২. তখনও ভোর হতে দেরী আছে

দুই

তখনও ভোর হতে দেরী আছে, কলকাতা সহরের কুয়াশা-ভেজা পথে জল দেওয়া হচ্ছে। বালিগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর প্যাসেঞ্জার-ট্রেণখানা ছাড়ে-ছাড়ে, এমন সময় দুজন কিশোর ছুটে এসে ট্রেণের একটা ফাঁকা কামরায় উঠে বসলো। ট্রেণ তখন চলতে সুরু করেছে।

দুজনের চমৎকার স্বাস্থ্য। মুখ-চোখ দেখলে সাধারণ নিরীহ, শান্ত, গো-বেচারী গোছের ছেলে মন হয় না। বেশ উৎসাহী, নির্ভীক বেপরোয়া মনের। কোনো বাধা-নিষেধ মানে না। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে কোথায় চলেছে যেন দুজনে। মরু-বিজয়ে–না, মাউণ্ট-এভারেষ্ট অভিযানে!

পরণে হাফ-প্যাণ্ট, হাফ-সার্ট; পিঠে খাকী ব্যাগ, তাতে জিনিষপত্র আছে। দুজনের নামও অদ্ভুত। একজনের ডাক-নাম বুলেট, আর একজনের নাম বজ্র।

কুয়াশার মধ্য দিয়ে ট্রেণ মৃদু-মন্দ গতিতে বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর পার হয়ে সহরের সীমানা ত্যাগ করে ক্রমে পল্লীর শ্যামল বুকে প্রবেশ করলো।

লাইনের এক দিকে গাছপালায় ঢাকা দু-একটা গ্রাম। অন্য দিকে সীমাহীন জলা—কুয়াশা-ঘেরা সকালে দেখাচ্ছে সমুদ্রের মত।

গড়িয়ার জলার উপর জমাট কুয়াশা ভেদ করে সূৰ্য্য উঠছে। সঙ্গে-সঙ্গে হু-হু করে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে আরম্ভ হলো।

ট্রেণের কামরায় এরা দুজন ছাড়া আর কোনো প্যাসেঞ্জার নেই। তবু এরা অতি-সন্তর্পণে চাপা-গলায় কথা কইছে।

বুলেট বললে–তোমার ছোরাখানায় ধার আছে তো বজ্র?

দৃঢ়কণ্ঠে বজ্র উত্তর দিলে–নিশ্চয়! কাল রীতিমত এগজামিন করে দেখেছি। ধার ঝক্‌ঝক্ করছে।

বুলেট বললে–আমি একটা ভয়ানক জিনিষ সঙ্গে নিয়েছি।

বজ্র জিজ্ঞাসা করলে–কি? কোনো অস্ত্র? গুলি? না, রিভলভার?

বুলেট ব্যাগ থেকে একটা শিশি বার করে দেখালো।

শিশিটা তেমন বড় নয়, নীল রংয়ের; ছিপি গালা দিয়ে খুব মোম-আঁটা! শিশির নীল আবরণ ভেদ করে দেখা যাচ্ছে, শিশির মধ্যে তরল পদার্থ।

বজ্র বললে–কি রে?

হেসে বুলেট বললে–সাক্ষাৎ যম…মারণ-অস্ত্র!

ট্রেণ গড়িয়া ষ্টেশনে পৌঁছুলো। গাড়ী থামতে বুলেট তাড়াতাড়ি শিশিটা ব্যাগের মধ্যে রাখলো।

ছোট স্টেশন গড়িয়া। প্ল্যাটফর্মে ভিড় খুব কম। যে-সব যাত্রী অপেক্ষা করছিল, তারা এ ডাউন গাড়ীতে উঠলো না, তারা যাবে আপে অর্থাৎ কাতার দিকে। গাড়ী এখানে বেশীক্ষণ থামে না। এক মিনিট পরে আবার গাড়ী চলতে আরম্ভ করলো।

গাড়ীর জানলা দিয়ে বুলেট মুক্ত প্রান্তরে সূর্যের উদয় দেখছে। রাঙা আভায় দিদিগন্ত কি সুন্দর না দেখাচ্ছে, যেন রঙের রাজ্য।

বজ্র হঠাৎ প্রশ্ন করলে–যেখানে চলেছি, সেখানকার সম্বন্ধে যা-যা জানতে বাকি ছিল, সে-সব জেনে নিয়েছ তো?

বুলেট বললে–যতদূর পেরেছি, জেনেছি। আর এই ম্যাপখানা কাল জোগাড় করেছি। ও-অঞ্চলের জানবার যা কিছু দরকার হবে, এতেই তা পাবে। কাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করতে হবে না। চমৎকার ম্যাপ।

বজ্ৰ উৎফুল্ল হলো, বললে–জানি। তোমার ব্যবস্থা সব সময় নিখুঁত, কোন দিন ভুলচুক থাকে না।

খাকি ব্যাগ থেকে বুলেট ম্যাপখানা বার করে বজ্রর হাতে দিলে। ম্যাপটা দেখতে দেখতে বজ্র জিজ্ঞাসা করলে–-ট্রেণে আমাদের কত থাকতে হবে?

একটু ভেবে বুলেট উত্তর দিলে–বড় জোর আর দু’ঘণ্টা।

বজ্র বললে–মোটে দুঘণ্টা! তাহলে লক্ষ্মীকান্তপুর কাছেই। আচ্ছা, ট্রেণে তো দু’ঘণ্টা। তারপর?

বুলেট বললে–তারপর শ্রীচরণ ভরসা, অর্থাৎ পায়ে হেঁটে আঠারো কি কুড়ি মাইল পথ। গাড়ী নেই। পায়ে হেঁটে পার হতে হবে পেল্লায় পেল্লায় মাঠ। এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না…তেপান্তরের মাঠ বললে– চলে! এ হাঁটা-পথের পর জল-পথ…মানে, ভীষণ নদী! সে নদীতে ভয়ানক কুমীর!

বজ্র বললে–নদী পার হতে নৌকো পাওয়া যাবে তো? না, সাঁতরাতে হবে?

বুলেট বললে–নৌকো পেতেই হবে, না হলে উপায় নেই। এ তোমার কাতার গঙ্গা নয়। সাঁতার কেটে পার হবে কি… কুমীরের পেটে গিয়ে পৌঁছুতে হবে তাহলে।

বজ্র বললে–ভারী চমৎকার জায়গায় যাচ্ছি তো আমরা! জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ।

হেসে বুলেট বললে–শুধু তাই নয়, সুন্দরবনের এসব অঞ্চলে চোর-ডাকাত ফোর-আসামী যে কত, সংখ্যা নেই। তাদের সঙ্গে আমাদের মুলাকাৎ হতে পারে।

বজ্র বললে–শুধু কুমীর, বাঘ, চোর, ডাকাত, খুনে, ফেরার আসামী। আর কিছু নেই?

বুলেট বললে–এ না হলে আর এ্যাডভেঞ্চার কি?

দু’জনে হাসতে লাগলো… প্রাণ-খোলা নির্ভীক হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *