২. বন্দিদশার তৃতীয় দিন

বন্দিদশার তৃতীয় দিন ভোরবেলায় আমাকে নিতে এলো ডুগ আর তার সহকারীরা। মনের অনেক গভীরে যেখানে আমি ডুব দিয়েছিলাম সেখান থেকে আমাকে তুলে আনতে বেশ কষ্ট করতে হলো তাদের। প্রথমে মনে হলো যেন বহু দূর থেকে  ভেসে আসছে তাদের কণ্ঠস্বর। আস্তে আস্তে অনুভব করলাম তাদের হাতগুলো জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছে আমাকে, জুতোগুলো লাথি মারছে। তবে শুধু যখন টের পেলাম যে আমার মুখের ওপর এক বালতি পানি ছুঁড়ে মারা হয়েছে তখনই আমার পূর্ণ চেতনা ফিরে পেলাম আমি। দুই হাতে আঁকড়ে ধরলাম বালতিটা, তারপর তলায় যেটুকু পানি পড়ে ছিল তাই গলায় ঢেলে গিলে ফেললাম। যদিও আমার হাত থেকে বালতিটা কেড়ে নেওয়ার জন্য ডুগের তিন সহকারী কম চেষ্টা করল না, তবে লাভ হলো না কোনো। ওই কয়েক ঢোক নোংরা ঈষদুষ্ণ পানি যেন আমার জন্য নতুন জীবন বয়ে আনল। অনুভব করলাম আমার পানিশূন্য দেহে নতুন করে শক্তি বয়ে যাচ্ছে, আমার চেতনার দুর্গে নতুন করে প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে আমাকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভোলা পিঠে বারবার চাবুক মারতে লাগল ডুগ; কিন্তু তাতে কোনো ক্ষেপই করলাম না আমি। একটু পরেই দিনের আলোতে খোলা বাতাসে বেরিয়ে এলাম আমরা। সত্যিই, যেই অন্ধকার কক্ষ থেকে আমাকে বের করে আনা হয়েছে তার তুলনায় এই বাতাস যেন গোলাপের সৌরভ; যদিও এখনো আমি কারাগারের ভেতরেই রয়েছি।

মাথার খুলিতে ভরা সেই প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হলো আমাকে। দেখলাম রথ নিয়ে এখানে অপেক্ষা করছে ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই চমকে উঠে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে, আমার বিধ্বস্ত চেহারা আর শুকনো অবয়বের দিকে তাকাতে চাইছে না। তার বদলে হাতে ধরা প্যাপিরাসে নিজের হায়ারোগ্লিফ আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার আগে তাকে ওই প্যাপিরাসে স্বাক্ষর করতে বলেছে ডুগ। কাজটা শেষ হতে ওয়েনেগের সঙ্গীরা আমাকে রথে উঠতে সাহায্য করল। যদিও আমি ব্যাপারটা ঢেকে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি; কিন্তু এখনো আমি অনেক দুর্বল, টলে উঠছি মাঝে মাঝেই।

লাগামে টান দিল ওয়েনেগ, খোলা ফটকের দিকে ঘোরাল রথের মুখ। মুখে বীভৎস হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকাল ডুগ। হেঁকে বলে উঠল, আপনার ফেরার অপেক্ষায় থাকব আমি প্রভু। শুধু আপনার ওপর প্রয়োগ করার জন্যই কিছু নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি আমি। এবং আশা করি সেগুলো আপনার বেশ পছন্দ হবে।

পাহাড়ের পাদদেশে সেই ছোট্ট নালাটার কাছে এসে পৌঁছলাম আমরা। এই সময় লাগাম টেনে রথ থামাল ওয়েনেগ, তারপর হাত বাড়িয়ে আমাকে নামতে সাহায্য করল। আমাকে নালার কিনারে নিয়ে এলো সে।

নিজেকে নিশ্চয়ই একটু সাফসুতরো করে নিতে চাইবেন আপনি, প্রভু। ওয়েনেগও ডুগের মতোই আমাকে প্রভু বলে ডাকছে; কিন্তু তাতে ঠাট্টার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। আপনার সুন্দর পোশাকগুলোর কী হয়েছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আপনার জন্য নতুন একটা টিউনিক নিয়ে এসেছি আমি। এখন যে অবস্থায় আছেন এভাবে ফারাওয়ের সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।

নালার পানি শীতল, সুস্বাদু। সারা শরীরে লেগে থাকা শুকনো রক্ত আর কারাকক্ষের ময়লা ধুয়ে ফেললাম আমি, তারপর পরিপাটি করে আঁচড়ে নিলাম আমার লম্বা, ঘন চুল। এগুলো আমার গর্বের বস্তু।

ওয়েনেগ ওই কারাগারে আগেও এসেছে, এবং নিশ্চয়ই জানে যে একবার ডুগের চোখে পড়ার পর আমার পোশাক এবং শিরস্ত্রাণের কী দশা হতে পারে। আর সে কারণেই আমার নগ্নতাকে আড়াল করার জন্য রথচালকদের জন্য তৈরি একটা নীল রঙের টিউনিক বা আঁটো পোশাক নিয়ে এসেছে সে। অদ্ভুত হলেও সত্যি, পোশাকটা আমার অবয়বকে স্নান করার বদলে আরো ফুটিয়ে তুলল, কারণ পোশাকটা বেশ আঁটো হওয়ার কারণে আমার একহারা পেশিবহুল গড়ন একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সাথে কোনো আয়না নেই, তা সত্ত্বেও ঝরনার পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে খুশি হয়ে উঠলাম আমি। স্বাভাবিকভাবেই এটা আমার শ্রেষ্ঠ পোশাক নয়; কিন্তু এখনো একটা ব্যাপার নিয়ে আমি গর্ব করতেই পারি। এমনকি ফারাওয়ের দরবারেও অন্তত চেহারা সুরতে আমার ওপর টেক্কা দিতে পারে এমন খুব বেশি মানুষ নেই।

ওয়েনেগ আমার জন্য পানীয় আর খাবারও নিয়ে এসেছে: রুটি আর নীলনদ থেকে ধরা ঠাণ্ডা মাছ। তার সাথে এক পাত্র বিয়ার। দারুণ সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর মনে হলো খাবারটা। অনুভব করলাম আমার সমস্ত শরীরে নতুন করে শক্তির স্রোত বইতে শুরু করেছে। এবার রথে উঠে ফারাওয়ের প্রাসাদের দিকে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। প্রাচীরঘেরা লুক্সর শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত ফারাওয়ের প্রাসাদ। আজ ঠিক দুপুরে আমার বিচার শুরু হওয়ার কথা, তবে নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা আগেই প্রাসাদের কেন্দ্রীয় হলঘরে প্রবেশ করলাম আমরা। ফারাও এবং তার সঙ্গীদের দেখা পেতে অবশ্য দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগল। এবং এক নজরেই বোঝ গেল সবাই কড়া মদ টানছিল এতক্ষণ, বিশেষ করে আমাদের ফারাও। লাল হয়ে আছে তার মুখ, কথায় কথায় হেসে উঠছে হো হো করে। হাঁটছে টলোমলো পায়ে।

গত কয়েক ঘণ্টা ধরে উপস্থিত সবাই ফারাওয়ের আগমনের অপেক্ষা করছিল। এবার উঠে দাঁড়াল সবাই, ফারাওয়ের সামনে এসে ঝুঁকে মার্বেল পাথরের মেঝেতে মাথা ঠেকাল। আমাদের সামনে সিংহাসনে বসল উটেরিক। তার দুই পাশে রইল সেই চাটুকারের দল। নিজেদের মাঝে খিক খিক করে হাসাহাসি করছে তারা। এমন সব কৌতুক করছে, যেগুলোর রস তারা ছাড়া আর কারো বোঝার সামর্থ্য নেই।

এরই মাঝে রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রী এবং রাজপরিবারের সদস্যরাও হলঘরে প্রবেশ করল। ফারাওয়ের পেছনে পাথরের আসনে তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আমার, অর্থাৎ অপরাধীর মুখোমুখিই বসল তারা।

এই উপস্থিত ব্যক্তিদের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর উঁচু পদমর্যাদার অধিকারী হচ্ছে ফারাও টামোসের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র, সিংহাসনের প্রতি যার অধিকার সত্তাই উটেরিক টুরোর পরেই সবচেয়ে বেশি।

তার নাম রামেসিস। তার মা ছিল ফারাওয়ের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী, যার নাম রানি মাসারা। কিন্তু রামেসিসের জন্ম দেওয়ার আগে ছয়টা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিল সে। ওদিকে টামোসের অন্য আরেক স্ত্রী, যে তার অপেক্ষাকৃত কম প্রিয় হলেও একটি ছেলের জন্ম দেয়। সেই স্ত্রীর নাম ছিল সামোরতি, এবং তার মাত্র কয়েক মাস পরেই মাসারার গর্ভে জন্ম হয় রামেসিসের। কিন্তু প্রথম পুত্র এবং সেইসাথে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে জন্ম দেওয়ার সম্মান লেখা ছিল সামোরতির কপালে। সেই সন্তানই উটেরিক টুরো।

উপস্থিত সবার মাঝে অটুট নীরবতা বিরাজ করলেও উটেরিক টুরো আর তার সঙ্গীদের মাঝে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আরো বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিজেদের মাঝে হাসাহাসি আর কথাবার্তা চালিয়ে গেল তারা। আমি এবং আমার সঙ্গীদের দিকে কারো খেয়ালই নেই। অগত্যা আরো কিছুক্ষণ ফারাওয়ের উদ্ভট খেয়াল সহ্য করতে বাধ্য হলাম আমরা।

হঠাৎ করেই প্রথমবারের মতো আমার দিকে তাকাল ফারাও। চাবুকের মতো তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল তার কণ্ঠস্বর। এই বিপজ্জনক অপরাধীকে আমার সামনে আনা হয়েছে অথচ তার হাত বাঁধা হয়নি কেন?

সরাসরি ফারাওয়ের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু রেখেই জবাব দিল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। হে মহাশক্তিমান অধিপতি… এমন তেলতেলে সম্বোধনে এর আগে কোনো ফারাওকে ডাকতে শুনিনি আমি। তবে পরে জেনেছিলাম কেউ যদি রাজকীয় ক্রোধের শিকার হতে না চায় তবে উটেরিক টুরোকে সম্বোধনের সময় এ কথাগুলোই তাকে ব্যবহার করতে হবে। …কয়েদিকে এখনো বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি এবং তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। তাই তাকে বেঁধে রাখার কথাও ভাবিনি আমি।

কী বললে? ভাবোনি? তা তো বটেই, তা তো বটেই। চিন্তাভবনা করার জন্য মাথার ভেতরে কিছুটা মগজ থাকা লাগে। খিক খিক করে হেসে উঠল ফারাওয়ের পায়ের কাছে জড়ো হওয়া চাটুকারের দল, হাততালি দিয়ে উঠল কেউ কেউ। ওদিকে ওয়েনেগের লোকদের মাঝ থেকে দুজন আমাকে উপুড় হয়ে শোয়া অবস্থান থেকে উঠে বসতে বাধ্য করল, তারপর ডুগের কাছ থেকে নিয়ে আসা হাতকড়াগুলো পরিয়ে দিল আমার কবজিতে। তারা যখন ফারাওয়ের নির্দেশ পালন করছে, আমি খেয়াল করলাম যে লজ্জায় আমার দিকে তাকাতে পারছে না ওয়েনেগ। হাত বাঁধা শেষ হতে আবার চাপ দিয়ে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হলো আমাকে।

হঠাৎ করে সিংহাসন থেকে নেমে এলো ফারাও উটেরিক টুরো, আমার সামনে পায়চারি করতে শুরু করল। মাথা উঁচু করার সাহস পাচ্ছিলাম না আমি, ফলে তাকে দেখাও যাচ্ছিল না। কিন্তু মার্বেলের মেঝেতে তার জুতোর শব্দ ঠিকই শোনা যাচ্ছে। এবং শব্দটা শুনে বোঝা যাচ্ছ যে তার পায়চারির গতি বাড়ছে, ধীরে ধীরে খেপে উঠছে সে।

হঠাৎ করেই আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল ফারাও, এদিকে তাকাও, ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক শুয়োর!

সাথে সাথে ওয়েনেগের লোকদের মাঝে একজন এগিয়ে এসে আমার চুল মুঠো করে ধরল, তারপর টান দিয়ে মেঝেতে উঠে বসতে বাধ্য করল আমাকে। এবার মুখটা রইল ফারাওয়ের দিকে।

কী কুৎসিত ভয়াবহ আর লোভী একটা চেহারা! বলে উঠল উটেরিক। কিন্তু আরো একটা জিনিস ওখানে দেখতে পাচ্ছি আমি। একেবারে দিবালোকের মতো পরিষ্কারভাবে সমস্ত মুখ জুড়ে লেখা রয়েছে একটা কথা- অপরাধী! হলঘরে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলা হলো কথাটা। এবার আমার এবং আমার পরিবারের বিরুদ্ধে এই হতভাগা যে অপরাধগুলো করেছে তার তালিকা তোমাদের জানানো হবে। তখন তোমরা বুঝতে পারবে এই বিশ্বাসঘাতকের জন্য আমি যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছি তা কতটা উপযুক্ত। ডান হাতের তর্জনী আমার মুখের দিকে তাক করল সে, রাগে থরথর করে কাঁপছে। আমার জানা মতে এর প্রথম শিকার ছিলেন আমার দাদি রানি লসট্রিস। যদিও আমার ধারণা তার আগেও আরো অনেকের সর্বনাশ করেছে এই শয়তান।

না! না! রানি লসট্রিসকে আমি ভালোবাসতোম, তীব্র ক্ষোভে আর দুঃখে চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি, ওই নামটা শুনে কোনোভাবেই নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। তাকে আমি আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসতাম।

হয়তো সে কারণেই তাকে খুন করেছিলে তুমি। তার ভালোবাসা পাওনি, তাই আর কেউ যেন পেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করেছ। শুধু তাকে খুন করেই ক্ষান্ত হওনি, এই ঘৃণিত কাজের কথা গর্ব করে লিখে রেখেছ রানি লসট্রিসের সমাধির ভেতরে তোমার তৈরি করা পুঁথিতে। তোমার হাতে লেখা সেই কথাগুলো আমি নিজের চোখে দেখেছিঃ সেথের সেই অভিশপ্ত চিহ্নকে খুন করেছি আমি, যা বেড়ে উঠেছিল তার গর্ভে।

নৃশংস দেবতা সেথ আমার কত্রীর গর্ভে যে ভয়ানক জিনিসটা তৈরি করেছিল সেটার কথা মনে পড়তে গুঙিয়ে উঠলাম আমি। আমার চিকিৎসাসংক্রান্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ওটার নাম আমি দিয়েছি কর্কট। হ্যাঁ, রানির মৃতদেহ থেকে ওই কুৎসিত জিনিসটা বের করে এনেছিলাম আমি। প্রচণ্ড শোকার্ত হয়ে পড়েছিলাম, যখন বুঝেছিলাম যে আমার সকল জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েও এর হাত থেকে আমার কত্রীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তার অনিন্দ্যসুন্দর দেহের মমীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করার আগে ওই কুৎসিত জিনিসটাকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছিলাম আমি।

কিন্তু এই সব কিছু এখন আমার কত্রীর নাতির কাছে বুঝিয়ে বলার মতো অবস্থা নেই আমার। আমি একজন কবি, যে শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলার মতো কোনো শব্দ আমি সেই মুহূর্তে খুঁজে পেলাম না। শুধু আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ফারাও উটেরিক টুরো আমার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগের তালিকা পড়ে যেতে লাগল। তার ঠোঁটে হাসি; কিন্তু চোখগুলো কোনো ফণা-তোলা গোখরার মতো ঠাণ্ডা, বিষাক্ত ঘৃণায় পরিপূর্ণ। যে বিষ সে আমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল তা সেই বিষধর সাপের চাইতে কোনো অংশে কম নয়।

উপস্থিত অভিজাত আর রাজবংশের সদস্যদের উদ্দেশ্য করে সে জানাল যে, কীভাবে আমি রাজকীয় কোষাগার থেকে সোনা এবং রুপার এক বিশাল সম্পদ চুরি করে নিয়ে গেছি, যেগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন তার বাবা ফারাও টামোস। আমার বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ হিসেবে ফারাও উটেরিক আমার ভূসম্পত্তি এবং অন্যান্য অস্থাবর সম্পদের বিপুল পরিমাণের কথা উল্লেখ করল, যেগুলো বিগত বছরগুলোতে তিল তিল করে অর্জন করেছি আমি। আরো একটি পুঁথি বের করে সেখান থেকে পড়তে শুরু করল সে। এতে রয়েছে কোষাগার থেকে আমার জালিয়াতি করে সরানো সকল সম্পদের বিবরণ। সব মিলিয়ে প্রায় কয়েক হাজার কোটি রৌপ্যের হিসাব দেখানো হয়েছে সেখানে, যদিও এত রুপা সারা পৃথিবীতেও নেই।

অভিযোগগুলো এমনই ভিত্তিহীন হাস্যকর যে, কোথা থেকে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করব ভেবে পেলাম না আমি। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে কেবল কিছু নির্দিষ্ট কথা বারবার বলতে লাগলাম আমি: না! ঘটনাটা এমন ছিল না। ফারাও টায়োস ছিলেন আমার একমাত্র পুত্রের মতো। এই সব কিছুই তার। প্রতি আমার সেবা এবং আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে আমাকে দিয়েছিলেন তিনি। তার পঞ্চাশ বছরের জীবনের পুরোটা সময় আমাকে পাশে পেয়েছেন ফারাও। কখনো তার কাছ থেকে কিছু চুরি করিনি আমি, সেটা সোনা-রুপা হোক আর এক টুকরো রুটি হোক।

কিন্তু আমার কথাগুলো যেন ফারাওয়ের কানেই ঢুকল না। নিজের মতো পড়ে অভিযোগের সমাহার পড়ে যেতে লাগল সে: এই আততায়ী টাইটা তার ওষুধ এবং বিষ-সংক্রান্ত জ্ঞান ব্যবহার করে রাজপরিবারের আরো একজন সদস্যের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এবং এবার তার শিকারে পরিণত হয়েছিল আমার আপন মা; সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং কোমলপ্রাণ রানি সামোরতি।

কথাগুলো শুনে আঁতকে উঠলাম আমি। রানি সামোরতির হাতে পুরুষত্ব হারিয়েছে বা মার খেয়ে আধমরা হয়েছে এমন বহু ক্রীতদাসের চিকিৎসা। করতে হয়েছে আমাকে। আমার বন্ধ্যাত্ব এবং ক্ষতবিক্ষত পুরুষাঙ্গ নিয়ে সুযোগ পেলেই নিষ্ঠুর ঠাট্টায় মেতে উঠতেন তিনি; হতাশা প্রকাশ করতেন এই বলে যে তার আগেই অন্য কেউ আমার ওপর খোঁজা করার ছুরি চালানোর সুযোগ পেয়ে গেছে। তার চাকরানিদের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল রানির শোবার ঘরে ক্রীতদাসদের অফুরন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা। আর সেই ক্রীতদাসদের সাথে রানির অযাচারের কারণেই হয়তো আজ এই মানুষ নামের কলঙ্কের জন্ম হয়েছে, যে এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে আমারই মৃত্যু পরোয়ানাঃ মহাশক্তিমান অধিপতি ফারাও উটেরিক টুরো।

একটা ব্যাপার আমি নিশ্চিতভাবে জানি, রানি সামোরতিকে আমি যেসব ওষুধ এবং জড়িবুটি দিয়েছিলাম সেগুলো ব্যর্থ হয়েছিল। অগণিত অবৈধ প্রেমিকের মাঝ থেকে এক বা একাধিক জনের কাছ থেকে তার শরীরে যে যৌনরোগ সৃষ্টি হয়েছিল তার চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়েছিলাম আমি। যদিও আমি তার শান্তি কামনা করি, তবে আমার মনে হয় জ্ঞানী দেবতারা তার ভাগ্যে ওই জিনিসটা লেখেননি।

তবে আমার বিরুদ্ধে ফারাও উটেরিকের আনীত অভিযোগগুলোর মাঝে এটাই সর্বশেষ নয়। তার পরের অভিযোগটাও আগেরগুলোর মতোই ভিত্তিহীন এবং চূড়ান্ত রকমের অবিশ্বাস্য।

তারপরে আছে আমার দুই ফুপু রাজকুমারী বেকাথা এবং তেহুতির প্রতি এই কুচক্রী শয়তানের বিশ্বাসঘাতকতা। এ কথা সবাই জানে যে, আমার বাবা তাদের দুজনকেই ক্রিট দ্বীপের ক্ষমতাবান এবং সম্পদশালী সম্রাট মিনোসের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমার বাবা ফারাও টামোস এই দুই কুমারীকে রাজকীয় কাফেলায় করে বিবাহের উদ্দেশ্যে মিনোসে পাঠান। তাদের সাথে যে যৌতুক পাঠানো হয় তা ছিল আমাদের জাতীয় সম্পদের এক অনন্য উদাহরণ। কয়েক শ লোক পাঠানো হয় তাদের সাথে। আমার বোনদের যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয় প্রায় দুই কোটি খাঁটি রৌপ্যখণ্ড। আপনারা যে অপরাধী এবং বিশ্বাসঘাতক টাইটাকে দেখতে পাচ্ছেন এর ওপরেই আমার বাবা বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কাফেলার নেতৃত্ব অর্পণ করা হয়েছিল এর ওপর। তার সাহায্যে ছিল সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জারাস এবং কর্নেল হুই। আমার জানা মতে টাইটা নামের এই ঘৃণিত ব্যক্তি সফলভাবে ক্রিটে পৌঁছায় এবং রাজা মিনোসের সাথে আমার ফুপুদের বিয়ে দেয়। কিন্তু দেবতা ক্রোনাস, যিনি দেবতা জিউসের পিতা এবং যার সন্তানরা তাকে অনন্তকালের জন্য পাহাড়ের নিচে শিকলে আবদ্ধ করে রেখেছে এবং যার নামে ক্রোনাস আগ্নেয়গিরির নামকরণ; তার ক্রোধের কারণে এক ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত ঘটে… এই পর্যন্ত বলে একটু দম নিল ফারাও, তারপর আবার তার অভিযোগের তীর ছুঁড়তে ফিরে গেল: যাতে ক্রিট দ্বীপ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং পাথর চাপা পড়ে মারা যান মিনোসের সম্রাট। এর পরবর্তী বিশৃঙ্খলার সুযোগে সেই দুই দস্যু জারাস এবং হুই আমার দুই ফুপুকেই অপহরণ করে। তারপর তারা আমার বাবা ফারাও টামোসের নৌবাহিনী থেকে দুটো জাহাজ ছিনতাই করে এবং আমার ফুপুদের নিয়ে উত্তরে পালিয়ে যায়, যেখানে কেবল অসভ্য বর্বরদের বাস, যেখানে পৃথিবীর শেষ। এই সবই ঘটে আমার দুই ফুপুর অনিচ্ছায়; কিন্তু আপনাদের সামনে উপস্থিত এই নরাধম টাইটার প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও সহযোগিতায়। মিশরে ফিরে আসার পর টাইটা তার প্রাক্তন ফারাওকে জানায় যে, তারা দুজনই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে মারা গেছেন, ফলে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা বাদ দিয়ে দেন ফারাও। এই অপহরণের ঘটনা এবং তার ফলে আমার দুই ফুপু যত কষ্ট সহ্য করেছেন তার সম্পূর্ণ দায়ভার টাইটার। এবং কেবল এই একটি অপকর্মের জন্যই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত।

যদি সত্যি কথা বলতে চাই তবে এই অভিযোগও আমার মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই, আমি সত্যিই অপরাধী। কিন্তু সে অপরাধ ছিল আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় দুই নারীকে তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে সহায়তা করার, তাদের জীবনে সুখ বয়ে আনার। নিজেদের দায়িত্ব যথাসম্ভব পালন করেছিল তারা, তাদের জন্য এটুকু আমাকে করতেই হতো। কিন্তু এবারও আমার বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি অভিযোগগুলো তুলেছে তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না। কারণ বেকাথা আর তেহুতিকে যখন তাদের ভালোবাসার পুরুষদের সাথে সুখের সন্ধানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তখনই আজীবন মুখ বন্ধ রাখার শপথ নিয়েছিলাম আমি।

আমার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল উটেরিক, তারপর বুক চিতিয়ে চাইল উপস্থিত অভিজাত এবং রাজপরিবারের সদস্যদের দিকে। অভিযোগের মাত্রা এবং গুরুত্ব শুনে সবাই এতটাই অবাক হয়ে গেছে যে, কারো মাঝে একটুও নড়াচড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এক এক করে প্রত্যেকের দিকে চাইল ফারাও, ইচ্ছে করেই যেন সবার উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার মুখ খুলল সে। আমি খুব ভালো করেই জানি যে তার কাছ থেকে কোনো দয়ামায়া আশা করা বোকামি। সত্যিই আমার সন্দেহকে ভুল প্রমাণিত করল না ফারাও উটেরিক।

আমি মনে করি কয়েদির বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে। তার সকল সম্পদ, তা ছোট হোক আর বড় স্থাবর হোক বা অস্থাবর এবং পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থিত হোক না কেন; বাজেয়াপ্ত করা হবে। এখন থেকে সেগুলো সব আমার কোষাগারের অংশ বলে গণ্য হবে।

উপস্থিত দর্শকের মাঝে একটা মৃদু উত্তেজনার গুঞ্জন বয়ে গেল, হিংসার সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল কেউ কেউ। সবাই জানে এই কথাগুলোর মাঝে কী বিশাল ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে। ফারাওয়ের পরে আমিই যে মিশরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এটা কারো অজানা নেই। কিছুক্ষণ দর্শকদের এই আলাপ চালানোর সুযোগ দিল ফারাও, তারপর এক হাত উঁচু করল সে। সাথে সাথে থেমে গেল সবাই। এই মুহূর্তে ভয়ানক এক বিপদের মাঝে রয়েছি আমি, তা সত্ত্বেও নতুন ফারাওয়ের প্রতি উপস্থিত সবার সমীহ আর ভয় খেয়াল করে অবাক না হয়ে পারলাম না। কিন্তু এটাও আমি বুঝতে শুরু করেছি যে, এই ভয় অমূলক নয়। তার পরেই হঠাৎ খিক খিক করে হেসে উঠল ফারাও। সেই মুহূর্তেই আমি প্রথম বুঝতে পারলাম, উটেরিক টুরো আসলে একজন বদ্ধ উন্মাদ এবং নিজের উন্মাদনাকে সামলে রাখার কোনো ইচ্ছেই নেই তার মাঝে। ওই তীক্ষ্ণ উঁচু লয়ের হাসি কেবল একজন উন্মাদের পক্ষেই হাসা সম্ভব। আর তার পরেই আমার মনে পড়ল যে তার মা-ও একজন উন্মাদ ছিল, যদিও তার উন্মাদনা প্রকাশ পেত কেবল যৌন অযাচারের মাধ্যমে। কিন্তু উটেরিক টুরোর মাঝে সেই পাগলামি রূপ নিয়েছে চূড়ান্ত আত্মম্ভরিতায়। নিজের জান্তব প্রবৃত্তি বা ইচ্ছাগুলো কখনো চেপে রাখতে পারে না সে, রাখেও না। তার ইচ্ছে ছিল দেবতায় পরিণত হওয়ার ফলে নিজেকে দেবতা হিসেবে ঘোষণা করেছে সে। তার ধারণা, নিজের দেবত্ব ঘোষণা করলেই দেবতা হওয়া যায়।

এই ব্যাপারটা বোঝার পরেই এই মহান জাতি, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী এই দেশের নাগরিকদের জন্য কেঁপে উঠল আমার বুক। তাদের কপালে যে বিরাট দুর্ভাগ্য নেমে আসছে তার মাত্র শুরু এখন। নিজের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না, কারণ জানি যে ইতোমধ্যে এই উন্মাদ তা নিশ্চিত করে ফেলেছে। কিন্তু আমার প্রিয় মিশরের কী হবে সেটা নিয়েই এখন দুশ্চিন্তা।

আবার কথা বলতে শুরু করল উটেরিক: আমার কেবল একটাই আফসোস যে, এই অপরাধীর মৃত্যু ঘটবে খুব সহজভাবে। আমার পরিবারকে সে যেই কষ্ট দিয়েছে তার তুলনায় এই শাস্তি কিছুই নয়। আমার ইচ্ছে ছিল এই বিশ্বাসঘাতক, সব সময় যে মহত্ত্ব আর মহানুভবতার ভান করেছে এবং নিজেকে বিরল ও বিপুল জ্ঞান এবং শিক্ষার অধিকারী বলে দাবি করেছে; সেই একই পরিমাণ কষ্টের সাথে তার শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

আমার ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার প্রতি হিংসা চেপে রাখতে পারছে না উটেরিক, বুঝতে পেরে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে। ব্যাপারটা তার নজর এড়াল না, রাগে ঝলসে উঠল তার চোখগুলো। কিন্তু কথা থামাল না সে।

আমি জানি এটা তার জন্য মোটেই যথেষ্ট শাস্তি নয়। তবু আমি এই মর্মে আদেশ দিচ্ছি যে, তাকে এখান থেকে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে এবং শিকলে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে নিপীড়ন-নির্যাতনের ভবনে। সেখানে একে অত্যাচারকারীদের হাতে সোপর্দ করা হবে, যারা… এখানে ফারাও উটেরিক এমন কিছু ভয়াবহ কাজের কথা উল্লেখ করল যে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু অল্পবয়স্ক মেয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসতে দেখলাম আমি, ভয়ে কেঁদেও ফেলল কেউ কেউ।

অবশেষে আবার আমার দিকে তাকাল ফারাও। এবার আমি তোমার মুখ থেকে সকল অপরাধের স্বীকৃতি শোনার জন্য প্রস্তুত। এর পরেই তোমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তোমার নিয়তির মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি, যদিও এখনো হাত বাঁধা আমার। পরিষ্কার গলায় কথা বলতে শুরু করলাম, কারণ আর কিছু হারানোর নেই আমার। বললাম, ধন্যবাদ হে মহাশক্তিমান অধিপতি ফারাও উটেরিক টুরো। এখন আমি বুঝতে পারছি আমি এবং আপনার অন্য সকল প্রজাদের মনে আপনার প্রতি এই অনুভূতি কেন জন্মেছে। নিজের কণ্ঠস্বরে চুঁইয়ে পড়া ব্যঙ্গের ভাব লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলাম না আমি।

কাপুরুষ উটেরিক একবার কেবল ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে, তারপর হাত নেড়ে সরিয়ে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিল। লুক্সরের রাজদরবারে আমিই এখন একমাত্র ব্যক্তি, যার মুখে হাসি খেলা করছে। বর্তমানে যে দানব মিশরের সিংহাসনে বসেছে তার বিরুদ্ধে কেবল এই ব্যঙ্গের হাসিটুকু ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নেই আমার কাছে।

.

ফারাওয়ের নির্দেশ অনুযায়ী ওয়েনেগ আর তার সৈন্যরা মিলে আমাকে নিয়ে লুক্সর প্রাসাদের দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। পরনে ছোট্ট এক টুকরো কাপড় আর শিকলগুলো ছাড়া কিছুই নেই আমার। বিশাল সিঁড়ির শুরুতে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম সিঁড়ির নিচে ভোলা প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া বিপুল জনতার দিকে। মনে হচ্ছে যেন এই বিশাল শহরের প্রতিটি নাগরিক আজ এখানে এসে হাজির হয়েছে, তাদের ভিড়ে উপচে পড়ছে প্রাঙ্গণ। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই।

তাদের ঘৃণা আর শত্রুতার ভাব অনুভব করতে পারছিলাম আমি। যদিও তাদের বেশির ভাগই আমার নিজের মানুষ। তারা অথবা তাদের বাপ-দাদারা বিগত পঞ্চাশটি যুদ্ধে আমার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছে। যারা যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে গেছে তাদের দায়িত্ব নিয়েছি আমি, আমার সম্পত্তির অংশ ভাগ করে দিয়েছি। আমার কারণেই আশ্রয় এবং দিনে অন্তত একবেলা খাবার পেয়েছে। তারা। যারা মারা গেছে তাদের বিধবারাও ক্ষতিপূরণ পেয়েছে আমার কাছ থেকে। তাদের কাজ দিয়েছি আমি, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছি, যাতে এই কঠিন পৃথিবীতে তারা নিজেদের জায়গা করে নিতে পারে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার সেই দানশীলতাকে তারা সবাই অস্বীকার করেছে, তার বদলে আজ এখানে হাজির হয়েছে নিজেদের ঘৃণার উন্মুক্ত প্রকাশ ঘটাতে।

এরা এখানে কেন? মৃদু স্বরে ঠোঁট প্রায় না নাড়িয়ে ওয়েনেগকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আরো মৃদু গলায় আমার প্রশ্নের জবাব দিল ওয়েনেগ। ফারাওয়ের নির্দেশ। এরা আপনাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিশাপ দিতে এসেছে, আবর্জনা ছুঁড়ে মারতে এসেছে আপনার গায়ে। ফারাও বলেছেন, যতভাবে সম্ভব আপনাকে অপমান করা হবে।

এ জন্যই আমার পোশাক খুলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সে। আমিও এতক্ষণ ভাবছিলাম আমার পোশাক খুলে নেওয়ার জন্য ফারাওয়ের এত ব্যস্ত তা কেন। এখন কারণটা বুঝতে পারছি। সে চায় আমি যেন ওই আবর্জনার স্পর্শ অনুভব করি। বেশ। তোমরা কিন্তু আমার বেশি কাছাকাছি থেকো না, তাহলে তোমাদের গায়েও লাগতে পারে।

আমি আপনার ঠিক এক কদম পেছনেই থাকব। যা আপনি সহ্য করতে পারবেন টাইটা তা আমিও সহ্য করতে পারব।

অনেক বেশি সম্মান দিচ্ছ আমাকে ওয়েনেগ, প্রতিবাদ জানালাম আমি।

তারপর নিজেকে শক্ত করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম ক্রোধান্বিত জনসমুদ্রের মাঝে। শুনতে পাচ্ছি আমার প্রহরীরাও সবাই আমার কাছাকাছি রয়েছে, কেউ আমাকে অপমানের মুখে একা যেতে দিতে রাজি নয়। তাড়াহুড়ো করছি না আমি, আবার ধীরে ধীরেও হাঁটছি না। স্বাভাবিক পদক্ষেপে মাথা উঁচু রেখে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি কেবল। জনসমুদ্রের মাঝে ভেসে থাকা মুখগুলো পরীক্ষা করলাম, এক এক করে ঘৃণার চিহ্ন খুঁজছি। অপেক্ষা করছি কখন তাদের অপমানের ঝড় আছড়ে পড়বে আমার ওপর।

তারপর একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মুখ আরো পরিষ্কার হয়ে আসতে হঠাৎ বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম আমি। উপস্থিত মহিলাদের অনেকের চোখেই অশ্রু। এটা তো আমি আশা করিনি। পুরুষদের চেহারা গম্ভীর, এমনকি ব্যাপারটা এতই অচিন্তনীয় যে, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে মন চাইল না- বিষণ্ণ হয়ে আছে, যেন শেষকৃত্যে অংশ নিতে এসেছে তারা।

হঠাৎ করেই সশস্ত্র প্রহরীদের সীমানা এড়িয়ে এক মহিলা সামনে চলে এলো। প্রহরীদের রাখা হয়েছে ইচ্ছে করেই, যেন তারা ভিড় সামলে রাখতে পারে। আমার কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে এসে থামল মহিলা, কিছু একটা ছুঁড়ে মারল আমার দিকে। জিনিসটা আমার পায়ের কাছে পড়ল। ঝুঁকে এসে শিকলে বাঁধা দুই হাত দিয়ে সেটা পাথরের মেঝে থেকে তুলে নিলাম আমি।

ফারাওয়ের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো আবর্জনা বা মানুষের বর্জ্য নয় সেটা, বরং নীলনদের পানি থেকে তুলে আনা একটা অদ্ভুত সুন্দর নীলপদ্ম ফুল। সাধারণত দেবতা হোরাসের পুজো দিতে এই ফুল ব্যবহার করা হয়। ভালোবাসা এবং গভীর সম্মানের প্রতীক এটা।

প্রহরীদের সারি থেকে দুজন এগিয়ে এলো মহিলার দিকে। তার দুই হাত ধরল তারা; কিন্তু কারো চেহারায় রাগের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। শান্ত ভঙ্গিতে মহিলাকে ধরে রেখেছে তারা, দুজনের চেহারাই বিষণ্ণ।

টাইটা! বলে উঠল মহিলা। আমরা তোমাকে ভালোবাসি।

তার পরেই জনতার সমুদ্রের মাঝখান থেকে দ্বিতীয় একটা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে উঠল, টাইটা! তারপর আরো একজন বলে উঠল টাইটা! হঠাৎ করেই যেন একজন মানুষ থেকে শুরু করে হাজার মানুষের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আমার নাম।

দ্রুত আপনাকে শহরের প্রাচীরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে, আমার কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বলল ওয়েনেগ ফারাও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সরে যেতে হবে আমাদের। না হলে তার ক্রোধ থেকে কেউ রেহাই পাবে না। কিন্তু এসব কী হচ্ছে আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না? আমিও পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিলাম। এবার আর কোনো কথা বলল না ওয়েনেগ, শুধু আমার বাহু চেপে ধরল শক্ত করে। আরেক হাত চেপে ধরল ওয়েনেগের অধীনের আরেকজন লোক। আমাকে প্রায় মাটি থেকে তুলে নিয়ে পথ ধরে দৌড়ে চলল দুজন। প্রতি মুহূর্তে কমে আসছে পথের প্রস্থ, কারণ দুই পাশে জড়ো হওয়া জনতা আমাদের দিকে সরে আসছে। সবার উদ্দেশ্য হয় আমাকে ছুঁয়ে দেখা অথবা জড়িয়ে ধরা; আসলে কোনটা সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।

পথের শেষ প্রান্তে রথের সারি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওয়েনেগের সহকারীরা। জনসমুদ্র আমাদের ওপর সম্পূর্ণভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সেখানে পৌঁছে গেলাম আমরা। এই হইচইয়ের কারণে ঘোড়াগুলো বেশ ভয় পেয়ে গেছে, তবে আমরা রথে ওঠার সাথে সাথেই চালকরা তাদের লাগামে টান দিল। নুড়ি বিছানো পথ ধরে রথ নিয়ে দৌড়ে চলল ঘোড়াগুলো, উদ্দেশ্য শহরের প্রধান দরজা। খুব তাড়াতাড়িই জনতার ভিড়কে পেছনে ফেলে এলাম আমরা। শহরের প্রধান ফটক যখন আমাদের চোখে পড়ল তখন তা বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করেছে। মরিয়া হয়ে সঙ্গীদের মাথার ওপর চাবুক ফুটিয়ে তাড়া দিল ওয়েনেগ, ফটক বন্ধ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সরু পথটা দিয়ে বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলাম আমরা।

.

যাচ্ছি কোথায় আমরা? কোনোমতে বলে উঠলাম আমি। কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না ওয়েনেগ, শুধু আমার হাতকড়ার চাবিটা তুলে দিল আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তীরন্দাজের হাতে। রথের ঝাঁকুনি থেকে আমি যেন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, এ জন্য আমাকে ধরে রেখেছিল লোকটা। আগে বাঁধন খুলে দাও, তারপর ম্যাগাসের শরীর ঢাকার ব্যবস্থা করো। আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না ওয়েনেগের মাঝে, তবে চেহারায় বেশ রহস্যময় একটা ভাব ফুটিয়ে তুলল সে।

কী দিয়ে আমার শরীর ঢাকবে ভেবেছ? নিজের প্রায় নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি। এবারও আমার প্রশ্নের কোনো জবাব মিলল না, তবে ওয়েনেগের তীরন্দাজ রথের নিচ থেকে একটা কাপড়ের পুঁটলি তুলে নিয়ে ধরিয়ে দিল আমার হাতে।

আপনি যে এত বিখ্যাত আমি জানতামই না, বলে উঠল তীরন্দাজ। পুঁটলি থেকে একটা সবুজ টিউনিক বের করে মাথায় গলালাম আমি। পুঁটলিতে এই একটা কাপড়ই আছে, ফলে বেশ বিরক্ত হলেও এটাই পরতে হবে আমাকে। সবুজ রংটা একেবারেই আমার পছন্দ নয়, কারণ আমার চোখের রংকে সম্পূর্ণ ম্লান করে দেয় এই রঙের পোশাক। ওরা কীভাবে আপনার নাম ধরে ডাকছিল শুনেছেন? উত্তেজিত গলায় বলে চলেছে তীরন্দাজ। আমি তো ভেবেছিলাম আপনাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে; কিন্তু না। ওরা তো আপনাকে ভালোবাসে! পুরো মিশর আপনাকে ভালোবাসে, টাইটা। লোকটার কথা শুনে লজ্জা লাগতে শুরু করল আমার, সুতরাং সেটা ঢাকার জন্য ওয়েনেগের দিকে তাকালাম আমি।

নির্যাতন ভবনে ভুগের কাছে পৌঁছানোর জন্য এটাই সবচেয়ে ছোট রাস্তা বলে তো মনে হয় না, বললাম আমি। এবার আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল ওয়েনেগ। ডুগের সাথে আপনার দেখা করার শখটা মেটাতে পারছি না বলে দুঃখিত প্রভু। এখন আসলে সম্মানিত ডুগের বদলে অন্য আরেকজনের সাথে দেখা করতে হবে আপনাকে। চাবুক চালিয়ে রথের গতি আরো বাড়িয়ে তুলল ওয়েনেগ। নীলনদের বন্দরের দিকে যে রাস্তা গেছে সেটা ধরে এখন ছুটছে আমাদের রথ। তবে বন্দরে পৌঁছানোর আগেই আরো একবার রথের মুখ ঘোরাল সে, এবার উত্তরমুখী একটা রাস্তায়, যেটা নদীর সাথে সমান্তরালে এগিয়ে গেছে। একই রকম দ্রুতগতিতে বেশ কয়েক লিগ পথ চলতে হলো আমাদের। একই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করে ওয়েনেগের চোখে নিজেকে অধৈর্য প্রমাণ করতে চাই না বলে চুপ করে থাকলাম আমি। এমনিতে আমার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই- রাগের চিহ্ন আমি কখনো চেহারায় প্রকাশ করি না। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি তার এই রহস্যময় নীরবতা একটু হলেও বিরক্ত করে তুলেছে আমাকে।

নদীর তীরে জন্মানো ঘন জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে নদীর রুপালি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু চেহারা ভাবলেশহীন করে রাখলাম আমি, পুব দিগন্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা দূরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর হঠাৎ ওয়েনেগকে উত্তেজিত গলায় বলতে শুনলাম, এই তো! যেখানে কথা ছিল সেখানেই আছেন দেখা যায়!

আমিও ঘুরে তাকালাম, তবে একেবারেই আস্তে আস্তে অলস ভঙ্গিতে। কিন্তু হঠাৎ করেই রথের ওপর ঝাঁকি খেয়ে সোজা হয়ে বসলাম আমি। নীলনদের কিনার থেকে মাত্র এক শ কদমের মতো দূরত্বে নোঙর করে দাঁড়িয়ে আছে। মিশরীয় নৌবাহিনীর প্রধান জাহাজ, নিঃসন্দেহে যেটা অন্য সব জাহাজের চাইতে বেশি শক্তিশালী এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন। দৌড়ের পাল্লায় অন্য সব জাহাজকে হারিয়ে দিতে পারে সে, নিজের ওপর ধারণ করতে পারে এক শ দক্ষ নাবিক ও যোদ্ধার ভার।

আর শান্ত হয়ে বসে থাকা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তড়বড় করে বলে উঠলাম, দেবী হাথোরের বিশাল বক্ষ আর পিচ্ছিল যোনির কসম! এ তো মেমনন!

দেবতা পোসাইডনের বিশাল পুরুষাঙ্গ আর উত্তাল অণ্ডকোষের কসম! জীবনে বোধ হয় প্রথমবারের মতো সঠিক কোনো কথা বললেন আপনি, টাইটা, আমার কথার জবাবে পাল্টা ঠাট্টা করে উঠল ওয়েনেগ।

এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম আমি। তারপর নিজেকে সামলাতে না পেরে হেসে উঠলাম, জোরে একটা ঘুষি মারলাম ক্যাপ্টেনের দুই কাঁধের মাঝখানে। এত সুন্দর একটা জাহাজ আমাকে দেখানো মোটেই উচিত হয়নি তোমার। এখন যত সব উদ্ভট চিন্তা খেলা করতে শুরু করেছে আমার মাথায়।

স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, ওই উদ্দেশ্যেই কাজটা করেছি আমি। এই কথা বলে নিজের রথের ঘোড়াগুলোর লাগাম টেনে ধরল ওয়েনেগ। দাঁড়া! শক্তিশালী প্রাণীগুলো মাথা ঝাঁকাল, ঘাড় বাঁকিয়ে টানটান করে তুলল লাগাম। নদীর কিনারে ঝাঁকি খেয়ে থেমে দাঁড়াল রথ। আমাদের সামনে নীলনদের তীরে এখন ভাসমান অবস্থায় দেখা যাচ্ছে বিশাল যুদ্ধজাহাজটাকে।

নদীর তীরে আমাদের দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে মেমননের নাবিকরা ব্যস্ত হয়ে উঠল। ক্রুশ আকৃতির ভারী তামার নোঙরটা পানি থেকে ওঠাতে শুরু করল কয়েকজন। তারপর ছোট ছোট পাল আর মৃদু পশ্চিমা বাতাসের সাহায্য নিয়ে জাহাজটা ধীরে ধীরে তীরের দিকে এগোতে শুরু করল, যেখানে আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

আমার উৎসাহই সবার চাইতে বেশি, কারণ আমি অনুভব করতে পারছি যে মুক্তি আসন্ন। নির্যাতন-নিপীড়নের ভবনে ভুগের সাথে আরো একবার দেখা করার হাত থেকে এবারের মতো বেঁচে গেছি আমি।

মেমনন হচ্ছে আমার প্রিয় ফারাও টামোসের ছোটবেলার নাম। হিকসস তীরের আঘাতে তার মৃত্যুর পর খুব সামান্য সময়ই পার হয়েছে। নীলের পশ্চিম তীরে রাজাদের উপত্যকায় তৈরি হয়ে আছে তার কবর; কিন্তু সেখানে শোয়ানোর আগে মৃতদেহের জন্য জরুরি মমীকরণ প্রক্রিয়াও এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। ফারাও টামোস সেখানে তার পূর্বপুরুষদের সাথে অনন্ত বিশ্রামে শায়িত হবেন।

আর এই মেমনন আদতে বিশালাকৃতির এক জাহাজ। তার গঠন সম্পর্কে আমার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানা আছে, কারণ নকশাটা মূলত আমিই তৈরি করেছিলাম, যদিও তা কেউ জানে না। আমার বদলে ফারাও টামোসই সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তার নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছিলেন; কিন্তু এখন তিনি মৃত। আর মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে তার কৃতিত্ব কেড়ে নেওয়ার মতো খারাপ মানুষ আমি নই। মেমননের খোলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব হবে এক শ কিউবিটের বেশি। সম্পূর্ণ ধারণক্ষমতা পূরণ করা হলে তিন হাজার কিউবিট পর্যন্ত পানি সরাতে পারে। প্রতি পাশে তিনটি ভাগে মোট ছাপ্পান্নটা দাঁড়। দাঁড়িদের বসার জায়গাগুলো নিচের দিকে বেশ ছড়ানো এবং ওপরের দিকের সারির সাথে আছে ভারসাম্য রক্ষার বাড়তি কাঠামো, ফলে দাঁড়ের সাথে দাঁড় বাড়ি খায় না কখনো। চওড়ায় তেরো কিউবিটেরও কম, ফলে জলপথে তীরবেগে ছুটতে পারে, আবার চড়ায় থামাতেও অসুবিধা হয় না। একমাত্র মাস্তুল চাইলে নামিয়ে ফেলা যায় আবার ইচ্ছে করলে বিশাল পালও খাটানো যায় তাতে। সত্যিই রণতরীদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর নকশার জাহাজ এই মেমনন।

জাহাজটা নদীর পাড়ে নোঙর করতে দীর্ঘদেহী রহস্যময় এক আগন্তুককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম পেছনের ডেকে। পরনে লাল রঙের আলখাল্লা, একই রঙের কাপড়ে ঢেকে রেখেছে মুখ। শুধু চোখের জায়গায় ফুটো করা। মনে হচ্ছে যেন নিজের পরিচয় সবাইকে জানাতে আপত্তি আছে এই লোকের। নাবিকরা জাহাজটাকে জায়গামতো বেঁধে রাখছে, এই সময় নিচে নেমে গেল সে। তার চেহারা দেখার বা পরিচয় আন্দাজ করার কোনো সুযোগই পেলাম না আমি।

কে ওটা? ওয়েনেগকে প্রশ্ন করলাম এবার। তার সাথেই কি দেখা করতে এসেছি আমরা?

মাথা নাড়ল ওয়েনেগ। আমি কিছু বলতে পারব না। এখানেই তীরেই আপনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাকে।

দ্বিধা না করে মেমননের সামনের ডেকে উঠে পড়লাম আমি, তারপর লম্বা লম্বা পায়ে ডেক পার হয়ে পেছনের ডেকে চলে এলাম। এখানে একটা গোলাকৃতি দরজা দিয়ে রহস্যময় লোকটা নিচে নেমে গেছে। ডেকের ওপর পা দিয়ে জোরে আঘাত করলাম আমি। সাথে সাথে একটা ভারী কিন্তু ভদ্র কণ্ঠস্বরে জবাব এলো। গলাটা চিনতে পারলাম না আমি।

দরজা খোলা আছে। নেমে আসুন আর দরজাটা বন্ধ করে দিন।

কথামতো কাজ করে নিচের কামরায় নেমে এলাম আমি। ছোট্ট একটা ঘর, নড়াচড়ার জায়গা বেশি নেই। কারণ এটা একটা যুদ্ধজাহাজ, প্রমোদতরী নয়। একটু আগে দেখা সেই লাল পোশাক পরা আগন্তুক এখানেই বসে আছে। উঠে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টা করল না সে, শুধু সামনে রাখা সরু বেঞ্চটা দেখিয়ে দিল।

এমন পোশাক পরে থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারবেন যে কেন সবার কাছ থেকে আমার চেহারা লুকিয়ে রাখা জরুরি, অন্তত কিছু সময়ের জন্য। ছোটবেলায় আপনাকে খুব ভালোভাবেই চিনতাম আমি; কিন্তু পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া আপনি আমার বাবাকেও খুব ভালোভাবে চিনতেন, যিনি অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন আপনাকে। এবং বর্তমানে আমার বড় ভাই, যে আপনার ব্যাপারে খুব একটা খুশি নয়…

কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই সামনে বসে থাকা মানুষটার পরিচয় সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম আমি। তাকে সম্মান দেখানোর জন্য তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াতে চাইলাম এবং কাজটা করতে গিয়ে দড়াম করে মাথায় বাড়ি খেলাম ডেকের সাথে। লেবানন থেকে আনা আসল সিডার কাঠের তৈরি ডেক, তার তুলনায় আমার মাথার খুলি কিছুই নয়। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে আবার বেঞ্চে বসে পড়লাম আমি, বাম চোখের ওপর দিয়ে রক্তের সরু ধারা গড়িয়ে। পড়তে শুরু করেছে।

আমার সামনে বসে থাকা মানুষটা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। তবে আমার মতো বোকামি করল না সে, মাথা নিচুই রাখল। নিজের মাথা থেকে লাল রঙের। কাপড়টুকু খুলে ফেলল সে, পাকিয়ে গোল আকৃতি দিল। তারপর সেটা আমার ক্ষতস্থানে চেপে ধরে চেষ্টা করতে লাগল রক্ত বন্ধ করার।

আপনিই প্রথম নন যে এখানে বাড়ি খেয়েছে, আমাকে আশ্বস্ত করল সে। ব্যথা লাগে ঠিক, তবে গুরুতর কিছু যে নয়, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, সম্মানিত টাইটা। এখন যেহেতু তার মুখ ঢেকে রাখা কাপড়টুকু আমার মাথার পরিচর্যায় ব্যস্ত, সেহেতু ইনি যে সত্যিই যুবরাজ রামেসিস সে ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ রইল না আমার মনে।

এটাই কিছুই নয় মহামান্য যুবরাজ। আমার বোকামির একটু শাস্তি পেয়েছি আর কি। রামেসিসের কাছ থেকে সহানুভূতি পেয়ে কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েছি আমি, তবে একই সাথে মাথা ঠাণ্ডা রেখে যুবরাজকে কাছ থেকে দেখার সুযোগটাও কাজে লাগাচ্ছি পুরোদমে।

রামেসিসের পদবি হচ্ছে নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল। নিজের কর্তব্যে সে এতই অবিচল যে, নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ সৈনিকদের ছাড়া অন্য কারো সাথে প্রায় দেখাই যায় না তাকে। তার নিজের বাবার ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। যদিও ছোটবেলায় তার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি আমি; ড্রাগন এবং অন্যান্য দানবের খপ্পর থেকে কীভাবে সুন্দরী রাজকুমারীকে উদ্ধার করে রাজপুত্র সেই গল্প শুনিয়েছি। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি আমরা। সম্পূর্ণভাবে নিজের বাবার প্রভাবে বড় হয়েছে রামেসিস। তারপর থেকে আর কখনো তাকে জানার সুযোগ হয়নি আমার। এখন তাই তার সাথে তার বাবা ফারাও টামোসের মিল লক্ষ্য করে অবাক না হয়ে পারলাম না আমি। এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই মিল তার প্রতি আমার সব সময়ের উঁচু ধারণা আরো বাড়িয়ে তুলল। সত্যি কথা বলতে, বাবার চাইতেও সুদর্শন হয়েছে সে। যদিও কথাটা ভাবতে বিবেকের একটু দংশন অনুভব করলাম আমি; কিন্তু কথাটা ঠিক।

রামেসিসের চোয়ালের গঠন আরো শক্তিশালী, দাঁতগুলো ধবধবে সাদা। তার বাবার চাইতেও সামান্য বেশি লম্বা সে; কিন্তু কোমর আরো বেশি সরু। হাত পা আরো বেশি টান টান। গায়ের রং অনেকটা যেন কড়া সোনালি; তার মা রানি মাসারার কাছ থেকে পাওয়া আবিসিনীয় রক্তের চিহ্ন। চোখগুলো আরো উজ্জ্বল, আরো বেশি গাঢ় রঙের। তাতে তীক্ষ্ণ কিন্তু একই সাথে দয়ালু এবং বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি।

মুহূর্তের মাঝেই তার প্রতি আবারও আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম আমি, যেন মাঝখানে কেটে যাওয়া এতগুলো বছরের কোনো অস্তিত্বই ছিল না কখনো। তার পরবর্তী কথাগুলো যেন আমার চিন্তাকেই প্রতিফলিত করল: আমাদের মাঝে অনেক মিলই আছে টাইটা। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় মিল হলো আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া শত্রুতা। আমাদের দুজনের লাশ দেখার আগে কোনোভাবেই থামবে না ফারাও উটেরিক টুরো। আপনি ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। আমার শাস্তি এখনো প্রকাশ্যে নির্ধারিত না হলেও আপনার চাইতে আমাকে কম ঘৃণা করে না উটেরিক।

কেন? জানতে চাইলাম আমি। আপনার ভাই আপনাকে ঘৃণা করছে কেন? প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে কোনো দ্বিধা বোধ করলাম না আমি। মনে হচ্ছে যেন এই লোকটার সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই, কখনো ছিল না। এর কাছে আমার কিছু লুকোনোর নেই, তেমনি আমার কাছেও কিছু লুকোনোর নেই তার।

কারণটা খুব সাধারণ। ফারাও টায়োস আপনাকে এবং আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন, তার বড় ছেলে উটেরিকের চাইতেও বেশি। এক মুহূর্ত বিরতি নিল রামেসিস, তারপর বলে চলল: আরেকটা কারণ হচ্ছে, আমার ভাই একজন উন্মাদ। তার বিকৃত মনের মাঝে বাস করা কাল্পনিক দানব আর প্রেতাত্মারা সর্বক্ষণ তাড়া করে ফেরে তাকে। নিজের চাইতে জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান যেকোনো ব্যক্তিকে সরিয়ে দিতে চায় সে।

এটা কি আপনি নিশ্চিতভাবে জানেন? প্রশ্ন করলাম আমি। মাথা ঝাঁকাল রামেসিস।

অবশ্যই। তথ্য সংগ্রহের নিজস্ব রাস্তা আছে আমার টাইটা, ঠিক যেমন আছে আপনার। গোপনে শুধু নিজের চাটুকারদের কাছেই আমার সম্পর্কে নিজের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব ব্যক্ত করেছে উটেরিক।

তাহলে এখন আপনি কী করতে চান? প্রশ্ন করলাম আমি এবং রামেসিসের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসা জবাবটা আমার কানে এমনভাবে বাজল, মনে হলো যেন আমি নিজেই বলেছি কথাগুলো।

ওকে খুন করার কথা আমি ভাবতেও পারব না। আমার বাবা ওকে ভালোবাসতেন, এই চিন্তাটুকুই আমার হাত থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাই বলে সে যদি আমাকে খুন করতে আসে তাহলেও আমি চুপ করে বসে থাকব না। আজই মিশর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। শান্ত যুক্তিপূর্ণ গলায় কথা বলল সে। আপনি কি আমার সাথে আসবেন, টাইটা?

অত্যন্ত আনন্দের সাথেই আপনার বাবার সেবা করেছি আমি, জবাব দিলাম আমি। আপনার জন্যও সেটা করতে পারলে সৌভাগ্য বোধ করব। আপনিই সেই রাজপুত্র, যার ফারাও হওয়া উচিত। সামনে এগিয়ে এসে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে আমার ডান হাত চেপে ধরল সে। আমি বলে চললাম, তবে আরো কিছু মানুষ আছে যারা আমার জন্য নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেছে।

হ্যাঁ, আপনি কাদের কথা বলছেন আমি জানি, জবাব দিল রামেসিস। ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ আর তার অধীনস্ত সৈন্যরা সবাই বিশ্বাসী এবং দক্ষ লোক। তাদের সাথে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে আমার। ঠিক হয়েছে আমাদের সাথেই যাবে সবাই।

মাথা কঁকালাম আমি। তাহলে আর কোনো সমস্যা দেখছি না আমি। আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন আমিও সেখানেই যাব, প্রভু রামেসিস। যদিও সেই জায়গাটা কোথায় আমি খুব ভালো করেই জানি, এমনকি যুবরাজ নিজেও হয়তো এত ভালোভাবে জানে না। তবে এখন সে ব্যাপারে কথা বলার সময় নয়।

আবার ডেকে উঠে এলাম আমরা দুজন। দেখলাম নদীর তীরে ইতোমধ্যে রথগুলো খুলে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে ফেলেছে ওয়েনেগ আর তার লোকেরা। এখন সেই টুকরোগুলো তোলা হচ্ছে জাহাজের ডেকে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে নিচের মাল রাখার জায়গায়। এরপর ঘোড়াগুলোকেও জাহাজে তুলে নিচে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে পাল তোলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল মেমনন। তীর থেকে সরে এলাম আমরা, উত্তর দিকে তাক করলাম জাহাজের মুখ। পালে আছে পর্যাপ্ত বাতাস, সেইসাথে নদীর ঢেউও আমাদের অনুকূলে। তার ওপরে নীলনদের জলে ফেনা তুলছে দাঁড়িদের ছন্দবদ্ধ দাঁড় টানা। তীর গতিতে উত্তর দিকে খোলা সাগর অভিমুখে এগিয়ে চললাম আমরা; ফারাওয়ের বিষাক্ত প্রভাব থেকে অনেক দূরে।

.

দীর্ঘজীবন পাওয়ার অন্যতম প্রধান সুবিধা হচ্ছে যেকোনো ক্ষত থেকে খুব দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষমতা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমার মাথায় তৈরি হওয়া ক্ষত থেকে রক্ত বের হওয়া থেমে গেল। শুকনো চামড়া জমতে শুরু করল সেখানে। নীলনদ যেখানে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে, সেই মোহনায় পৌঁছনোর আগেই ডুগ আর তার সঙ্গীদের অত্যাচারে আমার গায়ে তৈরি হওয়া চাবুকের দাগ এবং অন্যান্য কাটাছেঁড়াগুলো ভালো হয়ে গেল পুরোপুরি। আরো একবার পূর্ণ যুবকের মতো কান্তিময় হয়ে উঠল আমার চামড়া।

নদীপথ ধরে উত্তর দিকে সাগর অভিমুখে চলতে থাকার এই দিনগুলোতে যুবরাজ রামেসিসের সাথে আমার সম্পর্ক আবারও ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ পেলাম আমি।

আমাদের ওপর পরবর্তী যে সিদ্ধান্তের ভারটা নেমে এলো সেটা হচ্ছে মিশর ছাড়ার পর আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য নির্ধারণ করা। আমার মনে হচ্ছিল রামেসিস নিশ্চয়ই পৃথিবীর শেষ প্রান্তে হাথোরের পাথুরে দরজার মাঝ দিয়ে যেতে চায় জাহাজ নিয়ে, ওপাশে কী আছে দেখতে চায়। কিন্তু ওপাশে কী আছে আমি খুব ভালো করেই জানি। ওপাশে আছে শুধু নিঃসীম শূন্যতা। আমরা যদি সত্যিই ওই পথে এগোনোর মতো বোকামি করি তাহলে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত দিয়ে নিচে পড়ে যাব, তারপর অনন্তকাল ধরে নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মাঝ দিয়ে কেবল পড়তেই থাকব।

এটাই যে আমাদের কপালে ঘটবে, সেটা নিশ্চিত হচ্ছ কী করে? প্রশ্ন করল রামেসিস। খুব দ্রুতই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি আমরা, সম্বোধনও বদলে গেছে।

কারণ ওই দরজা থেকে এখন পর্যন্ত কেউ ফিরে আসতে পারনি, খুব স্বাভাবিক গলায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম আমি।

সেটা কীভাবে জানো তুমি? আবারও প্রশ্ন করল ও।

ওখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছে এমন একজনের নাম বলো তো? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম আমি।

হিসপানের স্কিভা।

এই নাম কখনো শুনিনি আমি। কে ছিল সে?

তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ভ্রমণকারী। আমার দাদার বাবার সাথে তার দেখা হয়েছিল।

কিন্তু তোমার সাথে কখনো তার দেখা হয়নি, তাই তো?

উম, না। বুঝতেই পারছ আমার জন্মের আগেই তিনি মারা গেছেন। তবে আমার বাবা আমাকে সেনেবসেনের গল্প শুনিয়েছিলেন।

তোমার বাবাকে আমি কতটা সম্মান করতাম নিশ্চয়ই তুমি জানো। তবে এই সেনেবসেনের গল্প নিয়ে তার সাথে কখনো আলোচনা করার সুযোগ হয়নি আমার। তা ছাড়া হাথোরের দরজার ওপাশে সত্যিই কী আছে সেটা তৃতীয় কোনো ব্যক্তির মুখ থেকে শুনে বিশ্বাস করতে চাই না আমি, বিশেষ করে যখন সেখানে নিজে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে হচ্ছে আমাকে।

তবে সৌভাগ্যক্রমে দুই রাত পরে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম রাজকুমারী বেকাথা এবং তেহুতি তাদের সন্তানদেরসহ ফারসিয়ান জলদস্যুদের হাতে ধরা পড়েছে। টারকুইস্ট নামে এক ভয়ানক সাগর দানবকে উৎসর্গ করার জন্য সাগরতীরে একটা পাথরের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাদের। পাখা আছে সেই দানবের, ফলে ইচ্ছে করলে বাতাস কেটে পাখির মতো উড়ে চলতে পারে, আবার মাছের মতো সাঁতার কাটতে পারে পানিতে। পঞ্চাশটা মুখ আছে তার, যেগুলো মানুষ খাওয়ার জন্য সর্বদা লালায়িত। সেই মুখগুলোর এক কামড়ে ভেঙে ফেলতে পারে মানুষের তৈরি যেকোনো জাহাজ।

স্বাভাবিকভাবেই রামেসিসকে এই স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে দ্বিধাবোধ করতে লাগলাম আমি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিশরীয় রাজপরিবারের প্রতি আমি যে পবিত্র শপথ নিয়েছি তা আমাকে পালন করতেই হবে। রামেসিস অবশ্য ভবিষ্যদ্রষ্টা এবং স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যাকারী হিসেবে আমার খ্যাতির কথা অনেক আগে থেকেই জানে। স্বপ্ন সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যাটুকু চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনল ও, তারপর নিজে কোনো মতামত না দিয়ে চলে গেল জাহাজের সামনের ডেকে। বিকেলের বাকি সময়টুকু সেখানেই কাটাল সে। সূর্য ডোবার সময় উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে ফিরে এলো এবং কোনো সময় নষ্ট না করে অল্প কথায় খুলে বলল নিজের মতামত।

আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি, আমার বাবা মহান ফারাও টামোস যখন আমার দুই ফুপুকে ক্রিটের রাজা মিনোসের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোমার দায়িত্বে পাঠিয়েছিলেন তখন তাদের ভাগ্যে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল সেটা আমাকে খুলে বলার জন্য। আমি জানি যে তারা আমার বাবার নির্দেশ পালন করেছিলেন, মিনোসকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তার পরেই ক্রোনাস পর্বতের ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে তাদের মৃত্যু হয়। আমার বাবা আমাকে এটাই বলেছিলেন। কিন্তু আমার ভাই উটেরিক তোমাকে বিশ্বাসঘাতকতা এবং মিথ্যে বলার অভিযোগে দণ্ডিত করেছে। উটেরিকের মতে ওই অগ্ন্যুৎপাতে আমার দুই ফুপু বেঁচে যান; কিন্তু তাদের স্বামী মিনোসের মৃত্যু হয়। তারপর তারা নিজেদের দায়িত্ব অনুযায়ী মিশরে ফিরে না এসে জারাস এবং হুই নামের দুই দলত্যাগী সৈনিকের সাথে অদৃশ্য হয়ে যান। উটেরিকের এই কথাগুলোকে আমি পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু এখন তোমার এই স্বপ্ন যেন তাদের বেঁচে থাকার দিকেই ইঙ্গিত করছে। কথা থামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল ও। সত্যি কথাটা বলো আমাকে টাইটা। আসলে কী ঘটেছিল আমার দুই ফুপুর ভাগ্যে?

কিছু অসুবিধা ছিল সে সময়, প্রশ্নটার জবাব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম আমি।

এটা কোনো জবাব হলো না, বলে উঠল রামেসিস। অসুবিধা ছিল বলতে আসলে কী বোঝাতে চাইছ তুমি?

তার চেয়ে বরং তোমাকে আরেকটা উদাহরণ দিই, রামেসিস।

মাথা ঝাঁকাল ও। বলো। আমি শুনছি।

মনে করো মিশরের রাজপরিবারের এক রাজপুত্র হঠাৎ জানতে পারল বর্তমান ফারাও অর্থাৎ তার বড় ভাই তাকে কোনো কারণ ছাড়াই খুন করতে চায়। ফলে দেশে থেকে প্রাণ হারানোর চাইতে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। এটাকে কি তুমি কর্তব্যের অবহেলা বলে ধরবে? প্রশ্ন করলাম আমি। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল রামেসিস। সামনে-পেছনে দুলছে মৃদু মৃদু যেন কী বলবে ঠিক করতে পারছে না।

শেষ পর্যন্ত জোরে জোরে কয়েকবার মাথা ঝাঁকাল ও, যেন চিন্তাভাবনাগুলো পরিষ্কার করতে চাইছে। মৃদু গলায় বলল, তুমি জানতে চাইছ এই ধরনের পরিস্থিতিকে আমি ব্যতিক্রম বলে স্বীকার করব কি না?

হ্যাঁ। করবে?

আমার মনে হয় সেটাই উচিত হবে, স্বীকার করল ও এবং হেসে ফেলল।

ইতোমধ্যে কাজটা করে ফেলেছি আমি।

সুযোগ চিনতে ভুল করলাম না আমি। বেশ। এবার তাহলে তোমার দুই ফুপুর কথা বলি। অত্যন্ত ভালো মেয়ে ছিল তারা, সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং অত্যন্ত অনুগত। তোমার বাবা তাদের ক্রিটে পাঠিয়েছিলেন মিনোসের স্ত্রী হতে। তাদের অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল আমাকে। তোমার বাবা এবং মিশরের প্রতি নিজেদের কর্তব্য খুব ভালোভাবেই পালন করেছিল তারা। যদিও তাদের দুজনেরই ভালোবাসার মানুষ ছিল, তবু মিনোসকে বিয়ে করে তারা। তারপর যখন ক্রোনাস পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতে মিনোস মারা গেলেন তখন হঠাৎ করে মুক্তি মিলে গেল তাদের। তখন তারা তাদের প্রেমিকদের সাথে পালিয়ে যায় এবং তাদের আটকানোর বদলে আমি বরং সাহায্য করি এই কাজে।

আমার কথাগুলো শুনতে শুনতে বিস্ময়ের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়ছে রামেসিসের। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ। তোমার দুই ফুপুই এখনো বেঁচে আছে, বললাম আমি।

সেটা তুমি কীভাবে জানো? জানতে চাইল ও।

কারণ মাত্র মাসখানেক আগেই তাদের স্বামীদের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমার ইচ্ছে তুমি ওদের সাথে দেখা করো। ইচ্ছে করলে ছদ্মবেশেও থাকতে পারো তুমি। টামোসের পরিবারের সদস্য নয়, স্রেফ মেমননের ক্যাপ্টেন হিসেবে। একমাত্র তাহলেই তোমার নিজের পালিয়ে আসার সিদ্ধান্তের সাথে ওদের সিদ্ধান্তের তুলনা করতে পারবে তুমি, বুঝতে পারবে ওরা সঠিক কাজটা করেছি কি না।

তার পরেও যদি আমার ধারণায় কোনো পরিবর্তন না আসে?

তাহলে তোমার সাথে হাথোরের দরজা পর্যন্ত যাব আমি, জাহাজ নিয়ে পৃথিবীর কিনার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ব অসীমের মাঝে।

উচ্চ স্বরে হেসে উঠল রামেসিস। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিতে পারল। হাসির চোটে চোখ থেকে বেরিয়ে আসা পানি মুছে জানতে চাইল, এই দুই রহস্যময় মহিলাকে কোথায় পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই জানো তুমি?

জানি।

তাহলে পথ দেখাও, আমন্ত্রণ জানাল ও।

*

দুই দিন পর আর তেমন কোনো দেরি ছাড়াই নীলের অববাহিকায় এসে পৌঁছলাম আমরা। হিকসস নৌবাহিনী ধ্বংস হয়ে গেছে, এখন আর এমন কোনো জাহাজ নেই যা আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারে। মেমনন নামের মানুষটি যেমন ভূভাগের ওপর একচ্ছত্র রাজত্ব করে গেছে তেমনি একই নামের জাহাজটাও জলপথে বিস্তার করেছে পূর্ণ আধিপত্য। আমাদের সামনে এখন ভূমধ্যসাগরের বিশাল জলরাশি। নীলনদের সাতটি মুখের মাঝে সবচেয়ে বড় যে মুখ সেই ফাতনিক অববাহিকা দিয়ে সাগরে প্রবেশ করলাম আমরা। বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় আরো একবার জাহাজ নিয়ে চড়তে পেরে আনন্দে ভরে উঠল আমার মন।

আমি জানি উত্তরমুখী যে পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তাতে হয়তো বেশ কয়েক দিন, এমনকি সপ্তাহখানেক পর্যন্ত ডাঙার কোনো চিহ্ন না দেখেই থাকতে হবে আমাদের। বছরের এই সময়টায় খুব সম্ভব সূর্যও দীর্ঘ সময় মেঘে ঢাকা থাকবে। এবং এমন পরিস্থিতিতে জাহাজ চালানো সত্যিই খুব কঠিন। তাই রামেসিসকে আমার জাদুর মাছটা দেখাব বলে ঠিক করলাম। বহু বছর আগে এক আফ্রিকান ওঝা আমাকে এই জিনিসটা দিয়েছিল। সাপের কামড় থেকে তার বড় ছেলেকে বাঁচিয়েছিলাম আমি। এটা তার কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ দেওয়া উপহার।

এই জাদুর মাছটা তৈরি করা হয়েছে একধরনের বিরল ভারী এবং কালো পাথর খোদাই করে, যে পাথর শুধু নীলের শেষ প্রপাতের ওপরে ইথিওপিয়াতেই পাওয়া যায়। উপজাতীয়দের কাছে এর নাম বাড়ি ফেরার পাথর, কারণ এর সাহায্যে তারা বাড়ি ফেরার পথ নির্ণয় করে। কালো উপজাতীয়দের জ্ঞানকে অনেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ঠিক; কিন্তু আমি তাদের মাঝে নই।

মার জাদুর মাছটা লম্বায় হবে আমার কড়ে আঙুলের সমান, তবে একেবারেই সরু। যখন প্রয়োজন হয় তখন পাথরটাকে আমি নৌকার মতো করে খোদাই করা এক টুকরো কাঠের সাথে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিই। তারপর মাছসহ ছোট্ট নৌকাটাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিভর্তি একটা গোল পাত্রে। পাত্রটা অবশ্যই কাঠের তৈরি হতে হবে এবং তার গায়ে থাকতে হবে উজ্জ্বল রঙে আঁকা নানা রকম রহস্যময় আফ্রিকান নকশা। এর পরেই আসে জাদুর অংশটুকু। পাথরের মাছটা ধীরে ধীরে; কিন্তু নিশ্চিতভাবেই উত্তরমুখী হয়ে ঘুরে যায়, জাহাজের মুখ যেদিকেই ঘোরানো থাকুক না কেন। যাত্রার এই পর্যায়ে এসে মেমননের নাক কেবল সামান্য বামে ঘুরিয়ে দিতে হলো আমাদের, যেদিকে মাছটা নির্দেশ করছিল। দিন হোক বা রাত, এই মাছের জাদু কখনো ব্যর্থ হয় না। যখন ফেরার সময় হবে তখন মেমননের নাকটা ঠিক উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিলেই হবে, অবশ্য তার আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে মিশরে ফেরার সুযোগ তৈরি হবে আমাদের জন্য।

ছোট্ট মাছটা দেখে অবজ্ঞায় নাক কুঁচকাল রামেসিস। আর কী কী করতে পারে এটা? প্রশ্ন করল সে। দেবতাদের প্রশস্তি গাইতে পারে? এক পাত্র ভালো মদ এনে দিতে পারে আমাকে? অথবা এমন একটা মেয়েকে দেখিয়ে দিতে পারে যার শরীরে মধুর স্বাদ পাওয়া যায়? প্রশ্নগুলো শুনেও না শোনার ভান করলাম আমি।

খোলা সাগরে নামার পর প্রথম রাতে সম্পূর্ণভাবে মেঘে ঢাকা রইল আকাশ। কোনো সূর্য চাঁদ বা তারা নেই, যা দেখে পথ নির্দেশ করা যায়। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে কেবল বাড়ি ফেরার পাথরের নির্দেশ অনুসরণ করে সারা রাত জাহাজ চালালাম আমরা। ভোর হওয়ার অনেক আগেই আমরা দুজন ডেকের ওপর উঠে পড়লাম, তেলের প্রদীপের টিমটিমে আলোয় তাকিয়ে রইলাম কাঠের পাত্রে ভাসমান মাছটার দিকে। আমার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নানা রকম কৌতুক করে সময়টা কাটানোর চেষ্টা করল রামেসিস। কিন্তু দিনের আলো ফোঁটার পর যখন আকাশের মেঘ কেটে গেল তখন মেমনন এবং আমার ছোট্ট মাছটা সেই একই হালকা পশ্চিম ঘেঁষে উত্তর দিকে মুখ করে আছে দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না তার।

এ তো আসলেই জাদু, তৃতীয় দিন সকালেও একই ঘটনা ঘটার পর ওকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম আমি। তারপর চতুর্থ দিন সকালে দিগন্তের ওপর সূর্যের জ্বলন্ত দেহটা উঁকি দেওয়ার সাথে সাথে এক নতুন দৃশ্য দেখা গেল। আমাদের জাহাজের ঠিক নাক বরাবর পাঁচ লিগ সামনে দেখা যাচ্ছে ক্রিট দ্বীপের ঝলসানো চেহারা।

অনেক বছর আগে আমি যখন প্রথম এই দ্বীপের ওপর দৃষ্টি রেখেছিলাম তখন দ্বীপের পাহাড়গুলো ছিল সবুজ ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দ্বীপের কিনারে গড়ে উঠেছিল বিরাট বিরাট সব শহর আর বন্দর, দেখেই বোঝা যেত যে পৃথিবীর মাঝে অন্যতম ঐশ্বর্যশালী এক দেশ এটা। দ্বীপের চারপাশের পানিতে সব সময় ভিড় করে থাকত মালবোঝাই জাহাজ আর রণতরীর দল। এখন সেই শহর বা জঙ্গল কোনোটাই নেই, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে দেবতা ক্রোনাসের আগ্নেয় নিঃশ্বাসে। যে পাহাড়ের নিচে তার ছেলে দেবতা জিউস তাকে আটকে রেখেছিলেন, প্রচণ্ড ক্রোধে সেই পাহাড়কেই এক তীব্র অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস করে দিয়েছেন তিনি। সেই পাহাড়টা এখন সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে পানির তলায়, কোনো চিহ্নই আর নেই তার। গতিপথ একটু বদলে নিয়ে দ্বীপের যথাসম্ভব কাছ দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। কিন্তু দ্বীপের বুকে এমন কিছুই চোখে পড়ল না, যা পরিচিত মনে হয়। এতগুলো বছর পরেও বাতাসে গন্ধকের কটু গন্ধ, তার সাথে মিশেছে মরা পশুপাখি আর মাছের দুর্গন্ধ। অথবা কে জানে এটা হয়তো স্রেফ আমার কল্পনাশক্তি আর শক্তিশালী ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের কারণে হচ্ছে। তবে এমনিতেও আমাদের জাহাজের খোলের নিচে যে জলভাগ তাতে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। পানির নিচে যে প্রবাল প্রাচীর ছিল তা অনেক আগেই উঁচু তাপমাত্রার আগে মারা গেছে। এমনকি রামেসিস আর তার নাবিকরা যারা আগে কখনো এদিকে আসেনি তারাও এই পরিপূর্ণ ধ্বংসের করাল রূপ দেখে নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

মানুষের সকল চেষ্টা, সকল সংগ্রামই যে দেবতাদের সামনে তুচ্ছ, এই ঘটনা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ, ফিসফিসে গলায় বলে উঠল রামেসিস। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে হবে আমাদের। দেবতা ক্রোনাসের প্রলয়ংকর ক্রোধের সামনে পড়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।

সুতরাং এবার দাঁড় বাওয়ার গতি বাড়াতে নির্দেশ দিলাম প্রধান দাঁড়িকে। আরো উত্তরে গ্রিসীয় সাগরে এসে পড়েছি আমরা। এখনো আমাদের অভিমুখ সেই হালকা পশ্চিম ঘেঁষে উত্তরে।

 আমার জন্য এদিককার সাগর একেবারেই অপরিচিত। ক্রিটের বেশি সামনে কখনো আসিনি আমি। কয়েক দিনের মাঝেই আগ্নেয়গিরির অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দ্বীপের পাশ কাটিয়ে এলাম আমরা। আবার আগের মতো শান্ত বন্ধুর মতো চেহারা ধারণ করল সাগর। রামেসিসের মস্তিষ্ক অত্যন্ত ধারাল, শেখার আগ্রহ প্রবল। এবং এতে বরং খুশিই হলাম আমি। আমার কাছ থেকে, বিশেষ করে নিজের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চাইল সে, যেটা সম্পর্কে আমার জ্ঞান প্রচুর। ফারাওদের চারটি প্রজন্মের পাশে সশরীরে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সেই জ্ঞান এখন খুশিমনেই রামেসিসের সাথে ভাগ করে নিলাম আমি।

তাই বলে মিশরের ইতিহাসে আমরা এত বেশি ডুবে যাইনি যে দায়িত্বে অবহেলা করব। সবচেয়ে শক্তিশালী রণতরীর পরিচালক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সত্যিই অনেক। অতীত নিয়ে আলোচনায় আমরা যতটা সময় দিলাম তার চাইতে অনেক বেশি সময় দিলাম ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়। এমন একটা জাহাজের জন্য যেটা স্বাভাবিক, প্রতিটি নাবিককে রামেসিস নিজের হাতে বাছাই করেছে। আমার চোখেও তাদের কাজের কোনো খুঁত ধরা পড়ল না। তবে আমি বরাবরই যেকোনো কিছুকে নিখুঁতের চাইতেও নিখুঁত করে তুলতে আগ্রহী। নিজের লোকদের কঠোর প্রশিক্ষণ দিতে লাগল রামেসিস এবং আমিও সেই প্রশিক্ষণের সর্বোচ্চ পর্যায় নিশ্চিত করতে তাকে সাহায্য করলাম।

সবচেয়ে দক্ষ সেনানায়কদের অন্যতম প্রধান গুণ হচ্ছে বিপদ অথবা শত্রুর অবস্থান বোঝার মতো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দখল রাখা। ক্রিট দ্বীপ ছাড়িয়ে আসার পর তৃতীয় দিন দুপুরে আমিও সেই অদ্ভুত অস্বস্তিটা বোধ করতে লাগলাম। বিকেলের প্রায় পুরোটা সময় দিগন্তের আনাচকানাচে খুঁজে খুঁজে কাটালাম আমি সামনে এবং পেছনে দুদিকেই। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি মনের গভীর থেকে উঁকি দেওয়া এই অজানা অস্বস্তিকে অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না। তারপর দেখলাম অস্বস্তিতে শুধু আমি একা ভুগছি না। রামেসিসও অস্থির হয়ে উঠছে, যদিও আমার মতো দক্ষভাবে সেটা চাপা দিতে পারছে না। তবে এটাও ঠিক যে, আমার চাইতে ওর অভিজ্ঞতা অনেক কম। শেষ বিকেলে সূর্য যখন পশ্চিম-দিগন্ত থেকে আর হাতখানেক ওপরে মাত্র তখন নিজের তলোয়ার আর শিরস্ত্রাণ নামিয়ে রেখে মাস্তুল বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল রামেসিস। দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাদের ফেলে আসা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল ও। একসময় নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না আমি। অস্ত্র এবং বর্ম খুলে নামিয়ে রাখলাম, তারপর এগিয়ে গেলাম মাস্তুলের গোড়ার দিকে। ইতোমধ্যে অন্য নাবিকরা, বিশেষ করে যারা দাঁড় বাইছে তারা বেশ আগ্রহের সাথে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। প্রধান ডেক থেকে মাস্তুলের মাথায় কাকের বাসায় উঠে এলাম আমি। ঝুড়িতে নড়েচড়ে বসে আমার জন্য জায়গা করে দিল রামেসিস, যদিও এই ছোট্ট জায়গায় দুজন দাঁড়ানো বেশ মুশকিল। কিছু না বলে কেবল কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল ও।

এখনো কোনো চিহ্ন দেখা গেছে তার? নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলাম আমি।

অবাক হয়ে গেল রামেসিস।

কার চিহ্ন? প্রশ্ন করল ও।

ওই যে, যে আমাদের পিছু নিয়েছে, জবাব দিলাম আমি। মৃদু স্বরে হেসে উঠল রামেসিস। তাহলে তুমিও আন্দাজ করতে পেরেছ। আস্ত একটা বুড়ো শয়তান তুমি, টাইটা।

আমি যদি বোকা হতাম তাহলে এই বয়স পর্যন্ত পৌঁছতে পারতাম না যুবক।

কেউ আমাকে বুড়ো বললে সেটা আমার ভালো লাগে না।

হাসি থামাল রামেসিস। তোমার কী মনে হয়? কে আমাদের পিছে লেগেছে?

আগের চাইতে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল ও।

এই উত্তর সাগর হচ্ছে মানুষের রক্তে হাত রাঙানো প্রত্যেকটা জলদস্যুর আখড়া। তাদের মাঝে নির্দিষ্ট করে কোনো একজনের কথা কি বলা সম্ভব?

আমাদের চোখের সামনে অলস ভঙ্গিতে দিগন্তে ডুব দিতে শুরু করল সূর্য। তবে দিগন্তরেখার কোথাও জীবনের বা নড়াচড়ার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না যতক্ষণ না…

ওই যে! দুজন এক সাথে চেঁচিয়ে উঠলাম আমরা।

সূর্যটা সমুদ্রের মাঝে সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে গাঢ় হয়ে আসা পানির ওপর এক ঝলক উজ্জ্বল সোনালি আলো ছুঁড়ে দিল। আমরা দুজনই বুঝতে পেরেছি যে ওটা আসলে আমাদের পেছনে যে জাহাজটা লেগেছে তার পালে সূর্যের আলোর প্রতিফলন, আর কিছু নয়।

খুব সম্ভব আমাদের ওপর হামলা চালানোর ফন্দি আঁটছে ওরা, না হলে এমন চোরের মতো আসবে কেন? নিশ্চয়ই আশা করছে যে সূর্য ডোবার পরে আমরা পাল খাটো করে ফেলব বা নামিয়ে রাখব। তাই আমাদের পাশ কাটিয়ে যেন চলে না যায় এই ভয়ে গতি কমিয়ে রেখেছে। অন্ধকারের মাঝে কোনো জানান না দিয়ে নিঃশব্দে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করেছে ব্যাটা, আন্দাজ করলাম আমি। তাহলে বরং আমরাই ওদের একটু চমকে দেওয়ার বুদ্ধি করি।

তোমার পরামর্শ কী টাইটা? নীলনদের বুকে অন্য জাহাজের সাথে নৌযুদ্ধে অভ্যস্ত আমি; কিন্তু এমন খোলা সাগরে আগে কখনো যুদ্ধ করিনি। তাই এখন তোমার নির্দেশই মেনে চলব আমি।

জাহাজের খোলে একটা বাড়তি পাল দেখেছিলাম আমি। ওটা কোথায়?

ওহ কালো রঙের পালটার কথা বলছ তুমি। রাতের বেলায় ওটা বেশ কাজে আসে, বিশেষ করে আমরা যখন শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিতে চাই।

এখন ঠিক ওই পালটাই আমাদের দরকার, বললাম আমি।

দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর জাহাজের গতিপথ সম্পূর্ণ সমকোণে ঘুরিয়ে নিলাম, এবং এই অবস্থায় পাল তুলে দিয়ে চললাম প্রায় এক মাইল পথ। এবার জাহাজ থামিয়ে সাদা পাল বদলে তুলে দিলাম কালো পাল। সম্পূর্ণ অন্ধকারে করতে হলো কাজটা, এবং যতটা ভেবেছিলাম তার চাইতে বেশি সময় লেগে গেল। তবে শেষ পর্যন্ত মধ্যরাতের মতো মিশমিশে কালো পাল টাঙিয়ে আবার আগের গতিপথে ফেরত আসতে পারলাম আমরা। এই কাজটা সম্ভব করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখল আমার সেই জাদুর মাছ, এবং মাঝে মাঝে মেঘের মাঝে জ্বলে ওঠা বিদ্যুৎশিখা।

আমি আশা করছিলাম যে অন্য জাহাজটা আমাদের আগের গতিপথই অনুসরণ করছে, এবং আমরা যখন পাল বদলাচ্ছিলাম তখন সেটা পার হয়ে সামনে চলে গেছে। ওই জাহাজের নাবিকরা নিশ্চয়ই অধীর হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে এখন, জানেই না যে আমরা ওদের পেছনে চলে এসেছি। আমাদের ধরার জন্য নিশ্চয়ই জলদস্যুদের নেতা তার জাহাজের সবগুলো পাল উড়িয়ে দিয়েছে, তাই রামেসিসকেও একই কাজ করতে নির্দেশ দিলাম আমি। তীরবেগে অন্ধকার চিরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল মেমনন। জাহাজের নাক বরাবর দুই পাশ থেকে উঠে আসছে ঢেউয়ের ফেনা, বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। আমাদের প্রত্যেকটা নাবিক সম্পূর্ণ সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু সময় কেটে যাওয়ার সাথে সাথে দুই জাহাজের অবস্থান নিয়ে মনে মনে যে হিসাব কষেছিলাম সেটা কতটা নির্ভুল তাই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলাম আমি।

তারপর একেবারে হঠাৎ করেই যেন রাতের বুক চিরে আমাদের সামনে বেরিয়ে এলো জলদস্যুদের জাহাজটা। তড়িঘড়ি করে একবার চিৎকার করে সাবধান করে দিলাম দাঁড়িদের। তার পরেই একেবারে আমাদের কাছে চলে এলো জাহাজটা। আরো একবার বিদ্যুৎ চমকাল, সেই আলোতে দেখলাম জাহাজটা পাশ ফিরে আছে। আন্দাজ করলাম জলদস্যুদের নেতা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিল যে আমাদের পেছন থেকে হামলা করা সম্ভব নয়, কারণ অন্ধকারে আমাদের পাশ কাটিয়েই চলে গেছে সে। এখন তাই জাহাজ ঘুরিয়ে আবার উল্টো পথে ফিরে এসে আমাদের খুঁজে বের করতে চাইছিল। এই মুহূর্তে একটা কাঠের গুঁড়ি মতো আড়াআড়ি হয়ে মেমননের সামনে ভাসছে জাহাজটা। পূর্ণ গতিতে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ। মেমননের গলুই অত্যন্ত ধারালো সন্দেহ নেই, যে জলদস্যুদের জাহাজটাকে দুই টুকরো করে ফেলতে পারবে মাঝ থেকে। কিন্তু তাতে আমাদের নিজেদের জাহাজের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও ষোলো আনা।

শুধু জাহাজ চালানোয় রামেসিসের দক্ষতা আর অন্য নাবিকদের প্রশিক্ষণের কারণেই সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হলো। তেমন কিছু হলে দুটো জাহাজই ধ্বংস হতো, সাগরের তলায় আশ্রয় হতো আমাদের সবার। একেবারে শেষ মুহূর্তে কোনোমতে মেমননের নাক ঘুরিয়ে ফেলতে পারল সে, ফলে আমাদের গলুইয়ের বদলে পেট দিয়ে অপর জাহাজকে বাড়ি মারল আমাদের জাহাজ। তার পরেও ধাক্কাটা এত তীব্রভাবে লাগল যে জলদস্যুদের জাহাজের প্রত্যেকটা নাবিক উল্টেপাল্টে পড়ে গেল। তাদের মাঝে এমনকি জাহাজের ক্যাপ্টেন আর প্রধান দাঁড়িকেও দেখা গেল। এদিক-ওদিক এলোমেলোভাবে পড়ে রইল তারা, বেশির ভাগই হয় আহত বা দারুণ ব্যথা পেয়েছে। যে দুই-একজন নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারল তারাও সংঘর্ষের ফলে অস্ত্র হারিয়ে ফেলেছে, ফলে আত্মরক্ষা করার কোনো উপায় নেই তাদের কাছে।

ওদিকে মেমননের বেশির ভাগ নাবিকই আগে থেকে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। ফলে সংঘর্ষের আগেই বিভিন্ন জিনিস আঁকড়ে ধরে নিজেদের রক্ষা করেছে তারা। তবে কয়েকজন অবশ্য ধাক্কার ঝাঁকুনিতে মেমননের ডেক থেকে দস্যুদের জাহাজে গিয়ে পড়ল। তাদের মাঝে আমি একজন। নিজের চেষ্টায় পতনের গতিরোধ করতে পারব না বুঝতে পেরে সামনে সবচেয়ে নরম যে জিনিসটা পেলাম সেটাকেই বেছে নিলাম এবং সামনে এগিয়ে গেলাম। জিনিসটা ছিল দস্যু জাহাজের ক্যাপ্টেন। দুজন জড়াজড়ি করে জাহাজের ডেকে গড়িয়ে পড়লাম আমরা, কয়েক গড়ান দিয়ে তবে থামলাম। তবে আমি থাকলাম ওপরে, ক্যাপ্টেনের বুকের ওপর বসা অবস্থায়। হুট করে জাহাজ বদল করতে হওয়ায় তলোয়ারটা হারিয়ে ফেলেছি, তাই সাথে সাথে ব্যাটাকে খুন করতে পারলাম না। তবে তাতে বোধ হয় সুবিধাই হলো, কারণ প্রায় সাথে সাথেই লোকটা কাতর সুরে গুঙিয়ে উঠে মাথার শিরস্ত্রাণের মুখাবরণটা সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আরো একটা বজ্রপাতের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল তার চেহারা।

*

সেথের দুর্গন্ধময় পশ্চাদ্দেশের কসম! তুমি এখানে কী করছ অ্যাডমিরাল হুই? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

আমার ধারণা তোমার আর আমার কাজ এখানে একই প্রিয় টাইটা। কিছু বাড়তি টাকা কামিয়ে নিচ্ছি আর কী, যন্ত্রণাকাতর গলায় জবাব দিল সে, দম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলল, এবার আমার বুকের ওপর থেকে সরো দেখি। তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি, তারপর আমাদের এই সময়োচিত পুনর্মিলন উদ্যাপন করার জন্য একটু খাঁটি ল্যাসিডিমনের লাল মদ নিয়ে আসি।

দুই জাহাজের নাবিকদের নিজেদের জায়গামতো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বেশ সময় লেগে গেল। সেইসাথে আহতদের পরিচর‍্যা আর দ্বিতীয় জাহাজের পানি সেচার যন্ত্র চালু করতেও আরো কিছু সময় নষ্ট হলো। সংঘর্ষে আমাদের চাইতে ওদের জাহাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি, এবং পানি সেচে না ফেললে ডুবেই যাবে।

সব ঝামেলা শেষ হওয়ার পর রামেসিসের সাথে হুইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলাম আমি। তবে রামেসিস যে মিশরের সিংহাসনের পরবর্তী সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী এটা আর বললাম না, শুধু বললাম যে সে এই জাহাজের ক্যাপ্টেন। তারপর হুইকে পরিচয় করালাম রামেসিসের সাথে; তবে তার ফুপা হিসেবে নয় বরং ল্যাসিডিমন নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল এবং শখের জলদস্যু হিসেবে।

দুজনের বয়সে বেশ বড় ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও দারুণ মিল হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমরা যখন লাল মদের দ্বিতীয় পাত্রটা ধরেছি তখন দুজন পুরনো দোস্তের মতো গালগল্প জুড়ে দিয়েছে।

দুই জাহাজের সব ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করতে, এবং আহতদের ক্ষতস্থান সেলাই আর ভাঙা হাড় জোড়া দিতে দিতে সারা রাত এবং পরের দিনের বেশির ভাগ অংশ পার হয়ে গেল। সব কাজ শেষ হওয়ার পর ল্যাসিডিমনের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত গিথিয়ন বন্দরের দিকে আমরা যখন রওনা দিলাম, মেমননকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল হুই। ওই জাহাজের নাম সে রেখেছে বেকাথা, তার স্ত্রীর নামে।

রামেসিসকে মেমননের দায়িত্বে রেখে বেকাথায় উঠে এলাম আমি, যাতে চুপি চুপি হুইকে আমাদের এই হঠাৎ আবির্ভাবের কারণটা খুলে বলা যায়। চুপচাপ আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে গেল সে এবং সব শেষ হতে হঠাৎ মৃদু স্বরে হেসে উঠল।

এতে হাসির কী হলো? জানতে চাইলাম আমি।

আরো খারাপ কিছুও ঘটতে পারত তোমার ভাগ্যে।

কীভাবে একটু বলো দেখি? এখন আমি নির্বাসিত, নিজের মাতৃভূমিতে ঢোকার কোনো অনুমতি নেই আমার। ঢুকলেই মৃত্যু। সেইসাথে নিজের সব জমিজমা আর সম্মানের আসনও হারিয়েছি। মিশর ছেড়ে পালিয়ে আসার পর এই প্রথমবারের মতো নিজের দুরবস্থা নিয়ে একটু দুঃখ প্রকাশ করার সুযোগ পেলাম আমি। প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল আমার।

আর যাই হোক নির্বাসিত হলেও তুমি এখনো অনেক ধনী এবং সবচেয়ে বড় কথা, এখনো বেঁচে আছ, আমাকে মনে করিয়ে দিল হুই। এর জন্য রাজা হুরোতাসকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত তোমার।

এই নামের মালিককে মনে করতে এক মুহূর্ত সময় লেগে গেল আমার। এখনো মাঝে মাঝে শুধু জারাস ছাড়া অন্য কোনো নামে তাকে মনে করতে পারি না আমি। তবে হুই ঠিকই বলেছে। আমি এখনো একজন ধনী মানুষ, কারণ হুরোতাস আমার প্রাপ্য সেই বিশাল সম্পদের অংশটুকু নিরাপদে পাহারা দিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া প্রায় তিন দশকের বিচ্ছেদের পর অবশেষে আমি আমার প্রিয় দুই রাজকুমারীর দেখা পেতে যাচ্ছি।

হঠাৎ করেই আবার উল্লসিত বোধ করতে শুরু করলাম আমি।

*

ল্যাসিডিমনের প্রথম যে জিনিসটার ওপর আমার চোখ পড়ল তা হচ্ছে ট্যাগেটাস পর্বতমালার চূড়াগুলো। এক একটা যেন ড্রাগনের দাঁতের মতো ধারালো আর চোখা, হেডিস প্রণালির মতো খাড়া। যদিও এখন বসন্তের শুরু; কিন্তু চূড়াগুলোর L, মাথায় এখনো ঝলমল করছে বরফ।

আমরা যতই সামনে এগিয়ে গেলাম ততই সাগরের বুক চিরে আরো ওপরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তারা। দেখলাম পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নিচু ঢালগুলোতে জন্মেছে সুউচ্চ সব গাছের ঘন জঙ্গল। আরো কাছে আসার পর সাগরের বেলাভূমি চোখে পড়ল আমাদের, বাদামি পাথরের প্রাকৃতিক দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত। একের পর এক ঢেউ এসে ফেনা তুলে সগর্জনে আছড়ে পড়ছে তাদের ওপর, যেন কোনো দুর্গের প্রাচীরে হামলা চালাচ্ছে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের সারি।

অনেক লিগ চওড়া একটা উপসাগরের মুখে প্রবেশ করলাম আমরা। এই হচ্ছে গিথিয়ন উপসাগর। এখানে অবশ্য ঢেউগুলো আরো শান্ত, অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট। তীরের আরো কাছাকাছি এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল এখান থেকে। পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা নদীর চওড়া মুখের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল আমাদের জাহাজ।

এর নাম হুরোতাস নদী, আমাকে জানাল হুই। তোমার খুব পরিচিত একজনের নামে রাখা হয়েছে এই নাম।

তার রাজধানী কোথায়? প্রশ্ন করলাম আমি।

এখান থেকে প্রায় চার লিগ ভেতরে, জবাব দিল হুই। ইচ্ছে করেই সাগরের তীর থেকে দূরে জায়গাটাকে তৈরি করেছি আমরা, যাতে অনাকাক্ষিত অতিথিদের এড়িয়ে থাকা যায়।

তাহলে তোমাদের নৌবাহিনী কোথায় থাকে? তোমাদের নৌশক্তির যে নিদর্শন আমি দেখেছি, এতগুলো যুদ্ধজাহাজকে লুকিয়ে রাখা তো সত্যিই খুব কঠিন।

ভালো করে তাকিয়ে দেখো টাইটা, বলল হুই। তোমার চোখের সামনেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে জাহাজগুলোকে।

অত্যন্ত তীক্ষ্ণ আমার চোখের দৃষ্টি; কিন্তু হুই কীসের কথা বলছে তা বেশ কষ্ট করেও বুঝে উঠতে পারলাম না। ফলে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠলাম মনে মনে। কেউ আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে সেটা আমার মোটেই পছন্দ হয় না। হুইও নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতে পারল, কারণ আমাকে একটা সূত্র ধরিয়ে দিল সে। ওইখানটায় দেখো, যেখানে পাহাড়গুলো সাগরের সাথে মিশেছে, বলল সে। তারপর অবশ্য পুরো ব্যাপারটা যেন লাফ দিয়ে উঠে এসে ধরা দিল আমার চোখে। একটু আগে তীরের ওপর ছড়িয়ে থাকা কিছু মরা গাছ দেখেছিলাম আমি ওখানে। এখন বুঝতে পারছি গাছগুলো আসলে স্বাভাবিক গাছের তুলনায় খুব বেশি সোজা আর লম্বা, এবং ডালপালাও নেই।

ওগুলো কি যুদ্ধজাহাজের মাস্তুল নয়? কিন্তু জাহাজের খোল কোথায় গেল? তোমরা কি তীরের ওপর তুলে রেখেছ জাহাজগুলোকে?

দারুণ বলেছ, টাইটা! সোল্লাসে আমার প্রশংসা করল হুই, ফলে তার শিশুসুলভ আচরণের ফলে আমার মনে যে বিরক্তি জেগে উঠেছিল তা কিছুটা হলেও কমে গেল। জাহাজগুলোকে লুকিয়ে রাখার জন্য বন্দরের সামনে একটা দেয়াল বানিয়েছি আমরা। ওগুলোর খোল দেয়ালের ওপাশে থাকায় দেখতে পাচ্ছ না তুমি। এবং মাত্র কয়েকটা জাহাজের মাস্তুল এখনো তুলে রাখা হয়েছে। বেশির ভাগেরই মাস্তুল নামিয়ে ফেলেছি আমরা, ফলে ওগুলোকে খুঁজে বের করা এখন আরো কঠিন।

সত্যিই বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হয়েছে কাজটায়, স্বীকার করলাম আমি।

এবার ওই লুকোনো বন্দরের দিকে এগিয়ে গেল আমাদের জাহাজ, মেমনন রইল পিছে পিছে। গায়ের জোরে তীর ছুড়লে যত দূরে যায়, বন্দরের দেয়াল থেকে তার অর্ধেক দূরত্বে রয়েছি আমরা; এই সময় হঠাৎ করেই প্রবেশপথটা ধরা দিল আমাদের চোখে। সাগরের দিক থেকে যেন বোঝা না যায় সে জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে ওটাকে। ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে পাল নামিয়ে ফেললাম আমরা, তার বদলে দাঁড়ের শক্তির ওপর নির্ভর করলাম বাকি পথটুকু পাড়ি দেওয়ার জন্য। বেশ ঘোরালো একটা পথ পাড়ি দিয়ে শেষ মোড়টা পার হতেই ভেতরের বন্দরটা আমাদের সামনে ভেসে উঠল। পুরো ল্যাসিডিমন নৌবাহিনী এখানে দেয়ালের সাথে বাঁধা রয়েছে। গোপন এই বন্দরের মাঝে চলছে পুরোদস্তুর কর্মব্যস্ততা। প্রতিটি জাহাজে নাবিকরা সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিতে দারুণ ব্যস্ত; পাল এবং খোলের মেরামতি করছে কেউ কেউ, বাকিরা খাবার পানি, যন্ত্রপাতি আর অস্ত্রশস্ত্রের বোঝা জাহাজে তুলছে।

তবে আমাদের জাহাজ দুটো বন্দরের ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে হঠাৎ করেই যেন থেমে গেল সব কিছু। তীরে দাঁড়ানো লোকগুলোর মাঝে গুঞ্জনের সৃষ্টি হলো মেমননকে দেখে। এর আগে তারা কখনো এমন একটা জাহাজকে দেখেছে কি না সন্দেহ। কিন্তু তার পরেই এমন একটা ব্যাপার ঘটল, যেটা এমনকি রামেসিসের জাহাজের মতো অসাধারণ দৃশ্য থেকেও তাদের চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য করল। সেটা আর কিছুই নয়, আমাদের সামনে থাকা জাহাজটা: হুইয়ের বেকাথা। সামনের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা নাবিকদের ছোট্ট দলটার দিকে ইশারা করতে শুরু করল তারা। একে অপরকে ডাকছে কেউ কেউ। তাদের উত্তেজিত আলাপের মাঝে আমার নাম-টাইটা-ও কয়েকবার উচ্চারিত হতে শুনলাম আমি।

নিঃসন্দেহে সবাই খুব ভালোভাবেই চেনে আমাকে। আমার সুদর্শন এবং সুবেশ চেহারা, বা একসময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি আমি- এই কারণগুলো তো আছেই, সাথে আরো একটা কারণে আমাকে মনে রেখেছে তারা; যেটা সব নাবিক বা রথচালকের কাছেই একইভাবে স্মরণীয়।

মেফিস শহর পুনর্দখল, সেইসাথে খামুদির পরাজয় এবং হিকসস বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করার পর যখন আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, তখন রাজা হুরোতাসকে অনুরোধ করেছিলাম আমার ভাগের সম্পদ থেকে কিছু অংশ তার সৈন্যদের মাঝে বিতরণ করে দিতে। যুদ্ধে তাদের অবদানের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই পুরস্কার। আমার প্রাপ্য দশ লাখ রৌপ্যখণ্ডের মাঝ থেকে এক লাখ বিতরণ করা হয়েছিল তাদের মাঝে, প্রতিজনের ভাগে পড়েছিল পাঁচ ডেবেন ওজনের দশটি করে রৌপ্যমুদ্রা। আমার কাছে বা যেকোনো অভিজাতের কাছেই এটা খুব সামান্য পরিমাণ; কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের কাছে। এর অর্থ প্রায় দুই বছরের বেতনের সমান। সোজা কথায় তাদের কাছে এটা বিশাল এক সম্পদ। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে মনে রেখেছে তারা, এবং সম্ভবত মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মনে রাখবে।

এ তো প্রভু টাইটা! উত্তেজিত গলায় বলাবলি করছে তারা, আমার দিকে ইঙ্গিত করছে আঙুল তুলে।

টাইটা! টাইটা! বাকিরাও এবার তাদের উত্তেজিত চিৎকারে যোগ দিল। দলবেঁধে বন্দরের ঘাটলায় এসে জড়ো হলো সবাই, আমাকে স্বাগত জানাতে চায়। তীরে নামার সাথে সাথে আমাকে ছুঁয়ে দেখার প্রতিযোগিতা লেগে গেল সবার মাঝে, কেউ কেউ তো অত্যুৎসাহী হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিতে চাইল। কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম আমি। শেষ পর্যন্ত হুই আর রামেসিস মিলে তাদের বিশজন লোকের সাহায্যে আমার চারদিকে বেষ্টনী তৈরি করল, যাতে আমার কোনো অসুবিধা না হয়। তারপর হট্টগোলের মাঝ থেকে আমাকে বের করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল কয়েকটা ঘোড়া, যেগুলো আমাদের নিয়ে যাবে সেই উপত্যকায়, যেখানে রাজা হুরোতাস এবং রানি স্পার্টা তাদের রাজধানী তৈরি করছেন।

উপকূল এলাকা ছাড়িয়ে যত সামনে যেতে লাগলাম ততই বাড়তে লাগল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দৃষ্টিসীমার ঠিক প্রান্তে সব সময় ভেসে আছে তুষারে ঢাকা পাহাড়চূড়াগুলো, মনে করিয়ে দিচ্ছে যে কিছুদিন আগেই শীতকাল গেছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঘন সবুজ কোমর সমান লম্বা ঘাস আর নানা রকমের ফুলের গাছে ঢাকা তৃণভূমি, ট্যাগেটাসের চূড়া থেকে নেমে আসা মৃদু বাতাসে যেন মনের আনন্দে মাথা দোলাচ্ছে তারা। বেশ কিছুটা পথ হুরোতাস নদীর কিনার ধরে পাড়ি দিলাম আমরা। তুষারগলা পানিতে ফুলে উঠেছে নদী; কিন্তু সে পানি এত পরিষ্কার যে ঢেউয়ের বিপরীতে ভেসে থাকা বড় বড় মাছগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাতে। বরফঠাণ্ডা পানিতে বুক পর্যন্ত ডুবে ঘুরে বেড়াচ্ছে অর্ধনগ্ন নারী-পুরুষের দল, হাতে বোনা লম্বা জাল টানছে কয়েকজনে মিলে। জালে ধরা পড়ছে মাছগুলো, সেগুলোকে তীরে তুলে এনে স্কুপ করা হচ্ছে। সেই কূপ থেকে সবচেয়ে বড় দেখে পঞ্চাশটা মাছ কিনে নিল হুই, রাজপ্রাসাদের রান্নাঘরে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো সেগুলোকে।

নদীতে দেখা এই মানুষগুলো ছাড়াও পথের পাশে মাঝে মাঝে দেখা যেতে লাগল ছোট ছোট ছেলেদের। ফাঁদ পেতে ধরা পায়রা আর তিতির বিক্রি করছে তারা। তার সাথে আরো দেখা গেল ছোট ছোট দোকান, বুনো ষাড় আর হরিণের মাংস বিক্রি হচ্ছে সেখানে। মাঠে চরে বেড়াচ্ছে গবাদিপশুর দল: গরু, ছাগল, ভেড়া এবং ঘোড়া। সবগুলোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, মোটাসোটা আর চকচকে লোমে ঢাকা শরীর। মাঠে যেসব নারী-পুরুষ কাজ করছে তারা সবাই হয় একেবারেই তরুণ অথবা একেবারেই বৃদ্ধ। কিন্তু সবার মাঝেই একই রকম সন্তুষ্টির ভাব স্পষ্ট। আমাদের দেখে চিৎকার করে শুভেচ্ছা জানাল তারা।

রাজধানীর কাছাকাছি পৌঁছানোর পরেই কেবল বদলাতে শুরু করল মানুষজনের চেহারা। এখন বেশির ভাগই বয়সে তরুণ, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার উপযুক্ত। দক্ষ হাতে তৈরি বড় বড় সেনানিবাসে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধবিদ্যা শেখায় পুরোদস্তুর মগ্ন সবাই। তাদের রথ, বর্ম আর অস্ত্রগুলো দেখে বোঝা গেল সবই সর্বাধুনিক কৌশলে তৈরি। সেগুলোর মাঝে দুই দিক বাঁকানো ধনুক আর হালকা কিন্তু শক্তপোক্ত চার ঘোড়ায় টানা রথও আছে।

বেশ কয়েকবার তাদের অনুশীলন দেখার জন্য থামলাম আমি। খুব দ্রুতই একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল। সেটা হচ্ছে, এরা সবাই প্রথম শ্রেণির দক্ষ সৈনিক, যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। প্রশিক্ষণের সর্বোচ্চ অংশটুকু আদায় করে নিচ্ছে সবাই। কেবল হুরোতাস আর হুইয়ের মতো দক্ষ যোদ্ধাকে এদের সেনাপতি হিসেবে পাওয়া গেলেই এটা সম্ভব।

উপকুল ছেড়ে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে সমতল ছেড়ে ওপরে উঠছি আমরা। প্রায় চার লিগ পথ পাড়ি দেওয়ার পর জঙ্গলে ঢাকা একটা ঢালু জমি বেয়ে উঠে এলাম আমরা এবং আবারও থমকে দাঁড়ালাম। তবে এবার অবাক বিস্ময়ে, কারণ আমাদের সামনে এখন দেখা যাচ্ছে চারপাশে উঁচু পাহাড়ে ঢাকা এক টুকরো সমতলভূমি। আর তার মাঝখানে গড়ে উঠেছে এই রাজ্যের রাজধানী।

সমতলের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে হুরোতাস নদী। তবে একটা নয়, বরং দুটো শক্তিশালী স্রোতস্বিনীতে নদীটা ভাগ হয়ে গেছে এখানে। দুই ধারার মাঝখানে গড়ে তোলা হয়েছে প্রধান দুর্গ, যাকে একই সঙ্গে রাজপ্রাসাদও বলা যায়। প্রাসাদকে ঘিরে প্রাকৃতিক পরিখা তৈরি করেছে নদীটা। সমতলের শেষ প্রান্তে নদীর দুই ধারা আবার এক হয়ে সামনে এগিয়ে গেছে সেই গিথিয়ন বন্দর পর্যন্ত।

দুৰ্গটা আসলে গড়ে উঠেছে মাটির ভেতর থেকে উঠে আসা আগ্নেয়শিলার ওপর ভিত্তি করে। কোনো এক প্রাচীন রাজার বাসভবন ছিল এটা। একসময় এখান থেকে চলে যায় সে। তারপর ট্যাগেটাস পর্বতমালায় বসবাসকারী বর্বর উপজাতি নেগলিন্টদের দখলে চলে যায় এই প্রাসাদ-দুর্গ। নেগলিন্টরা আবার পরাজিত হয় রাজা হুরোতাস এবং অ্যাডমিরাল হুইয়ের কাছে এবং তাদের দাসে পরিণত হয়।

নতুন পাওয়া এই দাসদের কাজে লাগিয়ে প্রাসাদের দুর্ভেদ্যতা আরো বাড়িয়ে তুলেছে হুরোতাস আর হুই, ফলে এখন তা প্রায় অজেয়। ভেতরটা শুধু সুপ্রশস্ত ই নয়, দারুণ আরামদায়কও বটে। এই জায়গাকেই নিজের নতুন দেশের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছে হুরোতাস।

দূর থেকে জায়গাটাকে দেখার জন্য অবশ্য বেশি সময় নষ্ট করলাম না আমি। তবে তাড়াহুড়ো করার আরো একটা কারণ হচ্ছে, হুই জায়গাটার ইতিহাস শোনাচ্ছিল আমাকে। নৌ সেনাপতি হিসেবে সে প্রথম শ্রেণির হতে পারে; কিন্তু বক্তা হিসেবে একেবারেই দুগ্ধপোষ্য শিশু। তাই ঘোড়ার পেটে আলতো করে পা দিয়ে চাপ দিলাম আমি, তারপর সবাইকে সাথে নিয়ে হালকা চালে দুর্গ লক্ষ্য করে এগোতে শুরু করলাম। বেশ কিছুটা দূরে থাকতেই খেয়াল করলাম পরিখার ওপর নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে টানা-সেতু। সেতুর অগ্রভাগ মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে তার ওপর দিয়ে পূর্ণ গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো দুই অশ্বারোহী, প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে তাদের কণ্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে আসা উত্তেজিত আনন্দের চিৎকারের তীব্রতা।

*

সামনের অশ্বারোহীকে এক নজরেই চিনে নিলাম আমি। তেহুতিই রয়েছে সামনে, সব সময় যেমন থাকে সে। বাতাসে পতাকার মতো উড়ছে তার লম্বা চুল। শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন মরিচার মতো লাল রং ছিল তার চুলের; কিন্তু এখন তা ধবধবে সাদা; সূর্যের আলোয় পেছনের ট্যাগেটাস পর্বতমালার তুষারের মতোই ঝলমল করছে। কিন্তু এই দূরত্ব থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তরুণী অবস্থায় যেমন ছিল; এখনো ঠিক তেমনই হালকা-পাতলা দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী সে।

তার পেছনে অপেক্ষাকৃত মন্থরগতিতে আসছে আরো একজন মহিলা, যার বয়স এবং ওজন দুটোই তেহুতির চাইতে বেশি। আমি নিশ্চিত, এর সাথে আগে কখনো দেখা হয়নি আমার।

উল্লসিত চিৎকার ছুঁড়তে ছুঁড়তেই পরস্পরের মুখোমুখি হলাম আমি আর তেহুতি। ঘোড়ার গতি প্রায় না কমিয়েই নেমে পড়লাম আমরা এবং মাটি থেকে পড়ার পরেও ভারসাম্য না হারিয়ে দুই পায়ে খাড়া হয়ে থাকতে পারলাম। নিজেদের ভরবেগটুকু ব্যবহার করলাম পরস্পরের দিকে ছুটে যাওয়ার কাজে। শক্ত করে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম আমরা।

একই সাথে কাঁদছে আর হাসছে তেহুতি। এতগুলো বছর কোথায় লুকিয়ে ছিলে, দুষ্টু ছেলে কোথাকার? আমি তো ভেবেছিলাম আর কখনো আমাদের দেখাই হবে না! আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে ওর গাল বেয়ে, থুতনিতে এসে জমা হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে নিচে।

আমার মুখও ভিজে গেছে। অবশ্য সেটা আমার নিজের অশ্রু নয়, বরং তেহুতির চোখের পানিই এসে লেগেছে আমার গালে। কত কথা জমে আছে ওকে বলার জন্য; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন গলায় আটকে গেছে কথাগুলো। তাই কেবল শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে রইলাম আমি; মনে মনে প্রার্থনা করছি যেন আর কখনো পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা না হই আমরা।

ইতোমধ্যে তেহুতির সঙ্গী আমাদের কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে। সাবধানে ঘোড়া থেকে নামল সে; তারপর দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।

টাইটা! তোমার অভাব যে কত তীব্রভাবে বোধ করেছি আমি তা বলে বোঝাতে পারব না। হাথোর এবং অন্য সকল দেব-দেবীকে ধন্যবাদ যে তারা তোমাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন, সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল সে। এতগুলো বছর পরেও সেই কণ্ঠস্বর একটুও বদলায়নি। এবং কণ্ঠটা শোনার সাথে সাথেই সেটা চিনতে পারলাম আমি এবং ক্ষীণ অপরাধবোধ জেগে উঠল আমার মনে।

বেকাথা! চিৎকার করে উঠলাম আমি, তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। তবে আরেক হাতে ঠিকই তেহুতিকে ধরে রেখেছি আমার আলিঙ্গনে। তেহুতির ছোট বোন বেকাথা, যদিও তার আকার দেখে এখন আর তাকে ছোট বলার উপায় নেই।

তিনজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রেখে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা, একই সাথে কাঁদছি আর হাজারটা অর্থহীন কথাবার্তা বলে চলেছি পরস্পরকে উদ্দেশ্য করে। যে দীর্ঘ বছরগুলো আমাদের আলাদা করে রেখেছিল তার দুঃসহ স্মৃতি যেন মুছে ফেলতে চাইছি এই কথাগুলোর মাঝ দিয়ে। দুজনের মাঝে তেহুতির নজর বরাবরই একটু বেশি তীক্ষ্ণ ছিল। হঠাৎ করেই সে বলে উঠল, একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত লাগছে আমার, বুড়ো বন্ধু টাইটা। অনেকগুলো বছর আগে শেষবার যখন তোমাকে বিদায় জানাই তার পর থেকে একটুও বদলায়নি তোমার চেহারা। সত্যি কথা বলতে, আরো যেন তরুণ হয়ে উঠেছ তুমি, আরো সুদর্শন হয়েছ।

স্বাভাবিকভাবেই আপত্তি জানানোর চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু কোনো জিনিসকে সঠিকভাবে বর্ণনা করার একটা স্বাভাবিক গুণ ছিল তেহুতির এবং এখনো একটুও বদলায়নি সেটা।

আমার যত দূর মনে আছে তার চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী হয়েছ তোমরা দুজনই, পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলাম আমি। তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে কিছুদিন আগেই তোমাদের স্বামীদের সাথে কথা হয়েছে আমার; কিন্তু তাতে তোমাদের দেখার ইচ্ছে কমেনি, বরং আরো বেড়ে গেছে। বেকাথা, তোমার চার ছেলে যখন হিকসস আধিপত্য থেকে মিশরকে মুক্ত করতে এসেছিল তখন তাদের সাথে দেখা হয়েছে আমার। কিন্তু সেটা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। এখন ওদের সম্পর্কে সব কিছু আবার তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই আমি। যেকোনো মায়ের জন্যই তার সন্তানদের কথা সব সময়ই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। প্রাসাদ পর্যন্ত বাকি পথটুকু নিজের ছেলেদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেই কাটাল বেকাথা।

আমার বোন যতটা বলছে এমন সোনার টুকরো নিশ্চয়ই নয় ওরা, দুষ্টুমির ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল তেহুতি। কিন্তু তেমন নিখুঁত কে-ই বা আছে বলো?

এটা শুধু হিংসে আর কিছুই নয়, আপত্তি জানাল বেকাথা। বুঝলে টাইটা, আমার বেচারা বোনটা কেবল এক সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তাও একটা মেয়ে। তবে এই কথায় কিছুই মনে করল না তেহুতি। বোঝা গেল আগেও বোনের কাছ থেকে বহুবার এই খোঁচা সহ্য করেছে সে, ফলে এখন আর এতে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না তার।

মাথায় রুপালি চুলের ঢল নেমেছে, তা সত্ত্বেও তেহুতি এখনো দারুণ দেখতে। কে জানে, হয়তো চুলগুলোই এর কারণ। চেহারায় কোনো বয়সের ছাপ বা রেখা পড়েনি, শরীর এখনো হালকা-পাতলা; কিন্তু শক্ত পেশিতে গড়া। শরীরের পোশাকে কোনো ফুল-লতা-পাতার নকশা বা নারীসুলভ চপলতার চিহ্ন নেই; বরং সৈনিকদের টিউনিক পরে আছে সে। চলাফেরায় নারীসুলভ কমনীয়তা যেমন আছে তেমনি আছে পুরুষের আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব। সহজেই হাসি ফোটে তার ঠোঁটে; কিন্তু উপযুক্ত কোনো কারণ থাকলে তবেই। দাঁতগুলো সমান ঝকঝকে সাদা। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত। শরীরে অনেকটা ফলবান আপেল গাছের মতো ঘ্রাণ। খুব সহজেই আবার আমার ভালোবাসা জয় করে নিয়েছে সে।

বেকাথার দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম বড় বোনের ঠিক উল্টোটা হয়েছে সে। তেহুতি যদি হয় যুদ্ধের দেবী অ্যাথেনা তাহলে বেকাথা হচ্ছে ধরিত্রীর দেবী গেইয়া। মোটাসোটা চেহারা, গায়ের রং গোলাপি। পূর্ণ চন্দ্রের মতো গোলাকার মুখ; কিন্তু আরো উজ্জ্বল ঝকঝকে। একটুতেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে, হয়তো জীবন তার কাছে অত্যন্ত আনন্দময় বলেই। আমার মনে পড়ল শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল সে, আকারে ছিল তার স্বামী হুইয়ের অর্ধেক। কিন্তু বেশ কয়েক সন্তানের জননী হওয়ার সাথে সাথে যদিও এখন বেশ মুটিয়ে গেছে বেকাথা তবু তাকে আগের মতোই ভালোবাসে হুই। এবং একটু পরেই আমি বুঝতে পারলাম ভালো তাকে আমিও বাসি।

দলের বাকিদের চাইতে বেশ সামনে সামনে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। হুই এবং রামেসিস ইচ্ছে করেই আমাদের আলাদা থাকতে দিল, যাতে দুই বোনের সাথে আমার সম্পর্কটা আবার জোড়া লাগিয়ে নিতে পারি। অবশ্য আমাদের ভেতরে এত কথা জমা হয়ে আছে যে এই সামান্য সময়ে সেগুলো মোটেও শেষ হবে না। সত্যিই কথা শেষ হওয়ার আগেই আমরা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী স্পার্টার দুর্গ-প্রাসাদের প্রধান ফটকে এসে পৌঁছলাম।

যদিও বহু দশক ধরেই ক্রীতদাসের দল এর ওপর কাজ করে যাচ্ছে, তবু এখনো সম্পূর্ণ হয়নি দুর্গের নির্মাণকাজ। তবে বিশাল প্রাচীর পরিখা এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে আন্দাজ করলাম, আমার জানা মতে যত সেনাবাহিনী আছে তাদের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী দলের আক্রমণও খুব সহজেই ঠেকিয়ে দিতে পারবে এই দুর্গ। ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম আমি, কাছ থেকে ভালোভাবে দেখতে চাই সব কিছু। ইতোমধ্যে পেছন থেকে হুই আর রামেসিস এসে যোগ দিল আমাদের সাথে।

তেহুতি এবং বেকাথা উভয়েই এবার তাদের মনোযোগ ফেরাল রামেসিসের দিকে। তাতে অবশ্য আমার কোনো আফসোস হলো না। ইতোমধ্যে তাদের মনোযোগের যথেষ্টরও বেশি ভাগ পেয়েছি আমি, রামেসিস সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতোই একজন মানুষ। সত্যি কথা বলতে ওর সাথে তুলনা করা যায় এমন কাউকে এখনো দেখিনি আমি। হয়তো একটু বাড়িয়ে বলা হলো; কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে এর বেশি কিছু আমি বলতেও চাই না। তাই ওদের একলা ছেড়ে দিয়ে আমি একটু পেছনে সরে এলাম।

তোমার পরিচয় কী যুবক? বেকাথার মাঝে কখনো পিছিয়ে থাকার লক্ষণ ছিল না, এখনো নেই। সরাসরি রামেসিসকে লক্ষ্য করছে সে।

আমার তেমন কোনো পরিচয় নেই, মহামান্যা, ভদ্রতার হাসি হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রামেসিস। আমি শুধু ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন, যাতে করে প্রভু টাইটা এই সুন্দর দ্বীপে আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমার নাম ক্যাপ্টেন রামি। আমি এবং রামেসিস দুজনই একমত হয়েছি যে, মিশরের সিংহাসনের সাথে রামেসিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা এখনই সবার সামনে প্রকাশ করা উচিত হবে না। সবাই জানে সবচেয়ে অগম্য স্থানেও ফারাও উটেরিক টুরোর গুপ্তচর পৌঁছে যেতে পারে।

ওদিকে তেহুতি সম্পূর্ণ অন্য রকম এক দৃষ্টিতে রামেসিসের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বোনের ঠাট্টা-তামাশার কোনো চিহ্ন নেই সেই দৃষ্টিতে।

মিশরীয় রাজপরিবারের সদস্য তুমি, মনে হলো যেন মন্তব্য নয়, বরং অভিযোগের সুরে কথাটা ছুঁড়ে দিল সে।

আপনি কীভাবে জানলেন, মহামান্যা? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল রামেসিস।

তুমি যখন কথা বলছ তখন তোমার বাচনভঙ্গি খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কয়েক মুহূর্ত রামেসিসের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর জবাব দিল তেহুতি। তারপর আরো নিশ্চিত গলায় বলে উঠল, তোমাকে দেখে আমার এমন একজনের কথা মনে পড়ছে যাকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি; কিন্তু বহু বছর দেখিনি। দাঁড়াও একটু ভেবে দেখি! তার পরেই আবার বদলে গেল তার অভিব্যক্তি; কিন্তু এবার আগের চাইতে অবাক ভাব ফুটল চেহারায়। তোমাকে দেখে আমার ভাই ফারাও টামোসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে- মাঝপথে থেমে গেল সে, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার আত্মীয়ের দিকে। রামি! আরে তাই তো! তুমি আমার ভাইপো রামেসিস। তার পরেই আমার দিকে ফিরল চোখে ভর্ৎসনা। কিন্তু একই সঙ্গে খুশিতে ঝকমক করে উঠল তার চোখজোড়া, ঠোঁটে লুকায়িত হাসি। তুমি খুব দুষ্টু, টাটা! আমাকে এমনভাবে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা কীভাবে করলে তুমি? আমি যেন আমার নিজের রক্ত-মাংসকেও চিনতে পারব না। ওকে তো আমিই প্রথম গালি দিতে শিখিয়েছিলাম। তোমার মনে নেই রামেসিস?

আবর্জনার ঝড়! তারপর, পাঁজির পা-ঝাড়া! খুব ভালো করেই মনে আছে। আমার। তেহুতির সাথে মিশল রামেসিসের হাসি। তখন আমার বয়স মাত্র তিন কি চার, ওদিকে তুমি তখন ষোলো কি সতেরো বছরের বুড়ি। কিন্তু ওই মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো এখনো আমার কানে মধুর মতো লেগে আছে!

লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামল তেহুতি, ভাইপোর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিল। এদিকে এসে তোমার এই বুড়ি ফুপুকে একটা চুমু দাও দেখি, দুষ্টু ছেলে!

অত্যন্ত আনন্দের সাথে দুজনকে আলিঙ্গন করতে দেখলাম আমি, এবং আনন্দটা শুধু এ জন্য নয় যে, রামেসিসের সাথে আপাতত আমাকে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত থেকে লাফ দিতে হচ্ছে না। এই পুনর্মিলনী সভা শেষ হতে হতে বেশ সময় লেগে গেল, কারণ স্বাভাবিকভাবেই বেকাথাও যোগ দিল এই আনন্দের উৎসবে। তবে শেষ পর্যন্ত আবার ঘোড়ায় উঠলাম, আমরা দুর্গের দিকে এগোতে শুরু করলাম। দুই বোন রইল রামেসিসের দুই পাশে, স্পর্শ করা যায় এমন দূরত্বে।

দুর্গের কাছাকাছি আসতেই খুলে গেল বিশাল দরজা। রাজা হুরোতাসকে দেখা গেল দুর্গ-প্রাচীরের গায়ে তৈরি করা অস্থায়ী কাঠামোর ওপর থেকে নেমে আসছে। এগুলো তৈরি হয়েছে দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করতে। এতক্ষণ ওর ওপর দাঁড়িয়ে কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল সে। চেহারা-সুরতে যতটা না রাজা তার চাইতে বেশি ওই মিস্ত্রিদের মতোই অবস্থা হয়েছে তার। সারা গায়ে ধুলোবালি ভর্তি। দূর থেকেই আমাকে চিনে ফেলেছে সে, যেটা খুবই স্বাভাবিক। ভিড়ের মাঝেও কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যাব, এমন মানুষ নই আমি। তা ছাড়া নিজের স্ত্রী এবং তার বোনকে অচেনা এক আগন্তুক যুবকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে লেগে থাকতে দেখেও বেশ আশ্চর্য হয়েছে সে।

এ হচ্ছে আমার ভাইপো রামেসিস! পঞ্চাশ কদম দূরে থাকতেই স্বামীকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল তেহুতি।

আমাদের ভাই টামোসের মেজ ছেলে, আরেকটু বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করেছে বেকাথা। ও আসলে নিশ্চিত করতে চাইছে যে, ভাইপো কথাটার অর্থ নিয়ে যেন কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। এবং তুমি আর টাইটা মিলে যখন উটেরিককে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলবে তখন ওই হবে মিশরের ফারাও। ইতোমধ্যে রাজা নির্বাচক পদে নির্বাচিত করা হয়েছে আমাকে, কথাটা শুনে বেশ অবাক হলাম আমি। তবে হুরোতাস সম্ভবত বেকাথার এ ধরনের দিবাস্বপ্ন দেখার স্বভাবের সাথে পরিচিত। সরাসরি এগিয়ে এসে রামেসিসকে জড়িয়ে ধরল সে, একই সাথে তার পরনের পোশাকে নিজের গায়ে লেগে থাকা ধুলোবালির একটা বড় অংশ স্থানান্তর করল।

শেষ পর্যন্ত রামেসিসকে ভালোবাসা জানানোর পালা শেষ হলো তার। বেকাথার মতোই জোর গলায় ঘোষণা করল, যুবরাজ রামেসিসকে স্বাগত জানানোর জন্য একটি উৎসবের আয়োজন করতেই হবে আমাদের। বাবুর্চিদের জানিয়ে দাও যে আজ রাতে এক ভোজের আয়োজন করছি আমি, যেখানে সবার জন্য ভালো খাবার এবং আরো ভালো মদের ব্যবস্থা থাকবে।

*

সেই সন্ধ্যায় দুর্গের ভেতরের উঠানে বারোটার মতো বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে চারদিকে আলোকিত করে তোলা হলো। সেইসাথে টেবিল পাতা হলো ল্যাসিডিমনের কয়েক শ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য। রাজা এবং তার পরিবারের সদস্যরা বসল প্রাঙ্গণের মাঝে একটা উঁচু মঞ্চের ওপর, যেখান থেকে তাদের সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পাবে বাকি সবাই। আমি বসলাম আমার দুই প্রিয় মানুষ তেহুতি এবং বেকাথার ঠিক মাঝখানে। আমাদের ঠিক নিচেই বসার ব্যবস্থা হয়েছে বেকাথা এবং হুইয়ের ছেলেদের। চারজন সুদর্শন তরুণ, রাজা খামুদিকে বিতাড়নের অভিযানে এরা সবাই গিয়েছিল মিশরে। যদিও তখন খুব অল্প সময়ের জন্য ওদের দেখেছিলাম আমি; কিন্তু মানবচরিত্র বিচারে আমার কখনো ভুল হয় না। এক নজরেই বুঝতে পারলাম যে বেকাথা সত্যিই ফারাও রক্তের মান রেখেছে, তার ছেলেরা সবাই মিশরের অভিজাত বংশধারার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ছেলেদের মাঝে দুজন ইতোমধ্যে বিয়ে করেছে, তাদের সুন্দরী স্ত্রীরাও বসেছে একই সাথে। সবার বয়সই হবে রামেসিসের কাছাকাছি, এবং তার সাথে উপযুক্ত সম্মানসূচক আচরণই করছে তারা। ওদের সম্পর্কে আমার মনোভাবের কথা জানালাম বেকাথাকে। একটুও অবাক না হয়ে আমার প্রশংসা গ্রহণ করল সে, ছেলেদের গুণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।

সত্যি কথা বলতে, আমি ভেবেছিলাম আমার ছেলেদের মাঝেই কেউ ওদের চাচাতো বোন সেরেনাকে বিয়ে করবে, আমাকে জানাল সে। ইতোমধ্যে আমি জেনে গেছি যে সেরেনা হচ্ছে তেহুতির সেই রহস্যময় কন্যার নাম। রাজা হুরোতাস অর্থাৎ তার বাবার পাশে একটা চেয়ার এখনো খালি পড়ে আছে তার অপেক্ষায়। ওদিকে প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে চলেছে বেকাথা: ওদের চারজনই এক এক করে সেরেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে কিন্তু সবাইকেই দক্ষভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে ও। বলেছে যার সাথে একই সাথে ন্যাংটো হয়ে গোসল করেছে, একই পাত্রে প্রস্রাব করার সময় নিজেদের গোপনাঙ্গের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছে তাদের কাউকে ওর পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব হবে না। কিন্তু আরো কয়েক শ পুরুষ, যারা ওকে একই প্রস্তাব দিয়েছে তাদের ও কী বলে ফিরিয়েছে সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করে আমার। পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকেও ওকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব এসেছে; কিন্তু কেউই পাত্তা পায়নি।

ওর সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে অত্যন্ত সুন্দরী সে, স্বীকার করলাম আমি। উৎসাহ পেয়ে আরো বলে চলল বেকাথা।

ওর চাচারাসহ সবাই বলে যে ও নাকি সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দরী নারী, দেবী আফ্রোদিতির সাথে পাল্লা দিতে পারে। যদিও আমার তা মনে হয় না। সে যাই হোক, এত খুঁতখুঁতে হলে বর আর জুটবে না ওর ভাগ্যে, একা একাই বুড়ি হয়ে মরতে হবে। আমার অন্য পাশে বসে থাকা তেহুতির দিকে দুষ্টুমিভরা দৃষ্টি ছুড়ল বেকাথা। তেহুতিও আমাদের কথা শুনছিল, তবে জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করল না সে। কেবল লাল জিভের ডগাটা বের করে দেখিয়ে দিল বেকাথাকে।

তো নারীত্বের এই আদর্শ উদাহরণ ব্যক্তিটি এখন কোথায়? জানতে চাইলাম আমি। এসব কথার কোনোটাই আসলে তেমন গুরুত্ব বহন করে না, তবে আমার মনে হলো যে দুজনের মাঝের দুষ্টুমি আরো গুরুতর রূপ নেওয়ার আগেই প্রসঙ্গ বদলে ফেলা ভালো হবে। আজ রাতে কি আমাদের সাথে যোগ দেবে না সে?

এখানে কোনো খালি আসন দেখতে পাচ্ছ? প্রশ্ন করল বেকাথা, একই সাথে চোখ দিয়ে ইশারা করল রাজা হুরোতাসের দিকে। একই টেবিলে আমাদের মুখোমুখি বসে আছে সে। এবং তার বাম পাশের চেয়ারটাই এখন এই জনাকীর্ণ উঠানে একমাত্র খালি আসন। দাঁত বের করে হাসল বেকাথা, তারপর বড় বোনের আগেই কথাটার জবাব দিয়ে দিল, স্পার্টার রাজকুমারী সেরেনা শুধু সেই ঢাকের তালেই নাচে, যার শব্দ সে ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না।

কথাটা বেশ মজার সুরেই বলল সে, ফলে অভিযোগের বদলে প্রশংসার মতো লাগল শুনতে। কিন্তু রাজা হুরোতাস এতক্ষণ মনোযোগর সাথে আমাদের কথা শুনছিল। এবার তাড়াতাড়ি সামনে ঝুঁকে এসে আলোচনায় প্রবেশ করল সে। যখন কোনো সুন্দরী নারী মাত্র এক ঘণ্টা দেরি করে, তখন বুঝতে হবে যে ঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য তার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না।

সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল বেকাথা। এবার আমি বুঝতে পারলাম এই রাজ্যের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে এবং রাজা হুরোতাসের প্রকৃত আনুগত্য আসলে কার প্রতি। উৎসবের কোলাহলে যেন প্রায় একই মুহূর্তে ছেদ টেনে দিল কেউ এবং এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো উপস্থিত সবাই বোধ হয় হুরোতাসের কথা শুনেই চুপ হয়ে গেছে। কিন্তু তার পরেই বুঝতে পারলাম কথাটা আসলে স্রেফ দু-একজন ছাড়া কারো কানে যাওয়ার কথা নয়। এবং এই মুহূর্তে হুরোতাস বা অন্য কারো প্রতি কেউ খেয়াল করছে না, বরং সবার দৃষ্টি ঘুরে গেছে দুর্গ থেকে প্রাঙ্গণে প্রবেশের যে দরজাগুলো রয়েছে তার দিকে। একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক তরুণী। অবশ্য আমার এবং রামেসিসের জীবনে তার প্রবেশের এই ঘটনার বিবরণ এভাবে দিতে গেলে আসলে কিছুই বলা হয় না। যেন হাঁটছে না রাজকুমারী সেরেনা, বরং শরীরে কোনো অংশ না নাড়িয়ে যেন ভেসে চলেছে বাতাসে। তার কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে পোশাকের লম্বা ঝুল, এটাই বোধ হয় কারণ। চুলগুলো মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা, ঝলমলে সোনালি এক মুকুট যেন। কাঁধ এবং বাহুর হালকা রোদে পোড়া ত্বকে কোনো দাগ নেই, ঠিক পালিশ করা মার্বেল বা সদ্য বোনা রেশমের মতো। দিঘল দেহ; কিন্তু প্রতিটি অংশ নিখুঁত অনুপাতে তৈরি।

তাকে আসলে সুন্দরী বলা যায় না, কারণ ওই শব্দটার মাধ্যমে সত্যিকারের সৌন্দর্যের কোনো প্রকাশই বর্ণনা করা যায় না। বিস্ময়কর বললেও বরং কিছুটা বোঝা যায়। তার চেহারার প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই নিখুঁত, এবং যখন সেগুলোকে একসাথে মিলিয়ে দেখা হয় তখন যে আশ্চর্য ঘটনার সৃষ্টি হয় তার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। উপস্থিত প্রতিটি মানুষের দৃষ্টি যেন আটকে গেছে তার ওপর। তবে তার সবচেয়ে সুন্দর যে অঙ্গ, অবশ্য যদি এভাবে কিছু নির্বাচন করা যায় আর কি; সেটা হচ্ছে তার চোখ। আকারে বিশাল; কিন্তু মুখের বাকি অংশের সাথে একেবারে নিখুঁতভাবে মানিয়ে গেছে। যেকোনো পান্নার চাইতেও উজ্জ্বল সবুজ চোখগুলো। একই সাথে যেমন তীক্ষ্ণ এবং অনুভূতিপ্রবণ, তেমনি শান্ত এবং উদার দৃষ্টি সে চোখে।

এই সৌন্দর্যের কাছাকাছি আসতে পারে এমন মাত্র দুজন নারীর সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। একজন ছিল রানি লসট্রিস, আমার প্রথম ভালোবাসা। আর তারপর আছে সেই নারী, যে এই মুহূর্তে আমার পাশে বসে আছে: রানি তেহুতি, যে ছিল আমার দ্বিতীয় ভালোবাসা এবং এখনো তাই আছে। এখন যে তরুণীকে আমার সামনে দেখছি, লসট্রিস এবং তেহুতি যথাক্রমে তার নানি এবং মা।

তবে নিঃসন্দেহে রাজকুমারী সেরেনা হচ্ছে আমার দেখা জীবিত এবং মৃত সকলের মাঝে সবচেয়ে সুদর্শনা এবং স্নিগ্ধ নারী।

আমার পাশে বসে থাকা তেহুতিকে খুঁজে নিল ওর দৃষ্টি, এবং অনিন্দ্যসুন্দর হাসি ফুটল ঠোঁটে। তার পরেই টেবিলের শেষ প্রান্তে বসে থাকা রামেসিস উঠে দাঁড়াল, এবং নড়াচড়ার ফলে ওর দিকে আকৃষ্ট হলো সেরেনার চোখ। সাথে সাথে ওর ঠোঁটে ফুটে ওঠা হাসিটুকু মিলিয়ে গেল, তার বদলে চেহারায় ফুটল অবাক বিস্ময়। হাঁটার মাঝখানে এক পা তুলে রাখা অবস্থাতেই থমকে গেল ও, কাপড়ের নিচ থেকে উঁকি দিল একটা স্যান্ডেলের অগ্রভাগ। পরস্পরের দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দুজন, যে সময়টায় পৃথিবীর আর কোনো মানুষের অস্তিত্ব রইল না তাদের মাঝে। একসময় পা-টা নামিয়ে মাটিতে রাখল সেরেনা; কিন্তু চোখগুলো তখনো আটকে রইল রামেসিসের ওপর। তারপর হঠাৎ লজ্জায় গোলাপের মতো লাল হয়ে উঠল ওর গাল। এবং ব্যাপারটা যদিও অসম্ভব; কিন্তু এই লাজুকতা যেন আরো সুন্দরী করে তুলল ওকে।

তুমিই তো আমার মামাতো ভাই রামেসিস? মা বলেছিল যে তুমি আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছ, জলতরঙ্গের মতো সুরেলা সামান্য চাপা গলায় প্রশ্ন করল ও। নীরব প্রাঙ্গণের প্রতিটি আনাচকানাচে ছড়িয়ে গেল তার কণ্ঠস্বর। ওর চোখে এমন এক আলো খেলা করছে, যেটা ত্রিশ বছর আগের একটা মুহূর্তের কথা মনে করিয়ে দিল; যে মুহূর্তে প্রথমবারের মতো জারাসের চোখে চোখ রেখেছিল তেহুতি। কোনো কথা না বলে শুধু একবার মাথা ঝাঁকাল রামেসিস, সেরেনার নিখুঁত সৌন্দর্য থেকে এক পলকের জন্যও চোখ সরাচ্ছে না।

আমার পাশেই বসে ছিল তেহুতি; কিন্তু দুর্গের প্রাঙ্গণে বসে থাকা কেউ খেয়াল করল না যে কখন যেন টেবিলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমার হাতে চাপ দিয়েছে সে। এই তো! মৃদু কিন্তু উত্তেজিত গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল ও। এই তো!

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সেই অলৌকিক মুহূর্তটাকে চিনে নিয়েছে তেহুতি। উনিশ বছর বয়সে অবশেষে নিজের জীবনসঙ্গীকে খুঁজে নিয়েছে তার মেয়ে।

*

এরপর যে সপ্তাহ এবং মাসগুলো কেটে গেল তা আমার স্মৃতিতে ধরে রাখা সময়গুলোর মাঝে অন্যতম সেরা সুখের সময়।

প্রথম খুশির ব্যাপারটা ঘটল তখন যখন রাজা হুরোতাস এবং তার রানি তাদের দুর্গ-প্রাসাদের নিচে সদ্য গড়ে তোলা কোষাগার ঘুরে দেখার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানাল। পাথরের তৈরি সিঁড়ি দিয়ে অনেকগুলো ধাপ নিচে নামলাম আমরা। সামনে রইল দশজন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রহরী, পেছনে আরো দশজন। পথ দেখানোর সুবিধার জন্য সবার হাতে রয়েছে জ্বলন্ত মশাল। সব শেষের সিঁড়িটা বেয়ে নেমে আসার পর একটা ভারী ব্রোঞ্জের চাবি দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিশাল দরজার তালা খুলল হুরোতাস। তারপর তিনজন প্রহরী মিলে ঠেলে খুলে ফেলল সেই দরজা।

রাজাকে অনুসরণ করে রাজকীয় ধনভাণ্ডারের ভেতরে ঢুকলাম আমি, আগ্রহের চোখে চাইলাম এদিক-ওদিক। যদিও মাটির নিচে এই অভিযানের কারণ সম্পর্কে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি, তবে মনে মনে আন্দাজ করেছিলাম যে এখানে কী চোখে পড়তে পারে আমার। হুরোতাস এবং তেহুতি দুজনই বেশ আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করছে আমাকে। প্রায় এক মুহূর্তের মাঝেই যা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেলাম আমি। ভারী গ্রানাইটের টুকরো দিয়ে তৈরি করা দেয়ালের পাশে দাঁড় করানো রয়েছে প্রায় পঁচিশটার মতো সিডার কাঠের তৈরি সিন্দুক। এমনিতে যদিও নিজের আচরণ নিয়ে আমি সব সময় সচেতন তবে এই ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম ঘটিয়ে খুশির চিৎকার ছাড়ার জন্য নিশ্চয়ই আমাকে দোষ দেওয়া যায় না। এক দৌড়ে কামরার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে গেলাম আমি, একটা সিন্দুক দুই হাতে ধরে তোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা সিন্দুকের স্তূপ থেকে সবচেয়ে ওপরের সিন্দুকটা নিচে নামানোর জন্য তিনজন প্রহরীর সাহায্য দরকার হলো। তারপর তলোয়ারের মাথা দিয়ে চাড় মেরে সিন্দুকের ডালা খুলে দিল তারা, এবং পিছিয়ে গেল।

আমি লোভী মানুষ নই। কিন্তু আপনাদের মনে রাখতে হবে, মাত্র কয়েক দিন আগেই আমার হাতে থাকা সকল জমিজমা এবং রৌপ্যমুদ্রার শেষ ডেবেন পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে চলে গেছে ফারাও উটেরিক টুরোর দখলে। যখন নিজের কাছে এক লাখ রৌপ্যখণ্ড থাকে তখন তা নিয়ে মাথায় কোনো চিন্তাই থাকে না। কিন্তু যখন সেই পরিমাণটা নেমে আসে একটিমাত্র ডেবেনে তখন মাথায় ওটা ছাড়া আর কোনো চিন্তার অবকাশ থাকে না।

আমার মনে হয় আর কখনো এমন অবিশ্বাস্য দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাব না আমি, মশালের আলোতে ঝলমল করতে থাকা সোনা এবং রুপোর বিশাল ভাণ্ডারের দিকে চোখ কুঁচকে তাকানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম আমি। অবশ্য বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো না কথাগুলো। তারপর হাতের তালু দিয়ে মুছে ফেললাম গাল বেয়ে নামা আনন্দের অশ্রু, এবং ঘুরে তাকালাম রাজা হুরোতাসের দিকে। তার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম আমি। ফিসফিস করে বললাম, ধন্যবাদ, মহামান্য রাজা। তারপর ঝুঁকে এলাম তার পায়ে চুমু খাব বলে। কিন্তু আমাকে কাজটা করার কোনো সুযোগ দিল না সে, সরে গেল সাথে সাথে। আমার দুই কাঁধে দুই হাত রেখে আমাকে তুলে দাঁড় করাল, তারপর চাইল আমার চোখের দিকে।

আমার এবং তেহুতির প্রতি তুমি শত শতবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছ। তার প্রতিদান হিসেবে এ আর এমন কী? প্রশ্ন করল সে।

বারোজন ক্রীতদাসের সাহায্য নেওয়ার পরেও এই বিশাল সম্পদ সম্পূর্ণ বাছাই করা ওজন করা এবং পরিশেষে আবার আগের জায়গায় তুলে রাখার জন্য পরবর্তী তিন দিন সময় লেগে গেল আমার। দ্রুত একটা হিসাব করে তেহুতি জানাল যে এই সম্পদ আরো অগণিত বছর আমার বিলাসবহুলভাবে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট।

অবশ্য সত্যিই যদি ওই অগণিত বছর আয়ু থাকে তোমার, নিজের হিসাবে খুঁত বের করার চেষ্টা করল সে।

সেটা কোনো সমস্যা হবে না, তাকে আশ্বস্ত করলাম আমি। সমস্যা হবে সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরের পাঁচ শ বছর কীভাবে চলব তাই নিয়ে।

হুইয়ের চার ছেলের মাঝে পারিবারিক বন্ধন সত্যিই দৃঢ়। তবে বয়সে বড় হওয়া, সৌন্দর্য, মোহময়ী ব্যক্তিত্ব এবং রাজার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় এই দলের অবিসংবাদিত নেত্রী হচ্ছে সেরেনা। ঘূর্ণিবায়ুর মতো নাচতে পারে সে, জানে তুফান বেগে ঘোড়া ছোটাতে। মানুষের পরিচিত প্রতিটা বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ক্ষমতা আছে তার, একই সাথে সুরেলা কণ্ঠে তুলতে পারে সাইরেনদের মতো মনমাতানো সুর; যারা নাবিকদের ভুলিয়ে নিয়ে ডুবোপাহাড়ে নিক্ষেপ করত। কিন্তু সেরেনার কণ্ঠস্বরে সর্বনাশের হাতছানি নেই, বরং আনন্দের ইশারা আছে।

এ ছাড়াও ধাঁধা বা ছড়া লিখতেও জানে সে এবং ছোট্ট এক টুকরো হাসি বা একটা শব্দ দিয়েই হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে অপরের মুখে।

পৃথিবীর প্রায় সকল প্রান্ত থেকেই ক্ষমতাশালী ধনী পুরুষরা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু তাদের সবাইকে সেরেনা এমন বুদ্ধির সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, কেউই হৃদয় ভাঙার ব্যথা অনুভব করেনি বরং এমনভাবে বিদায় নিয়েছে যেন সেরেনা তাদের অনেক বড় কোনো উপকার করেছে।

মায়ের মতোই সেরেনাও সুদক্ষ তীরন্দাজ এবং সব ধরনের ধারালো অস্ত্র চালাতে পারদর্শী। তেহুতির সেই চুনির হাতলওয়ালা নীল রঙের তলোয়ারকে স্পর্শ করার অনুমতি আছে শুধু তার। এই অস্ত্রের খ্যাতি প্রায় কিংবদন্তির সমান, যার উৎপত্তি সম্পর্কে ছড়িয়ে আছে নানা বিভ্রান্তি। আমি এটাকে প্রথম দেখেছিলাম অনেক বছর আগে ট্যানাসের হাতে; জীবনের বেশির ভাগ সময় যে ছিল রানি লসট্রিসের একনিষ্ঠ; কিন্তু গোপন প্রেমিক। মৃত্যুশয্যায় সে এই তলোয়ার দিয়ে গিয়েছিল লসট্রিসের ছেলে রাজপুত্র মেমননের হাতে। যদিও মেমনন ছিল ট্যানাসের পুত্র; কিন্তু এই কথা তার আসল বাবা-মা বাদে জানতাম শুধু আমি। লসট্রিসের মৃত্যুর পর তার জায়গায় ফারাও পদে অধিষ্ঠিত হয় মেমনন, নাম নেয় ফারাও টামোস। আমার প্রিয় দুই নারী তেহুতি এবং বেকাথার বড় ভাই ছিল সে, এবং সেই হিসেবে সেরেনার দাদু।

ক্রিটের মিনোসের সাথে তার দুই বোনের বিয়ের ব্যাপারে টামোসই সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, আমি তাকে কিছু সাহায্য করেছিলাম মাত্র। বিয়ের উপহার হিসেবে চুনির হাতলওয়ালা এই নীল তলোয়ারটি বোনকে দিয়েছিল সে। সেই ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে যখন মিনোস এবং তার দ্বীপ রাজ্যের প্রায় সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায় তখন দুই বিধবা বোন তাদের প্রেমিক হুই এবং জারাসের সাথে পালিয়ে আসে। উত্তরে এই ল্যাসিডিমনে নিজেদের রাজ্য গড়ে তোলে তারা। স্বাভাবিকভাবেই মিশরে ফিরে না গিয়ে প্রেমিকদের সাথে পালিয়ে যেতে দুই বোনকে সাহায্য করেছিলাম আমি। এবং স্বাভাবিকভাবেই এই বিখ্যাত অস্ত্র তখন তেহুতির কাছেই ছিল।

অত্যন্ত দক্ষ তলোয়ারযোদ্ধা হওয়ায় টামোসের কাছ থেকে উপহার পাওয়া নীল তলোয়ারের প্রায় প্রেমে পড়ে গিয়েছিল তেহুতি। খুব সম্ভব ক্রিট দ্বীপে ইচ্ছের বিরুদ্ধে রওনা দেওয়ার সময় এই একটা উপহারই সান্ত্বনা জুগিয়েছিল ওকে।

আর কাউকে কখনো এই জাদুকরী তলোয়ার, এমনকি ছুঁতেও দিত না তেহুতি; এমনকি তার স্বামী রাজা হুরোতাসকেও নয়। ঝকঝকে শরতের আকাশের মতো ধাতুর শরীর থেকে শত্রুর রক্তও সে নিজেই ধুয়ে পরিষ্কার করত সব সময়। একমাত্র তেহুতিই তলোয়ারের ধারগুলোকে পালিশ এবং ধার দিয়ে দিয়ে মৃত্যুর মতো নিখুঁত করে তুলেছিল, এবং কাজটা করতে দিয়ে নিজেও পরিণত হয়েছিল দক্ষ কামারে। 

তবে হুরোতাস নদীর তীরে একদিন আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল। এই দিনটা ছিল রাজকুমারী সেরেনার চৌদ্দতম জন্মদিন, যেদিন বালিকা থেকে সে নারীত্বে উপনীত হলো। তাকে দেওয়ার জন্য সত্যিই এর চাইতে বড় কোনো উপহার ছিল না।

আমি অবশ্য সেদিন ওদের সাথে ছিলাম না। কেবল রামেসিসকে নিয়ে ল্যাসিডিমনে পৌঁছানোর পরেই তেহুতির কাছ থেকে নিম্নোক্ত ঘটনার বিবরণ শুনেছি আমি। সেরেনার বয়স তত দিনে বিশ বছর হয়ে গেছে।

*

সেই দিন এখানকার সমাজের নিয়ম এবং নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী মা এবং মেয়ে দুজন মিলে ঘোড়া নিয়ে চলে গিয়েছিল দুর্গ থেকে দূরে হুরোতাস নদীর উজানে। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর একটু আগে নিজেদের ঘোড়াগুলো চাকরদের হাতে বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা। তারপর হাত ধরাধরি করে শেষ এক শ কিউবিট পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিল জলপ্রপাতের পাশে তৈরি করা রাজকীয় বাড়িটায়। পরিচারক বা চাকরদের কেউ ওদের অনুসরণ করেনি। রাজপরিবারের দুই সদস্যের ফিরে আসা পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করতে হবে তাদের।

নীল তলোয়ারটাকে কোমরের খাপে বেঁধে নিয়েছিল তেহুতি; কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। কারণ খুব কম সময়েই ওটা কাছ ছাড়া করে সে। সকালে তাদের চাকর এবং পরিচারকরা হাজির হয়েছিল বাড়িটায়। সব কিছু নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করে রেখে এসেছে তারা। বড় বড় তামার ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখেছে তাজা ফুল, ফলে বাড়ির প্রধান কামরাটা পরিণত হয়েছে যেন এক আনন্দের বাগানে। বসার আসনগুলো সাজানো হয়েছে এলক হরিণের চামড়া আর রেশমি বালিশ দিয়ে। মেঝের মাঝখানে জ্বালানো হয়েছে আগুন, কারণ শীতকাল এখনো বাকি। তারপর দশজন ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবার সাজিয়েছে টেবিলের ওপর; কারণ খুব ভালো করেই জানা আছে যে খাবার যা বাকি থাকবে সেগুলো তারাই পাবে।

বাড়ির সীমানার মাঝে প্রবেশ করার প্রায় সাথে সাথেই শরীর থেকে কাপড়ের বন্ধন খুলে ফেলতে শুরু করল তেহুতি আর সেরেনা। কোমর থেকে নীল তুলোয়ারের খাপটা খুলে নিল তেহুতি, তারপর অগ্নিকুণ্ডের সামনে রাখা টেবিলের ওপর যত্নের সাথে রাখল। পরনে থাকা সকল পোশাক এলকের চামড়ায় ঢাকা বালিশের ওপর ছুঁড়ে ফেলল দুজন। তারপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হাত ধরাধরি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তারা, দৌড়ে চলে গেল নদীর পাড়ে। সেখানে স্বচ্ছ পানিতে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল তারা, বাতাসে উঠল জলকণার মেঘ। পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ফলে দুজনই চমকে উঠল। নদীর ওপর ভাসছে পাহাড় থেকে ভেসে আসা বরফের বড় বড় চাঙড়। একে অপরকে পানি ছিটাতে লাগল তারা, যতক্ষণ না তেহুতি রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছিয়ে গেল। মায়ের পিছু ধাওয়া করল সেরেনা, তারপর জোর করে ধরে রাখল ঝরনার পানির নিচে; যতক্ষণ না মাফ চাইল তেহুতি। তার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি থাকলেও মেয়ের সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হলো তাকে। মনে হচ্ছিল যেন সেরেনার শরীরটা কোনো মানুষের রক্ত-মাংসে তৈরি নয় বরং ওই নীল তলোয়ারের মতোই রহস্যময় কোনো স্বর্গীয় পদার্থে গড়া হয়েছে তাকে।

কিন্তু পাহাড়ি নদীর বরফগলা পানির প্রচণ্ড ঠাণ্ডার সাথে পাল্লা দিয়ে এই দুই নারীর কারো পক্ষেই জয়লাভ করা সম্ভব ছিল না। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে যখন তারা তীরে ফিরে এলো তখন দুজনই প্রচণ্ড শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে। ঠাণ্ডার চোটে লাল হয়ে গেছে নিতম্ব আর তলপেট। বাড়ির ভেতরে ঢুকে অগ্নিকুণ্ডের মরে আসা আগুনে নতুন করে কাঠের টুকরো ছুঁড়ে ফেলল তারা, তারপর যখন সেগুলো নতুন করে জ্বলে উঠল তখন আগুনের এত কাছে এসে দাঁড়াল যে আরেকটু হলেই তাদের গায়ে আগুন লেগে যেত। চাকরদের রেখে যাওয়া শুকনো তোয়ালে দিয়ে পরস্পরের শরীর মুছে পরিষ্কার করে দিল তারা। শরীর গরম হয়ে আসতে যখন কাঁপুনি কমে এলো তখন বড় এক পাত্র লাল মদ নিয়ে এলো তেহুতি। সেটা কয়লার ওপর রাখল সে, তারপর যখন ভেতরের মদ ফুটতে শুরু করল তখন তার ভেতরে দুই মুঠো শুকনো গুল্ম ছুঁড়ে দিয়ে ভালোভাবে নাড়ল। শরীর সম্পূর্ণ শুকিয়ে আসার পর কাপড় পরে নিল দুজন, তারপর আগুনের সামনে রাখা একটা আসনে পাশাপাশি বসল। ধূমায়িত পাত্রটা হাতবদল হতে লাগল দুজনের মাঝে, উষ্ণ মদের কারণে আর পরস্পরের সান্নিধ্যে দুজনই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট বোধ করছে।

চুনি পাথরের বাঁটসহ সেই তলোয়ারটা এখনো খাপের মাঝে ভরে নিজের কোলের ওপর রেখেছে তেহুতি। এবার মেয়ের দিকে ঝুঁকে এলো সে, মুক্ত হাতটা দিয়ে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। সেরেনাও মায়ের গালে চুমু খেয়ে আদরের জবাব দিল, তারপর ফিসফিস করে বলল, এই সুন্দর দিনটার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ মা। আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েতে পরিণত করেছ তুমি।

এখন আর তুমি নিছক কোনো মেয়ে নও, প্রিয়। নারী হয়ে উঠেছ তুমি এবং তোমার সৌন্দর্য এখন ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। কিন্তু তোমার জন্মদিন তো এখনো শেষ হয়নি। তোমার জন্য আরো একটা উপহার আছে আমার কাছে।

ইতোমধ্যে আমাকে যথেষ্টরও বেশি দিয়েছ তুমি… বলতে শুরু করল সেরেনা, তারপর হঠাৎ ভাষা হারিয়ে ফেলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল মায়ের দিকে। কোল থেকে নীল তলোয়ারটা তুলে নিয়েছে তেহুতি, মেয়ের কোলের ওপর রেখেছে সেটা। তারপর সেরেনার হাতটা ধরল সে, তলোয়ারের বাটের ওপর রেখে ভাঁজ করে দিল আঙুলগুলো।

এটাই তোমার প্রতি আমার উপহার, সেরেনা, বলল সে। সাবধানে ব্যবহার কোরো এটা, যত্ন নিও। কিন্তু যখন প্রয়োজন হবে তখন যেন শত্রুর হৃৎপিণ্ড বরাবর আঘাত করতে দ্বিধা কোরো না।

এ যে অনেক বেশি, দুই হাত নিজের পেছনে নিয়ে গিয়ে মাথা নেড়ে বলল সেরেনা, এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে কোলের ওপর পড়ে থাকা অস্ত্রটার দিকে। আমি জানি তোমার কাছে এটা কত মূল্যবান। আমি এটা নিতে পারি না।

কিন্তু এই উপহারের সাথে যে আমার ভালোবাসাও মিশে আছে। আর এখন যদি এটা আমি ফেরত নিতে চাই তাহলে আমার ভালোবাসাও ফিরিয়ে নিতে হবে, যেটা অসম্ভব, বলল তেহুতি।

তলোয়ারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এনে মায়ের দিকে চাইল সেরেনা, এই কথার কী জবাব দেবে ভাবছে। কথার খেলা চলছে এখন দুজনের মাঝে। এমন একটা ব্যাপার, যেটা উভয়েই পছন্দ করে। তার পরেই তার মাথায় সমাধানটা চলে এলো। এই নীল তলোয়ার তো তোমারই একটা অংশ, তাই না? প্রশ্ন করল সে। একটু দ্বিধা করে মাথা ঝাঁকাল তেহুতি।

হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়, ব্যাপারটা স্বীকার করে নিল সে।

কিন্তু তোমার অংশ তো আমি নিজেও। আর তুমিও আমার একটা অংশ। ঠিক কিনা, বলো?

এবার তেহুতি বুঝতে পারল কী বোঝাতে চাইছে তার মেয়ে। গম্ভীর ভাব কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।

তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? আমরা তিনজন আসলে একই সত্তা এবং এই তলোয়ার আমাদের দুজনেরই অংশ। তার মানে আমরা তিনজন প্রত্যেকেই একে অপরের। এই কথা বলে তলোয়ারের চুনিখচিত হাতলটা চেপে ধরল সেরেনা টান দিয়ে সেটা বের করে আনল খাপ থেকে। তারপর বলল, এই অসাধারণ জিনিসটা তুমি আমার সাথে ভাগ করে নিতে চেয়েছ, এটা আমার জন্য অনেক বড় সম্মানের ব্যাপার, মা।

তারপর উঠে দাঁড়াল সে, তলোয়ারটা তুলে ধরল এমনভাবে যেন জ্বলন্ত মশাল তুলে ধরেছে। মনে হলো যেন তলোয়ারের ফলা থেকে প্রতিফলিত নীলচে আভায় পুরো ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছে। এবার অনুশীলনের ধাপগুলো শুরু করল সে, যেগুলো সেই ছোটবেলায় খেলনা তলোয়ার ধরার মতো বয়স হওয়ার সাথে সাথেই তাকে শিখিয়েছিল তেহুতি। প্রথমেই আক্রমণের বারোটি প্রাথমিক পদ্ধতি অনুশীলন করল সে, তারপর কোথাও না থেমে সাবলীল দ্রুততায় অন্য সবগুলো পদ্ধতি।

তাকে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করতে লাগল তেহুতি, আর একই সাথে অনুশীলনের গতি বাড়াতে শুরু করল সেরেনা। একসময় তার হাতের তলোয়ারটা মনে হতে লাগল এক টুকরো আলোর রেখা, ঠিক যেমনটা ফুলের সামনে ভেসে থাকার সময় হামিংবার্ডের পাখায় দেখা যায়। সেই পাখারই একটা অংশে পরিণত হলো তার হাত, প্রতিনিয়ত আকার বদলাচ্ছে। তলোয়ারের তালে তালে নাচতে শুরু করল তার সম্পূর্ণ শরীর। শেষে গ্রীস্মের আকাশে ফুটে ওঠা বিদ্যুৎশিখার মতো লঘু চঞ্চল পায়ে ঘুরতে শুরু করল সে। প্রতিটা ঘূর্ণনের সাথে সাথে তামার ফুলদানিগুলো থেকে একটা করে ফুলের উঁটা কেটে পড়ে যেতে লাগল তার তলোয়ারের ঘায়ে। কাজটা এত নিখুঁতভাবে ঘটতে লাগল যে, এমনকি ফুলগুলোও বুঝতে পারল না যে তাদের গোড়া কেটে ফেলা হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য যেন শূন্যে ভেসে থাকল তারা, তারপর পড়ে যেতে লাগল মেঝেতে। ততক্ষণে হয়তো নতুন তিন-চারটি ফুলের উঁটা কেটে পড়ে গেছে সেরেনার তলোয়ারের আঘাতে। মেঝের ওপর পুরু হয়ে জমল ফুলের আস্তরণ, শীতকালে যেভাবে জমে তুষার। শেষ পর্যন্ত যখন আর একটা ফুলও বাকি রইল না তখন যেভাবে নাচ শুরু করেছিল ঠিক সেভাবেই আবার হঠাৎ করে থেমে গেল সেরেনা, ঠিক আগের মতোই নীল তলোয়ারটা মশালের মতো তুলে ধরে রেখেছে মাথার ওপর।

সেদিন তেহুতি তলোয়ারবাজির এমন উৎকৃষ্ট নিদর্শন দেখেছিল যে, আর কোনো দিন সেটা সে ভুলবে না। এবং সেরেনার কোমর থেকে ঝুলতে থাকা নীল তলোয়ারটা দেখে আমার মন্তব্যের জবাবেই এই গল্প আমাকে শুনিয়েছিল সে।

*

দিনগুলো যদি আমার জন্য সুখের হয়ে থাকে তবে রামেসিস আর সেরেনার জন্য তা ছিল স্বর্গীয়। শুনেছি প্রথম দর্শনে প্রেম বলে কিছু নেই; কিন্তু এই জুটিকে দেখে সেই ধারণাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে বাধ্য হলাম আমি।

নিজেদের মাঝে তৈরি হওয়া আকর্ষণ এবং ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করল না তারা। সুযোগ পেলেই নিজেদের স্পর্শ করে তারা, একজন যখন কথা বলে তখন আরেকজন তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ চোখে। মাঝে মাঝে দেখা যায় পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে কোথাও বসে আছে তারা, বহুক্ষণ কেটে গেলেও নড়ার কোনো লক্ষণ নেই।

দুজনের এই ভালোবাসা দেখে প্রথমে তেহুতি খুশি হয়েছিল ঠিক; কিন্তু খুব শীঘ্রই সেটা ভয়ে রূপ নিল। মেয়ের কাছ থেকে সতীত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার একটা শপথ আদায় করে নিল সে, তারপর আমার কাছে অভিযোগ করতে এলো। ওই শপথ ও মন থেকে নেয়নি। মাদি ঘোড়া তার প্রথম মৌসুমে যেমন উত্তেজিত হয়ে থাকে ওর অবস্থাও তাই। রামেসিসকে দেখলেই ওর মনের অবস্থা কী হয় সেটা আমি ঠিকই বুঝতে পারি। আমাকে সাহায্য করো, টাটা।

চেহারায় নিষ্পাপ ভাব ফুটিয়ে তুললাম আমি। বললাম, কীভাবে সাহায্য করব? জারাস যখন তোমার পেছনে লেগেছিল তখন যেভাবে তোমার কুমারীত্ব রক্ষা করতে সাহায্য করেছিলাম সেভাবে?

চমকে উঠল তেহুতি, তারপর জ্বলন্ত চোখে তাকাল আমার দিকে। তোমার জন্য দুঃখ লাগছে আমার। এত নোংরা মন তোমার, টাইটা!

কখন আমার নোংরা মনের পরিচয় পেলে? প্রশ্ন করলাম আমি। ব্যাপারটা যখন তোমার আর জারাসের ছিল তখন, নাকি এখন রামেসিস আর সেরেনার ব্যাপারে? এই কথা শোনার সাথে সাথে নিষ্ফল রাগে হাত দুটো মাথার ওপর ছুড়ল তেহুতি, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল।

দুটোর মাঝে অনেক বড় তফাত আছে, হাসির দমক কিছুটা সামলে নিয়ে বলল সে। জারাস আর আমি কখনো আমার ভাই, অর্থাৎ ফারাওয়ের কাছ থেকে কোনো সুযোগ পাইনি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এক বুড়ো বরের সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল আমাকে। আমি শুধু চেয়েছিলাম জীবনে একবারের জন্য হলেও আমার ভালোবাসার পুরুষকে কাছে পেতে। কিন্তু সেরেনা আর রামেসিসের মিলনের প্রতি সবার সম্মতি রয়েছে। আমরা শুধু চাইছি ওরা একটু ধৈর্য ধরুক।

আমার মনে হয় সেই একটু ধৈর্যটা ঠিক কতখানি সেটা নিয়ে তোমার এবং তোমার মেয়ের মতামত সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এটা বলতে পারি যে, অন্তত রামেসিসকে সামলে রাখার চেষ্টা করব আমি।

এবং তেহুতিকে সত্যি কথাই বলেছিলাম আমি। ওর মতো আমিও জানি প্রথম প্রেমের উচ্ছ্বাস কতটা অপ্রতিরোধ্য হতে পারে। রাজা হুরোতাস এবং তেহুতি দুজনই রামেসিস আর সেরেনার মিলনের পক্ষে; কিন্তু ব্যাপারটা একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বও বহন করছে। হুরোতাস এবং তেহুতির মতে ল্যাসিডিমনের চারদিকে ছোট-বড় যে অসংখ্য রাজ্য রয়েছে তাদের সবগুলোর প্রধানদের বিয়েতে উপস্থিত থাকতেই হবে। এই বিয়ে থেকে যতটা সম্ভব রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করতে চায় রাজা হুরোতাস এবং তার স্ত্রী।

ওদের আন্দাজ অনুসারে রাজনৈতিক মৈত্রী আশা করা যায় এমন সবগুলো দেশের রাজার কাছে বিয়ের আমন্ত্রণপত্র পাঠাতে, সেইসাথে তাদের সবাইকে ল্যাসিডিমনের দুর্গ-প্রাসাদে অবস্থানের ব্যবস্থা সাজাতে সাজাতে প্রায় বছরখানেক সময় লেগে যাবে।

এক বছর! অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল রামেসিস। এর ভেতরে তো আমি বুড়ো হয়ে মরেই যাব! কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম সেরেনা অনেক বেশি ধৈর্য এবং বুদ্ধির পরিচয় দিল।

তুমি যতটা বলো সত্যিই যদি আমাকে ততটা ভালোবাসো, নিজের বাবা-মা এবং আমার উপস্থিতিতে রামেসিসকে বলল সে, তাহলে আমার বাবা এবং মায়ের কথা তোমাকে শুনতেই হবে। এই সুন্দর দেশের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আমি। সুতরাং এই দেশের প্রতি আমার কর্তব্যের গুরুত্ব আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার চাইতে অনেক বেশি। তা ছাড়া সময় এবং ত্যাগের সাথে সাথে আমাদের ভালোবাসার শক্তি আরো বাড়বে, তাই না? বলা যায় যে, এই একটা সাধারণ কিন্তু ওজনদার যুক্তি দিয়েই রামেসিসের মন ঘুরিয়ে ফেলল সে।

এখন পর্যন্ত ওকে আমি স্রেফ একজন সুন্দরী তরুণী হিসেবেই দেখে এসেছি। কিন্তু সেই দিন থেকে বুঝতে শুরু করলাম, আসলেই ওর ব্যক্তিত্ব কতটা শক্তিশালী। সত্যি কথা বলতে, ওর গুণ এবং মেধার প্রায় পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে সৌন্দর্যের পর্দার আড়ালে। কিন্তু যদি কেউ ওই পর্দার আড়াল ভেদ করে উঁকি দিতে পারে তাহলে দেখবে ভেতরে এমন এক বুদ্ধিমত্তা এবং ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে, যা সত্যিই অসাধারণ।

দিনের মাঝে অনেকটা সময় একসাথে কাটায় ওরা, ফলে ওদের ভালোবাসার কথা কারো অজানা নেই। কিন্তু কখনো মানুষের দৃষ্টির আড়ালে যায় না সেরেনা, ফলে কেউ ওদের নিয়ে কোনো অলস গালগল্পের জালও বুনতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এই জুটির দুজনই অন্যান্য বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী মানুষদের প্রতি দারুণভবে আকৃষ্ট, বিশেষ করে যেকোনো জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় সেরেনার আগ্রহ অনেক বেশি। প্রায় প্রতিদিনই অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে খুঁজে নেয় সে, নানা রকম বিষয়ে আলোচনা করে। সেসব বিষয়ের মাঝে আমাদের পৃথিবীর আকৃতির মতো ব্যাপার যেমন থাকে, তেমনি থাকে জোয়ার-ভাটার কারণ এবং চাঁদ আর সূর্য কী উপাদানে তৈরি তাই নিয়ে গবেষণা।

এই আলোচনা এবং বিতর্কগুলোর জন্য বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকি আমি। প্রথম দেখা হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, সেরেনাকে তার মা তেহুতির মতোই ভালোবেসে ফেলেছি। যদিও সে আমার মতামতকে বারবার অস্বীকার করে, কিছুতেই মানতে চায় না যে পৃথিবী আসলে চ্যাপ্টা; এবং জোয়ার-ভাটা হচ্ছে সাগরদেবতা পোসাইডনের অদম্য তৃষ্ণার ফল, যে কিনা প্রতিদিন দুইবার সাগর থেকে গভীর চুমুকে পানি টেনে নেয়। এটাও বিশ্বাস করে না যে, সূর্য আর চাঁদ আসলে একই বস্তু, যা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেটা এমন এক দাহ্য পদার্থে তৈরি, যেটা দিনের বেলায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠে শেষ হয়ে যায় আর রাতে আবার নিজেকে নতুন করে তৈরি করে। এসব ব্যাপারে ওর নিজের কিছু মতামত আছে, যেগুলো এমনই হাস্যকর যে একবারের বেশি দুইবার শুনতে ইচ্ছে করে না। আরে ওর কথা অনুসারে পৃথিবী যদি সত্যিই কুমড়োর মতো গোলাকার হবে, তাহলে ওর নিচে যে মানুষগুলো রয়েছে তারা পড়ে যায় না কেন?

পরবর্তী কয়েক মাসে আমার মাঝে একটা ধারণা ধীরে ধীরে শক্ত রূপ নিতে শুরু করল। সেরেনা খুব সম্ভব কোনো স্বাভাবিক মানব-মানবীর সন্তান নয়, অথবা ওর বাবা-মার মাঝে অন্তত একজনের মাঝে স্বর্গীয় কোনো গুণাবলি ছিল। এমন বুদ্ধি আর সৌন্দর্য এই পৃথিবীর কিছু হতে পারে না। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম, কারণ ইতোমধ্যে আমিও একই পথে হেঁটেছি বা বলা যায় একই আশীর্বাদ পেয়েছি। ব্যাপারটা আর ঠিক কীভাবে বুঝিয়ে বলা যায় আমার জানা নেই।

রাজা হুরোতাসের জন্য আমার মনে যে উঁচু ধারণা, তাতে কোনো খাদ নেই। সে একজন দক্ষ এবং সাহসী যোদ্ধা, পুরনো এবং বিশ্বস্ত বন্ধু। রাজা হিসেবে তার দক্ষতা বরং আরো বেশি, সত্যি কথা বলতে ফারাও টামোসের পরেই রাজ্য শাসনে তাকে এগিয়ে রাখব আমি। কিন্তু স্বাভাবিক মস্তিষ্কের কেউই রাজা হুরোতাসকে দেবতা বলে ভুল করবে না।

তবে সেরেনা কার গর্ভে বেড়ে উঠেছে সেটা নিয়ে অন্তত সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, কারণ দুজনের মাঝে কেবল একজনেরই ওই ক্ষমতা আছে। তাই এবার আমার মনে সন্দেহ ঢুকল, তেহুতি বোধ হয় সতীত্বের ওই চুলের মতো সরু পথটায় সারা জীবন অবিচল ছিল না।

তবু আমার সন্দেহকে নিশ্চিত করার জন্য সেরেনার এই সম্ভাব্য দেবত্বকে পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। কিছু কিছু লোক ভাবে আমি সব সময়ই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকি বা থাকার ভান করি। তবে তাদের কথাকে সত্যি প্রমাণিত করতে নয়, বরং আমার চারপাশের যারা আছে তাদের সবার প্রতি ভালোবাসা থেকেই কাজটা করতে হবে আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *