২. দিদি ডাকের মর্যাদা

সুমিতা তার ছোট বোনকে ভালবাসত, ঘোটর মতোই মায়া করত, দিদি ডাকের মর্যাদা রাখত।

নমিতা সেই ভালবাসা সেই মমতা অগ্রাহ্য করতে পারত না, ছোটর মতোই খাকত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে দিদির থেকে নিজেকে অনেক বড় ভাবত। বুদ্ধিতে বড়, বিদ্যেতে বড়। সুক্ষ্ম রসবোধে আর শিল্প

সৌন্দর্য-সংস্কৃতির রুচিবোধে দিদিকে নিজের থেকে নেহাতই ক্ষুদ্র মনে হত তার।

নমিতা যে বিশিষ্ট একজন, আর সুমিতা যে শুধুই একটা জন মাত্র, এ ধারণা জন্মে গিয়েছিল নমিতার অস্থি-মজ্জায়।

পিতৃপক্ষের এবং পিসির পক্ষের আত্মীয়রা যখন দুই যমজ বোনের মধ্যে একজনকে ল্যাংড়া এবং অপর জনকে আমড়ার সঙ্গে তুলনা করত, নমিতা অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে দেখত, যারা করছে তারা কোন দরের লোক।

.

এমনি করতে করতেই ম্যাট্রিক পাস করল তারা।

বোকা সুমিতা প্রথম বিভাগে পাস করল, চালাক নমিতা দ্বিতীয় বিভাগে।

এটা যে নমিতার সম্পূর্ণ অবহেলার ফল তাতে আর সন্দেহ ছিল না। তবু সুমিতা যেন ওর ওই বিভাগটা নিয়ে মরমে মরে গেল। আর নমিতা সগর্বে বলে বেড়াতে লাগল, পরীক্ষায় গোটাকতক মার্ক বেশি পাওয়াই যাদের কাছে পরমার্থ, আমি তাদের দলে নই বাবা! বিবেকের দংশনে কিছুমাত্র কাতর হসনি দিদি, তুই মনের আনন্দে তোর ফার্স্ট ডিভিশনটা সোনার আলমারিতে তুলে রাখগে যা। ২৫৪

মেয়ে দুটো কলেজে পড়বে কি না পড়বে, এ কথা একবার উঠেছিল। মাস্টারমশাই নামক যে জীবটি আমাদের শৈশববাল্যের কর্ণধার ছিলেন, তিনি পিসিকে মা বলতেন। আর সেই সূত্রেই তাঁর যাতায়াত অব্যাহত ছিল। বলা বাহুল্য আমরা বড় হয়ে ওঠার পর অবধি পড়িয়ে চলবেন এত বিদ্যে ছিল না মাস্টারমশাইয়ের। কিন্তু হিতৈষীর পোস্টটা আঁকড়ে ছিলেন তিনি বরাবর।

যদিও পিসির মতো বুদ্ধিহীন মেয়েমানুষকে যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মা ডেকে সম্পর্ক পাতায়, তার বুদ্ধি বিবেচনার উপর আমার অন্তত কিছুমাত্র আস্থা ছিল না।

তথাপি মাস্টারমশাই বলেছিলেন, ভর্তি করতে হলে এখনই অ্যাপ্লাই করতে হবে, দেরি করাটা ঠিক নয়। কিন্তু পিসি কলেজের নামে নাক তুলেছিল। বলেছিল, কলেজে পড়বে কী? তুমি বলছ কি বাবা! ছিঃ!

মাস্টারমশাই আমাদের জন্যে অনেক জল ঢেলেছিলেন, কিন্তু মাটি ভিজল না। কঠিন থাকল পিসি, আর জীবনে এই দেখলাম, একটা ব্যাপারে পিসি আর পিসে একমত হল।

পিসেও বলল, তুমি বলো কী মাস্টার? কলেজে ভর্তি হবে কি? চাকরি করবে নাকি?

মাস্টারমশাই নগলায় বললেন, কলেজে পড়লেই যে চাকরি করতে হবে তার কী মানে? পড়ার জন্যেই পড়া। আজকাল কত মেয়ে কলেজে পড়ছে।

পিসে বলল, তা সে ফ্যাশানের জন্যে তো টাকা চাই, কলসির জল গড়াতে গড়াতে তো তলায় ঠেকেছে।

মাস্টারমশাই সবিনয়ে বলেছিলেন, ফ্রি-তে পড়ার ব্যবস্থা যদি করতে পারেন তিনি, তা হলে কি

.

পিসেমসাই ছিটকে উঠলেন।

বললেন, ছি ছি, বলো কী মাস্টার? বংশের একটা প্রেসটিজ নেই? দেবেশ মুখুজ্যের মেয়েরা পড়তে যাবে দয়ার ভিখিরি হয়ে?

আমাদের বংশের মর্যাদা সম্পর্কে পিসেমশাইকে কখনও মাথা ঘামাতে দেখিনি। অবাক হলাম।

তবে পিসির ব্যাপারে অবাক হবার কিছু ছিল না। পিসি তাঁর বাপের বংশের মান-মর্যাদা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। অহরহই ভাইঝিদের শিক্ষা দিতেন, মনে রাখিস কত বড় বংশের মেয়ে আমরা।

কাজেই পিসি যখন বলল, বলল কী প্রফুল্ল, মেয়েরা ধেই ধেই করে কলেজে পড়তে যাবে? বংশের একটা মান-মর্যাদা নেই?তখন আমরা অবাক হলাম না।

শুধু কলেজে পড়ব এমন একটা রোমাঞ্চময় আশা, কেবলমাত্র ছলনা করে গেল, এইটাই বুকে বাজল। পিসি যখন ও পথ দিয়ে গেছে তখন আর আশা বৃথা।

তবুনমিতা নামের দুঃসাহসী মেয়েটা বলে ফেলেছিল, কী হয় পড়লে? কত বড় বড় ঘরের মেয়েরা তো পড়ছে—

প্রফুল্ল মাস্টারও তাড়াতাড়ি বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমিও তো তাই বলছিলাম, কত বড় বড় ঘরে আজকাল

পিসি দৃঢ় গলায় বলেছিল, তা হোক। তুমি ও বুদ্ধি ছাড়ো বাবা! বরং বলে রাখি, দুটি সুপাত্রের সন্ধান এনে দাও আমায়! এইবার বিয়ে দিয়ে ফেলে আজন্মের দায় থেকে মুক্ত হই।

প্রফুল্ল মাস্টারের মুখটা অবশ্য আর প্রফুল্ল থাকেনি। কারণ, দিদির উপর বিশেষ একটা উচ্চ ধারণা ছিল তাঁর, হয়তো বা (ডবল বয়েস হওয়া সত্ত্বেও) একটু দুর্বলতা।

পড়লে দিদি যে একটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হবে এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তিনি রেজাল্ট বেরোনোর দিন থেকে বহুবার।

তাই সুপাত্র খোঁজার কথায় মুখটা বেচারার মলিন হল। যদিও সেই দুবুকে পকেট লাগানো খাকি শার্টের সঙ্গে বঙ্গলক্ষ্মী মিলের বেয়াল্লিশ ইঞ্চি ধুতি পরা নিরেটমুখো সেই লোকটার মুখের মলিনতা খুব বেশি রেখাপাত করল না আমার মনে। আমি শুধু অপেক্ষায় রইলাম, কখন একা হব, সুপাত্র খোঁজার ভার পেয়ে মাস্টারমশাইয়ের মুখের রং পরিবর্তন নিয়ে কখন দিদিকে খ্যাপাব।

মাস্টারমশাইকে নিয়ে খ্যাপাতাম আমি দিদিকে।

 দিদি অস্বস্তি পেত।

বলত, মাস্টারমশাই না গুরু! গুরুকে নিয়ে ওসব কী ঠাট্টা রে নমু? ছিঃ। ডবল বয়সী উনি আমাদের। আমি হি হি করে হেসে বলতাম, তাতে কী? মাস্টারমশাই তো তোকে দেখতে দেখতে গলে যান।

তা হলে তোকে দেখতেও দিদি ধমক দিতে চেষ্টা করত, দুজনে তো একই রকম দেখতে।

শোনো কথা! দেখতে হলেই হল? তুই হলি প্রথম বিভাগ, আমি তাই?

পিসি আর একবার জোর দিল, হ্যাঁ বাবা, ওই কথাই রইল। অনেক জায়গায় যাওয়া-আসা আছে তোমার, বিদ্যে বুদ্ধি কুলশীল আকার-প্রকার সব দিকে একরকম দুটি পাত্র তুমি দেখবে।

পিসির কথা শুনে মাস্টারমশাইয়ের হয়ে উত্তর দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার, তা হলে খুঁজে বার করো তোমার ভাইঝিদের শুভ-জন্মগ্রহণের পাঁচ-সাত বছর আগে তোমাদের সঙ্গে জাতিগোত্র কুলশীল মিলোনো আর কোথায় কোন ভদ্রমহিলা যমজ পুত্র প্রসব করেছিলেন এবং তারা সুস্থ শরীরে জীবিত আছে।

কিন্তু বলা গেল না।

পিসি সেই বাঁচালতা দেখে মূৰ্ছা যেত তা হলে।

প্রফুল্ল মাস্টার তাঁর পাতানো মাতৃদেবীর নির্দেশ অনুযায়ী পাত্র খুঁজতে শুরু করলেন, আর আমরা দুটি যুগলকমল প্রেম-ভালবাসা মিলন-বিরহের স্বপ্ন-সরোবরে ভাসতে লাগলাম।

কিন্তু সুমিতা কি সত্যি ভাসত?

সুমিতার মধ্যে কি সেই আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল?

বুঝতে পারতাম না।

এক থালায় ভাত খেয়ে, আর এক বিছানায় শুয়েও দিদির হৃদয়-রহস্য ঠিক ধরতে পারতাম না আমি। বুঝতে পারতাম না দিদির মধ্যে যৌবন নামক বস্তুটা উদ্বেল হয়ে উঠেছে কিনা। হঠাৎ এক ঝলক ফাগুনে-হাওয়ায় উতলা হয়ে ওঠে কিনা দিদি, আবেগে আবেশে কারও মুখের পানে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কিনা দিদির, আর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে একখানা চওড়া বুকের মধ্যে আশ্রয় নিতে, তার গলা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে কিনা তার।

সন্ধ্যাবেলা পিসি যখন রান্নাবান্না সেরে ঠাকুরতলায় পাঠ শুনতে যেত, আর পিসে বৈঠকখানায় দাবায় বসত প্রফুল্ল মাস্টারের সঙ্গে, তখন আমি চয়নিকাখানা খুলে ভোলা গলায় পাঠ করতাম–

হে আমার চির ভক্ত একি সত্য? সবই সত্য?
চির-মন্দার ফুটেছে আমার মাঝে কি?
চরণে আমার বীণা ঝঙ্কার বাজে কি?
 নিশির শিশির ঝরে কি আমায় হেরিয়া?
প্রভাত আলোর পুলক আমাকে ঘেরিয়া?

অথবা পাঠ করতাম—

আমার যৌবন স্বপ্নে যেন ছেয়ে গেছে বিশ্বের আকাশ

দিদি তথন দিব্যি ছুঁচ সুতো নিয়ে পিসির ফরমায়েশি সেলাইগুলো পেড়ে বসত। সেলাই না থাকলে সন্ধ্যার আগেই দিদি বলত, পিসি, রোজ হাঁফাহাঁফি করে কষ্ট পাও কেন? যাও না তুমি, রুটিগুলো না হয় আমি সেঁকে রাখব।

এক-আধদিন রেগে বলতাম, এই সুমি মুখপুড়ি, পোড়ারমুখি, ওইসব হতচ্ছাড়া কাজ ভাল লাগে তোর এ সময়?

সুমিতা হেসে বলত, কাজের আবার সময় অসময়। সেরে ফেললেই হয়ে গেল।

 বলত।

কিন্তু সেরে ফেলতে দিদি পারত না। দুঘণ্টা লাগত ওর খানকয়েক রুটি সেঁকতে। পিসি পাঠ শুনে এসে দেখত তখনও দিদি রুটি ওলটাচ্ছে। কিছু বা ছিঁড়েছে, কিছু বা পুড়িয়েছে। পিসি দেখে গালে হাত দিত।

নয়তো বলত, পারিস না, করতে আসিস কেন বাছা? যে পারে, সে তো উপর বারান্দা থেকে নামে না।

সেলাইয়েও তথৈবচ।

একটা বালিশের ওয়াড় সেলাই করতে দিদি দিনের পর দিন পাড়ত তুলত।

কোনও কোনও দিন আমি কেড়ে নিয়ে চটপট সেরে দিয়ে তুলে রেখে বলতাম, পড়, পড় একটু প্রেমের কবিতা, এরপর নইলে বরের কাছে ঠকে যাবি

দিদি হাসত। দিদির হাসিটা বড় মিষ্টি ছিল।

বলত, তুই পড়ছিস, শুনছি তো৷।

আমি পড়লেই তোর হবে? আমি খেলে তোর খাওয়া হয়?

 দিদি আরও হাসত, যমজের শুনেছি তাও হয়।

তবে শোন,বলে হয়তো আরম্ভ করতাম আমি

তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি শতরূপে শতবার।
যুগে যুগে অনিবার।

 দিদি খপ করে বলে বসত–তোর যেন সেই রাম না হতেই রামায়ণ।

রেগে বই মুড়ে বইয়ের কোনাটা ওর মাথায় ঠুকে দিয়ে বলতাম, ওরে মুখ, রাম না হতেই তো রামায়ণ। ঠাকুর এলে বসিয়ে রেখে তবে কি কোথায় চাল কোথায় কলা করে খুঁজে বেড়াতে হয়? আগে থেকে নৈবিদ্যি প্রস্তুত রাখতে হয়।

দিদি মিষ্টি করে হাসত।

 দিদির মুখটা তখন একটু বুদ্ধি বুদ্ধি দেখাত। ওই মুখটাই যে আরশিতে দেখি আমি, তা মনে হত না।

দিদি বলত, রাখ প্রস্তুত করে। তারপর অসাবধানে কোন ফাঁকে কুকুর-শেয়ালে মুখ দিয়ে যাক।

ওরে সর্বনাশ! আমি লাফিয়ে উঠে বলতাম, এই ভয়ে তুই মনের দরজায় তালা-চাবি লাগিয়ে বসে আছিস? যৌবনকে রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে রেখে দিয়েছিস?

দিদি বলত, ভারী অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস তুই।

তা হয়তো সত্যি।

আমাদের আমলের সভ্যতা ভব্যতার মাপকাঠিতে আমি হয়তো একটু অসভ্যই ছিলাম। শান্ত মিনমিনে ভাল মেয়ে জীবটা আমার অসহ্য ছিল বলেই হয়তো এই অসভ্যতা।

তা ছাড়া পিসির সংসারের ওই ছকে বাঁধা স্তিমিত ছন্দে আমাকে যেন আর আঁটছিল না। আমার জীবন-তরণী সাগরে ভাসাবার উদ্দাম আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছিল।…

কিন্তু আমি পিছিয়ে পড়লাম।

সাগরের টিকিট আমার জুটল না চট করে। এক ঘণ্টার সিনিয়রিটির দাবিতে দিদি সে টিকিট পেয়ে গেল, বিনা তদ্বিরে, বিনা আকুলতায়।

দিদিকে অবজ্ঞাই করে এসেছি চিরকাল, এই প্রথম হিংসে করলাম।

 কিন্তু শুধুই করলাম?

না, করতে শুরু করলাম?

 প্রফুল্ল মাস্টারই এনেছিলেন সুপাত্রের সন্ধান। কিন্তু একজোড়া নয়, একটা।

পিসি বলল, আমি তো দুটোকেই এক রাত্তিরে পার করতে চাই বাবা প্রফুল্ল।

মাস্টারমশাই বললেন, চাই বললেই কি সব সময় পাওয়া যায় মা? এটিকে বসিয়ে রেখে অন্য পাত্র খুঁজতে গেলে, এরা কি বসে থাকবে? অন্যত্র বিয়ে দিয়ে ফেলবে ছেলের।… একজনেরই লাগিয়ে দিন। একই দিনে জন্মেছে বলে যে একই রাত্রে বিয়ে হতে হবে তার কী মানে? দুদিনের নেমন্তন্নটা বা ছাড়ব কেন আমরা?

তারপর একটু দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলেছিলেন মাস্টারমশাই। বলেছিলেন, ওদের তো আর ছোট বড় বলে

কিছু নেই? যাকে হোক লাগিয়ে দেবেন।

সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়েছিল পিসি, উঁহু, ছোট-বড় আছে বইকী! এক ঘণ্টার বড়ও বড়। নমুকে আমি সুমিকে দিদি বলতে শিখিয়েছি, দেখনি? দিদির বিয়েই আগে হবে।

.

পিসি বলেছিল, মেয়েদুটোর মা নেই, বাপ নেই। মা বাপওলা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব।

তা পিসির প্রতিজ্ঞাপূরণ হলেও সাধ মিটল না।

পাত্রের মা বাপ আছে, কিন্তু থেকেও নেই।

বৃন্দাবনে গুরু-আশ্রমে থাকেন তাঁরা। অবিশ্যি ছেলেটাকে মানুষ করে রেখে গেছেন। চাকরি-বাকরি করে, কাকার বাড়ি থাকে। বিদেশে বদলি হবার আশা আছে।

শুনে পিসির পছন্দ হয়নি।

বলেছিল, ও আর কী-ভাল পাত্তর আনলে তুমি প্রফুল্ল?

আমি আড়ালে হেসে বললাম, এই খুঁত বর নিয়ে আসার পিছনে মাস্টারমশাইয়ের কোন মনস্তত্ত্ব কাজ করছে বুঝতে পারছিস দিদি?

দিদি সব দিনের মতোই বলল, দূর অসভ্য!

 কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের প্যাঁচ কাজে লাগল না। পাত্র সম্পর্কে আগে যতই নাক উঁচু করুক পিসি, দেখে একেবারে বিমোহিত হয়ে গেল।

দেখতে আসবে বলেছিল, না করলে মাস্টারমশাই অপদস্থ হবেন ভেবে রাজি হয়েছিল পিসি। বলেছিল, পরে ঠিকুজি কুষ্টির অমিল তুলে ভেঙে দেব। মা বাপ বৃন্দাবনবাসী, ও আবার কী সংসার।

কিন্তু দেখে ওই যা বললাম–মোহিত।

কনে দেখতে পাত্র নিজেই এসেছিল কিনা! পাত্র, আর তার বন্ধু।

 দীর্ঘসুন্দর দেহ স্বাস্থ্যে উজ্জ্বল, আর চুল থেকে নখ পর্যন্ত যেন প্রাণের দীপ্তিতে ঝকমক করছে। কথা ধারালো, হাসি সুন্দর। কে বলবে বৃন্দাবনবাসী মা বাপের ছেলে। হয়তো বা এ একরকম প্রতিক্রিয়া।

যাই হোক, পাত্র দেখেই পিসি জামাই বলতে শুরু করল। আর রূপ-গুণের কথা বলতে বলতে গলে গেল।…

বয়েস থাকলে নিজেই বোধ করি প্রেমে পড়ে যেত পিসি।

চালাকি কাজে লাগেনি, তবু শেষ চালাকি করেছিলেন মাস্টারমশাই। বলেছিলেন, একটা মজা করুন না মা! দুজনকে একরকম সাজিয়ে রেখে দিন। পরে নমিতাকে দিয়ে চা দেয়াবেন, খুব ধাঁধায় পড়ে যাবে।

পিসি এ মজাটায় মজা পেয়েছিল।

 বলেছিল, তা মন্দ বলোনি বাবা! তা ছাড়া বড় জামাইকে দেখিয়ে বলেও রাখি যদি ওর বন্ধু বা আত্মীয়ের মধ্যে কোনও পাত্তর থাকে। দুটি বোন জোড়ের পাখি, কাছাকাছি থাকতে পেলে বাঁচবে।

এ প্রস্তাব আমার কাছে অপমানকর। আমি এ প্রস্তাবে রাজি হব না ভেবেছিলাম।

এক ঘণ্টার দাবিতে দিদি টিকিট পেয়ে গিয়েছিল বলে রাগে হাড় জ্বলে যাচ্ছিল আমার। তবু রাজি হয়ে গেলাম। একটা বিবাহযোগ্য পুরুষের সামনে বেরোবার সুযোগ পেয়ে, সে লোভ ছাড়তে পারলাম না।

দুজনের এক সাজের অভাব ছিল না।

প্রত্যেক সময় একই সাজপোশাক হত আমাদের। আশৈশব।

সেই বছরেই পুজোর সময় দুজনেরই টুকটুকে লাল ভয়েলের শাড়ি হয়েছিল, বড় বড় সাদা রেশমের ফুল দেওয়া। দিদিকে তাই পরিয়ে কনে দেখানো হল।

মাথা নিচু করে বসে থাকল দিদি। কথার উত্তর না ই দিয়ে সারল। চা, জলখাবার দেবার সময় আমিও এলাম সেই সাজে, দিব্য সপ্রতিভ ভঙ্গিতে। ২৫৮

বলা বাহুল্য, ওরা প্রায় হোঁচট খেল। কনের একটি যমজ বোন আছে, এ কথা তাদের বলা হয়নি। কাজেই বিভ্রান্ত না হয়ে করবে কী? পিসেমশাই কনে দেখানোরূপ গুরুতর কর্তব্য সেরে দিয়েই কেটে পড়েছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের উপর ছিল বাকি ভার।

মাস্টারমশাই জলখাবার প্লেট নিয়ে এলেন, আমি চা।

ওরা অবশ্যই এমন দেখেনি।

কেই বা দেখেছে, ঘাড় হেঁট করে কনে দেখা দেখিয়ে, সে মেয়ে তক্ষুনি বীরদর্পে আবার এসে ঘরে ঢোকে আতিথ্য করতে!

অতএব ওরা প্রায় হোঁচট খেল।

বন্ধুটি বলল, আঃ, আপনি আবার কেন কষ্ট করে—

আমি তো প্রস্তুত হয়েই গেছি।

চটপট উত্তর দিলাম, তাতে কী? আপনারা এত কষ্ট করে সেই কতদূর থেকে এসেছেন।

বর চমকে তাকাল।

তারপর মৃদু হেসে বলল, আপনার পিসেমশাইকে খুব ভয় করেন, তাই না?

মাস্টারমশাই একটু তাড়াতাড়ি বললেন, তা করে।

 বোঝাই যাচ্ছে, ঠকেছে। তবু সেটা আরও দৃঢ় করলেন মাস্টারমশাই। পিসের উপস্থিতির জন্যেই যে তখন এগজামিনে কোন সাবজেক্ট ছিল তাই বলতেই গলা বসে যাচ্ছিল, এবং তাঁর অনুপস্থিতিতেই গলা খুলল, সেটা ধরে নিয়ে বরই বলে বসল, পিসেমশাইকে খুব ভয় করেন বুঝি?

মাস্টারমশাই বললেন, তা করে।

বর আবার বলল, আমি তো তখন সত্যি বলতে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করা মেয়ে, অথচ নাম জিজ্ঞেস করলে ঘাম ছোটে–

আমি খোলা গলায় বললাম, কে বললে ফাস্ট ডিভিশন? মোটেই না। ওটা মাস্টারমশাইয়ের চালাকি। আমি মোটেই ফার্স্ট ডিভিশন নই।

ওরা অবশ্য ঠাট্টা ভাবল।

আবার বলল, যাক ওটা না হলেও ক্ষতি নেই, আপাতত তো লেটার পেয়ে পাস।

আমিও আবার বললাম, পাস-ফেলের ব্যাপার তো মিটে গেছে আগে। এখন আর এটা পরীক্ষার হল নয়, আর আমিও পরীক্ষার্থী নই, এসেছি আতিথ্য করতে। খাবারগুলো গরম আছে, ঠাণ্ডা করবেন না।

বন্ধুটি বলে উঠল, এখন আর ওঁর ঠাণ্ডা-গরমে কোনও প্রভেদ নেই।

বাচালতা করব স্থির করেই গেছি, বিয়েটা পণ্ড হলেই যেন মঙ্গল, এই মনোভাব, মাস্টারমশাইও তার সমর্থক। কাজেই বলে উঠলাম, হঠাৎ অবস্থা এমন শোচনীয় হল যে? শীত-গ্রীষ্ম, শীতল-উষ্ণে প্রভেদ নেই।

অবস্থা শোচনীয় হবার জন্যে আপনিই দায়ী,বললে বর, তখন যেন উৎসাহে বরফ জল ঢাললেন, আর এখন

এখন গরম জল, চা। বললাম হেসে হেসে, তা ছাড়া পিসিমা আরও এক থালা পুলি গড়ে নিয়ে ভাজছেন, আপনাদের গরম খাওয়াবেন বলে।

বন্ধুটি বলে উঠল, ইস। বিয়ে কাজটা আগেই ঘটিয়ে বসে আছি বলে আফশোস হচ্ছে। এ বাড়ির জামাই হলে, অন্তত গরম গরম পিঠে-পুলিটা জুটত ভাল৷

আমি বললাম, তা আফশোস জিনিসটা কি ফুরিয়ে যাবার? হয়তো ওটা আপনার বন্ধুর ভাগ্যে তোলা থাকল। বাকি জীবনটা উনিই করতে পারবেন ওটা।

ঠাট্টা জিনিসটাও নাকি ভয়ংকর।

প্রতিকূল গ্রহনক্ষত্ররা নাকি অদৃশ্যলোকে বসে মানুষের উচ্চারিত শব্দের উপর তথাস্তু করে। বলে, ঠিক আছে, যা বলেছিস তাই হবে। তথাস্তু।

হয়তো আমার সেই ঠাট্টার সময় ওই তথাস্তু গ্রহ বসেছিল।

কিন্তু তখন তাকে দেখা গেল না।

তখন মনে হল সমস্ত গ্রহই অনুকূল।

.

পিসি আহ্লাদের সাগরে ভাসছিল। পিসে আসতেই বলে উঠল, কথা দিয়ে গেল।

 পিসেমশাই বললেন, যাবে না মানে? শালার মেয়েরা কি ফেলনা? বলি খাঁই-টাই কী রকম বুঝলে?

পিসি বলল, শোনো কথা। খাঁইয়ের তো নামগন্ধ নেই। মা বাপ দেখবে না, ছেলে কি নিজে খাঁই করতে বসবে? কিছু নেবে না।

পিসে বলল, নেবে মানে? কত বড় কুলিনের ঘরে বিয়ে করতে ঢুকবে, তা জানো?

পিসি বলল, জানব না কেন? তুমি যত বড় ঘরে ঢুকেছিলে!

রেগে বলল না, হেসে।

বাড়িতে হালকা-হাসির হাওয়া উঠছে। মাস্টারমশাইও চলে গেছেন হাসি দেখিয়েই। দেখিয়েছেন পিসিকে।

আমিও দেখাচ্ছি হাসি। হি হি করে হেসে হেসে বলছি, কীরে দিদি, লাগল কেমন?

দিদি বলল, আমার থেকে তুই বেশিক্ষণ দেখেছিস, তুই-ই বল।

আমার বলায় লাভ? বেল পাকলে কাকের কী?

দিদি হঠাৎ একটা খাঁটি কথা বলল। হঠাৎ এই রকম এক-একটা খাঁটি কথা বলে ফেলত দিদি। অবাক লাগত। মনে হত দিদি কি সত্যি বোকা? না ওটা ওর ছলনা?

দিদি বলল, তা বটে, তবে কাক বেচারিই বেলটা পাকাল এই যা দুঃখ।

তার মানে?

 মানে, তুই গিয়ে খই না ফোঁটালে, পাত্র পত্রপাঠ প্রস্থান করত।

যে কথা আমি ভাবছিলাম, সেই কথা দিদি বলল।

আমাকে অতএব বিনয় করতে হল।

বললাম, তোর বুঝি বিশ্বাস ওরা ধরতে পারেনি? মাথা খারাপ! মাস্টারমশাই বলেননি ভেবেছিস? ও বাবা ফাস্ট ডিভিশনেই মোহিত।

দিদি শুধু একটু হাসল। অবিশ্বাসের হাসি।

বললাম, বাজি ফেল। বল ও ধরতে পেরেছে, না আমাকেই তুই ভেবেছে?

দিদি বলল, বাজিটার হারজিত প্রমাণ হবে কী করে?

 জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।

জিজ্ঞেস করে জেনে নিবি? কাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবি তুই? বিমূঢ়ের মতো বলল দিদি।

কেন, তোর ভাবী বরকে? আমি একটা চিঠি লিখলে রাগ হবে তোর? দিদি আমার হাত চেপে ধরল। বলল, বাজে বাজে পাগলামি করিসনে নমু! কোথায় কী তার ঠিক নেই, রাস্তার একটা লোককে তুই চিঠি লিখতে যাবি? বাজিতে আমিই হারছি বাবা! হল তো?

এই স্বভাব দিদির।

 যুদ্ধের আগেই হার মানা।

তখন ভাবতাম দিদিটা ভীরু।

এখন অন্য কথা ভাবি। ভাবি, জেতার জন্যে লড়ালড়ি না করে হার মানার খাতায় নাম লেখানো শক্তিহীনতার চিহ্ন, না শক্তির চিহ্ন?

দিদির মধ্যে যে শক্তি ছিল, সেটা এতই সহজভাবে সংহত ছিল যে, দেখতে পাওয়া যেত না। সেটা যেন সমুদ্রের মতো গভীর। আমি যে শক্তির বড়াই করেছি, সেটা সমুদ্রের উপরের ঢেউ।

দিদি বাজিতে হার মানার খাতায় স্বাক্ষর দিয়েছিল, কিন্তু দিদিই জিতল।

বাসরে বসে বর স্বীকার করল, সে আমাকেই দিদি ভেবেছিল, এবং দুবার দুরকম প্রকৃতি দেখে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরেছিল, তবু ভাবতে পারেনি একজোড়া শাড়ির মতো অবিকল একজোড়া মেয়ে আছে এদের বাড়িতে।

দিদি বাসরে কথা বলেনি, আমিই চালিয়ে গেছি আলাপ।

বললাম, গোলকধাঁধায় পড়েও তো ভয় খেয়ে পালালেন না, সম্মতি দিয়ে গেলেন।

বর বলল, ভয় বস্তুটা নেই আমার। বরং ভয়ের প্রতিই আকর্ষণ।

তবু ঠকেছেন, এটা মানছেন তো?

 বর হেসে বলল, উঁহু, মানছিনা। রীতিমত লাভবানই হয়েছি। একটির বদলে দুটি পেলাম, স্ত্রীর সঙ্গে শালি! ফাউ জিনিসটা লোভনীয়। তা ছাড়া শাস্ত্রে বলেছে, শান্ত স্ত্রী আর মুখরা শালি এটাই পরম সুখের।

এ শাস্ত্র কে আপনাকে শেখাল শুনি?

সব শাস্ত্র শিক্ষা করতে হয় না, কিছু শাস্ত্র বাতাসে ফেরে। ধরো প্রেমশাস্ত্র।

রাগ দেখিয়ে বললাম, ও শাস্ত্রটা বেশ ভালমতো শিখে ফেলেছেন বুঝি আগে থেকেই?

দিদি আমায় চিমটি কেটে থামাল।

এইভাবে দিদির বাসর কাটল।

বিয়ের কদিন পর দিদিকে নিয়ে জামাইবাবু তার মা বাপকে দেখাতে বৃন্দাবন যাবার ঠিক করল।

আমার মনে হল দিব্যি একখানা হনিমুন বাগাল দিদি! আর একবার ঈর্ষা অনুভব করলাম। অথচ জীবনে এই প্রথম দিদির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার মুহূর্তে ভয়ানক একটা মন-কেমনের যন্ত্রণা বোধ করতে লাগলাম। দিদি তো কেঁদে কেঁদে মুখ ফুলিয়েই ফেলল। একবার পিসির কাছে আবেদন করেছিল দিদি আমায় নিয়ে যাবার জন্যে, কিন্তু পিসি মারতে এল। বলল, এমন কথা বাবার কালে শুনিনি। তুই যাচ্ছিস তোর বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি, ও অত বড় মেয়ে তোর সঙ্গে যাবে কোন সুবাদে?

আমার যাওয়া হল না।

জীবনে এই প্রথম দিদির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল আমার। বিয়ের পর এ কদিন দিদি তো প্রায় আমাদের বাড়িতেই ছিল, সঙ্গে জামাইবাবুও। কারণ ওর কাকার বাড়িতে আলাদা ঘর নেই।

মাস্টারমশাইকে একখানা বাসা খুঁজে রাখবার অনুরোধ জানিয়ে জামাইবাবুরা গাড়িতে উঠল।

দিদি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমায় দেখছিল, আর কাঁদছিল, আমারও চোখ শুকনো ছিল না। তবু যেই ওদের গাড়ি বেরিয়ে গেল, আমার মনে হল, দিদির ওটা লোক-দেখানো ন্যাকামি। যাচ্ছেন বরের সঙ্গে নাচতে নাচতে রেলগাড়ি চড়ে বেড়াতে, শুনছি নাকি ফেরার সময় দিল্লি-আগ্রা দেখে আসবে, এর মাঝখানে কিনা বোনের জন্যে অশ্রু বিসর্জন করছেন! সব বাজে। দেখানো- দেখো দেখো, আমি কত মহৎ, কত ভাল! দিদির প্রতি এই এক অদ্ভুত ভাব ছিল আমার। প্রবল ভালবাসা, অথচ তীব্র ঈর্ষা। আমার এই মনস্তত্ত্বের তত্ত্ব বুঝতে পারিনি আমি কোনও দিন।

একাধারে দিদি আমায় টেনেছে আর ঠেলেছে।

এ কি আমরা যমজ বলে?

কিন্তু দিদির ক্ষেত্রেও তো তা হলে একই হবে।

অথচ তা হয় না।

দিদি আমার প্রতি স্নেহে বিগলিত। দিদিও যদি আমাকে হিংসে করত, হয়তো ভাল হত আমার। সর্বদা দিদিকে উচ্চস্তরের আর নিজেকে নিম্নস্তরের ভাবার গ্লানি এমন রূঢ় যন্ত্রণা দিত না আমায়।

.

দিদি হিংসের কথা ভাবতেই পারে না।

আর কেনই বা করবে?

দিদি তো অবিরত জিতেই চলেছে। আমার সব কর্মে পটুত্ব এবং দিদির সব বিষয়ে অপটুত্ব থাকা সত্ত্বেও চিরদিন পিসি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি সবাই দিদিকে প্রশংসা করেছে, দিদিকে বেশি ভালবেসেছে।

কারণ?

কারণ দিদি শান্ত, দিদি নম্র, দিদি সকলের মনজোগানী।

ওইগুলো যে দিদির সহজাত, এটা যেন সব সময় বিশ্বাস হত না আমার, মনে হত সুখ্যাতির আশায় ও রকম নরম হয়ে থাকে দিদি। কিন্তু ভাবলে আর কি, জিতে তো যেত দিদি।

পরীক্ষাতেও দিদিই জিতল।

 রাতদিন বই নিয়ে বসে থেকে থেকে সিদ্ধিলাভ করল। ওটা আমার অসহ্য। তা ছাড়া আমি ভেবেছিলাম দু-পাঁচদিন পড়েই মেরে নেব আমি, দিদির সারা বছরের খাটুনির ফসলের থেকে, ওই পাঁচদিনের খাটুনিতেই ভাল ফসল ঘরে তুলব। হল না।

মাস্টারমশাইয়ের মতো নির্বোধ একটা বুড়োর বিহ্বল দৃষ্টি আমার কাছে হাস্যকর, তবু দিদির প্রতি ওঁর ওই দৃষ্টি আমাকে বেজার করত।

তারপর তো বিয়ে হয়ে জিতে গেল দিদি।

ওর মনের মধ্যে বিয়ের জন্যে চাহিদার সৃষ্টি হয়নি, তবু দিব্যি একখানা বর পেয়ে গেল ও। এক ঘণ্টার বড়র দাবিতে এই পাওয়া যেন নির্লজ্জতার মতো মনে হল আমার।

তাও বরটা কেন বোকা-হাঁদা বুদ্ধ হল না? কেন কালোকোলো মোটা বেঁটে হল না?

না, দিদির প্রতি শত্রুতার মনোভাব নিয়ে এ কথা বলছিনা আমি। শুধু বলছিলাম দিদি যা মেয়ে, যে কোনও রকম বরকেই মেনে নিত ও। ওর লোকসান হত না কিছু।

তাই ভেবেছি তখন।

ভেবেছি দিদিকে আমি পুরোপুরি পাঠ করে ফেলেছি, এবং বুঝে নিয়েছি, সব রকম অবস্থাকে মেনে নিতে পারত ও

কত ভুলই ভাবি আমরা মানুষের সম্পর্কে!

দিদির বিয়েটা আমার কাছে কিঞ্চিৎ জ্বালাস্বরূপ হলেও, উন্মাদনা-আমোদও ছিল বইকী! বিয়ের বারো-চোদ্দ দিন তো এখানেই প্রায় থেকেছে ওরা। পিসির সংসারের এই স্তিমিত ছন্দের উপর এ যেন একটা উত্তাল ঝড়, অন্ধকার অন্তঃপুরে আলোর বন্যা।

সর্বদা এক স্ফুর্তিবাজ এবং প্রায় বেপরোয়া যুবকপুরুষের সান্নিধ্য আমাকে যেন নেশাচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

জামাইবাবুর ওই বেপরোয়া ভঙ্গি অবশ্য পিসি ততটা দেখতে পেত না; পিসি জামাই-আদরের রসদ গোছাতেই ব্যস্ত থাকত।

আর পিসিরও মেয়েলি মনের জামাই বুভুক্ষা পরিতৃপ্ত হচ্ছিল। তা ছাড়া লোকের কাছে তো গল্প করতে হবে পিসিকে। পিসির এক মাসতুতো বোন আসত প্রায়ই, পিসির প্রাণের পুতুল। তাকে সব বলা চাই। আর বেশি করেই বলা চাই।

জামাইকে যে পিসি যথার্থ জামাই-আদর করছে সে গল্প করার জন্যেও আরও এত যত্ন পিসির।

পিসি নীচের তলায় সারাক্ষণ, আমরা দোতলায়। জামাইবাবু বিয়ে বাবদ যে ছুটি নিয়েছিল তার জের চলছিল, তাই সর্বদাই আছে বাড়িতে।

জামাইবাবু বলত, যদি সেকাল হত, এবং আমি একজন রাজা হতাম, তোমাদের দুজনকেই রানি করে ফেলতাম।

দিদি ইতিমধ্যেই ওর বরে একেবারে নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিল। বরকে দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যেত, কিন্তু কথা বেশি বলতে পারত না। ও রকম কথায় বড়জোর বলত, তা হলে অবশ্যই একজন দুয়োরানি হত, আর আমারই দুয়োরানি হবার চান্স থাকত বেশি।

জামাইবাবু হেসে উঠে বলত, কেন? হঠাৎ এহেন সন্দেহের হেতু?

বাঃ, আমি যে বড়। বড়রানিরাই তো দুয়োরানি হয়।

দিদি কি তার অসতর্ক উক্তিকে ওইভাবে আবার ঢেকে নিত? না দিদির সরল বিশ্বাসী মন ওই ভাবেই ভাবত?

জামাইবাবু ও কথা হেসে ওড়াত। আচমকা আমাদের দুজনকে দুহাতে জাপটে ধরে বলে উঠত, আমার কাছে দুয়োর পাট নেই। দুজনেই সুয়ো৷ ২৬২

কৌতুকছলে হলেও ওই নিবিড় পুরুষ-স্পর্শ নিথর করে দিত আমাকে। মনে হত এই মুহূর্তটুকু চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে থাক, ডুবে যাক বিশ্ব চরাচর। কিন্তু সেই মনে হওয়াটাকে সবলে বিসর্জন দিয়ে হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলতাম, দিদি না হয় আপনার বউ, যা ইচ্ছে করতে পারেন। আমায় কেন?

জামাইবাবু বলত, দিদি বউ, তুমি মৌ। আরও মিষ্টি।

আমি অবাক হয়ে ভেবেছি, দিদি কেন রাগ করত না। আমি হলে নির্ঘাত রেগে-জ্বলে কুরুক্ষেত্র করতাম। দিদি কি এত বেশি পেয়ে গিয়েছিল যে, ওই উপচে পড়া ফেনাটুকুতে দৃকপাত করত না? না কি এ ওর সেই ছেলেবেলার মনোভাব। একটা খেলনা কি একটা পুতুল পেলে যেমন বিনা দ্বিধায় আমাকেই সেটা দিয়ে দিত দিদি, এও তাই?

তা সত্যি বলতে, রাতটুকু বাদ দিলে দিনের সময়ের অধিকাংশ আমিই দখল করে রাখতাম জামাইবাবুকে। গল্পে তর্কে গানে আবৃত্তিতে আমাদের দুজনের জমজমাটি আসরে দিদি যেন দর্শকমাত্র, শ্রোতামাত্র। অথচ দিদির মুখ আহ্লাদে জ্বলজ্বল করত, দিদির চোখ খুশিতে উদ্ভাসিত থাকত।

এটাও আমার কাছে অপমানকর ছিল বইকী!

এতে যেন দিদি আমার স্তর থেকে অনেকটা উচ্চস্তরে উঠে যেত। মনে হত দিদি তার অগাধ ঐশ্বর্যের এক কণা আমায় উপহার দিয়ে আত্মতৃপ্তির সুখ উপভোগ করছে।

আর রাত্রে যখন দিদি আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে খিলটা লাগিয়ে দিত, আমি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবতাম, কাল থেকে আর দিদির ওই কৃপার উপহারটুকু নিয়ে কৃতার্থ হব না আমি। জামাইবাবুকে অবজ্ঞা করব অগ্রাহ্য করব, কথার উত্তরে উছলে উঠব না। নিজের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকব। বহুক্ষণ ঘুম আসত না, ওই প্রতিজ্ঞাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতাম, দেখতে চেষ্টা করতাম তার প্রতিক্রিয়া।

কিন্তু সকাল হতেই যেই জামাইবাবু তার দীর্ঘ বলিষ্ঠ অপরূপ আকর্ষণীয় চেহারাটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই বলে উঠত, শালির নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে? তখন চুপ করে থাকতে পারতাম না। উছলে উঠেই বলে উঠতাম, হবে না কেন? আমার তোে অর্ধরাত অবধি জাগরণের পালা ছিল না।

জামাইবাবু হেসে উঠে বলত, নাঃ, একটা ভায়রাভাই জোগাড় করে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি নেই।

তীক্ষ্ণ হতাম আমি, আপনার অশান্তিটা কী?

বাঃ, নেই? একজন তৃষিতের সামনে বসে শীতল পানীয় পান করায় বিবেকের একটা দংশন নেই? আবার কথায় কথা বাড়ত, তর্ক জমত, ঝগড়া রাগারাগি সব কিছুর পালা চলত। সকালবেলাটা একছত্র অধিকার থাকত আমার। কারণ, দিদি সে সময়টা কিছুতেই দোতলায় বসে থাকত না, পিসির সাহায্যার্থে নীচে নেমে যেত, রান্নাঘরে বসে থাকত।

রেগে বলতাম, দিদি, পিসি তো একাই একশো! তুই আর সমুদ্রে শিশির বিন্দু ঢালতে যাস কী জন্যে?

দিদি বলত, তা হোক, শিশির বিন্দুরও একটা কর্তব্য আছে।

সে কর্তব্য এ ভদ্রলোকের উপরও থাকা উচিত। পিসির কাছে দু ঘণ্টা বসে থেকে তুই হয়তো পিসির দুটি শাক বেছে দিবি, কি চারটি কড়াইশুটি ছাড়িয়ে দিবি, কী বা লাভ হবে তাতে পিসির? অথচ এখানে তুই থাকা মানেই জামাইবাবুকে শীতলতার সাগরে ডুবিয়ে রাখা!

এখানে তো তুই আছিস, দিদি হেসে উঠত। বলত, তুইও একাই একশো!

রেগে বলতাম, অত বিশ্বাস করিসনি দিদি, ইচ্ছে করলে তোর বরকে কেড়ে নিতে পারি তা জানিস?

দিদি সেই অদ্ভুত মিষ্টি হাসিটা হাসত তখন। বলত, যে জিনিস কেউ ইচ্ছে করলে কেড়ে নিতে পারে, সে জিনিস থাকা না থাকায় তফাত?

চমৎকার! তোর গায়ের গয়নাগুলো রাস্তায় ফেলে রাখ তা হলে?

তা কেন? ওগুলো তো জড়বস্তু। ওর কি নিজস্ব সত্তা আছে?

ওসব পণ্ডিতি কথা রাখ। কখন কী হয় কে বলতে পারে?

তা না হয় পারে না,–দিদি হাসত, তোরই বা হঠাৎ অন্যের বর কেড়ে নেবার ইচ্ছে হবে কেন? তুই কি যে-সে?

আমি সামলে নিতাম নিজেকে।

ব্যাপারটাকে স্রেফ তরল ঠাট্টার খাতে গড়িয়ে দিতাম। বলতাম, তা হাতের কাছে নিজের বর পাচ্ছি না যখন।

ওরা দুজনেই হেসে উঠত।

 রাতারাতি ওর একটা বর জোগাড় করো দিকি, বলে দিদি বরের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে চলে যেত।

আমি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতাম, সেই যাচ্ছিস তো শাক বাছতে? মরগে যা! আমরা এখন রবীন্দ্রকাব্য-পাঠ সভা বসাচ্ছি।

দিদি অনুচ্চ পরিষ্কার গলায় উত্তর দিয়ে যেত, বসাস ক্ষতি নেই, বেশি গলা খুলিসনে। পিসেমশাইয়ের কানে না পৌঁছলেই ভাল।

আমি অতঃপর বাবার বইয়ের আলমারির চাবি খুলতাম।

 এ ছাড়া অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে এখানে বসিয়ে রাখবার যুক্তিই বা কী? শুধু দুজনে গল্প?

বেশিক্ষণ জমে না।

 কথা খুঁজে পাওয়া যায় না।

অথচ দিদি যতক্ষণ থাকে দুজনেরই মুখে খই ফোটে।

জামাইবাবু বলত, তোমার বাবার এই বইয়ের আলমারিগুলো দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। ভদ্রলোক হয়তো সব পড়েও যেতে পারেননি।

আমি আবহাওয়া গম্ভীর করতে রাজি হতাম না। বলতাম, তা পৃথিবীর নিয়মই এই, ধনবানে কেনে বই, জ্ঞানবানে পড়ে।

তবে পড়ুন জ্ঞানবতী মহিলা!

আমি দু-একখানা বই নিয়ে পাতা ওলটাবার ভান করতাম। অথচ আমি জানতাম কী পড়ব আমি। প্রেমের কবিতাই বেছে বেছে পড়তাম।

একদিন নারীর উক্তি পড়ছিলাম চয়নিকা থেকে। লজ্জার বালাই রাখিনি আমি, বেশ খোলা গলায় পড়েছিলাম–

আমি কি চেয়েছি পায়ে ধরে,
ওই তব আঁখি তুলে চাওয়া,
 ওই কথা, ওই হাসি, ওই কাছে।
আসা-আসি।
অলক দুলায়ে দিয়ে হেসে চলে
যাওয়া?
কেন আন বসন্তনিশীথে আঁখিভরা আবেশ বিহ্বল—

হঠাৎ দিদি দোতলায় এল। এমন আসে না কোনওদিন।

আমার সহসা মনে হল দিদি আমাদের উপর আচমকা ইনস্পেকশন চালাতে এসেছে। কেঁপে উঠলাম যেন। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হল। তাড়াতাড়ি বললাম, এই দেখ দিদি, তোর হয়ে নারীর উক্তি শুনিয়ে দিচ্ছি জামাইবাবুকে।

দিদি একটা ড্রয়ার খুলছিল। অবাক হয়ে বলল, কী বলছিস?

বলছি তোর কথাটা আমিই শোনাচ্ছি

দিদি হেসে বলল, আমার আবার কথা কি?

তোর কোনও কথা নেই?

কই, মনে পড়ছে না তো!

আমি সামলে উঠলাম। বললাম, তবে এসেছিলি কী করতে মরতে রসভঙ্গ করতে?

দিদি হেসে বলল, তোদের রসভঙ্গ করি, এ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি বাপু। পিসিমা নিমকি কাটবার জন্যে একটা পাতলা ছুরি চাইলেন–

ড্রয়ার থেকে পাতলা ছুরিখানা নিয়ে চলে গেল দিদি তাড়াতাড়ি।

জামাইবাবু চেঁচিয়ে বললেন, ওহে মহিলা, ছুরিখানি এই হতভাগ্যের বক্ষে বিদ্ধ করে গেলেই ভাল হত না?

দিদি একটু দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে হেসে বলে গেল, তোমাদের জমজমাটি আসরের উপর তো ছুরিকাঘাত করেই গেলাম!

আমি বই মুড়ে ফেললাম।

 দিদি চলে যাবার পর সত্যিই আর পাঠ জমল না।

আমি বইটা ঠেলে রেখে বলে ফেললাম, ছুরিটা ছুতো।

 জামাইবাবু চমকে বললেন, কী বললে?

 বলছি, দিদি ছুরির ছলে আমাদের উপর চোখ ফেলতে এসেছিল।

এরকম কথা আমি কোনওদিন বলিনি।

 সেদিন ইচ্ছে করে বললাম।

আমি যেন কিছু একটা উদঘাটিত করতে চাইছিলাম। এই ধরনের প্রসঙ্গ এনে ফেলে ভয়ংকর খাদের পথে পা বাড়াতে চাইছিলাম।

কিন্তু জামাইবাবু যেন আমার গালে একটা চড় মারল।

জামাইবাবু বলল, তোমার দিদি স্বর্গের দেবী নমিতা! ও জিনিস ও ভাবতেই পারে না।

ঘরে এসে সত্যিই নিজের গালে নিজে চড় মারলাম আমি। আর ভাবলাম আর নয়, আর নয়।

কিন্তু ওর সঙ্গে কথা না কয়ে থাকতে পারি না কেন?

.

সর্বদা ওর আশেপাশেই ঘুরতে ইচ্ছে করে কেন?

একদিন পিসি বলেছিল, হ্যাঁ রে নমি, তুই সর্বদা প্রিয়মাধবের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিস কেন বল তো? বড় হয়েছিস!

আমি কড়া গলায় বললাম, কেন, সন্দেহ হচ্ছে খারাপ হয়ে যাব?

পিসি থতমত খেল।

বলল, বাবাঃ, যেন ফণাধরা কেউটে! তোর সঙ্গে কথায় কে পারবে!

পিসে বলল, আর এ-ও বলি, নতুন জামাই এতদিন শ্বশুরবাড়িতে কেন?

পিসি আবার তৎক্ষণাৎ ফণাধরা কেউটের মতো ফোঁস করে উঠল।

বলল, আছে, বাড়িটা ওর শ্বশুরের বলে। পিসেশ্বশুরের বাড়ি হলে থাকতে আসত না। ও ভদ্দর ছেলে, তাই আলাদা বাসা খুঁজছে, নইলে ইচ্ছে করলেই তো এখানে থাকতে পারত।

থাকতে পারত? পিসে ভ্যাবলার মতো বলল, চমৎকার।

পিসি বলল, অবাক হচ্ছ কেন? পারতই তো, সুমির আর নমিরই বাড়ি, মনে রেখো সেটা।

পিসের কাছে কোনও সময় হারবে না পিসি, তা নিজের স্বার্থে ঘা পড়লেও। অথচ একদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ি থাকতে পারে না দুজনে।

পিসি একটু গঙ্গা নাইতে গেলে, যতক্ষণ না ফেরে, ছটফট করে পিসে।

.

তা এইসবের পরের দিনই বৃন্দাবনে গেল ওরা।

 দেদার কাঁদল দিদি।

আর আমার মনে হল, কান্নাটা দিদির ছল।

ও যেন আমাকে দুয়ো দিয়ে সেজেগুজে বরের সঙ্গে গাড়িতে উঠল।

জামাইবাবুর মুখে কী প্রসন্নতা!

তার মানে, আমাকে নিয়ে ওর শুধু মজা। আমি ওর খুশির খেলনা, ওর কৌতুকপ্রিয় প্রকৃতির কৌতুকের একটা উপকরণ। দিদিই প্রাণপুতুল। হ্যাঁ, এ কথা আমায় বলেছিল জামাইবাবু, বলেছিল দিদিকে দেখতে এসে দিদির শান্তশিষ্টনমূর্তি ওর মনে কোনও দাগ বসাতে পারেনি। পরে আমার চপলতাতেই আকৃষ্ট হয়েছিল, এবং এক কথায় কথা দিয়ে গিয়েছিল। তবে এও বলেছিল, কিন্তু পরে দেখলাম, ঘটনাটা ওভাবে না ঘটলে ঠকতুম। তোমার দিদি একটুকরো খাঁটি সোনা।

সেই খাঁটি সোনাটি নিয়ে খাঁটি বোষ্টম মা বাপের কাছে দর্শন দিতে গেলেন প্রিয়মাধববাবু, মাস্টারমশাই ছলছল চোখে ওদের মোটঘাট গাড়িতে তুলিয়ে দিল।

হয়তো মাস্টারটিকে নিয়ে খেলতে পারতাম। দিদিকে মুছে ফেলতে পারতাম ওর মন থেকে, কিন্তু সেটা বড়ই অরুচির।

এই প্রথম নিঃসঙ্গতা অনুভব করলাম জীবনে। আর দিদির স্নেহ, দিদির একান্ত ভালবাসা মনে পড়ে হৃদয় দীর্ণ-বিদীর্ণ হতে লাগল, নিজের প্রতি ধিক্কার এল। পিসির কাজের সাহায্য করতে শুরু করলাম।

.

কিন্তু সেই শ্মশান-বৈরাগ্য আর কদিন?

 দিদিরা ফিরল।

ওদের তখন বাসা ঠিক হয়ে গেছে। মাস্টারমশাই জোগাড় করে রেখেছে। আর পিসি মাস্টারের সঙ্গে গিয়ে উনুন পেতে, ভাঁড়ার গুছিয়ে রেখে এসেছে। দিদির যে বাবার বাড়ির ভাগের কথা মনে পড়েনি, এই কৃতজ্ঞতায় অনেকটা করছে পিসি।

.

দিদিরা বাসার খবর জেনেছিল।

 দিদিরা স্টেশন থেকে সেই বাসায় এসে উঠল।

প্রথম দিন পিসিই রান্না করে দিতে এসেছিল।

আমিও সঙ্গে গিয়েছিলাম।

 আমিই দিদিকে আগে দেখলাম জানলা থেকে।

দেখলাম, দিদি বেশ একটু বদলে গেছে। দিদি আর সেই পাতলা গড়নের রূপসী তরুণী নেই, যেন বেশ একখানি ভরাট-দেহ যুবতীতে পরিণত হয়েছে।

এই কদিনেই এত চেঞ্জ? ছিঃ!

 হিংসে করব না অবজ্ঞা করব? দেহের এই ভরাটত্ব কি মনের পূর্ণতার ছায়া নয়?

সম্পূর্ণ একা একা যুগল ভ্রমণে ওরা যে পরিপূর্ণতার স্বাদ পেয়েছে, তা তো ওদের মসৃণ মুখে, গভীর চোখে, আর কথার মধ্যেকার নিবিড় ব্যঞ্জনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এই জন্যেই বোধ করি বুদ্ধিমানের দেশে হনিমুনের প্রথা। অনেকজনের মধ্যে, সমাজ-সংসারের আওতার মধ্যে দৃষ্টি থাকে অস্বচ্ছ, চিত্ত থাকে বন্ধনগ্রস্ত, ভালবাসা নিজেকে বিকশিত করবার জায়গা পায় না।

দিদিরা বৃন্দাবনের ছুতো করে হনিমুন ঘুরে এল, পরস্পরের মধ্যে ডুবল।

তবে আর আমি ওদের অবজ্ঞা ছাড়া কী করব?

অবজ্ঞা করে বললাম, ওরে বাস, দিদি কী সাংঘাতিক মুটিয়েছিস? যাই বলিস, বড় হ্যাংলা বাপু তুই। এই কদিনের মধ্যেই এত আদর খেলি যে, ডবল হয়ে গেলি?

ডবল অবশ্য হয়নি দিদি, তবু সেটাই বললাম ঘেন্না দিতে।

 দিদি হাসল।

প্রতিবাদ করল না।

প্রতিবাদ করল দিদির বর।

বলে উঠল, এটা বড় বেশি অতিশয়োক্তি হচ্ছে না নমু?

আমি বললাম, মোটেই না। আপনি অন্ধ–চোখে দেখতে পাচ্ছেন না।

দিদি বলল, যা বলেছিস! শীতের মুখে নতুন দেশে বেড়াতে গিয়ে বেজায় চেঞ্জ লেগে গেছে।

পিসি যদি সহবত শিক্ষার পরাকাষ্ঠা দেখাতে নমিতাকে তার এক ঘণ্টার বড় বোন সুমিতাকে দিদি বলতে না শেখাত, যদি ওদের তো আর ছোট বড় নেই ভেবে বাঁচাল ছটফটে নমিতাটাকেই বর পাইয়ে দিত, আর সুমিতা যদি না আজীবন দিদিগিরির মাসুল জোগাত, হয়তো ওদের দুজনেরই জীবন-ইতিহাস আলাদা হত।

হয়তো ওরা আর পাঁচজনের মতোই সুখী সন্তুষ্ট গৃহিণী হত। কিন্তু তা হল না।

পিসি ওদের জীবনের প্রারম্ভে পরম শত্রুতা সেধে রেখেছিল।

 কিন্তু শুধুই কি পিসি?

ভাগ্যদেবতা নয়?

 ক্রুর নিষ্ঠুর দেবতা নামের কলঙ্ক ভাগ্য-বিধাতা!

নমিতার তো সুমিতার থেকে দামি পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হল কমাস পরেই। তবু কেন?

নমিতা পিসিকে যতই অবজ্ঞা করে আসুক আজীবন, পিসি তার কর্তব্যে ত্রুটি করেনি একতিলও। শুধু পিসি সুমিতার আগে নমিতার বিয়ে দেয়নি। কিন্তু সেই তো কাল হল, নমিতা তাই সুমিতার বরকে আগে দেখল। তাদের এই মরুভূমির সংসারে এক পশলা বৃষ্টি, এই হারেমের জীবনে একটি যুবক পুরুষ।

পিসি নির্বোধ হলে কী হবে, সাধারণ সংসার-পরিবেশের নীতি-দুর্নীতি, সভ্যতা-ভব্যতা, এসব তার চোখ এড়াত না। জামাইবাবুকে নিয়ে নমিতার মাতামাতি তার চোখ এড়ায়নি, আর জামাইকে ভালবাসলেও তার বেপরোয়া হুল্লোড় তার চোখে ভাল ঠেকত না।

তাই ওরা যখন বৃন্দাবনে গেছে, উঠেপড়ে লেগে পাত্র খুঁজেছে পিসি।

তা বাড়ি আর বর, এটা তখন অত দুর্লভ ছিল না। চেষ্টার মতো চেষ্টা করলে পাওয়া যেত।

অবস্থাপন্ন ঘরের এক উকিল পাত্র জোগাড় করে ফেলল পিসি। বছর দুই হল ল পাশ করে কোর্টে বেরোচ্ছে, সংসারে মা আছে, আরও দুটো ভাই আছে, কলকাতায় দুখানা বাড়ি আছে, দেশে জমিজমা আছে।

আর কী চাই?

 জামাইয়ের চেহারা?

 তাও ভাল।

 বরং প্রিয়মাধবের থেকে আরও একটু ফরসা।

ওরা সংসার পাতাতে না পাতাতেই পিসি এই পাত্রের কথা বলল ওদের কাছে।

 আহ্লাদে উছলে উঠল ওরা।

 নমিতাও উছলোবেই প্রতিজ্ঞা করে ঝলসে বেড়াতে লাগল।

 প্রিয়মাধব বলেছিল তখন, দুদিকে দুই চিনির নৈবিদ্যি নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, বায়োস্কোপ যাওয়া, সবই বুঝি ঘুচল এবার, ফাউটা লুঠে নিতে ডাকাত পড়েছে।

নমিতা বলেছিল, দুদিক সামলাবার দায় থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন তেমনি।

ওটা কি দায়?

তা একরকম।

প্রিয়মাধব বলেছিল, তা হোক, বুকের আধখানা খালি হয়ে যাচ্ছে। সুমিতার সামনেই বলেছিল।

সুমিতা বলেছিল, তোমার ইয়ার্কির ধরনটা এবার বদলাও বাপু! কে কী ধরনের লোক জানা তো নেই। ওর বর যদি এসব পছন্দ না করে?

না করে, উকিলের চিঠি দেবে।বলে হেসে উঠেছিল প্রিয়মাধব।

প্রিয়মাধব নামের ওই লোকটাকে নমিতা তখন কিছুতেই ঠিক বুঝতে পারত না। কখনও মনে হত, সুমিতা নামের ওই নিস্তেজ শান্ত মাতৃপ্রকৃতির মেয়েটার মধ্যে সে তার চঞ্চল রক্তের পরিতৃপ্তি পায় না। তাই নমিতার আগুনের দিকে আকৃষ্ট হয়, তার মধ্যে মনের চাহিদা মেটায়।

কখনও মনে হত, ওই সুমিতা-সাগরের অগাধ গভীরতাতেই সে নিমজ্জিত, এই চপলতা তার আমোদ মাত্র।

অতএব নমিতা অপমানিতা।

এই দুই টানাপোড়েনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল নমিতার।

নমিতা মনে করল ওদের একবার দেখিয়ে দিতে হবে।

দেখিয়ে দিতে হবে প্রেম কাকে বলে, প্রেমের উচ্ছ্বাস কাকে বলে।

মনে করল।

যদি সেই ওর মনে করাটা কাজে করতে পেত, তা হলেও হয়তো সবই ঠিক থাকত, কিন্তু নমিতা অনেক পেয়েও কিছু পেল না।

হেমন্ত উকিলের বহুবিধ গুণের মধ্যে একটা বিশেষ গুণ ছিল। চপলতা সে আদৌ পছন্দ করত না।

থিয়েটার বায়োস্কোপ দেখাকে সে অসার-আমোদ বলে মনে করত, নাটক নভেল পড়াকে প্রায় দুর্নীতি বলে মনে করত, এবং কবিতা বস্তুটা যে মানুষ ইচ্ছে করে পড়তে পারে, এটা সে ভাবতেই পারত না। তবে স্ত্রীকে সে ভালবাসতে দেরি করেনি। এবং স্ত্রীর এক ঘণ্টার দিদিকে দিদি বলে সমীহ করতেও ত্রুটি করেনি।

এই সুযোগটা নিত তার স্ত্রীর দিদি। প্রায়ই গাড়ি ভাড়া করে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটত, আর গিয়ে বলত, ভাই হেমন্ত, আজ একটু বউকে ছাড়তে হবে।

হেমন্তর মন ভিজোতে আরও বলত, যমজ বোন বুঝতেই তো পারছ। ও না ভোগ করলে আমার ভোগ হয় না। রাগ কোরো না ভাই।

যেন অনুমতি না নিয়ে উঠবে না। অথচ রাগ করত না হেমন্ত। এক কথাতেই অনুমতি দিত। পরে হেমন্ত নমিতাকে বলত, আশ্চর্য! তোমার যমজ বোন উনি, এ যেন বিশ্বাসই হয় না। দেবী আর উর্বশী।

নমিতা রেগে রেগে বলত, বিধাতার কারসাজি। নইলে আর কটাদিন আগে তোমা হেন দেবতা যদি আমাদের গার্জেনের চোখে পড়ত গো, ইতিহাস বদলে যেত।

হেমন্ত বলত, আমার পূর্বজন্মের পুণ্য ছিল না, তাই চোখে পড়েনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *