পারুল বসে আছে পুকুর ঘাটে। তার মন খারাপ। মন খারাপের অবশ্য যথার্থ কারণও রয়েছে। সে তার বাবাকে বলেছিল বিল কুড়ানির হাট থেকে ফেয়ারনেস ক্রিম আনতে। তার বাবা ক্রিম এনেছেনও। কিন্তু পারুল যা আশঙ্কা করেছিল ঘটনা তাই ঘটেছে। তার বাবা এনেছেন নকল ক্রিম। আসল আর নকল ক্রিমের প্যাকেট, ক্রিমের নাম, নামের বানান আর নকশাও প্রায় এক। একটা দুটো অক্ষর শুধু এদিক-সেদিক। তারা বাবা অতশত বোঝেন না। বোঝেন না বলেই পারুল একটা কাগজে স্পষ্ট করে লিখেও দিয়েছিল। কিন্তু সেই কাগজ তার বাবা হারিয়ে ফেলেছেন।
পারুল আব্দুল ফকিরের একমাত্র সন্তান। আব্দুল ফকির বাড়ি ফিরেছেন ভোরের আলো ফোঁটারও অনেক পর। এখন পড়ন্ত বিকেল। কিন্তু সেই সকাল থেকে এখন অবধিও পারুলের মন খারাপ। একটু-আধটু মন খারাপ না। ভয়াবহ রকমের মন খারাপ। মন খারাপের অবশ্য আরো অনেক কারণ রয়েছে। পারুল খেয়াল করে দেখেছে, মন খারাপের কোনো একটা ঘটনা ঘটলে তখন আগের ভুলে যাওয়া মন খারাপরে ঘটনাগুলোও একের পর এক মনে পড়তে থাকে। এই যেমন এখন পুকুর ঘাটে বসে পারুলের অতীতের অনেক মন খারাপের ঘটনা মনে পড়তে শুরু করেছে। সেইসব ঘটনা মনে করে তার গাল বেয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। সে সেই পানি মুছছে না। পানি টপটপ করে ঝরে পড়ছে পুকুরের পানিতে। পারুল সেই পানির দিকে তাকিয়ে নিমগ্ন মনে কাঁদছে। অবশ্য পারুল যে শুধু কাঁদছেই, তাও না। বরং এই ফাঁকে সে পুকুরের শান্ত পানিতে তার নিজের চেহারাটাও ভালো করে দেখে নিচ্ছে। পারুলের এই এক অভ্যাস। সুযোগ পেলেই নিজের চেহারাটা দেখতে তার ভারি ভালো লাগে। কিন্তু পুকুরের পানিতে নিজের চেহারা দেখতে দেখতে পারুল খানিক চিন্তিত হয়ে উঠল। তার হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, সে কি আগের চেয়ে খানিক শুকিয়েছে, নাকি মোটা হয়েছে? তার নাকখানা কি আরো খানিকটা লম্বা হয়েছে? গায়ের রঙ? পারুলের কেন যেন মনে হলো, তার গায়ের রঙটা এ ক’দিনে বেশ ময়লা হয়ে গেছে। কেমন তামাটে হয়ে উঠেছে মুখখানা।
এ ভারি দুশ্চিন্তার কথা। এই অবধি এসে পারুলের দুঃখবোধ আবার গাঢ় হয়ে উঠল। তার হঠাৎ মনে হতে লাগল, এই বছরটা তার জন্য আসলেই অপয়া বছর। না হলে এই বছরেই সবকিছু তার এত খারাপ যাচ্ছে কেন?
তা এই বছরটা পারুলের আসলেই খুব খারাপ যাচ্ছে। এ বছরই সে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করেছে। অথচ তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী লতা পাশ করে গেছে। লতা পাশ করেছে বলে অবশ্য তার খুব একটা আক্ষেপ নেই। তার আক্ষেপ অন্য জায়গায়, লতা পাশ করতে না করতেই লতার প্রেম হয়ে গেছে। ছেলের নাম আশিক। আশিক শহরে থাকে। লতা থাকে তার মামার বাড়ি রায়গঞ্জে। সেখানে কলেজ আছে। সে সেই কলেজে ভর্তি হয়েছে। রায়গঞ্জ বড় নদী বন্দর। সেখানে ইলেক্ট্রিসিটি আছে। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক আছে। এতে অবশ্য লতার সুবিধা হয়েছে। তার একটা মোবাইল ফোনও আছে। সে এসএসসি পাশ করার কারণে তার মামা তাকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লতার প্রেম হয়েছে সেই ফোনে।
পারুলের দুঃখটা এখানেই। লতার প্রেম হয়ে গেল, অথচ কিনা তার প্রেম হলো না। এই দুঃখেই সারাটাক্ষণ তার মন ভার হয়ে থাকে। সে রূপবতী মেয়ে। তার গায়ের রঙ উজ্জ্বল। গ্রামের মেয়েদের তুলনায় সে লম্বাও বেশ। তার চোখ দুটি খুব বড় না হলেও কোষা নাওয়ের মতো অত সরুও নয়। অবশ্য। নাক তার বাঁশির মতো লম্বা নয় বলে তার কিছু আক্ষেপও আছে। সেই আক্ষেপ মেটাতেই সে নিয়ম করে রোজ দু’বেলা তার নাকটি আঙুলে চেপে ধরে টানে। এই টানাটানিতে তার নাক কতটা বড় হয়েছে তা অবশ্য খুব একটা স্পষ্ট নয়, তবে নাকটি যে দিনকে দিন ভারি উঁচু হয়েছে, তা তার হাবভাবে বেশ বোঝা যায়। সে বেশ নাক উঁচু স্বভাবের হয়ে উঠেছে। এর কারণ পথে-ঘাটের ছেলে ছোঁকড়ারা তাকে দেখলেই ছোঁকছোঁক করে, পেছন থেকে শিস কাটে, চিঠিপত্রও দেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লতার শহুরে ছেলের সাথে প্রেম হয়ে যাওয়ার পর থেকেই গাঁয়ের আর কোনো ছেলেকেই পারুলের ভালো লাগে না। সে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। আশেপাশে ছোঁকছোঁক করা ছেলেদের দেখলেই তার গা জ্বলে। অথচ আগে একটা সুন্দর ছেলে দেখলেই কেমন একটা প্রেম প্রেম ভাব। চলে আসত তার। আজকাল আর ভালো লাগে না। পারুলের দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তার একখানা পুরোদস্তুর শহুরে প্রেমিকই চাই।
কিন্তু এই গণ্ডগ্রামে সে শহুরে ছেলে পাবে কই! এই নিয়ে তার বেজায় দুঃখ। সে আসলেই দুর্ভাগা। না হলে তার চেয়ে সে কম কিসে? বরং লতার চেয়ে তার গায়ের রঙ ফর্সা। লম্বায়ও সে লতার চেয়ে ঢের বেশি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার লতার শরীরে মাংস বলতে কিছু নাই, টিনটিনে হাড্ডিসার মেয়ে। মেয়ে মানুষের শরীরে মাংস না থাকলে সে আবার কিসের মেয়ে মানুষ! মেয়ে মানুষ হাড্ডিসার হলে পুরুষ মানুষের কাছে তার আর কদর কীসের! অথচ সেই হাড্ডিসার লতার প্রেম-ভালোবাসা হয়ে গেল শহুরে ছেলের সাথে। আর সে কিনা পড়ে রয়েছে এই গেয়ো ভূতদের মাঝে!
পারুলের বুকের ভেতরটা আবারও হু হু করে উঠল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ আর সে ভাত খাবে না। অবশ্য ভাত না খাওয়ার কারণ যে শুধু ক্রিমের জন্য রাগ, তা-ই নয়। সে তার কাছে শুনেছে, আজকালকার শহুরে ছেলেরা নাকি থলথলে স্বাস্থ্যবতী মেয়েদের পছন্দ করে না, তারা পছন্দ করে হালকা পাতলা শরীরের মেয়েদের। প্রথম প্রথম অবশ্য লতার কথা বিশ্বাস হয়নি পারুলের। সারাজীবন সে গাঁয়ের মা-চাচীদের কাছে শুনে এসেছে, পুরুষ মর্দ মানেই মেয়ে মানুষের মাংস থলথল শরীর পছন্দ। শুধু যে শুনেছে, তাই-ই নয়। আশেপাশে সে দেখেছেও। অথচ সেই দিনের সেই লতা কিনা তাকে কী সব জন্তর-মন্তর শেখাচ্ছে! লতা তার নিজের হাড্ডিসার শরীরের দুঃখেই আবার পারুলকে এইসব কূটমন্ত্র শেখাচ্ছে না তো? নানান ফুসমন্তর দিয়ে তাকে হাড্ডিসার করে তার ক্ষতি করতে চাইছে না তো! এই ভাবনাও পারুলের মনে এসেছে। তবে তার সেই ভাবনা বদলেছে লতার মোবাইল ফোনের কারণে। আজকাল লতা মাসে মাসে যে দুয়েকবার রায়গঞ্জ থেকে হোসনাবাদে আসে, তখন পারুল লতার মোবাইল ফোনে নানান ভিডিও দেখেছে। বেশিরভাগই হিন্দি সিনেমার গানের ভিডিও। সেইসব গানের নায়িকাগুলো দেখতে যে কী সুন্দর! ছিপছিপে শরীরের লম্বা লম্বা মেয়েগুলোকে দেখে তার সেই প্রথম নিজের শরীরটা নিয়ে আক্ষেপ হতে শুরু করল, ইশ! সেও যদি আর খানিকটা পাতলা হতে পারত!
কিন্তু পাতলা সে কী করে হবে! তার বেশি খেয়ে অভ্যাস। খেতে সে ভারি পছন্দ করে। সারাক্ষণ তার মুখে এটা-সেটা লেগেই থাকে। এত খেলে কি আর শুকানো যায়? আজকাল তাই সে নিজেকে বোঝাতেই না খাওয়ার নানান উপলক্ষ খুঁজতে থাকে, অজুহাত তৈরি করতে থাকে। আজ সারাদিন না খাওয়ার ভাবনাও তাই তার তেমনই এক অজুহাত।
পারুল তার পা দু’টি ছড়িয়ে রেখেছে পুকুরের জলে। স্বচ্ছ জলে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট পুঁটি, চাপিলা মাছ। মাছগুলোর ভয়-ডর বলতে কিছু নেই। তারা প্রায়ই পারুলের পা ঠুকরে দিচ্ছে। পারুল মৃদু পা নাড়াতেই অবশ্য চকিত চম্পট। পুকুরের পশ্চিম দিকের চিবিতে এক সারি গাছ। সেই গাছের ফাঁক দিয়ে তেড়ছাভাবে বিকেলের সোনারঙা রোদ এসে পড়েছে পারুলের গায়ে। সেই আলোয় পারুল হঠাৎ খেয়াল করল, এতক্ষণ ধরে জলের ভেতর ডুবে থাকা তার পা-জোড়া কেমন ফর্সা হয়ে উঠেছে। ধবধবে ফর্সা। যদিও খানিকটা ফ্যাকাশে লাগছে। কিন্তু ওই অতিরিক্ত ফর্সা রঙটুকুর কারণেই পারুলের হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেল। অদ্ভুতরকমের ভালো। তার আচমকা মনে হতে লাগল, আচ্ছা, সে যদি আরো খানিকক্ষণ জলের ভেতর তার নিজের পুরো শরীর ডুবিয়ে রাখে, তাহলে কী হবে?
পারুল এক পা দু’পা করে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে জলের ভেতর নামল। গত ক’দিন ধরে আচমকা বৃষ্টি না হওয়ায় গরমও খানিক চড়েছে। আষাঢ় মাসের ভরভরন্ত পুকুর। সেই পুকুরে গলা অবধি গা ডুবিয়ে পারুলের ভারি আরাম বোধ। হলো। সে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় জলের মধ্যে ভেসে রইল। পারুল চোখ খুলল তার বাবা আব্দুল ফকিরের গলা শুনে। সে চোখ মেলে দেখল চারপাশে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে। আব্দুল ফকির মসজিদ থেকে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফিরেছেন। তার মাথায় টুপি, হাতে জায়নামাজ। আব্দুল ফকির আবারও কন্যাকে ডাকলেন, মারে, এই সইন্ধ্যাবেলা সময় ভালো না। এইসময় সেয়ানা মাইয়াগো ঘরের বাইর হইতে হয় না। চুল খোলা রাখতে হয়নারে মা।
পারুল বাবার কথার উত্তর দিলো না। সে আবার চট করে চোখ বন্ধ করে যেমন ছিল তেমন করেই ভেসে রইল। তার মুখভর্তি পানি। আব্দুল ফকির মোলায়েম গলায় বললেন, মারে, তুমি এইরকম কইরো না। ভালো-মন্দ কিছু একটা হইয়া গেলে তখন কানলেও লাভ হইব না রে মা।
পারুল কলকল করে মুখের পানি ছাড়ল। তারপর চোখ বন্ধ রেখেই বলল, কী ভালো-মন্দ হইব আব্বা?
আব্দুল ফকির বললেন, তোমার মায়রে দেখোনা মা? তোমার মায়ও আছিল এই এক তোমার মতো। কোনো কথা শুনত না আমার। হাবড়ে-জাবড়ে যখন তখন ঘুইরা বেড়াইতো। সেই থেইকা এই অবস্থা! কত রকমের খারাপ জিনিস যে মানুষের চোউক্ষের অগোচরে আছেরে মা। মানুষ তো আর সব তার চামড়ার চৌক্ষে দেখে না।
পারুল বলল, আপনে তো দেহেন আব্বা। তা আপনে বলেন তো, এহন এইখানে কতগুলা খারাপ জ্বিন আছে? আমার চেহারা ছবি তো মাশাল্লাহ ভালো। তার উপর ভরা সন্ধ্যায় আমি চুল খুইলা পুষুনিতে ভাসতেছি। আমার চাইরপাশে
তো জ্বীনেগো মেলা বইসা যাওনের কথা আব্বা।
আব্দুল ফকির গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, এইভাবে কথা বলবা না মা। তোমারে উঠতে বলছি, তুমি ওঠো।
পারুল বলল, আপনের এত ডর ক্যান আব্বা? এরা তো আপনের কথায় উঠে বসে। আপনে বইলা দিলেই তো হয়, ওরে বদজ্বীনের দল, আমার কন্যার দিকে চক্ষু তুইল্যা তাকাইবি না। তাইলে কিন্তু ফুঁ দিয়া চক্ষু উপড়াই ফেলব। আপনের না কত ক্ষমতা!
আব্দুল ফকির আর কিছু বললেন না। বলার অবশ্য মানেও হয় না। তিনি জানেন, তার এই কন্যা কারো কথা শোনার মানুষ না। সে নিজে যা ভালো মনে করে, তাই করবে। তারপরও তিনি ফিরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বললেন, ঠান্ডা লাগাইয়া জ্বর বাঁধাইওনা মা। তোমার মায় ঘরে অসুস্থ। তুমিও অসুস্থ হইলে তার দেখাশোনা করব কে!
পারুল তখনই পানি থেকে উঠল না। সে উঠল এশার আজানের পর। আব্দুল ফকির অবশ্য মেয়েকে একা রেখে চলে যান নাই। তিনি বাড়ির ভেতর থেকে একখানা কেরোসিনের কুপি ধরিয়ে এনে এশার আজান অবধি পুকুর পারে বসে রইলেন। এই পুরোটা সময় তিনি মেয়েকে নানান কথাবার্তা, উপদেশ বাণী শোনালেন। যদিও পারুল তার কিছু শুনল কিনা, বোঝা গেল না। এশার আজানের পর পর কথা বলল পারুল। সে বলল, আব্বা, কুপি নিভান।
আব্দুল ফকির বললেন, এই আন্ধারে কুপি নেভাবো কেন মা?
পারুল বলল, আমি এখন উঠব।
আব্দুল ফকির বললেন, মারে, তুমি উঠলে কুপি নিভানো লাগব কেন? আন্ধারে তুমি কীভাবে উঠবা? তাছাড়া এই সময়ে চাইরপাশে কত সাপ খোপ থাকে।
পারুল বলল, আব্বা, মাইয়া মানুষ ভেজা কাপড়ে উঠলে সেইখানে কোনো পুরুষ মানুষের থাকন উচিত না। নিজের বাপ-ভাই হইলেও না। আপনে কুপিটা নিভাই দিলে আমি উঠতে পারি।
লজ্জায় আব্দুল ফকিরের মনে হলো তিনি মাটির নিচে ঢুকে যান। এই মেয়ে এমন সব বিচার-বিবেচনাহীন কথাবার্তা যে বলে! তিনি ফুঁ দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলেন। কিন্তু বাতি নিভিয়েই তার হঠাৎ মনে হলো, এই অন্ধকারে মেয়েটা একা একা উঠবে কী করে! পুকুর ঘাট থেকে বাড়ির পথ সামান্য দূরত্ব হলেও এই অন্ধকারে এইটুকু পথও অনেক। তিনি তো বাতিটা জ্বালিয়ে রেখে নিজেই চলে যেতে পারতেন। আব্দুল ফকির অন্ধকারের ভেতর থেকেই বললেন, মারে, তুমি এই আন্ধারে উইঠো না। আমি বাড়ি থেইকা তাবারনরে বাতি লইয়া পাঠাইতেছি। তুমি ডর পাইও না মা।
আব্দুল ফকিরের চিন্তা নামাজের। এশার আজান হয়েছে অনেকক্ষণ। মসজিদে নামাজ শুরু হয়ে যাবে। তিনি নামাজের সময় মসজিদে না থাকলে বিষয়টা মানুষের চোখে লাগবে। কিন্তু মেয়েকে এভাবে রেখে তিনি নামাজে যেতে পারছেন না। আব্দুল ফকির তাবারনের ঘরে ঢুকলেন। তাবারন এই বাড়িতে কাজ-কর্ম করে। বয়স তিরিশের ঘরে। বিয়েও হয়েছিল দুইবার। কিন্তু ছেলেপুলে হয় না বলে বাজা মেয়ের অপবাদ নিয়ে দু’বারই স্বামী-সংসার ছাড়তে হয়েছে তাকে। গত দু’দিন ধরে তাবারনের জ্বর। এইজন্যই তাবারনকে না। পাঠিয়ে আব্দুল ফকির নিজেই গিয়ে বসেছিলেন মেয়ের কাছে। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। আব্দুল ফকির তাবারনকে বাতি নিয়ে পারুলের কাছে পাঠালেন। পারুল ঘরে ঢুকতে আব্দুল ফকির হন্তদন্ত হয়ে মসজিদের দিকে ছুটলেন।
পারুল অবশ্য রাতে না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা রাখতে পারল না। তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। সে আয়োজন করে ভাত খেতে বসল। কিন্তু ভাত খেতে বসে সে আবিষ্কার করল তার শরীর খারাপ লাগছে। অবশ্য তারপরও সে তার সেই শরীর খারাপ নিয়েই ভাজা মরিচ মাখিয়ে গপগপ করে দুই প্লেট ভাত খেয়ে ফেলল। পারুলের জ্বর আসল গভীর রাতে। জ্বর মানে সাধারণ জ্বর না। একদম উথাল-পাথাল জ্বর। পারুল রাতে ঘুমায় একা। ছোটবেলা থেকেই তার একা ঘুমিয়ে অভ্যাস। কারো সাথে বিছানা ভাগাভাগি করতে সে পারে না। তার মার সাথেও না। অবশ্য জন্মের কয়েক বছর পর থেকেই সে দেখে এসেছে তার মা নুরুন্নাহার অসুস্থ। বেশিরভাগ সময়ই নুরুন্নাহারের ঘর থাকে বন্ধ। নুরুন্নাহার সেই বন্ধ ঘরের দরজায় শব্দ করতে করতে সারাদিন ইনিয়ে-বিনিয়ে সুরে সুরে নানান কথাবার্তা বলেন। তার সেই কথাবার্তার অবশ্য আগামাথা কিছু নেই। তাছাড়া নুরুন্নাহার বেশিরভাগ সময়ই কাউকে চিনতে পারেন না। এমনকি পারুলকেও না। তবে বহু বহু দিন পর মাঝে-মধ্যে তিনি একদম সুস্থ হয়ে ওঠেন। ভালো মানুষের মতো আচরণ করেন। সেদিন তিনি পারুলকে কাছে টেনে নিয়ে পারুলের মাথার চুল আঁচড়ে দেন, চুলে তেল দিয়ে দেন। পারুলের বিয়ে-শাদি নিয়ে নানান কথাবার্তা বলেন। কিন্তু তা ওই বড়জোড় এক-আধ দিন।
মাকে নিয়ে অবশ্য পারুলের আলাদা কোনো অনুভূতি নেই। বরং নুরুন্নাহার তার সুস্থতার সময়টুকুতে পারুলকে যে আদর যত্নটুকু করেন, পারুলের কাছে তাও ভীষণ বিরক্তিকর মনে হয়। এইজন্য সে পারতপক্ষে মায়ের আশেপাশে ভেড়ে না। কিন্তু আজ এই গভীর রাতে পারুলের কী যে হলো! তার হঠাৎ মনে হলো, এই জ্বর শরীর নিয়ে সে যদি এখন তার মায়ের গা ঘেঁষে বসে থাকতে পারত, তাহলে বোধহয় খানিক ভালো লাগত! পারুল বিছানা থেকে উঠল। জ্বরে তার সারা শরীর কাঁপছে। কিন্তু সে সেই কম্পমান শরীর নিয়েই বাতি জ্বালাল। তারপর ঘরের টিনের দেয়াল ধরে ধরে মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। নুরুন্নাহারের ঘরের দরজায় বিশাল তালা ঝুলছে। এই তালার চাবি পারুলের কাছে নেই। কার কাছে আছে তাও পারুল জানে না। সে বুঝতেও পারছে না সে এখন কী করবে? টিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে। তার শরীর কাঁপছে। জ্বরের তোড় বাড়ছে। পারুল নিজের ঘরের দিকে ফিরে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। নুরুন্নাহারের ঘরের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ আসছে। মৃদু শব্দ। সে অতি কষ্টে পা ফেলে ঘরের বন্ধ দরজায় কান পেতে দাঁড়াল। ভেতর থেকে গুনগুন কান্নার মৃদু শব্দ। কিন্তু সেই কান্না জুড়েও নুরুন্নাহার যেন কিছু বলছে। পারুল অবশ্য সেই কান্নার গুনগুনানি থেকে নুরুন্নাহারের বলা কথাগুলোকে আলাদা করতে পারল না। সে কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দীর্ঘ সময়। চারপাশে হারিকেনের আবছা আলো। সেই আলোয় তেরছাভাবে পারুলের বিদঘুঁটে ছায়া পড়েছে উত্তর দিকের দেয়ালে। ছায়াটা থেকে থেকে কাঁপছে। অদ্ভুত এক দৃশ্য। সেই অদ্ভুত দৃশ্যের দিকে তাকিয়েই পারুলের হঠাৎ মনে হলো সে তার মায়ের কান্নার শব্দ থেকে। কিছু একটা যেন আলাদা করতে পারছে। কী সেই কিছু একটা?
পারুল আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। চুপচাপ। নিঃসাড়। সে তার মায়ের সেই গুনগুন কান্নার শব্দ থেকে যা আলাদা করতে পারল, তার নাম একাকিত্ব। পারুল এই অচেনা সময়ের অবাক মুহূর্তে যেন আবিষ্কৃত করে ফেলল তার কাছে এতদিন অনাবিষ্কৃত হয়ে থাকা এক অতি সাধারণ সত্য। তার মা, ওই দরজার ওপাশের অন্ধকারে একা একলা একটা মানুষ, আর সবার মতোই দেখতে, শুনতে। কিন্তু সেই মানুষটা জগতের আর সকল মানুষের কাছ থেকে আলাদা, বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ। এমন করেই রোজ মাঝরাতে তিনি হয়তো কাঁদেন, কিন্তু এই জগতে তার সেই কান্না শোনার কেউ নেই। তার সেই কান্না হয়তো কেউ কোনোদিন শোনেওনি। তার নিজের গর্ভে ধরা সন্তানও না। অথচ সেই সন্তান তার হাত ছোঁয়া দূরত্বে ফড়িঙের মতো ছটফট করে ঘুরে বেড়ায়, পাখির মতো ডানা ঝাঁপটে উড়ে বেড়ায়। অথচ তার মায়ের কান্না শোনার মতো সামান্যতম ফুরসও তার নেই। এই জগতে তার মতো দুর্ভাগা মা আর কে আছে!
পারুল হঠাৎ সেই দরজার পাশে মেঝেতে বসে পড়ল। তার আজ কেন যেন কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে। হাউমাউ করা কান্না। কিন্তু সে কাঁদতে পারল না। আচ্ছা, পারুল কি কখনোই কেঁদেছে?
পারুলের হঠাৎ মনে হলো, এই তো কিছুক্ষণ আগে, আজ সন্ধ্যায়ই সে গাল ভাসিয়ে কেঁদেছে। রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের জন্য কেঁদেছে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তার কেন যেন মনে হলো, সত্যিকার অর্থেই কান্না বলতে যা বোঝায়, তা আসলে ওই কান্না নয়। আসল কান্না মানে অন্য কিছু। অন্যরকম কিছু। সেই অন্যরকম কান্না কি সে কখনো কেঁদেছে? পারুল মনে করতে পারল না, সে তার এই জীবনে কখনো অমন কান্না কেঁদেছে কিনা! সে ঝলমলে হাসিখুশি আনন্দময় এক তরুণী। জগতের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব কারণে তার প্রবল মন খারাপ হয়। সেই মন খারাপ নিয়ে সে কাঁদেও। কিন্তু তার সেই মন খারাপ ভাব বেশিক্ষণ থাকে না। সেই কান্নাও না। সে মুহূর্তকাল পরেই মেতে ওঠে অন্য কিছু নিয়ে।
কিন্তু আজ পারুলের খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অন্যরকম কান্না। পারুল অনেকটা সময় নিয়ে সেই অন্যরকম কান্নার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। কে জানে সে কেন পারল না? হয়তো এই এতদিনেও পারুল কখনো জানত না, জগতের সকল কান্না, কান্না নয়। কিংবা জগতের সকল কান্না এক নয়। কিছু কিছু কান্না থাকে আর সকল কান্নার চেয়ে গভীর, আর সকল কান্নার চেয়ে তীব্র। পারুল এই এতটা কাল সেই কান্নার কথা জানত না বলেই হয়তো সেই কান্নারা প্রবল অভিমানে তার কাছ থেকে লুকিয়ে ছিল দূরে। সযতনে আগলে রেখেছে তাদের বিশুদ্ধতম অশ্রু!
*
ফজু ব্যাপারী দাঁড়িয়ে আছে খাল পাড়।
রেইনট্রি গাছের ডাল ভেঙে সে পড়েছে পানিতে। আষাঢ় মাস। একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে রেইনট্রির পাতায় পানি জমে জমে পাতা ভার হয়ে গেছে। সেই পাতার ওজনে রেইনট্রির ডাল নুয়ে পড়েছে। ফজু ব্যাপারীর স্ত্রী সালেহা ভেবেছিল পাতার এই ওজনে ডাল আপনাআপনি ভেঙে পড়বে। কিন্তু তার ধারণা সত্যি হলো না। দুইদিন কেটে গেলেও ডাল ভেঙে পড়ল না। বরং ডালের অগ্রভাগ নিচু হতে হতে প্রায় মাটি ছুঁয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে ঝুঁকে রইল। সেই ডাল কাটতেই গাছে উঠেছিল ফজু ব্যাপারী। আর আচানক কাণ্ডটি ঘটল তখনই। সে গাছে উঠতেই ডাল ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে। সাথে পড়ল সেও। তাল সামলাতে না পেরে গাছের তলায় খালের পানিতে ছপ করে পড়ল ফজু। সমস্যা হচ্ছে পড়ে তার বাঁ হাত মচকে গেছে। পানিতে পড়লে হাত মচকে যাবার কথা নয়। কিন্তু তার গিয়েছে। হাতখানা মচকালো কী করে? খাল পাড় দাঁড়িয়ে ফজু ব্যাপারী এই কথাই ভাবছিল।
হাত মচকানোর রহস্য উদঘাটিত হলো আরো দু’দিন পর। বৃষ্টি থেমে গেছে। শুধু থেমেই যায়নি, দুদিনের মধ্যেই আকাশ ঝলমল করে রোদও উঠেছে। একটানা বৃষ্টিতে পানি যতটা বেড়েছিল এই দু’দিনে তার সামান্য খানিকটা আবার নেমেও গেছে। ফজু ব্যাপারী মচকানো হাত নিয়েই আজ ভোরবেলা খাল পাড় এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েই তার চক্ষু হঠাৎ আটকে গেল সে সেইদিন গাছ থেকে যেখানে পড়েছিল ঠিক সেইখানে। টানা বৃষ্টিতে খালের পাড় ধ্বসে গেছে। সেই ধ্বসে যাওয়া অংশ এতদিন পানিতে ডুবেছিল। দুদিনের টানা রোদে জায়গাটা আজ আবার সামান্য জেগে উঠেছে। সেই জেগে ওঠা জায়গায় কালচে রূপালি রঙের কিছু একটা ঝিলিক মারছে! ফজু কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হঠাৎ ভোঁ-দৌড়ে নেমে এলো ঢাল বেয়ে। একখানা কলসি! কলসির তিনভাগের দুইভাগ বের হয়ে আছে। বাকি একভাগ এখনো মাটির ভেতর। সেই কলসি দেখে ফজু নড়তে ভুলে গেল। তার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল, এই কলসিখানাই কি সেই কলসি? যেই কলসির কথা। সে জনমভর শুনে এসেছে!
এদিক-সেদিক তাকিয়ে হঠাৎ টুপ করে খালের পানিতে নেমে গেল ফজু ব্যাপারী। খানিক সাঁতার কেটে সে পৌঁছে গেল কলসিটার কাছে। কলসির বেশিরভাগ অংশই মাটির ভেতর থেকে বের হয়ে আছে। পুরু চামড়ার বন্ধনি দিয়ে শক্ত করে কলসির মুখ বাঁধা। কত আগের কলসি কে জানে! চামড়ার বন্ধনিটুকু এখানে সেখানে ক্ষয়ে গেছে, রঙ চটে গেছে। ফজু ডান হাতে কলসির মুখটা চেপে ধরে আলতো করে বার দুয়েক টানল। কিন্তু কলসি নড়ল না। ফজুর ধারণা ছিল, হালকা টানতেই কলসিখানা মাটির ভেতর থেকে বের হয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ঘটলো উল্টো। অনেক চেষ্টা করেও সে কলসিটা মাটির ভেতর থেকে টেনে বের করতে পারল না। ফজুর সমস্যা হচ্ছে তার বা হাত। গাছ থেকে সেদিন পড়ে বাঁ হাত মচকে যাওয়ায় ফজুকে এখন কাজ করতে হচ্ছে এক হাতে। কিন্তু একহাতে সে মাটেই সুবিধা করতে পারছে না।
ফজুর প্রবল দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে কি গিয়ে বাড়ি থেকে কোদাল বা শাবল জাতীয় কিছু নিয়ে আসবে? নাকি তার স্ত্রী সালেহাকে ডাকবে! অবশ্য এতদূর থেকে ডাকলেও সালেহা শুনতে পাবে না। তার চেয়ে ভালো সে যদি বাড়ি গিয়ে শাবল বা কোদাল কিছু নিয়ে আসে। কিন্তু তাতেও ফজুর মন সায় দিচ্ছে না। তার কেবল মনে হচ্ছে, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল! যদিও আশেপাশে কেউ নেই। তারপরও বিপদের তো হাত-পা নেই। দেখা গেল খালের উল্টো পাশের ওই ঘন নলখাগড়ার ঝোঁপ থেকে কেউ বের হয়ে এলো। কোনো গাছের উঁচু ডাল থেকেও কেউ ঠারে-ঠুরে চোখ রেখে থাকতে পারে। এইসব ভেবে ফজুর ভারি দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সাথে প্রবল অস্বস্তিও। যদিও এই ভোর বেলা কারোরই আশেপাশে থাকার কথা না। কিন্তু ফজু সেসব ভেবেও কোনোভাবেই নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছে না। তার বুকের ভেতরটা কেমন আনচান করছে।
কলসিটাকে যতটা সম্ভব পিঠ দিয়ে ঢেকে রেখে দীর্ঘ সময় কোমড় অবধি পানিতে ভেসে রইল ফজু। এই পুরোটা সময় সে তীক্ষ্ণ চোখে বোঝার চেষ্টা করেছে আশেপাশে কেউ রয়েছে কিনা! কিন্তু চারধার নিশ্চুপ। কোথাও একটা পাতার পরার শব্দ অবধিও নেই। ফজু তারপরও আরো কিছু সময় ঘাপটি মেরে বসে থেকে তারপর উঠল। চোখের পলকে দম বন্ধ করে সে দৌড়ে বাড়ি পৌঁছাল। সমস্যা হচ্ছে বাড়িতে গিয়ে সে শাবল বা কোদাল কোনোটাই খুঁজে পেল না। গোয়াল ঘরে রোজ সকালে গরুর গোবর ফেলার একটা ভাঙা কোদাল থাকে, সেই কোদালও কোথাও খুঁজে পেল না ফজু। চিৎকার করে সে তার বউ সালেহাকে ডাকল। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সালেহাও বাড়ির কোথাও নেই। না রান্নাঘরে, না ঘরের পেছনের উঠানে। কোথাও না। ফজুর কেমন শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। বুকের ভেতর ঢোলের বাড়ির মতো ধমধম শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ রান্নাঘরের পাটখড়ির বেড়ার সাথে ঝোলানো কাস্তেখানা চোখে পড়ল তার। সেই কাস্তে খানা তুলে নিয়েই ফজু আবার একদৌড়ে খালপাড় ফিরে এলো। কিন্তু খালপাড় এসেই তার মনে হলো, এক্ষুণি তার দম বন্ধ হয়ে যাবে! বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা এখনই ছিটকে বেরিয়ে আসবে।
একখানা ডিঙি নাও আসছে উত্তর দিক থেকে। সেই ডিঙি নাওয়ের ওপর দাঁড়িয়ে লগিতে নাও ঠেলছে ফতেহপুরের চেয়ারম্যান খবির খাঁর ছেলে মনির। এত দূর থেকে দেখেও মনিরকে চিনতে ভুল হলো না ফজুর। কিন্তু নাওয়ে আরো কেউ একজন আছে। সে নাওয়ের পাটাতনে ঝুঁকে বসে রয়েছে বলে তাকে স্পষ্ট চিনতে পারল না ফজু ব্যাপারী।
ফজু ব্যাপারী হন্তদন্ত হয়ে ঢাল বেয়ে নেমে এলো খালের পানিতে। সে চকিতে তাকিয়ে দেখল, নাহ্, কলসিখানা এখনও ঠিকঠাক আগের জায়গাতেই আছে। কিন্তু তার ভয় মনিরকে নিয়ে। মনির নাও বেয়ে এই দিকেই আসছে। সে যদি কলসিখানা দেখে ফেলে তা হলে আর নিস্তার নেই। অর্ধেক পানিতে ডুবেও ফজু ব্যাপারীর কপালের দুই পাশ বেয়ে দরদর করে ঘাম নামতে লাগল। কী করবে সে এখন?
মনির নাও বেয়ে দ্রুত কাছে চলে আসছে। তার লগির আঘাতে পানিতে তরঙ্গ তৈরি হয়েছে। সেই তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে খালের দু’পাশে সারি সারি লম্বা ঘাসের ঝোঁপের ভেতর। লম্বা ঘাসগুলো ঢেউয়ের তালে তালে কেঁপে উঠছে। সেই কেঁপে কেঁপে ওঠা ঘাসগুলো দেখেই ফজু ব্যাপারীর মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে কলসিটা থেকে হাতখানেক দূরের জলা থেকে ঘ্যাচঘ্যাচ করে কয়েক মুঠো ঘাস কেটে ফেলল। তার মচকে যাওয়া বা হাতখানাতে প্রচণ্ড ব্যথা। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই ব্যথা পাত্তা দিতে চায় না সে। আরো কয়েক মুঠো ঘাস কেটে ঘাসগুলো সে ছড়িয়ে দিলো কলসির ওপরে। পুরোপুরি না হলেও কলসিখানা অনেকটাই ঢেকে রাখা গেছে। এবার মন দিয়ে আরো ঘাস কাটতে শুরু করল ফজু ব্যাপারী।
মনির পৌঁছাল তার প্রায় সাথে সাথেই। সে ফজু ব্যাপারীকে দেখে হাঁক ছেড়ে বলল, কী ফজলু কাকা? এই বেয়ান বেলা খালের মধ্যে ঘাস কাটেন কোন দুঃখে?
ফজু ব্যাপারী বলল, গরু দুইটারে যে চরাইতে কোনখানে নিব, সেই উপায় কি আর আছেরে মনির? ঘাসের জমি তো সব ডুইব্যাই সারা।
মনির বলল, তয় কাকা, পানির ঘাস তো গরুতে খাইতে চায় না। গরু খায় শুকনা মাঠের ঘাস।
ফজু ব্যাপারী শীতে ঠোঁট ফাটা মানুষের মতো হেসে বলল, মোটে চুলায় রান্ধন জোটে না, আবার পান্তা না গরম? আরে ব্যাডা, গরু মরতে আছে না। খাইয়া। এখন ভিজা আর শুকনা ঘাস কি রে? যা দিব তাই খাইব।
মনির বলল, তয় খেয়াল কইরা কাকা। এই কাঁচা ঘাস খাইয়া না আবার গরুর পেট নাইমা যায়!
ফজু ব্যাপারী বলল, তোর খালি অলক্ষইন্যা কথারে মনির। তা এইখানে এই বেয়ান বেলা কী কামে আইছস?
মনির বলল, আপনের বাড়ির পাশের এইখানে খালে এইবার বাইল্যা মাছ পড়ছে ভালো। ইচা মাছেরও দেখি খুব ঝনঝনানি। এইজন্য এইহানে দুইখান বড় চাই পাতছিলাম কাইল রাইতে। এহন আইছি উঠাইতে। দেখি ইছা, বাইল্যা কিছু ধরা পড়ল কিনা!
ফজু ব্যাপারীর বুকখানি আবার ধক করে উঠল, আজ না দম বন্ধ হয়েই সে মারা যায়! মনির নাওখানা থামাল ফজু ব্যাপারীর ঠিক উল্টোদিকে নলখাগড়ার ঝোঁপের ভেতর। লম্বা বাঁশের লগিখানা খালের তলদেশের নরম কাদামাটিতে পুঁতে তার সাথে বেঁধে দিলো ডিঙি নাওখানা। ফজু ব্যাপারী এতক্ষণ চিনতে না পারলেও এবার চিনতে পারল, নাওয়ের মাঝখানে যে বসে রয়েছে, সে নয়ন। খাঁ-বাড়ির নাতি। এই ছোট ডিঙি নাওয়ে বসে থেকে তার অভ্যাস নেই বলেই সে নাওয়ের মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে কুঁজো হয়ে ঝুঁকে বসে রয়েছে।
ফজু ব্যাপারী নয়নকে উদ্দেশ্য করে বলল, কী ভাইগ্না, আছেন কেমন? আপনের শরীল এহন ভালো?
নয়ন মাথা ঝাঁকালো, জ্বী ভালো।
ফজু ব্যাপারী বলল, আপনের মায় কেমন আছে? বহু দিন তারে দেহি না। সে আর আমি কিন্তু এক বয়সী। বুঝছেন ভাইগ্না? কিন্তু আমরা থাকি গাঁও গ্রামে। খাটাখাটনিতে আমাগো শরীল যায় বুড়া হইয়া। বোঝলেন? এইজন্য আমাগো দেখতে বয়স লাগে বেশি।
নয়ন বলল, না না। আপনাকে দেখে তেমন বয়স মনে হয় না।
ফজু ব্যাপারী নয়নের কথা শুনে ফ্যা ফ্যা করে হাসল। তারপর বলল, মাছ ধরা দেখতে আইছেন?
নয়ন বলল, হ্যাঁ।
ফজু ব্যাপারী বলল, দেহেন দেহেন। শহরে থাইক্যা তো গ্রামের এইসকল জিনিস দেখন যায় না। মন ভইরা দেহেন।
নয়ন জবাব দিলো না। তবে মৃদু হাসল। সে তাকিয়ে আছে মনিরের দিকে। মনির গামছা পরে পানিতে নেমে গেল। ফজু ব্যাপারী আবারো বলল, তা ভাইগ্না, আপনে আইছেন তো মেলা দিন। শুনছি আপনে ঢাকায় বড় ডাক্তার, তা এতদিন যে থাকতেছেন, কোনো অসুবিধা হইব না?
নয়ন হাসল। বলল, ভাবছি এইখানেই ডাক্তারি শুরু করে দিব।
ফজু ব্যাপারীও হাসল। বলল, শোনেন ভাইগ্না। গ্রামের মানুষ যহন শহরে যায়, তহন চাইরপাশের যা দেহে, তাই-ই তাদের কাছে মনে হয় কী সুন্দর! কী সুন্দর! মনে হয় সারাটা জীবন এই শহরেই কাটাই দিব। আবার শহরের মানুষ যহন গ্রামে আসে, তারাও ভাবে সারাটা জীবন গ্রামে কাটাই দিব। কী সুন্দর গ্রাম! সবকিছুই তাদের ভালো লাগে। কিন্তু ওই শুকুরে শুকুরে আষ্ট দিন। বোঝলেন বাজান, আষ্ট দিন। তারপর যে যার জায়গায় যাওনের লইগ্যা মাছের মতো তড়পায়।
নয়ন এবারও হাসল। ফজু ব্যাপারীকে তার পছন্দ হয়েছে। লোকটার কথা বলার ধরন ভালো। শুনতে ভালো লাগে। সে বলল, আপনি কথা ঠিক বলেছেন। আমারও ঢাকায় যাওয়ার জন্য অস্থির লাগছে।
মনির গামছা পরে পানিতে নেমেছে। দুই হাতে ঢেউ তুলে পানিতে ভেসে যাওয়া কচুরিপানা সরাল। তারপর ঝুপ শব্দে ডুব দিলো। নয়নকে অবাক করে দিয়ে মনির দীর্ঘ সময় ডুবে থাকল পানিতে। সে যখন উঠল তখন তার হাতে বিশাল আকারের একখানা বাঁশের চাই। চাইভর্তি খলবল করছে বেলে আর চিংড়ি মাছ। মাছ ধরার এ এক অদ্ভুত গ্রাম্য যন্ত্র। এই যন্ত্রে মাছ খুব সহজেই ঢুকতে পারে কিন্তু একবার ঢুকে গেলে আর বের হতে পারে না। নয়ন অবশ্য জানে না, এই যন্ত্রেরর নাম চাই হয়েছে কেন!
মনির দাঁত বের করে হাসল, দেখলেন ম্যাভাই, পুরা খালের কোনো জায়গায় মাছের গন্ধ পর্যন্ত নাই, আর এইহানে এক্কেবারে মাছের খনি।
নয়নও মৃদু হাসল। সে বলল, তা ঠিক। কিন্তু এত মাছ কে খাবেরে মনির?
মনির এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। চাইয়ের ভেতর কলকল করতে থাকা মাছের দিকে তাকিয়ে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। তার জগতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর নেই। সে চাই নিয়ে নাওয়ের কাছে আসলো। তারপর চাইয়ের মুখ খুলে মাছগুলো ঢেলে দিলো নাওয়ের খোলে। ছটছট শব্দে মাছগুলো লাফিয়ে পড়ছে নাওয়ের দুইপাশের পাটাতনের মাঝখানের সামান্য জলভর্তি খোলের ভেতর। ফজু ব্যাপারী সেই দিকে তাকিয়ে বলল, তোর মাছের ভাগ্যখান খুব ভালোরে মনির। এই যে এইহানে আমার ঘরের লগের জায়গায় এত মাছ, কিন্তু দ্যাখ, আমি কিছু জানি না।
মনির হাসল। বলল, যার যা জাননের দরকার সে সেইটাই জানব কাকা। কিন্তু তুমি বেয়ান বেলা কলসি লইয়া ঘাস কাটতে আইছ কেন?
ফজু ব্যাপারীর বুকটা মুহূর্তে ধক করে উঠল। কেউ যেন ধারালো নখের তীক্ষ্ণ থাবায় খপ করে তার কলিজা ধরে টান দিলো। সে সাথে সাথে জবাব দিতে পারল না। মনির বলল, চাচীজান কি আইজকাল আপনেরে দিয়া পানিও নেওয়ায় নাকি কাকা?
ফজু ব্যাপারী ঠিক বুঝতে পারছে না আজ সকাল থেকে তার সাথে কি ঘটছে। মনির কি কলসির বিষয়ে কিছু বুঝতে পেরেছে? নাকি না বুঝেই বলেছে? সে আঁড় চোখে কলসিটা খানিক দেখে নিল। দুই দফা ঘাস দিয়ে ঢেকে দেয়ার পরও কলসির অবয়ব সামান্য বোঝা যাচ্ছে। কিছু ঘাষ পিতলের ওপর থেকে পিছলে সরে গেছে। সেই ফাঁকে কালচে রূপালি কলসির পেটের দিকের কিছুটা চোখে পড়ছে। ফজু ব্যাপারী দ্বিধান্বিত হলেও গলায় খানিকটা জোর ঢেলে বলল, তোর চাচীর বাতের ব্যথাডা আইজকাল বাড়ছে। কাজ-কাম করতে পারে না। গরুর ঘর থেইকা শুরু কইরা রান্ধনের পানি পর্যন্ত সব আমারই করা লাগে।
মনির তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, এই কাজ আপনে এমনে এমনেই করেন ফজু কাকা। আপনের বউ ডরানি নাম কি আর এমনে এমনে হইছে?
ফজু ব্যাপারী বলল, বিয়া-শাদি তো করস নাই। বিয়া-শাদি কর। সুন্দরবনের বাঘও বিলাইর মতো ম্যাও ম্যাও শুরু করে।
মনির মাছ ঢালা শেষ করে চাইখানা হাতে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল। ডুব দেওয়ার আগে সে ফজু ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে বলল, তৈয়ব উদ্দিন খাঁর নাতী আমরা ফজু কাকা। ভুইলা গেলে চলব কেমনে? খ-বাড়ির পোলা।
মনির কথা শেষ করে কেমন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। তারপর আবার বলল, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ লোক হিসাবে কেমন এইটা আর কেউ না জানলেও আপনের তো জাননের কথা কাকা। আপনে তো বজলু ব্যাপারীরই পোলা। আপনে ভুইলা গেলে হইব? মনে রাখতে হইব না? আমাগো শরীলে তার রক্ত।
ফজু ব্যাপারী কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মনির আবারো ঝুপ শব্দে ডুবে গেল পানির তলায়। নয়ন এতক্ষণ কথা বলেনি। সে নাওয়ের খোলের ভেতর বৃষ্টির ফোঁটার মতো ফুটতে থাকা মাছের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মনিরের কথাখানি খট করে তার কানে বিধে গেল, আপনে তো বজলু ব্যাপারীরই পোলা।
এই ফজু ব্যাপারীই তাহলে বজলু ব্যাপারীর ছেলে। যাকে ভুল করে আব্দুল ফকির ভেবে খুন করেছিল তার নানা তৈয়ব উদ্দিন খাঁ! বাকিটা সময় নয়ন আর কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারল না। সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফজু ব্যাপারীর দিকে। ফজু ব্যাপারী তখন একমনে ঘাস কেটে যাচ্ছে। সে ঘাস কেটে স্তূপ করে রাখছে তার পাশেই। নয়নের খুব ইচ্ছে করছিল ফজু ব্যাপারীর থে কথা বলতে। কিন্তু কী ভেবে সে আর কথা বলল না। কথা বলল না ফজু ব্যাপারীও। যেন মনিরের শেষ কথাগুলো তাকে মুহূর্তের মধ্যে জগতের আর সকল ভাবনা থেকে স্তব্ধ করেছে। মনির অবশ্য এসব কিছু খেয়াল করল না। সে মাথা মুছতে মুছতে নাওয়ে উঠল। লগিখানা টেনে তুলে নাও ছাড়ল।
ফজু ব্যাপারী বাড়ি ফিরল তারও খানিক পর। সালেহা তখনও ঘরে ফেরেনি। সে ঘরে ফিরে কলসিখানা চৌকির তলায় অবহেলা ভরে রেখে দিলো। এতক্ষণ যে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে সে কলসিখানার জন্য উন্মুখ হয়েছিল, সেই উত্তেজনা যেন অনেকটাই মিইয়ে গেছে। সে এই অবেলায় টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। তার পা-ভর্তি কাদা। শরীর পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। কিন্তু সেসবের কিছুই তার মাথায় নেই। তার চোখে তখন ভাসছে আজ থেকে প্রায় বছর পঁচিশেক আগের এক তুমুল বর্ষার থৈ থৈ দিন। সেই থৈ থৈ বর্ষায় তার বাবা বজলু ব্যাপারীর দেহবিহীন মাথাখানা পড়ে ছিল নদীর ধারে বটতলায় একখানা হোগলা পাতার মাদুরের ওপর। সেই মাথা ঘিরে মাছি ভন ভন করছে। বোকাসোকা কিসিমের কিশোর ফজু গভীর আগ্রহ নিয়ে বাবার কাটা মাথার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা বড় মাছি টুপ করে বাবার মুখের ভেতর ঢুকে গেল। ফজু প্রবল দুশ্চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে আছে সেই মুখের দিকে, মাছিটা বের হতে পারবে তো! নাকি মাছিসহ তার বাবার মাথা কবর দিয়ে দেয়া হবে?
তার বাবার শরীর রয়ে গেছে হোসনাবাদে আব্দুল ফকিরের বাড়িতে। সেই মুণ্ডুবিহীন শরীর আনতে দলবল নিয়ে হোসনাবাদ গেছে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ডান হাত হায়দার আলী। থানা-পুলিশ জানাজানি হওয়ার আগেই এই মাথা কবর দিতে হবে। কিন্তু কবর দেয়ার আগে মাথার সাথে শরীর দরকার। তারা গেছে। সেই শরীর আনতে। পনেরো-ষোলো বছরের কিশোরের তার বাবার এমন নৃশংস মৃত্যু না বোঝার কথা নয়। তার চিৎকার করে কাঁদার কথা। একটি মানুষের শরীরবিহীন মাথা দেখে আতঙ্কে মূৰ্ছা যাওয়ার কথা। কিন্তু সে তার কিছুই করল না। সেই দিন ফজুর কিছু একটা হয়েছিল। সে সেই সারাটা দিন। নদীর ধারে বসে রইল। একফোঁটা কাঁদল না অবধি। কিন্তু সেখান থেকে কেউ তাকে এক মুহূর্তের জন্য সরাতেও পারল না।
একের পর এক চোখের সামনে এইসব ভেসে উঠছিল ফজু ব্যাপারীর। তার মধ্যেই খানিক তন্দ্রামতো লেগে এসেছিল। কিন্তু সালেহার ডাকাডাকিতে তন্দ্রা ভাঙল তার। অবেলায় কাদাপানি মেখে বিছানায় শুয়ে থাকার কারণে সালেহা তার স্বরে একচোট গালমন্দও করল। কিন্তু ফজুর টকটকে লাল চোখ দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। আরো ভয় পেলো ফজু যখন হড়বড় করে বমি করে ফেলল। রাত নামতে না নামতেই ফজুর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর নামল। সেই জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে শুরু করল সে। আতঙ্কিত সালেহা স্বামীর মাথায় পানি ঢালতে গিয়ে আবিষ্কার করল চৌকির তলায় একখানা কলস। সেই কলসিখানার মুখ বাঁধা। সালেহার মাথায় তখন কোনো চিন্তাই কাজ করছিল না। সে সেই কলসি টেনে নিতে গিয়ে দেখল কলসিখানা অসম্ভব ভারী। কলসির মুখ যখন সে খুলল, তখন তার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছিল একখানা সোনার হার। সে হারখানা বের করল। এই জীবনে এমন একখানা সোনার হার পরার সৌভাগ্য তার কস্মিনকালেও হয়নি। সে কলসিখানা মেঝেতে উপুড় করে ধরল। ভেতর থেকে ঝনঝন করে বের হতে থাকল একের পর এক গহনা। মাঝরাতের সেই গভীর নৈঃশব্দ্যে, অসুস্থ স্বামীকে পাশে নিয়ে সালেহা ঘঘারগ্রস্তের মতো বসে রইল। তার সামনে স্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে এক কলসি সোনার গহনা!
*
পারুলের জ্বর সেরেছে সাত দিন বাদে। এই সাতদিনে তার চোখ বসে গেছে। গাল ভেঙে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে তার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই মন খারাপ ভাব খুব বেশিক্ষণ থাকেনি। বরং কিছুক্ষণ বাদেই তার মন ভালো হতে শুরু করেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেলেও নিজেকে তার সুন্দর লাগছিল। মনে হচ্ছিল তার চোখ মুখ জুড়ে একটা মায়া মায়া ভাব চলে এসেছে। যেন চোখভর্তি করে সে কাজল পরেছে। এ ক’দিনে সে খানিক শুকিয়েছেও। এই শুকিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। এমন কয়েকবার জ্বর হলে বিষয়টা তো মন্দ হয় না! শরীর দুর্বল হলেও পারুলের নিজেকে কেমন পাখির পালকের মতো ফুরফুরে লাগতে লাগল। সে দুপুরের আগে আগে সময় নিয়ে গোসল করল। এই সময়টা জ্বরজারির সময়। চারধারে সকলেরই জ্বর ঠান্ডা লেগেই আছে। ক’দিন আগেই তাবারন ভয়াবহ জ্বর থেকে উঠেছে। সে এসে পারুলকে বার দুই ডেকেও গিয়েছিল, কিন্তু পারুল তখনই পুকুর থেকে উঠল না। সে উঠল আরো কিছু সময় পর। তারপর যত্ন করে মাথা মুছল। চুল আঁচড়ালো। কপালে টিপ দিলো। পাটভাঙা কমলা রঙের একখানা শাড়ি পরল। তারপর আয়নার সামনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইল এবং নিজেকে দেখে তার মন ভালো হয়ে গেল। সে গুনগুন করে গানও গাইল কিছুক্ষণ। যদিও দুপুরে খেতে গিয়ে সবকিছুই ভারি বিস্বাদ লাগল পারুলের। কিছুই খেতে পারল না সে। তার কেবল মনে হচ্ছিল দু’খানা ঝাঁঝালো মরিচ আর কাঁচা আমের খানিক টক ডাল হলে সে পেটপুরে ভাত খেতে পারত। মুখটা কেমন টক-ঝাল তেষ্টায় মুখিয়ে আছে। কিন্তু এই অসময়ে কাঁচা আম সে কই পাবে? অবশ্য চালতা হলেও মন্দ হতো না। ডালের ভেতর নুন-মরিচে সেদ্ধ হওয়া দু’ফালি চালতা পাতে পেলে হয়তো আশ মিটিয়ে ভাত খাওয়া যেত।
পুকুর ধারের বাগানে একখানা চালতা গাছ রয়েছে। যদিও সেটাতে অনেকদিন আর চালতা ধরে না। কালেভদ্রে যাও দুয়েকখানা দেখা যায়, তাও পোকামাকড়ে ভর্তি। পারুল তারপরও ঘর থেকে বেরুল। বাইরে মেঘ-রোদের খেলা। ফুরফুর করে মৃদু হাওয়াও বইছে। পারুল ধীর পায়ে হেঁটে পুকুর পারে চলে এলো। উত্তর দিকের ঢিবির উপর সামান্য কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা কদম গাছ। গাছভর্তি শুভ্র-হলুদ কদম ফুল। সেই কদম ফুল দেখে পারুল মুগ্ধ হয়ে গেল। বিষয়টা এমন না যে সে আজই প্রথম কদম ফুল দেখছে, কিন্তু আজ কোনো কারণে সবকিছুতেই সে মুগ্ধ হচ্ছে। এমন হয়, প্রকৃতি কখনো কখনো মানুষকে প্রবল মুগ্ধতাভাবে আচ্ছন্ন করে। সে যা দেখে, তাই তাকে মুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখে। আবার কখনো কখনো তাকে করে তোলে জগৎ সংসারের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত। সে যা দেখে, তাই তাকে করে ফেলে চূড়ান্ত বিরক্ত। পারুলের আজ মুগ্ধ হবার সময়। সে যা দেখছে তাতেই সে মুগ্ধ হচ্ছে।
টানা বর্ষায় পুকুরের ঢিবি ছুঁইছুঁই হয়ে উঠে এসেছে বিলের পানি। সেখানে কচি ধানের সবুজ ডগা ফুরফুরে হাওয়ায় কাঁপছে। একটা মাছরাঙা ঝপ করে পানিতে ঠোঁট ডুবিয়ে ফুড়ুৎ উড়ে গেল। তার ঠোঁট ডোবানো জলে ঢেউয়ের ছোট্ট বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বৃত্তটা ক্রমশই ছাড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। কাছেই কোথাও বউ কথা কও ডাকছে। একটা কাঠঠোকরাও ঠুক ঠুক শব্দে কাঠ ঠুকছে। বাঁশের পাতায় শিস কেটে যাচ্ছে হাওয়া। কী শান্ত, স্নিগ্ধ সময়! পারুল ক্রমশই অবাক মুগ্ধতায় ডুবে যাচ্ছিল।
পারুলের মুগ্ধতায় ছেদ টানল জুলফিকার। পারুল টেরও পায়নি সে কখন তার পিছে এসে দাঁড়িয়েছে। জুলফিকার বার দুই গলা খাকড়ি দিয়ে পারুলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। তারপর বলল, তুমি এইহানে পারুল? আর তোমারে আমি সারা বাড়ি খুঁইজা পেরেশান!
পারুল ঝট করে মুখ তুলে তাকাল। এই মানুষটাকে দেখলেই রাগে তার গা ঝিমঝিম করে। তার মনে হচ্ছিল সে জুলফিকারকে কড়া গলায় কিছু বলে। কিন্তু সে কিছুই বলল না। এই চমৎকার সময় আর অনুভূতিটা তার নষ্ট করতে ইচ্ছে করছিল না।
জুলফিকার বলল, তুমি নাকি ভাত খাও নাই? কাকুজান বড় পেরেশানিতে আছেন। তিনি আমারে বলছেন তোমার খোঁজ-খবর নিতে। এতদিনের জ্বর, এহন প্যাট ভইরা ভাত না খাইলে কি চলব? শরীলের কী অবস্থা দেখছ?
পারুল কঠিন গলায় বলল, বুঝি নাই?
জুলফিকার বলল, কী সোন্দর শরীল স্বাস্থ্য আছিল তোমার। এই কয়দিনের জ্বরে পাটকাঠির লাহান হইয়া গেছে। ব্লাউজ পরছ, সেই ব্লাউজ হইছে ঢিলা। মনে হইতেছে তোমার মাপের না, অন্য কারো ব্লাউজ পরছ। এইজন্য ব্লাউজ হইছে ঢলঢলা।
পারুলের হঠাৎ কী হলো! সে চট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর দুই কদম আগে বেড়ে বলল, আপনে আমার ব্লাউজের মাপ নিতে আইছেন? কোন সাইজের ব্লাউজ আমি পরি, এইটা জানন খুব দরকার আপনের? কী, ব্লাউজ খুলব? ব্লাউজ খুইলা আপনেরে আমি ব্লাউজের মাপ দিব?
জুলফিকার পারুলের উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। সে পারুলকে পছন্দ করে। বেশ ভালোই পছন্দ করে। কিন্তু এই মেয়েকে সে কখনোই বুঝে উঠতে পারে না। সে কখন কোন মেজাজে থাকে সেটা বোঝা বড় মুশকিল। তার এই আগুন তো, এই পানি অবস্থা! সে মিনমিন করে বলল, ছি ছি, তুমি এইটা কী বলো পারুল! এই কথা মাইনষে শুনলে কী বলব?
পারুল বলল, আহারে আমার লজ্জাবতী লতা। শরমে এক্কেবারে চোখমুখ টকটকা লাল হইয়া গেছে, না? মাইনষেরে খুব ডর? আব্বারে বলব? আমি গোসলে আইলে যে আপনে নানান ছুতায় পুস্কুনির ঘাটে আসেন? কে জানে, কোনো গাছের, ঝোঁপঝাড়ের ফাঁকফোকড়ে লুকাইয়া থাকেন কিনা? বলব আব্বারে?
জুলফিকারের মাথা কাজ করছে না। সে এমন কী করেছে, কী বলেছে যে পারুল এমন ক্ষেপে গেল? জুলফিকারের চুলের গোড়া বেয়ে দরদর করে ঘাম নামছে। এই এক অদ্ভুত ব্যাপার! জগতের আর সকলের কাছে সে শক্ত সমর্থ বুদ্ধিমান মানুষ। ভরা মজলিশেও সে নানান কথাবার্তা ফটফট করে বলে ফেলতে পারে। কিন্তু এই একরত্তি মেয়ের কাছে আসলেই তার জিভ জড়িয়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়, কথা এলোমেলো হয়ে যায়।
পারুল বলল, চলেন আব্বার কাছে যাই। আব্বার কাছে গিয়া বলি আপনে আমার ব্লাউজের মাপ চাইছেন।
জুলফিকার ঝপ করে পারুলের পায়ের কাছে বসে পড়ল। তারপর দু’হাতে পারুলের পা জড়িয়ে ধরে করুণ গলায় বলল, আমি দোষ মনে কিছু বলি নাই পারুল। তারপরও আমার ভুল হইয়া গেছে, আমারে তুমি মাফ কইরা দাও।
পারুল নির্বিকার গলায় বলল, আপনে জোয়ান পুরুষ পোলা। সেয়ানা মাইয়ার ব্লাউজের মাপ খোঁজবেন, এইটাই তো স্বভাবিক ঘটনা। এতে দোষের কি আছে? চলেন আব্বার কাছে যাই।
জুলফিকার এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কাকুজান আমারে আস্তা রাখব না পারুল। আমারে সে জ্যাতা মাটিতে পুইত্যা ফালাইব।
পারুল বলল, ভালোই তো। তারপর আপনের শেকড় বাকড় গজাইব। আমার আব্বা বিশাল পীর ফকির মানুষ। দেখা গেল তার কেরামতিতে আপনার গাছে ফল পাকড় ধরতে থাকল।
জুলফিকার অসহায় চোখে পারুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। পারুলের মুখ অবশ্য ভাবলেশহীন। সে জুলফিকারকে বলল, চলেন। আব্বার কাছে যাই। গিয়া দেখি আপনেরে কেমনে সে জ্যাতা পুইত্যা ফালায়। জ্যাতা পুইত্যা ফেলানোর ঘটনা অনেক শুনছি। কিন্তু চোখে দেখি নাই। আইজ নিজ চোখে আরাম কইরা দেখব। খবরদার, আপনে কিন্তু তহন আবার এমনে মাইয়া মাইনষের মতো কইরা কান্দা কাটি করবেন না।
.
আব্দুল ফকির বসে আছেন উঠানে। তার হাত-পায়ে তেল মালিশ করছে রতন। রতন সেদিনের সেই সাপের বীণ বাজানো কিশোর। সে তেল মালিশ করতে করতে আব্দুল ফকিরকে বলল, দাদাজান, আমারে আসল মন্তর শিখাইবেন না? আমার গোক্ষুর সাপ ধরনের বড় শখ।
আব্দুল ফকির বললেন, তাড়াহুড়া করন যাইব না রে রতন। এইগুলান হইল সাধনার ব্যাপার। সাধনার বিষয়ে তাড়াহুড়া করলে সাধনা হয় না।
রতন কথা বলল না। সে একমনে আব্দুল ফকিরের পায়ে তেল মালিশ করছে। তেল মালিশ শেষ হলেই আব্দুল ফকির গোসলে যাবেন। সাধারণত এত বেলা করে তিনি গোসল করেন না। তিনি গোসল করেন রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেই। কিন্তু বহুবছর বাদে আজ তিনি ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারেননি। চারধারে বর্ষার পানি উঠে গেছে। এই পানির কারণেই সকলের জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি লাগছে। গোসলের আগে তাই সারা শরীর জুড়ে খানিক সরিষা তেলের মালিশ খুব উপকারি। ঠান্ডাটা জেঁকে ধরতে পারে না।
আব্দুল ফকির পারুলকে দেখে বললেন, মারে তাবারন বলল, দুপুরেও নাকি ভাত খাও নাই? নিজের মুখের দিকে চাইয়া দেখছ? কী সোনার বরন মুখোন কী হইছে?
পারুল হাসল। বলল, আব্বা, জ্বর হইছে। জ্বর তো আর এমনে এমনে যাইব না। যাওনের আগে তার ক্ষমতা একটু আধটু না দেখাইয়া গেলে কেমনে হইব?
আব্দুল ফকির বললেন, কথা সত্য। তয় মা, এই জন্যই তো একটু খানা খাদ্য খাইতে হইব। শরীলের যত্ন করতে হইব।
পারুল বলল, যার মা নাই, তার আবার যত্ন-আত্মি কী আব্বা?
আব্দুল ফকির বললেন, তোমার মা নাই কে বলল?
পারুল আবারো হাসল। তারপর বলল, আপনের কি ধারণা, আমার মা আছে?
আব্দুল ফকির বুঝতে পারছেন, পারুলের মনে কিছু একটা চলছে। কিন্তু কী চলছে তা তিনি ধরতে পারছেন না। তবে পারুল যে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। তিনি বললেন, তোমার মা আল্লাহর রহমতে সুস্থ হইয়া যাইব। তার আগে তোমারও তো সুস্থ থাকতে হইব মা। তুমি সুস্থ না থাকলে তোমার মা’র যত্ন করব কে?
পারুল এই বিষয়ে কোনো কথা বলল না। সে খানিক সরে গিয়ে জুলফিকারের পাশে দাঁড়াল। জুলফিকার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেও কিছুই বুঝতে পারছে না। পারুল হঠাৎ বলল, আপনের সাথে আমার একখান কথা আছে আব্বা। জরুরি কথা।
আব্দুল ফকির মুহূর্তে সতর্ক হয়ে উঠলেন। এই মেয়েকে নিয়েই তার যাবতীয় উৎকণ্ঠা। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পারুলের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, বলো মা।
পারুল বলল, কথাখান জুলফিকার ভাইয়ের বিষয়ে। আমি অনেকদিন থেইকাই ভাবছি কথাখান আপনেরে বলন দরকার। কিন্তু আপনে আবার কিনা কি মনে করেন, এই জন্য আর বলা হয় নাই। কিন্তু আজকে আর না বইলা পারতেছি না।
জুলফিকারের হৃদস্পন্দন যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। ঘটনা শোনার পর আব্দুল ফকির কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, সেই কথা চিন্তা করে তার হাত-পাও অবশ হয়ে আসছে। সে শেষ চেষ্টা হিসেবে গলায় সামান্য জোর ঢেলে কিছু। বলার চেষ্টা করল, পারুল… আমার কথাখান শোন… আমি…
পারুল অবশ্য জুলফিকারকে কথা শেষ করতে দিলো না। সে আচমকা গলা চড়িয়ে বলল, আপনে চুপ থাকেন। যা বলার আমারে বলতে দেন।
দমকা হাওয়ায় নিভে যাওয়া বাতির মতো দপ করে নিভে গেল। জুলফিকার। আব্দুল ফকির অবশ্য কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন পারুলের দিকে। পারুল ধীর স্থির গলায় বলল, জুলফিকার ভাইর বিয়ার বয়স হইছে অনেক আগেই। তারে একখান বিয়া দেওন জরুরি আব্বা।
পারুলের কাছ থেকে এই ধরনের কথা আব্দুল ফকির আশা করেননি। ফলে তিনি খানিক বিভ্রান্ত বোধ করছেন। যদিও তিনি তা তার মুখভঙ্গিতে প্রকাশ করলেন না। কেবল মৃদুকণ্ঠে বললেন, কেন? হঠাৎ এই কথা কেন?
জুলফিকারের মাথা কান ঝা ঝা করছে। সে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে এর পরের কথাটি কী হবে! আব্দুল ফকিরের প্রশ্নের জবাবে পারুল এখন তাকে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি তার নিজের মতো করে বানিয়ে বলবে। কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে? জুলফিকারের চিন্তাশক্তি কাজ করছে না। সে উভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইল। এখন আর তাকে এর থেকে রক্ষা করার কেউ। নেই।
পারুল বলল, আব্বা, আপনের ঘরে সেয়ানা মাইয়া। এই বয়সে সব বাপ মা-ই তার মাইয়ার বিয়ার জন্য ছেলে দেখে। আমার তো মা থাইকাও নাই। এখন এই দায়িত্ব তো আপনের। আমারেও তো আপনের বিয়া দিতে হইব। হইব না? আবার জুলফিকার ভাইরও বিয়ার বয়স অনেক আগেই হইয়া গেছে। তো এহন তো দুইজনেরই বিয়া দেওন দরকার। দরকার না?
আব্দুল ফকির রীতিমতো ধাক্কা খেলেন। পারুল কি জুলফিকারকে বিয়ে করার কথা বলছে? জুলফিকারের ঘোর এখনও কাটছে না। পারুল এইসব কী বলছে! সে কি সত্যিসত্যি তাকে বিয়ে করবে? জুলফিকারের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। এই ঘটনা সত্য না। খানিক বাদেই এই স্বপ্ন তার ভেঙে যাবে। সে দেখবে সে তার ছোট্ট ঘরের ময়লা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। পারুলকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। কিন্তু সচেতনভাবে এই কথা সে নিজেকেও কখনো বলার সাহস পায়নি। আর পারুলের আচার-আচরণেও কখনো সে এই বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পায়নি। পারুলের চেয়ে বয়সে সে ঢের বড়। তাছাড়া এই বাড়িতে সে অনেকটাই আশ্রিতের মতো। সেই ছোটবেলা থেকেই সে আব্দুল ফকিরের ফুটফরমায়েশ খাটে। আব্দুল ফকিরই তার ভালোমন্দ দেখেন। কিন্তু পারুলের সাথে বিয়ে? এটা অসম্ভব। কিন্তু পারুল এটি কী বলল? জুলফিকার তার নিজের অনুভূতি ধরতে পারছে না। ভালো-মন্দ কিছুই না। তার নিজেকে পুরোপুরি অসাড় মনে হচ্ছে।
আব্দুল ফকির চাপা গলায় বললেন, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না মা।
পারুল বলল, আমার আর জুলফিকার ভাইর বিয়ার ব্যবস্থা করেন আব্বা।
আব্দুল ফকির এবার যেন খানিক ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি সচরাচর পারুলকে নাম ধরে ডাকেন না। কিন্তু এইবার ডাকলেন। তিনি শক্ত গলায় বললেন, পারুল!
পারুল অবশ্য তার বাবার কথা গ্রাহ্য করল না। সে আবারও নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আমাদের দুইজনের বিয়ার ব্যবস্থা করেন। আমার জন্য ছেলে দেখেন। জুলফিকার ভাইর জন্যও মাইয়া দেখেন। আমি মাইয়া মানুষ। মাইয়া মানুষ বিয়ার পর শ্বশুর বাড়ি চইলা যায়, এইটাই নিয়ম। আমিও চইলা যাব। তখন আপনে থাকবেন একলা। আর আমার মায়ও অসুস্থ। তখন তাবারন খালায় একলা সব সামলাইতে পারব না। এইজন্য একটা ভালো মাইয়া দেইখ্যা জুলফিকার ভাইরেও একখান বিয়া করাই দেন। তার বউ থাকব এই বাড়িতে। সে আর তার বউ এই দুইজনে মিল্যা ঘর সংসার সব সামলাইয়া রাখব।
পারুল কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না। আব্দুল ফকিরের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এই মেয়েকে নিয়ে তিনি আর পারেন না। একে বোঝার সাধ্য তার নেই। এই অতি সামান্য এক কথা বলতে গিয়ে কী ভয়াবহ পরিস্থিতিই না সে তৈরি করল! রীতিমত আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল সে আব্দুল ফকিরকে। তার মনের ওপর দিয়ে একটা বড়সড় ঝড়ই যেন বয়ে গেল।
জুলফিকারের অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। তার নিজেকে এখন মনে হচ্ছে ঘুমের ঘঘারে বোবায় ধরা এক মানুষ। খানিক আগ থেকে একের পর এক যা ঘটছে, তার সবকিছুই সে দেখছে, শুনছে, অনুভব করছে, কিন্তু কোনো কিছুর ওপরই তার বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই। সে যেন এক খেলনা। পারুল তাকে নিয়ে ইচ্ছে মতো খেলছে। এই অনুভূতিটা বড় অসহায়ত্বের।
পারুল অবশ্য কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এলো। তারপর আব্দুল ফকিরের উদ্দেশ্যে বলল, আমার জন্য গাঁও-গ্রামের ছেলে দেখবেন না আব্বা। ছেলে দেখবেন টাউনের। আমার টাউনের ছেলে বিয়া করনের খুব শখ। টাউনের ছেলে বিয়া কইরা আমি টাউনে গিয়া থাকব। এই পঁচা কাদা পানির গাঁও-গ্রাম আমার ভালো লাগে না।
আব্দুল ফকির কোনো কথা বললেন না। তিনি শূন্য চোখে পারুলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পারুল অবশ্য কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না। আব্দুল ফকির বসে রইলেন যেমন ছিলেন তেমনই। তার সামনে পাথরের ভাস্কর্যের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব, বিধ্বস্ত জুলফিকার।
.
সেই দিন পারুল আর ঘর থেকে বেরুল না। ঘর অন্ধকার করে বসে রইল। বিকেলের দিকে আব্দুল ফকির কোথা থেকে ব্যাগভর্তি করে আমড়া নিয়ে আসলেন। সাথে ঝাল-মরিচের নুন। বাড়ির পেছনের বাগান থেকে দুখানা বড় জাম্বুরাও পারলেন। তাবারনকে বললেন সেসব কেটে পারুলকে দিতে। কিন্তু প্লেটভর্তি আমড়া নিয়ে পারুলের ঘরে গিয়ে তাবারন দেখল পারুল ঘুমিয়ে আছে। সে বারকয়েক ডাকল। কিন্তু পারুল উঠল না। এশার নামাজ শেষ করে আব্দুল ফকির ঘরে ফিরলেন। তিনি পারুলকে রাতের খাবার খেতে ডাকলেন। কিন্তু পারুলের তাতেও নড়চর নেই। পারুল সে রাতে আর জাগলই না। সে ঘুম থেকে উঠল পরদিন ভোরে। তার পেটে তখন রাজ্যের ক্ষিদে। ঝাঁঝালো পেঁয়াজ আর শুকনো ঝাল মরিচ ডলে প্লেটভর্তি পান্তা ভাত খেয়ে ফেলল সে। ঝালে তার জিভ মুখ পুড়ে যাচ্ছিল। চোখে পানি চলে এসেছে। তারপরও পারুলের মনে হচ্ছিল বহুকাল পরে সে তৃপ্তি করে কিছু খেয়েছে। শরীরে যেন শক্তি পাচ্ছে। খানিকটা রোদ চরতে সে নুরুন্নাহারের ঘরের সামনে গেল। ঘরের দরজায় তালা নেই। তবে দরজার পাল্লা বাইরে থেকে বন্ধ। সে দরজায় কান পেতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। আলতো হাতে দরজার পাল্লা খুলে সে ভেতরে ঢুকল। এই ঘরে কোনো জানালা নেই। কোনো হারিকেন বা কেরোসিনের কুপিও নেই। তাও টিনের ঘরের ফাঁকফোকড় দিয়ে ভোরের আলো আসছে। দরজা খুলে দেওয়ায় ঝট করে যেন এক ঝলক বাড়তি আলোও ঢুকে পড়ল ঘরে। সেই আলোয় পারুল তার মায়ের মুখখানা স্পষ্ট দেখল। দরজার ঠিক উল্টোদিকের টিনের বেড়ার গা ঘেঁষে যে চৌকিখানা রাখা, তার ঠিক নিচে মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন তার মা। পরনে নোংরা তেল চিটচিটে পেটিকোট আর ব্লাউজ। চোখের কোলে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ। পারুল খানিকটা সামনে এগুতেই বিদঘুঁটে কিছুর বোটকা গন্ধ যেন দমকা হাওয়ার মতো ভক করে এসে তার নাকে বাড়ি মারল। পারুল অবশ্য সেই গন্ধ পাত্তা দিলো না। সে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে তার মায়ের পাশে বসল। বসেই। রইল। দীর্ঘ সময়। নুরুন্নাহার ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি। এই জগৎ সংসারের কোথাও আছেন। যেন অন্য কোনো জগতে তিনি নিবিষ্ট মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তার অপাংক্তেয় শরীরখানা কেবল অনাদরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে এই পুঁতিগন্ধময় পৃথিবীতে।
পারুল সেই সকালে জুলফিকার আর তাবারনকে ডেকে নুরুন্নাহারের ঘর পরিষ্কার করালো। বিছানায় ধোয়া চাদর পেতে দিলো। নুরুন্নাহারের কথা, কাপড়-চোপড় ধুইয়ে শুকাতে দিলো রোদে। তারপর দীর্ঘ সময় নিয়ে। নুরুন্নাহারকে পুকুর ঘাটে বসিয়ে গোসল করালো। নুরুন্নাহার অবশ্য এই পুরোটা সময় ছোট্ট শান্ত মেয়ের মতো বাধ্য হয়েই রইল। ঝামেলা শুরু করল দুপুরে খাবার সময়। তাকে প্লেটভর্তি ভাত দেয়া হলো। সেই ভাত সে মুখে দিলো না। প্রতিটি ভাতের দানা সে আলাদা আলাদা করে আঙুল দিয়ে নেড়ে দেখতে লাগল।
পারুল বলল, মা, ভাত খাও।
নুরুন্নাহার বললেন, এই ছেমড়ি, তোর মা কেডা?
পারুল বলল, তুমি।
নুরুন্নাহার খিলখিল করে হাসলেন, আমার তো বিয়াই হয় নাই। বিয়া না হইতেই তোর মতো এতবড় মাইয়া হইল কেমনে?
পারুল বলল, তোমার বিয়া না হইলে তুমি এই বাড়িতে কেন আইছ?
নুরুন্নাহার বললেন, ফইরসাবে কই? তারে তো দেহি না। সে কই?
পারুল বলল, সে কাজে গেছে। তারে খোজো কেন?
নুরুন্নাহার বললেন, সে না থাকলে আমারে ভাত খাইতে দে।
পারুল বলল, তোমার সামনেই তো প্লেটভর্তি ভাত।
নুরুন্নাহারের হঠাৎ যেন মনে পড়ল তার সামনে প্লেটভর্তি ভাত। তিনি অনেকক্ষণ ভাতের প্লেটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ ভাতের প্লেটখানা তুলে দরজা দিয়ে বাইরের উঠানে ছুঁড়ে মারলেন। পারুল হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মা ভাত না খেতে চাইলেও এমন আচরণ কখনো করেননি। সে বলল, এইটা তুমি কী করলা?
নুরুন্নাহার বললেন, আমারে বিষ খাইতে দিছস? ভাতের মইধ্যে বিষ খাইতে দিছস? তাবিজও আছে দেখলাম। ভাতের নিচে ফইরসাবের পড়া তাবিজ। এইসব কইরা আমারে পাগল বানাবি? আমারে বলদ পাইছস? আমি বলদ? আমি বলদ না। হা হা হা।
নুরুন্নাহার শরীর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। পারুল অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। নুরুন্নাহার হাসি থামিয়ে বললেন, ভাত দে।
পারুল গামলা থেকে প্লেটে ভাত বাড়তে গেল। নুরুন্নাহার আচমকা চেঁচিয়ে উঠলেন, হারামজাদী মাগি, তোরে আমি কইছি ভাত দিতে। তুই আমারে আবারো বিষ দিতেছস?
পারুল বলল, ভাতই তো দিতেছি!
নুরুন্নাহার আবারো হাসলেন। বললেন, আমারে বলদ মনে করস? ওই ভাতের মইধ্যে কী আছে, ওই শালুনের মইধ্যে কী আছে, আমি সব জানি। আমারে পাগল বানাবি? আমারে জানে মারবি? হা হা হা। পারবি না। পারবি না।
পারুলের বুকের ভেতর কি যে হচ্ছে! সে নুরুন্নাহারের গা ঘেঁষে এসে বসল। তারপর বলল, মাগো, দুইটা ভাত তুমি খাও মা।
নুরুন্নাহার গা ঝাড়া দিয়ে পারুলকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আমার জন্য আবার ভাত রান। আমার সামনে বইস্যা চাউল ধুইবি। ভাত রানবি। তারপর আমি ভাত খাব।
পারুল আর কিছু বলল না। সে নুরুন্নাহারকে সামনে বসিয়ে চাল ধুলো। ভাত বসালো চুলায়। ভাত রান্না শেষে নুরুন্নাহারকে আবার ভাত খেতে বসালো। নুরুন্নাহার বললেন, ভাতে শালুন দিবি না। আমি ভাত খাব শালুন ছাড়া।
পারুল বলল, খালি খালি ভাত খাওন যায় মা।
নুরুন্নাহার পারুলের কথার জবাব দিলেন না। তিনি ভাতের প্লেট টেনে নিয়ে খানিকটা নুন ছিটিয়ে দিলেন। কিন্তু মুখে দিতে গিয়ে কি হলো! তিনি আবারো ভাতের প্লেট ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, এই ভাত ফালাইয়া আবার ভাত দে।
পারুল অবাক হলেও কিছু বলল না। সে আরেকটা প্লেটে ভাত দিলো মাকে। নুরুন্নাহার এবার সেই তরকারিবিহীন সাদা ভাত গপগপ করে খেতে লাগলেন। পারুল বলল, ভাতে একটু নুন তো ছিটাই নাও মা।
নুরুন্নাহার ভাত মুখে নিয়েই গমগম শব্দে বললেন, আবার? আবারো আমারে বলদ মনে করা শুরু করছস? ওই নুন শালুনের মইধ্যে কী আছে সবই। আমি জানি। সব।
নুরুন্নাহার আর কথা বললেন না। তিনি বড় বড় নলা মুখে নিয়ে শব্দ করে নুন তরকারি ছাড়া ভাত খেতে লাগলেন। পারুল একদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মাকে দেখে তার মনে হচ্ছে সহস্র বছরের বুভুক্ষু এক মানুষ। এই যেন তার শেষ বেলার আহার। এরপর আর কোনোদিনও সে খেতে পাবে না। জগতের আর কোনো কিছুর প্রতি তার কোনো খেয়াল নেই। তার যাবতীয় খেয়াল ওই প্লেটে। আর প্লেটের ওপর ফুলের মতো ফুটে থাকা নুন শালুনবিহীন ধবধবে সাদা ভাতের ভেতর।
নুরুন্নাহার ভাত খাওয়া শেষে উঠলেন। বিকেলের নরম রোদে পারুল মাকে নিয়ে উঠানে পিড়ি পেতে বসল। সে মায়ের মাথার জট হয়ে যাওয়া চুলের জটা ছাড়িয়ে তেল দিয়ে দিচ্ছে। এই সময়ে সে মায়ের সাথে নানান কথাবার্তা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু নুরুন্নাহার সেইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। তবে অবাক ব্যাপার হলো নুরুন্নাহার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন তারও কিছু পর। আছরের আজান হচ্ছিল। নুরুন্নাহার হঠাৎ স্পষ্ট গলায় বললেন, সেয়ানা মাইয়া হইছস। আজানের সময় মাথা উদলা ক্যা? মাথা ঢাক।
এই বলে তিনি নিজে তার মাথা শাড়ির আঁচলে ঢাকলেন। তারপর বললেন, ওজুর পানি দে। নামাজ পড়ব। পরনের কাপড় নাপাক কিনা কে জানে, একখান ধোয়া কাপড় দে। আর তোর কি নামাজ আছে? নামাজ থাকলে ওঠ। কাপড় পাল্টাইয়া ওজু কইরা আয়, একসাথে মা মেয়ে নামাজ পড়ব।
পারুল ভারি অবাক হলো। কিন্তু কিছু বলল না। সে রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড় থেকে এনে মাকে ধোয়া শুকনো কাপড় দিলো। ওজুর পানি দিলো। তারপর মা মেয়ে মিলে আছরের নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে পারুলের ভালো ঘরে বিয়ের জন্য দোয়া করে মোনাজাতে উচ্চস্বরে কাঁদলেন নুরুন্নাহার। তারপর তারা মা-মেয়ে হাঁটতে বেরুল। পুকুরের ধারে তখন স্নিগ্ধ বিকেল। সেখানে। পুকুরের ঘাটে বসে নুরুন্নাহার মেয়েকে নানান উপদেশ পরামর্শ দিলেন। মেয়ের গায়ের রঙ ময়লা হয়েছে দেখে তিনি ভারি চিন্তিত বোধ করতে লাগলেন। পুকুর পারের বাগানে খানিকটা হলুদের চাষ হয়েছে। তিনি সেখান থেকে ক’খানা হলুদ তুলে এনে পারুলের হাতে দিতে দিতে বললেন, প্রত্যেক বেয়ান বেলা খালি প্যাডে এই কাঁচা হলুদ খাবি। নাওনের আগে হলুদ মুখে মাইখা বইসা থাকবি। দেখবি, মুখের রঙ হইব কাঁচা হলুদের লাহান।
পারুল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর সুস্থ মমতাময়ী এক মা তার! অথচ সেই ছোটবেলা থেকে সে নিজেকে ভেবে এসেছে ভয়াবহ দুর্ভাগা মাতৃহীনা এক মেয়ে। নুরুন্নাহার একটানা কথা বলে যাচ্ছেন। সেইসব কথার কিছুই পারুল শুনছে কিনা তা সে জানে না। তবে সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল পুরোটা বিকেল। সন্ধ্যা নামার আগে মা-মেয়ে পুকুর ঘাটে নামল। নুরুন্নাহার বললেন, মাগরিবের আজান হইব এখন। এতক্ষণ যা বকর বকর করলাম, ওযু থাকনের কথা না। আবার ওযু কইরা নেই।
পারুল এবারও কোনো কথা বলল না। সে মাকে দেখছে। এই মাকে দেখার সৌভাগ্য তার খুব একটা হয়নি। এই ভর সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে কেউ নেই। জুলফিকার বেরিয়েছে তার বাবার সাথে। তাবারন গিয়েছে তার বোনের বাড়ি। বলে গেছে সন্ধ্যার মধ্যেই সে ফিরে আসবে। এই শূন্য বাড়ি একাকী সময়টুকু তাই পুরোপুরি মাকে কাছে পেতে চাইছে পারুল। ওযু শেষে তারা পুকুর ঘাট থেকে বাড়ির উঠানে ঢুকল। উঠানে রতন দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে বড় একখানা বোয়াল মাছ। সে বোয়াল মাছখানা উঠানের মাটিতে ঝপাট শব্দে ফেলে দিয়ে বলল, ও ফুপু, দাদাজানে মাছ পাঠাইছেন। বলছেন, এই মাছ ঝাল পেঁয়াইজ দিয়া রানতে। আপনের মোহে নাকি স্বাদ নাই? এইর লাইগ্যা এই মাছ।
পারুল অবশ্য মাছ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাল না। আগ্রহ দেখালেন নুরুন্নাহার। তিনি ঝাঁঝাল গলায় বললেন, এই ছ্যামড়া, মাছ আনছস এমনে মাটিতে ফালাই রাখছস ক্যা? যা, যা ঘর থেইকা চালন লইয়া আয়। মাছ মাটিতে রাখলে মাছের স্বাদ কইম্যা যায়। মাছ কি মাটির জিনিস নাকি ছ্যামড়া?
রতন বাঁশের চালুনি এনে তার ওপর মাছটা রাখল। নুরুন্নাহার পারুলকে নিয়ে নামাজ শেষে উঠানে হারিকেনের আলোয় মাছ কুটতে বসলেন। মাছ কুটতে বসেও তার মুখ আর থামে না, শোন, একবার তোর নানায় মাছ আনছে। মাছের নাম আইড় মাছ। যেমন তেমন আইড় না, বাঘা আইড়। জাল। টাইন্যা উঠাইতে গিয়া দেখে জাল প্রায় ছিড়া বাইর হইয়া যাইতেছে মাছ। সে লাফ দিয়া পইরা মাছ ধরছে শক্ত কইরা জাপটাইয়া। মাছে লেজ দিয়া বাড়ি মাইরা তোর নানার কান ফাটাই দিছে। সে তাও মাছ ছাড়ে নাই। মাছ নিয়া যহন বাড়ি ফিরল, তহন আমরা দেহি দুইহাত দিয়া সে মাছ বোহে জড়াই ধইরা রাখছে। কিন্তু তার গলা বুক ভাইসা যাইতেছে রক্তে। আহারে। তোর নানী তো দেইখ্যা এক চিকুর। কিন্তু বাজানে খালি হাসে। সেই মাছ রানতে রানতে পোর রাইত হইল। আমরা তহন ঘুমে পইড়া যাইতেছি। বাজানে তো আমাগো ঘুমাইতেই দিব না। আমরা ঘুমাই আর সে টাইন্যা ধইরা জাগায়। শেষ পর্যন্ত যহন মাছ রান্ধা হইল, তহন আর আমাগো জাগাইতে পারল না। আমরা জাগলাম না বইলা বাজানেও আর ভাত খাইল না। যেই মাছ দিয়া ভাত খাইব। বইলা সারা রাইত না খাইয়া জাইগা থাকল, সেই মাছ না খাইয়া আমাগো লইয়া ঘুমাইয়া থাকল। বেয়ানে আমরা উঠলে তারপর ভাত খাইব। বেয়ান বেলা উইঠা দেখে বিলাইতে মাছের পাতিল উল্টাইয়া ফালাইছে। মাছ, শালুন সব গড়াগড়ি খাইতেছে মাটিতে। বিলাই যতটুকু পারছে খাইছে। আর বাদ বাকিটা মাটিতে। বাজানের এত শখের মাছ, আমাগো লাইগা আর খাওয়া হইল না। আহারে আমার বাজান। বাজানগো।
নুরুন্নাহারের চোখ বেয়ে জল নামতে লাগল। সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, সেই বাজান মরণের সময়ও তারে দেখতে যাইতে পারি নাই। বংশের মোহে চুন কালি দিয়া ভাইগ্যা চইলা আইছিলাম তোর বাপের লগে। তোর বাপেও আর কোনো যোগাযোগ রাখতে দেয় নাই।
এই কথা যে পারুল জানে না, তা না। সেও এই ঘটনা অল্পবিস্তর জানে। কিন্তু আজ যেন সবকিছুই তার কাছে নতুন মনে হচ্ছে। স্পর্শময় মনে হচ্ছে। রাতে নুরুন্নাহার মাছ রান্না করলেন। মাছের সাথে ফালি ফালি করে কেটে গাছ আলুও দিলেন। এই গাছ আলু নুরুন্নাহারের খুব পছন্দ। বড় কোনো গাছের শরীর বেয়ে ডালপালা অবধি ছড়িয়ে যায় এই আলুর লতা। সেই লতায় ছোট ছোট অসংখ্য আলু ধরে। তবে আসল সুস্বাদু আলু থাকে এই লতার মূলে। মাটির তলায় লতার যে মূল থাকে, সেই মূল মূলত বিশাল আকারের কালচে খয়েরি রঙের একখানা আলু। নুরুন্নাহার সেই আলু দিয়ে বোয়াল মাছ রান্না করলেন।
তাবারন সন্ধ্যার পরপরই ফিরে এসেছে। কিন্তু পারুল বা তাবারনকে কোনো কাজেই হাত দিতে দিলেন না নুরুন্নাহার। রান্নাবান্নার সকল কাজ তিনি একা একাই করলেন। ফলে রান্না শেষ হতে হতে রাত গম্ভীর হয়ে গেল। আব্দুল ফকির জুলফিকারকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন এশার নামাজেরও অনেক পরে। তাকে কী এক জরুরি কাজে পরদিন কাকভোরে মাদারীপুরের শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। এই জন্য বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়বেন বলে ভেবেছিলেন আব্দুল ফকির। কিন্তু তাকে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে হলো দীর্ঘ সময়। গভীর রাতে যখন রান্না শেষ হলো তখন খিদেয় দিশেহারা অবস্থা সকলের। ঘরের মেঝেতে দস্তরখান বসিয়ে খেতে বসল সবাই। কেবল রতন নেই। রতন জুলফিকারের সাথে বাড়ির বাহির ঘরে থাকে। সে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে অনেক ডেকেও তোলা গেল না।
খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন নুরুন্নাহার। বহুকাল পরে একজন পরিপূর্ণ গৃহকত্রীর মতো নিজের ঘরকন্না সামলানোর তৃপ্তির আভা ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে। তিনি সকলের পাতে ভাত বেড়ে দিলেন। কাঠের মিটসেফ থেকে তরকারির পাতিল নামিয়ে রাখলেন মেঝেতে। গরম ধোঁয়া ওঠা তরকারির এই সুবাস সবাই চেনে। মাঝে-মধ্যে যখন নুরুন্নাহার সুস্থ হয়ে ওঠেন, তখন কখনো কখনো এমন করে রান্নার শখও তার হয়। আর সেই রান্নার সুবাস বহুদিন অবধি নাকে লেগে থাকে, স্বাদ লেগে থাকে জিভে। আজও তেমনি এক বিশেষ স্বাদ-আস্বাদের দিন।
আব্দুল ফকির প্লেটের গরম ভাত আঙুলে নেড়ে দিচ্ছেন। আগুন গরম ভাত থেকে ধোয়ার সাথে গলগল করে ভাপ বেরুচ্ছে। নুরুন্নাহারের সাথে এতক্ষণেও তার কোনো কথা হয়নি। নুরুন্নাহার পারুলের প্লেটে তরকারি বেড়ে দিতে দিতে বললেন, এই আলু দিয়া বোয়াল মাছ খাওনের সময় এহন না। আসল স্বাদ পাইতে হইলে এই শালুন খাইতে হয় শীতের সময়। আলু আর বোয়ালের লগে কয় টুকরা বাগুন আর ধইন্যা পাতা দিয়া রাইতে রাইন্ধা থুইয়া দিতে হয়। খাইতে হয় পরদিন বেয়ান বেলা ঠান্ডা ঠান্ডা। সব শালুন খাইতে মজা গরম গরম, কিন্তু এই এক শালুন, খাইতে মজা ঠান্ডা। ঠান্ডায় মাছ, আলু আর বাগুন ঝোলের লগে শক্ত হইয়া জমাট বাইন্ধা খাণ্ডা খাণ্ডা হইয়া থাকে। আগুন গরম ভাতের ওপরে সেই শালুন দিতে হয় চামুচ দিয়া কাইটা কাইটা। আহারে! মোহে দিলে মনে হইব বেহেস্তর খানা। এই গরমকালে এই জিনিস খাইলে সেই স্বাদ কি আর পাওন যায়?
আব্দুল ফকির এতক্ষণে কোনো কথা বলেননি। এবার বললেন, তোমার শরীল এহন কেমন নুরুন্নাহার? ভালো ঠেকতেছ?
নুরুন্নাহার আব্দুল ফকিরের কথার জবাব দিলেন না। তিনি তাবারনকে বাদ দিয়ে জুলফিকারের পাতে তরকারি দিলেন। আব্দুল ফকির বললেন, এহনও কি যহন-তহন তারা তোমার লগে দেখা দেয়? নাকি তাগো আনাগোনা কিছু কমছে?
নুরুন্নাহার বললেন, কারা দেখা দিব?
আব্দুল ফকির বললেন, তুমি জানো না কারা দেখা দিব? আবড়ে-জাবড়ে ঘুইরা বদ জ্বিনের নজর লাগাইছ। চেষ্টা তো আমি কম করতেছি না। কিন্তু বছরের পর বছর ধইরাও তারা তোমারে ছাইড়া যাইতেছে না। কথা তো আমার শুনবা না। এত কই ঘরের মইধ্যে থাকলেও শরীল ঢাইক্যা রাখবা। মাথায় কাপড় রাখবা। তা তো শোনন না। আমার কথা শুইনা চললে, এই বদ জ্বিনের আছড় বেশি দিন থাকত না। আব্দুল ফইর দুনিয়ার সব মাইনষের চিকিৎসা কইরা বেড়ায়, খালি নিজের ঘরের মাইনষের চিকিৎসা করতে পারে না। কেমনে পারব? এই ঘরে কেউ তারে দুই পয়সার দাম দেয়? কেউ তার কথা শোনে? তার কোনো নিয়ম-কানুন মানে কেউ? মানে না। মানলে তাল গাছ, মানলে দুলফা ঘাসও না। এত বছর ধইরা আব্দুল ফইরের বউরে জ্বীনে আছড় কইরা রাখছে। এইটা তো একটা লজ্জা-শরমেরও ব্যাপার আমার লইগা।
নুরুন্নাহার বললেন, লজ্জা-শরম লাগলে আপনে বোরকা পইড়া শরীল ঢাইক্যা চলাফেরা করেন। আর এহন ভাত খান। আমার বেশি কথা পছন্দ না। বেশি কথা শুনলে শরীল ঝিমঝিম করে। মাথায় রাগ ওঠে।
আব্দুল ফকির বললেন, মাইয়া মাইনষের এত রাগ ভালো না নুরুন্নাহার। এই রাগই তোমার সর্বনাশ করছে। আমার কথা শোনো নাই। এহন? এহন নিজের কী অবস্থা করছ দেহো। রাগ পুরুষ মানুষের বিষয়। মাইয়া মানুষ হইব পানির লাহান ঠান্ডা আর নরম।
নুরুন্নাহার হঠাৎ হি হি হি করে হেসে উঠলেন। তারপর অদ্ভুত গলায় বললেন, মাইয়া মাইনষের সবকিছুই খালি নরম হইব, না? গতর নরম হইব, বুক নরম হইব, মন নরম হইব? ব্যাটা মাইনষের তাইলে খুব আরাম লাগে না? পুরুষ মানুষ মাইয়া মানুষের সব নরম জিনিসই খালি পছন্দ করে, এই জন্য সব নরম হইতে হইব! অ্যাঁ?
নুরুন্নাহারের কণ্ঠ শুনে মুহূর্তেই আব্দুল ফকির আর পারুল সতর্ক হয়ে উঠল। এই গলা আর কথা বলার ভঙ্গি তারা চেনেন। আব্দুল ফকির নরম গলায় বললেন, থাউক এই সব কথা। প্লেট আইনা ভাত খাইতে বসো। আর তাবারনরে শালুন দেও। ও খালি প্লেট লইয়া কখন থেইকা বইসা আছে।
নুরুন্নাহার আচমকা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তিনি তার স্বরে চিৎকার করে বললেন, ক্যান? তাবারনের লইগা এত দরদ ক্যান? তাবারনের শরীল খুব। নরম না? তার নরম শরীলে খুব আরাম। আমার শরীল এহন শক্ত হইয়া গেছে, না?
প্রবল খিদে নিয়ে খেতে বসা প্রতিটা মানুষ মুহূর্তেই সচকিত হয়ে উঠল। এ যেন ভয়ঙ্কর কোনো বিপদের পূর্বাভাস। আব্দুল ফকির বললেন, এইগুলান তুমি কী বলতেছ আবোল-তাবোল?
নুরুন্নাহার প্রথমে কোনো কথা বললেন না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি এক লাফে তাবারনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর সাক্ষাৎ উন্মাদিনীর ভঙ্গিতে তিনি তাবারনের চুল ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ওই খানকি মাগি। ওই, তোর বোহের কাপুড় কই? তুই এইহানে বড় বড় ওলান বাইর কইরা বইসা রইছস ক্যান? ওই বুড়া শয়তানটারে তোর নরম শরীল দেহাস মাগি? তোর শরীল আমি কি করি দ্যাখ।
নুরুন্নাহারের হাতের ধোঁয়া ওঠা গরম তরকারির বাটিখানা কেউ এতক্ষণ খেয়াল করেনি। পারুল যতক্ষণে তার হাতের বাটি দেখে চমকে উঠেছে, নুরুন্নাহার ততক্ষণে সেই গরম তরকারিসুদ্ধ বাটিখানা উপুড় করে দিলেন তাবারনের শরীরে। তাবারন তীব্র চিৎকারে দু’হাতে বুক চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আব্দুল ফকির লাফ দিয়ে তার জায়গা থেকে উঠে আসলেন। কিন্তু মেঝেতে লুটিয়ে পড়া তাবারন তখন কাটা মুরগির মতো তড়পাচ্ছে। জুলফিকার আর পারুলের হতভম্ব ভাব যেন তখনো কাটেনি। চোখের সামনে ঘটা ঘটনাটি এখনও তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। নুরুন্নাহার যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, তেমনই দাঁড়িয়ে আছেন। তবে তিনি ভয়ঙ্কর শব্দে একনাগাড়ে হেসে যাচ্ছেন। হাসির ফাঁকে ফাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে লাগলেন তাবারনকে। আব্দুল ফকির অবশ্য নুরুন্নাহারকে কিছু বললেন না। তিনি পারুলকে ডেকে বললেন, মা, তাবারনরে তোমার ঘরে নিয়া যাও। ঘরে ডিম থাকলে অর বোহে কয়ডা ডিম ভাইঙা দেও। পোড়া জায়গায় কাঁচা ডিম উপকারী।
সেই রাতে আর কারো খাওয়া হলো না। নুরুন্নাহারের পাগলামি আবার বাড়তে লাগল। তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুললেন। আব্দুল ফকির নুরুন্নাহারকে জোর করে তার ঘরে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে রাখলেন। পরদিন ভোরে আব্দুল ফকির যাবেন মাদারীপুর শহরে। তার সাথে যাবে জুলফিকার। তাদের ফিরতে দিন দুই দেরি হবে। এই দুইদিন পারুল একা সবকিছু কীভাবে সামলাবে?
আব্দুল ফকির অবশ্য পারুলকে একা রেখে গেলেন না। তিনি খুব ভোরে রতনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাবারনের বড় বোনকে খবর দিতে পাঠালেন। তাবারনের বড় বোনের নাম ছবিরন। ছবিরন খবর পেয়ে সাথে সাথেই চলে এলো। আব্দুল ফকির মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন তার ঘণ্টাখানেক পরে। তাবারনের ঘটনা নিয়ে তিনি খানিক চিন্তিত। এই আগুনে পোড়া রোগের চিকিৎসা বলতে তিনি যা জানেন তা হলো মধু বা ডিমের সাদা অংশ ক্ষতস্থানে। দিয়ে রাখা। এতে জ্বলুনিভাব কমে। বিশেষ করে মধু দিলে ক্ষতস্থানে পচন ধরার সম্ভাবনা কমে। তিনি সেসব পারুল আর ছবিরনকে বুঝিয়ে বলেও এসেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ঘটনা তিনি আড়াল করবেন কী করে? তার বাড়িতে তার পাগল স্ত্রী কেন তাবারনকে পুড়িয়ে দিয়েছে এই নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠবে। দশ জনে দশ রকমের কথা তুলবে। এই মুহূর্তে তিনি বাড়ি থাকতে পারলে হয়তো কিছু একটা করতে পারতেন। কিন্তু মাদারীপুর তাকে যেতে হবে আজই। তিনি দুশ্চিন্তা নিয়েই ট্রলারে উঠলেন। কিন্তু ট্রলারে উঠে তার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল। এই দুশ্চিন্তার কারণ তাবারন নয়। এই দুশ্চিন্তার কারণ নয়ন!
নয়নের সাথে তার আরো একবার কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেল। তার ট্রলার যখন হোসনাবাদ ঘাট থেকে ছাড়ল, তার কিছুক্ষণ বাদেই আরেকখানা ট্রলার এসে ভিড়ল হোসনাবাদ ঘাটে। তবে ট্রলারখানা যখন হোসনাবাদের নদী ঘেঁষে দাঁড়ানো করাতকল পার হয়েছে, তখন মাঝনদীতে প্রায় মুখোমুখি পড়ে গেল আব্দুল ফকিরের ট্রলারের সাথে। আজ আকাশ আবার মেঘলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই বৃষ্টিতে ট্রলারের গলুইয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আব্দুল ফকির। নয়ন তাকে দেখতে না পেলেও আব্দুল ফকির ঠিক ঠিক দেখতে পেলেন নয়নকে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় নয়ন আর মনির তড়িঘড়ি করে ট্রলারের ছাদ থেকে নেমে আসছিল নিচে।
নয়ন আর মনিরকে চিনতে আব্দুল ফকিরের কষ্ট হলো না। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, এই অসময়ে এরা দুজন এখানে কেন? আব্দুল ফকির বিষয়টি নিয়ে ভারি চিন্তিত হয়ে উঠলেন।
তিনি চিন্তিত মুখেই হোসনাবাদ ছাড়লেন।
*
পারুল জানে তার বাবা আব্দুল ফকির বুদ্ধিমান মানুষ। কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে তিনি মোটেই বুদ্ধিমান মানুষ নন। এটি মনে হবার কারণ তাবারনের বোন ছবিরন। খালি বাড়িতে পারুলকে সাহায্য করার জন্য তিনি ছবিরনকে রেখে গিয়েছেন। কিন্তু সাহায্যের বদলে ছবিরন যা করছে তার নাম হুলস্থুল। সে বাড়িতে ঢোকার পর থেকে বাড়ি-ঘর মাথায় তুলে চিৎকার করে কাঁদছে। তার সাথে তার চার বছরের ছেলে, আর সাত বছরের মেয়ে। এদের দুজনের খানিক পরপর খিদে পায়। খিদে পেলে তারা মুখ ফুটে খাবারের কথা কিছু বলে না। যা করে তা হলো গলা ফাটিয়ে চিৎকার। সকাল থেকে এই তিনের চিৎকার চেঁচামেচিতে পারুলের কান ঝালাপালা। এখন আবার তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে তাবারন। মাঝখানে সে খানিক ক্ষ্যান্ত দিয়েছিল, এখন সেও সমানে চেঁচাচ্ছে। পারুলের ভীষণ অসহায় লাগছে।
উঠানে মানুষের ভিড় লেগে গেছে। ভিড় করা মানুষের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। এরা একদল নুরুন্নাহারকে দেখতে চাইছে। আরেকদল দেখতে চাইছে তাবারনকে। পারুলের মাথা সত্যি সত্যি খারাপ হওয়ার দশা। সে অসহায় ভঙ্গিতে বসে রয়েছে ঘরের দাওয়ায়। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর সে দিচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে সে চুপচাপ পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে থাকে। কিন্তু সেটিও সম্ভব না। এই অবস্থায় সে পুকুর পারে গিয়ে বসে থাকলে নানান কথা উঠবে। তাবারনের গলায় বুকে ডিমের সাদা অংশ মেখে দিয়েছে সে। এই জিনিস তাবারনকে খানিকটা আরাম দিলেও কিছুক্ষণ পরপরই সে চিৎকার করে উঠছে। আব্দুল ফকির বলেছিলেন তাবারনের পোড়া জায়গায় মধুও মাখাতে। কিন্তু ঘরে মধু নেই। রতনকে পাঠানো হয়েছে মধুর খোঁজে। অবশ্য এই অসময়ে সে মধু কোত্থেকে আনবে, পারুল জানে না।
গতরাতের কথা ভেবে পারুলের খুব ভয় হচ্ছে। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, তার মা ওই কাজ করেছেন! নুরুন্নাহারকে এত ভয়ঙ্কর হতে সে আগে কখনো দেখেনি। তাবারনের কথা ভেবে পারুলের প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা এমনিতেই জনমদুঃখী। মা-বাবা কেউ নেই। স্বামী-সংসার নেই। পারুল শুনেছে তার জন্মেরও আগে থেকে তাবারন এ বাড়িতে। নিজের থাকার মধ্যে তাবারনের রয়েছে এই এক বড় বোন। কিন্তু সেও তাবারনের খুব একটা খোঁজ খবর নেয় না। বাঁজা মেয়ে বলে তাবারনকে নিয়ে নানান সংস্কার অনেকের মধ্যে। নিজের বোনেরও কম নয়। সে চায় না, তার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভরভরন্ত সুখের সংসারে বন্ধ্যা তাবারনের ছায়া পড়ুক। অথচ আজ এসে বোনের দুঃখে সে পাড়া মাথায় করে চেঁচাচ্ছে।
খিদেয় পারুলের গা গোলাচ্ছে। কিন্তু কিছু খেতে তার ইচ্ছে হচ্ছে না। গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টিতেও উঠানে মানুষের ভিড় কমছে না। বরং বাড়ছে। পারুল অবশ্য ঘরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। নুরুন্নাহারও মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে চলেছে। উঠানে জড় হওয়া মানুষগুলো দুঃখী দুঃখী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তাবারন, নুরুন্নাহার আর পারুলদের দুঃখে তারা কাতর। কিন্তু পারুল স্পষ্ট টের পাচ্ছে, মানুষগুলো এই পরিস্থিতি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে। নুরুন্নাহারের অশ্লীল গালাগালেও তারা নিষিদ্ধ আনন্দ পাচ্ছে। এইসকল কিছুই অবশ্য অস্বাভাবিক বা ভয়ের কিছু নয়। আসল যা ভয়ের, তা হলো এরা এখান থেকে গিয়ে নানান রসালো গল্প। তৈরি করবে। সে সকল গল্প ক্রমশই আরো ডালপালা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়বে চারধারে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই এই ঘটনা নিয়ে নানান জায়গায় রসালো আচ্ছা। বসেও গিয়েছে। হোসনাবাদের বাজারের চায়ের দোকানে, মাছের বাজারে এই গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলার জমায়েত ইতিমধ্যেই বসে যাওয়ার কথা।
পারুলের ধারণা যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণ হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। রতন বাড়ি ফিরেছে। তবে সে একা ফেরেনি। তার সাথে গাঁয়ের কয়েকজন ছেলে ছোঁকড়া, দুয়েকজন বয়স্ক লোকও রয়েছেন। এদের সকলকেই পারুল কম-বেশি চেনে। তবে যাদের চেনে না, তারা হলো দুজন তরুণ। তাদের মধ্য থেকে একজনকে দেখে পারুলের চোখ আটকে গেল। চেহারা, হাঁটা, ভঙ্গি দেখে পারুল এক পলকেই বুঝে গেল, এই ছেলে এই গাঁয়ের নয়। এই গাঁয়ের তো দূরের কথা, সে কোনো গাঁয়ের ছেলেই নয়। সে নিশ্চিত করেই শহুরে ছেলে। ছেলের গায়ের রঙ ফর্সা। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। পারুল একদৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই এত এত বিপদের মধ্যেও তার হৃদস্পন্দন যেন মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।
হারু মুনশী মসজিদে নামাজ পড়ান। বয়স্ক মানুষ। তিনি এগিয়ে এসে পারুলের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ও পারুল? তাবারনের এহন অবস্থা কী? ফইরসাবের লগে টলার ঘাটে দেহা হইল। সে তো আমারে কিছু কইল না। তয় এইসব কথা কি আর অগোচর থাহেনি? বাতাসের মতো ছড়ায়। ঘটনা লইয়া তো টলারঘাট, বাজারে মাইনষের মজমা বইস্যা গেছে। কত আজাইর্যা বাজাইরা কথা সেইখানে!
পারুল কোনো কথা বলল না। সে তাকিয়ে আছে হারু মুনশীর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শহুরে যুবকের দিকে। হারু মুনশী বললেন, তায় এহন কী ব্যবস্থা নিলি? পোড়া রুগী। লগে লগে কোনো ব্যবস্থা না নিলে বিপদ। আর তোর মায়ের কী অবস্থা? পাগলামি কি আগেরতনও বেশি বাড়ছে?
পারুল এবার কথা বলল। সে বলল, আব্বায় বইলা গেছিল ডিমের সাদা অংশ মাখাইতে। আমি মাখাইছি। আর বলছিল মধু দিতে। কিন্তু ঘরে মধু আছিল না। এইজন্য মধু আনতে পাঠাইছিলাম রতনরে। কিন্তু রতন তো মনে হয় মধু পায় নাই।
পারুল সামান্য থেমে পেছনে দাঁড়ানো যুবকের দিকে ইঙ্গিত করে আবার বলল, এরা কারা কাকু? উনাগো তো কোনোদিন দেহি নাই।
হারু মুনশীর যেন এতক্ষণে মনে পড়ল যে তার সাথে দুজন আগন্তুক রয়েছেন। তিনি খানিক সরে গিয়ে বললেন, এনারা সম্মানী মানুষ। এই যে ইনি, ইনি হইছেন ফতেহপুরের চেয়ারম্যান খবির খাঁর পোলা মনির খা। আর তার সাথের জন খবির খাঁর বইনের পোলা। এনার নাম নয়ন। ইনি ঢাকা শহর থাহেন। বড় ডাক্তার। আমরা টলারঘাটে বইসা এই ঘটনা নিয়া কথা বলতেছি, এই সময়ে উনারা আইসা হাজির। জিগাইলেন, ফইরসাবের বাড়ি যাইবেন, বাড়িটা কোনদিকে? এরপর কথায় কথায় এ ও বলাবলি করতে লাগল আইজ রাইতের ঘটনাও। আর আল্লাহর কী কুদরত, তহনই জানলাম, উনি ডাক্তারও। এইজন্যই তাড়াহুড়া কইরা ওনারে লইয়া আইলাম। দ্যাখ, কিছু ব্যবস্থা যদি উনি করতে পারেন।
সাধারণ মেয়েলি লজ্জা-শরমের বালাই পারুলের কোনো কালেই ছিল না। ছিল না অতিরিক্ত আদব-লেহাজের বিষয়ও। সে খানিকটা চাঁছাছোলা টাইপের মেয়ে। যার তার মুখের উপর যখন তখন ইচ্ছেমাফিক কথা বলে দেওয়া তার অভ্যাস। তবে এর বাইরেও পারুলের চরিত্রে আরো একটি ব্যাপার রয়েছে। সেই ব্যাপারটি তেমন দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র নয় বলেই হয়তো সেটি সব সময়ই অপ্রধান হয়ে অগোচরেই থেকে যায়। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে সেই চরিত্রটি যেন দুম করে বের হয়ে এলো। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, হারু কাকু। ঘরের ভিতর আহেন। বিষ্টির মধ্যেও মাইনষের ভিড় দেখছেন? উঠানের মাটিগুলারেও ক্যাদা ক্যাদা কইরা ফেলছে। আপনেরা টিনের নিচে আহেন। আমি বসনের চেয়ার দেই।
পারুলের চোখ মুখে কেমন এক সলজ্জ ভঙ্গিমা। সে চট করে ঘরের ভেতর গিয়ে রতনকে দিয়ে দুখানা চেয়ার পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু সে নিজে আসলো না। বারান্দায় দীর্ঘ সময় বসে রইল নয়ন, মনির আর হারু মুনশী। সেদিনের সেই বিচিত্র নৌকাযাত্রার পর থেকেই নয়ন ভেতরে ভেতরে আরো একবার আব্দুল ফকিরের সাথে দেখা করবার জন্য উন্মুখ হয়েছিল। আজ তাই নিজের ইচ্ছেতেই ফতেহপুর থেকে সে আব্দুল ফকিরের সাথে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু তার ভাগ্য খারাপ, একটুর জন্য আব্দুল ফকিরের সাথে তার দেখাটা হলো না। মাঝখান থেকে সে এসে পড়েছে আরেক ঘটনার মধ্যে। তবে ট্রলারঘাটে এই ঘটনা শোনার পর থেকেই ঘটনাটি নিয়ে নয়নের মধ্যে একটা স্বাভাবিক কৌতূহলও তৈরি হয়েছে। এটি যেমন আর আট দশজন মানুষের মতো আব্দুল ফকিরের ঘরের খবর জানার স্বাভাবিক কৌতূহল, তেমনি আবার একটা ডাক্তারসুলভ আগ্রহও রয়েছে। এই গাঁও-গ্রামে এমন পোড়া রোগীর কী ব্যবস্থা এরা করে, কে জানে! এই রোগীর ক্ষেত্রেও আব্দুল ফকিরের বিশেষ কোনো টোটকা রয়েছে কিনা, এটিও নয়নের কৌতূহলের একটি বিষয়।
পারুল আসলো দীর্ঘ সময় পর। এই সময়ে সে ঘরে গিয়ে মুখে পানি ছিটিয়েছে। সামান্য পাউডার মেখেছে। চুলের গোছাটা খানিক গুছিয়ে খোঁপা করে বেঁধেছে। মজার ব্যাপার হলো পারুল তার পরনের শাড়িটাও এই ফাঁকে বদলে নিয়েছে। খানিক আগে তাবারনের ঘটনায় গভীরভাবে আহত, উদ্বিগ্ন যে পারুল, সেই পারুলের সাথে এই পারুলের যেন কোনো মিল নেই। যেন আলাদা মনোজগতের ভিন্ন দুই মানুষ। নয়ন পারুলকে দেখে অবাক হলো। তবে সেটি সে তার আচরণে প্রকাশ করল না। সে নরম গলায় বলল, উনার কোথায় পুড়েছে?
পারুল বলতে গিয়েও যেন খানিক সঙ্কোচ করল। তারপর বলল, গলা থেইকা পুরা বুক।
নয়ন পারুলের এই সামান্য সঙ্কোচের কারণটা ধরতে পারল। সে বলল, আমি ডাক্তার। ডাক্তারের কাছে কোনো সঙ্কোচ করবেন না। তবে একটা বিষয়, আপনার বাবা আবার কোনো সমস্যা করবেন না তো? তিনি নিজেই তো বড় কবিরাজ। নানান চিকিৎসা পথ্য দেন। এখন বাইরের কোনো ডাক্তার এসে চিকিৎসা দিলে যদি আবার কিছু মনে করেন?
পারুল ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলল, না না, আব্বা কিছু বলব না। আমার ওপরে সে কিছুই বলব না।
নয়ন মৃদু হাসল। বলল, আপনার বাবা বুঝি আপনাকে খুব ভালোবাসেন?
পারুল এই কথার জবাব দিলো না। নয়নই আবার কথা বলল। সে বলল, রোগীর এখন কী অবস্থা? কোনো ব্যবস্থা আপনারা নিয়েছেন?
পারুল মাথা দোলালো। সে বলল, আব্বা বইলা গেছিল ডিমের সাদা অংশ আর মধু মাখতে। ডিম মাখাইছি, কিন্তু মধু তো পাই নাই।
নয়ন বলল, আমি শুনেছি গরম ঝোল তরকারি পড়ে পুড়েছে, তাই না?
পারুল উপর নিচ মাথা ঝাঁকাল। নয়ন বলল, আপনি ডিম মাখানোর আগে কী পোড়া জায়গাটা ভালো করে পরিষ্কার করে নিয়েছিলেন?
পারুল মৃদু গলায় বলল, তাবারন খালায় তহন চিক্কর দিয়া কানতেছিল। আমার মাথা কাজ করতেছিল না। একটু পানি দিয়া ধুইয়া তাড়াতাড়ি ডিম মাখাই দিছি।
নয়ন বলল, আমি যেহেতু দেখতে পারছি না, সুতরাং বলতেও পারছি না, রোগীর ক্ষতস্থান কতটা গভীর। তবে একটা কথা, ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে না ফেললে কিন্তু ইনফেকশন হবে।
পারুল ইনফেকশন কথাটার অর্থ ঠিক বুঝল না। সে যে বোঝেনি সেটি নয়নের বুঝতে সামান্য সময় লাগল। নয়ন সাথে সাথেই আবার বলল, পচন ধরবে। মধু থাকলে ভালো হতো। মধু পচন ঠেকাতে খুব ভালো কাজ দেয়। তবে এখুনি ভালো করে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আর বলুন তো, পোড়া জায়গাটি কি লালচে সাদা হয়ে আছে?
পারুল সাথে সাথে জবাব দিলো না। সে এতটা খেয়াল করে দেখেনি। ভেতর থেকে এখনো তাবারনের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। তবে নুরুন্নাহার এখন খানিকটা থেমেছেন। পারুল মৃদু কণ্ঠে বলল, আমি পরিষ্কার কইরা আসব? ভালো কইরা দেইখাও আসব, কী অবস্থা?
নয়ন বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই পরিষ্কার করবেন। তবে আমার ধারণা পোড়াটা খারাপভাবেই পুড়েছে। কারণ, একে তো আগুন গরম তরকারি। তার ওপর জায়গাটাও পোড়ার জন্য খারাপ। এখানে আশেপাশে তো কোনো ওষুধের দোকান দেখলাম না। আমি একটা মলম লিখে দিচ্ছি, কোনোভাবে সম্ভব হলে কোথাও থেকে আনিয়ে নেবেন।
পারুল কেবল ডান দিকে মাথা কাত করল। তার কেমন যেন লাগছে। সে বোঝাতে পারবে না। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে? তার তো এমন হবার কথা না। সে হঠাৎ কিছু না বলেই টুপ করে ঘরের ভেতরে চলে গেল। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আবার ফিরে এলো। তারপর বলল, আপনেরা। কিন্তু দুপুরের না খাইয়া যাইবেন না।
নয়ন বলল, না না। আমরা এখুনি চলে যাব। আসলে আমরা এখানে এসেছিলাম একটা কাজে। আপনার বাবার সাথে আমার একটু দেখা করার বিষয় ছিল। কিন্তু এসে শুনি এই ঘটনা।
পারুল আরো কী কী বলতে চাইছিল, কিন্তু তার কিছুই সে বলতে পারল না। নয়নরা চলে যাওয়ার পর সারাটাদিন তার কাটল ঘোরের মধ্যে। বিকেল নাগাদ মানুষের ভিড় কমতে লাগল। ছবিরনও খানিক ধাতস্থ হয়েছে। সে রান্নাবান্না করে তার বাচ্চাদের খাইয়েছেও। তাবারন সারাদিন বাদে শান্ত হয়ে ঘুমিয়েছে। নিঘুম রাত আর সারাদিনের ধকলে পারুলের শরীরটাও ভেঙে পড়ছিল। সে ঘুমাবে বলে ঘর অন্ধকার করে বিছানায় শরীরখানা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম জেঁকে বসল তার চোখে। কিন্তু সেই ঘুম বেশিক্ষণ থাকল না। সে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠল। তারপর অন্ধকার ঘরে সে দীর্ঘ সময় চুপ করে বসে রইল। আজ সকালে তাদের ঘরের বারান্দায় বসে কথা বলা মানুষটাকে সে মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না। কিছুতেই পারছে না। মানুষটা যেন অবচেতনেই তার মাথায় পুরোপুরি গেঁথে গেছে।
লতার দেখাদেখি একটা শহুরে প্রেমিকের তীব্র আক্ষেপ তার ভেতরে ছিল। হয়তো এ কারণেই অমন কারো কথাই সে মনে মনে ভাবছিলও। কোথাও তীব্রভাবেই একটা শহুরে ছেলের অপেক্ষা তার ছিল! কিন্তু আজ চোখের সামনে পারুল যাকে দেখেছে, সে পারুলের কাছে রীতিমতো স্বপ্নেরও বেশি কিছু। একটা মানুষ এত সুন্দর করে হাসে, কথা বলে! পারুল মানুষটাকে কোনোভাবেই তার ভাবনা থেকে তাড়াতে পারছে না। সে ঘুমের মধ্যে মানুষটাকে স্বপ্নেও দেখেছে। স্বপ্ন দেখেই তার ঘুম ভেঙেছে। সে দেখেছে তাদের পুকুর ঘাটে সে আর মানুষটা বসে রয়েছে। মানুষটার পরনে নীল পাঞ্জাবি। আর তার পরনে নীল শাড়ি। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের প্রতিবিম্ব পড়েছে পানিতে। তারা দুজন পানির দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, পারুল, দেখো তো, পানি কাঁপছে, চাঁদও কাঁপছে। দৃশ্যটা সুন্দর না?
পারুলের কাছে দৃশ্যটা আহামরি সুন্দর কিছু বলে মনে হচ্ছিল না। কিন্তু এই মানুষটার পছন্দের বাইরে সে কিছু বলতে চায় না। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, খুব সোন্দর।
মানুষটা পারুলের দিকে তাকিয়ে আবার হাসল। তারপর বলল, সোন্দর পারুল, বলো সুন্দর।
পারুল অবশ্য তার কথা শুনল না। তার মাথায় গেঁথে আছে মানুষটার হাসি। মানুষ এত সুন্দর করে হাসে কীভাবে! সে নিস্পলক চোখে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা আবারো হাসল। বলল, তোমার সাথে আমার কি কথা ছিল পারুল? তুমি শুদ্ধ করে কথা বলবে। পুরোপুরি শুদ্ধ করে কথা বলতে পারলেই তোমাকে আমি ঢাকা নিয়ে যাব।
পারুল এবারো কোনো কথা বলল না। মানুষটা আবার বলল, কী? পারবে না পুরোপুরি শুদ্ধ করে কথা বলতে?
পারুল যে শুদ্ধ করে কথা বলার চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু সে পারছে না। এই শুদ্ধ করে কথা বলার ব্যাপারটি তার কাছে ভারি কঠিন মনে হচ্ছে। সে হঠাৎ বলল, আপনে তো ডাক্তার। বড় ডাক্তার। ডাক্তাররা তো সব কিছুই সহজে কইরা দিতে পারে। আপনে আমারে সহজে শুদ্ধ কইরা কথা বলনের কোনো ঔষুধ দিতে পারেন না? টুপ কইরা পানিতে গিল্যা ঔষুধ খাব, আর টপটপ শুদ্ধ বলা শুরু করব। কী এমন ঔষুধ নাই? দিতে পারবেন না?
মানুষটা পারুলের কথা শুনে হো হো করে হাসতে লাগল। সেই হাসি আর থামছে না। থামছেই না। পারুলের হঠাৎ ভয় করতে লাগল। সে মানুষটার হাসি থামাতে চাইছে। কিন্তু মানুষটাকে কী বলে ডাকবে সে? পারুল বুঝতে পারছে না, মানুষটাকে তার কী বলা উচিত! মানুষটা তার কী হয়, তাও সে জানে না! আচ্ছা কী সম্বোধনে ডাকবে সে মানুষটাকে? মানুষটার নাম ধরে?
কিন্তু কী নাম তার পাশে বসে থাকা মানুষটার?
পারুল হঠাৎ আবিষ্কার করল সে তো মানুষটার নামই জানে না। হয়তো নামটা সে জানত কিন্তু এই মুহূর্তে ভুলে গেছে। কিছুতেই আর নামটা মনে পড়ছে না পারুলের। সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পারল না। কোনোকিছুতেই মানুষটার নাম সে মনে করতে পারল না। পারুলের কী যে কষ্ট হচ্ছে! কী যে কষ্ট! কী নাম মানুষটার? বাদল? বেলাল? হাসান?
পারুল কিছুতেই কিছু মনে করতে পারল না। তার ঘুম ভেঙে গেল। সেই ঘুম ভাঙা সন্ধ্যায় পারুল এলোচুলে হেঁটে চলে এলো পুকুরের ঘাটে। ঘাটে বসে সে আবিষ্কার করল মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে মস্তবড় চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলো পড়েছে পুকুরের পানিতে। পুকুরের পানি সামান্য কাঁপছে। সাথে সাথে কাঁপছে চাঁদটাও। সে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে পুকুরের পানিতে কম্পমান সেই চাঁদের দিকে। তার হঠাৎ মনে হতে লাগল তার ঠিক অন্য পাশেই ঘাটের আরেক প্রান্তে বসে রয়েছে সেই মানুষটা। সে ঘাড় ঘুরে তাকালেই মানুষটাকে দেখতে পাবে। কিন্তু তার তাকাতে ইচ্ছে করছে না। কারণ তাকালেই যদি দেখে মানুষটা নেই! পারুল তাকালও না। সে তাকিয়ে রইল পুকুরের জল জোছনায়। সেই জল-জোছনায় তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার হঠাৎ মানুষটার নাম পড়ে গেল। মানুষটার নাম নয়ন। পারুল জানে, নয়ন মানে চোখ।
কী আশ্চর্য! সে তার চোখের সামনে থেকে নয়নকে তাড়াতে পারছে না।
*
ফজরের নামাজ শেষে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হাঁটতে বেরিয়েছেন। তার সাথে আছে এস্কান্দার। এস্কান্দারের হাতে তেল চকচকে বাঁশের লাঠি। এমন বাঁশের লাঠি নিয়ে আজকাল কেউ হাঁটে না। কোনো লাঠিয়ালও না। অবশ্য লাঠিয়ালের চলও আজকাল নেই। তবে এস্কান্দারের অভ্যাস হয়ে গেছে। সে তার এই অভ্যাসটা আর ছাড়তে পারেনি। এস্কান্দার শুনেছে, তার বাবা হায়দার আলী যখন তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে হাঁটতেন, তখন তার হাতে থাকত তীক্ষ্ণ ফলার ঝকঝকে বর্শা। কিন্তু সেই সব বর্শার যুগও আর এখন নেই। এই নিয়ে এস্কান্দারের ভেতরে ভেতরে এক ধরনের হতাশাও রয়েছে। মাঝে-মধ্যে তাই সময় সুযোগ পেলে তার এই হতাশার কথা সে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কাছেও প্রকাশ করে। যেমন আজ সে সুযোগ বুঝে তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে বলল, দাদাজান, একখান বন্দুক দরকার। দিনকাল ভালো না। এই বাঁশের লাঠি লইয়া আর চলে না।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁর একখানা অতি পুরোনো আমলের বন্দুক রয়েছে। বহুকাল সেই বন্দুক আর ব্যবহার হয় না। তবে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মাঝে-মধ্যেই বন্দুকখানা বের করে তা ঝেড়ে-পুছে, তেল মাখিয়ে আবার যত্ন করে রেখে দেন। তিনি জানেন, সেই বন্দুক খানার প্রতি এস্কান্দারের বড় লোভ। কিন্তু তিনি এই বন্দুক আর ব্যবহার করতে চান না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন, বাঁশের লাঠির কী দরকার? কোনো লাঠিরই আর দরকার নাই।
এস্কান্দার বলল, কী বলেন দাদাজান! ঘটনা হোনেন নাই? উত্তর কান্দির খোনকার বাড়ি দিন দুই আগে ডাকাতি হইল। যেই সেই ডাকাতি না, মারাত্মক ডাকাতি। মাডার হইছে তিনডা। পেপার পরতিকার লোকজনও হুনছি আইছে। পুলিশ আর পুলিশ।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এহন কী উড়া চিঠিতে ঘোষণা আইছে নাকি যে আমার বাড়িতেও ডাকাইত পড়ব? এই ডাকাইত ঠেকানোর জন্য তোর বন্দুক দরকার?
এস্কান্দার থতমত খাওয়া গলায় বলল, না দাদাজান, আপনের বাড়িতে ডাকাইত পড়ব, এমুন সাহস এহনো কোনো ডাকাইতের হয় নাই। তারপরও দাদাজান, একখান বন্দুক লগে থাকলে বল পাই।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তুই হায়দার আলীর পোলা। তোর বলের লইগা বন্দুক লাগে! তোর বাপ খালি হাতে গণ্ডায় গণ্ডায় মানুষ কাইত কইরা ফালাইত।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সাধারণত এত কথা বলেন না। কিন্তু কোনো কারণে আজ তার মন ভালো। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে এস্কান্দারের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, বন্দুক সবাই ধরতে পারে। কিন্তু চালাইতে পারে না।
এস্কান্দারের চোখে যেন আশার আলো জ্বলে উঠল। সে বলল, আমি চালানি শিখ্যা ফেলব দাদাজান। টিগার টানলেই তো গুল্লি বাইরায়।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সামান্য হাসলেন। কিছুক্ষণ আর কথা বললেন না। তারপর আচমকা বললেন, বন্দুক হাতে থাকলে গুলি সকলেই করতে পারে। এইটা কঠিন কোনো বিষয় না। কঠিন বিষয় গুলি না করতে পারা। বন্দুকের গুলি আর হাতের কাঁচা-পয়সা, এই দুই জিনিস হাতে থাকলেই খালি খরচ করতে মন চায়। হাত নিশপিশ করে। এই দুই জিনিস হাতে থাকনের পরও খরচ না কইরা থাকতে পারে খুব কম মানুষ। গুলিভর্তি বন্দুক হাতে লইয়াও গুলি না কইরা থাহাটাই আসল বন্দুক চালানি। এইটা শেখন দরকার সবার আগে।
তৈয়ব উদ্দিনের খাঁর এমন ভাবগম্ভীর কথাবার্তা খুব একটা বোঝে না এস্কান্দার। কিন্তু বন্দুকটার প্রতি তার খুব লোভ। যদিও সে জানে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে ভুলভাল বুঝিয়ে বন্দুক বের করা সম্ভব না। তারপরও মাঝে-মধ্যে সময় সুযোগ বুঝে সে খানিক চেষ্টা চরিত্র করে। তাতে অবশ্য লাভ বিশেষ হয় না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথা শুনে এস্কান্দার চুপ করে রইল।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আবার বললেন, তোর বন্দুক দরকার কেন সেইটা বল।
এস্কান্দার এবারও কোনো কথা বলল না। সে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, হামুকের বিলে কি হামুক ভাঙা পাখি আইছে? ওই পাখি তো শীতকালে আসনের কথা।
এস্কান্দারের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। সাথের এই মানুষটা যে তার কাছে কী, তা সে কোনোদিন কাউকে বোঝাতে পারবে না। সে কেমন কেমন করে যেন তার বুকের ভেতরটা দেখে ফেলে। শামুকের বিলে বারো মাস পাখি থাকে। শীতের দিকে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে শামুকভাঙা। বর্ষায় লাল শাপলার বিলে ধবধবে সাদা বকে ছেয়ে যায়। তবে শামুকভাঙাও কিছু থাকে। একখানা বন্দুক হলে বেশ হতো! বন্দুক হাতে নিয়ে কাঁধভর্তি শিকার করা পাখি শেকলের মতো ঝুলিয়ে হাঁটার খুব শখ এস্কান্দারের।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আরে গাধা। মানুষ মারনের বন্দুক আর পক্ষী মারনের বন্দুক এক না। পক্ষী মারনের বন্দুক আলাদা।
এস্কান্দার এবারো কোনো কথা বলল না। আজ কেন যেন সামান্য আশাবাদী হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁর শেষ কথায় সেই আশাটুকু হতাশায় পরিণত হলো। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আবারো ধীর পায়ে হাঁটা দিলেন। তার চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ। তারা হেঁটে হেঁটে সলিমুদ্দি দফাদারের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। সলিমুদ্দি দফাদার বেঁচে নেই। তার বৃদ্ধ অসুস্থ স্ত্রী একমাত্র পুত্রের সাথে শহরে থাকেন। চৌচালা ঘরের মূল দরজাখানা বাইরে থেকে তালা মারা। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অনেকক্ষণ সেই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সামনে বিস্তৃত উঠান। উঠান ঢেকে গেছে ঘন দূর্বা ঘাসে। সাথে বর্ষার হাওয়া জল পেয়ে কিলবিল করে বেড়ে ওঠা জংলি লতাপাতা। কিছু লতা সাপের মতো টিনের বেড়ার গা বেয়ে মাঝামাঝি অবধি উঠে গেছে।
সবুজ নাকি সব সময় প্রাণের স্পন্দন। অথচ এই বাড়ি, বাড়ির উঠান, ঘরের বেড়া অবধি এই যে এত গাঢ় সবুজ, তার সকলই কেবল প্রাণহীনতার গল্প বলছে। বলছে, এই বাড়িখানা শূন্য। এখানে মানুষ নেই, প্রাণ নেই, শব্দ নেই, কোলাহল নেই।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এই শূন্যতাকে তিনি খুব ভয় পান। তার এই দীর্ঘ জীবনে এমন কত দৃশ্য, কত গল্প যে তিনি দেখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। যৌবনের ভরভরন্ত, বেপরোয়া, প্রমত্ত মানুষকেও প্রৌঢ়ত্বে গিয়ে ভেঙেচুড়ে চুরমার হয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেছেন। সামান্য অনুগ্রহ ভিক্ষার জন্য নতজানু হতে দেখেছেন। যে বাড়ির দহলিজ ঘর জুড়ে রোজ শ’য়ে শ’য়ে মানুষের আনাগোনা হতো, শলিস বিচার বসতো, সেই বাড়ির দহলিজ ঘরের ভিটেয় লাউ, শিম, বড়বটির মাচা বসতে দেখেছেন। সেই মাচায় ঘুঘু, টিয়ের বাসা বসতে দেখেছেন। যে বাড়ির চুলায় রোজ মণকে মণ চালের ভাত, আস্ত খাসি, এক-দেড় মণ ওজনের মাছ রান্না হতো, সেই বাড়িতেও দিনের পর দিন আগুনবিহীন শূন্য চুলা তিনি দেখেছেন। দেখেছেন এক আধবেলা আহারের জন্য পাগলের মতো মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে সেই বাড়ির মানুষ! এই হলো জীবন। মানবজীবন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার আশিবছরের জীবনে এমন অসংখ্য গল্প দেখেছেন। অসংখ্য জীবনের গল্প। আর দেখেছেন বলেই তার ভয়। সবচেয়ে ভয় তার দুই পুত্রকে নিয়ে।
বড়জন খবির খাঁ তাও যতটুকু চোখ কান খোলা রেখে চলা মানুষ। বাবার ছায়ায় ভর করে চেয়ারম্যান অবধি সে হয়েছে। কিন্তু ছোটপুত্র দবির খা এই সকল কিছুরই বাইরে। সে বাড়ি ঘরে থাকে না। কই কই ঘুরে বেড়ায়! চার পাঁচ মাস পরে একবার আধবার বাড়ি ফেরে। আবার কখনো কখনো বছরও কেটে যায়। এই সময়ে বাড়ি ফিরে সে ধানের গোলা থেকে ধান, আঁখের গুড়ের জালা থেকে গুড়, সরিষা, সুপারি, বড় ডালপালাওয়াল বৃক্ষ এইসব বিক্রি করে টাকা জমায়। সেই টাকা নিয়ে দিন কয়েক পরে আবার উধাও হয়ে যায়। সে বিয়ে শাদি করেনি। এই নিয়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁও অবশ্য কখনো তাকে কিছু বলেননি। না বলার পক্ষে তার যুক্তিও রয়েছে।
তিনি খুব অল্পতেই বুঝতে পারছিলেন, এই ছেলেদের দিয়ে তার বংশ রক্ষা হবে না। তার চেয়ে নাতিদের দিকে নজর দেয়া জরুরি। তিনি খুব চাইছিলেন খবির খাঁর যেন পুত্র সন্তান হয়। আল্লাহ তার চাওয়া পূর্ণ করেছেন। খবির খাঁর দু’টি পুত্র সন্তান হয়েছে। বড়জনের নাম মবিন। ছোটজনের নাম মনির। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার এই দুই নাতিকে নিয়ে যারপরনাই হতাশ এবং চিন্তিত। আল্লাহ তার প্রার্থনা শুনেছেন। খবির খাঁর ঘরে দুটি ছেলে সন্তান তিনি ঠিকই দিয়েছেন। কিন্তু তাদের বোধ বুদ্ধি খুব একটা দেননি।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁর বেশিরভাগ চিন্তাভাবনাই তার আশেপাশের মানুষের কাছে অস্পষ্ট মনে হয়। কিন্তু কেউ সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। খবির খাঁও না। ফলে যেদিন বড় নাতি মবিনকে তিনি কুয়েত পাঠানোর কথা বললেন, সেদিন তার বড় পুত্র খবির খাঁ প্রচণ্ড রকমের অবাক হলেও এই সিদ্ধান্তের পেছনের প্রকৃত কারণটি জিজ্ঞেস করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি তিনি। এই সময়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আরো একটি কাজ করেছেন। সেটি হচ্ছে ছোট নাতি মনিরের নামে একখানা ব্যাংক একাউন্ট খুলিয়েছেন মাদারীপুর শহরে। সেই ব্যাংক একাউন্টের হিসেব দেখভাল করার দায়িত্বও পড়েছে মনিরের কাঁধে। এই দেখভাল, হিসেব-নিকেশ করতেই প্রতি মাসে একবার মাদারীপুর শহরের ব্যাংকে যেতে হয় মনিরকে।
মনিরের মতো কারো জন্য এটি ভারি কষ্টসাধ্য কাজ। এমনিতেই মনিরের টাকা-পয়সার দিকে তেমন আগ্রহ নেই। তার যত আগ্রহ তার সকলই কেবল মাছ ধরায়। তার ওপর ব্যাংকের মতো এমন জটিল বিষয়াদি! বড়ই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু গত চার বছরে মবিন কুয়েত থেকে যত টাকা পাঠিয়েছে মনিরের একাউন্টে, তার হিসেব-নিকেশ রাখতে গিয়ে মনির খানিকটা হলেও চোখা হয়ে উঠেছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সম্ভবত এই জিনিসটাই চাইছিলেন। নিজেকে সব সময় অপাংক্তেয়, অযোগ্য মনে করা মনির এই জটিল কাজটি করতে পেরে নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা শুরু করেছে। বছরখানেকের মধ্যে তার নিজেকে খানিকটা দায়িত্ববানও মনে হতে লাগল। সে এখন একা একাই ব্যাংক থেকে টাকা-পয়সার হিসেব-নিকেশ বুঝে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কাছে এসে তার বিস্তারিত হিসেব দেয়। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ পারতপক্ষে মনিরকে তার কাছে ঘেঁষতে দেন না। কেবলমাত্র এই হিসেব-নিকেশ করার সময়টুকু ছাড়া। তিনি এই সময়টুকুতে তীক্ষ্ণ নজরে মনিরকে পর্যবেক্ষণ করেন। মাঝে-মধ্যে তার মনে হয়, তিনি যা চাইছিলেন তেমনটাই হচ্ছে। আবার কখনো কখনো মনে হয়, তার এই এত এত পরিকল্পনা, শ্ৰম সকলই ভেস্তে গেছে।
রোদ উঠছে। গাছগাছালির ফাঁকে ভোরের আলোর আনাগোনা টের পাওয়া যাচ্ছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এস্কান্দারকে বললেন, চল, বাড়ির দিকে যাই।
এস্কান্দার বলল, আপনে বলছিলেন ফজু ব্যাপারী বাড়ির পিছের সুপারীর বাগান দেখতে যাইবেন।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যেন খানিক চমকালেন। বললেন, ও, তাই তো! চল, চল, বাগানটা দেইখাই যাই।
বেপারী বাড়ির পেছনের সুপারীর বাগান দেখতে যাওয়ার কথাটি যে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ভুলে গিয়েছিলেন, বিষয়টি তা নয়। বরং সেটি তার ভালো করেই মনে আছে। কিন্তু তিনি অবচেতন মনেই বজলু ব্যাপারীর বাড়ি, বাড়ির আশপাশটা এড়িয়ে চলতে চান। এমন না যে সেই বহুবছর আগে ভুলক্রমে খুন করে ফেলা বজলু ব্যাপারীর কথা মনে করে তিনি বজলু ব্যাপারীর বাড়ি এড়িয়ে চলেন। এই নিয়ে তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বোধও নেই। বরং কোনো এক অদ্ভুত কারণে তিনি বজলু ব্যাপারীর উপর ক্ষিপ্তই ছিলেন। তার কন্যা কোহিনূরকে নিয়ে সেই শৈশবে যখন বজলু ব্যাপারীর বাড়ির আমড়া গাছে বসে থাকার গুজব ছড়াল, সেই সময়ও তিনি প্রয়োজনের তুলনায় অধিক শাস্তিই বজলু ব্যাপারীকে দিয়েছিলেন।
বজলু ব্যাপারীর প্রতি এই সুপ্ত ক্ষোভের পেছনে একটা কারণ হয়তো রয়েছে, কিন্তু সেটি তেমন স্পষ্টও নয়। সেই কারণের কথা তৈয়ব উদ্দিন খাঁও প্রায় বিস্মৃত হতে চলেছেন। হয়তো সেই প্রায় বিস্মৃত ঘটনাই বজলু ব্যাপারীর প্রতি একটা সুপ্ত ক্ষোভ পুষে রাখতে তাকে অবচেতনেই সাহায্য করেছিল। তবে বজলু ব্যাপারীর ঘটনায় অনুশোচনা না থাকলেও নিজের ভেতরে ভেতরে অবচেতনে যে কিছু একটা রয়েই গেছে, তা তিনি টের পান। এই কিছু একটা কখনোই ধরতে পারেননি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। কিংবা নিজে নিজেই হয়তো অতি সতর্কতায় বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
আজ সুপারি বাগান দেখা শেষে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মন কেন যেন খানিকটা চঞ্চল হয়ে উঠল। তিনি হঠাৎ এস্কান্দারকে ডেকে বললেন, সলিমুদ্দি দফাদারের বাড়িখান দেখছস?
এস্কান্দার বলল, হ, দাদাজান। আহারে, কী বাড়ির কী সুরৎ হইছে!
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এইটাই দুইন্যার রীতি। কথায় আছে না, নদীর এই পাড় ভাঙলে, ওই পাড় গড়ে! আইজ যে আমির, কাইল সে ফইর? এইটা একটা গোল চক্করের মতো। ঘুইরা-ফিইরা এই চক্কর চলতেই থাহে। ওই সলিমুদ্দি দফাদারের দাদা, পর দাদারা এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বংশ আছিল। মাঝখানে মাত্র দুই-তিন পুরুষ। সেই বংশের এহন নাম-নিশানাও নাই। এই যে বজলু ব্যাপারী, তার পোলার নাম জানি কী? ফজু না? ফজলু ব্যাপারী?
এস্কান্দার বলল, জ্বে দাদাজান।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এই বজলু ব্যাপারীর বাপের দাদায় আছিল বিশাল ব্যবসায়িত। বালামি চাউলের নাওয়ে কইরা দ্যাশ-বিদ্যাশ জিনিসপত্র। লইয়া সওদা কইরা বেড়াইতো। তহন তো গাঁও গেরামের কারো হাতে নগদ টাকা-পয়সা কিছু থাকত না। কারো কাছে দুই একখান আধলি আছে মানে সে বড়লোক। সেই সময়ে সে দ্যাশ-বিদ্যাশে সওদা কইরা বহুত নগদ কাঁচা পয়সার মালিক হইছিল। বাহারি জিনিসপত্রও কিনত। একবার হুনছিলাম কোনো এক বন্দরে পানির দরে গয়না কিনছিল। বহুত পয়সার সোনার গয়না। সেই। গয়না লইয়াও আইছিল। কিন্তু গয়না থাহে নাই। বাজানের কাছে হুনছিলাম, সেই গয়না নাকি সে কিনা আনে নাই। কোনো জমিদারের বিরাট বজরা। ডুবছিল, বজরার যাত্রীরা কেউ বাঁচে নাই। পরের দিন তার নাও ভিড়ছিল সেই বজরার ধারে। লাশগুলা আশেপাশে সব ভাইস্যা উঠতেছিল। মহিলাগো সংখ্যাই আছিল বেশি। সব জমিদারের মাইয়া, বউ, নর্তকী এইসব। তাগো শরীলভর্তি আছিল সোনার গয়না। সে নাকি সেইসব লাশের শরীলেরতন সেই গয়না ছুটাই আনছিল। শোনা কথা। বাজানে ছোট থাকতে আমারে কইছিল।
এস্কান্দার হা করে তাকিয়ে আছে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দিকে। সে কৌতূহলবশত বলল, হেরপর? হেই গয়নার কী হইছে?
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ব্যাপারী সাবের নাকি বউ আছিল তিন জন। সেই গয়নার ভাগ নিয়া তিন সতিনের মইধ্যে লাগল ঝগড়া। ঝগড়া তো ঝগড়া, একদম রক্তারক্তি কাণ্ড! সেই ঝগড়া গড়াইল চুলাচুলি পর্যন্ত। ব্যাপারী সাবে শেষমেশ সিদ্ধান্ত দিলেন, বড় বউ পাইব সবচেয়ে বেশি। তারপর পাইব মাইঝ্যা। বউ। আর সবচাইতে কম পাইব ছোট বউ। ব্যাপারী সাবরে সামনাসামনি সবাই খুব ডরাইতো, এইজন্য তহন আর কেউ উচ্চবাচ্য কিছু করে নাই। কিন্তু দিন দুই বাদে ব্যাপারী সাব গেছেন গঞ্জে। আইস্যা দেহেন বাড়ির উঠানে বড় বউ আর মাইঝ্যা বউর লাশ। ছোট বই তাগো খাওনে বিষ দিয়া রাখছিল। কিন্তু সারা বাড়ি খুইজ্যাও আর ছোট বউরে পাওয়া গেল না। তারে পাওয়া গেল দুই তিন দিন পর গাঙের পানিতে। সে রাগের মাথায় বিষ দিয়া দুই সতীনরে মারছিল ঠিকই, কিন্তু মারনের পর আর নিজেরে সামলাইতে পারে নাই। নিজেও গাঙের পানিতে ডুইব্যা মরছে।
এস্কান্দার উদ্বিগ্ন গলায় বলল, সেই গয়নার কী হইছে?
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এইটাই রহস্য। সেই গয়না আর কেউ খুঁইজ্যা পায় নাই।
এস্কান্দার আরো একবার ভারি হতাশ হলো। সে বলল, কেউ পায় নাই? তাইলে গেল কই?
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সেইটা কেউ জানে না। তয় সবাই বলছিল, ছোট বউ সেই গয়না কোনো কলসে ভইরা, সেই কলসি গলায় বাইন্ধাই গাঙে ঝাঁপ দিছিল। সে ডুইবা মরছে। দিন কয়েক পর ভাইস্যাও উঠছে তার লাশ। কিন্তু সেই কলসি আর ওঠে নাই। সেই সময় গাঙ আছিল বিরাট বড়। এই কূল ওই কূল ঠিক আছিল না। সেই গাঙে তো আর সেই কলসি খোঁজন যায় না। তারপরও নানান সময় নানান মানুষজন সাধ্যমতো চেষ্টা করছিল, কিন্তু কেউ পায় নাই। আর আল্লাহরই এমন কুদরত। সেই ঘটনার পর থেইক্যা শুরু হয় ব্যাপারী সাবের পতন। এক ঝড়ে মালামাল সহ নাও ডোবল। ব্যবসায় একের পর এক লোকসান। এর মধ্যে তার হইল কালা জ্বর। তিন দিনের মধ্যে মারা গেলেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যে সেই বংশ পথের ফইর হইয়া গেল।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। তাকে সত্যি সত্যিই দুঃখিত মনে হচ্ছে। তিনি নিজে এইসব ঘটনা মনে করেই নানাভাবে চিন্তিত। একটা চক্র যেন ঘুরছে। সেই চক্র কাউকে তুলে দিচ্ছে শ্রেষ্ঠত্বের, প্রাপ্তির শীর্ষে। আবার কাউকে শীর্ষ থেকে মুহূর্তে নামিয়ে আনছে মাটিতে। এটাই তার ভয়। তিনি ভাগ্যে, অদৃষ্টে বিশ্বাস করা মানুষ। তারপরও চেষ্টা বলে একটা ব্যাপার আছে। দূরদৃষ্টি আর চেষ্টা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ফজু ব্যাপারীর বাড়ির পাশের খেতের আইল ধরে হেঁটে রাস্তায় উঠলেন। তারপর হঠাৎ কী মনে হতে গলা চড়িয়ে ফজু ব্যাপারীকে ডাকলেন, ফজলু, ও ফজলু বাড়ি আছনি?
এস্কান্দার আজ তৈয়ব উদ্দিন খাঁর আচরণে যথেষ্টই অবাক হচ্ছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এভাবে অন্য বাড়ির কাউকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে ডাকার মানুষ নন। সে বলল, দাদাজান, আমি ডাকব?
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, দেখ তো বাড়িতে কেউ আছেনি? অগো বাড়ির ভিটার মাটি তো বিষ্টিতে ধুইয়া সব আমার জমিনে নাইম্যা যাইতেছে। ডাক তো ফজুরে।
এস্কান্দার হন্তদন্ত হয়ে ফজু ব্যাপারীর বাড়ি ঢুকল। ফজুর ঘরের দরজা খোলা। এস্কান্দার বারকয়েক গলা চড়িয়ে ফজু ব্যাপারীকে ডাকল। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিলো না। বাড়ির উঠান পেরুলেই ডান দিকে ঢাল। ঢাল আরো খানিকটা ভোলা সমতল জায়গা রেখে আবার নেমে গেছে খালে। সে সেই ঢাল বেয়ে ফজু ব্যাপারীকে উঠে আসতে দেখল। তার সাথে আরো দুই অল্পবয়স্ক ছেলে। এস্কান্দার ফজু ব্যাপারীকে দেখে বলল, ও ফজু, বাড়িঘর ফাঁকা রাইখ্যা, দুয়ার খোলা রাইখ্যা কই থাহো? কতক্ষণ ধইরা গলা ফাটাইয়া ডাকতেছি?
ফজু বলল, আমাগো আর বাড়ি ঘর! দুয়ার খোলা থাকলেই কী, আর না থাকলেই কী! ঘরে কী আর কিছু আছে যে মাইনষে নিব?
এস্কান্দার বলল, বড় খাঁ সাব আইছেন। রাস্তায়। তোমার লগে যেন কী কথা বলবেন।
ফজু হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত সে দিশেহারার মতো করতে লাগল। তারপর দৌড়ে ঘরে ঢুকল। ঘর থেকে একখানা চেয়ার বের করে উঠানের ছোট আমগাছটার ছায়ায় রাখল। তারপর গলা চড়িয়ে স্ত্রী সালেহাকে ডাকতে লাগল। রাতের এঁটো বাসন ধুতে সালেহা গিয়েছে খালে। সে খালপাড় থেকেই চেঁচিয়ে জবাব দিলো। ফজু বলল, বড় খাঁ সাবে আসছে। তুমি তাড়াতাড়ি ঘরে আসো। তারে কিছু খাইতে তো দিতে হবে!
সালেহা কি বলল, তা আর শোনা গেল না। ফজু দৌড়ে ছুটে রাস্তায় গেল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ভাবছিলেন তিনি আর বাড়িতে ঢুকবেন না। কিন্তু তাকে বাড়িতে ঢুকতেই হলো। তিনি অতি সামান্য কিছু কথাবার্তা বললেন ফজু ব্যাপারীর সাথে। কিন্তু উঠতে যেতেই ফজু বলল, বেয়ান বেলা অনেক হাঁটছেন। এক গেলাস লেমুর শরবত খাইয়া যান দাদাজান।
সে সালেহাকে গলা চড়িয়ে ডাকল। সালেহা ফুল ভোলা কাঁচের গ্লাসে লেবুর শরবত নিয়ে এলো। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এতক্ষণ বোঝেননি যে তার কী প্রবল তেষ্টা পেয়েছে। তিনি সাধারণত বাড়ির বাইরে কোথাও কিছু খান না। কিন্তু সালেহার হাতে শরবতের গ্লাস দেখে তার বুকটা কেমন হাঁসফাঁস করতে লাগল। তিনি সালেহার হাত থেকে গ্লাসটা নিলেন। তারপর ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পুরো গ্লাস শেষ করে ফেললেন। সালেহা তার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি হঠাৎ গ্লাসটা আবার বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরেক গ্লাস দেও তো।
সালেহা শরবত বেশিই করেছিল। সে ঘর থেকে আরো এক গ্লাস শরবত নিয়ে এলো। গ্লাসটা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাতে দিয়ে সে সামান্য সরে গিয়ে দাঁড়াল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঢকঢক করে শরবত খেতে গিয়ে আচমকা স্থির হয়ে গেলেন। তার চোখ আটকে গেল সালেহার বাহুতে। তার বাহু কামড়ে ধরে বসে আছে একখানা বাজু। সোনার বাজুবন্দ।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁর অভিজ্ঞ চোখ সেই সোনার বাজুবন্দে চুম্বকের মতো আটকে রইল। তিনি শরবত থেকে আর পরের ঢোক নিলেন না। আসলে পরের ঢোক নিতে তিনি ভুলে গেছেন। সালেহার বাহুতে এই গয়না কোত্থেকে এলো? এই গয়নার নকশা তার চেনা। এই নকশা চিনতে তার ভুল হবার কথা না।
*
হেমা খবরটা শুনে দীর্ঘ সময় স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। তার ধারণা ছিল আজকাল কোনোকিছুই তাকে সেভাবে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। সে সংবাদটা নিতে পারছিল না। তার মা’র সাথে সব সময়ই একটা দূরত্ব তার ছিল। রেণু গম্ভীর, অন্তর্মুখী-স্বভাবের স্বল্পভাষী মানুষ। এই কারণেই কারো সাথেই তার আলাদা করে তেমন একটা বন্ধুত্ব বা সখ্যতা হয় না। সে তুলনায় বাবা আহমেদ আসলাম ঝলমলে প্রাণবন্ত মানুষ। চট করে মানুষের মনে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা তার রয়েছে। তিনি গল্প-আড্ডায় সকলের মধ্যমণি হয়ে থাকেন। ভালো গান গাইতে পারেন। সেন্স অফ হিউমার ভালো। দেখতে সুদর্শন। সব মিলিয়ে তার বাবা-মা দু’মেরুর দুজন মানুষ।
সেই দু’মেরুর দুজন মানুষের মধ্য থেকে তাই আর সকলের মতো হেমারও তার বাবার সাথেই সম্পর্কটা ভীষণ গাঢ়। হেমা বাবার সাথে তার কত কী যে শেয়ার করে! নয়নের সাথে তার সম্পর্ক থেকে শুরু করে রাহাতের গল্প। ক্লাসে ঘটে যাওয়া কোনো মজার ঘটনা থেকে শুরু করে কোনো বান্ধবীর দুম করে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলা অবধি। আবার দর্শন, আর্ট, রাজনীতির মতো গুরুতর বিষয় নিয়েও তাদের দীর্ঘ আলাপ চলে।
নয়নকে আসলাম সাহেবের পছন্দ। পছন্দের কারণ এই নয় যে, নয়নের কোনো কর্মকাণ্ডে তিনি দারুণভাবে মুগ্ধ। বরং তার মনে হয়েছে, নয়ন আর হেমাও দুই মেরুর দুজন মানুষ। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কারণে হলেও এদের পরস্পরকে পরস্পরের দরকার। সেখানে একজন ছায়া বিছিয়ে দিলে, সেই ছায়ায় নির্ভার আশ্রয় খুঁজে পরম শান্তিতে ডুবে থাকতেও তো অন্য একজনকে দরকার। হেমা ছায়াময়ী বৃক্ষ হলে নয়ন সেই অন্য কেউ।
বারকয়েক নয়নের সাথে আসলাম সাহেবের কথাও হয়েছে এবং সেই থেকে আসলাম সাহেবের একটা বদ্ধমূল ধারণা, হেমার জন্য নয়নকে যতটা না দরকার, তার চেয়ে হেমাকেই ঢের বেশি দরকার নয়নের। হেমা যেন লতিয়ে ওঠা কোনো গাছের পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খুঁটি। এই অদ্ভুত বিষয়টা কী করে এমন অল্প বয়সেই হেমা রপ্ত করে ফেলল, আসলাম সাহেবের কাছে তা এক বিস্ময়।
জোছনা রাতে বাপ-মেয়ে মিলে যখন এইসব নানান বিষয় নিয়ে খোলা ছাদে খোশগল্প চলে, তার মা রেণু তখন পরীক্ষার খাতা দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে হাই তোলেন। এই সময়ে মাকে ডাকতে এসে মাঝে-মধ্যে তার গম্ভীর গলার ধমকও হেমা খেয়েছে। ফলে মা তার কাছে যতটা না মা, তার চেয়েও বেশি হয়ে উঠেছেন রাগী স্কুল শিক্ষক। আর বাবা হয়ে উঠেছেন ক্রমশ বন্ধু।
খানিক আগে মেজো খালার ফোনটা পেয়ে প্রথমে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি হেমার। এমনিতেই নানা বাড়িতে খুব একটা যাওয়া-আসা নেই তাদের। কোনো এক অদ্ভুত কারণে রেণুও চান না, এই যোগাযোগটা থাকুক। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই হেমার নিজের একটা আলাদা জগৎ গড়ে উঠেছিল। ফলে আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে সেও কখনোই তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো যেন এই পরিবারটি। হেমার নানা-নানীও বেঁচে নেই, ফলে কেবল এই মেজোখালাই কালেভদ্রে ফোন দিয়ে খবর নেন। যদিও সেই ফোনের বেশিরভাগ সময় জুড়েই থাকে নানান অভিযোগ-অনুযোগ।
কিন্তু মেজোখালা আজ ফোন দিয়েই কড়া গলায় বললেন, এত বড় ধাড়ি মেয়ে হয়েছিস, খোঁজ-খবর কিছু রাখিস?
হেমা স্বাভাবিক গলায় বলল, কী হয়েছে খালা?
মেজো খালা বললেন, আবার জিজ্ঞেস করছিস কী হয়েছে? তোর বাবা কি করেছে শুনেছিস?
হেমা বলল, কী করেছে?
মেজো খালা ঝাঁঝালো গলায় বললেন, তুই কিছু শুনিসনি? কিছু জানিস না? নাকি বাপের চরিত্র সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনতে চাস না?
হেমার এবার বিরক্ত লাগতে শুরু করল। সে বিরক্ত গলায় বলল, খালা যা বলার স্পষ্ট করে বলো। এত পেঁচিও না।
মেজো খালা যেন রেগে গেলেন। তিনি গলা চড়িয়ে বললেন, আমি প্যাঁচাই না? আমি পাচাই? যা আর প্যাচাব না। এখন সৎ মা ঘরে আসলে তার গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ কর। সে সব প্যাঁচ খুলে দিবে। ধাড়ি মেয়ে হয়েছে, কিন্তু বাপ যে কোথায় কোন নষ্টামি করে বেড়ায় সে খেয়াল নেই! বাপ যে তলে তলে বছরখানেক আগেই আরেকটা বিয়ে করেছে, সে খবর রাখিস? রাখিস না। আমরা আর কে? আমরা এতদিনও কিছু ছিলাম না। আর এখন তো আরো থাকলাম না। এখন নতুন মা হয়েছে, নতুন খালাও হবে। তারা খুব আদর আহ্লাদ করবে।
হেমার আর কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। সে ফোনটা কেটে দিলো। তার বাবা বিয়ে করেছেন! বাবা-মায়ের মধ্যে সব সময়ই একটা শীতল দূরত্ব। তবে সেটি যে মায়ের কারণেই সে বিষয়ে সে এতদিন ধরেই নিশ্চিত ছিল। তাছাড়া বাবাকে তার সবসময়েই বুদ্ধিমান, সংবেদনশীল মানুষ বলেই মনে হয়েছে। সে নানান ঘটনায় দেখেও এসেছে যে বাবা মার মাঝে শীতল পরিবেশটা বিভিন্ন উপায়ে উষ্ণ করার চেষ্টাটা সব সময় বাবাই করতেন। মা বরং তাতে খুব একটা সাড়া দেননি। বাবার প্রতি প্রবল আস্থা ছিল বলেই সে কখনো এই বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলতে বা কারো কাছ থেকে কিছু শুনতেও যায়নি।
হেমা চুপচাপ বসে রইল। রেণু কলেজ থেকে ফিরলেন সন্ধ্যাবেলা। হেমার। হঠাৎ মনে হলো আজ মার সাথে সে কিছুক্ষণ কথা বলবে। কিন্তু কেমন একটা আড়ষ্টতা কাজ করছিল তার মধ্যে। মাকে গিয়ে কী বলবে সে?
হেমা শেষ অবধি গেল না। তার মধ্যে এখনো একটা দ্বিধা কাজ করছে! বাবা এমন একটা কাজ করতে পারে এটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। বাবার সাথে তার কথাও হচ্ছে না বেশ কিছুদিন। সে কি বাবাকে একটা ফোন করবে? হেমা পুরোটা সন্ধ্যা বারান্দায় বসে রইল। আজকাল ইলেক্ট্রিসিটি খুব যাচ্ছে। সন্ধ্যা হতে না হতেই দপ করে নিভে যায় আলো। আজও গিয়েছে। সে চুপচাপ বসে রইল বারান্দায়। কাঁধের উপর আলতো হাতের স্পর্শে হেমা চমকে উঠল। সে ভেবেছিল মা। কিন্তু হেমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তার বাবা। বাবার মুখে সেই ঝলমলে ভাবটা নেই। খানিক চিন্তিত, বিষাদগ্রস্ত ভাব। আসলাম সাহেব বললেন, একটু আমার সাথে আসবি?
হেমা বাবার কথার জবাব দিলো না। তবে সে উঠে দাঁড়াল। বাবার পেছন পেছন সে তার ঘরে ঢুকল। আসলাম সাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ শান্ত হয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেন, বিষয়টা তোকে আগেই জানানো উচিত ছিল। কিন্তু কিছু বিষয় নিয়ে আমার কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
হেমা এবারও কথা বলল না। আসলাম সাহেব বললেন, কথা বলতে ইচ্ছে না করার পেছনে কারণ রয়েছে। খুবই যৌক্তিক কারণ। কিন্তু এই যৌক্তিক কারণগুলো বেশিরভাগ মানুষের কাছেই মনে হবে যুক্তিহীন।
হেমা বাবার দিকে মুখ তুলে তাকাল। আসলাম সাহেব বললেন, তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। আমার ধারণা তোর বয়সের আর আট দশটা মেয়ের চেযে তোর বোঝাবুঝিও যথেষ্ট পরিণত। তারপরও আমি বিষয়গুলো নিয়ে কখনো তোর সাথে কথা বলবার মতো সাহস করে উঠতে পারিনি।
হেমা এবার কথা বলল। সে শান্ত, স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি কী বিয়ে করেছ?
আসলাম সাহেব সামান্য সময়ের জন্য থমকে গেলেন। তারপর হঠাৎ হেসে উঠে বললেন, আমি বিয়ে না করলে তুই কোত্থেকে এলি?
হেমা হাসল না। সে একইভাবে গম্ভীর গলায় বলল, আমি ঠাট্টা করছি না বাবা। সত্যিটা জানতে চাইছি।
আসলাম সাহেব বললেন, আরো অনেকেই আমাকে ফোন করে জানতে : চাইছে। কেউ কেউ সরাসরি। কেউ কেউ আকারে-ইঙ্গিতে। সমস্যা হচ্ছে, আমার বিয়ের খবরটা আমি ছাড়া অনেকেই জানে।
সামান্য কথা। কিন্তু হেমার বুক থেকে যেন পাথর ভার নেমে গেল। আসলাম সাহেব এবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। খানিকটা এলোমেলো পায়চারি করে আবার এসে বসলেন। তারপর বললেন, কিন্তু আমি এখন যেটি বলব সেটিও কম কষ্টকর কিছু না।
হেমা মুহূর্তের মধ্যে আবার থমকে উঠল। তবে এবার আর কোনো কথা বলল না। আসলাম সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন, উই আর গেটিং ডিভোর্স।
তিনি খানিক থামলেন। হেমা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে যেমন করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, তেমনই তাকিয়ে রইল। আসলাম। সাহেব বললেন, সিদ্ধান্তটা হঠাৎ নয়। দীর্ঘদিনের ভাবনা, প্রস্তুতির ফসল। আর একটা কথা, আশা করি বাবাকে তুই চিনিস। সে এমনি এমনি এই সিদ্ধান্ত নেয়নি। সে আর এই সম্পর্কটা বইতে পারছিল না।
হেমা বলল, তুমি কি অন্য কোনো রিলেশনে ইনভলভড বাবা?
আসলাম সাহেব হাসলেন। মলিন হাসি। তারপর বললেন, এই বয়সে কি অন্য কোনো সম্পর্কে ইনভলভড না হলে মানুষ ডিভোর্স নেয় না?
হেমা বলল, নাহ্। নেয় না। নিলে সবচেয়ে বেশি এই কারণটাতেই নেয় বাবা। তোমার বয়স কত এখন? অলমোস্ট ফিফটি? এই বয়স থেকেই মানুষের ক্রমশই নির্ভরতা দরকার হয়। তার স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজনরা তার সেই নির্ভরতা। যদি না এর চেয়ে বেশি কোনো নির্ভরতার সন্ধান সে পায়, তাহলে সে কেন এত বছরের সম্পর্কটা ভাঙবে বলো?
আসলাম সাহেব বললেন, নির্ভরতাটা কিসের?
হেমা সাথে সাথে জবাব দিতে পারল না। সে খানিক চুপ করে রইল। তারপর বলল, লাভ? কেয়ার?
আসলাম সাহেব বললেন, নির্ভরতাটা একেকজনের কাছে একেক রকমের। মানুষ এই যে বেঁচে থাকে। এই বেঁচে থাকার পুরোটা সময় জুড়ে সে কি চায় জানিস?
হেমা বলল, কী?
আসলাম সাহেব বললেন, শান্তি। আনন্দ। মানুষ যা-ই করুক, তার মূল লক্ষ্য হলো শান্তি। ধর কেউ কারো ক্ষতি করছে। কিন্তু মানুষ কেন কারো ক্ষতি করবে? সে কারো ক্ষতি করছে নিজের শান্তির জন্য, লাভের জন্য, আনন্দের জন্য। এই যে ধর মানুষ ধর্ম পালন করে। পুরো পৃথিবী জুড়ে এই যে এত এত ধর্ম। এই প্রতিটি ধর্মের মানুষই ধর্ম পালন করে তার শান্তির জন্য। তারা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে, সে তার ধর্ম পালন করলে, মৃত্যুর পর সে অনন্ত শান্তি পাবে। আবার সে তার এই শান্তির জন্য কিন্তু অন্যের অশান্তির কারণও হচ্ছে! হচ্ছে না? খুন-খারাবি, যুদ্ধ-হানাহানি। রোজ রোজ কত কত কিছু। এই সকল কিছুর পেছনেই কিন্তু যুক্তি এই একটাই, সকলেই তার মতো করে শান্তি চায়। কেউ শান্তির পাওয়ার জন্য খারাপ কাজ করে, খুন করে, কেউ শান্তি পাওয়ার জন্য জীবন বাঁচায়, ভালো কাজ করে। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে, সেটি ভালো হোক আর মন্দ, তার পেছনে রয়েছে কারো না কারো শান্তিতে থাকার, আনন্দে থাকার কারণ।
হেমা বলল, তুমি আর মার সাথে থাকতে আনন্দ পাচ্ছ না? শান্তি পাচ্ছ না?
আসলাম সাহেব বললেন, আমি একা না। সেও পাচ্ছে না। আমরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না।
হেমা বললে, ডিভোর্স নেয়ার মতো এমন তিক্ততা কতদিন থেকে বাবা?
আসলাম সাহেব সাথে সাথে জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, এমন অনেকবারই হয়েছে। কিন্তু এবার আর কোনো সুযোগ নেই।
হেমা মৃদু হাসল। তারপর বলল, কেন? তুমি কি এর চেয়ে শন্তিপূর্ণ আর কারো খোঁজ পেয়ে গেছ?
হেমার ওই মৃদু হাসিটুকুতে কী ছিল কে জানে! আসলাম সাহেব সামান্য অপ্রস্তুত হলেন। হেমা বলল, আমি বড় হয়েছি বাবা। মার থেকে তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক বেশি ফ্রেন্ডলি। তুমি বিষয়টা আমার সাথে শেয়ার করতে পারতে। আমার সব সময়ই তোমার প্রতি আলাদা একটা সমীহ কাজ করত। মনে হতো, জগতের কোনো সমস্যাই তোমার কাছে সমস্যা না। তুমি সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারো। আর…
হেমা কথা শেষ না করেই থেমে গেল। আসলাম সাহেব অবশ্য সাথে সাথেই হেমার কথা ধরলেন। তিনি বললেন, আর এই সামান্য সমস্যাটা আমি কেন মেটাতে পারলাম না, তাই তো?
তিনি প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে হেমার চোখের দিকে তাকালেন। হেমাও তাকিয়ে আছে তার দিকে। আসলাম সাহেব বললেন, তোর কি কখনো মনে হয়েছে, এই ঝলমলে হাসিখুশি আমি মানুষটার ভেতর প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ একজন মানুষ বাস করে? মনে হবার কথা না। আমি কাউকে কখনোই মনে হতে দিতে চাইনি। বছরের পর বছর আমি চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এই দীর্ঘ জীবনে এমন কখনো হয়নি যে আমি দেরি করে ঘরে ফিরে দেখেছি যে তোর মা আমার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করছে। এমন কখনো হয়নি। আমি জগতের আর সকলের কাছে স্বতস্ফূর্ত একজন মানুষ। কিন্তু এই একজন মানুষের কাছে আমি সারাটা জীবন কুঁকড়ে থেকেছি, জড়তায়, অপরাধবোধে।
হেমার আজ মুহুর্মুহু চমকে যাবার দিন। কই, এই এতদিনে হেমা কখনোই তো শোনেনি যে মার সাথে বাবা এমন কিছু করেছে, যার জন্য বাবা এমন প্রবল অপরাধবোধে ভুগছে! সে সরু চোখে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল, তারপর জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে ডাকল, বাবা!
আসলাম সাহেব বললেন, তোর মার সাথে আমার বিয়েটা স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। তুই জানতি, তোর নানা আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তার কোনো পুত্রসন্তান ছিল না বলেই কিনা জানি না, তিনি আমাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। প্রচণ্ড একগুয়ে মানুষ ছিলেন তিনি। পরিবারে তার কথাই শেষ কথা। সেই সূত্রেই এই বিয়ে। কিন্তু এর ভেতরে একটা অস্বাভাবিক গল্পও রয়েছে। এই গল্পটা একজন বাবার পক্ষে তার সন্তানকে শোনানো কঠিন।
আসলাম সাহেব চোখ থেকে চশমা খুলে শার্টের হাতায় চশমার কাঁচ মুছলেন। তারপর বললেন, বিয়ের যখন সবকিছু ঠিকঠাক, তখন, একদম শেষ মুহূর্তে এসে রেণু আমাকে একটা চিঠি লিখল। সে লিখল, সে এই বিয়ে করতে পারবে না। কারণ, তার বিয়ে হয়ে গেছে! রেণুর বয়স তখন বেশি না। ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। সদ্য ইউনিভার্সিটি পাশ করা একটা ছেলে রেণুকে পড়াত। সেই সূত্রেই প্রেম। ছেলেটা তখনও চাকরি-বাকরি কিছু পায়নি। অল্প বয়সের সম্পর্ক। রেণু লুকিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল। কিন্তু এই ঘটনা বাসায় কেউ জানে না। ছেলেটা তখনও রোজ বাসায় এসে তাকে পড়িয়ে যায়। এদিকে একদম শেষ মুহূর্তে এসে সে এই ঘটনা আমাকে জানাল। তখন বিয়ের মাত্র দু’দিন বাকি। বিয়ের বিশাল আয়োজন। কী করব তখন আমি?
আসলাম সাহেব সামান্য থামলেন। যেন তিনি হেমার কাছে সমস্যার সমাধান চাইছেন। কিন্তু হেমার মনে হচ্ছে এই মানুষটি যে গল্প তাকে বলছেন, তা পুরোপুরি অসম্ভব কষ্টে-সৃষ্ট একটা গল্প। এই গল্পটি তিনি খুব একটা না ভেবেই তৈরি করছেন। এমন হয়, মানুষ যখন কোনো দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ভেঙে দিতে চায় তখন সে নানান অজুহাত দেয়। হাজারটা যুক্তি দেয়, হাজারটা কারণ দেখায়। হেমার মনে হচ্ছে তার বাবাও তেমন কিছুই করছেন। কিন্তু গল্পের প্লটটা খুব আনাড়ি আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অবাস্তব হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হেমা এর শেষটা শুনতে চায়।
আসলাম সাহেব বললেন, রেণু আমাকে বলল, সে চায়, আমি যেন বিয়েটা ভেঙে দেই। কিন্তু বিয়ে ভাঙার কারণ হিসেবে যেন কোনোভাবেই সত্যটা না বলি। অন্য কোনো কিছু আমাকে বলতে হবে। কারণ তার বাবা তখন অসুস্থ। রেণু তার জেদটা পেয়েছে তার বাবার কাছে থেকেই। আর সে এও জানে, এই ঘটনা জানার পর এর প্রতিক্রিয়া মোটেই ভালো কিছু হবে না। কিন্তু আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। কাল বাদে পরশু বিয়ে, কত কত আয়োজন, গ্রাম থেকে আত্মীয়-স্বজন সব ঢাকায় চলে আসছে। আরো হাজারটা বিষয়। ভয়াবহ অবস্থা। পাগলের মতো হয়ে গেলাম আমি। কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। বিয়ের আগের দিন আমি উভ্রান্তের মতো রেণুদের বাসায় গেলাম। আমার তখন মাথা কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল, এই সমস্যার একমাত্র সমাধান রেণুর বাবা। আমি তার কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। রেণুর চিঠিটা তাকে দেখালাম। আমি ভেবেছিলাম ঘটনা শুনে তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করবেন। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই করলেন না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তার এক ল’য়ার বন্ধুকে ফোন দিয়ে বাড়িতে আনালেন। আনালেন ছেলেটাকেও। তারপর রেণুকে ডেকে শান্ত গলায় বললেন যত দ্রুত সম্ভব সে যেন ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে। রেণু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তিনি হঠাৎ ভয়াবহ চড় বসালেন রেণুর গালে। রেণু ছিটকে পড়ল মেঝেতে। তারপরের কিছু সময় তিনি রীতিমত উন্মাদ হয়ে গেলেন। কেউ তাকে থামাতে পারছিল না। রেণু সবার সামনে মরা মানুষের মতো পড়ে রইল মেঝেতে।
আসলাম সাহেব জগ থেকে ঢেলে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেললেন। তারপর বললেন, সেখানেই তখনই ডিভোর্সের ফর্মালিটিজ হয়ে গেল। কিন্তু ডিভোর্সের কিছু প্রসিডিওর থাকে। তাতে কিছুদিন সময়ও লাগে। এবং ডিভোর্সের পরও একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগ অবধি আবার বিয়ে হতে পারে না। কিন্তু রেণুর বাবা বললেন, বিয়ের অনুষ্ঠান যেমন হবার কথা ছিল, তেমনই পরদিনই হবে। কিন্তু বিয়ে হবে আরো পরে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! পৃথিবীতে এমন ঘটনা আর হয়েছে কিনা জানি না। আগে বিয়ে হয়ে পরে অনুষ্ঠান হবার ঘটনা অহরহই ঘটে। কিন্তু আমাদের ঘটল সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। রেণুর সাথে পরদিন জাঁকজমকভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। কিন্তু বিয়েটা হলো না। সবাইকে জানানো হলো ঘরোয়াভাবে বিয়ে আগেই হয়ে গেছে। কেবল অনুষ্ঠানটাই বাকি ছিল। রেণু থেকে গেল তাদের বাড়িতেই। আসল বিয়ে হলো সব সমস্যা সমাধান হবার পর। এর মধ্যে রেণুকে আর ঘর থেকে বের হতে দেয়া হলো না। আমি আমার দিকটা সামলালাম। ওই সময়টা আসলে আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রেণুর বাবা যা বলতেন, অন্ধের মতো সেটাই করতাম। এরপর পঁচিশ বছর। এই পঁচিশ বছর আমি এমন কিছু নেই যা করিনি। রেণু যাতে আমাকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভালোবাসে। সামান্যতম হলেও যেন একজন স্বাভাবিক স্ত্রীর মতো আচরণ করে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমি সেই চেষ্টাটা করে গেছি। পঁচিশটা বছর, কিন্তু একমুহূর্তের জন্যও সে আমাকে বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয়নি।
আসলাম সাহেব সামান্য থেমে আবার বললেন, প্রথম দিন থেকেই সে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি তখন ভেবেছি, যে অন্যায়টি আমি করেছি, সময়ের সাথে সাথে আর আমার চেষ্টায় সেই অন্যায়টি হয়তো মুছে দিতে পারব আমি। কিন্তু পারিনি। আমি রেণুর কষ্টটা বুঝেছি। দিনের পর দিন তার সেই কষ্টকর অনুভূতি মুছে দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা আমি করেছি। কিন্তু পারিনি। অথচ এই আমার একটা জীবনও কিন্তু আমি নষ্ট করেছি। সবাই বলতো একটা বাচ্চা-কাচ্চা হলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে সেটিও চায়নি। অনেক যুদ্ধের ফসল তুই। কিন্তু কিছু বদলায়নি। তুই তখন ছোট। আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছি। পথে ভয়াবহ বাস এক্সিডেন্ট হলো। তিনজন স্পট ডেড। হাসপাতাল থেকে রেণুকে খবর দেয়া হলো। রেণু সেই খবর জানালো তার বাবাকে। ব্যস। তিনি ছুটে গেলেন আমাকে দেখতে। কিন্তু রেণু একটা। ফোন অবধি করেনি। হাসপাতালে দেখতেও যায়নি। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে বাসায় ফেরার পরও সে একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করেনি, কেমন আছ! কি হয়েছে!
আসলাম সাহেবের গলা ভারি হয়ে এসেছে। তিনি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলালেন। তারপর ভেঁজা গলায় বললেন, এই একটা জীবন আমি কাটিয়ে দিয়েছি সেই মানুষটার সাথে, যে আমাকে প্রতিমুহূর্তে কেবল ঘৃণা করেছে, উপেক্ষা করেছে। আর তার প্রতি আমার অনুভূতিটাকে সে জগতের সবচেয়ে সস্তা জিনিস হিসেবে প্রতিমুহূর্তে ছুঁড়ে ফেলেছে। আমি সেইসব গল্প তোকে বলতে পারব না। এই যে এতসব বলে ফেললাম, হয়তো বাবা হিসেবে এইসব কিছুও তোকে বলা আমার ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি আর পারছিলাম না।
আসলাম সাহেব চশমা খুলে চোখ মুছলেন। হেমা বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবার জন্য তার মায়া হবার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে কেন যেন তা হচ্ছে না। বরং মা’র সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। একটা মানুষ বুকের ভেতর কী করে কারো জন্য সুদীর্ঘ সময় এমন তীব্র ভালোবাসা যত্ন করে পুষে রাখে? আবার একইসঙ্গে এমন তীব্র ঘৃণা পুষে রাখে!
আসলাম সাহেব দীর্ঘ সময় বসে রইলেন হেমার সামনে। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন হেমা তাকে কিছু বলবে। কিন্তু হেমা কিছুই বলল না। সে বসে রইল চুপচাপ, নির্বিকার। একটা কথাও বাবাকে বলল না সে। আসলাম সাহেব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সময় নিয়ে ঘুরলেন। দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তিনি। স্পষ্ট শুনতে পাননি, কিন্তু তার কেন যেন মনে। হলো তিনি অস্ফুট স্বরে শুনতে পেয়েছেন, হেমা পেছন থেকে তাকে ডেকেছে। এমন হয়, মানুষ যখন খুব করে কিছু চায়, তখন তার অবচেতন মন নানাভাবে বিভ্রম তৈরি করে। আসলাম সাহেব মুহূর্তখানেক দাঁড়ালেন। কিন্তু পরক্ষণেই। তার আবার মনে হলো, তিনি ভুল শুনেছেন। আচ্ছা, সব কথা শুনে হেমাও কী তাকে অপরাধী ভাবছে! তিনি আর পেছন ফিরে তাকালেন না। এস্ত পায়ে হেমার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে হেমা আলতো করে হাত রাখলো বাবার কাঁধে। তারপর ডাকল, বাবা!।
আসলাম সাহেব হঠাৎ হেমাকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। হেমা কিছু বলল না। সে দীর্ঘ সময় বাবাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
আসলাম সাহেব সেই রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাতে আর ঘরে ফিরলেন না। মা’র সাথেও দেখা হলো না হেমার। খাবার টেবিলে খাবার ঢাকা ছিল। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না তার। রাতে ঘুমাতে গিয়েও সারারাত ছটফট করতে লাগল হেমা। শেষরাতে সে ঘুমের ঘোরে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখল। সে দেখল সে ছোট্ট ফুটফুটে এক শিশু। কিন্তু তাকে রাখা হয়েছে একটা করাতকলে করাতের সামনে। তার মাথার কাছে শিষ কেটে চলে যাচ্ছে সুতীক্ষ্ণ করাত। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই করাতখানা ফালি হওয়া কাঠের মতো চিড়ে ফালি ফালি করে ফেলবে তার শরীর। সে যতটা সম্ভব তার শরীরটাকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। করাতখানা ক্রমশই এগিয়ে আসছে তার দিকে। কী করবে সে! প্রবল আতঙ্ক নিয়ে ঘুম ভাঙল হেমার। বাকি রাত সে আর ঘুমাতে পারল না। ভেতরে ভেতরে তার এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকল। মনে হতে লাগল, এই পৃথিবীতে সে এক অনাকাক্ষিত শিশু হিসেবে এসেছিল। তার মা তাকে চায়নি। তার বাবা তাকে চেয়েছিলেন বিশেষ এক কারণে। তাকে আলাদা করে তার জন্য কেউ চায়নি। হেমার নিজেকে বড্ড অনাহুত মনে হতে লাগল। বড় অনভিপ্রেত লাগতে লাগল। কী এক অদ্ভুত শূন্যতা, অদ্ভুত অভিমান আর কষ্ট হেমার বুকের ভেতর হু হু করে বয়ে যেতে থাকল।