লন্ডনে ফেরার পর আবার শুরু হল আমাদের রুটিনবাঁধা জীবন। সকালে গাড়ি নিয়ে দিব্যেন্দু, মা আর আমি একসঙ্গে ঘর থেকে বেরোই। আমি বিকেলে ফিরি। ওরা ফেরে রাতে। উইকএন্ডে আমি কখনও ওদের সঙ্গে, কখনও শীলা কিংবা স্কুলের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে শহরের বাইরে কোথাও বেড়াতে যাই। ছুটির দিন সারা সপ্তাহে জমিয়ে রাখা বাকি কাজ করি। আমি অবশ্য বাগানের কাজ ছাড়া কিছুই করি না। বাকি সব মা আর দিব্যেন্দু করে। দিব্যেন্দু এ বাড়িতে আসার পর আমাদের একটা লাভ হয়েছে। ওর একটা মস্ত বড় জাগুয়ার গাড়ি ছিলো। সেটা আমার স্কুলে যাওয়া আর মার অফিসে যাওয়ার সময় অনেক বাঁচিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া সন্ধ্যার পর টিউব স্টেশনগুলোয় মাতাল, গুন্ডা আর স্কীনহেড শয়তানদের উৎপাত লেগেই থাকে। গুন্ডারা কয়েকবারই মার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আমাকে একবার মারার জন্য তাড়া করেছিলো স্কীনহেড গুন্ডারা। দিব্যেন্দু বলে দিয়েছে সন্ধ্যায় স্কুলে দেরি হলে ওকে যেন ফোন করি। যখনই ফোন করেছি দিব্যেন্দু নিজে ড্রাইভ করে এসে নিয়ে গেছে।
রুটিনবাঁধা হলেও লন্ডনের জীবন কখনও নিরানন্দের মনে হয়নি। বিশেষ করে মার সঙ্গে দিব্যেন্দুর বিয়ের প্রথম বছর চমৎকার কেটেছিলো আমাদের। ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে ওদের প্রথম বিয়ে বার্ষিকীতে দিব্যেন্দু বড় একটা পার্টি দিয়েছিলো। আমাকে দিব্যেন্দু বলেছিলো, তোমার যত খুশি বন্ধু ইনভাইট করতে পারো তবে কতজন হবে সংখ্যাটা আগে বলে দিও। পার্টিতে আমার বন্ধু এসেছিলো চার জন। দুর্ভাগ্যের বিষয় লন্ডনে আমার কোনো বাঙালি বন্ধু নেই। আবার যারা এসেছিলো তারা কেউই ইংলিশ নয়। শীলার কথা আগেই বলেছি–সে ছিল লেবানি, ভিকি হচ্ছে ইন্ডিয়ান, জেন হাঙ্গেরিয়ান আর মাহমুদ জর্ডানের। মার এক দূর সম্পর্কের খালা থাকে ম্যানচেস্টারে, মার চেয়ে বয়সে সামান্য বড় হবে, সেও এসেছিলো। লন্ডনে দিব্যেন্দুর কোনো আত্মীয় ছিলো না, সবই বন্ধু। সবাই খুব দামী দামী উপহার দিয়েছিলো। ফুলে ফুলে সারা বাড়ি সেদিন বোঝাই হয়ে গিয়েছিলো।
মা আর দিব্যেন্দুর বিয়ের তারিখ ছিলো ডিসেম্বরের সাতাশ-এ। চারদিন পর নিউ ইয়াস ডে। মাকে বলে সেবার নতুন বছরের উৎসব করলাম স্কটল্যান্ডে। আমাদের সবচেয়ে বড়লোক বন্ধু ছিলো জেন। স্কটল্যান্ড গ্র্যাম্পিয়ন পর্বতের কাছে স্টার্লিং-এ ওদের মস্ত খামার বাড়ি। ওর দাদা এসেছিলো হাঙ্গেরি থেকে, এখন ওরা পুরো বৃটিশ হয়ে গেছে। আমাদের বারো জনকে ও বিশেষভাবে নেমন্তন্ন করেছিলো নতুন বছরটা ওদের ওখানে কাটাতে।
আমরা সবাই একদিন আগেই চলে গেলাম ট্রেনে চেপে। সেবার দারুণ মজার উৎসব হয়েছিলো তিন দিকে পাহাড়-ঘেরা জেনদের খামারবাড়িতে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে সবাই সারা রাত জেগেছিলাম। একটু পুরোনো ধাতের মানুষ হলেও জেনের বাবা দারুণ মজার সব গল্প বলতে পারে। খাওয়ার মেনুতে আমাদের জন্য বারবেকিউ ছিলো, নন অ্যালকহলিক ককটেল ছিলো আর ছিলো কয়েক রকমের প্রচুর সালাদ। আঠারো বছর না হলে হার্ড ডিং দেয়া যাবে না–এরকম সেকেলে নীতিতে বিশ্বাসী ছিলো জেনের বাবা।
জেনদের খামারে তিনদিন কাটিয়ে হালকা মনে লন্ডনে ফিরে এসে দেখি বাড়ির বাতাস কেমন যেন ভারি হয়ে আছে। দিব্যেন্দু আর মাকে যেরকম রেখে গিয়েছিলাম ওরা সেরকম আর নেই। রাতে খেতে বসে জেন-এর বাবার কাছ থেকে শোনা দুটো মজার জোক্স বলেছিলাম। শুনে মা সামান্য হাসলো কিন্তু দিব্যেন্দু যেন শুনতেই পায়নি এমনভাবে খেতে লাগলো।
আমাদের রাতের খাওয়া সাড়ে আটটার ভেতর হয়ে যায়। ঘুমোতে যাই দশটায়। এ দু ঘন্টা আমরা টিভি দেখি, নয়তো ভিডিও ক্লাব থেকে মার আনা কোনো বাংলা ছবি দেখি। মাঝে মাঝে, দিব্যেন্দু আর আমি আমাদের পছন্দের কোনো হরর নয়তো সাইফি ছবি আনি। আমরা দুজনেই সায়েন্স ফিকশন আর হরর পছন্দ করি। সেদিন টিভি র্যাকের নিচের তাকে দেখি দুটো নতুন হরর ছবি রয়েছে। দিব্যেন্দুকে বললাম, বাবা, তুমি কি এ ছবি দুটো দেখেছো?
বিয়ের পর আমি লক্ষ্য করেছি দিব্যেন্দুকে বাবা ডাকলে মা খুশি হয়। মাঝে মাঝে মাকে খুশি করার জন্য বাইরের কেউ না থাকলেও দিব্যেন্দুকে বাবা ডাকতাম। ও তখন রান্নাঘরে প্লেট ডিশ ধধায়ার কাজে মাকে সাহায্য করছিলো। আমার কথার জবাবে বললো, তোমার ইচ্ছে হলে দেখতে পারো।
দিব্যেন্দুর কথার ধরণ দেখে মনে হলো ওর ছবি দেখার তেমন ইচ্ছে নেই। মুড ভালো থাকলে ও বলতো, খবরদার, আমি আসার আগে টিভি অন করবে না। আমি একটা ফ্রেমও মিস করতে চাই না। তারপর ও আর মা দু কাপ কফি এনে সোফায় বসে। আমি ছবি চালাই। মা আমাদের সঙ্গ দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে বলে, সবগুলো হরর ছবি আমার একরকম মনে হয়। তোমরা কী যে মজা পাও আমি বুঝি না। আমার তো মাঝে মাঝে গা গুলোয়।
দিব্যেন্দুকে বললাম, তোমরা তাড়াতাড়ি এসো। আমি ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করছি।
আমাদের আগে যে এ ক্যাসেটটা নিয়েছিলো সে রিওয়াইন্ড না করে ক্লাবে ফেরত দিয়েছে। নির্ঘাত নতুন কোনো ইন্ডিয়ান মেম্বার হবে। এরা প্রায়ই ক্যাসেট রিওয়াইন্ড না করে ফেরত দিতে এসে জরিমানা দেয়। সেটা আবার পরে যে নেয় তার টাকা থেকে বাদ যায়। টাকা অবশ্য বেশি নয়, মাত্র পঁচিশ পি–তাই বা মন্দ কী। চারটা ক্যাসেটে এক পাউন্ড। এরকম প্রায়ই হয়। আমাদের পাড়ায় ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা বাড়ছে।
রান্নাঘরের কাজ সেরে দিব্যেন্দু একা এলো কফির কাপ হাতে। একটু পরে মা এসে শুকনো গলায় বললো, তোমরা ছবি দেখ। আমার মাথা ধরেছে, শোব। মা আর কিছু না বলে ওদের বেডরুমে ঢুকলো।
আমি ছবি ছাড়লাম। দিব্যেন্দু সোফায় ওর নিজের জায়গায় বসে এক মনে ছবি দেখতে লাগলো। তেমন আহামরি ছবি ছিলো না। দশ পনেরো মিনিট পরপরই বিজ্ঞাপন। আমাদের রিমোট খারাপ হয়ে গেছে কদিন হলো, নতুন কেনা হয়নি আলসেমি করে। বিজ্ঞাপন দেখানোর অবসরে, দিব্যেন্দুকে বললাম, তোমাকে এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন? শরীর ভালো আছে?
দিব্যেন্দু গম্ভীর হয়ে কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়লো। আমি আবার বললাম, মাকেও মনে হলো বেশ ডিপ্রেসড় । তুমি কি কিছু আঁচ করতে পেরেছো?
তোমার মায়ের শরীর ভালো নয়। এর বেশি দিব্যেন্দু কিছু বললো না। ওর গলাটা একটু রুক্ষ মনে হলো। মা সম্পর্কে কিছু বললে ও মার নাম ধরে বলে, কখনও–তোমার মা বলে না।
প্রথম দিকে ছবিটা সুবিধার মনে না হলেও একটু পরে বেশ জমে গেলো। একটা হন্টেড প্যালেসে একটার পর একটা ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটছে। অন্য সময় হলে দিব্যেন্দু আর আমি দম বন্ধ করে ছবি দেখতাম। অথচ তখন আমার একটুও ইচ্ছে করলো না ছবিটা দেখতে। দিব্যেন্দু যদিও তাকিয়ে ছিলো টেলিভিশনের দিকে, ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিলো ছবি সে মোটেও উপভোগ করছে না। কিছুক্ষণ পর আমি আস্তে করে দিব্যেন্দুকে জিজ্ঞেস করলাম, মার সঙ্গে কি কোনো ব্যাপারে তোমার মনোমালিন্য হয়েছে? মনোমালিন্য শব্দটা ভেবে বের করতে বেশ সময় লাগলো। যদিও মনে হচ্ছিলো বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে কথাটা, বাংলা ভালো জানলে হয়তো অন্যভাবে বলতে পারতাম। মার কড়া বারণ ছিলো বাড়িতে বিদেশী ছাড়া কারও সঙ্গে ইংরেজি বলা চলবে না।
দিব্যেন্দু আমার কথা শুনে একটু বিরক্ত হলো। ওর কপালে ভাঁজ পড়লো। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে বললাম, তোমাকে আমি আঘাত দিতে চাইনি।
একটু পরে দিব্যেন্দু ঠান্ডা গলায় বললো, সব মানুষের কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে অনীক। তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে বলেই তোমার জানা দরকার, সব কথা জানতে নেই। বিশেষ করে যা কারও একান্ত ব্যক্তিগত।
আমার বয়স ষোল। আমার বন্ধুদের চেয়ে পড়াশোনায় বেশি সিরিয়াস বলে অনেকে বলে বয়সের তুলনায় আমি নাকি অনেক ম্যাচিউরড। আমি জানি সব কিছু জানার ব্যাপারে আমার যে কৌতূহল আছে সেটা ঠিক ম্যাচিউরিটির পর্যায়ে পড়ে না। অনেকটা ছেলেমানুষি হয়ে যায়, তবু আমি এটা এড়াতে পারি না। আমার যে সব বন্ধু আছে তাদের কারওই এমন কোনো গোপন বা ব্যক্তিগত ব্যাপার নেই যা আমি জানি । শীলা, জেন, ভিকি নিজে থেকেই সব কথা বলে, ওদের কিছু জিজ্ঞেসও করতে হয় । আমার ব্যাপারে অবশ্য কাছের বন্ধুরা জানতে না চাইলে বলি না। কিন্তু এটা আমি বুঝি, বন্ধুর কাছে কোনো কিছু গোপন রাখা চলে না।
দিব্যেন্দু কথাটা যেভাবে বললো, মনে হচ্ছে ও আমাকে আর বন্ধু ভাবতে পারছে না। ওর কথা শুনে ওকে বন্ধু নয় বাবার মতোই মনে হলো, যারা কিনা শুধু উপদেশ দেয় আর চায় সব কিছু ওদের মতো করতে। নিজের বাবাকে কাছে না পেলেও অন্যদের বাবাকে তো দেখি–সব সময় ছেলেমেয়েদের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দিচ্ছে ছেলেমেয়েদের কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় সব বাবারা এ ব্যাপারে একমত । এমনকি জেনদের বাড়িতে যে গেলাম, শুনেছিলাম স্কটল্যান্ডের লোকেরা খুব খোলামনের হয়, কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। থার্টি ফাস্ট নাইটে জেন ওর বাবাকে অনেক ধরেছিলো বড়দের সঙ্গে আমাদেরও একটুখানি শ্যাম্পেন দিতে, বুড়োকে এতটুকু টলানো যায়নি।
বাবাকে নিয়ে মার সঙ্গে কখনও কোনো সিরিয়াস কথা হয়নি। বন্ধুদের বাবাদের দেখে কখনও মনে হয়েছে বাবা নেই, অনেক আরামে আছি। বাঙালী বাবারা ইউরোপিয়ানদের চেয়েও বেশি রক্ষণশীল হয়। এইটিথ সেঞ্চুরির উপন্যাসে যেমন দেখা যায় এখনও নাকি বাঙালি আর ভারতীয় বাবারা ছেলেমেয়েদের অনেক বয়স পর্যন্ত ফিজিক্যালি মারধর করে। কী ভয়ঙ্কর কথা! আমি ভাবতেই পারি না কেউ আমার গায়ে হাত তুলতে পারে! মা কখনও আমাকে মারেনি। কোনো কারণে বিরক্ত হলে ডেকে বুঝিয়েছে–আমার কাজটা অন্যায় হয়েছে। দিব্যেন্দুর সঙ্গে মার বিয়েতে আমি আপত্তি করিনি ও কখনও আমার ওপর বাবাদের মতো কর্তৃত্ব করবে না বলে । সত্যি কথা বলতে কী এখন পর্যন্ত করেনি। সেই রাতে হরর ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়েছিলো দিব্যিন্দু বুঝি আগের জায়গা থেকে সরে যেতে চাইছে।
ছবির দিকে মন না থাকলেও দিব্যেন্দু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো টেলিভিশনের দিকে। মনে হলো ও আমাকে উপেক্ষা করছে। কথাটা ভাবতে গিয়ে কষ্ট হলো আমার। বুকের ভেতরটা ভারি মনে হলো। ওকে বললাম, তুমি আমাকে বন্ধু বলেছো বলেই জানতে চেয়েছিলাম তোমাদের ভেতর কী হয়েছে। এটা যদি তুমি অনধিকার চর্চা মনে করো–ঠিক আছে এ ধরনের কথা আর কখনও বলবো না।
আমি আশা করছিলাম দিব্যেন্দু বলবে, ও কিছু নয়। এমনিতেই মন খারাপ। কিংবা বলবে–তোমাকে তিনদিন দেখতে না পেয়ে আমাদের সময় খুব খারাপ কেটেছে। তুমি এসেছো, সব ঠিক হয়ে যাবে। দিব্যেন্দু কোনো কথা বললো না। আমার বুকের ভেতর কান্না জমছিলো। মনে হলো এভাবে বসে থাকলে ঠিক কেঁদে ফেলবো। আমার দুর্বলতা প্রকাশ করে আমি দিব্যেন্দুর সহানুভূমি পেতে চাই না। ওকে গুড নাইট বলে উঠে চলে এলাম।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুতেই রাগ আর অপমানে আমার কান্না এলো। দিব্যেন্দু আমাকে এভাবে উপেক্ষা করবে আমি ভাবতেই পারছিলাম না। অথচ আমি কিছুই করিনি। কথাটা যতবার ভাবলাম ততবারই কেঁদে বালিশ ভেজালাম।
বাইরে থেকে সবাই বলে আমি নাকি খুব হাসিখুশি স্বভাবের। সারাক্ষণ সবাইকে মাতিয়ে রাখি। বন্ধুরা শুধু নয়, বড়রাও আমাকে পছন্দ করে আমার এই স্বভাবের জন্য। বন্ধুদের সঙ্গে আমি আমার আনন্দ শেয়ার করি, কিন্তু আমার কষ্ট শেয়ার করি না। কেউ আমাকে দেখে কখনও বুঝতে পারবে না প্রিয় কারও উপেক্ষায় আমি কী প্রচণ্ড কষ্ট পাই। একবার শীলা আমার সঙ্গে ডেট করে এক টার্কিশ ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলো প্রোগ্রাম বাতিল না করে। দেখা হওয়ার পর অবশ্য সরি বলেছে। তখন আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। অথচ শীলাকে এতটুকু বুঝতে দিইনি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। শীলা অবশ্য পরে বলেছে, আমার খুব খারাপ লেগেছিলো নিক। মেহমেট তোমার মতো নয়। ওর সঙ্গে আমি আর কোথাও যাবো না। শীলা যদি একথা না বলতে আমার সব সময় মনে হতো ও আমাকে উপেক্ষা করেছে।
সে রাতে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। পরে ঠিক করলাম মার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবো। মা নিশ্চয় দিব্যেন্দুকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে না। এক সময় মনে হলো দিব্যেন্দুর জায়গায় আমার নিজের বাবা থাকলে আমাকে এভাবে অবহেলা করতো না।
পরদিন আমার স্কুল ছিলো না। তখনও স্কুল খুলতে সাতদিন বাকি। সকালে নাশতার টেবিলে দিব্যেন্দুর সঙ্গে মার কিছু খুচরো কথা হলো রেডিওর এক প্রোগ্রাম নিয়ে। অনুবাদ বিভাগে নতুন এক মেয়ে এসেছে, ওর নাকি অনুবাদ ঠিক হয়নি। দিব্যেন্দু মাকে বললো সেই মেয়েকে সাহায্য করার জন্য। আমি ভেবেছিলাম দিব্যেন্দু গতরাতের ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। ও কিছুই করলো না। মাকে নিয়ে বেরোবার সময় শুধু বাই অনীক বলে চলে গেলো। ওর ওপর আমার খুব রাগ হচ্ছিলো। আগামীকাল শনিবার। ও যদি দয়া করে মাকে রেখে কোথাও যায় তবেই মার সঙ্গে একা কথা বলতে পারবো। আমার মন বলছিলো এ উইকএণ্ডে ও একাই বেরোবে।
দিব্যেন্দু আর মা চলে যাওয়ার পর গোটা বাড়িতে আমি একা। আমাদের বাড়িটার মালিক হচ্ছে এক বুড়ি মহিলা। মা অনেকবার কিনতে চেয়েছিলো, বুড়ি রাজি হয়নি। নিজেও অন্য জায়গায় ভাড়া থাকে, বলে এ বাড়ি হাতছাড়া করবে না। এ বাড়িটা একটু পুরোনো ধরনের হলেও বেশ আরামের। নিচে ড্রইং, ডাইনিং কিচেন আর লিভিংরুম। ওপরে তিনটা বেডরুম। একটা মা আর দিব্যেন্দুর, একটা আমার, আরেকটা অতিথিদের জন্য। বাড়িটার বাইরের দেয়াল পাথরের, ভেতরে ঘরের মেঝে আর সিঁড়ি কাঠের। সামনে কোনো জায়গা নেই, পেছনে বেশ বড় একখানা বাগান আছে। বাগানে দুটো আপেল গাছ আর একটা চেস্টনাট ছাড়া বড় গাছ নেই। কয়েকটা চিরসবুজ জাতীয় ছোট গাছের ঝোঁপ আছে। এপ্রিলে শীত চলে গেলে চারা বোনা হয়। পুরোনো টিউলিপ বেডগুলো মে মাস নাগাদ লাল, সাদা, বেগুনি টিউলিপে ঝলমল করে ওঠে। তখন থেকে মাসে একবার ঘাস ছাঁটতে হয়, সপ্তায় একবার শুকনো পাতা পরিষ্কার করতে হয়, গরমের সময় রোজ গাছে পানি দিতে হয়। বাগানের সব কাজ আমি নিজে করি। ফুল আর গাছ আমার ভালো লাগে।
একা বাড়িতে কিছুই করার নেই। শীলাকে ফোন করে পেলাম না। ভিকি আর জেনও বাড়িতে নেই। গতরাতে যে হরর ছবিটা দেখা বাকি ছিলো, কিছুক্ষণ ওটা দেখলাম। একটু পরেই একঘেয়ে মনে হলো। বুঝতে পারছিলাম এরপর কী হবে।
টেলিভিশন বন্ধ করে বাইরে বাগানে গেলাম। জানুয়ারি মাসের চার তারিখ, এখন পর্যন্ত বরফ পড়া আরম্ভ হয়নি। অন্যান্যবার ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বরফ পড়া শুরু হয়ে যায়। এবার নাকি ফেব্রুয়ারির আগে লন্ডনে বরফ পড়বে না। স্কটল্যান্ডে অবশ্য ডিসেম্বরের শুরুতেই বরফ পড়া আরম্ভ করে, এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না। লন্ডনের আবহাওয়া খুব খামখেয়ালি। বড়রা ঠাট্টা করে বলে মেয়েদের মন যেমন বোঝা যায় না, লন্ডনের আবহাওয়াও বোঝা যায় না। বিশেষ করে শরতে আর শীতে এরকম হয়। সকালে দেখা গেলো খটখটে রোদ, মিষ্টি আবহাওয়া, কেউ ছাতা নিয়ে বেরোয়নি, দু ঘণ্টা পরই কালো মেঘে আকাশ অন্ধকার হয়ে ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে প্যাঁচপ্যাঁচে বৃষ্টি শুরু হলো। যারা আবহাওয়ার বুলেটিন শোনে তারা অবশ্য খটখটে রোদের ভেতর ছাতা, রেইনকোট, সব সঙ্গে নিয়ে তৈরি হয়ে বেরোয়। বিপদে পড়ে তারা, যারা বাড়ি থেকে বেরোবার আগে বুলেটিন শোনে না।
সেদিন আবহাওয়া ছিলো চমৎকার। ঠাণ্ডা হলেও আকাশে রোদ ছিলা, এ সময়ে যা কদাচিৎ দেখা যায়। মাঝে মাঝে শুকনো ঠাণ্ডা বাতাসে শীতের ধার থাকলেও বিরক্তিকর ছিলো না। কিছুক্ষণ একা বাগানে হাঁটলাম। আপেল গাছের গোড়ায় ছোট্ট একটা গর্ত চোখে পড়লো। গত রোববারে বাগান পরিষ্কার করার সময় ওটা দেখিনি। বুকের ভেতরটা খচ করে উঠলো। ইঁদুরের গর্ত হলে ভয় নেই, বীভার বা ওই জাতীয় কিছু হলে আপেল গাছের শেকড় কেটে ফেলবে। এই আপেল গাছটা মা আর আমার দুজনেরই খুব প্রিয়। চমৎকার রঙ আর মিষ্টিও অনেক। অক্টোবর, নভেম্বর আর ডিসেম্বরে গাছতলায় আপেল পড়ে লাল হয়ে থাকে। মা বলে এই আপেল গাছ দেখলে নাকি গ্রামের বাড়ির কথা মনে হয়। মার গ্রামের বাড়িতে দুটো সিঁদুরে আমগাছ আছে। কালবৈশাখির ঝড়ের পর গাছতলায় টুকটুকে লাল আম এভাবে পড়ে থাকে। আমার আর মার প্রিয় আপেল গাছের গোড়ায় কোন পাজি জন্তু এভাবে গর্ত করেছে খুঁড়ে দেখতে হবে। মনটা ভালো ছিলো না, আপেল গাছের গোড়ায় গর্ত দেখে আরও খারাপ হয়ে গেলো।