২. জুলহাজ আবছা অন্ধকারে

জুলহাজ আবছা অন্ধকারে তার বিল্ডিংয়ের ছয়তলার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঠিক যখন নিচে লাফ দেবে তখন সেখানে একটা গাড়ী এসে থেমেছে। গাড়ী থেকে যাত্রীরা নামছে। ছোট একটা ছটফটে শিশু ছোটাছুটি করছে। জুলহাজ তাই কার্নিশে দাঁড়িয়ে রইল। গাড়ীটা সরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।

ঠিক তখন তার পকেটের টেলিফোনটা বেজে উঠল। কী আশ্চর্য? এ রকম সময়ে তার পকেটে টেলিফোনটা রয়ে গেছে? বেজে বেজে টেলিফোনটা এক সময় থেমে যাবে মনে করে জুলহাজ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। টেলিফোনটা সত্যি একসময় থেমে গেল, কিন্তু থেমে গিয়ে আবার সেটা বাজতে শুরু করল। জুলহাজ তখন টেলিফোনটা বের করে সেটাকে চাপ দিয়ে নিঃশব্দ করে দেয়। অচেনা নম্বর অচেনা মানুষ কেন তাকে বিরক্ত করছে? নিচে গাড়ীটা দাঁড়িয়ে আছে তা না হলে সে মোবাইল টেলিফোনটা টুক করে নিচে ফেলে দিতো।

জুলহাজ টেলিফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কি আছে যাকে শেষ মুহূর্তে টেলিফোন করা যায়? জুলহাজ কাউকে মনে করতে পারল না। সে অনেকদিন থেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিয়েছে, সবকিছু গুছিয়ে পরিকল্পনা করেছে। সুজিতের হাতে কিছু টাকা পর্যন্ত দিয়ে রেখেছে। সুজিত তার ছেলেবেলার বন্ধু, সে একটু অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে এই টাকাগুলো দিয়ে কী করবে? জুলহাজ বলেছে, হাতে রাখ। হঠাৎ করে ক্যাশ টাকার দরকার হলে কাজে লাগবে। সুজিত কী বুঝেছে কে জানে, হাতে রেখেছে।

সে কি সুজিতকে একটা ফোন দেবে? নিচে যতক্ষণ গাড়ীটা সরে না যাচ্ছে ততক্ষণ কি সুজিতের সাথে একটু কথা বলবে? তাকে কি বলবে তুই একটু বাসায় চলে আয়। তোকে যে টাকাগুলো দিয়েছিলাম সেগুলো নিয়ে আয়?

জুলহাজ অন্যমনস্কভাবে সুজিতের নম্বরটা বের করল। ফোন করবে? ঠিক তখন দেখলো গাড়ীটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে, তাই শেষ পর্যন্ত আর ফোন করল না। আবার অন্য কোনো একটা গাড়ী এসে থামবে। আবার দেরী হয়ে যাবে। জুলহাজ ফোনটা বন্ধ করতে গিয়ে সুজিতের নামের দিকে তাকালো। সুজিতের নামের ঠিক উপরে লেখা সুইসাইড হটলাইন। কী আশ্চর্য! এই নম্বরটি সে কখন তার টেলিফোনে ঢুকিয়েছে? কেন ঢুকিয়েছে?

জুলহাজ কিছুক্ষণ নম্বরটির দিকে তাকিয়ে রইল। সে কি এখানে একবার ফোন করে দেখবে? কী হবে ফোন করলে? তারা কি অনুনয় বিনুনয় করে তাকে কিছু বলবে? জুলহাজের ভেতরে রাগ, দুঃখ, হতাশা, আনন্দ, বেদনা কোনো অনুভূতিই নেই। শুধু একটুখানি কৌতূহল রয়ে গেছে। কী হবে এখানে ফোন করলে? করে দেখবে নাকী? সে কোনো কথা বলবে না, শুধু শুনবে তারা কী বলে?

জুলহাজ নম্বরটি স্পর্শ করে ফোনটা কানে লাগালো। কয়েক সেকেন্ড পর টেলিফোনটা রিং হতে শুরু করল। জুলহাজের হঠাৎ করে মনে হল শেষ মুহূর্তে এখানে ফোন করাটি খুব বোকামো হয়েছে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় তার নিজের উপর রাগ উঠে গেলো। সে ঠিক যখন টেলিফোন লাইনটা কেটে দেবে তখন মনে হলো অন্য পাশে কেউ একজন টেলিফোন ধরেছে। নারী কণ্ঠে কিছু একটা বলছে। আবার কৌতূহল জয়ী হল। জুলহাজ টেলিফোনটা কানে লাগালো। আগে কী বলেছে সে শোনেনি, ফলে সে অপেক্ষা করে আবার কী বলে সেটা শোনার জন্য। শুনতে পেলো একটি মেয়ে বলছে, “সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

জুলহাজ মেয়েটির গলার স্বর শুনে অবাক হয়ে গেল। বাচ্চা একটা মেয়ের গলার স্বর। শুনে মনে হয় বারো কিংবা তেরো বছরের মেয়ে। এই মুহূর্তে জুলহাজের ভেতরে রাগ, দুঃখ, হতাশা, বিস্ময় কিছু থাকার কথা নয়। তবু সে একটুখানি অবাক হলো। সুইসাইড খুবই গুরুতর একটা ব্যাপার। একজন মানুষ এমনি এমনি সুইসাইড করে না। তার কারণ হটলাইন

থাকে। জটিল কারণ থাকে। এটি ছেলেমানুষী ব্যাপার নয়। এটাকে ছেলেমানুষী ব্যাপারের মত দেখাও ঠিক নয়। বারো তেরো বছরের একটা মেয়েকে এ রকম একটা গুরুতর ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে দেয়া ঠিক নয়। কী রকম প্রতিষ্ঠান এ রকম তামাশা করে? জুলহাজ অবাক হয়ে দেখল সে একটুখানি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। হাতের টেলিফোনটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল তখন শুনলো মেয়েটি কী যেন বলছে। জুলহাজ আবার শোনার চেষ্টা করল, মেয়েটা বলছে, “হ্যালো আমি সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?” জুলহাজ কোনো কথা না বলে ফোনটা ধরে রাখল, মেয়েটা তার রিনরিনে বাচ্চা মেয়ের আদুরে গলায় বলল, “আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

জুলহাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার মনে হলো সে বলে, “হ্যাঁ আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। তোমার বাবাও পারবে না!” জুলহাজ অবশ্যি কিছু বলল না। টের পেল নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ পাক খেয়ে উঠছে। জীবনের শেষ মুহূর্তটিতে এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। রাগ, দুঃখ, হতাশা, আনন্দ সবকিছুর বাইরে এক ধরনের নির্লিপ্ততায় থাকার কথা ছিল।

জুলহাজ অন্যমনস্কভাবে টেলিফোনটা কানে ধরে রাখল। শুনতে পেলো মেয়েটি কথা বলে যাচ্ছে। তার কথা শুনছে কিনা জানতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি একটু থামল। কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা নেই, তখন প্রায় হঠাৎ করে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “কিছু মনে করবেন না প্লীজ, আপনি কী–আপনি কি আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন?”

জুলহাজ রীতিমত চমকে উঠল, মেয়েটির কথায় তার হাসি পেয়ে গেল। কোনো কথা বলবে না ঠিক করে রেখেছিল তারপরও সে প্রথমবার মুখ খুলল, বলল, “হ্যাঁ। আমি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছি। লাফ দিব। এক্ষুনি লাফ দিব। ছয়তলা থেকে।”

এই প্রথম জুলহাজ একটু কৌতূহলী হলো, সে অপেক্ষা করতে লাগল মেয়েটি কী বলে শোনার জন্য। রিনরিনে গলার স্বরের বাচ্চা একটা মেয়ে কীভাবে তাকে আত্মহত্যা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে সেটা দেখার জন্য।

কৌতূহল!

নেহায়েতই কৌতূহল! জীবনের শেষ মুহূর্তের শেষ একটু কৌতূহল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *