তোমাকে দেখছি।
আমাকে দেখার কিছু নেই।
আছে।
পাকামো করতে হবে না। যা গিয়ে পড়তে বস।
মুন্নি একটু অবাক হল। এখন পড়তে বসব কেন? হাফইয়ার্লি মাত্র শেষ হয়েছে। এখন আমাদের ছুটি।
ছুটির সময় পড়তে হয় না? ছুটির সময় পড়তে আমার ভাল লাগে না।
কিন্তু পড়া উচিত। ক্লাশ এইটের রেজাল্ট ভাল না হলে নাইনে তোকে ভাল সাবজেক্ট দেবে না। সায়েন্স কিংবা কমার্স তুই পাবি না। আমি ভিকারুননিসায় পড়েছি। ওই স্কুলের নিয়ম আমি জানি।
ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। ভাল সাবজেক্ট আমি পাব। দেখো সায়েন্সই পাব আমি।
তারপর একটু থামল মুন্নি। মুগ্ধ গলায় বলল, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ফুপি।
এবার মুন্নির দিকে ফিরল সেতু। সুন্দর করে হাসল। আমি সব সময়ই সুন্দর।
আজ একটু বেশি লাগছে। ইস্ আমি যদি তোমার মতো সুন্দর হতাম।
উঠে মুন্নির সামনে এল সেতু। দুহাতে মুন্নির মুখটা অতি আদুরে ভঙ্গিতে তুলে ধরল। আমার মতো হবি কেন? তুই আমর চেও সুন্দর।
.
শুভকে খুঁজতে তার রুমের দিকে যাচ্ছিল মালা।
হাতে মুখবন্ধ মোটাসোটা একটা এয়ারমেইল খাম আর পঞ্চাশ টাকার একটা নোট।
রুমে ঢোকার আগেই শুভর সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল।
শুভ বেশ ফিটফাট হয়ে বেরুচ্ছে। ফেডেড জিনসের সুন্দর প্যান্ট পরেছে, পায়ে কালো বুট, গায়ে বরফ সাদা টিশার্ট। খানিক আগে শেভ করেছে, মাথায় শ্যাম্পু করে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করেছে বলে খুবই ফ্রেস লাগছে তাকে। তার ওপর বেশ পুরুষালি, সুন্দর গন্ধের পারফিউম ইউজ করেছে। সেতুর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা থাকলে এরকম ফ্রেস হয়েই বেরয় সে।
তবু মালা তাকে বলল, তুই কি বেরুচ্ছিস?
দেখে বোঝা যাওয়ার পরও এরকম প্রশ্ন! শুভ খুবই ঠাট্টার ছলে নিল কথাটা। সিরিয়াস মুখ করে বলল, না, টয়লেটে যাচ্ছি।
মালা একটু থতমত খেল। কী?
হ্যাঁ। এরকম সাজগোজ করে, জিনস বুট পরে, টিশার্ট পরে, পারফিউম না লাগিয়ে আমি কখনও টয়লেটে যাই?
মালার স্বভাব হচ্ছে অতিশয় ন্যাকামো করা, অতিশয় আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলা। ভাইয়ের সঙ্গে একটা দুটো কথা বলার পরই সেই ভঙ্গিটা বেরিয়ে এল। দেখ তুই কিন্তু আমার সঙ্গে ফাজলামো করবি না। বল না, বেরুচ্ছিস?
শুভ একটু রুক্ষ্ম হল। শোন মালা…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখ বড় করল মালা। আপা না বলে হঠাৎ যে নাম ধরে ডাকছিস? বড় বোনকে কেউ নাম ধরে ডাকে?
তোর মাথায় ঘিলু আছে কী নেই পরীক্ষা করার জন্য ডাকলাম। সামান্য আছে। এজন্য নাম ধরে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে রিয়্যাক্ট করলি। তবে আর একটু ঘিলু তোর মাথায় থাকা খুব দরকার ছিল। তাহলে বুঝতি এইসব পোশাক পরে কেউ বসে থাকে না। দেখেই বোঝা যায় সে কোথাও বেরুচ্ছে। প্রশ্ন করার দরকার হয় না।
ছোট্ট শিশুর মতো আদুরে ভঙ্গিতে গাল ফোলাল মালা। হয়েছে, আর বলতে হবে না।
তারপর একটু থেমে বলল, বাইরে যখন বেরুচ্ছিসই, আমার কাজটা করে দিস সোনা।
কাজ মানে চিঠি পোস্ট করা।
হ্যাঁ। তুই তো জানিসই।
কিন্তু প্রত্যেক সপ্তাহে দুলাভাই ফোন করছেন, ফোন করলে আধঘণ্টার কম কথা বলেন না, বিদেশে থেকে বেচারা যা রোগজার করছেন সবই টেলিফোন বিলে চলে যাচ্ছে, তারপরও প্রতি সপ্তাহে তুই তাকে দেড় দুদিস্তা করে চিঠি লিখছিস! তোদের কথা কি ফুরোয় না?
না ফুরোয় না। সারাজীবন ধরে বললেও ফুরোবে না।
খামটা শুভর হাতে দিল মালা। যেখানেই যাস চিঠিটা পোস্ট করে তারপর যাবি।
ডানহাতে খাম ধরে বা হাতটা মালার দিকে বাড়াল শুভ। রিকশা ভাড়া দে।
পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিল মালা। চিঠি পোস্ট করতে বিশ টাকা আর দশটাকা তোর রিকশা ভাড়া। বাকি বিশ টাকা আমাকে ফেরত দিবি।
শুনে খ্যাক করে উঠল শুভ। তোর সাহস তো কম না। ছোটভাইর কাছে বিশটাকা ফেরত চাইছিস? আচ্ছা দেব কিন্তু তোর চিঠি আর কখনও পোস্ট করব না।
মালা মুম্বাই সিনেমার ভাইভক্ত বোনের ভঙ্গিতে বলল,এখন আমাকে তাহলে কী করতে হবে?
বল, বিশটাকা ফেরত দিতে হবে না, সোনা।
মালা মিষ্টি করে হাসল। আচ্ছা বললাম।
পুরো সেনটেনসটা বল।
বিশটাকা ফেরত দিতে হবে না, সোনা।
দ্যাটস গুড।
টাকাটা পকেটে খুঁজে বাড়ি থেকে বেরুল শুভ।
.
এক্সপোর্টফেয়ার থেকে কিছু ফুল কিনেছিল দোলন।
আসল ফুলের চেয়েও সুন্দর। বাড়িতে কারও আসার কথা থাকলে ড্রয়িংরুমের ফুলদানিগুলোতে সেই ফুল খুবই মন দিয়ে, পরিপাটি করে সাজায়।
কথাটা সেতু জানে।
এখন কি সেই ফুলই সাজাচ্ছে দোলন! না হলে সেতু যে ওদের বাড়িতে ঢুকল টের পেল না কেন! সেতুর আসার কথা থাকলে নীচতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে সে। অন্তত পাঁচ দশমিনিট আগ থেকে গেট বরাবর কোথাও না কোথাও সে থাকবেই যেখান থেকে সেতুকে ঢুকতে দেখা যাবে।
আজ কী হল?
নাকি সময়ের অনেক আগে চলে এসেছে সেতু!
সেতু ঘড়ি দেখল। না, ঠিক সময়েই এসেছে। বারোটা বাজতে দশমিনিট বাকি।
সেতু তারপর পা টিপে টিপে দোলনদের ড্রয়িংরুমের সামনে এসে দাঁড়াল।
হ্যাঁ যা ভেবেছিল তাই। ফুল সাজাচ্ছে দোলন। খুবই মগ্ন হয়ে সাজাচ্ছে। কোনওদিকে খেয়াল নেই।
নিঃশব্দে খানিক দাঁড়িয়ে দোলনকে দেখল সেতু, তারপর মৃদুশব্দে গলা খাকাড়ি দিল। দোলন একেবারে চমকে উঠল। দরজার দিকে তাকিয়ে সেতুকে দেখে হাসল। ও তুই? কখন এলি?
সেতু ভেতরে ঢুকল।
অনেকক্ষণ।
যাহ।
সত্যি। তুই টেরই পাচ্ছিলি না।
তারপরই যেন সেতুকে খেয়াল করে দেখল সে। দেখে খুবই মুগ্ধ হল। চোখ বড় করে বলল, কিন্তু তোকে দেখে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
কেন?
কী যে সুন্দর লাগছে!
ফুল রেখে সেতুর একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াল দোলন। এই, তুই এত সুন্দর কেন?
লম্বা সোফায় এককোণে বসল সেতু। বাস মালিকদের মতো কথা বলবি না।
মানে?
কোনও কোনও বাসের পেছনে লেখা দেখবি ‘পৃথিবী এত সুন্দর কেন? এই কেনর উত্তর কী?
ঠোঁটের মজাদার একটা ভঙ্গি করল দোলন। বাপরে, তুই দেখি মহাযুক্তিবাদি হয়ে গেছিস।
কিন্তু সে কোথায়?
নিশ্চয় রিকশায়। অস্থির হওয়ার কিছু নেই। বলেছে টাইমলি চলে আসবে। যে টাইমে আসার কথা সেই টাইমের আরও সাত মিনিট বাকি আছে।
আচমকা সেতু তারপর বলল, তোদের বাড়িতে কী হয়েছে?
দোলন অবাক হল। কই কিছু হয়নি তো।
তাহলে এমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছে কেন? অবশ্য তোদের বাড়িটা এমনিতেই ভুতুড়ে ধরনের।
আর তোদেরটা হচ্ছে জঙ্গল। দিনদুপুরে বেজী চড়ে বেড়ায়।
কথাটা পাত্তা দিল না সেতু। বলল, বল না বাড়িটা আজ এত ভুতুড়ে লাগছে কেন?
দোলন তার লম্বা নাকের ডগাটা একটু মুছল। বাড়িতে কেউ নেই। আমি আর দুটো কাজের বুয়া।
খালাম্মা খালুজান কোথায়?
দুজনেই যশোর গেছেন। ভাইয়ার ওখানে।
বাড়িতে শুধু তুই?
হ্যাঁ। অসুবিধা কী?
এই বয়সী মেয়েকে কাজের বুয়াদের কাছে রেখে…
দোলন হাসল। মা বাবা দুজনেই জানেন আমি খুবই বাঁজখাই টাইপের মেয়ে। আমার কাছে কেউ ভিড়বে না।
তোর জায়গায় আমি হলে এই চান্সটা যে কী নেয়া নিতাম না।
কী করতি?
ওকে রেখে দিতাম বাড়িতে।
শুনে চোখ বড় করল সেতু। কী?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
টাকা পয়সা দিয়ে কাজের বুয়া দুটোকে ম্যানেজ করে ফেলতাম। ওকে বলতাম বাড়ি থেকে ব্যাগট্যাগ নিয়ে চলে আস। বলবে ঢাকার বাইরে কোনও বন্ধুর ওখানে বেড়াতে যাচ্ছ।
তারপর?
মা বাবা যে কদিন না আসবে আমার সঙ্গে থাকবে সে।
রাতেও?
তবে!
বলিস কী? রাতে একসঙ্গে থাকা মানে…
মানে ফানে নিয়ে আমি ভাবছি না। যাকে ভালবাসি, যার জন্য মরে যেতেও পারি তাকে নিয়ে ওসব ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ভাব করব কেন? সে যেমন করে আমাকে চাইবে আমিও তেমন করে তাকে চাইব। দুজন দুজনকে চাইলে অসুবিধা কী?
ওরকম করে চাসনি এখনও?
না। চান্স পাইনি। জায়গা কোথায়?
আমি ব্যবস্থা করে দিই। তুই আমাদের বাড়িতে কয়েকদিন থাকবি বলে চলে আয়। শুভ ভাইকেও বল চলে আসতে।
সেতু খুবই উজ্জ্বল হল। অমন করতে পারলে বেশ হয়, না?
হ্যাঁ। করবি?
ধ্যাৎ!
লজ্জায় লাল হল সেতু। এসব ভাবতে ভাল লাগে কিন্তু করতে পারব না। বিয়ের আগে অমন করে শুভকে আমি পেতে চাই না। আমার মন ভরবে না।
ঠিক তখুনি কলিংবেল বাজল। দোলন লাফিয়ে উঠল। ওই এসে গেছে। তুই বোস, আমি গেট খুলে দিচ্ছি।
দোলন ছুটে বেরিয়ে গেল।
.
দুপুরবেলা অফিস ফেলে বাড়ি চলে এসেছে শাহিন এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি।
আজ কেন ফিরল?
বেডরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অবাক বিস্ময়ে স্বামীর দিকে তাকাল সুরমা। উতলা গলায় বলল, কী হয়েছে? এ সময় ফিরে এলে যে? অফিস করনি?
কাতর ভঙ্গিতে বিছানায় বসল শাহিন। ছুটি নিয়ে এসেছি। শরীর ভাল লাগছে না।
কোনও রকমে জুতোটা খুলল শাহিন, মোজা খুলতে পারল না। শুয়ে পড়ল।
ভারি শরীর নিয়েও দ্রুত বিছানার কাছে ছুটে এল সুরমা। ব্যস্ত ভঙ্গিতে শাহিনের কপালে হাত দিল। জ্বর এল না-কি? হ্যাঁ, শরীর বেশ গরম।
চোখ বন্ধ করে শাহিন বলল, মাথাটাও খুব ধরে আছে।
মাথায় পানি দিয়ে দেব?
দাও। একটা চাঁদরও গায়ে দিয়ে দাও। ঠাণ্ডা লাগছে।
ওয়ার্ডরোব থেকে চাঁদর বের করে শাহিনের গায়ে দিয়ে দিল সুরমা। তারপর বাথরুম থেকে প্লাস্টিকের বড় বালতি ভরে পানি আনল, মগ আনল, এনে অতিযত্নে। স্বামীর মাথায় পানি দিতে লাগল।
এ সময় হন্তদন্ত হয়ে মা এসে ঢুকলেন। শাহিন, কী হয়েছে বাবা?
তারপর ছেলের কপালে হাত দিলেন। ইস্ শরীর একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। কখন এরকম জ্বর এল? সকালবেলা আমাকে বলবি না! জ্বর নিয়ে অফিসে গেলি কেন?
শাহিন মুমুর্ষ গলায় বলল, তখন ছিল না। অফিসে যাওয়ার পর মাথা ব্যথা শুরু হল। শীত করতে লাগল। তারপর জ্বর এল।
পানি দেয়া বন্ধ করে উঠল সুরমা। তোয়ালে দিয়ে শাহিনের মাথা ভাল করে মুছে ঠিকঠাক মতো শুইয়ে দিল তাকে। তারপর কিচেনের দিকে চলে গেল। মা বসে রইলেন শাহিনের মাথার কাছে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এককাপ র চা আর একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নিয়ে এল সুরমা। শাহিনকে বলল, উঠে বস। গরম গরম র চায়ের সঙ্গে ট্যাবলেটটা খেয়ে নাও। এ এমন কিছু না। শর্দি জ্বর। তিনবেলা তিনটা ট্যাবলেট খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে মুখিয়ে উঠলেন মা। কে বলেছে তোমাকে এসব ছাইপাস খেলে ঠিক হয়ে যাবে! তুমি কি ডাক্তার যে নিজের ইচ্ছে মতো অমুদ খাওয়াচ্ছ?
শাশুড়ির এই ধরনের আচরণে সুরমা একেবারে বিব্রত হয়ে গেল। কোনও রকমে বলল, শর্দি জ্বরে এই ট্যাবলেটই দেয় মা।
মা আগের মতোই রুঢ় গলায় বললেন, কোন ট্যাবলেট দেয় না দেয় সেটা ডাক্তার বুঝবেন। জ্বর এসেছে, তোমার উচিত ছিল টেলিফোন করে ডাক্তার ডেকে আনা।
চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকাল শাহিন। এইটুকু জ্বরে ডাক্তার ডাকবার দরকার কী?
তুই চুপ কর। দরকার আছে কি নেই আমি বুঝব! একা এতবড় একটা সংসার টানতে টানতে শেষ হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা কিন্তু বাড়িতে তার কোনও যত্নআত্তি নেই। ঠিক আছে, আমিই ডাক্তারকে ফোন করছি।
রাগি ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন মা।
শাহিন তারপর উঠে বসল। চায়ের কাপ এবং ট্যাবলেটের জন্য সুরমার দিকে হাত বাড়াল। দাও।
গভীর অভিমানে হাত সরিয়ে দিল সুরমা। না থাক। কেন? এসব খাওয়ার দরকার নেই। ডাক্তার আসুক।
স্ত্রীর অভিমানটা বুঝল শাহিন। মায়াবি গলায় বলল, মন খারাপ করো না। মা সব সময়ই এমন।
এমন ছিলেন না, হয়ে গেছেন। বাচ্চাকাচ্চা হয় না বলে আমাকে তিনি পছন্দ করেন না।
চায়ের কাপ এবং ট্যাবলেট হাতে কিচেনের দিকে চলে গেল সুরমা। শাহিনের মনটা খারাপ হয়ে রইল।
.
দুহাতে সেতুর একটা হাত ধরে শুভ বলল, কী করা যায় বল তো!
চোখ তুলে শুভর দিকে তাকাল সেতু। কী হয়েছে?
উঠতে বসতে মা শুধু গালাগাল করছেন।
কেন?
চাকরির জন্য। আমার এখনও রেজাল্ট বেরয়নি। এ অবস্থায় কোথায় চাকরি পাব? কে আমাকে চাকরি দেবে?
সেতু মুখ গোমরা করে বলল, এসব শুনতে আমার ভাল লাগছে না।
ভাল না লাগার কী হল?
এলাম তোমার সঙ্গে প্রেম করতে, তুমি বলছ সমস্যার কথা।
সমস্যা থাকলে বলব না?
না বলবে না।
তাহলে কী করব?
আমাকে দেখবে।
দেখছি তো।
না দেখছ না। শাড়ি পরে, এত সুন্দর করে সেজে এলাম আর তুমি আমার দিকে তাকিয়েও দেখছ না।
হাত ছেড়ে এক হাতে সেতুকে বুকের কাছে টেনে আনল শুভ। মুখটা সেতুর মুখের কাছে নিয়ে বলল, কে বলেছে তাকাইনি? তাছাড়া তাকাতে হবেই বা কেন? আমার। চোখ জুড়ে সারাক্ষণই তুমি! মন জুড়ে তুমি! চোখ বুজে, চোখ খোলা রেখে সারাক্ষণই তোমাকে দেখছি আমি।
সেতুর গালে ঠোঁট ছোঁয়াল শুভ। তারপর দুহাতে তার মুখটা তুলে ধরল। সেতুর চোখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বলল, তোমার মতো এত সুন্দর মুখ আমি আর কারও দেখিনি।
একথার পর দুহাতে শুভর গলা জড়িয়ে ধরল সেতু। এভাবে বল বলেই আর কারও কথা ভাবতে পারি না আমি।
শুভ অবাক হল। আর কারও কথা মানে? কার কথা ভাবতে চাও?
ভাবতে চাই না। বাধ্য হতে পারি।
কথাটার অর্থ কী?
অর্থটা তুমি জান। তোমার সঙ্গে বিয়েতে ভাইয়ারা কিছুতেই রাজি হবে না।
আবার সেতুর চোখের দিকে তাকাল শুভ। সেতু যেভাবে কথাটা তাকে বলেছিল ঠিক সেইভাবে বলল, এলাম তোমার সঙ্গে প্রেম করতে আর তুমি বলছ সমস্যার কথা।
শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল সেতু। আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিলে?
দিলাম। কিন্তু ভাইয়ারা যদি বিয়েতে রাজি না হন তাহলে তুমি কী করবে?
জানি না।
ভাবনি?
না।
আজ থেকে ভাববে।
এসব ভাবার দায়িত্ব আমার না।
তাহলে কার?
তোমার।
আমি যা ভাবব, যা করব তুমি তা মেনে নেবে?
তোমার কী মনে হয়?
মনে হয় নেবে। তবে ওই ধরনের পরিস্থিতি হলে তোমাকে নিয়ে আমি পালিয়ে যাব।
তাই নাকি?
কেন তুমি বিশ্বাস করছ না?
না।
বল কী?
কেন বিশ্বাস করছি না জানো? যত সহজে বলছ আমি জানি এত সহজে কাজটা তুমি করবে না। চট করেই বড় বড় কথা যারা বলে আসল সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তারা সাধারণত পিছিয়ে থাকে।
তার মানে আমার ওপর তোমার ভরসা নেই?
সেতু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, এইসব প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দেব না। আমি শুধু জানি, আমি তোমাকে ভালবাসি, এই জীবন আমি তোমার সঙ্গে কাটাব। কেমন করে কাটাব তুমি না পারলে সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব।
কথাটা শুনে খুব ভাল লাগল শুভর। মুগ্ধ চোখে সেতুর দিকে তাকিয়ে রইল সে।
.
বিকেলবেলা নিজের রুমে বসে টিভি দেখছে শিলা, দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে রেখা এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। আসব ভাবী?
টিভিস্ক্রিন থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখার দিকে তাকাল শিলা। এসো।
তারপর রিমোট টিপে টিভি অফ করল।
রুমে ঢুকে একটা কাপ শিলার দিকে এগিয়ে দিল রেখা। চা খাও।
কাপটা নিল শিলা। হঠাৎ চা নিয়ে এলে?
চা খেতে খুব ইচ্ছে করছিল।
বিকেলের চা খাওনি?
খেয়েছি। কিন্তু চাটা তেমন ভাল ছিল না। রানি এত অখাদ্য চা করে, মুখে দেয়া যায় না। এজন্য নিজেই চা করলাম। চা করার সময় মনে হল তোমার জন্যও করি।
শিলা চায়ে চুমুক দিল।
রেখা বলল, ঘরে ভালও লাগছিল না। ভাবলাম চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গে গল্প করি।
রেখা তার চায়ের কাপে চুমুক দিল।
শিলা বলল, বাচ্চারা কোথায়?
কম্পিউটার গেম খেলছে।
তিনজনেই?
না। মেয়ে দুটো। বাবলুকে দেখলাম না।
বোধহয় বাইরে গেছে।
কথাটা যেন শুনতে পেল না রেখা। কী রকম আনমনা হয়ে গেল।
ব্যাপারটা খেয়াল করল শিলা। কী হয়েছে তোমার?
রেখা চমকাল। কই, কিছু হয়নি তো।
আনমনা হয়ে আছ কেন?
কদিন ধরে সবকিছু খুব একঘেয়ে লাগছে। বাচ্চাদের হাফইয়ার্লি শেষ হল, বেশ কয়েকদিন ছুটি। তার আগে গেল সামার ভেকেশান, কিন্তু এবার কোথাও যাওয়া হল না।
হ্যাঁ। সবাই মিলে কোথাও গিয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে এলে হতো। বাচ্চাগুলো এনজয় করত, আমাদেরও ভাল লাগত।
বাড়িতে একটা উৎসব আনন্দ হলেও ভাল হতো। একঘেয়েমিটা কাটত।
সেতুর বিয়ে ছাড়া সেই সম্ভাবনা নেই।
কথাটা শুনে রেখা যেন একটু উৎসাহিত হল। পর পর দুটো চুমুক দিল চায়ের কাপে। ভাইয়াকে বল সেতুর বিয়ে দিয়ে দিক। আমরা কয়েকদিন মজা করি।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল শিলা। এত আদরের বোনকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে সে বোধহয় রাজি হবে না। তবে আমি মনে করি ভালপাত্র পেলে উপযুক্ত মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভাল।
রেখাও তার কাপে শেষ চুমুক দিল। ঠিক তখুনি রিনরিন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন। উঠে গিয়ে ফোন ধরল শিলা। হ্যালো।
ওপাশ থেকে বেশ ভরাট, পুরুষালি গলায় ভেসে এল, আমি আপনার একজন ভক্ত। আপনি এত সুন্দর, এত ভাল, আমার ভাষাজ্ঞান কম বলে আপনাকে আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না যে আপনার জন্য দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা আমি কী রকম, কী বলব, বেচায়েন, মানে বেচায়েন হয়ে থাকি। আমার খবু ইচ্ছে করে আপনাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু আপনার স্বামীর ভয়ে এটেম্পটা নিতে পারছি না। লোকটা এমন করে পাহারা দিয়ে রাখছে আপনাকে। এত বড় বড় ছেলেমেয়ে থাকার পরও স্ত্রীকে এভাবে পাহারা দিয়ে রাখার কী দরকার বলুন তো। যদিও আপনাকে দেখে বোঝা যায় না যে আপনার ছেলেমেয়ে হয়েছে। মানে বিয়ে যে হয়েছে এটাই বোঝা যায় না।
এসব কথা শুনতে শুনতে ঠোঁটে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল শিলার। গলাটা সে প্রথমেই চিনে ফেলেছিল কিন্তু কিছু বলেনি। এখন আড়চোখে একবার রেখার দিকে তাকাল। রেখা আনমনা হয়ে আছে। শিলা যে টেলিফোন ধরে আছে রেখা যেন তা দেখতেই পাচ্ছে না।
চাপা গলায় শিলা বলল, ফাজলামো করো না। রেখা আমার রুমে। আমরা দুজনে মিলে এইমাত্র চা খেলাম। কখন আসবে?
ওপাশে থতমত খেল মামুন। যাহ বাবা, ধরা খেয়ে গেলাম! আসতে একটু দেরি হবে বলেই ভাবলাম তোমাকে একটু পটাই যাতে বাড়ি গিয়ে কোনও কৈফিয়ত না দিতে হয়। রেখাই সব মাটি করে দিল।
বুঝলাম।
কী বল, একটু দেরি করে এলে কোনও অসুবিধা আছে?
ছে। কী কারণে দেরি করবে?
কারণ আবার কী, বিজনেস।
এত বিজনেস করার দরকার নেই। চলে এস।
ঠিক আছে আসছি। এক্ষুনি আসছি, যে কাজে দেরি হওয়ার কথা সেটা না হয় আজ করব না। শোন।
বল।
একটা জলচৌকির অর্ডার দিয়েছি। সঙ্গে নিয়ে আসব?
কথা না বলে হেসে টেলিফোন নামিয়ে রাখল শিলা।
.
এসবের কয়েকদিন পর সেতুর বিয়ের একটা প্রস্তাব এল।
স্বপন সেদিন বাড়ি ফিরল একটু রাত করে। ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই রুমের একপাশে রাখা দুটো চেয়ারের একটায় গা এলিয়ে বসল। রেখা টিভি দেখছিল। বলল, টিভিটা অফ কর।
মুখ ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল রেখা। কেন?
কথা আছে।
খুব জরুরি?
মোটামোটি।
কিন্তু আমি খুব ভাল একটা প্রোগ্রাম দেখছি।
আচ্ছা দেখ।
উঠে ড্রেসিংরুমের দিকে যাবে স্বপন, রেখা বলল, ঠিক আছে বল।
তারপর টিভি অফ করল।
স্বপন আবার আগের জায়গায় বসল। তোমার মেয়ে ঘুমিয়েছে?
রেখা গ্রীবা বাঁকাল। স্বাভাবিক গলাই রুক্ষ্ম হয়ে গেল তার। আমার মেয়ে মানে?
স্বপন হাসল। তোমার গর্ভজাত।
গর্ভটা কি আমি অন্য কারও কাছে গিয়ে তৈরি করে এনেছিলাম! নাকি মেয়েটা অন্য কোথাও থেকে নিয়ে এসেছি?
অন্য সময় হলে এই নিয়ে কিছু মজা করত স্বপন। এখন করল না। মুহূর্তে সারেন্ডার করল স্ত্রীর কাছে। সরি। ভুল হয়ে গেছে।
বল আমাদের মেয়ে।
বলছি। কোথায় সে? ঘুমিয়েছে?
হ্যাঁ।
তাহলে কথাটা বলা যায়। কারণ টুপলু শুনলে মুহূর্তে রাষ্ট্র হয়ে যাবে। ছুটে গিয়ে প্রথমেই বলবে মুন্নিকে। মুন্নি এবং সে দুজনে মিলে বলবে বাবলুকে। এক ফাঁকে হয়তো রানিকেও বলবে। অর্থাৎ মিনিট চার পাঁচেকের মধ্যে সারাবাড়ি জেনে যাবে।
রেখা আবার গ্রীবা বাঁকাল। কী এমন কথা?
সেতুর বিয়ে।
কথাটা যেন বুঝতে পারল না রেখা। গলা আরেকটু তীক্ষ্ণ হল তার। কী?
স্বপন আবার বলল, সেতুর বিয়ে।
মানে?
বিয়ের আবার মানে কী? বিয়ে। তেরো বছর আগে তোমার আমার যা হয়েছে। ফলাফল হচ্ছে একটি কন্যা সন্তান। ডাকনাম টুপলু। ভাল নাম…
বাজে কথা না বলে আসল কথাটা বল। কোথায় বিয়ে, কী বৃত্তান্ত?
অসাধারণ একটা পাত্র পাওয়া গেছে। ডালাসের কোন এক ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছে। আমাদের কাছাকাছিই বাড়ি। বনানীতে। তিন ভাইয়ের মধ্যে এই ছেলে ছোট। বোন নেই। বাবা এবং বড় দুভাই বিজনেস করে। মতিঝিলে একটা অফিস আরেকটা চিটাগাংয়ে।
কীসের বিজনেস?
এক্সপোর্ট ইমপোর্টের বিশাল বিজনেস।
এবার মুখটা উজ্জ্বল হল রেখার। বল কী, এ তো দারুণ ব্যাপার।
স্বপন যেন আনন্দে একেবারে ফেটে পড়ল। সত্যি দারুণ ব্যাপার। ছেলেটির নাম আনিস। খুবই হ্যাঁন্ডসাম ছেলে। বোম্বের সারদ কাপুর না কী যেন একটা নায়ক আছে। অনেকটা ওরকম দেখতে।
যাহ।
সত্যি। বোনের বিয়ে নিয়ে আমি কি মিথ্যে বলব! তাছাড়া তোমরা তো সবাই দেখবেই। সেতুকে কোথায় যেন সে দেখেছে। ইউনিভার্সিটির ওদিকেই হবে। সেতুর ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি ওদের বাড়ি।
তাহলে ওদিকেই দেখেছে।
দেখেই খোঁজখবর নিয়েছে। জেনেছে আমার বোন।
প্রস্তাবটা আনল কে?
হাসান, আমার বন্ধু। সাংবাদিক। হাসানের সঙ্গে ছেলের বড়ভাইর বন্ধুত্ব। এসব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি! যোগাযোগের ডালপালা বেরিয়ে যায়।
রেখা মুগ্ধ গলায় বলল, সত্যি দারুণ ব্যাপার। মাত্র কদিন আগে ভাবী আর আমি সেতুর বিয়ে নিয়ে কথা বলছিলাম।
কী কথা?
মানে সেতুর বিয়ে হলে বাড়িতে একটা উৎসব আনন্দ হয়, এই আর কি! ভাবি অবশ্য বলছিলেন এত আদরের বোনকে এক্ষুনি বিয়ে দিতে রাজি হবেন না ভাইয়া। আচ্ছা শোন, তুমি কি ভাইয়াকে বলেছ?
না এখন গিয়ে বলব।
আগে তাঁকে বল। তিনি রাজি না হলে…!
রাজি না হওয়ার কোনও কারণ নেই।
কিন্তু সব শুনে মামুন কী রকম গম্ভীর হয়ে গেল। থমথমে গলায় বলল, বিয়ের পর সেতুকে কি আমেরিকায় নিয়ে যাবে?
স্বপন উৎসাহি গলায় বলল, না। ছেলে আমেরিকায় সেটেল করবে না, বাংলাদেশেই করবে। নিজেদের বিজনেস দেখবে। বিজনেস দেখার জন্যই আমেরিকা থেকে এমবিএ করে এসেছে সে?
ফলস এমবিএ না তো?
মানে?
আমেরিকায় ডিসওয়াসের কাজ করেও কিন্তু দেশে ফিরে অনেকে বলে অমুক ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, তমুক ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি।
পাগল হয়েছ! আমার সঙ্গে অমন কেউ করবে! হাসান আমার নেচার জানে না?
তবু মুখ উজ্জ্বল হল না মামুনের। আগের মতোই থমথমে গলায় বলল, আমাদের একমাত্র বোন, তাকে আমি বিদেশে থাকতে দেব না।
এসব ওরা জানে ভাইয়া।
কে বলেছে?
হাসান।
তোর সঙ্গে কথা বলার পর বলেছে?
না আগেই। কারণ ও এসব জানে।
এবার মুখে হাসি ফুটল মামুনের। তাহলে তো খুব ভাল কথা। এরচে’ ভাল পাত্র হয় না।
তুমি কী বল? কথাবার্তা বলব?
বলবি মানে? অবশ্যই বলবি। কালই বলবি।
ভেবে দেখ।
র কী ভাবব? আমার ভাবনা ফাইনাল।
কিন্তু সেতুর পড়াশুনো এখনও শেষ হয়নি।
তাতে কী হয়েছে। বিয়ের পরও পড়বে। আজকাল অনেকেই তা করছে। তুই কোনও গড়িমসি করিস না। ভাল করে খোঁজ খবর নিয়ে কথা ফাইনাল করে ফেল।
.
শুভর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে সেতুর মনে হল, আচ্ছা ওর নাকের ডগায় যদি মোটা একখানা গোঁফ থাকত তাহলে কেমন হতো!
গোঁফঅলা শুভকে দেখার জন্য তারপর মনটা ছটফট করে উঠল সেতুর। ছবিটা হাতে নিয়ে পড়ার টেবিলে এল সে। বলপয়েন্টে অতিযত্নে অতি নিখুঁত করে ছবির নাকের তলায় বেশ মোটা একখানা গোঁফ এঁকে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চেহারা একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেল শুভর। এই শুভকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল সেতু। আঁকা গোঁফে আঙুলের ডগা ছুঁইয়ে বলল, গুন্ডা।
সেতু যখন শুভর গোঁফ নিয়ে ব্যস্ত সে সময় পানির গ্লাস হাতে তাদের বেডরুমে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে শিলা। আসলেই মামুনের চে সে একটু বেশি লম্বা। এই বয়সেও ফিগার অত্যন্ত চমৎকার তার। গায়ের রং দুধের সরের মতো। সাজগোজের প্রতি খুবই ঝোঁক। বাড়িতেও বেশির ভাগ সময় সুন্দর শাড়ি পরে থাকে। বেশ কিছু গহনা পরে থাকে। সনু ওয়ালিয়ার মতো সামান্য লক্ষ্মীট্যারা সে। কাছ থেকে খেয়াল না করলে ব্যাপারটা একেবারেই ধরা যায় না। তবে শিলার সবচে বড় খুঁত তার পা। পা দুটো ময়ূরের পায়ের মতো।
শিলা যতটা ফিগার সচেতন মামুন ততোটাই উদাস। বয়স এখনও পঞ্চাশ হয়নি। তবু তার মধ্যে একটা বুড়োটে ভাব। মাথার চুল বেশ পেকেছে, শরীরটা মোটার দিকে। চোখে বহুদিন ধরে চশমা। কিন্তু মনের দিক দিয়ে সে বেশ সজীব। অন্তত শিলার কাছে। আর পোশাক পরে ভাল। দামী ব্র্যান্ডের শার্ট প্যান্ট, টাই জুতো। মাঝে মাঝে সুন্দর সানগ্লাস পরে। ভাল পারফিউম ইউজ করে, ভাল আফটারশেভ ইউজ করে।
আজ করেছে আজেরো।
আজেরোর গন্ধটা খুব প্রিয় শিলার। এজন্য স্বামী তারচে বেটে জেনেও তার পাশে সে এখন দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু পানিটা আজ খেল না মামুন। বলল, এখন থেকে কিছুদিন তোমার হাতের পানি না খেলেও চলবে।
শিলা অবাক হল। কেন?
বোনের বিয়ে। মন মাথা দুটোই ঠান্ডা হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেছি।
তোমার কীসের চিন্তা? বিয়ে তো তোমার না!
বাজে কথা বলো না।
ঠিক আছে চিন্তাটা কী, বল।
এত ভাল পাত্রের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিচ্ছ, আমার চিন্তা হচ্ছে নিজের মেয়ের জন্য এরকম পাত্র পাব কি না!
আমার ওইটুকু মেয়ের বিয়ে নিয়ে এখনই চিন্তা করছ তুমি?
ওইটুকু কই? ক্লাস এইটে পড়ছে। দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে। আগে এই বয়সী মেয়েদেরই বিয়ে হয়ে যেত। আমার দাদীর হয়েছিল দশবছর বয়সে।
তার মায়ের বিয়ে হয়েছিল নিশ্চয় আটবছর বয়সে। তার মায়ের তিনচার, আর তার মায়ের মায়ের পেটে থাকা অবস্থায়ই, তাই না।
শিলা হাসল। সব সময় ফাজলামো করো না।
ফাজলামো করছি না। আগের দিনে অল্প বয়সেই বিয়ে হতো মেয়েদের। এখন হয় না। শোন, তোমাকে একটু জ্ঞান দিই। ফ্যামিলি ট্রেডিসান জিনিসটা হচ্ছে বড়গুলো একধাপ গেলে ছোটগুলো যায় দুই ধাপ। অর্থাৎ…।
বুঝেছি।
পুরোটা মনে হয় বোঝনি। অর্থ হচ্ছে বোনের চে মেয়ের বিয়ে আরও ভাল পাত্রে হবে। যেমন আমার চে স্বপনের বিয়ে আরও ভাল পাত্রিতে হয়েছে, আরও ভাল ফ্যামিলিতে হয়েছে।
একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চেহারা বদলে গেল শিলার। শিলা আর শিলা রইল না। মা কালীর রূপ ধারণ করল। কী, আমার চে রেখা ভাল? আমাদের চে রেখাদের ফ্যামিলি ভাল? এতবড় অপমান তুমি আমাকে করলে?
হাতের গ্লাস ঠাস করে দেয়ালে ছুঁড়ে মারল শিলা। পানি এবং কাঁচের টুকরোয় বেডরুমের মেঝে ছেয়ে গেল। কিছুই খেয়াল করল না সে, দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
ততোক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেছে মামুন। কপালে হাত দিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বিছানায় বসে পড়ল। নিজেকে নিজে কোনও রকমে শুধু বলল, সর্বনাশ করে ফেলেছি। একদম সর্বনাশ করে ফেলেছি।
.
সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরেছে স্বপন।
ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কেমন লাগছে আমাকে?
রেখা মুগ্ধ চোখে স্বামীর দিকে তাকাল। কিন্তু সে কথা বলার আগেই টুপলু নির্বিকার। গলায় বলল, পচা।
টুপলু যে রুমের এককোণে বসে পুতুল খেলছে খেয়ালই করেনি স্বপন। পচা শব্দটা শুনে করল। কপট রাগের গলায় বলল, এই তোকে জিজ্ঞেস করেছি? তুই যা এখান থেকে।
বাপকে মোটেই পাত্তা দিল না মেয়ে। বলল, না যাব না। দেখছ না খেলছি!
টুপলুর দিকে আর তাকাল না স্বপন। রেখাকে বলল, বোনের বিয়ে উপলক্ষে নতুন পাঞ্জাবিটা পরলাম। হাসানরা আজ আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে। এজন্য খুব মুডে আছি।
রেখা বলল, এখনও বিয়ের কিছুই হয়নি, এখনই এত মুডের কী হল?
আজ সব ফাইনাল হবে।
তারপর বেশ স্বস্তির গলায় বলল, সেতুর বিয়েটা হয়ে গেলে আপাতত আমাদের আর কোনও প্রেসার থাকে না। বাবলু, মুন্নি ওদের বিয়ের বহু দেরি।
এই প্রথম ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল টুপলুর। পুতুল ফেলে লাফিয়ে উঠল সে। মা বাবার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। উত্তেজিত গলায় বলল, ফুপির বিয়ে? কবে?
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে ধমক দিল রেখা। চুপ কর। সব কথায় নাক গলানো!
ব্যাপারটা পছন্দ করল না স্বপন। মেয়েকে কাছে টেনে রেখাকে বলল, এটা ঠিক হল না। খানিক আগে দমক দিয়েছি আমি, এখন দিলে তুমি। দুজনেই যদি এমন করি মেয়েটি তাহলে কার কাছে যাবে?
টুপলু গাল ফুলাল। আমি ফুপির কাছে চলে যাব।
রেখা আগের মতোই রাগি গলায় বলল, যা এক্ষুনি যা।
টুপলুকে কোলের কাছে টেনে চেয়ারে বসল স্বপন। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল, শোন মা, ফুপির বিয়ের কথা এখন কাউকে বলো না, কেমন! বড়দের কথা ছোটদের কখনও বলতে হয় না।
খুবই সুবোধ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল টুপলু। আচ্ছা।
তারপর অতি নিরীহ ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল।
স্বপনও উঠল। কিন্তু দরজার দিকে যাওয়ার আগেই রেখা তাকে ডাকল। এই যে ভদ্রলোক, শুনুন।
স্বপন থমকে দাঁড়াল। ডাকের ভঙ্গিটা মারাত্মক। নিশ্চয় ভয়ংকর কোনও কথা আছে। বুকটা ছ্যাত করে উঠল স্বপনের। স্ত্রীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলল, জ্বী বলুন।
বোনের বিয়ে উপলক্ষে মাঝারি ধরনের একট প্রেসার আছে আপনার।
তা আমি কিছুটা বুঝেছি।
যেটুকু বুঝেছেন বলুন, শুনে কৃতার্থ হই।
বোধহয় গোটা তিন চারেক শাড়ি কিনে দিতে হবে আপনাকে।
তাতে দিতে হবেই। কিন্তু শাড়ি আমি ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি।
তাহলে?
কিঞ্চিত গহনাও দিতে হবে।
স্বপন একটা ঢোক গিলল। কী পরিমাণ?
খুব বেশি না। মাত্র একসেট।
সেটের সাইজ? মানে ওজন?
এক্ষেত্রে একটু সমস্যা আছে। সামান্য ওজনদার।
ভরির হিসেবে কতটা হতে পারে?
আপনি আরেকটু বসুন, বলছি।
কপট ভয়ের ভঙ্গি করে স্বপন বলল, বসতে হবে কেন?
শুনে অকস্মাৎ ভিড়মি খেতে পারেন। ভিড়মি খেয়ে পপাতধরণীতল হলে ব্রেন হেমারেজ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। স্বামীর ব্রেন হেমারেজ ঘটাতে মন চাইছে না।
অতটা বোধহয় হব না। আপনি নিঃসংকোচে বলুন। কত ভরি?
এই ধরুন বিশ বাইশ ভরি। মজুরিসহ লাখ দেড়েক টাকার ব্যাপার।
ভুরু কুঁচকে রেখার দিকে তাকাল স্বপন। গলার স্বর এবং ভাষা দুটোই স্বাভাবিক করল। চান্সটা একটু বেশি নিয়ে ফেললে না?
রেখা হাসল। কোনও কোনও সময় বেশি করেই চান্স নিতে হয়। ঝোঁপ বুঝেই তো কোপ মারে লোকে। আমাদের একটা মাত্র ননদ আর তোমরা এত বড়লোক। আর কিছু কি বলবার দরকার আছে?
না দরকার নেই। গ্রানটেড। কাটায় কাটায় বাইশ ভরি পেয়ে যাবে।
খুবই উজ্জ্বল ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল স্বপন।