২. দ্য মিরাকল মর্নিং-এর উৎপত্তি : হতাশা থেকে সৃষ্টি
হতাশা হলো ব্যাপক পরিবর্তনের কাঁচামাল। একমাত্র তারাই রক্ষা পাওয়ার আশা করতে পারে, যারা তাদের বিশ্বাস করা সব কিছু পিছনে ফেলে যেতে পারে।
—William S. Burroughs
আপনার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনের জন্যে দুটো জিনিস প্রয়োজন : হয় অনুপ্রেরণা আর না হয় হতাশা।
—Anthony Robbins
আমি ভাগ্যবান যে আপনারা যাকে বলেন “rock bottom” অর্থাৎ একেবারে তলানিতে পড়ে যাওয়া সেরূপ অবস্থায় আপেক্ষিকভাবে কম সময়ের মধ্যে দুইবার পতিত হয়েছি। আমি ‘ভাগ্যবান’ শব্দটা এই জন্যে বললাম যে এটা থেকে আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম এবং শিক্ষা পেয়েছিলাম। এটা ঘটেছিল আমার জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়ে এবং এটা আমাকে সক্ষম করেছিল ঠিক সেই ব্যক্তিটি হতে, যে ব্যাক্তিতে পরিণত হওয়াটা আমার জন্যে খুবই প্রয়োজন ছিল। এটা প্রয়োজন ছিল, আমি সব সময়ে যে জীবন চেয়েছি সেই জীবনটি সৃষ্টি করে নেওয়ার জন্যে। আমি শুধু আমার সাফল্যের জন্যেই কৃতজ্ঞ নই, ব্যর্থতার জন্যেও কৃতজ্ঞ। আমার এই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা অনেককে এভাবে সাহায্য করেছে যে, তারা শক্তিমান হয়েছে তাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সক্ষম হয়েছে তারা জীবনে যতটা অর্জন করা সম্ভব বলে এতদিন মনে করত তার চেয়ে বেশি অর্জন করতে।
আমার প্রথম সর্বোচ্চ খারাপ সময়: ঘটনাস্থলে মৃত
আপনারা জানেন যে, আমার প্রথম রক বটমটিই ( জীবনের সর্বোচ্চ খারাপ সময়) প্রায় হয়ে যাচ্ছিল আমার জীবনের শেষ রক বটম। কারণ ওটাতে আমি, প্রায় মারা গিয়েছিলাম। ২০ বছর বয়সে একজন মাতাল ড্রাইভারের কারণে আমার মাথা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। আমি যেন মারাই গিয়েছিলাম। (আমি এটা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি আমার প্রথম বই Taking Life Head On: How To Love the Life You Have While You Create the Life of Your Dreams- এ। সেখানে দেখিয়েছি কীভাবে অসংখ্য প্রতিকূল অবস্থা থেকে আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি এবং সেই সঙ্গে আরও রয়েছে আমার পাওয়া ৮টি শিক্ষা যা তাৎক্ষণিকভাবে আপনার জীবনের মান বৃদ্ধি করবে।)
আমার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খারাপ সময় : দেনায় নিমজ্জিত ও গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত
দ্বিতীয়বারের মতো হতাশায় ডুবে যাওয়াটা আমার জন্যে ছিল গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া অবস্থার চেয়ে খারাপ।
এটা ২০০৮ সালের কথা। সেই ১৯৩০ দশকের কুখ্যাত মহামন্দার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ২০০৮ সালে মন্দার চরম অবস্থা বিরাজ করছিল। গাড়ি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ার পরের বছরগুলোতে, আমার বিক্রয় ক্যারিয়ারে ( sales career) ও প্রশিক্ষণ ব্যবসায়ে (coaching business) সর্বোচ্চ সফলতা এবং একটি বেস্টসেলিং বই লেখা সত্ত্বেও আমি আবার চ্যালেঞ্জে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি মানসিক ও আর্থিকভাবে সম্পূর্ণরুপে ভেঙে পড়েছিলাম।
দৃশ্যত রাতরাতি আমি যেভাবে সফল উদ্যোগ সৃষ্টি করেছিলাম তা আর লাভজনক ছিল না। অমার মাসিক আয় অর্ধেকে নেমে এসেছিল। আমি আমার বিলসমূহ পরিশোধ করতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলাম। আমি সবেমাত্র আমার প্রথম বাড়িটি কিনেছিলাম। আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, আমরা প্রথম সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছিলাম। দেনায় ডুবে গেলাম, সবকিছু বন্ধক, এরূপ অবস্থায় পড়ে জীবনে প্রথম প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়ে গেলাম।
আমি জীবনের সর্বনিম্নতম স্তরে চলে গেলাম। এর চেয়ে খারাপ কিছু কি হতে পারত? সম্ভবত। কিন্তু ওটাই কি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা? একেবারেই তাই। আমি একদম তলানিতে চলে গেলাম।
কেন দেনা মৃত্যুর চেয়ে খারাপ
যদি আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আমার জন্যে কোনটা বেশি কঠিন ছিল, আমার গাড়ি দুর্ঘটনা না আর্থিক সংগ্রাম? আমি এখনও পর্যন্ত আর্থিক সংগ্রামের কথাই বলব। মাতাল ড্রাইভারের কারণে মাথায় আঘাত পাওয়া, ১১টি হাড় ভেফু যাওয়া, স্থায়ীভাবে মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যন্ত্রণা, ছয় মিনিটি মৃত অবস্থায় পড়ে থেকে এবং জ্ঞান ফিরে পেয়ে এরকম একটা সংবাদ জানা যে, আমি হয়ত আর কখনোই হাঁটতে সক্ষম হবো না- অধিকাংশ মানুষ মনে করবে যে কারো জীবনে এগুলো হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন অবস্থা। এরকম একটা ধারণা সঠিক— এই জাতীয় ভয়ঙ্কর ধংস থেকে পাওয়া যে শারীরিক, মনোজাগতিক এবং মানসিক যন্ত্রণা, তা কোনো ব্যক্তির জীবনের সর্বনিম্ন খারাপ অবস্থা হিসাবেই গণ্য হবে।
আপনি দেখুন, আমার গাড়ি দুর্ঘটনার পর আমার সেবা করার জন্যে অনেক মানুষ ছিল। হাসপাতালে আমার পরিবার কখনোই আমার পাশ থেকে সরেনি। আমি একটানা দর্শনার্থী পরিবেষ্টিত ছিলাম। পরিবারের লোকজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই আমার দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন। আমাকে ভালোবাসায় সিক্ত করেছিলেন ও সাহস দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার জন্যে অবিশ্বাস্য রকমের আন্তরিক কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স ছিলেন, যারা সর্বক্ষণ সার্বিকভাবে আমার যত্ন নিচ্ছিলেন ও সুস্থতার জন্যে তদারকি করছিলেন। তারা আমার জন্যে খাবার তৈরি করে পরিবেশন করছিলেন। সেখানে দৈনন্দিন কাজ কিংবা বিল পরিশোধের কোনও চাপও ছিল না। হাসপাতালের জীবনটা ছিল খুবই সহজ ও ভারমুক্ত।
দ্বিতীয় বারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তখন আমার জন্যে কারো কোনো সহানুভূতি ছিল না। কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। আমার যত্ন নেওয়া ও সুস্থতার বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার কেউ ছিল না। কেউ আমার জন্যে খাবার নিয়ে আসেনি। তখন আমার সঙ্গে শুধু আমি ছাড়া কেউ ছিল না। সবাই তাদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই যেন ভেঙে পড়ছিলাম। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে আমি যেন অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম।
আমাকে ভয় ও অনিশ্চয়তায় পেয়ে বসেছিল। শুধু বিছানায় শুয়ে থাকাটাই যেন ছিল আমার একমাত্র স্বস্তি। প্রতিদিন আত্মহত্যা করার কথা ভাবতাম। এরকম না যে, আমি শুধু আত্মহত্যার ভাবনাতেই নিমগ্ন থাকতাম। একজন মানুষের জীবনে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত শুধু সবচেয়ে স্বার্থপর একটা ব্যাপারই নয়, (যেহেতু এটা অনেক মানুষকেই কষ্ট দেয়), কিন্তু খুব গভীরভাবে ভাবলে, আমি জেনেছিলাম— জীবন যত কঠিনই হোক না কেন, সব সময়ই এটা থেকে বের হয়ে আসার একটা উপায় আছে। কিন্তু তবুও আত্মহত্যার চিন্তাতেই আমি ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। আমার অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসার কোনো উপায় দেখছিলাম না। আমি কোনো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না, যা আমাকে মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি দেবে।
যে সকালটি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল
তারপর এক সকালে সবকিছু পাল্টে গেল। খুব হতাশা নিয়ে ঘুম থেকে উঠি। যেন গোটা সপ্তাহটাই এমন ছিল। কিন্তু ওই সকালে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু করে ফেললাম। আমি আমার এক বন্ধুর পরামর্শমত মাথাটা হালকা করতে সকালে দৌড়ালাম। আমি দৌড়াতে অভ্যস্ত ছিলাম না। প্রকৃত পক্ষে শুধুমাত্র দৌড়ানোর জন্যে দৌড়ানো আমার খুব অপছন্দের ছিল। যাহোক, আমার প্রিয় বন্ধু Jon আমাকে বলেছিল যে, যখন সে খুব চাপ অনুভব করত তখন সে দৌড়াতো। কারণ এটা তাকে সক্ষম করে তুলত অধিক স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে, তার তেজ বাড়িয়ে দিত এবং এটা তাকে সমস্যার সমাধান পেতে সহযোগিতা করত। আমি মরিয়া ছিলাম। আমার কিছুই হারানোর ছিল না। আমি দৌড়ানোর কথা ভাবলাম।
সুতরাং সেই সকালে আমি আমার বাস্কেটবল স্যু পরে দৌড়ানোর প্রস্তুতি নিলাম। আমার iPod সঙ্গে নিলাম যেন ভালো কিছু উপভোগ করতে পারি। বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, যে বাড়িটি খুব শিগগিরই ব্যাংকের অধিকারে চলে যাবে। যদিও আমার কোনো ধারণাই ছিলনা যে, ওই দৌড়ে আমি পেয়ে যাব আমার সারা জীবনের সবচেয়ে শক্তিমান, গভীর ও জীবন বদলানো যুগান্তকারী পরিবর্তনসমূহ। (breakthroughs )
Jim Rohn-এর একটি আত্ম-উন্নয়নমূলক অডিও শুনছিলাম, এই অডিওটি যদিও আমি আগে শুনেছি, প্রকৃতপক্ষে কখনোই অনুধাবন করতে পারিনি। আপনি জানেন যে, কখনো কখনো কোনো কিছু বারবার শোনা সত্ত্বেও আপনার জীবনে তা কার্যকরী হয় না। কিন্ত অবশেষে কোনো এক দিন এটা আপনার জীবনে ক্লিক করে। আপনার মন একদিন পুরোপুরি উপযুক্ত হয়ে যায় এটা সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্যে। সেই সকালে, আমি আমার মনের সঠিক অবস্থানে ছিলাম, ওটা ছিল একটা মরিয়া অবস্থা আর তাই আমি সঠিকভাবে ধরতে পেরেছিলাম। যখন আমি শুনেছিলাম যে Jim খুব নিশ্চয়তার সঙ্গে ঘোষণা করছে, “আপনার সফলতার স্তর, খুব কমই আপনার ব্যক্তিগত উন্নতির স্তর অতিক্রম করবে, কারণ সফলতা এমন একটা জিনিস যা আপনি ঠিক সেই ব্যক্তিটি হয়ে তবেই আকৃষ্ট করেন।” আমি চলতে চলতে থমকে গিয়েছিলাম। এই একটি দর্শনই আমার সারা জীবন বদলে দিতে চলেছিল।
সমান্তরাল সফলতা
সহসা এটা আমাকে জাগিয়ে দিল। এটা ছিল যেন একটা জোয়ার। এক বাস্তবতার জোয়ার। ওলটপালট করা সে জোয়ারে আমি এই সত্যের মুখোমুখি হলাম যে আমি নিজেকে সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে পারছিলাম না, সেই ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারছিলাম না, যে ব্যক্তিটি হওয়া আমার জন্যে প্রয়োজন ছিল আমার কাঙ্ক্ষিত সফলতার স্তর আকর্ষণ করতে, সৃষ্টি করতে ও ধরে রাখতে। এক থেকে দশের স্কেলে আমি দশ স্তরের (Level 10 success) সফলতা চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত উন্নতির স্তর ছিল দুই কিংবা তিন স্তরের, অথবা খুব শুভ কোনো দিনে তা ছিল চার।
আমি বুঝতে পারলাম, এটা ছিল আমাদের সবার সমস্যা। আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা সবাই ১০ম বা সর্বোচ্চ স্তরের সফলতা আশা করি। স্বাস্থ্য, সুখ, অর্থসম্পদ, সম্পর্ক, ক্যারিয়ার, আত্মিকতা সব ক্ষেত্রেই আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকতে চাই। কিন্ত আমাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নের স্তর (জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, মানসিকতা, বিশ্বাস উত্যাদি) যদি দশম বা সর্বোচ্চ পর্যায়ের না হয় তাহলে জীবন সব সময়ই একটি সংগ্রামের ভেতর পড়ে যায়।
আমাদের বাহ্যিক পৃথিবী সব সময়ই আমাদের ভিতরের জগতের একটা প্রতিফলন। আমাদের সফলতার স্তর সব সময়ই আমাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নের সমান্তরাল হয়ে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কাঙ্ক্ষিত জীবন সৃষ্টিতে প্রতিদিন ও প্রতিটি মুহূর্তে নিবেদিত না হবো, ততদিন পর্যন্ত সফলতা শুধুমাত্র অর্জনের সংগ্রাম হয়ে থাকবে। বলা যায় অধরাই থাকবে।
আমি সরাসরি বাড়ির দিকে দৌড়ে আসি। আমি প্রস্তত হয়েছিলাম আমার জীবনটি বদলাতে।
আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ: সময় বের করা
আমি এটা বুঝতে পারলাম যে, আমার সব সমস্যার সমাধান ছিল প্রতিদিন আমার জীবনের ব্যক্তিগত উন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। এটা ছিল সেই মিসিং লিঙ্ক ( missing link) যা আমাকে সেই ব্যক্তি হতে সক্ষম করবে, যে ব্যক্তিটি হওয়া আমার জন্যে খুবই প্রয়োজন ছিল অনবরত জীবনকে আকৃষ্ট করতে, সৃষ্টি করতে ও আমার কাঙ্ক্ষিত সফলতা ধরে রাখতে।
যাহোক, সবার মতো আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল সময় বের করা। শুধুমাত্র জীবনে টিকে থাকতে ও বিল পরিশোধ করতে আমি এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, আমার ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্যে অতিরিক্তি সময় বের করার ধারণাটা ছিল যেন প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।
বেস্টসেলিং লেখক Matthew Kelly-এর এই কথাগুলো আমার খুব ভালো লাগে। তিনি বলেছেন,”একদিকে আমরা সবাই চাই সুখী হতে। অন্যদিকে আমরা সবাই জানি, কোন জিনিসগুলো আমাদেরকে সুখী করে। কিন্ত সেই কাজগুলো আমরা করি না। কেন? খুব সহজ। আমরা খুব ব্যস্ত। কোন কাজে ব্যস্ত? আমরা সবাই ব্যস্ত সুখী হওয়ার প্রচেষ্টায়।”
সুতরাং আমার পরিকল্পনা আঁকড়ে ধরলাম। সোফায় বসলাম। সময় বের করার জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম। কয়েকটি অপশন নিয়ে ভাবতে থাকলাম :
সন্ধ্যাটা হতে পারে কি?
আমি প্রথমে ভাবলাম, কাজের শেষে সন্ধ্যাবেলা আমি সময় বের করতে পারি অথবা এটা হতে পারে অধিক রাতে, যখন আমার সঙ্গী ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তখন আমি উপলব্দি করলাম, সারাদিনের ভেতর একমাত্র সন্ধ্যাটাই আমাকে তার সঙ্গে কাটাতে হয়। এটা না বললেও চলে যে গভীর রাতটাই আমার জন্যে সেরা সময়। আমি সাধারণত এত ক্লান্ত থাকি যে, মন স্থির করা আমার জন্যে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি চ্যালেঞ্জের। প্রকৃতপক্ষে আমি সুসঙ্গত নই। সুতরাং ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্যে সর্বোত্তম সময়ের প্রশ্নই আসে না। সন্ধ্যাটা কোনোভাবেই সর্বোত্তম সময় হলো না।
সম্ভবত বিকালটা?
আমি কি দিনের মাঝখানে সময়টা বের করতে পারি? সম্ভবত এটা হতে পারে আমার মধ্যাহ্ন বিরতিতে। অথবা এই সময়ের মধ্যে যখনই আমি অতিরিক্তি সময় বের করতে পারি। নাহ, সেই অতিরিক্ত সময় বের করা গেল না।
সকালে হতে পারে না!
তখন আমি সকাল বেলাটা বিবেচনায় নিলাম, কিন্তু নিজের থেকে বাধা পেলাম। আমি যে সকালে উঠা মানুষ নই, এটা বলাটা যেন একটা অবমুল্যায়ন। আসলে ভোরে উঠতে আমি ভয় পেলাম। বিশেষ করে সকালে উঠাটা আমার কাছে দৌড়ের মতোই অপছন্দের। কিন্তু সকালে উঠার ব্যাপারে আমি যত বেশি চিন্তা করতে থাকি, তত বেশি কয়েকটি বিষয় আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতে থাকে।
প্রথমত আমার মনে হলো, আমার ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্যে সকালে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারলে আমার দিনটা শুরু হবে খুবই ইতিবাচক উদ্দীপনা ও প্রেরণার সঙ্গে। সকালে আমি শিখতে পারব নতুন কিছু। আমি সম্ভবত সারা দিনের জন্যে আরও অধিক উৎসাহী, একাগ্র ও অনুপ্রাণিত হতে পারব। The Rudder of the Day টাইটেলে Steve Pavlina.com – এ পাওয়া একটি ব্লগ পোস্টের কথা মনে পড়ে গেল। Steve, যিনি Personal Development for Smart People বইয়েরও লেখক, বলেছেন, “এটা বলা হয়ে থাকে যে, প্রথম ঘণ্টাটি হচ্ছে দিনের রাডার। যদি আমি জেগে উঠার প্রথম ঘণ্টাতেই অলস ও এলোমেলো হই তাহলে সারাদিনই আমার একটি অলস ও নিস্প্রভ দিন কাটানোর প্রবণতা থাকবে। কিন্তু যদি আমি দিনের প্রথম ঘণ্টাটি উৎপাদনশীল করতে পারি, দিনের বাকিটা সময় সেদিকেই যাবে।”
এটা উল্লেখ না করলেও চলে, সকালে ব্যক্তিগত উন্নয়নের কাজ করলে আমার সারা দিনে আর এরকম কোনোই অজুহাত থাকবে না যে, ‘আমি ক্লান্ত, আমার সময় নেই’ ইত্যাদি। যদি আমার সকালটি এভাবে কাটে; আমি নিশ্চিত, প্রতিটি দিনই এভাবে যাবে।
অবশেষে আমি সকালের চেয়ে ভালো কোনো সময় পেলাম না। ব্যক্তিগত উন্নয়নর জন্যে, সকাল বেলাতেই কার্যকরী কিছু করাটা আমার কাছে সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে হয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যেই নিজেকে সকাল ছয়টায় বিছানা থেকে টেনে তোলা খুব কঠিন মনে হচ্ছিল। কারণ পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠার ধারণাটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্ত একটা ব্যাপার বলে মনে হতো। হতাশ আর কিছুটা পরাজিত মনোভাবে, আমার পরিকল্পনা ও সমগ্র ধারণা প্রায় বাদ দেওয়ার চিন্তা করলাম। আমি আমার মেন্টর Kevin Bracy-‘র কন্ঠ শুনতে পেলাম। Kevin সব সময় আমাকে বলতেন, “Hal, যদি তুমি তোমার জীবনকে ভিন্ন করতে চাও, প্রথমেই তোমাকে ভিন্ন কিছু করার জন্যে আগ্রহী হতে হবে।”
আমি জানি, Kevin-এর কথা সঠিক ছিল। কিন্তু তা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠা সহজ করতে পারেনি। একটি পরিবর্তনের জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে, আমি আমার নিজের সৃষ্ট আজীবন সীমাবদ্ধ বিশ্বাস যে, আমি কোনো মর্নিং পারসন নই, তা অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আমার সময়সূচি এভাবে সাজালাম যে, আমার ব্যক্তিগত উন্নয়নের প্রথম রুটিন সফল করতে সকাল ৫টায় ঘুম থেকে উঠব।
আমাদের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ: সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারি কাজ করা
তারপর আমি আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলাম। ওই ঘণ্টায় আমি যা যা করছিলাম তার সবকিছু ব্যাপক প্রভাব ফেলছিল। আমার জীবনে খুব দ্রুত উন্নয়ন ঘটে যাচ্ছিল। আমি পড়তে থাকলাম। আগেও পড়েছি। কিন্তু এখন বিশেষভাবে পড়তে চাইলাম। আমি ব্যায়াম শুরু করলাম। কিন্তু আমার মনের মতো হলো না। আরও ভালোভাবে করতে চাইলাম। সুতরাং এরূপ পরিস্থিতিতে আমি একটা সাদা কাগজ হাতে নিলাম এবং সেখানে সকল জীবন পরিবর্তনকারী ব্যক্তিগত উন্নয়নের অনুশীলনগুলো লিখে ফেললাম। আমি ওই অনুশীলনগুলো বছরের পর বছর শিখে আসছি কিন্তু কখনো নিজের জীবনে প্রয়োগ করিনি- কমপক্ষে কখনোই একটানা করিনি। সে কাজগুলো হচ্ছে ধ্যান ( meditation), ইতিবাচক আত্ম-কথন (affirmations), ডায়েরি লেখা (journaling), কল্পনা (visualization) এবং সেই সঙ্গে বই পড়া ও শরীরচর্চা করা।
আমি ছয়টি কার্যক্রম বেছে নিলাম। আমি মনে করলাম ওগুলো আমার জীবনে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ও নাটকীয় প্রভাব রাখবে। প্রতিটার জন্যে দশ মিনিট সময় রাখলাম। পরের দিন সকালে ছয়টিই চেষ্টা করতে পরিকল্পনা করলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে তালিকার দিকে তাকিয়েই আমি অনুপ্রাণিত হয়ে গেলাম! সহসা আমার মনে ব্যাপক একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। সকালের যে ঘুম থেকে উঠা আমার জন্যে ছিল ভয়ের তা হয়ে গেল খুবই আকর্ষণীয়। সেই রাতে আনন্দে আমি প্রায় ঘুমাতে পারলাম না। আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম যে, কখন সকাল হবে!
যখন ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম ঘড়ি বেজে ওঠে, আমার দুই চোখ প্রশস্ত হয়ে খুলে গেল এবং আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম। নিজেকে খুব শক্তিমান ও উত্তেজিত মনে হলো। এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও উদ্দীপনাপূর্ণ। আমি এতটাই উৎফুল্ল হলাম যে, এটা আমাকে শিশুকালে ঈদের সকালে ঘুম থেকে উঠার আনন্দের কথা মনে করিয়ে দিল। জীবনে প্রথম মনে হলো যে সকালে ঘুম থেকে উঠা খুবই সহজ একটা ব্যাপার। ঈদের সকালে একজন শিশু যেমন সারাদিনের আনন্দের কথা ভেবে ঘুম থেকে ওঠে, আমি তেমন সারাদিনের ব্যাপারে খুবই শক্তিমান ও উত্তেজিত হয়ে গেলাম। আজও আমার তেমনি মনে হয়।
যে সকালটি আমার সারা জীবন পাল্টে দিয়েছিল
দাঁত ব্রাশ করলাম, মুখ ধুয়ে নিলাম, হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। তখন বাজে ৫:০৫। দীর্ঘদিনের ভেতর প্রথমবারের মতো আমার জীবন নিয়ে সত্যই খুবই উত্তেজিত ও উৎসাহী হলাম। তখনও বাইরে অন্ধকার। আমি যেন শক্তিতে ভরপুর। জীবন পাল্টানো ব্যক্তিগত উন্নয়নের কাজকর্মের তালিকাটি টেনে বের করলাম। আমি বছরের পর বছর ওগুলো শিখেছি কিন্ত কখনো প্রয়োগ করিনি। এক এক করে আমি প্রতিটিই প্রয়োগ করলাম।
নীরবতা : দশ মিনিট নীরবে বসে প্রার্থনা ও ধ্যান করলাম এবং শুধুমাত্র আমার শ্বাসপ্রশ্বাসে মনোনিবেশ করলাম। আমার মনে হলো, যেন সম্পূর্ণরুপে চাপমুক্ত হলাম। আমার সারা শরীর ও মনের ওপর দিয়ে যেন একটা শান্তির বাতাস প্রবাহিত হয়ে গেল। ব্যস্ত সকালের বিশৃঙ্খলা থেকে এটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। দীর্ঘদিনের মধ্যে প্রথমবারের মতো আমি শান্তি অনুভব করলাম।
পড়া : কেন পড়ার সময় পাওয়া যায় না এ ব্যাপারে সব সময় অজুহাত তৈরি করতাম। কিন্তু ওই সকালে আমি সময় বের করতে খুবই আগ্রহী হলাম। সব সময় আমি বই পড়াকে একটা জীবনব্যাপী অভ্যাসে পরিণত করতে চেয়েছি। আমি সেল্ফ থেকে Napoleon Hill এর সেরা বই Think and Grow Rich বইটা হাতে নিলাম। অধিকাংশ বইয়ের মতো এটাও ছিল সেই একটা বই, যা আমি শুরু করেছিলাম কিন্তু কখনো শেষ করতে পারিনি। আমি দশ মিনিট বইটা পড়লাম। আমি কয়েকটি ধারণা পেয়ে গেলাম এবং ওই দিনেই তা প্রয়োগ করতে খুবই উত্তেজিত হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো যে, একটি ধারণাই (idea) জীবন পাল্টে দিতে পারে। আমি অনুপ্রাণিত হলাম।
আত্ম-কথন : কখনোই আত্ম-কথনের শক্তি কাজে লাগানো হয়নি। Think and Grow Rich বই থেকে self-confidence affirmation অংশটি জোরে জোরে পড়লাম এবং এটা খুবই আশ্চর্যজনক মনে হলো। ইতিবাচক আত্ম-কথন (affirmation) যেন একটি বিরাট শক্তি যা আমাকে মনে করিয়ে দিল আমার ভেতরে থাকা এবং আমাদের সবার ভিতরে বিদ্যমান অসীম সামর্থের কথা। আমি আমার নিজের affirmation নিয়ে লেখার চিন্তা করলাম। আমি যা চেয়েছিলাম তা খুব দ্রুত লিখলাম। আমি জীবনে কী হওয়ার জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম এবং জীবনে পরিবর্তন আনার জন্যে আমার যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল সবই লিখলাম। নিজেকে খুব শক্তিমান মনে হলো।
কল্পনা : আমি দেয়াল থেকে Vision Board-টা হাতে নিলাম। The Secret-সিনেমাটি দেখার পর আমি এটা বানিয়েছিলাম। কিন্তু এদিকে তাকানোর সময় হয়নি বললেই চলে। তাই visualization tool-এর উদ্দেশে এটা বানানো হলেও ব্যবহার করা হয়নি। দশ মিনটি ধরে আমার সমস্ত মনোনিবেশ একটি ইমেজ থেকে অন্য ইমেজে চলে যাচ্ছিল, প্রতিটায় থেমে যচ্ছিলাম, চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম এবং আমার সব সত্তা দিয়ে অনুভব করছিলাম যে এই ইমেজগুলির প্রতিটি আমার জীবনে প্রতিফলিত হলে কেমন হবে? আমি অনুপ্রাণিত হলাম।
ডায়েরি লেখা : দীর্ঘদিন থেকে কেনা আমার অনেকগুলো থেকে একটা ব্লাঙ্ক ডায়েরি ওপেন করলাম। অন্যগুলোর মতো, কয়েকদিনের বেশি লিখতে পারিনি, সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ লিখেছি। আজ আমি লিখলাম আমার জীবনে যেসব বিষয়ের জন্যে কৃতজ্ঞ ছিলাম তা নিয়ে। তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হলো যে, আমার হতাশা কেটে যাচ্ছে। যেন আমাকে চেপে ধরা একটি ভারী কুয়াশা কেটে যাচ্ছে। পুরোপুরি গেল না, কিন্ত খুবই হালকা অনুভূত হলো। যেসব বিষয়ে আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম সেগুলো নিয়ে শুধুমাত্র লেখাতেই আমার আত্মিক উন্নতি ঘটে গেল। আমাকে কৃতজ্ঞ মনে হলো।
সবশেষে ব্যায়াম : আমি সোফা থেকে উঠলাম। Tony Robbins-এর একাধিকবার বলা ‘গতি আবেগ সৃষ্টি করে’ কথাটা মনে পড়ে গেল। যতক্ষণ পারি বুকডন করলাম। কিছুক্ষণ অন্যান্য ব্যায়াম করলাম। ছয় মিনিট সময় হাতে ছিল। ডিভিডিতে Yoga video দেখলাম ও প্রথম ছয় মিনিটের যোগ ব্যায়াম সম্পন্ন করলাম। আমি নিজেকে শক্তিশালী অনুভব করলাম।
এটা ছিল অবিশ্বাস্য। আমি ইতোমধ্যে সেসব দিনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেললাম- যে দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি শান্তিপূর্ণ, প্রেরণাদায়ক, শক্তিমান, অনুপ্রেরণামূলক, কৃতজ্ঞতাপূর্ণ ও শক্তিশালী। মাত্র এক ঘণ্টা সময়ে এসব ঘটে গেল। তখন ঘড়িতে সবেমাত্র সকাল ৬:০০ টা বাজে। অলৌকিক কিছু নয়
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ৫:০০টায় ঘুম থেকে উঠতে থাকলাম ও আমার ৬০ মিনিট ব্যক্তিগত উন্নয়ন রুটিন অনুসরণ করলাম। তখন আমি যেভাবে অনুভব করছিলাম তা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সুখের এবং আমার মর্নিং রুটিনের ফলে যেভাবে আমার অগ্রগতি ঘটে যাচ্ছিল তাতে করে আমি এসব আরও অধিক পেতে চাইলাম। তাই একরাতে আমি যখন বিছানায় যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছিলাম, আমি একটা কাজ করলাম, যা ওই সময়ে একেবারেই অবিশ্বাস্য ছিল। আমি ঘড়িতে রাত চারটার অ্যালার্ম সেট করে রাখলাম। অবাক বিস্ময়ে এটা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম যে, আমি ওই রাতে স্বাভাবিক ছিলাম কিনা।
অবিশ্বাস্যভাবে রাত চারটায় ঘুম থেকে উঠা ঠিক সকাল পাচটায় উঠার মতোই সহজ মনে হলো। এ দুটোর যে কোনো সময়ে উঠা আমার কাছে অতীতে যখন আমি উঠতে চাইতাম না, সে সময়ের যে কোনো দিনের চেয়ে দশগুণ সহজ মনে হলো।
নাটকীয়ভাবে আমার মানসিক চাপের স্তর কমে গেল। আমি পেলাম অধিক শক্তি, স্বচ্ছতা ও মনোনিবেশ। আমি সত্যিই অনুভব করলাম যে আমি সুখী, উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত। হতাশার চিন্তা হয়ে গেল অতীতের একটা ব্যাপার। আপনি বলতে পারেন, আমি আমার সেই আগের স্বত্ত্বা ফিরে পেলাম। যদিও সবকিছুতে আমার এত বেশি ও দ্রুত বিকাশ ঘটছিল যে, আমি আমার অতীতের যে কোনো ভার্সনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। শক্তি, অনুপ্রেরণা, স্বচ্ছতা ও মনোনিবেশের ক্ষেত্রে আমি এক নতুন স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমি খুব সহজে আমার লক্ষ্য স্থির করতে পারছিলাম এবং আমার ব্যবসা ঠিক রাখতে ও উপার্জন বৃদ্ধি করতে কৌশল নির্ধারণ করতে পারছিলাম এবং তা অতি সহজে ও সক্ষমতার সঙ্গে কার্যকরী করতে পারছিলাম। Miracle Morning শুরু করার দুই মাসেরও কম সময়ে আমার উপার্জন শুধু আর্থিক দুরাবস্থার আগের পর্যায়েই ফিরে গেল না, এটা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হয়ে গেল।
আমি বুঝতে পারলাম, ব্যক্তিগত উন্নয়নের এই শক্তিশালী মর্নিং রুটিন এমন একটা জিনিস যা আমি অবশেষে আমার ব্যক্তিগত কোচিং ক্লায়েন্টদের সঙ্গে শেয়ার করব। তাই আমি ভাবলাম যে এটার একটা নামকরণ করতে হবে। আমার ভেতরে যে রূপান্তর ঘটে যাচ্ছিল তা ছিল অত্যন্ত গভীর এবং সবকিছু হয়েছিল অতি দ্রুততার সঙ্গে। মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ে হতাশা ও দুরাবস্থা কাটিয়ে আর্থিক নিশ্চয়তা ফিরে পেলাম ও উপভোগ করতে থাকলাম উত্তেজনাপূর্ণ এক ভরপুর জীবন। সবকিছু মনে হলো যেন অলৌকিক। সুতরাং একমাত্র উপযুক্ত নামটি মনে হলো ‘দ্য মিরাকল মর্নিং’।
যদি Katie এটা করতে পারে…
কয়েক সপ্তাহ পরে, Katie আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “Hal, কীভাবে তুমি তোমার সকাল শুরু করো?” আমি তাকে The Miracle Morning ও স্বাভাবিকের চেয়ে এক ঘণ্টা আগে উঠার উপকারিতা সম্পর্কে বলেছিলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বলেছিলেন, “আমি জানিনা কীভাবে আগে উঠা সম্ভব, Hal। বিশ্বাস করো, আমি কোনো মর্নিং পারসন নই!”
যাহোক, Katie সবসময়ই বিনয়ী ও মজাদার স্বভাবের। সে স্বভাবিক সময়ের এক ঘণ্টা আগে সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে The Miracle Morning অনুশীলন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো। আমি তাকে উৎসাহ দিলাম এবং তার সৌভাগ্য কামনা করলাম।
এক সপ্তাহ পরে দেখলাম Katie উজ্জীবিত! যখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, সে সত্যিই The Miracle Morning অনুশীলন করতে এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে ওঠে কিনা, আমি একটি অপ্রত্যাশিত উত্তর পেলাম। “নাহ। প্রথম দিনে আমি সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠেছিলাম, কিন্তু তুমিই সঠিক ছিলে — আমি এত অসাধারণ একটা সকাল পেয়েছিলাম যে, আমি এটা আরও আগে শুরু করতে চাইলাম! সুতরাং আমি সপ্তাহের বাকি কয়দিন ৫:০০টায় ঘুম থেকে উঠেছিলাম! Hal, এটা ছিল খুবই আশ্চর্যজনক!”
অবাক ব্যাপার! এ বিষয়ে আমার অন্যান্য কোচিং ক্লায়েন্টদেরকেও বলতে হয়েছিল।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমার অনেক ক্লায়েন্ট আমার সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন যে, তারাও তাদের নিজস্ব Miracle Mornings-এর মাধ্যমে জীবন বদলানো উপকারিতাসমূহের একই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করছিলেন। আমার কয়েকজন ক্লায়েন্ট তাদের বন্ধু ও সহকর্মীদের বলেছিলেন কীভাবে The Miracle Morning তাদের জীবন পাল্টে দিচ্ছিল। অনলাইন জগতে এটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ ফেসবুকে The Miracle Morning সম্পর্কে পোস্ট দেয়া শুরু করেন, টুইটারে এ বিষয়টা টুইট করেন। তারা গর্বের সঙ্গে YouTube-এ তাদের ভিডিও পোস্ট দিতে থাকেন।
সবাই যেন খ্যাপাটে, ঠিক আছে?
এই Joe আবার কে?
আমি বুঝতে শুরু করলাম, সমগ্র Miracle Morning-এ কিছু একটা রয়েছে। YouTube-এ একদিন আমার নাম দিয়ে আমার একটা ভিডিও সার্চ করলাম।
“Miracle Morning at Joe’s.” শিরোনামে একটি ভিডিও পেলাম। এই মানুষটিকে আমি জীবনে আগে কখনো দেখিনি। আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া তেমন ইতিবাচক ছিল না। “এই Joe আবার কে যে আমার Miracle Morning অন্যদিকে নকল করছে?” আমি কিছু ভেবে পেলাম না। একদিকে আনন্দ, বিস্ময়।
আমি ভিডিওটা প্লে করলাম এবং সেখানে পেলাম: “Hello, আমি আপনার বন্ধু Joe Diosana। আমরা সময়টা একটু দেখি …”(Joe ‘র- এ্যালার্ম ঘড়িতে দেখা যায়, ভোর ৫:৪১-এ অ্যালার্ম দেওয়া)। “এখন সকাল ৫:৪১, রবিবার, আপনি অবশ্যই অবাক হবেন, ‘Joe, বন্ধু, রবিবারের সকালে ৫:৪১-এ এই পৃথিবীতে আপনি এখন কী করছেন?’ ঠিক আছে, miraclemorning.com চেক করুন। হ্যাঁ, ওটা miraclemorning.com। ডাউনলোড করুন এবং ওখানে তথ্যগুলো দেখুন। এটা আমার কাছে ঠিক ঈদের মতো মনে হয়, সত্য বলছি, আমি এখন প্রচুর শক্তিতে ভরপুর। এখন প্রতিদিনই যেন ঈদ। এটা ভালো করে লক্ষ্য করুন, আমি আশা করি আপনি হয়ে যাবেন আশীর্বাদপুষ্ট।”
আমি তখন এক দৃষ্টিতে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বিস্মিত হলাম, আবেগে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি বুঝতে পারলাম The Miracle Morning সত্যিই একটা জীবন পাল্টানো ব্যাপার। আমি ভাবলাম, সারা পৃথিবীর সঙ্গে এটা শেয়ার করতে হবে। আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যেখানে এটাকে আমি কখনোই আমার সামান্য ব্যক্তিগত সকালের রুটিন ছাড়া বেশি কিছু ভাবিনি, তা এখন The Miracle Morning হিসেবে পৃথিবীর যত বেশি মানুষের সঙ্গে শেয়ার করা যায় তা একটা কর্তব্য বলে মনে হলো। এরকম মনে হলো কারণ এটা যেভাবে আমার জীবন পরিবর্তন করেছে সেভাবে তাদের জীবনেও রূপান্তর ঘটাতে পারে।
একটি আন্দোলন? নাকি জাগরণ?
প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো Katieকে আমি The Miracle Morning সম্পর্কে বলেছিলাম। YouTube-এ Joe’র- ভিডিওটিও আমি ওই সময় দেখেছিলাম। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সারা বছর আমি শত শত ই-মেইল পেতে থাকি। প্রতিটি মেইলে তারা কৃতজ্ঞতা ও উৎসাহ প্রকাশ করেছেন The Miracle Morning থেকে পাওয়া নতুন জীবনের জন্যে। The Miracle Morning এখন পৃথিবীব্যাপী একটা আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। যেন এক বৈশ্বিক জাগরণ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে ঘরে থাকা মায়েরাও এই কাতারে এসেছেন। নিবেদিত প্রাণ হয়ে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই ব্যক্তিগত উন্নয়নের এই উপহারটি ভোগ করছেন। আমি এখন খুব বড় চিত্র দেখছি, কীভাবে The Miracle Morning সারা পৃথিবীতে ভূমিকা রাখছে। এটা আমাদেরকে সক্ষম করে তুলছে পৃথিবীতে সেই জীবন সৃষ্টি করতে, যা আমরা চাই। খুব ইতিবাচকভাবে অন্যদের জীবনও প্রভাবিত করছে এবং আমাদের চারিপাশের পৃথিবীটা পাল্টে দিচ্ছে।
এই মিশনে আমি এখন খুবই উৎসাহী: আমার উৎসাহটি হচ্ছে মানুষকে শক্তিমান করে তাদের জীবন, পরিবার, সম্প্রদায় এবং গোটা পৃথিবী পাল্টে দেয়া। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে থেকে উঠে The Miracle Morning-এর মাধ্যমেই এই রূপান্তর ঘটে যাবে। প্রতিদিন অনেক মানুষ এই জাগরণে সামিল হচ্ছে। এটা ঘটছে দুইভাবে: প্রথমত, তারা শুধুমাত্র Miracle Morning.com ওয়েবসাইটটি তাদের বন্ধুমহল ও পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করছেন যেন তারা The Miracle Morning বইটির দুটো চ্যাপ্টার ফ্রী পেতে পারেন (সঙ্গে দুটো ফ্রী অডিও ভিডিও প্রোগ্রাম)। দ্বিতীয়ত, তারা সবাইকে The Miracle Morning Community at www.MyTMMCommunity.com 4 ইনভাইট করছেন। আমি এখন বিস্মিত যে কীভাবে এই প্রক্রিয়ায় অনেকের জীবন গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে।
অনেকেই এখন Joe’র ভিডিওটি অনুসরণ করে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠছেন। তারা সবাই এখন The Miracle Morning এর সঙ্গে জীবনযাপন মানিয়ে নিয়েছেন এবং তারা গর্বের সঙ্গে তাদের অ্যালার্ম ক্লকের সময় প্রদর্শন করছেন এটা প্রমাণ করতে যে, তারা ভোরেই জেগে যাচ্ছেন। Joe’র ভিডিও থেকে আমি আমার নিজস্ব Miracle Morning ভিডিও ব্লগের প্রতি উৎসাহিত হয়েছিলাম যা আশ্চর্যজনকভাবে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ YouTube-এর The Miracle Morning চ্যানেলে উপভোগ করছেন।
আমি সম্মানিত বোধ করছি ও খুব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, এত বেশি মানুষের সঙ্গে The Miracle Morning শেয়ার করার সুযোগ পেয়েছি। বাস্তবিকই, The Miracle Morning এখন আমার আলাদা একটা বিশেষ পরিচয়ে পরিণত হয়েছে। এটা এখন আমার একটা কর্মশালা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থা, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, বিক্রেতা, শিক্ষক সমাজ, হাইস্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা উৎপাদনশীলতা, প্রেরণা ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। কর্মশালাটি একটি নতুন পদক্ষেপ, যা কর্মচারীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে তাদের সুখ ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতি সাধন করছে। আপনি নিশ্চয় অনুমান করছেন যে, The Miracle Morning কর্মশালাটি সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় সকালে, সাধারণত প্রকৃত কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগে।
আপনার জীবনে আপনি যা যা পেতে ইচ্ছা করেন সেগুলো সৃষ্টি করে নেওয়ার জন্যে আপনাকে যেরকম মানুষ হওয়া প্রয়োজন তা হওয়ার জন্যে এই বইটি একটি আহ্বান ও সেই সঙ্গে সুযোগ। আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যসমূহে পৌঁছানোর জন্যে কাজ করতে এটি আপনাকে উদ্দেশ্যপূর্ণ সময় দেবে। এখনি শুরু করে এবং একটানা লেগে থেকে দৈনন্দিন অগ্রগতির মাধ্যমে, প্রকৃতপক্ষে যে জীবন আপনি আশা করেন এবং যে জীবনের আপনি দাবিদার সেই জীবনের দিকে অগ্রসর হয়ে আপনি পাবেন সফলতা ও আপনার স্বপ্নের জীবন। এবং এটা অনিবার্য।