়, নরেশ তখনও শুয়ে আছে। শুভার চোখের ওপর ভেসে ওঠে, কাল রাত্রে দেখা সেই মুখ। সে কি তবে সেই তালাগুনিনের নাকি! লোকটা মন্ত্র জানুক বা না জানুক, হাওয়া হতে জানে ঠিকই। যদি, এ লোকটাই সেই কাল রাত্রের পলাতক চোর হয়ে থাকে!

কিন্তু বেশিক্ষণ ভাববার অবসর পাওয়া যায় না। বিহানীর কাজকর্মের সাড়া-শব্দে নরেশের ঘুম ভেঙে যায়। শুভা জানে, বিহানী ইচ্ছা করেই, কাজে কর্মে, জোরে শব্দ করে, যাতে তার সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়। নরেশ উঠে বসে। একটু সময় চুপ করে বসে থাকে। তারপরে সোজা এ ঘরে চলে আসে। ঘরের এক পাশে দাঁড়ানো শুভার দিকে এক বার মাত্র তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, বাথরুমে ঢুকে যায়।

 শুভা জানে, এখন আর কোনও সমস্যা নেই। সে পাশের ঘরে চলে যায়। নরেশ এখন স্নান করে, জামাকাপড় পরে বেরিয়ে যাবে। তার গাড়ির গ্যারেজ অন্য জায়গায়। একটু পরেই তার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসবে। আগে, বিহানীই সাহেবের চা-জলখাবার দিত। আপাতত শুভাই দেয়। শুভা সেই ব্যবস্থাই দেখতে যায়।

কিন্তু মনের ভিতরের, পথহীন অনির্দিষ্ট অন্ধকার পাক খেতেই থাকে। যদিও দিনের বেলা একরকম, রাত্রি আসে আর এক রকম ভাবে, তবু তার যোগসূত্রটা ছিঁড়ে যায় না। দিনের বেলা যা স্তব্ধ, রাত্রে তা-ই ভয়ংকর শব্দে আছড়ে পড়ে। কোনওটাই শুভার কাম্য নয়, সহ্যও হয় না আর। অথচ একটা ভয় যেন দূর থেকে স্থির-দৃষ্টি অজগরের মতো ওকে সম্মোহিত করতে থাকে। নড়তে পারে না, পালাতে পারে না, ভিতরটা কেবল থরথর করতে থাকে। কী করবে, বুঝতে পারে না।

জলখাবার খেয়ে, বেরুবার আগে, নরেশ যেন একটু কৌতূহলিত গাম্ভীর্যে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, তারক কি লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে?

শুভা বলে, না।

নরেশ শক্ত মুখে, চুপ করে ভাবে। তারপরে বলে ওঠে, তবু এত সাহস কী করে হয়।

কথাটা যে কার সম্পর্কে বলে, কথার সুরে ঠিক বোঝা যায় না। যেন নিজের মনেই বলে। তারপরে মাথা নাড়ে নিজের মনে। চলে যেতে যেতে বলে, এভাবে আর চলে না।

ঘরের কাজকর্মের পর, বিহানী বাজার করে দেয়। একলা শুভা রান্না করে, খায়। কতটুকুই বা দরকার। ভাতে-ভাত হলেই চলে যায়। বিহানী আবার সেটা মেনে নিতে পারে না। সে একটু আনাজপাতি, মাছ, সবরকমই এনে দেয়। রাত্রে, নরেশের খাবারও তো করতে হয়। খাওয়া হোক বা না-হোক।

তারপরে সারাদিন ফাঁকা। ঘর দুটো প্রকাণ্ড। এত বড় ঘর এর আগে শুভা দেখেনি। আজকাল এরকম দুটো ঘরের মতো জায়গায়, ছকামরার দশতলা বাড়ি করা যায়। এঘর থেকে ওঘর যেন অনেক দূর, দুটো আলাদা বাড়ির মতো। শুভা রান্না করে, স্নান করে। যতটুকু ইচ্ছা করে, খায়। শুয়ে ঘুম আসে না। বাইরে যাবার কোথাও নেই। কোনও জায়গা চেনে না। তারকদা থাকতে বেরিয়েছে। বেড়িয়েছে, সিনেমা থিয়েটার দেখেছে। নরেশের সঙ্গে কোনওদিন তা যায়নি। বিহানী হয়তো কখনও কখনও বলেছে, তার সঙ্গে পার্কে ময়দানে বেড়াতে যেতে। তাও যায়নি। শুভার ভয়, বাইরে বেরুলেই অনেক চেনা লোকের সঙ্গে ওর দেখা হয়ে যাবে। কে কী বলবে, কোনও জবাব দিতে পারবে না। নিজেকে সব সময়ে ওর লুকিয়ে রাখতেই ইচ্ছা করে। চেনা অচেনা, কাউকেই যেন এ মুখ আর দেখানো যায় না।

বিকালে এসে বিহানী কাজ করে চলে যায়। তারপরে, শুভা গিয়ে দাঁড়ায় সেই জানালায়। সেখান থেকে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়িগুলোকে দেখা যায়। জানালায় বারান্দায় লোকজন, অনেক দৃশ্য। কোনও কোনওদিন, বাইরের দরজা খুলে, বাঁ দিকে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ছাদেও ওঠে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। নিজেকে যেন হাটের মাঝে এসেছে বলে মনে হয়। তখন আশেপাশের সবাই তাকে দেখতে পায়। সেই হোটেল বাড়িটার নানা দৃশ্য চোখে পড়ে। আসলে, হোটেল নয়, মেয়েদের দেহ ব্যবসায়ের আড্ডা। তা ছাড়া, আশেপাশের লোকজন এমন করে তাকিয়ে থাকে, যেন গিলে খাবে। তাই তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসে।

শুভা গিয়ে জানালায় দাঁড়ায়। অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। শীতের দিন, অনেক আগেই বেলা চলে যায়। সব জায়গায় বাতি জ্বলে উঠেছে। ছবির মতো নানা দৃশ্য দেখতে থাকে। আবার সেই মধ্যরাত্রের প্রতীক্ষা। সেই মার্তণ্ডের আবির্ভাব। দু হাত বাড়িয়ে, শুভাকে অন্য জীবনে টেনে নিয়ে যাবার সেই বীভৎস আকাঙ্ক্ষা হাঁ করে আসবে। কিন্তু কই, রাত পোহাল, দিন যেমন যাবার, চলেও গেল, শুভা তো তবু কোথাও গেল না। এভাবে কত দিন সে, এই পরিস্থিতিকে ঠেকিয়ে রাখবে। তারকদা কি আর আসবে। সে কি বেঁচে আছে এই পৃথিবীতে। বাড়ি ফিরে গেলে, বাবা-মা কী বলবে? শুভা কি যেতে পারবে। না কি, সত্যি অপঘাত মৃত্যুই আছে ওর কপালে।

কতক্ষণ এমনি দাঁড়িয়েছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। শুভা চমকে ওঠে। একটু অবাক হয়। কে হতে পারে? এখন তো মোটে, রাত্রি আটটার মতো হবে। এ সময়ে তো নরেশ আসে না। সে এলেও, কলিং বেল বাজায় না। জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দেয়। বিহানীও চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। অবিশ্যি, মাঝে মাঝে নরেশের ড্রাইভার আসে। নানারকম জিনিসপত্র রেখে যায়। তাও কালে-ভদ্রে।

শুভা সামনের ঘরে গিয়ে, দরজার কাছে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। এ সময়ে ভয়ের কিছু নেই। রাত্রি কিছুই হয়নি। সে ছিটকিনিটা খুলে দেয়। কিন্তু দরজা খোলবার সময় পায় না। বাইরের থেকে, কেউ যেন, ঠেলেই ঘরে ঢুকে পড়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা নিজেই আটকে দিয়ে, শুভার দিকে ফিরে তাকায়।

শুভার বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। যে মূর্তি ওর সামনে, যার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়, সে আর কেউ নয়, গতকাল রাত্রের সেই পলাতক লোকটা। শুভা চমকে উঠে, আরও কয়েক পা পেছিয়ে দাঁড়ায়। লোকটার চোখ থেকে, চোখ নামাতে পারে না। অথচ কিছু জিজ্ঞেস করতেও, ওর গলায় কথা সরে না।

গতকালের সেই পোশাকই লোকটার গায়ে। গাঢ় সবুজ রঙের গোটা হাত ঢাকা, গলা পর্যন্ত সোয়েটার। কালো রঙের প্যান্ট, পায়ে জুতো। মাথার চুলগুলো কপালের কাছে রুক্ষু হয়ে এসে পড়েছে। দরজাটা বন্ধ করেই, শুভার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। সে-ও চোখ নামায় না শুভার চোখ থেকে।

কয়েক মুহূর্ত পরে, লোকটা বলে ওঠে, ভয় নেই, আমি কিছু করব না।

 কথাগুলো যেন ধারালো আর স্পষ্ট। বলে সে এক পা এগোয়। শুভা তৎক্ষণাৎ পাশের ঘরের দরজার কাছে ছুটে যায়। লোকটা চকিতে এক বার চারিদিকে দেখে নেয়। আবার বলে, ভয় নেই।

শুভার মনে হয়, ওর প্রাণটা বোধ হয়, গলার কাছে এসে ঠেকেছে। এখুনি মুখ দিয়ে, একটা তীব্র শব্দে বেরিয়ে যাবে। লোকটা ইতিমধ্যে, পাশ ফিরে সেই ঢাউস আলমারিটার কাছে চলে যায়। যেখানে গত রাত্রে লুকিয়েছিল, সেখানে গলা বাড়িয়ে দেখল। মাদুরটা হাতে নিয়ে, আরও নিচু হয়ে দেখল। তারপরে যেন খুবই হতাশ হয়েছে, এমনিভাবে, মাদুরটা ছুঁড়ে ফেলে দিল কোণে। মেঝেতে একেবারে মাথা পেতে, আলমারির তলাটাও দেখল।

সেই মুহূর্তেই, শুভার চোখের সামনে, সেই লোহার পাতের অদ্ভুত জিনিসটা ভেসে উঠল। যন্ত্রের মতো সেই জিনিসটা। লোকটা কি তা হলে সেটাই খুঁজতে এসেছে? সহসা যেন ওর ভয় একটু কমে গেল, আর ঠোঁটের কোণ দুটো শক্ত হয়ে উঠল। লোকটা যদি নিজের থেকে ড্রয়ার খুলে খুঁজে না পায়, তা হলে কিছুতেই ও বলবে না।

লোকটা দাঁড়িয়ে, শুভার দিকে ফিরে তাকাল। লোকটা নয়, একটা ছেলে। তারকাদের থেকে ছোট। ছাব্বিশ-আটাশ হতে পারে। বলল, ভয়ের কিছু নেই। কাল আমাকে খুব বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আমি একটা দরকারে এসেছি।

কথা স্পষ্ট, কিন্তু খুব দ্রুত। শুভার চোখে অবিশ্বাস, ভয়। কথা বলল না। বিহানীর সেই কথা ওর মনে পড়ে গেল, তালাগুনিন। এই কি সেই লোক! এই লোকই গত রাত্রে ওভাবে পালিয়েছিল?

সে জিজ্ঞেস করল, আলমারির ওখানে কিছু পাওয়া গেছে?

প্রথমেই শুভার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, জানি না।

লোকটা জুতোর ওপর চাপ দিয়ে, শরীরটাকে একটু একটু দোলাতে থাকে। বলে, বললাম তো, ভয়ের কিছু নেই। আমি একটা জিনিস খুঁজতে এসেছি খালি। মনে হয়, ওটা আমি এখানে ফেলে গেছি।

অবিশ্বাস আর ভয়ের মধ্যেও, শুভা জিজ্ঞেস করে, কী জিনিস?

লোকটা বাঁ হাতের তালুটা এক বার ঘোরায়। বলে, এই একটা লোহার পাতের যন্ত্রের মতো। গোল পাতের ওপর তিনটে মুখ। একটা হাতল আছে। এরকম কিছু পাওয়া গেছে? এই আলমারিটার পাশে?

শুভা যেন হঠাৎ জবাব দিতে পারে না। এক লহমায়, একটা মিথ্যে কথা বলতে, কেমন আটকে যায়। সেই ফাঁকেই, সে বলে ওঠে, পাওয়া গেছে, না? কোথায় সেটা?

এতক্ষণ ধরে, লোকটার উপস্থিতি ও চোখের দিকে চেয়ে থেকে, শুভার ভয়টা যেন অনেকখানি কমে আসে। যদিও বিশ্বাস করতে পারে না কিছুতেই। কিন্তু ওর কৌতূহলের মাত্রা একটু বাড়ে। বলে, জিনিসটা কী, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

লোকটা কথা বলে না। কিন্তু শুভার চোখ থেকে চোখ সরায় না। যেন শুভার ভিতরটা পর্যন্ত দেখে নিতে চায়। এক বার যেন লোকটার চোখের কোণ দুটো কুঁচকে উঠল। মুখটা শক্ত দেখাল। শুভা ভয় পেল আবার। পাশের ঘরে ঢুকে, দরজাটা বন্ধ করে দেওয়াই, ওর নিরাপদ হওয়ার একমাত্র রাস্তা। সেইজন্যে ও দরজার কাছাকাছিই দাঁড়িয়েছিল।

লোকটার দৃষ্টি চারপাশে আর একবার ঘুরে গেল। বলে, তা হলে পেয়েছেন?

না।

তবে জিনিসটা কী তা জানতে চাইলেন কেন?

এমনভাবে কথা বলছে, যেন লোকটা চোর বা ডাকাত নয়। যেন কাল রাত্রে পালিয়ে এখানে আসেনি। এমনি এসেছিল। কিছু ফেলে গিয়েছে, তারই খোঁজে এসেছে। শুভার মুখ থেকে, আপনিই প্রশ্ন বেরিয়ে আসে, তুমি কে?

লোকটার ঠোঁটের কোণে একটু হাসির ঝিলিক দেখা গেল। বলল, আমাকে আপনি চিনবেন না।

শুভা বলে ওঠে, তুমি চোর, আমি জানি।

লোকটা এক বার ভুরু কোঁচকায়। শুভা আবার বলে, কাল রাত্রে তুমি এপাড়ায় ঢুকেছিলে, ভোরাদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলে। তারপর পালিয়েছিলে।

লোকটার ভুরু আর চোখের মণি যেন জোড়া লেগে যায়, এমনভাবে তাকায়। তবু কোনও কথা বলে না। শুভা ধারণা করে, লোকটা ধরা পড়ে যাচ্ছে বলে, কথা বলতে পারছে না। সাহস পেয়ে ও আরও বলে ওঠে, তুমি তালাগুনিন।

লোকটার ঘাড়টা আর একটু বেঁকে ওঠে। বলে, সে আবার কে?

তুমি জান না?

লোকটা ঘাড় নাড়ে। আর মুহূর্তেই শুভা দেখতে পায়, লোকটা যেন চোখের নিমেষে, ভিতর ঘরের মাঝখানের দরজায় এসে পড়ে। শুভা ভয় পেয়ে, চিৎকার করতে যেতেই, একটা শক্ত হাত ওর মুখ চেপে ধরে। পিছনে ঘাড়ের কাছেও তেমনি শক্ত থাবা।

শুভা হাত দিয়ে, মুখের থেকে হাত সরাতে যায়। সাঁড়াশির মতো সে হাত একটুও সরাতে পারে না। চকিতে এক বার লোকটার মুখের দিকে চায়। লোকটা বলে ওঠে, আগেই বলেছি, ভয়ের কিছু নেই। বাজে কথা শুনতে আসিনি আমি এখানে। কোথায় আছে সেটা?

শুভা সমস্ত শক্তি দিয়ে, মুক্তি পাবার চেষ্টা করে। লোকটার স্পর্শ যেন তাকে আরও শিউরে তোলে।

লোকটা বলে, চেঁচাবেন না, ছেড়ে দিচ্ছি। চেঁচালে, ব্যাপারটা খুব সুবিধের হবে না।

ছেড়ে দিয়েই, পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয় সে। বলে, বলুন, সেটা কোথায়?

শুভা ততক্ষণে, অনেকখানি সরে গিয়ে, ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আঁচল দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে, লোকটার দিকে তাকায়। ওর চোখে ভয় আছে, কিন্তু রাগের উত্তেজনা তার থেকে কম নয়। এবং সবথেকে আশ্চর্য, তবু ও ভেঙে পড়ে না। বললে, আমি কী করে জানব, কোথায় কী ছিল।

আমি কি এ ঘরে ছিলাম নাকি?

তবে কে ছিল?

 যার ঘর, সে-ই ছিল।

 ও, সেই মাতালটা, যে কাল আপনাকে নিয়ে টানাটানি করছিল?

সত্যি কথাটা শুনতে যে এত খারাপ লাগে, আগে যেন শুভার জানা ছিল না। ও বলে ওঠে, সে যেই হোক, তাতে তোমার কী?

আমার কিছুই না। তবে, লোকটা আপনার স্বামী নয়, তা বুঝতে পেরেছি। আপনি তো

 হঠাৎ থেমে যায় লোকটা। গলার স্বর বদলে বলে, যাক গে, ও সবে আমার দরকার নেই। তবে, লোকটা বদমাইশ। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। কী যেন নাম, নরেশ, হ্যাঁ নরেশ। তা হলে, সে-ই ছিল এ ঘরে?

বলতে বলতে কয়েক পা এগিয়ে আসে সে। ঢাউস আলমারিটা দেখিয়ে বলে, এর চাবি কোথায়?

যার জিনিস, তার কাছে।

হুম। আর এই আয়রন সেন্টার চাবি?

 তার কাছেই।

লোকটা হঠাৎ নরেশের বিছানাটা টেনে একেবারে উলটে দেয়। বালিশের তলায় দেখে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার টেনে খোলে, আবার বন্ধ করে। তারপর শুভার দিকে এক বার তাকিয়ে, বাথরুমের দরজাটা খুলে রেখে, ভিতরে ঢুকে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার ফিরে আসে। শুভা মনে মনে ভেবেও মুহূর্ত কটির সুযোগ নিয়ে, কোনওদিকে যেতে পারল না। বরং মনে মনে লোকটার কথা ভেবে অবাক হচ্ছিল, নরেশকে মাতাল বদমাইশ বলতে শুনে। নরেশের ওপরে লোকটার রাগের কথা শুনে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেই বলল, পাশের ঘরে চলুন, একবার দেখব।

শুভা বলে, তুমিই দেখ না!

আপনি তা হলে বাইরে গিয়ে চেঁচাবেন। আসুন আসুন, তাড়াতাড়ি আসুন, আমার সময় নেই।

একে স্পর্ধা বলে না। যেন কতই স্বাভাবিক একটা কথা বলছে। কিংবা যেন শুভার চেনা লোক। শুভা বলে ওঠে, আমি আবার পালাব কোথায়?

লোকটা থমকে যায়। বলে, তাও তো বটে। আপনার তো আবার পালাবারও উপায় নেই। চোরের থেকেও খারাপ অবস্থা।

একটু যেন হাসির ঝিলিক দেখা যায় লোকটার মুখে। তাও বাঁকা ঝিলিক। যেন বিদ্রূপ করছে। আবার বলে, নিজের দোষেই তো ফাঁদে পড়েছেন। কাল যা শুনলাম, তাই মনে হল। তা সে যাক গে, অন্য কোথাও না পালান, ঘরের বাইরে গিয়ে চেঁচাতে পারেন। ও সব ঝুট ঝামেলা বাড়াতে আমার ভাল লাগে না। চলুন।

শুভা যেন ভুলে যায়, ও কার সঙ্গে কথা বলছে। একটা অপমানবোধ ওকে হঠাৎ জ্বালিয়ে দেয়। কেঁজে বলে ওঠে, আমার কথায়, তোমার মতো একটা চোরের কোনও দরকার নেই। কী দেখতে চাও, দেখে নাও।

শুভা রাগে ও উত্তেজনায়, দ্রুত পাশের ঘরে যায়। এই মুহূর্তে ভয়ের কথাও ওর মনে থাকে না যেন।

কিন্তু লোকটা অতিরিক্ত মাত্রায় সচেতন আর সতর্ক। শুভা পাশের ঘরে ঢুকে পাছে দরজা বন্ধ করে দেয়, সেই জন্যে প্রায় শুভার গায়ে গায়ে ঘেঁষে পাশের ঘরে যায়। পাশের ঘরে গিয়েও, শুভা যত সরে যেতে চায়, লোকটা ততই ওর পাশ ঘেঁষে থাকে। বলে, উঁহু, অতটা দূরে থাকবেন না। আমার কাছে কাছে থাকুন।

শুভা ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, কেন?

বলা যায় না, ছিটকে ও ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আর আমিও আটকা পড়ে গেলাম।

শুভা রাগে ও বিদ্রুপে, ঝলসে ওঠে, তাতেই বা তোমার কী। কাল রাত্রে জানালা দিয়ে যেভাবে ধরা পড়ার ভয়ে এসে ঢুকেছিলে, সেই জানালা দিয়েই পালাবে।

লোকটা যেন ভারী নিশ্চিন্ত হয়ে, এমনি একটা কথার কথা বলে, সেটা ঠিক হবে না। সবাই দেখতে পাবে, আর

শুভা বলে ওঠে, অমনি ধরা পড়ে যাবে, আর সবাই ইঁদুর-পেটা করে তোমাকে মেরে ফেলবে, সেই ভয়।

লোকটা ঘাড় কাত করে এক বার তাকাল শুভার দিকে। শুভার মনে হল, লোকটার মুখটা কী রকম বদলে গিয়েছে। ঠিক এরকম মুখ এক বারও দেখেনি। রাগ বা গম্ভীর না, একটা অন্যরকম ভাব। যেটা ও বুঝতে পারে না, কিন্তু ওর বুকের মধ্যে, বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো একটা চমক লেগে যায়। ভয়ে ওর শিরদাঁড়ার কাছটা কী রকম শিরশিরিয়ে ওঠে।

লোকটা বলে, স্টিলের আলমারিটা খুলুন।

 শুভা বলে, খোলাই আছে।

ওর গলায় আর তেমন ঝাঁজ নেই। লোকটা মুখ ফিরিয়ে নেয়। শুভার নতুন করে সন্দেহ বাড়তে থাকে। লোকটা কি খালি সেই জিনিসটাই নিতে এসেছে। নাকি আর কোনও মতলবে। চাউনিটা যেন কী রকম বিচ্ছিরি লাগল। শুভার গা-টা এখনও যেন ছমছম করছে।

লোকটা আলমারিটা খুলে, তন্ন তন্ন করে দেখল। হাত দিয়ে যত দেখে, তার চেয়ে চোখ দিয়ে, অনেক তাড়াতাড়ি দেখে নেয়। আলমারিটাতে শুভার জামাকাপড়, ব্যবহারের দু-চারটে অন্যান্য জিনিস ছাড়া কিছুই নেই। আলমারিটা দেখা হয়ে যেতেই, এ ঘরের খাটের বিছানা উলটে, বালিশের তলা, সবই দেখল। তারপরে ডাক দেয়, আসুন, বাথরুমে আসুন।

বাথরুমে?

হ্যাঁ।

কেন?

ও লোকটার চোখের দিকে প্রায় ভয়ার্ত জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। লোকটা তা লক্ষ না করে বলে, বললাম তো, আপনাকে দূরে রাখলে চলবে না। আপনি বাথরুমে দাঁড়ান, আমি একটু দেখে নিই।

শুভা তবু খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এক বার ভাবে, বলে দেয় কোথায় আছে জিনিসটা। কিন্তু লোকটার কথার মধ্যে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না। ও আবার লোকটার চোখের দিকে তাকায়। তারপর বাথরুমে ঢুকে, দরজার পাশেই দাঁড়ায়।

এখানে বিশেষ কিছু দেখবার জায়গা ছিল না। দু-একটা তাক, একটা ডালা বন্ধ কাঠের বাস্কেট। তাও দেখল সে। তার মধ্যেই দুবার শুভার দিকে দেখে নিয়েছে। আশ্চর্য, এই লোকটাই কি সত্যি গতকাল পাইপ বেয়ে পার হচ্ছিল। আর, শুভাকে নিয়ে তার এত ভয়। আসলে বিশ্বাস করতে পারছে না।

ওরা কেউই কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কোনও কারণও নেই। শুভা যদি পারত, তা হলে নিশ্চয়ই বাথরুমের দরজাটা চকিতে টেনে, বন্ধ করে দিত। কিন্তু ওর সাহসে কুলোল না।

লোকটা বেরিয়ে এল। এ ঘরের চারিদিকে আর এক বার চোখ বুলিয়ে পাশের ঘরে গেল। শুভা মাঝখানের দরজায় দাঁড়াল। লোকটা আর এক বার ঢাউস আলমারিটার পাশে, কোণের দিকে উঁকি দিল। তারপর নিজের মনেই বলল, তা হলে, কী যেন নাম, নরেশ না কী, কালকে রাত্রের সেই মাতালটা, ওর হাতেই পড়েছে। আর এতক্ষণে, পুলিশের কাছে হয়তো জমাও দিয়েছে। এবার আপনাকেই ধরবে। পুলিশ এলে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

শুভা আবার ভয়ের কথা ভুলে যায়। বলে, আমাকে?

 লোকটা একটা চিরুনি বের করে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, হ্যাঁ। নরেশবাবু তো সবসময় বাড়ি থাকে না। ওটা কী করে এ ঘরে এল, জিজ্ঞেস করবে না? আপনিই তো সব সময় এই ফ্ল্যাটে থাকেন। কিছু একটা হলে, আপনার জানবার কথা।

শুভা কোনও জবাব দিতে পারল না। কথাটা সেদিক থেকে একেবারে মিথ্যে নয়। যদিও ওর সে ভয় নেই। নরেশ কোনওদিনই সে জিনিসটা দেখতে পাবে না, জানতেও পারবে না।

লোকটা পুলওভারটা টেনে টেনে বলে, তবে, আমি এসে খুঁজে গেছি, এ কথা বললেও আমার কিছু যাবে আসবে না। আচ্ছা, চলি।

লোকটা শুভাকে অবাক করে দিয়ে, সত্যি দরজার কাছে গিয়ে, ছিটকিনিতে হাত দেয়। শুভার মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে যায়, এমন কী জিনিস সেটা, যার জন্যে পুলিশ পর্যন্ত এসে পড়বে?

লোকটা ফিরে বলে, বললাম তো কী জিনিস।

কী হয় ওটা দিয়ে?

 চিচিং ফাঁক।

বলতে বলতে, লোকটার ঠোঁটের কোণে যেন একটু হাসির রেখার ঝিলিক দেখা যায়। হাতের ভঙ্গিতে চাবি ঘোরাবার মতো করে বলে, সব রকমের তালা-চাবি খোলা যায়। সবাই তাই বলে পারে না। হাতের গুণ থাকা চাই।

শুভা বলে ওঠে, চোরের হাতের গুণ।

লোকটা ঘাড় নেড়ে বলে, হুম।

 শুভা আবার বলে, কাল রাত্রেই জানতাম, তুমি একটা চোর।

তবু নরেশবাবুকে বললেন না কেন?

সে অবস্থা থাকলে, নিশ্চয়ই বলতাম। তোমার হাতে ছুরি ছিল। বললে তুমি কী করতে, তা জানি। চোর-ডাকাতদের বিশ্বাস কী।

লোকটা ছিটকিনি খোলবার জন্যে মুখ ফেরাল। হঠাৎ আবার এদিক ফিরে বলে উঠল, আমি চোর। আর নিজে কী?

মানে?

কথাটা বুঝে উঠার আগেই, শুভার গায়ে যেন আগুনের ঝাপটা লেগে যায়। শুধু মুখ নয়, ওর চোখেও রক্ত ছুটে আসে।

লোকটা ছিটকিনি খুলে ফেলল। বেরিয়ে যাবার আগে বলে, মানে, নিজেরই তো ভাল জানা আছে।

লোকটা অদৃশ্য হয়ে যায়। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যায়। শুভা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ওর মাথার মধ্যে যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অসহায় রাগে দাঁতে দাঁত চেপে, ও যেন নিশ্চল পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকে। তারপরে, দুঃসহ প্রতিকারহীন রাগই যেন, একটা অসহ্য কষ্টে পরিণত হতে থাকে। বুকের মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয়। দরজার চৌকাঠ শক্ত করে ধরে। এক সময়ে হঠাৎ ওর শরীরটা কাঁপতে থাকে। মুখে হাত চাপা দিয়ে ধরে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠে।

কতক্ষণ এভাবে কেটে যায়, খেয়াল থাকে না শুভার। এক সময়ে নিজেরই দীর্ঘশ্বাসে, নিজেই চমকে ওঠে, সংবিৎ ফিরে পায়। ও নড়েচড়ে ওঠে। লোকটার কথাগুলো আবার ওর মনে পড়ে। লোকটার ওপর এখন ওর আর তেমন রাগ হয় না। কিন্তু একটা চোর হয়ে, নোকটাও তাকে এভাবে নোংরা ইঙ্গিত করে গেল। তারপর আস্তে আস্তে, নিজের জীবনের ভাবনাই, ওকে আর এক পাথারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

লোকটা চোর বলে হয়তো, শুভার এতখানি লেগেছে। কিন্তু চোর ছাড়াও যে কেউই জানবে, সে-ই তো তাকে এই ইঙ্গিত করবে। ইঙ্গিত কেন, মুখ ফুটেই বলবে। নরেশ তো বলছেই। কোনও কথাই তো তার মুখে আটকায় না।

কিন্তু লোকটা যেন শুধু চোরের মতো কথা বলেনি। চোরেরা কি অমনি করে কথা বলে। লোকটার কথা যেন তার চেয়েও বেশি। কথা বলার ভাব-ভঙ্গি, সবকিছুর মধ্যে একটা অবহেলা, অথচ তীব্রতা। নরেশ চেঁচিয়ে চিৎকার করে যত উত্তেজিত করতে না পারে, লোকটা আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কথা বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি পারে। লোকটা লোকটা বলা ঠিক নয়। একটা ছেলেই, হয়তো শুভার থেকে খুব বেশি বড় হবে না, বা সমবয়সিই। এ ঠিক চোর তো? তা হলে চোর বলাতে এত রাগ কীসের।

শুভারই বা এত রাগ কীসের। চোরকে না হয় চোর বললে রাগ হয়। শুভাও কি তাই। শুভা হাঁটতে হাঁটতে সামনের ঘরের মাঝখানে আসে। আসলে, চোরটা ঠিক চোরের মতো আচরণ করেনি। শুভা যে সব ভয় পেয়েছিল, তার কিছুই ঘটেনি যেন, খুব সহজভাবে এল, গেলও সহজভাবেই। শুধু নিজের প্রয়োজনটা মেটাবার জন্যে।

ওর সহসা খেয়াল হয়, বাইরের দরজাটা খোলা। শুভা তাড়াতাড়ি লাগাতে গিয়ে থমকে যায়। আস্তে আস্তে দরজাটা খোলে। সামনের বারান্দায় আলো জ্বলছে। নিশ্চয়ই নীচের দারোয়ান সন্ধ্যাবেলাতেই জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। শুভা বারান্দায় যায়। সামনের রেলিংয়ের সামনে দাঁড়ালে, নীচে দিয়ে যে রাস্তাটা গেটের দিকে গিয়েছে, সেটা দেখা যায়। গেটের পাশ দিয়ে রাস্তায় নোক-চলাচল করছে, তাও দেখা যায়।

রেলিংয়ের কাছে যেতে গিয়েও, শুভা থমকে যায়। ও তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। দিয়েই ঢাউস আলমারিটার টানা খুলে, সেই অদ্ভুত জিনিসটা বের করে। কী বলছিল যেন লোকটা? চিচিং ফাঁক। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা শুভার কথায় বিশ্বাস করল কেমন করে। শুভা বলল, আর তা-ই মেনে নিল, সত্যি আলমারিটা বন্ধ আছে! চোরের আবার এমন মতিগতি হয় নাকি। তার তো অবিশ্বাস করে, সবই টেনে টেনে দেখা উচিত ছিল।

শুভা লোহার পাতের অদ্ভুত অবয়ব বস্তুটি চোখের সামনে এনে দেখতে থাকে। খুব যে একেবারে মিহি করে কাটা তা নয়। হয়তো লোকটা নিজের হাতেই তৈরি করেছে। এবার শুভার লক্ষ পড়ে, চাবির মতো লম্বা লম্বা তিনটি ডাঁটি ছাড়া, গোল অংশের বাদবাকি ভয়ংকর ধারালো। তেমন করে মারলে দেহের ছোটখাটো অংশ কেটে ফেলা যায়।

কিন্তু এটা দিয়ে কি সত্যি সব রকমের আলমারি আর তালাচাবি খোলা যায়? ভাবতেই, শুভার দৃষ্টি পড়ে নরেশের বিখ্যাত কোম্পানির তৈরি আয়রন সেফে। কৌতূহলিত হয়েও সত্যি এগিয়ে যায় আয়রন সেফের কাছে। তিন দিকের তিনটি চাবিই ভিতরে ঢোকাবার চেষ্টা করে। দুটো ঢুকলই না। একটা খানিকটা ঢুকেই আটকে গেল। শুভা বলে উঠল, মিথ্যুক! চোর!

নিতান্ত কৌতূহল বশেই ও এক বার পরখ করল। তারপরে ধারালো জায়গা, গলার কাছে এক বার ছোঁয়াল। চোখ বুজে চুপ করে রইল। তারপরে নামিয়ে নিয়ে এল। মনে মনে বলল, আমি যদি নরেশের সিন্দুক ভেঙে চুরি করি বা গলা কেটে মরি, কিছুতেই কিছু যায় আসে কী?

ভাবতে ভাবতে ওর চোখে আবার আসন্ন মধ্যরাত্রের সেই অসহায় উদ্বেগ ফুটে ওঠে। আস্তে আস্তে পাশের ঘরে গিয়ে, বিছানায় এলিয়ে পড়ে। হাতে থাকে সেই অদ্ভুত জিনিসটা, যার নাম চিচিং ফাঁক। কিন্তু ওর মন চলে যায় অন্যখানে। বাবা মা ভাই বোন আর–আর তারকা। তারকদা কি সত্যি আর কোনওদিন আসবে!…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *