পুন্নিকে দেখতে এলেন একজন। রিকশা থেকে বুড়ো মানুষটি যখন নামছিলেন তখনই তার ফরসা টুকটুকে নাদুসনুদুস চেহারাটা দেখে সকলের ভাল লেগে গেল। পুন্নির বাপ আবেগে দিগিনকে বলে ফেললেন, দেখেন, যেন ঠিক পাকনা শসা।
তা পাকা শসার মতোই চেহারা বটে। মুখে অবশ্য হাসি নেই। গম্ভীর হয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ এসে বসলেন। চারধারে একটু চেয়ে দেখলেন। কথা কম হলেও বেরসিক নন। জলখাবারের প্লেটটা আসতে দেখে বললেন, সেই লৌকিকতা।
না না, কিছু নয়। বলে পুন্নির বাপ, একটু মিষ্টিমুখ আর কী।
রক্তে চিনি একশো কুড়ি। আপনার মেয়ের মুখশ্রী যদি মিষ্টি হয় তা হলেই হবে, আলাদা মিষ্টির দরকার নেই।
ভারী ম্লান হয়ে গেলে পুন্নির বাপা পুন্নির মুখশ্রী তেমন মিষ্টি নয়, সবাই জানে। তবুপুন্নিকে আনা হল। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ অবশ্য পুন্নির দিকে এক পলকের বেশি চেয়ে দেখলেন না। চিনি ছাড়া চা তৈরি করে দিতে হয়েছিল নতুন করে, সেইটে চুমুক দিতে দিতে বললেন, যেতে পারো মা। তোমার গার্জিয়ানদের সঙ্গে কথা বলি বরং।
পুন্নি চলে যেতেই দিগিনের উকিল দাদা জিজ্ঞেস করেন, কেমন দেখলেন? চলবে?
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, রং তো কালোই, মুখশ্রী ওই চলনসই।
পুন্নির বাবা বলতে গেল, কিন্তু কাজকর্ম—
ভদ্রলোক হাত তুলে বললেন, ও তো সবাই জানে। ঘরের কাজকর্ম তো আর জজিয়তি ব্যারিস্টারি নয়।
দিগিনের দিকে চাইলেন ভদ্রলোক। বললেন, কী দেবেন আপনারা?
যা চান।–দিগিন গম্ভীর হয়ে গেলেন।
চাওয়ার কী? আপনাদের বাজেটটা না জেনে বলি কী করে?
যা সবাই দেয়। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ফার্নিচার, খাট, গয়না, ছেলের আংটি, ঘড়ি।
হুঁ।-বলে গম্ভীরভাবে আবার চা খেলেন। বললেন, আলমারি তো গোদরেজের?
তা-ই হবে।
গয়না?
চোদ্দো-পনেরো ভরি।
ঘড়িটা?
রোলেক্স।
ভদ্রলোক শ্বাস ফেললেন। তারপর বলেন, আমি কী পাব?
মানে?
ছেলে আর ছেলের বউ তো এ সব পাবে। আমার পাওনা কী?
কী চান?
নগদ।
বলুন কত?
আমি বলব না। শুনব।
তখন সবাই পীড়াপীড়ি করতে থাকে ভদ্রলোককে কিছু একটা বলার জন্য। ভদ্রলোক কেবলই হাতজোড় কবে বলেন, আমি কিছু বলব না, আরও চার জায়গায় মেয়ে দেখেছি। সকলেরই টাকার অঙ্ক পেয়েছি। সব লিখে জামশেদপুরে জানাব আমার স্ত্রীকে। তিনি সব বিচার করে যেখানে মত দেন সেখানেই হবে। আমি দূত মাত্র, আপনারা সবাই বরং পাশের ঘর থেকে টাকার ব্যাপার পরামর্শ করে ঠিক করে আসুন।
বোঝা গেল, লোকটা স্বাভাবিকভাবেই একজন ডিকটেটার। সব জায়গায় কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা রাখে। দিগিনের দাদারা আর দুই ভগ্নিপতি পাশের ঘরে চলে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। বড়দা ডেকে গেলেন, দিগিন। দিগিন গেলেন না। মাদ্রাজি চুরুট ধরিয়ে ঠায় বসে রইলেন লোকটার দিকে চেয়ে।
একটু পরে ওঁরা ফিরে এলে বড়দা বললেন, আমরা দুই হাজার নগদ দেব।
দুই!–ভদ্রলোক নির্বিকারভাবে উচ্চারণ করেন।
দিগিন লোকটার দিকে চেয়ে রইলেন মাদ্রাজি চুরুটের ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে। তারপর হঠাৎ বললেন, দশ।
অ্যাঁ।–ভদ্রলোক তাকালেন।
দশ হাজার দেব। নগদ।
ভদ্রলোক হাঁ করে চেয়ে থাকেন। বাক্যহারা দুই দাদা আর দুই ভগ্নিপতি সন্দেহের চোখে দেখেন। কিছু বুঝতে পারেন না।
ভদ্রলোক একটা শ্বাস ফেলে বলেন, আচ্ছা।
আচ্ছা নয়, দশ হাজার দেব। বিয়ের পাকা কথা দয়া করে আজই বলে যান। নইলে আমরা অন্য পাত্র দেখি।
ভদ্রলোক ইতস্তত করতে থাকেন। দিগিন গিনিপিগ দেখার মতো করে কৌতূহলী চোখে ভদ্রলোককে দেখেন। মানুষ-গিনিপিগের মধ্যে কোন কথায় বা কোন অবস্থায় কী রকম প্রতিক্রিয়া হয় সেটা লক্ষ করা দিগিনের এক প্রিয় অভ্যাস।
ভদ্রলোকের নির্লিপ্ত ভাবটা ঝরে যায়। ফরসা মুখখানায় একটু লাল আভা ফুটে ওঠে।
দিগিন মৃদুস্বরে বলে, আমার বড় আদরের ভাগনি। মনে মনে বহুদিনের ইচ্ছে ওর একটা ভাল বিয়ে দিই। কাজেই পুন্নির জন্য আমি আলাদা খরচ করব। আপনি চিন্তা করবেন না।
কিন্তু আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু পরামর্শ
কথাটা শেষ করতে পারেন না ভদ্রলোক।
দিগিন বলেন, সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আমরা দেরি করতে পারব না। আমার দাদাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চাকরির ছেলে পছন্দ নইলে একটি ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার ছেলে আমার হাতেই ছিল। আপনি যদি আজ স্পষ্ট মতামত না দেন তা হলে আমরা তো দেরি করতে পারি না।
ভদ্রলোকের কঠিন ব্যক্তিত্বের এবং কর্তৃত্বের ভাবটা খসে গেছে। লাল মুখখানা রুমালে ঘষে আর-একটু লাল করে তুললেন। আধ-খাওয়া জলের গ্লাসটায় এক বার চুমুক দিলেন।
তারপর বললেন, আলমারিটা গোদরেজের তো?
নিশ্চয়ই।
সোনা যদি আর একটু বাড়াতেন।
দিগিন চুরুট মুখে নিয়ে বলেন, পনেরো ভরি তো দেওয়াই হচ্ছে আমাদের ফ্যামিলি থেকে। আমি নিজে একটা পাঁচ ভরির নেকলেস দেব। আর প্রত্যেকটি এক ভরি ওজনের ছ-গাছা চুড়ি।
আমার ছেলে কী পাবে? এ তো মেয়ের কথা হল, ভালই
একটা স্কুটার দেব, একটা ফ্রিজ।
ভদ্রলোক ঠিক বিশ্বাস করতে পারেন না। দিগিনের দিকে সন্দেহের চোখে তাকান আবার অবিশ্বাসও করতে পারেন না। দিগিন শিলিগুড়ির নামজাদা লোকদের একজন। তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও কথার দাম আছে। কিন্তু এত লোভানি কেন, মেয়ের কোনও গুপ্ত খুঁত আছে কি না এই নিয়েই বোধহয় দ্বিধায় পড়েন ভদ্রলোক।
সেটা দিগিন আন্দাজ করে বলেন, আমাদের মেয়ে যা পাচ্ছেন তেমন স্বভাবের মেয়ে পাওয়া যায় না। আপনি পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে খোঁজ নিতে পারেন।
না, না, তার কী দরকার?
খোঁজ নেওয়া ভাল, সন্দেহের দরকার কী?
বড়দা ভ্রু কুঁচকে দিগিনের চুরুটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মুখখানা দেখছিলেন। তিনি স্বভাবতই বিরক্ত। তার বড় দুই মেয়ের বিয়েতে দিগিন এত খরচ করেননি। মেজদাও খুশি নন। পুন্নির বাপ একটু ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি দিগিনের একটা চুরুট ধরিয়ে নিয়ে বলে, তা হলে পাকা কথা আজই হয়ে যাকা–বলে সমর্থনের জন্য চার দিকে তাকাল। তার দুই সম্বন্ধী শ্বাস ফেলেন।
বড়দা বললেন, সব তো শুনলেন। সন্তুষ্ট তো?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বলেন, মন্দ কী?
তা হলে? দিগেন জিজ্ঞেস করেন।
ভদ্রলোক একটু করুণ সুরে বলেন, ছেলে একবার নিজের চোখে দেখবে না?
কেউ কিছু বলার আগেই দিগিন দৃঢ়স্বরে বলেন, না। আমাদের পরিবারে পাত্রকে মেয়ে দেখানোর নিয়ম নেই।
কথাটা ডাহা মিথ্যে। সবাই দিগিনের দিকে চেয়ে থাকেন। এই ঘরে যে সব ঘটনা ঘটছে তার কর্তৃত্ব নিশ্চিতভাবে এখন দিগিনের হাতে। তাই কেউ কিছু বলতে সাহস পান না।
ভদ্রলোক অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, মেয়েটিকে আর এক বার ডাকুন।
পুন্নি আবার আসে। তার চোখেমুখে একটা ভয়ার্ত ভাব। বহু টাকায় ছোটমামা তার জন্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কিনছে, একথা ভিতরবাড়িতে ছড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সে এতটা কল্পনাও করেনি। তাই তার মুখে ভয়, লজ্জা, সংকোচ।
ভদ্রলোক পুন্নির দিকে চেয়ে বলেন, মা, এই বুড়ো ছেলেটার বায়না-টায়না একটু রাখতে পারবে তো? আমার বড় বউমা হবে তুমি, তা রান্নাটান্না কি বুড়োর একটু সেবা-টে, এ সব পারবে তো?
পুন্নি মৃদু হেসে মাথা নত করে নিয়মমাফিক। স্নেহভরে চেয়ে থাকেন দিগিন। এর আগে তিন বার পুন্নিকে নাকচ করে গেছে নিটি ছেলেপক্ষ। তাই ও আর পাত্রপক্ষের সামনে বেরোতে চায় না, সে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিলেন দিগিন। বিয়েটা যে হবে, বোঝাই যাচ্ছে।
ভদ্রলোক দিগিনের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলেন, মেয়ে তো অপছন্দের নয়। আমার পছন্দই হয়েছে।
কথা দিচ্ছেন তা হলে?
ভদ্রলোক একরকম হাপধরা হাসি হেসে বললেন, ওই দেওয়াই হল।
আমরা খুব বেশি দেরি করতে পারব না।
দেরি করে আমাদেরই বা লাভ কী?
তা হলে অগ্রহায়ণে দিন ঠিক করি?
করুন। আমি এ সপ্তাহেই আবার আসব। আমার স্ত্রীকে একটু খবর দেওয়া নিতান্ত দরকার। আমার একার কথায় কিছু হবে না।
স্ত্রীকে সব টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন জানিয়ে দিন। ছেলেরও মত দিন। কিন্তু সেগুলো সেকেন্ডারি ব্যাপার। আপনার মত থাকলে কেউই আপত্তি করবে না।
মানিসেন্ট্রিক লোকটি মাথা নাড়েন। সম্বন্ধটা হাতছাড়া যে তিনি নিজের স্বার্থেই করবেন না তা বোঝাই যাচ্ছিল। বললেন, তা হলে কথাটা ফাইনাল বলেই ধরে নিন।
দিগিন মাথা নেড়ে বললেন, ধরে নিচ্ছি। আমরা আর সেই ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটির গার্জিয়ানদের সঙ্গে কথা বলব না।
ভদ্রলোক হাঁপ ছাড়লেন।
মনে মনে হাঁপ ছাড়লেন দিগিনও। ‘নির একসময়ে বোধহয় ধারণা ছিল যে, যেহেতু তারা মামাবাড়িতে আশ্রিত সেই জন্যই তার ভাল বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেখতেও সে তেমন কিছু নয়, মামারাও খরচ করবেন না। হয়তো আদপে বিয়েই হবে না তার। সেই কারণেই বোধহয় পুন্নি শান্ত এবং ভাল মেয়ে হয়েও একদা একটি ছেলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। ছেলেটা পাড়ার বখাটেদের একজন। লেখাপড়া করেনি, জতে নিচু, গুণের মধ্যে ভাল গোলকিপার ছিল। কবে কখন প্রেম হয়েছিল কে জানে। কিন্তু বাড়িতে কথাটা জানাজানি যখন হয় তখন ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। সারা রাত্রি ধরে একটা ফাংশন হয়েছিল তিলক ময়দানে, সেখানে যাওয়ার নাম করে এক বার গিয়েছিল পুন্নি। সকালে ফিরেও এল। কিন্তু ওর বন্ধুদের মধ্যে কে যেন বাড়িতে বলে দিয়েছিল যে পুন্নি ফাংশানে একটুক্ষণ থেকেই শান্তনুর সঙ্গে কেটে পড়েছিল। শিলিগুড়ি কলকাতার মতো বড় জায়গা নয়, এখানে সবাই সকলের খোঁজখবর রাখে। পুন্নির ব্যাপারটাও অনেকেই জেনে গেল। কিন্তু পুন্নির মা বাবা মেয়েকে শাসন করেননি। বড়দার কানে যেতেই উনি মত দিলেন, ও সব জাত-ফাত, শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে কী হবে? বিয়ে দিয়ে দাও। মেজদারও তাই মত ছিল। এবং বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর উদ্যোগও চলছিল। ব্যাপারটা দিগিন জানতে পারেন সবার শেষে।
দিগিন জাত-টাত বড় একটা মানতেন না, তাঁর নিজের শিক্ষাও বেশি দুর নয়! বিয়েটাতে মতও তিনি হয়তো দিতেন। কিন্তু তার মনে হয়েছিল, পুন্নির ভালবাসাটা খাঁটি নয় এবং বাড়ির লোক বোঝা নামাতে চাইছে। প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপে সংসারটার নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। পুন্নিকে ডেকে নিভৃতে প্রশ্ন করতেই সে কেঁদে ফেলল। প্রথমে বলল যে সে সত্যিই ছেলেটাকে ভালবাসে। ওকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। তার পর দিগিন তার কাছ থেকে আস্তে আস্তে সব খবরই বের করে নেন। পুন্নি ছেলেটার সঙ্গে রাত কাটিয়েছে, পিকনিকে গেছে, চিঠি লিখেছে পরম্পরকে। পুন্নি যে ফাঁদে পড়ে গেছে সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। রাত কাটানোর ব্যাপারটা ছেলেটাই রটায়। এবং এমনই তার সাহস যে পুন্নির লেখা কিছু চিঠি সে এসে বড়দা আর পুন্নির বাবাকে দেখিয়েও যায়। ও সব দেখে ভয় পেয়ে সবাই বিয়ের উদ্যোগ করে।
দিগিন বুঝতে পারেন, ছেলেটাকে ভয় দেখিয়ে বা পুন্নিকে চোখ রাঙিয়ে কোনও লাভ নেই। কিন্তু অত সহজে তিনি বাড়ির লোকের মতে মত দিতে পারলেন না। ছেলেটার দুঃসাহস এবং দুষ্টুবুদ্ধি তার ভিতরটাকে শক্ত করে তুলল। কিন্তু মুখে তিনি কিছু বললেন না, মতামত দিলেন না। শুধু একদিন অমলকে ডেকে গোপনে বললেন, আমার ভাগনির সঙ্গে তোমার ভাব শুনছি, ঠিক নাকি?
ছেলেটা মাথা নিচু করে বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ।
বিয়ে তো করবে, কিন্তু কাজ-টাজ কিছু করছ?
চেষ্টা করছি।
চেষ্টায় কী হবে? ধরা করার কেউ আছে?
না।
ঠিক আছে, সে ভার আমি নিচ্ছি। তবে একটা কথা, চাকরি পাকা হওয়ার আগে বিয়ে-টিয়ে হবে না কিন্তু।
ছেলেটা চাকরির কথায় যথেষ্ট শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠেছিল দিগিনের প্রতি। বলল, আজ্ঞে না। এম-ই-এস-এর প্রায় সব হর্তাকর্তাকেই চেনেন দিগিন। তাদের কাছে নিয়ে গেলেন। ক্লাস ফোর স্টাফ হিসেবে তার চাকরি হয় এবং চাকরি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আসামের নেফায় তাকে বদলি করা হয়। সমস্ত ব্যাপারটাই দিগিন খুব নিপুণভাবে করেছিলেন। কেউ কিছু টের পায়নি। সবাই জেনেছিল হবু জামাইকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই দিগিনের এই চেষ্টা। পুন্নিও বোধহয় খুশি হযেছিল। অমল নেফায় যাওয়ার আগেই একদিন পুন্নিকে ডেকে দিগিন বললেন, ওর কাছ থেকে তোর চিঠিগুলি চেয়ে নিবি।
কেন ছোটমামা?
মিলিটারির সঙ্গে থাকবে, আজ এ জায়গায়, কাল সে জায়গায়, ওগুলো হারিয়ে যদি ফেলে, আর অন্য কারও হাতে যদি পড়ে লজ্জার ব্যাপার।
পুনি লজ্জা পেয়ে বলে, আচ্ছা।
সব ক’টা চেয়ে নিবি, নইলে কিন্তু ছাড়বি না।
যদি দিতে না চায়?
দেবে, বলিস না-দিলে ছোটমামা রাগ করবে। চিঠিপত্র ছছাটমামা পছন্দ করে না। কে কোথায় দেখে ফেলবে।
চিঠি ফেরত দিয়েছিল অমল। নেফা থেকে কয়েকখানা চিঠি লিখে থাকবে। বছরে এক-আধবার আসে, দেখাসাক্ষাৎও বোধহয় করে পুন্নির সঙ্গে। কিন্তু পুন্নির প্রেমের দুধ কেটে ছানা হয়ে গেছে, এ সত্য পুন্নির মুখ দেখলেই আজকাল বোঝা যায়। সঙ্গ বন্ধ করে দিলে যে কত ফলস প্রেম নাকচ হয়ে যায়।
অমল ক’দিন আগেই এসে ঘুরে গেছে। শিগগির আর আসবে না। এই ফাঁকে পুন্নিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে পাচার করতে পারলে ভয়ের কিছু থাকবে না। প্রেমের তেজটাও কমজোরি হয়ে এসেছে। বাড়ির লোকও ব্যাপারটা ভুলে গেছে। কেবল দিগিন ভোলেননি। দুটো গিনিপিগের ওপর তার প্রেম-বিষয়ক পরীক্ষাটা তিনি চালিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তার ফলাফলটা দেখবেন বলেই ভোলেননি।
কয়েক দিন পরে এসে পাটিপত্র করে যাবেন বলে কথা দিয়ে ভদ্রলোক উঠলেন।
এর আগে পুন্নির দুটো সম্বন্ধ ভেঙে গিয়েছিল উড়োচিঠির জন্য। কে বা কারা উড়ো চিঠি দিয়েছিল কে জানে।
তবে দিগিনের পরিবারের শত্রু কেউ কেউ থাকাই সম্ভব। পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও কি নেই। মাৎসর্যে আক্রান্ত লোক। এবার নিশ্চিতভাবে পাত্রটিকে কিনে নিলেন দিগিন, উড়োচিঠিতে বোধ হয় আর কাজ হবে না।
ভদ্রলোক চলে যেতে দিগিন নিজের টংগি ঘরখানায় এসে বসেন। মনটা ভাল নেই। উত্তরে মেঘপুঞ্জ জমে উঠেছে। বেলা পড়ে এল। একটু শীত বাতাস বয় আজকাল, দিগিন ইজিচেয়ারে বসে টুলের উপর পা তুলে দেন। পুন্নির বিয়ে হয়ে গেলে তার একটু একা লাগবে। পুন্নিটা খুব সেবা করত।
পুন্নির কথা ভাবতে ভাবতেই পুন্নি উঠে এল নীচে থেকে।
ছোটমামা।
হু।
তুমি কী কাণ্ডটা করলে শুনি।
কী?
অত টাকা খরচ করে বিয়ে দেবে?
না হয় দিলাম।
ছি ছি, লোকে কী বলবে?
কী বলবে?
ভাল বলবে না। আমারও বিশ্রী লাগবে। বড়মামা, মেজোমামা, মেসোমশাই কেউ খুশি হয়নি।
কেন, কেউ কিছু বলেছে নাকি?
বলেছে।
কী?
কী আবার। পাত্র আন্দাজে দেওয়া-থোওয়া বড্ড বেশি হয়ে গেছে।
সে আমি বুঝব। তোর পাকামির দরকার কী? যা চা করে আন।
পুন্নি রাগ করে বলে, আমি এ বিয়ে করব না।
না করিস না করবি। আমি ঠিক দকলীর সঙ্গে সম্বন্ধ করে দেব।
তুমি অত টাকা খরচ করবে কেন? ওতে আমার সম্মান থাকে না।
সে আমি বুঝব। সম্মান নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না।
পুন্নি চা করতে যায়।
বড়বউদি এসে ডাকেন, দিগিন ভাই।
হু।
তাজ্জব। পুন্নির কি টাকার সঙ্গে সম্বন্ধ করলে?
করলাম।
এত কিছুতে রাজি হলে কেন? কী এমন পাত্র?
পাত্র খারাপ না।
তা হলেই বা। নগদ দশ হাজার, স্কুটার, ফ্রিজ, সোনা, তুমি কী ভেবেছ বলো দেখি? ওরা তো অত পাওনার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। তুমি আগ বাড়িয়ে বললে কেন?
মুখ বন্ধ করে দিলাম। আর টু শব্দও করতে পারবে না।
কেন? আরও অনেক কমেই তো হত। দশ হাজার নগদ শুনেই তো কাত হয়ে পড়েছিল।
দিগিন হাসেন। তিনি আসলে একটি সুন্দর বৃদ্ধের আকৃতির গিনিপিগকেই লক্ষ করেছিলেন সারাক্ষণ। যখন বুঝলেন ভদ্রলোকের টাকা-কেন্দ্রিক মন, তখন তিনি তাকে লোভানির পর লোভানিতে উসকে তুলেছিলেন। লোকটার নির্বিকার ব্যক্তিত্ব, ঠান্ডা মেজাজ ঝরে গেল, কর্তৃত্বের ভাবটা পড়ল খসে। মানুষ-গিনিপিগের বেশি কিছু নয়।
বউদির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ঠাকরান, আজ ভাল করে শুটকি মাছ রাঁধো তো।
কেন, কেউ খাবে নাকি?
হু।
কে?
ভটচায, আমার ব্যাঙ্কের এজেন্ট।
মাইফেল বসবে, না?
দিগিন হেসে বলেন, ঠাকরোন, তুমি মাইফেলের মানেই জানো না।
বয়স হল, এখন ও সব ছাড়ো না!
ছেড়ে ধরবটা কী?
সবই তোমার অদ্ভুত। শুধু শুটকি হলেই হবে নাকি?
না। ওই সঙ্গে একটু ফ্রায়েড রাইস মাংস আর মাছও কোরো। চাটের জন্য আলুর বড়া কোরো। মেটে চচ্চড়ি তো আছেই। ভটচায মদ-টদ খায় না, একটু চাখবে মাত্র। তাই খাবারটা দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যাবে।
বউদি চলে যাওয়ার আগে বলেন, টাকাটা কিন্তু একদম ভস্মে ঘি ঢালা হল। পারলে পাটিপত্রের দিন একটু কাটছাট কোরো।
তাই কখনও হয়। কথা হচ্ছে কথা। কিছু কাটছাট হবে না।
তোমার দাদা বলছিলেন এত টাকা বেরিয়ে গেল, শানুটাও লস দিচ্ছে, ব্যাবসাপত্রের না ক্ষতি হয়।
দিগিন একটা হাসি লুকোলেন, বললেন, ক্ষতি হবে তো বটেই। সোপস্টোনটা ডোবাবে, তবে ঠিকেদারি তো আছেই। চিন্তা কী?
বউদি একটু দাঁড়িয়ে থাকেন।
দিগিন বলেন, পুনির বিয়ে দেওয়ার পর আমি গরিব হয়ে যাব না ঠাকরোন, ভয় নেই।
বউদি শ্বাস ফেলে বলেন, তোমরাই বোঝো। আমি মেয়েমানুষ আমার এ সব কথায় থাকার কী?
মেয়েমানুষই তো কথায় থাকে। নইলে সংসারটা বাক্যহারা হয়ে যেত।
বউদি বলেন, তবু তো মেয়েমানুষের পদতল ছাড়া গতি নেই।
বউদি চলে যান। পুন্নি চা নিয়ে আসে। সন্ধে হয়। হিমালয় ঢেকে যায়। তিনধারিয়ার আলোব মালা জেগে ওঠে। ডাউহিলের ডগায় বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে। দার্জিলিঙের রাস্তায় ক্রমান্বয়ে মোড় নিয়ে যে-সব গাড়ি উঠছে বা নামছে তাদের হেডলাইট মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছে।
সন্ধের মুখে দিগিন পোশাক পরে মোটর-সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়িতে বলে যান, ভটচায় এলে যেন বসানো হয়।
এই শরৎকালে শিলিগুড়ির মতো এমন সুন্দর জায়গা আর হয় না। আবহাওয়াটি বড় মনোরম। ঘাসে গাছপালার একটা ভেজা গন্ধ ওঠে। শিশির পড়ে, চারধাবে একটা নিঃশব্দ উৎসব লেগে যায়।
নিউ মার্কেটে আলো ঝলসানো দোকানপাট। হিলকার্ট রোড এখন কলকাতাকে টেক্কা দেয় আলোর বাহারে। চারধার আলোয় আলোময়।
দিগিন বাইকটা আস্তে চালিয়ে সেবক রোডের মোড় পেরিয়ে মহানন্দার পুলের কাছে এসে ট্যাঙ্কে পেট্রল ভরে নেন। পাম্পের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর বর্ধমান রোড ধরেন। ফাকা রাস্তা, ঝড়ের বেগে চলে আসেন ময়নার বাড়ির কাছে।
উঁচু রাস্তা থেকে একটা শুড়িপথ নেমে গেছে। বড় রাস্তায় বাইকটা সঁাড় করিয়ে অন্ধকার রাস্তাটা ধরে নেমে যান। ড্রেনের ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব পাতা, সরপর, ঝুমকোলতার চালচিত্রওলা লোহার গেট। একটু ছোট বাগান। শিউলির গন্ধে ম ম করছে। কাঁচা মাটির গন্ধ পান। সেইসঙ্গে ধূপকাঠির একটা মিষ্টি গন্ধ।
ছোট হলেও বাড়িটা খারাপ না। দু’খানা ঘর, বাগান, কুয়ো, সবই আছে। বাছাই ভাল কাঠের দরজা-জানালা, বারান্দায় গ্রিল। একটা রাগী ভুটিয়া কুকুর আছে পাহারাদার। আর আছে একজন নেপালি ঝি। ময়না কিছু কষ্টে নেই। দিগিন মাঝে-মাঝে রাতে থেকেও যান। প্রায়দিনই দেখা করতে আসেন, যথেষ্ট টাকা-পয়সা দেন। ময়নার খারাপ থাকার কথা নয়। গত বাইশ-তেইশ বছর তো এভাবেই কেটেছে।
ধূপকাঠির গন্ধটা উন্মুখ হয়ে শুকতে শুকতে বারান্দায় উঠে আসতেই একটা অস্ফুট আহ্বাদের আওয়াজ করে কুকুরটা এসে লুটিয়ে পড়ে। বারংবার লাফ দিয়ে গায়ে ওঠে, প্রবল আবেগে পায়ে মুখ ঘষে। দিগিন তার মাথায় চাপড় মেরে আদর করেন। ঘরে টিউবলাইট জ্বলছে, নীল পরদা ফেলা। পুরুষকণ্ঠে ভিতর থেকে প্রশ্ন আসে, কে?
দিগিন উত্তর দেন না। কণ্ঠস্বরটা তিনি চেনেন। কাটিহারের ফকির সাহেব। মাঝেমধ্যে এদিকে আসেন।
বাইরের ঘরে একটা চৌকি আছে, গোটা দুই বেতের চেয়ার। চৌকিতে ফকির সাহেব বসে। লম্বা চুল, পরনে আলখাল্লা, চোখে সুর্মা মুখে পান। দাড়িটা ট্রিম করে কামাননা। চোখের দৃষ্টিতে একটা জ্বলজ্বলে তীব্রতা আছে। লোকে বলে ফকির সাহেবের বয়স একশো। সেটা বোধ হয় বাড়িয়ে বলা। দেখে পঞ্চাশের বেশি মনে হয় না।
দিগিন পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন।
ফকির সাহেব মৃদু হেসে বলেন, আও বেটা।
কখন এসেছেন?
বিকালে। রাতের গাড়িতে ফিরে যাচ্ছি, তো ভাবলাম ময়না বিটির সঙ্গে দেখা করে যাই।
আমাদের ওখানে গেলেন না তো?
যাব। ফি হপ্তা তো আসছিই।
ধূপকাঠির সুন্দর সুবাস আবার বুক ভরে টানেন দিগিন।
ময়নার ঝি উঁকি দিয়ে দেখে যায়। একটু পরেই ময়না আসে।
পরনে একটা চওড়া লালপাড়ের সাদা খোলের শাড়ি। বিয়াল্লিশ বছরের কিছু মেদ ও মেচেতা শরীর আর মুখকে শ্রীহীন করেছে বটে, কিন্তু এখনও দীর্ঘ শরীরে যথেষ্ট যৌবন রয়ে গেছে। মাথায় এলো খোঁপা, কপালে চন্দনের টিপ। নাকটা একটু ছোট হলেও ময়নার চোখ ছোট নয়। বেশ বড় বড় দুটি চোখ। মুখে কিছু ক্লান্তি, কিন্তু গাভীর্য। ময়না আজকাল নেপালি ভাষায় কখনও কথা বলে না। এমনকী সে তার ঝিয়ের সঙ্গে পর্যন্ত বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলে।
দিগিনকে দেখেই মুখটা অন্য ধারে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ফকির সাহেবের জন্য রান্না করছি, তুমিও খেয়ে যেয়ো।
দিগিন মাথা নাড়েন। বলেন, বাসায় আজ এক বন্ধু খাবে।
ও।–ময়না বলে।
দিগিন বেতের চেয়ারে বসেন। একটা চুরুট ধরান। বিশ্বের এমন কোনও মানুষ নেই যার সামনে দিগিন চুরুট না খান।
ফকির সাহেব তার পোঁটলা থেকে একটা কৌটো বের করে পান খেলেন, একগাদা দোক্তা মুখে দিয়ে ঝিম হয়ে বসে রইলেন একটু। পিক-টিক ফেলেন না। বার দুই-তিন হেঁচকি তুলে দোক্তার ধাক্কা সামলে নিয়ে বললেন, কী খবর-টবর?
ভালই।
বন্নোরহো।
আমার হাতটা একটু দেখবেন ফকির সাহেব?
দিনের বেলা।
আগেও তো দেখেছেন।
জরুর।
আমার মরণ কবে?
ফকির সাহেব মজবুত ঈাত দেখিয়ে হাসলেন, বললেন, ওইসব জেনে কী হয় রে বেটা?
ময়না দাঁতে ঠোঁট কামড়ে একটু অসহায়ভাবে চেয়ে থাকে দিগিনের দিকে। কথা বলে না।
দিগিন নীরবে চুরুট খেয়ে গেলেন কিছুক্ষণ। অন্যমনস্ক। একটা শ্বাস ফেলে বললেন, মানুষ জম্মায় কেন ফকির সাহেব?
খোদায় মালুম।
ফকির সাহেব উদাস উত্তর দেন। পানটা মজে এসেছে। নিমীলিত চোখে সেই স্বাদটা উপভোগ করতে করতে আস্তে করে বলেন, কৌন জানে। পয়দা বেফয়দা। তব ভি কুছ হ্যায় জরুর।
দিগিন হাসলেন। ফকির সাহেব তাত্ত্বিক নন, দার্শনিক কথাবার্তা আসে না, এমন অনেক কথা বলে ফেলেন যা ধর্মবিরুদ্ধ।
ষোলো বছরের সেই কিশোরীটি কত বড় হয়ে বুড়ো হতে চলল। কিন্তু কেন? আটান্ন বছর বয়সে এ সব প্রশ্ন নিতান্ত জরুরি বলে মনে হয়।
ফকির সাহেব একটা মস্ত বোতল পোঁটলা থেকে বের করে ময়নার হাতে দিলেন। বললেন, রাখ। এক মাহিনা আওর খেয়ে দেখ।
ওষুধটা বাচ্চা হওয়ার জন্য খায় ময়না। দিগিন জানেন। গত তিন-চার মাস ধরে খাচ্ছে।
ময়না বোতলটা নিয়ে এক বার দিগিনের দিকে তাকায়। চোখে একটা শুন্যভাব। বহু বছর ধরেই কি ময়না তার শূন্য চোখে চেয়ে আছে দিগিনের দিকে? দিগিন ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেন না। একটা বাচ্চা ময়নাকে তিনি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা হয়তো ময়নারই দোষ। কারণ, ময়না তো একা দিগিনের সঙ্গ করেনি। কাজেই দিগিন নিজেকে দায়ি করতে পারেন না। ময়নাও বাচ্চার জন্য তেমন ভিখিরিপনা করেনি কখনও। আজকাল কান্নাকাটি করে। দিগিন বিরক্ত হন? ময়না আজকাল কেবল এক রকম ভাষাহীন চোখে চাইতে শিখেছে। দিগিন সেটা সহ্য করতে পারেন না। ময়নাকে তিনি যত দূর সম্ভব সুখে রেখেছেন, কখনও বিশ্বাসের ভঙ্গ হয়নি। বউয়ের চেয়ে কিছু কম তো নয়ই, বরং বেশি সুখেই আছে ময়না। মর্যাদা হয়তো নেই। কিন্তু মর্যাদা না পেলেই বা ঘুমের তরকারির দোকানের সেই অশিক্ষিত মেয়েটির কী যায় আসে। বরং উলটোদিক থেকে দেখলে ময়নাই দিগিনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি। অবাধে মেলামেশা করেছে ছোকরাদের সঙ্গে। পয়সা রোজগারের জন্য নয়, কিংবা কেবল যৌনকাতরতার জন্যও নয়। সে বোধ হয় দিগিন নামের একটা পাথর ভাঙতে পারেনি বলেই পুরুষের বুক চিরে চিরে একটা নিরন্তর প্রবহমান ফরাকে খুঁজেছে। পায়নি। দিগিনের কাছ থেকে চলে যেতে চেয়েও যেতে পারেনি ময়না। সঁড়ের পোষা ময়না, যেতে পারে না। দিগিন ওর দিকে চেয়ে এক গিনিপিগকেই দেখতে পান। ময়নাকে তেমন শাসন কখনও করেননি দিগিন, কর্তৃত্ব নয়, দাবি-দাওয়াও নয়। হাওয়া-বাতাসের মতো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। কেউ কারও বাঁধা নয়। তবু কেন বাঁধা আছে ময়না তা ভাবেন দিগিন, অনেক চুরুট পুড়ে যায়, তবু সমাধান খুঁজে পাননি পঁচিশ বছর ধরে।
ময়না ভিতরবাড়িতে চোখের ইশারায় ডাকে। দিগিন উঠে যান। ধূপকাঠির গন্ধ ছাপিয়ে উঠেছে মাংস রান্নার গন্ধ। প্রেশার কুকারের তীব্র হুইসল বেজে উঠল।
ভিতরের ঘরে ময়না শোয়। একটা খাট পাতা, একটা ড্রেসিং টেবিল, কাঠের কাচবসানো আলমারি আলনা। দিগিন বিছানায় পা তুলে বসেন, ময়না মোড়া টেনে মুখখামুখি বসে।
ফকির সাহেবের ওষুধের টাকাটা দিয়ে দিতে হবে। ময়না বলে।
কত?
বিয়াল্লিশ টাকা। আমি দিয়ে দিচ্ছি আজ।
আমার কাছে আছে, দিয়ে দেব’খন যাওয়ার সময়।
ময়না চুপ করে থাকে একটুক্ষণ। হঠাৎ মুখ তুলে বলে, মরার কথা জিজ্ঞেস করছিলে কেন?
এমনই।
আমি জিজ্ঞেস করেছি।
কী?
বলেছি, বাঁচতে ইচ্ছে করে না।
ও।
ফকির সাহেব বললেন যে, বাচ্চা হলে বাঁচতে ইচ্ছা করবে।
তাই নাকি।
ময়না দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, একা বেঁচে থাকা কত কষ্টের।
কষ্ট কী? দুনিয়ায় সবাই একা।
ময়না এ সব কথা ভাল বোঝে না। কিন্তু শুনলেই আজকাল ওর চোখ ভরে জল আসে। এখনও এল। চোখ মুছল নীরবে।
ময়না বলল, আমি কোথাও ঠিক চলে যাব।
দিগিন চুপ করে রইলেন।
ময়না বলে, শুনছ?
শুনেছি।
আমি কোথাও চলে যাব।
যেয়ো, আমি তো কখনও বারণ করিনি।
একটু তীব্রস্বরে ময়না বলে, কেন বারণ করোনি?
কেন করব?
ময়না কথা খুঁজে পায় না। আসলে সে বাঙালি মেয়েদের মতো কথার ওস্তাদ নয়। তার ওপর সে নানা রকম পাপ-বোধে ভোগে। সে জানে, দিগিনের প্রতি সে তেমন বিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়নি।
প্রেশার কুকারের আর-একটা হুইসল বেজে ওঠে। শিউলির গন্ধের সঙ্গে মাংসের গন্ধ মিশে যায়। ময়নার ঝি কফি নিয়ে আসে।
দিগিন উঠে বসেন। বাঁ হাতের পাঁচ আঙুলের ওপর কাপসুদ্ধ প্লেটটা ধরে রেখে তিনি নীচে বসে ময়নার দিকে তাকান। দাঁড়ের ময়না। গিনিপিগ। বলেন, আজ সকালে শালুগাড়ার সিদ্ধাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম।
ময়না চেয়ে থাকে।
দিগিন কফিতে চুমুক দিয়ে বলেন, সিদ্ধাই বলল, একজন ফরসা আর লম্বা মেয়েছেলে আমার খুব ক্ষতি করবে।
মেয়েছেলেটা কে?
তা বলেনি।
ফরসা আর লম্বা?
হ্যাঁ।
ময়না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সে কি আমি?
কী করে বলি?
কীরকম ক্ষতি?
তা-ও স্পষ্ট করে বলেনি।
ময়না চেয়ে থাকে। হঠাৎ মাথাটা নোয়ায়।
দিগিন হেসে বলেন, বোগাস। আসলে সবাই তোমাকে চেনে। আমাদের সম্পর্ক জানে, তাই ওসব বলে।
তুমি তো বিশ্বাস করো।
না, করি না।
তবে গিয়েছিলে কেন?
গিনিপিগ দেখতে।
গিনিপিগের ব্যাপারটা ময়না জানে। তাই বুঝল।
আমি তোমার আর কী ক্ষতি করতে পারি? যদি ক্ষতি করি তো আমার ভাত-কাপড় জুটবে কী করে?
সেই জন্যই তো বলছি সব বোগাস।
ময়না হঠাৎ মুখখানা তুলে বলল, ক’দিন আগে একদিন সকালে শানু এসেছিল।
শানু? চমকে ওঠেন দিগিন, কেন?
তেমন কোনও কারণ তো বলেনি। একটা স্কুটার হাঁকিয়ে এল।
কী বলল?
বলল, কাকিমা কিছু টাকা দাও, খুব লস যাচ্ছে।
দিগিন অবাক হন। বলেন, কাকিমা বলে ডাকল?
ময়নার চোখে আবার জল। কথা ফুটল না, মাথা নাড়ল কেবল।
টাকা দিলে?
দিইনি। বললাম দেব।
কত?
খুব বেশি নয়। দু’হাজার। তোমাকে বলতে বারণ করেছিল।
কেন?
ও একটা হিসেব মেলাতে পারছে না। তোমাকে ভয় পাচ্ছে। বলল, কাকাকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। টাকাটা ক্যাশে দেখাতে হবে।
দিগিন আগুন-গরম কফি শেষ করেন। চুরুট ধরিয়ে নেন। ছড়ানো ঠ্যাং দুটো নাড়তে নাড়তে বলেন, ডোবাবে।
কী?
ওই ছেলেটাই ডোবাবে। বংশের কুড়াল।
এমন সুন্দর করে ডাকল। তোমাদের বাড়ির কেউ তো আমাকে ও রকম করে ডাকেনি কখনও। আমার কথা মুখেই আনে না কেউ। কখনও আনতে হলে নাম ধরে ময়না বলে। ছোট-বড় সবাই।
দিগিন উঠতে উঠতে বলেন, টাকাটা ওকে দিয়ো না। কথা দিলাম যে!
দিগিন নিশ্বাস ফেলে বলেন, তাতে ওর ক্ষতি হবে। যত দূর জানি ও জুয়া-টুয়া খেলছে, ফাটকায় টাকা ঢালছে। রাতারাতি বড়লোক হতে চায়।
চাক। ছেলেমানুষ।
দিগিন অবাক হয়ে ময়নার দিকে চেয়ে থাকেন একটু। মা হতে না-পারা ময়না ভিখারিনির মতো চেয়ে আছে। দিগিন শ্বাস ফেলে বলেন, ইচ্ছে হলে দিয়ো। কিন্তু ও টাকাটা বাজে ব্যাপারে নষ্ট করছে। তা ছাড়া তোমার কাছে টাকা চাইবে কেন? ওর লজ্জা থাকা উচিত।
ময়না তার বড় দু’খানা চোখ পরিপূর্ণ মেলে দেয় দিগিনের মুখের ওপর। বলে, আপন মনে করে চেয়েছে। ওকে বোকো না। আমার ছেলে থাকলে সে যদি টাকা নষ্ট করত তা হলে কী করতে?
শাসন করতাম।
বেশি জোর করলে শাসন করা যায়। ও তো মোটে একবার চেয়েছে। টাকাটা কিন্তু আমি দেব। তুমি কিছু বোললা না।
দিগিন অন্যমনস্কভাবে বলেন, সোপস্টোনের পিছনে বহু টাকা নষ্ট করেছে। কিছু বলিনি। কিন্তু এ সবের একটা শেষ থাকা উচিত।
তুমিও তো টাকা কম নষ্ট করো না।
সে করি রোজগার করে। ওর তো এ সব রোজগারের টাকা নয়। ব্যাবসাতে আমি ওকে নিয়েছি বিশ্বাস করে, বিশ্বাস রাখতে না পারলে ছাড়িয়ে দেব।
সবাইকে তো ছাড়িয়ে দিয়েছ, কাকে নিয়ে থাকবে?
আমার কাউকে দরকার হয় না।
ময়না সে সত্যটা জানে! তাই চুপ করে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে হঠাৎ বলে, শানু বিয়ে করবে।
দিগিন চমকে ওঠেন, কী বললে?
শানু বিয়ে করবে।
কাকে?
পছন্দ করা মেয়েকে।
তোমাকে কে বলল?
শানু নিজেই বলে গেছে। কালিম্পঙের মেয়ে। বিয়ে করে আমার কাছে এনে তুলবে বলেছে।
দিগিন চেয়ে থাকেন। ঠিক বুঝতে পারেন না।
ময়না নিজেই বলে, মেয়েটা বিধবা, তোমরা নাকি ঘরে নেবে না, তাই আমার কাছে রাখবে।
দিগিন একটা হাই চাপলেন। বললেন, ও।
আমি কী করব?
শানুকে বলে দিয়ে যে এ বাড়িটাও আমার, আর যে ঠিকাদারি ব্যাবসার জোরে বাজারে ও নিজে চালু আছে সেটাও আমার। কাজেই ইচ্ছে করলেই ও যা খুশি করতে পারবে না।
ময়না হঠাৎ আস্তে করে বলে, আমি কি তোমার বউ?
দিগিন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলেন, এ সব কথা তো অনেক হয়েছে, আবার কেন?
ধরো যদি শানুও তোমার মতোই কাজ করে তবে দোষের কী। আমার মতো কাউকে বউ করে। এনে যদি বাঁধা মেয়েমানুষের মতো রেখে দেয় তো তুমি কি তাকে শাসন করতে পারো?
পারি।–দিগিন শান্ত গলায় বলেন।
কেন পারো?
কারণ আমি টাকা রোজগার করে নিজের পয়সায় সব করেছি। ওর মাজায় সে জোর নেই। ওর আছে বারফাট্টাই। ফকির সাহেব একা বসে আছেন, তুমি তার কাছে যাও। শানুর চিন্তা আমি করব।
ময়না শ্বাস ফেলে উঠে যায়। এ পাথর সে ভাঙতে পারবে না।
.