২. ফারাও-এর তাঁবু

ফারাও-এর তাঁবুর চেয়ে লর্ড নাজার তাঁবুটা বড় ও বেশি বিলাস বহুল। সে একটা অবলুস কাঠ ও হাতির দাঁতের তৈরি স্বর্ণ দিয়ে সজ্জিত অপ্রতুল ও দামি রৌপ্য খচিত মিশরের প্রধান প্রভুদের চিত্র আঁকা সিংহাসনে বসল। হুরিয়া থেকে আনা পশমি মাদুর দিয়ে বালির মেঝে ঢাকা, যা বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত এবং তার মধ্যে উজ্জ্বল সবুজ রং ছিল যা নীলের দুই তীরের সু-শ্যামল চিত্রকে নির্দেশ করে। যখন সে রাজ প্রতিভূ হিসেবে প্রকাশিত হল তখন নাজা সবুজ রং-টা তার হাউজের রং হিসেবে বেছে নিয়েছে।

নাজার বিশ্বাস সুগন্ধি প্রভুদের কাছে আসতে উৎসাহ দেয়। আর তাই তাঁবুর খুঁটির চেইনের সাথে ঝুলানো সিংহাসনের পাশে নিচু টেবিলটার উপর খোলা কাঁচ পাত্রে সুগন্ধি রেখেছে। রাজপ্রতিভূ তার পরচুলা খুলে রেখেছে এবং একজন ভৃত্য তার ন্যাড়া মাথার উপর মোমের তৈরি একটা সুগন্ধি পাখা ধরে আছে। মোমটা গলতেই এটা তার গাল ও ঘাড় বেয়ে নেমে এল যা তাকে একটা শীতল অনুভূতি ও প্রশান্তি এনে দিল।

তাঁবুর ভেতরটায় বাগানের মতই ফুলেল সুবাস। এমনকি দরবারের উচ্চপদস্থ লোকগণ, রাষ্ট্রদূতেরা এবং অন্য যারা সিংহাসনের দিকে মুখ করে বসে আছে তাদেরও রাজ প্রতিভূ-র সামনে আসার আগে গোসল করে সুগন্ধি মেখে আসতে হয়। টাইটা সার্জনের উপদেশ অনুসরণ করল। তার চুলের ধুলো পরিষ্কার করল ও ঘাড়ের উপর দিয়ে তা আচড়াল এবং বোয়া ও ইস্ত্রি করা এবং সূর্যালোর মতো নির্মল তার সাদা লিলেন জামাটা পড়ল। তাঁবুর প্রবেশ মুখে সে রাজ-প্রতিভূকে অভিবাদন জানানোর জন্যে হাঁটুগেড়ে বসল। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই, সেখানে এটা মন্তব্য ও অনুমানের গুঞ্জন উঠল। বিদেশি রাষ্ট্র দূতেরা তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল এবং ফিস্ ফিসিয়ে বলতে লাগল যে, তারা তার নাম শুনেছে। এমনকি সৈন্যরা ও যাজকেরা মাথা নাড়তে লাগল এবং একে অপরের সাথে কথা বলতে কাছাকাছি এল। এই সে বিখ্যাত ম্যাগোস। পবিত্র টাইটা, ধাঁধা বিশেষজ্ঞ। টাইটা, হুরাসের আঘাত প্রাপ্ত চোখ।

লর্ড নাজা প্যাপিরাস থেকে চোখ তুলল যা সে পরখ করছিল এবং সামনের দিকে চেয়ে হাসল। প্রকৃতই সে একজন সুদর্শন লোক, ভাস্কর্যের মত দেহ এবং অনুভূতিপ্রবণ ঠোঁট তার। তার নাক সোজা ও সরু এবং তার চোখটা সোনালি মনকা-পাথরের ন্যায়–জীবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত। তার নগ্ন বুকে কোন চর্বি নেই এবং তার বাহু সরু ও শক্ত পেশীবহুল।

দ্রুত টাইটা সকল গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, যারা সিংহাসনের কাছাকাছি বসে আছে তাদের অভিবাদন জানাল। ফারাও ট্যামোস-এর মৃত্যুর অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে রাজ-ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষমতার একটা বড় রদ-বদল হয়েছে। অনেক পরিচিত মুখকে দেখা যাচ্ছে না এবং অনেকে রাজ প্রতিভূ-র আশীর্বাদে অন্ধকার থেকে হঠাৎ করে সূর্যালোকে চলে এসেছে। তাদের মধ্যে ফেট গার্ডের আসমর একজন।

এগিয়ে আসুন, লর্ড টাইটা, নাজার কণ্ঠ সুখকর ও নিচু। টাইটা সিংহাসনের দিকে এগোল এবং রাজ-সদস্যগণ সরে তাকে স্থান করে দিল। রাজ-প্রতিভু টাইটার উদ্দেশ্যে একটা হাসি দিল। আপনি জানেন যে আপনি আমাদের অনুগ্রহের অনেক উপরে অবস্থান করছেন। আপনি আপনার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন যা ফারাও ট্যামোস বিশেষভাবে আপনার উপর অর্পণ করেছিলেন। আপনি প্রিন্স নেফারকে অমূল্য নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ রকম উচ্চ অভ্যর্থনায় টাইটা অবাক হয়ে গেল কিন্তু সে তা প্রকাশ করল না। আর এখন যখন প্রিন্স নেফার যখন ফারাও সেটি হয়েছেন তখন তার আপনাকে আরো বেশি প্রয়োজন।

সে চিরঞ্জীব হোক, টাইটা বলল এবং বাকিরা তার প্রতিধ্বনি তুলল।

তিনি চিরঞ্জীব হোন।

লর্ড নাজা হাত উঠাল। আপনি এখানে বসুন, আমার সিংহাসনের ছায়ায়। যখন আমি ফারাও-এর বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করব তখন আমারও আপনার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন পড়বে।

আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সম্মান রাজ-প্রতিভূ আমাকে দেখালেন। টাইটা একটা নিরীহ দৃষ্টিতে নাজার দিকে তাকাল। তার চেহারায় গোপন ষড়যন্ত্রের ছায়াটা সে স্পষ্ট খুঁজে পেল না। তাকে যে আসন দেওয়া হল সেখানে সে বসল কিন্তু সিল্কের কুশানটা সরিয়ে পশমি,মাদুরে সে আসন নিল। তার পিঠ সোজা ও কাঁধটা চারকোনা।

দরবারের কাজ শুরু হল। তারা জেনারেল ক্রাতাসের দায়িত্ব ভাগ করছিল: একজন দেশদ্রোহী হিসেবে তার সব কিছু বাজেয়াপ্ত করা হল এবং রাজকোষের অধীনে নেওয়া হল। ক্রাতাসের অধীনে থাকা হাপি মন্দির ও রহস্যের যাজকগণ, নাজা প্যাপিরাস থেকে পড়ল, যাবতীয় ভূমি ও স্থাপনা যা নদীর পূর্ব পারে ডেনডেরা ও আবনাবের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত, সবকিছু।

ঘোষণাটা শুনে তার পুরোনো বন্ধুর জন্যে টাইটা দুঃখ পেল কিন্তু এসবের কিছুই সে তার চেহারায় প্রকাশ করল না। মরুভূমি থেকে আসার সময় হিলটো ক্রাতাসের মৃত্যুর ঘটনা তাকে বলছে এবং তাকে আরো জানায় যে সবাই, এমনকি সম্মানী ও মহৎ লোকেরা পর্যন্ত মিশরের নতুন রাজ-প্রতিভূর সামনে নরমভাবে চলা ফেরা করে। মেনসেট মৃত, সে রাজ্য কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিল। ঘুমের মধ্যে তিনি মারা যান কিন্তু কেউ কেউ বলে যে তার মরণ যাত্রায় সে সামান্য সাহায্য পেয়েছিল। সিনকাও মৃত, রাজ-দ্রোহীতার জন্যে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। যদিও তার প্রতারণা করার কোন প্রমাণ নেই। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এছাড়া আরো পঞ্চাশ জনেরও বেশি লোক মহান ক্রাতাসের সাথে তার পরোলোকের যাত্রায় সঙ্গী হয়েছে। আর বর্তমান কাউন্সিলের সদস্যরা নাজার পোষা কুকুর সব।

ক্ৰাতাস ছিল টাইটার সেই সব সোনালি দিনের শেষ বন্ধন, যখন ট্যানোস, লসট্রিস ও সে যুবক ছিল। সে তাকে অনেক ভালোবাসত।

দেশদ্রোহী কাতাসের সমস্ত শস্য যা তার নামে অ্যাথরিবিসে মজুদ ছিল তা বাজেয়াপ্ত করে রাজ-প্রতিভূকে দেয়া হল, লর্ড নাজা প্যাপিরাস থেকে পড়ল।

পঞ্চাশটি পরিপূর্ণ বজরা, টাইটা হিসেব করে দেখল, ক্ৰাতাস এ ব্যাপারে দক্ষ ও সুচতুর বিনিয়োগকারী ছিল। গুপ্তচর বৃত্তির গুরুভার লর্ড নাজা আন্তরিকভাবেই নিজের কাছে রাখল।

এ সবকিছু জনসাধারণের ভালো এর জন্য ব্যবহার করা হবে। দখল বাজটা যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন। টাইটা অভিব্যাক্তি ব্যাক্ত না করে অবাক হয়ে ভাবল জনসাধারণের ভালোটা আসলে কে করবে!

যাজক এবং অনুলেখনগণ ব্যস্তভাবে মাটির টেবিলের উপর সব কিছু রেকর্ড করে নিচ্ছে। এগুলো মন্দিরের আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হবে। সবকিছু দেখা ও শুনার পরও তার রাগ ও দুঃখগুলো টাইটা তার হৃদয়ে কপাট বন্ধ করে রাখল।

এখন আমরা অন্য রাজকার্য প্রণালি শুরু করতে যাচ্ছি, নাজা বলল। যখন ক্রাতাসের উত্তরাধিকারীরা সব কিছু থেকে বঞ্চিত হবে হিসেব মতো তখন সে তিন লক্ষ স্বর্ণের অধিকারী ও আরো ধনী হবে। এবার আমি রাজকন্যা হেজারেট ও মেরিকারার ভবিষ্যৎ ভালোর জন্য আমি চিন্তিত। রাজ্য কাউন্সিলের সদস্যদের সাথে আমি আন্তরিকভাবে আলোচনা করেছি। সবাই সম্মত হয়েছে যে তাদের ভালোর জন্য আমাকে তাদের বিয়ে করা উচিত। আমরা পত্নী হিসেবে তারা আমার পূর্ণ সুরক্ষায় থাকবে। দেবী আইসিস রাজ কুমারীদের রক্ষক। আমি দেবীর যাজিকাদের আদেশ করেছিলাম গণনা করার জন্যে এবং তারা জানিয়েছে দেবীদের নিকটও এই বিবাহ গ্রহণযোগ্য। ফারাও ট্যামোসকে সমাহিত করার এবং প্রিন্স নেফার সেটির রাজ্যাভিষেক হওয়ার পরবর্তী পূর্ণিমায় এ বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।

টাইটা নড়ল না, তার চেহারা নিষ্প্রভ কিন্তু এই ঘোষণায় তার চারপাশে একটা মরমর ধ্বনি উঠল। রাজনৈতিক কারণে এমন দ্বৈত বিবাহের নিদর্শন রয়েছে। উপস্থিত সবাই জানত এই বিবাহের মাধ্যমে লর্ড নাজার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজকীয় ট্যামোস হাউজের একজন সদস্য হওয়া এবং সিংহাসনের দাবিদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।

টাইটার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেল। যেন এইমাত্র সে থেব নগরের মধ্যস্থানে অবস্থিত হোয়াইট টাওয়ার থেকে ফারাও নেফার সেটির মৃত্যুর ঘোষণা শুনল। ফারাওকে সমাহিত করার পূর্বের ৭০ দিনের আর মাত্র ১২ দিন বাকি। নীলের পশ্চিম তীরে ভ্যলি অব কিংস-এ ফারাওকে সমাহিত করার পর তার উত্তরাধিকারের রাজাভিষেক হবে এবং তার কন্যাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। তারপর কোবরাটা আবার আঘাত হানবে। টাইটা এ ব্যাপারে নিশ্চিত। তারপর মনে। বিপদের শঙ্কা, যা নেফারকে ঘিরে আছে তা নিয়ে সবার সাথে সেও উঠল এবং বুঝল যে রাজ-প্রতিভূত মজলিস ভেঙে দিয়েছে। নাজা উঠে সিংহাসনের পিছন দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আর টাইটা অন্যদের সাথে তাঁবু থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে এগুল।

কর্নেল আসমর তাকে থামানোর জন্য সামনে বাড়ল এবং হাসি দিয়ে দ্রভাবে বলল, লর্ড নাজা, মিশরের রাজ-প্রতিভূ আপনাকে যেতে নিষেধ করেছেন। তিনি আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চান।

আসমর এখন রাজ-প্রতিভূ-র বডিগার্ডের কর্নেল, সবচাইতে ভালো দশ হাজার সৈন্যের প্রধান। এ অল্প সময়ে সে একজন ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। মানা করার কোন কারণ বা সম্ভাবনা ছিল না এবং টাইটা সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। আমি ফারাও-এর দাস এবং তার রাজ-প্রতিভূরও। তারা দুজনেই হাজার বছর বেঁচে থাকুক।

আসমর তাকে তাঁবুর পিছনে দিকে নিয়ে গেল এবং ভেতরে প্রবেশের জন্যে পর্দা তুলে ধরল। টাইটা নিজেকে পাম বনের মধ্য খুঁজে পেল এবং অসমর তাকে গাছের ভেতর দিয়ে একটা ছোট ও এক কক্ষের তাঁবুর দিকে নিয়ে গেল। এই প্যাভেলিয়নটার চারপাশে গোল হয়ে এক ডজন সৈন্য পাহাড়া দিচ্ছে কারণ এটা গোপন বৈঠকের স্থান যেখানে রাজ-প্রতিভূ-র অনুমুতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না।

আসমরের নির্দেশ দিতেই সৈন্যরা এক পাশে সরে দাঁড়াল এবং কর্নেল টাইটাকে তাঁবুর ভেতরের রাস্তাটা দেখিয়ে নিয়ে গেল। নাজা ব্রোঞ্জের বোল থেকে মাথা তুলে তাকাল, সে হাত ধুচ্ছিল। ম্যাগোস, আপনাকে স্বাগতম। সে উষ্ণভাবে হাসল এবং ইশারায় গালিচা বিছানো মেঝের মাঝখানের কুশানের স্কুপটা দেখাল। টাইটা আসন নিতেই নাজা আসমরের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ল এবং যে তাবুর দরজার সামনে তার তলোয়ার খুলে পাহাদার হিসেবে নিজে দাঁড়াল। তবুটায় তারা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই এবং তাদের আলোচনা কান পেতে কারো শোনার কোন সম্ভাবনাও নেই।

নাজা গয়না ও রাজমুকুট খুলে ফেলেছে। যখন সে টাইটার মুখোমুখি একটা কুশানে বসল তাকে আন্তরিক ও বন্ধুত্বপরায়ণ দেখাল। সে মিষ্টি মাংসের ট্রে ও শরবতের সোনালি বোল ইঙ্গিত করল। দয়া করে গ্রহণ করুন। টাইটার ইচ্ছে করল না করতে কিন্তু যে জানত রাজ-প্রতিভূ-র মেহমানদারি অস্বীকার করার অর্থ হল নিজের শত্রুতা প্রকাশ করা এবং তার চরম বিরোধিতার ব্যাপারে নাজাকে সতর্ক করে দেওয়া।

এখন পর্যন্ত লর্ড নাজার জানার কোন কারণ নেই সে নতুন ফারাও এর প্রতি তার মনের অভিসন্ধি অথবা তার কৃত অপরাধসমূহ কিংবা তার অপরাপর উচ্চাভিলাষের কথা টাইটা জানে। ধন্যবাদান্তে টাইটা তার মাথা ঝুঁকল এবং হাত দিয়ে দূরবর্তী একটা সোনালি বোল টেনে নিল। তারপর সে নাজার অন্য একটা শরবতের বোল তুলে নেয়ার অপেক্ষা করল। রাজ-প্রতিভূ কোন প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই এটা তুলে পান করল।

টাইটা এবার বোলটা তার ঠোঁটের কাছে নিল এবং এক চুমুক নিল। সে তা তার জিহ্বার মধ্যে রাখল। অনেক বিষ আছে যা স্বাদহীন এবং তাদের সনাক্ত করা যায় না। কিন্তু টাইটা সবগুলোর উপর গবেষণা করেছে এবং এমনটি টক স্বাদ যুক্ত ফলও তাদের গন্ধ তার কাছ থেকে গোপন রাখতে পারে না। পানীয়তে কোন কিছু মিশানো ছিল না এবং সে আনন্দের সাথে তা গিলে ফেলল।

আপনার বিশ্বাসের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, নাজা গম্ভীরভাবে বলল এবং টাইটা বুঝল সে তার সতেজতা গ্রহণের চাইতে বেশি কিছু বুঝিয়েছে।

আমি ফারাও এর দাস এবং তাই তার রাজ-প্রতিভূ-রও।

আপনি রাজ্যের অমূল্য ব্যক্তি। উল্টো নাজা বলল। আপনি বিশ্বস্ততার সাথে তিনজন ফারাও-এর সেবা করছেন এবং সবাই কোন প্রশ্ন ছাড়াই আপনার উপদেশ গ্রহণ করত।

আপনি আমাকে বেশি সম্মান দিচ্ছেন, আমার লর্ড। আমি বৃদ্ধ ও ক্ষীণ।

নাজা হাসল। বৃদ্ধ? হ্যাঁ, আপনি বৃদ্ধ। আমি এটা বলতে শুনেছি যে আপনার বয়স ২০০ বছরেরও বেশি। টাইটা মাথা নাড়াল, তবে কোন কিছু স্বীকার বা অস্বীকার করল না। কিন্তু, জীর্ণতা, না! আপনি বৃদ্ধ এবং একটা পবর্তের মতো নিদর্শন। সবাই জানে আপনার জ্ঞান সীমাহীন। এমনকি অনন্ত জীবনের রহস্যটাও আপনার জানা।

তোষামোদ অশালীন ও নির্লজ্জ এবং টাইটা এর পিছনে গোপন কোন কারণ ও অর্থ খুঁজল। নাজা চুপ ছিল। তাকে আশান্বিত দেখল। সে কি শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে? টাইটা তার চোখের দিকে তাকাল এবং তার মন লোকটির মনের ভাবনাসমূহ ধরতে স্থির করল। সেগুলো সন্ধ্যার অন্ধকার আকাশের বিপরীতে দ্রুত ধাবমান গুহা বাদুরের আকৃতির মতই চলমান ও বিস্মৃতিপ্রবণ।

সে তার একটা অভিলাষ পুরোপুরি বুঝল এবং হঠাৎই বুঝল নাজা তার কাছে কি চায়। জ্ঞান তাকে শক্তি দিয়েছে এবং একটা অবরুদ্ধ শহরের দরজার মতো তা তার সামনে উন্মোচিত হল।

হাজার বছর ধরে সকল রাজা ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা অনন্ত জীবনের রহস্যের খোঁজ করেছেন। সে নরম সুরে বলল।

সম্ভবত একা একজন মানুষই তা পেয়েছে, নাজা ব্যাকুলভাবে কুনুই তার নিজের হাঁটুর উপর রেখে সামনে ঝুকল।

আমার লর্ড, আমার মত বৃদ্ধ মানুষের জন্য প্রশ্নটা খুবই গভীর, দুশ বছর অনন্ত জীবন নয়। টাইটা অসম্মতি সূচকভাবে হাত ছড়াল কিন্তু চোখ নামিয়ে নিল যাতে নাজা তা বুঝতে পারে। দ্বৈত মুকুট ও অনন্ত জীবন, সে ভাবল এবং মনে মনে হাসল যদিও তা বাইরে প্রকাশ করল না। এই প্রতিভূর চাওয়টা অল্প ও সাধারণ।

নাজা সোজা হল। আমরা এ গভীর ব্যাপারে অন্য সময় কথা বলব। তার হলুদ চোখে বিজয়ের আলো। কিন্তু এখন আপনাকে আমি অন্য কিছু জিজ্ঞেস করব। এটা আমার সম্বন্ধে ভালো ধারণা প্রমাণ করার বলতে পারেন আপনার একটা সুযোগ। সেই সাথে সঙ্গতভাবে আপনি আমার অসীম কৃতজ্ঞতাও পেতে পারেন। সে বান মাছের ন্যায় ঘুরল। টাইটা ভাবল, একদা আমি তাকে নীরস মাটির-পিন্ড সৈন্য মনে করতাম। আমাদের সবার কাছ থেকে প্রদীপের আলো লুকিয়ে রাখার মত শক্তি তার আছে। সে জোরে সহজভাবে শুধু বলল, যদি তা আমার ক্ষমতার মধ্যে হয়, আমি ফারাও-এর রাজ-প্রতিভূকে কিছুই অস্বীকার করব না।

আপনি একজন আমন-রা ধাঁধার অধিকারী। নাজা নিশ্চিয়তা নিয়ে বলল যা অস্বীকার করার যা কোন পথ নেই।

আরো একবার টাইটা লোকটার মাঝে উচ্চাশার ছায়াময় গভীরতা দেখল। শুধুমাত্র মুকুট-ই নয় অনন্ত জীবনও সে চায়! সে তার ভবিষ্যৎটাও জানতে চায়। টাইটা অবাক হল কিন্তু অনুগতভাবে মাথা নাড়ল ও বলল, আমার লর্ড আমি সারাজীবন রহস্য অনুসন্ধান করেছি এবং সম্ভবত খুব অল্পই আমি শিখেছি।

আপনার পুরো দীর্ঘ জীবনে, নাজা জোর দিয়ে বলল, এবং আপনি অনেক কিছু জেনেছেন?

টাইটা মাথা নামাল ও চুপ রইল। কেন আমি ভেবেছি যে সে আমাকে হত্যা করবে? টাইটা নিজেকে প্রশ্ন করল। সে আমাকে তার নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করবে কারণ সে যা বিশ্বাস করে তা আমার হাতের মুঠোয়, অমরত্বের চাবি।

টাইটা; রাজা ও প্রভুদের প্রিয়জন, আমি চাই আপনি আমার জন্যে আমন-রা এর ধাঁধা অনুশীলন করেন।

আমার লর্ড, আমি কোন রানী বা ফারাও অথবা এমন কেউ যে মিশরের সিংহাসনের বসবে না এমন কারো জন্যে আমি কখনো ধাঁধা অনুশীলন করি নি।

তবে এখন ঐ রকম একজন আপনাকে বলছে, নাজা খুব জোর দিয়ে বলল।

মহান হুরাস তাকে আমার নিকট এনে দিয়েছেন। আমি তাকে আমার হাতে পেয়েছি, টাইটা ভাবল এবং বলল, আমি ফারাও এর রাজ-প্রতিভূ-র ইচ্ছা মাথা পেতে গ্রহণ করলাম।

আজ থেকেই কি আপনি আমার জন্যে ধাঁধা অনুশীলন করা শুরু করবেন? আমি প্রভুদের ইচ্ছা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। নাজার সুন্দর মুখটা উত্তেজনা ও লোভে জীবন্ত হয়ে উঠল।

কেউ-ই ধাঁধায় হালকা ভাবে ও সহজে প্রবেশ করতে পারে না, টাইটা আপত্তি করল। সেখানে অনেক বিপদ, শুধু তা আমার জন্যই নয় বরং তার জন্যও যে এই অলৌকিক কাজের জন্যে অনুরোধ করে। ভবিষ্যৎ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হতে সময় লাগবে।

কতটা সময়? নাজার কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশা ঝরে পড়ল।

টাইটা তার কপালে গভীর চিন্তার বলিরেখা ফুটিয়ে তুলল। টোপটা গিলতে তাকে কিছু সময় দাও, টাইটা ভাবল। এটা তাকে টোপটা গিলতে আরো ব্যাকুল করে তুলবে। অবশেষে সে চোখ তুলে তাকাল। অ্যাপিস উৎসবের প্রথম দিন।

*

পর দিন সকালে যখন সে তার বড় তাবু থেকে বের হল তখন গতকালের বস মরুদ্যানে প্রবেশ করা ধুলোয় আচ্ছাদিত ও গন্ধময় অদ্ভুত ভূষণ থেকে ফারাও সেটি তার আসল রূপে ফিরে এল। রাজকীয় ব্যক্তিত্ব যা তার সঙ্গীদের আতঙ্কিত করে থাকে তা দ্বারা সে নাপিতদের তার মাথা ন্যাড়া করা থেকে বিরত রেখেছে। পরিবর্তে তার কালো কোঁকড়া চুলে শ্যাম্পু করা হয় ও যতক্ষণ না তা প্রভাতের সূর্যালোকের ন্যায় কপিল বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল ততোক্ষণ তা আঁচড়ানো হল। মাথার উপর সে নেবেত, শকুন দেবী এবং নাজা, কোবরাটার মুকুট পরিধান করেছে। লাল ও লাল রঙের কাঁচের চোখ দিয়ে তার কপালের উপর তা জোড়া লেগেছে। চিবুকের উপর রাজত্বের নকল দাড়িও সে লাগিয়েছে। তার মেক-আপটা দক্ষতার সাথে করা হয়েছে যাতে তার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পায় এবং লোকজন যারা তাঁবুর সামনে অপেক্ষা করছিল তারা প্রশংসা ও ভয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবং মাথা নিচু করে সম্মান জানাল। তার নকল আঙুলের নখগুলো স্বর্ণের তৈরি এবং পায়ে চটিটাও স্বর্ণের। বুকে সে ধারণ করে আছে মিশরের মুকুটের সবচাইতে মূল্যবান পাথরের একটা: ট্যামোসের চিত্র খচিত হার যাতে প্রভু হুরাসের চিত্রকর্ম, বাজ পাখিটা অলংকৃত করা। সে রাজকীয় ভঙ্গিতে হাঁটল, হাতে দন্ড এবং হৃৎপিন্ডের উপর সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষার ক্রসটি তার ধরা। শান্তভাবে সে সামনের দিকে চেয়ে রইল যতোক্ষণ না সে চোখের কোনা দিয়ে টাইটাকে লোকজনের সামনের সারিতে বসে থাকতে দেখল এবং তার উদ্দেশ্যে সে দুষ্টুমির ভঙ্গিতে ইশারায় চোখ নাড়ল।

চারপাশে সুগন্ধির মেঘ উড়িয়ে, লর্ড নাজা তার এক কদম পিছনে অলংকার শোভিত হয়ে হাঁটছে এবং কতৃত্ত্বে গুরুগম্ভীর। তার কোমরে ঝুলছে নীল তোবারি এবং ডান বাহুতে বাজ পাখির সীল মোহর। তারপর এল রাজকুমারীরা। তারা মাথায় দেবী আইসিসের সোনালি পালক ও হাতের আঙ্গুল ও পায়ের পাতায় সোনার আংটি পরিধান করে আছে। তারা আজ আর কঠিন নয়, গতকালের মতো তাদের পরাধীন লাগছে না। গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত তার লিনেন কাপড়াবৃত আর তা এতো সুন্দর ও স্বচ্ছ যে ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন নদীর মতই সূর্যালোক তার মধ্য চলাচল করছে।

মেরিকারার নিতম্ব সরু ও বুক পুরুষালী ধরনের। কিন্তু হেজারেট এর দেহে নারীত্বের ভাবটা স্পষ্টত। তার বুক স্ফীত আর নিতম্বটাও ভারি।

ফারাও সিঁড়ি বেয়ে উঠে তার রাজকীয় বাহনে আসন নিল। লর্ড নাজা ডান পাশে দাঁড়াল ও রাজকন্যারা তার পায়ের কাছে বসল।

যাজকদের সঙ্গিরা যারা থেবস্ এর ৫০টি বিভিন মন্দির থেকে এক জন করে এসেছে আগে চলতে চলতে তারা বাঁশি, ঢোল-ডাগর, হর্ন বাজাতে লাগল ও প্রভুদের সম্মানে গান গাইতে লাগল। আসমরের বডি গার্ডরা যাত্রায় তাদের অবস্থান নিল এবং তারপর এল হিলটোর রথের বহর, সবগুলো সরু পতাকা ও ফুল দিয়ে সাজানো এবং ঝকঝক করছিল। ঘোড়াগুলোর চামড়া টান টান করা হয়েছে এবং তাদের শরীর মূল্যবান ধাতুর ন্যায় চমকাচ্ছিল এবং তাদের কেশর পাজরের উপর বিনুনি করে রাখা। এঁড়ে বাছুরগুলো নিখুঁত সাদা, তাদের কুজগুলো লিলি ও ওয়াটার হাইয়াচিন দিয়ে সাজানো হয়েছে। তাদের দীর্ঘ প্রসারিত শিংগুলো এবং এমন কি তাদের খুরগুলোও স্বর্ণের পাত দিয়ে আবৃত করা হয়েছে। এগুলোর চালকেরা হল বিবস্ত্র নুবিয়ান দাস। তাদের দেহ ও শরীর থেকে প্রতিটি লোম তুলে ফেলা হয়েছে। তাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দামী তেল মাখা হয়েছে, যাতে তারা সূর্যের আলোতে চমকায়, কালো দেখায়–সেথের চোখের ন্যায়–যা তাদের এঁড়ে বাছুরের সাদা চামড়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা দলটাকে তাড়া দিল এবং এঁড়ে বাছুরগুলো ধুলার মধ্য দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলল। তাদের পিছনে দশ হাজার ফেট গার্ড যোদ্ধা এক সাথে প্রশংসায় গান গেয়ে উঠল। থেবসের জনগণ তাকে স্বাগত জানাতে শহরের প্রধান ফটক খুলে দিল এবং দেয়ালের উপরে পর্যন্ত সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। বাইরের এক মাইল পর্যন্ত ধুলোর রাস্তা তারা পাম পাতা, খড় ও ফুল দিয়ে ঢেকে দিয়েছে।

থেবসের দেয়াল, টাওয়ার ও ভবনগুলো রোদে পোড়া ইট দিয়ে তৈরি পাথরের টুকরাগুলো সমাধি ও মন্দির তৈরির জন্যে সংরক্ষিত। নীলের উপত্যকায় কদাচিৎ বৃষ্টি হয় তাই এসব জিনিস নষ্ট হবার কোন সম্ভাবনা নেই; মাত্র সবকিছু চুনকাম করা হয়েছে এবং ট্যামোস হাউজের আকাশি রঙের ব্যানার টানানো হয়েছে।

নাচ-গানে মশগুল লোকদের নিয়ে শোভাযাত্রাটি প্রধান ফটক দিয়ে শহরে প্রবেশ করল। তারা আনন্দে কাঁদছিল; সরু রাস্তাটা পূর্ণ হয়ে গেল। ফলে রাজকীয় বহরটার গতি বিশাল কচ্ছপের ন্যায় শ্লথ হয়ে পড়ল। যাত্রা পথে প্রতিটি মন্দিরে রাজকীয় যান দীর্ঘক্ষণ যাত্রা বিরতি করল এবং ফারাও প্রভুদের উদ্দেশ্যে বলী দিতে নামল।

নদীর তীরবর্তী ডকে পৌঁছবার পূর্বেই বিকেল হয়ে গেল এবং সেখানে ফারাও এর দলকে নদী পার করে পশ্চিম তীরের মেমননের প্রাসাদে পৌঁছে দিতে ফেরি অপেক্ষা করছিল। তারা চড়তেই ২০০ বৈঠা চালক দ্রুত প্যাডল চালাল। ড্রাম বাজিয়ে ছন্দ তুলল এবং বড় সারস পাখির ন্যায় ডানা মেলে তারা এগিয়ে চলল।

দাঁড়-টানা নৌকাটা আরো অসংখ্য ছোট ছোট নৌকা সহযোগে সূর্যের শেষ আলোতে নদী পার হল। এমনকি যখন তারা পশ্চিম তীরে পৌঁছল তখনও রাজার প্রথম দিনের দায়িত্ব শেষ হয়নি। অন্য একটি রাজকীয় বাহন তাকে জনগণের মধ্য দিয়ে তার পিতা, ফারাও ট্যামোস এর শেষ কৃত্যের মন্দিরে নিয়ে গেল।

উঁচু সড়কে তারা উঠার পূর্বেই অন্ধকার নামল। দুই পাশে আগুন জ্বেলে আলোকিত করা হল এবং রাজকোষ থেকে দেওয়া বিয়ার ও ওয়াইনে জনগণ নিজেদের ভাসিয়ে দিচ্ছে।

যখন ফারাও ট্যামোসের মন্দিরে নামল এবং তার পিতা ও তার রক্ষক হুরাসে বিশাল মূর্তির মাঝের সিঁড়ি দিয়ে উঠল তখন জনগণের চিৎকারে তার কানে তালা লাগার উপক্রম। হুরাসের স্বর্গীয় ১০০ টা রূপের প্রতিটি মূর্তি-বাচ্চা হারপোক্রাটেস রূপে, এক পাশে চুল ও একটা আঙ্গুল মুখে দেওয়া; আইসিস-এর দুগ্ধ পান রত অবস্থায় কিংবা ফুটন্ত পদ্মফুলে বসা, অথবা বাজপাখির মাথা বিশিষ্ট ইত্যাদি। রাজা ও প্রভু মনে হল যেন এক হয়ে গেছে।

লর্ড নাজা ও যাজকেরা বালক ফারাওকে লম্বা কাঠের ফটক দিয়ে দুঃখের কক্ষে নিয়ে গেল, ঐ পবিত্র স্থানটায় যেখানে ট্যামোস-এর মমি পাথরের আয়তকার কালো বেদীর উপর শায়িত। অন্য কক্ষের দেয়ালে কবর রক্ষক দেবতা আনুবিস এর কালো মূর্তি পাহারারত। পাশেই মুক্তার ন্যায় অ্যালাবাসটারের স্বচ্ছ জারে ফারাও-এর হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও নাড়িভূড়ি রাখা রয়েছে।

বিপরীত দিকের দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে স্বর্ণে আবৃত শবধান রাজ-শব গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কফিনের ঢাকনা ফারাও-এর একটা চিত্রকর্ম বহন করছে যা এতো জীবন্ত যে তা দেখে নেফারের হয় মুড়ে উঠল, মনটা দুঃখে ভরে গেল এবং তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অশ্রু মুছে সে যাজকদের অনুসরণ করে যেখানে ঘরটার মধ্যখানে তার পিতার দেহ শায়িত সেখানে এল।

লর্ড নাজা বেদীর অন্য পাশে নেফারের মুখোমুখি অবস্থান নিল এবং প্রধান পুরোহিত মৃত রাজার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। যখন সবাই মৃত রাজার মুখ খোলার জন্যে প্রস্তুত হলো দুজন পুরোহিত লিনেনটা যা দ্বারা শবটা ঢাকা ছিল তা এক পাশে সরাল এবং নেফার অজান্তেই তার পিতার দিকে চেয়ে গুটিসুটি মেরে গেল।

আর মৃত্যুর পর সপ্তাহ জুড়ে, যখন নেফার ও টাইটা মরুভূমিতে ছিল, মমি কররা রাজার দেহ নিয়ে কাজ করেছে। প্রথমে তারা লম্বা হাতওয়ালা একটা চামচ তার নাক দিয়ে ঢুকিয়ে মাথার খুলির মধ্য থেকে মগজ বের করে নিয়েছে। এরপর তারা তার চোখ খুলে নিয়েছে যা সহজেই পচন ধরে, এবং অক্ষি কোঠর ও খুলির গহ্বর ন্যাট্রোন লবণ ও সুগন্ধি হার্ব দ্বারা পূর্ণ করে দেয়। তারপর তারা মাথা উপরের দিকে দিয়ে মৃত দেহটাকে ঘন লবণের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে এবং ত্রিশ দিন এভাবে রেখেছে ও প্রতিদিন ক্ষারের দ্রবণ পরিবর্তন করেছে। ফলে চর্বি শুষে চামড়া শক্ত হয়। শুধুমাত্র চুল ও মাথার চামড়াটা অপরিবর্তিত থাকে।

তারপর ন্যাট্রোন দ্রবণ থেকে শব দেহকে বের করে এই পাথরের অতিকায় বেদীর উপর রাখা হয়েছে এবং তেল ও হারবাল উপাদান তাতে লাগানো হয়। পেটের খালি অংশটা রঞ্জন ও মোমের শুকানো লিনেন কাপড় দ্বারা পূর্ণ করা হয়। বুকের যেখানে তীরটা আঘাত করেছিল সেই জায়গা সেলাই করা হয়েছে এবং স্বর্ণ ও দামী পাথরের গহনা তার উপর রাখা হয়েছে। ছোট পাথর ও তীরের অগ্রভাগ যা রাজাকে হত্যা করেছে তা মমি-কররা তার দেহ থেকে বের করে নিয়েছে। কাউন্সিলের সদস্যগণ কর্তৃক পরখ করার পর ওটাকে স্বর্ণের বাক্সে সীল করা হয় এবং এটা তার সাথে তার কবরে যাবে যা পরবর্তী জীবনে যাত্রা কালে কোন ব্যাঘাত ঘটানোর সময় শয়তানের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী অস্ত্র হবে।

মমি করার পরবর্তী চল্লিশ দিন শবদেহকে মরুর লু-হাওয়ায় পুরোপুরি শুকানো হবে।

যখন এটা জ্বালানি কাঠের মত শুকিয়ে যাবে তখন তা বাঁধা হবে। লিলেন ব্যান্ডেজ দিয়ে খুব সূক্ষ্ম ও সাবধানের তা পঁাচানো হবে আর তখন পুরোহিতগণ প্রভুদের উদ্দেশ্য মন্ত্র পড়বেন। তাদের নিচে মূল্যবান তাবিজ ও কবজ রাখা হবে এবং প্রতিটি পরত রঞ্জন দ্বারা প্রলেপ দেওয়া হবে যা ধাতুর মতো কঠিন ও শক্ত করে আটকে ধরবে। শুধুমাত্র মাথাটা উন্মুক্ত রবে এবং পরবর্তী সপ্তাহের পূর্বেই মুখটা খুলে চারজন সবচাইতে দক্ষ মেকআপ আর্টিস্ট মোম ও প্রসাধন ব্যবহার করে ফারাও-এর চেহারায় একটা জীবন্ত ভাব ফুটিয়ে তুলবে। তারা চোখের কোঠরে পাথর ক্রিস্টাল ও কালো আগ্নেয় শিলা বসিয়ে দিয়েছে। সাদাটা অর্ধস্বচ্ছ, আইরিস ও পিউপিল ঠিক রাজার স্বাভাবিক বর্ণের সাথে মিলে গেছে। কাঁচের গোলকটা মনে হল জীবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত, নেফার তাদের মধ্যে দিয়ে ভয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল–আশা করল চোখে পাতা নড়ুক ও তার পিতার পিউপিল তাকে চিনতে পেরে প্রসারিত হোক। ঠোঁটগুলো আঁকা হয়েছে ও রং লাগলো হয়েছে, যে কোন সময় যেন তারা হাসবে এবং তার রং করা চামড়া এমন মসৃণ ও উগ্র দেখাল যেন উক্ত রক্ত এখনো তার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। তার চুল ধোয়া হয়েছে এবং তা পরিচিত কালো খোঁপা করা হয়েছে যা নেফারের অতি পরিচিত।

লর্ড নাজা, প্রধান পুরোহিত ও গায়কবৃন্দ দ্বিতীয় বারের মতো মৃতের জন্য মন্ত্র পড়তে লাগল; কিন্তু নেফার তার পিতার মুখ থেকে চোখ সরাতে পারছিল না।

সে প্রতিচ্ছবি এবং আয়না নয়, সে সঙ্গীত এবং সুর নয়, সে পাথর এবং বাটালি নয়। সে চির দিন বেঁচে থাকবে।

প্রধান পুরোহিত নেফারের পাশে এল ও সোনার চামচটা তার হাতে দিল। নেফারকে রীতিটা শিখিয়ে দেওয়া হল, কিন্তু তার হাত কাঁপতে লাগল যখন সে চামটা তার পিতার ঠোঁটের উপর রাখল এবং বলল, আমি আপনার মুখ খুললাম যাতে আপনি আরো একবার কথা বলার ক্ষমতা পান। সে চামচ দিয়ে তার পিতার নাক স্পর্শ করল এবং বলল, আমি আপনার নাক খুললাম যাতে আপনি আরো একবার শ্বাস নিতে পারেন। তারপর সে শবটির প্রত্যেকটি সুন্দর চোখ স্পর্শ করল। আমি আপনার চোখ খুলে দিলাম যাতে আপনি আবার এই জগৎ ও ভবিষ্যৎ দুনিয়ার সৌন্দর্য দেখতে পান।

এটা শেষ হতেই মমিকররা মাথা ঢেকে দিল ও সুগন্ধি রঞ্জন দ্বারা প্রলেপ মাখাল। এরপর রাজ সভাসদগণ যারা অপেক্ষা করছিল তারা এগিয়ে এল। তারা স্বর্ণের মুখোশটা মুখের উপর বসিয়ে দিল এবং আরো একবার তা দীপ্যমান জীবনের জ্যোতি ছড়াল। আচারাদির বিপরীতে শুধুমাত্র একটা মৃত্যু মুখোশ ও একটা সোনালি কবর ছিল ফারাও ট্যামোসের জন্যে। অথচ তার পিতা তার পূর্বে কবরে গেছেন সাতটা মুখোশ ও সাতটা শবাধার নিয়ে, একটার মধ্যে আরেকটা, প্রতিটি প্রতিবার আগেরটার চাইতে আরো বেশি বড় ও সাজানো।

রাতের বাকি সময়টা নেফার স্বর্ণের শবাধারের পাশে রইল, প্রার্থনা করল ও ধূপ পোড়াল এবং তার পিতাকে তাদের মাঝে নেওয়ার জন্য প্রভুদের উৎসাহ দিল। যেন দেবতাদের মাঝে তাকে আসন দেওয়া হয় সে প্রার্থনা সে করল। প্রত্যুষে সে পুরোহিতদের সাথে বের হয়ে মন্দিরে সারিবদ্ধ বাড়ির কাছে গেল যেখানে তার পিতার প্রধান বাজ শিকারী তার অপেক্ষা করছিল। সে তার হাতে একটা রাজকীয় বাজ পাখি ঢেকে ধরে ছিল।

নেফারটেম! নেফার ফিসফিস্ করে পাখিটার নাম বলল। পদ্ম ফুল সে শিকারীর হাত থেকে সুন্দর পাখিটা নিল ও নিজের মুঠোয় ধরে তা উঁচু করে ধরল যাতে নিচে দাঁড়ানো লোকজন তা স্পষ্ট দেখতে পায়। পাখিটার পায়ে স্বর্ণের চেইনে একটা স্বর্ণের পাত ঝোলানো। ওটার মধ্যে তার পিতার রাজচিহ্ন খোদাই করা। এটা ফারাও ট্যামোস ম্যামোসের গডবার্ড। এটা আমার পিতার সত্তা। সে শক্তি অর্জনের জন্য একটু দম নিল কারণ তার প্রায় কান্না চলে এসেছিল। তারপর সে বলতে লাগল, আমি আমার পিতার গড বার্ডকে মুক্ত করে দিলাম। সে বাজটার মাথা থেকে চোখ বাঁধার চামড়া সরিয়ে ফেলল। ভোরের আলোয় পাখিটার হিংস্র চোখগুলো মিটমিট করে উঠল এবং পাখিটা তার ডানা ঝাঁপটাল। নেফার ওটার পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই পাখিটা ডানা প্রসারিত করল। উড়ে যাও, পবিত্র আত্মা! নেফার চিৎকার করে বলল, অনেক উঁচুতে উড়ে যাও আমার জন্যে ও আমার পিতার জন্যে।

সে পাখিটা উপরে নিক্ষেপ করল এবং ওটা ভোরে বাতাসে ভর করে অনেক উপরে উঠে গেল। দুইবার মাথার উপর চক্কর দিল এবং তারপর একটা বন্য ও ভয়ানক চিৎকার দিয়ে পাখিটা নীল পার হয়ে উড়ে গেল।

গড় বার্ডটা পূর্বে উড়ে গেল! প্রধান পুরোহিত সজোরে বলল কথাটা। মন্দিরে সিঁড়িতে দাঁড়ানো সমাবেশের প্রতিটি সদস্য জানে এটা একটা অশুভ সংকেত।

নেফার শারীরিক ও মানসিকভাবে এতোটাই ক্লান্ত ছিল যে যখন সে পাখিটার উড়ে যাওয়া দেখল সে তার পায়ের উপর টলে উঠল। টাইটা পরে যাওয়ার পূর্বে তাকে ধরল ও অন্যত্র নিয়ে গেল।

মেমনন প্রাসাদে নেফারে শয়ন কক্ষে ফিরে টাইটা একটা তরল তৈরি করল এবং হাঁটুগেড়ে তার পাশে বসে নেফারকে তা এগিয়ে দিল। নেফার একটা বড় চুমুক দিয়ে কাপটা নামাল এবং জিজ্ঞেস করল, কেন আমার পিতা মাত্র একটা ছোট কফিন পেল যখন তুমি বলে থাকো আমার দাদাকে সাতটা ভারি স্বর্ণের শবাধার সহকারে সমাহিত করা হয়েছিল এবং তার শেষকৃত্যের বাহনটা নিতে বিশটা শক্তিশালী ষাঁড় লেগেছিল?

আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে জাঁকজমক শেষকৃত্য হয়েছে তোমার দাদার। সে তার সাথে অনেক কিছু নিয়ে পরকালে যাত্রা করেছে, নেফার। টাইটা সম্মত হল। কিন্তু ঐ সাতটা কফিনে প্রায় ত্রিশ লাখ আঁটি স্বর্ণ নিয়েছিল এবং যা পুরো জাতিকে ভিখারী করে দিয়েছিল প্রায়।

নেফার চিন্তিত ভাবে কাপটার ভেতর তাকাল, তারপর শেষ কয়েক ফোঁটা পান করল। আমার পিতাও ঐরকম একটা শেষকৃত্য দাবি করে, কারণ তিনি একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন।

তোমার দাদা পরকাল নিয়ে বেশি ভাবতেন। টাইটা ধৈর্য নিয়ে ব্যাখ্যা করল, আর তোমার পিতা তার নিচু ও মিশরের ভালো নিয়ে বেশি ভেবেছেন।

নেফার এ ব্যাপারে এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেড়ার চামড়ার বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল। তারপর সে আবার চোখ খুলল। আমি আমার পিতার জন্যে গর্বিত; সহজভাবে কথাটা বলল সে।

আশীর্বাদে টাইটা হাতটা তার কপালে রাখল এবং ফিসৃফিস্ করে বলল, এবং আমি জানি একদিন তোমাকে নিয়েও গর্ব করার মতো তোমার পিতার অনেক কারণ থাকবে।

*

তারা যে মিশরের দীর্ঘ ইতিহাসের সবচাইতে ভয়ংকর ও চরম সময়ে এসে পৌচেছে এ ব্যাপারে টাইটাকে সতর্ক করার জন্যে বাজপাখি নেফারটেম এর উড্ডয়নের অশুভ সংকেতের দরকার নেই। যখন টাইটা নেফারের শয়নকক্ষ ত্যাগ করল ও মরুভূমি দিয়ে যাত্রা করল, তার মনে হল যেন তারাগুলোর গতির থেমে গেল এবং অনাদি দেবতারা পিছু হটল ও তাদের সবচাইতে এই বিপদজনক সময়ে তাদের ত্যাগ করল। মহান হুরাস, আমাদের এখন আপনার দিক নির্দেশনা দরকার। আপনি এই তা-মেরি, মূল্যবান ভূমিটা আপনার নিজ হাতে ধারণ করেন। এটাকে আপনার আঙুলের ফাঁক দিয়ে পিছলে যেতে দিয়েন না এবং ক্রিস্টালের ন্যায় ছত্রভঙ্গ হতেও দিয়েন না। আমরা দুঃখের মধ্যে আছি তা হতে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েন না। আমাকে সাহায্য করুন, মহান বাজপাখি। আমাকে পথ দেখান। আপনার ইচ্ছেটা আমার কাছে স্পষ্ট করুন যাতে আমি আপনার ইচ্ছা অনুসরণ করতে পারি।

যেতে যেতে সে প্রার্থনা করল, একে একে মরুর পাহাড়সমূহ পাড়ি দিল। তার দীর্ঘ লাঠির পাথরে ঠুকার আওয়াজ একটা হলুদ শিয়ালকে সতর্ক করে দিল এবং শিয়ালটি চাঁদের আলোয় আলোকিত পাথরের খাঁজের উপর দিয়ে ভোঁ দৌড় মারল। যখন সে নিশ্চিত হল কেউ তাকে অনুসরণ করছে না তখন সে ঘুরে নদীর সমান্তরালে চলল এবং গতি দ্রুত করল। হুরাস, তুমি ভালো করেই জান আমাদের হার জিতের সম্ভাবনা সমান সমান। ফারাও ট্যামোস শেষ এবং আমাদের নির্দেশনা দেওয়ার মতো আর কোন যোদ্ধা নেই। অ্যাপেপি ও তার হিকগণ দক্ষিণে এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তারা প্রায় অজেয়। তারা আমাদের বিরুদ্ধে জড়ো হচ্ছে এবং আমরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারব না। দুরাজ্যের দ্বৈত-মুকুট বিশ্বাসঘাতক পোকা দ্বারা পচন ধরছে এবং নতুন শোষককে তা টিকে থাকতে দেবে না। আমার চোখ খুলে দিন, মহান প্রভু এবং আমাকে পথ দেখান, যাতে আমরা দখলবাজ ডাকাত হিকস্ ও আমাদের রক্তের ধংসাত্মক বিষের বিরুদ্ধে জয় লাভ, করতে পারি।

দিনের বাকি সময় টাইটা পাথুরে পাহাড় ও নিরব স্থানগুলোতে ঘুরে বেড়াল, প্রার্থনা করল ও সামনের পথ অনুসন্ধান করল। পড়ন্ত বেলায় সে নদীর দিকে ফিরল এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছল। সে এখানে সরাসরি রাস্তায় আসতে পারত কিন্তু এতে অনেক লোক তাকে দেখে ফেলবে এবং এ সময়ে মরুতে তার একা থাকার প্রয়োজন ছিল।

গভীর আঁধারে বেশির ভাগ লোক যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন সে নদীর পাড় ধরে মন্দিরে দিকে অগ্রসর হল। ফটকের শূন্যে লুকানো জায়গায় একটা মশাল জ্বলছিল। এটা প্রভু বেস এর খোদাই করা মূর্তি যা প্রবেশ মুখে পাহারারত। মদ্যপান ও আনন্দ-উল্লাসের বিবৃত বামন প্রভু হল বেস। তার জিভটা তার বাঁকানো হাসি দেয়া ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অলসভাবে ঝুলে আছে। মশালের কম্পিত আলোয় যখন টাইটা তার পাশ দিয়ে গেল তখন তাকে সে দাঁত বের করা একটা হাসি উপহার দিল।

মন্দিরের একজন সহায়ক পুরোহিত ম্যাগোসকে অভ্যর্থনা জানাল। সে তাকে মন্দিরের ভেতরস্থ পাথুরে কক্ষে নিয়ে গেল। সেখানে তার জন্যে এক ঘটি ছাগলের দুধ, রুটি ও মধু রাখা ছিল। তারা জানত এগুলোর প্রতি টাইটার দুর্বলতা প্রচন্ড এবং খেতে খুব পছন্দ করে।

ইতোমধ্যে তিনজন লোক আপনার আগমনের অপেক্ষায়, আমার লর্ড, তরুণ যাজক তাকে বলল।

বেসটেট কে সবার আগে আমার কাছে নিয়ে এসো, টাইটা নির্দেশ দিল।

বেসটেট হল নোমার্ক অর মেমফিস-এর প্রধান অনুলেখক। সে টাইটার একজন অন্যতম মূল্যবান তথ্য দাতা। যখন ইয়েলো ফ্লাওয়ার ছড়িয়ে পড়েছিল তখন টাইটা তার সন্তানদের রক্ষা করেছিল। টাইটাকে তার অনেক কিছু বলার আছে যা রাজ-প্রতিভূর উত্থানের সময় ঘটেছে এবং সে তার দান যথাযথ অনুগত্যের সাথে গ্রহণ করেছে। আপনা আশীর্বাদই যথেষ্ট দান, মহান টাইটা।

বৎস! আশীর্বাদে ফুলে যেও না, টাইটা তাকে বিদায় দিল।

তারপর আসল থেবসের মহান হুরাস মন্দিরের প্রধান যাজক। যে তার নিয়োগের জন্য টাইটার কাছে ঋণী, কারণ ফারাও ট্যামোসের কাছে তার জন্যে টাইটা মধ্যস্থতা করেছিল। অধিকাংশ ধনী ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা হুরাসের মন্দিরে প্রার্থনা করতে বলি দিতে যায় এবং তারা সবাই প্রধান পুরোহিতের নিকট নিজেদের গোপন কথা বলে। তৃতীয় ব্যক্তি যে টাইটার কাছে রিপোর্ট করল সে হল নলরো, উত্তরের আর্মি সেক্রেটারি। সেও একজন খোঁজা এবং যারা লিঙ্গহীনতা ভোগ করে তাদের মধ্যে একটা বন্ধন রয়েছে।

যৌবনের প্রথম দিন থেকে যখন টাইটা নিজেকে সিংহাসনের ছায়ার পিছনে রাজ-কার্যে সংযুক্ত করেছে, তখন থেকেই সে নিখুঁত বুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন যার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাতের বাকি সময় ও পরের দিনের বেশির ভাগ সময় সে তাদের কথা শুনল এবং নানান প্রশ্ন করল। আর যখন সে মেমনন প্রাসাদে ফেরার জন্যে প্রস্তুত হল তখন যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তার কাছে প্রকাশ হয়ে গেল।

সন্ধ্যায় সে নদীর পার ধরে প্রাসাদে ফিরতে সোজা পথ ধরল। ঘরে ফিরতি কৃষকেরা তাকে চিনল, তার শুভ ভাগ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করে তাকে বলল, হুরাসের কাছে আমাদের জন্যে প্রার্থনা করো, ম্যাগোস। কারণ তারা সবাই জানত সে একজন হুরাস ভক্ত। অনেকে তাকে ছোট ছোট কিছু উপহার দিল এবং এক চাষী তার সাথে রাতের খাবার খেতে তাকে জোর অনুরোধ করল।

*

রাত নামতেই টাইটা চাষীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল এবং তাকে আগুনের পাশে রেখে এল। সে দ্রুত চলল, উদ্বিগ্ন–যদি না আবার রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। প্রত্যুষের পূর্বে সে প্রাসাদে ফিরল, এবং রাজ শয়নকক্ষে যাবার আগে সে গোসল ও পোশাক পরিবর্তনের সময় পেল না। দরজায়, প্রবেশ দ্বারে দুজন রক্ষী তাদের বর্ষা আড়াআড়ি ধরে তার পথ আটকাল।

টাইটা বিস্মিত হল, পূর্বে এমনটা কখনো হয়নি। সে রাজ-শিক্ষক, ফারাও ট্যামোস কর্তৃক তের বছর পূর্বে নিয়োগ পেয়েছেন। সে রাগত দৃষ্টিতে রক্ষীদের দিকে তাকালেন। তারা চোখ নামাল কিন্তু নিজেদের অবস্থানে অটল রইল। অপরাধ নেবেন না, মহান ম্যাগোস। এটা কর্নেল আসমর ও রাজ-রক্ষকের বিশেষ আদেশ। রাজার কক্ষে কারো প্রবেশ রাজ-প্রতিভূর অনুমোদন বহির্ভূত।

সার্জেন্ট অবিচল, তাই টাইটা সেখানে গেল যেখানে নাজা তার প্রিয় লোকদের সাথে সকালের নাস্তা করছিল। আমার লর্ড নাজা, আপনি জানেন যে আমি ফারাও এর নিজ পিতা কর্তৃক তার শিক্ষক ও বিজ্ঞ পরামর্শদাতা পদে নিয়োগ প্রাপ্ত। তাই দিনের বা রাতের যে কোন সময় তার কক্ষে প্রবেশ করার অধিকার আমার রয়েছে।

সে অনেক বছর আগের কথা, মহান ম্যাগোস, পিছনে দাঁড়ানো দাসের কাছ থেকে আঙুরের একটা থোকা নিয়ে মুখে পুরতে পুরতে নাজা ধীর লয়ে জবাব দিল।

আর তা তখনকার জন্যে ঠিক ছিল, কিন্তু ফারাও সেটি আর বাচ্চা নেই। তার আর এখন কোন সেবকের প্রয়োজন নেই। অপমানটা আকস্মিক ছিল, সে তা পাত্তা দিল না। আমি তার রাজ প্রতিভূ। ভবিষ্যতে সে আমার কাছেই সাহায্য ও উপদেশ চাইবে।

রাজার প্রতি আপনার অধিকার ও দায়িত্ব আমি স্বীকার করছি কিন্তু নেফারের কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে রাখা অপ্রয়োজনীয় ও নিষ্ঠুর, টাইটা প্রতিবাদ করল কিন্তু নাজা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল।

সবচাইতে জরুরি রাজার নিরাপত্তা, সে বলল এবং খাবার থেকে উঠল ও বোঝাল যে খাবার পর্ব এবং সাক্ষাৎ দর্শন শেষ। তার বডিগার্ড তার কাছাকাছি থাকল যাতে টাইটা কাছে ঘেষতে না পারে।

সে নাজার সফর সঙ্গীদের বাগান পেরিয়ে কাউন্সিল চেম্বারের দিকে যেতে দেখল। সে তৎক্ষণাৎ তাদের অনুসরণ করল না, এক পাশে ঘুরে বসে ভাবতে লাগল।

নেফারকে নাজা নজর বন্দী করে রেখেছে। তার নিজের প্রাসাদেই সে বলতে গেলে বন্দি। সে একা ও শত্রু বেষ্টিত। টাইটা তাকে রক্ষা করার উপায় খুঁজল। আরো একবার সে মিশর থেকে পালিয়ে কোন বিদেশি ক্ষমতার সুরক্ষায় নেফারকে নিয়ে যাবার কথা ভাবল যতোদিন না সে তার জন্ম-অধিকার দাবি করার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যাই হোক এখন তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে শুধু রাজ কোয়ার্টারের সব দরজাই বন্ধ নাকি থেব ও মিশর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সবগুলো পথই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

কোন সহজ সমাধান নয় এবং এক ঘণ্টা গভীর চিন্তার পর টাইটা উঠে দাঁড়াল। কাউন্সিল চেম্বারের গার্ডরা এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে তাকে যাবার জায়গা করে দিল এবং টাইটা দুই সারির মধ্যবর্তী সরু স্থান দিয়ে নেমে তার জন্য বরাদ্দ করা সামনের বেঞ্চে বসল। নেফার তার রাজ প্রতিভূ-র পাশে বেদীতে বসে আছে। সে মিশরের উচ্চ রাজ্যের মুকুট পরে আছে এবং তাকে বিবর্ণ ও বিমর্ষ দেখাল। টাইটা বুঝল ইতোমধ্যে তাকে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। কিন্তু সে বালকটির চারপাশে কোন ভয়ংকার ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারল না। সে তাকে শক্তি ও উৎসাহ দিতে মনোযোগ দিল, কিন্তু নেফার তার দিকে শীতল ও দোষীর ন্যায় দৃষ্টি হানল, কারণ সে রাজ অভিষেক মিস করেছে।

টাইটা রাজকার্যে মনোনিবেশ দিল। তারা উত্তর থেকে আসা সবশেষ খবর নিয়ে আলোচনা করছিল। সেখানে রাজা অ্যাপেপি আবার আবনাব দখল করে নিয়েছে যা কিনা তারা তিন বছর আগে দখল করেছিল। এ নিয়ে ঐ দুর্ভাগ্যের শহরটা আট বার হাত বদল হল সেই ফারাও ম্যামোস, ট্যানোস-এর পিতার রাজত্ব কাল হতে। যদি ফারাও ট্যামোস হিকস্‌দের তীর দ্বারা বধূ না হতেন তবে তার বলিষ্ঠ কৌশল এ দুর্বিণিত শক্তিকে সমূলে উৎখাত করে দিতো নিশ্চিত। তখন তাহলে এখন হিকস্ সৈন্যরা থেব আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত না হয়ে তার পরিবর্তে শত্রু রাজধানী তাদের অ্যাভারিস অভিমুখে এগোত।

টাইটা লক্ষ্য করল কাউন্সিলের সদস্যরা প্রতিটি সমস্যার ক্ষেত্রে মত-বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন। তারা শেষ হারাটার কারণ খুঁজল, যা একটা বোকাও সহজে বুঝবে যে ফারাও-এর অকাল মৃত্যুই এর প্রধান কারণ। যিনি তার আর্মিকে কোন দিক নির্দেশনা না দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। অ্যাপেপি তার মৃত্যুর এ সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে।

তাদের তর্ক শুনে টাইটা আগের চাইতে অনেক জোড়ালোভাবে অনুভব করল এই যুদ্ধটা মিশরের শরীরে চলমান ফোঁড়ার মতই হবে। ধৈর্যচুত্য হয়ে সে ধীরে উঠে দাঁড়াল এবং কাউন্সিল কক্ষ থেকে বের হয়ে এল। এখানে তার আর কিছু দেখার নেই কারণ এখনো তারা মৃত ফারাও ট্যামোস-এর পরিবর্তে উত্তরের সৈন্যদেরকে নেতৃত্ব কে দেবে তা নিয়ে তর্ক করছিল। এখন যেহেতু সে চলে গেছে, অ্যাপেপির সাথে যুদ্ধ করার মতো কেউ নেই–না আসমর, না টেরন বা না নাজা নিজে। হেঁটে চলতে চলতে টাইটা বিড়বিড় করল। আমাদের ভূমি ও সৈন্যরা দীর্ঘ ষাট বছরের যুদ্ধে রক্তে ঝড়ে সাদা হয়ে গেছে। আমাদের শক্তি বাড়াতে হবে এবং আমাদের মধ্য থেকে একজন মহান নেতার অভ্যুদয় ঘটাতে হবে। সে নেফারের কথা ভাবল। কিন্তু ছেলেটির সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে কিছু বছর লেগে যাবে যা টাইটা জানে। আমন-রা-এর ধাঁধা থেকে তা সে জেনেছে, ভাগ্য তার জন্যে এমনটাই পরিকল্পনা করে রেখেছে।

আমাকে ঐ সময়টা পর্যন্ত তাকে জয়ী রাখতে হবে এবং যতক্ষণ না সে প্রস্তুত হয় ততোক্ষণ অব্দি তাকে নিরাপদে রাখতে হবে।

তারপর সে প্রসাদের মহিলাদের কোয়ার্টারে গেল। যেহেতু সে খোঁজা ছিল তাই সে যেতে পারত, অন্য পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তিন দিন পূর্বে রাজ কুমারীরা জেনেছে সে তাদের বিয়ে হবে এবং টাইটার আরো আগে তাদের সাথে দেখা করা উচিত ছিল। তারা দ্বিধান্বিত ও হতাশ হয়ে আছে এবং তার সহানুভূতি ও সাহায্য তাদের প্রয়োজন হতে পারে।

সে আঙ্গিনায় প্রবেশ করতেই মেরিকারা তাকে প্রথম দেখল। একজন আইসিস যাজকি তাকে শিক্ষাদান করছিল এবং সে সেখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে দৌড়ে তার নিকট এল। দৌড়ানোর সময় কাঁধের ওপর তার চুলের গোছা দুলতে লাগল। সে তার কোমর দুহাতে পেচিয়ে ধরল এবং তার সব শক্তি দিয়ে জোরে চেপে ধরল। ওহ্, টাইটা, তুমি কোথায় ছিল? গত কয়দিন আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি।

তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই টাইটা বুঝল সে কাঁদছিল, কারণ তার চোখ লাল হয়ে আছে এবং চোখের চারপাশটা গাঢ় কাল। এখন সে আবার তা শুরু করল, ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে কেঁপে উঠছিল। টাইটা তাকে কোলে তুলে নিল এবং জড়িয়ে ধরে রাখল যতোক্ষণ না সে একটু শান্ত হল। কি হয়েছে, আমার ছোট্ট বানর? কি সে যা তোমাকে এতো অসুখী করেছে?

লর্ড নাজা আমাকে কোন গোপন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে এবং আমার ভয়ানক কিছু করবে। সে কিছু একটা বড় ও তীক্ষ্ণ জিনিস আমার ভেতরে রাখবে যা আমাকে ব্যথা দিবে ও আমার রক্ত বের হবে।

কে তোমাকে এটা বলেছে? টাইটা খুব কষ্টে তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করল।

মাগারা ও সাক, মেরিকারা ফুঁপিয়ে বলল।

ওহ্, টাইটা, তুমি কি তাকে তা আমার সাথে করা থেকে বিরত করতে পারবে না? দয়া করে, ওহ, দয়া করে তা কর।

টাইটা বুঝল ঐ নুবিয়ান মেয়ে দুটোই তার এই ভয়ের জন্যে দায়ী। সাধারণত তাদের গল্পগুলো আফ্রিকার পিশাচ ও ভূতদের নিয়ে হয় কিন্তু এখন তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। মনে মনে টাইটা বেয়াদব মেয়ে দুটোকে উচিত শাস্তি দেয়ার কসম খেল এবং রাজ কন্যার ভয় দূর করার উদ্যোগী হল। এখন তাকে শান্ত করতে কৌশল ও স্নেহ দরকার, কারণ মেরিকারা ভীত ছিল। সে তাকে বাগানের একটা নির্জন কোনে নিয়ে গেল, বসাল এবং মেয়েটি তার কোলে গুটিসুটি মেয়ে রইল এবং মাথটা টাইটার বুকের সাথে সেটে রাখল।

তার ভয়টা অবশ্যই অমূলক। এমনকি বিয়ের পরও, এটা প্রকৃতির নিয়ম। নাজা মেরিকারাকে তার প্রথম ঋতুর পূর্বেই বিছানায় নেবে এবং তার এখনো বছর খানেক বাকি। শেষ পর্যন্ত সে তাকে শান্ত করতে সফল হল এবং তারপর রাজ ঘোড়াশালে তাকে সকালে জন্ম নেওয়া ঘোড়া শাবক দেখাতে নিয়ে গেল।

যখন সে আবার হাসছিল ও লাফালাফি করতে লাগল টাইটা তাকে তখন অন্দর মহলে ফিরিয়ে আনল এবং তাকে আনন্দ দিতে কিছু যাদু দেখাল। সে এক জগ নীলের পানিতে আঙুল ডুবিয়ে শরবত বানাল এবং এক সাথে তা তারা পান করল।

তারপর একটা পাথর সে বাতাসে ছুঁড়ে মারল যা একটা জীবন্ত ক্যানারি পাখিতে পরিণত হয়ে উড়ে গিয়ে একটা ডুমুর গাছের শীর্ষে গিয়ে বসল। গাছটায় বসে পাখিটা নাচল ও গান গাইল। টাইটা তাকে ছেড়ে দুই দাসী মাগারা ও সাককে খুঁজতে গেল। তাদের সে এমন ধমক দিল যে তারা ভয়ে কাঁপতে লাগল এবং করুণ সুরে দুঃখ করল। সে জানত মাগারা এই রকম অস্বস্তিকর ঘটনার লীডার তাই সে তার কান থেকে যাদু বলে একটা বিছু বের করে আনল ও তার মুখের এক ইঞ্চি নিচে রাখল যা তাকে এতো ভীত করল যে সে ভয়ে প্রসাব করে দিল।

সন্তুষ্ট হয়ে সে হেজারেটকে খুঁজতে গেল। সে তাকে নদীর তীরে তার বীণা নিয়ে বসে থাকা অবস্থায় পেল। টাইটার দিকে সে চেয়ে ছোট একটা কষ্টের হাসি দিল কিন্তু বীণা বাজনো থামালো না। টাইটা তার পাশে উইলো গাছটার শূন্যে ঘাসের উপর বসল। যে সুরটা সে বাজাচ্ছিল তা তার দাদীর প্রিয় একটা সুর। টাইটা এটা তাকে শিখিয়েছে এবং এখন সে গলা ছেড়ে গাইতে লাগল।

আমার হৃদয়টা আজ আহত কোয়েল পাখি যেন।
যখনই তোমার মুখটা আমি দেখি, প্রিয়!
মনটা তখন ভোরের আকাশ হতে চায়
আর তুমি হেসে ওঠতেই
সূর্যালোক বুঝি আঁধার সব তাড়াল।

তার কণ্ঠ মিষ্টি ও আবেগাপ্লুত, এবং টাইটা অনুভব করল সে নিজেও কাঁদছে। যেন সে এখন আবার লসট্রিসের কন্ঠ শুনল। সেও তার সাথে যোগ দিল। তার কণ্ঠ এখনো পরিষ্কার ও জোরালো, এ বয়সে এবং দাঁত নেই তবুও। এই যুগলের সামনে দিয়ে যাওয়া সব নৌকার মাঝিরা তাদের গান শুনে একটু জিরিয়ে নিতে লাগল।

গান শেষে হেজারেট বীণাটা পাশে সরিয়ে তার দিকে ফিরল। প্রিয় টাইটা আমি খুব খুশি যে তুমি এসেছো।

আমি দুঃখিত যে তোমাকে অপেক্ষায় রেখেছি, আমার রাতের চাঁদ। ডাক নামটা শুনে হেজারেট ক্ষীণ একটা হাসি দিল কারণ প্রকৃতির প্রতি সমসময়ই তার একটা রোমান্টিক ভাব ছিল। এখন বলো আমি তোমার জন্যে কি করতে পারি?

তুমি লর্ড নাজার কাছে যাবে এবং আমার হয়ে ক্ষমা চাইবে। আমি তাকে বিয়ে করতে পারবো না।

তার দাদী এ বয়সে যেমন ছিল সেও তেমন। লসট্রিসও অসম্ভব কাজের শুরু দায়িত্ব একই রকম নিশ্চয়তা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে তার উপর চাপিয়ে দিত। হেজারেট তা গভীর নীল সুন্দর চোখ দুটো তার দিকে ফেরাল। তুমি জানো, আমি ম্যারনকে কথা দিয়েছি, আমি তার স্ত্রী হব। ম্যারন হচ্ছে ক্রাতাসের নাতি ও প্রিন্স নেফারের ফুর্তিবাজ সাথী।

টাইটা হেজারেটের দিকে অনুগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে তাকাল কিন্তু কখনো বুঝাল না যে সে তার অনুভূতিগুলোকে উজ্জীবিত করলো। হেজারেট, আমি তোমাকে অনেক বার বলেছি যে তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও। তুমি রাজকুমারী। তোমার বিয়েটা কোন আবেগের বশবর্তী হয়ে করা ঠিক হবে না। এটা কোন রাজনৈতিক কারণে অন্যরকম হতে পারে।

তুমি বুঝছ না, টাইটা, হেজারেট নরম স্বরে বলল, কিন্তু মিষ্টি দৃঢ়তা নিয়ে। আমি ম্যারনকে ভালোবাসি। আমার ছেলেবেলা থেকে তাকে আমি নিচু। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই, লর্ড নাজাকে নয়।

আমি মিশরের রাজ-প্রতিভূর আদেশ খণ্ডাতে পারবো না। সে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সে তার মাথা নাড়াল ও তার দিকে চেয়ে হাসল।

তুমি অনেক জ্ঞানী টাইটা। আমি জানি তুমি কিছু একটা ভাববে। আর তুমি সব সময়ই তা কর। সে তাকে বলল এবং অনুভব করল আবেগে বুঝি তার হৃদয় ভেঙ্গে যাবে।

*

লর্ড টাইটা, আমি আপনার সাথে ফারাও কিংবা আমার বিবাহের বিষয়ে কোন কথা বলতে ইচ্ছুক নই। এই দুব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেবার আমিই নেবো। সে বুঝিয়ে দিল যে এ ব্যাপারে আর কোন কথা নয়। নাজা তার সামনে লেখার টেবিলে ছড়ানো স্ক্রৌলটায় মনোযোগ দিল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হল, এক পাল বন্য হাঁস পূর্ব তীর থেকে উড়াল দিয়ে তাদের ভারি ডানা ঝাঁপটা দিতে দিতে নীলের ধূসর প্রশস্ত পানি পেরোল এবং প্রাসাদের বাগান যেখানে তারা বসে ছিল তার উপর দিয়ে উড়ে গেল। অবশেষে টাইটা আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে যাওয়ার জন্য উঠল। সে রাজ-প্রতিভূতে মাথা ঝুঁকে বিদায় জানাতে উদ্যত হতেই নাজা তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। আমি আপনাকে যেতে বলি নি।

আমার লর্ড, আমি ভাবলাম আমাকে আপনার আর প্রয়োজন নেই।

বরং আপনাকেই আমার সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। সে এক দৃষ্টিতে টাইটার দিকে চাইল ও ইশারায় তাকে আবার বসতে বলল। আপনি আমার ধৈর্য ও সহ্য পরীক্ষা করছেন। আমি জানি আপনি কখনো ফারাও ট্যামোসের জন্যে আমন-রা অনুশীলন করতে অস্বীকার করেননি। যখনই তিনি বলেছেন তখনই তা করেছেন। তাহলে আমার সাথে কেন এতো ছল-চাতুরী? এই ভূমির রাজ-প্রতিভূ হিসেবে আমি আর কোন দেরি করব না। আমি এ কাজটা শুধু আমার লাভের জন্যে নয় বরং এ জাতির এই উত্তরের যুদ্ধে টিকে থাকার জন্যে করতে চাই। প্রভুদের দিক নির্দেশনা আমার দরকার। আর আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যে তা আমার জন্যে করতে পারেন।

নাজা এতো আকস্মিকভাবে উঠে দাঁড়াল যে তার সামনের টেবিলে উল্টে গেল এবং প্যাপিরাসের স্ক্রৌলটা পিছলে পড়ে গেল। সেদিকে সে কোন নজর দিল না, বরং চিৎকার করে উঠল, আমি আপনাকে আমার হয়ে আমান-রা অনুশীলনের আদেশ দিচ্ছি।

টাইটা নাটকীয় ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করল। পিছনের কয়েক সপ্তাহ ধরেই সে এই আল্টিমেটামের জন্য প্রস্তুত ছিল। এবং নেফার যাতে নিরাপদ থাকে তাই সে তাকে দেরি করাল। তার বিশ্বাস যতক্ষণ না সে ধাঁধার রহস্য তাকে বলবে তততক্ষণ লর্ড নাজা নেফারের বড় কোন ক্ষতি করবে না।

ধাঁধার জন্যে পূর্ণিমা সবচাইতে উত্তম সময়। টাইটা তাকে বলল। আমি ইতোমধ্যে আয়োজন শুরু করেছি।

নাজা তার টুলে বসল। আপনি এটা এখানে আমার কোয়ার্টারে করবেন। সে বলল।

না, লর্ড রাজ-প্রতিভূ, ওটা ঠিক হবে না। টাইটা জানে যদি নাজাকে সে বসে রাখতে চায় তাহলে তাকে অশান্ত রাখতে হবে। প্রভুদের যতো বেশি নিকটে থাকা যায় ভষ্যিত্বণী ততো বেশি নির্ভুল হয়। বসিরিসের অশিরিশ মন্দিরে আমি যাজকদের নিয়ে সব ব্যবস্থা করেছি। ঐ খানটাতেই আমি মধ্যরাতে পূর্ণিমায় ধাঁধা অনুশীলন করব। মন্দিরের ভিতরের অংশে তা অনুশীলন করব। পবিত্র আত্মারা আমাদের সাহায্য করবে। টাইটার কণ্ঠ রহস্যে ভারি হল। সেখানে শুধু আমি এবং আপনি উপস্থিত থাকব। অন্য কোন মানুষ, যা প্রভুরা আপনাকে বলবে তা শুনা ঠিক হবে না। আসমরের একজন প্রহরী শুধু দরজায় পাহারা দিবে।

নাজা অশিরিশের একজন ভক্ত এবং তার অভিব্যক্তি স্থির ছিল। টাইটা জানে যে সময় ও স্থান সে পছন্দ করছে তার দ্বারা নাজা প্রভাবিত হবে। যেমনটি আপনার ইচ্ছে, নাজা সম্মত হল।

*

রাজকীয় নৌকা যোগে বুশিরিসে যেতে দুদিন সময় লাগল এবং আসমরের বাহিনী চারটা নৌযানে করে তাদের অনুসরণ করল। মন্দিরের শূন্যের হলুদ সমুদ্রতীরে তারা নামল এবং যাজকেরা স্তুতিগান ও সুগন্ধি নিয়ে রাজ-প্রতিভূকে স্বাগতম জানাতে অপেক্ষা করছিল। রাজ প্রতিভূর সুগন্ধি প্রিয়তার খবর রাজ্যব্যাপী সবার জানা। তাদের জন্য প্রস্তুত কোয়ার্টারে তাদের নিয়ে যাওয়া হল। নাজা গোসল করে সুগন্ধি মাখল এবং ফল ও শরবত খেয়ে সতেজ হল। টাইটা প্রধান যাজকের সাথে মন্দিরের বেদী পরিদর্শন করল ও মহান প্রভু অশিরিশের উদ্দেশ্য বলী দিল। পরে টাইটার পরামর্শে প্রধান যাজক চলে গেল এবং তাকে তার সান্ধ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্যে একা রেখে গেল। অতীতের ধাঁধা অনুশীলনের সময় যে কয়জন জীবিত ব্যক্তি বর্তমান আছে তাদের মধ্যে লর্ড নাজা কখনো ছিল না। তাই টাইটা ঠিক করল তাকে সন্তুষ্ট করতে অভিনয় করবে, প্রকৃত নিয়ম ও রীতিতে নিজেকে নিঃশেষ করার কোন ইচ্ছা টাইটার নেই।

সূর্য ডোবার পর প্রধান যাজক রাজ-প্রতিভূকে ভোজ দিল। তার সম্মানে সে মন্দিরের চারপাশে জন্মানো আঙ্গুরের ক্ষেত থেকে তৈরি বিখ্যাত আঙুর মদ পরিবেশন করল। এই বুশিরিসেই মহান প্রভু অশিরিশ মিশরে প্রথম আঙুর পরিচয় করান। মদ পান করতে করতে যাজকরা মহান প্রভুর জীবন কাহিনী নাটকীয় ভঙ্গিমায় ক্রমান্বয়ে অভিনয় করে দেখাল। একেকটি অশিরিশ মূর্তি একেক রঙের ছিল, কোনটা মৃতের ন্যায় সাদা, কোনটা কালো, কোনটাবা লাল। তবে প্রতিটির চেহারায় সব সময় এক শোষকের ভাব বজায় ছিল। শেষ অংকে শাক-সবজির প্রতীক সবুজ রং ধারণা করল। মিলেট, যে শস্য এখন মিশরীয়রা খায়, যা জীবনের প্রতীক। তারপর অশিরিশকে মাটির শূন্যে কবর দেওয়া হয় যা মৃত্যুর প্রতীক। তারপর পরকালের অন্ধকার রাজ্যে সে মিলেট বীজের ন্যায় অংকুরিত হল এবং এরপর অনন্ত জীবনে নিয়ে উপরে উঠে আসল। তখন প্রধান যাজক প্রভুর শক্তির নাম জপল: রাতের চোখ, অনন্ত শ্রেষ্ঠ জীব, গেবের পুত্র এবং ওয়েনেফার, শ্রেষ্ঠ মহানুভব।

ধূপ জ্বেলে, ড্রাম বাজিয়ে যাজকেরা প্রভু ও শয়তানের যুদ্ধ কাহিনী একে একে বর্ণনা করে গেল। কিভাবে সেথ তার ভালো ভাই অশিরিশকে শত্রুতাবশত পর্বত চূড়ায় বন্দি করে রেখেছিল এবং নীলে নিক্ষেপ করেছিল ডুবে মরার জন্য। যখন তাঁর মৃত দেহ নদীর তীরে ভেসে এল তখন সেথ তা টুকরো টুকরো করল এবং বিভিন্ন স্থানে পুঁতে দিল। এখানে এই বুশিরিসে তার মেরুদন্ড লুকিয়ে ছিল। তারপর তাদের বোন আইসিস তার দেহের সব অংশ খুঁজে বের করে একত্রিত করে এবং তারপর তার সাথে মিলিত হয় এবং নিজের পাখা দ্বারা বাতাস দিয়ে তাঁকে নিঃশ্বাস দিয়ে জীবন ফিরিয়ে দেয়।

মধ্যরাতের অনেক আগেই মিশরের রাজ-প্রতিভূ মদের নেশায় বুঁদ হয়ে গেল। যখন পূর্ণ চাঁদের রূপালি আলো ছাদের ফোকর দিয়ে প্রবেশ করল প্রধান যাজক সবাইকে হাত দিয়ে ইশারা করল এবং নাজা ও টাইটা ছাড়া সবাই প্রস্থান করল।

যাজকদের গান যখন আর শোনা গেল না, তখন টাইটা রাজ-প্রতিভূকে হাত ধরে নিয়ে চলল এবং চাঁদের আলোয় গোপন কুঠরীতে নিয়ে গেল। তারা দরজায় কাছে পৌঁছতেই তা আপনা-আপনি খুলে গেল। লর্ড নাজা হয়তো পিছু হটতো কিন্তু টাইটা তাকে সামনে নিয়ে চলল।

ঘোট কুঠরীটির এক কোনে রাখা মশালের আলোয় ঘরটি আলোকিত, মেঝের ঠিক মাঝখানে নিচু একটা টুল রাখা। টাইটা নাজাকে তার নিকট নিয়ে গেল ও ইশারায় বসতে বলল। সেখানে সে বসতেই পিছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং লর্ড নাজা ভয়ে চারদিক তাকাতে লাগল। সে দাঁড়িয়ে যেতে উদ্যত হতেই টাইটা তার কাঁধে হাত রেখে তাকে তা থেকে বিরত করল। যাই আপনি দেখবেন কিংবা শোনবেন তখন নড়বেন না। কোন কথা বলবেন না। যদি জীবনের প্রতি আপনার মায়া থাকে কিছু করবেন না। কিছু বলবেন না।

টাইটা তাকে বসিয়ে রাখল এবং রাজকীয় ভঙ্গিমায় প্রভুর মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে তার হাত উঠাল এবং যাদু বলে হঠাৎ একটা সোনার পানপাত্র আনল, যা থেকে ধূয়া উদ্‌গরিত হচ্ছিল। সে তা উঁচু করে ধরল এবং অশিরিশকে পাত্রটার মধ্যে আশীর্বাদ দিতে বলল। তারপর নাজার নিকট এনে তা তাকে পান করতে বলল। পানীয়টা ছিল মধু, মাশরুম ও গোলাপের পাপড়ির তৈরি। টাইটা হাত তালি দিতেই পাত্রটা আবার গায়েব হয়ে গেল।

তারপর সে খালি হাতটা নাজার সামনে এনে ধরল এবং যাদু কসরতের মতো করে তা নাজার মুখের সামনে দুলাতেই চোখের পলকে আমন-রা-এর ধাঁধা তার হাতে চলে এল। টাইটা তাকে তা তার নিজ হাতে ঢেকে দিতে বলল, এবং সে আমন-রা-এর মন্ত্র পড়তে লাগল। আলো ও আগুনের মহান অধীশ্বর, স্বর্গীয় মহানুভবতায় জাগ্রত, আসুন এবং আমাদের আবেদন শুনুন।

ধাঁধাটা তার স্পর্শে গরম হতেই নাজা টুলের উপর ঝিমুতে লাগল এবং তা টাইটার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সে স্বস্তি পেল। বৃদ্ধ লোকটি যখন ধাঁধাগুলো নিয়ে ঘরটির মধ্য দিয়ে হেঁটে বিশাল মূর্তির পায়ের কাছে রাখছিল তখন সে খুব ঘামছিল। টাইটা হাঁটুগেড়ে বসে প্রণাম করল। কিছু সময়ের জন্য সেখানে অগ্নি শিখার হিসহিস আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ শুনা গেল না; এবং ছায়ার নড়া-চড়া ছাড়া আর কোন নড়াচড়া ছিল না, যা দেয়ালের উপর মশালের আলোয় সৃষ্টি হয়ে নাচছিল। তারপর হঠাৎ কক্ষটির ভেতর এক ভয়ানক আওয়াজ হল। এমন আওয়াজ যেন আবার প্রভুর দেহটা তার শয়তান ভাই কর্তৃক ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। নাজা গোঙানির মত আওয়াজ করল ও শাল দিয়ে মাথা ঢাকল।

আবার নিরবতা নেমে এল যতোক্ষণ না হঠাৎ করে মশালের আলো ছাদ পর্যন্ত উঁচু হয়ে ঠেকল এবং হলুদ থেকে ভয়ংকর সবুজ এবং বেগুনি, লাল ও নীল রং ধারণ করল। ওগুলো থেকে অনেক ধূয়া বের হচ্ছিল এবং কক্ষটি ভরে গেল। নাজার দম বন্ধ হয়ে হল এবং কাশতে লাগল। তার মনে হল তার নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে ও সে জ্ঞান হারাচ্ছে। মাথার মধ্যে সে নিজের শ্বাসের আওয়াজ অনুভব করল।

টাইটা ধীরে ঘুরে তার সামনে এসে দাঁড়াল এবং নাজা তাকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল, কারণ টাইটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তার চেহারা সবুজ উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করেছে, ঠিক অশিরিশের ন্যায়। তার খোলা মুখ দিয়ে সবুজ রঙের ফেনা বের হয়ে বুকে বেয়ে পড়ছে ও তার চোখ থেকে রূপালি আলোর ঝলকানি মশালের আলোর উপর ঝিলিক তুলল। পা না নাড়িয়ে নাজা যেখানে বসে আছে সেখানে সে এল। এবং মুখ দিয়ে শয়তান ও জিনদের ন্যায় আওয়াজ করল। একটা চিৎকার কোকানো, হিস্ হিস্ করে গোঙানি ও পাগলের মতো হাসির আওয়াজ।

লর্ড নাজা উঠার চেষ্টা করল কিন্তু আওয়াজ ও ধূয়ায় তার খুলি ভরে গেল এবং অন্ধকার তাকে ছেয়ে ধরল। তার পা ভারি হয়ে এল, পায়ের নিচে সে মাটি খুঁজে পেল না এবং অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।

*

মিশরের রাজ-প্রতিভূর যখন জ্ঞান ফিরল ততোক্ষণে সূর্য অনেক উপরে উঠে গেছে, নদীর পানিতে তার ঝলকানি চমকাচ্ছিল। সে নিজেকে তার রাজকীয় নৌকায় সিল্কের মাদুরে শায়িত অবস্থায় খুঁজে পেল। চারপাশে সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল এবং নৌকার সাদা পালটা চোখের সামনে দেখল যা সবুজের উপর সাদা পাখির ন্যায় ছড়িয়ে আছে। তার খুব তৃষ্ণা পেল, অনুভব করল জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে এবং মনে হল মাথার খুলির ভেতর তার দেখা সব শয়তানেরা ফাঁদ-বন্দী হয়ে আছে। সে ফুঁপিয়ে উঠে কাঁপতে লাগল এবং বালতির মধ্যে বমি করল যা, একজন ভৃত্য তার সামনে ধরে ছিল।

টাইটা তার পাশে এসে দাঁড়াল। নাজার মাথাটা তুলে কোন এক অলৌকিক পানীয় পান করাল যা তার মাথার ব্যাথা, জ্বালা ঠাণ্ডা করে দিল এবং তার পেটে জমে থাকা গ্যাস বের করে দিল। তারপর কথা বলার মতো শক্তি পেতেই সে ফিসফিসিয়ে টাইটাকে জিজ্ঞেস করে বলল, আমাকে বল, টাইটা; সব কিছু। আমার কিছুই মনে নেই। ধাঁধায় কি পেলে?

উত্তর দেওয়ার পূর্বে টাইটা সব নাবিক ও দাসদের বাইরে বের করে দিল। তারপর সে তার বিছানার পাশে হাঁটুগেড়ে বসল। নাজা কাঁপা কাঁপা একটা হাত তার বাহুতে রাখল এবং করুনভাবে ফিসৃফিস্ করে বলল, আমার পরের কোন কিছুই মনে নেই… গত রাতের ভয়ংকর ঘটনা তার মনে পড়তেই সে ইতস্তত: বোধ করল ও কেঁপে উঠল।

আমরা প্রায় সেবেননিটোস পৌঁছে গেছি, মহামান্য, টাইটা তাকে বলল। রাত নামার আগেই আমরা থেব পৌঁছে যাব।

কি হয়েছে, টাইটা? সে টাইটার কাঁধ ঝাঁকাল। ধাঁধায় কি দেখলে?

বিস্ময়কর, মহামান্য? টাইটার কণ্ঠটা আবেগে কেঁপে উঠল।

বিস্ময়কর? নাজার আকর্ষণ বাড়ল এবং সে উঠে বাসার চেষ্টা করল। কেন তুমি আমাকে মহামান্য বলছ? আমি ফারাও নই।

যা প্রকাশিত হয়েছে এটা তারই অংশ।

আমাকে বল! আমাকে সব খুলে বল!

আপনার কি মনে আছে কি ভাবে মন্দিরের ছাদ পদ্ম পাপড়ির ন্যায় খুলে গিয়েছিল এবং রাতের আকাশ থেকে বিশাল পথ আমাদের দিকে নেমে এল?

নাজা তার মাথা নাড়াল এবং অনিশ্চিতভাবে সম্মতি সূচক ঝাঁকাল। হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়েছিল। পথটায় উঠার জন্যে স্বর্ণের সিঁড়ি ছিল।

আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। টাইটা আরো জোর দিল। আমরা স্বর্ণের সিঁড়িতে চড়লাম। নাজা নিশ্চিত হতে তার দিকে তাকাল।

দুই ডানারওয়ালা সিংহের পিঠে চড়ে আমরা উপরে উঠে গেলাম। টাইটা মাথা নাড়ল।

হ্যাঁ, সিংহটার কথা আমার মনে আছে, কিন্তু তারপর আর কিছুই মনে নেই।

এই রহস্যগুলো মনকে অবশ ও চোখকে ঝাপসা করে দেয় যা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের নেই। এমনকি আমিও যার কিনা সপ্তম ও শেষ শক্তি আছে অবাক হয়েছিলাম যা দেখলাম। টাইটা আন্তরিকভাবে ব্যাখ্যা করল। কিন্তু হতাশ হবেন না, কারণ প্রভু আমাকে আপনার কাছে তা ব্যাখ্যা করার আদেশ দিয়েছেন।

বল, যাদুকর! কোন কিছু বাদ দিও না।

সিংহের পিঠে চড়ে আমরা কালো সমুদ্র ও সাদা পর্বত অতিক্রম করলাম। আসমান ও জমিনের সব রাজ্য আমাদের নিচে রয়ে গেল।

নাজা আগ্রহ ভরে মাথা নাড়ল, বলে যান।

অবশেষে আমরা প্রভুরা যেখানে বাস করেন সে প্রাসাদে পৌঁছলাম। তার প্রসাদের ভিত্তি পাতাল পর্যন্ত গভীর এবং পিলারগুলো আকাশ ও তারাদের ধরে ছিল। আমরা আমাদের উপরে আগুনের ন্যায় উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় সিংহাসনে এবং স্বর্গের অন্য প্রভুরা রুপা, সোনা, ক্রিস্টালের সিংহাসনে বসেছিল।

নাজা তার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাল, তার তাকাতে কষ্ট হচ্ছিল। হ্যাঁ, এখন তুমি যা আমাকে বললে তা মনে পড়েছে। নীল কান্ত মণি ও হীরার সিংহাসনে তারা বসেছিল। তারপর প্রভু কথা বললেন? সে দ্বিধান্বিত। তিনি আমার সাথে কথা বললেন, তাই না?

হ্যাঁ, এতো জোরে বললেন যেন পবর্তের উপর থেকে মহান প্রভু অশিরিশ বলছেন: প্রিয় নাজা! তুমি সব সময়ই আমার একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই তুমি পুরস্কৃত হবে।

এর অর্থ কি? তিনি কি তা স্পষ্ট করে বলেছেন, টাইটা?

টাইটা শান্তভাবে মাথা নাড়াল, হ্যাঁ, মহামান্য।

তুমি আবার উপাধিটা ব্যবহার করলে। আমাকে বল কেন।

যেহেতু আপনি আদেশ করলেন, মহামান্য, আমি আপনাকে সব বলব। মহান অশিরিশ তাঁর ভয়ংকর মহিমার সর্বোচ্চ পর্যায় আরোহণ করলেন এবং আপনাকে সিংহের পিঠ থেকে নামিয়ে তার পাশে আগুন ও স্বর্ণের সিংহাসনে বসালেন, তিনি আপনার মুখ ও হৃদপিন্ড স্পর্শ করলেন এবং স্বর্গীয় ভাই বলে সম্বোধন করলেন।

তিনি আমাকে স্বর্গীয় ভাই বলেছেন? এটা দিয়ে প্রভু কি বুঝিয়েছেন?

টাইটার রাগ হল। নাজা সবসময়ই একজন চালাক, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও অনুভূতি প্রবণ মানুষ। তাকে অযথা সব ব্যাখ্যা করে বলা দরকার নেই। টাইটার যাদুর মশরুমের শরবত এবং ধূয়া যা গতরাতে টাইটা যা তার উপর চালনা করে ছিল তার বেশ এখনো কাটেনি। তার মাথা পরিষ্কার হতে আরো কয়েকদিন লাগবে। আমাকে খুব ভালো বর্ণনা দিতে হবে, সে সিদ্ধান্ত নিল এবং বলে গেল, আমি নিজেও দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম তার কথায়। অর্থটা আমার কাছেও স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু তারপর মহান প্রভু আবার কথা বললেন; আমি আপনাকে দেবতাদের স্বর্গীয় মন্দিরে স্বাগত জানাই, স্বর্গীয় ভাই।

নাজার চেহারা পরিষ্কার হল এবং তার অভিব্যক্তিতে গর্বিত ও জয়ীভাব ফুটে উঠল। আমাকে তিনি কি দেবত্ব দান করেনি, টাইটা? নাশত এটা ছাড়া তার আর কোন অর্থ নেই।

যদিও সন্দেহ ছিল তাও তিনি দ্রুত দূরে করে দিলেন। কারণ অশিরিশ উচ্চ ও নিম্ন মিশরের দ্বৈত মুকুট নিলেন এবং আপনার মাথায় স্থাপন করলেন এবং আবার বললেন, জয়, স্বর্গীয় ভাইয়ের। জয়, যে ফারাও হবে। নাজা চুপ করে রইল কিন্তু জ্বলজ্বল চোখে টাইটার দিকে চেয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর টাইটা বলল, মাথায় মুকুট সহকারে আপনার পবিত্রতা প্রকাশ পেল। আমি আপনার সামনে হাঁটুগেড়ে বসলাম এবং অন্য প্রভুদের সাথে পূজা করলাম।

নাজা তার আবেগ লুকানোর কোন চেষ্টা করল না। সে স্বপ্নের আকাশে উড়তে লাগল। সে বিমোহিত হয়ে গেল। টাইটা সুযোগটা নিল। তারপর অশিরিশ আবার কথা বললেন, তোমার সব কাজে তোমার পথপ্রদর্শক হবে বৃদ্ধ জ্ঞানী টাইটা কারণ সে জাদুকর ও আমন-রা এর অধিকারী। বিশ্বস্ততার সাথে তার নিদের্শনা অনুসরণ করবে এবং যতো উপহার দেব বলেছি সব তোমার হবে।

সে নাজার প্রতিক্রিয়া দেখল। সে এটা কি বেশি নির্দিষ্ট করে ফেলল কিন্তু সে অবাক হল নাজা কোন বাধা ছাড়াই তা মেনে নিল।

আর কি টাইটা? প্রভু আমাকে আর কি বলেছেন?

আপনাকে আর কিছু বলেনি কিন্তু তিনি তারপর আমাকে সরাসরি বললেন। তার কথাগুলো আমার আত্মায় গিয়ে বিধল কারণ তিনি আমার উপর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করলেন। তার কথা যার প্রতিটি শব্দ আগুনের মত আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে।

টাইটা, ধাঁধার অধিকারী, আপনার আর কোনো ভালোবাসা, আনুগত্য ও দায়িত্ব নেই। আপনি আমার রাজকীয় ও স্বর্গীয় ভাই নাজার দাস। আপনার একমাত্র কাজ তাকে তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করা। যতোক্ষণ না আপনি তার মাথায় উচ্চ ও নিম্ন রাজ্যের দ্বৈত মুকুট দেখবেন ততোক্ষণ আপনি থামবেন না।

অন্য কোন আনুগত্য বা ভালোবাসা, নাজা নরম স্বরে বলল। তার মনে হল। তাকে অগ্নি পরীক্ষার সবচাইতেও খারাপ অবস্থায় ফেলা হল। তার শক্তি ফিরে আসছে এবং তার পরিচিত চতুর আলো তার হলুদ চোখে জোরালো হল। এবং তুমি কি তোমার সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছ যা তোমার উপর ন্যস্ত হয়েছে, টাইটা? সত্য কথা বল, তুমি কি এখন আমার লোক নাকি তুমি মহান পিতাকে অস্বীকার করেছো?

কিভাবে আমি মহান প্রভুকে ফিরিয়ে দিতে পারি? টাইটা স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করল। সে তার মাথা নামাল ও কপাল ডেকের উপর রাখল। দুই হাতে সে নাজার খালি ডান পা নিল ও তার নিজের মাথার উপর স্থান দিল। প্রভু আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন আমি তা গ্রহণ করেছি। আমি আপনার লোক স্বর্গীয় মহামান্য। হৃদয় ও মাথা ও আত্মা, সর্বত্র আমি আপনার।

তোমার অন্য দায়িত্বের কি হবে? ফারাও নেফার সেটির জন্মের সময় যে ওয়াদা করেছিলে তার কি হবে এবং এমন কি তুমি তার রাজ অভিষেকের দিনটিতে যা করেছো?

মহান প্রভু অশিরিশ আমাকে পূর্বের সব দায়িত্ব থেকে অবসর দিয়েছেন। আপনার কাছে যে ওয়াদা করেছি সেটা ছাড়া অন্য শপথের কোন অর্থ আমার কাছে আর নেই।

নাজা তাকে উঠাল এবং তার চোখে তাকিয়ে রইল, সেখানে মিথ্যা ও প্রতারণার চিহ্ন খুঁজল। টাইটা শান্তভাবে তার দিকে তাকাল, সে রাজ-প্রতিভূর সন্দেহ, আশা ও সংশয় বুঝল যা ঝুরির মধ্যে রাখা ইঁদুরের মতো জড়াজড়ি করে আছে, যা বাজপাখির খাদ্য হবার অপেক্ষায়। পিতার ইচ্ছাই কর্ম, টাইটা ভাবল। সে নিজেকে বিশ্বাস করাবে, কারণ সে তা চায়।

ঐ হলুদ চোখগুলোতে সন্দেহ দূর হতে সে দেখল এবং নাজা তাকে জড়িয়ে ধরল। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি যখন দ্বৈত মুকুট পরব তখন তুমি তোমার আশা বা কল্পনার চাইতেও বেশি পুরস্কৃত হবে।

*

ঐ দিন থেকে নাজা টাইটাকে তার কাছাকাছি রাখল এবং বৃদ্ধ মানুষটি তার বিশ্বস্ত তা অর্জনের মাধ্যমে নিজের নতুন পদকে কাজে লাগিয়ে রাজ-প্রতিভূর কিছু অঘোষিত উদ্দেশ্য বদলে দিতে লাগল। নাজার কথায় টাইটা পূর্ব লক্ষণগুলোকে আরেক বার যাচাই করে দেখল। সে একটা ভেড়া জবাই করল এবং ওটার নাড়িভূড়ি, যা রাজপ্রাসাদ থেকে একটা বাজপাখি ছাড়তেই তা নিয়ে উড়াল দিল এবং তারা তার চলে যাওয়ার দিকটা দেখল। এসব থেকে সে নিশ্চিত করল যে প্রভু রাজকন্যাদের সাথে নাজার বিয়ের অনুমতি দেননি যতক্ষণ না অন্তত পরবর্তী নীলের বন্যা শুরু হয় অথবা নিশ্চিতভাবে বন্যা না হয়। নাজা ঝুঁকি নিতে পারবে না, তাহলে ওটা দুর্ভোগ বাড়াতে পারে। মিশরের জীবন মহান নদীর বন্যার উপর নির্ভর করে। এই ভবিষ্যৎ বাণী দিয়ে টাইটা নেফারের বিপদ ও রাজকন্যাদের জ্বালা-যন্ত্রণা দেরি করাল।

নাজা প্রতিবাদ করল এবং তর্ক করল কিন্তু বুশিরিসের ভয়ংকর রাতের পর তার পক্ষে টাইটার ভবিষ্যৎ বাণী অবহেলা করা প্রায় অসম্ভব। এরমধ্যে উত্তরের যুদ্ধের খারাপ সংবাদে তা তাকে আরো বিরত রাখল। নাজার আদেশে, টাইটার অজ্ঞাতে, মিশরের আর্মিরা আবনাব ফিরিয়ে আনতে উল্টো আক্রমণের কথা ভাবছিল। তারা পরাজিত হয় এবং তিনশ রথ ও প্রায় এক রেজিমেন্ট পদাতিক সৈন্য ঐ মরণ যুদ্ধে তারা হারাল। এখন অ্যাপেপি থেবসের দিকে ধেয়ে আসছে। তাই এখন যে বিয়ের সময় না তা নাজা বুঝল এবং নেফারের নিরাপত্তা আরো কিছু দিন বাড়ল।

এরই মধ্যে বহু লোক প্রতিনিয়তই থেব থেকে দক্ষিণে রাস্তা ও নদী পথে পালিয়ে যেতে লাগল। পূবে যখন ব্যবসায়ীরা হিকস্‌দের অত্যাচার দেখার জন্য থামল তাদের যানগুলো ডাকাতি হলে লাগল। ফলে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেল।

একটাই পথ আছে যাতে আপনি অ্যাপেপিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আর তা হল শান্তি চুক্তি করা। টাইটা রাজ-প্রতিভূকে উপদেশ দিল।

সে তার বাহিনীকে এটা প্রায় অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে এবং জোর নির্দেশ দিয়েছে যে কোন অবস্থায়ই আত্মসমর্পণ নয়। নইলে তারা তাদের সৈন্যবাহিনীকে এ সুযোগে আরো শক্তিশালী করে ফেলবে, কিন্তু নাজা তাকে আর কিছু বলার অনুমতি দিল না। এটা আমিও বিশ্বাস করি, ম্যাগোস, সে আগ্রহ ভরে রাজি হল। প্রায়ই আমি আমার প্রিয় বন্ধু, ফারাও ট্যামোসকে এ বিষয়টা বোঝাতে চেয়েছি, কিন্তু সে কখনো আমার কথা শোনেনি।

আমাদের সময় প্রয়োজন; টাইটা ব্যাখ্যা করল, কিন্তু নাজা হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।

অবশ্যই আপনি ঠিক। নাজা এই অপ্রত্যাশিত সমর্থনে খুশি হল। সে প্রতিটি সদস্যকে হিকদের সাথে শান্তির ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কেউই রাজি হয়নি, এমনকি চিনকাও পর্যন্ত। এমনকি অনুগত আসমরও অ্যাপেপির নিকট আত্মসমপর্ণের চাইতে নিজের তরবারিতে জান দিতে প্রস্তুত। এই ভূমিতে কাউন্সিলকে জোর করার বিষয়ে রাজ-প্রতিভূর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

হিকস্‌দের সাথে শান্তি স্থাপনটা নাজার কাছে এক স্বপ্ন, দুই সাম্রাজ্য মিলিত হওয়া এবং একজন ফারাও তা শাসন করবে সেই স্বপ্নটা তার আজন্মের। একমাত্র এক ফারাও যে হিকস্ ও মিশরীয় দুজাতির অংশ সে-ই এ রকম অর্জনের কথা ভাবতে পারে এবং জানে, সন্দেহাতীত ভাবে, ধাঁধার মধ্য দিয়ে প্রভুরা তাকে সে ওয়াদা করেছেন।

সে আন্তরিক ভাবে বলে গেল, আমার জানা উচিত যে আপনি, টাইটা; যিনি হলেন একমাত্র ব্যক্তি যে নিজেকে কোন কুসংস্কারে অন্ধ করে রাখেন না। সবাই চিৎকার করে উঠল, আত্মসমর্পণ নয় এবং অসম্মানের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। সে তার মাথা নাড়াল। আপনি এবং আমি দেখতে পাচ্ছি যে আমরা শক্তি দিয়ে যা অর্জন করতে পারি না তা শান্তি দিয়ে করতে পারি। নীলের উপত্যকায় ষাট বছর পর মিশরীয় বা এশিয়ানদের চাইতে হিকস্‌রাই বেশি অবস্থান করছে। তারা আমাদের প্রভুদের সম্মান হানি, আমাদের দর্শন এবং আমাদের স্ত্রীলোকদের গ্রহণ করছে। তাদের অসভ্য রক্ত আমাদের দ্বারা নরম ও মিষ্ট হয়েছে। আমাদের সুন্দর আচরণে তাদের বন্য আচরণ পাল্টে গিয়েছে।

তার পরীক্ষামূলক পরামর্শে রাজ-প্রতিভূর সাড়াটা এতোই শক্ত যে টাইটা চমকে পিছু হটল। সে যা সন্দেহ করেছে তার চাইতেও এখানে বেশি কিছু বিরাজমান। সময় নিয়ে ভাবতে হবে এবং নাজার প্রকৃত মনোস্কামনা সম্পর্কে আভাস পেতে হবে, সে বিড়বিড় করে বলল। ওগুলোতো জ্ঞানের কথা; আমরা কিভাবে এ যুদ্ধ বিরতির চুক্তি আশা করতে পারি, রাজ-প্রতিভূ?

নাজা ব্যাখ্যা করতে ব্যাকুল হল, আমি জানি হিকদের মধ্যে অনেকে আছে যারা এই ব্যাপারে একমত। তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ করতে একটু সময় লাগবে শুধু। তারপর আমরা দুই রাজ্যে শান্তি ও একাত্মতা আনতে পারি।

পর্দা উঠতে শুরু করেছে। হঠাৎ টাইটার একটা সংশয়ের কথা মনে পড়ল যা একদা সে শুনেছিল, কিন্তু তখন সাথে সাথে সে তাতে প্রত্যাঙ্ক্ষিত হয়েছিল। কারা সে হিকস্ যারা সহানুভূতিশীল? সে জানতে চাইল। তারা কি উচ্চপদস্থ? অ্যাপেপির ঘনিষ্ঠ?

প্রকৃতপক্ষে, মহৎ ব্যক্তিরাই, অ্যাপেপির যুদ্ধ সভার একজন সদস্য। নাজা এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছিল কিন্তু খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করল। তবে এটুকুই টাইটার জন্যে যথেষ্ট। নাজার অতীত ইতিহাসের হিকস্‌দের সাথে তার সম্পর্কের ক্ষীণ গুজবটুকু নিশ্চয়ই সত্য এবং যদি এটা সত্য হয় তবে বাকিটাও সত্য। আরো একবার সে নাজার উচ্চাশার প্রশস্থতা ও গভীরতায় অবাক হল।

ঐ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে দেখা করা এবং কথা বলা কি সম্ভব? টাইটা সতর্কতার সাথে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, নাজা নিশ্চিত করল। আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের কাছে পৌঁছাতে পারি।

টাইটার কাছে এই সাধারণ কথার অর্থ ব্যাপক। মিশরের ঐহিত্যগত শত্রুদের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে মিশরীয় রাজ-প্রতিভূর ঘনিষ্টতা আছে। তার বিষয়ে আর কি গোপন থাকার আছে? তার লোভ-লালসা তাকে কোথায় পৌঁছিয়েছে! টাইটার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা অনুভূতির স্রোত বয়ে গেল এবং ঘাড়ের উপরস্থ রূপালি চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে গেল।

ফারাও-এর এই প্রিয় বন্ধটি যে ফারাও এর মৃত্যুর সময় পাশে ছিল সেই একমাত্র সাক্ষী কীভাবে ফারাও মারা যান। অসীম উচ্চাশা ও নিষ্ঠুর উদ্দেশ্য সম্বলিত এ প্রাণীটির হিকস্‌দের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক আছে এবং সে তীরটি ছিল হিকদের, একটা তীর যা ফারাওকে হত্যা করেছে। কত গভীর পর্যন্ত ষড়যন্ত্র চলছে?

তবে সে এসবের কিছুই তার চেহারায় প্রকাশ পেতে দিল না এবং গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়াল। এদিকে নাজা দ্রুত বলে গেল, আমি নিশ্চিত যে আমরা হিকদের সাথে শান্তি চুক্তি করতে পারব এবং অ্যাপেপি ও আমরা মিলে রাজ্য পরিচালনা কাউন্সিল গড়ে তুলব। তখন আমাদের কাউন্সিলকে ঠিক করার জন্য আপনার সাহায্য দরকার হবে। সম্ভবত আবার তখন ধাঁধার অনুশীলন করে আপনার প্রভুদের ইচ্ছাটা জানাতে হতে পারে।

নাজা পরামর্শ দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রতারণার পরিকল্পনার কথাটা ব্যক্ত করল। বুশিরিসে কী ঘটেছে সে কী সন্দেহ করেছে? টাইটার অন্তত তা মনে হল না, তবে সে তৎক্ষণাৎ চিন্তাটা বাতিল করে দিল। অভিব্যক্তিটা শক্ত করে বলল, তবে যে কোন অবস্থাতেই ধাঁধার দোহাই দিয়ে কিছু করা বা আমন-রা প্রভুর নামে ভুল কিছুর ভাবার কিন্তু বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

নাজা দ্রুত জবাব দিয়ে বলল, আমি ওরকম অসৎ কিছুর কথা বলছি না, কিন্তু ধাঁধার মাধ্যমে ইতোমধ্যে তো প্রভু আমাকে সমাধান দিয়েছেন।

টাইটা বিতৃষ্ণার একটা আওয়াজ করল। প্রথমে আমাদের ভাবতে হবে এই চুক্তি সম্ভব কিনা। অ্যাপেপি অবশ্যই বিশ্বাস করে তার সেনাবাহিনী শক্তিশালী এবং আমাদের সাথে সাক্ষাৎ দিতে অস্বীকার করতে পারে। আমরা শান্তির কথা বললেও সে যুদ্ধের কোন তিক্ত শেষের কথা ভাবতে পারে।

আমার মনে হয়না তা হবে। আমি আপনাকে অন্য পক্ষে থাকা আমাদের বন্ধুদের নাম দেবো। আপনি লুকিয়ে সাক্ষাৎ করবেন। টাইটা, হিকাও আপনাকে চেনে ও সম্মান করে এবং আমি আপনাকে একটি মাদুলি দেব যা প্রমাণ করবে যে আপনি আমার লোক। আমাদের পক্ষে আপনিই উত্তম মধ্যস্থতাকারী। তারা আপনার কথা শুনবে। টাইটা কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবল, অন্তত সে এই পরিস্থিতি থেকে প্রিন্স নেফার ও রাজকুমারীদের জন্যে কোন সুবিধা নিতে পারে কিনা। কিন্তু এই অবস্থায় সে কিছু খুঁজে পেল না। যাই ঘটুক নেফার এখন মৃত্যু বিপদে রয়েছে।

শুধুমাত্র একটা ব্যাপারে টাইটা নিশ্চিত হল যে যদি নেফারের বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত করতে পারে তাহলে মিশর থেকে চলে যাওয়া সম্ভব হবে। অন্তত যতোক্ষণ নাজা ক্ষমতায় রয়েছে। ঐ রকম ভাবার কোন সুযোগ রয়েছে? নাজা তাকে শত্রুদের সাথে চুক্তি করতে পাঠাচ্ছে। সে কি নেফারকে সাথে নিতে তা ব্যবহার করতে পারে? মুহূর্তের মধ্যেই সে বুঝল সে পারবে না। বালক ফারাও-এর সাথে তার সাক্ষাৎটা এখনও নাজার ইচ্ছাধীন। তাকে কখনোই তারা একা থাকতে অনুমতি দেবে না। এমনকি কাউন্সিলের সময়ও তার কাছাকাছি বসার অনুমতি তার নেই অথবা সাধারণ কথা বলারও। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুধুমাত্র যখন নেফারের গলা ব্যথা হয় তখনই তাকে নেফারের শয়নকক্ষে তার কাছাকাছি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তার শশ্রুষার জন্যে। কিন্তু নাজা ও আসমর দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিল। ব্যথার সময় নেফার ফিসফিস ছাড়া আর কোন শব্দ করতে পারেনি কিন্তু তার চোখ দুটো টাইটার উপর থেকে থেকে সরেনি এবং যখন আলাদা হওয়ার সময় হয় তখন সে টাইটার হাতটা ধরেছিল, তাও প্রায় দশদিন আগে।

টাইটা শুনেছে তাকে সরিয়ে নাজা নেফারের জন্যে অন্য শিক্ষক পছন্দ করেছে। ব্লু-গার্ড থেকে আসমর প্রশিক্ষক নিয়েছে যে তাকে ঘোড়ায় চড়া, রথ চালনা, তলোয়ার চালনা ও তীর ছুঁড়া শেখাবে। যদি নেফারকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং অকৃতকার্য হয়, তবে শুধু সে নাজার বিশ্বাসই হারাবে না নেফারকেও ভয়ংকর বিপদে ফেলবে।

না, এই কাজটা সে হিকদের রাজ্যে বসেও করতে পারে; শুধুমাত্র বালক ফারাও এর নিরাপত্তা নিশ্চিত ও আরো সতর্কতা অবলম্বন করে।

এটা আমার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব প্রভুরাই আমার উপর দিয়েছেন যেন আপনাকে আমি যে কোন ভাবে সাহায্য করি। আমি এই কাজ করব। টাইটা বলল। হিকস্‌দের সীমানা দিয়ে যাওয়ার নিরাপদ রাস্তা কোনটি? আপনি বলেছেন তারা আমাকে ভালো করে চেনে এবং তারা আমাকে চিনতে পারবে।

নাজা প্রশ্নটা আগেই জানত। আপনাকে রথের পুরোনো রাস্তা বালিয়াড়ির ভিতর দিয়ে এবং ওয়াদির নিচ দিয়ে গেবেল ওয়াদুনের রাস্তাটা ব্যবহার করতে হবে। অপর দিকের আমার বন্ধুরা রাস্তার সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের উপর কড়া নজর রাখছে।

টাইটা মাথা নাড়ল। ঐ পথেই ফারাও ট্যামোস তার মৃত্যুর দেখা পেয়েছেন। আমি গালালার বাইরে কখনো যাইনি। বাকি পথ দেখানোর জন্যে আমার একজন পথ প্রদর্শক দরকার।

আমি আমার নিজের বর্শা বাহক ও ব্লু-গার্ডের এক সদস্যকে আপনাকে এর মধ্য পথ দেখিয়ে নেবার জন্য পাঠাব। নাজা ওয়াদা করল। তবে রাস্তাটা দীর্ঘ ও কঠিন। আপনাকে এখনই রওয়ানা হতে হবে। প্রতিদিন, প্রতিঘণ্টা সময়ক্ষেপণ তা আরো কঠিন করে দিতে পারে।

*

ভগ্ন শহর গালালা থেকে যাত্রা শুরু করে মাত্র চারবার বিরতি নিয়ে টাইটা সবটা পথ রথ চালিয়ে এল। তারা অর্ধদিনে পথটা অতিক্রম করল যা নাজা ও ট্যামোসের চাইতে কম সময়ে এবং তাদের প্রাণীদের অবস্থাও তাদেরগুলো থেকে ভালো ছিল।

তার পিছনে নয়টি যানের সৈন্যরা ম্যাগোসের সম্মানে বিনা বাক্যে তাতে সশ্রদ্ধ অনুসরণ করে যাচ্ছে। তাকে তারা অশ্বারোহী সেনাদলের পিতা রূপে গণ্য করে। কারণ সেই প্রথম মিশরে রথ তৈরি করে এবং তার জন্য সৈন্য বাহিনী গঠন করেছিল। হিকদের বিরুদ্ধে ফারাও ট্যামোসের বিজয়ের সংবাদটা রথ চালিয়ে থেবস্ থেকে এলিফানটাইন-এ তার নিয়ে যাওয়াটা এক বীরগাঁথা কাহিনী। এখন যখন তারা তাকে বালিয়াড়ির মধ্য দিয়ে অনুসরণ করছে এবং তারা বুঝছে লোক কথাগুলো আসলেই সত্য। বৃদ্ধ লোকটির প্রাণশক্তি প্রচুর এবং তার মনোযোগ কখনো এদিক ওদিক হয় না। তার কোমল কিন্তু শক্ত হাতে লাগাম ধরাটা কখনো ক্লান্ত হয় না এমনকি যখন সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে ঘোড়াগুলো তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চালায় তখনও। সে বাহিনীর সবাইকে মুগ্ধ করেছে রেখেছে এমনকি তার পাশে চলা নাজার বর্শা বাহককে পর্যন্ত।

গিল হচ্ছে নাজার বর্শা বাহক। তার রুক্ষ, সূর্যে পোড়া চেহারা ও হালক গড়ন শরীর যা একজন রথীর দরকার, তদুপরি তার রয়েছে তারের মত শক্তি ও হাসিখুশি মন। সে বাছাই করা কমান্ডার, রথের অন্যতম একজন চালক।

দিনের গরম ও রাতের ঠাণ্ডা সব সময়েই তারা চলতে লাগল। এখন ভোরবেলা তারা বিশ্রামের জন্য থামল। যখন সে ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াচ্ছিল তখন গিল যেখানে টাইটা একটা পাথরের উপর বসে গেবেল ওয়াদুনের ওয়াদি দেখছিল সেখানে এল এবং সিরামিকের পানির একটা জগ তার দিকে এগিয়ে দিল। টাইটা বেশ খানিকটা পানি মুখে নিল এবং গালালা থেকে আনা তিতা পানি কোন রকম বিতৃষ্ণা ছাড়াই গিলে ফেলল। মধ্যরাতে তাদের শেষ বিরতির পর এটাই তার প্রথম পানি পান।

বেদুইন আক্রমণকারীদের চেয়ে একজন বৃদ্ধ যাদুকর আরও ভয়ংকর, গিল ভাবল, পূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়ে সে টাইটার থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়েছিল এবং সে কোন আদেশ দেয় কিনা তার প্রতীক্ষায় রইল।

কোথায় ফারাও ট্যামোস আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন? অবশেষে টাইটা জিজ্ঞেস করল। গিল উদিয়মান সূর্যের আলো রক্ষার্থে হাত দিয়ে চোখে ছায়া দিল এবং ওয়াদির যেখানে নদী শুকিয়ে গেছে সেদিকটা দেখাল। ঐখানে আমার লর্ড। ঐ দূর পাহাড়ের কাছে।

কাউন্সিলের নিকট ফারাও ট্যামোসের মৃত্যুর প্রমাণ দেবার পর টাইটা এই প্রথম গিলকে প্রশ্ন করল। কাউন্সিল সবাইকে ডেকে জেরা করেছিল। টাইটার মনে আছে গিলের প্রমাণ ছিল সঙ্গতি পূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য। সে কাউন্সিলের ভয়ে ছিল না কিন্তু একজন সৎ ও সাধারণ সৈন্যের মতো কথা বলেছিল। যখন তাকে তীরটা দেখানো হল তখন সে হিকদের তীরটা সনাক্ত করে যা ফারাও ট্যামোসকে হত্যা করেছিল। তীরের অগ্রভাগ দুই খন্ডে বিভক্ত ছিল। লর্ড নাজা আঘাতের ব্যথা কমানোর জন্য তীরটা ভেঙেছিল।

ওটাই ছিল তাদের প্রথম সাক্ষাত। থেবস্ ছাড়ার পর দুএকবার তারা একটু আধটু কথা বলেছে কিন্তু কখনো দীর্ঘ আলাপের সুযোগ ছিল না।

এখানে কি আর কেউ আছে যে সে দিন তোমাদের সাথে ছিল? টাইটা জিজ্ঞেস করল।

কেবল সেমোস, কিন্তু যখন আমাদের উপর হামলা হল তখন সে ওয়াদিতে রথ নিয়ে অপেক্ষা করছিল, গিল জবাব দিল।

আমি চাই তুমি আমাকে ঠিক স্থানটায় নিয়ে যাও এবং সেই সাথে আমি এও চাচ্ছি যেন তুমি আমাকে যুদ্ধের ময়দানটায় নিয়ে যাও। টাইটা তাকে বলল।

গিল কাঁধ ঝাঁকালো। ওটা যুদ্ধ ছিল না, কেবল মাত্র খন্ড যুদ্ধ। ওখানে দেখার কিছু নেই। ওটা একটা খালি জায়গা। যাই হোক, মহান ম্যাগোসের যেমন আদেশ তেমনটাই হবে।

দলটি আবার যাত্রা করল এবং ওয়াদি দিয়ে এক লাইনে নামল। একশ বছরেও এখানে বৃষ্টি হয় নি এবং এমনকি মরুর বাতাস ফারাও এর রথের চাকার দাগ মুছে দিতে পারেনি, সেগুলো গভীর চিহ্ন এঁকেছিল এবং এখনো তা বোঝা যাচ্ছে। ওয়াদির মাঝে পৌঁছে টাইটা তা অনুসরণ করতে লাগল এবং তার নিজের রথের চাকাও গভীর দাগ এঁকে দিচ্ছিল।

তারা হিকদের অতর্কিত আক্রমণের ব্যাপারে সজাগ ছিল এবং ওয়াদির দুই তীর দেখল। যদিও পাথরগুলোর বাস্পীয় তাপ এলোমেলো মরীচিৎকার ছবি তৈরি করছিল কিন্তু শত্রুর কোন চিহ্ন দেখা গেল না।

ঐ যে ওয়াচ টাওয়ার। গিল সামনে দেখাল এবং টাইটা দেখল নিখুঁত বিবর্ণ নীল আকাশের বিপরীতে একটা প্যাচানো ছায়া মূর্তি নেশাগ্রস্থের ন্যায় হেলে আছে।

নদী তটে তারা আরেকটি বাক নিল এবং এমনকি দুশ কদম দূর থেকেও টাইটা অসংখ্য চাকার চিহ্ন দেখতে পেল। যেখানে ফারাও ও দলটা থেমেছিল এবং একত্রিত হয়েছে এবং যেখানে অনেক লোক নেমেছিল ও উঠেছিল সেই সব চিহ্ন সে দেখতে পেল ওয়াদির নরম বালিতে। টাইটা তার দলকে ধীরে চলার নির্দেশ দিল এবং সামনে তারা হাঁটার গতিতে এগুতে লাগল।

এই স্থানে ফারাও নেমেছিলেন এবং আমরা লর্ড নাজার সাথে অ্যাপেপির ক্যাম্প দেখতে সামনে যাই। গিল ড্যাসবোর্ডের উপর দিয়ে দেখাল।

টাইটা রথ থামাল এবং সবাইকে তা করার নির্দেশ দিল। আমার জন্যে এখানে অপেক্ষা কর, সে পেছনে থাকা রথের সার্জেন্টকে আদেশ করল। তারপর গিলের দিকে ঘুরে বলল, আমার সাথে এসো। আমাকে লড়াইয়ের স্থানটা দেখাও।

গিল বন্ধুর পথ দিয়ে তাকে উপরে নিয়ে গেল। প্রথমে সে ধীরে চলল বৃদ্ধ লোকটির প্রতি সদয় হয়ে কিন্তু শীঘ্রই বুঝল টাইটা প্রতি পদক্ষেপে তার সমকক্ষ। ফলে সে আরো গতি বাড়াল। ঢাল বাড়ল এবং তাদের চলার পথটা আরো বেশি অসম হল। এমনকি গিলও জোরে শ্বাস নিতে লাগল। অবশেষে তারা বিশাল বড় অর্ধ পাহাড়াকৃতির পাথরটার কাছে পৌঁছল যা পথটাকে প্রায় আটকে দিয়েছে।

এই পর্যন্তই আমি এসেছিলাম। গিল ব্যাখ্যা করল।

ফারাও কোথায় পড়েছিল? টাইটা চারপাশ তাকাল, এগিয়ে হেঁটে সামনে গেল কিন্তু সম্মুখে শুধু ভোলা পাহাড়ী প্রান্তর। কোথায় হিকস্‌রা লুকিয়েছিল? কোথায় থেকে তীরটা ছোঁড়া হয়?

আমি বলতে পারব না, লর্ড। গিল মাথা নাড়াল। যখন লর্ড নাজা যখন পাহাড়ের ঐপাশে এগিয়ে গেল তখন সে আমাকে এবং অন্যদের এখানে অপেক্ষা করতে আদেশ দেয়।

ফারাও তখন কোথায় ছিলেন? তিনি কি নাজার সাথে গিয়েছিলেন?

না, প্রথমে যান নি। রাজা আমাদের সাথে অপেক্ষা করছিলেন। লর্ড নাজা উপরে কিছু শুনেছিল, দেখতে গিয়েছিল এবং আমাদের চোখের আড়ালে চলে যায়।

আমি বুঝলাম না। কোথায় তোমাদের আক্রমণ করা হয়েছিল?

আমরা এখানে অপেক্ষা করছিলাম। আমি দেখলাম ফারাও অধৈর্য হয়ে পড়লেন। পাথরের ওপাশ থেকে লর্ড নাজা কিছুক্ষণ পর শিষ বাজায়। তখন ফারাও ওঠে দাঁড়ালেন, চলো সৈন্যরা! তিনি আমাদের বললেন এবং পথ ধরে উপরে চলে যান।

তুমি কি তার কাছাকাছি ছিলে?

না, আমি সারির পিছনে ছিলাম।

পরে কি ঘটেছিল ও দেখেছিলে?

ফারাও বড় পাথরের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যান। তারপর চিৎকার শুনতে পাই এবং সেই সাথে যুদ্ধের আওয়াজ। আমি হিকস্‌দের কণ্ঠ শুনি এবং তীর ও বর্শা পাথরে গাঁথার শব্দ। আমি সামনের উদ্দেশ্যে দৌড়েছিলাম কিন্তু আমাদের লোক যারা পাথরের এপাশে বসে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাদের দ্বারা পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ি।

গিল সামনে দৌড়ে গিয়ে তাকে দেখাল কিভাবে পথ সরু হয়েছে এবং লম্বা পাথরটার সামনে থামল। এই পর্যন্তই আমি গিয়েছিলাম। তখন লর্ড নাজা চিৎকার করে বলছিল যে ফারাও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। আমার সামনে লোকেরা গাদাগাদি করেছিল এবং হঠাৎ-ই তারা আমি যেখানে দাঁড়ানো ছিলাম সেখানে রাজাকে বসিয়ে দেয়। আমি তখনই ভেবেছিলাম ফারাও মৃত।

হিকা কতো কাছাকাছি ছিল? তারা কজন ছিল? তারা কি অশ্বারোহী ছিল নাকি পদাতিক বাহিনী? তুমি তাদের চিনতে পেরেছিলে? টাইটা জানতে চাইল। হিকদের প্রতিটি দল আলাদা রকম রাজ চিহ্ন পড়ে থাকে যা মিশরীয় সৈন্যদের পরিচিত।

তারা খুব কাছে ছিল, গিল বলল। এবং তারা অনেক ছিল। কমপক্ষে এক স্কোয়াড্রেন।

কোন বাহিনী? টাইটা জোর দিল। তুমি কি তাদের পালক চিনতে পেরেছো?

প্রথম বারের মত গিলকে অনিশ্চিত দেখাল ও তার মুখ লজ্জানত হল। আমার লর্ড, আমি শত্রুদের উপর চোখ রাখিনি। তারা পাথরের পিছনে ওখানে ছিল।

তাহলে তুমি কি ভাবে তাদের শক্তি ও সংখ্যা জানলে? টাইটা ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

লর্ড নাজা চিৎকার করছিল, গিল ভেঙ্গে পড়ল ও তার চোখ নামিয়ে নিল।

নাজা ছাড়া আর কেউ কি শত্রুদের দেখেছে?

আমি জানি না, সম্মানীয় ম্যাগোস। লর্ড নাজা আমাদের আদেশ দিয়েছিল রথের কাছে ফিরে যেতে। আমরা দেখলাম ফারাও খুব জখম হয়েছেন, হয়তোবা মৃত। আমাদের মন ভেঙে গিয়েছিল।

তুমি নিশ্চয়ই এটা পরে তোমার সাথীদের সাথে আলাপ করেছ। তাদের কেউ কি বলেছে যে তারা শত্রুদের দেখেছে? কিংবা তাদের কেউ কি তীর বা বর্শা দিয়ে কোন হিকত্সকে আঘাত করেছে?

গিল সন্দেহ ভরে মাথা নাড়ল। আমার মনে নেই। না, আমার তা মনে হয় না।

রাজা ছাড়া আর কি কেউ আঘাত পেয়েছিল?

কেউ না।

কেন তুমি এসব কাউন্সিলকে বলোনি? কেন তুমি বলোনি যে তুমি শত্রুদের দেখনি? টাইটা এখন রেগে গেল।

লর্ড নাজা আমাদের বলেছে শুধুমাত্র প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং বেশি কথা বলে কাউন্সিলের সময় নষ্ট না করতে আদেশ দিয়েছেন। গিল লজ্জায় কাঁধ কুঁজো করল। আমার যতোদূর মনে হয় যুদ্ধ না করে পালিয়ে যাওয়াটা আমাদের কেউ মেনে নিতে চায় নি।

লজ্জা পেয়ো না গিল। তুমি তোমাকে করা তোমার আদেশ পালন করেছে। দয়ার্দ্র কণ্ঠে টাইটা তাকে বলল। এখন এখানে পাথরের উপর ওঠো এবং চোখ খোলা রাখ। আমরা এখন হিকদের রাজ্যে। আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। টাইটা ধীরে সামনে এগোল এবং বড় পাথরটার ওপাশে গেল যা রাস্তাকে আটকে রেখেছে। সে থামল ও সামনের মাটি ভালো করে পরীক্ষা করল। এদিক থেকে সে ওয়াচ টাওয়ারের ভাঙ্গা উপরের অংশটা দেখতে পেল। রাস্তাটা ওদিকে চলে গেছে। তারপর তা খাঁজের চূড়ার ওধারে হারিয়ে গেছে যা ভালোই খোলামেলা। হিক সৈন্যদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। মাত্র কিছু পাথরের টুকরো ও সূর্যে পোড়া কিছু কন্টক বৃক্ষ সেখানে রয়েছে শুধু। তখন তার মনে পড়ল ঘটনাটা রাতে ঘটেছে। কিন্তু কিছু একটা তার খটকা লাগাল। টাইটা ক্ষতির একটা অস্পষ্ট আভাস অনুভব করল, তার মনে হল যেন কোন শক্তিশালী শত্রু তাকে দেখছে।

এই অনুভূতি এতো জোরালো যে সে সূর্যালোর মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং চোখ বন্ধ করল। সে তার মন ও আত্মাকে খুলল, যা শুকনো স্পঞ্জ-এর মত হয়ে চার পাশের বাতাস থেকে যে কোন প্রভাব বোঝার চেষ্টা করল। প্রায় তৎক্ষণাৎ তার অনুভব আরো জোরালো হল যে এখানে কোন ভয়ংকর কিছু রয়েছে এবং শয়তানের দৃষ্টিটা সামনেই কোথা থেকে আসছে, তার থেকে বেশি দূরে নয়। সে চোখ খুলল এবং ধীর হেঁটে ওদিকে গেল। ওখানে দেখার কিছু ছিল না শুধু গরম পাথর ও কণ্টক ছাড়া কিন্তু এখনও সে গরম বাতাসে অশুভ কিছুর গন্ধ পাওয়া যচ্ছে। ক্ষীণ কিন্তু পচা-মাংস খেকো বন্য কোন প্রাণীর নিঃশ্বাসের ন্যায়।

সে থামল ও শিকারী কুকুরের মতো নাক কুঁচকালো এবং সাথে সাথে বাতাসটা ধুলোময় ও শুষ্ক লাগলো কিন্তু পরিষ্কার। যা তার কাছে প্রমাণ করে যে পলায়নপর গন্ধটি স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে কিছু। সে নারকীয়তার একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনি ধরতে পারল যা এই জায়গায় সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু যখন সে নিখুঁতভাবে তা খুঁজতে গেল তখন সব অদৃশ্য হয়ে গেল। সে এক কদম সামনে এগোল, তারপর আরেক কদম এবং আরেকবার অসহ্য দুর্গন্ধটা তার নাকে এসে ধাক্কা দিল। আরেক কদম এবং এখন গন্ধটার সাথে গভীর দুঃখের একটা অনুভূতি যোগ হল যেন সে অমূল্য কোন কিছু হারিয়ে ফেলেছে যার অভাব অন্য কিছু দিয়ে পূরণ হবার নয়। সে নিজেকে জোর করে, বলতে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাথুরে রাস্তাটায় আরেক পদক্ষেপ এগিয়ে নিল এবং মুহূর্তেই কিছু একটা তাকে জোরে আঘাত করল যা তার ফুসফুস থেকে বাতাস বের করে দিল। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল এবং হাঁটুর উপর বসে পড়ল, বুক চেপে ধরল, তার দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এটা ভীষণ যন্ত্রণার, মৃত্যু যন্ত্রণা এবং সে তার সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। যেন একটা কোবরা–যে তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। সে কোনরকমে রাস্তায় ফিরে এল এবং তখন সাথে সাথে ব্যথাটা চলে গেল।

গিল তাকে চিৎকার করতে শুনেছিল এবং সে রাস্তায় নেমে এল। সে টাইটাকে ধরে ফেলল এবং দাঁড়াতে সাহায্য করল। কী? কিসের ব্যথা? কী আপনাকে যন্ত্রণা দিল, আমার লর্ড?

টাইটা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। যাও! আমাকে ছাড়ো। তোমরা এখানে বিপদের মধ্যে আছে। এই জায়গাটা কোন মানুষের নয় বরং প্রভুদের অথবা শয়তানদের। যাও! আমার জন্যে পাহাড়ের শূন্যে গিয়ে অপেক্ষা কর।

গিল ইতস্তত করল, কিন্তু যখন সে ঐ জ্বলজ্বলে চোখগুলোর দিকে তাকাল এবং ভূত দেখার মতো কাছ থেকে সরে এল।

যাও! টাইটা বলল এবং এমন কণ্ঠে যা গিল দ্বিতীয় বার শুনতে চাইল না। দ্রুত পালাল সে।

তার চলে যাবার অনেকক্ষণ পর টাইটা তার দেহ ও মনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল। তার বিরুদ্ধ শক্তির সাথে লড়াই করতে নিজেকে প্রস্তুত করল। কোমড়ে ঝুলানো ঝুলিটায় সে হাত দিল এবং লসট্রিসের দেওয়া মাদুলিটা বের করল। সে সামনে এগুলো, যখন সে ঠিক জায়গাটায় আবার এল ব্যথাটা তাকে আরো গভীরভাবে চেপে ধরল যেন একটা তীর তার বুকে বিঁধল এবং সে চিৎকার করে পারল না। তারপর যখন সে পিছু হটল ব্যথাটা আগের মতই চলে গেল।

হাঁপাতে হাঁপাতে সে পাথুরে ভূমির দিকে তাকাল। প্রথমে এতে কোন চিহ্ন দেখা গেল না এবং অন্যান্য অমসৃণ রাস্তার সাথে এর কোন পার্থক্যও নেই। তারপরই ছোট একটা বায়বীয় ছায়া মাটির উপর দেখা গেল। দেখতে দেখতে তা পরিবর্তিত হল, ঝকঝকে গাঢ় লাল বর্ণের একটি পুকুরে পরিণত হল। ধীরে ধীরে তার হাঁটু পর্যন্ত তাতে ডুবে গেল সে। একজন রাজা ও একজন প্রভুর হৃদয়ের রক্ত, সে ফিসফিস্ করে বলল। এখানে এই স্থানটিতে ফারাও ট্যামোস মারা গিয়েছেন।

সে নিজেকে তিরস্কার করল এবং শান্ত কিন্তু শক্ত কণ্ঠে হুরাসের নিকট প্রার্থনা করল, যা এতোটা শক্তিশালী যে একমাত্র কয়জন সপ্তম মাত্রার ক্ষমতাধারী ব্যক্তির কণ্ঠই তা শুধু পারে। সপ্তমবার মন্ত্র পাঠ করতেই সে অদৃশ্য পাখার আওয়াজ শুনল যা তার চারপাশের মরু বাতাসে ঘূর্ণি তুলল। প্রভু এখানে, সে ফিসফিস্ করে বলল এবং প্রার্থনা করতে শুরু করল। সে ফারাও, তার বন্ধুর জন্য প্রার্থনা করল। তার যন্ত্রণা ও শাস্তি লাঘবের জন্য হুরাসের নিকট প্রার্থনা করল। তাকে এই ভয়ংকর স্থান হতে মুক্ত হবার অনুমতি দিন, সে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করল। তাকে এখানে আটকে রাখার অর্থ হবে তার আত্মাকে খুন করা।

প্রার্থনা করার মাঝেই সে শয়তান তাড়ানোর চিহ্ন আঁকল। তার চোখের সামনে রক্তের পুকুরটা কাঁপতে লাগল যেন শুকনো মাটি ওটাকে শুষে নিচ্ছে। যখন শেষ বিন্দু অদৃশ্য হল তখন টাইটা একটা নরম অসঙ্গত আওয়াজ শুনল। ঘুমন্ত বাচ্চার কান্নার মত এবং সেই সাথে দুঃখ ও হারানোর ভয়ংকর বোঝা যা তার উপর চেপে ছিল তা তার কাঁধ থেকে সরে গেল। তারপর যখন সে দাঁড়াল তখন মুক্তির এক অসীম আনন্দ সে উপভোগ করল। যেখানে রক্তের পুকুরটা ছিল সেদিকে সে এগিয়ে গেল। এমনকি যখন সে তার চটি পরা পা দুটো দৃঢ় ভাবে তার উপর নিয়ে দাঁড়ালো তখন কোন ব্যথা অনুভব হলো না এবং তার স্বস্তির অনুভূতিও নষ্ট হলো না।

শান্তিতে যাও, আমার বন্ধু এবং আমার রাজা, পরকালে অনন্ত জীবন পাও, সে জোরে বলল এবং অনন্ত জীবন ও সুখের চিহ্ন আঁকলো।

সে ফিরে চললো এবং যেখানে পাহাড়ের শূন্যে রথগুলো অপেক্ষা করছিল সেদিকে যখন ফিরছিল তখন রাস্তায় কোন একটা কিছু তাকে রুখে দিল। সে তার মাথা উঠালো এবং আবার বাতাসের স্বাদ নিল। এখনও শয়তানের ক্ষীণ একটা গন্ধ বাতাসে আছে, শুধুমাত্র ওটার পলায়নপর একটা চিহ্ন। চিন্তিত ভাবে সে খাঁজের কাছটায় পৌঁছল, ফারাও যেখানে মারা গিয়েছেন সে স্থান অতিক্রম করলো এবং এগিয়ে চলল। প্রতি কদমে অশুভ গন্ধটা আরো শক্তিশালী হলো যততক্ষণ না এটা তার কণ্ঠে ধরল এবং তার বমি আসতে লাগল। আরো একবার সে বুঝল এ প্রকৃতির নিয়মের বাইরের কোন কিছু। সে চলতে লাগল এবং বিশ কদমের মতো যাওয়ার পর গন্ধটা ক্ষীণ হতে শুরু করল। সে থামল এবং ফিরে এল। সাথে সাথেই গন্ধটা আবার তীব্র হল। এবার সে আগ-পিছ করল যতোক্ষণ না ওটা সর্বোচ্চ পরিমাপে তীব্র হল। সে পথের মধ্যে থামলো এবং দেখলো তা এখনও শক্তিশালী, প্রায় দম বন্ধ করার মতো। যে একটা কণ্টক বৃক্ষের প্যাচানো ডালের নিচে দাঁড়াল যা রাস্তার উপর জন্মেছিল। সে উপরে তাকাল এবং দেখল শাখাগুলোর আকৃতি অদ্ভুত, যেন কোন মানুষের হাত আলাদাভাবে তাদের আড়াআড়ি ভাজে রাখা–যা নীল আকাশের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিচে তাকাল এবং ঘোড়ার মাথাকৃতির একটি পাথর তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কিছুদিন আগে এটা সরানো হয়েছিল এবং আবার আগের অবস্থানে তা রাখা হয়েছে। টাইটা পাথরটা সরালো। এবং দেখলো এটি গাছের শিকড়ের মধ্যকার একটা গোপন গর্তকে ঢেকে রেখেছে। সে পাথরটা একপাশে সরিয়ে ভেতরে উঁকি মারল। তার ভেতরে কিছু একটা ছিল এবং সে এঁকে বেঁকে বস্তুটার কাছে পৌঁছলো যা একটা সাপ বা বিচ্ছু রাখার মত খাপ। খুব সুন্দর একটা চিত্র ও নকশা আঁকা বস্তু সে বের করে আনলো। এটা যে। একটা তীরের খাপ তা বোঝার আগ পর্যন্ত সে বস্তুটির দিকে মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে রইল। এর প্রকৃতি সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই কারণ এটার নকশা হিকসোসাইনদের মতন এবং তাতে সেথের ছবি আঁকা, যুদ্ধের কুমির দেবতা যা হিকস্ যোদ্ধা কর্তৃক ভক্তিরত। টাইটা মোচর দিয়ে তা খুলল এবং দেখল খাপটির মধ্যে যুদ্ধের ছয়টা তীর রাখা যাতে সবুজ ও লাল পালক লাগানো। সে একটা ফলা বের করে আনল এবং তা চেনা মাত্রই তার হৃদপিণ্ড হিংস্রভাবে স্পন্দিত হতে লাগল। কোন ভুল নেই। সে খুব ভালো করে ভাঙ্গা ও রক্তে ঢাকা এর একটা পরীক্ষা করেছে। যেটা নাজা কাউন্সিলের সামনে দিয়েছিল। যে তীরটা ফারাওকে মেরেছিল এটা ওটার মতই। সে এটাকে আলোর মধ্যে ধরল এবং নিখুঁতভাবে ফলার উপর সীলমোহর খুঁজল। এটা একটা সিংহের মাথা যার চোয়ালের মধ্যে ঐতিহ্যগত চিহ্ন টি ধারণ করে আছে। সে এই চিহ্ন ধবংসাত্মক তীরটির মধ্যেও দেখেছে। দুটো একই তীর। হাতের মধ্যে নিয়ে তীরটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখলো যেন শেষ তথ্যটুকু সে নিতে চাইল। নাকের সামনে সে তীরটা ধরল এবং যুঁকলো। ওখানে শুধু কাঠ, রং ও পালকের ঘ্রাণ। যে দুর্গন্ধ তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল ওটা চলে গেছে। ফারাও এর গুপ্ত ঘাতকের এই খাপটা কেন লুকানোর প্রয়োজন হল? যুদ্ধের শেষে হিকা এটা ময়দানে ফেলে যেতে পারত। তাদের অস্ত্র কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যে যথেষ্ট সময় ছিল। এটা খুব সুন্দর ও মূল্যবান বস্তু, কোন যোদ্ধাই এটি ত্যাগ করবে না যদি না সে বাধ্য হয়, টাইটা ভাবল।

আরো ঘণ্টা খানেক সে পাহাড়ের পাশে কিছু খুঁজলো এবং অতি প্রাকৃতিক আর কোন গন্ধ চিহ্নিত করতে পারল না। সে নিচে নেমে এল এবং রথগুলোকে ওয়াদির নরম বালির উপর অপেক্ষারত দেখতে পেল। সে খাপটা তার এপ্রোনের শূন্যে লুকিয়ে ফেলল।

*

রাত নামা না পর্যন্ত তারা ওয়াদির মধ্যে লুকিয়ে রইল। তারপর হালকা ভাবে চাকা চলতে শুরু করল। ঘোড়াগুলোর খুরসমূহ চামড়ার আবরণ দিয়ে ঢাকা এবং খোলা অস্ত্রের আওয়াজ সতর্কতার সাথে চেপে রাখা হল। তারা হিকদের রাজ্যের গভীর দিয়ে চলছিল। গিল তাদের পথ দেখিয়ে চলল।

বর্শা বাহক জায়গাটা ভালোই চেনে এবং যদিও টাইটা কিছু বলল না, তবুও সে অবাক হল লোকটি তার প্রভুর সাথে কতো বার এই রাস্তায় চলেছিল এই ভেবে এবং শত্রুদের সাথে সাক্ষাত করতে তারা আবার কোন জায়গা ঠিক করেছে কে জানে।

এখন তারা নীলের পাললিক ভূমিতে। দুই বার তারা রাস্তায় মোড় নিয়েছে এবং যতক্ষণ না অস্ত্রে সজ্জিত লোকেরা নিকষ আঁধারে তাদের লুকানো স্থানটা অতিক্রম করে না যায় তাদের অপেক্ষা করতে হবে। মধ্য রাতের পর তার একটা অজানা প্রভুর মন্দিরে এসে পৌঁছল। যা একটা ফাঁকা পাহাড়ে গর্ত করে তৈরি করা হয়েছে। গুহাটা পুরো সেনাবাহিনী, যান, ঘোড়া ও মানুষ রাখার মত যথেষ্ট বড়। শীঘ্রই বোঝা গেল যে এই স্থানটা একই কাজে আগেও ব্যবহার করা হয়েছে। ভাঙা বেদীর পিছনে প্রদীপ ও তেল রাখা এবং একটি কক্ষে ঘোড়ার খাবারও রাখা আছে। তারা ঘোড়ার হার্নেস খুলে তাদের খাওয়াল আর সৈন্যরা নিজেদের খাবার খেয়ে খড়ের বিছানা তৈরি করে শুয়ে পড়ল এবং শীঘ্রই নাক ডাকতে লাগল। ইতোমধ্যে গিল সৈন্যের পোশাক ছেড়ে একজন কৃষকের পোশাক পড়ে নিয়েছে। আমি কোন ঘোড়া ব্যবহার করবো না! সে টাইটাকে ব্যাখ্যা করল। এতে লোকের মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করবে। পায়ে হেঁটে আধা দিনেই আমি বুবাসতি ক্যাম্পে পৌঁছতে পারব। কাল বিকেলের আগে আমার ফেরার আশা করবেন না। বলেই সে পিছলে গুহা থেকে বের হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

সৎ গিল, যেমন তাকে মনে করেছিলাম ওরকম সে ভন্ড সৈন্য নয়, টাইটা ভাবল। সে লর্ড নাজার মিত্রদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল যা গিল তাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।

সকাল হতেই সে একজন প্রহরীকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়োগ করল যেখান থেকে বাতাস পাতালের মন্দিরে বইছে। ঠিক দুপুরের আগে চূড়া থেকে একটা নিচু সংকেত তাদের বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিল এবং টাইটা প্রহরীর সাথে চূড়ায় যোগ দিল। পূর্ব দিক থেকে একটা ভারি দল মাল বোঝাই গাধা নিয়ে সরাসরি মন্দিরের প্রবেশ মুখের দিকে এগিয়ে আসছে এবং টাইটা অনুমান করল এই দলটিই সম্ভবত গুহাটা ব্যবহার করে। এটা নিশ্চিত যে এরাই ঘোড়ার খাবার রেখে গেছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড়ের পাশে সরে যাত্রীদলের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। সে দ্রুত ইভিল পর্বতের অ্যাশেরিয়ান বই থেকে তিনটি মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে পথের মাঝে সাদা কোয়ার্টজ পাথরের একটা স্তূপ তৈরি করল। তারপর দলটি পৌঁছানোর অপেক্ষায় রইল।

প্রথম গাধাটি ৫০ কিউবিট দূরে অথবা সারি থেকে ততোখানি এগিয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে প্রাণীগুলো মন্দির ও তার ভেতরের আনন্দের কথা জানে, আর তাই চালকের কাছ থেকে চলার জন্যে তার কোন উৎসাহের প্রয়োজন ছিল না। যখনই সাদা কোয়ার্টজ পাথরের স্তূপের সামনে প্রাণীটি এল তখন ওটা এমন ভয় পেয়ে সরে গেল যে একটা বস্তা তার পিঠ থেকে পিছলে পড়ে গেল ও তার পেটের শূন্যে ঝুলতে লাগল। সে চার পায়ে লাফাতে লাগল এবং একই সাথে চেঁচাতে লাগল। মন্দিরের বেশ দূর দিয়ে ওটা দৌড় দিল। তার উত্তেজনা সারির অন্য প্রাণীগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল এবং তারাও চেঁচাতে লাগল এবং সীসার লাগামের বিরুদ্ধে মাথা বাঁকাল, চালককে লাথি মারল ও গোল হয়ে ঘুরতে লাগল যেন মৌমাছির দল তাদের আক্রমণ করেছে। এর ফলে প্রাণীদের পুনরায় ধরে একত্রিত করতে এবং শান্ত করতে ও মন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু করতে দলটির দিনের বাকি সময় লেগে গেল। এবার একজন শক্ত ও সামর্থ্য প্রধান চালক সারির সামনে চলল ও বড় লাগাম দিয়ে অস্থির গাধাটাকে নিয়ে চলল। সে পথের মাঝখানে থাকা পাথরগুলো দেখে থামল। সারিটা তার পিছনে জমা হল এবং অন্য চালকেরা সামনে এল। তারা উচ্চ কণ্ঠে ও হাত উচিয়ে তৎক্ষণাৎ একটা আলোচনা করল। টাইটা পাহাড়ের পাশে লুকিয়ে সব শুনছিল।

অবশেষে প্রধান চালক অন্যদের রেখে সামনে একা এগিয়ে এল। প্রথমদিকে তার পদক্ষেপ দৃঢ় এবং নিশ্চিত দেখাল কিন্তু শীঘ্রই তা ধীর হল এবং শান্ত হয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে দূর থেকে পাথরের নকশাটা পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর সে পাথরগুলোর উদ্দেশ্যে থুথু ছুঁড়ল এবং লাফ দিয়ে পিছনে সরে গেল। সে আশা করছিল তারা অপমানের জবাব ওটা দিবে। সবশেষে সে শয়তানের দৃষ্টির বিপরীতে চিহ্ন আঁকল এবং ঘুরে, হেলেদুলে বিজয়ী ভঙ্গিতে তার লোকদের নিকট ফিরে গেল। চিৎকার করে ও হাত নেড়ে তাদের পিছু সরালো। অন্যদের বুঝতে একটু সময় লাগল। তাড়াতাড়ি পুরো দলটি যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরতে লাগল। টাইটা পাহাড় থেকে নেমে এল ও পাথরগুলোকে ছড়িয়ে দিল। তাদের প্রভাব নষ্ট করে দিল এবং অন্য যাত্রী যাদের অপেক্ষায় সে ছিল তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিল।

গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে তারা বিশজন সশস্ত্র লোক এল, গিল তাদের পথ দেখাচ্ছিল। তারা ছড়িয়ে থাকা পাথরগুলোকে অতিক্রম করে এল এবং গুহার প্রবেশ মুখে অস্ত্রের ঝনঝনানি তুলে নামল। নেতৃত্বে থাকা লোকটা লম্বা, তার কাঁধ চওড়া ও ভারি পশমী ক্রু এবং মাংসল বাঁকানো নাকের অধিকারী সে। ভারি কালো গোঁফটা তার বুক পর্যন্ত ঠেকেছে এবং নানান রঙের সুতা দিয়ে তা সাজানো।

আপনিই সে ওয়ারলক, কি বলেন? অতিরিক্ত জোর দিয়ে সে বলল। টাইটা ভেবে দেখল সে যে তাদের একজনের মতোই হিকদের ভাষা বলতে পারে তা তাদের বুঝতে দেয়া ঠিক হবে না। তাই ভদ্রভাবে মিশরীয় ভাষায় উত্তর দিল এমন ভাবে এবং না দাবি করল না অস্বীকার করল তার যাদুর ক্ষমতাকে। আমার নাম টাইটা, মহান প্রভু হুরাসের একজন দাস। আপনার উপর তার আশীর্বাদ আসুক তা আমি প্রার্থনা করি। আমি দেখছি যে আপনি কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি কিন্তু আমি আপনার নাম জানিনা।

আমার নাম টর্ক, সিংহ গোত্রের প্রধান এবং রাজা অ্যাপেপির উত্তরের আর্মির কমান্ডার। আমাকে দেবার জন্যে আপনার কাছে কি কোন চিরকুট আছে, ওয়ারলক?

টাইটা তার ডান হাত খুলল এবং নীল কাঁচে ঘেরা চীনামাটির ভাঙা এক টুকরো দেখাল যা প্রভু সেথের প্রতিজ্ঞা স্বরূপ দেয়া, ছোট মূর্তির উপরের অংশ। টর্ক সংক্ষেপে ওটা পরীক্ষা করল। তারপর তার তরবারির বেল্টে ঝোলানো ঝুলি থেকে চীনামাটির আরেক অংশ বের করল এবং দুটি অংশ একত্রিত করে একসাথে লাগাল। ভাঙ্গা অংশদ্বয় পুরোপুরি মিলে গেল এবং সে একটা সম্ভষ্টির আওয়াজ করল। আমার সাথে আসুন, ওয়ারলক।

টাইটাকে পাশে নিয়ে টর্ক নেমে আসা রাতে বেরিয়ে এল। তারা নীরবে পর্বতে উঠে তারার আলোতে মুখোমুখি দাঁড়াল। টর্ক তরবারির খাপটা নিজের দুই হাঁটুর মাঝে রেখে হাতটা তার ভারি তরবারির গোড়ায় ধরে রাখল।

অবিশ্বাসের বেশি স্বভাব থেকে টাইটা ভাবল কিন্তু তবুও এ যুদ্ধে সে একজন প্রধান মধ্যস্থকারী।

আপনি আমার জন্যে দক্ষিণের খবর এনেছেন। টর্ক বলল বিবৃতি করার সুরে কোন প্রশ্ন নয়।

আমার লর্ড, আপনি নিশ্চয় ফারাও ট্যামোসের মৃত্যুর খবর শুনেছেন?

আমরা যখন আবনাব শহর দখলে নেই তখন তার মৃত্যুর খবর শুনি। টর্ক মিশরীয় ফারাও-এর ক্ষমতা স্বীকার না করার প্রতি সতর্ক। হিকদের কাছে একমাত্র শাসক হচ্ছে রাজা অ্যাপেপি। আমরা এও শুনেছি যে একজন বালক উচ্চ মিশরের সিংহাসনের দাবিদার।

ফারাও নেফার সেটির বয়স মাত্র ১৪ বছর। টাইটা নিশ্চিত করল। তার মতো সেও সতর্ক থাকল তার সম্বন্ধে বলার সময় ফারাও-এর পদবির প্রতি জোর দিতে।

কয়েক বছরের জন্য সে তার দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। ততোদিন পর্যন্ত লর্ড নাজা তার রাজ-প্রতিভূর দায়িত্ব পালন করবে।

হঠাৎ গভীর মনোযোগ নিয়ে টর্ক সামনে ঝুকল। হিকস্‌দের গুপ্তচর বৃত্তি প্রকৃতই দুর্বল যদি তারা কমপক্ষে উচ্চরাজ্যের বিষয়াদি সম্পর্কে না জানে। তখন তার মনে পড়ল সেই ক্যাম্পেইনটার কথা যেখানে সে ও ফারাও ট্যামোস হিকদের থেস্ এ থাকা স্পাই ও তথ্যদাতাদের বিরুদ্ধে একটা অভিযান চালায় এবং তা ছিল ঠিক রাজার মৃত্যুর পূর্বে। তারা গর্ত থেকে তাদের টেনে বের করেছিল এবং পঞ্চাশ জনের বেশিকে গ্রেফতার করেছিল। শাস্তি দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। টাইটা খুব তৃপ্ত হয়েছিল এই কাজে যে অন্তত শত্রুদের নিকট তথ্য প্রবাহটা তারা বন্ধ করতে পেরেছিল।

তাহলে দক্ষিণের রাজ-প্রতিভূর পক্ষ থেকে আপনি আমাদের কাছে এসেছেন। টাইটা টর্কের মাঝে বিজয়ের একটা অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করল যখন সে আবার জানতে চাইল, নাজার কাছ থেকে কি সংবাদ আপনি এনেছেন?

লর্ড নাজা চান আমি তার প্রস্তাব যেন সরাসরি অ্যাপেপির কাছে নিয়ে যাই, টাইটা জবাবটা এড়িয়ে গেল। প্রয়োজনের বেশি তথ্য সে টর্ককে দিতে চায় না।

টর্ক তৎক্ষণাৎ একটা ভদ্র রাগ প্রকাশ করল। নাজা আমার ভাই (কাজিন), সে শীতল কণ্ঠে বলল। যে সংবাদ সে পাঠিয়েছে তা শুনতে তার আপত্তি থাকার কথা নয়। নিজের আবেগের উপর টাইটার এতোটাই নিয়ন্ত্রণ ছিল যে সে বিস্ময় প্রকাশটা সংযত রাখতে সামর্থ হল। যদিও তা টর্কের দিক থেকে একটা প্রধান অংশ। রাজ-প্রতিভূর ব্যাপারে তার সন্দেহ অবশেষে সত্যি হল। যখন সে উত্তর দিল তার কণ্ঠ নিয়ন্ত্রিত ছিল, হ্যাঁ, আমার লর্ড, এটুকু আমি জানি। যাইহোক, এ মুহূর্তে অ্যাপেপির জন্যে আমি যা নিয়ে এসেছি তা…।

আপনি আমাকে অপমান করছেন, ওয়ারলক। আমার আপনার রাজ-প্রতিভূর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আছে। উত্তেজনায় টর্কের কণ্ঠ রুক্ষ হয়ে গেল। আমি ভালো করেই জানি আপনি অ্যাপেপিকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ও একটা দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চুক্তি করতে এসেছেন।

আমি এর বেশি কিছুই আপনাকে বলতে পারব না, আমার লর্ড। টর্ক নিশ্চই একজন যোদ্ধা কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রকারী নয়, টাইটা ভাবল। কিন্তু আবার সে যখন বলল তখন তার কণ্ঠ ও বলার ধরনে পরিবর্তন হল না, আমি আমার বার্তাটা শুধু রাখাল সর্দার অ্যাপেপিকেই দিতে পারব। এভাবেই হিকস্ শাসক উচ্চ রাজ্যে পরিচিত। আপনি কি আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবেন?

যেমনটা আপনার ইচ্ছে, ওয়ারলক। মুখ বন্ধ রাখুন যদি পারেন, যদিও এটার কোন দরকার নেই। টক রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। রাজা অ্যাপেপি বুবাসতিতে আছেন। আমরা শীঘ্রই সেখানে যাব।

নীরবে তারা পাতাল মন্দিরে ফিরল। টাইটা গিল ও বডি গার্ডদের সার্জেন্টকে ডাকল। তোমরা তোমাদের কাজ ঠিকমতই করেছ। সে তাদের বলল। আর এখন তোমরা গোপনে থেব ফিরে যাবে যেমন করে গোপনে এসেছ।

আপনি আমাদের সাথে ফিরবেন না? গিল চিন্তিত ভাবে প্রশ্ন করল। সে প্রকৃতই বৃদ্ধ লোকটির প্রতি দায়িত্ব বোধ করল।

না। টাইটা মাথা নাড়ল। আমি এখানে থাকব। যখন তোমরা রাজ-প্রতিভূকে রিপোর্ট করবে তখন তাকে বলবে আমি অ্যাপেপির সাথে দেখা করতে চলেছি।

তেলের বাতির মৃদু আলোতে ঘোড়াগুলোকে রথের সাথে বাঁধা হল এবং অল্প সময়ের মধ্যে তারা রওনার জন্যে প্রস্তুত হল। গিল টাইটার স্যাডেল ব্যাগ রথ থেকে এনে তাকে দিল। তারপর সে সম্মান জানিয়ে তাকে কুর্নিশ করল,

আপনার সাথে ভ্রমণ করা অনেক সম্মানের, আমার লর্ড। যখন আমি বাচ্চা ছিলাম তখন আমার পিতা আপনার অভিযানের অনেক গল্প আমাকে শুনিয়েছেন।

সে আপনার রেজিমেন্টের অ্যাসিউট-এ ছিল। তিনি বাম প্রান্তের ক্যাপ্টেন ছিল।

তার নাম কি? টাইটা প্রশ্ন করল।

লাসরো, আমার লর্ড।

হ্যাঁ, টাইটা মাথা নাড়ল। আমার তাকে ভালোভাবেই মনে আছে। যুদ্ধে সে তার বা চোখ হারিয়েছিল।

গিল বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায় তার দিকে তাকিয়ে রইল। তা প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা এবং এখনও আপনার তা মনে আছে!

সাঁইত্রিশ, টাইটা তাকে সংশোধন করে দিল। ভালোভাবে যাও, যুবক গিল। আমি গতরাতে তোমার ভাগ্যচক্র দেখছিলাম। তুমি দীর্ঘ জীবন পাবে ও অনেক সম্মান অর্জন করবে।

বর্শা বাহক লাগাম উঠাল ও রাতের যাত্রা শুরু করল। গর্ব ও অহংকারে ভাষাহীন সে। এরই মধ্যে লর্ড টর্কের বাহিনীও ঘোড়ায় চড়ে বসেছে এবং রওয়ানা দিতে প্রস্তুত। যে ঘোড়াটায় গিল মন্দিরে ফিরেছে সে সেটা টাইটাকে দিয়েছে। টাইটা স্যাডেল ব্যাগ ঘোড়ার পিঠে ফেলল এবং ওটার পিছনে সে লাফ দিয়ে উঠল। হিকস্‌দের মিশরীয়দের ন্যায় দুদিকে পা ঝুলিয়ে বসতে দ্বিধা নেই এবং তারা গুহার প্রবেশ দ্বার দিয়ে বেড়িয়ে এল ও পশ্চিমে মোড় নিল, রথের সারি যে দিকটায় গেছে, তার উল্টো দিকে।

ভারি অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর মাঝ দিয়ে টাইটা চলছিল। টর্ক পথ দেখাচ্ছে এবং টাইটাকে তার পাশে চলার জন্যে সে কোন আমন্ত্রণ জানাল না। সে তাকে এড়িয়ে চলছে যেহেতু টাইটা তাকে নাজার সংবাদ দিতে সরাসরি মানা করেছে। টাইটা অবহেলিত হয়ে খুশিই হল কারণ এতে সে চিন্তা ভাবনার সময় পেল। সত্যিই নাজার দ্বৈত রক্ত খুব চমৎকার একটা সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।

পুরো রাত জুড়ে তারা পশ্চিমে নদীর দিকে চলল এবং প্রধান শত্রুর মূল ঘাঁটি রয়েছে বুবাসতিতে। যদিও এটা রাত তবুও রাস্তায় বার বার বিভিন্ন যানের সাথে তাদের দেখা হল। এগুলো ওয়াগন ও ঘোড়ার গাড়ি যা মিলিটারি অস্ত্রে ভরা, তারা যেদিকে চলছে ওগুলোও সেদিকেই যাচ্ছে। একই সংখ্যক যান আবার অ্যাভারিস ও মেমফিসের দিকে চলছে যারা অস্ত্র নামিয়ে দিয়ে এসেছে।

যখন তারা নদীর কাছাকাছি এল, টাইটা দূর থেকে বুবাসতির চারপাশে হিকদের ক্যাম্পের আগুন দেখতে পেল। মনে হচ্ছিল মিটমিট করে জ্বলা আলোর ভূমি ওটা যা নদী তীরের দুদিকে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। মানুষ ও প্রাণীর একটা বৃহৎ উপনগরী, যা অন্ধকারে দেখা গেল না।

একটা আর্মি ক্যাম্পের গন্ধের মতো আর কিছু পৃথিবীতে নেই। যখন তারা এগিয়ে গেল তা আরো জোরালো হল ও তাদের চেপে ধরল। অনেক গন্ধের মিশ্রণ, সৈন্য দলের গন্ধ, সার ও গোবরের, আগুনের ধোয়ার, চামড়া ও শুকনো খড়কুটার গন্ধ। তবে সবচাইতে বেশি ছিল অপরিচ্ছন্ন মানুষ ও তাদের কাচাঁ ঘা, খাবার, রান্নার ও মদের, পুঁতে না রাখা আবর্জনা ও ময়লা, মল ও গোবরের স্তূপ এবং তার চাইতেও বেশি ছিল না পুঁতে রাখা মৃতদেহের দূর্গন্ধ।

এই ভয়ংকর সব দুর্গন্ধ ছাড়িয়েও টাইটা আরো একটা অসুস্থ দূষণ বের করল। সে এটা চিনতে পারল এবং তখনি তা বুঝল যখন একজন অসুস্থ লোক তার ঘোড়ার সামনে মাতালের মত দুলতে লাগল, যা তাকে বাধ্য করল দ্রুত লাগাম টানতে। সে লোকটির চেহারায় বিবর্ণ লাল রঙের দাগ দেখতে পেল এবং নিশ্চিত হলো। এখন সে জানে কেন অদ্যাবধি অ্যাপেপি আবনাব জয় করে সামনে যেতে পারে নি, কেন সে এখনো তার রথ দক্ষিণে থেবসের দিকে পাঠায় নি যেখানে মিশরের সৈন্য অগোছালো হয়ে আছে এবং তার দয়ায় টিকে আছে। টাইটা তার ঘোড়াকে পাশে সরিয়ে টর্কের কাছাকাছি নিয়ে এল এবং শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করল, আমার লর্ড, কখন আপনার সৈন্যদের প্রথম প্লেগ আক্রমণ করে।

টর্ক এতো জোরে লাগাম টানল যেন সে ভূত দেখার মত ভয় পেল। আপনাকে এ সব কে বলল, ওয়ারলক? সে জানতে চাইল। এটা কি আপনার যাদুর একটা অভিশাপ? আপনিই কি আমাদের উপর এই মারাত্মক ব্যাধি প্রয়োগ করেছেন? অস্বীকার করার সুযোগ না দিয়ে সে রাগে ঘোড়াকে লাথি মেরে চলে গেল। টাইটা দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করল, কিন্তু তার চোখ ব্যস্ত রইল চারপাশে কি ঘটছে তার প্রতিটি অবস্থা বোঝার জন্যে।

এরই মধ্যে আলো বাড়তে লাগল এবং দুর্বল ও কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্যকে ঘন কুয়াশা ও বনের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে উঁকি দিতে দেখা গেল যা সবকিছু আচ্ছন্ন করে সকালের আকাশকে ঢেকে রেখেছে। এতে একটা ভূতুড়ে অলৌকিক পরিবেশের সৃষ্টি হল যেন কোন পাতাল জগতের দৃশ্য এটা। মানুষ ও প্রাণীগুলো এর প্রভাবে অন্ধকারে পরিবর্তিত হয়ে গেল। যেন কোন নরক। শয়তানের দেহ এবং তাদের ঘোড়াগুলোর খুড়ের শূন্যে সাম্প্রতিক বন্যার কাদা কালো ও আঠালো মাটি এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে।

প্রথমে তারা শব যানগুলো অতিক্রম করে এল এবং টাইটার চারপাশের লোকগুলো নিজেদের আলখেল্লা দিয়ে তাদের তাদের মুখ ও নাক অশুভ দুর্গন্ধ থেকে বাঁচাতে ঢাকল। যা নগ্ন, অর্ধশুকনো মৃতদেহগুলো থেকে আসছিল, যা গাড়ির পিছনে উঁচু করে স্তূপ করা। দুর্গন্ধ থেকে তাড়াতাড়ি বাঁচার জন্য টর্ক পা দেপে ঘোড়াকে তাড়া দিল। কিন্তু সামনে এমন আরো অনেকগুলো লাশ ভর্তি যান ছিল যা তাদের রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দিল।

তারা আরো পোড়ানোর জায়গা অতিক্রম করে এল যেখানে গাড়িগুলো থেকে ভয়াবহ বোঝাগুলো সব নামানো হচ্ছিল। লাকড়ি এই এলাকায় পাওয়া দুর্লভ এবং আগুনের শিখা শবদেহগুলোকে পোড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তারা পপত্ শব্দ করছিল ও শিখাগুলো ঝিরঝির করে কাঁপছিল। আর ক্ষয় হওয়া মাংস থেকে চর্বি ফোঁটায় ফোঁটায় বের হয়ে তৈলাক্ত কালো ধোয়ার সৃষ্টি করল, যা সেখানে থাকা জীবন্ত মানুষদের মুখ ও গলা ঢেকে দিল।

কত জন প্লেগে মারা গেছে? টাইটা অবাক হল। এবং কত জন আবার আমাদের সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে?

প্লেগ ভয়ানক অপচ্ছায়ার মতো যে কোন আর্মি দলে হানা দিতে পারে। অ্যাপেপি এখানে বুবাসতিতে অনেক বছর ধরে ক্যাম্প করে আছে যা ইঁদুর, শকুন ও শবখাদক আর বড় বড় সারসে ভর্তি। তার লোকেরা নিজেদের বর্জ্যের মধ্যে একত্রিত হয়ে বাস করছে। তাদের দেহে মাছি ও উকুন হাঁটছে, পচা খাবার খাচ্ছে ও সেচের খালের পানি পান করছে যেখান দিয়ে ময়লা আবর্জনা ও গোবরের স্তূপ বয়ে চলে। এই রকম পরিবেশেই প্লেগ দ্রুত ছড়ায়।

বুবাসতির কাছাকাছি ক্যাম্পে লোকজনের সংখ্যা আরে বেশি। দুর্গ নগরীর দেওয়াল ঘেঁষে তাঁবু, কুঁড়ে ও জীর্ণ কুটিসমূহ দাঁড়িয়ে এমনকি গর্তগুলো পর্যন্ত ঘিরে লোকজন বাস করছে। প্লেগ রোগীদের মধ্যে যারা একটু বেশি ভাগ্যবান তারা ছিন্ন পামের ডালের নিচে শুয়ে সকালের গরম সূর্য থেকে বাঁচার কোন রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যরা পায়ে দলা কর্দম ভূমিতে শুয়ে আছে। ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় কাতর। মৃত ও মৃত প্রায় সব এক সাথে মিশে গেছে। যারা যুদ্ধে আহত ও যাদের কলেরা–হয়েছে তারাও একসাথে রয়েছে।

যদিও তার স্বভাব ছিল চিকিৎসা করার তবুও টাইটা তাদের কোন সাহায্য করল না। তারা নিজের দ্বারাই দোষী। তাই একজন কিভাবে এতোগুলো লোককে সাহায্য করবে? তার চাইতে বড় কথা, তারা এই মিশরের শত্রু এবং এটা পরিষ্কার যে এই মহামারী প্রভুর পক্ষ থেকে একটা অভিশাপ। তাছাড়া একজন হিকস্‌কে চিকিৎসা করার অর্থ হল থেবসে বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য আরো একজনকে প্রস্তুত করা এবং যারা তার প্রিয় শহরে আগুন দিবে ও লুটপাট করবে।

তারা সুরক্ষিত দুর্গে প্রবেশ করল এবং দেখল এর ভেতরের অবস্থাও তেমন ভালো না। প্লেগ রোগীরা সেখানে পড়ে আছে, রোগে তারা মারা গেছে এবং ইঁদুর ও বেওয়ারিশ কুকুরগুলো সে মৃতদেহ খাচ্ছে এবং এমনকি যারা এখনও জীবিত আছে তাদেরও আত্মরক্ষার শক্তি নেই।

অ্যাপেপির প্রধান কার্যালয় হল বুবাসতির প্রধান ভবন। একটা ভারি কাদার ইটের এবং শুকনো খড়ের প্রসাদ যা শহরের মধ্যখানে অবস্থিত। সহিস তাদের ঘোড়াগুলো প্রধান ফটকে নিয়ে গেল কিন্তু লর্ড টর্ক টাইটাকে উঠান দিয়ে অন্ধকার হলরুমে নিয়ে গেল যেখানে ধূপ ও চন্দন কাঠ একটা ব্রোঞ্জের পাত্রে প্লেগের দুর্গন্ধ লুকানোর জন্য পুড়ানো হচ্ছে যা শহর ও চারপাশের ক্যাম্পবাসীদের কাছ থেকে আসছিল। কিন্তু আগুনের কাঁপা কাঁপা শিখা গরম বাতাসকে অসহনীয় করে তুলেছে। এমনকি এখানেও এই প্রধান কার্যালয়ে প্লেগ রোগীর গোঙানির আওয়াজ রহস্যজনকভাবে বাজছে এবং অন্ধকার কোনে জড়াজড়ি করে তা পড়ে আছে। ভবনের গভীর গোপন স্থানের শক্ত ব্রোঞ্জের দরজার সামনে সেন্ট্রিরা তাদের থামিয়ে দিল। কিন্তু যখনই তারা টর্কের বিশাল দেহ চিনতে পারল তারা একপাশে সরে দাঁড়াল এবং তাদের যেতে দিল। এটা অ্যাপেপির ব্যক্তিগত এলাকা। দেয়ালে চমৎকার সব কার্পেট ঝুলানো এবং আসবাবপত্র দামী কাঠ, আইভরি ও মুক্তার তৈরি যার বেশির ভাগ মিশরের প্রসাদ ও মন্দির থেকে লুট করে আনা।

টর্ক টাইটাকে একটা ছোট কিন্তু বিলাস বহুল উপকক্ষে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল এবং তাকে সেখানে রেখে গেল। দাসীরা তাকে একজগ শরবত ও পাকা খেজুর ও ডালিম দিয়ে গেল। সে একচুমুক পানীয় খেল কিন্তু ফল খেল অল্প। সে সর্বদা মিতহারী।

তাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। সময়ের বহতা দেখিয়ে সূর্যরশ্মি একটা উঁচু ও একমাত্র জানালা দিয়ে প্রসন্নভাবে একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে এল। একটা কার্পেটের উপর শুয়ে সে তার স্যাডল ব্যাগটা বালিশের মত ব্যবহার করল, ঝিমালো কিন্তু কখনই গভীর ঘুমাচ্ছন্ন হল না এবং প্রতিটি শব্দে জেগে উঠছিল। এরই মাঝে সে শুনল দূরে মহিলারা কাঁদছে এবং ভারি দেয়ালের ওপাশে কোথাও শোকার্তনাদ বাজছিল।

অবশেষে বাইরে ভারি পায়ের আওয়াজ হল এবং দরজার পর্দা সরে গেল। একটা বিশালকায় দেহ দরজায় এসে দাঁড়ালো। সে শুধু একটা লাল স্কাট পড়ে আছে যা তার বৃহৎ পেটের নিচে স্বর্ণের চেইন দ্বারা আটকানো। তার বুক ধূসর তারের মত কোকড়ানো পশমে ঢাকা, ভালুকের চামড়ার ন্যায় ভারি। পায়ে ভারি স্যান্ডেল পরা ও হাঁটুর শূন্যে শক্ত পালিশ চামড়ার বর্ম পরা। কিন্তু সে কোন তলোয়ার বা অন্য কোন অস্ত্র বহন করছিল না। তার বাহু ও পা-গুলো মন্দিরের পিলারের ন্যায় ভারি এবং যুদ্ধে আহত দাগে ঢাকা যা অনেক আগে শুকিয়ে সাদা ও সিঙ্কি হয়ে আছে। অন্যগুলো আবার কিছুদিন আগের যা লাল ও হা করে আছে। তার দাড়ি ও ঘর্মাক্ত চুলগুলোও ধূসর বর্ণের কিন্তু কোন গতানুগতিক নিয়মে ফিতা বাধা নেই। ওগুলো তেল দেয়া বা আচড়ানো না, এলোমেলো। তার কালো চোখগুলো বন্য ও বিহ্বল এবং বৃহৎ বাকা নাকের নিচে ভারি ঠোঁট দুটো যেন ব্যথায় মুচড়ে আছে।

আপনি টাইটা, চিকিৎসক, সে বলল।

তার কণ্ঠ শক্তিশালী কিন্তু কোন হিকস্ উচ্চারণ নেই কারণ তার জন্ম অ্যাভারিসে এবং সে মিশরীয় সংস্কৃতি ও জীবনধারা অনেকটাই আয়ত্ত করে ফেলেছে।

টাইটা তাকে ভালো করেই জানে তার কাছে অ্যাপেপি হল দখলবাজ, বর্বর এবং তার দেশ ও তার ফারাও এর চিরন্তন শক্র। নিজের অভিব্যক্তি নিরপেক্ষ রাখতে সে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তিটা পুরো ব্যায় করল এবং যখন উত্তর দিল কণ্ঠটা শান্ত রাখল, আমি টাইটা।

আমি আপনার দক্ষতা সম্পর্কে শুনেছি। অ্যাপেপিও বলল, আমাদের এখন তা দরকার। আমার সাথে আসুন।

টাইটা তার স্যাডেল ব্যাগগুলোকে কাঁধে নিল ও তাকে অনুসরণ করে উদ্যান দিয়ে বেরিয়ে এল। লর্ড টর্ক সেখানে একদল অন্ত্রধারী রক্ষা বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তারা টাইটার চতুর্দিকে অবস্থান নিল যখন সে হিক রাজাকে প্রাসাদে অভ্যন্তরে অনুসরণ করে চলল। সামনে কান্নার আওয়াজ জোরালো হল যতোক্ষণ না অ্যাপেপি ভারি পর্দা সরালো যা অন্য একটি দরজাকে ঢেকে ছিল এবং টাইটাকে একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকানো হল।

জনবহুল কক্ষটির অ্যাভারিসের আইসিস মন্দিরের যাজকদের বৃহত্তম অংশে পূর্ণ। টাইটার ঠোঁট কুঁচকে গেল যখন সে তাদের মাথার পালক দ্বারা তাদের চিনতে পারল। তারা এক কোণায় কাঁসার পাত্রকে ঘিরে মন্ত্র পড়ছে ও বাদ্য বাজাচ্ছে। যার মধ্যে লোহার আংটা পুড়ে লাল হয়ে জ্বলছিল। এইসব হাতুড়ে বিদ্যার সাথে টাইটার পেশাগত দ্বন্দ দুই পুরুষ পুরোনো।

চিকিৎসক ছাড়াও আরো বিশ জন লোক মেঝের মাঝখানে রাখা অসুস্থ রোগীর বিছানা ঘিরে আছে। সভাসদ ও আর্মি অফিসাররা, অনুলেখক ও অন্যান্য কর্মচারীরা, সবাইকে শান্ত ও দুঃখী দেখাল। বেশির ভাগ মহিলারা হাঁটুগেড়ে মেঝেতে বসে আছে, আর্তনাদ ও শোক করছে। শুধুমাত্র একজন বিছানায় শোয়া বালিকাটির সেবা করে যাচ্ছে। রোগী থেকে তার বয়স বেশি নয়, সম্ভবত তের কি চৌদ্দ বছর বয়স এবং সে কপারের পাত্র থেকে গরম ও সুগন্ধি পানি দিয়ে রোগীর শরীর মুছে দিচ্ছে। একনজরেই আকর্ষণীয় বালিকাটির দৃঢ়, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা টাইটার নজর কাড়ল। রোগীর জন্য তার দুচিন্তাটা স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে, তার অভিব্যক্তি স্নেহার্দ্র এবং তার হাত দ্রুত ও দক্ষ।

টাইটা তার ধ্যান বালকটির দিকে দিল। তার নগ্ন দেহ সুঠাম কিন্তু রোগে নষ্ট হয়ে গেছে। তার চামড়ায় প্লেগের দাগ স্পষ্ট এবং তাতে ঘাম শিশিরের ন্যায় জমে আছে। তার বুকে কাঁচা ক্ষত যেখান থেকেও রক্ত ঝরছে এবং তাতে আইসিসের যাজকরা ছ্যাকা দিয়েছে। টাইটা দেখল বালকটি রোগের শেষ অবস্থায় আছে। তার পুরু কালো চুল ঘামে ভেজা, তার চোখের উপর আলুচা রঙের ক্ষতে ভরা, যা খোলা ও উজ্জ্বল কিন্তু কিছু দেখছে না।

ও খিয়ান, আমার ছোট ছেলে, অ্যাপিপি বলল। সে বিছানার পাশে গেল ও অসহায়ভাবে বাচ্চাটির দিকে চেয়ে রইল। প্লেগ তাকে নিয়ে যাবে যদি না আপনি তাকে রক্ষা করেন, ম্যাগোস।

খিয়ান কুঁকিয়ে উঠল এবং পাশ ফিরল, বুকে ক্ষতের ব্যথায় হাঁটুগুলো সে গুটিয়ে নিল। ফত ফত শব্দ করে তার দুই নিতম্বের মধ্য দিয়ে মল ও তাজা রক্ত বেরিয়ে মাটির বিছানার লিনেনটার উপর বেয়ে পড়ল।

যে মেয়েটি তার সেবা করছিল সে সাথে সাথে তার পিছন দিক একটা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে দিল এবং কোন সংকোচ ছাড়াই চাদরের উপরের ময়লা পরিষ্কার করল। কোণায় চিকিৎসকরা আবার নতুন করে মন্ত্র পড়া শুরু করল এবং প্রধান যাজক এক জোড়া গরম হুক ব্রোঞ্জের কাঠ-কয়লা থেকে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগুতে লাগল।

টাইটা সামনে এগোল, তার লম্বা লাঠি দিয়ে লোকটির পথ রোধ করে দাঁড়াল, যথেষ্ট হয়েছে! তুমি ও তোমার কসাইরা ইতোমধ্যে যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলেছ।

আমাকে অবশ্যই তার দেহের জ্বরকে পোড়াতে হবে। লোকটি প্রতিবাদ করল।

বের হও, টাইটা গম্ভীর স্বরে বলল। তারপর কক্ষে অন্য যারা ভীড় করেছিল সবার উদ্দেশ্যে বলল, সবাই বের হয়ে যান।

আমি তোমাকে ভালো করেই জানি, টাইটা। তুমি একজন ঈশ্বর নিন্দুক এবং একজন দৈত্য ও শয়তানের আত্মার অধিকারী। যাজক তার জায়গায় দাঁড়াল এবং ভয়ংকরভাবে তার জ্বলন্ত ব্রোঞ্জের যন্ত্রটি ভাঁজ করে রাখল। আমি তোমার যাদুকে ভয় পাই না। এখানে তোমার কোন জোর নেই। প্রিন্স আমার দায়িত্বে।

টাইটা পিছু সরল এবং তার লাঠিটা যাজকের পায়ের কাছে ফেলতেই সে কেঁপে উঠল ও লাফ দিয়ে পিছু হঠল। নিচে পড়ে লাঠিটি মোচড়ালো ও হিসহিস করতে লাগল এবং টাইলসের উপর দিয়ে সাপের মতো তার দিকে এগুতে লাগল। হঠাৎ করে ওটা মাথা উঁচু করল, ওটার খন্ডিত জিহ্বা কুঁচকানো ঠোঁটের মধ্য দিয়ে জোরে বেরিয়ে এল এবং তার গোল গোল কালো চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল। তৎক্ষণা দরজার কাছে থাকা লোকগুলো চিৎকার দিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সভাসদ ও যাজকেরা, সৈন্যরা ও চাকর বাকররা, ভাঁড়েরা ও আরো যারা ছিল সবাই কে কার আগে যাবে হুড়োহুড়ি করতে লাগল। পালাতে ইতস্তত করে প্রধান যাজক লোহার হুকটিকে নাচালো, তারপর চিৎকার দিল কারণ সে খালি পায়ে ছড়ানো কয়লার উপর নাচছিল।

সেকেন্ডের মধ্যে কক্ষটি খালি হয়ে গেল। শুধু অ্যাপেপি রইল যে নড়েনি এবং মেয়েটিও যে অসুস্থ বিছানার পাশে ছিল। টাইটা নিচু হল এবং লেজে ধরে পরিবর্তন হওয়া সাপটিকে নিল। সাথে সাথেই ওটা তার হাতের মুঠিতে সোজা, শক্ত ও কাঠ হয়ে গেল। সে তার আগের অবস্থায় আসা লাঠি দিয়ে বিছানার পাশের মেয়েটিকে নির্দেশ করল। তুমি কে? সে জানতে চাইল।

আমি মিনটাকা। ও আমার ভাই। রক্ষণাত্মকভাবে সে তার হাতটা বালকটির ঘামে ভেজা কোঁকড়ানো চুলের উপর রাখল এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার চিবুক তুলে ধরল। তুমি তোমার সবচাইতে ভয়ংকর শক্তি যদিও প্রয়োগ কর ম্যাগোস তবুও আমি তাকে ছেড়ে যাব না। তার ঠোঁট কাপল ও কালো চোখ দুটি বড় হল। তার সামনে থাকা সর্প লাঠি যা টাইটা তার দিকে নির্দেশ করে আছে তা দেখে স্পষ্টত: সে ভীত হয়ে আছে। আমি তোমাকে ভয় পাই না, সে তাকে বলল।

বেশ, টাইটা দ্রুত বলল। তাহলে তোমাকেই আমার বেশি কাজে লাগবে। কখন ছেলেটি শেষ বার পান করেছে?

মনে করতে তার সময় লাগল। আজ সকাল থেকে সে কিছুই মুখে তুলেনি।

ঐ হাতুড়েগুলো কি দেখেনি যে সে যেভাবে রোগে মারা যাচ্ছে একই ভাবে তৃষ্ণায়ও মারা যাচ্ছে। সে ঘামছে এবং বেশির ভাগ জল তার দেহ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। টাইটা বিরক্তি প্রকাশ করল এবং বিছানার পাশে রাখা কপারের জগটা উঠিয়ে তার ভেতর শুঁকে দেখাল।

যাজকদের বিষ ও প্লেগের তরলে এটা নষ্ট হয়ে গেছে। সে দেয়ালের উপর তা সজোরে নিক্ষেপ করল। রান্না ঘরে যাও এবং অন্য একটি জগ আনো। নিশ্চিত হয়ো যেন এটা পরিষ্কার থাকে। কূপ থেকে ওটা ভরবে, নদীর পানি দেবে না। দ্রুত কর, বালিকা। সে দৌড়ে ছুটে গেল আর টাইটা তার ব্যাগ খুলল। এক জগ পরিষ্কার পানি নিয়ে মিনটাকা প্রায় সাথে সাথে ফিরে এল। টাইটা শুলের একটা ওষুধ তৈরি করে লোহার পাত্রে তা গরম করল।

তাকে এটা পান করাতে আমাকে সাহায্য কর, দাওয়াইটা প্রস্তুত হতেই সে মেয়েটিকে আদেশ করল। সে তাকে দেখাল কিভাবে তার ভাই-এর মাথা ধরে রাখতে হবে এবং কিভাবে তার গলা দাবাতে হবে যখন সে পানিটা মুখে ঢালবে। শীঘ্রই খিয়ান একাই গিলতে শুরু করল।

আমি আপনার সাহায্যে কি করতে পারি? রাজা জিজ্ঞেস করল।

আমার লর্ড, এখানে আপনার কোন কাজ নেই। আপনি ক্ষতিপূরণের চাইতে ধবংস করতেই দক্ষ। রোগীর দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে এবং তার পানে না। তাকিয়ে টাইটা তাকে খারিজ করে দিল। একটা দীর্ঘ নীরবতা কক্ষটিতে নেমে এল, একসময় অ্যাপেপির ব্রোঞ্জের স্যান্ডেলের আওয়াজ তুলে কক্ষ ত্যাগ করল।

মিনটাকা শীঘ্রই ম্যাগোসের প্রতি তার ভয়টা জয় করল এবং সাহায্যকারী রূপে দ্রুত ও আন্তরিক হিসেবে নিজেকে সে প্রমাণ করল। টাইটার ইচ্ছাগুলো যেন সে আগেই বোঝার সামর্থপূর্ণ। সে তার ভাইকে জোর করে পান করাল যখন টাইটা তার ব্যাগ খুলে কড়াই-এ অন্য আরেকটি ওষুধ তৈরি করছিল। এক ফোঁটাও নষ্ট না করে তার গলায় দিয়ে পুরো দাওয়াই নামিয়ে আনতে সে সফল হল। ভাইয়ের বুকের পোড়া ক্ষত স্থানগুলোতে সে আঠালো আরামদায়ক মালিশ লাগাতে সাহায্য করল। তারপর তারা দুজনে খিয়ানকে লিনেন কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল এবং কূপের পানি দিয়ে ভালোভাবে ভিজিয়ে দিয়ে তার জ্বলন্ত দেহকে ঠাণ্ডা করতে লাগল।

যখন মিনটাকা একটু বিশ্রাম নিতে তার পাশে বসতে এল তখন এক মুহূর্তের জন্য টাইটা তার হাতটা নিয়ে তালু উপুর করে ধরল। সে তার কব্জির লাল ফোস্কগুলো পরীক্ষা করল। কিন্তু মিনটাকা হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল।

এগুলো প্লেগের দাগ নয়, সে লজ্জায় ভেঙ্গে পড়ল। এগুলো শুধু মাছির কামড়। এই প্রাসাদ মাছিতে ভরা।

যেখানে মাছি কামড়ায় সেখানেই প্লেগ হয়, টাইটা তাকে বলল। তোমার কামিজ খোল।

কোন সংকোচ ছাড়াই মিনটাকা উঠে দাঁড়াল এবং তার গোড়ালি পর্যন্ত তা খুলেল ফেলল। তার নগ্ন দেহ, যদিও স্লিম ও আবেদনময়ী তা সুষম ও সুঠাম বৈশিষ্ট্যের।

একটা মাছি তার বিবর্ণ পেট থেকে লাফিয়ে চলে গেল। ক্ষিপ্র গতিতে টাইটা ওটাকে বাতাসে ধরল এবং তার নখের মাঝে নিয়ে পিষে ফেলল। পোকাটা তার স্বচ্ছ পেটের শূন্যের দিকে গোলাপি দাগ রেখে গিয়েছে।

ঘুরে দাঁড়াও, সে আদেশ করল এবং তা সে মানল। অন্য আরো একটি ঘৃণ্য পোকা তার পিঠ বেয়ে শক্ত গোল নিতম্বের ভাজের দিকে নেমে গেল। টাইটা তার আঙ্গুল দিয়ে ওটা চিমটি দিয়ে তুলল এবং এটার কালো চকচকে শক্ত খোলসটাকে পিষে দিল। ফলাফলে এটা ফোঁটা রক্ত দেখা গেল।

যদি তুমি তোমার এই সব ক্ষুদ্র পোষ্য থেকে মুক্ত না হও, তবে তুমি হবে পরবর্তী শিকার। সে তাকে বলল এবং রান্না ঘর থেকে এক বোল পানি আনতে পাঠাল। কাঁসার হাঁড়িতে সে পাইরেগ্রাম গাছের শুকনো লাল রঙের ফুল সিদ্ধ করল এবং তা দিয়ে সে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ধুয়ে দিল। সে আরো চার পাঁচটা মাছি মারল যেগুলো তার ভেজা চামড়া থেকে লাফ দিয়ে কড়া জলধারা থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল।

তারপর যখন তার নগ্ন দেহ শুকিয়ে এলো মিনটাকা তার পাশে এসে বসল এবং অচেতনভাবে কথা বলতে লাগল। তারা একসাথে তার কাপড়ের শেষ মাছি ও তাদের ডিমগুলো কাপড়ের ভাজ ও সেলাই করা স্থান থেকে সরাল। শীঘ্রই তারা ভালো বন্ধু হয়ে গেল।

রাত নামার আগেই খিয়ান-এর অন্ত্র আরেকবার খালি হল। কিন্তু এবার তা ছিল পরিমাণে অল্প এবং মলের মধ্যে কোন রক্ত ছিল না। টাইটা মল খুঁকে দেখল। তাতে প্লেগের রসের দুর্গন্ধের পরিমাণ কমেছে। সে তার শক্তিশালী গুল্মের ওষুধ তৈরি করল এবং খিয়ানকে আরো এক জগ ভালো পানি তারা পান করাল। অবশেষে সে প্রসাব করল যা টাইটার কথা মতো শুভ লক্ষণ যদিও তার পানিটা ছিল অল্প, গাঢ় হলুদ ও এসিড সম্বলিত। এক ঘণ্টা পর সে আবার জল ত্যাগ করল, আগের চেয়ে হালকা রঙের এবং এবার ততোটা দুর্গন্ধ নেই।

দেখুন আমার লর্ড, মিনটাকা চিৎকার করে উঠল, তার ভাইয়ের গালে হাত বুলিয়ে বলল, লাল ক্ষতগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং তার শরীর শীতল হচ্ছে।

স্বর্গের পরীর ন্যায় তোমার আছে উপশম করার স্পর্শ, টাইটা তাকে বলল, কিন্তু পানির জগের কথা ভুললে চলবে না। ওটা খালি।

সে দৌড়ে রান্না ঘরের গেল এবং এক জগ পানি নিয়ে প্রায় তৎক্ষণাৎ ফিরে এল। যখন সে ওটা তাকে দিল তখন হিকদের ভাষায় সে একটা ঘুমপাড়ানি গান ধরল এবং টাইটা তার কণ্ঠের মিষ্টতা ও পরিচ্ছন্নতায় মুগ্ধ হল।

ঘাসের মাঝে বাতাসের শব্দ শোনো, ছোট প্রিয়।
ঘুমাও, ঘুমাও, ঘুমাও।
শোনো নদীর আওয়াজ,
আমার ছোট্ট শিশু;
স্বপ্ন দেখ, স্বপ্ন দেখ, স্বপ্ন দেখ।

টাইটা তার চেহারা অবলোকন করল। হিকদের মত যা একটু চওড়া এবং তার গালের হাড়গুলো বোঝা যায়। তার মুখ বড়, ঠোঁট পূর্ণ ও নাকটা শক্ত। কোনটাই একেবারে নিখুঁত নয় কিন্তু প্রত্যেকটি সুন্দরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও অন্যগুলোর সাথে মানানসই এবং তার গাল লম্বা ও মাধুর্যপূর্ণ। ঐতিহ্যগত কালো জ্বর নিচে কাঠ বাদাম আকৃতির চোখগুলো প্রকৃতই চমৎকার। তার অভিব্যক্তি প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল। অন্যরকম এক সৌন্দর্য, সে ভাবল কিন্তু সৌন্দর্যই শেষ নয়। দেখ!, সে গান থামাল ও হাসল। সে জেগেছে।

খিয়ানের চোখ খোলা এবং বোনের দিকে সে তাকিয়ে আছে।

তুমি আমাদের মাঝে ফিরে এসেছো, দুষ্ট বাদর। যখন সে হাসল তার দাঁতগুলো সমান ও প্রদীপের আলোতে সাদা দেখাল। আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম। তুমি আর তা কখনই করবে না। সে খুশির ও স্বস্তির কান্না লুকাতে তাকে জড়িয়ে ধরল যা হঠাৎ করে তার চোখে চলে এসেছিল।

টাইটা বিছানার ছাড়িয়ে ওপাশে তাকাল এবং দেখল অ্যাপেপির বিশাল দেহটা দরজায় দাঁড়িয়ে। টাইটা জানেনা কতক্ষণ ধরে সে ওখানে। কিন্তু এখন সে টাইটার উদ্দেশ্যে না হেসে মাথা নাড়ল; তারপর ঘুরল ও দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

ঐদিন বিকাল পর্যন্ত খিয়ান তার বোনের সাহায্যে উঠে বসতে সমর্থ হল এবং স্যুপ খেল যা সে তার মুখে তুলে দিল। দুদিন পর তার চামড়ার লাল লাল দাগগুলো চলে গেল। দিনে তিন-চারবার অ্যাপেপি ঘরটিতে আসত। খিয়ান তখনো উঠতে পারত না। কিন্তু যখনই তার পিতা আসত সে তার হৃদপিন্ড ও তার ঠোঁট স্পর্শ করে তাকে সম্মান জানাত।

পঞ্চম দিনে সে দুলকি পায়ে বিছানা থেকে নামল ও রাজার সামনে হাজির হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অ্যাপেপি তাকে ধরে পুনরায় বালিশে শুইয়ে দিল। যদিও বালকটির প্রতি তার স্নেহ পরিষ্কার তবুও সে অল্প কথা বলল ও প্রায় তৎক্ষণাৎ চলে গেল। কিন্তু দরজায় গিয়ে সে টাইটার দিকে পিছু ফিরল এবং কাঠখোটাভাবে মাথা নাড়িয়ে তাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিল।

*

তারা প্রাসাদের সবচাইতে উঁচু চূড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। এই উচ্চতায় উঠতে তাদের দুশ সিঁড়ি বাইতে হয়েছে এবং এখান থেকে দখলকৃত আবনাব দূর্গস্থ নদীর উপর দিকটা দেখা যায় যা ঝর্ণা থেকে দশ মাইল দূরে। আর থেব ওখান থেকে দশ মাইলেরও কম।

অ্যাপেপি রক্ষীকে নিচে যাবার আদেশ দিল এবং এই স্থানে তাদের একা রেখে ত্যাগ করতে বলল যাতে তাদের কথা কেউ আড়ি পেতে না শোনে। তারা দক্ষিণের বৃহৎ ধূসর নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। সে পুরো যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত, তার হাঁটুর নিচের অংশে ও বুকে চামড়ার বর্ম পড়া, তলোয়ারের বেল্টের আংটার সাথে স্বর্ণের ব্যাজ ঝোলানো এবং তার দাঁড়ি লাল রঙের ফিতা দ্বারা সজ্জিত যা তার আনুষ্ঠানিক পোষাকের সাথে মানানসই। অসামঞ্জস্যভাবে সে স্বর্ণের ইউরিয়াস, শকুন ও কোবরার মুকুটটা তার রুপালি কুঁকড়ানো চুলের উপর পড়েছে। এটা টাইটাকে ক্রোধান্বিত করল। এই দখলবাজ এবং লুণ্ঠনকারী নিজেকে সমস্ত মিশরের ফারাও ভাবে এবং পবিত্র রাজমুকুট পড়েছে। কিন্তু তার অভিব্যক্তি শান্ত রইল। পরিবর্তে সে তার মনকে অ্যাপেপির ভাবনাসমূহ ধরতে স্থির করল। তা ছিল জট পাকানো জালের ন্যায়। এতো গভীর ও সর্পিল যে টাইটা পর্যন্ত পরিস্কারভাবে তা উপলব্ধি করতে পারল না কিন্তু সে ওগুলোর মধ্যে একটা শক্তি অনুভব করল যা অ্যাপেপিকে এ রকম ভয়ানক শত্রু বানিয়েছে।

কমপক্ষে তারা আপনার সম্পর্কে যা বলেছে তার কিছুটা সত্য, ম্যাগোস, অ্যাপেপি দীর্ঘ নীরবতা ভাঙ্গল। আপনি একজন বড় মাপের চিকিত্সক। টাইটা চুপ রইল।

আপনি কি কোন যাদু বলে আমার আর্মিদের প্লেগ ভালো করে দিতে পারেন যেভাবে আমার ছেলেকে করলেন? অ্যাপেপি জিজ্ঞেস করল। আমি আপনাকে এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দেব। এতে স্বর্ণ যা বহন করতে দশটি শক্তিশালী ঘোড়া লাগবে।

টাইটা মলিন হাসি দিল। আমার লর্ড, যদি আমি এরকম কোন যাদু জানতাম তাহলে তো আপনার বদমাশগুলোকে সুস্থ করার কষ্ট না করে শূন্য থেকেই এক লাখ স্বর্ণমুদ্রা যাদু দিয়ে বানিয়ে নিতাম।

অ্যাপেপি তার মাথা ঘুরাল ও হাসিটা ফিরিয়ে দিল। কিন্তু তার মধ্যে কোন রস বা সদিচ্ছা ছিল না। আপনার বয়স কত, ওয়ারলক? টর্ক জিজ্ঞেস করল, আপনার বয়স নাকি ২০০ বছরেরও বেশি, এটা কি সত্য?

টাইটা তার কথা না শোনার একটা ভাব করল। অ্যাপেপি বলে গেল, আপনি কত চান, ওয়ারলক? যদি স্বর্ণ না চান তবে আমি আপনাকে কি দিতে পারি? সে প্রশ্নটার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না, কিন্তু ভবনের উত্তর প্রান্তের পাঁচিলের দিকে শব্দ করে হেঁটে গেলেন এবং পিছনে হাত মুঠি করে দাঁড়ালো। নিচে তার আর্মি ক্যাম্পের দিকে সে তাকাল এবং পোড়ানো জায়গা অতিক্রম করে। এখানে আগুন জ্বলছে এবং ধোঁয়া নিচু হয়ে নদীর সবুজ পানি পেরিয়ে ভেসে মরুভূমির দিকে চলে যাচ্ছে।

আপনি একটা জয় পেয়েছেন, আমার লর্ড, টাইটা নরম স্বরে বলল, কিন্তু আপনাকে মৃতের স্তূপসমূহকে ভালোভাবে অবলোকন করতে হচ্ছে। নিজে নিজে প্লেগ সেরে যাওয়া এবং আপনার লোকেরা আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার পূর্বেই ফারাও তার সৈন্য পুনরায় একত্রিত করবে এবং তার শক্তি গুছিয়ে ফেলবে। অ্যাপেপি রাগে নিজেকে ঝাঁকি দিল যেভাবে একটা সিংহ মাছি ঝেড়ে ফেলে। আপনার সাহস আমাকে বিরক্ত করছে, ওয়ারলক।

নাহ, লর্ড, আমি নয় বরং সত্য ও যুক্তি আপনাকে বিরক্ত করছে।

নেফার সেটি একজন বাচ্চা। আমি তাকে একবার হারিয়েছি। আবারও আমি তাই করব।

তার চাইতেও যা আপনার জন্য ভাবা জরুরি তা হল তার আর্মিতে কোন প্লেগ নেই। আপনার গুপ্তচরেরা আপনাকে বলে থাকবে যে ফারাও-এর আসোয়ান এ আরো ৫টি সৈন্যবাহিনী এবং আসউতে আরো দুটি বাহিনী রয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই নদীর স্রোতে ভেসে দক্ষিণে আসছে। নতুন চাঁদ উঠার পূর্বেই তারা এখানে পৌঁছে যাবে।

অ্যাপেপি একটা মৃদু হুংকার দিল, তবে কোন কথা বলল না। টাইটা অবিশ্রান্ত ভাবে বলে গেল, ষাট বছরের যুদ্ধে দুই রাজ্যকেই রক্ত ঝড়িয়ে সাদা করে দিয়েছে। আপনি কি আপনার পিতা, সেলিটিসের ষাট বছরের রক্তক্ষয়টা অতিক্রম করতে পেরেছেন? এটাই কি যা আবার আপনার ছেলে আপনার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে?

অ্যাপেপি তার দিকে ঘুরে ভ্রুকুটি করে তাকাল, আমাকে এতো কঠিনভাবে পীড়ন করবেন না, বৃদ্ধ। আমার পিতাকে তাচ্ছিল্য করবেন না, স্বর্গীয় প্রভু সেলিটিসকে। বিরক্তি প্রকাশ করে দীর্ঘ নীরবতার পর অ্যাপেপি আবার কথা বলল, উচ্চ রাজ্যের তথাকথিত রাজ প্রতিভূ এই নাজার সাথে আলোচনার আয়োজন করতে আপনার কত সময় লাগবে?

যদি আপনি আপনার সীমানায় আমাকে বাধা না দেয়া হয় এবং একটি দ্রুত নৌযান আমাকে ব্যবহার করতে দেন তবে তিন দিনে আমি থেব পৌঁছে যাব। স্রোতের সাথে ফেরাটা তার চেয়ে দ্রুত হবে।

আপনাকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আমি টর্ককে আপনার সাথে দেবো। নাজাকে বলবেন তার সাথে আমি আবনাবের বাইরে পেরার পশ্চিম তীরে হাথোর মন্দিরে দেখা করব। আপনি ওটা চেনেন?

আমি ভালো করেই ওটা চিনি, আমার লর্ড, টাইটা বলল।

আমরা সেখানে কথা বলতে পারি। অ্যাপেপি বলল। তবে তাকে বলবেন যেন আমার কাছ থেকে বিশেষ কিছু সুবিধা আশা না করে। আমি বিজেতা আর সে। পরাস্ত। আপনি এখন যেতে পারেন।

টাইটা দাঁড়িয়ে রইল।

আপনি যেতে পারেন, ওয়ারলক, অ্যাপেপি তাকে দ্বিতীয় বারের মত বলল।

ফারাও নেফার সেটির বয়স প্রায় আপনার মেয়ের সমান, মিনটাকার, টাইটা একগুয়ের মতো বলল। তাকে আপনি পেতে আপনার সাথে আনতে পারেন।

কি উদ্দেশ্যে? অ্যাপেপি সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।

দুই রাজ্যের–আপনার রাজত্ব ও ট্যামোস,ফারাওদের রাজত্বের মধ্যে একটা দীর্ঘ শান্তি চুক্তির নিদর্শন হিসেবে।

অ্যাপেপি তার দাঁড়ির ফিতা ধরে টানতে লাগল, তার হাসি লুকানোর জন্য।

সেথের দোহাই, আপনি যেভাবে ওষুধ বানান সেভাবে চতুরতার সাথে ষড়যন্ত্রও করেন, ওয়ারলক। এখন আপনি আমার বিরক্তটা সহ্যের বাইরে যাবার পূর্বে চলে যান।

*

হাথোরের মন্দিরটি অনেক বছর আগে ফারাও সেহেরটাওয়ি-এর রাজত্বকালে পাহাড়ের পাশে পাথর খনন করে আবিষ্কার করা হয়, কিন্তু তখন থেকে প্রত্যেক ফারাও একে আরো খনন করে চলেছে। এখানকার যাজিকারা ধনী, প্রভাবশালী নারী গোষ্ঠী যারা কোন না কোনভাবে দুই রাজ্যের দীর্ঘ শত্রুতাকে বাঁচিয়ে রাখতে এমনকি বিভিন্ন সময়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

দুটি বৃহৎ দেবীর মূর্তির মাঝে মন্দিরের উঠানে হলুদ পোশাকে তারা একত্রিত হল। একজন হাথোর হল সোনালি শিং ওয়ালা সাদা-কালো দাগযুক্ত গরু ও অন্যটি তার মনুষ্য দেহ, লম্বা, সুন্দরী নারী যে শিং-এর মুকুট ও সূর্যের সোনালী গোলক তার মাথায় পড়ে আছে।

যাজিকারা মন্ত্র পড়ল ও বাদ্য বাজাল যখন ফারাও নেফার সেটির অনুচরবর্গ পুবদিকের অংশ থেকে উঠানে বেরিয়ে এল এবং রাজা অ্যাপেপির সভাসদগণ পশ্চিমের স্তম্ভের সারি দিয়ে প্রবেশ করল। আলোচনায় পৌঁছানোর ধারাটায় এমন একটা ঘৃণিত বিতর্ক তৈরি হল যে শুরু করার পূর্বেই মধ্যস্থতা প্রায় ভেঙে গেল। প্রথমে পৌঁছানোটাকে ক্ষমতার অবস্থান সম্মানের যেখানে ২য় বার পৌঁছানো শান্তি ভিক্ষার মতো মনে হতে পারে। কোন পক্ষই সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতে নারাজ।

এর ফলে টাইটা একসাথে প্রবেশের কৌশলের পরামর্শ দিয়েছে। সে চালাকি করে দুইজন প্রতিনিধির রাজ মুকুট পরার ব্যাপারে একইরকম বিরক্তিকর প্রশ্ন ঠিক করেছে। উভয়েই দ্বৈত মুকুটকে এড়িয়ে যাবে। অ্যাপেপি পরবে নিম্ন মিশরের লাল পাথরের মুকুট যখন নেফার সেটি পরবে উচ্চ মিশরের সাদা পাথরের মুকুট।

উভয় শাসকের সহচররা জায়গাটাকে ঘিরে রয়েছে, গম্ভীর ও বেজার মুখ করে একে অপরের দিকে মুখ করে। শারীরিকভাবে মাত্র কয়েক কদম দূরে একজন আরেকজন থেকে অবস্থান করছে কিন্তু ষাট বছরের তিক্ততা ও ঘৃণা যা তাদের মাঝে এক বিশাল কঠিন দেয়াল তুলে দিয়েছে। ভেড়ার শিং-এর ব্রোঞ্জের ঝংকার দিয়ে শত্রুতাপূর্ণ নীরবতা ভাঙ্গল। এটা দুই বিরোধী দলকে মন্দিরের দুই অংশ থেকে বেরিয়ে আসার সংকেত।

লর্ড নাজা ও ফারাও নেফার সেটি ধীর স্থিরভাবে সামনে কদম বাড়াল ও উঁচু সিংহাসনে বসল। আর দুই রাজকন্যা হেজারেট ও মেরিকারা ম্র ও ভদ্রভাবে তাদের অনুসরণ করল এবং নাজার সিংহাসনের পায়ের নিকট আসন নিল কারণ তারা তার বাগদত্তা। উভয় বালিকাকে এতোটাই প্রসাধন লাগানো হয়েছে যে তাদের চেহারা অভিব্যক্তিহীন হাথেরের মূর্তির ন্যায় লাগছে, যার ছায়ায় তারা এখন অসীন।

একই সময়ে মন্দিরের বিপরীত অংশ থেকে হিকস্‌দের রাজ পরিবার বেরিয়ে এল। অ্যাপেপি তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। পুরোপুরি যুদ্ধের সাজে সজ্জিত সে। সে উঠানের উপর দিয়ে বালক ফারাও-এর দিকে তাকাল। তার ছেলেদের মধ্যে আটজন তাকে অনুসরণ করল, শুধু খিয়ান বাদে, যে তার সব ছোট ছেলে, কারণ সে এখনো নদীর উজানে এবং এ যাত্রার জন্য যথেষ্ট সুস্থ হয়নি। তাদের পিতার মতই রাজপুত্রেরা যুদ্ধ সাজে সজ্জিত।

একটা স্বার্থপর ঘৃণিত রক্তচোষা বদমাশ, টাইটা ভাবল যখন নেফারের সিংহাসনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সে তাদের দেখছিল।

তার মেয়েদের মধ্য থেকে মাত্র একজনকে সে তার সাথে এনেছে। পুরু কণ্টক ক্যাকটাসের মধ্যে মরুর গোলাপের মতই তার ভাইদের বিপরীতে মিনটাকার সৌন্দর্য জ্বলজ্বল করছিল। মিনটাকার তার বিপরীত ভিড়ের মধ্যে টাইটার লম্বা সরু অবয়ব ও রূপালী চুল চিনতে পারল এবং তার চেহারায় হাসি খেলে গেল। আর তা এতোটাই উজ্জ্বল যে মুহূর্তের জন্য মনে হল যেন সূর্যটা উঠানের উপর চাঁদোয়া ছড়িয়ে দিল। কোন মিশরীয় এর আগে তাকে দেখেনি এবং সারির মধ্যে একটা চাপা গুণগুণ ও বিড়বিড় শব্দ বয়ে গেল। তার জন্যে তারা প্রস্তুত ছিল না। একটা কথা প্রচলিত ছিল যে হিকত্স মেয়েরাও পুরুষের ন্যায় ভারি গড়নের এবং দ্বিগুণ কুৎসিত। ফারাও নেফার সেটি একটু সামনে ঝুঁকে এল এবং উপলক্ষ্যের গাম্ভীর্যতা সত্ত্বেও বোতল আকৃতির সাদা মুকুটের নিচে সে তার কানের লতি ধরে টান দিল, এটা তার একটা স্বভাব যা টাইটা বদলানোর অনেক চেষ্টা করেছে। এবং নেফার শুধু তখনই তা করে যখন সে কোন কিছুর প্রতি বেশি আকর্ষণ অনুভব করে কিংবা তার মনোযোগ যখন অন্য দিকে চলে যায় তখন। টাইটা দুই মাসের বেশি সময় ধরে নেফারকে দেখেনি। নাজা তাকে আলাদা করে রেখেছে। অ্যাপেপি প্রধান কার্যালয় থেকে তার ফেরার পর থেকে–তবুও বালকটির সাথে সে এতোই ঘনিষ্ঠ, এভোই একাত্ম ছিল যে এখনো খুব সহজেই সে তার ভাবনাগুলো ধরতে পারে। সে বুঝল নেফারের মধ্যে অনুপ্রেরণা ও উত্তেজনা জাগছে, আর তা ততটাই গভীর যেন সে এইমাত্র তার তীরের সীমানায় একটা গজলা হরিণ দেখল অথবা বশ না মানানো ঘোড়া শাবকের পিঠে চড়ল বা একটা বক একটা বাজ পাখির দিকে ছুঁড়ে মেরেছে এবং ওটার পতন দেখছে।

বিপরীত লিঙ্গের উপস্থিতিতে তাকে এভাবে আর কখনো প্রভাবিত হতে টাইটা দেখেনি। নেফার সবসময় সব স্ত্রীলোকের প্রতি তাকায় এমনকি তার বোনদের প্রতিও আর তা একটা রাজকীয় ঘৃণা নিয়ে। যাইহোক, বছরেরও কম সময় হবে যখন সে তার বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছেছে এবং বেশিরভাগ সময় সে টাইটার সাথে জঙ্গলে, গেবেল নাগারে অন্যদের থেকে আলাদা হয়েছিল সেখানে তার মনোযোগ এভাবে আকর্ষণ করার মত কিছু ছিল না যেভাবে মিনটাকা এখন করছে।

অল্প চেষ্টায় সে যা অর্জন করল তাতে টাইটা একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করল। এটা তার সব পরিকল্পনাকে জটিল করতে পারে ও বিপদ বাড়াবে অন্তত এখন তারা যে অবস্থায় আছে যদি নেফার হিকস্ মেয়েটির প্রতি গভীর অপছন্দ অনুভব করে। যদি দুজনের বিয়ে হয় তবে নেফার অ্যাপেপির জামাই হবে ও তার নিরাপত্তায় চলে আসবে। এমনকি নাজাও এরকম একজন শক্তিশালী ও ভয়ানক মানুষের বিরুদ্ধে যেতে থামবে। মিনটাকা অজান্তেই নেফারকে রাজ-প্রতিভূর ষড়যন্ত্র ও উচ্চাশা হতে রক্ষা করবে। আর এ একত্রিকরণের পিছনে টাইটার এটাই মনোকামনা।

অল্প সময়ের মধ্যে যখন তারা তার ভাইকে সেবা ও চিকিৎসা করেছে তখন টাইটা ও মিনটাকা একটা দৃঢ় বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। এখন টাইটা এমনভাবে মাথা নাড়ল ও তার হাসিটা ফিরিয়ে দিল যা অন্যরা বুঝল না। আর মিনটাকা তার দিক থেকে তখনই দৃষ্টি সরাল। তার বিপরীতে বসা মিশরের মহান স্ত্রীলোকদের প্রতি আকর্ষণ নিয়ে তাকাল। সে তাদের সম্পর্কে অনেক শুনেছে। কিন্তু এই প্রথম সে তাদের দেখল। দ্রুত সে হেজারেটকে চিনল। নিশ্চিত নারী সুলভ স্বভাব নিয়ে সে একজনকে চিনল যে তার মতই আকর্ষণীয় এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ শত্রু। হেজারেটও তার ব্যাপারে একইভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল এবং তারা সংক্ষিপ্ত কিন্তু উদ্ধত ও সমান শত্রুতাপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর মিনটাকা প্রভাবশালী অবয়ব লর্ড নাজার দিকে দৃষ্টি উঠাল এবং মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

সে ছিল এমন একজন দীপ্যমান ব্যক্তি, যে তার ভাই ও পিতার চেয়ে অনেক ভিন্ন। সে স্বর্ণ ও দামী পাথরে জ্বলছিল এবং তার লিনেন এমন খাঁটি যে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। এই দূর থেকেও সে তার সুগন্ধির সুবাস অনুভব করল যা তাদের আলাদা করেছে বন্য ফুলের ভূমির ন্যায়। তার চেহারাটা প্রসাধনীর এক মুখোশ। তার ত্বক উজ্জ্বল এবং সুরমা দিয়ে চোখ আঁকা ও বাড়ানো। তবুও সে তাকে কোন সাপের বা বিষাক্ত পোকার মারাত্মক সৌন্দর্য ভাবল। সে কেঁপে উঠল ও তার দৃষ্টি রাজ-প্রতিভূর পাশের সিংহাসনে বসা অবয়বের দিকে ফিরিয়ে নিল।

ফারাও নেফার সেটি তার দিকে এমন গভীরভাবে তাকিয়েছিল যে সে তার শ্বাস প্রশ্বাস পর্যন্ত ধরতে পারল। তার চোখগুলো এতোটাই সবুজ যে প্রথম দর্শনেই তা তাকে আকর্ষণ করল এবং চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও সে তা পারল না। তার পরিবর্তে সে লজ্জা পেতে শুরু করল। সাদা মুকুটের নিচে এবং চিবুকে আঁকা নকল দাড়ি নিয়ে নেফার সেটি এমন মর্যাদাপূর্ণ ও স্বর্গীয়ভাবে তাকালো যে সে হত বিহ্বল হয়ে পড়ল। তখন হঠাৎ ফারাও তাকে একটা উষ্ণ ও অর্থপূর্ণ হাসি দিল। তৎক্ষণাৎ তার চেহারা বালক সুলভ ও আবেদনময় হল এবং অকারণেই তার নিঃশ্বাস দ্রুত হল ও সে আরো বেশি লজ্জা পেল। খুব চেষ্টা করে সে তার চোখ সরাল এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে হাথোর দেবীর গভীর মূর্তি দেখতে লাগল।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তার কিছুটা সময় লাগল এবং এরই মধ্যে লর্ড নাজা উচ্চ রাজ্যের রাজ-প্রতিভূ কথা বললেন। পরিমিত কণ্ঠে সে অ্যাপেপিকে অভিনন্দন জানাল, কূটনৈতিকভাবে তাকে হিকস্ রাজা বলে সম্বোধন করলেন। কিন্তু মিশরের রাজ্যে তার দাবির বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। মিনটাকা একাগ্র চিত্তে তার ঠোঁট দেখল কিন্তু নেফারের দৃষ্টি যে তার উপর নিবন্ধিত সে ব্যাপারে সজাগ ছিল এবং তার দিকে না তাকানোর প্রতিজ্ঞা করল।

লর্ড নাজার কণ্ঠ ছিল মনোরম ও একঘেয়েমিময় এবং শেষ পর্যন্ত সে আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারল না। সে চুরি করে চোখের কোণা দিয়ে দ্রুত একবার নেফারের দিকে তাকাল, ইচ্ছা ছিল সাথে সাথেই অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু তার চোখ তার উপর স্থির রইল। নীরব হাসিতে তারা জ্বলজ্বল করছিল ও তাকে মুগ্ধ করল। তার স্বভাব শান্ত নয় কিন্তু এখন তার হাসি ছিল লাজুক ও দ্বিধান্বিত এবং সে অনুভব করল তার চেহারা আবার গোলাপি হয়ে যাচ্ছে। সে চোখ নামিয়ে কোলের উপর রাখা তার হাতের দিকে তাকাল। আঙ্গুলগুলো একসাথে মোচড়ালো যতক্ষণ না সে স্থির হল এবং নিজেকে থামাল। সে হাত স্থির রাখল কিন্তু তার শান্তি নষ্ট করায় সে নেফারের প্রতি রাগ হল। সে-ই একমাত্র মিশরীয় ফুলবাবু। আমার ভাইদের যে কেউ তার চাইতে বেশি পৌরুষপূর্ণ ব্যক্তি এবং তার চেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর। এরকম অসভ্যভাবে আমার দিকে তাকিয়ে সে আমাকে শুধু বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। আমি আর তার দিকে তাকাবো না। আমি পুরোপুরি তাকে এড়িয়ে যাব। সে সিদ্ধান্ত নিল এবং তার সিদ্ধান্ত বজায় থাকল যতোক্ষণ না লর্ড নাজা তার কথা বন্ধ করল এবং তার পিতা তাকে উত্তর দিতে লাগল।

সে তার পুরু কালো পাপড়ির নিচ দিয়ে আরেকবার নেফারকে দেখে নিল। সে তার পিতার দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু যখনই তার দৃষ্টি তার মুখের উপর পড়ল তার চোখ তার দিকে ঘুরে গেল। সে তার অভিব্যক্তি রাগান্বিত ও কঠোর করার চেষ্টা করল। কিন্তু যখন সে হাসল তার ঠোঁটগুলো করুণায় স্পন্দিত হল। সে প্রকৃতই আমার কয়জন ভাইদের মত সুন্দর, সে স্বীকার করল, তারপর দ্রুত আরেকবার দেখে নিল। অথবা তাদের যে কারো মত। সে তার কোলের দিকে ফিরে তাকাল ও এ ব্যাপারে ভাবল। তারপর আরো একবার তা নিশ্চিত করার জন্য চুপিচুপি তাকাল। সম্ভবত তাদের যে কারো থেকে সুন্দর, এমনকি রুগার থেকেও। সঙ্গে সঙ্গেই সে অনুভব করল যে তার সবচাইতে বড় ভাইকে প্রতারণা করছে এবং তার মতামত পরিমার্জন করল, অবশ্যই ভিন্নভাবে।

সে পাশে থাকা রুগার দিকে তাকাল। ফিতাসহ দাড়ি ও কালো তে সে একজন পুরোপুরি যোদ্ধা। রুগা একজন সুদর্শন পুরুষ, সে আনুগত্যের সাথে ভাবল।।

বিপরীত সারি থেকে মনে হল না যে তাকে টাইটা দেখছে কিন্তু সে নেফার ও মিনটাকার মধ্যে লুকানো আদান প্রদানের একটি সূক্ষ্ম তারতম্যও ধরতে ব্যর্থ হয়নি। বরং সে এর চাইতে বেশি কিছু দেখল। লর্ড টর্ক, নাজার ভাই অ্যাপেপির সিংহাসনের পিছনে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে মিনটাকার বাহু ঘেঁষে। তার বাহু তার বুকের উপর ভাজ করা এবং সে চিত্র খচিত খাঁটি স্বর্ণের মনিবন্ধ পড়ে আছে। এক দিকের কাঁধে ভারি ও বাঁকানো ধনুক এবং অন্য কাঁধে স্বর্ণের পাতে ঢাকা তীরের খাপ ঝোলানো। গলায় সে শৌর্য ও বীর্যের স্বর্ণের চেইন পরে আছে। হিক মিশরীয় মিলিটারি সম্মান ও সাজসজ্জা গ্রহণ করেছে সেই সাথে তাদের বিশ্বাস ও রীতিনীতি। টর্ক হিক রাজকন্যাকে গভীর অভিব্যক্তি নিয়ে দেখছিল।

আবারও নেফার ও মিনটাকার মধ্যে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি বিনিময় হল যা টর্ক তার কালো, বিমর্ষ দৃষ্টি নিয়ে দেখল। টাইটা তার রাগ ও হিংসা বুঝতে পারল। যেন খামসিনের গরম ও অসহনীয় মেঘ, সাহারার ভয়ংকর বালি ঝড় মরুর দিগন্তে সৃষ্টি হচ্ছে। আমি পূর্বে এটা দেখিনি। টর্ক কি মিনটাকাকে সত্যি ভালোবাসে নাকি রাজনৈতিক কোন কারণ এর পেছনে আছে? সে বোঝার চেষ্টা করল। তার প্রতি কি তার সত্যি আকর্ষণ আছে নাকি তাকে সে ক্ষমতায় আরোহনের সিঁড়ি মনে করে? প্রতিটি অবস্থান থেকেই এটা বিপদজনক এবং অন্য বিষয়সমূহও আমাদের হিসেবে রাখতে হবে।

অভিবাদন পর্ব শেষ হল এবং তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বলা হয়নিঃ যুদ্ধ বিরতির আলোচনা পরের দিন গোপন সময়ে শুরু হবে। উভয় পক্ষ তাদের সিংহাসন থেকে উঠল ও মাথা নত করে সম্মান জানাল ও স্যালুট দিল এবং তাদের উঠার সময় ঘণ্টা ও বাঁশি বাজল।

টাইটা হিকস্ সারিতে শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে নিল। অ্যাপেপি ও তার পুত্ররা দেবীর যমজ গরুর মাথা সম্বলিত লম্বা পিলারে ঘেরা দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। শেষবারের মত পিছনে তাকিয়ে মিনটাকা তার পিতা এবং ভাইদের অনুসরণ করল। লর্ড টর্ক তাকে কাছাকাছি থেকে অনুসরণ করল এবং তার কাঁধের উপর দিয়ে ফারাও নেফার সেটির দিকে শেষবারের মত তাকাল। তারপর সেও পিলারের মধ্যে দিয়ে অদৃশ্য হল। তার এভাবে অদৃশ্য হবার মুহূর্তে খাপের মধ্যে থাকা তার তীরগুলো ঝনঝন আওয়াজ তুলল এবং তাদের রঙিন পুচ্ছ টাইটার চোখে পড়ল। পালকগুলো ছিল লাল ও সবুজ এবং একটা অশুভ কিছু টাইটার মনে দোলা দিল। টর্কও দরজা দিয়ে চলে যাবার সময় টাইটাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল।

*

টাইটা মন্দিরে পার্শ্বস্থ পাথরের কক্ষটিতে ফিরে এল যা শান্তি আলোচনার সময়ে থাকতে তার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সে একটু শরবত পান করল, কারণ বাইরে গরম ছিল। তারপর সে পাথরের পুরু দেয়ালের জানালার নিকট গেল। এক ঝাঁক উজ্জ্বল রঙের বাবুই পাখি লাফাচ্ছে ও নিচের স্কুল ছাদে বসে কিচির মিচির করছে। সে তাদের উদ্দেশ্যে শস্য ছুঁড়ে দিতেই তারা তার কাঁধে এসে বসল ও তার হাত থেকে তুলে খেতে লাগল। টাইটা সকালের ঘটনা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল এবং আলোচনা কালীন সময়ে তার দৃষ্টিতে ধরা পড়া সব ঘটনা নিয়ে ভাবল।

টর্কের কথা মনে হতেই নেফার ও মিনটাকাকে নিয়ে তার যে বিস্ময় ও খুশি ছিল তা সে ভুলে গেল। সে হিকস্ রাজকন্যা ও লোকটির সম্পর্কের বিষয়টা বিবেচনা করল। আসল সমস্যাটা তখনই তৈরি হবে যখন সে তাদের নিয়ে তার পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করতে চাইবে। হঠাৎ জানালার বাইরে ঝুলন্ত ছাদে একটা ছায়াকে লুকিয়ে চলতে দেখতে পেয়ে তার চিন্তায় বাধা পড়ল। যা মন্দিরের একটা বিড়াল; রোগা, ক্ষতের দাগ ও সংক্রামক রোগে বিভিন্ন জায়গায় ওটার চামড়া ছড়ানো। বিড়ালটা পাখিগুলোর দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে যেগুলো বাইরের জানালার পতাকার উপর লাফাচ্ছিল। সে শস্য দানা তুলে নিল।

টাইটা সতর্ক দৃষ্টি ও স্থির নিয়ে বিড়ালটাকে দেখতে লাগল। বুড়ো বেড়ালটি থেমে গেল এবং সন্দেহ নিয়ে এদি ওদিক তাকাতে লাগল। হঠাৎ প্রাণীটির পিঠ ধনুকের মত বেঁকে গেল এবং তার দেহের প্রতিটি পশম খাড়া হয়ে গেল ও সামনের খালি পাথুরে পতাকার দিকে চেয়ে রইল। তারপর একটা চিৎকার করে ঘুরে ছাদের নিচ দিয়ে দৌড়ে পাম গাছের নিকট পৌঁছল। তারপর লম্বা পুঁড়ির উপর উঠে পাতাযুক্ত ডালের চূড়ায় পৌঁছে সেখানে করুণভাবে ওটা ঝুলে রইল। টাইটা আরেক মুঠো শস্য পাখিগুলোকে দিল ও তার মনযোগ তুলে নিল।

এখানে আসতে তাদের দীর্ঘ যাত্রায়ও টর্ক তার যুদ্ধে খাপটা দৃঢ়ভাবে আটকে রেখেছিল। যার ফলে টাইটা পক্ষে ফারাও-এর হত্যা হওয়ার স্থান থেকে পাওয়া তীরের সাথে তার তীরের মিলিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। কজন হিকস্ অফিসারের লাল ও সবুজ রঙের নক্সা করা তীর আছে সে শুধু অনুমান করল। কিন্তু সম্ভবত সংখ্যাটা অনেক বেশি, যদিও প্রত্যেকের আলাদা চিহ্ন আছে। একমাত্র একটাই পথ আছে যার দ্বারা ফারাও ট্যামোস-এর মৃত্যুর সাথে টর্কের সংযোগ বের করা যাবে। এবং তার মাধ্যমে তার ফুফাতো ভাই নাজার। তাই তার একটা তীর পরীক্ষা করতেই হবে। তার সন্দেহের উদ্রেক না করে এটা যতোটা সম্ভব দ্রুত করা যায় ততই ভালো, সে ভাবল।

আরেকবার সে তার ভাবনা থেকে ছুটে গেল। তার কক্ষের বাইরে সে কতগুলো কণ্ঠ শুনল। একটা ছিল তরুণ ও পরিষ্কার এবং তৎক্ষণাৎ সে তা চিনতে পারল। অন্যগুলো কর্কশ, অনুরোধপূর্ণ ও প্রতিবাদী।

লর্ড আসমর বিশেষ আদেশ দিয়েছেন।

আমি কি ফারাও নই? তুমি কি আমার নির্দেশ মানতে বাধ্য নও? আমি ম্যাগোসের সাথে দেখা করতে চাই এবং তোমরা আমাকে বাধা দেওয়ার সাহস দেখাতে পারনা। তোমরা সরে দাঁড়াও, নেফারের কণ্ঠ শক্তিশালী ও আদেশমূলক। বয়ঃসন্ধির অনিশ্চয়তা চলে গেছে এবং সে একজন পুরুষের মতই কথা বলছে।

তরুণ বাজপাখি তার পাখা মেলছে এবং পুচ্ছ দেখাচ্ছে, টাইটা ভাবল এবং রাজাকে অভিবাদন জানাতে শস্যকণার ধুলো ঝেড়ে জানালা থেকে সে সরে এল।

নেফার দরজার পর্দা একপাশে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। দুজন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী অসহায়ভাবে তাকে অনুসরণ করল, তার পিছনে দরজায় ভিড় করল। নেফার তাদের এড়িয়ে ঠোঁটে হাত রেখে টাইটার মুখোমুখি দাঁড়াল।

টাইটা, আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট, নেফার বলল।

আমি দুঃখিত, টাইটা গভীর আনুগত্য প্রকাশ করল। কিভাবে আমি আপনাকে আঘাত করেছি?

তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছে। যখনই আমি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি তারা আমাকে বলেছে তুমি হিকস্‌দের সাথে গোপন মিশনে গিয়েছ অথবা মরুতে গেছ কিংবা অন্য কোন আজব গল্প শুনিয়েছে। বৃদ্ধ লোকটির সাথে আবার মিলতে পেরে নেফার তার খুশি ঢাকতে ভ্রুকুটি করল। তারপর তুমি হঠাৎ করে কোথা থেকে বেরিয়ে এলে, অথচ তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না বলে কথা দিয়েছিলে। আর এখন তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি অনুষ্ঠানের সময় আমার দিকে তাকাচ্ছিলে না পর্যন্ত। তুমি কোথায় ছিলে?

মহামান্য, সে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস, টাইটা রক্ষীদের উদ্দেশ্যে ইশারা করল।

সাথে সাথে নেফার তাদের দিকে ক্রোধ সহকারে ঘুরল। আমি আরো একবার তোমাদের চলে যেতে আদেশ করেছি। যদি তোমরা এখনই না যাও তবে আমি তোমাদের দুজনকে মৃত্যুদন্ড দেবো।

তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা সরে গেল তবে বেশি দূরে গেল না। টাইটা এখনো তাদের বিড়বিড় ও অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পাচ্ছে। তারা পর্দার ওপাশে বারান্দায় অপেক্ষা করছে। সে জানালার দিকে মাথা দিয়ে ইশারা করল এবং ফিস্ ফিস্ করে বলল, জেটিতে আমার একটি ছোট নৌকা আছে। আপনি কি মাছ ধরতে যাবেন? তার উত্তরের অপেক্ষা না করে টাইটা তার স্কার্ট টান দিয়ে উপরে তুলল এবং জানালার ঝুলে লাফিয়ে উঠল। কাঁধের উপর দিয়ে সে একবার পিছন তাকাল। নিমিষে নেফার তার রাগ ভুলে গেল এবং আনন্দে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। সে তার সাথে যোগ দিতে কক্ষের ভেতর দিয়ে দৌড়ে গেল। টাইটা বাইরের ছাদে লাফিয়ে নামল এবং নেফার চুপচাপ তাকে অনুসরণ করল। স্কুল পালানো ছেলে মেয়েদের মতো তারা মাথা নিচু করে চুপিচুপি ছাদ পার হল এবং খেজুর গাছের নিচ দিয়ে নদীর দিকে চলল। জেটিতে রক্ষীরা রয়েছে কিন্তু তরুণ ফারাওকে বাঁধা দেয়ার কোন নির্দেশ তাদের নেই। তারা কুর্ণিশ করে সম্মানার্থে একপাশে সরে দাঁড়াল। নেফার ও টাইটা প্রায় হামাগুঁড়ি দিয়ে মাছ ধরার নৌকায় গিয়ে উঠল। প্রত্যেকে একটা করে বৈঠা নিল ও ঠেলা দিয়ে নৌকা ভাসাল। আন্দোলিত হওয়া প্যাপিরাসের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথ ধরে টাইটা নৌকা চালাল এবং মিনিটের মধ্যে তারা জলার পানিতে একা হয়ে গেল। তীর থেকে দূরে গোপন জল পথের ধাঁধার মধ্যে তারা হারিয়ে গেল। তুমি কোথায় ছিলে, টাইটা? নেফারের রাজকীয় ভাবটা এখন আর নেই। আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি?

আমি তোমাকে সব খুলে বলব, টাইটা তাকে আশ্বস্ত করল। কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে সব বল তোমার সাথে যা কিছু হয়েছে, সব।

নোঙ্গর করার জন্যে তারা সরু প্যাপিরাস ঘেরাহ্রদের একটা নির্জন স্থানে এসে থামল এবং নেফার তাকে সবকিছু খুলে বলল তার সাথে যা কিছু ঘটেছে, শেষবার যখন তারা একাকী কথা বলেছিল তার পর থেকে সব। সে নাজার আদেশে সোনার খাঁচায় বন্দী, তার কোন পুরনো বন্ধু তার সাথে সাক্ষাৎ করতে সামর্থ নয়। এমনকি ম্যারন কিংবা তার নিজের বোনদের সাথেও নয়। তার একমাত্র বিনোদন ছিল প্রাসাদের লাইব্রেরি থেকে প্যাপিরাসের স্ক্রৌল পড়া, পুরানো যোদ্ধা হিলটোর কাছে রথ চালানো ও অস্ত্র বিদ্যে শেখা। এমনকি নাজা একাকী আসমরকে ছাড়া আমাকে বাজ শিকার করতে কিংবা মাছ ধরতে যেতে দিত না। নেফার তিক্ত কণ্ঠে অভিযোগ করল।

সে জানতই না যে টাইটা মন্দিরে স্বাগত অনুষ্ঠানে থাকবে যতোক্ষণ না সে তাকে সেখানে দেখেছিল। সে জানত সে গেবেল নাগারে। আর এখন প্রথম সুযোগেই যখন নাজা ও আসমর; অ্যাপেপি, টক ও অন্যান্য হিস্ যোদ্ধাদের সাথে গোপন শান্তি চুক্তিতে ব্যস্ত, সে তার রক্ষীদের সাথে রাগ দেখিয়ে যে কোয়ার্টারে সে বন্দী ছিল সেখান থেকে টাইটার সাথে দেখা করতে চলে এসেছে।

তোমাকে ছাড়া জীবনে কোন মজা নেই, টাইটা। আমার মনে হয় আমি এক ঘেয়েমিতে হয়তো মারাই যাব। নাজা অবশ্যই আমাদের আবার একত্রিত হতে দেবে। তোমার উচিত তার উপর একটা যাদু করা।

এটা আমরা খুব অল্পই বিবেচনা করতে পারি, টাইটা দক্ষভাবে পরামর্শটা এড়িয়ে গেল। কিন্তু এখন আমাদের হাতে সময় খুব অল্প। যখন সে দেখবে আমরা মন্দিরে নেই তখন নাজা আমাদের খুঁজতে সমস্ত আর্মি পাঠিয়ে দেবে। আমাদের নিজেদের কথাগুলো আগে শেষ করা দরকার। দ্রুত ও অল্প কথায় সে নেফারকে তাদের শেষ সাক্ষাতের পর তার সাথে যা হয়েছে সব বলল। সে তাকে নাজা ও টর্কের সম্পর্কের কথা বলল এবং সে কিভাবে ফারাও ট্যামোসের মৃত্যু দৃশ্য দেখেছে এবং সেখানে সে যা খুঁজে পেয়েছে তা তাকে বর্ণনা করল। নেফার বাধা না দিয়ে শুনল কিন্তু যখনই টাইটা তার পিতার মৃত্যুর কথা বলল তখন তার চোখ জলে ভরে গেল। সে অন্য দিকে তাকিয়ে কাশল ও হাতের উল্টোদিক দিয়ে চোখ মুছল।

তুমি কি পরিমাণ বিপদে রয়েছে আশা করি এখন তা বুঝতে পেরেছে। টাইটা তাকে বলল। আমি নিশ্চিত যে ফারাও ট্যামোসের হত্যার সাথে নাজার নিশ্চয়ই কিছু যোগসূত্র রয়েছে এ আমরা যতোই এই প্রমাণের দিকে এগোচ্ছি ততোই ঐ বিপদটা বাড়ছে।

একদিন আমি আমার পিতার হত্যার বদলা নেবো, নেফার প্রতিজ্ঞা করল এবং তার কণ্ঠ দৃঢ় ও কঠিন।

এবং আমি তোমাকে তা করতে সাহায্য করব। টাইটা ওয়াদা করল। কিন্তু এখন নাজার ষড়যন্ত্র থেকে তোমাকে আমার রক্ষা করতে হবে।

কি ভাবে তুমি তা করবে বলে পরিকল্পনা করেছে, টাইটা? আমরা কি মিশর  থেকে পালিয়ে যাবো, যেমনটা আগে আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম?

না, টাইটা মাথা নাড়ল। সাধারণ অবস্থায় আমি তা ভেবেছিলাম, কিন্তু এখানে নাজা আমাদের অনেক সাবধানে রেখেছে। যদি আবার সীমানা থেকে পালানোর চেষ্টা করি, তবে হাজারটা রথ আমাদের পিছু করবে।

তাহলে আমরা কি করতে পারি? তুমিও তো বিপদে রয়েছ।

না, আমি নাজাকে বুঝিয়েছি আমার সাহায্য ছাড়া সে সফল হতে পারবে না। সে অশিরিশের মন্দিরের অভিনয়ের কথা ব্যাখ্যা করল এবং জানালো কিভাবে নাজাকে বিশ্বাস করিয়েছে যে সে তার সাথে অনন্ত জীবন ভাগ করে নেবে।

নেফার ম্যাগোসের চতুরতায় দাঁত বের করে হেসে উঠল, তাহলে তোমার পরিকল্পনা কি?

আমাদের সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পালিয়ে যাওয়া অথবা নাজার দুনিয়া থেকে দূরে যাবো আমরা। এই সময়ে আমার সাধ্য অনুযায়ী তোমাকে আমি রক্ষা করবো।

কি ভাবে তুমি তা করবে?

এই শান্তি চুক্তির আয়োজন করতে নাজা আমাকে অ্যাপেপির কাছে পাঠিয়েছিল।

হ্যাঁ, আমি জানি তুমি অ্যাভারিস গিয়েছিলে। যখন আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলাম তারা আমাকে তা বলেছে।

অ্যাভারিসে নয়, বুবাসতিতে; অ্যাপেপির যুদ্ধের প্রধান হেড কোয়ার্টারে। যখন অ্যাপেপি নাজার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছে আমি তাকে বুঝিয়েছি যে তাদের চুক্তিটা তোমার ও অ্যাপেপির কন্যার বিয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে। একবার যখন তুমি হিকস্‌দের রাজার নিরাপত্তায় চলে আসবে তখন নাজার ছুরি ভোঁতা হয়ে যাবে। সে চুক্তি বাতিল করে আবার এই ভূমিতে যুদ্ধে জড়িয়ে পরার রিস্ক নেবে না।

অ্যাপেপি তার মেয়েকে আমার স্ত্রী হিসেবে দিতে যাচ্ছে? নেফার অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। যাকে আমি সকালের অনুষ্ঠানে লাল কাপড়ে দেখেছি, সে? .

হ্যাঁ, টাইটা বলল। মিনটাকা তার নাম।

আমি তার নাম জানি, নেফার জোরালোভাবে তাকে নিশ্চিত করল। শিকারী নক্ষত্রপুঞ্জের ক্ষুদ্র তারার নামে তার নাম দেওয়া হয়েছে।

হ্যাঁ, ওটা তার, টাইটা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। মিনটাকা, বড় নাক ও হাস্যকর মুখের কুৎসিত এক মেয়ে।

সে কুৎসিত নয়! নেফার রেগে উঠল। সে এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যা ছোট নৌকাটা প্রায় উল্টে দিচ্ছিল এবং তাদের হ্রদের ময়লা কাদার মধ্যে ফেলে দিচ্ছিল।

সে সবচাইতে সুন্দর… যখন সে টাইটার চেহারা ও অভিব্যক্তি দেখল, সে দমে গেল, আমি বলতে চাচ্ছি যে সে দেখতে সুন্দর। সে অনুতাপে দাঁত বের করে হাসল। তুমি সবসময় আমাকে ধরে ফেল। কিন্তু তোমাকে অবশ্যই আমার কাছে স্বীকার করতে হবে যে সে সুন্দর, টাইটা।

অবশ্য যদি তুমি বড় নাক ও হাস্যকর মুখ পছন্দ কর।

নেফার পিপে থেকে একটা মরা মাছ তুলে নিল ও টাইটার দিকে ছুঁড়ে মারল। নিজেকে রক্ষা করতে টাইটা মাথা সরিয়ে নিল।

আমি কখন তার সাথে কথা বলতে পারব? সে জিজ্ঞেস করল, এমন ভাবে বলল যেন এটার কোন গুরুত্ব তার কাছে নেই। সে মিশরীয় ভাষা বলতে পারে, তাই না?

তুমি যেভাবে বলতে পারো সে সেভাবেই পারে। টাইটা তাকে নিশ্চয়তা দিল। তাহলে আমি কখন তার সাথে দেখা করবো? তুমি আমার জন্যে এটা করতে পার। টাইটা আগেই তা বুঝেছিল। তুমি রাজকন্যা ও তার বান্ধবীদের এখানে জলাশয়ে শিকারে এবং সম্ভবত একটা পিকনিকে আমন্ত্রণ জানাতে পারো।

আমি আজ বিকেলেই আসমরকে তাকে আমন্ত্রণ জানাতে পাঠাবো। নেফার সিদ্ধান্ত নিল, কিন্তু টাইটা মাথা বাঁকালো।

সে রাজ-প্রতিভূর কাছে প্রথমে যেতে পারে এবং নাজা সাথে সাথেই বিপদটা দেখতে পাবে। সে কখনই এটা হতে দেবে না। একবার যখন সে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে যাবে তখন তোমাদের দুজনকে একত্রিত হওয়া থেকে রুখতে সে তার ক্ষমতায় যা আছে তার সব করবে।

তাহলে আমরা কি করতে পারি? নেফারকে বিক্ষুব্ধ দেখাল। আমি নিজেই তার কাছে যাবো। টাইটা ওয়াদা করল এবং সেই সময়ে প্যাপিরাসের ভেজা ঝোঁপের বিভিন্ন দিক থেকে তাদের চারপাশ থেকে ক্ষীণ চিৎকার ও দাঁড়ের আওয়াজ ভেসে এল। তুমি যে মন্দিরে নেই আসমর তা খুঁজে পেয়েছে এবং তোমাকে আনতে তার নেকড়েগুলোকে পাঠিয়েছে, টাইটা বলল।

এটা প্রমাণ করে তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া কত কঠিন। এখন মনোযোগ দিয়ে শোন, কারণ আবার আলাদা হয়ে যাওয়ার পূর্বে আমাদের খুব কম সময় হাতে আছে।

তারা দ্রুত কিছু কথা বলল। যে কোন জরুরি প্রয়োজনে খবর আদান-প্রদানের ও তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করল। কিন্তু সব সময়ই চিৎকার ও বৈঠার আওয়াজ আরো জোরালো হচ্ছিল, কাছে আসছিল। মিনিটের মধ্যে অস্ত্রে সজ্জিত একটি ছোট যুদ্ধ বাহিনী প্যাপিরাসের ঝোঁপ ভেঙ্গে দ্রুত উদয় হল, বিশ জন লোক বৈঠা বেয়ে এগিয়ে এল। কমান্ড থেকে একটা চিৎকার এল, ঐ যে ফারাও। ছোট নৌকাটার দিকে দাঁড় টান!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *