২. ধ্বনিপরিবর্তন-সূত্র

দ্বিতীয় অধ্যায় – ধ্বনি-পরিবর্তন

১. ধ্বনিপরিবর্তন-সূত্র

ভাষা পরিবর্তনশীল। নদীর মতোই ভাষা অখণ্ডস্রোতে চলে এবং নিয়ত গতিপথ বদলাইতে চেষ্টা করে। ভাষার পরিবর্তন—মুখ্যত ধ্বনিপরিবর্তন—অনুধাবন করিলে প্রায়ই কতকগুলি সুনির্দিষ্ট সূত্র পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক ভাষায় কালক্রমে যে ধ্বনিপরিবর্তন সংঘটিত হয় তাহা বিশেষ বিশেষ নিয়মের মধ্যে ধরা যায়। যেমন সংস্কৃত [জতু, মধু, বধূ, সখী] বাঙ্গালায় হইয়াছে (জউ, মউ, বউ সই)। এইরকম উদাহরণ হইতে ধ্বনিপরিবর্তন-সূত্র দেখানো যায় যে, সংস্কৃতের দুই স্বরধ্বনির মধ্যবর্তী [ত, ধ, খ] ইত্যাদি ব্যঞ্জনধ্বনি আধুনিক বাঙ্গালায় লুপ্ত হইয়াছে। প্রাচীন বাঙ্গালা [রাতি, পাঁতি, আঁশু, ফাগু] আধুনিক বাঙ্গালায় হইয়াছে [রাত, পাঁত, আঁশ, ফাগ]। ইহা হইতে এই সূত্র আবিষ্কৃত হয় যে, প্রাচীন বাঙ্গালার অন্ত্য ই-কার ও উ-কার আধুনিক বাঙ্গালায় (পশ্চিমবঙ্গের উপভাষায়) লোপ পাইয়াছে।

ধ্বনিপরিবর্তনের নিয়মের অন্যথাও অনেক সময়ে হয়। সে সব ব্যতিক্রম কেন হইল তাহার কারণ দুর্লক্ষ্য নয়। ধ্বনিপরিবর্তন-সূত্রের অধিকার বিষয়ে দুইটি শর্ত মানিতে হইবে। (১) ধ্বনিপরিবর্তন-সূত্রটি কোন বিশেষ ভাষার বিশেষ অবস্থায়ই খাটে, অন্য অবস্থায় খাটে না। (২) শব্দের মধ্যে ধ্বনিগুলির সুনির্দিষ্ট সংস্থানেই সূত্রের অনুযায়ী পরিবর্তন ঘটিতে পারে, অন্যথা নয়। পূর্বে দেখানো গিয়াছে যে, প্রাচীন বাঙ্গালার অন্ত্য ই-কার ও উ-কার আধুনিক বাঙ্গালায় লোপ পাইয়াছে। এই সূত্র পূর্ববঙ্গের উপভাষায় প্রযোজ্য নয়; পূর্ববঙ্গের উপভাষায় এখানে ধ্বনি দুইটি লুপ্ত হয় না, স্থান পরিবর্তন করে। সুতরাং প্রাচীন বাঙ্গালার [আজি, কালি] স্থানে পশ্চিমবঙ্গে [আজ, কাল] এবং পূর্ববঙ্গে (আইজ, কাইল) হইয়াছে। সংস্কৃতের পদমধ্যস্থিত ড-কার বাঙ্গালায় ড়-কার হয়। এটি একটি সূত্র। যেমন ‘বিড়াল’ হইতে ‘বিড়াল’ ‘আড়ম্বর’ হইতে ‘আড়ম্বর’। এই সূত্র খাটে তখনই যখন ড-কারের ঠিক আগে কোন ব্যঞ্জনধ্বনি থাকে না। যেমন ‘দণ্ড’ হইতে ‘দাণ্ডা’, ‘ষণ্ড’ হইতে ‘ষণ্ডা’। ব্যঞ্জনধ্বনি অনুনাসিক হইয়া পূর্ববর্তী স্বরধ্বনিতে চলিয়া গেলে সূত্র, তখন খাটে। ‘ভণ্ড’ হইতে ‘ভাঁড়’ ‘ষণ্ড’ হইতে ‘ষাঁড়’॥

২. সাদৃশ্য

গণিত-সূত্রের যেমন ব্যতিক্রম নাই, ধ্বনিপরিবর্তন-সূত্রের তেমন নয়। ভাষার জন্ম ও বিকাশ হইয়াছে মানুষের সামাজিক বোধ ও আন্তর প্রেরণা হইতে। মানুষের মনের বাহিরে ভাষার অস্তিত্ব নাই। সুতরাং মানুষের মনের খেলা অনুযায়ী ভাষার নিয়মশীলতার ব্যতিক্রম হইতে পারে, এবং হইয়াও থাকে। ব্যতিক্রমের অবকাশ বেশি নাই, এবং ব্যতিক্রমের কারণও সাধারণত অজ্ঞেয় নয়। যে সাম্যবোধ আদিম মানবের শিশুমনে জাগ্রত ছিল বলিয়া তাহার কণ্ঠোদ্‌গীর্ণ অপরিস্ফুট অত্যন্ত অগোছালো অসংলগ্ন বিচ্ছিন্ন শব্দসমূহকে গুছাইয়া ভাষার গণ্ডীতে আনিয়াছিল, তাহা অন্ধকার অতীতের কাল হইতে অদ্যাবধি মানুষের মনে নিয়ত জাগরূক থাকিয়া তাহার ভাষাবন্ধনকে দৃঢ় রাখিয়াছে সেই সাম্যবোধই ভাষাশক্তির একটা মূল উৎস। একই শ্রেণীর ভিন্নাকার বিবিধ পদকে এক ছাঁচে ঢালিবার প্রচেষ্টার ফলেই সকল উন্নতিশীল ভাষার ব্যাকরণ সরল হইতে সরলতর হইয়া চলিয়াছে।

একাধিক ভিন্নাকার শব্দ যদি অন্য শব্দের আকার পায় তবে সেই ব্যাপারকে বলে সাদৃশ্য (Analogy)। কখনো কখনো ইহারই প্রভাবে অনেক শব্দ সুনির্দিষ্ট ধ্বনিপরিবর্তনের নিয়ম এড়াইয়া যায়। একটি উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া বলিতেছি।

সংস্কৃতে শব্দমধ্যস্থিত যুক্ত (conjunct) ব্যঞ্জনধ্বনি প্রাকৃতে যুগ্ম (double) ব্যঞ্জনধ্বনিতে পরিণত হইয়াছিল, এবং প্রাকৃতের এই যুগ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি আবার বাঙ্গালায় একটিমাত্র ব্যঞ্জনে পরিণত হইল, আর এই ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী হ্রস্ব স্বর, দীর্ঘ হইল। যেমন, সং কর্ম > প্রা কম্ম > বা কাম, নিদ্রা > নিদ্দ > নীদ, পশ্চা(ৎ) > পচ্ছ > পাছ, ভক্ত > ভত্ত> ভাত, সন্ধ্যা > সঞ্‌ঝা >সাঁঝ, ইত্যাদি। কিন্তু সংস্কৃত ‘সর্ব’ হইতে প্রাকৃতে ‘সব্ব’ হইল বটে, কিন্তু তাহা হইতে বাঙ্গালায় ‘সাব’ না হইয়া ‘সব’ হয় কেন? এখানে তো সূত্রের ব্যতিক্রম হইল। ইহার উত্তরে বলিতে পারা যায় যে, সম্ভবত এখানে ‘সভা’ শব্দের প্রভাব পড়িয়াছে, তাই ‘সাব’ না হইয়া ‘সব’ হইয়াছে। যে সময়ে প্রাকৃত ভাষা হইতে বাঙ্গালা ভাষার উদ্ভব হয়, সে সময়ে বহুত্বজ্ঞাপক ‘সভা’ শব্দের প্রচলন ছিল, এখন যেমন আমরা বহুবচনে ‘গণ, সমূহ, সমাজ, সম্প্রদায়’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করিয়া থাকি, সেইরকম॥

৩. ধ্বনিপরিবর্তনের বিবিধ কারণ

ধ্বনিপরিবর্তনের কারণ অনেকরকম,—বক্তার জিহ্বার জড়ত, শ্রোতার শ্রবণশক্তির অপ্রখরতা, পরিচিত অন্য ভাষার ধ্বনির প্রভাব, ব্যক্তিবিশেষের উচ্চারণের অনুকরণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এ সব কারণ বহিরঙ্গ, ব্যক্তি বিশেষের উচ্চারণ বৈষম্যের হেতু। তবে এইরকম ব্যক্তিগত উচ্চারণ-বৈষম্যই ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করিয়া ব্যাপক পরিবর্তন আনিয়া সর্বজনের গ্রাহ্য হইয়া দাঁড়ায়। বয়স্ক লোকের সঙ্গে থাকিয়া শিশু যখন ক্রমে ক্রমে ভাষার অধিকার লাভ করিতে থাকে তখন তাহার পরিবেশে আত্মীয়স্বজন দাসদাসীর কথাই সে অনুকরণ করিতে থাকে। তাহার পর শিশু বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে তাহার সেই অধিগত ভাষারীতি, উচ্চারণে ও পদপ্রয়োগে বিকৃতি থাকিলে সে সব সমেত, সে তাহার বিশিষ্ট পরিবেশে ব্যবহার করিতে থাকে এবং এইভাবে তাহা পরবর্তী পুরুষে সঞ্চারিত করিয়া দেয়। এইরূপে ভাষাবিকার পুরুষান্তরক্ৰমে ব্যক্তি হইতে পরিবারে, পরিবার হইতে গোষ্ঠীতে, গোষ্ঠী হইতে সমাজে—এইভাবে সঞ্চারিত হইতে থাকে।

পরিবর্তনের একটি কারণ হইতেছে ভিন্নসম্প্রদায়ের সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্রব। দুই ভাষাসম্প্রদায়ের সংস্রব ঘনিষ্ঠ হইলে এক ভাষা (সাধারণত হীনতর অথবা যে ভাষার খাতির কম) অপর ভাষা (সাধারণত উন্নততর অথবা যে ভাষার খাতির বেশি) হইতে শব্দ ও ইডিয়ম যথেচ্ছ গ্রহণ করিয়া থাকে। সংস্রব অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হইলে দৈবাৎ এক ভাষার ধ্বনিগত বিশেষত্ব অপর ভাষায় সঞ্চারিত হইতে পারে। ত্রয়োদশ শতাব্দে বাঙ্গালাদেশ মুসলমান অধিকারে আসিতে থাকে এবং চতুর্দশ শতাব্দের মধ্যে প্রায় সমগ্র বাঙ্গালাদেশে মুসলমানের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমান শাসকদের কাজের ভাষা ফারসী। সুতরাং তখন হইতে বাঙ্গালা ও ফারসী দুই ভাষাই চলিতে থাকে। ফারসী ভাষা শাসকের ভাষা বলিয়া লোকব্যবহারে সে ভাষার গৌরব বেশি ছিল। এই কারণে বাঙ্গালা ভাষায় এমন অনেক শব্দ আসিয়া গিয়াছে যাহার কোনই প্রয়োজন ছিল না। যেমন ‘হাওয়া’, ‘বাতাস’ (‘বা’ ‘বাও’ স্থানে), ‘লাল’ (‘রাতা’ স্থানে), ‘মজুর’ (বেরুনে’ স্থানে), ‘কুলুপ’ (‘কুঁজি-তালা’ স্থানে) ইত্যাদি।

তাহার পর অষ্টাদশ শতাব্দের শেষভাগে ইংরেজ-অধিকার শুরু হইল। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন ধরিয়া রাজকার্যে ফারসী চলিত রহিল কিন্তু ইংরেজের ভাষা ইংরেজীর মান ও মূল্য সব উপরে গেল। তাহার পর ইংরেজী ফারসীর স্থানও লইল এবং শিক্ষার প্রধান বিষয় হইয়া দাঁড়াইল। বাঙ্গালার তুলনায় ইংরেজী মর্যাদায় ও মাহাত্মে বড়। সুতরাং অনাবশ্যক হইলেও ইংরেজী শব্দ ও ইডিয়াম কখনো কখনো বাঙ্গালা ও ফারসী শব্দের স্থানে গৃহীত হইল। যেমন, ‘গোটুহেল’, ‘গোটেহেল’ (go to hell)—‘উচ্ছন্ন যাও’ স্থানে; ‘ইস্টুপিট’ (stupid)—‘আহাম্মক’ স্থানে; ‘কাপ’—‘পেয়ালা’ স্থানে; ‘ডিশ’—‘পিরিচ’ স্থানে; ইত্যাদি।

ভৌগোলিক অবস্থান ধ্বনিপরিবর্তনের গৌণ কারণ হইতে পারে। ভৌগোলিক অবস্থানের উপর দেশের আবহাওয়া নির্ভর করে, এবং আবহাওয়ার উপর দেশের অধিবাসীদের দেহচর্চা ও শরীর-প্রক্রিয়া (উচ্চারণে মুখপ্রযত্ন ইত্যাদি) নির্ভর করে। সুতরাং একই ধ্বনির উচ্চারণে স্থানবিশেষে ঈষৎ বৈলক্ষণ্য দেখা দিতে পারে। তবে এ বিষয়ে কোন স্থির সিদ্ধান্ত অদ্যাপি হয় নাই। তাহা ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী এবং বিভিন্ন বিচিত্র গবেষণার উপর নির্ভর করিতেছে।

পূর্বে বলিয়াছি যে, ভাষায় যে সুষমতা দেখা যায় তাহা আসলে ভাষার স্বভাববিরুদ্ধ সুতরাং কৃত্রিম। মুখে যাহা বলি তাহাই আসল ভাষা। প্রত্যেক দলের ও সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ভাষায়, অর্থাৎ ছোটখাট উপভাষায় এমন কিছু না কিছু বিশিষ্টতা থাকে যাহা অন্য দলে ও গোষ্ঠীতে নাই। এই বিশিষ্টতাগুলিই উপভাষার বীজ। আরও তলাইয়া দেখিলে জানিব যে, কোন দলের উপভাষার মূলে আছে সেই দলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রভাববান্‌ ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির অথবা পরিবারের বিশেষ বাচনভঙ্গি। সুতরাং ভাষার বিশেষত্বের জড় খুঁজিলে শেষ পর্যন্ত গিয়া পাইব ব্যক্তি অথবা পরিবার বিশেষের বাক্-ব্যবহারে। ভাষাবিজ্ঞানবিদেরা অনুমান করেন যে, ধ্বনিপরিবর্তনের মূল খুঁজিলেও পরিশেষে আমরা এইরূপে কোন ব্যক্তি বা পরিবার বিশেষের উচ্চারণভঙ্গিতে পৌঁছিতে পারি। কিন্তু এ অভিমত সপ্রমাণ করিবার মতো উপাদান চিহ্নবিহীন অতীতের গর্ভে বিলীন। এখন যদি আমরা যথেষ্ট উপাদান রাখিয়া যাই তবে ভবিষ্যৎকালের ভাষাবিজ্ঞানবিদেরা তাহা ব্যবহার করিয়া ভবিষ্যতে হয়ত কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছিতে পারিবেন॥

১. এ সব নিয়ম আইনের মতো অলঙ্ঘনীয় নয়, ভাষাসম্প্রদায়ের উচ্চারণরীতিরই সাময়িক প্রকৃতির নির্দেশক। সেইজন্য এ নিয়মের ব্যতিক্রমও হয়।

এই উদাহরণটিকে ব্যতিক্রম না বলাই বোধ হয় ঠিক। সঙ্গততর ব্যাখ্যা পরে দ্রষ্টব্য

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *