পূর্বপুরুষের একটা তালুকের সাড়ে তিন আনা অংশের মালিক ছিলেন আমার বাবা। সে গর্বে তিনি সর্বক্ষণ স্ফীত হয়ে থাকতেন। কেউ টু শব্দটি করলে সহ্য করতে পারতেন না। গ্রামের মানুষ এইরকম একটা ফুটো তালুকদারের কর্তালী মেনে নেবে তারা তেমন বোকা ছিল না। সুতরাং তারা শব্দ করত, হল্লা করত, গান করত এবং চিৎকার করত। গ্রামবাসীর সম্মিলিত জীবনধারা থেকে খসে পড়া শব্দমালা আমার জনকের গায়ে বিছুটির জ্বালা ধরিয়ে দিত। সে জ্বালা মিটাতে যখন-তখন তিনি আদালতে ছুটতেন। বেছে-বেছে ফৌজদারী মামলা রুজু করতেন। একধারা দুধারা থেকে আরম্ভ করে ক্রিমিনাল অ্যাক্টের সাতশ সাতাশি ধারা পর্যন্ত গরীব প্রতিবেশীর নামে ঠুকে দিতেন।
এ ব্যাপারে আবুনসর মোক্তার সাহেব ছিলেন বাবার ডান বাম দুই হাত এবং সে সঙ্গে শলা-পরামর্শ বুদ্ধি-বিবেচনার একখানি নির্ভরযোগ্য আড়ত। একেকটি মোকদ্দমার দিন এলে আমাদের বাড়িতে উৎসবের ধুম লেগে যেত। মুরগীর পোলাও হতো, খাসী জবাই হতো, সাবেক কালের বড় বড় চীনামাটির বাটিতে ঝোলে-ঝালে রাধা রুই-কাতলার মস্তক হা-করে তাকিয়ে থাকত। সাক্ষীরা লুঙ্গির গিট খুলে দিয়ে চিবিয়ে চুষে খেত। বাটাভরা পান থেকে কিছু মুখে পুরত এবং কিছু লুঙ্গির গিটে ঔজত। তারপর সাড়ে সাত টাকা নগদ গুণে ভোর সাড়ে আটটায় ট্রেনে আল্লাহর নামে হলপ করে মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে আদালতে ছুটত। মোকদ্দমা কোর্টে ওঠার আগে বাবা সাক্ষীসাবুদসহ আবদুল ফাত্তাহ লেনে মুক্তার সাহেবের বাসায় এসে হাজির হতেন। মোক্তার সাহেব সাক্ষীদের মিথ্যে কথার প্যাঁচগুলো একটু একটু কষে দিতেন।
আমাদের বাড়িতে পাঁচ সাত জন মোল্লা সারাক্ষণ মুখে ফেনা ছুটিয়ে কোরআন পাঠ করত। মা সারাদিন রোজা রেখে আসমানের আল্লাহর মন জোগাতে চেষ্টা করত। মোকদ্দমার দিন এলে ভারি খুশী হয়ে উঠতাম আমরা সব কটি ভাইবোন। মানুষজনের নিপ্রাণ স্তব্ধতায় ক্ষণস্থায়ী হলেও একটা চাঞ্চল্য জেগে উঠত। তা আমাদের বুকের গভীরে আনন্দের ঘূর্ণিস্রোত বইয়ে দিত। মোকদ্দমার দিন যাতে ঘন ঘন আসে সেজন্য শিশুমনের সবটুকু আবেগ ঢেলে খোদার কাছে আবেদন পাঠাতাম। তাড়াতাড়ি মোকদ্দমার দিন এলে বাবা ভীষণ নেতিয়ে পড়তেন। তিনি অনেক সময় নামাজের বিছানায় ঘুমিয়ে যেতেন। মুখের রেখাগুলো আরো গভীর দেখাতো। এ সময় মাকে বড় কাতর দেখতাম।
সেবার একটা ব্যাপার ঘটে গেল। বাবা তাঁর প্রতিভার জোরে একটা আধা খুনের মামলায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। বাস্তবে কিন্তু লোকটিকে খুন করার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ ছিল না। তবে তিনি দীর্ঘদিন থেকে প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছিলেন, ওই হারামজাদা পাজীটাকে বাগে পেলে খুন না করে ছাড়বেন না। বলাবাহুল্য, কারো সঙ্গে ঝগড়া বচসা ইত্যাদি হলে তিনি খুন করার সংকল্প সাড়ম্বরে ঘোষণা করতে পারলেই খুব প্রীত হতেন। শেষ পর্যন্ত সে ঘোষিত মানুষটাই মঙ্গলবার হাট থেকে ফেরার পথে ভয়ংকরভাবে জখম হলো।
গাঁয়ের লোকদের কেউ বাবার নামে অপবাদ দিল, আবার কেউ তার প্রথম পক্ষের বড় ছেলেকে দুষল। ঐ ছেলেটার সঙ্গে তার তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর একটা বিশ্রী ব্যাপার নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি হচ্ছিল। সে যাক্। লোকটা কিন্তু বাবাকে এক নম্বর আসামী করে মামলা লটকে দিল। সে ছিল গাঁয়ের খুব জবরদস্ত মানুষ। তার বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষে কেউ সাক্ষ্য দেবে তা ছিল কল্পনারও অতীত। মোক্তার সাহেব বাবাকে একজন প্রখ্যাত মিথ্যেবিশারদ সাক্ষী জুটিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু এই মহাপুরুষের সাক্ষ্য দেয়ার গুণে কত খুনের আসামী বেকসুর খালাস গেছে, কত তালুকদারী জমিদারী লাটে উঠেছে, কত সম্পন্ন গেরস্তের বাস্তুতে ঘুঘু চরেছে- রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করেছিলেন। বাবা এই ফলাও বর্ণনা শুনে খুবই আশ্বস্ত হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সাক্ষীকে দেবার জন্য মোক্তার সাহেবের হাতে নগদ একশ টাকা প্রদান করেছিলেন। সেও নিতান্ত কাচুমাচু হয়ে। তাঁর ভাবখানা এরকম ছিল যে এই মহান মিথ্যের শিল্পীর প্রকৃত সমাদর করার ক্ষমতা আপাতত তার নেই। সেই সময়ে আমাদের সংসারে টাকা পয়সার খুবই টানাটানি। জমি বন্ধক রেখেও কোথাও টাকা সংগ্রহ করার উপায় ছিল না। কারণ বন্ধকীযোগ্য জমিগুলো বহু আগেই মহাজনের দখলে গিয়েছিল।
অবশেষে একদিন আমরা মিথ্যে বলার বীরপুরুষটিকে দেখতে পেলাম। কালো কুচকুচে বেঁটে চেহারার গুছি দাড়িঅলা আস্তে আস্তে কথা বলে মানুষটিকে ভীতি মিশ্রিত কৌতূহলসহকারে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। যতক্ষণ এই রহস্যময় মানুষটি আমাদের বাড়িতে ছিল, আমি একবারও অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাইনি। ভাবে ভঙ্গিতে আমাদের মনে হয়েছিল মস্তবড় একজন বীর পুরুষ বাক্যের মন্ত্রশক্তিতে পৃথিবীর যাবতীয় নয়কে হয় এবং হয়কে নয় করার ক্ষমতা তিনি রাখেন বটে।
আদালতে হাকিমের সামনে হাজির হওয়ার পরেই লোকটা তার আসল প্রতিভার পরিচয় দিল। প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আরো কিছু বাড়তি টাকা কোমরের খুতিতে খুঁজে আদালতগৃহে শপথ করে বলল যে সে নিজের কানে বাবাকে বলতে শুনেছে যে আহাদ আলীকে খুন না করে তিনি ছাড়বেন না এবং আহাদ আলী যে আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহে প্রাণে বাঁচতে পেরেছে, সেজন্য হাকিমের সামনেই আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালো! এমন পাকা সাক্ষীর কথা অবিশ্বেস কোন্ হাকিম করতে পারে? মামলায় আমাদের হার হলো। বাবা একটুর জন্য জেল থেকে বাঁচলেন। লোকজনকে বলাবলি করতে শুনলাম মাথার শুভ্রকেশের দিকে তাকিয়ে আদালতের হাকিম বাবার ওপর করুণা করেছেন। আমাদের নগদ আড়াই হাজার টাকা জরিমানা দিতে হলো। সারা বছরের খোরাকীর জন্য আমাদের যে জমিগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো, তার একাংশ জলের দামে বেচে আদালতের প্রাপ্য শোধ করতে হলো।
সময় বয়ে যাচ্ছিল। এরই ফাঁকে ফাঁকে বোনেরা সেয়ানা হয়ে উঠল। বিয়ে হয়ে গেল সকলের ঝটঝট করে। এ ব্যাপারে বাবার ধর্মপ্রীতি খুবই সাহায্য করল। তিনি মনে করতেন যুবতী মেয়ে ঘরে পুষে রাখাটা মস্ত গুনাহর কাজ। তাই বোনেরা একটু সেয়ানা হয়ে উঠতে না উঠতেই হাতের কাছে যাকে পেলেন কোনোরকম বাছবিচার না করে ধরে ধরে গছিয়ে দিলেন।
বাকি রয়ে গেলাম আমি। সবে বি. এ. ক্লাশে ভর্তি হয়েছি। আমার পড়াশোনা সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে বাবাকে কোনোদিন উচ্চবাচ্য করতে শুনিনি। তিনি কিন্তু মনে মনে এই স্কুলে কলেজে পড়াশোনার কাজটাকে পছন্দ করতেন না। তবে মুখ ফুটে কোনোদিন প্রতিবাদও করেননি। কতেক বিষয়ে তিনি আমার মায়ের ওপরে জবরদস্তি করতে সাহস পেতেন না। আমার পড়াশোনা তার একটি।
আমার মায়ের অত ঠাট ঠমক ছিল না। মা সাদাসিদে গেরোস্তর ঘরের মেয়ে। কোনোদিন তাকে কারো বিরুদ্ধে নালিশ করতে শুনিনি। অপ্রাপনীয় বস্তুর প্রতি লোভ কিংবা আগ্রহ মা জীবনে দেখায়নি। মায়ের উৎসাহ, আগ্রহ এবং চোখের জলই আমার তাবৎ কর্ম-প্রেরণার উৎস।
আমার বাবাও যে এক সময়ে প্রকৃত পশু হতে চেষ্টা করেছিলেন তার প্রমাণ আমার এই মা। বাবা যৌবনকালে এক গেরস্ত ঘরের মেয়েকে রূপ দেখে জোর করে বের করে নিয়ে এসেছিলেন। মোল্লা মৌলবী ডেকে যে বিয়ে পড়ানোর একটা ব্যাপার আছে তাও প্রথমে করেননি। পরে চাপে পড়ে কিছু কিছু সামাজিকতা পালন করতে হয়েছিল! বাবাকে বাঁকা লাঠি হাতে মসজিদ থেকে বেরুতে দেখলে পাড়ার বর্ষীয়সী নারীরা স্মৃতির ভাণ্ড নাড়া দিয়ে সেসব কথা যখন বলাবলি করত লজ্জা শরমে আমার দুকান লাল হয়ে যেত।
আড়াই হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে বাবার মাথা ভয়ংকর বিগড়ে গিয়েছিল । গ্রামে আমাদের খুবই অখ্যাতি রটেছিল। বাবা দশজনের সামনে মুখ দেখাতে পারছিলেন না। হাটে বাজারে যাওয়া-আসা করাও তাঁর পক্ষে একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তিনি আমাদের দহলিজে বসে দিনরাত চাপা রাগে ফুলতে লাগলেন। অপমানে হতাশায় অন্ধ হয়ে এককালীন হিতৈষী সুহৃদ আবুনসর মোক্তার সাহেবের সঙ্গে এক ধারা দুধারা থেকে শুরু করে আইনের সর্বোচ্চ নম্বরে মামলা জুড়ে দিলেন।
আবুনসর মোক্তার সাহেব এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে জটিল প্যাঁচ কষে দুনিয়ার আমাদের অংশ নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসছিলেন, সে একই সূক্ষ্ম প্যাঁচ অতীতজীবী উদভ্রান্ত বাসনার অসহায় শিকার আমার বাবার ওপর ঠাণ্ডা মাথায় অথচ পরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে প্রয়োগ করে রক্তের গাঁজলা বের করে দিচ্ছিলেন। মামলায় আমাদের হার হচ্ছিল। বাবা যতই হারছিলেন ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। এক সময়ে অবশ্য তাঁর বুঝতে বাকি রইল না, কানা মোক্তার তাঁকে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী না করে ছাড়বেন না।