জ্ঞানব্রত কাছে এগিয়ে এসে সুজাতাকে জড়িয়ে ধরলেন। সুজাতা মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতেই তিনি বললেন, না, না, ভয় নেই, চুমু খাব না, তুমি কী সুন্দর, সুজাতা! তুমি স্বর্গের মানুষ। এই পৃথিবীর নও; গুড নাইট!
নিজের খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লেও তক্ষুনি ঘুম এল না জ্ঞানব্রতর। ক্যালকাটা ক্লাবের সন্ধ্যেটার কথা মনে পড়তে লাগল। এলা নামের মেয়েটি কী অদ্ভুত! তার মেয়ের প্রায় সমান। চুমকির সঙ্গে একসঙ্গে পড়েছে। সেই মেয়ে ক্যালকাটা ক্লাবে গিয়ে মদ খায় না শুধু, স্পষ্ট তাকে সিডিউলস করার চেষ্টা করেছে। চকচকে স্থির দৃষ্টি মেলে ঠোঁটটা কাঁপাচ্ছিল।
এলার ব্যাপারটা সুজাতাকে বলা হয়নি বলে জ্ঞানব্রত একটু অপরাধী বোধ করছেন। স্ত্রীর কাছে কোনো কিছু লুকোনো তাঁর স্বভাব নয়। তাঁর কোনো গোপন জীবন নেই! থাক, পরে বললেও চলবে।
মাঝরাতে ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসলেন জ্ঞানব্রত। তিনি একটা স্বপ্ন দেখছিলেন। এখনো স্বপ্নের ঘোর কাটেনি। তারপর ভালো করে চোখ মেলে দেখলেন সুজাতার খাটে তখনও আলো জ্বলছে, আর কয়েক পৃষ্ঠা বাকি বইটার। সুজাতা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।
জ্ঞানব্রত বললেন, লালন ফকির?
শব্দ শুনে এদিকে তাকিয়ে সুজাতা জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার উঠলে যে, জল খাবে?
জ্ঞানব্রত বললেন, এবার মনে পড়েছে। ওটা লালন ফকিরের গান।
এবার সুজাতা অবাক না হয়ে পারল না। সামান্য একটু ভুরু তুলে বলল, তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওই গানটার কথা ভাবছ?
হ্যাঁ, একটা স্বপ্ন দেখলুম–ছেলেবেলায় এই গানটা আমি প্রায়ই শুনতুম এক বুড়োর মুখে…আমি জানি এটা লালন ফকিরের গান…।
সুজাতা অনেকগুলো বছর বিদেশে কাটিয়েছে। বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে তার বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। তবে ফ্যাশান অনুযায়ী সে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে উপযুক্ত আগ্রহ প্রকাশ করে এবং সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি ফিলম দেখে। লালন ফকিরের নামও সে শোনেনি। কখনো কোথাও শুনে থাকলেও তার মনে ওই নাম কোনো রেখাপাত করে না।
কোনো কথা না বলে সুজাতা অপেক্ষা করে রইল। হলই-বা একটা বিদঘুটে, গেঁয়ো গান লালন ফকির নামে কোনো একজনের লেখা বা সুর দেওয়া, কিন্তু তাই নিয়ে মাঝ রাতে ঘুম ছেড়ে আলোচনা করতে হবে? এটা তো ঠিক স্বাভাবিক ব্যবহার নয়। জ্ঞানব্রত চ্যাটার্জি তো কখনো এ-রকম করেন না।
আমি বাজি ফেলে বলতে পারি এটা লালন ফকিরের গান!
তুমি কার সঙ্গে বাজি ধরতে চাইছ?
এতক্ষণে পুরোপুরি ঘোর কাটল। সত্যিই তো, তিনি প্রায় পাগলের মতন ব্যবহার করছেন।
ওঃ হো:! তোমায় ডিস্টার্ব করলুম। কত রাত হল, তুমি এখনও ঘুমোওনি?
আমি আর তিন-চার পাতা শেষ করব।
আর আধ ঘণ্টা পরে একই ঘরের দু-টি খাটে দু-জন নারী-পুরুষ দু-রকম দু-টি স্বপ্ন দেখল। একজন প্যারিসের মঁমার্ত অঞ্চলের, যেখানে ইন্সপেক্টর মেইগ্রে এইমাত্র এক কোটিপতি বাউণ্ডুলেকে স্ত্রী-হত্যার দায়ে গ্রেফতার করলেন। আর একজন দেখল বাংলার এক অতিসাধারণ পাড়াগাঁর। সেখানে দু-তিনটি শিশু লুকোচুরি খেলছে এক আমবাগানে।
পরদিন সকালে ঠিক সেই ছ-টাতেই ঘুম ভাঙল জ্ঞানব্রতর। রুটিন মেলানো প্রত্যেকটি কাজ করে যেতে লাগল। তবু মনের মধ্যে একটা অস্থির অস্থির ভাব। খেতে বসবার আগে সাতটি টেলিফোন এবং তিন জন দর্শনপ্রার্থীর সঙ্গে কাজের কথা বলতে হল তাঁকে, তবু সেই ছটফটানিটা গেল না।
খাবার টেবিলে সুজাতা ঘুম ভেঙে উঠেই ছুটে এল যথারীতি। উজ্জয়িনীও আজ এই সময় ব্রেকফার্স্ট খেতে টেবিলে এসে বসেছে। মেয়েকে আজ একটু বেশি করে লক্ষ করতে লাগলেন জ্ঞানব্রত।
এই উজ্জয়িনীরই সহপাঠিনী এলা। উজ্জয়িনী বলেছে রবিবারে ব্যাণ্ডেলে পিকনিক করতে যাবে বন্ধুদের সঙ্গে। সত্যি ব্যাণ্ডেলে যাবে, না কোনো হোটেলে গিয়ে মদ খাবে, পুরুষমানুষ সম্পর্কে ওর কি এর মধ্যেই অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে? না, না, সব মেয়ে একরকম হতে পারে না।
তুই এলা নামে কারুকে চিনিস?
মা আর মেয়ে দু-জনেই অবাক হল। সুজাতার মুখে অবশ্য তার কোনো রেশ নেই, কিন্তু উজ্জয়িনী তো এখনও ঠিক লেডি হয়নি, তাই সে বেশ চমকে গেল। তার বাবার মুখ থেকে এই ধরনের প্রশ্ন সে এই প্রথম শুনল।
এলা? কোন এলা?
সরকার না চ্যাটার্জি কী যেন বলল পদবিটা, ঠিক মনে নেই। তোর সঙ্গে ব্রেবোর্নে কোনো এক বছরে পড়েছে।
এলা কে? না তো। ওই নামে তো কাউকে মনে করতে পারছি না। ভালো নাম কী?
এটাই নিশ্চয় ভালো নাম, আমাকে শুধু ডাকনাম বলবে কেন? বলল যে একবার নাকি আমাদের এবাড়িতেও এসেছে?
তুমি তাকে কোথায় দেখলে?
ক্যালকাটা ক্লাবে…আমার একজন চেনা লোকের কাজিন হয় বলল। আমাকে আগে দেখেছে, তোর খুব চেনা।
আমাকে–ও, এলা। হ্যাঁ, এবার বুঝতে পেরেছি, মোটে এক বছর পড়েছিল, তারপর তো অনেকদিন আর দেখিনি।
তোরা ব্যাণ্ডেল যাচ্ছিস এই রোববার?
হ্যাঁ। বাবা, তোমার গাড়িটা দেবে সে-দিন?
ক-জন যাবি? ইচ্ছে করলে কারখানার একটা স্টেশন ওয়াগন নিতে পারিস।
আমরা ছ-জন। অ্যাম্বাসাডারেই হয়ে যাবে।
ড্রাইভার চাই? না, তোর বন্ধুদেরই কেউ চালাবে?
সুজাতা বলল, না, না, ওরা বড্ড জোরে চালায়…জ্ঞান সিং থাকুক ওদের সঙ্গে…
উজ্জয়িনী একবার তাকাল মায়ের দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, মা! তুমি কেমন আস্তে গাড়ি চালাও!
একথা ঠিক সুজাতার হাতে স্টিয়ারিং পড়লে আর রক্ষা নেই। ইউরোপের ট্রাফিক আর কলকাতার ট্রাফিক যে এক নয়, সে-কথা তার মনে থাকে না। দু-বার ছোটোখাটো অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, তবু সুজাতা কম স্পিডে গাড়ি চালাতে পারে না।
সুজাতা বলল, আমি তো ওইজন্যই এখন গাড়ি চালানো ছেড়ে দিয়েছি।
জ্ঞানব্রত বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া শেষ করলেন। নিজের মেয়ে সম্পর্কে তিনি মিথ্যে সন্দেহ করছিলেন। চুমকির মুখটা কত সরল, মোটেই ও এলার মতো নয়। বাড়ির গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে নির্দোষ পিকনিকে।
কারখানা থেকে অফিসে আসবার পর তিনি রেডিয়ো স্টেশনে ফোন করলেন। মি. বড়ুয়া, আমি জ্ঞানব্রত চ্যাটার্জি। আজ আবার আপনাকে একটু ডিস্টার্ব করছি।
মি. চ্যাটার্জি? বলুন, বলুন, লাস্ট ইভনিং ওয়াজ ওয়াণ্ডারফুল, খুব জমেছিল–ওই মেয়েটি আজ সকালে দেখা করতে এসেছিল আমার কাছে।
কোন মেয়েটি।
ওই যে এলা সরকার। রেডিয়োতে চান্স চায়–আপনার রেফারেন্সে এসেছে যখন, একটা কিছু ব্যবস্থা তো করতেই হবে।
জ্ঞানব্রত চ্যাটার্জি মাঝপথে বাধা দিতে গেলেও বড়ুয়া সাহেব থামলেন না।
জানেনই তো মি. চ্যাটার্জি আমাদের এখানে কিছু কিছু ফর্মালিটি তো আছেই, আমি নিজে গানটান খুব-একটা বুঝি না, ওকে একবার অডিশান দিতে হবে–আমাদের একটা মিউজিক বোর্ড আছে–তবে হয়ে যাবে, ওর ঠিক হয়ে যাবে, দেখলেই বোঝা যায় ট্যালেন্টেড, আপনি নিশ্চিত থাকুন, এজন্য আর ফোন করবার দরকার ছিল না।
জ্ঞানব্রত চ্যাটার্জি বলতে চাইলেন যে, তিনি এলা নামের ওই মেয়েটিকে মোটেই পাঠাননি। এবং তার জন্য ফোনও করছেন না।
মেয়েটা দারুণ কেরিয়ারিস্ট তো! কালকের আলাপের সুযোগ নিয়ে আজ সকালেই বড়ুয়ার সঙ্গে দেখা করেছে!
কিন্তু এসব কথা তিনি টেলিফোনে বললেন না। এলা মেয়েটিকে তিনি পাঠাননি ঠিকই। তবে ওই মেয়েটি যদি এইভাবে রেডিয়োতে গান গাইবার সুযোগ পায় তাতে তিনি বাধাই-বা দেবেন কেন? যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন ও যা পারে করুক।
মি. বড়ুয়া, আমি ফোন করছি আরও একটা কারণে…কাল সন্ধ্যে বেলা এই কথাটা আপনাকে জিজ্ঞেস করব ভেবেই–শেষপর্যন্ত আর বলাই হল না–হয়তো আপনি মনে করবেন খুবই পিকিউলিয়ার রিকোয়েস্ট।
কী ব্যাপার? আপনি এত হেজিটেট করছেন কেন?
এটা আমার বাতিকও বলতে পারেন। কাল সকাল দশটা আন্দাজ, না ঠিক দশটাই হবে। একজন একটা পল্লিগীতি গাইছিল। সেই গায়কের নামটা আমি জানতে চাই। বেতার জগতে নাম ছাপা নেই, আমি এক কপি বেতার জগত কিনে দেখলুম আজ।
কোন চ্যানেলে।
মানে!
শর্ট ওয়েভে? বিবিধ ভারতী?
তা জানি না। ইন ফ্যাক্ট, রেডিয়ো বাজছিল পাশের বাড়িতে…গানের লাইনগুলো ছিল এইরকম :
শহরে ষোলো জন বোম্বেটে
করিয়ে পাগল পারা…
গানটি শুনে বড়ুয়া সাহেবও যে রীতিমতন অবাক হয়েছেন, তা টেলিফোনের এপাশ থেকেও বোঝা যায়। তিন বার জিজ্ঞেস করলেন কী গান? মুম্বাই শহরে। দাঁড়ান, দাঁড়ান, লিখে নিই।
তারপর তিনি বললেন, এই গানের গায়কের নাম আপনি জানতে চান?
হ্যাঁ। সম্ভব হলে তার বাড়ির ঠিকানাও।
…নো প্রবলেম। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আপনাকে রিং ব্যাক করে জানিয়ে দিচ্ছি।
এদেশে যাদের নামের সঙ্গে সাহেব যুক্ত থাকে, তারা অন্তত একটা ব্যাপারে সাহেবদের মতন নন। তাঁদের পনেরো মিনিট মানে দেড় ঘণ্টা। দেড় ঘণ্টা বাদে বড়ুয়া সাহেব ফোন করে জানালেন যে ওই গানের গায়ক একজন আনকোরা নতুন শিল্পী, তার নাম শশীকান্ত দাস। ঠিকানাটা এই…।
ঠিকানাটা কাগজে লিখতে লিখতে জ্ঞানব্রত জিজ্ঞেস করলেন, এই জায়গাটা কোথায়?
বড়ুয়া সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তা কী করে জানব বলুন, উনি তো কখনো আমাকে ওঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করেননি! কী ব্যাপার বলুন তো, আপনি এই লোকটিকে নিয়ে কী করবেন?
ওর কাছ থেকে গানটা শিখব! আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। বড়ুয়াকে আর কোনো কথা না বলতে দিয়ে জ্ঞানব্রত ফোন রেখে দিলেন।
আজ সারাপৃথিবীতে তাঁর যত কাজই থাক, তবু একবার এই শশীকান্ত দাসের সঙ্গে তাকে দেখা করতেই হবে।
রেডিয়ো স্টেশনের পি সি বড়ুয়া যে ঠিকানাটি দিয়েছিলেন, সেই বাড়িটি খুঁজে বার করতে খুব বেশি অসুবিধে হল না। বাগবাজারের কাছে একটা গলির মধ্যে মেসবাড়ি। এটা যে মেসবাড়ি, তা দরজা দিয়ে ভেতরে এক-পা বাড়ালেই টের পাওয়া যায়। এইসব বাড়িতেই একটা উগ্র পুরুষ পুরুষ গন্ধ থাকে।
অনেক কালের বাড়ি, সিঁড়িগুলো ক্ষয়ে যাওয়া, রেলিং নড়বড়ে। দো-তলার বারান্দায় একটা তারে নানান রঙের লুঙি শুকোচ্ছে।
জ্ঞানব্রত এসেছেন সন্ধ্যেবেলা, কিন্তু এখনো এবাড়ির বাসিন্দারা সবাই ফিরে আসেনি। চুপচাপ, খালি খালি ভাব, সদর দরজাটা হাট করে খোলা, এক-তলাতে এক জনও লোক নেই! জ্ঞানব্রত একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন, তারপর উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে।
মাঝপথে একজন লোকের সঙ্গে দেখা হল। লোকটির গায়ের রং মিশমিশে কালো, রোগা লম্বাটে চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। লোকটি পরে আছে শুধু একটা গামছা।
তাকে এই মেসের কোনো ভৃত্য কিংবা রান্নার ঠাকুর মনে করে জ্ঞানব্রত জিজ্ঞেস করল, ওহে, শশীকান্ত দাস কোন ঘরে থাকেন বলতে পারো?
লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে গভীর বিস্ময়ে তাকাল জ্ঞানব্রতর দিকে।
তারপর আমতা আমতা করে বলল; আজ্ঞে…আমিই শশীকান্ত..।
জ্ঞানব্রত একটু হাসলেন। তিনি এমন কিছু অন্যায় করেননি। এই ঘটনার আরও অনেক ক্লাসিক উদাহরণ আছে। বঙ্কিমচন্দ্রকে খালি গায়ে দেখে একজন আগন্তুক জিজ্ঞেস করেছিল, ওহে, বঙ্কিমবাবু বাড়ি আছেন কিনা বলতে পারেন? বিদ্যাসাগর এবং মাইকেল সম্পর্কেও এরকম গল্প আছে। তবু বঙ্কিমবাবু ছিলেন সুপুরুষ। বিদ্যাসাগর বা মাইকেলের তুলনায় এই লোকটিকে বেশ সুদর্শনই বলতে হবে। গায়ের রং কালো হলেও ছিপছিপে মেদবর্জিত শরীর। ভালো করে মেকাপ দিয়ে, মাথায় একটা পালকের মুকুট পরিয়ে দিলে অনায়াসেই যাত্রাদলের কেষ্টঠাকুর সাজানো যায়।
জ্ঞানব্রত বললেন, ও, আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।
লোকটির বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। জ্ঞানব্রতর চেহারায়, ব্যক্তিত্বে ও পোশাকে বেশ একটা সম্ভ্রান্ত ব্যাপার আছে। এইরকম মানুষ সচরাচর শশীকান্ত দাসের মতন লোকের কাছে যেচে দেখা করতে আসে না।
শশীকান্ত বলল, আজ্ঞে আমি তো আপনাকে স্যার ঠিক চিনতে পারলাম না…!
জ্ঞানব্রত বললেন, আগে তো আলাপ হয়নি, চিনবেন কী করে? আপনার সঙ্গে আমার একটা দরকার আছে।
দরকারের কথা শুনে শশীকান্ত আরও বিভ্রান্ত। তার বুকের মধ্যে একই সঙ্গে দারুণ বিপদের ভয় কিংবা দারুণ কোনো সুসংবাদের আনন্দের জোয়ার-ভাটা চলছে।
আমার সঙ্গে স্যার আপনার দরকার..বলুন স্যার।
জ্ঞানব্রতর হাবভাব খুব বেশি সাহেবি ধরনের। বছরে দু-তিনবার তাঁকে ইউরোপ আমেরিকা যেতে হয়। তিনি লোকের সঙ্গে কথা বলবার সময় মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে রাখেন, কখনো একটু কাশতে হলে মুখের সামনে হাত চাপা দেন। প্রকাশ্যে কোনোদিন তিনি হাই তোলেননি কিংবা হেঁচে ফেলেননি। খাওয়ার পর ঢেকুর তোলা তার কাছে অসভ্যতার পরাকাষ্ঠা।
সেইরকমই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাজের কথা বলাও তাঁর পক্ষে একটা চরম অভদ্রতার ব্যাপার।
আপনার ঘর কোনটা?
ওই যে স্যার, সিঁড়ির ডানপাশেই সাত নম্বর।
আপনি আমায় মিনিট দশেক সময় দিলে আপনার ঘরে বসে একটু কথা বলতুম।
নিশ্চয়ই স্যার, চলুন স্যার।
শশীকান্তর সঙ্গে সিঁড়ির দু-তিন ধাপ ওঠার পর জ্ঞানব্রত আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি স্নান করতে যাচ্ছিলেন?
হ্যাঁ স্যার! সকালে জল পাওয়া যায় না, সবাই অফিস যায়, দশটার মধ্যেই চৌবাচ্চা খালি…তাই আমি বিকেলেই…
–ঠিক আছে। আপনি স্নান করে আসুন, আমার তাড়া নেই। আমি আপনার ঘরে অপেক্ষা করছি।
-না, না, স্যার, আমি পরে চান করব। একদিন চান না করলেও ক্ষতি নেই।
কিন্তু জ্ঞানব্রতর পক্ষে গামছা-পরা খালি গায়ে একজন লোকের দিকে সামনাসামনি তাকিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। তাঁর রুচিতে বাঁধে।
এবার তিনি বেশ জোর দিয়ে বললেন, না, এখনই আগে স্নান সেরে আসুন!
শশীকান্ত তবু ওপরে উঠে এসে সাত নম্বর ঘরের তালা খুলে, দরজাটা হাট করে বললে, আপনি ভেতরে বসুন। তবে, স্যার, আমি দু-মিনিটের মধ্যে চান করে আসছি।
লোকটি বুদ্ধি করে এবার একটা লুঙি ও জামা সঙ্গে নিয়ে গেল।
শশীকান্তের ব্যবহারে এর-মধ্যেই জ্ঞানব্রত একটু দুঃখিত হয়েছেন। ও একজন গায়ক, একজন শিল্পী, ও কেন একজন অচেনা লোকের সঙ্গে এমন স্যার স্যার বলে কথা বলবে সব শিল্পীরই আত্মাভিমান থাকা উচিত।
ঘরখানা স্যাঁৎসেঁতে, অন্ধকার। এ-রকম ঘরে জ্ঞানব্রত চ্যাটার্জি বহুদিন ঢোকেননি। এ রকম অস্বাস্থ্যকর ঘরেও মানুষ দিব্যি বেঁচে থাকে তাই না? তারাও হাসে, ফুর্তি করে এবং ভবিষ্যৎ কালে মানুষদের জন্ম দেয়।
ঘরের মধ্যে পাশাপাশি তিনটি খাট, তার মধ্যে দু-টি খাটের বিছানা গোটানো। অন্য বিছানাটি পাতাই রয়েছে। তার চাদরটা তেল চিটচিটে। সম্ভবত ওই বিছানাটা শশীকান্তর। দেয়ালে দুটি ক্যালেণ্ডার ছাড়া ঘরে আর কোনো আসবাব নেই। অন্ধকারটা একটু চক্ষে সইতে জ্ঞানব্রত দেখতে পেলেন, দু-দিকের দেয়ালে দু-টি আলনাও রয়েছে, তাতে জামাকাপড় ডাঁই করা।
একটি বিছানা গুটোনো খাটে জ্ঞানব্রত বসলেন অতিসন্তর্পণে। সারাঘর জুড়ে রয়েছে বিশ্রী গন্ধ, অনেকটা পচা চামড়ার গন্ধের মতন। এক-পায়ের ওপর আর এক-পা তুলে জ্ঞানব্রত পায়ের ডগাটি নাড়তে লাগলেন।
সিগারেটের তৃষ্ণাটা এইসময় তীব্র হয়ে ফিরে এল। একা কোথাও বসে কারুর জন্য অপেক্ষা করায় সিগারেটের অভাবটা বেশি অনুভব করা যায়।
দু-মিনিট না হোক, প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল শশীকান্ত। হুড়ুস-ধাড়ুস করে গায়ে জল ঢেলেই সে ছুটে এসেছে। ভিজে চুল ঝুলছে মুখের চারপাশে।
আপনি চা খাবেন স্যার?
জ্ঞানব্রত প্রথমে বললেন, না, তারপর একটু থেমে বললেন, আপনি আগে চুল আঁচড়ে নিন।
জ্ঞানব্রত প্রথমে ঠিক হুকুম করতে না চাইলেও তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধেও তাঁর গলায় সেইরকম একটা সুর ফুটে ওঠে। প্রত্যেক দিন অনেকগুলি মানুষ তাঁর আদেশ মেনে কাজ করে। সেই জন্যই জ্ঞানব্রতর এইভাবে কথা বলা অভ্যেস হয়ে গেছে।
শশীকান্ত একটা খাটের তলায় উঁকি দিয়ে টেনে আনল একটা কাঠের আয়না-চিরুনি। তা দিয়ে ঝটাপট চুল আঁচড়ে ফেলল।
শশীকান্ত একটা সবুজ লুঙির ওপর পরেছে একটা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি। এ-রকম রঙের অসামঞ্জস্যে জ্ঞানব্রতর চক্ষুকে পীড়া দেয়। তবু তিনি মুখে পাতলা হাসি ফুটিয়ে রেখেছেন।
আপনি রেডিয়োতে গান করেন?
হ্যাঁ স্যার। আপনি কি রেকর্ড কোম্পানি থেকে এসেছেন?
না। আমার সঙ্গে ওসবের কোনো সম্পর্ক নেই। একদিন রেডিয়োতে আপনার একটা গান শুনে…ইয়ে আমায়…।
জ্ঞানব্রত ঠিক শব্দটি খুঁজে পেলেন না। বস্তুত দিনের অধিকাংশ সময়ই তাঁকে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। বাংলা কথার মধ্যেও মিশে যায় ইংরেজি, পরপর দু-তিনটে টানা বাংলা বাক্য বলার অভ্যেস তাঁর নেই।
তিনি সংক্ষেপে বললেন, ভালো লেগেছিল।
কোন গানটা স্যার!
শহরে ষোলোজন বোম্বেটে…করিয়ে পাগলপারা…।
ও, ওখানা বড়ো ভালো গান স্যার! সকলেরই ভালো লাগে।
লালন ফকিরের, তাই না?
–ঠিক ধরেছেন স্যার! তবে লালন ফকিরের গানের কপিরাইট নেই। রেডিয়োর লোকেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল…
জ্ঞানব্রত একটা নিশ্চিন্ত নিশ্বাস ফেললেন।
তারপর পকেট থেকে একটা ছোটো বাক্স বার করে খুললেন। সেটির মধ্যে রয়েছে একটি নতুন হাতঘড়ি।
বাক্সটি শশীকান্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে জ্ঞানব্রত অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, আপনার গান শুনে আমার ভালো লেগেছিল সেইজন্য সামান্য একটি উপহার এনেছি। আপনি নিলে আমি খুব খুশি হব।
শশীকান্ত নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না যেন! রেডিয়োতে একখানা গান শুনে কেউ এসব দামি জিনিস উপহার দিতে পারে? রেডিয়োতে তো সবাই বিনা পয়সায় গান শোনে। পুরো একদিনের প্রোগ্রামের জন্য রেডিয়ো থেকে সে পায় পঞ্চাশ টাকা মাত্র। আর এই ভদ্রলোক একখানা গান শুনে দিচ্ছেন একটা ঘড়ি। এর দাম পাঁচ-শো না হাজার কে জানে!
এটা সত্যিই আমায় দিচ্ছেন স্যার?
আপনার জন্যই এটা এনেছি।
বস্তুত এটাও জ্ঞানব্রতর সাহেবি ব্যবহারেরই একটা অঙ্গ। এদেশের লোক অন্য লোকের সময়ের দাম দিতে জানে না। যখন-তখন অন্যের বাড়িতে বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে গিয়ে তাদের সময় নষ্ট করতে কারুর বাধে না। কিন্তু নিজের গরজে কারুর কাছে গেলে তার বিনিময়ে কিছু দেওয়া উচিত। জ্ঞানব্রত তো নিজের গরজেই এসেছেন।
শশীকান্ত মুগ্ধভাবে ঘড়িটি দেখছে। সেদিক থেকে তার চোখ ফেরাতে পারছে না। বোঝাই যায় সে কখনো নিজস্ব হাতঘড়ি হাতে পরার সুযোগ পায়নি।
আমার একটা উপকার করবেন?
চমকে উঠে শশীকান্ত বলল, কী, বলুন, স্যার?
সেদিন রেডিয়োতে আপনার ওই গানটা আমার পুরোপুরি শোনা হয়নি। যতটা শুনেছিলাম তাও মনে নেই। ওই গানটি আমাকে আর একবার গেয়ে শোনাবেন?
এখন শুনবেন, স্যার; এখানে মিউজিক-টিউজিক কিছু নেই, রেডিয়ো স্টেশনে ওদের সব ব্যবস্থা থাকে। আচ্ছা। আমি খালি গলাতেই শোনাতে পারি অবশ্য–
হঠাৎ জ্ঞানব্রতর মনে হল, মেসের এই গুমোট-অন্ধকার ঘরে বসে ওই গানটা শুনলে তাঁর ভালো লাগবে না। বরং আরো ভালো লাগাটা কেটে যাবে।
তিনি হাত তুলে বললেন, থাক। এখন থাক। এক কাজ করলে হয় বরং…একদিন আমার বাড়িতে গিয়ে ওই গানটা গাইবেন। তাহলে টেপে তুলে রাখতে পারি। যাবেন আমার বাড়িতে?
শশীকান্ত তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গিয়ে বলল, নিশ্চয়ই যাব, স্যার। কোথায় আপনার বাড়ি? কবে যাব?
কোটের পকেট থেকে জ্ঞানব্রত নিজের একটা কার্ড বার করে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই যে, এতে সব লেখা আছে।
যদি শশীকান্ত ইংরেজি না পড়তে পারে, সেইজন্য তিনি মুখেও নির্দেশ দিয়ে দিলেন তার বাড়ির অবস্থান সম্পর্কে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কাল থেকে এই রবিবারের মধ্যে যেকোনো দিন সন্ধ্যে বেলা আসতে পারেন। সাতটার পর থেকে আমি বাড়িতে থাকব।
কালই যাব স্যার।
আপনি এ গান কার কাছ থেকে শিখেছেন?
কুষ্টিয়ায় যখন ছিলাম, তখন বাবন সাঁইয়ের কাছ থেকে শিখেছিলাম। বাবন সাঁই অনেক শিখিয়েছেন আমায়। তিনি খোদ লালন ফকিরের শিষ্য!
কুষ্টিয়া?
হ্যাঁ স্যার। সেখানেই আমার বাড়ি।
এখানে এসেছেন কবে?
এসেছি তো স্যার দুই বৎসর আগে…তারপর স্রোতের শ্যাওলার মতন ভেসে বেড়াচ্ছি। কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। এখানে এই ঘরে পরেশ রায় থাকেন। তিনি আমাদের গ্রামের লোক, তিনি দয়া করে কিছুদিনের জন্য আমায় থাকতে দিয়েছেন। তা অন্য যে একজন আছেন তিনি পছন্দ করেন না আমায়। তিনি এক ঘরে তিন জন থাকা নিয়ে ম্যানেজারের কাছে কমপ্লেন করেছেন।
আপনার বাড়ির অন্য লোকজন কোথায়?
আমার মা-বাবা কেউ নেই, স্যার। আর দু-চার মাস পরে আমি নিজেই একখানা ঘর ভাড়া করতে পারব মনে হয়। রেডিয়ো আর্টিস্ট হবার পর দু-চার জায়গায় ফাংশানে চান্স পাই স্যার। পঁচাত্তর টাকা করে দেয়।
কুষ্টিয়ার কোন গ্রামে ছিল আপনার বাড়ি?
কুমারখালি। আপনি কুমারখালি গ্রামের নাম শুনেছেন, স্যার? কুমারখালিতে থানাও আছে।
যেন একটা বিদ্যুৎ চমকাল জ্ঞানব্রতর মাথার মধ্যে। তাঁর মনে পড়ে যায় তাঁর দাদামশাইয়ের মুখখানা। লম্বা চেহারা, সারামুখে দাড়ি। সম্রাট শাহজাহানের মতন পেছনে দু টি হাত দিয়ে পায়চারি করতেন লম্বা টানা বারান্দায়, আর মুখে প্রায় সবসময়ই থাকত গুনগুন গান। গান-বাজনার দারুণ ভক্ত ছিলেন তিনি। সেই দাদামশাইয়ের মুখেই জ্ঞানব্রত এই গানটা শুনেছেন অতিশৈশবে। ক-দিন ধরে সেই কথাটাই মনে করতে পারছিলেন না।
হ্যাঁ একথাও মনে পড়ছে যে, দাদামশাইয়ের কাছে প্রায়ই একজন ফকির এসে গান শোনাতেন। দু-জনে বন্ধুত্ব ছিল খুব। সেই ফকিরই কি বাবন সাঁই।
জ্ঞানব্রত অনেকটা আপন মনেই বললেন, কী আশ্চর্য যোগাযোগ? ওই কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে আমিও থাকতাম!
আপনার বাড়ি কুমারখালিতে, স্যার? কোন বাড়ি?
আমাদের নিজেদের বাড়ি নয়, মামার বাড়ি, সেখানেই আমি বেশি থেকেছি। আমার দাদামশাই ছিলেন সত্যপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যার, বাঁড়ুজ্যেদের বাড়ি। খুব নামকরা বাড়ি।
জ্ঞানব্রত সেখানে ছিলেন মাত্র ন-বছর বয়েস পর্যন্ত। সেইসময় দাদামশাই মারা যান। তারপর এগারো বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ। তারপর থেকে অনেকগুলো দুঃখকষ্টের বছরের কথা স্পষ্ট মনে আছে জ্ঞানব্রতর, কিন্তু তার আগের কথা কিছুই মনে পড়ে না। অথচ সেইসময়টা ছিল কত সুখের।
অনেকের তো দু-তিন বছর বয়েসের কথাও কিছু কিছু মনে থাকে। অথচ জ্ঞানব্রতর শৈশবটা নিশ্চিহ্ন। শুধু একটা গান, সেইসময় শোনা একটা গান এতদিন পরে ফিরে এল।
জ্ঞানব্রত সেই ধরনের মানুষ নন যে তিনি একসময় কুষ্টিয়ায় ছিলেন বলেই আর একজন কুষ্টিয়ার লোককে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরবেন আনন্দে। ও-রকম দেশোয়ালি প্রীতি তাঁর নেই। বস্তুত পূর্ববাংলা সম্পর্কে তীব্র কোনো নস্টালজিয়াও তিনি বোধ করেন না। মানুষ বাঁচে বর্তমান নিয়ে, হঠাৎ জ্ঞানব্রত শশীকান্তকে বললেন, আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন।
শশীকান্ত আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
আপনার বাক্স-বিছানা নিয়ে চলুন আমার সঙ্গে। আপনার থাকবার জায়গার অসুবিধে বলছিলেন, আপনি আমার বাড়িতে থাকবেন।
আপনার বাড়িতে থাকব, স্যার?
হ্যাঁ।
আজই?
তাতে অসুবিধে কী আছে?
পরেশদাকে কিছু বলে যাব না?
ওকে চিঠি দিয়ে যান। পরে আর একদিন এসে সব বুঝিয়ে বলবেন। আমার বাড়িতে অনেক জায়গা আছে। আপনার অসুবিধে হবে না।
না, না, আমার আর কী অসুবিধে, আমি যেখানে-সেখানে থাকতে পারি…কিন্তু, সত্যি বলব স্যার? কেমন কেমন সব লাগছে। মনে হচ্ছে যেন রূপকথা। আপনি এসে আমায় একটা ঘড়ি দিলেন, তারপর বললেন, আপনার বাড়িতে থাকতে দেবেন, এও কি সম্ভব?
জ্ঞানব্রত এবার বেশ জোরে জোরে হাসলেন!
তারপর বললেন, আপনাদের এই গলির মোড়ে আমার গাড়ি আছে। আমি সেখানে অপেক্ষা করছি! আপনি তৈরি হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসুন।
শশীকান্তকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন জ্ঞানব্রত।
নিজের বাড়িতে এসে শশীকান্তকে নিয়ে সরাসরি উঠে এলেন দো-তলায়।
এখানে একটি গেস্ট রুম সারাবছর সাজানোই থাকে। অতি নিকটাত্মীয় কেউ এলে তবেই তাকে রাখা হয় এই দো-তলার ঘরে। এ ছাড়া এক-তলায় আরও দু-টি ঘর আছে।
শশীকান্তকে ঘর এবং সংলগ্ন বাথরুম দেখিয়ে-বুঝিয়ে দিচ্ছেন জ্ঞানব্রত, এই সময় সুজাতা এসে সেখানে দাঁড়াল। যতই অবাক হোক, মুখে তার কোনো চিহ্ন ফোটাবে না সুজাতা, তবু মনে মনে সে ভাবছে, হঠাৎ কী হল মানুষটার? গত কয়েকদিন ধরে যেরকম ব্যবহার করছে তা কিছুতেই তার চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। এইরকম একটা কাঠের মিস্ত্রি টাইপের লোককে ধরে এনে দো-তলার ঘরে রাখতে চায়।
জ্ঞানব্রত স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, সুজাতা, ইনি একজন শিল্পী এর নাম শশীকান্ত দাস, আজ থেকে ইনি আমাদের এখানে থাকবেন। দেখো, যেন এর কোনো অযত্ন না হয়।
শশীকান্ত এগিয়ে এসে সুজাতার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই সুজাতা আরে আরে বলে দু-তিন পা পিছিয়ে গেল।
জ্ঞানব্রত বললেন, উজ্জয়িনী কোথায়? ওর সঙ্গে এঁর আলাপ করিয়ে দিতে চাই।
পরদিনই জ্ঞানব্রত চলে গেলেন মাদ্রাজে।
বাড়িতে যে কী একটা গন্ডগোলের সৃষ্টি করে গেলেন, তা জ্ঞানব্রত খেয়ালও করলেন না। কয়েকটা দিন তিনি একটু পাগলামিতে মেতে ছিলেন; কিন্তু কোম্পানির নানান কাজে তাঁকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাকছে।
মাদ্রাজ থেকে দিল্লি, সেখান থেকে উলটে আবার ব্যাঙ্গালোর, তারপর মুম্বাই। অর্থাৎ সাতদিনে প্রায় পাঁচ হাজার মাইল ওড়াউড়ি করতে হল জ্ঞানব্রতকে।
এদিকে বাড়িতে এক অদ্ভুত অতিথি।
প্রথম গোলমাল শুরু হল সকাল আটটায়।
সুজাতা কোনোদিনই ন-টার আগে জাগে না। এখন স্বামী কলকাতায় নেই, এখন তো আরও বেলা পর্যন্ত ঘুমোনো যায়। কাল রাতে সুজাতা স্লিপিং পিল খেয়ে শুয়েছে। তবু আটটার সময়েই তার ঘরের দরজায় দুম দুম ধাক্কা।
বেশ কিছুক্ষণ পর ঘুমজড়িত চোখে দরজা খুলে সুজাতা জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার!
সুজাতার শিক্ষাদীক্ষা এমনই যে, সে কোনো কারণে বিরক্ত হলেও প্রথমেই ঝি-চাকরের ওপর ধমকে ওঠে না, কিংবা বাড়িতে ডাকাত-পড়া অথবা আগুন-লাগার মতন বিচলিত হয়ে ওঠে না যখন-তখন।
সারদা এবাড়ির বাসনপত্ৰ মাজে, ঘর ঝাঁট দেয়। সে প্রায় চোখ কপালে তুলে বলল, ও দিদিমণি! ওঘরের বিছানায় কে একটা ডাকাতের মতন লোক ঘুমিয়ে আছে? কী সাংঘাতিক কথা! শিগগির পুলিশে খবর দাও।
মাথায় ঘুমের নেশা, সুজাতার আগের রাত্রির কথা স্পষ্ট মনে পড়ল না। সারদা আঙুল তুলে গেস্ট রুমটা দেখাল। সেখানে একজন লোক ঘুমিয়ে আছে! কে?
বাবু কোথায়?
বাবু তো ভোর বেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
তখন সুজাতার মনে পড়ল, জ্ঞানব্রতর আজ সকাল ছটা দশের ফ্লাইট ধরার কথা। নিশ্চয়ই পাঁচটার মধ্যে গেছে। এসব দিনে জ্ঞানব্রত কখনো স্ত্রীকে ডাকেন না।
কিন্তু গেস্ট রুমে কে শুয়ে থাকবে?
রতন কোথায়?
রতন দুধ আনতে গেছে, এখনও আসেনি।
এবাড়ির কাজের লোকরা রাত্তিরে সবাই নীচে থাকে। সিঁড়ির মাঝখানে একটা লোহার গেট থাকে। সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয় রাত্রে। রোজ ভোরে জ্ঞানব্রত সেই গেট খুলে দেন। তিনি কলকাতার বাইরে থাকলে এই সারদা এসে রাত্রে শুয়ে থাকে দো-তলার বারান্দায়।
পাতলা নাইটি পরে থাকে সুজাতা। ঘরের মধ্যে ফিরে ড্রেসিং গাউনটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আবার বাইরে বেরোলেন। তারপর গেস্ট রুমের দিকে কয়েক-পা এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালেন। এবার সব মনে পড়ে গেছে। সেই রাধাকান্ত না শশীকান্ত কী যেন, সেই লোকটি নিশ্চয়ই। জ্ঞানব্রত যাকে কাল রাত্রে সঙ্গে করে এনেছিলেন।
সুজাতা হেসে জিজ্ঞেস করল, কালো মতন একটা লম্বা লোক তো?
সারদা বলল, হ্যাঁ গো দিদিমণি। দেখলে ভয় করে।
ভয়ের কিছু নেই। বাবুর চেনা লোক। জেগে উঠলে চা দিস। সুজাতা আবার ফিরে গেল নিজের বিছানায়।
যাদের জীবনে কোনো ঘটনা ঘটে না, তারা প্রায়ই কোনো রোমহর্ষক ঘটনা সম্পর্কে ভাবতে ভালোবাসে।
সারদা ধরেই নিয়েছিল যে, কোনো হুমদো চেহারার চোর এবাড়িতে ঢুকে পড়ে, তারপর মনের ভুলে ঘুমিয়ে আছে। দরজা বন্ধ করে ওকে আটকে সবাই মিলে চেঁচিয়ে, পুলিশ ডেকে বেশ একখানা জমাট ব্যাপার হবে। সেসব কিছুই হল না। এ-রকম উটকো চেহারার লোক বাবুর চেনা। বাবুদের বিছানায় শোবে? সারদার স্বামীও তো এর চেয়ে অনেক সুন্দর ছিল, সে কোনোদিন বাবুদের গদিতে শোওয়ার কথা কল্পনাও করেনি।
কোমরে আঁচল জড়িয়ে সারদা এবার নির্ভয়ে অতিথির ঘরে ঢুকল। বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়েছে। মোটাসোটা গোলগাল চেহারা, মুখে মেচেতার দাগ, তবু সারদাকে দেখলে কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের গিন্নি হিসেবে অনেকের মনে হতে পারে। বেশ পরিষ্কার একটি সাদা শাড়ি পরা। এ বাড়ির দাস-দাসীরা ফিটফাট পরিচ্ছন্ন থাকবে, এই সুজাতার নির্দেশ। ওদের জামাকাপড় কিনে দিতে সুজাতার কোনো কার্পণ্য নেই।
শশীকান্ত অঘোরে ঘুমোচ্ছে। খাটের বাইরে বেরিয়ে আছে তার একটা পা। তার শোয়ার ভঙ্গিতেও গ্রাম্যতা আছে।
অনেক রাত পর্যন্ত সে ঘুমোতে পারেনি। ঘুমোনো সহজ না কি? তার জীবনের এই আকস্মিক পরিবর্তনে সে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। নরম বিছানায় শুয়ে শুয়েও উত্তেজনায় তার শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। কী হয়ে গেল ব্যাপারটা! এসব স্বপ্ন নয় তো? মাঝে মাঝে উঠে উঠে সে হাতঘড়িটা দেখছিল। এই ঘড়িটাও সত্যি, তার নিজস্ব ঘড়ি। ঠিক যেন সোনা দিয়ে তৈরি।
শেষ রাতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সারদা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি জোরে ঘর ঝাঁট দিতে লাগল। তাতেও লোকটার ঘুম ভাঙল না দেখে সে জিনিসপত্র সরাতে লাগল খটাখট শব্দে। এসময় শশীকান্ত চোখ মেলে তাকাতেই সারদা ঘুরিয়ে নিল নিজের মুখটা। একটাও কথা বলল না সে লোকটার সঙ্গে। শুধু সে যে লোকটিকে পছন্দ করেনি, এটাই বুঝিয়ে দিতে চায়।
শশীকান্তও সারদার সঙ্গে কথা বলার সাহস পেল না।
সুজাতার ভাঙা ঘুম আর জোড়া লাগেনি। আরও কিছুক্ষণ বিছানায় ছটফট করার পর ডাকলেন, রতন! রতন!
রতন ততক্ষণে দুধ নিয়ে ফিরে এসেছে। চায়ের জলও চাপানো আছে। রতন! সুজাতা ডাকা মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা নিয়ে আসতে হয়। খুব পাতলা চা দু-তিন কাপ খায় সুজাতা।
রতন চায়ের ট্রে এনে সাজিয়ে দিল সুজাতার বেড-সাইড টেবিলে।
ওই যিনি গেস্ট রুমে আছেন, তাঁকে চা দিয়েছিস?
না।
উনি জেগেছেন?
হ্যাঁ।
তাহলে চা দিসনি কেন?
ও চা খায় কি-না তা তো আমি জানি না।
সুজাতা হাসল। রতনের মুখখানা ঘোঁজ হয়ে আছে। রতনের মনের ভাব বুঝতে সুজাতার একটুও অসুবিধে হয় না।
রতনের চেহারা ও পোশাক ওই লোকটির থেকে অনেক বেশি উচ্চাঙ্গের। ওইরকম একটি লোককে ডেকে এনে বাবুদের বিছানায় শোওয়ানো হবে, এটা সে পছন্দ করবে কেন? এ রকম লোককে সেবা করতেও সে অরাজি।
ওকে জিজ্ঞেস কর। উনি যদি চা না খান, তাহলে এক কাপ দুধ দে। উনি খুব ভালো গান করেন।
আজ দুপুরেও এখানে খাবেন?
খাবেন তো নিশ্চয়ই। উনি এখানে বেশ কয়েকদিন থাকবেন। তোদের বাবু তাই তো বলে গেছেন।
এবার সুজাতা স্নানের ঘরে ঢুকবে। এরপর অন্তত এক ঘণ্টার জন্য সারাপৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
শশীকান্ত ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে আছে উবু হয়ে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘর থেকে বেরোতে সে ভয় পাচ্ছে। জ্ঞানব্রতবাবু তাকে এঘরে থাকতে বলেছেন। এঘরের বাইরে বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করা কি উচিত তার পক্ষে?
রতন কিছু জিজ্ঞেস না করেই এক কাপ চা রেখে গেছে তার সামনে। গরম গরম চা-টা শেষ করে ফেলল শশীকান্ত। এর আগে একবার সে বাথরুমটা দেখে এসেছে। বাথরুমে কমোড। শশীকান্ত জানে না ও জিনিস কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। ওঃ কী ঝামেলার মধ্যে তাকে ফেললেন ওই জ্ঞানব্রতবাবু।
এর পরের বিপত্তিটা হল অন্যরকম।
উজ্জয়িনী কাল নাইট শোতে সিনেমায় গিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে। ফিরেছে প্রায় রাত বারোটায়। সুতরাং সে শশীকান্তকে দেখেনি।
দশটা আন্দাজ ঘুম থেকে উঠেই উজ্জয়িনী গেল বাথরুমে। টুথব্রাশ হাতে নিয়ে দেখল, টুথপেস্ট নেই।
টুথপেস্ট কোম্পানির মালিকের বাড়িতেও কখনো টুথপেস্ট না থাকা বিচিত্র কিছু নয়। যে জিনিস ইচ্ছে করলেই বিনে পয়সায় শত শত পাওয়া যায়, সেই জিনিসের কথা মনেই থাকে না।
এমনও হয়েছে, সকাল বেলা বাথরুমে টুথপেস্ট না পেয়ে রতনকে পাঠিয়ে দোকান থেকে টুথপেস্টের নতুন টিউব কিনে আনতে হয়েছে। রতন অতশত বোঝে না। সে এনেছে অন্য কোম্পানির টুথপেস্ট। তখন সেটা ফেরত পাঠানো হল। কিন্তু পাড়ার দোকানে গোল্ডেন স্টার টুথপেস্ট নেই। ফলে বাধ্য হয়েই অন্য টুথপেস্ট ব্যবহার করতে হত।
জ্ঞানব্রত দৈবাৎ নিজের বাড়িতে সেই অন্য কোম্পানির টুথপেস্টের টিউব দেখে ফেলেছিলেন। তিনি ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করেননি।
বাথরুমের বন্ধ দরজার আড়াল থেকে দু-বার চেঁচিয়ে ডাকল, মা, মা।
কিন্তু সুজাতা নিজেই এখন বাথরুমে বন্দি। সে এখন মেয়ের ডাকে সাড়া দিতে পারবে না।
উজ্জয়িনীর স্বভাব অত্যন্ত ছটফটে। কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য তার নেই। সব জিনিস তার এক্ষুনি চাই।
তার মনে পড়ল। গেস্ট রুমের সঙ্গের বাথরুমে এক সেট জিনিস সবসময় রাখা থাকে। ওখান থেকে টুথপেষ্ট ধার করা যায়।
হাতে ব্রাশটা নিয়ে রাত-পোশাক পরা অবস্থাতেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে উজ্জয়িনী ছুটে গেল গেস্ট রুমে।
মায়ের কাছ থেকে এইটুকু অন্তত শিক্ষা পেয়েছে উজ্জয়িনী যে সে হঠাৎ অবাক হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে না, সহজে ভয়ও পায় না।
বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ লুঙিপরা, খালি গায়ের একজন কালো লম্বা লোক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
আড়ষ্টভাবে থমকে গেল উজ্জয়িনী।
বাঘকে বশ করবার জন্য যেমন তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে থাকতে হয়, সেইরকমভাবে চেয়ে উজ্জয়িনী জিজ্ঞেস করল, তুমি–তুমি কে?
তার চেয়েও বেশি আড়ষ্টভাবে শশীকান্ত বলল, আজ্ঞে, আমার নাম শশীকান্ত দাস—
তুমি এখানে কী করছ?
আজ্ঞে, জ্ঞানব্রতবাবু আমাকে এখানে থাকতে বলেছেন।
এখানে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি নিজে কাল রাতে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন…আমি নিজে থেকে আসতে চাইনি, তিনিই জোর করে বললেন।
উজ্জয়িনী শশীকান্তর আপাদমস্তক আর একবার দেখল! কিছুতেই এর কথা বিশ্বাস করা যায় না। তার বাবা এইরকম একটা লোককে…রতন রতন বলে ডাকতে ডাকতে উজ্জয়িনী বেরিয়ে গেল সে-ঘর থেকে। তারপর রতনের কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে তার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।
সারাদিন ধরে শশীকান্তর সঙ্গে কথা বলার জন্য কেউ এল না। উজ্জয়িনী চলে গেল কলেজে। একটু পরে সুজাতাও চলে গেল মহিলা সমিতির এক মিটিং-এ। সুজাতার খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক নেই। এক-একদিন দুপুরে কিছু খাওয়াই হয় না। শরীর থেকে অন্তত দশ পাউণ্ড ওজন খসিয়ে ফেলতে সে বদ্ধপরিকর।
রতন দুপুরের খাবার দিয়ে গেল শশীকান্তর ঘরেই।
চীনে মাটির প্লেটে ভাত, তারই মধ্যে ডাল, আলু ভাজা। আর একটি বাটিতে মাংস।
ওইটুকুনি ভাত, শশীকান্ত তিন গেরাসে খেয়ে নিতে পারে। বস্তুত ভাত ছাড়া তার আর কোনো প্রিয় খাদ্য নেই। শুধু একটু ডাল পেলেই সে পুরো এক সের চালের ভাত খেয়ে ফেলতে পারে।
সেই ভাতটুকু শেষ করে শশীকান্ত থালা চাটতে লাগল। রতনের আর পাত্তা নেই।
মেসবাড়ির ঠাকুরও জিজ্ঞেস করে আর ভাত লাগবে? আর এবাড়ির কেউ তা জিজ্ঞেস করল না? এ কীরকম বাড়ি! গতকাল রাতে জ্ঞানব্রত নিজের সঙ্গেই শশীকান্তকে নিয়ে বসেছিলেন খাবার টেবিলে। রাতে ছিল রুটি। শশীকান্ত রুটি পছন্দ করে না। তা ছাড়া প্রথম দিন সে লজ্জায় বেশি খায়নি। কিন্তু প্রত্যেক দিন এ-রকম সিকি-পেটে খেয়ে থাকতে হলেই হয়েছে আর কী! তাহলে কাজ নেই তার নরম গদির বিছানায়।