২. দেখা হয় নাই
আমরা ইঁটপাতা গলি, গলির ফ্যাঁকড়া, তস্য গলির ভিতর দিয়া অলস পদক্ষেপে হাঁটিতেছিলাম । এত সরু যে একটো গরুর যাত্রাপথ সহজ করিতে দেয়ালে পিঠ দিয়া থামিতে হইল । অপর দিক হইতে কোনও পথচারী আসিলে, পাশাপাশি দুইজন হাঁটাও বিরক্তিকর । আমি তিনজনের পিছনে । মিনিট কুড়ি অতিবাহিত হইয়া গিয়া থাকিবে ।
অগ্রগামী পথপ্রদর্শকের উদ্দেশে ক্লান্তকন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়িলাম, এ কোন এলাকায় বাসা লইয়াছে অতুল, যে টাঙ্গা বা রিকশাও প্রবেশ করে না ?
বাসা আবার কোথায় ? ছয়সাত বৎসর হইল, ফাঁকা শিবমন্দির চত্ত্বরটিতে বউবাচ্চাসহ আশ্রয় লইয়াছিল । এক্ষণে তৎসংলগ্ন ঘরগুলি ও সমগ্র পরিসর দখল করিয়া ভাড়া খাটাইতেছে । তীর্থযাত্রী ও হিপিগণকে ভাড়া দেয়, এবং শিবরাত্রীতে ও অন্যান্য পূজাপার্বণে বেশ ভালোই আয় হয় । তবে, এই গলিটিতে প্রবেশ না করিয়া আন্য প্রশস্ত পথেও আসা যায়, উহা একটু দূর হইবে, এই যা । প্রত্যুত্তর শুনিয়া কন্ঠস্বরটি প্রণব ঘোষের বলিয়া আঁচ করিলাম । পেটে চা-ডিম-পাঁউরুটি প্রবেশ করিয়া গঞ্জিকা-চরসের সাময়িক রসায়নকে বিস্হাপিত করিয়া দিয়াছে । স্মৃতি স্বস্হানে ফিরিয়াছে ।
অতুল সম্পর্কে যতই শুনিতেছি, রহস্য ততই জট পাকাইতেছে । অতুলের চিত্রশিল্পী বন্ধুরা তাহার অতীত সম্পর্কে কিছুই জানে না । নবদ্বীপে গিয়া হয়ত বউ সংগ্রহ করিয়া থাকিবে । সন্তান লইয়া চলিয়া আসিয়াছে কাশী । তুলসিকাঠের কন্ঠী গলায় উহার তো যাওয়া উচিত ছিল মথুরা-বৃন্দাবন । তৎপরিবর্তে বেনারসে আগমন করিয়া হইয়া গিয়াছে শিবের ভক্ত । কখন এক ফাঁকে দাস পদবিটি বিষ্ণুকে অর্ঘ্য দিয়া শিবের নিকট মুখার্জি পদবি বর পাইয়াছে ।
চিন্তার রেশ বিঘ্নিত হইল উল্লাস মিত্রের কটাক্ষ-মিশ্রিত মন্তব্যে, অতুল মুখোর স্ত্রী কেকা বউদি অমন শেয়ানা না হইলে সামলানো কঠিন হইত; অন্য নারী হইলে কবেই দুরছাই করিয়া পলাইত ।
নির্মল কহিল, জোড়াতালি নাই এরূপ মানবসম্পর্ক হয় না; ভাবমূর্তি ব্যাপারটিই নকল ; আমরা সবাই, অন্তরে ঝুঁকিয়া অন্বেষণ করিলে দেখিব হয় মনোগ্যামি হইতে পলিগ্যামির দিকে অগ্রসৃ হইয়াছি, অথবা পলিগ্যামিতে শুরু করিয়া শেষ আশ্রয় লইয়াছি মনোগ্যামিতে ।
সবাকার ওষ্ঠদ্বয়ে বেশ ভাল করিয়া লিউকোপ্লাস্ট সাঁটিয়া দিল নির্মল রক্ষিত ।
অতুলের আস্তানায় পৌঁছাইয়া যাহা দেখিলাম তাহা দেয়াল-ঘেরা একটি মন্দিরচত্ত্বর, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে রঙের শেষ পোঁচ পড়িয়াছিল । অযত্নে ও ঝড়বৃষ্টি-রৌদ্রের অবিরাম প্রহারে পাথুরে আকার পরিগ্রহ করিয়াছে । ইংরাজের স্নেহধন্য কোনো জমিদার কখনও পূণ্যলাভের আশায় তৈয়ারি করাইয়াছিল, যাহার ফল আজ অতুল ও তাহার পরিবার ভোগ করিতেছে ।
উল্লাস মিত্র, সম্ভবত তাহার কন্ঠস্বর বাজখাঁই বলিয়া, অতুলের নাম ধরিয়া ডাকিতে, বারো-তেরো বৎসরের এক কিশোরী, স্কুলের পোশাকে—বোধহয় স্কুল যাইবে বলিয়া প্রস্তুত হইতেছিল— ভিতর হইতে আসিয়া চৌকাঠে দাঁড়াইয়া বলিল, বাবা তো নাই, পাবলিশারের নিকট গিয়াছে ।
এই মুখটি পূর্বে দেখিয়াছি, এমনতর সন্দেহ হইল । কিন্তু অতুলের কন্যা বারো-তেরো বৎসরের কী ভাবে হইয়া গেল, নাকি মেয়েটির গড়নপেটন দ্রুত পুষ্টিলাভ করিয়াছে, ভাবিতেছি, এমন সময়ে কিশোরীটি আমাকে দেখিয়া মুচকি হাসিল ও কহিল, শিশুদা না ? আমাকে কি চিনিতে পারিয়াছ ? তোমরা ঘরের ভিতরে আসিয়া উপবেশন করো, আমি মাকে ডাকিয়া আনিতেছি ।
আমি তবু কিশোরীটিকে মনে করিতে পারিলাম না । প্রবেশের পর, খোলা উঠানের প্রথম ঘরটিতে, কয়েকটি অতিপুরাতন চেয়ার ও খাটের উপর সতরঞ্চি পাতা । আমরা অতুলের স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম ।
পাটভাঙা কস্তাপেড়ে গরদের শাড়ি পরিতে সময় লাগিয়াছে । অতুলের কন্যাটি মায়ের সহিত আসিয়া দাঁড়াইল, ঠোঁটের চিলতে হাসি উহার চক্ষুদ্বয়কে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে । তিরিশোর্ধ মহিলার মুখ এক মুহূর্তের জন্য দপ করিয়া নিভিয়া গিয়াছিল, সামলাইয়া সপ্রতিভ করিয়া তুলিলেন ।
দেখামাত্র অতুলের স্ত্রীকে চিনিতে পারিলাম । কল্যাণী বউদি , বেনারসে আসিয়া কেকা বউদিতে রূপান্তরিত । এয়েটি কুহু । বর্ধমানে অতুলদের পাড়ায় থাকিতেন প্রসন্নকান্তি মুখোপাধ্যায়, ডাকবিভাগে ডেডলেটার অফিসে নিত্যযাত্রী ; কল্যাণী তাহার স্ত্রী। অফিস হইতে ফিরিয়া প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে নিষ্ঠুর প্রহার করিতেন । মদ্যপ অবস্হায় যুক্তির অতীতে থাকিতেন বলিয়া পাড়ার লোকে এক রবিবার প্রসন্নবাবুকে তিরস্কার করিয়াছিল । কোনও ফল হয় নাই । স্ত্রী ও কন্যার কান্না বরদাস্ত করিতে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল প্রতিবেশিগণ ।
একদিন প্রতিবেশিগণ জানিয়া স্বস্তি পাইলেন যে কন্যাকে লইয়া কল্যাণী বউদি বাপের বাড়ি চলিয়া গিয়াছেন । কেহ খোঁজখবর করিলে প্রসন্নবাবু, স্ত্রীর বিদায়ের পর যিনি পোসনে মাতাল হিসাবে খ্যাত হন, বলিতেন, মাগিটাকে ডিভোর্স দিয়াছি ।
সেই তখনই অতুল নবদ্বীপে চলিয়া গিয়াছিল বলিয়া প্রচারিত । সবই, অদ্য স্পষ্ট হইল , গল্প । বয়সে যথেষ্ট বড় কল্যাণী বউদি ও তাহার কন্যাকে লইয়া কাশী পলায়ন করিয়া ক্ষান্ত হয় নাই অতুল। প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের পদবিটিও লুঠদখল করিয়াছে । বেচারা পোসনে মাতাল তিন বৎসর পর দ্বিতল বাড়ি সস্তায় বিক্রয় করিয়া কলিকাতা অভিমুখী হইয়াছিলেন ।
বাড়ির ভিতর হইতে শিশুর ক্রন্দনের শব্দ আসিতে থাকায় প্রণব জিজ্ঞাসা করিল, কী বউদি, আবার মা হইলেন, নাকি নূতন ভাড়াটিয়া ?
পূনর্বার দপ করিয়া নিভিয়া সামলাইল সুশ্রী তন্বী মহিলা । বলিল, ওটি আমার সতীনের পুত্র । অনামুখো সতীন উহাকে ফেলিয়া রাখিয়া পলাইয়াছে ।
নির্মল উল্লাস উপেন সুভাষ ও প্রণব একযোগে চিৎকার করিয়া উঠিল, কে? জোসেফিন ?
কল্যাণী বউদি, নাঃ, কেকা বউদিই লিখি, স্মিতহাস্যে কহিল, হ্যাঁ, অতুল দিল্লি এমব্যাসি আর এয়ারপোর্টে গিয়া সংবাদ আনিয়াছে, সে বেটি নিজের দেশে পলাইয়াছে ।
ছুঁচের আর কোকেনের নেশাখোর ধনী সতীনের চেয়ে সতীনপো মানুষ করা ভাল, প্রায় উপদেশাত্মক কন্ঠে নির্মল রক্ষিত মতামত জানাইতে, উল্লাস কহিল, মার্কিন কোটিপতির মেয়ে অতুলের হাত হইতে ফসকাইয়া গিয়াছে বটে, পুত্রটিকে সযত্নে প্রতিপালন করুন, ভবিষ্যতে বৈভবপ্রাপ্তি হইতে পারে ।
কুহুর একটি ফুটফুটে ভাই হইল, আমি তাহাতেই আনন্দিত । কেকা বউদি ছদ্ম গর্বের সহিত কহিল ।
আমার মুখমন্ডলে সংশয়, সন্দেহ, হয়ত বা আতঙ্ক খেলা করিতেছিল । বেনারস না আসিলেই ভাল হইত । কেকা বউদি আমার মনঃস্হিতি অনুধাবন করিয়া বলিল, চলো শিশু, তোমাকে শিবমন্দিরটী দেখাই, জাগ্রত দেবতা ।
গৃহের অভ্যন্তরটি দেখার আগ্রহ ছিল । কেকা বউদিকে অনুসরণ করিলাম। প্রশস্ত খোলা উঠানের দুই দিকে ছয়টি করিয়া ঘর । কয়েকটিতে দেশি-বিদেশি অতিথি আছে । তাহাদের জামাকাপড় তারে শুকাইতেছে ।
উঠানের কেন্দ্রস্হলে নির্মিত ছোট মন্দিরের শিবলিঙ্গটি এমনই অতিকায় যে প্রবেশমাত্র দেখা যায় । উঠান পার হইয়া গৃহের অন্দরমহলে প্রবেশমাত্র কেকা বউদি অকস্মাৎ আমার দুই হাত ধরিয়া অনুনয়ে কাতর হইয়া কহিল, প্লিজ প্লিজ প্লিজ শিশু, আমাদের অতীতের কথা কাহাকেও বলিও না ; আমি ঈশ্বরের নামে বলিতেছি কুহু অতুলেরই কন্যা । প্রসন্ন ছিল পুরুষত্বহীন, এবং জানিত কুহু তাহার সন্তান নহে, সে তো সন্তানোৎপাদনের অনুপযুক্ত ছিল, তাই আমাদের উভয়কে বেদম প্রহার করিত । কাহাকেও কিছু বলিও না , আমার ভরা সংসার ভাসিয়া যাইবে । মহিলার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার মুখমন্ডলে । মুখের এত নিকটে মুখ আনিয়া কথাগুলি বলিল কেকা বউদি, যে তাহার তপ্ত মুখগহ্বর হইতে ধুম্রপানের গন্ধ পাইলাম । গোলাপি আলজিভটুকু দেখিয়া অনভিপ্রেত অনুভূতি ঘটিল ।
আমি বলিয়া ফেলিলাম, এত সাহসী পদক্ষেপ লইয়াছেন, এর পর কলঙ্কের পরিমন্ডল গড়িয়া তন্মধ্যে সন্ত্রস্ত থাকিবার আর কোনও কারণ দেখি না ; স্বসৃষ্ট ভয় হইতে বাহির হইয়া আসুন । আমি আপনাদের কথা যে গোপন রাখিব সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন । বলিয়া, ধুম্রপায়ী ভক্তিমতীর নাকের পাটা, কানের লতি, ছোট্ট কপাল ,কোঁকড়ানো চুলের খোঁপা ও পাতলা ওষ্ঠাধর দেখতে দেখিতে বুঝিতে চাহিলাম ।
প্রচুর সিঁদুর, বড়সড় টিপ, শাঁখা-পলা, সোনার ভারি কন্ঠহারে আভূষিতা কেকা বউদি কিয়ৎ আশ্বস্ত হইয়া আমার হাত ছাড়িয়া দিলে, আমি তাহার মেঘলা মুখের দিকে তাকাইয়া জানিতে চাহিলাম, তাঁহার বাবা এখন কোথায় ? শুনিয়াছিলাম তিনি একমাত্র সন্তান ।
মা তো আমার সঙ্গেই এই মন্দির-বাড়িতে আছেন । বাবার মৃত্যু আমার বর্ধমানে থাকাকালীনই ঘটিয়াছিল । প্রসন্ন যাইতে দেয় নাই । বেনারসে আসার দেড় বৎসর পর একরাত্রে আমি ও অতুল চাকুলিয়া গিয়া মায়ের সহিত গোপনে দেখা করিয়া লইয়া আসিয়াছিলাম । মা অমত করন নাই । প্রসন্নের সহিত বিবাহ দিয়া তাঁহারা যে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করিয়া ফেলিয়াছিলেন তাহা মা স্বীকার করিয়া লইয়াছেন । বাবাও এই সম্পর্কে মানিয়া লইতেন বলিয়া অনুমান করি ।
তবে ? ইহার পরও অজানা আতঙ্কে বাস করার কারণ দেখি না । বলিলাম ।
আতঙ্ক বলো বা যাহাই বলো, তাহা অজানা নহে । অতুলের নিকট আমার আকর্ষণ ক্ষমতা বিলুপ্ত, অথচ অতলের যৌবনের চাহিদা এখনও তৃপ্ত হয় নাই ; একই নারীকে লইয়া সে প্রতিদিন কাটাইতে পারে না । কী কুক্ষণে বেনারস আসিয়াছিলাম, ঠিক এক্ষণেই, যখন সবকিছু গুছাইয়া তুলিয়াছি, ঝাঁক বাঁধিয়া স্বেচ্ছাচারিণীগণ বিদেশ হইতে নামিয়া আসিতেছে ; ইহারা স্বদেশ হইতে নির্ণয় লইয়া আসিয়াছে যে জীবনকে যথেচ্ছ উপভোগ করিবে, যাহার সহিত ইচ্ছা শুইবে, প্রতিটি মাদক সেবন করিবে, এক স্হানে মন ভরিয়া গেলে আরেক দেশে চলিয়া যাইবে ; আসে একজনের সহিত, শোয় পাঁচ-সাতজনের সহিত, চলিয়া যায় আরেকজনের সহিত । মথুরা বা বৃন্দাবনে গিয়া সংসার পাতিলে হয়ত সংসার এরূপ খাঁড়ার ধারের উপর অষ্টপ্রহর থাকিত না । আমার সব আছে, কেবল মানসিক শান্তি নাই । প্রসন্নের দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ লইয়াছিলাম । অতুলকে কী করিয়া বাগে আনিব জানি না । ধুম্রপায়ীর পাতলা, বোধহয় হালকা লিপ্সটিক বুলাইয়া লহিয়াছে, ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া কথাগুলি বাহিরিল ।
আমি দ্রুত কেকা বউদির আপাদমস্তক এক ঝলক দেখিলাম, নির্লজ্জের ন্যায়ই চোখ বুলাইলাম । চোখ ধাঁধানো ত্বক, পিচ্ছিল চটক আদল-আদরা, ধুন্ধুমার গা-গতর, উদ্দীপনাময় ভরপুর স্তন, যাহা প্রহারে জর্জরিত করিয়া প্রসন্নকান্তি নিজের অক্ষম ক্ষোভ উগরাইয়া দিত, যাহাতে স্ত্রীর দেহের মর্যাদায় ধুলা না জমিয়া যায়, কী করিয়া সেই দেহটিকে অনাদর করিতেছে অতুল, তা অতুলই বলিতে পারে । জড়াইয়া ধরিয়া ঠোঁটে ঠোঁট চাপিয়া আপাত-আবিল দুঃখের মোড়ক ছিঁড়িয়া বাহিরে টানিয়া আনার তীব্র ইচ্ছা সংবরণ করিয়া বলিলাম, অতুল যেমন আছে থাকুক, এই দেবোত্তর সম্পত্তি হইতে যথেষ্ট আয় হয় বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে । কথা, ছোঁয়া, চাহনি, দেহ দিয়া নির্বাচিত একজনের সহিত সম্পর্কের দানা বাঁধিতে হইবে, এমন বাধ্যবাধকতা আছে নাকি ? আর্থিক সচ্ছলতা দিয়াও সম্পর্ক আত্মিক হইতে পারে ।
হ্যাঁ, অতুলকে ওই ব্যাধি ধরিয়াছে , দ্রুত ধনী হইবার ব্যাধি । কথা কয়টি এমনভাবে উপস্হাপন করিল কেকা বউদি, যেন বর্ষাকালের নদীর গা-ছাড়া ভাব । আনচান হইলাম । কথাটিতে বোধহয় সত্যের সহিত বেশ কিছুটা মিথ্যার মিশ্রণ প্রয়োগ করিল মহিলাটি ।
ব্যাধি শব্দটি শুনিয়া পরিচিতির অদ্ভুত বাককৌশল আমায় চমকিত করিল । মনে হইল ব্যাধি থাকা ভাল; তাহা একাকীত্বের আরাম প্রদান করে । জিজ্ঞাসা করিলাম, কীভাবে দ্রুত বড়লোক হইবে ? ব্যবসায় করিতেছে নাকি ?
স্তম্ভিত করিয়া দিয়া কেকা বউদি কহিলেন, হ্যাঁ, গাঁজা-চরস-আফিমের ; নেপাল হইতে চোরাপথে ওই মাদকদ্রব্যগুলি সস্তায় কিনিয়া লইয়া আসে এক বিহারি দালাল, অতুল তাহা ডলারের অত্যুচ্চ দামে হিপি-হিপিনিগণকে বিক্রয় করে । ডলারের ভাল কালোবাজার রহিয়াছে বেনারসে । সন্দেহ হইল, আমি অতুলের বন্ধু বলিয়া কেকা আমায় অতুলের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করিতেছে । কার্যকারণ ঠাহর করিতে পারিলাম না ।
নিজের জটিল জীবনে কিয়দংশ আমাতে সম্প্রচারিত করিতে সফল হইল কেকা বউদি । বরফের ঘাম ছাঁৎ করিয়া আমার অস্তিত্ব জুড়িয়া কুলকুলিয়া বহিয়া উঠিল । বলিলাম, চলুন, সবাই অপেক্ষা করিতেছে ।
ফুলকাটা পিতলের থালায় রক্ষিত কাজল ছাই ও চন্দন লইয়া আমার কপালে একটি টিপ আঁকিয়া কেকা বউদি কহিলেন, হ্যাঁ, চলো, কপালে দেখনসত্য লিখিয়া দিলাম, কেননা নির্মল রক্ষিত নামক যুবকটির দৃষ্টি ও বুদ্ধি অতীব তীক্ষ্ণ । কালক্রমে চিত্রশিল্পীরূপে খ্যাত হইবে, এখনই উহার আঁকা তৈলচিত্র প্রচুর দামে বিক্রয় হয় । আমাদের বাসায় মিনিট পনেরোর জন্য প্রথমবার আসিয়াছিল । ওইটুকু দেখিয়া আমার হুবহু পোরট্রেট আঁকিয়া পাঠাইয়াছিল; কেবল শাড়ির পরিবর্তে আমাকে কমলা রঙের শেমিজ পরাইয়াছিল এবং খোঁপার পরিবর্তে কাঁধের দুই পাশে সন্মুখদিকে চুল নামাইয়া দিয়াছিল । ভালো লাগিয়াছিল দেখিয়া যে শাড়ি খুলিয়া শেমিজ তো পরাইয়াছে, নিজ হাতে খোঁপাও হয়ত খুলিয়া দিয়া থাকিবে শিল্পীর কল্পনায় !
বৈঠকঘরের দিকে উঠানের ভিতর দিয়া যাইতে-যাইতে বলিলাম, তাই বুঝি ? কোথায় টাঙাইয়াছেন ?
অতুল উহাও বেচিয়া দিয়াছে । নির্মলকে বলি নাই, ক্ষেপিয়া রণক্ষেত্র সৃষ্টি করিবে । নির্মল অন্তত অতুলকে চিত্রশিল্পীর ভেক পরাইয়াছে । প্রচ্ছদ অঙ্কন হইল অতুলের জীবিকার সাইনবোর্ড ।
ভেক ? ও ! অতুল আপনার ছবিটিতে নিজ নাম স্বাক্ষর করিয়া বেচিয়া দিয়াছে ? ডলারের বিনিময়ে ! চমৎকার । আফশোষ রহিল যে নির্মল রক্ষিতের চক্ষের ভিতরে আপনার উপস্হিতি দেখিবার সুযোগ পাইলাম না ।
বৈঠকঘরে ফিরিয়া দেখিলাম যে কুহুর সহিত নির্মল, উপেন, সুভাষ, উল্লাস ও প্রণাব কথার খেলায় মশগুল । উল্লাস মিত্রকে উল্লু চাচা ও নির্মল রক্ষিতকে নিমকি চাচা বলিয়া খেপাইবার প্রয়াস পাইতেছে কুহু । বাবা ও মা তাহাকে স্ব-স্ব জটিল অন্তদ্বন্দ্ব হইতে দূরে রাখিতে সফল হইয়াছেন দেখিয়া অনুমান করিলাম অতুল ও কেকার ভিতর একটি শীতযুদ্ধ চলিতেছে ।
কেকা বউদির সপ্রতিভ ও থমথমে, এবং আমার চাপা বিচলিত মুখমন্ডল দেখিয়া আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে জায়মান চিন্তাপ্রক্রিয়াকে পড়িবার, এবং কোনও নির্ণয়ে পোঁছাইবার চেষ্টা করিল নির্মল রক্ষিত ।
প্রণব ঘোষ জিজ্ঞাসা করিল, জোসেফিন স্পার্কসের বাচ্চাটার কী নাম রাখিলেন বউদি ? দাড়ি গোঁফ কুঁকড়া চুলে ঢাকা প্রণবের কন্ঢস্বর মহিষাসুরি আদেশের মত শোনাইল । বর্ধমান শহরে একবার একটি যাত্রাদলে মহিষাসুরের অভিনয় দেখিয়াছিলাম ; স্বাস্হ্যের কারণে জনৈক অবাঙালি পালোয়ান মহিষাসুরের অভিনয় করিয়াছিল ।
কুহু লাফাইতে-লাফাইতে বলিল, উহার নাম কং ; জোসেফিন মাম্মি উহাকে কং বলিয়া ডাকিত ।
কং আবার কেমনতর নাম, এই প্রশ্ন কেহ তুলিবার পূর্বে কেকা বউদি কহিল, ভিয়েতকং হইতে কং নামকরণ । তবে আমি উহার নাম রাখিব গোরা, রবি ঠাকুরের গোরা । তারপর আমার দিকে ফিরিয়া, শিশু তুমি বাড়ি গিয়া ডাকযোগে আমাকে এককপি রবি ঠাকুরের উপন্যাসটি পাঠাইও । গোরা সাবালক হইলে বইটি পড়িয়া নিজের জন্মরহস্যের সূত্র পাইবে ।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, গোরা মুখোপাধ্যায় ?
কেকা বউদি উত্তর দিল, হ্যাঁ, গোরাদাস মুখার্জি , অতুলদাস মুখার্জির সহিত সাযুজ্য রাখিয়া ; আমি জীবিত থাকিলে অনুরূপ মিল দিয়া উহাদের পুত্রদের নাম রাখিব কৃষ্ণদাস, শ্যামদাস, কালিদাস, এইরকম ।
আমি প্রস্তাবে সমর্টন জানাইলাম, সেই ভাল, পুরাতনের সহিত নূতন মিলিয়া-মিশিয়া থাকুক ।
খাটের উপর রাখা কাঁসার ফুলকাটা থালায় পেস্তা, কিসমিস, আখরোট, কাগজি বাদাম ও প্যাঁড়াগুলি দেখিয়া, যাহা সম্ভবত ভক্তগণ অর্ঘ্য দিয়া থাকিবে, এবং কুহু আনিয়া রাখিয়াছে, কেকা বউদি বলিল, ওমা, তোমরা কেহ পূজার প্রসাদ গ্রহণ করো নাই ? শিশু, তুমি তো প্রথমবার আসিয়াছ, মিষ্টিমুখ করিয়া যাও ।
আমি একটি প্যাঁড়া তুলিয়া লইয়া, আচ্ছা চলি বউদি, অতুলকে জানাইবেন, বলিয়া উঠিয়া পড়িলাম । আমার দেখাদেখি অন্যেরাও । অতুল হঠাৎ আসিয়া পড়িলে আরও না জানো কোন কোন সাপ-খোপ বাহির হইবে , এবং সেসব সাপের স্মৃতি তাড়া করিয়া বেনারসে আগমনে উদ্দেশ্য মাটি করিয়া দিবে । এখনই কেমন যেন সন্দেহ হইতেছে যে বোকার মতো একখানি পোস্টকার্ডের ডাকে দিকবিদিক জ্ঞানহীন হইয়া চলিয়া আসিয়াছি ।
পথে নামিয়া, যে-গলি দিয়া আসিয়াছিলাম, তাহার পরিবর্তে ডান দিকের গলিতে বাঁক নিয়া মিনিট খানেকেই দশাশ্বমেধ ঘাটে যাইবার পথে আসিয়া পোঁছাইলাম । স্নানার্থীগণের প্রত্যাবর্তনের পথ বলিয়াই, অতুলের শিবমন্দিরের অর্থকরী রমরমা । সন্ধ্যায় হয়ত ঘরপালানো সাহেবমেম ও গৃহবিতাড়িত বাঙালি বিধবাগণের ভজনকীর্তন হয় ।
ঘাটের সন্নিকটে আসিয়া ফুটপাতে ছায়ায় বসিলাম । সবাই চুপচাপ । প্রত্যেকে হয়ত কেকা বউদি ও অতুলের সম্পর্কের একটি অন্ধের হস্তিদর্শনের ন্যায় ছবি গড়িয়া চিন্তা করিতেছে । অথবা শিল্পীগণের বিপথগামী চিন্তাহীনতায় মগ্ন ।
তিনজোড়া যুবক-যুবতী, হয়ত আমেরিকার, হয়ত ইউরোপের, হাত ধরাধরি করিয়া অলস পদক্ষেপে হাঁটিবার সময়ে, চিত্রশিল্পীগণকে দেখিতে পাইয়া, হাই-হ্যালো করিয়া চলিয়া গেল । উহাদিগের মাঝে কালোচুল তরুণীটি দৌড়াইয়া আসিয়া নির্মলের গালে একটি স্পর্শচুম্বন দিয়া ফিরিয়া গেল । ইহারও চিত্র আঁকিয়া থাকিবে নির্মল, নিউড আঁকিয়া থাকিলে মেয়েটির সর্বস্ব দেখিবার সুবর্ণসুযোগ পাইয়াছে । গেরুয়া লুঙ্গি পরিহিত, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, মাথায় ছোট-ছোট কাঁচাপাকা চুল, আমাদের নমস্কার করিয়া স্নানার্থে জলে গিয়া নামিলে, নির্মল কহিল, ইনি হিন্দি ভাষার বিখ্যাত কবি নাগার্জুন, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন । আবার সবাই চুপচাপ ।
কিয়ৎক্ষণ পর আমার দিকে তাকাইয়া নির্মল রক্ষিত শুধাইল, অতুল যর চিঠিখানি আপনাকে লিখিয়াছিল, তাহা কি আপনার নিকটে আছে ? যদি থাকে তাহা ্ইলে আমি কি উহা পড়িতে পারি ?
আমার শঅর্টের বুকপকেটেই ছিল পোস্টকার্ডটি, যাহা আমি উল্লাসকে দিলাম, উল্লাস প্রণবেকে, প্রণব নির্মলকে । উহারা দুইজনে আমার ও নির্মলের মাঝে বসিয়াছিল । তিনজনে চিঠিটি পড়িয়া, হাসাহাসির পরিবর্তে, মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিয়া গম্ভীর হইয়া গেল । চিঠিতে অতুলের বার্তাটি এইরূপ:
শিশির অফুরন্ত, ………………………………………………………………………………………………………..হ্যাশ ও হুস্ন ; মেরি এবং মেরিহুইনা ; পাতা আর পতন ; বিদেশিনী ও ছিনিমিনি । দুই মাসের মাইনে নিয়ে একমাসের জন্য চলে এসো । তাড়াতাড়ি । ………………………………………………………………………………………………………….. অতুল মূর্খ
চিঠিটি আমার হাতে ফিরত আসিয়া পুনরায় বুকপকেটে বিরাজ করিল, ও শুনিতে লাগিল আমার উদ্বিগ্ন হৃৎস্পন্দন । উহারা কে্হই স্তব্ধতা ভাঙিল না । চিত্রশিল্পী । হয়ত নদীবক্ষে নৌকা, ঘাটের চ্যাঁচারির ছাতার তলায় পুরোহিত কর্তৃক সংস্কাররত যজমান, পূণ্যকামী স্নানার্থী, বাতাসে উড়ন্তচুল বধু, গঙ্গার ওপারে আবছা-সবুজ পরিদৃশ্য পাঁচজনকে চিন্তামগ্ন ও আত্মহারা করিয়া তুলিয়াছে ।
আমার মাথায় এক ভিন্ন ভাবনা । কোন দেশের কে এক আইন ব্যবসায়ী ও উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক জোম্যাককার্থি, তদ্দেশে সাম্যবাদ-বিরোধীতাকে এমন পর্যায়ে লইয়া গেল যে আতঙ্কিত রাষ্ট্র তাহার নিজেরই স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কর্মী, সেনা বিভাগ, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের ভুতগ্রস্ত কালো তালিকা প্রস্তুত করিয়া হেনস্হা অপমান-যন্ত্রণার চূড়ান্ত করিয়া তুলিল, একঘরে ও কোণঠাসা করিয়া শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করিল । তাহাকে লাথি মারিয়া বিদায় করিবার পর কী হইল ? সীমালঙ্ঘনের বিস্ফোরণ, যাহার কয়েকটি ঢেউ অদ্য আছড়াইয়া পড়িয়াছে কাশীতে । যাঁহারা বার্ধক্য বারানসী শব্দবন্ধটির নিদান দিয়াছিলেন, তাঁহারা এক্ষণে এই শহরে আসিয়া চমকিত হইবেন । হিপি-হিপিনিগণ পধিমধ্যে পরস্পরকে টুকটাক চুমা খাইতেছে, স্হানীয় মানুষের ভ্রুক্ষেপ নাই ।
টেংরাগেঁটে আকৃতির যুবক, প্রণবের এই মন্তব্যে, শিশির আপনার ভাগ্য ভাল ; খুব জোর বাঁচিয়া গিয়াছেন, শুনিয়া চিন্তায় ছেদ পড়িল । প্রশ্নাতুর হইলাম ।
নির্মল, আমার দিকে না তাকাইয়া, নদীর সৌন্দর্য দেখিতে-দেখিতে বলিল, জোসেফিন স্পার্কস নামে যে যুবতীটির কথা শুনিলেন, তাহার পিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া রাজ্যের ধনী গোমাংস ব্যবসায়ী । রাজ্যটিতে, এবং আমার সন্দেহ স্পার্কস পরিবারে, কু ক্লাকস ক্যানের ঘোর প্রভাব ছিল , যাহার সদস্যগণ ইহুদি, ক্যাথলিক ও কৃষ্ণকায়দের , খোলাখুলি ঘৃণা করার সংস্কৃতি লালন করে । জোসেফিন নিউ ইয়র্কে স্নাতক স্তরে পড়িতে গিয়া জনৈক ক্যাথলিক মেক্সিকান যুবকের প্রেমে পড়ে ও তাহাকে নিজের গৃহে লইয়া যায় । একে ক্যাথলিক তাহার উপর বিশুদ্ধ শ্বেতাঙ্গ না হওয়ায়, যুবকটি পরিজন প্রতিবেশিদের দ্বারা দ্বারা নির্মমভাবে প্রহৃত হয় । জোসেফিনকে স্বগৃহে বন্দি করিয়া রাখা হইয়াছিল ; তৎপশ্চাৎ উহাকে ব্রিটেনে অক্সফোর্ডে ভর্তি করা হইয়াছিল । পড়াশুনা জলাঞ্জলি দিয়া মেয়েটি ইসতানবুল কায়রো হইয়া বেনারসে আসিয়া যথেচ্ছাচার ও নিষেধভঙ্গের আস্তানা গাড়িয়াছিল ।
তুই কী করিয়া জানিলি, আমাকে তো বলিস নাই ? উল্লাস মিত্রের কথায় ব্যাঘাত ঘটিল কাহিনীতে, যাহার প্লটের ভিতর আমি কী ভূমিকা পালন করিতেছি, বোধগম্য নহে ।
নির্মলের জবাবদিহি, এতক্ষণ চিন্তা করিতেছিলাম, বলিব কি বলিব না । প্রণবের কথা শুনিয়া সাহস হইল । প্রণবকে আমি এতাবৎ এবিষয়ে কিছুই বলি নাই ।
প্রণব কহিল, আমাকে হিন্দি দৈনিক আজ পত্রিকার সাংবাদিক ও কার্টুনিস্ট বিক্রম পরিহার বলিয়াছে ।
নির্মল কাহিনী বজায় রাখিল, যাহা শিনিবার জন্য আমি যুগপৎ উৎকন্ঠিত ও উদগ্রীব ছিলাম ।
জোসেফিনের পিতামাতা প্রথমে কোতোয়ালিতে সন্ধান করিয়াছিলেন । কোতোয়ালি কর্তৃপক্ষ উহাদের আজ পত্রিকার বিক্রমের সহিত দেখা করিতে বলে । বিক্রম হিপিগণের উপর নজর রাখে ও ভারতবিরোধী কার্য করিতে দেখিলে বা আড়িপাতিয়া শুনিলে, সেসব তথ্যাবলী কোতোয়ালিতে জানায় । বিক্রম হইল পুলিশের চর ।
তাহার পর কী হইল ? উ্ল্লাসের প্রশ্ন শুনিয়া মনে হইল সে গল্পের রসে আমার চেয়েও বেশি জারিত ; সে তো শ্রোতামাত্র, যখন কিনা আমি গল্পের গোপন একটি পাত্র বলিয়া অনুমান ।
নির্মল বলিল, জোসেফিনের পিতামাতাকে আমার বাসায় লইয়া আসে বিক্রম, কেননা অতুল ও কেকা বউদির জাল হইতে জোসেফিনকে মুক্ত করার উপায় বিক্রম খুঁজিয়া পায় নাই । উল্লাস প্রশ্ন তুলিল, মুক্ত ? কী বলিতেছিস ? অতুলের সহিত তো স্বেচ্ছায় জোসেফিন বৎসরাধিক লিভ টুগেদার করিতেছে । কেকা বউদির সন্মতিক্রমে করিতেছে !
কন্ঠে শ্লেষ মিশাইয়া প্রণবের উত্তর, বাধ্যবাধকতা অধবা প্যাঁচ-পয়জার না থাকিলে কোনও স্ত্রী কি প্রতি রাত্রে তাহার নিজের ও সাড্ডল্য কন্যার চক্ষের সন্মুখে নিজের স্বামীর আরেক নারীর সহিত শয়ন সহ্য করিতে পারে ? সহ্য করিতে পারে কি যখন কয়েকমাস পর জানিতে পারিল জোসেফিন সন্তান-সম্ভবা, এবং কোনো শর্তে গর্ভপাত ঘটাইবে না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছে ? কেকা বউদির দেহের ছাঁদ ও কুখশ্রীর ধারেকাছে যাইবে না প্রায় হাড্ডিসার লম্বামুখ জোসেফিন স্পার্কস । হিপিগণের আগমনের পর হইতে অতুল শ্বেতাঙ্গ স্তন ও যোনির আসক্ত হইয়া পড়িয়াছিল ; তাহার নিকট একখানি শ্বেতাঙ্গিনী দেহ প্রতিরাত্রে পাইলেই হইল ।
আমি ভাবিতেছিলাম প্রতিবাদকে একজন বিদ্রোহী নারী কোথায় তুঙ্গে লইয়া যাইতে পারে । খ্রিস্টধর্মবিরোধী পৌত্তলিক প্যাগান ও কৃষ্ণকায় হিদেনের বিবাহ-বহির্ভূত সন্তান গর্ভে ধারণ, তাহাও মন্দির চত্ত্বরে ! এবং তাহার নাম কং ।
নির্মল কহিল, অতুলকে কেকা বউদি বাঁধিয়া রাখিয়াছিল জোসেফিনের উপস্হিত দ্বারা । জোসেফিনকে অতুল বাঁধিয়া রাখিয়াছিল উহার বিখ্যাত ফ্যাগ দ্বারা । কং-এর আগমনবার্তা সব ভণ্ডুল করিয়া দিল ।
ফ্যাগ কী ? আমি জানিতে চাহিলাম ।
নদীর দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখিয়া নির্মল উত্তর করিল, চারমিনার সিগারেটের ভিতর আফিম চরস ও গাঁজাপাতার মিশ্রণ , যাহার মৌতাতের নেশা হইতে জোসেফিনকে মুক্ত হইতে দেয় নাই অতুল । অষ্টপ্রহর উহাকে নেশায় আচ্ছন্ন রাখিত । ফ্যাগ বস্তুটির ফরমুলা প্রস্তুতকারক হইলেন স্বয়ং কেকা বউদি । জোসেফিনও অতুলের বিছানা ও নেশাজগত হইতে মুক্তি চায় নাই বলিয়া প্রতীয়মান হয় । পিতামাতা ও সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাহাকে আত্মধ্বংসে প্ররোচিত করিয়া থাকিবে । উহার পোশাকে লিখিত থাকিত, ফাক দি ইনভেডার্স অব ভিয়েৎনাম বা লং লিভ ভিয়েৎকং ।
সে যাহা হউক, জোসেফিনের মাতাপিতা কী করিয়া বাচ্চাটিকে ফেলিয়া জোসেফিনকে লইয়া গেলেন ? জানিতে চাহিল উল্লাস ।
নির্মল বলিল, বিক্রমকয়েকদিনের মধ্যেই সংবাদ আনিল যে চোরাকারবারি সুখেশ্বর পাসোয়ানের সহিত অতুল গোরক্ষপুর গিয়াছি, চারপাঁচ দিন পর মালের কনসাইনমেন্ট লইয়া ফিরিবে । জানিতে পারিয়া জোসেফিনের মাতাপিতাকে তাঁহাদের হোটেল হইতে লইয়া গেলাম কেকা বউদির নিকট। দশ হাজার ডলার ক্যাশ লইয়া কংকে পোষ্য করিয়া নিজের পরিবারে রাখিতে রাজি হইলেন কেকা বউদি । নেশায় চুর করানো জোসেফিনকে কেকা বউদি ও কুহু ধরাধরি করিয়া গলির বাহিরে আনিল । পিতামাতা টাঙ্গা লইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন, দশাশ্বমেধের পূর্ববর্তী গোলচক্রে । তাঁহারা সম্ভবত সেইদিনই কলকাতা পাড়ি দিলেন । ঢাকা, কোলোম্বো না ব্যাংকক, তাহা আমাকেও জানান নাই ।
আমি বলিলাম , ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরিল, কিন্তু আমি কী করিয়া খুব বাঁচিয়াছি, তাহা বুঝিলাম না ।
দ-শ-হা-জা-র-ড-লা-র ! উল্লাসের উচ্চারিত স্বগতোক্তিতে পথচারীগণ ফিরিয়া তাকাইলেও নির্মল এবং প্রণব প্রতিক্রিয়া অব্যক্ত রাখিল । বিপুল টাকা, সন্দেহ নাই । বারাণসীতে একটি বাগানবাড়ি অথবা মধ্য কলকাতায় তিনতলা সুদৃশ্য অট্টালিকা হইয়া যাইবে ।
নির্মলের কথার মুগুরে আমার মস্তিষ্কের চাক হইতে মৌমাছি বোলতা ভিমরুলের ঝাঁক অজানা ভয়ে আমাকে নিমেষে ঘর্মাক্ত করিল । ওই বিদেশিনী শাঁকচুন্নিকে আপনার ঘাড়ে চাপাইবার ষড়যন্ত্র পাকা করিয়া ফেলিয়াছিল আপনার বন্ধু ও তদীয় পত্নী ; উহারা জানে আপনি যেকোনো শ্বেতাঙ্গিনীর সহিত শয়ন করিবার জন্য লালায়িত ।
হ্যাঁ, আমি শুশ্ককন্ঠে প্রত্যুত্তর করিলা, অদ্যাবধি শ্বেতাঙ্গিনী দেহ আলিঙ্গনে পাই নাই ; সম্ভবত জোসেফিনকে পাইলে, আপনাদের বক্তব্য অনুযায়ী সুশ্রী ও মাংসল না হইলেও, যতদিন কাশীতে আছি, আহারে-বিহারে-শয়নে-স্বপনে গ্রহণ করিতাম । তবে, শিশু-সন্তানের ফ্যাঁকড়া ও দুগ্ধবতী স্তনসহ যুবতীকে লইতাম কিনা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না । মহিলাটিকে দেখিলে নির্ণয় লইতে পারিতাম । তেমন-তেমন দেখিলে স্বগৃহে লইয়া গিয়া বিবাহ করিতেও পারিতাম । কথাগুলি বলিতেছিলাম ও স্মৃতিতে ঝিলিক দিয়া উঠিতেছিল কাঁধ হইতে হাঁটু পর্যন্ত পীতাভ-গোলাপী দীপ্তিময় নারীদেহ । দীর্ঘশ্বাস সে কথার আনাচে-কানাচে, তাহা যথাসম্ভব চাপিয়া বলিলাম, মনে হইতেছে কল্যই ফিরিতে হইবে ।
নির্মলব্যাটা ধরেছে ঙিক । কংকে পয়দা করার জন্যে জোসেফিন যেই গোঁ ধরল, তখন অতুলের অবস্হা খাঁচার ইঁদুরের মতন । বেশ এনজয় করেছি অতলের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দুরবস্হা । শিশির দত্তকে চিঠিটা আমিই লিখেছিলুম, আমার নিজের হাতের লেখায় । তা ধরতে পারেনি নির্মল, হাতের লেখাই দ্যাখেনি কখনও ; অতুলের ইংরেজিতে সই দেখে থাকবে ওর তথাকথিত পেইনটিংগুলোয় ।
অতুল যেই বলল যে ওর বন্ধু শিশিরটা বেশ ছোঁক-ছোঁক টাইপের, আমি বললুম, তাহলে ওকেই লোভ দ্যাখাও । পরিকল্পনা বদলাতে হল জোসেফিনের বাপ-মা এসে পড়ায় । কিন্তু কংটাকে পোষ্য করতে যখন বাধ্য হলুম, তখন শিশিরকে বিকল্প এক ষড়যন্ত্রের তুরুপের তাস করব বলে ছকে নিয়েছিলুম । আসুক শিশির , টোপ তো ফেলাই আছে । এসে পড়ার পর বঁড়শিতে অন্য টোপ গিঁথে দেবো । শেষ পর্যন্ত মেরেও দিলুম বাজি । মানুষ মানুষের কাজে লাগবে বলেই তো মানুষকে মানুষ বলে । যারা কাজে লাগাতে পারে না তারা অমানুষ ।
শুধু জোসেফিনকে ঝেড়ে ফেলাটুকুই তো নয় । আমার মগজে যা চলছিল, তাকে বলা যায় বৃহত্তর ষড়যন্ত্র । ব্যাকঢ চুপচাপ টাকা জমিয়ে গেছি, আর তার গরমে তাপ খেয়েছে আমার মগজ । ওৎ পেতে অপেক্ষা করেছি সময়-সুযোগের ; ফাৎনা নড়ে উঠতেই, ব্যাস, ঘ্যাচাং ।প্রসন্নর সঙ্গে প্রেম করেই বিয়ে করেছিলুম, যখন ও চাকুলিয়ায় ডাকঘরে পোস্টেড ছিল । চিঠি ফেলতে গিয়ে আলাপ । ভেবেছিলুম, দেখতে-শুনতে লালটুশ, সরকারি চাকরি করে । কিন্তু তখন কী করে জানব যে ওর লেংটু নামক বস্তুটা অপদার্থ মাংসখন্ড ! ডাক্তারও হাল ছেড়ে দিলে । কুমারীই থেকে গিয়েছিলুম বিয়ের কত বছর পরও । অথচ হিজড়ে ইডিয়েটটা, প্রেম করেও, কুড়ি হাজার টাকা যৌতুক নিয়েছিল । প্রসন্নটা ছিল আস্ত অমানুষ আর আমি একজন জলজ্যান্ত মানুষ । প্রেমে পড়লে মেয়েদের উচিত প্রেমিকের পুরুষত্ব যাচাই করে নেয়া । নইলে কোনোদিন আঁওল ভাঙবে না ।
আতুলকে তো বলতে গেলে গেঁথে তুলেছিলুম । দুপুরে ওকে কয়েকদিন শরবত, পেঁয়াজের বড়া আর পিরিতের অগড়-বগড় খাইয়ে, ঘনিষ্ঠ হতেই, সদ্য গোঁফ-বেরোনো অতুল চলে এল আঁচলের নিয়ন্ত্রণে । প্রথম দুপুরের পর, রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলে, বারান্দায় দাঁড়াতুম আর অতুল চলে আসত । গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে প্রেমিক-প্রেমিক চেহারা নিয়ে আসত ; হয়ত ভাবত ও কচি বলে আমি আবার ওর হাত থেকে ফসকে কোনো দরকচার পাল্লায় গিয়ে না পড়ি । সত্যি কত কচি ছিল অতুল, শেষে সেও দরকচা মেরে গেল । সব পুরুষই বোধহয় কিছুদিন ব্যবহারের পর দরকচা মেরে যায় । সাময়িক সম্পর্কই একমাত্র সম্পর্ক , আর যত কচি তত ভাল ।
যখন শুনল প্রসন্নটা পুরুষত্বহীন হিজড়ে আর আমি ওর বাচ্চার মা হতে চলেছি, ঘাবড়ে গিয়ে অতুল বর্ধমান থেকেই উধাও হয়ে গেল । ওর আড়পাগল বাবার সঙ্গে দেখা করতে, খঞ্জনি বাজানো থামিয়ে, বলেছিলেন অতল নবদ্বীপে । দিনভর হরিনাম গেয়ে-গেয়ে ওর বাবার ফুসফুস ওনার দেহটাকে চাঙ্গা রেখেছে দেখেছিলুম, গলায় কন্ঠী, কপালে চন্দনের তেলক । তখনই ভালো করে জানলুম যে অতুলরা বৈষ্ণব ।
উধাও হবার কিছুদিন পর দাড়ি-গোঁফ বাড়িয়ে অতুল এক দুপুরে এসে বলল, ও নবদ্বীপে নয়, বেনারসে আছে, একখানা দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের তালে আছে । তারপর কয়েকবার এসে পথে দাঁড়িয়ে অতুল শুনে গেছে আমি আর আমার মেয়ে মার খাচ্ছি । ত্রাহি কাঁদছি । রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও বুঝতে পারত যে ওর দেয়া বাচ্চার জন্যেই মার খাচ্ছি :; শুধু ও জানত আর আমি জানতুম সেই বদম মার খাবার রহস্য । নমাসে-ছমাসে এসে ও দেখে যেত আমার মার খাওয়া দেহের দাগগুলো । ভাবতুম, মন রাখার জন্য অভিনয় করে সমবেদনা জানিয়ে চলে যায় ।
কুহুর যখন ছ’বছর বয়স, তখন পালিয়ে যাবার প্রস্তাব নিয়ে অতুল এলো । আমরা আলাদা-আলাদা হাওড়া স্টেশানে পৌঁছে সোজা মোগলসরাই , সেখান থেকে বেনারসের এই মন্দির চত্ত্বরে । মন্দিরের শিবলিঙ্গ পথচলতি আয়োসুয়োরা দেখতে পেত না বলে বিসর্জন দিয়ে বড় মাপের কালো গ্র্যানাইটের লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করলুম । আর দ্যাখে কে । শিব জাগ্রত হলেন, আর আমার নিজের নিয়মিত আয়ের ব্যবস্হা হল ।
ভালই চলছিল । কিন্তু প্রথম থেকেই বুঝতে পারছিলুম, আমার প্রতি অতুলের আর আকর্ষণ নেই । কিংবা আমাকে ছুঁতেই বোধহয় ভয় পায় । কচি মন নিয়ে যা করেছিল তা করার সাহস ফুরিয়ে গিয়ে ওর মধ্যে আমি হয়ে উঠেছি অন্যের পলাতকা স্ত্রী । একজন ভক্তের কাছে শুনলুম, বেনারসে এসে কোনো অবাঙালি হাত-ফেরতা যুবতীর সঙ্গে ও সম্পর্ক পাতিয়েছিল । মেয়েটা নাকি এই মন্দিরচত্ত্বরে অতুলের সঙ্গে দিনপনেরো ছিল । শেষে মেয়েটার অনোন্যপায় বাবা-মা ওকে ধরেবেঁধে বেনারস ছেড়ে নিজেদের গ্রামে চলে গেলেন । মেয়েটার সূত্রেই অতুল গাঁজা-চরস-আফিম কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিল । হাত-ফেরতা মেয়ে, কতজনের সেতুবন্ধন ঘটিয়েছিল কে জানে ।
অতুল সামনের ঘরটায় শুতো, যেমন ও প্রথম থেকে শুতো, আমরা আসার আগে থাকতে । আমার আর কুহুর বভবস্হা করে দিল পেছনের ঘরটায় । দুই ঘরের মাঝে উঠোনের পাশে অতগুলো ঘর ফাঁকা থাকলে অতুলের কান্ডকারখানা আমার আওতার বাইরে চলে যাবে ভেবে আমিই ঘরগুলো তীর্থযাত্রীদের ভাড়া দেয়া শুরু করলুম । তারপর হিপিরা একের পর এক আসা আরম্ভ করলে তাদের দিতে লাগলুম ; ভালো পয়সা দিত হিপিগুলো , চাইতে হত না আমাদের দিশি লোকেদের মতন । কিন্তু কে জানত হিপিগুলোর মধ্যে চরসের নেশায় মশগুল জোসেফিন স্পার্কস নামে ভয়ংকর বিপদ একদিন উদয় হবে আর সুখ-শান্তি নষ্ট করে দেবে, এমনকি জীবনের পথটাই বদলে দিয়ে চলে যাবে । এখন যদিও মনে হয় যে জোসেফিন এসেছিল, ভালই হয়েছিল, জীবনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে করে নিতে পেরেছিলুম ।
লোচ্চা-লোফার শিশিরটা অকালের বাদলা জোসেফিনের চরিত্রে প্রতিবাদীর গুণ পেল । আরে ও তো আমেরিকান । আমি বাঙালি বউ হয়ে যে প্রতিবাদ সারাজীবন প্রতি পদে করে গেলুম, তা তোর নজর এড়িয়ে গেল কী করে !
ইউরোপে রেনেসঁসের হর্ষোল্লাসে ঈশ্বরপ্রণীত নিয়মশৃঙ্খলার ভাঙনকে মুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল । মৃত ঈশ্বরের সিংহাসনে বসানো হয়েছিল মানুষকে । পরিবর্তনটি ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিয়েছিল মানবসমাজে; প্রথমে ইউরোপে, তারপর উপনিবেশগুলোয় । প্রায় প্রতিটি উপনিবেশে, সেখানকার ঈশ্বর এবং গোষ্ঠীগুলোর ইষ্টদেবতাকে, মেরে ফেলতে ইউরোপ যে সফল হয়েছিল, শুধু তা-ই নয়, সে-সমস্ত দেশের ইউরোপীয়-মুল্যবোধ প্রভাবিত ভূমিপুত্রদের মধ্যে এই চিন্তাচেতনাকে ইতিবাচক গরিমা দিতে পেরেছিল । তার আগে ইশহবর বা দেবী-দেবতার সঙ্গে তুলনা করে ব্যক্তিমানুষকে প্রতিষ্ঠা দেয়া হতো অমুক লোকটি দেবতুল্য, বা মহিলাটি সাক্ষাৎ ভগবতী ।
এই যে অটুলস ফ্যাগ নামের সিগারেটটা, ওটা আমিই মাথা খাটিয়ে আবিষ্কার করেছি । অতুল তো লুকিয়ে-চুরিয়ে আঁদরু পেঁদরু সেজে চরস আর আফিম বিক্রি করত । আমিই চারমিনার সিগারেটের তামাকের সঙ্গে গাঁজাফুল আর ডগার পাতা, শুখা চরস আর আফিমের মিশেল দিয়ে দশটা সিগারেট প্যাকের ভদ্রজামা পরালুম । বেরোতেই হিট । বিক্রি দেখে অতুলের চোখ ছানাবড়া । আমি নিজে অবশ্য ও ধোঁয়া গিলি না, আমাকে অনেক বছর বাঁচতে হবে, বেঁচে থাকার আনন্দ নিতে হবে । ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে ।
তখন কোনো নিয়ম-নিষেধ ছিল না । আশির দশকের মাঝ থেকে সরকার আইন করে সব বন্ধ করে দিলে । আমি তার আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলুম । হিপিরা আসা বন্ধ হল, আমার জীবনের পথও বদলে ফেললুম ।