দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা
এখন স্বল্পকালীন শাসিত প্রদেশগুলোর হালহাকিকত পর্যালোচনা করে দেখা যাক মুসলমানদের প্রতি তাদের পক্ষ থেকে কোন ধরনের আচরণ করা হয়।
ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের জণ্যে গভর্ণরগণকে আইন অনুযায়ী যে বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তা প্রয়োগ না করার নিশ্চয়তা না দিলে কংগ্রেস সরকার গঠনে সম্মত হবে না। অর্থাৎ তাদের পরিস্কার কথা এইযে
, সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে তারা মোটেই রাজী নয়। ভারত শাসনে বৃটিশ পলিসির মর্মকথা এই যে, কংগ্রেস তথা ভারতীয় হিন্দু জাতিকে যে কোন মূল্যে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। মুসলিম স্বার্থ পদদলিত করে হিন্দুদেরকে তুষ্ট করার দৃষ্টান্ত অতীতে বহু দেখা গেছে। এবারেও ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো কংগ্রেসকে সরকার গঠনে সম্মত করার জন্যে গোপনে এ নিশ্চয়তা দান করেন যে, গভর্ণরগণ তাঁদের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না যা ১৯৩৫ সালের আইনে তাঁদেরকে দেয়া হয়েছে। এ নিশ্চয়তা দানের পরই কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠনে রাজী হয়।
সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠন করে এবং সকল প্রাদেশিক দলীয় নীতি পুরোপুরি কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মাদ্রাজে কংগ্রেস ৭৪টি আসন লাভ করে এবং রাজা গোপালাচারিয়া মন্ত্রীসভা গঠন করেন। বোম্বাইয়ে কংগ্রেস মাত্র ৪৮টি আসন লাভে সমর্থ হয়।অন্যান্য ছোটখাটো কয়েকটি সমমনা দল নিয়ে বি.জে.খের (B.J. Kher) মন্ত্রীসভা গঠন করেন। বোম্বাইয়ে কংগ্রেস মাত্র ৪৮টি আসন লাভে সমর্থ হয়। অন্যান্য ছোটখাটো কয়েকটি সমমনা দল নিয়ে বি.জে. খের (B.J. Kher) মন্ত্রীসভা গঠন করেন।
যুক্তপ্রদেশে শতকরা ৫৯ আসন কংগ্রেস লাভ করে এবং জিবি প্যান্ট প্রধানমন্ত্রী হন। বিহারে শতকরা ৬২ আসন লাভ ক’রে শ্রকৃষ্ণ সিনহা সরকার গঠন করেন। মধ্যপ্রদেশে শতকরা ৬৩ আসন লাভের পর ডাঃ কারে এবং পরবর্তীকালে শুকলা প্রধানমন্ত্রী হন।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস শতকরা মাত্র ৩৮ আসন পেলেও ডাঃ খান সরকার গঠন করেন।
উড়িষ্যার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে। কংগ্রেস মন্তীসভার পূর্বে পার্লাকিবেদীর মহারাজা চার মাসের জন্যে (এপ্রিল-জুলাই) স্বল্পকালীন সরকার গঠন করেন। বিশ্বনাথ দাস জুলাই ১৯৩৭ পর্যন্ত কংগ্রেস মন্ত্রীসভা পরিচালনা করেন। কংগ্রেস মন্ত্রীসভার পদত্যাগের পর গভর্নর শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৯৪১ এর শেষভাগে গোদাবরী মিশ্রর নেতৃত্বে কতিপয় সংসদ সদস্য কংগ্রেস হাই কমান্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং পার্লাকিবেদীর মহারাজাকে মন্ত্রীসভা গঠনে সহায়তা করেন। মহারাজা তিনজনকে নিয়ে –তিনি স্বয়ং, মিশ্র এবং একজন মুসলমান মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কংগ্রেস হাই কমান্ডের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও মন্ত্রীসভা কাজ চালিয়ে যায়।
প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস শাসন
ভারতের এগারোটি প্রদেশের মধ্যে সীমান্ত প্রদেশসহ সাতটিতে কংগ্রেসের প্রায় আড়াই বছরের শাসন (জুলাই ১৯৩৭ থেকে অক্টোবর ১৯৩৯) হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের এক অতি বেদনাদায়ক ইতিহাস। এসব প্রদেশে সকল ক্ষমতার চাবিকাঠি ছিল কংগ্রেসের হাতে। এ ক্ষমতার ব্যবহার কংগ্রেস কিভাবে করেছিল এবং তা রাজনৈতিক ও সাংবিদানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে কি অশুভ পরিনাম ডেকে এনেছিল তা-ই এখন আলোচনা করে দেখা যাক।
কোয়ালিশন সরকার গঠনে অস্বীকৃতি
সাইত্রিশ সালের নির্বাচনের পর পরই মুসলিম লীগ সভাপতি মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক বিবৃতিতে বলেনঃ
সংবিধান এবং মুসলিম লীগ পলিসি আমাদেরকে অন্যান্য দলের স্বার্থে সহযোগিতা করতে বাধা দেয় না। আমরা যে কোন দলের সাথে সহযোগিতা করতে পারি আইনসভার ভেতরেও এবং বাইরেও।
কিছু সংখ্যক কংগ্রেসপন্থীসহ সকলেই এ আশা পোষণ করছিলেন যে, হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠিত হবে। কিন্তু মুসলিম লীগের সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা করতে কংগ্রেসের অস্বীকৃতি এ আশা ফলবতী হতে দেয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ যুক্ত প্রদেশের অবস্থা এখানে বর্ণনা করা যেতে পারে। এখানে আইন সভায় মোট ২২৮ আসনের মধ্যে মুসলমানদের জন্যে ৬৪ আসন ছিল। তার মধ্যে কংগ্রেস লাভ করে একটি, মুসলিম লীগ ২৬, স্বতন্ত্র মুসলমান ২৮ এবং জাতীয় কৃষি দল ৯। এখানে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ কোয়ালিশন গঠনের বিষয় নিয়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হয়। অবশেষে কংগ্রেস হাই কমান্ডের অন্যতম সদস্য মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে জানিয়ে দেন কোন কোন শর্তে প্রাদেমিক সরকারগুলোতে মুসলিম লীগ যোগদান করতে পারে। শর্তগুলো নিম্নরূপঃ
১। ইউপি আইন পরিষদে মুসলিম লীগ কোন পৃথক দল হিসাবে কাজ করবে না।
২। ইউপি আইন পরিষদের বর্তমান মুসলিম লীগ দল কংগ্রেসের অংশ হিসাবে পরিগণিত হবে, কংগ্রেস পার্টির সদস্য হিসাবে তারা পার্টির অন্যান্য সদস্যদের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। পার্টির আলোচনায় অংশগ্রহণের অধিকারও তাদের থাকবে। পার্টির আলোচনায় অংশগ্রহণের অধিকারও তাদের থাকবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। প্রত্যেক সদস্যের একটি মাত্র ভোট দানের অধিকার থাকবে।
৩। আইন পরিষদের সদস্যদের জন্যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যে নীতি নির্ধারণ করবে এবং যেসব নির্দেশ দিবে, তা কংগ্রেস সদস্যগণ এবং এসব সদস্য মেনে চলবেন।
৪। ইউপি এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ড ভেঙ্গে দিতে হবে। ভবিষ্যতে কোন উপ-নির্বাচনে সে বোর্ড কোন প্রার্থী দিতে পারবে না। কোন আসন শূন্য হলে, কংগ্রেস যাকে নির্বাচনের জন্যে প্রার্থী মনোনিত করবে তাকেই সমর্থন করতে হবে।
৫। মন্ত্রীসভার সদস্যপদ এবং আইন সভার সদস্যপদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত যদি কংগ্রেস করে, তাহলে সে সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগ থেকে আগত সদস্যগণ মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন।
কংগ্রেস হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে মুসলিম লীগকে প্রদত্ত উপরোক্ত শর্তগুলো ছিল হাস্যকর ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ফ্যাসিবাদী মানসিকতার পরিচায়ক। সামান্যতম আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন কোন ব্যক্তি বা দল উপরোক্ত শর্তগুলোর কোন একটিও গ্রহণ করতে পারতো না। কারণ তা হতো আত্মঘাতী।
কংগ্রেসের এ অবিবেচনাপ্রসূত ঔদ্ধত্যের কারণ নির্ণয় করা মোটেই কষ্টকর নয়। মিঃ গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু ভারতে একমাত্র কংগ্রেস ব্যতীত অন্য দলের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজী ছিলেন না। এ দেশে কোন হিন্দু-মুসলিম সমস্যা আছে –একথাও তাঁরা স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। জওহরলাল নেহরু ১২ই মে, ১৯৩৭ সালে চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে বলেন যে, তাঁর বিশ্বাস ভারতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যাটি শুধুমাত্র অল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, জমিদার ও পুঁজিপতিদের মধ্যে সীমিত, যাঁরা এমন এক সমস্যা সৃষ্টি করছেন যা জনগণ স্বীকার করেনা। আইনসভার ভেতরে মুসলমানদের একটা আলাদা দল থাকবে এমন ধারণার প্রতি তিনি বিদ্রুপ বান নিক্ষেপ করেন।
কংগ্রেস ঘোষিত নীতি অনুযায়ী নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের প্রতি আহবান জানানো হয় মন্ত্রীসভার সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্যে নিজেদের দল ভেঙ্গে দিয়ে কংগ্রেসে যোগদান করতে। যুক্ত প্রদেশে হাফেজ মুহাম্মদ ইব্রাহীম এবং বোম্বাইয়ে এম, ওয়াই, নূরী কংগ্রেস শপথনামায় স্বাক্ষর করে কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন। উড়িষ্যায় কোন মুসলমানকে মন্ত্রীসভায় নেয়া হয়নি। মধ্য প্রদেশে জনৈক শরীফকে নেয়া হলেও পরবর্তীকালে তাঁকে সরিয়ে একজন হিন্দু নেয়া হয়।
কংগ্রেস প্রধান প্রদেশগুলোতে কোয়ালিশন সরকারের তো কোন প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু অকংগ্রেস প্রধান প্রদেশগুলোতে কংগ্রেসকে কোয়ালিশনে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির পথ করে দেয়া হয়। বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ১৯৩৮ সালে কোলকাতা মুসলিম লীগ সম্মেলনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেন, কংগ্রেস বারবার এই বলে চাপ সৃষ্টি করছিল যে মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিমন সরকার গঠন করলে তা হবে অধিকতর স্থিতিশীল। সিন্ধুতে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের (Communal Award) বদৌলতে হিন্দুরা যে কৌশলগত সুযোগ সুবিধা লাভ করেছিলেন, তার ফলে সিন্ধু আইন পরিষদে মুসলিম লীগ দল গঠনে তাঁরা বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করেন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অকংগ্রেস মন্ত্রীসভা কংগ্রেসের খপ্পরে পড়ে অপসারিত হয়।কংগ্রেস চাচ্ছিল অন্যান্য সকল দল ভেঙ্গে দিয়ে দেশের একমাত্র দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে। কংগ্রেস ‘একদেশ-একদল-এক নেতার’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। এ নেতৃত্ব ছিল মিঃ গান্ধীর হাতে। সখল কংগ্রেস সরকার প্রতিটি নীতি নির্ধারণে গান্ধীর শরণাপন্ন হতো এবং তাঁর নির্দেশ বেদবাক্যের মতো মেনে নিত। কোন সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হোক, গভর্ণরের সাথে কোন দ্বন্দ্ব-কলহ হোক, অথবা সাধারণ কোন নীতি পলিসি গ্রহণের বিষয় হোক, কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোর প্রধানমন্ত্রীগণ তাঁর (গান্ধীজির) শরণাপন্ন হতেন নির্দেশ-উপদেশ লাভের উদ্দেশ্যে। মিঃ গান্ধী ভাসরয়ের সাথে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আলাপ আলোচনা করতেন। কিন্তু নিজেকে দেখাতেন একজন নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসাবে। কংগ্রেসের উপর তাঁর একনায়কসূলক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রকাশিত থাকলেও কংগ্রেসের সদস্য তালিকায় তাঁর নাম ছিলনা। তাঁর জনৈক গুণগ্রাহী শেঠ গোবিন্দ দাস বলেন, কংগ্রেসীদের নিকটে গান্ধীর পদমর্যাদা ছিল ফ্যাসিস্টদের নিকটে মুসোলিনির, নাৎসীদের নিকেট হিটলারের এবং কমিউনিষ্টদের নিকটে স্টালিনের পদমর্যাদার মতোই (Muslim Separatism in India, Abdul Hamid p.218)
কংগ্রেসের মধ্যে সংসদীয় মানসিকতা অক্ষুণ্ণ থাকবে –কংগ্রেসের এ দাবী ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। কারণ কংগ্রেসী মন্ত্রীগণ না নির্বাচকমন্ডলীর কাছে, আর না আইনসভার কাছে দায়ী ছিলেন।তাঁরা ছিলেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বশংবদ প্রজার ন্যায়। মধ্য প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ডাঃ খারের এবং কোলকাতার সুভাস চন্দ্র বোসের সাথে কংগ্রেস হাই কমান্ডের আচরণ তার একনায়কত্বই প্রমাণ করে।
সুভাস চন্দ্র বোস ১৯৩৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তী বছরেও তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিদ্বতা করে যথারীতি নির্বাচিত হন। কতিপয় কংগ্রেস নেতা তাঁর পদপ্রার্থিতার বিরোধিতা করেন এবং নির্ভাচনে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। অনেকের ধারনা মিঃ গান্ধীজির পরাজয় মনে করা হয়। কংগ্রেসের কার্যকরী সংসদের সদস্যগণ একযোগে পদত্যাগ করেন। অবশেষে গান্ধীকে খুশী রাখার জন্যে কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতিকে অপসারিত করা হয়।
কংগ্রেস শাসন এবং মুসলমান
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মন্ত্রীসভার শাসন মুসলমানদের জন্যে চিল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। এসব প্রদেশে মুসলিম লীগকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠনে কংগ্রেসের অস্বীকৃতি মুসলমানদের জন্যে ছিল সাবধান বাণী। কিন্তু বাস্তবে কংগ্রেস যখন এসব প্রদেশে তাদের পরিকল্পিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করে, তখন মুসলমাগণ যা ভয় করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশী দুর্বিষহ অব্স্থার সম্মুখীন হয়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সভ্যতা সংস্কৃতি বিলুপ্তির চরম আশংকা দেখা দেয় এবং সামাজিক প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকেও পরিকল্পিতভাতে তাদেরকে অপসারিত করার অভিযান শুরু হয়। এমনকি কংগ্রেস শাসনের অধীন তাদের জানমাল ইজ্জত আবরুও একেবারে লুণ্ঠিত হতে থাকে।
কংগ্রেস সরকার ও হিন্দু জনসাধারণের যেসব আচরণ মুসলমানদের ধর্মীয় ভাবাবেগ মারাত্মকভাবে আহত করে তা হলো –‘বন্দে মাতরাম’ সংগীত, নামাজের আজানে বাধা দান, নামাজরত অবস্থায় নামাজীদের উপর আক্রমণ, মসজিদের সম্মুখ দিয়ে বাদ্যসহ শোভাযাত্রা পরিচালনা, গরুর গোশত নিষিদ্ধকরণ প্রভৃতি।
আইনসভার দৈনিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার প্রাক্কালে মুসলমানদের বাধাদাদ সত্ত্বেও অনিবার্যরূপে ‘বন্দে মাতরাম’ সংগীত গাওয়া হতো। বংকিম চন্দ্র চ্যাটার্জি ১৮৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘আনন্দ মঠ’ নামজ উপন্যাসে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের রণধ্বনি হিসাবে ‘বন্দে মাতরম’ সংগীত রচনা করেন। ১৯০৫ সালের পর হিন্দুদের ‘বংগভংগ রদ’ আন্দোলনে বন্দে মাতরম ‘জাতীয় সংগীত হিসাবে গাওয়া হয়। এ গানের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা।
যেসব মুষ্টিমেয় মুসলমান সরকারী চাকুরীতে ছিলেন তাঁদের মানসম্মান ও প্রভাবপ্রতিপত্তি শুদু ক্ষুণ্ণই করা হলো না, বরঞ্চ তাঁদের চাকুরীর মেয়াদকাল হুমকির সম্মুখীন করা হলো। বহু ঘটনার মধ্যে দৃষ্টান্তস্বরূপ একটির উল্লেখ একানে করা যেতে পারে। মধ্য প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎকারে একথা বলেন যে, তাঁর মন্ত্রীসভা প্রদেশের একমাত্র মুসলমান বেসামরিক জেলা অফিসারের চাকুরী স্থায়ীকরণের বিষয়টির চরম বিরোধিতা করে। এর একমাত্র কারণ ছিল এই যে তিনি ছিলেন একজন মুসলমান।
মুসলিম জনসাধারণ তাদের হিন্দু প্রতিবেশী এবং প্রশাসনযন্ত্রের চরম স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়ে পড়েছিল। মধ্য প্রদেশের কোন কোন বস্তিতে মুসলমানদের ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং মুসলিম মহিলাদের ইজ্জত আবরু লুণ্ঠন করা হয়। একটি গ্রামের দেড়শ’ জন পুরুষ মুসলমানকে হত্যার অভিযোগে কয়েকদিন যাবত পানাহারের সুযোগ ব্যতীত থানায় আবদ্ধ রাখা হয়, নানাভাবে অপমানিত ও নির্যাতিত করা হয়। পরে কোর্ট তাঁদেরকে বেকসুর মুক্তি দান করে। মধ্য প্রদেশের মন্ত্রীগণ কোর্টে অভিযুক্ত মুসলমানদের বিচার চলাকালে (in sub judice cases) মতামত ব্যক্ত করতেন –যার ফলে বিচারকগণ অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতেন। নাগপুর হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি একটি মামলার রায়ে নির্ভিক চিত্তে একথা বলেন যে, পুলিশ, কংগ্রেস নেতা, ম্যাজিস্ট্রেট, হাকিম এবং মন্ত্রী একযোগে নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিমঞ্চের দিকে ঠেলে দিত। এসব হতভাগ্যদের মুসলমান হওয়অ ছাড়া আর কোন অপরাধ ছিলনা। (Muslim Separatism in India, Abdul Hamid p.122)
কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোতে মুসলমানগণ যে নানানভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছিলেন, তার প্রতিকার কল্পে ২০শে মার্চ, ১৯৩৮ এ অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। পীরপুরের রাজা সাইয়েদ মুহাম্মদ মাহদীকে সভাপতি করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি উক্ত বছরের ১৫ই নভেম্বর তার পূর্ণাংগ রিপোর্ট পেশ করে। ব্যক্তিগতভাবে সরেজমিনে তদন্ত করেই এ রিপোর্ট পেশ করা হয়।
পরবর্তী বছরের মার্ট মাসে শরীফ রিপোর্ট নামে আর একটি রিপোর্ট নামে আর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বিহার প্রদেশে মুসলমানদের উপর হিন্দুদের নির্যাতনের কাহিনী বর্ণিত হয় এ রিপোর্টে। কংগ্রেস সরকারগুলোর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগপূর্ণ আর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে। এ রিপোর্টের প্রণেতা ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক।
এ তিনটি তথ্যপূর্ণ ও মূল্যবান দলিলপত্র এবং সমসাময়িক মুসলমান পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনাবলীর ফাইল কংগ্রেসের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলোর অগণতান্ত্রিক ও মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকার বিরুদ্ধে মুসলমানদের অভিযোগের মৌলিক উপকরণ ও মালমশলা উপস্থাপন করে। যেহেতু কংগ্রেস শাসনের স্বাভাবিক মেজাজ প্রকৃতি পরবর্তীকালে পাকিস্তানের ধারণা-মতবাদকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল এবং অখন্ড ভারতের মতাদর্শ তেকে মুসলমাদেরকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল
, সেজন্যে তদন্ত রিপোর্টে উদঘাটিত তথ্যের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করার এবং তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার প্রয়োজন আছে।
পীরপুর রিপোর্ট
পীরপুর রিপোর্টে নিম্ন বিষয়গুলোর উপর জোর দেয়া হয়েছেঃ
১। কংগ্রেস সরকার সংখ্যালঘুদের (মুসলমানদের) ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা দানে ব্যর্থ হয়েছে।
২। কংগ্রেস একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িত সংগঠন বলে প্রমাণিত।
৩। ক্ষমতামদমত্ত কংগ্রেসের রুদ্ধদ্বার নীতি (Closed door policy) অবলম্বন এবং কোয়ালিশন সরকার গঠনে অস্বীকৃতি হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটিয়েছে।
৪। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদের ধারণা অনুযায়ী সংখ্যাগুরুর শাসন ও অবিচার উৎপীড়ন থেকে অধিকতর উৎপীড়ন আর কিছু হতে পারেনা।
৫। মুসলিম লীগের কাছে অত্যন্ত অবমাননাকর প্রস্তাব পেশঃ যেমন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি ভেঙ্গে দাও, আইনসভায় লীগদল ভেঙ্গে দিয়ে দ্বিধাহীনচিত্তে কংগ্রেস শপথনামায় স্বাক্ষর কর, ইত্যাদি।
৬। মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গণসংযোগ আন্দোলন (Mass Contact Movement) এবং কতিপয় মুসলমানকে নানভাবে খরিদ করে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লাগানো এবং
৭। কংগ্রেস শাসনাধীন প্রদেশগুলোতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং মুসলমানদের জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।
ফজলুল হক সাহেবের বিবৃতি
কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলোর পদত্যাগের পর পরই বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব এ, কে, ফজলুল হক যে বিবৃতি দান করেন তা একটি প্রচারপত্রের আকারে পুনঃ প্রকাশিত হয়। তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেনঃ
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস মারমুখো হিন্দুদেরকে চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের জন্যে মাঠে নামিয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর কংগ্রেস তার ইচ্ছা ও সংকল্প চাপিয়ে দেয়ার জন্যে এ কাজ শুরু করেছে। কংগ্রেস কি চায়? চায় যে, গোমাতা সংরক্ষিত হোক, মুসলমানদেরকে গোমাংস ভক্ষণ করতে দেয়া যাবেনা। মুসলমানদের ধর্মকে অবনত ও দমিত করে রাখতে হবে। কারণ এটা হিন্দুদের দেশ নয়?
তারপর শুরু হলো আযানের উপর বাধা নিষেধ। মসজিদে নামাযীদের উপর আক্রমণ। নামাযের সময়ে মসজিদের সম্মুখ দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে বাজনা বাজিয়ে মিছিল পরিচালনা। দুঃখজনক ঘটনা পাল্টা দুঃখজনক ঘটনা ডেকে আনবে এতে আশ্চর্যের কি আছে?
তারপর বিবৃতিতে বিহারে সংঘটিত বাহাত্তরটি, যুক্ত প্রদেশে তেত্রিশ এবং মধ্য প্রদেশের কতকগুলি দুর্ঘটনার উল্লেখ্য করা হয়। কোন মুসলমান কোথাও একটি গরু কুবানীর জন্যে জবাই করলে মুসলমানদের হত্যা করা হয়, তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং মুসলিম নারী ও শিশুর উপর নির্যাতন চালানো হয়। এসবের কোন প্রতিকার করা হয় না। ফলে সংখ্যালঘু মুসলমানগণ বড়ো দুঃসহ জীবন যাপন করতে থাকে।
কংগ্রেস শাসনের অধীন মুসলমানদের চরদ দুর্দশা বর্ণনা করে জনাব ফজলুল হক যে বিবৃতি দেন, হিন্দু পত্রিকাগুলো তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। বরঞ্চ মুসলমানদের বিরুদ্ধে কল্পিত অভিযোগ ফলাও করে প্রকাশ করতে থাকে। (I.H. Qureshi –The Struggle for Pakistan, A. Hamid –Muslim Separatism in India))
শিক্ষার অংগনেও মুসলমানদের উপর চরম অন্যায় অবিচার শুরু হয়েছিল যার জন্যে মুসলিম সুধীবৃন্দ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ শাসন আমলে মুসলমানগণ শিক্ষা ক্ষেত্রে খুবই পশ্চাদপদ ছিলেন যার জন্যে তাঁদেরকে নানান অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো। কংগ্রেস শাসন আমলে তাদের শিক্ষানীতি তাদেরকে দারুণভাবে শংকিত ও বিচলিত করে। ১৯৩৮ সালের শেষভাগে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিলভারত মুসলিম এডুকেশনাল কনফরেন্সে (All India Muslim Educational Confernc e) ৫২-তম অধিবেশনে নবাব কামাল ইয়ার জং বাহাদুরের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
উদ্দেশ্য ছিল ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা পুংখানুপুংখরূপে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা এবং মুসলিম শিক্ষার একটি স্কীম তৈরী করা যাতে তাদের সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যাবলী সংরক্ষিত হয়। বাংলার আইন পরিষদের স্পীকার এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার স্যার আজিজুল হকের নেতৃত্বে একটি সাব কমিটি গঠিত হয়। সাব কমিটি সঠিক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থান সফর করেন এবং ১৯৪২ সালে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করেন। বিদ্যামন্দিরগুলোতে যে ওয়ার্ধা স্কীম অব এডুকেশন চালু করা হয়েছিল, রিপোর্টে তার তীব্র সমালোচনা করা হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশে এ এক জঘন্য আকার ধারণ করে। মুসলমানদের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী এ আইনসভায় একটি বিল পেশ করা হয়। সকল মুসলিম সদস্য এবং ডাঃ খারে সহ কতিপয় হিন্দু সদস্য বিরোধিতা করেন। সকল বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিলটি পাশ করা হয়।
এ ব্যবস্থার অধীনে যুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচিত হবে। মুসলিম স্কুলগুলোর জন্যে কোন বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মিঃ গান্ধীর প্রতিকৃতির সামনে হিন্দুদের পূজা অর্চনার ভংগীতে কৃতাঞ্জলীপুটে দাঁড়াতে হতো এবং তাঁর (মিঃ গান্ধীর) বন্দনা গাইতে হোত। এ মূল পরিকল্পনা –ওয়ার্ধা স্কীম ছিল গান্ধীমানসিকতার সৃষ্টি। শিশুদের মনে হিন্দু ধর্মীয় ভাবধারা অংকিত করা এবং হিন্দু পৌরাণিক মনীষীদের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধার মনোভাব সৃষ্টি করা। এভাবে মুসলমানদেরকে তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও পরস্পরাগত ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই ছিল এ শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য। কংগ্রেস শিক্ষা ব্যবস্থার মূলনীতি ছাড়াও এর কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ও মুসলমানদের মদ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে
, বোম্বে প্রদেশে স্কুলগুলোতে বহু নতুন প্রাথমিক পাঠ্য পুস্তক থেকেই পাঠ্যতালিকা তৈরী করতেন। মুসলমানদের প্রবল আপত্তি ছিল এই যে, এসব পুস্তকে হিন্দু ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির প্রশংসা করা হয়েছে এবং শুধুমাত্র হিন্দুয়ানি শব্দমালা ব্যবহার করা হয়েছে।
বোম্বে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে যে, এ ধরনের প্রাথমিক পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নের দ্বারা কংগ্রেস মুসলমানদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রেখে এবং তাদের কচিকাঁচা মনকে হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতির ভাবধারার উদ্বুদ্ধ করে ভারতে মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চায়।
বোম্বে মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের মুসলমান সদস্যগণ প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তকগুলো প্রত্যাহার করার জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করলে তা প্রত্যখ্যান করা হয়। প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সদস্যগণ অধিবেশন থেকে ‘ওয়াক আউট’ করেন। কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলোর পদত্যাগের পর, উর্দু টেক্সট বুক কমিটি পুনরায় উক্ত পাঠ্য পুস্তকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তা পাঠের উপযোগী নয় বলে রিপোর্ট দেন এবং তার ফলে সেগুলো অনুমোদিত তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।
(Times of India, dt.11 and 26 July and 14 December, 1939)
উপমহাদেশের এগারোটির মধ্যে সাতটি প্রদেশে আড়াই বছরের কংগ্রেস শাসন একথাই প্রমাণ করে যে এখানে কংগ্রেস শাসনের অধীনে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সভ্যতা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যসহ অস্তিত্বই মুছে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে মিঃ জিন্নাহ বলেন, কংগ্রেস সমগ্র উপমহাদেশে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যে কেউ ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত সময়কালের ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পর্যবেক্ষণ করলে তিনি দেখতে পাবেন যে, কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এ দেশ থেকে অন্য সকল সংগঠন নির্মূল করে একটি অতি নিকৃষ্ট ধরনের ফ্যাসিবাদী সংগঠন কায়েম করা। এমতাবস্তায় ভারতে একটি সংসদীয় সরকার পরিচালনা করা অসম্ভব। এখানে গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে হিন্দুরাজ। এ অবস্থা মুসলমানগণ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। [Jamiluddin Ammed (Ed) –Some Recent Speeches & Writtings of Mr. Jinnah (Lahore, 1952]
কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলোর মুসলিম বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে নিরপেক্ষ মহলও মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেন যে, এখানে সংখ্যাগুরুর শাসনে মুসলমানদের আশংকা অমূলক নয়। জনৈক ভারতীয় খৃষ্টানের মতে কংগ্রেস হচ্ছে জার্মানীর নাৎসী পার্টির ভারতীয় সংস্করণ। (Rev. Pitt Banarjee –Letter of Manchester Guardian, 18 August, 1942; I.H. Qureshi –The Struggle for Pakistan)
বিভিন্ন পত্রিকার অভিমত
কংগ্রেসের সাতটি প্রদেশে সরকার গঠনের ফলে হিন্দু জাতীয়তা কেমন উগ্ররূপ ধারণ করে ও সাম্প্রদায়িক তিক্ততা বৃদ্ধি পায় সে সম্পর্কে কোলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা লেখেঃ প্রত্যেক ভারতপ্রেমিক বিচলিত হবেন এই দেখে যে, প্রাদেশিক অটোনমি স্থাপিত হওয়ার দরুন কী ভয়ানক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইকনমিস্ট পত্রিকা মন্তব্য কনের, প্রদেশগুলোকে সরাসরি দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায় -মুসলিম ভারত ও কংগ্রেস ভারত। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একজন প্রাক্তন সম্পাদক বলেছিলেন
, হ্নিদু মুসলিম বিরোধ কেবল ধর্মীয় কারণে নয়, জীবনধারায় দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ানক পার্থক্য রয়েছে। সংগ্রেসী প্রাদেশিক সরকারগুলো সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির নির্দেশে শাসন চালাতে থাকে। এজন্যে এমন সার্বিক কংগ্রেসী প্রতাপের অভিব্যক্তিতে বৃটেনের কংগ্রেস সমর্থকগণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। কংগ্রেসের হিন্দুকরণ নীতি, বন্দে মাতরম সংগীত ও গান্ধীর প্রতিকৃতি পূজা শিক্ষাংগনে প্রবর্তন প্রভৃতি সহজেই প্রমাণ করে যে নতুন শাসন ব্যবস্থার পুরোপুরি হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। (The British Achivement in India: A Survey, Rawlinson; p.214; মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ২৮৭)
হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ অন্য কোন সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে মুসলমানদের কিছুতেই বরদাশত করতে রাজী নয়। যার কারণে ভারতে হিন্দু-মুসলিম মিলন সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে মুসলমানগণ মোটেই দায়ী নন। মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হিন্দুভারত সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু এ কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন যে তিনি ছিলেন হিন্দু মুসলিম মিলনের অগ্রদূত? তিনি বহু বছর ধরে এ মিলনের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিরাশ হয়ে ভারতভূমি ত্যাগ করেন এবং আর কোন দিন ভারতে আসবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু পরে তাঁকে মুসলমানের ন্যায্যা দাবী ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের লক্ষ্যে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হয়।
হিন্দু মুসলিম মিলন তো দূরের কথা হিন্দুদের চরম মুসলিম-বিদ্দেষের কারণে ১৯২০ সাল থেকে আট বছর সাম্প্রদায়িক দাংগায় সারা দেশ জর্জরিত হয়। ১৯২৩ সালে ১১টি, ১৯২৪ সালে ১৮টি, ১৯২৫ সালে ১৬টি, ১৯২৬ সালে ৩৫টি এবং ১৯২৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩১টি বিরাট দাংগা অনুষ্ঠিত হয়। ফোর্ট নাইটলী রিভিউতে জনৈক ইংরেজ লেখেন
, হিন্দু ও মুসলমানের মিলন পৃথিবীর আরও অনেক অসম্ভব জিনিসের মতো একটা অসম্ভব ব্যাপার। এশিয়াটিক রিভিউ পত্রিকায় জনৈক প্রাট্রিক ফ্যাগান লেখেন, পরাধীন ভারতের মুসলমানদের দুটি পথ খোলা আছে –হয় হিন্দু জাতিতে লীন হয়ে যাওয়া, না হয় দৈহিক শক্তি বলে ভারতের কোন কোন অঞ্চলে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েম করা। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদূদ-২৮৬)
ভারতে সাম্প্রদায়িক দাংগা-হাংগামা কোন বছরই বন্ধ থাকেনি। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে এসব দাংগা সংঘটিত হয়। একথাও সত্য যে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় এসব দাংগার উদ্যোক্ত এবং তারাই মূলতঃ দায়ী। কিন্তু মিঃ গান্ধী চোখ বন্ধ করে সকল ক্ষেত্রেই মুসলমানদেরকে দায়ী করেছেন। ফলে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আড়াই বছরের কংগ্রেসী শাসনে যে হিন্দু রামরাজ্যের নমুনা স্থাপিত হয়েছিল এবং মুসলমানদের ভাগ্যে যে চরম দুর্দশা নেমে এসেছিল তার কিঞ্চিৎ আলোচনা উপরে করা হয়েছে। এ সময়ে, ১৯৩৮ সালে সুভাসচন্দ্র বোস কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁকে অন্যান্যের তুলনায় খানিকটা উদারচেতা মনে করা হতো। তাঁর সাতে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দীর্ঘ পত্র বিনিময় হয়। কায়েদে আজম বারবার মিঃ সুভাসচন্দ্র বোসকে একথা বলেন যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একত্রে মিলিত হয়ে সকল বিবাদ ও মতপার্থক্যের মীমাংসা করা হোক। কায়েদে আজম কংগ্রেস মুসলিম লীগ তথা হিন্দু মুসলিম মিলনের সর্বশেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু সুভাস বোস কায়েদে আজমের পত্রের জবাবে বলেনঃ
লীগের সাথে আলাপ আলোচনার ব্যাপারে ওয়ার্কিং কমিটির করার আর কিছু নেই। (Muslim Political Thiught the Ages 1562-1947-G.Allana Moqbul, Lahore, p-242)
কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৮ সালে পাটনায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেনঃ
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ চান যে মুসলমান ভারতে হিন্দুরাজ শর্তহীনভাবে মেনে নিক। ….আপনারা অবশ্যই জানেন যে কংগ্রেস ফ্যাসিবাদী প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব করার উদ্দেশ্যে হিন্দু-মুসলিম সমঝোতার সকল পথ রুদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, ভারতে চারটি শক্তি ক্রিয়াশীল- (১) ব্রিটিশ, (২) ভারতীয় রাজ্যের শাসকবৃন্দ, (৩) হিন্দু এবং (৪) মুসলমান। কংগ্রেস পত্র-পত্রিকা যতোই ফলাও করে প্রকাশ করুক না কেন; দুপুরে বিকেলে ও রাতে তাদের সংস্করণ বের করুন এবং কংগ্রেস নেতারা যতোই গলাবাজি করুন যে, কংগ্রেস একটি জাতীয় সংগঠন, আমি বলি তা মোটেই সত্য নয়। এ একটা হিন্দু সংগঠন ব্যতীত কিছু নয়। এটাই সত্য কথা এবং কংগ্রেস নেতারা তা ভালো করে জানেন। এতে কয়েকজন মাত্র –কয়েকজন বিভ্রান্ত ও পতভ্রষ্ট –কয়েকজন মুসলমান খারাপ মতলবে সংশ্লিষ্ট থাকলেই তা জাতীয় সংগঠন হয় না, হতে পারে না। কংগ্রেস প্রধানতঃ একটি হিন্দু সংগঠন এবং আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি কেউ তা অস্বীকার করুক দেখি। আমি জিজ্ঞেস করি কংগ্রেস কি মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে?
শ্রোতাগণ সমস্বরে জবাব দেন –না, না, না।
আমি জিজ্ঞেস করি –কংগ্রেস কি খৃষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে? তফসিলী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে? অব্রাহ্মণদের প্রতিনিধিত্ব করে? জনগণ প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে সমস্বরে বলে না, না, না।
তিনি আরও বলেন, কংগ্রেস সখল হিন্দুরাও প্রতিনিধিত্ব করেনা। হিন্দু মহাসভা-লিবারাল ফেডারেশন –এদেরও প্রতিনিধিত্ব করেনা। তবে নিঃসন্দেহে কংগ্রেস একটি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। এছাড়া আর কিছু নয়।
তিনি বলেন, দেশের জন্যে দুর্ভাগ্য যে, কংগ্রেস হাইকমান্ড অন্যান্য সম্প্রদায় ও সংস্কৃতি নির্মূল করে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠানর জন্যে একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
কায়েদে আজম অতঃপর একটি একটি করে কংগ্রেসের ভূমিকার উল্লেখ করে প্রমাণ করেন যে, কংগ্রেস জাতীয় সংগঠন নয়। তিনি বলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে কি করে? জাতীয়তাবাদের ভান করলেও ‘বন্দে মাতরম’ দিয়ে কাজ শুরু করে। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে ‘বন্দে মাতরম’ জাতীয় সংগীত নয়।
ততাপি তা জাতীয় সংগীত হিসাবে গাওয়া হয় এবং অন্যান্যদের উপরও চাপিয়ে দেয়া হয়। এ শুধু তাদের দলীয় সমাবেশেই গাওয়া হয় না। বরঞ্চ সরকারী ও মিউনিসিপাল স্কুলগুলোতেও তা গাইতে সকলকে বাধ্য করা হয়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস তা গাইতে অনুমতি দিক না দিক, ‘বন্দে মাতরম’ জাতীয় সংগীত হিসাবে অবশ্যই মুসলমানদের মেনে নিতে হবে। এ হচ্ছে পৌত্তলিকতা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উদ্রেককারী স্তুতিগান।
তিনি বলেন, তারপর কংগ্রেস পতাকার কথাই ধরা যাক। এ ভারতের সর্বজনস্বীকৃত জাতীয় পতাকা নয়। তথাপি তার প্রতি প্রত্যেক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে এবং তা সরকারী বেসরকারী সকল গৃহে উত্তোলন করতে হবে। মুসলমানরা এ নিয়ে যতোই আপত্তি করুক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না। কংগ্রেস পতাকা ভারতের জাতীয় পতাকা হিসাবে অবশ্যই উত্তোলন করতে হবে এবং মুসলমানদের উপর তা জোর করে চাপিয়ে দিতে হবে। অতঃপর তিনি হিন্দী হিন্দুস্থানী স্কীম সম্পর্কে বলেন যে, উর্দুকে দাবিয়ে রাখা ও তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য।
ওয়ার্ধা শিক্ষা প্রকল্প
মিঃ গান্ধীর সকপোলকল্পিত ওয়ার্ধা শিক্ষা প্রকল্পের (Warda Scheme of Education) ভয়াবহ পরিণাম উপরের আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছে।
কায়েদে আজন তাঁর ভাষণে বলেনঃ আজকাল হিন্দু মানসিকতা ও দৃষ্টিভংগী সতর্কতার সাথে পরিপুষ্ট করা হচ্ছে এবং মুসলমানদেরকে তাদের দৈনন্দিন জীবনে হিন্দু আদর্শ ও ভাবধারা অবলম্বনে বাধ্য করা হচ্ছে। মুসলমানরা কি কোথাও এ ধরনের কোন কিছু করছে? কোথাও কি তারা হিন্দুদের উপর মুসলিম সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছে? বরঞ্চ মুসলমানদের উপর হিন্দু সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে তারা সামান্য প্রতিবাদ ধ্বনি করলেই তাদেরকে সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাদেরকে বলা হয় শান্তি বিনষ্টকারী এবং সঙ্গে সঙ্গেই স্বৈরাচারী সরকারী প্রশাসন যন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে পড়ে। বিহারে সংঘীটত ঘটনাবলীর কথাই ধরুন না কেন, কংগ্রেস সরকারের অধীন কাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানা হয়েছে? মুসলমানদের। কাদের বিরুদ্ধে দমননীতি অবলম্বন করা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে এবং কাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে? মুসলমানদের বিরুদ্ধেই এসব কিছু করা হয়েছে। কিন্তু এমন একটি দৃষ্টান্তও কি কেউ পেশ করতে পারে যে মুসলিম লীগ অথবা কোন মুসলমান মুসলিম-সংস্কৃতি হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে? (Creation of Pakistan, Justice Syed Shameem Hossain Kadir, pp.139-143)