পরদিন প্রভাত। পাখিরা কলরব করিতেছে, দূরে মন্দির হইতে প্রভাত-আরতির শঙ্খ ঘণ্টারব আসিতেছে।
প্রতাপ তাহার শয়নকক্ষে শয্যায় ঘুমাইতেছে। তাহার পালঙ্কের শিয়রে দুইটি পট দেয়ালে টাঙানো রহিয়াছে; একটি রানা প্রতাপ সিংহের, অপরটি ছত্রপতি শিবাজীর।
অঙ্গনের দিকে জানালা দিয়া সূর্যের নবারুণ আলোক ঘরে প্রবেশ করিতেছিল, সহসা কয়েকজনের কলহরুক্ষ কণ্ঠস্বর শোনা গেল। প্রতাপ ধীরে ধীরে চক্ষু মেলিল, তারপর ঈষৎ বিস্ময়ে শয্যাপাশে উঠিয়া বসিল। ঘুমের জড়তা তখনও ভাল করিয়া ভাঙে নাই
অকস্মাৎ বারান্দা হইতে তাহার মাতার মর্মান্তিক কাতরোক্তি কানে আসিল।
হাঁ রণছোড়জী, এ কি করলে এ কি করলে
প্রতাপ এক লাফে জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। জানালা দিয়া প্রাঙ্গণের সমস্তটাই দেখা যাইতেছে। শেঠ গোকুলদাস এখানে উপস্থিত আছেন, তাঁহার সঙ্গে জন দশ বারো লাঠিয়াল অনুচর। একজন অনুচর মোতির লাগাম ধরিয়া বাহিরের দিকে লইয়া যাইতেছে এবং বৃদ্ধ লছমন তাহাকে বাধা দিবার চেষ্টা করিতেছে।
গোকুলদাস বলিতেছেন,—যাও নিয়ে যাও আমার আস্তাবলে—
লছমন বলিল,-না না—ছেড়ে দাও মোতিকে– আমার মালিকের ঘোড়া আমি নিয়ে যেতে দেব না
যে লোকটা মোতিকে লইয়া যাইতেছিল সে লছমনকে সজোরে একটা ঠেলা দিল, লহমন ছিটকাইয়া গিয়া চিকু গাছের তলায় পড়িল।
জানালায় প্রতাপের মা তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন, তিনি কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন,–
ওরে প্রতাপ কি হবে বাবা
ক্রোধে বিস্ময়ে প্রতাপের কণ্ঠরোধ হইয়া গিয়াছিল, সে এক হাতে মাকে সরাইয়া দিয়া ঘর হইতে বাহির হইল।
বাহিরের বারান্দায় যেখানে বন্দুকটা দেয়ালে টাঙানো ছিল, ঠিক সেই স্থানে গোকুলদাসের অনুচর কান্তিলাল দাঁড়াইয়া ছিল, প্রতাপ তাহাকে লক্ষ্য না করিয়া সদর দরজা দিয়া বাহির হইয়া প্রাঙ্গণে নামিয়া লইয়া গেল। গোকুলদাসের সম্মুখীন হইয়া কঠোর স্বরে কহিল,
কি হয়েছে? কী চাও তুমি আমার বাড়িতে?
গোকুলদাস ব্যঙ্গভরে বলিলেন,—ওহে, ঘুম ভেঙেছে এতক্ষণে। যারা মহাজনের টাকা ধারে তাদের এত ঘুম ভাল নয়। এখন গা তোলো–আমার বাড়ি ছেড়ে দাও।
তোমার বাড়ি!
হাঁ, আমার বাড়ি। তোমার বাপ টাকা ধার করেছিল, কাল তার মেয়াদ ফুরিয়েছে। আজ আমি সমস্ত সম্পত্তি দখল করেছি; এ বাড়ি এখন আমার।
আদালতের হুকুম এনেছ?
গোকুলদাস মিহি সুরে হাস্য করিলেন
আদালতের হুকুম আমার দরকার নেই। আমার হক, আমি দখল করেছি। তোমার যদি কোনও নালিশ থাকে তুমি আদালতে যাও।
প্রতাপ এতক্ষণ অতি কষ্টে ধৈর্য ধরিয়া কথা বলিতেছিল, এখন আর পারিল না। তাহার পায়ের কাছে একটা চেলাকাঠ পড়িয়াছিল, সে তাহাই তুলিয়া লইল। আরক্ত চক্ষে চাহিয়া বলিল,-
বটে! আমার সম্পত্তি তুমি গায়ের জোর দখল করবে! পাজি বেনিয়ার বাচ্চা, বেরোও আমার বাড়ি থেকে, নইলে
প্রতাপ হিংস্রভাবে চেলাকাঠ গোকুলদাসের মাথার উপর তুলিল, গোকুলদাস সভয়ে মস্তক রক্ষা করিবার জন্য হাত তুলিলেন।
এই সময় বারান্দা হইতে কান্তিলালের কণ্ঠস্বর আসিল—
খবরদার!
সকলে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, কান্তিলাল প্রতাপের বন্দুক লইয়া তাহার দিকে লক্ষ্য করিয়া আছে। গোকুলদাস এবার নির্ভয় হইয়া কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইলেন।
কান্তিলাল বলিল,-লাঠি ফেলে দাও—
প্রতাপ নিস্ফল ক্রোধে ফুলিতে লাগিল কিন্তু হাতের লাঠি ফেলিল না।
কান্তিলাল আবার বলিল,-লাঠি ফেলে দাও নইলে
বন্দুকের ঘোড়া টানার কট করিয়া শব্দ হইল। এই সময় আলুথালু বেশে প্রতাপের মা ভিতর হইতে বারান্দায় বাহির হইয়া আসিলেন, তাঁহার চেহারা দেখিলেই বোঝা যায় তাঁহার মানসিক বিপন্নতা চরমসীমায় পৌঁছিয়াছে।
প্রতাপ—ওরে প্রতাপ, লাঠি ফেলে দে বাবা! আয়, আমার কাছে আয়
প্রতাপ দেখিল মা দুই হাতে বুক চাপিয়া ধরিয়া টলিতেছেন, এখনি পড়িয়া যাইবেন। সে হাতের লাঠি ফেলিয়া দিয়া ছুটিয়া গিয়া মাকে ধরিয়া ফেলিল।
মা-! কি হয়েছে মা?
মা কম্পিত নিশ্বাস টানিয়া বলিলেন, কিছু না বাবা, বুকটা বড় ধড়ফড় করছে! চল্ বাবা, আমরা চলে যাই
গোকুলদাস বলিলেন, হ্যাঁ, ভাল চাও তো ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে যাও আমার কাছে চালাকি চলবে না।
মা বলিলেন,-চল বাবা—এখান থেকে আমায় নিয়ে চল—
মাতা-পুত্র হাত ধরাধরি করিয়া এক পা অগ্রসর হইলেন, তারপর মায়ের বক্ষ ভেদ করিয়া একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস বাহির হইল—
উঃ—আমার স্বামীর ভিটে-শ্বশুরের ভিটে—
চাপা কান্নার দুর্নিবার উচ্ছ্বাস তাঁহার কণ্ঠে আসিয়া আটকাইয়া গেল, শিথিল অঙ্গে ধীরে ধীরে তিনি মাটিতে শুইয়া পড়িলেন। প্রতাপ সভয়ে ডাকিল,
মা–
মা সাড়া দিলেন না। প্রতাপ নতজানু হইয়া তাঁহার বুকে কান রাখিয়া শুনিল, বুকের শেষ দুর্বল স্পন্দন ধীরে ধীরে থামিয়া যাইতেছে।
মুখ তুলিয়া প্রতাপ পাগলের মত চিৎকার করিয়া উঠিল— মা—! মা–! মা–!
.
রাত্রি। আকাশে পূর্ণচন্দ্র।
শ্মশানে চিতার উপর প্রতাপের মাতার দেহাবশেষ পুড়িতেছে। অদূরে প্রতাপ একটি শিলাখণ্ডের উপর করলগ্নকপোলে বসিয়া একদৃষ্টে চিতার পানে চাহিয়া আছে। তাহার কয়েকজন শ্মশানসঙ্গী প্রতিবেশী আশে-পাশে বসিয়া আছে— সকলেই নীরব। তাহাদের মুখের উপর চিতার অস্থির আলো খেলা করিতেছে।
প্রতাপের মুখ পাথরের মত নিশ্চল, আলো ছায়ার চঞ্চল খেলা তাহার মুখে কোনও ভাবান্তর আনিতে পারিতেছে না।
নিকটবর্তী গাছের ডালে একটা শকুন কর্কশকণ্ঠে ডাকিয়া উঠিল। সকলের মুখ তুলিয়া সেইদিকে চাহিল, কিছু প্রতাপ মুখ তুলিল না, যেমন অপলক চক্ষে চিতার পানে চাহিয়া ছিল তেমনি চাহিয়া রহিল।
.
শ্মশান হইতে বহু দূরে জলসত্রের ক্ষুদ্র কক্ষে বাতায়ন দিয়া ঐ চাঁদের আলো মেঝের উপর পড়িয়াছে। ভিতর হইতে ঘরের দ্বার রুদ্ধ, ঘরের কোণে স্তিমিত দীপশিখা জ্বলিতেছে। মেঝের উপর উপুড়করা একটি বেতের টুকরির ভিতর হইতে মাঝে মাঝে সুখপাখিত পক্ষিশাবকের তন্দ্রাক্ষীণ কিচিমিচি শব্দ আসিতেছে।
কাঠের একটি সুপরিসর হিচকা বা দোলনার উপর চিন্তা বসিয়া আছে। এই দোলনাই তাহার শয্যা। আজ চিন্তার চোখে নিদ্ৰা নাই; প্রতাপ আসিবে বলিয়া চলিয়া গিয়াছে, আর আসে নাই। কেন আসিল না? তবে কি তাহার অনুরাগ শুধু মুখের কথা? দুদণ্ডের চিত্ত-বিনোদন? ভাবিয়া ভাবিয়া চিন্তা কূলকিনারা পায় নাই; মধ্যাহ্ন সন্ধ্যায় গড়াইয়া গিয়াছিল, সন্ধ্যা মধ্যরাত্রের নিথর নিষ্ফলতায় ভরিয়া গিয়াছে। কেন সে আসিল না? আজ প্রতাপ আসিবে বলিয়া চিন্তা বন্যকুসুম তুলিয়া দুটি মালা গাঁথিয়া রাখিয়াছিল— সে-মালা চিন্তা কাহার গলায় দিবে?
ব্যথাবিষণ্ণ সুরে সে নিজমনেই গাহিতেছিল—
আমার মনে যে-ফুল ফুটেছিল
আকাশের সূর্য তারে শুকিয়ে
দিল রে।
ধুলাতে পড়ল ঝরে সে
বাতাসের নিদয় পরশে
বুকে মোর কাঁটার বেদনা
বুক দুখিয়ে দিল রে।
আমার মনে চাঁদ—
আমার মনে চাঁদ যে উঠেছিল
ও তারে প্রলয় মেঘে লুকিয়ে
দিল রে।
মরমের মৌন অতলে
নিরাশার ঢেউ যে উথলে—
জীবনের পাওনা-দেনা মোর
কে চুকিয়ে দিল রে।
গুনগুন করিয়া গাহিতে গাহিতে চিন্তা ঘরময় ঘুরিয়া বেড়াইল, টুকরি তুলিয়া কপোতশিশু দুটিকে দেখিল, জানালায় দাঁড়াইয়া জ্যোৎস্না নিষিক্ত বহিঃপ্রকৃতির পানে চাহিয়া রহিল, কিন্তু তাহার সংশয়পীড়িত মন শান্ত হইল না।
.
ওদিকে অন্ত্যোষ্টিক্রয়া শেষ হইয়া গিয়াছে; প্রতাপ ও তাহার সঙ্গীগণ জল ঢালিয়া চিতা নিভাইতেছে।
চিতা ধৌত করিয়া সকলে চিতার উপর এক মুষ্টি করিয়া ফুল ফেলিয়া দিল, তারপর সরিয়া আসিয়া একত্র দাঁড়াইল। সঙ্গীদের মধ্যে যিনি বয়োজ্যষ্ঠ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া প্রতাপ বলিল,-
অম্বুভাই, তোমরা আমার দুর্দিনের বন্ধু। আমি আর তোমাদের কী বলব, মা স্বর্গ থেকে তোমাদের আশীর্বাদ করবেন। শ্মশানের কাজ তো শেষ হয়েছে, এবার তোমরা ঘরে ফিরে যাও।
অম্বুভাই প্রশ্ন করিল,—আর তুমি?
প্রতাপ বলিল,—আমি আর কোথায় যাব অম্বুভাই, আমার তো যাবার স্থান নেই।
অম্বুভাই বলিল,-ও কথা বোলো না প্রতাপ। আমার কুঁড়েঘর যতদিন আছে ততদিন তোমারও মাথা গুঁজবার স্থান আছে। চল, আজ রাত্রিটা বিশ্রাম কর, তারপর কাল যা হয় স্থির করা যাবে।
প্রতাপ বলিল,-আমার কর্তব্য আমি স্থির করে নিয়েছি। তোমরা ঘরে ফিরে যাও অম্বুভাই। আমি অন্য পথে যাব।
অম্বুভাই বলিল, অন্য পথে? কোথায়? কোন্ পথ?
প্রতাপ বলিল,—আমি যে-পথে যাব সে পথে আজ তোমরা যেতে পারবে না, তাই তোমাদের কাছে বিদায় নিচ্ছি। হয়তো আবার কোনওদিন দেখা হবে। —বিদায় বন্ধু, বিদায় ভাই সব। নমস্কার, তোমাদের নমস্কার।
প্রতাপ যুক্তকরে সকলকে বিদায়-নমস্কার করিল। সকলে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।
.
শেঠ গোকুলদাসের প্রাসাদ মধ্যরাত্রির চন্দ্রালোকে ঘুমাইতেছে। কিংবা হয়তো ঘুমায় নাই। দ্বিতলে তোশাখানার জানালাটি খোলা আছে এবং সেখান হইতে মৃদু প্রদীপের আলোক নির্গত হইতেছে; মনে হয় প্রাসাদ ঘুমাইলেও তাহার একটি চক্ষু জাগিয়া আছে।
সিংদরজার সম্মুখে সশস্ত্র সান্ত্রিগণ কিন্তু দুই চক্ষু মুদ্রিত করিয়াই ঘুমাইতেছে। না ঘুমাইবার কোনও কারণ নাই, শেঠ গোকুলদাসের দেউড়িতে চোর ঢুকিবে এত বড় সাহসী চোর দেশে নাই।
সিংদরজার দুইপাশে দীর্ঘ প্রাচীর চলিয়া গিয়াছে। দক্ষিণ দিকের দেয়াল যেখানে মোড় ঘুরিয়া পিছন দিকে গিয়াছে, সেই কোণের কাছে সহসা একটি মাথা উঁকি মারিল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল–প্রতাপ। সে শ্মশানে সঙ্গীদের বিদায় দিয়া সটান এখানে আসিয়াছে। গোকুলদাসের সহিত তাহার হিসাব-নিকাশ এখনও শেষ হয় নাই।
প্রতাপ দেয়ালের কোণ হইতে গলা বাড়াইয়া দেখিল প্রহরীরা ঘুমাইতেছে। তখন সে দেয়ালের গা ঘেঁষিয়া পিছন দিকে ফিরিয়া চলিল। বাড়ির পশ্চাদ্দিকে যেখানে পাঁচিল শেষ হইয়াছে সেখানে উপস্থিত হইয়া প্রতাপ দেখিল পাঁচিলের গায়ে একটি দরজা রহিয়াছে। ইহা চাকর বাকরদের ব্যবহার্য খিড়কি দরজা।
খিড়কি দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। কিন্তু পাঁচিল বেশী উঁচু নয়। প্রতাপ লাফাইয়া পাঁচিলের কিনারা ধরিয়া ফেলিল, তারপর বাহুর বলে শরীরকে উর্ধ্বে তুলিয়া পাঁচিলের উপর উঠিয়া বসিল। ভিতরে কেহ কোথাও নাই, শষ্পাকীর্ণ ভূমির উপর শিশিরকণা ঝিকমিক করিতেছে। বাড়িটি সবুজ জলে ভাসমান এক চাপ বরফের মত দেখাইতেছে। পিছনের দেয়াল ঘেঁষিয়া একসারি ঘর, ইহা গোকুলদাসের আস্তাবল ও গোহাল।
প্রতাপ নিঃশব্দে নিজেকে পাঁচিল হইতে ভিতর দিকে নামাইয়া দিল। খিড়কির দরজা কেবল অর্গলবন্ধ ছিল, প্রথমেই সেটি খুলিয়া দিল; প্রয়োজন হইলে পলায়নের রাস্তা খোলা চাই।
তারপর সে সতর্কপদে পিছনের ঘরগুলির দিকে চলিল। মানুষ কেহ নাই; একটি ঘরে কয়েকটি গরু রহিয়াছে। এইরূপ কয়েকটি ঘর পার হইবার পর একটি ঘরের সম্মুখীন হইতেই ভিতরের অন্ধকার হইতে ঘোড়ার মৃদু হ্রেষাধ্বনি আসিল। প্রতাপ চিনিল— মোতি।
ঘরের সম্মুখে দ্বার নাই, কেবল দুটি বাঁশ পাশাপাশি অর্গল রচনা করিয়াছে। প্রতাপ বাঁশ দুটি সন্তর্পণে সরাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।
আস্তাবলের মধ্যে মোতি প্রভুকে দেখিয়া চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, প্রতাপ তাহার গায়ে মুখে হাত বুলাইয়া তাহাকে শান্ত করিল, তারপর দেয়ালে-টাঙানো লাগাম লইয়া তাহার মুখে পরাইল। জিনের পরিবর্তে একটি কম্বল তাহার পিঠে বাঁধিল, লাগাম ধরিয়া বাহিরে লইয়া আসিল।
এই সব ব্যাপারে একটু শব্দ হইল বটে কিন্তু ভাগ্যক্রমে কেহ জাগিল না। প্রতাপ মোতিকে লইয়া খিড়কি দরজা দিয়া বাহির হইল; কিছুদুর একটা গাছের তলায় লইয়া গিয়া তাহার গলা জড়াইয়া কানে কানে বলিল,-
মোতি, এইখানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাক। যতক্ষণ না ফিরে আসি শব্দ করিসনি।
মোতি সম্মতিসূচক শব্দ করিল। তখন প্রতাপ তাহার গলা চাপড়াইয়া আবার ভিতরে গিয়া প্রবেশ করিল। এইবার আসল কাজ।
প্রতাপ দুই হাত ধীরে ধীরে ঘষিতে ঘষিতে ঊর্ধ্বে প্রাসাদের দিকে চাহিল।
তোশাখানার গদির উপর বসিয়া গোকুলদাস মোহর গণিতে ছিলেন। তাঁহার হাতবাক্সের পিঠের উপর সারবন্দী সিপাহীর মত থাকে থাকে মোহরের স্তম্ভ গড়িয়া উঠিতেছিল। চম্পা গদির এক পাশে অর্ধশয়ান অবস্থায় চিবুকের নীচে করতল রাখিয়া নিদ্রালুনেত্রে দেখিতেছিল।
পিতলের দীপদণ্ডে তৈলপ্রদীপ মৃদু আলো বিকীর্ণ করিতেছিল। ঘরে আর কেহ নাই। ভারী মজবুত দরজা ভিতর হইতে বন্ধ।
ঘুম-জড়ানো চোখে চম্পা ছোট একটি হাই তুলিল।
আর কত মোহর গুণবে? এবার শোবে চল না।
গোকুলদাস থলি হইতে আরও এক মুঠি মোহর বাহির করিয়া গণিতে গণিতে বলিলেন,–
হুঁ হুঁ-এই যে হল—
এই সময় খোলা জানালার বাহিরে প্রতাপের মুখ অস্পষ্টভাবে দেখা গেল; গোকুলদাস মোহর গণনায় মগ্ন; চম্পার পিঠ জানালার দিকে; সুতরাং কেহই তাহাকে লক্ষ্য করিল না।
প্রতাপ নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করিয়া দাঁড়াইল, তাহার সতর্ক চক্ষু একবার ঘরের চারিদিক ঘুরিয়া আসিল। বন্ধ দরজার দুই পাশে দুটি পিস্তলের উপর তাহার দৃষ্টি পড়িল। কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাহাদের দিকে চাহিয়া থাকিয়া সে দেয়াল ঘেঁষিয়া ছায়ার মত সেই দিকে অগ্রসর হইল।
ইতিমধ্যে গোকুলদাস ও চম্পার মধ্যে অলস বাঙ বিনিময় চলিয়াছে।
চম্পা বলিতেছে,— আচ্ছা, বার বার মোহর গুণে কি লাভ হয়? মোহর কি গুণলে বাড়ে?
গোকুলদাস একটি সন্দেহজনক মোহর আলোর কাছে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে দেখিতে নাকিসুরে হাস্য করিলেন।
হুঁ হুঁ হুঁ তুমি কি বুঝবে। মেয়েমানুষ আর টাকা— দুইই সমান, কড়া নজর না রাখলে হাতছাড়া হয়ে যায় হুঁ হুঁ হুঁ
কথাটা চম্পার গায়ে লাগিল। সে উঠিয়া বসিয়া স্থিরনেত্রে স্বামীর মুখের পানে চাহিল।
টাকার কথা তুমি বলতে পার, কিন্তু মেয়েমানুষের কি জানো তুমি? তিনবার বিয়ে করলেই হয় না।
গোকুলদাস হাসিলেন হুঁ হুঁ হুঁ
চম্পার চক্ষু প্রখর হইয়া উঠিল।
কড়া নজর না রাখলে মেয়েমানুষ হাতছাড়া হয়ে যায়! আমার ওপর কত নজর রাখো তুমি? তার মানে কি আমি মন্দ?
গোকুলদাস বলিলেন,—শাস্ত্রে বলে পুরুষের ভাগ্য আর স্ত্রীলোকের চরিত্র হুঁ হুঁ হুঁ
চম্পা অধর দংশন করিল।
দ্যাখো, স্বামীর নিন্দে করতে নেই, স্বামী মাথার মণি। কিন্তু তুমি তুমি মহাপাপী। একদিন বুঝবে আমি সতীলক্ষ্মী কি না—যেদিন তোমার চিতায় আমি সহমরণে যাব। সেদিন যখন আসবে—
বদ্ধদ্বারের নিকট হইতে গম্ভীর আওয়াজ আসিল—
সেদিন এসেছে।
চম্পা ও গোকুলদাস একসঙ্গে দ্বারের দিকে ফিরিলেন; দেখিলেন প্রতাপ দাঁড়াইয়া আছে, তাহার দুই হাতে দুটি পিস্তল।
কিছুক্ষণ জড়বৎ থাকিয়া গোকুলদাস জাঁতিকলে পড়া ইদুরের মত একটি শব্দ করিয়া দুই হাতে হাতবাক্সটি আলাইয়া তাহার উপর উপুড় হইয়া পড়িলেন। চম্পা একেবারে পাথরের মূর্তিতে পরিণত হইয়াছিল, সে তেমনি বসিয়া রহিল।
প্রতাপ আসিয়া তাহাদের নিকট দাঁড়াইল; তাহার চোখে কঠিন কাচের মত দৃষ্টি
গোকুলদাস, আমাকে চিনতে পার?
গোকুলদাস ভয়ে ভয়ে একটু মাথা তুলিলেন। বলিলেন,–
অ্যাঁ-হ্যাঁ-প্রতাপভাই—
প্রতাপ বলিল,-মহাজন, আজ তোমার দিন ফুরিয়েছে তা বুঝতে পারছ?
গোকুলদাসের কণ্ঠস্বর ভয়ে তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল—
না না না, প্রতাপভাই, তুমি বড় ভাল ছেলে বড় সাধু ছেলে— তোমাকে আমি সব সম্পত্তি ফিরিয়ে দেব
প্রতাপ ডান হাতের পিস্তলটা তাহার রগের কাছে লইয়া গিয়া বলিল,–
চুপ–আস্তে। চেঁচিয়েছ কি গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।
গোকুলদাস ঢোক গিলিয়া নীরব হইলেন। এমন সময় চম্পা ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেই প্রতাপের বাঁ হাতের পিস্তল তাহার দিকে ফিরিল।
প্রতাপ বলিল,-বেন, তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই না, কিন্তু গোলমাল করলে তুমিও মরবে।
চম্পার সুন্দর মুখখানি বিচিত্র উত্তেজনায় আরও সুন্দর দেখাইতেছিল, সে চাপা গলায় বলিল,-
না, আমি গোলমাল করব না। কিন্তু, ওকে তুমি ছেড়ে দাও প্রাণে মেরো না।
প্রতাপ বলিল,-প্রাণে মারব না! ও আমার কি করেছে তা জানো?
চম্পা বলিল,-জানি। ও তোমার যথাসর্ব কেড়ে নিয়েছে, ওর জন্যেই তোমার মার মৃত্যু হয়েছে। ও মহাপাপী। কিন্তু তবু ভাই, তুমি ওকে ছেড়ে দাও। আমি ওর জন্যে বলছি না, তুমি আমাকে বহিন বলেছ, আমার মুখ চেয়ে ওর প্রাণ ভিক্ষা দাও।
চম্পা যেখানে দাঁড়াইয়াছিল সেইখানেই নতজানু হইয়া বলিল,–
ভাই, আমার দিকে চেয়ে দ্যাখো–আমার কুড়ি বছর বয়স, আমাকে বিধবা কোরো না
গোকুলদাস চি চি শব্দে যোগ করিয়া দিলেন,
শুধু ও নয়, আরও দুজন আছে
প্রতাপ বলিল,-চোপরও!
গোকুলদাস আবার কাঠের পুতুলের মত নিঃসাড় হইয়া রহিলেন। চম্পা বলিল, ভাই প্রতাপ ভাই-
প্রতাপ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া ক্ষণেক চিন্তা করিল। গোকুলদাসকে হাতে পাইয়া ছাড়িয়া দেওয়া তাহার পক্ষে বড় মর্মান্তিক ব্যর্থতা; এখনও তাহার বুকে মায়ের চিতার আগুন জ্বলিতেছে। কিন্তু এদিকে এই নিরপরাধী যুবতী বিধবা হয়। প্রতাপ তিক্তদৃষ্টিতে গোকুলদাসের পানে চাহিল।
চম্পা আবার বলিল,-ভাই! প্রতাপভাই।
প্রতাপ বলিল,-ছেড়ে দিতে পারি— যদি—
উদ্ভাসিত মুখে চম্পা উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল,–
তুমি আর যা বলবে তাই করব। কী করব বল?
প্রতাপ দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিল। গোকুলদাসের পক্ষে মৃত্যুর চেয়েও বড় শাস্তি আছে। সে বলিল,-
প্রথমে চাবি নিয়ে সব সিন্দুক খুলে দাও।
গোকুলদাস আঁকুপাঁকু করিয়া উঠিলেন।
অ্যাঁ— তবে কি?
প্রতাপ দুইটি পিস্তল গোকুলদাসের দুই চোখের অত্যন্ত নিকটে লইয়া গিয়া বলিল,-
চুপ করে থাক্ বেইমান হারামী; কথা কয়েছিস কি মরেছিস। চম্পাকে বলিল,—যা বললাম কর।
চম্পা ত্বরিতে গোকুলদাসের কোমর হইতে চাবির গোছা লইয়া একে একে সব সিন্দুকগুলি খুলিয়া দিল। প্রত্যেকটির জঠরে বহু দলিল, মোহরের থলি ও বন্ধকী গহনা দেখা গেল।
চম্পা বলিল,-এই যে প্রতাপভাই, এবার কি করব বল?
প্রতাপ বলিল,-এবার বেশ ভারী দেখে দুটো মোহরের থলি নাও।—নিয়েছ?
হাঁ ভাই, এই যে নিয়েছি
গলায় দড়ি বাঁধা দুটি পরিপুষ্ট থলির মুঠ ধরিয়া চম্পা দেখাইল।
প্রতাপ বলিল,-আচ্ছা, এবার থলি দুটোকে জানালার বাইরে ফেলে দাও।
চম্পা ভারী থলি দুটি বহিয়া জানালার কাছে লইয়া গেল, তারপর একে একে তুলিয়া জানালার বাহিরে ফেলিয়া দিল। নীচে ধপ ধপ করিয়া শব্দ হইল।
.
নীচে সিংদরজার সম্মুখে সান্ত্রীরা পূর্ববৎ ঘুমাইতেছিল, ধপ ধপ শব্দে চমকিয়া জাগিয়া তাহারা সন্দিগ্ধভাবে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিতে লাগিল।
.
এদিকে তোশাখানার জানালায় চম্পা ভিতর দিকে ফিরিয়া সপ্রশ্নচক্ষে প্রতাপের পানে চাহিল। প্রতাপ সন্তোষসূচক ঘাড় নাড়িয়া বলিল,-
এবার সিন্দুক থেকে দলিলের কাগজ বার করে নিয়ে এস—
গোকুলদাস আর একবার আকুল-বিকুলি করিয়া উঠিতেই প্রতাপের পিস্তল তাঁহার ললাট স্পর্শ করিল, তিনি আবার তৃষ্ণীভাব ধারণ করিলেন। চম্পা ছুটিয়া গিয়া সিন্দুক হইতে দুই মুঠি ভরিয়া দলিলের পাকানো কাগজ লইয়া প্রতাপের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রতাপ নীরবে শুধু চোখের সঙ্কেতে প্রদীপশিখা দেখাইয়া দিল। ইঙ্গিত বুঝিতে চম্পার বিলম্ব হইল না, সে দলিলগুলি আগুনের উপর ধরিল।
দলিলগুলি জ্বলিয়া উঠিলে চম্পা সেগুলি মেঝের উপর রাখিয়া দিল। প্রতাপ আবার তাহাকে মস্তকের ইঙ্গিত করিল, সে ছুটিয়া পাঁজা ভরিয়া দলিল আনিয়া আগুনের উপর ঢালিয়া দিতে লাগিল। চম্পার ভাব দেখিয়া মনে হয়, সে এই কাজ বেশ উপভোগ করিতেছে। ক্রমে একটি বেশ বড় গোছের ধুনি জ্বলিয়া উঠিল।
গোকুলদাস পঙ্কে-পতিত হাতির মত বসিয়া নিজের এই সর্বনাশ দেখিতে লাগিলেন; কিন্তু রগের কাছে পিস্তল উদ্যত হইয়া আছে, তিনি বাঙ্নিষ্পত্তি করিতে সাহস করিলেন না। তাঁহার মুখগহ্বর কেবল নিঃশব্দে ব্যাদিত এবং মুদিত হইতে লাগিল।
সমস্ত দলিল অগ্নিতে সমর্পিত হইলে, প্রতাপ পিস্তল দুটি নিজ কোমরবন্ধে রাখিল, শুষ্ক কঠিন হাসিয়া বলিল,–
মহাজন, তোমার বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছি, এখন যত পারো ছোবল মারো। একটা দুঃখ, তোমার সিন্দুক লুঠ করে ন্যায্য অধিকারীদের সোনাদানা ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। হয়তো আবার আসতে হবে। বেন, তোমার বৈধব্য কামনা করি না, কিন্তু স্বামীকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও তাহলে ওকে সৎপথে চালিও। চললাম।
প্রতাপ জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। চম্পা জোড়হস্তে তদগত কণ্ঠে বলিল,-
ভাই, তোমাকে প্রণাম করছি। তুমি আমার প্রাণ দিয়েছ, যতদিন বাঁচব তোমার গুণ গাইব—
এই সময় দ্বারের বাহির বহু কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল— পুরী জাগিয়া উঠিয়াছে। প্রতাপ এক লাফে জানালা ডিঙাইয়া বাহিরে অদৃশ্য হইয়া গেল। দরজায় করাঘাত পড়িতেই গোকুলদাস লাফাইয়া উঠিয়া উন্মত্ত কণ্ঠে চিৎকার করিলেন,
চোর চোর-ডাকাত! আমার সর্বনাশ করে গেল। ওরে হতভাগা মেয়েমানুষ, দরজা খুলে দে না–
চম্পা হাসিয়া বলিল,-তুমি খোলো না। আমি অবলা মেয়েমানুষ, ঐ জগদ্দল দরজা খোলা কি আমার কাজ।
গোকুলদাস মুক্তকচ্ছভাবে ছুটিয়া গিয়া লোহার দরজার হুড়কা খুলিতে খুলিতে চেঁচাইতে লাগিলেন,
গুণ্ডার বাচ্চা পালিয়েছে–পাকড়ো পাকড়ো–ফটক বন্ধ করো—
.
জানালার নীচে মোরহরভরা থলি দুটি পড়িয়াছিল। প্রতাপ দেয়াল বাহিয়া নামিয়া আসিয়া থলি দুটি মুঠ ধরিয়া দুহাতে তুলিয়া লইল।
সিংদরজার প্রহরীরা থলি পতনের শব্দে জাগিয়া উঠিয়াছিল। শব্দটা তাহাদের সন্দেহজনক বলিয়া মনে হইয়াছিল, তাই তাহারা উঠিয়া কবাটের তালা খুলিয়া ভিতরে প্রবেশপূর্বক অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, ক্রমে পুরীর সকলে জাগিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু জানালার নীচে পতিত থলি দুটা কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই। সিংদরজার কবাট খোলা রহিয়াছে কিন্তু সেখানে কেহ নাই। প্রতাপ শিকারী শ্বাপদের মত নিঃশব্দে পা ফেলিয়া সেইদিকে চলিল। খিড়কি দরজার বাহিরে মোতি আছে কিন্তু সেদিকে যাওয়া আর নিরাপদ নয়, চারিদিক হইতে সজাগ মানুষের হাঁক-ডাক আসিতেছে।
সিংদরজায় পৌঁছিতে প্রতাপের আর কয়েক পা বাকি আছে এমন সময় বাড়ির কোণ ঘুরিয়া এক দল লাঠি-সড়কিধারী লোক আসিয়া পড়িল— তাহাদের আগে আগে কান্তিলাল। প্রতাপকে দেখিয়াই তাহারা হৈ হৈ করিয়া ছুটিয়া আসিল, সঙ্গে সঙ্গে জানালা হইতে গোকুলদাসের তীক্ষ্ণ তারস্বর শোনা গেল
ধর ধর—ঐ পালাচ্ছে।
প্রতাপ তীরবেগে সিংদরজা দিয়া বাহির হইয়া দক্ষিণদিকে ছুটিয়া চলিল। ঐ দিকে মোতি আছে; যদি সে কোনও রকমে একবার মোতির পিঠে চড়িয়া বসিতে পারে তবে আর তাহাকে ধরে কে? কিন্তু কান্তিলাল ও তাহার সহচরেরাও দৌড়ে কম পটু নয়, তাহারা সবেগে তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছে। বিশেষত একটা লোক এত বেগে ছুটিয়া আসিতেছে যে তাহাকে ধরিয়া ফেলিল বলিয়া।
দুই হাতে ভারী দুটি থলি, সুতরাং প্রতাপ অতি দ্রুত ক্লান্ত হইয়া পড়িতেছিল; অবশেষে পলায়নের আর কোনও উপায় না দেখিয়া সে হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইল। যে লোকটা সর্বাগ্রে তাড়া করিয়া আসিতেছিল, সে নাগালের মধ্যে আসিতেই প্রতাপ ডান হাতের থলিটি ঘুরাইয়া গদার মত তাহার মস্তকে প্রহার করিল। লোকটা আর্তনাদ করিয়া সেইখানে মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে মোহরের থলি ফাটিয়া গিয়া চারিদিকে মোহর ছড়াইয়া পড়িল। প্রতাপ আর সেখানে দাঁড়াইল না, আবার দৌড়াইতে আরম্ভ করিল। কিছুক্ষণ দৌড়াইয়া সে একবার পিছু ফিরিয়া দেখিল, কেহ তাহাকে তাড়া করিয়া আসিতেছে কিনা। সে দেখিল তাহার পশ্চাদ্ধাবনকারীরা সকলেই মাটিতে হামাগুড়ি দিয়া ও পরস্পর কাড়াকাড়ি করিয়া মোহর কুড়াইতেছে। প্রতাপ তখন দৌড়াইতে দৌড়াইতে ডাকিতে লাগিল,-
মোতি—মোতি–
তাহার কণ্ঠস্বরে কান্তিলাল ও অনুচরগণের হুঁশ হইল যে চোর পলাইতেছে, তখন তাহারা উঠিয়া আবার তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিল।
কিন্তু চোরকে তাহারা ধরিতে পারিল না। প্রভুর আহ্বান মোতির কানে গিয়াছিল; সে ক্ষণেক উৎকর্ণ থাকিয়া সহসা হ্রেষাধ্বনি করিয়া প্রভুর কণ্ঠস্বর অনুসরণপূর্বক দৌড়াইতে আরম্ভ করিয়াছিল। প্রতাপ শুনিল পিছনে মোতির ক্ষুরধ্বনি অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। সে আবার ডাকিল,
মোতি! মোতি! আয় বেটা!
মোতির ক্ষুরধ্বনি আরও স্পষ্ট হইতে লাগিল। সে পশ্চাদ্ধাবনকারীদের ছাড়াইয়া প্রতাপের পাশে পৌঁছিল। দুজনে পাশাপাশি দৌড়াইতেছে। তারপর প্রতাপ একলম্ফে ধাবমান মোতির পিঠে চড়িয়া বসিল।
কান্তিলাল ও তাহার সাঙ্গোপাঙ্গ থ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল; বেগবান্ অশ্ব ও আরোহী জ্যোৎস্নাকুহেলির মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল।
.
রাত্রি তৃতীয় প্রহর। চাঁদ পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িয়াছে।
জলসত্রের প্রকোষ্ঠে চিন্তা ঝুলার উপর ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও বোধ করি প্রতাপের কথা তাহার মন জুড়িয়াছিল— ঠোঁট দুটি অল্প-অল্প স্ফুরিত হইতেছিল। অবহেলা-ম্লান মালা দুটি বুকের কাছে গুচ্ছাকারে পড়িয়া তাহার তপ্ত নিশ্বাসের সহিত নিজের ব্যর্থ সুগন্ধ মিশাইতেছিল।
সহসা অর্গলবদ্ধ দ্বারে করাঘাত হইল। চিন্তা চমকিয়া চক্ষু মেলিল, ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বিস্ফারিত নেত্রে ঘরের পানে চাহিয়া রহিল।
আবার দ্বারে করাঘাত হইল। চিন্তা নিঃশব্দে উঠিল; দ্বারের পাশে একটি ঝকঝকে ধারালো কাটারি ঝুলিতেছিল, সেটি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া কড়া সুরে প্রশ্ন করিল,-
কে তুমি?
বাহির হইতে চাপা গলায় আওয়াজ আসিল—
চিন্তা, দোর খোলো– আমি প্রতাপ
তাড়াতাড়ি কাটারি রাখিয়া চিন্তা দ্বারের হুড়কা খুলিতে প্রবৃত্ত হইল—
তুমি তুমি এত রাত্রে—
দ্বার খুলিতেই প্রতাপ ভিতরে প্রবেশ করিল। কপালে ঘাম, চুলের উপর ধূলা পড়িয়াছে, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তাহার মূর্তি দেখিয়া চিন্তা শঙ্কা-বিস্ময়ে তাহার বুকের কাছে সরিয়া আসিয়া প্রশ্ন করিল,-
এ কি—কী হয়েছে?
প্রতাপ প্রথমে দ্বারের অর্গল বন্ধ করিয়া দিল; তারপর চিন্তার দিকে ফিরিয়া তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া ভগ্নস্বরে বলিল,-
চিন্তা, কাল তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর আমার দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমি এখন সমাজের বাইরে ডাকাত–বারবটিয়া
চিন্তা সত্রাসে প্রতিধ্বনি করিল,
ডাকাত! বারবটিয়া! কেন, কি করেছ তুমি?
প্রতাপ মোহরের থলি চিন্তার হাতে দিয়া ক্লান্ত হাসিল, তারপর ঝুলার উপরে গিয়া বসিল। —
বলছি। কিন্তু বেশী সময় নেই, এতক্ষণে আমার নামে হুলিয়া বেরিয়ে গেছে, সকাল হবার আগেই পালাতে হবে—
চিন্তা ঝুলার পাশে নতজানু হইয়া ব্যাকুলস্বরে বলিয়া উঠিল,
ওগো, কী হয়েছে সব আমায় বল।
বলব। তার আগে তোমার কর্তব্য কর।
কর্তব্য?
পানিহারিন, পিপাসার্ত পথিককে আগে একটু জল দাও।
ত্বরিতে জলভরা ঘটি আনিয়া চিন্তা প্রতাপের হাতে দিল। প্রতাপ ঊর্ধ্বমুখ হইয়া ঘটির জল গলায় ঢালিয়া দিতে লাগিল।
ওদিকে পরপের বাহিরে মোতি দাঁড়াইয়াছিল, তাহার মুখের লাগাম একটি খুঁটিতে বাঁধা ছিল। মোতি স্থির হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহার কান পর্যন্ত নড়িতেছিল না। প্রয়োজন হইলে সে এমনি নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে পারে–যেন পাথরে কোঁদা মুর্তি।
অদূরে ঝোপের আড়াল হইতে একটি মুণ্ড গলা বাড়াইয়া উঁকি মারিল। তাহার দৃষ্টি মোতির দিকে। কিছুক্ষণ একাগ্রদৃষ্টিতে মোতিকে নিরীক্ষণ করিয়া সে নিঃশব্দে ঝোপের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল। চাঁদের আলোয় লোকটিকে পরিষ্কার দেখা গেল— চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের একটি ক্ষীণকায় দীর্ঘগ্রীবা যুবক। তাহার মুখে ধূর্ততা মাখানো, পাতলা গোঁফজোড়া সর্বদাই খরগোশের গোঁফের মত অল্প অল্প নড়িতেছে। সে মোতির উপর অবিচলিত দৃষ্টি রাখিয়া এক পা এক পা করিয়া তাহার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। যুবকের ভাবভঙ্গি দেখিয়া মোতি সম্বন্ধে তাহার মনোভাব সততার পরিচায়ক বলিয়া মনে হয় না।
.
ইত্যবসরে ঘরের মধ্যে প্রতাপ ও চিন্তা পাশাপাশি ঝুলার উপর বসিয়াছে, প্রতাপ তাহার কাহিনী বলা শেষ করিয়াছে। চিন্তার চোখে জল, সে দুই হাতে প্রতাপের একটি হাত শক্ত করিয়া ধরিয়া আছে।
প্রতাপ বলিল,-সব তো শুনলে। আমি আমার রাস্তা বেছে নিয়েছি। এখন তুমি কি করবে বল।
চিন্তা বলিল,-তুমি যা বলবে তাই করব। – আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চল—
নিশ্বাস ফেলিয়া প্রতাপ মাথা নাড়িল।
তা হয় না, আমার সঙ্গে তুমি থাকলে–
চিন্তা বলিল,-আমার কষ্ট হবে ভাবছ? তুমি সঙ্গে থাকলে আমি সব কষ্ট সহ্য করতে পারব।
প্ৰতাপ বলিল,-আমি তা জানি চিন্তা। সে জন্যে নয়। তবে বলি শোন। আমি এখন ডাকাত বারবটিয়া, মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশার উপায় আর আমার নেই। পাহাড়ে গুহায় জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে আমায় জীবন কাটাতে হবে। অথচ শহরে বাজারে মহাজনদের মহলে কোথায় কি ঘটছে তার খবর না জানলেও আমার কাজ চলবে না। মেঘনাদের মত মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আমাকে এই অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে চিন্তা।
চিন্তা বলিল,-তবে আমাকে কি করতে হবে হুকুম দাও।
প্রতাপ বলিল,-তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি যেমন প্রপাপালিকা আছ তেমনি থাক।
আমি তোমার কোনও কাজই লাগব না?
তুমি হবে আমার সব চেয়ে বড় সহকারিণী। তোমার সঙ্গে আমার কী সম্বন্ধ তা কেউ জানে না। তুমি এখানে যেমন আছ তেমনি থাকবে। এই পথ দিয়ে কত লোক আসে যায়, তাদের মুখে অনেক টুকরো-টাকরা খবর তুমি পাবে। এই সব খবর তুমি আমার জন্যে সঞ্চয় করে রাখবে। আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করব আর দুনিয়ার খবর নিয়ে যাব।
চিন্তা কিয়ৎকাল নীরব হইয়া রহিল, প্রস্তাবটা প্রথমে তাহার মনঃপূত হয় নাই, কিন্তু ক্রমে তাহার সংশয় কাটিয়া গিয়া মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল।
বেশ, তাই ভাল। তবু তো মাঝে মাঝে তোমায় চোখে দেখতে পাব।
প্রতাপ চিন্তাকে কাছে টানিয়া লইয়া গাঢ়স্বরে বলিল,–
চিন্তা, আজ পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই তোমাকে এখানে ফেলে রেখে চলে যাওয়া যে কত মর্মান্তিক তা তো তুমি বুঝতে পারছ? কোথায় ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ে করে সুখে-স্বচ্ছন্দে দিন কাটাব
চিন্তা অবহেলা-ম্লান মালা দুটি ঝুলার উপর হইতে তুলিয়া লইল; একটি মালা প্রতাপের হাতে দিয়া অন্যটি তাহার গলায় পরাইয়া দিল, গম্ভীর শান্ত চক্ষে চাহিয়া বলিল,-
এই আমাদের বিয়ে। ভগবান যদি দিন দেন তখন সুখে-স্বচ্ছন্দে তোমার ঘর করব।
চিন্তার গলায় হাতের মালা পরাইয়া দিয়া প্রতাপ তাহার দুই হাত ধরিয়া গভীর আবেগভরে তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল—
চিন্তা
এই সময় দ্বারে খুটখুট করিয়া শব্দ হইল। প্রতাপের কথা শেষ হইল না, তাহাদের দুইজোড়া সন্ত্রস্ত চক্ষু দ্বারের উপর গিয়া পড়িল।
কিছুক্ষণ নীরব; তারপর বাহিরে হইতে একটি করুণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল—
ও মশায় ঘোড়ার মালিক, একবার দয়া করে বাইরে আসবেন কি?
কণ্ঠস্বরের কাতরতা আশ্বাসজনক। তবু কিছুই বলা যায় না। প্রতাপ ও চিন্তা দৃষ্টি বিনিময় করিল। প্রতাপ কোমর হইতে একটি পিস্তল বাহির করিয়া নিঃশব্দে দ্বারের কাছে গিয়া কান পাতিয়া শুনিল, তারপর হঠাৎ দ্বার খুলিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান লোকটির বুকের উপর পিস্তল ধরিয়া কর্কশস্বরে বলিল,-
কি চাও? কে তুমি?
অতর্কিত আক্রমণে লোকটি প্রায় উটিয়া পড়িয়া যাইতেছিল, কোনও রকমে সালাইয়া লইল। সে আর কেহ নয়, সেই ক্ষীণকায় যুবক। চক্ষু চক্রাকার করিয়া সে প্রতাপের পানে ও পিস্তলটার পানে পর্যায়ক্রমে তাকাইয়া শেষে বলিল,-
ওটা সরিয়ে নিলে ভাল হয়— আমি কিঞ্চিৎ ভয় পেয়েছি।
প্রতাপ পিস্তল নামাইল না, চিন্তাকে ডাকিয়া বলিল,–
চিন্তা, প্রদীপটা নিয়ে এস।
প্রদীপ হাতে লইয়া চিন্তা প্রতাপের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রতাপ এখন লোকটিকে ভাল করিয়া দেখিল–সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এবং দৈহিকশক্তির দিক দিয়াও উপেক্ষণীয়। লোকটিও ইহাদের দুজনকে দেখিয়া বুঝিয়া লইল যে ইহারা গুপ্তপ্রণয়ী; সে একটু লজ্জার ভান করিয়া ঘাড় চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল,-
এ হে হে—আমি দেখছি কিঞ্চিৎ দোষ করে ফেলেছি— এমন চাঁদনী রাত্রে প্রণয়ীদের মিলনে বাগড়া দেওয়া—কিঞ্চিৎ
প্রতাপ প্রশ্ন করিল,—তুমি কে?
যুবক করুণভাবে বলিল, বলতে নেই আমার অবস্থাও প্রায় একই রকম। মামুদপুরের বড় মহাজন রতিলাল শেঠের মেয়ের সঙ্গে কিঞ্চিৎ প্রেম হয়েছিল, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাশুনা হচ্ছিল, হঠাৎ বাগড়া পড়ে গেল। সবাই মার মার করে তেড়ে এল। কাজেই এখন আমি পলাতক—ফেরারী আসামী।
প্রতাপ ও চিন্তার মধ্যে চকিত দৃষ্টি বিনিময় হইল।
প্রতাপ বলিল,–তুমিও ফেরারী?
প্রতাপ ও চিন্তা বারান্দায় বাহির হইয়া আসিল।
যুবক বলিল,—ফেরারী না হয়ে উপায় কি? রতিলাল শেঠ কিঞ্চিৎ কড়া-পিত্তির লোক, ধরতে পারলে কোনও কথা শুনত না, সটান টাঙিয়ে দিত। তাই পলায়নের রাস্তা যতদুর সুগম করা যায় তারই চেষ্টায় আছি। আপনার ঘোড়াটি—
যুবক লোলুপ দৃষ্টিতে মোতির পানে ফিরিয়া চাহিল।
প্রতাপ ভূকুঞ্চিত করিয়া বলিল,-আমার ঘোড়া? মোতি?
যুবক বলিল, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম ঘোড়াটি চোখে পড়ল। তা ভাবলাম ঘোড়ার মালিক নিশ্চয় কাছেপিঠে আছেন, তিনি যদি ঘোড়াটি উচিত মূল্যে বিক্রি করেন তাহলে আমার কিঞ্চিৎ উপকার হয়।
বিক্রি করব? মোতিকে বিক্রি করব!
যুবক বলিল,-দেখুন, আমি বড়লোক নই কিন্তু গরজ বড় বালাই। আপনাকে না হয় উচিত মূল্যের কিঞ্চিৎ বেশীই দেব।
প্রতাপ একটু হাসিল, এই কৌতুকপ্রিয় অথচ কূটবুদ্ধি যুবকটিকে তাহার ভাল লাগিল। বিপদের মুখেও যাহার মন হইতে হাস্যরস মুছিয়া যায় না তাহার ভিতরে পদার্থ আছে। প্রতাপ প্রশ্ন করিল,-
তোমার নাম কি?
যুবক সবিনয়ে উত্তর দিল,
বলতে নেই আমার নাম ভীমভাই অর্জুনভাই শিয়াল।
প্রতাপ বলিল,-একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আমার ঘোড়াটি একলা পেয়ে তুমি চুরি করলে না কেন?
ভীমভাই একটু সলজ্জ হাসিল। তাহার গোঁফজোড়া নড়িতে লাগিল—
বলতে নেই সে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আপনার ঘোড়াটি কিঞ্চিৎ বেশী প্রভুভক্ত, লাগামে হাত দিতেই ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিল। এই দেখুন।
ভীমভাই হাত বাহির করিয়া দেখাইল; হাতের পোঁচায় ঘোড়ার দাঁতের দাগ রহিয়াছে, তবে রক্তপাত হয় নাই।
ভীমভাই বলিল,—এখন ফেরারী আসামীর প্রতি দয়া করে ঘোড়াটি বিক্রি করবেন কি?
প্রতাপ বলিল,-মোতিকে কিনতে পারে এত টাকা কাথিয়াবাড়ে নেই। তাছাড়া আমিও তোমার মত ফেরারী, মহাজনের টাকা লুঠ করেছি।
ভীমভাই বিপুল বিস্ময়ে হাঁ করিয়া কিছুক্ষণ প্রতাপের মুখের পানে চাহিয়া রহিল
বলতে নেই কিঞ্চিৎ রোমহর্ষণ ব্যাপার মনে হচ্ছে আমিও ফেরারী, আপনিও ফেরারী। এমন যোগাযোগ বলতে নেই সহজে ঘটে না।
প্রতাপ পিস্তল কোমরে রাখিয়া ভীমভাইয়ের কাঁধের উপর হাত রাখিল, মর্মভেদী দৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া শেষে বলিল,-
ভীমভাই, তোমার মত মানুষ আমার দরকার। তুমি আসবে আমার সঙ্গে?
ভীমভাই প্রশ্ন করিল,—বলতে নেই—কোথায়?
প্রতাপ বলিল,-তোমার আমার জন্যে কেবল একটি পথ খোলা আছে, ডাকাতির পথ, বারবটিয়ার পথ। আসবে এ পথে?
মহানন্দে ভীমভাই প্রতাপকে একেবারে জড়াইয়া ধরিল।
আসব না? বলতে নেই আসব না তো যাব কোথায়? আজ থেকে তুমি আমার গুরু আমার সর্দার।
প্রতাপ ভীমের আলিঙ্গন মুক্ত হইল। বলিল,–
আজ আমাদের নবজীবনের ভিত্তি হল। চিন্তা, আজ আমার মাত্র তিনজন বিদ্রোহী দুর্গম পথে যাত্রা শুরু করলাম। ক্রমে আমাদের দল বেড়ে উঠবে দেশে বিদ্রোহীর অভাব নেই। ভীমভাই, আমরা তিনজন মিলে যে আগুন জ্বালব
ভীমভাই বলিল,-তিনজন নন—চারজন। বলতে নেই আমার একটি সাথী আছে—
সাথী? কই কোথায়?
অবস্থাগতিকে কিঞ্চিৎ আড়ালে আছে। এই যে ডাকছি।
ভীমভাই মুখের মধ্যে দুইটি আঙুল পুরিয়া দিয়া তীব্র শিস্ দিল, তারপর ডাকিল,–
তিলু। তিলোত্তমা।
যে ঝোপের আড়াল হইতে কিছুকাল পুর্বে ভীমভাই উঁকি মারিয়াছিল, তাহার পিছন হইতে একটি হাস্যমুখী তরুণী বাহির হইয়া আসিল। পরিধানে ঘাগরা ও ওড়নি, হাতে একটি ছোট্ট পুঁটুলি, তিলোত্তমা দৌড়িয়া আসিয়া ভীমভাইয়ের পাশে দাঁড়াইল।
ভীমভাই বলিল,-তিলু, আজ থেকে আমরা ডাকাত-গলার মধ্যে হুঙ্কার শব্দ করিল) ইনি আমাদের সর্দার।
তিলুর চোখ দুটি ভারি চঞ্চল আর দাঁতগুলি মুক্তাশ্রেণীর মত উজ্জ্বল, সে চঞ্চল কৌতুকভরা চক্ষে চিন্তা ও প্রতাপকে নিরীক্ষণ করিয়া দশনচ্ছটা বিচ্ছুরিত করিয়া হাসিল। প্রতাপ সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিল,-
ইনি কে ভীমভাই?
ভীমভাই বলিল,—চিনতে পারলে না সর্দার? বলতে নেই রতিলাল শেঠের মেয়ে তিলু। কিঞ্চিৎ একগুঁয়ে মেয়ে, কিছুতেই শুনল না, আমার সঙ্গে পালাল। ওর জন্যেই তো আমার এই সর্বনাশ।
প্রতাপ স্মিতমুখে চিন্তার পানে চাহিল। তিলু কলকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। চিন্তা প্রদীপ রাখিয়া হাসিতে হাসিতে গিয়া তিলুকে জড়াইয়া লইল।
.
ভোর হইতে আর বেশী দেরি নাই। চন্দ্র অস্ত যাইতেছে। থাকিয়া থাকিয়া দুএকটা কোকিল কুহরিয়া উঠিতেছে।
জলসত্রের সম্মুখে পথের উপর মোতি দাঁড়াইয়া। তাহার পিঠের উপর সারি দিয়া তিনজন আরোহী : সর্বাগ্রে প্রতাপ লাগাম ধরিয়া বসিয়া আছে, তাহার পিছনে ভীমভাই প্রতাপের কাঁধে হাত দিয়া বসিয়া আছে, সর্বশেষে তিলু একহাতে ভীমভাইয়ের কোমর জড়াইয়া তাহার পিঠের উপর গাল রাখিয়া পরম সুখে মৃদু মৃদু হাসিতেছে। তিলু ও ভীমভাইয়ের গলায় বনফুলের মালা দুটি ইতিমধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে, তাহারাও এখন গন্ধর্বমতে বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী।
চিন্তা পথের উপর দাঁড়াইয়া তাহাদের বিদায় দিতেছে। কোনও কথা হইল না, প্রতাপ একবার ঘাড় ফিরাইয়া চিন্তার পানে চাহিয়া একটু হাসিল। তারপর তাহার বলগার ইশারা পাইয়া মোতি ধীর পদে পাহাড়ের অভিমুখে চলিতে আরম্ভ করিল।