অতঃপর ঘোর সর্পিল সুড়ঙ্গে
০১.
এক এই যখন জীবনানন্দের মনের অবস্থা, তখন দিল্লির ঠিকানায় একদিন মা কুসুমকুমারীর একটা চিঠি এল। চিঠিতে এক আচমকা খবর। মা লিখেছেন, চাকরি বাকরি তো হলো এবার তোর বিয়ে করা দরকার। আরও লিখেছেন, ঢাকায় তারা একজন মেয়ে দেখেছেন তার জন্য, তাদের পছন্দ হয়েছে। ঢাকা ব্রাহ্মমন্দিরের আচার্য অমৃতলাল গুপ্তের ভাইয়ের মেয়ে, পড়ে ইডেনে, নাম লাবণ্য। মা লিখেছেন, জীবনানন্দ যেন একবার ঢাকায় এসে মেয়েটাকে দেখে যান, তাঁর পছন্দ হলেই তারা বিয়ের আলাপ পাকা করবেন। লাবণ্যর একটা ছবিও পাঠিয়ে দিয়েছেন কুসুমকুমারী।
লাবণ্যর ছবিটা উল্টেপাল্টে দেখেন জীবনানন্দ। মেয়েটা অপূর্ব রূপসী নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই অচেনা রূপসীকে নিয়ে কী করবেন তিনি? এক চেনা রূপসী যে তাঁর মন দখল করে আছে, সে কথাও বা মাকে বলবেন কী করে? কিন্তু ওই চেনা রূপসীর নাগাল পাওয়াও যে অসম্ভব, সেটাও টের পেয়েছেন ইতিমধ্যে। দ্বিধায় জর্জরিত রইলেন জীবনানন্দ। মনের ভেতর চলল দোলাচল। ভেবে ভেবে একসময় তাঁর মনে হলো, বৃথা কেনই-বা তিনি শোভনার জন্য অপেক্ষা করবেন। সেখানে কোনো সম্ভাবনা তো অবশিষ্ট নেই। কেনই-বা তিনি এই নতুন সম্ভাবনাকে যাচাই করে দেখবেন না? লাবণ্যকে এক অজানা নতুন জীবনের ইঙ্গিত বলে মনে হলো তাঁর। এই ভাবনা মনকে চঞ্চল করল। জীবনানন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকা যাবেন, পরিচিত হবেন লাবণ্যর সাথে।
রামযশ কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে বরিশাল হয়ে জীবনানন্দ চলে গেলেন ঢাকার ব্রাহ্মমন্দিরের আচার্য অমৃতলালের বাড়িতে। মায়ের কাছ থেকে ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন যে অমৃতলালের ভাই রোহিনীকুমার এবং তাঁর স্ত্রী সরযু বালা অল্প সময়ের ব্যবধানে অকালে মারা গেলে তাদের মেয়ে লাবণ্যকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন অমৃতলাল। লাবণ্য পাটনা থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকার ইডেন কলেজে এসে ভর্তি হয়েছেন তখন। কাকা অমৃতলালই লাবণ্যর অভিভাবক। জীবনানন্দ যখন অমৃতলালের বাড়িতে গেলেন, তখন পরীক্ষা উপলক্ষে লাবণ্য হোস্টেলে। অমৃতলাল হোস্টেল থেকে জরুরি তলব করে আনলেন লাবণ্যকে। পরদিন লাবণ্যর পরীক্ষা, তা ছাড়া সেদিন সারা সকাল প্রচুর বৃষ্টি হয়ে রাস্তাঘাট কাদাপানিতে ভরা। লাবণ্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাদাপানি ডিঙিয়ে এলেন এবং বিরক্ত হয়ে কাকাকে বললেন, কী এমন জরুরি দরকার পড়ল যে এই সময় ডেকে আনলে?
অমৃতলাল বললেন, বলছি সব। আগে কয়টা লুচি ভেজে একটু বসার ঘরে এসো, একজন অতিথি আছেন। লাবণ্য বাধ্য মেয়ের মতো বেশ কতগুলো লুচি ভেজে প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে গেলেন বসার ঘরে। তার শাড়ি, স্যান্ডেলে তখনো রাস্তার কাদা, আঁচল কোমরে গোঁজা। বসার ঘরে গিয়ে দেখলেন শ্যামলা মতো এক লোক বসে আছেন। অমৃতলাল বসতে বললেন লাবণ্যকে। লাবণ্য বেশ বিরক্ত হয়ে একটা মোড়ার ওপর গিয়ে বসলেন। অমৃতলাল লাবণ্যকে বললেন, তোকে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি জীবনানন্দ দাশ, দিল্লিতে একটি কলেজের অধ্যাপক।
লাবণ্য নমস্কার জানিয়ে বসে রইলেন। লাবণ্য, জীবনানন্দ, অমৃতলাল সবাই চুপচাপ। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ঝুলে রইল তাঁদের মধ্যে। জীবনানন্দ সেখানে গেছেন আবার যেন যাননি। একটা আধাআধি মন নিয়ে বসে ছিলেন। একপর্যায়ে জীবনানন্দ লাবণ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো আইএতে পড়ছেন জানলাম, তো আইএতে কোন কোন সাবজেক্ট নিয়েছেন? লাবণ্য বিরক্তি নিয়েই বললেন, ইকোনমিকস, হিস্ট্রি, ফিলোসফি। জীবনানন্দ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলোর মধ্যে কোন সাবজেক্টটা বেশি ভালো লাগে আপনার? যেন মাস্টার আর ছাত্রীর আলাপ হচ্ছে। অতিথিকে লুচি দিতে এসে এ রকম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে ভাবেননি লাবণ্য। কোনো রকমে বললেন, ইতিহাস, বলেই বসার ঘর থেকে উঠে চলে গেলেন ভেতরে।
অমৃতলাল একটু অপ্রস্তুত হলেন, বললেন : পরীক্ষা চলছে তো তাই একটু উদ্বিগ্ন আছে। লাবণ্যর পড়াশোনার খুব শখ।
জীবনানন্দ: তা তো নিশ্চয়ই। পড়াশোনাটা তো ইমপর্টেন্ট।
লুচি খেতে খেতে দিল্লির জীবন নিয়ে কথাবার্তা বললেন জীবনানন্দ। তারপর বললেন : আজ উঠি।
অমৃতলাল উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন জীবনানন্দের সিদ্ধান্ত জানবার জন্য। সপ্রশ্ন তাকালেন তিনি।
রূপসী বলে সুনাম আছে লাবণ্যর। লাবণ্যর রূপ জীবনানন্দের মনে বিস্ময় জাগায়। যেমন তিনি তাঁর কবিতায় একবার লিখেছেন বনে হরিণীর রূপ দেখে চিতার বুকে জাগে বিস্ময়। জীবনানন্দ বললেন, আমি এ বিয়েতে রাজি।
অমৃতলাল উফুল্ল হয়ে উঠলেন। পরম প্রশ্রয়ে জীবনানন্দের হাত ধরলেন, পিঠে হাত বোলালেন। আবেগাক্রান্ত হয়ে বললেন, আজ আমার খুব আনন্দের দিন, বাবা…।
তার মা এরপর প্রয়োজনীয় আলাপ সারবেন জানিয়ে বিদায় নিলেন জীবনানন্দ।
জীবনানন্দ চলে গেলে অমৃতলাল উত্তেজনায় লাবণ্যকে ডাকতে লাগলেন, লাবণ্য মা, আয় এদিকে, এখানে বস। এবার বল অধ্যাপক ভদ্রলোকটিকে তোর কেমন লাগল?
লাবণ্য অবাক হয়ে বললেন, কেমন লাগল মানে?
অমৃতলাল তখন বিয়ের ব্যাপারটা খোলাসা করলেন।
রেগে গেলেন লাবণ্য, কী বলছ তুমি, কাকু? আমার পরীক্ষা চলছে। আমি এখন এসব নিয়ে একদম কথা বলতে চাই না।
অমৃতলাল, তার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে তোর পড়াশোনার ব্যাপারে তার কোনো রকম আপত্তি থাকবে না।
লাবণ্য আর আলাপ না বাড়িয়ে বলেছেন, আমি হোস্টেলে চললাম, অনেক পড়া বাকি।
ইডেন কলেজের হোস্টেলে বিষণ্ণ লাবণ্যর মনে পড়ে তার মা-বাবার কথা। বিয়ের মতো অত বড় সিদ্ধান্ত নিতে ভয় করে তার। এ-ও টের পান যে পিতৃমাতৃহীন একটি মেয়েকে কাকা আর কতকাল ভরণ-পোষণ দেবেন? কত দিন আর তিনি এভাবে তাঁদের গলগ্রহ হয়ে থাকবেন? তা ছাড়া দিল্লির ওই অধ্যাপক সম্পর্কেও তাঁর কৌতূহল হয়। সে সময়ে মেয়ে দেখার চলতি রেওয়াজ তো ছিল জটিল। মেয়েকে সাজিয়ে-গুজিয়ে আনা হতো পাত্রের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সামনে, তারপর চলত কঠিন সাক্ষাৎকার পর্ব, চলত মেয়ের নানা শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা, মেয়ের হাঁটা কেমন, চুল কেমন ইত্যাদি দেখা। কিন্তু লাবণ্য তো একেবারে সাদামাটা একটা শাড়িতে, তা-ও আবার পাড়ে, স্যান্ডেলে কাদা মাখা অবস্থায় তার মুখোমুখি হয়েছেন। লাবণ্য ভাবলেন, অধ্যাপক সাহেব তো এই দেখেই তাকে পছন্দ করেছেন। লোক তাহলে মন্দ হবেন না বোধ হয়। সব দিক বিবেচনা করে লাবণ্য অমৃতলালকে জানান যে তিনি বিয়েতে রাজি। বিয়ের দিন তারিখ, আয়োজন নিয়ে আলাপ শুরু হলো দুই পরিবারের মধ্যে।
.
০২.
জীবনানন্দ বিয়েতে সম্মতি জানিয়ে দিল্লিতে ফিরলেন। কিন্তু দিল্লির একাকিত্বে ফিরে এসে জীবনানন্দ লক্ষ করলেন, তাঁর মনে আনন্দের চেয়ে বরং শুরু হয়েছে। শঙ্কা, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব। লাবণ্যকে দেখে এসেছেন, এখন সে আর নেহাত ফটোগ্রাফের একটা মুখ নয়, সে এক স্পষ্ট নারী। তাকে বিয়ে করবার সম্মতি জানিয়ে এসেছেন। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, শোভনাকে তিনি বিদায় জানাচ্ছেন চিরতরে। অথচ দিল্লিতে ফিরে দেখতে পেলেন মনের ভেতর বারবার ফিরে আসছে শোভনা। তাকে কিছুতেই মুছতে পারছেন না মন থেকে। মনের ভেতর তার শুরু হয়েছে লাবণ্য আর শোভনার টানাপোড়েন। তাঁর সাংকেতিক ডায়েরিতে ছড়িয়ে আছে সেসব দ্বন্দ্বের চিহ্ন। ১৯৩০-এর সেই সময়ের জীবনানন্দের ডায়েরির কয়েকটা লাইন, Labanya: a dream & a nightmare-BY (full portrait, detailed analysis & all).
লাবণ্যকে তার একাধারে স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। আবার ভাবছেন বেবীর কথা, যাকে তিনি বিওয়াই বলেই সম্বোধন করেন ডায়েরিতে। তাদের দুজনকে নিয়ে মনের ভেতর গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন।
Many disires to BY but checked-tragedy Labanya background. বেবীকে নিয়ে অনেক কামনা-বাসনা জাগছে মনে কিন্তু সেগুলোকে সামলে নিচ্ছেন, কারণ প্রেক্ষাপটে আছে লাবণ্য।
Dreams about Y: how difficult to crush & smother associations and seek an anodyne in L: yet this is what I am to do! এখানে বেবী শুধু Y-তে পরিণত হয়েছে আর লাবণ্য L-এ। ওয়াইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। ভাবছেন ওয়াইয়ের প্রতি এই তীব্র আবেগ ভুলে গিয়ে এলের ভেতর স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা কী ভয়ানক কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে অথচ সে কাজটাই তাঁকে করতে হবে।
জীবনানন্দ তখন একটা প্রবল মানসিক চাপের ভেতর আছেন। রাত জাগছেন নির্ঘুম। একদিন ডায়েরিতে লিখছেন, Back aching after much night through corruption: so a morning! Corruption মাস্টারবেশনের একটা প্রতিশব্দ। জীবনানন্দ তাঁর অন্য আরও বেশ কিছু লেখায় মাস্টারবেশনকে করাপশন হিসেবেই লিখেছেন। ডায়েরির এই এন্ট্রিতে দেখা যাচ্ছে, সারা রাত বেশ কয়বার হস্তমৈথুন করেছেন তিনি। তাতে সকালে পিঠ ব্যথা করছে তার। স্বমেহনের যৌন আনন্দের ভেতর দিয়ে তিনি বুঝি নিজেকে ভারমুক্ত করতে চাচ্ছিলেন তখন।
মানসিক টানাপোড়েনের এ রকম একটা অবস্থাতেই একদিন একটা বেমক্কা কাজ করলেন জীবনানন্দ, গেলেন দিল্লির বেশ্যালয়ে। রামযশ কলেজের তার এক সহকর্মী নিয়ে গেলেন তাঁকে। ওই নিষিদ্ধ পল্লিতে যাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন জীবনানন্দ ডায়েরিতে, Girls here-first impression of brothels-women here: ideas about them: everything-নমস্তে।
বেশ্যালয়ে ঢুকতেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা খদ্দের ধরবার জন্য নমস্তে নমস্তে বলে চলেছে, জীবনানন্দ সেগুলো দেখতে দেখতে চললেন, তাদের নিয়ে নানা কিছু ভাবছেন তিনি। তারপর এভরিথিং। এর অর্থ কী দাঁড়ায়। গণিকালয়ের সব রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর? বলা যাচ্ছে না। তবে একটা দ্বিধান্বিত, বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থায় তিনি বেশ্যালয়ের বিচিত্র উত্তেজনায় কিছুটা সময় কাটিয়েছেন, সেটা জানা যাচ্ছে।
.
০৩.
দিল্লিতে যখন জীবনানন্দ এক অস্থির সময় পার করছেন, লাবণ্য আর শোভনাকে নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছেন, কৌতূহলে একদিন বেশ্যালয়েও পা রাখছেন, তখন বরিশালে চলছে তার বিয়ের আয়োজন। ইতিমধ্যে কুষ্ঠি ইত্যাদি দেখে বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে ৯ মে ১৯৩০। ঠিক হয়েছে বিয়ে হবে ঢাকার ব্রাহ্মমন্দিরে। এর মধ্যে একদিন দিল্লিতে শোভনার চিঠি পেলেন জীবনানন্দ। শোভনা লিখেছেন, তাঁর বিয়েতে আনন্দ করতে তিনি যাচ্ছেন বরিশাল। এই চিঠি পেয়ে একাধারে বেদনা আর কৌতুক বোধ হলো জীবনানন্দের। কী আশ্চর্য মেয়ে এই শোভনা। মানুষের হৃদয় নিয়ে কী অদ্ভুত খেলা খেলতে পারে সে।
জীবনানন্দ রামযশ কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে গেলেন ঢাকায়। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হবে ঢাকায়। বরিশাল থেকে তার বাবা-মা আর বয়োজ্যেষ্ঠরা এলেন। পরিবারের বাইরে আর এলেন তাঁর সাহিত্যজীবনের একমাত্র প্রহরী বুদ্ধদেব বসু, সঙ্গে তার বন্ধু কবি অজিতকুমার দত্তও।
বিয়ের দিনে তোলা জীবনানন্দ ও লাবণ্যর যুগল ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে বেশ নিপাট করে ধুতি, পাঞ্জাবি পরেছেন জীবনানন্দ, গায়ে একটা চাদর জড়িয়েছেন, আঙুলে একটা আংটি। বিয়েতে তখন বরের সোনার বোতাম, ঘড়ি এসব নেওয়ার রেওয়াজ, জীবনানন্দ নেননি। ওই আংটিটা নিয়েছেন। যদিও সেটা নিয়ে পরে অপরাধবোধে ভুগেছেন। ছবিতে জীবনানন্দের পাশে বসা রূপসী লাবণ্য। লাবণ্য উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন ক্যামেরার দিকে। তার চোখে ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন। মনে খানিকটা দ্বিধা নিয়ে স্বপ্ন জীবনানন্দও দেখছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রবাদ আছে, মানুষ স্বপ্ন দেখে আর কোথাও কেউ একজন হাসে।
বিয়ের পর জীবনানন্দ স্টিমারে করে ঢাকা থেকে বরিশাল ফিরলেন নতুন বউ নিয়ে। বরিশালে সর্বানন্দ ভবনে হবে বিবাহ-উত্তর উৎসব। স্টিমারঘাটে বাড়ির সব অনুজ আত্মীয়রা এসেছেন নববধূকে বরণ করে নিতে। জীবনানন্দ দেখলেন সেই আত্মীয়কুলের ভিড়ে আছেন শোভনাও। মিলুদার বিয়েতে আনন্দ করতে আসবেন, এ কথা শোভনা আগেই দিয়েছিলেন। যে নারীর জন্য বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন একদিন, যার ঠোঁটের উষ্ণতা লেগে আছে তার ঠোঁটে, তিনি কিনা ফুলচন্দন দিয়ে বরণ করছেন তার স্ত্রীকে, এই দৃশ্যের বৈপরীত্য বিহ্বল করে রাখে জীবনানন্দকে। কিন্তু তার মনের সেই খবর বিয়েবাড়ির হট্টগোলে কারও টের পাবার কথা নয়। শোভনা কি পেয়েছেন?
নবদম্পতিকে ঘিরে বরিশালের সর্বানন্দ ভবনে আনন্দ উৎসব। ভিড়, হইহুল্লোড়ের ফাঁকে আড়ালে-আবডালে শোভনার সাথে দু-একবার কথা বলেছেন। জীবনানন্দ। শোভনার এত ফুর্তি দেখে যে তিনি বিস্মিত, সে কথা জানিয়েছেন। এভাবে একান্তে কথা বলা যে সমীচীন নয়, শোভনা বলেছেন তাকে। শোভনাবিষয়ক উদ্বেগ মনে চেপে নববিবাহিত বরের ভূমিকা পালন করে গেছেন জীবনানন্দ। আরও অন্যদের সঙ্গে মিলে জীবনানন্দের বাসরঘর সাজিয়ে দিয়েছেন শোভনা। দিনের শেষে অনুজরা সব মিলে তাকে ঠেলে দিয়েছে বাসরঘরে। সেখানে ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসে লাবণ্য। জীবনানন্দ দেখলেন, লাবণ্য ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন, কী হলো?
লাবণ্য বললেন, কিছু না, এমনি। মাকে, বাবাকে মনে পড়ছে খুব।
জীবনানন্দ নীরবে শোনেন লাবণ্যর কথা। মা-বাবাহীন এই অচেনা মেয়েটার জন্য মনে মায়া জাগে তার।
পরিবেশ খানিকটা হালকা করতে জীবনানন্দ বলেন, শুনেছি তুমি গান করো। একটা গান শোনাবে?
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে লাবণ্য বলেন, কোন গান করব?
জীবনানন্দ : রবীন্দ্রনাথের জীবন মরণ সীমানা ছাড়ায়ে গানটা জানো?
লাবণ্য ঘাড় নেড়ে বললেন জানেন। তারপর হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বাসরঘরের বিছানায় বসে মৃদু স্বরে গাইলেন, জীবন মরণ সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে।
লাবণ্য গানটা শেষ করলে জীবনানন্দ বললেন, আরেকবার একটু গাইবে?
লাবণ্য একটু অবাক হলেন। বাসররাতে শুনবার মতো এটা একটা গান? তা ও আবার দুবার? লাবণ্য গানটা গাইলেন আবার।
বিয়ের দিনকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ মনে হলো কেন জীবনানন্দের? সেই জীবন-মৃত্যুর সীমানায় কোন বন্ধুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন তিনি? কার কথা স্মরণ করছেন তিনি?
অবশ্য জীবনানন্দ বলেছেন অন্য কথা। বিয়ের অনেক দিন পেরিয়ে যাবার পর একদিন লাবণ্য জীবনানন্দকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, তুমি প্রথম রাতেই জীবন-মরণের সীমানা ছাড়াতে চেয়েছিলে কেন, বলো তো?
জীবনানন্দ হেসে বললেন, ওই গানটার এ রকম দুটা লাইন আছে না–
আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া
জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত, শোনা উচিত, তাই না?
.
০৪.
পেছনের সবকিছু ভুলে একটা শুভ আরম্ভই করতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ। কিন্তু কিছুদিনের ভেতরেই তাঁর দাম্পত্যে দেখা দিতে লাগল নানা রকম অশুভ সংকেত। বিয়ে উপলক্ষে রামযশ কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিলেন জীবনানন্দ। ছুটি শেষ হয়ে আসছিল। কিন্তু মনটা তখনো দিল্লির সেই অনাত্মীয় পরিবেশে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত নয়। ছুটি বাড়ানোর একটা দরখাস্ত তিনি পাঠিয়ে দিলেন কলেজে। কিন্তু ফিরতি ডাকে পেলেন এক অপ্রত্যাশিত চিঠি। কর্তৃপক্ষ তাঁর ছুটি না বাড়িয়ে তাকে বরং জানিয়ে দিয়েছে যে তার আর কলেজে যোগ দেবার দরকার নেই। জীবনানন্দকে চাকরিচ্যুত করা হলো। কলেজে এমনিতেই জীবনানন্দ অজনপ্রিয় ছিলেন, বিভাগীয় প্রধান সুকুমার দত্তও তার ওপর প্রসন্ন ছিলেন না, ফলে ক্ষেত্র প্রস্তুতই ছিল। তাঁর ছুটির দরখাস্তের সুযোগে জীবনানন্দকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হলো। দ্বিতীয়বার বেকার হলেন জীবনানন্দ।
দিল্লির চাকরিটা তার পছন্দের ছিল না নিঃসন্দেহে, কিন্তু তাই বলে এই মুহূর্তে, বিয়ের ঠিক পরপরই এভাবে চাকরি চলে যাওয়া একটা মারাত্মক বিপর্যয়ের ব্যাপার হলো জীবনানন্দের জন্য। সংসারে টাকাপয়সার টানাটানি সব সময় আছে, তার ওপর ঘরে তাঁর সদ্য বিয়ে করে আনা স্ত্রী। এই অবস্থায় উপার্জনহীন হয়ে থাকা চলে কী করে? খুব নিরালম্ব বোধ করতে লাগলেন জীবনানন্দ। হন্যে হয়ে আবার একটা চাকরি খুঁজতে লাগলেন। পত্রিকা দেখে দরখাস্ত করতে লাগলেন। কিন্তু মাসের পর মাস যায়, চাকরি আর মেলে না। এর আগে একবার এমন একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছেন জীবনানন্দ সিটি কলেজে চাকরিটা হারিয়ে। আবার সেই একই। পরিস্থিতিতে পড়ে খুব নাজেহাল বোধ করতে লাগলেন তিনি।
এদিকে লাবণ্যও ভেঙে পড়েছেন মানসিকভাবে। বিয়ের পরপরই সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে গেছে তাঁর। স্বপ্নভঙ্গ ঘটে গেছে। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে কাকার কাছে বড় হয়েছেন লাবণ্য। সেখানে পেয়েছেন স্নেহ, অবাধ স্বাধীনতা। বিয়ের পর বরিশালের সর্বানন্দ ভবনের বিরাট যৌথ পরিবারের নানা নিয়মকানুনের ভেতর এসে তাঁর মন হাঁসফাঁস করতে লাগল সব সময়। স্বামী জীবনানন্দকে বিয়ে করেছিলেন দিল্লির অধ্যাপক জেনে কিন্তু দেখলেন বিয়ের পরপরই তিনি বেকার। এই যৌথ সংসারে নানা রকম কাব্যজ্ঞানের চর্চার কমতি না হলেও টাকাপয়সার কমতি বরাবর। স্বামীর উপার্জন নেই, ফলে টাকার জন্য তাকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় শ্বশুরবাড়ির অন্য সদস্যদের দিকে। আগে জানতেন না কিন্তু বিয়ের পর এ খোঁজও পেলেন যে তাঁর স্বামী একজন কবি। লাবণ্য সাহিত্য-পৃথিবীর খোঁজ তেমন রাখেন না। জীবনানন্দের কবিতার বই উল্টেপাল্টে দেখেছেন কিন্তু সেসব কবিতা তার কাছে কোনো অর্থ বহন করেনি। লাবণ্য চেয়েছিলেন নেহাত সচ্ছল এক পরিবারের সাধারণ এক স্ত্রী হতে। লাবণ্যর সে প্রত্যাশায় ভাঙন ধরল। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর লাবণ্য দাশ তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, আমি শৈশব কাটিয়েছি ছোটনাগপুরের পার্বত্য অঞ্চল গিরিডিতে। শালবনের আলো-আঁধারিতে ছায়াঘেরা পথে ঘুরে বেরিয়ে বর্ষায় উচ্ছল যৌবনা পাহাড়ী নদী উশ্রীর রুপোলী ধারায় পা ডুবিয়ে এবং ছোট ছোট পাহাড়ের উপর দৌড় ঝাঁপ করেই আমার দিন কেটেছে। বন্ধন কাকে বলে জানতাম না। তাই বরিশালে প্রতি পদে পরাধীনতার শিকল ফাঁস হয়েই আমার গলা আটকে ধরল। টানাটানি করে সে ফাস আগলা করতে গিয়ে চোখের জলেই ভেসেছি কিন্তু তাকে তার জায়গা থেকে একটুও নড়াতে পারিনি।
লাবণ্যর স্মৃতিচারণায় তার নিজের বঞ্চনার কথা যেমন আছে, পাশাপাশি আছে তার আত্মীয়স্বজন, ভাইবোনদের বৈষয়িক নানা সাফল্যের তালিকা। এর ভেতরে কোনো কিছু গুছিয়ে উঠবার আগেই অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভধারণ করলেন লাবণ্য। বছর না ঘুরতেই জন্ম হলো তাঁদের কন্যা মঞ্জুশ্রীর। বিপর্যস্ত সংসারে সন্তান পালনের বিড়ম্বনায় শরীর-মন আরও বিগড়ে গেল লাবণ্যর, মেজাজ খিঁচড়ে থাকতে লাগল তার। সবকিছুর জন্য দোষারোপ করতে লাগলেন জীবনানন্দকে, কাঁদতে লাগলেন সারা দিন। মাঝে মাঝে কথা বন্ধ, খাওয়া বন্ধ করে দরজায় খিল লাগিয়ে বসে থাকতেন। বিয়ের পর লাবণ্যর বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার খোঁজ পাওয়া যায় জীবনানন্দের ডায়েরিতে। বিয়ের বছরখানেক পরের ১৯৩২-এর ডায়েরিতে লিখছেন, The same old rejection কথা বন্ধ…তুমি আমার কি benefit her great concern and solicitous for me step by step brought down to this callous negativity… লাবণ্য জীবনানন্দের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছেন। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে দেখা যাচ্ছে। তাদের সম্পর্ক একটু একটু করে একটা হৃদয়হীন ঘোর নেতিবাচকতায় পৌঁছেছে।
আরেক পৃষ্ঠায় লিখছেন, Our marriage is scram…সারা দিন কাঁদে…আমায় ধুলায় মিশিয়ে দেয়…মুক্তি চায়…উঠে পড়ি…কী করব? আত্মহত্যা? শীতের রাতে অন্ধকার পুকুরে ডুবে মরব?…।
তাঁদের বিয়ে একটা চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে টের পাচ্ছেন জীবনানন্দ। লাবণ্য সারা দিন কাঁদছেন, জীবনানন্দকে অপদস্থ করে ধুলায় মিশিয়ে দিতে চাচ্ছেন, মুক্তি চাচ্ছেন। কীভাবে মুক্তি দেবেন তিনি ভাবছেন। শীতের রাতে অন্ধকারে পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করে কি তাকে মুক্তি দেবেন?
L terrible অবস্থা for 3-4 days দরজা বন্ধ, নাওয়া না, খাওয়া না, শুধু মুড়ি-দিনের পর দিন–কোনো অনুনয়-বিনয় কিছু না…will strave to death…এ বাড়ির সবাই তারপর…ওকে ভূতে পায় নাকি? এখানে L লাবণ্যকেই চিহ্নিত করছে। লাবণ্য তিন-চার দিন ধরে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে ঘরে নিজেকে আটকে রেখেছেন। শুধু মুড়ি খেয়ে থেকেছেন, না খেয়ে মরে যেতে চান। বাড়ির সবাই মিলে বুঝিয়ে তারপর তাকে খাইয়েছে।
বোঝা যায়, নতুন দাম্পত্যে লাবণ্যর একরকম ভূতে পাওয়ার অবস্থাই হয়েছিল। ডাক্তারি ভাষায় হয়তো বলা যেত ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন। দাম্পত্যের শুরুতেই জীবনানন্দ টের পেলেন যে লাবণ্যর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সেতু ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
.
০৫.
জীবনানন্দ তখন বস্তুত এক খাদে পড়ে গেছেন। চাকরিটা চলে গেছে আর বিয়ে ব্যাপারটা এক দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে লেখালেখি। সব মিলিয়ে এমন এক বাজে অবস্থায় পড়বেন, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। এই পর্যায়ে জীবনানন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন বরিশালে আর থাকবেন না, কলকাতায় চলে যাবেন। বরিশালে বসে চাকরি খোঁজাখুঁজি করে লাভ হলো না কোনো। ভাবলেন এবার কলকাতায় গিয়ে চাকরি খুঁজবেন। কলকাতায় গিয়ে একটা মেসে উঠলেন। জোগাড় করলেন একটা টিউশনি। টিউশনির টাকায় খাওয়ার আর মেসের খরচ মেটাতে লাগলেন। সেই সঙ্গে চলল পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে চাকরির দরখাস্ত। এদিকে তার ছোট ভাই অশোকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস করে আবহাওয়া দপ্তরে একটা চাকরি পেয়ে গেলেন। তাঁর পোস্টিং হলো কলকাতার বাইরে। অশোকানন্দ চাকরি পেয়ে টাকা পাঠাতে লাগলেন জীবনানন্দকে, বরিশালে লাবণ্যকে। ছোট ভাইয়ের টাকায় কায়ক্লেশে নিজের সংসার চলছে তখন তাঁর। মনে মনে ভীষণ কুণ্ঠিত হয়ে আছেন তিনি। দরখাস্ত করে কোথাও কোনো চাকরি হচ্ছে না। একটা কাজের চেষ্টায় কলকাতায় দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলেন জীবনানন্দ, নানা রকম ব্যবসার চেষ্টা করতে লাগলেন। এমন ঘোর নাজেহাল অবস্থায় তিনি পড়েননি কোনো দিন জীবনে। কলকাতায় তাঁর ওই মর্মান্তিক বঞ্চনার দিনগুলোর ছবি ফুটে আছে তার ১৯৩১ ৩২ সালের ডায়েরিতে, জীবনানন্দের সেই সংকেতিক ভাষায়, Today: a day much soiled: degraded in soul (I have bowed down before every cat & dog). জানাচ্ছেন দিনটা কেমন মাঠে মারা গেল, অপমানিত লাগছে। জানাচ্ছেন চাকরি খুঁজতে কত কুকুর-বিড়ালের কাছে নতজানু হতে হচ্ছে তাকে।
A unsuccessful man, a failure, an unemployed kicked: Show the least success & you will be fawned. নিজেকে সর্বাংশে ব্যর্থ মনে হচ্ছে তাঁর। বলছেন, একজন বেকারকে সবাই লাথিগুতো দিয়ে তাড়িয়ে দেয়; সাফল্য দেখাও, একমাত্র তখনই লোকে পুছবে তোমাকে।
Ushar ranjan & insurance & business etc. talks and pleasure of খেলা দেখা for me: many things gone out of life. ইনস্যুরেন্সের দালালি করবেন কি না এ নিয়ে কথা হচ্ছে কারও সঙ্গে। আনন্দের ভেতর ছিল সুযোগ পেলে স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখা। টিকিটের পয়সা নেই, ফলে সেসব আনন্দও বাদ দিতে হচ্ছে তাকে। এ রকম আরও কত কিছু তার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, সে কথা ভাবছেন।
ঢ্যাঁড়স sustaining me: The irony & beauty of it. বোর্ডিংয়ে ঢ্যাঁড়স খেয়ে বেঁচে আছেন। উঁড়সের এই কৌতুক আর সৌন্দর্য নিয়ে ভাবছেন।
Heat, little sleep at noon- Tea shop once for all, cant spend more than 3 pice-poverty limiting & crushing the soul down. Thinking of scrapping the newspaper. বোর্ডিংয়ে দুপুরে একটু ঘুমাবেন, গরমে সেটা আর হলো না। চা খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। হাতে তিন পয়সা আছে। মাস চলতে হবে। দারিদ্র্য তাঁকে একেবারে পিষে ফেলছে। মনটাকে একেবারে ছোট করে দিচ্ছে। সংবাদপত্র একটা রাখতেন, সেটাও বাদ দেবেন ভাবছেন।
Both- Business: malacca cane ছাতার ডাঁট, House mortgage etc, Brokerage-Life!
ছাতার বাঁট তৈরির জন্য মোটা বেত লাগে, সেই বেতের ব্যবসার ব্যাপারে কথা হয়েছে কারও সঙ্গে কিংবা বাড়ি মর্টগেজের দালালিও করা যায় কি না এসব ভাবছেন। এই তাহলে জীবন, আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিয়ে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছেন।
Fine clear breezy night with fleecy clouds and moon..And the bogey of no money, no position, no opening or opportunity, no sympathy. ফুরফুরে হাওয়ায় একটা খুব পরিষ্কার রাত, আকাশে চাঁদ আর মেসের বিছানায় শুয়ে নিজেকে মনে হচ্ছে ফালতু এক লোক, যার কোনো টাকা নেই, সমাজে কোনো জায়গা নেই, কোথাও কোনো সুযোগ নেই, সহানুভূতি নেই।
no more than 3 pices & what can 3 pices give you? হাতে শুধু তিন পয়সা আছে। তিন পয়সা দিয়ে কীভাবে চলবে তা-ই ভাবছেন।
Dr. Das. the insane idiot throwing the door in my face-long walk (No bus fare). কোনো এক ডা. দাসের কাছে গিয়েছিলেন হয়তো চাকরির জন্য। সেই ইডিয়টটা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাসভাড়া নেই, হেঁটে হেঁটে মেসে ফিরেছেন।
Kali & গরম জল দিয়ে খাটের ছারপোকা। সস্তা মেসের খাটে রাজ্যের ছারপোকা। কোনো এক কালিকে নিয়ে গরম পানি দিয়ে সেই ছারপোকা। মারছেন তিনি।
….moneylessness, like a dirty wallowing pig. টাকাপয়সা ছাড়া নিজেকে কাদায় পড়ে যাওয়া একটা শুয়োরের মতো মনে হচ্ছে।
To what social position & status have I arrived now?-A PARIAH A man who cant incur debts. Reflect 1 great disability-Like a bankrupt moral and material-a nuisance. ভাবছেন সমাজের কোথায় এসে ঠেকলাম? ব্যর্থ, অথর্ব, নৈতিক, বাস্তবিক সব দিক দিয়ে একটা নুইসেন্সে পরিণত হয়েছেন যেন।
.
মানুষ ভাত খেয়ে বাঁচে না শুধু
০১.
প্রথম বছর কোনো চাকরি মিলল না, ভাবলেন পরের বছর একটা কিছু তো মিলবেই। তাও মিলল না, মিলল না তার পরের বছরও। একদিকে চাকরি নেই, অন্যদিকে সংসারে তীব্র তিক্ততা সব মিলিয়ে এক হৃদয়বিদারক, শ্বাসরোধী পরিস্থিতি তখন তাঁর জীবনের। বছরের পর বছর জীবন-জীবিকার কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলেন না তিনি। একটা ঘোর অসহায়ত্বের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলেন। জীবনের কাছে যেন একটা ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছেন তিনি তখন।
কিন্তু জীবনানন্দ জানেন পৃথিবীতে একটা জায়গা অন্তত তার আছে, যেখানে গেলে তিনি সম্রাট। সেখানে তার কোনো প্রভু নেই, সেখানে জয়-পরাজয়ের মামলা শুধু নিজের সঙ্গে। সেটা লেখার দেশ। সেই ঘোর অসহায়ত্বের ভেতর বেঁচে উঠবার জন্য, বেঁচে থাকবার জন্য তিনি আবার লেখায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কিন্তু কী লিখবেন? কবিতা যা লিখেছেন তা সাগ্রহে ছাপিয়েছে প্রগতি পত্রিকা। কিন্তু আশ্চর্য পরিহাস, তাঁর বিয়ের ঠিক পরপরই বন্ধ হয়ে গেল বুদ্ধদেব বসুর প্রগতি পত্রিকা। তার কিছুদিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে আধুনিক কবিতার আরেক পত্রিকা কালি কলম। যেসব পত্রিকা তাঁর কবিতা ছাপাত, সেগুলোর দরজা তখন বন্ধ। এই রকম সময় জীবনানন্দ অভিনব এক সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি যা কোনো দিন লেখেননি, তা লেখা শুরু করলেন। জীবনানন্দ গল্প লিখতে শুরু করলেন, লিখলেন উপন্যাসও। কবিতা ছাপা হবে না, গল্প-উপন্যাসও ছাপা হবে না কিন্তু ওই মুহূর্তে জীবনের অভিজ্ঞতার যে জটাজালের ভেতর আটকে আছেন, তা গল্পেই খোলাসা করা যাবে বলে মনে হলো তাঁর। মনে করলেন জীবনের ওই ক্রান্তির সময়টায় নেহাত নিজের জীবনের দিকে তাকাবার জন্য, নিজের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য, নিজের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবার জন্যই গল্প লিখবেন তিনি। নিজের এক গল্পের চরিত্রের মুখেই খোলাসা করে গেছেন সেই অভিপ্রায়। তার জামরুল তলা গল্পের চরিত্র বলে, গল্প লিখবার ঘন্টা মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনের খুব একটা উৎসর্জনের জিনিস বলে মনে হয়।..সারাদিন গল্পটা লিখতে গিয়ে দীন, গ্রন্থিমাংশের পুনরুক্তি ও জীবনের জীর্ণশীর্ণ পুরনো বিষণ্ণতা ও মূল্যবোধের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে কোথাও চলে যেতে পারি তাহলে আমার কাজ হবে…মানুষ ভাত খেয়ে বাঁচে না শুধু, সে পুঁইশাকের চচ্চড়ি ও কুঁচো চিংড়ির ঘন্ট খেতে পারে কিন্তু চিন্তা ও কল্পনা তবুও তার। সে পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আবিষ্কার করতে পারে, অদৃশ্য সমুদ্রের শব্দ শুনতে পারে, ভোরের রাঙা সূর্যে অর্ধনারীশ্বরেরর ভয়াবহ সুন্দর রূপ দেখতে পারে।
তাঁর নিজের জীবন তখন বস্তুত দীন, গ্রন্থিমাংসের পুনরুক্তি। সেই কুঁচো চিংড়ির দারিদ্র্য ভোগের ভেতরও চিন্তা আর কল্পনাকে জারি রেখে পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আবিষ্কারের আশায় গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন তিনি। সেসব গল্প-উপন্যাস কোথাও ছাপাননি, গুপ্তধনের মতো সেগুলো আবিষ্কৃত হলো তাঁর মৃত্যুর পর পাওয়া সেই কালো ট্রাঙ্কগুলোতে।
বলা যায় জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসগুলো প্রায় সর্বাংশেই আত্মজৈবনিক। তাঁর নিজের জীবনের সংকটগুলো নিয়েই তিনি নাড়াচাড়া করেছেন সেই গল্পে। গল্প উপন্যাসগুলো যেন তাঁর ডায়েরিরই এক সম্প্রসারিত রূপ। সে সময় লেখা তাঁর অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের মূল চরিত্রের কোনো চাকরি নেই, সে নববিবাহিত, প্রেমিক তাকে উপেক্ষা করেছে, স্ত্রীর সঙ্গে তার বিস্তর মনের ফারাক। গল্পগুলো যে নিজের জীবনকে অদলবদল করে লেখা, সে ইঙ্গিতও গল্পেই রেখে গেছেন তিনি। কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময় গল্পটা শুরু হয়েছে এভাবে, বিনোদ নিজের জীবনের একটা গল্প লিখছে। তারপর লিখছেন, এখন লেখবার অবসর নেই, রুচি নেই, আবেগ নেই। চারিদিককার পরিশ্রম অবসাদের দরকার মেটাতে মেটাতে জীবনে আর কিছুই নেই যেন…তবু এইটুকু লিখে রাখা যাক।…এইটুকু নিজে লিখে নিজেকে দেখবারও কেমন একটা প্রয়োজন আছে যে। নিজের জীবনের কথাই, নামগুলো মাত্র বদলে দিয়ে লিখতে শুরু করেছে সে।
জীবনানন্দ গল্পগুলো লেখার সন-তারিখ লিখে রাখলেও গল্পগুলোর কোনো নাম দেননি। নামগুলো দিয়েছেন পরবর্তীকালে তাঁর পাণ্ডুলিপির সম্পাদকেরা। তার সেই সময়ের গল্পগুলো বস্তুত তার দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতারই এক ধারাবিবরণী যেন। বিয়ের পরপরই তাঁর জীবনের যে ব্যাপক ওলটপালটগুলো হতে শুরু করল, সেগুলোর দিকেই তিনি গভীর অভিনিবেশে তাকিয়েছেন এসব কথাসাহিত্যে।
.
০২.
জীবনানন্দ যাকে ভালোবাসতেন, মনে মনে যাকে প্রেমিকা হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন, তাঁকে তিনি স্ত্রী হিসেবে পাননি, বিয়ে করতে হয়েছে অচেনা এক নারীকে। অথচ বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেই নারী, যাকে তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষ বলে মনে করতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জীবনানন্দের একেবারে শুরুর গল্পগুলোর বিষয় ঠিক এটাই। সেসব গল্পের অধিকাংশগুলোতেই দেখা যায় গল্পের পুরুষ চরিত্রের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে তাঁর প্রেমিকা এবং তাতে তৈরি হয়েছে মনের এক দ্বন্দ্বের। কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময় গল্পের চরিত্রের নাম হিমাংশু, তার প্রেমিকা অরুণা কিন্তু হিমাংশুর বিয়ে হচ্ছে সরোজিনীর সঙ্গে। বিয়ের অনুষ্ঠানে আসবে সে কথা জানিয়ে হিমাংশুকে চিঠি লিখেছে প্রেমিকা অরুণা। জীবনানন্দের বিয়েতে শোভনার উপস্থিতির সরাসরি সূত্রকে লক্ষ না করে উপায় নেই। অরুণার সেই চিঠি নিয়ে হিমাংশুর অনুভূতি, …আগাগোড়া সমস্ত চিঠিটাই এমন তাচ্ছিল্য ও তামাশার মুডে লেখা এবং তা এতই স্বাভাবিক (অকৃত্রিম) যে মনে হয় হিমাংশু এতদিন পরে যে এমন ধরনের একটা কাজ করতে যাচ্ছে অরুণার নিজের দিক দিয়ে অন্তত আকস্মিক বা নিদারুণ মনে করা তো দূরের কথা, সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মনে করে আগ্রহের সঙ্গে সহানুভূতি করছে, কোনো আঘাত পাওয়া, স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, দূরে পড়ে থাকার কোন প্রয়োজন নেই যেন অরুণার। সে সকলের সঙ্গে একজন হয়ে হিমাংশুর এই বিয়ে ব্যাপারটাকে পুরো মাত্রায় উপভোগ করতে পারে। হিমাংশুর বিয়েতে কি কি তামাশা ও ফুর্তি করতে পারা যায় তারই এক মর্মান্তিক লিস্টি দিয়ে চিঠিটাকে। সে ছেলেমানুষির শেষ সীমায় নিয়ে পৌঁছিয়েছে।
অরুণার সঙ্গে তার প্রেমের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে হিমাংশুর, …এক হিসাবে দেখতে গেলে, জীবনের প্রকৃত প্রয়োজনের হিসাবের দিক দিয়ে অরুণার সঙ্গে যে কটি বছর তার ভালোবাসা গেছে–বটেই অপচয়ের বছর। যে ভালোবাসা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না, যেমন বিবাহে বা বিবাহহীন দাম্পত্যেও, জীবনকে তাও অভিজ্ঞ করে বটে, জীবনের কোনো এক সময়ের প্রয়োজনও মেটায়, পরিতৃপ্তিও বোধ করা যায়, কিন্তু কাকের কালো পাখনার ভিতর থেকে থেকে থেকে যে ময়ূরকণ্ঠী রঙ ফুটে বেরয় তেমনি ক্ষণিকের জিনিসগুলো, জীবনের সাদাসিদে প্রচার প্রয়োজনের সম্পর্কে একেবারে অবান্তর। এসবই বোঝে হিমাংশু, কিছুদিন থেকে বুঝে আসছে। কিন্তু তবুও, শিগগিরই বিয়ে করতে যাচ্ছে যদিও হিমাংশু–তবুও
পারছে সে বিবাহিত জীবনের আগাগোড়াটাকে ভালো করে ধরতে। কখনো সেটাকে সম্পদের জিনিস বলে মনে হয়, কখনো কর্তব্যের, কখনো বোঝার, না পারছে সে জীবনের প্রয়োজনীয় প্রেমটাকে ছেড়ে দিতে, অরুণার ভালোবাসাকে…অরুণাকে ভালোবেসে জীবনটা আজও খেয়ে যাচ্ছে যেন, এ রকম খরচ হয়ে যাচ্ছে। কেবলই দ্বিধা, কেবলই বাধা, কেবলই যাতনা, অপচয়। কোন শান্তি বা স্থিরতা না পেলে জীবনের কোন কাজই যে আরম্ভ হতে পারবে না…
জীবনানন্দের ডায়েরির সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায় হিমাংশুর দ্বিধার উৎস।
তার উপেক্ষার শীত গল্পের চরিত্র শরদিন্দু অরুকে ভালোবেসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু অরু সব দিক বিবেচনা করে বলেছিল, এ বিয়ে হবার নয়। শরদিন্দু এখন অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করছে। অরু শরদিন্দুর আত্মীয়কুলেরই একজন। এ গল্পেও দেখা যাচ্ছে শরদিন্দুর প্রাক্তন প্রেমিকা এসেছে তার বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিয়ের অনুষ্ঠানের কোলাহল এড়িয়ে শরদিন্দু এক ফাঁকে অরুকে বলছে, তোমার ভালোবাসা আমাকে কী দিয়েছে? কুন্তিপাকের যন্ত্রণাও না, স্বর্গের চরিতার্থতাও না, নির্জীব পৃথিবীর হয়তো মেরুর দিকের পৃথিবীর খানিকটা অসাড়তা, প্রাণহীনতা, অকৃত্রিম কৃত্রিমতা, তার নিষ্ফলতা, তার শীত, এই তুমি দিয়েছ। কিন্তু তবু আমার ভালোবাসাকে জাগিয়ে প্রেমে যে কত আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, আগুন, আবিষ্কার, নিজে না বুঝে সেসব বুঝবার সুযোগও তুমিই আমাকে করে দিয়েছ বটে। তা ঠিক। তুমি জীবনে না এলে প্রেমও বুঝতাম না, অপ্রেমকেও না।
কেন বিয়ে করছে তার একটা ব্যাখ্যা শরদিন্দু দিচ্ছে অরুকে, বিবাহকে গুণী লোক যতই নিরর্থক মনে করুক না কেন, জীবনকে এ ঢের দেয়, সাধ তৃপ্তি, অবসাদ, অসাধ, অভিজ্ঞতা, সাহস, দায়িত্ব, ক্ষমতা ও আবিষ্কার। বিবাহের ভিতর রেখেও বিবাহের অতিরিক্ত জীবনে পৌঁছিয়ে দেয় মানুষকে। যেন মাটির ভিতর ঘাস হয়ে ফুটে উঠবার স্বাভাবিকতা, ঘাসের বুকে শিশিরের ফোঁটার ভিতর নক্ষত্রকে প্রতিফলিত করবার মতো প্রতিভা বিবাহ। বিবাহের মধ্য দিয়ে চালিয়ে নিয়ে জীবনের অনাবিষ্কৃত বিস্তৃত খননের মধ্যে মানুষকে এইসব দেয়।
নিজের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী সম্পর্কে ভাবছে তার বিবাহিত জীবন গল্পের চরিত্র অজিত? এই মেয়েটি তার জীবনে আজ কে? একে বিয়ে করে এনেছে মাত্র। অবিশ্যি নিজের ইচ্ছায় ও যত্নে একটা বিবাহিত জীবন থাকা দরকার। জীবনের ফাঁকফোকরে নানা সময়েই যে আশ্রয়টা না হলে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক পুরুষ বা নারী কারুরই চলে না।
নিজের বিয়ের সিদ্ধান্তের সময় যেসব টুকরো ভাবনা তাঁকে তাড়িত করেছে, এসব গল্পে সেসবই নেড়েচেড়ে দেখেছেন যেন জীবনানন্দ। তাঁর আকাঙ্ক্ষা কামনার বিলাস গল্পের চরিত্র প্রমথ ভাবছে, মানুষের জীবনে রূপের স্থান কোথায়, ভালোবাসার সঙ্গে রূপের কী যোগ, নিতান্ত শরীরেই বা কতটুকু, ভালোবাসার পথে পরিপূর্ণ অর্থটুকু কী, বাস্তবিক প্রেম কী যে, এর সূচনা কোথায়, পরিণামই বা কতদূর, কোথায় বা ব্যথা তার, তার ঈর্ষা, হিংসা তার, তার শ্লেষ, দৌরাত্ম্য, দুরাচার, মাদকতা, উল্লাস, অমৃত, তারপর কুয়াশা, তার শীত, তার মৃত্যু।
লক্ষ করবার যে জীবনানন্দের গদ্যে ভর করে আছে তার কবিতার আমেজও। এ এক নতুন ধরনের গদ্য যেন।
.
০৩.
দাম্পত্য তাঁর প্রথম দিককার গল্পগুলোর প্রধান থিম হলেও গল্পগুলোর সন-তারিখ লক্ষ করলে দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে সেসব গল্পের ভেতরের প্রসঙ্গগুলো পাল্টে যাচ্ছে। শুরুর গল্পগুলোতে পুরুষ চরিত্রের প্রাক্তন প্রেমিকার প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এলেও ক্রমশ তা কেন্দ্রীভূত হয়েছে শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের দিকে। লক্ষ করলে দেখা যায় তাঁর গল্প-উপন্যাসের দম্পতির সম্পর্কের বিবর্তনের সমান্তরালে চলছে জীবনানন্দের নিজের দাম্পত্যের বিবর্তনও।
জীবন প্রণালী উপন্যাসে অঞ্জলি তার স্বামীকে বলছে, বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেছে, এমএ পাশ করেছ এক যুগ আগে, তবুও একটা পয়সা যদি সম্বল নেই তোমার–মেয়েমানুষকে জীবনে আকাঙ্ক্ষা করতে গিয়েছিলে কেন?…একটা খাঁচার পাখিকে পুষতে হলেও তো নিঃসম্বল হলে চলে না! অথচ সৃষ্টির সব চেয়ে বড় জিনিস নিয়ে খেলা করলে কপর্দকহীন হয়ে।
বাসর রাত গল্পের প্রেমনীহারের স্ত্রী মনিকা স্বামীকে বলছে, নিজেরা কায়ক্লেশে যে সংসার চালাতে পারে না সেখানে একজন পরের মেয়েকে এনে যারা কষ্ট দেয় তারা কি সৎ?
অসম্ভব নয় জীবনানন্দের বেকারত্বে এই ছিল লাবণ্যর প্রতিক্রিয়া। সেই যে বিয়ের পরপর কথা বন্ধ, খাওয়া বন্ধ করে দিতেন লাবণ্য তখন তাঁর মুখেই কি এমন কোনো সংলাপ উচ্চারিত হয়েছিল? তাঁর গল্পের পুরুষ চরিত্র অবশ্য অকপটে মেনে নিচ্ছে যে স্ত্রীর এই অভিযোগ খুবই যৌক্তিক। কিন্তু সেসব চরিত্র নিজেরাই নিঃসহায়।
তাঁর গল্পের স্বামী কপর্দকহীন বটে তবু স্ত্রীর রূপে তাদের মুগ্ধতা জাগে, আকাক্ষা জাগে স্ত্রীর সান্নিধ্যের। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, কারণ স্ত্রীর মেজাজ ইতিমধ্যে বিগড়ে গেছে। বাসর রাত গল্পে স্ত্রী মনিকাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখছে স্বামী প্রেমনীহার, তার মনে হচ্ছে, …বউয়ের মাথাটা যেন একটা গোক্ষুরের নীড়, মেয়েটি এপাশ ওপাশ ফিরছে আর নাকে কপালে বুকে শাড়ির উপর সাপশিশুদের মত অজস্র চুল ভেঙ্গেচুরে ফণা তুলে ঘুমিয়ে পড়ছে। ঘুম থেকে জেগে ফণা বিস্তার করে দিচ্ছে। অপলক হয়ে এই রূপ দেখা যায়। প্রতিবারই মনের ভেতর অসহ্য বিদ্যুৎ খেলে, হয়তো সৃষ্টির শেষ দিন অবধি এ রূপের সংস্পর্শে এমনি পুলকবিদ্যুৎ স্ফুরিত হয়ে চলবে। প্ৰেমনীহার হাঁ তাকিয়ে, চোখ বুঝে অনেকক্ষণ ভেবে দেখে…ধীরে ধীরে ওর মাথায় নিবিড় আকুতিতে হাত রাখলো প্রেমনীহার। চুলের ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে আঙ্গুল বুলিয়ে নিতে লাগলো।
কিন্তু মনিকার মাথাসুদ্ধ সমস্ত চুল যেন তারের মতো কঠিন হয়ে উঠল, মেয়েটি ঘাড় ফিরিয়ে বলল, আঃ কি সব করছো। বিড়ালের মতো ফেস করে ওঠে।
না না ওঠে না যেন সে, তার চেয়ে প্রেমনীহারই বরং একটু সরে শোবে, সভয়ে মনিকার চুলের ভেতর থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে প্রেমনীহার খুব সন্তর্পণে অনেকখানি দূরে সরে গেল। সমস্ত বিছানাটাই প্রায় মনিকার জন্য ছেড়ে দেয়নি কি? চায় যদি আরও ছেড়ে দেবে। বুকের ভেতর কেমন একটা ঢিবঢিব করে উঠল প্রেমনীহারের।
মনিকা গজগজ করতে করতে বলল, ধেত্তর, কেমন পাট পাট করে সাজানো ছিলো দিল আমার চুলের পাট নষ্ট করে…।
এরপর প্রেমনীহার ভাবছে, …কেনই বা মানুষ বিয়ে করতে যায়? আজ রাতেই হয়তো লক্ষ লক্ষ লোকে পৃথিবী ভরে বিবাহের উৎসবে খেতে গিয়েছে এবং কোটি কোটি লোক তাদের জয় জয়কার করছে, কিন্তু কাল তাদের কাছ থেকেই ঢের সত্য কথা শোনা যাবে। সে কথাগুলো মোটেও ভরসা জনক নয়…
বিয়ে করে একধরনের ফাঁদে পড়া গেছে, এমন একটা ভাবনা জীবনানন্দের গল্পে ক্রমশ ফুটে উঠতে থাকে। তাঁর গল্পের অনেক চরিত্রই লেখক, তারা টের পায় বিবাহিত জীবনে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করা একটা দুরূহ ব্যাপার। ক্ষণিকের মুক্তি দেয় ভরিয়া নামের গল্পে বিরাজ, যে কিনা লেখালেখি করতে চায়, বলছে, কোন ব্যতিব্যস্ততার ভিতর আর্ট টিকতে পারে না, দারিদ্রতার ভিতর তা হতে পারে না, জটিল পরিবারের তোলপাড়ের ভিতর আর্ট কী করে টিকবে?…বিয়ে করা আর্টিষ্টের পক্ষে মারাত্মক–বিবাহ এদের দুজনের নিকট একদিনও হয়তো মোহের রূপে আসেনি, একদিনের জন্যও হয়ত এরা মেয়ে বা পুরুষ জীবনের কুহককে বুঝতে পারেনি পরস্পরের সংসর্গে।
চাকরী নেই নামের আরেক গল্পে সুকুমার ভাবে, নিজের জীবন ঢের অপরাধী। ঢের বিমুখ। ঢের অপারগ। কিন্তু তাই নিয়ে সুকুমার এতদিন কাউকে ভারাক্রান্ত করতে যায়নি। আকাশের দিকে উধাও একটা ভারী বেলুনের মত নিজের বোঝও সে বুঝছিলো না। সে কবিতা লিখতে, নদীর পাড়ে গিয়ে বসত, একা একা সারাদিন সাইকেলে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু বিয়ে করার পরের থেকেই বেলুনটা নামছে যেন, নামছে, নামছে, নেমে পড়ছে।…
বিয়ের পর থেকেই জীবনানন্দের নিজের জীবনের বেলুনটাও তো নামতেই শুরু করেছিল।
.
০৪.
ক্রমশ জীবনানন্দের গল্পগুলোর পুরুষ চরিত্রের নারী এবং পুরো বিয়ে ব্যাপারটা নিয়েই একটা মোহভঙ্গ ঘটতে থাকে।
বত্রিশ বছর পর গল্পের চরিত্র অভয় ভাবে, …স্ত্রী পুরুষের সম্পর্ক তার কাছে এখন অবসাদের মত বোধ হচ্ছে…জীবনে কোন প্রেমিকা নেই এখন অভয়ের, কোন অভিসারিকা নেই, নেই, আজকের জীবনে এ একটা চমৎকার অর্জন, মেয়েমানুষের যা কিছু যতকিছু সুন্দর, অভয়ের কাছে সমস্ত নিরর্থক–আজ। সে অন্য অনেক জিনিস নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।
আঘ্রাণের শীত গল্পের পুরুষ কথক বলে, একদিন নারীকে নিয়ে যে অভিনব স্বপ্ন ও মোহের রাজ্যে থাকব বলে ভাবতাম, যেখানে আর কোন কিছু প্রবেশ করতে পারবে না। সে খেয়াল আমার ভেঙ্গে গেছে…।
দাম্পত্য ক্রমশ মর্মান্তিক হয়ে ওঠে জীবনানন্দের গল্পগুলোতে। তাঁর গল্পের দম্পতিদের ভেতর এরপর শুধু মানসিক নয়, শারীরিক দূরত্বও তৈরি হতে শুরু করে।
বাসর শয্যার পাশে গল্পে দেবব্রতকে সাবধান করে দিয়ে তার স্ত্রী নীহার বলে, উনুনের ধোয়া আমার সহ্য হয় না আগের থেকে বলে রাখছি…সবদিক হবে কি করে? সুন্দর ভোগা ভোগা শরীরও চাই, আবার রান্নাবাড়িও চাই তা কি কখনো হয়? বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল নীহার। ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছিল। দেবব্রত অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর একটা বাতি অন্ধকার করে ঘুমন্ত বধূকে আদর করতে গিয়েই বাতিটা তৎক্ষণাৎ জ্বালিয়ে ফেলতে হলো দেবব্রতকে। স্ত্রী বলল, ভালো হবে না কিন্তু বলে রাখছি, তুমি আলাদা বিছানায় শোও গে।
প্রেমিক স্বামী গল্পের স্বামী প্রভাত তার স্ত্রী মালিনাকে বলে, সেসব কাঁচা আনাড়ির বর্বর মোহ ভালোবাসার সময়, সেসব অনেকদিন হয় কেটে গেছে। মনে ওসব নিরর্থক ধোয়া নিয়ে স্ত্রী-পুরুষের সংসর্গের জীবনটাকে পণ্ড করে দেয়ার সময় এখন আর নাই। এখন আমি বস্তু চাই।
বস্তু মানে?–মালিনা ঘাড় হেঁট করে থেমে গেল।
প্রভাত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, কেন মিছেমিছে ঢঙ করছো, জানো না তুমি সব?
মোট কথা, তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর বিয়ের আনন্দ মিটে গেছে। তাঁর গল্পের বিবাহিত চরিত্রকে এরপর দেখা যায় বিড়ম্বিত হয়ে একা একা মাঝরাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁর অশ্বত্থের ডালে গল্পটি অদ্ভুত। আজকের দিনে লিখলে লোকে এর ওপর ম্যাজিক রিয়েলিজমের তকমা লাগিয়ে দিত হয়তো। সেই গল্পের কথক বলছে, …ঘরের উত্তর দিকের একটা কোনে আমার কোঠা। ছোট্ট একটা কোঠা। একটা টেবিল রয়েছে, একটা চেয়ার, বইয়ের আলমারী একটা আর খাট একখানা। আমি একাই থাকি সেখানে। বিয়ের আগে যেমন ছিলাম, তেমনি আছি। নিজেকে অবিবাহিত একাকী মানুষ ভাবতে বেশ লাগে। বিশেষত এই শীতের রাতে এই পাড়াগাঁয়ে।…
অশ্বত্থের ডালে গল্পের চরিত্র এরপর গভীর রাতে পেঁচার ডাক শুনে বাইরে বেরিয়ে যায়। যায় মজুমদারদের পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে। সেখানে প্রায় অন্ধ এক লোক বাড়ি পাহারা দেয়, যার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয় সে। এ লোক কখনো ঘুমায় না। সে বলে, যে পেঁচা পেঁচানী ডাকছে তারা আসলে মজুমদার এবং তার স্ত্রী। মজুমদারের স্ত্রী মরে পেঁচা হয়ে গেলে মজুমদারও মরে পেঁচা হয়, কারণ তারা দুজন একত্রে থাকতে চায়।
আগেকার দিনে এমন ভালোবাসা হতো। এখন আর হয় না, বলে সেই একাকী কথক পাহারাদার। তারপর সে বলে, হয় না যে তার নমুনা তো তুমি। রাত দুটো অবধি একটা কানার সঙ্গে ইয়ার্কি দিচ্ছ।
বিয়ে নিয়ে চরম মোহভঙ্গের পর তাঁর গল্পের পুরুষ চরিত্ররা ডিভোর্সের চিন্তাও করতে শুরু করে, মাংসের ক্লান্তি গল্পে স্বামী রাগ করে এসে বলছে, খ্রীস্টান হতে হবে।
স্ত্রী হেম আঁতকে ওঠে, কেন?
তোমাকেও হয় খ্রীস্টান না হয় মুসলমান করে ছাড়ব।
হেম মুখ দিয়ে রা’টি বের করতে পারে না। স্বামী কী বলছে?
স্বামী : হিন্দু সমাজ ডাইভোর্স দেবে না। দিক না দিক বয়ে গেল, আমি খ্রীস্টান হয়ে তোমাকে ডিভোর্স করব…আবার সামান্য কথার ছুতা ধরে–তোমাকে মুসলমান করব কি আমি মুসলমান হব।
তারপর?
নতুন করে সংসার পাতব, নতুন একটা বউ আনব, হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, ব্রাহ্ম যাই হোক না কেন, তোমার সঙ্গে এই ম্যারেজটা আবার ফেইলর হয়ে গেছে, ডিভাষ্টেটিং…
১৯৩০, ৩১, ৩২-এ লেখা জীবনানন্দের গল্পগুলো এমন একটা ডিভাস্টেটিং দাম্পত্য জীবনেরই ধারাবিবরণী যেন। মনে রাখা দরকার যে সেটা জীবনানন্দের বিয়েরও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর।
.
০৫.
লক্ষ করলে দেখা যায় নিজের দাম্পত্য জীবনের স্তর আর জীবনানন্দের গল্পের চরিত্রগুলোর স্তর সমান্তরালে এগোচ্ছে। দেখা যায়, যে বছর তাঁর গল্পের নারী চরিত্রগুলো গর্ভবতী, সে বছর লাবণ্যও গর্ভবতী। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর গর্ভধারণ খুব বেদনাদায়ক এবং কুৎসিত অভিজ্ঞতা। মা হবার কোন সাধ গল্পের চরিত্র শেফালীর মোটেও মা হবার কোনো সাধ নেই। ঘটনাক্রমে গর্ভবতী হয়েছে সে। জীবনানন্দ লিখছেন, …সেই প্রথম মাসের বমি, অরুচি, বমি, চাপ, পেটের কষ্ট, দুর্বলতা, ওর সৌন্দর্যের অবিশ্রাম ধ্বংস তারপর কি রকম একটা বিকৃতি বীভৎসতা। শেফালীর জীবনের এই মোটা দিকটার সঙ্গে ওর আর একটা নিবিড় কষ্টের দিক জড়িয়ে রয়েছে, তা শুধু সংসারের অভাব নিয়েই নয়, মানুষের পরিহাস নির্মমতা নিয়েও বটে, কিন্তু শুধু তা নিয়েও নয়, কেনই এমন সন্তান হচ্ছে এবং যদিও বা হলো প্রমথের ভেতর দিয়ে তা কেন হলো, এমনতর একটা পরিহাসের ভিতর এসেই বা হতে গেল কেন, এসবের ভিতর থেকে কে তাকে বাইরে নিয়ে যাবে, হায় কে? এমনই একটা প্রবল মর্মান্তিক বিষম হাঁফ শেফালীর জীবনে এই সাত আট মাস ধরে দেখে আসছে প্রমথ।
শেফালীর মনে হয় সন্তানের চাপ তার সমস্ত পেটটাকে গিলে খাচ্ছে, বাচ্চাটাকে তার একটা বিজাতীয় টিউমারের মত মনে হয়। অপেক্ষা না করে খামোখাই যে সে স্ত্রীকে গর্ভবতী করে দিয়েছে একথা ভেবে গল্পে স্বামী অপরাধ বোধে ভোগে।
…শেফালীর সংস্কার বা শিক্ষার খাতিরে নয়, নিজের উপভোগের চাতুর্যের পরিপাটি ব্যবস্থার জন্য নয়, শেফালীর রূপের প্রয়োজনে অন্তত প্রমথের ঢের প্রতীক্ষা করা উচিৎ ছিলো। গাছের নীচে একরাশ শেফালীর উপর যখন একটা কুকুর এসে বিছানা গুটিয়ে বসে (তখন ব্যাপারটা এমন হয়)?
এ গল্পটা যে বছর লিখছেন, সেই ১৯৩১-এ জীবনানন্দের প্রথম সন্তান মেয়ে মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়।
এ সময় জীবনানন্দ একটা উপন্যাসও লিখেছেন পূর্ণিমা নামে। সে উপন্যাসের পুরুষ চরিত্রকে খুব নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে দেখা যায়। সে এমনকি সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর মৃত্যুও কামনা করছে। পূর্ণিমা উপন্যাসের চরিত্র সন্তোষ আর পূর্ণিমার অসুখী দাম্পত্য। পূর্ণিমা যখন গর্ভবতী তখন সন্তোষ ভাবছে, পূর্ণিমার যদি মৃত্যু হত–এই প্রসবের সময়–তা হলে দু জনেই বেঁচে যেতে পারত তারা। কিন্তু তা কি হবে? তা যে হবে না এই মনে রেখেই জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়া ভাল–দু জনের সমগ্র জীবনটা সমস্ত পরিশ্রম, প্রয়াস ও ব্যর্থতার ও প্রয়াসের জন্য।
প্রেমহীনতা, রূঢ়তা, নিষ্ঠুরতায় ভরা এক দাম্পত্যের ইতিবৃত্ত জীবনানন্দের এই পর্যায়ের গল্পগুলো।
.
০৬.
কিন্তু জীবনানন্দ কি গল্পগুলো লিখেছেন দাম্পত্যে জড়িয়ে পড়া এক পুরুষের মোহভঙ্গের বর্ণনা দিতে শুধু? তিনি কীটের বুকের ব্যথা টের পান, একটা অসম দাম্পত্যে জড়িয়ে পড়া একজন নারীর বুকের ব্যথা কি তিনি টের পাবেন না? জীবনানন্দের গল্পে দম্পতির স্ত্রীদের দৃষ্টিকোণটাও জানতে পারি আমরা। মা হবার কোন সাধ গল্পের বেকার স্বামীর স্ত্রী শেফালী তার স্বামীকে চিঠিতে লেখে, আমার জন্মের থেকে বোর্ডিং-এর শেষ দিনগুলো অব্দি দুঃখ কাকে বলে তা ত জানিনি, কেমন নির্ভাবনায়, হাসিতামাশায় দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল আমার। কিন্তু সে যাক, সেসব কথা মনে পড়লেই বড় কষ্ট হয়। বিয়ে মানুষ সাধ করেই করে, কিন্তু আমি অত সুখের কল্পনা না করতে গেলেও কোনদিন কি ভেবেছিলাম ঠিক এরকমটা হবে…কলেজে কোনদিনও তা অতিবড় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম না মানুষের জীবনের ভেতর এত সব তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা, নোংরামি থাকতে পারে নাকি আবার…এও আমার দুর্ভাগ্যর আর এক কিস্তি যে বিয়ের আগে চার পাঁচ বছর নানা জায়গায় চাকরী করলে, কিন্তু বিয়ের পর থেকেই তোমার আর কাজ নেই…
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর লাবণ্য যে স্মৃতিকথা লিখেছেন, তার বহু আগেই যেন লাবণ্যর কথাগুলো তার হয়ে লিখে গেছেন জীবনানন্দ। তার গল্পে স্ত্রীর অসহায়ত্বে সহানুভূতিশীল স্বামীকেও দেখতে পাই আমরা। দেখা যায়, এই গল্পেই শেফালীর স্বামী প্রমথ তার স্ত্রীর পরিণতির কথা ভেবে বরং কষ্ট পাচ্ছে। সে ভাবছে, শেফালী অনেক। বড় ঘরে পড়লে পারত। যে রকম বেদনা মেয়েটি চায় না, যে উপলব্ধি অলক্ষ সহিষ্ণুতা মমতার জীবনকে মেয়েটি আপাদমস্তক জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে ঘৃণা করে, এর কপালের সৌভাগ্যও বরাবর একে যেই পথ থেকে দূরে রেখেছে, রাখত যেন, আশ্বাস দিয়ে গেছে যেন, হায় কোন আকস্মিকতার দুর্ভাগ্যে সেই বিবিধ সম্ভাবনার সমৃদ্ধির থেকে মেয়েটি এই সবচেয়ে দুঃসাধ্য পথেই খসে পড়লো। প্রমথের জীবনের নিষ্ক্রিয়তা ও নিরর্থকতার ভিতর, নিজের পণ্ডপ্রায় জীবনকে উদ্ধার করার জন্য প্রমথের এইসব ঘৃণা তুচ্ছ ষড়যন্ত্রের ভিতর, এই উপহাসের মধ্যে, এই কদর্যতার মধ্যে।
পুরো পরিস্থিতিতে স্বামী ভাবছে তার নিজের অসহায়ত্বের কথাও,? …কি করে শেফালীকে উপশম দেয়া যায় তার পথ খুঁজবার, কোন দিনও পথ পাওয়া যাবে না ভেবে অনেকক্ষণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে থেকে তবুও প্রতীক্ষা করবার, আশা করবার, সব সময়ই নিজের ব্যথাকে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী অনুভূতিপ্রবণ, বড় অশ্রুআবেগপূর্ণ বুঝতে পেরে সেগুলোকে জমিয়ে রেখে নিশ্চেষ্টতায় লজ্জা, ঘৃণা পেয়ে প্রয়াসে ব্যাকুল হয়ে উঠবার এই সবের ভার প্রমথের ওপর, এই সবের সার্থকতা ও অসার্থকতা নিয়ে তার জীবন। এই জীবনকে প্রশ্ন করবার কোনো অবসর তার নেই। ইচ্ছাও আছে কি?…।
তাঁর গল্পের স্ত্রীরাও টের পাচ্ছে তাদের স্বামীদের বঞ্চনা। কারুবাসনা উপন্যাসে স্ত্রী স্বামীকে বলছে, বাস্তবিক, তোমার স্ত্রী হয়ে এসে তোমাকে বড় লাঞ্ছনা দিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে–নিজের জীবনের কথা ভেবে দেখ যদি তুমি, তা হলে হয় তা উপলব্ধি করতে পারবে যে লোকসান আমার বেশি হলেও শূন্যতা যেন তোমার বেশি-কারণ সঞ্চয় বলে কোনদিনই কিছু যেন পাওনি।
তাঁর গল্পগুলো সেল্ফ রেফারেনশিয়াল হলেও জীবনানন্দ তাঁর নিজের জীবনকেই তাঁর গল্পের বিষয় করে নিয়ে বস্তুত নিংড়ে বুঝবার চেষ্টা করছেন নর-নারীর সম্পর্কের নানা মাত্রাকেই। একজন ব্যক্তি হিসেবে নয় শুধু লেখক হিসেবে একটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে যখন তিনি তাঁর গল্পের কিম্বা বলতে গেলে তার নিজের দাম্পত্যের দিকে তাকাচ্ছেন, তখন একটি অসম বিয়ের পরিস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই তার মনে হচ্ছে নিরাশ্রয় দুটা জীব যেন। দাম্পত্য এক অবোধ জোনাকী লিখেছেন তিনি, জ্বলে আর নিভে।
.
০৭.
এই গল্পগুলো যখন জীবনানন্দ লিখছেন, তখন পাশাপাশি অব্যাহত আছে তাঁর কলকাতায় মেসে থেকে অবিরাম চাকরি খোঁজার চেষ্টা। অনেকগুলো গল্প তিনি ওই মেসে বসেই লিখেছেন। দেখা যায় জীবনানন্দের গল্পের দম্পতির স্বামী চরিত্রও ঠিক তার মতোই একসময় মফস্বলের বাড়ি ছেড়ে চলে আসে কলকাতায়, ওঠে মেসে। কলকাতায় গিয়ে পরিবারের প্রতিদিনকার অসহায়ত্বের জাল থেকে বেরিয়ে একটা একাকিত্ব খোঁজে তার গল্পের চরিত্র, সেই সঙ্গে আদাজল খেয়ে খোঁজে চাকরি। তার এই সময়ের গল্পে, উপন্যাসে আছে সেই মেস-জীবনের প্রকট বিড়ম্বনার চালচিত্র। তার বিভা নামের উপন্যাসের চরিত্র মেসে থাকে। মেসের এই চরিত্র পয়সার অভাবে খায়নি। সে ভাবছে, সারাদিন আজ খেয়েছি বা কী? বিকেলে এক কাপ চা খেয়েছিলাম। অযথা পয়সা খরচ হবে বলে এক পয়সার ডালমুট কিনে খেতেও ভরসা পাইনি। এ সময় সে মেসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, পাশের বাড়ির বিভা নামের মেয়েটার ঘরের টেবিলে অনেক খাবার, …কেক-বিস্কুট কফি পড়ে আছে–যে কেউ নিয়ে যেতে পারে। চুরুট টানতে-টানতে ভাবি চড়াইয়ের মত হলে বেশ হত। আমার এ জানালার গরাদের ভেতর দিয়ে উড়ে একেবারে গিয়ে পড়তাম বিভার ছোট টি-টেবিলটার ওপর। তারপর যা নিরবচ্ছিন্ন সার্থকতা তা চড়াইই জানে আর চড়াইর ভুবন–
নিরুপম যাত্রা গল্পের চরিত্রও কলকাতার দারিদ্র্যক্লিষ্ট এক মেসবাসী। সে ভাবছে, বিপদ এই যে সামান্য দাড়ি কামাতে, একটা দেশলাই ব্যবহার করতেও যার সাহায্যের দরকার, সেই পয়সাই নাই। বয়স ত্রিশ বছর–আরো কুড়ি কি ত্রিশ বছর যদি সে বাঁচে তাহলে তিন টাকা সোয়া আনায় হয় না।
সফলতা নিষ্ফলতা উপন্যাসের চরিত্র নিখিল তার কলকাতার মেসে খাওয়ার বর্ণনা দেয়, বোর্ডিং এর ম্যানেজারকে বড় অমানুষ বলে মনে হয়–ঘেন্না করতে ইচ্ছা করে। পুঁইশাকের চচ্চড়ি-রামঝিঙ্গে আর কুঁচো চিংড়ির ঘ্যাট গোরুর কলাই–দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বচ্ছরের পর বচ্ছর এই একই ব্যবস্থা–এই বোর্ডিং এ এসেই প্রথম দেখলাম। ট্যাংরা মাছ আর পারসে মাছ দিয়ে ঝোল করে কিন্তু মাছ ভাজে না–ঝোলে তেল বা মশলাও কিছু তেমন দেয় না, সমস্তই সিদ্ধর ব্যাপার যেন, কেমন একটা আঁশটে গন্ধ মাছের ঝোলের মধ্যে লেগে থাকে যেন–মনে হয় যেন বাজারের মাছের গা ধোওয়া জল খাচ্ছি–আর এই কাঁচা মাছই চিবুচ্ছি যেন। এক আধ দিন পোনা মাছ। আসে–কিন্তু বরফের জন্যই হোক না তা এত অসার যে মুখে দিয়ে বিড়ালের ভিজে লোমের আস্বাদ পাই কখনও কখনও–(কিম্বা এত শক্ত থাকে যে মনে হয় সুন্দরী কাঠ চিবুচ্ছি) এই বোর্ডিং এ এসেই মাছ খাওয়ার সাধ আমার ঢের কেটে গিয়েছে। মাছ মাংসের ভিতরকার অশ্লীলতা এমন গভীরভাবে আমি আগে কোনও দিন টের পাইনি।
চাকরি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত তাঁর গল্পের চরিত্ররা। আমরা চারজন উপন্যাসের এক চরিত্র বলে, অনেকটা সময় কেটে যায়। চাকরি খুঁজতে বেরুই না তবু আর। কোনও চাড় নেই। পথে ঘুরে ঘুরে কাপড় নোংরা হবে শুধু। জুতোর বাট খসে যাবে, পথে পথে মানুষের কফ পিত্তি মাড়িয়ে উধ্বশ্বাসে চলব, কুষ্ঠ রোগীদের দেখব, পয়সার জন্য বার বার বেচারারা নুলো হাতে সেলাম ঠুকবে আমাকে! দয়া হবে না আমার। চায়ের দোকানে ঢুকব–তাকিয়ে দেখব, জেঁকের মত কালো পুরু বা পান রঙা মাদারি বা চেকনাই মিহি ঠোঁট, নোংরা বা ঝঝরে বক ঠুটোর মত চোখ নাক নিয়ে চা খোরের দল বসে গেছে চারদিকে–হাসছে, ঠাট্টা করছে, রগড় করছে–হয়তো কাব্য চর্চাও করছে।…
গল্পগুলো যেন তার সেই সময়কার জীবনেরই গোপন ডকুমেন্টেশন। যেমন তিনি তখন করতেন তেমনি তার গল্পের চরিত্র মাঝে মাঝে কলকাতার মেস থেকে মফস্বলের বাড়িতে ফেরে। সে বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করে এক হিমশীতল চাপা বিভীষিকা। অঘ্রানের শীত গল্পের বেকার পুরুষ চরিত্র কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরে রাতে কথা বলছে স্ত্রীর সাথে :
উমা : ঘুম পেয়েছে?
স্বামী : রাত তো কম হয়নি উমা।
উমা : কালেকটরের ঘড়িতে তো দশটা বাজলো।
স্বামী : কিন্তু শীতের রাতে এই ঢের বিশেষত পাড়াগাঁয়ে।
উমা: কলকাতায় হলে কী করতে?
স্বামী: তা হয়তো বাইরেই থাকতাম, হেঁটে বেড়াতাম কিম্বা একটা পার্কে গিয়ে বসতাম।
উমা : এত রাত অবধি বসে থাক?
স্বামী : হ্যাঁ তা থাকি মাঝে মাঝে।
উমা : কোথায় বসো?
স্বামী : বেঞ্চিতে কিংবা ঘাসের উপর পার্কে বা মনুমেন্টের কাছে।
উমা : একা?
স্বামী : একাই তো।
উমা : খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললে, বসে বসে কী কর?
স্বামী : মতলব আঁটি।
উমা : কীসের?
স্বামী : ভবিষ্যতে কী করব।
উমা : বাস্তবিক একটা চাকরী টাকরী পেলে না।
তারপর তারা আলাপ করে মাসে ৭০ টাকা বেতনের একটা চাকরি পেলে কী কী করবে। স্বামী বলে, ২০ টাকা কলকাতায় বাসা ভাড়া দেবে এবং জানতে চায় বাকি ৫০ টাকায় সংসার চলবে কি না? উমা কাগজ-পেনসিল নিয়ে বসে সেই কাল্পনিক বেতনের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ সংসারের একটা খসড়া করতে।
স্ত্রী যখন হিসাব করছে স্বামী ভাবে, …এমন কত খসড়া তার বসন্তের লেখা হয়েছে আর কালবোশেখীতে উড়ে গেছে। জ্যৈষ্ঠে তৈরি হয়েছে আবার আষাঢ় শ্রাবণের জলে ভিজে গেছে। আশ্বিনে গড়া হয়েছে ফের হেমন্তের হিমে চিমসে গেছে…
স্ত্রী উমা বলে স্বামীর চাকরি হলে তার ছোট বাচ্চাটার জন্য একটা উলের টুপি কিনবে। কোন রঙের টুপি হলে ভালো হয় এ নিয়ে দুজনে পরামর্শ করে। অথচ ঘরে ফুটো পয়সা নেই। উমা একটা বই পড়ছিল, বইটার চল্লিশ পৃষ্ঠা পড়তে তখনো বাকি। পরদিন উঠে পড়বে, জানাল স্বামীকে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল দুজন। গভীর রাতে বাড়ির পেছনের পুকুরে ঝপ করে একটা শব্দ শোনা গেল। স্বামী গিয়ে দেখল উমা পুকুরে ডুব দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। একটা বইয়ের বাকি অর্ধেকটা না পড়ে, ছেলের জন্য একটা টুপি কেনার স্বপ্ন দেখতে দেখতে উমা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তারপর স্বামী কলকাতার মেসে ফিরে যায়। আগের নিয়মে মেসের জীবন চলে। স্বামী ভাবে, …জীবন সম্বন্ধে আমার ধারণা আগের মতই আছে। অন্ধকার রাতে মেসের ঘরে শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়। এখনই এই মেসের প্রকাণ্ড লবজোন তেতালা বাড়ি ভূমিকম্পে দুমড়ে উঠে আমাকে কোন অতলে তলিয়ে দিতে পারে। সেখান থেকে অনন্তকালের ভেতরও কেউ আমাকে খুঁজে বের করতে পারবে না।…জীবন এরকমই। উমার মৃত্যুর আগেও আমি এই কথা ভাবতাম। এখনো ভাবি। জীবন সম্বন্ধে আমার মতামত স্থিরই আছে। জীবন এরকমই। সে আমাকে বাঁচতে দিয়েছে, খেতে দিচ্ছে, জীবনের অন্ধতা ও ভয়ঙ্করতার সম্বন্ধে কলম ধরে লিখতে দিচ্ছে। এই তার যথেষ্ট কৃপা। এতদিন লিখতে দিচ্ছে, লিখে চলি। আর কি করব? আর কিছু করার নাই। মাঝে মাঝে দেশের বাড়িতে গিয়ে খেতে মাঠে রোদে প্রজাপতি মৌমাছিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি কিন্তু তাদের উজ্জ্বল চঞ্চল জীবন সত্যি না মুখোস বুঝতে পারি না। খুব সন্দেহ হয়। কিন্তু মুখোস হোক সত্যি হোক মৌমাছিকে দাঁড়কাকে ঠুকরে খাচ্ছে এ আমি দেখেছি। দেখেছি ছোট ছোট ছেলেরা প্রজাপতির পাখনা ছিঁড়ে খেলা করছে।
জীবনানন্দ জানিয়ে দিচ্ছেন যে জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা বীভৎসতা, নির্মমতার খোঁজ তিনি পেয়েছেন। পতঙ্গের জীবনের আনন্দকেও সন্দেহ করছেন তিনি, তাঁর মনে হচ্ছে ওসব আসলে মুখোশ। কারণ তিনি জানেন মৌমাছি যত আনন্দেই উড়ুক, তাকে ঠুকরে খাবার জন্য আছে দাঁড়কাক, প্রজাপতি যে ফুর্তিতেই তার রঙিন পাখা মেলুক, তার সেই পাখা ছিঁড়ে ফেলবার জন্য প্রস্তুত আছে দুষ্ট ছেলের দল। একজনের আনন্দ, প্রেম নস্যাৎ করবার জন্য বরাবর ওত পেতে আছে কেউ। জীবন, জগৎ সবকিছুর ভেতর একটা গভীর অসহায়ত্ব আছে। যেন, আছে আশ্রয়হীনতা, এমনই মনে হচ্ছে তাঁর।
.
আমরা সবাই বসন্তের জ্যোৎস্নায় মৃত হরিণ
০১.
এসব গল্প জীবনানন্দ একের পর এক লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু কাউকে দেখাননি। ছাপাবার জন্য কোনো পত্রিকায় পাঠাননি। ওই সময়টাতে সাহিত্যজগৎ থেকে জীবনানন্দ একরকম নির্বাসিত। বেশ কয় বছর হলো কোথাও কোনো ছাপা লেখা নেই তার। সাহিত্যজগতের কারও সঙ্গে যোগাযোগও নেই তার। তার একসময়ের সুহৃদ অচিন্ত্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে মুনসেফের চাকরি নিয়ে চলে গেছেন কলকাতার বাইরে। তা ছাড়া জীবনানন্দের নতুন কবিতার ব্যাপারে অচিন্ত্যর আগ্রহও কমে গেছে ইদানীং। বুদ্ধদেব বসুর প্রগতি পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তার সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই অনেক দিন। বেকার মেসবাসী হারিয়ে যাওয়া এক কবি তখন জীবনানন্দ।
এই রকম এক সময়ে জীবনানন্দ একটা চিঠি পেলেন সেই সময়ের আরেক উদীয়মান আধুনিক কবি বিষ্ণু দের কাছ থেকে। বিষ্ণু দে জীবনানন্দকে জানালেন যে সে সময়ের রবীন্দ্রোত্তর নামজাদা কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নতুন একটা পত্রিকা প্রকাশ করছেন পরিচয় নামে এবং অনুরোধ করলেন এই নতুন পত্রিকার জন্য একটা কবিতা দিতে। বেশ কিছু গল্প লিখলেও জীবনানন্দ কবিতা লেখা বন্ধ রেখেছিলেন অনেক দিন। বিষ্ণু দের কবিতা লেখার অনুরোধে চাঙা হয়ে উঠলেন তিনি। সমাজ-সংসারে নানা বিড়ম্বনার ভেতর আছেন তখন জীবনানন্দ। তবু অনেক দিন পর বসলেন কবিতা লিখতে। ইতিমধ্যে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে জীবনের নতুনতর উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন জীবনানন্দ। মূলত জীবনের ভেতর যে গোপন এক সর্বব্যাপী নিঃসহায়তা আছে, এ তার সাম্প্রতিক উপলব্ধি। জীবনের এই নতুন বোধ নিয়ে তিনি এক বিস্ফোরক কবিতা লিখলেন এ সময়। কবিতায় এক শিকারের গল্প শোনালেন জীবনানন্দ। কিন্তু এ কবিতা শিকারের গল্প ছাড়িয়ে স্পর্শ করল জীবনের আরও গভীরতর স্তরকে। কবিতার নাম তিনি দিলেন, ‘ক্যাম্পে’ :
এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি
কাহারে সে ডাকে!
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,
এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ঘুম আর আসে নাকো
বসন্তের রাতে।
চারিপাশে বনের বিস্ময়,
চৈত্রের বাতাস,
জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন!
ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;
কোথাও অনেক বনে–যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই
পুরুষ-হরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;
তাহারা পেতেছে টের,
আসিতেছে তার দিকে!
আজ এই বিস্ময়ের রাতে
তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;
তাহাদের হৃদয়ের বোন
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়,
পিপাসার সান্ত্বনায়–আঘ্রাণে–আস্বাদে!
কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নেই আর যেন!
মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই,
সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু;
কেবল পিপাসা আছে,
রোমহর্ষ আছে।
মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়!
লালসা-আকাঙ্ক্ষা-সাধ-প্রেম-স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে
আজ এই বসন্তের রাতে;
এইখানে আমার নকটার্ন–।
একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে।
দাঁতের নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই
সুন্দরী গাছের নিচে–জ্যোৎস্নায়!
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে,
হরিণেরা আসিতেছে।
–তাদের পেতেছি আমি টের
অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়,
ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়।
ঘুমাতে পারি না আর;
শুয়ে শুয়ে থেকে
বন্দুকের শব্দ শুনি;
তারপর বন্দুকের শব্দ শুনি।
চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণী আবার ডাকে;
এইখানে প’ড়ে থেকে একা একা
আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে
বন্দুকের শব্দ শুনে শুনে
হরিণের ডাক শুনে শুনে।
কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;
সকালে–আলোয় তারে দেখা যাবে
পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা প’ড়ে আছে।
মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তারে এইসব।
আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব,
..মাংস-খাওয়া হল তবু শেষ?
…কেন শেষ হবে?
কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে
তাদের মতন নই আমিও কি?
কোনো এক বসন্তের রাতে
জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে
আমারেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায়–দখিনা বাতাসে
অই ঘাইহরিণীর মতো?
আমার হৃদয়-এক পুরুষ-হরিণ
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয়–চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?
আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো
যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে
এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিলে নাকি
জীবনের বিস্ময়ের রাতে
কোনো এক বসন্তের রাতে?
তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে!
মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমরাও পড়ে থাকি;
বিয়োগের–বিয়োগের-মরণের মুখে এসে পড়ে সব
ঐ মৃত মৃগদের মতো।
প্রেমের সাহস-সাধ-স্বপ্ন লয়ে বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা মৃত্যু পাই;
পাই না কি?
দোনলার শব্দ শুনি।
ঘাইমৃগী ডেকে যায়,
আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো
একা একা শুয়ে থেকে;
বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয়।
ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে;
যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়
হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে
তাহারাও তোমার মতন;
ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয়
কথা ভেবে-কথা ভেবে ভেবে।
এই ব্যথা,–এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে,
কোথাও ফড়িঙে-কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে,
আমাদের সবের জীবনে।
বসন্তের জ্যোৎস্নায় ঐ মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই।
কবি বনের পাশে ক্যাম্প ফেলে গভীর বনে ঘাই হরিণীর ডাক শুনছেন, সেই ডাক শুনে দলে দলে ছুটে আসছে পুরুষ হরিণের দল, সেই সুযোগে শিকারি গুলি করে। হত্যা করছে হরিণদের। সেই মৃত হরিণদের দেখে কবির মনে হচ্ছে, আমরা সবাই এদের মতোই। এই হচ্ছে কবিতার মূল কথা। এর আগে আমরা দেখেছি জীবন, জগৎ সবকিছুর ভেতর যে একটা গভীর অসহায়ত্ব আছে, আশ্রয়হীনতা আছে সে কথার ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন তাঁর গল্পে। গল্পের সেই কথাই যেন সম্প্রসারিত করলেন এই কবিতায়।
ঘাই একটা অসমিয়া শব্দ, যার অর্থ শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহৃত জ্যান্ত পাখি। এই শব্দ জীবনানন্দ শিখেছেন আসামে অতুলানন্দ কাকার কাছে বেড়াতে গিয়ে, যখন শোভনার সঙ্গে চলছে তার প্রাণের খেলা। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, জীবনানন্দের এই কবিতায় রয়েছে অন্তত তিনটা স্তর। এক স্তরে এটা নেহাত একটা হরিণ শিকারের গল্প। শিকারের গল্প তো সেই ছোটবেলার মনিরুদ্দীনের কাছেও তিনি শুনেছেন অনেক, তারপর শুনেছেন অতুলানন্দ কাকার কাছে। বনের পাশে ক্যাম্প করে সে রকমই একটা হরিণ শিকারের গল্প জীবনানন্দ শোনালেন। আবার আরেকটা স্তরে এটা এক ব্যর্থ প্রেমের গল্পও। হরিণী যেন একটা টোপের মতো সারা রাত ডেকে ডেকে আকৃষ্ট করেছে তার পুরুষ প্রেমিক হরিণকে, তারপর সেই পুরুষ হরিণ ঘাই বা টোপ হরিণের ডাকে তার কাছে আসতে গিয়ে অসহায়ের মতো নিহত হয়েছে শিকারির হাতে। আবার তৃতীয় স্তরে এই কবিতা শিকার, প্রেম ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে মানুষের মৌলিক অসহায়ত্বেরও বিবরণ। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, সব মানুষই এই পৃথিবীতে এসে নানা স্বপ্নের টোপে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে বেড়ায়, তারপর কোনো এক অদৃশ্য শিকারির হাতে যেন নিহত হয় তারা। যেমন গল্পে তিনি বলেছেন মৌমাছি নিহত হয় দাঁড়কাক দ্বারা, প্রজাপতির হন্তারক হয় দুরন্ত বালক।
জীবনানন্দের জীবনে ঘাই হরিণী নামক টোপ তাহলে কোনটা? শোভনার প্রেম, লাবণ্যর রূপ নাকি কবিতা আর সাহিত্য সৃষ্টির ইচ্ছা? সেসব হরিণীর ডাকে বাস্তবের কোনো চিতাবাঘের ভয় না করে তিনি ছুটে গেছেন সেই দিকে, তারপর কোথাকার কোন অদৃশ্য শিকারি তাকে পরিণত করেছে এক বেকার, চালচুলাহীন, অকর্মণ্য মেসবাসীতে।
.
০২.
অনেক দিন পর পত্রিকায় একটা ছাপা কবিতা দেখে জীবনের চারদিককার দৈন্য আর ব্যর্থতার ভেতর মনে আনন্দ এল জীবনানন্দের। কিন্তু তার আনন্দ ম্লান করে দেবার জন্য ওত পেতে আছেন অনেকেই। অনেক দিন পর পত্রিকায়। জীবনানন্দের একটা কবিতা পেয়ে তার ওপর হামলে পড়ার দারুণ মওকা পেয়ে গেলেন তার সদাপ্রস্তুত প্রতিপক্ষ সজনীকান্ত। শনিবারের চিঠি পত্রিকায় ক্যাম্পে কবিতা নিয়ে তিনি লিখলেন, চোরা গাইরা যে কেবল জয়ন্তী উৎসর্গের মাঠে আসিয়া কপিলা গাই সাজেন তাহা নহে, তাহারা মাঠবিশেষে ভিন্ন যোনীতেও বিহার করিয়া থাকেন। সম্প্রতি পরিচয় ক্ষেত্রে এইরূপ কোন বর্ণচোরা গাই হরিণীরূপে ঘাই মারিয়াছেন। কবিতাটার যদিও ক্যাম্পে ধাম কিন্তু ক্যাম্পের বাইরে। কবিতাচ্ছলে কবি যে বিরহিণী ঘাইহরিণীর আত্মকথা ও তাহার হতো দার মর্মকথা কহিয়াছেন, তাহা পরম রমণীয় হইয়াছে।
হৃত্তুতো দার কথা পাঠক বোধহয় বুঝিলেন না। কবি বলিতেছেন যে বনের যাবতীয় ঘাইহরিণকে তাহার হৃদয়ের বোন ঘাইহরিণী আঘ্রাণ ও আস্বাদের দ্বারা তাহার পিপাসার সান্ত্বনার জন্য ডাকিতেছে। পিস্তুতো মাস্তুতো ভাইবোনদের আমরা চিনি। হস্তুতো বোনের সাক্ষাৎ এই প্রথম পাইলাম। এবং সে ডাক শুনিয়া–
একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে
দাঁতের নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই
সুন্দরী গাছের নীচে-জ্যোৎস্নায়।
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে…
ভাইয়েরা নাহয় তাদের বোনের কাছে আসিল, মানিলাম, আটকাইবার উপায় নাই–কবির তন্ময়তায় না হয় গাছও সুন্দরী হইল, বুঝিলাম–কবির ঘোর লাগিয়াছে–কিন্তু মেয়েমানুষ কি করিয়া নোনা হইল? নোনা ইলিশ খাইয়াছি বটে কিন্তু কবির দেশে মেয়েমানুষেরও কি জারক প্রস্তুত হয়? কবি যে এতদিনে হজম হইয়া যান নাই, ইহাই আশ্চর্য।…।
এরপর সজনীকান্ত লিখলেন, পরিচয় একটি উচ্চশ্রেণীর কালচার বিলাসী ত্রৈমাসিক পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ইহাকে স্নেহে অভিনন্দন জানাইয়াছেন এবং হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় ইহাতে লিখিয়া থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ ও হীরেন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্যক্তিরা যে কাগজের সম্পর্কে সম্পর্কিত, তাহাতে কি প্রকার জঘন্য অশ্লীল লেখা বাহির হইতে পারে ও হয় তাহার একাধিক পরিচয় পরিচয় দিয়াছে। ক্যাম্পে তাহার চূড়ান্ত নমুনা।
সজনীকান্ত ঘোষণা দেবার পর ক্যাম্পে একটি অশ্লীল কবিতা এই বলে বেশ একটা প্রচার-প্রচারণা হলো। ১৯৩২ সালে পরিচয় পত্রিকার যে সংখ্যায় ক্যাম্পে কবিতাটা ছাপা হয়, সে একই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মাঘের আশ্বাস কবিতাটা। রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটা পড়েছিলেন এবং পড়েছিলেন। ক্যাম্পে কবিতাটাও। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠজন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তাঁর ডায়েরির পাতাতে লিখছেন, তিনি একদিন রবীন্দ্রনাথের ওখানে গিয়ে দেখেন রবীন্দ্রনাথ সুধীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলছেন তাঁর পরিচয় পত্রিকাটা নিয়ে। প্রশান্তচন্দ্র শুনলেন রবীন্দ্রনাথ বলছেন, জীবনানন্দ দাশের ঐ ঘাইহরিণী কিছু হয়নি। সুধীন্দ্রনাথ দত্তও তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওর মধ্যে লেখার কোন ষ্টাইল নেই, কেমন পাঁচমিশেলী।
ক্যাম্পে কিচ্ছু হয়নি, ক্যাম্পে পাঁচমিশেলী, কথাগুলো মনে রাখা যেতে পারে।
.
০৩.
সাহিত্যমহলে ক্যাম্পে কবিতা নিয়ে নানা রকম অপব্যাখ্যা শুরু হলে একপর্যায়ে জীবনানন্দ আগে কখনো যা করেননি তা-ই করলেন, ক্যাম্পে কবিতার ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেই একটা লেখা লিখলেন। তিনি লিখলেন, আমার ক্যাম্পে কবিতাটি সম্বন্ধে দু একটি কথা বলা দরকার মনে করি। কবিতাটি যখন লেখা হলো তখন মনে হয়েছিলো সহজ শব্দে শাদা ভাষায় লিখেছি বটে কিন্তু তবুও কবিতাটি হয়তো অনেকে বুঝবে না। বাস্তবিকই ক্যাম্পে কবিতাটির মানে অনেকের কাছে এতই দুর্বোধ্য রয়ে গেছে যে এ কবিতাটিকে তারা নির্বিবাদে অশ্লীল বলে মনে করেছেন।
কিন্তু তবু ক্যাম্পে অশ্লীল নয়। যদি কোন একমাত্র স্থির সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তা জীবনের–মানুষের কীট ফড়িঙের সবার জীবনেই নিঃসহায়তার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নিঃসহায়-ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এই, এই মাত্র। কবিতাটির এই সুর শিকারী, শিকার, হিংসা এবং প্রলোভনে ভুলিয়ে যে হিংসা সফল–পৃথিবীর এইসব ব্যবহারের বিরক্ত তত নয়–বিষণ্ণ যতখানি, বিষণ্ণ, নিরাশ্রয়। ক্যাম্পে কবিতায় কবির মনে হয়েছে তবু যে স্কুল হরিণ শিকারীই শুধু প্রলোভনে ভুলিয়ে হিংসার আড়ম্বর জাকাচ্ছে না, সৃষ্টিই যেন তেমন এক শিকারী, আমাদের সকলের জীবন নিয়েই যেন তার সকল শিকার চলছে, প্রেম প্রাণ স্বপ্নের একটা ওলটপালট ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন যেন সবদিকে : King Lear 47 As flies to want on boys are we to the gods. They kill us for their sport. এই আয়োজন।
বাংলা সাহিত্যে অন্তত কাব্যে এ সুর ক্যাম্পে কবিতার এই পবিত্র কঠিন নিরাশ্রয়তার সুর, জ্যোৎস্নার ওই মৃত মৃগদের মতো আমরা সবাই–এই সুর আগে এসেছে কিনা জানি না। অন্তত এ সুরের সঙ্গে চলতি বাঙালি পাঠক ও লেখক যে খুব কম পরিচিত তা নিঃসংকোচে বলা যেতে পারে। যে জিনিস অভ্যস্থ বুদ্ধি বিচার ও কল্পনাকে আঘাত করে যা পরিচিত নয় তার অপরাধ ঢের। কিন্তু তবু অশ্লীলতার দোষে ক্যাম্পে কবিতাটি সবচেয়ে কম অপরাধী। ইংরাজি, জার্মান বা ফ্রেঞ্চে এ কবিতাটি অনুবাদ করে যদি বিদেশী literary circle এ পাঠানো যেত, তাহলে কবিতাটির যে সুরের কথা আমি ইতিপূর্বে বলেছি তাই নিয়ে বিশ্লেষণ চলতো। দু একটি prurient মন ছাড়া এ কবিতাটির ভিতর অত কিছু খুঁজে বার করবার কোনো ক্ষমতা কারু থাকতো না; prurient; মন যাদের সব সময়েই সব জায়গায়ই সব কিছুর ভিতর থেকেই নিজেদের প্রয়োজনীয় খোরাক খুঁজে বার করবার অবাধ শক্তি তাদের রয়েছে; এই তাদের একমাত্র শক্তি। এই prurient এর কাছে ক্যাম্পে অশ্লীল, আকাশের নক্ষত্রও শ্লীল নয়। শেলীর soul sister পাশ্চাত্য কবি সমালোচক ও পাঠকদের গভীর আদরের Expression কিন্তু হৃদয়ের বোন (এই expressionটির জন্য শেলীর কাছে আমি ঋণী)–এই শব্দ দুটি prurient অন্তঃকরণকে শুধু বুঝতে দেয় যে সে কত prurient–তার ভিতর অন্য কোন চেতনা জাগায় না। Muleykeh (একটি ঘোটকী) সম্বন্ধে Browning বলেছেন, She was the child of his heart by the day, the wife of his breast by night. af 110 Browning সম্বন্ধে prurient কি বলত।
কিন্তু বাংলাদেশে সজনে গাছ ছাড়া আরো ঢের গাছ আছে–সুন্দরী গাছ। বাংলার বিশাল সুন্দরবন ছেয়ে রয়েছে যে সজনের কাছে তা অবিদিত থাকতে পারে–prunent এর কাছে প্রকৃত সমালোচক অন্তরাত্মা যেমন চিরকালই অজ্ঞাত, অনাবিষ্কৃত। বাংলাদেশের সব কবিই এই ১৯৩২ সালে কালজয়ী কবিতা যুদ্ধেরও ভিতর রয়ে যায়নি। কিন্তু হায় যদি তেমন হয়ে থাকতে পারা যেত। সহজ সরল বোধ নিয়ে সুসাধ্য সুগম পথে চিন্তালেশ শূন্যতার অপরূপ উল্লাসে জীবন কত মজারই না হতো তা হলে।
নিজের লেখার ব্যাপারে জীবনানন্দের আস্থা বরাবর মোলো আনা, ফলে কারও অক্ষম সমালোচনায় বিন্দুমাত্র বিচলিত নন তিনি। হতে পারেন জীবনযাপনে বিপর্যস্ত কিন্তু সাহিত্যকে তিনি বরাবর রাখেন উঁচু মঞ্চে। মেডিওক্রাসিকে তিনি ভয় পান। নিজের লেখাকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে ঠেলে দিয়ে বিচার করবার চ্যালেঞ্জ ছুড়বার সাহস রাখেন তিনি। এই লেখায় তাই একটা সুপ্ত রাগ আছে। কবিতাটার বহিরাঙ্গ ছাপিয়ে এর ভেতর যে জীবনের গভীর নিরাশ্রয়তার সুর তাকে তাই তিনি চোখে আঙুল দিয়ে স্পষ্ট করে তুলতে চাইলেন। সামাজিক, মানসিকভাবে জীবনানন্দ নিজেও তখন নিরাশ্রয়। তাঁর এই নিরাশ্রয়তাকে একটা দার্শনিক স্তরে নিয়ে পুরো সৃষ্টির নিরাশ্রয়তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইলেন। ব্যঙ্গ করে যে সজনেগাছের কথা তুলেছেন, সেটা যে সজনীকান্তকে মনে করেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
ক্ষোভের বশে লেখাটা তিনি লিখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শেষে আর কোথাও ছাপতে দেননি। অনেক বছর পর ভূমেন্দ্র গুহকে এই লেখার কথা বললে, ভূমেন্দ্র তাঁদের সম্পাদিত ময়ুখ পত্রিকায় লেখাটা ছাপতে চাইলে জীবনানন্দ রাজি হননি। তিনি বলেন, এসব করে আসলে কিছু হয় না, পাঠক নিজের মত করে সময় মত বুঝে নেবে।
ভূমেন্দ্র বলেন, আপনার লেখাটা দিলেন আমরা সজনীকান্তের সমালোচনার উচিত জবাব দিয়ে একটা লেখা লিখতে চাই আমাদের পত্রিকায়।
জীবনানন্দ তাতেও রাজি হলেন না, বললেন, এসব ছেপে কি হবে? ওরা যখন থাকবেন না, আমিও থাকবো না, এবং আপনারাও নির্ঘাৎ বুড়ো হয়ে পড়বেন তখন হয়তো ব্যাপারটার এক রকমের যাথার্থ নির্ণীত হবে, হয়তো হবে না। এসব ছেপে কিছু হয় না। ছাপাবেন না।
জীবনানন্দের এই লেখা অবশ্য তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়েছিল শতভিষা পত্রিকায়। যখন সত্যিই তাঁরা নেই, জীবনানন্দও নেই, তারপর একদিন ভূমেন্দ্র বুড়ো হলেন তখনই বস্তুত এ কবিতার যাথার্থ নির্ণীত হলো। ক্যাম্পে নামের সেই পাঁচমিশেলি কবিতা বাংলার বাঁক ফেরানো এক কবিতা হিসেবেই দেখা দিল।
.
অবিরল অন্ধকারের ভেতর
০১.
সাহিত্যে নিজের আত্মবিশ্বাস যতই দৃঢ় হোক না কেন ব্যক্তিজীবনে তখন তাঁর ধস নেমেই চলেছে। চাকরি হারানোর পর চার বছর পেরিয়ে গেছে, নানা চেষ্টাচরিত্র করেও কোনো কাজ তিনি জোটাতে পারেননি তখনো। কলকাতার মেসে তখনো মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন জীবনানন্দ। সে সময়ের ডায়েরির দিকে আবার চোখ রাখা যাক, বড় পিসিমার চিঠি & its tone-Everywhere I am downed: my problem puzzling and vexing everyone (the greater pity). কলকাতার মেসে বসে বড় পিসিমার চিঠি পেয়েছেন বরিশাল থেকে। চিঠিটার টোন নিশ্চয়ই মন বিগড়ে দেওয়ার। চিঠি থেকে টের পাচ্ছেন বাড়ির সবাই তার অবস্থা নিয়ে খুবই চিন্তিত এবং খেপেও আছে। কতটা নিচে নেমে গেছেন তাই ভাবছেন।
Lavanyas letter (stabbing): I might flow down the wave of this dark wind & never retum. মেসে বসে লাবণ্যর চিঠি পেয়েছেন। চিঠিতে নিশ্চয়ই খুব রূঢ় কোনো কথা ছিল। চিঠিটা একেবারে তার বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধেছে। মনে হচ্ছে অন্ধকারে ডুবে যাই আর ফিরে না আসি কখনো।
I wish I would be bachelor again-Aghast when I think of the future domestic life– তার মনে হচ্ছে আবার ব্যাচেলর হয়ে যেতে পারলেই বরং ভালো হতো। বিশেষ করে যখন সংসার-জীবনের ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন, তখন এ কথা আরও বেশি করে মনে পড়ছে।
Letter to Kristi Da & Prankristo: deep humiliation-any cat & dog. কোনো কৃষ্টি, প্রাণকৃষ্ট প্রমুখের কাছে চাকরির আশায় চিঠি লিখেছেন জীবনানন্দ কিন্তু অপমানিত হয়েছেন কুকুর-বিড়ালের মতো।
On বসে থাকা–বেকার কখনো বসে থাকে না, they stand & run & throb & palpitate, it is only the well-placed who have eternal charm of the easy chair or cushions, sofas & beds for them. কেউ হয়তো জীবনানন্দকে বলেছে কোথাও চাকরি করছ না, বসে বসে কী করছ? কথাটায় রাগ হয়ে এই বসে থাকা নিয়ে ভাবছেন। বেকাররা তো বসে থাকে না। তারা দাঁড়ায়, দৌড়ায়, ছুটে বেড়ায়। কেবল ভালো অবস্থানের লোকেদের জন্যই বরাদ্দ আছে ইজিচেয়ার, কুশন, সোফা বা বিছানার অনন্ত শৌখিনতা।
সমাজ সংসার মিছে সব, such moods very frequent. রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা সমাজ-সংসার মিছে সব, মিছে এই জীবনের কলরব–প্রায়ই তার মনে আসছে আজকাল।
…lovelessness of wife-preposterous of marriage, missing a girl & destroying an infant all things combined to creat the swelling tears of yesrternight: স্ত্রীর প্রেমহীনতা, হাস্যকর একটা বিয়ে, একজন নারীকে বারবার মনে পড়া, নিজের কন্যার কথা ভেবে মনে হয়েছে একটা ছোট শিশুর জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছেন যেন, এসব কথা ভেবে আগের রাতে একা একা কেঁদেছেন।
.
০২.
এমন দীর্ঘ বেকারত্বে এক রকম হতভম্ব জীবনানন্দ। ডায়েরির এই ভাবনাগুলোই তখন বরাবরের মতো বিস্তারিত করে চলেছেন গল্প-উপন্যাসে। তাঁর নিরুপম যাত্রা উপন্যাসের চরিত্র প্রভাত কলকাতায় মেসে বসে বসে ভাবে, …জীবনটাকে নেড়েচেড়ে দেখলাম, সংসারে যারা সফল হবে তাদের জাত আলাদা : ভালবাসার চেয়ে সফলতাকেই তারা ভালবাসে বেশি–আমার ঠিক উল্টো, প্রেম, দাক্ষিণ্য, মমতার, ঘরানা গন্ধেই তৃপ্তি!…মানুষ যদি এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে তা হলে জীবন তাকে মনে করে অপদার্থ শব, সময় আসে শুকুনের মত উড়ে, তাই আসে–তাই আসে…
তারপর, …প্রতিদিন সকালবেলা এই দুরারোগ্য ছন্দ তাকে পেয়ে বসেছে; কেরোসিন কাঠের টেবিলে ডিটমারের লণ্ঠনটা নিভিয়ে অন্ধকারের ভিতর মেসের বিছানায় শুয়ে থেকে প্রতিদিন রাতের বেলা মনে হয়েছে, এই অন্ধকারের যেন শেষ না হয় আর, এ বিছানার থেকে কোনো দিন যেন আর তাকে উঠতে না হয়।
অন্ধকারে ডুবে যেতে চাওয়া, ঘুম থেকে আর জেগে উঠতে না চাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষার কথা জীবনানন্দ লিখেছেন ডায়েরিতে, গল্পে। ক্যাম্পে কবিতাটা লিখবার পর এ সময়ে লেখা আরেকটা কবিতা জীবনানন্দ লিখেছিলেন, যার নামই তিনি দিয়েছিলেন অন্ধকার। সেই কবিতা ঠিক এই ভাবনাকে কেন্দ্র করেই। এই কবিতাটা সে সময় লিখলেও সেটা কোথাও ছাপাতে দেননি তিনি। বিশেষ করে, ক্যাম্পে কবিতা নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া তিনি পেয়েছেন, তাতে এই কবিতা ছাপাবার স্পৃহা পাননি তিনি। কবিতাটা পরে হারিয়েও ফেলেছিলেন। বহু বছর পর কাগজের ফাঁকে খুঁজে পেয়ে ছাপিয়েছিলেন। সে কবিতায় তিনি লিখেছিলেন;
জানো না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানো না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন
অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মত মিশে থেকে
হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে
বুঝতে পেরেছি আবার;
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়-আক্রোশে ভরে গিয়েছে;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের
আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভেতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে
থাকতে চেয়েছি।
… … …
গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি,
হে হিম হাওয়া
আমাকে জাগাতে চাও কেন।
সেই সময় জীবনযুদ্ধে লিপ্ত তিনি। কিন্তু এভাবে সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি হতে আর ইচ্ছা করছিল না জীবনানন্দের। এই পৃথিবীকে তার মনে হচ্ছিল যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে উৎসব করছে। এই পৃথিবীতে জেগে থাকার বদলে কোনো এক অন্ধকার পৃথিবীতে ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছিল তখন তার। সময়, সূর্য, কোকিল, স্মৃতি, ঠান্ডা হাওয়া কাউকে অনুরোধ করতে বাদ রাখছেন। না, তারা যেন তাকে সেই ঘুম থেকে না জাগায়।
.
০৩.
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, সংসার, সমাজের এই পরাজয়ের ভেতরও জীবনানন্দের মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছে তার পুরোনো প্রেম, শোভনা ওরফে বেবী ওরফে Y, বিওয়াই তখন পর্যবসিত হয়েছে শুধু ওয়াইতে। এ সময়ের ডায়েরির আরও কিছু লাইন,–Y, etc. evoking no feeling: only my struggle for settlement. …ওয়াইর কথা তখনো মনে পড়েছ তার কিন্তু তখন আর তা কোনো বিশেষ অনুভূতি আনছে না আর। তাঁর তখনকার সংগ্রাম শুধু টিকে থাকার।
‘Y’s card… There was a day…now no impression: How things change: Now pity বেবীকে কি জন্মদিনের কার্ড পাঠাবার কথা ভাবছিলেন? কিন্তু তার সঙ্গে এখন সেসব দিন আর নেই, সেটা টের পাচ্ছেন তিনি। ভাবছেন কীভাবে দিন সব বদলে যায়, এখন মনে ভালোবাসা বলে কিছু নেই, আছে শুধু করুণা।
About Y’s জন্মদিন, telephone & her silence. বেবীর ভাবনায় মনে বিশেষ কোনো অনুভূতি আনে না বলছেন ঠিকই কিন্তু তার জন্মদিনে তাকে স্মরণ করছেন। বেবীর জন্মদিনে তাকে ফোন করেছিলেন হয়তো। কিন্তু অপর প্রান্তে বেবীর নীরবতা।
Y : what of her?… No letter, nothing….I can imagine her in the romantic setting: kissing and kind-would be life & death to me even two years back: but now! নিজেকেই প্রশ্ন করছেন তিনি, বেবী নিয়ে কেন এত ভাবছি আমি? তাকে নিয়ে রোমান্টিক দৃশ্যের কথা ভাবছেন, সেই চুমু এবং আরও কিছু-বছর দুয়েক আগে এসবই ছিল তাঁর কাছে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন কিন্তু এখন সেসব দূর অস্ত।
এই সময় সমান্তরালভাবে তাঁর উপন্যাসেও উঠে আসছে এমন ভাবনা। সফলতা নিষ্ফলতা উপন্যাসের চরিত্র নিখিল এক জায়গায় বলছে, যাকে ভালবাসতাম, অন্যরা একে একে এসে তাকে ভালবাসছে। সাহিত্যে যে জায়গা করে নিয়েছিলাম, তা নষ্ট হয়ে গেছে। বায়োস্কোপ থিয়েটার ফুটবল কাউন্সিলের জন্য কোনও স্পৃহাও নেই আর। হেমন্তের ধানক্ষেতের নরম ধূসর অভিজ্ঞতা জন্মেছে জীবনে–শান্ত ধূসর নিস্পৃহ পাকা অভিজ্ঞতা-মাঝে মাঝে মাইনে অর্জন করবার অধিকারটা আজ সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু তবুও এই ঘৃণিত জিনিসটাই প্রেমের চেয়েও আমাকে ঢের বেশী দখল করে রেখেছে যেন, আমার মৃত্যুর সময়েও এক হাতে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার–হয়তো একশ টাকার কেরানিগিরির আর এক হাতে সেই মেয়েটির আত্মনিবেদনের চিঠি–এই দুটি জিনিসের মধ্যে কোনটিকে যে ভালবাসব, বুঝে উঠতে পারছি না।
.
০৪.
প্রেম, সংসার এসব তো তাঁর হাত ফসকে গেছেই। চেয়ে চেয়ে দেখছেন যে সাহিত্যের জন্য সবকিছুর সঙ্গে বাজি ধরেছেন, সেই সাহিত্যের পৃথিবীতেও তার কোনো স্থান নেই তখন। তাঁর সমসাময়িক লেখকদের কাছ থেকে পাচ্ছেন অবজ্ঞা, উপেক্ষা। ত্রিশ দশকের গোড়ায় কলকাতার সে সময়ের সাহিত্যিকদের দিকে একধরনের কৌতুক, ব্যর্থতা, ঈর্ষা নিয়ে তাকাচ্ছেন তিনি। তার সেই গোপন পর্যবেক্ষণগুলো রয়ে গেছে তাঁর ডায়েরিতে, Lucky Achin & others, prospering in every phase: in literature (RTP1301 of up to date & various magazines & otherwise writings & the incessant notices & reviewes of them so much so that even to nod to me seems perhaps humiliating to the them). অচিন্ত্য ভাগ্যবান মনে হচ্ছে জীবনানন্দের। তিনি দেখছেন, কীভাবে সাহিত্যে তাঁর খ্যাতি তরতর করে বাড়ছে। অবিরাম কথাসাহিত্য লিখছেন, নানা পত্রিকায় তাঁর লেখার রিভিউ হচ্ছে। জীবনানন্দকে একটু দূর থেকে সম্ভাষণ করাও যেন তার জন্য অপমানজনক এখন। অথচ এই অচিন্ত্য একদিন নীলিমা কবিতা পড়ে ছুটে এসেছিলেন তাঁর কাছে। কত বিকেল একসঙ্গে হেঁটেছেন গড়ের মাঠে, তাঁকে চা, কাটলেট খাইয়েছেন।
Premen & others enjoying ছানা & রসগোল্লা। লিখছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র আর অন্যরা বেশ ছানা, রসগোল্লা খাচ্ছেন। অর্থাৎ বেশ অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি জুটছে তাঁদের।
Premen Mitra in college square: on writing & so on…more genuine than Achin. কলেজচত্বরে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা হয়েছে জীবনানন্দের। তাকে অচিন্ত্যের চেয়ে আন্তরিক মনে হয়েছে জীবনানন্দের।
A wonder: How the asthmatic Achin & others of the type with appearently less means & planks than me stand where they stand. …? জীবনানন্দ অবাক হয়ে ভাবছেন অচিন্ত্য এবং অন্যরা তার চেয়ে কম ক্ষমতা নিয়েও কীভাবে ওই অবস্থানে আছে।
Vishnu De: mag. Board- current lit (disunity). Hankering or hunger for fame of Rabi & Pramatha even: an ironical drama. জীবনানন্দ দেখছেন তরুণ কবি বিষ্ণু দে খ্যাতির জন্য কেমন ক্ষুধার্ত, রবীন্দ্রনাথের মতো কিংবা নিদেনপক্ষে প্রমথ চৌধুরীর মতো খ্যাতি পাবার ইচ্ছা তাঁর।
Advance article Modern Bengali poetry omitting me: tremendous shock- Elvis of poisonous propaganda- As if nothing matters- Keep head cool. আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে কেউ একজন প্রবন্ধ লিখেছেন কিন্তু সেখানে জীবনানন্দের নাম নেই। ভীষণ আঘাত পেয়েছেন জীবনানন্দ। টের পাচ্ছেন বিষাক্ত প্রপাগান্ডা চারদিকে। তারপরও মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, সে কথা ভাবছেন। যেন কিছুই হয়নি, মনের ভেতর এমন ভাব ধরে রাখবার চেষ্টা করছেন।
Everything old musty wom out & second hand about me: literature, liberty, catalogue- Even in peorty thrust back, my anthologies & cuttings dont help me: oh were I like Sudhin Dutta controlling even the newest French journal!… জীবনানন্দের মনে হচ্ছে তার সবকিছুতেই জং ধরে গেছে-সাহিত্য, স্বাধীনতা। তাঁর কবিতা সংকলনও আর তাঁকে সাহায্য করছে না। ভাবছেন আহা সুধীন দত্তের মতো যদি হতে পারতেন। একটা নতুন ফরাসি পত্রিকার ওপরও সুধীনের কেমন হাত আছে।
Great insult & injury both by city Coll as well as literary body: What do I prayed? Who serves me! No body, nowhere & the corruption, bulging flesh & washing away…To die thus. … এই কলকাতা শহর, এখানকার লেখক-শিল্পীরা জীবনানন্দকে কী ভীষণ অপমান করল ভাবছেন। কোন ঈশ্বরের সেবা করলাম, নিজেকেই প্রশ্ন করছেন। প্রশ্ন করছেন, তার কথা কে ভাবে? নিজেই উত্তর দিচ্ছেন, না, কেউ না, কোথাও কেউ নেই, শুধু ফেঁপে ওঠা মাংসপিণ্ড সব…ভাবছেন বরং মরে যাওয়াই ভালো…
বলাবাহুল্য ত্রিশ দশকের গোড়ার ঠিক সেই সময়টায় বাংলা সাহিত্যের প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বিশ্বভ্রমণ করছেন। রাজকীয় অতিথি হয়ে তিনি ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড হয়ে জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন। লালগালিচা সংবর্ধনা হচ্ছে তাঁর সর্বত্র। সুইজারল্যান্ড থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে যাচ্ছেন কমিউনিস্ট রাশিয়ায়, নানা সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছেন। একদিন রবীন্দ্রনাথের সমান্তরালে যদিও উচ্চারিত হবে তার নাম, তবু ঠিক এই সময়টাতে জীবনানন্দ মেসের বিছানার ছারপোকা মারছেন আর না খেতে পেয়ে পাশের বাড়ির চড়ুইয়ের রেখে যাওয়া বিস্কুট খাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে গল্প লিখছেন।
.
০৫.
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও কোনো চাকরি পেতে যখন ব্যর্থ হলেন, তখন জীবনানন্দ ভাবতে লাগলেন যেকোনো রকম একটা কাজ পেলেই বর্তে যাবেন, শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ থাকার দরকার নেই। ডায়েরিতে লিখলেন, Had I been even an office typist! একটা অফিসের টাইপিষ্ট হলেও মন্দ হতো না।
Statesman reporting : flood: Could I be a reporter? স্টেটসম্যান পত্রিকায় বন্যার কথা পড়েছেন। ভাবছেন কাগজের রিপোর্টার হলেও তো চলে।
My own students- me… মশাই যখন চাকরি করবেন etc. E.B.R and all that low—–mean—dull life –story.. If I die—my ghost: an old gurd (humor, pathos & peorty of all that)
জীবনানন্দের এক ছাত্রও তাঁকে চাকরি দিতে চাইছে তখন, ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়েতে, গার্ডের চাকরি। পুরো ব্যাপারটা তাঁর কাছে একাধারে করুণ এবং হাস্যকর মনে হচ্ছে। এ নিয়ে একটা গল্প লেখার কথা ভাবছেন তিনি, যে গল্পে তিনি হবেন রেলের গার্ড এবং মরে গিয়েও তিনি গার্ড হয়ে ঘুরবেন। পরে তার সফলতা নিষ্ফলতা উপন্যাসে সত্যিই এমন একটা দৃশ্য নিয়ে লিখলেন তিনি। উপন্যাসের চরিত্র বলছে, গার্ডের চাকরিটা নিলাম না কেন জানো? একদিন দুপুর বেলা জেগে জেগে স্বপ্নের কী অদ্ভুত খেয়ালের ছবি দেখতে লাগলাম, মনে হলো আমি গার্ড হয়েছি গার্ডগিরি করে বুড়োও হয়েছি, তারপর মরে গেছি, তবু তারপর নৈহাটি ষ্টেশনে সাদা স্যুট সাদা টুপি পরে পায়চারি করছি–
মরে গিয়েও?
হাতে একটা সবুজ ফ্ল্যাগ, সাদা সু–সাদা টুপি–আমার ভূত-কমল চুপ করে রইল।
আমি বললাম, এই হতো না কি আমার?
কত লোকে গার্ড হচ্ছে—
কিন্তু আমি গার্ড হলে এটাই হত না কি আমার, কমল?
সবুজ ফ্ল্যাগ।
সবুজ ফ্ল্যাগ–সাদা সু–সাদা টুপি।
নৈহাটি প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছ।
আমি তো সমস্ত জীবন ভরেই করেছি–তারপর আমার ভূতও করছে বটে
.
ডায়েরিতে গার্ডবিষয়ক যে করুণ, হাস্যকর এবং কাব্যময় এক দৃশ্যের কথা বলেছেন, এই দৃশ্য যেন তাই।
তার গল্পের বেকার চরিত্রদেরও ঠিক এভাবে নানা রকম কাজ খুঁজতে দেখা যায়, সেই কাজ খোঁজার আলাপের ভেতর থাকে চাপা কৌতুক মেশানো বেদনা।
কারুবাসনা উপন্যাসের সংলাপ,
একটা টেকনিক্যাল কিছু শেখো।
কোনো জবাব দিলাম না।
শিখে এসো।
টাকা নেই।
বেশ, তা হলে ব্যাঙ্কিং শেখো না। তাও টাকা নেই? আচ্ছা, তা হলে নিরিবিলি বসে দর্জিগিরি শেখো না কেন?
খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কিংবা ডিমের ব্যবসা করতে পার, ছোট ডিমের?
পোলট্রি ফার্মিং।
…পাঁচ হাজার প্রাইভেট কার, দু হাজার ট্যাক্সি, এক হাজার বাস। চুরুট জ্বালিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের পথে-ঘাটে এই সব ছুটছে; কত ড্রাইভার দরকার হয়, ভেবে দেখ তো! মোটর ড্রাইভারি শিখে নাও।
.
০৬.
মাঝে মাঝে জীবনানন্দের তখন মনে হচ্ছে এসব চাকরি, ব্যবসা সবকিছুর ভাবনা বাদ দিয়ে তাঁর উচিত শুধু লেখায় মনোযোগ দেওয়া। সেটাই তার আসল কাজ। ডায়েরিতে লিখছেন, Very often I think that instead of frittering away my energy, I ought to just do that for what I stand & in which I excel & delight & which in my true vocation: literature. …
এ সময় প্রায়ই তিনি ভাবছেন এভাবে নানা রকম চাকরি খুঁজে অযথা শক্তিক্ষয় না করে তাঁর শুধু সেই কাজই করা উচিত যে কাজ তিনি সবচেয়ে আনন্দের সঙ্গে করেন, ভালো করতে পারেন এবং যেখানে তার সত্যিকারের ক্ষমতা, প্রেরণা : সাহিত্য… Iconcerned from every point of view and suffering greatly materially, spiritually and what pains me infinitely artistically… লিখছেন বস্তুগত, আধ্যাত্মিক নানা দিকে ভীষণভাবে ভুগছেন। কিন্তু বেশি ভুগছেন শৈল্পিকভাবে।
.
অস্বাভাবিক, অবৈধ মানুষ, এই আর্টিস্ট
০১.
প্রশ্ন হতেই পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে, এত চেষ্টা করা সত্ত্বেও জীবনানন্দ কোনো চাকরি পাচ্ছিলেন না কেন? বেশ কয়েকটা কারণ ভাবা যেতে পারে। প্রথমত, জীবনানন্দ যখন বিয়ে করলেন ঠিক সেই সময়, ১৯৩০ দশকের গোড়ায় শুরু হয় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝের টালমাটাল সময় তখন পৃথিবীতে। আমেরিকার শেয়ারবাজারে বড় ধস নেমেছে। তার বিরাট প্রভাব পড়েছে ইউরোপের অর্থনীতিতেও। ব্রিটেনের উপনিবেশ তখন ভারত। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সে সময় ভারতের বাজেট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বহুগুণ। অফিসে, আদালতে, কারখানায় নতুন কোনো নিয়োগ তো দূরের কথা, বহু মানুষকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। অল্প কিছু কাজের সুযোগ তৈরি হলে চাকরির দরখাস্তের বিশাল লাইন পড়ে যাচ্ছে।
জীবনানন্দের একটা গল্পে দেখা যাচ্ছে, কোনো এক অফিসের দুটা পোস্টের জন্য দরখাস্ত করেছেন তিন শ মানুষ। ফলে সাধারণভাবে চাকরির ব্যাপক আকাল তখন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও নতুন নিয়োগ তেমন ছিল না বললেই চলে। ফলে জীবনানন্দের জন্য সুযোগ সীমিত হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির বিজ্ঞাপনে জীবনানন্দ দরখাস্ত করলেও সেই যে এমএ পরীক্ষায় সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিলেন, সে জন্য পিছিয়ে পড়তেন। শিক্ষকতার সামান্য যে কয়টা শূন্য পদ তৈরি হতো, তাতে দরখাস্ত করত প্রথম শ্রেণি পাওয়া ছাত্ররা। জীবনানন্দ পাস করেছেন প্রায় বছর দশ আগে, ইতিমধ্যে বহু ছাত্রই বেরিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তাদের বহুজনই পেয়েছেন প্রথম শ্রেণি। ফলে ইন্টারভিউ তালিকায় নাম আর উঠত না তাঁর। এই সেকেন্ড ক্লাস পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে তাঁর জীবন প্রণালী উপন্যাসে কথা আছে সরাসরি, শ্রীবিলাস তোমার মতন এমএ পাশ শুধু?
হ্যাঁ।
তবে ওর চাকরী হল, তোমার হল না কেন?
শ্রীবিলাস এমএতে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিল।
আমি তো এমএ দেবই না ভেবেছিলাম, বন্ধু-বান্ধবেরা ধরে বেঁধে
এ রকম রুচিবিকার হল কেন তোমার? ইস, নিজের জীবনটাকে এ রকম করে নষ্ট করে দিতে হয়।
কয়েক নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পাইনি। বোধ হয় দশ কি বার—
ছি, মোটে এই দশটা নম্বরের জন্য তোমাতে আর ওতে এতখানি তফাৎ?
পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার এই কায়দা নিয়ে জীবনানন্দ ক্ষোভের কথা লিখেছেন তাঁর শিক্ষা, দীক্ষা, শিক্ষকতা প্রবন্ধে, ফার্স্ট ক্লাস এমএ হলেই যে সে সেকেন্ড ক্লাসের চেয়ে বেশি বিদ্বান বা কুশলী শিক্ষক হতে পারে আমি তা মনে করি না…যে সব সেকেন্ড ক্লাস ডিগ্রীওলা প্রফেসর কুড়ি পঁচিশ বছর অধ্যাপনা করেছেন কিন্তু এখন বাস্তুভিটা থেকে ছিটকে পড়ে নিশ্চয়তা ও ছন্দ হারিয়ে পশ্চিম বাংলার পথে ঘাটে ফিরছেন–কোন কলেজে স্থান পাচ্ছেন না, তারা শেষ পর্যন্ত কি করবেন ভাবনার বিষয়।
অবশ্য সেই জীবন প্রণালী উপন্যাসেই তার চরিত্র বলে, কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস পেলেও শ্রীবিলাসের মত সুস্বাস্থ্য আমার কোনোদিনই হত না।
কি করে বলো তুমি তা?
শ্রীবিলাসের জলজ্যান্ত চেহারা, সে আত্মতৃপ্তিতে কথা বলে, জীবনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তার, আকাঙ্ক্ষা আমাদের সকলের চেয়ে ঢের বেশি, কায়ক্লেশে
যারা পথে-পথে ঘুরছে তাদের মাড়িয়ে চলতে শ্রীবিলাস খুব ভালবাসে, জীবনটাকে যারা মালার হাটে কিনে চেতলার হাটে চড়িয়ে বিকোতে পারে দিনে দুশ বার করে, তাদের সঙ্গে শ্রীবিলাসের খুব বন্ধুত্ব-বরাবরই এই রকম।
জীবনানন্দের ইতিমধ্যে এ উপলব্ধিও হয়েছে যে শুধু ডিগ্রি হলে চলে না, কৃতকার্য হতে হলে জীবনটাকে মালার হাটে কিনে চেতলার হাটে চড়িয়ে বিকোতে পারার দক্ষতাও লাগে। সেই চতুরতা জীবনানন্দের ছিল না। ফলে চেনাজানা কোনো প্রভাবশালী লোকজনের যোগসাজশ ঘটিয়ে চাকরির বিশেষ সুযোগও তিনি তৈরি করতে পারেননি। কলকাতার সিটি কলেজে, তারপর দিল্লির রামযশ কলেজে যে চাকরি পেলেন, দুটাই তাঁর বাবার ব্রাহ্মসমাজ সূত্রে। কিন্তু দুটা চাকরিই তিনি হারালেন। চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য যে কিছু কায়দাকানুন জানা দরকার, সেগুলোও আয়ত্তে ছিল না তার। ফলে তার বাবার পক্ষে ব্রাহ্মসমাজের যোগাযোগ ব্যবহার করে আর নতুন কোনো চাকরির ব্যবস্থা করার সুযোগ ছিল না। কিংবা দুবার ব্যর্থ হবার পর তিনি হয়তো আর কাউকে বলতেও কুণ্ঠিত ছিলেন। অবশ্য বাংলার বাইরে দু-একটা চাকরির সুযোগ জীবনানন্দের হয়েছিল। তার বাবা শিলংয়ে একটা চাকরির খোঁজ পেয়েছিলেন, তার এক পিসতুতো বোন সরকারের শিক্ষা বিভাগের বড়কর্তা ছিলেন, তিনি পাঞ্জাবের অমৃতসরে একটা কলেজে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন কিন্তু জীবনানন্দ এর কোনোটাই নেননি। দিল্লির চাকরির অভিজ্ঞতার সুবাদে বাংলার বাইরে চাকরি করতে যাওয়ার ব্যাপারে তার একাধারে অনীহা এবং ভীতি ছিল। বাংলার বাইরে চাকরি করতে না যাবার ইচ্ছার কথা লিখেছেন ডায়েরিতে। তার আকাঙ্ক্ষার জগৎ গল্পের চরিত্রেরও তেমন ভাবনা, …বিভূতি কড়িকাঠের দিকে তাকাইয়া কহিল-পেশোয়ার যাওয়ার কথা বলছে, হয়তো পঁচিশ ত্রিশ টাকার একটা কেরানিগিরির জন্য কিন্তু জীবনে টাকাই কি সব? আচ্ছা তুমি বলো উপমা, মানুষ এটা উপলব্ধি করে দেখে না যে জীবনের ফাঁকে ফাঁকে যে গভীর সম্ভাবনা ও সফলতার জিনিস রয়েছে তার মূল্য সমস্ত টাকার ওপরে, এই তো খুকিকে দেখছি। তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলাম রাস্তার কত বন্ধুবান্ধব রয়েছে আমার, এই সবের বদলে যদি আমি একরাশ টাকার মালিক হয়ে বসতাম…
চাকরি বলতে তিনি মূলত এতকাল করেছেন শিক্ষকতা। শিক্ষকতা যে তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে করতেন, তা বলা যায় না। ছাত্রদের ভেতর জনপ্রিয় হতে পারেননি। শিক্ষকতার বাইরে আরও নানা রকম কাজ করারও চেষ্টাও করেছেন জীবনানন্দ। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, ছাতার বাটের ব্যবসা। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের যে ধাত, তাতে ওই সব ব্যবসার ভেতর তার মানিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপারই হতো। ইনস্যুরেন্সের এজেন্টকে তো রীতিমতো কথা ভাঙিয়েই চলতে হয়, তেমনিভাবে ব্যবসার একটা বড় পুঁজি কথা। অথচ জীবনানন্দ তো কথাই বলতে চাইতেন না, পারতেন না। মোট কথা, যেকোনো জাগতিক কাজে সাফল্য পেতে হলে যে ন্যূনতম সজাগ, সতর্ক একধরনের প্রবণতা দরকার, জীবনানন্দের মগ্ন ব্যক্তিত্বে সেই প্রবণতা ছিল না।
তবে সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে জীবনানন্দ বস্তুত কোনো চাকরি করতে না পারলেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। লাবণ্য তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে জীবনানন্দ চাকরি পেতেন না কথাটা যতটা সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য যে তিনি চাকরি করতে চাইতেন না। চাকরির দাসত্ব ব্যাপারটা তাঁকে বরাবর পীড়া দিত। জীবনানন্দ লিখেছেন :
পৃথিবীতে নাই কোন বিশুদ্ধ চাকুরী
এ কেমন পরিবেশে রয়ে গেছি সবে
বাকপতি জন্ম নিয়েছিলো যেই কালে…
.
জীবনানন্দের কারুবাসনা উপন্যাসের মূল চরিত্র নিজেকে যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, তাতে তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না আমাদের। সে বলছে, আমার বয়স চৌত্রিশ, বার বছর আগে এমএ পাশ করেছিলাম বটে, বিয়ের আগে দু-তিনটে কলেজে অস্থায়ী কাজ করেছি–আরো অনেক কাজ করেছি; কিন্তু সংসার ও সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষদের জীবনের পদ্ধতির সঙ্গে কোথাও না কোথাও সম্পূর্ণ ভিন্নতা ও জটিলতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি আমি। কাজেই এমএ ডিগ্রি ও স্ত্রী সন্তান সত্ত্বেও এই চৌত্রিশ বছর বয়সে আজও আমি সংসারী হয়ে উঠতে পারলাম না। আক্ষেপের কথা হয় তা কিংবা আক্ষেপের কথাই-বা কেন আর? জীবন তো শুধু স্ত্রী-সন্তান নিয়েই নয়।
কবিতা আর কবিতা, তারপরও কবিতা এই নামের গল্পের মূল চরিত্রকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, কী ভালো লাগে তোমার?
সে বলছে, কলকাতার এক নির্জন কিনারে একটা সাদা একতলা বাড়ি, পড়বার কোঠা, কয়েকটা মেহগিনি কাঠের টেবিল চেয়ার, কার্পেট আর আমার দরকার মত অজস্র বইয়ে ভরা–সারাদিন লিখব পড়ব চুরুট টানব…।
এই হচ্ছে জীবনানন্দের মনের কথা। এমন একটা ভাবনা তিনি বরাবর ভেবেছেন, এমন একটা জীবন যদি পাওয়া যেত, যেখানে শুধু নিজের মতো ভাবনায় মগ্ন থেকে আর লিখে পার করে দেওয়া যায় সময়, তাহলেই হয়তো তিনি সবচেয়ে খুশি হতেন। যদি শুধু লিখেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারতেন, তাহলেই বর্তে যেতেন। একজন শতভাগ শিল্পীর জীবনই খুঁজছিলেন জীবনানন্দ।
.
০২.
এই সময়েই একটা নতুন বোধোদয় হলো জীবনানন্দের। এই যে একজন শতভাগ শিল্পীর জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা, তাঁর মনে হলো সব সংকটের মূল হচ্ছে ওইখানে। তাঁর গল্প-উপন্যাসের সব চরিত্রই প্রায় বলা যায় তার মতো শিল্পপ্রেমিক কিন্তু জীবন জীবিকায় ব্যর্থ। এই সময়ে লেখা তাঁর গল্প-উপন্যাসের বেশ কিছু চরিত্রের এই উপলব্ধি ঘটে যে শিল্পসাহিত্যের প্রেম, আর্ট, এগুলোই তাদের ডুবিয়েছে, এগুলোই তাদের জীবনে সফল হতে দেয়নি। কারুবাসনা উপন্যাসের চরিত্র একেবারে স্পষ্ট করে বলে সে কথা, কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সব সময়ই শিল্প সৃষ্টি করবার আগ্রহ, তৃষ্ণা, পৃথিবীর সমস্ত সুখ-দুঃখ, লালসা, কলরব, আড়ম্বরের ভিতর কল্পনা ও স্বপ্ন চিন্তার দুর্ভেদ্য অঙ্কুরের বোঝা বুকে বহন করে বেড়াবার জন্মগত পাপ। কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে নিয়েছে। আমার সংসারকে ভরে দিয়েছে ছাই-কালি-ধূলির শূন্যতায়…আকাক্ষা ও উদ্যমের অকুতোভয় স্বাভাবিকতা ও অমিততেজা সাংসারিকতা যদি থাকত তাহলে গত ছ-সাত বছরের মধ্যে কোনো না কোনো কাজ আমি নিশ্চয়ই খুঁজে পেতাম; হয়ত কোনো ইস্কুলে পঁচিশ টাকার মাস্টারি নিতাম, কোনো মেসের সরকার হয়ে যেতাম হয়ত, লাইফ ইনসিওরেন্সের এজেন্সি নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে একদিনে হয়ত প্রদীপ জ্বালিয়ে ফেলতে পারতাম, দর্জির কাজ শিখে ফেলতাম কিংবা স্টেনোগ্রাফার হয়ে যেতাম, নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতায় ক্যানভাস করতাম হয়ত, কিংবা প্রাণপণে শেয়ার বিক্রি করতাম, হয়ত মুদির দোকানের মালিক হয়ে বসতাম, কিংবা-দুতিন গ্রুপে এমএ নিয়ে ফেলতাম, হয়তো নিদারুণ একনিষ্ঠতার সঙ্গে জেলে পচতাম, কিংবা ভ্রূক্ষেপহীন অক্লান্তিতে পথে পথে জুতো সেলাই করে চলতাম…আলুর আড়ৎ না-খুলে সাহিত্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছি বলে মনের ভিতর কোনো বেদনা থাকত না। যদি আমি বিবাহ না করতাম, সন্তান না হত আমার, যদি একা থাকতাম আমি–তা হলেও শিল্পসৃষ্টি ভালবেসে, সংসারে বিফল হয়ে, মনের ভিতর কোনো নিরবচ্ছিন্ন বেদনা থাকত না। হয়ত খুব লঘুভাবে থাকত। কিন্তু কল্যাণী ও খুকির ভার এমন একজনের উপর পড়েছে, যে, না পারে ঐকান্তিকভাবে শেয়ার ক্যানভাস করে বেড়াতে, না পারে ঘোলের শরবতের দোকান খুলে লক্ষ্মীকে অধিকার করবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাতে…একখানা গল্পের বইয়ের সাংসারিক দাম যে তেমন কিছু নয়, একখানা কবিতার বইয়ের দাম যে আরো ঢের কম তা তাকে বারবার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সংসার; কিন্তু তবুও সমস্ত কবিতা ও শিল্পসৃষ্টির প্রেরণা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে সংসারের ছককাটা উন্নতির পথে পরিপূর্ণ অন্তর্ধান করবার মত স্বাভাবিকতা কোনোদিনই সে অর্জন করতে পারে না। এমনই অস্বাভাবিক অবৈধ মানুষ সে, এই আর্টিস্ট…
প্রেতিনীর রূপকথা উপন্যাসের চরিত্রও বলছে, ছোটবেলায় বৈষ্ণব পদাবলীর প্রতি কেমন আসক্তি জন্মাল আমার–সেই থেকেই জীবনটা আমার নষ্ট হয়ে গেল…এখন অবিশ্যি বৈষ্ণব কবিতা চাপা পড়ে গেছে; মাঝে-মাঝে ডন ভাল লাগে, মাঝে-মাঝে হুইটম্যান, এ্যালেন, পো, কিংবা শেক্সপিয়ার-এর সনেট–কিন্তু এই সব করেই সাংসারিক জীবনটা খোয়া গেল আমার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হলেও ভাল হত, কিন্তু পাশ করলাম ইংরেজি লিটারেচারে এমএ। এখন এ বয়সেও আমার জুতো সেলাই শিখতে ইচ্ছা করে…
আমরা চারজন উপন্যাসে চরিত্র বলছে, ট্রামের কন্ডাক্টর যে হতে চাই না তা নয়; জুতা বুরুশ হতেও আপত্তি নেই, রিকশা টানতে রাজী আছি। আমরা যে অনেকদিন পর্যন্ত ইউনিভার্সিটিতে পড়েছিলাম, এমএ পাশ করেছি, আমাদের কেউ কেউ যে প্রাইজ পেয়েছি–এ সমস্তই আমরা নির্বিঘ্নে গিলে ফেলতে রাজি আছি–জুতা বুরুশ করে দু পয়সা কামাতে আমারা তিনজন সব সময়েই প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের একটা বিপদ রয়েছে এই যে, অল্প বয়স থেকেই অত্যন্ত অশুভ ক্ষণে গভীর অভিজ্ঞতার গল্প ও জীবনের ভাব প্রতিভা প্রকাশ করেছে ভালো ভাষায় যে সব লেখা–সেগুলোকে ভালোবেসেছিলাম; আমরাও অনুভব করেছি যে আমরা যা দেখেছি জেনেছি, তা রাস্তার লোকের কাছে রাস্তার লোকের মত ব্যক্ত না করে এমন ভাবে বলব যে, তার ভেতর সত্যের স্ব-ভাষিকতা আরো বেশী থাকবার জন্যই তা বেশী সুন্দর হচ্ছে বলে মনে হবে। (এবং) লেখাকে আমরা খুব গভীর কাজ বলে মনে করেছি, জুতা বুরুশ করা বা রিকশা টানার চেয়ে এ হীন নয়–বেশী পরিশ্রম ও সাধনা সাপেক্ষ, পৃথিবীর অনেকেই এ কথা স্বীকার করতে চায় না–কিন্তু আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। এই হচ্ছে আমাদের বিপদ।
জীবনানন্দের একটা গল্পের নামও রয়েছে আর্টের অত্যাচার। সেই গল্পের চরিত্র ভাবছে, বোর্ডিং-এর রুমে একা থেকে সে ভেবেছে কবি না হয়ে টেনিস খালোয়াড় হলে জীবনটা কত মুখর হত তার। কোনো চিন্তা তাকে বাধা দিত না। কোন শব্দের রাশি এসে হৃদয়ে আঘাত করে বসত না। আমাদের সাজাও, আমাদের সাজাও, আমরা নগ্ন কুৎসিত হয়ে পড়ে আছি, তুমি সাজাতে জান, তোমাকে আমরা চিনি। তুমি শৃঙ্খলার ওস্তাদ, তুমি আমাদের তুলে ধরো–তোমার হাতে আমরা সুন্দর হব। নিখিলের চোখে জল আসত না বরং সে টেনিসের র্যাকেট ছিঁড়ে গেলে একটু অসোয়াস্তি পেত, র্যাকেট মেরামত করে কত খুশি হত সে। ওই খোলোয়াড় দুটির মত কাল সারারাত ভরে চিৎকার করতে পারত সে। জীবনের না জানি কোন অনাবিষ্কৃত আস্বাদন। সে কবি। জীবনকে সে নাকি বোঝে। বোঝে বটে কিন্তু আস্বাদন করতে পারে কোথায়!…অথচ এই ছেলে দুটোর আমোদ তো নিতান্ত সামান্য। তবু তারা কবি নয়, আর্টিষ্ট নয়, পৃথিবীর অসংখ্য সামান্য আনন্দে তাদের জীবন কি নিশ্চিন্ত, তাদের বিচ্ছেদ আছে বটে, মৃত্যু আছে মানুষের সমস্ত দুঃখ তাদেরও সহ্য হয় কিন্তু তবুও এ অত্যাচার তারা জানে না। নিখিল ভাবে, লক্ষ লক্ষ লোকের থেকে বেছে নিয়ে এই যে চিন্তার পর চিন্তা অজস্র উৎশৃংখল শব্দের পর শব্দ সঙ্গে করে নিয়ে এসে দিনের পর দিন তার বুকে এই যে আঘাত করতে থাকে, নিজের এই রূপ হতে চায়–কী গভীর অত্যাচার এই।…এরা জানে না শব্দের অত্যাচার কাকে বলে, হাজার হাজার শব্দের ভিতর থেকে একটিকে বেছে নিতে রাতের পর রাত কেটে গিয়েছে না?…আর্ট মানুষকে না দেয় সুখ না দেয় সোনা। আর্ট যার জন্য সমস্ত সাধারণ উদ্দেশ্য ও আস্বাদের থেকে সে বহুদিন আগেই সরে এসেছে যাকে বুঝতে ধরতে বিশ্বাস করতে গিয়ে সকলের সহানুভূতি হারিয়ে বসেছে নিখিল। আজ সব খুইয়ে দিয়েছে সব। আর্ট আজ নিখিলকে একটা পয়সার মত পুরষ্কার দিল না, এ রুমে বসে যদি যে শুকিয়ে ঘষটে মরে যায় তার মরা শরীরটাকে লাথি দিয়ে যদি তারা অপমান করে, নর্দমায় ফেলে দেয়, যদি তাকে কুকুরের মত বিচার করে তাহলে আর্টের কড়ে আঙ্গুলে গিয়েও সে সব লাগবে না।
আর্টের ওই অত্যাচারে কাবু হয়ে জীবনানন্দ তখন কলকাতার পথে পথে একটা হারিয়ে যাওয়া হাসছানার মতো ঘুরছেন। ইতিমধ্যে বিয়ের পর, দিল্লির চাকরি হারাবার পর এক এক করে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু কোনো দিকে কোনো সুরাহা হলো না তার। জীবিকা, সংসার আর লেখালেখি এই তিনটার কোনো সমীকরণই মিলছে না তখন তাঁর জীবনে। জীবনানন্দ আপাদমস্তক আশ্রয়হীন তখন। একটা আশ্রয় খুঁজছেন তিনি, মনের আশ্রয়। যেখানে সব জাগতিক হিসাব নিকাশের বাইরে গিয়ে প্রাণ মেলে দেওয়া যাবে? মা-বাবা তার মঙ্গল কামনা করছেন জানেন কিন্তু তাদের কাছে সেই প্রাণের আরাম পাবার পরিস্থিতি তো নেই তখন, সাংসারিক বিপাকে বিপন্ন বিরক্ত লাবণ্যর কাছে সেই আশ্রয় পাবার সম্ভাবনা তো মিটে গেছে আগেই, যাকে ভালোবাসতেন সেই শোভনা এখন নাগালের অনেক অনেক বাইরে, সাহিত্য-পৃথিবীতেও তাঁর কোনো একান্ত বন্ধু নেই।
.
কাকের তরুণ ডিম পিছলায়ে পড়ে
০১.
নিরালম্ব এই কলকাতার জীবনে এ সময় হঠাৎ তার মনের আশ্রয় হয়ে উঠল বাংলার প্রকৃতি। তিনি কলকাতার মেসের ওই কংক্রিটের নিরেট বেকার জীবন। থেকে মনে মনে ছুটি নিয়ে হাজির হলেন তার আজন্ম চেনা নিমপাখি, বঁইচি, জলাঙ্গীর দেশে। তাঁর সেই বরিশালে। প্রকৃতির ভেতর তিনি যেন খুঁজে পেলেন বেঁচে উঠবার, বেঁচে থাকবার নতুন প্রেরণা। একটা ঘোরের ভেতর জীবনানন্দ এ সময় অনেকগুলো সনেট লিখে ফেললেন। সেসব সনেটে শুধু বাংলার প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনা আর সেই সঙ্গে বাংলার যুগ-যুগান্তের ইতিহাস। জীবনানন্দ সেই প্রকৃতিকে এমনভাবে অক্ষরে বন্দী করলেন, যেন তিনি তৈরি করছেন এক অক্ষরের মিউজিয়াম। লিখেছেন এমনভাবে, যেন কোনো দিন যদি কোনো এক অ্যাটম বোমার আঘাতে বাংলা নামের এই দেশ ধ্বংস হয়ে যায়, যদি বাংলা বলে কোনো দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে আর থাকে, তাহলে কোনো এক অনাগত কালের মানুষ যেন এই কবিতাগুলো পড়তে পড়তে চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো দেখতে পায় এই দেশটাকে। জীবনের ওই নাজুক পর্বে বাংলার প্রকৃতিকে নতুন করে যেন আবিষ্কার করলেন জীবনানন্দ। লিখলেন একের পর এক নেশা ধরানো কবিতা :
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে–সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বথ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে,–সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্ম জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙখচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্মীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;
সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ‘পর–
শঙ্খমালা নাম তার : এ-বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।
তাঁর মনে হয় এই বাংলার আমের পাতার ঘুমন্ত কাঁচপোকার সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেই বুঝি মধুর শান্তি আসবে তার জীবনে;
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে;
তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা–আমার তরুণ দিন
তখনো হয়নি শেষ–সেই ভালো–ঘুম আসে–বাংলার তৃণ
আমার বুকের নিচে চোখ বুজে-বাংলার আমের পাতাতে
কাঁচপোকারা ঘুমায়েছে–আমিও ঘুমায়ে রবো তাহাদের সাথে,
ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে–এই ঘাসে–কথাভাষাহীন
আমার প্রাণের গল্প ধীরে ধীরে মুছে যাবে–অনেক নবীন
নতুন উৎসব রবে উজানের–জীবনের মধুর আঘাতে
আরও লিখলেন :
পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন বাস করে হৃদয়ের নরম কাতর
অনেক নিভৃত কথা জানিয়াছি; পৃথিবীতে আমি বহুদিন
কাটায়েছি; বনে বনে ডালপালা উড়িতেছে–যেন পরী জিন
কথা কয়; ধূসর সন্ধ্যায় আমি ইহাদের শরীরের ‘পর
খইয়ের ধানের মতো দেখিয়াছি ঝরে ঝর ঝর
দু-ফোঁটা মাঘের বৃষ্টি,-শাদা ধুলো জলে ভিজে হয়েছে মলিন,
স্নান গন্ধ মাঠে ক্ষেতে…গুবরে পোকার তুচ্ছ বুক থেকে ক্ষীণ
অস্পষ্ট করুণ শব্দ ডুবিতেছে অন্ধকারে নদীর ভিতর :
এই সব দেখিয়াছি; দেখিয়াছি নদীটিরে-মজিতেছে ঢালু অন্ধকারে;
সাপমাসী উড়ে যায়, দাঁড়কাক অশ্বত্থের নীড়ের ভিতর
পাখনার শব্দ করে অবিরাম; কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐ ধারে
কে যেন দাঁড়ায়ে আছে : আরো দূরে দুএকটা স্তব্ধ খোড়ো ঘর
পড়ে আছে; খাগড়ার বনে ব্যাং ডাকে কেন–থামিতে কি পারে;
(কাকের তরুণ ডিম পিছলায়ে পড়ে যায় শ্যাওড়ার ঝাড়ে।)
নদীর পাড়ে অন্ধকার, জিন-পরির গায়ে বৃষ্টি নামছে, উড়ে যাচ্ছে সাপমাসি, নদীর পাড়ে অন্ধকারে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাঙ ডাকছে, বাসা থেকে কাকের ডিম ধীরগতিতে পড়ে যাচ্ছে শ্যাওড়ার ঝারে, এমনি এক আধিভৌতিক জগতে তখন জীবনানন্দ ডুব দিয়েছেন। তার এসব কবিতা নেহাত প্রকৃতির বর্ণনা নয় যেন, এ এক ডুবতে বসা মানুষের বেঁচে উঠবার আকুতি, তার আদিম ভালোবাসার মেনিফেস্টো। লক্ষ্য করবার, প্রকৃতি আর প্রাণিকুলের সঙ্গে পৃথিবী ভাগাভাগি করে বসবাস করার যে দাবি উঠেছে পরিবেশবাদীদের কাছ থেকে আজকাল, সে দাবি নিভৃতে তুলে গেছেন জীবনানন্দ বহুকাল আগেই। শুধু মানুষকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়বার বিরোধিতা করেছেন তিনি। তেমনি নিজ দেশের প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন জাত্যভিমান। জীবনানন্দ বলেছেন, তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও/ আমি এই বাংলার পাড়ে রয়ে যাব, দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে… অন্য পৃথিবীর দিকে যাদের চোখ তাদের প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই, তিনি শুধু নিজের সিদ্ধান্তের কথা বলছেন। তিনি বলছেন না সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি বলছেন তাঁর দেশ সবচেয়ে সুন্দর করুণ।
.
০২.
একজন পাঠকের কাছে চিঠিতে জীবনানন্দ এই কথাটাই লিখেছেন একসময়, বলেছেন যে জীবনের নানা বিড়ম্বনার ভেতর যখন তিনি একধরনের রুদ্ধশ্বাস সময় কাটাচ্ছিলেন, তখন আবহমান বাংলা আর বাঙালির এই জীবন, প্রকৃতি, ইতিহাসের ভেতর ডুব দিয়ে তিনি নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন। অক্ষরের ভেতর দিয়ে এভাবে একেবারে বাংলার নাড়ির ভেতর ঢুকে তিনি শ্বাস নিচ্ছিলেন তখন। সেই চিঠিতে জীবনানন্দ জানিয়েছেন যে ধারাবাহিকভাবে লিখিত এই কবিতাগুলো প্রত্যেকে আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র সত্তার মতো নয় কেউ, অপর পক্ষে সার্বিক বোধে এক শরীরী, গ্রামবাংলার আলুলায়িত প্রতিবেশ প্রসূতির মতো ব্যষ্টিগত হয়েও পরিপূরকের মতো পরস্পরনির্ভর… বাংলাকে নিয়ে লেখা এই কবিতাগুলোও জীবনানন্দ ছাপাননি কোথাও। আরও অনেক লেখার মতো সযত্নে রেখে দিয়েছেন তাঁর সেই কালো ট্রাঙ্কে। তবে সনেটগুলো নিয়ে একটা বই বের করবার কথা ভেবেছিলেন তিনি, নামও ঠিক করে রেখেছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা। কেন এমন নাম দিতে চেয়েছিলেন তিনি? সে কি এই কারণে যে নগরায়ণের চাপে বাংলার সেই মৃদু প্রকৃতি আসলে তখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছে? জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর সেই অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হলো কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনা সিগনেট প্রেসের উদ্যোগে। তবে জীবনানন্দ প্রস্তাবিত নাম গেল বদলে। সিগনেট প্রেসের মালিক দীলিপ কুমার বললেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা নামটা বড় ভারী। তিনি বইটার নাম দিলেন রূপসী বাংলা। ঘটনা শেষে এই দাঁড়াল যে বৃহত্তর পাঠকের কাছে জীবনানন্দ একদিন পরিচিত হলেন রূপসী বাংলার কবি হিসেবেই।
জীবনানন্দের জানবার কথা নয় যে যখন তিনি এই পৃথিবীতে নেই, তখন তার চেনা বাংলার নীলিমা অনেকগুলো দিন, মাস বাস্তবিকই ভীষণ ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। ত্রস্ত হয়েছিল অন্য এক কারণে। কারণ, তাঁর সেই প্রিয় বাংলার মাটি, নদী, আকাশে তখন শেল, মর্টার, মেশিনগানের তাণ্ডব। একটা ব্যাপক যুদ্ধ বেধেছিল এখানে। নিভৃতচারী এই কবির নাম তখন উচ্চারিত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। জীবনানন্দ জানবার সুযোগ পাননি যে বরিশালসহ পূর্ব বাংলার রণাঙ্গনে স্টেনগান। হাতে মুক্তিযোদ্ধারা তখন গেয়েছেন, বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ। যুদ্ধ মানে তো শুধু অস্ত্রের দাপট নয়, যুদ্ধ মানে দেশের জন্য মায়াও। তাঁর কবিতা দেশের জন্য সেই মায়া জাগিয়েছিল সবার মনে। তারপর একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষে একদিন সেই কাঁঠাল পাতা ঝরার দেশে ফুটে উঠেছে নতুন এক দেশ, বাংলাদেশ।