২. তারাপদর দেখা নাই

০২.

দিন তিনেক আর দেখা নেই তারাপদর।

চারদিনের দিন সন্ধের মুখে তারাপদ হাজির, সঙ্গে চন্দন আর নতুন একটি ছেলে। পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই কিকিরা বুঝে নিলেন, ছেলেটি জগন্নাথ।

ঘরে পা দিয়েই তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, আপনার স্যান্ডেল উডকে ধরে এনেছি। আর এই আমাদের জগুদা।”

কিকিরা হাসিমুখে বললেন, “এসো। বোসো হে জগন্নাথবাবু, বোসো।” বলে চন্দনের দিকে তাকালেন। “কিসের এমন ডিউটি তোমার স্যান্ডেল উড? আজ মাসখানেক বেপাত্তা হয়ে রয়েছ?”

চন্দন বলল, “বলবেন না, হাসপাতালে গণ্ডগোল, অর্ধেক লোক ছুটিতে। খেটে-খেটে মরছি। তার ওপর শুনছি, জানুয়ারিতে নাকি আমাকে বাইরে ট্রান্সফার করে দেবে। কোথায় দেবে কে জানে! অজ গাঁ-গ্রামে ঠেলে দেবে! আমার মন-মেজাজ বড় খারাপ, কিকিরা!”

কিকিরা বললেন, “জানুয়ারি! তার এখন মাস-দুই দেরি। এখন থেকে মেজাজ খারাপ করছ কেন! এখন সবেই নভেম্বরের গোড়া!”

চন্দন বলল, “আপনার আর কী? ভিলেজ ডাক্তারির ঝক্কি তো জানেন না। হাসপাতালের দরজায় বড়ি ফেলে দিয়ে পালায়। ডেঞ্জারাস?”

তারাপদ রগড় করে বলল, “তোর বডিও একদিন ফেলে দেবে, চাঁদু তুই বরং চাকরি ছেড়ে দে, দিয়ে নফর কুণ্ডু লেনে পি. পি. শুরু কর।

কিকিরা বললেন, “পি. পি-টা কী?”

“প্রাইভেট প্র্যাকটিস” বলে হাসতে লাগল তারাপদ। হাসতে হাসতে বলল, “খুব কম খরচে বসে যেতে পারবি। একটা টেবিল, দু-তিনটে চেয়ার, বেঞ্চি একটা। ব্যস! আর তোর লাগবে নাম-ছাপানো প্যাড। একটা স্টেথো। সেটা তোর আছে। কত কম খরচে ব্যবসা বল!”

কিকিরা, চন্দন, দুজনেই হেসে উঠলেন।

জগন্নাথ হাসল না। সে একে নতুন লোক, তায় কিকিরার চেহারা, পোশাক, এই অদ্ভুত ঘরটি দেখে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারাপদ তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোথায় ধরে এনেছে? কিকিরাকে দেখলে তো সাকাসের জীব মনে হয়। আর এই ঘরটা যেন চিতপুরের থিয়েটারের সাজ-ভাড়া দেওয়া কোনো দোকান-টোকান।

জগন্নাথ রীতিমত হতাশ হয়ে পড়ছিল। তারাপদ অবশ্য আগেই বলে দিয়েছিল, “জগুদা, তোমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে গিয়ে ভড়কে যাবে না, আমাদের কিকিরা রহস্যময় পুরুষ, মিস্টিরিয়াস ক্যারেকটার কিকিরা দি গ্রেট, কিকিরা দি ওয়ান্ডার। ওঁর বাইরের স্টাইল দেখে ভেতরের ব্যাপার বুঝবে না। বাইরে উনি সাকাসের ক্লাউন, ভেতরে হুডিনি। ম্যাজিশিয়ান হুডিনি নাম শুনেছ তো? কিকিরা হলেন হুডিনি প্লাস শার্লক হোমস।”

জগন্নাথের মনে হল, তারাপদ বাজে কথা বলেছে। কিকিরার ওপর ভরসা করা মানে পুরোপুরি ডুবে যাওয়া।

তারাপদ জগন্নাথের মুখ দেখে বুঝতে পারছিল জগুদা বেশ হতাশ। কিকিরার দিকে তাকাল সে। বলল, “কিকিরা-স্যার, জগুদার সঙ্গে আপনি কথা বলুন। জগুদা ভাবছে, এ-কোথায় তাকে নিয়ে এলুম! ঘাবড়ে গিয়েছে বেচারি।”

কিকিরা জগন্নাথের দিকে তাকালেন, বললেন, “আগে কথা, না, চা?”

“চা আসছে। বগলাদাকে বলে এসেছি।”

কিকিরা বললেন, “ভাল করেছ। তা জগন্নাথবাবু, আপনি কি প্রেসিদ্ধ কল্পবৃক্ষর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন?” মজার ঢঙেই বললেন কিকিরা।

জগন্নাথ থতমত খেয়ে গেল। কিকিরার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল, কথা বলতে পারল না।

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “কিকিরা, হাউ স্ট্রেঞ্জ! আপনি কেমন করে জানলেন?”

কিকিরা হেসে বললেন, “ভৌতিক উপায়ে। আমি স্পিরিট ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। দু’দিন চেষ্টা করে লাইন পেলাম। কলকাতার টেলিফোনের মতন ওদের লাইনেও গোলমাল, জট পাকিয়ে আছে। আমাদের যেমন বর্ষা ওদের তেমন শীত–বেশি কুয়াশা হলেই লাইন নষ্ট বারবার রং নাম্বার।” বলে কিকিরা হাসতে লাগলেন।

তারাপদরা হেসে ফেলল।

শেষে তারাপদ বলল, “আপনি ঠিকই ধরেছেন। জগুদা শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।”

“কবে?”

তারাপদ জগন্নাথের দিকে তাকাল। মানে সে জগুদাকেই জবাবটা দিতে বলল।

জগন্নাথ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, “গত পরশু।”

“দেখা হল প্রেতসিদ্ধর সঙ্গে?”

“আমি বাড়িটার মধ্যে ঢুকিনি। ঢুকতে ভয় হল। বাইরে থেকে দেখে এলাম।”

“বাইরে থেকে! কী দেখলে?”

“গলির নাম কাঁঠালতলা নয়। লোকে বলে, কাঁঠালতলা। গলির মুখে বিরাট এক কাঁঠালগাছ। কত কালের গাছ কে জানে! সরু গলি, বাই লেনের মতন। ইট বাঁধানো গলির একদিকে কোনো বড় গুদোম-টুদোম হবে, কিসের জানি না, পাঁচিল তোলা রয়েছে। মাথায় পুরনো টিনের ছাউনি। লঙ্কার ঝাঁঝ নাকে আসছিল। বোধ হয় মশলাপাতি থাকে ওখানে। মশলা-গুদোম। বাঁ দিকে গুদোম, ডান দিকে ভাঙাচোরা কয়েকটা বাড়ি। অনেক পুরনো। ওখানে কারা থাকে জানি না, জনকতক মুটে-মজুর, ঠেলাওয়ালা দেখলাম। গলির শেষে একটা পোড়ো বাগানবাড়ির মতন বাড়ি। সামনের দিকে ঝোঁপঝাড়, আগাছা। ভেতরে এক বাড়ি। কম সে কম শ’ সোওয়া-শো বছরের হবে।”

কিকিরা বললেন, “তুমি বাড়ির কাছে গিয়েছিলে?”

 মাথা নেড়ে জগন্নাথ বলল, “খুব কাছে যাইনি। যেতে ভয় করছিল।”

“ভয় ছিল! কিছু দেখলে ওখানে?”

“আজ্ঞে দেখেছি।”

“কী দেখলে?”

“দু-তিনজনকে দেখলাম, বাড়িটার মধ্যে ঢুকছে।”

“একসঙ্গে?”

“প্রথমে ঢুকল দু’জন। খানিকটা পরে একজন।”

“সাজপোশাক কেমন, বয়েস কত হবে আন্দাজে, বাঙালি না অন্য কিছু?”

জগন্নাথ বলল, “তিনজনেই বাঙালি বলে মনে হল না। অবাঙালিও রয়েছে। বয়েস কম নয়। আমার চেয়ে বড়। একজনের তো মাথার চুলই সাদা-সাদা লাগল। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল, জ্যোৎস্নাও ফুটেছিল। তবু আমি ভাল করে দেখতে পাইনি। আমার ভয়ও করছিল। আমি যেখানে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানটায় বোধ হয় আগে দরোয়ানের ঘর ছিল। এখন সব ভাঙাচোরা, চারদিকে কুলঝোঁপ!”

কিকিরা বললেন, “কতক্ষণ ছিলে তুমি?”

“বড়জোর আধ ঘণ্টা।”

 “আর কিছু দেখোনি?”।

“আজ্ঞে, আর-একটা জিনিস দেখেছি। একটা লোক বড় প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে কাকে যেন পুরে কাঁধে করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।”

চন্দন আর তারাপদ চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। কিকিরাও যেন অবাক হলেন।

তারাপদ কিকিরাকে বলল, “জগুদা আমাকে বলেছে, স্যার। আমার মনে হয়, জগুদা ভুল দেখেছে। আজকাল কত তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়, আপনি দেখেছেন! জগুদা বলছে, বাড়িটার কাছাকাছি কোনো আলোও জ্বলছিল না। ব্যাপারটা চোখের ভুল।”

কথার মধ্যে বাধা দিয়ে জগন্নাথ বলল, “চোখের ভুল নয়। আমি দেখেছি। অন্ধকার হয়ে এলেও এখন শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলো ছিল। গতকাল পূর্ণিমা গিয়েছে।”

কিকিরা বললেন, “প্লাস্টিকের ব্যাগে লোক ঢোকে কেমন করে?”

জগন্নাথ বলল, “বড় ব্যাগ। মুড়ি-অলারা যেমন প্লাস্টিকের ব্যাগ মাথায় নিয়ে মুড়ি বিক্রি করতে যায়, সেইরকম।“

“ব্যাগের মধ্যে মানুষ ছিল তুমি বুঝলে কেমন করে?”

“দেখলাম।”

“ভুল দেখোনি?”

“কী জানি, আমার চোখে তো মানুষই মনে হল।”

 চন্দন এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, এবারে বলল, “একজন মানুষের ওজন কত হতে পারে? রোগাসোগা হলেও মিনিমাম চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ কেজির মতন। সাবালকের কথা বলছি। বাচ্চা-কাচ্চা হলে অন্য কথা। একজন সাবালক, মানুষকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া সোজা কথা?”

জগন্নাথ বলল, “বাঃ, ঘাড়ে-পিঠে করে আমরা মানুষ বই না! আগের দিনে কলকাতার বাবুরা ঝাঁকামুটের মাথায় চেপে অফিস-কাছারি যেত।”

চন্দন হেসে ফেলে বলল, “সেই মুটে, সেই বাবু এখন আর নেই। জগন্নাথবাবু! অবশ্য হ্যাঁ, ঘাড়ে-পিঠে আমরা মানুষ বই বইকি এখনও। তবে তার প্রসেস আলাদা।”

কিকিরা বললেন, “তুমি কি ঠিকই দেখেছ, জগন্নাথ?”

“আমার তাই মনে হয়।”

কিকিরা কথা ঘুরিয়ে নিলেন। বললেন, “তুমি তারপরই চলে এসেছ।

“হ্যাঁ। আমার এমনিতেই ভয় করছিল। তার ওপর লোকজন ঢুকছে, প্লাস্টিকের ব্যাগে-ভরা মানুষ, এইসব দেখে আমি পালিয়ে এলাম”।

তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, জগুদা এমনিতেই ভিতু মানুষ, নার্ভাস, নিরীহ। জগুদা যে কেমন করে ওখানে গিয়েছিল, কোন সাহসে, তাই আমি বুঝতে পারছি না। না।”

জগন্নাথ কোনো জবাব দিল না।

এমন সময় চা নিয়ে এল বগলা। গোল বড় ট্রে করে চা এনেছে। চায়ের সঙ্গে ডালপুরি, আলুর দম; একটা করে ডবল শোনপাপড়ি।

কিকিরা বললেন, “নাও হে তোমরা, হাত লাগাও। এ ডালপুরি হাউস মেড নয়, গণেশের দোকানের। ভালই করে। খাও।”

নিজে কিকিরা কিছু নিলেন না, শুধু চায়ের কাপটি তুলে নিলেন।

চন্দন খাবারের দিকে হাত বাড়াল। বলল, “গরম আছে রে তারাপদ, নিয়ে নে। আপনিও নিন জগন্নাথবাবু।“

ওরা খাওয়া শুরু করল।

কিকিরা জগন্নাথকে লক্ষ করতে লাগলেন। আধময়লা রং জগন্নাথের। মাথায় মাঝারি। সামান্য গোলগাল চেহারা। মাথায় চুল কম। মুখটি দেখলেই বোঝা যায়, ছেলেটি নিরীহ ধরনের, গোল-গোল চোখ, মোটা নাক, ছোট কপাল। কত আর বয়েস হবে। বড়জোর ঊনত্রিশ-ত্রিশ।

কিকিরা জগন্নাথকে বললেন, “এবার একটা কথা বলো তো?”

 তাকিয়ে থাকল জগন্নাথ।

“তুমি যে ওই প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষটির কাছে গিয়েছিলে, কেন গিয়েছিলে?”

জগন্নাথ চুপ। যেন তার মুখে কোনো জবাব জুটছে না। ইতস্তত করতে লাগল। চোখ নিচু করল।

কিকিরা নিজেই বললেন, “তুমি ওই প্রেতসিদ্ধর চিঠির কথা বিশ্বাস করো?”

জগন্নাথ চোখ তুলে তারাপদর দিকে তাকাল, চন্দনকেও দেখল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। বোধ হয় তার সঙ্কোচও হচ্ছিল। শেষে ভাঙা-ভাঙা ভাবে সামান্য আড়ষ্ট হয়ে বলল, “দেখতে গিয়েছিলাম।”

“কেন?”

“মনে হল…”

“তোমার মনে হল, ওই লোকটার কথা যদি সত্যি হয়। তাই না?”

জগন্নাথ আবার চোখ নিচু করল। অল্প সময় চুপ করে থেকে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। ..আপনি আমাদের বাড়ির কথা কিছু জানেন না। আমার বাবা একজন জুয়েলার ছিলেন। অবস্থা পড়ে যাবার পর তিনি নিজে আর তেমন ব্যবসাপত্র করতে পারতেন না। কলকাতার কয়েকটা বড়-বড় জুয়েলারের দোকানে আসা-যাওয়া করতেন। তাদের পাথর-টাথর পরখ করে দিতেন। নিজে কোনো অডার পেলে দোকান থেকে কিনিয়ে দিতেন। তাঁর একটা কমিশন থাকত।” কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে গেল জগন্নাথ। যেন বাবার কথা ভাবছিল। খানিকটা উদাস বিষণ্ণ হয়ে থাকল অল্পক্ষণ। পরে আবার বলল, “আমার বাবা অদ্ভুতভাবে মারা যান। একদিন বর্ষার সময় রাত করে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি যখন, তখন একটা মোটর সাইকেল এসে তাঁকে ধাক্কা মারে। বাবা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান রাস্তায়। তাঁর কোমরের কাছে লেগেছিল। বাবাকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখে দুজন পাড়ার রিকশঅলা হইচই করে ওঠে। মোটর সাইকেলঅলা পালিয়ে যায়। বাবাকে ওরা বাড়ি পৌঁছে দেয়। কিন্তু বাবার কোথায় যে লেগেছিল কে জানে, দিন-তিনেকের মাথায় হাসপাতালে মারা যান। বাবা কম বয়েসেই মারা গেলেন।”

কিকিরা জগন্নাথের বিষণ্ণ মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন, তারপর নরম গলায় বললেন, “কী আর করবে! তোমার ভাগ্য! ওই তারাপদরও তো একই অবস্থা। ওকেও মা বাবা হারাতে হয়েছে কম বয়েসেই।”

তারাপদ বলল, “আমি জগুদাকে বলেছি সব। ও-নিয়ে আর দুঃখ করে লাভ নেই। আমাদের মতন আরও কত ছেলেমেয়ে আছে!”

কিকিরা বললেন, জগন্নাথকে, “তোমার মা কতদিন হল নেই?”

“মা আজ প্রায় দেড় বছর হল নেই। গত বছরের গোড়ার দিকে মা মারা যান।”

“কী হয়েছিল?”

“বুকে ব্যথা। আমি তখন অফিসে। খবর পেয়ে বাড়ি গিয়ে দেখি, মা নেই। মাকে হাসপাতাল নিয়ে যাবারও সুযোগ হয়নি। আগেই মারা গিয়েছেন।”

“হার্ট অ্যাটাক?”

“হ্যাঁ। মায়ের হার্টের রোগ ছিল। তবে হঠাৎ এমন হবে কেউ ভাবেনি।”

চন্দন বলল, “হার্টের রোগের ব্যাপারটা বড় ট্রেচারাস। কখন কী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। “

কিকিরা চা শেষ করে চুরুটের খাপটা টেনে নিলেন। মাঝে-মাঝে শখ করে চুরুট খান। বড় চুরুট পছন্দ করেন না। সরু-সরু আঙুলের মতন পাঁচ-দশটা চুরুট তাঁর সব সময়েই মজুত থাকে।

চুরুট ধরিয়ে কিকিরা জগন্নাথকে বললেন, “এবার একটু অন্য কথা বলা যাক। আমার প্রথম কথা হল, ওই প্রেসিদ্ধ শুদ্ধানন্দ কল্পবৃক্ষটির কথা তুমি বিশ্বাস করছ কেন?”

জগন্নাথ মুখ তুলে তাকিয়ে থাকল। জবাব দিতে পারছিল না। শেষে বলল, “পুরো বিশ্বাস করিনি।”

“বিশ্বাস না করলে চিঠিটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?”

জগন্নাথ মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “ঠিক বিশ্ব নয়, তবে এরকম হয় শুনেছি।”

“কী শুনেছ?”

কী শুনেছে জগন্নাথ বলতে যেন লজ্জা পাচ্ছিল। কিংবা সঠিকভাবে জানে না বলে চট করে বলতে পারছিল না। ইতস্তত করে বলল, “আমার এক পিসেমশাই সাহেব কোম্পানিতে হেড ক্যাশিয়ার ছিলেন। একবার ক্যাশ থেকে হাজার চল্লিশ টাকা তছরুপ হয়। পিসেমশাইয়ের হাতে হাতকড়া পড়ার অবস্থা। পিসেমশাই, তো লজ্জায়, অপমানে, ভয়ে আত্মহত্যাই করতে যাচ্ছিলেন। পিসিমাই তাঁকে বাঁচিয়ে দেন। পিসিমা আগেই মারা গিয়েছিলেন। তাঁর আত্মা এসে পিসেমশাইকে বলে দেয়, টাকাটা কে নিয়েছে, নিয়ে কোথায় রেখেছে?”

তারাপদ আর চন্দন হেসে উঠল। কিকিরা হাসলেন না।

তারাপদদের হাসিতে জগন্নাথ ক্ষুণ্ণ হল। বলল, “বিশ্বাস না করলে আমি আর কী করব। তবে এরকম ঘটনা আমি আরও শুনেছি। আমাদের পাড়ার মথুরজেঠা একবার বিশেষ দরকারে বাড়ির সিন্দুক থেকে দরকারি দলিলপত্র বার করেছিলেন। পরে সেই দলিলপত্র হারিয়ে যায়। ওই দলিল শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল মথুরজেঠারই বইয়ের আলমারির নিচের তাকে, পুরনো পাঁজির আড়ালে। জেঠার বাবার আত্মা এসে বলে গিয়েছিল। নয়ত ওই পুরনো দলিল আর সময়মতন খুঁজে পাওয়া যেত না।”

চন্দন এবার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল। তারাপদকে সিগারেট দিল। বলল, “জগন্নাথবাবু, এসব হল গল্প। আপনি এগুলো বিশ্বাস করেন?”

জগন্নাথ বলল, “বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, তবু মনে হয়, হতেও তো পারে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে কেমন করে বলব! এই তো সেদিন কাগজে পড়ছিলাম, একজন নামকরা বিজ্ঞানী যাচ্ছিলেন বিদেশে, এক সেমিনারে। সকালে তাঁর প্লেন। রাত্রে ঘুমের মধ্যে মাকে স্বপ্ন দেখলেন। মা বারণ করলেন ওই প্লেনে যেতে। ভদ্রলোকের মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। তিনি শেষ পর্যন্ত সকালের প্লেনে গেলেন না। দুপুরে দিল্লির প্লেন ধরলেন। সকালের প্লেনটায় অদ্ভুতভাবে অ্যাকসিডেন্ট হল। মারা গেল কত প্যাসেঞ্জার। এ-সব কেন হয় কে জানে! হয়।”

তারাপদ সিগারেট ধরিয়ে বলল, “কাকতালীয় ব্যাপার…!”

 কিকিরা কিছুক্ষণ কথা বলেননি। এবার বললেন, জগন্নাথকে, “হয় কি হয় না সেটা পরের কথা। তার আগে তুমি আমায় বলল তো, বোনের বিয়ে নিয়ে তুমি খুব চিন্তায় আছ, তাই না?”

জগন্নাথ মাথা হেলিয়ে বলল, “হ্যাঁ। মা বেঁচে থাকতে কত খোঁজখবর করতেন। মা তো মারা গেলেন। আমার আর কেউ নেই, এই বোনটি ছাড়া। ওর জন্য আমি সারাদিন ভাবি। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমার দায়িত্ব চুকবে।”

কিকিরা বললেন, “বিয়ের কি সব ঠিকঠাক হয়েছে!”

“আজ্ঞে না। কথাবার্তা এক-একবার হয়। আর এগোয় না। আমরা গরিব মানুষ। বাবা মারা যাবার পর মা আমাদের বড় কষ্ট করে মানুষ করেছিলেন। মা আর নেই। আমি যে কেমন করে ঝুমুর বিয়ে দেব কে জানে?”

কিছুক্ষণ আর কথা বলল না কেউ।

শেষে কিকিরা বললেন, “জগন্নাথ, একটা কথা বলো তো? তোমার একথা কেন মনে হচ্ছে যে, তোমার মা তোমার বোনের বিয়ে-থার জন্য কিংবা তোমাদের আপদ-বিপদের জন্য কম হোক, বেশি হোক–কিছু সোনাদানা, টাকা কোথাও লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন।”

জগন্নাথ বোকার মতন তাকিয়ে থাকল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। পরে বলল, “আমার মনে হত না। ওই চিঠিটা পেয়ে আমি প্রথমে বিশ্বাসও করিনি। ভেবেছিলাম, কোনো বাজে লোক আমার সঙ্গে তামাশা করেছে। ওটা উড়ো চিঠি। পরে পাঁচরকম ভাবতে-ভাবতে আমার মনে হল, মা মাঝে-মাঝে বলতেন, ঝুমুর বিয়ের জন্যে ভাবতে হবে না, একটা ব্যবস্থা মা করে রেখেছেন। কী ব্যবস্থা, মা অবশ্য বলতেন না। কথাটা মনে হবার পর আমার কেমন…।” কথাটা আর শেষ করল না জগন্নাথ।

কিকিরা ঘাড় নাড়তে-নাড়তে বললেন, “বুঝেছি। তোমার মনে হচ্ছে হয়ত মা কোথাও কিছু রেখে গেছেন লুকিয়ে।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

কিকিরা তাঁর মাথার লম্বা-লম্বা চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে আচমকা বললেন, “জগন্নাথ, তোমার বাবা না জুয়েলার ছিলেন? দামি পাথর-টাথর পরখ করতে পারতেন?”।

“হ্যাঁ। বাবার খুব নামডাক ছিল। বাবা পাথর যাচাইয়ে এক্সপার্ট ছিলেন। দামটামও ঠিক করতে পারতেন। হীরের ব্যাপারে বাবার চেয়ে বড় আর কেউ ছিল না।”

“হঁ। তোমার বাবা মোটর সাইকেলের ধাক্কায় ভীষণ জখম হন। মারাও যান। এইখানটায় যে গোলমাল লাগছে, জগন্নাথ। উনি জখম হন, না, ওঁকে জখম করা হয়? একটু তো ভাবতে হয় হে। দু-একটা দিন সময় দরকার। না কি হে চন্দন?”

চন্দন কোনো জবাব দিল না।