২. পঁচিশ বছর আগেকার কথা

পঁচিশ বছর আগেকার কথা।

মিস্টার সরকার অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেই স্ত্রীকে বললেন, শিবানী একটা খবর আছে।

স্বামীর গলার টাই খুলে দিতে দিতে শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, আবার বদলী নাকি?

না।

তবে আবার কি খবর?

মিস্টার সরকার দুহাত দিয়ে স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন, যদি বলতে পারো তাহলে তোমাকে এক সপ্তাহের জন্য দার্জিলিং ঘুরিয়ে আনব।

এই বর্ষায় আমি দার্জিলিং যাচ্ছি না।

কেন?

আমি কি পাগল যে এই বর্ষায় দার্জিলিং যাব?

বর্ষাতেই তো দার্জিলিং যেতে হয়। শহরে কোন জানাশুনা লোক দেখা যাবে না। সারাদিন বেশ ঘরের মধ্যে…

অসভ্যতা না করে খবরটা বলো।

অফিস থেকে গাড়ি কিনতে বলেছে।

গাড়ি কিনতে বলেছে মানে?

মানে গাড়ি কেনার টাকা দেবে, মাসে মাসে আড়াইশো টাকা কেটে নেবে।

আর অ্যালাউন্স তো দেবে?

তা তো দেবেই।

তবে তোমাকে আমি গাড়ি চালাতে দিচ্ছি না।

তোমাকে চালাতে পারছি আর গাড়ি চালাতে পারব না?

স্বামীর জামার বোতাম খুলতে খুলতে শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, কবে গাড়ি কিনতে হবে?

এই মাসের মধ্যেই কিনতে হবে!

কি গাড়ি কিনবে?

তুমি বলো।

অস্টিন। ঘোটর মধ্যে ভারি সুন্দর গাড়ি।

তোমার দাদার অস্টিন আছে বলে কি আমাকেও অস্টিনই কিনতে হবে?

এই পৃথিবীতে যেন আমার দাদাই একমাত্র অস্টিন চড়েন!

আমিও অস্টিন কিনব ভেবেছি!

আজে-বাজে রঙের গাড়ি নিও না।

তুমি কি রঙের চাও?

স্টিল গ্রে।

.

নমস্কার স্যার। আমাকে চৌধুরী সাহেব…

তোমার নামই কি বিহারীলাল দাস?

হ্যাঁ স্যার।

চৌধুরী তো তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

কৃতার্থের হাসি হেসে বিহারী বলল, ওঁদের বাড়ির সবাই আমাকে খুব স্নেহ করেন।

তাই বলছিল বটে।

আমার বাবা চৌধুরী সাহেবের বাবার গাড়ি চালাতেন। আর চৌধুরী সাহেব তো আমার কাছেই গাড়ি চালানো শিখেছেন।

শিবানী বললেন, এই সাহেবকে স্টিয়ারিং ধরতে দেবে না।

বিহারী হাসে।

না না হাসির কথা নয়।

কিন্তু সাহেব যদি বলেন?

সাহেব কান্নাকাটি করলেও দেবে না।

শিবানীর কথায় শুধু বিহারী না মিস্টার সরকারও হাসেন।

হাসি থামলে মিস্টার সরকার বিহারীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মাইনে-টাইনে কাজকর্মের ব্যাপারে চৌধুরী যা বলেছে তাতে আপত্তি নেই তো?

না স্যার।

সোমবার আমার গাড়ির ডেলিভারী পাব।

আমি কখন আসব স্যার?

সকাল নটা-সাড়ে নটার মধ্যে এসো।

বিহারী দুজনকে নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।

সরকার দম্পতির জীবনে বিহারীলাল দাসের সেই প্রথম আবির্ভাব।

বছর ঘুরে পূজা এলো। শিবানী মিস্টার সরকারকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁগো বিহারীকে একটা ধুতি-পাঞ্জাবি দেবে না?

ও তো অফিস থেকে মাইনে পাবে।

তা পাক। হাজার হোক তোমাকে দাদা বলে ডাকে, আমাকে বউদি বলে। আমাদেরও তো একটা কর্তব্য আছে।

মিস্টার সরকার ও-কথার কোনো জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পূজায় তুমি আমাকে কি দিচ্ছ?

শিবানী স্বামীর কানে কানে বলল, অনেক অনেক ভালোবাসা।

বিহারী সত্যিই বড় ভালো মানুষ। সব সময় মুখে হাসি লেগে আছে। কোন সময় কাজে বলে না। সর্বোপরি অত্যন্ত সৎ লোক।

বউদি!

কি বিহারী?

একটা ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে।

মিসেস সরকার হেসে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার না আমার?

আপনি কেন অন্যায় করবেন? আমারই অন্যায় হয়েছে।

কি হয়েছে?

শনিবার আপনাদের সিনেমার টিকিট কেটে বাকি পয়সা ফেরৎ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।

বিহারী একটা টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা এগিয়ে দিতে গেলেও মিসেস সরকার নিলেন না। বললেন, এত বড় অন্যায় যখন করেছ তখন তোমাকে কিছু খেসারত দিতে হবে।

বলুন বউদি।

আমাকে একটু ঢাকুরিয়া নিয়ে যেতে হবে।

বিহারী এক গাল হাসি হেসে বলল, এ খেসারত দিতে তো আমি সব সময় প্রস্তুত।

মিসেস সরকার ঘুরে দাঁড়াতেই বিহারী বলল, বউদি পয়সাটা নিলেন না?

না।

ঢাকুরিয়া যাবার পথে বিহারী গাড়ি চালাতে চালাতেই মিসেস সরকারকে বলে, বউদি প্রায় তিন বছর গাড়ি কেনা হয়েছে কিন্তু একবারও আপনারা গাড়ি নিয়ে বাইরে কোথাও গেলেন না।

তোমার দাদার বলে সময় হয় না।

সামনের সপ্তাহেই তো দাদার তিন দিন ছুটি।

কেন?

অ্যানুয়াল কনফারেন্সের জন্য বেশি খাটতে হয়েছে বলে সামনের সপ্তাহে দাদার ডিপার্টমেন্টের সব অফিসারদের তিন দিন ছুটি।

ছুটির কথা তোমাকে কে বলল?

অফিসেই শুনেছি।

আজ?

আজ না। কনফারেন্স শেষ হবার দিনই সব অফিসারদের বলে দেওয়া হয়েছে।

অথচ তোমার দাদা আমাকে কিছুই জানাননি।

হয়তো ভুলে গিয়েছেন।

তোমার দাদার সব কথা মনে থাকে। শুধু ছুটির কথা বলতেই ভুলে যান।

বিহারী হাসে।

একটু চুপ করে থাকার পর মিসেস সরকার জিজ্ঞাসা করেন, সামনের সপ্তাহে কোন তিন দিন ছুটি জানো?

বৃহস্পতি-শুক্র-শনি।

তার মানে তো চার দিন ছুটি!

হ্যাঁ।

কিছুক্ষণ পরে বিহারী বলে, এই বছরে কোম্পানির অনেক মাল বিক্রি হয়েছে বলে এই ছুটির সময় বাইরে বেড়াবার জন্য বোধহয় কোম্পানি থেকেই খবর দেবে।

এসব কিছু আমাকে বলে না।

দাদা যেন জানতে না পারেন আমি আপনাকে বলেছি।

জানলেই বা কি হবে?

না বউদি, দাদাকে আমার কথা বলবেন না।

আচ্ছা বলব না।

.

মিস্টার সরকার গাড়িতে বসতেই বিহারী জিজ্ঞাসা করল, সোজা বাড়ি যাব?

হ্যাঁ।

পার্ক স্ট্রিট ছাড়িয়ে লাউডন স্ট্রিটে ঢুকতেই বিহারী বলল, দাদা একটা কথা বলব?

কি?

কাল বউদির জন্মদিন। কিছু কিনবেন না?

দেখেছ! একদম ভুলে গিয়েছিলাম।

গাড়ি ঘুরিয়ে নেব? চল গড়িয়াহাট ঘুরে যাই।

গড়িয়াহাটেই যখন যাচ্ছেন তখন ঢাকুরিয়ার দাদা-বউদিকে কাল আসার কথা বলে আসবেন কি?

মিস্টার সরকার একটু হেসে বললেন, বিহারী তুমি স্টিয়ারিং না ধরলে যে আমার সংসার করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।

কি যে বলেন দাদা?

দ্যাখো বিহারী, স্ত্রী-পুত্রকে শুধু অন্নবস্ত্র দিলেই সংসারে শান্তি আসে না। এইরকম ছোটখাটো দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করলেই সংসারে শান্তি পাওয়া যায়।

একটু পরে মিস্টার সরকার বললেন, ভালো কথা বিহারী, সামনের আঠারই আমাদের চৌধুরীর বাবা-মার বিয়ের ডায়মণ্ড জুবিলী। তার আগে তোমার বউদিকে নিয়ে একটা ভালো ধুতি আর শাড়ি কিনে আনার কথা মনে করিয়ে দিও তো।

দেবো।

ওদের দুজনের খেয়াল না থাকলেও বিহারীর ঠিক মনে আছে।

মিস্টার সরকারকে নিয়ে অফিসে বেরুবার সময় বলল, বউদি আমি দাদাকে পৌঁছে ফিরে আসছি।

কেন?

চৌধুরী সাহেবের বাবা-মার ধুতি-শাড়ি…

মিসেস সরকার হাসতে হাসতে বললেন, আমার একদম মনে ছিল না।

আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন।

ঠিক আছে।

মিস্টার সরকার অফিস যাবার জন্য প্রায় তৈরি। শিবানী ওর পার্স, ডায়েরী, কলম, রুমাল এগিয়ে দিচ্ছেন।

বিহারী একটু দূর থেকেই বলল, বৌদি, দাদা কি তৈরি?

হ্যাঁ।

দাদা কি চেকটা নিয়েছেন?

শিবানী নয়, মিস্টার সরকার জিজ্ঞাসা করলেন, পেট্রোল পাম্পের চেক তত দিয়ে দিয়েছ। আজ আবার কিসের চেক?

বিহারী বলল, আজই তো ইন্সিওরেন্সের…

ওকে কথাটা শেষ করতে হল না। শিবানী বললেন, আজই তো প্রিমিয়াম দেবার লাস্ট দিন, তাই না?

মিস্টার সরকার বললেন, আমি তো একদম ভুলে গিয়েছিলাম।

শিবানী হাসতে হাসতে বললেন, আজ যদি বিহারী মনে না করিয়ে দিত তাহলে…

মিস্টার সরকার বিহারীকে শুনিয়েই একটু জোরে বললেন, বিহারী ভুলে গেলে ওকে শূলে চড়াতাম না!

.

এ সংসারে বিহারীর একটা বিশেষ ভূমিকা, বিশেষ মর্যাদা অনস্বীকার্য। ঘরে-বাইরের ছোট-বড় খুঁটিনাটি হাজার দিকেই ওর নজর। ওর নজর না দিয়ে উপায় নেই। সরকার দম্পতি জানেন, বিহারী যখন আছে তখন চিন্তার কিছু নেই।

তারপর একদিন এ-সংসারে খোকনের আবির্ভাব হতেই হঠাৎ সবকিছু মোড় ঘুরে গেল। বিহারী এখন আর পার্শ্ব চরিত্র নয়, এ সংসারের অন্যতম মুখ্য চরিত্র।

খোকনের অন্নপ্রাশন হয়ে গেল।

পরের দিন সকালে চা-জলখাবার খেয়ে সবাই মিলে গল্পগুজব হচ্ছিল। হঠাৎ মিস্টার সরকারের মা বললেন, যে যাই বলো, বিহারী না থাকলে কাল একটা কেলেঙ্কারি হতো।

শিবানী হাসতে হাসতে বললেন, আপনার আদুরে ছেলে শুধু চাকরি করতে জানে। কোনোমতে একদিন টোপর মাথায় দিয়ে বিয়ে করেছিল ঠিকই কিন্তু ওকে নিয়ে সংসার করা যে কি দায়, তা আমি আর বিহারী ছাড়া কেউ জানে না।

শিবানীর মা বললেন, এই বয়সের ছেলেরা কোন কালেই সংসারী হয় না। আরও দুটো-একটা ছেলেমেয়ে হোক, তারপর নিশ্চয়ই সংসারী হবে।

শিবানী একটু জোরেই হাসলেন। তারপর বললেন, এই খোকন হবার সময় আমার যা শিক্ষা হয়েছে তাতে আমার আর ছেলেমেয়ে হয়ে কাজ নেই।

মিস্টার সরকারের দিদি মীনা বললেন, যাইহোক শিবানী, আমি এবার বিহারীকে নিয়ে যাচ্ছি। চা বাগানে থাকতে হলে বিহারীর মতন একজন অল রাউন্ডার দরকার।

দিদি, তুমি কি আমার এই উপকারটুকু করার জন্যই দার্জিলিং থেকে এসেছ?

তুই বল শিবানী, ওই মহাদেব নোখোর স্বামীকে নিয়ে চা বাগানে থাকা যায়?

মীনার কথায় সবাই হাসেন।

মীনা বললেন, তোমরা হাসছ কিন্তু যে লোকটা অফিসে আর তাসের আড্ডা ছাড়া আর কিছু জানে না, তাকে নিয়ে…

ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মিস্টার সরকারের ছোট বোন বীণা বললেন, দিদি বিহারীকে বউদি ছাড়বে না। তুই বরং আমার বরটাকে নিয়ে যা।

মীনা একবার অজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, অজয় তো একটা ক্লাউন! ওকে নিয়ে কে সংসার করবে?

অজয় সঙ্গে সঙ্গে শিবানীকে বলল ডার্লিং, এই অপমানের পর এক্ষুনি চারটে রসগোল্লা আর পর পর দু কাপ চা না খেলে আমি আর বাঁচব না।

ইন্ডিয়া কিং সিগারেট চাই না?

আমি কি সুহাসদার মতন নেশাখোর?

তাও তো বটে!

হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে বিহারী এসে শিবানীকে বলল, বউদি, ছশো টাকা দিন!

শিবানী রেগেই বললেন, আমি টাকা পাব কোথায়? তোমার দাদার কাছ থেকে নাও।

বিহারী হেসে বলল, কালো হাত ব্যাগ থেকে এখন দিন। পরে আমি…

দ্যাখো বিহারী, তুমিও তোমার দাদার মতন বেশ ওস্তাদ হয়ে গেছ।

এখন দিন। পরে আমি ঠিক দিয়ে দেবো।

শিবানী উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, তোমার দাদা বুঝি ভয়ে এলেন না?

দাদা একটু কাজে বেরিয়েছেন।

বাজে বোকো না। এক মিনিট আগে ওর গলা শুনলাম আর…

অজয় বললেন, ডার্লিং আমার টাকাটাও এনো।

শিবানী ঘুরে দাঁড়িয়ে অজয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার এক লাখ টাকাই আনব?

না, না, হাজার খানেক।

শিবানী মীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানো দিদি, তোমাদের এই জামাই গতবার কলকাতায় এসে কি রকম ফোর-টোয়েন্টি করে আমার…

ডার্লিং তুমি সে টাকা এখনও পাওনি? আমি তো ফিরে গিয়েই তোমাকে চেক পাঠিয়েছিলাম।

ব্যাঙ্ক অফ বে অফ বেঙ্গলের চেক আমার দরকার নেই।

শিবানীর কথায় সবাই হেসে উঠলেন।

.

আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলেন। সবার পৌঁছনোর সংবাদও এলো। সবাই চিঠিতে বিহারীর কথা লিখেছেন।

কদিন পরে শিবানী ওকে বললেন, বিহারী, চিঠিতে সবাই তোমার কথা লিখেছেন। মীনাদি আর অজয় লিখেছে তোমাকে নিয়ে ওদের ওখানে ঘুরে আসতে।

সত্যি বউদি, একবার ঘুরে এলে হয়।

ওরা এত করে বলেছে যে না গেলে অত্যন্ত অন্যায় হবে।

যাইহোক, খোকনের অন্নপ্রাশনের জন্য আপনাদের সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বেশ আলাপ-পরিচয় হয়ে গেল।

তোমাকে তো সবারই খুব ভালো লেগেছে।

ভালো কথা বউদি, আপনাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আমার কত আয় হয়েছে জানেন?

আয় হয়েছে নাকি? কত?

তিনশো দশ টাকা পেয়েছি।

দেড়শো টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিও।

না বউদি, এ টাকা থেকে কিছুই ব্যাঙ্কে রাখতে পারব না!

কেন?

সন্তোষের বইপত্তর কিনতে হবে, তাছাড়া এবার শীতে লেপতোষক না করালে…

পুরো টাকাই লাগবে?

হ্যাঁ বউদি।

ঠিক আছে, আমি তোমাকে একশো টাকা দেব। এই একশো টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দেবে।

আপনাদের দয়ায় খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। আপনি আবার টাকা দেবেন কেন?

খোকনের অন্নপ্রাশনে এত খাটা-খাটনি করলে…

দাদা তো আমাকে ধুতি-সার্ট কিনে দিয়েছেন। আবার…

এত বড় একটা কাজ তুমি উদ্ধার করে দিলে আর তোমাকে কিছুই দেবো না? তাই কী

দুদিন পরে বিহারী বলল, বউদি, ব্যাঙ্কে আমার কত জমেছে জানেন?

কত?

চোদ্দশো পঞ্চাশ।

এর একটি পয়সাতেও তুমি হাত দেবে না।

বিহারী হাসে।

সেদিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী খোকনের অন্নপ্রাশনের কথাই আলোচনা করছিলেন।

জানো শিবানী, আমি ভীষণ নার্ভাস ছিলাম।

কেন?

এত লোকজন নেমন্তন্ন করে যদি কোন কেলেঙ্কারি হয়, সেই ভেবেই আমি মনে মনে খুব নার্ভাস ছিলাম।

আর আমরা নেমন্তন্ন করতে তো কাউকে বাদ দিইনি।

বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, অফিসের লোকজন–এদের তো বাদ দেওয়া যায় না।

যাইহোক, বেশ ভালয় ভালয় সব হয়ে গেল।

তবে হ্যাটস অফ টু চৌধুরী আর বিহারী।

চৌধুরীদা বড় বাড়ির ছেলে। অনেক কাজকর্মের অভিজ্ঞতা থাকা স্বাভাবিক কিন্তু বিহারী যে এসব কাজেও এত এক্সপার্ট তা আমি ভাবতে পারিনি।

আমিও কল্পনা করতে পারিনি।

আমি ওকে একশো টাকা দিয়েছি।

খুব ভালো করেছ। ও ডেকরেটর আর মিষ্টির দোকানের বিল থেকে কত টাকা বাঁচিয়েছে জানো?

কত?

দুশো পঁচাত্তর টাকা।

তুমি হলে একটা পয়সাও বাঁচাতে পারতে না।

অসম্ভব।

তাছাড়া বিহারী খোকনকে কি দারুণ ভালোবাসে, তোমাকে কী বলব।

হ্যাঁ, খোকনও ওর খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে। আই মাস্ট ডু সামথিং ফর বিহারী।

কি করবে?

আমাদের অফিসের সব ড্রাইভারের অ্যাকসিডেন্ট ইন্সিওরেন্স আছে। অফিসই প্রিমিয়াম দেয়। অফিসারদের ড্রাইভারদের অ্যাকসিডেন্ট ইন্সিওরেন্স করলে অফিস থেকে অর্ধেক প্রিমিয়াম দেবে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ভাবছি, বাকি অর্ধেক প্রিমিয়াম আমি দিয়ে ওরও একটা…

খুব ভালো হবে। হাজার হোত কলকাতা শহরে ড্রাইভারী করা! কখন কি হয় কিছুই বলা যায় না।

তা তো বটেই।

.

দেখতে দেখতে খোকন তিন বছরের হল। বিহারী কদিন আসছে না। খোকনকে রোজ বিকেলে গাড়িতে বসাতেই হবে। ও স্টিয়ারিং নেড়ে-চেড়ে ঘণ্টা দুই কাটিয়ে দেয়।

সেদিন বিকেলে মিস্টার সরকার অফিস থেকে ফিরতেই শিবানী বললেন, জানো একটু আগে বিহারী এসে খবর দিয়ে গেল ওর একটা মেয়ে হয়েছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। বিহারী খুব খুশি।

ছেলেটা এত বড় হবার পর মেয়ে হল, খুশি হবারই তো কথা। খোকন আরো একটু বড় হবার পর তোমার একটা মেয়ে হলে আমিও কি কম খুশি হবো?

এত সব খায় না।

খায় না মানে? আমাদের একটা মেয়ে হবে না?

একটা হবার ঠেলাতেই আমার জান বেরিয়ে গেছে। ন্যাড়া বেলতলায় বার বার যায় না।

তাই বলে…

ন্যাকামি কোরো না। ওই কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারব না।

খুব কষ্ট হয়? কষ্ট হবে কেন? এত আরাম লাগে যে…

শিবানী চলে গেলেন।

পরে চা খাবার সময় মিস্টার সরকার বললেন, শিবানী বিহারীর মেয়েকে একদিন দেখে এসো।

তুমি যাবে না?

না, না, আমি গেলে ওর স্ত্রী লজ্জা পাবে।

তা ঠিক।

দাদা কাল আপনি ট্যাক্সিতে অফিস যাবেন!

মিস্টার সরকার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? গাড়ির ফুয়েল পাম্প কি আবার গণ্ডগোল করছে?

বিহারী নির্মম ঔদাসীন্যের সঙ্গে বলল, গাড়ি ঠিকই আছে।…

তবে?

কাল খোনকে পোলিও ভ্যাকসিন দেবার জন্য…

মিস্টার সরকার জানেন বিহারীর এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোন ফল নেই। তাই বললেন, ঠিক আছে।

খোকনের সঙ্গে বিহারীর খুব ভাব। মাত্র কমাসের শিশু হলেও বিহারীকে দেখলেই ও হাসবে, কোলে চড়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে।

খোকনকে কোলে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বিহারী শিবানীকে বলে, জানেন বউদি, আমি গত জন্মে খোকনের কাছে গাড়ি চালানো শিখেছিলাম।

শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, তাই নাকি?

তাইতো এবার আমি ওকে গাড়ি চালানো শেখাব।

শিবানী ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করেন, এখনই শেখাবে?

না বউদি, ঠাট্টার কথা নয়। আপনি দেখবেন খোকনের মতন ড্রাইভিং…

তোমার খোকন তো সবই করবে।

করবেই তো!

.

শিবানী হাসতে হাসতে স্বামীকে বললেন, বিহারী আজ কি বলছিল জানো?

কি?

ট্রাফিক পুলিশটা নম্বর নিয়েছে বলে ও বলছিল, খোকনকে পুলিশ কমিশনার হতেই হবে।

ও একটা বদ্ধ পাগল!

কিন্তু ও খোকনকে এত ভালোবাসে যে তা বলার নয়।

তা ঠিক।

বিহারীর বাড়ি থেকে ঘুরে এসেই শিবানী মিস্টার সরকারকে বললেন মেয়েটার রং কালো হলেও দেখতে ভারি সুন্দর হবে।

তাই নাকি?

দিন কয়েক পরে তুমিও একবার দেখে এসো। মেয়েটাকে তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।

মিস্টার সরকার শিবানীর কানে কানে বললেন, যতদিন তুমি আমাকে একটা মেয়ে দিচ্ছ না, ততদিন অন্যের মেয়েদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।

একটা ছেলে দিয়েছি। আমি আর কিছু দিতে পারব না।

ছি, ছি, ওকথা বলে না।

অত যদি মেয়ের সখ হয় তাহলে আরেকটা বিয়ে করো।

ঠিক আছে। ডিভোর্স করে তোমাকেই আবার বিয়ে করছি।

শিবানী হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

কদিন পরে বিহারী শিবানীকে বলল, বউদি, এবার দাদাকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিই?

কেন?

আমি দু-চার দিন না থাকলে দাদার খুব অসুবিধে হয়।

কেন? অফিসের গাড়িতেই তো যাতায়াত করেন।

অফিস যাতায়াত চলে যায় ঠিকই কিন্তু আর তো কোথাও যেতে পারেন না।

এই বয়সে গাড়ি চালাতে গিয়ে…

দাদার কি এমন বয়স হয়েছে? অফিসের সাতজন ডেপুটি ডিভিশন্যাল ম্যানেজারের মধ্যে দাদার বয়স সব চাইতে কম।

শেখাবে শেখাও কিন্তু তোমার দায়িত্ব।

আপনি কিছু চিন্তা করবেন না বউদি। আমি তিন মাসের মধ্যেই দাদাকে এমন গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবো যে তখন আমি বড় জামাইবাবুদের টি গার্ডেনে চাকরি নিয়ে…

শিবানী হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি খোকনকে ছেড়ে যেতে পারবে?

বিহারী কোন জবাব দিতে পারে না। শুধু হাসে।

মাস চারেক পরের কথা।

স্টিয়ারিং-এ মিস্টার সরকার, পাশে বিহারী, পিছনে শিবানী আর খোকন।

দক্ষিণেশ্বর হয়ে গান্ধীঘাট। সেখান থেকে ঢাকুরিয়া হয়ে বাড়ি।

শিবানী হাসতে হাসতে বললেন, বিহারী, তোমার ছাত্র তাহলে অনার্স নিয়েই পাস করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *