দ্বিতীয় দিন
বিষাণ, ২৮ জুন: সকাল
আবার সেই চোখ দু’টো। রাস্তা পার হতে গিয়ে নজরে পড়ায় ছ্যাঁত করে উঠল বিষাণের বুকটা। কোনও মানুষের চোখে যে এতটা ভায়োলেন্স থাকতে পারে তা এই লোকটাকে না দেখলে জানতই না বিষাণ।
আজ মনটা এমনিতেই কুঁকড়ে আছে, তার উপর লোকটাকে দেখে ভিতরে-ভিতরে আরও গুটিয়ে গেল বিষাণ। না, লোকটা ওকে দেখছেও না। হয়তো জানেও না ওর অস্তিত্ব। তবু গতকাল সকালের ওই ক্ষুধার্ত চোখ দু’টো কিছুতেই ভুলতে পারছে না ও।
ঢাকুরিয়া ব্রিজের কাছে যে ফুটব্রিজটা রয়েছে, তার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। গায়ে রেনকোট আর মাথায় ছোট্ট একটা পলকা ছাতা। ছাই রঙে কলকাতা ডুবে আছে আজ। নুডল্সের মতো সরু জল নেমে আসছে আকাশ থেকে। ছিপছিপে কাদা গোটা শহরটার গায়ে ক্রিমের মতো লেগে রয়েছে। এমন দিনে সেল্সের কাজে বেরনোর মতো শাস্তি আর কিছু নেই।
নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বিষাণের। এখন সকাল আটটা বাজে। আজ সাড়ে সাতটা নাগাদ একটা ক্লায়েন্ট ভিজ়িট ছিল। ভদ্রলোককে কিছুতেই ধরা যাচ্ছিল না। ওঁর স্ত্রীর কাছে পিউরিফায়ার বিক্রি করতে গিয়ে তিন-চারবার ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এসেছে বিষাণ। তবে তার ভিতর এটাও জেনে এসেছিল যে, হাজ়ব্যান্ড মানুষটিকে সকাল আটটার ভিতর এলে ধরা যাবে। তাই সাড়ে সাতটায় চলে গিয়েছিল বাড়িতে। কিন্তু গিয়ে যে কী ভুল করেছে ও। ভদ্রলোক নিজে যে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তা ও জানবে কী করে? সকাল-সকাল কুড়ি মিনিট ধরে মুরগি করেছেন বিষাণকে। একজন কমার্সের ছেলে পারবে কী করে জল নিয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে ডিবেটে? এ তো জলে নেমে কুমিরকে কুস্তিতে হারানো!
বাড়িটা থেকে বেরিয়ে গলার টাইটা খুলে নিয়েছে বিষাণ। হুঁ, টাই! মনে হচ্ছে ছাগলের গলার দড়ি। ক্ষয়া গোড়ালির জুতো আর ফুটো মোজার সঙ্গে টাই! শালা, কম্বিনেশন দেখলে চমকে চোদ্দো হয়ে যাবে সবাই! তারপর মাথায় ধরা ছাতাটারও একটা শিক খুলে গিয়েছে মিনিটদশেক আগে। মাথার উপর শিকটা টুলটুল করে নড়ছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে বিষাণের। শালা, ভগবান বলে কি কিছুই নেই? রোজ তো বেরনোর সময় মায়ের ঘরে সিংহাসনে রাখা ছবিগুলোকে প্রণাম করে ও। তা সেই সব কি ওই এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়ালরা জানতে পারেন না?
আজ শনিবার। তবে বিষাণের ছুটি বা হাফ বলে কিছু নেই, বরং চাপ আছে। মাসের শেষ বলে টার্গেট ফুলফিল করতে দৌড়তে হবে আরও বেশি। ও টার্গেটের অনেকটা পিছনে পড়ে আছে। গতকাল সন্ধেবেলা অফিসে রিপোর্ট করতে গিয়ে টিমলিডার সন্তোষদার কাছে ভাল ঝাড় খেয়েছে ও।
অফিসের লম্বা হলটার এক কোনায় সন্তোষদার কিউবিকল। লোকটাকে কখনও হাসতে দেখেনি বিষাণ। গতকালও মুখ-চোখ কুঁচকে একটা সেল্স রিপোর্ট উলটোচ্ছিল। রিপোর্টটা যে বিষাণেরই ছিল, তা বিষাণ বুঝবে কী করে?
“সন্তোষদা, এই যে আজকের ফলো-আপ রিপোর্ট।” বিষাণ সন্তোষদার সামনে গিয়ে গতকাল কোথায় কোথায় গিয়েছিল তার লিস্টটা রেখেছিল।
“ঢং হচ্ছে?” সন্তোষদা খিঁচিয়ে উঠেছিল একেবারে।
“মানে?” বিষাণ থতমত খেয়ে গিয়েছিল।
“গত মাসগুলোতে কী করেছিস তুই? সেল্স রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে? সেল্স হয়েছে তোর, যে রিপোর্ট দিচ্ছিস? এখানে কে ঢুকিয়েছে তোকে? মালিকের বন্ধুর রেকমেন্ডেশনে কাজ পেয়েছিস বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছিস? আমার টিমের টার্গেটকে একা নষ্ট করে দিচ্ছিস তুই। শালা, একটা পিউরিফায়ারও বিক্রি হয় না তোর? আমাদের এখানে তিন মাস এমন পারফর্ম করলে লাথ মেরে বের করে দেওয়া হয়। তোর পাঁচ মাস হয়ে গেল প্রায়। দ্যাখ বিষাণ, আর নয়। আমাকেও চাকরি রাখতে হবে। আর জাস্ট এক মাস সময় দেব। তোকে এবার ছেঁটে ফেলার নির্দেশ এসেছে।”
আর এক মাস? মাসে পনেরোটা পিউরিফায়ার টার্গেট থাকে ওদের, কী করে বেচবে এতগুলো মেশিন? কে কিনবে? অফিস থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির শহরটা, তার জ্বলা-নেভা সিগন্যাল, গাড়ির লম্বা লাইন, বিলবোর্ডের দাপাদাপির দিকে তাকিয়ে বিষাণের মনে হয়েছিল, এত মানুষের ভিতর পনেরো জন নেই যে ওর দিকে হাত বাড়াবে? পনেরো জন নেই, যে বিষাণের জন্য নিজের চেক বইটা খুলবে?
বিষাণ বোঝে, সেল্স সবার জন্য নয়। ওর মতো মুখচোরা, সেন্টিমেন্টাল মানুষের পক্ষে ‘পুশি’ হয়ে জিনিস বিক্রি করা সম্ভব নয়। সেল্সম্যানের আমিত্বকে ঢেকে রাখে ওর লাজুক স্বভাব, যা সন্তোষদার ভাষায় ‘ঢং’।
জলের ছাটে ঘড়ির আবছা-হয়ে-আসা কাচটা আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করে সময় দেখল বিষাণ। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। সেই লোকটাকে আর ফুটব্রিজের কাছে দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টিটা একই ভাবে হয়ে চলেছে। বৃষ্টির শনিবার বলেই বোধ হয় কলকাতা আজকে একটু শ্লথ। এমন দিনে কার ইচ্ছে করে লোকের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে পিউরিফায়ার বিক্রি করতে? তবু নিজের বেকারত্বকে এক মাস লেট করানোর জন্যই বোধহয় ও দৌড়চ্ছে।
“কী রে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন?” হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠল বিষাণ। একমুহূর্তের জন্য যেন চিনতেও পারল না মানুষটাকে। তারপর বুঝল কপিল। খাকি রঙের পুরনোদিনের ভারী ওয়াটার প্রুফ, হাঁটু অবধি গামবুট আর মাথায় ঘোমটার মতো ছাউনি। দেখে মনে হচ্ছে, চটি গোয়েন্দা বই থেকে উঠে আসা চরিত্র।
“কী রে, অফিসে যাসনি?” কপিল আবার প্রশ্ন করল।
বিষাণ হাসল, এ লোকটা জীবন্ত প্রশ্নকোষ। একে পৃথিবীর সব কিছু জানতে হবে। যেন কেউ দিব্যি দিয়ে পাঠিয়েছে যে, সব জেনে না এলে ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া হবে।
বিষাণ বলল, “না, আমার তো পথেই অফিস। একটা কাজ আছে, অজু আসবে। ওর সঙ্গে দেখা করেই একবার শিয়ালদার দিকে যাব।”
“কেন? ট্রেন ধরবি?” কপিল চোখগুলো গোল করল।
বিষাণ পালটা বলল, “তুমি এখানে?”
“আমি?” কপিল প্রশ্ন করতেই অভ্যস্ত। শুনতে হয়তো অতটা নয়। তাই সামান্য হোঁচট খেল। টালুমালু চোখে তাকিয়ে বলল, “দোয়েল ওষুধ কিনতে দিল। কাছাকাছি পেলাম না বলে এত দূর আসতে হল।”
বিষাণ তাড়া দিল, “তা যাও তা হলে। লেট কোরো না। আর এত সকালে কি পাড়ার ওখানে ওষুধের দোকান খোলে? আর একটু পরে বেরতে পারলে না?”
আবার প্রশ্ন! কপিল আরও ঘাবড়াল। আজ দিনটা হয়তো কপিলের নয়। কপিল বলল, “না দেখি এদিকে যদি কোনও দোকান খোলা পাই। আচ্ছা, কাল যা বলল চন্দ্র তা সত্যি? তোকে সত্যিই কি বের করে দেবে ও?”
অজুর কাণ্ডজ্ঞান কোনওদিনই বেশি নেই। কিন্তু ইদানীং যেন পুরোটাই লোপ পেয়েছে। মোবাইলে বিশেষ ব্যালান্স নেই বিষাণের। একটা কল বড়জোর হবে। তাই ওর ভিতর দু’বার অজুকে মিস কল দিয়েছে। ব্যাটা একবারও রিং ব্যাক করল না? আর কতক্ষণ দাঁড়াবে ও? ওর কি সময়ের দাম নেই কোনও?
সময়ের দাম? কথাটা মনে পড়তেই হাসি পেল বিষাণের। ওরই দাম নেই, তো ওর সময়! গতকাল রাত্রে এই কথাগুলোই তো স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে চন্দ্র।
বিকেলে চন্দ্রর ফোন পেয়ে বেশ অস্বস্তিতে ছিল বিষাণ। কী এমন দরকারি কথা যে চন্দ্র ফোন করল ওকে? বিষাণ ভেবেছিল যে, অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু অফিসে গিয়ে সন্তোষদার কাছে এমন ঝাড় খেয়েছিল যে, অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরতেই পারেনি ও।
চন্দ্র বলেছিল আটটার ভিতর বাড়ি ফিরতে। কিন্তু বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সাড়ে ন’টা বেজে গিয়েছিল। ভয় লাগছিল বিষাণের। চন্দ্র আবার কিছু বলবে না তো?
আজকাল চন্দ্র বাড়িতেই ড্রিঙ্ক করা শুরু করেছে। গতকালও নিজের ঘরে হুইস্কির বোতল, গ্লাস আর ছোলা-বাদাম নিয়ে বসেছিল চন্দ্র। বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরে ব্যাগ রাখামাত্র কপিল বলেছিল, “তোকে তোর দাদা গোরু-খোঁজা খুঁজছে। যা তাড়াতাড়ি।” বিষাণের টেনশন যেন বেড়ে গিয়েছিল আরও কয়েক ধাপ। আজ শিওর কপালে ঝাড় আছে। কেন যে চন্দ্রকে এত ভয় পায় ও!
চন্দ্রর কাছে যাবে বলে ঘর থেকে বেরতে-বেরতে শুনছিল কপিল জিজ্ঞেস করছে, “হ্যাঁ রে, কাউকে হন্যে হয়ে খুঁজলে গোরু-খোঁজা বলে কেন বল তো?”
“তোর এতক্ষণে সময় হল?” চন্দ্রর ঘরে ঢুকেই প্রশ্নের সঙ্গে অ্যালকোহলের গন্ধও পেয়েছিল বিষাণ। এই গন্ধটা একদম সহ্য হয় না ওর।
বিষাণ বলেছিল, “অফিসে বস আটকে দিয়েছিল। তাই…”
“একদিন ম্যানেজ করতে পারলি না?”
পারেনি যে, তা তো স্পষ্ট। বিষাণ উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। ও জানে যে, এসব উত্তর দিতে গেলে হিতে-বিপরীত হবে।
“তা তোদের কোম্পানিটা কেমন? কত বড়?”
“তা ইয়ে…বড়ই বোধ হয়। মাঝারি টাইপের বড়।”
“মাঝারি বড়? মানে?” চন্দ্র সোজা হয়ে বসেছিল, “তোদের পিউরিফায়ারের তো অ্যাড দেখি। ডাইনোসর টাইপের একজন অ্যাকট্রেস আছে না তাতে?”
বিষাণ মাথা নিচু করেছিল। চন্দ্র কী বলতে চায়?
চন্দ্র বলেছিল, “লোন-টোন দেয় তোদের কোম্পানি? সে-সব সুবিধে আছে?”
“লোন?” বিষাণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল একদম।
“হ্যাঁ। লোন দেয়? মানে এমপ্লয়িরা লোন-টোন পায়?”
“আমি ঠিক জানি না রে দাদা।” বিষাণের অস্বস্তি হচ্ছিল।
“জানিস না মানে? তুই চাকরি করিস, আর জানিস না?”
“মানে, দরকার পড়েনি তো। তাই…” বিষাণের জলতেষ্টা পাচ্ছিল। চন্দ্র কোনদিকে কথাটা নিয়ে যাবে, বুঝতে পারছিল না বিষাণ।
চন্দ্র আরও একটু এলিয়ে বসে গ্লাসটা তুলে নিয়েছিল। সময় নিয়ে চুমুক দিয়েছিল হলুদ তরলে। তারপর আচমকাই বলেছিল, “ষাট হাজার টাকা লোন নে কোম্পানির থেকে।”
“কত টাকা?” ঠিক বুঝতে পারেনি বিষাণ।
“ষাট হাজার টাকা। সিক্সটি থাউজ়্যান্ড রুপিজ়।” কেটে-কেটে বলেছিল চন্দ্র।
“অত টাকা? আমায় লোন দেবে কেন?”
“তুই চাকরি করিস। লোন নিবি। কাজ করে শোধ করে দিবি।” চন্দ্র এমনভাবে বলেছিল যেন চুইংগাম চিবোনোও এর চেয়ে কঠিন।
“আমায় সত্যি লোন দেবে না। চাকরিটাই থাকে কি না সন্দেহ!” বিষাণ কী বলবে বুঝতে না-পেরে দুম করে বলে দিয়েছিল কথাটা।
“মানে?” শেষের কথাটা শুনে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেছিল চন্দ্র। পায়ের ধাক্কায় টেবিল থেকে গ্লাস আর ছোলা-বাদামের প্লেটটা উলটে পড়েছিল মেঝেতে। অ্যালকোহল ছড়িয়ে গিয়েছিল মেঝেময়।
ঘাবড়ে পিছিয়ে এসেছিল বিষাণ।
“চাকরি থাকবে না মানে? কেন থাকবে না চাকরি?” চন্দ্র চিৎকার করছিল রীতিমতো।
“আ…আমার…ইয়ে…পারফরম্যান্স, মানে, খুব একটা…” বিষাণ তোতলাচ্ছিল। চন্দ্রর চিৎকারে মা আর দোয়েল এসে দাঁড়িয়েছিল দরজায়।
চন্দ্র বলেছিল, “আমি কিছু জানি না। এতদিন ধরে তোকে বইছি আর তুই বলছিস টাকা দিতে পারবি না? শুয়োরের বাচ্চা! লাথি মেরে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেব।”
চন্দ্রকে মারমুখী দেখে মা আর দোয়েল দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল দু’জনের মাঝে। মা বলেছিল, “কেন এমন করছিস চন্দ্র? কী হয়েছে?”
চন্দ্র মায়ের দিকে ঘুরে বলেছিল, “কী হয়েছে মানে? আমার ষাট হাজার টাকা দরকার। আমি আগেই লোন নিয়েছি। আর পাব না। ওকে বলছি অফিস থেকে নিতে। কিন্তু জানোয়ারটা বলছে, ‘পারবে না’!”
“কীসের দরকার তোমার টাকার? কী হবে টাকা দিয়ে? এই তো গতকাল একটা পলিসি করলে। তার পরেও কীসের দরকার টাকার?” দোয়েল অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল।
“সব তোমায় বলতে হবে?” চন্দ্র খেঁকিয়ে উঠেছিল।
দোয়েল তবু ছাড়েনি, “বলতেই হবে। সারাদিন পর ছেলেটা বাড়িতে এসেছে আর তাকে তুমি…”
চন্দ্র কথাটা শেষ করতে না দিয়েই এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিল দোয়েলের গালে। মাথা টলে দোয়েল পড়েই যাচ্ছিল যদি না বিষাণ ধরে ফেলত।
“আমার বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছিস! শালা, শুয়োরের বাচ্চা, হারামিপনা হচ্ছে! আজ তোকে…” চন্দ্র উন্মাদের মতো লাফিয়ে পড়েছিল বিষাণের গায়ে। বিষাণ দোয়েলকে আড়াল করে একহাত দিয়ে শুধু ঠেকিয়ে দিয়েছিল চন্দ্রকে। অন্যদিন হলে চুপচাপ মার খেয়ে নিত, কিন্তু চন্দ্রর কথার ভিতরের নোংরা ইঙ্গিতটায় মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল বিষাণের।
বিষাণ মুখচোরা, লো-কনফিডেন্স মানুষ হলেও গায়ের জোর সাংঘাতিক। ইচ্ছে হলে চার-পাঁচ জনকে একাই সামলে নিতে পারে। কিন্তু কখনও তা করে না। মনে হয়, কী হবে মারামারি করে?
তবু প্রতিটা কমজোরি মানুষের ভিতরকার দৈত্য তো একসময় জাগেই। গতকাল যেমন জেগে উঠেছিল বিষাণের দৈত্য। ও চন্দ্রকে হাত ধরে তুলে ধরেছিল শূন্যে, ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “তোকে কিন্তু বেদম মারব যদি আর কখনও নোংরা কথা বলিস।”
গতরাতটা খুব খারাপ কেটেছে বিষাণের। কাউকে কড়া কথা বললে ওর নিজেরই খারাপ লাগে। কপিলের নাক ডাকা, বৃষ্টির শব্দ, সারাটা রাত জাগিয়ে রেখেছিল ওকে।
আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরনোর ঠিক আগে চন্দ্র এসে বলেছিল, “তোমাদের বাড়ি ছেড়ে আমি মাসখানেকের মধ্যে চলে যাব। আমার থেকে তোমরা কোনওরকম সাহায্য আশা কোরো না।”
কিন্তু মাসখানেক পর তো ওর আর চাকরিই থাকবে না। বিষাণ জানে, ওর পক্ষে এই চাকরিটা জিইয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু এর মধ্যে নতুন চাকরি কোথায় পাবে ও? টিউশনি করে পাওয়া বাইশশো টাকায় কতদিন যাবে মাসের? মায়ের সামান্য মাইনে আর ওর সামান্য টাকা দিয়ে ওদের তিনজনের খরচ চলবে? চন্দ্র সংসারে যে আট হাজার টাকা দেয়, সেটা আর পাবে না। বিষাণের মনে হয়েছিল, চন্দ্রকে অমন করে মারাটা কি ওর উচিত হয়নি?
“একটা বড় ছাতাও জোটে না তোমার?” হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠল বিষাণ। সবুজ লম্বা গাড়িটার জানলা খুলে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে কুমুদ্বতী!
এমন সকালে আচমকা কুমুকে দেখে বিষাণের বুকের ভিতরে অসংখ্য তুলোর বীজ ফাটল যেন, কেউ হালকা একটা বেলুন ভাসিয়ে দিল কোথাও, যেন কোথাও-না-কোথাও এই মুহূর্তে চুম্বনবদ্ধ হল কোনও নারী-পুরুষ!
“কী দেখছ অমন করে?” কুমু গাড়ি থেকে নেমে এল।
বিষাণ লজ্জা পেল। সত্যিই তো, এমন করে কেউ দ্যাখে? বিষাণ বলল, “সরি কুমু, ওই বাড়িটায় যেতে পারিনি এখনও। রোববার সন্ধেবেলা যাব।”
“ঠিক আছে। আমি অজুর বদলে এসেছি। এই নাও ম্যাগাজ়িনের জন্য ম্যাটার।”
“অজুর বদলে?” বিষাণ আশ্চর্য হল।
“হ্যাঁ। ও আমাদের বাড়ি থেকে ম্যাটার আনতে গিয়েছিল। তখন আমিই ওকে আসতে বারণ করলাম…”
হঠাৎ বেরসিকের মতো বিষাণের মোবাইলটা পকেট থেকে চিৎকার করে উঠল। বিরক্ত লাগল বিষাণের। স্ক্রিনে নামটা দেখে আপন মনে বলল, “ও লাবানা!”
“লাবানা?” কুমু স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে উঠল। নরম চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠল। হাতের ম্যাটারটা বিষাণের মুখে ছুড়ে দিয়ে বলল, “হ্যাভ আ নাইস টক,” তারপর গাড়িতে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।
কলকাতার মেঘগুলো ঢুকে পড়ল বিষাণের বুকের ভিতর, বৃষ্টিগুলো ঢুকে পড়ল মাথায়, লুকোনো বজ্রবিদ্যুৎ ছুটে গেল শিরায়-শিরায়। নিজেই একটা বর্ষাকাল হয়ে বিষাণ দেখল, গোটানো কাগজের রোলটা মাটিতে পড়ে ভিজে চলেছে।
রথী, ২৮ জুন: সকাল
রেনকোটটা গুপির। তবে বুড়ো বৃষ্টির জন্য বাড়িতে আটকা পড়ে আছে বলে রথী এটাকে আজ ব্যবহার করতে পারছে। তবে গায়ে ছোট হচ্ছে খানিকটা। ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টিতে সারা শহরের কেমন একটা সর্দি-সর্দি ভাব। বর্ষাকাল একদম ভাল লাগে না রথীর।
ব্রিজের পাশের ইন্ডিয়ান অয়েলের ঘড়িতে এখন আটটা বাজতে পাঁচ। এই সময়টায় ব্রিজের পাশের রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে কাজে যায় ব্লসম। অন্তত ছ’মাস আগেও যেত। আর আশা করা যায় যে, এখনও এখানেই মিস্টার গোভিলের মায়ের দেখাশোনার কাজটা ব্লসম করে।
গতকাল সারা রাত ঘুমোতে পারেনি রথী। ব্লসমের মুখটা বারবার মনে পড়ছিল ওর। ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, ব্লসম ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে অমন করে চলে যেতে পারে! এই মেয়েটাই যে ওর জন্য একসময় সব কিছু ছাড়তে রাজি হয়েছিল। স্রেফ ছ’মাসে পৃথিবী এত বদলে যেতে পারে! ও কী করে ভুলে গেল সব? কই রথী তো কিছু ভোলেনি! জেলে প্রতি মুহূর্তে ও ব্লসমের সঙ্গে কাটানো সময়গুলোই চিন্তা করেছে। সেই সময়গুলোকে বুকের ভিতর সমস্ত রুক্ষতা থেকে আড়াল করে রেখেছে। তবে?
আজ থেকে আড়াই বছর আগের ঘটনা। শীতকাল হলেও বৃষ্টিতে সব ঝাপসা হয়েছিল সেদিনও। মছলন্দপুর থেকে একটা বড় গাড়ি চালিয়ে ফিরছিল রথী। শিবির একটা মাল ডেলিভারি করার ছিল পুনম সিং বলে একটি লোককে। পুনম উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছিল। মাল পেয়ে পেমেন্ট করে চলে গিয়েছিল। তারপর হাইওয়ে দিয়ে ধীরেসুস্থেই গাড়ি চালাচ্ছিল রথী। বিড়ার কাছে গাড়ি থামিয়ে এক কাপ চাও খেয়েছিল। ওই টিনের ছাউনিওয়ালা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে কোনও কারণ ছাড়াই বুকের ভিতরে একটা শূন্য হাইওয়ে জেগে উঠেছিল রথীর। মনে হয়েছিল, এমন বৃষ্টির দিনে, এমন শীতের বিকেলে, ওর জন্য তো কেউ অপেক্ষা করছে না। তা হলে কোথায় ফিরবে ও? কেন ফিরবে?
বৃষ্টি দেখতেই হয়তো আকাশের অনেক উপরে ভগবান নিজের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সেসময় ও নীচে ঝুঁকে দেখেও ছিলেন রথীকে। না হলে কি পরের আধঘণ্টার মধ্যে এভাবে পালটে যেত রথীর জীবন?
বিকেলের আলো মরে আসছিল দ্রুত। মাঝে-মাঝে বড়-বড় ট্রাক পাস করছিল দু’টো-একটা। রথী গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। বারাসাত ঢোকার মুখে সামনে রাস্তায় কয়েকটা আবছায়া চেহারা দেখে নিজের অজান্তেই গাড়িটা থামিয়ে দিয়েছিল ও। দেখেছিল কারা যেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছে।
চারটে মেয়ে। রথী ওদের দেখেই বুঝেছিল যে মেয়েগুলো খুব বিপদে পড়েছে। ওকে দেখেই মেয়েগুলো কিচিরমিচির করে উঠেছিল একসঙ্গে। কী বলছে ওরা? জট পাকানো শব্দ, অবিরাম বৃষ্টির মধ্যেই রথী দেখেছিল ছাউনির তলায় চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে শুয়ে রয়েছে একটা মেয়ে। মেয়েটার চোখ বোজা। কপালের বাঁ দিকটা দিয়ে রক্ত বেরচ্ছে। মেয়েটা কি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে? রথী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল মেয়েটার দিকে। আশপাশের মেয়েগুলো বলছিল, “পড়ে গিয়েছে, বৃষ্টিতে পিছল, অ্যাক্সিডেন্ট হাসপাতাল।” রথী বেঞ্চের সামনে গিয়ে ঝুঁকে পড়েছিল মেয়েটাকে গাড়িতে ওঠাবে বলে। ঝুঁকে পড়েও কোলে তুলতে গিয়েও ফ্রিজশটের মতো জমে গিয়েছিল। এমন দরিদ্র চায়ের দোকানে, রংচটা বেঞ্চে, কে ঘুমিয়ে রয়েছে একা? কোথায় ছিল এতদিন ও?
সরকারি হাসপাতালের অবস্থা সম্বন্ধে খুব ভাল ধারণা আছে রথীর। গাড়িতে মেয়েটি ও তার বান্ধবীদের তুলে নিয়েই ফোন করেছিল শিবিকে। কাজ ঠিকমতো মিটে গিয়েছে বলে মেয়েটির কথা সংক্ষেপে বলেছিল। শিবি বলেছিল, কাছের বারাসাত হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ওখানে ফোন করে বলে দিয়েছিল শিবরতন ঘোষ। মোমের মতো মেয়েটির চিকিত্সায় কোনও সমস্যাই হয়নি। মেয়েটার বাড়ির লোকজনও এসে পড়েছিল বারাসাত হাসপাতালে। সবাই একসঙ্গে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল রথীকে।
ব্লসম! মোমের মেয়েটার নাম ব্লসম! রথীর গলা শুকিয়ে আসছিল। এমন তো কোনওদিন ওর হয়নি! ব্লসমের জ্ঞান ফিরেছিল আগেই। অল্প কথাও বলছিল সবার সঙ্গে। রথীর সঙ্গে, কেন কে জানে, কথা বলেনি একটাও। শুধু আড়ে— আড়ে তাকিয়েছিল দু’-একবার।
ব্লসমকে একদিন অবজ়ারভেশনে রেখে পরের দিন সকালে ছেড়ে দিয়েছিল ডাক্তাররা। সেদিন বিকেলেই ব্লসমের দাদার দেওয়া রানিকুঠির ঠিকানায় গিয়েছিল রথী।
এক সপ্তাহের মধ্যেই ব্লসমের জন্য সারাদিন মনকেমন করত রথীর। মনে হত সব ছেড়ে ওর কাছে চলে যায়। ব্লসমদের ছোট্ট বাড়ি, নির্জন গলি আর সুন্দর পরদা দেওয়া জানলাগুলোও যেন ক্রমাগত টানত রথীকে।
তবে ব্লসমদের বাড়িতে গেলেও ওর মা-ই বেশি গল্প করত। ব্লসম শুধু মাথা নাড়ত, হুঁ-হাঁ করত, হঠাৎ-হঠাৎ রথীর চোখে চোখ রাখত।
তারপর একদিন রথীর জ্বর হয়েছিল। চার-পাঁচ দিন বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ। রথীর ইচ্ছে করত ব্লসমের মোবাইলে ফোন করতে। কিন্তু লজ্জা করত। আর সেই না-পারাটা ওর আরও মনখারাপ করে দিত। সারাদিন শুয়ে-শুয়ে মোমের তৈরি মেয়েটার মুখই মনে করত রথী।
তারপর একদিন এসেছিল ফোনটা। স্ক্রিনে লেখা ব্লসম নামটা কেমন যেন বরফের ছ্যাঁকা দিয়েছিল শিরদাঁড়ায়। কাঁপা হাতে কলটা রিসিভ করেছিল ও।
“হ্যালো?” রথীর গলা কাঁপছিল।
“রথী?” শিফনের মতো গলাটা ভেসে এসেছিল।
“হ্যাঁ,” নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল রথীর। বুঝতে পারছিল না কী বলবে।
“তুমি কয়েক দিন আসছ না তো, তাই মা বলছিল…”
“মা? মানে কাকিমা?” রথী কোনওমতে বলেছিল।
“হ্যাঁ, ইয়ে…আমি বললাম, তোমায় ডিস্টার্ব করার দরকার নেই। তবু মা এমন জোর করল…যে…তা তুমি কেমন আছ?”
“ও, কাকিমা বলল!” রথীর মনটা চার গোল খেয়ে গিয়েছে এমনভাবে গোঁত্তা খেল, “আমি আছি একরকম। একটু জ্বর হয়েছে। তাই…”
“ও আচ্ছা…” ব্লসম একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, “তা হলে আমি রাখি?”
রেখে দেবে? আরও পাঁচ গোল।
রথী চুপ করে গিয়েছিল। মনে-মনে রাগও হয়েছিল খুব। ও মায়ের কথায় ফোন করেছে? নিজের তা হলে আগ্রহ নেই?
“কী হল? চুপ করে গেলে কেন? আমি রেখে দিই?” ব্লসম আবার জিজ্ঞেস করেছিল।
“আমি কী বলব?” রথী বুঝেছিল কষ্টের ছিটেফোঁটাগুলো মন উপচে কথার ওপর এসে পড়ছে।
“তোমার কিছুই বলার নেই? মা তো সকাল থেকে ফোন করতে বলছিল। কিন্তু এখন, এই বিকেলে করলাম। মা বাড়ি নেই। ভাবলাম…” ব্লসম চুপ করেছিল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলেছিল, “যাক গে। আমি তা হলে রাখছি।”
“ব্লসম,” প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল রথী, “আমি এবার নির্ঘাত মরে যাব! তুমি দেখো, আমি এবার মরে যাবই।”
ব্লসম গভীর গলায় বলেছিল, “মরতে দিলে তো। তুমি না থাকলে কে আমায় বৃষ্টির মধ্যে কোলে তুলবে?”
রথী কোনও কথা বলতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল যে, ব্লসম নয়, আসলে ও নিজেই মোমের তৈরি। ও শুধু অস্ফুটে বলেছিল, “আমি তোমায়…তোমায়…”
ব্লসম আদুরে গলায় বলেছিল, “জানি। জানো, আমিও।”
মোটরবাইকটা ব্রিজ থেকে নেমে সামনে বাঁ দিকে ইউ-টার্ন মেরে হুশ করে বেরিয়ে গেল। রথী দেখল, পিছনের সিটে সাদা সি-থ্রু পলিথিনের রেনকোট গায়ে ব্লসম বসে রয়েছে। আর বাইক চালাচ্ছে ক্র্যাশ হেলমেট আর নীল উইন্ডচিটার পরা একজন। সামনের জনকে চেনা যাচ্ছে না। তবু ব্লসমের বসা দেখে রথী বুঝল ঘনিষ্ঠ কেউ। রথীর বুকের ভিতর হিংসের সবুজ আগুনটা দপ করে উঠল। এর কথাই কি ছানু বলেছিল? ব্লসম তো দেখেছিল ওকে। তবু বাইকটা থামাল না! ব্লসম ফোন ধরছে না বলে ও তো এসএমএস করে জানিয়েছিল যে, এই ফুটব্রিজের কাছে ও অপেক্ষা করবে। তা হলে! যখন জানত এখানে রথী থাকবে, তখনও কেন অমন ঘনিষ্ঠভাবে বাইক চড়বে ও? ব্লসম কি সত্যি আর রথীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না?
বৃষ্টিতে সব কিছু অপার্থিব মনে হচ্ছে আজ। রথীর যেন আর কোথাও যাওয়ার নেই। ব্লসম যখন আর ভালবাসে না, তখন বেঁচে থেকে আর লাভ নেই। সত্যিই তো, কার জন্য বেঁচে থাকবে রথী? টাকার জন্য? কার জন্য উপার্জন করবে টাকা? যার জন্য এত কষ্ট করতে চাওয়া, সে তো এই ছ’মাসেই রথীকে পুরনো পোশাকের মতো ছুড়ে ফেলেছে। একটা দুঃখী জলের ফোঁটা আলতো পায়ে চোখের পাতা থেকে গালে নামল রথীর। তারপর এবড়ো-খেবড়ো দাড়ির ফাঁক দিয়ে হাঁটতে লাগল তার দুঃখী মুখটা নামিয়ে। ফেলে-দেওয়া মানুষরা মুখ নামিয়ে একা-একা হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে?
“আবে, তখন থেকে হর্ন মারছি শুনতে পারছিস না?” জোরে ডাকটায় মুখ তুলে তাকাল রথী। ছানুর সঙ্গেও মোটরবাইক? মাথা গরম হয়ে গেল রথীর, বলল, “তুই কোন হরিদাস যে তোর হর্ন শুনতে হবে?”
“আইব্বাস, মেজাজ তো পুরো ফার্নেস গুরু! আয়, বিড়াল শালা ডেকেছে।”
এটা ঠিক হয়েই ছিল যে, আটটা থেকে সওয়া আটটার ভিতর ছানু রথীকে পিক-আপ করে নেবে। তা হলে ও মাথা গরম করছে কেন? রথী নিজেকে সংযত করল। বাইকে বসে বলল, “এটা কার গাড়ি রে?”
“মাধবদার। মাধবদা বিক্রি করে দেবে বলছে। পারলে কিনে নেব।”
রথী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছানুর কাঁচা টাকা হচ্ছে। পুরিয়া বিক্রির ফল। ছেলেটা বুঝছে না, এসব করলে কতটা বিপদে পড়বে ও। তার উপর শিবির থেকে লুকিয়ে কারবার করছে! যাক গে, ওর কী? যে যা পারে করুক। ও তো মনে-মনে যা ঠিক করার করেই নিয়েছে। ছ’মাস আগে শেষ দেখা হওয়ার দিন ব্লসম যা বলেছিল, তা সেসময় পাত্তা দেয়নি রথী। কিন্তু এবার দেবে। গত ছ’মাস ধরে অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। হিমিও তো বলেছিল সাহায্য করবে। দেখা যাক, শিবিকে বলার পর কী দাঁড়ায়!
মনোহরপুকুর রোডের অফিসটায় এমন ওয়েদারেও লোকের ভিড় আছে বেশ। শিবি ক্ষমতাশালী লোক। আর যে-কোনও পাওয়ার সেন্টার হল গুড়ের ডেলা, পিঁপড়েদের লাইন লেগেই থাকবে।
পবন আজও সেই জং-ধরা চুল নিয়ে শাহরুখ খানের মতো ভঙ্গি করে বসেছিল। ওকে দেখে নতুন ছবির গোল্ডেন জুবিলির পরের হাসিটা ছুড়ে দিল। রথী বিরক্ত চোখে তাকাল। ও জানে, গতকালের চলে যাওয়ায় শিবি নিশ্চয় রেগে আছে। শালা, শনিবারগুলোই অপয়া। প্রথমে ব্লসম। তারপর এখন শিবি।
শিবির চেম্বারের পরদা সরিয়ে ক্ষয়াটে মতো একটা লোক বেরনোর পর আর-একটা লোক ঢোকার চেষ্টা করতেই পবন গর্জন করে উঠল, “আরে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? বসুন চেপে।”
লোকটা বিরক্ত হয়ে বসে পড়ল।
পবন রথীকে চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করল ভিতরে যেতে। তারপর ছানুকে বলল, “আরে দাদা, বাইকখানা কার? একদম ‘ধুম টু’ টাইপ যে!”
শিবির সামনে একটা ইংরেজি পেপার খোলা।
এত সকালেই স্নান করে চন্দনের ফোঁটা কেটে বসে রয়েছে মানুষটা!
“কী শালা দেবদাস? কী খবর?”
“আছি দাদা।” রথী চোয়াল শক্ত করল।
“রাগ করেছিস তোকে জেলে দেখতে যাইনি বলে?” শিবির কথায় রসগোল্লা ঝরছে।
“না, ঠিক আছে।” রথী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শিবির কথায় বুথ ক্যাপচার করতে গিয়েই তো হাজতে যেতে হয়েছে ওকে। অবশ্য শিবির সমস্যাটা ও বোঝে। জেলে গিয়ে রথীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে কি আর শিবির প্রেস্টিজ থাকে? আর তা হলে তো সবার সামনে ফাঁসও হয়ে যাবে অনেক কিছু।
“ঠিক না থাকলেও ঠিক করে নিতে হয় রে রথী। জীবনের দুঃখ-কষ্ট মনের ভিতরে চেপে সব ঠিক করে নিতে হয়। লোকে কি আর সম্মান করে এখানে আসে? ওরা আসে ভয়ে আর লোভে। তোরাও তো কত কী ভাবিস, বলিস আমায়? কার এমন জীবন ভাল লাগে বল? একবার আটকে গেলে তো আর উপায় থাকে না। আমারও যে অনেক শত্রু। অনেক বিপদ। ভাল লাগে না রে, তবু ক্রসটা বইতেই হয়। তুই কি ভেবেছিস ছ’মাসে এমনিই ছাড়া পেয়ে গেছিস? শোন, গতকাল চলে গিয়েছিলি, আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু আজ একটা…”
অনেকক্ষণ থেকে ভ্যানতাড়া করছে লোকটা। আর ভাল লাগছে না। রথী হাত তুলল। বলল, “দ্যাখো শিবিদা, আমি আর কোনও কাজ করব না। এ-লাইনে আমি আর নেই।”
“মানে?” বিড়ালের মতো চোখ তুলে তাকাল শিবি।
“মানেটা খুব সোজা। আর কাজ করব না।”
“শোন রথী, মাথাগরম করিস না। ঝাপুবাবুর কাজ। না করলে কোটি টাকার লোকসান…”
“দ্যাখো দাদা…” রথী কথাটা শেষ করতে গিয়েও থামল। পকেট থেকে ফোনটা চ্যাঁচাচ্ছে। রথী ফোনটা বের করে স্ক্রিনে চোখ রাখল। আর সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন বরফ আর আগুন একসঙ্গে ঢেলে দিল ওর শরীরে। ওর হাতের তালু ঘেমে গেল নিমেষে। ভাল করে স্ক্রিনটা দেখল রথী, ব্লসম!
জয়, ২৮ জুন: সকাল
যশ বর্মনের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে মিনিটদশেক আগেই। এখন জয় বসে আছে কনট্র্যাক্ট পেপার নেওয়ার জন্য।
অফিসটা পার্ক স্ট্রিটের একটা পুরনো বাড়িতে। গতকাল ফোন করায় আজ সকাল সাতটা নাগাদ আসতে বলেছিল যশ। সকাল সাতটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল জয়। বলেছিল, “যশজি, এত সকালে!”
“হবেই দাদা, আমার যে সময় নেই!” যশ হেসেছিল ফোনের ওপারে।
“সময় নেই?” আশ্চর্য হয়েছিল জয়।
“আমায় দুপুরের ফ্লাইটে দিল্লি বেরিয়ে যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে কাল ইউরোপ বেরব। তা ছাড়া আপনি যোগাযোগ করতে এত লেট করলেন!”
জয় জানে, ও লেট করে ফেলেছে। তাই কথা বাড়ায়নি।
পৌঁছে প্রায় আধঘণ্টা কথা বলে সব ফাইনালাইজ় করে দশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছে জয়।
জয় পকেট থেকে ফোনটা বের করল। শামিমকে একটা ফোন করা দরকার। কাল ঠিক সময়ে যাতে জায়গামতো পৌঁছে যায় সেটা বলে রাখতে হবে।
“হ্যালো, জয়দা!” শামিমের গলায় ঘুম।
“কী রে ঘুমোচ্ছিলি?” জয় হালকা গলায় বলল।
“বাইরে যা ওয়েদার, বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।”
শব্দ করে হাসল জয়, “বাড়িতে শুয়ে থাকলেই কি আর রোজগার হবে?”
“ওঃ, তুমি যা বলো না!” শামিম হাই তুলল, “বলো, কেন ফোন করলে?”
“কাল টাকা নিয়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাব আমি। শিবির লোকজন অ্যাকটিভ হচ্ছে। সঙ্গে নবীনকেও রাখিস। মেশিন আনবি। তিরিশ লাখ ইন ক্যাশ খুব বেশি নয়, কিন্তু খুব কমও নয়। সুতনুদার এখন টাকার চাপ যাচ্ছে। নতুন কনট্র্যাক্ট ধরতে প্রচুর মাল্লু খাওয়াতে হয়েছে। তুই কিন্তু অ্যালার্ট থাকিস।”
“তুমি চিন্তা কোরো না, জয়দা।” শামিমের গলায় যেন সামান্য বিস্ময় টের পেল জয়।
ইশ, বেশি বলে ফেলেছে! নতুন ছেলেকে এতটা বলা ঠিক হয়নি। কেন এমন করল জয়? ও তো কখনও এমন করে না। তা হলে? কাল রাতের ব্যাপারটা ওকে সত্যিই কি নাড়িয়ে দিয়েছে ভিতরে-ভিতরে?
জগৎমামু বলে, “হালকা হও, বাঁধন কাটো। কী হবে আঁকড়ে? ছাড়তে না জানলে বাঁচতে শেখা যায় না, জয়!”
কী ছাড়ার কথা বলে মামু? কেন বলে? না ছাড়লে বাঁচতে শেখা যায় না? দু’টো কেমন পরস্পরবিরোধী নয়? জয়কে সব কিছু রক্ত জল করে অর্জন করতে হয়েছে। এসব ফিলজ়ফি মাথায় ঢোকে না ওর।
“সরি, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন,” সামনের দরজাটা খুলে একটা মুখ উঁকি দিল, “কিন্তু প্রিন্টারে কালি ফুরিয়ে গিয়েছে। রিফিল করিয়ে আনতে পাঠিয়েছি। সকাল বলে একটু লেট হচ্ছে। আপনাকে ব্রেকফাস্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
ছেলেটা বোধ হয় যশের সেক্রেটারি, কথাবার্তায় আন্তরিক। জয় হেসে বলল, “না, আমি এখন কিছু খাব না। আমি ওয়েট করছি।”
ছেলেটা হাসল, “অ্যাজ ইউ উইশ। সরি এগেন।”
মানে আরও কিছুটা সময়? অপেক্ষা করতে খুব বিরক্ত লাগে জয়ের। মামু বলে, “মনটা বাঁধো জয়। অস্থির মন বুনো শুয়োরের মতো।” হোক বুনো শুয়োর, তবু সেটাই তো ওকে প্রায় ফুটপাথ থেকে এখানে তুলে এনেছে। তবে একটাই আফসোস আছে জয়ের। পড়াশোনাটা বিশেষ করতে পারেনি। এইচএস দিয়েছিল, পাশ করতে পারেনি।
ঘরে ঢোকার মেন দরজাটা খুলল এবার। যে ছেলেটা ঢুকল তার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। কাঁধে রংচটা লেদারের ব্যাগ। গলায় একটা টাই, নীল রঙের উপর সাদা টিপ-টিপ ছাপ। এরা বেশ কয়েক বছর হল কলকাতার নতুন শ্রেণির প্রাণী। লোকে ব্যঙ্গ করে ওদের ‘বেচুবাবু’ বলে। এদের দেখলে কষ্ট হয় জয়ের। একটা জোর-করে-আনা কনফিডেন্সের তলায় সবারই যেন কেমন ‘হারিয়ে গিয়েছি’ ভাব। বিক্রি করা যে কী কঠিন কাজ জয় জানে। ও তো নিজেও গ্যাসের বার্নার বিক্রি করতে ঘুরেছে কয়েক মাস।
তবে এই ছেলেটাকে দেখে ওরকম কিছু বিক্রি করতে চায় মনে হচ্ছে না। এ হয় ক্রেডিট কার্ড, নয় ইন্সিওরেন্স বিক্রির জন্য এসেছে। সত্যি এদের জীবন খুব কঠিন।
আবার সেই ছেলেটি দরজা খুলে কচ্ছপের মতো মাথা বের করল। মুখটা এবার সামান্য গম্ভীর, “আপনি একটু বসুন। স্যার সময়মতো ডাকবেন। তবে আজ না এলেই পারতেন। স্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই দিল্লি বেরিয়ে যাচ্ছেন।”
ছেলেটা হতাশ গলায় বলল, “উনিই আমায় এখন আসতে বলেছিলেন। মান্থ এন্ড। টার্গেট পূরণ না করতে পারলে…”
সেক্রেটারি আরও গম্ভীর হয়ে গেল। এই মুখটা দেখে জয়ের আর তত আন্তরিক মনে হচ্ছে না।
সেক্রেটারি ছেলেটি বলল, “ওকে, ওকে, বসুন।” তারপর জয়কে বলল, “আপনারটা হয়ে গিয়েছে মিস্টার রাউথ। ভাল করে পড়ে সই করে রাখবেন।” ছেলেটার মুখে সেই আন্তরিকতা ফুটে উঠল আবার। “সাবাস!” মনে মনে বাহবা দিল জয়। ইমোশনের পিংপংয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা বড় খাম হাতে পেয়ে গেল ও। ভিতরে কনট্র্যাক্ট কপি। আর অপেক্ষা করার কোনও মানে হয় না। জয় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল বৃষ্টির শহরে। একটু দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি পেয়ে গেল জয়। ট্যাক্সিতে উঠে বলল, “টেকনিশিয়ান স্টুডিও, টালিগঞ্জ।”
গাড়ির দোলা আর জানলার ফাঁক দিয়ে আসা হাওয়ায় চোখ বুজে আসছে জয়ের। মনে হচ্ছে, কোনও ভার নেই শরীরে। যে-কোনও সময় শিমুল তুলোর মতো উড়ে যেতে পারে। নিমেষের জন্য চোখ বন্ধ হয়ে এল জয়ের। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই কেয়ার মুখটা মনে পড়ায় চমকে সোজা হয়ে বসল। কেয়া গতকাল খুব হিংস্র হয়ে উঠেছিল। তবে শুরুটা করেছিল জয়। বিকেলে শপিং মলে বাঁশি আর কেয়াকে একসঙ্গে দেখার পর থেকেই ফুঁসছিল ও। তাই হাতকাটা বলাইকে ফোনে ধরেছিল।
“কী খবর, হঠাৎ এমন সময়?” বলাই আশ্চর্য হয়েছিল।
“তোর সঙ্গে খুব দরকার।” জয় কাঁপছিল রাগে।
“কেন জয়দা? তোমার গলাটা তো ভাল শোনাচ্ছে না!” বলাই বলেছিল।
“তোর একটা হেল্প চাই।”
“সুতনুদার কাজে? বললাম তো শিবি নড়ছে। সামলে থাকতে হবে।”
“না, না,” অধৈর্য হয়ে উঠেছিল জয়, “আমার পারসোন্যাল দরকার। এর সঙ্গে কারও যোগ নেই।”
“হুম, টপ সিক্রেট।” বলাই হেসেছিল।
“তবে…” ইতস্তত করছিল জয়। নিজের স্ত্রীর কেচ্ছা অন্যের সামনে বলতে কার ভাল লাগে? আর বলাই তো ভাল করে চেনে কেয়াকে।
“কেন সংকোচ করছ জয়দা? বলে ফেলো। কেউ জানবে না।” এবার আর হাসছিল না বলাই।
“একটা বিশ্বস্ত লোক চাই। একজনকে ফলো করতে হবে। পারবি?”
“এ আর এমন কী কাজ? হামেশাই করছি।”
“তা হলে…” জয় বলতে গিয়ে শেষ করতে পারেনি।
বলাই বলেছিল, “এখানে নয়। কাল সকালে আমার ডেরায় এসো। আমিই যেতাম, কিন্তু শরীরটা ঠিক নেই। ভাবছি কাল রেস্ট নেব। আমার সঙ্গে চা-মুড়ি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করবে।”
“ঠিক আছে।” জয় কথা বাড়ায়নি।
তবে রাগ কমেনি ওর। বাড়ি ফিরে গুম হয়ে ছিল। রাতে খাওয়ার পর ও সটান ঢুকে পড়েছিল কেয়ার ঘরে।
কেয়া আকাশি নীল রঙের খুব সরু স্ট্র্যাপের নাইটি পরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। চুলগুলো ভেঙে পড়েছিল কপালে। বাঁ গালের লাল তিলটা যেন বেড সাইড ল্যাম্পের আলোয় জ্বলে উঠেছিল ভিতর থেকে। উপচে-ওঠা বুক দু’টোর মধ্যের গভীর খাদের দিকে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়েছিল জয়। বহু-বহুবার তো এসব ওর দেখা। তবু গত রাতে কেয়াকে কেমন যেন অন্য নারী মনে হচ্ছিল, যেন ওর গায়ে কোনওদিন হাতই দেয়নি জয়! প্রবল ইচ্ছেটা মাথার ভিতর আগুন হয়ে ঘুরছিল। শরীর নিজের খিদে মেটাতে পারছিল না বলে রাগটার ভিতর ভরে দিচ্ছিল সব অগ্ন্যুত্পাত। জয় ক্ষুধার্ত গলায় ডেকেছিল, “কেয়া।”
চমকে উঠেছিল কেয়া। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের বুকের কাছে হাত চলে গিয়েছিল ওর। আরও রাগ বেড়ে গিয়েছিল জয়ের। ও বলেছিল, “তোমার কি মনে হয় আমি অন্ধ?”
“মানে?” কেয়া থতমত খেয়ে গিয়েছিল।
“মানেটা জানো না? ভুলে গিয়েছ আজ কী দিন?”
“কী আজকে?” কেয়া দ্রুত সামলে নিয়ে আক্রমণ সাজানোর জন্য তৈরি হয়েছিল।
“তুমি আজও এমন করতে পারলে?”
“আজ কী করেছি আমি?” জিজ্ঞেস করেছিল কেয়া।
“তুমি…তুমি…” জয় রাগের চোটে খেই হারিয়ে ফেলছিল। আর কেন কে জানে, বাঁশির কথাটা সরাসরি বলতেও পারছিল না। মনে হচ্ছিল, সন্দেহের বশে কিছু বললে যদি হিতে-বিপরীত হয়। ওর হাতে তো কোনও প্রমাণ নেই। এমন বললে কেয়া যদি আরও দূরে সরে যায়! কিন্তু যা ও দেখেছে, তা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? বাঁশির দিকে তাকিয়ে কেন হাসছিল কেয়া? তাও এমন দিনে? নাইটি-ঢাকা শরীরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল জয়ের।
জয় বলেছিল, “তোমার লজ্জা করছে না? ভুলে গিয়েছ আজ কী দিন?”
“আছে, আছে,” আচমকা চিৎকার করে উঠেছিল কেয়া, “মনে আছে,…আজ বাবুইয়ের মৃত্যুদিন। চার বছর আগে তুমিই মেরে ফেলেছিলে বাবুইকে।”
“এসে গিয়েছে দাদা,” ট্যাক্সিচালকের কথায় সংবিৎ ফিরল জয়ের। চোখের কোণ দিয়ে নেমে আসা সরু জলের রেখাটা মুছে মানিব্যাগ বের করল। এখান থেকে বলাইয়ের বাড়িটা হেঁটে তিন-চার মিনিট।
বলাইয়ের বাড়িটা একতলা। সামনের গেট খুলে সামান্য একটা বাগান পেরিয়ে ঢুকতে হয়। বারান্দায় একটা ক্যাম্পচেয়ারে বসে এক হাত দিয়ে ধরে একটা ম্যাগাজ়িন দেখছিল বলাই। এক হাত দিয়ে, কারণ বলাইয়ের বাঁ হাতটা কব্জি থেকে কারা যেন কেটে নিয়েছিল। বলাই বলে শিবির লোক ছিল ওরা। কিন্তু শিবি তা কখনও স্বীকার করে না। ঘটনাটা ছ’বছর আগের। বলাই নস্কর তারপর থেকেই হাতকাটা বলাই।
“এসো জয়দা!” বলাই অমায়িক হেসে উঠে দাঁড়াল।
জয় বারান্দাতেই বলাইয়ের পাশের ক্যাম্পচেয়ারে বসে পড়ল। তারপর কোনও রকম ভণিতা না-করেই বলল, “শোন বলাই, তোকে আমি বিশ্বাস করি। তাই তোকে বলছি, ব্যাপারটা খুবই সেনসিটিভ।”
বলাই ভাল করে জয়ের মুখ দেখল। বলল, “বিশ্বাস করতে পারো আমায়। কোনওদিন তোমায় নিরাশ করেছি? জীবনে দু’টো খুন করেছি। তাও তোমার জন্য। নির্ভয়ে বলো। তোমার কোনও ক্ষতি হবে না।”
“কেয়া…” জয় দু’হাত দিয়ে মুখটা ঘষল।
“বউদি?” বলাই সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল।
“একটা ছেলে। আমি ঠিক জানি না। ওরা দু’জনে…আমি সত্যি জানি না আমি কী বলছি। আমি রাত্রে ঘুমোতে পারি না রে বলাই।”
“তুমি কী চাও শুয়োরের বাচ্চাটাকে কাঁচি করে দিই?”
“না। জাস্ট ফলো করে দ্যাখ আমার সন্দেহ সত্যি কিনা। যা করার আমি করব।”
বলাই এক মুহূর্ত ভাবল। বলল, “ঠিক আছে। তবে আমাদের সবাই তোমায় আর বউদিকে চেনে। ফলো করতে বললে কেচ্ছা হয়ে যাবে। তার চেয়ে…দাঁড়াও একজন আছে। আগে বলো, মালটাকে চিনব কী করে?”
জয় পকেট থেকে একটা রঙিন ছবি বের করল। গত বছর, দোকানে গণেশপুজোর দিন তোলা ছবিটায় জয় আর বাঁশি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। “এই যে।”
বলাই ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল, “এ যে কষ্টিপাথরের কেষ্ট! চিন্তা কোরো না। ডে-বাই-ডে খবর পেয়ে যাবে।”
“একটু দেখিস বলাই। আমি…”
“ফিকর মত করো। সব ঠিক হয়ে যাবে,” বলাই কাটা হাতটা তুলে বরাভয় দিল, “আমি একজনকে ফোন করে খবর দিচ্ছি। দশ মিনিটে চলে আসবে। আমার সঙ্গে পুরনো দোস্তি, তবে তোমাদের চেনা নয়। বউদি-ফউদির কথা কিচ্ছু বলবে না। যা বলার বলব আমি।”
বলাই মোবাইলটা তুলে ডায়াল করল, “হ্যালো। তোর জন্য একটা আর্জেন্ট কাজ আছে। পেমেন্ট ভাল। চলে আয় তাড়াতাড়ি। আমরা তোর জন্য ওয়েট করছি নেলো।”
রথী, ২৮ জুন: বিকেল
কতদিন কলকাতায় এমন একটানা বৃষ্টি হয়নি? এই জুনেও টানা বৃষ্টিতে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে কয়েক ডিগ্রি। লাল একটা উইন্ডচিটার গায়ে দিয়ে রয়েছে রথী। এই উইন্ডচিটারটা দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে সেখান থেকে কিনে এনেছিল ব্লসম। প্যারাসুট কাপড়ের জিনিসটা, বেশ সুন্দর দেখতে। এটা সচরাচর গায়ে দেয় না রথী। কিন্তু আজ এটা বের করেছে ও। এতদিন পর ওর সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে যাওয়াটা কি যেমন-তেমন ভাবে হতে পারে?
রথী ছাতাটা নিয়ে ফুটপাথের ভিতর দিকে মসজিদের গায়ে সরে গেল। আনোয়ার শাহ রোডের মোড়ে টিপু সুলতান মসজিদটা বেশ সুন্দর। ঠাকুরদেবতায় খুব একটা ভক্তি নেই রথীর। তবু যে-কোনও মন্দির, মসজিদ বা ক্যাথিড্রালের পরিবেশটাও খুব টানে রথীকে।
প্রায় সওয়া চারটে বাজে। শনিবার বিকেলে অন্যদিন আনোয়ার শাহ-র এই মোড়টায় এমন সময় জট লেগে যায়। কিন্তু বৃষ্টি সব কিছুর মতো জটকেও নেতিয়ে দিয়েছে। আজ মোড়টায় তেমন ব্যস্ততা নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে মন্দ লাগছে না রথীর। চাপা টেনশন হচ্ছে। অন্য কিছুর জন্য কোনওদিন টেনশন হয় না ওর। কিন্তু ব্লসম যে ‘অন্য কিছু’ নয়, সেটা ওর মন হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়াচ্ছে ওকে। ওই ছোট্ট মোমের পুতুলের সামনে রথী যে কেন এমন অসহায় হয়ে যায়!
মোবাইলে সেই কথার পর রথীকে দেখতে ব্লসম একদিন ওদের বাড়িতে এসেছিল। দিদি ব্লসমকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। রথী যত ডানপিটেই হোক না কেন, মেয়েদের ব্যাপারে বরাবর ওকে লাজুক বলেই ধরেছে দিদি। অবশ্য এটা বোধহয় সব মা আর দিদিদেরই সাধারণ চরিত্র। তারা সবসময় ছেলে বা ভাইকে মেয়েদের ব্যাপারে লাজুক ও নিরীহ ভাবে।
ঘরে শুয়েই রথী শুনতে পেয়েছিল নরম আবছা সেই গলাটা। আর শুয়ে থাকতে পারেনি, বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। গালে সাত দিনের না-কাটা দাড়ি নিয়ে নিজেকে ভূতের মতো লাগছিল রথীর। ভেবেছিল, ইশ, ব্লসম প্রথমদিন এল, আর সেদিনই এমন গুহামানবের মতো দেখতে লাগছে ওকে!
ব্লসমকে দেখে দিদির চোখে হাজারও প্রশ্ন দেখতে পেয়েছিল রথী। তবে ভাগ্য ভাল, ব্লসমের সামনে দিদি কোনও প্রশ্ন করেনি।
রথীর ঘরে প্লাস্টিকের চেয়ারে মাথা নিচু করে বসেছিল ব্লসম। রথী ভাবছিল, যে মেয়ে একা আসতে পারে এখানে, সে এমন লাজুক হয়ে বসে রয়েছে কেন?
রথী বলেছিল, “তুমি ভাল আছ?”
“আমি?” টলটলে চোখ দু’টো তুলে তাকিয়েছিল ব্লসম। রথীর ওই সামান্য ঘরে এক পাহাড় ফুল ফুটে উঠেছিল যেন। ব্লসম বলেছিল, “তুমি কেমন আছ? আর এটা রাখো।”
হাতে ধরা কাগজের ঠোঙাটা এগিয়ে দিয়েছিল মেয়েটা। রথী খুলে দেখেছিল কমলালেবু।
“এর কিন্তু দরকার ছিল না। আমি ফল খাই না।”
“তুমি খাবে না?” ব্লসম অসহায় মুখ তুলে তাকিয়েছিল রথীর দিকে।
রথীর সমস্ত জ্বর কোথায় পালিয়েছিল কে জানে! ও ভেবেছিল, খাবে না মানে? ব্লসম বললে ঠোঙাটা পর্যন্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারে, তো কয়েকটা ফল! ব্লসমের মুখ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে রথী বলেছিল, “নিশ্চয়ই খাব।”
বেশিক্ষণ বসেনি ব্লসম। দিদির দেওয়া চা-বিস্কিটও ছুঁয়ে দেখেনি। শুধু যাওয়ার সময় হঠাৎ রথীর কাছে এসে ওর হাতটা স্পর্শ করে বলেছিল, “ভাল হয়ে উঠে ফোন কোরো। আমি অপেক্ষা করব।”
ব্লসম চলে যাওয়ার পর দিদি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রথীর উপর, “কে রে মেয়েটা? নাম তো জানলাম। বাঙালি? কোথায় থাকে? কোথায় আলাপ হল তোদের? কত দূর এগিয়েছিস তোরা? আমাকে কিছু বলিসনি কেন?”
একসঙ্গে দশজন বোলার বল করলে কোন বলটা খেলবে ব্যাটসম্যান? রথী কোনও উত্তর দেয়নি। চুপ করে শুয়ে পড়েছিল বিছানায়।
“কী রে কিছু বল? কে মেয়েটা? তোর সঙ্গে কী এমন সম্পর্ক যে একেবারে একা-একা বাড়িতে এসে উঠেছে?” দিদির কথার ধাঁচটা বাঁকা হচ্ছিল ক্রমশ। রথীর মেজাজ চড়ছিল। কিন্তু ও এটাও বুঝতে পারছিল যে, ঝগড়া করলে অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।
রথী বিছানায় উঠে বসে শান্ত গলায় বলেছিল, “মেয়েটার নাম তো জেনেইছিস। ব্লসম। রানিকুঠিতে থাকে। আর আমিই ওর সঙ্গে নিজে থেকে আলাপ করেছিলাম। মেয়েটা পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিল, আমি ওকে হেল্প করেছিলাম।”
“কিন্তু নামটা অমন, গায়ের রং অমন। বাঙালি?”
“অ্যাংলো ইন্ডিয়ান।”
“অ্যাঁঃ?” দিদি আঁতকে উঠেছিল, “কায়েতের ছেলে মেমসাহেব ঘরে তুলবি?”
“কী যা-তা বলছিস? এর মধ্যে কায়েত-মেম আসছে কেন? বিয়েই বা কেন আসছে? মেয়েটাকে আমি খুবই পছন্দ করি। বিয়ের মতো মনের অবস্থা এখন আমার নেই। কিন্তু পরে বিয়ের ইচ্ছে হলে করব। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কোনও বাধা হবে না, বুঝেছিস?”
“বাবা-মা বেঁচে থাকলে তুই এমন করতে পারতিস?”
রথী আবার বলেছিল, “মেয়েটা বিউটিশিয়ানের কাজ জানে। আর পাশাপাশি নার্সের কাজ করে ভাল রোজগার করে।”
দিদি এর উত্তরে তখন আর কিছু না বললেও দুপুরে খাবার দেওয়ার সময় বলেছিল, “কেমন রোজগার করে তোর ব্লসম? দেখিস ভাই, তোকে না পথে দাঁড় করিয়ে দেয়।”
দিদির কথাটা মনে পড়ায় হেসে ফেলল রথী। মানুষ কী ভেবে বলে আর তা কীভাবে সত্যি হয়! এখন পথেই তো দাঁড়িয়ে রয়েছে রথী।
ব্লসমের জন্য কতদিন পর অপেক্ষা করছে ও। শিবির ওখানে ব্লসমের ফোনটা পেয়ে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিল। শিবি বলেছিল, “এখন ফোন-টোন রাখ, আমার কথাটা খুব দরকারি।”
“সরি দাদা, এই ফোনটা ধরতে হবে আমায়।”
শিবিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা ধরেছিল রথী, “হ্যালো, হ্যালো, ব্লসম,… তুমি কোথায়?”
“আঃ, এমন করছ কেন?” ব্লসম যেন বিরক্ত হয়েছিল সামান্য, “আস্তে কথা বলো।”
রথী সামলে নিয়েছিল। পৃথিবীতে একমাত্র এই একজনই ওর সঙ্গে এমন করে কথা বলে। রথী বলেছিল, “সরি, সরি। আসলে…মানে…”
“তুমি সকালে ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়েছিলে কেন?”
আমি তো তোমায় মেসেজ করেছিলাম।”
“মেসেজ করলেই সব মাফ হয়ে যায়?”
“তুমি তো দেখাই করছ না আমার সঙ্গে। আমায় একবার আমার কথাটা বলতে দেবে না?”
“কোনও কিছু বলার আর বাকি নেই রথী। তুমি নিজের দিকটাই দেখছ। আমার কথা কখনও চিন্তা করেছ?”
ব্লসম খুব শান্ত গলায় বললেও রথীর ভিতরে স্প্লিন্টারের মতো গেঁথে যাচ্ছিল কথাগুলো। ও যেন চোখের সামনে সুন্দর মুখটা দেখতে পাচ্ছিল। রাগ হলেই ব্লসমের চোখ দু’টো অনেক দূরের হয়ে যায়।
“তুমি একবার যদি আমার কথাটা শুনতে…” রথী কী করবে বুঝতে পারছিল না।
“সেই জন্য তোমায় ফোন করলাম। চারটে নাগাদ আনোয়ার শাহ রোডের মোড়ে টিপু সুলতান মসজিদের সামনে দাঁড়াবে। তোমার সঙ্গে দেখা করব আমি।”
“ঠিক আসবে তো?” রথীর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।
“না এলে ফোন করব কেন তোমায়?”
“আমি অপেক্ষা করব।” রথী হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু তার আগেই ফোন রেখে দিয়েছিল ব্লসম।
হৃৎপিণ্ডটা এমন ডানা ঝাপটাচ্ছিল যে রথীর মনে হচ্ছিল, সুযোগ পেলেই ব্যাটা উড়ে পালাবে। ওর মনে হয়েছিল, সকালে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়ানোটা তা হলে একদম ব্যর্থ হয়নি।
“বাবা, তোর এমন একপিস রূপ আছে জানতাম না তো!” শিবি হাসছিল। বিড়ালের মতো চোখ দু’টো কেমন যেন দপদপ করছিল লোকটার।
রথী চোয়াল শক্ত করে নিয়েছিল। সত্যি ব্লসমের ফোনটা পেয়ে এমন ঘোর লেগে গিয়েছিল ওর যে ভুলেই গিয়েছিল সামনে শিবি আছে। ব্যাটা সব শুনেছে।
শিবি বলেছিল, “তা কী যেন নাম বললি মেয়েটার? ব্লসম, না? বেশ নাম। কতদিনের আলাপ? সেই অ্যাক্সিডেন্ট কেসের মেয়েটা নাকি?”
রথীর হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল। কেন যে হুড়োহুড়ি করে ঘরের ভিতর কলটা নিল!
“বলবি না? বেশ। তা তোর প্রাইভেট ব্যাপার যখন, তখন আমি আর কী বলব? তা মেয়েটাই কি তোকে কুপরামর্শ দিচ্ছে নাকি?”
“কুপরামর্শ?” মানে? রথী ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল শিবির দিকে।
“মানে আমার এখানে কাজ না-করার ইচ্ছে। প্রেম করছিস। বিয়ে করবি নিশ্চয়ই। বাচ্চাকাচ্চাও হবে। কাজ তো জানিস না কিছু। পড়াশোনা যা করেছিস, নিজে জানিস। বউ-বাচ্চাকে খাওয়াবি কী? তোর ব্লসমকে বোঝা যে, পয়সা রোজগারের ক্ষেত্রে ভাল বা খারাপ পথ বলে কিছু নেই। পয়সা আত্মার মতো, কখনও মলিন হয় না।”
“দ্যাখো শিবিদা, আমি সত্যি বলছি, কাজ ছাড়ার সঙ্গে কারও সম্পর্ক নেই। এটা আমারই ডিসিশন। আমার বাবা-মা নেই। কিন্তু যেটুকু তাঁদের দেখেছি দু’জনেই খুব সাধারণ আর সৎ ছিল। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। তাঁর ছেলে হয়ে ছ’মাস জেল খেটে এলাম, তা-ও ভোটে বোমাবাজি করতে গিয়ে! নিজের উপরই ঘেন্না হয়।”
“বলছিস, এতে মেয়েটার কোনও হাত নেই?” শিবি চোয়াল শক্ত করেছিল।
“না!” জোরের সঙ্গে বলেছিল রথী। তবে কথাটা কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়। প্রথম-প্রথম ব্লসম জানতে চায়নি রথী কী করে। কিন্তু তারপর একদিন জানতে চেয়েছিল ।
ব্লসমের জন্মদিন ছিল সেটা। সদ্য বেশ কিছু টাকা পেয়েছিল রথী। তা সেই টাকা দিয়ে ব্লসমের জন্য বেশ দামি মুক্তোর হার কিনে নিয়ে গিয়েছিল ও।
হারটা দেখে অবাক হয়ে ব্লসম জিজ্ঞেস করেছিল, “এটা কিনলে কেন? কত দাম এটার? শুধু-শুধু বাজে খরচ।”
ব্লসমের ছোট্ট হাত দু’টো নিজের মুঠোয় নিয়ে রথী বলেছিল, “কেন বাজে খরচ বলছ? তোমার জন্য আমি এটুকু পারি না?”
ব্লসম বলেছিল, “খরচটা যে বাজে হয়েছে তা তুমিও জানো। আমরা খুব সাধারণ বাড়ির মানুষ। নিম্ন মধ্যবিত্ত। এভাবে খরচ করা আমাদের মানায় না।”
আঁতে ঘা লেগেছিল রথীর। বলেছিল, “তুমি জানো, আমি কত রোজগার করি?”
ব্লসম সরাসরি জানতে চেয়েছিল, “কী কাজ করো তুমি?”
রথী ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছিল যে, শিবরতন ঘোষ নামে একজন বিজ়নেসম্যানের প্রোমোটারি ব্যবসায় কাজ করে ও। কিন্তু ব্লসমের নানারকম জেরায় এই কথাটা প্রমাণ করতে পারেনি রথী।
ব্লসম যা বোঝার বুঝেছিল। তারপর বলেছিল, “শিবরতন ঘোষ, মানে শিবি। লোকটা ভাল নয়। ওর কাজ ছেড়ে দাও। না হলে গণ্ডগোলে পড়বে। কোনও ছোটখাটো কাজ করো। দু’জনের রোজগারে ঠিক চলে যাবে আমাদের।”
দু’জনের রোজগার? আমাদের? রথী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ব্লসমের দিকে। বিয়ের কথা বলছে কি মেয়েটা? রথীর তো বহুবার মনে হয়েছে বলার কথা। কিন্তু ব্লসমের সামনে এলেই তো সব গুবলেট হয়ে যায়। তাই এটা কোনওদিন বলতে পারেনি। আর ওর সেই না-পারাটা কী অদ্ভুতভাবে বলে দিয়েছিল ব্লসম।
রথী কোনও কথা বলছিল না। ও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মোমের পুতুলের দিকে। ব্লসম নিজে এগিয়ে এসে রথীর গলার চেনটা ধরে টেনে নামিয়ে এনেছিল ওর মুখ। তারপর দু’হাত দিয়ে ওর মুখটা ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল। জিভ দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়েছিল রথীর ঠোঁট। ও আর মনে করতে পারছিল না কিছু। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছিল যেন। ওর হাত দু’টো জড়িয়ে নিয়েছিল মাখনের মতো নরম ব্লসমের শরীরটা।
পরে রথী চলে আসার আগে ব্লসম আবার বলেছিল শিবির কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা। তারপর থেকে দেখা হলেই ব্লসম একই কথা বলত। রথী সবসময়ই এটা-সেটা বলে কাটিয়ে দিত। কিন্তু পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গত ছ’মাসে ব্লসমের যুক্তিটা স্পষ্ট বুঝেছে রথী।
শিবি বলেছিল, “ঠিক আছে। এটাই শেষ কাজ তোর। আর বলব না। শোন রথী, আমিও তেমন খারাপ লোক নই, পাকেচক্রে এখানে এসে পড়েছি। ঝাপুবাবুর থেকে কাজটাও নিয়েছি তোর নাম করে। এটা উদ্ধার করে দে। আর শোন, খুব কিছু রিস্কও নেই। মাল তুলে গা ঢাকা দিবি। তারপর সময়-সুযোগমতো বেরিয়ে যে অ্যাড্রেস বলব, সেখানে পৌঁছে দিবি।”
“কাজটা একা করতে হবে?”
“আমি তোকে বললাম। তিরিশ হাজারে রফা হয়েছে। একা করলে তিরিশ হাজার তোর। আর তুই যদি সঙ্গে কাউকে চাস, তা হলে তাকে তুই কী টাকা দিবি, সেটা তোর ব্যাপার।”
“ছানুকে সঙ্গে রাখব ভাবছি।” রথী বলেছিল।
“ছানু?” সামান্য চিন্তিত মুখে রথীর দিকে তাকিয়েছিল শিবি, “তোর বন্ধু, তুই যা ভাল বুঝিস। তবে ছেলেটা ভাল নয়। পুরিয়ার ব্যবসা ধরেছে। খুব খারাপ লাইন। আমায় বলেনি, ভেবেছে যদি বাগড়া দিই। কাজ শেষ করে টাকা নিয়ে চলে যাস তোর ব্লসমের সঙ্গে। কেমন?”
“তা কাজটা কী বলবে তো? কী মাল তুলতে হবে?”
শিবি ঝুঁকে বসে বলতে শুরু করেছিল।
“অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছ?” মৃদু গলার ডাকটা যেন কয়েক হাজার বছর পর শুনল রথী। সেই সাদা পাতলা ওয়াটার প্রুফ। মুখটা দেখলেই শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় রথীর, কথা বলতে কষ্ট হয়। এত কাছে দাঁড়িয়ে ছ’মাস সাতদিন পরে কথা বলছে রথী। এক-একটা দিন ও গুনে রেখেছে।
“মানে…ইয়ে…” রথী হাসল। আসলে চোখে জল এসে গিয়েছিল ওর।
“শোনো রথী,” ব্লসম চোখে চোখ রাখল, “এই ক’মাস আমি খুব কষ্টে ছিলাম। বাড়িতে মা আর দাদা চায় না তোমার সঙ্গে আমি আর সম্পর্ক রাখি। আমিও অনেক ভেবেছি। আমি বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার সঙ্গে থাকতে রাজি আছি। কিন্তু এই মুহূর্ত থেকে তোমায় সব খারাপ কাজ ছাড়তে হবে। আমি কোনও কথা শুনব না। এখনই আমার গা ছুঁয়ে বলতে হবে যে, তুমি সব ছেড়ে দিলে।”
ফরসা, সুন্দর হাতটা বাড়িয়ে দিল ব্লসম। কিন্তু কী করে ব্লসমকে ছুঁয়ে মিথ্যে বলবে ও? মা বলত, কাউকে ছুঁয়ে মিথ্যে বললে সে মারা যায়। অন্য কোনও ক্ষেত্রে এসব মানে না রথী। কিন্তু এ যে ব্লসম! ও কী করে বলবে যে আর একটামাত্র কাজ করতে হবে ওকে? ব্লসম তো মানবেই না। তা হলে? দ্বিধাগ্রস্ত মুখ নিয়ে ব্লসমের দিকে তাকাল রথী।
“বুঝেছি!” ব্লসমের চোখটা আবার দূরে চলে গেল খুব। তারপর রথীকে আর কিছু বলার সুযোগ না-দিয়েই একটা চলন্ত অটোকে থামিয়ে তাতে উঠে চলে গেল।
গোটা ব্যাপারটা হতে ঠিক এক মিনিট লাগল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রথী দেখল, যেন গোটা শহরটাই ওর সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
বিষাণ, ২৮ জুন: বিকেল
এখানে আরও কুড়ি-পঁচিশ মিনিট তো বসতেই হবে। তার মধ্যে সেল্স রিপোর্টে আজকের ফলো-আপটা ফেয়ার করে লিখে ফেলতে হবে। ব্যাগের চেন খুলে কাগজপত্তর বের করল বিষাণ। যে ক’দিন আছে এখানে, নিয়মটা তো পালন করতেই হবে।
বাইরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে একটানা। বৃষ্টির জোর বেশি নয়, তবু অনেকক্ষণ ধরে হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় জল জমতে শুরু করেছে। এখন আবার এখান থেকে লেকগার্ডেন্স যেতে হবে।
লিখতে শুরু করার আগে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল বিষাণ। হলঘরটা বিরাট বড়। আর তাতে প্রায় ষাট-সত্তর জন লোক বসে রয়েছে। এই রানিকুঠি অঞ্চলে ডঃ ভূপেন বিজলির নামডাক খুব। আজকাল প্রচুর লোক হোমিওপ্যাথি করায়। মা-ও এই ডাক্তারকেই দেখায়। মায়ের হাঁটুতে সমস্যা হচ্ছে খুব। এই ডাক্তারেরই ওষুধ খায়, কিন্তু প্রায় দশদিন হল ওষুধ ফুরিয়েছে। মা আজকাল এত কেয়ারলেস হয়ে গিয়েছে যে, ওষুধ ফুরোনোর কথা বলেইনি কাউকে।
দোয়েল দুপুরে ফোন করেছিল বিষাণকে। বলেছিল, ডাক্তারের চেম্বারে চলে আসতে। মাকে নিয়ে দোয়েল আসবে। আর বিষাণকে পৌঁছে যেতে হবে ডিসপেনসারি। বিষাণের একটু বিরক্ত লেগেছিল। বলেছিল, “কপিলকাকুকে বলো না সঙ্গে যেতে! আমি এখন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে, এখান থেকে এই ওয়েদারে সন্তোষপুর যাওয়া চাট্টিখানি কথা?”
“ও আমি জানি না। কপিলকাকুকে দিয়ে ডাক্তারের ওষুধ আনানো যেতেই পারে। কিন্তু কাকু দুপুরে কোথায় যেন বেরোবে। ডাক্তার দেখানোর পর অন্তত আধ ঘণ্টা বসে ওষুধ নিতে হয়। মা অতক্ষণ বসতে পারবে না।”
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে মেট্রো ধরে রবীন্দ্র সরোবর, তারপর সেখান থেকে অটোয় এই রানিকুঠি! জান বেরিয়ে গিয়েছে একদম।
কপালটা ছোট থেকেই খুব ভোগায় বিষাণকে। মাধ্যমিকে ভুল রেজাল্ট এল। এইচএস-এ ইনকমপ্লিট। বি কম-এ অ্যাডমিট কার্ডে নাম ভুল। শালা, এই কপালটা যদি স্যান্ডপেপার দিয়ে ঘষে নতুন করে লেখা যেত! খেলাধুলোতেও তো ভাল ছিল, কিন্তু পোলভল্ট দিতে গিয়ে ডান হাতের কব্জিটা ভাঙায় আর খেলাই হল না।
অটো করে আসতে-আসতে এমনই মনে হচ্ছিল বিষাণের। আসলে মনখারাপ চুম্বকের মতো। আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা পুরনো দুঃখের টুকরো-টাকরা সব টেনে এনে এক জায়গায় জড়ো করে। তার উপর আনোয়ার শাহ রোডের মোড় থেকে সাদা ওয়াটার প্রুফ পরা একটা সুন্দরী মেয়ে টালিগঞ্জ পর্যন্ত কাঁদতে-কাঁদতে এসেছে। পাশে বসে কেউ যদি ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে কাঁদে, কার না মেজাজ গরম হয়? আর শুধু মেজাজ গরম নয়, খারাপও লাগছিল বিষাণের। কেউ কাঁদলে ভীষণ খারাপ লাগে ওর।
ডাক্তারের চেম্বারে আর বিষাণ ঢোকেনি। দোয়েল আর মা ঢুকেছিল। তারপর বেরিয়ে এসে ডাক্তারের স্লিপটা ধরিয়ে দিয়েছিল বিষাণকে। স্লিপের টোকেন নম্বর, আঠেরো। অভিজ্ঞতা থেকে বিষাণ জানে, কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের ধাক্কা। মা আর দোয়েলকে ট্যাক্সি ধরে দিয়ে ভিতরে এসে বসেছে এখন। একজন নম্বর ধরে ডাকছে। এখন ছয় ডাকা হয়েছে।
আজ দিনটাই বাধাবিঘ্নে ভরা। পকেটের ফোনটা ট্যাং-ট্যাং করে উঠল আবার। আশপাশের দু’-তিন জন খুব রাগ-রাগ মুখ করে তাকাল বিষাণের দিকে, যেন খুব গর্হিত কোনও কাজ করেছে ও। বিষাণ তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরল। চাপা গলায় বলল, “হ্যালো।”
“কোথায় তুই? এখনও এলি না?” আনন্দীর গলা।
বিষাণ বলল, “আমি রানিকুঠির এখানে আছি।”
“রানিকুঠি? তোকে বললাম না নেমন্তন্ন আছে আমাদের এখানে! প্রায় ছ’টা বাজে, এখনও এলি না!” আনন্দীর গলায় সামান্য রাগ।
“আসলে কাকিমা, মায়ের শরীরটা খারাপ হয়েছে। তাই ডাক্তারের কাছে এসেছি। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই বেরব।”
“আসার পথে একটা কাজ করে দিবি?”
বিষাণ হাসল। এই জন্য ফোন করে আসার খবর নেওয়া হচ্ছে? আর ‘কাজ করে দিবি’ মানে তো ‘কাজটা কর।’
ও বলল, “হ্যাঁ, নিশ্চয়। বলুন না।”
“লর্ডসের মোড়ে রাজার দোকান থেকে আমার বার্থ-ডে কেকটা নিয়ে আসতে হবে তোকে। রানিকুঠি থেকে গল্ফগ্রিন দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসবি। আমি ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে দেব। চিন্তা করিস না।”
“চিন্তা করিস না!” কথাটা খচ করে লাগল বিষাণের। হয়তো আনন্দী কথার তোড়েই বলে ফেলেছে, কিন্তু বিষাণের মনে কাঁটার মতো লাগল কথাটা। চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা যা ট্যাক্সি ভাড়া হবে, তা কি দিতে পারে না ও? আনন্দী কি ওকে এতটাই অপদার্থ ভাবে? কেন এরা এমন করে কথা বলে ওর সঙ্গে?
“হ্যালো, এই বিষাণ, শুনতে পাচ্ছিস?” আনন্দীর গলায় অধৈর্য। বিষাণ ভাবল, এরা সবসময় এত তাড়া দেয় কেন?
“আছি লাইনে। কেকটা নিয়ে যাব। আমায় দেবে তো?”
“আমি ফোনে বলে দিচ্ছি। তোর নামটা গিয়ে বলবি জাস্ট। টাকাপয়সা দেওয়া আছে। শুধু বলবি, ভাল করে প্যাক করে দিতে। যা বিচ্ছিরি ওয়েদার। কেকে জল লাগলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। বুঝেছিস?”
“হ্যাঁ কাকিমা।” বিষাণ সংক্ষেপে বলল।
“আরে, তোকে বলতাম না। সকালে কুমু বলেছিল যে, ও নিজেই নিয়ে আসবে। কিন্তু তারপর হঠাৎ ওর মুডটা এমন অফ হয়ে গেল কেন কে জানে! যাকে-তাকে দিয়ে তো এসব আনানো যায় না। তাই তোকে বললাম।”
বিষাণের ভাল লাগছে না একদম। কুমুর এখনও মুড অফ! আচ্ছা মেয়ে তো! কার মুড খারাপ আর তার খেসারত দিচ্ছে কে!
কুমু যে কেন হঠাৎ-হঠাৎ মুড খারাপ করে কে জানে! বিষাণ প্রথম যেদিন অজুর সঙ্গে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল, সেদিনও কুমুর মেজাজ খারাপ ছিল।
সেদিন আনন্দীর সঙ্গে পরিচয়ের পর অজু বলেছিল, “চল তোকে সাউথ ক্যালকাটার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।”
“সবচেয়ে সুন্দরী?” বিষাণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। অজুর চিরকাল বাড়িয়ে বলার স্বভাব। তাই বিষাণ ভেবেছিল, এটাও সেই ‘বাড়ির বিড়াল পাড়ার মোড়ে বাঘ’ ব্যাপার।
ওদের তিনতলা বাড়িতে ঢুকেই বিষাণ বুঝেছিল যে, এরা খুব পয়সাওয়ালা। কিন্তু কুমুর ঘরে ঢুকে বুঝেছিল যে শুধু পয়সা নয়, রুচিও খুব সুন্দর। পুরো ঘরটাই লেমন আর বেবি পিংকের কম্বিনিশনে সাজানো। ঘরের ভিতরে এসি চলছে, স্পষ্ট বুঝেছিল বিষাণ। কার্পেটের উপর বসে খাটে হেলান দিয়ে একটা মোটা ইংরেজি বই পড়ছিল কুমু।
পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকেই হলুদ আর গোলাপির ভিতর এমন একটা গোলাপি রঙের মেয়ে দেখে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল বিষাণ। ওর মন বলেছিল, ধ্যাৎ, খুব ভুল বলেছে অজু। ওটা সাউথ ক্যালকাটা হবে না, সাউথ এশিয়া হবে।
অজুদের ঢুকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল কুমু। বলেছিল, “আ ব্রুট উইল রিমেন আ ব্রুট।”
“কেন?” অজু হেসেছিল।
“নক করতে হয় বাবা-মা কিংবা স্কুলে শেখায়নি?”
অজু বলেছিল, “তোর মেজাজ খারাপ মনে হচ্ছে!”
কুমু উত্তর দেয়নি। পালটা বলেছিল, “পিছনের ওটি কে?”
“ও আমার পুরনো বন্ধু বিষাণ। আনন্দী আন্টি ম্যাগ পাবলিশ করবে শুনে আমার মনে হল যে, উই নিড আ টিম অব ডেডিকেটেড সোলজার্স। হি ইজ় ওয়ান অব দেম।”
বিষাণ বুঝতে পারছিল যে, এই মেয়ে ভোগাবে। তারপর এমন ঘর। এমন পরিবেশ। এর ভিতর নিজেকে গুরুচণ্ডালী দোষের মতো লাগছিল ওর। একছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। এ কোথায় এনে ওকে ফাঁসাল অজু!
“এ লিটারারি ম্যাগের কাজ করবে? ও এসব বোঝে? এমন পালোয়ানের মতো চেহারা নিয়ে কি ফাইনার আর্টস হয়?”
পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে গিয়েছিল বিষাণের। পালোয়ান হলে কি সাহিত্য বোঝার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি? সুন্দর বলে যা খুশি তাই বলবে? ও বলেছিল, “আয়াম সরি। আমি এখানে আসাতে হয়তো আপনি রাগ করেছেন। আমি আসছি।”
“দাঁড়া না,” অজু হাত টেনে দাঁড় করিয়েছিল বিষাণকে। তারপর কুমুকে বলেছিল, “ডোন্ট বি সো মিন। ও হয়তো লেখে না, কিন্তু গল্প-উপন্যাস খুব পড়ে। সিনসিয়ার ছেলে। একটা ভাল ম্যাগ করতে গেলে কাজের ছেলের দরকার হয়। তা ছাড়া ওকে আন্টিও অ্যাপ্রুভ করেছে।”
ফেরার পথে অজু বলেছিল, “মেয়েটা ঠোঁটকাটা হলেও ভাল। গুড অ্যাট হার্ট। তুই কিছু মাইন্ড করিস না। ও নিজের বয়ফ্রেন্ড আর তার বাবা-মা’কেও ছাড়ে না।”
“বয়ফ্রেন্ড!” বিষাণের মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল।
‘ওরে নাড়ু আমার!” খ্যাক-খ্যাক করে হেসেছিল অজু, “খুব বেদনা পেলে কি হৃদয়ে? তা ওর বয়ফ্রেন্ড থাকবে না তো কি খেন্তিপিসির বয়ফ্রেন্ড থাকবে?”
“না, না,…” তুত্লেছিল বিষাণ, “এমনি বললাম।” কিন্তু মোটেও এমনি বলেনি ও। বুকের ভিতরে কোথায় সূক্ষ্ম ফাটল ধরেছিল ওর। বুঝতে পারছিল সবটাই অযৌক্তিক। পাঁচ মিনিটের দেখা একটা মেয়ে। তার উপর দু’জনের জীবনে আকাশপাতাল ফারাক। দুঃখ পাওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে কি? কোন লজিকে দুঃখ পাচ্ছে ও? কিন্তু মন কবে লজিক মেনেছে? বিষাণের চিড়-খাওয়া মন কেবলই মনে করেছে, কুমুর দৃষ্টিতে কী যেন একটা সংকেত ছিল। কোনও অজানা গুপ্তধনের পথনির্দেশ।
তারপর মাঝে-মাঝেই আনন্দীর বাড়িতে যাতায়াত করতে হত বিষাণকে। তবে কখনোই কুমুর সঙ্গে দেখা হত না। কুমু ফিজিক্স নিয়ে এমএসসি পড়ছিল তখন। ফলে ব্যস্ত থাকত। তবু আনন্দীদের বাড়িতে ঢোকার মুখে হাত-পা ঘেমে উঠত বিষাণের, বুকে চাপা কষ্ট হত আর যখন গিয়ে কুমুর দেখা পেত না, তখন মনে হত গোটা পৃথিবীটাই অনর্থক।
তবু পৃথিবী অনর্থক হয় না। রোদের ভাঁজে অনেক জাদু লুকোনো থাকে। তখন শুধু টিউশন করত বিষাণ। একদিন এক জায়গায় পড়াতে যাচ্ছে, হঠাৎ “এই বিষাণ!” বলে একটা মেয়ের গলা পেয়েছিল ও। আর এতদিন যাবৎ থেমে থাকা সমস্ত কয়লার ইঞ্জিন একসঙ্গে স্টেশন ছেড়ে দিয়েছিল। থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে বিষাণ দেখেছিল কুমুকে। জিন্স আর হাতকাটা টপ পরে লম্বা, সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ডাকছিল ওকে।
এই ছেলেটা কে? বিষাণের বুকের সমস্ত ইঞ্জিন থমকে গিয়েছিল আবার। ওর রাগ হচ্ছিল খুব। আচ্ছা মেয়ে তো, এভাবে বারবার ইঞ্জিন চালালে আর বন্ধ করলে ইঞ্জিন খারাপ হয়ে যাবে না! তা ওকে ডাকল কেন? পরমুহূর্তেই মনে হয়েছিল ডাকবে না-ই বা কেন? বিষাণ কে হয় ওর যে অন্যের সামনে ডাকবে না?
ও এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কুমুর সামনে। তারপর বিষণ্ণ গলায় বলেছিল, “ও আপনি! বলুন, কিছু বলবেন?”
কুমু চোখ পাকিয়ে বলেছিল, “না তো কি এমনি টাইমপাস করছি যাকে-তাকে ডেকে?”
“না, না মানে…,” কিন্তু-কিন্তু করেছিল বিষাণ।
কুমু বলেছিল, “তোমায় একটা কথা বলা দরকার। কাইন্ড অব আ ওয়ার্নিং-ও বলতে পারো। এই লিট্ল ম্যাগ নিয়ে অজেয় আর আমার মা’র ভ্যানতাড়ায় ফেঁসে যেয়ো না।”
“মানে?” অবাক লেগেছিল বিষাণের। নিজের মা’কে নিয়ে এমন কেউ বলে?
“মা এসব করে সোসাইটিতে স্টেটাস বাড়াতে চায়। অজেয় ‘কবি হবে আর ছবি ছাপবে’ টাইপের মোটিভ নিয়ে মাকে গ্যাস খাওয়ায়। তুমি তো ওদের মতো নও, গাধা পেয়ে তোমায় খাটিয়ে নেবে। বুঝলে?”
‘তুমি তো ওদের মতো নও’ মানে? কী করে বুঝেছিল কুমু যে ও ওদের মতো নয়? আর গাধা? এটা কি প্রশংসা, না নিন্দে? তবে কুমুর অত কাছাকাছি যাওয়াটাই ওর কাছে সেদিনের হেডলাইন ছিল। ও মনে-মনে বলেছিল, “অন্তত তোমায় একবার দেখতে পাব, এই ভরসাতেই আমি স্বেচ্ছায় গাধাবৃত্তি বরণ করব।”
সেই দিন আর আজ! কুমুর সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তবু বিষাণ সহজ হতে পারেনি একটুও। একবার ভুল করে একটা কাণ্ড করে ঝাড়ও খেয়েছে কুমুর কাছে। কিন্তু কোনওদিনও কুমুকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি ওর বয়ফ্রেন্ডের কথা। কুমুর ব্রেক-আপের খবর শুনেছে অজুর মুখে। কোনওদিন জিজ্ঞেস করতে পারেনি, প্রথম থেকেই বিষাণের সঙ্গে এমন রুক্ষ ব্যবহার কেন করে ও?
এই তো আজ সকালেই ঢাকুরিয়ায় কেন অমন ব্যবহার করল। লাবানা যদি ফোন করেই থাকে, তাতে ওর কী?
এসব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলেও জিজ্ঞেস করে না বিষাণ। একটা অজানা ভয় ওকে সাহসী হতে দেয় না।
সকালে যে শুধু ম্যাগাজ়িনের ম্যাটারই দিতে আসেনি কুমু, নেমন্তন্নও করতে এসেছিল তা তো বুঝতেই পারেনি বিষাণ। ভাগ্যিস, আনন্দী পরে ফোন করে বলেছিল। বিষাণ জানে, আজকে ওখানে গেলে কুমু ঠিকমতো কথাই বলবে না। কে জানে ঘরভর্তি লোকের সামনে খারাপ কথা বলবে কিনা!
“আচ্ছা, এত বৃষ্টি হচ্ছে কেন বল তো?” প্রশ্নটা আচমকা শুনে থতমত খেয়ে গেল বিষাণ। আরে, কপিলকাকু এল কোথা থেকে?
“বাড়িতে ফোন করেছিলাম। শুনলাম, তুই নেমন্তন্ন থাকা সত্ত্বেও ওষুধ নিবি বলে বসে আছিস। তাই ভাবলাম চলে আসি। তুই বেরিয়ে যা, আমি ওষুধ নিয়ে ফিরব।”
“তুমি নিয়ে যাবে?” বিষাণ আশ্চর্য হল।
“বড্ড প্রশ্ন করিস তুই। যা এখন।” কপিল বিষাণের হাত থেকে স্লিপটা নিয়ে নিল।
বিষাণ আর অপেক্ষা করল না। কারণ আর-একটু থাকলেই কপিল হাজারটা প্রশ্ন করে বসবে। তাড়াতাড়ি বেরতে-বেরতে শুনল, কপিল নিজের মনে বলছে, “এখনকার দিনে কেউ কাউকে হেল্প করতে চাইলেও সন্দেহের চোখে দেখা হয় কেন?”
বিষাণ ভাবল, কিছু প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াই ভাল।
কেক নিয়ে যখন আনন্দীদের বাড়ি পৌঁছল বিষাণ, তখন সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। বাড়ির ব্যালকনিতে ছোট-ছোট আলো দিয়ে সাজিয়েছে আনন্দীরা। এত বয়সে কেন জন্মদিন করছে মহিলা? বুঝতে পারে না বিষাণ। বাড়ির গেট পেরিয়ে ঢুকতেই লম্বামতো মানুষটাকে দেখল বিষাণ। জয়সেন। সুতনুর খাস লোক। সামনাসামনি পড়ে গেলে সৌজন্যমূলক হাসি দেয় জয়। আজ যেন দেখতেই পেল না বিষাণকে। জয়ের মুখটা চিন্তিত দেখাচ্ছে।
দু’হাতে পলিথিনে প্যাক করা বিশাল বড় কেকটা ধরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও সামনের দৃশ্য দেখে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বিষাণ। বিষাণের মনে হল, এই মুহূর্তে ও যেন অন্ধ হয়ে যায়। তবু চোখ দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখল, সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে একটা সুন্দর দেখতে ছেলের ডান হাতটা নিজের দু’হাতে ধরে হাসিমুখে কথা বলছে কুমুদ্বতী!
জয়, ২৮ জুন: বিকেল
বাবুইয়ের মৃত্যুর জন্য কেয়া এখনও জয়কেই দোষী মনে করে? কিন্তু এতবার বলেও কেন কেয়াকে বোঝাতে পারে না ও? বাবুই ওর ছেলে ছিল না? সেদিন ও ঠিক সময়ে আসার চেষ্টা করেনি? বাবুইয়ের মৃত্যু ওর গোটা জীবনকে নাড়িয়ে দেয়নি? কেয়া দেখে না এখনও বাবুইয়ের জন্য জয় কীরকম কষ্ট পায়! এ-কথা সত্যি যে, জয় নিজে থেকে কখনও কেয়ার সামনে নত হতে পারে না। কখনও গিয়ে বলে না যে আমারও কষ্ট হয়। কেয়ার সেই সব মনখারাপের দিনগুলোয় জয় পারেনি কেয়াকে জড়িয়ে রাখতে। কোনওদিনই খুব একটা মন খুলে কথা বলতে পারে না জয়। বাবুইয়ের মৃত্যুর পর আরও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল ও। সেই দূরত্ব আজ বেড়ে গিয়েছে অনেক। মাঝে-মাঝে জয়ের মনে হয়, কেয়া তো এখনও তেমনই আছে। শুধু রাগের চাদর দিয়ে সবটা ঢাকা। যদি নিজের জড়তা আর মনের গিঁটগুলোকে খুলে কেয়ার কাছে দাঁড়ায় জয়, তা হলে কি কেয়া টেনে নেবে না ওকে? কিন্তু কিছুতেই পারে না জয়। গতকালই তো কথা বলতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলল। যার ফলশ্রুতি, ওকে শুনতে হল যে জয় নাকি মেরে ফেলেছে নিজের সন্তানকে!
সেই সাতাশে জুনটা সারা জীবনের মতো ক্ষত হয়ে আছে জয়ের মনের মধ্যে। সেদিনও সুতনুর কাজে মৌরিগ্রাম ছাড়িয়ে আরও কিছুটা গিয়েছিল জয়। সেখানেই ফোনটা পায়। জগত্মামুর গলাটা ফোনে কাঁপছিল। “কী হয়েছে মামু?” জয় জিজ্ঞেস করেছিল।
“বাবুই…বাবুই পড়ে গিয়েছে।”
“ও…” জয় ভেবেছিল এ আর এমন কী! বাবুই তো খুব ছটফটে। ছোটবেলায় জয়ও নাকি এমন দামাল ছিল। ওর তো কোনও ছোটবেলার ছবি নেই, তাই বাবুইকে দেখে নিজের ছোটবেলায় ফিরে যেত জয়। কখনও ওকে বকত না, শুধু আদর করত। কেয়া রাগ করত, বলত, “এত আশকারা দিয়ো না তো। একটু শাসন করো।”
“দুর, ও তো ছোট!” জয় হাসত।
কেয়া আরও রেগে বলত, “তোমার জন্যই ও নষ্ট হবে।”
জয় হেসে বলত, “ঠিক আছে, পরের জন যে আসবে তাকে তুমি তোমার মতো করে রেখো।”
“পরের জন মানে?” কেয়া চোখ পাকাত।
জয় গুটিগুটি পায়ে ওর দিকে এগোতে-এগোতে বলত, “ও তুমি তো আবার এমনিই বললে বোঝো না! ঠিক আছে প্র্যাকটিক্যালি বলছি।”
“পড়ে গিয়েছে তো কী হয়েছে?” জয় জিজ্ঞেস করেছিল, “ও তো রোজই পড়ে যায় কয়েকবার।”
“এটা সিরিয়াস, মাথায় লেগেছে। তাক থেকে খেলনা পাড়তে গিয়ে স্লিপ করে পড়ে গিয়েছে…চোখ খুলছে না।”
সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছিল জয়। যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটিয়েছিল গাড়ি। বাবুই চোখ খুলছে না? কী হল ওর? এমন তো অনেকবার পড়ে গিয়েছে। তখন তো কিছু হয়নি! তা হলে আজ কেন চোখ খুলছে না?
রাস্তাঘাট আবছা লাগছিল জয়ের। পাগলের মতো অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিয়েছিল জয়। সিগন্যাল যে ভেঙে ফেলেছে কখন, খেয়ালই করেনি!
বেশ খানিকক্ষণ পর ট্র্যাফিক সার্জেন্ট এসে আটকেছিল জয়কে। জয় অনুনয় করেছিল, ফাইন দিতে চেয়েছিল। গাড়ির পেপার্স দেখতে চেয়েছিল সার্জেন্টটি। মাথার ঠিক রাখতে পারেনি, জোর করে গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল জয়। তাতে ঝঞ্ঝাট রাস্তা থেকে সোজা গিয়ে থেমেছিল থানায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ছাড়া পেয়েছিল জয়। ঘণ্টাচারেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, বারবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল কেয়াকে। পায়নি।
নার্সিংহোমে ঢোকার সিঁড়িতে আলুথালু হয়ে বসেছিল কেয়া। দেখে মনে হচ্ছিল, ওর চোখ দু’টো পাথরের তৈরি। কোনও কথা বলছিল না কেয়া।
“কী হয়েছে কেয়া? বাবুইয়ের কী হয়েছে?” জয় হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল কেয়ার সামনে।
“তুমি মেরে ফেললে বাবুইকে?” আবছা গলায় বলেছিল, “একবারই চোখ খুলেছিল বাবুই। তোমাকে খুঁজছিল। না পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। আর খুলল না। তুমি মেরে ফেললে বাবুইকে? তুমি ওর জন্য এলে না? তুমি পারলে কী করে? কী করে মারতে পারলে বাবুইকে?”
ঝনঝন করে ফোন বেজে উঠতে চমকে উঠল জয়। কতক্ষণ একমনে বসে আছে ও? এখন ক’টা বাজে? ঘড়ি দেখল জয়। পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। আর কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে! জয় চায়ের কাপটা রেখে ফোনটা বের করল পকেট থেকে। কেয়া! হঠাৎ কেয়া! আজ দুপুরে তো কনট্র্যাক্টটা নিয়ে গিয়েছিল ওর দোকানে। তখন তো কেয়া কথাই বলেনি। হঠাৎ এখন ফোন করল? জয় ফোনটা ধরল, “হ্যালো।”
“দুপুরে কনট্র্যাক্টটা কোথায় রেখে গিয়েছিলে?”
“কনট্র্যাক্টটা?” জয় সময় নিল। বলল, “তোমার বাঁশিকে দিয়ে এসেছিলাম।”
“ভদ্রভাবে কথা বলো, আমার বাঁশি মানে?”
জয় থমকাল। এ নিয়ে কথা বাড়ানোই যায়। কিন্তু সুতনুর এখানে আর ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। ও বলল, “ওটা কথার কথা।”
“কোথায় রেখেছ কনট্র্যাক্টটা?”
“বললাম তো বাঁশিকে দিয়েছি।”
“আঃ, আমি ডুপ্লিকেট কপিটার কথা বলছি!” কেয়ার গলায় অধৈর্য, “তাড়াতাড়ি বলো, আমি সারাদিন তোমার সঙ্গে কথা বলব নাকি?”
“ওটা তো আমার কাছে!” জয় বলল।
“নিজের কাছে রেখেছ কেন? সই তো করব আমি।”
জয় বলল, “ভুল হয়ে গিয়েছে। এখনই নিয়ে কী করতে?”
“বড্ড বাজে কথা বলো। জিনিসপত্র এক জায়গায় না রাখলে তো হারিয়ে যাবে। তা ছাড়া সই করে রাখব। দোকান থেকে সায়ন্তনীকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব যশের কাছে। বাড়ি থেকে সায়ন্তনী নেবে কী করে?”
“কেন সোমবার তুমি নিয়ে যাবে না?” জয় অবাক হল।
“না, বাঁশির সঙ্গে আমায় যেতে হবে এক জায়গায়,” কেয়া আরও বিরক্ত হল, “তুমি এত প্রশ্ন করছ কেন?”
“কোথায় যাবে সোমবার?”
“তোমায় সব বলতে হবে? ডিসগাস্টিং।” ফোনটা রেখে দিল কেয়া।
মাথাটা আবার গরম হয়ে গেল। কোথায় যাবে কেয়া? কী ভেবেছে ও? জয় বোকা? সকালে বলাইয়ের কাছে যাওয়ার জন্য যেটুকু অস্বস্তি হচ্ছিল, সেটা আর এখন হচ্ছে না। বরং শরীরে কষ্টটা বাড়ছে। বলাইয়ের লোকটা ঠিকমতো কাজ করবে তো?
নেলোকে দেখে ঠিক ভরসা হয়নি জয়ের। কেমন একটা ক্ষয়াটে চেহারা। মাথাটা পাতা-ছিঁড়ে-নেওয়া মুলোর মতো। চোখের নীচে কালি। দেখলেই মনে হয় ভুখা পার্টি।
বলাইয়ের দিকে দ্বিধার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল জয়। বুঝতে পেরেছিল বলাই। হেসে নেলোকে বসতে বলে তাকিয়েছিল জয়ের দিকে। বলেছিল, “নেলো অনেক আগে থেকে আমায় চেনে। তোমার কাজে ওই পারফেক্ট।”
জয় তেতো হাসি হেসেছিল।
নেলো বলেছিল, “আপনি চিন্তা করবেন না।”
বলাই আর সময় নষ্ট করেনি। বাঁশির ছবি দেখিয়ে নজর রাখার ব্যাপারটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল। নেলো বলেছিল, “দোকান থেকেই কি ফলো করব? মানে আজ থেকেই কি…”
“হ্যাঁ।” বলে উঠেছিল বলাই।
“ঠিক আছে,” নেলো সময় নিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, “কিন্তু কেন এই লোকটিকে ফলো করব, তা জানতে পারি?”
জয় তাকিয়েছিল বলাইয়ের দিকে। বলাই চোখ দিয়ে জয়কে আশ্বস্ত করে বলেছিল “কেসটা খুব নাজ়ুক। দাদার বউকে লোকটা ‘দিদি, দিদি’ করে, কিন্তু মনে হয় শালার অন্য কোনও মতলব আছে। তাই চোখে-চোখে রাখবি। বুঝলি?”
নেলো মাথা নেড়েছিল, “জিজ্ঞেস করলাম বলে কিছু মনে কোরো না। দাদাকে সময়-সময় খবর দিয়ে দেব। তা, দাদার মোবাইল নম্বরটা? খবর জানাতে হবে তো!”
বলাই নেলোকে থামিয়েছিল, “তুই আমায় জানাবি।”
“হ্যালো জয়দা, বোর হচ্ছ, না? দ্যাখো তো কাকাইয়ের কাণ্ড। নিজে জরুরি কাজ আছে বলে চলে গিয়ে তোমায় ফাঁসিয়ে দিয়ে গিয়েছে।” কুমু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল।
সুতনুরা দুই ভাই-ই লেকগার্ডেন্সের এই বিশাল বড় বাড়িটায় থাকে। তবে দু’টো আলাদা অংশে। অন্যদিন বিতনুদের অংশে আসতে হয় না জয়কে। কিন্তু আজ বিতনুদের ড্রয়িংরুমেই বসে রয়েছে ও। আজ আনন্দী বউদির জন্মদিন। অনেক গেস্ট আসবে। সুতনুরও থাকার কথা। কিন্তু সুতনু কি স্যাটারডে ইভনিংয়ে বউদির জন্মদিনে হোস্টগিরি করে কাটাবে? সে বান্দা নাকি? তা হলে জিনার কী হবে?
কেয়ার দোকান থেকে বেরিয়ে বিকেলে এই বাড়িতে এলে সুতনু জয়কে বলেছিল, “আজ তোমার এদিক-ওদিক যাওয়ার দরকার নেই। আজ আনন্দী বউদির জন্মদিন। দাদা গেস্টদের সামলাবে না অন্য ব্যবস্থা দেখবে? তাই তুমি বাদবাকিটা দেখে দিয়ো। কেমন?”
“আপনি থাকবেন না দাদা?” জয় অবাক হয়েছিল।
“না, মানে…” সুতনু সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করেছিল, “আমায়…ওই জিনার ওখানে একবার…”
“আচ্ছা-আচ্ছা!” সুতনুকে আর বিব্রত করতে চায়নি জয়। যা পারে করুক।
এসব ভাবতে-ভাবতেই সিমি ঘরে ঢুকেছিল। সুতনুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলেছিল, “আজ দিদিভাই বিশেষ করে তোমায় থাকতে বলল, তুমি তা-ও বেরচ্ছ?”
“মানে?” সুতনু ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল সিমির দিকে, “তোমার দিদিভাই কি আমার সংসার চালাবে? বড় একটা কাজ আছে। এখন যেতেই হবে। এ কি মন্টেসারি স্কুল নাকি যে ব্যাঙে পেচ্ছাপ করল আর রেনি-ডের ছুটি দিয়ে দিল? এখানে কোটি-কোটি টাকা অ্যাট স্টেক। বুড়ো বয়সে বউদিরই বা নেচেকুঁদে হ্যাপি বার্থ-ডে বলে ঢং করার কী আছে, জানি না।”
জয় মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসতে গিয়েছিল ঘর থেকে। এমন ডাহা মিথ্যে নিজের বউকে বলে কী করে মানুষটা? এই লোকটার কাছে অনেক ব্যাপারে ঋণী জয়, কিন্তু এই সব নোংরামো দেখলে সহ্য করতে পারে না একদম। কিন্তু ঘর থেকে বেরতে গিয়েও পারেনি জয়। কারণ সুতনু সিমিকে ঠিক সেই সময়ই বলেছিল, “তুমি জয়কে জিজ্ঞেস করো না কত ইমপরট্যান্ট এই মিটিংটা। কী জয়, বলো সিমিকে।”
জয় যন্ত্রের মতো মাথা নেড়েছিল শুধু। সিমি কি বুঝেছিল যে জয় মিথ্যে কথা বলছে? কে জানে! আসলে সিমি এত ভাল যে, ওকে মিথ্যে বলতে খারাপ লাগে জয়ের। জিনা বলে মেয়েটা যে কী জাদু করেছে কে জানে!
সিমি বলেছিল, “কিন্তু বউদি রাগ করবে খুব। বিশেষ করে তোমায় থাকতে বলেছিল।”
সুতনু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে বলেছিল, “জয়কে রেখে গেলাম। ও সব সামলে দেবে।
“ও জয়দা, কী হল?” কুমু আবার জিজ্ঞেস করল।
“কী আবার হবে? একটু বোর হচ্ছি।” হাসল জয়।
“হওয়ারই কথা। মায়ের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই বয়সে খুকি সেজে ‘হ্যাপি বার্থডে’ গাইবে। সব জায়গায় মুখ-দেখানো সেলেব্রিটিরা মদের গ্লাস হাতে প্লাস্টিকের হাসি হাসবে। অসহ্য!”
“তুমিও বোর হচ্ছ মনে হচ্ছে! কেন? সুন্দরমতো ছেলেটা তো আছে দেখছি। ওর সঙ্গে গল্প করো না!” জয় হাসল। এমন টুকরোটাকরা ইয়ার্কি ও কুমুর সঙ্গে করেই থাকে। তাতে অবশ্য মেয়েটা মনে করে না কিছু।
কুমু বিরক্তির ভঙ্গি করল, “মায়ের বান্ধবীর ছেলে। শুধু গাড়ি, ডিস্কো, জামাকাপড়ই বোঝে… মাকাল ফল একটা।”
“যাঃ, তা হলে তোমার কাজে লাগবে না,” জয় হাসল, “তোমার আগ্রহ সাহিত্য, সিনেমা, ছবি নিয়ে, তাই না?”
“আর একটু পরেই ওকে একটা কাজে লাগবে আমার। তুমি না খেয়ে পুট করে পালিয়ে যাবে না কিন্তু, কেমন?”
জয় কিছু বলার আগেই ওর ফোনটা বেজে উঠল আবার। সঙ্গে-সঙ্গে কুমু বলল, “কথা বলো, আসছি।”
শামিমের ফোন, “কাল ক’টায় কোথায় দাঁড়াব?”
“কাল?” চিন্তা করল জয়। কাল ডলার তুলতে হবে। ও বলল, “শোন, তুই এক্সাইড মোড়ে সকাল দশটা নাগাদ দাঁড়াবি। আমি রামনকে নিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।”
“ঠিক আছে। তোমার সঙ্গে কি মেশিন থাকবে? না আমি আমারটা নিয়ে নেব?”
“দরকার নেই। রোববারের বাজার। রাস্তায় লোক কম থাকবে। একদম ওসব সঙ্গে রাখবি না। বুঝেছিস?”
শামিম ফোনটা রেখে দিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল জয়। বৃষ্টি হয়েই চলেছে। এমন ওয়েদারে রোববার বেরতে ইচ্ছে করে?
“কী জয়, তুমি নীচে যাওনি?” বিতনুর গলা পেয়ে দরজার দিকে তাকাল জয়। এই মানুষটাকে দেখলেই কেমন যেন সম্মান করতে ইচ্ছে করে। একই মায়ের পেটে এমন দু’ ধরনের মানুষ কী করে জন্মায়? জয় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। আসলে এ বাড়ির নীচের তলায়, গ্যারাজের পাশে একটা বড় হলের মতো জায়গা আছে। সেখানেই সব অনুষ্ঠান হয়।
জয় বলল, “না দাদা, সব অ্যারেঞ্জ তো করাই হয়ে গিয়েছে। রিবন আর ফুলের ডেকরেশনের লোকগুলো কাজ করছে। ওদের বলেছি, হয়ে গেলে যেন ডেকে দেয় তখন গিয়ে দেখে আসব। তবে দাদা, যা ওয়েদার, লোকজন আসবে তো?”
বিতনু হাসল, “এমনি ডিনার হলে ক’জন আসত সন্দেহ আছে। কিন্তু ককটেল তো, সব লেজ নাড়তে-নাড়তে আসবে। যাক গে বাদ দাও, তোমায় একটা দরকারি কথা বলি। আমার অফিসে একটা ছেলে দরকার। ইয়ং, সৎ আর কর্মঠ। চেনাশোনার মধ্যে নিলে একটা রিলায়েবিলিটি থাকে। তোমার সন্ধানে থাকলে বোলো তো।”
জয় মাথা নাড়ল, “বলব দাদা।”
কিন্তু কথাটা বলেই হাসি পেল ওর। ইয়ং ছেলে প্রচুর আছে। কিন্তু সৎ আর কর্মঠ? ওদের লাইনে ‘সৎ’ কথাটা আপেল দিয়ে তৈরি ম্যাঙ্গো ড্রিঙ্কের মতো শোনাচ্ছে। সবাই শর্টকাটে টাকা রোজগার করতে চায় বলেই তো অসৎ পথ ধরে। কত টাকা দেবে বিতনু? বড়জোর দশ হাজার, কিন্তু ওদের লাইনে দশ মিনিটে দশ হাজার কামানোর উপায় আছে।
বিতনু বলল, “ঠিক আছে জয়, তুমি বসো। আমি আসি।”
জয় মাথা নেড়ে বসে পড়ল আবার। আর ভাল লাগছে না। কাঁহাতক ঝঞ্ঝাট পোহানো যায়? ফোনটা বের করে নম্বর টিপে বলাইকে ধরল জয়, “হ্যালো বলাই, কোনও খবর?”
“খবর তেমন কিছু নেই। ও এখনও দোকানেই আছে। মাঝে মোবাইলে কথা বলার জন্য দোকানের বাইরে বেরিয়ে একটা শেডের তলায় ঢুকেছিল।”
“তখন দোকানে কেয়া ছিল?”
“তা তো জিজ্ঞেস করিনি। কেয়াবউদির উপর নজর রাখার কথা তো নেলোকে বলিইনি, পরে বলে দেব।”
মনটা খচখচ করছে জয়ের। বাইরে বেরিয়ে ফোন করছে, মানে গোপন ফোন, যা সবার সামনে করা যায় না। নিশ্চয়ই কেয়া তখন দোকানে ছিল না। নিশ্চয়ই কেয়াকেই করছিল ফোনটা। মাথায় যেন আগুন জ্বলছে জয়ের। একবার যদি হাতেনাতে প্রমাণ পায় না, তা হলে বাঁশিকে এমন বাজাবে! শালা জন্মের মতো অন্যের বউয়ের দিকে তাকানো বের করে দেবে।
ফোনটা আবার বেজে উঠল। আরে জিনা! হঠাৎ মনটা কেমন কু-ডাক দিয়ে উঠল জয়ের। এমন সময় তো জিনা ফোন করে না!
“হ্যালো, জিনা?”
“জয়…জয়…” জিনা কাঁপছে ভয়ে, “সুতনু…অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। খুব ঘামছে, চোখ খুলছে না।”
“মানে?” তড়াক করে লাফিয়ে উঠল জয়।
“প্লিজ়, একবার এসো। আমি…ডাক্তারকে কল করেছি…কিন্তু তুমি প্লিজ়…সুতনুর অবস্থা সিরিয়াস।”
“আমি আসছি।”
জয় লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এল। কথাটা এখনই কাউকে বলা যাবে না। ফোনটা বের করে সুতনুর নিজস্ব ডাক্তারকে কল করে হনহন করে মেন গেটের দিকে হাঁটা দিল। সুতনুর এমন দিনে অসুস্থ হওয়াটা মোটেও ভাল কথা নয়। অস্বস্তি হচ্ছে জয়ের।