দু-একদিনের মধ্যে প্যারিস প্লাস্টারের ছাঁচটা হয়ে গেল। সুশীল প্রাচীন ধনী বংশের সন্তান, ওর যে ছাঁচ গড়িয়ে দিলে, সে ভাবলে ওদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি এটা। ফেরত দেওয়ার সময় সে বললে–এটা আমার এক বন্ধুকে একবার দেখতে দেবে?
কেন বল তো?
আমার সে বন্ধু মিউজিয়ামে কাজ করে। পন্ডিত লোক। যদি গভর্নমেন্টের তরফ থেকে এটা কিনে নেওয়া হয় তাই বলছি।
তাকে তোমার স্টুডিয়োতে কাল নিয়ে এসো।
পরদিন জামাতুল্লাকে নিয়ে সুশীল বন্ধুর স্টুডিয়োতে গিয়ে দেখলে একটি সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক সেখানে বসে আছেন।
বন্ধুটি বলে উঠল–এই যে এসো সুশীল, ইনি এসে অনেকক্ষণ বসে আছেন–আলাপ করিয়ে দিই–ডা. রজনীকান্ত বসু, এম. এ., পিএইচ. ডি.–মিউজিয়ামে সম্প্রতি চাকুরিতে ঢুকেছেন।
কিছুক্ষণ পরে ডা. বসু পদ্মরাগের সিলমোহরের ওপর ঝুঁকে পড়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠে বললেন–এ জিনিসটা আপনি পেলেন কোথায়?
সুশীলের আর্টিস্ট বন্ধু বললে–ওটা ওদের বংশের জিনিস। ওরা পল্লিগ্রামের প্রাচীন ধনী বংশ।
ডা. বসু সন্দিগ্ধ মুখে বললেন–কিন্তু এ তো তা নয়! এ যে বহু পুরোনো জিনিস! এ আপনারা পেয়েছিলেন কোথায় তার ইতিহাস কিছু জানেন? যদি বলতে বাধা না থাকে–
সুশীল বললে–না ডা. বসু, আমি এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারব না। আপনি কী আন্দাজ করছেন।
ডা. বসু বললে–দেখুন, সিলমোহরের ওপর এ চিহ্ন আমি নিজে কখনো দেখিনি–তবে এই ধরনের পাথরের ওপর সিলমোহর ওঁকারভাটে পাওয়া গিয়েছে। ফরাসি ইন্দোচীনের জঙ্গলের মধ্যে বহু পুরোনো নগরের ধ্বংসস্তূপে। এর সময় নির্দিষ্ট হয়েছে মোটামুটি খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী। আমাদের মিউজিয়ামেও আছে–কাল যাবেন, দেখাব। কিন্তু আপনার এটা আরও পুরোনো, আমি একে নির্ভয়ে নবম শতাব্দীতে ফেলে দিতে পারি–কিংবা তারও আগে।
সুশীল বললে–আপনার তাই মনে হয়?
নিশ্চয়ই। নইলে বলতাম না। আর সেই জন্যেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি আপনাদের পূর্বপুরুষে এটা পেলেন কী করে? এ হল সমুদ্রপারের জিনিস। বাংলা দেশের পাড়াগাঁয়ের আম গাছের ছায়ায় শান্ত ও নিরীহ জিনিস নিয়ে কারবার–কিন্তু এ সিলমোহরের পেছনে রয়েছে অজানা সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার দুর্দান্ত সাহস, দুর্জয় বিক্রম, যুদ্ধ, রক্তপাত–ভারতবাসী যেদিন সমুদ্রের ওপারে বিদেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেইসব দিনের ইতিহাস এ সিলমোহরের সঙ্গে জড়ানো। তাই বলছি, এটা আপনারা পেলেন কী করে?
.
ওখান থেকে বেরিয়ে আসবার সময়ে সুশীলের মনে টাকার স্বপ্ন ছিল না।
ছিল যে সুদূরের, দুঃসাহসিক অভিযানের স্বপ্ন–জামাতুল্লা খালাসির অত বড়ো পদ্মরাগ মণিখানার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
সে এমন এক দিনের স্বপ্ন–যা প্রত্যেক ভারতবাসীর আত্মসম্মানকে জাগ্রত করে, তরুণদের প্রাণে নতুন আশা, উৎসাহ ও আনন্দের সংবাদ আনে বয়ে–
তবু তা সুশীলের মনে যে ছবি জাগালে তা আদৌ স্পষ্ট নয়–সবই আবছায়া, সবই ধোঁয়া ধোঁয়া। সুশীল ইতিহাসের ছাত্র নয়। ডা. বসুর শেষ কথা ক-টির সঙ্গে যেন এক অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক শক্তি মেশানো ছিল–তার চোখের সামনে প্রাচীনকালের সুদীর্ঘ অলিন্দ বেয়ে তলোয়ার হাতে বর্মে চর্মে সুসজ্জিত বীরের দল সারি সারি চলেছে, মৃত্যুকে তারা ভয় করে না–অজানা সমুদ্রপথে তাদের বিজয় অভিযান নব উপনিবেশের ইতিহাস সৃষ্টি করে ভাবীকালের অসহায় ও অকর্মণ্য সন্তানদের শিরায় শিরায় নতুন রক্তের আলোড়ন এনে দেয়।
কোথায় সে পড়ে আছে পাড়াগাঁয়ে, পুরোনো জমিদার-ঘরের বিলাসপুষ্ট আয়েসি ছেলেটি সেজে–তাদেরই পূর্বপুরুষ একদিন যে অসি হাতে সপ্ত সমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছিল–তাদেরই স্বজাতি, স্বদেশবাসী–আর সে থাকবে দিব্যি আরামে তাকিয়া ঠেস দিয়ে শুয়ে, তেলে জলে, দাদখানি চালের ভাত আর মাছের ঝোলে কোনোরকমে পৈতৃক বাঙালি প্রাণটুকু বজায় রেখে চলবে টায় টায়।
চিরকাল হয়তো এমনি কেটে যাবে তার।
প্রজা ঠেঙিয়ে খাজনা আদায় করে, পুরোনো চন্ডীমন্ডপে বসে তামাক টেনে আর পালপার্বণে গ্রাম্য লোকজনের পাতে দই মোণ্ডা দিয়ে হাততালি অর্জন করবার প্রাণপণ চেষ্টায় মশগুল হয়ে।
তারপর আছে মামলা, মোকদ্দমার তদারক করতে কোর্টে ছুটোছুটি–ডিক্রি, নালিশ, কিস্তিবন্দি, সইমোহরের নকল, সমন জারি–উঃ! ভাবলে তার গা কেমন করে। প্রাচীন ধনী বংশের লাল খেরো-বাঁধানো রোকড় ও খতিয়ানের চাপে সে নিজের যৌবন ও জীবনকে একদম পিষে মেরে ফেলে শেষের দিকে যখন মহকুমার হাসপাতালে একটি মাত্র রোগী থাকবার স্থানের টাকা জেলাবোর্ডের হাতে দেবে স্বর্গীয় পিতৃদেবের স্মৃতি-রক্ষা কল্পে–তখন হয়তো সে পাবে রায়সাহেব বা রায়বাহাদুর খেতাব।
আর সঙ্গে সঙ্গে ভাববে, এই তো জীবনের পরম সার্থকতা সে পেয়ে গেছে।
না দেখবে দুনিয়া–না দেখবে জীবন, টুলিপরা বলদের মতো ঘানিগাছের চারিধারে ঘুরেই জীবন কাটাবে।
রাত্রে সে সনৎকে ডেকে বললে–সনৎ, তোর সাহস আছে?
কেন দাদা?
আমি যদি বিদেশে বেরোই, আমার সঙ্গে যাবি?
এখুনি–যদি নিয়ে যাও!
অনেক দূরে হলেও?
যেখানে বল।
বাড়ির জন্যে মন কেমন করবে না?
আমি পুরুষ মানুষ না দাদা? ও কথাই ওঠে না!
আমি এমনি জিজ্ঞেস করছি
পরদিন সে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে বসে পড়ল পুরোনো দিনের বৃহত্তর ভারতের ইতিহাস। যেসব কথা সে জানত না, কোনোদিন শোনেনি–ডা. বসুর কথায় তার ইচ্ছে গেল সেগুলো জানবার ও পড়বার।
বিজয়সিংহের সিংহল বিজয়ের কাহিনি, চম্পা রাজ্যের কথা–সুদূর সমুদ্রপারের ভারতীয় উপনিবেশ চম্পা। ভারতবাসী অসির তীক্ষাগ্রভাগ দিয়ে যে দেশের মাটি পাথরের গায়ে নাগরাজ বাসুকী, শিব-পার্বতী ও বিষ্ণুমূর্তি অমর করে রেখেছে।
জামাতুল্লা খালাসিকে সে এক-শো বার ধন্যবাদ জানালো ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে বসে পড়তে পড়তে।
সে তো এক পাড়াগাঁয়ে অলস জীবনযাপন করছিল—
কোনোদিন এসব কথা সে জানতেও পারত না–এত বড়ো ছবি তার মনে কোনোদিন জাগতও না–যদি দৈবক্রমে জামাতুল্লা খালাসি সেদিন তার পাশে এসে বসে দেশলাই না চাইত।
তুচ্ছ এক পয়সার দেশলাই।
পড়ার টেবিলে বসে বসেই সুশীলের হাসি পেল কথাটা ভেবে।
ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি থেকে বার হয়েই জামাতুল্লা খালাসির সঙ্গে দেখা করতে গেল।
মাঠের মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসে আছে। সুশীলকে দেখে সে বললে–আসুন বাবু, কাল রাতে এক কান্ড হয়ে গেছে! আপনার সঙ্গে দেখা করব বলে–
সুশীল বাধা দিয়ে বললে–কী–কী?
জামাতুল্লা বললে–সে এক আজগুবি কান্ড বাবু—
কীরকম ব্যাপার?
আপনার সেই বন্ধুর বাড়ি থেকে পাথরখানা নিয়ে কাল ফিরছি বাবু, মেটেবুরুজের কাছে ছোটোমোল্লাখালি বলে যে বস্তি ওই বস্তির কাছে আমার এক দোস্ত থাকে। ভাবলাম, চা খেয়ে যাই। সেখানে একেবারে মানুষ নেই–ফাঁকা মাঠ, সিকিমাইল দূরে ছোটোমোল্লাখালি বস্তি। হঠাৎ বাবু আমার মনে হল আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, কে যেন আমার গলা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে আমায় মেরে ফেলবার চেষ্টা করছে–আমি তো চেঁচিয়ে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম–কিন্তু পড়ে গেলাম চিৎপাত হয়ে মাঠের মধ্যে–পেছনে সে-সময় পায়ের শব্দ শুনলাম যেন–
সুশীল ব্যস্ত হয়ে বললে–পাথরখানা আছে তো?
শুনুন বাবু, তারপর। আমি এমন কান্ড কখনো দেখিনি। চিৎপাত হয়ে পড়ে আর জ্ঞান নেই। যখন জ্ঞান হল তখন দেখি আমার চারিপাশে দু-তিন জন লোক দাঁড়িয়ে, তারা কেউ পানি এনে আমার চোখে-মুখে দিচ্ছে, কেউ গামছা নেড়ে বাতাস করছে। আমার দোস্ত-এর নাম বলতে তারা আমায় ছোটোমোল্লাখালি নিয়ে গেল তার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে যখন আমার হুঁশ বেশ ভালো ফিরে এল, আমি পকেটে হাত দিয়ে দেখি পাথরখানা নেই।
বল কী? নেই! গেল সেখানা!
শুনুন বাবু আজগুবি কান্ড! পাথর নেই দেখে তো আমি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম। দোস্তের বাড়ি তো শোরগোল পড়ে গেল। কত লোক দেখতে এল–আমার দোস্ত কতবার মুখে-চোখে পানি দিয়ে ডাক্তার ডেকে আমায় চাঙ্গা করলে। আমি সেই রাত্রেই বাড়ি চলে গেলাম–
তারপর?
বাবু আপনি বলুন একটা কথা। আমি কাল আপনার দোস্তের কাছে দেখাতে গিয়েছিলাম কী নিয়ে? যে ছাঁচ তৈরি হয়েছিল তাই নিয়ে–না আসল পাথরখানা নিয়ে? আপনার ওই যে দোস্ত খুব এলেমদার লোক, তার কাছে?
ও, ডা. বসুর কাছে তুমি তো আসল পাথরখানা নিয়ে গেছলে। ছাঁচখানা নিয়ে যাইনি ঠিক তো? কিন্তু বাবু বাড়ি ফিরে দেখি আসল পাথরখানা পকেটে রয়েছে, ছাঁচখানা নেই।
সুশীল হো-হো করে হেসে বললে–এ কোনো আজগুবি কান্ড হল না জামাতুল্লা। তুমি দু-খানাই নিয়ে গেছলে। যে তোমার গলা টিপেছিল সে ছাঁচখানাকে ভুল করে নিয়ে গেছে– আসলখানা তোমার পকেটেই রয়ে গিয়েছিল। কোন পকেটে কোনটা রেখেছিলে মনে আছে?
বাবু আমি ছাঁচটা নিয়েই যাইনি–
আমি বলছি শোনো। তুমি ভুলে দুটোই নিয়ে গেছলে। কিন্তু এ থেকে আমাদের সাবধান হতে হবে। কেউ আমাদের পাথরের খবর পেয়েছে–কলকাতা গুণ্ডা বদমাইশের জায়গা আমরা ক-দিন ধরে এখানে পাথরের কথা বলেছি, তত সাবধান হইনি। এখানেও শুনতে পারে, সেদিন ডা. বসুর ওখানে দুটো আরদালি দাঁড়িয়ে ছিল–আমার সন্দেহ হয় তাদের মধ্যে কেউ শুনতে পারে। যাক, ভালোই হয়েছে যে আসলখানা চুরি যায়নি! আজ তোমার সঙ্গে নেই তো সেখানা?
না বাবু। আমি কি আর তেমনি উজবুক?
লোক লেগেছে আমাদের পেছনে। খুব সাবধানে চলাফেরা করবে।
জামাতুল্লা হেসে বললে–বাবু, লোক লেগে আমায় হঠাৎ কিছু করতে পারবে না। সারাঙ্গুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছি–কত বদমাইশ লোকের সঙ্গে কতবার কারবার করেছি। এই হাতদুটো যে দেখছেন–এ দুটো ঠিক থাকলে এর সামনে কেউ এগোতে পারবে না জানবেন খোদার দোওয়ায়।
সুশীল একবার চারদিকে চেয়ে দেখলে–কোনোদিকে কোনো লোক নেই। সঙ্গীকে চুপিচুপি বললে–এসব কথা এখন নয়। তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারবে?
কোথায় বাবুজি?
আমার বাসায়। সেখানে ঘরের মধ্যে বসে সব কথা হবে এখন।
জামাতুল্লাকে সঙ্গে নিয়ে সুশীল তাদের বাসায় এল। আসার পথে কোনো কিছু অঘটন ঘটেনি দেখে সুশীলের মন থেকে ভয় ও বিপদাশঙ্কা অনেকখানিই চলে গেল। জামাতুল্লাকে কিছু খেতে দিয়ে ও তার জন্যে বাইরের ঘরের কোণে বিছানা করে দিলে।
জামাতুল্লা বললে–বাবুজি, বিছানা কেন?
রাত্রে এখানে তোমায় রাখব। যেতে দেব না মেটেবুরুজে। সাবধানের মার নেই। খিদিরপুরের মাঠ থেকে মেটেবুরুজ পর্যন্ত জায়গা বড্ড নির্জন–গুণ্ডা বদমাইশদের আড্ডা। রাত্রে সে-পথে গেলে বিপদ আছে। তোমার যত সাহসই থাকুক–রাত্রে যাওয়া হবে না।
সুশীলের এ সতর্কতার জন্যে জামাতুল্লাকে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকতে হয়েছিল।
রাত্রে আহারাদির পরে সুশীল জামাতুল্লাকে বললে–আমার মতলব তোমাকে বলব বলেই তোমায় ডেকেছি। আমার মনে হয়েছে আমরা যে করেই হোক–চলো সেই বনের মধ্যে প্রাচীন নগরের সন্ধানে বেরোই। টাকাকড়ির সন্ধান আমি করছি নে–পাই ভালো, তা আমি একা নেব না–নটরাজনের স্ত্রীর শেষ দিনগুলো যাতে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটে তার ব্যবস্থা করব তা দিয়ে। তারপরে তুমি আছ, আমি আছি। ভগবানের আশীর্বাদে আমার ঘরে খাবার ভাবনা নেই।
জামাতুল্লা খালাসি ঘাড় নেড়ে বললে–সে আমি আগেই জানি বাবু–আপনি রইস আদমি –মানুষ দেখেই চিনতে পারি। নইলে আপনাকে এত বিশ্বাস করতাম না। বড়ো ঘরানা আপনারা, আপনাদের নজর হবে বড়ো।
তা ছাড়া কী জান জামাতুল্লা? এই বয়স হচ্ছে বিদেশ বেড়ানোর সময়। চিরকাল বাড়ি বসে থাকব যদি, তবে দুনিয়া দেখব কবে? … তোমার সাহস আছে আমায় সেখানে নিয়ে যাবার তো?
এ বাবুজি সাহসের কথা নয়। জাহাজ চালানো বিদ্যের কথা–কৌশলের কথা। সিঙ্গাপুরে আমার এক দোস্ত আছে তাকে খুঁজে বার করতে হবে। সে সুলু সি-তে জাহাজ চালিয়েছে অনেক দিন–আপনার কাছে ছিপাব না, বোম্বেটের কাজ করত সে। এখন বড্ড কড়া শাসন, ওলন্দাজ সরকার আর আমাদের ইংরেজ সরকারের। মানোয়ারি জাহাজ সর্বদা ঘুরছে। বোম্বেটে জাহাজ ধরতে পারলেই ধরে নিয়ে আসবে–আর গুলি করবে। সেজন্যে সে কাজ ছেড়ে দিয়ে দোকান করে বসে আছে সিঙ্গাপুরে। তাকে সঙ্গে নিতে হবে।
তাহলে কীরকম ব্যবস্থা করবে যাবার?
আপনি টাকা কত নিতে পারবেন বলুন।
শ-পাঁচেক। তার বেশি এক পয়সা নয়।
তাও নেবেন না। আপনি আমার দোস্ত–দু-শো নিয়ে চলুন। আমি পাথর বিক্রি করে ফেলি–সেই টাকায় চালাব।
সে টাকা তোমায় আমি নিতে দেব না জামাতুল্লা। নটরাজনের স্ত্রীকে বঞ্চিত করে সে-পাথর নিয়ে আমাদের ফল ভালো হবে না। নটরাজন স্বর্গ থেকে দেখবে আর অভিশাপ দেবে।
এই জন্যেই তো বলি, রইস আদমির বুদ্ধি আর আমাদের বুদ্ধি! আপনি যা বলবেন বাবুজি।
অনেক রাত হয়েছিল। জামাতুল্লার বিশ্রামের বন্দোবস্ত করে দিয়ে সুশীল নিজে শোবার জন্যে চলে গেল বটে–কিন্তু তার সারারাত ঘুম এল না চোখে। এবার কী ক্ষণে সে বাড়ি থেকে বার হয়েছিল! সাগরপারের যাত্রী হয়ে যদি সেই অজানা দ্বীপে অরণ্যের মধ্যে প্রাচীন যুগের হিন্দু-কীর্তি শুধু চোখের দেখা দেখে আসতে পারে–তবেই সে জীবন সার্থক বিবেচনা করবে। চম্পারাজ্যের মতো সেখানেও আর এক হিন্দু উপনিবেশ ছিল নিশ্চয়ই মহাকালের চক্রনেমির আবর্তনে অরণ্য গ্রাস করেছে সে নগরী–তবুও ভারতের সন্তান সে প্রাচীন যুগের সেই পুণ্যভূমির পবিত্র ধূলি স্পর্শ করে সে ধন্য হতে চায়।
অর্থের জন্যে সে যাচ্ছে না।
পরদিন সকালে উঠে সুশীল জামাতুল্লাকে চা ও খাবার খেতে দিয়ে তার সঙ্গে গল্প করতে বসেছে–এমন সময় কাগজওয়ালা খবরের কাগজ দিয়ে গেল; সুশীল কাগজ খুলে সংবাদগুলোর ওপর সাধারণভাবে চোখ বুলোতে গিয়ে হঠাৎ উত্তেজিত সুরে বলে উঠল– জামাতুল্লা, আরে, তোমাদের মেটেবুরুজে খুন! …
জামাতুল্লা চা খেতে খেতে চমকে উঠে বললে–কোথায় বাবু, কোথায়?
দু-নম্বর মফিজুল সর্দারের লেন, একটা কুঠুরিতে নূর মহম্মদ নামে একটা লোককে গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে–
সুশীল কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখলে জামাতুল্লা তালপাতার মতো কাঁপছে–অতি কষ্টে সে সুশীলকে জিজ্ঞেস করলে–কী নাম লোকটির বাবুজি?
নূর মহম্মদ–
জামাতুল্লা চা ফেলে উঠে এসে সুশীলের হাত ধরে বললে–আপনি আমার সবচেয়ে বড়ো দোস্ত–কাল এখানে রেখে আপনি আমার জান বাঁচিয়েছেন! নূর মোহম্মদ আমার ঘরেই থাকে। এক বিছানাতে দু-জনে শুই–কাল আমি থাকলে আমাকেই মারত, আমি ভেবে ভুল করে ও বেচারিকে খুন করে গিয়েছে–
সুশীল বলে–তুমি এখুনি বাড়ি যাও–সেই জিনিসটা–
বাবু, সে আমি অন্য জায়গায় রেখেছি–সেখান থেকে কেউ সেটা বের করতে পারবে না।
সুশীল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে–তবুও একবার যাও—
সেটা নিয়ে বাবুজি আপনাদের বাড়িতে রেখে দিন আপনি–মেহেরবানি করে যদি রেখে দেন!
নিশ্চয়ই রাখব। তুমি একা যেও না–চলো আমিও সঙ্গে যাচ্ছি। আমার ভাই সনৎকে সঙ্গে নেব।
পাথরখানা এনেই সুশীল কয়েকদিনের মধ্যে তার আর-একখানা ছাঁচ করিয়ে নিয়ে সেখানা ব্যাংকে জমা দিয়ে এল। ওসব জিনিস সঙ্গে রাখলেই যত গোলমাল।
কিন্তু ব্যাংকে রাখবার কয়েকদিন পরেও ঘটে গেল এক বিপদ।
সুশীল তখন হাজার দুই টাকার ব্যবস্থা একরকম করে ফেলেছে। তার কাকাই টাকাটা তাকে দেবেন–তবে সে বলেছে ব্যাবসার জন্যেই ওটা দরকার–বিদেশে যাওয়ার কথা শুনলে কেউ উৎসাহ দিত না। ওর সঙ্গে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে রাজি, সনৎ একথা জানিয়েছে।
সুশীল বৌবাজার দিয়ে গিয়ে জামাতুল্লাকে ট্রামে দিয়ে এল। ট্রাম পরবর্তী থামবার জায়গায় যাবার পূর্বেই ট্রামে এক শোরগোল উঠল।
জামাতুল্লা ট্রামের বেঞ্চিতে বসবার সঙ্গে সঙ্গেই পাশের একজন লোক নেমে গেল– নেমে যাবার সময় একবার যেন তার হাতখানা জামাতুল্লার পিঠের দিকে ঠেকল..অন্তত জামাতুল্লার তাই মনে হল। পরক্ষণেই জামাতুল্লা রক্তাক্ত দেহে চিৎপাত ট্রামের মেঝেতে!
লোকজন হইহই–পুলিশ! পুলিশ! সবাই মিলে ওকে ধরাধরি করে নামিয়ে ফেললে।
শেষে দেখা গেল ওর বিশেষ কিছু লাগেনি এবারও। একখানা ধারালো ছুরি দিয়ে বোধ হয় আততায়ী কোমরের থলে কাটতে চেষ্টা করেছিল। ছুরিখানা দৈবাৎ তলপেটের পাশের দিকে লেগে খানিকটা অগভীর রেখা সৃষ্টি করে লম্বালম্বিভাবে কেটে গিয়েছে।
এই ঘটনার ঠিক সাতদিন পরে সুশীল, সনৎ ও জামাতুল্লা তিনজনে একখানা রেঙ্গুনগামী জাহাজে চড়ে বসল–আপাতত সিঙ্গাপুর এবং সেখান থেকে ব্যাটেভিয়া যাবে এই হল উদ্দেশ্য ওঁদের।
মাস দুই পরের কথা। সকাল বেলা।
সুশীল সিঙ্গাপুরের ভারতীয় পাড়ায় একটি ছোটো শিখ হোটেলের একটা ঘরে বসে সনৎকে বলছিল–আমরা এখানে এসে ভালো করলাম কী মন্দ করলাম এখনও বুঝিনি সনৎ। জামাতুল্লার বোম্বেটে বন্ধু তো দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির লোক–ও হাসতে হাসতে মানুষ খুন করতে পারে। ওকে কি খুব বিশ্বাস করা উচিত হল?
বিশ্বাস না করেই বা উপায় কী দাদা? ও ছাড়া সুলু সমুদ্রে জাহাজ চালাবে কে? তবে আমার মনে হয় যখন আমাদের কাছে এমন কোনো মূল্যবান জিনিস নেই–তখন সে অনর্থক মানুষ খুনের দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে যাবে কেন?
এমন সময় বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। জামাতুল্লা তার বোম্বেটে বন্ধু মি. ইয়ার হোসেনকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ইয়ার হোসেন ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে একটা চুল-ছাঁটা দোকান করে ভাড়াটে চীনে নাপিত দিয়ে চুল ছাঁটায়-রোজগার মন্দ হয় না। বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর বয়স হবে, রোগা চেহারা–চোখের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ভালোমানুষ ও নিরীহ ধরনের বলে মনে হয়–পরনে সাহেবি পোশাক। লোকটা ভারতীয় নয়, মালয়ও নয়–কোন দেশের লোক তা কখনো বলেনি। তবে তার কথাবার্তা থেকে মনে হয় ভারতের ওপর টানটা তার বেশি। কথাবার্তা বলে ইংরেজিতে, নয়তো মালয় ভাষায়। তার ভাঙা ইংরেজি জামাতুল্লা বেশ বোঝে।
এ ধরনের লোকের সঙ্গে কখনো সুশীল বা সনৎ-এর পরিচয় ঘটেনি ইতিপূর্বে। বাইরে মোটামুটি ভদ্রলোক, এমনকী বেশ নিরীহ প্রকৃতির প্রৌঢ় ভদ্রলোক–কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইয়ার হোসেন দুর্দান্ত দস্যু। মুহূর্তের মনোমালিন্যের ফলে যারা বন্ধুর বুকে অতর্কিতে তীক্ষ্ণধার কিরিচ বসিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করে না–এ সেই-জাতীয় লোক।
ইয়ার হোসেন ঘরে ঢুকে বললে–বসে আছেন? আমায় আর দু-শো টাকা দিতে হবে– দরকার রয়েছে।
সুশীল জামাতুল্লার মুখের দিকে চাইলে অতি অল্পক্ষণের জন্যে। জামাতুল্লা চোখের ইঙ্গিতে তাকে বলে দিলে ইয়ার হোসেনকে যেন সে প্রত্যাখ্যান না করে।
কত টাকা বললেন মি. হোসেন?
দু-শো কী আড়াইশো—
বেশ, নেবেন। সেদিন নিয়েছেন এক-শো—
ইয়ার হোসেন যেন খানিকটা উদ্ধত সুরে বললে–নিয়েছি তো কী হবে? তোড়জোড় করতেই সব টাকা যাচ্ছে–
জাহাজের কী হল? চার্টার করবেন?
জাহাজ চার্টার করবার টাকা কোথায়? কিন্তু আচ্ছা, একটা কথা বলি। আপনারা সে বিহ্মমুনির দেশে যেতে চাইছেন কেন? টাকা-কড়ি হীরে-জহরত সেখানে সত্যি আছে?
কী করে বলি সাহেব! তবে, তোমার কাছে লুকোব না। খুব বড়ো রত্নভান্ডার সেখানে লুকোনো আছে এই আমাদের বিশ্বাস। ওই মণির ওপর আঁক-জোঁক আছে–ওটাই তার হদিশ–অন্তত নটরাজন তাই বলেছিল।
আমি চেষ্টা করে দেখব–কিন্তু আমার ভাগ ঠিক তিন ভাগের এক ভাগ চাই। ফাঁকি দেবার চেষ্টা করলেই বিপদ ঘটবে। এই হাতে অনেক মানুষ খুন করেছি, সে-কথা কে না জানে? মানুষ মারাও যা, আমার কাছে পাখি মারাও তা।
সুশীলের গা যেন শিউরে উঠল। কাজের খাতিরে এমন নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোকের সঙ্গে আজ তাকে মিশতে হচ্ছে–ভাগ্য কী জানি কোন পথ তাকে নির্দেশ করছে! মুখে বললে–না সাহেব, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো–ফাঁকে তুমি পড়বে না।
ইয়ার হোসেন বললে–একটা গল্প বলি শোনো তবে। একবার আমার জাহাজে ছ সাতজন মাল্লা মদ খেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে। তাদের দলে একজন সর্দার ছিল, সে এসে আমায় জানালে, এই এই শর্তে আমি রাজি না হলে তারা আমার হাত-পা বাঁধবে–মেরে ফেলতেও পারে। আমি ওদের সান্ত্বনা দিয়ে শর্তে সই করে দিলাম। তারপর ইঞ্জিন রুমের বড়ো কর্মচারীকে ডেকে বললাম–জাহাজে কয়লা দিয়েই স্টিম বন্ধ করে ফার্নেসের মুখ খুলে রাখবে।
ইঞ্জিনিয়ার বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে–কেন কাপ্তেন সাহেব–এ তো বড়ো বিপজ্জনক ব্যাপার–সেই ভীষণ উত্তাপে ফার্নেসের মুখ খুলে রাখব?
সে বেচারি আমার মতলব কিছু বুঝলে না। আমি সেই বিদ্রোহী সর্দারকে আর তার চারজন অনুচরকে বললাম ফার্নেসে কয়লা দিতে। এদিকে ইঞ্জিন-রুমে টেলিগ্রাফে ইঞ্জিনিয়ারকে পুরোদমে স্টিম দিতে বলেই ওরা ঘরে ঢুকবার সঙ্গেসঙ্গে পুলি ঘুরিয়ে জাহাজ প্রায় পঁচিশ ডিগ্রি কোণ করে স্টারবোর্ডের দিকে কাত করে ফেললাম। টাল সামলাতে না পেরে ওরা হঠাৎ গিয়ে পড়ল খোলা ফার্নেসের মুখে। লোক ঠিক করা ছিল, তক্ষুনি তারা ওদের ফার্নেসের আগুনে ধাক্কা মেরে ঠেলে দিয়ে ফার্নেসের দরজা ঘটাং করে বন্ধ করে দিলে।
সনৎ ও সুশীল রুদ্ধনিশ্বাসে বললে–তারপর?
তারপর? তারপর দু-দিন পরে কতকগুলি আধপোড়া হাড় পোড়া কয়লার ছাইয়ের সঙ্গে ফার্নেস-সাফ-করা কুলি সমুদ্রের জলে ফেলে দিলে। মিউটিনি শেষ হয়ে গেল।
কেউ টের পেলে না?
সবগুলো বদমাইশ যখন ও পথে গেল–তখন বাকিগুলি আপনা আপনিই চুপ করে গেল। ভালোমানুষির দিন চলে গিয়েছে জানবেন। নিষ্ঠুর হতে হবে, নির্মম হতে হবে–তবে মানুষের অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পারবেন।
সুশীল বুঝল না এমন নিরীহ ভালোমানুষটির আড়ালে কী করে এমন দৃঢ় ও নির্মম চরিত্র লুকোনো থাকতে পারে।
আর একটা কথা–অস্ত্রশস্ত্র কেমন আছে আপনাদের?
কিছু না, একটি করে অটোম্যাটিক আছে দু-জনের–তার কার্টিজ নেই।
রাইফেল নেই?
ভারত থেকে রাইফেল কেনা? মি. হোসেন, এবার আপনি হাসালেন।
ইয়ার হোসেন দ্বিরুক্তি না করে বেরিয়ে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে একটা বড়ো রিভলবার নিয়ে এসে সুশীলের হাতে দিয়ে বললে–পছন্দ হয়?
ওঃ, এ তো চমৎকার জিনিস।
এই কিনব তিনটি তিনজনের, আর একটা পুরোনো মেশিনগান—
মেশিনগান কী হবে!
অনেক দরকার আছে।
সুশীল ও সনৎ দু-জনেই দেখলে সে অনেকরকম জানে-শোনে। জাহাজ চালানোর যন্ত্রাদি কিনবার সময়–তার যে কিছু কিছু বিজ্ঞানের জ্ঞানও আছে–এ পরিচয়ও পাওয়া গেল। চালচলনে, ধরনধারণে–সে সর্বদাই মনে করিয়ে দেয় যে সে সাধারণ নয়।
সুশীল জামাতুল্লাকে বললে–তুমি বলেছিলে দু-শো টাকা হলেই হবে–তো এখন দেখছি পাঁচশো টাকাই মি. হোসেন নিয়ে নিলে নানা ছুতো করে; হাতে কিন্তু এক পয়সাও রইল না–
কোনো ভয় নেই বাবুজি, আমি যখন আছি। ও তেমন লোক নয়।
লোক নয় কীরকম? ভয়ানক লোক, আমরা বুঝেছি। ও দরকার মনে করলে তোমার মতো পুরোনো বন্ধুর গলা কাটতে এতটুকু দ্বিধা করবে না।
বাবুজি দেখছি ভয় পেয়ে গিয়েছেন।
তা একটু পেতে হয়েছে। টাকাটা ও মেরে দেবে না তো? তুমি হুশিয়ার হয়ে থাকবে ওর পেছনে।
বাবুজি আমি হাজার পেছনে থেকেও কিছু করতে পারব না–ও যদি ইচ্ছে করে তবে সিঙ্গাপুর থেকে আজই পালিয়ে যেতে পারে–কেউ পাত্তাই পাবে না। ইয়ার হোসেন ছাঁচটার কথা জিজ্ঞেস করছিল–
তুমি কী বললে?
বললাম, বাবুর কাছে আছে।
মতলব কী?
না বাবু খারাপ কিছু নয়–ও একবার দেখতে চায়।
ওঃ, ভাগ্যিস আসল পদ্মরাগখানা ব্যাংকে জমা দিয়ে এসেছিলাম কলকাতায়! নইলে সেই পাথর নিয়ে কলকাতাতেই খুন হয়ে গেল মেটেবুরুজে! এখানে আনলে সে-পাথর আমরা হাতে রাখতে পারতাম না!
জামাতুল্লা গলার স্বর নীচু করে বললে–বাবুজি, এখানেও লোক পেছন নিয়েছে।
সুশীল ও সনৎ একযোগে সবিস্ময়ে বলে উঠল–কীরকম!
এখন বলব না, আপনারা ভয় পেয়ে যাবেন। সিঙ্গাপুর ভয়ানক জায়গা–এখানে দিনদুপুরে মানুষের বুকে ছুরি বসায়–পরে শুনবেন।
সিঙ্গাপুরে যেদিকে বড়ো ডক তৈরি হয়েছে, ওর কাছে অনেক দূর পর্যন্ত সামরিক ঘাঁটি। সাধারণ লোককে সেসব রাস্তা দিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। জামাতুল্লাকে পথপ্রদর্শকরূপে নিয়ে দু-জনে সেই দিকে বেড়াতে বেরোলো। সমুদ্রের নীল দিগন্ত-প্রসারী রূপ এখান থেকে যেমন দেখায়, এমন আর কোথাও থেকে নয়। দুপুরের কাছাকাছি সময়টা প্রখর রৌদ্রকিরণে সমুদ্র জল ইস্পাতের ছুরির মতো ঝকঝক করছে। দু-খানা মানোয়ারি জাহাজ বন্দর থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে।
একজন চীনেম্যান এসে ওদের পিজিন ইংলিশে বললে–টি, স্যার, টি?
নো টি।
নো টি স্যার? মাই হাউস হিয়ার স্যার, ভেরি গুড হোম-মেড টি স্যার!
সনৎ বললে–চলো দাদা, চলো জামাতুল্লা, একটু চা খেয়ে আসি।
সবাই মিলে রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা চীনা বাঁশঝাড়ের আড়ালে একটা অ্যাসবেস্টস এর ঢেউ-খেলানো পাত দিয়ে ছাওয়া ছোট্ট বাড়িতে এল। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বাঁশের টেবিল পাতা আছে বারান্দায়। তিনজনে সেখানে বসে দূরে সমুদ্রের দৃশ্য দেখছে–এমন সময় চীনেম্যানটি চা নিয়ে এল। ওরা চা খাচ্ছে, সে লোকটা আবার কিছু কেক নিয়ে এসে ওদের সামনে রাখলে। ওদের বললে–তোমরা কোথায় যাবে?
সুশীল বললে–বেড়াতে এসেছি।
কোথা থেকে?
কলকাতা থেকে।
ভেরি গুড। চমৎকার জায়গা সিঙ্গাপুর।–এখান থেকে আর কোথাও যাবে নাকি?
না, আর কোথাও যাব না।
ভালো কিউরিও কিনবে?
কী জিনিস?
এসো না ঘরের মধ্যে।
ওরা তিনজনে ঘরের মধ্যে ঢুকল। বুদ্ধের মূর্তি, মালা, ড্রাগনের মূর্তি, পোর্সিলেনের পেটমোটা চীনে ম্যাণ্ডারিনের মূর্তি ইত্যাদি সাধারণ শৌখিন জিনিস আলমারিতে সাজানো– ওরা হাতে করে দেখছে, এমন সময়ে সনৎ একটা জিনিস হাতে নিয়ে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠল–
দাদা দেখো!
সুশীল ও জামাতুল্লা দু-জনেই চেয়ে দেখলে, একখানা জেড পাথরে তৈরি ছুরির গায়ে কী আঁক-জোঁক কাটা। ভালো করে দু-জনেই দেখলে অবিকল সেই আঁক-জোঁক, নটরাজনের পদ্মরাগ মণির গায়ে যে আঁক-জোঁক ছিল।
ওরা সবাই অবাক হয়ে গেল।
সুশীল বললে–এ ছুরিখানার দাম কত?
দু-ডলার, মিস্টার।
এ ছুরি তুমি কোথায় পেলে?
দেখি ছুরিখানা? ও, এ আমি একজন মালয়ের কাছে কিনেছিলাম।
এখানেই?
হ্যাঁ, একজন মাল্লা ছিল সে।
কোথা থেকে সে ছুরিখানা পেয়েছিল তা কিছু বলেনি?
না মিস্টার। তবে ছুরিখানা সে ভয়ে পড়ে বিক্রি করে। সে বলেছিল দু-দু-বার সে প্রাণে মরতে মরতে বেঁচে যায়, এ ছুরিখানার জন্যে। তার পেছনে লোক লেগেছিল। লুকিয়ে আমার কাছে বিক্রি করে। কেউ জানে না যে এখানা আমার কাছে আছে।
আমরা এখানা নেব।
ওখানা বিক্রি হবে না।
আমরা তিন ডলার দেব।
নিয়ে বিপদে পড়বে তোমরা। ও নিও না।
তোমার দোকানের জিনিস বিক্রি করতে আপত্তি কী?
আমি আমার খরিদ্দারকে বিপদে ফেলতে চাইনে। শোনা মিস্টার, আমি জানি ও ছুরি তুমি কেন নিতে চাইছ। ওই আঁক-জোঁকগুলোর জন্যে–ঠিক কিনা? প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে অনেকে জানে ওই আঁকগুলো কোথাকার এক গুপ্ত নগর আর তার ধনভান্ডারের হদিশ। সকলে জানে না বটে, তবে পুরোনো লোক কেউ কেউ জানে। অনেক পুরোনো জেড পাথরের আংটিতে ওই আঁক-জোঁক আমি দেখেছি। ও নিয়ে একটা গুপ্ত সম্প্রদায় আছে। সম্প্রদায়ের বাইরে আর কারো কাছে এই আঁক-জোঁকওয়ালা আংটি কী ছুরি কী কিরিচ দেখলে তারা তার পেছনে লেগে গুপ্তহত্যা পর্যন্ত করে ফেলে–তবে তাদের আসল উদ্দেশ্য থাকে, জিনিসটাকে হস্তগত করা।
কেন?
পাছে অন্য কেউ ওই আঁক-জোঁকের হদিশ পেয়ে সেই প্রাচীন নগর আর তার গুপ্ত ধনভান্ডার আবিষ্কার করে ফেলে। ওরা নিজেরা যখন বের করতে পারলে না–তখন আর কাউকে ওরা খোঁজ করতেও দেবে না। ও চিহ্নের জিনিস কাছে রাখা মানে প্রাণ হাতে করে বেড়ানো। কিন্তু আমার মনে হয় কী জান, মিস্টার? ওরকম নগর কোথাও নেই। ও একটা মিথ্যা প্রবাদের মতো এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। কেউ দেখেছে এ পর্যন্ত বলতে পার? কেউ বলতে পারে সে দেখেছে? কেউ সন্ধান দিতে পারে? ও একটা ভুয়ো গল্প।
চা খেয়ে বাইরে এসে তিনজনে সমুদ্রের দিকে চলল।
চীনেম্যানটি পিছন থেকে ডেকে বলল–ওদিকে যেও না মিস্টার, সামরিক সীমানা– যাওয়া নিষেধ। সমুদ্রের ধারে এদিকে বসবার জায়গা নেই।
একটু নির্জন স্থানে গিয়ে সুশীল বললে–জামাতুল্লা, শুনলে সব কথা? এখনও কি তোমার মনে হয় সে নগর আছে কোথাও? আমরা আলেয়ার পেছনে ছুটছি নে? নটরাজনের গল্প ভুয়ো নয়?
জামাতুল্লা বললে–তবে পদ্মরাগ মণি এল কোথা থেকে?
আমি তোমায় বলছি নটরাজনের কাহিনি আগাগোড়া বানানো গল্প। পদ্মরাগ মণিখানা সে কোনোপ্রকার অসৎ উপায়ে হস্তগত করে–যার ওপরে প্রাচীন ও প্রচলিত প্রথানুযায়ী ওই চিহ্নটি-আঁকা ছিল। এ ছাড়া ওর কোনো মানে নেই।
জামাতুল্লার মুখ-চোখের ভাব হঠাৎ যেন বদলে গেল–কত বৎসর পূর্বের এক স্বপ্নভরা দিন, এক আতঙ্কভরা কৃষ্ণা রজনীর স্মৃতি তার মুখের রেখায়, চোখের দৃষ্টিতে। সে বললে– কিন্তু বাবুজি, নটরাজন হয়তো দেখেনি, আমি তা দেখেছি। ভীষণ বনের মধ্যে অন্ধকার রাত কাটিয়েছি। আমি কারো কথা শুনিনে।
খুব সাবধান জামাতুল্লা, আমাদের প্রাণের দাম এক কানাকড়িও না–যদি একথা কোনোরকমে প্রকাশ হয় যে আমরা ওই আঁক-জোক-পড়া পাথরের ছাঁচ বা সেই নগর খুঁজতে বেরিয়েছি।
ঠিক বাবুজি। সে-কথা আমারও মনে হয়েছে। এই সিঙ্গাপুর ভয়ানক জায়গা–এখানে পথে পথে রাত্রের অন্ধকারে খুন হয়। ভারি সাবধানে থাকতে হবে আমাদের। ইয়ার হোসেনকে সাবধান করে দিতে হবে। মুশকিল হয়েছে লোকটা মাতাল, মদ খেয়ে কোনো কথা প্রকাশ করে না ফেলে। চলে, যাওয়া যাক।
তিনজনে সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে বাসার দিকে রওনা হল।
পরদিন ইয়ার হোসেন এসে ওদের বাসায় খুব সকালেই উপস্থিত হল। সনৎ তখন উঠেছিল। চায়ের জন্যে স্টোভ ধরিয়েছে–ইয়ার হোসেনকে দেখে বললে–আসুন মি. হোসেন, ঠিক সময়েই এসেছেন–চা তৈরি।
ইয়ার হোসেন রুক্ষ প্রকৃতির লোক। বলে উঠল–চা খাবার জন্যে ঠিক আসিনি। আরো দু-শো টাকা চাই।
হঠাৎ সনৎ-এর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–আরও দু-শো! তাহলে তো আমাদের হাতে রইল না কিছু।
তা আমি কী জানি? এ কাজে এসেছেন যখন তখন পয়সার জন্যে হঠলে চলবে না। নয়তো বলুন ছেড়ে দিই।
না না, দাঁড়ান আমি দাদা ও জামাতুল্লাকে ডাকি।
সুশীল শুনে বললে–তাই তো, ব্যাপার কী? চলো, দেখি ব্যাপার কী।
ইয়ার হোসেন বাইরে বসে আছে। সুশীল গিয়ে বললে–গুড মর্নিং মি. হোসেন। কী মনে করে এত সকালে?
সব ঠিক। আজ রাত্রে রওনা হতে হবে। সব বন্দোবস্ত ঠিক হয়ে গিয়েছে।
সনৎ ও সুশীল একসঙ্গে বলে উঠল–কীরকম?
ইয়ার হোসেন গম্ভীর মুখে বললে–সব ঠিক। তার আগে সেই ছাঁচখানা একবার দেখি– এখুনি। আর দু-শো টাকা–এখুনি।
সুশীলের ইঙ্গিতে সনৎ বাক্স খুলে প্যারিস-প্লাস্টারের ছাঁচ ওর হাতে দিলে। ইয়ার হোসেন ছাঁচখানা উলটে-পালটে দেখে-শুনে বললে–নাও। এসব বুজরুকি অন্য কিছুই না। কিছুই হবে না হয়তো।–টাকা?
সুশীল বললে–টাকা রয়েছে জামাতুল্লার কাছে। সে আসুক।
কোথায় সে?
তা তো জানিনে। সকালে বেড়াতে বেরিয়েছে।
আচ্ছা, আমি বসি।
এখন কী ঠিক করলেন বলুন মি. হোসেন।
এখান থেকে ডাচ স্টিমার বো ছাড়ছে আজ রাত দশটায়। আমাদের নামতে হবে সাঙ্গাপান বন্দরে–সুলু সমুদ্রের ধারে। সাঙ্গাপান মশলার বড়ো আড়ত–সেখান থেকে চীনে জাঙ্ক ভাড়া করে যাব।
এসব অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ডাচ স্টিমারে উঠতে দেবে? মেশিনগান কিনেছেন নাকি?
সব ঠিক আছে। আপনি শুধু দেখুন ইয়ার হোসেন কী করতে পারে।
আরও এক ঘণ্টা কেটে গেল। জামাতুল্লা আর ফেরে না। সুশীল ও সনৎ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ল। কাল বিকেলের সেই চীনাম্যানের কথা বার বার মনে পড়ছিল ওদের। কথাটা ইয়ার হোসেনকে বলা ঠিক হবে না হয়তো–ভেবেই ওরা বললে না। কিন্তু জামাতুল্লা সব জেনে শুনে একা বেরোল কোথায়?
বেলা প্রায় দশটা। এমন সময় জামাতুল্লা ঘর্মাক্ত কলেবরে এসে হাজির হল। ওর মুখের চেহারা দেখে তিনজনেই একসঙ্গে বললে–কী হল তোমার?
জামাতুল্লা ক্ষীণ হাসি হেসে বললে–কিছুই না।
কিন্তু তোমার চেহারা দেখে–
এই রোদে—
সুশীল বললে–জামাতুল্লা, মি. হোসেন আরও দু-শো টাকা চান।
ও! তা দিন বাবু। এই নিন চাবি।
উনি বলছেন আজ রাত্রে আমাদের রওনা হতে হবে।
জামাতুল্লা সে-কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে বললে–টাকাটা দিয়ে দিন ওঁকে আগে।
টাকা নিয়ে ইয়ার হোসেন বিদায় নেবার পর-মুহূর্তেই জামাতুল্লা নিম্নসুরে বললে-বড়ো বেঁচে গিয়েচি! ডকের পাশে যে গলি আছে ওখানে দু-জন মালয় গুণ্ডা আমাকে আক্রমণ করেছিল। দু-জন দু-দিক থেকে কিরিচ হাতে। ভুড়ি ফাঁসিয়ে দিত আর-একটু হলে। আমি প্রাণপণে ছুটে বেঁচেছি। তোমরা অত ছুটতে পারতে না, মারা পড়তে ওদের হাতে। কালকের সেই চীনেম্যানের কথাই ঠিক। আমরা খুব বিপন্ন এখানে। বাড়ি থেকে কোথাও বেরিও না। ইয়ার হোসেনকে কিছু বোলো না।
সনৎ ও সুশীল রুদ্ধনিশ্বাসে ওর কথা শুনছিল। কথা শেষ হলে সনৎ তাকে চা ও টোস্ট খেতে দিয়ে বললে–কিছু বলিনি আমরা। ও আজই যেতে বলছে–শুনেছ তো?
যাতে হয় আজই আমাদের পালাতে হবে। এখন প্রাণ নিয়ে জাহাজে উঠতে পারলে বাঁচি!
বল কী জামাতুল্লা? এত ভয় নেই। চীনেম্যানটার বাজে গল্পটা দেখছি তোমার মনে বড়ো দাগ কেটে দিয়েছে।
বাবুজি, মেটেবুরুজের মাঠে খুনের কথাটা ভেবে দেখুন। সে পাথরখানার জন্যে নয়– আঁক-জোঁকের জন্যে। এখন আমার তাই মনে হচ্ছে। অসাবধান হবেন না আজ দিনমানটা। জাহাজে উঠলে কতকটা বিপদ কাটে বটে।
সেদিন বিকেলে ইয়ার হোসেনের লোক আবার এল। একটা সিলমোহর করা চিঠি সুশীলের হাতে দিয়ে বললে–এর উত্তর এখুনি চাই। সুশীল চিঠিখানা পড়ে দেখলে, আজ কীভাবে, কোথা থেকে রওনা হতে হবে, সেই ব্যবস্থা চিঠিতে লেখা। ইয়ার হোসেন অন্য পথ দিয়ে যাবে। ওদের যেন চেনে না, এভাবে। জাহাজে না উঠে এদের তিনজনের সঙ্গে সে কথাবার্তা বলবে না।
সুশীল চিঠির উত্তর দিয়ে দিলে। জামাতুল্লা বললে–আমাদের জিনিসপত্র যদি কিনতে হয়, এই সময় কিনে নিয়ে আসি–চলুন।
ওরা বেরিয়ে এল বাসা থেকে। ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের বড়ো বাজারে জিনিসপত্র কিনবে এই ওদের ইচ্ছে। জামাতুল্লা বললে–বাবু, কিছু ভালো জিনিস খেয়ে নেওয়া যাক। জানেন, কোনো অজানা রাস্তায় অনেক দূর যেতে হলে, ভালো খেয়ে নিতে হয়। অনেকদিন হয়তো ভালো খাবার অদৃষ্টে জুটবে না।
একটা শিখ রেস্টুরেন্টে ওরা গিয়ে বসল। মাংস, কাটলেট, চা, টোস্ট ইত্যাদি আনিয়ে খাওয়া শুরু করেছে, এমন সময় একজন ইউরোপীয় পোশাক পরা মালয় এসে ওদের টেবিলে বসে বিনীতভাবে বললে–সে কি তাদের সঙ্গে বসে খেতে পারে?
সুশীল বললে–হ্যাঁ, নিশ্চয়।
সে আর কোনো কথা না বলে খাবার আনিয়ে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বসে খেতে লাগল। তারপর আবার ওদের দিকে চেয়ে বললে–আপনারা ভারতীয়?
সুশীল ভদ্রভাবে উত্তর দিলে–হ্যাঁ।
এখানে এসেছেন বেড়াতে, না?
হ্যাঁ।
কেমন লাগছে সিঙ্গাপুর?
বেশ জায়গা।
এখান থেকে দেশে ফিরছেন বোধ হয়?
তাই ইচ্ছে আছে।
আপনারা তিনজনে বুঝি এসেছেন?
না, আমরা এখানে এক হোটেলে থাকি–আলাপ হয়ে গিয়েছে।
বেশ, বেশ।
আপনারা কোন হোটেল উঠেছেন জানতে পারি কি? আমাদের একজন ভারতীয় বন্ধুর একটা ভালো হোটেল আছে, সেখানে খাবার-পত্র সস্তা। ঘরদোরও ভালো। যদি আপনাদের দরকার হয়–
সনৎ হঠাৎ বলে উঠল–না, ধন্যবাদ। আমরা আজই চলে যাচ্ছি।
সুশীল টেবিলের তলা দিয়ে সনৎকে এক রামচিমটি কাটলে। মালয় লোকটার চোখে-মুখে একটা কৌতূহলের ভাব জাগল। সেটা গোপন করে সে বললে–ও! আজই যাবেন?
কিন্তু ভারতের জাহাজ তো আজ ছাড়বে না?
সুশীল বললে–না, আমরা রেলে উঠে যাচ্ছি কুয়ালালামপুর।
ও, কুয়ালালামপুর? দেখে আসুন, বেশ শহর।
আরও কিছুক্ষণ পরে লোকটা বিল চুকিয়ে দিয়ে চলে গেল।
সুশীল রাগের সঙ্গে সনৎ-এর দিকে চেয়ে বললে–ছি ছি এত নির্বোধ তুমি? ও-কথা কেন বলতে গেলে?
সনৎ অপ্রতিভ মুখে বললে–আমি ভাবলাম ওতেই আপদ বিদেয় হয়ে যাবে। অত জিগগেস করার ওর দরকার কী? আমরা যদি-বা যাই, তোর তাতে কীরে বাপু?
তা নয়। কে, কী মতলব নিয়ে কথা বলে, দরকার কী ওদের সঙ্গে সব কথা বলার?
জামাতুল্লা বললে–ঠিক কথা বলেছেন বাবুজি।
সন্ধ্যার কিছু আগে ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বার হয়ে রাস্তায় নেমে দু-একটা জিনিস কেনবার জন্যে বাজারের দিকে চলেছে–এমন সময় জামাতুল্লা নীচু গলায় চুপিচুপি বললে–ওই দেখুন সেই লোকটা!
সুশীল ও সনৎ চেয়ে দেখলে, সেই মালয় লোকটা একটা দোকানে কী একটা জিনিস কিনছে। ওদের দিকে পিছন ফিরে।
সুশীল বললে–চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই–মোড়ের দোকানে জিনিস কিনি গে।
জিনিস কিনতে একটু রাত হয়ে গেল। ওরা বড়ো রাস্তা বেয়ে অনেকটা এসে ওদের হোটেল যে গলিটার মধ্যে সে-গলিটাতে ঢুকতে যাবে, এমন সময় কী একটা ভারি জিনিস সুশীলের ঠিক বাঁ-হাতের দেয়ালে জোরে এসে লেগে ঠিকরে পড়ল সামনে রাস্তার ওপরে।
ওরা চমকে উঠল। জামাতুল্লা পথের ওপর থেকে জিনিসটা কুড়িয়ে নিয়ে বললে– সর্বনাশ!
ওরা দু-জনে নীচু হয়ে জিনিসটা দেখতে গেল–কিন্তু জামাতুল্লা বললে–বাবুজি, ছুটে আসুন, এখানে আর দাঁড়াবেন না বলছি!
দু-জনে জামাতুল্লার পিছনে পিছনে দ্রুতপদে চলতে চলতে বললে–কী, কী হয়েছে? কী জিনিস ওটা?
মিনিট পাঁচ-ছয় ছুটবার পর নির্জন গলিটার শেষ প্রান্তে ওদের হোটেলটা দেখা গেল। জামাতুল্লা হাই ছেড়ে বললে–যাক খুব বেঁচে যাওয়া গিয়েছে! এখানা মালয় দেশের ছুঁড়ে মারা ছুরি! ওরা দশ-বিশ গজ তফাত থেকে এই ছুরি ছুঁড়ে লোকের গলা দু-খানা করে কেটে দিতে পারে। আমাদের তাগ করেই ছুরিখানা ছুঁড়েছিল–কিন্তু অন্ধকারে ঠিক লাগেনি। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে, যে ছুঁড়েছে তার আর-একখানা ছুরি ছুঁড়তেই বা কতক্ষণ?
সনৎ সেই ভারি ছোরাখানা হাতে করে বললে–ওঃ, এ গলায় লাগলে পাঁঠা কাটার মতো মুন্ডু কেটে ছিটকে পড়ত! কানের পাশ দিয়ে তির গিয়েছে!
সুশীল বললে–এ সেই গুপ্ত সম্প্রদায়ের লোকের কাজ। আমাদের পেছনে লোক লেগেছে।
জামাতুল্লা বললে–লোক লেগেছে, তবে আমাদের বাসাটা এখনও বার করতে পারেনি। আমি বলিনি যে এখানে আমরা বিপন্ন। আমার না বলবার কারণ আছে।
রাতে ডাচ স্টিমার বেন্দা ছাড়ল। ইয়ার হোসেন বড়ো বড়ো কেরোসিন কাঠের প্যাকবাক্স ওঠালে গোটাকতক জাহাজে–তাদের বাইরে বিলিতি বিয়ার মদের বিজ্ঞাপন মারা। ওঠাবার সময় অবশ্যি কোনো হাঙ্গামা হল না–কিন্তু সুশীল ও সনৎ-এর ভয় তাতে একেবারে দূর হয়নি। সিঙ্গাপুরের বন্দর ও প্রকান্ড নৌঘাঁটি ধীরে ধীরে দিকচক্রবালে মিলিয়ে গেল–অকূল জলরাশি আলোকোৎক্ষেপী ঢেউয়ে রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
চারদিনের দিন সকালে জাহাজ এসে সাঙ্গাপান পৌঁছোলো। এখানে এসে ওরা নেমে একটা চীনা হোটেলে আশ্রয় নিলে।
সাঙ্গাপান মশলার খুব বড়ো আড়ত, কতগুলি নদী এসে সমুদ্রে পড়ছে, নদীর সেই মোহনাতেই বন্দর অবস্থিত–যেমন আমাদের দেশের চট্টগ্রাম।
ইয়ার হোসেন বাংলা জানে না, উর্দু বা হিন্দুস্থানীও ভুলে গিয়েছে–ও জামাতুল্লার সঙ্গে কথা বলে পিজিন ইংলিশে ও মালয় ভাষায়। বললে–জামাতুল্লা, এবার তুমি তোমার সেই দ্বীপে নিয়ে যেতে পারবে তো?
পারব বলে মনে হচ্ছে। তবে এখনও ঠিক জানি নে–
সুশীল বললে–শুনুন মি. হোসেন। যখন আমার সঙ্গে জামাতুল্লার দেখা হয় গ্রামে, ও বলেছিল ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজের একটা দ্বীপে এর জাহাজ নারকেলের ছোবড়া ও কুচি বোঝাই করতে গিয়ে ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায়। কেমন, তাই তো জামাতুল্লা? রাস্তার কথাটা একবার ভালো করে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।
ঠিক বাবুজি—
তারপর বলে যাও—
তারপর আমরা সাতদিন সেইখানে থাকি।
ইয়ার হোসেন বললে–সেখানে থাকি মানে কী বুঝিয়ে বলো। দ্বীপে, না সমুদ্র?
না সাহেব, দ্বীপে তো নয়–আমরা যাচ্ছিলাম এক দ্বীপ থেকে আর এক দ্বীপে। মাঝ দরিয়ায় এ কান্ড ঘটে। তারপর সৌরাবায়া থেকে জাহাজ এসে আমাদের উদ্ধার করে।
কতদিন পরে উদ্ধার করে?
আট-দশ দিন কী ওইরকম।
সুশীল বললে–আগে বলেছিলে সাতদিন।
বাবু, ঠিক মনে নেই। অনেক দিনের কথা। সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে। সেই সময় সমুদ্রের বিষাক্ত কাঁকড়া খেয়ে সব কলেরা হয়ে মারা গেল–বাকি ছিলাম কাপ্তান আর আমি। দ্বীপ ছিল নিকটেই–যেখানে ডুবো পাহাড়ে আমাদের জাহাজ ধাক্কা খেয়েছিল, সেখান থেকে ডাঙা নজরে পড়ে। জাহাজের রশির দু-রশি কী তিন রশি তফাতে। দ্বীপ দেখলে আমি চিনতে পারব–তার ধারে একটা পাহাড়, পাহাড়ের গা বেয়ে একটা ঝরনা পড়েছে সমুদ্রে। বড়ো বড়ো পাথর পড়ে আছে, পাথরগুলি সাদা রঙের।
সুশীল হেসে বললে–তোমার সেই বিহ্মমুনির দ্বীপ?
জামাতুল্লা গম্ভীর মুখে বললে–হাসবেন না বাবুজি। এসব কাজে নেমে এ দেশের সব দেবতাকে মানতে হবে। না মানলে বিপদ হতে কতক্ষণ? আমি খুব ভালো করেই তা জানি।
ইয়ার হোসেন বললে–বুঝলাম, ও সব এখন রাখো। সাঙ্গাপান থেকে কোন দিকে যেতে হবে, কত দূরে? একটা আন্দাজ দাও–একটা নটিক্যাল চার্ট করে নেওয়া যাক।
আমরা সাঙ্গাপান থেকেই রওয়ানা হয়ে যাই পূর্ব-দক্ষিণ কোণে–আন্দাজ দু-শো মাইল– সেখান থেকে পূর্বে উত্তর-পূর্ব কোণে যাই আন্দাজ পঞ্চাশ মাইল। এইখানে সেই ডুবো পাহাড়ের জায়গাটা–যতদুর আমার মনে হচ্ছে–
ইয়ার হোসেন অসহিষ্ণুভাবে বললে–যতদূর মনে হলে তো হবে না! আমাদের সে দিকে যেতে হবে যে। সুলু সমুদ্রের সর্বত্র তো ঘুরে বেড়াতে পারা যাবে না। আচ্ছা তুমি সে দ্বীপ কতদূর থেকে চিনতে পারবে? নেমে, না জাহাজে বসে?
জাহাজে বসে চিনতে পারব ওই সাদা পাথরের পাহাড় আর ঝরনা দেখে।
কত সাদা পাথরের পাহাড় থাকে–
না সাহেব, তা নয়। সে পাথরের পাহাড়ের গড়ন অন্য রকম। দেখলেই চিনব।
ইয়ার হোসেন আর সুশীল দু-জনে মিলে মোটামুটি ম্যাপ এঁকে নিয়ে সেদিন রাত্রে আর একবার মিলিয়ে নিলে জামাতুল্লার বর্ণনার সঙ্গে। চীনা জাঙ্ক ভাড়া করা হল। দু-মাসের মতো চাল, আটা, চা, চিনি বোঝাই করে নেওয়া হল জাঙ্কে–আর রইল বিয়ারের কাঠের বাক্সভরতি অস্ত্রশস্ত্র ও মেশিনগান।
ইয়ার হোসেন প্রস্তাব করলে–এখানে বিলম্ব করা উচিত নয়। আজ রাত্রেই যাওয়া যাক–শত্রু লাগতে পারে–
জামাতুল্লা বললে–সেকথা ঠিক। কিন্তু রাত্রে হারবার-মাস্টার জাহাজ কী নৌকো ছাড়তে দেবে না, পোর্ট পুলিশে ধরবে। এসব জায়গায় এই নিয়ম। বোম্বেটে ডাকাতের আড্ডা কিনা সুলু সি! কড়া নিয়ম সব।
তবে?
কাল সকালে চলুন সাহেব—
ইয়ার হোসেন দ্বিধার সঙ্গে এ প্রস্তাবে মত দিলে। সুশীলকে ডেকে বললে–রাতের অন্ধকারে যাওয়া ভালো ছিল। দিনের আলোয় সকলের মনে কৌতূহল জাগিয়ে যাওয়া ভালো না। যাই হোক, উপায় কী?
সকাল আটটার পরে সাঙ্গাপান থেকে ওদের নৌকো ছাড়ল। মাত্র দেড় টনের চীনা জাঙ্ক –সমুদ্রে মোচার খোলার মতো। কিন্তু জামাতুল্লা বললে–জাঙ্ক হঠাৎ ডোবে না, এসব তুফানসংকুল সমুদ্রে পাড়ি দিতে চীনা জাঙ্ক-এর মতো জিনিস নেই।
জাহাজ ছেড়ে অনেক দূর এল, ক্রমে চারিধারে শুধু সমুদ্রের নীল জলরাশি।
জামাতুল্লা নাবিক ও কর্ণধার–কিন্তু যে বৃদ্ধ চীনাম্যান জাঙ্কের সারেং সেও দেখা গেল বেশ জাহাজ চালাতে জানে। দু-দিন জাহাজ চলবার পরে জামাতুল্লার সঙ্গে চীনা সারেং-এর ঝগড়া বেধে গেল।
ইয়ার হোসেন বললে–চেঁচামেচি কেন? কী হয়েছে?
চীনা সারেং বললে–জামাতুল্লা সাহেব জাহাজ চালাতে জানে না–কোথায় নিয়ে যাচ্ছে–
জামাতুল্লা বললে বিশ্বাস করবেন না ওর কথা! ও লোকটা একেবারে বাজে।
ইয়ার হোসেন ও সুশীল পরামর্শ করে জামাতুল্লার ওপরই কিন্তু জাহাজ চালানোর ভার দিলে। একদিন সন্ধ্যার সময়ে দূরে ডাঙা ও আলোর সারি দেখা গেল।
চীনা সারেং ছুটে গিয়ে বললে–ওহে, বড়ো যে জাহাজ চালাচ্ছ–ও ডাঙা আর আলো কোথাকার? এদিকে এত বড়ো ডাঙা কীসের?
জামাতুল্লাও একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। চার্ট অনুসারে ওখানে আলো আর ডাঙা দেখবার কথা নয়। চীনা সারেং ইয়ার হোসেনকে আর সুশীলকে ডেকে বললে–ওকে বলতে বলুন স্যার, ও আলো আর ডাঙা কীসের?
জামাতুল্লাকে মাথা চুলকোতে দেখে চীনা সারেং বিজয়গর্বে বললে–আমি বলে দিচ্ছি স্যার –সাণ্ডা প্রণালীর মুখে পিয়েরপং বন্দরের আলো–তার মানে বুঝেছেন? আমরা আমাদের যাবার রাস্তা থেকে এক-শো মাইল পূর্ব-দক্ষিণে হঠে এসেছি–এইরকম করে জাহাজ চালালে দক্ষিণমেরুতে পৌঁছোতে আমাদের আর বেশি দেরি থাকবে না স্যার!
চীনা সারেং সেদিন থেকে হল কাপ্তেন।
সুশীল বললে–রাগ কোরো না জামাতুল্লা। তুমি অনেকদিন এ কাজ করোনি, ভুলে গিয়েছ। হে।
জামাতুল্লা বললে–তা নয় বাবুজি। আমি ভুলিনি জাহাজ চালানো। আমার চার্ট ঠিক ছিল, আমার মনে হয় কী গোলমাল হয়েছে বা চার্টে ভুল করে রেখেছে।
আরও তিনদিন পরে বিকেলের দিকে চীনা কাপ্তেন বললে–পারা নামছে স্যার, দড়িদড়া সামলে আর জিনিস সামলে আপনারা খোলের মধ্যে নেমে যান–ঝড় উঠবে।
তিন ঘণ্টার মধ্যে ভীষণ ঝড় এল পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে। দড়িদড়া ছিঁড়ে পাল উড়িয়ে নিয়ে যায়–জামাতুল্লা চিৎকার করে বললে–সব খোলের মধ্যে যান–ভয়ংকর ঢেউ উঠেছে—
জাঙ্কের ডেকের ওপর বড়ো বড়ো ঢেউ সবেগে আছড়ে পড়ে ক্ষুদ্র দেড় টনের জাঙ্কখানা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙেচুরে সমুদ্রের তলায় ডুবিয়ে দেবে মনে হল সবারই–কিন্তু দু-তিন বার জাঙ্কখানা ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেল–নাকানি-চুবুনি খেয়েও আবার সমুদ্রের ওপর ঠেলে ওঠে। সাবাস মোচার খোলা!
হঠাৎ চীনা কাপ্তেন চিৎকার করে উঠল–সামনে পাহাড়–সামলাও–
জামাতুল্লা হালে ছিল, ডাইনে সজোরে হাল মারতেই কান ঘেঁষে কতকগুলো বজবজে সমুদ্রের ফেনা ঘুরতে ঘুরতে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে চলে গেল, ফেনাগুলোর মাঝে কালো রঙের কী একটা টানা রেখা যেন ফেনারাশিকে দু-ভাগে চিরে দিয়েছে। ডুবো পাহাড়।
ঝড়ের শব্দে কে, কী বলে শোনা যায় না–তবুও সুশীল শুনলে, চীনা কাপ্তেন চিৎকার করছে–খুব বাঁচা গিয়েছে। আর একটু হলেই সব শেষ হত আমাদের!
ইয়ার হোসেন ও সুশীল বাইরে একচমক দেখতে পেলে–জলের মধ্যে মরণের ফাঁদ পাতাই বটে! সাক্ষাৎ মরণের ফাঁদ!
জামাতুল্লা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হাল ধরে আছে। একটু আলগা হলেই এই ভীষণ জায়গায় জাঙ্ক বানচাল হয়ে ধাক্কা মারবে গিয়ে বাঁ-দিকের ডুবো পাহাড়ে। খানিকটা পরে জামাতুল্লার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠল ভয়ে–এ কী! দু-দিকেই যে ডুবো পাহাড়!–ডাইনে আর বাঁয়ে।
চীনা কাপ্তেনকে হেঁকে বললে–কোথা দিয়ে জাহাজ চালাচ্ছ গাধার বাচ্চা! পাহাড়ের চুড়ো দিয়ে যে! মারবে এবার–ঝড়ের তুফানের মধ্যে চীনা কাপ্তেনের কথাগুলো অট্টহাস্যের মতো শোনা গেল। কী যে সে বললে, জামাতুল্লা বুঝতে পারল না।–কিন্তু যারই ভুল হোক, জাহাজ বাঁচাতে হবে।
সে সামনে-পিছনে চেয়ে দেখলে–পাহাড়ের কালো রেখা অতিকায় শুশুকের শিরদাঁড়ার মতো জলের ওপর স্পষ্ট জেগে; মাস্তুলের দিকে চেয়ে দেখলে চীনা সারেং সব পাল গুটিয়ে ফেলেছে–কেবল মাঝের বড়ো মাস্তুলে ষোলো ফুট চওড়া বড়ো পালখানা ঝড়ের মুখে ছিঁড়ে ফালি-ফালি হয়ে অসংখ্য সাদা নিশানের মতো উড়ছে। সে দেখলে নিশানগুলোর জন্যে জাহাজখানা এদিকে-ওদিকে হেলছে ঘুরছে। চক্ষের নিমেষে সে কোমর থেকে ছুরি বার করে পালের মোটা সনের কাছি কাটতে লাগল। একবার করে খানিকটা কাটে, আবার ছুটে গিয়ে হাল টিপে ধরে।
অমানুষিক সাহস ও দৃঢ়তা এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাঁচ ছ-মিনিটের মধ্যে সে অত বড়ো মোটা রশিটা কেটে ফেললে। ফেলতেই দড়িদড়া ঢিলে পড়ে পাল সড়াং করে অনেকখানি নেমে এল।
চীনা কাপ্তেন চিৎকার করে বললে–কে রশি কাটলে?
আমি।
খুব ভালো কাজ করেছ! এবার সামলাও ঠ্যালা! যদি জান না কোনো কিছু, তবে সবটাতেই সর্দারি করতে আস কেন?
চীনা কাপ্তেন মিথ্যে বলেনি। জামাতুল্লা সভয়ে দেখলে পালে ঢিলে পড়াতে জাঙ্ক এবার জগদ্দল পাথরের মতো ভারী হয়ে পড়েছে যেন। পিছন থেকে বাতাস ঠেলা মেরেও তাকে নড়াতে পারছে না–সুতরাং দু-দিকের মরণ ফাঁদকে অতিক্রম করে বাহির সমুদ্রে পড়তে এর অনেক সময় লেগে যাবে–ইতিমধ্যে বাতাস দিক পরিবর্তন করলেই–বিষম বিপদ।
ইয়ার হোসেন পাকা লোক। সে বুঝেছিল কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে। মাথা বার করে বললে–কী হল আবার? জাঙ্ক নড়ে না যে!
চীনা সারেং বললেনড়বে কী স্যার-নড়বার পথ কি আর রেখেছে জামাতুল্লা? এবার বাঁচাতে পারলাম না বোধ হয়!
কিন্তু সুখের বিষয় আধঘণ্টার মধ্যে ভয় কেটে গেল। বাতাস পিছন হতেই বয়ে চলল একটানা–এবং আধঘণ্টার মধ্যে জাঙ্ককে ডুবো পাহাড়ের ফাঁদ পার করে বাহির সমুদ্রে তাড়িয়ে দিলে।
জামাতুল্লা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
চীনা কাপ্তেন টিটকিরি দিয়ে বললে–বাঁচলে সবাই আজ নিতান্ত বরাতের জোরে! তোমার হাতের গুণে নয়, মনে রেখো।
সমুদ্র শান্ত, জ্যোৎস্না উঠেছে–সুশীলদের দল খোলের ঢাকনি খুলে ডেকের ওপর এসে দাঁড়াল।
হঠাৎ জ্যোৎস্নার মধ্যে দূরে কী একটা বিরাট কালো জিনিস দেখা গেল–জল থেকে উঁচু হয়ে আছে মাথা তুলে।
ইয়ার হোসেন বললে–কী ওটা?
সুশীলও জিনিসটা প্রথমে দেখতে পেলে না–তারপর দেখে বিস্মিত হল–অস্পষ্ট কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নালোকে কিছু ভালো দেখা যায় না–তবু একটা প্রকান্ড কৃষ্ণকায় দৈত্যের মতো আকাশের গায়ে কী ওটা জল থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে?
সনৎও সে-দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল।
একমাত্র জামাতুল্লা দু-চোখ বিস্ফারিত করে জিনিসটার দিকে চেয়েছিল।
ইয়ার হোসেন কথার উত্তর না পেয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, জামাতুল্লা তাকে হাতের ইঙ্গিতে থামিয়ে দিয়ে ডেকের সম্মুখভাগে এগিয়ে এসে কালো জিনিসটা ভালো করে দেখতে লাগল।
চীনা সারেং টিটকিরি দেওয়ার সুরে বললে–দেখছ কী, ওটা ডুবো পাহাড়–বুড়ো বয়সে চোখে ভালো দেখতে পাইনে–তবুও বলছি
সুশীল বললে–জলের উপর জেগে রয়েছে যে! ডুবো পাহাড় কী করে হল?
চীনা সারেং বললেও পাহাড়ের চুড়োটা মাত্র জেগে আছে জলের ওপর, স্যার। প্রকান্ড ডুবো পাহাড় ওটা–
জামাতুল্লা এইবার সুশীলকে একধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললে–সারেং ঠিক বলেছে। এতক্ষণ পরে আমি চিনেছি, এই সেই পাহাড় বাবুজি–এই পাহাড়ে ধাক্কা খেয়েই–
সুশীল অবিশ্বাসের সুরে বললে–চিনলে কী করে?
আমি এতক্ষণ তাই চেয়ে দেখছিলাম–এবার আমার কোনো সন্দেহ নেই–ওই ডুবো পাহাড়ের এক জায়গায় দক্ষিণ কোণে একটা শুয়োরের মুখের মতো ছুঁচলো গড়ন দেখছেন কি? আসুন আমি দেখাচ্ছি–এতকাল আমার মনে ছিল না, কিন্তু এবার দেখেই মনে পড়েছে।
ইয়ার হোসেনকে বলি?
কিন্তু ওই হলদেমুখো চীনাটাকে কিছু বলবেন না, বাবুজি। ওটাকে আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না–আপনি বলুন হোসেন সাহেবকে–
যদি ও-ই সেই ডুবো পাহাড়টা হয়, তবে তো ওখান থেকে জমি দেখা যাবে, আর সেই সাদা পাথরের পাহাড়টা—
সে হল তিন রশি চার রশি তফাতে বাবুজি–চাঁদনি রাতে সাদা পাথরের পাহাড় অত দূর থেকে ভালো দেখা যাবে না। সকাল হোক—
চীনা সারেং চিৎকার করে উঠল–হ্যাঁল সামলাবে না গল্প করে সময় কাটাবে–ডুবো পাহাড় সামনে, সে খেয়াল আছে?
জামাতুল্লা বিরক্ত হয়ে বললে–আঃ, হলদেমুখো ভূতটা বড় জ্বালালে দেখছি–দাঁড়ান বাবুজি–আপনি হোসেন সাহেবকে বলুন, আমি দেখি ওদিকে কী বলে–
সুশীল হাসতে হাসতে বললে–তুমি যাই বল, ও কিন্তু খুব পাকা জাহাজি–এসব অঞ্চল দেখছি ওর নখদর্পণে–ওস্তাদ জাহাজি–এ বিষয়ে ভুল নেই—
কিছু পরে চীনা সারেং তার নাবিকগিরির সুদক্ষতার এমন একটি প্রমাণ দিলে যাতে জামাতুল্লাকে পর্যন্ত তারিফ করতে হল। জামাতুল্লার হাল পরিচালনায় জাঙ্ক যখন ডুবো পাহাড়ের একদিক দিয়ে যাবার চেষ্টা করছে তখন চীনা সারেং হুকুম দিলে–সামনে এগোও–পাশ কাটাবার চেষ্টা করছ কেন?
সামনে এগিয়ে ধাক্কা খাবে নাকি?
এই বিদ্যে নিয়ে মাঝিগিরি করতে এসেছ সুলু সি-তে? নিজের দেশে নদী খালে ডোঙা চালাও গে যাও গিয়ে! ওই পাহাড়ের দু-পাশের ভীষণ চাপা স্রোতের মুখে পড়ে জাঙ্ক পাহাড়ের গায়ে সজোরে ধাক্কা মারবে–সে খেয়াল আছে? তোমার হালের সাধ্যি হবে না সে স্রোতের বেগ সামলানো–দেখছ না জল কীরকম ঘুরছে?
জামাতুল্লা তখনও ইতস্তত করছে দেখে চীনা সারেং হেঁকে বললে–জামাতুল্লা এবার সবাইকে মারবে স্যার–ওকে বুঝিয়ে বলুন, একবার ওর হাত থেকে ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন–এবার বোধ হয় আর রক্ষে হয় না–
সুশীল আর ইয়ার হোসেন জামাতুল্লাকে বললে–ও যা বলছে তাই করো না জামাতুল্লা–
ও কী বলছে তা আপনারা খেয়াল করছেন না? ও বলছে ওই ডুবো পাহাড়ের দিকে সোজাসুজি হাল চালাতে–মরব তো তাহলে–
চীনা সারেং জামাতুল্লার কথা শুনতে পেয়ে বললে–চালিয়ে দেখোই না কী করি। মরণের অত ভয় করলে মাল্লাগিরি করা চলে না সাহেব–
জামাতুল্লা চোখ পাকিয়ে বললে–হুঁশিয়ার! আমি আর যাই হই–মরণের ভয় করি তা তুমি বলতে পারবে না, হলদেমুখো বাঁদর—
সুশীল ধমক দিয়ে বললে–ও কী হচ্ছে জামাতুল্লা? এ সময়ে ঝগড়া-বিবাদ করে লাভ কী? সারেং যা বলছে তাই করো—
জামাতুল্লা হাতের চাকা ঘোরাতেই জাঙ্ক পাহাড়ের একেবারে বিশ গজের মধ্যে এসে পড়ল –ঠিক একেবারে সামনা-সামনি–সবাই দুরুদুরু বক্ষে চেয়ে আছে, সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর ঘাঁটি, এ থেকে কী করে চীনা জাঙ্ক বাঁচবে কেউ বুঝছে না–দেখতে দেখতে বিশ গজের ব্যবধান ঘুচে গেল–দশ গজে
আর বুঝি জাঙ্ক রক্ষা হয় না–মতলব কী চীনাটার?… সবাই বিস্ফারিত চক্ষে চেয়ে আছে বুকের ভিতর চেঁকির পাড় পড়ছে সবারই–হঠাৎ সারেং ক্ষিপ্রহস্তে প্রকান্ড একটা জাহাজি কাছি সুকৌশলে সামনের দিকে অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বললে–ডাইনে হাল মারো–
সঙ্গেসঙ্গে একটা আশ্চর্য কান্ড ঘটে গেল যা ইয়ার হোসেন ও জামাতুল্লা তাদের জাহাজি মাল্লা-জীবনের অভিজ্ঞতায় কখনো দেখেনি। জাহাজ ডান দিকে ঘুরে পাহাড়ের গুঁড়িটা পেরিয়ে যেতেই সারেং-এর কাছি গিয়ে পাহাড়ের সরু অংশটা জড়িয়ে ধরল এবং পেছন দিক দিয়ে ঘড় ঘড় করে নোঙর পড়ার শব্দে সবাই বুঝল বড়ো সি-অ্যাঙ্কর অর্থাৎ সমুদ্রের মধ্যে ফেলার বড়ো নোঙর তার সুদৃঢ় আঁকশির মুখ দিয়ে সমুদ্রের তলায় পাথর ও মাটি আঁকড়ে ধরলেই জাহাজের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হবে।
বোঁ করে অতবড়ো জাঙ্কখানা ডিঙি নৌকোর মতো ঘুরে গেল আর পরক্ষণেই স্থির, অচল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল পাহাড় থেকে তিন-চার গজের মধ্যে। জাঙ্ক আর পাহাড়ের মধ্যে কেবল একফালি সরু সাগর–জল, একটা বড়ো হাঙর তার মধ্যে কষ্টে সাঁতার দিতে পারে।
ইয়ার হোসেন বলে উঠল–সাবাস সারেং।
সুশীল ও সনৎ নিশ্বাস ফেলে বললে–খুব বাঁচিয়েছে বটে—
জামাতুল্লা চুপ করে রইল।
চীনা সারেং হলদে দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বললে–বিদেশি লোক এখানে জাহাজ চালাতে পারে না, স্যার! জামাতুল্লা মাল্লাগিরি যা জানে, তা খাটে চাটগাঁয়ের বন্দরে–এসব সে জায়গা নয়–এখানে জাহাজ চালাতে হলে পেটে বিদ্যে চাই অনেকখানি–
ইয়ার হোসেন বললে–এখন কী করা যাবে বল। জাহাজ তো আটকে গেল।
সারেং ওদের অভয় দিয়ে বললে–জাঙ্ক আটকায়নি। জোয়ার এলেই সকালে জাঙ্ক ছাড়া নিরাপদ।
সকলে দুরুদুরু বক্ষে সকালের প্রতীক্ষায় রইল। সুশীল আর জামাতুল্লা ভালো করে ঘুমোতেই পারলে না। খুব ভোরে উঠে জামাতুল্লাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে সুশীল বললে– এসো, চেয়ে দেখো–চলো বাইরে–
জামাতুল্লা বাইরে এসে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললে–ওই সেই সাদা পাহাড় আর সেই দ্বীপ! আমি কাল রাত্রেই বুঝেছিলাম বাবুজি, কাউকে বলিনি–
কেন?
কী জানি বাবুজি, চীনা সারেংটাকে আর এই হোসেন সাহেবকে আমার তেমন যেন বিশ্বাস হয় না, খোদার দিব্যি বলছি ওদের সামনে মুখ খোলে না আমার। হোসেন সাহেব আস্ত গুণ্ডালোক, বাধ্য হয়ে ওর সাহায্য নিতে হয়েছে, কিন্তু সিঙ্গাপুরে ওর নাম শুনে সবাই ভয় পায়।
সে-কথা আর এখন ভেবে লাভ কী বল। ওদের নিয়েই কাজ করতে হবে যখন। ইয়ার হোসেনকে বলি কথাটা।
ইয়ার হোসেন সব শুনে জামাতুল্লাকে ডেকে বললে–কোনো সন্দেহ নেই তোমার? এই দ্বীপ ঠিক?
ঠিক।
আমরা নেমে কিন্তু জাঙ্ক ছেড়ে দেব–ঠিক করে দেখো এখনও।
সুশীল ও জামাতুল্লা আশ্চর্য হয়ে বললে–জাঙ্ক ছেড়ে দেবেন কেন?
আমি ওদের অন্য এক গল্প বলেছি। আমি বলেছি জঙ্গলে মাঠের ইজারা নিয়েছি ডাচ গভর্নমেন্টের কাছে–এখানে আমরা এখন থাকব কিছুদিন। ওদের বলতে চাই নে–চীনেরা লোক বড়ো ভালো না
দুপুরের পর জালি বোটে জিনিসপত্র ও দুটি ছোটো ছোটো তাঁবু সমেত ওদের সকলকে অদূরবর্তী দ্বীপের শিলাবৃত তীরভূমিতে নামিয়ে জাঙ্কের সারেং তার ভাড়া চুকিয়ে নিয়ে চলে গেল।
সুশীল ইয়ার হোসেনকে বললে–ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজের দ্বীপ তো এটা? ডাচ গভর্নমেন্টের কোনো অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু–
সেসব বড়ো হাঙ্গামা। ডাচ গভর্নমেন্টের কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে জান যাবে তাহলে; কেন যাচ্ছি আমরা–ও দ্বীপে কতদিন আমরা থাকব! হয়তো আমাদের সঙ্গে পুলিশ পাহারা থাকত–সব মাটি হত।
জামাতুল্লা দ্বীপের মাটিতে নেমে কেমন যেন স্বপ্নমুগ্ধের মতো চারিদিকে চেয়ে দেখতে লাগল। এতকাল পরে সে যে এখানে আসবে তা মেটেবুরুজের মাল্লাপাড়ার হোটেলে সানকিতে ভাত খেতে বসে কখনো কি ভেবেছিল? সে ভেবেছিল তার দুঃসাহসের জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই বিহ্মমুনির দ্বীপ আবার!
সুশীল ভাবছিল, কী অদ্ভুত যোগাযোগ! বাংলা দেশের পাড়াগাঁয়ের জমিদারের ছেলে সে চিরকাল বসেই খাবে পায়ের ওপর পা দিয়ে, নির্বিঘ্নে জমিজমার খাজনা শোধ, দুপুরে লম্বা ঘুম দেবে, বিকেলে দুপুরে মাছ ধরবে, সন্ধ্যায় বৈঠকখানায় পৈতৃক তাকিয়া হেলান দিয়ে তাস দাবা খেলবে, রাত্রে পিঠে-পায়েস খেয়ে আবার ঘুম দেবে–এই সনাতন জীবনযাত্রা-প্রণালীর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি তার পিতৃপিতামহের বেলায়–তার বেলাতেও সে-ধারা অক্ষুণ্ণই থাকত, দৈবক্রমে সেদিন গড়ের মাঠে জামাতুল্লা খালাসি তার কাছে ম্যাচিস চাইতে না আসত। কত সামান্য ঘটনা থেকে জীবনের কত বৃহৎ ও গুরুতর পরিবর্তন শুরু হয়।
সুশীল ও সনৎ দ্বীপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের ঘন বনানী এ পর্যন্ত তারা কোথাও দেখেনি–রীতিমতো ট্রপিক্যাল অরণ্য যাকে বলে, তা এতদিন সুশীল ছবিতেই দেখে এসেছে এবং ইংরেজি ভ্রমণের বইয়ে তার বর্ণনাই পড়ে এসেছে–এতকাল পরে তা সে দেখল। জলের ধার থেকেই অপরিচিত গাছপালার নিবিড় বন আরম্ভ হয়েছে–বনস্পতি মাতার বড়ো বড়ো গাছের গায়ে অর্কিডের ফুলগুলি সুগন্ধে প্রভাতের বাতাস মাতিয়েছে– মোটা মোটা লতা দুলছে এ গাছ থেকে ও গাছে। কত রঙের প্রজাপতি উড়ছে–সামনে সুনীল সমুদ্র প্রস্তরাকীর্ণ তীরভূমিতে এসে সজোরে ধাক্কা মারছে, একেবারে খোলা জলরাশি থইথই করছে দক্ষিণমেরু পর্যন্ত, একটা ব্রেকওয়াটার পর্যন্ত নেই কোথাও–যদি কেউ জলে পড়ে, তবে হাঙরের আহার্য হবে এ জানা কথা–এসব সমুদ্রে হাঙরের উপদ্রব অত্যন্ত বেশি সুশীল আগেই শুনেছে। বনের মধ্যে অনেক জায়গায় এখনও অন্ধকার কাটেনি–কারণ প্রভাতের রৌদ্র তার মধ্যে এখনও অনেক জায়গাতেই ঢোকেনি–দেখে বোধ হয়, দুপুরেও ঢোকে কিনা সন্দেহ।
ইয়ার হোসেন দেখে-শুনে বললে–এ যে ভীষণ জঙ্গল দেখছি–। জামাতুল্লা বললে– আগে যেমন দেখেছিলাম তার চেয়েও যেন জঙ্গল বেশি হয়েছে।
সুশীল জানতে চাইলে এ দ্বীপে লোক আছে কিনা। ইয়ার হোসেন বললে–ম্যাপে তো কিছু দেয় না–এ দ্বীপের কিছুই দেখিনে ম্যাপে–কী জামাতুল্লা, তুমি কী দেখেছিলে?
কোথাও কিছু নেই।
বেশ ভালো জান?
আমার যাওয়ার পথে অন্তত তো কিছু দেখিনি—
এখান থেকে তোমার সে নগর কতদূর হবে আন্দাজ?
তিন চার দিনের পথ।
এত কেন হবে? এ দ্বীপের প্রস্থ তো খুব বেশি হবার কথা নয়!
সুশীল বললে–কত বলে আন্দাজ করছেন, মি. হোসেন?
ত্রিশ মাইলের মধ্যে। তবে একটা কথা, এই জঙ্গল ঠেলে যাওয়ায় পথ এগোবে না বেশি। অনেক জায়গায় পথ কেটে নিয়ে তবে এগোতে হবে। তিন দিন লাগা বিচিত্র নয়।
সেদিন তাঁবু খাঁটিয়ে দুপুরে বিশ্রাম করে বিকেলের দিকে দ্বীপের মধ্যে ঢোকবার জন্যে ইয়ার হোসেন সবাইকে তৈরি হতে বললে। মালয় কুলি ওরা এনেছিল সাতজন, জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে–এরা সবাই ইয়ার হোসেনের হাতের লোক এবং মুসলমান ধর্মাবলম্বী। ওদের গতিক বড়ো সুবিধের বলে মনে হয়নি সুশীলের ও সনৎ-এর গোড়া থেকেই। দেখে মনে হয় সিঙ্গাপুরে এরা চুরি ডাকাতি ও রাহাজানি করে চালিয়ে এসেছে এতদিন। যেমন দুশমনের মতো চেহারা, তেমনি ধূর্ত দৃষ্টি এদের চোখে। ইয়ার হোসেনের কথায় এরা ওঠে বসে। জামাতুল্লা এদের বিশ্বাস করত না। কিন্তু উপায় কী, ইয়ার হোসেনকে যখন দলে নিতে হয়েছে, তখন এদের রাখতে হবে।
দু-দিন সমুদ্রের ধারে তাঁবু ফেলে থাকবার পরে সকলে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
সুশীল-সনৎ এমন জঙ্গল কখনো দেখেনি। গাছপালা যে এত সবুজ, এত নিবিড়, এত অফুরন্ত হতে পারে–বাংলা দেশের ছেলে হয়েও এরা এ জিনিসটা এই প্রথম দেখলে। ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে এক-একটা ছোটো নদী বা খাঁড়ি–তার দু-পাশে যেন গাছপালা ও বনঝোঁপের সবুজ পর্বত–কত ধরনের অর্কিড, কত ধরনের লতা, কত অদ্ভুত ও বিচিত্র ফুল।
একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বন কাটতে কাটতে মোটে মাইল তিনেক এগিয়ে যেতে সক্ষম হল।
সন্ধ্যার দিকে ইয়ার হোসেন বললে–এখানে আজ তাঁবু ফেলা যাক।
কিন্তু তাঁবু ফেলবে কোথায়? সুশীল চারিদিকে চেয়ে দেখলে ভয়ানক ঘন জঙ্গলের মধ্যে বড়ো বড়ো দোলানো লতার তলায় ভিজে স্যাঁৎসেঁতে মাটির ওপর রাত্রে বাস করতে হবে। আজ সারাদিনের অভিজ্ঞতায় এরা দেখেছে এখানকার জঙ্গলে তিনরকম জীব যেখানে সেখানে বাস করে–যে তিনটিই মানুষের শত্রু। প্রথম, বড়ো বড়ো রক্ত-শোষক জোঁক; দ্বিতীয়, বিষধর সর্প; তৃতীয়, মৌমাছি। এই তিনটি শত্রুর কোনোটাই কম নয়–যেকোনোটার আক্রমণ মানুষের জীবন বিপন্ন হবার পক্ষে যথেষ্ট।
কোনো রকমে তাঁবু খাটানো হল।
ঘুমের মধ্যে কখন ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল–ট্রপিক্যাল অরণ্যের এ অঞ্চলে বৃষ্টি লেগেই আছে, এমন দিন নেই যে বৃষ্টি হয় না। ঘুমের মধ্যে সুশীল দেখলে তাঁবুর ফাঁক দিয়ে কখন বৃষ্টির জলের ধারা গড়িয়ে এসে ওদের বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে। বাইরে বৃষ্টির বিরাম নেই।
হঠাৎ চারিদিক কাঁপিয়ে কোথায় এক গুরুগম্ভীর নিনাদ শোনা গেল–সমস্ত অরণ্য যেন কেঁপে উঠল।
সনৎ চমকে উঠে বললে–কে ডাকে দাদা?
অন্য তাঁবু থেকে ইয়ার হোসেন বলে উঠল–ও কীসের ডাক?
কেউ কিছু জানে না। না জামাতুল্লা না ইয়ার হোসেন–কেবল ইয়ার হোসেনের জনৈক অনুচর বললে–ওটা বুনো হাতির ডাক স্যার।
আর একজন অনুচর প্রতিবাদ করে বললে–ওটা গন্ডারের ডাক।
কিছুমাত্র মীমাংসা হল না এবং আবার সেই ডাক, সঙ্গেসঙ্গে অন্য এক জানোয়ারের ভীষণ গর্জন। সেটা শুনে অবশ্য সকলেই বুঝতে পারলে–বাঘের গর্জন।
এরই ফাঁকে আবার বন-মোরগও ডেকে উঠল। সময়ে এক-পাল বন্য কুকুরের ডাকও।
সনৎ বললে–ও দাদা, এ যে ঘুমোতে দেয় না দেখছি—
সুশীল উত্তর দিলে–কানে আঙুল দিয়ে থাকো—
ইয়ার হোসেন বললে–রাইফেল নিয়ে বসে থাকতে হবে–কেউ ঘুমিও না–
এটা নিতান্ত প্রথম দিন বলে এদের ভয় ছিল বেশি, দু-একদিনের মধ্যে জন্তুজানোয়ারের আওয়াজ গা-সওয়া হয়ে গেল। নিবিড় ট্রপিক্যাল জঙ্গলের মধ্যে প্রতি রাত্রেই নানা বন্য জানোয়ারের বিচিত্র আওয়াজ–আওয়াজ যা করে, তাঁবুর আশে-পাশেই করে–কিন্তু তাঁবুর লোককে আক্রমণ করে না।
সুশীল দু-দিন ঘুমোতে পারেনি–কিন্তু তিন রাত্রির পরে সে বেশ স্বচ্ছন্দে ঘুমোতে পারলে।
জঙ্গলের কূল-কিনারা নেই–ওরা পাঁচদিন ধরে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরেও কোনো কিছুই দেখতে পেলে না সেখানে–ওই বন আর বন।
সূর্যের আলো না দেখে সুশীল তো হাঁপিয়ে উঠল। এ জঙ্গলে সূর্যের আলো আদৌ পড়ে না।
আগে দেশে থাকতে সে দু-একখানা ভ্রমণের বইতে পড়েছিল যে মেক্সিকোতে, মালয়ে, আফ্রিকায় এমন ধরনের বন আছে, যেখানে কখনো সূর্যালোক প্রবেশ করে না। কথাটা আলংকারিকের অত্যুক্তি হিসেবেই সে ধরে নিয়েছিল, আজ সে সত্যই প্রত্যক্ষ করলে এমন বন, যা চিরঅন্ধকারে আচ্ছন্ন, পড়ন্ত বেলায় কেবল সুউচ্চ বনস্পতিরাজির শীর্ষদেশ অস্তমান সূর্যের রাঙা আলোয় রঞ্জিত হয় মাত্র। ক্কচিৎ নিবিড় লতাঝোঁপের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো চাঁদের আলো সামান্য-মাত্র পড়ে, নতুবা সকল সময়েই গোধূলি দিনমানে। চিরগোধূলির জগৎ এটা যেন।
একদিন সনৎ পড়ে গেল বিপদে।
তাঁবু থেকে বন্দুক হাতে শিকার করতে বার হয়ে সে একটা গাছের ডালে এক ভীষণ অজগর সাপ দেখে সেটাকে গুলি করলে। সাপটা দুলতে দুলতে গাছের ডাল থেকে পাক ছাড়িয়ে ঝুপ করে একবোঝা মোটা দড়াদড়ির মতো নীচে পড়ে গেল।
সনৎ সেটার কাছে গিয়ে দেখলে অজগরের মাথাটা গুলির ঘায়ে একেবারে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার ল্যাজটা হঠাৎ এসে সনৎ-এর পা দু-খানা জড়িয়ে ধরে শক্ত কাঠ হয়ে গেল। সরীসৃপের হিমশীতল স্পর্শ সনতের স্নায়ুগুলোকে যেন অবশ করে দিলে, নিজের পা দু-খানাকে সে আর মোটেই নাড়তে পারলে না–হাতদুটোকে যখন কষ্টে নাড়ালে তখন লোহার শেকলের মতো নাগপাশের শক্ত বাঁধনে তার পদদ্বয় গতিশক্তিহীন।
অজগর তো মরে কাঠ হয়ে গেল, কিন্তু সনৎ চেষ্টা করেও কিছুতেই নাগপাশ থেকে পা ছাড়াতে পারলে না। পা যেন ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে, এমনকী সনৎ-এর মনে হল আর কিছুক্ষণ এ অবস্থায় থাকলে সে চিরদিনর মতো চলৎশক্তি হারাবে। এদিকে বিপদের ওপর বিপদ, বেলা ক্রমশ পড়ে আসছে–এরই মধ্যে গোধূলি গিয়ে যেন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে বনে। কিছুক্ষণ পরে দিক ঠিক করে তাঁবুতে প্রত্যাবর্তন অসম্ভব হয়ে পড়বে। আরও কিছুক্ষণ কাটল, শেয়ালের দল বনের মধ্যে ডেকে উঠল–একটু পরেই বন্য হস্তীর বৃংহিত অরণ্যভূমি কাঁপিয়ে তুলবে, হায়েনার অট্টহাসিতে বুকের রক্ত শুকিয়ে দেবে।
সনৎ সবই বুঝছে–কিন্তু কোনো উপায় নেই। বন্দুকটার আওয়াজ করলে তাঁবুর লোকদের তার সন্ধান দেওয়া চলত বটে কিন্তু বন্দুকে গুলি নেই। শেষ দুটো টোটা অজগরের দিকে সে ছুঁড়েছে।
তিমিরময়ী রাত্রি নামল।
অসহায় অবস্থায় চুপ করে কাত হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। প্রথমটা তার মনে খুব ভয় হল–কিন্তু মরীয়ার সাহসে সাহসী হয়ে শেষ পর্যন্ত সে চুপ করে শুয়েই রইল। মৃত অজগরটাকে অন্ধকারে আর দেখা যায় না কিন্তু তার হিমশীতল আলিঙ্গন প্রতিমুহূর্তে সনৎকে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল যে প্রাণের বদলে সে প্রাণই নিতে চায়।
সারারাত্রি এভাবে কাটলে বোধহয় সনৎ সে যাত্রা ফিরত না–কিন্তু অনেক রাত্রে হঠাৎ সনৎ-এর তন্দ্রা গেল ছুটে। অনেক লোক আলো নিয়ে এসে ডাকাডাকি করছে। ইয়ার হোসেনের গলা শোনা গেল–হ্যাঁলু-উ-উ–মি. রায়–
সনৎ-এর সর্বশরীর ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে গিয়েছিল–সে গলা দিয়ে স্বর উচ্চারণ করতে পারলে না। কিন্তু ইয়ার হোসেনের টর্চের আলো এসে পড়ল ওর ওপরে। সবাই এসে ওকে ঘিরে দাঁড়াল। পাশের মৃত অজগর দেখে ওরা আগে ভেবেছিল সর্পের বেষ্টনে সনৎও প্রাণ হারিয়েছে–তারপর ওকে হাত নাড়তে দেখে বুঝলে ও মরেনি।
তাঁবুতে নিয়ে গিয়ে সেবা শুশ্রূষা করতে সনৎ চাঙা হয়ে উঠল।
ইয়ার হোসেন সেদিন ওদের ডেকে পরামর্শ করতে বসল।
জামাতুল্লাকে বললে–কই, তোমার সে মন্দিরের বা শহরের ধ্বংসাবশেষ তো দেখি নে কোনোদিকে।
জামাতুল্লা বললে–আমি তো আর মেপে রাখিনি মশাই ক-পা গেলে শহর পাওয়া যাবে –সবাই মিলে খুঁজে দেখতে হবে।
সুশীল একটা নকশা দেখিয়ে বললে–এ ক-দিনে যতটা এসেছি, জঙ্গলের একটা খসড়া ম্যাপ তৈরি করে রেখেছি। এই দেখে আমরা যে-যে পথে এসেছি দেখতে হবে, সে-পথে আর যাব না।
আবার ওদের দল বেরিয়ে পড়ল, দু-দিন পরে সমুদ্র-কল্লোল শুনে বনঝোঁপের আড়াল থেকে বার হয়ে ওরা দেখলে–সামনেই বিরাট সমুদ্র।
সনৎ চিৎকার করে বলে উঠল–আলাট্টা! আলাট্টা!
সুশীল বললে–তোমার এ চিৎকার সাজে না সনৎ। তুমি জেনোফনের বর্ণিত গ্রিক সৈন্য নও, সমুদ্রের ধারে তোমার বাড়ি নয়–
ইয়ার হোসেন বললে–ব্যাপার কী? আমি তোমাদের কথা বুঝতে পারছি নে–
সনৎ বললে–জেনোফন বলে একজন প্রাচীন যুগের গ্রিক লেখক–নিজেও তিনি একজন সৈনিক–পারস্য দেশের অভিযান শেষ করে ফিরবার সমস্ত দুঃখ-কষ্টটা দশ সহস্রের প্রত্যাবর্তন বলে একখানা বইয়ে লিখে রেখে গিয়েছেন–তাই ও বলছে–
ইয়ার হোসেন তাচ্ছিল্যের সুরে বললে–ও!
জামাতুল্লা বললে–আমার একটা পরামর্শ শোনো। কম্পাসে দিক ঠিক করে চলো এবার উত্তর মুখে যাই–ওদিকটা দেখে আসা যাক।
সকলেই একথায় সায় দিলে। সূর্যের মুখ না দেখে সকলেরই প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। ওরা প্রথম দিনেই সমুদ্রের বালির ওপরে অনেকগুলো বড়ো বড়ো কচ্ছপ দেখতে পেলে। ইয়ার হোসেনের একজন অনুচর ছুটে গিয়ে একটাকে উলটে চিত করে দিলে, বাকিগুলি তাড়াতাড়ি গিয়ে সমুদ্রের মধ্যে ঢুকে পড়ল। মালয় দেশীয় দায়ের (মালয়েরা বলে বোলো) সাহায্যে কচ্ছপটাকে কাটা হল, মাংসটা ভাগ করে রান্না করে সকলে পরম তৃপ্তির সঙ্গে আহার করলে। ভাগ করার অর্থ এই যে ইয়ার হোসেনের দল ও জামাতুল্লার রান্না হত আলাদা, সুশীল ও সনৎ-এর আলাদা রান্না সনৎ নিজেই করত।
একদিন সমুদ্রের ধারে বালির ওপরে কী একটা জানোয়ার দেখে সনৎ ছুটে এসে সবাইকে খবর দিলে।
সকলে গিয়ে দেখলে প্রকান্ড বড়ো শুয়োরের মতো বড়ো একটা জানোয়ার বালির ওপর চুপ করে শুয়ে। তার থ্যাবড়া নাকের নীচে বড়ো বড়ো গোঁফ–মুখের দু-দিকে দুটো বড়ো
বড়ো দাঁত।
ইয়ার হোসেন বললে–এ এক ধরনের সীল–সিঙ্গাপুরের সমুদ্রে মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায় বটে।
সীলের মূল্যবান চামড়ার লোভে সনৎ ওকে গুলি করতে উদ্যত হল।
ইয়ার হোসেন নিষেধ করে বললে–ওটা মেরো না–ও সীলকে বলে সী লায়ন, ও মারলে অলক্ষণ হয়।
পরদিন তাঁবু তুলে সকলে উত্তর দিকের জঙ্গল ভেদ করে রওনা হল। উত্তর দিকের জঙ্গলে সমুদ্রের ধার দিয়ে অনেকটা গেল ওরা। এক গাছ থেকে আর এক গাছে বড়ো বড়ো পুষ্পিত লতা সারাবন সুগন্ধে আমোদ করে ঝুলে পড়েছে–সুবৃহৎ লতা যেন অজগর সাপের নাগপাশে মহীরুহকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করছে–রাশি রাশি বিচিত্র অর্কিড। বিচিত্র উজ্জ্বল বর্ণের পাখির দল ডালে ডালে–অদ্ভুত সৌন্দর্য বনের। সুশীল বললে–মি. হোসেন, ও কী লতা জানেন? যেমন সুন্দর ফুল–আর লতা দেখা যাচ্ছে না ফুলের ভারে– গন্ধও অদ্ভুত। ইয়ার হোসেন লতার নাম জানে না–তবে বললে, সিঙ্গাপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ওরকম লতা সে দেখেছে।
সারাদ্বীপে গভীর বন। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া কঠিন ও অনবরত গাছপালা কেটে যেতে হয় পথ করবার জন্যে–কাজেই ওরা সমুদ্রের ধার বেয়ে চলছিল। এক জায়গায় একটা নদী এসে সমুদ্রে পড়েছে বনের মধ্যে দিয়ে, নদী পার হয়ে যাওয়া কষ্টকর বলে ওরা বাধ্য হয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। নদী সরু হবার নাম নেই–অনেক দূরে বনের মধ্যে ঢুকে এখনও নদী বেশ গভীর।
সুশীল বললে–ওহে, নদীটা আমাদের দেশের বড়ো একটা খালের মতো দেখছি। এ দ্বীপে এত বড়ো নদী আসছে কোথা থেকে? তেমন বড়ো পাহাড় কোথায়?
নিশ্চয়ই বড়ো পাহাড় আছে বনের মধ্যে, সেইদিকেই তো যাচ্ছি–দেখা যাক–
আরও আধঘণ্টা সকলে মিলে গভীর জনহীন বনের মধ্যে দিয়ে চলল। বনের রাজ্য বটে এটা–সত্যিকার বন কাকে বলে এতদিন পরে প্রত্যক্ষ করল সুশীল-সনৎ।
হঠাৎ এক জায়গায় একটা নাগকেশর গাছ দেখে সুশীল বলে উঠল–এই দেখো একটা আশ্চর্য জিনিস! এই গাছ কোথাও এদিকে দেখা যায় না। নিশ্চয়ই ভারতবর্ষ থেকে আমদানি এ গাছটা।
খুঁজতে খুঁজতে আশেপাশে আরও কয়েকটা নাগকেশর গাছ পাওয়া গেল। এই গভীর বনের মধ্যে নাগকেশর গাছ থাকার মানেই হচ্ছে এখানে কোনো ভারতীয় উপনিবেশের অস্তিত্ব ছিল পুরাকালে।
সনৎ বললে–কিন্তু এ গাছ তো খুব পুরোনো না, দেখেই মনে হচ্ছে। আট ন-শো বছরের নাগকেশর গাছ কি বাঁচে?
তা নয়। ঔপনিবেশিক ভারতীয়দের নিজেদের হাতে পোঁতা গাছের চারা এগুলো। বড়ো গাছগুলির থেকে বীজ পড়ে পড়ে এগুলি জন্মেছে। এ গাছ অধস্তন চতুর্থ বা পঞ্চম পুরুষ আসল গাছের।
সেদিনই সন্ধ্যার কিছু পূর্বে সনৎ বনের মধ্যে এক জায়গায় একটা কৃষ্ণ-প্রস্তরমূর্তি দেখে চিৎকার করে সবাইকে এসে খবর দিলে। ওরা ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখলে গভীর জঙ্গলের লতাপাতার মধ্যে একটা ভাঙা পাষাণমূর্তি–মূর্তির মুন্ডু নেই, তবে হাত-পা দেখে মন হয় শিবমূর্তি ছিল সেটা, দু-হাত উঁচু প্রস্তর-বেদির ওপর মূর্তিটা বসানো, এক হাতে বরাভয়, অন্য হাতে ডমরু, গলায় অক্ষমালা–এত দূর দেশে এসে ভারতীয় সংস্কৃতির এই চিহ্ন দেখে সুশীল ও সনৎ বিস্ময়ে ও আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ল–সেখান থেকে যেন সরে যেতে পারে না। এই দুস্তর সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষেরা হিন্দুধর্মের বাণী বহন করে এনেছিল একদিন এদেশে। সুলু সমুদ্রের ওই ডুবো পাহাড় অতিক্রম করতে চীনা জাঙ্কওয়ালা যে কৌশল দেখালে, এই কম্পাস ও ব্যারোমিটারের যুগের বহু বহু পূর্বে তাদের পূর্বপুরুষেরা সে-কৌশল একদিন না যদি দেখাতে পারতেন–তবে নিশ্চয়ই এ দ্বীপে পদার্পণ তাদের পক্ষে সম্ভব হত না। মনে মনে সুশীল তাঁদের প্রণতি জানালে। নমো নমঃ দিগবিজয়ী পূর্বপুরুষগণ, আশীর্বাদ করো–যে বল ও তেজ তোমাদের বাহুতে, যে দুর্ধর্ষ অনমনীয়তা ছিল তোমাদের মনে, আজ তোমার অধঃপতিত দুর্বল উত্তরপুরুষেরা যেন সেই-বল ও তেজের আদর্শে আবার নিজেদের গড়ে তুলতে পারে, সার্থক করতে পারে ভারতের নাম বিশ্বের দরবারে।
জামাতুল্লা ও ইয়ার হোসেনও চমৎকৃত হল। এ বনেও একদিন মানুষ ছিল তাহলে! এই যে গভীর বন আজ শুধু অজগর আর ওরাং ওটাংয়ের বিচরণক্ষেত্র, এখানে একদিন সভ্য মানুষের পদশব্দ ধ্বনিত হয়েছে, মন্দির গড়েছে, মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছে–এ-ই সকলের চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার বলে মনে হল এদের কাছে।
জামাতুল্লাকে সুশীল বললে–কেমন, এসব দেখেছিলে বলে মনে হয়?
এসব দেখিনি। তবে এতে বোঝা যাচ্ছে মানুষের বাসের নিকটে এসে পড়েছি।
সে জায়গাটা কেমন?
সে একটা শহর বাবুজি। তার বাইরে পাঁচিল ছিল একসময়ে। এখন পড়ে গিয়েছে।
কম্পাস দেখে দিক ঠিক করেছিলে? ল্যাটিচিউড লঙ্গিচিউড ঠিক করেছিলে?
না বাবুজি, ওসব কিছু করিনি। কম্পাস ছিল না।
সকলের মনে আশার সঞ্চার হল যে এবার নিশ্চয়ই সেই প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষের কাছাকাছি আসা গিয়েছে। কিন্তু তারপর তিনদিন কেটে গেল, চারদিন গেল, পাঁচদিন গেল– আবার সামনে সমুদ্রের পূর্ব তীর, আবার সুনীল সুলু সি। কোথায় নগর, কোথায়ই-বা কী। একখানা ইট বা পাথরও জঙ্গলের মধ্যে কোথাও কারো চোখে পড়ল না আর। আবার হতাশ হয়ে পড়ল সকলে। জামাতুল্লাকে ইয়ার হোসেন বললে–জামাতুল্লা সাহেব, স্বপ্ন দেখনি তো হিন্দু-মন্দিরের আর শহরের? জামাতুল্লা গেল রেগে। ইয়ার হোসেনের অনুচরেরা নিজেদের মধ্যে কী বিড়বিড় করতে লাগল।
সুশীল সনৎ ও জামাতুল্লাকে গোপনে ডেকে বললে–ইয়ার হোসেনের ওই লোকগুলোকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে যদি কিছু চিহ্ন না পাওয়া যায়– দেখছি ওগুলো ভারি বদমাইশ!
জামাতুল্লা বললে–ভাববেন না বাবুজি, আমি ছুরি চালাব, আপনাদের জন্যে প্রাণ দেব! ওরা কী করবে? কাঠের ভেলা তৈরি করে সুলু সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নিয়ে যাব–ওই হলদেমুখো চীনে জাঙ্কওয়ালা বড়ো বাহাদুরি করে গেল আপনাদের কাছে–দেখব ও কত বাহাদুর!
একদিন সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেক আগে সুশীল বনের মধ্যে পাখি শিকার করতে বেরোলো বন্দুক নিয়ে। কিছুদূর জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে সে অস্পষ্ট গোধূলির আলোয় দূর থেকে একটা লম্বা পাহাড়-মতো দেখতে পেলে। আরও কাছে গিয়ে সে দেখলে পাহাড় ও তার মধ্যে একটা খাল, তাতে জল আছে–গভীর খাল। জলে পদ্মফুল ফুটে রয়েছে। ভালো করে চেয়ে দেখে সে বুঝলে ওপারে ওটা পাহাড় নয়, একটা উঁচু পাঁচিল হতে পারে ওটা। খাল নয়, মানুষের হাতে কাটা পরিখা হয়তো। পাঁচিলের ওপর বড়ো বড়ো গাছ গজিয়েছে, মোটা মোটা শেকড় পাঁচিলের গা বেয়ে এসে মাটিতে নেমেছে–তাদের ডালপালার ফাঁক দিয়ে জায়গায় জায়গায় পাঁচিলের গায়ের বড়ো-বড়ো পাথরের চাঁইগুলি দেখা যাচ্ছে।
সুশীল আনন্দে ও বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল।
এই তবে সেই প্রাচীন নগরীর প্রাচীন ও পরিখা। এ বিষয়ে ভুল থাকতে পারে না–তবে, হয়তো সে উলটো দিক থেকে এটাকে দেখছে। নগরীর সিংহদ্বার অন্য দিকে আছে কোথাও।
সে যখন সকলকে গিয়ে খবর দিল তখন সন্ধ্যার অন্ধকার সমগ্র বনভূমিকে আচ্ছন্ন করেছে। ইতিমধ্যেই ওরাংওটাং ও শৃগালের ডাক শোনা যাচ্ছে। দু-একটা নিশাচর পাখি ছাড়া অন্য পাখির কূজন থেমে গিয়েছে। ডালপালার ফাঁকে ঊর্ধ্বে কৃষ্ণ আকাশে নক্ষত্রাদি দেখা দিয়েছে।
ইয়ার হোসেন বারণ করলে–এখন না, এ রাত্রিকালে তাঁবু ছেড়ে কোথাও যেও না, কাল সকালে দেখা যাবে।
সুশীলের আনা পাখি দিয়ে তাঁবুতে ভোজ হল রাত্রে।
জামাতুল্লা বললে–পাঁচিল যখন বেরিয়েছে–তখন আমায় মিথ্যেবাদী বলে বদনাম আর কেউ দিতে পারবে না। পরদিন সকলে গিয়ে দেখলে, সত্যই বিরাট প্রাচীর ও পরিখার অস্তিত্ব, ওদের সেখানে কোনো প্রাচীন নগরীর অস্তিত্বের নিদর্শনস্বরূপ বিরাজমান।
পরিখার জলে পদ্মফুল দেখে সুশীল ও সনৎ ভাবলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতীক যেন ওই ফুল। আটশো বছর আগে যে হিন্দু ঔপনিবেশিকগণ প্রথম পদ্মলতা এনে দুর্গপরিখার জলে পুঁতে দেয়, তারা আজ কোথায়? কিন্তু জলে একবার শেকড় গেড়ে যে পদ্মলতা বেঁচে উঠেছিল, সে বংশানুক্রমে আজও অক্ষয় হয়ে বিরাজ করছে এই গভীর অরণ্যের মধ্যে। ইয়ার হোসেনের আদেশে তার দু-জন অনুচর জল মেপে দেখলে, এখানে পার হওয়া অসম্ভব। পরিখার জল বেশ গভীর। পরিখার এক বাহু ধরে এক দল ও অন্য দিকে অন্য বাহুর সন্ধানে অন্য দল বার হল।
শেষের দলে গেল সুশীল।
উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বা প্রাচীর-পরিখার উত্তর দিকে আধ মাইল-টাক গিয়ে ওদের দল সবিস্ময়ে দেখলে প্রাচীরের এক স্থান ভগ্ন। মাঝখান বেয়ে বেশ একটা রাস্তা যেন ছিল সুপ্রাচীনকালে। এখন অবশ্য ঘন বন। দেখে মনে হয় শত্রু দ্বারা দুর্গ বা নগর-প্রাচীর হয়তো এখানে ভগ্ন হয়ে থাকবে, নতুবা এর অন্য কোনো কারণ নির্দেশ করা যায় না।
দেখা গেল পরিখার সেইখানে প্রাচীনকালে বোধহয় কাঠের সেতু ছিল, এখন সেটা ভেঙে পড়েছে জলে। জলের গভীরতা সেখানে কম। কাঠের সেতু প্রথমে দেখা যায়নি। ইয়ার হোসেনের জনৈক অনুচর প্রথমে জলের ধারে একটা শেকল দেখতে পায়। শেকলটা টেনে জলের মধ্য থেকে একখন্ড লোহার পাত বেরোলো। আন্দাজ করা কঠিন নয় যে এই লোহার পাত কাঠের চওড়া তক্তার গায়ে লাগানো ছিল। অনুমানটুকু ছাড়া কাঠের সেতুর অস্তিত্বের জন্য কোনো নিদর্শন এতকাল পরে কীভাবে পাওয়া সম্ভব হতে পারে!
ইয়ার হোসেন বললে–এখান দিয়ে পার হওয়া যাক–জল গম্ভীর হবে না।
সুশীল সামান্য একটু আপত্তি করলে–অথবা কেন যে করলে তা সে নিজেই জানে না।
প্রথমে নামল ইয়ার হোসেন নিজে–তার পেছনে নামল সুশীল। হাত তিন-চার মাত্র জলে যখন ওরা গিয়েছে তখন ওরা দেখলে সামনে জলের যা গভীরতা, তাতে আর অগ্রসর হওয়া চলবে না। ঠিক সেই সময় ওদের নিকট থেকে হাত পাঁচ-ছয় দূরে ইয়ার হোসেনের একজন অনুচর–যে শিকল টেনে তুলেছিল জল থেকে–সে নামল, উদ্দেশ্য, ওদের পাশাপাশি সেও পরিখা পার হবে। কিন্তু পরক্ষণেই এক ভয়াবহ কান্ড ঘটল।
সুশীল চোখের কোণ দিয়ে অল্পক্ষণের জন্যে দেখতে পেলে, লোকটার ছ-সাত হাত দূরে ছোট্ট কাঠের মতো কালো কী একটা জিনিস যেন ভাসছে। দু-সেকেণ্ড মাত্র, পরেই হঠাৎ যেন ভূমিকম্পে বিরাট জলোচ্ছাস উঠল, একটা আর্ত চিৎকার-ধ্বনি অল্পক্ষণের মধ্যে শোনা গেল… কীসের একটা প্রবল ঝাঁপটা এসে ওদের জলের ওপর কাত করে ফেললে…ওদের দু জনকে।
পরক্ষণেই ইয়ার হোসেনের সেই অনুচর অদৃশ্য।
কী হল ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারলে না–অবিশ্যি এক মিনিটও হয়নি এর মধ্যে সব ঘটে গেল।
সঙ্গেসঙ্গে ডাঙায় যারা ছিল তারা চেঁচিয়ে উঠল–শয়তান! শয়তান!
ইয়ার হোসেন আকুলভাবে চিৎকার করে বললে–ডাঙায় ওঠো–ডাঙায় ওঠো!
হতভম্ব সুশীল কাদা হাঁচড়ে মরি-বাঁচি ডাঙায় উঠল–পাশাপাশি ইয়ার হোসেন উঠল, জলে চেয়ে দেখলে জল কাদা-ঘোলা হয়েছে, ইয়ার হোসেনের অনুচর নিশ্চিহ্ন।
সুশীল ও ইয়ার হোসেন তখনও হাঁপাচ্ছে; সুশীলের বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে!
সে ভীত কণ্ঠে বললে–কী হল?
ইয়ার হোসেন বললে–আমাদের সাবধানে জলে নামা উচিত ছিল। এইসব প্রাচীনকালের জলাশয়ে কুমির থাকা সম্ভব, একথা ভুলে গিয়েছিলাম। খোঁজো সবাই–
কুমির! সুশীল অবাক হয়ে গেল। কে জানত নগরীর পরিখায় কুমির থাকতে পারে। দুর্গপরিখার প্রহরী এরা–হয়তো প্রাচীন দিনেই শত্ৰুরোধকল্পে জলের মধ্যে কুমির ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সুবিশ্বস্ত প্রহরীর ন্যায় এখনও তারা বাইরের লোকের অনধিকার প্রবেশে বাধাদান করছে।
খুঁজে কিছু হল না–জল কিছুক্ষণ পরে হতভাগ্য অনুচরের রক্তে রাঙা হয়ে উঠল। ইয়ার হোসেন বললে–আজ থামলে আমাদের চলবে না–এগোও। নগরের ফটক খোঁজো–
সুশীল বললে–জলের মধ্যে অজানা বিপদ। জল পার হওয়ার দরকার নেই– হেঁটে বা সাঁতরে। কোথাও সেতু আছে কি না দেখা যাক।
আবার উত্তর মুখে সকলে চলল। মাইল দুই সোজা চলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল–কারণ ভীষণ জঙ্গল কেটে কেটে অগ্রসর হতে হচ্ছে। আগুন জ্বেলে তাঁবু ফেলে সেদিন সকলে সেখানে রাত্রি কাটাবার আয়োজন করলে। এমন সময় বহু দূরে একটা বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল–তার উত্তরে ওরাও একটা আওয়াজ করলে। দু-টি দলের মধ্যে যোগসূত্র রাখবার একমাত্র উপায় এই বন্দুকের আওয়াজ–অনেক দূর থেকে দক্ষিণগামী দলের এ হল সংকেত-ধ্বনি। পরদিন সকালে আরও এক মাইল গিয়ে প্রাচীরের উত্তর দিক থেকে পূর্ব দিকে মুখ ফেরালে। অর্থাৎ এ দিকে আর শহর নেই। প্রাচীর ধরে সবাই বাঁকতে গিয়ে দেখলে পরিখার এপারে অনেকগুলো স্তূপ, স্তূপের ওপর বিরাট জঙ্গল। বড়ো বড়ো পাথর গড়িয়ে এসে পড়েছে স্তূপ থেকে নীচে–সেগুলি বেশ চৌকশ করে কাটা। সম্ভবত স্কুপের ওপর কোনো দুর্গ ছিল যা ঠিক নগর-প্রাচীরের উত্তর-পশ্চিম কোণ পাহারা দিত।
পশ্চিম মুখে কতটা যেতে হবে কেউ জানে না, কারণ তারা দৈর্ঘ্য ধরে যাচ্ছে, না প্রস্থ ধরে যাচ্ছে তা জানবার সময় এখনও আসেনি। সেদিনও কেটে গেল বনের মধ্যে; সন্ধ্যা নামল। সন্ধ্যায় যে বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল, তার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ও অস্পষ্ট।
সুশীল বললে–আমরা দৈর্ঘ্য অতিক্রম করেছি–প্রস্থ ধরে চলেছি। বুঝেছেন মি. হোসেন।
এবার বুঝলাম। ওদিকে যে দল গিয়েছে তারা ওদিকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে বন্দুক ছুড়ছে। অন্তত সাত মাইল দূর এখান থেকে।
পরদিন বেলা দশটার মধ্যে নগরীর সিংহদ্বার পাওয়া গেল। সেখানটাতে পরিখার ওপর পাথরের সেতু। এপারে সেতু রক্ষার জন্যে দুর্গ ছিল, বর্তমানে প্রকান্ড ভরা ঢিবি।
সকলে ব্যস্ত হয়ে সেতু পার হয়ে সিংহদ্বার লক্ষ করে অল্প কিছুদূর অগ্রসর হয়েই থেমে গেল।
সিংহদ্বারের খিলান ভেঙে পড়ত–যদি বট-জাতীয় কয়েকটি বৃক্ষের শিকড় আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে না জড়িয়ে ধরে রাখত। সিংহদ্বারের দু-পাশে অদ্ভুত দুই প্রস্তরমূর্তি–নাগরাজ বাসুকি ফণা তুলে আছে সামনে, পেছনে তিনমুখবিশিষ্ট কোনো দেবতার মূর্তি। সূর্যের আলো ওপরের বটবৃক্ষের নিবিড় ডালপালা ভেদ করে মূর্তি দু-টির গায়ে বাঁকাভাবে এসে পড়েছে।
গম্ভীর শোভা। সুশীল শুধু নয়, দলের সকলেই দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নেত্রে চেয়ে রইল এই কারুকার্যময় সিংহদ্বার ও প্রাচীন যুগের শিল্পীর হাতের এই ভাস্কর্যের পানে।
সুশীল হাতজোড় করে প্রণাম করলে মূর্তি দু-টির উদ্দেশ্যে। সে পুরাতত্ত্ব বা দেবমূর্তি সম্বন্ধে অভিজ্ঞ না হলেও আন্দাজ করলে এ দুটি তিনমুখবিশিষ্ট শিবমূর্তি।
সুলু সমুদ্রের এই জনহীন অরণ্যাবৃত দ্বীপে প্রাচীন ভারতের শক্তি ও তেজ একদিন এই দেবমূর্তিকে স্থাপিত করেছিল। আজ ভারত অধঃপতিত,–দাসত্বের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত। হে দেব, তোমার যে ভক্তগণ তোমাকে এখানে বাহুবলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তারা আজ নেই– তাদের অযোগ্য বংশধরকে তুমি সেই শৌর্য ও সাহস ভিক্ষা দাও, তাদের বীরপুরুষদের বংশধর করে দাও, হে রুদ্রভৈরব!
ইয়ার হোসেন পর্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিল। এই বিরাট ভাস্কর্যের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে বললে–যদি আমার দিন আসে, এই মূর্তি সিঙ্গাপুরের মিউজিয়ামে দান করবার ইচ্ছে রইল–
সুশীল বললে–তা কখনো করবেন না মি. হোসেন, যেখানকার দেবতা সেইখানেই তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিন। অমঙ্গলকে ডেকে আনবেন না।
সিংহদ্বার অতিক্রম করে ওরা নগরীর মধ্যে ঢুকল। কিন্তু অল্প কিছুদূর গিয়েই দেখলে, এত দুর্ভেদ্য জঙ্গল যে দশ হাত এগিয়ে যাবার উপায় নেই বন না কাটলে। সিংহদ্বারের সামনেই নিশ্চয় প্রাচীন নগরের রাজপথ ছিল, কিন্তু বর্তমানে সে রাজপথের ওপরই তিন-চার-শো বছরের পুরোনো বট-জাতীয় বৃক্ষ, বন্য রবার, বন্য ডুমুর গাছ! এইসব বড়ো গাছের নীচে আগাছা ও কাঁটালতার জঙ্গল। ওরাংওটাংও এই জঙ্গল ভেদ করে অগ্রসর হতে পারে না– মানুষ কোন ছার।
ইয়ার হোসেনের হুকুমে মালয় অনুচরেরা বোলো দিয়ে জঙ্গল কেটে কোনোরকমে একটু সঁড়িপথ বার করতে করতে সোজা চলল।
সুশীল বললে–এ জঙ্গল তো দেখছি নগরের বাইরে যেমন ছিল এখানেও তেমনি। কেবল এটা পাঁচিলের মধ্যে এই যা তফাত। কে একজন চেঁচিয়ে উঠল–দেখুন! দেখুন!
সকলে সবিস্ময়ে চেয়ে দেখল, সামনে প্রকান্ড একটা মন্দিরের চূড়া লতাঝোঁপের আবরণ থেকে অনেক উঁচুতে মাথা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের কাছে যাবার কোনো উপায় নেই–অনেক দূর থেকে বড়ো-বড়ো দেওয়াল ভাঙা পাথর ছড়িয়ে জঙ্গলাবৃত হয়ে পড়ে আছে অন্তত দেড়-শো হাত পর্যন্ত।
ওরা ডিঙিয়ে লাফিয়ে কোনোরকমে মন্দিরের সামনে বড়ো চত্বরের কাছে এল–কিন্তু সামনেই গোপুরমের মতো উঁচু পাইলন টাওয়ার। তার সুবিশাল পাথরের খিলান ফেটে চৌচির হয়ে সিংহদ্বারের মতোই আষ্টেপৃষ্ঠে বড়ো বড়ো শেকড় আর লতার বাঁধনে আজ কত যুগ যুগ ধরে ঝুলছে–তার ঠিকানা কারো কাছে নেই। গোপুরম ছাড়িয়ে মন্দিরের দেওয়াল, বিকটাকার দৈত্যের মুখের মতো সারি সারি অনেকগুলি মুখ দেওয়ালের গায়ে বেরিয়ে আছে–সুশীল আঙুল দিয়ে ওদের দেখিয়ে বললে–দেখো কী চমৎকার কাজ! হয় পাথরের কড়ি নয়তো পয়োনালি, যাকে ইংরেজিতে বলে গর্গয়েল। অর্থাৎ বিকট জানোয়ারের মুখ বসানো নালি।
সকলেই অবাক হয়ে সেই কল্পনাসৃষ্ট ভীষণ মুখগুলোর দিকে চেয়ে রইল। সুন্দরকে গড়ে তোলে সেও যেমন কৌশলী শিল্পী, ভীষণকে যে রূপ দেয়, সে শিল্পীও ঠিক তত বড়ো। সুশীলের মনে পড়ল আনাতোল ফ্রাঁসের সেই গল্প, শয়তানকে এমন বিকট করে আঁকলে শিল্পী যে, রাতের অন্ধকারে শয়তান এসে শিল্পীকে জাগিয়ে জিজ্ঞেস করলে–তুমি আমাকে এর আগে কোথায় দেখেছিলে যে অমন করে এঁকেছ? শিল্পী বললে–আপনি কে?
শয়তান বললে–আমি লুসিফার। যাকে তোমরা বল শয়তান। ও নামটায় আমার ভয়ানক আপত্তি তা জান? তুমি কী বিশী করে এঁকেছ আমায়! আমি কি অত খারাপ দেখতে? দেখো না আমার দিকে চেয়ে!
শিল্পী দেখলে শয়তানের মূর্তি দেখতে বেশ সুন্দর, তবে মুখশ্রী ঈষৎ বিষণ্ণ। ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললে–আমায় মাপ করুন, আমি এর আগে দেখিনি আপনাকে। আমি স্বীকার করছি আমার ভুল হয়েছে। আমি ভুল শুধরে নেব–
শয়তান হাসতে হাসতে বললে–তাই শুধরে নাও গে যাও–নইলে তোমার কান মলে দেব–