২. তারাপদর আর ঘুম আসছিল না

০২.

তারাপদর আর ঘুম আসছিল না। বটুকবাবুর মেসের কোথাও আর ছিটেফোঁটা বাতি জ্বলছে না বৃষ্টির দরুন ঠাণ্ডাও পড়েছে, খুব, এ-সময় লেপ মুড়ি দিয়ে তোফা ঘুম মারবে কোথায়, তা নয়, মাথার মধ্যে যত রকম এলোমেলো ভাবনা। আগের বার, যখন তারাপদর কপালে ভুজঙ্গ কাপালিক জুটেছিল, তখন দশ-পনেরোটা দিন মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল তার। তারাপদ নিজেই সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, তার ভাগ্য নিয়ে অদ্ভুত এক খেলা চলছিল, মাথা খারাপ না হয়ে উপায় ছিল না তার। কিন্তু এবারে তারাপদ নিজে কোথাও জড়িয়ে নেই। তবু এত ভাবনা কিসের?

কিকিরা মানুষটি সত্যিই অদ্ভুত। এই ক’মাসের মেলামেশায় তারাপদরা বুঝতে পেরেছে, কিকিরা মুখে যত হাসি-ঠাট্টা তামাশা করুন না কেন, তাঁর একটা বিচিত্র জীবন আছে। স্পষ্ট করে, খুলে কিকিরা এখন পর্যন্ত কোনোদিন সে জীবনের কথা বলেননি। বলেছেন, সে-সব গল্প পরে একদিন শুনো, বললে মহাভারত হবে, তবে বাপু এটা ঠিক–আমি ম্যাজিকের লাইনের লোক। তোমরা ভাবো, ম্যাজিক জানলেই লোকে ম্যাজিশিয়ান হয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। তা কিন্তু নয়, কপালে না-থাকলে শেষ পর্যন্ত কেউ দাঁড়াতে পারে না। আমার কপালটা মন্দ। এখন আমি একটা বই লেখার চেষ্টা করছি ম্যাজিকের ওপর, সেই পুরনো আমল থেকে এ পর্যন্ত কেমন করে ম্যাজিকের ইতিহাস চলে আসছে বুঝলে?

তারাপদরা অতশত বোঝে না। কিকিরাকে বোঝে। মানুষটি চমৎকার, খুব রসিক, তারাপদদের স্নেহ করেন আপনজনের মতন। সত্যি বলতে কী, এতকাল চন্দন ছাড়া তারাপদর নিজের বলতে কেউ ছিল না, এখন কিকিরাকেও তারাপদর নিজের বলে মনে হয়।

কিকিরা যখন বলেছেন, তখন তারাপদকে সিংভূমের কোন এক জঙ্গলে যেতেই হবে তাঁর সঙ্গে। তবে দীপনারায়ণের ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার সময় তারাপদরা আবার কথাটা তুলেছিল। চন্দন কিকিরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি যাঁকে চেনেন না জানেন না, তাঁর কথা বিশ্বাসই বা করছেন কেন, আর এইসব খুনখারাপির মধ্যে নাকই বা গলাচ্ছেন কেন?”

কিকিরা তখন যা বললেন, সেটা আরও অদ্ভুত।

এই কলকাতাতেই কিকিরার এক বন্ধু আছেন, যিনি নাকি আশ্চর্য এবং অলৌকিক এক গুণের অধিকারী। কিকিরার চেয়ে বয়েসে সামান্য বড়, নাম রামপ্রসাদ। সন্ন্যাসীধরনের মানুষ, কোনো মঠের সন্ন্যাসী নন, সাত্ত্বিক ধরনের লোক, চিতপুরের দিকে গানবাজনার যন্ত্র সারাবার একটা দোকান আছে তাঁর। একা থাকেন। এই মানুষটির এক অলৌকিকশক্তি আছে। অদেখা কোনো কোনো ঘটনা তিনি দেখতে পান। তাঁকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বা জানতে চাইলে তিনি চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর ওই অবস্থায় যদি কিছু দেখতে পান সেটা বলে যান। যখন আর পান না, থেমে যান। সব সময় সব প্রশ্নের জবাবও দেন না। বলেন, তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর এই অলৌকিক শক্তির কথা সকলে জানে না, কেউ-কেউ জানে। মুখে-মুখে তাঁর কথা খানিকটা ছড়িয়ে গেলেও মানুষটি অন্য ধাতের বলে তাঁকে নিয়ে হইচই করার সুযোগ হয়নি। নিজেও তিনি কারও সঙ্গে গলাগলি করছে চান না। একলা থাকতে ভালবাসেন। তবু গণ্যমান্য জনাকয়েক আছেন, যাঁরা রামপ্রসাদবাবুর অনুরাগী। কিকিরা রামপ্রসাদবাবুকে যথেষ্ট মান্য করেন।

রামপ্রসাদবাবুর বাড়িতেই কিকিরা দীপনারায়ণকে দেখেছিলেন। আলাপ সেখানেই। রামপ্রসাদবাবুই কিকিরাকে বলেছিলেন, “কিঙ্কর, তুমি এর ব্যাপারটা একটু দেখো তো, আমি ভাল কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”

“চন্দন জিজ্ঞেস করেছিল, “রামপ্রসাদবাবু চোখ বন্ধ করে কী দেখতে পান?”

“ভূত আর ভবিষ্যৎ–দুইই কিছু কিছু দেখতে পান।” বলেছিলেন কিকিরা।

চন্দন ঠাট্টা করে বলেছিল, “দৈবজ্ঞ!”

কিকিরা বলেছিলেন, “যদি দৈবজ্ঞ বলতে চাও বলো, তবে ব্যাপারটা ঠাট্টার নয় চন্দন। তোমায় আগে বলেছি, আবার বলছি, এই জগৎটা অনেক বড়, বড়ই অদ্ভুত, আমরা তার কণার কণাও জানি না। তুমি রামপ্রসাদবাবুকে দৈবজ্ঞ বলে ঠাট্টা করছ, কিন্তু তুমি জানো না, বিদেশে–যেমন হল্যাণ্ডে সবচেয়ে পুরনো যে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে সাইকলজির ডিপার্টমেন্টে বিশ বাইশজন এই ধরনের মানুষকে রেখে নিত্যিদিন গবেষণা চালানো হচ্ছে। এই বিশ বাইশজনকে আনা হয়েছে সারা য়ুরোপ খুঁজে–যাঁদের মধ্যে কমবেশি এমন কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দেখা গিয়েছে যা সাধারণ মানুষের দেখা যায় না। ডাক্তার আর সাইকলজিস্টরা মিলে কত এক্সপেরিমেন্ট না করছে এদের ওপর। জানার চেষ্টা করছে–কোন্ ক্ষমতা এদের আছে, যাতে এরা যা চোখে দেখেনি তার কথাও কিছু না-কিছু বলতে পারে।”

কিকিরা যত যাই বলুন, চন্দন বিশ্বাস করেনি কোনো মানুষ অলৌকিক কোনো ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।

তারাপদ চন্দনের মতন সবকিছু অবিশ্বাস করতে পারে না। বিশেষ করে কিকিরা যখন বলছেন। ব্যাপারটা যদি গাঁজাখুরি হত–কিকিরা নিজেই মানতেন না। ভুজঙ্গের আত্মা নামানো তিনি মানেননি। তারাপদ ঠিক বুঝতে পারছে না, কিন্তু তারও মনে হচ্ছে, কিছু থাকলেও থাকতে পারে। সাধারণ মানুষ সাধারণই, তারা কী পারে না-পারে, তা নিয়ে অসাধারণের বিচার হতে পারে না। রাজার ছেলে রাজাই হয়, এটা সাধারণ কথা, কিন্তু রাজার ছেলে সমস্ত কিছু ত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধও তো হয়।

এই সব দশরকম ভাবতে-ভাবতে শেষ পর্যন্ত তারাপদ কখন ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন বিকেলে সে একাই কিকিরার বাড়ি গিয়ে হাজির। আজ সারাদিন আর বৃষ্টি নেই। তবে মাঝে মাঝে রোদ উঠলেও আকাশটা মেঘলা-মেঘলা। কলকাতা শহরে সব পুজোতেই হইচই আছে সরস্বতী পুজোর বেলায় কম হবে কেন! তারাপদর আজ টিউশানি নেই, কালও নয়। ছুটি। দু-চার দিন ছুটি নিতে হবে আরও। তারাপদর একটা চাকরির জন্যে কিকিরাও উঠে পড়ে লেগেছেন। বলেছেন, “দাঁড়াও, তোমায় আমি চাকরিতে না বসিয়ে মরব না।”

কিকিরা বাড়িতেই ছিলেন। বললেন, “এসো এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম।”

তারাপদ বলল, “কেন?”

কিকিরা বললেন, কালকেই আমাদের যেতে হবে, বুঝলে! টিকিট-ফিকিট দিয়ে গেছে।”

“কালকেই? কখন ট্রেন?”

“রাত্তিরে।”

তারাপদ বসল। কিকিরাকে দেখতে লাগল।

কিকিরা সুটকেসের মতন একটা বাক্সে নানা রকম জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। পাশে একটা ঝোলা।

তারাপদ বলল, “আপনার সেই দীপনারায়ণ আজ আবার এসেছিলেন?”

না। সকালে আমি গিয়েছিলাম।” কিকিরা বললেন।”একটা জায়গায় যাব, তার আগে কিছু ব্যবস্থা করা দরকার তো! তার ওপর তুমি সঙ্গে যাচ্ছ, চন্দনও যাবে দু-চার দিন পরে–দীপনারায়ণকে বলে আসা দরকার।”

সামান্য চুপ করে থেকে তারাপদ বলল, “উনি নিজে যাবেন না?”

“আজই ফিরে যাবেন!”

কী মনে করে তারাপদ হেসে বলল, “আমরা তা হলে কাল থেকে রাজ-অতিথি?”

কিকিরা মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে বললেন, “কাল এ-বাড়ি ছাড়ার পর থেকে।”

“থাকব কোথায়?”

“রাজবাড়ির গেস্ট হাউসে।”

তারাপদ মনে মনে রাজবাড়ির একটা ছবি কল্পনা করবার চেষ্টা করল। দেখল, হিন্দি সিনেমার রাজবাড়ি ছাড়া তার মাথায় আর কিছু আসছে না। গঙ্গাধরবাবু লেনে বটুকবাবুর মেসের বাসিন্দে বেচারি, রাজবাড়ির কল্পনা তার মাথায় আসবে কেন? নিজের মনেই হেসে ফেলল তারাপদ।

কিকিরা নিজেই বললেন, “আমরা রাজবাড়িতে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকব না, বুঝলে!”

তারাপদ বুঝতে পারল না। নিজেদের পরিচয় ছাড়া আর কী পরিচয় আছে তাদের। অবাক হয়ে কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

সুটকেস গুছোতে-গুছোতে কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ চান না যে, রাজবাড়ির লোক বুঝতে পারে আমরা তাঁর হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছি। আমরা যাব পুরনো বই কেনাবেচার ব্যবসাদার হিসেবে। পুরনো বই, পুরনো ছবি।”

বুঝতে না-পেরে তারাপদ বলল, “সেটা কী?”

“সেটা ভয়ংকর কিছু নয়। এই কলকাতা শহরে আগে এক ধরনের ভাল ব্যবসা ছিল। প্রেস্টিজঅলা ব্যবসা। একশো সওয়াশো দেড়শো বছর আগেকার সব ছবি-সাহেবদের আঁকা–বিলেতে ছাপা হত নানা জায়গায় বিক্রি হত, এ-দেশেও। ছবিগুলো সব এদেশের মানুষকে নিয়ে, এখানকার নদী পাহাড় বন জঙ্গল নিয়ে। ছবিগুলো মোটা দামে বিকোত, রাজারাজড়ারা, ধনী লোকেরা কিনত, বাড়িতে লাইব্রেরি বৈঠকখানা সাজাত। ছবি ছিল, বইও ছিল। সে সব বই আর পাওয়া যায় না, ছাপা হয় না। কোনো ধনী লোক মারা গেল, কিংবা রাজা স্বর্গে গেল, দেখাশোনার লোক নেই, তখন সে সব বই বিক্রি হয়ে যেত। কখনো কখনো নীলামে আজকাল সেব্যবসা নেই। দু-একজন অবশ্য খোঁজে থাকে। তারা কোনোরকমে কেনা-বেচা করে পেট চালায়–এই আর কী।”

তারাপদ বলল, “আমি তো ওসব কিছু জানি না।”

 কিকিরা বললেন, “জানবার দরকার নেই। আমিই কি ছাই জানি। যাদের বাড়িতে যাব, তারাও জানে না। বাপ-ঠাকুরদা ঘর সাজিয়েছিল, তারাও সাজিয়ে রেখেছে। নয়ত হাজার টাকা দামের ছবি একশো টাকায় ছাড়ে, না পাঁচশো টাকার বই পঞ্চাশ টাকায় ছেড়ে দেয়? তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাকবে; যা করতে বলব, করে যাবে। বুঝলে?”

তারাপদ মাথা নাড়ল। বলল, “নামটামও পালটাতে হবে নাকি?”

“না, মোটেই নয়। ফাদার-মাদারের ডোনেট করা নাম পালটাবে কেন?”

কিকিরা এতক্ষণ পরে একটা রসিকতা করলেন। তারাপদ হেসে ফেলল। বলল, “কিকিরা, আমরা তা হলে সত্যি সত্যি গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছি? শার্লক হোমস আর ওয়াটসন?”

কিকিরা বললেন, “বলতে পারো। কিন্তু ওয়াটসনসাহেব, সেখানকার জঙ্গলে তোমার এই ফতুয়া চলবে না। একটা লম্বা গরম কোটটোট–পুরনো হলেই ভাল–জোগাড় করতে পারো না? নয়ত শীতে মরবে।”

তারাপদ বলল, “বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে চেয়ে নেব।”

কিকিরা সুটকেস বন্ধ করলেন। বাইরে গেলেন। সামান্য পরে ফিরে এলেন।

তারাপদ যেন কিছু ভাবছিল বলল, “কাল আমি রাত্তিরে শুয়ে-শুয়ে ভাবছিলাম। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো? রামপ্রসাদবাবুর জন্যেই কি আপনি দীপনারায়ণের এই ব্যাপারটা হাতে নিলেন?”

নিজের চেয়ারে বসে কিকিরা একটা সরু চুরুট ধরাচ্ছিলেন। চুরুট ধরানো হয়ে গেলে বললেন, “খানিকটা তাই।”

“খানিকটা তাই মানে?”

 ফুঁ দেবার মতন করে ধোঁয়া ছেড়ে কিকিরা বললেন, “রামপ্রসাদবাবুর কোনো ভৌতিক ক্ষমতা আছে, মস্তর-ফন্তর জানা আছে তা আমি বিশ্বাস করি না, তারাপদ। তবে আমি পড়েছি এবং দেখেছি এক-একজন মানুষ থাকে যারা সচরাচর না-দেখা জিনিস দেখতে পায়, কিংবা ধরো বুঝতে পারে। রামপ্রসাদবাবু যেটা পারেন সেটা হল, দেখা। যেমন ধরো, একটা ছেলে স্কুলে গেল-বিকেলেও বাড়ি ফিরে এল না, সন্ধেতেও নয়। বাড়ির লোক দুশ্চিন্তায় ভাবনায় ছটফট করছে, ভাবছে কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি না! থানা-পুলিশ হাসপাতাল করে বেড়াচ্ছে। এখন তুমি রামপ্রসাদবাবুকে গিয়ে ধরলে। তিনি যদি রাজি হন, তবে চোখ বন্ধ করে বসে থাকবেন কিছুক্ষণ। তারপর হয়ত চোখ বন্ধ করেই বলবেন–আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তার মানে–সেই ছেলেটি সম্পর্কে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। আবার এমনও হতে পারে, তিনি বললেন : ছেলেটিকে তিনি আর-একটি কালো প্যান্ট-পরা ছেলের সঙ্গে সাইকেল চেপে রাস্তায় ঘুরতে দেখছেন, কোনো পার্কের কাছে গিয়ে দুজনে বসল, তারপর দুই বন্ধু মিলে আবার সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। হঠাৎ কোনো বাস এসে পড়ল রাস্তায়। সাইকেলটাকে ধাক্কা মারল…তারপর–তারপর আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”

তারাপদ শিউরে উঠে বলল, “মানে ছেলেটি বাস চাপা পড়েছে?”

“চাপাই পড়ুক আর ধাক্কা খেয়ে ছিটকেই পড়ক–সেটা অন্য কথা। মরল, না হাসপাতালে গেল, সেটাও আলাদা কথা। ওই যেটুকু তিনি দেখলেন, মাত্র সেইটুকুই বলতে পারলেন।”

অবাক হয়ে তারাপদ কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “উনি যা বলেন তা কি সত্যি হয়?”

“হতে দেখেছি। শুনেছি।”

“এটা কেমন করে হয়?”

“তা বলতে পারব না। জানি না। কেমন করে হয় তা জানার জন্যেই তো কত লোক, পণ্ডিত-টণ্ডিত, দিনের পর দিন মাথা ঘামাচ্ছে। ওই যে তোমাদের প্যারা-সাইকোলজি বলে কথাটা আছে, এ-সব বোধ হয় তার মধ্যে পড়ে।”

 তারাপদর অবাক ভাবটা তখনো ছিল, তবু খুঁতখুঁত গলায় বলল, “কেমন করে এটা হয় তার একটা যুক্তি দেবার চেষ্টাও তো থাকবে।”

সরু চুরুটটা ঠোঁটে চুঁইয়ে আবার নামিয়ে নিলেন কিকিরা। বললেন, “বুঝতে পারলে, ধরতে পারলে তবে না যুক্তি। এখন মোটামুটি একটা ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় সিক্সথ সেন্স।”

“সিক্সথ সেন্স?”

“মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কথা আমরা জানি। এটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, কিংবা বোধ। কেউ কেউ বলছেন, মানুষ যখন পশুর পর্যায়ে ছিল, আদিম ছিল, তখন তার মধ্যে একটা বোধ ছিল যার ফলে সে অজানা আপদ-বিপদ-ক্ষতি বুঝতে পারত। এখনো বহু পশুর মধ্যে সেটা দেখা যায়। মানুষ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যত সভ্য হয়েছে ততই তার আদিমকালের অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় যে, সেই হাজার-হাজার বছর আগেকার মানুষের কোনো দোষ বা গুণ কোটিতে এক আধজনের মধ্যে অস্পষ্টভাবে থেকে গেছে। একে তুমি প্রকৃতির রহস্য বলতে পারো। এ ছাড়া আর কী বলা যায় বলো।”

তারাপদ বরাবরই খানিকটা নরম মনের ছেলে। সহজে কিছু উড়িয়ে দিতে পারে না। বিশ্বাস করুক না করুক অলৌকিক ব্যাপারে বেশ আগ্রহ বোধ করে। কিকিরার কথা তার ভাল লাগল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর তারাপদ বলল, “রামপ্রসাদবাবু কি আপনাকে বলেছেন, দীপনারায়ণের সন্দেহ সত্যি?”

“তিনি সত্যি মিথ্যে কিছু বলেননি। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ বসে থেকেও তিনি কিছু দেখতে পাননি রাজবাড়ির। কাজেই এমনও হতে পারে দীপনারায়ণের সন্দেহ মিথ্যে। বা এমনও হতে পারে সত্যি। রামপ্রসাদবাবুর কাছ থেকে আমরা কোনো রকম সাহায্য এখানে পাচ্ছি না, তারাপদ। কিন্তু আমি ওঁকে শ্রদ্ধাভক্তি করি। উনি যখন দীপনারায়ণের ব্যাপারটা দেখতে বেললেন, আমি না বলতে পারিনি।”

তারাপদ যেন কিছু মনে করে হেসে বলল, “তা হলে ধাঁধার পেছনে ছুটছি?”

“তা বলতে পারো।”

“ওহো, একটা কথা কাল আপনাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি। রাত্রে আমার মনে পড়ল। দীপনারায়ণদের যে ছোরার বাঁটটা আপনি রেখেছেন, সেটার হাজার-হাজার টাকা দাম বললেন। অত দামি জিনিস আপনি নিজের কাছে রাখলেন কেন? দীপনারায়ণই বা কোন বিশ্বাসে আপনার কাছে রেখে। গেল?”

কিকিরা এবার মজার মুখ করে তারাপদকে দেখতে-দেখতে হেসে বললেন, “ওয়াটসনসাহেব, এবার তোমার বুদ্ধি খুলেছে। সত্যি ব্যাপারটা কী, জানো? ছোরার যে বাঁটটা তোমরা দেখেছ, ওটা নফল, ইমিটেশান। আসলটা রাজবাড়িতে রয়েছে। সিন্দুকের মধ্যেই।”

তারাপদ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। খানিক পরে আবার বললেন, “না, তোমার সঙ্গে মজা করলাম। ওটা আসলই। ও জিনিসের কি নকল হয়। উনি আমায় বিশ্বাস না করলে রাজবাড়িতে নিয়ে যাবেন কেন! যাকগে, যাঁর জিনিস তাঁকে ফেরত দিয়ে এসেছি।”