দীপুর সাথে তার আব্বার সম্পর্ক একটু অদ্ভুত। মোটেই অন্য দশজন আব্বা আর তাদের ছেলের মতো নয়। দীপু তার আব্বার সাথে এমনভাবে কথা বলে যেন তিনি তার ক্লাসেরই একটি ছেলে। নিজের আম্মাকে কখনও দেখেনি, আব্বাই তাকে বড় করেছেন একেবারে ছেলেবেলা থেকে। কাজেই দীপুর আব্বাই তার সবচেয়ে বড় বন্ধু।
পা বিছিয়ে বসে ছিল দীপু। আব্বা ওর পায়ে ঝাঝালো গন্ধের কী একটা প্লাস্টার লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। আরামে দীপু আহ উহ করতে করতে আব্বাকে দিনের পুরো ঘটনা খুলে বলছিল। আব্বা চুপ করে শুনে যাচ্ছেন, ভালমন্দ কিছুই বলছেন না। দীপু আশা করছিল আব্বা তার পক্ষ নিয়ে বলবেন তারিক যে কাজটা করেছে সেটা অন্যায়। কিন্তু আব্বা একবারও তারিককে দোষ দিয়ে একটা কথাও বলবেন। না। দীপু বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি কি মনে করছ সব দোষ তা হলে আমার?
কে বলল সব দোষ তোর?
তা হলে—
তা হলে কী?
তারিক যে আমাকে ধোলাই দেবে বলল?
তা আমি কি করব?
দীপু চুপ করে থাকল, সত্যিই তো, ওর আব্বা কী করবেন? কিন্তু সমবেদনাটা তো ও পেতে পারে।
তা হলে তুমি বলছ মারামারি করি ওর সাথে?
আমি কিছু বলছি না।
ও যদি করতে চায়?
ইচ্ছে হলে করবি, ইচ্ছে না হলে করবি না, মার খাবি।
দীপু হাল ছেড়ে দিল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি ওর সাথে গন্ডগোল করতে চাই না, অথচ এমন পাজি, ইচ্ছে করে ঝগড়া করে জান আব্বা, এখনি সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে।
তুই কি মনে করিস সিগারেট খেলেই পাজি হয়?
হয়ই তো!
তা হলে আমিও পাজি?
যাও! দীপু হেসে বলল, তুমি কত বড় আর ও কত ছোট!
আমিও তো অনেক ছোট থেকে সিগারেট খেতাম।
দীপু খানিকক্ষণ অবাক হয়ে ওর আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যি যদি ওর আব্বাও অনেক ছোট থেকে সিগারেট খাওয়া শুরু করে থাকেন, তা হলে অবশ্যি সিগারেট খাওয়ার অপরাধে তারিককে পাজি বলা যায় না। ওর আব্বার মতো ভাল মানুষ পৃথিবীতে কয়জন আছে?
তবুও ছোটবেলায় সিগারেট খাওয়া শুরু করাটা সহজভাবে মেনে নিতে পারল। পাল্টা প্রশ্ন করল, তা হলে তুমি মনে কর ছোট থাকতে সিগারেট খেলে কোনো দোষ নেই? আমি সিগারেট খাওয়া শুরু করলে তুমি খুশি হবে?
তুই খাবি কেন?
যদি খাই।
তা হলে বুঝব তুই খারাপ ছেলেদের সাথে মিশতে শুরু করেছিস, সিগারেট খাওয়া শিখেছিস।
দীপু চোখ বড় বড় করে বলল, তাই তো বলছি তারিক সিগারেট খায়, এর মানে খারাপ ছেলেদের সাথে মেশে!
একশোবার। তাই বলে ও নিজেও খারাপ ছেলে তুই কেমন করে জানিস। হয়তো আবার ভাল ছেলেদের সাথে মিশে ভাল হয়ে যাবে! আর ও যে তোকে দেখানোর জন্যে সিগারেট খায়নি সেটা কে বলবে? ঐরকম বয়সে সবার ইচ্ছে হয় একটা কিছু দেখাতে।
দীপু আবার হাল ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে বলল, বেশ, তারিকের কোনো দোষ নেই, ও একটা বাচ্চা মহাপুরুষ।
আব্বা হেসে ফেললেন। বললেন, শোন, তোকে একটা কথা বলে রাখি।
কী?
তুই তারিককে দেখতে পারিস না, ঠিক?
দীপু একটু দ্বিধা করে মাথা নাড়ল।
তাই তারিকও তোকে দেখতে পারে না। যদি কখনও এরকম হয় যে তোর হঠাৎ তারিককে ভাল লেগে যায়, তা হলে দেখবি তারিকও তোকে বন্ধু মনে করবে।
দীপু মাথা নেড়ে বলল, তারিককে ভাল লাগা অসম্ভব। চেহারা দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। হলুদ দাঁত, কয়দিন যে দাঁত মাজে না কে জানে।
আব্বা বললেন, তারিককে দেখতে পারিস না বলে খালি তার দোষগুলো চোখে পড়ছে। খোঁজ নিয়ে দেখ, তারিকও তার বন্ধুদের বলছে, দীপুর চেহারা দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, খরগোসের মতো কান।
দীপু হেসে ফেলল। সত্যিই ওর কান ওর মুখের তুলনায় একটু বড়, কিন্তু এটা কি ওর দোষ?
.
দিনগুলো চমৎকার কাটছিল দীপুর, অনেক বন্ধু হয়ে গেছে ওর ক্লাসের সবার সাথেই ওর পরিচয়। প্রায় সবার বাসাতেই যায়, বন্ধুদের আম্মাদের এমন ঘনিষ্ঠভাবে খালাম্মা বলে ডাকে যে মনে হবে বুঝি কতদিনের পরিচয়। ওর নিজের বই পড়ার শখ। কাজেই যাদের বাসায় বই আছে, হেঁটে হেঁটে সেখান থেকে বই নিয়ে আসতে ওর কোনো ক্লান্তি নেই।
তারিক যদিও ধোলাই দেবে বলে শাসিয়েছিল, কিন্তু সেরকম কোনো চেষ্টা করল ন!! অবশ্যি ওর সাথে আর খাতিরও হল না। দুজন দুজনকে এড়িয়ে যায়। মাঝে মধ্যে মেজাজ খারাপ থাকলে তারিক অবশ্যি ঝগড়া খুঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। দীপু তেমন সুযোগ দেয় না।
স্কুলেও চমৎকার সময় কাটছিল, শুধু বুধবার করে ড্রিল-স্যারের ক্লাসটা আস্তে আস্তে অসহ্য হয়ে উঠল। প্রথমবারের পরে ও আর তেমন বেশি কিছু মার খায়নি, কিন্তু ভাল ভাল দুর্বল ছেলেগুলোকে মুখ বুজে মার খেতে দেখে দেখে ওর বিরক্তি ধরে গেছে। একদিন টাইফয়েড থেকে উঠে এসে কমল মার খেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। দেখে দীপুর এমন খারাপ লাগল যে বলার নয়! এই অর্থহীন মারপিট কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা নিয়ে সেদিন থেকেই সে সবার সাথে কথা বলতে শুরু করল। প্রথমে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন, তারপর ক্লাসের প্রায় সবাইকে নিয়েই সে ছোটখাট কয়েকটা মিটিং করল। তারিকের মতো দু-একজন ছাড়া সবাই দীপুর সাথে একমত হয়ে বলল সত্যি এটা বন্ধ করা দরকার। দৌড়ে যারা শেষে এসে পৌঁছুবে তাদের পিটিয়ে যাওয়া রীতিমত অন্যায়। দৌড়াতে না পারাটা কারো অপরাধ হতে পারে না।
অনেক আলোচনা করেও ঠিক করা গেল না কীভাবে এটা বন্ধ করা যায়। বেশির ভাগ ছেলেই বলল সবাই মিলে হেডস্যারের কাছে নালিশ করা হোক। অবশ্যি কেউই নিশ্চিত হয়ে বলতে পারল না হেডস্যারকে বললে ড্রিল-স্যারের উৎপাত বন্ধ হয়ে যাবে, না দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
নালিশ করার বুদ্ধিটা দীপু প্রথমেই বাতিল করে দিল। সোজা বলে দিল নালিশ করার মাঝে সে নেই। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় একবার একটা ছেলের কাছে মার খেয়ে সে স্যারকে নালিশ করে উল্টো নিজে মার খেয়েছিল। দীপু এখনও কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। হয়তো ঐ ছেলেটা শহরে ডেপুটি কমিশনারের ছেলে বলে স্যার তাকে শাস্তি দিতে সাহস পাননি। কিন্তু উল্টো সে নিজে কেন মার খেল এখনও চিন্তা করে পায় না। বাসায় এসে সে তার আব্বাকে ঘটনাটা খুলে বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল, আব্বা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে, তবু শোন বাবা, এরকম ব্যাপার অনেকবার ঘটবে। যত বড় হবি তত বেশি দেখবি। কাজেই কখনও কাউকে কিছু নিয়ে নালিশ করবি না। যাদের নিজেদের কিছু করার ক্ষমতা নেই শুধু তারা নালিশ করে।
দীপু কথাটা মনে রেখেছে। এর পরে সে কখনও কাউকে কিছু নিয়ে নালিশ করেনি। কাজেই এবারেও হেডস্যারের কাছে নালিশ করার বুদ্ধিটা সে সোজাসুজি বাতিল করে দিল। কিন্তু তার বদলে কী করা হবে সেট বলে দেয়া এত সহজ হল না।
সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ঠিক তক্ষুনি দীপুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ক্লাসের সবাই, সম্ভব না হলে বেশির ভাগ ছেলেদের রাজি করাতে পারলেই সে তার বুদ্ধিটা কাজে লাগাতে পারে। প্রথমে একজন দুজন, আস্তে আস্তে সবাই রাজি হয়ে গেল। পরের বুধবারের জন্যে তখন দীপু অপেক্ষা করতে লাগল খুব আগ্রহ নিয়ে।
বুধবারের ড্রিল ক্লাসে ড্রিল-স্যার সেদিনও সবাইকে লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে বলে দিয়েছেন, আজ শেষ পাঁচজন। স্যার যদি একটু লক্ষ্য করতেন তা হলে দেখতেন, ছেলেদের ভেতর আজ আর ভয়ের ভাবটা নেই, বরং একটু উত্তেজনা। সবার চোখ চকচক করছে।
স্যার বাঁশিতে ফু দিলেন, অন্য দিনের মতো সবার প্রাণপণে ছুটে যাবার বদলে আজ একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। সবাই মিলে এক লাইনে আস্তে আস্তে দৌড়াতে লাগল। প্রথমে একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল কিন্তু কিছুক্ষণেই সবাই লাইন ঠিক করে ফেলল। তারিক এবং আরও দু-একজন শুধু প্রাণপণে ছুটে যাচ্ছিল, দীপু জানত ওরা যাবে। কিন্তু যখন দেখল অন্যরা সত্যি এক লাইনে ছুটে যাচ্ছে, তখন আর একা দৌড়াতে ভরসা পেল না, তারিক এবং আর বাকি তিনজনও ফিরে এসে লাইনে মিশে গেল। তখন দীপুর ফুর্তির সীমা থাকল না।
ড্রিল-স্যারের বিস্ফারিত চোখের সামনে চল্লিশজন এক লাইনে তালে তালে পা ফেলে দেয়াল ছুঁয়ে আবার তালে তালে পা ফেলে ফিরে আসতে লাগল। এমন শৃঙ্খলা কখনও দেখা যায় না, রাস্তায় লোকজন দাঁড়িয়ে গেল মজা দেখতে। দৌড় শেষ হবার সময় সবাই দু’পাশে তাকিয়ে লাইন ঠিক করে নিল, আর দীপু যেরকম চেয়েছিল ঠিক সেরকম করে একসাথে লাইনে পা দিয়ে কয়েক পা ছুটে থেমে গেল।
আজ আর কেউ এগিয়ে যায়নি, কেউ পিছিয়েও পড়েনি, এবারে দেখা যাবে শেষ পাঁচজন কীভাবে বেছে নেন।
স্যার লম্বা লাইনটির দিকে তাকালেন, রাগে তাঁর মুখ থমথম করছে! হাতের বেতটি মুচড়িয়ে এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, এটা কার বুদ্ধি?
কেউ কোনো কথা বলল না।
কার বুদ্ধি এটা? প্রচণ্ড ধমকে অনেকে কেঁপে উঠল এবার, তবুও কেউ কোনো কথা বলল না। স্যারের মুখ অপমানে কালো হয়ে উঠল। দাঁত চিবিয়ে বললেন, যদি না বলিস তা হলে একধার থেকে মারতে শুরু করব। এমন মার মারব যা কোনোদিন দেখিসনি। এক মিনিট সময় দিলাম–
ভয়ের একটা কাঁপুনি দীপুর মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল। ও বুঝতে পারল এক মিনিট পর সত্যি স্যার একধার থেকে মারতে শুরু করবেন। দীপু ভেবেছিল ক্লাসের সব ছেলেকে কোনোদিন মারা সম্ভব না, তাই কাউকে মারবেন না। কিন্তু এখন দেখল এই স্যারের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব।
এক মিনিট পর আমি মারতে শুরু করব, এখনও বল কার মাথা থেকে এটি বেরিয়েছে। কে এই বুদ্ধি বের করেছিস এক পা এগিয়ে আয়। কেউ কোনো কথা বলল না। কয়েকজন আড়চোখে দীপুকে দেখার চেষ্টা করল।
দীপু ঠিক করল, ও স্বীকার করে নেবে। বুদ্ধিটা ওর, ওর একার জন্যে সবাইকে মার খাওয়ানো ঠিক হবে না। খামোকা পাঁচজনের মার খাওয়া বন্ধ করতে গিয়ে সবাইকে মার খাওয়ানো শুরু করিয়ে লাভ কী? দীপু শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে অল্প অল্প কাঁপতে লাগল।
এগিয়ে আয় এক পা, স্যার আবার চিৎকার করে উঠলেন।
দীপু এক পা এগিয়ে গেল, ওর মুখ ফ্যাকাসে, পা কাঁপছে থরথর করে। সহ্য করতে পারবে তো মার? কেঁদে ফেলবে না তো যন্ত্রণায়?
লাইনে বাকি ছেলেগুলো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ টিপু ছটফট করে উঠল। তারপর এক পা এগিয়ে এসে দীপুর পাশে দাঁড়াল। টিপুর দেখাদেখি কমল আর সাজ্জাদও এগিয়ে আসে সামনে। আর তাদের দেখাদেখি হঠাৎ পুরো ক্লাস এক পা এগিয়ে দীপুর দু’পাশে সারি বেঁধে দাঁড়াল। তারিক একা একা শুধু আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর সেও সাবধানে এগিয়ে এসে লম্বা লাইনে মিশে গেল।
দীপু দু’পাশে তাকাল—তার কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দু’পাশে চল্লিশজন ছেলের লম্বা সারি, সবাই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কোনো কথা বলছে না। কিন্তু দীপু বুঝতে পারছে ওরা কেউ ওকে একা মার খেতে দেবে না! ওর বুকের ভেতর জানি কেমন করে ওঠে, চোখে পানি এসে ঝাঁপসা হয়ে যায় সবকিছু।
সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, স্যার কাউকেই মারলেন না। অনেকক্ষণ ওদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর বেতটা ছুঁড়ে ফেলে পুরো ক্লাসটা ছুটি দিয়ে দিলেন। ওরা ফিরে যেতে যেতে দেখল, স্যার একা মাঠের মাঝে চুপচাপ বসে বসে সিগারেট খাচ্ছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। মনে হচ্ছে অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন হঠাৎ করে।
এর পরেও স্যার মাস তিনেক ছিলেন স্কুলে, তারপর রিটায়ার্ড করে চলে গেলেন। এর মাঝে একবারও নাকি একটি ছেলেকেও মারেননি।