২. টেলিফোনে লীলা কাউকে হ্যালো বলে না

টেলিফোনে লীলা কাউকে হ্যালো বলে না। বান্ধবীদের বলে, আমি সমুচাঁ। মুহিবকে বলে, আমি লী। অপরিচিতদের বলে, লীলা কথা বলছি।

লীলা টেলিফোন করেছে মুহিবকে। যথারীতি বলল, আমি লী। ওপাশ থেকে হেড়ে গলায় কে একজন বলল, কারে চান?

লীলা বলল, এটা মুহিবের ফোন না?

ওপাশ থেকে বলল, হইতে পারে। আমি স্যারের নাম জানি না।

আপনার স্যার কে?

হিরু।

হিরু মানে? তার নাম হিরু?

নাটকের হিরু। স্যার এহন পার্ট গায়। পরে করেন।

আপনি কে?

আমার নাম ছামছু। প্রডাকশনে কাম করি। আফা, অহন রাখি। হিরুইন আমারে বুলায়!

আধঘণ্টা পর লীলা আবার টেলিফোন করল। সেই হেঁড়ে গলা। লীলা বলল, আপনি ছামছু?

জে।

আপনার স্যার কী করে?

হিরুইনের সাথে নাশতা খায়।

কী নাশতা?

এক পিস কেইক, সিঙাড়া আর কলা।

আপনার স্যারকে কি এখন টেলিফোন দেয়া যাবে?

ধরেন দিতাছি।

টেলিফোনে মুহিবের গলা পাওয়া গেল। লীলা বলল, কী করছ তুমি?

মুহিব বলল, নাটক করছি। চ্যানেল আই-এ ভ্যালেনটাইন ডে-তে দেখাবে।

তুমি অভিনয় কর জানতাম না তো!

মুহিব হাসতে হাসতে বলল, আমি নিজেও জানতাম না। পাকেচক্রে হয়ে গেল। কীভাবে হয়ে গেল পরে বলব।

কিসের অভিনয় করছ?

আমি একজন পেইন্টার। আমার সঙ্গে হঠাৎ একটা মেয়ের পরিচয় হয়েছে। এই নিয়ে গল্প। মেয়েটি অন্ধ।

কোথায় শুটিং হচ্ছে বলো তো? আমি আসছি। শুটিং দেখব। আমি জীবনে কখনো শুটিং দেখি নি।

অসম্ভব। তোমার সামনে আমি কিছুই পারব না।

তোমার অভিনয় কেমন হচ্ছে?

মনে হয় ভালো। ডিরেক্টর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমি মঞ্চকর্মী কি-না। এই থেকে মনে হলো ভালো হচ্ছে। লীলা, আমাকে ডাকছে। পরে কথা বলব। মনে হয় শট দিতে হবে।

শট দিতে হবে মানে কী?

একটা সিকোয়েন্স হবে। সিকোয়েন্সকেই এরা শট বলে। আমি ঠিক জানিও। লীলা রাখি?

 

ডিরেক্টর সাহেব সিকোয়েন্স বুঝিয়ে দিলেন। অন্ধ মেয়েটিকে আপনি রাস্তা পার করে দেবার জন্যে হাত ধরেছেন। মেয়েটি বলল, হাত ধরেছেন কেন?

আপনি বলবেন, রাস্তা পার করার জন্যে।

মেয়েটি বলবে, হাত ছাড়ুন, আমি নিজে নিজে রাস্তা পার হতে পারি।

এই বলে হাত ছাড়িয়ে সে নিজে নিজে রাস্তা পার হতে যাচ্ছে, তখন দেখা গেল দ্রুতগতিতে একটা ট্রাক আসছে। আপনি ভয়ে অস্থির হয়ে একবার ট্রাকের দিকে তাকাচ্ছেন, আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছেন। আমি কাট না বলা পর্যন্ত অভিনয় ধরে রাখবেন। অভিনয় ছেড়ে দেবেন না।

মুহিব বলল, কী বললেন বুঝতে পারলাম না স্যার। অভিনয় ধরে রাখব মানে কী?

যারা নতুন তাদের প্রধান সমস্যা, নিজের ডায়লগ বলার পরই তারা। এক্সপ্রেশন ছেড়ে দেয়। এটা করবেন না। বুঝেছেন?

জি স্যার।

দৃশ্যটা খুবই ভালো হলো। ডিরেক্টর বললেন, এক্সেলেন্ট। শুধু এক্সেলেন্ট বললেও কম বলা হবে। এক্সেলেন্টের ওপরে। তোমরা আমাদের নতুন অভিনেতা মুহিবের জন্যে একটা ক্ল্যাপ দাও।

সবাই ক্ল্যাপ দিল। ডিরেক্টর তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরাতে ধরাতে মুহিবকে বললেন, সিগারেটের ব্যান্ড হেভিট কি আছে?

মুহিব জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করল। ডিরেক্টর প্রডাকশনের এক ছেলেকে (ছামছু না, অন্য আরেকজন) বললেন, মুহিবকে এক প্যাকেট সিগারেট দাও।

প্রডাকশনের ছেলে সিগারেট দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল, ডিরেক্টর সারি আপনেরে ভালো পাইছেন। আপনার কপাল খুলল। চা খাবেন? চা দিব?

দাও।

হিরুইন আপনারে ডাকে। ঐ দেহেন, ইশারা করতেছে।

মুহিব সিগারেটের প্যাকেট হাতে এগিয়ে গেল। হিরোইনের নাম নিলি। তার গায়ের রঙ শ্যামলা। এই রঙেই তাকে সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে ফর্সা রঙ তাকে মানাত না। তার বয়স পঁচিশের ওপরে, কিন্তু দেখাচ্ছে সতেরো-আঠারো বছরের তরুণীর মতো।

নিলির মাথার ওপর প্রডাকশনের একটা ছেলে প্রকাও ছাতা ধরে আছে। নিলি বসে আছে ছায়ায়। তার পাশে একটা খালি চেয়ার আছে। মুহিব সেখানে বসল না। নিলি বলল, দূরে বসেছেন কেন? ছায়ায় এসে বসুন।

মুহিব বলল, আমি একটা সিগারেট ধরবি এইজন্যে দূরে বসেছি।

নিলি বলল, তাহলে ঠিক আছে। আমি সব সহ্য করতে পারি, দুটা জিনিস সহ্য করতে পারি না। সিগারেটের ধোয়ার গন্ধ আর কানের কাছে মশার ভনভন শব্দ। আমার এমনই কপাল, এই দুইয়ের অত্যাচার আমাকে সহ্য করতে হয়। ধরুন একটা ঘরে আমি আছি, আরো দুজন আছে। ঘরে যদি মশা থাকে, সেই মশা ঐ দুজনের কাছে যাবে না। আমার কানের কাছে এসে শুনন করতে থাকবে। আর ঐ দুজন যদি সিগারেট ধরায়, তাদের ধোয়া অন্য কোনো দিকে যাবে না। আসবে আমার কাছে। আপনি সিগারেট ধরাচ্ছেন না কেন?

মুহিব বলল, থাক, আপনার সামনে ধরাব না।

নিলি বলল, ধরান তো। আমি এখুনি প্রমাণ করব যে ধোয়া আমার দিকে আসবে।

মুহিব সিগারেট ধরাল। ধোয়া সত্যি সত্যি নিলির দিকে যাচ্ছে। নিলি খিলখিল করে হেসে ফেলল। মুহিব মনে মনে স্বীকার করল, এত সুন্দর হাসির শব্দ সে আগে কখনো শোনে নি। বেশিরভাগ রূপবতী মেয়ে নকল হাসি হাসে। হাসার সময় ঢং করার চেষ্টা করে। তাদের হাসি হায়নার হাসির মতো হয়ে যায়। মুহিবের ধারণা, প্রতিটি তরুণী মেয়ের হাসির শব্দ রেকর্ড করে তাকে শোনানো উচিত। এতে যদি কিছু হয়।

মুহিব, আপনার বোন কেমন আছে?

ভালো আছে ম্যাডাম।

অশ্রু নাম, তাই না?

জি।

তাকে ডাক্তারের কাছে কবে নিয়ে যাবেন?

এখনো ঠিক করি নাই।

আজ তো সন্ধ্যার আগেই শুটিং শেষ হবে। আজই নিয়ে যান। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আপয়েন্টমেন্ট করে দেই। দেব?

জি আচ্ছা।

নিলি হ্যান্ডব্যাগ খুলে টেলিফোন বের করল। অনেক সময় নিয়ে এসএমএস টাইপ করে পাঠিয়ে দিল। টেলিফোন ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, আটটার আগে চলে যাবেন। গ্রীনরোড়ে তার চেম্বার। ৩৮ গ্রীনরেড়ি। চেম্বারে সাইনবোর্ড আছে–নিরাময়। ডাক্তার সাহেবের নাম খালেক। মনে থাকবে?

থাকবে।

আমার অন্ধের অভিনয় কেমন হয়েছে?

ভালো হয়েছে।

দর্শক যখন দেখবে তখন কি তাদের মনে হবে এই মেয়েটা সত্যি অন্ধ?

মুহিব বলল, মনে হবে না।

নিলি বলল, কেন মনে হবে না?

কারণ আপনি বিখ্যাত অভিনেত্রী। সবাই আপনাকে চেনে। আপনি যাই করেন সবাই ধরে নেবে অভিনয় করছেন। তবে যারা আপনাকে চেনে না, তারা অন্ধ মেয়ে ভাববে। অবশ্যই ভাববে।

এত জোর দিয়ে অবশ্যই কেন বলছেন? আমাকে খুশি করার জন্যে?

জি-না ম্যাডাম। আমি হিমু গ্রুপের মানুষ। হিমু গ্রুপের মানুষ কাউকে খুশি করার জন্যে কিছু করে না।

নিলি বলল, হিমুর ব্যাপারটা আমি জানি। উপন্যাসের একটা চরিত্র। একে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কিছু নেই।

ম্যাডাম, মানুষের নিয়ম হচ্ছে, গুরুত্বহীন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া। আর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলি পাশ কাটিয়ে যাওয়া।

নিলি বলল, হতে পারে। আপনার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে, আরেকটা ধরান তো।

মুহিব অবাক হয়ে বলল, আরেকটা ধরাব?

হুঁ। আরেকটা।

কেন?

নিলি বলল, আমি বিরক্ত হতে পছন্দ করি। আপনি আরেকটা সিগারেট ধরাবেন, তার ধোয়া আমার দিকে আসবে, আমি বিরক্ত হব। মজা না? নিলি আবারো খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতেই সে উঠে গেল। ডিরেক্টর সাহেব হাতের ইশারায় ডাকছেন। শট বুঝিয়ে দেবেন।

 

ডাক্তার খালেকের চেম্বারে মুহিব বোনকে নিয়ে বসে আছে। বেচারি ভয়ে অস্থির।

সে দুবার ফিসফিস করে বলল, ভাইয়া, ভয় লাগছে।

ডাক্তার খালেকের শরীর ভারি। গলার স্বর ভারি। চশমার কাচ ভারি। তিনি তার বেয়ারাকে কঠিন কঠিন কথা নিচু স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলছেন। বেয়ারার হাতে চায়ের কাপ। হাত কাঁপছে বলে কাপ এবং পিরিচে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। যে-কোনো মুহুর্তে পিরিচ থেকে কাপ পড়ে যাবে এমন অবস্থা।

করিম, তুমি যে ভুল করেছ সেই ভুল কি আর হবে?

হবে না স্যার।

একই উত্তর গতমাসে একবার দিয়েছ, বলেছ ভুল আর হবে না। বলেছিলে?

জি স্যার।

তার আগের মাসে একবার বলেছিলে, আর ভুল হবে না। বলেছিলে যে মনে আছে?

মনে আছে।

দানে দানে তিনদান। তিনদান হয়ে গেছে। এখন বিদায়! ক্লিনিকের ম্যানেজারের কাছ থেকে বেতন নিয়ে ভ্যানিস হয়ে যাও। ভ্যানিস বুঝ? ভ্যানিস মানে হাওয়া। আর যেন তোমাকে দেখতে না পাই।

জি আচ্ছা সার।

ভ্যানিস হবার আগে আমাদের তিনজনকে তিনটা লেবু চা দিয়ে যাও। চা ভালো হলে আবার চাকরিতে বহাল হবার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।

করিম প্রায় ছুটে বের হয়ে গেল। এই অবস্থাতেও তার হাতে ধরা পিরিচ থেকে চায়ের কাপ পড়ল না। ডাঃ খালেক মুহিবের দিকে ফিরে বললেন, আপনার নাম মুহিব?

মুহিব বলল, জি স্যার।

আর এই মেয়েটির নাম অশ্রু। এই অশ্রুই কি খাটের নিচে ভূত দেখে? কি মা, তুমি ভূত দেখ?

অশ্রু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

ডাঃ খালেক বললেন, নিলি টেলিফোনে আমাকে বিস্তারিত জানিয়েছে। ওর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। নিলি আছে কেমন?

মুহিব বলল, ম্যাডাম ভালো আছেন।

অভিনয় করে বেড়াচ্ছে?

জি স্যার।

ডাঃ খালেক অশ্রুর দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন তোমার সঙ্গে কথাবার্তা। মা, বলো তুমি কি খুব ধর্মকর্ম কর?

মুহিব প্রশ্নের উত্তরে না বলতে যাচ্ছিল, তাকে চমকে দিয়ে অশ্রু বলল, জি স্যার।

পাঁচ ওয়াক্ত রেগুলার নামাজ ছাড়া আর কী পড়? তাহাজ্জুতের নামাজ পড়?

জি।

চাশতের নামাজ? সকাল এগারোটার দিকে পড়া হয়।

পড়তে চেষ্টা করি। যেদিন কোচিং খাকে সেদিন পড়তে পারি না।

ডাঃ খালেক বললেন, সিজিয়োফ্রেনিক রোগীদের অনেক লক্ষণের মধ্যে একটা হচ্ছে তারা হঠাৎ প্রবল উৎসাহে এবং আবেগে ধর্মকর্ম শুরু করে। নামাজ, রোজা, তসবি জপ।

মুহিব বলল, ও যে ধর্মকর্ম করে আমি জানতাম না স্যার। আমি কখনো দেখি নি।

ডাঃ খালেক বললেন, দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে এখন দেখি বেশির ভাগ পারিবারিক বন্ধন আলগী। পরিবারের এক সদস্য কী করছে অন্যরা তার খোঁজ রাখছে না। ছেলে ড্রাগ ধরেছে, বাবা-মা কিছুই জানে না। ভেরি স্যাড।

মুহিব বলল, জি স্যার।

ডাঃ খালেক হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, করিমকে চা দিতে বলেছি প্রায় আট মিনিট আগে। এখনো চা আসে নি।

মুহিব বলল, আপনার কথাবার্তায় সে খুব ভয় পাচ্ছিল তো, এইজন্যে ভুলে গেছে। প্রচণ্ড ভয় পেলে স্মৃতি এলোমেলো হয়। বাবা যখন আমাকে ধমকান, আমারও এরকম হয়। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, যা পাঁচটা সিগারেট নিয়ে আয়। আমি বাবার সামনে থেকে বের হই, সিগারেটের কথা ভুলে যাই।

ডাঃ খালেক অশ্রুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিও কি তোমার ভাইয়ের মতো বাবাকে ভয় পাও?

অশ্রু বলল, পাই স্যার।

তোমার বাবা কি তোমার খাটের নিচের ভূতের কথা জানেন?

জানেন।

উনি এই বিষয়ে কী বলছেন?

অশ্রু বলল, বাবা বলেছেন ভূত থাকবে ভূতের মতো, তুই থাকবি তোর মতো। সমস্যা কী?

ডাঃ খালেক বললেন, আমি তোমাকে বেশ কিছু ওষুধ দিচ্ছি। নিয়মমতো খেতে হবে। ভুল করা যাবে না। দশদিন পর আবার আসবে। এই দশদিনে কতবার ভূত দেখলে, ভূতটা কী করল, সব খাতায় লিখবে। তারিখ এবং সময়ও লেখা থাকবে। হাতের কাছে একটা খাতা নিয়ে ঘুমুতে যাবে। রাতে কোনো স্বপ্ন দেখে যদি ঘুম ভাঙে, সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটা লিখে ফেলবে। স্বপ্ন হচ্ছে Short time memory. রাতের স্বপ্ন দিনে মনে থাকে না। এইজন্যেই রাতেরটা রাতে লিখে ফেলতে হয়। কী বললাম মনে থাকবে?

জি স্যার।

রাতে কি একা ঘুমাও।

জি।

একা ঘুমুবে না। কেউ-না-কেউ যেন রাতে তোমার সঙ্গে থাকে।

জি আচ্ছা।

মুহিব ভিজিট দিতে গেল। ডাঃ খালেক বললেন, নিলি আপনাকে পাঠিয়েছে, কাজেই ভিজিটের প্রশ্ন ওঠে না। নিলি আমার পেশেন্ট ছিল। তারও অশ্রুর মতো সমস্যা ছিল, তবে সে ভূত দেখত না। অচেনা এক লোককে তার ঘরে বসে থাকতে দেখত। যাই হোক বিদায়। দশদিন পর দেখা হবে।

মুহিব উঠে দাঁড়াল, আর তখনি করিম ট্রে নিয়ে ঢুকল। ট্রেতে চা আছে, নোনতা বিসকিষ্ট আছে। তিন গ্লাস পানি আছে।

ডাঃ খালেক করিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, চা নিয়ে বি সুপিড়। তোর চা এখন কে খাবে?

চেম্বার থেকে বের হয়ে অশ্রু বলল, ডাক্তারটা পাগলা আছে, তাই না ভাইয়া?

মুহিব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, পাগলের ডাক্তাররাও খানিকটা পাগল হন।

উনি পাগলের ডাক্তার।

হুঁ।

আমি কি পাগল?

অবশ্যই পাগল। পাগল না হলে কেউ খাটের নিচে ভূত দেখে?

অশ্রু বলল, তুমি ভুলে গেছ, ভূতটা টান দিয়ে আমার মাথার এক গোছা চুল ছিঁড়ে ফেলেছিল।

মুহিব বলল, তুই নিজের চুল নিজে ছিঁড়েছিস। ভূতের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস।

নিজের মাথার চুল আমি নিজে কেন ছিঁডব?

পাগল বলেই ছিঁড়বি। যাই হোক, ওষুধ কিনে দিচ্ছি। ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে ভালো হয়ে যা।

ওষুধ যে কিনবে টাকা আছে?

আছে।

কোথায় পেয়েছ?

মুহিব জবাব দিল না। নাটকের শুটিং-এ দিনের টাকা দিনে দিয়ে দেয়। মুহিব চার হাজার টাকা পেয়েছে। ঢাক বাজিয়ে এই তথ্য জানাবার কিছু নেই।

রাস্তার ওপাশেই একটা ফার্মেসি দেখা যাচ্ছে। সে যাচ্ছে ফার্মেসির দিকে। অশ্রু তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। অশ্রুকে কেন জানি খুব আনন্দিত বলে মনে হচ্ছে।

ভাইয়া, ওষুধ কেনার পরেও কি তোমার কাছে টাকা থাকবে?

থাকতে পারে। এক জায়গা থেকে চার হাজার টাকা পেয়েছি।

যদি টাকা থাকে আমাকে একটা জিনিস কিনে দিবে?

কী জিনিস?

একটা বোরকা। বাইরে যখন যাই, পুরুষমানুষগুলা কেমন করে যেন তাকায়। এত বিশ্রী লাগে!

বোরকা কেনার মধ্যে আমি নাই।

প্লিজ ভাইয়া। প্লিজ।

মুহিব বিরক্ত মুখে নয়শ টাকা দিয়ে একটা বোরকা কিনল।

 

ভাইবোন বাসায় ফিরল রাত নটায়।

উঠানে বেতের চেয়ারে আলাউদ্দিন বসে আছেন। বারান্দায় বাতি জ্বালানো। বাতির আলোয় তার থমথমে মুখ দেখা যাচ্ছে। ছেলেমেয়েকে ঢুকতে দেখে তার মুখের চামড়া শক্ত হয়ে গেল। তিনি ছেলেকে কিছু জিজ্ঞেস না করে অশ্রুকে বললেন, কোথায় গিয়েছিলি? সত্যি কথা বলবি সত্যি কথা বললে ক্ষমা পারি। মিথ্যা বললো বটি দিয়ে গলা ফাঁক করে ফেলব।বল। কোথায় গিয়েছিলি?

অশ্রুঘলল, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম বাবা।

আলাউদ্দিন বললেন, টাং টাং ঘরে ঘুরছি আর মুখে বলছিস ভাক্তারের কাছে গিয়েছি। ফার্স্ট শো সিনেমা দেখে এসেছিস। সত্যি কথা বলা সত্যি কথা বললে ক্ষমা। সিনেমা দেখে এসেছিস।

অশ্রু বলল জি বাবা।

কোন হলে ছবি দেখেছিস বলাকা?

অশ্রুবলল, জি বাবা।

ছবির নাম কী?

অশ্রু হতাশাচোখেমুহিবের দিকে তাকালে আজ মিথ্যাদিবস বাধ্য হয়ে বোনের কারণে মুহিবকে বলতে হলো ছবির নাম, বাবা কেন আসামি।

আলাউদ্দীন অশ্রুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ছবির নামা বাবা কেন আসামি?

অশ্রুর গলা পর্যন্ত কান্না চলে আসছে।অনেক কষ্টে কান্না আটকেবলল, জি বাবা।

ঠিক আছে, সামনে থেকে যাও। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া করে আমাকে বাধিত কর।

 

খাবার সময়ও আলাউদ্দিন অনেক ঝামেলা করলেন। ডিমের তরকারিতে লবণ। বেশি হয়েছে এই নিয়ে ঝামেলা। তিনি কঠিন গলায় কালেন, চিনি বেশি হলে খাওয়া যায়। লবণ বেশি হলে খাওয়া যায় না অশ্রুর মা, তুমি কি এই কথাটা জানো?

রাজিয়া জড়সড় হয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না।

এত বছরেও যার লবণের আন্দাজ হয় নাই, তাকে কীশাস্তি দেয়া উচিত সেটা জানো? জবার দাও, জানো?

রাজিয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, জানি না।

আলাউদ্দিন ঠান্ডা গলায় বললেন, কী করা উচিত। রাজিয়া বেগম আতঙ্কিত গলায়। এদিক-ওদিক তাকালেন। ছেলেমেয়ে কাউকেই আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। এই ভয়ঙ্কর কুৎসিত কথা কেউ শোনে নি। কিংবা কে জানে ঘরে বসে হয়তো শুনেছে। তাঁর চোখে পানি এসে গিয়েছিল তিনি সাবধানে। চোখের পানি মুছলেন।

মুহিব অশ্রুর ঘরে খাটের ওপর বসে ছিল। অশ্রু বলল, বাবা কী কথা বলেছে শুনেছ ভাইয়া?

মুহিব বলল, না। আমার কানে ফিল্টারের মতো আছে। যে সব কথা শুনতে চাই না, কান সেগুলি ফিল্টার করে বাইরে ফেলে দেয়।

তুমি সত্যি শুনতে পাও নি?

মুহিব জবাব দিল না। বাটি ভাঙার আওয়াজ আসছে। আলাউদ্দিন সম্ভবত গ্লাস বাটি ছুড়ে মারা শুরু করেছেন। রাগারাগির শেষ পর্যায়ে তিনি এই কাজ করেন।

অশ্রু বলল, ভাইয়া, রাতে আমার সঙ্গে কে ঘুমাবে?

মুহিব বলল, কেউ ঘুমাবে না। তুই একা ঘুমাবি।

ভাক্তার যে বলল একা না ঘুমাতে?

মুহিব বলল, ডাক্তার একা ঘুমাতে নিষেধ করেছেন, এদিকে আবার রবীন্দ্রনাথ বলেছেন একা ঘুমাতে। ডাক্তার বড় না রবীন্দ্রনাথ বড়?

রবীন্দ্রনাথ আবার কখন একা ঘুমাতে বললেন?

মুহিব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, একলা চল একলা চল রে। চলার বেলায় একলা, আবার ঘুমুবার বেলায়ও একলা—

একলা ঘুমাও একলা ঘুমাও একলা ঘুমাও রে
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা ঘুমাও রে…

অশ্রু বলল, ভাইয়া, তোমার গানের গলা তো খুবই সুন্দর।

মুহিব বলল, তাতে সমস্যা কী?

অশ্রু বলল, তুমি কোনো একটা গানের স্কুলে ভর্তি হয়ে গান শিখ তো ভাইয়া।

মুহিব সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, শুধু গান না। নাচও শিখব। দাড়িগোঁফ কামিয়ে ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে খালি গায়ে হিজড়া নাচ দিব— এসো হে বৈশাখ।

অশ্রু হাসছে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি বন্ধ করার চেষ্টা করছে, পারছে না।

রাজিয়া ঘরে ঢুকে বললেন, তোরা খাবি না?

মুহিব বলল, বাবার রাগ কমেছে?

হ্যাঁ। ভাত খেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে।

মুহিব বলল, তোমার প্রবেশ নিষেধ?

হ্যাঁ।

মুহিব বলল, ভালোই হয়েছে, তুমি অশ্রুর সঙ্গে ঘুমাবে। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম— ডাক্তার বলেছেন রোগী যেন একা না শোয়।

রাজিয়া বললেন, রোগী মানে? অশ্রুর কী রোগ হয়েছে?

মুহিব বলল, অশ্রুর ভূতরোগ হয়েছে। খাটের নিচে যে ভূত দেখে এইটাই রোগ। মা, তাকে একটা বক্সখাট কিনে দিলে কেমন হয়! বখাটে খাটের নিচ বলে কিছু নেই, কাজেই ভূত বেচারার থাকার জায়গাও নেই। সে বাধ্য হয়ে বাবার খাটের নিচে আশ্রয় নেবে। মাঝরাতে বাবাকে ভয় দেখাবে।

রাজিয়া বললেন, খেতে আয় তো।

মুহিব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, মা, তুমি যে লটারিতে এক হাজার টাকা পেয়েছ এটা জানো?

না তো। আমি তো কোনো লটারির টিকিট কিনি নাই। মুহিব বলল, আমি তোমার হয়ে কিনেছি। সেখানে এক হাজার টাকা পাওয়া গেছে। এই নাও।

রাজিয়া টাকা হাতে নিতে নিতে আনন্দিত গলায় বললেন, কিসের লটারির টিকিট কিনেছিলি?

মুহিব বলে, ড্রামা লটারি। সেখানেই উঠেছে। তুমি বিরাট ভাগ্যবতী মা।

 

রাত একটা বাজে। মুহিবের চোখ ঘুমে ভেঙে আসছে। সে অনেক কষ্টে জেগে আছে। লীলা রাত একটায় টেলিফোন করবে। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমুতে যাবে। এই নিয়ম।

মুহিবের টেলিফোন বাজছে। মুহিব ঘুমঘুম গলায় বলল, লীলা, কেমন আছ?

লীলা বলল, বৃষ্টি হচ্ছে জানো?

মুহিব বলল, জানি। আমাদের বাসার ছাদ টিনের। ছাদে শব্দ হচ্ছে।

আমি ঠিক করেছি ছাদে উঠে বৃষ্টিতে ভিজব।

মুহিব বলল, বৃষ্টিতে ভিজে নিওমোনিয়া বাধাও। কোনো অসুবিধা নেই।

লীলা বলল, কতক্ষণ তোমাকে দেখি না জানো?

কতক্ষণ?

চুয়ান্ন ঘণ্টা। কাল সন্ধ্যায় বাসায় আসতে পারবে?

পার্টি?

হ্যাঁ পার্টি।

হাইফাই ধরনের?

বলতে পার। পার্টি দিচ্ছেন আহসান সাহেব। উনি হাইফাই পার্টি পছন্দ করেন।

আহসান সাহেবটা কে?

তুমি যদি উত্তরমেরু হও উনি দক্ষিণমেরুরও দক্ষিণ। বৎসরে ছয় মাস আমেরিকা-ইউরোপ করেন। তাঁর একটা পিএইচডি ডিগ্রি আছে। টঙ্গীতে তার এটা ওষুধ ফ্যাক্টরি আছে। সাভারে আছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি।

তোমার সঙ্গে সম্পর্কটা কী?

লীলা বলল, আমার মা তাকে খুব পছন্দ করতেন। বাবাকে মৃত্যুর আগে বলে গেছেন তার সঙ্গে যেন আমার বিয়ে হয়।

সম্ভাবনা আছে?

অবশ্যই আছে। অপছন্দ করার মতো কিছু তাঁর মধ্যে নেই।

মুহিব হাই তুলতে তুলতে বলল, টেলিফোন রাখি। ঘুম পাচ্ছে।

লীলা বলল, আচ্ছা। তোমাদের ওদিকে কি এখনো বৃষ্টি হচ্ছে?

হুঁ।

হুঁ কী! সুন্দর করে বলল।

বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।

লীলা বলল, এক লাইন বৃষ্টির গান গেয়ে টেলিফোন রাখ।

মুহিব বলল, আমি ক্যাসেট প্লেয়ার না। টিপ দেবে আর গান বের হবে।

এক লাইন। প্লিজ, এক লাইন।

বৃষ্টির গান একটাও মনে পড়ছে না।

লীলা বলল, ঐটা গাও–এসো করো স্নান নবধারা জলে– এসো নীপ বনে। গানটা মাথার মধ্যে নিয়ে আমি বৃষ্টিতে ভিজব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। তিনবার প্লিজ বললে কথা শুনতে হয়। না শুনলে কী হয় জানো?

কী হয়?

তিনদিক থেকে বিপদ আসে।

মুহিব বলল, এখন গান শুরু করলে আমার ঘুম কেটে যাবে।

লীলা বলল, ঘুম কাটলে খুব ভালো হবে। তুমিও বৃষ্টিতে ভিজবে। একই সময় একই কাজ দুজন দুদিকে করব।

মুহিব হতাশ গলায় বলল, আমার ঘুম কেটে গেছে। সারারাত আমার আর ঘুম হবে না।

ঘুমের ওষুধ খেলেও হবে না?

না। এটা আমার অনেক দিনের সমস্যা, ঘুম কাটলে ঘুম শেষ।

তাহলে গল্প কর। তোমার নাটকটা কবে দেখাবে?

জানি না।

অন্ধ সেজেছে যে মেয়েটি তার নাম কী?

নিলি।

উনি তো বিখ্যাত অভিনেত্রী।

জানি না তো।

আমাদের ইউনিভার্সিটির একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এক্স স্টুডেন্ট হিসেবে। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি অভিনয় করেন কী জন্যে? তিনি বললেন, অভিনয় হচ্ছে অন্য মানুষ সাজা। এক অর্থে মানুষকে ভেঙ্গানো। মানুষকে ভেঙ্গাতে আমার ভালো লাগে। এই জন্যেই অভিনয় করি। মজার আনসার না?

খুব মজার না। যারা শো বিজনেসে থাকেন, তাদের মজার মজার কথা বলতে হয়।

লীলা বলল, তুমিও তো এখন শো বিজনেসে ঢুকে পড়েছ। তুমি একটা মজার কথা বলো। আচ্ছা আমি প্রশ্ন করছি–মুহিব সাহেব, আপনি অভিনয় করেন কেন?

হঠাৎ কিছু টাকা পাচ্ছি এই কারণে অভিনয় করি।

আপনার জীবনের প্রথম অভিনয় নিয়ে মজার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?

না নেই। সব অভিজ্ঞতাই টেনশনের।

ঠিক আছে। একটা টেনশনের অভিজ্ঞতাই বলুন।

মুহিব বলল, একটা দৃশ্য ছিল এরকম— অন্ধ মেয়েটি দিঘির পারে বসে আছে। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। আমি যে তার পাশে বসেছি এটা সে বুঝতে পারল না। আমি তখন তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে কাশলাম।

এই দৃশ্যে টেনশনের কী আছে?

টেনশনের ব্যাপার হচ্ছে, দৃশ্যটা আমার পছন্দ হচ্ছিল না। কাশি বান্ধবীর দৃষ্টি আকর্ষণ কেন করব? আমি তখন ডিরেক্টর সাহেবকে বললাম, কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ না করে আমি যদি নিচু গলায় এক লাইন গান করি–আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে– তাহলে কেমন হয় স্যার? আমি গান গাইতে পারি। ডিরেক্টর স্যার বললেন, খুবই ভালো হয়। ম্যাডাম নিলি বললেন, মোটেই ভালো হয় না। পুরো ব্যাপারটা সিনেমেটিক হয়। সস্তা বাংলা সিনেমা। দুজনের মধ্যে তর্ক বেধে গেল। এক পর্যায়ে ম্যাডাম কঠিন গলায় বললেন, আমি এই নাটকে কাজ করব না। আমি চলে যাচ্ছি, আপনি অনা কোনো নায়িকা খুঁজে বের করুন।

উনি চলে গেলেন?

হ্যাঁ চলে গেলেন। আমার জন্যে পুরো ব্যাপারটা কেঁচে গেল। আগামীকাল শুটিং ছিল। শুটিং ক্যানসেল হয়ে গেছে।

লীলা বলল, তুমি সমস্যা বাঁধিয়েছ, তোমার উচিত সমস্যা মেটানো।

কীভাবে মেটাব?

যে সমস্যা তৈরি করে সে জানে কীভাবে সমস্যা মিটাবে। এই অনেক কথা বলে ফেলেছি— আমার নিজেরই এখন ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।

বৃষ্টিতে ভিজবে না?

অবশ্যই ভিজব। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘুমাব। তুমি কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘুমিয়েছ?

না।

একটা পাটি পেতে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। টাওয়েল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে। মুখে বৃষ্টি পড়লে ঘুম আসবে না। মনে হবে মশা কামড়াচ্ছে।

লীলা টেলিফোন রেখে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *