প্রান্ত–স্পর্শ
২.১
তাঁর কবর হল একটা ঘিঞ্জি গোরস্থানে। সারাটা জীবনই তিনি নিঃসঙ্গ কাটিয়েছেন, মরণের পর তিনি অনেক সঙ্গী-সাথী পেলেন। সারি সারি কবর চারদিকে।
ফাদার ডেমিয়েন আচ্ছন্ন হয়ে আছেন গভীর বিষাদে। সান্ত্বনা জানাতে ভঁর বৃদ্ধ চাচা মৃদুস্বরে বললেন, তোমার মা এখন সুখে আছে, ডেমিয়েন। কবরে শুয়ে থাকার চেয়ে সুখ আর কিছুতে নেই।
ফাদার ডেমিয়েন কিছু বললেন না, ছোট্র নিঃশ্বাস ফেললেন। হ, মা হয়ত সুখেই আছে। হে পরম করুণাময় ঈশ্বর, তুমি সুখ দাও এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাকে। ইহজগতের সমগ্র দুঃখ ও বেদনার উর্ধ্বে যে প্রগঢ়ি সুখ, সেই সুখ করুণাধারার মত নেমে আসুক। দয়া করো, প্রভু দয়া কর।
ফাদার ডেমিয়েন যখন জর্জটাউনে ফিরে এলেন তখন দুপুর। সারাদিন অভুক্ত, এক গ্লাস পানিও মুখে দেননি। সন্ধ্যাবেলা অনেকে এসে সমবেদনার কথা বলল। তিনি শুনলেন চুপ করে। শান্ত ভঙ্গিতে সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। ঘুমুতে গেলেন অনেক রাতে। ঘুম ঠিক এল না। এক ধরনের অবশ অচ্ছিন্নতার মধ্যে বিচিত্র স্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি ম্যানহাটনের এক বহুতল ভবনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। নিচে রাস্তায় অসংখ্য লোকজন যাওয়া-আসা করছে। হঠাৎ দেখতে পেলেন, এক বৃদ্ধা রাস্তার মাঝখানে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দিশেহারা ভঙ্গি। হঠাৎ বৃদ্ধা ডেমিয়েন, ডেমিয়েন করে ডাকতে শুরু করল। যেন সে কোন কারণে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। বৃদ্ধা হঠাৎ ছুটতে শুরু করল। আধাে ঘুমের মধ্যেই ফাদার ডেমিয়েন মা মা করে ডকিতে লাগলেন। ঘুম ভেঙে দেখেন, চোখের পানিতে বালিশ ভিজে গেছে।
তিনি বাকি রাত জেগে কাটিয়ে দিলেন। পরদিন সারা সকাল ঘর থেকে বেরোলেন না। যেন তার কিছুই করার নেই, কোথাও যাওয়ার নেই। দুপুরে লাঞ্চ খেতে গিয়েও গলা দিয়ে কিছু নামাতে পারলেন না। সব কিছুই কেমন যেন বিস্বাদ। ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে সারাদিন চুপচাপ বসে থাকলেন।
সন্ধ্যার দিকে হলি ট্রিনিটির প্রধান যাজক এলেন ফাদার ডেমিয়েনকে সমবেদনা জানাতে। ভদ্রলোক অত্যন্ত বৃদ্ধ। কিন্তু গলার স্বর যুবকের মতো। তোমার মায়ের জন্যে আমি আজ বিশেষ প্রার্থনা করেছি, ডেমিয়েন।
ধন্যবাদ, ফাদার। আপনার অসীম করুণা।
কত বয়স হয়েছিল তোমার মায়ের?
সত্তর।
বেশ বয়স হয়েছিল তাহলে। একটা সমৃদ্ধ জীবন কাটিয়ে গেছেন।
ফাদার ডেমিয়েন কিছুই বললেন না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। বৃদ্ধ যাজক হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, আমাদের হলি ট্রিনিটিতে গত রাতেও কারা যেন শয়তানের উপাসনা করেছে।
আঁ?।
হ্যাঁ, মা মেরিকে একটা বেশ্যার মত করে এঁকে তারপর উপাসনা করা হয়েছে। লাতিন ভাষায় লেখা টাইপ করা একটা কাগজ পাওয়া গেছে।
কি লেখা?
দারুণ অশ্লীল কথাবার্তা। মা মেরির সঙ্গে মেরি মাগদালেনের সমকামী সম্পর্ক নিয়ে যাচ্ছেতাই বর্ণনা …
তাই?
হ্যাঁ। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানো ডেমিয়েন, লেখাটি চমৎকার, নিখুঁত লাতিনে লেখা। আমার পড়ে মনে হল, যারা এসব করছে তাদের মধ্যে একজন নিশ্চয়ই পাদ্রী। সে অত্যন্ত জ্ঞানীও। এত চমৎকার লাতিন যে কেউ লিখতে পারে না। মনে হয় মানসিকভাবে অসুস্থ কোন পাদ্রী আছে এই দলে। তোমার কি মনে হয়, ডেমিয়েন?
বিচিত্র নয়। থাকতেও পারে। মানসিক ভারসাম্যহীন অনেকেই আছে আমাদের চারপাশে, তারা সুস্থ মানুষের মতোই ঘুরে বেড়ায়।
ডেমিয়েন?
বলুন।
তোমার কি সন্দেহ হয় কাউকে?
ফাদার ডেমিয়েন অবাক হয়ে বললেন, আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, কারণ তুমি একজন সাইকোলজিস্ট। অসুস্থ কোন পাদ্রী যদি থাকে, তাহলে তুমি সহজেই তাকে ধরতে পারবে। এখানে যারা আছে তাদের সবাইকে তো তুমি চেনো। তাছাড়া অনেকেই তোমার কাছে আসে।
ফাদার ডেমিয়েন খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, মনের একটা বিশেষ অবস্থায় এ ধরনের জিনিস করা যায়, তাকে বলে সমনামবুলিজম–স্বপ্নচারিতা। এটা ধরা খুব মুশকিল। যারা এর রোগী তারা নিজেরাও জানে না কি করছে।
হুঁ। আচ্ছা ডেমিয়েন, তুমি লাতিন কেমন জানো?
ফাদার ডেমিয়েন শান্ত স্বরে বললেন, লাতিন আমি বেশ ভাল জানি।
এর দুদিন পর ফাদার ডেমিয়েন কারাসকে উপসনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হল। তাকেজর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে সাইকোলজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে বলা হল। এই দায়িত্ব পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বলা হল, ফাদার ডেমিয়েনের কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।
২.২
রেগান ডাঃ ক্লীনের চেম্বারে একটা বড় বিছানায় শুয়ে আছে। ওর একটি পা দুহাতে ধরে বাকিয়ে ফেললেন ডাঃ ক্লীন। ধরে রাখলেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর ছেড়ে দিলেন। সহজভাবেই পা ফিরে গেল আগের অবস্থায়।
পরীক্ষাটি বেশ কয়েকবার বিভিন্নভাবে করা হল। ফল একই। ডাঃ ক্লীনকে মনে হল তিনি ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। হঠাৎ এক সময় উঠে বসে রেগান একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল ডাক্তারের মুখে। একজন নার্সকে ডেকে এনে রেগানের পাশে থাকতে বলে ডাক্তার ক্রিসের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন।
মিসেস ম্যাকনীল, বিছানাটা কি সত্যি-সত্যি নড়ছিল?
হ্যাঁ।
কতক্ষণ ধরে?
ঠিক জানি না। দশ থেকে পনেরো সেকেণ্ড হয়তো।
কখন থামল?
এক সময় রেগান হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। তারপর বিছানা ভিজিয়ে অলিগোছে ঘুমিয়ে পড়ল। বিছানা কঁপাও বন্ধ হল সঙ্গে সঙ্গে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে?
সমস্ত রাত, পরের দিন দুপুর পর্যন্ত।
ডাক্তার চিন্তিত মুখে ভ্রু কুঁচকাল।
কি হয়েছে ওর, ডাক্তার?
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বিছানা কপার ব্যাপারটি হচ্ছে ক্রনিক কস্ট্রাকশনের জন্যে। শরীরের পেশী যদি কিছুক্ষণ পর পর শক্ত ও নরম হতে থাকে তাহলে এরকম হয়। মস্তিষ্কে যদি কোন প্রদাহ হয় তখনো এটা হতে পারে।
তাহলে আপনি বলছেন ওই সময় রেগানের মাংসপেশীতে …
ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বললেন, না। পরীক্ষা করে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। আচ্ছা, রেগান কি কখনো মাথায় আঘাত পেয়েছিল?
না। আমার তো মনে পড়ে না।
অল্প বয়সে কোন বড় অসুখ-বিসুখ হয়েছিল?
বাচ্চাদের যে-সব অসুখ হয় ওই সব হয়েছিল– মামস, চিকেন পক্স এই সব।
ঘুমের মধ্যে হাঁটার ঘটনা কখনো লক্ষ্য করেছেন?
না, কখনোই না। ওই পার্টির দিনই প্রথম দেখলাম।
মিসেস ম্যাকনীল, আপনি কি করে বুঝলেন যে পার্টির দিন ও ঘুমের মধ্যে হাঁটছিল?
কারণ, পরদিন আর ওর কিছু মনে ছিল না। ও যে পার্টিতে গিয়ে একা একা হাজির হয়েছিল এই কথাটাই মনে করতে পারল না।
এরকম আরো কিছু লক্ষ্য করেছেন?
ক্রিস জবাব দিতে কিছুটা সময় নিল। যেন বলার ইচ্ছা নেই, তবু বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে। ওর বাবা ওকে টেলিফোন করেছিল। সেটা ওর একেবারেই মনে নেই।
কবে হয়েছে ঘটনাটা?
ওর জন্মদিনে।
কি কথাবার্তা হয়েছে?
ক্রিস অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে বলল, রেগান ওর বাবাকে অত্যন্ত কুৎসিত একটা কথা বলে টেলিফোন নামিয়ে রেখেছে।
কি কথা?
সেটা আমি বলতে চাই না। প্লীজ, ডাক্তার।
ডাক্তার ক্লীন এবার চিন্তিত মুখে বললেন, তাহলে ও যে বলছে কারা যেন ওর ঘরের আসবাবপত্র নাড়াচাড়া করে, তা সত্যি?
কি বলছেন, ডাক্তার?
আসবাবপত্র ও নিজেই রাত্রিবেলা নাড়ায়, কিন্তু পরে আর তা মনে থাকে না। মেডিকেল সায়ান্সে একে বলে অটোমেটিজম। ঘোর-পাওয়া একটা অবস্থা। রোগী বুঝতে পারে না সে কি করছে, পরে তার মনেও থাকে না।
আমার মনে হয়, আপনার কথাটা ঠিক নয়। রেগানের ঘরে কাঠের যে আলমারিটা আছে তার ওজন কম হলেও এক টন। ওটা ও নাড়াবে কি করে?
ঘোর পাওয়া রোগীর মধ্যে প্রচণ্ড শারীরিক ক্ষমতা দেখা যায়। আর কোন অস্বাভাবিক ঘটনা লক্ষ্য করেছেন?
গতকাল সকালে রেগান ওর ঘরে বসে ক্যাপ্টেন হাউডির সংগে কথা বলছিল।
কি নাম বললেন?
ক্যাপ্টেন হাউডি। প্ল্যানচেটে যে প্রেতাত্মাটি আসে বলে ওর ধারণা।
ডাঃ ক্লীন মাথা নাড়লেন। তার ভ্রু কুঁচকে গেল।
ওকি এখন কোন গন্ধ পায়?
ও তো সারাক্ষণই ঘরে একটা খারাপ গন্ধ পায়।
যেন কোন কিছু পুড়ছে। পোড়া গন্ধ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?
মিসেস ম্যাকনীল, এইসব লক্ষণ এক ধরনের অসুখের। একে বলে মস্তিষ্কের কেমিকোইলেকট্রিক্যাল অ্যাকটিভিটির বিশৃংখলা। মস্তিষ্কের ভেতরকার টেম্পোরাল লোবের প্রদাহ থেকে এটা হয়। আমি আপনার মেয়ের ই ই জি নেবো।
কি নিবেন?
ইলেকট্রনএনসিফ্যালোগ্রাফ। মস্তিষ্ক তরঙ্গের প্যাটার্ন পরীক্ষা। পরীক্ষাটা কি এখনই করতে চান?
হ্যাঁ, ঘুমের ওষুধ দিয়ে পরীক্ষাটা চালাতে হবে। নড়াচড়া করলে কিছু বোঝা যাবে না। ওকে আমি পঁচিশ মিলিগ্রাম লিব্রিয়াম দিতে চাই।
ক্রিস শুধু ঢোক গিলল কয়েকবার। ওর গলা-বুক শুকিয়ে এসেছে।
ক্রিসকে ডাক্তার নিয়ে রেগানের ঘরে ঢুকলেন। হাতে সিরিঞ্জ। রেগান তাকাল রাগী চোখে। ফিসফিস করে বলল, এই ডাক্তার। এই কুত্তা। এই শুয়োরের বাচ্চা।
ক্রিস অসহায়ভাবে শুধু ছি ছি করে উঠতে পারল। ওর একদম স্বর ফুটছিল।
ইনজেকশন দিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন। বলে গেলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবেন। নার্স ঘরে ই ই জি-র যন্ত্রপাতি আনতে শুরু করল। ডাক্তার যখন ফিরলেন তখনো লিব্রিয়ামের কোন প্রভাব পড়েনি রেগানের ওপর। বেশ অবাক হয়ে গেলেন তিনি।
পঁচিশ মিলিগ্রাম লিব্রিয়ামেও কিছু হয়নি!
আরো পঁচিশ মিলিগ্রাম দেয়া হল রেগানকে।
ডাক্তার ক্লীন ই ই জি-র পদ্ধতি ব্যাখ্যা করলেন, আমরা মস্তিষ্কের বা ও ডান দুদিকের তরঙ্গই মিলিয়ে দেখব–কোথাও কোন অসামঞ্জস্য আছে কি-না। কারণ এমন অসামঞ্জস্য থাকলেই দেখা যায় রোগী এমন অনেক কিছুই শোনে বা দেখে যার আসলে কোন অস্তিত্ব নেই।
পরীক্ষায় কিছুই পাওয়া গেল না। ডাঃ ক্লীন আরো অবাক হলেন। তরঙ্গগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণই আছে।
ডাঃ ক্লীন দীর্ঘ সময় নিঃশব্দে বসে রইলেন। ক্রিস জিজ্ঞেস করল, কি দেখলেন ডাক্তার?
ই ই জি-তে কিছু পাওয়া যায়নি। অবশ্য এ থেকে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলাটা ঠিক হবে না। অনেক সময় …?
ওর অসুখটা তাহলে কি?
এটাকে কোন অসুখ বলা ঠিক হবে না।
তাহলে?
রেগানের আসলে এপিলেপি–মৃগীরোগ হয়েছে।
হায় ঈশ্বর। আপনি এসব কি বলছেন?
মিসেস ম্যাকনীল, অনেকের মত দেখছি আপনারও রোগটা সম্পর্কে খুব ভুল ধারণা আছে। এটা এমন কোন ভয়ংকর রোগ নয়। মূৰ্ছা যাওয়ার প্রবণতা সব মানুষের মধ্যেই আছে। আবার এর প্রতিরোধের ক্ষমতাও মানুষের জন্মসূত্রেই পাওয়া। কারো কারো ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ক্ষমতাটি কম। এটা কোন অসুখ নয়।
চিকিৎসা নেই এর?
আছে, নিশ্চয়ই আছে। অনেক ধরনের এপিলেপ্সি আছে। ধরুন, আমার কথা শুনতে শুনতে মুহূর্তের জন্যে আপনি অন্য রকম হয়ে গেলেন। আমি কি বললাম তার কিছুই শুনতে পেলেন না। এটাও এক ধরনের এপিলেপি।
আগে তো রেগানের এসব ছিল না!
এখন হয়েছে, এটা হতে পারে অনেক কিছু থেকেই; চিন্তা, মানসিক আঘাত, ক্লান্তি, ভয় এসব থেকে এপিলেপ্সি শুরু হতে পারে। এরকম নজিরও আছে যে, কোন বিশেষ ধরনের শব্দ শুনেই রোগী মূছা গেছে।
কিন্তু তাই বলে রেগান এরকম বদলে যাবে কেন?
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলে যাওয়ার বিষয়টি খুবই সাধারণ। এ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। দুতিনশো বছর আগে কারো যদি এ রকম অবস্থা হত তাহলে সবাই ভাবতে রেগানকে বোধহয় ভূতে পেয়েছে। তখন ওঝা ডেকে আনতো।
ক্রিস অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলল, আমি এসব আর শুনতে চাই না, ডাক্তার।
এখনই এতটা ভেঙে পড়বেন না, মিসেস ম্যাকনীল। ওকে আমরা এক্স-রে করে দেখবো। তারপর আমার পরিচিতি একজন নিউরোসার্জন আছেন, তার সংগে যোগাযোগ করিয়ে দেব। দেখবেন সব ঠিক করে ফেলবো।
কখন করবেন এক্স-রে?
এখনই করতে চাই– চদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে।
যা ভাল মনে হয় করুন। প্লীজ, ডাক্তার, মেয়েটাকে সুস্থ করে দিন।
ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন ক্রিস সন্ধ্যার দিকে ঘরে ফিরল। এক্স-রে রিপোর্ট পাওয়া যাবে দুদিন পর। লিব্রিয়ামের প্রভাবে রেগান আচ্ছন্নের মত হয়ে পড়েছে। ওকে বিছানায় শুইয়ে ক্রিস এল রান্নাঘরে। শ্যারন বলল, কফি দেবো?
দাও।
মনে হচ্ছে একটা ধকলের দিন গেছে আজ?
হ্যাঁ। কেউ খোজ করেছিল?
তোমার এজেন্ট ফোন করেছিল। ছবি পরিচালনার ব্যাপারে তুমি এখনো কিছু বলছো না দেখে সে খুব চিন্তিত।
ক্রিস গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুই ভাল লাগছে না ওর।
শ্যারন বলল, মিসেস মেরি জো পেরিন রেগানের খোজ নিতে এসেছিলেন।
একটা বই দিয়ে গেলেন–একটা চিঠিও রেখে গেছেন।
ক্রিস উল্টে পাল্টে দেখল বইটা। বেশ মোটা বই। নামটা ক্রিসকে কৌতুহলী করে তুলল, প্রেত-পূজা ও প্রসঙ্গ কথা। চিঠিতে মেরি জো লিখেছেন।
প্রিয় ক্রিস,
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে হঠাৎ গিয়েছিলাম, সেখানে বইটা পেয়ে নিয়ে এলাম আপনার জন্যে। শয়তানের উপাসনা সম্পর্কে বইটিতে কয়েকটা অধ্যায় আছে। আপনি কিন্তু পুরো বইটাই পড়বেন; হয়ত অন্যান্য অংশও আপনার কাছে আকর্ষণীয় লাগবে। শিগগিরই দেখা হবে।
–মেরি জো
ক্রিস বইটা শ্যারনের দিকে এগিয়ে দিল। বলল, পড়ে শোনাও তো দেখি ব্যাপারটা কি?
রাতে দুঃস্বপ্ন দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছে না-কি?
শ্যারন টেবিলের ওপর থেকে বইটা তুলেও দেখল না। চলে যাওয়ার সময়ও সঙ্গে নিতে ভুলে গেল। আসলে আজ রাতে বইটা পড়ে কাল সকালে ক্রিসকে শোনাবে এটাই ছিল শ্যারনের ইচ্ছা। টেবিলে বইটা পড়ে থাকতে দেখে ক্রিস নিজেই পড়বে বলে ভাবল, কিন্তু না– খুব অবসন্ন বোধ করছে ও। ওপরে গিয়ে রেগানকে দেখে এল, অঘোরে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। কিছুক্ষণ টিভি দেখল চুপচাপ, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে কিন্তু প্রেত-উপাসনা সংক্রান্ত বইটা আর দেখা গেল না। কখন সেটা অদৃশ্য হয়েছে কেউ লক্ষ্য করেনি।
২.৩
এক্স-রে প্লেটগুলো সারি করে সাজানো। ডাঃ ক্লীন ও নিওরোলজিস্ট দুজনেই গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছেন প্লেটগুলো। তাদের লক্ষ্য এমন কিছু দেখা যায় কি না যার দ্বারা মনে হতে পারে পিনিয়াল গ্ল্যাণ্ড নড়ে গেছে। তেমন কিছু অবশ্য দেখা গেল না। কোথাও এমন কোন ইংগিত নেই যা থেকে বোঝা যেতে পারে রেগানের মস্তিষ্কে কোন রকম চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
না, কোন কিছু নেই। সব স্বাভাবিক। নিওরোলজিস্ট এক সময় চশমা খুলে পকেটে রেখে শান্ত স্বরে বললেন, ডাঃ ক্লীন, আমি তো কিছুই দেখলাম না।
গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন ডাঃ ক্লীন।
কিছু একটা তো দেখতে পাওয়া উচিত।
আরেক দফা এক্স রে নেয়ার কি কোন দরকার আছে?
উহুঁ। তার চেয়ে বরং একটা এল পি করা যাক।
হ্যাঁ, সেটা করা যেতে পারে।
নিউরোলজিস্ট হঠাৎ বললেন, মেয়েটাকে আমি একবার দেখতে চাই।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আজ কি আপনার সময় আছে?
না আজ একটু …
নিউরোলজিস্টের কথা শেষ হওয়ার আগেই টেলিফোন বেজে উঠল।
ডাঃ ক্লীন?
হ্যাঁ, কি ব্যাপার?
মিসেস ম্যাকনীল আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। খুব নাকি জরুরী।
কোন লাইনে আছেন?
বারো নম্বরে।
ঠিক আছে।
ডাঃ ক্লীন বোতাম টিপলেন, মিসেস ম্যাকনীল, আমি ক্লীন বলছি। কি ব্যাপার?
ডাঃ, আপনি কি এই মুহূর্তে একবার আসতে পারেন? ক্রিসের কণ্ঠস্বর খুব উত্তেজিত শোনাচ্ছে। গলার স্বর কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে।
কি হয়েছে?
হায় ঈশ্বর– আপনি এখনই চলে আসুন। রেগান যেন কেমন করছে–
রেগান?
হ্যাঁ, আমি বলতে পারছি না। আপনাকে আসতে হবে। এখনই আসতে হবে। প্লীজ, ডাক্তার, প্লীজ।
ডাঃ ক্লীন ও নিউরোলজিস্ট দুজনেই চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হলেন। শ্যারন দরজা খুলে দিল। রেগানের ঘর থেকে তখন এক ধরনের বীভৎস আওয়াজ আসছে। অনেকটা যন্ত্রণাকাতর পশুর আর্তনাদের মতো। শ্যারনের মুখ কাগজের মত সাদা। সে ঠিকমত কথাও বলতে পারছে না।
আমি … আমি … শ্যারন স্পেনসার। ক্রিস ওপরে আছে। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।
রেগানের ঘরের দরজার কাছে আসতেই ক্রিস বেরিয়ে এল। আতংকগ্রস্ত মানুষের চেহারা। চোখে-মুখে দিশেহারা ভাব।
ডাঃ ক্লীন, আসুন–নিজের চোখে দেখুন। বলতে বলতে ক্রিস কান্নায় ভেঙে পড়ল।
ডাঃ ক্লীন ঘরে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন একটা ব্যাপার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলেন।
রেগান তার বিছানা থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে আসছে। একবার-দুবার নয়, বার বার। কেউ যেন ওকে দুহাতে সজোরে ধরে ওপরে তুলছে, আবার ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে নিচে। আতরে কাকুতি-মিনতি করছে রেগান, ও আমাকে মেরে ফেলবে। ওকে থামাও, ওকে থামাও। মা, প্লীজ, ওকে থামাও।
ডাক্তার দুজন নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল নিউরোলজিস্টের কপালে। ডঃ ক্লীন বার বার ঢোক গিলছেন।
ক্রিস দুহাতে চোখ ঢেকে রুদ্ধ স্বরে বলল, ডাক্তার, দয়া করে বলুন–এসব কি।
ক্রিসের কথা শেষ হওয়ামাত্র হঠাৎই যেন অদ্ভুত ব্যাপারটা থেমে গেল। রেগান কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে গিয়ে কেমন নিঃস্পন্দ হয়ে গেল। তার কঁপা গলা শোনা গেল, আমাকে পুড়িয়ে ফেলছে। উহ, আমাকে পোড়াচ্ছে। মা—মা–
ডাক্তার দূজন এগিয়ে গেলেন। রেগান তখন বিড় বিড় করে কি যেন বলতে লাগল–সম্পূর্ণ অপরিচিতি কোন ভাষায়, বিচিত্র এক সাপ খেলানো সুরে, মিয়ানখয়েছিয়ে … মিয়ানখয়েছিয়ে …
ডাঃ ক্লীন নিচু হয়ে রেগানের হাত ধরলেন। কোমল স্বরে বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে, দেখি এখন তোমার অসুবিধাটা কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে রেগান ঝটকা মেরে সোজা হয়ে উঠে বসল। দেখতে দেখতে তার সুন্দর মুখে কদাকার একটা ছাপ পড়ল। কথা বলে উঠল কর্কশ পুরুষ কণ্ঠে। ভারী ও গম্ভীর স্বর, তাতে ঘৃণা আর বিদ্বেষ মেশানো। এই মেয়েটা আমার। এই মেয়ে আমার।
বলতে বলতে হা হা করে হাসল রেগান। বীভৎস এক কুৎসিত হাসি। পর মুহূর্তেই মুখ থুবড়ে বিছানায় পড়ে গেল, যেন কেউ ওকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
তারপর একটানে নাইট গাউন খুলে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পড়ল। ডাক্তার দুজনের দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাল। হিস হিস করে বলল, কি, কেমন দেখছিস আমাকে? শুতে চাস আমার সঙ্গে? আয়। কাপড় খুলে বিছানায় আয়। খুব মজা পাবি। হি হি হি।
ক্রিস এ দৃশ্য আর সহ্য করতে পারল না। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। ডাঃ ক্লীন সহজ ভঙ্গিতে রেগানের হাত ধরতেই ও ফুঁপিয়ে উঠে বলল, প্লীজ, ওকে থামান। ও আমাকে মেরে ফেলছে। ওকে থামান। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। প্লীজ, প্লীজ!
ডাঃ ক্লীন ব্যাগ খুললেন। ইনজেকশান দিয়ে রেগানকে ঘুম পাড়ানো দরকার। নিউরোলজিস্ট দেখলেন, রোগানের সারা শরীর অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হতে শুরু করেছে। এ রকম দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। রেগানের মুখ থেকে আবারো সেই বিচিত্র ভাষার তুবড়ি ছুটল। ডাঃ ক্লীন বললেন, ওকে আমি লিব্রিয়াম দিচ্ছি। পঞ্চাশ মিলিগ্রাম। আপনি শক্ত করে ধরুন।
লিব্রিয়াম দেয়ার আগেই রেগন জ্ঞান হারাল।
ডাঃ ক্লীন বললেন, মূৰ্ছ গেছে, তাই না?
হ্যাঁ, সেরকমই লাগছে।
কি মনে হয় আপনার?
নিউরাসথেনিয়া হতে পারে।
হিস্টিরিয়া নয়। হিস্টিরিয়াতে শরীর এরকম বার্কতে পারে না।
এটা প্যাথলজির কেস।
আমারো তাই ধারণা। লক্ষণ মিলে যাচ্ছে।
ইনজেকশান শেষ করে ডাঃ ক্লীন কপালের ঘাম মুছলেন। থেমে থেমে বললেন; আমি একটা এল পি করাবো, এখনই এই অজ্ঞান থাকতে থাকতেই। এল পি থেকে কিছু নিশ্চয় বোঝা যাবে।
নিউরোলজিস্ট মাথা নাড়লেন। চলুন, আগে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলি।
ক্রিস চোখে রুমাল দিয়ে তখনো কাদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ডাক্তারদের আসতে দেখে নিজেকে কতকটা সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
মিসেস ম্যাকনীল, আপনার মেয়ে এখন ঘুমিয়ে আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। ওকে বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। চব্বিশ ঘন্টার মত ঘুমুবে।
ভাল করেছেন, ডাক্তার। আমি লজ্জিত, এ-রকম ছেলেমানুষের মত কান্নাকাটি করেছি। দয়া করে কিছু মনে করবেন না।
না– না। এতে লজ্জিত হওয়ার কি আছে? মা কঁদবেন স্বাভাবিক কারণেই। গোটা ব্যাপারটাই কেমন অদ্ভুত। আমি আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি ডাক্তার ডেভিড। নিউরোলজিস্ট।
ক্রিস বলল, বলুন ডাক্তার, আপনি কি দেখলেন? আমার মেয়ে এখন পুরো উন্মাদ। ওকে কি কোন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে হবে?
ডাঃ ডেভিড শান্ত স্বরে বললেন, আপনার মেয়ের অসুখটা অস্বাভাবিক। এই রকম অবস্থায় সবার আগে সাইকিয়াট্রিস্টের কথাই মনে পড়ে। তবে আমার ধারণা এটা প্যাথলজিরই একটা ব্যাপার।
ঠিক আছে, কিন্তু এখন কি করতে চান?
আমরা একটা এল পি মানে লাম্বার ট্যাপ করবো?
কি করবেন?
স্পাইনাল কর্ড থেকে রস নিয়ে সেটা পরীক্ষা করে দেখবো।
ক্রিস হঠাৎ খাপছাড়া ভাবে বলল, আমাকে একটা কথা শুধু বোঝান। কি করে ও বিছানা থেকে অমন ওপরে ওঠে আর নিচে নামে?
জবাব দিলেন ডাক্তার ক্লীন, এর উত্তর তো আপনাকে আগেও দিয়েছি। এক্সিলারেটেড মটর ফাংশান।
এর কারণ আপনারা জানেন?
না, আমরা জানি না।
লাম্বার ট্যাপ কখন করতে চান?
এখনই। আপনার আপত্তি নেই তো?
আপনাদের যা ইচ্ছা করুন। শুধু আমার মেয়েটাকে ভাল করে দিন। আমি আর কিছুই চাই না।
আমি যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতে টেলিফোন করছি।
ক্রিস বলল, কফি খান। কফি দিতে বলি।
হ্যাঁ, বলুন।
লাম্বার ট্যাপের ফলাফল কখন জানবো?
আজই।
ডাক্তার ক্লীন টেলিফোনে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে স্টাডিতে এসে বসলেন। কফির কাপে চুমুক দিয়ে ক্রিসের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। রেগানের এই অবস্থা হল কখন থেকে তা জানতে চাইলেন। ক্রিস শান্ত স্বরে বলতে শুরু করল। আজ সকাল থেকে শুরু হয়েছে। এর আগের দুদিন ও বেশ ভালই ছিল। আমি ভাবলাম ওষুধ কাজ করছে। তারপর মঙ্গলবার দিন সকালে, আমি রান্নাঘরে বসে কফি খাচ্ছি, তখন হঠাৎ ছুটে এল রেগান। ওকে নাকি তাড়া করছে ক্যাপ্টেন হাউডি। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ও বিছানায় শুয়েছিল, হঠাৎ ক্যাপ্টেন হাউডি এসে ওকে চিমটি কাটতে লাগল, তারপর নাকি ওর প্যান্ট টেনে খুলে ফেলতে লাগল। ও তখন আমার কাছে ছুটে পালিয়ে এল।
আপনি কি করলেন?
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম–কিছু না। কিছু হয়নি। তখন ও রামাঘরের দরজা দেখিয়ে চেঁচাতে লাগল–ঐ যে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, ঐ যে।
ডাঃ ডেভিড শুকনো গলায় বললেন, খুবই অদ্ভুত কেস। আচ্ছা মিসেস ম্যাকনীল, সে-সময় রেগানের গায়ে জ্বর ছিল?
আমি জানি না। আমি বলতে পারবো না।
চোখ লাল ছিল?
এসব আমাকে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করছেন। আমার কিছুই খেয়াল নেই।
ডাঃ ক্লীন বললেন, তারপর কি হল বলুন।
ক্রিস ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ডাঃ ক্লীন তার ব্যাগ খুলে একটা ট্যাবলেট বের করলেন, এটা খেয়ে নিন, ভাল বোধ করবেন।
ট্রাংকুলাইজার?
হ্যাঁ।
ক্রিস ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর মৃদুস্বরে বলল, রেগান তখন অন্য রকম গলায় কথা বলতে লাগল।
পুরুষের গলায়?
হ্যাঁ। খুব ভারি গলা। যেন রাগী কোন পুরুষের কণ্ঠ।
স্পাইনাল ফ্লুইড নেয়া হল সহজেই। রেগান কোন রকম নড়াচড়া করল না। ডাঃ ক্লীন বললেন, সারা রাতে আর জাগবে বলে মনে হয় না। তবুও যদি জেগে ওঠে তাহলে ওকে থােরাজাইন ইনজেকশান দিতে হবে। আমি প্রেসক্রিপশন লিখে যাচ্ছি, আনিয়ে রাখবেন। আর একজন নার্স রাখা দরকার ইনজেকশান দেয়ার জন্যে।
শ্যারন বলল, ইনজেকশান আমি দিতে পারি, ডাক্তার।
খুব লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সিরিঞ্জে কোন বাতাসের বুদ্বুদ না থাকে।
আমি অনেক ইনজেকশন দিয়েছি। আমি জানি।
তাহলে তো ভালই হল।
রসলিন মেডিকেল বিল্ডিং-এর একটা ঘরে ডাঃ ক্লীন রেগানের স্পাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষা করছিলেন। প্রথমে দেখলেন প্রোটিনের পরিমাণ কত।
স্বাভাবিক।
ব্লাড সেলের সংখ্যা? স্বাভাবিক।
কোনো ফাংগাস ইনফেকশন হয়েছে কি?
না, তা কিছু হয়নি।
আর চিনির পরিমাণ?
ঠিকই আছে। রক্তের দুই-তৃতীয়াংশ পরিমাণ চিনি আছে।
ডাঃ ক্লীন গম্ভীর হয়ে গেলেন। ক্রিস সারাক্ষণই পাশে ছিল। ডাক্তারের ভাবান্তর ওর চোখ এড়াল না। বলল, কিছু বলবেন কি?
মিসেস ম্যাকনীল, আপনার ঘরে কি ড্রাগস আছে? এল এস ডি জাতীয় ড্রাগস? কিংবা এমফিটামিন ট্যাবলেট?
না, ডাক্তার। এগুলো আমি রাখি না।
ডাঃ ক্লীন শুকনো মুখে বললেন, আমার মনে হয়, এখন আমাদের একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে। আমরা কিছু ধরতে পারছি না।
ক্রিস বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। ক্লান্ত, বিরক্তও কিছুটা। বাড়িতে কেউ নেই। কয়েকবার শ্যারন, শ্যারন বলে ডাকল, কোন জবাব নেই। উইলি আর কালকে ছুটি দেয়া হয়েছে। ওরা ফিরবে রাত আটটার দিকে। কিন্তু শ্যারন রেগানকে ফেলে কোথায় গেল?
দোতালার ঘরে গিয়ে ক্রিস দেখে, রেগান গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘরের বড় জানালাটি হাট করে খোলা। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। নিশ্চয়ই শ্যারনের কাজ। জানালাটা খুলে রাখা ওর উচিত হয়নি। জানালা বন্ধ করে ক্রিস নিচে নেমে এসে দেখে, উইলি ফিরেছে।
কোথায় গিয়েছিলে উইলী?
ম্যডাম, কিছু কেনাকাটা ছিল। তারপর একটা ছবি দেখলাম। কাল আজকে আমাকে বিটলসদের ছবিটা দেখতে দিয়েছে। ও অবশ্য অন্য একটা ছবি দেখতে গেছে।
ভালো, কার্লের তাহলে সুবুদ্ধি হচ্ছে।
ক্রিস টেলিফোন করতে বসল ওর এজেন্টকে। এ কদিনে সবার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আফ্রিকায় ছবি পরিচালনার ব্যাপারটার কতদূর কি হল সে খোজ নেয়া দরকার। এজেন্টকে পাওয়া গেল না। রাত আটটায় শ্যারন ঘরে ফিরল।
কোথায় ছিলে, শ্যারন?
ও তোমাকে কিছু বলে নি?
কে? কি বলবে?
বার্ক–বার্ক ডেনিংস।
বার্ক! সে আবার এল কোত্থেকে? আমি তো এসে কাউকে দেখলাম না।
শ্যারন অবাক হয়ে বলল, বার্ক এসেছিল তোমার খোজে। আমি তাকে বসিয়ে রেখে ফার্মেসিতে গেলাম থােরাজাইন ইনজেকশান কিনতে। বলে গেলাম, আমি না আসা পর্যন্ত যেন কোথাও না যায়।
ক্রিস অত্যন্ত বিরক্ত হল। কঠিন স্বরে বলল, বার্ককে তুমি এখনো চিনতে পারলে না? ওর মত লোককে কোন দায়িত্ব দিতে আছে কখনো? তুমি যেই বেরিয়েছ অমনি হয়ত সে-ও বেরিয়ে গেছে।
ক্রিস আবার এজেন্টকে টেলিফোন করল। এবারও তাকে পাওয়া গেল না।
উইলি বলল, ম্যাডাম, আপনি কিছু খাবেন? স্যাণ্ডউইচ?
হ্যাঁ, তা আনতে পারো।
কফি দেবো সঙ্গে?
দাও।
অনেকদিন পর ক্রিস টেলিভিশনের সামনে বসল। অতি বাজে প্রোগ্রাম, তবু সে নড়ল না। কার্ল ফিরল রাত সাড়ে নটার পর। তার মুখের ভাব কি কারণে যেন খানিকটা বিষণ্ণ। ক্রিস ঘুমুতে যাওয়ার জন্যে টিভি বন্ধ করে যখন উঠে দাঁড়াল তখন ঘড়িতে রাত পৌনে বারোটা, আর ঠিক তখনি টেলিফোন বেজে উঠল।
ফোন করেছে বার্ক ডেনিংসের ইউনিটের এক সহকারী পরিচালক। তার গলার স্বর ভাঙা।
ক্রিস, খবর পেয়েছো?
কি খবর?
খুব খারাপ খবর। বার্ক ডেনিংস মারা গেছে।
কি বললে?
বাক মারা গেছে, ক্রিস। তোমার বাড়ির উল্টো দিকের রাস্তায় এম স্ট্রীটে তার লাশ পাওয়া গেছে। ঘাড় ভাঙা। তোমার বাড়ির পেছনে যে খাড়া সিঁড়ি আছে, মনে হয় সেখান থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল।
ক্রিসের হাত থেকে রিসিভারটা পড়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রেগানের ঘর থেকে ক্রুদ্ধ কর্কশ আওয়াজ ভেসে এল। তারপর মনে হল সিড়ি বেয়ে কেউ যেন ভারী পায়ে নেমে আসছে। ক্রিস ভয়ে আতংকে চেঁচিয়ে উঠল, ডাঃ ক্লীনকে টেলিফোন করো। শ্যারন, ডাঃ ক্লীনকে বল তিনি যেন এখনই আসেন। এখখনি!
কিন্তু শ্যারনের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলতে পারল না ক্রিস, একটু নড়তেও পারল না। যেন জমাট বেঁধে গেছে ওর সারা শরীর। শ্যারনের পেছনে রেগান কখন এসে পড়েছে! ধনুকের মত তার সারা শরীর বাকা, মাকড়শার মত হাতে পায়ে হেঁটে ও শ্যারনকে অনুসরণ করে চলছে। লকলক করছে রেগানের জিভ, আর হিস হিস জাতীয় শব্দ করছে।
শ্যারন! কোন রকমে উচ্চারণ করল ক্রিস, ওর দৃষ্টি তখনো স্থির হয়ে আছে রেগানের দিকে।
টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থামল শ্যারন, দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে তাকিয়ে অবশ্য কিছু দেখতে পেল না সে, কিন্তু পরক্ষণেই ওর পায়ের গোড়ালির কাছে রেগানের জিভের ছোবল এসে পড়ল। শ্যারন আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।
ক্রিস ব্যাকুল হয়ে চিৎকার করছে, ডাক্তারকে ডাকো, আসতে বল তাকে–এখনই।
যখন যেদিকে শ্যারন চলতে থাকে, রেগানও অনুসরণ করে চলে সেদিকে। কি ভয়ংকর দৃশ্য।
২.৪
শুক্রবার। ২৯ এপ্রিল।
একজন অত্যন্ত বিখ্যাত নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট এবং ডাঃ ক্লীন রেগানকে পরীক্ষা করছেন। ক্রিস তার বসার ঘরে বসে আছে।
ডাক্তাররা প্রায় আধঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করলেন। এই আধঘণ্টাই রেগান বিকট চিৎকার করল। মাঝে মাঝে কুৎসিত গালাগাল। দুবার নিজের দুকান চাপ দিয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল, যেন হঠাৎ কোন প্রচণ্ড শব্দ শুনছে। দুচোখ ওর গাঢ় রক্তবর্ণ।
সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ ক্লীনকে বললেন, মেয়েটাকে ট্রাংকুইলাইজার দিন। তারপর আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো।
রেগানকে পঞ্চাশ মিলিগ্রাম থােরাজাইন দেয়া হল। তেমন কাজ হল না। আরো পঞ্চাশ মিলিগ্রাম দেয়ার পর সে অনেকটা আচ্ছন্নের মত হয়ে পড়ল। অবাক হয়ে তাকাল ডাক্তারদের দিকে। ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমার মা কোথায়?
উনি আসবেন এখখুনি। আমরা দুজন ডাক্তার।
কান্না কান্না গলায় রেগান ডাকল, মা! মা! কাঁদছে কেন? তোমার কি ব্যথা লাগছে?
লাগছে।
কোথায় বল তো?
সবখানে–সারা শরীরে আমার ব্যথা! উহ কি যন্ত্রণা!
ক্রিস এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। ফুপাতে ফুপাতে রেগান বলল, ও আমাকে খুব ব্যথা দেয়। মা ওকে তোমরা থামাও, প্লীজ!
সাইকিয়াট্রিস্ট অত্যন্ত নরম গলায় বললেন, ব্যাপারটা কি বল তো, রেগান?
আমি জানি না। আগে ও আমাকে কত পছন্দ করতো, এখন খালি ব্যথা দেয়।
কে সে?
ক্যাপ্টেন হাউডি। আর … আর …
বল রেগান। বল, আর কি?
মনে হয় আরো কে যেন আমার ভেতরে আছে, আমাকে দিয়ে সে অনেক কিছু করায়!
সে কি ক্যাপ্টেন হাউডি?
জানি না।
অন্য কেউ?
জানি না। আমি সত্যি জানি না!
সাইকিয়াট্রিস্ট এগিয়ে এসে রেগানের হাত ধরলেন। মিষ্টি গলায় বললেন, রেগান, আমি একটা বেশ মজার খেলা জানি। তুমি কি সিনেমাতে কখনো হিপনোটাইজ করা দেখেছো?
হ্যাঁ।
আমি খুব সহজেই মানুষকে হিপনোটাইজ করতে পারি। এখন তোমাকে হিপনোটাইজ করবো। কেমন? এতে তুমি ভাল হয়ে যাবে। এই দেখো তোমার মা বসে আছেন, ভয়ের কিছু নেই।
ক্রিস বলল, ভয়ের কিছু নেই, মা-মণি, ডাক্তার যা বলছেন শোন। লক্ষ্মী, মা আমার।
রেগান আর কোন আপত্তি জানাল না।
জানালায় পর্দা টেনে ঘরকে অন্ধকার করা হল। সাইকিয়াট্রিস্ট পকেট থেকে বের করলেন একটা সোনার চেন। চেনের মাথায় গোল একটা চকচকে জিনিস। সেটা দেখিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট রেগানকে বললেন, এই চেনটা আমি দোলাবো, তুমি চেয়ে থাকবে এই গোল জিনিসটার দিকে। কেমন?
রেগান মাথা নাড়ল।
তিনি এক হাতে দোলাতে লাগলেন চেনটা, আর অন্য হাতে ছোট্ট একটা পেন টর্চ লাইটের আলো ফেললেন রেগানের চোখে। ভারী ও গম্ভীর গলায় বলতে লাগলেন সম্মােহিত করার কথাগুলো, রেগান, তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তোমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসবে। ঘুম পাবে। খুব ঘুম। খুব শান্তির ঘুম …
রেগান মুহূর্তের মধ্যে ঘুমে নেতিয়ে পড়ল। সাইকিয়াট্রিস্ট অবাক হয়ে বললেন, এত সহজে ঘুমিয়ে পড়বে ভাবিনি।
রেগান বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। ক্রিস পাশেই পাংশু মুখে বসে। ডঃ ক্লীন সিগারেট ধরালেন। সইকিয়াট্রিস্ট বললেন, এখন তোমার ভাল লাগছে, রেগান?
হ্যাঁ। ওর গলার আওয়াজ স্পষ্ট ও নরম, যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।
তোমার বরস কত, রেগান?
বারো।
তোমার ভেতরে কি কেউ থাকে?
মাঝে মাঝে থাকে।
সে কি কোন লোক?
হ্যাঁ।
সে কে?
জানি না।
সে কি ক্যাপ্টেন হাউডি?
জানি না।
সে কি একজন পুরুষ?
জানি না।
এখন কি সে তোমার মধ্যে আছে?
জানি না।
রেগান, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তুমি কি তার সঙ্গে কথা বলতে দেবে আমাকে?
না।
কেন দেবে না?
আমায় ভয় করে।
কিসের ভয়?
জানি না।
আমি যদি ওর সাথে কথা বলি তাহলে ও তোমাকে ছেড়ে দেবে। তুমি কি চাও ও তোমাকে ছেড়ে দিক?
হ্যাঁ, চাই।
বেশ, তাহলে ওকে কথা বলতে দাও।
না।
দাও, লক্ষী মেয়ে। তোমার ভাল হবে। ও ছেড়ে যাবে তোমাকে।
আচ্ছা।
সাইকিয়াট্রিস্ট বিরতি নিলেন কিছুক্ষণের। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, রেগানের ভেতরে যে আছে আমি এখন তার সঙ্গে কথা বলছি। তুমি যদি থেকে থাকো তাহলে তুমিও এখন সম্মােহিত হয়ে আছে। তাহলে অবশ্যই আমার সব প্রশ্নের জবাব তোমাকে দিতে হবে।
রেগানের ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কোন শব্দ হল না। সাইকিয়াট্রিস্ট আবার বললেন, তুমি যদি থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই তোমাকে আমার সব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তুমি আছো? জবাব দাও, তুমি কি আছ?
নীরবতা। একটা অদ্ভুত কিছু যেন হচ্ছে রেগানের মধ্যে। ওর ঠোঁট দুটো বেঁকে যাচ্ছে। গালের চামড়া কুঁচকে উঠছে। প্রকাণ্ড একটি হাঁ করল রেগান। ওর জিভ ক্রমশ বের হয়ে আসছে। কাঁপছে। ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে উঠছে ঘরের বাতাস। পচা উগ্র একটা গন্ধ বেরিয়ে আসছে রেগানের হাঁ-করা মুখ থেকে।
ক্রিসের নড়বার শক্তি নেই। ফিসফিস করে শুধু বলল—
হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর!
সাইকিয়াট্রিস্ট এবার প্রশ্ন করতে লাগলেন অনেকটা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে, তুমিই কি থাকো রেগানের মধ্যে?
রেগান মাথা নাড়ল।
তুমি কে?
মিয়াউকেয়ান।
এটা কি তোমার নাম?
রেগান মাথা নাড়ল।
তুমি কি পুরুষ?
আনহ।
তুমি কি আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছ?
আনহ।
এ কথার অর্থ যদি হ্যাঁ হয় তাহলে মাথা নাড়ো।
রেগান মাথা নাড়ল।
তুমি কি কোন বিদেশী ভাষায় কথা বলছ?
আনহ।
কোত্থেকে তুমি এসেছ?
রশ্বঙ্গ।
তুমি বলছো তুমি হ্রস্ব ই থেকে এসেছ।
আনমিয়াছিসেয়েরশ্বঈকেথে।
সাইকিয়াট্রিস্ট খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, এখন থেকে তোমাকে যখন প্রশ্ন করব তখন তুমি মাথা নেড়ে উত্তর দেবে। একবার মাথা নাড়লে হ্যাঁ, আর দুবার নাড়লে না। বুঝতে পেরেছো?
রেগান একবার মাথা নাড়ল।
তোমার উত্তরগুলোর কোন অর্থ আছে?–আছে।
তোমাকে কি রেগান আগে চিনতো?–না।
তোমাকে কি রেগান কল্পনা করেছে?–না।
তুমি সত্যি আছ?–হ্যাঁ।
তুমি কি রেগানের একটা অংশ?–না।
তুমি কি কখনো রেগানের অংশ ছিলে?–না।
তুমি কি রেগানকে পছন্দ করো?–না।
অপছন্দ করো?–হ্যাঁ।
ঘৃণা করো?–হ্যাঁ।
রেগানের বাবা-মার ডিভোর্সের জন্যে তুমি কি রেগানকে দায়ী করো?—না।
রেগানের বাবা-মার সঙ্গে কি তোমার কোন সম্পর্ক আছে?–না।
ওর কোন বন্ধুর সঙ্গে?–না।
তবু তুমি রেগানকে ঘৃণা করো?–হ্যাঁ।
তুমি তাকে শাস্তি দিতে চাও?–হ্যাঁ।
মেরে ফেলতে চাও?–হ্যাঁ।
তাকে মেরে ফেললে তুমি নিজেও কি মরে যাবে না?–না।
সাইকিয়াট্রিস্ট কেমন বিমূঢ় হয়ে পড়লেন বলে মনে হল। প্রশ্নোত্তরগুলো তার মনমত হচ্ছে না। ব্যাপারটা তিনি গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করলেন।
এমন কি কিছু আছে যা করা হলে তুমি রেগানকে ছেড়ে যাবে?–হ্যাঁ।
তুমি কি বলতে পারো তা কি?–হ্যাঁ।
তুমি কি বলবে?—না।
কিন্তু–
কথাটা শেষ করার আগেই সাইকিয়াট্রিস্ট হঠাৎ অস্ফুট চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলেন। পরমুহূর্তেই একটা বিকট চিৎকার। দুই হাতের বন্ধু মুষ্ঠিতে রেগান চেপে ধরেছে সাইকিয়াট্রিস্টের অণ্ডকোষ। হাতে তার অসুরের শক্তি। ক্রিস স্তম্ভিত হয়ে দেখল, দুজনে বিছানার ওপর দাপাদাপি শুরু করেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় চিল্কার করে উঠলেন সাইকিয়াট্রিস্ট, ডাঃ ক্লীন, ডাঃ ক্লীন, আমাকে বাঁচান। মেরে ফেলল, আমাকে মেরে ফেলল।
রেগান হঠাৎ ঘর ফাটিয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে উঠল।
ক্রিস লাফিয়ে উঠল। বিছানাটা ভয়ংকরভাবে কাপছে। ডাঃ ক্লীন দৌড়ে গিয়ে বাতি জ্বালালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা ভয়ংকর কিছু যেন ঘর ছেড়ে চলে রেগান গেল। আবার নেতিয়ে পড়ল। ডাঃ ক্লীন পরীক্ষা করে দেখলেন রেগান ঘুমিয়ে পড়েছে। সাইকিয়াট্রিস্টের মুখ কাগজের মত সাদা। ক্রিস ফুঁপিয়ে উঠল, বলুন আপনারা, আমার মেয়ের কি হয়েছে?
মিসেস ম্যাকনীল, আসুন আমরা নিচে গিয়ে কথা বলি।
ক্লান্ত পায়ে নিচে নেমে এল সবাই। কেউ কারো মুখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারছে না।
এখন আপনারা বলুন, আমরা মেয়ের কি হয়েছে? আপনারা তো নিজের চোখেই সব দেখলেন, এখন বলুন।
মিসেস ম্যাকনীল, পুরো ব্যাপারটাই বেশ জটিল।
তবুও কিছু একটা তো বলবেন?
আমার ধারণা, রেগানের হিস্টিরিয়া হয়েছে।
হিস্টিরিয়া?
হ্যাঁ, হিস্টিরিয়া।
এই যে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ কথা বলছে রেগানের মুখ দিয়ে, এটাও হিস্টিরিয়া? কি বলছেন আপনারা?
সাইকিয়াট্রিস্ট রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। শান্ত স্বরে বললেন, রেগানের মনে একটা অপরাধবোধ আছে। সেই অপরাধবোধের জন্যেই ও নিজেকে নিজে শাস্তি দিতে চায়। এজন্যেই ও ক্যাপ্টেন হাউজিকে তৈরি করেছে। এই কাল্পনিক হাউড়ি এখন শাস্তি দিচ্ছে ওকে।
অপরাধবোধটা আসবে কোত্থেকে?
বাবা-মার ডিভোর্সের জন্যে শিশুরা সব সময়ই নিজেদের দোষী ভাবে। অপরাধবোধটা আসে সেখান থেকেই।
ক্রিস ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাল একটা। বলল, তাহলে আপনার ধারণা ওর হিস্টিরিয়া হয়েছে?
হিস্টিরিয়া হওয়ারই সম্ভাবনা।
রোগটা কি রকম একটু বুঝিয়ে বলুন।
মনের অসুখের শারীরিক অসুখ হয়ে যাওয়াকেই বলে হিস্টিরিয়া। হিস্টিরিয়া রোগীর মধ্যে দ্বৈত ব্যক্তিত্ব দেখা যায়। অনেক রকম অস্তিত্বহীন জিনিস ওরা দেখে। রেগানের সঙ্গে এসব লক্ষণ কিন্তু বেশ মিলে যায়, মিসেস ম্যাকনীল।
এখন আসল কথা বলুন। ওর কী চিকিৎসা করবেন?
ডাক্তার দুজনেই চুপ করে থাকলেন। ক্রিস অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলল, চুপ করে আছেন কেন? বলুন, এখন কি করতে হবে?
আমার মতে বেশ কয়েকজন এক্সপার্টকে দিয়ে পরীক্ষা করানো দরকার। সপ্তাহ তিনেকের জন্যে হাসপাতালে রেখে ভালমত পরীক্ষা করতে হবে। ডেটনের বেরিঙ্গার ক্লিনিক হবে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা, মিসেস ম্যাকনীল।
ক্রিস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আরেকটা সিগারেট ধরাল। ডাঃ ক্লীন বললেন, ক্লিনিকে দিতে আপনার কোন আপত্তি আছে?
না, আপত্তি কিসের? তবে আমি ভরসা হারিয়ে ফেলছি, ডাক্তার।
সাইকিয়াট্রিস্ট টেলিফোন করলেন বেরিঙ্গার ক্লিনিকে। তারা জানাল পরদিন ভোরে এসে রেগানকে নিয়ে যাবে। আরো মিনিট দশেক চুপচাপ বসে থেকে ডাক্তাররা বিদায় নিলেন।
বেরিঙ্গার ক্লিনিকে যাওয়ার জন্যে কোন পোশাক পরতে হবে ক্রিস তাই দেখছিল। নতুন একটা পরচুলা আনিয়েছে সেদিন, ওটা পরলে কেউ আর ওকে চিনতে পারে না সহজে। নামী অভিনেত্রীদের কোথাও যাওয়াও এক ঝামেলা। কার্ল এসে বলল, একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
বল, দেখা হবে না। আমি ব্যস্ত।
ভদ্রলোক একজন ডিটেকটিভ।
ডিটেকটিভ?
হ্যাঁ। উইলিয়াম কিণ্ডারম্যান। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের লেফটেন্যান্ট।
আমার সঙ্গে তার কি দরকার?
আমি জিজ্ঞেস করিনি, ম্যাডাম। পরে আসতে বলবো?
না, আমি যাচ্ছি।
ডিটেকটিভ ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের ওপরে। মোটাসোটা ভারিক্কী মানুষ। চোখের দৃষ্টি চকচকে। হাসিহাসি মুখ। পুলিশের লোক বলে মনেই হয় না। ক্রিসকে দেখামাত্র হাত বাড়িয়ে দিল। আমার সৌভাগ্য যে মুখোমুখি আপনার সঙ্গে দেখা হল। আপনাকে আমি পর্দায় অসংখ্যবার দেখেছি।
আমি কি করতে পারি আপনার জন্যে বলুন?
কিছুই না। একদম কিছু না। রুটিন মাফিক দুই একটা প্রশ্ন করব শুধু।
করুন।
আপনি ব্যস্ত থাকলে আরেকদিন আসবো। যেদিন বলবেন সেদিন আসবো। আমার কোন তাড়া নেই।
কিণ্ডারম্যান চলে যাওয়ার ভঙ্গি করল। ক্রিস বলল, ব্যাপারটা কি বার্ক ডেনিংস সম্পর্কিত?
হ্যাঁ, তাই। একটা লজ্জার ব্যাপার, তাই না?
বার্ক কি খুন হয়েছে? সেই জন্যেই কি এসেছেন আপনি?
কিণ্ডারম্যান সহজভাবে হাসল। না, না, সে সব কিছুই না। রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ। একজন বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যু তো, কাজেই পরিচিত দুএকজনকে দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করা শুধু।
বার্কের টাকা-পয়সা কি চুরি গেছে?
উহুঁ, একটা পয়সাও না। অবশ্য আজকাল এমন ব্যাপার দাঁড়িয়েছে যে, খুন করতে কোন মোটিভ লাগে না। আসল জিনিস হচ্ছে ড্রাগস, এল.এস.ডি, বুঝলেন?
কিণ্ডারম্যান সরুচোখে তাকাল ক্রিসের দিকে। কি যেন লক্ষ্য করল। তারপর আবার সহজ ভঙ্গিতেই বলল, আমি নিজে একজন পিতা, তাই যখন দেখি আজকালকার ছেলেমেয়েদের কি অবস্থা তখন বুকটা ফেটে যায়। আপনার ছেলেমেয়ে আছে?
হ্যাঁ, একটা।
ছেলে না মেয়ে?
মেয়ে। ক্রিস বলল, আসুন বসার ঘরে। সেখানে বসে যা জিজ্ঞেস করার করবেন।
কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার নেই আমার। রুটিন ব্যাপার। ইয়ে, মানে, মিসেস ম্যাকনীল …
বলুন।
আপনাকে একটু কষ্ট দিতে পারি?
বলুন, কি ব্যাপার?
বদহজম হয়েছে আমার। বয়স হলে যা হয়। আপনার ঘরে কি সেভেন আপ জাতীয় কিছু আছে? না থাকলে অসুবিধা নেই। কোনই অসুবিধা নেই।
আছে, আমি এনে দিচ্ছি।
না, না, আপনাকে উঠতে হবে না। ফ্রিজ কোথায় বলুন, আমি নিয়ে আসছি। রান্নাঘরে?
আপনাকে উঠতে হবে না। আমি দিচ্ছি।
মানুষকে বিরক্ত করতে খুব খারাপ লাগে আমার।
বিরক্তির কিছু নেই।
কিণ্ডারম্যান কিন্তু ক্রিসের সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে গেল। আচমকা বলল, একটা মাত্র মেয়ে আপনার, তাই না?
হ্যাঁ।
বয়স কতো?
কয়েক দিন আগে বারো হয়েছে।
তাহলে আপনার চিন্তার কিছু নেই। বয়স বেশি হলেই মুশকিল। দুনিয়া আগের মত নেই, মিসেস ম্যাকনীল। আমি আমার স্ত্রীকে সেদিন কথায় কথায় বললাম–মহাপ্রলয়ের আর বেশি বাকি নেই।
রান্নাঘরে কার্ল কি একটা পরিষ্কার করছিল। সে ফিরেও তাকাল না। কিণ্ডারম্যান কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগল কার্লকে।
মিসেস ম্যাকনীল, সত্যি বড় লজ্জা লাগছে। আপনার মত একজন বিখ্যাত অভিনেত্রীর সঙ্গে আজ আমার প্রথম দেখা, আর আজকেই কি না আমি চাইলাম সেভেন আপ।
বরফ লাগবে, মিঃ কিণ্ডারম্যান?
না, না, তার দরকার নেই।
ক্রিস বোতলের মুখ খুলল। কিণ্ডারম্যান কথা বলছে ক্রিসের সঙ্গে, কিন্তু চোখ রাখছে কার্লের ওপর।
মিসেস ম্যাকনীল, আপনার ছবি দ্য এনজেল আমি কবার দেখেছি জানেন? ছয় বার। বিশ্বাস হয়? একবার নয়, দুবার নয়, ছয় বার।
ভাল লেগেছিল?
ভাল মানে? আমি হাউ মাউ করে কেঁদেছি। বড্ড ইমোশনাল ছবি। অবশ্য সামান্য একটু ত্রুটি আছে। খুবই সামান্য। আমি কিন্তু সাধারণ একজন দর্শক হিসেবে বলছি। অন্য কিছু ভাববেন না আবার। আপনার কি মনে হয় না ছবিটার আবহ সংগীত বড্ড চড়া?
ওসব আমি বুঝি না। তবে ছবিটা যে আপনার ভাল লেগেছে তা জেনে খুব খুশি হলাম।
আবার বসার ঘরে এসে কিণ্ডারম্যানের চোখে পড়ল, টেবিলের ওপর একটা পাখির মূর্তি। নখ দিয়ে মূর্তির গায়ে আঁচড় কাটল সে। ক্রিস তাকাতেই লজ্জিত হয়ে হাসল। চমৎকার পাখি, মিসেস ম্যাকনীল। কে বানিয়েছে?
আমার মেয়ে।
চমৎকার। খুব চমৎকার।
আপনি কি জানতে চাইছিলেন, বলুন। .
কিছু না। বলতে গেলে বলা যায় জিজ্ঞেস যা করার তা করা হয়েছে। হা হা হা। এমনি একটু গল্পগুজব করছি আর কি। শুধু একটা কি দুটো প্রশ্ন। না করলেও হয়। তবু এসেছি যখন, কি বলেন?
জিজ্ঞেস করুন, আমি বলছি।
বার্ক ডেনিংস যে রাতে মারা যান সে রাতে তিনি কি এ বাড়িতে এসেছিলেন?
হ্যাঁ।
কখন?
বার্ক এসেছিল সাতটার দিকে।
ব্যাস, এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় পা ফসকে …। পানির মত পরিষ্কার। শুধু রেকর্ড ঠিক রাখার জন্যে আর একটা প্রশ্ন।
বলুন।
কটার সময় তিনি বিদায় নিয়েছিলেন?
আমি ঠিক জানি না। তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না, ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
তাহলে কি করে জানলেন তিনি সাতটার সময় বিদায় নিয়েছেন?
শ্যারনের কথা থেকে অনুমান করেছি।
শ্যারন!
শ্যারন স্পেনসার। আমার সেক্রেটারি। বার্ক যখন এসেছিল তখন ও বাড়িতে ছিল।
বার্ক ডেনিংস কি শ্যারনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?
না, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। শ্যারন তাকে বসিয়ে রেখে ওষুধ কিনতে বাইরে যায়। এর পর আমি ফিরে আসি।
কটা বাজে তখন?
সাড়ে সাতটার মত হবে।
আপনার সেক্রেটারি কখন ওষুধ কিনতে যান?
আমি ঠিক বলতে পারবো না।
মিঃ ডেনিংস যখন এ বাড়িতে ছিলেন তখন কে ছিল তাঁর সঙ্গে?
আমার মেয়ে ছিল। আর কেউ ছিল না।
আপনার কাজের লোকজন নেই?
আছে, উইলি আর কার্ল। স্বামী-স্ত্রী। তখন ওরা বাড়িতে ছিল না। ওদের আমি ছুটি দিয়েছিলাম।
ওদের কি আপনি প্রায়ই ছুটি দেন, না শুধু ওই দিনই দিয়েছিলেন?
প্রায়ই ছুটি দিই।
ক্রিসের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা শুরু হলেও এখন যা শুরু হয়েছে তা নিখুঁত তদন্ত। কিন্তু কেন? ক্রিস দেখল, কার্ল রান্নাঘরের সামনে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের জিনিসটা পরিষ্কার তবু কাল এত ঘষাঘষি করছে কি জন্যে?
কিণ্ডারম্যান একটা সিগারেট ধরিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, মিসেস ম্যাকনীল, তাহলে দেখা যাচ্ছে একমাত্র আপনার মেয়েই বলতে পারবে কখন মিঃ ডেনিংস বিদায় নিয়েছেন।
না, সে বলতে পারব না। সে খুব অসুস্থ। ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
কি অসুখ জানতে পারি?
না, আমরা নিজরাই এখনো জানি না।
ঠাণ্ডা বাতাস থেকে হয় এই সব। ঠাণ্ডা বাতাসে থাকে লক্ষ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া। খুব লক্ষ্য রাখতে হবে।
ক্রিস সরু চোখে তাকিয়ে রইল।
আপনার মেয়ের ঘরটা কোথায়?
দোতলায়। শেষ মাথায়।
ওর ঘরের জানালা বন্ধ রাখবেন। ঠাণ্ডা বাতাস হচ্ছে সমস্ত অসুখের মূল। এখন আমি কার্লকে শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। তারপর শেষ। পুলিশের চাকরি যে কি যন্ত্রণা, মিসেস ম্যাকনীল।
কার্ল নিজে থেকেই সামনে এগিয়ে এল।
মিঃ কার্ল, আপনি কাল কটায় বাড়ি ফিরেছেন?
আমি সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরেছি ঠিক নটা পঁয়ত্রিশে।
কি ছবি দেখেছেন?
লিয়ার। ক্রেস্ট মুভি হাউসে।
আমি ছবিটা দেখেছি। চমৎকার ছবি।
ছবি শুরু হয়েছে ঠিক ছটায়। শেষ হয়েছে আটটায়। শেষ হওয়ামাত্র আমি বাসে উঠলাম …।
না, না, এত সব বলতে হবে না। কোন প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন না থাকলেও আমি বলতে চাই। আমি এম স্ট্রীটে বাস থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরেছি।
আহা, কে জানতে চাচ্ছে এসব? ছবিটা কেমন ছিল সেটা বলুন।
ছবিটা ভালো।
আপনার স্ত্রী, তিনি কি আপনার সঙ্গে ছিলেন?
না, সে অন্য ছবি দেখেছে।
কি ছবি দেখেছেন তিনি?
বীটলসদের একটা ছবি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। মিসেস ম্যাকনীল, আজ তাহলে উঠি। যদি দরকার হয় তাহলে পরে আবার টেলিফোন করবো।
আমি কিন্তু কিছুদিন এখানে থাকবো না। ডেটনে যাচ্ছি।
আমার কোন তাড়া নেই। আমি অপেক্ষা করবো।
কিণ্ডারম্যান সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে চিন্তিত সুরে বলল, আপনার মেয়ের জন্যে কি ভাল ডাক্তারের ব্যবস্থা করেছেন?
হ্যাঁ, ওকে আমি একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছি।
ক্লিনিকটা কোথায়?
ডেটনে–এই যে বললাম আমি যাচ্ছি সেখানে।
ও। তাহলে আজ উঠি, মিসেস ম্যাকনীল। গুড নাইট।
গুড নাইট।
কিণ্ডারম্যান চিস্তিতমুখে তার গাড়ির দিকে এগুল। গাড়িতে উঠে সে বাতি জ্বালাল। গ্রোভ কম্পার্টমেন্ট খুলে ছোট্ট একটা ছুরি বের করে তার নখের ডগায় লেগে থাকা রঙ চেঁছে চেঁছে তুলতে লাগল। রঙ লেগেছে রেগানের বানানো পাখির মূর্তি থেকে। ছোট্ট একটা খামের ভেতর রঙের গুঁড়োগুলো রেখে সেটার মুখ বন্ধ করে দিল কিণ্ডারম্যান। এগুলো পাঠাতে হবে পরীক্ষার জন্যে। কার্ল লোকটার ব্যাপারে আরো খোজ খবর নিতে হবে। বয়স বেশ হয়ে গেলেও ব্যাটা এখনো দিব্যি গাট্টাগোট্টা। বউটা তত বুড়িয়ে গেছে। দেখলে কে বলবে ওরা স্বামী-স্ত্রী! গাড়ির ড্রাইভারকে কিণ্ডারম্যান বলল মর্গে নিয়ে যেতে। মর্গের ৩২ নম্বর লকারে বার্ক ডেনিংসের লাশ রাখা আছে। সেটা আরেকবার দেখা প্রয়োজন।
কিণ্ডারম্যা অনেকক্ষণ ধরে বার্ক ডেনিংসের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকল। আগেও সে দুবার দেখেছে আর প্রতিবারেই তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছে। বার্ক ডেনিংসের মাথাটা এমনভাবে ঘোরানো যেন কেউ মুচড়ে সেটা ঘুরিয়ে তাকে মেরেছে। কুৎসিত ব্যাপার। কিণ্ডারম্যান মৃদু স্বরে বলেই ফেলল, পুলিশের চাকরির মত খারাপ চাকরি আর নেই।
২.৫
ফাদার ডেমিয়েন কারাস সুতির একটা টি শার্ট আর খাকী রঙের প্যান্ট পরে দৌড়াচ্ছিলেন। তিনি রোজ ঘণ্টাখানেক এ-রকম দৌড়ান। উপাসনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর এই হয়েছে তার নতুন রুটিন। আজ তিনি দৌড়াচ্ছেন এসট্রনমিক্যাল অবজারভেটরির দিকে। গা বেয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়ছে। পায়ের পেশীগুলো টন টন করছে। তবু অবজারভেটরি পর্যন্ত না পৌঁছে তিনি থামবেন না।
মেডিক্যাল স্কুলের কাছে এসে ফাদার কারাস বা দিকে মোড় নিলেন। তখনই তার চোখে পড়ল সামনের দিকে বেঞ্চে বসা এক লোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ্য করছে। লোকটির গায়ে ওভারকোট, মাথায় ফেল্ট হ্যাট। মুখের ভাব কিছুটা যেন বিষণ্ণ।
কাছাকাছি আসতেই ওভারকোট পরা লোকটা উঠে দাঁড়াল। ভাঙা গলায় শুধাল, ফাদার কারাস?
কারাস মাথা নাড়লেন। একটুখানি হাসলেন। থামলেন না, কিন্তু গতিবেগ কমিয়ে দিলেন যাতে লোকটা তাকে ধরতে পারে। বললেন, আমি থামতে পারছি না। দয়া করে এগিয়ে আসুন।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই,আমি আসছি।
লোকটা এবার দৌড়াতে শুরু করল। ফাদার কারাস জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি আমি চিনি?,
না, ফাদার। আমার নাম উইলিয়াম কিণ্ডারম্যান। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে আছি।
আমার কাছে কি দরকার বলুন তো?
ফাদার, আমি শুনেছিলাম আপনি দেখতে একজন বক্সারের মতো। আসলেও তাই। আপনার গালে একটা কাটা দাগ পর্যন্ত আছে। তা সত্যি সত্যি কি বক্সিং করেন?।
মাঝে মাঝে করি।
আপনার বাড়ি কোথায় ফাদার? বসতবাড়ি?
নিউইয়র্ক।
গোল্ডেন গ্লোভসে, তাই না?
হ্যাঁ। আপনি তো সব খোজ-খবর নিয়েই এসেছেন মনে হচ্ছে।
ফাদার, দয়া করে একটু আস্তে হাঁটতে পারবেন? বয়স হয়ে গেছে তো, এখন আর আগের মত দৌড়াতে পারি না।
আমি দুঃখিত। ফাদার কারাস গতিবেগ অনেকখানি কমিয়ে দিলেন।
আপনি সিগারেট খান, ফাদার?
হ্যাঁ, খাই।
উচিত নয়। ক্যানসার, বুঝলেন, ক্যানসার। আমার কাছে কেন এসেছেন তা কিন্তু এখনো বলেননি। আপনি তো ব্যস্ত, তাই না, ফাদার? না।
মুখ কাচুমাচু করে কিন্ডারম্যান বলল, ব্যস্ত থাকলে অবশ্য অন্য সময় আসবো।
কারাস এবার হেসে ফেললেন, কি বলবেন, বলে ফেলুন তো দেখি। আমি আপনার কথা ঠিক ধরতে পারছি না।
কারাস শব্দ করে হাসলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, কথা ধরতে না পাবার লোক আপনি নন, সব কিছুই আপনি ঠিক ঠিক ধরতে পারেন।
কিণ্ডারম্যান একটু অপ্রস্তুত হল। সামলে নিয়ে বলল, ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। বোকা সেজে কথা বলা আমার অভ্যাস, ফাদার। এতে অনেক বেশি ফল পাওয়া যায়। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমি কোন ভান করব না।
আপনি প্রেততত্ত্ব সম্পর্কে জানতে এসেছেন, তাই না?
হ্যাঁ, ফাদার। কিন্তু এর বাইরেও কিছু আছে।
কেউ কি খুন হয়েছে?
কি করে অনুমান করলেন?
আপনি হোমিসাইড থেকে এসেছেন তো, তাই অনুমান করছি।
ফাদার, আপনি একটু বেশি বুদ্ধিমান।
মিঃ কিণ্ডারম্যান, আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন তা এখনো বুঝতে পারিনি। কাজেই যতো বুদ্ধিমান আপনি আমাকে ভাবছেন আসলেই অতোটা আমি নই।
ফাদার, একটা গোপন কথা বলতে পারি আপনাকে? খুবই গোপন?
বলুন।
আপনি কি বিখ্যাত চিত্র পরিচালক বার্ক ডেনিংসের নাম শুনেছেন?
হ্যাঁ, শুনেছি। তাকে আমি দেখেছিও।
দেখেছেন? কিভাবে তিনি মারা গেছেন তা জানেন?
পত্রিকায় পড়েছি। সিড়ি থেকে পা ফসকে …
তাহলে সবটা জানেন না।
তাই?
হ্যাঁ। আপনি খুব অল্পই জানেন। আচ্ছা, অন্য একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি। আপনি কি ডাইনী, শয়তান এইসব বিষয়ে কিছু জানেন?
কিছুটা।
কিছুটা মানে কতটুকু?
একবার এসবের ওপর একটা রিসার্চ পেপার তৈরি করেছিলাম।
বাপ রে, আপনি তো তাহলে রীতিমত একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। কিণ্ডারম্যান উৎসাহের চোটে ফাদারে হাত চেপে ধরল। বুঝলেন ফাদার, আমি কিছুই জানি না। বলতে গেলে আমি একজন অশিক্ষিত লোক। মহামূখ। তাছাড়া এই সব জটিল বিষয় বুঝতে হলে মাথার মধ্যে যেসব জিনিস থাকতে হয় …
মিঃ কিণ্ডারম্যান, আপনি কিন্তু আবার বোকার ভান করছেন।
দুঃখিত, ফাদার, আমি দুঃখিত। এখন থেকে আমি সবকিছু সরাসরি বলব। একেবারে দিব্যি দিয়ে বলছি।
সেটাই ভালো।
হলি ট্রিনিটিতে মা মেরির মূর্তিকে রঙ করে একটা বেশ্যার মূর্তি বানানো হয়েছে। মলমূত্র এনে রাখা হয়েছে তার সামনে। এসব কি কোন প্রেত পূজার সঙ্গে যুক্ত?
হয়ত।
চমকার, এখন আসুন বার্ক ডেনিংস প্রসঙ্গে। সে কিভাবে মারা গেছে জানেন?
ওই পত্রিকায় যা পড়েছি …
আচ্ছা, একটা গোপন কথা বলছি এবার। কিন্তু কোথাও বসতে হবে আপনাকে। আর দৌড়াতে পারছি না। বয়স হয়েছে আমার, ফাদার, আগের দিন আর নেই।
কারাস অগত্যা একটা বেঞ্চে বসলেন। হাসিমুখে বললেন, এবার বলুন আপনার গোপন কথা।
বলছি, বলছি।
কিণ্ডারম্যান হাপাতে লাগল। সে সত্যি সত্যি কাহিল হয়ে পড়েছে। টপ টপ করে ঘাম পড়ছে। মিনিট দুই চুপ করে থেকে সে টেনে টেনে বলল, বার্ক ডেনিংসের মৃতদেহ পাওয়া গেছে সাতটা পাঁচ মিনিটে। সিড়িগুলোর নিচে। তার ঘাড় ছিল ভাঙা। মাথাটা সম্পূর্ণ পেছন দিকে ঘোরানো।
তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, সিড়ি থেকে পড়ে এমন একটা অবস্থা হতে পারে না?
হতেও পারে। জায়গাটা বেশ উচু। তবে ফাদার …
সম্ভাবনা খুব কম?
হ্যাঁ, খুবই কম। এখন বলুন প্রেততত্ত্বে এ ধরনের মৃত্যুর কথা কি আছে?
আছে। বলা হয়েছে শয়তান যখন কাউকে মারে তখন এইভাবে মারে।
এখন ফাদার, আপনি কি চার্চের ওই প্রেত পূজা আর বার্ক ডেনিংসের মৃত্যু–এই দুয়ের মধ্যে কোন যোগাযোগ দেখতে পাচ্ছেন?
কারাস কিছু বললেন না। কিণ্ডারম্যান সিগারেট ধরিয়ে শান্ত স্বরে বলল, আপনার কি মনে হয় না, মানসিকভাবে অসুস্থ কোন লোক হলি ট্রিনিটিতে শয়তানের পূজা করছে? বার্ক ডেনিংসের মৃত্যুর পেছনে তার কি কোন হাত থাকতে পারে না?
হয়ত পারে।
চমৎকার। এখন যে লোকটা শয়তানের পুজা করছে সে চার্চ সম্পর্কে ভাল জানে, লাতিন জানে, উপাসনার নিয়ম-কানুন জানে। কাজেই সে নিজেও একজন পত্রী হতে পারে। পারে না?
পারে।
ফাদার, আপনি তো সবাইকে চেনেন। তারপর আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, নামকরা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আপনার পক্ষে, আমি মনে করি, কোন্ পাদ্রীটি মানসিকভাবে অসুস্থ তা অনুমান করা খুব সহজ।
না, সব সময় তেমন অনুমান করা যায় না। মাঝে মাঝে দারুণ অসুস্থ লোকও দিব্যি ভাল মানুষের মত ঘুরে বেড়ায়। পৃথিবীর সেরা সাইকোলজিস্টদেরও ধরার সাধ্য নেই ওরা অসুস্থ কিনা। এ ছাড়া মিঃ কিণ্ডারম্যান, আমি জানলেও বলব না। ডাক্তারদের আর ফাদারদের অনেক কিছু গোপন রাখতে হয়। আমাদের কিছু নীতি মেনে চলতে হয়।
এর ফলস্বরূপ অসুস্থ ব্যক্তিরা আবার অপরাধ করার সুযোগ পায়, পায় না?
ফাদার চুপ করে রইলেন।
বলুন, পায় না?
তা হয়ত পায়।
কিণ্ডারম্যান দৃঢ় স্বরে বলল, কিছুদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন সাইকিয়াট্রিস্টের ছয় বছরের জেল হয়েছে। কারণ সে তার একজন রোগী সম্পর্কে পুলিশকে কোন তথ্য দেয়নি। পত্রিকায় আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন খবরটা।
আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
ছি ছি, ফাদার। ভয় দেখাবো কি? আপনি আমাকে লজ্জায় ফেললেন।
ফাদারদের কাছে কেউ যদি কনফেশন করে তাহলে ফাদাররা তা গোপন রাখতে পারেন। আইন তাদের সে অধিকার দিয়েছে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
আমি মনে করি, মানুষের একটা আশ্রয় থাকা প্রয়োজন– যেখানে সে নির্ভয়ে তার অপরাধ স্বীকার করে মন হালকা করতে পারে।
কিন্তু ফাদার, অপরাধ স্বীকার করার পরও তো একজন আবার অপরাধ করতে পারে। আমাদের কি উচিত নয় ওদের খুঁজে বের করা?
অবশ্যই উচিত। তবে, মিঃ কিণ্ডারম্যান, আমি এরকম কাউকে চিনি না। চিনলেও আপনাকে বলতাম না। আমাদের উর্বর্তনকে জানাতাম।
আচ্ছা, ফাদার, আপনি তো অনেককেই নিয়মিত দেখছেন। ওদের দিকে, মানে পাদ্রীদের দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন কি?
মিঃ কিণ্ডারম্যান, উপাসনার দায়িত্ব থেকে আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অনেকের সঙ্গে এখন আমার আর দেখা হয় না। কিণ্ডারম্যান কি একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আপনি কি সিনেমা দেখেন ফাদার?
দেখি।
লিয়ার দেখেছেন?
না।
আমরা সঙ্গে যাবেন ছবি দেখতে? একা একা ছবি দেখতে আমার ভাল লাগে একটুও। আমরা স্ত্রী আবার আমার সঙ্গে যেতে চায় না। অথচ আমার ইচ্ছে করে কাউকে সঙ্গে নিয়ে দেখি। যাবেন, ফাদার?
কবে?
সে আমি ঠিক করব। আমি ঠিক করে এসে আপনাকে নিয়ে যাব।
বেশ তো। আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?
না, না।
আমি কি যেতে পারি এখন?
নিশ্চয়ই। তবে ফাদার, আপনার কাছ থেকে একটা জিনিস নিতে চাই।
কি?
হলি ট্রিনিটিতে একটা টাইপ করা কাগজ পাওয়া গিয়েছিল। অনেক অশ্লীল কথাবার্তা লেখা, সেই কাগজটা—
কি করবেন সেটা দিয়ে? আঙুলের ছাপ তো পাবেন না। অনেকের হাত পড়েছে তাতে।
তবু একটু দেখতে চাই।
বেশ তো, আসুন আমার সঙ্গে।
সন্ধ্যা সাতটা তেইশ মিনিটে কিণ্ডারম্যান একটা স্পেকটোগ্রাফিক অ্যানালিসিস করল। দেখা গেল, যে-রঙ রেগানের বানানো পাখিতে ছিল, সেই রঙই শয়তান উপাসকরা মাতা মেরীর গায়ে মাখিয়েছে।
রাত আটটা সাতচল্লিশ মিনিটে কার্লকে দেখা গেল শহরের একটা বস্তি অঞ্চল থেকে চুপিসারে বেরোতে। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে সে বাসস্ট্যাণ্ড পর্যন্ত এসে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর হঠাৎ হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তার আশেপাশে কেউ ছিল না। লেফটেন্যান্ট কিণ্ডারম্যান তখন ছবি দেখছিলেন মাইল খানেক দূরের একটা প্রেক্ষাগৃহে।
২.৬
মে মাসের ১১ তারিখ বুধবার বিকাল তিনটায় রেগানকে ডেটন থেকে ফিরিয়ে আনা হল। ডাক্তাররা রেগানের ঘরের বড় জানালাটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিল। আর ঘর থেকে সরিয়ে নিল সবগুলো আয়না ও কাচের জিনিস।
ডাঃ ক্লীন এসে অনেকক্ষণ ধরে ক্রিসকে শেখালেন কিভাবে নাকের ভেতর নল দিয়ে খাবার খাওয়াতে হয়। এখন রেগানের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে এই পদ্ধতি ছাড়া খাবার খাওয়ানোর অন্য উপায় নেই। ডাঃ ক্লীন বললেন, মিসেস ম্যাকনীল, লক্ষ্য রাখবেন তরল খাবার যেন ফুসফুসে চলে না যায়। খুব সাবধানে ব্যবহার করবেন এটা।
ডাঃ ক্লীন চলে যেতেই ক্রিস তার এজেন্টকে ফোন করল। জানিয়ে দিল, ছবি পরিচালনার দায়িত্ব সে এখন নিতে পারবে না। মিসেস জো পেরিনকেও ফেন করল ক্রিস, কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না।
কার্ল শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে বিছানার সঙ্গে রেগানকে বাধল। তার মুখ তখনো অভিব্যক্তিহীন। এক সময় শুধু বলল, ম্যাডাম, আমাদের রেগান কি ভাল হবে?
ক্রিস তার কোন উত্তর দিল না।
কার্লের মধ্যে রেগানের জন্যে গাঢ় মমতা আছে। ক্রিস দেখেছে, কাল প্রায়। সারাক্ষণই রেগানের ঘরে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
ক্রিসের জীবনযাত্রা সংগত কারণেই বদলে গেছে। তার অনুভূতিগুলো কেমন ভেঁতা হয়ে গেছে ইদানীং। বসার ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে এক সময় ভাবল, বাইবেল পড়লে কেমন হয়? কিন্তু ঘরে বাইবেল নেই। ধর্মীয় কোন কিছুই নেই। ক্রিস অলস চোখে তাকাল বইয়ের তাকের দিকে–একি! মেরি জোর পাঠানো বইটা এখানে কেন? এটা না তার শোবার ঘরে ছিল?
ক্রিস তাক থেকে বইটা নামিয়ে আনল। এখানে কে আনল এটা?
শ্যারনকে ডেকে এ-কথা সে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই ক্রিস বইটার প্রসঙ্গ তুলল। বইটা পড়েছ?
না, এ-ধরনের বই পড়তে আমার ভাল লাগে না। ভূত-প্রেতের বই আমি পড়ি না। রাতে ঘুম হয় না–বিচ্ছিরি লাগে।
বই হাতে ক্রিস উপরে উঠে গেল।
কার্ল, কার্ল!
কি হয়েছে, ম্যাডাম?
এই বইটা কি তুমি বসার ঘরে রেখেছ?
না, ম্যাডাম।
উইলি কোথায়?
রান্নাঘরে। ডিনার তৈরি করছে।
নিচে নেমে এল ক্রিস। তার মনে একটা সন্দেহ জেগেছে। হয়ত রেগান পড়েছে এই বই, বেরিঞ্জার ক্লিনিকের ডাক্তাররা যা বলেছেন হয়ত তাই সঠিক। রেগান সম্ভবত এই অবস্থায় এসেছে অটোসাজেশনের মাধ্যমে। এই বইটাই হয়ত সবকিছুর মূলে।
উইলি?
ম্যাডাম।
এই বইটা কি তুমি বসার ঘরে রেখেছো?
হ্যাঁ।
কোথায় পেয়েছিলে এটা?
রেগানের শোবার ঘরে। সত্যি?
হ্যাঁ, ম্যাডাম। রেগানের ঘরের মেঝেতে পড়েছিল। ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ দেখলাম।
ঠিক আছে, যাও।
উইলিকে বিদায় দিয়ে চিন্তিত মুখে ক্রিস বইটা নিয়ে বসল। ডাইনীতন্ত্র। ভূতে পাওয়া। শয়তানের উপাসনা। অনেকগুলো অধ্যায় আছে বইটিতে। মিসেস জো পেরিন এই বইটা তাকে পড়তে দিলেন কেন?
ক্রিস।
কি?
ডিটেকটিভ মিঃ কিণ্ডারম্যান তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন।
ওকে চলে যেতে … না, না, আসতে বল শ্যারন, আসতে বল।
মিসেস ম্যাকনীল।
আসুন, ভেতরে আসুন।
কেমন আছেন আপনি?
ভাল। ধন্যবাদ।
আর আপনার মেয়ে? সে কেমন আছে?
আগের মতোই।
আ-হা, বড় দুঃখের ব্যাপার। বাচ্চা-কাচ্চার শরীর খারাপ থাকলে কেমন লাগে আমি জানি। আমার মেয়ে রুথের যখন অসুখ হল, ওহ,…
দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।
ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ। অবশ্যি আপনি ব্যস্ত থাকলে আরেকদিন অসিতে পারি। কোন তাড়া নেই আমার।
না, ব্যস্ত না। কি যেন বলছিলেন?
রুথের কথা বলছিলাম। আমার বড় মেয়ে। থাক সে-সব। আরেকদিন বলবো। আপনি ব্যস্ত। আমার নিজর জীবনের কথাই বলবো। অদ্ভুত। আপনি ইচ্ছা করলে একটা ছবি বানাতে পারেন। আমার মায়ের কথাই ধরুন। তার জন্যে আমরা সপ্তাহে ছদিন গোসল করতে পারতাম না। গোসল হত শুধু শুক্রবারে। বাকি ছদিন গোসল বন্ধ। বলতে পারেন কেন?
ভারি আশ্চর্য তো! কেন?
হ্যাঁ, আশ্চর্যের ব্যাপারই। ওই ছদিন আমার মা বাথটাবে একটা কাতলা মাছ ছেড়ে রাখতেন। জ্যান্ত মাছ। তার ধারণা ছিল, মাছটা বাথটাবের সব দূষিত জিনিস খেয়ে ওটাকে জীবাণুমুক্ত রাখবে। এখন আপনি বুঝুন অবস্থাটা।
ক্রিস কোন কথা বলল না। কিণ্ডারম্যানের দিকে তাকিয়ে রইল। কেমন বিমূঢ় ওর চাহনি। কিণ্ডারম্যান কিন্তু হঠাৎ উৎসাহী হয়ে নড়েচড়ে বসল। মিসেস ম্যাকনীল, আপনার হাতের এই বইটা প্রেত পূজার ওপর লেখা, তাই না?
হ্যাঁ।
কোনো ছবির গল্পের জন্যে পড়ছেন?
না, এমনি।
বইটা ভালো?
মিঃ কিণ্ডারম্যান, আপনি ঠিক কি জন্যে এসেছেন বলুন তো?
এই দেখুন, কিচ্ছু মনে থাকে না। আসল কথাই ভুলে গেছি। তবে তেমন কিছু না, এই যা। না এলেও হতো, কিন্তু …?
কিন্তু কি?
কিণ্ডারম্যান প্রসঙ্গ পাল্টে হঠাৎ শ্যারনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে বোধহয় আমার পরিচয় হয়নি।
আমি শ্যারন স্পেনসার। ক্রিসের সেক্রেটারি।
খুব আনন্দ হল আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে মিস স্পেনসার। আমি আবার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করি। বকবক করা আমার স্বভাব।
কিছু জিজ্ঞেস করতে চান আমাকে?
মিঃ ডেনিংসকে এ বাড়িতে বসিয়ে রেখে আপনিই তো ওষুধ আনতে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
তাকে একা রেখে গিয়েছিলেন?
না, একা নয়, রেগান ছিল।
তাঁকে রেখে কখন আপনি ঘর ছেড়ে যান?
সাড়ে ছটা হবে। তখন টিভির ছনম্বর চ্যানেলে খবর হচ্ছিল।
ক্রিস হঠাৎ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, আপনি এত সব জিজ্ঞেস করছেন কেন?
একটা হিসাব মিলছে না, মিসেস ম্যাকনীল। তাই খোঁজ-খবর নিতে হচ্ছে। যেমন ধরুন, মিঃ ডেনিংস আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখা না করেই দশ মিনিটের মধ্যে চলে গেলেন অথচ ঘরে তখন গুরুতর অসুস্থ একটা মেয়ে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়?
ক্রিস শুকনো গলায় বললেন, বার্ককে তো আপনি জানেন না, ও খুব খামখেয়ালী।
মিসেস ম্যাকনীল, আরো একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে।
বলুন।
মিঃ ডেনিংস এ-শহরে তাঁর গাড়ি নিয়ে আসেননি। আমি খোঁজ নিয়েছি, তিনি কোথাও যেতে হলে সব সময় টেলিফোন করে ট্যাক্সি আনেন। ঠিক না?
হ্যাঁ, ঠিক।
কাজেই তাঁর উচিত ছিল এখান থেকে ট্যাক্সির জন্যে ফোন করা। কিন্তু প্রতিটা ট্যাক্সি কোম্পানীতে খোঁজ নিয়েছি এ-রকম কোন রেকর্ড তাদের কাছে নেই।
ক্রিসের মুখ ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। কিণ্ডারম্যান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ব্যাপারটা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে, মিসেস ম্যাকনীল।
জটিল?
প্যাথলজিস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী মিঃ ডেনিংসের মৃত্যু দুর্ঘটনার জন্যে হলে হতেও পারে। কিন্তু …
আপনি কি বলতে চান ওকে খুন করা হয়েছে?
কিণ্ডারম্যান আমতা আমতা করে বলল, আমি বুঝতে পারি, সমস্ত ব্যাপারটাই আপনার জন্যে অত্যন্ত দুঃখজনক।
হোক দুঃখজনক, আপনি বলে যান।
মিঃ ডেনিংসের মৃতদেহ পরীক্ষা করলে প্রথমে মনে হয় কেউ যেন ওকে … তার আগে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
শ্যারনের দিকে ফিরল কিণ্ডারম্যান। মিস স্পেনসার, আপনি যখন ওষুধ আনতে যান তখন মিঃ ডেনিংস কি রেগানের ঘরে ছিলেন?
না, বসার ঘরে।
এমন কি হতে পারে না যে তিনি একসময় উঠে গিয়েছিলেন রেগানের ঘরে?
এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন? ক্রিস শুকনো গলায় বলল।
আপনার মেয়ের হয়ত মনে আছে, তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলে …
আমি তো আপনাকে আগেও বলেছি সে অত্যন্ত অসুস্থ, তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা ঠিক। আগেই বলেছেন।
আপনি এত সব জিজ্ঞেস করছেন কেন, বলুন তো?
মিসেস ম্যাকনীল, একটা নতুন সম্ভাবনার দিকে আমার চোখ পড়েছে। এমন কি হতে পারে না যে মিঃ ডেনিংস সেদিন খুব বেশি মদ খেয়ে ফেলেছিলেন আর এই অবস্থায় আপনার মেয়ের ঘরে হাজির হলেন, তারপর সেখান থেকে জানালা দিয়ে নিচে পড়ে মারা গেলেন– হতে পারে না এ রকম?
না। প্রথমত, জানালাটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বার্ক কখনো বেসামাল মাতাল হত না, যদিও প্রচুর মদ খেতো।
তাই কি?
হ্যাঁ। ছবি পরিচালনার সময় সে থাকত পাঁড় মাতাল, কিন্তু তাতে ছবি পরিচালনার কোন অসুবিধা হত না।
আচ্ছা বেশ, তাহলে বলুন ওই রাতে কি অন্য কারো বাড়িতে আসার কথা ছিল?
না।
আপনার এমন কোন বন্ধু কি নেই যে খোঁজ-খবর ছাড়াই হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়?
এ-রকম বন্ধু আমার একজনই–বার্ক।
কিণ্ডারম্যান গম্ভীর মুখে মাথা চুলকাতে লাগল। তারপর নিচু গলায় হেসে বলল, মিসেস ম্যাকনীল, পুরো ব্যাপারটাই জট পাকিয়ে গেছে। আমি বলতে গেলে অথৈ সমুদ্রে পড়ে গেছি। একজন লোক এল আপনার সঙ্গে দেখা করতে। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করেই, অত্যন্ত অসুস্থ একটা মেয়েকে ঘরে একা ফেলে সে চলে গেল? আশ্চর্য নয় কি?
ক্রিস কথা বলল না। কিণ্ডারম্যান গলার স্বর আর এক ধাপ উঁচুতে তুলে বলল, আমার কি মনে হয় জানেন? একজন অত্যন্ত বলশালী লোক মিঃ ডেনিংসকে খুন করেছে। তারপর আপনার মেয়ের ঘরের জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে।
ক্রিস বিবর্ণ হয়ে গেল। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমল তার কপালে।
এই জন্যেই আমি জিজ্ঞেস করছি মিসেস ম্যাকনীল, কে আসতে পারে? ভাল করে চিন্তা করুন।
না, না, এখানে আমার খোঁজে কেউ আসে না।
কার্ল বা উইলি–তাদের খোঁজেও কেউ আসে না?
না, ওদের কোন পরিচিত লোকজন নেই। ওরা নিজেদের মত থাকে।
তা এমনও তো হতে পারে–কেউ কিছু হয়ত দিতে এসেছে, একটা পার্সেল কিংবা দোকানের কোন অর্ডার?
তাতে কি?
হয়ত কোন একটা কারণে সেই পিয়ন বা মেসেঞ্জারের সঙ্গে ঝগড়া বেধে গেল মিঃ ডেনিংসের। তাঁর মেজাজ, আমি যতদূর খবর নিয়েছি, খুবই উগ্র ধরনের ছিল। মিসেস ম্যাকনীল, এমন কেউ কি এসেছিল?
আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়, আপনি কালকে বরং জিজ্ঞেস করতে পারেন। ডাকব কার্লকে?
না থাক। উঠব এবার, ঘরে আপনার অসুস্থ মেয়ে। তাকে অবশ্য দু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারলে … .খুবই মামুলী কথা …
কোন কথা বলার মত অবস্থা আমার মেয়ের নেই।
হ্যাঁ, খুব দুঃখের ব্যাপার। আচ্ছা মিস স্পেনসার, আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল। আজ উঠি। গুড নাইট।
গুড নাইট, মিঃ কিণ্ডারম্যান।
ক্রিস বলল, আসুন আপনাকে এগিয়ে দেই …।
না, না, তার কোন দরকার নেই।
দরজা পর্যন্ত গিয়ে কিণ্ডারম্যান হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। মুখে লজ্জিত ভঙ্গি। মিসেস ম্যাকনীল, একটা অনুরোধ করতে চাই আপনাকে, যদি কিছু মনে না করেন।
না মনে করার কিছু নেই। বলুন।
মানে, ..আমার মেয়ের জন্যে একটা অটোগ্রাফ …
সংকোচের সঙ্গে কাগজ ও কলম বের করল কিণ্ডারম্যান। ক্রিস হাসিমুখে বলল, বলুন, আপনার মেয়ের নাম কি?
মিসেস ম্যাকনীল … আসলে হয়েছে কি … মানে আপনাকে সত্যি কথাই বলি … অটোগ্রাফটা আমি নিজের জন্যেই চাইছি। আমি আপনার একজন ফ্যান… আপনার ‘এনজেল’ ছবিটা আমি ছবার দেখেছি।
ক্রিস খস খস করে লিখল; উইলিয়াম কিণ্ডারম্যানের জন্যে ভালবাসা, তারপর নাম সই করল।
মিসেস ম্যাকনীল, আপনি না, খুব ভালো! আচ্ছা চলি, গুড নাইট।
ক্রিস দরজা বন্ধ করেছে, তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলে ক্রিস দেখে কিণ্ডারম্যানই দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় চুলকে কিণ্ডারম্যান বলল, মিসেস ম্যাকনীল, ইয়ে… মানে … লজ্জার মাথা খেয়ে আবার বিরক্ত করতে হচ্ছে। একটা কথা মনে পড়ে গেল কি না তাই ..
বলুন।
আপনার ওই কার্লের সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই। কোন পার্সেল-টার্সেল এসেছিল কি না এই ব্যাপারে একটু নিঃসন্দেহ হওয়া আর কি! জিজ্ঞেস না করলে বুকের মধ্যে কেমন খচ খচ করবে। অবশ্য জানি কেউ আসেনি তবু …
আপনি ভেতরে এসে বসুন, আমি কার্লকে ডেকে দিচ্ছি।
না, না, আমি বসব না। চট করে কথাটা জিজ্ঞেস করেই চলে যাব। আপনাকে আর কষ্ট করে থাকতে হবে না। প্লীজ!
ঠিক আছে।
কার্ল এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, তার মুখ যথারীতি ভাবলেশহীন, তবে চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক শীতল।
মিঃ কার্ল এস্টর্ম?
বলুন।
আইন মোতাবেক আপনি আমার কথার জবাব ইচ্ছা করলে না-ও দিতে পারেন। ইচ্ছা করলে একজন এটর্নির মাধ্যমেও আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।
কি জানতে চান, বলুন।
আপনি যা বলবেন, প্রয়োজন হলে তা আমি কোর্টে আপনার বিপক্ষে ব্যবহার করতে পারি। ঠিক আছে?
ঘাড় নাড়ল কার্ল।
আপনি আগে বলেছিলেন এপ্রিলের আঠাশ তারিখ রাতে মিঃ ডেনিংসের মৃত্যুর সময় আপনি ছবি দেখছিলেন ক্রেস্ট সিনেমা হলে।
হ্যাঁ।
কখন সিনেমা হলে ঢুকলেন?
ঠিক মনে নেই।
কিন্তু আগে বলেছিলেন ছটার সময় ঢুকেছেন।
হ্যাঁ ছটার সময়ই হবে।
আপনার ছবিটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছেন?
হ্যাঁ।
ছবি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হল থেকে বেরিয়ে আসেন?
হ্যাঁ। আগে বেরোননি তো? মনে করে দেখুন—
না, পুরো ছবিটাই দেখেছি।
কখন ফিরে আসেন বাড়িতে?
ঠিক সাড়ে নটায়।
আর আপনি বলছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছবিটা দেখেছেন?
হ্যাঁ। আমি তো বললামই।
দেখুন মিঃ কার্ল, আপনার সমস্ত কথাবার্তা আমি টেপ করছি। কাজেই ঠিকঠাক বলাই ভালো।
আমি ঠিকঠাক বলছি।
তাহলে আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ছবি শেষ হওয়ার মিনিট দশেক আগে একটা লোক হলে বেশ হৈচৈ করেছে?
মনে আছে।
হৈচৈ-এর কারণটা বলতে পারেন?
মাতাল ছিল লোকটা।
তাকে কি করা হয় তখন?
বের করে দেয়া হয়।
ছবি শেষ হয় কখন?
ঠিক আটটায়।
তার আগে নয়?
না, ঠিক আটটায়।
কিণ্ডারম্যান সিগারেট ধরিয়ে এবার ঠাণ্ডা চোখে তাকাল কার্লের দিকে। দেখল মূর্তির মুখের মত অভিব্যক্তিহীন একটা চেহারা।
মিঃ কার্ল?
বলুন।
ও রাতে সিনেমা হলে কোন গণ্ডগোল হয়নি। আমি আপনাকে ঘটনাটা বানিয়ে বললাম। আপনার কিছু বলার আছে?
না।
হলের প্রজেকশন রুমের লগবুক আমি পরীক্ষা করেছি। যান্ত্রিক গোলযোগের জন্যে ওই রাতে ছবি শেষ হয়েছে আটটা পনেরোয়। কাজেই ছবিটি শেষ পর্যন্ত দেখে থাকলে ঠিক সাড়ে নটায় আপনি ফিরতে পারেন না।
কার্ল বরফ শীতল চোখে তাকিয়ে রইল, কোন জবাব দিল না।
মিঃ কার্ল?
বলুন।
কোথায় ছিলেন ওই রাতে?
আমি ছবি দেখছিলাম।
কিণ্ডারম্যান হাসি হাসি মুখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কালের দিকে। কার্ল ফিসফিস করে বলল, আপনি কি আমাকে অ্যারেস্ট করবেন?
না, এত সহজে কাউকে অ্যারেস্ট করি না আমি। গুড নাইট, মিঃ কার্ল।
গুড নাইট।
বেজায় ঠাণ্ডা পড়েছে, কি বলেন?
হ্যাঁ।
দ্রুতপায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল কিণ্ডারম্যান।
রাত দশটার মত বাজে। শ্যারন ঘুমুতে গেছে। রেগানের ঘরের বাইরে এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল কার্ল। সে-ও একসময় নিজের ঘরে চলে গেল। ক্রিস পর পর দুপেয়ালা কফি খেয়েছে। না, ঘুম আসছে না কিছুতেই। রেগানের ঘরও সাড়াশব্দহীন। তার মানে এখনো জেগে ওঠেনি ও। ডাক্তারের কথাই ঠিক, রেগান আজ রাতে আর জাগবে না।
রাত এগারোটার দিকে ক্রিস মেয়েকে দেখতে গেল। ঘরের ভেতর নীল আলো। ভয়ানক নীরবতা। বাতাস কেমন যেন ভারি হয়ে আছে। ক্রিস মৃদু স্বরে ডাকল, রেগান, মা-মণি।
কোন সাড়া নেই।
ক্রিস খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে ঠিক তখনই ভারি গলায় কে যেন ডাকল, চলে যাচ্ছে কেন? এসো, ফিরে এসো, ময়না সোনা চাঁদের কণী।
কয়েক মুহূর্ত ক্রিস স্পষ্টভাবে কিছু চিন্তাও করতে পারল না। বার্ক ডেনিংসের গলা ভেসে আসছে রেগানের ঘর থেকে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব।
আমি তোমার মেয়ের সঙ্গেই আপাতত আছি। যাব কোথায় বল? কি হল, ভেতরে আসছ না কেন?
ক্রিস বিকৃত স্বরে ডাকল, কাল, কার্ল!
আহ, আবার কার্লকে ডাকা কেন? ভয় লাগছে? ভয়ের কিছু নেই।
ক্রিস খোলা ঘরের দিকে তাকাল। রেগানের কাত হয়ে থাকা মাথাটা দেখা যাচ্ছে। ও কি জেগে আছে? খুট খুট করে শব্দ হল। কিসের শব্দ? ক্রিস তাকাল বন্ধ জানালার দিকে। তখনই চোখে পড়ল ওটা, কিন্তু কি ওটা?
চিৎকার করে উঠল ক্রিস, আর ওই চিৎকারের মধ্যেই জ্ঞান হারাল।