দুই
ঢ্যাঙা ময়লা দোহারা গোলমুখো রাঘব । বেহেড রাম টেনে পেশী গলছে, রক্তে চিনি অবশ্যম্ভাবী, হিসিতে পিঁপড়ে লাগতে শুরু । টুকলি-স্নাতক বলে ওর ছুটির দরখাস্ত, ফিনাইল সাবান ঝ্যাটা ডাসটার সোয়াইপার ন্যাপথালিন, মানে অফিসকে ঝকঝকে রাখার জন্য যাকিছু দরকার, তার আর্জি, যা আগে অতনু লিখে দিত, এখন রমা লেখে । পদাতিক জওয়ানের ওপর যুদ্ধ লড়ার ভার দিয়ে তাঁবুতে আয়েশ করেন ব্রিগেডিয়ার ।
অতনু : টাকা গোনার কেরানিগিরির চেয়ে ঢের ভালো কাজ এই মেথর-ঝাড়ুদার খ্যাদানো ।
ন্যাতানো হিলহিলে সাতবাস্টে পোকালাগা ঝিমিয়ে-পড়া তেলচিটে নোংরা নোটের পাহাড়-ঘেরা উত্যকায় বসে একনাগাড়ে বিচলিত হবার চেয়ে, ও-কাজ অনেক আরামের । নোটের মাঝখানে বসলেই টেনশান । রক্তে গিরগিটি সাঁতরায় । তলপেটে পাঁকাল মাছ কিলবিল করে । প্রথম দিকে তো ঘুমই হতো না ।
রাঘব : শুধু ঝাড়ুদার খ্যাদাই কে বললে আপনাকে ? বেসমেন্টে ফুটবল মাঠের মাপে যে ভল্টটা আছে, দেখেছেন ? চারপাশে আয়না-লাগানো এনটার দ্য ড্র্যাগন করিডরে রাইফেলধারী প্যারামিলিটারি চব্বিশ ঘণ্টা ? আমাকেই খেয়াল রাখতে হয় । সিকিউরিটির অ্যালার্ম বেলের পাগলা ঘণ্টির মহড়ার সময় দেখেছেন ? সবচেয়ে বেশি ছোটাছুটি করতে হয় এই রাঘব বোয়ালকে ।
আগ্রহ নেই বলে দেখেনি অতনু । কী আর এমন আছে দেখার ! কর্মচারীরা ইচ্ছে করলে নিজেদের জরুরি কাগজপত্র দলিল-দস্তাবেজ গয়নাগাটির বাকসো সিল মেরে রাখতে পারে ওখানে, বিনে খরচে । অন্য কোথাও লকার নিতে হবে না । ইনকাম ট্যাক্স সেলস ট্যাক্স সিবিআইরা অতর্কিত হানায়, যা আজকাল আখছার বলে অ্যাকাউন্টস অফিসার বিরক্ত, যে সোনাদানা হিরেমুক্ত পাউণ্ড ডলার ইউরো থাক-থাক নোট পায়, পেল্লাই কালো-কালো তোবড়ানো ট্রাঙ্কে ভরে, ফেলে রেখে যায়, হাভাতে প্যাংলা জনাচারেক দিনমজুরের কাঁধে চাপিয়ে । সহজে ফয়সালা হয় না সেসব কেসের, পড়ে থাকে বছরের পর বছর । কালো প্যাঁটরার ওপর জমতে থাকে কালো প্যাঁটরার পাহাড় । অ্যাকাউন্টস অফিসার চেঁচায়, ‘বাঞ্চোতগুনো সুইস ব্যাঙ্কে রাখলেই পারতো, নিজের বাড়িতে কেন যে লুকিয়ে রাখে ।’
ব্যাপারটা দেখার অনুসন্ধিৎসায় সুশান্ত একটা ফাঁকা চুরুট বাকসো, ওর জ্যাঠার, চটে মুড়ে সিল করে রেখে এসেছে । ননীগোপাল বসু সেদিন ভল্টের বিঘত লম্বা চাবির গোছা ঝুলিয়ে, নাকে রুমাল বেঁধে, পচা টাকার গোটা পঞ্চাশ বস্তা পোড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে বের করছিলেন, সুশান্তকে বললেন, ‘বাঃ, এই বয়সেই গুছিয়ে নিয়েছ বেশ ।’
পাটনা শহরে যেবার বন্যার কোমর-উঁচু জল ঢুকেছিল, বেসমেন্টের নতুন-পুরোনো সব নোট গলে হালুয়া হয়ে গিয়েছিল তিন দিনে । চরম ক্ষতি হয় রাম ইকবাল সিং হিন্দি অনুবাদকের । নেপাল থেকে দু’কিলো ভালো জাতের আফগানি চরস এনে রেখেছিল, ঠাকুরের গয়না বলে ।
ননীগোপালবাবুর কাজটা উচ্চপদ্সহ মুদ্দোফরাসের । দিনের পর দিন নাকে রুমাল, টাকে তোয়ালে, অলস দুপুরের টাক-ঝলসানো রোদে, চুল্লির জানলাফোকর দিয়ে, গুণে-গুণে অগুনতি বিষাক্ত বাণ্ডিল ফেলা, কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরানো, দাউ-দাউ ওব্দি শিমুল গাছের ছায়ায়, উনুনবাড়ির চুল্লির খিড়কিতে তালা দেয়া, তালা টেনে দেখা, পরের দিন সকালে এসে ছাই খুঁচিয়ে পরখ কোনো নোট বেঁচে আছে কিনা । সে-সময়ে ময়লা নোটের শ্বাসকষ্টে ঠাস করে ফেটেছে, ননীবাবুকে অবাক করে, শিমুলের উদাসীন বিগতযৌবন তুলোকৌটো ; মুহূর্তখানেকের জন্যে ননীগোপাল-যন্ত্রকে খোকাপুরুষে পালটেছে বসন্তঋতুর ইয়ার্কি ।
হেডঅফিস থেকে উড়ো খবর এসেছে যে নোট পোড়ানো বন্ধ করে এবার নোটের পাল্প তৈরি হবে আর তা থেকে কাগজ তৈরি হবে । পাল্প তৈরির মেশিন বসবে কয়েকটা সরকারি কেন্দ্রে । সেখানে চালান যাবে বস্তাভরা পচা নোট ।
চুল্লিটার দেয়ালে এক অবিবেচক অশ্বথ্থগাছ, পাত্তা না পেলে এসব গাছগাছালির যেমন হয়, হু-হু বেড়ে চলেছে, কেউ ওপড়াতে চায়নি । এখন কাটতে কারোর সাহসে কুলোয় না, কাটলে বংশরক্ষা হবে না । রাঘব খুঁজে-খুঁজে কাহার কুর্মি দুসাধ মুসহর চামার হাজাম পাশি ডেকে এনেছে । তারপর শিয়া সুন্নি কুরেশি বোহরা আহমেদিয়া শিখ খ্রিস্টান কাঠুরে ছুতোর বা কসাই । ‘হায় বাপ, পিপল,’ বলে পালিয়েছে সবাই ।
‘রাঘববাবু, ইউ ক্যান নট কাট ডাউন দি পিপল,’ বাঁ হাত দিয়ে ডান কান থেকে রুমালের খুঁট তুলে বলেছেন ননীগোপাল, অনেকের মতে কমরেড ননীগোপাল ।
ননীবাবুর এই অনুমান যে যতদিনে জোয়ান গাছটা চুল্লিটাকে খাবে, ততদিনে অবসর প্রাপ্তি ঘটে যাবে ওনার, কপালের ওপর আব বেড়ে আলুর মতন হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই । ধারণাটা ঘা খায়, চুল্লিটার ওপর প্রচণ্ড বৃষ্টির রাতে লকলকিয়ে বাজ পড়লে । অশথ্থ গাছটা জাগ্রত প্রমাণ হওয়ায়, কর্মচারী অফিসার ফিরিঅলা দালাল সবাই সেলাম ঠোকে গোড়ায় । বেচয়েন লাল সেখানে পয়সা ফেলার বাকসো রেখেছে কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসায়টি আর কোঅপারেটিভ স্টোরের সিংকিং ফাণ্ডের জন্য । রাণা রামদেও সিং কোঅপারেটি স্টোরের সচিব থাকাকালে, তালের টিন গুঁড়োদুধের টিন জ্যাম জেলি স্কোয়াশের বোতল ইঁদুর আরশোলা আর মাকড়সায় খেয়ে ফেলেছিল । অডিটাররা বিশ্বস করেছে রানা রামদেও সিং-এর বক্তব্য ।
মুখার্জি এসেই বেচয়েন লালের বাকসো সরাতে চেয়েছিলেন । হেডঅফিসে ফ্লপিতে লিখে নোট পাঠিয়েছিলেন, কুরিয়ারে, তখন ইনটারনেট বসেনি পাটনা অফিসে । যাবার দিন গাছটার গোড়ায় সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট ঢুকিয়ে গেছেন বাকসোটায় । উনি যেসব অখদ্দে নোট পাস করেছেন, সেগুলো পুড়ে নষ্ট হবার পরই ধ্বসেছে চুল্লিটা । আসছে মাসের ছাব্বিশ লাল পেনসিল হাতে তারিখে অডিট পার্টি এসে পড়বে ।
রাঘব : ননীদা তো স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নিলেন গো । সোনালি করমর্দন । গ্র্যাচুইটির টাকায় বাংলাদেশি মেয়ে কিনছেন কোন নোট এক্সচেঞ্জারের কাছ থেকে । হিন্দি মতে বিয়ে করবেন ।
রমা : উনি নাকি ভারজিন ?
রাঘব : হ্যাঁ, বিহারে থেকেও ভারজিন রয়ে গেলেন । আমাকে বিয়ের যোগাড়যন্তর করতে হবে আর সম্প্রদান ।
রমা : যাক, একজন সুপারঅ্যানুয়েটেড জামাই বোনাস ।
রাঘব : গোলমাল হবে না তো ? মেয়েটা বগুড়ার মুসলমান । ঝি-গিরি করে থাকা-খাওয়া কুলোচ্ছিল না, তারপর শরীর বেচত । হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাফাঙ্গা না বেধে যায় ।
রমা : তুমি অত ভিতু কেন ? বাংলাদেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করতে গিসলে, আর এটুকু সামলাতে পারবে না ? তা ননীদার খর্চাখরচ কেমন পড়ল ?
রাঘব : পনেরো হাজার । দেখতে-শুনতে নাকি দারুণ । ইচ্ছে করে নোংরা সেজে থাকে মেয়েটা, যা শহরের অবস্হাগতিক ।
রমা : ননীদার তো কোনও টেলিফোন আসে না । নোটের ছাই ঘাঁটতে-ঘাঁটতে মড়ার সোনার আঙটি।
বিয়ের রাতে, ক্লার্ক অওয়ধ হোটেলের ব্যাংকিয়েট হলে, লোহার হোমকুণ্ড থেকে হিলহিলে ধোঁয়াক্কারে, লিট্টি, বথুয়াশাক, মেথিফোড়ন-দেয়া খোসাসুদ্দু আলুরসুন, বেগুনের ভরতা, লাউয়ের পায়েস, আটার কাচাউড়ি খেতে-খেতে সুশান্ত আর অতনু থ, স্তম্ভিত, হতবাক, এঁটোহাতে কর্তব্যবিমূঢ় ।
সম্রাট হোটেলে মুখার্জির ঘরে যে মেয়েটি ঢুকেছিল প্রথম দিন, আর অতনুর দেহ ওর জীবনে অর্গলবর্জিত হতে প্রশ্রয় দিয়েছিল, সেই রহস্যময়ীর নাবাল সুগন্ধ, দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে, আলপনা আঁকা পিঁড়ের ওপর, সে এক বিপর্যয় । ওরা দুজনেই মনে-মনে চেঁচাচ্ছিল, যা কেবল ওরা দুজনেই, সুশান্ত আর অতনু শুনতে পাচ্ছিল, “ননীদার কাছে যেও না ; আমরা আওরংজেবের অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দেব ।”
‘আর করলার খোসা শুকিয়ে খাবেন না ননীদা, ঠোঁট দুটো মিষ্টি রাখবেন, বহুমূত্র, সরি, অ্যাঁ, ডায়াবেটিস সামলাবার বদ্যি তো পেয়ে গেলেন’, প্রশাসন বিভাগের অরিন্দমের মন্তব্যে নিজেদের সামলে ওঠার সময় আর সুযোগ পেল সুশান্ত আর অতনু ; আর সেই ফাঁকে পকেটে বাঁ হাত ঢুকিয়ে তটস্হ ভাব দূর করতে চাইল সুশান্ত, অতনু ধুতির কোঁচায় । ঘাড়ের কাছটা, লাল ব্লাউজের ওপর যেটুকু খোলা, সুশান্ত মনে-মনে সেখানে ঠোঁট চেপে রইল ।
মালাবদল করতে-করতেই, ননীগোপাল ধমকে উঠলেন অরিন্দমকে, ‘অতনু-সুশান্তদের ক্যাশ সাইড থেকে ক্লারিকাল সাইডে বদলির কেসটা চেপে রেখেছিস কেন ?’
চন্দ্রকেতু সিং জানালো, সবাই বাংলায় কথা বলছে বলে, কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না । ওর রাজপুত ভূমিহার স্যাঙাতরা ওর সমর্থনে হইহই করে ওঠায়, বেচয়েন লাল বাঙালিদের তরফ নিয়ে নিলে তড়িঘড়ি, কেননা এদান্তি ও কমিউনিস্ট নেতা জগন্নাথ সরকারের সঙ্গে ওঠবোস চালু করেছে, ইউনিয়ানের নির্বাচনে বাঙালিদের ভোট টানতে হবে ।
চশমা, বাইফোকাল, পরে যাতে শুভদৃষ্টি করতে না হয়, তাই নরম কনট্যাক্ট লেন্স, বশ অ্যান্ড ল্যাম্বে ধোয়া, করিয়েছিলেন ননীদা । আর তেমন বুড়িয়ে যাওয়া ঘোলাটে ঘোলাটে দেখাচ্ছিল না ; গোঁফে কলপ, ঠোঁটে হালকা লিপ্সটিক, দামি পারফিউম, শ্যাম্পু-করা বুকে আধপাকা চুল, দুবাই থেকে ঝকঝকে জুতো, নেপাল থেকে চিনা-সিল্কের পাঞ্জাবি, ঢাকা থেকে ধুতি, যতোটা দেখন-জোয়ান করে তোলা যায় ।
মামুদ জোহের ওর পুরো নারী-নারকো গ্যাঙ নিয়ে, অসীম পোদ্দার, দেবেন্দর প্রসাদ, মলয় রায়চৌধুরী, শিবু পালিত, সজল, অশোকতরু, কমলেশ, প্রতুল, নরেশ, রবীন দত্ত, পুলক, সুশীল প্রায় সবাই হাজির । সারারাত সে কি নাচ ! দমাদম মস্ত কলন্দর, কোই মুঝে পগলা কহে, দম মারো দম, ডিজের ফাটা রেকর্ড ঝমাজঝম । সবাই টঙ । টাল্লি । টাইপিস্ট বাহাদুর চউবে, কর্মচারীদের দশ টাকায় দশ পয়সা প্রতিদিন হিসেবে ধার দেয় । একপাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের দলে মানসী বর্মণ, শ্যামলী কর্মকার, উমা ভর্মা, নয়নিকা জায়সওয়াল আরও অনেকে । দপতরি গুলাব শর্মা, ছোটো জাতে বিয়ে করে আর ফেরত যেতে পারেনি গ্রামে । ভাজপা, ইনকা, ভাকপা, জপা, জদ গোষ্ঠীর অনেকে । দালালরা নতুন পোশাকে । এলাহি ।
দিনভর জোয়ান হয়ে ওঠার অফুরন্ত নাড়িস্পন্দনের দাবদহে ননীগোপাল নিজের সঙ্গে তর্কে ব্যস্ত, চাউনি দিয়ে ঘেরাও । জানলায়, হলদে নরম কলকে ফুলের দুর্বল ডালে, ভোরবেলায়, দোয়েল পাখির বন্দিশ আশ্রিত গান । পৃথিবীতে এর আগে কলকে ফুল দোয়েল পাখি ছিল না । হুড়মুড় কোথ্থেকে এসে পড়েছে বর্ষাকাল । অন্ধকারের অন্দরমহলে নক্ষত্রদের অবাধ গতিবিধি । বার্ধক্যের কাছাকাছি যখন, বিয়ে করে, শৈশবে হারানো বগুড়া ময়মনসিংহ খুঁজে পেলেন তার অপাপবিদ্ধতার গভীরে, সেখানে, সে অতল-গভীরে, রুই মাছের পিচ্ছিল ঝাঁক পাশাপাশি রুপোলি বাসা বাঁধে ।
ননীগোপালের বিয়ের রাতেই কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ দেখাচ্ছিল অরিন্দমকে, মদ তো খায়নি ও । তবু কথায়-কথায় ‘না।’ কেউ কিছু না বলতেই, বাসর জাগার মাঝে, ‘না।’ ‘না।’
–এই অরিন্দম ।
–না ।
–কী হয়েছে ?
–না ।
–আরে, কী হয়েছে ?
–না ।
–যাঃ ।
–না ।
–ইয়ারকি রাখুন তো ।
–না ।
–বোকা নাকি !
–না ।
–নাটক বন্ধ কর দিকিনি ।
–না ।
এক্কেবারে মাথা খারাপ হয়ে গেল শুমুলতলা থেকে ফেরার পরই । ওর মামা চালান করে দিলেন কলকাতার লুম্বিনি পার্ক । ‘কেমন যেন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল এদান্তি, তোমরা কিছু জানো ?’ পাশের ফ্ল্যাটের তিরিশোর্ধ গৃহবধুর সঙ্গে অফিস পালিয়ে দুমদাম দুপুর কাটাচ্ছে, জানত ওরা । বলল, সুশান্তই বলল গোবেচারা মুখে দুশ্চিন্তার অভিনয় টাঙিয়ে, ‘না, আমাদের তো কিছু বলেনি ও।’ অরিন্দমের থেকে সাত বছর বড়ি পীনোন্নত মহিলা আসল কাজটা করতে দিচ্ছেন না, অথচ চলছে দুবছর, মুখ আর আঙুল দিয়ে পারস্পরিক যেটুকু হয় । শেষ হাসিখুশি ছিল অরিন্দম শিমুলতলার ক’দিন । তারপর আবিষ্কৃত হয় লুঙ্গি গেঞ্জিতে মোগলসরাই স্টেশানে । নতুন টাকার ষোলোটা প্যাকিং বাকসো বেনারসে স্টেট ব্যাঙ্কে পৌঁছে ফেরার সময় শিবু পালিত ওর কাঁধে হাত রাখতেই, ‘না’। ব্যাপার কী জানতে চাওয়ায় একদলা থুতু বাঁ হাতের তেলোতে নিয়ে কপালে ছপ । সেই কবে বাবা মারা গেছেন অরিন্দমের । বোনের বিয়ে হয়েছে আকাশবাণীর এক গায়কের সঙ্গে । মা আর ছোটো ভাই ।
অরিন্দমের মামার বাড়ির বাইরে বেরিয়ে, গেটের কাছে, ‘পাশের ফ্ল্যাটেই চলছে দু’বছর অথচ ওর মা কেন টের পাননি ?’ প্রশ্নের মধ্যে প্রমেথিয়াসের মতন মুকখু হয়ে উঠতে চাইছিল অতনু ।
শিমুলতলায় ইউনিয়ানের হলিডে হোমে হুড়দংগ । অতনু সুশান্ত মৌলিনাথ অরিন্দম । রাত্তিরে পাথুরে পথে জোনাকি-ওড়ানো অন্ধকার বুনো বাতাসে চারজন উদোম উলঙ্গের লাট্টুপাহাড় জয় । দুপুর পাহাড়ি নদীর জলের তলায় ডুবে জলেতে কেবল উচ্ছৃত শিশ্নটুকু ভাসাতে, মৌলিনাথের ওয়াটার অর্কিড দর্শণ আর চিৎকার । জলে কিছুতেই নামতে চাইছিল না গৌর-গা মৌলিনাথ । অরিন্দম কালো, শৈশব থেকে সর্ষের তেল মালিশ-খাওয়া চিকনত্বক কালো, নার্ভাস হলে নাক খোঁটে ।
‘চেহারা তো কয়লার খাদান, কী করেই বা মেয়েমানুষটা হ্যাণ্ডল করছে আপনাকে,’ অরিন্দমের ভাসমান শিশ্নকে উদ্দেশ্য কে ক্রুদ্ধ মৌলিনাথ, মোটা কাচের চশমায় খুদে-খুদে চোখ । অফিসে বসে দুপুরের লাঞ্চ-খাওয়া হাই তুলতে গিয়ে রেটিনা ফ্র্যাকচার । ভর্তির পরীক্ষায় কেরানিদের তালিকায় শীর্ষে ছিল মৌলিনাথ । রমা ব্যানার্জির জন্যে রাঘবের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছিল রোগা পাতলা কালো অরিন্দম । অরিন্দম জিততে-জিততে ছেড়ে দিলে । পাশের ফ্ল্যাটে ততদিনে বগলকাটা ব্লাউজের খাঁজ নামতে নামতে করাঘাতের আওতায় ; সন্দেহের অতীত তখন হয়ে চলেছে জীবনের সার্থকতা ।
–ননীদার বউয়ের নাম জানেন নাকি ? মৌলিনাথ প্রসঙ্গ পালটাতেই জলের তলা থেকে শেকড়ের ঝুরিসুদ্ধ উঠে এসেছিল তিনটে তিন রঙের অর্কিড ফুল ।
–সুলতানা, সুলতা বলে ডাকেন ননীদা ।
–তুই কী করে জানলি ?
–রাঘব নেমন্তন্ন করেছিল ওনাদের ।
–ননীদার বউ কি শাড়ি পরে না শালোয়ার ?
–শাড়ি, শাড়ি । তোর প্রেমিকাদিদির মতন ল্যাংটো থাকবে নাকি, ঠিক দুকুরে !
–না, মানে…
–ননীদার কিন্তু উচিত ছিল আমাদের ফিইস্ট দেয়া ।
–তারপর আপনি ঢুকে পড়ুন ওনার হেঁসেলে ।
–ঢুকতে দিলে ঢুকব ।
–ছুঁচ যখন ফাল হয় তখন ছুঁচের কষ্ট কেউ বোঝে না ।
–শাল্লাহ ।
চানটান করে ফেরার পর গায়ে, মানে চুলহীন বুকে, আর ভাতখোরের সদ্যনতুন নেয়াপাতিতে পাউডার মেখে, হলিডে হোমের গাড়িবারান্দার সিঁড়িতে বসেছিল, পরিপাটি চুল, কাঁধে পৈতে, স্মৃতির ধোঁয়াটে এলাকায় ঘুরছিল এক মনে অরিন্দম । মৌলিনাথ বেশ কিছুক্ষণ যাবত অরিন্দমের খোলা পিঠের বাঁ দিকে আলতো ঘুষি সহযোগে, ‘প্রেম করা হচ্ছে ! পরকীয়াবাজি ! অ্যাঁ ?’ বড়বড় করে যাচ্ছিল অবিরাম । আচমকা খেঁকিয়ে অরিন্দমের ককিয়ে ওঠা, ‘কী হচ্ছে কী, লাগে না নাকি !’ শিশুরও লা্বে না এমন আদর-ঘুষি, ওরা তিনজন স্তম্ভিত, বিব্রত । চুপচাপ ।
গলা খাঁকারি দিয়ে অতনু, ‘যাই, দাড়িটা কামিয়ে আসি’, আর সঙ্গে-সঙ্গে সুশান্ত, ‘চল, আমায় একটা শ্যাম্পুর স্যাশে কিনতে হবে।’ রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা-ফ্যা শেষে সন্ধে নাগাদ ফিরে এসে ওরা দুজন দেখল, কাঠের বাসন্তী আঁচে সুস্বাদু খরগোশ ঝলসাচ্ছে মৌলিনাথ আর অরিন্দম, লোহার শিকেতে ন্যাকড়ামোড়া দুটো দিক বাঁ-হাত ডান-হাত করছে । মুখময়, দু-জনেরই, উপশমহীনতার আভা । চোখে-মুখে নগর জিয়ন উপভোগের করুণ ও দয়নীয় আনন্দপ্রবাহ । খেতে-খেতে, খাবার পর, শুতে যাবার সময়, কেউ কোনও কথা বলেনি । সকালে মিটকি মেরে পড়ে থেকে চারজনেই দেরিতে একে-একে উঠেও কথাবার্তা না-হওয়ায়, সুশান্ত চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘শিমুলতলা তো দেখা হয়ে গেল । আর কী ? ফেরা যাক তাহলে ।’ ও, সুশান্ত, নিজের ব্যাগ গোছানো আরম্ভ করলে, অরিন্দম মৌলিনাথ অতনুও দেখাদেখি ।
মনের মধ্যে বিতর্কিত মতান্তর চলছিল চারজনের । যে যার নিজের ।
মৌলিনাথ : কোথ্থেকে এই পাতিপুরুষ নোটগুনিয়েদের পাল্লায় পড়লুম । না আসলেই ভালো ছিল । চারদিনের ছুটি নষ্ট । ঘোরাঘুরি আর খাওয়া । বই নেই কাগজ নেই টিভি নেই । পড়াশুনা করে না, গবেটের দল । ছ্যাবলামি আর নোংরামো । ভদ্রতা নেই, আদর্শ নেই, চিন্তা নেই । অফিসে চারদিনে অনেক কাজ জমে যাবে । অ্যাকাউন্টেন্ট মিত্র সায়েব হাসি-ঠাট্টা করবেন । জ্যোতিন্দর প্রসাদকে বলে আসা হয়নি । তাড়াহুড়োয় ছুটির দরখাস্তটা কমরেড এ কে সিনহাকে দিয়ে এসেছিলুম ।
সুশান্ত : জায়গাটায় কোনো ব্যবসার জিনিস কালেক্ট করার সুযোগ নেই । এটা এক্কেবারে ট্যুরিস্টদের স্বাস্হ্য ফেরাবার আড্ডা । প্রেমিক-প্রেমিকা টাইপের ছেলে-মেয়েও রয়েছে, কনডোম তো গেস্টহাউসেই গোটাদশেক পড়ে থাকতে দেখেছি, নানা রঙের । প্রেমের আবার রঙও হয় । দুধের মিষ্টি এখানে প্রচুর হয় বটে, কিন্তু তা পাটনায় নিয়ে গিয়ে বিক্কিরি লোকসান । ফলটল বাইরে থেকে আসে । লর্ড কর্নওয়ালিসের পেয়ারের জমিদারদের স্বাস্হ্য ফেরাবার কিংবা মোসাহেব সঙ্গে নিয়ে মাগিবাজি করবার বাগানবাড়িগুলো ভেঙে পড়ছে, প্রোমোটারদের নজরে এসেছে মনে হচ্ছে । কয়েকটা পালটে গেছে হলিডে হোমে, যদ্দিন টেকে, ধ্বসে না পড়ে । হোমগুলোর জন্যে মদের দোকান চলছে । আরেকটু খোঁজখবর করা যেত । ভেস্তে দিলে অরিন্দম আর মৌলিনাথ । পরে কাকার সঙ্গে আসব একবার । মা-বাবারও ভাল্লাগবে জায়গাটা । আসাম থেকে এক ট্রাক আনারস আনার জল্পনা করছিল কাকা । কদ্দুর এগোলো কে জানে।
অরিন্দম : আমার অবস্হা তো কেউ আর বুঝবে না । মিথ্যে নিয়েও কী গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে । অসহ্য । এই দুর্গতি থেকে আরোগ্যের উপায় নেই । অথচ জীবনে বিরুদ্ধে আমি কিছুই করিনি । পালাতে হবে । দুঃখের নিজস্ব আনন্দ থেকে পালাতে হবে । কোথায় যাব ? নিঃশ্বাস ধরে রাখার ক্ষমতা আর আজ আমার নেই । পালানো কি নৈতিক বিজয় নয় ! ধাতানি খেয়ে গড়াতে-গড়াতে মানুষ নিজের ঠাঁই টের পায় । জানাজানি হলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নেই । কী ভাববেন মা ? না । না । ছেড়েছুড়ে চলে যাব অন্য কোথাও । কাশি গঙ্গোত্রী হরিদ্বার দ্বারকা রামেশ্বরম । কলকাতায় বদলির দরখাস্তটা মঞ্জুর হয়ে গেলে বেঁচে যেতুম । ওখানেও যদি জেনে যায় সবাই ? ফালতু ছেঁদো লোকেরাও ঘেন্না করার টিটকিরি মারার বিচার করার ক্ষমতা পেয়ে যায় । কেন যে এমন একটা বিপদে আটকে গেলুম ! নেকড়েরা কবর খুঁড়ে লাশ খাবে । পাড়াপড়শি সহকর্মী মৌলিনাথ সবাই জুরি । অবুঝ । ওদের নিয়ম-নীতির বাইরে গেলেই প্রতিশোধ নেবে । ওফ ।
অতনু : জায়গাটা সত্যি, পৃথিবীর বোধহয় সব জায়গাই, কেমন যেন ভালো লেগে যাবার ব্যবস্হা করে রাখে । এরা সব নিজের হ্যান নিজের ত্যান নিজের অমুক নিজের তুসুক নিয়ে কাটিয়ে দিলে । আমিও তো, অন্যের কোনও কাজে এলুম না । নিজেরই বা কী কাজে এলুম ? আমার বেঁচে থাকার মানে কি কেবল আমার ? অরিন্দমের প্রশ্বাসেও রয়েছে স্বীকারোক্তি : প্রেম চাই, নারীর দায়-দায়িত্ব চাই না । অবশ্য, একজন মানুষের গোপনীয়তা তার নিজের । কেন কিছু ব্যাপার গোপনীয় ! এটা আসলে একরকমের চুরি । তালা তো আগে তৈরি হয়, চাবি পরে । জীবনে অনেক ঘটনা এমন যে অপরাধ আর বিচারের তফাত থাকে না । পিঠে লাঠি খেয়ে অনুভবের নতুনত্ব আসে । তা নতুন তো বটে !
‘–চল, ইস্টিশানে গিয়ে ট্রেনের টাইম দেখে নেব । কোনও না কোনও ট্রেন তো থাকবে । আমি রেজিস্টারে সই করে চৌকিদারের হিসেব মিটিয়ে দিয়েছি ।’ সুশান্ত জানালো ।
স্টেশানে পৌঁছে প্রচণ্ড ভিড় । শ’দুয়েক লোক প্ল্যাটফর্মে । ট্যুরিস্ট নয় । কালো আটপৌরে সাধারণ মানুষ, নোংরা, গরিব, স্নানহীনতার দুর্গন্ধ । অনেকের হাতে ঝাণ্ডা, কে জানে কোন দলের । দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল পাটনাগামী ট্রেন আসছে । চুম্বকে আলপিনের মতো ঝুলছে মানুষ, ট্রেনের ছাদে, এনজিনের সামনে । খাটোধুতি, প্ল্যাটফর্মে বসে-থাকা এক বৃদ্ধের কাছে সুশান্ত, তার হাত থেকে ঝাণ্ডাটা চেয়ে নিয়ে, জানতে পারল, গত আট আগস্ট জামশেদপুরে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার তরুণ তুর্কি নেতা নির্মল মাহাতো খুন হয়েছেন, তার মানে যেদিন ওরা এখানে এসেছিল, সেই দিনই । এরা সবাই পাটনা যাচ্ছে গুসসা অভিযানে ।
ট্রেনের ঢোকা কেবল দুষ্কর নয় অসম্ভব আঁচ করে, হাতের ঝাণ্ডা উঁচু, ট্রেন এসে পড়েছে প্ল্যাটফর্মে, সুশান্ত ঝাণ্ডা উঁচু করে, যত জোরে পারে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নির্মল ঞাহাতো জিন্দাবাদ ।’
: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।
: মাহাতোজি অমর রহে ।
: অমর রহে, অমর রহে ।
: নির্মল মাহাতো ।
: জিন্দাবাদ ।
: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।
: নির্মল মাহাতো জিন্দাবাদ ।
: ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ।
: জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।
তাকে ঘিরে-ওঠা ভিড়কে সঙ্গে নিয়ে একটা কামরায়, শোষক আর শোষিতের আবহমান সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে, ট্রেনের কামরায় ঢুকে গেল সুশান্ত । ওরা তিনজন পারল না উঠতে । ছেড়ে দিল ট্রেন । ট্রেন অদৃশ্য হলে স্টল থেকে একটা খবরের কাগজ কিনলে মৌলিনাথ ।
দক্ষিণ বিহার জুড়ে হরতাল । গমহরিয়ার কংগ্রেসি অমরেন্দ্র সিনহা, ডুমারিয়ার বনরক্ষক প্রয়াস পাসওয়ান, আদিত্যপুরের সতীশ শর্মাকে কুপিয়ে মেরেছে রাগি জনতা । রাঁচি চাইবাসা জামশেদপুর দুমকায় ভয়ে কেউ বেরোচ্ছে না রাস্তায় ।
টিসকোর চামারিয়া গেস্টহাউসের পোর্টিকোয় পৌড়ায়াটের ঝাড়খণ্ডি বিধায়ক সুরজ মণ্ডল আর নির্মল মাহাতো কথা বলছিলেন স্হানীয় দুই সংবাদদাতা এন কে সিং আর সুনীল ব্যানার্জির সঙ্গে । অওতার সিং তারির মায়ের শ্রাদ্ধ ছিল, তাই রাঁচি থেকে আসার সময়ে মোর্চার কর্মকর্তা বাবুলাল সোয় আর শিবাজি রায়ও মাহাতোজির সঙ্গে ছিলেন । সকাল সাড়ঢ নটা নাগাদ দেখা করতে এসেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট টি এন শর্মা । তারপর কালীপদ মাহাতো যে গাড়িটা কিনেছিল, যেটাকে ঝাড়খণ্ড ক্রান্তিরথে পালটে বিহার বাংলা ওড়িশা ঘোরার পরিকল্পনা, সেটার অনুমোদন শেষে পোর্টিকোয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন দুজনে । আচমকা ঘঢ়টানি খেয়ে একটা গাড়ি এসে থামতে, পাখির ডানার মতন গাড়ির চারটে দরোজা একসঙ্গে খুলে, দুমদাম তিনজন বন্দুকধারীর সঙ্গে নামে জামশেদপুরের রংবাজ বাহুবলী বীরেন্দর সিং আর তার দুই ভাই পণ্ডিত-পপপু । চিৎকার করে হুকুম দেয় বীরেন্দর, ‘দুটোকে আজকে এখানেই উড়িয়ে দে ।’ দুজন ঠিকেদার সুনীল সিং আর শংকর সিংও দাঁড়িয়ে ছিল পোর্টিকোয় । ভ্যাবাচাকা কাটিয়ে ওঠার আগেই চলতে থাকে গুলি । নির্মল মাটিতে, রক্তে । সুরজ মণ্ডলের ডান হাত এফোঁড় ।
আগের বছর সোনারিতে, নভেম্বরে, বীরেন্দরের ওপর কয়েকজন লোক চড়াও হয়ে খুন করতে চেয়েছিল ওকে । নির্মলসুদ্দু মোর্চার ছ-সাত জনের নামে পুলিশে এফ আই আর করেছিল ও, বীরেন্দর । এও জানিয়েছিল যে সুবর্ণরেখা পরিকল্পনায় নির্মল বাইরের ঠিকেদারদের আনত, প্রায় নিয়মিত । ঠিকেদারির মালকড়ির বাঁটোয়ারায় নাকি গণ্ডোগোল । এদিকে সুরজ মণ্ডল বলছে যে পুরো ষড়যন্ত্রটা সেচ আর সংসদীয় মন্ত্রী রামাসুর পরসাদ সিং-এর, আট বচ্ছর যাবত বিশ সূত্রীর পুরো টাকা, সিংভূমে খরচ করার বদলে নিজে হড়পে নিয়েছে । বীরেন্দর ওর স্যাঙাত ।
তার আগের বছর, মানে আগের বছরের আগের বছর, গরমকালে, সাহেবগঞ্জের ঝাঁঝিতে, গলায় ঝোলানো নতুন ডুগডুগি বাজাতে-বাজাতে একজন সাঁওতাল যুবকের পেছন-পেছন তীর-ধনুকধারী সাঁওতাল পুরুষ আর খোঁপায় ফুলগোঁজা নারীদের বিশাল মিছিলের ওপর পুলিশ যাণ পড়পড়িয়ে গুলি চালায়, যেন দোলের পিচকিরি নিয়ে রঙ খেলছে, পনেরোটা লাশ পড়ে গেলেও পালায়নি কেউ, কাননা মন্তর পড়ে নাচতে-নাচতে প্রায়-উদোম জানগুরু ঝাড়ফুঁক দিয়ে হাপিস করার চেষ্টা করছিল পুলিশ আর গুলিগোলার । ঝাঁঝি থেকে দিকুগুলোকে বিঠলাহা করার জন্য গ্রামে-গ্রামে সবুজ পাতা পাঠিয়ে বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিল আগেই । কারি-পাহাড়পুর রকসি সবৈয়া কান্দর বড়াকেঁদুয়া জরদাহা পোখরিয়া এসব দুর্গম গ্রামে পুলিশের সঙ্গে ষড় করে দিকুরা মেরে ফেলেছে অনেক সাঁওতালকে । এই তালে, আইনশৃঙ্খলার গোঁজামিলে, উপজাতি এলাকার পাদরি, ফাদার অ্যান্টনিকে গুলি করে মেরে ফেললে পুলিশের দল, সাঁওতালদের ওসকানোর গুরু ঠাউরে ।
গণ্ডোগোলটা আরম্ভ হয়েছিল, জঙ্গল ইজারার ঠিকেদার, কঠের চোরাচালানি দিকু মোতি ভগত আর বনরক্ষক এরিক হাঁসদার হিসসা ভাগ নিয়ে । পুরো যতটা হিসসা হওয়া উচিত, তা পাচ্ছে না, এই উষ্মায় এরিক হাঁসদা বোরিয়া থানায় মোতি ভগতের বিরুদ্ধে এজাহার ঠুকে দিতে, মোতি ভগত থানার সবাইকে তোড়ে করকরে মিষ্টিমুখ করাবার ফলে, ভগত পেল কংগ্রেসের লোকজন, আর হাঁসদা পেল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা । একদিকে দিকু আর রাষ্ট্র, অন্যদিকে অরণ্য আর উপজাতি ।
মৌলিনাথ চশমার পুরু কাঁচ পুঁছতে-পুঁছতে, ‘কবে সেই বিভূতিভূষণের আরণ্যক পড়ে ছিলুম ; আমরা তাহলে আজ কোথায় দাঁড়িয়ে ?’
‘–ভেবে লাভ নেই, ঘুরেফিরে সব বাঙালি পরিবার ওই কথাই ভাবছে।’ অতনু ফুট কাটল ।
অরিন্দম কোনও কথা বলা দরকার মনে করেনি । শিকারের আগে গোখরো যেমন মাথা তুলে ব্যাঙকে অভিবাদন জানায়, কিংবা পুলিশের কবর খুঁড়ে গুমখুন লাশ তুললে মৃতদেহ যেমন নিজের মনে হাসে, ও-ও, অরিন্দম, ‘সকলেই অস্হিরতা্য় ভুগছে’, ভাবল ।
‘আর তো সন্ধে ওব্দি ফেরার গাড়ি নেই, চলুন না, দেওঘর বৈদ্যনাথধাম যাই ট্যাকসিতে,’ মৌলিনাথ প্রস্তাব দিতেই, আশ্চর্য, অরিন্দম সায় দিলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ।
অতনু জানালো, পুকুরের ঠাণ্ডা জলে নামছে এমন সন্তর্পণে, ‘ধ্যুৎ, আমি তো ধর্মের কিচ্ছু বুঝি না । নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, টিশ্যু কালচার, পিনাল কোড, জয়েসের ইউলিসিসও যা, ধর্মও তাই ।’
অরিন্দম বিড়বিড় করছে দেখে, ফেলে পালানো সুশান্তর উদ্দেশে চাপা ক্রোধে মৌলিনাথকে জানালো, ‘পৈতে আকটা পরি, বিনা মন্তরের, অফিসের শাদা টোয়াইনের, নইলে মা অশান্তি করেন । রামাশ্রে পাসওয়ানকে বললেই নতুন টোয়াইন দিয়ে তৈরি করে দ্যায়, অফিসের ড্রয়ারে স্টক করা আছে । এখন ওব্বেশে দাঁড়িয়েছে । আমি দিগভ্রান্ত থাকতে চাই।’
খোকাবয়ব মৌলিনাথ দেখল ড্যাবড্যাবে, ফিসফিস করে বলা কথায় যে পুইরোনো তাচ্ছিল্য থাকে, বলল, ‘আরে, চলুন, চলুন ।’ মৌলিনাথ অরিন্দমের মধ্যে তুইতোকারি । অতনুর বেলায় বিশেষ মেশে না বলে, আপনি । নিজে থেকে এই প্রথম বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল অতনু । বাবা মারা যাবার পর । অরিন্দম আর ওর বাড়ির খবরাখবর জানলেও, কিছুই জানে না মৌলিনাথের পরিবারের বিষয়ে । বরানগরে ওর আত্মীয়রা থাকেন, হয়তো, বাবা-মাও, কিন্তু দ্যাখেনি কাউকে কখনও ; আলোচনা করে না বাড়ির ব্যাপারে । পাটনায় এসে মেসবাড়িতে, তারপর একটা ঘরভাড়া, এখন অফিসের কোয়ার্টারে । একা থাকে, একা রাঁধে, একা খায় ।
সামনের সিটে অরিন্দম, পেছনে মৌলিনাথ ঢুলছে অতনুর পাশে । ছুটন্ত পিচপথের দুপাশে যত রকমের সবুজ হয়, সোনাঝুরি আকাশমণি মহুয়া সিরিষ আম দেওদার শিশু অর্জুন তমাল আমলকি বট অশথ্থ তাল খেজুর পিয়াল বকুল মাতামাতি করছে, বাতাসের আদর খেয়ে । প্রতিধ্বনি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়তলি । অতনু ভাবছিল, অরিন্দমকে বলবে, পশ্চাত্তাপ মানুষকে খাটো করে, কিন্তু বলতে পারল না ।
মৌলিনাথ আর অরিন্দম গেল শিবের পুজো দিতে, বাংলা জানা এক পাণ্ডার হেপাজতে । পাণ্ডার দেয়া ধুতি পরে । ওদের জামা জুতো হাতঘড়ি মানিব্যাগ পাহারা দিতে-দিতে সুশান্তর প্রশংসা করছিল অতনু । সুশান্ত কতো অনায়াস ; বেঁচে থাকার এজেণ্ডা সর্বদা তৈরি, মুহূর্ত অনুযায়ী এজেণ্ডা ।
জলপ্যাচপেচে দালানে খালি-পা, গ্যাঁদাফুলের মালা গলায়, চন্দনের তেলক কপালে, আঁজলায় কচি শালপাতার ঠোঙায় প্রসাদ নিয়ে ফিরলে, অতনু জানতে চাইল, ‘কতো গচ্চা গেল ?’ তাইতে অরিন্দম, ‘ঠাকুরদেবতা নিয়ে ঠাট্টা করবেন না ; পৈতেটা দেবতাকে উৎসর্গ করে দিলুম, আর পরব না ।’
মৌলিনাথ বলল, ‘তাড়াতাড়ি ছাড়ান পাবার জন্যে মানত করেছিস তো ? কাটিয়ে দে, কাটিয়ে দে ।’ অরিন্দম প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে গেল ।
জামাকাপড় পরে ওরা অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের দিকে, এক্কাগাড়িতে । মৌলিনাথ গলা ছেড়ে দিয়ে, ‘বেএএদনায় ভোওওরে গিয়েছে পেয়ালাআআআ, নি্য়ো হে নিয়ো, হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা, পিয়ো হে পিয়ো…’ । এক্কাচালক মৌলিনাথকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আশ্রম মেঁ পিনা মনা হ্যায় ।’
গেটের কাছে নামতেই, এক আশ্রমিক যুবক অরিন্দম কে বলল, ‘স্যার, আপনার কানে-কানে একটা মন্তর ফস করে বলে দেব, জীবন জুড়িয়ে যাবে ।’ একটু দূরে নিয়ে গিয়ে, বকুল গাছের ছায়ায়, ছেলেটি অরিন্দমকে বলল, ‘স্যার দশটা টাকা দেবেন, দরকার আছে ।’ দিয়ে দিলে । দিতে গিয়ে মানিব্যাগে রাখা মহিলাটির ফোটোটা বের করে উড়িয়ে দিল কুটিকুটি ।
আশ্রমে ঘুরতে-ঘুরতে, এক বিশাল বাদামি কুঁজউঁচু সাহিওয়াল ষাঁড় পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে ছুঁচলো গোলাপি শিশ্ন বের করে পা পটকাচ্ছে দেখে, অরিন্দম হনহনিয়ে আশ্রমের অফিসঘরে পৌঁছে, সামনের প্যাংলা চেহারা চশমাচোখ মাঝবয়সীকে, ‘দাদা, দিয়ে দিন না একটা গোরু, কতো কষ্ট পাচ্ছে প্রাণীটা, ওই তো অত্তো গোরু রয়েছে ওখানে, ওর মধ্যে থেকে দিয়ে দিন না একটা ।’ ওনারা, বৈরাগী কেরানিরা, অরিন্দমের মুখের দিকে বলদ-চাউনি মেলে, নিজেদের সেরেস্তাদারি বাক্যালাপে ফেরত যায় ।
আবার এক্কাগাড়িতে, গানহীন, স্টেশানের কাছে হোটেলে খেয়ে, ট্রেন ধরল ওরা, তখন রাত অনেক । গাড়ির হ্যাঁচকায়, আচমকা রুকে গেল বলে, বাংক থেকে ঝুঁকে মৌলিনাথ জানতে চাইল, ‘কোন স্টেশান রে অরিন্দম ?’ তারপর সাড়া না পেয়ে আবার, কিন্তু জবাব না পাওয়ায় ঝুঁকে বুঝতে পারল সিটে নেই অরিন্দম । সামনের বাংকটায় অতনু বেঘোর । ঝিমুনির মাঝে সহযাত্রীদের কথাবার্তা থেকে কে একজন কাটা পড়েছে শুনের বাংক থেকে নিচে লাফিয়ে ডাকল অতনুকে, ‘অরিন্দম সিটে নেই, কে একজন কাটা পড়েছে, গাড়ি থেমে আছে বেশ কিছুক্ষণ ।’
‘কী বলছেন কী,’ অতনু হতচকিত, ও-ও নামে লাফিয়ে, চটিতে পা গলিয়ে কামরা থেকে পাথরের ওপর, দৌড়োয় যেদিকে একদল লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে, আর পৌঁছে জোর দিয়ে ঠেলে ভিড়ে সেঁদিয়ে যায় । বীভৎস । থেঁতো হয়ে গেছে একেবারে । হাত আর মাথা ধড় থেকে আলাদা ।
–সামনেকি গাঁও কি অওরত হ্যায় কোই । খুদকুশি করলি বেচারি ।
রক্তে জবজবে শাড়ি, কাটা হাতে সবুজ কাঁচের চুড়ি, ভাঙেনি, আতঙ্ক আর উদ্বেগ স্তিমিত হলে, লক্ষ্য করে ওরা দু’জন । কামরায় নিজেদের জায়গায় যখন ফিরল, তখনও আসেনি অরিন্দম । গাড়ি ছেড়ে দিল । ওরা নিজেদের মধ্যে অরিন্দমকে নিয়ে বলাবলি করছিল, কিছুটা চাপা উত্তেজনায়, আঁচ করে সামনের বুড়োটে লোকটা, বোধহয় কৃষক, বেশ চওড়া হাতের তালু, পাকানো রোদে পোড়া গড়ন । জানালো যে আপনাদের সাথী বাড় কিংবা বক্তিয়ারপুরে নেমে গেছে । শুনে, বিরক্তি আর রাগ হল দুজনেরই । ট্রেনটা আস্তে-আস্তে ফতুহা স্টেশান পার হচ্ছিল ।
ফতুহা !
এখানে, এই ফতুহায়, দেশ স্বাধীন হবার পাঁচ মাস আগে, তখন বিহারে কংগ্রেস দলের অন্তরিম সরকার, একটা ছুটন্ত মোটরগাড়িকে হাত দেখিয়ে, থামতে বলেছিল একদল পুলিশ । সবাই হিন্দু । ডাকাত ধরতে বেরিয়েছে । গাড়ির পেছনের সিটে কংগ্রেস দলের অধ্যক্ষ আবদুল বারি । দেশ স্বাধীন হলে উনিই হবেন রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী । মোহনদাস করমচন্দ গান্ধি পাটনা আসছেন বলে বারি সাহেবের তাড়া । পুলিশ দল জানালো তারা বারি-ফারি কিছু জানে না, আর টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে রাস্তার ওপর ফেলেই একাধিক থ্রি নট থ্রি দিয়ে ঝাঁঝরা, ছলনি । মুখ থুবড়ে পড়লেন আর মারা গেলেন আবদুল বারি, শাহবাদ জেলার কোইলওঅর গ্রাম থেকে সবকিছু ছেড়েছুড়ে নুন বানাতে গিয়েছিলেন গান্ধির সঙ্গে । বলেছিলেন, পাকিস্তান-ফাকিস্তান মানি না । লড়াইটা হিন্দু মুসলমানের গোপন ষড়যন্ত্রের কাজিয়া, না রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, তা কেউ জানতে পারেনি । অ্যাডিশানাল জজ রায়সাহেব পি কে নাগ নামে এক বাঙালির এজলাসে পুলিশগুলোর বিরুদ্ধে মাসকতক মামলা চলার পর, ব্যাস, ভুলে যায় সবাই, সাংবাদিকরাও । বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর তখতে বসলেন বিহার কেশরী নামে খ্যাত শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, আর শুরু হয়ে গেল জাতপাতের খেয়োখেয়ি । বারি সাহেবের দুই ছেলে সালাউদ্দিন আর শাহাবুদ্দিনকে বারোকাঠা পুসতইনি জমি থেকে খেদিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার প্রথম প্রজন্মের গুণ্ডারা । ভারতবর্ষের ভিড়ে হাপিশ হয়ে গেছে ওরা, আর ওদের ছেলেমেয়ে ।
অতনুদের বাড়ির কাছ থেকে পুর্বদিকে মাখানিয়া কুঁয়া চাঁইটোলা নয়াটোলা মছুয়াটুলি লঙ্গরটুলি দরিয়াপুর হাথুয়া মার্কেট বাকরগঞ্জ হবে যে রাস্তাটা গান্ধি ময়দানে গিয়ে পড়েছে, সেটার নাম এখন বারি পথ, মুসলমান ভোটদাতাদের জন্য কনসোলেশান প্রাইজ । গান্ধি ময়দানের দক্ষিণে, অতনুদের অফিসবাড়ির বিশাল অট্টালিকা । বারিপথের দু’পাশে সমস্ত ফাঁকা জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে, চট টাঙিয়ে, অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িকুঁড়ির ষষ্টিপূজক ছট মাইয়ার সংসার, ভাত ডাল রুটি আলুসেদ্ধর দোকান, চুলকাটার, তাড়ির, গাঁজার, জুয়ার, তেলেভাজার, খাজা আর বেসনলাড্ডুর, রিকশ আর ঠ্যালা রাখার, বাঁশ আর শালখুঁটির, টিপ-সিঁদুর-চুড়ির পশরা দোকান, নানা দেবীদেবতার মিনিমন্দির ।
বারি পথের সমান্তরাল, গঙ্গার পাশ দিয়ে, পশ্চিমে পাটনাসাহেব থেকে পুবে খগোল ওব্দি এগিয়ে গেছে, দু’পাশে ঝকমকে দোকানপশরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল টাউনহল গোলঘর সাজিয়ে অশোক রাজপথ । সারা পাটনা শহর দেখা যায় গোলঘরের টং থেকে । দুর্ভিক্ষের শষ্যভাঁড়ার হিসেবে তৈরি হয়েছিল মন্বন্তরে, এখনও তাই, গর্ভগৃহে চ্যাঁচালে তেইশবার প্রতিধ্বনি হয় । পায়ে-পায়ে ক্ষয়ে গর্ত হয়ে গেছে গোলঘরের একশো পঁয়তাল্লিশটা দাঁত বের-করা সিঁড়ি । মেরামতের টাকা, ইংরেজরা চলে যাবার পর, ফিবছর ভাগাভাগি হয় । রাস্তা সারাবার বরাদ্দও তাই । নালি-নর্দমা পড়ে আছে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে পচা পাঁকে ; বর্ষায় রাস্তাগুলো নিজেরাই নিজেদের দুর্বিসহ পায় । গান্ধি ময়দানের পূর্ব-দক্ষিণ দিকটা, ফ্রেজার রোড বেইলি রোড ডাকবাংলো রোড বোরিং রোড নষ্ট আর অসহ্য নয় ততোটা । মন্ত্রী আমলা জজ উকিল ঠিকেদাররা থাকে ওদিকে । টিমটিমে হলেও, সন্ধের পর আলো জ্বলে ওদিকের পথে-গলিতে-মোড়ে । বারিপথ তখন প্রায়ান্ধকার, ছমছমে, ক্রমশ ফাঁকা । মাঝে-মাঝে যাত্রী-ঠাশা মিনিবাস, ধাক্কা খেয়ে আর মেরে দোমড়ানো, অটো থেকে ঝুলন্ত বাড়তি যাত্রী, অবিরাম হর্ন বাজিয়ে আওয়াজ দিয়ে আলোর কাজ চালায় ।
বারিপথে কেবল ছটপুজোয় সারারাত আলো জ্বলে, রাস্তার দুপাশে বেআইনি খুঁটি পুঁতে, হুজিং করে ঝোলানো হাজার চিনা টুনির রিমঝিম আলো । ওই একদিনই ঝাঁট পড়ে রাস্তায় । ভোর রাতে সধবার দল উদোম স্নান করবে । কেউ-কেউ পথের ওপর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে-করতে ঘাটে যাবে । ছোকরা মাস্তানরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, ভেঙে পড়ে ঘাটে-ঘাটে বাইনোকুলার হাতে, পারিবারিক বাইনোকুলার, যা দিয়ে বাপ-জ্যাঠাও একই কাজ করেছিল, অজস্র উলঙ্গ নারীর জোয়ান সুঠাম দেখার লোভে । গঙ্গার পাড় বরাবর তাই ঘাটে-ঘাটে তেরপলের পর্দা টাঙানো থাকে মহিলা পুলিশ পাহারায় । ছটের সময় ঠেকুয়া তৈরি হয় ঘরে-ঘরে । চারপাঁচজন পড়শি দিয়ে যায় অতনুদেরও, শক্ত মুচমুচে নরম ঘি জবজবে নানা রকমের মিষ্টি ঠেকুয়া । অনেকদিন ওব্দি থাকে ।
বেলা হয়ে আসছে, কখন পাটনায় পৌঁছোবে কে জানে, নিজের ব্যাগ থেকে একটা ঠেকুয়া মৌলিনাথকে দিয়ে অতনু বলল, ‘অরিন্দমের ব্যাপারটা সুশান্তকে জানিয়ে দেবেন, বাড়ি না ফিরলে কেলেংকারি, সুশান্ত ওর মা আর ভাইকে ম্যানেজ করে নেবে ।’
বাড়ি ফেরেনি অরিন্দম । শিবু পালিত ওকে আবিষ্কার করেছিল মোগলসরাই স্টেশনে, খালি-পা, কদিনের দাড়ি, লাল চোখ, চুল উস্কোখুস্কো , উদভ্রান্ত, কিছু খায়নি দিনকতক । ডানায় ঠোঁট গুঁজে ঘুমন্ত পাতিহাঁসের মতন একা । চেহারা দেখে, মনে হয়েছিল শিবু পালিতের, বেঁচে থাকার ইচ্ছের বাইরে চলে গেছে । শিবু ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেল পাটনায় । কলকাতায় নিয়ে গেলেন ওর ডাক্তার মামা ; মানসিক রোগের হাসপাতালে ঠাঁই পেল ।
‘পাগল হবার আগে অরিন্দম তোদের ক্লারিকালে ট্রান্সফারের কেসটা হিল্লে করে গেছে তো ? সারা জীবন নোট গুনবি নাকি ?’ একদিন অফিসে এসে বলে গেলেন ননীগোপাল । আর বললেন, ‘রাঘব তো সিকিউরিটি অফিসার হয়ে চলে যাচ্ছে কলকাতা । হেডাপিস থেকে যে আসছে, তাকেই মুরগি আর ছানার পায়েস খাওয়াচ্ছে রমা । নতুন সব বিভাগ খোলা হবে, তোরা ঝপাঝপ প্রোমোশান পেয়ে যাবি ।’
অতনু নিজেকে নিঃশব্দে বলল, ‘প্রোমোশান নিয়ে কী করব !’
অফিসের নতুন বাড়িটা ননীগোপালের সামনেই তৈরি । তখন গান্ধি ময়দানের রেলিং ছিল না, গেট ছিল না । শুলভ শৌচালয়ের গ্যাস-আলো জ্বলত না, ময়দানের মধ্যে রেলিঙের কিনারঘেঁষা হাঁটা পথে, যার ওপর এখন জগিং করতে বেরোয় হাফপ্যান্ট যুবকেরা । ময়দানের উত্তরে ডুমো-ডুমো শ্রীকৃষ্ণ হলটা হয়নি । আবদুল বারি মারা যাওয়ায়, শ্রীকৃষ্ণ সিং মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল, ভূমিহার । এখন ভূমিহারদের দিনকাল গেছে । উঁচু জাতের রাজনীতিকদের দিনকাল কোনঠাশা হয়ে গেছে । তফসিলিরাই নিজেদের মধ্যে দলিত-মহাদলিত ভাগাভাগি চালাচ্ছে ।
অফিসে নতুন বাড়িতে তৈরির সময়ে, সিমেন্টে গঙ্গামাটি মেশানো হাতেনাতে ধরেছিল ভিজিল্যান্স । ফলে, এগজিলিউটিভ ইনজিনিয়ারে পদোন্নতি পেয়ে মুম্বাই বদলি হয়ে গেছে মারাঠি ক্লার্ক-অফ-ওয়র্কস । স্হপতি, নামকরা, শতকরা একভাগের আধ ভাগ । বেশি নিয়েছিল সিপিডাবল্যুডির রেটের চেয়ে । ব্ল্যাকলিস্টেড ঠিকেদার, নতুন নামে কোম্পানি খুলে পেয়েছিল ঠিকেটা । পুরোনো দপতরবাড়ি থেকে আসবাবপত্র আসার পথে, নতুন বাড়িটায় আসতে-আসতে, দুটো গোদরেজ আলমারি আর একটা গোদরেজ টেবিল, কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে প্রাণ পাবার দরুন, মাঝরাস্তা থেকে লোপাট । ননীদার কাছে অনেক পুরোনো গল্পের ডাঁই । চাকরি ছেড়েও অনেক খবর রাখছেন, যা সবাই জানে না । তার মানে ননীদার ওয়ানরুম ফ্ল্যাটে বেশ মুখরোচক আড্ডা জমছে আজকাল । যাবে একদিন, ভেবেও অতনু কুন্ঠিত ।
রাঘব-রমা ট্রান্সফার হয়ে, ছলছলে হাসি বিলিয়ে, কলকাতা যাবার পর, শীতাতপ যন্ত্রের হরিয়ানাবাসী ইলেকট্রিশিয়ান, যার এসি পার্টসের দোকান ফ্রেজার রোডে, আর যে ভ্যায়েনচো ভ্যায়েনচো ভ্যায়েনচো ছাড়া কথা বলে না, পদোন্নতি পেয়ে রাঘবের পোস্টে কেয়ারটেকার হয়ে গেল । অফিসটা কেন্দ্রীয় এসি । ড্রয়ারে শাল-সোয়েটার রাখে কেউ-কেউ । বাচ্চার খেলনার মতন থারমোমিটার ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে হিউমিডিটি মাপার এক ফাঁকে মুচকি হাসি বিলিয়ে যায় টাকমাথা সুপারভাইজার, ‘ঝপ করে এগারো ডিগরিতে নেমে গেল।’ বাইরে তখন রাস্তার পিচ গলাচ্ছে গ্রীষ্ম, আর দুপুর বেলার গোঁয়ার রোদ্দুরকে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে সূর্য । শীতাতপ না হলে অতনু-সুশান্তদের ফ্যানের হাওয়ায় নোট গোনা আর বাছাই অসম্ভব । মৌলিনাথ আর অরিন্দমের সে-সুযোগ নেই, ওরা কেরানি ।
রোজ যতো পুরোনো নোট জমা পড়ে, তার মধ্যে থেকে প্রত্যেক নোট-পরীক্ষক কর্মচারীর মাথাপিছু দিনকার বরাদ্দ অনুযায়ী, পচে নোট আর ভালো নোট বাছাই করার কাজ, যাতে পচা নোটগুলো জ্বালানো আর ভালোনোটগুলো বাজারে ছাড়া যায় আবার । অতনু প্রায় ছেড়ে দিয়েছে বাছাবাছি-গোনাগুনির কাজ । সুশান্ত তো একদমই । নারী-নারকো গ্যাঙের সবাই । মহিলারা কেবল গোনে, বাছাই করে, এক মনে, ধৈর্য ধরে । অতনুর মনের মধ্যে এর জন্য একটা খচখচ থাকলেও, প্রায় সবাই যখব সেই কাজ করছে, তখন সৎ হওয়ার অনেক হ্যাঙ্গাম, বেশ বিপজ্জনক । পাঞ্জাবি এক বড়োসাহেব এসে, ক্লোজ সার্কিট টিভি বসিয়ে নজর রাখতে চাইছিল । বেচয়েন বলেছিল, ‘শালা বিজলি থাকে না বলে এসি চলে না অনেক সময়ে, লিফট চলে না, ঘুরঘুট্টি বেসমেন্ট, উনি চলেছেন টিভি লাগাতে ।’
সত্যি, শীতকালে, অফিস ছুটির সময়ে, আলো চলে গেলে, গায়ে-পড়া পুরুষের ইচ্ছাকৃত ধাক্কা বাঁচাবার জন্য মহিলাতরা অনেকেই, দ্রুত টর্চ বের করে নিজেদের কাঁধব্যাগ হাতব্যাগ থেকে, আত্মরক্ষার জন্য । কেউ-কেউ সিগারেট লাইটার হাতে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল । যেমন মানসী বর্মণ, এককালে ওদের বিরাট বইয়ের দোকান ছিল, ননীগোপাল ওর বাবাকে দেখেছেন, রাশিয়ার নেতাদের মতন বপু-হোৎকা আর মোদো-গোলাপি চেহারা ।
শিমুলতলা দেওঘর থেকে ফেরার পরের দিনই, অতনুর সেকশানে ঝপাং শব্দে ডাইস মেশিনে একাধিক গর্ত করে নোট নষ্ট করছিল রসিক পাসওয়ান, চাপরাসি । ব্যস্ততার মাঝে, কর্মরত অতনুর কপালে এসে ছিতকে লাগল রসিকের তর্জনীর কাটা ডগাটা, লেগে, ওর কপালে রক্তের টিপ পরিয়ে, ওরই টেবিলে পড়ল । বুঝে ওঠা মাত্র ও স্তম্ভিত । পেট মোচড় দিয়ে বমি উঠে আসছিল আরেকটু হলে । পকেট থেকে রুমাল বের করে প্রায়-নির্বিকার রসিক জড়িয়ে নিলে কাটা রক্তঝরা আঙুলে, আর আঙুলের টুকরোটা দেখাতে গেল প্রধান খাজাঞ্চিকে । সুশান্তকে বলতে ও জানিয়েছিল, ওদের আঙুল-টাঙুল বীমা করিয়ে রেখেছে অফিস । দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে বীমা করানো থাকে । আঙুল কাটার অঢেল ক্ষতিপূরণ দিতে হয় । তর্জনীর জন্যে তো মোটা টাকা পাবে । ওর বোধহয় টাকার খাঁকতি, তাই নিজের আঙুল কেটে ফেলেছে নিজেই ।
গরমকালেও রসিকের সর্ষের তেল, শীতকালে শাদা উর্দির কলার তেলচিটে, বর্ষাকালে রবার জুতোর ক্যাঁকোঁ, পানিবসন্তের শ্রীছাঁদ । রসিকের ঘটনার পর অতনু লক্ষ করেছে, সুখচৈতি রাম, হরবিলাস, ট্যাঙোয়া মাহাতো, রামপুজন সিং, খলিল আহমদ সকলেরই একটা করে বা দুটো আঙুল কাটা ।
বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধেও বীমা করানো আছে । মানুষের অভাব-অনটনের দুঃখে গড়া মতিগতি । আগেকার দিনে, ইংরেজদের সময়ে, প্রধান খাজাঞ্চি আসত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে, নোট গোনানো বাছাই আর পোড়াবার জন্যে । সে ভর্তি করত নিজের চেনাজানা নির্ভরযোগ্য লোকজন । এখন টাকাকড়ি পরীক্ষকরা এলডি থেকে ইউডি, উপখাজাঞ্চি হয় । কেউ যদি নোটফোট গেঁড়িয়ে লোকসান করায়, তাই বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধে বীমা । দিনের পর দিন চারধাতরে এত টাকা, পচা গন্ধমাখা টাকার ঢিবি, থাক-থাক টাকা, যে অতনুর ভয়-ভয় করে । ভয়ের বিরুদ্ধে বীমা নেই । মানুষের সম্পর্ক ভেঙে যায় বিশ্বাসভঙ্গের দরুন, তার জন্য তো বীমা হয় না ! হলে, আর দু’পক্ষ মেনে নিলে, অনেক কষ্টের সুরাহা হতে পারত ।
হাতে-হাতে টাকা এত নোংরা কী ভাবেই বা হয়, ভেবেছে অতনু । তুলতুলে হয়ে ওঠে । মানুষের হাতে তো অমন ময়লা থাকেনা, যতো জমে যায় নোটে ! ময়লা, হাতে থাকলেও, থাকে গরিব মজুর কুলি কামিন চাষির চেটোয় । আর টাকা ঘুরে বেড়ায় ধনীর, সচ্ছল মানুষের, হাত ফেরতা । কতো করকরে থাকে যখন নতুন । অন্ধকারের আগল ঠেলে কী দশা হয় শেষে, পুড়ে মরার আগে । একেবারে মানুষের মতন, সারা জীবন নিজের অস্তিত্বে জড়ো করা ময়লা নিয়ে পুড়তে যায় । এতো গাদাগাদা নতুন-পুরোনো টাকা যে ফুটবল মাঠের মাপের স্ট্রং রুমেও বস্তাবন্দী কুলোবে না । বেশ কয়েক মাস আগে থাকতে ক্লায়েন্ট ব্যাংককে জানিয়ে রাখতে হয় যে তারা কতো বস্তা বা বাকসো পচা নোট জমা দেবে অতনুদের ভাঁড়ারে । কবে যে কাউন্টিং মেশিন আর শ্রেডার আসবে, কেবল গুজবই শোনা যায় । তেলচিটে হিলহিলে নোটগুলো তো কাউন্টিং মেশিনে দিলেই ছিঁড়ে পাকিয়ে দলা হয়ে যাবে ।
আইন পালটে, সরকারি খরচ মেটাবার জন্যে, রাজনীতিকদের পোয়াকে বারো করার জন্যে, যতো ইচ্ছে নোট ছাপা যায়, বাজারে ছাড়া যায় । ননীগোপাল যখন চাকরিতে ঢুকেছিলেন তখন বাজারে পাঁচশো কোটি টাকার নোট ঘুরে বেড়াতো । চাকরিতে ইস্তফাদেবার সময়ে তা এক লক্ষ ষাট হাজার কোটিও । বেড়েই চলেছে প্রতিবছর । সব গেছে হিল্লি-দিল্লির নেতা ঠিকেদার আমলা চোরাকারবারী সঞ্চয়চোরদের গবভে । ডাকাত আর বিধায়ক গোপাল সিং । সতবীর সিং, সুরেন্দ্র সিং রাঠি, মোহম্মদ ইলিয়াস, শাহাবুদ্দিন, শ্রীপাল, ধর্মপাল যাদব, হরিশংকর তেওয়ারি, বীরেন্দ্র শাহি, রঞ্জিত, শারদা প্রসাদ রাওয়ত, বিলায়তি রাম কত্যাল, রাজু ভটনাগর, রাজেশ কুমার সিং, মিত্রসেন যাদব, বিনয় কাটিয়ার, নাজির আলি, লটুরি সিং, রমাকান্ত যাদব, রিজওয়ান জহির, দুধনাথ যাদব, পপ্পু যাদব, ওম প্রকাশ গুপ্তা, শমিউল্লা খাঁ, কৃষ্ণকিংকর সিং, রামপাল শর্মা, বাবুলাল তিওয়ারি, মঙ্গলপতি ত্রিপাঠি, সঞ্জয় সিং, বালেন্দু শুকলা, কুঁয়র অশোক বীরবিক্রম সিং, গণপতরাও ধুরবে, জগমাল সিং, রাজকুমার জয়পাল, বীরভদ্র সিং, আবদুল লতিফ, সি এম ইব্রাহিম, পাপ্পু কালানি, হিতেন্দ্র ঠাকুর, মির্জা হাজি মস্তান, ইউসুফ প্যাটেল, করিম লালা, বরদারাজন মুদালিয়ার, দাউদ ইব্রাহিম, টাইগার মেমমন, সুকুর নারায়ণ বখ।ইয়া, সূর্যদেও সিং, আলমজেব, মহেশ ঢোলকিয়া, রমাকান্ত নায়েক, আমিরজাদা সমদ খান, সতীঋ খোপকর, বিনায়ক ওয়াগলে, বিটঠল চভান, থিম বাহাদুর থাপা, চার্চিল আলেমাও — এদের হাতে-হাতে ফিরেছে মোটা টাকার আর পাতলা টাকার নোট ।
অতনুর মনে হয়, ওর নিজের মাইনের টাকা, আর এই সমস্ত গিজগিজে টাকা এক জিনিস নয় । মাইনে পেলে ও অঙ্ক গোনে টাকায় । এসব পচা নোটগুলোর অঙ্ক যাই হোক, তাদের সংখ্যা গোনে । পঞ্চাশ টাকার একশোটা নোটও যা পাঁচশো টাকার একশোটা নোটও তাই ।
বরাদ্দ ছুটির শেষে রসিক পাসওয়ান কাজে যোগ দিলে, সুশান্ত জানতে চেয়েছিল, কী গো, আঙুলের ঘা শুকিয়ে গেছে তো ? কাটলে কেন আঙুলটা জেনেশুনে।’
–‘নাতনিটার বিয়ে দিলুম । ছুটিও পেলুম, টাকাও ।’ রসিক পাসওয়ান অমায়িক ।
‘–মাইনে তো যথেষ্ট পাও।’ সুসান্তর খোঁচা ।
‘–ছেলেটাকে তো কোথাও ঢোকাতে পারলুম না । প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে টাকা তুলে একটা মুদির দোকান করে দিয়েছিলুম । চালাতে পারলে না ।’
‘–তাই বলে আঙুল কেটে নিলে ?’ সুশান্তর বিস্ময় ।
‘–ওই একটাই নাতনি । ভালো দেখে বিয়ে দিয়ে দিলুম ।’
ভালো শব্দটার কী ভাবে খোলোশা হয়, অপেক্ষা করছিল অতনু । হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সুশান্ত ।
‘–কী করব বলুন । ছেলেটা গধহা বেরোলো । এখন ছ’টা নাতিকে মানুষ করতে হবে । লেখাপড়া শিখছে । মাইনের টাকা তো ওদের জন্যেই খরচে ফেলি পুরোটা । ছেলের বউটা শেষ বাচ্চা বিয়োবার সময় বাঁচেনি ।’
‘–ওদের ঠাকুমা আছে তো ?’
‘–হ্যাঁ, আছে বলেই রক্ষে ।
‘মানুষ করা’ আর ‘গধহা’ শব্দ দুটোয় আরেকবার আটকালো অতনু । রসিকের বাড়ি অওরঙ্গাবাদের দরমিয়া গ্রামে, শুনেছে । অনেকে বলে ও থাকে ওয়ারিসআলি গঞ্জে, নওয়াদা জেলায় । দরমিয়া আর ওয়ারিসআলিগঞ্জ দুটোই নকসল্লি মাওওয়াদিদের গঢ়, ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতি জনআদালত বসায় । গত বছর আশ্বিন মাসে ওর ছেলের নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল, আর রসিকের খোঁজখবর করতে শাদাপোশাক পুলিশ এসেছিল অফিসে, সুশান্তর কাছে জেনেছে অতনু ।
আশ্বিন মাসের সেই সন্ধেবেলা তিরিশ-চল্লিশজনের জামাত পৌঁছেছিল অম্বিকা সিং-এর বাড়ি, ভালা ভোজালি বরছা গঁড়াসা নিয়ে । বাড়ির দালান থেকে ইন্দ্রদেব-এর ছোটো ভাই ভীমকে কব্জা করে ওকে দিয়েই দরোজায় টোকা দেওয়াতে, অম্বিকার দাদা জগন্নাথ সিং-এর সদরের দরোজা খুলতে বাধ্য করায় । রামলেশ, প্রমোদ, মুরারী আর বারো বছর বয়সী গয়া সিংএর হাত যারা পিছমোড়া করে বেঁধেছিল, রসিক পাসওয়ান তাদের একজন । ভিড়ে একজন, ‘তোদের বাপগুলো কোথায়,’ বলে উঠতেই, শুনতে পেয়ে, অম্বিকা সিং স্ত্রী গাজরদেবীকে একটু উঁকি মেরে দেখতে বলে কী ব্যাপার । গাজরদেবীর হুঁশিয়ারি শোনামাত্র, চালার গোলটালি সরিয়ে পালায়, লুকোয় গিয়ে অড়হর খেতের মধ্যে । অম্বিকা আর জগন্নাথ সিংকে না পেয়ে রসিকের দল রামলেশ, প্রমোদ, মুরারী, গয়া, গাজরদেবী, অম্বিকার মেয়ে গীতা আর জগন্নাথের মেয়ে পুষ্পার মাথা ওখানে দাঁড়িয়ে আলাদা করে দিয়েছিল ধড় থেকে । তারপর ওরা, ঝিঁঝিডাকা জোনাকি-জ্বলা ওই রাতেই, মরদনবিঘায় গিয়ে, বৈদ্যনাথ সিং, অলখদেও সিং আর ওর ছেলের বউ উষা আর বৈদ্যনাথের মেয়ে শকুন্তলাকে ছিন্নভিন্ন করার পর, আওয়াজ দিয়েছিল, ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই লাশের বদলে লাশ ।’ আসলে ঠিক সতেরোদিন আগেই, দরমিয়ার ছ-সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, পরসডিহায়, উঁচু জাতের লোকেরা, অম্বিকা-জগন্নাথের লেলিয়ে দেবার দরুণ, বন্দুকের গুলি মেরে ষাট বছরের জগন্নাথ সাহু, নব্বই বছরের চামার সাহু আর তার ছেলে রাজেশ্বর সাহু, রাজারাম সাহু আর দুই নাতি সঞ্জয় আর বিনয়ের লাশ নামিয়ে দিয়েছিল ।
আরেকজন চাপরাশি ঝুনুরাম কিসকুর কাঁধে হাত রেখে মসকরা করতে-করতে রসিক পাসওয়ান সিঁড়ি দিয়ে মেজানাইন ফ্লোরের দিকে এগোলে, অতনু সুশান্তকে বলতে বাধ্য বোধ করল, ‘সবায়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে এত নাক গলাস কেন ?’
সুশান্ত বলল, ‘সকলেরই নকল গল্প আর আসল গল্প দুটোই জানি, সবকটা আঙুল কাটা চাপরাসির । মুঙ্গের থেকে বন্দুক কিনবে রসিক । রামখেলাওন ওর রক্ষিতার হার গড়িয়ে দিয়েছিল সবজিবাগের কণকমন্দির জুয়েলার্স থেকে । শেখ আলি পাঁচ হর্স পাওয়ারের ডিজেল পাম্প কিনেছে ।’ তারপর কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে, ‘দিনকতকের জন্যে সিক লিভ নেবো । কাকার সঙ্গে আসাম যাচ্ছি দু ট্রাক আনারস আনতে ।’
অতনু জানতে পারল, শনিবার বিকেলে, অ্যানেকসি বিলডিঙে ক্যানটিন কমিটির নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে, চন্দ্রকেতু সিং দিলে খবরটা, বাঁ-চোখের পাতা সামান্য কাঁপিয়ে, ননীদা সস্ত্রীক হনিমুনে গেছে সুশান্ত আর ওর কাকার সঙ্গে, কামাক্ষ্যা আর গণ্ডারের অভয়ারণ্যে, বয়সের স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য মেটাতে । সুশান্ত তার মানে চেপে যাচ্ছে কিছু-কিছু । চন্দ্রকেতু চশমা পুঁচছিল । চশমা খুলে ফেললে মনে হয় ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে ।
সুশান্ত-অতনুর সম্পর্কে যেটুকু লুকোছাপা না হলে নয় । অতনু কুঁড়ে, আরামপ্রিয়, যে-কোনো ছাপা কাগজ পড়তে ভালোবাসে, বসার চেয়ে ওর ভালো লাগে গড়িয়ে পড়তে, মেঝেতে বসলে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে, বাসে-ট্রেনে উঠেই হাতল খোঁজে, অতিথি বা বয়স্করা বসার আগেই বসে পড়ে । বিছানায় বসলে এলিয়ে পড়ে বালিশ টেনে । সুশান্ত খবরের কাগজ বই ম্যাগাজিন পড়ে না, শেয়ার দরে ওঠানামার দরটুকু ছাড়া । খেলার খবর, রাজনীতিতে আগ্রহ নেই, অথচ একনাগাড়ে বকবক করতে পারে । সকলের বাড়ি-বাড়ি চষে বেড়ায় মোটরসাইকেলে । ছোঁয়াচে উৎফুল্লতায় ভোগে ।
অতনু মেয়েমহলে অস্বস্তি পায় । সুশান্ত সহজ । অফিসারদের অ্যাসোশিয়েশান, কর্মচারী ইউনিয়ান, ক্যানটিন, সমবায়, স্পোর্টস ক্লাব কিছুতেই অংশ নেয় না ও, সুশান্ত, কিন্তু খবর রাখে পুরো । গান-বাজনার ও কুইজ মাস্টাত, বিদেশি হোক বলিউডি হোক ইন্ডি পপ হোক । অডিও ডিভাইস কানে লাগিয়ে মোটর সাইকেল চালায় । বললেই টুইস্ট রক অ্যান রোল র্যাপ ট্যাংগো হিপহপ রুম্বা ফ্রি ফর অল নেচে দেবে সুশান্ত । অতনু তো নতুন পরিচিতের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আড়ষ্ট হয়, দ্রুত কেটে পড়ার ছুতো খোঁজে ।
সুশান্তদের একান্নবর্তী পরিবারে প্রতি সপ্তাহে গ্যাস সিলিণ্ডার লাগে । ঢিলেঢালা অগোছালো খোকাখুকুরা চোর-পুলিশ খেলতে-খেলতে পাক খেয়ে যায় বনেদি ড্রইংরুমে । জ্যাঠাকাকাদের অট্টহাসির ছররা ছিটকোয় তিনতলা থেকে একতলা । প্রতিটি ঘরের দেয়াল জুড়ে দোল খেলার রং । এক তলায় সিঁড়ির নিচে ডাঁই করা চটি আর জুতো, যার যেটা ইচ্ছে পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যায় । সুশান্ত আর ওর বড়জ্যাঠামশায় ছাড়া, যিনি এখনও সাইকেল চালিয়ে আন্টাঘাট কিংবা চিড়াইয়াটাঁড়ে বাজার করতে যান, আর কারোর স্নান করার আর খাবার বাঁধাধরা সময় নেই । সুশান্তদের বাড়িতে ঢুকলে অতনুর ইচ্ছে করে পরিবারের সদস্য হয়ে যেতে । ও এত চাপা যে নিজে থেকে কোনো হুল্লোড় আরম্ভ করতে পারে না । অন্যের বানানো হুল্লোড়ে ঢুকতেও ইতস্তত ।
নিজের মাইনের টাকা ওব্দি অন্যের সামনে গুনতে লজ্জা করে অতনুর । চাকরির প্রথম মাইনের একটা পাঁচ টাকার প্যাকেট, লুকিয়ে গুনতে গিয়ে অফিসের পায়খানায় পড়ে গিয়েছিল । পড়ে যেতেই ফ্লাশ । অফিসকে তাই জানিয়ে দিয়েছে, মাইনেটা ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে ; ব্যাঙ্ক থেকে তো আর থোক অতো টাকা তুলতে হবে না । সুশান্তই পরে অতনুকে খোসা ছাড়িয়ে বের করে আনতে পেরেছে । স্কুল-কলেজে অতনুর নিকটবন্ধু ছিল না । অতনুর কাছ থেকে কলম বা বই নিয়ে কেউ ফেরত না দিলে ওর মন খুঁতখুঁত করে ; নোটসের খাতাও স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ে সহপাঠিনীদের কাছ থেকে ফেরত চাইতে পারেনি । সুশান্তর মোটর সাইকেলও যে যখন ইচ্ছে চেয়ে নিয়ে যায় ।
অখিলেশ ঝা আই এ এস দিয়ে সফল হবার পর গ্রামের রাজপুত দারোগা যখন পুলিশ এনকোয়ারি নিয়ে খেলাচ্ছিল তখন সুশান্তর মোটর সাইকেলে অখিলেশকে বসিয়ে তদবিরের জন্যে চন্দ্রকেতু সিং নিয়ে গিয়েছিল ওরই, মানে চন্দ্রকেতুর গ্রাম, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার সোনিয়া-রানিগঞ্জ গ্রামের মাফিয়া সরদার সুরজদেও সিং-এর ভাই রামাধীরের কাছে । দারোগাটা রামাধীরের শালা । রামাধীরের বিরুদ্ধে তখন অবশ্য ফৌজদারি চলছিল ৩০২, ৩০৭, ৩২৪ আর ৪৫২ ধারায় । রামাধীরের একটা টেলিফোনে কাজ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু ফেরার সময় বিহটার কাছে গ্রামের আধন্যাংটো ছেলেরা গোটাকতক মোষের ল্যাজ মুচড়ে, ওদের দিকে হাঁকিয়ে দেওয়ায়, রাস্তা থেকে নেমে মোটর সাইকেলটা কাঁঠাল গাছে ধাক্কা খায় আর সঙ্গে-সঙ্গে দুজনেই অজ্ঞান, গায়ের ওপর খসে-পড়া এঁচোড় । ঘণ্টা দুয়েক ওরা ওখানেই পড়েছিল । গ্রামবাসীরা কলম ঘড়ি আঁটি টাকাকড়ি যা কিছু ওদের পকেটে আর ছিল, মায় কাঁধব্যাগও, হাতিয়ে কেটে পড়েছে সেই সুযোগে । বিডিও দেখতে পেয়ে জিপে তুলে নিয়ে যায় । ওদের আর দোমড়ানো মোটর সাইকেলকে । মামুদ জোহেরের ম্যাটাডর নিয়ে বিহটা থেকে মোটর সাইকেল আর হাতে-মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা দুই সহকর্মীকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল সুশান্ত ।
কোন আগ্রহ গিঁথে রেখেছে সুশান্তদের বিরাট পরিবারটাকে, যখন কিনা পাটনায় কোনো একান্নবর্তী পরিবার আর টিকে নেই, যে পরিবারের মধ্যে চুপচাপ সেঁদিয়ে যেতে চেয়েছে অতনু, তা অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারেনি অতনু । বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু চাষি পরিবারের কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক, অথচ ঢুকেছে আজেবাজে পচা নোট বাছাইয়ের চাকরিতে । গ্লানিবোধ বা দুঃখ, নজরে পড়ে না । মেমারিতে জমিজিরেত চাষবাস তদারক করেন সুশান্তর ন-কাকা নতুনকাকা, তাঁরা আসেন কখনও কখনও পশ্চিমে বেড়াতে আসার নাম করে । নতুনকাকার বড় ছেলে নকশাল হয়েছিল, বাড়ি ফেরেনি আজও । পাটশাক, জামরুল, আঁশফল, নোনা, কামরাঙা, গোলাপজাম ওদের বাড়িতেই প্রথম দেখেছে অতনু, মেমারি থেকে আনা ।
অতনুর বাড়িতে বিধবা মা । তিরিক্ষি দুর্গন্ধের নালির গায়ে সটান শাদা বাড়ি ওদের । একতলা । দোতলা অর্ধেক হয়ে আধখেঁচড়া ইঁট-বেরোনো । মায়ের শাদা থান আর অতনুর শাদা ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কোনো রং নেই পোশাকের । কাকাতুয়া দুটো শাদা । বাড়ি ফিরলেই ওর মন খারাপ, তার কোনো কারণ নেই, উৎস নেই । মায়ের সঙ্গে বড়ো একটা কথাবার্তা হয় না । অতনু মাছমাংস কেনে না । ডাল ভাত আলুভাতে তরকারি । ডাল তরকারি আলুভাতে ভাত । শাদাকালো টিভিটা পালটে রঙিন টিভির প্রস্তাবে রাজি করানো যায়নি মাকে । বহুকাল অন্ধ আর বোবা হয়ে পড়ে আছে ।
সুশান্তর বাড়িতে পুঁটলি তোরঙ্গ বাকসো প্যাঁটরা এলে বাড়িসুদ্দু সবাই হুমড়ি খেয়ে কী আনলে গো, ওটা কী গো, একটু দেখতে দাও না গো, পছন্দের বলিহারি, সুশান্তর ছোটো ভাই অপাংশু সবচেয়ে বেশি উৎসুক । অতনুর কোনো আত্মীয় নেই । আছে কি না তা জানেও না অতনু । কেউ আসে না । কেউ যায় না । কেউ চিঠি লেখে না, বিয়ে পৈতে অন্নপ্রাশন শ্রাদ্ধের কার্ড পাঠায় না ।
অতনুর জন্মের সময়ে ওর মায়ের প্রসবক্রিয়া নষ্ট করতে বাধ্য হয়েছিল ডাক্তার । ভাইবোন নেই । পড়াশোনায় চিরকেলে ছাপোষা, দ্বিত্বীয় শ্রেনিতে, অথচ মুখে বই গুঁজে থাকতে ভালোবাসে সারাক্ষণ । খেলাধুলাহীন । আগ্রহ নেই । কেউ কখনও জানতে চায়নি বড়ো হয়ে ও কী হতে চায় । জিগ্যেস করলে জবাব দেবার মতন ভাবনা ছিল না ওর আকাঙ্খায় । বাবা কেন যে ইংরেজি পড়ালেন ! কখনও ভালো লাগেনি ভাষাটা । রসকসহীন সাহিত্য । যদিও প্রতি ক্লাসে প্রতিবছর ইংরেজি পেপারে সবচেয়ে বেশি মার্কস অতনুই পেয়ে এসেছে । ইংরেজিতে পড়লে ওর মুখস্হ হয়ে যায় ; বাংলা আর হিন্দিতে হয় না । উচ্চাশা না থাকলেও, ভবিষ্যতের ধারণা না থাকলেও, কেউই বোধহয় নোট আর পয়সাকড়ির পরীক্ষক হতে চায় না । ভালো নোট, খারাপ নোট, আসল নোট, নকল নোট,সচল নোট, অচল নোট, আস্ত নোট, কাটা নোট, বাছাই নোট, ছাঁটা নোট, তাজা নোট, পচা নোট, কারোর উচ্চাকাঙ্খায় জাগে কি ! বালকের কিশোরের তরুণের যুবকের ? তার বাবার ঢুকেছিলেন এই চাকরিতে । বছর দু’তিন চাপরাশি থাকার পর নোটপরীক্ষক হয়েছিলেন । নাগপুরে । তারপর মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, মাদ্রাজ, বাঙ্গালুরু, পাটনা । পাটনায় মারা গেলেন বলে বাবার দৌলতে অতনু পেল চাকরিটা । মাইনে যথেষ্ট, দুপুরেই ছুটি, এরকম আয়েশের চাকরি তো আর পাওয়া যাবে না । সেঁটে গেল অতনু ।