২. পর্দা উঠল

পর্দা উঠল। ঘোষক খুব ইনিয়ে বিনিয়ে সাধ এবং সাধ্যের গল্প শোনালেন। একেবারে প্রথম একজন মধ্যবয়সী মহিলা এলেন উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে। আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে–! ইনিয়ে বিনিয়ে দুলে দুলে গান লোকে চুপচাপ শুনছিল। তারপর রবীন্দ্রসঙ্গীত সহযোগে নৃত্য। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নাচ, একথা ঘোষক বললেন না। আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে দোলে, মঞ্চের ওপাশ থেকে গান ভেসে এল আর বছর তিরিশের এক মহিলা চকচকে শাড়ি পেঁচিয়ে পরে ছুটে এলেন মঞ্চে। গানের কথার রূপ দিলেন হাত পা চোখের ভঙ্গিমায়। দোলাও-এর সঙ্গে যেভাবে হাত নাড়লেন তা শিশুকে ঘুম পাড়াবার সময় মায়েরা ওইভাবে হাতে তুলে দোলায়। কিছুক্ষণ দেখার পর অসহ্য মনে হল আমার কাছে। এইসব বুড়োধাড়ি মেয়েকে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বলা উচিত, তোমার বয়স কত মা? পাঁচ বছরের বাচ্চা যা করে তা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তোমাকে কি মানায়?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। প্রকাশক চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, একি? কোথায় যাচ্ছ?

এসব দেখলে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। ওঁকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে এলাম। হলের বাইরে এসে মনে হল, আহা, কী আরাম।

আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলায় না জন্মাতেন, বাংলাভাষায় না লিখতেন তাহলে বাঙালি কি নিয়ে থাকত। এইসব ধ্যাস্টামো কীভাবে করত? নজরুল যা লিখেছেন তা নিয়ে এইসব ইয়ার্কি করা যায় না। মধুসুদন বড্ড সিরিয়াস এবং এই লাইনে তাঁকে ফেলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে অনেক দিয়েছেন, একটা আধশোওয়া জাতিকে টেনে তুলে ছুটতে সাহায্য করেছেন, কিন্তু কী দরকার ছিল ওঁর নৃত্যনাট্য লেখার? রোগা রোগা বাবরি চুল রাখা ধেড়ে ধেড়ে ছেলেগুলো ওইসব নৃত্যনাট্যে শরীর দোলায়, পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে-র সময় আঙুলের মুদ্রায় কাকে তারা ডাকে তারা নিজেরাই জানে না। যে আবেগ কবির কলমে ছিল তা এইসব নাচিয়েদের কল্যাণে উধাও।

বাসস্টপে দাঁড়ালাম। রবীন্দ্রসদনের সামনে বাসস্টপটায় এই সময়েও বেশ ভিড়। হঠাৎ নজরে এল একটি অল্পবয়সী মেয়ে বিরক্ত হয়ে সরে আসছে আমার দিকে। তার ঠিক পাশেই মধ্যবয়সী একটি লোক যার হাতে গাড়ির চাবি। লোকটা চাবিটা দেখানোর ভঙ্গি করে নাড়ছে। মাথাটা গরম হয়ে গেল। সোজা মেয়েটির পাশে গিয়ে বললাম, দাঁড়ান ভাই। এবার লোকটাকে ডাকলাম, এই যে এদিকে আসুন।

লোকটা একটু হকচকিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল আমার মতলব কী!

 বললাম, আপনার গাড়িটা কোথায়? এখানে নিয়ে আসুন। আপনার বাড়িতে আমরা যাব।

মেয়েটি আঁতকে উঠল, আমি কেন যাব? আমি কোথাও যাব না।

বললাম, আপনি ভয় পাবেন না। ওর গাড়িতে চড়ে আমরা ওর বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের বলে আসব উনি বাসস্টপে মেয়ে দেখলেই গাড়ির চাবি দেখান। যান, নিয়ে আসুন গাড়ি।

হঠাৎ লোকটা উদাসী হয়ে গেল। যেন পৃথিবীতে কোনো সমস্যা নেই এমন ভঙ্গি করে হেঁটে যেতে লাগল আকাদেমির দিকে। একবারও ফিরে তাকাল না।

বললাম, এবার যান। আর ও আপনাকে বিরক্ত করবে না। মেয়েটি সেই যাওয়া দেখে বলল, আমার খুব ভয় করছে।

কেন? কী বলেছে ও আপনাকে?

 কিছু বলেনি। শুধু গাড়ির চাবি দেখিয়ে বলছিল, সঙ্গে গাড়ি আছে।

ঠিক আছে। বাসে উঠুন।

তখনই একটা প্রাইভেট বাস এসে দাঁড়াল। মেয়েটি ভীতচোখে বলল, এই বাস।

 বেশ। উঠুন। আমি না হয় একটু এগিয়ে দিচ্ছি।

মেয়েটি ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল। আমি পাদানিতে। এইভাবেই যাওয়া আসা করতে হবে তা কলকাতার মানুষ মেনে নিয়েছে অনেককাল। গোটা পাঁচেক স্টপ চলে যাওয়ার পর মনে হলো এখন তো মেয়েটার কোনো ভয় নেই। ভাড়া দিয়ে টিকিট নিয়ে নেমে পড়লাম।

নামবার পর দেখলাম আমি এখন ভবানীপুরে। আমাকে ফিরতে হবে উল্টোদিকে। সময় নিয়ে ভাবি না, কিছু বাড়তি পয়সা খরচ হল। কয়েক পা হাঁটতেই আমার পা স্থির হলো। উল্টো দিকের গলিতে ঢুকে তিন নম্বর বাড়িটা আমাকে টানতে লাগল। এটা কী রকম হলো? এখানে আসার কোনো কথা ছিল না। একেই কি কাকতালীয় ব্যাপার বলে। বছরখানেক আগে শেষবার আমি ওই বাড়িতে গিয়েছি। সেদিন হেনা বলেছিল, বিপ্লব, তুমি আর এখানে এসো না। আমি তোমাকে টলারেট করতে পারছি না। তোমার সঙ্গ আর পেলে আমি পাগল হয়ে যাব।

সেই শেষ। এই একবছর কোনো যোগাযোগ নেই, না দেখা, ফোন।

আজ টানটাকে এড়াতে পারলাম না। গলিতে ঢুকলাম। তিন নম্বর বাড়িটা পাঁচতলা। লিফট আছে। হেনা থাকে তিনতলায়। লিফট থেকে নেমে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলাম। এক বছরে মানুষ কি একই রকম থাকে? হেনা কি একটুও পাল্টায়নি। তারপরেই মনে হল, আমি কি পাল্টেছি?

উত্তরটা স্পষ্ট। না, পাল্টাইনি, একবছর আগে যা ভাবতাম তা বাতিল করার কোনো কারণ ঘটেনি যখন তখন পাল্টাবো কেন? আমি যদি না পাল্টাই তাহলে হেনারও তো একই অবস্থা হওয়া স্বাভাবিক। অতএব আমার উচিত নয় ওকে বিরক্ত করা। আমি ফিরলাম। লিফটের বোতাম টিপলাম নেবে যাওয়ার জন্যে। একটু পরেই লিফট উঠে আসার আওয়াজ হল। লিফট উঠে আসছে। হেনা বা তার মা দেখতে পাওয়ার আগেই আমি নিচে নেমে যেতে চাই।

লিফট থামল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল হেনা এবং তার পেছনে এক ছিমছাম যুবক। আমি চমকে গিয়েছিলাম। মুখ ফিরিয়ে নিতেই শুনলাম প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে হেনা বলছে; আরে তুমি? কখন এলে? চলে যাচ্ছ যে। এসো এসো। প্রায় দৌড়ে এসে হেনা আমার হাত ধরল। এক সেকেন্ডের জন্যে হলেও আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। এই গলায় হেনা কখনও আমার সঙ্গে কথা বলেনি। আর এখন, শেষ কথা হয়ে যাওয়ার পর, এভাবে বলছে ভাবা যায় না।

আমি বললাম, না, থাক, মনে হচ্ছে তুমি এখন ব্যস্ত থাকবে!

ব্যস্ত? তুমি কী বলছ? এসো, কাম অরিত্র। হেনা এগিয়ে গিয়ে বেল টিপল। তারপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, অরিত্র, মিট মাই ফ্রেন্ড, বিপ্লব, আমার অনেক দিনের বন্ধু।

অরিত্র মাথা নাড়ল, নমস্কার।

লোকটা নমস্কার বলল, কিন্তু হাত তুলল না। এখন মনে হলো, তুলতে যে হবেই তার কোনো মানে নেই। মুখে বললেই তো মানে বোঝানো হলো। দরজা খুলল যে কাজের মেয়েটি তাকে আমি চিনি না। অন্তত গত এক বছরে প্রথম পরিবর্তন নজরে এল। প্রথম বলা ঠিক হল না, দ্বিতীয়, প্রথম পরিবর্তন তো হেনার বলা একটু আগের কথাগুলো। যে ভঙ্গিতে ও কখনও কথা বলেনি তা আজ বলল।

তোমরা একটু বসো প্লিজ। হেনা সোফা দেখিয়ে ভেতরে চলে গেল।

আমরা বসলাম। বসা মাত্র অরিত্রকে দেখলাম একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পাতা খুলতে। অর্থাৎ ও এখন আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। আচ্ছা, এই লোকটা কে? হেনার সঙ্গে ওর কী ধরনের সম্পর্ক! যে ভঙ্গি নিয়ে ঘরে ঢুকল তাতে খুব অন্তরঙ্গ বলে মনে হচ্ছে না। এ কি অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করছে? হঠাৎ বুকের ভেতর অস্বস্তি এল। সেটা মুহূর্তের জন্যে। তারপরেই ভাবলাম, এ নিয়ে আমি ভাবছি কেন? হেনা এখন স্বাধীন। কারও কাছে কোনো অবলিগেশন নেই। যা ইচ্ছে তাই ও করতে পারে।

হেনা ফিরে এল, কী খাবে বলো? চা, কফি না ঠাণ্ডা?

অরিত্র কাঁধ নাচাল। আমি বললাম, কিছু না।

এখনও রাগ পড়েনি?

মানে?

তুমি না একটা যাচ্ছেতাই। হাসল হেনা, জানো অরিত্র, বিপ্লব বড় অভিমানী। কদিন আগে ওর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করেছি, বাবুর রাগ হয়ে গেল।

অরিত্র ম্যাগাজিন রেখে আমায় দেখল তারপর হেনাকে।

হেনা হাসল, আমরা খুব পুরনো বন্ধু। আমরা পরস্পরকে খুব ভাল বুঝতে পারি।

 ও।

বিপ্লব, অরিত্র খুব আপ রাইজিং। আমার সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ হয়েছে। আমার এক অফিস কলিগ ওর বন্ধু, সেই সুবাদে।

হঠাৎ অরিত্র ঘড়ি দেখল, মাই গড। সে উঠে দাঁড়াল।

 হেনা জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আমার জন্যে ক্যালকাটা ক্লাবে একজন অপেক্ষা করছে। আমি খুবই দুঃখিত, আমাকে এখনই চলে যেতে হচ্ছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

হেনা বলল, কিন্তু–!

অরিত্র কাধ নাচিয়ে দরজার দিকে এগোলো। হেনা চটপট ওর পেছনে ছুটল। অরিত্রকে দরজা খুলে দিয়ে সে বলল, আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কাজ থাকলে তো কিছু করার নেই!

অরিত্র মাথা নেড়ে বেরিয়ে যেতেই সে দরজাটা বন্ধ করল।

ফিরে যখন এল তখন আমি অন্য হেনাকে দেখলাম, মুখের একটা উপশিরাও নড়ছে না। স্থির পায়ে আমার উল্টোদিকের সোফার পাশে এসে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার সঙ্গে একবছর দেখা হয়নি অথচ তুমি ভদ্রলোককে বললে কদিন আগে আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করেছ। কী ব্যাপার?

ওটা না বললে অরিত্র এখান থেকে এখন চলে যেত না। ও যখন আজ আমার কাঁধে চেপেছিল তখন ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করে ওকে কাটাব। আজকের সন্ধেটা ওর প্রেম প্রস্তাব শুনে নষ্ট করতে হবে বলে খারাপ লাগছিল। তা হঠাৎ তোমাকে দেখে মনে হলো বেঁচে গেলাম। আমার কথা শুনে তুমি প্রতিবাদ করোনি সেটা ইনডাইরেক্টলি আমাকে হেল্প করেছে, তাই তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি কি বিশেষ কোনো কারণে এখানে এসেছিলে? হেনা তখনও বসছিল না।

না।

তাহলে?

হঠাৎ এ পাড়ায় চলে আসি। আসার পর মনে হল অনেকদিন দেখা হয়নি।

হঠাৎ এ পাড়ায় চলে আসি মানে? প্ল্যান না করে কেউ আসে নাকি? এরকম সিলি যুক্তি দেবার বয়স তুমি দশ বছর আগে পেরিয়ে এসেছ বিপ্লব। তাছাড়া অনেককাল দেখা হয়নি মানে এই নয় দেখা করার জন্যে ছটফট করতে হবে। তোমার সঙ্গে আমার শেষবার যে কথা হয়েছিল তা নিশ্চয়ই মনে আছে। যাকগে, আজকে তুমি আমাকে ইনডাইরেক্টলি সাহায্য করেছ। চা খাবে?

না।

তাহলে–!

 আমি হেনার দিকে তাকালাম, তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?

 আমি খুব টায়ার্ড!

টায়ার্ড। একটু আগে অরিত্র যখন এসেছিল তখন তোমাকে দেখে বা কথা শুনে একটুও মনে হয়নি ওকথা। আমি না থাকলে নিশ্চয়ই অরিত্র এখনই উঠে যেত না!

হঠাৎ হেনা শরীরটাকে দ্রুত সোফায় নিয়ে গেল, কী করতে চাও তুমি? বসতে চাও, বসো কতক্ষণ বসবে দয়া করে বলে দাও সেইমত তৈরি হই।

হেনা? আমি চমকে উঠলাম।

 হেনা মুখ ফেরাল অন্য পাশে।

বেশ। আমি যাচ্ছি।

এক মিনিট! বসো। আমি খুব অবাক হয়ে গেছি তোমার ব্যাপার দেখে।

মানে?

যে তুমি আমার সঙ্গে কোনরকম অ্যাডজাস্ট করতে চাইতে না সেই তুমি আজ এলে কেন?

এককালে তো সম্পর্ক ছিল, সে সময়টা তো মিথ্যে ছিল না। যদি সেটাকে বন্ধুত্ব বলো তাহলে তার সুবাদে তো আসা যায়, এরকম মনে হয়েছিল আমার। ভুল মনে হয়েছিল। এখন তুমি প্রতিদিন হয়তো নতুননতুন প্রেমপ্রস্তাব শুনতে অভ্যস্ত। পুরনোকে ভাল লাগার কথা নয়।

বাঃ। চমৎকার! তুমি দেখছি বাংলা সিনেমার সংলাপ ভাল লিখতে পারবে। এখনও নিশ্চয়ই কোনো কোম্পানির চাকর হওনি। হয়েছ? তা দ্যাখো না, চেষ্টা করে ফিল্মলাইনে! হেনা মাথা ঝাঁকাতেই ওর চকচকে পালিশ করা কাঁধ ছুঁয়ে থাকা চুলগুলো চোখ গাল স্পর্শ করে গেল, হ্যাঁ। প্রেমপ্রস্তাবের কথা বলছিলে না? আমি স্বীকার করতে বাধ্য আজ পর্যন্ত তুমি ছাড়া আর সমস্ত পুরুষ আমাকে প্রস্তাব দেবার সময় প্রায় একই ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করেছে অথবা একই ভঙ্গিতে কথা বলেছে। ব্যাপারটা ক্রমশ এমন একঘেঁয়ে হয়ে গিয়েছে যে আর শোনার মত ধৈর্য আমার নেই।

তবু তো আজ শুনতে যাচ্ছিলে?

হ্যাঁ। কারণ কাজের সুবাদে অরিত্রর সঙ্গে আমার আলাপ। আমি আজ যে কোম্পানিতে আছি কাল সেখানে নাও থাকতে পারি। খামোকা কাউকে চটিয়ে দিয়ে আমার কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া লোকটা ভদ্রলোক, লম্পট নয়।

আচ্ছা! তা আমাকে হঠাৎ আলাদা করলে কেন?

ওটা আমার বোকামি।

বোকামি?

তখন বয়স কম ছিল। তুমি যেসব কথা বলতে সেগুলোকে সত্যি বলে মনে হত, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করত। জীবন সম্পর্কে তোমার অ্যাপ্রোচ ছিল নেগেটিভ। এই বয়সে বাঁকা বাঁকা কথা শুনতে বেশ আরাম লাগত। কিন্তু সেটা বয়স বাড়ার পর নেহাৎ বোকামো বলেই মনে হয়েছে। তোমার মনের বয়স বাড়েনি বলে তুমি একই জায়গায় পড়ে আছ। তোমাকে সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তাই যারা বানানো ক্লিশে হয়ে যাওয়া শব্দ-উচ্চারণ করে, জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দুনম্বরি হাসে, তাদের সহ্য করতে তোমার আপত্তি নেই।

না, নেই। তোমাকে আমি আগেও অনেকবার বলেছি কোটি কোটি মানুষ যা মেনে নিয়েছে। তুমি তার ব্যতিক্রম হতে পারো না। এই যে তুমি এম. এ. পাস করেও চাকরি করনি, ব্যবসা করনি, কীভাবে টাকা রোজগার করছ, আদৌ করছ কি না তা জানি না, তোমার ওপর কেউ নির্ভর করতে পারে? তুমি নিজে নিজের ওপর নির্ভর করতে পারো?

আমার তো চলে যাচ্ছে।

হ্যাঁ। বাবার হোটেলে দুবেলা খাওয়া আর পৈতৃক বাড়ির ছাদ মাথার ওপর থাকলে বুলির বিপ্লব করা যায়। কিন্তু তাও কদিন? তেইশ কি চব্বিশ। তোমার বয়স তো তাও অনেককাল পার হয়ে গিয়েছে। এবার তাকিয়ে দ্যাখো না। দুটো পা মাটিতে রাখো!

যার দশে হয়নি তার একশতেও হবে না হেনা।

তার মানে চিরকাল তুমি একটি অকর্মণ্য মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবে?

অকর্মণ্য? আমি হাঁ হয়ে গেলাম।

 নিশ্চয়ই। শুধু কথাসর্বস্ব মানুষকে কেউ বিশ্বাস করতে পারে? আর যে কথা আজকের যুগে অচল! তোমার ওপর কোনো মানুষ আস্থা রাখতে পারবে? তুমি কারও দায়িত্ব নিতে পারবে?

তোমার এসব কথায় যুক্তি আছে, ছিল। আমি তাই একবছর আগে মেনে নিয়েছি।

তবু তুমি নিজেকে শোধরাওনি?

না। আজকাল আমার বমি পায়।

 বমি পায়?

কেউ দুনম্বরি কথা বললে বা জ্ঞান দিলে শরীর গুলিয়ে ওঠে। হেনা, অনেকক্ষণ থেকে আমার এইরকম হচ্ছে। তোমার টয়লেটে যেতে পারি?

নোঃ। চিৎকার করে উঠল হেনা, তোমার শরীরের কোনো কিছু এ বাড়িতে রেখে যাবে না তুমি।

বমিও করতে পারব না?

এনি ড্যাম থিং।

কিন্তু আমি পারলাম না। তিরের মতো দৌড়ে গেলাম টয়লেটের দিকে। যেহেতু আমার জানা ছিল তাই দরজাটা খুলে বেসিনে পৌঁছাতে পারলাম শেষমুহূর্তে। ভেতর থেকে যাবতীয় আবর্জনা বেরিয়ে আসার কথা, কিন্তু কয়েক চামচ তেতো জল ছাড়া কিছু বের হল না। মুখে ঘাড়ে জল দিলাম, একটু কুলকুচি করলাম হাঁপাতে হাঁপাতে।

তুমি কি অসুস্থ? টয়লেটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে হেনা।

না। মাথা নাড়লাম। তখনও শরীরে কাঁপুনি হচ্ছিল।

তাহলে?

এরকম হয়।

ডাক্তার দেখিয়েছ?

আমি উত্তর দিলাম না। পৃথিবীর কোনো ডাক্তার এর চিকিৎসা করতে পারবে না। একথা বলে কী লাভ। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই হেনা বলল, শোনো। একটু বসে যাও।

কেন?

আমি অনুরোধ করছি।

এই গলায় হেনা অনেককাল কথা বলেনি। আমি বসলাম। হেনা ভেতরে চলে গেল। মানুষের নিজস্ব কিছু চরিত্র আছে। এই চরিত্র এক একজনের এক একরকম। তার নিজের মতন। আবার কিছু চরিত্রে অনেকের পার্থক্য নেই। এই যেমন, সম্পর্ক যখন সহজ থাকে, মন ভাল থাকে তখন মানুষ যে গলায় কথা বলে, একবার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে গেলে নিজের অজান্তে আর সেই গলা ব্যবহার করতে পারে না। তখন হয়তো ঝগড়া হচ্ছে না, সেদিন কোনো অশান্তি হয়নি কিন্তু মন টোল খেয়ে গেলে কণ্ঠস্বর সেই যে পাল্টে যায় তা আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না। যদি যায় তাহলে বলতে হবে অসাধ্যসাধন করা হলো। আজ হেনার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে, এমন ভাবার তো কোনো কারণ নেই।

এক গ্লাস জল নিয়ে এল হেনা, খেয়ে নাও।

বিনা বাক্যব্যয়ে জল খেলাম। খুব প্রয়োজন ছিল জলের।

আমার হাত থেকে গ্লাস ফিরিয়ে নিয়ে হেনা সোফায় বসল। ও এখন কথা খুঁজছে বুঝতে পারছি। কীভাবে আমাকে বুঝবে, সেটা ভেবে পাচ্ছে না। চিরকালই ওর জ্ঞান দেবার একটু ঝোঁক আছে। ওকে সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে চিনি। তখন স্কার্ট পরে কলেজে যেত, দুটো বেণী পিঠে নাচত। আমি বাংলা, ও ইকনমিক্স। আমি যখন এম. এ. ক্লাশে সময় নষ্ট করছি তখন কিসব পরীক্ষা দিয়ে হেনা চাকরিতে ঢুকে পড়েছে। ওর নিজের বাড়ি ব্যারাকপুরে। এই ফ্ল্যাটটা ওর বাবা ওকে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একজন খুব পুরনো মহিলা হেনার সঙ্গে একবছর আগেও থাকত। হেনাকে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে। সে মহিলা কি এখন নেই?

এই সময় হেনা বলল, আমার খিদে পেয়েছে। তুমি একটু বসবে, দেখি কী বানাতে পারি।

 কেন? তোমার সেই মহিলা নেই?

না। নাতনির বিয়েতে গেছে। হেনা উঠে গেল।

খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম বমিটা করার পর। সোফায় শরীর এলিয়ে দিলাম। এবং তার ফলে যে কখন ঘুম এসে গেল তা বুঝতে পারিনি। যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজে গেছে। ঘর অন্ধকার। হেনা এ-ঘরে নেই। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম। তারপর ডাকলাম, হেনা।

কোনো সাড়া এল না। আমি দ্বিতীয়বার ডাকলাম, এবার একটু জোরে। কিন্তু তবু সাড়া এল না।

হেনা কি আমার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে? আমি পাশের ঘরে ঢুকলাম। এটা তিন ঘরের ফ্ল্যাট। এর পাশেরটা হেনার বেডরুম, বেডরুমের দরজা বন্ধ। কয়েকবার নক করা সত্ত্বেও সাড়া এল না। ঠিক তখনই টেলিফোনটা আওয়াজ করে উঠল। শব্দটা এমন আকস্মিক যে আমি ছিটকে উঠেছিলাম। আমি আবার বন্ধ দরজায় আঘাত করলাম, তোমার টেলিফোন, প্লিজ দরজা খোলো।

তবু দরজা খুলে বেরিয়ে এল না হেনা। এটা রসিকতা হলে মোটা দাগের রসিকতা। আর নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সন্দেহ আছে বলে হেনা দরজা দিয়েছে, এমন ধরে নিলে আর দরজায় আঘাত করে ওর চৈতন্য জাগানোর কোনো মানে হয় না। তার চেয়ে রিসিভারটা তুলে বলে দিই আজ রাত্রে ফোন করে কোনো লাভ নেই।

রিসিভার তুলতেই মনে হল, কী শাস্তি। ছোট ফ্ল্যাটে রাত বাড়লে শব্দ ভয়ঙ্কর হয়ে যায়।

হ্যালো! গম্ভীর হয়ে বললাম।

যাক। তোমার ঘুম শেষপর্যন্ত ভেঙেছে। হেনার গলা।

আরে তুমি? তুমি কোত্থেকে বলছ? আমি হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজাটা দেখলাম।

তখন তোমাকে বলার সুযোগই হল না। আমি সাড়ে নটা নাগাদ ডিনারে বেরিয়েছি। খুব ভাল বড় পার্টি হচ্ছে এক বান্ধবীর বাড়িতে। তুমি এমন মড়ার মতো ঘুমাচ্ছিলে যে তোমাকে আর ডিস্টার্ব করিনি আসার সময়। এখন তো রাত হয়ে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই চলে যাবে। যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে দিয়ে যেও। প্লিজ! রাখছি। 

ওপাশে রিসিভার রাখার আওয়াজ হল। ফোন নামিয়ে ধাতস্থ হতে সময় লাগল আমার। বন্ধ দরজাটার দিকে তাকালাম। ওর ভেতরে কেউ নেই অথচ কত আজেবাজে ভাবনা মাথায় আসছিল বন্ধ দরজা দেখে। এমন তো হতেই পারে, হেনার আগে থেকেই নেমন্তন্ন ছিল। আমাকে ওভাবে ঘুমোতে দেখে ও কেন নেমন্তন্ন বাতিল করবে?

কিন্তু খিদে পাচ্ছে খুব। আমি শেষ কখন খেয়েছি? দুপুরে। রুটি আর আলুর দম। আমার কাছে পয়সা ছিল, বিকেলে যাহোক কিছু খেয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু সঙ্গে লোক থাকলে ওই হয় মুশকিল। প্রকাশকের গাড়ি করে রবীন্দ্রসদনে গিয়েছিলাম। ওঁর উচিত ছিল আমাকে খাওয়ার কথা বলা। বলেননি। আমি যা খাব তা উনি খাবেন না বলেই আমি কিছু বলিনি।

কিচেনে ঢুকলাম। ফ্রিজ ভর্তি খাবার। মাংস-মাছ সব রান্না করা রয়েছে। এমনকি ভাতও। কিন্তু গরম না করে খাওয়া যাবে না। হেনা কি তিন চার দিনের রান্না একসঙ্গে রেঁধে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে? মিষ্টির বাক্সটা দেখলাম। নাঃ। চলবে না। ফ্রিজ বন্ধ করে হটবক্সটা দেখলাম। কিছুই নেই ভেতরে। কিন্তু হেনা বলেছিল কিছু বানাতে কিচেনে যাচ্ছে। কী বানিয়েছে তখন?

পেলাম শেষ পর্যন্ত। একটা সসপ্যানের মধ্যে চাপা দেওয়া ছিল। মোটা সোটা ওমলেট আর চার পিস টোস্ট। ওমলেট একটাই। তার মানে হেনার নিজেরটা খেয়ে গেছে। স্বাভাবিক। অফিস থেকে ফিরে এসে অভুক্ত অবস্থায় কেউ পার্টিতে যায় না।

ঠাণ্ডা ওমলেট এবং শীতল টোস্ট ক্ষুধার্তের জিভে কোনো বিস্বাদ আনে না। খাওয়া হয়ে গেলে শরীরে বল পেলাম। এবার ফেরা যাক। রাত ঢের হয়েছে। এরপরে বাস পাব না। ট্যাক্সিতে চেপে বাড়ি ফেরার বিলাসিতা আমি অ্যাফোর্ড করতে পারি না। কিন্তু বাইরের দরজা খুলতে যাওয়ার সময় মনে হল হেনার সঙ্গে আমার কোনো কথাই হল না। একবছর ধরে না আসার কারণে যে ব্যবধান ছিল তা আর কখনই না এলে নিশ্চয়ই আরও বেড়ে যেত। কথা বলার কোনো প্রয়োজনই হত না। কিন্তু আজ সন্ধেবেলায় কথাগুলো নতুন করে উঠেছিল। সেটা শেষ করতে হলে আমাকে আবার এই ফ্ল্যাটে আসতে হয়। ওই আবার আসা হেনা পছন্দ করবে না। তাই সাপ ব্যাঙ যা হোক আজই শেষ করে যাওয়া ভাল। যতই রাত হোক, কলকাতার রাস্তায় কেউ পড়ে থাকে না।

তবে বাড়িতে যে খাবার আমার জন্যে বরাদ্দ সেটা নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। আমার জন্যে খাবার না রাখার জন্যে বলে দেব বলে ফোনের দিকে এগোলাম। ডায়াল করতে গিয়ে থমকে গেলাম। যাচ্চলে! আমার বাড়ির নাম্বারটা যেন কত? ঝাপসা ঝাপসা লাগছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। অদ্ভুত যন্ত্রণা শুরু হল। তারপরেই মনে হল ওটা আমার বাড়ি ভাবলাম কেন? যে বাড়িতে আমি থাকি, মানে রাত্রিবাস করি, সেটা আমার বাড়ি হবে কেন? ওটা আমার পিতার বাড়ি। পিতা? ধ্যাৎ! পিতা বললেই কিরকম মুনিঋষি সাধুসন্ত সেইন্টদের ছবি মনে আসে। বাবা শব্দটার মধ্যে ওগুলো অতটা না হলেও কিছুট তো থাকছেই। বাপ শব্দটা বরং অনেক বেশি সহজ। কোনো স্ট্যাম্প নেই। মেয়েরা যদি বাপের বাড়ি বলতে পারে তাহলে ছেলেরাই বা বলবে না কেন? এইটুকু ভাবতেই নাম্বারটা মনে এসে গেল।

ওপাশে ফোন বাজছে। আমার বাপ বাড়িতে থাকলে এখন তার আহ্নিকের সময়। নিশ্চয়ই ভাই ফোনটা তুলবে। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। ফোনটা বেজে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। লাইনটা কেটে আবার ডায়াল করলাম। একই অবস্থা। এমন হতেই পারে না। নিশ্চয়ই ফোন খারাপ হয়েছে। বাড়ি খালি করে সবাই অন্য কোথাও কিছুতেই চলে যেতে পারে না। ওয়ান নাইন নাইনে ফোন করলাম। মিনিট তিনেক বাজল কিন্তু দিদিমণিরা সাড়া দিলেন না।

শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলাম। ঘড়ি বলছে এগারোটা বেজে গিয়েছে। এবার বেরুতে হয়। আলো নিভিয়ে দিতেই দরজায় শব্দ হল। বাইরে থেকে চাবি ঘুরিয়ে কেউ দরজা খুলছে। চোর নাকি? দ্রুত সরে এলাম এক কোণে! চোর হলে হেনার উপকার করে যাওয়া উচিত। আলমারির আড়ালে দাঁড়ালাম।

কিন্তু হেনারই গলা বাজল, তোমাদের অনেক ধন্যবাদ পৌঁছে দেবার জন্যে।

টুক করে আলো জ্বলল। হেনা এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল। আমি ঘড়ি দেখলাম। যাচ্চলে। আমি এতক্ষণ কী দেখছিলাম? এগারোটা নয়, বারোটা বেজে গেছে।

একটি মহিলা কণ্ঠ বলল, টয়লেট কোথায় হেনা?

ওইতো, ওইদিকে। যাও। হেনার গলা। তারপরেই টয়লেটের দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল।

সঙ্গে সঙ্গে একটি পুরুষ কণ্ঠ শুনলাম। চাপা গলায় বলছে, হেনা! আমি আর পারছি না।

 কেন? শরীর খারাপ? হেনা খুব সিরিয়াস।

ওঃ। ঠাট্টা কোরো না। আই নিড ইউ হেনা, আই লাভ ইউ।

প্লিজ সুমিত! তোমার বউ শুনলে দুঃখ পাবে।

আই ডোন্ট কেয়ার! আমি আর ওর সঙ্গে থাকতে পারছি না। আই নিড ইউ।

রিয়েলি?

 জাস্ট টেল মি ইয়েস।

তোমার বউ-এর সামনে বলতে পারবে?

তুমি আমাকে পরীক্ষা করছ?

না। কিন্তু মুশকিল হল, তুমি একবারও জানতে চাইছ না আমি ফ্রি আছি কি না!

তার মানে?

আমি তো অন্য কারো সঙ্গে এনগেজড হয়ে থাকতে পারি?

মাই গড!

কেন? পারি না?

 সেই ভাগ্যবানটি কে?

তুমি চিনবে না। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম।

হেনা, তুমি আমাকে ব্লাফ দিচ্ছ না তো?

হেনাকে উত্তর দিতে হল না কারণ সেইসময় টয়লেটের দরজা খুলে গেল। আশ্চর্য দুনম্বরি লোক তো। বউ টয়লেটে যাওয়া মাত্র অন্য মহিলাকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে? ইচ্ছে হচ্ছিল বাইরে বেরিয়ে এসে লোকটার কলার ধরি। কিন্তু মহিলা বললেন, চলো। এলাম ভাই।

এসো। আবার বলছি অনেক ধন্যবাদ এখানে আসার জন্যে। হেনার গলা।

দরজা বন্ধ হল। আলো নিবল। নিবল বলেই সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হেনা আমাকে দেখতে পেল না। শোওয়ার ঘরে ঢুকে গেল সে। ঘরে আলো জ্বলল। গুনগুন করে সুর ভাঁজছে হেনা। মনে বোধহয় আনন্দ এসেছে। কেন? এই যে একের পর এক অবিবাহিত বা বিবাহিত পুরুষেরা ওকে প্রেম নিবেদন করছে, তাই? কিন্তু ব্যাপারটা কী? এই দুনম্বরি লোকটাকেও হেনা যার কথা বলল সে আমি ছাড়া কেউ নয়। অথচ এখন হেনা আমার সঙ্গে প্রেম করছে না। কিন্তু প্রেমিকদের কাটাবার জন্যে আমার নাম ব্যবহার করছে। কেন?

হেনা বেরিয়ে এল। এখন ওর পোশাক পাল্টে গেল। হালকা নীল এবং বেশ পাতলা একটা হাতাকাটা নাইটি পরেছে। এক পলক দেখতে পেলাম, তারপরেই কিচেনে ঢুকে আলো জ্বালল। গুনগুনানি বন্ধ হচ্ছে না এখনও। আমি এখন কী করি। চোরের মতো এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা আর ভাল দেখাচ্ছে না। আমি যে যাইনি, এই বাড়িতেই ছিলাম, তাও হেনা পছন্দ করবে না। অথচ এখন দরজা খুলে বেরুতে গেলেই আমি ওর কাছে ধরা পড়ে যাব।

তখনই কিচেনের আলো নিবিয়ে বেরিয়ে এল হেনা। একটু দাঁড়াল। তারপর টেলিফোনের সামনে গেল। আমি ওর পেছনটা দেখতে পাচ্ছি। হেনার ফিগার খুব ভাল। আজকাল চুলে নানান কায়দা করায় গ্ল্যামার বেড়ে গেছে। ওপাশের আলো জ্বেলে নিয়ে হেনা ডায়াল করল। কয়েক সেকেন্ড বাদেই সে হ্যালো বলল।

হ্যালো। আমি খুব দুঃখিত এত রাত্রে আপনাদের বিরক্ত করছি বলে। আসলে বিপ্লব আমার এখান থেকে একটু দেরি করে বের হয়েছে। ও ঠিকঠাক বাড়িতে পৌঁছাল কিনা সে ব্যাপারে চিন্তায় ছিলাম। কী বললেন? এখনও পৌঁছায়নি? অদ্ভুত! আমি? আমি ওর সঙ্গে একসময় কলেজে পড়তাম। আমার নাম হেনা। আপনি? ওহো, না মেসোমশাই, আমি আগে কখনও ফোন করিনি। নাম্বারটা লেখা ছিল। কী বললেন? এটা ঠিক, আপনি নিশ্চয়ই আপনার ছেলেকে চেনেন। ওকে কনভিন্স করা খুব ডিফিকাল্ট। ও, তাই? এ তো খুব ভাল ব্যাপার। এন. আর আই-দের সঙ্গে? বাঃ। আচ্ছা, ঠিক আছে, না না, তার দরকার নেই। আজ রাত্রে আর ফোন করতে হবে না। নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে। গুডনাইট।

আমি হতভম্ব হয়ে শুনছিলাম। আমার বাপের এখন সুখনিদ্রা দেওয়ার সময়। এই সময় তিনি ফোন তুললে ক্ষেপে যাওয়ার কথা, এক পার্টির বড়কর্তার ফোন যদি না হয়। আজ হেনা যে গলায় বলল তাতে মনে হল তিনি বেশ ফুর্তিতে আছেন। আর হেনার ব্যাপারটা কী? কোনোদিন ও সত্যিই ফোন করেনি। আজ সে পৌঁছালো কি না তা জানতে এত উদ্বিগ্ন হবে কেন?

হেনা তার ঘরে চলে গেল। ঠিক করলাম ও ঘুমিয়ে পড়লে এখান থেকে বেরিয়ে যাব। কিন্তু কাঁহাতক এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়? আমি অন্ধকার ঘরে পা টিপে টিপে সোফার কাছে গেলাম। তারপর প্রায় নিঃশব্দে সোফায় বসে পড়লাম। আঃ, আরাম।

হেনার এই ফোন করাটা আমাকে খুব ডিস্টার্ব করছে। এত রাত্রে ফোন করে বাবার সঙ্গে কথা বলা মানে ও ইচ্ছে করেই জানিয়ে দিল ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। কেন? বাবাকে জানিয়ে ওর কী লাভ যখন সম্পর্কটা নেই।

ভেতরের ঘরের টিউব নিবল এবং একটা হালকা নীল আলো জ্বলে উঠল। আর বড়জোর মিনিট পনেরো। তার মধ্যেই ওর ঘুমিয়ে পড়ার কথা। আমি ঘড়ি দেখতে লাগলাম। অন্ধকারে ঘড়ির ভেতর যেভাবে জ্বলে তাতে রহস্য আরও বেড়ে যায়।

পনেরো মিনিট বাদে উঠে দাঁড়িয়ে মনে হল হেনা ঘুমিয়েছে কি না দেখে তবেই দরজা খোলা উচিত। নইলে খুলতে গেলে যে শব্দ হবে তাতেই হেনা সজাগ হয়ে যাবে।

নিঃশব্দে ওর বেরুমের দরজার পাশে পৌঁছে গেলাম। উঁকি মারতেই আমার শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ প্রবাহিত হল। উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে হেনা। সেই নাইটিটা পাশে খুলে রেখেছে। এখন তার অঙ্গে শুধু অন্তর্বাস ছাড়া কিছু নেই। ওই নীল আলো ওর শরীরে খোলা জায়গায় পড়ে অপূর্ব মায়া সৃষ্টি করেছে। আমার মনে তীব্র বাসনা জাগল ওই জায়গা স্পর্শ করতে। এমন আকর্ষণ আমি কখনও অনুভব করিনি। এক পা এগিয়েই আমি থেমে গেলাম। হঠাৎই নিজেকে চোর বলে মনে হলো।

চুপচাপ ফিরে এলাম। মাথার মধ্যে যেন আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুই ভাবতে পারছি না। শুধু মনে হচ্ছিল এখান থেকে বেরিয়ে গেলে আমি বেঁচে যাব। দরজা খুললাম। সামান্য শব্দ বাজল। বন্ধ করলে সেটা দ্বিগুণ হল। মনে হলো হেনার গলা শুনতে পেলাম। ও কি জেগে উঠে কে বলল। লিফট বন্ধ। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলাম। যত তাড়াতাড়ি পারি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই।

নিচে নেমেই দেখতে পেলাম গেট বন্ধ। সেখানে তালা ঝুলছে। বের হবার কোনো উপায় নেই। কী করা যায়? দারোয়ান নিশ্চয়ই তালাচাবি দিয়ে অন্য কোথাও চলে যায়নি? লোকটাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম উঁকি মেরে। এদিকের আলো জ্বলছে না। দারোয়ানকে দেখতে পেলাম না। সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।

মিনিট পনেরো বাদে মনে হল ওপরেই উঠে যাই। হেনাকে ডেকে তুলে বলি সব কথা। আমার কোনো মতলব ছিল না এই থেকে যাওয়ার পেছনে। ঠিক সেই সময় কেউ একজন হাঁকল, কে? কে ওখানে? কৌন হ্যায়?

চিৎকারটা এত জোরে যে আমি ঝটপট সরে এলাম। ওই লোকটাই কি এই বাড়ির দারোয়ান? এই সময় দ্বিতীয় গলা শোনা গেল, কেয়া হুয়া সেলিম ভাই?

একটা লোককে দেখলাম গেট থেকে সরে যেতে। তালা খোল, জলদি।

এইবার হাতেনাতে ধরা পড়ার চেয়ে লুকিয়ে পড়া ভাল। নাকি, এগিয়ে গিয়ে বলব, আমি চোর নই। হেনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম কিন্তু গেট বন্ধ হয়ে গিয়েছে তা জানতাম না। যুক্তিটা জলো বলে মনে হলো। হেনা নিশ্চয়ই জানে কখন গেট বন্ধ হয়। সেক্ষেত্রে সে নিশ্চয়ই তার কাছে রাখা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিত। ওরা আমাকে হেনার কাছে ধরে নিয়ে যাবে সত্যিই বলছি কিনা জানার জন্যে। তখন হেনা কী বলবে?

দ্রুত দৌড়ে ওপরে উঠলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার সামনে পৌঁছে বেল বাজালাম। মিনিটখানেক গেল, মনে হচ্ছিল অনেক সময়। নিচে হল্লা বাড়ছে। এই সময় দরজা খুলল হেনা। তার পরনে এখন হাউসকোট। আমাকে দেখে সে হতভম্ব, তুমি?

তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম। তখনও নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি।

তুমি এখানে কী করে এলে? প্রায় চিৎকার করে উঠল হেনা।

প্লিজ! চুপ করো। সব বলছি। আমি মিনতি করলাম।

কিন্তু!

আমি তোমাকে বিরক্ত করছি কিন্তু কোনো উপায় নেই। যদি কেউ এখানে খোঁজ করতে আসে তাহলে বলবে আমি এখানে আসিনি।

এই বাড়িতে ঢুকলে কী করে?

আমি এখান থেকে বের হইনি। সোফায় বসে হেনাকে সব খুলে বললাম।

হঠাৎ হেনার চোখমুখ অন্যরকম হয়ে গেল, আমি শুয়ে পড়ার পর তুমি আমার বেডরুমে গিয়েছিলে? সত্যি কথা বলো?

না। বলেই মনে হল, মিথ্যে বলে কী লাভ, ভেতরে যাইনি। দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ কিনা। আই অ্যাম সরি।

ভেতরে গিয়ে ডাকোনি কেন?

অ্যাঁ?

 ভেতরে ঢুকে আমাকে ডাকোনি কেন?

আমার মনে হয়েছিল ঘুম থেকে উঠে আমাকে দেখে তুমি রেগে যাবে।

 অদ্ভুত। আচ্ছা, বলো তো, তুমি আর কতদিন আমাকে জ্বালাবে?

আমি চাইনি।

এখন কী করবে। এত রাত্রে এখান থেকে আমি যদি তোমাকে নিয়ে গিয়ে গেট খুলে দিই তাহলে কাল সবাই গল্পটাকে নানান রঙে সাজাবে। উঃ।

আমি এখানেই থাকছি। সকাল হলে গেট খুললে বেরিয়ে যাব। আমাকে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। যাও, শুয়ে পড়। তোমাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত।

দুঃখিত! শব্দটাকে অর্থহীন করে দিলে তুমি।

যাও। শুয়ে পড়।

কী ভাবে?

তার মানে?

 একই ফ্ল্যাটে একজন পুরুষ বাইরে বসে থাকলে আমার ঘুম আসবে?

দরজাটা বন্ধ করে দাও।

বেডরুমের দরজা আমি কখনও বন্ধ করি না।

ও। আমি প্রমিজ করছি, ওদিকে আমি যাবো না। বিশ্বাস করো।

আমি বিশ্বাস করি না। তুমি একবার গিয়েছ, আবার যেতে পার। তখন সাহস পাওনি, এখন। তাছাড়া আমি হাউসকোট বা শাড়ি পরে শুতে পারি না। তুমি এ ঘরে থাকলে এগুলো ছেড়ে শোওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

হঠাৎ আমার মনে হল বড্ড বাড়াবাড়ি করছে হেনা। বললাম, যা ইচ্ছে তাই করো তাহলে। আলো নিবিয়ে চলে যাও, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।

হেনা চলে গেল। আলো নেবাল না। আমি চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। বাপ নিশ্চয়ই আজ রাত্রে অনেক কিছু ভেবে নিয়েছে। কাল বাড়িতে গেলে গেট আউট বললে অবাক হব না। পরিস্থিতি যেরকম হবে সেইরকম কাজ করতে হবে। আগেভাগে ভেবে কোনো লাভ নেই। তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। চেয়ারের ওপর পা ছড়িয়ে দিয়ে সোফায় হেলান দিতে ঘুম এসে গেল। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।

হাঁটুতে মৃদু আঘাত লাগতেই ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখলাম প্রায় রণরঙ্গিনী মূর্তি ধরে হেনা দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ওঠো!

কেন?

আমার ফ্ল্যাটে তুমি আরাম করে ঘুমাবে আর আমি ঠায় জেগে থেকে সেটা দেখব এটা হতে পারে না।

তুমি ঘুমাচ্ছো না কেন?

কারণ আমি মানুষ। তোমার মতো অ্যাবনর্মাল নই যে সুইচ টিপলেই ঘুম চলে আসবে। তোমাকে এখানে থাকতে হলে জেগে থাকতে হবে, নইলে চাবি দিচ্ছি বেরিয়ে যাও, যাওয়ার সময় আমার লেটার বক্সে চাবিটা ফেলে দিয়ে যেও।

এত রাত্রে আমি কোথায় যাব?

তুমি তো আমার অনুমতি নিয়ে এখানে থাকোনি।

বেশ। দাও চাবি।

বাঃ। তবু তুমি জেগে থাকবে না?

 তোমার উদ্ভট ইচ্ছে পূর্ণ করার কোনো মানে হয় না।

 কে উদ্ভট? আমি না তুমি? এম. এ. পাশ করে বেকার বসে আছ, কি না, আমি দুনম্বরি উপায়ে পাওয়া চাকরি নেব না। ভালবাসব অথচ যাকে ভালবাসি তাকে নিরাপত্তা দেব না। তোমার মত সুবিধেবাদী অলস অকর্মণ্যরাই একথা বলে। এই সমাজে তুমিই নিজেকে উদ্ভট করে রেখেছ।

বেশ। তুমি আমাকে কী করতে বলো?

আমার কিছু বলার নেই।

 প্লিজ, হেনা।

হেনা আমার দিকে তাকাল, বেশ। পারবে তুমি তোমার বাবার অফার অ্যাকসেপ্ট করতে? এন. আর. আই-দের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করতে পারবে?

তুমি বুঝতে পারছ না, ওটা করতে গেলে বাপের দুনম্বরি ক্ষমতার সাহায্য চাই। পার্টি, রাইটার্স বিল্ডিং, সর্বত্র বাপের প্রতিপত্তি খাটিয়ে কাজ আদায় করতে হবে। যার এই সুযোগ নেই সে বেচারা কোনোদিন যা পাবে না আমি তা সহজেই পেয়ে যাব। আমাকে তুমি এই অন্যায় করতে বলছ? আমি বোঝাবার চেষ্টা করলাম।

অন্যায়? এই যে এখানে একজন অবিবাহিতা এক মহিলার ফ্ল্যাটে মধ্যরাতে তুমি দাঁড়িয়ে আছ যার সঙ্গে তোমার কোনো লিগ্যাল সম্পর্ক নেই, এটা অন্যায় নয়? এতই যখন তোমার আপত্তি তাহলে এখানে পড়ে আছ কেন? জঙ্গলে বা পাহাড়ে চলে যাও। সেখানে হয়তো এত সমস্যা থাকবে না। হেনা ছুটে ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল চাবি নিয়ে। টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, গেট লস্ট।

চাবিটা তুলে বেরিয়ে এলাম। নিচে নেমে তালা খুলতেই একজন এগিয়ে এল, আপনি কোন ফ্ল্যাট থেকে আসছেন স্যার?

উত্তর দিলাম। লোকটা দ্বিতীয় প্রশ্ন করার আগে বাইরের দেওয়ালে টাঙানো লেটার বক্সগুলোর মধ্যে যেটার বুকে হেনার নাম লেখা তার গর্তে চাবিটা ফেলে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখলাম রাস্তা শুনশান। আলোগুলো হলদেটে লাগছে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মনে হলো, সত্যি কি আমি উদ্ভট? হেনাকে আজ কত বছর হয়ে গেল বন্ধু বলে নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি একবারও ওকে চুমু খাইনি। কলেজে পড়ার সময় এসব ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ তারা কতবার জিজ্ঞাসা করেছে আমাদের সম্পর্ক কত দূর এগিয়েছে? চুমু খাওয়া ওদের কাছে হাত মেলানোর মতো সহজ ব্যাপার ছিল, ওরা আরও এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হেনার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করলেও ওসব ভাবনা আমার মাথায় আসেনি। হেনা যখন চাকরি নিল, ওর ব্যাচেলার মামার এই ফ্ল্যাটে উঠে এল তখন তো অনেক সময়ই একা পেতাম। মামা মারা যাওয়ার পর তো কোনো ভয় ছিল না। তাহলে? আমি কি একজন ছেলেবন্ধুর থেকে হেনাকে আলাদা করিনি? এটা উদ্ভট নয়? একজন আমার বয়সী ছেলে হেনার মত সুন্দরী মহিলাকে প্রেমিকা হিসেবে পেয়ে শরীর সম্পর্কে নিস্পৃহ থাকবে কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *