ডলির বাবা আমার পাশে এসে দাঁড়ান, এমনভাবে যেনো তিনি আমার বাবা; আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি সুখী বোধ করছেন; আমি যে নদীতে হারিয়ে যাই নি এটা তার জন্যে একটি গভীর সুখ। আমার মনে হয় এই প্রথম কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। দেলোয়ারের বাবা এমনভাবে দাঁড়ান নি, যদিও তিনি অনেক বছর ধরেই আমাকে স্নেহ করেন; আর ডলির বাবা হয়তো এর আগে আমাকে একবার দেখেছেন। তাঁর মুখে আমি প্রশান্তি দেখতে পাই।
তিনি বলেন, তুমি নেমেছিলে বলেই ডলি নেমেছিলো।
আমি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি, কিন্তু নদীটাকে দেখতে পাই না।
তিনি বলেন, তোমার জন্যেই আমার মেয়েটি বেঁচে আছে।
আমি বলি, না।
তিনি বলেন, তুমি না নামলে ডলি নামতো না।
আমি বলি, আমার নামা ঠিক হয় নি।
তিনি বলেন, এ কী বলছো, বাবা?
আমি বলি, আমার বন্ধু মারা গেছে।
তিনি অপ্রতিভ হয়ে পড়েন, বিব্রত বোধ করেন; এবং বলেন, না, না; দেলোয়ারের জন্যে দুঃখের আমার শেষ নেই, সে আমার ছেলেই ছিলো, তবু।
আমি দেলোয়ারের মায়ের দিকে এগিয়ে যাই; তিনি আমার মুখের ওপর তার দুটি চোখ স্থির করে রাখেন।
আমি বলি, গাড়ি থেকে নেমে আমি অপরাধ করেছি।
তিনি কোনো কথা বলেন না; অন্যরা আমার চারপাশে ঘিরে আসে।
আমি আবার বলি, আমি অপরাধ করেছি।
আমি হাঁটতে থাকি; কারো দিকে তাকাই না; আমার পেছনে একটি নদী আছে, সে-কথা আমি ভুলে যেতে চাই; আমার পেছনে ডলি আছে, ডলির বাবা, মা আছেন, দেলোয়ারের বাবা, মা আছেন, অন্যরা আছে, ডুবুরিরা আছে, সে-কথা আমি ভুলে যেতে চাই। পোন্টুন থেকে হেঁটে আমি সড়কে উঠি; সড়ক ধরে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে আমার ভালো লাগতে থাকে; আমার মনে হতে থাকে নদীর ভেতর থেকে, নদীর ভেতরে ডুবে-যাওয়া গাড়ি থেকে এইমাত্র আমি উঠে এসেছি; পরমুহূর্তে মনে হয় গাড়ি নিয়ে আমি ডুবে যাচ্ছি, গাড়ির কাঁচ ভাঙার জন্যে প্রচণ্ড চেষ্টা করছি, দেলোয়ার আমাকে জড়িয়ে ধরছে, তাকে ছাড়িয়ে কাঁচ ভেঙে আমি ওপরে উঠে আসছি; আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, আমার শরীরে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি সড়কের পাশে বসে পড়ি; আমার ঘুম পায়।
মাঝরাতে আমি বাসায় ফিরলে মা বেশ অবাক হয়। এতো রাতে আমি অনেক বছর বাসায় ফিরি নি।
মা জিজ্ঞেস করে, কেমন বেড়ালি?
আমি বলি, ভালো।
আমার ঘরে গিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি; বিস্ময়কর ঘুম হয় আমার। এমন গভীর ঘুম আমার অনেক দিন হয় নি। আমার ঘুম হয়তো ভাঙতো না, বছরের পর বছর হয়তো আমি ঘুমিয়ে চলতাম, কিন্তু আমি ঘুমের ঘোরে শুনতে পাই আমার দরোজায় কারা যেনো ভিড় করেছে, দরোজায় ভীষণ শব্দ করছে, আমাকে ডাকছে; আর আমার মনে হতে থাকে আমি পানিতে ডুবে গেছি, একটি বাক্সের ভেতর আটকে গেছি আমি, বাক্সটি আমি খুলতে পারছি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুম ভাঙলে আমি দরোজা খুলতেই সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমি জানতে চাই, কী হয়েছে।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে; ছোটো বোনটি আমাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে থাকে। বাবার হাতে আমি সকালের কাগজটি দেখতে পাই।
বাবা জিজ্ঞেস করেন, ফিরে এসে কিছু বললি না কেনো?
আমি বলি, গাড়ি থেকে নেমে আমি অপরাধ করেছি।
মা কেঁদে ওঠে, কী বলছিস তুই, তাহলে তোকে আমি কোথায় পেতাম?
আমি গিয়ে আবার শুয়ে পড়ি; হাতের পাশে একটি পুরোনো প্লেবয় পাই। আমার ঘুমোতে ইচ্ছে করে না, আমি প্লেবয়ের পাতা উল্টোতে থাকি; মাঝের পাতাগুলোতে এসে প্লেমেইটটির ছবি দেখতে থাকি, মেয়েটির এতো কিছু এতো অপরূপভাবে আছে, মেয়েটির সব কিছু আমার ভালো লাগতে থাকে, তার শরীর থেকে মাংসমেশানো একটি সুগন্ধ এসে আমার নাকে লাগতে থাকে; আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে না। আমি অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটির ছবির ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকি; মেয়েটি জীবিত হয়ে উঠবে বলে আমার মনে হয়, ডলিকে আমার মনে পড়ে। দেলোয়ার নিশ্চয়ই ডলির বুকে মাথা রেখে এভাবে ঘুমোতে; আমি কখনো ঘুমোবো না, কেননা আমি কখনো বিয়ে করবো না, কেননা আমি অপবিত্র। হঠাৎ আমার মনে হয় আমি আর অপবিত্র নই, কেউ জানে না আমি অপবিত্র; দেলোয়ার জানতো, সে আর নেই; বিলকিসকে আমি একবার বলেছিলাম, কিন্তু আমার অপবিত্রতা তার কাছে পবিত্রতার থেকেও পবিত্র; আজ আর কেউ জানে না আমি অপবিত্র। দেলোয়ার কাউকে বলে নি বলে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি। সে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলো, অন্য কারো কাছে সে আমার অপবিত্রতার কথা বলে নি। কেনো বলে নি? তাহলে আমি অন্যদেরও দেলোয়ারের মতো পবিত্র ভাবতাম বলে? অন্যদের সাথে দেখা হলে আমার কখনো অপবিত্রতার বোধ হতো না; হতো দেলোয়ারের সাথে দেখা হলে; দেলোয়ার আমার কাছে অন্যদের সমান হতে চায় নি বলেই হয়তো বলে নি। নিজেকে আমার হাল্কা লাগতে থাকে; এখন আমি আর কারো কাছে অপবিত্র নই। কিন্তু যে-মেয়েটিকে আমার ভালো লাগতো, আট বছর আগে, সে কোথায় আমি জানি না; সে তার মামার সাথে পালিয়ে গেছে, শুনেছি আমি; মেয়েটির মুখ আমি মনে করতে পারি না; কিন্তু আমার ভালো লাগতে থাকে। তার সাথে দেখা হলেও আমি অপরাধবোধে ভুগবো না।
দু-তিন দিন আমি ঘর থেকে বেরোই নি; বিছানা ছেড়েই উঠি নি। তারপর আমার বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বাসা থেকে বেরিয়ে বুঝতে পারি না কোথায় যাবো; তবে আমি একটি রিক্সা ডেকে ফেলেছি, রিক্সাঅলা আমার সামনে এসে থেমেছে, না থামলেই আমার ভালো লাগতো। রিক্সাঅলাকে ফিরিয়ে দেবো? লোকটি আমার দিকে কেমন করে তাকাবে না? আমি রিক্সায় উঠে বসি, রিক্সাঅলাকে আমি আজিমপুর যেতে বলি। আমার দেলোয়ারদের বাসায়ই যেতে ইচ্ছে করে। গেলেই হয়তো আমি দেলোয়ারকে দেখতে পাবো। রিক্সা থেকে নেমে আমি দেলোয়ারদের বাসার সামনে এসে দাঁড়াই; বাসার ঘণ্টা বাজাতে গিয়ে আমি থেমে যাই; সেখান থেকে নেমে এসে আমি রাস্তায় দাঁড়াই। তারপর আবার দেলোয়ারদের বাসার দরোজায় গিয়ে দাঁড়াই, আবার ঘণ্টা বাজাতে গিয়ে থেমে যাই; এবং রাস্তায় নেমে আসি। ওই মুহূর্তে আমার নারায়ণগঞ্জ যেতে ইচ্ছে করে, দেলোয়ারের সাথে একবার আমি যেখানে গিয়েছিলাম। আমি এখন যদি নারায়ণগঞ্জ যাই, দেলোয়ার তা জানবে না; আমি যে আবার অপবিত্র হয়ে গেছি, দেলোয়ার তা জানবে না; আমাকে বলতে পারবে না তোমার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। একবার অপবিত্র হওয়ার পর কেউ কি দ্বিতীয় বার অপবিত্র হতে পারে, একবার চরিত্র নষ্ট হওয়ার পর কি দ্বিতীয় বার চরিত্র নষ্ট হতে পারে? আমার আর কিছু অপবিত্র হওয়ার নেই, আর কিছু নষ্ট হওয়ার নেই। আমি একটি রিক্সা নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে যাই, দেখি সেখানে কোনো ট্যাক্সি নেই; এখন আর ট্যাক্সি চলে না। আমার নারায়ণগঞ্জ যেতেই হবে, নারায়ণগঞ্জে আমার জরুরি কাজ রয়েছে, কাজটি আজ সন্ধ্যায়ই সম্পন্ন করতে হবে, নইলে আর করা হবে না; আমি একটি বেবি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে নামি। কিন্তু কোথায় যাবো? দেলোয়ার আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছিলো? আমার অপবিত্রতার পবিত্র তীর্থক্ষেত্র কোথায়? আমি জানি না। আমি একটি রিক্সা নিই, রিক্সাঅলা বারবার কোথায় যাবো জানতে চায়, আমি তাকে আমার গন্তব্য বলতে পারি না। আমি একেকটি অন্ধকার পথের মোড়ে এসে রিক্সাঅলাকে ঢুকতে বলি, তারপর আরো অন্ধকার একটি গলি খুঁজি, সেই গলি পাই না; তখন তাকে আমি অন্য দিকে যেতে বলি; আবার কোনো অন্ধকার পথের মোড়ে এসে তাকে ভেতরে ঢুকতে বলি, আরো অন্ধকার একটি গলি খুঁজি, সেই গলি পাই না; রিক্সাঅলাকে আবার চালাতে বলি। আমি শুধু তাকে চালাতে বলতে থাকি; কিন্তু কেউ সম্পূর্ণ গন্তব্যহীন হয়ে কিছু চালাতে পারে না; আমার রিক্সাঅলাও পারে না, সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে; কিন্তু আমার ক্লান্তি নেই। আমি চোখ বুজে আমার গন্ত্যটিকে দেখতে পাই,–একটি মেয়ে আমাকে টেনে তার ঘরে ঢুকিয়ে ফেলছে,–কিন্তু চোখ খুলে আর দেখতে পাই না।
রিক্সাঅলা রিক্সা থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ছার, আসলেই কন আপনে কই যাইবেন?
আমি বিব্রত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলি, তোমাকে বলা যাবে না।
রিক্সাঅলা হেসে ওঠে, বলে, এইডা ক্যামন কতা অইল, আমারে লইয়া যাইবেন আর আমারে বলন যাইব না।
আমি চুপ করে থাকি।
সে বলে, কিছু ভাইব্বেন না, ছার, কই যাইবেন কইয়া ফালান।
আমি বলি, একটি অন্ধকার রাস্তা, তারপর একটা অন্ধকার গলি।
রিক্সাঅলা বলে, অহন বুজছি ছার, আপনে পাড়ায় যাইবেন। তারপর হেসে বলে, ঢাকা থিকা আইছেন বুঝি।
আমি বলি, হ্যাঁ।
রিক্সাঅলা বলে, ছার, পাড়ায় যাইয়া কাম নাই; আপনারে আমি এক ভাল জায়গায় লইয়া যাইতে পারি।
আমি বলি, কোথায়?
রিক্সাঅলা বলে, আমারই বাসায়, ছার; খুব ভাল, ছার। আমার বউ আছে, আর আমার বইন আছে, যারে আপনার পছন্দ অয়।
রিক্সাঅলা তার বাসার দিকে রিক্সা চালাতে থাকে; ময়লা অন্ধকারের পর অন্ধকার ঠেলে সে আমাকে তার ময়লা অন্ধকার বাসায় নিয়ে যায়। ভেতরে ঢুকতে আমার ভয় হয়, তবু তার পেছনে পেছনে আমি ঢুকি; ঢুকতেই দুটি রোগা কুৎসিত নারী আমার সামনে এসে দাঁড়ায়; আমার শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে; আমি সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রাখি। নারী দুটি ভেতরে মরচে-পড়া ধাতুর ঘর্ষণের মতো হেসে ওঠে।
রিক্সাঅলা মাফ চেয়ে বলে, আমার বউ আর বইনডা দেকতে ভাল না, ছার, কামে ভাল; এমন পাইবেন না, ছার।
মায়া হয় আমার লোকটির জন্যে, কিন্তু আমার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে বমি করে দিতে চায়; আমি হাঁটতে শুরু করি, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আমি কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারি না; আমি হাঁটতে থাকি। রিক্সাঅলা কি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? কিন্তু দেখি রিক্সাঅলা তার রিক্সা নিয়ে আমার পাশে এসে থেমেছে।
সে বলে, ওডেন ছার, আপনেরে দিয়া আহি।
আমি রিক্সায় উঠে বসি।
একদিন বিকেলে আমি ডলির টেলিফোন পেয়ে চমকে উঠি।
ডলি বলে, নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছেন।
আমি বলি, না, না; আমারই উচিত ছিলো আপনার খবর নেয়া।
ডলি বলে, আমি তো আপনার খবর নেয়ার জন্যে টেলিফোন করি নি।
আমি বলি, তা করেন নি ভালোই করেছেন; তবে আপনার খবর নেয়া সত্যিই আমার উচিত ছিলো।
ডলি বলে, সত্যি করে বলুন আপনি গাড়ি থেকে নেমেছিলেন কেনো?
আমি বলি, আমি জানি না।
ডলি বলে, আপনি জানেন।
আমি বলি, আমি কেনো গাড়ি থেকে নেমেছিলাম তা আপনাকে আমি কখনোই বলতে পারবো না।
ডলি বলে, আপনি না নামলে আমি নামতাম না।
আমি বলি, আমার অপরাধ হয়ে গেছে।
ডলি বলে, আমার অপরাধ হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি।
আমি বিলি, আমি খুব দুঃখিত।
ডলি বলে, আমার এখন শোকের মধ্যে থাকার কথা, কিন্তু আমি রয়েছি। অপরাধবোধের মধ্যে।
আমি বলি, সব কিছু ভুলে যাওয়াই ভালো।
ডলি বলে, আপনি ভুলতে পারবেন?
আমি বলি, না।
ডলি বলে, তাহলে আমাকে ভুলতে বলছেন কেনো?
আমি বিব্রত হয়ে বলি, আর কিছু আমি ভাবতে পারছি না বলে।
ডলি খিলখিল করে ওঠে, এমন মানুষ আমি দেখি নি।
ডলিদের বাসায় আমাকে যেতে হবে; ওর মা আমাকে দেখতে চান, অর্থাৎ আমার সাথে কথা বলতে চান; এবং ডলি চায় আমি যেনো শিগগিরই, আগামী কালই, ওদের বাসায় যাই। আমি কি ডলিদের বাসায় যাবো? ডলির মায়ের সাথে কথা বলতে?, ডলির মায়ের সাথে আমি কী কথা বলবো? তিনিও কি জানতে চাইবেন কেনো আমি গাড়ি থেকে নেমেছিলাম? জানতে চাইবেন ডলির সাথে আমার আগে পরিচয় ছিলো কি না? আমি কি ওদের বাসায় যেতে পারবো? মাংসমেশানো সুগন্ধে যদি আমার দম বন্ধ হয়ে আসে? দেলোয়ারদের বাসায় আমি গিয়েছিলাম, কলিংবেল বাজাতে পারি নি; ডলিদের বাসায় গিয়েও যদি অমন হয়? আমি কি ডলিদের বাসায় যাবো? আমার যেতে ইচ্ছে করে না; কিন্তু বাইরে বোরোনোর জন্যে যখন আমি চুল আঁচড়াচ্ছি তখন ইচ্ছে করে, এখনই আমি ডলিদের বাসায় যাই। ডলিকে কি দেখতে আমার ইচ্ছে করছে? একটা তীব্র সুগন্ধ কি পেতে ইচ্ছে করছে আমার? তার মুখটি আমি মনে করতে পারছি না। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি, এবং ডলিদের দরোজায় গিয়ে ঘণ্টা বাজাই। ডলিই দরোজা খুলে দেয়, এবং আমাকে দেখে খুব বিস্মিত হয়।
ডলি বলে, আপনি এখনই আসবেন আমি ভাবি নি।
আমি বলি, নইলে আমার আর আসা হতো না।
ডলি বলে, কেনো?
আমি বলি, আমার এমনই মনে হচ্ছে।
ডলি একটু ভয় পেয়ে যায়, আমাকে সে বসতেও বলে না; কিন্তু আমি বসে পড়ি। আমি একটা তীব্র সুগন্ধ পেতে চাই, যা মাংসের ভেতর থেকে উঠে আসে, উঠে এসে শ্বাস রোধ করে; তবে আমি কোনো সুগন্ধ পাই না। ডলির মাংস কি আর সুগন্ধ উৎপাদন করে না, ডলির মাংস কি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে; দেলোয়ারের জন্যে? তার মাংস কি অপরাধবোধে ভুগছে?
ডলি বলে, আপনি আজই এসে পড়লেন? আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
আমাকে দেখে বোধ হয় ডলির ভেতরে অপরাধবোধটা জেগে উঠছে।
আমি বলি, একটা তীব্র সুগন্ধ আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে।
ডলি বলে, এখন সুগন্ধ পাচ্ছেন?
আমি বলি, না।
ডলি জিজ্ঞেস করে, আপনি যে-সুগন্ধটি পেয়েছিলেন, সেটা কেমন?
আমি বলি, মাংসের সাথে মেশানো এক রকম সুগন্ধ আর সুগন্ধের সাথে মেশানো এক রকম মাংস; আগে আমি কখনো পাই নি।
ডলি বলে, আপনি সুস্থ ছিলেন না।
আমি বলি, আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিলো।
ডলি বলে, এতে পুরুষদের শ্বাসরুদ্ধ হয় না।
ডলির কাছে পুরুষ বলতে কি শুধু দেলোয়ারই বোঝায়? না কি আমিও তার অন্তর্ভুক্ত? এতে দেলোয়ারের শ্বাসরুদ্ধ হতো না,–ডলি ভালোভাবেই জানে; দেলোয়ার হয়তো ওই সুগন্ধে বেশি করে বেঁচে উঠতো–আমি ঠিক জানি না, কিন্তু ডলি জানে; আর আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছিলো। ডলি ভেতরে চলে যায়; একটু পর তার মা এলে অভ্যাসবশতই আমি দাঁড়িই; তিনি হাত ধরে আমাকে বসান। আমি যেমন অভ্যাসবশত তাঁকে দেখে দাঁড়িই, তিনি কি তেমনি অভ্যাসবশতই আমাকে হাত ধরে বসান? আমাকে দেখে তিনি সুখ পাচ্ছেন–আমি একটু কষ্ট পাই; দেলোয়ারের মা এভাবে আমার হাত ধরতেন না। অমনি নিজেকে আমার অপরাধী মনে হয়; আমি একজনের মায়ের কাছে অপরাধ করেছি বলে আরেকজনের মা সুখী হয়েছেন, যদিও তাকে সুখী করার কথা আমি কখনো ভাবি নি; এখনো ভাবতে পারছি না।
তিনি বলেন, ডলিকে দেলোয়ারদের বাসা থেকে একবারও কেউ দেখতে আসে নি।
আমি বলি, ডলি কি দেলোয়ারদের বাসায় গিয়েছিলো?
তিনি বলেন, না। আমি বারবার যেতে বলছি, ডলি যাচ্ছে না। মনে হয় কোনোদিন যাবে না। তিনি আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, তোমাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছিলো।
আমি বলি, আমার অপরাধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, না, না; তোমার জন্যেই ডলি বেঁচে আছে।
আমি বলি, আমরা দুজনই অপরাধ করেছি।
তাঁর চোখে আমি কয়েক বিন্দু অশ্রু জমতে দেখি; তিনি চোখ মুছতে মুছতে ভেতরে চলে যান।
এবার আমি মাংসমেশানো সুগন্ধটি পেতে শুরু করি;–মহাজগতের কোথাও মাংসের ভেতরে তীব্র সুগন্ধ উৎপাদন শুরু হয়েছে; সে-সুগন্ধ বইতে শুরু করেছে আমাকে ঘিরেই। আজ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে না; আমি আরো সুগন্ধের জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠছি; আমার ভেতর, মাংসের ভেতর, আমার যে-আত্মা নেই, তারও ভেতর ওই সুগন্ধের জন্যে ক্ষুধা জেগে উঠছে।
ডলি ঢুকে জিজ্ঞেস করে, মাংসমেশানো সুগন্ধ কি পাচ্ছেন?
আমি বলি, পাচ্ছি।
ডলি বলে, আজ আপনার কেমন লাগছে?
আমি বলি, এ-সুগন্ধই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
ডলি বলে, আপনার কাছে একটি কথা আমি জানতে চাই, আপনি কি আমাকে বলবেন?
আমি বলি, বলুন।
ডলি বলে, আপনি কি চান আমি সারাজীবন অপরাধবোধের মধ্যে থাকি?
আমি বলি, অপরাধবোধের মধ্যে থাকা খুব কষ্টকর।
ডলি বলে, আমি হাঁপিয়ে উঠেছি; আমি হয়তো আত্মহত্যা করে বসবো।
আমি বলি, আত্মহত্যার কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে, তবে কখনো করে উঠতে পারবো না।
ডলি বলে, মা আমাকে সব সময় জড়িয়ে ধরে রাখতে চায়, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চান, তাতে আমার মনে হয় আমি অপরাধ করেছি।
আমি বলি, আমারও এমনই মনে হয়। আমি আছি বলে মা এতো সুখী বোধ করছে যে আমার মনে হয় আমি কোনো অপরাধ করেছি।
ডলি বলে, দেলোয়ার আমাকে অপরাধবোধের মধ্যে রেখে গেছে।
দেলোয়ার আমাকে অনেক বছর অপরাধবোধের মধ্যে রেখেছিলো। আমি বলি।
ডলি বলে, সেটা কী?
আপনাকে আমি তা বলতে পারবো না; এখন আমি সেই অপরাধবোধ কাটিয়ে উঠেছি। আমি বলি।
ডলি বলে, দেখে মনে হয় না আপনি কোনো অপরাধ করতে পারেন।
আমি বলি, আমি তো প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো অপরাধ করি।
ডলি বলে, আপনি বাড়িয়ে বলছেন।
আমি বলি, এই যে আমি এখন মাংসমেশানো সুগন্ধ পাচ্ছি, আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো অপরাধ করছি।
ডলি বলে, এই সুগন্ধেই আপনি সেদিন গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন?
আমি বলি, হ্যাঁ।
ডলি বলে, আজ কেমন লাগছে?
আমি বলি, বুক ভরে সুগন্ধ নিতে ইচ্ছে করছে।
ডলি বলে, আপনি অপরাধ করছেন।
আমি বলি, আমি সব সময়ই বোধ করি আমি অপরাধ করছি, কিন্তু বুঝে উঠতে পারি না কী অপরাধ করছি, কার কাছে অপরাধ করছি।
ডলি বলে, আপনার বন্ধুর কাছে।
আমি হাসি, আমার খারাপ লাগে না;–আমি প্রফুল্ল মনেই বেরিয়ে আসি; শহরটিকে আমার সুন্দর মনে হয়। অনেক বছর আমি প্রফুল্লতা–(শব্দটি ঠিক তো? অনেক বছর। আমি শব্দটি ব্যবহার করি নি)–বোধ করি নি; অনেক বছর আমার বুক ঝলমল করে ওঠে নি। কখন থেকে আমি প্রফুল্ল নই? যে-মেয়েটিকে দেখে আমি কেপে উঠতাম, তাকে কেরোলিনের শার্টপরা মামার সাথে বেবিতে কোথায় চলে যেতে দেখার পর থেকে? অদ্ভুত চুল আঁচড়ানো দুলাভাইয়ের সাথে বেবিতে করে কোথায় চলে যেতে দেখার পর থেকে? কেনো আমার প্রফুল্লতা নষ্ট হয়ে যায়? মেয়েটি কি আমাকে কথা দিয়েছিলো সে কারো সাথে বেরিয়ে যাবে না? আমি কি কোনোদিন তাকে বলেছি আপনি কারো সাথে বেবিতে উঠবেন না; আমার সাথে উঠবেন? আমার সাথে মেয়েটি উঠবে কেনো? আমার সাথে দূরে যাবে কেনো? আমি কি তখন থেকেই প্রফুল্লতা হারিয়ে ফেলি? নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পর থেকে? অপবিত্র হওয়ার পর থেকে? আমি আজ কেনো প্রফুল্ল হয়ে উঠছি?
বৃষ্টি নামছে–মসৃণ কোমল উষ্ণ-শীতল নিবিড় সিল্ক নামছে; অনেক বছর আমি বৃষ্টি দেখি নি, ছোঁয়া পাই নি। কেনো দেখি নি, ছোঁয়া পাই নি। বৃষ্টিকে কি আমি প্রতিপক্ষ ভেবেছি? বৃষ্টির ফোঁটা না ঠাণ্ডা আলোর টুকরো এগুলো? আমার মুখে আমার চোখে। আমার চুলে রাশিরাশি আলোর টুকরো জলের টুকরো হয়ে পড়ছে; আমার সঙ্গে শুধু বৃষ্টি আছে, আর কেউ নেই। আমি বৃষ্টির সাথে খেলছি, বৃষ্টি আমার সাথে খেলছে। রাস্তার পাশে কয়েকটি গাছ আমার মতোই প্রফুল্ল, গাছগুলো গলে সবুজ রঙ ঝরে পড়ছে। সবুজ? না কালো? না লাল? না হলদে বুঝতে পারছি না। কতো বছর আমি গাছের নিচে দাঁড়াই নি। কেনো দাঁড়াই নি? আমি গাছগুলোর নিচে গিয়ে দাঁড়াই, গাছের পাতা থেকে রঙ ঝরে পড়ুক, আমার চুলের ওপর পড়ুক, আমার মুখের ওপর পড়ুক। ডলিকে ডেকে আনবো? নারায়ণগঞ্জের মেয়েটিকে? যে-মেয়েটি বেবিতে চলে যেতো, তাকে। বৃষ্টি আরো প্রচণ্ড মধুর অন্তরঙ্গ নিবিড় নামছে। যতোই নামছে, আমি প্রফুল্ল হয়ে উঠছি, বৃষ্টি ততোই নামছে। পৃথিবীতে বৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নেই। ওই দিক থেকে একটি মেয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। সেও কি আমার মতোই প্রফুল্ল। তাকে ছুঁয়ে কি বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও প্রফুল্ল? মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। না কি আমিই মেয়েটির দিকে এগোতে থাকি? মেয়েটিকে দেখে আমি হাসি; হাত নাড়ি–মেয়েটিকে চেনা মনে হয়, যদিও আগে কখনো দেখি নি; আমাকেও তার চেনা মনে হয়, যদিও আগে কখনো দেখে নি; সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। না কি আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। মেয়েটি আমার হাত ধরে-না কি আমি তার হাত ধরি? হাত ধরাধরি করে আমরা রাস্তার মাঝে দিয়ে দৌড়োই; মেয়েটি খলখল করে হাসতে থাকে; আমরা দৌড়োত থাকি। একবার আমরা রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ি। তারপরই হাত ধরাধরি করে আমরা একটি ঝোঁপের ভেতর ঢুকি; আমরা যে ঝোঁপের ভেতরে ঢুকবো আমরা জানতাম না; আমি যখন জানতে পারি মেয়েটি তখন জানতো না, মেয়েটি যখন জানতে পারে আমি তখন জানতাম না; আমরা দুজনই এক সময় এক সাথে জানতে পারি। আমাদের জড়িয়ে ধরে আমরা ঘাসের ওপর গড়িয়ে পড়ি; আমরা খলখল করে হেসে উঠি, আমাদের খলখল হাসি শুনে আমরা আরো খলখল করে হেসে উঠি;–এক সময় আমি সম্ভবত বলে উঠি, কতো লাগবে তোমার–তখন বৃষ্টি আরো কালো আরো শাদা আরো খলখল করে নামে; মেয়েটি আমাকে ঘাসের সাথে মিশিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকে, এই বিষ্টিতে টাকা লাগবে না, এই বিষ্টিতে টাকা লাগবে না।
কয়েক দিন আগে এটা আমার চোখে পড়ে; পড়ার পর থেকেই আমি ভয় পাচ্ছি–ঠাণ্ডা একটা ভয়; ভয়টা শিরশির করে আমার রক্তের ভেতর দিয়ে বয় আমি তা টের পাই। সকালে আমি যতোই অফিসের দিকে এগোতে থাকি, ভয়টা বাড়তে থাকে; আমার ভয় করতে থাকে যে আজো যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠবো দারোয়ানটি আমাকে দেখে দাঁড়াবে না, সালাম দেবে না। আগে কি দারোয়ানটি আমাকে সালাম দিতো না? আমাকে দেখে পঁড়াতো না? যতো দূর মনে পড়ছে লোকটি আগে আমাকে দেখেই লাফিয়ে উঠতো, একটা বড়ো সালাম দিতে; আমার হাতের জিনিশপত্রগুলো নেয়ার জন্যে অনেকটা টানাটানিই করতো। না, আমি তাকে জিনিশপত্রগুলো বইতে দিই নি; আমার হাতে এমন কীই বা থাকে। আমি হাতে কোনো ব্যাগ বা বাক্স বইতে পছন্দ করি না; যাদের হাতে ওগুলো থাকে তাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমার; তাদের আমি খুব শ্রদ্ধা করি; আমার অমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে ভয় হয়। আমার হাতে যা থাকে সেগুলো আমি নিজেই বয়ে নিতে পারি; তার জন্যে দারোয়ানটির মতো একটা আস্ত লোক আমার দরকার নয়। কিন্তু লোকটি আজকাল আমাকে দেখতে পায় না কেনো? আমাকে কি আজকাল আগের থেকেও গুরুত্বহীন দেখায়?
আজকাল সে নিজেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে; মুখের চারদিক ঢেকে দাড়ি রেখেছে, মাথায় একটা গোল টুপিও পরছে; লিকলিকে হলেও তাকে বেশ সম্ভ্রান্ত মনে হয়; এজন্যেই হয়তো দাঁড়ায় না, সালাম দেয় না। আমিই হয়তো কোনোদিন তাকে সালাম দিয়ে বসবো। লোকটি যদি না দাঁড়াতো, সালাম না দিতো, আমার যেতে আসতো না–আমি প্রত্যেক মানুষের মর্যাদায় বিশ্বাস করি, তাকে একটি চেয়ার এনে দিতেও মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় আমার; কিন্তু দেখছি আমার একটু যায় আসে, আমি যখন দালানে ঢুকি তখনই দেখতে পাই কেরামতুল্লাহ মিয়াও ঢুকছেন, আর তাকে দেখার আগেই দোরোয়ানটি দাঁড়িয়ে পড়ছে, উঠে বড়ো একটা সালাম দিচ্ছে; কেরামতুল্লাহ মিয়ার। বাক্সটি হাতে নিয়ে তার পেছনে পেছনে চোদো জন্মের চাকরের মতো হাঁটছে। আমি অবশ্য এ-দৃশ্য দেখতে চাই না, দেখেও দেখি না, পেছনে তাকাই না; আমি চোখ আর কান বন্ধ করে ওপরে উঠতে থাকি; কিন্তু আমি সব কিছুই দেখতে আর শুনতে থাকি; আমার সব কিছুই ঠিক থাকে, তবে মনে হয় আমার কিছুই ঠিক নেই। আমি দারোয়ানটিকে ‘তুমি’ই বলি; দেখেছি সে টুলে বসেই আমার কথার জবাব দেয় বা দেয় না; কিন্তু কেরামতুল্লাহ মিয়া তাকে ‘তুই’ই বলেন। আমি শুনতে পাই কেরামতুল্লাহ মিয়া দারোয়ানটিকে বলছেন, অই হারামজাদা, তোর বউ ক্যামন আছে? দারোয়ানটি গলে পড়ছে, সে জানাচ্ছে তার বউ ভালোই আছে; কেরামতুল্লাহ মিয়া জানতে চাচ্ছেন, হারামজাদা, আবার বউর প্যাট বানাইছছ নি? শুনে বিনয়ে দারোয়ানটি সিঁড়িতে মিশে যাচ্ছে, লজ্জায় মুখ খুলতে পারছে না, শেষে বলছে, হ, গরিবগো সখআল্লাদের আর কী আছে, কেরামতুল্লাহ মিয়া বলছেন, তর বউরে একবার দেকতে যামু; দারোয়ানটি বলছে, আমার বউ আপনের কতা প্রত্যেক দিনই কয়। কেরামতুল্লাহ মিয়াকে দারোয়ানটি চোদ্দো পুরুষের প্রভু মনে করছে; যদিও কেরামতুল্লাহ মিয়া আমার বেশ নিচের পদেই আছেন; আমার মুখোমুখি হ’লে বড়ো একটা সালাম দেন; কিন্তু দারোয়ানটি কেনো আমাকে মূল্য দিচ্ছে না?
আমি কি আগামী সকালে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে দারোয়ানটিকে বলবো, এই দাঁড়াও; আমাকে সালাম দাও? সেটা কি শোভন হবে? অন্যরা শুনলে কী ভাববে? ভাববে, না হাসবে? কিন্তু এ-দারোয়ানটিই তো বছরখানেক আগে আমার কাছে এসেছিলো; মেঝেতে মিশে গিয়ে কেরামতুল্লাহ মিয়ার নামে অভিযোগ করেছিলো যে কেরামতুল্লাহ মিয়া তাকে হারামজাদা, বাপের-জন্ম-না বলে গালি দেন, এবং ঘরে নিয়ে তাকে দিয়ে জুতো খোলান, এবং মাঝেমাঝে চড় কষিয়ে দেন, এবং তার ঘরে কোনো কোনো দিন মেয়েলোক এলে কেরামতুল্লাহ মিয়া তাকে দরোজায় দাঁড় করিয়ে রাখেন-এসব অভিযোগ করেছিলো; এবং আমি ব্যাপারটি দেখবো বলে তাকে কথাও দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই দুপুরেই দেখি কেরামতুল্লাহ মিয়া তাকে নিয়ে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন; বলছেন, হারামজাদা, একশোটা ট্যাকা নে; ঈদের বকশিশ। দারোয়ানটি পা ছুঁয়ে সালাম করছে কেরামতুল্লাহ মিয়াকে, এবং বলছে, বউর একটা শাড়ি দরকার। কেরামতুল্লাহ মিয়া বলছেন, একদিন বউ দ্যাকতে লইয়া যাইচ, শাড়ি কিন্না দিমু। আমি আর ব্যাপারটি দেখি নি; দারোয়ানটিও আর চায় না যে আমি ব্যাপারটি দেখি।
কিন্তু দারোয়ানটি আমাকে দেখে দাঁড়ায় না বা সালাম দেয় না, তাতে আমার কী আসে যায়? তবে ভেতরে ভেতরে কেনো আসে যায়? আমি কি লোকটিকে এখান থেকে বদলি করিয়ে দেবো? ইচ্ছে করলে আমি পারি; তাকে যে দেখাশোনা করে, তাকে বললেই দু-একদিনের মধ্যে দারোয়ানটিকে অন্য কোথাও বদলি করে দেবে। কিন্তু আমি কি একটি দারোয়ানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছি? তাকে কি ভেতরে ভেতরে আমার সমান করে তুলেছি? আচ্ছা, দারোয়ানটি কি আমার চেয়ারে বসতে পারতো না? আমি বসতে পারতাম না তার টুলে? আমার খারাপ লাগতে থাকে; ইচ্ছে হয় একবার নিচে নেমে তার কাছে মাফ চেয়ে আসি। আমি নিচে নামি না, মনে মনে মাফ চাই। কিন্তু দুপুরে একবার আমার নিচে নামতে হয়; দেখি দারোয়ানটি টুলে বসে আছে, আমাকে দেখে দাঁড়াচ্ছে না, সালাম দিচ্ছে না।
আমি বলি, এই, দাঁড়া।
দারোয়ানটি লাফিয়ে উঠে সালাম দেয়। আমার বেশ ভালো লাগে।
সে বলে, কী, ছার?
আমি বলি, যা দেখে আয় আমার ঘরে তালা লাগানো হয়েছে কি না।
লোকটি দৌড়ে ওপরে উঠে যায়। আমি বুঝতে পারি না এখন কোথায় যাবো। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার ওপরে উঠতে থাকি; দেখি দারোয়ানটি নিচে নেমে আসছে; আমাকে দেখেই একটা সালাম দেয়, আর কী যেনো বলে; আমি তার কথা শুনতে পাই না, শুনতে চাই না; আমি আমার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকি; আর দারোয়ানটি আমার পিছে পিছে আসতে থাকে। আমি উঠে আমার ঘর খুলে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিই; দারোয়ানটি আমার দরোজায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আমি চাই সে আমাকে ডাকুক, ভেতরে ঢুকুক; কিন্তু সে হয়তো সাহস পায় না; আমিও তাকে ডাকি না। কেরামতুল্লাহ মিয়া বারান্দায় বেরিয়েছেন, তাঁর জুতোর শব্দেই আমি তা বুঝতে পারি; দারোয়ানটিকে দেখে তিনি বলেন, এই হারামজাদা, তুই অইখানে কী করছ? এই দিকে আয়। দারোয়ানটি তাকে জোরে একটা সালাম দেয়, আমি ঘরে বসে শুনতে পাই। কেরামতুল্লাহ মিয়া বেশ জোরে কথা বলেন, এটা একটি সুবিধা; তিনি কোথায় আছেন, কী করছেন তা দূর থেকেও টের পাওয়া যায়। তিনি বলছেন, আমার ঘরে আয়, পাও দুইটা টিপ্পা দে। তারা দুজনে ঘরে ঢুকছে আমি বুঝতে পারি। এখন দারোয়ানটি কেরামতুল্লাহ মিয়ার ঘরে আছে, আমি বেরোলে তার সাথে দেখা হবে না; দাঁড়িয়ে সে আমাকে সালাম দেবে না; আমার একটু স্বস্তি লাগে। আমি বসে থাকতে পারি না, উঠে দাঁড়াই; দাঁড়াতে গিয়ে একবার পা কাঁপে; কিন্তু আমাকে এখনই বেরোতে হবে, দারোয়ানটির মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারবো না, আমি আস্তে আমার ঘরের দরোজা খুলি, মাথা নিচু করে তালা লাগানোর চেষ্টা করি, তালাটি প্রথমে লাগতে চায় না, আমি একটু ঘেমে উঠি;–তারপর সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করি।
ডলি কয়েকবার ফোন করেছে, পায় নি; সে তার পরিচয়ও দেয় নি, দিতে তার ভালো লাগে নি; সে কোনো মেস্যাজ রাখে নি; মনে করেছে একবার না একবার পাবেই; এবার পেয়ে গেলো। ডলি আশা করেছিলো আমি তাকে টেলিফোন করবো, করি নি; করি নি বলে আমার স্বভাব সম্পর্কে-আমার সম্পর্কে-একটি সিদ্ধান্ত সে। নিয়েছে, যদিও সিদ্ধান্তটি আমাকে জানাবে না। আমি কি ডলির সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছি? কারো সম্পর্কে কোনো স্থির ধারণায় পৌঁছোনো আমার পক্ষে সম্ভব হয় না; কাউকে বছরের পর বছর ধরে দেখেও আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না যে সে এ-রকম, বা ও-রকম, বা সে-রকম; ডলির সম্পর্কে হয়তো কখনোই নিতে পারবো না। নেয়ার কথাই আমার মনে আসে নি। ডলি কি তার সাথে আমাকে সম্পর্কিত মনে করছে? সে কি মনে করছে আমরা দুজন একই অপরাধের শেকলে বাঁধা পড়ে গেছি, এবং আমাদের পরস্পর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার? নইলে আমাকে সে খুঁজবে কেনো; সারাজীবনে সে খোঁজার দরকার বোধ করে নি; তার জীবনে আমি ছিলামই না; এই সেদিন প্রবেশ করেছি। ওই ঘটনা না ঘটলে সে আমাকে খুঁজতো না; ঘটনাটি ডলিকে-আমাকে বেঁধে ফেলেছে? একসঙ্গে? ডলি আমাকে খুঁজবে, একবার না পেলে বারবার খুঁজবে? আমি ডলিকে খুঁজবো, একবার না পেলে একশোবার খুঁজবো? ডলি আমাকে বাসায় যেতে বলছে; আজই যেতে বলছে-বিকেলেই; আমার সাথে তার অনেক কথা আছে। তার কথা আর কণ্ঠস্বর অদ্ভুত লাগছে আমার; এ-পর্যন্ত কেউ আমাকে বলে নি তার সাথে আমার অনেক কথা আছে। অনেক কথা কাকে বলে? আমি কখনো কারো সাথে অনেক কথা বলি নি, কখনো মনে হয় নি আমার কারো সাথে অনেক কথা আছে। অনেক কথা কি একা ডলিই বলবে, কি আমাকেও বলতে হবে? অনেক কথা শোনার জন্যে, অনেক কথা বলার জন্যে আমি তো কোনো ব্যাকুলতা বোধ করছি না।
আমি বলি, আমার সাথে আপনার অনেক কথা আছে?
ডলি বলে, তাহলে কার সাথে?
আমি বলি, কথাগুলো আপনি ভেবে ঠিক করে রেখেছেন?
ডলি বলে, চমৎকার লোক তো আপনি! কথা কি সব আগে থেকে কেউ ঠিক করে মুখস্থ করে রাখে? কথা বলতে বলতেই তো কথা আসে।
আমি বলি, কথা বলতে বলতে কি ঠিক কথা আসে?
ডলি বলে, ঠিক কথা বলে কিছু নেই; একই কথা ঠিক হতে পারে আবার ঠিক নাও হতে পারে।
আমি বলি, আপনার সাথে তো আমার অনেক কথা নেই।
ওপাশে ডলি নিশ্ৰুপ হয়ে যায়, যেনো সারা শহর ভ’রে মৃত্যু নেমে এসেছে; টেলিফোন জুড়ে বয়ে চলে ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতা; তাতে আমার হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
মেরুশীতলতা থেকে মাথা জাগিয়ে ডলি বলে, আমার আছে।
আজই যাবো বলে ডলিকে আমি কথা দিই; তবে যতোই বিকেল হতে থাকে আমার ততোই ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সন্ধ্যায় আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না, বাইরে বেরোই। অনেক বছর পুরোনো বইয়ের দোকানে যাই না, পুরোনো নিউজপ্রিন্টের গন্ধ কি না; পুরোনো গন্ধের জন্যে আমার ভেতরটা ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। পুরোনো গন্ধ শুকতে শুকতে আমি সেদিকে এগোতে থাকি। পুরোনো বাঙলা বইয়ের গন্ধ আমার ভালো লাগে না, আমার পছন্দ ঝকঝকে নতুন বাঙলা বই; কিন্তু পুরোনো ইংরেজি বই, নিউজপ্রিন্টের, আমার ভালো লাগে; তার ভেতর থেকে একটা ধূসর গন্ধ ওঠে, বিদেশি গন্ধ ওঠে, আমার ভালো লাগে। রিক্সা থেকে নেমে আমি বই পর্যন্ত পৌঁছোতে পারি না; রেলিংয়ে বোম্বের একঝাক মেয়ের সারিসারি রঙিন ছবি আমাকে এলামেলো করে দেয়; আমার রক্ত থেকে নিউজপ্রিন্টের গন্ধ মুছে যায়, আমি রঙ আর রক্তের বিপর্যয়কর গন্ধ পেতে থাকি। আমার মগজে অজস্র রঙ হল্লা করে ঢুকতে থাকে, একটি মেয়ের নাভি দেখে আমি ওই অতল গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই;–আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। একটু দূরেই রবীন্দ্রনাথ ঝুলছে, দেখে আমার হাসি পায়;–মহৎ হওয়ার কী কষ্ট; আমি এভাবে কখনো ঝুলবো না। নাভির মেয়েটির পাশে ওই ছবিটিকে অশ্লীল মনে হয়; আমি ওদিকে আর তাকাতে পারি না; কিন্তু নাভি আমাকে টানতে থাকে। নাভি, নাভি, নাভি। রবীন্দ্রনাথ যদি এখন এসে দাঁড়াতো কোন ছবিটি তাকে টানতো? কোন ছবিটি সে কিনতো? কোনো ছবি সে কিনতো না, সে মহাপুরুষ; আমি মহাপুরুষ নই, কখনো হবো না; পুরোনো বইয়ের দোকানে আমি এসেছি, কিন্তু বইয়ের কাছে যেতে পারছি না, আমাকে টেনে ধরে আছে ওই পাতালগভীর নাভিটি। কোনটি আমি কিনবো–নাভি না রবীন্দ্রনাথ? নাভি কেনা আমার ঠিক হবে না, কিনলে রবীন্দ্রনাথই কেনা উচিত। কিন্তু নাভিই আমাকে টানছে, নাভিই ডাকছে আমাকে। আমি নাভিটি কিনে ফেলি; লোকটি সুন্দরভাবে গুটিয়ে নাভিটি আমার হাতে তুলে দেয়।
ছার, নাবিডা বড় সোন্দর, একনম্বর মাল, লোকটি হাসে আর বলে, শোঅনের ঘরে টাঙ্গাইয়েন। আমি একটা টাঙ্গাইছি।
আমি লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি।
ঘরে বউ থাকলে অসুবিদা অইব, লোকটি আবার হাসে।
আমি বলি, নেই।
তাইলে ত কতা নাই, লোকটি বলে, দিইনরাইত চাইয়া থাকতে পারবেন।
আমি আবার হাসি।
লোকটি বলে, নাবির নিচের দিকটা দ্যাহেন, চাইলেই পাগল অইয়া যাইতে ইচ্ছা অয়।
আমি নাভিটি নিয়ে হাঁটতে শুরু করি; নাভিটি ভয়ঙ্করভাবে নড়ে উঠছে, আমার হাত থেকে লাফিয়ে পড়ে যাচ্ছে; আমি নাভিটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে হাঁটতে থাকি, এবং তার প্রচণ্ড আন্দোলন অনুভব করি। আমি কি নাভির নিচের দিকে চেয়েছি, আমি কি পাগল হয়ে গেছি? বোধ হয় নাভিটিকে আমি ধরে রাখতে পারবো না; নাভিটি আমার বাহু ভেঙে রাস্তায় উপচে পড়তে চাচ্ছে; আমি জোরে নাভিটিকে ধরে রাখি, কিন্তু নাভিটি আমার বাহুর ভেতরে ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত হতে থাকে। নারায়ণগঞ্জের মেয়েটি তো এমনভাবে দোলে নি; সে তো আমার বাহু ভেঙে বেরিয়ে পড়তে চায় নি;–সে বারবার চেষ্টা করছিলো যাতে আমি বোতাম খুলতে না পারি। সে আরো দশ টাকা চাচ্ছিলো; আমি তাকে আরেকটি দশ টাকা দিয়েছিলাম, তারপরও সে বোতাম খোলে নি; আমাকে খুলতে দেয় নি। এই মেয়েটির নাভির নিচে কী আছে? ভাবতে ভাবতে আমাকে পাগল হয়ে যেতে হবে? আমি একটি রিক্সা নিই, ডলিদের বাড়ির দিকে যেতে থাকি। এই নাভি নিয়ে কি আমি ডলির সামনে দাঁড়াতে পারি? ডলি আমার হাতে এটা দেখে হয়তো মনে করবে আমি তার জন্যে কোনো উপহার এনেছি; যখন বুঝবে এটা উপহার নয়, তখন হয়তো জানতে চাইবে এটা কী? আমি কি বলতে পারবো আমার হাতে একটা নাভি রয়েছে? আমি বলতে পারবো না। কিন্তু কেনো বলতে পারবো না? ডলির কাছে কি আমি একটি মহাপুরুষ হতে চাই? বাঙালি, বিশেষ করে মেয়েরা, মহত্ত্বে খুব বিশ্বাস করে; তাই পুরুষগুলো মারাত্মক মহাপুরুষ হতে চায়; প্রতিটি বাঙালি পুরুষই একেকটি অবতার। আমি পুরুষ, ডলি নারী; ডলির কাছে মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা আমার জাতিগত কর্তব্য। আমি কি ডলির কাছে অবতার হতে চাই? আমি কি চাই ডলি আমার চরিত্রের প্রশংসা করুক; আমার নির্মল চরিত্রে ডলি মুগ্ধ হোক? না, আমি তা চাই না; চরিত্রের থেকে নাভিটি আমাকে বেশি আকর্ষণ করছে। নাভিটিকে আমি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি না।
ডলি বলে, আপনার আসতে এতো দেরি হলো।
ডলি খুব ক্লান্ত; দেলোয়ার যেদিন গাড়ি নিয়ে নদীতে পড়ে যায় সেদিনও ডলির স্বর এতো ক্লান্ত শোনায় নি।
আমি বলি, একটু বইয়ের দোকানে যেতে চেয়েছিলাম।
ডলি বলে, দেলোয়ারের জন্যেও কখনো আমি এতো অপেক্ষা করি নি।
শুনে আমার ভালো লাগে। আমি বলি, একটি ছবি কিনলাম।
ডলি বলে, আমার কথা না ভেবে আপনি ছবি কিনতে গেলেন?
আমি বলি, আপনার কথা আমি সারাক্ষণ ভেবেছি।
ডলি বলে, একেই বলে সারাক্ষণ ভাবা?
আমি বলি, আমি এভাবেই ভাবি।
ডলি আমার মুখের দিকে বরফের মতো তাকিয়ে থাকে; এতোক্ষণ ধরে কেউ আমার মুখের দিকে আগে কখনো তাকায় নি। আমার মুখের দাগগুলো নিশ্চয়ই চোখে পড়ছে ডলির; তবে মুখের দাগ সম্পর্কে আমার অস্বস্তিগুলো অনেক আগেই কেটে গেছে ব’লে আমি অস্বস্তি বোধ করি না।
আমি বলি, আপনি কি আমার মুখের দাগগুলো ভালোভাবে দেখছেন?
ডলি চমকে উঠে বলে, কী বললেন?
আমি বলি, আপনি বোধ হয় আমার মুখের দাগগুলো দেখছিলেন।
ডলি বলে, না তো; আপনার মুখে দাগ আছে না কি?
আমি বলি, অনেকগুলো ছিলো।
ডলি বলে, ওসব থাক; আপনি কী ছবি কিনলেন দেখি।
আমি সামনের নিচু টেবিলের ওপর নাভিটিকে মেলে ধরি, ডলি চিৎকার করে। উঠতে গিয়ে থেমে যায়; বসা থেকে দাঁড়াতে গিয়ে বসে পড়ে; চোখ বন্ধ করতে গিয়ে চোখ বন্ধ করতে পারে না; আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বিব্রত বোধ করি না; আমি ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
ডলি বলে, আমি ভেবেছিলাম আপনি কোনো ভালো ছবি কিনেছেন।
আমি বলি, ছবিটি ভালো।
ডলি বলে, এটা আপনার কাছে ভালো ছবি?
আমি বলি, হ্যাঁ, এটা ভালো ছবি; ছবির নাভিটি।
ডলি বলে, আপনি এমন মানুষ?
আমি বলি, আপনাদের দেয়ালের ওই ছবিটির থেকে অনেক ভালো ছবি।
ডলি বলে, রবীন্দ্রনাথের ছবির থেকে এটা ভালো?
আমি বলি, হ্যাঁ।
ডলি বলে, কেনো?
আমি বলি, ওই ছবিটির দিকে তাকানো আর না তাকানো সমান।
ডলি বলে, আপনি একথা বলছেন?
আমি বলি, আর এ-ছবিটি ভরে আছে সৌন্দর্য;–অসম্ভব আগুন, ঠাণ্ডা, কোমল, রঙিন; দেখার পর কেউ আর আগের মতো থাকে না।
আমি ডলিকে অনুরোধ করি, আপনি ছবিটির দিকে আরেকবার তাকান।
ডলি আমার কথা রাখে, ছবিটির দিকে চোখ খুলে তাকায়।
আমি বলি, নাভিটি।
ডলি কোনো কথা বলে না; আমার দিকে তাকিয়ে থাকে; এমনভাবে তাকায় আমার মনে হয় আরো অনেকক্ষণ ডলি তাকিয়ে থাকুক; আমার মুখের দাগগুলো তাহলে মুছে যাবে।
আমি আবার বলি, নাভিটি।
ডলি বলে, সুন্দর, সুন্দর; তবে অশ্লীল।
আমি বলি, আপনিও তাহলে সুন্দর, সুন্দর; তবে অশ্লীল।
ডলি বলে, আমরা দুজন অপরাধ করেছি, এমন আলোচনা আমাদের সাজে না।
আমি বলি, অপরাধীরা যে-কোনো আলোচনা করতে পারে।
ডলি বলে, আপনি কি সত্যিই মনে করেন আমি অশ্লীল?
আমি বলি, জানেন, কয়েক দিন আগে আমি ফেরিঘাটে গিয়েছিলাম।
আমার কথা শুনে ডলি চমকে ওঠে; তারপর ডলিকে অসহায় দেখায়; তারপর ডলিকে রক্তশূন্য দেখায়; তারপর ডলিকে সুন্দর দেখায়; তারপর ডলিকে অপরাধী দেখায়। নিজেকে আমার হাল্কা লাগে; ডলিকে এমন অসহায় রক্তশূন্য সুন্দর অপরাধী দেখায় যে আমার ভেতরের অপরাধবোধটা অনেকটা কেটে যায়, আমি নাভিটির দিকে তাকিয়ে থাকি। তাহলে আমার থেকে ডলি বেশি অপরাধ করেছে; আমার অপরাধ ডলির অপরাধের থেকে কম। কিন্তু ফেরিঘাটে আমি কেনো গিয়েছিলাম? আমার কোনো কাজ ছিলো না বলে? আমার সময় কাটছিলো না বলে? নদীর দৃশ্য দেখতে ইচ্ছে করছিলো বলে? আমি ভুল করে একটা বাসে চেপে বসেছিলাম বলে? আমার মনে পড়ছে আমি একটা বাসে চেপে বসেছিলাম; বাসে আমি অনেক ধরনের গন্ধ। পেয়েছি, কিন্তু কোনো মাংসমেশানো তীব্র সুগন্ধ পাই নি। মাংসমেশানো তীব্র সুগন্ধ পাই নি বলে আমার দম আটকে আসে নি, বাস থেকে আমার নামতে ইচ্ছে করে নি; বাসটি যখন ফেরিতে উঠছিলো, তখনো আমি নামি নি; নামার কথাই আমার মনে আসে নি। একটা ভয়ঙ্কর শব্দ করে বাসটি ফেরিতে উঠেছিলো, উঠতে গিয়ে একবার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো; তাতে আমার অদ্ভুত ভালো লেগেছিলো; বাসের কেউ ভয় পায় নি-একটি লোক চিনেবাদাম খাচ্ছিলো; কেউ বাস থেকে নামে নি, আমিও নামি নি। বাসটির ইঞ্জিন আবার চালু হলে গোঁ গোঁ করে বাসটি ফেরির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়; আমি আমার সামনে পানি দেখে হেসে উঠি। পেছনে একটা ট্রাক এসে থামে, এতো মসৃণভাবে থামে যে মনে হয় কেউ শেলাইকল বন্ধ করলো। আমি বাস থেকে নামি নি, নামতে আমার ইচ্ছে হয় নি। ফেরি ছেড়ে দিলে আমার আরো বেশি ভালো লাগে; নদীটিকে আমার অচেনা মনে হয়। এই নদী আমি আগে দেখি নি? ফেরিটি নদীর অন্য পারে ভিড়তেই আমি বাস থেকে নেমে আসি; আমার মনে পড়ে আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই। ফেরিতে নেমে আমি ঝাল মুড়ি কিনি, খেতে আমার ভালো লাগে; অনেক দিন আমি ঝাল মুড়ি খাই নি, খাওয়ার কথাও মনে হয় নি। আমি কেনো এখানে এলাম একবার ভাবতে চেষ্টা করি। কার যেনো মুখ আমি মনে করার চেষ্টা করি, পরে মনে হয় দেলোয়ারের মুখ মনে করার চেষ্টা করছি; কিন্তু মনে করতে পারি না। এই নদীর তলদেশে যদি কখনো আমি ঘুমিয়ে পড়ি, আমার খারাপ লাগবে না; আমার হয়তো বেশি করে ঘুম পাবে; যে-ঘুম আমি ঘুমোতে চেয়েছি, কিন্তু পারি নি, সে ঘুম আমি ঘুমোতে পারবো। আমার ওপর দিয়ে ঘুমের স্রোত বয়ে যাবে। ফেরিটি আবার এপারে ফিরে আসে; আমি বাস থেকে নেমে একটি বেবি নিই; পোন্টুন বা নদীর পারে আমার দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না।
ডলি বলে, আমাকে নিয়ে গেলেন না কেনো?
আমি বলি, আপনার কথা আমার মনে পড়ে নি।
ডলি বলে, ফেরিঘাটে গেলেন অথচ আমার কথা মনে পড়লো না?
আমি বলি, আপনার কথা আমি সব সময় ভাবি না।
ডলি বলে, অথচ আপনার কথা আমি সব সময় ভাবি, দেলোয়ারের থেকে বেশি ভাবি; ফেরিঘাটের কথা মনে হলেই প্রথম আপনার কথা মনে পড়ে, তারপর দেলোয়ারের কথা।
আমি বলি, কেনো?
ডলি বলে, আপনার জন্যেই আমি আজ বেঁচে আছি। আপনার জন্যেই আমি অপরাধবোধের মধ্যে আছি।
আমি বলি, আমি আপনার বেঁচে থাকা আর অপরাধবোধ?
ডলি বলে, দুটোই।
এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে; ডলি গিয়ে দরোজা খুলে দেয়। ডলির সাথে ঢোকেন দেলোয়ারের আব্বা; আমি উঠে সালাম দিই।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি এ-বাসায় মাঝেমাঝেই আসো?
আমি বলি, জি।
তিনি বলেন, কিন্তু তুমি তো আমাদের বাসায় একবারও গেলে না।
আমি বলি, না।
তিনি বলেন, তোমাদের আগে থেকেই পরিচয় ছিলো?
আমি বলি, হ্যাঁ।
তিনি বলেন, দেলোয়ার না থাকায় তোমরা সুখীই হয়েছো।
আমি কোনো কথা বলি না, ডলি কোনো কথা বলে না। দেলোয়ারের আব্বা উঠে দাঁড়ান, দরোজার দিকে হাঁটতে থাকেন; দরোজা খুলে বেরিয়ে যান। ডলি কোনো কথা বলে না, আমি কোনো কথা বলি না।
আমার আলমারির ড্রয়ারে একটি ফাইল পড়ে আছে; অত্যন্ত জরুরি–সচিব আর যুগ্মসচিব চাচ্ছেন, মাননীয় মন্ত্রী এখনো চান নি; যুগ্মসচিব আভাস দিয়েছেন তিনিই আসলে এটা চান; আমি ড্রয়ারে ফেলে রেখেছি, ফাইলটির কথা মনে না পড়লেই আমি ভালো থাকি। কিন্তু কেনো ভালো থাকি? আমি বুঝতে পারি না। বিপ্লবটিপ্লব করে ফেলছি, তা নয়; একটা নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছি, তাও নয়; তবে ওটির কথা মনে হ’লে আমার ভালো লাগে না। আমার কাছে একটি বিশেষ নোট চাওয়া হচ্ছে, আমার তা লিখতে ইচ্ছে করছে না; প্রত্যেক দিনই চাপ পড়ছে, আমাকে ওই নোট লিখতে হবে। আমি আমলা; আমি শিখেছি বস কখনো ভুল করতে পারেন না; আমার টেবিলেই, ইংরেজিতে, একটি শ্লোক বাঁধানো রয়েছে বস কখনো ভুল করতে পারেন না; যদি সন্দেহ হয় তুমি অপর পিঠ দেখো; অপর পিঠে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা আছে। বস কখনো ভুল করতে পারেন না। এ-শ্লোকের পবিত্রতায় আমার কোনো সন্দেহ নেই; এ-শ্লোক আমি মানি, প্রথম কলমার মতো এটি আমি মেনে চলবো সারাজীবন; কিন্তু আমি ওই নোট আমি লিখতে পারছি না। আমলা হওয়া আমার ঠিক হয় নি? আমার উচিত ছিলো রাড়িখাল ভাগ্যকূল কাজিরপাগলা কণকসার হাই ইস্কুলে মাস্টার হওয়া। আমি নোট লিখছি না এটা কোনো মহৎ কাজ নয়; কিন্তু আমি লিখতে পারছি না। সৌদিতে আট হাজার শ্রমিক পাঠানোর ফাইলে আমাকে এক পারা নোট লিখতে হবে; আমি না লিখলেও চলবে, শুধু আমাকে একটা সই দিতে হবে। এটা এমন কী কঠিন কাজ। মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় একটা প্যারা লিখে ফেলি, কী লিখবো তার ভাষাটাও আমার ভেতরে তৈরি হয়ে গেছে; কিন্তু লিখতে পারছি না। ওই ফাইলের কথা মনে হ’লে আমি মরুভূমি দেখতে পাই, মরুভূমিতে নিজেকে ঝাড়ুদার হিশেবে দেখতে পাই; আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মরুভূমি আমার ভালো লাগে না। এর চেয়ে আমি পুকুরে পুকুরে পুঁটিমাছ ধরে বেচবো। আধুনিক দাসব্যবসার ফাইল এটা; এ-দাসব্যবসার ফাইল আমার খুলতে ইচ্ছে করে না, সই দিতে ইচ্ছে করে না। সবুজ গাছপালা আর কালো মেঘের ছেলেগুলোকে, আমার মনে হয়, আমি দাস করে পাঠানোর নোট লিখছি। মনে হয় নিজেকেই দাস করে পাঠাচ্ছি; নতুন হাবশি হয়ে উঠছি।
হাবশি হওয়ার জন্যে, আমি জানি, সবাই পাগল। পুকুরে পুকুরে কেউ পুঁটিমাছ ধরতে চায় না, পুকুরই নেই-পুঁটিমাছ কোথায়; সবাই হাবশি হতে চায়। নতুন একটা হাবশি জাতি হয়ে উঠছি আমরা–চমৎকার। তবু ওরা, এই আট হাজার, ঝাড়ুদার হবে; কিছু দিন পর হয়তো আমাকে পঞ্চাশ হাজার খোঁজা পাঠানোর নোট লিখতে হবে। আমাদের খোঁজারাই শ্রেষ্ঠ, ওদের সব কিছু উপড়ে ফেলা হয়; তারপর শেলাই করে দেয়া হয়; আপনারা আমাদের দেশ থেকে খোঁজা নিন, এমন কোনো আবেদন লিখতে হবে হয়তো আমাকেই আট হাজার হাবশি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দেয়াই তো ভালো; যেতে না পারলে ওরা ডাকাতি করবে, যারা চমৎকার আছি তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। ওদের হাবশি করে তোলাই ভালো। হাবশি হলেও বেশ বেতন পাবে,-আমার তিনগুণ; ফিরে ভালো বিয়ে করতে পারবে, অষ্টম শ্রেণী ফেলকরা ছেলেগুলো দেশে ফিরে বিএ পাশ মেয়ে বিয়ে করতে পারবে। সমাজের উন্নতি হবে, শিক্ষিত মায়েদের পেট থেকে শিক্ষিত সন্তান বেরোবে; সন্তানগুলোর গায়ে লেখা থাকবে না বাপ অষ্টম শ্রেণীতে ফেল করেছিলো; লেখা থাকবে না ওরা মেথরের সন্তান। ওরা হাবশি হোক, মেথর হোক আমার কিছু যায় আসে না; কিন্তু আমার কাছ থেকে যে-নোট চাওয়া হচ্ছে তা আমার লিখতে ইচ্ছে করছে না। ওখান থেকে যে-প্রস্তাব এসেছে, তা আমার খুব খারাপ লাগছে না; বিমান ভাড়া দিয়ে ওরা নেবে, তিন বছর পর ফেরার সময় বিমান ভাড়া দেবে, আর যে-বেতন দেবে সব ব্যয়ের পরও তিরিশ হাজারের মতো থাকবে। খুব খারাপ মনে হচ্ছে না আমারা কাগজপত্র দেখেই চুক্তিটা করে ফেলতে পারি; বা বেতন বাড়ানোর জন্যে একটা দাবি পাঠাতে পারি।
আমার কাছে চাওয়া হচ্ছে অন্য ধরনের নোট; লিখতে হবে ব্যাপারটি দেখার জন্যে কমপক্ষে চার সদস্যের একটি উচ্চপর্যবেক্ষক দল ওখানে যাওয়া দরকার; কেননা বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আট হাজার লোকের ব্যাপার; তাই সব কিছু ভালোভাবে দেখেই চুক্তি করা উচিত; নইলে মন্ত্রণালয় আর রাষ্ট্র অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। এটা লেখার কোনো ইচ্ছে আমার হচ্ছে না। মন্ত্রণালয় আর রাষ্ট্র অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়বে? অস্বস্তি কাকে বলে? রাষ্ট্র আর মন্ত্রণালয় অস্বস্তিকে কবে পাত্তা দিয়েছে। আমার হাসি পায়; আমি আমলা, আমার কাজ নিজের প্রয়োজনে দুঃস্বপ্ন বানানো; দুঃস্বপ্নটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা। আমি তা পারছি না। কিন্তু আজই ফাইলটা যুগ্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, এগারোটার মধ্যে না পৌঁছোলে সচিব আমাকে ডাকবেন–এমন একটা আভাস সকালেই পেয়েছি। আমি নোট লিখছি না; বরং আমার ভিখিরিনিটিকে মনে পড়ছে; লিকলিকে কুৎসিত মেয়েটিকে মনে পড়ছে। লিকলিকে কুৎসিত মেয়েটি পিঠে প্রায়-মরা একটা বাচ্চা নিয়ে আমার সামনে হাত পেতেছিলো; মনে হয় এখনো হাত পেতে আছে। আমি চারদিকটা আরেকবার দেখে নিই। না, এখানে কোনো আবর্জনা নেই; কোনো নোংরা হাত নেই। মেয়েটিকে দেখেই আমার ঘেন্না লেগেছিলো, তারচেয়ে বেশি ঘেন্না লেগেছিলো পিঠের প্রায়-মরা বাচ্চাটিকে দেখে। অমন বাচ্চা আমি দেখতে পারি না; বাচ্চাঅলা ভিখিরিনিদের আমি কখনো ভিক্ষা দিই না, বুড়ো ভিখিরিগুলোকেও দিই না; আমার ঘেন্না লাগে।
ভিখিরিনিটি হাত পেতে বাচ্চাটার জন্যে একটা টাকা চায়। আমি এড়িয়ে যেতে পারতাম; এড়াই না, দাঁড়াই; জিজ্ঞেস করি, বাচ্চাটা কার?
ভিখিরিনিটি বলে, আমার।
আমি বলি, ওর বাপ কোথায়?
ভিখিরিনিটি বলে, মইর্রা গ্যাছে।
আমি বলি, সত্য করে বলল ওর বাপ কে?
মেয়েটি ভয় পেয়ে যায়; বলে, ছার, রাস্তায় হুই, বচ্ছর বচ্ছর বাচ্চা হয়; বাপের খবর রাকতে পারি না।
সচিব আমাকে সালাম দিয়েছেন;–সালাম শব্দটি শুনলে আমার হাসি পায়। প্রথম যোগ দেয়ার পর পিয়ন আমাকে এসে বলেছিলো, ছার আপনেরে ছালাম দিছে। আমি ব্যাপারটি বুঝি নি, বলেছিলাম, স্যারকে গিয়ে বলো অলাইকুম সালাম। পিয়ন হেসে বলেছিলো, এইডা না, ছার আপনেরে ডাকছেন। আজো আমার হেসে উঠতে ইচ্ছে করে, আমি হেসে উঠি।
সচিব আমাকে বলেন, তুমি ফাইলটা ছাড়ছো না কেনো?
আমি একটু সময় নিই, কী বলবো বুঝতে পারি না; তারপর বলি, স্যার, আমাকে আপনি বলেই সম্বোধন করবেন।
সচিব চমকে ওঠেন; এটা তিনি আশা করেন নি। তিনি বলেন, তুমি বেয়াদবি করছো, খুব বিপদে পড়বে।
আমি বলি, আমাকে ক্ষমা করবেন, স্যার; আপনাকে অপমান করার জন্যে কথাটি বলি নি, বিপদেও আমি পড়তে চাই না; তবে অপরিচিত কেউ আমাকে তুমি বললে আমার ভালো লাগে না।
তিনি আরো ক্ষেপে উঠে চিৎকার করে বলেন, আমি তোমার অপরিচিত নই।
আমি বলি, আপনাকে আমি চিনি, আপনার সব সংবাদ জানি, আপনার বাল্যকাল থেকে গতকালের সব গল্প আমার জানা; আপনার তৃতীয় স্ত্রীকেও আমি দেখেছি; তবু আপনাকে আমার অপরিচিত মনে হয়।
তিনি বলেন, তুমি দাঁড়াও, দাঁড়িয়ে কথা বলো; আমার সামনে তোমার বসার অধিকার নেই।
আমি দাঁড়াই, দাঁড়াতে আমার খারাপ লাগে না; বসেই আমার খারাপ লাগছিলো, দাঁড়িয়ে আমার ভালো লাগে; সারাদিন আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো।
তিনি বলেন, নোটটা আজই লিখে দাও।
আমি বলি, স্যার, আমি লিখতে পারছি না।
তিনি বলেন, তোমাকে কথা দিচ্ছি চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হিশেবে তোমার নাম আমি রাখবো।
আমি বলি, আমার নাম রাখবেন না, স্যার; সদস্য হতে আমার ভালো লাগবে না।
তিনি বলেন, তুমি বোধ হয় আরো বেশি চাও; ঠিক আছে, যাতে জন পঞ্চাশেক লোক তুমিও পাঠাতে পারো, তাও আমি দেখবো;–তোমার অন্তত পাঁচ লাখ থাকবে।
আমি বলি, স্যার, আমি সদস্য হতে চাই না, লোকও পাঠাতে চাই না।
তিনি বলেন, কেনো?
আমি বলি, আমি নোটটি লিখতে পারবো কি না জানি না; তারপর নোট লিখলেও মরুভূমিতে আমি যেতে পারবো না।
তিনি বলেন, কেনো?
আমি কোনো জবাব দিই না।
তিনি বলেন, ওমরাটাও তোমার করা হয়ে যাবে, বেশ কিছু ডলারও থাকবে।
আমি বলি, হজ করতে আমার ভালো লাগবে না।
সচিব লাফিয়ে ওঠেন, চিৎকার করেন, তুমি কি মুসলমান নও?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না; এ-প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর আমার জানা নেই বলে মনে হয়। আমি বুঝতে পারি আমার সাথে তার আর কোনো কথা নেই। ফিরে এসে আমি নোটটা লিখে ফেলি, লিখতে আমার খারাপ লাগে না; লেখার পর দেখতে পাই বেশ গুছিয়ে লিখেছি; আমি কয়েকবার পড়ি নোটটা, পড়তে পড়তে আমার মুখস্থ হয়ে যায়।
ছুটির দিন; ঘুম থেকে জেগে দেখি সিগারেট নেই। চায়ের সাথে সিগারেট না খেলে আমার মনেই হয় না চা খাচ্ছি; মনেই হয় না ভোর হয়েছে; মনেই হয় না বেঁচে আছি; মনেই হয় না আমার বেঁচে থাকা দরকার। সিগারেট না থাকলে আমি কাজের মেয়েটিকে ডাকি, আজো ডাকছি; মেয়েটি আমার ডাকে ভোরের আলোর মতো ছুটে আসে, আজ আসছে না। মেয়েটির একটা রোগ আছে, মাঝেমাঝে পেটের ব্যথায় কাতরাতে থাকে–দেখলে মনে হয় মেয়েটি খুব কষ্ট পাচ্ছে; আমি একদিন পেট টিপেও দিয়েছিলাম; মেয়েটি আমার হাত তার পেটে শক্ত করে চেপে ধরেছিলো; আজ হয়তো তাই হয়েছে। আগেই বোঝা উচিত ছিলো মেয়েটির কিছু হয়েছে; চা চাওয়ার পর মেয়েটি চা আনে নি, মা-ই চা নিয়ে এসেছে; তখনই আমার বোঝা উচিত ছিলো। ওই হিতৈষী লোকটির পরামর্শ শোনা উচিত হয় নি আমার; লোকটি সিগারেট ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলো, ছেড়ে দেয়ার পর তার কী কী উন্নতি হয়েছে তাও বুঝিয়ে বলেছিলো; আর ছেড়ে দেয়ার একটা উপায়ও দেখিয়ে দিয়েছিলো। ছেড়ে দেয়ার উপায় হচ্ছে পাঁচটি পাঁচটি করে সিগারেট কেনা; পুরো প্যাকেট না কেনা। আমার অভ্যাস একসাথে দশ প্যাকেট কেনা; সেখান থেকে পাঁচটায় এসেই বিপদে পড়েছি, আধঘণ্টা পরপরই সিগারেট শেষ হয়ে যায়, আর মেয়েটিকে আমি দিনে পাঁচসাতবার ডাকাডাকি করি। প্যাকেটে পাঁচটা সিগারেট দেখলেই আমার ভয় লাগে, মনে হয় পৃথিবীতে সিগারেট নেই; আমার সিগারেট খাওয়ার তৃষ্ণাটা তখন তীব্র হয়ে ওঠে, পৃথিবীর সব সিগারেট একসাথে টানতে ইচ্ছে করে, আনার সাথে সাথেই আমি সিগারেটগুলো শেষ করে ফেলি; আবার মেয়েটিকে ডাকতে থাকি। মেয়েটিও চমৎকার, টাকা নিয়ে নাচতে নাচতে সিগারেট আনতে চলে যায়। আমার সিগারেট দরকার; তাই কি ও এমন নাচতে নাচতে যায়? না কি মুদিদোকানটিতে যেতে পারছে বলেই ওর পায়ে নাচ আসে? কে ওকে নাচায়? নাচুক ও; কিন্তু আজ আসছে না।
মা এসে জানতে চায়, মেয়েটিকে ডাকছো কেনো?
আমি বলি, সিগারেট আনতে হবে।
মা বলে, ওর পেট ব্যথা করছে।
সিগারেট ছাড়াই আমাকে নিরর্থক বেঁচে থাকতে হবে; আমি নিজে এখন সিগারেট কিনতে যেতে পারবো না; অর্থাৎ আমাকে বেঁচে থাকতে হবে কিন্তু আমি বেঁচে থাকবো না। আমি উঠে বাথরুমে যাই; সেখান থেকে বাবা ও মা কথা বলছেন শুনতে পাই, শুনে আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
বাবা বলছেন, আনিস মেয়েটিকে ডাকছে কেনো?
মা বলছে, সিগারেট আনার জন্যে।
বাবা বলছেন, আমাকে টাকাটা এনে দাও না, আমি সিগারেট এনে দিই।
বাবার কথা শুনে আমার সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে যায়, কাঁপতে থাকে; আমি আর বাথরুম থেকে বেরোতে পারবো না। অবসর নেয়ার পর থেকেই বাবা কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছেন, শিশু হয়ে যাচ্ছেন; সবাইকে ভয় পাচ্ছেন। আগে সবাই তার ভয়ে কাঁপতাম, মনে মনে এখনো আমি কাঁপি; কিন্তু আজকাল তিনিই সবার ভয়ে কাঁপছেন। তাঁকে আগে কখনো নামাজ পড়তে দেখি নি, আজকাল মসজিদেও যাচ্ছেন; এবং দাড়ি রেখেছেন, মুখ বেশ ঢেকে গেছে কয়েক মাসে। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম দাড়ির কোনো উপকার পাচ্ছেন কি না; জবাব দিয়েছিলেন যে বেশ পাচ্ছেন, লোকজন নিয়মিত সালাম দিচ্ছে, আগে এতো সালাম পেতেন না; আর সালাম পেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আমি বলেছিলাম, আমিও দাড়িটা রেখে ফেলবো ভাবছি, ধার্মিক হতে হলে সময় থাকেতই হওয়া ভালো, বুড়ো বয়সে ধার্মিক হওয়া খুব সন্দেহজনক; শুনে তিনি হাহাকার করে উঠেছিলেন; মার কাছে কয়েক দিন বারবার জানতে চেয়েছিলেন সত্যিই আমি দাড়ি রাখতে যাচ্ছি কি না, ধার্মিক হতে যাচ্ছি কি না; মাকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে আমি দাড়ি না রাখি। আমি প্রথম যখন সিগারেট ধরেছিলাম তিনি জানতে পারেন নি, জানার পর বেশ বড়ো একটা শাস্তি দিয়েছিলেন; দু-দিন একটি ঘরে আটকে রেখেছিলেন। আমি আজো সিগারেটে প্রতিটি টানের সাথে দু-দিন করে একটি ঘরে আটকে থাকি।
বাথরুম থেকে বেরোনোর পর মা বলে, টাকা দাও, সিগারেট আনিয়ে দিই।
আমি বলি, না, লাগবে না।
দুপুরে বাবা আমার ঘরে আসেন, আমি অবাক হই; আমার ঘরে তিনি অনেক বছর আসেন না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় খুবই ভয়ে আছেন, সাহস করে এ-ঘরে ঢুকেছেন; বিনা অনুমতিতে ঢোকার জন্যে তিনি ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছেন না। তাই তাড়াতাড়ি আমার বিছানার ওপর বসে পড়েন। চেয়ারও ছিলো দুটি; কিন্তু চেয়ারে তিনি বসলেন না, এটাই প্রথম আমার চোখে পড়লো;–আমি বাবার দিকে না তাকিয়ে চেয়ার দুটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমি বলি, আমাকে ডাকলেই পারতেন।
তিনি বলেন, না, না; একটা কথা বলতে এলাম।
আমি বলি, আপনি কেমন আছেন?
তিনি বলেন, ভালোই তো; তবে তোমার সাথে একটা কথা আছে।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
তিনি বলেন, আমার বেশ কিছু টাকা দরকার।
টাকার কথা শুনে আমার ভেতরটা শুকিয়ে যায়; বেশ কেনো, কিছু টাকাও আমি জমাতে পারি নি। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না এমনভাবে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
তিনি বলেন, চল্লিশ হাজার টাকার মতো দরকার, খুবই দরকার।
আমি বলি, এতো টাকা তো আমার নেই।
তিনি বলেন, নেই, তুমি সত্যি বলছো?
আমি বলি, সত্যি বলাই তো আপনি আমাকে শিখিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, কিন্তু তুমি যে-চাকরি করো, তাতে তো টাকা থাকার কথা।
আমি বলি, আমার বেতন কতো তা তো আপনি জানেন।
তিনি বলেন, তোমার চাকরিতে বেতন দিয়ে তো কেউ চলে না।
আমি বলি, আপনি তো ছেলেবেলায় আমাকে সৎ হওয়ার কথা বলতেন।
বাবা খুব বিব্রত বোধ করেন, মাথা নিচু করে বসে থাকেন; তিনি উঠে যেতে চেষ্টা করেন, কিন্তু উঠতে পারেন না; তিনি বসে থাকতে চান, কিন্তু বসে থাকতে পারেন না।