২. তমাল দত্তকে চেনেন না

তমাল দত্তকে চেনেন না, এমন জীবিত কি মৃত কোন বাঙালী আছেন বলে অন্ততঃ আমি জানি না। কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে, হাওড়া হাটের ভীড়ে, হাজরা পার্কের মহতী জনসভায়, মহাজাতি সদনে, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে, টালিগঞ্জের ফিল্ম পাড়ায়, মোহনবাগান টেন্টে, ইডেন গার্ডেনে টেস্ট ম্যাচের ভীড়ে, তারকেশ্বরের মেলায় অথবা নিউ দিল্লী কালীবাড়ী বেঙ্গলী ক্লাবের বার্ষিক উৎসবে, বোম্বে শিবাজী পার্কে বাঙালীদের নববর্ষ উৎসবে বা মাদ্রাজে গৌড়ীয় মঠের কোন অনুষ্ঠানে, যে-কোন নারী-পুরুষকে জিজ্ঞাসা করুন, তমাল দত্তকে চেনেন?

আপনার এই প্রশ্ন করার জন্য ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা প্রথমে অবাক হয়ে আপনার দিকে তাকাবেন। তারপর বলবেন, চিনি না মানে? সে আমাদের ফ্যামিলী ফ্রেণ্ড। অর্থাৎ ভদ্রলোকের বিধবা মা, ভদ্রলোকের স্ত্রী, ভদ্রলোকের বিবাহিতা ও অবিবাহিতা বোন, ভদ্রলোকের ভাই, ছেলেমেয়ে সবার সঙ্গে তমাল দত্তের গভীর ভাব, গভীর ভালবাসা।

পুরী এক্সপ্রেসের থার্ড ক্লাশ কম্পৰ্টমেন্টে, দিল্লী মেলের এয়ার কণ্ডিসনড ফার্স্ট ক্লাশ কুপেতে বা এয়ার ইণ্ডিয়ার বোয়িং ৭০৭-এ বা বি-ও-এ-সি ভি-সি টেন-এ চড়ে পাশের বাঙালী যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন, তমাল দত্তকে চেনেন? আগের মতন ঠিক একই জবাব পাবেন। এমন ঘটনাও ঘটতে পারে যে, পিছনের সারি থেকে মিঃ রবার্টসন বললেন, ইউ আর টকিং অফ টমাল ডাটটা?

–দ্যাটস রাইট।

-হি ইজ এ গুড ফ্রেণ্ড অফ মাইন। একটু ঢোক গিলে মিঃ রবার্টসন একথাও বলতে পারেন ইন ফ্যাক্ট ডাটটা না এলে ইভনিং যেন ইভনিং-ই মনে হয় না।

কোয়ান্টাস ফ্লাইটে করাচী থেকে রোম যাবার পথে যদি কোনদিন মিস পেনসিলভেনিয়ার সঙ্গে দেখা হয় তবে জিজ্ঞাসা করবেন ঐ তমাল দত্তের কথা। দেখবেন, কি রোমান্টিকভাবে উত্তর দেয়।

এতবড় ভারতবর্ষটা একবার নয়, দুবার নয়, তিন-তিনবার ঘুরলাম। চমৎকার দেশ কিন্তু ইণ্ডিয়া উইদাউট ডাটটা ইজ হেল ফর মি।

লুফৎহান্সা ফ্লাইটে চড়ে জার্মানী বা ইউরোপ ঘুরতে-ঘুরতে মিস রোডকে পাশে পেলে আলাপ করবেন। আলাপটা একটু ঘন হলে জিজ্ঞাসা করবেন চেনেন নাকি আমাদের মিঃ ডাটটাকে? আপনাদের এদিকে তো বছরের অর্ধেক সময়ই থাকেন……

আমি বাজী রেখে বলতে পারি মিস রোড বলবেন, মাই গড! তুমি মার কাছে মাসীর গল্প করছ! মাইনে জের লিভে হের টামাল।

আমাদের পাড়ার সরলা পিসিমা বলেন, ও হতচ্ছাড়াকে তো শিবরাত্তিরের দিন পশুপতিনাথে, প্রয়াগের কুম্ভমেলায় আর যে-কোন মানুষ মরলে শ্মশানঘাটেও পাওয়া যায়।

এক কথায় বাঙালীর একটি পরম গর্বের বস্তু হচ্ছে তমাল দত্ত। বাংলা দেশের দ্বারদেশে তমাল দত্তকে শশা-রুমে সাজিয়ে রাখলেও নিশ্চয়ই কেউ আপত্তি করবেন না।

আমার পোড়া কপাল বাংলাদেশে জন্মে, দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েও একটি বারের জন্য প্রভুর দর্শন পাইনি। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে দু-একবার কানের পাশ দিয়ে বন্দুকের গুলি চলে যাবার মতো একটুকুর জন্য তমাল দত্তের সঙ্গে দেখা হয়নি। এইত সেবার বার্লিনে গিয়ে পৌঁছলাম বিকেলের দিকে। সন্ধ্যায় কেম্পিনিস্কি হোটেলের বারে বসে দু-চারজন পরিচিত-অপরিচিতের সঙ্গে আড্ডা দেবার সময় শুনলাম, লাঞ্চের পর প্যান এ্যামেরিকান ফ্লাইটে ফ্রাঙ্কফার্ট হয়ে নিউইয়র্ক চলে গেছেন। মিসফরচুন নেভার কামস অ্যালোন। লণ্ডনেও ঠিক এমনি এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার। হতাশায় বেদনায় বহুসময় দীর্ঘনিশ্বাস পড়ত এবং প্রায় অন্যমনস্কভাবে হাই তুলে তুড়ি দিতে দিতে বলতাম, সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।

একদিন ছিল যখন আমি এমনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতাম। আজ আর আমার সে-দুঃখ নেই। উপরওয়ালা আমার মনের কান্না নিশ্চয়ই শুনেছিলেন তা নয়তো অমনভাবে তমাল দত্তের সঙ্গে জেনেভা এয়ার পোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জে দেখা হয়!

……এক বন্ধু দর্শনের জন্য মস্কো থেকে সোজাসুজি লণ্ডন না গিয়ে জেনেভা হয়ে যাবার ঠিক করেছিলাম। হাতে ঘণ্টা পাঁচেক সময় ছিল। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আধঘণ্টা–পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগেই আবার এয়ারপোর্টে ফিরে এলাম। ব্রিটিশ ইউরোপীয়ান এয়ারওয়েজের কাউন্টারে টিকিট দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে যখন ট্রানজিট লাউঞ্জে ঢুকলাম তখনও বেশ সময় আছে। এতোটা আগে না এলেই হতো কিন্তু ট্রানজিট লাউঞ্জে বসে নানা দেশের বিভিন্নমুখী যাত্রীদের আমার বেশ লাগে বলেই হাতে একটু সময় নিয়ে এসেছিলাম। পাঁচ-দশ মিনিট স্যুভেনির সপে দাঁড়িয়ে সুইস হস্তশিল্পের নিদর্শন দেখার পর এক কোণায় এক কাপ কফি নিয়ে বসে বসে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিচ্ছিলাম চারদিকে। দুএকজন ভারতীয় নারী-পুরুষকেও দেখেছিলাম কিন্তু সেখানে দৃষ্টিটাকে আটকে রাখার আকর্ষণ বা প্রয়োজন বোধ করিনি। কফির পেয়ালা শেষ করে একটা সিগারেটের আধাআধি শেষ করতে না করতেই কানে ভেসে এলো…প্যাসেঞ্জার্স ট্রাভেলিং টু লণ্ডন বাই বি-ই-এ ফ্লাইট ফোর জিরো ওয়ান আর রিকোয়েস্টেড টু প্ৰসিড টু গেট নাম্বার সিক্স। পৃথিবীর নানান দেশের একদল যাত্রী ছনম্বর গেটের কাছে জমায়েত হলেন। গ্রাউণ্ড হোস্টেস প্রতিটি যাত্রীর কাছ থেকে বোর্ডিং কার্ড ফেরৎ নিয়ে প্যাসেঞ্জার লিস্টে একটা চিহ্ন দিয়ে দিলেন। গেটের বাইরে বাসের সামনে যখন অপেক্ষা করছিলাম, গ্রাউণ্ড হোস্টেস আমাদের অপেক্ষা করতে বলে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মিনিট খানেক বাদেই মাইক্রোফোনে শুনতে পেলাম… লণ্ডন-বাউণ্ড প্যাসেঞ্জার মিঃ টামাল ডাটটা! আপনি তাড়াতাড়ি ছনম্বর গেটে আসুন। তিনবার এই একই ঘোষণা মাইক্রোফোনে প্রচার করা হয়েছিল কিন্তু তমাল দত্ত আমার সঙ্গে একই প্লেনে লণ্ডন যাবেন শুনে উত্তেজনায় আমি প্রথমবারের ঘোষণা ছাড়া, পরের দুটি ঘোষণা শুনতে পাইনি। আগ্রহে উত্তেজনায় আমি ট্রানজিট লাউঞ্জের দিকে চেয়ে রইলাম। দুএক মিনিট পরই একজন সুদর্শনা পশ্চিমী এসে যে কৃষ্ণকায় ভদ্রলোকটিকে ছনম্বর গেটের সামনে বিদায় জানিয়ে গেলেন তিনিই যে আমাদের পরম গৌরব তমাল দত্ত, সে বিষয়ে আমার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না। প্লেনে চড়বার সময় অনেক সহযাত্রীর সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে আমি শেষ পর্যন্ত মিঃ দত্তর পাশে আসন নিলাম। ভেবেছিলাম আমিই আগে আলাপ করব কিন্তু তা আর হলো না। হাতের ব্রীফ কেসটা সীটের নিচে রেখে কোমরে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে মিঃ দত্ত বললেন, মনে হচ্ছে আপনি ইণ্ডিয়ান..।

শুধু ইণ্ডিয়ান নই, বাঙালীও।

মিঃ দত্ত বললেন, জানেন মশাই গড ইজ ভেরী কাইণ্ড টু মী। যখন যেখানে যেটি চেয়েছি একবার ছাড়া ভগবান আমাকে কোনদিন ব্যর্থ করেননি। কদিন জেনেভায় বেশ হৈ চৈ করে কাটাবার পর কেমন করে একলা-একলা চুপচাপ একটা ঘণ্টা প্লেনে কাটাব তাই ভাবছিলাম। উপরওয়ালা ঠিক জুটিয়ে দিলেন আপনাকে।

মনে-মনে আমিও উপরওয়ালাকে স্মরণ করছিলাম, তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম এমন একটি পরম-পুরুষ মহাপুরুষের সঙ্গে আমার পরিচিত হবার আশ্চর্য সুযোগ দেবার জন্য।

প্লেন কিছুক্ষণের মধ্যে তীরবেগে উপরে উঠে গেল। কোমর থেকে বেল্ট খুলে দুজনে সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে প্রথম সুখটান মেনে মিঃ দত্ত প্রশ্ন করলেন, বিয়ে করেছেন স্যার?

না।

করবেন নাকি?

করব না বলে তো ভাবিনি এখনও।

এই মেরেছে। আপনার মতলব তো সুবিধে মনে হচ্ছে না। আমার কানের কাছে মুখটা এনে মিঃ দত্ত ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রেমে পড়েছেন নাকি?

আমি একটু হেসে উত্তর দিলাম, ইচ্ছা তো করে কিন্তু পেলাম কোথায়?

এয়ার হোস্টেস কফি দিয়ে গেল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মিঃ দত্ত বললেন, মেয়েদের ব্যাপারে আমার চাইতে অভিজ্ঞ লোক বাংলাদেশে অন্তত নেই। তাই বলছিলাম স্যার, ওসব ঝামেলায় আর জড়াবেন না!

আমি প্রশ্ন করলাম, কেন বলুন তো?

কেন আবার? প্রেম করলে বিয়ে হবে না, বিয়ে করলে প্রেম হবে না বলে।

আমি কোন কথা বললাম না, শুধু একটু মুচকি হেসে জানালা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশের দিকে তাকালাম।

মিঃ দত্ত বললেন, হাসালেন স্যার! এটা আমার কথা নয়; ফ্রাঙ্কলিন বলে গেছেন–Where theres marriage without love, there will be love without marriage.

মিঃ দত্তের কথায়-বার্তায় আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। ইংলিশ চ্যানেল পার হবার আগেই আমাদের পরিচয় গভীর হয়েছিল ওর হৃদয়-মাধুর্যে। লণ্ডনে গিয়ে আলাদা হোটেলে থাকবার অনুমতি দিলেন না আমাকে। প্রথমে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম কিন্তু মিঃ দত্ত কোন ওজর আপত্তি শুনলেন না। বললেন, স্যার জানেনই তো লাইফ ইজ বাট এ্যান ওয়ার্কিং স্যাডো। সুতরাং যে কদিন আছি একটু আনন্দ করতে দিন না! বাধা দিচ্ছেন কেন?

মিঃ দত্তের আতিথ্যে অল্ডউইচের ধারে হোটেল ওয়ালডর্ফেই উঠলাম। দুটি সপ্তাহ শুধু একসঙ্গেই ছিলাম না, তমাল দত্তের মনের গ্রন্থির সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম। পার্বত্য নদীর মত উচ্ছল আনন্দময় যে তমাল দত্তকে দুনিয়ার সবাই জানেন, চেনেন, ভালবাসেন, সে তমাল দত্তকে আমি ঠিক দেখতে পাইনি। তমাল দত্তের চোখে জল দেখিনি কিন্তু মনের কান্না শুনতে পেয়েছিলাম। হাসি-খুশী ভরা তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে হয়তো অনেকে ডুব দেবার প্রয়োজন বা তাগিদ বোধ করেননি। কিন্তু তমাল দত্তের অতি উচ্ছলতা দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল তার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা বিরাট ক্ষত আছে; আর সেই ক্ষতটাকে ঢেকে রাখবার জন্যই তার সমস্ত উচ্ছলতা।

দুচার দিন ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার পরই আমি বেশ বুঝতে পারলাম কোন্ সুদূর অতীতে উনি কোথায় যেন একটা হোঁচট খেয়েছিলেন এবং সেদিনের সে-দুঃখ সে-আঘাতকে ভোলবার জন্য আজ গেলাস-গেলাস হুইস্কী খান, অসংখ্য মানুষের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হো হো করে হেসে ওঠেন।

সুযোগ আসতে খুব বেশী দেরী হলো না। আমি জানতাম উইক এণ্ডে মিঃ দত্তের অনেকগুলো ইনভিটেশন ছিল কিন্তু তবুও শুক্রবার রাত্তিরে হোটেলে ফিরে ওকে এক বোতল হোয়াইট হর্স নিয়ে বসে থাকতে দেখে আমি একটু অবাক না হয়ে পারলাম না। ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে করতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার দত্তসাহেব? শুক্রবারের বারবেলায় সখীদের কাঁদিয়ে একলা-একলা একি করছেন!

জানেন স্যার, পেশাদার অভিনেতারাও অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। একটা সময় আসে যখন তারাও অভিনয় ছেড়ে ঘর-সংসারী হন। কিন্তু আমার জীবনে সে সুযোগটাও তো আসবে না, তাইত মাঝে-মাঝে একটু একলা থাকি।

সামনের বোতলটা হাতে নিয়ে বললেন, একলা একলা এই হোয়াহট হর্সে চেপে ঘুরে বেড়াই। আর কি করব বলুন?

কথাটার ঠিক মর্ম বুঝলাম না। মিঃ দত্তের মুখোমুখি হয়ে সেন্টার টেবিলের ওপাশে বসে বললাম, কেমন যেন রোমান্টিক হয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।

গেলাসে আরো খানিকটা হুইস্কী ঢালতে-ঢালতে জিজ্ঞাসা করলেন, গগন হরকরার নাম শুনেছেন?

লণ্ডনের ওয়ালডর্ফ হোটেলের রুম নম্বর থি-ফাইভ-ফোরে বসে হঠাৎ গগন হরকরাকে মনে করা সহজ হয়নি। মিঃ দত্ত খালি গেলাসে একটু হুইস্কী ঢেলে বললেন, একটু তাজা হয়ে নিন। সত্যি একচুমুক হুইস্কী-সোডা খেয়ে মনে পড়ল গগন হরকরার কথা। বললাম, আপনি সেই গগন হরকরার কথা বলছেন যে লিখেছে আমি কোথায় পাব তারে?

ঠিক ধরেছেন স্যার।

একটু থেমে এক ঢোক হুইস্কী খেলেন, একটা টান দিলেন হাতের সিগারেটে।…জানেন স্যার আজ রোমান্টিক বলে ঠাট্টা করতে পারেন কিন্তু একদিন সত্যিই আমি রোমান্টিক ছিলাম। আজও সেই রোমান্সের আগুনে তিলে তিলে পুড়ে মরছি। গগন হরকরার ভাষায় কি বলতে ইচ্ছে করে জানেন?

কি?

বলতে ইচ্ছে করে—

আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই কেমন
        করে। মরি হায় হায় রে।
        ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
        ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।

সেই উইক-এণ্ডের শুক্রবার রাত্তিরে তমাল দত্তের অতীত জীবনের এক অজ্ঞাত অধ্যায়ের ইতিহাস মিঃ দত্ত নিজেই আমাকে শুনিয়ে ছিলেন।

…আমাদের বালী গ্রামের গোঁসাইপাড়ায় হারাধন বাঁড়ুজ্যের বাড়ীতেই এক কালে আমার সারাদিন কেটেছে। স্কুল-কলেজ পালিয়েও বাঁড়ুজ্যে বাড়ীর আড্ডাখানায় বা বাঁড়ুজ্যে মাসিমার রান্না ঘরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়েছি। গঙ্গায় নতুন ইলিশ উঠলে মাকে বলতাম না, বলতাম বাঁড়ুজ্যে মাসিমাকে–মাসিমা, কাল নতুন ইলিশ দিয়ে ভাত খাব। মাসিমা বলতেন, খাবি কিরে? আজই তোর জন্যে ইলিশ আনিয়েছি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার দুমাস আগে টাইফয়েড হলে মা ছাড়া আর যাঁরা রাত জেগেছেন, মানত করেছেন সে হচ্ছে বাঁড়ুজ্যে মাসিমা আর সুলতা। মা তো মাঝে-মাঝেই অভিমান করে মাসিমাকে বলতেন, ছেলেটাকে আমি পেটে ধরেছি কিন্তু ছেলেটা তোরই।

যাই হোক, বয়স একটু বাড়লে হঠাৎ খেয়াল হলো সুলতাকে ভালবেসেছি। একদিন মেসোমশাই দোকানে যাবার পর মাসিমা চলে গেলেন কল্যাণেশ্বরতলায় পূজা দিতে। সুলতাকে ডেকে বললাম, লতা শুনে যা। সুলতা কাছে এসে বললাম, তোর হাতটা দেতো। লতা হাত বাড়িয়ে দিলে নিজের হাতের মধ্যে ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম, লতা, একটা কথা বলব?

বল না খোকনদা।

তুই রাগ করবি না?

তুমি পাগল হয়েছ! তোমার কথায় রাগ করব?

অনেক দিনের অনেক দ্বিধা-সঙ্কোচ কাটিয়ে যুবক দত্তসাহেব সেদিন সতাকে বলেছিলেন, লতা, তুই আমাকে বিয়ে করবি?

দত্তসাহেব লক্ষ্য করেনি এক মুহূর্তে লতার মুখের চেহারাটায় আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন হয়েছিল; দত্তসাহেব সেদিন খেয়াল করেননি, লতা ঠোঁট কামড়ে অবাক হয়ে তার খোকনদার দিকে চেয়েছিল। নিরুত্তর লতাকে আর একবার হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে উত্তর দিচ্ছিস না যে?

লতা সেদিন শুধু হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল। দত্তসাহেব ভেবে ছিলেন লজ্জায় লতা উত্তর দিতে পারেনি, পরে দেবে। দিনকতক পরে আর একবার লতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে লতা, সেদিন যা জিজ্ঞেস করলাম, তার তো কোন জবাব দিলি না।

কি উত্তর দেব খোকনদা?

আর একটু চাপ দেবার পর লতা বলেছিল, তা হয় না খোকনদা!

ছাত্রজীবনে খুব ভাল ছেলে না হলেও ফেল করার মতো ছাত্র ছিলেন না দত্তসাহেব কিন্তু তবুও তিনি বিএ পরীক্ষায় ফেল করলেন। পরীক্ষায় ফেল করার অজুহাতে দত্তসাহেব বাঁড়ুজ্যে বাড়ী যাওয়া বন্ধ করলেন। ছোটবেলা থেকে অনায়াসে যে খোকনদাকে লতা পেয়ে এসেছে, তাঁর মূল্য সে আগে উপলব্ধি করতে পারেনি।

যখন উপলব্ধি করল, কি যেন সে হারিয়েছে, কোথায় যেন তার ছন্দ-পতন ঘটেছে, প্রতিদিনের জীবনযাত্রার কোথায় যেন কিসের অভাব হচ্ছে, তখন বড় দেরী হয়ে গেছে। আশীর্বাদ হবার দিন একবার নয়, বারবার মনে হয়েছিল খোকনদার কাছে ছুটে পালায়, কিন্তু দ্বিধা, সঙ্কোচ, ভয়, সংস্কার লতাকে টেনে রেখেছিল। শ্রীরামপুরের অনাথ চক্রবর্তীর গলায় মালা পরাবার আগে একবার বিদ্রোহ করবার ইচ্ছা হয়েছিল তার, কিন্তু পারেনি।

ছোটবেলা থেকে মনের দোসর হওয়া সত্ত্বেও সেদিনের অনভিজ্ঞ যুবক খোকনদা তাঁর লতার মনের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা জানতে পারেনি। তাইতো সে লতার অবজ্ঞাকে সহ্য করতে পারেনি, বালীগ্রাম ত্যাগ করে পৃথিবীর জনারণ্যে সে নিজেকে মিশিয়ে দেবার জন্যে বেরিয়ে পড়েছিল।

সেদিনের বালীগ্রামের প্রায় অজ্ঞাত অপরিচিত ব্যর্থ প্রেমিক যুবক তমাল দত্ত প্রতিশোধের আগুন বুকে নিয়ে আগামী দিনের দিকে এগিয়ে যাবার পথে প্রতি পদক্ষেপে সার্থক হয়েছে। এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ফার্ম খুলেছেন, হয়ত কোটি টাকাই রোজগার করেছেন। একদিন একটি নারীর কাছে অবজ্ঞা পেলেও পরবর্তীকালে ব্যবসা বাণিজ্য অর্থ-প্রতিপত্তির সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে অনেক, অনেক নারী এসেছে তাঁর জীবনে। অদৃষ্টের চাকা আরো অনেকখানি ঘুরেছিল।

তাইতো একদিন লতাও এসে হাজির হয়েছিল রাসেল স্ট্রীটে তমাল দত্তের অফিসে। কাজের ভীড়ে, ফাইল পত্তরের চাপে ভিজিটার্স দেখার যখন সময় হলো তখন প্রায় পৌণে-পাঁচটা বাজে। লতাকে চেম্বারে ঢুকতে দেখে মিঃ দত্ত চমকে গিয়েছিলেন। প্রথম দু-চার মিনিট দুজনের কেউই কথা বলতে পারেনি। নির্বাক দুটি মানুষ সেদিন অস্তগামী সূর্যের করুণ রশ্মির মুখোমুখি হয়ে বহু দূরে ফেলে আসা অতীত স্মৃতির মধ্যে ডুব দিয়েছিল। লতা চোখের জলের বন্যা বইয়েছিল, নিজের মনের অন্তর্দ্বন্দ্বের গোপন ইতিহাসের খুঁটিনাটিও বলেছিল তার খোকনদাকে। আর শুনিয়েছিল তার ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের করুণ ইতিহাস।

মিঃ দত্ত চোখের জল ফেলেনি, কিন্তু পাতা দুটো ভিজে উঠেছিল। বেশী কথা বলতে পারেনি। তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে শুধু বলেছিলেন, লতা, ভুলে যেও না একদিন তোমাকে ভালবাসতাম হয়তো আজও ভালবাসি। তোমার চোখের জল দেখলে আজও আমার পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব নয়। হয়তো তোমারই কথা ভেবে নিজের জীবনে আর কোন মেয়েকে ঠাঁই দিতে পারলাম না। একটা মোটা ভারী দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, যাক সেসব কথা। তুমি যে তোমার খোকনদাকে ভোলনি, সেজন্য ধন্যবাদ, আর ভবিষ্যতে যদি মনে কর তবে মনে করব অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও কিছুটা সার্থকতা পেলাম।

ওয়ালডর্ফ হোটেলে বসে বসে বহু আলোচিত এই মানুষটির জীবনকাহিনী শুনতে-শুনতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আর একটা নতুন বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে মিঃ দত্ত জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা স্যার, এত মদ খাই, এত মেয়েকে নিয়ে খেলা করি কিন্তু তবুও কেন লতাকে ভুলতে পারি না বলতে পারেন? বলতে পারেন অনেক স্মৃতির তলা থেকে ঐ স্মৃতিটাই বারবার কেন উঁকি দেয়?

প্রেম শাস্ত্রে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সীমিত। তাছাড়া তমাল দত্তের জীবনকাহিনী শুনে নিজের মনের মধ্যেও যেন একটা নাড়া খেয়েছিলাম। শুধু বললাম, কেউটে সাপের বিষের জ্বালা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারে, কিন্তু এ বিষের জ্বালা তো কোনদিন যায় না।

দুদিন পরে মিঃ দত্ত নিউইয়র্ক রওনা হলেন। আমিও ঐদিনই দিল্লীর পথে রোম রওনা হলাম। আমার প্লেন দেরীতে ছাড়লেও দত্তসাহেবকে বিদায় জানাবার জন্য একই সঙ্গে এয়ারপোর্ট এলাম। দুজনেই লগেজ চেক আপ করে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ট্রানজিট লাউঞ্জে ঢুকলাম। দুবোতল বিয়ার নিয়ে দুজনে এক কোণায় বসলাম। মিঃ দত্ত একটু হাসলেন, তলিয়ে গেলেন অতীত স্মৃতির ভীড়ে। আর এক সিপ বিয়ার খেয়ে বললেন, জানেন স্যার, এই ট্রানজিট লাউঞ্জ আমার বড় ভাল লাগে। কত বিচিত্র দেশের বিচিত্ৰতর মানুষ এখানে কিছু সময়ের জন্য আসছেন। কেউ এক পেগ হুইস্কি, কেউ এক গেলাস বিয়ার, কেউ বা এক কাপ চা বা কফি নিয়ে বসে থাকেন। কেউ হাসছেন, কেউ ভাবছেন, কেউ বা হয়তো আমারই মতো কোন জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে মরছেন। কেউ হয়তো বিয়ে করতে যাবার আনন্দে প্লেন ধরার জন্য এখানে অপেক্ষা করেন, আবার কেউ হয়ত প্রিয়তম মানুষের ফিউনারেলে যোগ দেবার জন্য প্লেনের পথ চেয়ে বসে থাকেন।

মিঃ দত্ত চোখ দুটোকে সরিয়ে নিলেন, দৃষ্টিটা লম্বা রাণওয়ে ছাড়িয়ে আরো অনেক অনেক দূরে নিয়ে গেলেন। তারপর একটু নরম গলায় ভেজা ভেজা স্বরে বললেন, এই দুনিয়াটাও তো একটা বড় ধরনের ট্রানজিট লাউঞ্জ। কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে; কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে। কারুর প্লেন পনেরো মিনিট পরে, আবার কারুর প্লেন দুচার ঘণ্টা পরে। তবে যাবে সবাই, থাকবে না কেউ। তাইতো ভাবি, আমিও একদিন চলে যাব, চলে যাবে লতা। হয়তো আমার প্লেন আগে, লতার প্লেন পরে। কিন্তু সব যাত্রীকেই তো একদিন একটা জায়গায় মিলতে হবে…..

মাইক্রোফোনে হঠাৎ ঘোষণা শোনা গেল, প্যাসেঞ্জার্স ট্রাভেলিং টু নিউইয়র্ক বাই এয়ার ইণ্ডিয়া ফ্লাইট ওয়ান জিরো থি, আর রিকোয়েস্টেড টু প্ৰসিড টু…

মিঃ দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। আমার হাতে হাত দিয়ে বললেন, চলি স্যার! হয়ত আবার কোনদিন এমনি ট্রানজিট লাউঞ্জে দেখা হবে। গুড বাই।

আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। যখন হুঁস হলো তখন দেখি এয়ার ইণ্ডিয়া বোয়িং আকাশে উড়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *