সপ্তম অধ্যায়। পুত্রেষ্টি
পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করত সেকালে। আমরাই বা কি কম করি? ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো আজকাল যজ্ঞের মতন! উপযুক্ত পুত্র কিন্তু ফললাভ হয় কীদৃশ?
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রা। এবং সেই যাওয়া হয় অগস্ত্যযাত্রা। মা-বাপকে ছেড়ে তারা দূরে চলে যায়। নিজেদের প্রবল কর্মযজ্ঞে এমনই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, সেই উচ্চাশায় জলস্তম্ভে মা-বাপ মাতৃভূমি সব ঘুচে মুছে যায়।
এত কষ্ট করে লেখাপড়া শেখানো, মা-বাপের কোনো কাজে লাগে না। এ যেন পুত্র বিসর্জন দেবার মন্ত্রপাঠ! শুভ চলে গেছে। আমেরিকায়। শিলাদিত্যও শুনছি দিল্লিতে চলে গেছে। কেন, এখানে লেখাপড়া হয় না? এখন দিল্লি। পরের ধাপ আমেরিকা। আর ফিরবে না। কোনোদিনই না। এদেশটা ওদের ভালোই লাগে না।
পুত্রসন্তান প্রার্থনা কি এইজন্যে? আমেরিকা! আমেরিকা! আমেরিকা! ওদের ধ্যানজ্ঞান আমেরিকা, ধর্মকর্ম আমেরিকা। সেই স্বপ্নরাজ্যেই চলে গেছে আমার ছেলে-বউ! আর কোনোদিনও ফিরবে না ভবানীপুরের এই গলিতে। সুষমা বলে, কেন? বছর বছর তো আসছে? আরে, বেড়াতে আসা, আর দায়িত্ব নিয়ে বসবাস করা কি এক হল? সুষমা বলে, আজকাল দিল্লি-বম্বেতেও যা, বিলেত-আমেরিকাও তাই। হপ্তায় হপ্তায় তো ফোন করছে। কিছু তেমন হলেই ছুটে আসবে।
ছুটে আসবে না হাতি। নিজেদের ছুটি-ছাটা হিসেব করে তবে তো আসবে? মিঞা-বিবির টাইমিং চাই তো? আমি সর্বদা সক্কলকে বলি, খবরদার শুভমদের ইসকুলে ছেলে পড়িও না। পেট থেকে পড়েই প্রেম করতে শিখে যাবে ওখানে। তার পরেই শিখবে আমেরিকা পলায়নের কৌশল। যদি ছেলেকে জন্মের শোধ নির্বাসনে পাঠিয়ে দিতে চাও, তো ওই ইশকুলে দাও। রেজাল্টের লোভ করতে গিয়ে মূলে হা-ভাত হয়ে যাবে!
.
বউটা আবার বাঁজা। আমাদের দিয়ে তো মেয়ে পছন্দ করায়নি, নিজেই নিজের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে সেই হামা টানার সময় থেকেই। তর সইল না, বিয়ে করে ফেললে ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা শেষ হতে না হতে। তখনো রেজাল্ট বেরোয়নি। দুজনেই ফাস্ট ক্লাস। দুজনেই সোনার মেডেল। দুজনেই ফেলোশিপ। দুজনেই ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল। নাগালের বাইরে একবার চলে গেলে কি আর ধরা যায়? এই সুষমাকেই তো দেখলুম।
মেয়ে সবর্ণ বলব না, বামুন বটে, কিন্তু বারেন্দ্র। আমাদের ভট্টচায্যি বাড়ির উপযুক্ত বউ সে নয়। বাঙালবাড়ির মেয়ে। বাবা উদ্বাস্তু। কিন্তু স্পষ্ট দেখেছি মেয়েটার কপালে একটা আঁচিল–কপালে আঁচিল মানেই সে মেয়ে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারিণী হবে। কিন্তু আঁচিলটা ডান কপালে। মুখের ডানদিকে আঁচিল, মেয়েদের পক্ষে সুলক্ষণ নয়। কথাটা বললুম শুভমকে ডেকে। সে ছেলেও তেমনি। সে তো হেসেই উড়িয়ে দিলে। উল্টে আমাকেই বলল, বাবা, সামুদ্রিক জ্যোতিষে পুরুষমানুষের কোনো লক্ষণবিচার নেই? তুমি আমাকে দেখে বলো তো আমার কী কী সুলক্ষণ, কী কী দুর্লক্ষণ আছে? এই যে আমার পড়ে গিয়ে ডান কপালে কাটার দাগ, এই দক্ষিণ ললাটে ক্ষতচিহ্ন মানে কি আমার কপাল ফুটো? আমি কি ভাবতেও পারতাম আমার বাবার সঙ্গে এভাবে ঠাট্টা-ইয়ারকি দিয়ে কথা বলছি? আমার মা কখনো তা অ্যালাউ করতেন? কিন্তু সুষমা কিছু বলে না, হাসে।
আশ্চর্য, বাঁজাবউ বললে, সুষমাই খেপে যায়। বলে, ওরা ইচ্ছে করেই, পরিকল্পনা করেই এখন বাচ্চা চায় না–এখন দুজনেই রিসার্চ করছে, ভীষণ ব্যস্ত থাকে, বাচ্চা হলে তাকে দেখবে কে? আমি যদি জোর করি, বলি, কেন তুমি দেখবে–তখন কথা ঘুরিয়ে বলে, বউ বাঁজা, না ছেলে বাঁজা, তা তুমি পরীক্ষা করিয়েছ? এটা আবার কথা?
আমার যে কোথায় দুঃখু, সুষমা বোঝে না। পরিহাস করে। যত বলি আমার পূর্বপুরুষ জলটুকুও পাবে না সুষমা বলে,
ষাট! কী কথার ছিরি! আমাদের তো শুভ আছে। আমরা জল পাব না কেন? তোমার কি ছেলে হয়নি? তুমি অপুত্রক? তোমার পূর্বপুরুষকে তো শুভই জল দেবে!
আরে, শুভর পরে! শুভর পরে কে দেবে? শুভকেই বা জল দেবে কে?
সুষমা বলে, তোমাকে অত ভাবতে হবে না। যত কুচিন্তা! বলে, আমি বাড়িতে না থাকলে এমনিতেই এক গেলাস জল চাইল বাছু মণির মা রঘু পঞ্চাশবার চেঁচিয়ে তবে তুমি এক গেলাস জল পাও। মরে গেলে কী হবে তাই নিয়ে ভাবো কেন? তাছাড়া শাস্ত্রই যদি মানবে তবে তাতে আছে পুত্রবানদের পুত্র জল দেবে, কিন্তু যাদের কেউ নেই, তাদের তো হিন্দুমতে প্রত্যেকেই জল দেবে। কত জল খাবেন তোমার চোদ্দোপুরুষ?
শুভকে কে জল দেবে? বললেই খেপে উঠে সুষমা উল্টে আমাকে বকে, ছেলে বেঁচে থাকতে তার শ্রাদ্ধের কথা ভাবে, এমন বাবা দেখিনি! অথচ কবছর আগেও সুষমা এভাবে কথা বলত না। ওরা দুবোন ছিল দুরকমের। সুষমা ছিল নীরব, ভীতু, চাপা। সুরমা ছিল স্পষ্টবক্তা। এখন দেখছি সুষমাও তার বোনের মতনই হয়ে যাচ্ছে। আজকাল সুরমার মতনই সুষমাও স্পষ্টকথা বলে। বাইরের পাবলিকের কাছে বক্তৃতা দিতে দিতে ওর সঙ্কোচটুকু কেটে গেছে। আগে কখনও আমার মুখে মুখে কথা বলত না সুষমা।
আমি যে সুষমাকে ছাড়া বাঁচতে পারি না। আমার যে সুষমার বাইরে কোনো জীবন নেই। কোনো পৃথিবী নেই। সেটা সুষমাকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না। যতই চেষ্টা করি না কেন, প্রেমে, অভিমানে, রাগে কিছুতেই ওকে ধরে রাখতে পারি না। অথচ ওকে ঘরে না বাঁধতে পারলে আমার শরীর সারবে না। আমার রোগেও উদ্বিগ্ন হয় না আজকাল। উল্টে কেবলই আমাকে বাড়ি থেকে বের করতে চায়। কেবলই বলে, বাড়ি বসে বসে ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছ, তাই রোগ, আর রাগ, এই দুই বাতিক হচ্ছে, ঠিক তোমার মায়ের মতন।
সুষি কথায় কথায় আমাকে এখন বলে, তোমার মায়ের মতন।–আর ওই কথাটা আমার বিশ্বাস ওকে সুরমাই শিখিয়েছে। ওই রোগ আর রাগ। আমার মনে আছে অনেকদিন আগে সুরমা একবার আমাকে বলেছিল, জামাইবাবু, আপনার মায়ের এই রোগ আর রাগ সামলাতেই সুষিটার জীবন কেটে গেল! সুষি এখন আমাকে ওই কথা বলে। তোমার এই রোগ আর রাগ! আবার বলে, রাগটাও নাকি রোগ। রিটায়ারমেন্টের পর অনেক লোকেরই এরকম ডিপ্রেশন হয়। তাই সুষমার চেষ্টা হয়েছে কেবলই আমাকে ব্যস্ত রাখা। ওর ইচ্ছে আমাকে আবার কাজে ঢোকানো। বাড়িতেই চেম্বার বানিয়ে রেখেছিল, আমি প্র্যাকটিস করব বলে। পাগল? দুবেলা বাড়িভর্তি রুগি আসুক, লাইন দিয়ে থাকুক, আমি ওই করি আরকি! আমার তো বলতে নেই বাপ-ঠাকুর্দার দয়ায় অন্নসংস্থানের ব্যবস্থার অভাব নেই।
সুষমার বা এই বুড়ো বয়সে রাস্তায় বেরিয়ে মিটিঙে মিটিঙে চক্কর মেরে বেড়ানোর কী দরকার ছিল? হিন্দু ধর্মের সেবা তো চুলোয় গেছে। হিন্দু শব্দটা ও রাখেনি কোথাও ওর সংগঠনে। কিসের জন্যে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করলাম, আর কী হয়ে গেল!
মানুষজন, দিনকাল চোখের সামনে সব কেমন আশ্চর্যভাবে পাল্টে যাচ্ছে। অবাক হয়ে দেখি আমার স্ত্রী-পুত্র আমার অসুস্থতাকে মোটে গুরুত্বই দেয় না। অথচ আমার মায়ের অসুস্থতাকে আমরা বাপ-ছেলেতে কতটা গুরুত্ব দিতাম! মায়ের দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা সদাসর্বদা সশঙ্কিত থেকেছি। সুষমাও তা দেখেছে। অথচ আমার বেলায় তার মনোভাব অন্যরকম।
ছেলে তো আরও এককাঠি। শুভ দেশে এলেই কেবল বলবে, বাবা তুমি নিজেকে প্রশ্রয় দিও না, এটা খুব বিপজ্জনক রোগে পরিণত হতে পারে–ট্রাই টু ওভারকাম ইট।
–যেন এখন আমার কোনো বিপজ্জনক রোগ নেই–ঠাকুমার মতন তোমারও কিন্তু হাইপোকনড্রিয়া হচ্ছে, এই থেকে শেষে মেনিক ডিপ্রেসিভ হয়ে যাবার ভয়–আরে ডাক্তার কে? তুই? না আমি? আমার অসুস্থতায় আমার সবচেয়ে আপনজনরাই বিশ্বাস করে না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? হাউ টু কভিন্স দেম? আই হ্যাভ ওনলি আ ফিউ ডেজ টু গো!
সুষমা হরেক রকম করে চেষ্টা করে আমার রোগটাকে উড়িয়ে দেবার। আমার কথাটা শোনো! কিছু হয়নি গো তোমার! তুমি তো সুস্থ সবল পুরুষমানুষ, কেন রুগি সেজে শুয়ে থাকো বলো তো? চলো আমার সঙ্গে দিল্লি বলে টানাটানি করবে। যখন-তখন সেজেগুজে এসে বলবে, কী করছ? চলো, একটু বাজার করে আসি! আরে, আমার কি শরীরে পোষায়? সুষমা বুঝতেই পারে না। ইদানিং এমন হয়েছে যে ওকে চোখের আড়াল করলেই আমার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সুষমা সেটা বুঝেও বুঝতে চায় না। স্বামীসেবা ব্যাপারটাকে মোটে গুরুত্বই দিতে চায় না আজকাল, অথচ শাশুড়ির কী অক্লান্ত সেবা করেছে। নার্স থাকতেও, আয়া থাকতেও, নিজের হাতে পায়খানা পরিষ্কার করেছে মায়ের। সুষমার হাতের সেবাটিই মা চাইতেন, তাতেই তার তৃপ্তি ছিল। তাতে সুষমাও কখনও আপত্তি করেনি।
আর এখন? আমি যদি বলি, সুষি, একটু পাশে এসে বসো, মাথায় একটু হাতটা বুলিয়ে দাও, হাতে কাজকর্ম না থাকলে, আসবে, হাত বুলিয়ে দেবে। কিন্তু যদি মিটিং থাকে? মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মণির মাকে, কি বাচ্চুকে ফিট করে দিয়ে ঠিক বেরিয়ে চলে যাবে। মিটিং ক্যানসেল করে আমার কাছে বসে থাকবার পাত্রী নয় সে। অথচ কত অন্যরকম ছিল আগে!
মুখে প্রকাশ করে না বটে, কিন্তু আমি বেশ টের পাই যে, লোকজন এলে, তার মধ্যে থেকে ওকে ডেকে পাঠালে সুষমা বিরক্ত হয়। হয়তো সুরমা এসেছে, ওরা দু-বোনে গল্প করছে নীচে। তখন আমার মাথাব্যথা করল। আমি ডেকে পাঠালাম, ওপরে এসো, আমার মাথাটা টিপে দিয়ে যাও–কিংবা ওর সংগঠনের কর্মীরা এসেছে কোনো আলোচনা চলছে। তখন আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি খবর পাঠালাম, এসো, আমার প্রেশার চেক করে ওষুধ দিয়ে যাও–এসব সময় ও সর্বদাই চলে আসে, মাথাও টিপে দেয়, প্রেশারও চেক করে, ওষুধও দেয়, যা বলেছি সবই করে, মুখে কিছু বলেও না–কিন্তু হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয় যে এটা ও খুশি হয়ে করছে না। ওর যে নিজের কাজে বিঘ্ন ঘটছে, সে-ভাবটা একটুও গোপন করে না। আমার মা-বাবা এই সুষমাকে দেখে যাননি। তারা পুণ্যবান মানুষ ছিলেন!
.
অষ্টম অধ্যায়। ক্যালি ফস্
সুষমার আসার কথা না আজকে? রান্নাঘরে চলে এসেছেন আদিত্য। সুরমা চপ গড়ছেন দাঁড়িয়ে। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ছে সুরমার মনোযোগী মুখের ওপরে। আদিত্য দেখেন, কোমরে আঁচল গোঁজা। সুরমা, সুষমা দুই বোনেরই গড়ন খুব সুন্দর। মেদহীন, দীর্ঘাঙ্গী, একমাথা চুল, লাবণ্যে উদ্ভাসিত মুখ বুদ্ধিতে উজ্জ্বল। অবসর নেবার পরে আদিত্য নতুন করে সুরমাকে দেখতে সময় পেয়েছেন। সুরমা আপনমনে গুণগুণ করে গান করছেন। যদি হয় জীবনপূরণ নাই হল মম-রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুরমার শিক্ষয়িত্রী হিসেবে প্রচুর সুনাম। সুরমার গলাটাই পেয়েছে শিলু!
হ্যাঁ, সুষির জন্যই তো মাংসের চপটা বানাচ্ছি। এই এল বলে। তোমার কচুপাতা রেডি তো? সুরমা হেসে স্বামীর দিকে তাকান।
সত্যি, কী একটা বাড়ি! মাংস ঢুকবে না, পেঁয়াজ রসুন ঢুকবে না–সারাটা জীবন সুষিটা কষ্ট করে গেল।
আর ডাক্তার প্রসেনজিৎ ভট্টাচার্য সারাদিন ধুতি পরে খালিগায়ে বসে বসে ভাগবত আর গীতা পড়ছেন, দশবার হাত ধুচ্ছেন, আহ্নিক করছেন–আমি বাবা শুভমকে দোষ দিই না, ছেলেটা পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে। ওকে ধুতি পরানোর জন্য কম চাপ দিচ্ছিল প্রসেনজিৎ? গায়ত্রী না জপ করলে বেড-টি পাবে না! অ্যাবসার্ড!
আদিত্য চামচ করে একটু মাংসের পুর তুলে মুখে পুরলেন।
আরে? ও কি ছোঁক ছোঁক? এক্ষুনি তো চপ তৈরি হয়ে যাবে। ছদ্ম বকুনির সঙ্গে সুরমা প্লেটে করে আরেকটু পুর তুলে দিতে দিতে বলেন,
সত্যি, কী করে পারল যে সুষিটা এতদিন পাগল না হয়ে থাকতে? আমি হলে তো কবেই পালিয়ে যেতাম। ওই শাশুড়ি! ওই শ্বশুর! ওই স্বামী! প্রত্যেকেই এক একজন মহাপুরুষ!
পুরটা সত্যি দারুণ হয়েছে–থ্যাংকিউ। কিন্তু অত নিন্দা কোরো না, নিজে কিনা। দেবতার মতন বর পেয়েছ, তার ওপরে নো শ্বশুর, নো শাশুড়ি, তাই অন্যের বেলায় অত কঠোর কথা–
আহাহা! সাধে কি দেবতার মতন বর? দেবীর মতন বউয়ের জন্যে তো দেবতা হতেই হবে। বুঝলেন রায়মশাই?
অথবা অসুরও তো হতে পারে?
বলতে বলতে ডোরবেল বাজে।
আমি দেখছি–সুরমার আগেই আদিত্য ছুটলেন দরজায়। হইহই করে সুষমা ঢুকলেন।
কই? কচুপাতা কই? হবে না! হবে না। তারপরেই–আরে, কী তৈরি করছিস রে সুরো? এত সুগন্ধ বেরুচ্ছে? ঢুকেই খিদে পেয়ে গেল? কী রাঁধছিস আজ আমার জন্যে? গন্ধে ভুরভুর করছে বাড়িঘর?
তোমার তো বাছা পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ শুঁকলেই খিদে পাবে। যেমন নিরামিষ্যি বাড়িতে রাঁধাবাড়া তোমার!
সত্যি বাবা যে কী দেখে আমার বিয়েটা দিয়েছিলেন?
কেন? দেখতে তো সবই ভালো। জামাইবাবুর মতো সুপুরুষ তুই আর দেখেছিস? আমি দেখিনি। এই সেদিনই তোর জামাইবাবুকে বলছিলুম সেই কথা–পাত্র তো আইডিয়াল! রূপ, বংশ, ধনরত্ন, শিক্ষা, চাকরি, জাতকুল, মায় কোষ্ঠী পর্যন্ত সবই তো মিলেছিল। খুচরো পাগলামির খবরটা তো কেউ সংসার না করলে বুঝবে না। ওটা কোষ্ঠীতে লেখা ছিল না!
সত্যি! এতগুলো বছর কেটে গেল, সেই সতেরো থেকে রওনা হয়ে এই ছাপান্নোয় এসে পৌঁছেছি। তবু মনে আরাম পেলান না। সদাসর্বদা মনটা যেন কান খাড়া করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে! কী হয়-কী হয়! ভয়ে টানটান হয়ে থাকা!
তোমার বোন বলছিল, সে হলে কবেই পালাত! তুমি মহীয়সী, গরীয়সী, পটিয়সী পূর্ণশশী, তাই এখনও প্রসেনজিতের ঘর করছ!
না-না, উনি মানুষটা তো মন্দ নন? আমাকে সত্যি সত্যি প্রাণের সমান ভালোবাসেন। সেটা কিন্তু ভুল নয়।
কেবল নিজের মাকে প্রাণের চাইতেও অনেক বেশি ভালোবাসেন। তাই তো?
সেটা আর কী করা! লীলাবতী-ফিক্সেশনটা ওঁদের বংশগত রোগ, জামাইবাবু! ইটস্ আ ডিজিজ।
ওই যে গেল গেল ভাব, সর্বক্ষণই এই বুঝি-মা-মরে গেল, এই মিথ তোর শাশুড়ি নিজে নিজেই বানিয়েছিল, সুষি।
মহিলা নিজের দিকে অ্যাটেনশন কী করে ড্র করতে হয়, খুব ভালোরকম জানতেন। খুব এফেটিভ হত ওঁর তুকতাক–আদিত্য সোফায় বসতে বসতে বলেন, হায়রে, আমরা যদি তার এককণাও জানতাম! মনে আছে, শুভর বিয়ের দিনে কী কান্ড করলেন?
মনে নেই আবার? সুরমা রান্নাঘর থেকেই যোগ দেন, হঠাৎ তোর শাশুড়ির এমনই শরীর খারাপ করতে লাগল, যে বাড়িসুদ্ধ তারই সেবাশুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, বর বেরুতে একটু দেরি হয়ে গেল!–ব্যস্! জামাইবাবু বললেন, যাত্রার লগ্ন ওভার! যাত্রা নাকচ। এখন লগ্ন নেই। মাথায় বাজ পড়ল সবার!
ওই তো সাড়ে পাঁচটার সময় বর নিয়ে বেরুবার কথা, আমরা বর বরণ শুরু করতে করতেই সাড়ে পাঁচটা বাজিয়ে ফেললুম–উনি হিসেব কষলেন বেরুতে বেরুতে পৌনে ছটা হয়ে যাবে, ব্যস্ উনি বেঁকে বসলেন Its too late for today বলে। ভাগ্যিস তোরা ছিলি! জামাইবাবু, আপনি জবরদস্তি না করলে সেদিন সত্যি আমার ছেলের বিয়েই ভেস্তে যেত! কী যে পাগলামি আছে ওঁর!
হ্যাঁ, সত্যি, সেদিন ও যদি ঠেলেঠুলে বরযাত্রীদের গাড়িতে না তুলে দিত, চেঁচামেচি না জুড়ে দিত, কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। অথচ বিয়ের লগ্ন ঢের দেরি ছিল, রাত দশটার পরে টাইম।
উঃ! শুধু শুধু কী হট্টগোলটাই বাধালেন! আর সেই গোলমালে আমি কী করলাম? মনে আছে তোর সুরো? সেই যে বরকে বরণ করতে গিয়ে? হঠাৎই-সুষমা সুরমা আদিত্য তিনজনের অট্টহাসিতে ঘরের দেয়াল চমকে ওঠে।
মনে আবার নেই? ঘাবড়ে, নার্ভাস হয়ে, ভীতু ভীতু মুখে, ঘোমটা টেনে বরণ-ডালাটি হাতে নিয়ে তুই টুক্ করে পিঁড়ির ওপরে উঠে দাঁড়ালি, আর শুভ রইল মাটিতে। দিব্যি মন দিয়ে বরণ করতে শুরুও করেছিলি, হঠাৎ কে যেন বলল, আরে আরে? ও কী হচ্ছে? বরের মা কেন পিঁড়িতে? বর যে মাটিতেই দাঁড়িয়ে রইল? তারপরে আর তুই বরণ করবি কি, নিজেই হেসে কুটিপাটি!
তুই আমাকে কীরকম ধমক লাগালি? সুষি, না শিগগির পিঁড়ি থেকে–আর অত হাসতে হবে না
আর শুভও কেমন বকুনি দিল তোকে? যেটা জানো না সেই সব যে কেন করতে যাওয়া? ঠাম্মাকেই বললে পারতে, এসব ঠাম্মার লাইনের ব্যাপার। এদিকে বিধবা বলে যে ঠাম্মা স্ত্রী-আচার কিছুই করতে পারছেন না,
অতএব তড়িঘড়ি শয্যা নিয়ে নিলেন–সেও স্ত্রী-আচারই বটে!
নাগো, শুধু ওইটেই বোলো না, সুরমা স্বামীকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন, সেদিন উনি নিজে যদি ছেলেকে ডেকে না বলতেন, যাও বাছা জিতু, ছেলেকে নিয়ে বিয়ে দিতে যাও, আমি ঠিক থাকব, বউমা তো কাছে রইল–তাহলে তুমি যতই লাফাও না কেন, উনি যেতেন না, মাকে নিয়ে মায়ের পাশে বসে থাকতেন, আর বলতেন, আদিত্য বরং বরকর্তা হয়ে যাক! মা নিজে অনুমতি দিলেন বলেই জামাইবাবু সেদিন বর নিয়ে গেলেন।
ওটাই তো খেলা। ইঁদুর-বেড়াল খেলা। পাওয়ার গেম। এই সুতো টানছি, এই সুতো ছাড়ছি–
যাকগে এখন তো নেই। ওসব কথা থাক না—
নেই, কিন্তু ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে গেছেন।
সত্যিই ছেলের মধ্যে দিয়েই লীলাবতী বেঁচে আছেন। বিবাহে অনুমতি দিলেও ওঁর প্রকৃতপক্ষে পছন্দ ছিল না লোপাকে। তার মতন ক্যাটকেটে ফর্সা রং নয়, অতএব সে রূপসীও নয়। এখন তো তার ছেলেই অবিকল মায়ের মনের-প্রাণের কথাগুলো বলেন। প্রসেনজিৎ যেন তার বাবা এবং মায়ের যুগ্ম প্রতিধ্বনি।
শুভম জানত তার গোঁড়া জাত-পাত ঠিকুজি-কুলুজি-গোত্র-কোষ্ঠি-মানা উগ্র হিন্দুত্ববাদী পরিবারে এ বিয়েতে অনুমতি মিলবে না। বাবা লোপামুদ্রাকে গ্রহণ করবেন না। মনে মনে দশ বছর ধরেই সে প্রস্তুত হচ্ছিল, বাবা আপত্তি করলে, তার পরবর্তী ধাপগুলি কী কী হবে, সবই হিসেব কষা ছিল তাদের। যথারীতি বাবা আপত্তি করলেন। কিন্তু চমক বাকি ছিল লীলাবতীর জপের থলিতে। নাতির বেলায় লীলাবতীর মনের ভাব বদলে গেল, তিনি লোপামুদ্রাকে গ্রহণ করলেন। আহা, বামুনের মেয়ে তো? স্ত্রীর দুষ্কলাদপি, বারেন্দ্র তো কী হয়েছে–ওদের সঙ্গে বেশি দহরম-মহরম না করলেই হল। মার মত আছে যখন, তখন আর প্রসেনজিৎ অমত করেন কী করে? বিয়ে ভালোভাবেই হল, ওঁদের একমাত্র সন্তানের বিবাহ ঠিক যেমনভাবে হওয়া উচিত। না, এককড়ি পণও নেননি অহংকারী প্রসেনজিৎ।
.
কিন্তু বিয়ের মাস দুয়েকের মধ্যে শুভম বউকে নিয়ে সাতসমুদ্র পেরিয়ে উড়ে পালাল। গায়ত্রী মন্ত্র জপ না করে জলস্পর্শ না করা, বাড়িতে থাকলে ধুতি পরা, নিয়মিত পৈতে মাজা, বাড়িতে মাংস-রসুন-পেঁয়াজ-বিড়ি-সিগারেট না খাওয়া, এইসব বিচিত্র নিয়মকানুন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল শুভম্ লোপামুদ্রাকেও। ভালো ছাত্র হলেও সে চিরদিনই খেলাধুলো, হাসিঠাট্টা ভালোবাসে, দায়ে পড়ে ঠাকুরঘরে পা দেয় একমাত্র পরীক্ষার দিন সকালে।
আমেরিকাতে গিয়ে দুজনে মন দিয়ে পড়াশুনো শুরু করে দিল। কিন্তু প্রতিবছরই একবার নিজে আসে, আর একবার বউকে পাঠায়। ছমাস অন্তরই তাই একজনের সঙ্গে দেখা হয়। আর উপহারের তো অন্ত নেই। বাড়ি ভরে গেছে ওদের আনা গ্যাজেটে। সুষমার অবশ্য সেসব ব্যবহার করবার মতো সময় নেই। তিনি বাইরের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু ছেলে বউয়ের ভালবাসা সুষমা ছুঁতে পারেন। ওদের দূরে থাকাটা যে ভালবাসার অভাবে নয়, সেটাও বোঝেন। যে-সময়ে ওরা পৃথিবীতে এসেছে, সেই সময়টা বড় নির্মম। বাড়ি থেকে বের হয়ে, সুষমা এই দশ বছরের নতুন দৃষ্টি পেয়েছেন, অনেক কিছু শিখেছেন। ঘরে বন্দি হয়ে থেকে প্রসেনজিৎ যা শিখতে রাজি নন।
এখন ওদের রোজগার ভালো। দুজনেরই গবেষণা এখন যে পর্যায়ে, তাতে খানিকটা হাঁপ ছাড়ার ফুরসৎ আছে। বারবার টিকিট পাঠাতে চাইছে শুভ, বাবা-মাকে কাছে নিয়ে যেতে চায়। বস্টনের প্রত্যন্তের এক গ্রামে, সুন্দর বাগানঘেরা বাড়িতে আছে ওরা, অনেক পাখি আসে সেই বাগানের বড় বড় গাছে, আর প্রচুর ফুল ফোটে, সুবাস ভেসে থাকে বাতাসে। নানাভাবে লোভ দেখায় শুভ। লোপা খুব চমৎকার রান্না করতে শিখেছে। লোপা অপূর্ব গাড়ি চালাচ্ছে। তোমরা এলে নায়াগ্রা ফলস্ দেখাতে নিয়ে যাব। তোমরা এলে ক্রস কান্ট্রি ট্রিপে বেরুতে পারি, বস্টন টু একেবারে সানফ্রানসিকো। সুষমার খুব ইচ্ছা করে। লোপামুদ্রার বাবা-মা গত বছর ঘুরে এলেন। ওঁরা তো উচ্ছ্বসিত।
কিন্তু, না। প্রসেনজিৎ যাবেন না। এ বয়সে ম্লেচ্ছ দেশে যাবার প্রশ্ন নেই। অল্পবয়েসেই যখন গেলেন না! ছেলে তবু বলেই যায়–আরে এসো তো একবার? দেখে তো যাও আমরা কোথায় থাকি, কেমন বাড়িতে থাকি, কী খাই, কোথায় কাজ করি, কারা আমাদের বন্ধু, অবসরে কী করি? তোমাদের জানতে ইচ্ছে করে না?
নো থ্যাংক ইউ। প্রসেনজিতের এক কথা। তোমরাই এসো। দেশে ফিরে এসো। এইখানেই তোমাদের থাকার কথা। এটাই সত্য। এটাই বাস্তব। ওটা স্বপ্ন। স্বপ্নের বাড়িঘর দেখে আমি কী করব?
প্রসেনজিতের নিষেধ মেনে তার ছেলে (বউও। সুষমা তো দেখছেন, এখন এ ব্যাপারে মেয়ে-ছেলেতে আর ফারাক নেই) মদ-সিগারেট খায় না। আমেরিকাতে সকলেই, কি পুরুষ, কি মেয়ে, নির্বিচারে মদ-সিগারেট খায় বলে প্রসেনজিৎ বিশ্বাস করেন। কিন্তু শুভ বলেছে, অনেকেই আছেন যাঁরা মদ ছোঁন না। প্রচুর সংখ্যক অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে ওখানে নিরামিষ খাওয়া শুরু করেছে। এবং শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা ধূমপান করাকে অমার্জিত সমাজবিরোধী আচরণ বলে মনে করেন। শিক্ষিত সমাজে ধূমপান এখন খুবই কমে গেছে। কাজেই শুভরা মদ-সিগারেট খাচ্ছে-কি-খাচ্ছে-না, এটা ওদের কাছে কোনো বড় কথাই নয়। বিশ্বভুবনের এই মরণোন্মুখ হাওয়া-বাতাসটুকুকে যতটুকু বিষমুক্ত রাখা যায়। গাড়ি তো চালাতেই হচ্ছে। যদিও ওদেশে এখন নানারকমের পলিউশান কন্ট্রোলের কায়দা তৈরি হয়েছে।
সুষমার এসব ব্যাপারে উৎসাহ আছে। দুঃখী মেয়েদের কাজে নেমে দেখেছেন সারা পৃথিবীই এখন ওঁর অনেক কাছাকাছি। প্রসেনজিৎ এই জগতে পৌঁছুতে পারেননি। তাঁর অহংকার অন্যত্র। তার ছেলের কোনো নেশা নেই।
শুভ-লোপামুদ্রার কাছে বেড়াতে যেতে সুষমার খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু প্রসেনজিৎকে ফেলে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। নিয়েও যাবার উপায় নেই।
দীক্ষার পরে কেউ কালাপানি পার হয় না। সোজা জবাব প্রসেনজিতের।
প্রসেনজিতের যখন বয়েস শুভর মতোই, ইংলন্ডে এক প্রসিদ্ধ হাসপাতালে চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। পিতার অনুমতিও মিলেছিল। সুষমার বিয়ের পর তখন সবে বছর খানেক হয়েছে। রাজশেখরবাবুর সে কী আহ্লাদ! তিনি ঠিক করলেন নিজেই খরচ দিয়ে সুষমাকেও সঙ্গে পাঠাবেন, যদি শ্বশুর তার খরচ না দিতে চান।
কিন্তু লীলাবতীর মত ছিল না। মুখে আপত্তি করেননি, উৎসাহও দেননি। মনের অসম্মতি বাইরে টের পেতে অসুবিধে হয়নি কারুরই। অতএব প্রসেনজিৎ নিজেই বিদেশে যেতে রাজি হলেন না। লীলাবতাঁকে ছেড়ে তিনি যাবেন কীভাবে? মায়ের এত অসুখ, হঠাৎ যদি কিছু হয়ে যায়? মাকে ছেড়ে যাননি প্রসেনজিৎ। তাঁর বাবাও জোর করেননি। ছেলের বিলেত-টিলেত না যাওয়াই তো ভালো? নিজেরও তো বয়েস হচ্ছে তার।
জীবনের সেই সুবর্ণ সুযোগ, F.R.C.S পড়বার শখ এবং সুবিধে, কত অনায়াসেই ত্যাগ করেছিলেন মাতৃমুগ্ধ প্রসেনজিৎ। সেজন্য তার মনে কোনো আপসোসও দেখেননি সুষমা। আশ্চর্য ঘরকুনো মানুষটা।
প্রসেনজিতের বাবা তেমন দুঃখিত না হলেও, সুষমার বাবা যারপরনাই আশাহত হয়েছিলেন জামাইয়ের এই সিদ্ধান্তে। মাতৃভক্তি ভালো, কিন্তু এটা কী বস্তু? ওঁর মায়ের রোগটা তো ক্রনিক ডায়াবেটিস। এবং সেটা এমন কিছু বিপজ্জনক সীমাতেও পৌঁছে যায়নি। অকারণে এত ভয় পেলে কী চলে? রাজশেখর বুঝেছিলেন, কথা বলে কোনো ফল হবে না। প্রসেনজিৎ নিজে যা স্থির করেছেন, তাই করবেন। উন্নতি জলাঞ্জলি দেবেন।
মায়ের অসুস্থতার কারণে জামাই যখন বিলেত গেল না পড়াশুনো করতে, তখন সুষমার পিসিমা জিগ্যেস করলেন, সুষির শাশুড়ির কী অসুখ করেছে? যার জন্যে ছেলে বিলেত যেতে পারল না!
সুষমার বাবা গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন–ওঁর মাথায় ডায়াবেটিস হয়েছে।
এই মাথায় ডায়াবেটিস এখন প্রসেনজিতেরও হয়েছে। ওঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে। এই বয়সে ওঁর প্রস্টেটে নির্ঘাত ক্যানসার ছড়াচ্ছে। এখনও তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, নেহাত দুর্ভাগ্যবশত। একেবারে শেষ অবস্থায় বোঝা যাবে। এবং তখন চিকিৎকার সময় থাকবে না। অথচ এখন ধরা কিছুতেই পড়ছে না রোগটা! ফলে চিকিৎসাও হচ্ছে না। কি সুষমা, কি শুভ, এরা কেউ যে অসুখটাতে বিশ্বাস করতে চায় না, সেটা এদেরই হৃদয়হীনতার কারণে। সুরমা এবং আদিত্য এলে অবশ্য প্রসেনজিৎ খুশিই হন, কেননা ওঁরা ওঁর অসুখ নিয়ে পরিহাস করেন না কখনোই বরং মন দিয়ে শোনেন। বেশ সিরিয়াসলি শরীরের খোঁজখবর নেন আদিত্য। পুরুষমানুষ, তারও তো এই প্রবলেমটা হবেই একদিন। আদিত্য সামান্য ছোট প্রসেনজিতের চেয়ে।
.
খেতে বসে সুষমা বললেন,
পরশুদিন ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছি। উনি তো বেজায় গোলমাল শুরু করে দেবেন, ওঁকে এখনও কিছু বলিনি।
সে কি রে? কখন বলবি?
যাবার সময়ে বলে যাব। তোরা একটু যাস। আমি তিনদিন বাদেই ফিরব। যেতে-আসতেই দুটো দিন নষ্ট–মিটিঙে থাকছি তো মিনিমাম সময়।
তোর এইসব ব্যাপারে প্রসেনজিৎকে সঙ্গে নিতে পারিস না, না? কোনো কাজে টাজে?
সঙ্গে এলে তো নেব? এত বড় ডাক্তার, আমাদের সংগঠনে ওঁর কতকিছু করবার আছে–তা উনি শুধু হিন্দুধমের সেবা করবেন। আমি হিন্দুধর্মের সেবা করি না। আমার সংগঠন সব ধর্মের দুঃখী মেয়ের জায়গা আছে, সব ধর্মের কর্মী আছে।
সত্যি ডাক্তার হয়ে উনি যে কী করে এসব মৌলবাদী কথাবার্তা বলেন, আমি বুঝি না।
এই যে তুমি আলাদা একটা কর্মজীবন গড়ে নিয়েছ, তোমার এই কাজের জগতে প্রসেনজিৎকে তুমি মোটে এন্ট্রি দাওনি–ওটা তোমার একার এরিয়া–এইজন্যেই এতটা অস্থির হয় ও। হিন্দু নারী-টারী করলে তার মধ্যে ওঁরও একটা ধর্মীয় রোল থাকত–কিন্তু তোমার হয়ে গেছে পিওর মানবধর্ম, প্রসেনজিতের ধর্মবিশ্বাসের সেখানে জায়গা নেই–এইটেই ওঁকে এতটা ইনসিকিয়োর করে ফেলেছে, যত জেলাস হচ্ছে, তত পজেসিভ হচ্ছে, যত পজেসিভ, তত অ্যাগ্রেসিভ–যাই বলো সুষি, রূপসী বউকে একা ছেড়ে দিতে কার না বুক ধুকপুক করে?
থামুন তো জামাইবাবু? দেখছেন আপনাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেও উনি শরীর খারাপ বলে আসেন না, সল্টলেক নাকি অতিরিক্ত দূরে। তিনি যাবেন আমার সঙ্গে মিটিং অ্যাটেন্ড করতে?
সুরমা দুজনের প্লেটেই টাংরী কাবাব তুলে দিতে দিতে বলেন, সত্যি জানোই তো, উনি চিরকালই আমিটি-আর-তুমিটি। আগে ছিলেন শুধুই মা, এখন হয়েছে শুধুই বউ। বউ যদি অসুখ বলে শুয়ে থাকত। তাহলে উনি নিজে আর শুয়ে পড়তেন না, উঠে পড়ে বউকে তেড়ে যত্ন করতেন।
যা বলেছিস সুরো। উনি অবশ্য কেউ অসুস্থ হলেই সেবা করবেন, তা ভেবো না। দিদি তো অসুস্থতার সঙ্গে মুখ-দেখাদেখি নেই। এমনকী ভাইফেঁটাতেও যান না–বিজয়ায় আমি একাই যাই–যোগাযোগ সবই আমার সঙ্গে–অথচ একমাত্র দিদির ওই তো একটা মাত্র ভাই–
প্রসেনজিতের এটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাকৃত একাকিত্ব। ও যদি স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকতে চায়, তুমি কী করবে?
একা তো থাকতে চান না, নির্বাসনে তো আমাকেও সঙ্গী চান–যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দুজনে–
ডেজার্ট আইল্যান্ডে শুধু প্রসেনজিৎ আর সুষমা। না, ডেজার্ট নয়, ড্রিম আইল্যান্ড ইন আ ল্যান্ড অব মিল্ক অ্যান্ড হানি–এইভাবে ভাবো না?
ইয়ারকি কোরো না তো, সুষমার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারো না? কিন্তু তোরও দোষ আছে সুষি, কোথায় বেরুচ্ছিস, কখন ফিরবি, এ খবরগুলোতো দিয়ে যাবি কে? সেদিন ফোন করেছি, তোকে চাইলাম, জামাইবাবু বললেন বেরিয়েছিস। কোথায়? জানেন না। কখন ফিরবি? তাও জানেন না। বেশ দুঃখী দুঃখী শোনাল। ন্যাচারালি!
সুষমার ভ্রু কুঁচকে গেল।
এটা কবে?
এই তো, রোববার বিকেলে।
এই রোববার? ৪ঠা? খুব ভালোই জানতেন কোথায় বেরিয়েছি। রোটারি সদনে। একটা ইস্টলেশন মিটিং ছিল। ওঁর নেমন্তন্ন ছিল ওখানে ডিনারে। উনি তো গেলেন না, আমিও মিটিং সেরেই দৌড়ে পালিয়ে এলাম ডিনার না খেয়ে। ওঁর ভয়ে।
তবে যে বললেন, জানেন না?
ওটাই তো পাগলামি।
শুভর খবরও বললেন জানেন না।
সেও ওই। গত চারদিন শুভ যতবার ফোন করেছে, উনি ফোন ধরেননি। কথা বলবেন না। অভিমান হয়েছে।
কিসের অভিমান?
সে তুই ওঁকেই জিগ্যেস করিস। মায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে উনি নিজের ডাক্তারী কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে বিলেতে পড়তে না গিয়ে এখানেই রইলেন, মেডিক্যাল কলেজে–আর এতবড় একটা গুরুতর অসুস্থ বাপকে ফেলে, ছেলে কিনা ডলারের লোভে পড়ে রয়েছে আমেরিকায়? কেন, টাকার কি অভাব ছিল ঘরে? না চাকরির? তাই কথা বলবেন না। যেহেতু ছেলে অর্থগৃধু।
কি মুশকিল! ওঁদের সময় আর শুভদের সময় কী এক? আমাদের কত বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল? আর খুকুর বয়েস এখন কত? সে বীরভূমে এস. ডি. ও হয়ে চলে গেল। গৌতমের সঙ্গে বিয়েটা ঝুলেই রয়েছে। হ্যাঁ, বিয়েটা হবে, করছি, করব, এত তাড়া কিসের? এ কি আমরা ভাবতেও পারতুম?
তুই একটু বোঝা না তোর জামাইবাবুকে। শুধু শুভমের ওপরে এত রাগ। সেদিন বলছেন–এমন কুলাঙ্গার ছেলে না জন্মালেই ভালো হত। ষাট ষাট। কি সর্বনেশে কথা? ভাব দিকিনি?
সুষমার অস্থির গলা–এমন ছেলের বাপ না হলেই খুশি হতাম–বলে কেউ? কী করেছে ছেলে? এমন বাপের কাছে কেনই বা ফিরবে বল ছেলে?
তাও তো তোর ছেলে ডিউটি সবই করে। বছরে নিজে একবার আসে, ফিরে গিয়ে বউকে একবার করে পাঠায়, হপ্তায় দুবার তিনবার করে ফোন করে, বউ এসে সংসারে যা। কিছু দরকার সব কিনে দিয়ে যায়–এখানে এক বাড়িতে বাস করেও ছেলে-বউরা এত করে না রে–দেখি তো চাদ্দিকে? শুভমের সত্যি তুলনা হয় না–বউটাও হয়েছে তেমনি চমৎকার।
বাবাকে খুশি করতে মদ-সিগারেট ছোঁয় না। মাংস-টাংসগুলো অবশ্য খেতে ভালোবাসে–সে তো আমিও বাসি–বউটাকে কেন খাবার কষ্ট দেব শুধু শুধু? সেই নিয়ে রাগ। বিদেশে কেন ছেলের বাড়ির হেঁশেলে রসুন-পেঁয়াজ-মাংস ঢুকেছে!
আমার কাছে খান কী করে তাহলে?
তুই তো ভট্টচার্য-বাড়ির বউ নোস। তাছাড়া আজকাল তো খায়ও না বাড়ির বাইরে। দিনকে দিন গোঁড়া হচ্ছে। আমি রেগেমেগে বললুম, এবার থেকে স্বপাক খাও, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি–তা খাবেন না, এদিকে তো রামকুঁড়ে। ঠাকুরের হাতের নিরিমিষ্যি রান্নাটি চাই, মাছ রাঁধতে হবে আমাকে।
এতর মধ্যে তুই রোজ–সত্যি! দেখালি বটে!
আমিই মাছটা রেঁধে ফেলি। কতটুকুই বা সময় লাগে? এই যখন কলকাতার বাইরে যাই তখন মাছ বেঁধে ফ্রিজ করে দিয়ে যাই। date লিখে দিই প্রত্যেক কৌটোর ওপরে। খুলে খুলে গরম করে দেয় ঠাকুর। এই কায়দাটা বউমা শিখিয়ে দিয়ে গেছে।
বউমা যে নতুন চাকরি পেয়ে তোকে কাপড় কিনতে পাঁচশো ডলার পাঠালো, সেটা বলেছিস জামাইবাবুকে?
পাগল? হিংসের চোটে মরেই যাবেন না? তোমাকে কেন দিল? আমাকে কেন দিল না? এদিকে তুমি যে ওকে কষ্ট দেবে, যন্ত্রণা দেবে, ও কেনই বা তোমাকে ভালোবাসার উপহার পাঠাবে? উনি এটা বোঝেন না। সবই ওঁর কাছে ডিউটি। শ্বশুরের প্রণামী কই? শ্বশুর তো শাশুড়িরও দেবতা? আরেক ধাপ ওপরে না?
য্যাঃ, কী যে বলিস!
তুই এসে দেখেই যা না, ঠিক বলছি কিনা? যেতেই তো চাস না ওঁর কাছে।
তোর বাড়িতে গিয়ে কি কারুর স্বস্তি আছে সুষি? গেলেই মনে হয় তোকে মুশকিলে ফেলা হল। দুটো কথা বলবি, আর জামাইবাবু চেঁচাবেন, শুনছ? শুনছ? একটু এদিকে শুনে যাও– তোর দোটানা পড়ে যায়। একবার এদিকে, একবার ওদিকে। তোরই বেশি কষ্ট এতে। তার চেয়ে তুই যখন এখানে আসিস, তবু একটু হাত-পা ছড়িয়ে গল্প করতে পারিস-ওখানে ওটা হয় না।
আমি গেলে কিন্তু প্রসেনজিৎ দিব্যি বসে গল্প-টল্প করে, বেদ-বেদান্ত পুরাণ-টুরাণ নিয়ে কত জ্ঞান বিতরণ করে, তখন তো ওগো শুনছ করে না?
তখন তো উনি নিজে অকুপায়েড থাকেন। আমি গেলে বেশিক্ষণ ওঁর সামনে বসে বসে গল্প করতে পারি না, সুষি যে একদম রিল্যাক্স করে না ওঁর সামনে, সব কথা তো বলা যায় না ওঁর কাছে—
উনি একা থাকতে পারেন না, আবার আমি ছাড়া আর কারুর সঙ্গে মিশতে ও পারেন না। শুধু এই জামাইবাবুই একলা এক্সেপশন! আদিত্য এসেছে শুনে খুশি হন। আর যে-কেউ আসুক, উনি বিরক্ত!
আমি এলেও? নাঃ, আমি এলে বিরক্ত হন না জামাইবাবু। তবে আমিই বোর হয়ে যাই।
ইয়ার্কি-ঠাট্টা না করতে পারে, প্রসেনজিটা বড্ডই সিরিয়াস, কিন্তু শালী এলে বিরক্ত হবে এমন জীব এখনো জন্মায়নি। সুরো, প্রসেনজিৎকে তোমরা এত নিন্দে করো না। হ্যাঁ, যখন ওঁর মা বেঁচে ছিলেন তখন বাড়ির অ্যাটমসফিয়ারটাও বড্ড ক্লোজড, বড্ড সাফোকেটিং লাগত–কিন্তু এখন তো–।
সাফোকেটিং? জামাইবাবু, আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরছেন, আমি আশায় আশায় বসে আছি, উনি এমন একখানা মুখ করে বাড়ি ঢুকলেন, যেন মড়া পুড়িয়ে এলেন। অবিকল শ্মশানঘাট থেকে এলে মুখের যেমন অবস্থা হয়। তেমনি। চুপচাপ এসে, কথা নেই, হাসি নেই, জুতো খুলে, হাত-পা ধুয়ে, অফিসের কাপড় ছেড়ে, সোজা মায়ের ঘরে চলে গেলেন। আমি যেন নেই।
শুভ যখন ছোট, বাবার কাছে ছুটে যেত, তার দিকে নজর দিতেন না, চোখমুখ উদ্বিগ্ন, টেস্, ঘরে মরণাপন্ন রুগি থাকলে যেমন হয়।–কেন? না, মার যদি কিছু হয়ে যায়? মা এদিকে দিব্যি পান চিবিয়ে, টি.ভি. দেখে, চুরি করে মিষ্টি কিনে এনে খেয়ে, চুলটুল বেঁধে, সেজেগুজে শুয়ে পড়েছেন সন্ধেবেলায়, ছেলেকে দেখাবেন বলে। সে এক নাটক বটে। কী দিনই গেছে।
এইজন্যেই তোদের বাড়িতে লোকজন আসত না
তুইই তো বুদ্ধি করে শেখালি। শুভ জন্মানোর পরে। আত্মীয়-স্বজনদের সব ডাক, ছেলেকে দেখতে আসতে বল। সবাই আসুক। তাদের খাইয়ে-দাইয়ে যত্ন কর, ধরে রাখ, বারবার আসতে বল, দেখবি আত্মীয়-স্বজন তার পক্ষে কথা বলবে, বোকা তো কেউ নয়। হলও তাই। এখন বাড়িতে যে আসে, আমার কাছেই আসে। সেটাই তো ওঁর অপছন্দ। বলেন, বাহাদুরি কেনার জন্যে তুমি লোকের যত্ন-আত্তি করো। কী বলব বল? হিংসে নয়?
এখন তো বেরিয়ে পড়েছিস বাইরের পৃথিবীতে, বৃহত্তর জীবনে, মস্ত বড় কমপিটিশন এখানে জামাইবাবুর পক্ষে
এখনও একই কথা বলেন–বাহাদুরি কেনবার জন্যেই তুমি দুঃখী মেয়েদের উপকার করো। এঁকে তুই কী বলবি? এই মানুষের সঙ্গে ঘর করি।
সাইকোপ্যাথ বলব, আবার কী বলব। বউকে এত হিংসে করতে আমি জন্মে দেখিনি।
কেন করবে না? সুরো তুমি ভেবে দ্যাখো, যা যা সুষি আজ হয়েছে, তার কোনোটাই হওয়া কি অসম্ভব ছিল প্রসেনজিতের পক্ষে? বরং আরও বেশি করেই হতে পারত, বেশি শিক্ষিত সে, কিন্তু পারেনি। যে কোনো কারণেই হোক, ওঁর দ্বারা এই পাবলিক সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা সম্ভব হত না কোনোদিনই। চাদ্দিকে বউয়ের এত ভক্ত, এত নামডাক, বউকে সে হিংসে করবে না? কাগজে ছবি, টিভিতে ছবি–
হ্যাঁ, সুষমা ভট্টচার্যকে লোকে রোজ ডাকছে এই স্কুলে প্রাইজ দাও, এই সভায় বক্তৃতা দাও, উত্তম্যান অব দি ইয়ার হয়ে গেল ঝট করে, বালিকা সুরক্ষার অনাথ মেয়েরা প্রাইজ পেয়ে নরোয়ে গেল, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ-কে নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হল– সগর্বে সুরমা আদিত্যর কথার পিঠে আরো আরো কথা যোগ করে দেন।
তুই থাম তো সুরো। বরং আমাকে একটা জরুরি কথা ব–গলায় ব্যথা করলে কী ওষুধ খাই? দুদিন ধরে খুব গলাব্যথা করছে—
সে কিরে? জামাইবাবু ঘরে বসে আছেন আর আমাকে জিগ্যেস করছিস কী ওষুধ খাবি?
সর্বনাশ। ওঁকে বললেই তো হয়ে গেল। ক্যানসার দিয়ে শুরু করবেন। প্রথমেই বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ হয়ে যাবে, যেটুকু নড়াচড়ার স্বাধীনতা অ্যাদ্দিনে পেয়েছি সব যাবে–তারপর পঞ্চাশটা টেস্ট
এ তো আচ্ছা জ্বালা? এই যে তোকে দিনরাত্তির পটের বিবি করে সোনার সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছেন চোখের সামনে, ওঁকে তুই সামান্য গলাব্যথার কথাটুকুও বলতে পারিস না? এটা তো কাজের কথা
কাজের কথা, মনের কথা, কোনটেই বা ওঁর কাছে বলা যায়? পাম্প খারাপ, জল। ওঠেনি, ওঁর জন্যে বাথরুমে ড্রামে জল ভরে রাখা হল, উনি একবার জিগ্যেস করলেন না, হঠাৎ ড্রাম কেন? মন খারাপ তো আরোই বুঝতে পারবেন না।
গাড়ি খারাপ হলেও তো তুইই গাড়ি নিয়ে উড়িয়াপাড়ায় যাস–আগে এসব কে করত?
শ্বশুরমশাই করতেন। গণেশকে দিয়ে। আমিও গণেশকে দিয়ে করাই। উনি কোনো খোঁজ রাখেন না।
বিল-টিল। ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক?
এখন সেও সব আমার ঘাড়ে। ওই গণেশ।
সামনে বসিয়ে রেখে তোর সঙ্গে কী গল্প করেন জামাইবাবু? সবই ধর্ম আলোচনা?
তাই তো। নয় তো ছেলের নিন্দে। দিদির নিন্দে। আমি শুনি। আমার মনের কথা বলব নাকি ওঁর সঙ্গে বসে বসে? দূর!
শরীর খারাপটাও বলবি না? উনি তো ডাক্তার?
হোকগে ডাক্তার। নিজের শরীর নিয়েই উনি ব্যতিব্যস্ত। কিরে? গলাব্যথার কিছু ওষুধপত্তর তুই কি আমায় দিতে পারবি? না পারবি না?
দাঁড়া, বেলেডোনা থার্টি এনে দিচ্ছি আর গার্গেল কর নুন জলে। এও তোকে বলে দিতে হবে? সত্যি!
বেলেডোনা? হঠাৎ হেসে ফেললেন সুষমা। চোখের দৃষ্টিতে অনেক দূরের ছায়া পড়ল–
আচ্ছা সুরো, তোর মনে আছে ফুলশয্যার রাত্তিরে উনি আমাকে যে প্রেমের বাক্যটি বলেছিলেন? তোকে আমি পরের দিন কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বলেছিলাম। সেই যে ক্যালি ফসঃ
বাপরে! সে কি ভোলবার? সেই শুনে তো আমিও ভয়ে কাঁটা। না জানি আমার ফুলশয্যার রাতে আমার বরের মুখে কী না কী শুনব!
দুই বোনের হাসির কলরোলের মধ্যে টেবিলে কফি আর কাবাব, আর গরম গরম মাংসের চপ আর স্যালাড এসে যায়। আদিত্য উঠে দাঁড়ান। চেয়ার ঠেলে।
সুরমা, সুষমা, আই অ্যাম সরি টু রিমাইন্ড য়ু, এই ঘরে আরো একজন আছে। আমাকে একঘরে করে দিয়ে তোমরা সাংকেতিক ভাষাতে আড্ডা মেরে হেসে গড়াচ্ছ, দিস ইজ সিপ্লি নট ডান।
স্যরি স্যরি, জামাইবাবু, আপনাকে কি সুরো বলেনি কথাটা? আমি ভেবেছি–
শোনো, বউকে ফুলশয্যার রাত্তিরে বেচারা প্রসেনজিৎ কী বলেছিল, সেটা অন্য কারুরই জানবার কথা নয়। তবে যদি আমার বেটার হাফ সেটা জেনেই ফেলে থাকেন, তবে ওয়ার্স হাফেরও সেটা জানায় কোনো অপরাধ নেই।
বাবারে বাবা, অত অভিমানে কাজ নেই। বলছি বলছি শুনুন।
ফুলশয্যার রাত্রে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আমার বরমশাই আমাকে গম্ভীর গলায় বললেন, সুষমা শোনো। আমার মায়ের স্বাস্থ্য খুব খারাপ। তার আয়ুষ্কাল স্বল্প। আমি তাই কিছুদিন হল সন্ন্যাস গ্রহণ করব স্থির করেছি। বলতে পারো, তার মধ্যে বিবাহ কী করে হল? মায়েরই শেষ ইচ্ছা রক্ষা করতে এই বিবাহ। আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্কের মধ্যে তুমি কোনো এক্সপেকটেশন রেখো না। মায়ের সেবা করবার জন্যেই আমি তোমাকে বিয়ে করে এনেছি। হিন্দু ধর্মের প্রথা অনুসারে এই পরিবারে জীবন যাপন করি আমরা। তুমি তো বাইরের মানুষ, তাড়াতাড়ি সব শিখে নাও। আমার মা, আমার বাবা, এঁদের আমি দেবতা জ্ঞানে সেবা করি। এবং তুমিও তাই করবে। এটাই এ সংসারে তোমার কর্তব্য। এই বলে পকেট থেকে একটা এতটা বলতেই দুই বোনে চোখাচোখি করে আরেকবার হেসে ফেলেন, কিশোরীকালের হাসির মতো বাঁধনহীন হাসি।
পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বের করে আমাকে তিনটে বড়ি দিলেন, নিজেও তিনটে বড়ি খেলেন–ক্যালি ফস্। খাও, দেহমন শান্ত থাকবে। জামাইবাবু, ফুলশয্যার রাত্রে ক্যালি ফসের মতন প্রচণ্ড পাওয়ারফুল অ্যামব্রোজিয়াক খাবার কথা কি আগে শুনেছেন?
তবে সুখের বিষয়, ক্যালি ফস্ খেয়ে খুব বেশিদিন সন্ন্যাসজীবন যাপন করতে পারেননি তিনি, আমার ভগ্নীর রূপের শিখায় পতঙ্গের মতো–
দূর! কোথায় পতঙ্গ? প্রথম প্রথম বেশ অনেকদিনই ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। আশ্চর্য মানুষ! শাশুড়ি সব কিছু জেনেশুনেও ছেলেকে কিছু বলতেন না। আমি ছিলাম ভোদা, আর সুরোর তখনও বিয়ে হয়নি।
গুডনেস! সুরো! তোমার জামাইবাবুর এরকম সুকীর্তিটা তুমি গোপন রেখেছিলে? প্রসেনজিৎ তো হার্মিট, আরে, ও তো মহর্ষি প্রসেনযোগী! আমি তো ওঁকে সাষ্টাঙ্গে পেন্নাম ঠুকব–সুষির মতন একটা ডাকসাইটে সুন্দরীকে ঘরে বসিয়ে ক্যালি ফস খাইয়ে,
থামুন তো জামাইবাবু
হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে যান আদিত্য।
এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে কুলাঙ্গার তো বলবেই সে। নিজে বাবা-মা-র যেমন সেবা করেছে, ছেলের কাছেও সেটাই তার এক্সপেকটেশন। নিজে বিলেত না গিয়ে মাতৃপুজো করেছে, আর ছেলে কিনা আমেরিকা পালিয়ে গেল? বউ ঘরে থাকলেই তো সেবা সেবা করে শ্বশুর তাকে অতিষ্ঠ করে তুলত। সবাই সুষমা নয়। বিয়ে টিকত না। শুভ পালিয়েছে ঠিক করেছে। মায়ের দূরবস্থার সে সাক্ষী, বউয়েরও অমনি হোক, চায়নি। কিন্তু প্রসেনজিৎ বুঝবে কেন? সে তার আদরের ছেলেটাকে তো কাছে রাখতে চায়।
.
একমুহূর্তের জন্যে ঘরে যেন বাতাস বন্ধ হয়ে গেল।
কেউ কোনো কথা বলছে না।
হঠাৎ পাখার শব্দটা শোনা যেতে লাগল ঘরর…ঘরর…ঘরর..
সুষমা যেন সহজ স্বরেই বলে ওঠেন,–জামাইবাবু শিলুর কোনো খবর পেলেন? অনেকগুলো কাগজে তো বেরিয়ে গেল। এখনও নো রেস্পন্স?
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সুরমা বেরিয়ে যান, সম্ভবত বেলেডোনা নিয়ে আসতে।
এখনও তো তেমন কিছু-মাঝখানেই অসমাপ্ত বাক্যটি হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন আদিত্য। তারপর আবার বলেন–ছমাস হতে চলল ওরা দিল্লিতে নেই। দিল্লি। মুম্বাই। চেন্নাই। হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর। প্রতিটা মেট্রোপলিটন সিটিতেই বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। চোখে কি আর পড়েনি?
একটা ফোন করলে পারত।
যদি ফোন করবার মতো অবস্থায় থাকে।
ষাট ষাট কী যে বলেন! আজকালকার ছেলেছোকরারা কত কারণেই তো উধাও হতে পারে। শিলু তো রোম্যানটিক, তায় আর্টিস্টিক টেম্পারমেন্ট, ঠিক কী জন্যে যে এমন চুপচাপ-কাগজে কতবার–তাও–তো খুকু কী বলছে? খবর নিচ্ছিল তো ভেতর থেকে। কিছু শুনল?
খুকু তো বলছে হয়তো দেশের বাইরে, কাঠমাণ্ডু-টা কোথাও গিয়েছে–খবর এখনো পায়নি–
এখানে বন্ধু-টন্ধুরা কিছু জানে না? শিলুর তো গানের দলটা আছে–ওর সেই দারুচিনি দ্বীপ?
হ্যাঁ, সিনামন আইল্যান্ড–তো? সে দলটল আর নেই। শিলু দিল্লি চলে গেল, অনিন্দ্য মুম্বাই চলে গেল। দলও ভেঙে গেল। তবু খুকু খোঁজ করেছিল। দিল্লিতে ফিরে যাবার পরে শিলু কারুর সঙ্গেই কনট্যাক্ট রাখেনি।
সুরো, সেই অনিন্দ্য ছেলেটার বাড়িতে আমরা একবার?
সে তো দুর্গাপুরের ছেলে
মুম্বাইয়ের ঠিকানা
ছেলেগুলোর কাছে যদি
শুভাকে?
নাঃ, জানে না, শুভা খুব ব্যস্ত–ও তো দুহপ্তার মধ্যে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।
টেলিফোন বেজে উঠল।
হ্যালো, সুরমা? সুষমা আছে ওখানে?
আছে ধরুন। আপনি ভালো তো? সুষি–জামাইবাবুর ফোন!
.
নবম অধ্যায়। রাতপাখির ডাক
শিলাদিত্যের খাতা। শনিবার
একটা যদি স্থির বিন্দু না থাকে মনের মধ্যে, তাহলে সুস্থ মস্তিষ্কে বেঁচে থাকা যায় না। আমারও নিশ্চয় একটা স্থিরবিন্দু রয়েছে কোথাও, একটা অনির্বাণ শিখা, সেটা কখনো স্তিমিত, কখনো উজ্জ্বল, কিন্তু সর্বদাই জ্বলছে। প্রাণের প্রাণ। নিশ্চয়ই আছে, নইলে তো উন্মাদ হয়ে যাবার সুযোগ পেতুম। চারিদিকে যখন অনেক কথার সমুদ্র বয়ে যায়, ঢেউ আছড়ে পড়ে বিতর্কের, আমার বুকের মধ্যেকার সেই নৈঃশব্দ্য আমি তখনও টের পাই। যা আমাকে ধরে রাখে। ভেসে যেতে দেয় না। ডুবে যেতেও দেয় না। ভাসিয়ে রাখে, ফিরিয়ে আনে। খুব ভিতরদিকে, অনেক গভীরে আমার একটা ঠিকানা আছে, সেই ঠিকানাটা আমি কাউকে জাক্ষ্ম নাতে পেরে উঠি না। অথচ সেই ঠিকানাতে না পৌঁছতে পারলে কেউ তো আমাকে খুঁজেই পাবে না। আমার নাগাল পাবে না। আমার সঙ্গী জুটবে কেমন করে? বন্ধু পাব কী করে? যত সঙ্গী, যত বন্ধু, সবাই তো বারবাড়ির দালানে বসে আছে। সংযোগের চেষ্টা তুমি যতই করো না কেন, সেটা তো সম্পূর্ণতা পায় না তোমারই দোষে। তুমি তো সবটা অনাবৃত করতে পারো না।
বাইরের আলো-বাতাসের চাপে যে ভিতরের ঠিকানাটা হারিয়ে যেতে পারে, গুঁড়িয়ে যেতে পারে, সেই উদ্বেগে তুমি ওটাকে পুষে রাখো বুকের মধ্যে গভীর এক যন্ত্রণার ইঁদারা খুঁড়ে, যাতে শুধু রক্ত, শুধু অশ্রু, আর তলহীন কামনা। কামনা সঙ্গের, মিলনের, সংযোগের, ভালোবাসার। বাইরের শিলাদিত্যকে দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে অন্দরের শিলাদিত্য, আর অবাক হয়ে ভাবে, এইটাই আমি? যত হই চই বেড়ে ওঠে, যত আড্ডা, যত ডিস্কো, যত। লেট নাইট, তত ক্ষীণ হয়ে আসে প্রকৃত যোগাযোগ।
রবিবার
আজ শুভোদাদা ফোন করেছিল। বস্টন থেকে। শুভদাদা চিরকাল হই-চই ভালোবাসে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ভালোবাসে। আমার ঠিক উলটো। আমি তো আসলে লাজুক। শুভদাদাকে আমি বোধহয় বুঝতে পারি, ওকে বোঝা খুব কঠিন নয়। মেসোমশাই ওকে যত বন্ধ করতে চেয়েছেন শুভদাদা তত বাইরে ছুটেছে। শুভদাদা আমাকে ঠিক বোঝে না। সবটা বোঝে না। ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সে আমি ওর ছোটভাই বলে। আমি শিলাদিত্য বলে নয়। শুভদাদাকে দোষ দিই না, যে যেমন সে তেমনই। আমি আমার মতন। শুভদাদা শুভদাদার মতন। ওর জীবনটাও তো সোজা সরল নয়। যেরকম ছিলেন ঠাম্মা, সেইরকমই মেসোমশাই। তার মধ্যেই জোর করে শুভদাদা নিজের মতন হয়েছে। মামণি ছাড়া ওকে জোর দেবারও বাড়িতে কেউ ছিল না। মামণিরও নিশ্চয় অনেকটা জোর লেগেছিল।
যে সমাজে শুভদাদা আর আমি, দুটো মানুষই আছি, সেই সমাজ কেবল দাদাকেই চেনে। মেসোমশাই ওরকম অদ্ভুত হওয়া সত্ত্বেও দাদা একদম ঠিক ঠিক মতন বেড়ে উঠেছে। কলকাতায় ইশকুলে পড়েছে, রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছে, পার্কে ফুটবল, শীতকালে গলিতে আলো জ্বেলে ব্যাডমিন্টন, সাইকেল নিয়ে মেয়েদের গানের ইশকুলের সামনে চক্কর মেরেছে। শুভদাদা সবই করেছে। আমি এসব কিছুই পারিনি। আমি যা পেরেছি, তা সমাজের চোখেই পড়েনি, পড়লেও তার মাথামুণ্ডু কেউ বোঝেনি।
আর আমার যে হঠাৎ সবকিছুই কেমন গোলমাল হয়ে গিয়েছিল ছোটবেলায়। সেই জটটা তো খুলতেই পারিনি। আমি লাল কালিতে দাগানো একটা দিনের মতন আলাদা হয়ে গিয়েছি, ভিতরে যত নিঃসঙ্গ হয়েছি, তত ঢুকে পড়েছি নিজের ভিতরে নিজে, ততই হুল্লোড় করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। যতই হুল্লোড় করেছি ততই বিযুক্ত হয়ে পড়েছি চারিপাশ থেকে, যত বিপন্ন বোধ করেছি, বিচ্ছিন্নতা ততই গ্রাস করেছে আমাকে। আঘাত পেলে প্রত্যাঘাতও কেমন করে করতে হয় কেউ শিখিয়ে দেয়নি আমাকে, আমি তাই আঘাত পেয়ে সরে যেতেই শিখেছি। সরতে সরতে সরতে, জীবনের এক কোনায় পৌঁছে গেছি, এখানে শিল্প ছাড়া আমার প্রকৃত সঙ্গী নেই। এখান থেকে আর সরবার মতন ঠাই নেই। তাই কালশিটে পড়ে গেলেও কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়েই থেকেছি। মাটিতে লুটিয়ে পড়িনি। এবারে সরতে হলে তো অনন্তে ঝাঁপ।
কাকে এসব কথা বলব? এতদিন একা শুভাননাই আমার বন্ধু ছিল–শুভাকে সব কিছু বলতে চাই। বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু শুভা শুনতে চায় না। শুভা বুঝতে চায় না। অনিকে বলেছি। এতদিনে।
শুধু অনিকেই বলতে পেরেছি। শুধু অনিকেই বলা যায়, বলা গেছে। অনিন্দ্য শিল্পী। অনি স্থান, কালের সীমায় বন্দী থাকে না। সমাজের খেরোর খাতার হিসেবকেও গ্রাহ্য করে না। ওর আছে ওর নিজের জগৎ, যে জগতের চাবিটা অনি আমাকেও দিয়েছে। পৃথিবী অনেক দেখেছে অনিন্দ্য, অনেক মানুষ দেখেছে। নিজের বাইরে এসে দাঁড়াতে পারে ও। বাইরে থেকে নিজের দিকে তাকাতে পারে। সেইটেই অনি আমাকে শেখাতে চেয়েছে, সেই চোখটাই খুলে দিতে চেয়েছে। যাতে আমিও নিজের বাইরে এসে দাঁড়াতে পারি, বাইরে থেকে নিজের দিকে চাইতে পারি।–তা নইলে তুই শিল্পী কিসের? অভিনয় শিখবি কী করে? অনি বলেছে, নিজের মধ্যে নিজে ঢুকে থাকতে থাকতে একদিন অন্ধ হয়ে যাবি। বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। বাইরের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ–কত কি ঘটে যাচ্ছে! অনিন্দ্য এইজন্যেই এত সুন্দর ডকুমেন্টারি ফিল্ম তোলে–জীবনকে খুব কাছ থেকে দ্যাখে ও।
ওর কলকাতার বাইজিদের ডকুফিল্মটা কান ফেস্টিভালে দেখানো হচ্ছে- অনিন্দ্য মে-মাসে কানে যাচ্ছে।
শিল্পীর স্বভাবেই অনিন্দ্য নিজেকে বাদ দিয়ে আমার কথাটা বুঝতে চেষ্টা করে। শুভা তো কেবলই নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে। বুঝতেই চায় না যে এটা ওর-আমার ব্যাপার নয়। এটা শুধু আমারই, একা আমারই যন্ত্রণা।
বুধবার
আমার গান-বাজনা শুভার পছন্দ নয়, সে চায় আমি সোজাসুজি এম. এ.-তে অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারে ঢুকে পড়ি। অথবা দিদির মতো আই. এ. এস. হই। শুভা ভর্তি হয়েছে এম. বি. এ পড়তে, জোকাতেই পেয়েছে। কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি দিল্লি-এন. এস. ডি. তে চান্স পেয়েছি। আমার স্বপ্ন সফল হচ্ছে–পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুধু একা আমিই স্কলারশিপ পেয়েছি, ইন্টারভিউ ভালো হয়েছিল। নাসিরুদ্দিন ছিলেন। গান বাজনা? হ্যাঁ। এবং থিয়েটারও। মঞ্চ আমার স্বপ্ন। এন. এস. ডি থেকেই চেষ্টা করব যদি টিভিতে কোনো চান্স পাই। শুনেছি ওখান থেকে নানারকম কনট্রাক্টস হয়ে যায়। আজকাল ভি.জে.-র কাজটায় দারুণ গ্ল্যামার। কিন্তু শুভা চায় না আমি ওই ধরনের জীবনে যাই। ওর বিশ্বাস, শো-বিজনেসে আত্মার পরিচর্যা হয় না। আর এম. বি. এ পড়লেই বুঝি হয়? বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেই তো সবচেয়ে বেশি মনুষ্যত্বের অসম্মান ঘটে। এদেশে, বিদেশে, সব দেশেই। শুভা মানতে চায় না। আমার দিল্লিতে যাওয়া নিয়ে শুভার খুব মন খারাপ। শুভা আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু ওর মতন করে ভালোবাসে। আমার মতন করে নয়। শুভা আমাকে চায়। কিন্তু আমার মতন আমাকে নয়, ওর মনের মতন একটা শিলাদিত্যকে ও গড়ে নিতে চায়। আমার এই নিজস্ব প্রকৃত শিলাদিত্যকে ওর সহ্য হবে না, এটা আমি এখনও বুঝতে পারছি কিন্তু শুভা বুঝতে চাইছে না। বাল্যপ্রেম, প্রথম প্রেম, তার প্রবল মোহ তো ছিন্ন করা সহজ নয়। শুভার মতো বাস্তববাদীর পক্ষেও না।
অথচ শুভদাদা আর লোপাদির সম্পর্কটা কি সুন্দর টিকে গেল। ওরা বিয়ে করে ফেলল। ওরাও তো স্কুল-ফ্রেন্ডস ছিল। মেসোমশাইয়ের দিক থেকে এত বাধা-বিপত্তি, এত অশান্তি, ঝড়-ঝাঁপটা সহ্য করেও নোপাদি আর শুভদাদা সুন্দর জীবনযাপন করছে বস্টনে। আর কলকাতায় পালা করে আসা-যাওয়া। মেসোমশাইকে খুশি করা তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরেরও সাধ্যি নয়, কিন্তু বাকি সবাই খুব খুশি।
শুভার সঙ্গে আমার সেরকম সম্পর্কটা হল না। শুভার স্বভাব অতিরিক্ত বাস্তববাদী,
কেরিয়ার ওর কাছে ঈশ্বরের চেয়েও পবিত্র, তার কাছাকাছি আর কিছু নেই।
এই গানবাজনা থিয়েটারটাই যে আমারও ঈশ্বর, সেটা ও মানতে চায় না। বলে, এটা শুধু হবি, এটা কোনো কেরিয়ারই নয়। এটা এক্সট্রাকারিকুলার। এটা অবসর বিনোদন মাত্র। কীভাবে বোঝাব শুভাকে? ও তো আমাকে ছোট্ট থেকেই দেখছে। বাবা-মা যেটা বোঝেন, সেটা শুভা কেন বুঝবে না? আর বাবা-মা যেটা বোঝেন না, সেটাও তো এতদিনে শুভারই বোঝা উচিত ছিল।
বৃহস্পতিবার
অনি বলেছে শুভাকে এবার মুক্তি দিতে। অনি বলছে দিল্লি যাওয়ার পরে শুভাকে জানাতে যে এ সম্পর্ক চলছে না, শুভা নতুন জীবন খুঁজে নিক। এতে আমারও ভালো হবে। আমাদের বন্ধুত্বটা অটুট থাকে যাতে, অনি বলছে সেই চেষ্টাও করা খুব দরকার, বাল্যকালের বন্ধুত্ব জীবনের মহার্ঘ্য সম্পদ। কিন্তু শুভার ওপরই নির্ভর করবে বন্ধুত্ব রাখা-না-রাখা। আমি সব সময়ই শুভার বন্ধু। শুভা ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু কোথায়? গানের দলের সঙ্গীসাথীরা? হই-হুঁল্লোড়ের সঙ্গীসাথী মানেই কি বন্ধু? ভিকি, সোম, বান্টি, বলবীর, কণিষ্ক কেউই সেভাবে আমার বন্ধু নয়। শুধু অনিন্দ্য।
বৃহস্পতিবার
দিদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য! দিদির অনিকে ভালো লাগেনি। দিদির না গৌতমদার?
গৌতমদার মতামতটা দিদিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। ছোটবেলাতে দিদিই ছিল আমার বন্ধু। গৌতমদা ওর জীবনে আসার পরে দিদি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আর শুভা দিদির জায়গায় চলে আসছে।
দিদি আর আমি দুজনেই তো বাইরের স্কুলে পড়েছি, পাহাড়ের হোস্টেলে থেকেছি। ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসেছি মা-বাবার কাছে। আমাদের ভাইবোনের সম্পর্কটাই ছিল হাসিখুশির। ছুটির মেজাজের। যখন স্কুল ফুরোল, আমি কলেজে পড়ছি কলকাতা শহরে, তখন আমাদের নতুন করে চেনা হতে লাগল–সেই সময়েই হঠাৎ গৌতমদা ঢুকে এল দিদির জীবনে। এখনও গৌতমদা।
আমি দিল্লিতে চলে যাচ্ছি শুনে দিদিও খুশি নয়। দিদি আই.এ.এস হয়ে গেছে, কোথায় পোস্টিং হবে জানা নেই। কোনো অজ পাড়াগাঁয়ে সম্ভবত। গৌতমদা সোজা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভে চান্স পায়নি। গৌতমদা অ্যালায়েডে পেয়েছে। বোধহয় রেলওয়েতে যাবে। দুজনে থাকবে দুজায়গায়। জানি না ওদের কীরকম প্ল্যান। শুভার ইচ্ছে আমিও দিদির মতো আই.এ.এস. হই। বি.এ.-তে ফার্স্টক্লাস পাইনি, কিন্তু ফিটি এইট পার্সেন্ট ছিল, তাতেই শুভার ধারণা হয়েছে আমি পারব। দিদিরও দৃঢ় বিশ্বাস আমি পারব। বাবার মাথাতেও ঢুকিয়ে দিয়েছে।
একমাত্র মা দেখছি কোনো বিকল্প মতামত দিচ্ছেন না–নিজে গান করেন বলেই বোধহয় আমার গানবাজনা তার আপত্তি নেই, সহানুভূতি আছে।
মঞ্চে অভিনয়ে শুভার মতোই দিদির এবং বাবারও উদ্বেগ যথেষ্ট। তাদের ভাবনা, শো-বিজনেসে যেমন কোনো সিকিউরিটি নেই, তেমনি ডিগনিটিও নেই। এবং নানারকম ডেনজারও এসে পড়ে। যদি সাসিড করো, গুলশনের মতন মাফিয়া এসে পড়বে। যদি না সাসিড করো, তবে তো এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কপিটিশন এমনই তীব্র। অনি বলছে দিল্লিতে থাকাকালীন N_F T_I-তে খবর নিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং লাইনটাও একটু দেখতে। মডেলিংয়ে অনেক টাকা, গ্ল্যামারও, আমার কাজের সঙ্গেও খাপ খাবে। (চেহারার সঙ্গেও বেখাপ্পা হয়তো হবে না।) আমি ভাবছি বান্টির মাকে বলব। বান্টির মা মুম্বাইতে ফ্যাশন মডেলিংয়ের লাইনে ছিলেন, অনেককে চেনেন। এ বিষয়ে বাবা-মা-দিদি কাউকে কিছুই বলিনি। শুভকে বলতেই তার যা প্রতিক্রিয়া দেখলাম! যেন ফ্যাশনমডেলরা খুনে, কিংবা বেশ্যা। এখনও তো কোনো পদক্ষেপই নিইনি, কেবল পরিকল্পনাটুকু বলতেই, এই! মধ্যবিত্ত মানসিকতা জিনিসটি যে কী, দিনে দিনে টের পাচ্ছি। ঘরে, বাইরে।
শুক্রবার
কত জন্মের পুণ্যফলে অনিন্দ্য এল আমার জীবনে। যে জিনিসটা এতদিন অস্ফুট ছিল, আলো-আঁধারিতে যে-মুখ আমি ঠিক চিনতে পারিনি বলেই আমার এত কষ্ট, আমার নিজস্ব সেই মুখখানি অনির ধরে দেওয়া আয়নায় স্পষ্ট ফুটে উঠল। অনি যদি না আসত আমার জীবনে, জীবন যে কী হতে পারে, আমার তা-ই জানা হত না। এত রং, এত আলো, এত সুর, এতবড় আকাশ, এত বড় পৃথিবী, অনিই তার ঠিকানা জানাল। শিল্পের প্রতি প্রেম যে কী, গানকে ভালোবাসা কী, এতদিন বুঝিনি। আমি শুভকেও ভালোবাসি। কিন্তু অনি, অনি আমার জীবনে একটা ঝড়ের মতো, যে ঝড় শুকনো পাতা সব ঝরিয়ে দেয়। নতুন পাতার আর বর্ষাঋতুর পথ খুলে দেয়। সত্যি আমার নতুন করে জন্ম হয়েছে অনির কল্যাণে।
হ্যাঁ, নতুন জন্মই। শৃঙ্খলমুক্তি। স্ফুরণ। ছেলেবেলার একটা দুর্ঘটনা আমাকে যেভাবে বেঁধে রেখেছিল এতদিন–যন্ত্রণায়, অপমানে, লজ্জায়, অপরাধে, অনি আমাকে তা থেকে মুক্তি দিল। অনি বোঝাল এরকম হয়েই থাকে। এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। সব ছোট ছেলেদের জীবনেই কিছু না কিছু ঘটনা থাকে–হ্যাঁেস্টেলে তো নিত্য-নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা। এ নিয়ে আমার এত উদ্বেগের, এত যন্ত্রণার, এত অপরাধী হয়ে থাকার মতো কোনো কারণই নেই। হ্যাঁ, তখন ভালো লেগেছিল, বেশ তো? সেটাও কোনো অপরাধ নয়। কিছু দোষের নেই তাতে। জীবন অনেক বড়। অনেক। যা হয়েছিল, তা যদি আবারও কখনও ঘটে–ঘটতেই পারে–যদি কখনও ঘটেও যায়, তাতে লজ্জার কিংবা অপরাধের কিছু নেই। ভালোবাসা কখনও অপরাধ হতে পারে?
মানুষের ভালোবাসার নানা রং–
অনি বলেছে, মায়ার বিস্তার অনেকদূর অবধি–সোজাসুজি রেললাইন বেয়ে গড়িয়ে চলে না আমাদের জীবনে–তুই তো শিল্পী, তোর তো জটিল হবেই জীবনের পথ–তাতে লোকসান কিসের?
বাইরে দামোদর নদ তখন অন্ধকার আকাশের সঙ্গে মিশে গিয়েছে–হঠাৎ একটা রাতপাখি উড়ে গেল, টিটি টিট্টি–অনি গেয়ে উঠেছিল গলা ছেড়েঃ
নদী ভরা ঢেউ
জানে না তো কেউ
কেন মিছে তরী তবু বাও বাও রে
(একবার) চুবানি খেয়ে ভারি
(তুমি) বলো–ওহে কাণ্ডারী
আমায় বাঁচাও বাঁচাও রে–
রবিবার
আমার দামোদর স্মৃতিতে বড় মায়া। দুর্গাপুরেই অনিন্দ্য আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিল আমার নিজস্ব প্রকৃতি, আমার আসল মুখচ্ছবি। সেই বিশাল দামোদরের তীরে ছোট্ট বাগান ঘেরা নির্জন বাংলো, গিটার নিয়ে আমরা দুজনে–গিটার, আর বিয়ার, আর গাঁজা, আর গান, গান, গান। সারা রাত। রাত্রি স্থির হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার যেন ঝিকিমিকি ম্লান জ্যোৎস্নায় আরও গাঢ় হয়েছিল এদিকে ওদিকে, জায়গাটা ঠিক দুর্গাপুর ছিল না। একটু বাইরে একটু দূরে একটু জনহীনতায়, যেখানে নিজেকে আবিষ্কার করা তুলনায় সহজ, সেইখানেই অনির কাছে আমায় নবজন্ম হয়েছিল–অথচ কাউকে বলা যায়নি একথা। কাউকে নয়। শুভাকে বলতে গেলাম, ফল হল বিপরীত। দিদিকে বললে কী বুঝত? দিদিকে বলা উচিত ছিল কি?
মঙ্গলবার
বারংবার ভুল করতে করতে একদিন তো মানুষ ঠিক পথটা খুঁজে পায়? বারবারই কি হারিয়ে যাবে বনের মধ্যে পায়ে চলার সেই পথটা, শস্যদানা ছড়িয়ে চিহ্নিত করে রেখে গেলেও ঘরে ফেরার উপায় নেই, পাখিরা এসে খুঁটে খেয়ে নেবে সেই দানাগুলো। পিছন ফিরলে দেখতে পাব সেই পথহীন, আদি অন্তহীন মহারণ্য। সে কি স্মৃতির বন? নাকি বিস্মৃতির? পিছনে তাকিয়ে কি স্বপ্ন দেখা যায়? এমনকী কী দুঃস্বপ্নও? না। তার জন্যে সামনে চলতে হবে। পথ তৈরি করে নিতে হবে। স্বপ্নের রাস্তা। কৈশোরের বকুলগন্ধেরা যে পথ চিনিয়ে দেয়, যৌবনের রক্তাক্ত কাটাবেধা ফনিমনসার ঝোঁপ যে পথ চিনিয়ে দেয়, সে পথে স্বপ্ন নেই। শুধু স্মৃতি। আমার ভুল যেন ফুরোচ্ছে না, আমার সামনে সঠিক পথের চিহ্ন ফুটে উঠছে না কিছুতেই, অথচ দূর থেকে ভেসে আসছে এক অচেনা সুবাস। সে কি পাকা ফলের? সে কি বিষ্টি ভেজা মাঠের? কদম কেশর ঢেকেছে আজ বনতলের ধূলি–শুভার গলায় এই গানটি। মৌমাছিরা কেয়াবনের পথ–আচ্ছা কেয়াফুল কেমন? আমি জীবনে কখনো কেয়াফুল দেখিনি। অথচ মা-র মুখে শুনেছি এই লেকের ধারেই অনেক কেয়াঝোপ ছিল এককালে। গন্ধে ভারী হয়ে থাকত বাতাস। কাছে যেত না কেউ সাপের ভয়ে। ফুল তুলে বিক্রি করত বস্তির দুষ্টু দুরন্ত ছেলেরা। মা-রা কিনতেন, দুআনার একটা ফুল। এখন কি একটা ঝোঁপও বাকি নেই? একেবারে সব মুছে গেছে?
হঠাৎ শুভার সঙ্গে যে কী হয়ে গেল!
শুক্রবার
এক একটা দিন হঠাৎ ঝলসে ওঠে, আর জীবনটাকে উলটেপালটে বদলে দিয়ে যায়। ওলট পালটটা ঘটে যায় সমাজের ভেতরে, বাইরে থেকে দেখে কেউ টের পাবে না। একেই কি বয়স বাড়া বলে? বয়েস তো শুনেছি রোজ ঘুমের মধ্যে টুক টুক করে বাড়ে। আমি তো দেখতে পাচ্ছি মানুষের বয়স রোজ অল্প অল্প করে বাড়ে না। হঠাৎ হঠাৎ একটা ঘা খেয়ে বেড়ে যায়। একটা ঘটনায়। একটা সংবাদে। একটা দৃশ্য দেখে। বয়সে বাড়াটা যে কীরকম, আমি ইদানিং খুব তাড়াতাড়িও দুবার টের পেয়েছি। সেদিন অনিন্দ্যর সঙ্গে দুর্গাপুরে গিয়ে, আর পরশুদিন যখন অনিন্দ্যর সঙ্গে কথাবার্তার কথা, দুর্গাপুরের গল্প সব শুভার কাছে করলাম।
শুভার সেই মুখ, সেই চাবুক-খাওয়া মুখখানা আমার বয়েস দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। কত কম চিনি আমরা পরস্পরকে। কী এমন ছিল আমার কথায়? কী ছিল এত সাংঘাতিক, এত মর্মভেদী? আমি চেয়েছিলাম শুভকে আমার আনন্দ-যন্ত্রণার অংশ দিতে–তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া–সুধা-বিষে না মিশলে কেমন করে হবে। চুম্বন?
আমি ভাবতেই পারিনি শুভা এতে আঘাত পাবে। দৌড়ে পালিয়ে গেল, আমি লোকে কি ভাববে ভেবে পিছু পিছু দৌড়লাম না। কাল ফোন করেছি। মাসিমা বললেন, শুভা শুয়ে আছে, ঘুমোচ্ছে, শরীর ভালো নেই। আজ ফোন করেছি, মাসিমা বললেন, শুভা বাড়ি নেই, বেরিয়েছে। বুঝতে পারছি না শুভা অ্যাভয়েড করবার জন্য মাসিমাকে এইরকম নির্দেশ দিয়ে রেখেছে কিনা। কী হল শুভার? কী ভাবছে ও? শুভার আচরণে আমার নিজেকে গর্হিত অপরাধের আসামী বলে মনে হচ্ছে। অথচ আমার অপরাধটা কী?
কলকাতা
রবিবার
প্রিয় শুভা,
জানি তোর শরীর ভালো নেই। কিন্তু আমাকে তো আজ চলে যেতেই হচ্ছে। যাবার আগে অনেক চেষ্টা করলাম, তোর সঙ্গে দেখা হল না। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা।
তুই বোধহয় অনিন্দ্যর ব্যাপারটা খুবই ভুল বুঝেছিস। আমাকে কি তুই কিছুই চিনিসনি শুভা?
মাথা ঠান্ডা কর। শুধু শুধু কষ্ট পাস না। সত্যিই তোর ভুল হচ্ছে। একদিন ঠিক বুঝতে পারবি। আমি ফিরতে ফিরতে তুই তো জোকা-রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হয়ে যাবি, যা বুঝতে পারছি। Good Luck দিল্লি পৌঁছেই ই-মেল করব। আমার হোস্টেলের ঠিকানা মা-র কাছে আছে। ভালো থাকিস। Lots of Love,
তোর
শিলাদিত্য
.
দশম অধ্যায়। পরোটা আলুচচ্চড়ি
এই নতুন কর্মজীবন, নতুন দায়িত্ব, কোথায় শুরু হবে আনন্দের মধ্যে, তা নয়, চরম উদ্বেগে, চরম সর্বনাশের দুর্ভাবনা নিয়ে শ্রাবস্তীর কর্মজীবনে পদক্ষেপ।
শিলাদিত্য গরমের ছুটিতে এসেছিল। ফিরে গিয়ে বছরটা কমপ্লিট করেছে, কিন্তু, কোর্স কমপ্লিট করেনি। এ বছর জুন মাসে কলকাতায় আসেনি, দিল্লিতেও নেই। অগস্টে আর ফিরে যায়নি ক্লাসে। পুজো হয়ে গেছে, দেওয়ালি হয়ে গেল, ক্রিসমাসের ছুটি চলে গেল। শিলাদিত্য এন.এস.ডি.-তে ফেরেনি, কলকাতাতেও না। শ্রাবস্তী চণ্ডীগড়ে খোঁজ নিয়েছিল। মোনালিসার বাবাও জানেন না মেয়ে কোথায়, কি শিলু কোথায়। অথবা জানলেও বললেন না। তবে তাঁর সঙ্গে কথা বলে শ্রাবস্তীর মনে হয়েছে, তিনি জেনেশুনেও খবরটা বলছেন না। তাতে শ্রাবস্তীর উদ্বেগ কিঞ্চিৎ কমেছে। অবশ্য মেয়ের যেমন চরিত্র তাতে মেয়ের জন্য উদ্বেগ না-করার অভ্যেস হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয় মোনালিসার বাবার পক্ষে। কিন্তু শিলাদিত্যর স্বভাব তো সেরকম নয়। তবে বাড়িতে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে।
ভাই আমার ওপরে এত বিরক্ত কেন হল? ভয় পেয়ে আমি ওকে সবই খুলে বলেছিলাম। লিসার সব কথা। তাতে আমার ওপর খেপে যাওয়ায় কী হয়েছে শিলুর? আমি ওকে সতর্ক করে দেব না তো দেবে কে? প্রেমে পড়লে কি মানুষ সবটা দেখতে পায়? দৃষ্টি কি স্বচ্ছ থাকে? কী যে বোঝাল ওকে মোনালিসা নামের দুষ্টু মেয়েটা! যে সর্বনাশের ভয় পেয়েছিলাম সেই সর্বনাশই মনে হয় হয়েছে।
.
বাবা-মাকে মোনালিসার কথা বলা হয়নি। গৌতম বারণ করল। গৌতম বলল, এই উড়নচণ্ডে ছাত্রসমাজের চেহারার সঙ্গে ওদের পরিচয় নেই–বিশেষ এই ইংরিজি গানবাজনা থিয়েটার-ফিল্ম-ফ্যাশনের বিচিত্র জগতের সঙ্গে। ওঁরা বুঝবেন না। আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন। শিলুর জন্য ভয় পাবেন। তার চেয়ে এটা ওঁদের না জানাই মঙ্গল। জেনেই বা কী লাভ? শিলাদিত্য ওঁদের কিছুই জানায়নি, হঠাৎ উধাও হয়ে গেল মোনাসিলা গর্গের সঙ্গে। গৌতম প্রচুর চেষ্টা করছে। খোঁজ নিয়েছে। জেলে নেই। হাসপাতালে নেই। মৃত্যুসংবাদও নেই। অতএব তারা আছে নিশ্চয় কোথাও। গৌতম, শ্রাবস্তী দুজনেরই ধারণা গোয়াতে কিংবা কাঠমাণ্ডুতে ওদের খোঁজ মিলবে। কোনো হিপি আশ্রমে। এ সম্ভাবনাটুকুও শ্রাবস্তীর মা-বাবাকে জানাতে রাজি নয় গৌতম–ওর ধারণা ছেলে হিপিদের সঙ্গে থাকতে পারে, এটা শুনলেই ওঁরা ভেঙে পড়বেন।
শ্রাবস্তীর অবশ্য ধারণা অন্য। শ্রাবস্তী অবাক হয়ে ভাবে, এতদিন দেখেও গৌতম ওর মা-বাবাকে চিনল না। যেমন এতদিন ওকে দেখেও গৌতমের মা-বাবা চিনলেন না। শ্রাবস্তীকে। পদে পদে তার প্রমাণ পায় শ্রাবস্তী। যেমন সেদিন গৌতমের মামা-মামি এসেছেন। জামসেদপুর থেকে। ওর মা শ্রাবস্তীকে ডেকে ওঁদের সামনে আদর করে বললেন, এসো তো শ্রাবস্তী, পরোটাগুলো বেলে দেবে একটু আমার সঙ্গে। (আরে আমি পারি নাকি পরোটা বেলতে!) শ্রাবস্তী গেল তার পিছু পিছু রান্নাঘরে, গিয়ে বলল,-মাসিমা, আমি কিন্তু পরোটা বেলতে জানি না। আলুচচ্চড়ি বানিয়ে দিতে পারি বরং। উত্তরে গৌতমের মা বললেন, জানি না বললে তো হবে না। ঘরের বউ, পরোটা বেলতে পারবে না? সে কি হয়? শুধু জজ ম্যাজিস্ট্রেট হলেই তো মেয়েদের চলবে না, রান্নাঘরটাও সামলাতে হবে।
কথাটা খুব ভুল নয়–সুরমাও কখনও যে এধরনের কথা বলেন না তা না। কিন্তু তার বলার সুরটা আলাদা। তাতে এই অনুশাসনের স্বর শোনেনি শ্রাবস্তী। সব কাজকর্ম শিখে রাখা ভালো, সুরমা শিলুকেও তো রান্নাঘরে ডাকেন। ব্রেকফাস্ট করে দিতে পারেও শিলু। গৌতম রান্নাঘরে ঢোকে না।
ওদের বাড়িতে শ্রাবস্তীর প্রধান ভূমিকা ঘরের বউ হয়ে রান্নাবান্না, ঘরকন্না করার। তার আই. এ. এস. হয়ে রাজ্যশাসন করাটা যেন এলেবেলে শৌখিনতা মাত্র। গৌতম যে অ্যালায়েড সার্ভিসেস পেল সেটাতেও তারা শ্রাবস্তীর প্রতি কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ। যেন সে একটা বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করে ফেলেছে তাদের ছেলের চেয়ে দুপা এগিয়ে গিয়ে। অথচ বি. এ.-র রেজাল্টেও ফারাক ছিল। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল কেবল একজনই, শ্রাবস্তী। তখন ওঁদের এই মনোভাবটা বোঝা যায়নি, গৌতম তার বন্ধুর সাফল্যে এতই গর্বিত হয়েছিল। আই. এ. এস. পাওয়াতেও গৌতমের মনে ক্ষোভ নেই, খুশিই আছে। কিন্তু মা-বাবার মতে মত দিয়ে চলা স্বভাব গৌতমের। শ্রাবস্তীর ও-বাড়িতে জিন্স পরার অনুমতি নেই। গৌতমও বলল মেনেই নিতে, এটা তো ছোট ব্যাপার। গৌতমের বোন ঋতা কিন্তু জোর করে জিন্স পরে। গৌতমের মা শ্রাবস্তীকে সালোয়ার কামিজ পরতেও বারণ করেছিলেন। ওর বাবা নাকি পছন্দ করেন না। কিন্তু ঋতাই ঝগড়া করে (গৌতম নয়!) সেই অনুমতিটা আদায় করেছে শ্রাবস্তীর জন্য। শ্রাবস্তীকে জিও পরতে বলে সে বলে, পরলেই মেনে নেবে ঠিক। ওদের অন্যায় আব্দার শুনো না। তুমি তোমার মতো থাকবে। শ্রাবস্তীই বরং গৌতমের কথা শুনেছে, ঋতার কথা না শুনে। সেটা কি ঠিক করেছে? সারা জীবনের জন্য কি এই সিদ্ধান্ত রাখা যাবে? গৌতমের সব কথা শোনার? ও যদি অ্যালায়েড না পেত আই. এ. এস হয়ে যেত, তাহলে ওকে অগ্রাহ্য করা ঢের সহজ হত। এখন শ্রাবস্তীকে অনেক সতর্ক হয়ে বুঝেসুজে চলতে হয়, পাছে গৌতমের মনে আঘাত লাগে?
গৌতমনের পরিবারের সঙ্গে শ্রাবস্তীর মিল নেই বিশেষ। ওঁরা তুচ্ছতাকে খুব বড় মূল্য দেন। এখানে প্রসেনজিতের কথা মনে পড়ে যায় শ্রাবস্তীর। অথচ ঠিক বিপরীত মেরুতে আছেন ওঁরা–গৌতমের বাবা বহুকালের নিবেদিত প্রাণ সি.পি.এম কর্মী। গোঁড়ামি যে কত রকমের হতে পারে! রক্ষণশীলতার নানা মুখ, নানা মুখোশ। ঐশ্বর্যের মতো দারিদ্রেরও একটা অহংকার থাকে সময়ে সময়ে। সে দম্ভ আরও ভয়ানক হতে পারে। শ্রাবস্তী সেটা বোঝে না। তা নয়। কিন্তু ওঁরা যে গৌতমের বাবা-মা!
সুরমা-আদিত্যর সংসারে মুক্ত বাতাসে মানুষ হওয়া শ্রাবস্তীর গৌতমের বাড়িতে দম আটকে আসে। রাজনীতিতে বামপন্থী হলেই যে তারা সংসারে মুক্ত মন নিয়ে আসেন না, সেটা এখানে স্পষ্ট। গৌতম তো এ-বাড়িরই মানুষ! শ্রাবস্তীর মাঝে মাঝে ভয় করে। হঠাৎ করে সুষমার কথা মনে পড়ে যায়।
.
মোনালিসা গর্গের খবরে গৌতম অতিরিক্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিল কি? বেশি ভয় পেয়েছিল? ভয়, না বিতৃষ্ণা? নাঃ, ওটা বিচলিত হবার মতোই খবর। তারপর অনিন্দ্যর ব্যাপারটা। গৌতমের মুখে অনিন্দ্যর কথাটা শুনতে ভালো লাগেনি শ্রাবস্তীর। যেমন শ্রাবস্তীর মুখে মোনালিসার কাহিনী শুনতে শিলাদিত্যর ভালো লাগেনি। (শিলু আমায় নিজেই কেন বলল না অনিন্দ্যর কথাটা? বললে কী ক্ষতি ছিল?)
শুভার সঙ্গে এতদিনের এত সুন্দর সম্পর্কটা ছিন্ন করে দিল্লি গেল কেন শিলু? শুভা থাকলে তো মোনালিসা ঢুকতে পারত না শিলুর জীবনে।
মোনালিসা জুয়া খেলতে বসেছে জীবনটাকে নিয়ে। যে কোনো এক্সপেরিমেন্টের জন্যে প্রস্তুত সে। নৈতিকতার ধার ধারে না। লৌকিকতা, চক্ষুলজ্জা–এসব শব্দ তার অভিধানে নেই। অঢেল পয়সা, আর অসীম স্বাধীনতা, এই দুই সর্বনেশে বারুদের স্কুপের ওপরে বাসা বেঁধেছে ওই মেয়ে। এককালের মিস চণ্ডীগড়–ফেমিনার কভার গার্ল–আছে শাণিত রূপ, প্লাবিত যৌবন। শিলাদিত্য গিয়ে পড়ল শেষে এই মেয়েরই পাল্লায়। এত মানুষ থাকতে দিল্লি শহরে, সেই রীমা ভীমানির ধনী সোশ্যালাইটদের উড়নচণ্ডী আড্ডাতেই ধরে নিয়ে গেল শিলুকে, লিসা রীমা ভীমানির মেয়ের বন্ধু। সে মেয়েটিও দিল্লিতে সুপরিচিত। ধনীদের জন্য বিউটিপার্লার চালায় সে একটি–প্রচণ্ড বিখ্যাত মেয়ে সে। ওদের একটা বার আছে–সেখানে হঠাৎ একটি মেয়ে খুন হয়ে গেছে অল্প কিছুদিন আগে। তবুও বার চলছে–এত রাজনৈতিক ক্ষমতা ওই রীমা ভীমানির। ওসব সঙ্গ শিলুর পক্ষে মস্ত ক্ষতিকর। শিলু বুঝছে না।
.
মোনালিসা গর্গকে কখনো শ্রাবস্তীদের বাড়িতে মানায়? সুরমা-আদিত্য রীতিমতো সন্ত্রস্ত তার হাবভাবে, চালচলনে। শ্রাবস্তী অস্থির, উদ্বিগ্ন হয়েছিল–ওই মেয়ের মধ্যে একটা অচেনা, জটিল জীবনের সংকেত পেয়েছিল সে। গৌতম খবর নিতে শুরু করল, অচিরাৎ খবর মিলে গেল। মেয়ে তো নাম করা। সোশ্যাল ওয়ার্ক করে মানুষ দেখে দেখে সুষমার এমনই হয়েছে, মোনালিসাকে দেখেই তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠেছিল। তিনি গোপনে শ্রাবস্তীকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এ মেয়েটাকে তো ড্রাগ অ্যাবিউজার বলে মনে হচ্ছে–একে বাড়িতে রাখা একদম চলবে না–শিলুর সঙ্গে একে মিশতেই দেয়া ঠিক নয়–সুষমা সুরমাকে আসল কথাটা বাদ দিয়ে বলেছিলেন, মেয়েটাকে বাজে মেয়ে মনে হচ্ছে সুরো, ওকে বাড়িতে না রাখাই ভালো।
এটা বলা সহজ, কিন্তু করা অত সহজ নয়। শ্রাবস্তী কী করবে? মা-বাবার কাছে ড্রাগ শব্দ উচ্চারণ করলেই তো তারা মূর্ছা যাবেন। এ ব্যাপারে গৌতম ঠিক। বাবা-মা ওই একটি জিনিসকে ভয় পান। ড্রাগ। শিলুকে মোনালিসার থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। চরম সর্বনাশ থেকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবেই শিলুকে-শ্রাবস্তী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। মোনালিসার কথা সব খুলে বলেছিল শিলুকে। শিলু জানত সবই। অবাক হল না। বিরক্ত হল।
নানা অজুহাতে, নানা চেষ্টায়, শ্রাবস্তীর ঐকান্তিক প্রয়াসেও মোনালিসাকে কিছুতেই যখন নড়ানো গেল না, আত্মমগ্ন শিলাদিত্য কোনো ইঙ্গিতই ধরতে চাইল না, তখন অক্ষমতার ক্ষোভে অস্থির হয়ে শ্রাবস্তী নিজেই বাড়ি ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল। ভাবল এবার শিলাদিত্যর চোখ ফুটবে। কিন্তু জ্ঞানগম্যি যে আর হবার নয়। যে সর্বনাশের ভয় পাচ্ছিল শ্রাবস্তী সেই সর্বনাশ যে হয়েই গিয়েছে তা কি তখনও টের পেয়েছিল সে? নাকি টের পেয়েও বিশ্বাস করতে চায়নি?
গৌতম বলেছিল, একা লিসাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই তোমার ব্রাদারটিও ওই লাইনেই আছেন।
কথার সুরটা শ্রাবস্তীর খুব খারাপ লেগেছিল। শ্রাবস্তী বিশ্বাসও করেনি। ক্রমশ শ্রাবস্তীর ধারণা হচ্ছে গৌতম শিলুকে পছন্দ করে না। তার পোশাক-আশাক, তার পপ-ব্যান্ড সিনামন আইল্যান্ড, তাদের গানবাজনা, কোনো কিছুই যেন গৌতমের মনঃপুত নয়। ওরা যে ম্যাক্সমুলর ভবনে অনুষ্ঠান করে কাগজে কাগজে অত প্রশংসা কুড়ল, গৌতম তাকেও বলেছিল-ওঃ! রেভ রিভিয়ু!–ওসব রাখো তো? যত রাজ্যের বড়লোকের ছেলেরা দল করেছে, পুরো মিডিয়া ওদের হাতের মুঠোয়।
শ্রাবস্তীর কানে ভালো শোনায়নি কথাগুলো! কেমন একটা অস্বস্তি হয়েছিল, গৌতম কি শিলুকে–? ওকে কি একটু ঈর্ষাই করে গৌতম? কেন, শ্রাবস্তীর তো ঠিক উলটোই মনে হল। শ্রাবস্তীর বরং মনে হয়েছিল ছেলেগুলোর সত্যি ট্যালেন্ট আছে। অনিন্দ্যর কোরিও গ্রাফি, শিলুর লেখা গান-ভিকির পারকাশ্যান–কিন্তু অনিন্দ্য মুম্বাই চলে গেল মেধা পাটকরের ওপরে ডকুমেন্টরি করতে, আর শিলাদিত্য চলে গেল দিল্লি, দারুচিনি দ্বীপও ডুবে গেল।
শিলু যখন এসেছিল, বাকি ছেলেগুলোও এসে কদিন বাড়িতে জড়ো হয়ে হই হই করেছিল বটে, কিন্তু তারপর তো খেল্ খতম। দলের ছেলেগুলো সকলেই অল্পবিস্তর গাঁজাখোর। কিন্তু গাঁজা নিয়ে তো ভাবনা নয় শ্রাবস্তীর। তার ভাবনা অন্যত্র। আরও অনেক গভীরতর ক্ষতির সম্ভাবনা যেখানে।
শিলাদিত্যের খবর এখনও কিছু জানা গেল না। বোঝা যাচ্ছে না ক্ষতির বহর কতখানি। মোনালিসার খবর যা পাওয়া গেছে তারপরে তো আর মনে-প্রাণে কোনো ভরসাই থাকে না। বাবা-মাকে কিছুই বলতে পারা যাচ্ছে না, তাদের জন্যে শ্রাবস্তীর মনে প্রবল দুশ্চিন্তা। ওঁরা। কেউই বাইরে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করছেন না, খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। অথচ শ্রাবস্তী তো জানে। তাদের রক্তের মধ্যে অশান্তির ঢেউ আকাশ ছুঁয়েছে।
গোয়াতে একবার যাওয়া দরকার।
এবং কাঠমাণ্ডুতে।
অবশ্য নেপালে আরও ঢের জায়গা আছে। ছোটখাটো গ্রামেও যথেষ্ট নেশার সামগ্রী মেলে। যেখানে ড্রাগের সাপ্লাই অপ্রতুল নয় সেরকম কোনো জায়গাতেই মোনালিসা থাকবে বলে গৌতমের ধারণা। এবং মোনালিসার সঙ্গে শিলু।
কে জানে কতদূরে ছড়িয়েছে, কত গভীরে নেমেছে সর্বনাশের শেকড়। বাবা-মা-র এতগুলো চিঠি বেরুল এতদিন ধরে এতগুলো কাগজে, একটাও কি চোখে পড়ল না শিলুর? এতটা নিঃশব্দ কেন? নৈঃশব্দ্যই তো ভয়ের।
.
একাদশ অধ্যায়। চিঠি পড়া
চিঠিঃ এক
আমেদাবাদ
১২ জানুয়ারি ১৯৯৯
শ্রীচরণেষু মা গো,
আমি জানি আমার জন্যে ভেবে ভেবে তোমরা কত কষ্টে আছ। কিন্তু সত্যি খবরটা যদি পাও তাহলে বাবা আর তুমি আরও বেশি কষ্ট পাবে, এই দুর্ভাবনায় নীরব থাকাই স্থির করেছিলাম। কিন্তু বারবার কাগজে তোমাদের চিঠি চোখে পড়েছে–তাতে সান্ত্বনা পাই, ওতেই জানছি যে, তোমরা আছে, তোমাদের ভালোবাসার জায়গাটা আমার জন্যে এখনও ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি, মা। কিন্তু আমার জীবনের চালচিত্রটা পালটে গেছে।
দিল্লিতে ফেরার পর থেকেই মোনালিসার শরীরটা খারাপ হয়ে পড়ল। ওকে যখন কলকাতায় নিয়ে যাই, তখনই ওর স্বাস্থ্য গোলমাল করছে। দিদি ঠিকই ধরেছিল ওই সময়টায় আমার জীবনে একটা প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। দিদির কাছে তোমরাও এতদিনে নিশ্চয়ই লিসার ড্রাগ অ্যাডিকশনের কথা জেনে থাকবে। দিদির ভয় ভুল ছিল না, মা। লিসা, এবং আমাদের অন্যান্য সঙ্গীসাথীদের কল্যাণে দিল্লিতে এসে আমারও ওই মরণ-নেশাতে হাতে-খড়ি হয়ে গিয়েছিল। তাই কলকাতাতে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলাম, যদি মুক্তি পেতে পারি।
আরও একটা কারণেও মোনালিসাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। আমাদের পরিবার নিয়ে আমার মনে একটা গভীর তৃপ্তি, আর গর্ববোধ আছে বলে। লিসার মা ওকে বাল্যকালেই ছেড়ে অন্য সংসার পাততে চলে গিয়েছেন। বাবা ব্যবসার ধান্দায় এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়ান, ব্যবসাও খুব শুভ্রধবল নয়। তার সাঙ্গো-পাঙ্গরাও তেমনি। লিসা আয়া-বাবুর্চির জিম্মাতেই মানুষ হয়েছে। একলা একলাই বড় হয়ে উঠেছে বলতে পারো। হাতে প্রচুর অর্থ এবং স্নেহের কোঠায় শূন্য। জীবনটাকে নিয়ে যেমন খুশি খেলাধুলো করেছে। নিজেকেও একটা খেলনার মতোই টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলেছে। আমি চেয়েছিলাম সেই ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগাতে। ভেবেছিলাম, তোমার কাছে, বাবার কাছে, দিদির কাছে লিসাকে একবার নিয়ে ফেলতে পারলে, ওর বিভ্রান্তি ঘুচে যাবে। মানুষকে বিশ্বাস করতে ওর যে প্রবল ভীতি, সেটা কেটে যাবে।
কিন্তু বাড়িতে যাবার পরে কিছু আর ঠিকঠাক হল না। যা সব কাণ্ডকারখানা হতে লাগল, তাতে আমার পরিকল্পনা বাস্প হয়ে উবে গেল। দোষ আমারই মা। আমিও তখন ঠিক আমাতে ছিলাম না। নিজের মধ্যে জোরটা ছিল না বলেই বোধ হয় কাউকেই কিছু বোঝাতে পারিনি।
লিসাকেও বোঝাতে পারিনি কিছু, দিদিকেও নয়। ওরা তাই মোটে কাছাকাছিই এল না। তোমাকেও বোঝাতে পারিনি আমি কী চাই–তাই লিসা তোমার কাছেও গেল না।
তুমিও মা, ওকে কাছে টানলে না, একটু যেন ভয়ে ভয়ে দূরে দূ রেই রইলে। লিসারই দুর্ভাগ্য, তোমাদের মতো মা-বাবা, দিদির মতো দিদির কাছে গিয়েও লিসা তোমাদের কাছাকাছি যেতে পারল না। দূরত্বের বেড়া ডিঙোতে পারল না–সরিয়ে রাখল নিজেকে। আমিও সেতুবন্ধনের চেষ্টা ঠিকমতন করতে পারিনি। আমারও সময়টা তখন ঠিকঠাক ছিল না মা। নতুন নেশার গোপন উত্তেজনার আর গভীর অপরাধবোধের তুমুল বিষে মেশানো অন্ধকার সময় ছিল সেটা আমার।
ফলে যা হবার নয়, তাই হল। সবই উলটোপালটা হয়ে গেল। দিদি বাড়ি থেকে চলে গেল তাতে অপমানিত হয়ে লিসাও ফিরে গেল দিল্লি। আমি না পারি একে দুষতে, না ওকে। ফলে নেশার মাত্রা বেড়ে গেল। তোমাদের চিঠি লিখব কোন মুখে? ফোনে বলব কী? দিল্লি থেকেই আমার নিস্তব্ধতার শুরু। আমার সান্ত্বনা, দিদি আছে। তোমাদের কাছে দিদি থাকবে।
তোমার হয়তো মনে পড়বে, কলকাতাতে থাকতেই লিসার জ্বর হচ্ছিল। পেটের গোলমাল হচ্ছিল। দিল্লিতে এসেও সেটা চলতে লাগল। আজ পেটের অসুখের জ্বর, তো কাল সর্দিকাশির জ্বর। মুখের মধ্যে পর্যন্ত এমন ঘা, যে কিছুই খেতে পারে না। তবু কিছুতেই কিছু কথা শুনবে না। ডাক্তার দেখাবে না। কলকাতা থেকে এসে আমি আর হোস্টেলে যাইনি, লিসাদের মস্ত বাড়ি পঞ্চশীল পার্কে। লিসার সঙ্গে আমিও সেখানেই ছিলাম। কিন্তু সিলার স্বাস্থ্য হঠাৎ এমন ভেঙে পড়তে লাগল, যে আর ক্লাসেই যেতে পারছিল না। দ্রুত ওজন কমতে লাগল। গায়ে ব্যথা। কাশিতে দমবন্ধ। ডাক্তার ধরে আনা হল। বহুবিধ রক্ত পরীক্ষা করে, শেষ পর্যন্ত জানা গেল, ওর রক্তে শুধু এইচ. আই. ভি. পজিটিভই নয়, লিসার শরীরে এইডসের লক্ষণ পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পেয়েছে। অনেকদিন আগেই ওর রক্ত এইচ.আই.ভি. পজিটিভ হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। চেক করা হয়নি।
ওকে নিয়ে আমেদাবাদে এসেছি। এখানে গ্যাপ (GAAP) নামে গুজরাত এইডস অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম হয়েছে, তারা চমৎকার কাজ করছে। ওরাই লিসার শুশ্রূষার, চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে দিয়েছে। চণ্ডীগড়ে ওর বাবাকে বারবার খবর দিয়েছি। উনি চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন। দেখতে আম্মু সেননি। নিষ্ঠুরতার, নির্মমতার এমন নগ্ন চেহারা আমি এর আগে দেখিনি। দিল্লির বন্ধুরাও যখন লিসার অসুস্থতার কারণ শুনল, কেউই আর ধারে কাছে রইল না। অথচ ওর বাড়িটা ভর্তি হয়ে থাকত শুধু লিসার বন্ধুর দঙ্গলে। শুধু আমার বন্ধু অনিন্দ্য দুবার এসেছে মুম্বাই থেকে। শুধু অনিই যোগাযোগ রাখে। লিসার পাশে পাশে আমি রয়েছি এই ছমাস। এই অসুখে ছমাস সময় যে কত দ্রুত কেটে যায়! ওকে দেখলে তুমি আর চিনতে পারবে না মা। ওর ওজন এখন আটাশ কেজি। লিসার শুশ্রূষার জন্যে ভাবনা কোরো না, মোনালিসা যতদিন বাঁচবে, ওর পাশে আমি থাকব।
গত পরশু লিসার মা এসেছেন। বারো-তেরো বছর পরে মা-মেয়েতে দেখা–এই প্রথম, এই শেষ। এই দেখাটুকুই যদি আরও ছসাত বছর আগে হত! মাগো, অহংকার অভিমান, লজ্জা, সংকোচ, ভয়–কত রকমের মিথ্যের পাঁচিল তুলেই আমরা নিজেদের ক্রমশ নিঃসঙ্গ করে ফেলি! ফুরিয়ে ফেলি। ওর মাকে দেখেছি। তাই সাহস করে আজ এই চিঠি। নিউমোনিয়া হয়েছে লিসার। এই অসুখের মধ্যে নিউমোনিয়া হলে, তার কোনো চিকিৎসা নেই। শেষ সম্বল শুধু ভালোবাসা। সেইটে দেবার জন্যেই আমারও এইখানে থেকে যাওয়া। একটাই তো জীবন? একদিন ছেড়ে যেতেই হবে এই মাটি; তার আগে যতগুলি জীবনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি, ততই আমি ভাগ্যবান।
আমি আমেদাবাদেই থাকব। এন.এস.ডি. তে তো আর ফেরা হবে না। এখানে অনেক দুঃখী মানুষ মা। এই গ্যাপ প্রতিষ্ঠানটিতেই আমি স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছি। এদের সকলের আমাকে দরকার আছে।
আর আমারও একদিন এদের দরকার হবে, মা। ইলাইজা টেস্টে আমিও হয়েছি এইচ.আই.ভি. পজিটিভ। হ্যাঁ। এই একই ভবিষ্যৎ আমার জন্যেও অপেক্ষা করে আছে। যদিও এখন ঠিক আছি। যা বলছি মা, সব সত্যি কথা–তোমাকে নির্ভার করতে, সত্যিই বলা উচিত। ভয় পেও না মা। শক্ত হও। কালই তো গাড়ি চাপা পড়ে মারা যেতে পারে একজন বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলেও। জগতে কেউই চিরঞ্জীবী হতে আসিনি। তুমি একা নও মা। পৃথিবী জুড়ে আরও অনেক ছেলেমেয়ের মায়ের তোমারই মতো মর্মান্তিক অবস্থা, মনে রেখো। এই অসুখের সংক্রমণ অতি সীমিত। তাই সাবধান থাকাও সহজ। ত্রুটি আমারই। অসতর্কতা। একটি মাত্র মুহূর্তের বিভ্রমও চিরদিনের মতো বদলে নিয়ে যায় আমাদের জীবন। এই ইঞ্জেকশনের ছুঁচ যে কতজনের যমদণ্ড হয়েছে।
মাগো, আমার কিন্তু শরীরটরির সব স্বাভাবিক। অসুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। শুধু মোনালিসার সঙ্গে থাকি বলেই আমারও রুটিন ইলাইজা টেস্ট করিয়েছিলেন ডাক্তার মহিলাটি। তাই ধরা পড়ল। এমনিতে আমি কর্মক্ষম, সুস্থ আছি। রোগের বীজাণু এখনও সক্রিয় হয়নি। নাও তো হতে পারে? সর্বদা হয় না কিন্তু!
দিদি যেন লিসার ওপরে রাগ করে না। ও খুব অন্যায় করেছে ঠিকই, দিদি ঠিক-ঠিকই ভয়গুলো পেয়েছিল। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে। দিদিকে বোলো, এই সময় কারুর ওপরে রাগ পুষে রাখতে নেই, ক্ষমা করে দিতে হয়। এমনকী লিসাকেও। দোষ তো আমারও। কেউ তো আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নেশা ধরিয়ে দেয়নি। আমারও বুদ্ধির ভুল হয়েছিল মা। দাম তো দিতেই হবে। মাগো–দিদি, তুমি, বাবা আমার ভালোবাসা নিও। মামণিকেও জানিও। এই চিঠি ওঁকেও দেখিও। মেসোমশাই, শুভদাদা, লোপাদি সবাই ভালো তো? তোমরা ভালো থেকো, মা।
তোমার
শিলু।
পুনশ্চ : লিসাকে তোমরা বাড়িতে নিয়ে যেতে বারবার ডেকেছ বলে কাগজে তোমাদের চিঠি পড়ে, লিসার চোখে জল। সে খুবই কৃতজ্ঞ। এইটুকু মমতা ওর কাছে অনেকখানি। এখন বোধহয় অল্প অল্প চেনা হচ্ছে তোমাদের। যখনই হোক, যেটুকুই হোক, সেইটুকুই লাভ। আর ভাবনা কোরো না। এই তো খবর পেলে। এবার সামলে ওঠো দুঃসংবাদটা। তুমি তো কঠিন হতে পারো। বাবাকে একটু বুঝিয়ো। দিদিকেও বোলো বাবাকে বোঝাতে। আমার জন্য ভেব না। তুমি তো ঈশ্বরবিশ্বাসী।
.
চিঠিঃ দুই
১৭/২সি জাস্টিস চন্দ্রমাধব স্ট্রিট
কলকাতা-২০
১৭ জানুয়ারি ৯৯
আমার আদরের শিলাইবুড়ো,
এতদিন দেরি করতে হয় রে? তোমার চিঠির জন্যে বসে বসে তোমার বাবা-মায়ের প্রাণ সত্যি সত্যি বুঝি ঠোঁটের কাছে উঠে এসেছিল। আমি তো ভয় পেতে শুরু করেছিলাম ওঁদের জন্যে–চাপা মানুষ–কেউই হাহাকার করছেন না, দুজনেরই ভয়, ইনি দুর্বল হলে উনি বুঝি ভেঙে পড়বেন। তাই দুজনেই অতিরিক্ত স্বাভাবিক আছেন। আর ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাই হচ্ছেন। আর তোমার ওপরে আমার এতক্ষণ যে রাগটাই হচ্ছিল! তুমি কি সত্যি সত্যি সন্ন্যাসী হয়ে গেলে? পূর্বাশ্রমের কথা বুঝি আর মনে নেই? যাই হোক না কেন, তুমি তো জানো আমরা তোমার সঙ্গে সর্বদা আছি। সদাসর্বদা।
তোমরা এই ভয়ের দিনে, এই বিপদের দিনেই যদি আমাদের কথা না মনে পড়ে, তবে কবে আমাদের কথা ভাববে? তুমি তো জানো আমি কাদের নিয়ে কাজ করি। আমার সঙ্গেও একটু যোগাযোগ করলে না? তবু ভগবান তোমাকে তো সুবুদ্ধি দিয়েছেন শেষ পর্যন্ত, সেই মস্ত দয়া। এবার দেরি না করে অবিলম্বে তোমার শরীরের খবর আমাকে ডিটেইলসে জানাবে। তোমার ফোন নম্বর কী?
গ্যাপের কাজকর্মের খবর আমরাও জানি। তুমি যে ওদের সাহায্য পেয়েছ মোনালিসার জন্যে, এটা খুবই ভালো খবর। গুজরাতের অবস্থা দ্যাখো, আর এখানে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে? এইডস হয়েছে শুনেই রুগিকে পরিত্যাগ করে তার মা-বাবা-স্ত্রী নিঃশব্দে পালিয়ে গিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকেও তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে, ছোঁয়াচের ভয়ে। সে কি বাঁচে? আরেকজন এইডস রুগিকে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, জমাদার, কেউই অ্যাটেন্ড করেনি। দিনের পর দিন! সেও মারা গেছে। মেডিক্যাল প্রোফেশনেও এতদূর জ্ঞানের অভাব। বর্ধমানের একজন রুগির কখনো ভবিষ্যতে এইডস হতেও পারে, যেহেতু তার রক্তে এইচ আই ভি পজিটিভ বেরিয়েছে–এই কারণে গ্রামের লোক রাত্রিবেলায় তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। নেবানো না গেলে, পরিবারসুদ্ধ পুড়ে মরত। এই সবই বাস্তব ঘটনা। fact!
পশ্চিমবঙ্গের মতো উদারপন্থী, মুক্তমনা, আধুনিক, প্রগতিবাদী রাজ্যের এই অবস্থা! সচেতনতা সৃষ্টির কাজ কিছুই ছড়ায়নি। এই নিষ্ঠুরতা, অমানুষিকতা সবই অযৌক্তিক মৃত্যুভয়, এবং চরম অজ্ঞতাপ্রসূত। অতএব শিলুবুড়ো, বুঝতেই পারছ, এই রাজ্যেই তোমার আমার প্রচুর দায়িত্ব, প্রচুর কাজ রয়েছে। চিরদিন ওখানেই থেকে তুমি কী করবে? ওখানে তো তবু কাজ হচ্ছে। কর্মী আছে। শিলুবাবু, এখানেই তোমার অনেক জরুরি কাজ পড়ে আছে–you are badly needed here! তুমি যে সেবার কাজে এখন নিযুক্ত রয়েছ, সেই কাজেই তোমার সম্পূর্ণ মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মনের অবস্থাও বুঝতে পারছি। তোমাদের ভালো হোক, মোনালিসার যন্ত্রণা লাঘব হোক, এই প্রার্থনা করি। এ-রোগে শেষদিকে বড় কষ্ট।
আমার বালিকা সুরক্ষা আশ্রম আর মহিলা নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘের বিষয়ে তো জানতেই। এখন আমি সোনাগাছিতে এইডস নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সঙ্গে কাজ করছি। এবং জাতীয় এইডস নিয়ন্ত্রণ সমিতি-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতির দায়িত্বে আছি। তুমি এলে আমি অনেক বেশি জোর পাব।
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, তোমার মা একটা গান খুব গাইতে ভালোবাসেন–আমারও গানটি প্রায়ই মনে পড়ে–অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো/সেই তো তোমার আলো– শিলুবুড়ো, অন্ধকারকে ভয় পেতে নেই–
সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো/সেই তো তোমার ভালো– সেই ভালোটার খোঁজেই ছুটছি আমি, তুই, আমরা সবাই।–এখানে এসে আমাদের সঙ্গে হাত মেলাও।
শুভরা এই গ্রীষ্মে আসছে। ওরা কাজ করতে ব্রাজিল যাবে তার পরে। ওর সঙ্গে তোমার career possibilities discuss করো। ওরা অনেকরকম খবর রাখে।
অনেক আদর নাও। Welcome back! লিসাকে, তোমাকে প্রাণঢালা আশীর্বাদ ইতি।
তোমার সৎসাহসে মুগ্ধ,
মামণি
পুনশ্চ : তোমাকে যেসব ভয়াবহ গল্প বললাম, এইডস রোগীর পরিবারকে একঘরে করার বিষয়ে, তাতে ভয় পেয়ে যেন আমাদের অস্বস্তির কথা ভেবে বাড়ি ফিরতে দ্বিধা কোরো না। তোমার পরিবারকে একটা সুযোগ দাও। এই সর্বনেশে সামাজিক অজ্ঞতা ও অমানবিকতার স্পষ্ট বিরোধিতা করতে, পথনির্দেশ দিতে আমাদের সুযোগ করে দাও।
.
চিঠিঃ তিন
১৭ জানুয়ারি ১৯৯৯
সল্টলেক রায়বাড়ি
শিলুবাবা,
তোমার গলাটি এতদিন পরে চিঠির মধ্যে দিয়ে ভেসে এসে আমাদের প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছে। এতদিন কেন চুপ করে ছিলে? তোমার মা খুব ভেঙে পড়েছিলেন ভেতরে ভেতরে। অসুস্থ হলে মাকে জানাবে না, বাবাকে জানাবে না, এটা তোমার কীরকম বুদ্ধি, শিলুবাবা? তোমার বন্ধুকে তুমি প্রাণ ঢেলে সেবা করছ, শুনে আমরা তোমাকে নিয়ে গর্বিত। এমন হৃদয়বান সন্তান পাওয়া ভাগ্যের কথা। ঈশ্বর তোমাকে আরও ভালোবাসার শক্তি দিন। এর চেয়ে বড় শক্তি পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তবে জীবন বড় জটিল–তাই এই ভালোবাসাই, যা কিনা সৃষ্টির মূলে, আবার অনাসৃষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় কখনও কখনও।
তোমার চিঠি পেয়ে যেমন আনন্দ হল, বলা নিষ্প্রয়োজন, তেমনিই মন গভীরভাবে বিষণ্ণ হয়েছে। তোমার জন্য। তোমার বন্ধু মোনালিসার জন্যে। তোমাদের পুরে প্রজন্মের জন্যে। এবং আমাদের নিজেদের সংবেদনের অভাবের জন্যেও। কিছুই তো বুঝিনি। তাকে তুমি নিয়ে এসেছিলে স্নেহমমতার স্পর্শ দিয়ে রক্ষা করবে বলে, অথচ আমরা ওকে ঠিকমতো অভ্যর্থনাই দিইনি। সেও মনে মনে হয়তো আমাদের গ্রহণ করতে পারেনি। সেজন্য সুরো, এমনকী খুকুর সঙ্গেও তার ভাব হল না। আমরাও সেদিকে গা করিনি, লিসাকে আমাদের তেমন ভালো লাগছিল না। ওরকম মেয়ে আগে তো দেখিনি? নিজের পরিবারে যে নিরাপত্তা সে পায়নি, তুমি চেয়েছিলে সেই অমৃতের স্বাদ তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে। কাযর্ত হয়ে গেল বিপরীত। সে তো ভিতরে এলই না, তোমাকেও বের করে নিল তোমার নিরাপত্তার বেষ্টনি থেকে, স্নেহের সুরক্ষার আড়াল থেকে। আমরা তাকে সামান্য আত্মবিশ্বাসটুকু দিতে বিফল হয়েছি, শুধুই বোঝার ভুলে।
আমাদের সারাটা জীবনই এইরকম ভুলে ভরা। মানুষ চায় একরকম আর জীবন তার হাতে তুলে দেয় অন্য এক পাওয়া। এই তো দ্যাখো না, দোষ তো কারুরই ছিল না, অথচ সব কিছুই ভুলভাল হয়ে গেল। ঈশ্বরের কাছে মোনালিসার আরোগ্য প্রার্থনা করি। কত মির্যা ও তো এই পৃথিবীতেই হয়েছে। এইডস্ রিসার্চ যেভাবে চলছে তাতে আমার দৃঢ় ভরসা, নতুন সহস্রাব্দের আগেই এইডস্-এর ওষুধ বের করে ফেলব আমরা। প্রতিষেধক, এবং নিরাময়ের ওষুধ, দুই-ই। আমার বিশ্বাস দুহাজার এক দুটি অমূল্য উপহার হাতে করে উপস্থিত হবে। ক্যানসার-কিওর, আর এইডস্-কিওর।
শিলুবাবা, তুমি ভয় পেয়ো না, সময় তোমার স্বপক্ষে আছে। ভাগ্যে থাকলে লিসাকে আমরা হয়তো ধরে রাখতে পারব। তোমার মা এবং আমি আবার বলছি, লিসা আমাদের সংসারে স্বাগত। অসুস্থ লিসাকে আমরা যত্ন করবার দায়িত্ব নিতে রাজি আছি। কাগজে প্রকাশিত চিঠির বাক্য থেকে পিছু হটছি না। দুজনেই এসো। আমরা অবসরপ্রাপ্ত, আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় রয়েছে মনোযোগ দেবার মতন। চিঠিতে আমরা বলেছিলাম এটা লিসারও বাড়ি। এখনও তাই বলছি।
তুমি ঠিকই বলেছ। একটা মাত্র জীবন আমাদের। বড়ই শীগগির ফুরিয়ে যায়। তার মধ্যে যে কটি প্রাণের সঙ্গে সংযোগ সাধন করতে পারি, সেটুকুই লাভ। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে লাভ-ক্ষতির হিসেবগুলো সব পালটে যাচ্ছে। যা বুঝলাম। এই মৃত্যুশাসিত জীবনে ক্ষতি শুধু একটাই। অপ্রেমে। বিচ্ছেদে। ঘৃণায়। মৃত্যু তো আসবেই, তুমি ঠিকই বলেছ। তাকে ভয় পাওয়া অর্থহীন। ভয় যন্ত্রণাকে। দেহের চেয়েও, মনের যন্ত্রণাকে। তুমি অপরের মুখ চেয়ে, সেই যন্ত্রণা লাঘবের কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছ। তোমার মানুষ-জন্ম সার্থক হয়েছে, নিজেকে তুমি আর্তের সেবায় উৎসর্গ করেছ। We are proud of you, my son! এবার লিসার শুশ্রূষার কাজে তুমি আমাদেরও সঙ্গে নাও। মনে রেখো তুমি একাকী নও, তোমরা দুজনে নিঃসঙ্গ নও। We have all the time in the world to look after you two-15773115 7/5 at আমার প্রচুর অবকাশ। কোন কাজে যে লাগব, তাই ভেবে পাই না।
শিলুবাবা, পালিয়ে থেকে লাভ নেই। যা ঘটে গিয়েছে, তা নির্মম বটে, কিন্তু সেটাই বাস্তব। যত কঠোরই হোক সত্যকে তো মেনে নিতেই হবে আমাদের। এখন দেখা দরকার, সেই কঠোর বাস্তব, সেই মর্মান্তিক সত্য থেকে কতটা প্রাণরস নিংড়ে নেওয়া যায়। প্রাণের সম্ভাবনা অশেষ। ইটচাপা পড়া ঘাস দেখেছ? সাদা রং হয়ে যায়, কিন্তু বেঁচে থাকে। ভালোবাসার সম্ভাবনাও অশেষ। মনের বল হারিও না। মনে বল রেখো।
খুকু ছুটি নিচ্ছে তোমার কাছে যাবে বলে। বিশেষত মোনালিসার কাছেই। তার কাছে আমাদের যে গর্হিত অপরাধ হয়ে গেছে, যদি তার আংশিক প্রায়শ্চিত্তও এখন করা সম্ভব হয়! Its never too late. শিলুবাবা, Life has infinite possibilities তাই খুকু যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসতে। ওকে ফিরিয়ে দিও না। মোনালিসাকেও প্রস্তুত করো। ওর মা-কে বুঝিয়ে বলো। মনে মনে তৈরি থেকো, অনেক সমস্যা, অনেক অপমানের, বহু লাঞ্ছনার মধ্যে এসে পড়বে। তবুও ফিরে এসো, যদিও জানি ফিরে এসেও জীবন সহজ হবে না। কঠিন দুরূহ পথ পরিক্রমার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসো। আমরাও থাকব তোমাদের সঙ্গে। আছি। ভরসা রেখো।
মা চিঠি দেবেন দুয়েকদিনের মধ্যেই। তোমার মায়ের মতো নিশ্চয় আরো অজস্র মা বলছেন, ঠাকুর আমার ছেলের রোগটা আমাকে দিয়ে দাও, ছেলেকে সুস্থ করে দাও–সুরমার মতো ঠান্ডা মাথা মেয়েও শেষে লোকনাথ বাবাকে এহেন অন্যায়, মরীয়া অনুরোধ-উপরোধ করছে দেখে চিঠি উত্তরটা আমিই দিয়ে দেওয়া স্থির করলুম। এই চিঠির মনের ভাষাটা কিন্তু আমাদের দুজনেরই। আরও একটা কথা! এতদিন বাদে চিঠি যদি দিলে, সেটা একলা মায়ের নামে? বাবা বাদ? তোমার মা চিঠি পেয়ে খুব যে নিশ্চিন্ত হয়েছেন তা বলতে পারি না। কিন্তু সুষমা, খুকু, এরা দুজনে তোমার মাকে বোঝাচ্ছে যে আরও কত খারাপ খবর হতে পারত। হয়নি, সে শুধু ভগবৎকৃপায়।
মায়ের ও আমার স্নেহাশীর্বাদ নিও। মোনালিসাকেও জানিও। বাড়ি ফেরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নাও। ইতি।
তোমার বাবা চিরশুভার্থী
শ্ৰী আদিত্য রায়।