দ্বিতীয় দৃশ্য
[অপরূপ বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে রাণী ঢুকছেন। রাণীর পেছনে ফুলের সাজী হাতে দুইজন সহচরী। রাণী ঘুরছেন অস্থির হয়ে। রাণীর পিছনে পিছনে সহচরীরা ঘুরছে।]
রাণী : মহারাজা প্রাসাদে এখানে এসে পৌঁছেন নি?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
রাণী : এত সময় তো লাগার কথা নয়? আমার ভাল লাগছে না।
১ম সহচরী : সুরশিল্পী আসমত আলী খাঁন সাহেবকে আসতে বলব? গান শুনিয়ে তিনি আপনাকে তুষ্ট করবেন।
রাণী : প্রথম প্রহর পার হয়েছে, আমার খুব অস্থির লাগছে। কিছুতেই মন বসছে না। প্রজাদের দেখতে বেরিয়েছেন। ওদের দেখার কি আছে?
১ম সহচরী : ওস্তাদজীকে আসতে বলি?
রাণী : প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন দেশের অবস্থা ভাল নয়। প্রজারা অসন্তুষ্ট। চারিদিকে অভাব। এই সব বলে বলে তারা মহারাজাকে বিরক্ত করেছে। নয়ত তিনি বের হতেন না। আমার ভাল লাগছে না।
১ম সহচরী : ওস্তাদজীকে বলি আপনার প্রিয় গান গেয়ে শুনাবার জন্যে। এতে মহারাণীর মন প্রফুল্ল হবে। বলব?
রাণী : না, না। আমার কিছুতেই মন বসছে না। তোমরা আমাকে বিরক্ত করবে না।
২য় সহচরী : চলে যাব?
রাণী : যাও, চলে যাও।
১ম সহচরী : আপনি একা থাকবেন?
রাণী : চলে যেতে বলছি, চলে যাও, কেন কথা বাড়াচ্ছ? আমি একা একা খানিকক্ষণ বাগানে হাঁটব। মহারাজা এসে পৌঁছান মাত্র আমাকে খবর দেবে।
[সহচরী দু’জন চলে যাওয়ার পর ওস্তাদজী ঢুকবেন।]
ওস্তাদজী : মহারাণী, আমাকে স্মরণ করেছেন?
রাণী : আমি কাউকে স্মরণ করিনি।
ওস্তাদ : ওরা বলছিল আপনার মন বিক্ষিপ্ত। বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করবার জন্যে সঙ্গীতের মত আর কিছুই নেই। আপনি চাইলে মালকোষ রাগে…।
রাণী : আমি কিছুই চাই না। আচ্ছা, আপনি বলুন তো প্রজাদের দেখতে যাবার এই খেয়াল মহারাজার কেন হল? কি মানে থাকতে পারে এর?
ওস্তাদ : রাজাদের কিছু অদ্ভুত খেয়াল থাকতে হয়। তা না থাকলে সবাই ওদের সাধারণ মনে করবে। নৃপতিরা অসাধারণ থাকতে পছন্দ করেন।
রাণী : তারে মানে?
ওস্তাদ : দেশ জুড়ে অভাব! ঘরে ঘরে হাহাকার। এর মধ্যে দেখার কিছুই নেই। মন প্রফুল্ল করার মত কোন দৃশ্য নয়। তবে, রাজারা মাঝে মাঝে মানুষের কষ্ট দেখতে ভালবাসেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে।
রাণী : এসব আপনি কি বলছেন?
ওস্তাদ : প্রজারা যখন রাজপ্রাসাদের চারিদিকে ঘিরে দাঁড়াবে, তখন আপনি ছাদে দাঁড়িয়ে তাকাবেন ওদের দিকে। আপনার ভালই লাগবে। দুঃখী মানুষদের দেখতে বড় ভাল লাগে। অন্যের দুঃখকে খুব কাছ থেকে না দেখতে পেলে নিজের সুখ ঠিক বোঝা যায় না মহারাণী।
রাণী : প্রজারা রাজপ্রাসাদ ঘিরে দাঁড়াবে? [ওস্তাদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বেন] কবে?
ওস্তাদ : তা তো বলতে পারব না। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ওদের পায়ের শব্দ শুনি। ওরা আসতে শুরু করেছে মহারাণী।
রাণী : আপনি চলে যান আমার সামনে থেকে। [ওস্তাদ কুর্নিশ করে চলে যেতেই রাণী হাততালি দেবেন। সহচরী দু’জন এসে ঢুকবে।] মহারাজার কোন খবর পাওয়া গেছে?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
রাণী : মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে তোমরা কি কোন পায়ের আওয়াজ পাও?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
[ঠিক তখন নকিবের গলার আওয়াজ।]
নকিব : মহিম গড়ের মহামান্য রাজা, অজাতশত্রু, ভীমবাহু, মহাবল বীরশ্রেষ্ঠ মহারাজা রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছেছেন।
[সহচরী দু’জন বের হয়ে যাবে, মহারাজার প্রবেশ]।
রাণী : আপনার ফিরতে দেরি দেখে বড় ভয় পেয়েছিলাম।
রাজা : পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এক বিশাল মাঠের মাঝখানে বসে বসে আকাশের তারা দেখছিলাম।
রাণী : প্রজাদের অবস্থা কেমন দেখলেন?
রাজা : মাঠের মধ্যে সন্ধ্যা নামল। ক্রমে ক্রমে চারদিকে অন্ধকার হচ্ছে। চারদিকে পাখি ডাকছে। কি চমৎকার দৃশ্য! মনে বড় আনন্দ হলো রাণী।
রাণী : প্রজাদের তাহলে দেখতে যাননি?
রাজা। : এত চমৎকার বাতাস বইছিল–এত আনন্দ চারদিকে তোমাকে একদিন নিয়ে যাবে সেখানে। দু’জনে পাশাপাশি বসে সন্ধ্যা হওয়া দেখব। সেই মাঠে আমরা ছোট-খাটো উৎসবের মত করতে পারি।
রাণী : কবে? কবে নিয়ে যাবেন? আমার এক্ষুণি যেতে ইচ্ছা করছে। আমরা কি কাল যেতে পারি?
রাজা : নিশ্চয়ই পারি।
রাণী : প্রজাদের কথা যেসব শুনছি সেসব তাহলে ঠিক নয়। ওরা সুখেই আছে, তাই না মহারাজা?
রাজা : দুঃখ নিয়ে মাতামাতি করা আমার পছন্দ নয়। দুঃখ থাকবেই। সেই দুঃখ থেকে ওদের মন ফিরিয়ে নেব। ওদের জন্যে একটা উৎসব করব।
রাণী : উৎসব?
রাজা : চমৎকার একটি উৎসব। আনন্দ-উল্লাস-গান। আকাশ ভরা থাকবে জোৎস্না। পুরনারীরা হাত ধরাধরি করে নাচবে।
রাণী : চমৎকার। কিন্তু …। শুনছি হাজার হাজার মানুষ রাজপ্রাসাদের দিকে আসছে।
রাজা : কোথায় শুনেছ?
রাণী : সত্যি নয় তাহলে?
রাজা : না, সত্যি নয়। তাছাড়া সত্যি হলে কিছু যায় আসে না। ওদের আসতে দাও। ওরা আসুক, যোগ দিক আমাদের উৎসবে। এ উৎসব শুধু তোমার আমার উৎসব নয়। এ উৎসব আমাদের সবার। আমরা সবাই মিলে নাচবো, সবাই মিলে গাইবো। ফুলে ফুলে রাজ্য ঢেকে দেব। রাণী… ।
রাণী : বলুন!
রাজা : যাও, ফুল-সাজে সেজে আস। আজ আমার মনে বড় আনন্দ। বড় সুখের সময় আজ। তুমি অপরূপ সাজে সেজে দাঁড়াও আমার সামনে। সভাসদদেরও আসতে বল। আজ আমি সবাইকে পুরস্কৃত করবো।
রাণী : আমি আসছি। আমি এক্ষুনি আসছি। [প্রস্থান]
[মন্ত্রী প্রবেশ করবেন]
মন্ত্রী : মহারাজা আমাকে স্মরণ করেছেন?
রাজা : আমি আজ সবাইকে স্মরণ করেছি। আজ আমার মনে গভীর আনন্দ। আজ আমি সবাইকে পুরস্কৃত করব। কিন্তু তোমাকে আজ এত মলিন দেখাচ্ছে কেন?
মন্ত্রী : আমার গায়ের রঙটাই ময়লা মহারাজা।
রাজা : তোমার ঘোর কৃষ্ণবর্ণেও আনন্দের জ্যোতি ছিল। আজ তা দেখছি না।
মন্ত্রী। : হেতমপুর থেকে হাজার হাজার প্রজা এসেছে, তারা আপনার দর্শনপ্রার্থী। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
রাজা : এখন তো আমার কথা বলার সময় নেই মন্ত্রী।
মন্ত্রী : অপেক্ষা করতে বলব?
রাজা : হ্যাঁ, অপেক্ষা করুক। ভূষণ্ডির মাঠে বসে অপেক্ষা করুক। সময় হলেই আমি ওদের দর্শন দেব। কিংবা আমার বার্তা নিয়ে লোক যাবে। সে বার্তা হবে আনন্দের বার্তা। সুখের বার্তা।
মন্ত্রী : এই শীতের রাতে মাঠে বসে থাকবে?
রাজা : (চমকে) এই কি শীতকাল?
মন্ত্রী : [হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বেন।]
রাজা : শীত হলেও ভূষণ্ডির মাঠের দৃশ্য বড় চমৎকার। আকাশে চাঁদ আছে। ফুলে সৌরভ আছে। পাখির গান আছে। চারদিকে আনন্দ চিকমিক করছে। ওদের সময় ভালই কাটবে। [নেপথ্য থেকে শোনা যাবে কথা বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই। মহারাজা কান পেতে শুনবেন ও বিরক্ত হয়ে মঞ্চ ত্যাগ করবেন। মন্ত্রীও যাবেন। গ্রামবাসীর দল কথা বলতে চাই, আমরা কথা বলতে চাই–বলতে বলতে মঞ্চে প্রবেশ করবে। রাজার নকিব এসে দাঁড়াবে। গর্বিত ভঙ্গিতে।
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই– রাজা সাবের সাথে আমরা কথা বলতে চাই।
নকিব : রাজা সাব ব্যস্ত মানুষ এত সময় নাই।
বৃদ্ধ ঃ টুপিওয়ালা ভাই রাজা সাবের সাথে দুইটা কথা বলতে চাই। সময় আমরার অনেক আছে সময়ের অভাব নাই। [দলের সবার দিকে তাকিয়ে] ওরে তোরা বস। [সবাই বসে পড়বে] [নকিব রেগে গিয়ে একজনকে টেনে তুলে এক চড় বসিয়ে দেবে।]
নকিব : মনে নাই ডর ভয় পা ছড়াইয়া ক্যামনে বয় [সবাই উঠে দাঁড়াবে।]
এই কথাটা মনে রাখন চাই। রাজবাড়ির সামনে কারুর বসার হুকুম নাই। হেতমপুরের বোকার দল, আইন জানা নাই?
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই, কোন জায়গাতে বইসা থাকম্ এইটা জানতে চাই।
নকিব : ভূষণ্ডির মাঠে যাও। জায়গাটা ভাল। ফুলের গন্ধ আছে। পাখির গান আছে। চান্দের আলো ভি আছে। যখন সময় হবে, খবর নিয়ে সেইখানেতে মোদের লোক যাবে।
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই।
খবরটা একটু যেন তাড়াতাড়ি পাই।
নকিব : রাজা সাবের অত তাড়া নাই।
সকলেঃ কথা বলতে চাই।
[বলতে বলতে ভূষণ্ডির মাঠের দিকে রওনা হবে।]