০২.
দামেস্কের কারাগারের একটি ছোট্ট অন্ধকার কুঠরী। সারা দিনের ভিক্ষাবৃত্তি শেষে মুসা বিন নুসাইরকে এই অন্ধকার কুঠরীতেই রাত্রি অতিবাহিত করতে হয়। তিনি যখন তাঁর ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটি সেই ছোট্ট অন্ধকার কুঠরীতে এলিয়ে দিতেন তখন তাঁর বিগত জীবনের একেকটি ঘটনা ছবির মতো তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠত। স্মৃতিগুলো একে একে চোখের সামনে এসে জড়ো হত।
অতীত দিনের কোন ঘটনাই তিনি মনে করতে চাইতেন না। অতীতের প্রতিটি স্মৃতি তাঁর হৃদয়-স্পন্দন বাড়িয়ে দিত। হৃদয়ের এই স্পন্দন তাঁর নিকট মৃত্যুযন্ত্রণার মতো মনে হত। তিনি বুক ভরা ব্যাথা নিয়ে পরাজিত ও বঞ্চিত জীবনের শেষ দিনটির অপেক্ষা করছিলেন।
তাঁর মনে কোন আফসোস নেই। নেই কোন অতৃপ্তি। তাঁর অশান্ত মনের একমাত্র প্রশান্তি এই যে, তিনি আল্লাহর দ্বীনের পয়গাম আটলান্টিক মহাসগরের পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন।
অপরাধ না করেও তিনি যে অপরাধের শাস্তি ভোগছেন, এ জন্য আল্লাহর কাছে তিনি কোন অনুযোগ করেননি। তিনি ভালো করেই জানেন, আল্লাহ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট নন। পার্থিব সকল বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মানসিকভাবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এই কারাগারেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আর অজ্ঞাত কোন স্থানে তাকে দাফন করে দেওয়া হবে। হয়তো বা তাঁর জানাযার নামাযও পড়া হবে না।
তিনি ভাবতেও পারছিলেন না যে, ইতিহাসের পাতায় তিনি অমর হয়ে থাকবেন। যত দিন সূর্যের উত্তাপে পৃথিবী সজীব থাকবে, চাঁদ-সেতারা রাতের আকাশ আলোকিত করবে, তত দিন ইতিহাসের বুকে মুসা বিন নুসাইরের নাম থাকবে। তাঁর বিজয়গাথা মানব হৃদয়ে ঈমানের দ্যুতি ছাড়াবে।
তিনি জানতেন না, তারিক বিন যিয়াদ এখন কোথায়? খলীফা দুজনকেই দামেস্ক ডেকে এনেছিলেন। তারিক বিন যিয়াদের কথা চিন্তা করে মুসা বিন নুসাইরের আফসোস হচ্ছিল। আন্দালুসিয়া-বিজয়ী নওজোয়ান এই সিপাহসালারের সাথেও হয়তো এমনই আচরণ করা হচ্ছে। তিনি বোধ হয়, এই কারাগারের কোন অন্ধকার কুঠরীতে বন্দী হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
মৃত্যুপথযাত্রী মুসা বিন নুসাইয়ের মন আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। লাঞ্ছনা-গঞ্জনার ভারে ন্যুজ। অতীত দিনের স্মৃতিগুলো অবচেতন মনে বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠে।
এই তো সে দিনের কথা। উত্তর আফ্রিকার ছোট্ট একটি রাজ্য সিউটার গভর্নর জুলিয়ান তাঁর নিকট এলো। সে দিনের পুরো দৃশ্যটাই তাঁর চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠল। ঐদিন তিনি উত্তর আফ্রিকার একটি শহর তানজানিয়ায় অবস্থান করছিলেন।
তিনি মিসর ও আফ্রিকার আমীর নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে একটি মুহূর্তের জন্যও নিশ্চিন্তে কোথাও বসে থাকতেন না। কখনও একাই শত্রুর মোকবেলায় জেহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কখনও সৈন্য পরিচালনায় শাহসওয়ারের ভূমিকা পালন করতেন। আবার কখনও সুদক্ষ সমাজ সংস্কারকের ন্যায় সংস্কারকর্মে আত্মনিয়োগ করতেন। কখনও শহরে-গঞ্জে কখনও গ্রামে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে রাজ্যের সঠিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেন।
এমনই ব্যস্ততার মাঝে যখন তাঁকে সংবাদ দেওয়া হল, সিউটার গভর্নর জুলিয়ান তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়। তখন তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ‘জুলিয়ান! কী উদ্দেশ্যে সে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়?
যে লোকটি জুলিয়ানের আগমনের সংবাদ নিয়ে এসেছিল সে বলল, ‘জুলিয়ান একা আসেনি, তার সাথে আরো লোকজনও আছে। তাদেরকে উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা বা শাহীখান্দানের লোক বলে মনে হচ্ছে। তারা বেশ কিছু উপহার-উপঢৌকনও সাথে এনেছে।’
‘আল্লাহর কসম! আমার বিশ্বাস হয় না’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। কেউ কি বিশ্বাস করবে, যাদের সাথে আমাদের লড়াই চলছে, যারা আমাদের জানের দুশমন, আচানক তারা আমাদের দোস্ত হয়ে গেছে? অসম্ভব, কিছুতেই হতে পারে না। তারা হয়তো সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আমি তাদের সন্ধির প্রস্তাব কিছুতেই গ্রহণ করব না।’
‘মুহতারাম আমীর!’ একজন সভাসদ আরয করলেন। তারা এতটা দূর থেকে এসেছেন, তাদেরকে সাক্ষাতের সুযোগ প্রদান করা হোক।
***
সিউটা রোম সাগরের পাড়ে অবস্থিত আফ্রিকার সীমান্তবর্তী একটি ছোট্ট রাজ্য। তার বিপরীত দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জাবালুতারিক বা জেব্রেলটার প্রণালী। সিউটা ও জাবালুতারিকের মধ্যখান দিয়ে যে সাগর বয়ে গেছে তার বিস্তৃতি প্রায় বার মাইল।
সিউটা হল আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিকের করদ-রাজ্য। সিউটার নিজস্ব সৈন্যবাহিনী আছে। তা সত্ত্বেও রডারিক নিজের কিছু সৈন্য সেখানে মোতায়েন করে রেখেছে।
আন্দালুসিয়ার মতো শক্তিশালী রাজ্যের মদদপুষ্ট হওয়ার কারণে জুলিয়ান সর্বদা শক্তি প্রয়োগ করে আশ-পাশের অঞ্চল দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করত। জুলিয়ানের ঔদ্ধত্য দমন করার জন্য মুসা বিন নুসাইর প্রায়ই ফৌজ প্রেরণ করতেন। জুলিয়ান বাহিনীর সাথে তাদের কয়েকবার লড়াইও হয়েছে।
মুসা বিন নুসাইর সিউটা দখল করে নেওয়ার জন্য দুই-তিনবার রীতিমত আক্রমণ পরিচালনা করেন। কিন্তু সিউটার দুর্গ এতটাই মজবুত যে, কিছুতেই তা পদানত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানবাহিনীকে দুর্গের মধ্যে বন্দী করে রাখার জন্য বাবার ফৌজের মাধ্যমে দুর্গ অবরোধ করেও রাখেন।
তিনি এই ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন যে, জুলিয়ানের অত্যাচার চিরতরে বন্ধ করার জন্য অতিসত্বর সিউটার উপর কঠিন হামলা চালাবেন। প্রয়োজন হলে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত দুর্গ অবরোধ করে রাখবেন, যেন ক্ষুধ-পিপাসায় কাতর হয়ে দুর্গের লোকেরা অস্ত্র সমর্পণ করতে জুলিয়ানকে বাধ্য করে। তবে তিনি এই আশঙ্কাও করতেন যে, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ বড়ারিক জুলিয়ানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। মুসা বিন নুসাইর একে একে দুইবার দূত মারফত জুলিয়ানকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি জুলিয়ানকে এই মর্মে পত্রও লেখেছিলেন যে,
‘জুলিয়ান! নিজে শান্তিতে থাকুন, অন্যকেও শান্তিতে থাকতে দিন। অন্যথায় আপনাকে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।’
জুলিয়ান প্রতিউত্তরে স্বৈরাচারী মনোভাব ও ঔদ্ধতের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি প্রতিউত্তরে লেখেছিলেন,
‘সালতানাতে ইসলামিয়ার আমীর! সিউটা অবরোধ করার আগে আন্দালুসিয়ার ফৌজি শক্তি সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকা উচিত। যেন পরবর্তীতে পিছু হটার লাঞ্ছনা পেতে না হয়।
মুসা বিন নুসাইর মনে মনে ভাবলেন, সেই জুলিয়ানের মতো স্বেচ্ছাচারী ও অবাধ্য দুশমন এসেছে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে! তিনি কিছুটা আশ্চার্য হয়ে বার্তাবাহককে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘জুলিয়ানকে ভিতরে নিয়ে এসো।’
***
শাহীলেবাস পরিহিত জুলিয়ান রাজকীয় গাম্ভির্যের সাথে দরবারে প্রবেশ করল। সে সময় দরবারে মুসা বিন নুসাইরের সামনে দুই-তিনজন উপদেষ্টা ও কয়েকজন সালার বসাছিলেন। জুলিয়ানকে দেখে মুসা বিন নুসাইর উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ঠোঁটের কোনে মুচকিহাসির রেখা টেনে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। জুলিয়ান সামনে অগ্রসর হয়ে বললেন,
‘আমি শান্তি ও নিরাপত্তার বাণী নিয়ে এসেছি, শান্তি ও নিরাপত্তার বাণী নিয়ে ফিরে যেতে চাই। দোস্তীর পয়গাম নিয়ে এসেছি, দোস্তীর সওগাত নিয়ে ফিরে যেতে চাই।’
জুলিয়ানের দোভাষী বার্বার ভাষায় জুলিয়ানের কথা তরজমা করে গুনাল।
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের সাথে কোলাকুলি করলেন। তিনি তাকে ডানবাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে কুরসির দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন, আমাদের ঘরে ভয়ঙ্কর কোন দুশমন এসে উপস্থিত হলে আমরা তাকে দোস্তই মনে করি। আপনার মনে যত মারাত্মক দুরভিসন্ধিই থাক না কেন, এ মুহূর্তে আমরা আপনাকে দোস্ত মনে করব।’
দোভাষী উভয়ের কথা তরজমা করে শুনাচ্ছিল।
জুলিয়ানের সাথে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিহিত চৌকস দুজন দেহরক্ষী দরবারে প্রবেশ করল। তারা উভয়ে দরজায় দু’পাশে ফলা বিশিষ্ট বল্লম উঁচিয়ে নিশ্চল পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। তাদের দৃষ্টি ছিল সতর্ক ও অন্তর্ভেদী।
তারা উভয়ে জুলিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিল। জুলিয়ান মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল। তারা দুজন যন্ত্রচালিতের ন্যায় সম্মান প্রদর্শনের জন্য মাথা ঝুকাল। তারপর সোজা হয়ে উল্টো পায়ে দরবার থেকে বের হয়ে গেল।
তারা বের হয়ে যাওয়ার অল্প কিছুক্ষণ পরে কৃষ্ণকায় দু’জন লোক দরবারে প্রবেশ করল। তাদের মাথায় সফেদ টুপি। আর নিম্নাঙ্গে ঝলমলে রেশমী কাপরের লুঙ্গি।
তারা বড়সড় একটি বাক্স ধরাধরি করে দরবারে প্রশে করল। বাক্সটি মুসা বিন নুসাইরের সামনে রেখে ঢাকনা খালে দিল। তারপর উভয়ে মুসার সামনে দু’জানু হয়ে কুর্নিশ করল। কুর্নিশ শেষে মাথা নিচু করে উল্টো পায়ে বাইরে চলে গেল।
তারা চলে যাওয়ার পর আরো দু’জন হাবশী গোলাম আরেকটি বাক্স নিয়ে দরবারে প্রবেশ করল।
“সিউটার সম্মানিত রাজা! মুসা বিন নুসাইর বলে উঠলেন। আপনার লোকদের বলে দিন, তারা যেন আমাকে কুর্নিশ না করে। আমার সামনে মাথা না ঝুঁকায়।
ইসলামী সালতানাতের আমীর!’ জুলিয়ান বলল। এরা গোলাম, শাহীখান্দানের লোক নয়। এদের কুর্নিশ করতে বাধা দেবেন না।’
‘আমরা সকলেই গোলাম।’ মুসা আসমানের দিকে ইশারা করে বললেন। ‘আমরা কেবল এক বাদশাহকেই কুর্নিশ করি। তাঁর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সেজদাবনত হই। সে বাদশাহ হলেন, মহান আল্লাহ। সম্মান প্রদর্শনের এই পদ্ধতি আপনি আপনার দরবারে পালন করুন, আমাদের কোন আপত্তি নেই। এ মুহূর্তে আমরা আল্লাহর দরবারে বসে আছি।’
মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কখনও মুসলমানদেরকে একত্রিত হয়ে নামায পড়তে দেখেননি?”
‘আফ্রিকার মহামান্য আমীর! আমি দেখেছি।’ জুলিয়ান বলল। আপনার ফৌজ যখন সিউটা অবরোধ করে তখন এক সন্ধ্যায় আমি দুর্গ প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছি, আপনার ফৌজ একজন ব্যক্তির পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করছিল।
‘এ দৃশ্য দেখে আপনার মনে কী অনুভূতি জন্মেছিল? আপনি কি দেখেননি, সেখানে একজন সাধারণ সিপাহী ও সিপাহসালার, সাদা ও কালো, আমীর ও গরীব সকলে এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল? সেখানে এমন কোন নিয়ম ছিল না যে, আমীর প্রথম সারিতে দাঁড়াবে, আর গরীব পিছনের সারিতে দাঁড়াবে। ইসলামে গোলাম ও মনিবের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে সকলে সমান হয়ে যায়। মানুষের সামনে মানুষের মাথা ঝুঁকিয়ে সেজদা করা হারাম, গুনাহের কাজ।
তিনটি বড় বড় বাক্স দরবারে আনা হল। মুসা বিন নুসাইরের নিষেধসত্ত্বেও বাক্স বয়ে নিয়ে আসা গোলামরা মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করে যাচ্ছিল, আর জুলিয়ান না বুঝার ভান করে মুচকি-মুচকি হাসছিলেন। তিনটি বাক্সই মহামূল্যবান হাদিয়া-তোহফায় ভরা ছিল। জুলিয়ান এগুলো মুসা বিন নুসাইরের জন্য এনেছিলেন।
‘আফ্রিকার আমীরের জন্য একটি ঘোড়াও এনেছি।’ জুলিয়ান বললেন। বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আন্দালুসিয়ার জঙ্গী ঘোড়া। এত তীব্র বেগে ছুটে যে, মনে হয়, দৌড়াচ্ছে না; উড়ে চলছে। একমাত্র শাহসওয়ারকেই সে তার পিঠে আরোহণের সুযোগ দেয়। যেখানেই লাগাম টেনে ধরা হয় সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। এই ঘোড়া বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এটি শাহী আস্তাবলের সেরা ঘোড়া।’
‘আমি নিজের পক্ষ থেকে এবং খলীফাতুল মুসলিমীনের পক্ষ থেকে আপনার শোকরিয়া আদায় করছি।’ মুসা বিন নুসাই বললেন। এখন বলুন, আপনার আগমনের উদ্দেশ্য কি?
***
‘আফ্রিকা ও মিসরের সম্মানিত আমীর!’ জুলিয়ান বললেন। আমি আপনার জন্য অরেকটি তোহফা এনেছি, এ তোহফা খোদ আপনাকে অগ্রসর হয়ে গ্রহণ করতে হবে। আমিও আপনার সফরসঙ্গী হব। চলার পথে কৃষ্ণসাগরের অথৈ জলরাশী বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমি আমার নৌবহর ও নাবিক আপনাকে দেব। তারা আপনার হুকুমে কাজ করবে।’
‘একমাত্র আল্লাহই আমাদের অন্তরের গোপন কথা জানেন।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। প্রথমত আপনার আগমনের উদ্দেশ্যই আমার নিকট স্পষ্ট নয়। তার উপর আপনি যে তোহফার কথা বলছেন, সেটা এতটাই রহস্যপূর্ণ যে, তা বুঝার মতো যোগ্যতা আমার নেই। আপনি আপনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করলে আমার মতো সল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের পক্ষে বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হবে।
‘আমি যে তোহফার কথা বলছি, সেই তোহফার নাম, আন্দালুসিয়া। জুলিয়ান বললেন। ‘আন্দালুসিয়া যে এক অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশ। এ ব্যাপারে আপনি ভালোভাবেই অবগত আছেন। আপনি চাইলে এই রাজ্যকে ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। আন্দালুসিয়ার পর ফ্রান্স। আন্দালুসিয়ায় আপনি আপনার রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফ্রান্স আক্রমণ করতে পারবেন।
‘ইসলামী সালতানাতের সাথে আপনার এই আন্তরিকতা প্রদর্শনের কী কারণ থাকতে পারে? মুসা বিন নুসাইর বললেন। তাছাড়া আপনার স্বজাতি বাদশাহ রডারিকের সাথে আপনার এই হঠাৎ দুশমনিইবা কি কারণ ঘটতে পারে?
আপনার হয়তো জানা আছে, আমি বাদশাহ রডারিকের করদ-রাজা। জুলিয়ান বললেন। সে আমাকে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। সে সর্বদা এই আশঙ্কা করে যে, আরব মুসলমানগণ অপরাজেয় এক সামরিক শক্তিরূপে যেভাবে আত্মপ্রকাশ করছে, মনে হয় তারা অতিসত্বর আন্দালুসিয়াকে পদানত করে ইউরোপে প্রবেশ করবে। তারা সময়ের সামান্য ব্যবধানে রোম-পারস্যের ন্যায় মহাশক্তিধর দুটি সাম্রাজ্যকে তছনছ করে দিয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য জয় করতে করতে উত্তর আফ্রিকার সীমান্ত সৈকতে এসে পৌঁছেছে। অল্প সময়ের মধ্যে আফ্রিকার হিংস্র জাতি বাবার সম্প্রদায়কে ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল এক সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছে। আর এসব কিছুই হল রডারিকের ভয়ের কারণ। তাই আপনি যেন কখনও আন্দালুসিয়া আক্রমণ করতে না পারেন, সে জন্য রডারিক আমাকে আপনার পথেরাঁটা হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।’
‘তাহলে কি আপনি আন্দালুসিয়া ও আমাদের মাঝে একজন স্বাধীন রাজা হয়ে থাকতে চান?’ মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনার এই প্রশ্নের উত্তর পরেও দেওয়া যাবে। জুলিয়ান বললেন। আগে আপনি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। আন্দালুসিয়ার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেভরা সুজলা-সুফলা রাজ্যকে আপনার বিশাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার কোন চিন্তা কি আপনার আছে?
‘না.. আন্দালুসিয়ার উপর হামলা করার মতো সৈন্যবাহিনী আমার নেই।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তাছাড়া আন্দালুসিয়ার বিশাল সৈন্যবাহিনীর সাথে। লড়াই করার জন্য রসদ সংগ্রহ করাও আমার পক্ষে অসম্ভব।
এটা ছিল মুসা বিন নুসাইরের একটি কুটনৈতিক চাল। তিনি প্রতিপক্ষকে তার ইচ্ছা ও শক্তি সম্পর্কে বেখবর রাখতে চাচ্ছিলেন। তিনি কথার প্যাঁচে ফেলে জুলিয়ানের আগমন-রহস্য উদ্ধার করতে চাচ্ছিলেন।
প্রকৃত সত্য হল, মুসা বিন নুসাইর কয়েকবারই সমুদ্র অতিক্রম করে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তার অভিজ্ঞ সালারদের সাথে পরামর্শও করেছেন। খলীফার ইজাযতের জন্য চেষ্টাও চালিয়েছিলেন।
খলীফার ইজাযত নেওয়া তাঁর পক্ষে কোন কঠিন কাজ ছিল না। কারণ, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক অমুসলিম রাজ্যে আক্রমণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হিন্দুস্তান আক্রমণের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। তথাপি মুসা বিন নুসাইরের মনে সামান্য দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কারণ, তিনি জানতেন আরবদের এখনও সরাসরি কোন নৌযুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয়নি। আরব মুজাহিদগণ কিস্তি চালনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন ঠিক; কিন্তু স্থলযুদ্ধের তুলনায় নৌযুদ্ধের কলা-কৌশল অনেকটা ভিন্ন হয়ে থাকে। সে ব্যাপারে আরব মুজাহিদদের এখনও পর্যন্ত কোন প্রত্যক্ষ ধারণা জন্মেনি।
আফ্রিকা থেকে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করতে হলে একমাত্র সমুদ্রপথেই অগ্রসর হতে হবে। এই সমুদ্রপথে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করা হলে আন্দালুসিয়ার বিশাল নৌবহর নিশ্চিতরূপে বাধা প্রদান করবে। এই বাধা অতিক্রম করা মুসলমানদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার আদৌ কোন ইচ্ছা তার নেই। তিনি সন্দেহ করছিলেন, হয়তো জুলিয়ান এ জন্য এসেছে যে, মুসলমানগণ আন্দালুসিয়ার ব্যাপারে কী ধরনের চিন্তা-ভাবনা করছেন, তা জানার জন্য। তাঁর মনে এই সন্দেহও উঁকি দিচ্ছিল যে, জুলিয়ান হয়তো দেখতে এসেছেন, মুসলমানগণ কী করছে? তারা যদি বিলাসপ্রবণ হয়ে যুদ্ধ থেকে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে তাহলে অতর্কিত হামলার মাধ্যমে মিসর ও আফ্রিকা থেকে চিরতরে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হবে।
এসব কথা চিন্তা করেই মুসা বিন নুসাইর এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন মুসলমানদের পরিকল্পনা ও শক্তি-সামর্থ সম্পর্কে জুলিয়ান কোন ধরনের ধারণা অর্জন করতে সক্ষম না হয়।
অপরদিকে জুলিয়ানের আগমনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, মুসা বিন নুসাইরকে আন্দালুসিয়া আক্রমণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা। তাই তিনি আন্দালুসিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভৌগোলিক গুরুত্বের কথা চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরছিলেন।
‘সম্মানিত আমীর! আপনি হয়তো জানেন না, আন্দালুসিয়া কুদরতের অপূর্ব সৃষ্টি-শৈলীর এক আশ্চর্য নিদর্শন। সবুজ পাহাড় আর মনোমুগ্ধকর উপত্যকায় ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর এক মুলুক। চতুর্দিকে সবুজের সমারোহ। দিগন্ত বিস্তৃত শস্যের সবুজ আভায় উদ্ভাসিত ফসলের মাঠ। পত্র-পুষ্পে আচ্ছাদিত ঘন বৃক্ষরাজির চোখ জোড়ানো দৃশ্য, আর সবুজের বুক চিরে কুলকুল তানে বয়ে চলা অসংখ্য নদ-নদী। মাটির উপর মাঠ ভরা সোনালী ফসল, আর মাটির নিচে থরে থরে সাজানো অসংখ্য খনিজ সম্পদ।
আপনি একবার সেখানে গেলে আর কখনও আরবের বালুকাময় মরুর দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করবেন না। ফিরে আসতে চাইবেন না আফ্রিকার এই কঙ্করময় মরু ভূমিতেও।
সেখানের মানুষ সুন্দর। সেখানের মেয়েরা পাগলকরা রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারিনী। আপনি জান্নাতের হুর-পরীদের সৌন্দর্যের কথা শুনেছেন, যা শুধু মৃত্যুর পরই দেখা যাবে। জানা নেই, কে সেই সৌন্দর্য ভোগ করতে পারবে, আর কে পারবে না। কিন্তু আন্দালুসিয়া গেলে আপনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে বাধ্য হবেন। এই সেই জান্নাত, আল্লাহ যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
জুলিয়ান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মুসা বিন নুসাইরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আফ্রিকার আমীর, আপনি কী ভাবছেন? আন্দালুসিয়ার প্রবেশদারের চাবি আমার হাতে, আমি সেই চাবি আপনার হাতে তুলে দেব।
জুলিয়ান আন্দালুসিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এমনি হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরছিলেন যে, মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়ার সৌন্দর্যে মোহবিষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন বয়োবৃদ্ধ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি। ইহুদি-নাসারাদের জাদুময়ী বাক-চাতুর্য ও চিত্তাকর্ষক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই অবগত ছিলেন।
তিনি ইঙ্গিতে নিজের লোকদের এবং জুলিয়ানের সাথে আগত মেহমানদেরকে দরবারকক্ষ থেকে বাইরে যেতে বললেন। দরবারকক্ষে থাকলেন শুধু মুসা বিন নুসাইর, জুলিয়ান আর দোভাষী।
***
‘জুলিয়ান! তুমি আমার জন্য অত্যন্ত সুন্দর একটি ফাঁদ পেতেছ।’ মুসা বললেন। “তোমার বিবেক-বুদ্ধি কি এতটাই লোপ পেয়েছে যে, তুমি এ কথা ভাবার প্রয়োজনই অনুভব করোনি, যাকে তুমি কথার জাদুতে ভুলাতে এসেছ, সে সাধারণ কোন ব্যক্তি নয়। জীবন-যুদ্ধের এক লড়াকু সৈনিক সে। তাঁর তীক্ষ্মদৃষ্টি মানুষের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা গোপন কথাও বলে দিতে পারে।’
‘এতে কোনই সন্দেহ নেই, আমীর মুসা! জুলিয়ান বললেন। আমি এসব কিছু চিন্তা করে তবেই এসেছি, সেই সাথে আমি আপনার শোকরিয়া আদায় করছি যে, আপনি আমাকে ছোট ভাই মনে করে তুমি বলে সম্ভোধন করেছেন।
জুলিয়ান তার দুটি হাত মুসা বিন নুসাইরের প্রতি প্রসারিত করে বললেন, ‘আমার দোস্তী কবুল করুন এবং আমার মনের মাঝে যে কথা গোপন আছে, সে কথা শ্রবণ করুন।
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পর জুলিয়ান নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং দ্রুত হাতে তরবারী কোষ মুক্ত করলেন। তার চেয়েও বেশি দ্রুত মুসার হাত তলোয়ারের বাট স্পর্শ করল। কিন্তু জুলিয়ানের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল আশ্চর্যজনক। তিনি তলোয়ার হাতের তালুতে তুলে দু’কদম অগ্রসর হলেন। অতঃপর হাটু গেড়ে বসে মুসা বিন নুসাইরের পদতলে রেখে দিলেন। তারপর এক পা পিছে সরে এসে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
‘আমীর মুসা! জুলিয়ান আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন। এই তলোয়ার কখনও কারো সামনে আত্মসমর্পণ করেনি। এই তলোয়ার অনেক শক্তিধর দুশমনের উদ্ধত মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। মুসা আমার কথায় মনে কষ্ট নিও না। আমাকে দাম্ভিক ও অহংকারী মনে করবেন না। এটা সেই তলোয়ার যাকে স্বয়ং আপনিও পরাস্ত করতে পারেননি। আপনার বার্বার ফৌজ পর্যন্ত এই তলোয়ারের ঝলক দেখে সিউটা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
সেই তলোয়ার আজ আপনার পদতলে রাখা। কোন বাদশাহ বা কোন সিপাহী এতো সহজে নিজের তলোয়ার দুশমনের পদতলে সমর্পণ করে না। কিন্তু আজ আমি আপনাকে আর দুশমন মনে করি না, ভাই মনে করি; দোস্ত মনে করি। আজ এক দোস্ত তার দুঃখের কথা অপর দোস্তকে শোনাতে এসেছে। মুসা! শোনবেন তার দুঃখের কথা? হবেন কি তার দুঃখের ভাগী?
মুসা বিন নুসাইর ঝুঁকে তলোয়ার উঠিয়ে হাতের তালুতে রেখে জুলিয়ানের সামনে পেশ করে বললেন, ‘আমি আনন্দ অনুভব করছি এ জন্য যে, তুমি আমাকে একজন বিশ্বস্ত দোস্ত, আর স্নেহশীল ভাই মনে করছ। আমি তোমার তলোয়ারের কদর করি।
মুসা নিজ হাতে জুলিয়ানের কোমরে ঝুলন্ত কোষে তলোয়ার রেখে দিয়ে বললেন। এখন কি আমার দোস্ত আমাকে তার দুঃখের কথা শোনাবে?’
‘হ্যাঁ, যে কথা শোনাতে এসেছি, তা শোনিয়ে তবেই ফিরে যাব। জুলিয়ান বললেন। আমি আমীর মুসাকে জিজ্ঞেস করছি, কেউ যদি তার মেয়ের ইজ্জত ছিনিয়ে নেয়, তাহলে তিনি তাকে কি শাস্তি দেবেন?
‘অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা হবে। মুসা বিন নুসাইর বললেন।
‘অপরাধী যদি কোন রাজ্যের বাদশাহ হয়?’ জুলিয়ান জানতে চাইলেন।
‘তাহলে মুসা তার বাদশাহী মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে। সেই বাদশাহর শাহী হেরেমের মেয়েদেরকে দাসী-বান্দির মতো বন্দী করে সাথে নিয়ে আসবে।
সেই নির্যাতিতা মেয়েটি যদি আপনার কোন দুশমনের হয়।
‘সেই মজলুম মেয়ে এবং তার বাবা যদি ফরিয়াদি হয়ে আসে তাহলে মুসা তারও প্রতিশোধ নিবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে অবশ্যই লক্ষ্য রাখবে যে, প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তার সালতানাত যেন কোন হুমকির সম্মুখীন না হয়ে পড়ে।
‘না, মুসা! আপনার সালতানাত কোন হুমকির সম্মুখীন হবে না; বরং আপনার সালতানাত আরো বিস্তৃতি লাভ করবে।’
‘মুসা বিন নুসাইর! সেই মজলুম বাবা স্বয়ং আমি, আর লঞ্ছনার শিকার আমারই মেয়ে।
‘তাহলে তোমার তলোয়ার এখনও কোষবদ্ধ কেন? আমার পদতলেই বা কেন তা সমর্পণ করছ?
‘এ জন্য যে, অপরাধী আমার চেয়েও বেশী শক্তিশালী। সে আন্দালুসিয়ার বাদশাহ। মানুষরূপী শয়তান রডারিক।
‘তোমার মেয়েকে রডারিক পেল কীভাবে?
‘দোস্ত মুসা! এখন আমি রডারিকের করদ-রাজা ঠিক; কিন্তু আমার সম্পর্ক আন্দালুসিয়ার শাহীখান্দানের সাথে। এক সময় আমার রাজ্য আজাদ ছিল। সময়ের পালাবদলে সিউটার প্রতিরক্ষার দায়ভার আন্দালুসিয়ার বাদশাহ নিজ হাতে তুলে নেয়। এভাবেই সিউটা আন্দালুসিয়ার করদরাজ্যে পরিণত হয়। আমি রাজা থেকে গভর্নর হয়ে যাই।
আমাদের শাহীখান্দানের নিয়ম হল, কোন মেয়ে পনের-ষোল বছরে উপনীত হলে, তাকে আন্দালুসিয়ার শাহীমহলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে সে শাহী আদব-কায়দা, কথাবার্তা ও চাল-চলন সম্পর্কে অবগত হতে পারে। শাহীখান্দানের লোকেরা কখনও কখনও তাদের দশ-বারো বছরের মেয়েকেও শাহীমহলে পাঠিয়ে দেয়।
আমিও আমার মেয়ে ফ্লোরিডাকে শাহীখান্দানের নিয়ম অনুযায়ী রডারিকের শাহীমহলে পঠিয়ে দিয়েছিলাম। তখন তার বয়স সতেরো বছরের চেয়ে কিছু কম ছিল। যেহেতু আসল উদ্দেশ্য ছিল শাহী আখলাক এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া, সেহেতু বিভিন্ন খান্দান থেকে আগত উঠতি বয়সের মেয়েদেরকে শাহীখান্দানের মহিলাদের তত্ত্বাবধানেই রাখা হত। পুরুষদের সাথে তাদের কোন রকম সম্পর্ক থাকতো না। কিন্তু আমার মেয়ে আমাকে জানিয়েছে, রডারিক প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে।
‘তোমার মেয়ে এখন কোথায়? মুসা বিন নুসাইর জানতে চাইলেন।
‘আমি তাকে আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডো থেকে নিয়ে এসেছি। সে এখন সিউটাতে আছে। আপনি ইচ্ছে করলে তাকে এখানে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মুসা বিন নুসাইর! আমি আমার বেইজ্জতীর প্রতিশোধ নিতে চাই। আর এর একমাত্র রাস্তা হল, রডারিককে হত্যা করা। কিন্তু তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ সে সব সময় দেহরক্ষীদের নিচ্ছিদ্র বেষ্টনীর মধ্যে থাকে। একা কখনই বাইরে বের হয় না।
এজন্য বিকল্প যে চিন্তা নিয়ে আমি আপনার নিকট এসেছি, তা হল আপনি আন্দালুসিয়ার উপর আক্রমণ করবেন। আমি আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করব। তবে আমি দৃশ্যপটে উপস্থিত হব না।
আন্দালুসিয়ার ফৌজ বেশুমার। তাদের সংখ্যাধিক্যের প্রতি তাকালে আপনাদের পক্ষে তাদের মোকাবেলা করা অসম্ভব মনে হবে, কিন্তু আপনার ফৌজের মাঝে আত্মোৎসর্গের যে জযবা, আর সামরিক ডিসিপ্লেন আমি দেখেছি, তা রডারিকের বাহিনীতে মোটেও নেই।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পরে করা যাবে। এই মুহূর্তে আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনার বাহিনী রডারিকের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে।
আমার মনে প্রতিশোধের যে আগুন জ্বলছে রডারিককে হত্য না করা পর্যন্ত সে আগুন কখনও নির্বাপিত হবে না। আমি তার বাদশাহীকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চাই।
বন্ধু, আমার মনের এই আকাক্ষা একমাত্র আপনিই পূর্ণ করতে পার। ওয়াদা করছি, এই লড়াইয়ের যাবতীয় সুফল একমাত্র আপনিই ভোগ করবেন। আমাকে শুধু এতটুকু আশ্বাস দিতে হবে যে, সিউটার উপর আপনি কোন রকম হস্তক্ষেপ করবেন না। সিউটাকে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন।
***
জুলিয়ানের দুটি মেয়ে। একজনের নাম ফ্লোরিডা, অন্য জনের নাম মেরী। ফ্লোরিডা যতই বড় হচ্ছিল তার সৌন্দর্যের দ্যুতি ততই ছড়িয়ে পড়ছিল। তার মা সখিদের বলতো, “দিনে দিনে মেয়ে আমার যেভাবে রূপের-রানী হয়ে উঠছে, তাতে করে ওর জন্য ওমন রূপের-রাজা কোথায় যে তালাশ করে পাব?
ফ্লোরিডার মার জানা ছিল না যে, তার রূপে-রানী মেয়ে চৌদ্দ বছর বয়সেই তার মনের রাজাকে খুঁজে পেয়েছে। রাজ কুমারীর এই মনের মানুষটি কোন রাজপুত্র ছিল না। সে ছিল তাদেরই শাহী আস্তাবলের শাহসওয়ারের ছেলে।
শাহসওয়ার শাহীখান্দান ও ফৌজী অফিসারদের ছেলে-মেয়েদেরকে ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজীর প্রশিক্ষণ দিত। সে সুবাদে শাহীমহলে তার যথেষ্ট মান-সম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। হেনরি ছিল তার একমাত্র নওজোয়ান ছেলে।
ফ্লোরিডার বয়স যখন তের-চৌদ্দ বছর তখন হেনরির বয়স সতেরো কি আঠারো। বাবার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে বালক বয়সেই হেনরি শাহসওয়ার হয়ে গিয়েছিল। তীরন্দাজীতেও সে যথেষ্ট দক্ষ ছিল।
ফ্লোরিডার চৌদ্দ বছর বয়স হলে জুলিয়ানের নির্দেশে হেনরির বাবা তাকে সকাল-সন্ধ্যা ঘোড়সওয়ারীর প্রশিক্ষণ দিতে লাগল। একদিন জুলিয়ান হেনরির বাবাকে ডেকে এনে বললেন,
‘আমার মেয়েকে সাধারণ কোন মেয়ে মনে করো না। তুমি জান, আমার কোন ছেলে নেই। এই মেয়েই আমার ছেলের অভাব পূরণ করবে। পুরুষ মনে করে তাকে ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজীর প্রশিক্ষণ দেবে, যেন সে দ্রুতগতি সম্পন্ন ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার চালনা করতে পারে। ঘোড়ার পিঠে চড়েই যেন তীর নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়।’
দেড়-দুই মাসে ফ্লোরিডা ঘোড়সওয়ারীতে এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠল যে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে সে অনায়াসেই বড়সড় খানাখন্দ ও উর্দু উর্দু ঝোঁপঝাড় টপকে যেতে পারত।
তার উস্তাদ তাকে দূরে কোথাও যেতে দিত না। কিন্তু ফ্লোরিডা ছিল রাজকন্যা। অন্য সকল রাজকন্যার মতো সেও উস্তাদের নির্দেশের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে ঘোড়া নিয়ে বহু দূর চলে যেত। ফ্লোরিডার এই ঔদ্ধত্যে তার উস্তাদ চিন্তিত হয়ে পড়ত। তার ভয় হত, মেয়েটি যেমন একরোখা তাতে করে কোন ঝোঁপঝাড় পেরোতে গিয়ে ছোট ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে পারে। তাছাড়া তাল সামলাতে না পেরে ঘোড়াই যদি হোছট খেয়ে পড়ে যায়, আর ফ্লোরিডার কোন ক্ষতি হয়, তাহলে তার উপর মহাবিপদ নেমে আসবে।
ফ্লোরিডার উস্তাদ এসব কথা চিন্তা করে অনাগত বিপদ থেকে তাকে উদ্ধারের জন্য একটি প্রতিকার বের করল। ফ্লোরিডা যখন ঘোড়া নিয়ে জঙ্গলের দিকে ছোটে যেতো তখন তার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য সে তার ছেলে হেনরিকে ঘোড়ায় চড়ে তার অনুসরণ করতে বলে দিল।
একদিন ফ্লোরিডা দেখতে পেল, হেনরি কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করছে। সে যেখানেই যায় হেনরি তার পিছু নেয়। ফ্লোরিডা তখন এনিয়ে কোন আপত্তি তুলেনি। একদিন ফ্লোরিডা গভীর জঙ্গলে এসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। হেনরি ফ্লোরিডাকে লাগাম টেনে ধরতে দেখে সামান্য দূরে ঘোড়া থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফ্লোরিডা পিছন ফিরে হেনরির দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসতে লাগল।
হেনরি ছিল পৌরুষদীপ্ত সৌন্দর্যের অধিকারী। তার দেহের গঠনশৈলীই বলে দিতো, সে একজন সুপুরুষ। তাকে দেখলে বুঝা যেত, তার বাহুতে আছে শত্রুকে ধরাশায়ী করার মতো অসীম শক্তি। আর চোখে আছে যে কোন মেয়েকে পাগল করার করার মতো দৃষ্টি।
ফ্লোরিডা ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে বলে উঠল, ‘হেনরি আমাকে ঘোড়া থেকে নামাও। এতটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে, নিচে নামা সম্ভব হচ্ছে না।’
শাহজাদী ফ্লোরিডার নির্দেশ শোনামাত্র হেনরি দৌড়ে তার ঘোড়ার নিকট চলে এলো। সে ফ্লোরিডাকে নিচে নামানোর জন্য ঘোড়ার জিনের সাথে লাগানো রেকাবে হাত রাখল। কিন্তু ফ্লোরিডা তার বাহু প্রসারিত করে হেনরির গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল।
হেনরি তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে পিছে সরে আসতে চাইল। কিন্তু শাহজাদী তাকে নিজ বাহুবন্ধন থেকে বের হতে দিল না। সে হেনরিকে বলল, “চলে যেয়ো না হেনরি, তোমাকে আমার ভালো লাগে। অনেক ভালো লাগে।’
শাহজাদী, আমি তোমার সামান্য এক নওকরের ছেলে।’ হেনরি ভয়ে ভয়ে বলল। কাউন্ট জুলিয়ান যদি জানতে পারেন…।’
হেনরির কথা শেষ না হতেই ফ্লোরিডা বলে উঠল, ‘আমাকে ভুল বোঝ না হেনরি, আমি অবশ্যই মেয়েমানুষ; কিন্তু আমার স্বভাব অন্যান্য মেয়েদের মতো নয়। আমি শুধুমাত্র তোমার দেহ চাই না। আমি চাই এমন ভালোবাসা, যে ভালোবাসা অন্তরের মাটিতে অঙ্কুরিত হয়, আর তার দীপ্তি অন্তরলোকে ছড়িয়ে পড়ে। তুমি কি এমন ভালোবাসা সম্পর্কে অবগত নও?
“না, শাহজাদী।’ হেনরি স্বসংকোচে উত্তর দিল।
‘আমাকে শাহজাদী বলো না। আমি তোমাকে হুকুম দিচ্ছি না যে, তুমি আমাকে ভালোবাস। আমার শুধু এতটুকু অনুরোধ, আমাকে ফ্লোরা বলে ডেকো।
***
এই ঘটনার পর অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। হেনরি এখন শাহজাদীকে ফ্লোরা বলেই ডাকে। সবার সামনে হেনরি শাহজাদীর গোলাম হয়েই থাকে; কিন্তু দুর্গ থেকে বের হয়ে দূরে কোথাও গেলে সে হয়ে উঠে শাহজাদীর মনের মানুষ; প্রাণের পুরুষ।
ফ্লোরিডা প্রথম দিন হেনরিকে বলেছিল, আমি শুধুমাত্র তোমার দেহ চাই না, আমি চাই সত্যিকার ভালোবাসা; চাই একটা মনের মতো মন।
ফ্লোরিডা তার কথা রেখেছিল। হেনরির প্রতি তার ভালোবাসা শুধু দেহসর্বস্ব ছিল না। সে দেহ-মন দিয়ে একান্তরূপে হেনরিকে ভালোবেসে ছিল। তার ভালোবাসার বীজ অন্তরের মটিতে অঙ্কুরিত হয়ে ছিল, আর তার শাখা-প্রশাখা অন্তরলোকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
হেনরির সরাসরি তত্ত্বাবধানে ফ্লোরিডা শাহসওয়ারী, তীরন্দাজী ও অসি চালনার প্রশিক্ষণ নিতে লাগল। ফ্লোরিডার বাবা-মার মনে এ ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহও জন্ম নেয়নি যে, তাদের মেয়ে তার জীবনসাথী খুঁজে পেয়েছে।
ফ্লোরিডা ও হেনরি কখনও এ কথা চিন্তাও করেনি যে, তাদের বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। তারা ভেবেও দেখেনি যে, জুলিয়ান কখনই মখমলের চাদরের ছিন্ন অংশে চটের জোড়া লাগাবেন না।
এসব কিছু চিন্তা করা তো দূরের কথা, তারা প্রেমের নেশায় আর আবেগের টানে এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে, তারা শুধু নিজেদের অবস্থানের কথাই ভুলে যায়নি; বরং গোটা পৃথিবী সম্পর্কেই বেখবর হয়ে পড়েছিল।
এমনি করেই সময় বয়ে চলছিল। দেখতে দেখতে দু’টি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন ফ্লোরিডার মা ফ্লোরিডাকে কাছে ডেকে বললেন,
‘তোমার বাবা তোমাকে টলেডো নিয়ে যাবেন। আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিকের শাহীমহলে তোমাকে এক বছর থাকতে হবে।’
‘কেন? ফ্লোরিডা তার মাকে জিজ্ঞেস করল।
‘কী আশ্চর্য! তার মা বললেন। “তুমি কি জান না, শাহীখান্দানের মেয়েদেরকে শাহী আচার-আচরণ, আর শিষ্টাচার শিখার জন্য সেখানে গিয়ে থাকতে হয়?
‘আমি কি গ্রাম্য বুদ্ধ নাকি যে, শাহী আদব-কায়দা সম্পর্কে কিছুই জানি না।’ ফ্লোরিডা বলল। আমার মাঝে কিসের অভাব দেখেছেন আপনি? আমি সেখানে যাব না। সেখানের অনেক অপ্রীতিকর কথা আমি শুনেছি। সেখানে যে ধরনের আদব-কায়দা, আর শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া হয়, তার অনেক কাহিনীই আমার জানা আছে।
মা অনেক বুঝালেন, কিন্তু ফ্লোরিডা গোঁ ধরে রইল। তার একই কথা, এ সকল বাদশাহদের কোন চরিত্র নেই। তাদের কোন আদর্শ নেই। অবশেষে তার বাবা যখন তাকে অনেকটা আদেশের সুরে আন্দালুসিয়া যেতে বললেন, তখন সেই আদেশ উপেক্ষা করার সাহস তার হল না। সে ভালো করেই জানত, তার বাবা কতটা নির্দয়, আর পাষাণ।
জুলিয়ান ও তার স্ত্রী ফ্লোরিডাকে সাথে নিয়ে আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডোর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর তারা ফ্লোরিডাকে রডারিকের শাহীমহলে রেখে সিউটা ফিরে এলেন।
টলেডো অবস্থানকালে একদিন তারা রডারিকের সাথে ফ্লোরিডার পরিচয় করিয়ে দেন। রডারিক ফ্লোরিডার উপচে পড়া যৌবন, আর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়ল। সে অবচেতন মনে বলে উঠল, বাহ! কী সুন্দর! তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘জুলিয়ান, তোমার এই মেয়েকে কোন নামমাত্র শাহজাদার সাথে বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করে দিও না।
‘এ আমার মেয়ে নয়; আমার ছেলে। জুলিয়ান মুচকি হেসে বললেন।
এমনি আরো অনেক কথার পর ফ্লোরিডাকে রডারিকের শাহীমহলে রেখে যখন তার বাবা-মা চলে আসছিলেন তখন তাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিল।
***
ফ্লোরিডা টলেডো গেছে আট-দশ দিন হয়। ইতিমধ্যে তার বাবা-মা টলেডো থেকে সিউটা ফিরে এসেছেন।
একদিন হেনরির বাবা জুলিয়ানের নিকট এসে বলল, হেনরিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
জুলিয়ানের নির্দেশে হেনরির খুঁজে পাহাড়-জঙ্গল, মরুভূমি সবত্র চষে ফেলা হল, কিন্তু কোথাও তার কোন হদিস মিলল না।
সিউটায় থাকলে তো তাকে পাওয়া যাবে? সে সিউটার সীমানা পেরিয়ে কয়েক দিনের কষ্টকর সফর শেষে টলেডো চরে গিয়েছিল। ফ্লোরিডার বিরহবেদনা সে সইতে পারছিল না। তাই পালিয়ে টলেডো চলে গিয়েছিল।
সেখানে পৌঁছে সে শাহী আস্তাবলে উপস্থিত হয়ে সেখানের দায়িত্বশীল অফিসারের নিকট চাকরির দরখাস্ত পেশ করল। অফিসার ঠাট্টার ছলে তার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য একটি অত্যন্ত বেয়াড়া ঘোড়ার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘চাকরি চাচ্ছ? ঠিক আছে, তাহলে এই ঘোড়ায় সওয়ারী করে দেখাও।’
ঘোড়াটি ছিল অত্যন্ত বেয়াড়া, সহজে কারো বশ্যতা স্বীকার করত না। হেনরি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘোড়র দিকে এগিয়ে গেল। সে অল্প সময়ের মধ্যে জিন লাগিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল। আস্তাবলের কর্মচারীরা এসে জড় হতে লাগল। তারা হেনরির ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি উপভোগ করার জন্য কৌতূহলী চোখে অপেক্ষা করতে লাগল।
দেখতে দেখতে ঘোড়া অবাধ্য হয়ে উঠল। সওয়ারীর বশ্যতা স্বীকার করতে সে মোটেই প্রস্তুত নয়। কিন্তু হেনরি হল পাকা ঘোড়সওয়ার। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে এই অবাধ্য, বেয়াড়া ঘোড়াকে তার বশে নিয়ে এলো। সে দ্রুতবেগে ময়দানের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে একের পর এক ব্যারিকেট টপকে যেতে লাগল।
যারা তামাশা দেখার জন্য জড় হয়েছিল তারা অভিভূতের ন্যায় ছুটন্ত ঘোড়ার দিকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে হেনরি তীরন্দাজী ও বর্শা নিক্ষেপের পারঙ্গমতা প্রদর্শন করল। ফলে সে আস্তাবলে ভালো একটি চাকরি পেয়ে গেল। হেনরি শুধু চাকরি চাচ্ছিল না; সে ফ্লোরিডার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সে জেনে নিল, ফ্লোরিডা কোথায় থাকে।
ফ্লোরিডার সাথে দেখা করতে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হল না। একদিন পাঁচ-ছয়জন শাহজাদী ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোর জন্য আস্তাবলে এলো। তাদের মাঝে ফ্লোরিডাও ছিল। ফ্লোরিডার মতো এ সকল শাহজাদীরাও শাহী শিষ্টাচার, আদব-কায়দা ও বাদশাহী চাল-চলনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছিল। ঘোড়সওয়ারীও তাদের প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ফ্লোরিডা হেনরিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। সে সোজা হেনরির নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কি? সে স্বাভাবিক আওয়াজেই জিজ্ঞেস করল, যেমনিভাবে শাহজাদীগণ অন্যান্য কর্মচারীদের নাম জিজ্ঞেস করে থাকে। আওয়াজের মধ্যে যেন তার অস্থিরতা প্রকাশ না পায়, সেদিকে তার খেয়াল ছিল।
‘আগাস্টা।’ হেনরি তার ছদ্মনাম বলল। এখানে সে সকলের নিকট এই নামই বলেছিল।
‘কোথাও যেন আমি তোমাকে দেখেছি।’ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফ্লোরিডা বলল।
হয়তো দেখেছেন, আমি অনেক জায়গাতেই থেকেছি।’ হেনরি আত্মসংবরণ করে বিনীতস্বরে বলল।
অন্যান্য শাহজাদীরাও হাসতে হাসতে তাদের পাশে এসে জড় হল।
‘আস্তাবলে তুমি কি কাজ কর?’ ফ্লোরিডা জিজ্ঞেস করল।
শাহজাদী! এ বহুত আচ্ছা শাহসওয়ার।’ আস্তাবলের অফিসার নিকটেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে শাহজাদীদের সাথে কথা বলার সুযোগ খেজছিল, এবার মওকা পেয়ে বলে উঠল।
‘আজ একেই আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন। আমি দেখতে চাই সে কত বড় শাহসওয়ার।’ ফ্লোরিডা অফিসারকে লক্ষ্য করে বলল।
অফিসার হেনরিকে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিল। শাহীমহল থেকে বের হয়ে ফ্লোরিডা সঙ্গী শাহজাদীদের বলল, আমি এই শাহসওয়ারের সাথে ঘোড়া দৌড়িয়ে দেখতে চাই, ঘোড়দৌড়ে সে কতটা দক্ষ।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লোরিডা ও হেনরির ঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পাশা-পাশি ছুটতে লাগল। তারা সবুজ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বহুদূর এগিয়ে গেল। যখন তারা ফিরে এলো তখন নিজেদের সব কথাই তারা বলে নিয়েছিল। হেনরি ফ্লোরিডাকে বলল, সে কাউকে কিছু না বলেই সিউটা থেকে চলে এসেছে।
‘এখনই ফিরে যাও। ফ্লোরিডা উৎকণ্ঠার সাথে বলে উঠল। আব্বা যদি জানতে পারেন, তুমি এখানে তাহলে তিনি প্রথম সন্দেহ এটাই করবেন যে, তুমি আমার জন্যই এখানে এসেছ। সিউটার শাহীচাকরি ছেড়ে এতদূর এসে চাকরি করার অন্য কোন অযুহাত দাঁড় করিয়ে তুমি কাউকেই আশ্বস্ত করতে পারবে না।’
‘আরো কয়েকটা দিন থাকতে দাও ফ্লোরা!’ হেনরি আবেগভরা কণ্ঠে বলল। দু-একবার তোমার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দাও। তারপর আমি চলে যাব। গিয়ে বাবাকে বলব, সিউটায় থেকে থেকে হাপিয়ে উঠে ছিলাম, তাই কয়েক দিনের জন্য আন্দালুসিয়া থেকে ঘুরে এলাম।’
***
শাহীমহলের চতুপাশে ঘন বৃক্ষরাজির বাগান। গোটা বাগান জোড়ে ফল আর ফুল বৃক্ষের সমাহার। কোন কোন জায়গা পত্র-পুস্পে একেবারে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। ফ্লোরিডা হেনরিকে এমনি একটি জায়গার কথা বলল। সেখানে পৌঁছার রাস্তাও দেখিয়ে দিল। তবে সতর্ক করে দিল যে, অর্ধেক রাতের পরই শুধু এখানে আসা সম্ভব, অন্যথায় টহলদার সিপাহীদের হাতে ধরা পড়তে হবে।
হেনরি সব বিপদ উপেক্ষা করে পত্র-গুল্মে আচ্ছাদিত বাগানের সেই গোপনস্থানে একে একে দুইবার এসে ফ্লোরিডার সাথে সাক্ষাৎ করল। ফ্লোরিডাকেও এখানে আসার জন্য অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হতো।
শাহীরেওয়াজ শেখার জন্য যে সকল শাহজাদী এখানে আসত সব সময় তাদেরকে চোখে চোখে রাখা হত। তা সত্ত্বেও ফ্লোরিডা প্রহরীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে গভীর রাতে তার কামরা থেকে বের হয়ে পা টিপে টিপে বাগানে এসে উপস্থিত হতো।
দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় ফ্লোরিডা হেনরিকে তিন রাত পর দেখা করতে বলল।
হেনরির যেদিন বাগানে আসার কথা সে দিনই রডারিক চার-পাঁচ দিনের সফর শেষে শাহীমহলে ফিরে এলো। আন্দালুসিয়ার দূরবর্তী কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্রোহীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। বিদ্রোহ দমনের জন্য রডারিক সেখানে গিয়েছিল।
সেই অঞ্চলের তিন বিদ্রোহী নেতাকে হত্যা করে ঐদিন সন্ধ্যায় রডারিক ফিরে এলো। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি আর বিদ্রোহ দমনের আনন্দ তার মনে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
বিদ্রোহ দমনের আনন্দে রডারিক সন্ধ্যার পর শরাবের আসর জমিয়ে বসল। সে আনন্দ আর উল্লাসে ফেটে পড়ল। বুঝতে পারছিল না, আনন্দের এই মুহূর্ত সে কীভাবে উদ্যাপন করবে!
রাজা-বাদশাহরা আনন্দ-ফুর্তির সময় মদ আর নারী নিয়েই মেতে থাকতে পছন্দ করে। রডারিকের শাহীমহলেও এই দুটি বস্তুর কোন অভাব ছিল না। শরাবের আসরে দু-একজন দরবারীও রডারিকের সাথে নিজেদের পারঙ্গমত প্রদর্শন করছিল।
সুশ্রী ও চমৎকার দেহের অধিকারিনী একটি অল্পবয়স্কা মেয়ে রডারিকের পানপাত্র ভরে দিচ্ছিল। রডারিক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “কোন ফুল আছে, ফুল?
তারপর সামন্য সময়ের জন্য রডারিকের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। সে বলল, “না, আজ আমার প্রয়োজন কোন কলির বা আধফুটা কলির।’
একজন দরবারী মুচকি হেসে বলল, এই তো সেই ফুল–যা শাহানশাহে আন্দালুসিয়ার নিদমহলে সুরভি ছড়িয়ে থাকে।’
‘না, আজ কোন নতুন কলি চাই। রডারিক নেশার ঘোরে বলে উঠল।
সে সামান্য সময়ের জন্য কি যেন চিন্তা করে চুটকী বাজিয়ে বলল। “হা… হা… পেয়েছি, ফ্লোরিডা… জুলিয়ানের মেয়ে ফ্লোরিডা…।’
‘শাহানশাহে আন্দালুসিয়া! একজন উপদেষ্টা বলে উঠল। বাহির থেকে আসা শাহজাদীগণ আমাদের নিকট পবিত্র আমানত। তারা এখানে আদব-আখলাক শেখার জন্য এসেছে। আজ পর্যন্ত কোন শাহজাদীর সাথেই কোন প্রকার অভদ্র আচরণ করা হয়নি। সুতরাং এই রেওয়াজ যেন নষ্ট না করা হয়।
‘আমি তাকে আন্দালুসিয়ার রানী বানাব। নেশার ঘোরে রডারিকের কথা জড়িয়ে আসছিল। তোমরা সকলে চলে যাও, আর ফ্লোরিডাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।
‘মহামান্য শাহানশা!’ সেই উপদেষ্টা আবার বলল। “বিপদ সম্পর্কে আপনাকে সতর্ক করা আমার কর্তব্য। এই কর্তব্য আদায়ে আমাকে জীবন দিতে হলেও আমি রাজী আছি। হয়তো আপনারই তলোয়ার দেহ থেকে আমার গর্দান আলাদা করে ফেলবে। তবুও আমার আত্মা এই মনে করে প্রশান্তি লাভ করবে যে, আমি আমার কর্তব্য পলনে অবহেলা করেনি।
‘কিসের বিপদ?’ রডারিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলল। ‘জুলিয়ানের পক্ষ থেকে আমার কী এমন বিপদ হতে পারে? প্রথম কথা হল, তার মেয়ে ফ্লোরিডা শাহানশাহে আন্দালুসিয়ার নিদমহলে রাত্রি যাপন করাকে নিজের জন্য বিরাট সম্মান মনে করবে। দ্বিতীয় কথা, সে যদি আমাকে গ্রহণ না করে এবং তার বাবার কাছে অভিযোগ করে তাহলে জুলিয়ান আমার কী-বা ক্ষতি করতে পারবে।
সে তো মাত্র দুই ইঞ্চি জমিনের মালিক। আমাদের বিশজন শাহসওয়ারের সাথে লড়াই করার ক্ষমতাও সে রাখে না। আমরাই তার শক্তি। অবশ্য সে আরব আর বাবার বাহিনীকে সিউটা অতিক্রম করে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করতে দিচ্ছে না। কিন্তু তার একমাত্র কারণ হল, তার পিঠে আমাদের হাত রয়েছে। আমরা যদি তার উপর থেকে আমাদের হাত সরিয়ে নেই তাহলে বার্বার মুসলমানরা তার দুর্গের একেকটি ইট-সুরকি পর্যন্ত খুলে নিবে, আর তার দুই মেয়েকে দাসী বানিয়ে নিয়ে যাবে।
‘আমি যদি কিছু সময়ের জন্য তার মেয়েকে আমার নিদমহলে ডেকে আনি তাহলে তো তার খুশী হওয়া উচিত। তাছাড়া আমি তার মেয়েকে আমার রানীও বানাতে পারি।’
‘মহামান্য শাহানশা!’ সেই উপদেষ্টা পুনরায় বলল। আমি শুধু এতটুকুই বলতে পারি যে, আমাদের উচিত অন্যকে বন্ধু বানানো। বন্ধুকে শত্রু বানানো কিছুতেই ঠিক হবে না।’
‘তুমি নির্বোধের মতো কথা বলছ।’ রডারিক হুঙ্কার ছেড়ে বলল। এখন যাও, ফ্লোরিডাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।
ক্ষমতার দম্ভ ও রাজত্বের গরিমা, আর শরাবের নেশা ও নারীর লিলা রডারিককে উন্মাদ বানিয়ে দিয়েছিল। কোন কিছুই সে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারছিল না।
কিছুক্ষণ পর ফ্লোরিডা তার কামরায় এসে উপস্থিত হল। তার চেহারায় ছিল আনন্দের উচ্ছ্বাস। ছোট মেয়েকে বাবা ডাকলে সে যেমন আনন্দে উল্লসিত হয়ে বাবার কাছে দৌড়ে যায়, ফ্লোরিডাও শাহানশাহে আন্দালুসিয়ার আহ্বানকে নিজের জন্য এক অনাকাক্ষিত সম্মান মনে করে উত্যু হয়ে ছুটে এসেছিল। কামরায় প্রবেশ করতেই রডারিক তাকে মজবুত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়।
ফ্লোরিডা এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে রডারিকের কুমতলব বুঝতে পেরে নিজেকে মুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু চরিত্রহীন উন্মাদ রডারিকের পেশীবহুল বাহুর শক্ত বেষ্টনী থেকে মুক্ত হওয়া তার পক্ষে ছিল একেবারেই অসম্ভব। রডারিকের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য সে অনেক কান্নাকাটি করল।
রডারিকের ধারণাও ছিল না যে, কোন মেয়ে তাকে এমনি তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। রডারিক তাকে রানী বানানোর লোভ দেখাল। কিন্তু সে সতীত্ব হারিয়ে রানী হতে রাজি হল না।
রডারিক তাকে ভয় দেখাল, সে যদি তার প্রস্তাবে রাজি না হয় তাহলে সিউটার উপর আক্রমণ করা হবে এবং তার বাবা-মা ও গোটা পরিবারকে টলেডোর অলিগলিতে ভিক্ষা চাইতে বাধ্য করা হবে।
ফ্লোরিডা রডারিককে বলল, ‘আসমান-জমিন জ্বালিয়ে ভস্ম করে দাও, তবুও আমি আমার সতীত্ব, আমার কুমারীত্ব বিসর্জন দেব না।’
আন্দালুসিয়ার ইতিহাস রচয়িতাদের সকলেই এ কথা লেখেছেন যে, ফ্লোরিডা রডারিকের কোন প্রলোভন বা হুমকির সামনে আত্মসমর্পণ করেনি। সে বারবার তার সতীত্ব আর কুমারীত্বের দোহায় দিচ্ছিল, কিন্তু ক্ষমতার দাপট আর মদের নেশা তখন রডারিককে হিংস্র পশু বানিয়ে দিয়েছিল, ফলে মোল বছর বয়স্কা এক অবলা মেয়ে তার সতীত্ব আর কুমারীত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হল না।
***
রাতের অর্ধপ্রহর অতিবাহিত হয়েছে। নিঝুম নিশুতি রাত। কোথাও কোন সারা-শব্দ নেই। ঘন বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত অন্ধকার এক জায়গা দিয়ে দেয়াল টপকে হেনরি বাগানে প্রবেশ করল। এর আগেও সে এই জায়গা দিয়ে দুইবার বাগানে প্রবেশ করেছে। সে দেয়াল ঘেঁষে মাথা নিচু করে সেই স্থানে এসে পৌঁছল যেখানে ফ্লোরিডার সাথে তার সাক্ষাৎ হত। ফ্লোরিডা এখনও এসে পৌঁছেনি।
তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সে দেখতে পেল, একটি ছায়া ধীরে ধীরে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আরো কাছে আসার পর স্পষ্ট হল, ছায়াটি একটি মেয়ের। হেনরি বরাবরের ন্যায় দুই-তিন পা অগ্রসর হয়ে ফ্লোরিডাকে লক্ষ্য করে দুই বাহু প্রসারিত করে ধরল। কিন্তু ফ্লোরিডাকে আজ একেবারেই স্থবির ও নিস্তেজ মনে হচ্ছিল। তার মাঝে প্রেমাস্পদের সাথে অভিসারের কোন উত্তেজনা ছিল না। সে হেনরির বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তার হাত সরিয়ে দিলো। তারপর একদিকে ঝুঁকে ঘাসের উপর বসে পড়ল। তাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছিল।
‘কি হয়েছে, ফ্লোরিডা?’ হেনরি তার পাশে বসতে বসতে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘আমার থেকে দূরে থাক, হেনরি!’ ফ্লোরিডা কাঁদতে কাঁদতে বলল। আমার এই অপবিত্র দেহ তুমি ছোঁয়ো না। এখন আমি আর তোমার যোগ্য নই। আমি আমার আত্মমর্যাদাশীল, বাহাদুর বাবাকে মুখ দেখাতে পারব না। এখন আমি আমার নিজেকেই অভিসম্পাত করছি।’
‘ফ্লোরা কি হয়েছে, বলবে তো?’ হেনরি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল।
ফ্লোরিডা তাকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে বলল, ‘আমার সতীত্ব ছিল আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ।’ ফ্লোরিডা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর বলছিল। আমি নিজেকে কখনও শাহজাদী মনে করিনি। যদি আমার রানী হওয়ার ইচ্ছা থাকত তাহলে আমার বাবার অধীন এক কর্মচারীর ছেলেকে আমি কখনই ভালোবাসতাম না।’
‘ফ্লোরা!’ হেনরি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে তার কাপড়ের নিচে রাখা খঞ্জর বের করে বলল। আমি এই চরিত্রহীন বাদশাহকে হত্যা করে তোমার ইজ্জতের প্রতিশোধ নেব। তাকে হত্যা করে মহল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করব। যদি ধরা পড়ি তাহলেও কোন পরোয়া করি না। তোমার ইজ্জতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি হাসি মুখে জীবন দিতেও রাজি আছি।’
‘না, হেনরি, না।’ ফ্লোরিডা দাঁড়িয়ে তার সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বলল। “তুমি ঐ শয়তানের কাছেও পৌঁছতে পারবে না। তার আগেই ধরা পড়ে যাবে। আমি তোমাকে লক্ষ্যহীন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। তুমি এক কাজ কর, সকালে শহরের ফটক খোলার সাথে সাথে শহর থেকে বের হয়ে পড়বে। যে কোন অযুহাতেই হোক সবচেয়ে উত্তম ঘোড়া নিবে। তারপর যতটা দ্রুত সম্ভব সিউটা পৌঁছে আমার বাবার কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলবে।
তাঁকে বলবে, তিনি যেন কোন বাহানায় আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। রডারিককে যেন কিছুতেই বুঝতে না দেন যে, তিনি এ ঘটনা সম্পর্কে জানেন। তিনি যদি রডারিকের সামনে সামান্য অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করেন তাহলে এই অসচ্চরিত্র বাদশাহ তাকে খুন করে ফেলবে। আর আজীবনের জন্য আমাকে তার মহলে বন্দী করে রাখবে। রডারিক আমাকে অত্যন্ত ভয়াবহ ধমকি দিয়েছে। বাবাকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে বলবে। অন্যথায় সিউটা তাঁর হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর আমাদের পরিবারের পরিণতি হবে খুবই ভয়ঙ্কর।
***
ভোর হতেই হেনরি আস্তাবলের সেরা ঘোড়ার পিঠে জিন লাগিয়ে নিল। প্রতিদিনের রুটিনওয়ার্ক হিসেবে ঘোড়ার পরিচর্যার অযুহাতে সে দুর্গ থেকে বের হয়ে এলো।
শহর রক্ষা প্রাচীরের ফটক কিছুক্ষণ হল খুলে দেওয়া হয়েছে। দুর্গ থেকে বের হয়েই সে ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিল। যত দ্রুত সম্ভব তাকে এখন জেলেটার পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে জাহাজ ধরে সমুদ্র পথে সিউটা যেতে হবে।
টলেডো থেকে জেত্রেলটার দূরত্ব হল পাঁচশ মাইল। একটি মাত্র ঘোড়া নিয়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করা একেবারেই অসম্ভব। হেনরি ভাবল, তার ফিরে আসতে দেরী হচ্ছে দেখে, দুর্গ থেকে তার খুঁজে লোকজন বের হয়ে পড়তে পারে। তাই সে বিদ্যুৎগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়ে সে একটি নদীর কিনারে ঘোড়া থামিয়ে তাকে পানি পান করাল। তারপর পুনরায় সফর শুরু করল।
সে অবিরাম ছুটে চলছিল। রাতের বেলাও সফর অব্যাহত রাখত। খুব অল্প সময়ের জন্য আরাম করত। আর বেশির ভাগ সময়ই সফর করত। বিরামহীনভাবে চলতে চলতে সে চারদিনে পাঁচশ মাইলের দূরত্ব অতিক্রম করে জেলেটার বন্দরে এসে পৌঁছল।
জেলেটার সমুদ্র বন্দর। সিউটা যাওয়ার জন্য কোন জাহাজই তখন তৈরী নেই। দুই-তিন দিনের মধ্যে কোন জাহাজ সিউটার উদ্দেশ্যে রওনাও হবে না। একটি পাল তোলা নৌকা নদীর পারে নোঙর করা ছিল। নৌকার মাঝি-মাল্লারা একা হেনরিকে পার করে দেওয়ার জন্য এতো বেশি পয়সা চাচ্ছিল যে, হেনরির কাছে এই পরিমাণ পয়সা ছিল না। হেনরি নৌকার মাঝিদের বলল,
‘এই ঘোড়া তোমাদের নৌকার চেয়েও মূল্যবান। এটা তোমাদের হয়ে যাবে, আমাকে সিউটার সমুদ্রসৈকতে পৌঁছে দাও।’
‘আমরা নৌকার সামান্য মাঝি, ঘোড়া দিয়ে আমরা কী করব?’ মাঝিরা বলল। এমনিতেই আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে পেট ভরে দু’বেলা খেতে পাই না, ঘোড়াকে কোত্থেকে খাওয়াব?”
‘তোমরা ঘোড়াটি বিক্রি করেও তোমাদের পাওনা উসুল করে নিতে পার।
‘আমরা ঘোড়র দর-দাম সম্পর্কে কিছুই জানি না।’
‘তাহলে তোমরা আমাকে বিশ্বাস কর।’ হেনরি নিরাশ হয়ে বলল। সিউটা পৌঁছে আমি তোমাদের ভাড়া মিটিয়ে দেব এবং তোমাদেরকে পুরস্কৃত করব।’
মাঝিরা তার চেহারা-সুরত, লেবাস-পোশাক ও শাহীঘোড়া দেখে তাকে বড় কোন অফিসার মনে করছিল। তারা ঘোড়াসহ তাকে নৌকায় উঠিয়ে নিল।
মাঝিরা নোঙর খুলে পাল তোলে দিল। তীর-তীর করে নৌকা চলতে শুরু করল।
সমুদ্র পথের এই দূরত্ব ছিল মাত্র বার মাইল। নৌকা যখন সিউটার সমুদ্র বন্দরে এসে পৌঁছল তখন সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হেনরি মাঝিদেরকে সাথে নিয়ে সোজা জুলিয়ানের মহলে গিয়ে উঠল। সে প্রহরীদের বলল,
‘কাউন্ট জুলিয়ানকে এখনই আমার আগমনের সংবাদ দাও। আমি টলেডো থেকে শাহজাদী ফ্লোরিডার অত্যন্ত জরুরী পয়গাম নিয়ে এসেছি।’
জুলিয়ান তৎক্ষণাৎ তাকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। সে তার মেয়ের সংবাদ জানার জন্য অস্থির হয়ে ছিলেন।
‘তুমি ফ্রেডরিকের ছেলে হেনরি না?’ জুলিয়ান বললেন।
‘হ্যাঁ, কাউন্ট!’ হেনরি বলল।
‘তুমি কি টলেডো থেকে আসছ? বাবাকে কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলে বুঝি?
‘হ্যাঁ, কাউন্ট! এখানে ভালো লাগছিল না, তাই আন্দালুসিয়া সফর করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েছিলাম। সম্মানিত কাউন্ট! আমার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, আর হঠাৎ আগমন করা আপনার জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমি যে পয়গাম নিয়ে এসেছি, তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রথমে ছোট্ট একটি আবেদন, আমি যে নৌকায় এসেছি, তার ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। মাঝি আমার সাথেই এসেছে। তাদের ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। আমি তাদেরকে পুরস্কৃত করব বলে ওয়াদা করেছি।’
জুলিয়ান ভাড়া ও পুরস্কার উসুল করার নির্দেশ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তার মেয়ে কী পয়গাম পাঠিয়েছে?
হেনরি ফ্লোরিডার পয়গাম শোনানের সাথে সাথে জুলিয়ান বিদ্যুতাড়িতের ন্যায় উঠে দাঁড়ালেন। তার শরীরের সমস্ত রক্ত চেহারায় আর চোখে জমা হতে লাগল। রাগে-দুঃখে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি কামরার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত পায়চারী করতে লাগলেন।
শাহজাদীর সাথে ঘটনাক্রমে আমার দেখা হয়েছিল। হেনরি বলল। সে আমাকে এ ঘটনা শুনালে আমি রডারিককে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু শাহজাদী আমাকে এই বলে বাধা দেয় যে, আমি রডারিক পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না; বরং তার পূর্বেই ধরা পড়ে যাব। আমি সেখানের শাহী আস্তাবল থেকে ঘোড়া চুরি করে এখানে পৌঁছেছি।’
‘শাহজাদী ঠিকই বলেছে। জুলিয়ান বললেন। ঐ দুরাচার শয়তানকে হত্যা করা এতো সহজ নয়। আমি অবশ্যই এর প্রতিশোধ নেব। তুমি এখন যেতে পার।’
জুলিয়ান হলেন এই এলাকার বাদশাহ। তাই তিনি এমন একটি নাযুক বিষয়ে সামান্য একজন কর্মচারীর সামনে কোন প্রকার মন্তব্য প্রকাশ করা সমীচীন মনে করছিলেন না। তিনি হেনরিকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন।
‘না, কাউন্ট! এই পুরস্কার আমি কোন সাফল্যের বিনিময়ে গ্রহণ করব? হেনরি বলল। আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি আন্দালুসিয়া গিয়ে রডারিককে হত্যা করার সুযোগ তৈরি করে নিব।
***
জুলিয়ান অল্প সময়ের মধ্যে কিছু উপহার-উপঢৌকন নিয়ে টলেডো এসে উপস্থিত হলেন। তিনি রডারিকের সাথে এতোটাই আন্তরিকতার পরিচয় দিলেন যে, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার মেয়ের সাথে রডারিকের অশালীন আচরণ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। যে কেউ তাকে দেখলে ধারণা করবে, তিনি আন্দালুসিয়ার বাদশাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য শুভেচ্ছার সওগাত নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।
বাদশাহ রডারিক যখন দেখল, জুলিয়ান কিছুই জানে না তখন সে জুলিয়ানের প্রতি অন্যান্য করদ-রাজাদের তুলনায় অনেক বেশি আতিথেয়তা ও সম্মান প্রদর্শন করল। রডারিক তার সম্মানে রাজকীয় ভোজের আয়োজন করল। ভোজসভায় গান-বাজনার ব্যবস্থাও করা হল। ফ্লোরিডা ভোজসভায় তার বাবার পাশেই বসা ছিল। সে রডারিকের আচরণ সম্পর্ক তার বাবাকে সব কিছু খুলে বলল। রডারিক তাকে যে ধমকি দিয়েছে সে কথাও বলল।
‘আমাদের আস্তাবলের প্রধান ফ্রেডরিকের ছেলে হেনরি আমাকে সব কিছু বলেছে।’ জুলিয়ান বললেন। আমি রডারিকের সামনে অজ্ঞ বনে বসে আছি। আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। তার পর এমন প্রতিশোধ নেব যে, ওর বাদশাহী মাটির সাথে মিশে যাবে।
পরদিন বাদশাহ রডারিক জুলিয়ানের সাথে একান্ত বৈঠকে মিলিত হল। সে জুলিয়ানের সাথে সিউটার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ে মতবিনিময় করল। রডারিক জুলিয়ানকে জিজ্ঞেস করল, “ইতিমধ্যে নিশ্চয় মুসলমানরা সিউটা আক্রমণের সাহস করেনি?
‘না, তারা সিউটার দুর্ভেদ্য প্রাচীরের সাথে মাথা ঠোকরিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।’ জুলিয়ান বললেন। তারা বুঝতে পেরেছে যে, সিউটার উপর আন্দালুসিয়ার মতো দুর্বিনীত শক্তির ছায়া রয়েছে। আরব ও বার্বার মুসলমানরা সিউটার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও সাহস করে না।’
‘তোমার মেয়ে ফ্লোরিডা শুধু সৌন্দর্যের প্রতিমাই নয়, বুদ্ধিমতি এবং বাহাদুরও বটে। তাকে কোন সাধারণ ব্যক্তির হাতে তুলে দিও না; আমি তার তরবিয়তের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ বোধ করছি।’
জুলিয়ান অনুগত গোলামের মতোই বললেন, ‘এটা আমার সৌভাগ্য। আমি কিছু দিনের জন্য ফ্লোরিডাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই।
‘না নিয়ে গেলেই ভালো হয়। রডারিক বলল।
‘তার মা খুব বেশি অসুস্থ। জুলিয়ান মিথ্যে বানিয়ে বললেন। তার মা’ই আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দু-একদিনের জন্য ফ্লোরিডাকে নিয়ে এসো। আমি তার মা’র আবেগে আঘাত দিতে পারি না। দু-একদিন পরই আমি মেয়েকে পাঠিয়ে দেব।’
রডারিক প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তাকে পাঠিয়ে দেবে? তাহলে নিয়ে যাও।
জুলিয়ান আরেকটি মিথ্যা কথা বললেন, ফ্লোরিডা বলেছে, সে খুব শীঘ্রই ফিরে আসতে চায়।’
‘তোমার মেয়ে অবশ্যই ফিরে আসতে চাইবে।’ রডারিক বলল। আচ্ছা জুলিয়ান! শুনেছি, তোমাদের এলাকায় উন্নত প্রজাতির বাজপাখি পাওয়া যায়? আমার একটি শিকারী বাজপাখি প্রয়োজন।’
‘হ্যাঁ, শাহানশাহে আন্দালুসিয়া! আমি আপনার জন্য এমন শিকারী বাজপাখি পাঠাবো, যা কখনও আপনি দেখেননি। সে শিকারের উপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে, তাকে বাঁচার সুযোগ পর্যন্ত দেয় না।
জুলিয়ান ফ্লোরিডাকে সিউটা নিয়ে আসার পরের দিনই মুসা বিন নুসাইরের সাথে সাক্ষাতের জন্য বেরিয়ে পড়লেন।
***
মুসা বিন নুসাইর অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সর্বদা সতর্কতা অবলম্বনকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, একজন খ্রিস্টানের পক্ষে কীভাবে সম্ভব মুসলমানদের মাধ্যমে আরেকজন খ্রিস্টানের উপর আক্রমণ করানো। তিনি ভাবছিলেন, এটা খ্রিস্টানদের কোন ষড়যন্ত্র নয় তো! তাই তিনি হুট করে জুলিয়ানকে কোন আশ্বাসও দিতে পারছিলেন না।
‘আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর তাহলে আমি আমার কন্যা ফ্লোরিডাকে এখানে ডেকে আনছি, আপনি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। জুলিয়ান মুসা বিন নুসাইরকে বললেন।
‘আমি হেনরির সাথে কথা বলতে চাই।’ মুসা বললেন। আমার বার্তাবাহক তাকে নিয়ে আসবে। সে না আসা পর্যন্ত তুমি এবং তোমার সাথে আগত ব্যক্তিগণ আমার এখানে মেহমান হিসেবে থাকবে।’
হেনরিকে আনার জন্য তখনই একজন বার্তাবাহক পাঠিয়ে দেওয়া হল। এই অবকাশে জুলিয়ান মুসা বিন নুসাইরের নিকট আন্দালুসিয়া ও রডারিক সম্পর্কে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন, যা আজ পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হয়ে আছে।
‘মুসা বিন নুসাইর!’ জুলিয়ান বললেন। রডারিকের প্রতি আমার এই আক্রোশ নতুন কোন বিষয় নয়। এক পুরনো শত্রুতার জের ধরে আমি তার প্রতি এই আক্রোশ পোষণ করে আসছি। আপনি হয়তো জানেন যে, এক সময় আন্দালুসিয়ার শাসন ক্ষমতা ছিল গোথ বংশের হাতে। সে সময় রডারিক আন্দালুসিয়ার সৈন্যবাহিনীর একজন জেনারেল ছিল। অর্টিজা নামক গোথবংশীয় এক ব্যক্তি তখন আন্দালুসিয়ার বাদশাহ ছিলেন। স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ।
অর্টিজার ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে পাদ্রিরা ধর্মের ছত্রছায়ায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল। তারা বিলাসবহুল জীবন যাপন করত। গির্জাগুলো পাপপুরীতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সে সময় পোপের নির্দেশই ছিল শেষ কথা। পাদ্রিরী যা ইচ্ছা তাই করত। কারণ, তারা ছিল ধর্মীয় অনুসৃত ব্যক্তি। জনসাধারণ ও সৈন্যবাহিনী তাদেরকে সম্মান করত। স্বয়ং বাদশাহও তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস করতেন না।
সামাজিক পরিস্থিতি এই পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, একদিকে সম্পদশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছিল, আর অন্য দিকে সম্পদহীন ব্যক্তিরা কপর্দক শূন্য হতে হতে পথের ভিখারিতে পরিণত হচ্ছিল। প্রজা সাধারণ মূলত রাজবংশের দাসানুদাস ছিল। লোকদেরকে বেগার খাটানো হতো। তাদেরকে খুব সামান্য পারিশ্রমিক দেওয়া হতো। অতি সামান্য ও তুচ্ছ বিষয়ে প্রজাদের উপর নির্যাতন চালানো হত। বিভিন্ন কর ও টেক্স আদায় করতে করতেই জনগণের নাভিশ্বাস উঠত। তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করত। অপর দিকে শাহী কোষাগারের পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। রাজবংশের লোকেরা আরাম-আয়েশ আর বিলাসিতার জীবন যাপন করছিল। এমনি পরিস্থিতিতে অর্টিজা শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
আমার স্ত্রী হলেন তাঁরই কন্যা। অর্টিজার অন্তরে ধর্মের প্রতি সম্মান ও জনসাধারণের প্রতি ভালোবাসা ছিল। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করার সাথে সাথে গির্জা ও। পাদ্রিদের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং গির্জাসমূহ থেকে পাপের পঙ্কিলতা বিদূরিত করেন। এরপর তিনি সে সকল বিত্তশালীদের প্রতি মনোনিবেশ করেন, যারা জনগণের রক্ত চুষে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল। অর্টিজা জনসাধারণের উপর থেকে ট্যাক্স তুলে নিয়ে বিত্তশালীদের উপর ট্যাক্স আরোপ করেন। সম্পদশালীদের সম্পদের হিসাব-নিকাশ করে তাদের উপর পৃথক পৃথকভাবে কর ধার্য করেন। ফলে জনসাধারণের অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে।
কিন্তু ধর্মীয় স্বার্থবাদী এবং বিশাল-বিপুল সম্পদের অধিকারী কায়েমী স্বার্থবাদী ব্যক্তিরা কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছিল না। তারা ভুখা নাজা জনসাধারণের রক্ত চুষে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তুলেছিল, সে সম্পদ পুনরায় তাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে রাজি হল না। ভোগবাদী, স্বার্থপর পাদ্রিরা ধর্মের ধুয়া তুলে সেনাবাহিনীকে এই বলে অর্টিজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ইন্ধন যোগাল যে, অর্টিজা ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে ধর্মীয় ব্যক্তিদেরকে তার গোলাম বানাতে চায়।
ভোগবাদী ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনী বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তখন এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় রডারিক। অর্টিজার আস্থাভাজন সৈন্যদের সংখ্যা অনেক কম ছিল। তারা বিদ্রোহীদের সাথে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। বিদ্রোহীরা বিজয়ী হলে সকল পাদ্রি মিলে রডারিককে বাদশাহ নিযুক্ত করে।
রডারিক বাদশাহ হওয়ার পর সর্বপ্রথম যে নির্দেশ জারি করে তা হল, অর্টিজাকে হত্যা করা হোক। অর্টিজার হত্যাকাণ্ড সম্পাদন হওয়ার পর পরই নেতৃবর্গ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শাহীখান্দানের লোকজন, কায়েমী স্বার্থবাদী ব্যক্তিবর্গ ও ভোগবাদী পাদ্রিরা পুনরায় ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়।
মুসা বিন নুসাইর, আমি আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আপনি আন্দালুসিয়া আক্রমণ করলে, সেখানের জনসাধারণ অত্যাচারী ও বিলাসী বাদশাহ এবং তার জেনারেলদের পক্ষ ত্যাগ করবে। সৈন্যবাহিনীও বিগড়ে যেতে পারে। আপনার সেনাবাহিনী যদি শৌর্য-বীর্যের সাথে লড়াই করে তাহলে আন্দালুসিয়ার সৈন্যবাহিনী ময়দান ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।’
জুলিয়ানের সর্বপ্রকার উৎসাহ প্রদান সত্ত্বেও মুসা বিন নুসাইর তাকে কোন ধরনের আশ্বাসবাণী শুনানো থেকে বিরত রইলেন।
***
চার-পাঁচ দিন পর হেনরি মুসা বিন নুসাইরের বার্তাবাহকের সাথে সিউটা থেকে তানজানিয়া এসে পৌঁছল। অন্যান্য মেহমানদের মতোই তাকে আদর আপ্যায়ন করা হল। অতঃপর তাকে মুসার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হল।
হেনরি জুলিয়ান থেকে এ কথা গোপন রেখেছিল যে, সে ফ্লোরিডাকে ভালোবাসে এবং তারা গোপনে একজন আরেকজনের সাথে মিলিত হতো। সে ফ্লোরিডার বিরহবেদনা সইতে না পেরে টলেডো চলে গিয়েছিল। অথচ জুলিয়ানের নিকট সে বলেছিল, সিউটায় তার মন হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাই সে মনোরঞ্জনের জন্য টলেডো ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল।
মুসা বিন নুসাইরের নিকট সে স্বীকার করে যে, ফ্লোরিডার সাথে তার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। ফ্লোরিডার সাথে সাক্ষাতের জন্যই সে টলেডো ভ্রমণ করে। সেখানে কীভাবে তাদের উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কীভাবে তারা পরস্পর মিলিত হয়, কীভাবে রডারিক ফ্লোরিডার শ্লীলতা হরণ করে–এসব ঘটনা সবিস্তারে মুসা বিন নুসাইরের নিকট বর্ণনা করে।
মুসা বিন নুসাইর হেনরিকে আনুষঙ্গিক আরো কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন করেন। হেনরি যথাসম্ভব সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়। প্রশ্ন করে করে মুসা বিন নুসাইর তার মনের সন্দেহ দূর করে নেন এবং হেনরিকে মেহমান খানায় পাঠিয়ে দেন। অতঃপর জুলিয়ানকে নিজের কাছে ডেকে পাঠান।
‘ভাই জুলিয়ান!’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘আমি তোমার প্রতিটি কথা এবং বন্ধুত্বের প্রস্তাবের ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি, আমি আমার উপদেষ্টাবৃন্দের সাথেও সলাপরামর্শ করেছি। ভাই জুলিয়ান! আমি তোমার কথায় পূর্ণাঙ্গরূপে আস্থা স্থাপন করেছি, তবে আমি একা এভো বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি না। তাছাড়া আন্দালুসিয়াও ছোটখাট কোন রাজ্য নয়। তার সৈন্যবাহিনীও কোন মামুলী বাহিনী নয়।
আমি খলীফার নির্দেশের অপেক্ষা করছি, আজই আমি খলীফার নিকট পয়গাম লেখে দামেস্কের উদ্দেশ্যে আমার বার্তাবাহক পাঠাচ্ছি। উত্তরের জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। বার্তাবাহক যেন অত্যন্ত দ্রুত পৌঁছতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে। তারপরও বার্তাবাহকের ফিরে আসতে প্রায় একমাস লেগে যাবে। তুমি এখন চলে যাও। পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন পর এসো। আর না হয়, আমিই তোমাকে সংবাদ দিয়ে ডেকে পাঠাব।’
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানকে বিদায় দিয়ে বার্তাবাহককে ডেকে আনেন। তিনি বার্তাবাহককে দিয়ে খলীফার নামে এক দীর্ঘ পয়গাম লেখান, যে পয়গামে তিনি জুলিয়ানের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরেন।
সে সময় খলীফা ছিলেন ওলিদ বিন আবদুল মালেক। তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন মর্দেমুমিন ছিলেন। তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান এই ছিল যে, কীভাবে ইসলামের পয়গাম পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া যায়।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অনুরাধে মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হিন্দুস্থান বিজয়ের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন।
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করার পর লেখেন :
‘ঘটনাচক্রে জুলিয়ান আজ এক বিরাট বৃক্ষের খণ্ডিত শাখার ন্যায় আমাদের করায়ত্ত হয়েছে। সম্মানিত খলীফার দরবারে আমি আমার ইচ্ছার কথা এভাবে প্রকাশ করছি, বহু দিন থেকেই আমার দৃষ্টি আন্দালুসিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য উন্মোখি হয়ে আছে। ইসলামের পয়গাম মিসর ও আফ্রিকার সমুদ্রসৈকতে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। আমি কয়েকবারই তানজানিয়ার সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আন্দালুসিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। প্রতিবারই আমি সমুদ্রের বুক চিরে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার পরিকল্পনা এঁটেছি। এখন একজন খ্রিস্টান রাজা সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছে। তাই সকল দিক বিবেচনা করে আমাকে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার অনুমতি প্রদান করুন।
আমি আরেকটি দিকেও মহামান্য খলীফার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তা হল আমার নিকট যে সৈন্যবাহিনী আছে, তাদের বেশিরভাগই বার্বার। বার্বার হিংস্র ও হানাহানী প্রিয় এক সম্প্রদায়। আমি তাদেরকে নিয়ম-শৃঙ্খলার অনুগত করেছি। কিন্তু তারা বেশি দিন শান্তিতে বসে থাকার লোক নয়। যুদ্ধ-বিগ্রহ এদের স্বভাবজাত বিষয়। তারা সর্বদা অবাধ্যতা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য প্রস্তুত থাকে। দীর্ঘদিন তাদেরকে নিয়ম-শৃঙ্খলার অনুগত করে রাখা সম্ভব নয়। আর কিছু দিন তাদেরকে এমন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে কর্মহীন করে আবদ্ধ রাখলে তারা নিজেরাই নিজেদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়বে এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার অবাধ্য হয়ে যাবে। এমনকি তারা ইসলামের ব্যাপারেও বিমুখ হয়ে যেতে পারে।
খলীফাতুল মুসলেমীন! আমি এতো দিন তাদেরকে সিউটা আক্রমণ করা ও অবরোধ করার মাঝেই ব্যস্ত রাখতাম, কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবত এই কাজটিও বন্ধ হয়ে আছে। এখন এই বার্বার সৈন্যবাহিনীকে কোন না কোন জিহাদী ময়দানের সন্ধান দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে; যেন তারা দুশমনের খুন প্রবাহের নেশা পূর্ণ করতে পারে।
রক্ত প্রবাহের এই নেশা চরিতার্থ করা ছাড়া তাদেরকে প্রকৃত মুমিন ও মুজাহিদ বানানোর জন্যও আন্দালুসিয়া অভিমুখে জিহাদের উদ্দেশ্যে পাঠানো উচিত। কাফেরদের রাজ্যে গিয়ে তাদের সাথে জিহাদ করে যখন তারা বিজয় লাভ করবে এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য কাজ করবে তখন তাদের চিন্তা-চেতনায় ইসলামের জন্য মহব্বত সৃষ্টি হবে।‘
***
বার্তাবাহক বেশ কয়েকদিন পর খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের পয়গাম নিয়ে উপস্থিত হল। খলীফার পয়গাম উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। তবে খলীফা সতর্কতা অবলম্বনের ব্যাপারে খুব বেশি তাকিদ দিয়ে লেখেন :
সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যারা দ্বীন-ইসলাম থেকে বিমুখ তাদের উপর পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপন করা উচিত হবে না। সতর্কতাস্বরূপ জুলিয়ানকে কোন না কোনভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। সিউটার করদ-রাজা জুলিয়ান যদি পরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয়, তাহলে দামেস্ককে অবহিত করলে এখান থেকে যুদ্ধ-রসদ ও জরুরি সামান-পত্ৰ অতি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
মুসা বিন নুসাইর ভার উপদেষ্টা পরিষদকে খলীফার পয়গাম পড়ে শোনান। তিনি সকলের নিকট সুচিন্তিত পরামর্শ তলব করেন। আরবদের বিবেক-বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর ছিল। তারা অল্প কিছুক্ষণ মত-বিনিময়ের পর জুলিয়ানকে পরীক্ষা করার পন্থা বের করতে সক্ষম হল।
মুসা বিন নুসাইর তৎক্ষণাৎ একজন রাজদূতকে এই বলে সিউটা পাঠিয়ে দিলেন যে, পয়গাম পাওয়ামাত্রই যেন জুলিয়ান মুসা বিন নুসাইরের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
জুলিয়ান এই সংবাদের অপেক্ষায়ই ছিলেন, সংবাদ পাওয়ামাত্রই তিনি তৈরি হয়ে নিলেন। তিনি তার সাথে আন্দালুসিয়ার ক্ষমতাচ্যুত বাদশাহ অর্টিজার ভাই আউপাস ও উচ্চপদস্থ একজন সেনা-অফিসারসহ একশত বিচক্ষণ রক্ষীসেনা নিয়ে রওনা হলেন।
এই রাজকীয় কাফেলা আফ্রিকার রাজধানী কায়রোয়ান’ এসে পৌঁছার সাথে সাথে জুলিয়ান মুসার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। ঐতিহাসিকদের মতে এই সাক্ষাতে অর্টিজার ভাই আউটপাস এবং জুলিয়ানের উচ্চপদস্থ সেনা-কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিল। এই সাক্ষাতের মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্য আন্দালুসিয়ার দরজা খুলে গিয়েছিল।
‘ভাই জুলিয়ান, দামেস্ক থেকে অনুমতি পাওয়া গেছে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তবে শর্ত হল, তোমাকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিককে তুমি এমনই এক দুশমন মনে কর যে, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে না।’
‘এই প্রমাণ পেশ করার কী পদ্ধতি হতে পারে–আপনিই বলুন?’ জুলিয়ান বললেন। আমি তো শুধুই প্রহর গুণছি, সেই সময় কখন আসবে যখন আমি নরাধম রডারিক থেকে আপন কন্যার ইজ্জতের প্রতিশোধ নিতে পারব।’
‘মুহতারাম আমীর!’ আউপাস বলল। আমার সেই ভাইয়ের আত্মা আমাকে রাত্রে ঘুমোতে দেয় না, যার বিরুদ্ধে রডারিক বিদ্রোহ করে ছিল এবং যাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে বাদশাহ হওয়ার পর তাকে হত্যা পর্যন্ত করেছিল। এখন সে আমাদের খান্দানের উপর এমন এক আঘাত হেনেছে, যদি আপনি আমাদের স্থানে হতেন তাহলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একদিনও অপেক্ষা করা বরদাশত করতেন না। আপনার সৈন্যবাহিনীর মতো সৈন্যবাহিনী যদি আমাদের থাকত তাহলে আমরা সাহায্য ভিক্ষা চাওয়ার জন্য আপনার দরজায় এসে দাঁড়াতাম না।’
‘এখন আর অপেক্ষা করব না। মুসা বিন নুসাইর বললেন। জুলিয়ান! এক কাজ কর, তোমরা তোমাদের সৈন্যবাহিনী নিয়ে রাতের অন্ধকারে সদ্র পার হয়ে আন্দালুসিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী কোন অঞ্চলে আক্রমণ করো। তবে আন্দাসুলিয়ার ফৌজ টের পাওয়ার আগেই তোমরা তোমাদের ফৌজ ফিরিয়ে আনবে। এই আক্রমণই একটা প্রমাণ হিসেবে থাকবে যে, তোমরা রডারিককে নিজেদের দুশমন মনে কর। আমি তোমাদের প্রতিশোধ স্পৃহার প্রচণ্ডতা অনুমান করতে চাই।’
‘আমার ফৌজ যদি সেখানে কোন কারণে আটকা পড়ে যায়? জুলিয়ান জানতে চাইলেন। কিংবা আমার ফৌজের তুলনায় অধিক সংখ্যক ফৌজের সাথে যদি মোকাবেলা করতে হয় তাহলে আমার পরিণতি কী হবে?’
‘তোমাকে মন্দ পরিণতির সম্মুখীন হতে দেব না। মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘আমার ফৌজ সমুদ্রসৈকতে উপস্থিত থাকবে। আমি সংবাদ প্রেরণের এমন ব্যবস্থা করব যে, তোমার বাহিনী কোন প্রকার বিপদের সম্মুখীন হলে তৎক্ষণাৎ আমাকে অবহিত করা হবে এবং আমার ফৌজ তোমার সাহায্যার্থে সেখানে উপস্থিত হবে।’
***
জুলিয়ান ও আইপাস তৎক্ষণাৎ তাদের সম্মতি প্রকাশ করলেন। মুসা বিন নুসাইরের সাথে মিলে তারা আন্দালুসিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী একটি এলাকায় আক্রমণের প্রান তৈরি করলেন। অতঃপর জুলিয়ান ও আউলাস সিউটার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।
মুসা বিন নুসাইর তার কিছু সংখ্যক সৈন্যকে সেনাপতি আবু যুর’আ তুরাইফ বিন মালেক আল-মু’আফেরীর নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। মুসা বিন নুসাইর তাকে বলে দিলেন, তিনি যেন সিউটার পার্শ্ববর্তী কোন অঞ্চলে পৌঁছে তাঁবু গেড়ে অপেক্ষা করেন। জুলিয়ান যখন তার সৈন্যবাহিনী আন্দালুসিয়া অভিমুখে পাঠাবে তখন তুরাইফ তার বাহিনীকে সিউটার উপকূলে এনে উপস্থিত করবে।
তুরাইফ তার বাহিনী নিয়ে সিউটার উপকূলে এসে পৌঁছলে জুলিয়ান শাহীমহল থেকে বের হয়ে এসে তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি তুরাইফকে বললেন, ‘শাহীমহলে চলুন, সেখানে এক শাহীকামরায় আপনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘কাউন্ট জুলিয়ান!’ সেনাপতি তুরাইফ বললেন। আমাদের সেনাপতি তার আয়ত্তাধীন কোন সিপাহীর তুলনায় নিজেকে উত্তম ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী মনে করে না। তাই সে অন্যদের থেকে পৃথক ও উন্নত ব্যবস্থাকে নিজের জন্য অসমীচীন মনে করে। যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি ও সিপাহী একই মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। আমাদের ধর্ম মানুষের উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ সমর্থন করে না। আপনি যদি আমাদেরকে নামায পড়তে দেখেন তাহলে আপনি পার্থক্য করতে পারবেন না, কাতারে কাতারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো মুসলমানদের মাঝে কে উচ্চপদস্থ ফৌজী, আর কে সাধারণ সিপাহী? কখনও এমনও হয় যে, আমাদের অধীন সাধারণ কর্মচারী সামনের কাতারে দাঁড়ায়, আর আমরা পিছনের কাতারে দাঁড়াই। সেনাপতির সৌভাগ্য শুধু এই যে, তিনি ইমামতির দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে থাকেন।
‘আপনারাই আন্দালুসিয়া বিজিত কতে সক্ষম হবেন। জুলিয়ান উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন। এটাই হল ইসলামের শক্তির সেই উৎস, যা আপনি বর্ণনা করলেন, অথচ আমাদের সেনাপতি তার অধীন সিপাহীকে ব্যক্তিগত চাকর মনে করে। তারপরও আমি বলব, আমার মহলের দরজা আপনার জন্য সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে।’
কয়েক দিন পরের কথা। এক রাতের আঁধারে জুলিয়ানের ফৌজ এবং তুরাইফের নেতৃত্বাধীন সৈন্যবাহিনী পালতোলা রণতরীতে আরোহণ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রণতরী আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে সিউটার সমুদ্রসৈকত ত্যাগ করবে।
জুলিয়ান তার স্ত্রী ও দুই কন্যা–ফ্লোরিডা ও মেরীকে সাথে নিয়ে সৈন্যদেরকে বিদায় জানানোর জন্য এসেছিলেন। তারা রণতরী থেকে নেমে তীরে উঠে এলো। ফৌজ রওনা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফ্লোরিডা তার বাবার জন্য এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। সে চাচ্ছিল, পুরুষালী পোশাক পরিধান করে সৈন্যদের সাথে আন্দালুসিয়া আক্রমণে অংশ গ্রহণ করবে। সে তার বাবার যুদ্ধবর্ম ও ঢাল-তলোয়ার বের করে এনেছিল। কিন্তু জুলিয়ান তাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছিল না। তার মাও তাকে বাধা দিচ্ছিল।
ফ্লোরিডা চিৎকার করে বলছিল, আমি কি শাহসওয়ার নই? আমি কি ঢাল-তলোয়ার চালনা করতে জানি না? আমি কি বর্ষা নিক্ষেপ করতে পারি না? আমার ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তীর কি কখনও নিশানা দে করতে ব্যর্থ হয়েছে?’
বাবা-মা উভয়ে তাকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে, তারা সবকিছুই জানেন, কিন্তু দুশমন যখন ঢাল-তলোয়ার আর বর্ষা নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয় তখন আত্মরক্ষা করে চতুর্দিকে খেয়াল রেখে, দুশমনের আঘাত প্রতিহত করা এবং তাকে প্রতিঘাত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে দক্ষ তীরন্দাজের ধনুক থেকে নির্গত তীরও নিশানা ভেদ করতে ব্যর্থ হয়। লড়াই করে মৃত্যুবরণ করা পুরুষের কাজ; মেয়েদের কাজ নয়।
‘শ্লীলতাহানী আমার হয়েছে, ফ্লোরিডা চিৎকার করে বলল। “অত্রব আন্দালুসিয়ার উপর প্রতিশোধমূলক প্রথম আঘাত আমাকেই হানতে হবে।’
ফ্লোরিডা যখন কারো কথাই শুনছিল না তখন জুলিয়ান তাকে এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষান্ত করেন যে, মুসলমানরা যখন রডারিককে পরাজিত করবে তখন আমি মুসা বিন নুসাইরের নিকট আবেদন করব, তিনি যেন রডারিককে জীবিত গ্রেফতার করে তোমার হাতে সোপর্দ করে। তখন তুমি তাকে নিজ হাতে হত্যা করতে পারবে।’
বাবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ফ্লোরিডা কিছুটা শান্ত হল। অবশেষে জুলিয়ান মুসলিম সেনাপতি আবু যারুআ তুরাইফ-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। সেখানে তিনি মুসলিম সেনাপতির সাথে ফ্লোরিডাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন ফ্লোরিডা শেষ সুযোগ মনে করে তুরাইফকে এই বলে বারবার অনুরোধ করতে লাগল, যেন তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে অনুমতি আদায় করে দেন।
“তোমার বাবা হয়তো তোমাকে অনুমতি দিয়ে দেবেন, সেনাপতি তুরাইফ বললেন। কিন্তু আমি তোমাকে কিছুতেই অনুমতি দেব না। কারণ, আমরা এমন এক জাতি, যারা আপন স্ত্রী-কন্যার ইজ্জত ও সম্মানের জন্য হাসি মুখে জীবন উৎসর্গ করতে পারে। সুতরাং তোমার মতো একজন নারীকে যুদ্ধের ময়দানে দুশমনের সামনে পাঠানো আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে?
সেনাপতি তুরাইফের কথা শুনে ফ্লোরিডার যুদ্ধে যাওয়ার শেষ আশাটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল।
সমুদ্রপথের দূরত্ব ছিল মাত্র বার মাইল। জুলিয়ানের রণতরীর নাবিকরা ছিল অত্যন্ত দক্ষ ও চৌকস। সমুদ্র ছিল প্রশান্ত, আর বাতাস ছিল অনুকূলে। বাতাসের আনুকূল্য পেয়ে পালোলা রণতরী পানিতে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ তুলে সুতীব্র বেগে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল। নাবিকরা কাঙ্ক্ষিত সময়ের পূর্বেই জুলিয়ানের সৈন্যবাহিনীকে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে পৌঁছে দিল। সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব ছিল আউপাসের হাতে।
***
রাতের অর্ধ প্রহর। যুদ্ধ সাজে সজ্জিত রণতরী আন্দালুসিয়ার দক্ষিণ দিক একটি ছোট্ট শহর মেয়দিনস্পনুর বন্দরে নিঃশব্দে নোঙর ফেলল। শহরের বাসিন্দারা তখন গভীর ঘুমে অচেতন। সমুদ্র সন্নিকটবর্তী ফৌজি চৌকিগুলোতে সৈন্যরা অনেকক্ষণ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। যে সকল সৈন্যের পাহারার দায়িত্ব ছিল তারা কোথাও বসে কোথাও দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে। তাদের কোন ভয় ছিল না। তারা জানত, সিউটা হল আন্দালুসিয়ার প্রবেশ মুখ। আর সেই প্রবেশ মুখে আছে বড় মজবুত দুর্গ। আর আছে জুলিয়ানের অতন্দ্র প্রহরী সৈন্যবাহিনী।
কেবলমাত্র মুসলমানদের পক্ষ থেকেই ভয় ছিল। এই সম্ভাবনাও ছিল যে, তারা সিউটার রাস্তা ত্যাগ করে বহু দূরের সমুদ্র তীর ঘুরে এসে আক্রমণ করতে পারে কিন্তু আরবদের ব্যাপারে এটা প্রসিদ্ধ ছিল যে, তারা রণতরী পরিচালনায় অনভিজ্ঞ। সামুদ্রিক যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। বাস্তবতাও ছিল তাই। আরবদের তখন পর্যন্ত নৌযুদ্ধের কোন সুযোগই আসেনি। এটাই ইসলামের প্রথম নৌযুদ্ধের ঘটনা।
আন্দালুসিয়ায় সীমান্তরক্ষীবাহিনী শত্রুর আক্রমণ সম্পর্ক একেবারেই বেখবর ছিল। তারা সব ধরনের বিপদ থেকে নিশ্চিন্ত ছিল। পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী জুলিয়ানের সৈন্যবাহিনী নিঃশব্দে রণতরী থেকে নেমে তীরে উঠে এলো। কমান্ডার আউপাস আগে থেকেই জানত, কোথায় কোথায় সীমান্তরক্ষা চৌকী আছে। সে তার অধীনস্থ বাহিনীকে সেসকল চৌকিতে দ্রুত আক্রমণের নির্দেশ দিল।
নৈশ প্রহরীরা শুধু দেখতে পেল, কিছু ছায়ামূর্তি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ব্যাস, এ পর্যন্তই। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের উপর কেয়ামত সংঘটিত হয়েগেল। চৌকিতে গভীর ঘুমে অচেতন সিপাহীদের জাগ্রত হওয়ার সুযোগই হল না। তারা বেঘোরে মারা পড়ল।
প্রতিরক্ষা চৌকীগুলো একটির চেয়ে আরেকটি বেশ দূরে অবস্থিত ছিল। সুবহে সাদেক উদিত হওয়ার পূর্বেই প্রতিটি চৌকিতে আক্রমণ করে সিপাহীদের হত্যা করা হল। তাদের মাঝে এমন কেউ ছিল না, যে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে কোন বড় শহরে পৌঁছে এই সংবাদ দেবে যে, আন্দালুসিয়া শত্রুসেনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
ভোরের আলো ফুটার সাথে সাথে জুলিয়ানের বাহিনী আশ-পাশের আরো দুই-তিনটি শহরে আক্রমণ করে বসল। তারা সেখানে লুটতরাজ, খুন-খারাবী ও ত্রাস সৃষ্টি করল। সৈন্যদের প্রতি জুলিয়ানের নির্দেশ ছিল–কোন গির্জা যেন অক্ষত না থাকে। তার নির্দেশ অনুযায়ী সৈন্যরা কয়েকটি গির্জা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিল। আর কয়েকটিতে আগুন লাগিয়ে দিল।
সন্ধ্যা পর্যন্ত সিউটার সৈন্যবাহিনী এই ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রাখল। তাদের সামনে কোন সুন্দরী যুবতী মেয়ে এসে পড়লে তাকেও তারা উঠিয়ে নিত। জুলিয়ান তাদেরকে আরো নির্দেশ দিয়েছিল যে, হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের সময় এই ঘোষণা করতে হবে যে, এটা সিউটার বাহিনী। তাই হানাদার বাহিনী নিজেদেরকে সিউটার বাহিনী বলে পরিচয় দিচ্ছিল, আর রক্তের হোলী খেলায় মেতে উঠছিল।
সিউটার হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলায় আন্দালুসিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী কয়েকটি শহর একেবারে বিপর্যস্ত ও লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। সারা দিনের লুটতরাজ আর হত্যাযজ্ঞ শেষে সিউটা-বাহিনী যেমন আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে ছিল তেমনি আকস্মিকভাবে রণতরীতে চেপে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকত ত্যাগ করে সিউটার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।
হানাদার বাহিনী সিউটায় ফিরে এলে জুলিয়ান মুসলিম সেনাপতি তুরাইফকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি আপনাদের এই সন্দেহ দূর হয়েছে যে, আমি রডারিককে জানের দুশমন মনে করি?
জুলিয়ান মুসলিম সেনাপতিকে বললেন, হে মুসলিম সেনাপতি! অবশ্যই আপনি বুঝতে পারছেন, আমি নিজের জন্য এক বিপদজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছি। এখন রডারিক সিউটায় পাল্টা হামলা করবে।’
‘তার হামলা করা উচিত। সেনাপতি তুরাইফ বললেন। সে এটা কীভাবে বরদাশত করবে যে, তার অধীন সামান্য এক করদ-রাজা তার রাজ্যে এসে তার বাহিনীর নওজোয়ানদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তার অধীনস্থ প্রজাদের ঘর লুণ্ঠন করেছে, গ্রামের পর গ্রাম ভস্মিভূত করেছে।
তবে কাউন্ট জুলিয়ান, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমরা কখনই আপনাকে একা ছেড়ে দেব না। আমার এই বাহিনী এখন থেকে এখানেই থাকবে। তারা সদা সতর্ক থাকবে। আপনি এখনই আমাদের আমীর মুসা বিন নুসাইরের নিকট চলে যান। আপনি তার সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি করুন। আর এই চুক্তির সংবাদ আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিকের নিকট পৌঁছে দিন।’
মুসলিম সেনাপতির পরামর্শ অনুযায়ী সেই দিনই জুলিয়ান মুসার সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি সম্পাদন করার জন্য রওনা হয়ে গেলেন।
***
প্রথম থেকেই মুসার এই ধারণা ছিল যে, জুলিয়ান তাঁকে ধোকা দিচ্ছে না। তথাপি তিনি তার এই ধারণাকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে চাচ্ছিলেন। তাই তিনি সম্মিলিত বাহিনীর মাধ্যমে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী আরেকটি দ্বীপশহর–এগোসিস আক্রমণের প্লান তৈরি করেন। এই সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ দ্বারা মুসা বিন নুসাইর বুঝতে চেষ্টা করছিলেন, জুলিয়ান ও তার বাহিনীর উপর কতটা নির্ভর করা যায়। সেই সাথে তিনি এটাও পরখ করতে চাচ্ছিলেন, আন্দালুসিয়ার বাহিনী কতটা রণ-নিপুন। তাদের কমান্ডারইবা কতটা যুদ্ধ-পারদর্শী।
মুসা বিন নুসাইর আবু যারু’আ তুরাইফ বিন মালেক আল-মু’আফেরীকে সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন। বাহিনী রওনা হওয়ার পূর্বে মুসা বিন নুসাইর সেনাপতিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ইবনে মালেক, খুব সতর্ক থেকো, চারদিকে চোখ-কান খোলা রেখো। তোমার অধীনস্থ সালারদেকেও সতর্ক থাকতে বললো। তোমরা জুলিয়ানের বাহিনীর কমান্ডারদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। লক্ষ্য করবে, তারা আমাদেরকে ধোঁকা তো দিচ্ছে না? এটাও খেয়াল করতে হবে যে, তারা সাহসী না ভীরু।
আমি জুলিয়ানকে বলতে শুনেছি, সে তার কমান্ডারদেরকে বলছিল, “তোমরা মুসলমানদেরকে এ কথা বলার সুযোগ দেবে না যে, জুলিয়ানের বাহিনী ভীরু, কাপুরুষ। তোমরা এমন কোন আচরণও করবে না, যার কারণে মুসলমানদের এই সন্দেহ হয় যে, আমরা তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি। মুসলমানদের আমীরের মনে এখনও আমাদের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস জন্মেনি।
মনে রেখো! আপন ইজ্জতের জন্য বীরপুরুষ নিজের জান কুরবান করতে পারে, কিন্তু অন্যকে ধোকা দিতে পারে না। তোমরা একজন ধোকাবাজ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যাচ্ছ। সেই ধোঁকাবাজ হল, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিক। তোমাদেরকে প্রথমেই বলা হয়েছে, রডারিক হল আমাদের দুশমন। তোমরা তার উপর একবার আক্রমণ করেছ। আমি তোমাদেরকে শুধু একটি কথার উপরই বেশি গুরুত্ব দিতে বলব, তা হল মুসলমানরা যেন এটা মনে না করে যে, তোমরা ভীরু, কাপুরুষ। তোমরা ধোকাবাজ।”
***
জুলাই ৭১০ খ্রিস্টাব্দের কোন এক রাত্রির শেষ প্রহর। সুবহে সাদেকের আলো-আঁধারে মুসা বিন নুসাইর ও জুলিয়ানের সম্মিলিত বাহিনী কয়েকটি বিশাল আকৃতির রণতরীতে আরোহণ করল। ঐতিহাসিক সন্ধিপত্রে জুলিয়ানের বাহিনীর কোন সংখ্যা লেখা হয়নি, তবে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল, চারশ পদাতিক, আর একশ অশ্বারোহী।
এগোসিরাস আয়তনের দিক থেকে ছোট্ট একটি দ্বীপ। গুপ্তচরের মাধ্যমে পূর্বেই সেখানকার যাবতীয় সামরিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেখানে আন্দালুসিয়ার সৈন্যসংখ্যা কত? কোথায় কোথায় প্রতিরক্ষা চৌকি আছে–এসব সম্পর্কে সম্মিলিত বাহিনী পূর্ব থেকেই অবহিত ছিল।
সম্মিলিত বাহিনী এমন এক স্থানে তাদের যুদ্ধ-জাহাজ নোঙর করল, যে স্থানটি গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। তার চতুর্পাশে বহু দূর পর্যন্ত বড় বড় পাথরের টিলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এসব উঁচু উঁচু টিলার কারণে সেনাচৌকি থেকে সমুদ্র তীরের এই স্থানটি ভালো করে দেখা যায় না। এই স্থানটিতেই সম্মিলিত বাহিনীর সৈন্যরা অবতরণ করল।
সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও সম্মিলিত বাহিনী তাদের অবস্থান গোপন রাখতে সক্ষম হল না। সম্মিলিত বাহিনীর রণতরীগুলো যখন যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে খোলা সমুদ্রে দ্বীপটির দিকে এগিয়ে আসছিল তখন বহু দূর থেকেই সেই দৃশ্য দ্বীপবাসীদের দৃষ্টি গোচর হয়েছিল।
রণতরী সমুদ্র তীরে নোঙর করার সাথে সাথে ঘোড়াগুলো নিচে নামানো হল। পদাতিক বাহিনীও নিচে নেমে এলো; কিন্তু অশ্বারোহীরা তখনও ঘোড়ায় চড়ে বসেনি। পদাতিক বাহিনীও সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোন রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। এমন সময় আচমকা টিলার পিছন থেকে তাদেরকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি তীর বৃষ্টি শুরু হল।
আন্দালুসিয়ার তীরন্দাজ বাহিনী পূর্ব থেকেই গাছের পিছনে ও ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে ওঁত পেতে ছিল। মাত্র কয়েকদিন আগে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী একটি এলাকা জুলিয়ানের বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। একারণে সীমান্ত এলাকা ও সমুদ্রতীরবর্তী দ্বীপাঞ্চলগুলোতে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। টহলদার বাহিনী পূর্ব থেকেই প্রস্তুত হয়েছিল।
তীরের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য যে সকল অশ্বারোহী এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়েছিল। সেনাপতি তুরাই তাদেরকে হুকুম দিলেন, তারা যেন তীরবৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করে চতুর্দিক থেকে টিলাগুলো ঘিরে ফেলে।
পদাতিক বাহিনী প্রথমেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। অধিকাংশ সৈন্য পিছে হটে সমুদ্রের দিকে চলে এসেছিল। অনেকে রণতরীতে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল। সম্মুখভাগে শুধু আহত সৈনিকরাই প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছিল।
জুলিয়ান-বাহিনীর কমান্ডার আউপাস এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করে নিজ বাহিনীকে একত্রিত করে নির্দেশ দিচ্ছিল। তার সিপাহীরা নির্দেশ পাওয়ামাত্র টিলা লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল।
আন্দালুসিয়ার তীরন্দাজরা সমুদ্রতীরের হানাদার সিপাহীদের লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি তীর নিক্ষেপ করছিল। আউপাসের সৈন্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিল। তারা ডানে-বাঁয়ে ও পিছনে ছড়িয়ে পড়ে টিলা, গাছপালা ও ঝোঁপঝাড়ের আড়াল খুঁজতে লাগল। ফলে তীরন্দাজদের তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে লাগল।
আউপাস পিছন দিক থেকে সিপাহীদেরকে উত্তেজিত করছিল। সিপাহীরাও অসম সাহসিকতার সাথে তীরবৃষ্টি উপেক্ষা করে টিলার উপর চড়তে শুরু করল।
সেনাপতি তুরাইফ আউপাসের সিপাহীদের নির্ভীক সাহসিকতা দেখে নিজ বাহিনীর তীরন্দাজদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন টিলার নিচের গাছগুলোতে আরোহণ করে প্রতিপক্ষের তীরন্দাজদের নিশানা বানায়। নির্দেশমতো গাছে আরোহণ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের তীরের আঘাতে কয়েকজন মুসলিম তীরন্দাজ আহত হলেও অন্যরা গাছে আরোহণ করতে সক্ষম হল। তারা গাছে আরোহণ করে টিলার পিছনে অবস্থানরত আন্দালুসিয়ার তীরন্দাজদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে লাগল। উপায়ন্তর না দেখে আন্দালুসিয়ার তীরন্দাজরা পিছে হটতে বাধ্য হল।
মুসলিম অশ্বারোহীরা টিলাগুলো পূর্বেই ঘেরাও করে নিয়েছিল। প্রতিপক্ষের কোন তীরন্দাজই সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারল না। আন্দালুসিয়ার সৈন্যরা আক্রমণকারী সৈন্যদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে সেনাপতি তুরাইফ তার অশ্বারোহীদেরকে টিলার পিছনে আত্মগোপন করে থাকতে বললেন। তিনি কমান্ডারদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন।
উভয় বাহিনী মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। আন্দালুসিয়ার বাহিনী খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পিঠটান দিতে বাধ্য হল। সেনাপতি তুরাইফ আত্মগোপন করে থাকা অশ্বারোহীদেরকে পলায়মান সৈন্যদের পিছু ধাওয়া করার ইঙ্গিত দিলেন। অশ্বারোহীরা টিলার পিছন থেকে বের হয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে পলায়নরত বাহিনীকে ধরে ফেলল। আন্দালুসিয়ার বাহিনী এমন হঠাৎ আক্রমণের আশঙ্কা করেনি। তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করতে শুরু করল। মুসলিম বাহিনী তাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে লাগল। শত্রুপক্ষ ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের শিকার হল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। বিজিত বাহিনী এই দ্বীপের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখল আল-খাযরা বা সবুজ দ্বীপ।
***
সবুজ দ্বীপ থেকে ফিরে সেনাপতি তুরাইফ মুসা বিন নুসাইরের নিকট যুদ্ধ জয়ের পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি জুলিয়ান ও তার সৈন্যবাহিনী সম্পর্কে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস জুলিয়ান আমাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে না। তার বাহিনীও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে।’ তিনি আরো বলেন। ‘আন্দালুসিয়ার সৈন্যদের মাঝে যুদ্ধ করার স্পৃহা খুবই কম। তাদের নেতৃত্ব দানকারী কমান্ডারদের মাঝেও এমন কোন বিশেষত্ব নেই, যা আমাদেরকে পেরেশান করতে পারে।
মুসা বিন নুসাইর যুদ্ধ জয়ের রিপোর্ট শুনে আন্দালুসিয়ার চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য পরিপূর্ণ প্লান তৈরি করতে মনোনিবেশ করেন। এই সময় জুলিয়ান মুগীস আর-রুমী নামক এক নওমুসলিমকে সাথে নিয়ে মুসা বিন নুসাইরের সাথে। সাক্ষাৎ করতে আসেন।
জুলিয়ান মুসলিম বাহিনীর সাথে আন্দালুসিয়া যাওয়ার ইচ্ছায় এসেছিল। সে মুগীস আর-রুমীকেও সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর অনুমতি দিতে ইতস্তত করছিলেন।
জুলিয়ান কিছুটা বিরক্ত হয়ে অনুযোগের স্বরে বললেন, ‘মুসা! এখনও কি আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস জন্মেনি? আমি এমনটিই সন্দেহ করছিলাম। আপনাদের আস্থা অর্জন করার জন্য আমি আরেকটি উপায় সাথে করে এনেছি।’
এ কথা বলেই জুলিয়ান দরবার থেকে বের হয়ে গেলেন। সিউটা থেকে তার বেশ বড় একটি কাফেলা এসেছিল। সেই কাফেলায় তার অধীনস্থ কর্মচারী, দেহরক্ষী সেনাকর্মকর্তা ও উপদেষ্টাবৃন্দ ছিলেন। তাদের সাথে রাজবংশের মহিলারাও ছিল।
জুলিয়ান পুনরায় যখন দরবারে প্রবেশ করলেন তখন তার সাথে অনিন্দ্য সুন্দর দু’টি মেয়ে ছিল। তারা ছিল অসাধারণ রূপসী, আর মোহনীয় দেহ-সৌষ্ঠবের অধিকারিনী।
জুলিয়ান দরবারে প্রবেশ করেই বললেন, এরা আমার মেয়ে। এই হল ফ্লোরিডা, আর এ হল তার বোন মেরী। মুসা! আমি এই দুজনকে আপনার নিকট পণবন্দী হিসেবে অর্পণ করতে চাই। এরাই হল আমার মান ও সম্মান। ফ্লোরিডা আমার সেই মেয়ে, যার জন্য আমি আমার এক ক্ষমতাধর পুরাতন দোস্তকে দুশমন, আর এক পুরাতন দুশমনকে দোস্ত বানিয়েছি।
আপনি দেখেছন, আমি আমার আত্মমর্যাদা হারিয়ে কতটা উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। বিরাট ক্ষমতাধর এক বাদশাহর রাজত্বে আক্রমণ করে আমি নিজের জন্য কত বড় বিপদ ডেকে এনেছি। তারপরও আমি ক্ষান্ত হয়নি। তোমার বাহিনীর সাথে আমার নিজের বাহিনীকে পাঠিয়ে ছিলাম তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ দখল করার জন্য। মুসা বিন নুসাইর! আজ আমি আমার সেই ইজ্জত আপনার হাতে পণ হিসেবে তুলে দিচ্ছি। আমি অথবা মুগীস যদি আপনাদেরকে সামান্য ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে আমার মেয়েদেরকে দাসী বানিয়ে নিবেন অথবা হিংস্র বার্বারদের হাতে ছেড়ে দেবেন।’
কোন ঐতিহাসিকই এই বিষয়টি স্পষ্ট করে লেখেননি যে, মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, নাকি তাদের মাঝে অন্য কোন কথা হয়েছিল? ঐতিহাসিকগণ শুধু এতটুকুই লেখেছেন যে, জুলিয়ান পণ হিসেবে তার দুই মেয়েকে মুসলমানদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। হয়তো মুসা বিন নুসাইর তার সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।
জুলিয়ান দ্বিতীয় যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা হল সে তার পূর্ণ বাহিনী মুসলিম বাহিনীর সাথে আন্দালুসিয়া পাঠাবেন। মুসা বিন নুসাইর তার এই প্রস্তাব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তিনি জুলিয়ানের নিকট এতটুকু সহযোগিতার আশা পোষণ করেন যে, মুসলিম বাহিনীর কাছে যুদ্ধ-রসদ প্রেরণ করার ক্ষেত্রে সিউটা ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করবে। সেই সাথে মুসলিম বাহিনী আন্দালুসিয়া যাওয়া-আসার পথে সিউটার দুর্গে থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবে।
সবশেষে জুলিয়ানের নিকট এই প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য রণতরীর ব্যবস্থা যেন জুলিয়ান করে দেন।
জুলিয়ান সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। তিনি এই আশ্বাসও দেন যে, তার বাহিনী সর্বদা সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকবে।
মুসা বিন নুসাইর সেই দিনই খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের নামে একটি পয়গাম লেখে একজন কাসেদকে দামেস্ক পাঠিয়ে দেন। খলীফা পূর্বেই আন্দালুসিয়া আক্রমণের অনুমতি দিয়েছিলেন; কিন্তু মুসা বিন নুসাইর ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। তিনি সার্বিক পরিস্থিতি উল্লেখ করার পর লেখেন :
‘আন্দালুসিয়া আক্রমণের জন্য পুনরায় অনুমতি নেওয়া আমার নিকট সময়ের অপচয় ব্যতীত আর কিছুই মনে হয় না, কিন্তু আপনি হিন্দুস্তানে সৈন্য প্রেরণ করেছেন। তাদের প্রয়োজন হয়তো এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যার কারণে আপনি আমাকে আন্দালুসিয়ার মিশন মুলতবী করার নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা উভয় রণাঙ্গনে সমানতালে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যে, উভয় রণক্ষেত্রেই মুসলিম বাহিনী দুর্বল হয়ে যেতে পারে অথবা একটিতে দুর্বল হয়ে যেতে পারে…। তাই অধীনের পক্ষ থেকে আরয এই যে, মহামান্য খলীফা বিষয়টির গভীরতা চিন্তা করে দেখবেন।’ খলীফার পক্ষ থেকে অত্যন্ত উৎসাহব্যাঞ্জক উত্তর আসে। তিনি লেখেন :
‘আল্লাহর নাম নিয়ে সকল প্রস্তুতি পূর্ণ করো এবং যথা সম্ভব দ্রুত রণাঙ্গনের উদ্দেশ্যে সৈন্য পাঠিয়ে দাও। তবে খুব ভেবে-চিন্তে সেনাপতি নির্বাচন করবে।’
***
সেনাপতি নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বেশ কয়েকটি কারণে মুসা বিন নুসাইর সেনাপতি তুরাইফকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করতে চাচ্ছিলেন না। তন্মধ্যে একটি কারণ হল, বাহিনীর প্রায় একশ ভাগ সৈন্যই হল বার্বার। তাই মুসা বিন নুসাইরও চাচ্ছিলেন, প্রধান সেনাপতিও হবে বাবার সম্প্রদায়ভুক্ত। আরব সেনাপতি তার অধীনস্থ হবেন।
সে সময় বাবার সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে এমন কয়েকজন ব্যক্তির উন্মেষ ঘটেছিল, যারা রণাঙ্গণে নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা রাখতেন। তারা সকলেই নিজ
নিজ যোগ্যতা বলে কমান্ডারের পদবী অর্জন করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন। ছিলেন, তারিক বিন যিয়াদ।
প্রধান সেনাপতি নিযুক্তির ব্যাপারে মুসা বিন নুসাইর তন্ময় হয়ে ভাবছিলেন। তাঁর স্মৃতির পর্দায় অতীত দিনের ঘটনাগুলো মূর্ত হয়ে উঠছিল। তিনি যেন সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলেন।
এই তো সে দিনের কথা। তখনও বেশিরভাগ বার্বার ইসলাম গ্রহণ করেনি। তারা আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিল। এই বার্বারদের সাথেই মুসা বিন নুসাইরকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। তিনি তাদের অন্তরে যেমন যুদ্ধের আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিলেন, তেমনি প্রেম-ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অনুভূতিও সৃষ্টি করে ছিলেন। তিনি এক দিকে তাদের উপর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন, অপর দিকে বন্ধুত্বের সুনিবিড় বন্ধনে তাদেরকে আবদ্ধ করেছেন।
সে সময় অনেক বার্বারই মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তাদের অনেককেই উচ্চপদস্থ মুসলিম কর্মকর্তাগণ গোলাম বা কর্মচারী হিসেবে নিজেদের কাছে রেখে দেন। মুসা বিন নুসাইরও এক বার্বার নওজোয়ানকে পছন্দ করেন। তিনি সেই নওজোয়ানকে নিজের কাছে রেখে দেন। সেই নওজোয়ান মুসা বিন নুসাইরের নিকট একজন গোলামের মতোই ছিল।
সেই গোলামের কথা শুনে, তার কাজ দেখে, মুসা বিন নুসাইরের মনে হল, এই গোলাম কোন মামুলী বংশের হতে পারে না। তার মাথার চুল ঈষৎ লাল। চেহারায় এক ধরনের ঔজ্জ্বল্য। এক দিন মুসা বিন নুসাইর তাকে তার বাব-দাদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, সে ভাণ্ডাল’ বংশোদ্ভূত।
ভাণ্ডাল বংশ বার্বারদের মাঝে অন্যান্য বংশের তুলনায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। বংশগত কারণেই হয়তো এই গোলাম অত্যন্ত বিচক্ষণ, বুদ্ধিদীপ্ত ও অনন্য গুণাবলীর অধিকারী ছিল। ফৌজী কলা-কৌশল রপ্ত করার প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক ছিল। ঘোড়সওয়ারিতেও সে ছিল অত্যন্ত দক্ষ। তীরন্দাজী ও তরবারী চালনায় তার কোন সমকক্ষ ছিল না। বার্বারদের বিদ্রোহী গোত্রগুলোকে দমন করার জন্য মুসা বিন নুসাইর যখন বের হতেন তখন সেও তার সাথে বের হতো। সিউটা অবরোধের সময়ও সে মুসার সাথে গিয়েছিল।
মুসা বিন নুসাইর লক্ষ্য করতেন, এই গোলাম শুধু তাঁর সেবাই করে না, বরং কখনও কখনও কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ রণকৌশল সম্পর্কেও সঠিক পরামর্শ দিয়ে থাকে। আরবী ভাষা সে আপন মাতৃভাষার মতোই শিখে নিয়েছিল।
রণ-পটুতার কারণে মুসা বিন নুসাইর মুসলিম ফৌজের মাঝে তাকে এক বিশেষ পদ প্রদান করেন। তার মাঝে নেতৃত্ব প্রদানের মতো তেজোদ্দীপ্ত কিছু গুণাবলী ছিল। মুসা বিন নুসাইর তাকে কোন এক রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করেন। সে পরীক্ষায় কৃতকার্য হলে মুসা তার প্রতি খুশী হয়ে তাকে একটি বাহিনীর কমান্ডার বানিয়ে দেন। এর পর অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সে আপন যোগ্যতা বলে সহকারী সেনাপতি পদে পদোন্নতি লাভ করে।
এই পর্যায়ে পৌঁছার অনেক পূর্বেই সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মুসা তার নাম রাখেন তারিক, আর তার বাবার নাম যিয়াদ। তারিক বিন যিয়াদ।
তারিক বিন যিয়াদ এখন মুসলিম বাহিনীর এক সম্মানিত সেনাপতি। আন্দালুসিয়া আক্রমণের নেতৃত্ব প্রদান করার জন্য সেনাপতি নির্বাচনের প্রয়োজন দেখা দিলে বারবার মুসার দৃষ্টি এই আযাদকৃত গোলাম তারিক বিন যিয়াদের উপরই নিবদ্ধ হতে লাগল।
তাঁকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করার জন্য মুসা তার মাঝে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তা হল তাঁর আপোষহীন নেতৃত্ব। তারিক বিন যিয়াদ রণাঙ্গনে শুধু সামনে এগিয়ে যেতেই অভ্যস্ত ছিলেন। পশ্চাৎপসারণ জাতীয় কোন শব্দের সাথে তাঁর কোন পরিচয় ছিল না।
***
হঠাৎ এক দিন মুসা তারিক বিন যিয়াদকে ডেকে বললেন, আন্দালুসিয়া আক্রমণের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তোমাকে নির্বাচন করা হয়েছে। মুসা তারিক বিন যিয়াদকে পরীক্ষা করার জন্য তাঁর সামনে আন্দালুসিয়ার ম্যাপ রেখে বললেন, এই হল আন্দালুসিয়া, তুমি কীভাবে এই রাজ্য আক্রমণ করবে, আমাকে বুঝিয়ে বল? মনে রেখো, তোমার বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা বেশির চেয়ে বেশি সাত হাজার হবে। কমও হতে পারে, তবে বেশি হবে না।’
তারিক বিন যিয়াদ ম্যাপ ভাঁজ করে এক পার্শ্বে রেখে দিয়ে বললেন, ‘সম্মানিত আমীর! আমি এমন এক প্রতিশ্রুতি এবং এমন এক নীতিমালার উপর ভিত্তি করে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে সৈন্যবাহিনীকে অবতীর্ন হতে বলব যে, তারা শুধু সামনেই অগ্রসর হবে, পিছে হটার কথা কেউ চিন্তাও করবে না। ‘বাঁচলে গাজী মরলে শহীদ’ এই হবে তাদের মূলমন্ত্র।
তারিক বিন যিয়াদের কথা শুনে মুসার বার্ধক্য পীড়িত অভিজ্ঞ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল।
মিসর ও আফ্রিকার রাজধানী কায়রোয়ান। সেনাপতি নিযুক্ত হওয়ার সাথে সাথে রাজধানী কায়রোয়ানের অলিগলিতে তীর-ধনুক-বর্শাসহ নানা ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরির হিড়িক পড়ে গেল। সবচেয়ে বেশি বানানো হল, তীর ও হাতে নিক্ষেপযোগ্য বর্শা।
মুসা বিন নুসাইর নির্দেশ দিলেন, ‘তীর ও হাতে নিক্ষেপযোগ্য বর্শার এত বিপুল পরিমাণ মওজুদ গড়ে তুলো, যেন আন্দালুসিয়া থেকে এই পয়গাম না আসে–তীর ও বর্শা শেষ হয়ে গেছে। কারণ, আন্দালুসিয়া যেতে হলে সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে। শত্রুপক্ষ আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে রসদ সরবরাহের একমাত্র মাধ্যম সমুদ্রপথ বন্ধ করে দেবে। তখন কিছুতেই যুদ্ধাস্ত্র সরবাহ করা সম্ভব হবে না।’
তারিক বিন যিয়াদ তার অধীনস্থ সৈন্যদেরকে কঠোর ট্রেনিং-এর মাধ্যমে প্রস্তুত করতে লাগলেন। আন্দালুসিয়ার যে এলাকায় যুদ্ধ হবে সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি জুলিয়ানের নিকট জানতে চাইলেন। জুলিয়ান তাঁকে সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে সবিস্তারে অবহিত করলেন।
ভৌগোলিক দিক থেকে আন্দালুসিয়া উত্তর আফ্রিকার চেয়ে একেবারেই ভিন্ন রকম। দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা সবুজের সমারোহ, আর সবুজ চাদরে ঢাকা উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি, খরস্রোতা নদী আর পাহাড়ী ঝর্নার নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরা অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আন্দালুসিয়া।
জুলিয়ানের তথ্য অনুযায়ী তারিক তার বাহিনীকে আন্দালুসিয়ার ভৌগোলিক অবস্থার অনুপাতে ট্রেনিং দিতে লাগলেন। অবশেষে এক দিন যুদ্ধে যাওয়ার দিনক্ষণ উপস্থিত হল। তারিক বিন যিয়াদকে যে বাহিনী দেওয়া হয়েছিল তার সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র সাত হাজার। তাদের মধ্যে কয়েকশ অশ্বারোহীও ছিল। সাত হাজারের এই বাহিনীর সকল সদস্যই ছিল বার্বার সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
জুলিয়ান মুসলিম বাহিনীকে চারটি বড় বড় রণতরী প্রদান করেছিলেন। রণতরীর নাবিক ও ক্যাপ্টেনও তিনিই দিয়েছিলেন। এই রণতরীগুলো এত বড় ছিল যে, সাত হাজার সৈন্য, কয়েকশ ঘোড়া ও অন্যান্য যুদ্ধ-সামগ্রী অনায়াসেই তাতে বহন করা সম্ভব হয়েছিল।
রণাঙ্গনে রওনা হওয়ার পূর্বে তারিক বিন যিয়াদ বিদায়ী সাক্ষাতের জন্য মুসা বিন নুসাইরের নিকট এসে তাঁকে বললেন, ‘মুহতারাম আমীর! আপনার নিকট শুধু বিজয়ের সুসংবাদ পৌঁছবে।
‘ইবনে যিয়াদ! মুসা বললেন। ভুলে যেয়োনা শক্ৰসংখ্যা এক লক্ষেরও অধিক হতে পারে।’
‘আমাদের শক্ৰসংখ্যা যুদ্ধের ময়দান সর্বদা বেশিই হয়ে থাকে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমি আপনাকে একটি সুসংবাদ দিতে চাই, আমি গতরাত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখেছি, তিনি আমাকে এই বলে সুসংবাদ দিয়েছেন, “হিম্মতহারা হয়ো না, নিজের প্রতি আস্থা রেখো, দায়িত্ব পালনে অবিচল থেকো; বিজয় তোমারদেরই হবে।”
তারিক বিন যিয়াদের এই স্বপ্নের কথা খ্রিস্টান ঐতিহাসিকগণও লেখেছেন। এ থেকে বুঝা যায়, এটা কোন মুসলিম ঐতিহাসিকের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত কাল্পনিক কোন আবিষ্কার নয়।
***
৭১১ খ্রিস্টাব্দের ৯ই জুলাই-এর এক সুন্দর বিকাল। রণতরী রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত। সকল সৈনিক রণতরীতে উঠে নিজ নিজ অবস্থান বুঝে নিয়েছে। মুসলিম বাহিনীকে বিদায় জানাতে শত-সহস্র নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর সমুদ্রসৈকতে সমবেত হয়েছে। সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে তারা সকলে হাত উঠিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিজয় কামনা করে দু’আ করে। দু’আ শেষে তারা তাকবির ধনীর মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীকে বিদায়সম্ভাষণ জানায়।
তাদের মুহুর্মুহু তাকবির ধ্বনীতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। নিস্তরঙ্গ জলৰাশিতেও যেন উচ্ছ্বাসের ঢেউ লাগে। মুজাহিদগণ তাকবির বলতে বলতে ধীরে ধীরে নোঙর তুলে নেন। রণতরীর মাস্তুলে হাওয়া লেগে পাল ফুলে উঠে। ধীরে ধীরে জাহাজগুলো সমুদ্রসৈকত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।
মুসলিম বাহিনীকে বিদায় জানাতে আসা নর-নারীদের চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। তাদের মধ্যে কেউ হলেন সৈন্যদের মা-বাবা, কেউ স্ত্রী-কন্যা, আর কেউ আদরের ছোট ভাই-বোন।
এই সাত হাজার মুজাহিদের মধ্য থেকে কেউ হয়তো আর কোন দিন আন্দালুসিয়া থেকে ফিরে আসবেন না। আল্লাহর পয়গামকে সমুদ্রের ওপারে পৌঁছানোর জন্য জানের নাযরানা দিতে আজ তারা রওনা হয়েছেন, হয়তো তাঁরা আজীবনের জন্য দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবেন। তাদের সাথে আর কোন দিন হয়তো আপনজনের দেখাও হবে না।
***
মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ-জাহাজ ‘ক্যাপেল’ নামক স্থানে সমুদ্র-তীরবর্তী একটি অঞ্চলে নোঙর করল। মুসলিম বাহিনী সেখানে অবতরণ করার পর সেই স্থানের নাম রাখা হল, জেলেটার বা জাবালুতারিক। সেই স্থানের নাম আজও অপরিবর্তীত আছে।
সকল সৈন্য জাহাজ থেকে নেমে আসলে তারিক বিন যিয়াদ তাদেরকে সামরিক শৃঙ্খলার সাথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। তিনি জাহাজের নাবিকদেরকে পৃথকভাবে দাঁড়াতে বলেন। তিনি একটি উঁচু স্থানে ঘোড়র উপর বসে ছিলেন। ঘোড়র উপর বসে থেকেই তিনি নাবিকদেরকে বললেন, ‘চারটি জাহাজের সব কটিতেই আগুন লাগিয়ে দাও।
নাবিকরা আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি পুনরায় চিৎকার করে বললেন, ‘যুদ্ধজাহাজ থেকে সকল সৈন্য নেমে এসেছে। যুদ্ধ-রসদও নামিয়ে আনা হয়েছে। এখন আমাদের জাহাজের আর কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং তাতে আগুন লাগিয়ে দাও।’
এমন নির্দেশ একমাত্র সেই সেনাপতিই দিতে পারেন, যার মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেছে। নাবিকরা অবাক হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইল।
এবার তারিক আরেকটু উঁচু আওয়াজে তাঁর বাবার সৈন্যদের লক্ষ্য করে বললেন, হে বার্বার ভাইসকল, তোমরা জাহাজে আগুন লাগিয়ে দাও। আমরা এখান থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে চাই না।’
বাবার সিপাহীরা তার নির্দেশমতো সবগুলো জাহাজে আগুন লাগিয়ে দিল। আগুনের লেলিহান শিখা অতি দ্রুত সবগুলো জাহাজে ছড়িয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জাহাজের পাল, মাস্তুল, কড়িকাঠ ও পাটাতন আগুনের গ্রীসে পরিণত হল। জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ডগুলো সমুদ্রে ছিটকে পড়তে লাগল। ধোঁয়ায় আন্দালুসিয়ার আকাশ-সীমা আচ্ছাদিত হয়ে গেল।
তারিক বিন যিয়াদ জলদগম্ভীর কণ্ঠে লুঙ্কার দিলেন। গোটা বাহিনী তার প্রতি মনোনিবেশ করল। তিনি সকলকে লক্ষ্য করে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও জ্বালাময়ী এক বক্তৃতা প্রদান করলেন। তার কণ্ঠ থেকে শব্দগুলো যেন বিদ্যুত্তরঙ্গের ন্যায় মর্মভেদী আওয়াজ তুলে ছিটকে পড়ছিল, আর সৈন্যদের মর্মমূলে আঘাত হেনে চলছিল।
তারিক বিন যিয়াদ নিজে ছিলেন বাবার বংশীয়, গোটা বাহিনীও ছিল বার্বার বংশোদ্ভূত, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মাতৃভাষার পরিবর্তে আরবী ভাষায় এক ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেন। তাঁর সেই ভাষণ ইতিহাসের পাতায় আজও সংরক্ষিত রয়েছে; কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে।
তারিক বিন যিয়াদ তার ভাষণে বলেন :
‘প্রিয় নওজোয়ান বন্ধুগণ! এখন পিছে হটার বা রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে যাওয়ার আর কোন উপায় নেই। তোমাদের সামনে রয়েছে তোমাদের জানের দুশমন, আর তোমাদের পিছনে রয়েছে কূল-কিনারাহীন অথৈ সমুদ্র। সামনের দিকেও তোমাদের পালানোর কোন পথ নেই, পিছনের দিকেও কোন পথ নেই। এখন বাঁচতে হলে তোমাদের করণীয় হল, ধৈর্য, হিম্মত, আর অবিচলতার পরিচয় দেওয়া।
এই রাজ্যে তোমাদের দৃষ্টান্ত হল, কৃপণের দুয়ারে অনাথের আগমনের ন্যায়। এখানে কেউই তোমাদের সাহায্য করবে না। তোমাদের সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি, আর কাপুরুষতা তোমাদের নাম-নিশানা পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তোমাদের শক্ত সংখ্যা তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তাদের যুদ্ধাস্ত্র তোমাদের যুদ্ধাস্ত্রের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।
শত্রুপক্ষের নিকট যুদ্ধ-রসদ পৌঁছার অনেক উপায় রয়েছে। আর তোমাদের যুদ্ধ-রসদ ফুরিয়ে গেলে নতুন যুদ্ধ-রসদ পাওয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই।
যদি তোমরা সাহসিকতার পরিচয় না দাও তাহলে তোমাদের মান-সম্মান মাটির সাথে মিশে যাবে। তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ভূলুণ্ঠিত হবে। তোমাদের মান-সম্মান তোমাদেরকেই অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। তোমাদের শৌর্য-বীর্য তোমাদেরকেই বজায় রাখতে হবে। শত্রুপক্ষকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে হবে। তাদের শক্তির ভিত্তিমূল ধসিয়ে দিতে হবে। প্রথম আঘাতেই তাদেরকে বিপর্যস্ত ও লণ্ডভণ্ড করে দিতে হবে।
আমি তোমাদেরকে এমন কোন বিষয় সম্পর্কে ভয় দেখাচ্ছি না, স্বয়ং আমি যার সম্মুখীন হবো না। তোমাদেরকে এমন কোন স্থানে লড়াই করার জন্যও উদ্বুদ্ধ করছি না, স্বয়ং আমি যেখানে লড়াই করব না। আমি সার্বক্ষণিক তোমাদের সাথেই থাকব। যদি তোমরা অটল-অবিচল থাকো তাহলে এই রাজ্যের ধন-দৌলত, মান-সম্মান তোমাদের পদচুম্বন করবে। যদি তোমরা সাময়িক কষ্টকে বরদাস্ত করো তাহলে এই রাজ্যের প্রতিটি বস্তু তোমাদের হবে।
আমিরুল মুমিনীন ওলিদ বিন আবদুল মালেক তোমাদের মতো নওজোয়ান বীরপুরুষদেরকে এক মহান কাজের জন্য নির্বাচন করেছেন। যদি তোমরা এই কাজে সফল হতে পার তাহলে তোমরা এখানের রাজ-রাজাদের জামাতা হতে পারবে। এখানকার অপরূপ রূপসী নারীদের স্বামী হতে পারবে। যদি তোমরা এই রাজ্যের শাহসওয়ারদেরকে রাজিত করতে পার তাহলে আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলের আদর্শ এখানেও সমাদৃত হবে।
মনে রেখো, আমার কথা ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করো, আমি তোমাদেরকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছি, সেদিকে গমনকারী সর্বপ্রথম ব্যক্তি আমি নিজেই। যুদ্ধের ময়দানে সর্বপ্রথম আমার তরবারিই কোষমুক্ত হবে।
এই যুদ্ধে আমি যদি শাহাদাত বরণ করি তাহলে তোমরা তোমাদের বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী কাউকে সিপাহসালার বানিয়ে নিবে। তবে কোন পরিস্থিতিতেই আল্লাহর রাস্তায় জীবন কুরবান করা থেকে বিমুখ হবে না। যত দিন পর্যন্ত এই রাজ্য বিজিত না হবে তত দিন পর্যন্ত তোমরা হিম্মত হারা হয়ে দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে বসে থেকো না।’