২. বন্ধ দরজার দিকে তাকাল চার্লি

বন্ধ দরজার দিকে তাকাল চার্লি। তারপর জিভ সরু করে শিষ দিল। প্যান্টের অনেকখানি ভিজেছে। বোতাম খুলে চেন টানলেই চলে না, বেশ কসরৎ করে টেনে খুলতে হয় ওটাকে। রুকস্যাক থেকে আর একটা প্যান্ট বের করে নগ্ন শরীরে গলিয়ে নিল সে। জাঙ্গিয়াটাকে ভেজা প্যান্টের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে কার্পেটের ওপর বসতে বেশ আরাম, হালকা লাগল।

.

মোমবাতির আলোটা স্থির হয়ে আছে। তিরতিরে পাতলা আলো। শীত করছে খুব। বাইরে দমাদম বৃষ্টি ঝরছে। এই ছেলেটা বাঙালি। সন্দেহবাগীশ এরা কেমন যেন। ছেলেটা দরজা বন্ধ করে কী করছে। ওর সঙ্গে গল্প করতে পারলেও তো শীতটা কমত। চার্লি হাসল। শালার কথাবার্তার মধ্যে মালিক মালিক ভাব আছে! রুকস্যাক থেকে কম্বল বের করল সে। কোনাটা ভিজেছে! এখানে যে এত শীত তা কেউ বলেনি। কী দরকার ছিল যে এখানে আসার! শালা মাথায় ভূত চেপে গেল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সূর্যোদয় এখানে হয়। শুনেই বুকের ভেতরটা কিলবিল করে উঠল। জীবনে সে অনেকদিন সূর্য ওঠা দেখেছে। একই ব্যাপার। দিগন্ত থেকে চট করে একটা লাল সূর্য আকাশে উঠে পড়ে। কিন্তু ওরা বলল এখানে নাকি সূর্য ওঠার আগে এক ঘণ্টা জুড়ে নানান কাণ্ড হয়। এখন যা বৃষ্টি হচ্ছে তাতে সেই কাণ্ডটা আদৌ ঘটবে কি না তাতে সন্দেহ। তাহলেই চিত্তির! এত পরিশ্রম এত সময় নষ্ট, ফালতু হয়ে গেল। ব্যাগ থেকে কৌটো বের করল চার্লি। তারপর ঢাকনাটা খুলে দুই আঙুলের ডগায় খানিকটা গুঁড়ো পদার্থ তুলে জিভের তলায় ঢালল। জিন্দেগীতে সে অনেক রকম নেশা করেছে কিন্তু ছোট মালটার জবাব নেই। কোলকাতায় ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে মাত্র পঞ্চাশ টাকায় পেয়েছে সে। এর আগে দুদিন খেয়েছিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে শরীর গরম হয়ে যায়। মাথার ভেতরটা হালকা কারণ কান দুটো দিয়ে সব গরম বের হয়ে যায়। এতে শীত নির্ঘাৎ কম লাগবে। চার্লির গাল জিভ যেন পুড়ছিল। সে জানালার শার্সির দিকে তাকাল। চিরকাল যেটাকে সে অপছন্দ করে এসেছে আজ সেই ভুলটাই করল। আমি পরিশ্রম করব, সময় নষ্ট করব আর ফলটা পাব কিনা তা ভাগ্যের হাতে ঝুলবে? কভি নেহি। ওসব ন্যাকাপনার মধ্যে থাকার কোনো মানে হয় না। হাত মুঠো করে জোরে ঘুষি মারলো চার্লি ঘরের মেঝেতে। কার্পেটে শব্দটা ক্ষইয়ে দিল কিন্তু কার্পেট কাপলো। চার্লি হাসলো। এইটাই ঠিক। হাতে হাতে ফল পাওয়া চাই। মানুষের জীবন এত ছোট যে ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে বসে থাকা মানে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ গাধাটার বন্ধু হওয়া। হায়, সে নিজে ওই কাজটাই শেষ পর্যন্ত করলো! এখন বৃষ্টি যদি না থামে, না খেয়ে শুকিয়ে টলতে টলতে ফিরে যাও! গিয়ে বল, এবার হলো না, ঠিক আছে, নেক্সট টাইম। দুটো পা দুমদাম ছুঁড়লো সে, শালা নেক্সট টাইমের কাঁথায় আগুন।

শরীর সামান্য গরম হয়েছে। কিন্তু কোলকাতায় যে দুবার খেয়েছিল সেরকম নয়। এই ঠাণ্ডার জন্যে রিঅ্যাক্ট করছে না নাকি! চার্লি চোখ বন্ধ করলো। চোখ বন্ধ করলেই শালা সেই বুড়িটা কোত্থেকে ফুড়ুৎ করে চলে আসে। কুঁজো হয়ে হাঁটছে তো হাঁটছেই! আর মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে বলে, ওঃ, চার্লি, মাই বয়!

চার্লি চোয়াল শক্ত করলো। তারপর আর একবার উচ্চারণ করলো, মাম্মি লিভ মি অ্যালোন, প্লিজ। অথচ বুড়ি ছাড়ে না। ঘুম না আসা পর্যন্ত ফিরে আসেই। হর্লেমের রাস্তায় রোজ একবার টহল দেওয়া চাই। বুড়ি ভেবেছিল তার ছেলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে! কমসে কম মেয়র কিংবা ভালো একটা চাকরি করে গুছিয়ে নেবে।

এই ভারতবর্ষে যদি বুড়ি আসত! তুমি কে হে? আমি আমেরিকান! শালা এখানকার একটা ভিখিরিও কথাটা শুনে হাসত। আমেরিকান বলতে এরা বোঝে লাল চামড়ার মানুষ, দুপকেট ভর্তি ডলার। তার রঙচটা জিনসের প্যান্ট এবং ময়লা জামা দেখে মানুষেরা যে চোখে তাকায়, সেটা বুঝতে একটুও অসুবিধে নয় না চার্লির। ভারতবর্ষের এই গরীব কালো মানুষগুলো পর্যন্ত এড়িয়ে চলে। মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে সে পথচলতি ইণ্ডিয়ান ছোকরার মন্তব্য শুনেছে, আফ্রিকান, নিগ্রো।

কেউ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। অবশ্য তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না সে। তবে ভাবতে গেলে খারাপ লাগে। সদর সরাইখানায় জায়গা পেতে তাকে দুঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কিন্তু সেইসময় যে হিপিগুলো এল তারা কিন্তু স্বচ্ছন্দে জায়গা পেয়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার বরাতে যে বাঙ্কটা জুটেছিল তার আশে পাশে ছিল যত ভিখিরিমার্কা হিপিদের ভিড়। দিনরাত গাঁজা খেত তারা আর পয়সা ধার চাইতো। মেয়েগুলো ছিল শুটকো আর ছেলেগুলো পৌরুষত্বহীন। প্রথম রাত্রেই একটা মেয়ে তাকে বলেছিল, হেই ব্ল্যাকি, ডু য়ু ওয়ান্ট মি? ফিফটি রুপিস উইল বি ওকে! মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিল সে। এক ইঞ্চি ময়লা খাবলা খাবলা হয়ে জমে রয়েছে সারা শরীরে। মাথার চুলে কতদিন যে চিরুনি দেয়নি তার ঠিক নেই। দুটো কোটরে বসা চোখ ধকধক করছে। অতদূরে বসে তবু পোশাকের দুর্গন্ধ নাকে আসছে। সে ঠাট্টা করে বলেছিল, আই কান্ট, আই কান্ট।

মেয়েটা তার এক সঙ্গীকে খুঁচিয়ে হেসে উঠেছিল, লুক, অ্যান য়ুজলেজ বুল। রাগে শরীর জ্বলে উঠেছিল। ইচ্ছে করেছিল এক লাফে কাছে গিয়ে মেয়েটার ঘাড় মটকে দিতে। কিন্তু কিছুই করেনি সে। শুধু পাশ ফিরে শুয়েছিল। না, নো মোর ক্রাইম।

দেশ থেকে পালিয়ে আসার তিনদিন আগে সে জীবনে প্রথমবার অপরাধ করেছে। ওয়েল, য়ু মে টেক ইট অ্যাজ অ্যা ক্রাইম। চটপট হাতটা আঘাত করেছিল মেয়েটার ঘাড়ে। চিৎকার করার সময় পায়নি মেয়েটা। কাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে, আর সে পালিয়েছিল, সেফ চোরের মতো তিন দিন লুকিয়ে থাকা। তারপর এই ভাবে ভেসে আসা। মেয়েটা বাঁচল না মরলো সে জানে না। যেভাবে পড়েছিল তাতে মনে হয় না আবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছে। এবং বুড়োটা, সেই বুড়ো সাদা চামড়ার শকুনটা তাকে নিশ্চয়ই খুঁজে বেড়াচ্ছে। পুলিশমহলে ভালো যোগাযোগ আছে লোকটার। কিন্তু মেয়েটাকে আঘাত করার বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না তার। যে ডিপার্টমেন্টাল সেন্টারে সে কাজ করতো মেয়েটা থাকতো তার ঠিক ওপরে। সুন্দরী, ছিমছাম এবং ছোটখাটো মেয়ে। হাসত চমৎকার। বাড়িওয়ালা ছিল স্টোরের মালিক ওই শকুনটা। মেয়েটার বাপ মা থাকতো জর্জিয়ায়। বুড়োর নজর ছিল মেয়েটার ওপর আর মেয়েটার তার। প্রথম প্রথম সে এড়িয়ে চলেছিল। এই চাহনিতে তো অনেকখানি ভালবাসা ছিল। অন্তত তাই তখন মনে হয়েছিল। অথচ সবটাই যে খেলা, একটা শরীরকে নাচিয়ে আনন্দ পাওয়া, একটা মনকে এলোমেলো করে দূরে বসে মজা দেখা, এসব বুঝতে সময় লেগেছিল তার। যখন বুঝেছিল তখন–

চার্লি থুতু ফেলতে গিয়ে দেখলো তার জিভ শুকিয়ে গেছে। এই গুঁড়োটা যেন শরীরের সব জল শুষে নেয় কিন্তু তেষ্টা পায় না। সাদা চামড়ার মেয়েদের সে চিরজীবন এড়িয়ে এসেছে। দূর থেকে দেখেছে কিন্তু কাছে ঘেঁষেনি। অথচ কি কাণ্ড, সেই ভুলটাই করে বসল সে। আমেরিকা থেকে আসার আগে ভেবেছিল পুলিশ তাকে আটকাবে। খুব ভয়ে ভয়ে ছিল কিন্তু কিছুই হলো না। কেন হলো না সেটাই সে বুঝতে পারে না। প্রায়ই মনে হয় একটা চিঠি লিখবে বুড়িকে মাম্মি, আমার জন্যে পুলিশ কি শানিয়ে বসে আছে? কিন্তু লেখার ইচ্ছেটা শেষ পর্যন্ত থাকে না।

ভারতবর্ষে এসে তার ভালো লেগেছিল, কালো চামড়ার দেশ। একমাত্র হিপি আর খুব বড়লোক ছাড়া সাদা চামড়ার মেয়েদের চোখে পড়ে না। কিন্তু যতক্ষণ তোমার পকেটে টাকা তুমি এখানে খাতির পাবে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পা দিতেই দালালগুলো ছেঁকে ধরতো তাকে। গার্লস গার্লস অ্যাণ্ড গার্লস। এবং যেখানে একটা নতুন জেনারেশনকে দেখতে পেল সে। অ্যান্ড নো ইন্ডিয়ানস। হোয়াইটস গার্ল অথচ হোয়াইট নয়। এরা আবার অন্য ভারতীয়দের থেকে আলাদা। ঢং দেখে মনে হতো যেন সোজা লণ্ডন কিংবা ন্যুয়র্ক থেকে নেমেছে। এদের দেখে উদাস চোখে তাকাত চার্লি।

সেদিন খুব মেঘ করেছিল। কোলকাতাটা তার পুরোটাই দেখা হয়ে গিয়েছে। এখানে সাধারণ মানুষ জন্তুর মতো বাস করে কিন্তু তাতেই বেশ আরাম পায়। পায়ে হেঁটে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। সে। লক্ষ্য করেছে যেই সে নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ায় ঢুকতো অমনি একদল বাচ্চা তার পিছু নিত। তাদের ভাষা সে জানে না কিন্তু হাসি এবং হল্লা শুনে বুঝতে অসুবিধে হতো না সেটা টিটকিরি। ওই কালো বাচ্চাগুলো কেন যে তাকে টিটকিরি দিত সে বুঝে উঠতে পারে না। একদিন একটা ট্রামে উঠে দ্যাখে বেশ ভিড়। কিন্তু একজন মহিলা বসে আছেন এবং তার পাশের আসন খালি, সেখানে কেউ বসছে না। মহিলা মধ্যবয়সী এবং মোটাসোটা। চার্লির পা ব্যথা করছিল, সে এক্সকিউজ মি বলে সেই আসনটিতে বসতেই মহিলা যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে লাফিয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো হো হো করে হেসে উঠল। চার্লি অবাক হয়ে দেখলো মহিলা নামলেন না, কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার মুখ চোখে ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। চার্লির বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার বিশাল শরীর, কালো রঙকে মহিলা অপছন্দ করেছেন। কিন্তু মহিলার গায়ের রঙ তো ফর্সার ধারেকাছে নয়।

সেদিন সেই মেঘের সন্ধ্যায় সে পার্ক স্ট্রিট দিয়ে হাঁটছিল। এই জায়গাটার সঙ্গে কোলকাতার চরিত্রের কোনো মিল নেই। এই সময় দালালটা তার পেছনে লেগে শোনাল, ইন্ডিয়ান গার্লস স্যার, ভেরি চিপ। ব্ল্যাক সুইট গার্লস।

চার্লি দাঁড়িয়ে গেল। এইরকম বর্ণনা সে কখনও শোনেনি। বিশাল লম্বাটে বাড়ির দোতলায় তাকে নিয়ে গেল দালালটা। যাওয়ার সময় বলেছিল, হান্ড্রেড রুপিস স্যার, চিপ ভেরি চিপ। মেয়েটি ইন্ডিয়ান, গায়ের রঙ কালো, জীনসের প্যান্ট আর শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। চার্লিকে দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে দালালটাকে ভারতীয় ভাষায় কিছু জিজ্ঞাসা করে মাথা নাড়তেই দালালটা বললে, স্যর, ইউ আর ভেরি বিগ। টু হান্ড্রেড স্যার, টু হান্ড্রেড।

এক ঝটকায় দালালটাকে সরিয়ে সে নিচে নেমে আসতেই হাসি শুনতে পেয়েছিল। মেয়েরা খিলখিল করে হাসছে। আর এই প্রচণ্ড শীতে, পাহাড়ের নির্জনে মোমবাতির আলোয় বসে চার্লি চোখ বন্ধ করল। আই অ্যাম টু বিগ, আমি খুব কালো। ওয়েল, এতে আমার কি হাত ছিল? কাঁধ-ঝাঁকাল চার্লি। তারপর জিভে একটা শব্দ করে চোখ বন্ধ করতেই বুড়ি এসে গেল। সে মনে মনে আদুরে গলায় বুড়িকে বলল, লিশন মাম্মি, আই অ্যাম গোয়িং টু ফেস গড টুমরো। ঠিক তোমার ভগবান নয় আবার অল দি সেম। ওরা বলেছে সকালে সূর্য ওঠার আগে এখানকার পাহাড়ে পাহাড়ে আর আকাশের গায়ে যে কারবার হয় তাতে ঈশ্বর দর্শন ঘটে। মাম্মি, আই উইল আস্ক দ্যাট বাস্টার্ড কেন সে মানুষের চামড়ার রঙ আলাদা করেছে। কেন শালা একজন সব সুখ ভোগ করবে আর একজন তাই চেয়ে দেখবে। চার্লি চোখ খুলে শিষ দিল। তার খুব প্রিয় সুর। এই সুরটা তার বুড়ি মা খুব ভালবাসত। রুকস্যাকে হেলান দিয়ে চার্লি সুরটা নিয়ে খেলা করতে লাগল।

.

বন্ধ পাল্লায় পিঠ দিয়ে এবার পার্থর খানিকটা স্বস্তি হলো। শুধু ছিটকিনি নয়, হুড়কোটাও তুলে দিল সে। যা বিশাল চেহারা এই একে ঠিক ভরসা নেই। সে হ্যান্ডেলটাকে দরজার পাশে এমনভাবে রেখে দিল যাতে প্রয়োজনেই ব্যবহার করা যায়। ফায়ার প্লেসের আগুন এখন টিম টিম করছে। মোমবাতি নেই সুতরাং ওটাকে বাড়ানো দরকার। যদিও সারা ঘরে একটা গরম লালচে আভা ছড়িয়ে আছে। পার্থ আরও দুটো কাঠ আগুনের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বিছানার দিকে তাকাতেই দুটো চোখ দেখতে পেল। আপাদ-চিবুক কম্বলে ঢেকে অ্যান তার দিকে তাকিয়ে আছে। ও দ্রুত উঠে এল খাটের ওপর। তারপর খুব নিচু গলায় বলল, একটা লোক এসেছে, বিশাল চেহারা, নিগ্রো!

শেষ শব্দটা শোনামাত্র অ্যানের চোখ কুঁচকে গেল, কপালে ভাঁজ পড়ল। চট করে উঠে বসলো সে, আফ্রিকান? এই অভিব্যক্তির সঠিক অর্থ ধরতে পারলো না পার্থ। আমেরিকান বললে আবার দেশওয়ালীর অনুভূতি বেড়ে না যায়। কিন্তু সত্যি কথাটা না বলে পারলো না সে। অ্যানের ঠোঁটে একটু একটু করে হাসি ফুটল, আমার জীবনের প্রথম পুরুষ একজন নিগ্রো, তুমি যা শুনতে চাইছিলে।

কোনো কারণ নেই তবু পার্থর মনে হলো পাশের ঘরের লোকটাকে ঢুকতে দেওয়া উচিত হয়নি। লোকটা যেন সব ব্যাপারে তাকে টেক্কা মেরে যেতে পারে। সে একটু জড়ানো গলায় বললো, এর নাম চার্লি, তার কী ছিল?

এবার হেসে ফেললো অ্যান, তুমি সত্যিই শিশু। এখন আর তার নাম দিয়ে কী হবে, চার্লি টম ডিক একটা হলেই হলো। ও কী করছে?

আস্তে কথা বলো! লোকটা সুবিধের নয়। শুধু তুমি বললে বলে ওকে ঢুকতে দিয়েছি। ওর চেহারা গুণ্ডার মতন, কথাবার্তা খুব চোয়াড়ে। আমি চাই না যে ও তোমার অস্তিত্ব টের পাক। ওই চেহারাকে আমি কখনই বিশ্বাস করি না। চাপা গলায় বলছিল পার্থ।

হাসি চাপতে গিয়েও পারল না অ্যান। শব্দটা ছিটকে বেরিয়ে এল। চমকে উঠে পার্থ হাত বাড়াল ওর মুখ চাপা দিতে। কিন্তু ততক্ষণে সামলে নিয়েছে অ্যান। ফিসফিস স্বরে বললো, তুমি খুব জেলাস। কিন্তু আমার জন্যে তুমি এত ভাবছ কেন? আমার কাছে তুমি যা ও তাই। যাক, ছেড়ে দাও এসব কথা। একটা লোকের চেহারা বিশাল হওয়া মানে সে খারাপ হবে এই যুক্তি ঠিক নয়। যে আমাকে রেপ করেছিল সে ছিল খুব রোগা, আমার চেয়েও।

পার্থ নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল অ্যান ঠিকই বলেছে। সত্যি কথাই, চার্লির সঙ্গে তার পার্থক্য ওর কাছে কিছুই থাকতে পারে না। এক সে জায়গা দিয়েছে আর তার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওকে চার্লির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা ভালো লাগছিল না পার্থর। কিছুক্ষণ এক ঘরে থেকে কি তার মনে অধিকার-বোধ জন্মে গেছে। অতএব সে ঘাড় নাড়ল, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ তখন ঠিক আছে। কিন্তু লোকটা যদি একটা বেড়ালও হতো তবু আমি অপছন্দ করতাম। খামোকা আমাদের প্রাইভেসিটাকে ও নষ্ট করল।

অ্যান ধীরে ধীরে বালিশে মাথা রাখল, পৃথিবীর সমস্ত পুরুষই এক ধাতুতে গড়া। ও কেন এসেছে? সূর্য দেখতে তো? তাহলে আমরা তিনজনেই তীর্থযাত্রী। অতএব রাগ কোরো না।

পার্থ কম্বল দুটোকে শরীরের ওপর টেনে নিয়ে কাত হয়ে শুয়ে একটা হাত খুব আলতো করে অ্যানের পেটের ওপর রাখল। যদিও হাতের তলায় কম্বল এবং পোশাকের স্তর তবু ওর শরীরে একটা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছিল। সে কোনোরকমে বলল বলো।

অ্যানের বোধহয় আর কথা বলতে ভালো লাগছিল না। সে ক্লান্ত গলায় বলল, কী আর বলব!

তোমার কথা, তোমার সব কথা। ক্রমশ পার্থর ডান হাত অ্যানকে বৃত্তের মতো ঘিরে ফেলছিল। অ্যান হাসল, এভাবে কথা বলা যায় না! তাছাড়া আমার পেটে লাগছে, হাতটা সরাও। কথাটা শেষ হয়ে আসামাত্র পার্থর হাত ছেঁড়া দড়ির মতো আলগা হয়ে যাচ্ছিল। এখন দুজনেই পাশাপাশি নিঃস্বার্থ শুয়ে। পার্থর মনে হচ্ছিল সে খুব ভুল করছে। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। অ্যানের ওপর অনেক আগেই তার জোর খাটানো উচিত ছিল। এবং সেটা করার এখনও সময় যায়নি। আর তখনই ডিমঘরে বেশ জোরে শব্দ হলো। ওটা কাশি কিংবা হাঁচি হতে পারে কিন্তু পার্থর নার্ভে চড়াং করে উঠল। সে উঠে বসল। তখনই অ্যান চোখ বন্ধ করে বলল, আমার তখন মাত্র পনেরো বছর বয়স।

প্রসারিত দুই হাতকে কোনোরকমে সংযত করল পার্থ। তার ফ্যাসফেসে গলায় শব্দ উঠল, পনেরো?

চোখ খুলল, অ্যান, খুলে হাসল, চৌদ্দ বছর দশ মাস। একটু আগে ভাগেই ঈশ্বর আমার শরীরে মেয়েলি সম্পত্তি চালান করেছিলেন। ফলে সমবয়সী ছেলেরা আমার দিকে চকচকে চোখে তাকাত। আমার মা ছিলেন খুব রক্ষণশীল। অন্যান্য মেয়েরা যখন শরীর দেখানো পোশাক পরত তখন আমার হাঁটুও কেউ দেখতে পায়নি। মা আমাকে অহরহ বলতেন মেয়েদের সবসময় পুরুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা উচিত। একমাত্র স্বামী ছাড়া কোনো পুরুষ মেয়েদের আপন নয়, এইসব। আর এসব কথা শুনতে শুনতে হয়তো বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম কারণ আমার কোনো ছেলেবন্ধু ছিল না। আমার মেয়ে বন্ধুদের যখন প্রেম দেওয়া নেওয়া শুরু হয়ে গেছে তখন আমি ছিলাম একদম একা! সেই সময় আমরা একবার আমার মায়ের মামার বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। নির্জন গ্রামের বাড়িতে আমার দাদু এবং দিদিমা ছাড়া ছিল তিন-চারজন ঝি-চাকর। চাষবাস আর খামার দেখতো এক বৃদ্ধ নিগ্রো। ঝি-চাকররাও ছিল তাই। এখানে যাওয়ার পর আমার বেশ স্বাধীনতা মিলল। আমি একা একা সারাদিন ঘুরে বেড়াতে পারতাম। ফলের বাগান, চাষের খেত এমন কি পাশের বনের ভেতরে চলে যেতাম। মাকে দিদিমা বলতেন ওখানে কোনো ভয় নেই। তাছাড়া পুরুষ মানুষও ওইসব অঞ্চলে বেশি নেই। চাকরবাকরদের মা ঠিক পুরুষ বলে ভাবতে চাইত না। একদিন বিকেলে এক বনে বেড়াচ্ছি হঠাৎ মনে হলো একটা ঘন ঝোপের আড়াল সরিয়ে এগিয়ে দেখি একটা নিগ্রো ছেলে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। তার শরীরে একটাও পোশাক নেই। কুড়ি বাইশ বছরের একটি যুবতী নিগ্রো তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমাকে দেখামাত্র মেয়েটি যেন আঁতকে উঠলো। প্রচন্ড ভয় ওর চোখে মুখে ফুটে উঠল। আমি ওকে চিনতে না পারলেও বুঝতে পারলাম সে আমার দাদুর কাছেই কাজ করে। মেয়েটা এত ভয় পেয়েছিল যে হাত বাড়িয়ে তার পোশাক তুলে নিয়ে নিঃশব্দে দৌড়ে গেল উল্টোদিকে। আমি তার শরীরটাকে বনের আড়ালে মিলিয়ে যেতে দেখলাম। ও যে ভয় পেয়েছে এটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কিন্তু কেন ভয় পেল তাই ঠাওর করতে পারছিলাম না। ওরা নিশ্চয়ই অন্যায় কাজ করছিল যা কালো চামড়াদের করতে নেই। কিন্তু এসব ভাবনার সঙ্গে আমার মনে হয়েছিল ওই মেয়েটির শরীরের গঠন খুব সুন্দর, কিন্তু এই ছেলেটির মতো নয়। ওর কালো চামড়ায় রোদের আভা পড়ায় কেমন নীলচে জেল্লা বের হচ্ছিল। মেয়েটির হঠাৎ উঠে যাওয়া টের পেতে ছেলেটির সময় লাগল। উপুড় হওয়া অবস্থায় ও কিছু একটা বলে ডাকল। আমার মনে হলো এই মুহূর্তেই ওই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু কেন জানি না আমি এক পা নড়তে পারলাম না। দু-তিনবার ডেকে খুব অবাক হয়ে ছেলেটি উঠে বসল। এবং তখনই সে আমাকে দেখতে পেল। অদ্ভুত অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো ওর মুখে। না, শুধু ভয় নয় সেইসঙ্গে আরও কিছু। আমি বোকার মতো বলেছিলাম, ও চলে গিয়েছে। ছেলেটা যেন তাতে আরও অবাক হলো। ডানদিকে, বোধহয় মেয়েটির যাওয়ার পথ অনুমান করে সে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। আমি দেখলাম ছেলেটি সত্যি খুব রোগা কিন্তু ওর মধ্যে কি একরকম কাঠিন্য ছড়ানো। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। আমার চেয়ে অনেক লম্বা। কিন্তু তার পুরুষাঙ্গ এত উদ্ধত যে আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকার কানে যাওয়ামাত্র সে লাফ দিল। এক হাতে আমার মুখ বন্ধ করে পাগলের মতো আমাকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করলো। আমি দুহাতে তাকে বাধার দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রোগা শরীরেও অত জোর সে কী করে পেল জানি না, আমি হেরে গেলাম। ছেলেটিও আমাকে ধর্ষণ করল। যে মুহূর্তে ও আনন্দ খুঁজছিল সেই মুহূর্তে আমি নিঃশব্দে কাঁদছিলাম। আমি জানি ও আনন্দ পায়নি। হয়তো ওর প্রেমিকার কাছে যে আনন্দ পাওয়ার জন্যে উন্মুখ ছিল তা আমার জন্যে পায়নি বলে প্রতিশোধ নিয়ে গেল। কিন্তু আমার মা যা পারেননি ছেলেটা তাই পারল। পুরুষ মানুষের সম্পর্কে এক ধরনের বিতৃষ্ণা ও আমার মনের গায়ে খোদাই করে দিয়ে গেল। অ্যান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর একটা হাত কপালের ওপর রেখে বললো, কতক্ষণ যে ওভাবে পড়েছিলাম জানি না। হয়তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরল যখন তখন দেখি সেই মেয়েটি আমার পাশে বসে। ছেলেটি নেই। আমার জামাকাপড় বিন্যস্ত। মেয়েটিকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু জ্ঞান ফেরামাত্র সে আমার পায়ের ওপর মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ব্যাপারটা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল। ক্রমশ, আমার জন্যে নয়, মেয়েটার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছিল। বাড়িতে বললাম পড়ে গিয়ে পায়ে লেগেছে। কেন মিথ্যে কথা বলেছিলাম, কেন সবাইকে ডেকে সত্যি কথা বলে ছেলেটিকে চিনিয়ে দেবার চেষ্টা করিনি তা জানি না। মেয়েটি কিন্তু আমাকে সেই অনুরোধ করেনি একবারও। পরে মনে হয়েছে একটি পুরুষাঙ্গের আঘাত মেয়েদের শরীরের গোপন জায়গায় যে অনুরণন সৃষ্টি করে তা তার মনের বয়স অনেক বাড়িয়ে দেয়। অনেক না বোঝা জিনিস বুঝতে এক লহমা দেরি হয় না তার। আমারও বোধহয় তাই হয়েছিল। না হলে একদিনে আমি অত বড় হয়ে গেলাম কেন? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সব বীজ ফসল বহন করে না। তাই আমি বেঁচে গেলাম। সেই রাত্রে ঠিক এইরকম ঝড় উঠেছিল আকাশ কাঁপিয়ে।

অ্যানের কথাগুলো হাঁ করে গিলছিল পার্থ। শেষ হওয়ামাত্র বললো, ছেলেটিকে আর দ্যাখোনি?

দেখেছি! তবে অন্য চেহারায়, নানান জায়গায়। সাদা চামড়াতেও। এই সময় ডিমঘরে পায়ের শব্দ উঠল। দরজার কাছে এসে চার্লি ডাকল হেই মিস্টার!

গলাটা এমন আচমকা কানে এল যে ত্ৰস্তে পার্থ অ্যানের মুখে হাত চাপা দিল। ইঙ্গিতে ওকে কথা না বলতে বলে ও শোওয়ার চেষ্টা করল। মনে মনে বললো, শালা!

হেই মিস্টার! দরজায় আলতো শব্দ হলো, মিস্টার পাতরো!

ফিসফিসিয়ে অ্যান বললো, ও কিছু চাইছে। সাড়া দাও নইলে থামবে না।

ইচ্ছে ছিল না কিন্তু পার্থর মনে হলো কথাটা ঠিক। সে চিৎকার করলো কী চাও?

প্লিজ দরজাটা একবার খোলো। প্লিজ। চার্লির গলায় অনুবোধ।

কী দরকার তোমার? তখনই বলেছি আমাকে বিরক্ত করবে না।

আর করব না। তুমি কি খাটে শুয়েছ?

হ্যাঁ।

 কম্বলের তলায়?

অনেক কম্বল কি তোমার কাছে আছে? হেই মিস্টার, প্লিজ!

কেন, তাতে তোমার কী দরকার? শিরা ফুলিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল পার্থ।

আমি এই ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারছি না। আমার স্লিপিং ব্যাগ ভিজে গেছে। প্লিজ হেই মিস্টার।

পার্থ অ্যানের দিকে তাকাল। অ্যান বললো, ফিসফিসিয়ে, যেভাবে কথা বললে শুধু নিজেই শোনা যায়, লোকটা খুব কষ্ট পাচ্ছে মনে হচ্ছে।

মুখ ফেরাল পার্থ। একটু আগে যে মেয়ে তার জীবনের সবচেয়ে করুণ অভিজ্ঞতার জন্যে একটা নিগ্রোকে দায়ী করেছিল সেই আবার একটা নিগ্রো কষ্ট পাচ্ছে বলে অনুভব করছে! পার্থ চাপা গলায় বলল, আমি কী করব? আমার চারটের বেশি কম্বল নেই। ওকে একটা দিলে আমারই রাত্রে ঘুম হবে না ঠান্ডায়। নিজেকে কষ্ট দিয়ে আমি দান করতে চাই না।

অ্যান হাসল, এ ঘরে তো মোটেই ঠান্ডা নেই। যতক্ষণ ফায়ারপ্লেস জ্বলছে ততক্ষণ আমাদের কোনো কষ্ট হবে না। বেচারা তো সূর্য দেখতে এসেছে।

বেমালুম মিথ্যে কথা বলল পার্থ, যখন আর জ্বালাবার মতো কাঠ থাকবে না তখন?

ওঃ, তোমরা বড্ড ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে অনিশ্চিত করে তোল। ঠিক আছে, তুমি আমার কম্বল শেয়ার করতে পার তেমন প্রয়োজন হলে।

সমস্ত শরীরে যেন প্লাবন বয়ে গেল। এখন যদিও পাশাপাশি শুয়ে কিন্তু আলাদা কম্বলের পাতলা আড়াল একটু একটু করে কঠিন ইস্পাতের চেহারা নিচ্ছিল। অ্যানের জীবনের ওই ঘটনাটা শোনার পর সেই আড়াল সরাবার ক্ষমতা তার আসত কিনা সন্দেহ। কিন্তু দুটো শরীর যদি এক কম্বলের তলায় থাকে–ও ভগবান, তুমি কি দয়াময়। দ্রুত খাট থেকে নেমে একটা কম্বলে শরীর জড়িয়ে নিল পার্থ। তারপর অন্য কম্বলটাকে হাতে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করলো, এই যে চার্লি, তুমি শুনতে পাচ্ছ?

ডিমঘর থেকে আওয়াজ ভেসে এল, হ্যাঁ, কিন্তু এখানে ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা।

ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি কিন্তু একটা শর্তে। তুমি ঘরের কোণে গিয়ে চুপ করে বসো। পার্থ দরজার গায়ে হাত দিল।

কেন? আমি বসতে পারছি না। এত ঠাণ্ডায় বসা যায় না। তাছাড়া ও কোনায় আমাকে তুমি বসতে বলছো কেন? তুমি কি ভাবছ আমি জোর করে ঢুকে তোমার খাটে শুয়ে পড়ব?

অমি কিছুই ভাবছি না। শুধু তুমি দরজা থেকে দূরে সরে থাকো। আমি তোমায় জায়গা দিয়েছি, আশা করি তুমি আমার এই অনুরোধ রাখবে। তুমি কি সরে গিয়েছ? পার্থ কথাগুলো বলার সময় বুঝতে পারছিল এতে চার্লির সন্দেহ বাড়তে পারে। কিন্তু সে নিরুপায়। আজকের রাতটা কেটে যাওয়ার পর ও যদি অ্যানের অস্তিত্ব জানতে পারে তাহলে বয়েই গেল। ওপাশের দরজা থেকে দুটো পায়ের শব্দ দূরে চলে গেল। তারপরে যে গলাটা পার্থ শুনল সেটায় বোঝাল চার্লি কথা রেখেছে। খুব সন্তর্পণে দরজা খুলে পার্থ মুখ বের করল। চার্লি এখন সেই কোণে স্লিপিং ব্যাগের ওপর বসে আছে বাবু হয়ে। অতবড় শরীটাকে কি অসহায় দেখাচ্ছে। কম্বলটা ছুঁড়ে দিল পার্থ ওর গায়ে। দুহাতে লুফে নিয়ে সেটাকে সমস্ত শরীরে জড়িয়ে চার্লি বলে উঠল, থ্যাঙ্কু, থ্যাঙ্কু, আঃ কি আরাম। তারপরই নাক টানল, মেয়েদের বুকের মতো গরম।

ও যে গন্ধ বলল না তাতে পার্থ খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো। সে গম্ভীর মুখে বলল, আশা করি আর আমাকে বিরক্ত করবে না। আমি বারবার বিছানা ছেড়ে উঠতে চাই না।

কম্বলের একটা অংশ চটপট স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে শীত এড়াবার ব্যবস্থা করছিল চার্লি, না। আর তোমাকে ডাকব না। ইটস টেরিবল কোল্ড। ওরা আমাকে ব্লাফ দিয়েছে। ইয়ুথ হোস্টেল না ছাই! তারপর সেখানে আরাম করে বসে বলল, কিন্তু মুশকিল হলো, আমার প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেছে। আমার সঙ্গে যা ছিল বৃষ্টির জলে সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আঙুল দিয়ে একটা ভেজা প্যাকেট দেখালো চার্লি, তোমার কাছে খাবার আছে?

কথাটা শোনামাত্র মাথার ভেতর চট করে বুদ্ধিটা খেলে গেল। এই লোকটার যা শরীর তাতে অল্পস্বল্প কষ্ট সহ্য করা এর কাছে কিছু নয়। একে যদি রাজি করানো যায় তাহলে নিজেদেরও প্রয়োজন মেটে। কিন্তু এই আবহাওয়ায় কোনো মানুষ বাইরে বের হতে চাইবে না। তাছাড়া মনে হচ্ছে এর ঠাণ্ডাটা একটু বেশি। সে নিজে অবশ্য ওখানে ওইভাবে বসে থাকলে মরে যেত। সে একটু চিন্তার ভান করে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে? অনেকক্ষণ না খেয়ে আছ?

তোমার কাছে তাহলে খাবার আছে! চার্লির মুখ চোখে উল্লাস। সে উঠে দাঁড়াতে যেতেই পার্থ চিৎকার করলো, না, একদম উঠবে না, চুপ করে বসো!

খুব অবাক হয়ে গেল চার্লি। তারপর বাধ্য ছেলের মতো স্লিপিং ব্যাগের ওপর বসে পড়ে বললো, তুমি আমাকে শত্রু বলে মনে করছ কেন? আমরা বন্ধুর মতো কথা বলতে পারি। বিশেষ করে আমরা দুজনেই যখন কালো মানুষ।

কালো মানুষ! পার্থ চার্লির মুখের দিকে তাকাল। স্প্রিং-এর মতো চুলগুলো মৌমাছির চাক হয়ে রয়েছে। চামড়া থেকে অজস্র কালো পিচ যেন অনবরত গলে পড়ছে। এই লোকটা ওকে দলে টানতে চাইছে। তার নিজের গায়ের রঙ একসময় দুধে আলতায় মেশানো ছিল। রোদে পুড়ে সামান্য তামাটে হলেও যে কোনো বাঙালি বলবে সে ফরসা। আর এই নিগ্রোটা বেমালুম বলে দিল আমরা দুজনেই কালো! কি আস্পর্ধা। সে আড়ষ্ট হলো। কথাটা ভেতরের ঘরে গেলে হয়তো অ্যানের ব্যবহার পাল্টে যেতে পারে। বিশেষ করে ওর জীবনে একটা কালো লোকের দগদগে স্মৃতি রয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে তর্ক করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। গরিব মানুষেরা কাউকে দলে টানতে চাইলে তাকে গরিব মনে করে খুশি হয়। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্যে পার্থ বলল, আমার কাছে খাবার আছে। তুমি খেতে চাও?

ও সিওর। তুমি লোকটা সত্যিই ভালো। এইরকম দুর্যোগের রাত্রে আমাকে জায়গা দিলে, খাবার দিচ্ছ। আমি তোমাকে চিরকাল মনে রাখব। বিগলিত গলায় বললো চার্লি।

তাহলে তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে। বাংলো থেকে বেরিয়ে খানিকটা নিচে গেলেই তুমি আমার জিপ দেখতে পাবে। জিপের দরজা খুললেই একটা হটবক্স দেখতে পাবে যার ভেতরে প্রচুর লোভনীয় খাবার এখনও গরম রয়েছে।

পার্থর কথা শেষ হওয়ামাত্র আর্তনাদ করে উঠলো চার্লি, তুমি এই ঠাণ্ডায় আমাকে বাইরে যেতে বলছ। ওই বৃষ্টি গায়ে যদি আবার লাগে–! আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে শিউরে উঠল যেন সে।

পার্থ নির্বিকার গলায় বললো, তাহলে আমার কিছুই করার নেই। গুড নাইট। দরজার পাল্লা বন্ধ করতে যেতেই চার্লি চিৎকার করে উঠলো, দাঁড়াও, দাঁড়াও। তোমার ওই ঘরে কি একটুও খাবার নেই? যদি থাকে তাহলে আমাকে আর বাইরে যেতে হয় না।

তোমার সঙ্গে এতক্ষণ রসিকতা করছি বলে যদি মনে করো।

না-না আমি সেকথা বলছি না। তুমি ওভাবে কথা বলছ কেন? ব্রিটিশরা আমাদের সঙ্গে ওই গলায় কথা বলে। যেন আমরা পৃথিবীর দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। কিন্তু তুমি আমি তো আর ব্রিটিশ নই, সাদা চামড়ার লোকও নেই। অলরাইট, আই উইল টেক দ্য চান্স। আমার খুব খিদে পেয়েছে। হয় পেটভরতি খাবার নয় একটা মেয়েছেলে সঙ্গে না থাকলে আমার রাত্রে ঘুম আসে না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল চার্লি। তারপর কাচের দেওয়ালে চোখ রাখল। বৃষ্টি বোধহয় এই মুহূর্তে সামান্য ধরেছে। চার্লির চেহারা খুব করুণ হয়ে উঠল। বোঝা যাচ্ছে যে সে বাইরে পা বাড়াতে সাহস পাচ্ছে না। পার্থ ওর এই সিদ্ধান্তে আবার খুশি হয়েছিল। কিন্তু চার্লির দ্বিধা দেখে সে উৎসাহ দেবার জন্যে বলল, যা খাবার আছে তা তোমার অর্ধেক আর আমার অর্ধেক। খুব ডিলিসিয়াস। তাছাড়া গরম কম্বলও রয়েছে গাড়িতে, ইচ্ছে হলে নিয়ে আসতে পার। তাতে রাত্রে ঘুম খুব আরামদায়ক হবে। আর দেরি করো না, বৃষ্টি কম আছে বেড়িয়ে পড়ো।

এতগুলো পাওয়ার কথা শুনে চার্লি ওয়ারপ্রুফটা পরে নিল। তারপর দরজা খুলে স্প্রিং-এর মতো বেরিয়ে গেল। হাওয়া সমানে চলছে। পার্থ একবার ভাবল এগিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া উচিত, নইলে ঘরটার উত্তাপ জিরো ডিগ্রির নিচে চলে যাবে কিন্তু ঠান্ডার চোটে সে পা বাড়াতে সাহস করল না। মিনিট তিনেক যদি হয় খুব বেশি। বুলেটের মতো ছিটকে ঢুকলো চার্লি। ঢুকেই পা দিয়ে দরজা ভিজিয়ে পিঠ চেপে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো, ও মাই গড! কি ঠান্ডা! কিন্তু আমি এনেছি। উ। এই যে তোমার হটবক্স। মাটিতে সেটাকে নামিয়ে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে হটবক্সটাকে ফের তুলল সে। তারপর থপথপ করে কয়েক পা এগিয়ে সেটা পার্থর সামনে বাড়িয়ে দিল। ছোঁ মেরে হটবক্সটা নিয়ে নিল পার্থ। চার্লি ততক্ষণে শরীর থেকে ওয়াটারপ্রুফ খুলে ফেলেছে। দুটো কম্বল শরীরে মুড়ে স্লিপিং ব্যাগের ওপর শরীর এগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করেছে। পার্থ এই প্রথম কৃতজ্ঞ বোধ করল। চার্লির জায়গায় সে নিজে হলে মরে গেলেও যেত না। ওরকম শরীর বলেই এটা সম্ভব। সে খাবারগুলোকে ঠিক আধাআধি করল। তারপর চার্লির অংশ একটা বাটিতে রেখে ওর সামনে এলিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে উঠল না চার্লি। চোখ বন্ধ করেই নাক টানলো, আঃ, খুব সুন্দর গন্ধ। তোমাদের এই দেশটা অদ্ভুত। সবকিছু সুন্দর। এখানকার প্রকৃতি সুন্দর, মানুষ সুন্দর, খাবার সুন্দর। তোমরা ভাগ্যবান। কিংবা আমরাই ফালতু।

কেন? চার্লির কথা বলার ধরনে এখন বেশ ভালো লাগছে পার্থর। লোকটার চেহারা দেখলে যে আতঙ্ক জাগে, এইসব কথাবার্তা শুনলে সেটা মোটেই থাকে না।

সাদা চামড়ারা তোমাদের দেশে এসে জুড়ে বসেছিল কিন্তু তোমরা তাদের তাড়িয়ে স্বাধীন হয়েছ। আর আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকই বনে গেলাম।

পিচ করে জিভে শব্দ তুলল চার্লি।

সাদা চামড়ার মানুষের ওপর তোমার এত রাগ কেন?

রাগ? তড়াক করে উঠে বসল চার্লি, আমি ওদের ঘেন্না করি। গত রায়েটের সময় ওরা আমার এক বান্ধবীর পরিবারকে কুকুরের মতো পুড়িয়ে মেরেছে। অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন, গ্রেটেস্ট ধাপ্পাবাজ অব অল টাইম। ওই লোকটা যদি সে সময় আমাদের পক্ষ নিয়ে ওদের সঙ্গে সমঝোতায় যেত তাহলে আজ একজন কালো মানুষ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতো। তুমি জানো আমি কে?

আমি তোমাকে এই প্রথম দেখলাম, কী করে জানব বলো!

ওয়েল, আই উইল টেল ইউ। আমি একটা স্কুলে পড়াই। দু বছর পরপর আমি এশিয়াতে চলে আসি, আফ্রিকায় ঘুরে বেড়াই। ছুটি পেলেই আর ওখানে ভালো লাগে না। ওয়েল, আই অ্যাম ব্ল্যাক ম্যান এবং আমি এই জন্যে গর্বিত হতাম যদি আমার রক্তে সাদা চামড়ার স্মৃতি না থাকতো। এইটে ভাবলেই আমার ঘেন্না বেড়ে যায়। চার্লির মুখ বিকৃত হলো।

হটবক্সটা যে তখনও হাতে ধরা তা খেয়ালই নেই পার্থর, বিস্ময়ে সে তাকিয়ে ছিল। চার্লি বললো, আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিল মুল্যাটো।

মুল্যাটো। পার্থ শব্দটার মানে হাতড়ালো, কোথায় যেন এই শব্দটাকে পেয়েছে সে।

ওয়েল, এটা একটা বিরাট গল্প। আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দাকে কিনে এনেছিল একজন হোয়াইটম্যান। লোকটার ছিল বিরাট ব্যবসা। সেইসঙ্গে ক্রীতদাসদের খামার। ভালো চেহারার কালো পুরুষ কিংবা মেয়ে পেলেই কিনে নিত লোকটা। তারপর তাদের দিয়ে সন্তান উৎপাদন করিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিত মোটা দামে। বাপ মায়ের স্বাস্থ্য ভালো হলে সন্তানেরও শরীর ভালো হয়। লোকটা এ বিষয়ে ছিল খুব ওস্তাদ। আমার ঠাকুর্দার ঠাকুমা নামী খুব সুন্দর শরীরের অধিকারিণী ছিলেন। মালিকের এক বন্ধু ওর কাছে রাত কাটাতে এসে সেই কালো মেয়েটিকে ভোগ করেন। এটা নাকি তার ন্যায্য পাওনা ছিল। আর তাতেই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। মেয়েটি যে সন্তান প্রসব করল তার চামড়া ছিল সাদা। একদম সাহেবদের মতো। এমনকী চুলও সেরকম। শুধু পিঠের মাঝখানে এক ইঞ্চি কালো চামড়া গোল হয়ে ছিল। মালিকের কি দুর্মতি হলো, জন্মমাত্রই তাকে সরিয়ে ফেললেন। সেই বাচ্চা সাদা চামড়াদের সঙ্গে সাদা হয়ে বড় হলো। এ খবর মালিক ছাড়া আর কেউ জানতো না। তিনি ওকে দত্তক নিলেন। সাদা চামড়া বলে ক্রীতদাসদের বাজারে তাকে বিক্রি করা যেত না। সাদা চামড়াদের সঙ্গে সাদা সমাজেও ওকে নিজেদের লোক বলে গ্রহণ করা হয়েছিল। এই ছেলেটিও কখনও নিজের ইঞ্চিখানেক কালো চামড়া কাউকে দেখাতো না। তারপর খুব সুন্দরী একটি সাদা মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিলেন মালিক। বিয়ের পর ওর বউ ওকে কখনও নগ্ন অবস্থায় দ্যাখেনি। কিন্তু এদের সন্তান হলো তাকে দেখে সাদারা খেপে উঠলো। বাচ্চাটা ঠিক আমাদের মতো কুচকুচে কালো, মাথার চুল এইরকম। নিজের মাথায় হাত বোলাল চার্লি।

পার্থর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, তারপর?

প্রথমে কেউ কেউ সন্দেহ করেছিল সাদা মেয়েটি হয়তো কোনো কালোর সঙ্গে সন্দেহটা এত মারাত্মক চেহারা নিচ্ছিল যে ছেলেটা বোকামি করে বসল। বোকামি ছাড়া আর কি বলবো একে, ওরা বলে ভালবাসা, লভ। মেয়েটাকে ভালবেসেছিল বলে ছেলেটা প্রতিবাদ করেছিল যে কোনো কালো নয়, সেই সন্তানটির জনক। এবং তার পিঠে কুচকুচে কালো চামড়া আছে। তৎক্ষণাৎ বাচ্চাটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো খামারে আর পাঁচটা কালোর কাছে। আর, তোমরা ভাবতে পারো কী হয়েছিল লোকটার? ওরা ওকে কুকুরের মতো গুলি করে হত্যা করে। আর সেই কালো বাচ্চাটার বংশধর আমি। ভগবানের অসীম দয়া এই যে ওই কালো বাচ্চার ঔরসে কালো সন্তানই জন্মেছে? কে জানে সাদাদের যে রক্ত আমার শরীরে থেকে গেছে তা থেকে আমি বিয়ে করলে আমার সন্তান সাদা হবে কিনা! শুধু এই ভয়ে আমি বিয়ে করছি না। রক্ত ধোওয়া যায় না। নইলে আমি আমার শরীরের সব রক্ত থেকে সাদাদের ভাগটা ধুয়ে ফেলতাম। হঠাৎ একধরনের শব্দ আচমকা বেরিয়ে এল চার্লির শরীর থেকে যাকে আর্তনাদও বলা যায় না আবার কান্না বললেও কম বলা হয়। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে লোকটা। যে খাবারের জন্যে জীবন বিপন্ন করে একটু আগে ছুটে গিয়েছিল সেটা সামনে পড়ে থাকলেও কোনো হুঁশ নেই। আচমকা এক অন্য জগতে চলে গেছে চার্লি।

ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করল পার্থ। পেছন ফিরতেই চমকে উঠল সে, অ্যান বিছানার উপর উঠে বসেছে। কম্বল বুক অবধি টেনে নিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। ও যে চার্লির পুরো গল্পটা শুনেছে তা বুঝতে অসুবিধে হলো না পার্থর। হঠাৎ একধরনের আনন্দ এল মনে, দুই ঘরে পাশাপাশি দুজন সাদা আর কালো রয়েছে। একজনের সতীত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল কোনো কামুক কালো মানুষ আর একজন নিয়ত শরীর থেকে সাদা মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করার জন্যে ছটফট করে। অতএব, এই দুইজন কখনও এক হবে না, অন্তত আজকের রাত্রে যে হবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

পার্থ খাবারের জায়গাটা টেবিলে রেখে ফায়ারপ্লেসের সামনে এগিয়ে গেল। উবু হয়ে দুটো কাঠ গুঁজে দিতে দিতে মনে হলো আরও কাঠ স্টোর থেকে আনা দরকার। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় ওই প্যাসেজে যাওয়া খুবই কষ্টকর। ঠিক তখন অ্যান বলল, মানুষ মানুষকে কত ঘেন্না করে, না?

পার্থ দেখলো অ্যান এখনও বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে অথচ ও কোনকিছু ভালো দেখছে না। কথাটা যেন নিজেকেই শোনাল অ্যান। পার্থর এই ভঙ্গি ভালো লাগলো না। বেশ সমব্যথার সুর গলায়। কী করে সম্ভব তার মাথায় ঢুকছে না। অ্যানের তো ওকে ঘেন্না করা উচিত। সে হটবক্সের দুটো পাত্রে খাবারগুলো ভাগ করে একটা অ্যানের দিকে বাড়িয়ে দিল। ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে অ্যান খাবার দেখে বললো, হোয়াটস দিস?

রোস্ট চিকেন আর পরোটা। খেয়ে দ্যাখো, খুব খারাপ লাগবে না। একটু কম হবে হয়তো, ওই ব্যাটা নিগ্রোটাকে অনেকখানি দিয়ে দিতে হলো যে! পার্থ অ্যানের পাত্রটি ধরিয়ে দিয়ে ওর পাশে আরাম করে বসলো। অ্যান করুণ গলায় বললো, ও এই ঠান্ডায় ভিজে ভিজে এনে দিল, না? খাবারের গন্ধে খিদেটা আরো জোরদার হয়েছিল। কিন্তু এই কথায় ছোট্ট ধাক্কা খেলা পার্থ, তুমি কি ওই কালোটার ওপর সহানুভূতিশীল হচ্ছ?

অ্যান হাসলো, তুমিও ওকে কালো ভাবো তাই না? যাক, ছেড়ে দাও এইসব কথা। আসলে লোকটা এমন আন্তরিক গলায় কথা বলছিল যে–। পাত্রটির ওপর সামান্য ঝুঁকে ঘ্রাণ নিল অ্যান, আঃ, ডিলিসিয়াস! খুব ঝাল নেই তো?

প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় স্বস্তি পেল পার্থ, না না, মোটেই নয়। খেয়ে দ্যাখো।

 খুব সাবধানে এক টুকরো ভেঙে মুখে দিয়ে অ্যান বললো, চমৎকার।

পার্থ লক্ষ্য করল খাওয়া শেষ হওয়ার মধ্যেই অ্যান আবার সহজ হয়ে আসছে। হাত ধোওয়া দরকার কিন্তু এই ঠান্ডায় জল ছোঁওয়া যাবে না আর ভেতরে জল তো নেইই। অ্যান পাত্রটি মাটিতে নামিয়ে রেখে হাত উঁচু করে দেখল, আঙুলগুলো তেলতেলে হয়ে গিয়েছে। তারপর সে মেঝেয় নেমে ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট তোয়ালে বের করে হাত মুখ মুছে পার্থর দিকে সেটা এগিয়ে দিল। আঙুল থেকে তেল উঠলেও যে গন্ধটা জড়িয়ে থাকল সেটা খুব অস্বস্তিকর। যত ঠান্ডাই হোক এখন একবার আঙুল জলে ডোবাতে পারলে স্বস্তি হতো। দ্বিতীয় দরজার দিকে তাকিয়ে অ্যান বলল, টয়লেট কি এদিকে?

হ্যাঁ, কিন্তু ওখানে জল নেই। তুমি যদি যেতে চাও তাহলে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে ওই টর্চটা নিয়ে যাও। অ্যান বেরিয়ে গেলে পার্থ চট করে বিছানাটা ঠিকঠাক করে নিল। দুটো কম্বল এমনভাবে পাশাপাশি রাখল যাতে তৃতীয়টাকে ঠিক মাঝখানে ছড়িয়ে দিলে দুজন স্বচ্ছন্দে তলায় শুতে পারে। তারপর পিটার স্কটের বোতল থেকে এক ঢোঁক গলায় ঢালতেই মনে হলো, আর নয়, এবার নেশা হয়ে যেতে পারে। নেশা হলে রাতটাই মাটি হয়ে যাবে। এখন প্রায় পৌনে আটটা। রিনটেকে কোনো প্রাণ নিশ্চয়ই এই বাংলোর বাইরে জেগে নেই। অতএব আর সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। অ্যান ফিরে এলে ওকে একটু একা থাকার সুযোগ দিয়ে পার্থ অ্যানের কম্বলটা মুড়ি নিয়ে টয়লেটে গেল। ফেরার সময় কিছু কাঠ স্টোর থেকে নিয়ে এল সে। ঠান্ডায় থর থর করছে শরীর। ঘরে ঢুকে ফায়ারপ্লেসের সামনে উবু হয়ে বসে শরীর সেঁকতে গিয়ে শুনলো অ্যান বলছে, তুমি শুয়ে পড়ো।

তুমি? পার্থর শরীর থেকে কাঁপুনিটা যাচ্ছিল না।

অনেক রাত তো সারাজীবনে ঘুমোলাম, আজ আমি জেগে থাকব।

 কেন? অবাক হয়ে গেল পার্থ।

কোনো বড় কারণ নেই। তাছাড়া এত কষ্ট করে এলাম যদি ভোরবেলায় ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে আর কোনোদিন সূর্যটাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে দেখতে পাব না। তুমি শুয়ে পড়ো, আমি ঠিক সময়ে তোমাকে ডেকে দেব! অ্যান চেয়ারটা ফায়ারপ্লেসের কাছে সরিয়ে সেদিকে পিঠ দিয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে পার্থর সমস্ত সত্তা চিববিড় করে উঠলো। আবার খেলাচ্ছে মেয়েটা। যত সে ভদ্রতা করছে তত ও তার সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু এখন যদি সে জোর জবরদস্তি করতে যায় তো পাশের ঘরের নিগ্রোটা সব টের পেয়ে যাবে। এই হয়েছে আর এক মুশকিল। অতএব ঠান্ডা মাথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে বিছানায় নিয়ে আসতে হবে। সে হেসে বলল, আসলে তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না।

বিশ্বাস করছি না? তোমাকে! কেন?

তোমার মনে হচ্ছে একসঙ্গে শুলে আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না।

অ্যান হাসলো, হয়তো! তুমি বলছো তুমি এখনও কুমার। অতএব তোমার বাসনা তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক। আবার আমার ক্ষেত্রে সেটা একদম উল্টো। এত দেখে দেখে চোখ পচে গেছে, মনে কোনো আবেগ আসে না, শরীরে রোমাঞ্চ ওঠে না। অথচ বাইরে থেকে এই শরীর দেখে লোকে লোভী হয়, হাত বাড়ায়। কী আর করা যাবে। তোমাকে একটা কথা বলি। সেদিন একটি লোকের সঙ্গে দিল্লি থেকে কলকাতায় আসবার সময় আমার পরিচয় হয়। চেয়ার কারের পাশাপাশি সিটে বসে আসছিলাম আমরা। লোকটা খুব আমুদে কিন্তু কথা বলে আস্তে আস্তে। অনেক অভিজ্ঞতার কথা বলছিল সে। যেগুলো শুনতে শুনতে আমার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছিল। আবার ঠিক সেই প্রচন্ড হাসির মুহূর্তে এমন একটা ছোট্ট ব্যথার টোকা দিচ্ছিল সে গল্পের মধ্যে যে আচমকা হৃদপিন্ড বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আর ও যখন মেয়েদের সঙ্গে মাটির তুলনা করে বলল দুজনেই এক তখন আমার শরীরে রোমাঞ্চ এল! লোকটার সঙ্গে আমার শরীরের কোনো সংশ্রব ছিল না, আমরা যৌন মিলনের চেষ্টাও করছিলাম না কিন্তু তবু মনে হলো আমার সমস্ত শরীর পুলকিত, আমি মৈথুনের আবেগে আপ্লুত হলাম। পরে এ নিয়ে অনেক ভেবেছি। যৌন সম্পর্ক যখন জল-ভাতের মতন, কোনো প্রস্তুতির দরকার হয় না, হয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। ক্রমশ করমর্দনের মতো গুরুত্বহীন ব্যাপার হয়ে যাবে হয়তো। তা সেইসব মুহূর্তে আমি একটুও শিহরিত হই না, হয়তো সেই বালিকা বয়সের প্রথম স্মৃতি আমাকে শিহরন এনে দেয় না। কিন্তু শুধু কথা শুনে আমার সেটা হলো কী করে। যে মাটির শরীরে কর্ষণ করে মানুষ খাবার সংগ্রহ করে সেই মাটির বুকেই চিরদিনের জন্যে সে আশ্রয় নেয়। মাটি হলো স্ত্রীলোক। তাকে অনন্তকাল ধরে মানুষেরা খনন করে যাচ্ছে, সে খাদ্যের ইচ্ছেয় হোক অথবা আশ্রয়ের আকাঙ্ক্ষায় হোক। উঃ, শুধু এই একটা কথাই আমাকে রোমাঞ্চিত করে দিয়েছিল।

ঠিক সেইসময় দরজায় নক্ হলো। এবার অত্যন্ত আস্তে এবং ভদ্রভাবে। অ্যান চকিতে সেদিকে তাকিয়ে দুহাতে মুখ ঢাকল। শব্দটা যেন বাঁচিয়ে দিল পার্থকে তার অ্যানের কথা শুনতে শুনতে এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কেউ যেন কুয়োর মধ্যে তার দুপা ধরে আরও নিচে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অ্যানের শরীর সম্পর্কে যেটুকু আশার প্রদীপ জ্বলেছিল সেগুলোকে যেন এতক্ষণ ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এই শব্দটা যেন অবশিষ্টটাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করল। সে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলো, কী ব্যাপার? আবার দরজায় শব্দ করছ কেন?

চার্লির বিনীত গলা শোনা গেল, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ পাতরো?

ঘুমিয়ে পড়লে কেউ কথার জবাব দেয় না। তুমি কিন্তু বারবার আমাকে বিরক্ত করছ!

 আমি দুঃখিত, খুব দুঃখিত। কিন্তু আমার টয়লেটে যাওয়ার দরকার ছিল।

আঃ, তাতে আমি কী করব!

না, সেকথা তোমাকে বলছি না। তুমি একটু দয়া করে দরজাটা খুলবে?

না, চার্লি, এটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!

জানি। কিন্তু আমি কি ভুল দেখছি। আমি শুধু জানতে চাই, আমি ভুল দেখছি?

ভুল দেখছো, কি ভুল দেখছো তুমি? তুমি কি মাতাল?

মাতাল, নো নো, আমার সঙ্গে মদ নেই। আমি একটা দৃশ্য দেখতে পেয়েছি। ভেবেছিলাম দরজা খুলে তলপেটটা খালি করে নেব কিন্তু সেটা করতে গিয়েই দেখতে পেলাম।

পার্থ ওই ঘরের জানালার দিকে তাকালো। না এখন বৃষ্টি হচ্ছে না। তবে হাওয়ার শব্দ হলেও ঝড় নেই। আকাশ কি পরিষ্কার হয়ে গেছে? চার্লির গলা আবার ভেসে এল, পাতরো, সময় নষ্ট করো না, প্লিজ, আমি যা ভেবেছি তা যদি ঠিক হয় তাহলে—দরজা খোল পাতরো।

পার্থ চকিতে অ্যানের দিকে তাকাল। অ্যান পাথরের মূর্তির মতো সেইভাবে বসে। ওর হঠাৎ মনে হলো ব্যাপারটা চার্লির চাল নয় তো। কোনোভাবে সে কি অ্যানের গলা শুনতে পেয়েছে? ঝড় কখন থেমেছে ওরা তো খেয়ালই করেনি। এই নির্জন পাহাড়ে চার্লি কি দেখতে পারে? কিছুই না। অতএব সেরেফ ভাঁওতা দিয়ে সে দরজা খোলাতে চাইছে। ওরকম শক্তিশালী চেহারার সঙ্গে সে গায়ের জোরে পারবে না। অ্যানকে চার্লি দখল করবেই। অ্যান চার্লির কথা শুনছে কিন্তু কোনো আওয়াজ করছে না। যে মেয়েটা এই ঘরে ঢুকেছিল বিকেলবেলায় তার সঙ্গে এখন যে মেয়েটা বসে আছে তার কোনো মিল নেই। একদম পাল্টে গেছে মেয়েটা। চার্লি আবার তাড়া দিল, ফর গড শেক পাতরো, উঠে এসো।

হঠাৎ মন বদলাল পার্থ। এই ঘরের আবহাওয়া এখন এত ভারী হয়ে গিয়েছে যে অ্যানকে বিছানায় নিয়ে আসা মুশকিল হবে। বরং সে যদি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চার্লির সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটায় তাহলে অ্যানের পরিবর্তন হতে পারে। আর চার্লি যদি এ ঘরে মেয়ের অস্তিত্ব টের পেয়ে থাকে তো কিছুই করার নেই। এই দরজা ভাঙতে ওই শরীরের কোনো কষ্টই হবে না। সে কম্বলটাকে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে অ্যানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, তুমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকো, আমি এই লোকটাকে একদম বিশ্বাস করি না।

একান্ত বাধ্য মেয়ের মতো অ্যান ওর কথা শুনতেই পার্থ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, চার্লি।

ইয়া! কুইক।

তুমি তোমার জায়গায় ফিরে গিয়ে বসো।

ওকে! দরজা খোলো।

 পায়ের শব্দ শুনল পার্থ। তারপর হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরে দরজা খুলল। খুলেই সে চিৎকার করে উঠল, আঃ, জানলা খুলেছ কেন? হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরে। কাচের জানলার একটা পাল্লা খুলেছে চার্লি। আর সেই জানলা দিকে মুখ বের করে কিছু যেন দেখার চেষ্টা করছে। ওর গলা শোনামাত্র উত্তেজিত ভঙ্গিতে কাছে যেতে ইশারা করল, দ্যাখো, দ্যাখো, ওটাকে তোমার কী মনে হয় বলো তো?

পার্থ বিশ্বাস করল এটা চার্লির ভাঁওতা নয়। এত ভালো অভিনয় কোনো মানুষ করতে পারে না। ওই ঘর দখল করার যদি বাসনা থাকত তাহলে সে দরজা খোলামাত্র লাফিয়ে পড়তে পারত। তার হাতে হ্যান্ডেল আছে বটে কিন্তু সেটা চার্লির কাছে খেলনা ছাড়া কিছু নয় তা সে নিজেই জানে। তাই ওই ঠান্ডা হাওয়ায় যেচে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না। খুব সাবধানে হ্যান্ডেলটাকে ধরে এগিয়ে এল পার্থ। জানলার কাছে আসতেই মনে হলো কম্বল ভেদ করে অজস্র সূচ যেন শরীরে বিধছে। মুখের চামড়া অসাড় হয়ে আসছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য দেখে এসব কষ্ট ভুলে যেতে ইচ্ছে করছিল। বৃষ্টি নেই, ঝড় থেমেছে। আকাশ পরিষ্কার। ঝকঝকে তারারা যেন বড্ড কাছে নেমে এসেছে। আর সমস্ত রিনটেকের ওপর একটা সাদা আস্তরণ চাদরের মতো বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। একটা পাতলা জ্যোৎস্না সেই সাদায় মাখামাখি হয়ে রয়েছে। হঠাৎ পার্থর মনে হলো যদি এখানে চার্লি না থাকত তাহলে অ্যানকে ডেকে এনে দেখাত সে। এত সুন্দর দৃশ্য থেকে বেচারা বঞ্চিত হচ্ছে। কাচের ওপর যে জল জমেছে তা মুছলে বন্ধ ঘর থেকেই এসব দেখা যেত। সাদা আস্তরণ কি তুষার? চার্লি বলল, দেখেছ?

কি? কোনো বিশেষ কিছু দেখতে পেল না পার্থ।

ওই যে ভাঙা বাড়িটার বারান্দায়। চার্লি আঙুল তুলে দেখালো।

ওটা ইয়ুথ হোস্টেল। ছাদ উড়ে গিয়েছে আজকের ঝড়ে। তার বারান্দায় কী যেন পড়ে রয়েছে। পার্থ ভালো করে ঠাওর করার চেষ্টা করল। হলদেটে কিছু। দৃষ্টি ঠিক হলে সে অস্ফুট উচ্চারণ করলো, মানুষ?

 সঙ্গে সঙ্গে চার্লি উত্তেজিত হলো, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

 তুমি সিওর ওটা মানুষ? ততক্ষণে একটা শরীরের আদল যেন দেখতে পেল পার্থ। উপুড় হয়ে কোনো মানুষ শুয়ে আছে। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ওই ভাঙা বারান্দায় কেউ যদি থাকে তাহলে চিরকালের জন্যে শুয়ে পড়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। সে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে জানলা থেকে সরে এল। এই সুন্দর প্রকৃতিটাকে আর ভালো লাগছে না। চাপা গলায় বললো, জানলাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়। ওটা মানুষ, নিশ্চয়ই মরে গেছে।

মরে গেছে? চার্লি চিৎকার করে উঠলো তুমি কী করে বুঝলে ও মরে গেছে?

 এই টেম্পারেচারে ওখানে পড়ে থাকা মানে মরে যাওয়া! পার্থ তার দরজার কাছে ফিরে গেল।

কিন্তু এটা তো শুধুই অনুমান। আর অনুমান সে সবসময় সত্যি হবে তার কোনো যুক্তি নেই। আমাদের একবার ওখানে গিয়ে দেখে আসা দরকার। চার্লি তার ওয়াটারপ্রুফটা তুলে নিল।

 ওর কথা শুনে আঁতকে উঠলো পার্থ, তুমি এখন ওখানে যাবে? বাইরে বরফ পড়ছে?

বাট আই কান্ট হেল্প। চিৎকার করে উঠলো চার্লি, মানুষটা যদি বেঁচে থাকে এখনও তাহলে সারাজীবন নিজেকে খুনী মনে হবে। তুমি আসবে না?

আমি? ওঃ, নো ইম্পসিবল। এই ঠাণ্ডায় আমি যাচ্ছি না। একটা ডেড বডি দেখতে যাওয়ার জন্যে এত কষ্ট করার কোনো মানে হয় না। পার্থ সরাসরি বলে দিল।

উত্তরে চার্লি কাঁধ নাচাল, তাহলে আমি একাই যাব, তুমি প্লিজ ওয়েট করো।

ওর সঙ্গে যা গরম জামা ছিল শরীরে চাপিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেই পার্থ দরজা বন্ধ করে ছুটে গেল ভেতরের দরজায়। পাল্লা খুলে চাপা গলায়–নিচের হোস্টেলের বারান্দায় একটা লোক পড়ে আছে। বোধহয় মরে গেছে এতক্ষণে।

চট করে উঠে বসল অ্যান, সেকি? কী করে এল? লোকাল লোক?

বুঝতে পারছি না। পার্থ গলায় উত্তেজনা আনবার চেষ্টা করল, চার্লিকে পাঠিয়েছি।

পাঠিয়েছি? অ্যানের বলার ধরনটা ঠং করে কানে বাজল পার্থর। সে ধীরে ধীরে দরজাটা বন্ধ করে আবার জানলার কাছে ফিরে এল। ছিটকিনি তুলে দিয়ে গিয়েছিল চার্লি। সেটাকে খুলে সামান্য ফাঁক করে চোখ রাখল পার্থ। সাদা আস্তরণের ওপর দিয়ে দৌড়ে নেমে যচ্ছে চার্লি। ব্যাটার যে খুব ঠান্ডা লাগছে তা দৌড়োবার ভঙ্গিতেই বোঝা যায়। অ্যান যেন এই কালো ভূতটার ওপর ক্রমশ সহানুভূতি দেখাতে শুরু করেছে। বিচিত্র মানুষের মন। ওর গল্প যদি সত্যি হয় তাহলে কালোলোকগুলোর ওপর কখনই সহানুভূতি আসতে পারে না। পার্থ দেখল চার্লি হোস্টেলের বারান্দায় পৌঁছে গিয়েছে। লোকটার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু দেখছে। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে বোধহয় বুকের ওপর কান পাতার চেষ্টা করল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এই বাংলোর দিকে মুখ করে দুহাতে তালুর আড়াল রেখে চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করল। চিৎকারটা অস্পষ্ট এল কিন্তু কোনো কথা বুঝতে পারল না পার্থ। সে অবাক হয়ে দেখলো চার্লি দুহাতে লোকটাকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অনেক কষ্টে কাঁধের ওপর তুলে চার্লি টলতে টলতে এগিয়ে আসার চেষ্টা করল। তাহলে কি লোকটা বেঁচে আছে এখনও? নিশ্চয়ই আছে। নইলে চার্লি ওকে বাংলোয় নিয়ে আসবে কেন? ঠোঁট কামড়াল পার্থ। আর একটা ঝামেলা বাড়ল। চার্লিকে এই ঘরে ঢুকতে দেওয়াই ভুল হয়েছিল। তা যাহোক করে সেটা ম্যানেজ হয়েছে। কিন্তু চতুর্থজন আসা মানে রাতটার বারোটা বেজে গেল। এখন একটা অর্ধমৃত লোকের পেছনে সময় যাবে। এরকম অবস্থা যে সে অনুমতি ছাড়াই আর একজনকে ঢোকাচ্ছে এবং সেখানে বাধা দিতে গেলে নিজেকে পশুর অধম মনে হবে। জানলা বন্ধ করার আগে পার্থ দেখলো চার্লি একবার পড়ে যেতে যেতে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিল। দুতিন পা হেঁটে জিরিয়ে নেবার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়ছে। নিচে থেকে উঠে আসতে অনেক সময় লাগছে চার্লির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *