২. দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস

০২.

দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস সুলতান সাহেবের নেই। সেই সুযোগও অবশ্যি নেই। লাঞ্চের পর তিনি গা এলিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন। শুয়ে থাকতে থাকতে যেন ঘুম না এসে যায় তারজন্যে হাতে ইন্টাররেস্টিং কোন বই থাকে। ঘুম যখন চোখ জড়িয়ে আসে তখন তিনি বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করেন। আজ ঘুম তাড়াবার জন্যে তাঁর হাতে আছে সালভাদর ডালির বিখ্যাত ডায়েরী। ডায়েরীর কথাগুলো এই বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী সত্যি সত্যি লিখেছেন না নিজেকে বিশিষ্ট করার জন্যে লিখেছেন সুলতান সাহেব ঘুম ঘুম চোখে তা ধরার চেষ্টা করছেন। তাতেও ঘুমটা ঠিক কাটছে না। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে সে সত্যি লিখুক বা মিথ্যা লিখুক জগতের তাতে কিছু যায় আসছে না। সে ছবি কেমন এঁকেছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

সালভাদর ডালি লিখেছেন- আমি শিশুদের পছন্দ করি না। একজন শিল্পী শিশুদের পছন্দ করেন না তা-কি হয়? শিল্পীর অনুসন্ধান হচ্ছে। সৌন্দর্য এবং সত্যের অনুসন্ধান। শিশুরা একই সঙ্গে সত্য ও সুন্দর।

চোখে ঘুম নিয়ে জটিল ধরনের চিন্তা করা যায় না। তখন ঘুম আরো বেশি পায়। সুলতান সাহেব বই বুকের উপর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেই শুনলেন- শো শো শব্দ হচ্ছে। সমুদ্র গর্জনের মতো শব্দ। সেই সঙ্গে দুলুনি। ঘুমের মধ্যেই শুনলেন তাঁর মেয়ে রানু তাকে ডাকছে- বাবা উঠ, বাবা উঠ। ঝড় হচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়।

স্বপ্নের মধ্যেই তিনি ঝড় দেখলেন। স্বপ্নে ভয়াবহ বিপর্যয় দৃশ্যগুলোতেও আনন্দ মেশানো থাকে। তিনি স্বপ্নে ঝড় দেখছেন। সেই দৃশ্য তাঁর কাছে খুবই সুন্দর লাগছে। তিনি দেখছেন খড়কুটোর মতো ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে তার মনে হচ্ছে পাখির পালকের মতো। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখেন রানুকে দেখা যাচ্ছে। ঝড় তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে গেলেও রানুকে উড়িয়ে নিচ্ছে না। রানুর লম্বা চুল বাতাসে উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। এবং সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল হয়ে ডাকছে- বাবা বাবা।

সুলতান সাহেবের ঘুম ভাঙ্গল। তিনি দেখলেন এই বিকেলেও ঘর অন্ধকার। এবং সত্যি সত্যি ঝড় হচ্ছে। বাড়ির জানালায় খট খট শব্দ হচ্ছে। ঘর ভর্তি ধুলোভরা বাতাস। সুলতান সাহেব ধড়মড় করে উঠে বসলেন। রানু আনন্দিত গলায় বলল, বাবা ঝড় হচ্ছে।

আশ্বিন মাসের ঝড়ে এত আনন্দিত হওয়া ঠিক না। আশ্বিনা ঝড় প্রবল হয়ে থাকে। বাড়ি-ঘর তুলে নিয়ে যায়। ঝড় তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কিন্তু যতক্ষণ থাকে ততক্ষণে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলে।

রানু বলল, বাবা আমি ঝড় দেখতে বাগানে যাব।

সুলতান সাহেব বললেন, পাগলামী করবি না। ঝড় দেখার জন্যে বাগানে যেতে হয় না। ঘরের ভেতর থেকে ঝড় দেখা যায়।

আমার বাগানে যেতে ইচ্ছে করছে বাবা।

 ডাল ভেঙ্গে মাথার উপর পড়বে।

রানু শাড়ির আঁচল কোমরে জড়াতে জড়াতে বলল, পড়ক। সুলতান সাহেবকে রানু আর কোন কথা বলার সুযোগ দিল না। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে বাগানে নেমে গেল। বাগানের গাছপালা যে হারে দুলছে-ডাল ভেঙ্গে পড়বে এটা প্রায় নিশ্চিত। মেয়েকে যুক্তি দিয়ে এখন ফেরানো যাবে না। কিছু মুহূর্ত আসে যখন মানুষ কোন যুক্তি মানে না। সুলতান সাহেব দেখলেন রানু প্রায় ঝড়ের মতোই এক গাছের নিচ থেকে আরেক গাছের নিচে যাচ্ছে। সে মনে হয় নিজের মনে চেঁচাচ্ছেও। ঝড়ের কারণে তার চিৎকার শোনা যাচ্ছে না।

সুলতান সাহেবের মনে হলো রানুকে একা একা বাগানে ছোটাছুটি করতে দেয়া ঠিক না। তার উচিত মেয়ের কাছে যাওয়া। সেটাও করা যাবে না রানুকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে একা একা ছোটাছুটি করতে তার ভাল লাগছে। ঝড়ের মাঝখানে সে তার নিজের একটা জগত তৈরি করে ফেলেছে। এই জগতে সুলতান সাহেবের কোন মূল্য নেই। মেয়ের আনন্দে তিনি ভাগ বসাতে পারছেন না। ডাল ভেঙ্গে মেয়ের মাথায় পড়বে এই দুঃশ্চিন্তাটাও তিনি দূর করতে পারছেন না। যা ঘটার তা ঘটবেই ফেটালিস্টদের মতো এই চিন্তাও করতে পারছেন না। জটিল কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। আচ্ছা সালভেদর ডালি কি কোন ঝড়ের ছবি এঁকেছেন? প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে সেরকম কোন ছবি? না আঁকেন নি। মাইকেল অ্যাঞ্জালো আঁকেন নি, গঁগা আঁকেন নি। আধুনিক কালের মন্টে আঁকেন নি, পিকাসো আঁকেন নি। কেন আঁকেন নি? তাঁরা কি ঝড় দেখেন নি। তাঁরা সবাই কি ভীতু প্রকৃতির ছিলেন? ঝড়ের সময় তাঁরা দরজা বন্ধ করে ছিলেন?

.

সোহাগী গ্রামে ভয়ংকর একটা ব্যাপার হয়েছে। বিকাল পাঁচটা দশম মিনিটে গ্রামের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। ভাদ্রমাসের শেষে আশ্বিনের শুরুতে এরকম ঝড় হয়। এই ঝড়কে বলে আশ্বিনা ঝড়। কাঁচা বাড়িঘর ভেঙে পড়ে। টিনের চালা উড়ে যায়। গ্রামের মানুষ এ ধরনের ঝড়ের সঙ্গে পরিচিত। তাদের কাছে একটা ভয়ংকর কিছু না।

ভয়ংকর ঘটনা যেটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে ঝড়ের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে ধুপ করে একটা শব্দ হল। চাপা আওয়াজ কিন্তু ঝড় ছাপিয়েও সেই আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজটার মধ্যেই অশুভ কিছু ছিল। অশুভ ব্যাপারটা জানা গেল ঝড় থামার পর। সোহাগী গ্রামের পাঁচশ বছরের পুরনো এক মসজিদ ভেঙে পড়ে গেল। মসজিদের নাম জমুন খাঁ মসজিদ। অনেক দিন ধরেই মসজিদ ভেঙে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দেয়াল এবং ছাদ ফেটে গিয়েছিল। বৃষ্টির সময় ফাটা ছাদ দিয়ে পানি পড়ত। ভাঙা দেয়ালে সাপ আশ্রয় নিয়েছিল। একবার জুমা নামাজের খোৎবা পাঠের সময় সাপ বের হয়ে পড়েছিল। মসজিদের ইমাম মওলানা ইসকান্দার আলি সাপটা প্রথমে দেখেন এবং খোত্বা পাঠ বন্ধ করে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে ওঠেন। সাপটা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে চলে যায়। জুমার নামাজের শেষে মসজিদে যে সাপ বাস করে তাকে মারা যায় কি যায় না তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আল্লাহর ঘরে যে আশ্রয় নিয়েছে তাকে মারা কি ঠিক? সে তো কারো কোনো ক্ষতি করে নাই।

মওলানা ইসকান্দর আলি বয়স পঞ্চাশ। রোগা শরীর। অতিরিক্ত লম্বা বলে খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটেন। হাতে ছড়ি নিয়ে হাঁটার বয়স তার হয় নি। তারপরও তার হাতে বিচিত্র একটা বেতের ছড়ি সবসময় থাকে। হাঁটার সময় ছড়িটা তিনি হাত বদল করতে থাকেন। এই বাঁ হাতে এই ডান হাতে। মোটামুটি দেখার মতই দৃশ্য। মওলানা ইস্কান্দার আলি নিজের চারদিকে রহস্য তৈরি করে রাখতে পছন্দ করেন। মওলানা সাহেব শুরু থেকেই মসজিদেই ঘুমাতেন। কারণ আল্লাহর ঘর কখনোই পুরোপুরি খালি রাখা ঠিক না। তাছাড়া ইবাদত ছাড়াও মসজিদে বসে থাকার মধ্যে সোয়াব আছে। সাপ বের হবার পরে অবশ্যি ইসকান্দার আলি মসজিদে ঘুমানো ছেড়ে দিলেন।

মসজিদ ভেঙে নতুন মসজিদ তৈরির প্রস্তাব এক জুম্মা বারে করা হল। মওলানা ইসকান্দর আলি কঠিন গলায় বললেন, প্রস্তাব যিনি করেছেন তিনি তওবা করেন। আল্লাহর ঘর মেরামত করা যায়, ভাঙা যায় না। উনার ঘর উনি যদি ভাঙতে চান তিনি নিজে ভাঙবেন।

সেই ঘটনাই ঘটেছে। জয়ুন খাঁ মসজিদ ধুপ করে ভেঙে ঢিবির মতো হয়ে আছে। পুরো ঘটনাটা ঘটেছে মওলানা ইসকান্দর আলির সামনে। মওলানা সাহেব এই বিভীষিকা দূর করতে পারছেন না। তিনি আতঙ্কে কাঁপছেন। মসজিদ থেকে বের হতে আর দুটা মিনিট দেরি হলে তিনি স্কুপের নিচে চাপা পড়তেন। ঘটনা কিভাবে ঘটল মওলানা তার প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা দিলেন এই ভাবে :

আছরের নামাজ শেষ করলাম আমি একা। দিন খারাপ দেখে কোনো মুসুল্লি আসে নাই। যাই হোক, কী আর করা। আমি তো দড়ি দিয়ে বেঁধে মুসুল্লি আনতে পারব না। ঐটা বাদ থাকুক। যে কথা বলছিলাম আছরের নামাজ শেষ করে তসবি নিয়ে বসেছি। আপনারা হয়তো জানেন আছর থেকে মাগরের পর্যন্ত সময়টা খুব জটিল। কেয়ামত হবে আছর থেকে মাগরেবের মাঝখানের সময়ে।

আমি একমনে তসবি পড়তেছি। শুধু হয়েছে ঝড়। আমি ভাবলাম হোক না ঝড়। আমি বসে আছি আল্লাহর ঘরে। আমার আবার ভয় কী? আমি চোখ বন্ধ করে তসবি পাঠে মন দিয়েছি। তখন কলবের ভিতরে কে। যেন বলল- ইসকান্দর বাইরে যাও, সময় খারাপ। আমি বাইর হইলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ধুপ।

মওলানা ইসকান্দর আলি যেরকম রোমহর্ষক বর্ণনা দিতে চেয়েছিলেন তেমন দিতে পারলেন না। ঘটনা বর্ণনার উত্তেজনার কারণে ধুপ শব্দটার অদ্ভুত উচ্চারণ করলেন। অদ্ভুত উচ্চারণের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি যুক্ত হওয়ায় এবং হাতের বেতের ছড়িটাও ধুপ করে পড়ে যাওয়ায় কিছু হাস্যরস তৈরি হল– কয়েকজন হেসে ফেলল।

মওলানা বললেন, হাসেন কে? আল্লাহ পাকের ঘর ভেঙে গিযেছে এর মধ্যে হাসির কিছু আছে? হাসি বন্ধ করে এই ঘটনা কেন ঘটল বিবেচনা করেন। এই সোহাগী গ্রামে কী গজব আসতেছে এইটা একটু ভাবেন। আল্লাহপাক এই অঞ্চলে তার ঘর চায় না। কেন চায় না?

ইসকান্দর আলি বক্তব্য শেষ করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। শ্রোতাদের ভেতর তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। এরা কি নতুন মসজিদ তৈরি করবে? নতুন মসজিদ না হলে তার চাকরির কী হবে? সে বিদেশি মানুষ। মসজিদের ইমামতি বাবদ তাকে মাসে পাঁচশ টাকা দেয়া হয়। গ্রামের মসজিদের ইমামতির টাকা কখনোই ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আশ্চর্যের ব্যাপার, এটা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছিল। বিয়ে, আকিকা, মিলাদে টাকাপয়সা খারাপ আসছিল না। তবে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের যে-ব্যাপারটা আছে তা হচ্ছিল না। গ্রাম্য বিচার বা সালিসিতে তাকে কখনো কেউ ডাকে না। গ্রামে একটা স্কুল হবে। সেই বিষয়ে প্রায়ই সভা-সমিতি হয়, সেখানেও তাঁর ডাক পড়ে না। ডাক পড়লে স্কুলের চেয়ে মাদ্রাসার প্রয়োজন যে বেশি তা তিনি গুছিয়ে বলতে পারতেন। যে শিক্ষায় আল্লাহকে পাওয়া যায় সেই শিক্ষাই আসল শিক্ষা। স্কুল কলেজের শিক্ষা ইহকালের জন্যে। মাদ্রসার শিক্ষা ইহকাল-পরকাল দুই জাহানের জন্যে। সোহাগীতে একটা ঈদগা দরকার। যে ঈদগায় আশেপাশের মানুষও নামাজ পড়তে আসবে। সেই বিষয়েও কারো কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ঈদগা বানাতে তো আর দালান কোঠা তুলতে হয় না। ইমাম সাহেবের খোবা পড়ার একটা জায়গা হলেই হয়। তিন শ ইট দুই বস্তা বালি এক বস্তা সিমেন্ট।

মওলানা ইসকান্দর আলি খুবই মন খারাপ লাগছে। মসজিদ ভাঙার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটার পরও মানুষ কী স্বাভাবিক আছে! যে এটা কোন ব্যাপার না।

মওলানা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আপনাদের কথা জানি না। আমি অতি ভয়ে আছি। আমাদের উপর বিরাট গজব আসতেছে।

গনি মিয়া বললেন, গজবের কথা আসতেছে কেন? বহুদিনের পুরানা মসজিদ। কোনোদিন মেরামতি হয় নাই। বাতাসের ধাক্কা লাগছে। ভাইঙ্গা পড়ছে। এতদিন যে টিকেছে এটাই যথেষ্ট।

ইসকান্দার আলি বিরক্ত-চোখে গনি মিয়ার দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। গনি মিয়া এই অঞ্চলের ক্ষমতাবান মানুষদের একজন। পরপর তিনবার চেয়ারম্যান ইলেকশন করেছেন। পাশ করতে পারেন নাই। সেটা কোন কথা না। তিনবার ইলেকশন করার ক্ষমতা কয়জনের থাকে? জমি-জিরাত ছাড়াও নেত্রকোনা শহরে তাঁর রাইসমিল আছে। একটা করাত কল কেনার চিন্তাভাবনা করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এই ধরনের মানুষের মুখের উপর কথা বলা যায় না। সত্য কথাও বলা যায় না। দিনকাল পাল্টে গেছে, এখন আর মানুষ আগের মতো নাই। মওলানা ধরনের মানুষের দিকে। এখন আর আগের মতো ভয়-মিশ্রিত শ্রদ্ধার চোখে কেউ তাকায় না। মওলানাও যে বিবেচনায় রাখার মতো একজন, কেউ তাও বোধ হয় মনে করে না। ছট্‌ফট্ ভাবে।

সোহাগী গ্রামটা অনেক ভেতরের দিকে হলেও থাকার জন্যে ভালো। গ্রামের মানুষ হতদরিদ্র না। সবারই অল্প-বিস্তর হলেও জমি-জিরাত আছে। এরা খাটাখাটনি করে। আমোদ ফুর্তি হৈচেও করে। ক্লাবঘরের মতো আছে। ক্লাবঘরে পত্রিকা আসে। একটা লাইব্রেরি আছে। লাইব্রেরিতে দুই আলমারি বই। ব্যাটারিতে চলে এমন টিভি আছে। যেদিন যেদিন নাটক চলে, ভাড়া করে ব্যাটারি আনা হয়।

মওলানা ইসকান্দর আলি এদের সাথে যোগ দিতে পারেন না, তিনি মওলানা মানুষ। টিভির সামনে বসে প্রেম-ভালবাসার নাটক দেখবেন এটা কেমন কথা? ইচ্ছা থাকলেও গ্রামের যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হয়। আমোদ ফুর্তির সবটাই আসলে শয়তানি কর্মকাণ্ড। এইসব কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়ানোও ঠিক না। আবার এদের কাছ থেকে খুব দূরে থাকাও ভুল। গ্রামের মানুষদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে তাদের সঙ্গে থাকতে হবে। দুধকে দই বানাতে হলে দইয়ের বীজ হয়ে দুধের সঙ্গে মিশতে হবে। দই-এর বীজ দশ হাত দূরে রেখে দিলে দুধ দুধই থাকে দই হয় না।

সোহাগী গ্রামে স্কুল হবে খুব ভাল কথা। বিদ্যাশিক্ষায় দোষ কিছু নাই। আমাদের নবী করিম বিদ্যাশিক্ষার কথা বলেছেন। তবে স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে টিপু সুলতান নাটক করতে হবে এটা কেমন কথা? সেই নাটকের জন্যে পাড়া থেকে মেয়ে নিয়ে আসতে হবে এটাই বা কেমন কথা। মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে এর সঙ্গে কি নাটকের মেয়ের কোনো যোগ নাই? ইসকান্দর আলি তার এই জাতীয় সন্দেহের কথা কাউকে বলবেন কিনা এখনো বুঝতে পারছেন না। মিটিং করে সবাইকে বলার দরকার নাই। এক দুইজনকে ঠিকঠাক মতো বলতে পারলেই কথা চলা শুরু করবে। কথা শুরু করাটাই কঠিন। একবার শুরু করলে কথা চলতে থাকে

গ্রামের মানুষ তাঁর কথায় কতটা গুরুত্ব দেবে তাও তিনি ধরতে পারছেন না। বিদেশি মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। তিনি বিদেশি মানুষ। আর দশটা মানুষের সঙ্গে যে মিশ খায় না, তাকেও কেউ পছন্দ করে না। তিনি আর দশটা মানুষের সঙ্গে মিশ খান না। যারা সারাক্ষণ ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে তাদের মানুষ ভয়ের চোখে দেখে। তিনি তাই করেন। দিনের পর দিন রোজা করেন। রোজার একটা সোয়াব তো আছেই, তাছাড়াও রোজার অনেক সুবিধা আছে- সারাদিন খাওয়াখাদ্যের কোনো ঝামেলা নাই। সন্ধ্যাবেলা ইফতারের সময় কোনো-এক বাড়িতে উপস্থিত হন। যার বাড়িতে যান সে খুবই আনন্দের সঙ্গে ইফতার ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে শেষরাতের খাবার একটা বাটিতে করে সেখান থেকেই নিয়ে যান। কবে কোন বাড়িতে খাবেন এটা আগে থেকে বলেন না। এতে একধরনের রহস্য তৈরি হয়। সাধারণ মানুষ রহস্য পছন্দ করে।

দিনের পর দিন রোজা রাখার একটা উপকারিতা তিনি ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছেন। তার ব্যাপারে এই কথাটা চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। এখন অনেক দূর থেকে তাঁর কাছে লোকজন পানিপড়া নিতে আসে। তিনি ফিরিয়ে দেন। মুখে বলেন, এখনো সময় হয় নাই। সময় হোক পানিপড়া দিব।

এতেও খানিকটা রহস্য তৈরি হচ্ছে। তার মতো মানুষের জন্যে যত বেশি রহস্য তৈরি হয় তত ভালো। তিনি আরেকটা কাজ খুবই গুরুত্বের সঙ্গে করেন– কোরান পাক মুখস্থ করা। ছোটবেলায় হাফেজিয়া মাদ্রাসায় চার বছর ছিলেন। তাতে লাভ হয় নি। তার সঙ্গের সবাই হাফেজ হয়ে গেছে, তিনি পারেন নাই। কোরানে হাফেজ সবাই হয় না। যার উপর আল্লাহপাকের খাস দয়া আছে সেই হতে পারে। তার উপর আল্লাহপাকের যে খাস দয়া নাই তা তিনি বুঝতে পারেন। তারপরেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যে-কোনো একদিন সফল হয়ে যাবেন। সেটা আজ রাতেও হতে পারে, কালও হতে পারে। আবার আরো একবছর লাগতে পারে।

মওলানা ইসকান্দর আলি ঝড়ের পর হাঁটতে বের হয়েছেন। আজ তার পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। মনের উপর চাপ গিয়েছে বলেই বোধ হয় এই তৃষ্ণা। বুক মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। কোন বাড়িতে ইফতার করবেন তিনি। এখনো ঠিক করেন নি। হুট করে কোনো বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ইফতারের কথা বললে তাদের বিপদেই ফেলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত খারাপ ইফতার, কোনো বাড়িতে করেন নি। কাটা পেঁপে, শশা, দুধ-চিড়া, একটা ডিম সেদ্ধ, একটা কলা, তেল মরিচ দিয়ে মাখানো চাল ভাজা। নাই নাই করেও অনেক কিছু হয়ে যায়।

ঝড় এই গ্রামের মোটামুটি ভালোই ক্ষতি করেছে। ঘরবাড়ি না ভাঙলেও বেশকিছু গাছপালা ভেঙেছে। সুলেমানের নতুন বানানো টিনের ঘরের সব টিন উড়িয়ে নিয়ে গেছে। অথচ সুলেমানের পাশেই বিষ্ণুর কাঁচা খড়ের বাড়ির কিছুই হয় নি। আল্লাহপাকের কর্মকাণ্ড বোঝা সাধারণ মানুষের কর্ম না।

মওলানা ইসকান্দর আলি একবার ভাবলেন, ইফতারের জন্যে বিষ্ণুর বাড়িতে উপস্থিত হলে কেমন হয়। অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িতে খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না এমন তো কোনো কথা হাদিস কোরানে নাই। তাছাড়া বিষ্ণু লোক অত্যন্ত ভালো। সে কখনো মিথ্যাকথা বলে না, এবং সুযোগ পেলেই মানুষের উপকার করার চেষ্টা করে। বিষ্ণু তার জন্যে একটা শীতল পাটি বুনে দিয়েছে। একটা তালের পাখা বানিয়ে দিয়েছে।

নবী করিমের একটা হাদিস আছে। এক সাহাবা নবী (স.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইসলাম কী? নবী উত্তরে বললেন, ইসলাম হল সত্য ভাষণ এবং পরোপকার।

এই বিবেচনায় বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বলা যায়, ও বিষ্ণু আইজ তোমার ঘরে ইফতারি করব। বিষ্ণু ছোটাছুটি করে ভাল যোগাড়ই করবে। আর যোগাড় করতে না পারলেও কিছু করার নেই। রিজিক উপর থেকে আসে। মানুষভাবে তার খাওয়া খাদ্য সে যোগাড় করে। আসল ঘটনা ভিন্ন। পিপীলিকা জানে না তার খাদ্য কে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে পিপীলিকা যায় হঠাৎ দেখে দুইটা চিনির দানা। পিপীলিকা খুশি। সে জানে না এই চিনির দানা তার চলার পথে কে ফেলে গেল। সে মহানন্দে চিনির দানা ঘরে নিয়ে যায়। পিপীলিকা যেমন চিন্তা করে না, মানুষও চিন্তা করে না। অথচ মানুষকে চিন্তা করার বুদ্ধি আল্লাহপাক দিয়েছেন।

ইস্কান্দার আলি বিষ্ণুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন- বিষ্ণুকে ডাকবেন কী ডাকবেন না মনস্থির করতে পারছেন না। ইফতার ওয়াক্তের বেশি দেরি নাই। মনস্থির করা দরকার।

কে, মওলানা সাহেব না?

ইস্কান্দার আলি চমকে তাকালেন। তার পেছনে সুলতান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। সুলতান সাহেবের সঙ্গে তাঁর আগে পরিচয় হয় নাই। এই প্রথম দেখা। কেউ না বলে দিলেও তাঁর চিনতে অসুবিধা হল না। শহরবাসী মানুষের শরীরে শহরের চিকন লেবাস চলে আসে। এই লেবাস চোখে দেখা যায় না। তবে লেবাসের ফলে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। একজন শহরবাসী মানুষ যদি খালি গায়ে হাঁটু উঁচু লুঙ্গি পরে গ্রামের কোনো ক্ষেতের আলের উপর বসে থাকে তখনও তাকে চেনা যায়। শিক্ষার লেবাসও আছে। এই লেবাসও চোখে দেখা যায় না। একই পোষাক পরিয়ে একজন শিক্ষিত এবং একজন মূর্খকে পাশাপাশি বসিয়ে রাখলেও চেনা যায়– কে শিক্ষিত কে মূর্খ।

সুলতান সাহেব গ্রামের এসেছেন এই খবর তিনি পেয়েছেন। অসম্ভব মানী একজন মানুষ তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন থাকতে এসেছেন। মওলানা ইস্কান্দার আলির উচিত ছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসা। উচিত কাজটি করা হয় নি।

মানী লোককে সম্মান দিতে হয়। এও হাদিসের উপদেশ। মানী, জ্ঞানী এবং গুণী এই তিন সব সময় সম্মান পাবে। কারণ মান, জ্ঞান এবং গুণ আল্লাহপাকের পুরষ্কার। আল্লাহপাক নিজে যাকে পুরষ্কার দিয়েছেন– সাধারণ মানুষ তাকে সম্মান দিবে না কেন?

কেমন আছেন মওলানা সাহেব।

জ্বি ভাল আছি। আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গিয়েছি– এই বেয়াদবী ক্ষমা করে দিবেন। আসোলামু আলায়কুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

আপনার কথা শুনেছি। আপনাকে দেখার শখ ছিল।

জনাব, আমি খুবই নাদান মানুষ। ঝড়ের পর গ্রামের অবস্থা দেখতে বের হয়েছি। ক্ষয় ক্ষতিটা দেখি ভালই হয়েছে। শুনলাম মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে।

জ্বি জনাব।

 মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে শুনে খুবই খারাপ লাগছে– এত দিনের পুরনো মসজিদ। কত ইতিহাস এর সঙ্গে জড়িত ছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম আর্কিওলজি বিভাগকে মসজিদটার ব্যাপারে উৎসাহী করতে। সম্ভব হয় নি। এই মসজিদের সবচে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা কী আপনি লক্ষ্য করেছেন?

ইস্কান্দার আলি বললেন, কোন ব্যাপারটার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না।

ইমাম যে জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ান সেই জায়গাটাকে কি বলে? মনে হয় মিম্বর। এই মসজিদে এ রকম দুটা জায়গা। পাশাপাশি। দুজন ইমাম তো নিশ্চয়ই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়াবেন না। তাহলে দুটা জায়গা কেন? নিশ্চয়ই এর পেছনে ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা কি? …

ব্যাপারটা ইস্কান্দার আলি লক্ষ্য করেছেন। মাথা ঘামান নি। এখন মনে হচ্ছে মাথা ঘামানোর দরকার ছিল। ইফতারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। একজন মানী লোক কথা বলছেন ফট করে তার মুখের উপর বলা যায় না– জনাব আমি যাই। মাগরেবের আজান দেয়া দরকার। আজানটা তিনি কোথায় দেবেন। জামাতে নামাজ পড়তে যদি কেউ আসে তারা কোথায় নামাজ পড়বে?

মওলানা সাহেব!

জ্বি।

 চলুন আমার সঙ্গে চা খাবেন।

 জ্বি আচ্ছা জনাব। বহুত শুকরিয়া।

মওলানা সুলতান সাহেবের পেছনে হাঁটছেন। তাঁর কাছে সুলতান সাহেব মানুষটাকে অস্থির প্রকৃতির বলে মনে হচ্ছে। অতি দ্রুত হাঁটছেন। অস্থির প্রকৃতির মানুষ দ্রুত হাঁটে। অস্থির প্রকৃতির মানুষ কথাও বেশি বলে। হড়বড় করে কথা বলতে থাকে। তবে মানুষটার অহংকার মনে হয় কম। এত বড় মাপের মানুষ বাংলাদেশ সরকারের একজন রাষ্ট্রদূত। আগে ছিলেন বার্মার রাষ্ট্রদূত, এখন সম্ভবত নেপালের। মানুষটা হাঁটছেন লুঙ্গি পরে। গায়ে সৃতির পাঞ্জাবী। তার মত সামান্য মানুষকে প্রথম দেখাতেই চা খাবার দাওয়াত করে নিয়ে যাচ্ছেন।

মওলানা সাহেব।

 জ্বি।

.

ইস্কান্দার আলি সুলতান সাহেবের বারান্দায় বসে আছেন। সুলতান সাহেব ভেতরে গিয়েছেন খুব সম্ভব চায়ের কথা বলতে। ইস্কান্দার আলি একটু চিন্তিত বোধ করছেন। চা আনতে আনতে রোজা খোলার সময় হয়ে যাবে না তো। শুধু চা নিশ্চয়ই আসবে না। চায়ের সঙ্গে নাশতা থাকবে। পানি থাকবে। ইস্কান্দার আলির সঙ্গে ঘড়ি নেই। মাগরেবের ওয়াক্ত বোঝার জন্য তাকে প্রকৃতির উপর নির্ভর করতে হয়। আজ আকাশ ঘোলা। সূর্য ডোবার ঠিক সময়টা ধরা মুশকিল। এই বাড়িতে হাঁস-মুরগি থাকলে ভাল হত। হাঁস-মুরগি সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘরে ঢুকে যায়। মোগর বাগ দেয় সূর্য ওঠার সময়। তবে আজকাল বোধ হয় নিয়ম পাল্টে গেছে। তাঁর নিজের বাড়িতে একটা মোরগ ছিল রাত দুটা আড়াইটার দিকে বাগ দিয়ে সবার ঘুম ভাঙ্গাতো।

সুলতান সাহেবের বাড়ির বারান্দাটা ভাল। সামনেই বাগানের মত আছে। দেশী ফুলের বাগান। একটা জবা ফুলেরগাছ জবা ফুলে লাল টুকটুকে হয়ে আছে। জবা হিন্দুদের পূজায় লাগে। মুসলমান বাড়িতে এই ফুলের গাছ থাকা ঠিক না। মানুষ এবং জ্বীনের ভেতর যেমন হিন্দু মুসলমান আছে, গাছপালার মধ্যেও আছে। জবা তুলসি এইগুলা হিন্দু গাছ। নারিকেল-সুপারি মুসলমান গাছ। বাতাসের সময় এরা সিজদার মত নিচু হয় বলেই মুসলমান।

চারদিক পরিষ্কার ঝকঝক করছে। ঝড়ের কারণে শুকনো পাতা পড়ে থাকার কথা। একটা শুকনো পাতাও নেই। মনে হয় ঝট দেয়া হয়েছে। সুলতান সাহেবের বাড়িটা পাকা। এই গ্রামের তিনটা পাকা বাড়ির মধ্যে সুলতান সাহেবের বাড়িটা সবচেয়ে সুন্দর। সুন্দর বাড়ি আল্লাহর রহমত স্বরূপ। এই মানুষটার উপর আল্লাহর রহমত আছে।

ইস্কান্দার সাহেব খুবই অবাক হয়ে দেখলেন সুলতান সাহেব দুহাতে দুটা চায়ের কাপ নিয়ে নিজেই বারান্দায় এলেন। চায়ের সঙ্গে আর কিছু নেই। অথচ রোজা খোলার সময় হয়ে গিয়েছে বলে তার ধারণা।

সুলতান সাহেব বললেন, আমি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আছি। এর মধ্যে কোন এক রাতে এসে আমার সঙ্গে ডিনার করবেন। আমার বড় মেয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করতে চায়।

ইস্কান্দার আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?

জানি না কেন। আপনার সম্পর্কে নানান গল্প-গুজব শুনেছে। আপনি নাকি সারা বছর রোজা রাখেন। সত্যি না-কি?

জ্বি না, সত্যি না। বছরে অনেক দিন আছে রোজা রাখা নিষিদ্ধ।

সেই নিষিদ্ধ দিনগুলো ছাড়া বাকি দিনগুলোতে রোজা থাকেন?

ইস্কান্দার আলি চুপ করে রইলেন। সুলতান সাহেব বললেন, আজ কি রোজা আছেন?

জ্বি।

আপনার তো ইফতারের সময় হয়ে গেল।

ইস্কান্দার আলি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, কোন সমস্যা নাই। এক গ্লাস পানি দিলেই হবে। পানি দিয়ে রোজা খুলব।

সুলতান সাহেব ব্যস্ত ভঙিতে উঠে ভেতরে চলে গেলেন। ইস্কান্দার আলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ইফতার আসবে। বড়লোকের বাড়ির ইফতার অতি উন্নত মানের হবারই কথা। দেখা যাক আল্লাহপাক আজ তার কপালে রিজিক কী রেখেছেন।

ইস্কান্দার আলি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন- মাগরেবের আজানটা তিনি এই বাড়ির উঠান থেকেই দেবেন। আজান তো তাকে দিতে হবে। মসজিদ নেই আজানটা তিনি দিবেন কোথায়। সুলতান সাহেব নিশ্চয়ই বলবেন না আপনি আমার বাড়ির উঠানে আজান দিতে পারবেন না। কোনো মুসলমানের পক্ষেই এই কথা বলা সম্ভব না।

সুলতান সাহেব আবার ঢুকলেন। এই বার তাঁর হাতে এসট্রে এবং সিগারেট। তিনি বসতে বসতে বললেন, রানুকে আপনার ইফতার তৈরি করতে বলে এসেছি। রানু আমার বড় মেয়ে। দেখি সে কী করে।

হুমায়ূন আহমেদ ইস্কান্দার আলি বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।

সুলতান সাহেব বললেন, আজানের এখনো কিছু দেরি আছে। আজকের সূর্যাস্ত ছটা আটে বা দশে। এগজেক্টলি বলতে পারছি না। তিন দিনের আগের পত্রিকা দেখে বলছি।

আপনার মেহেরবাণী।

 আমি সিগারেট খেলে কি আপনার অসুবিধা হবে?

জ্বি-না।

আমাদের গ্রাম আপনার কেমন লাগছে?

জ্বি-ভাল। অতি উত্তম।

 গ্রামের মানুষরা কেমন?

 অতি ভাল। সবাই আমাকে বড় পিয়ার করেন।

এই গ্রামের ছেলে, নাম মাহফুজ তার সঙ্গে কি পরিচয় আছে?

ভাল পরিচয় আছে। বুদ্ধিমান অন্তর পরিষ্কার। অতি উত্তম ছেলে।

যে তিন বারে ইন্টারমিডিয়েট পাস করতে পারে না সে অতি উত্তম হয় কীভাবে? বুদ্ধিমান যে বলছেন, তাকে বুদ্ধিমান তো বলা যায় না। একটা গ্রাম বদলে ফেলবে– স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বানাবে। পাকা রাস্তা করবে। এ ধরণের অবাস্তব চিন্তা কোন বুদ্ধিমান ছেলে করবে না। কাজ কর্মহীন অলস মানুষ দুধরণের চিন্তা করে হয় অসৎ চিন্তা কিংবা সৎ চিন্তা। ছেলেটা সৎ চিন্তা করছে। তার চিন্তার ধরণ থেকেই বোঝা যায় কাজ কর্মহীন মানুষ।

ইস্কান্দার আলি চুপ করে রইলেন। কারো আলোচনা সমালোচনার সময় চুপ করে থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। মনে হচ্ছে সুলতান সাহেব মাহফুজ নামের মানুষটার উপর বিরক্ত হয়েছেন। ইস্কান্দার আলি বিরক্তির কারণটা ধরতে পারছেন না। বিরক্তিটা কোন পর্যায়ের তাও ধরা যাচ্ছে না। মনে হয় খুব বেশি পর্যায়ের। বড় মানুষরা রাগ-বিরক্তি-ভালবাসা-ঘৃণা সবই মাত্রার মধ্যে রাখেন। তারা কখনো মাত্রা অতিক্রম করেন না। এটা ভাল। পাক কোরানে মানুষকে বার বার বলা হয়েছে- সীমা অতিক্রম না করার জন্যে।

 মওলানা সাহেব!

জ্বি জনাব।

আমি কাজের মানুষ। আমি কাজ পছন্দ করি। স্বপ্ন বিলাস পছন্দ করি না। স্কুল ফান্ডের জন্যে নাটক হবে। নাটকের জন্যে শহর থেকে নায়িকা আসবে– এইসব খুবই ফালতু ব্যাপার। স্কুলটা সেখানে মূল না। নাটক করাটাই মূল বিষয়। নাটক থিয়েটার নিয়ে কয়েকদিন হৈ চৈ করা।

হৈ চৈ করার দরকার আছে। আনন্দ ফুর্তি সবই প্রয়োজন কিন্তু শিখণ্ডি দাঁড় করানো কেন? স্কুল কলেজ পেছনে রেখে নাটক থিয়েটার কেন? আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। বিরক্তির প্রধান কারণ আমাকে এর সঙ্গে যুক্ত করা। আমি কিছুই জানি না, হঠাৎ দেখি হাতে লেখা পোস্টার টিপু সুলতান নাট্যানুষ্ঠান– আমি প্রধান অতিথি। পোস্টারে দুটা বানান ভুল। আমি এসেছি রানুকে নিয়ে কয়েকটা দিন নিরিবিলি সময় কাটাতে, এর মধ্যে একি উপদ্রব!

.

ইস্কান্দার আলির মনে হল এই মানুষটার বিরক্তি সহজ পর্যায়ের না, জটিল পর্যায়ের। বিরক্ত মানুষের সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক না, কারণ বিরক্তি যে-কোন সময় দিক বদলায়। একজনের বিরক্তি অন্য জনের উপর চলে আসে। মাহফুজের উপর বিরক্তিটা হঠাৎ তার উপর এসে পড়তে পারে। ভালবাসা বা রাগের ক্ষেত্রে এরকম ঘটে না। এক জনের ভালবাসা আরেক দিকে যায় না, বা এক জনের রাগ অন্যজনের দিকে যায় না।

রানু ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ঢুকল। ইস্কান্দার আলি হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মনে হল দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের জীবনে তিনি এমন রূপবতী তরুণী দেখেন নি। বেহেশতবাসী প্রত্যেককে সেবার জন্যে সাতটা করে হুর দেয়া হবে। ইস্কান্দার আলির মনে হল সেই সাতটা হুরের কোনটাই এই মেয়ের পায়ের কড়ে আঙ্গুলের নখের কাছে যেতে পারবে না। এক দৃষ্টিতে কোন তরুণী মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা নিতান্তই অভদ্রতা, কিন্তু ইস্কান্দার আলি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছেন না। রানু ইস্কান্দার আলির দিকে তাকিয়ে বলল, চাচা স্লামালিকুম।

ইস্কান্দার আলি হড়বড় করে বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম মা। ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রহমতুল্লাহ।

ইস্কান্দার আলি তার দৃষ্টি মেয়েটির হাতের ট্রের দিকে নিয়ে গেলেন। অতি অল্প সময়ে সে অনেক আয়োজন করেছে। লেবুর সরবত, সমুচা, গোশত পরাটা, আরেকটা বাটিতে সবুজ রঙের কী-যেন দেখা যাচ্ছে। শহুরে কোন খাবার বোধ হয়। মিষ্টি জাতীয় কী-না কে জানে। ইফতারের মিষ্টি জাতীয় কিছু থাকা দরকার। নবীজীর সুন্নত। নবীজীর মতো হওয়া তো সম্ভব না। তাঁর দুএকটা কাজকর্ম অনুসরণ করার সামান্য চেষ্টা।

রানু বলল, মওলানা সাহেব, আপনি অবশ্যই আরেকদিন আমাদের এখানে ইফতার করবেন এবং রাতে খাবেন। আজ তাড়াহুড়া করে কী করেছি আমার খুবই খারাপ লাগছে।

ইস্কান্দার আলি বললেন, জ্বি আচ্ছা আম্মা। আপনি অনেক ইফতারের ব্যবস্থা করেছেন। অকারণে শরমিন্দা হচ্ছেন। তাছাড়া আম্মা, মানুষের রিজিক আল্লাহপাক নির্ধারণ করে রাখেন। আজ আমি ইফতার কী করব সবই অনেক আগে ঠিক করা। আল্লাহপাক যা যা চেয়েছেন আপনি তাই তৈরি করেছেন। তার বেশিও না, কমও না। মা, ঘরে কি রেডিও আছে?

রানু বরল, জ্বি না। কেন বলুন তো।

 আজান শোনার জন্য।

সুলতান সাহেব বললেন, এবারে রেডিও আনা হয় নি। তাড়াহুড়া করে এসেছি।

ইস্কান্দার আলি বললেন, কোন অসুবিধা নাই। অনুমানে রোজা ভাঙব। খালি চোখে যখন গায়ের পশম দেখা যাবে না তখন বুঝতে হবে সূর্য ডুবেছে।

রানু বলল, বা, ইন্টারেস্টিং তো। আমি কিন্তু আমার গায়ের পশম দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কি রোজা ভাঙবেন?

ইস্কান্দার আলি বললেন, আম্মা আরেকটু দেখি।

রানু বলল, আপনাকে দেখার এবং আপনার সঙ্গে কথা বলার আমার সখ ছিল। আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি।

 কি গল্প?

আপনি সারাবছর রোজা রাখেন, সারারাত জেগে ইবাদত করেন।

আম্মা গল্পের মধ্যে মিথ্যা আছে। সত্য গল্পের মধ্যে মানুষ আনন্দ পায় না। এই জন্যে গল্পের মধ্যে মিথ্যা মিশায়। শরীর সুস্থ রাখবার ব্যাপারে আমাদের ধর্ম খুব জোর দিয়েছে। সারারাত ইবাদত বন্দেগী করলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে।

আপনি কি আপনার সমস্ত কাজ-কর্ম হাদিস-কোরান দেখে করেন?

জ্বি-না আম্মা, করি না। করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া হাদিস-কোরান তেমন জানিও না।

আমার বাবা কিন্তু খুব ভাল জানেন। তিনি ধর্ম-কর্ম করেন না কিন্তু এই বিষয়ে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা।

ইস্কান্দার আলি এক পলক তাকালেন সুলতান সাহেবের দিকে তারপর সাহস করে বলে ফেললেন-যে বিদ্যা কাজে খাটে না সেই বিদ্যার কোন দাম নাই গো আম্মা।

সুলতান সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ইস্কান্দার আলি রোজা ভাঙছেন। সারাদিনের উপবাসী একজন মানুষ আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করবে। এই সময়টা তর্ক করে জটিল করা ঠিক না। তাছাড়া তর্ক তার সঙ্গেই করা যায় যে বোঝে। মওলানা সাহেবকে তিনি যদি বলেন কাজে খাটবে না ভেবে কী বিদ্যা অর্জন বন্ধ রাখা যায়? মওলানা কী ব্যাপারটা বোঝবেন? নবীজী বলেছেন-বিদ্যা অর্জনের জন্যে সুদূর চীনে যাও। তিনি তো বলেন নি যে বিদ্যা তুমি কাজে খাটাতে পারবে সেই বিদ্যা অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেও না।

ইস্কান্দার আলি প্রথমেই সবুজ রঙের খাবারটা খাচ্ছেন। টক-মিষ্টি খাবার। বাদামের গন্ধ আসছে। আল্লাহপাকের দুনিয়াতে কত খাবারই না আছে। এই খাবারটার নাম জিজ্ঞেস করাটা কী অভদ্রতা হবে। রানু মেয়েটা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ইস্কান্দার আলির মনে হল মেয়েটার আসল নাম রাণী। আদর করে তারা ডাকে রানু। দুটা নামই সুন্দর। বড়ই সুন্দর।

সুলতান সাহেব বললেন, আপনি এ-পর্যন্ত কয়টা রোজা রেখেছেন?

ইস্কান্দার বিনীত ভঙিতে বলল, ইয়াদ নাই জনাব। রোজার হিসাব রাখার চেষ্টাও করি নাই। যার হিসাব তিনি রাখবেন। আমার দরকার ইবাদত করা। নেকি-বদির হিসাব রাখার জন্যে দুই কাঁধে দুই ফিরিশিতা আছে। মানুষের হিসাবে ভুল-ভ্রান্তি হয়, ফিরিশতার হিসাবে হয় না।

সুলতান সাহেব বললেন, আপনি একদিন হাতে সময় নিয়ে আসবেন। ধর্ম নিয়ে আলোচনা করব।

আপনি আসতে বলছেন আমি অবশ্যই আসব। কিন্তু জনাব ধর্ম আলোচনা করতে পারব না। এই বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান-বুদ্ধি নাই।

রানু বলল, আমি তো শুনেছি পুরো কোরান শরীফ আপনার মুখস্ত।

ভুল শুনেছেন মা। মুখস্ত করার চেষ্টা করতেছি। হয়েও হয় না। গণ্ডগোল হয়ে যায়। আল্লাহপাক বিশেষ দয়া না করলে কোরান-মজিদ মুখস্ত হবে না। আম্মাজী, এই সবুজ মিষ্টি কি আরেকটু আছে।

 জ্বি আছে। আমি নিয়ে আসছি।

মিষ্টিটার নাম কি?

মিষ্টিটার নাম রানু-পছন্দ। আমার আবিষ্কার করা মিষ্টি-এই জন্যে আমার নামে নাম। মিষ্টিটা আপনি ছাড়া আর কেউ এতো পছন্দ করে খায় নি।

আম্মাজী, একেবার বেহেশতী মিষ্টি।

রানু খুশি খুশি মুখে মিষ্টি আনতে গেল। যাবার আগে বলে গেল আপনি ধীরে সুস্থে অন্য খাবারগুলো খান। মিষ্টি তৈরী নেই, বানিয়ে আনতে সামান্য দেরি হবে।

তাহলে থাক।

থাকবে কেন? দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।

ইস্কান্দার হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে সুলতান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, জনাব আপনার কন্যা উপস্থিত নাই এই ফাঁকে আপনাকে একটা কথা বলার ইরাদা করেছিলাম। যদি অনুমতি দেন।

সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে ফেললেন। মওলানা-টাইপ মানুষের বিশেষ কথা মানেই সাহায্য। ভিক্ষা-বৃত্তি। একটা কোন ফাঁক পেলেই এরা অভাব-অনটনের কথা বলবে। সুলতান সাহেব গম্ভীর গলায় বলেন, বলুন কি বলবেন?

মাহফুজ ছেলেটার প্রসঙ্গে একটা কথা।

কি কথা?

সে অতি ভাল ছেলে। মানব-দরদী। তার চিন্তা-ভাবনা সবই অত্যন্ত পরিষ্কার। জগতের নিয়ম হল ভালর হাত ধরে মন্দ ঢুকে।

জগতের নিয়ম বলার দরকার নেই- মাহফুজ সম্পর্কে কি বলতে চাচ্ছেন বলুন।

ছেলেটা খারাপ-পাড়া থেকে একটা মেয়ে নিয়ে গ্রামে আসতাছে। নাটক করবে।

তাতে সমস্যা কি?

জ্বি-না কোন সমস্যা নাই। উদ্দেশ সৎ হলে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু জনাব জগতের নিয়ম হল…

আপনাকে জগতের নিয়ম ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। মূল ব্যাপারটা বলুন।

মেয়েটা থাকবে আপনার বাড়িতে। এটা জনাব ঠিক হবে না। আপনি যে বাড়িতে থাকেন- রানু মা যে বাড়িতে থাকে।

আমার বাড়িতে থাকবে মানে? কই আমি তো কিছু জানি না। আমাকে কিছু না জানিয়ে আমার বাড়িতে একটা প্রসটিটিউট এনে তুলবে? কি বলছেন এসব?

তাহলে জনাব আমি ভুল শুনেছি। এরা আলাপ-আলোচনা করছিল সেখান থেকে শুনলাম।

শুনুন ইস্কান্দার সাহেব, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কয়েকটা দিন নিরিবিলিতে থাকার জন্যে এসেছি। বিশেষ কিছু দুর্ভাগ্যজনক কারণে আমার মেয়েটার মন অত্যন্ত খারাপ। কথাবার্তা বলে আমি মেয়েটার মন ভাল করতে চাই। এর মধ্যে বাইরের কেউ এসে আমাদের সঙ্গে থাকবে সে প্রশ্নই আসে না।

ইস্কান্দার আলি খাওয়া বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচু গলায় বললেন রানু মার কি হয়েছে?

তার কি হয়েছে সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই।

জ্বি জনাব, অবশ্যই। আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন।

আপনি কিছু খাচ্ছেন না। খান।

রানু সবুজ মিষ্টির বাটির নিয়ে ঢুকল। হাসি মুখে বলল, আপনাকে এই মিষ্টি রান্না করা শিখিয়ে দিয়ে যাব। খুব সহজ। সবুজ রং-টা কোন ব্যাপার না। এটা হল ফুড কালার। একটা শিশি আপনাকে দিয়ে যাব। আপনি রান্না-বান্না করতে পারেন না?

জ্বি আম্মা পারি। ডাল-ভাত, আলু-ভর্তা এই সব। জটিল কিছু পারি না।

রানু-পছন্দ মিষ্টি বানানো জটিল কিছু না। ইনগ্রেডিয়েন্টসও সবই হাতের কাছে পাবেন। শুধু শাদা সির্কা লাগবে। শাদা সির্কা নিশ্চয়ই পাওয়া যায়? এখানে পাওয়া না গেলেও নেত্রকোনায় তো পাওয়া যাবেই। আপনি নেত্রকোনা থেকে আনিয়ে নেবেন।

ইস্কান্দার আলি মৃদু গলায় বললেন, আম্মাজী, আপনার অনেক মেহেরবানী।

রানু আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মওলানা সাহেবের খাওয়া দেখতে তার খুবই ভাল লাগছে। সুলতান সাহেব তাকিয়ে আছেন বিরক্ত চোখে। হঠাৎ কেন জানি খুবই বিরক্ত বোধ করছেন। বিরক্তির কারণটা ধরতে পারছেন না। সন্ধ্যার এই সময়টা তিনি বাগানে হাঁটাহাঁটি করেন। মওলানার কারণে হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না– এটাই কি কারণ। তাকে ফেলে রেখে বাগানে চলে যাওয়া যায়। সেটাও ঠিক হবে না। মওলানাকে তিনিই চা খেতে ডেকে এনেছেন। অবশ্যি রানু আছে। মওলানার দায়িত্ব তার উপর দিয়ে চলে যাওয়া যায়। সেটাও বোধ হয় ঠিক হবে না। গ্রামের মানুষরা খুব সুক্ষ্মভাবে কিছু চাল চালে। শহুরে মানুষ সে-সব ধরতে পারে না। তাঁর সহজ-সরল মেয়েকে এসব চাল থেকে দূরে রাখতে হবে।

ভাল-মানুষ ভাবধরা এই মওলানা একটু আগে সুক্ষ্ম চাল চালল। মাহফুজ ছেলেটা একটা খারাপ মেয়ে নিয়ে আসছে সেই মেয়ে থাকবে তাঁর বাড়িতে। ঘটনার বড় অংশই মিথ্যা। তাঁর বাড়িতে মেয়েটার থাকার অংশটা। মাহফুজ কোন বোকা ছেলে না। সে তার বাড়িতে একজনকে রাখবে সেই বিষয়ে আগে কথাবার্তা বলে রাখবে না তা হয় না। তাহলে মওলানা এই মিথ্যা কথাটা কেন বলল?

এই ধরণের মানুষ কথায় কথায় নবীজীর প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। তার আদর্শ পালন করার জন্যে ব্যস্ততার সীমা থাকে না। আংগুলে আকিক পাথর পরা, চোখে সুরমা দেয়া এই সব সুন্নত কারণ নবীজী করতেন। আসল সুন্নতের ধারেকাছে কেউ নেই। আসল সুন্নত, তিনি মিথ্যা কথা কখনও বলেন নি।

সুলতান সাহেব থমথমে গলায় বললেন- মওলানা সাহেব, আপনার হাতে কি এটা আকিক পাথর?

ইস্কান্দার আলি বললেন, জ্বি জনাব।

আকিক পাথর কেন পরেছেন?

পাক-কোরানে আকিক পাথরের উল্লেখ আছে জনাব। তার চেয়েও বড় কথা নবীজী সাল্লাললাহু আলায়হে সালাম এই পাথর পরতেন।

ও আচ্ছা।

ইস্কান্দার আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। তিনি পরিস্কার বুঝতে পারছেন মানুষটা হঠাৎ রেগে গেছেন। হঠাৎ রাগার কারণটা কী? না-কী মানুষটার স্বভাবই হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *