২. দ্বিতীয় দিন

১১. দ্বিতীয় দিন

ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো হেডকোয়ার্টার, নিউ দিল্পি

ভিডিও ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে অ্যাংগেল অ্যাডজাস্ট করে নিলেন ইমরান। অপেক্ষা করছেন প্যাটারসনের জন্য। কয়েক ঘণ্টা আগে স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের লিডারকে ফোন করার পর ভদ্রলোক বেশ বিরক্ত হয়েছেন। কারণ ওয়াশিংটনে এখন ভোর। ইমরান তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছেন। কিন্তু আইবি অফিসারের মনে হয়েছে যে অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। হাতে আসা সূত্র ধরে এগোবার জন্য প্রস্তুত। আর যদি এর জন্য ইন্দো-ইউএস টাস্ক ফোর্সের লিডারকে মাঝ রাতেও ঘুম থেকে জাগাতে হয়, তিনি তাই করবেন।

ইমরানের পাঠানো ইমেইল দেখেই মন বদলে ফেললেন প্যাটারসন। এক ঘণ্টার ভেতরে ভিডিও কনফারেন্স করার জন্য রাজি হয়ে গেলেন।

কেঁপে কেঁপে জীবন্ত হয়ে উঠল টেলিভিশনের পর্দা। বাক্সের অর্ধেক পর্দা জুড়ে দেখা গেল প্যাটারসনের কঠোর চেহারা। বাকি অর্ধেকে এক পাড়ুর মুখাবয়ব। হালকা গড়নের লোকটার মাথার পাতলা চুলগুলোও ধূসর রঙা। ইমরান জানেন ইনি কে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল আর প্রিভেনশনের ওয়াশিংটন অফিস থেকে ডা. হ্যাংক রয়সন। কনফারেন্স নিশ্চিত করে ইমেইলে রয়সন আসার সম্ভাবনাও জানিয়েছিলেন প্যাটারসন।

“মর্নিং” আমেরিকান দুজনকে অভিবাদন জানালেন ইমরান।

“মর্নিংএকযোগে উত্তর দিলেন অপর প্রান্তের দুইজন।

“ডা, রয়সন, এতটা শর্ট নোটিসে কনফারেন্সে যোগ দেবার জন্য ধন্যবাদ। সোজা পয়েন্টে চলে এলেন প্যাটারসন, “কিরবাঈ যেটা পাঠিয়েছে প্লিজ সেই রিপোর্টের উপর আপনার মন্তব্য বলুন।”

“ওয়েল” খুকখুক করে গলা পরিষ্কার করে শুরু করলেন রয়সন, “প্রথমত, আপনাদেরকে বুঝতে হবে যে রিপোের্টগুলো বেশ প্রাথমিক পর্যায়ের আর তাই কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো যায়নি। তবে টক্সিকোলজী রিপোর্টস আর ডিএনএ সিকোয়েন্স করাটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের কাছে যা আছে তা হল প্রাথমিক টক্সিকোলজী রিপোর্ট আর পলিমেরাজ চেইন রিঅ্যাকশন টেস্টিং অর্থাৎ পিসিআর টেস্টিং এর ফলাফল। যার মাধ্যমে ডিএনএ টার্গেট সিকোয়েন্স পূর্ণতা পায়।”

“পিসিআর টেস্টিং কী তা আমরা জানি” বাধা দিলেন প্যাটারসন, “রিপোর্টস সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানাটাই বেশি জরুরি।”

অসন্তুষ্ট হয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালেন রয়সন, “মিঃ কিরাবাঈ এর সাথে পরিচিত কিনা আমি জানি না।”

“ওয়েল, রিপোর্টগুলো দেখে আর গুগলে সময় কাটিয়ে আমি খানিকটা জেনে নিয়েছি” হেসে ফেললেন ইমরান, “কিন্তু আপনি এতটা ভেবেছেন তাই ধন্যবাদ।” ভাবলেন যাক, প্যাটারসনের তিক্ত ব্যবহারের খানিকটা ভরসাই করা গেল।

নাক সিটকালেন রয়সন, “তো তাহলে ব্যাপারটা হল কি যদিও বেশ জটিল। আমাদের কাছে অনুমানের ভিত্তিতে বলছি-পূর্ব থেকেই এক ধরনের আনআইডেন্টিফায়েড ব্যাকটেরিয়াম আর অজানা একটা রেট্রোভাইরাস আছে। প্রতিটা স্যাম্পলেই এ দুটোর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।” আবারো একদৃষ্টে ক্যামেরার দিকে তাকালেন, “আপনার পাঠানো স্যাম্পলগুলো নিয়ে সিডিসি আমাদের নিজস্ব কিছু পরীক্ষা করার পরেই এই ফলাফল গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে খুব বড় কোনো ভুল হয়নি।” চোখ নামিয়ে রিপোর্টগুলো চেক করে আবার ক্যামেরার দিকে তাকালেন,

“ব্যাপারটা সত্যিই বেশ অদ্ভুত। ব্যাকটেরিয়া স্বাস্থ্যবান সব বায়োফিল্ম তৈরি করেছে, যেখানে সেলগুলোর চারপাশে বিপুল পরিমাণে ম্যাট্রিক্স ম্যাটেরিয়াল থাকায় ইমিউন রেসপন্স থেকে সুরক্ষা পাচ্ছে। প্রাথমিক টক্সিকোলজী রিপোর্ট নির্দেশ করছে যে, ব্যাকটেরিয়া প্রচুর টক্সিন বমি করছে ফলে মৃত্যু অনিবার্য।” এবারে ইমরানকে বললেন, “মিঃ কিরবাঈ, আপনি এই স্যাম্পলগুলো কোথা থেকে পেয়েছেন?”

গত রাতের ঘটনা খুলে বললেন ইমরান, “ফ্যাসিলিটিতে পাওয়া কয়েকটা র‍্যানডমলি সিলেক্টেড মৃতদেহ থেকে। আর হার্ডডিস্ক থেকে যেটুকু ডাটা উদ্ধার করতে পেরেছি, আপনারা হয়ত দেখেছেন, সেই মেডিকেল হিস্ট্রিতেও রিপোর্টের মতই একই ইনফরমেশন লেখা আছে।”

মাথা নাড়লেন রয়সন, “হ্যাঁ। আপনার পাঠানো মেডিকেল হিস্ট্রি আর এ রিপোর্টগুলোর উপসংহার প্রায় একই। আর ইনফেকশনের কারণে মৃত্যুবরণ করা লোকগুলোও কয়েকটা ফাইলের মালিক। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেডিকেল ফাইল অনুযায়ী প্রাথমিক ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের চার থেকে পাঁচ বছর পরে তারা মারা গেছেন। তার মানে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হবার পরপরই এ রোগীদেরকে ডরমিটরিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমন কোনো সেল যেখানে ইনফেকশনটা আবদ্ধ ছিল কিন্তু পুরোপুরি খতম হয়নি। তাই এটা স্পষ্ট যে মানবদেহে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি প্রোটিনকে নতুন করে বানাবার ক্ষমতা আছে এই ব্যাকটেরিয়ার ক্রমানুযায়ী পুনঃপুন বেড়ে উঠলেও ক্লিনিক্যাল কিংবা লক্ষণাত্বক কোনো প্রভাব দেখা যায় না।”

“আচ্ছা আমাকে একটু বুঝতে দিন” ধীরে ধীরে বললেন ইমরান, “আপনি বলছেন যে, এই লোকগুলো চার থেকে পাঁচ বছর আগে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। কোনো একভাবে মানব প্রোটিনের মাধ্যমেই এ ব্যাকটেরিয়া দীর্ঘকাল ব্যাপী টিকে থাকতে পারে। আবার একই সময়ে এগুলো এমন কিছু বায়োফিল্ম তৈরি করে যার মাধ্যমে সেল মিডিয়েটেড ইমিউন রেসপন্স কিংবা সিএমআই থেকে সুরক্ষা পায়। তাই লক্ষ করার মত ইনফেকশনের কোনো চিহ্নই দেখা যায় না।”

“কারেক্ট।” প্রথমবারের মত হাসলেন রয়সন। দেখা গেল নিয়মিত ধূমপানের ফলে কালো হয়ে যাওয়া দাঁতের সারি। “আর কখনই হঠাৎ করে কিছু একটা, হয়ত সি এম আই’র দুর্বলতা কিংবা অন্য কোনো ট্রিগার ফ্যাক্টরের কারণে ব্যাকটেরিয়ার রস সক্রিয় হয়ে বিষ ছড়াতে থাকে। যার ফলে হাই ফিবার, অতিরিক্ত তৃষ্ণা, প্রচণ্ড পেটের ব্যথা, চরম অবসন্নতা, চিত্তবৈকল্য, শারীরিক শিথিলতাজনিত প্যারালাইসিস দেখা দেয়। সাধারণত এসব চিহ্ন ফুটে উঠার কয়েকদিনের মাঝেই আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে।”

কথাগুলো হজম করার জন্য কয়েক সেকেন্ড নিলেন ইমরান।

কিন্তু প্যাটারসন এতটা সময় নিলেন না, “মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক কিরবাঈ। এই বেচারাদের উপর ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব আর কতদিনে তা প্রকাশ পায় তার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আর টেস্ট চালানো হচ্ছিল।”

“বায়োটেররিজম” বড় একটা নিশ্বাস ফেলে জানালেন ইমরান; বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে কেউ হিউম্যান সাবজেক্ট নিয়ে এরকম বীভৎস খেলা খেলতে পারে।

‘আ…ফট করে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসাটা বোধহয় ঠিক হবে না, তাই না?” এক আঙুল তুলে বাধা দিলেন রয়সন। “DNA-সিকোয়েন্সি আর হাতে থাকা প্যাথোজেনের জিন ব্যাংক চেক করার পরেই কেবল বলা যাবে যে এগুলো কি সত্যিকার অর্থেই কোনো নতুন ব্যাকটেরিয়া নাকি বর্তমান কোনো প্রজাতির সাথেও সম্পর্ক আছে। এছাড়াও ইনফেকশন ছড়ানোর জন্য দায়ী কারণটাকে চিহ্নিত করার জন্যও আরো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।”

খারিজ করে দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন প্যাটারসন, “শিউর, শিউর। কিন্তু টাস্ক ফোর্সের প্রায়োরিটি হিসেবে একে গ্রহণ করা যায়। এই কারণে এই দলটাকে একত্র করা হয়েছে।”

“আর ভাইরাস?” হঠাৎ করেই মনে পড়ল যে রয়সন একটা ভাইরাসের কথাও বলেছিলেন।

মাথা চুলকালেন রয়সন, “আসলে এটা আরেকটা অদ্ভুত জিনিস।” আরো একবার চোখ নামিয়ে পেপারসগুলো পড়ে দেখলেন, “রেট্রোভাইরাস সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু জানি না। বিস্ময়কর হল যে, কোনো ধরনের তীব্র ভাইরাস ইনফেকশনও দেখা যায়নি। হার্ড ড্রাইভের মেডিকেল ফাইলেও এ সম্পর্কে কিছু লেখা নেই। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবকটি টেস্টের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

“ও.কে” নিজের কাগজপত্রগুলো একসাথে করে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখলেন ইমরান। যতটুকু মনে হচ্ছে কনফারেন্স শেষ। তার আরো কিছু কাজ আছে। “গাইজ, যত দ্রুত সম্ভব সিডিসি’র উপসংহারমূলক মন্তব্য পেলে ভালো হয়। এরই মাঝে সিয়াটলের টাইটানের সাথেও কথা বলেছি। কিন্তু নতুন মলিকিউল সম্পর্কিত তাদের গবেষণার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সাহায্য করা ব্যতীত আর কিছু জানে না বলেই দাবি করছে। অন্যদিকে বিল্ডিংয়ের মালিকপক্ষ বলছে তারা শুধু টাইটানকে লিজ দিয়েছে। এর ভেতরকার অপারেশন সম্পর্কে তারা কিছু জানে না। তার মানে কেউ ব্যক্তিগতভাবে এ অপারেশন চালাচ্ছিল।”

প্যাটারসনকে চিন্তিত দেখাল। রয়সনও অবাক হয়ে গেলেন। “সিয়াটল নিয়ে কাজ করার ব্যবস্থা আমি করছি।” প্রমিজ করলেন প্যাটারসন, “যদি কোনো কানেকশন থাকে তাহলে তা অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে।”

নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন ইমরান। মনে মনে সাজিয়ে ফেললেন নিজের প্ল্যান। এর আগে এ ধরনের কঠিন কেস তেমন একটা পাননি। তবে

একটা ব্যাপার একেবারেই পরিষ্কার।

চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে বায়োটেররিস্টের দল।

ভারতে।

তার নাকের ডগায়।

অথচ কোথায় খুঁজতে হবে সেটাই জানেন না।

.

জোনগড় কেল্লা

দশ মিনিট আগে খুঁজে পাওয়া ফাইলটাকে নিয়ে বসে আছে বিজয়। লেবেলটাই বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কোনো লেখা নেই। কেবল “…”

তাই স্বভাবতই কার্টনের অন্য ফাইলগুলো থেকে এ ফাইলটাকে আলাদা করে নিয়ে পাতা ওল্টাতে বসেছে। বেশিরভাগ কাগজই বাবার হাতে লেখা নোট কিংবা নিউজপেপার আর্টিকেলের ক্লিপিংস। লেখা আছে সারা দেশ ব্যাপী খনন করা বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটের নোটস আর ডায়াগ্রামস। রেকর্ডের কোনো লিপিবদ্ধ তথ্য। কেবল বিভিন্ন ডাটা। মনে হচ্ছে যেন বাবা এ সমস্ত খননকাজের ডাটা একসাথে করে এখানে রেখে দিয়েছেন; গুগল কিংবা উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ করেছেন। তবে যখন এই ফাইল তৈরি হয়েছে তখন তো উইকিপিডিয়ার জনুই হয়নি। পেজ আর ব্রিনও ক্যালিফোর্নিয়ার গ্যারাজেই সীমাবদ্ধ ছিল।

তাহলে এই পাতাগুলোকে ফাইলবন্দী করার সময় বাবার মাথায় কোনো চিন্তা ঘুরছিল? এতগুলো তথ্য জড়ো করার জন্য যে অসম্ভব খাটতে হয়েছে সেটা তো বলাবাহুল্য।

বিজয় কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই পেপারসগুলো পড়তে শুরু করল। দেখা যাক বাবার চিন্তা-ভাবনার ধাচ বোঝা যায় কিনা। আর এতটা গুরুত্ব দিয়ে কেন এগুলোকে জড়ো করা হয়েছে সেটাও জানা যাবে।

তবে যত সময় কাটতে লাগল, বিজয়ের বিস্ময় ততই বাড়ছিল। এই প্রচন্ড প্রচেষ্টার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গভীর কারণ আছে।

কিন্তু সেটা কী?

.

১২. তৃতীয় দিন

জোনগড় কেল্লা

নিবিষ্ট মনে কয়েক ঘণ্টা আগে খুঁজে পাওয়া ফাইলটা পড়ছে বিজয়। বিষয়গুলো বেশ চমকে উঠার মতন। ডকুমেন্টগুলোর মধ্যে কোনো কানেকশন আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে কেন এই ফাইলটা তৈরি হয়েছে জানা না থাকলে হয়ত কোন কানেকশন বোঝাও যাবে না।

হঠাৎ করেই মোবাইল ফোন বেজে উঠতে ঘোর ভাঙ্গল। ঘড়িতে দেখা যাচ্ছে রাত তিনটা। এই সময়ে কলিনের কোন্ দরকার পড়ল আবার? তাছাড়া সে তো দুর্গেই আছে!

“তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ?” বন্ধুর কাছে অনুযোগ করল বিজয়।

“বাচালে দোস্ত। এই সময়ে আমার ফোনটা যদি তোমার কাঙ্ক্ষিত হত তাহলে তো চিন্তায় পড়ে যেতাম।” মজা করল কলিন।

হেসে ফেলল বিজয়, “এখন বলো এত রাতে কেন ফোন করেছ?”

খানিক থেমে কলিন জানাল, “আমার মনে হয় তুমি যদি নিচে এসে নিজের চোখে দেখো তাহলে বেশি ভাল হয়।”

“লিভিং রুম?”

“ইয়াপ। দেরি করো না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাইলটাকে বন্ধ করে রুমের দরজায় তালা লাগিয়ে দিল বিজয়। রুমটাকে খুঁজে পাবার পর থেকে চাবিটা সবসময় নিজের কাছেই রাখে। আরেকটা ডুপ্লিকেট বানালেও এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে যা ও ছাড়া আর কেউ জানে না। একটা লাইফলাইন, বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগের একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে। এ সুযোগ সে কখনোই হারাবে না।

মাঝে মাঝে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত বুঝতেই পারবে না যে তোমার কাছে কী ছিল।

আজ রাতটা মনে হচ্ছে সারপ্রাইজের রাত। লিভিং রুমে ঢুকতেই যেন জমে গেল। মনে হচ্ছে ভূত দেখছে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না।

ধীরে ধীরে নিজেকে শান্ত করে পা রাখল রুমে। কিন্তু কী বলবে কিংবা করবে কিছুই মাথায় আসছে না।

বন্ধুর অবস্থা বুঝতে পারছে কলিন। তাই কিছু বলল না।

“হাই, বিজয়” জড়োসডো ভঙ্গিতে সাদা সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল এলিস। এতক্ষণ কলিনের সাথে বসে থাকলেও এবারে সে নিজেও লজ্জা পাচ্ছে।

কোনো উত্তর দিল না বিজয়। শক্ত হয়ে গেছে চোয়াল। ভ্রু-কুঁচকে কী যেন ভাবছে। এমর কোনো সম্ভাবনা কখনো প্রত্যাশাই করে নি। বহুকষ্টে মনের গহীনে কবর দিয়েছে পুরনো স্মৃতি। ভেবেছে আর কখনো তাদের কথা স্মরণ করবে না। তারপরও আজ আবার সবকিছু মাথাচাড়া দিয়ে উঠল; ঠিক এগারো বছর আগেকার মতই তরতাজা হয়ে। আর সেই সাথে আসা বিভিন্ন অনুভূতিও যথেষ্ট জ্বালাচ্ছে। স্পর্শকাতর এ পথে সে কখনোই ফিরে আসতে চায়নি। কখনোই না। অথচ এখন ঠিক তাই করছে।

অবশেষে খুঁজে পেল কণ্ঠস্বর, “এখন রাত তিনটা বাজে।” যথাসাধ্য নির্লিপ্ত থাকতে চেষ্টা করল বিজয়, “তুমি এখানে কী করছ? বলেছিলে না, আমার সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাও না? বদলে গেলে কেন?”

“ও বিপদে পড়েছে।” বাধা দিয়ে বলে উঠল কলিন। এলিস উত্তর দেবার আগেই জানাল, “আমাদের সাহায্য দরকার।”

শীতল নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বিজয়।

“বিজয়, ও সত্যিই ভয়ংকর বিপদে পড়েছে। আমাদের সাহায্য করা উচিত।” আবারো চেষ্টা করল কলিন।

বহুকষ্টে নিজের আবেগ দমন করল বিজয়। “এ জায়গাটা তো ইউএস থেকে অনেক দূর।” আস্তে আস্তে জানাল, “তারপরেও সাহায্যের জন্য এখানে এসেছ তার মানে বেশ মরিয়া হয়ে উঠেছ।”

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এলিস। পুরনো ক্ষতটাতে আবার আঘাত পেয়েছে। বুঝতে পারল ভুলে যাবার চেষ্টা করলেও সার্থক হয়নি। “আমি জানি তোমার মনের অবস্থা আর সত্যিই বলছি অন্য কোনো উপায় থাকলে এখানে আর আসতাম না। কিন্তু আমার হাতে আর কোনো অপশন ছিল না।”

গলার স্বর সংযত করল বিজয়, “কী হয়েছে?”

গ্রিসে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুর ঘটনাগুলো খুলে বলল এলিস। ড্যামনের মার্ডার, মারকোর মৃত্যু আর হাইওয়ে ধরে পালিয়ে আসার কথা বলতে গিয়ে কেঁপে উঠল গলা। শেষ করল এই বলে যে, “আমার ইউএসে ফিরে যাবার সুযোগ নেই। যেখানেই যাই না কেন ওরা ঠিকই খুঁজে বের করবে। তাই অন্য কোথাও যাবার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু ইউএসের বাইরে এমন কাউকে চিনি না যাকে বিশ্বাস করা যায়। দিল্লিতে কার্ট ওয়ালেসের কজন পরিচিত আছেন। তারাই এয়ারপোর্ট থেকে এ পর্যন্ত আসার জন্য গাড়ি দিয়েছেন। আরো বলেছেন এতে করে নাকি গ্রিসের বাইরে কেউ আর আমার ট্রেস পাবে না। প্রাইভেট জেট। প্রাইভেট কার। কোনো ধরনের পেপার কিংবা ইলেকট্রনিক ট্রেইল থাকবে না।”

একদৃষ্টে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে ছেলেটার প্রতিক্রিয়া বুঝতে চাইছে। তবে মনে হচ্ছে এলিসের কাহিনি শুনে খানিকটা নরম হয়েছে।

“কাম অন বিজয়” নীরবতা ভাঙ্গল কলিন, “ওর তো থাকার জায়গা দরকার। সত্যিই বিপদ ওঁৎ পেতে আছে আর তোমার এই কেল্লায় অন্তত পঞ্চাশটা রুম আছে। কয়েকটা রাত কি থাকতে দেবে না?”

প্রথমে বন্ধু তারপর এলিসের দিকে ঘুরল বিজয়, “তোমাকে একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে” সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানাল, “আসলে আমাদের দুজনকেই। আমার জীবন কিন্তু আগের জায়গায় থেমে নেই। এখন আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। তুমি আর আমি-এসবই অতীত। তাই চাই না তুমি আমার আর রাধার মাঝে আসো।”

“রাধা ওর ফিয়ান্সে” এলিসকে সাহায্য করল কলিন।

মাথা নাড়ল এলিস। এর চেয়ে বেশি কিছু আশাও করেনি। তারপরও কেন যেন এখানে নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে। কখনো ভারতে না এলেও চারপাশে বন্ধুরা তো আছে!

“দুর্গের নিরাপত্তার জন্য আমাদের নিজস্ব সিকিউরিটি সিস্টেম আছে।” জানাল বিজয়, “বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত এখানে যতক্ষণ থাকবে কেউ তোমার গায়ে হাত দিতে পারবে না।” বললেও মনে পড়ে গেল গত বছর আঙ্কেলের ভাগ্যে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো। যাই হোক জোর করে তা মন থেকে তাড়িয়েও দিল। তারপর তো সিস্টেম আরো আপগ্রেড করা হয়েছে।

“থ্যাংক ইউ বিজয়” উত্তরে জানাল এলিস, “তুমি যে আমাকে সাহায্য, করতে রাজি হয়েছ সে কারণে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

জোর করে হাসল বিজয়। নিজের আবেগ লুকোতে পুরোপুরি সচেতন। “শিওর। সাহায্য করতে পারলে সব সময় ভাল লাগে।

“কলিন, তুমি গিয়ে এলিসকে গেস্ট রুম দেখিয়ে দাও। যেটা ইচ্ছে খুলে দিও। ওকে গাইজ, আমি এখন ঘুমাতে যাচ্ছি। রাধা কাল আসছে। তাই ওর সামনেও ঘুমন্ত থাকতে চাই না।” এরপর কলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর কাল সকালে ইমরানের সাথে আমাদের মিটিং আছে।”

কলিন মাথা নাড়তেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল বিজয়।

এরপর এলিসের দিকে তাকাল, “ওয়েল, একেবারে খারাপ কিছু হয়নি, কী বলো?”

“আমাকে রাধা সম্পর্কে আরো কিছু বলো তো?” জিজ্ঞেস করল এলিস, “ও দেখতে কেমন?”

ভ্রু-কুঁচকে ফেলল কলিন। যতটা সহজ ভেবেছিল মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ ততটা সহজ হবে না।

.

১৩. জোনগড় কেল্লা

“মর্নিং” ডাইনিং রুমে ঢুকতেই বিজয়ের মেজাজ খিঁচড়ে গেল। কলিন আর এলিসের ব্রেকফাস্ট এখনো শেষ হয়নি। ব্যাড টাইমিং। যে কোনো মুহূর্তে রাধা এসে পড়বে।

চেশায়ার বিড়ালের মত দাঁত বের করে হাসল কলিন। এতদিনে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বিজয়। কিন্তু ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে এলিসের হাসি দেখেই নিজেকে শান্ত করতে বেগ পেতে হল।

“তোমার ঘুম ভালো হয়েছে? উদ্বেগ নয় বরঞ্চ ভদ্রতা রক্ষায় জানতে চাইল এলিসের কাছে। যদিও গতরাতের আলোচনার পর থেকে মাথার মাঝে কয়েকটা ব্যাপার ঘুরছে।

মাথা নাড়ল এলিস। “উমম হুমম। থ্যাংকস। তোমার?”

উত্তর দিল না বিজয়। গতরাতের কথাগুলো ভাবছে। “আচ্ছা তুমি বলেছিলে যে সমাধিতে একটা আইভরী কিউব পেয়েছ?” মুখ ভর্তি মাসালা ওমলেট আর পরোটা নিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল।

হা হয়ে মুখ তুলে তাকাল এলিস। গত রাতের আলোচনার পর তো মনে হয়েছিল যে গ্রিসে ওর অভিজ্ঞতা নিয়ে বিজয়ের কোনোই আগ্রহ নেই।

“ইয়েস” তারপরও উত্তর দিল। “খোদাইকৃত শিলালিপিও আছে।”

“আর মারকো ফিরে এসে বলেছিল যে ড্যামন সেটা হোটেলে নিয়ে যেতে বলেছে?”

“দ্যাটস রাইট।” বিজয় কেন এতটা চিন্তা করছে ভেবে অবাক হয়ে গেল এলিস।

“তারপর তুমি কিউবটাকে নিয়ে কী করেছ?”

“আমার ব্যাকপ্যাকে রেখে দিয়েছি।” কী বলেছে ভাবতেই শক্ত হয়ে গেল এলিস। আতঙ্ক আর অস্থির হয়ে ছোটাছুটির মধ্যে ভুলেই গিয়েছিল যে কিউবটা এখনো ওর সাথেই আছে। কন্টেইনারের ভেতর ভরে ব্যাকপ্যাকে করে ভারতেও নিয়ে এসেছে।

“তার মানে ওরা এটাই চায়।” বিড়বিড় করে উঠল বিজয়, “দ্য কিউব।”

মাথা ঝাঁকাল এলিস। তপ্ত গনগনে ইস্ত্রির ছ্যাকা খাওয়ার মত করে মনে পড়ে গেল দুই রাত আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। “ওরা আমার পিছনে লেগেছে কারণ আমি সমাধিটা দেখেছি। মারকোর অন্য কোনো দোষ ছিল না। কেবল আমাদের সাথে থাকা ছাড়া। তাই ওকেও মেরে ফেলল। সেই সন্ধ্যায় ওখানে যারাই ছিল তাদের সবাইকে খুন করে ফেলেছে।”

এবারে চিন্তিত ভঙ্গিতে বিজয় জিজ্ঞেস করল, “আর তোমার ল্যাপটপ আর ক্যামেরা?”

“হোটেলের রুমে ফেলে এসেছি।”

“তাহলে তো তারা সমস্ত আর্টিফ্যাক্টের ছবি পেয়ে যাবে।” দ্বিধায় পড়ে গেল বিজয়, “কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

বড় বড় হয়ে গেল এলিসের চোখ। “না, পাবে না। ল্যাপটপে ছবিগুলো আপলোড করার টাইমও পাইনি। ভেবেছিলাম পরে করব তাই মেমোরি স্টিক বের করে কোমরের পাউচে রেখেছি। এখনো সাথেই আছে।”

ঊরুতে চাপড় মারল বিজয়, “এইতো পাওয়া গেছে। কিউবটাই হল যত নষ্টের গোড়া।” জোর দিয়ে বলল, “এখানে দুটো কারণ আছে। প্রথমত, পুরো কালেকশন থেকে একমাত্র কিউবটাই মিসিং। ওদের কাছে ছবিও নেই। তার মানে অরিজিন্যালটাই দরকার। ঠিক?”

“রাইট” বিড়বিড় করে উঠল এলিস। এখনো সন্দেহে দুলছে মন।

“দ্বিতীয়ত, তুমি বলেছ যে একেবারে সবার শেষে ট্যাবলেট আর মূর্তিগুলোর পেছনে কিউবটাকে পেয়েছ। ততক্ষণে ড্যামনও চলে গেছে।”

“দ্যাটস রাইট।” বিজয় কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারল এলিস। “তুমি অবাক হচ্ছ যে না দেখেও ড্যামন এটার কথা কিভাবে জানলেন? হতে পারে হয়ত গোপন চেম্বারে অন্যান্য আর্টিফ্যাক্ট গুলো পরীক্ষা করার সময় দেখেছেন।”

মাথা নাড়ল বিজয়। “না, তা না। আমি ভাবছি কো-ডিরেক্টরেরা সমস্ত কিছু সরিয়ে ডিগ হাটে নিয়ে যেতে বলেছিল। তাই তো?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে ড্যামন কেন শুধু কিউবটাকে নিয়ে হোটেলে যাবার কথা বলল? এটার বিশেষত্বই বা কী? আর তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল মারকো বলেছিল যে ড্যামনের তোমাকে কিউবটা হোটেলে নিয়ে আসার কথায় বেজায় রেগে গিয়েছিল স্ট্যাভরস। তার কথানুযায়ী ড্যামনেরই নিয়ে আসা উচিত ছিল। তার মানে ড্যামনকে কিউবের গুরুতু জানিয়ে হোটেলে নিয়ে আসার আদেশ দেয়া হয়েছিল। এখান থেকে উদয় হচ্ছে আরো কয়েকটা প্রশ্ন না দেখেও কিভাবে পিটার, স্ট্যাভরস কিংবা অন্য কেউ জানল যে সমাধিতে কিউবটা আছে?”

এলিস নিজেও গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। “হতে পারে” ধীরে ধীরে বলে উঠল, “ড্যামনই বলেছেন; তারপর তারা হোটলে আনার আদেশ দিয়েছেন।”

“আমার সেটা মনে হচ্ছে না” নিজের যুক্তি দিল বিজয়, “তোমার ব্যাখ্যা মানতে হলে বেশ কিছু কাকতালীয় ঘটনা ঘটতে হবে। প্রথম, তোমার আগে ড্যামনকে এটা দেখতে হবে। তা কিন্তু ঘটেনি। ড্যামন স্ট্যাভারসকে জানাবার পর যদি কোনো বিশেষত্ব নাই থাকে তবে আর সবকটিকে বাদ দিয়ে কেন এটাকেই হোটেলে আনতে বলল? অন্যগুলো কেন নয়? আর সবশেষ হল, একমাত্র এটাই তাদের কাছে নেই। এমনকি ছবিও না। তার মানে কিউবটাই আসল কালপ্রিট।”

“কিছুই বুঝতে পারছি না।” উত্তরে জানাল এলিস, “হয়ত তোমার কথাই ঠিক। যুক্তিগুলোও ঠিক আছে। কিউবটাই বোধহয় খুঁজছে। কিন্তু কোনো বিশেষ কিছু তো নয়। তবে হ্যাঁ আইভরি দিয়ে তৈরি আর গায়ে দুর্বোধ্য কিছু লেখা।”

“সমাধিতে পাওয়া পুরনো একটা আইভরি কিউবের জন্য কেন এত মানুষকে মেরে ফেলতে হবে?” বিস্মিত হয়ে গেল কলিন। “কার সমাধি এটা?”

ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল এলিস। “তোমাদেরকে আসলে এই খনন কাজের ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানানো উচিত। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে যে আমরা কী খুঁজছি।”

“গাইজ” বাদ সাধল কলিন, “যদি আমরা কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসস্থান কিংবা সমাধি অথবা এ জাতীয় কিছু নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তাহলে আরেকটু আরামদায়ক কোথাও যাওয়া যায় না? এসব আলোচনা যে কেমন হয় তা আমার ভালই জানা আছে। প্লিজ ডাইনিং টেবিলে না।”

হেসে ফেলল বিজয়, “শিওর, স্টাডি?”

“গ্রেট আইডিয়া” খুশি হল কলিন। দুর্গে আঙ্কেলের স্টাড়িটা ওর সত্যিই বেশ পছন্দ। “আজ সূর্যের দেখা মিলেছে তাই আশা করছি দিনটাও ভালো কাটবে।”

সবাই মিলে স্টাডিতে গিয়ে কোণার দিকের কফি টেবিলের চারধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসল। পাশের দেয়ালে এলসিডি টিভি।

“আঠারো মাস আগে শুরু করল এলিস, “ওয়ালেস অ্যার্কিওলজিক্যাল ট্রাস্টের হয়ে এই খনন কাজের লিডিং মেম্বার হিসেবে যোগ দিয়েছি।” বন্ধু দুজনের দিকেই তাকাল, “তোমরা মেসিড়নের তৃতীয় আলেকজান্ডার সম্পর্কে কতটা জানোনা?”

“কে?” আরাম করে সাদা চামড়ার কুশনে হেলান দিয়ে জানতে চাইল কলিন, “দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের সাথে জড়িত কেউ?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিস, “তৃতীয় আলেকজান্ডারই হচ্ছেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’।”।

লাজুক হাসল কলিন, “ওহ, সরি, ইতিহাস আসলে আমার জিনিস না।”

“যাই হোক” বলে চলল এলিস, “কয়েকটা কারণে কার্ট ওয়ালেস ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছেন যেন আমি এই মিশনে থাকি। তাছাড়া হেলেনিস্টিক ইতিহাসে আগ্রহ থাকায় আমিও রাজি হয়েছি।”

“এই মিশনের বিশেষ কোনো কিছু নিশ্চয় তোমাকে আকর্ষণ করেছে।” বলে উঠল বিজয়। “আমি তোমাকে চিনি। মনে না ধরলে তুমি কিছুতে জড়াও না।”

হাসল এলিস। এই কারণেই বিজয়কে ভালবেসেছিল। কিভাবে যেন ছেলেটা ওর মনের সব কথা টের পায়। তাহলে সম্পর্কটা টিকলো না কেন?

কিন্তু কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যেতেই ঘরে ঢুকল বাটলার শিভজিৎ। “হুকুম, ডা. শুক্লাকে নিয়ে রাধা ম্যাডাম এসেছেন।”

বাবাকে নিয়ে রুমে ঢুকল হাস্যমুখী রাধা, “শিভজিৎ, আমাদের আসার কথা তোমাকে ঘোষণা করতে হবে না।” কিন্তু এলিসকে দেখেই মুছে গেল হাসি।

পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এলো কলিন। তাড়াতাড়ি করে পরিচিতি দিতে লাগল। জানে বিজয়কে নিয়ে রাধা কতটা পজেসিভ। তাই ঘুণাক্ষরেও এলিসকে বিজয়ের এক্স-গার্লফ্রেন্ড হিসেবে বুঝতে দিল না। বিজয় নিজের সুবিধা মতন কোনো সময়ে পরে সব বুঝিয়ে বলবে।

অন্যদিকে বিজয় উঠে গিয়ে ডা. শুক্লাকে আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরল। “আপনি এসেছেন দেখে আমি সত্যিই খুশি হয়েছি।”

“ভাবলাম যাই তোমাদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আসি, গত বছরের পর তো আর কলিনের সাথে দেখা হয়নি।” হেসে ফেললেন ভাষাবিদ।

এবার রাধার দিকে ফিরে চুমু দিল বিজয়, “আমার তো তর সইছিল না।”

পাল্টা হাসি দিল রাধা, “আমারও।”

দুজনে মিলে সোফায় বসল। কলিনের পাশে বসলেন ডা. শুক্লা, “গ্রিসে এলিসের কিছু ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে।” শুরু করল বিজয়, “ও আমাদেরকে সেসবই জানাচ্ছিল।”

রাধার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল এলিস। তারপর জানাল, “কার্ট ওয়ালেস আমাকে বললেন যে ওনার টিম এমন একটা সূত্র পেয়েছে যার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে মূল্যবান এক রহস্যের সমাধান করা যাবে।”

“বিলিওনিয়ার কার্ট ওয়ালেসই ওর খনন কাজের ফান্ড দিয়েছেন।” রাধাকে জানাল কলিন। বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল মেয়েটা। “রহস্যটা কী?” আগ্রহী হয়ে উঠলেন ডা. শুক্লা।

“দ্বিতীয় ফিলিপের পত্নী এবং দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াসের সমাধি। কিছুদিন আগ পর্যন্ত এই সমাধির অস্তিত্ব আর লোকেশন সম্পর্কে কোনো প্রমাণ না থাকায় বিস্তর জল্পনা-কল্পনা ছিল। তবে এখন আমি জানি এর অবস্থান।”

নাড়া খেল বিজয়ের স্মৃতি। কি যেন একটা মনে আসি আসি করেও আসছে না। এই নাম। অলিম্পিয়াস। আগেও কোথায় যেন শুনেছে? আর একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে। হয়ত গত মাসেই কিংবা তার কিছুদিন আগে। কিন্তু কোথায়? যাই হোক উত্তরটা শুনে কেবল বলল, “ওয়াও, অসাধারণ।”

ওর দিকে তাকিয়ে হাসল এলিস, “তোমরা গ্রিক ইতিহাস নিয়ে কতটা জানো আমি জানি না। কিন্তু রানি হিসেবে উনার রাজত্বকাল ছিল অত্যন্ত বিশৃংখল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র চতুর্থ আলেকজান্ডারের জন্য সিংহাসনকে সুরক্ষা করতেই ক্ষমতায় বসেছিলেন। প্রথমে পারডিকাস আর পরে পলিপারচনের সাথে হাত মিলিয়েছেন। মেসিডোনিয়ান জেনারেল হিসেবে তাদের দুজনেরই নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। অতঃপর ইফিরাস আর মেসিডোনিয়ার মধ্যে অবরুদ্ধ করার পর সবশেষে ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিড়নাতে ক্যাসান্ডারের হাতে বন্দী হন। আলেকজান্ডারের ভাইসরয় হিসেবে অ্যান্টিপ্যাটারপুত্র ক্যাসান্ডার এশিয়া অভিযানেও এসেছিলেন। যেসব মেসিডোনিয়ানকে রানি মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন তাদের আত্মীয়রাই পরবর্তীতে তার প্রাণ হরণ করে। তবে এই ষড়ন্ত্রের মূলে ছিল ক্যাসান্ডার। কারণ সে নিজ হাতে কাজটা করতে চায়নি। অলিম্পিয়াসকে ক্যাসাভার এতটা ঘৃণা করত যে তার মৃতদেহও সমাধিস্থ করতে দেয়নি। আদেশ জারি করে যেন তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। তবে, চুপিসারে ঠিকই তাকে কবর দেয়া ও সম্ভবত ইফিরাসের ফাইরাসের শাসনামলে সমাধিও নির্মিত হয়। যিনি কিনা অলিম্পিয়াদের মতই একজন ইয়াসিড ছিলেন।”

চারপাশের শ্রোতাদের দিকে তাকাল এলিস। “বলে যাও” উৎসাহ দিলেন ডা. শুক্লা, “সত্যিই বেশ ইন্টারেস্টিং।”

“আমরা সমাধিটাকে খুঁজে পেয়েছি।” এত সহজে মাত্র চারটা শব্দে ঐতিহাসিক আবিষ্কারটার কথা বলে ফেলল দেখে এলিস নিজেই বিস্মিত হয়ে গেল।

“এটাই যে রানি অলিম্পিয়াসের সমাধি সেটা জানলে কিভাবে?” জানতে চাইল রাধা। একটু আগেই মেয়েটা এমনভাবে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে হেসেছে যা ওর মোটেও ভালো লাগেনি। কে এই মেয়ে? বিজয় তো কখনো এ নাম বলেনি।

“ওয়েল এ ব্যাপারে শুরু করতে হলে অলিম্পিয়াস সম্পর্কে কিছু বলতে হবে। মারকিজিয়ালস গ্রামে বিংশ শতকের শুরুতে অলিম্পিয়াসের সমাধির কথা লেখা একটা শিলালিপি পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় যে, এখানেই ছিল প্রাচীন পিড়না। কার্টের রিসার্চ টিম একটা নিউজ আইটেম খুঁজে পেয়েছে যেটার বেশিরভাগই আবার মুছে গেছে। তারা এটাকে খুঁজে পেয়ে কিনে নেয়। এখানে সমাধির ব্যাপারে সরাসরি উল্লেখ করে লেখা হয়েছে এটা মারকিজিয়ালসের চেয়ে করিনোসের বেশি কাছে। তাই আমরাও স্যাটেলাইট রিমোর্ট সেন্সরের মাধ্যমে মাটির নিচে সমাধি সদৃশ কাঠামোর প্রমাণ পেয়ে সেখানেই খনন শুরু করি। যদিও একেবারে ভেতরে না ঢোকা পর্যন্ত এর বাসিন্দা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না।” স্বীকার করল এলিস। “কিন্তু দেয়ালের ভাস্কর্যগুলো দেখার সাথে সাথে… চেম্বারের সর্বত্র দেখা সাপগুলোর কথা মনে পড়তেই থেমে গেল। তারপর আবার জানাল, “আপনারা হয়ত জানেন যে লোককাহিনি অনুযায়ী আলেকজান্ডারের জনক ফিলিপ নন। আলেকজান্ডারের মা তাকে জানিয়েছেন যে তিনি জিউসের পুত্র যে কিনা সাপের বেশে এসে রানির সাথে মিলন করেছেন। লোককাহিনি অনুযায়ী সাপের প্রতি অলিম্পিয়াসের এক অন্যরকম মুগ্ধতা কাজ করত। তিনি এমনকি এগুলোর সাথে ঘুমাতেই অভ্যস্ত ছিলেন। এই কারণেও হয়ত আলেকজান্ডারের জন্ম নিয়ে সে লোকজ কাহিনি তৈরি হয়েছে।” অ্যান্টি চেম্বারের দেয়ালে দেখা সেই রানির পেইন্টিং, সমাধির চেম্বারের দেয়ালের সাপ আর তৃতীয় আরেকটা চেম্বারে খুঁজে পাওয়া গোপন মূর্তি আর ট্যাবলেটগুলোর কথা খুলে বলল এলিস।

“আর সেই কিউব?”

নিজের কৌতূহল আর দমাতে পারল না বিজয়। “আমরা দেখতে পারি?”

.

১৪. আইভরির এক ধাঁধা

কিউবটা আনতে নিজের রুমে গেল এলিস। এই ফাঁকে রাধা আর ডা. শুক্লাকে মেয়েটার গ্রিসের অভিজ্ঞতা খুলে বলল বিজয়।

“এই কারণে ইউএস ফিরে না গিয়ে এখানে এসেছে।” মন্তব্য করল রাধী।

“পালানোর চেষ্টা করার সময় আমাকে ফোন করেছিল।” রাধার কণ্ঠস্বরে সন্দেহের আভাস পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল কলিন, “হয়ত ভেবেছে যে এখানে আসলে কোনো সমস্যা হবে না।”

“আর তাই তো হয়েছে, না?” উত্তর দিল রাধা।

ঠিক তখনি আবার ফিরে এলো এলিস। কন্টেইনার খুলে কিউবটি কফি টেবিলের উপর রাখল যেন সবাই দেখতে পায়। চারটা মাথা একসাথে কিউবটার উপর উপুড় হয়ে পড়ল।

“এখানে কী লেখা আছে? তুমি পড়তে পেরেছ?” এলিসের দিকে তাকাল রাধা।

মাথা নাড়ল এলিস। “এই লেখা আমি কখনোই দেখিনি। তবে কেমন পদ্য টাইপের মনে হচ্ছে। আমার ভুলও হতে পারে।”

“এটা ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট।” ঘোষণা করলেন ডা. শুক্লা, এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কিউবটা দেখছিলেন। “আরো অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এটা সংস্কৃতে লেখা। অথচ সংকৃত লেখার জন্য ব্রাহ্মীকে তেমন একটা ব্যবহার করা হত না। এই কিউবটা নির্ঘাৎ ভারত থেকে নেয়া হয়েছে।”

পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল এলিস, কলিন আর বিজয়। “ভারতীয় একটা কিউব প্রাচীন গ্রিক সমাধির মধ্যে কী করছিল?” আশ্চর্য হয়ে গেল এলিস। “ভ্রমণ করার জন্য দূরতুটা কম নয়। সবার আগে ভাবতে হবে যে এটা গ্রিসে গেল কী করে?”

এলিসের দিকে তাকালেন ডা. শুক্লা, “কন্টেইনার থেকে বের করে যদি আমি এটা আরেকটু কাছ থেকে দেখি তুমি কিছু মনে করবে?”

“শিওর” সম্মত হল এলিস। কী লেখা আছে জানার জন্য অন্যদের মত সে নিজেও বেশ আগ্রহী।

উল্টে-পাল্টে কিউবটার ছয়টা পাশই পড়লেন ডা. শুক্লা। “ইন্টারেস্টিং” বোঝা গেল অবাক হয়েছেন।

“বলো না পাপা” চাপ দিল রাধা, “পদ্যগুলো পড়ে শোনাও।”

পিটপিট করে তাকালেন ডা. শুক্লা, “কিউবের একটা পাশ একেবারে খালি। অন্যগুলোতে সব মিলিয়ে পাঁচটা পদ্য আছে। একটা হল :

ঢালের উপরের নদী
যেখানে একসাথে মেশে দিন আর রাত্রি
আর শুক্র দেখায় শিবের ইঙ্গিত
পাঁচ মুকুটঅলা সেই মহাশক্তিধর সাপ
তোমাকে জীবন দান করবে যে প্রবেশদ্ধার
তার চির প্রতিপালক।

গুঙ্গিয়ে উঠল কলিন, “ওহ, খোদা! সাংকেতিক মেসেজঅলা আরেকটা ধাঁধা। এক বছরও হয়নি এগুলোর হাত থেকে বেঁচে এসেছি।”

“ইয়েস; কিন্তু মর্মোদ্ধার করে অবশেষে সিক্রেট লোকেশন খুঁজে পাওয়াটাও কম মজার ছিল না, তাই না?” বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল বিজয়।

“শুধু আমরা যে কিডন্যাপ হয়েছি সে অংশটা বাদে।” মনে করিয়ে দিল রাধা। ওই অভিজ্ঞতার নগ্ন আতঙ্ক এখনো পুরোপুরি ভুলতে পারেনি।

“আর শেষ পদ্যটার মর্মোদ্ধার করে লোকেশনটা তুমিই পেয়েছিলে কলিন।”

“ইয়াহু, জানি, জানি।” ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল কলিন। “কিন্তু ওরকম আরেকটা শিকারে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই। মনে হচ্ছে যতবার ভারতে আসব ততবারই এসব ধাঁধা আর কবিতা এসে চেপে ধরবে।”

ধাঁধার সমাধানের উত্তেজনায় এরই মাঝে জ্বলছে রাধার চোখ। “এই ধাঁধাগুলোরও মর্মোদ্ধার ঠিকই হয়ে যাবে। ভারতীয় স্বভাবই হল এরকম প্রহেলিকা সৃষ্টি করা। যেমন ধরো, শরীরের ইঙ্গিত হল তার ত্রিশূল।”

কাঁধ ঝাঁকাল এলিস, “আমার কোনো ধারণাই নেই এ ব্যাপারে। তোমরাই ভালো জানবে। কিন্তু যেটা খটকা লাগছে তা হল, ভারতীয় শিলালিপি খোদাই করা একটা আইভরি কিউব একটা গ্রিক সমাধিতে কিভাবে পৌঁছাল।”

“এটা অবশ্যই ভারতেরই তৈরি।” বলে উঠলেন ডা. শুক্লা। “শুক্রের উল্লেখও ভারতীয় পুরাণের অংশ। ঋষি ব্ৰিণ্ডর পুত্র হল শুক্র; অসুরের প্রধান ধর্মগুরু। নবজীবন সঞ্চারের বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আর এই জ্ঞান ব্যবহার করেই দেবতারদের হাতে নিহত দানবদেরকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে শুক্র।”

“অন্য পাশগুলোতে কী লেখা আছে?” জানতে চাইল বিজয়।

কিউবটাকে উল্টে ফেললেন ডা. শুক্লা। “এটার ভারতীয় হবার আরেকটা প্রমাণ পাওয়া গেল। একপাশে লেখা আছে :

দ্রুত বহতা চোখের ওপাশে
লবণহীন গভীর সমুদ্রের ধারে
নিজেদের ছায়া ফেলল তিন ভ্রাতা
পথ দেখিয়ে দিল তীরের মাথা
যা চলে গেছে পাতালে
সর্পের চিহ্নের গভীর গোপনে
খুঁজে পাবে তোমার কাঙ্ক্ষিত ভূমি।”

মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, “ভারতীয় পুরাণে পাতালের মানে হল পৃথিবীর নিম্নাংশ, নরক। টেকনিক্যালি সাতটা প্রেতলোকের একটা।”

“মানে সত্যিই নরক?” জিজ্ঞেস করল কলিন।

“ঠিক তা না।” শুধরে দিলেন ডা. শুক্লা, নরক তো আসলে পশ্চিমা ধারণা। ভয় দেখিয়ে মানুষকে সত্যের পথে ধরে রাখা। হিন্দু দর্শন কিংবা পুরাণে নরকের এরকম কোনো ধারণা নেই। সত্যিই একটা নিম্নস্থ দুনিয়া। যা আমাদের পৃথিবীর ভূমিতলের নিচে অবস্থিত।”

চারপাশে তাকাল এলিস, “আর কোনো আইডিয়া? আমার মাথায় কিছু আসছে না। কেবল মনে হচ্ছে যে কোথাও যাবার জন্য এক ধরনের নির্দেশনা।”

“আমার মনে হচ্ছে” বলে উঠল কলিন, “পাতালে যাবার জন্য তাড়া দিচ্ছে এই পদ্য। বাস্তবের সাথে তো কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না। পুরোটাই লোককাহিনি না?”

“সম্ভবত সবকটির অনুবাদ করা হলে ভালো একটা আইডিয়া পাওয়া যাবে।” মাঝখানে মন্তব্য করল রাধা। “গো অন পাপা” পিতাকে তাগাদা দিল, “অন্যগুলো কী বলে দেখা যাক।”

.

১৫. আরো কিছু ধাঁধা

“ও. কে, পরেরটা বলছি, আরো একবার কিউবটাকে ঘোরালেন ডা. শুক্লা,

“আর পাথরের চারপাশের ভূমি থেকে
তুলে নাও ফল, পাতা আর বাকল
প্রথমে পাবে অনেক শেকড় আর ফল
গাঢ় বেগুনি, সাদা আর ছাইরঙা খোসা।
কিংবা সবুজ আর বাদামি।
পরেরটার গাত্রবর্ণ বেশ মসৃণ
ভেতরে বেগুনি ফল
তবে সাবধানে থেকো
স্পর্শ করলেই জ্বলে উঠবে তুক।”

“একেবারে নিখুঁত এক নির্দেশনা” বিদ্রূপ করে উঠল কলিন, “যদি জানা থাকে যে কী খুঁজছে।” “কিন্তু এতে করে বোঝা গেল যে এলিস এইমাত্র যা বলল সেটাই ঠিক।” বাধা দিল রাধা, “কোনো একটা অভিযানের গোপন গাইড হচ্ছে এ কিউব। শুধু সমস্যা হচ্ছে এর উদ্দেশ্যটাই জানি না।”

পরের শিলালিপিটা পড়লেন ডা. শুক্লা,

“মনে রেখ, সাহসী অভিযাত্রিগণ
যদি তুচ্ছ করো এসব বাধা
একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়বে সব বিপত্তি
সাপের ভয়ংকর দৃষ্টি–
অন্যথায় খোয়াবে
সবচেয়ে মূল্যবান সেই উপহার।”

“ও, কে” আবার বাদ সাধল কলিন, “এই ধাঁধাটার অন্তত একটা লাইনের মর্মোদ্ধার আমিই করতে পারব” অন্যদের দিকে তাকিয়ে সবজান্তার মত হাসল, “এখানে বলা হচ্ছে যদি তুমি নির্দেশগুলোকে নামানো আর সতর্কবাণীকেও তুচ্ছ জ্ঞান করো-সেগুলো যাই হোক না কেন নিজের জীবন হারাবে। এটাই হল সবচেয়ে মূল্যবান উপহার অন্য আর কিছুই হতে পারে না।”

“তোমাদের কথাই বোধহয় ঠিক” চিন্তিত হয়ে পড়ল রাধা, “কিন্তু এখনো বোঝা যাচ্ছে না যে নির্দেশগুলো কোথায় নিয়ে যাবে। এছাড়া একগাদা কল্পনা তো আছেই-শিব, সাপ, ফল, দ্রুত বহতা চক্ষু-এগুলোইবা কিভাবে খুঁজে পাবো?”

“একেবারে শেষেরটা পর্যন্ত অপেক্ষা করো” ছেলে-মেয়েরা যখন কথা বলছে ডা. শুক্লা তখন সর্বশেষ শিলালিপিটা পড়ছেন। এবারে জানালেন, “লেখা আছে :

পূর্ব আর পশ্চিমকে বিভক্ত করে
যে উপত্যকাদ্বয়
এবারে সে প্রবেশদ্বারে যাও
কাজে লাগাও নিজের বুদ্ধিমত্তা
মনে রাখবে তুমি সেথায় যাবে
যেথায় ঘুমায় সূর্য।”

“ওহ, গ্রেট” গুঙ্গিয়ে উঠল কলিন, “এবারে আরেকটা প্রবেশদ্বার আর সূর্যকেও পাওয়া গেল। এটা পাগলামো না তো কী? সূর্যটা আবার কে?”

“উঁহু তা না।”-ভ্রু-কুঁচকে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে রাধা। “সূর্য হচ্ছে ভারতীয় সূর্য দেবতা। সূর্য পূর্ব দিকে উঠে। তার মানে এই ধাঁধায় দুটো উপত্যকার কথা বলা হয়েছে আর নির্দেশানুযায়ী পূর্বদিকেরটাই বেছে নিতে হবে।”

“এটা একটা গুড পয়েন্ট। কিন্তু কোন্ উপত্যকা? আর সূর্য তো পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায়। তার মানে পশ্চিম দিকও হতে পারে। দিনের সময়ের উপর নির্ভর করবে।” এতক্ষণে কথা বলল বিজয়।

নিভে গেল রাধার চোখের আলো। “এই ধাঁধাটাকে সমাধা করার জন্য কোনো রেফারেন্স পয়েন্ট তো নেই।” কাঁধ ঝাঁকাতেই কণ্ঠস্বরের অসন্তুষ্টিও বোঝা গেল। “একটা স্টার্টিং পয়েন্ট দরকার, তাহলে বোঝা যাবে যে কোন পাশটা আগে পড়তে হবে। কিংবা এই কিউবটা তৈরির উদ্দেশ্য জানতে হবে। এসব ছাড়া তো মর্মোদ্বার সম্ভব নয়।”

“ঠিক কথা।” সম্মত হল এলিস। “কিউবটা তৈরির পেছনে নিশ্চয় কোনো একটা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু কী উদ্দেশ্য সেটা জানারই কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। “ আবারো কন্টেইনারে ঢুকিয়ে রেখে দিল কিউবটা।

“ও.কে, তাহলে আজ এ পর্যন্তই থাক। এখন বাইরে গিয়ে কেল্লার চারপাশে একটু ঘুরে বেড়ালে হয় না? এত সুন্দর একটা দিন। তাছাড়া ধাঁধাগুলোর তো সমাধানও হচ্ছে না। ঈশ্বর জানেন যে এতে আমি কতটা খুশি হয়েছি। আর আমার জীবনটা হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। তাই কোনো ধরনের দুঃসাহসিক অভিযানে গিয়ে তা খোয়াতে চাই না। এগুলো গ্রিক হিরোদেরকেই মানায়; হারকিউলিস আর ওর জ্ঞাতিভাইরা। আমার মত বিংশ শতকের কাউকে না।” উঠে দাঁড়িয়ে এলিসের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল কলিন। হাস্যমুখে সাড়া দিল মেয়েটা।

“ডোন্ট ওরি” হা হা করে অট্টহাসি দিল বিজয়। “এমনিতেও আমরা যে এগুলোর পিছনে ছুটব সেরকম মনে হচ্ছে না। গ্রিস এখান থেকে অনেক দূর। তাই উত্তরের আশায় অত দূর ছুটে যাবার কোনো মানে হয়না। আর তাছাড়া আমাদের তো কোনো গরজও নেই। অনর্থক এই বুদ্ধির খেলায় পা না বাড়ানোটাই সমীচিন।”।

“আমার মনে হয়, একটু তাজা বাতাসে ঘুরে আসলে ভালই লাগবে।” উঠে দাঁড়িয়ে এলিস আর কলিনকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ডা. শুক্লা। রয়ে গেল বিজয় আর রাধা।

কৌতূহল নিয়ে তাকাল বিজয়।

“তো” শুরু করল রাধা, “মেয়েটা কে? হট, সোনালি কেশধারী, বার্বির মত চেহারার মেয়েটা মাঝরাতে পৌঁছেই তোমাদের বন্ধু হয়ে গেল? কেন এসেছে? বলো?”

রাধার কণ্ঠে মজা করার ভাব থাকলেও বিজয় বুঝতে পারল ওকে খুলে বলা দরকার। তাই এলিসের সাথে ওর অতীত সম্পর্কের কথা স্বীকার করল। “কিন্তু চিন্তা করো না” আশ্বস্ত করল রাধাকে, “এসবই এখন অতীত। বহুকাল আগেই চুকেবুকে গেছে। যখন তোমার সাথে দেখা হল তখন আমার সঙ্গী ছিল কেবল কাজ আর কাজ।”

মাথা নেড়ে হেসে ফেলল রাধা। কিন্তু মনের মাঝে কী যেন খচখচ করছে। বিজয়কে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই; ওকে মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে যে এলিস আর বিজয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মেয়েটাই বেশি শক্ত ছিল। এলিস কেমন করে বিজয়ের দিকে তাকাচ্ছিল সেটাও সে দেখেছে। তাই সন্দেহ হচ্ছে যে এখনো হয়ত মন থেকে বিজয়কে ভুলতে পারেনি। ব্রেক আপ আর এত বছরের দূরত্ব সত্ত্বেও এলিস এখনো বিজয়ের কথা ভাবে।

ঠিক করল এখন এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে সময়মতই সব সামলাবে। “ইমরান এখানে কখন আসবেন?” জানতে চাইল রাধা।

ঘড়ির দিকে তাকাল বিজয়, “বলেছিলেন যে দুপুর হবে। আমাদের হাতে এখনো অনেক সময় আছে।” হঠাৎ করেই আরেকটা কথা মনে এলো, “চলো, সময় যেহেতু পাওয়া গেছে তোমাকে অদ্ভুত একটা জিনিস দেখাবো। উপরের তলার একটা রুমে যেতে হবে।”

“ইমরান কেন দেখা করতে চাইছেন?” সিঁড়ি বেয়ে পাঁচ তলায় উঠতে গিয়ে জানতে চাইল রাধা।

“ঠিক করে কিছু বলেননি। শুধু এটুকু জানিয়েছেন যে টাস্ক ফোর্সের প্রথম কেস পেয়েছেন আর সে ব্যাপারেই ব্রিফ করবেন। কিন্তু কেন যেন তেমন হাসি-খুশি শোনায়নি উনার গলা।”

.

১৬. জোনগড় কেল্লা

“এটা তো আসলেই বেশ অদ্ভুত!” বিজয়কে হতবুদ্ধি করে দেয়া ফাইলটার পাতা ওল্টাতে গিয়ে বলল, “সবকিছুকে একত্রে ফাইলবন্দী করে যাবার পেছনে নিশ্চয়ই তোমার বাবার শক্ত কোনো যুক্তি আছে।”

কাধ ঝাঁকাল বিজয়, “সেটাই তো ভেবে বের করতে চাইছি। কিন্তু কারণটা যে কী হতে পারে সে সম্পর্কে মাথায় কোনো আইডিয়াই আসছে না।”

“এটা কী?” বিভিন্ন চিহ্ন আঁকা একটা এ-ফোর সাইজের পৃষ্ঠার দিকে ইশারা করল রাধা। সিম্বলগুলোকে খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখল। “দেখে মনে হচ্ছে উত্তর-ইউরোপীয় প্রাচীন বর্ণমালা। আরে এগুলোতে হাতে লেখা হয়েছে। তোমার বাবার হ্যান্ডরাইটিং?”।

“জানিনা” স্বীকার করল বিজয়। “উনার হাতের লেখা কেমন ছিল তাও, খেয়াল নেই। আসলে বাবার সম্পর্কেও তেমন কিছু মনে পড়ে না।” মাথা নাড়িয়ে। জানাল, “একসাথে তো খুব বেশি সময় কাটানো হয়নি। এখন আফসোস হয়। আরেকটু যদি কাছে পেতাম। তখন মনে হত কোথায় আর যাবো। তাই বাড়ির পাশের পার্কে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট আর ফুটবল খেলা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতাম। অথচ দেখো এখন আর কিছু করার নেই।” নীরব হয়ে গেল বিজয়। আস্তে করে ওর হাত ধরল রাধা। মেয়েটা ওর কাছে আছে জেনে কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে গেল মন।

“এখানে একটা লিস্টও আছে” আরেকটা কাগজ হাতে নিয়ে দেখছে রাধা, “মনে হচ্ছে কোনো সূচিপত্র।”

রাধার হাতের কাগজটা দেখল বিজয়, “একটা কাজ করলে কেমন হয়, চলো চেক করে দেখি, ফাইলের কাগজপত্র আর এই সূচিপত্রের মাঝে মিল আছে কিনা। হুম?”

একমত হল রাধা। মনে হচ্ছে সেটাই ভালো হবে। আর শেষমেশ কিছু পাওয়া না গেলেও সমস্যা নেই; বিজয় তো স্বস্তি পাবে! ইনডেক্স পাতাটা ফাইল থেকে বের করে নিল। তারপর একেকটা নাম ধরে ধরে আবার ফাইল গোছানো শুরু করল বিজয়।

এতটা সহজ হল না কাজটা। ঠিকঠাক নাম অনুযায়ী কেবল অল্প কয়েকটাই পাওয়া গেছে। তাই লিস্ট অনুসারে মেলাবার পর বাকিগুলোকে অনুমানে গোছাতে হল।

“তালিকার তিনটা আইটেম এই ফাইলে নেই।” সমস্ত কিছু জায়গামত রেখে দেবার পর ঘোষণা করল রাধা। হিসাব করে দেখাল, “কে এস-১, কে এস-২ আর তৃতীয়টা হল একটা মাত্র চিহ্নঅলা নামটা পড়তে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, “এটা কি একটা ডব্লিউ?”

বিজয়ও মনোযোগ দিয়ে দেখছে, “মনে তো হচ্ছে ডব্লিউ। কিন্তু একটু বেশিই ঢেউ খেলানো। দেখো কোনো সোজা লাইন নেই।” কিছু একটা মনে পড়তেই হঠাৎ করে শক্ত হয়ে গেল।

“কী হয়েছে?” রাধারও চোখে পড়েছে ছেলেটার পরিবর্তন। “মনে হচ্ছে মিসিং ডকুমেন্টসগুলোর একটা আগেও কোথায় যেন দেখেছি।” স্মরণ করতে গিয়ে সরু হয়ে গেল বিজয়ের চোখ, “কোথায় যে কে এস দেখলাম!” উঠে দাঁড়িয়ে রুমের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কার্টনগুলোর দিকে তাকাল। গত দুই সপ্তাহ ধরে ঘেটে দেখলেও এখন মনে হল, “আবার সবকিছু গোড়া থেকে খুঁজে দেখতে হবে।”

“চলো আমিও হাত লাগাচ্ছি।” একটা কার্টন টেনে নিয়ে খুলে ফেলল রাধা।

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল বিজয়। তারপর নিজেও আরেকটা বাক্স টেনে আনল। এ কারণেই রাধাকে এত ভালোবাসে। বুঝতে পারছে নির্লিপ্ত থাকলেও এলিসের উপস্থিতি মেয়েটা এখনো মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু কিছুই বুঝতে না দিয়ে ঠিকই বিজয়ের কাজে সাহায্য করছে। রাধার এই মানসিক শক্তি আর আত্মবিশ্বাসকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে বিজয়। নিজস্ব প্রয়োজন আর অগ্রাধিকারকে এক পাশে ঠেলে সবসময় প্রাধান্য দেয় তার বন্ধু আর পরিবারকে। ইস, বিজয়ও যদি এমন হতে পারত! এর বদলে ব্যস্ত থাকে নিজের অন্তর্মুখী জগৎ নিয়ে। হঠাৎ করেই মনে পড়ল এলিসের কথা। জানে এমআইটিতে থাকার সময় কেন দুজনের ব্রেক আপ হয়েছে। তারপরও বিজয় বহুবার ভাবতে চেয়েছে কোথায় ওর ভুল হয়েছিল। অবশেষে বুঝতেও পেরেছে। কখনোই এলিসের কাছে মনের দুয়ার খুলে দিতে পারেনি। সিরিয়াস আর চাপা স্বভাবের বিজয় পিতা-মাতার মৃত্যুর পর আরো বেশি করে নিজের মাঝে গুটিয়ে যায়। ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডিকে প্রাণপণে ভুলে থাকতে চেষ্টা করেছে। আর তাই নিজের চারপাশে গড়ে তুলেছে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল। আর স্বপ্নের প্রজেক্টটাকে গুরুত্ব দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। এলিসের সাথে দেখা হবার পর মনে হয়েছিল এবার বুঝি সবকিছু বদলে যাবে। কিন্তু দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালটা কেন যেন একটুও ভাঙ্গতে পারেনি।

অতঃপর বহুদিন পার হয়ে গেলেও ওকে এভাবে ছেড়ে যাবার জন্য এলিসকে ক্ষমা করতে পারেনি। কথা নেই, বার্তা নেই, এমনকি বিজয়কে বদলাবার কোনো সুযোগও দেয়নি। ফলে নিজের ভুল সত্ত্বেও তিক্ত হয়ে গেছে বিজয়ের মন। অনেক পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছে যে এলিস যদি ওর ভুলগুলো দেখিয়েও দিত তার পরেও কোনো লাভ হত না। বিজয় আসলে কোনো ধরনের সম্পর্কের জন্য তৈরিই ছিল না। ব্রেকআপের সেই কষ্ট ভুলতে পুরো দুই বছর লেগেছে। এরপর তো কোনো সম্পর্কের কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর আসত। একদিকে তাই নিজের কাজ নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর অন্যদিকে মনে হত যে নিজেকে উজাড় করে দেয়া বুঝি কোনোকালেই সম্ভব হবে না।

আর তারপর রাধার সাথে পরিচয়। বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে বছরখানেক আগে। তাও আবার আঙ্কেল খুন হবার পরে এক অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে। তবে যাই ঘটুক না কেন এখন সে প্রকৃতই খুশি। অসম্ভব তৃপ্ত। ওর জন্য রাধার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেউই নেই।

“এই তো পাওয়া গেছে!” ভাবনার গভীর সমুদ্র থেকে যেন বিজয়কে টেনে তুলল রাধার কণ্ঠস্বর। মেয়েটা কী পেয়েছে দেখার জন্য চোখ তুলে তাকাল।

রাধার হাতে পাতলা কার্ড বোর্ডের ফাইলের ভেতর রিবন দিয়ে বাঁধা এক তোড়া কাগজ। বোঝা যাচ্ছে কাগজগুলো বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। একেবারে জীর্ণপ্রায়। “কে-এস-১” ঘোষণা করল রাধা।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিজয়ের চেহারা, “গ্রেট, চলো, ভেতরে কী আছে দেখি।”

“দেখে তো মনে হচ্ছে হাতে লেখা জার্নালের ফটোকপি।” ফাইল খুলে কাগজগুলোতে চোখ বোলাচ্ছে রাধা, “দিস ইজ ইন্টারেস্টিং; তোমার বাবা তো হিস্টোরিয়াল ছিলেন তাই না?”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিল বিজয়।

“এ ধরনের জিনিস সংগ্রহে রেখে গেছেন তার মানে নিজের কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। এটা দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের সময়কার একটা জার্নালের অনুবাদ কপি।”

এমন সময় বেজে উঠল বিজয়ের মোবাইল ফোন। কলিন। ইমরান এসেছেন।

“দুপুর হয়ে গেছে নাকি?” ঘড়ি দেখেই দাঁত বের করে হেসে ফেলল রাধা, “মজা করার সময় আসলে সময়ের হুশ থাকে না।” জার্নালটাকে নেড়ে দেখাল, “প্রথম পাতায় লেখা আছে এটা অত্যন্ত পুরনো এক জার্নালের অনুবাদ, যেটা, কী যেন লোকটার নাম…” নামটাকে ভালোভাবে পড়ে দেখল, “হুম পেয়েছি, ইউমেনিস। অরিজিন্যাল জার্নালটা উনি লিখে গেছেন। তারপর লরেন্স ফুলার নামে আরেকজন সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে।”

রাধার হাত থেকে জার্নালটাকে নিয়ে কয়েকটা পাতা ওল্টালো বিজয়। এটাকে নিরাপদে রাখতে গিয়ে বাবা এতটা কষ্ট করেছেন। জানতে হবে, কেন? একটা নাম দেখে তো আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। রাধাকে দেখাতেই বিজয়ের হাত থেকে নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ে দেখল মেয়েটা। সাথে সাথে উত্তেজনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখ।

.

১৭. টাস্ক ফোর্স সভা

পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো দুজনে। রাধার হাতে একটু আগে পাওয়া জার্নাল। প্ল্যান হল ইমরান চলে গেলেই বিজয়কে নিয়ে একসাথে বসে পড়বে।

দশ মিনিট পরেই গ্লাস লাগানো কফি-টেবিলের চারপাশে একসাথে হল বিজয়, রাধা আর কলিন। গবেষণা কক্ষের দরজায় ডাবল লকড় করে সিরিয়াস ভঙ্গি নিয়ে এসে বসলেন ইমরান। এমনকি অন্যদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময়েও শান্ত হয়ে রইলেন।

“রাইট” শুরু করলেন আইবি স্পেশাল ডিরেক্টর, “টাস্ক ফোর্স তার ফাস্ট কেস পেয়েছে। থিংক ট্যাংক হিসেবে তাই তোমাদেরকে ব্রিফ করতে এসেছি। প্যাটারসনের সাথেও যোগাযোগ হয়েছে। সে তার ইউ এস টিম মেম্বারদেরকে জানাবে।”

খানিক বিরতি দিয়ে আবার বললেন, “সম্ভাব্য বায়োটেররিজমের কেস এসেছে হাতে। দুই রাত আগে, আমার শৈশবের বন্ধু আনোয়ার সাহায্যের অনুরোধ করে মেইল পাঠিয়েছিল। কিন্তু তখন আমি এটা জানতাম না; তবে এখন মনে হচ্ছে ও পাঁচ বছর আগে ইউ এস মাল্টিন্যাশনাল টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের ভারতীয় রির্সাচ সেন্টারে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ভলান্টিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছে। আর্য ল্যাবরেটরিতে পাওয়া মৃতদেহসহ সে রাতে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন ইমরান।

“আইটি ল্যাবে পাওয়া মৃতদেহই আনোয়ার। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ায় চেনার কোনো উপায় ছিল না। ডিএনএ অ্যানালাইসিস করে নিশ্চিত হয়েছি।” থেমে গেলেন ইমরান। বন্ধুর মৃত্যুর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। “পুরোটাই আমাদের অনুমান। তবে মনে হচ্ছে আনোয়ার কোনো এক ফাঁকে আইটি ল্যাবে ঢুকে মেইলটা পাঠিয়েছে। আর তারপর ওকে ধরে হত্যা করা হয়েছে। অটোপসি রিপোর্ট কনফার্ম করেছে যে মৃত্যুর কারণ হল মাথার ভেতর ঢুকে পড়া বুলেট।

একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ। আরো মনে হচ্ছে, ওরা যখন বুঝতে পেরেছে যে ইমেইলটা একজন আইবি অফিসারকে পাঠানো হয়েছে তখনই আর দেরি না করে সবাইকে খুন করে পুরো ভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে; যেন কোনো প্রমাণই আর না থাকে।”

“তার মানে একটা নতুন বায়ো-উইপন তৈরির জন্যই এসব ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হচ্ছিল?” জানতে চাইল রাধা, “টাইটান কী বলছে?”

“আমরাও প্রথমে তাদেরকেই সন্দেহ করেছি। কিন্তু টাইটানের দাবি যে তাদের সমস্ত ট্রায়ালই বৈধ আর ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়াও স্বীকৃতি দিয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস রেজিস্ট্রিও চেক করে দেখেছি। টাইটান ওখানে অসংখ্য ট্রায়ালের রেজিস্ট্রেশন করেছে। প্যাটারসন আর তার দল ইউএসে টাইটানের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট আর বোর্ডের চেয়ারম্যান ও মেজরিটি শেয়ারহোল্ডার কাট ওয়ালেসের সাথেও কথা বলেছে।”

নামটা শুনে সাথে সাথে নড়ে উঠল বাকিরা। “এই লোকটাই তো এলিসের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজে ফান্ড দিয়েছিল বিস্মিত হল বিজয়। “এলিস কে?” তৎক্ষণাৎ জানতে চাইলেন ইমরান, “এর সাথে ওর কিসের সম্পর্ক?”

“ও আমার ফ্রেন্ড। ইউএসে থাকে। হঠাৎ করেই আজ সকালে এখানে এসেছে।” খুব দ্রুত এলিসের কাহিনি বলে গেল বিজয়। ওয়ালেসের কথাও বাদ দিল না। :

শেষ হতেই ঠোঁট কামড়ে ধরলেন ইমরান। “তোমার বন্ধু তো আসলেই এক কঠিন সময় পার হয়ে এসেছে। শুনে ভাল লাগল যে অবশেষে সরে আসতে পেরেছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে দুটো কেসেই কার্ট ওয়ালেস’কমন ফ্যাক্টর। আর তার চেয়েও কাকতালীয় হল এমন একটা সময়ে তোমার বন্ধু ভারতে এসেছে যখন আমরা সম্ভাব্য বায়োটেররিজমের কেস হাতে পেয়েছি।”

ইমরান কী ভাবছেন বুঝতে পারল বিজয়, “আমি ওর হয়ে নিশ্চয়তা দিচ্ছি” অভয় দেয়ার চেষ্টা করে বলল, “আমি ওকে চিনি…” রাধাকে না ক্ষেপিয়ে কিভাবে ওর আর এলিসের সম্পর্ক বর্ণনা করা যায় তা নিয়ে খানিক ভেবে জানাল, “আসলে বলা যায় ওর সম্পর্কে ভালোভাবে জানি।” . চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন ইমরান, “হয়ত। কিন্তু এখানে আসার টাইমিং আর আমাদের কেসের কার্ট ওয়ালেসের সাথে ওর সম্পর্কটা আসলেই কৌতূহলোদ্দীপক। হতে পারে এটা কো-ইন্সিডেন্স ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না।”

চুপ করে গেল বিজয়। নিজের অসন্তোষ চাপার চেষ্টা করছে।

আবারো শুরু করলেন ইমরান, “ওয়ালেস আর টাইটানের পুরো সিনিয়র ম্যানেজমেন্টই আর্যর মালিক সুমন পাওয়ার উপর আঙুল তুলেছে। আগুন লাগার পর থেকে তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় খোঁজা হয়েছে। অথচ একেবারে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। তাই ফলাফল শূন্য। তবে আরো কিছু খবর আছে। আগুনে হার্ড-ড্রাইভের যথেষ্ট ক্ষতি হলেও আমাদের অত্যন্ত অত্যাধুনিক আইটি ল্যাবে বেশ কিছু ডাটা উদ্ধার করতে পেরেছি। যার মাঝে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সাবজেক্টদের উপর ফাইলও আছে। এসব মেডিকেল হিস্ট্রি থেকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত মৃতদেহগুলোর উপর অটোপসি রিপোর্ট আর স্যাম্পল নিউ দিল্লির ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল আর পুনেতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতেও পাঠিয়েছি। এদের ফাইন্ডিংসের সাথে ওয়াশিংটনে অবস্থিত সি ডিসি-র রিপোর্ট মিলিয়ে দেখা হয়েছে; যা মাত্র আজ সকালেই হাতে এসেছে।”

আগের দিন সন্ধ্যায় প্যাটারসন আর ডা. রয়সনের সাথে আলোচনার কথাও সবিস্তারে জানালেন। “তো এখন আমাদের অনুমান হল যে এই পাওয়াই চুপিচুপি সেন্টারে গোপন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছিল। ইউএসের কারো জড়িত থাকার আশঙ্কাও বাদ দেয়া যাচ্ছেনা। বিশেষ করে ওয়ালেস নিজে। যদিও শক্ত কোনো প্রমাণও নেই।”

ইমরানের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো রুম।

“তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?” বরাবরের মতই সবার আগে মুখ খুলল কলিন।

“আর আমরাই বা কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” যোগ করল বিজয়।

“আপাতত হাতে তেমন কোনো কাজ নেই সিদ্ধান্ত জানালেন ইমরান, “তাই আমি চাইছি, তোমরা সব অ্যাংগেল থেকে সমস্যাটাকে ভেবে দেখো। যদি কোনো নতুন আইডিয়া পাওয়া যায়। এই ফাঁকে ফিল্ড এজেন্টরা পাওয়া আর অন্য কোনো লিড পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখুক। তারা চার থেকে পাঁচ বছর আগেকার নিউজপেপার ঘেঁটে কিনিক্যাল ট্রায়ালের বিজ্ঞপ্তি দেখছে আর সেই সাথে এই ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের সাথেও কথা বলছে। আমি ভারতে টাইটানের সিইও ভা, স্বরূপ ভার্মার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আর টাইটানের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. বরুণ সাক্সেনার সাথেও মিটিং করব।”

“এ ব্যাপারে আমরাও সাহায্য করতে পারি” প্রস্তাব দিল রাধা। “সি এম ও-র সাথে দেখা করতে আমার কোনো সমস্যা নেই; যদি আপনি বলেন

“থ্যাংকস।” হেসে ফেললেন ইমরান। কিন্তু এটা একটা ফিল্ড জব। জার্নি টাস্ক ফোর্স সেট আপের পর তোমরা ট্রেনিং নিয়েছ; কিন্তু কোনো অভিজ্ঞতা তো নেই। ব্যাপারটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে যদি সত্যিই বায়োটেররিজমের সাথে দেখা হয়ে যায়।” না চাইলেও গত বছর মহাভারতের সিক্রেট খোঁজার সময়ে টেররিস্টদের সাথে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা মনে পড়ে গেল।

.

১৮. গুড়গাঁও

গুড়গাঁওয়ে অবস্থিত দ্য ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটের ফ্ল্যাট স্ক্রিন মনিটরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছে পিটার কুপার। রুমের এক কোণায় যন্ত্রপাতি ভর্তি একটা তাক থেকে ঝুলছে একগাদা তার। আরেক সারি সার্ভারের সাথে গিয়ে মিশেছে।

কুপার এই কম্পিউটার জিনিসটাকে একটুও বোঝে না। বাহান্ন বছরের জীবনে টেকনোলজির সাথে কখনোই তেমন বন্ধুত্ব হয়নি। একুশ বছর বয়সে যখন অর্ডারে যোগ দিয়েছে, তখন সম্বল ছিল কেবল ভাড়া করা পিস্তলের টেলিস্কোপিক সাইট দিয়ে যে কোনো দূরত্বে দেখা চলন্ত টার্গেটে লাগাবার ক্ষমতা। এছাড়া সষ্টিকর্তা ওকে সত্যিই এক অত্যাশ্চর্য স্মৃতিশক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন। আর এই দুই দক্ষতা মিলে তাকে বানিয়ে তুলেছে এক ভয়ংকর গুপ্তঘাতক। দিনে দিনে যা আরো শাণিত হয়ে উঠছে।

এ পর্যন্ত যে কতজনকে খুন করেছে তার কোনো হিসাবও নেই: নারী, পুরুষ, ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে। আসলে কুপারের কাছে এরা কোনো সংখ্যা নয়। মানুষ হিসেবে ভাবা তো বহু দূরের কথা। কুপারের কাছে এরা কেবল সহজ-সাধারণ টার্গেট। যাদেরকে খতম করাটাই আনন্দের। নিজের কাজটা সে ভালোই বোঝে। নিয়মিত সাফল্য নিয়ে তাই যথেষ্ট গর্বিত। একটা টার্গেটও কখনো মিস হয়নি। এমনকি ট্রিগারের উপর হাত কপারও অভিজ্ঞতা হয়নি।

বছরের পর বছর ধরে অর্ডারে তাই প্রভাব প্রতিপত্তিও বেড়ে গেছে। এখন তার কাজগুলো কৌশলগতভাবে বেশি গুরুত্ব পায়। যার মানে হল আগের তুলনায় কম অ্যাসাইনমেন্ট। যদিও বয়সের ভারে চোখের দৃষ্টি এখনো একটুও মান হয়নি। অবশ্য তার সফলতার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি একটা বিরাট ভূমিকা রাখলেও সেটা কখনো তেমনভাবে স্বীকার করে না। তার মতে এক স্ট্যাটেজিস্টের মারণাস্ত্র হল মাথা। সেখানেই থাকে সব প্রযুক্তিবিদ্যা। বাকি সবকিছু অনর্থক।

“বর্তমান স্ট্যাটাস কী?” কনসোলে বসে থাকা টাক মাথা লোকটার কাছে জানতে চাইল কুপার। মোচঅলা লোকটার নাম কৃষাণ। স্থানীয় টেকনোলজি

“যদি শুরুই না করি তো অভিজ্ঞতাই বা কিভাবে হবে?” জোর দিল রাধা, “আপনার সাথে যদি সিইও-র কাছে যাইও তো কী হবে? আপনি তো সাথেই থাকবেন।”

“রাজি হয়ে যান, ইমরান” অট্টহাসি দিল বিজয়, “ও একটা বুলডগ। এখন আর পিছু হটবে না।”

নিজের পিঠে চাপড় দিয়ে ভাব দেখাল রাধা। “আমার মনে হয় ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং হবে। কাম অন ইমরান; চলুন ঝাঁপিয়ে পড়ি।”

“ওহ, ওকে” হাত বাড়িয়ে দিলেন ইমরান। “ফাইন। একটা ইন্টারভিউতে আর এমন কিইবা ঘটতে পারে? বিকাল সাড়ে চারটায় ইন্টারভিউর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। একই সময়ে সিএমও-র সাথে মিটিং করবে আমার লোকেরা।”

ফোনের জন্য হাত বাড়াতেই বাজতে শুরু করল রিংটোন। মনোযোগ দিয়ে ওপাশের কথা শুনতেই কালো হয়ে গেল ইমরানের চেহারা।

“কোনো খারাপ সংবাদ?” অনুমান করতে চাইল বিজয়। “এই মাত্র পাওয়ার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এক্সপ্রেস ওয়ের সাথে কার অ্যাক্সিডেন্ট। কেউ গাড়ির ব্রেক আগে থেকেই নষ্ট করে রেখেছিল। তাই কোনো সুযোগই পায়নি।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন, “শেষ জীবিত সূত্রটাও হারিয়ে গেল। তার মানে খেলার স্বার্থে তাকেও বলি দেয়া হয়েছে। টাইটানের কারো হাতেই আছে আসল নাটাই। সমস্যা হল, সে যে কে তা খুঁজে পাবারই কোনো উপায় নেই।”

.

১৮. গুড়গাঁও 

গুড়গাঁওয়ে অবস্থিত দ্য ওয়েস্টিন হােটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটের ফ্ল্যাট স্ক্রিন মনিটরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছে পিটার কুপার। রুমের এক কোণায় যন্ত্রপাতি ভর্তি একটা তাক থেকে ঝুলছে একগাদা তার। আরেক সারি সার্ভারের সাথে গিয়ে মিশেছে। 

কুপার এই কম্পিউটার জিনিসটাকে একটুও বােঝে না। বাহান্ন বছরের জীবনে টেকনােলজির সাথে কখনােই তেমন বন্ধুত্ব হয় নি। একুশ বছর বয়সে যখন অর্ডারে যােগ দিয়েছে, তখন সম্বল ছিল কেবল ভাড়া করা পিস্তলের টেলিস্কোপিক সাইট দিয়ে যে কোনাে দূরত্বে দেখা চলন্ত টার্গেটে লাগাবার ক্ষমতা। এছাড়া সৃষ্টিকর্তা ওকে সত্যিই এক অত্যাশ্চর্য স্মৃতিশক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন। আর এই দুই দক্ষতা মিলে তাকে বানিয়ে তুলেছে এক ভয়ংকর গুপ্তঘাতক। দিনে দিনে যা আরাে শাণিত হয়ে উঠছে। 

এ পর্যন্ত যে কতজনকে খুন করেছে তার কোনাে হিসাবও নেই নারী, পুরুষ, ছােট ছােট ছেলে-মেয়ে। আসলে কুপারের কাছে এরা কোনাে সংখ্যা নয়। মানুষ হিসেবে ভাবা তাে বহু দূরের কথা। কুপারের কাছে এরা কেবল সহজ-সাধারণ টার্গেট। যাদেরকে খতম করাটাই আনন্দের। নিজের কাজটা সে ভালােই বােঝে । নিয়মিত সাফল্য নিয়ে তাই যথেষ্ট গর্বিত। একট! টার্গেট ও কখনাে মিস হয়নি। এমনকি ট্রিগারের উপর হাত কাঁপারও অভিজ্ঞতা হয় নি। 

বছরের পর বছর ধরে অর্ডারে তাই প্রভাব প্রতিপত্তিও বেড়ে গেছে। এখন তার কাজগুলাে কৌশলগতভাবে বেশি গুরুত্ব পায় যার মানে হল আগের তুলনায় কম অ্যাসাইনমেন্ট। যদিও বয়সের ভারেন্সেখের দৃষ্টি এখনাে একটুও মান হয় নি। অবশ্য তার সফলতার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি একটা বিরাট ভূমিকা রাখলেও সেটা কখনাে তেমনভাবে স্বীকার করে না। তার মতে এক স্ট্যাটেজিস্টের মারণাস্ত্র হল মাথা। সেখানেই থাকে, সব প্রযুক্তিবিদ্যা। বাকি সবকিছু অনর্থক।

“বর্তমান স্ট্যাটাস কী?” কনসােলে বসে থাকা টাক মাথা লােকটার কাছে জানতে চাইল কুপার। মোচঅলা লােকটার নাম কৃষাণ। স্থানীয় টেকনােলজি টিম চালায়। গাত্রবর্ণ কালো হলেও আইটিতে একটা জিনিয়াস। কুপারের তাই ধারণা।

থেসালোনিকিতে পুলিশ জড়িয়ে পড়ার পর এলিসের পিছু না নিয়ে ট্রাক করার সিদ্ধান্ত নেয় কুপার। গোপন এই মিশন লোকচক্ষুর অন্তরালেই সারতে চেয়েছিল। অন্যদিকে মিডিয়ার কাছে খনন সাইটের ঘটনাটা যাতে লিক না হয় সেদিকটা সামলেছে স্ট্যাভরস। সত্যি ব্যাপারটা তাই কেউ জানতেই পারবে না। আর মিশনটাও সিক্রেট থাকবে।

কেবল বিষফোঁড়া হল এলিস। মেয়েটা যে কেবল চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী তা নয়, ওর কাছে মিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদটাও রয়ে গেছে। যেমন করেই হোক তা এবার পেতেই হবে। তবে এতে করে তার কিংবা মিশনের প্রতি যেন কারো দৃষ্টি না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

থেসালোনিকিতে মেয়েটা উধাও হবার পর থেকেই বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেছে। তারপর টের পেয়েছে যে এলিস সে দেশ ছেড়েই চলেছে। কিন্তু কুপারও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। বিশেষ করে যখন জানত যে ওর পাসপোর্ট সাইট হোটেলেই রয়ে গেছে। নিজের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কুপার থেসালোনিকিতে আমেরিকান কনস্যুলেটেও যোগাযোগ করেছে। সেই গ্রিক সিংগেল মাদার প্রথমে সাহায্য করতে রাজি না হওয়ায় তার পাঁচ বছরের মেয়েটাকেও তুলে আনতে হয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এরপরই কুপারকে গড়গড় করে সবকিছু বলে দিয়েছে শোকার্ত মা। ওয়াশিংটন থেকে স্পেশ্যাল অর্ডারসহ দ্রুত গতিতে এলিসের পাসপোর্ট ইস্যুর কথাও তার কাছ থেকেই জানতে পেরেছে। পরের দিন সকালবেলার নিউজপেপারে সবাই মাতা কন্যার গলা কাটা মৃতদেহের ছবি দেখেছে। এটা অবশ্য কুপারের স্টাইল নয়। এসব তার নতুন ডেপুটির কর্ম। ছোকরা আবার অস্ত্রের চেয়ে ছুরিতেই বেশি পটু।

পরের স্টপ হল গ্রিক ইমিগ্রেশন। যেখানে তার বেতনভুক্ত কন্ট্যাক্ট নেটওয়ার্ক আছে। তাদের কাছেই শুনেছে যে এলিস ভারতের নিউ দিল্লির উদ্দেশ্যে প্রাইভেট জেটে চড়ে বসেছে।

স্ট্যাভরসকে গ্রিসের দেখভালের জন্য রেখে অর্ডারের দেয়া প্রাইভেট জেটে করে কুপার নিজেও উড়ে এসেছে একই জায়গায়। ভারতে নেমে লোকাল মেলের সাথে যোগাযোগ করে গুড়গাঁওতে হেডকোয়ার্টার সাজিয়েছে। এখন শুধু জানার বাকি যে এলিস কোথায় আর কার কাছে উঠেছে। ব্যাপারটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। নিজের মিশন পুরো করার জন্য কেউ আর তাকে আটকাতে পারবে না। এলিস তো একটা উটকো ঝামেলা। একটা পিপড়া, যেটা কিনা পিকনিকের বারোটা বাজাতে এসেছে। এখন এটাকে পিষে মারার সময় হয়েছে।

নিজের চেয়ার ঘুরিয়ে কুপারের দিকে তাকাল কৃষাণ। “মেয়েটা জোনগড়ের একটা দুর্গে উঠেছে। নিউ দিল্লি থেকে দূরত্ব ১৩০ কি. মি. ওর সাথের লোকজনদেরকে আইডেন্টিফাই করেছি।” থেমে গেল কৃষাণ। “খবর বেশি ভালো না।”

ভ্রু তুলে তাকাল কুপার। “সাথে দুজন আমেরিকান নাগরিকও আছে। একজন আবার জন্মসূত্রে ভারতীয়। বিজয় সিং। অন্যজন হল কলিন বেকার। আরেকজন মেয়ে আছে যে কিনা ইন্ডিয়ান ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটোমিক এনাজিতে কাজ করে, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট রাধা শুক্লা। আরো আছে ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর স্পেশাল ডিরেক্টর ইমরান কিরবাঈ।”

ভ্রুকুটি করল পিটার। মেয়েটা তত মনে হচ্ছে ভালই সেয়ানা। এরই মাঝে ইন্ডিয়ান ইনটেলিজেন্স এজেন্সিকেও জড়িয়ে ফেলেছে। কৃষাণ ঠিকই বলেছে। খবর মোটেও ভালো না। “আইবি’র লোকটা এখানে কী করছে? তাদের আলোচনা সম্পর্কে কিছু জানা যায় না?”

“আমাদের টিম জায়গামতই আছে। কিন্তু ওরা এমন একটা রুমে আছে যেখানে কোনো সারভেইল্যান্স কাজ করে না। অডিও কন্ট্রাক্টও নেই। আর এমন কোনো ফাঁক নেই যেখান দিয়ে ভিজুয়াল কন্ট্রাক্ট করা যাবে। ফলে কোনো উপায়ই দেখছি না।” স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুপার। “আসলে আমাদের স্টিগ্রে থাকলে ভাল হত। তাহলে তাদের কলগুলোও ট্র্যাক করে সব বের করে ফেলা কোনো ব্যাপারই ছিল না।”

এবার ভ্রুকুটি করল কুপার, “এই মিশনকে এমনিতেই যতটা সম্ভব লো প্রোফাইল রাখতে চাইছি। একটা দেশে স্টিনগ্রে নিয়ে আসার মানে তুমি জানো? সম্ভাবনার পাশাপাশি আমাদের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেবে। তুমি না একটা জিনিয়াস? তো হাতের কাছে যা আছে তাই নিয়েই কাজ করো না।”

নিজের অপশনগুলোও খতিয়ে দেখল। যদি টার্গেট সত্যিই একটা দুর্গে গিয়ে লুকিয়ে থাকে তাহলে তো হেভি গোলাবারুদ ছাড়া কাজ হবে না। কিন্তু তাতে করে আবার মানুষের নজর কাড়ার ঝামেলাও আছে।

এর পরিবর্তে তাই নির্দেশে জানাল, “আমাদের সবকয়টা টিমকে সজাগ থাকতে বলল। ওই দুর্গের প্রতিটা মানুষের গতিবিধি আমাকে জানাবে। ওরা কোথায় যায়, কী করে কিছু বাদ দেবে না।”

হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলল কুপার। বছরের পর বছর ধরে ট্রিগার টেপার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষা করা তাকে ধৈর্যশীল হতে শিখিয়েছে। তাই আজও এর ব্যত্যয় হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই সঠিক মুহূর্ত নিজে থেকে এসে ধরা দেয়।

আর এর যে বেশি দেরি নেই সেটাও ভালোভাবেই জানেন। সব সময় তাই হয়েছে।

.

১৯. কৌতূহলোদ্দীপক এক আবিষ্কার

কেল্লার দোতলায় গবেষণা কক্ষে বসে নিজের ল্যাপটপের স্ক্রিন দেখছে বিজয়। ইমরান আর রাধা টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের সাথে মিটিংয়ের জন্য বের হয়ে যাবার পর থেকেই চোখ দুটো আঠার মত জার্নালের পাতায় সেটে আছে। মাঝে মাঝে আবার নোটপ্যাডে নোটও নিচ্ছে।

রাধার খুঁজে পাওয়া জার্নালটা পড়ার পর গত আধঘণ্টা ধরে নিজের নোট রেফার করে ইন্টারনেট সার্চ করছে। এই ফাঁকে মাত্র একবারই কিছুক্ষণের জন্য ব্রেক নিয়ে ঘুরে এসেছে পাঁচতলার সেই বিশেষ রম থেকে, যেখানে বাবা মায়ের জিনিস ভর্তি কার্টনগুলো পেয়েছিল। তবে কাঙ্ক্ষিত ফাইলটা খুঁজে পেতেই আবার দৌড়ে গবেষণা কক্ষে চলে এসেছে।

হঠাৎ করে দরজায় নক শুনে চোখ তুলে তাকাল বিজয়।

“ওই, তোমার কি শেকড় গজিয়ে গেল নাকি?” ভেতরে এলো কলিন।

বন্ধুকে দেখে দেঁতো হাসি দিল বিজয়। জানে কৌতূহলে কলিনের পেট ফেটে যাচ্ছে। এতক্ষণ যে অপেক্ষা করেছে সেটাই বেশি।

ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল কলিন, “ইমরানের সাথে ওর মিটিং কেমন হয়েছে তুমি জানতে না চাওয়ায় এলিস খানিকটা রুষ্ট হয়েছে। বাকিদেরকে ব্রিফ করার পর স্টাডিতে বসে এলিসের সাথেও আধাঘণ্টা কথা বলে গেছেন ইমরান। কিন্তু বিজয়ের মাথায় কেবল জার্নালের কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই রাধা আর ইমরান চলে যেতেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেছে।

“ওতো আর ছোট খুকী নয়” পাল্টা আবারো একবার হাসল বিজয়, “তাহলে জিজ্ঞেস করার কী আছে? আর ইমরানও বেশ সজ্জন মানুষ। যদিও বুদ্ধিমানও বটে। তাই জানি সব ভালোই হয়েছে।”

মাথা নাড়ল কলিন, “উনি এলিসকে একগাদা প্রশ্ন করে ওর খনন সাইট, ওয়ালেস আর তার স্ট্রাস্ট, ওই রাতে ওর সাথে কী কী ঘটেছে স জেনে নিয়েছে। এমনকি হোয়াটস অ্যাপে স্ট্যাভরস আর পিটারের ছবিও পাঠাতে বলেছেন উনার নাম্বারে। দেখতে চাইছেন ওই দুজন সম্পর্কে কিছু বের করা যায় কিনা।”

এরপর কৌতূহল নিয়ে বিজয়ের জার্নাল আর নোটপ্যাডের দিকে তাকাল, “আচ্ছা তুমি কী নিয়ে এত ব্যস্ত?”

“আমি একটু পরেই তোমাদেরকে জানাতাম। এত আকর্ষণীয় একটা জিনিস পেয়েছি না! আর এলিস দেখলে তো হা হয়ে যাবে। আমাদের হাত ধরেই সমাধা হবে এক প্রাচীন রহস্য।”

ঘোৎ ঘোৎ করে উঠল কলিন, “জানতাম যে এরকমই একটা কিছু ঘটবে। আসলে তোমাকে একা রেখে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে।” কিন্তু বন্ধুর কথা শুনে আবার আগ্রহও হচ্ছে, “একটু থামো; এলিস আর ডা. শুক্লাকে নিয়ে আসি।”

অন্যেরা আসতে আসতে সেন্টার টেবিলের উপর সব গুছিয়ে রাখল বিজয়; জার্নাল, ল্যাপটপ আর পাঁচতলা থেকে নিয়ে আসা ফাইল।

কলিন আর ডা. শুক্লার সাথে রুমে ঢুকেই উৎসাহ নিয়ে ওর দিকে তাকাল মেয়েটা।

“এলিস” শুরু করল বিজয়, “এটা তোমার বিশ্বাস না হলেও আশা করছি ভালো লাগবে। আজ সকালে তুমি যখন অলিম্পিয়াসের কথা বললে তখনি কেন যেন মনে হয়েছিল যে এই নামটা আগেও কোথাও যেন শুনেছি। পড়ে মনে পড়ল যে কোথাও পড়েছি। এখানে, দেখো।” জার্নালটাকে তুলে নিল হাতে, “মেসিডোনিয়ার ইউমেনিসের একটা সিক্রেট জার্নাল।” আগ্রহ নিয়ে তাকাল বিজয়।

একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এলিস। বুঝতে পারছে না বিজয় ওর সাথে তামাশা করছে কিনা। একটা সিক্রেট জার্নালং ইউমেনিসের?” কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল যে কতটা ধাঁধায় পড়ে গেছে। “সত্যি বলছ তো?”

হেসে ফেলল বিজয়। জার্নালটা পড়ার পর ইন্টারনেটের রেফারেন্স থেকে গ্রিক ইতিহাস সম্পর্কে এত কিছু জেনে গেছে যে এলিসের কাছ থেকে ঠিক এই প্রতিক্রিয়াই আশা করেছে।

“ফাইন” নিজের নোটগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। এখানে এমন কিছু তথ্য আছে যা বললে বুঝে যাবে যে আমি কতটা সিরিয়াস: আলেকজান্ডারের হয়ে সগডিয়ান পাথরের কাছাকাছি ব্যাকট্রিয়াতে ক্যালিসথিনস একটা সিক্রেট অভিযানে গিয়েছিলেন। এছাড়াও ভারত আক্রমণের সময়ও আলেকজান্ডার আর ইউমিনেস, দুজনে মিলে আরেকটা গোপন মিশনে অংশ নিয়েছিলেন।”

একেবারে হা হয়ে গেল এলিস। বিজয় যা যা বলছে সব সত্যি হলেও ইউমিনেসের যে একটা সিক্রেট জার্নাল আছে তা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। অথচ এখানে একেবারে তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।

“আমাকে একটু দেখতে দেবে?” হাত বাড়াতেই ওকে জার্নালটা দিল বিজয়।

“দাঁড়াও দাঁড়াও” বন্ধুর হাত ধরে ফেলল কলিন, “ইউমিনেস কে? ক্যালিসথিনসই বা কে? ক্যালিসথেনিকস এর আবিষ্কারক?”

“ক্যালিসথিনস, দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের সময়কার গ্রিক ইতিহাসবিদ” খানিকক্ষণের জন্য জার্নাল থেকে মনোযোগ সরিয়ে

কলিনের প্রশ্নের উত্তর দিল এলিস। “ফোসিয়ান যুদ্ধ আর গ্রিসের বিস্তৃত ইতিহাসের লেখক। তবে সম্ভবত দ্য ডিডস অব আলেকজান্ডার লিখে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। সেখানে আলেকজান্ডারের সবকয়টা অভিযান সম্পর্কে লিখে তাকে দেবত্ব দান করে গেছেন। অনেকেরই মতে, জিউসের পুত্র সম্পর্কিত আলেকজান্ডারের জন্য নিয়ে সেই লোককাহিনির প্রতিষ্ঠাতাও তিনিই। গ্রিকবাসীর দুনিয়ায় সিওয়াতে আলেকজান্ডারের ভ্রমণ আর প্যাম্পিলিয়াতে সমুদ্রের দুভাগ হয়ে যাবার গল্পও তিনিই ছড়িয়েছেন। সেই সিওয়াতেই নাকি ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওরাকল আলেকজান্ডারকে জিউস আমানের পুত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে নির্মম ব্যাপার হল, তিনিই আলেকজান্ডারকে দেবতা রূপে পরিচিত করেছেন আবার এ কারণে উপহাস করাতেই মৃত্যুবরণও করেছেন।”

“ওয়াও! তার মানে আলেকজান্ডার নিজেকে সত্যিই ঈশ্বর মনে করত নাকি?” কলিন এবারে সত্যিই বিস্মিত হন।

“ইয়েস” ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল এলিস। “৩২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্য এশিয়ায় বিজয় লাভের পর আলেকজান্ডার বাল্ক শহরে ক্যাম্প করে ঘোষণা করে দেন যে তাঁকে দেবতা হিসেবেই উপাসনা করতে হবে। পারস্য আর মধ্য এশিয়ায় জয়লাভ, সিওয়ার ওরাকলের স্বীকৃতি, অভিযান সম্পর্কে ক্যালিসথিনসের উচ্চ প্রশংসা সবকিছু মিলিয়ে তাকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে তিনি বুঝি সত্যিই ঈশ্বর।”

“অথচ ক্যালিসথিনসই তাকে ঈশ্বর হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন।” বিড়বিড় করে গত আধঘণ্টা ধরে নিজের রিসার্চ স্মরণ করে নিল বিজয়।

মাথা নেড়ে সম্মত হল এলিস। “কারেক্ট। আর তিনি যে শুধু প্রত্যাখ্যান করেছেন তা না; ইলিয়াডের একটা লাইন উদ্ধৃত করে আলেকজান্ডারকে বলেছেন :

“প্যাট্রোক্লাস তোমার চেয়েও উত্তম ছিল; কিন্তু মৃত্যু তাকেও ছেড়ে দেয়নি।”

“এটা তো এক ধরনের বিপ” মন্তব্য করল কলিন, “মানে লোকটা আরেকটু নরম স্বরে বোঝাতে পারত। কাউকে ঈশ্বর না বলার ক্ষেত্রে আরো তো কত উপায় আছে। বিশেষ করে যখন তার কাছে তলোয়ার থাকে।”

“এই কারণেই আলেকজান্ডার তাকে হত্যার আদেশ দেন। সে সময়ে অবশ্য নিজের বিরুদ্ধ মতের কাউকেই আর সহ্য করতে পারতেন না। একই সময়ে আবার আলেকজান্ডারকে গুপ্ত ঘাতকের হাতে মারার ষড়যন্ত্র হয়। আর সেই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার মিথ্যে অভিযোগে ক্যালিসথিনসকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে মেরে ফেলা হয়। আলেকজান্ডার নিজে তাঁকে ক্রুশে দিয়েছেন।

থরথর করে কেঁপে উঠল কলিন, “কী ভয়ংকর। আর ক্যালিসথিনস তার জন্যে এত কিছু করার পরেও আলেকজান্ডার এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাহলে মেসিডোনিয়ার ইউমিনেস কোত্থেকে আসলো?”

বিজয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল এলিস, “বিজয় নিজে যেহেতু একা একা গোপন কিছু রিসার্চ করেছে, তাহলে এটাও সেই জানাক।”

.

২০. ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ

মেসিডোনিয়া, গ্রিস

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে একদৃষ্টে দেখছেন মেসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের স্ত্রী অলিম্পিয়াস। বাদামি দেহত্বক, কালো চোখ আর কৃষ্ণবর্ণের চুলঅলা লোকটার পরনে এমন এক ধরনের সাদা ঢোলা পোশাক যা তিনি আগে আর কখনো দেখেননি। একই সাথে এটাও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে তার কাছেই সেই বিশেষ সংবাদটা আছে। অর্ডারের একেবারে উপর মহল থেকে যদি নিশ্চয়তা না পেতেন তাহলে তো দেখার সাথে সাথে একে বিদায় করে দিতেন। দ্বিতীয়বার চিন্তা করার কোনো প্রয়োজনই হত না।

“আমি শুনেছি তুমি নাকি দেবতাদের সিক্রেট সম্পর্কে অনেক কিছু জানো?” স্থির দৃষ্টি দিয়ে লোকটাকে একেবারে বিদ্ধ করে দিয়ে অবশেষে বলে উঠলেন অলিম্পিয়াস।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল সাদা পোশাকধারী, “যা, কিন্তু তারা আপনার দেবতা নন। প্রাচ্যের দেবতা। আমার জনগণের দেবতা। লোকটার উচ্চারণ বেশ অদ্ভুত আর কথাও বলছে ধীরে ধীরে। এই ভাষা বোধহয় তেমন জানে না।

ভ্রুকুটি করলেন অলিম্পিয়াস। লোকটার নির্লিপ্ততা আর তার রাজকীয় পদমর্যাদার প্রতি ঔদাসীন্য দেখে বিরক্ত লাগছে। কিন্তু সেই তথ্যটাও জানা দরকার। অধীর হয়ে এরই জন্য এত অপেক্ষা। তাই নিজের রাগ কমিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। একবার যখন পেয়ে যাবেন সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তু তখন আর এই উজবুকের ভাগ্য নির্ধারণে ভাবার কিছু থাকবে না।

“আমি তা জানি। সেটা কোনো সমস্যাই না। কার দেবতা তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। ঠিক আছে?”

নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল বাদামি গাত্রবর্ণ, “এই লোকগাঁথা সম্পূর্ণ সত্য। আমি তার জামিন দিচ্ছি।”

“তুমি যে সত্যি কথা বলছ, সেটাই বা কিভাবে জানব?” জানতে চাইলেন অলিম্পিয়াস।

এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকাল লোকটা, “হে রানি, আপনি কী আমাকে সন্দেহ করেন?” এতটা সোজা-সাপ্টা প্রশ্ন শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন অলিম্পিয়াস। হেসে ফেলল লোকটা। “এতটা ঔদ্ধত্য। এত উচ্চাকাভক্ষা আর আমার কথায় যদি ভরসা না থাকত তাহলে এতগুলো নদী আর সমুদ্র পেরিয়ে এখানে আনার ব্যবস্থা করতেন না, নিশ্চয়। তারপরেও আপনার সন্দেহের জন্য ক্ষমা করে দিচ্ছি। যারা জানে না তাদের কাছে এই পুরান বিশ্বাস করা সত্যিই কষ্টকর।”

অলিম্পয়াসের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য খানিক বিরতি দিয়ে আবার বলল, “ও রানি, আপনার কী মনে হয়? আমার বয়স কত?”

আবার ভ্রু-কুঁচকে ফেললেন অলিম্পিয়াস। এই লোকটার বয়স কত তা জেনে কী হবে? শুধু তো সেই তথ্যটাই দরকার। তাই হালকাভাবে কাঁধ আঁকিয়ে বললেন, “আমি কিভাবে জানব?”

“গত ছয়শ বছর কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে আমি এই পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াচ্ছি। বছর গোনা বাদ দিয়ে তাই এখন শুধু দশক হিসাব করি।”

পুরোপুরি সজাগ হয়ে গেলেন অলিম্পিয়াস। এবারে তো তাহলে লোকটার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ব্যাপারটা সত্যিই আলাদা। দেখে তো চল্লিশের বেশি মনে হচ্ছে না অথচ কিনা বলছে ছয়শ। যদি তার দাবি সত্য হয় তো…

মনে মনে ভেবে দেখলেন রানি। “দেবতাদের সিক্রেট কোথায় লুকানো আছে আমাকে বলো?” সাগ্রহে সামনে ঝুঁকতেই দেখা গেল জ্বলজ্বল করছে চোখ।

“এখান থেকে অনেক দূর, হে রানি” উত্তরে জানাল লোকটা। “ইন্দুস ভূমির এক গোপন স্থানে। এমনভাবে লুকানো আছে যেন অজানা কেউই হাত দিতে না পারে।”

“দুনিয়ার একেবারে শেষে ফিসফিস করে উঠলেন অলিম্পিয়াস। উত্তেজনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চেহারা।

“গ্রিকদের মত এত উন্নত একটা জাতি হয়েও পৃথিবী সম্পর্কে আপনি এত কম জানেন দেখে অবাক লাগছে।” বিদ্রূপ করে মন্তব্য করল দার্শনিক লোকটা।

তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন অলিম্পিয়াস। লোকটা তো মহাপাজি। এক আই ব্রো তুলে জানতে চাইলেন কী বলতে চায়।

“আপনার দার্শনিকেরা কি এটাই শেখায়? যে দুনিয়ার শেষ মাথা ইন্দুসের ওপারে? তাহলে আপনার পুত্রও পৃথিবীর শেষ অব্দি পৌঁছানোর জন্য তার বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে আর যখন ফিরে আসবে তখন সেই হবে মেসিডোনিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী।” এরপর গলার স্বর নিচু করে জানাল, “আপনাকে জানিয়ে রাখি হে রানি ইন্দুসের ওপারেও ভয়ংকর আর চওড়া সব নদীর ধারে ছড়িয়ে আছে পৃথিবী। আছে শক্তিশালী সব রাজা আর আপনার ধারণারও বাইরে সব অস্ত্র। এসকল ভূমি একদা দেবতাগণ নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাই প্রয়োজন মিটে গেলেই যেন ফিরে আসে আপনার পুত্র। নতুবা আপনার আর তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মিলে মেসিডোনিয়াকে ধ্বংস করে দেবে।”

লোকটার স্পর্ধা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন রানি অলিম্পিয়াস। কিন্তু তারপরও নিজেকে শান্ত করলেন। কেননা এখনো মোক্ষলাভ হয়নি। বদলে তাই জানতে চাইলেন, “তাহলে আমাকে কী দিতে চাও?”

নিজের ঢোলা পোশাকের পকেট থেকে লুকানো কী যেন বের করে রানির হাতে দিল লোকটা। “পূর্বপুরুষেরা আমাদের জন্য বানিয়ে গেছেন। তবে খোদাইকৃত লেখাগুলো আপনি বুঝতে পারবেন না। কেননা আপনি তো আর আমাদের দেবতাদেরকে চেনেন না!” এরপর একটা পার্চমেন্ট বের করে রানির হাতে দিয়ে জানাল, “এখানে আসার সময় এটা আমি আপনার জন্য বানিয়েছি। শিলালিপি গ্রিকে লেখা। আমি বুঝিয়ে বলব নচেৎ বুঝবেন না। আর এটা” একটু আগেই রানির হাতে দেয়া দুটো জিনিসের একটাকে ইশারা করে বলল, “আমাদের দেশে অবশ্যই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ইন্দুস পার হবার পরে আপনার পুত্র যেন একেবারে গহীনে লুকিয়ে রেখে দেয়। যেন আর কেউ খুঁজে না পায়।” আবার কিছু বলার আগে খানিকক্ষণ বিরতি নিল। চেহারা এবার বেশ সিরিয়াস দেখাচ্ছে, “কিন্তু খুব সাবধান। পুরো ব্যাপারটাই, অত্যন্ত বিপজ্জনক। নির্দেশগুলোকে ঠিকঠাকভাবে না মানলে সামনে কেবল মৃত্যুই আছে।”

জিনিস দুটো হাতে নিতেই উত্তেজনায় কেঁপে উঠল রানি অলিম্পিয়াসের হাত। প্রথমটা দেখে মনে হচ্ছে হাড়ের তৈরি কিউব। নিশ্চয় বেশ প্রাচীন। বয়সের ভারে হলুদ হয়ে গেছে। গায়ে খোদাই করা ভাষাটা সত্যিই অজানা। দ্বিতীয় জিনিসটা হল শিলালিপি খোদাই করা কালো একটা ধাতব পাত। পার্চমেন্টের শিলালিপি বুঝিয়ে দিয়ে কী কী করতে হবে রানিকে সেই নির্দেশনাও দিয়ে দিল লোকটা।

চামড়া সদৃশ্য কাগজের একটা জায়গা দেখিয়ে জানাল, “এখানে গিয়ে আপনার পুত্রকে থামতেই হবে। এর বেশি যেন কিছুতেই না এগোয়। সেখান থেকেই বাসায় ফিরতে হবে অথবা আর ফেরারই অবস্থা থাকবে না।” এদিকে অলিম্পিয়াসের তেমন আর মনোযোগ নেই। চামড়ার উপর চোখ বোলাতেই উত্তেজনা আরো বেড়ে গেল। পুত্র আলেকজান্ডারের জন্য তাঁর পরিকল্পনা এবার সফল হতে চলেছে। এরই মাঝে পুত্রের সাম্রাজ্য বৃদ্ধির ক্ষুধাও টের পেয়েছেন। ফিলিপের রেখে যাওয়া সীমানা বৃদ্ধিই তাঁর কাম্য। আর এবার দেবতাদের সিক্রেট হাতের মুঠোয় চলে আসায় দুনিয়ার বুকে পুত্রের শাসনভার তিনি নিশ্চিত করেই ছাড়বেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে নয়। ঈশ্বর হিসেবেই এ পৃথিবী শাসন করবে আলেকজান্ডার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *