২. নিমতলা শ্মশান

পাঁচ

০১.

নিমতলা শ্মশানে ভোর ফুটল, রাস্তায় রাত কাটানো ভিখিরির মতন রাতের কালো কালো ছায়াগুলো সরে গেল, সূর্য উঠল, দিনের আলোয় কলকাতা শহরকে শ্মশানেই প্রথম দেখলুম। মা পুড়ল। গঙ্গার ঘোলা-জলে রোদ তখন প্রাণখুলে হাসছে।

০২.

কলকাতা শহর নাকি ইন্দ্রপুরী। আমার কাছে শহরটা কিছুদিন কাঠ হয়ে থাকল। চারপাশে কেবল যেন ফাঁকা ফাঁকা। আমি এই শহরের কথা বুঝতে পারতাম না। এখানের সব কিছুই আমাকে অবাক করত। মনে হত, সমস্ত শহরটা বিরাট এক তাঁবুর তলায় সার্কাসের খেলা দেখাচ্ছে।

০৩.

 হাঁদুবাবুর বস্তিতে ওরা আমার কাছ থেকে এক মাসের ভাড়া আগাম নিয়ে নিয়েছিল। কাশীর গলির চেয়েও বস্তিটা ঠাণ্ডা, অন্ধকার, দুর্গন্ধভরা। ঠিক কত যে লোক থাকত এই বস্তিতে আমি কিছুতেই ঠাওর করে উঠতে পারিনি। ভোর হবার আগে থেকে মানুষের গলার স্বর শুনতে পেতুম, রাত বারোটার পরও বস্তিটা চুপ হত না। যারা কথা বলত, তারা কি মেয়ে কি মন্দবাই যেন গলার সহজ স্বর হারিয়ে ফেলেছে। কেমন কর্কশ, ভাঙা, ফাঁপা সুর গলায়। আমার মনে হত, এদের বুকে অনেক বুঝি শ্লেষ্ম জমা হয়েছে।

০৪.

মাঝে মাঝে মনে হত, কাশী ফিরে যাই। কিন্তু ফিরে যেতে পারতাম না। মানুষ একবার যা ফেলে আসে সহজে সেখানে আর ফিরে যেতে পারে না। কলকাতা আসার সময় আমার মনে একটা জীয়ন্ত ফুলের চারা যেন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছিল, হু হু করে বাড়ছিল; কলকাতায় আসতে না আসতেই সেই চারা কে যেন উপড়ে ছিঁড়ে টান মেরে ফেলে দিল।

০৫.

গ্যাসবাতির আলোয় একদিন নিজের ছায়া দেখলুম। ছায়াটা রাস্তার ধার বয়ে দেওয়ালে পেচ্ছাপখানার ওপর তালপাতার ভূতের মতন পড়েছিল। যেন আমার পা গা মেরুদণ্ড মুখ মাথা বলে আর কিছু নেই। ছায়াটা বেশিক্ষণ দেখতে পারলাম না, কেমন একটা ভয় হল হঠাৎ। হন হন করে হেঁটে গলি ধরে ভেতরে চলে এলাম অনেকটা। দাঁড়ালাম হঠাৎ। গলি আরও সরু হয়ে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। লম্বা মতন এক বাড়ির তলায় দাঁড়িয়ে দুটো মেয়ে সিগারেট খাচ্ছিল ভাগাভাগি করে। অনেক খড়িগুড়ো আর আলতা ওদের মুখে, কপালের টিপ জোনাকির মতন পিটপিট করছে। আচমকা আমার মনে হল, সত্যি কি আমার শরীরটা ছায়া হয়ে গেছে? আস্তে আস্তে একটি মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, রেল স্টেশনের টিকিটঘরে যেমন করে মানুষ টিকিটের টাকা গুণে দেয়, আমি ঠিক সেইভাবে ওর হাতে টাকা গুণে দিলাম। আর টাকা গুণে দিয়ে আমি এমন এক টিকিট কিনলাম যে-টিকিট আমায় ছায়া থেকে মাংস ও রক্তের ঠিকানায় নিয়ে যাবে।

০৬.

একটা বাচ্চা ককিয়ে ককিয়ে কাঁদছিল। ঘুম ভাঙল আমার। ফরসা হয়েছে। ভাঙা খড়খড়ির জানালার ওপারে বাচ্চাটা কাঁদছে। এপারে আমরা। আমি আর গোলাপ। গোলাপ মুখ থুবড়ে হাত ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে, ঠিক যেন মরা জন্তু। দিশি মদের বোতলটা গড়িয়ে গড়িয়ে গোলাপের বাসনের কাছ-পর্যন্ত চলে গেছে। বাচ্চাটা কাঁদছিল। …গোলাপকাল বলছিল, তার একটা ছেলে হয়েছিল একবার। মা মা বলতে শেখার পর মাত্র দুটো দাঁত নিয়ে মরে গেছে।

০৭.

গোলাপকে জাগিয়ে দিয়ে আমি চলে আসছিলাম। গোলাপ শুধোল, আবার কবে আসা হবে? কথার কোনও জবাব দিলাম না। একটু হাসি হাসি মুখ করলাম শুধু। ..আর আসা হবে না। আমি কেন এসেছিলাম গোলাপ জানে না। গোলাপের জন্যে খরচ করার মতন পয়সাও আর আমার নেই।

০৮.

বইয়ের দোকানের চাকরিটা আমায় সহদেবদাই দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল জানি না। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াই তখন চিৎপুরের রাস্তায়, কাশী থেকে আনা পুঁজি ফুরিয়েছে; পকেট মেপে একবেলা চিড়ে মুড়ি খাই অন্যবেলা উপোস। একদিন সন্ধে তখন উতরে গেছে, শ্রাবণের ধরা বৃষ্টি আবার এল হুড়মুড় করে। রাস্তা থেকে উঠে দোকানের সরু বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চিৎপুরের রাস্তা জলের ঝাঁপটা খাচ্ছে সকাল থেকেই, মাগুর মাছের মতন কালো পিছল তার চেহারা, বাতিগুলিতে তেমন রোশনাই নেই। অনেক পরে পরে ঠং ঠং করে ঘন্টা বাজিয়ে জানলা-আঁটা ট্রাম এক-আধটা যাচ্ছিল। বৃষ্টি আর ধরে না। কানে গেল, দোকানের মধ্যে বসে কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পালা পড়ছে। এ আমার চেনা পালা, শোনা পালা। ছেলেবেলায় শুনেছি, ইন্দ্রদের কাছে থাকবার সময় গাঁ-গ্রামে এ-পালা কতবার গেয়ে গেছে যাত্রার দল। বারান্দা ছেড়ে দোকানের চৌকাঠে এসে দাঁড়ালাম। সহদেবদা পালা পড়ছে–দোকান ফাঁকা। …কখন যেন আমি ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম সহদেবদাও পালা পড়তে পড়তে হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়ে থেমে গেল। কী চাই? সহদেবদা শুধোল। চটক ভাঙল আমার, আধভেজা চেহারা, মুখ ভর্তি দাড়ি, চিট ময়লা জামাকাপড়। ভয় হল, আমায় না চোর ভাবে। তাড়াতাড়ি ঢোঁক গিলে বললাম, পালা কিনব। .কোন পালা? আপনি যেটা পড়ছিলেন। সহদেবদা একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল, আমি কোন পালা পড়ছিলাম? কর্ণার্জুন। .সহদেবদা সামান্যক্ষণ আর কথা বলল না, হাঁ করে চেয়ে চেয়ে আমায় দেখল। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে বলল, কর্ণের বাপের নাম কী? …আমি থতমত খেয়ে গেলাম। সহদেবদা সরাসরি চেয়ে আছে, আমার দিকে। শেষে ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেললাম, সূর্যদেব। সহদেবদা শুনল, বিড়িতে টান দিল জোরে জোরে। তারপর বলল, কর্ণর বাবার নাম নারায়ণচন্দ্র শীল। আমি কর্ণ বলে খ্যাপার মন হা হা করে হাসতে লাগল সহদেবদা। এমন হাসি আমি আর শুনিনি। হাসিটা যেন দপ দপ করে হলকা তুলে জ্বলছিল। আমার মনে পড়ল, কাশীতে একজন ম্যাজিক দেখাত, একগলা স্পিরিট খেয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে হাসত, মুখ খুললে আগুন জ্বলত, বন্ধ করলে নিবত।

চন্দ্র শীল। আমি কণা

০৯.

সেই থেকে আমার তারিণী লাইব্রেরিতে চাকরি। দিনের বেলা সহদেবদার বাসায় খেতে পেতাম, মাস-মাইনে পঁচিশ টাকা। আমি নতুন, পুরনো কর্মচারী আরও ছিল দেড়জন। দাশমশাই আর দুলাল। দুলালটা বাচ্চা, বছর চোদ্দ-পনেরো বয়স। ছেলেটা বোবা-হাবা, কথা বলতে পারত না, কিন্তু কাজকর্ম করত চমৎকার। সহদেবদা দুলালকে সব সময় নন্দদুলাল বলে ডাকত। কেন, কে জানে?

১০.

শহর কলকাতা দেখতে দেখতে কবে যেন সয়ে গেল আমার। সহদেবদা বলত: কলকাতায় এলে ফিলটার করা জল খাওয়া যায় বুঝলে ফটিকচাঁদ, আয়নার মতন রং জলের। এ-জল পেটে ধরে গেলে অন্য জল মুখে সরে না আর। ঠাট্টা করেই বলত সহদেবদা। আর দোকানের তক্তায় তবলার বোল বাজিয়ে কলকাতার গান গাইত:

তুমি যে পরের সোনা আগে তা ছিল না জানা…

সহদেবদার বুড়ো আঙুল থেকে আরও একটা ছোট কচি আঙুল বেরিয়েছিল। ডান হাতটা উপুড় করলে বুড়ো আঙুলটা চেপ্টা মাথা-ভাঙা মাগুর মাছের মতন দেখাত। একদিন সহদেবদা আমায় বলেছিল, আমাকে তুই একলব্য করে দিতে পারিস ফটিকচাঁদ, এই আঙুলটা দেখলে বউ শালী বড় ঘিন ঘিন করে।

১১.

সহদেবদার বউ দেখতে ভাল ছিল। বেশ কটকটে ফরসা রং, মাটির সরার মতন গোল মুখ, চোখ দুটি ছিল ভয়ংকর টানা টানা–যেন কাজললতা। …দুপুরের আগে আগে আমি খেতে যেতাম, সহদেবদা দোকানে থাকত, আমি ফিরে এলে সহদেবদা চলে যেত। সহদেবদার বউ আমায় পাত পেড়ে খেতে দিত। প্রথম প্রথম কথাবার্তা বলত না, পরে বলত। গলার স্বরটা কিন্তু মোটা মোটা ছিল তার।

১২.

একদিন ভাতের মধ্যে একটা মাথার কাঁটা পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সহদেবদার বউকে আমার ভয় করত। কপালের চারপাশ থেকে টেনে কষকষে করে চুল বাঁধত সহদেবদার বউ, বিড়ের মতন মস্ত খোঁপা করত, সরার মতন গোল মুখটা তাতে যেন রুক্ষ রুক্ষ দেখাত। গলার স্বরটাও ছিল মোটা, খ্যাসখ্যাসে।

১৩.

রুপোর ঝুমকো কাঁটাও পেয়েছিলাম একদিন। সহদেবদার বউ গা করেনি। বরং ঠোঁট উলটে চোখ চলকে এমন ভাব করেছিল যেন ঠাট্টা করেই বলল, কাঁটাটা তোমার গলায় বিঁধেছে নাকি?

১৪.

সহদেবদার দোকানে হরেক রকমের বই-যাত্রার পালা, ব্রতকথা, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, নাটক, নবেল, যাদুমন্ত্র, শিক্ষা, রতিশাস্ত্র। দোকানের কাজকর্ম হালকা থাকলে আমি বসে বসে বই পড়তাম। একদিন দুপুরে এক ছোকরা বাবু বশীকরণ কিনতে এসেছিল। খদ্দের বিদেয় করার পর সহদেবদার হঠাৎ সে কী হাসি। হাসতে হাসতে দমবন্ধ হবার জোগাড়। একটু সুস্থির হবার পর সহদেবদা বলল, কী কারবারই ফেঁদে বসেছি ফটিকচাঁদ, আমার দোকানে বাজারের সেরা বশীকরণ পাওয়া যায়; মেয়েছেলে বশীকরণটা আমার বাবা লিখেছিল, বেটাছেলে বশীকরণটা আমি লিখেছি। সহদেবদা হা হা করে হেসে উঠল আবার।

১৫.

সহদেবদার বউয়ের সঙ্গে আমার বেশ জমে আসছিল। চুলের কাঁটা ভাতের পাতে পড়ত না আর। তার বদলে সাজানো গোছানো ভাতের থালায় কোনওদিন একটু ঘি পড়ত, কোনওদিন বা মাছের বড় টুকরো। খেয়ে-দেয়ে আঁচিয়ে উঠলে সহদেবদার বউ আমার হাতে দুখিলি পান টুপ করে ফেলে দিত। …একদিন পানের সঙ্গে কড়া জরদা মিশিয়ে দিয়েছিল। দোকানে আসার পথে গা গুলিয়ে বমি এল। সেদিন সারাটা বিকেল গা বিড়োনো ভাব নিয়ে কাটল।

১৬.

পরের দিন সহদেবদার বউ ঠোঁটা-টেপা চাপা হাসি হেসে শুধোল, কী গো কাশীর বাবু, কেমন আছ? হাসিটা যেন রঙ্গ রসে জ্বাল দেওয়া, মোটা সর পড়েছে গালে চোখে। আমি নজর করে সে হাসি দেখলাম। …সেদিন সহদেবদার বউ পান দেবার সময় হাতের খিলি খুলে দেখাল। বলল, চুন সুপুরি ছাড়া কিছু নেই বাপু, দেখে নাও; পরে যে বলবে শেকড়-টেকড় খাইয়ে দিয়েছিবলতে বলতে দুলে দুলে হেসে উঠল সহদেবদার বউ। আমার মনে হচ্ছিল, মানুষের শরীরে যত শেকড় থাকে এত আর কোথাও নয়।

১৭.

শীত ফুরিয়ে গেছে। আমাদের চিৎপুরের গলিতে ভোঁ কাটা ঘুড়ির মতন টাল খেতে খেতে ফাল্গুনের বাতাস দু-এক দমকা এসে পড়ে। হোলির হররা ছুটছে রাতে। সহদেবদার বউ ততদিনে আমার কাছে আমি তুমি হয়ে গেছে। ওর চোখ দেখে আমার কী মনে হয় তা বলেছিঃ কী টানা টানা–ঠিক যেন কাজললতা। সহদেবদার বউ চোখের মনি আড় করে হেসেছে, বলেছে, তা হলে বলল এই কাজললতার কাজল পরতে কাশীর বাবুর বড্ড সাধ।

১৮.

সাধ মেটার আগে আগেই একদিন সহদেবদা সাত সকালে দোকানে এসে হাজির। সবে দোকান খুলে আমি ঝাড়া-মমাছা করছি, মাটির গণেশের তাকে ধূপদানিতে ধূপকাঠিটা অর্ধেকও পোড়েনি, খুশির চোটে লুটোপুটি খেতে খেতে যেন দোকানে ঢুকল সহদেবদা। আত্মহারা। দোকানের সিন্দুক খুলল, কাগজপত্র কী বের করল, পকেটে পুরল। আমায় দশটাকার একটা নোট দিয়ে বলল, আমি একটু শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি বুঝলি, দাশমশাই এলে পাঁচটা টাকা দিয়ে কালীঘাটে পাঠিয়ে দিবি পুজো দিতে, বাকি টাকাটায় তোরা পেট ভরে মিষ্টি খাস৷কীসের পুজো, মিষ্টিই বা কেন হঠাৎ? সহদেবদা চৌকাঠের ওপারে পা রেখে একটু দাঁড়াল, প্রাণভরে হাসল। বলল, তুই না একেবারে গবেট, গবেটের বাচ্চা…কীসের আবার মিষ্টি বুঝলি নান্যাকা চৈতন…তোর বউদির এবার মাইরি জোর আটকেছে…সহদেবদা হাসির টাল সামলাতে সামলাতে নেমে গেল। …চমক ভেঙে চেয়ে দেখলাম, ফুল দিয়ে ময়ূরপঙ্খী সাজানো একটা মোটর গাড়ি হুস করে চলে গেল, বর বউয়ের মুখ দেখতে পেলাম না।

১৯.

সেদিন দোকানের বউনি শুরু করেছিলাম ভোজবাজি শিক্ষা দিয়ে।

২০.

চৈত্র মাসটা খাঁ খাঁ করে উঠল। আমাদের বস্তিতে নটু পালের বউ বেশ্যা হল, কার্তিক ছুতোর বসন্ত হয়ে মরল, শৈলবালা বঁটি দিয়ে সোমত্ত মেয়ের পা কুপিয়ে দিল। কেন, কী করে, কেমন ভাবে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে কে জানে! ঘটছে দেখছি, চোখের সামনে হুট হাট ঘটে যাচ্ছে। সমস্তই ভোজবাজি। সহদেবদার বউয়ের পেটে বাচ্চা আসাটাও বোধ হয়।

২১.

সহদেবদার বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। দুপুরে দোকানের কাছাকাছি এক হোটেলে ভাত খেতাম। পাঁচ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছিল সহদেবদা। মানুষটার মেজাজ আরও দরিয়া হয়ে গিয়েছিল। মুখ ফুটে চাইলে আরও পাঁচটা টাকা বেশি দিতে না করত না। সহদেবদার এই ডগমগে ফুর্তির ভাবটা আমি হামেশাই লক্ষ করতাম। মাঝে মাঝে অসম্ভব রাগ হত। লোকটা এত বোকা গাড়োল অঙ্ক কী করে হল।

২২.

ও বাড়িতে একদিন ঘটা করে সত্যনারায়ণ পুজো হল। বউ যাতে ভালয় ভালয় বিয়োয় সহদেবদা সেই আশায় পুজো-আচ্চা তুকতাক কিছু আর বাকি রাখছিল না। সত্যনারায়ণের নেমন্তন্ন রাখতে আমরা তিন জনেই গিয়েছিলাম–আমি, দাশমশাই আর দুলাল। বাড়িতে অন্য লোকজনও এসেছিল। সহদেবদার বউকে অল্পের জন্যে একবার দেখেছিলাম। পেট-ঝোলা হাঁসের মতন হাঁটছিল। উত্তর দিকের ঘর থেকে এল, বারান্দায় সত্যনারায়ণের পুজোর কাছটায় এসে গড় হয়ে প্রণাম করল, শান্তির জল মাথায় নিয়ে চলে গেল। ওর গায়ের কোরা ফাঁপানো শাড়িটা যেন চালচিত্তিরের মতন চটক দিচ্ছিল।

২৩.

ফেরবার পথে দাশমশাই সহদেবদার বাড়ির কথা আমার কাছে খাটো গলায় গল্প করলেন। সহদেবদার বউ বাপের একমাত্র সন্তান, বাপের কিছু সম্পত্তি আছে, নেবুতলায় বাড়ি আর চালু তেলকল। বুড়ো বছর খানেক হল চোখ বুজেছে। মরার আগে মেয়ে-জামাইকে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। বেঁচে থাকতেই জামাইয়ের ওপর হাড়ে হাড়ে চটা ছিল বুড়ো; ভাবত, বেজাত বেজন্ম এই ছোঁড়াটাই তার মেয়েকে পটিয়ে পাটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেছে। আসলে ওই মেয়েতেই এই ছেলেকে গিথেছিল। …বড্ড রাগ বুড়োর, মেয়ে জামাইয়ের ওপর। সম্পত্তির কানাকড়িও দেয়নি; উইল করে গেছে। মেয়ের যদি ছেলেমেয়ে হয় পুরো সম্পত্তি তাদের বর্তাবে নয়তো ও-সম্পত্তি বুড়োর ভাইপোদের। দাশমশাই বিড়িতে টান দিয়ে বললেন, বুড়োর ভাইপোরা এই সম্পত্তি লুটতে শুরু করেছিল। আমাদের বাবু আর তাঁর পরিবার হাত কামড়ে মরছিল এতদিন। নিজের পাতের ঘি–অন্যে চেটেপুটে খাচ্ছে মানুষ কাঁহাতক আর সহ্য করে!

২৪.

সহ.দেবদার বউকে এরপর আমি যথার্থ করে চিনলাম। বাজির দৌড় জেতবার জন্যে সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। মাথার কাঁটা তার কিছু কমতি ছিল না। আঁকশির মতন এই কাঁটা সে আরও কত ছড়িয়েছিল কে জানে। তবে ছড়িয়েছিল। নয়তো ছ বছর ধরে যে সহদেবদা কাজে আসেনি–সেই সহদেবদা হঠাৎ কাজে আসত না। সহদেবদার নিজের গুপ্তকথাও আমি কিছু কিছু জানতাম। কবিরাজি হাকেমি নানান ওষুধ খেত ও! বলত, আমার লাইব্রেরির বশীকরণও যেমন ভুসি মাল বুঝলি ফটিকচাঁদ, এশালাও সব তেমনি…কিছু হয় না।

২৫.

সহদেবদার বউকে চিনতে পেরেছিলাম, চিনতে পারিনি সহদেবদাকে। বড্ড সাদামাটা ভাল মানুষ লোক, তার ঘরে অন্যে সিঁধ কেটেছে এবুঝি স্বপ্নেও ভাবত না। শেষ পর্যন্ত নিজের পৌরুষেই সে জিতেছে–মানুষটা এই আনন্দে গর্বে ভরপুর হয়েছিল।

২৬.

বেশ কয়েক মাস পরে সহদেবদাকে আমি চিনতে পারলাম। বাড়িতে সহদেবদার বউয়ের আজকাল অবস্থা। পাক্কা তিন দিন কামাইয়ের পরে দোকানে এল সহদেবদা। তখন সন্ধে হয়ে গেছে, আমরা দোকান বন্ধ করছি। সহদেবদার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, আমাদের যেন শ্মশানে যাবার জন্যে ডাকতে এসেছে। দাশমশাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, আমি চমকে উঠেছিলাম, বোবা দুলাল দোকানের দরজার সামনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাশমশাইয়ের গলা থেকে স্বর বেরুচ্ছিল না, তবু তিনিই আধ-খাপচা বেয়াড়া স্বরে শুধোলেন, বউমা? .সহদেবদা মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, ঠিক আছে, বেঁচে আছে। আমরা তিনজনে নিশ্চিন্ত হলাম খানিকটা। ..দাশমশাই আর দুলালকে বিদায় করে দিয়ে সহদেবদা বলল, আমায় একটু জল খাওয়া। জল খাওয়ালাম, চা সিগারেট এনে দিলাম। সহদেবদা দু হাতে মাথা ঢেকে চুপ করে বসে থাকল। মাঝে মাঝে মুখ উঠিয়ে রাস্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল। আমার সঙ্গে কথা বলছিল না, যেন সে একা একটি মানুষ এই ঘরে বসে আছে। ধীরে ধীরে রাত হয়ে উঠল। দোকানের বইয়ের আলমারির ফাঁক-ফোকর থেকে দু একটা ইঁদুর বেরিয়ে এল, কড়িকাঠের ওপর থেকে টিকটিকি ডাকল, ট্রামের টিকিতে আগুন ঝলসে দোকানের সামনেটা পলকের জন্যে আলো হয়ে উঠল। …চমক ভাঙল সহদেবদার। বলল, দোকান বন্ধ কর। …কাঠের পাল্লা লাগাতে লাগাতে দেখলাম, দোকানের ক্যাশ খুলে মুঠো ভর্তি করে যা পারল পকেটে পুরে নিল সহদেবদা। দরজায় তালা লাগাচ্ছি সহদেবদা একটা রিকশা থামাল। রিকশায় বসে আমায় ডাকল, উঠে আয় ফটিক।

২৭.

আমরা বেশ্যাপাড়ায় এলাম। গলিটা যেখানে শেষ হব হব, সহদেবদা রিকশা থামাল, নামল। গোটা একটা টাকাই দিয়ে দিল রিকশাঅলাকে। আমায় বলল, ভাল দেখে একটা মেয়েছেলে বাছ–বলতে বলতে সহদেবদা কপা এগিয়ে পাশের দোকানটায় চলে গেল।

২৮.

মানুষটার মতিভ্রম হয়েছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উলটো দিকের রাস্তা থেকে একজন গলা ছেড়ে সোডাজলের গান গাইল। দেড়তলার খোলা জানালা দিয়ে বুক গলিয়ে পানের পিচ ফেলল আর-একজন। নাচের সাথে ডুগি তবলার বোল বাজছিল আশেপাশে কোথাও। আমার মুখোমুখি বাড়িটার সরু ছোট খোলা সদরের দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, তিন ধাপ সিঁড়ি, তিন সিঁড়িতে তিনটে মেয়ে বসে। প্রথম ধাপের মেয়েটা পা ফাঁক করে বসে পায়ের গোড়ালির কাছে সায়া টানছে আর হাসছে। …সহদেবদা এল, কাঁধে হাত রাখল। কাঁধের কাছটা এমন জোরে থাবা দিয়ে ধরেছিল, মনে হল যেন ওর সমস্ত শরীরের ভারটা আমার ওপর ফেলে দিয়েছে। আস্তে আস্তে গলা জড়িয়ে ধরল সহদেবদা। শোষা শোষা গলায় বলল, ওই মেয়েটার কাছে চল, জানলার মেয়েটা…একলা আছে।

২৯.

সহদেবদাকে এগিয়ে দিয়ে পিছু ফিরতে যাচ্ছি খপ করে আমায় ধরে ফেলল। এত জোরে এমন করে কখনও আমার হাত আর কেউ ধরেনি। মনে হচ্ছিল, আমায় ছাড়া আর এক পা এগোবার সাধ্য সহদেবদার নেই। ইচ্ছে করলে হাতটা হয়তো আমি ছাড়িয়ে নিতে পারতাম। ছাড়ালাম না। বললাম, তুমি যাও, আমি একটু পান খেয়ে আসি। দুজনেই এক জায়গায়…। আমায় কথা শেষ করতে দিল না সহদেবদা, ওর হাতের আঙুলগুলো আরও শক্ত হল, আমার কবজির কাছটায় হাড় কনকন করে উঠল, সহদেবদা বলল, দুজনেই এক সঙ্গে যাব। তুই সাক্ষী থাকবি, ফটিক। আমি শালা পুরুষ মানুষ কি না স্বচক্ষে তুই দেখবি। সহদেবদার গলা কর্কশ রুক্ষ, চোখে ফুলকি। আমার হাত ধরে টানছিল সহদেবদা, টকটকে লাল শাড়ি পরা বেশ্যাটা দেওয়ালে পিঠ হেলিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।

৩০.

কতটা রাত হয়েছিল জানি না। রিকশা করে সহদেবদাকে নিয়ে ফিরছিলাম। সোনাগাছির গলিটা যেন থকে গিয়ে মড়ার মতন পড়ে ছিল। গ্যাসবাতিগুলো বাড়ির বউয়ের মতন পথ চেয়ে চেয়ে জড়ানো চোখে ঢুলছে। নোংরা ঘিঞ্জি ঠাণ্ডা বাড়িগুলোর গা বেয়ে দিশি মদ কাঁকড়া ভাজা আর পেঁয়াজের গন্ধ ব্যাড় ব্যাড় করছে। রিকশাটা আস্তে আস্তে চলেছে। সহদেবদা মাল খেয়ে আমার ঘাড়ে মাথা গুঁজে পড়ে আছে। …গলির জট ছাড়াতে ছাড়াতে আমরা যে কোথায় এসে পড়লাম কে জানে। আমি কিছু ঠাওর করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কোথায় এসেছি কোথায় যাচ্ছি আমরা কেউ জানি না–আমি না, সহদেবদা নয়, রিকশাঅলাও না। আমাদের যাওয়া কোনও জানা ঠিকানায় নিয়ে যায় না শেষ পর্যন্ত। সহদেবদা যেখানে এসেছে সেটা না বাড়ি না বেশ্যাপাড়া। বোধহয় এটা দোকানপাড়া। সহদেবদা দোকান খুলে বসে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বশীকরণ শিক্ষা বিক্রি করবে। বাড়িতে তার কলমকরা ছেলে বড় হবে, বেশ্যাপাড়ার আজকের মেয়েটা বুড়ি হবে; সহদেবদা কোনওটাকেই বশ করতে পারবে না। ছেলের নাম দিয়ে আরও একটা বশীকরণ লিখবে। বেচবে। গাঁট গাঁট বেচবে আর দোকান বন্ধ হয়ে গেলে ট্রাম রাস্তায় নেমে দেখবে–জগতে কোনও কিছু তার বশে নেই। কাঁদবে সহদেবদা, রোজ–প্রত্যহ, আজকের মতন। কিংবা হাসবে, যেমন করে আমায় দেখে প্রথম দিন হেসেছিল।

৩১.

রিকশা থামিয়ে আমি নেমে পড়লাম। তারপর ভীষণ ভয়ংকর একটা বোঝার মতন যেন সহদেবদাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়ে হন হন করে ছুটে পালালাম।

.

ছয়

০১.

ময়রার দোকানের সামনের এঁটো পাতার যেমন ঠিক-ঠিকানা নেই, কখনও ভিখিরি কখনও কুকুরের মুখে মুখে একখান থেকে আর-একখানে গিয়ে পড়ে, শেষে দমকা হাওয়ায় উড়ে উড়ে কোথাও চলে যায়–আমার জীবনটাও সেইভাবে কাটছিল। শশী কোম্পানির ছবি বাঁধাইয়ের দোকান থেকে মাধবমোহন অপেরায় এসেছিলাম। সেবার অপেরা নতুন পালা খুলেছিল নহুষের প্রেতাত্মা। আমায় সারাটা শীত কলকাতার বাইরে মফঃস্বলে নহুষের প্রেতাত্মা সেজে কাটাতে হয়েছে। ছাতার কাপড়ের কালোবোরখা পরে রাতের পর রাত জেগে থাকা আর যাত্রার আসরের বাইরে এলেই খেকি কুকুরগুলোর তাড়া খাওয়া আমার ভাল লাগত না। আমি জানতাম, ধুতি জামা পরা এই মানুষটাই আসল প্রেতাত্মা কালো বোরখাটা নেহাতই কাপড়, তার আত্মা নেই। মাধবমোহন অপেরার মালিক আমায় বাপ মা তুলে গাল দিয়ে বলেছিল, ওরে আমার বিদ্যেসাগর, খুব যে কুলোয় করে বিদ্যে ঝাড়ছিস, আত্মা দেখার জন্যে কেউ বায়নার টাকা দিয়ে যায় না-বুঝলি। ..আমি জানতাম কালো কাপড়টার জন্যেই মানুষ দাম দেয়।

০২.

অপেরা ছেড়ে দিয়ে মাস দুই নীলাম হাঁকার কাজ করলাম ডাববাবুর দোকানে। নীলাম হাঁকার গলা আমার ভালই ছিল। ডাববাবুর ধারণা হল, আমার গলার স্বর তেমন ভাবে চড়তেই পারে না, খদ্দের যে ভাববে এই বুঝি হাতছাড়া হল হল তেমনটি হয় না। ডাববাবু বললেন, নীলামের কারবারে খদ্দেরকে গরম করে দিতে হয়, তুমি ঠিক গরম করতে পারো না। ..চল্লিশ টাকা মাস মাইনের আর কত গরম করার মতো আগুন থাকে শরীরে আমি বুঝতে পারিনি।

০৩.

ছেঁড়া-খোড়া শুকনো পাতার মতন আমি যখন যে-পাশে হাওয়ার দমকা সেই পাশে উড়ে যাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে আর একটা বছর কেটে গেল। দরজিপাড়ার দিকে এক গেঞ্জিকলে চাকরি পেয়েছিলাম। চাকরিটা কিছু নয়, কিন্তু কারখানার বাড়িটা আমার অদ্ভুত লাগত। ভাঙা গেটঅলা কতকালের পুরনো এক বাড়ি, গায়ে একরত্তি চুন সুরকি নেই, ইটগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে ঝরছে, নাট-মন্দিরের মতন বাড়িটার পেল্লায় মাথাটা লম্বা লম্বা তালগাছের মতো থামের ওপর ভর করা। কত যে ঘর ছিল ওবাড়িতে কে জানে, বিশ-পঁচিশ পঞ্চাশও হতে পারে। কাঠের সিঁড়ি, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার কুঠরি, হাঁটুড়োবা ধুলো, কেমন এক পাতাল পাতাল গন্ধ। একরাশ পায়রা আর এক গাদা চড়ুই সারাদিন বারান্দায় ঝটপট করছে। দালানের সামনে একটুকরো জমি। একটা ন্যাংটো মেয়েছেলের মূর্তি হেঁট মুখে পিঠ নুইয়ে পায়ের তলা থেকে কাপড় তুলে নিচ্ছে, যেন দালানে কারুর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে লজ্জায় মরি মরি। জমিটার একপাশে কামিনী ফুলের গাছ একটা, আর কিছু জবা গাছ। …উত্তর দিকের দালানের কুঠরিতে আমাদের গেঞ্জিকল, ওপাশে সাইনবোর্ড লেখার কারখানা–মাঝের কুঠরিগুলোয় ছাপাখানা। দোতলায় এক জ্যোতিষী বসে, গয়নার বাক্স তৈরি করে দু-তিন জন কারিগর, থিয়েটারের সিন আঁকে শশিবাবু আর তার সাকরেদ দুজন। বাড়িটার আর কোথায় কী আছে জানতাম না। অথচ দোতলার উত্তর দিকের জানলার আধখানা বন্ধ পাপড়ির ওপর দিয়ে প্রত্যহ ভিজে শাড়ি ঝুলত, প্রত্যহ। সকালে যখন কারখানায় আসতাম, দেখতাম শাড়িটা ভিজে; দুপুরে দেখতাম শাড়ির বদলে ধুতি ঝুলছে। আমাদের মধ্যে কেউ জানত না, ওই ঘরটায় কে থাকে। কেউ কোনওদিন জানলায় কারুর মুখ দেখেনি। সবাই ভাবত, এ বাড়ির বুড়ো ম্যানেজারের ওটা অন্দরমহল। বুড়ো ম্যানেজারকে দুপুরবেলা একবার দেখা যেত। খড়ম পায়ে সিঁড়ির রেলিং ধরে আস্তে নেমে আসত দালানে। ন্যাংটা মেয়ের মূর্তিটার কাছে এসে বেতের বাটি থেকে ভাতের দানা ছিটিয়ে পায়রা আর চড়ুইগুলোকে খাওয়াত। তারপর খট খট করে আবার চলে যেত, মনে হত মানুষটা এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে, আবার এখুনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। কারও দিকে তাকাত না, কথা বলত না; মাঝে মাঝে শুধু সিঁড়ি ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাত।

০৪.

 গেঞ্জিকলের কাঠিমগুলো সুতো ছাড়ত আর কলগুলো গেঞ্জি বুনত। মাঝে মাঝে আমার মনে হত, আমরা সবাই কাঠিম হয়ে গেছি।

০৫.

একদিন ছাপাখানার কেষ্টপদ দোতলার জ্যোতিষীর কাছে হাত দেখিয়ে এসে বলল, দুমাসের মধ্যে তার বিয়ে হবে। আমি ঘুরন্ত কাঠিমগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছিলাম, কেষ্টপদ বিয়ে করতে যাবার সময় একটা জালি গেঞ্জি পরবে। হয়তো এই কারখানার গেঞ্জি।

০৬.

কারখানার ছুটি হয়ে গেলে একদিন আমি আস্তে আস্তে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। জ্যোতিষীর ঘরের সামনে শশিবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। সারাটা বারান্দা জুড়ে একটা থিয়েটারের আঁকা সিন মাটিতে মেলা ছিল। আকাশের চাঁদ, কটা পাখি, গাছের ডাল-পালা শশিবাবুর পায়ের তলায়। ফুরোন বিকেলের আলো দিয়ে যেন আকাশ চাঁদ গাছ পাখির গায় পালিশ তুলে নিচ্ছিলেন শশিবাবু। …তাঁর উলটো দিকে দুই বাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি অতটা খেয়াল করিনি। পাঁচ টাকায় শশিবাবু অতটা আকাশ অমন গোল চাঁদ গাছ পাখি সব বাবুদের ভাড়া দিয়েছিলেন এক রাত্রের জন্যে। …আমার কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছিল, একদিন পাঁচ টাকা দিয়ে আমিও অতটা আকাশ অমন বাতাস ভাড়া করব।

০৭.

ছাপাখানার কেষ্টপদ সোনালি প্রজাপতি আঁকা কবিতা ছাপিয়ে বিয়ে করল। তার বউয়ের নাম চাঁপা। আমার বার বার চাঁপারানির কথা মনে পড়ছিল। চাঁপারানি এতদিনে বুড়ি হয়ে গেছে। মানুষ শুধু বুড়ো হয়। একদিন আমিও হয়ে যাব। এখনই নিজেকে কত পুরনো লাগে। রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমি আমার শরীরের চারপাশে গন্ধ পাই। কারখানার পুরনো বাড়িটার গায়ে যেমন গন্ধ, অনেকটা যেন ওই রকম, নোনা, ভ্যাপসা, ধুলো ধুলো। গন্ধটা আমার মন মেজাজ খারাপ করে দেয়। আনমনা হয়ে থাকি। কখনও কখনও অসহ্য লাগে; মনে হয় চৌবাচ্চার কতকালের বাসি জলের মতো আমার শরীরের রক্তেও বাসি গন্ধ ধরেছে, পোকা হয়েছে, মশা উড়ছে। আর হাড়গুলো মরা গাছের ডালের মতন শুকনো।

০৮.

একদিন স্বপ্ন দেখলুম: শশিবাবু চুনের বালতি আর পাটের পোচড়া নিয়ে আমার কাছে এসেছেন। থিয়েটারের পুরনো রং উঠে যাওয়া পট যেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, আমায় তেমন করে দেখছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমাকে নিয়ে শশিবাবু কী করতে চান।

০৯.

সকালে ঘুম ভাঙতে তারাপদ ড্রাইভারের বউটাকে খুব হাসতে দেখলাম। কলের গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছিল আর ননীর বোনকে কী যেন ইশারা করছিল। আমায় কল ছেড়ে দিয়ে তারাপদর বউ সরে গেল। বস্তির বাইরে নোংরা কলতলায় ননীর বোন সুহাসিনী হাঁটুতে মুখ ঢেকে ধনুকের মতন পিঠ করে বসেছিল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। …মুখে চোখে জল দিয়ে চলে আসছিলাম, কানে গেল তারাপদর বউ হেসে হেসে বলছে, তাড়াতাড়ি মুক্ত হয়ে নে…আজ বাদে কাল বিয়ের পিড়িতে বসবি না! ..যত অনাছিষ্টি বাপু তোদের।

১০.

গেঞ্জিকলে ঢোকার সময় দেখলাম, ন্যাংটা মেয়ের মূর্তিটার মাথায় চড়ে সাদা পায়রাটা ময়লা ফেলছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পায়রাটাকে উড়িয়ে দিলাম শব্দ করে। মেয়েটার সারা গা বুক পেট পাছা পায়ে এত ময়লা জমে আছে আমি জানতাম না। ইচ্ছে করছিল, মেয়েটাকে পরিষ্কার করে চান করিয়ে দি।

১১.

দুপুরে এক ফাঁকে দু-গ্রাস মুড়ি চিবিয়ে জল খেয়ে বাইরে রোদে পঁড়িয়েছিলাম। কেষ্টপদ এসে এক খিলি পান দিল। বিড়ি ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে মূর্তিটাকে দেখছিলাম। কেষ্টপদ হাসতে হাসতে বলল, নকল জিনিস দেখে দেখে মন খারাপ করে লাভ কী, একটা আসল জিনিস নেবে তো বলল, ব্যবস্থা করি। .কথাটা আমার বুকে যেন কোথায় একটা আলগা গিটের মতন এসে পড়ল। কেষ্টপদ যদি টানত, গিটটা লাগত, শক্ত হত। ও টানল না গিটটা, আমি বোকার মতন হাসলাম। বললাম, বিয়ের পিড়েতে বসার আগে নাকি মুক্ত হতে হয়? কী–? কেষ্টপদ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এমন কথা জীবনে শোনেনি। আমি সকালবেলার কথা তুলে বললাম, আমাদের বস্তিতে একটা মেয়ের পরশু দিন বিয়ে, একটা বউ তাকে মুক্ত হতে বলছিল…। কেষ্টপদ এবার হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে আমার গায়ে নুয়ে পড়ছিল। যতবার মুখ খুলতে গেল ডুবন্ত মানুষের জল গেলার মতন হাসির খাবি খেল। আমি হাঁ করে কেষ্টপদর হাসি দেখছিলাম। ম্যানেজার বুড়ো ঠিক তখন সামনে, ন্যাংটা মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেষ্টপদ তখনও হাসছে। কা কা করে কাক ডেকে উঠল, পায়রাগুলো ঝটপট করতে করতে নেমে এল, চড়ুইগুলো মাঠে, বুড়ো ম্যানেজার ভাতের দানা ছিটোচ্ছে। কেষ্টপদর হাসির দমক কমে এসেছে ততক্ষণে, আমার কানের কাছে মুখ হেলিয়ে বলল, হায়রে আমার কপাল মহারাজ, তুমি বললে কী! …আরে, মেয়েদের হতে হয়…মুক্ত-টুক্ত হতে হয়… কেষ্টপদর সারা মুখ কেমন যেন দেখাচ্ছিল, বিশ্রী রকম হাসির পিচ ছড়িয়ে মুখটা ছেতরে গেছে। হাসতে হাসতে দুলতে দুলতে চলে গেল কেষ্টপদ। আমি বোকার মতন দাঁড়িয়ে থাকলাম। চোখে পড়ল, একটা কাক আদুল গা পাথুরে মেয়েটার একপাশের উঁচু বুকের ওপর পায়ের নোখ রাখার চেষ্টা করছিল; পা পিছলে গেল, কাকটা সঙ্গে সঙ্গে পাক খেয়ে উড়ে গেল, তারপরই ছিটনো ভাতের দানার ওপর এসে বসল নাচতে নাচতে।

১২.

আমার কলের কাঠিমটা সেদিন বার বার সুতো ছিঁড়তে লাগল। ঝাপসা ঠাণ্ডা ঘর, তিনটে হলুদ মিটমিটে বাতি, কলের কেমন একটা একঘেয়ে শব্দ, ত্রৈলোক বিশ্বাসের কাশি আর থুতু ছিটানো, আমার মনে হচ্ছিল চারপাশে মাথা বোঝাই আস্তাকুঁড় নিয়ে আমি বসে আছি। ভাল লাগছিল না কিছু। বুকের মধ্যে একটা ফোঁড়া যেন এবার পেকে টাটিয়ে টনটন শুরু করছে। কেষ্টপদ আমার মন মেজাজ বিগড়ে দিয়ে গেছে। দু-দিন বিয়ে করেই সবজান্তা! আমি সহদেবদার দোকানে অঢেল রতিশিক্ষার বই পড়েছি, মেয়েছেলেদের সাথে শোওয়া বসাও কি কম করেছি! কেষ্টপদ আমায় কী শেখাবে! সুহাসিনীর মুক্ত হওয়া মেয়েদের মামুলি ব্যাপার এ-আমার ভাবতেই ভাল লাগছিল না।

১৩.

সুহাসিনীর বিয়ের দিন আমি ওকে অনেক বার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি। মেয়েটা তার সব নোংরা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছিল। ওকে লাজুক খুশি সুন্দর দেখাচ্ছিল। সিঁথিতে সিঁদুর ওঠার পর সুহাসিনীর মুখ একরাত্রে ফুটে উঠল। সকালে উঠে আমি অবাক হয়ে সেই ফোঁটা ফুল দেখলাম।

১৪.

শশিবাবু কিছুদিন ধরে একটা ভাঙা মন্দির আঁকছেন। মন্দিরের পাশে গা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে গাছ-গাছালি। অন্ধকার থম থম করছে।

১৫.

ম্যানেজার বুড়ো একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পা পিছলে পড়ে গেল। শেষ সিঁড়িতে তার মাথা, ডান পায়ের খড়মটা অনেকগুলো ধাপ উঁচুতে একপাশে পড়ে আছে। হাতের বাটি থেকে ভাতের দানা দালানে ছড়িয়ে পড়েছে। হই-হট্টগোলের মধ্যেও একটা কাক, কয়েকটা চড়ুই, এক জোড়া পায়রা দালানে উড়ে এসে ভাতের দানা খুঁটে খাচ্ছিল। ন্যাংটো মূর্তিটার পেটের তলায় এক খাবলা ছায়া, পিঠ মাথা হাত রোদে পড়ছে।

১৬.

এমন মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি। নকশা করা পালংকে শুয়ে ছিল। পালঙ্কটা শশিবাবুর আঁকা পুরনো ভাঙা মন্দিরের মতন দেখাচ্ছিল। মেয়েটির বাড়ন নেই, পায়ের দিকটা বেঁটে বেঁটে, বুকের দিক ভীষণ পুরুষ্ট, মাথাটা মোটা মোটা। মুখ গোল। তবু কেমন কচি কচি দেখায়। ডান চোখের তলায় মস্ত এক তিল। গায়ের রং ফরসা, খুব ফরসা। ম্যানেজার বুড়োর কাঠ শরীরটা দেখে ও শুধু কাঁদল, অন্ধের মতন দুটি হাত দিয়ে বাতাস হাতড়াল, উঠতে পারল না বসতে পারল না, কান্নাটা যেন শোওয়া শরীরে তেমন করে উথলে উঠতে না পেরে মরে গেল।

১৭.

ম্যানেজার বুড়োর নাতনি উঠতে বসতে দাঁড়াতে হাঁটতে পারে না। হাত দুটো নৌকোর দাঁড়ের মতন নড়াতে চড়াতে পারে, আলগা করে মুঠো করতে পারে আঙুল। আর পারে কথা বলতে। ওর নাম রাজলক্ষ্মী।

১৮.

শশিবাবুই ফ্যাসাদে পড়েছিলেন। ম্যানেজার বুড়ো মরার পর রাজলক্ষ্মীকে দেখাশোনা করার ভার যেন আপনা থেকেই তাঁর ঘাড়ে পড়ল। শশিবাবু বলতেন, আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লুম তো, এখন এই পুতুলটাকে নিয়ে আমি করি কী! শশিবাবু একটা ঝি রেখে দিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক পরে ঝি পালাল। শশিবাবু আর-একটাকে ঠিক করে নিয়ে এলেন। পরের দিন সেও পালাল। শশিবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন, পুরুষ মানুষ হলে আমিই না হয় সামলে দিতাম, কিন্তু মেয়েছেলেকে। চান করানো কাপড় ছাড়ানো…এটা ওটা, আমিই বা করি কী করে!

১৯.

আমাদের বস্তি থেকে আমি এক বিধবা বুড়িকে এনে দিয়েছিলাম। বুড়ি আমায় বলল, দিনের বেলা তবু কাটে, রাতে থাকতে পারি না গো। ভয় লাগে। থ্যাঁতলানো টিকটিকির মতন মেয়েটা যখন বুক পেট ঘষড়ে বিছানায় উঠে বসতে যায়, পারে না…মাগো, সে কী দেখায় তখন। চোখে দেখা যায় না। এ কাজ পারবনি করতে।

২০.

 কেষ্টপদ একদিন হেসে হেসে আমায় বলল, আরে তুমিই তো আছ, বিয়ে করে ফেলো না মেয়েটাকে। পাথরের ন্যাংটো চেহারা দেখার চেয়ে এতে অনেক আরাম পাবে। …হাজার হোক মানুষের ধড়টা তো আছে রে, বাবা!

২১.

কেষ্টপদর হাসি আমার ভাল লাগেনি, তার কথা শুনে লোকটাকে চামার বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমি রাজলক্ষ্মীকে বিয়ের কথা ভাবছিলাম। কালো আলপাকার মতন অন্ধকারে চোখ খুলেও সব কিছু ভাবা যায়। ভাবতে ভাবতে আমার মনে হল, পাথরের মূর্তি আর রাজলক্ষ্মীর ধড়ের মধ্যে কোনও তফাত নেই। সুহাসিনীর মত বউ হতে ওরা পারে না।

২২.

একদিন রাজলক্ষ্মীকে কে যে হঠাৎ নিয়ে চলে গেল! কেষ্টপদ বলল, হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেখানেই রেখে দেবে। খাওয়াবে দু-বেলা আর কাটা-ছেঁড়া করবে। …জ্যোতিষী বলল, বয়ে গেছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে…এ সব কার কীর্তি আমি জানি। বেওয়ারিশ মাল, ভাঙা ফুটো যাই হোক হাতের মুঠোয় পেলে কে ছাড়ে রে, বাবা!

২৩.

শশিবাবু এ বাড়িতে আর আসতেন না। শুনলাম, থিয়েটারের সিন আঁকার জন্যে নতুন বাড়ি নিয়েছেন। …আমি মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম, শশিবাবুর আঁকা ভাঙা মন্দিরের মধ্যে একটা মূর্তি হাসি মুখে শুয়ে আছে। মুখটা দেখতে পেতাম না। তবু মনে হত, মুখ আছে, মূর্তি আছে…কারখানা বাড়ির সামনে ন্যাংটো মেয়ের মূর্তিটা আমরা সবাই দেখতে পাই, শশিবাবুর মন্দিরের মধ্যে মূর্তিটাকে দেখতে পাই না।

২৪.

গেঞ্জিল আর আমার ভাল লাগত না। মনে হত, আমার সমস্ত জীবন কাঠিমের সুতোর মতন একঘেয়ে হয়ে এসেছে। আমি ফুরিয়ে এসেছি। সেই কোন সকাল থেকে হেঁটে হেঁটে এখন আমার পা ধরে এসেছে, শরীর ক্লান্ত, আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। থিতিয়ে বসার জন্যে সর্বাঙ্গ ভেঙে যাচ্ছে। বস্তিঘরের ভাঙা খাঁটিয়া চিটচিটে বালিশ একটা লণ্ঠন আর নিজের শরীরের বিশ্রী গন্ধ ছাড়া আমার আর কিছু নেই। …একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে নিজের বুকের ব্যথাটার কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু আমার পাশে কথা শোনার মতন কেউ ছিল না; আর-একদিন বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট থেকে উঠে আসার সময় আকাশ উতলা করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল, আমি বিহ্বল হয়ে চাঁদ দেখবার জন্যে আঙুল তুলে বুঝতে পারলাম, আমার পাশে এমন কেউ নেই যে আমার আঙুলে ভোলা চাঁদ দেখবে।

২৫.

আমাদের ভোলা মুদির দোকানে একটা খাঁচা ঝুলত। খাঁচার মধ্যে মস্ত এক টিয়াপাখি। ভোলার বউ ছেলে বিয়োতে গিয়ে মরে যাবার পর ভোলা একদিন সকাল থেকে পাখিটাকে খোঁচাতে লাগল। সারাটা দিন খোঁচাল। সন্ধের আগে পাখিটা মরে গেল।

২৬.

 গেঞ্জিকলের মালিক খাঁ বাবুর শালার সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা ছিল না। একদিন লোকটা কারখানায় এসে কী কথায় যেন হাসতে শুরু করল। আমার দিকে চেয়েই হাসছিল। আমার ভাল লাগছিল না। রাগ হচ্ছিল, ঘেন্না হচ্ছিল। খাঁ বাবুর শালার বাঁধানো দাঁতের পাটি হাসির তোড়ে খুলে গেল। সমস্ত মুখটা হঠাৎ যেন চুপসে গেল লোকটার, গাল ভেঙে গেল। শেয়ালের মতন দেখাচ্ছিল ওকে। দাঁতের পাটি কুড়িয়ে নেবার সময় খাঁ বাবুর শালার ভুড়ি থেকে কাপড়টা আলগা হয়ে খসে গেল। লোকটা নকল দাঁত, খোলা পাছা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কী জানি কেন, লোকটাকে আমার মারতে ইচ্ছে করছিল। কাপড় সামলে উঠেও যদি আবার কষে হাসতে শুরু করত, আমি ঠিক ওকে মারতাম। মাথায় তখন রক্ত চড়ে গিয়েছিল আমার। খাঁ বাবুর শালা আর হাসল না। দাঁতের নকল পাটি মুখে ফেলে চলে গেল। পরে শুনলাম, লোকটা ওইরকমই। কাঁদার সময় ও হাসে,কাঁদতে পারেনা; কান্নাটাই ওর হাসি। …কে জানে কেন, খাঁ বাবুর শালা আমার দিকে চেয়ে চেয়ে কাঁদছিল। হয়তো আমাকে দেখে, হয়তো আমায় কিছু মনে করিয়ে দিতে।

২৭.

 সেদিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমিও কেঁদেছিলাম। নিজের চোখের নোনতা জল জিব দিয়ে চেটেছি। বালিশ থেকে মরা মরা গন্ধ উঠছিল। ঘরের মধ্যে অন্ধকারে ইঁদুর ছুটছিল, মুড়ির ঠোঁঙাটা ফুটো হয়ে গেছে বোধহয়। সেই অন্ধকারে কে যেন আমার দিকে চেয়েছিল। হয়তো যশোদা, হয়তো…। ভোররাতে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম না; মনে হল সারারাতের অন্ধকার বস্তির খোলার চালে নিংড়ে দিয়ে আকাশ এবার শুকোতে যাবে। কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। বস্তির নখানা ঘরের দরজা আঁট হয়েছিল। …কয়েক পা এগিয়ে এসেছি কি উত্তর দিকের ঘর খুলে গেল। শব্দ শুনলাম। কাঠের খিল খুলে কে যেন বাইরে এসেছে। চিনতে পারছিলাম না।

২৮.

সদর থেকে পা টিপে টিপে ফিরলাম। খোলা দালানে সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। ওর শাড়ির আঁচল কাঁধের ওপর আলগা হয়ে ঝুলে ছিল, মস্ত গোল খোঁপাটা ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়েছে, পিঠের দিকটা যেন কলাগাছের পাতার মতন বাঁকা। আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে ও হয়তো সকাল বুঝতে চাইছিল। কাক তখন ডেকে উঠেছে। ভোরের ফরসা পা বাড়িয়েছে দালানে। …আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ও আমায় ডাকল। হাত নেড়ে নয়, ডাক দিয়ে নয়, আমার দিকে ফিরে চেয়ে। ওর দুটি চোখ ঠিক যেন ভোরবেলার ঘুমভাঙা এক জোড়া পাখির মতন আমার গায়ে উড়ে এসে বসল। পা-পা করে আমি এগিয়ে গেলাম। কাছে এসে মনে হল, ওর মুখ প্রতিমার চেয়েও সুন্দর, ওর শরীর পেঁজা তুলোর মতো নরম, শিশির ভেজা মাঠের মতন ওর গা থেকে মাটির গন্ধ আসছে। আমি ওকে ছুঁতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই সকালের আলো এসে বস্তির দাওয়া ভরে গেল। আমার মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে আরও কিছু আসবে। মাথার ওপর চোখ তুলে একটুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, মুখ নামিয়ে দেখি, ও চলে গেছে, দাওয়া ফাঁকা।

২৯.

গেঞ্জিকলে সেদিন অযথা ঝগড়া করলাম। কোনও কারণ ছিল না; অযথাই। গেঞ্জিকলের ঘর, কল, কাঠিম, মানুষ জন সবই আমার অসহ্য লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই কারখানার মানুষগুলোকে খেলো রদ্দি সাইজ-মাপা গেঞ্জি করে তোলা হয়। এরা সবাই হাত পা মাথা কাটা ধড়।

৩০.

সেদিন রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম: চারপাশে শুধু গেঞ্জি উড়ছে। মেঘের তলায় এক ফোঁটা জায়গা নেই। ছোট বড় মাঝারি ঢাউস গেঞ্জিতে আকাশ ভরে গেছে।

৩১.

স্বর্ণকে আমি বলেছিলাম, শশিবাবুর কাছে সাকরেদিকরলে আমি থিয়েটারের সিন আঁকতে পারব। স্বর্ণ মাথা নেড়ে বলেছিল, না; তুমি অন্য কিছু করো। .শশিবাবুর ঠিকানা আমি জানতাম না, তবু বলেছিলাম।

৩২.

খুব গরম তখন। স্বর্ণকে বললাম, আমি ঠেলাগাড়ি করে আইসক্রিম বিক্রি করার কাজ পেতে পারি। স্বর্ণ মাথা নাড়ল, বলল, ছিঃ! আইসক্রিম বিক্রি করার ঠেলাগাড়ি কোথায় পাওয়া যায় আমি জানতাম না, তবু স্বর্ণকে বলেছিলাম।

৩৩.

বর্ষা এল। স্বর্ণ বলল, এত লোক এত কাজ পাচ্ছে, তুমি পাচ্ছ না! …আমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে নুটবিহারী সাধুখাঁর ভেজাল তেল আর হুঁকোর তামাকের আড়তে কাজ করছিলাম স্বর্ণ জানত না।

৩৪.

পুজোর আগে আগে স্বর্ণকে বললাম, অঘ্রান মাসের পর আর দেরি সইব না। স্বর্ণ মুখ নিচু করে হাসল। বলল, বিয়ের কথা কেউ কি জোর করে বলতে পারে। কপালে থাকলে অঘ্রানেই হবে।

৩৫.

পুজোর পর সত্যিই আমি কিছু আখের গুছিয়ে নিয়েছিলাম। নুটবিহারী সাধুখাঁর ভেজাল আমার উপকার করেছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আড়তের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতাম। আমার সমস্ত শরীরে তেল ধরে গিয়েছিল, তামাক ঘেঁটে ঘেঁটে হাত কালো হয়ে গিয়েছিল। মালিক আমায় ভীষণ বিশ্বস্ত কর্মচারী মনে করত। আমি পেছোনো কালো হাত দিয়ে আমার মজুরি তুলে নিলাম।

৩৬.

গিলটি সোনার বাহারি দোকান দিয়ে বসলাম খাসা জায়গায়, একবারে মোড়ে। আমার দোকানের চারদিকে চারটে রাস্তা চলে গিয়েছিল। উত্তরে গরিব গেরস্থ পাড়া, পুবে বেশ্যাপটি, দক্ষিণে হিন্দুস্থানি আর উড়ে ঝি-চাকরদের মহল্লা। পশ্চিমের রাস্তাটা বাবুপাড়ার অন্দর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। …গিলটি গহনার দোকানে বসে আমি ভদ্রলোক হয়ে গিয়েছিলাম। কাশীর হোটেলের গাইডগিরি করার সময়ও এতটা ভদ্রলোক ছিলাম না। স্বর্ণ খুব খুশি হয়েছিল। স্বর্ণ ভদ্রলোক হওয়া ভালবাসত, তার বড় সাধ ছিল ভদ্রলোককে বিয়ে করবে।

৩৭.

একদিন আমার গিলটি সোনার দোকানের আয়নায় মাঝদুপুরে যশোদার ছায়া পড়ল। আমি চমকে উঠেছিলাম। মরা মানুষ জ্যান্ত হয় না। কোনও নকল যশোদা এসেছিল–হাত ভরে মিছরি-তোলা চুড়ি পরে চলে গেল। আমি বাজিয়ে বাজিয়ে টাকাগুলো গুণে নেবার সময় বুঝতে পেরেছিলাম আসল-নকল বোঝার ক্ষমতা আমার হয়ে গেছে।

৩৮.

শীত পড়তে স্বর্ণদের বস্তি ছেড়ে আমি উঠে এলাম। দরজিপাড়ার দিকে একখানা ঘর ভাড়া করে বাসা বাঁধলাম। জাম কাঠের তক্তপোশ, নতুন বিছানা, একটা চেয়ার, দেওয়াল-গাঁথা আলনা। স্বর্ণর জন্যে শাড়ি কিনে রাখলাম, চুল বাঁধার আয়না, নিমফলের নকশা করা ভরি দেড়েকের হার। চিনে সিঁদুরও কিনেছিলাম এক পাতা।

৩৯.

পৌষ মাসে স্বর্ণ তার বাবার সঙ্গে দেশে গেল, বারাসতে। বিয়ের আগে দেশ বাড়ি ঘুরে আসতে গেল একবার। মাঘের প্রথমে বিয়ে। স্বর্ণর জন্যে নতুন তুলোর সুন্দর এক লেপ করিয়ে রাখলাম। ওপরের কাপড়টায় মস্ত এক পদ্ম; যেন লাল শালুর পুকুরে পদ্মটা পুরোপুরি ফুটে উঠেছে। আমার মনে হত, পদ্মটা স্বর্ণর মুখ।

৪০.

মাঘ মাস পড়ল। স্বর্ণদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই স্বর্ণর বাবা বলল, এই যে ফটিক, তুমি এসেছ। এসো, ঘরে এসে বসো। ঘরে কোথাও স্বর্ণ ছিল না। স্বর্ণর একটা শাড়ি সায়া মাথার চুলের ফিতে কিচ্ছু । ঘরটা খাঁ খাঁ করছিল। স্বর্ণর বাবা নীলকণ্ঠের দোকান থেকে ছোট ছোট গ্লাসে দু গ্লাস চা নিয়ে এল। আমার দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কড়া শীত হে, নাও গরম গরম খেয়ে নাও। ..স্বর্ণর বাবা বুঝতে পারছিল না, আমার শরীর তার মতন বুড়ো হয়ে যায়নি, আমার রক্ত এই মাঘের শীত পাবে বলে কতদিন ধরে ভেতরে ভেতরে নিজেকে গরম করে নিয়েছে। স্বর্ণর বাবা বুঝতে পারছিল না, আমার তেষ্টা নীলকণ্ঠর দুর্গন্ধ চায়ে মিটবে না। সব তেষ্টা এক রকম নয়।

৪১.

স্বর্ণকে তার বাবা খাঁটি সোনার দোকানের মালিকের হাতেই তুলে গিয়েছে। স্বর্ণ জানে, খাঁটি সোনার মালিক গিলটি সোনার মালিকের চেয়ে অনেক বেশি ভদ্রলোক।

৪২.

সেদিন ভীষণ শীতে পদ্ম আঁকা সেই নরম নতুন তুলোর মধ্যে শুয়ে শুয়ে আমি কারখানা ঘরের ন্যাংটা মেয়েটার কথাই ভাবছিলাম। এই জগৎটাই আজব, পাথর আর মানুষের ধড়ের মধ্যে তফাতটা গায়ে গায়ে, তলায় তলায় নয়। লেপের শালুর পুকুরে ডুবে যেতে যেতে আমার মনে হল, স্বর্ণর চেয়েও সুন্দর মেয়েছেলে বেশ্যাপাড়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো স্বর্ণকেই পাওয়া যেতে পারে। …আমি লেপ ছুঁড়ে ফেলে উঠে বসতে গেলাম। পারলাম না। আমার জ্বর এসেছে। সেই অদ্ভুত পুরনো জ্বর।

.

সাত

০১.

সেবারে শীত ভাঙতে তর সইল না। ফাল্গুন মাসেই রোদ ভীষণ চড়ে উঠল, গরম পড়ল হাঁসফাঁসিয়ে। আমার বাড়ির সামনে হাড়গিলে নোংরা রাস্তাটা চওড়া করা হচ্ছিল। নুড়ি পাথরের ঢিবি জমল চারপাশে, বাতাসে আলকাতরার পোড়া পোড়া গন্ধ, রোলার গাড়ির দশ বিশ মণি পাথরটা সব কিছু পিষে ফেলছে। মরা শুকনো নুলো গাছটাকে ওরা কুপিয়ে কাটল, রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলল।

করপোরেশনের মালটানা লরির ওপর চাপিয়ে যখন পাচার করছে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, মরা কোপানো গাছটার সব চেয়ে পলকা ছোট ভোঁতা ডালে দুটি সবুজ কচি পাতা। খোলা লরিটা চলে যাচ্ছিল, ধড়কাটা মরা গাছটার একটা ডাল মাটিতে লুটিয়ে ঘষটে ঘষটে যাচ্ছে, ধুলো উড়ছে; মনে হচ্ছিল, বুড়ো কঙ্কালসার একটা হাত বাড়িয়ে গাছটা যেন তার পুরনো মাটি আঁকড়ে থাকতে চাইছে প্রাণপণে। কচি সবুজ দুটি পাতার দিকে চেয়ে চেয়ে আমি ভাবছিলাম, গাছটা মরতে চায়নি, অনেক কষ্ট করে অনেক দিন ধরে ওর মরা গায়ে দুটি নতুন পাতা জাগিয়েছিল। কেউ দেখল না।

০২.

গিলটি সোনার দোকানটা বেচতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বেচা হল না। আরও ছটা মাস নকল সোনার কারবার চলল। আস্তে আস্তে আবার মন কখন মুষড়ে পড়ল। কিছু আর ভাল লাগত না, না দোকান না বাসা। কলকাতা শহর আমার ভেতরটা ফাঁপা ভোঁতা করে দিয়েছিল। আমি অন্য কোথাও পালিয়ে যাবার কথা ভাবতাম, কোনও ছোটখাটো মফস্বল শহর কিংবা গাঁ-গ্রামে।

০৩.

একদিন আমি মাঠ, গাছ আর নদীর স্বপ্ন দেখলাম। সে মাঠের শেষ ছিল না, মাঠের পর মাঠ, ধু ধু করছে। কখন যেন সেই মাঠও ফুরিয়ে গেল, তখন শুধু গাছ। কী গাছ কে জানে! গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়েছিল, একটা পাতাও কোথাও কাঁপছিল না। সব কেমন চুপচাপ। তারপর গাছও সরে গেল, তখন নদী। নদী ভরা জল। কল কল করে শুধু জল বইছে।

০৪.

আমার বাসাবাড়ির উলটো দিকে এক অন্ধ ছোকরা থাকত। একদিন মাঝরাতে লোকটা পাগল হয়ে গেল। পাগল হয়ে যাবার আগে সে বারান্দায় এসেভীষণ চেঁচামেচি শুরু করেছিল। আমি তার চেঁচানি শুনেছি। লোকটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে দিচ্ছিল আর বলছিল, তার চোখ খুলে গেছে, সে দেখতে পাচ্ছে।

০৫.

দোকানটা বেচার জন্যে আমি মরীয়া হয়ে উঠেছিলাম। খদ্দের জুটছিল না। একদিন চালু দোকানটার দিকে অনেকেই চোখ দিত, এখন আর কেউ ফিরে তাকায় না। গিলটি সোনার দোকান পুরনো হয়ে বুঝি আসল চেহারা নিয়েছিল: ভাঙা আয়না, কাঁচ-ফাটা শো-কেস, পা-মচকানো চেয়ার, ধুলো-সমস্ত দোকানটাই ম্যাড়ম্যাড় করত। খদ্দের আর বড় একটা আসত না।

০৬.

সেদিন সন্ধের ঝোঁকে এক খদ্দের এসে হাজির। আমার দোকানে ঝকঝকে গয়না একটাও ছিল না। সময়ে পেলে ম্যাড়ম্যাড়ে কালচে গয়নাগুলোতে পালিশ তুলে দিতে পারতাম। লোকটা বসতেও চায় না। বিশ পঁচিশ টাকার বেচা-কেনা বরবাদ হয়ে যায় দেখে আমি বললাম, বাড়ির ঠিকানা দিলে কাল ভোরে পৌঁছে দেব। কী ভেবে লোকটা হঠাৎ বলল, কাল সে আসবে, দুপুরে। …পুরো এক সেট মেয়েদের গয়না বেছে দিয়ে লোকটা চলে গেল। বারোগাছা চুড়ি, হার, আঁটি আর পালিশের মাল মশলা নিয়ে আমি বসে পড়লাম।

০৭.

পরের দিন দুপুরে লোকটা এল না। বিকেল হয়ে গেল, আশা ছেড়ে দিলাম। অযথা কাল রাত পর্যন্ত বসে বসে বোকার মতন অচল গয়নাগুলোর পেছনে খেটেছি। অন্য কোথাও থেকে গয়নাগুলো সে কিনে নিয়েছে। লোকটার ওপর নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। পালিশ করা গয়নাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলাম আর পায়ের শব্দ গুণছিলাম নোকটার, যদি আসে–এসে পড়ে…..

০৮.

লোকটা আর এল না। অথচ ওই রকম বিকেল-ভাঙো-ভাঙো মুখে পরের দিন এক জোড়া মেয়ে দোকানে এসে উঠল। আমার দোকানে তখনও বাতি জ্বলেনি। বাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম। একটি মেয়ের মাথায় ঘোমটা ছিল, সিঁথিতে সিঁদুর ছিল, হাতে শাঁখা, ব্রোঞ্জের পাতলা কলঙ্ক-ওঠা দুগাছা করে চুড়ি, গলায় গিলটির হার। অন্য মেয়েটির গলা খালি, হাতে কাচের লাল চুড়ি কগাছা করে, মাথার বাঁ পাশ ঘেঁষে সাদা সিঁথি। মেয়েটা লাজুক, নিরীহ, তার ফরসা মুখে বসন্তের দাগ। …বউ মেয়েটি গয়না দেখতে চাইল। আইবুড়ো মেয়েটি মাঝে মাঝে আয়নার দিকে তাকাচ্ছিল আর আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে ঘাড় ঘোরাচ্ছিল। ..সদ্য সদ্য পালিশ-তোলা গয়নাগুলো ওদের সামনে ধরে দিলাম। বউ মেয়েটির চোখে লেগে গেল। সঙ্গের মেয়েটির গলায় হারটা পরিয়ে দিয়ে পরখ করে দেখতে লাগল। আমার দিকে ফিরে আচমকা শুধোল, মানিয়েছেনা? আমি দোকানদার, আমার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলা উচিত ছিল, চমৎকার মানিয়েছে; কিন্তু বলতে গিয়েও কথাটা মুখে এল না। মেয়েটির গলা সরু, লম্বা ধরনের অথচ হাড়গিলে নয়, নিটোল; বুকটা রোগাটে হলেও কলাপাতার মতন ছড়ানো। হারটা ওর গলায় ঠিক মানাচ্ছিল না। আমি মাথা নাড়লাম, নিজের লোকসানের কথাটা খচখচ করে উঠছিল, তবু মাথা নেড়ে বললাম, হারটা মানায়নি৷…বউ মেয়েটি যেন আমার সঙ্গে তামাশা করে বলল, যা মানাবে তবে তাই একটা দেখি। .দেখানোর মতন হার আমার দোকানে ছিল না, দোকানের আর সব গয়নাই ম্যাড়ম্যাড় করছে। যে-হারের জলুস নেই সে-হার দেখিয়ে কী করব। …হার বেচার আশা ছেড়ে দিয়ে আমি পালিশ তোলা চুড়িগুলো ওদের দিকে ঠেলে দিলাম। বউ মেয়েটি চুড়ির গোছ মুঠোয় তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল; দেখতে দেখতেই বলল, এ ওর হাতে বড় হবে…দেখ তো, কুমু… মেয়েটির দিকে চুড়ি ঠেলে দিয়ে ও আমার দিকে তাকাল, কই হার কই? ..খোলাখুলি বলতে হল অগত্যা:হার আছে, তবেনষ্ট হয়ে আছে, ভাল লাগবে না দেখতে। …বউ মেয়েটি ঠেটি কেটে হাসল, বলল, হিরে জহরত গিনি সোনার দোকানে এসেছি নাকি, গিলটির আবার ভাল মন্দ, দেখি কী আছে। কুমু চুড়ি দেখছিল, অল্প একটু চোখ তুলে আমায় দেখল।

০৯.

চুড়ির গোছ নিয়ে গেল ওরা। দর দাম করে ছটাকার এক পয়সা বেশি দিল না। পরের দিন হার নিতে আসবে বলে চলে গেল। আমি কথা দিয়েছিলাম পরের দিন কুমুর গলার মানানসই হার এনে রেখে দেব।

১০.

সেই লোকটার মতন কুমুও আসবে না জানতাম। তবু ওর জন্যে হার বেছে পালিশ তুলে রেখেছিলাম। কুমু এল। একা। হারটা ওকে মানিয়েছিল খুব। আয়নায় নিজের গলা দেখে কুমুর চোখে খুশির ফুল ফুটল। ওর সরল সহজ খুশি দেখে আমার মন খুঁত খুঁত করছিল। হারের জলুসটা কদিন পরেই চলে যাবে, তখন তো কুমু হাসবে না। বলি কি নাবলি করে শেষ পর্যন্ত বললাম, পালিশটা বেশি দিন থাকবে না…। কুমু চোখ ফিরিয়ে তাকাল। তার চোখের পাতা ক্ষণে ক্ষণে পড়ে। ছোট ছোট নরম চোখ, যেন ভাল করে তাকাতে কষ্ট পায়। কুমু গলার কাছে হাত তুলে হার ছুঁল, একটু মাথা হেলিয়ে বলল, জানি; আমি বেশি পরব না।

১১.

কুমুর পুরো নাম কুমুদিনী। বউ মেয়েটি ওর বউদি, নাম বিন্দু। সরখেল লেনের গলিতে ওরা থাকে। বাইশ নম্বর বাড়ি। বাড়িটা বোধহয় এক সময় আস্তাবল ছিল। এখন দু পরিবারের। দালানে পুরু শ্যাওলা আর আস্তাকুঁড়। ঘরের ভেতর বাইরে শুধু খামচা খামচা ইট, কালচে রং ধরে গেছে। কুমুদের কুঠরিটা দক্ষিণ কোণে। ঘরের সামনে আধভাঙা একটা কড়িকাঠ মাথার ওপর ঝুলে রয়েছে। কুমুর দাদা অনাদিবাবু পোস্টাফিসে পিয়নের চাকরি করে। বিন্দু ঘরে বসে ডজন দরে বাচ্চাদের ইজের কেটে দেয় দরজিদের। বিন্দুর নিজের দুটো বাচ্চা।

১২.

ওবাড়ির সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিল। বিন্দু বউদি ঠোঁটকাটা কিন্তু বেশ রগুড়ে মানুষ। আমায় বলত, দোকানি ঠাকুরপো৷ বিন্দু বউদিরা ভদ্র ভাল-ঘরের মেয়ে ছিল, অবস্থা পড়ে পড়ে যখন ভিখিরি তখন অনাদিদার সঙ্গে বিয়ে হয়। বিন্দু বউদি বলত, আমার মাথার ওপর চার বোন, বাবা বড় দুজনকে তবু সোনা ছুঁইয়ে বিয়ে দিতে পেরেছিল, আমাদের দুজনের বেলায় শুধু শাঁখা, নয়তো পোস্টাফিসের পিয়নকে বিয়ে করতে বয়ে গেছল আমার! .অনাদিদা কথাগুলো শুনত, মনে হত মনে মনে হাসছে। কিন্তু মুখে একদিনও এক চিলতে হাসি ফুটতে দেখিনি। অনাদিদা বড় ভালমানুষ, বড় ভাল।

১৩.

বিন্দু বউদির মুখেই শুনেছিলুম, কুমুর এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে যায়, অনাদিদার চেনাশোনা ছেলে, পোস্টাফিসের লাল গাড়ি চালাত। বিয়ে করব বলে মত দিয়ে শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসল, মেয়ের মুখে অত খাবলা খাবলা গর্ত, বাড়িতে মত হচ্ছে না। বিন্দু বউদি বলেছিল, বিয়ে লাগবে বলেই না তোমার দোকানে গিয়েছিলাম গো, দোকানি ঠাকুরপো, ওই একটু গলা হাত সাজিয়ে ননদ পার করব, তা সে ভাগ্যে হল না। ..কথাটা শুনে আমি মনমরা হয়ে গিয়েছিলাম।

১৪.

কুমু গিলটির চুড়ি হার পরত না। তার ভাঙা বাক্সে তুলে রেখে দিয়েছিল বোধহয়। তার হাতে কাচের লাল চুড়ি থাকত দুগাছা করে।

১৫.

দোকানটা সেবারে শীতের সময় বেচে দিলাম। বিন্দু বউদি শুনে বলল, আহা-হা করলে কী ঠাকুরপো, তোমার মাথায় কি ভূত চেপেছিল…দোকানটা বেচে দিলে? অনাদিদা ছেলেকে ভাঙা শ্লেটে অঙ্ক শেখাচ্ছিল, বলল, তোমরা ছেলে-ছোকরারা সব রকম ভেবেচিন্তে কাজ করো না। …বেশ তো, গয়নার দোকান চলছিল না–ওখানে একটা চুল কাটার সেলুন করলে পারতে। …কলকাতার অলিতে-গলিতে আজকাল নানান রকমের চুল কাটার সেলুন হচ্ছে, খুব চালু ব্যবসা…চুল না কেটে দাড়ি গোঁফ না কামিয়ে পুরুষ মানুষের চলে না। বিন্দু বউদি স্বামীকে ধমক দিয়ে বলল, অত বুদ্ধি তো নিজেই কেন চিঠির থলির সঙ্গে নাপিতদের মতন একটা বাক্স আর এক শিশি জল নিয়ে বেরোও না, তবু কিছু আয় হয়।

১৬.

কুমু কিছু বলল না। কলাইয়ের বাটিতে করে যখন চা দিচ্ছিল কুমু, তার চোখের দিকে ঠাওর করে চেয়ে থাকলাম। মনে হল, দোকানে হার পরার পর আমার কথা শুনে যে ভাবে চোখ তুলে তাকিয়ে বলেছিল, জানি–ঠিক সেই ভাবে যেন চোখ দিয়ে বলেছে, দোকান তুমি বেচে দেবে আমি জানি।

১৭.

বিন্দু বউদি দিন কয় পরে পরে একদিন শুধোল, কী করবে এবার তুমি, ঠাকুরপো? কী করব জানতাম না, আমি ভেবেও ঠিক করতে পারি না কিছু। বললাম, কলকাতায় আর থাকব না। বিন্দু বউদি আকাশ থেকে পড়ল যেন, অবাক হয়ে শুধোল, তোমার কি বাড়ি আছে? একটু বুঝি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, তারপর সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, আছে। বিন্দু বউদি শুধোল, কোথায়? …কোথায়? কোথায় আমার দেশ বাড়ি? কোন নামটা বলব? আমার ছোটবেলার শহরের নাম বলতে পারি, ময়না আমায় ঠাঁই দিয়েছিল যেখানে সেখানকার কথাও বলতে পারি, সেই শহরটার কথা, কলমিদের গাঁয়ের নাম, যশোদার বাড়ি ছিল যেখানে সেই জায়গাটার নাম আমি আরও অগুনতি নামের যে কোনও একটার কথা বলতে পারি। বিড়ি ধরাবার অছিলায় খানিকটা সময় নিয়ে বললাম, কাশী, কাশীতে মাথা গোঁজার মতন একটা জায়গা আছে। কথাটা বলে আমি এমন হাসি হাসি মুখ করলাম, যেন কত বিনয় করে বলেছি কথাটা। বিন্দু বউদির চোখের পলক পড়ছিল না। কাশী নামটা কানেই শুনেছে বউদি, দেখেনি কোনওদিন। আমি কাশীর লোক জেনে চোখ ভরে আমায় দেখল; শেষে মনভরা গলায় বলল, তোমার মা বাবা বুঝি কাশীতেই থাকেন? বিড়িতে জোর এক টান দিয়ে কাশতে কাশতে বললাম, হ্যাঁ, সবাই কাশীতে।

১৮.

আমারই দোকানের সেই পুরনো গিলটি গয়না কুমুর গলায় হাতে পরিয়ে দিয়ে বিন্দু বউদিরা আমার সঙ্গে কুমুর বিয়ে দিল। সেটা মাঘ মাস। বিয়ের দিন খুব শীত পড়েছিল। স্বর্ণর জন্যে তৈরি করানো লেপটা দিয়ে পরের দিন কুমুকে ঢেকে দিয়েছিলাম। লেপটা ময়লা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু লাল শালুর ওপর পদ্মফুলের নকশাটা নষ্ট হয়ে যায়নি। স্বর্ণর শাড়ি কুমুকে দিয়েছিলাম। কুমু জানল ও শাড়ি তার জন্যেই আমি কিনে রেখেছি আগেভাগে। স্বর্ণর হারটা বেচে না দিলে কুমুকেই দিতাম। হারটা অনেক আগেই বেচা হয়ে গিয়েছিল।

১৯.

বিন্দু বউদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেদিন রেলগাড়িতে চাপলাম সেদিন বিন্দু বউদি বলেছিল, মেয়েটা বড় চাপা, ওর মন আর পাথরে চাপা জল দুইই সমান, একটু বুঝেসুঝে তোমার মনের মতন করে নিয়ো; তুমি যে স্বামী।

২০.

কাশীর ট্রেনে চেপে বসলেও আমি কাশী যাচ্ছিলাম না। কোথায় যাচ্ছিলাম, তাও জানি না। কুমু আমার পাশে চুপ করে বসেছিল। আমাদের পায়ের তলায় একটা বাক্স, মাথার ওপর পুঁটলি। বিছানাটা আধ খোলা করে বলেছিলাম দুজনে। রাত্রে গাড়ি ছেড়েছিল, মেল গাড়ি। বাইরে ফ্যাকাশে জ্যোৎস্না। গাড়িটা সিটি মারতে মারতে হাওয়ার বেগে আমাদের কাশীতে নিয়ে যাচ্ছিল।

২১.

কুমু জানলায় মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ঘুমোচ্ছিল বোধহয়। আমার চোখে ঘুম ছিল না। কী করব, কোথায় গিয়ে নামব, কোনখানে গিয়ে উঠব কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। কুমু জানে সে তার স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে, কাশীতে। কী করে কমুকে সত্যি কথাটা বলব তাও ভেবে পাচ্ছিলাম না। কুমু আমায় ঠক ভাববে, কিন্তু কুমু তো বুঝবে না, ওদের না ঠকালে আমি কিছুতেই কুমুকে বিয়ে করতে পারতাম না।

২২.

কী একটা বড় স্টেশনে গাড়ি থামতে কুমুকে ঠেলা দিলাম। কুমু জেগে উঠল। শুধোলাম, চা খাবে? কুমু মাথা নাড়ল। খুরি করে চা নিয়ে কুমুকে দিলাম। ভয়ংকর শীত! চা খেতে খেতে সেই হলুদ আলোয় কুমুকে দেখছিলাম। গাড়িটা ঘুমিয়ে পড়েছে, অসাড় অসাড় ভাব। ছুটন্ত চাকার শব্দ মাঝে মাঝে বাতাসের চাবুকের মতন শোনাচ্ছিল। কে যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেঁপো রুগির মতন কাশছিল। একটা হিন্দুস্থানি বউ তার স্বামীর পায়ের কাছে পুঁটলির মতন পড়েছিল। থেকে থেকে তার স্বামীর পায়ের ঠেলা তার মাথায় মুখে নাকে লাগছিল, বউটা তবু ঘুমোচ্ছিল। …বিড়ি ধরিয়ে টানছিলাম আমি, বন্ধ জানলার কাঁচে জলের দাগের মতন কুমুর ছায়া দেখা যাচ্ছিল, ছায়াটা গাড়ির তালে তালে দুলছিল। মনে হচ্ছিল, কুমুর ছায়াটা কলকাতায় যাচ্ছে, কুমু কাশীতে।

২৩.

শেষরাতে হঠাৎ ঠেলে ঠুলে জাগিয়ে দিলাম কুমুকে। জিনিসপত্র টানাটানি করছি দেখে কুমু শুধোল, কাশী এসে গেছে? কোনও জবাব দিলাম না। কুমুকে নিয়ে নেমে পড়লাম। শীতের শেষরাতের স্টেশন, লোক প্রায় নেই। কনকনে ঠাণ্ডা। হাত পা মুখ জমে যাচ্ছিল শীতে। কুমুঠক ঠক করে কাঁপছিল।

২৪.

মুশাফিরখানায় সবাই তাল পাকিয়ে বাক্স পোঁটলা আগলে ঘুমোচ্ছ। জায়গাটা ঢাকা। বাইরের কনকনানি অতটা নেই। চায়ের দোকানে উনুনটা জ্বলছিল। মাথা কান বেঁধে কম্বলে গা ঢেকে একটা লোক দোকানের টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। …আমরা একটা কোণ বেছে নিয়ে বসলাম। কুমু তখনও কাঁপছিল। আমার গায়ের গরম চাদরটা তার গায়ে জড়িয়ে দিলাম।

২৫.

আগুন গরম চা। কুমুর জিব পুড়ে গেল। আমার খুব আরাম হচ্ছিল। ভোর হয়ে আসছে। বাইরে ফরসা যত বাড়ছিল ততই যেন মাঘের শীত কামড়ে ধরছিল। শীতে না ভয়ে–আমি কেন কাঁপছিলাম কে জানে। ঘুমন্ত লোকগুলো একে একে জেগে উঠছিল।

২৬.

রোদ উঠল। কুমুকে বললাম, আমরা ভুল করে অন্য গাড়িতে উঠেছিলাম। কাশীর গাড়িতে নয়। মাঝপথে টিকিটবাবুরা নামিয়ে দিয়েছে। …কুমু কিছু বলল না।

২৭.

মুশাফিরখানার বাইরে আসতে আমি চমকে উঠলাম। কাল শেষ রাতে শীতে আমি বুঝতে পারিনি, কোথায় এসে নেমেছি। এখন বুঝলাম। এই শহর আমার ছেলেবেলার শহর–এই শহরে চাঁপারানি ছিল, শ্যামলালবাবু ছিল, মুশাফিরখানায় চায়ের দোকানে পার্বতী ছিল। স্টেশনের ভেতরে বাইরে এত বদলে গেছে যে চেনার কোনও উপায় ছিল না। …কুমুকে বললাম এখানে একটা দিন থেকে যাই, কাল আবার কাশীর গাড়ি ধরব। …কুমু কিছু বলল না।

২৮.

শহরটা বদলে গেছে। চাঁপারানিদের বাড়ির সেই গলিটা আছে, বাড়ি নেই। কালাচাঁদের হোটেল কবে উঠে গেছে। চাবাবুর দোকানটা খুঁজে পেলাম না। মাড়োয়ারিদের ধর্মশালাটা ছিল। সেখানেই উঠলাম।

২৯.

ধর্মশালার ঘরটায় জানলা ছিল না। দরজাটা নড়বড়ে। রাত্রে মোমবাতি জ্বালিয়ে কুমুর মুখোমুখি বসেছিলাম। আজ আর কুমু কাঁপছিল না। বিছানার ওপর পায়ে লেপ চাপা দিয়ে বসেছিল। শালপাতার এঁটো ঠোঙা পড়ে আছে এক দিকে, জলের কুঁজোটার মুণ্ড ভেঙে গেছে। একটা পোকা ফর ফর করে উড়ছিল। কুমুর মুখের বসন্তের দাগগুলো চন্দনের শুকনো ফোঁটার মতন দেখাচ্ছিল। ওর হাতে সেই চুড়ি সেই হার। মাথায় খোঁপা ছিল না। …আমার মন খুশিতে আনন্দে ভরে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, কুমুর সঙ্গে আমার কত কাল আগে যেন বিয়ে হয়েছে।

৩০.

আমার কথা কুমুকে বললাম। কুমু শুনল। একটিবারের জন্যেও মুখ খুলল না। সব কথা বলা হয়ে গেলে আমার হঠাৎ মনে হল, কাশীর গাড়ি কাশীতে পৌঁছে গেছে। …কুমু আমার দিকে শেষ পর্যন্ত একটুক্ষণ চেয়ে ছিল। তার চোখ বলছিল, জানি, আমি সব জানি।

৩১.

লেপের তলায় কুমুকে আমি দু হাতে এমন করে জড়িয়ে শুয়েছিলাম যে এক সময় আমারই মনে হল, ওকে আমি আগলে রেখেছি প্রাণপণে। হয়তো কুমুর ব্যথা লাগছিল, তবু একটিবারও কুমু নড়ল না, আমার হাত সরিয়ে দিল না। মুখ ফুটে একটুও শব্দ বেরুল না ওর। ও যেন বোবা।

৩২.

কুমুকে আমার বোবাই মনে হত। আমার কোনও কাজে সে হাঁনা করত না। …বাজারের মধ্যে সেই চাঁপারানিদের গলির কাছাকাছি একটা এক-খুপরির বাসা ভাড়া করেছিলাম, সবজিবাজারে আলুর দোকান দিয়ে বসেছিলাম। কুমু কিছু বলত না। কুমু সারাদিন কাজ করত, ঘর ঝাঁট দিত, কয়লা ভাঙত, উনুন ধরাত, রান্না করত, বাসন মাজত আর রাত্রে বিছানা পাতত শোবার।

৩৩.

গরম পড়তে আলু পচতে শুরু করল। আমার বাসা-ঘরের মেঝেতে কুমু বস্তা থেকে আলু ঢেলে ছড়িয়ে রাখত, পচা আলু আলাদা করত। সমস্ত ঘরটা পচা আলুর গন্ধে ভেপসে থাকত। রাতে শুয়ে শুয়ে মনে হত আমি কুমু আমরাও একদিন পচে যাব।

৩৪.

একদিন কুমু ভীষণ বমি করতে শুরু করল। তারপর থেকে প্রায় রোজই খাওয়ার পর কুমু নর্দমার কাছে ছুটে যেতবমি করত।

৩৫.

কুমুর চেহারাটা বর্ষার জলে হঠাৎ কেমন সুন্দর হতে শুরু করল। মুখ ভরে গেল, গা ভরে গেল, পা হাত ফরসা হয়ে উঠল। কুমুর চোখের নীচে একটু কালি কালি দাগ ধরল, বুক পুরন্ত হয়ে উঠল।

৩৬.

পুজোর সময় কুমুকে সুন্দর শাড়ি জামা কিনে দিয়েছিলাম, ওকে নিয়ে ঠাকুর দেখিয়ে বেড়াতাম। বেশি হাঁটতে পারত না কুমু। ওর কষ্ট হত। মুখ ফুটে তবু বলত না।

৩৭.

একদিন বাজার থেকে দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি কুমু কার্তিকের রোদে দাওয়ায় বসে আছে। তার পায়ের কাছে পেটমোটা একটা বেড়াল। কুমুর পা আঁচড়াচ্ছিল বেড়ালটা। আমায় দেখে কুমু বেড়ালটাকে হাতে করে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কুমুর হাতে শাঁখা আর কাচের চুড়ি।

৩৮.

সবজিবাজারে আমার আলুর ব্যবসা ফেঁপে উঠছিল। আমি ভাবছিলাম বাজারে দোকান পেতে না বসে আলু চালান আর আড়ত নিয়ে বসবা…কুমুর পয়ে আমার ভাগ্য পালটে যাচ্ছে। কুমুর পেটে যে আসছে তার পয়ে। কুমুকে আমার আরও ভালবাসতে ইচ্ছে করত।

৩৯.

কুমু ভালবাসা বোঝে কি বোঝে না আমি ভেবে পেতাম না। ওর খুশি বলে কিছু দেখিনি, আহ্লাদ বলে মুখে কিছু ফুটত না। সমস্ত মুখটা কাঁচড়ার পুতুলের মতন। হাসি না, কান্না না, কথা না। বিন্দু বউদির কথা মনে হত: ও বড় চাপা মেয়ে, সহজে মন বোঝা যায় না; পাথর চাপা জলের মতন। …কুমুর মন আমি সত্যিই বুঝতে পারতাম না। মনে হত, ওর মন নেই; কিংবা মনটাও মুখের মতন বোবা।

৪০.

তখন পৌষ মাস। একদিন সকালে কুমু কাঁদছিল। ঘুম ভাঙলে উঠে বসে দেখলাম কুমু মুখে কাপড় পুরে কাঁদছে। তার মুখ যন্ত্রণায় নীলচে হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল ওর সমস্ত মুখটায় বুঝি এখুনি কালশিরে পড়ে যাবে। ..পাশের বাসার বউ বলল, প্রসব ব্যথা। আমি দাই ডাকতে লালাবাবুর কুঠির দিকে ছুটলাম। মন্দা দাই ছিল না। কে যেন বললে, কাঠগোলার দিকে দাই মাসি আছে, খুব ভাল, তাকে নিয়ে যাও।

৪১.

কাঠগোলার কাছে একটা কুয়ো। মুখোমুখি দাই মাসির বাড়ি। ডাগর মতন ফরসা একটা মেয়ে কুয়ো থেকে জল তুলছিল। চাকার শব্দ হচ্ছিল। দাই মাসির দরজা হাট করে খোলা। ডাকাডাকি করতে মেয়েটাই এগিয়ে এল। বলল, তার মা এখনও ঘুমোচ্ছ।

৪২.

ঘুম ভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে যে এল তাকে দেখে আমি চিনতে পারলাম। চমকে উঠলাম। মুখ থেকে কথা খসছিল না। চাঁপারানি–সেই চাঁপারানি, আমি যাকে ছেলেবেলায় মনে মনে মা বলতাম। চাঁপারানি আমায় চিনতে পারল না।

৪৩.

কুমু সারাটা বেলা কাটা কই মাছের মতো ছটফট করল, কাতরাল, কাঁদল। বিকেল নাগাদ তার ছেলে হল। চাঁপারানির পায়ে আমার গড় হয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছিল।

৪৪.

ছেলেটার চোখ হল না। সবাই বলল, ফুটবে–পাতা জুড়ে আছে তাই অমন জোড়া জোড়া দেখায়।

৪৫.

ছেলেটার গায়ের নীলচে ভাবটা গেল না। সবাই বলত মায়ের নাড়ি ময়লা ছিল তাই অমন হয়েছে, আর একটু বড় হলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

৪৬.

ছেলেটার গা ভর্তি লোম, মাথাটা বড়, ঠ্যাংগুলো বাঁকা বাঁকা।

৪৭.

কুমু জীবনে এক দিনই কেঁদেছিল–সেই প্রসবের দিন; আর কাঁদত না। কাঁদত না, হাসত না, কিছু বলত না। ছেলেকে কোলে করে বসে থাকার সময় তার চোখ ছেলেটাকে এক নজরে দেখত, আর দৃষ্টিটা যেন বলত, এমন হবে আমি জানতাম।

৪৮.

আমার অসহ্য লাগত। অন্ধ, ময়লা, লোমওলা, কদাকার ওই ছেলেটাকে দেখলে সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করতে উঠত। মানুষ না বাঁদর কীসের বাচ্চা ওটা বুঝতে পারতাম না। রাগে যন্ত্রণায় ছটফট করতাম, কুমুকে গালাগাল দিতাম। ওর নাড়িতে এত ময়লা কেন ছিল! কেন! একদিন কুমুকে মেরেছিলাম। কুমু আমার ভাত খাওয়ার সময় বাচ্চাটাকে কোলে করে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল; বাচ্চাটা কাকের ছানার মন চেঁচাচ্ছিল।

৪৯.

আস্তে আস্তে বাসায় আসা আমার বন্ধ হয়ে গেল প্রায়। দুপুরে ভাত খেতে আসতাম একবার। রাত্রে আসতাম না প্রায় দিনই, কোনও কোনওদিন আসতাম, গলা পর্যন্ত মদ গিলে। কুমুকে কুমুর বাচ্চাকে নেশার চোখে দেখতে পেতাম না, বাচ্চার কান্নাটা আমার সেই মরা ঘুম ভাঙাতে পারত না।

৫০.

জগতে হাজার হাজার মানুষের ছেলে জন্মায় মানুষের মতো চেহারা নিয়ে, আমার ছেলে কেন অমন হল? আমি হাজার ভেবেও বুঝতে পারতাম না, কুমুর পেটে একটা জানোয়ার কী করে এল, কুমুর নাড়িকে কে ময়লা করল!

৫১.একদিন জানোয়ারটার মুখে কথা ফুটল। কুমুকে জড়ানো স্বরে মা মা বলছিল। তখন বাইরে ভয়ংকর বৃষ্টি। আমি ঘরে আটকা পড়ে বসেছিলাম। ঘরের চৌকাঠের কাছে কাত হয়ে পড়েছিল ছেলেটা। ওটা ঠিক মতন বসতে পারে না, অপলকা পায়ে দাঁড়াতেও পারে না। জন্তুর মতন মেঝেতে পড়ে পড়ে ছেলেটা মা মা করছিল। …আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল, ছেলেটার গলা টিপে মেরে ফেলি। কুমু বাসন মাজতে বসেছে, বাইরে তুমুল বৃষ্টি, কেউ কিছু জানতে পারবে না।

৫২.

কুমুর ছেলের জ্বর হল ধ্ব। আমি বাসায় থাকতাম না। বাজারের মানিকলাল আমায় একটা আস্তানা জোগাড় করে দিয়েছিল। কালী মন্দিরের গলিতে সেই আস্তানায় আমি ভূতের মতন বেঁচেছিলাম। সকালে উঠে বাজারে আলুর আড়তে যেতাম, দুপুরে জগুবাবুর হোটেলে ভাত খেতাম, বিকেলে আড়তের দরজায় তালা ঝুলিয়ে খাঁ খাঁমনে এদিকে সেদিকে ঘুরতাম, চা বিড়ি পান খেতাম, সন্ধের ঝোঁকে মনে হত আমার মেরুদণ্ডের তলা থেকে একটা ব্যথা বিষফোঁড়ার মন তর তর করে পেকে ফুলে চড়িয়ে যাচ্ছে। মাথাটা জ্বরো রুগির মক্স গরম ভার হয়ে আসত, ঘাড়ের কাছটায় অসহ্য ব্যথা, চোখ কান জ্বলে যেত। বুকের মধ্যে একটা হাত যেন ক্রমাগত কী একটা খুঁজে পাবার জন্যে হাতড়ে বেড়াত। …আমি কালী মন্দিরের গলিতে ফিরে আসতাম। কৌশল্যা আমার খাঁটিয়া পেতে দিত, ধেনো মদের বোতল পেড়ে দিত কুলুঙ্গি থেকে। সারাটা রাত মদ আর কৌশল্যার গায়ের টক টক কেমন এক গন্ধের মধ্যে আমি ডুবন্ত মানুষের মন হাঁসফাঁস করে মরতাম।

৫৩.

বাজারে আলুর আড়তে খবর পাঠাল কুমু। ছেলেটা মরে যাচ্ছে।

৫৪.

আমাদের বাজারে এক পাগলি জুটেছিল। তার সারা গায়ে ঘা। পাগলি একটা ভাঙা হাঁড়ির মধ্যে এক গণ্ডা কুকুর ছানা নিয়ে বসে থাকত, আর থেকে থেকে সব কটা বাচ্চাকে এক সঙ্গে হাঁড়ি চাপা দিয়ে বলত, চারটে পয়সা দিলে কুকুরগুলোকে সে পায়রা করে আকাশে উড়িয়ে দেবার খেলা দেখাবে। আমি জানতাম, এ হয় না; এ রকম ভেলকি হবার নয়, তবু তাকে চারটে পয়সা দিয়েছিলাম।

৫৫.

কুমু আমায় আর ডেকে পাঠায়নি, তবু একদিন সাঁঝে বাসায় গেলাম। কুমু দাওয়ায় বসে তার ছেলেকে দুধ দিচ্ছিল। আমার সারা গা ঘিন ঘিন করে উঠল। কুমুর শরীরের ভেতরটাও নোংরা হয়ে যাচ্ছে। কুমু আমার দিকে চোখ তুলে চাইল। তার দু-চোখ গর্তে ঢুকেছে, কালো হয়ে গেছে চোখের চারপাশ, মাথার চুল রুক্ষ, গায়ের শাড়িটা চিটচিটে ময়লা। …কুমুকে বললাম, ছেলে ফেলে রেখে ভাল করে চান করে আসতে। কুমু গ্রাহ্য করল না।

৫৬.

এই ভাবে নোংরা হয়ে তুমি কত দিন বসে আছ? কুমুকে চোয়াড়ের মতন শুধোলাম। কুমু জবাব দিল না।

৫৭.

তোমার ঘেন্না করে না, সারাদিন এই নোংরা কোলে নিয়ে বসে থাকতে, ঘেন্না করে না? আমি বেপরোয়া গলায় চিৎকার করে উঠলাম। কুমু চমকাল না, ভয় পেল না, জবাব দিল না।

৫৮.

ওই জন্তুটাকে মেরে ফেলল। ওটাকে কোলে পিঠে বুকে করে বয়ে বেড়িয়ে লাভ কী তোমার! সারা জীবন ওকে নিয়ে বাঁচতে পারবে না। কুমুকে ভাল কথাটা বোঝাতে গেলাম। কুমু বুঝল কি না কে জানে। ছেলেটাকে মাদুরে শুইয়ে লণ্ঠন ধরাতে গেল। ঘর অন্ধকার। ছেলেটা চৌকাঠের পাশেই শুয়ে ছিল। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হল চৌকাঠের পাশে অন্ধকারে আমার পা কেউ টেনে নিচ্ছে..ঠিক তখন লণ্ঠন হাতে কুমু এল। কুমুর হাতে লণ্ঠন, আমার ছায়াটা কেমন যেন দুলে নেচে ভেঙে ছোট্ট হয়ে ছেলেটার গায়ে পড়ল। লণ্ঠন নামিয়ে রেখে কুমু আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, আমি তার হাত ধরে ফেললাম। ঝটকা মেরে কাছে টানতেই লণ্ঠনের আলোটা আড়াল পড়ে গেল। আর অন্ধকার আচমকা এমন ভাবে কুমুর গায়ে মুখে ছড়িয়ে পড়ল যে আমার মনে হল, কুমুই আমার ছায়া হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মাঘের শীত হঠাৎ আমার গায়ে কনকনিয়ে উঠল, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।

৫৯.

কুমু বলল, জানি সব জানি। .এই গলার স্বর ঠিক সেদিনের মন, অবিকল সেই সুর। দোকানে আমার গিলটির হার গলায় পরার পর আমি বলেছিলাম ওর পালিশ থাকবে না। কুমু বলেছিল, জানি সব জানি। …হঠাৎ আমার মনে হল, কুমু আমার সব জানত, আমার সমস্ত কুমু আমার সব জানে, সব জানবে।

৬০.

হাত ছেড়ে মাটির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, আমার ছায়া কুমুর গায়ে আড়াল হয়ে আছে কুমুর ছায়াটাই মাটিতে ছড়ানো। মনে হচ্ছিল, আমার আর ছায়া নেই কুমুই আমার ছায়া। আর সেই ছায়ার ওপর ছেলেটা শুয়ে আছে।

৬১.

ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পালাতে গিয়ে লণ্ঠনটা পায়ে লেগে ছিটকে পড়ল। কাঁচ ভাঙল, কেরাসিনের গন্ধ উঠল ধক করে, ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাইরে এসে দেখি আকাশটা কেমন লালচে। হয়তো ঝড় উঠবে, হয়তো কোথাও আগুন লেগেছে।

৬২.

ঘুরে ঘুরে ছুটে ছুটে কখন যেন আর পা চলল না, ঠাণ্ডায় হিমে শীতে সমস্ত শরীর অসাড়, একটু আগুনের আশায় গরমের লোভে স্টেশনে এলাম। চায়ের দোকানের উনুনটা নিবে গেছে। লোকগুলো পুঁটলির মতন হাত পা গুটিয়ে মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছ। …কলকাতার গাড়ি এসে চলে গেল, মাঝরাতে কাশীর গাড়ি এসে উলটো দিকে চলে গেল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, যে কোনও গাড়িতে গিয়ে উঠে বসি। উঠতে পারছিলাম না। ভীষণ জ্বর এসে গিয়েছিল।

৬৩.

শেষরাতে বুঝি গাড়িতে উঠে বসেছি। গাড়ি ছাড়ল। কোথাকার গাড়ি কোথায় যাচ্ছে কিছু জানি না। হুঁশ নেই। চাকার শব্দের সঙ্গে কুমুকাঁদছিল। ছেলেটা চেঁচাচ্ছিল। …কে জানত, আমার সমস্ত ময়লা আমি কুমুকে মাখিয়েছি, কে ভেবেছিল কুমুর নাড়িতেও সেই ময়লা পুরু হয়ে জমে থাকবে। আমায় কেউ মুক্ত করেনি।

৬৪.

ঘুম ভাঙলে দেখলাম, আমি স্টেশনের মুশাফিরখানায় শুয়ে আছি। ঝাড়ুদারের ঝেটা জঞ্জাল সাফ করছে। এটো পাতা বিড়ির টুকরো আমার মুখে এসে পড়ছে। …উঠে বসলাম। গায়ে জ্বর। পা টলছিল। …বাইরে এসে দেখি শীতের রোদ উথলে পড়ছে।

৬৫.

বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। জ্বর, না জ্বালা,না কি আর কিছুতে কে জানে আমার পিঠে যেন একটা কুঁজের মতন কী উঁচু হয়ে আছে।

৬৬.

হয়তো আমার কুঁজ হচ্ছিল।

৬৭.

কুমু ছেলে কোলে দাওয়ায় বসেছিল। পায়ের কাছে কাঠের গুঁড়ো ভরা কাপড়ের ছোট্ট পাখি। সদরের দরজাটা আমি বন্ধ করে দিলাম। খিল তুলে দিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *