প্ৰথম খণ্ড (অবাক বাংলাদেশ : রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি )
দ্বিতীয় খণ্ড - রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ : পথের শেষ কোথায়?
তৃতীয় খণ্ড - রাষ্ট্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ : লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে
চতুর্থ খণ্ড - নির্বাচন : আমার ভোট আমি দেব
পঞ্চম খণ্ড - রাজনৈতিক সংস্কৃতি : কান্ডারি হুঁশিয়ার
ষষ্ঠ খণ্ড - উত্তরণের সন্ধান : কোথায় চলেছি?

২. জাতীয়তাবাদ : জয় বাংলা ও বাংলার জয়

দ্বিতীয় খণ্ড – রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ : পথের শেষ কোথায়?

The Philosophers have only interpreted the world, in various ways. The point, however, is to change it.
—Karl Marx
(Words inscribed on Marx’s grave)

Failure and disillusionment are realities, but ideologies are dreams. And dreams, it would seem, do not fade easily.
—Miyuki Miyabe

পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কি আছে শেষে।
এত সাধনা! এত কামনা কোথায় মেশে?
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২. জাতীয়তাবাদ : জয় বাংলা ও বাংলার জয়

২.১ প্রস্তাবনা : অবশ্যম্ভাবী না কাকতালীয়?

একজন অতি আকর্ষণীয় মহিলার ছলাকলা, কতিপয় মুসলিম আমলার কূটচাল ও অতিথিবৎসলদের দেশে এক রাজনৈতিক নেতার হাড়কিপটেমি—এ ধরনের কতিপয় কাকতালীয় দুর্ঘটনার ফলে পাকিস্তানের জন্ম। ১৯৬১ সালে মওলানা আবুল কালাম আজাদের (১৮৮৮-১৯৫৮) India Wins Freedom শীর্ষক আত্মজীবনী পড়ে আমার কাছে তা-ই মনে হয়েছিল।[১] অথচ তখন পাকিস্তানিরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো বিচক্ষণ নেতার আবির্ভাবের ফলেই পাকিস্তানের পয়দা সম্ভব হয়েছিল।

প্রথমে মওলানা আজাদের ব্যাখ্যা নিয়ে শুরু করি। মওলানা সাহেব মনে করতেন, জিন্নাহর মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ দাবি ছিল পাকিস্তান নামের একটি সার্বভৌম স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব জানতেন যে পাকিস্তান ধারণাটি ছিল অবাস্তব। তাই জিন্নাহ ও তাঁর চেলারা স্বাধীন রাষ্ট্র সম্ভব না হলে সম্মানজনক আপসের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। এর প্রমাণ হলো, ১৯৪৬ সালেও মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। ১৯৪৬ সালে ঘোষিত ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তাব করা হয় যে ব্রিটিশ সরকার অবিভক্ত ভারতকে স্বাধীনতা দেবে, তবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তিনটি শাসনতান্ত্রিক অঞ্চল (group) সৃষ্টি করা হবে।[২]একটি অঞ্চলে থাকবে বর্তমান পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত প্রদেশসমূহ। দ্বিতীয় অঞ্চলে থাকবে তৎকালীন বাংলা ও আসাম প্রদেশ। এই দুই অঞ্চল ছাড়া ভারতের সব অঞ্চল তৃতীয় গ্রুপের আওতাধীন হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব হবে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও যোগাযোগ, মানবাধিকার, মুদ্রাব্যবস্থা, বহিঃশুল্ক ও পরিকল্পনা। বাকি সব দায়িত্ব থাকবে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক সরকারের হাতে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রদেশগুলো আঞ্চলিক সরকারের দায়িত্ব নির্ধারণ করবে। এই ব্যবস্থা নিয়ে ১০ বছর দেশ চলবে। তবে যদি কোনো গ্রুপ এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হয়, তবে সে গ্রুপের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার থাকবে। প্রতি ১০ বছর অন্তর প্রদেশগুলোর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা পরীক্ষার অধিকার থাকবে। মুসলিম লীগ অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ প্রস্তাব মেনে নেয়। কংগ্রেসও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু নতুন কংগ্রেস সভাপতি নেহরু দাবি করেন যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য যে সংসদ গঠিত হবে, তারাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এবং তাদের জন্য মন্ত্রিসভা মিশনের সূত্র বাধ্যতামূলক নয়। এর ফলে মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে।

মওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে ভারতকে অভিন্ন রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। India Wins Freedom বইয়ে তিনি এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন।

মওলানা আজাদের বিশ্বাস যে কংগ্রেসের সম্মতি ছাড়া ভারত বিভাগ সম্ভব ছিল না। কংগ্রেসের সম্মতি মানে মহাত্মা গান্ধীর অনাপত্তি। মহাত্মা গান্ধীর সম্মতির জন্য তাঁর অতি কাছের দুজন নেতার সমর্থন ছিল অত্যাবশ্যক। একজন হলেন জওহরলাল নেহরু (১৮৮৯-১৯৬৪); অন্যজন বল্লভভাই প্যাটেল (১৮৭৫-১৯৫০)।

মওলানার বিশ্বাস, জওহরলাল ভারত বিভাগের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি লিখেছেন :

Jawaharlal was not at first ready for the idea and reacted violently against the idea of partition. Lord Mountbatten persisted till Jawaharlal’s opposition was worn down step by step. Within a month of Lord Mountbatten’s arrival in India, Jawaharlal, the firm opponent of partition had become, if not a supporter, at least acquiescent to the idea.[৩]

মওলানার কাছে জওহরলালের এই পরিবর্তন বিস্ময়কর মনে হয়। তিনি তাই লিখেছেন :

I have often wondered how Jawaharlal was won over by Lord Mountbatten. He is a man of principle, but he is also impulsive and very amenable to personal influences. I think one factor responsible for the change was the personality of Lady Mountbatten. She is not only extremely intelligent but has a most attractive and friendly temperament. She admired her husband greatly and in many cases tried to interpret his thoughts to those who would not at first agree with him.[৪]

লেডি মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিত্বের মায়াবী সংস্পর্শে নেহরুর ভারত বিভাগের মতো একটি মৌল ধারণা বদলে গেছে, এ ধরনের মন্তব্য মওলানার পক্ষে অত্যন্ত সাহসী বক্তব্য ছিল। যখন এ বই প্রকাশিত হয়, তখন নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘বন্ধু ও সহযোদ্ধা জওহরলাল নেহরুকে’। বইটির সম্পাদক হুমায়ুন কবির লিখেছেন, মওলানা বিশ্বাস করতেন যে নেহরুর এত গুণাবলি রয়েছে ও ভারতের সেবায় তিনি এত নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে তাঁর স্বল্পসংখ্যক দুর্বলতা তাঁর জীবদ্দশাতে আলোচনা না করাই বিধেয়।[৫] তবু সত্যের খাতিরে তিনি নেহরুর জীবনের এ অপ্রিয় সত্যটি এড়িয়ে যাননি। এডউইনা- নেহরুর রোমান্টিক সম্পর্ক শুধু হলুদ সাংবাদিকতার বিষয় নয়; মওলানার বদৌলতে তা এখন একাডেমিক গবেষণার বিষয়।

এডউইনা (১৯০১-৬০) এক বনেদি লর্ড পরিবারের কন্যা। পিতা ছিলেন রক্ষণশীল দলের এমপি। তাঁর মা ছিলেন ইহুদি পরিবারের মেয়ে। তাঁর খ্রিষ্টান নানার প্রেমে পড়েন তাঁর ইহুদি নানি এবং তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নানি অল্প বয়সে মারা যান এবং এডউইনার জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মাও গতায়ু হন। তিনি নানার কাছে বড় হন এবং তাঁর যখন ২০ বছর বয়স, তখন তাঁর নানা তাঁকে তাঁর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে মারা যান। এডউইনা ইংল্যান্ডের একজন ধনী ও সুন্দরী বিবাহযোগ্যা কুমারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। নানার কাছ থেকে তিনি ২০ লাখ পাউন্ড (যা বর্তমান বাজার দামে ৭.৯২ কোটি পাউন্ড) ও লন্ডনের অভিজাত অঞ্চলে প্রাসাদোপম বাসস্থান উত্তরাধিকার সূত্রে পান।

মাউন্টব্যাটেনের পিতৃকুল ছিল জার্মান রাজবংশ আর তাঁর মা ছিলেন মহারানি ভিক্টোরিয়ার নাতনি। রাজপরিবারের এই সন্তান তখন রাজকীয় নৌবাহিনীতে একজন কনিষ্ঠ অফিসার; বেতন বছরে ৬১০ পাউন্ড (আজকের বাজারমূল্যে ২০ হাজার পাউন্ড)। সুদর্শন ও সপ্রতিভ রাজপুত্র মাউন্টব্যাটেন ধনবতী ও সুন্দরী কুমারী মেয়ে এডউইনার প্রেমে পড়েন। ১৯২২ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরে। অনেকে মনে করেন যে মাউন্টব্যাটেনের সমকামী প্রবণতা ছিল। আর এডউইনার সমস্যা ছিল যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা। বিয়ে তাঁদের ভাঙেনি, বাইরে একে অপরকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সমর্থন করেছেন। তবে ভেতরে তাঁরা নিজেদের মর্জিমাফিক জীবন যাপন করেছেন। ১৯৪৬ সালে মাউন্টব্যাটেন যখন সিঙ্গাপুরে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, তখন এই রূপকথার দম্পতির সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতিবিদ নেহরুর পরিচয়। নেহরুর জীবনীকারের মতে, প্রথম দর্শনেই নেহরু ও এডউইনার প্রেমের সূত্রপাত।

১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেনে নবনির্বাচিত শ্রমিকদলের সরকার ভারত থেকে যত শিগগির সম্ভব ব্রিটিশ শাসন নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রত্যাহারের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে ভারতের সর্বশেষ ভাইসরয় হিসেবে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে নিয়োগ দেয়। তাঁর দায়িত্ব ছিল যত শিগগির সম্ভব ভারতের স্বাধীনতা প্রদান (যার সর্বশেষ সময়সীমা ছিল ১৯৪৮ সাল)। মাউন্টব্যাটেন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে ভারত বিভক্তি ছাড়া শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ভারত বিভাগের প্রধান অন্তরায় হলো কংগ্রেসের বিরোধিতা। গান্ধীর সমর্থন ছাড়া এ বিরোধিতার অপসারণ সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে, নেহরুর মত পরিবর্তন না করতে পারলে গান্ধীর সমর্থন পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কাজেই নেহরুর সমর্থন ছাড়া মাউন্টব্যাটেনের ভারতে সাফল্য লাভ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের সূত্র গ্রহণ করার পরও যে নেহরু ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় ভবিষ্যতে ভারত বিভাগের সম্ভাবনা থাকায় তাকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁকে সরাসরি ভারত বিভক্তিতে কে ও কীভাবে রাজি করায়? এই আপাত-অসম্ভবকে সম্ভব করেন অঘটনঘটনপটীয়সী এডউইনা; এ প্রশ্ন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। অবশ্য কীভাবে তিনি সেটা করেছিলেন, তা নিয়ে পণ্ডিতেরা একমত নন। ২০১২ সালে ৮৩ বছর বয়সে এডউইনার কনিষ্ঠ কন্যা পামেলা তাঁর স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন।[৬] তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে তাঁর মায়ের সঙ্গে জওহরলালের গভীর প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল ও তাঁর বাবাসহ সবাই এ সম্পর্কে জানতেন। তবে এ প্রেম দেহজ ছিল না; এ প্রেম ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক। তাঁর মতে, ভাইসরয়ের স্ত্রীর পক্ষে পরপুরুষের সঙ্গে দেহজ সম্পর্ক সম্ভব ছিল না। কিন্তু সবাই এ মতের সঙ্গে একমত নন। স্ট্যানলি ওয়ালপার্টের নেহরু-জীবনী পড়লে মনে হয় যে এ প্রেম ইন্দ্রিয়জ ছিল।[৭] এ মতবাদকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান পাকিস্তানি নৃতত্ত্ববিদ আকবর এস আহমেদ। তিনি এডউইনা ও নেহরুর দৈহিক সম্পর্কের বিভিন্ন প্রমাণ উল্লেখ করেন। তিনি দাবি করেন যে এডউইনা ভারত বিভক্তি ও কাশ্মীর প্রসঙ্গে নেহরুর বক্তব্য গ্রহণ করতে মাউন্টব্যাটেনকে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর মতে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নেহরু-এডউইনার কয়েকটি প্রেমপত্র দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি নাকি এ সম্পর্কে রাজনীতি করতে রাজি হননি।[৯] অধ্যাপক আহমেদ দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে এডউইনা ভারতের পক্ষে ব্রিটিশ প্রশাসনকে প্রভাবান্বিত করেছেন। কিন্তু ভারত বিভাগ প্রশ্নে নেহরুর মত পরিবর্তন করে পাকিস্তানের যে উপকার তিনি করেছেন, তা বেমালুম চেপে গেছেন। ভারতের রাজনীতিতে মাউন্টব্যাটেন ও এডউইনার অংশগ্রহণ ছিল আকস্মিক দুর্ঘটনা। প্রশ্ন হলো, নেহরুর মত পরিবর্তনে এডউইনার সাফল্য ছাড়া কি ভারত বিভাগ সম্ভব ছিল?

নেহরুর মতো ভারত বিভাগের সময় কংগ্রেসের আরেক শক্তিমান নেতা ছিলেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। নেহরু রাজি হলেও প্যাটেল রাজি না হলে কংগ্রেসের পক্ষে ভারত বিভাগ মেনে নেওয়া সম্ভব হতো না। নেহরুর মতো প্যাটেলও ছিলেন ভারত বিভাগের ঘোরতর বিরোধী। অথচ কংগ্রেসের মধ্যে তিনিই ভারত বিভাগের বড় সমর্থক হয়ে দাঁড়ান। এর জন্য অন্য কেউ দায়ী নন, দায়িত্বটা তাঁর নিজের। তিনি মুসলিম লীগকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। যখন ভারতে সব বড় দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ভাগ করা হবে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবে মুসলিম লীগ। কিন্তু মুসলিম লীগ প্রথম পর্যায়ে মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়াতে বল্লভভাই প্যাটেলকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে লীগ মন্ত্রিসভায় যোগ দেয় এবং পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুসারে দাবি করে যে তাদের নেতা লিয়াকত আলী খানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হোক। প্যাটেল ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। তিনি কংগ্রেস নেতাদের বোঝান যে মুসলিম লীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা অতি জরুরি। কাজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া যাবে না। মুসলিম লীগকে দেওয়া হোক অর্থ মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয় চালানোর জন্য যে এলেমের প্রয়োজন, তা মুসলিম লীগ মনোনীত কোনো মন্ত্রীর পেটেই নেই। এ মন্ত্রণালয় চালাবেন বিশেষজ্ঞ আমলারা। এতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হবে, কিন্তু তিনি আদৌ কার্যকর হবেন না। লিয়াকত আলীর কাছে যখন এ প্রস্তাব আসে, তখন তিনি এটি প্রত্যাখ্যানের জন্য জিন্নাহর কাছে আবেদন করেন। ইতিমধ্যে এ বার্তা দিল্লির আমলাদের মধ্যে চাউর হয়ে যায়। প্যাটেল জানতেন না যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ বিভাগে দুজন সুদক্ষ মুসলিম কর্মকর্তা ছিলেন। একজনের নাম গোলাম মোহাম্মদ, যিনি পরে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন। আরেকজন হলেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, যিনি পাকিস্তানের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল ও পরে প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁরা জিন্নাহর মাধ্যমে লিয়াকত আলীকে বোঝাতে সক্ষম হন যে তাঁদের সমর্থন নিয়ে তাঁর পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা মোটেও শক্ত হবে না। উপরন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলে তাঁদের পক্ষে কংগ্রেসের সব রাজনৈতিক উদ্যোগ আটকে দেওয়া সম্ভব হবে। লিয়াকত আলী অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেন। বাজেটে ব্যবসায়ের ওপর কর বাড়ালেন। উচ্চবিত্তের হিন্দুরা ফাঁপরে পড়ল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব নতুন ব্যয়ের প্রস্তাব নাকচ করা হলো। এবার প্যাটেল নিজেই ঝামেলায় পড়লেন। এ প্রসঙ্গে মওলানা লিখেছেন :

The Sardar’s was the responsibility for giving finance to the Muslim League. He, therefore, resented his helplessness before Liaqat Ali more than anybody else. When Lord Mountbatten suggested that partition might offer a solution to the present difficulty he found ready acceptance to the idea in Sardar Patel’s mind. In fact, Sardar Patel was fifty per cent in favor of partition even before Lord Mountbatten appeared on the scene. He was convinced that he could not work with the Muslim League. He openly said that he was prepared to have a part of India if only he could get rid of the Muslim League. It would not be perhaps be unfair to say that Vallabhbhai Patel was the founder of Indian partition.[১০]

দেশ বিভাগের প্রস্তাব নেহরু আর প্যাটেলের সমর্থনলাভের পর এ প্রস্তাব গান্ধীর মৌন সম্মতি লাভ করে। দেশ বিভাগ ঠেকানোর সর্বশেষ উপায় ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অদ্ভুত সীমানা নির্ধারণ করা। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস আবদুল জব্বার খানের (১৮৮৩-১৯৫৮, যিনি ডক্টর খান সাহেব নামে সমধিক পরিচিত) নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জয়লাভ করে। সিদ্ধান্ত হয় যে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে কি না, সে সম্পর্কে গণভোট হবে। মওলানার বর্ণনা অনুসারে, ডক্টর খান সাহেব ও তাঁর ভাই খান আবদুল গফফার খান খুবই কৃপণ ছিলেন। এমনকি নির্বাচনের জন্য কংগ্রেস থেকে যে অর্থ পাঠানো হয়, সে টাকা পর্যন্ত তাঁরা খরচ করেননি। তাঁদের ব্যক্তিগত কার্পণ্য অতিথিবৎসল পাঠান চরিত্রের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। এই প্রসঙ্গে মওলানা লিখেছেন :

On one occasion, a large deputation from Peshwar came to see me in Calcutta in connection with the election funds. As it was tea time, I offered them tea and biscuits. Several members of the deputation looked at the biscuits with surprise. One took up a biscuit and asked me its name They seemed to enjoy the biscuit and then told me that they had seen such biscuits in Dr. Khan Shahib’s house but he had never offered biscuits or even a cup tea to any of them.[১১]

পাঠানদের দেখিয়ে চা-বিস্কুট খাবে, অথচ তাদের সাধবেও না, এ ধরনের ব্যক্তির পক্ষে জনসমর্থন ধরে রাখা সম্ভব নয়। কাজেই সীমান্ত প্রদেশের গণভোটেও কংগ্রেসের পরাজয় ঘটল। এসব কাকতালীয় ঘটনার অনিবার্য পরিণতিতে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে।

যারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করে, তারা মনে করে যে তাদের কায়েদে আজমের দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলেই পাকিস্তানের জন্ম। তবে এখানেও দুর্ঘটনার ভূমিকা একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডোমেনিক ও লা পিয়েরের মতে, জিন্নাহ যখন পাকিস্তানের জন্য চূড়ান্ত দর-কষাকষি করছেন, তখন তাঁর ফুসফুসে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে।[১২] এই খবর জিন্নাহর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও জিন্নাহ নিজে জানতেন। কিন্তু কংগ্রেসের কেউ জানত না। জিন্নাহর চিকিৎসক এ খবরের গোপনীয়তা রক্ষা করেছেন। অন্যথায় কংগ্রেস আপসে হয়তো রাজি হতো না। যত সময় যেত, জিন্নাহ আপসের জন্য অস্থির হয়ে পড়তেন। কাজেই যারা পাকিস্তানের সমর্থক, তাদের পক্ষেও দুর্ঘটনার তত্ত্ব একেবারে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

শুধু কাকতালীয় ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও পাকিস্তানের জন্মের অনিবার্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ১৯৩০ সালে কবি ইকবাল এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক সভায় পাঞ্জাব, উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের সমন্বয়ে একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র সৃষ্টির দাবি করেন। তবে এ রাষ্ট্রের তিনি কোনো নাম দেননি। পাকিস্তান শব্দটির জন্ম চৌধুরী রহমত আলী কর্তৃক ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ‘Now or Never’ শীর্ষক ক্রোড়পত্রে।[১৩] এই দলিলে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে চারটি প্রদেশের আদ্যক্ষর নিয়ে (পাঞ্জাবের ‘পি’, আফগান বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ‘এ’, সিন্ধ-এর ‘এস’ ও বালুচিস্তানের ‘তান’) পাকিস্তান শব্দের উৎপত্তি। তবে ‘আই’ অক্ষরটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেন ‘আই’ অক্ষরটি ইন্ডাস নদীর আদ্যক্ষর; আবার কেউ বলেন উচ্চারণের সুবিধার জন্য ‘আই’ যুক্ত হয়েছে। মোটকথা এ নামে বাংলার কোনো উল্লেখ নেই। ১৯৪০ সালে লাহোরে শেরেবাংলা কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দটি আদৌ বহৃত হয়নি। লাহোর প্রস্তাবে একটি পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি করা হয়নি। লাহোর প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছিল :

The establishment of completely independent states formed by demarcating geographically contiguous units into regions which shall be so constituted with such territorial readjustments as may be necessary, that areas in which the Mussulmans are necessarily in a majority as in the North Western and Eastern zones of India, shall be grouped together to constitute Independent States as Muslim Free National Homelands in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.[১৪]

এ কথা সুস্পষ্ট যে লাহোর প্রস্তাবে কমপক্ষে দুটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়েছিল। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই মুসলিম লীগ বাংলায় নির্বাচনে জয়লাভ করে। মুসলিম লীগ জানত যে এক পাকিস্তানের দাবি লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। তাই ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে মুসলিম লীগ থেকে নির্বাচিত সাংসদের এক কনভেনশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাব (যা সংশোধনের এখতিয়ার দলের ছিল, দল কর্তৃক মনোনীত সাংসদের নয়) সংশোধন করা হয়। এই প্রস্তাবে ‘Independent States’-এর বদলে দাবি করা হয় ‘a sovereign independent state, comprising Bengal and Assam in the north-east zone and the Punjab, the N.W.F.P., Sind, and Baluchistan in the north-west zone.[১৫]

জন্মের এক বছর চার মাস চার দিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান দাবি করা হয়। এত তাড়াতাড়ি এত বড় দাবি পূরণের নজির ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল। পাকিস্তান শব্দটি চয়ন করা হয়েছিল মাত্র সাড়ে ১৪ বছর আগে। মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে ভারতে মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ছিল। ভারতে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের হিন্দুরা ঠাট্টা করে পাকিস্তানের সমর্থক বলত। জিন্নাহ নিজে স্বীকার করেছেন যে তিনি হিন্দুদের দেওয়া পাকিস্তান নাম মেনে নিয়েছেন। এত দ্রুততার সঙ্গে পাকিস্তানের জন্ম হয় যে এর আবির্ভাব অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

ভারতের ভৌগোলিক ঐক্য প্রকৃতির অবদান। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় চেতনা গড়ে উঠেছে। রামায়ণ-মহাভারতের মতো ধর্মগ্রন্থ এ চেতনাকে লালন করেছে। কালিদাসের কাব্যে সর্বভারতীয় চেতনা বিধৃত। মৌর্য সাম্রাজ্য থেকে মোগল সাম্রাজ্য পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার বছর ধরে অসংখ্য রাষ্ট্রনায়ক এই ঐক্যের সাধনা করেছেন। অথচ মুসলিম লীগের মতো একটি দ্বিতীয় সারির রাজনৈতিক দলের পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণের সাড়ে সাত বছরের মাথায় সেই ঐক্য খানখান হয়ে গেল। এ ধরনের ঐতিহাসিক প্রবণতা অবিশ্বাস্য। পাকিস্তানের যারা সমর্থক, তারা অনেকেই ধরে নিয়েছিল, এ বিভক্তি টিকবে না। অনেক হিন্দু নেতা মনে করতেন যে পাকিস্তান হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। তাই পাকিস্তানিদের প্রিয় স্লোগান ছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বা ‘পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক’।

বাংলাদেশের আবির্ভাব পাকিস্তানের চেয়েও অনেক বেশি আকস্মিক। আনুষ্ঠানিকভাবে এক পাকিস্তানের প্রস্তাব গ্রহণের এক বছর কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তানের জন্ম হয়। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক দাবি করার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। মূলত ছয় দফা দাবিতে বাংলাদেশের দাবি প্রচ্ছন্নভাবে পেশ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছয় দফা (কেন্দ্ৰীয় সরকারের কর আদায়ের কোনো ক্ষমতা থাকবে না এই প্রস্তাবটি ছাড়া) কোনো নতুন প্রস্তাব নয়। ছয় দফা ছিল মূলত লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবি। ছয় দফা দাবি ঘোষিত হয় ১৮ মার্চ ১৯৬৬। ছয় দফায় বাংলাদেশের কোনো উল্লেখ ছিল না। তবু যদি ছয় দফাতেই বাংলাদেশ দাবির সূত্রপাত হয়েছে ধরে নিই, তাহলে বাংলাদেশ দাবি অর্জিত হয়েছে মাত্র পাঁচ বছরে। অনেকে মনে করেন যে ১৯৭১ সালে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে বাংলাদেশের জন্ম অনিবার্য ছিল না। কাজেই যখন ভারতের মিত্রবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের জন্ম হয়, তখন বাংলাদেশের অনেক সমালোচকই এর অনিবার্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

যাঁরা মনে করেন যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অবশ্যম্ভাবী ছিল না, তাঁরা বলে থাকেন যে ইয়াহিয়া খানের মতো মদ্যপ ও দুশ্চরিত্র রাষ্ট্রপতি না হলে হয়তো আলোচনার মাধ্যমে ছয় দফা অর্জন করা যেত। আবার কেউ কেউ বলেন, যদি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জীবিত থাকতেন, তাহলে পাকিস্তানের অখণ্ডতা হয়তো অক্ষুণ্ণ থাকত। স্মরণ করা যায়, দিল্লিতে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে এক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব সোহরাওয়ার্দীই উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৯২ সালে, মৃত্যু হয়েছিল ১৯৬৩ সালে ৭১ বছর বয়সে। ১৯৭১ সালে জীবিত থাকলে তাঁর বয়স হতো ৭৯ বছর।

সমসাময়িক ইতিহাস যতই বিশ্লেষণ করা হবে, সব ঐতিহাসিক ঘটনার অনিবার্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলা সম্ভব। কী অনিবার্য আর কী অনিবার্য নয়, তা বুঝতে হলে সমসাময়িক রাজনীতির ডামাডোল উপেক্ষা করে প্রশ্ন করতে হবে, যা ঘটেছিল তা অবশ্যম্ভাবী ছিল কি না। বস্তুত বাংলাদেশের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী ছিল এই কারণে যে পাকিস্তানের সৃষ্টি ছিল কাকতালীয় ও ইতিহাসের মূলধারা থেকে বিচ্যুতি এবং এই বিচ্যুতি সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ হলো ইতিহাসের ধারার প্রয়োজনীয় সংশোধন।

পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের মূল বক্তব্য ছিল যে যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে, তারা ভাষা, ভৌগোলিক দূরত্ব ও জনগোষ্ঠী নির্বিশেষে এক জাতি। এর ফলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার দুটি অংশ প্রায় হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত। তার অধিবাসীরা বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে এবং জনগোষ্ঠীর দিক থেকেও তারা ভিন্ন। ঠাট্টা করে বলা হতো, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র ছিল ইংরেজি ভাষা আর পিআইএ নামে একটি বিমান কোম্পানি। অথচ ইসলামের জন্মভূমি মধ্যপ্রাচ্যে ভৌগোলিক নৈকট্য, ভাষাগত অভিন্নতা ও জনগোষ্ঠীর সাদৃশ্য সত্ত্বেও সেখানে রাজনৈতিক ঐক্যের কাছাকাছিও গড়ে তোলা যায়নি। (সারণি-২.১)

সারণি-২.১
ভৌগোলিকভাবে অবিচ্ছিন্ন আরবিভাষী মুসলমান দেশসমূহের তালিকা

ভৌগোলিকভাবে অবিচ্ছিন্ন আরবিভাষী মুসলমান দেশসমূহের তালিকা

মুসলমান আরব দেশসমূহের জনসংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের চেয়ে কম। এরা একই ধর্মে বিশ্বাস করে, একই আরবি ভাষায় কথা বলে এবং একটি অবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে বাস করে। তবু আরব বিশ্বে ১৯টি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। অথচ ভাষাগত ভিন্নতা এবং ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সব ভারতীয় মুসলমান শুধু ধর্মের ভিত্তিতে কীভাবে একটি রাষ্ট্রে মিলিত হবে, তার কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা নেই। ভাষা ও ভৌগোলিক বন্ধন অগ্রাহ্য করে কীভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের এক রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, সে সম্পর্কে কোনো যুক্তিসংগত পরিকল্পনা পাকিস্তানের সমর্থকেরা দিতে পারেননি। ভারতে কমপক্ষে দুটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। তাতেও সব ভারতীয় মুসলমান হয়তো একত্র হতে পারত না, তবে অধিকাংশ মুসলমানের ঠাঁই হতো।

মিশন পরিকল্পনা, যা মওলানা আজাদ সমর্থন করেছিলেন, তাতে দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের সম্ভাবনা ছিল। কাকতালীয় ঘটনাপ্রবাহে দুটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রের বদলে ভারতে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ মেয়াদে ভারত উপমহাদেশে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষে দুটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব ছিল না। তাই পাকিস্তানের জন্ম নয়, পাকিস্তানের বিভক্তিই ছিল ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। পাকিস্তান সৃষ্টি ছিল ইতিহাসের মূলধারা থেকে বিচ্যুতি। বাংলাদেশ সৃষ্টির ফলে এই উপমহাদেশের রাজনীতি ইতিহাসের মূলধারায় ফিরে আসে।

ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব অনিবার্য না কাকতালীয়—এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তবু এ বিতর্ক শুধু অতীতের বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ নয়। এই বিতর্কের সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও জড়িয়ে রয়েছে। এই নিবন্ধে তাই বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রবন্ধটি পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে এই অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের আকস্মিকতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডের বিচার্য বিষয় হলো সম্প্রতি চটজলদি যেসব জাতীয়তাবাদী সত্তা আত্মপ্রকাশ করেছে—তারা টেকসই কি না তা বিবেচনা করা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ কতটুকু টেকসই, সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি পরীক্ষা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাঙালি বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিতর্ক পর্যালোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের ওপর আধিপত্যবাদের সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং এই প্রবন্ধের মূল বক্তব্যসমূহ সংক্ষেপে বিবৃত হয়েছে।

২.২ জয় বাংলা বনাম বাংলাদেশ জিন্দাবাদ

আপাতদৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ দীর্ঘদিন ধরে তার শক্তি সঞ্চয় করে। তাই জাতিরাষ্ট্রের নাটকীয় আবির্ভাব সম্ভব নয়। যেখানে চটজলদি জাতিসত্তার আবির্ভাব, সেখানে জাতীয়তাবাদ কতটুকু টেকসই, তা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে জাতীয়তাবাদের গত দুই শতাব্দীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে মনে হয় যে জাতীয়তাবাদ আস্তে আস্তে আত্মপ্রকাশ করে না। অনেক ক্ষেত্রেই এর আকস্মিক আত্মপ্রকাশও ঘটে।

জাতিরাষ্ট্রের সংখ্যা

সারণি-২.২ থেকে দেখা যায়, ১৮১৫-৫০ সময়কালে মোট স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৮! অথচ এই সংখ্যা বর্তমানে ২০৩-এ উন্নীত হয়েছে। বিগত দুই শ বছরে রাষ্ট্রের সংখ্যা প্রায় ৫.৪ গুণ বেড়েছে। এ বৃদ্ধি যে একেবারে থেমে যাবে, সে ধরনের কোনো প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে না। সারণি-২.৩ এ বর্তমান বিশ্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রের জন্য সক্রিয় আন্দোলনের একটি তালিকা দেখা যাবে।

সারণি-২.৩
বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রের জন্য সক্রিয় আন্দোলনের তালিকা

বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রের জন্য সক্রিয় আন্দোলনের তালিকা
বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রের জন্য সক্রিয় আন্দোলনের তালিকা
বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রের জন্য সক্রিয় আন্দোলনের তালিকা

বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুধু উন্নয়নশীল দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, উন্নত দেশেও এন্তার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রয়েছে। মানুষের ইতিহাসে প্রথম টেকসই উন্নয়নের সূচনা হয় যুক্তরাজ্যে। এ দেশে প্রায় ৪০০ বছর ধরে গণতন্ত্র সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। তবু এ দেশে ৪টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার দাবি রয়েছে। ৩০০ বছর একত্রে থাকার পর স্কটরা যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা চায়। এই প্রশ্নে গণভোটে ২০১৪ সালে অবশ্য স্কটরা হেরে যায়। তবে স্বাধীনতাকামীরা প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোট পায়। আর ৫ শতাংশ জনসমর্থন পেলেই স্কটল্যান্ড নামে একটি নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিতে পারত। যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা চায় ওয়েলসের অধিবাসীরা, করনওয়ালের কেল্টিক নরগোষ্ঠী ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রোটেস্টান্টরা। ইউরোপে রাশিয়াতে ১৫টি, স্পেনে ১০টি ও ফ্রান্সে ৪টি নতুন রাষ্ট্রের দাবি রয়েছে। ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বরে কেটালোনিয়ার জনগণ স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটে মত দিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। গত ২০০ বছরে প্রায় বিশ্বে ১৫৫টি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এরপর নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি কমে এলেও এখনো একেবারে থেমে যায়নি।

মজার ব্যাপার হলো, নতুন রাষ্ট্র একবার স্থাপিত হলে খুব অল্প ক্ষেত্রেই তা আবার পরিবর্তিত হয়। একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছিল পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির একত্রীকরণে। আবার কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নতাকামী রাষ্ট্রকে দমন করে মূল রাষ্ট্র (যথা যুক্তরাষ্ট্র, নাইজেরিয়া, কঙ্গো ইত্যাদি)। এ ধরনের কিছু ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা বাদ দিলে দেখা যায়, একবার জাতীয়তাবাদী শক্তি জয়লাভ করলে পুরোনো ব্যবস্থা আর ফিরে আসে না। এর একটি বড় কারণ হলো, প্রতিটি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। যদি কোনো অঞ্চল পুরোনো রাষ্ট্রকাঠামোতে ফিরে আসে, তবে তার জনসংখ্যাকে এটি মেনে নিতে হয় (বর্তমান বিশ্বে কোনো অঞ্চলকে জনশূন্য করে অধিভুক্ত করা সম্ভব নয়)। এতে ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। কাজেই পুরোনো রাষ্ট্রের অভিভাবকেরা এ ধরনের সংযুক্তির তীব্র বিরোধিতা করবে। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক, বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ ভারতে যোগ দিতে চায়। সে ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এর বিরোধিতা করবে। এর কারণ হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ভারতে যোগ দিলে সর্বভারতীয় নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

সারণি-২.৪
ভারত ও বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যা, ২০১১

ভারত ও বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যা, ২০১১

সারণি-২.৪ থেকে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান ব্যবস্থায় ভারতে মুসলমান ভোটারের অনুপাত হচ্ছে প্রতি ১০০ জন ভারতীয়ের মধ্যে ১৪.২৩ জন। যদি কোনো কারণে ভারত-বাংলাদেশ একত্র হয়, তবে প্রতি ১০০ জন ভারতের নাগরিকের মধ্যে ২২.৭ শতাংশ হবে মুসলমান। সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে যদি নিবিড় ঐক্যের বন্ধন গড়ে ওঠে এবং যদি তারা একই দলের পক্ষে ভোট দেয়, তবে ভারতের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। বর্ণহিন্দুদের রাজনৈতিক আধিপত্য ক্ষুণ্ন হতে পারে। কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা এ ধরনের বড় পরিবর্তন চাইবে না।

রাজনৈতিক সমস্যা শুধু ফেডারেল রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না; তা বাংলা অঞ্চলের আশপাশের প্রদেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে। বাংলা ভারতে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা। ভারতে মোট ৮.৩৩ কোটি বাংলাভাষী লোক রয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৫ কোটি লোক বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় কথা বলে।

সারণি-২.৫
বাংলাদেশের আশপাশে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর জনসংখ্যা

বাংলাদেশের আশপাশে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর জনসংখ্যা

যদি ২৩ কোটি বাংলাভাষী লোক একত্র হয়, তবে প্রতিবেশী অঞ্চলসমূহে ওড়িয়া, আসামি, খাসি, বোরা, মণিপুরি প্রভৃতি ভাষাভাষীরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের এবং উড়িষ্যা ও বিহারের প্রদেশসমূহ এর বিরোধিতা করবে। বাংলাদেশের ভারতে অন্তর্ভুক্তির ফলে ভারতের জনগণের লাভের সম্ভাবনা কম। ১৯৪৬ সালে হিন্দু বাঙালি সাংসদদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে হিন্দু বাঙালিরা ভাষার বন্ধনের চেয়ে ধর্মের বন্ধনের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। ১৯৪৬ সালে বাংলার হিন্দু সাংসদদের বাংলাকে অবিভক্ত রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। হিন্দু সাংসদরা রাজি হলে অবিভক্ত বাংলা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হতো। হিন্দু সাংসদরা সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

শুধু মুসলিম ঐক্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে এ ধরনের রাষ্ট্রে বাংলাদেশের কোনো লাভ নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলে পাকিস্তানিদেরও এ ধরনের রাষ্ট্র সৃষ্টিতে আগ্রহ থাকবে না; কেননা, এই রাষ্ট্রে ভিন্ন ভাষা ও জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকবে। বাংলাদেশ চাইলেও (যার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা নেই) বাংলাদেশের অবলুপ্তি ভারতের বা পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বস্তুত ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের অস্তিত্ব অত্যাবশ্যক।

ব্রিটিশ শাসনকালে এই উপমহাদেশে দুই ধরনের জাতীয়তাবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথমত, কংগ্রেসের নেতাদের বক্তব্য ছিল, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদ একটি। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগ নেতাদের বক্তব্য ছিল যে ভারতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি ভিন্ন জাতি। ভারতে এখন তিনটি জাতি রয়েছে; ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাঙালি। এই তিন জাতির মধ্যে বাঙালি জাতিই সবচেয়ে স্থির। ভাষা ও গোত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানি জাতির ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তেমনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদও ভঙ্গুর। এখনো বিচ্ছিন্নতাবাদী জনগোষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয়। তিনটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালি জাতিই সবচেয়ে স্থিতিশীল। ভারতীয় বা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ধসে পড়লেও বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম। অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থই লিখেছেন :

যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।

২.৩ বাঙালি বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ

বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের আদি সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।’ ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় ঘোষণা (পঞ্চদশ সংশোধনী) আদেশবলে সামরিক শাসকেরা এই অনুচ্ছেদটি বাদ দেয় ও স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে। স্পষ্টতই সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের কাছে দেশের মূল সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাদের মূল আপত্তি ছিল তিনটি। প্রথমত, বাংলাদেশে শতভাগ ব্যক্তি বাংলা ভাষায় কথা বলে না। কাজেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের সকল নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, যদিও ভাষা মুক্তিসংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তবু শুধু ভাষাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের একমাত্র ভিত্তি নয়। বাংলাদেশ শূন্য থেকে আসেনি, এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ ভাগ মুসলমান। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামকরণে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ইসলামের ভূমিকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তাই সমালোচকেরা এই নামকরণের বিরোধিতা করেন। তৃতীয়ত, বাঙালি জনগোষ্ঠী শুধু বাংলাদেশে বাস করে না, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাস করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন হওয়া উচিত সব বাঙালির জন্য একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এ ধরনের সমালোচকেরা মনে করেন যে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যুক্ত বাংলা চায় না। কাজেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামকরণ মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। এই ঘরানার রাজনীতিবিদেরা তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিস্থাপন করতে চান। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভাষাভিত্তিক। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ভূখণ্ডভিত্তিক। আসলে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ নামে স্বতন্ত্র কোনো ভূখণ্ডের অস্তিত্ব ছিল না। বাংলাদেশের ভূখণ্ড হচ্ছে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ড। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমান সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে। কাজেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ-সম্পর্কিত তত্ত্বের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সমর্থকদের দাবি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের মতে, সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কবর দেওয়া হয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রামের সূচনা তা একান্তই ভাষাভিত্তিক, এটি শুধু বাংলাদেশেই ঘটেনি। পৃথিবীর সর্বত্রই জাতীয়তাবাদ ও ভাষার এ ধরনের সম্পর্ক দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক বেনেডিক্ট এন্ডারসন যথার্থই লিখেছেন :

What the eye is to the lover-that particular ordinary eye he or she is born with, language-whatever language history has made his or her mother tongue-is to the patriot. Through that language, encountered at mother’s knee and parted with only at the grave, pasts are restored, fellowships are imagined and futures dreamed.[১৬]

মায়ের ভাষার প্রতি আবেগমণ্ডিত অনুরক্তি বাংলার ইতিহাসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ঐতিহাসিক লরেন্স জিরিং এ প্রসঙ্গে যথার্থই মন্তব্য করেছেন :

Bengali love affair with their language involves a passionate ritual that produces emotional experiences seldom found in other parts of the world.[১৭]

তাঁর মতে, বাংলাদেশের জনগণের ভাষার প্রতি এই তীব্র অনুরাগের উৎস বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুতে নিহিত। বর্ষাকালে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যায়। এর ফলে অধিবাসীদের জীবনে স্থবিরতা দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে লরেন্স জিরিং লিখেছেন :

Bengalis pass the rainy season huddled together in small groups, riding out the torrential downpour in virtual isolation sustained only by recitations and songs that fill the time, waiting for rains to subside and water to recede.[১৮]

বাংলা ভাষার প্রতি তীব্র অনুরাগের একটি বড় কারণ হলো, বাংলা ভাষার আবির্ভাব কুসুমাস্তীর্ণ পথে হয়নি। গণমানুষের মুখের ও প্রাণের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ধর্মের সহজে স্বীকৃতি পায়নি। ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ের জন্য তাকে পাঁচটি সাম্রাজ্যবাদী ভাষার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এই ভাষাগুলো হলো সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি। প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী ভাষার পেছনে ছিল শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী।

সংস্কৃত ভাষার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ব্রাহ্মণেরা। মনুসংহিতায় সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে শূদ্রেরা উপস্থিত থাকলে বেদের শ্লোক আবৃত্তি করা যাবে না। এই নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ছিল নিম্নবর্ণের লোকেরা যাতে বেদে কী লেখা আছে তা জানতে না পারে। একই কারণে হিন্দুশাস্ত্রের বঙ্গানুবাদ নিষিদ্ধ করা হয়। শাস্ত্রকারেরা বিধান দিলেন :

অষ্টাদশ পুরণাণিরামস্য চরিতানি চ
ভাষায় মানব শ্রুত্বা রৌরব নরকং ব্রজেৎ।[১৯]

এর অর্থ হলো, রামায়ণ ও অষ্টাদশ পুরাণের বাণী ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ শুনলে তাকে রৌরব নরকে যেতে হবে। অর্থাৎ বাংলা ভাষায় হিন্দুধর্মের চর্চা নিষিদ্ধ করা হয়। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের হামলা থেকে উদীয়মান বাংলা ভাষাকে রক্ষা করে মুসলমান রাজাদের আনুকূল্য ও সাধারণ মানুষের সমর্থন।

ব্রাহ্মণদের মতো মুসলমান মোল্লা-মৌলভিরাও বাংলা ভাষা প্রচলনের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। হিন্দুদের জন্য যেমন পবিত্র ভাষা সংস্কৃত, তেমনি মুসলমানদের জন্য পাক ভাষা হলো আরবি। মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর বাণী বাংলা ভাষার মতো পৌত্তলিকতা দোষে দুষ্ট ভাষায় অনুবাদ করা যাবে না। বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত। কাজেই এর শব্দসম্ভারে পৌত্তলিকতার ছাপ অবশ্যই থাকবে। তাই ফতোয়া দেওয়া হলো যে বাংলা ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে লেখা যাবে না। এভাবে আরবির সঙ্গে ফারসি ও উর্দু ভাষাও বাংলার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়।

ফারসি ভাষা ছিল মুসলমান শাসকদের রাষ্ট্রভাষা। শুধু মুসলমান শিক্ষিত ব্যক্তিরাই নয়, বাংলার অভিজাত হিন্দুরাও অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ফারসি ভাষার চর্চা করত। উপরন্তু ভারতের বাইরে থেকে ও উত্তর ভারত থেকে অনেক বহিরাগত মুসলমান বাংলায় বসতি স্থাপন করে। তারা উর্দু বা ফারসি ভাষায় কথা বলত। কাজেই বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আশরাফ বা অভিজাত শ্রেণির লোকেরা বাংলা ভাষাকে ছোটলোকের ভাষা হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখত। মোল্লা- মৌলভি, আমির-ওমরা ও আশরাফদের বাধাকে অগ্রাহ্য করে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যায় সাধারণ মানুষের সমর্থন।

এরপর ইংরেজদের রাজত্বকালে রাজানুকূল্য নিয়ে আরেক শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয় ইংরেজি ভাষা। এই অসম প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষের সমর্থনই ছিল বাংলা ভাষার প্রধান শক্তি। সব শেষে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের আশরাফদের উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করেছে বাংলার সাধারণ মানুষেরাই। বাংলাদেশে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি, বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল কমপক্ষে ৭০০ বছর আগে, যখন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকেরা মোল্লা-মৌলভিদের ফতোয়াকে অগ্রাহ্য করে বাংলা ভাষায় ইসলামের বাণী প্রচারের ব্যবস্থা করেন। তবে আন্দোলন শুধু ফতোয়া অগ্রাহ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বুকের রক্ত দিয়ে বাংলার সাধারণ মানুষ তাদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এই সুদীর্ঘ ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করেছে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে ভাষার ভূমিকা মুখ্য হলেও ভাষাই একমাত্র উপাদান নয়। এখানে পরোক্ষভাবে ধর্মের ভূমিকাও রয়েছে। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, বাংলা ভাষায় প্রথম মুসলমান সাহিত্যিক হিসেবে চতুর্দশ/পঞ্চদশ শতাব্দীতে আত্মপ্রকাশ করেন শাহ মুহম্মদ সগীর। তাঁর রচনা পাঠ করলে স্পষ্টতই দেখা যায়, মৌলভিদের ফতোয়ার ফলে বাংলা ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে কিছু লেখা সমীচীন হবে কি না, সে সম্পর্কে তাঁর মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। দেশি ভাষায় কাব্য রচনায় তাঁর ভয় ছিল। ইউসুফ-জোলেখা কাব্যগ্রন্থে তিনি কেন বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন, তার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন :

ন লিখে কিতাব কথা মনে ভয় পাত্র।
দোষিব সকল তাক ইহ না জুয়াএ। গু
নিয়া দেখিলু; আক্ষি ইহ ভয় মিছা
 না হয় ভাষায় কিছু হয় কথা সাচা ॥
শুনিয়াছি মহাজনে কহিতে কথন।
রতন ভান্ডার মধ্যে বচন সে ধন ॥[২০]

মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। প্রথমত, বেশির ভাগ মুসলমান লেখক ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ভাষার সীমাবদ্ধতা মেনে নেন। সপ্তদশ শতাব্দীর লেখক আবদুল হাকিম (১৬২০-৯০) লিখেছেন :

আরবী পড়িয়া বুঝ শাস্ত্রের বাখান।
যথেক এলেম মধ্যে আরবী প্রধান ॥
আরবী পড়িতে যদি না পার কদাচিৎ
ফারছি পড়িয়া বুঝ পরিণাম হিত ॥
ফারছি পড়িতে যদি না পার কিঞ্চিৎ।
নিজ দেশি ভাষে শাস্ত্র পড়িতে উচিত ॥[২১]

তিনি এ কথা স্বীকার করে নেন যে ইসলামের বাণী প্রচারের জন্য সর্বোত্তম মাধ্যম হচ্ছে আরবি ভাষা। যারা আরবি জানে না, তাদের জন্য ফারসি পরবর্তী উত্তম ভাষা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু যারা দুটি উত্তম ভাষা কোনোটিই জানে না, তাদের অন্তত স্বদেশি ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার সুযোগ থাকা উচিত। বাংলা ভাষায় ধর্মচর্চা করা বিধেয় নয়। কিন্তু যারা আরবি-ফারসি ভাষা জানে না, তাদের বাংলা ভাষায় ধর্মচর্চা না করতে দিলে তারা ধর্মের আলো থেকে বঞ্চিত হবে। একই দৃষ্টিকোণ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর কবি শেখ মুত্তালিব লিখেছেন :

আরবীতে সকলে না বুঝে ভাল মন্দ
তেকারণে দেশি ভাষে রচিলু প্রবন্ধ ॥
মুসলমানী শাস্ত্রে কথা বাঙ্গালা করিল।
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু ॥
কিন্তু মাত্র ভরসা আছয়ে মনান্তরে।
বুঝিয়া মুমীন দোয়া করিব আমারে ॥
মুমীনের আশীর্বাদে পুণ্য হইবেক।
অবশ্য গফুর আল্লাহ পাপ খেমিবেক ॥
এ সব জানিয়া যদি করয়ে রক্ষণ।
তবে সে মোহেরে পাপ হইবে মোচন ॥ [২২]

মুত্তালিব স্বীকার করেন যে বাংলা ভাষায় মুসলমানি শাস্ত্রচর্চা করলে গুনাহ হবে। তবে কবির আশা এই যে যারা আল্লাহর বাণী বুঝতে পারেনি, তারা এই বেদাত কাজ থেকে উপকৃত হবে। যেসব মুসলমান উপকৃত হবেন, তাঁরা, যাঁরা বাংলায় ইসলাম সম্পর্কে লিখছেন, তাঁদের মাগফিরাত কামনা করবেন। এর ফলে মহান আল্লাহ লেখকদের পাপ ক্ষমা করবেন।

কতিপয় লেখক বাংলা ভাষায় লেখার জন্য যেসব পাপ হবে, তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মুসলমানি শাস্ত্রকথা বাংলা ভাষায় আরবি হরফে লেখেন। মুহাম্মদ ফসীহর (সপ্তদশ শতাব্দী) মতো কিছু লেখক আরবি হরফে বাংলা লেখেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলা গ্রন্থ মাক্তুল হুসাইন আরবি হরফে রচিত হয়।

তৃতীয় ধারার লেখকেরা মোল্লা-মৌলভিদের ফতোয়ার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, মহান আল্লাহ সব ভাষাই বোঝেন। তাই বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়ার কোনো কারণ নেই। সপ্তদশ শতাব্দীর কবি আবদুল হাকিম তাই যুক্তি দেখিয়েছেন :

যেই দেশে যেই বাক্যে কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন ॥
সর্ব বাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বংগদেশি বাক্য কিবা যত ইতি বাণী ॥
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ ॥[২৩]

যারা মারফত জানে না, তারাই হিন্দু ভাষার লিপি ব্যবহারে কুণ্ঠাবোধ করে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তিনি শুধু আরবি ভাষাই জানেন না, তিনি হিন্দুদের ভাষাসহ সব ভাষাই জানেন। সুতরাং বাংলা ভাষায় ইসলামের বাণী প্রচারে কোনো অসুবিধা নেই। তাই যেসব মোল্লা-মৌলভি মুসলমানদের বাংলা ভাষা প্রচলনে বিরোধিতা করছেন, তাঁদের উদ্দেশে তিনি লেখেন :

যে সবে বঙ্গতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥
দেশি ভাষে বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায় ॥
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গতে বসতি।
দেশি ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ॥[২৪]

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয় যে বাংলা ভাষা নিয়ে বাংলার মুসলমানদের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। একদিকে তারা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত ছিল, অন্যদিকে স্বদেশ ও মাতৃভাষার প্রতি ছিল তাদের সুগভীর ভালোবাসা। ধর্ম ও ভাষা নিয়ে টানাপোড়েন বাঙালির ইতিহাসের কোনো নতুন উপাদান নয়। এই দ্বন্দ্বই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলা ছাড়া ভারতের সর্বত্র হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু বাংলায় এই দ্বন্দ্ব ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। এই তিন পক্ষ হলো হিন্দু, আশরাফ বা অভিজাত মুসলমান ও আতরাফ বা ধর্মান্তরিত সাধারণ মুসলমান সমাজ। ভাষা ও ধর্মের টানাপোড়েনকে জিইয়ে রেখেছে বাংলার আশরাফ মুসলমানরা। এরা ছিল প্রধানত বাইরে থেকে আসা মুসলমান অভিবাসীদের সন্তান। তাদের পূর্বপুরুষদের ফেলে আসা দেশগুলো ছিল তাদের হৃদয়ে দীপ্যমান। বাংলায় বাস করেও তারা বাঙালিসত্তা গ্রহণ করেনি। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলমানরা একই সঙ্গে তাদের বাঙালি ও ইসলামি সত্তার জন্য গর্বিত ছিলেন।

বাংলায় একই সঙ্গে দুটি দ্বন্দ্ব কাজ করে। একটি হলো হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব। বাংলার বেশির ভাগ মুসলমানপ্রধান অঞ্চলে হিন্দুরা ছিল জমিদার, জমির মালিক ও মহাজন। ব্রিটিশ সরকারের সৃষ্ট চাকরি ও শিক্ষার বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধাও হিন্দুরা দখল করে নেয়। তাই অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের দ্বন্দ্ব ছিল অনিবার্য। পক্ষান্তরে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে বহিরাগত আশরাফ ও স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ছিল না। আশরাফরা স্থানীয় ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের তাদের চেয়ে হীন গণ্য করত। বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার সম্প্রসারণের ফলে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে স্থানীয় জোতদারেরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে ভাষা গুরুত্ব লাভ করে।

বাঙালি মুসলমানদের জীবনে ভাষা ও ধর্মের দ্বন্দ্ব সব সময়ই ছিল, তবে বিদেশি শাসনের প্রথম দিকে হিন্দুদের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে এ দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় মুসলমানরা আশরাফদের নেতৃত্ব মেনে নেয়। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর হিন্দু আধিপত্যের ভয় দূর হয়। সীমিত সম্পদের মধ্যে আশরাফ ও জোতদারদের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘাত দেখা দেয়। এই পর্যায়ে ভাষা ও ধর্মের দ্বন্দ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের মুখের ভাষা প্রাধান্য লাভ করে। পক্ষান্তরে হিন্দু- মুসলমানের দ্বন্দ্বের সময় ধর্ম সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব লাভ করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাঙালি জাতীয়তা ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ পরস্পরবিরোধী ধারণা নয়, এরা একটি বহুমাত্রিক জাতীয়তাবাদের দুটি মাত্রা মাত্ৰ।

একই ব্যক্তি কখনো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেছে, আবার পরে সেই ব্যক্তিই অবলীলাক্রমে ভাষাগত জাতীয়তাবাদে আস্থা স্থাপন করেছে। এই প্রসঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর স্কুলজীবনের কথা স্মরণ করে তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নেই। শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই।’[২৫] অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না, এটা আমি মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম।’[২৬] বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সুস্পষ্টভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাষাগত ও ধর্মীয় এই দুই উপাদানের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বাঙালিদের ‘আমাদের বাঙালি’ ও ‘আমাদের নয় বাঙালি’ এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। ‘আমাদের বাঙালি’ (অর্থাৎ পূর্ব বাংলার বাঙালিদের) প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটি হলো আমরা মুসলমান, আর একটি হলো আমরা বাঙালি।’ ‘আমাদের বাঙালি’ সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন, ‘নিজকে এরা চেনে না। আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।’ (পৃষ্ঠা ৪৭-৪৮)

ভারতীয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা বিশ্লেষণ করে তিনি যথার্থই লিখেছেন :

He was a fervent and articulate supporter of the Partition as well as the creation of Pakistan. He felt that it was the only way in which Muslims of Bengal could ensure for themselves a place under the Sun. He was not a religious extremist but was deeply convinced of the sanctity and relevance of the Islamic identity of Bengali Muslims who he felt would not get a fair deal from Hindu dominated India.[২৭]

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দীক্ষিত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বিশ্লেষণ করে তিনি আরও লিখেছেন :

Mujib as the first head of government of Bangladesh was deeply imbued with a sense of Bangladesh’s identity as a distinct socio-ethnic and political force in the sub-continent. He was clear about the ethno- cultural separateness of East Bengal from West Bengal (He emphasised the differences between a ‘Bangal’ and a ‘Ghoti’). He was also clear in his mind that the national identity of newly created Bangladesh can be sustained only if the Muslim identity of Bangladeshis forms a primary ingredient in ‘Bangladeshi nationalism’. This emphasis on Islamic identity of Bangladesh was not underpinned by any religious extremism or fanaticism or hostiity towards the minorities of Bangladesh.[২৮]

স্পষ্টতই বাঙালি জাতীয়তাবাদে দুটি উপাদান রয়েছে : ভাষাগত ও ধর্মীয়। যেহেতু পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নিদারুণ ব্যর্থতার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব, সেহেতু ভাষাগত উপাদানের প্রাধান্য রয়েছে, তবে ধর্মীয় উপাদান একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। এখানেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভয়। আবার কি ধর্মীয় উপাদানসমূহ প্রাধান্য লাভ করতে পারে? এ সম্ভাবনা যে একেবারে নেই, তা বলা ঠিক হবে না। অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনো ইসলামি উপাদানসমূহ অতি সক্রিয় রয়েছে। ওলন্দাজ ঐতিহাসিক উইলেম ভনশেন্ডেল লিখেছেন, ‘In many ways the Bangladesh state was the Pakistan state by another name’,[২৯] তবে অনেক বাংলাদেশির পাকিস্তানপ্রীতি সর্বার্থে ইসলাম ধর্মে প্রত্যাবর্তন নয়। বরং তাদের ভারত-বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুধু ধর্মীয় উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বড় রাষ্ট্র। বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতের প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্তকে আধিপত্যবাদের প্রয়াস হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। (আধিপত্যবাদ সম্পর্কে এ প্রবন্ধের পরবর্তী খণ্ডে আলোচনা করা হয়েছে)। সেই দিক থেকে অনেক বিষয়েই পাকিস্তানের ও বাংলাদেশের অবস্থান অভিন্ন। এতে ধর্মের প্রভাব খুবই কম। তবে এ ধরনের ভারতবিদ্বেষীরা ইসলাম-পসন্দ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একজোটে কাজ করে। তাই অনেক সময় ইসলাম-পসন্দ দলগুলোকে শক্তিশালী মনে হয়। তিনটি কারণে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদে ইসলামের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

প্রথমত ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতা বাঙালিদের ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতি মোহ চিরতরে ঘুচিয়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে যখন মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা দানা বাঁধে তখন এখানে মুসলমানরা ছিল শোষিত আর বর্ণহিন্দুরা ছিল শোষক। সাম্প্রদায়িকতার ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ভারতে চলে যায়। এই অভিবাসীদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিল বর্ণহিন্দু, যারা দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের শোষণ করেছে। নিম্নবর্ণের হিন্দু যারা থেকে যায়, তারা নিজেরা ছিল শোষিত। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে আজকের বাংলাদেশে অধিকাংশ শোষকই মুসলমান। এর ফলে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে তলোয়ারের জোরে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পথ ও মত নিয়ে বিভিন্নতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিদ্যমান ধর্মগুলোর মধ্যে একটি বড় সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান সব ধর্মই মানুষ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে। ধর্ম এখানে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে প্রচলিত ধর্মগুলো ধ্রুপদি হিন্দুধর্ম হতে ভিন্ন। অবশ্যই ইসলাম, বৌদ্ধধর্ম ও আদিবাসীদের ধর্মবিশ্বাস শাশ্বত হিন্দুধর্মসম্মত নয়। এমনকি যারা হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করে, তাদের ধর্মবিশ্বাসও নানাবিধ তন্ত্রমন্ত্র দ্বারা দূষিত। এসব বিশ্বাস যারা পছন্দ করেছে, তারাই হচ্ছে বাংলাদেশি হিন্দুদের সিংহভাগ। দীর্ঘদিন ধরে একটি উন্মুক্ত পরিবেশে বিভিন্ন মত ও পথের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক উইলেম ভনশেন্ডেল যথার্থই লিখেছেন :

Ideas, peoples and goods have met and mingled at this major crossroads since time immemorial, leaving innumerable cultutral, economic and gentic traces and creating a distinct regional culture. It is frrom such mingling and cross fertilization that modern Bangladeshi identities have emerged-never monolithic, often conflicted and in perpetual flux.[৩০]

বাংলাদেশের ভেতরে তাই ধর্মীয় উপাদানসমূহের শক্তি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদে তাই ধর্মের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাওয়ার কথা।

তবু দুটি শঙ্কার কারণ রয়ে গেছে। প্রথমত, বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সকল ধর্মের মধ্যে মৌলবাদী চেতনা পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে মৌলবাদী চেতনার প্রসার লক্ষণীয়। বাইরে থেকে মৌলবাদ বাংলাদেশে তরুণ মুসলমানদের আকর্ষণ করতে পারে। তবে বাংলাদেশে ভাষা ও ধর্মনিরপেক্ষ উপাদানসমূহ এত প্রবল যে শুধু বৈদেশিক প্রভাব জাতীয়তাবাদী চেতনায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করলেও, ইতিহাসের মূলধারাকে প্রভাবান্বিত করার আশঙ্কা কম।

দ্বিতীয় শঙ্কার কারণ ভারত। ভারত বাংলাদেশের চরম দুর্দিনে সমর্থন দিয়েছে। এখনো অনেক ক্ষেত্রে ভারতের সমর্থন প্রয়োজন। তবু বাংলাদেশের জনগণ ভারতের ওপর আস্থা বা ভরসা রাখতে পারে না। এর কারণ, ভৌগোলিক ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত অনেক বড়। ছোট দেশগুলো সব সময়ই বড় দেশকে ভয় করে। এই ভয় ছড়িয়ে পড়লে তা সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। পরবর্তী খণ্ডে আধিপত্যবাদ নিয়ে তাই আলোচনা করা হবে।

২.৪ বাংলাদেশে আধিপত্যবাদ ও জাতীয়তাবাদ

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের তুলনায় অনেক বেশি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ‘জিন্দাবাদ’ তকবির না দিলেও এ জাতীয়তাবাদ টিকে থাকবে। জিন্নাহর পাকিস্তান ও গান্ধীর ভারতের তুলনায় শেখ মুজিবের বাংলাদেশ অনেক বেশি টেকসই। তবু আগামী দিনগুলোতে একে দুটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। প্রথম সমস্যা হলো আধিপত্যবাদ, যা জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন সফল হওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়ন এ জাতীয়তাবাদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

তাত্ত্বিক দিক থেকে সব রাষ্ট্র সমান। বাস্তবে কিন্তু এ সমতার অস্তিত্ব দেখা যায় না। জর্জ অরওয়েল বিদ্রূপ করে জন্তুদের জগতে সমতা নিয়ে যা লিখেছেন, তা রাষ্ট্রের সমতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি লিখেছেন, ‘All animals are equal but some animals are more equal than others.’ পৃথিবীতে যে প্রায় ২০০ দেশ, তারা আইনগতভাবে সমমর্যাদার অধিকারী হলেও বাস্তবে তাদের ক্ষমতার মধ্যে প্রভেদ রয়েছে। দুই ধরনের রাষ্ট্রের আধিপত্যের ক্ষমতা রয়েছে। প্রথমত পুঁজিবাদী বিকাশের শীর্ষে অবস্থানকারী দেশ বা দেশগুলো। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে প্রধান আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র। এর আধিপত্যবাদী ক্ষমতা শুধু অর্থনৈতিক আধিপত্যে সীমাবদ্ধ নয়। সাংস্কৃতিক আধিপত্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই তিন ধরনের আধিপত্যকে নিশ্চিত করে সামরিক ক্ষমতা। যেহেতু পৃথিবীর সব অঞ্চলের দেশই এ ধরনের আধিপত্যবাদের শিকার, সেহেতু এ ধরনের নিষ্পেষণ সরাসরি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে তত প্রভাবিত করে না। দ্বিতীয়ত, অনেক অঞ্চলেই আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র রয়েছে। আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অনেক বেশি সোচ্চার।

বাংলাদেশ অঞ্চলে তিনটি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি রয়েছে। প্রথমত রয়েছে ইসলামি আধিপত্যবাদ। প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তান এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে কাজে লাগায়। তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামের নামে পাকিস্তানের আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

দ্বিতীয়ত, চীন এশিয়াতে একটি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কোনো সরাসরি সীমান্ত নেই। সামরিক আধিপত্য তাই সুদৃঢ় নয়। যদিও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, তবু ভাষাগত ভিন্নতার ফলে সাংস্কৃতিক প্রভাবও সীমিত। তবে চীনের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অর্জন মানুষের ইতিহাসে তুলনাহীন। চীন বর্তমানে বিশ্বের একটি বড় অর্থনীতি কাজেই চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর অবশ্যই পড়বে। তবে এ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ নয়। একে প্রতিহত করবে মার্কিন ও ভারতীয় অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিমান আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ হচ্ছে ভারতীয় আধিপত্যবাদ। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় উদার কূটনীতিবিদ জে এন দীক্ষিত যথার্থই লিখেছেন :

The point to be remembered is that India looms large in many ways in Bangladesh’s domestic politics and foreign policy. India is too overarching and too proximate to be ignored. It is also too proximate and assymetrical identity to have a close relationhip with. This is the Bangladesh.[৩১]

সৌহার্দ্যে ও প্রতিযোগিতায়, ভালোবাসায় ও বিদ্বেষে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক অনন্য। অভিন্ন জনগোষ্ঠী, একই ভাষা, ধর্মের বন্ধন ও সামগ্রিক ইতিহাসজুড়ে পারস্পরিক লেনদেন এদের নিবিড় বাঁধনে বেঁধেছে। অথচ আজ দুটি দেশ কাঁটাতারের বেড়ায় বিভক্ত। কয়েক দশক আগে এরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছে। আজ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে প্রচণ্ড বাঙালিবিদ্বেষ দৃশ্যমান। তবু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুফলও দেখা যায়। প্রায় ৬৭ বছর পর ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবু চারটি প্রাচীন সমস্যার আশু কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না :

পানিবণ্টন সমস্যা : ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় যথার্থই লিখেছেন, ‘বাংলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাংলার ছোট বড় অসংখ্য নদনদী। এই নদনদীগুলিই বাংলার প্রাণ; ইহারাই বাংলাকে গড়িয়াছে, বাংলার আকৃতি প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনও করিতেছে। এই নদনদীগুলিই বাংলার আশীর্বাদ; এবং প্রকৃতির তাড়নায়, মানুষের অবহেলায় কখনো কখনো বাংলার অভিশাপও।’[৩২] বাংলাদেশের সব বড় নদীই আন্তর্জাতিক। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে; মিয়ানমারের সঙ্গে রয়েছে চারটি। তবে বাংলাদেশ মূলত ভারত থেকে প্রবাহিত অভিন্ন নদী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুদূর অতীত থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্য পর্যন্ত এই নদীসমূহের পানিবণ্টনের কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যা দেখা দেয় ভারত বিভক্তির সঙ্গে সঙ্গে। এর সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পানির চাহিদাও অনেক বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নও পানির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। উজানের দেশ ভারত ভাটির দেশের চাহিদা বিবেচনায় না নিয়ে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। এতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে একটি সাময়িক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও অন্য নদীর পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। দুটো কারণে পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান সহজ হবে না। প্রথমত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পানিবণ্টনের প্রশ্নে জনসমর্থন প্রয়োজন। এ ধরনের সমর্থন সৃষ্টি করা অত্যন্ত শক্ত। ভারতের ভেতরে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে নদীর পানির বিভাজন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়নি। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে পানিবণ্টনের কোনো চটজলদি সমাধান পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, ভারতের জাতীয় পানি পরিকল্পনা অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবহারে বিশ্বাস করে না। বিশেষ করে, বিজেপি নেতৃত্ব মনে করে, যেসব অঞ্চলে উদ্বৃত্ত পানি রয়েছে, সে পানি অববাহিকা-নির্বিশেষে তাদের পানিঘাটতি অঞ্চলে প্রেরণের অধিকার রয়েছে। তাই তারা ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার উদ্বৃত্ত জলরাশি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে স্থানান্তরের পক্ষপাতী। এর ফলে বাংলাদেশে তীব্র পানিসংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। তাই বাংলাদেশে ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গরু ও চোরাচালান : বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বব্যাপী শুল্কের প্রাচীর ও অশুল্কের বাধা কমে যাওয়াতে চোরাচালানের হার কমে গেছে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও চোরাচালানের হার হ্রাস পেয়েছে। তবু বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে এখনো চোরাচালানের দৌরাত্ম্য অব্যাহত রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো, ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকায় ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে গরু রপ্তানি করে না। অথচ ভারতের কৃষকেরা চায় বুড়ো, অকেজো ও কম উৎপাদনশীল গো-সম্পদ রপ্তানি করতে। বাংলাদেশের ভোক্তারা আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্য উপযুক্ত দাম দিয়ে প্রতিবেশী দেশ থেকে গরু কিনতে চায়। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে গরু রপ্তানি বন্ধ থাকায় ভারত থেকে সব গরু চোরাচালানের মাধ্যমে আসে। সিএনবিসির একটি প্রতিবেদন থেকে (২ জুলাই ২০১৫) দেখা যায়, ভারত থেকে প্রায় ২০ লাখ গরু-মহিষ বাংলাদেশে চোরাচালান করা হয়। এর মূল্য প্রায় ৬৮ কোটি ডলার বা ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ভারত থেকে ফেনসিডিল নামক মাদকদ্রব্য আসে। প্রতিবছরই কিছু হিন্দু পরিবার ভারতে বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে তাদের সব সম্পদ ভারতে পাচার করে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে চোরাচালান বাবদ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিশোধ করতে হয়। ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা অত্যন্ত সীমিত। তাই এই পুরো অর্থ, যার পরিমাণ ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা, স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে শোধ করতে হয়। সামগ্রিকভাবে আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে চোরাচালানের পরিমাণ ২৪ হাজার কোটি হতে ৩০ হাজার কোটি। এই বিশাল চোরাচালানের উপকারভোগীরা কখনো বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে দেবে না।

মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতা : সম্প্রতি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব চুক্তিকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে অনেকেই মনে করেন। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বাধা দূর হলেও কাঁটাতারের বেড়া এবং জটিল ভিসা-ব্যবস্থা এই দুই দেশের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ বাধার সৃষ্টি করেছে। সীমান্তের অপর পারে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনটি ভয় রয়েছে। ভারতীয়দের মতে, ১৯৫০ থেকে ২০০১ সময়কালে ১.২ থেকে ১.৭ কোটি বাংলাদেশি ভারতে অভিবাসী হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যসমূহে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোর সংখ্যাধিক্য হুমকির সম্মুখীন। আসামে সাত দশকের বেশি সময়জুড়ে বাঙাল খেদা আন্দোলন চলছে। দ্বিতীয়ত ভয় করা হচ্ছে যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে। উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রে এক মিটার পানি বাড়লে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এর ফলে প্রায় তিন কোটি লোক শরণার্থী হয়ে পড়তে পারে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতে চলে যেতে চেষ্টা করবে। কাজেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মোট ৪ হাজার ৯৬ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ২ হাজার ৭৩৫ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কিছু অংশ ছাড়া ভারত আর কোনো প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেনি। শুধু কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেই ভারত ক্ষান্ত হয়নি; ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে চরম ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃত্ব দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিএসএফকে ট্রিগার হ্যাপি বা বন্দুকের ঘোড়াপ্রিয় বলে বর্ণনা করেছে। ২০০০ থেকে ২০১০ সময়কালে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে মারা গেছে। গড়ে প্রতি চার দিনে একজন বাংলাদেশি মারা যায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বেআইনি অভিবাসীরা নির্যাতনের শিকারও হন। এই পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে সৃষ্টি হয়েছে। এর কোনো চটজলদি সমাধান নেই।

বাণিজ্য ঘাটতি ও বিনিয়োগ : এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ ও পণ্য রপ্তানির সমস্যা। ২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুসারে ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানির মূল্য ছিল ৫.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে মাত্র ৬৮৯.৬ মিলিয়ন ডলার। এ বছরে তাই বাণিজ্যঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩-১৪ সালে এই ঘাটতি ছিল ৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার। ( কালের কণ্ঠ, ২৪ অক্টোবর ২০১৬, পৃষ্ঠা ৫)। গত দুই বছরে আমদানি হ্রাস ও রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে ঘাটতি পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও বাণিজ্যঘাটতি তুলে দিতে হলে বাংলাদেশকে ভারতে রপ্তানি কমপক্ষে ৯০০ শতাংশ বাড়াতে হবে। এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

বাণিজ্যঘাটতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ বৃদ্ধিজনিত সমস্যা। এই সমস্যাই হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশের আজকের ও আগামী দিনের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশিদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে না, ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরাও এ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেশ একটি বহুলপ্রচারিত পাক্ষিক। ২০১৫ সালে মোদির বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে পত্রিকাটির ১৭ জুন সংখ্যায় ‘মাছ নিয়ে গেছে চিলে’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। নিচে সম্পাদকীয়টির শেষ অংশটি উদ্ধৃত হলো :

আবার পাশাপাশি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেনার জন্য বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষ থেকে সামান্য সুদে দু’শো কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন মোদী। অনেকের মতে, দূর পথে যাবে এ ঋণ। টাকা আদতে চলে যাবে আদানি-অম্বানিদেরই পকেটে। কেননা তারাই হবে সেই বেসরকারি সংস্থা, যাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। দেশের স্বার্থ সম্পর্কে মোদী নিশ্চয়ই সচেতন, তাঁর দেশপ্রেম নিয়েও কোনো প্রশ্ন উঠবে না। কিন্তু নিজের রাজ্যের স্বার্থ রক্ষায় তাঁর এই পরোক্ষ উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। তবে এই সফরের সাফল্যে তৃপ্তির হাসিটি মোদী কিংবা হাসিনা হাসেননি। শিল্প-বাণিজ্যে পশ্চিম বঙ্গের বন্ধ্যাত্ব ঘুচছে না দেখে মমতার হাসি এমনিতেই ঘুচে গেছে। অতএব তিনিও হাসতে পারেননি। তাহলে কে? বরাতের ক্ষীরটুকু খেয়ে শেষ হাসিটি হেসেছেন দু’জন—আদানি ও আম্বানি।[৩৩]

যে ধরনের লেনদেন শুধু আদানি ও অম্বানির মুখে হাসি ফোটায় অথচ মোদি, মমতা বা হাসিনাকে হাসায় না, সেসব ব্যবসা কতটুকু টেকসই হবে, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ এ ধরনের অসম সম্পর্ক নিয়ে সজাগ না থাকলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে নেতিবাচক প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের ভাগ্যবিধাতারা ভারতীয় কূটনীতিবিদ জে এন দীক্ষিতের নিম্নলিখিত পরামর্শটি স্মরণ রাখতে পারেন :

The approach to economic, scientific and cultural cooperation with India would be selective and subject to constant caution about not allowing India to become excessively influential in Bangladesh. This is both a legitimate and logical orientation to which India should adjust and be responsive.[৩৪]

২.৫ বিশ্বায়ন ও জাতীয়তাবাদ : একদিন বাঙালি ছিলাম রে

নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের ধারণার পরিবেশে জাতীয়তাবাদের জন্ম। কিন্তু বিশ্বায়নের পরিবেশে আজকের দুনিয়াতে নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের ধারণা অচল হয়ে পড়েছে। নিজ দেশে অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার একসময়ে ছিল অকল্পনীয়। আজ তা সম্ভব। বাণিজ্যের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল চূড়ান্ত। আজ অনেক ক্ষমতা চলে গিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে। জাতিসংঘের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নজরদারি বেড়েছে। পরিবেশ থেকে স্বাস্থ্য, পরিবহন থেকে বেআইনি মুদ্রা পাচার—জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক খবরদারি সম্প্রসারিত হয়েছে। আন্তর্জাতিকতার চাপে রাষ্ট্রের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জাপানি লেখক কেনেচি ওয়ামির ভাষায়, জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থার অবসান ঘটেছে। সমাজতত্ত্ববিদ অ্যান্থনি গিডেন্স তাই লিখেছেন, ‘Nations have lost most of the sovereignty they once had, and politicians have lost most of their capability to influence events।’৩৫ অবশ্য সার্বভৌমত্বের অবক্ষয় সর্বত্র একই হারে হয়নি। যে দেশে বিশ্বায়নের মাত্রা বেশি, সেখানে সার্বভৌমত্বের অবক্ষয়ের পরিমাণও বেশি।

বিশ্বায়ন শুধু রাষ্ট্রের ক্ষমতা ওপরের দিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যায়নি, বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্র অনেক ক্ষমতা নিচের দিকেও হারাচ্ছে। মানুষ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ক্রীড়নক হতে চায় না। তারা রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে চায়। বিশ্বব্যাপী তাই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের দাবি উঠছে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে জাতিরাষ্ট্র ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতাও জাতিরাষ্ট্রসমূহের নেই। মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ ডেনিয়েল বেল যথার্থই লিখেছেন, বড় সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিরাষ্ট্র ছোট, আর মানুষের ছোট সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্য বেমানানভাবে বড়।

এই পরিস্থিতিতে প্রচলিত প্রতিষ্ঠানসমূহ ‘খোলস প্রতিষ্ঠান’ বা ‘Shell institution’-এ পরিণত হয়েছে। ভেতরে পরিবর্তন চলছে, কিন্তু বাইরের খোলস অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। অ্যান্থনি গিডেন্স এই পরিস্থিতিকে নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেন :

We continue to talk of the nation, the family, work, tradition, nature, as if they were all the same as in the past. They are not. The outer shell remains, but inside they have changed ~ and this is happening not only in the USA, Britain or France, but almost everywhere. They are what I call Shell institutions. They are institutioins that have become inadequate to the tasks they are all called upon to perform.[৩৬]

রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটছে। তবে পরিবর্তনের হার সর্বত্র সমান নয়। উন্নত দেশসমূহে এই পরিবর্তন অনেক ব্যাপক; উন্নয়নশীল দেশসমূহে এ পরিবর্তন অনেক শ্লথ।

তবে তৃণমূল পর্যায়ে সর্বত্রই বিশ্বায়নের বিপক্ষে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। মানুষ অস্বস্তিকর দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। অনেক মানুষের কাছেই মনে হচ্ছে যেন তারা পরিচিত ভুবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। এই সুরই

প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাংলাদেশের লোকগীতিতে :

একতারা বাজাইও না
দোতারা বাজাইও না
একতারা বাজাইও না, ঢাকঢোল বাজাইয়ো না
গিটার আর ব্যাঞ্জো বাজাও রে
একতারা বাজাইলে মনে পইড়া যায়
একদিন বাঙালি ছিলাম রে
একদিন বাঙালি ছিলাম রে।

বিশ্বায়নের প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও এই চাপা ক্ষোভ স্থানীয় সত্তাকে অদূর ভবিষ্যতে বাঁচিয়ে রাখবে।

বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের বিকাশের এই সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয় একটি প্রলম্বিত প্রক্রিয়া। ইতিহাসের অনেক বাঁক ও মোড় অতিক্রম করে এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের নিম্নলিখিত প্রবণতাসমূহ নীতিনির্ধারকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের আবির্ভাব আকস্মিক হলেও কাকতালীয় নয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। এ জাতীয়তাবাদ সুস্থিত এবং এর সহজে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। বস্তুত এই উপমহাদেশে তিনটি জাতিরাষ্ট্র রয়েছে : পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যার পরিবর্তনের সম্ভাবনা ভারত কিংবা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কম।

বাংলা ভাষা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি। তবু সব বাংলাভাষী নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে একটি বাঙালি রাষ্ট্রের উদ্ভবের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। এর প্রধান কারণ, পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা তাদের হিন্দু ঐতিহ্যের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং তারা কোনোমতেই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাজি হবেন না। ১৯৪৭ সালে বাংলাকে ভাগ করা হবে কি না, এ বিষয়ে যখন বাংলা বিধানসভায় ভোট নেওয়া হয়েছিল, তখন হিন্দু বিধায়কেরা সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।

বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র। ভারতের রাজনীতিবিদেরা কখনো এত বিপুল পরিমাণ মুসলমান নাগরিককে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হবেন না। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদে ধর্ম একটি গৌণ উপাদান। এমনিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে উগ্র ধর্মীয় চেতনা কখনো প্রাধান্য লাভ করেনি। বাংলাদেশের ধর্মীয় চেতনা সব সময়ই ছিল মানবতাবাদী।

জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে নিজস্ব সত্তাকে রক্ষা করার জন্য। জাতীয়তাবাদী চেতনা তাই সব সময়ে আধিপত্যবাদ-বিরোধী। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের জন্য ভারতীয় আধিপত্যবাদ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারত একটি বন্ধুরাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে প্রচুর সাহায্য করেছে। তবে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়। যদি অসতর্কভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পরিচালিত হয়, তাহলে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। যেহেতু ভারত একটি হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র, সেহেতু ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ সংগ্রাম পুনরুজ্জীবিত ইসলামি চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। এ সম্পর্কে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে।

পাদটীকা

১. Maulana Abul Kalam Azad. India Wins Freedom. Hyderabad: Orient Longmans, 1988.

২. Ishtiaque Husain Qureshi. The Struggle for Pakistan. Karachi: University of Karachi, 1965.248-262.

৩. Maulana Abul Kalam Azad. প্রাগুক্ত, ১৯৮

৪. Maulana Abul Kalam Azad. প্রাগুক্ত, ১৯৮

৫. Maulana Abul Kalam Azad. প্রাগুক্ত, ২৫২

৬. Pamela Hicks. Daughter of the Empire, London: Weidenfeld and Nicolson, 2012.

৭. Stanley Wolpert. Nehru, A Tryst With Destiny. New Delhi and Oxford: Oxford University Press 1996.

৮. Akbar S. Ahmed . Jinnah, Pakistan and Islamic Identity. London and New York: Routledge, 1997.

৯. Akbar S. Ahmed. প্রাগুক্ত, ১৪১

১০. Maulana Abul Kalam Azad. প্রাগুক্ত, ১৯৭-১৯৮

১১. Maulana Abul Kalam Azad. প্রাগুক্ত, ১৮২-১৮৩

১২. Collins, Larry and Lapierre Dominique 1975. Freedom at Midnight. New York. Simon and Schuester. 1998

১৩. Choudhary Rahmat Ali. Now or Never. In G Allana Pakistan Movement Historical Records. Karachi : University of Karachi, 1969, 104-110.

১৪. Ishtiaq Husain Qureshi. 1968 প্রাগুক্ত, ১২০-১২১

১৫. Ishtiaq Husain Qureshi. 1968 প্রাগুক্ত

১৬. Benedict Anderson. 1983. Imagined Communities. London. Verses

১৭. Lawrence Ziring 1992. Bangladesh, from Mujib to Ershad. Dhaka. University Press Ltd.

১৮. Lawrence Ziring, প্রাগুক্ত

১৯. গোলাম মুরশিদ। ২০০৬। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, ঢাকা : অবসর

২০. মুহম্মদ এনামুল হক, ১৯৫৭। মুসলিম বাংলা সাহিত্য। ঢাকা : পাকিস্তান পাবলিকেশন্স, ৭৫

২১. মুহম্মদ এনামুল হক, ১৯৫৭, প্রাগুক্ত

২২. মুহম্মদ এনামুল হক, ১৯৫৭, প্রাগুক্ত, ১৯৮

২৩. মুহম্মদ এনামুল হক, ১৯৫৭, প্রাগুক্ত, ৬৭

২৪. মুহম্মদ এনামুল হক, ১৯৫৭, প্রাগুক্ত

২৫. শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১৪। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৫

২৬. শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১৪। প্রাগুক্ত, ২১-২২

২৭. J. N. Dixit. 1999. Liberation and Beyond. Dhaka: University Press Ltd.

২৮. J. N. Dixit. 1999. প্রাগুক্ত, ২২৩-২২৪

২৯. Willem Van Shendel. 2009. A History of Bangladesh. New Delhi, Cambridge University Press, ২৬৮

৩০. Willem Van Shendel. 2009. প্রাগুক্ত, ২৬৮

৩১. J. N. Dixit. 1999. প্রাগুক্ত, ২৮১

৩২. নীহাররঞ্জন রায়। ১৪০০ বঙ্গাব্দ (পুনর্মুদ্রণ) বাঙ্গালীর ইতিহাস। আদিপর্ব, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং

৩৩. দেশ, ১৭ জুন ২০১৫

৩৪. J. N. Dixit. 1999. প্রাগুক্ত

৩৫. Anthory Giddens, প্রাগুক্ত

৩৬. Anthory Giddens, প্রাগুক্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *