২. দ্বিতীয় দিন

২. দ্বিতীয় দিন

রাজুর ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। তাদের ঘরে দুটি বিছানা একত্র করে একটা বড় বিছানা তৈরি করে তার মাঝে সাগর, রাজু আর আজগর মামা ঘুমিয়েছিল। ঘুমুতে ঘুমুতে অনেক দেরি হয়েছিল, আজগর মামা এলে সবসময় তা-ই হয়, সব নিয়ম কানুন ওলটপালট হয়ে যায়। সাগর এখনও ঘুমিয়ে আছে, রাজু উঠে পড়ল। বসার ঘর থেকে আব্বা, আম্মা আর আজগর মামার গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। চোখ মুছে সে বসার ঘরে উঁকি দিল–আজগর মামা সোফায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন, হাতে গামলার মতো বড় একটা মগ, সেটা বোঝাই গরম চা। মামা রাজুকে দেখে একটা হাঁক দিলেন, “রাজু! রেডি হয়ে যা।”

“কেন মামা?”

“যাবি আমার সাথে।”

“কোথায়?”

“আমার বাসায়। দেখবি কী ফাস্টক্লাস একটা মোটর সাইকেল কিনেছি–ইয়ামাহা একশো সি.সি.! গুলির মতন যায়। রেডি হ।”

“সত্যি? রাজু তার আম্মা-আব্বার দিকে তাকাল।

আজগর মামা একটা ধমক দিয়ে বললেন, “সত্যি না তো কী? পরীক্ষা শেষ, এখন ঘরে বসে বসে টেলিভিশন দেখে পচে যাবি নাকি? যা, সাগরকে ডেকে তোল–”

আম্মা বললেন, “দাদা, তোমার অসুবিধে হবে, ওরা খুব জ্বালাতন করে।”

“করলে করবে। আজগর মামা গোঁফের ফাঁক দিয়ে হেসে বললে, আমিও জ্বালাতন করব। সমান-সমান হয়ে যাবে।”

রাজু আনন্দে একটা চিৎকার দিয়ে গিয়ে সাগরকে ডেকে তুলল। অন্য দিন হলে সাগর উঠেই রেগেমেগে কিছু একটা বলে বসত। আজকে কিছুই করল না, মামার বাসায় যাবে শুনে সেও চিৎকার করে বিছানা থেকে নেমে দুই হাত প্লেনের মতো দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে সারা ঘরে দৌড়াতে শুরু করে।

ট্রেন দশটার সময়, হাতে বেশি সময় নেই। তাড়াতাড়ি সবকিছু ঠিকঠাক করে নিতে হবে। বেশি জিনিস নিয়ে কোথাও যাওয়া মামা দুচোখে দেখতে পারেন না–আগেই ঘোষণা করে দিলেন যে যেটা নিজে টেনে নিতে পারবে সে সেটা নেবে। রাজু আর সাগর তাদের স্কুলব্যাগ খালি করে সেখানে কয়েকটা জামাকাপড় কাগজ-কলম গল্পের বই ভরে নিল। সাগর তার কিলবিলে গোখরো সাপ আর খেলনা-পিস্তল নিয়ে নিল। রাজু নিল তার পেন্সিল কাটার চাকু। আম্মা টুথব্রাশ চিরুনি আর তোয়ালে বের করে দিলেন। সাথে পানির বোতল আর ছোট বিস্কুটের প্যাকেট। আব্বা মানিব্যাগ বের করে কিছু টাকা বের করে দিলেন তার সাথে সেটা সাবধানে কীভাবে রাখতে হবে তার উপরে একটা বিশাল বক্তৃতা।

বের হবার আগে সকালের নাস্তা করে যেতে হবে, কিন্তু উত্তেজনায় রাজু আর সাগর কিছু খেতে পারছিল না। আম্মা বললেন, প্লেটের পুরো খাবার শেষ না করা পর্যন্ত ঘর থেকে বের হতে পারবে না, তাতে ট্রেন ফেল করলে করবে।

এমনিতেই রোজ যা খেতে হয় আজকে তার থেকে দ্বিগুণ খেতে দিয়েছেন–শুধু তা-ই নয়, খাওয়ার পর পুরো এক গ্লাস দুধ-জীবনের উপরে বিতৃষ্ণা এসে যাবার মতো অবস্থা!

শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি তারা ঘর থেকে বের হল, আম্মা-আব্বা হেঁটে হেঁটে একেবারে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। স্কুটারে ওঠার আগে আম্মা প্রথমে সাগরকে, তারপর রাজুকে একবার বুকে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “সাবধানে থাকিস। মামাকে বেশি জ্বালাবি না।”

সাগর বলল, “আর মামা যদি জ্বালায়?”

আম্মা হেসে ফেললেন, বললেন, “তা হলে কী হবে তো জানি না।”

.

স্টেশনে পৌঁছানোর পর থেকে শুধু দৌড়। প্রথমে দৌড়ে দৌড়ে টিকেট কেনা, তারপর দৌড়ে দৌড়ে ট্রেনে ওঠা। ট্রেনে উঠে দেখা গেল সেটা ভুল ট্রেন, তারপর আবার দৌড়ে দৌড়ে ঠিক ট্রেনে ওঠা। ছুটে ছুটে রাজু আর সাগরের দম ফুরিয়ে গেল সত্যি, কিন্তু ভারি মজা হল। ট্রেনে ওঠার পর দেখা গেল এত ছোটাছুটি করে ট্রেনে ওঠার কোনো দরকার ছিল না, ট্রেন ছাড়তে বেশ দেরি আছে।

ট্রেনে ওঠার আগে মনে হয় ট্রেনটা যেন ছেড়ে না দেয়, ট্রেনে ওঠার পর মনে হয় এখনও ছাড়ছে না কেন ট্রেনটা! সাগর একটু পরে পরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, “ছাড়ছে না কেন ট্রেনটা?”

আজগর মামা একটা খবরের কাগজ কিনে নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে সেটা পড়তে পড়তে বললেন, “সময় হলেই ছাড়বে। তোর এত তাড়া কিসের?”

সাগর আর রাজু তখন জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাইরে তাকাল, ট্রেনে বসে সময় কাটানো খুব সোজা, চারিদিকে এত মজার মজার জিনিস থাকে যে দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায়। সেসব দেখতে দেখতেই হঠাৎ গার্ডের বাঁশি শোনা গেল, ট্রেনের ইঞ্জিন তখন কয়েকটা হুইসিল দিয়ে নড়তে শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর বেগ বাড়তে থাকে, খটাং খটাং শব্দ হয় আর ট্রেনটা কেমন মজার মতো দুলতে থাকে। রাজু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, কত কী মজার জিনিস বাইরে! এমনিতেই যেসব জিনিস দেখলে একটুও মজা লাগার কথা না, কিন্তু ট্রেন থেকে দেখলে সেটাকেই কী অসাধারণ মনে হয়। একটা মানুষ উদাস মুখে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে কিংবা একটা ছোট ছেলে ট্রেনের সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে, যেন ট্রেনটাকে সে দৌড়ে হারিয়ে দেবে। একটা গরু ট্রেনের শব্দ শুনে লেজ তুলে দৌড়াচ্ছে আর তার পিছনে লাল চুলের একটা ছোট মেয়ে। দৌড়াচ্ছে সেটাকে ধরার জন্য, কী মজার দৃশ্য! শহরে রাস্তাঘাট আর গাড়ি স্কুটার দেখে দেখে চোখ পচে গেছে, ট্রেন থেকে বিশাল ধানক্ষেত নদী নালা পুকুর দেখে রাজুর চোখ জুড়িয়ে যায়।

রাজুর ট্রেনে চড়তে খুব ভালো লাগে। যতক্ষণ ট্রেন চলছে ততক্ষণ বাইরে তাকিয়ে কত কী দেখা যায়, তারপর ট্রেন যখন কোনো-একটা স্টেশনে থামে, তখন আরও মজার ব্যাপার শুরু হয়। অন্ধ ফকিরের সুর করে গান, বাদামওয়ালা, ঝালমুড়ি আর কলা, চিরুনি আর খবরের কাগজের ফেরিওয়ালা। প্লাটফর্মে লোহার ট্রাংকের উপর গ্রামের বউ জবুথবু হয়ে বসে থাকে, আর ছোট একটা ছেলে মুখে আঙুল দিয়ে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ-হঠাৎ দেখা যায় কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, মানুষটার মুখের দিকে তাকালে বুকের ভিতর জানি কীরকম করতে থাকে।

ট্রেনে উঠলে সবচেয়ে মজা লাগে লোকজনের কথা শুনতে। কত মজার মজার গল্প, রাজনীতির গল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের গল্প, দেশ-বিদেশের গল্প, চোর ডাকাত বাটপারের গল্প। কত যে মজার মানুষ আর কত যে তাদের মজার মজার অভিজ্ঞতা, না শুনলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।

ট্রেনটা অনেকক্ষণ একটানা চলতে চলতে শেষে একটা জংশনে থামল। ট্রেনটা প্রথম যখন এসে থামে তখন ভারি মজা লাগে, কিন্তু যদি বেশিক্ষণ থেমে থাকে তা হলে আবার মনে হতে থাকে, কী ব্যাপার, ছাড়ছে না কেন? সাগর একটু পরেই আবার শুরু করে দিল, “মামা, ট্রেন ছাড়ছে না কেন?”

মামা কী-একটা ইংরেজি বই পড়ছিলেন, সেটা পড়তে পড়তে চোখ না তুলে বললেন, এটা বড় জংশন, অন্য ট্রেনের সাথে ক্রসিং হবে, ছাড়তে দেরি আছে।

রাজু বলল, “মামা, ট্রেন থেকে নামি?”

আজগর মামা বললেন, “নাম।” সাগর বলল, “আমিও নামি?”

“নাম। বেশি দূরে যাবি না কিন্তু। দুজনে একসাথে থাকবি। যখন ঘণ্টা দেবে চলে আসিস।”

“ঠিক আছে মামা।”

আজগর মামা বই থেকে চোখ তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, “ট্রেনের নিচে কাটা পড়িস না যেন!”

“যাও!” রাজু আর সাগর ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।

আজগর মামা কোনোকিছুতেই না করেন না, এইজন্যে রাজু মামাকে এত পছন্দ করে। যদি আব্বা আর আম্মা থাকতেন তা হলে এতক্ষণে দুজনে মিলে ধমক দিয়ে তাদের বারোটা বাজিয়ে দিতেন।

ট্রেন থেকে নেমে রাজু সাগরকে নিয়ে প্রথমে ইঞ্জিনটা দেখতে গেল। কী বিশাল ইঞ্জিন-গুমগুম শব্দ করছে! দেখে মনে হয় যেন একটা বিশাল ডাইনোসর কেউ বেঁধে রেখেছে বলে রেগে ওরকম শব্দ করছে। পুরো ট্রেনটাকে এই ইঞ্জিনটা টেনে নিয়ে যায়, দেখে বিশ্বাস হতে চায় না। ইঞ্জিনটা দেখে সাগর বলল, “আমি বড় হয়ে ইঞ্জিনের ড্রাইভার হব।”

রাজু সাগরের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল, “সত্যি?”

“সত্যি। তুমি কী হবে?”

রাজু উদাস-উদাস মুখে বলল, “এখনও ঠিক করিনি। ফাঁইটার প্লেনের পাইলট হতে পারি।”

“প্লেনে কি হুইসিল আছে?”

“নেই।”

সাগর মাথা নাড়ল, “তা হলে আমি পাইলট হব না।”

রাজু সাগরের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না, সে নিজে যখন ছোট ছিল তখন তার ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে ফায়ার ব্রিগেডের ড্রাইভার হবে।

ইঞ্জিনটা দেখে তারা হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছিল। স্টেশনে কতরকম মানুষ কিছু বেদেনি বসে আছে কাঁচের চুড়ির ঝাপি নিয়ে। কিছু ন্যাংটো ছেলে ছোটাছুটি করছে, কোমরে কালো সুতো দিয়ে ঘুঙুর বাধা, সেটা টুং টুং করে বাজছে সাথে সাথে, দেখে মনে হয় খুব মজার একটা খেলা চলছে এখানে। একটা ছাগল খুব গম্ভীর মুখে একটা ঠোঙা চিবিয়ে যাচ্ছে, পাশেই একটা কুকুর–সেটা তার পাশে দিয়ে যেই হাঁটছে তাকে খুঁকে যাচ্ছে, মনে হয় সেটাই যেন তার চাকরি। স্টেশনে ট্রেনের এত লোকজন, হৈচৈ–তার মাঝে একজন ময়লা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে–লোকটির নিশ্চয়ই অনেক ঘুম পেয়েছে।

রাজু আর সাগর যখন হেঁটে নিজেদের কামরার কাছাকাছি চলে এসেছে হঠাৎ তাদের সামনে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। হৈচৈ শুরু হয়ে গেলে রাজুর সবসময় একটু ভয়-ভয় করে, কিন্তু সাথে সাথে সেটা কী জন্যে হচ্ছে দেখার খুব কৌতূহল হয়। সে সাগরের হাত শক্ত করে ধরে সেটা দেখতে এগিয়ে গেল। কাছে যেতে না-যেতেই জায়গাটাতে খুব ভিড় জমে গেল, বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে কোনো এক ধরনের ধস্তাধস্তি হচ্ছে। রাজু কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করে, আর সাগর সাথে সাথে চেঁচাতে শুরু করে, “আমি দেখব, আমি দেখব।”

সামনে মানুষের খুব ভিড়, রাজু ভালো করে দেখতে পারছিল না, কিন্তু যেটুকুও দেখল তাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেল, একজন মানুষকে ধরে অনেকগুলি মানুষ মিলে মারছে। সে কী মার, ঘুষিতে মুখ ফেটে রক্ত বের হয়ে আসছে, চুলের মুঠি ধরে মুখে ঘুষি মারছে, মাটিতে ফেলে লাথি মারছে–কী ভয়ংকর একটা দৃশ্য! লোকটাকে মারতে মারতে মানুষগুলি আস্তে আস্তে আরও খেপে উঠছে, দেখে মনে হয় কেউ যেন আর পুরোপুরি মানুষ নেই, কেমন যেন জন্তু-জন্তু হয়ে উঠেছে। চিৎকার করে গালি দিতে দিতে একজন আরেকজনের ওপর দিয়ে মানুষটাকে মারছে–এরকম করে মারলে কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারে!

মানুষের ধাক্কাধাক্কি হৈচৈ আরও বাড়তে থাকে, তার মাঝে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে রাজু আর সাগর পিছনে সরে আসে। রাজু তবু কিছুটা দেখতে পেরেছে, সাগর কিছু দেখেনি, তখনও তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে, “কী হয়েছে? আমি দেখব, আমি দেখব—”

যে-মানুষটাকে মারছে সেই মানুষটা এখন চিৎকার করে কাঁদছে, কিন্তু কারও ভিতরে কোনো মায়াদয়া নেই, মনে হয় তাকে মেরেই ফেলবে। কেন জানি হঠাৎ রাজুর শরীর খারাপ হয়ে যায়, মনে হতে থাকে বুঝি হড়হড় করে বমি করে ফেলবে। রাজু সাগরের হাত ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরল, আর ঠিক তখন দেখল আজগর মামা ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন, বিশাল গলায় হাঁক দিয়ে বলছেন, “কী হচ্ছে এখানে? কী হচ্ছে?”

লোকগুলি তখনও মারছে, আজগর মামা তার মাঝে হাত দিয়ে লোকগুলোকে থামাতে গিয়ে নিজেই মনে হয় দুই-চারটা কিল-ঘুষি খেয়ে গেলেন, কিন্তু যেসব গা

করে মামা আবার চিৎকার করে ধমক দিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে এখানে? কী হচ্ছে?”

যে-কয়জন মানুষ খুব উৎসাহ নিয়ে পেটাচ্ছিল তাদের একন চকচকে চোখে বলল, “পকেটমার স্যার। পকেট মেরেছে।”

“কার পকেট মেরেছে?”

“এই যে স্যার, এই সাহেবের।”

যে-সাহেবের পকেট মেরেছে সে এসে নিচে-পড়ে-থাকা মানুষটিকে কষে একটা লাথি মারতেই আজগর মামা খপ করে লোকটার কলার চেপে ধরে বললেন, “এই লোক তো পকেট মেরেছে। আপনি কী করছেন?”

লোকটা থতমত খেয়ে বলল, “কী করছি?”

“মানুষ মারছেন। এই লোকের যদি পকেট মারার জন্যে শাস্তি হয় আপনার তা হলে মানুষ মারার জন্যে শাস্তি হতে হবে।”

আশেপাশের যে-মানুষগুলো এতক্ষণ কিল ঘুষি লাথি মারছিল হঠাৎ তারা থতমত খেয়ে থেমে গেল। আজগর মামা চিৎকার করে বললেন, “আপনারা কি মানুষ না? একজন মানুষ কখনও আরেকজন মানুষকে এভাবে মারে!”

একজন, যে মারতে মারতে নিজের মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিল, চোখ লাল করে বলল, “চোরকে মারব না তো কোলে তুলে রাখব?”

আজগর মামা মাথা ঘুরিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “না, তাকে কোলে তুলে রাখবেন না–তাকে পুলিশে দেবেন। দেশে আইন-কানুন আছে সেটা সম্মান করতে হয়।”

আশেপাশে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের কয়েকজন আবার মার মার করে এগিয়ে আসতে চাচ্ছিল, কিন্তু দেখা গেল বেশির ভাগ মানুষই হঠাৎ করে মারপিটে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকজন আজগর মামার সাথে একমত হয়ে মাথা নেড়ে বলতে লাগল, “ঠিকই তো, একজন মানুষকে কি কখনও এভাবে মারে?”

ভিড়টা তখন হঠাৎ পাতলা হয়ে গেল এবং আজগর মামা নিচে-পড়ে-থাকা মানুষটাকে টেনে তুললেন, মনে হল লোকটার সারা মুখ থেঁতলে গেছে, রক্তে মাখামাখি। শরীরের কাপড়জামা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, পরনের লুঙ্গিটা খুলে যাচ্ছিল, কোনোমতে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। মামা লুঙ্গিটা বেঁধে দিয়ে বললেন, “হাঁটতে পারবে?”

লোকটা রক্তমাখা একদলা থুতু ফেলে মাথা নাড়ল। আর ঠিক তখন দেখা গেল দুজন পুলিশ হেঁটে হেঁটে আসছে। পুলিশকে দেখামাত্রই যারা মারধোর করেছিল সাথে সাথে তারা সরে পড়ল।

রাজু আর সাগর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, মামা পুলিশ দুজনের সাথে কথা বলছেন। পুলিশ দুজন কথা শুনে মাথা নাড়ল, তারপরও একজন মুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব আয়েশ করে ধোয়া ছেড়ে লোকটাকে ধরে নিয়ে গেল। মামা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন লোকটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে যাচ্ছে–তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত মুছে উদ্বিগ্ন মুখে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলেন, দেখে মনে হল রাজু আর সাগরকে খুঁজছেন। রাজু আর সাগর তখন ছুটে গেল মামার কাছে। আজগর মামা দুই হাতে দুজনকে ধরে বললেন, “তোরা এখানে, আমি আরও ভাবলাম কোথায় গেলি!”

ঠিক তখন একজন বুড়োমতোলোক এগিয়ে এল, আজগর মামার খুব কাছাকাছি এসে নিচু গলায় বলল, “বাবা, আপনি আজকে একটা খুব বড় কাজ করেছেন।”

মামা কিছু না বলে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটা আবার বলল, “আপনি না থাকলে আজকে এই লোকটা খুন হয়ে যেত। সবার চোখে আমি খুন দেখেছিলাম–”

মামা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়লেন। লোকটা মামার হাত স্পর্শ করে বলল, “আপনার জন্যে দোয়া করি বাবা। আরও মানুষ দরকার আপনার মতো।”

মামা একটু হাসলেন, লোকটা বলল, “যাই বাবা।”

মামা মাথা নাড়লেন আর লোকটা তখন হেঁটে হেঁটে চলে গেল।

.

ট্রেনে উঠে রাজু আজগর মামাকে বলল, “মামা, তোমার অনেক সাহস তাই না?”

মামা অবাক হয়ে বললেন, “সাহস? সাহস কোথায় দেখলি?”

“এই যে এতগুলি লোক খেপেছিল, তুমি তার মাঝে গিয়ে কেমন করে লোকটাকে বাঁচালে–”

“এর মাঝে সাহসের কী দেখলি?”

“যদি লোকগুলি তোমাকে কিছু করত! কীরকম ভয়ানক লোক”

মামা একটু হেসে বললেন, “তোদের একটা কথা বলি, সবসময় মনে রাখিস। সব মানুষের মাঝে একটা ভালো জিনিস আছে–চোর ডাকাত খুনি বদমাস–সবার মাঝে। সবসময় চেষ্টা করতে হয় সেই ভালো জিনিসটা বের করে আনার। চেষ্টা করে দেখিস, মানুষের মাঝে ভালো জিনিসটা বের হয়ে আসবে। যদি চেষ্টা করিস দেখবি অসম্ভব খুনে ডাকাত বদমাইশ মানুষও হঠাৎ করে ভালো একটা-কিছু করছে।”

“কিন্তু মামা–”

কোনো কিন্তু নেই” মামা মাথা নেড়ে বললেন–”মানুষকে বিশ্বাস করবি। মানুষ কখনও খারাপ হতে পারে না।”

.

ট্রেনটা আর ঘণ্টা দুয়েক গিয়ে একটা ছোট স্টেশনে থেমে গেল। সেখানে থামবার কথা নয়, তাই লোকজন নেমে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে মুখ কালো করে ফিরে এল। সামনে একটা ছোট ব্রিজের কাছে লোকাল ট্রেনের বগি পড়ে আছে, সেটা না সরানো পর্যন্ত ট্রেন যাবে না। সবাই যখন সেটা নিয়ে কথাবার্তা বলছে মামা তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চল।”

রাজু অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”

“এখনও জানি না।”

“তা হলে?”

“চল তত বের হই আগে–হেঁটে, রিকশায়, বাসে, স্কুটারে করে চলে যাব। ট্রেন থেমে থাকলে কি জীবন থেমে থাকবে নাকি?”

ট্রেনের অন্য লোকজন অবাক হয়ে মামার দিকে তাকিয়ে রইল। মামা তার মাঝে টেনে তার ব্যাগটা নামিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। মামার পিছুপিছু রাজু আর সাগর, আর তাদের দেখাদেখি আরও বেশ কয়েকজন। সবাই মিলে যখন হাঁটছে তখন তাদের দেখে ট্রেন থেকে লোকজন গলা বের করে খোঁজ নিতে শুরু করল। মামা মাথা নেড়ে বললেন, “আমি জানি না যাওয়ার কোনো রাস্তা আছে কিনা–গিয়ে খোঁজ খবর নেব।”

রাজু ভয় পাওয়া গলায় বলল, “মামা, যদি কোনোকিছু পাওয়া না যায়?”

“না পাওয়া গেলে নাই।”

“তখন কী হবে?”

মামা চোখ নাচিয়ে হাসলেন, “তা হলে তো মজাটা হবে! রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে গান গাইতে গাইতে যাব। ধুলার মাঝে পা ডুবিয়ে হেঁটে যেতে কী মজা–কখনও হেঁটেছিল?”

রাজু মাথা নাড়ল, সে হাঁটেনি।

মামা জিব দিয়ে এরকম শব্দ করলেন, “ফাস্ট ক্লাস।”

রাজুর প্রথমে একটু সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু একটু পরে দেখল সত্যি সত্যি মামার মাঝে দুশ্চিন্তার ছিটেফোঁটা নেই। কোথায় যাবেন কী করবেন সেটা যেন ব্যাপারই না, উলটো তার মাঝে একটা ফূর্তির ভাব চলে এসেছে। ফূর্তি জিনিসটা মনে হয় সংক্রামক, একটু পরে রাজু আর সাগরের ফূর্তি লাগতে লাগল।

মাইলখানেক হেঁটেই একটা ছোট নদী এবং নদীর উপরে একটা ব্রিজ পাওয়া গেল, ব্রিজের সামনে দুটো মালগাড়ি রেললাইনের উপর কাত হয়ে পড়ে আছে। মালগাড়িকে ঘিরে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছে। তাদের দেখে মনে হল না ব্যাপারটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা আছে। মামা তাদের কাছে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলেন ক্রেন আনার জন্যে খবর পাঠানো হয়েছে, এখনও চার-পাঁচ ঘণ্টার ধাক্কা।

আজগর মামা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নদীর তীরে নেমে এলেন। সেখানে কিছু নৌকা বাঁধা ছিল, মামা গিয়ে নৌকার মাঝিদের সাথে এমনভাবে গল্পগুজব করতে শুরু করলেন যেন কতদিন থেকে তাদের সাথে পরিচয়। মাঝিদের কাছে খবর পাওয়া গেল নদী পার হয়ে অন্য তীরে গেলে ছোট রাস্তা আছে, কপাল ভালো থাকলে রিকশা পাওয়া যায়–সেই রাস্তা ধরে পাঁচ-ছয় মাইল গেলে বাস পাওয়া যাবে। শুনে মামা রাজুর দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বললেন, দেখলি, বলেছিলাম না, কিছু-একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে!

আজগর মামা নদী পার হওয়ার জন্যে একটা নৌকা ভাড়া করলেন। সেই নৌকায় বসে জুতা খুলে পা ডুবিয়ে দিলেন নদীর পানিতে। মামার দেখাদেখি রাজু আর সাগরও চেষ্টা করল, কিন্তু তাদের পা ছোট বলে পানি নাগাল পেল না, শুধু নৌকার দুলুনিতে ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দিতে লাগল। নদীটা দেখতে খুব ছোট মনে হচ্ছিল, কিন্তু পার হতে গিয়ে দেখা গেল সেটা খুব ছোট নয়। নদীর মাঝামাঝি বেশ স্রোত, পানিতে কেমন জানি কালচে সবুজ রং, তাকালে কেমন জানি ভয়-ভয় করে, মনে হয় পানির নিচে বুঝি রহস্যময় কিছু লুকিয়ে আছে।

নদী পার হয়ে মামার মনে হয় বেশ ফূর্তি হল। যখন দেখলেন ওপারে কোনো রিকশা নেই তখন ফূর্তিটা আরও বেড়ে গেল–পুরো রাস্তাটা হেঁটে হেঁটে যেতে পারবেন। মামা তখন তার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে গান ধরলেন। আজগর মামার অনেকগুণ, তিনি পারেন না এমন কোনো কাজ নেই, কিন্তু গানের ব্যাপারটিতে খোদা তাঁকে ছিটেফোঁটা কিছু দেননি। তার গলায় কোনো সুর নেই, চড়া জায়গায় এলেই তার স্বর চিরে যায় এবং হঠাৎ করে তার গলা মোটা হয়ে যায়। তবে মামার দরদের কোনো অভাব নেই–শুধু দরদের কারণেই রাজু মামার গান শুনে হেসে ফেলল না, বরং নিজেও তাঁর সাথে গাইতে শুরু করল। রাজুর দেখাদেখি সাগরও। তাদের গান শুনেই হোক আর যে-কারণেই হোক, কিছুক্ষণের মাঝেই গ্রামের রাস্তায় তাদের পিছুপিছু ছোট বাচ্চাদের একটা দল হাঁটতে শুরু করে, রাজু একা হলে লজ্জায় মাথা কাটা যেত, কিন্তু আজগর মামার কোনো জক্ষেপ নেই।

ঘণ্টাখানেক হেঁটে সাগর বলল, সে আর পারছে না–ট্রেনে করে সে আম্মার কাছে ফিরে যেতে চায়। শুনে আজগর মামা চোখ কপালে তুলে বললেন, “সে কী! এখনও তো মজার কিছু শুরুই করলাম না!”

সাগর বলল, তার আর মজা করার ইচ্ছে করছে না, পা ব্যথা করছে। তারপর চোখ-মুখ কুঁচকে ভেউভেউ করে কাঁদতে শুরু করল। আজগর মামা তখন তাকে কাঁধে তুলে নিলেন। কাঁধে উঠে সাগরের মতো একটু ভালো হল, চোখ মুছে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল।

সাগরকে ততক্ষণ ঘাড়ে করে নিতে হত কে জানে, কিন্তু ঠিক তখন টুনটুন করে একটা রিকশা হাজির হল। আজগর মামা মনে হয় একটু ব্যাজার হয়েই রিকশায় উঠলেন। গ্রামের রাস্তায় রিকশা অবিশ্যি খুব আরামের ব্যাপার নয়–হাঁটতে হয় না সত্যি, কিন্তু ঝাঁকুনিতে জীবন বের হয়ে যেতে চায়। শেষ পর্যন্ত যখন বড় রাস্তা পৌঁছাল তখন যেন জানে পানি এল সবার। রাস্তার মোড়ে একটা বটগাছ, তার নিচে একটা ছোট দোকান, এটাই হচ্ছে বাসস্টেশন। দোকানটি একই সাথে মুদির দোকান, একই সাথে পান-সিগারেটের দোকান, আবার একই সাথে চায়ের দোকান। সামনে একটা ছোট বেঞ্চ। মামা বেঞ্চে পা তুলে বসে চায়ের অর্ডার দিলেন। মামাকে দেখেই কি না কে জানে, দোকানি চায়ের কাপ গরম পানিতে থোয়া শুরু করল।

চা খেতে খেতে আজগর মামা দোকানির সাথে গল্প শুরু করলেন। তার কাছেই জানা গেল একটু পরপরেই বাস আসে, কাজেই তাদের যেতে কোনো অসুবিধে হবে না। দোকানির কথা সত্যি, কারণ চা খেতে খেতেই একটা বাস এসে হাজির। বাসের কন্ডাক্টর নিচে নেমে বাসের গায়ে থাবা দিতে দিতে তারস্বরে চাচাতে শুরু করল। মামা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা তিনজন যেতে পারব?”

কন্ডাক্টর মামার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, “কোনো অসুবিধা নাই, উঠেন।”

‘সাথে বাচ্চা ছেলে আছে, বসার জায়গা দরকার।”

“বসার জায়গা করে দেব। কোনো অসুবিধা নাই।”

“তোমার বাস তো দেখি মুড়ির টিন! সব জায়গায় থামতে থামতে যাবে, নাকি একবারে যাবে?”

“ডিরেক্ট বাস, ডিরেক্ট! আর কোথাও থামাথামি নাই–”

কন্ডাক্টর মামার সাথে কথা বলতে বলতে চোখের কোনা দিয়ে কী যেন দেখছিল, হঠাৎ দূরে কী-একটা দেখে সে খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে, মামা, রাজু আর সাগরকে প্রায় ঠেলে তুলে বাসের গায়ে দমাদম মারতে শুরু করল। সাথে সাথে বাস ছেড়ে দিল।

ভিতরে খুব ভিড়, লোকজন গাদাগাদি করে আছে। তার মাঝে কন্ডাক্টর পিছলে পিছলে ঢুকে গিয়ে একটা সীট থেকে নিরীহ দুইজন লোককে ধমকাধমকি করে তুলে দিয়ে আজগর মামাকে ডাকতে থাকে। মামা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “সে কী! ওদের তুলে দিচ্ছ কেন?”

কন্ডাক্টর অবিচল মুখে বলল, “কোনো অসুবিধা নাই। সীটের জন্য আলাদা ভাড়া। না দিলে খাড়াইয়া যাবে।”

মামা রাজু আর সাগরকে নিয়ে চাপাচাপি করে বসলেন। বাসের সীটগুলি এত কাছাকাছি যে ব্যাগগুলি পর্যন্ত রাখার জায়গা নেই। অনেক কষ্ট করে সীটের ফাঁকে সেগুলি ঢোকানো হল।

বাস ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ছুটে চলছে, তার ভিতরে কন্ডাক্টর দুই হাত ছেড়ে অন্য যাত্রীদের গায়ে হেলান দিয়ে ভাড়া নিতে থাকে। রাজু কিছুক্ষণের মাঝে আবিষ্কার করল কন্ডাক্টর মানুষটির কথাবার্তা খুব খারাপ। বিশেষ করে যেসব মানুষ একটু গরিব ধরনের তাদের সাথে এমনভাবে কথা বলে যে শুনে গা জ্বলে যায়। লোকজনকে ধমক দিয়ে গালিগালাজ করে বাসের মাঝে সে মোটামুটি একটা ভয়ংকর অবস্থা তৈরি করে ফেলল।

বাসে ওঠার সময় কন্ডাক্টর বলেছিল বাসটা আর কোথাও থামবে না, কিন্তু দেখা গেল আসলে কথাটি সত্যি নয়। পাঁচ-দশ মিনিট পরে পরে বাসটি থামতে লাগল। শুধু তা-ই না, এমনিতেই বাসে কারও বসার জায়গা নেই, তার মাঝে কন্ডাক্টর ঠেলে ঠেলে আরও মানুষ এনে ঢোকাতে লাগল। কিছুক্ষণের মাঝে মনে হল, বাস নয়, এটি বুঝি পল্টনের জনসভা। এই ভিড়ের মাঝে একজন একটা পাহাড়ি হালুয়া বিক্রি করতে লাগল, এটি নাকি স্বপ্নপ্রদত্ত ঔষুধ এবং এটি খেলে এমন কোনো অসুখ নেই যেটি ভালো হয় না। লোকজন মনে হয় আজকাল একটু বুদ্ধিমান হয়েছে, কারণ ঔষধের দাম কমাতে কমাতে প্রায় বিনি পয়সার দিয়ে দিচ্ছিল, তবু কেউ একটি শিশি পাহাড়ি হালুয়া কিনল না।

বাসের যাত্রাটা কিছুক্ষণের মাঝে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল, কারণ এই বাসটি যেসব যাত্রীকে থেমে থেমে তুলে নিচ্ছে তারা নিশ্চয়ই পিছনের বাসের যাত্রী। পিছনের বাসটি যাত্রীদের জন্যে এই বাসটি ধরে ফেলল আর তখনই দুই বাসে রেস শুরু হয়ে গেল। এত বড় বাস যে এত জোরে ছুটতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না, দেখে মনে হল এবারে একটা অ্যাকসিডেন্ট না হয়ে যায় না।

ঠিক এরকম সময় বাসের কান্ডাক্টর গরিব ধরনের একজন যাত্রীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে বসে। মনে হয় ঠিক এই জিনিসটারই দরকার ছিল, হঠাৎ করে তিড়িং করে সামনে বসে থাকা একজন লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, মানুষটা লিকলিকে শুকনো এবং কালো, চোখে চশমা এবং মুখে গোঁফ, দেখে মনে হয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মানুষটি চিৎকার করে বলল, “বাস থামা!”

কন্ডাকটর চোখ পাকিয়ে বলল, “বাস কি আপনার বাবার?”

আর যার কোথায়, লিকলিকে মানুষটি এই ভিড়ের মাঝে গেল কীভাবে কীভাবে এসে কন্ডাক্টরের শার্টের কলার চেপে বলল, “কী বললি হারমজাদা?”

কন্ডাক্টর এবার একটু ঘাবড়ে গেল, তবু ঘাড় বাঁকা করে বলল, “লাইনের বাস কি আপনার কথায় থামানো যায়?”

“থামা বলছি এক্ষুনি।”

“কেন?”

“তোমার বাস জ্বালিয়ে দেব।”

সাথে সাথে সমস্ত বাসে একটা আনন্দধ্বনি উঠল এবং বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “জ্বালিয়ে দাও। শালার বাস জ্বালিয়ে দাও।”

কয়েকজন ছুটে গেল ড্রাইভারের কাছে, চুলের মুঠি ধরে বলল, “থামা শালা বাস।” কিছু মানুষ এসে কন্ডাক্টরকে বাসের দেয়ালে ঠেলে ধরল। মনে হল দু চারটে কিলঘুষিও পড়ল, অন্যেরা বাসের ছাদে মেঝেতে লাথি মারতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে বাসের ড্রাইভার তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে বাস এনে থামায়, সাথে সাথে পাশ দিয়ে পিছনের বাসটি হুশ করে বের হয়ে গেল।

বাস থামা মাত্রই লিকলিকে মানুষটি বাস থেকে নেমে চিৎকার করে বলল, “সবাই নামেন ভাই বাস থেকে, এই বাস জ্বালিয়ে দেব।”

কিছু-কিছু প্যাসেঞ্জারের মনে একটু সন্দেহ ছিল, কিন্তু দেখা গেল লিকলিকে মানুষটি সত্যিই বাস পুড়িয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। তার আরও কিছু অ্যাসিস্টেন্ট জুটে গেছে, তারা সবাই মিলে সত্যি সত্যি বাস পোড়ানোর ব্যবস্থা করতে থাকে। একজন গিয়ে পেট্রোল ট্যাংকটা খুলে সেখানে একটা রুমাল ভিজিয়ে আনে, একটা দেয়াশলাইও বের হয়ে আসে।

রাজু ভয়ে পেয়ে বলল, “মামা, সত্যি সত্যি বাস পুড়িয়ে দেবে?”

মামা দাঁত বের করে হাসলেন, বললেন, “মনে হয়। এই লাইনে এখনও একটা দুইটা বাস পোড়ানো হয়নি, তাই কন্ডাক্টরগুলির বড় বাড় বেড়েছে।”

“কিন্তু মামা, সত্যি সত্যি বাস পুড়িয়ে দেবে? তুমি কিছু বলবে না?”

মামা চোখ মটকে বললেন, “দেখি না কী হয়। এই কন্ডাক্টর মানুষটা বড় ফাজিল, ব্যাটার খানিকটা শাস্তি হওয়া দরকার। তা ছাড়া—”

“তা ছাড়া কী মামা?”

“আমি কখনও বাস পোড়ানোনা দেখিনি। দেখি কেমন করে পোড়ায়।”

লিকলিকে মানুষটি পেট্রোল-ভেজা রুমালে আগুন ধরিয়ে বাসের মাঝে ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই কন্ডাক্টর, বাস-ড্রাইভার আর দুজন হেল্পার ছুটে এসে আগুনটা কেড়ে নিয়ে পা দিয়ে দাপিয়ে নিভিয়ে দিল। বাসের যাত্রীরা তখন বাস পোড়ানোর পক্ষে এবং বিপক্ষে এই দুই দলে ভাগ হয়ে একটা তুলকালাম শুরু কাণ্ড করে দিল। মামা পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটিতে খুব মজা পাচ্ছেন। রাজু ভয়ে পেয়ে বলল, “মামা, কিছু-একটা করো!”

সাগর তখন ঊ্যা করে কেঁদে দিল। সাগরের কান্নার জন্যেই হোক আর রাজুর কথাতেই হোক মামা তখন এগিয়ে গিয়ে তার বাজখাই গলায় একটা হাঁক দিলেন, “এই যে ভাই, সবাই আমার কথা শোনেন।”

মামার গলার আওয়াজ না শুনে কোনো উপায় নেই, সবাই মামার দিকে ঘুরে তাকাল।

মামা বললেন, “এই ব্যাটা কন্ডাক্টর ভারি ফাজিল। ব্যাটার একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।”

“দরকার!” লোকজন চিৎকার করে বলল, যারা কন্ডাক্টরের শার্টের কলার ধরে রেখেছিল তারা এই সময়ে তাকে ধরে একটা শক্ত ঝাঁকুনি দিল।

মামা গলা উঁচিয়ে বললেন, “বাসটা পোড়ালে শাস্তি তো কন্ডাক্টরের হবে না, শাস্তি হবে বাস-মালিকের। এই ব্যাটা কন্ডাক্টর তো বাস-মালিককেও ঠকিয়ে প্যাসেঞ্জার তুলছে।”

“সত্যি কথা।” লোকজন হুঙ্কার দিল।

“তা ছাড়া আমাদের সবারই তো বাড়ি যাওয়া দরকার। এই সময়ে বাস পোড়ালে আবার বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। পুলিশে ফুলিশে খবর দিলে আবার অন্য ঝামেলা। আমি বলি কি–”

লোকজন মামার মুখের দিকে তাকাল, “কী?”

“এই কন্ডাক্টরকে একটা শাস্তি দিয়ে আমরা বাসে করে বাড়ি যাই।”

“ঠিক কথা।” লিকলিকে মানুষটা বলল, “ঘুষি মেরে শালার সামনেই দুটো দাঁত ফেলে দিই–”

“না, না, তার দরকার নেই। একে বরং এখানে রেখে যাই। তা হলে আর রাস্তা থেকে লোক তুলতে পারবে না, আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাব।”

অনেক মানুষ মামার কথায় রাজি হল, উত্তেজনার প্রথম ধাক্কাটা কমে এসেছে, এখন সবাই চাইছে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান। লিকলিকে মানুষটা শুধু তখনও চিৎকার করে যাচ্ছে, “না, এত সহজে ছাড়লে হবে না। ধরে আগে শক্ত মার দিই–”

কয়েকজন মানুষ তখন লিকলিকে মানুষটাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু সে সহজে শান্ত হবার পাত্র নয়–মানুষ রোগা হলে মনে হয় তাদের রাগ খুব বেশি হয়।

শেষ পর্যন্ত লিকলিকে মানুষটাও রাজি হল, কিন্তু এক শর্তে। কন্ডাক্টরকে একটা সুপারি গাছে বেঁধে যাবে। সে কারও কথা শুনল না, একটা গামছা দিয়ে কন্ডাক্টরকে রাস্তার পাশে একটা সুপারি গাছে বেঁধে ফেলল।

বাস-ড্রাইভার এবং হেল্পার দুজন একটা কথাও বলল না, তাদের মুখ ফ্যাকাশে এবং রক্তশূন্য, বাসটি যে সত্যি সত্যি পুড়ে যায়নি এতেই তারা খুশি। মামা তখন সবাইকে বাসে উঠে বাস ছেড়ে দিতে বললেন, বাসকে ঘিরে তখন আশেপাশের অনেক মানুষ জমা হয়ে গেছে। বাসটা যখন ছেড়ে দিচ্ছিল মামা জানালা দিয়ে গলা বের করে তাদের বললেন, “ভাই, লোকটাকে খুলে দেবেন একটু পরে। মনে হয় অনেক শাস্তি হয়েছে।”

এরপর বাস আর কোথাও থামল না, টানা চার ঘণ্টা চলে যখন শহর পৌঁছাল তখন রাত দশটা। আম্মা বিস্কুটের প্যাকেট আর পানি দিয়েছিলেন বলে রক্ষা, সেটা দিয়েই রাতের খাবার সারতে হল। বাসে বসে বসে রাজু আর সাগর মামার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নামার সময় তাদেরকে ডেকে তুলে নামালেন, আধো ঘুমে তারা মামার সাথে গিয়ে স্কুটারে উঠে বসল। মামা বললেন, “ঘুমাবি না কিন্তু, বাসায় গিয়ে খেতে হবে। জেগে থাক।”

রাজু আর সাগর জেগে থাকতে চেষ্টা করল, টের পাচ্ছিল পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তায় স্কুটার ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি হঠাৎ যেন চোখে এসে ভর করেছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল–এর মাঝে কীভাবে জানি দুজনেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *