২. তার আগের দিন

তার আগের দিন

পর্থকওলের প্রভাত। জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। মেঘলা করেছে বলে আকাশের রঙের সঙ্গে সমুদ্রের রং ম্যাচ করছে না। সোম বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে, আমার তো ঘুম ভেঙেছে, পেগির ভেঙেছে কি না। আমি যদি উঠতে গিয়ে শব্দ করি তার ঘুম অকালে ভাঙবে। অকালে নয় তো কী? কাল রাত্রি মনে পড়ে না? পড়ে। ওঃ, কী দুর্দিনই গেছে। কিছুতেই রাত্রের আশ্রয় খুঁজে পাইনে, যদি-বা পেলুম কী লজ্জা! একটি ঘরে দু-জনের বিছানা। কখনো এমন ঘটে কারুর জীবনে? কোনোদিন কল্পনা করতে পেরেছি?

সোম আকাশ ও সমুদ্র উভয়ের রাত্রিযাপন-রহস্য অনুধ্যান করছে। ভাবছে, কেমন করে আত্মসংবরণ করলুম? পাশের বিছানায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রলোভন। যুবতী নারী? তার বিনিময়ে ইংল্যাণ্ডের রাজমুকুট তুচ্ছ, রকফেলারের ঐশ্বর্য ছার। ঘুম কি কিছুতেই আসে? তার প্রতিটি নিঃশ্বাসপতনের শব্দ শুনছিলুম—যেন এক একটি ডলার। হঠাৎ একসময় তার নিঃশ্বাস ফেলা থামল। সে পাশ ফিরল। ফিরে লেপটাকে আরেকটু উপরের দিকে টেনে নিল। রাত্রি অন্ধকার হলেও কাচের দেয়ালজোড়া জানালা যেন জানালা নয়, কাচের দেয়াল। বাড়ির সবচেয়ে উঁচু ঘর, গ্যারেট, ছাদটা ঢালু হয়ে নেমেছে আমাদের পায়ের দিকে। বেশ দেখতে পাচ্ছিলুম তার বব-করা চুল তার গাল বেয়ে তার মুখ ও চিবুক আড়াল করেছে। ইচ্ছে করছিল হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিই, তা হলে তার শুভ্র মুখখানি রজনীগন্ধার মতো ফুটন্ত দেখায়। কিন্তু সে যে ভীষণ চমকে উঠত। হয়তো চেঁচিয়ে উঠত, ‘চোর’, ‘চোর’। অথবা তার চেয়ে যা খারাপ তাই অনুমান করত! বলত, নাঃ, পুরুষমানুষকে এতটুকু বিশ্বাস করতে নেই। ওরা মার্জার বৈষ্ণব, সুযোগ পেলেই নখদন্ত বের করে।

সোমের বক্ষে নটরাজের তান্ডব চলেছিল যতক্ষণ না তার ঘুম এসেছে ততক্ষণ। কামনার ডম্বরুধ্বনি, কল্পিত সম্ভোগের তাতা থই থই, অসংযমের ছন্দ। রাত্রে কয়েকবার ঘুম ভেঙে গেলে সোম খালি ভেবেছে, জীবনে এ সুযোগ ফিরবে না, জীবনে এমন রাত আসবে না—too good, too good। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে রাত্রি প্রভাতের অভিমুখে ছুটেছে। মুর্মূষুর মতো হতাশ হয়ে সোম জীবনের শেষ মুহূর্তগুলির মতো পেগির নিঃশ্বাসপতনের শব্দ গুনতে থাকে, গুনতে গুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে।

এইমাত্র তার শেষবার ঘুম ভেঙেছে। এবার প্রভাত। কাপড় ছাড়তে হবে, প্রাতরাশ করতে হবে, তারপর সমুদ্রকূলে খানিক বেড়িয়ে লণ্ডনের ট্রেন ধরতে হবে। আবু হোসেনের আরব্যরজনী পোহাল। পেগির ছুটি ফুরিয়েছে, পেগি কাল অফিস করবে। লণ্ডনের জনতার মধ্যে সোম তার কেউ নেয়, সোমও তাকে খুঁজে নিরাশ হবে।

আসন্ন বিরহের বেদনা তার সম্ভোগকামনাকে লজ্জা দিয়ে চুপ করিয়েছিল। আহা, চাইনে সম্ভোগ, চাইনে আর কিছু, সমস্ত জীবনটা যদি এবারকার ইস্টারের ছুটি হত তার এবং পেগির। তারা শুধু পরস্পরের সান্নিধ্যটুকু পেত, গল্প করত, তর্ক করত, একসঙ্গে খেত, একই ঘরে স্বতন্ত্র শয্যায় শুয়ে পরস্পরকে বলাবলি করত, ‘গুডনাইট, মিস্টার সোম’, ‘গুডনাইট, মিস স্কট।’

‘হ্যালো।’

সোম পাশ ফিরে দেখল পেগি তখনো তেমনি নিশ্চলভাবে পড়ে। ওঠবার নাম করছে না। নিদ্রা ও জাগরণের মাঝখানকার আলস্যটুকু ভোগ করে নিচ্ছে। শুধু আলগোছে ডাকছে, ‘হ্যালো।’

সোম বলল, ‘ঘুম ভেঙেছে আপনার?’

‘আপনার?’

‘অনেকক্ষণ। সত্যি কথা বলতে কী আমার ঘুম ক্রমাগত ভেঙেছে আর লেগেছে।’

‘আমার নাকের গর্জনে?’

‘কখনো না। আপনার নাক তো কামান নয়।’

‘কটা বাজল?’

‘আটটা বাজে।’

‘উঠতে কান্না পাচ্ছে।’

‘আরও আট ঘণ্টা ঘুমোন না?’

‘উঁহু, ট্রেন ফেল করব।’

‘কোথাকার ট্রেন? লণ্ডনের, না, টেনবির?’

পেগি গা-ঝাড়া দিয়ে বলল, ‘ওমা, টেনবি গেলে আমার চাকরি থাকবে?’

‘কিন্তু টেনবি না গেলে আপনার আফশোস থাকবে। কাল শুনলেন না টেনবির সুখ্যাতি?’

‘আমার দেশের সকলই সুন্দর। It is a dear old country. তা বলে সব ঘুরে দেখবার মতো আয়ু আমার নেই।’

সোম নীরব।

পেগি বলল, ‘আপনার উৎসাহে আমি বাধা দেব না, মিস্টার সোম।’

সোম অভিমানের সুরে বলল, ‘আপনার যে উৎসাহ নেই এই আমার উৎসাহের চরম বাধা।’

‘অদ্ভুত মানুষ তো? আমার চাকরিটি নেবেন?’

‘তা কি বলেছি? আপনার চাকরি আপনি সারাজীবন রাখুন।’

‘পারি নে এমন মানুষকে নিয়ে। সলসবেরি থেকে টানলেন ব্রিস্টলে। ব্রিস্টল থেকে পর্থকওলে। টেনবি থেকে নিউ ইয়র্কে টানবেন নাকি?’

‘নিউ ইয়র্ক থেকে ইন্ডিয়ায়।’

‘আশ্চর্য নয়। কী জাদু আছে আপনাতে। ব্ল্যাক ম্যাজিক জানেন বুঝি?’

‘তা যদি জানতুম তবে আমার দুঃখ ছিল কী! আপনাকে একদন্ড চোখের আড়াল হতে দিতুম না।’

‘এরই মধ্যে এত। আমি ভেবেছিলুম এই লোকটির যখন কালো চেহারা তখন এই হবে আমার একমাত্র পুরুষ-বন্ধু।’

‘তার মানে কী, মিস স্কট?’

‘আর ঘটা করেন কেন? যা বলে ডাকতে মন চায় তাই বলে ডাকুন।’

‘পেগি বলে ডাকব?’

(হেসে) ‘ডাকলে জিভখানা কেটে ফেলব না?’

‘তুমি তা হলে আমাকে কল্যাণ বলে ডাকবে?’

‘কী নাম? কলিন?’

‘কল্যাণ।’

‘কোলল্যান।’

‘হয়েছে।’

‘তা হোক। ও নামে ডাকা শক্ত। সোম বলে ডাকব।’

‘কিন্তু একমাত্র পুরুষ-বন্ধু সম্বন্ধে কী বলছিলে, পেগি।’

‘বলছিলুম এমন একজন পুরুষ দেখলুম না যে বন্ধুতার মর্যাদা রাখল। দু-দিন পরে নর-নারীর সেই আদিম সম্পর্ক। বন্ধু হয়ে উঠল প্রেমিক। হতে চাইল স্বামী।’

‘স্বামী কি নারীর শ্রেষ্ঠ বন্ধু নয়?’

‘চাইনে শ্রেষ্ঠ বন্ধু। চাই কতকগুলি পুরুষ যারা আমার তেমনি দরদি বন্ধু হবে যেমন আমার বন্ধুনি ক্যাথরিন, ম্যারিয়ন, মেরি। আমার অসুখ করলে তত্ত্ব নেবে, বলবে না যে, ‘‘কী হবে গো! তোমার অসুখ আমাতে বর্তায় না?’’ আমার সঙ্গে সিনেমায় গিয়ে হঠাৎ আমার গলাটা জড়িয়ে ধরবে না, আমি গাল সরিয়ে নিলে আমার কানের উপর চুমু খাবে না।’

সোম হাসতে হাসতে বলল, ‘আচ্ছা, আমি সে গ্যারান্টি দিচ্ছি। আমি ঠিক গালকেই তাক করব—আমার লক্ষ্য অব্যর্থ।’

পেগি হেসে গড়াতে গড়াতে যেই খাটের প্রান্তরেখায় এল অমনি লাফ দিয়ে বলল, ‘বন্ধু, চোখ বোজো। আমার কাপড় ছাড়া হয়ে গেলে পরে চোখ খুলতে পারবে।’

সোম চোখ ফিরিয়ে নিল সমুদ্রের দিকে। সেখান থেকে মাইল খানেক দূর। তবু যারা সমুদ্রের ধারে বেড়াতে বেরিয়েছে তাদের বেশ দেখা যায়।

কাপড় ছেড়ে পেগি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বলে গেল, ‘নীচে অপেক্ষা করছি। দেরি কোরো না।’

খেতে খেতে পেগি বলল, ‘সোম, ভেবে দেখলুম, এত দূর যখন এসেছি তখন টেনবিটা দেখে যাওয়াই ভালো। একদিনের ছুটির জন্যে তার করে দিই।’

‘উঁহু। তিন দিনের কমে আমি রাজি নই।’

‘সোম, don’t be silly।’

‘পেগি, don’t be rude।’

‘মাফ চাইছি, সোম।’

‘মাফ করবার কিছু নেই, পেগ।’

‘You are a dear.’ (কোমল সুরে)

‘পেগ তোমার তিন দিনের মাইনে দেবার মতো সঙ্গতি তোমার বন্ধুর আছে।

‘কিন্তু তোমার বন্ধুনি তা নেবে না, সোম।’

‘নিক নাই নিক, আমি আমার দাবি ছাড়ব না। তিনটি দিন আমাকে দিতে হবে।

‘সোম, be reasonable, দু-দিন।’

‘আচ্ছা, দু-দিন।’

পেগি ও সোম রাত্রের ঘরভাড়া দিয়ে বিদায় নেবে এমন সময় বাড়ির কর্ত্রী এসে সোমকে একখানি অটোগ্রাফের খাতা দিয়ে বলল, ‘নিজের ভাষায় আপনার নামটি লিখে দিয়ে যাবেন? কৃতার্থ হব।’

সোম বলল, ‘নিশ্চয় লিখে দেব।’

বুড়ি বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি?’

পেগি হেসে বলল, ‘আমার নিজের ভাষা কি আমি জানি? সোম, তুমি আমাদের নিজের ভাষায় লিখে দাও।’

বুড়ি তার কথা বিশ্বাস করল না। এদের রং আলাদা, ইংরেজির উচ্চারণ আলাদা।

কিন্তু পেগি কেন নিজের নাম-ধাম লিখল না? কারণ সে কিছুতেই লিখতে পারত না যে তার নাম পেগি সোম। যদি লিখত পেগি স্কট তবে বুড়ি ভাবত, বটে? ডুবে ডুবে জল খাবার আর জায়গা পেলে না? কাল বারোটা রাত্রে এসে বললে, ‘ঘরের সন্ধানে চার ঘণ্টা ঘুরেছি, আজকের মতো আশ্রয় দাও।’ আইবুড়ো মেয়ের এই চক্রান্ত।

পর্থকওল থেকে টেনবি যাবার পথে অনেকগুলো চেঞ্জ। ক্রমাগত ট্রেন বদল করতে করতে পাছে লাঞ্চ-এর সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায় এই ভেবে তারা মাঝপথে নেমে পড়ল সোয়ানসি-তে। খুব বুদ্ধিমানের কাজ করল, কেননা সে রাত্রে উপবাস দিতে বাধ্য হওয়া তাদের অদৃষ্টে ছিল। অবশ্য সে-কথা আগে থেকে জানলে তারা ডবল লাঞ্চ খেত, এত খেত যে রাত্রে খাবার দরকার হত না। কিন্তু তারা ভবিতব্যজ্ঞ ছিল না। সেইজন্যে সম্মুখে একটা রেস্তোরাঁ দেখে ঢুকে পড়ল এবং ওয়েলস-জাতীয়া ওয়েট্রেসকে ফরমাশ দিল যা সাধারণত খেয়ে থাকে তাই।

পেগি বলল, ‘ওয়েলসরা কেমনতরো funny, যেন ইংরেজই নয়।’

সোম বলল, ‘ইংরেজ না হলেই funny হতে হবে তার মানে কী!’

‘আহা, তোমাকে গায়ে পেতে নিতে কে বলছে? আমি শুধু বলতে চাই ওরা দেখতে আমাদের মতো নয়।’

‘আমার মতো নয় সে-কথা ঠিক। এবং তোমার মতো নয় সে-কথাও ঠিক। অনেকটা কন্টিনেন্টালদের মতো। ওই ছেলেটিকে লক্ষ করো। ওই যুবকের দলটিকেও।’

‘বড়ো বক বক করে। শিষ্ট হয়ে এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না, নড়ছেই চড়ছেই উঠছেই বসছেই।’

‘আমার এই ভালো লাগে। সর্বদা সব ক-টা অঙ্গ ব্যবহার করছে। আমার দেশের লোক তাই করে।’

‘তবে তোমার দেশে আমি যাব না।’

‘আমার দেশের দুর্ভাগ্য।’

‘শুনেছি তোমার দেশে সাপ আছে।’

‘শুধু সাপ? বাঘ ভাল্লুক কুমির। তার চেয়েও যা মারাত্মক, মশা মাছি ইঁদুর।’

(রুদ্ধনিঃশ্বাসে) ‘সত্যি?’

‘সত্যি।’

‘তবে সে-দেশে তুমি ছিলে কী করে?’

‘আরও তিরিশ কোটি মানুষ আছে।’

‘সত্যি?’

‘বিশ্বাস হয় না?’

‘না।’

‘বইতে পড়নি?’

‘বই আমি তেমন পড়ি নে। I am not a great reader, you know.’‘তোমাদের সাম্রাজ্য। খবর রাখ না?’

‘ইশকুলে পড়েছিলুম বটে India is the brightest gem on the British crown। আর ওখানকার সবাই ভেলকি জানে। তুমি জান?’

‘পাগল!’

‘না, না, সত্যি বলো। লুকিয়ো না। লোহাকে সোনা করতে পার?’

‘তা জানলে তো আমরা জাত-কে-জাত বড়োলোক হয়ে থাকতুম, পেগি।’

‘আর কত বড়োলোক হতে? শুনেছি তোমার দেশে অগুনতি মহারাজা। এই যে তুমি এত দূর দেশে এসেছ বড়োলোক বলেই তো পারলে?’

‘এর জন্যে অনেক দুঃখ পেয়েছি পেগ। সে তুমি ভাবতে পারবে না, বন্ধু। তোমার দেশের ছেলেরা যে বয়সে যৌবনকে ভোগ দিয়ে সার্থক করে সে বয়সে আমি ঘরে খিল দিয়ে বই মুখস্থ করেছি। কত বসন্ত দোরে ঘা দিয়ে গেছে, সাড়া পায়নি। আমি যে যুবক সে আমি প্রথম উপলব্ধি করলুম তোমার দেশে পা দিয়ে।’

এর পরে কিছুক্ষণ দু-জনেই নিস্তব্ধে পরস্পরকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। মুখে মৃদু মিষ্টি হাসি।

পেগি বলল, ‘আচ্ছা, তোমার দেশে কুকুর আছে?’

সোম অট্টহাস্য করে বলল, ‘অসভ্যতা মাফ করো, পেগি। বললে পারতে, তোমার দেশে মেয়েমানুষ আছে?’

‘সে তো স্বতঃসিদ্ধ।’

‘মোটেই না। এমন দেশ আছে যেখানে মেয়েমানুষ নেই।’

‘Don’t be ridiculous.’

‘ধরো, অ্যান্টার্কটিকা একটা মহাদেশ। সেখানে মেয়েমানুষ নেই।’

পেগি হার মানল। বলল, ‘তাই তো। তুমি ভয়ানক চতুর। কিন্তু আমার কথার উত্তর দিলে না যে। তোমার দেশে কুকুর আছে?’

‘আছে। তুমি কুকুর ভালোবাসো?’

‘ভালোবাসি। I worship them.’

‘আশ্চর্য নয়। কে যেন লিখেছে ইংরেজরা আগে God-কে পূজা করত, আজকাল Dog-কে পূজা করে।’

আরও কয়েকবার ট্রেন বদল করে তারা টেনবির গাড়িতে উঠল। তখন সূর্যাস্তের বেশি দেরি নেই। তবে ভরসা এই যে ইংল্যাণ্ডের গোধূলি বহুক্ষণব্যাপী।

গাড়িতে নতুন আলাপীরা চিরন্তন বিষয় নিয়ে আলাপ জমিয়ে তুলছিল। ‘এমন ওয়েদার কোনো বছর হয় না।’…‘যেমন করে হোক ইস্টারের সময়টা বৃষ্টি হবেই। এবারকার ইস্টারটা ব্যতিক্রম।’…‘প্রতিদিন রৌদ্র। সারাদিন রৌদ্র।’

পেগি ও সোম পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চোখে চোখে হাসছিল। এই চারটি দিন তাদের দু-জনের পক্ষে সব দিক দিয়ে সুদিন।

এক বর্ষীয়সী সোমের সঙ্গে আলাপ করবার ছল খুঁজছিলেন। বললেন, ‘আপনি আসছেন কোনো গরম দেশ থেকে, না মশাই?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। ইন্ডিয়া থেকে।’

‘সঙ্গে করে এই সুন্দর ওয়েদারটি নিয়ে এসেছেন আমাদের জন্যে।’

সকলে সায় দিয়ে বলল, ‘ঠিক ঠিক।’

সোম সস্মিত প্রতিবাদ করল, ‘কিন্তু আমি এসেছি কবে! দেড় বছর আগে!’

‘দেড় বছর আগে।’ (প্রতিবেশীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে’) ‘সেইজন্যে এমন ইংরেজি বলতে পারছেন।’

‘ইংরেজি আমি দেশেই শিখেছি।’

‘বটে! ইশকুল আছে ও দেশে?’

‘অজস্র।’

বর্ষীয়সী আর কথা খুঁজে পেলেন না। একটি মধ্যবয়সিনী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওয়েলস কেমন লাগছে?’

সোম বলল, ‘ইংল্যাণ্ডের থেকে এমন কী তফাত।’

‘আমিও তাই বলি। কিন্তু যারা ইংল্যাণ্ড গেছে তারা বলে অনেক তফাত!’

‘আপনি ইংল্যাণ্ডে যাননি?’

‘কবে আর গেলুম! যাই যাই করি, যাওয়া হয়ে ওঠে না।’

সোম বলল, ‘আপনাকে কিন্তু দেখতে ওয়েলসের লোকেদের মতো নয়।’

‘তা তো হবেই। পেমব্রোক অঞ্চলে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের পূর্বপুরুষ ছিল ফ্লেমিশ আগন্তুক।’

পথে মধ্যবয়সিনী নেমে গেলেন। যাবার সময় এমনভাবে ও এমন সুরে ‘গুড বাই’ বললেন যেন বহু পুরাতন বন্ধুনি।

সোম পেগির আরও নিকটে সরে এল। পেগি বিনা বাক্যব্যয়ে তার হাতে হাত রাখল। একান্ত নির্ভরের সঙ্গে। সোম নিজেকে ধন্য জ্ঞান করল। তার অন্তর কানায় কানায় পূর্ণ। সূর্যাস্তটি সুন্দর। ট্রেনটি মন্থর। প্রতিবেশীগুলি সহৃদয়। আর তার সাথিটি? সে পোষা পাখিটির মতো তার হাতের মুঠোয় নিজের প্রাণটি ভরে দিয়েছে।

পেগে সোমের কাঁধে মাথা রেখে নিঃস্পন্দ হয়ে রইল। তার দৃষ্টি জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্তে নিলীন হয়েছে। সোম অনড় অচঞ্চলভাবে কাঁধ খাড়া রাখল। সে এক কঠোর পরীক্ষা।

অবশেষে ট্রেন টেনবিতে পৌঁছোল।

তখন গোধূলি লগ্ন। দু-জনে হাত ধরাধরিভাবে ছোটো শহরটিতে রাতের বাসার খোঁজে চলল।

গুটি দুই তিন হোটেল অতিক্রম করল। তাদের হাতের টাকা ফুরিয়ে আসছে ক্রমে। হোটেলের খাঁই মেটানো যায় না। যদি ছোটো বোর্ডিং হাউস পায় তো উত্তম হয়।

দু-এক জায়গায় বেল টিপল। জিজ্ঞাসা করে, উত্তর পেল, এখানে তো ঘর খালি নেই, আর একটু এগিয়ে গেলে পেতে পারেন। আর একটু এগিয়ে যেতে যেতে তারা যেখানে পৌঁছোল সেখানে সমুদ্র সংকীর্ণ হয়ে শহরের মধ্যে প্রবেশ করেছে।

একজনের সঙ্গে দেখা।

সোম বলল, ‘বলতে পারেন, এখানে বোর্ডিং হাউস পাই কোথায়?’

‘কী? আসল সমুদ্রটা কোন দিকে? সোজা দক্ষিণ মুখে যান, সমুদ্রে পড়বেন, বাঁধানো ঘাট, বিস্তৃত promenade.’

‘সে-দিকে বোর্ডিং হাউস আছে?’

‘একটা নতুন সিনেমা তৈরি হচ্ছে। আমরাই তৈরি করছি। তৈরি শেষ হয়ে যাক, আমরা ওখানে একটা মিটিং করব দেখবেন। লেবার পার্টির মিটিং। জানেন মশাই, জায়গাটা কনসারভেটিভদের পৈত্রিক সম্পত্তি—বাছাধনরা নড়তে চান না সিংহাসন থেকে। তা ওরা চলে ডালে ডালে তো আমরা চলি পাতায় পাতায়।’

লোকটা বদ্ধ কালা ও বাচাল। সোম বলল, ‘পেগি, কী করা যায়?’

পেগি বলল, ‘কালকের মতো চার ঘণ্টা হাঁটতে পারি নে বাপু। আজকে ইস্টার সোমবার, সব জায়গা ভরতি।’

সোম আরেকবার চেষ্টা করল। ‘ওহে, শুনছ? আমরা লণ্ডন থেকে আসছি—’

‘আমি জানি আপনি টাইবেটান (Tibetan)। ঠিক কি না বলুন। আমি বাডিজম (Buddhism) সম্বন্ধেও খবর রাখি, মশাই।’

সোম হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘পেগ, তুমি এইখানে বোসো। আমি খোঁজ করে আসছি।’

পেগি বলল, ‘ওকে হাত নেড়ে বোঝাতে পার না ইঙ্গিতে?’

সোম বলল, ‘তা হলে ও ভাববে আমি ওকে কালা বলে উপহাস করছি। রেগে আমার মাথা নেবে।’

যা হয় হোক সামনের টি-রুমসে ধাক্কা মারব। এই ভেবে সোম পেগিকে পিছনে রেখে খানিক দূর এগিয়ে গেল।

টি-রুমসের দরজা খুলে একটি বুড়ি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল।

সোম বলল, ‘দু-টি মানুষের জন্যে ঘর দরকার। হবে?’

সোম আশা করেনি যে ‘হ্যাঁ’ শুনবে। বুড়ি বলল, ‘দু-টি ছোটো ঘর খালি ছিল। আজকেই একটিতে লোক নিয়েছি। একটি ছোটো ও একটি বড়ো ঘর খালি আছে। দেখবেন?’

সোম পরিদর্শন করল। ঘর দু-টি স্বতন্ত্র তলায়। বুড়িকে বলল, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। বেহাত কোরো না।’

পেগিকে বলল, ‘তোমার পছন্দ হবে না জানি। তবু নাই ঘরের চেয়ে যেমন-তেমন ঘর ভালো। এখন ভেবে বলো একটা বড়ো ঘর ও একটা ছোটো ঘর নেওয়া যাবে, না, কেবল একটা বড়ো ঘর?’

‘দুটো ঘর নিলে টাকা বেশি নেবে?’

‘নেবে না? ইস্টারের মরসুম?’

‘তবে—তবে—’

‘বুঝেছি। কিন্তু বড়ো ঘরটিও যথেষ্ট বড়ো নয়। তাতে একটা বড়ো খাট ও একটা ছোটো খাট। ছোটো খাটটাতে বিছানা পাতা নেই।’

‘উপায়?’

‘বুড়িটি ভালো। বললে পেতে দেবে।’

বুড়ি বলল, ‘তার আর কী! ধোপা-খরচা দিতে রাজি থাকেন তো আরেক সাজ বিছানা পেতে দিচ্ছি।’

সোম বলল, ‘তা না হয় হল। আমি চার দিন স্নান করিনি, মিসেস উইলকিনস। স্নানের ঘর আছে তো?’

‘দুঃখিত হলুম স্যার। শোবার ঘরে গরম জল দিয়ে আসতে পারি। গামলায় স্নান করবেন।’

‘অভ্যাস নেই, মিসেস উইলকিনস। তোমরা কোথায় স্নান কর?’

‘আমার কথা যদি জানতে চান আমি পঁয়ত্রিশ বছর এই বাড়িতে আছি। পঁয়ত্রিশ বছর গামলায় স্নান করে আসছি স্যার।’

‘শাবাশ! বোধ হয় পঁয়ত্রিশ বারের বেশি স্নান করতে হয়নি, মিসেস উইলকিনস।’

বুড়ি আপত্তি করে বলল, ‘না, না, সে কী হয়, স্যার! সমুদ্র এত কাছে। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রস্নান করেছি।’

‘ঠিক, মিসেস উইলকিনস, তোমারও তো একদিন এঁর বয়স ও এঁর সৌন্দর্য ছিল।’

স্নানের ব্যবস্থা হল। কিন্তু আহারের ব্যবস্থা করতে পারবে কি না শুনে বুড়ি ঘাড় নাড়ল। বুড়ি ও তার বুড়ো সন্ধ্যার আগে High Tea খায়, ইতিমধ্যে খাওয়া হয়ে গেছে। বাড়িতে এমন কিছু নেই যাতে দু-জনের পেট ভরতে পারে। তবে এখানে হোটেলগুলোতে ডিনার-এর সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায়নি, হোটেলে ডিনার খেয়ে সমুদ্রের বাঁধের উপর বেড়িয়ে এলে যদি ক্ষুধা লাগে তবে কিছু ডিম ও রুটি বুড়ি জোগাতে পারবে।

রেস্তোরাঁ খোলা পাওয়া গেল না। ছোটো শহর। ছ-টার আগে অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে।

খোলা ছিল কয়েকটি দামি ও নামি হোটেল। কিন্তু সেখানে খাবার খরচা অনেক। অত খরচ করতে পেগি কিংবা সোম রাজি নয়। পেগি বেরিয়েছিল তিন দিনের বাসা খরচা সম্বল করে। তিন দিনের বদলে চার দিন তো হলই, পাঁচ দিনও হবে। শুধু তাই নয়। সলসবেরি পর্যন্ত রেলভাড়া সঙ্গে ছিল, তার চারগুণ দূরে এসেছে। সেই জন্যে পেগি আজ তার বাড়িতে তার করেছে, ‘টেনবির ডাকঘরের ঠিকানায় তার করে টাকা পাঠাও।’ টাকাটা কাল সকালে ডাকঘরে গেলে পাবে খুব সম্ভব। তবু বলা যায় না তো। ডাকঘরওয়ালিরা যা দজ্জাল। যখন পুরুষ কেরানি ছিল তখন সুন্দরী তরুণীর মুখ দেখে বিশ্বাস করত। এখন ডাকঘরগুলো মেয়ে-কেরানিতে ঠাসা। তারা বিষম খুঁতখুঁতে। হয়তো বলবে, ‘তুমি যে পেগি স্কট তার প্রমাণ কী?’ পেগি বলবে, ‘ক-জন পেগি স্কট এসে তোমার কাছে টাকা চেয়েছে শুনি?’ মেয়েটা জবাব দিতে না পেরে চটে যাবে।

সোম পনেরো দিনের খরচা সঙ্গে এনেছিল, কিন্তু টেনবি পর্যন্ত রেলভাড়া লাগবে, তার উদ্ভটতম কল্পনাও এতদূর যায়নি। যেন একজন কলকাতা ছাড়বার আগে ভেবেছিল হাজারিবাগ অবধি যাবে, কিন্তু ঘটনাচক্রে উপনীত হয়েছে রাওয়ালপিন্ডিতে। তার কল্পনার দৌড় ছিল গিল্ডফোর্ড পর্যন্ত, কিন্তু ভুল গাড়িতে চড়ে সলসবেরি, তার পরে রামমোহন রায়ের কবর দেখতে ব্রিস্টল। এতদূর যখন এসে পড়েছি তখন ওয়েলসটা মাড়িয়ে গেলে ক্ষোভ থাকে না। তাই কার্ডিফ পর্যন্ত আসা। তারপর থেকে বিধাতার নির্দেশ। কেমন করে কী হয়ে গেল, হঠাৎ চলন্ত বাস ধরে পর্থকওল রওনা হওয়া, রবিবারের রাত্রি, বাসা কিংবা খাবার কোনোটাই খুঁজে না পাওয়া, অনেক কান্ড করে অদ্ভুত অবস্থায় রাত্রিবাস। বাঘ একবার মানুষের স্বাদ পেলে স্বাদ বদলাতে চায় না। আরও নির্জনে পেতে চাই পেগিকে, আরও নির্জনে। পর্থকওলে বড়ো ভিড়, চলো টেনবি। টেনবিতেও ভিড় নেহাত কম নয়, চলো অন্য কোথাও। সোম ইতিমধ্যে ভাবতে আরম্ভ করেছে কাল পেগিকে নিয়ে কোন ঘুমন্ত পুরীতে যাবে—পেমব্রোক, ফিশগার্ড, আয়ারল্যাণ্ড? অন্তত সন্নিকটবর্তী ম্যানরবিয়ের, যেখানে নর্মান যুগের দুর্গ আছে? ম্যানরবিয়ের যদি যথেষ্ট জনবিরল না হয় তবে পেমব্রোক, ফিশগার্ড, আয়ারল্যাণ্ড। টাকা চাই। যা অবশিষ্ট আছে তাকে সঞ্চয় করা বুদ্ধিমানের কাজ। পেগিকে আজ টাকার জন্যে তার করতে বারণ করেছে কত। সে-ই যখন পেগিকে দূর থেকে দূরতর দেশে নিয়ে চলেছে তখন টাকার ভাবনা পেগির নয়, তার। কিন্তু পেগি বারণ মানেনি। বলেছে, সুখ যখন আমারও, সুখের দাম তখন আমিও দেব না কেন। ঋণী হতে পারব না, সোম।

সোম ভাবছিল, ভগবান করুন, পেগির যেন বাড়ি থেকে কাল টাকা না আসে। তা হলে আমার কাছে ধার নিতেই হবে তাকে। শোধ দেবার সময় আসার আগে পেগি আমার প্রিয়া। তখন আমরা শুধু অভিন্নহৃদয় নই, অভিন্নপকেট।

তা বলে পেগি কিংবা সোম কারুর ইচ্ছে ছিল না যে আজকের রাতটা উপোস দেবে। ওকথা ওরা ভুলেও ভাবেনি। লণ্ডন-ব্রিস্টলের মতো একটা সস্তা রেস্তোরাঁ পাবেই। টেনবির সুখ্যাতি শুনেছে। এমন একটাও রেস্তোরাঁ পাবে না যেখানে অল্প খরচে নৈশভোজন করা যায়?

সমস্ত শহরটা তিন বার চষে বেড়াবার পর তাদের চেতনা হল যে ন-টা বাজে। এখন হোটেলগুলোতেও ডিনার-এর সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ইতো নষ্টস্ততো ভ্রষ্টঃ।

পেগি বলল, ‘আমি আর শরীরের ভার বইতে পারছি নে, সোম। আমার ক্ষুধাও কখন নষ্ট হয়ে গেছে।’

সোম বলল, ‘লক্ষ্মীটি, এখনও দু-একটা হোটেলে ডিনার না হোক সাপার পাওয়া যাবে। আমার কাঁধে ভর দাও।’

পেগি বলল, ‘আমি এইখানে বসে তোমার প্রতীক্ষায় রইলুম। তুমি খেয়ে এসো।’

‘সে হয় না, দুষ্টু। একযাত্রায় পৃথক ফল?’

‘আমার ক্ষুধা নেই বলে তুমি উপোস দেবে? বেশ তো!’

‘তোমাকে ফেলে রেখে আমি স্বর্গেও যেতে চাই নে, অমৃতও খেতে চাই নে।’

(অতি কষ্টে খিল খিল করে হেসে) ‘যেমন অবলীলাক্রমে বললে, শুনে মনে হল ও কথা অনেক বার প্র্যাকটিস করেছ। প্রেম করতে করতে ঝানু হয়ে গেছ। না?’

‘মুখে যা আসে বলো। কিন্তু পেট খালি রাখতে পাবে না বলে দিলুম।’

‘জোর করে গেলাবে নাকি?’

‘নিশ্চয়ই। তোমার দেহের উপর আমার অধিকার আছে।’

‘ইস!’

‘ইস কী গো? তুমি না খেয়ে রোগা হয়ে যাবে, আমি তাই দেখে ও তাই স্পর্শ করে সুখ পাব?’

‘যেন তোমার সুখের জন্যে আমার সৃষ্টি?’

‘নিশ্চয়ই। তোমার সুখের জন্য আমার। স্ত্রী-পুরুষ পরস্পরের ভোগের জন্যে।’

‘যাও। তর্ক করবার মতো শক্তি নেই আমার।’

‘তবে আমার কাঁধে ভর দিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো হাঁটো। ওই যে ফলের দোকানটা ওটা এখুনি বন্ধ হয়ে যাবে।’

বাস্তবিক দোকানটা বন্ধ হবার মুখে। সোম ও পেগি এক মিনিট পরে এলে পস্তাত।

‘ইয়েস, ম্যাডাম? ইয়েস, স্যার?’

পেগি বলল, ‘আমাকে দাও আপেল।’

সোম বলল, ‘আমাকে দাও কমলা লেবু।’

তারপর দু-জনে সমুদ্রের বাঁধের উপর একটি বেঞ্চিতে বসে ফলগুলির সদব্যবহার করল। অন্ধকার রাত্রি। আকাশে একটিও তারা অনুপস্থিত নেই। সমুদ্রের জল আকাশের মতো কালো অথচ ফেন-ধবল। তারাগুলি যেন আকাশের ফেনা, সমুদ্রে ছিটিয়ে পড়ছে।

আপেল ও কমলা লেবু ওরা ভাগ করে খেল। পেগি আধখানা খায়, সোম বাকিটা শেষ করে। সোম কিছুটা খায়, বাকিটা পেগিকে খাইয়ে দেয়। আদর করে তার মাথাটি বুকের কাছে আনে, একটি হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতটি তার মুখের কাছে নেয়। পেগি যখন হাঁ করে তখন দুষ্টুমি করে হাত সরিয়ে নেয়, পেগি চটে গিয়ে বলে, ‘চাইনে আমি খেতে।’ মুখে কুলুপ লাগায়। সোম তার মুখ খোলবার ভান করে গাল টিপে দেয়। পেগি হাসি চেপে থাকতে পারে না। মুখ খোলে। সেই সুযোগে সোম তার মুখে খাবার গুঁজে দেয়।

পেগি বলল, ‘রাত অনেক হয়েছে। এবার পুলিশে পাকড়াবে।’

সোম বলল, ‘কেন, আমরা তো কোনো অপরাধ করছি নে?’

‘কে জানে বাপু। তুমি যে রেট-এ অগ্রসর হচ্ছ—’

‘বাকিটা শেষ করে ফেল। যে রেট-এ অগ্রসর হচ্ছি—’

‘মিস সাভিজ-এর মামলা মনে পড়ে? জিক্স হাইড পার্কে এক-শোটা পাহারাওয়ালা অতিরিক্ত বসিয়েছে।’

‘টেনবিতে তো বসায়নি?’

‘কে জানে বাপু; শুনলে না, কনসারভেটিভদের পৈত্রিক সম্পত্তি? বাবুরা বেকার সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হালে পানি পাচ্ছেন না, ঠাওরেছেন এই করলে বুড়ি ভোটারদের ভোট-এর জোরে অথই পাথার পার হবেন। সেটি আমরা হতে দিচ্ছিনে।’

‘তোমরা ফ্ল্যাপাররা তো এবার ভোট-এর অধিকার পেয়েছ। কাকে ভোট দিচ্ছ?’

‘লেবার-কে।’

‘ইংল্যাণ্ডের মেয়েদের আমি চিনি। ডাচেসরা যেদিকে ওরাও সেইদিকে।’

‘না গো মশাই। ওদের যথেষ্ট নিজত্ব আছে। ওরাও একটু-আধটু চিন্তা করে থাকে।’

‘চিন্তাশক্তি থাকলে তো?’

‘অমন যদি বল তোমাকে ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেব।’

‘তাতে করে এই প্রমাণ হয় যে তোমাদের বাহুবল আছে। কিন্তু চিন্তাশক্তি?’

‘না যদি থাকে কেয়ার করিনে। রূপ যৌবন বাহুবল ও বিত্ত—এই মানুষের পক্ষে যথেষ্ট।’

‘এই যদি তোমাদের ধারণা হয় তবে ভাবী যুগের ইংল্যাণ্ডের কী দশা হবে ভাবি।’

‘ইংল্যাণ্ডের দশা ভাবতে হবে না। ইংল্যাণ্ড অমর। Her soul goes marching on.’ পেগি চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। আর কালক্ষেপ করল না। বেঞ্চি ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি-না স্নান করবে কথা দিয়েছ?’

‘যাঃ। ভুলে মেরে দিয়েছিলুম।’

‘এই তো তোমার চিন্তাশক্তির প্রমাণ। এখন এসো। চলৎ শক্তির প্রমাণ দাও। মিসেস উইলকিনস অভিশাপ দিতে থাকবে।’

শোবার ঘরে স্নানের জল দিয়েছে। যে স্নান করবে সে ছাড়া আর কেউ ঘরে ঢুকতে পারে না।

পেগি বলল, ‘তুমি উপরে যাও, স্নান করো গে। আমি ততক্ষণ মিসেস উইলকিনসের সঙ্গে গল্প করতে থাকি।’

পেগিকে একদন্ড চোখের আড়াল করলে সোমের চোখ ছল ছল করে, একদন্ড কাছছাড়া করলে সোমের প্রাণ চলে যায়। সোম দশ মিনিটে স্নান শেষ করে, রাতের কাপড় পরে ঠাণ্ডা লাগবার ভয়ে বিছানায় উঠল। কিন্তু যতই অপেক্ষা করে পেগি আর আসে না।

পেগি কি এ ঘরে শোবে না?

নীচে গিয়ে পেগিকে পাকড়াও করে আনবে, সে উপায় নেই। তা হলে পোশাক পরতে হয়, অন্তত ড্রেসিং গাউন চড়াতে হয়। বাহুল্য মনে করে ড্রেসিং গাউন সোম আনেনি। সঙ্গে একটা হাত-ব্যাগ এনেছে, তাতে ধরে রাতের কাপড়, কামাবার সরঞ্জাম, অতিরিক্ত টাইকলার মোজা গেঞ্জি শার্ট। আর দু-চারটে খুচরো উপকরণ। যেটা পরে সেটার বেশি সুট আনেনি। সোম বোঝা বাড়াতে ভালোবাসে না। তাতে ভ্রমণের সুখ হ্রাস পায়। সোম দেখল পেগিরও মত তাই। পেগি অবশ্য এক বস্ত্রে আসেনি। তবু একটা সুটকেসে তার কুলিয়ে গেছে। সোম বয় পেগির সুটকেস, পেগি ধরে সোমের হাত-ব্যাগ। কুলি করতে হয় না। ট্যাক্সি করতে হয় না। পথে চলার সুখ তারা ষোলো আনা ভোগ করছে।

দরজায় টোকা পড়ল। ‘ভিতরে আসতে পারি?’

সোম বলল, ‘আমার স্নান হয়ে গেছে কখন!’

পেগি দুধের গেলাসটি সোমের মুখের কাছে এনে বলল, ‘Now be a good boy।  এটুকু ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলো দেখি, যাদু।’

সোম বলল, ‘এ কী?’

‘এর নাম দুধ। ছোটো ছেলেরা এই খেয়ে ঘুমোয়।’

‘ছোটো মেয়েটির খাওয়া হয়েছে?’

‘ছোটো মেয়েটি স্নান করেনি, গরম দুধের দরকার বোধ করে না।’

‘ছোটো ছেলেটির প্রতিজ্ঞা সে একা কোনো জিনিস খাবে না।’

‘ঢং রাখো। ওঠো, খাও।’

‘হুকুম?’

‘হুকুম।’

‘তবে দেখছি উঠতে হল। কিন্তু পেগ, তুমি একটি চুমুক খাও।’

‘কী আবদারে ছেলে! এমনটি দেখিনি!’

‘কী কড়ামেজাজি ঠাকুমা! এমনটি দেখিনি!’

দুধ খাওয়া শেষ হলে পেগি বলল, ‘লক্ষ্মী ছেলেরা এখন লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোয়। ঠাকুমার কাপড় ছাড়া দেখে না।’

সোম পাশ ফিরে চোখ বুজল। পেগি কাপড় ছেড়ে প্রথমে গ্যাসের বাতি নিভিয়ে দিল, তারপরে নিজের বিছানায় লাফ দিয়ে উঠল। পেগির বড়ো খাট, সোমের খাট ছোটো।

‘সোম, ঘুমোলে?’

সোম গলার সাহায্যে নাক ডাকাতে লাগল। সেই তার উত্তর।

‘আমি একা জেগে থাকি কেন? আমি কিন্তু সত্যি সত্যি নাক ডাকাব।’

সোম বলল, ‘চেষ্টা করলেও পারবে না।’

‘ও কৌশলটা তোমার পেটেন্ট?’

‘তুমি জাল করতে চাইলেও পার না।’

পেগি চেষ্টা করে হাস্যাস্পদ হল। তার নিজের হাস্যাস্পদ।

কতক্ষণ কেটে গেল।

পেগি হঠাৎ আর্তকন্ঠে ডাকল, ‘সোম!’

সোমের ঘুম লেগে আসছিল। একটু ঝাঁঝের সঙ্গে সাড়া দিল। ‘কী, পেগ।’

‘ওটা কী ওখানে দাঁড়িয়ে?’

সোম চোখ মেলে বলল, ‘কোনটা?’

‘ওই যে জানালার কাছে। সোম, আমি মরে যাব। উঃ—উঃ—উঃ।’

সোম উঠে বসল। জানালার কাছে একটা ছায়া। গাছের ছায়া হবে। সোম জানালার কাছে গিয়ে স্ক্রিন টেনে দিল। বাইরে থেকে যেটুকু আলো আসছিল—গ্যাস পোস্টের আলো—সেটুকু গেল বন্ধ হয়ে। তখন সোম মোমবাতি জ্বালাল।

‘পেগ।’

‘কী?’

‘জানালার দিকে তাকাও।’

‘না গো। আমার গা ছমছম করছে।’

‘ভূত নয়, পেগ। গাছের ছায়া।’

‘তুমি আমার কাছে এসে বোসো।’

সোম তার শিয়রে বসল। বলল, ‘এত সাহসী অথচ এত ভীতু তুমি। সব মেয়েই তাই।’

সোম তার চুলগুলির ভিতর আঙুল বুলিয়ে দিতে লাগল। পেগি নীরবে আদর উপভোগ করতে থাকল।

সোম বলল, ‘অনেকটা হেঁটেছ আজ। পা কনকন করছে?’

‘করছে।’

সোম তার পায়ের কাছে উঠে গেল। পায়ে হাত বুলিয়ে দিল। পা টিপে দিল।

পেগি বলল, ‘উঃ। লাগে।’

‘একটু লাগবেই তো। তা নইলে সারবে না।’

পেগি বলল, ‘বড্ড লাগছে।’

সোম বলল, ‘আচ্ছা, আরেকটু আস্তে টিপছি।’

সোমের নিজেরই নেশা লেগে গেছিল। পনেরো মিনিট কেটে গেল। সে থামবার নাম করে না। বলে, ‘এবার উরু আর কোমর।’

পেগি বলল, ‘আমি আপত্তি করলে কি তুমি শুনবে যে আপত্তি করব?’

অর্থাৎ সে সাহ্লাদে সম্মতি দিল।

তারপর সোম দাবি করল পিঠ।

পেগি বলল, ‘তোমার ম্যাসাজ-এর হাত দেখছি পাকা। কোথায় কোথায় প্র্যাকটিস করেছ?’

সোম বলল, ‘ওটা আমাদের professional secret।’

সোমের শ্রান্তি ক্লান্তি ছিল না। পিঠের পরে হাত। একঘণ্টা কেটে গেল। রাত তখন বোধ করি একটা।

পেগি বলল, ‘আমাকে ঘুমোতে দেবে না?’

‘আগে তোমাকে সুস্থ করে তুলি।’

‘তুমি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছ, আমার শরীরের কোনো অঙ্গ বাদ দেবে না!’

‘তাতে তোমার লোকসান?’

‘লোকসান? মেয়েমানুষের লজ্জাশরম বলে কি কিছু নেই?’

‘ওটা একটা কুসংস্কার।’

‘উঃ, আমাকে ডালকুত্তার মতো ছিঁড়ে ফেলো না।’

‘আচ্ছা, আরও আস্তে।’

সোমের উৎসাহ ক্রমশ শ্লীলতার সীমা টপকাতে চায়। বুক।

পেগি বলল, ‘ওইটি পারবে না। সরাও, সরাও, হাত সরাও।’

সোম অভিমানে খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। লক্ষপতি ছিল, কোটিপতি হতে গিয়ে পড়বি তো পড় শূন্যের কোটায়। মন্টিকার্লোতে জুয়ো খেলতে গেছিল। প্রায় সব পেয়েছিল, সব পাবার লোভে সব খোয়াল। এখন তাকে গলাধাক্কা দিয়ে casino-র চৌহদ্দি পার করে দিয়েছে।

সোমের মন গেল গলা ছেড়ে কাঁদতে। কিন্তু তার পৌরুষের অহংকার ছিল। তাইতে তাকে বাঁচাল। সে চুপটি করে বিছানায় ফিরে আসবার আগে এক ফুঁয়ে বাতিটি দিল নিবিয়ে। পেগিকে ‘গুড নাইট’ বলতেও অভিমানে তার মুখ ফুটছিল না। সে ভাবছিল, নাঃ, কালকেই লণ্ডনে রওয়ানা হবে, পেগি যা ভাবে ভাবুক। কীই-বা তার সঙ্গে সোমের সম্পর্ক! পথে কুড়িয়ে পাওয়া একটা মেয়ে। সোমকে দিয়ে পা টিপিয়ে নিল পর্যন্ত। নিশ্চয়ই অন্ধকারে মুখ টিপে টিপে হাসছে। ভাবছে, প্রশ্রয় দিলুম, দিলুম, দিলুম। খেলিয়ে খেলিয়ে বুকের কাছ পর্যন্ত আনলুম! তারপরে মারলুম ফট করে একটা চড়। কুকুর! কুকুর! কুকুর! মাথায় উঠত!

সোম বোধকরি ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ জেগে বোধ করল কার উষ্ণ নিঃশ্বাস তার গালের উপর পড়ছে। কে যেন আদর করে তার চোখের পাতার উপর সুগন্ধিযুক্ত রুমাল বুলিয়ে দিচ্ছে। সোম জাগল বটে, কিন্তু অভিমানে কথাটি কইল না। পেগি জানতেই পারল না যে সোম জেগে আছে। সোম বুদ্ধি খাটিয়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল ঠিক ঘুমন্ত মানুষের মতো।

পেগি সোমের কপালের উপর ঝুঁকে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরে একটি চুমু খেল। যেন খাওয়া আর ফুরায় না। এক মিনিট যায়, দু মিনিট যায়, পাঁচ মিনিট যায়। সোম ভাবল, পেগি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?

সোম বলল, ‘পেগ?’

পেগি চমক দমন করে সহজভাবে বলল, ‘ডিয়ার?’—ক্ষণেকের জন্যে মুখ তুলে আবার তেমনিভাবে রাখল। না জানি কত মধু পেয়েছে। শেষ না করে উঠে যেতে চায় না।

সোম বলল, ‘পেগ, স্বার্থপরের মতো একা খেয়ো না। আমাকেও অংশী হতে দাও।’

পেগি বসবার ভঙ্গি বদল করে সোমের ওষ্ঠের উপর ওষ্ঠ ও সোমের অধরের উপর অধর স্থাপন করল। তার বুকের একাংশ সোমের বুকের একাংশ চুম্বন করছিল।

সোম আনন্দের উত্তেজনায় মূর্ছা গেল। যখন চেতন হল তখন পেগি উঠে গেছে। সোমের হৃদয় বলছিল, আমি পূর্ণ, আমার খেদ রবে না আজকে যদি মরি। দেহ বলছিল কী জ্বালা! কী জ্বালা! আমার শিরায় শিরায় মশাল জ্বলছে। সমুদ্রে ডুব দিয়ে মরব।

সোম বিছানা ছেড়ে অনেকক্ষণ পায়চারি করল—ধীরে, অতি ধীরে; যাতে পেগির ঘুম না চটে যায়। জানালার কাছে এসে স্ক্রিন খুলে দিল। সমুদ্রের হাওয়া ঝিরঝির করে তার গায়ে এসে লাগল। তার দেহ স্নিগ্ধ হল।

আবার বিছানায় ফিরে এল। ভাবতে লাগল, কী আশ্চর্য এই জগৎ, কী আশ্চর্য মানুষের জীবন! পৃথিবীর এক কোণে তার জন্ম, পেগির জন্ম আর এক কোণে। তেইশ বছর তার খোঁজে কাটিয়ে দিয়েছে, এতদিন পায়নি। অকস্মাৎ ভিক্টোরিয়ার ভুল ট্রেনে সাক্ষাৎ। প্রথম রাত্রে সে স্বল্পপরিচিতা, সৌজন্যময়ী। দ্বিতীয় রাত্রে সে অবিজিতা, রহস্যময়ী। তৃতীয় রাত্রি পর্থকওলে। চতুর্থ রাত্রি এইখানে। চার রাত্রি নয়, যেন চারটি গুণ।

সোম একে একে প্রত্যেক যুগের ইতিহাস মনে লিখতে লিখতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *