উদিতের গায়ে খানিকটা জলের ছিটে লাগতে, বিরক্ত হয়ে একটু সরে দাঁড়াল। দেখল, একটি মেয়ে, রেনকোট গায়ে রেখেই ম্যাগাজিনের ওপরে ঝুঁকে পড়েছে। তার কোট থেকেই, ওর গায়ে জল পড়েছে। মেয়েটি ওর দিকে এক বার তাকাল মাত্র। আবার ম্যাগাজিনের ওপর ঝুঁকে পড়ল। উদিত বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল, মহারানি এলেন। রংচঙে রেনকোট গায়ে দিয়ে, সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকবেন, তা থেকে কারোর গায়ে জল পড়লেও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন ওটা আর গায়ের থেকে খোলা যায় না।
মেয়েটির দৃষ্টি পড়েছে তখন, উদিত যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনের বইগুলির ওপর। সে আরও এগিয়ে এল, আর উদিত রীতিমতো বিরক্ত হয়ে, অন্যদিকে সরে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি ফিরে চেয়েও দেখল না। তার ভেজা বর্ষাতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটা যেন, উদিতকে সরিয়ে দেবার জন্যই। উদিত একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে, ঘাড় কাত করে মেয়েটির দিকে তাকাল। হাতে একটি মাঝারি ব্যাগ ছাড়া, কিছু নেই। বর্ষাতির হাতা গুটিয়ে নিয়েছে, তাই ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। কবজির ঘড়িটা বেশ দামি মনে হল। দু হাতের নখ সযত্ন লম্বিত এবং রঞ্জিত। ঠোঁটে চোখেও রং, চুল ঘাড় ছাড়িয়ে নীচে নামেনি। দেখতে অবিশ্যি মেয়েটি সুন্দরী বা রূপসী, সেই জাতীয়। টানা চোখ, টিকোলো নাক, ফরসা রং, শরীরের গঠনটিও ভাল। বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে। কিন্তু এ সব পোশাক-আশাকের মেয়ে দেখলেই, উদিতের বিরক্ত লাগে। বড়লোকি ফ্যাশান। দিশি মেমসাহেব।
হঠাৎ মেয়েটি এক বার ঘাড় ফিরিয়ে উদিতকে দেখল। বোধ হয়, একটি লোককে তার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেখে, না তাকিয়ে পারল না। উদিতের আপাদমস্তক দেখল মেয়েটি। উদিত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল, একটা সিগারেট ধরাল। মেয়েটি ইতিমধ্যে দেশি আর বিদেশি, ইংরেজি আর বাংলা, প্রায় আধ ডজন ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিয়েছে। নিয়ে, স্টলের লোকটির দিকে বাড়িয়ে দিল। লোকটি সব দেখে বলল, সতেরো টাকা বারো আনা।
মেয়েটি ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পার্স বের করল, দুটো দশ টাকার নোট এগিয়ে দিল। খুচরো আর ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে, চলে যাবার আগে, পিছন ফিরে স্টেশনের ঢোকবার দিকটা দেখল। মনে হল যেন, দেখার মধ্যে একটা সতর্কতা আছে। তারপরে, সবদিকেই এক বার চোখ বুলিয়ে, প্ল্যাটফরমের গেটের দিকে এগিয়ে গেল। উদিত দেখল, ওর যে প্ল্যাটফরমে যাবার কথা মেয়েটি সেদিকেই গেল।
এই সময়েই স্টলের লোকটি বলে উঠল, একটু সরে দাঁড়ান মশাই।
স্বরে স্পষ্ট বিরক্তি। উদিতের নিজেকে কী রকম অপমানিত মনে হল। ও তাড়াতাড়ি সরে গেল, আর সেই মেয়েটির ওপর রাগ হতে লাগল। নিশ্চয়ই লোকটা, ওর ওপর রেগে গিয়েছে, ও এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, একটা কাগজও কেনেনি। আর একজন ওকেই সরিয়ে দিয়ে প্রায় কুড়ি টাকার কাগজ কিনে নিয়ে গেল। উদিতের মনে হল, টাকা থাকলে ওরকম ডাঁট সবাই দেখাতে পারে। তার ওপরে আবার মেয়ে! নিশ্চয়ই নিজের আয়ের পয়সায়, ওরকম করকরে নোট বের করে, রঙিন ম্যাগাজিন কেনা যায় না। ও প্ল্যাটফরমের দিকে এগিয়ে গেল।
যা ভেবেছিল, তাই, প্ল্যাটফরমে একটু গা বাঁচিয়ে দাঁড়াবার জায়গা নেই। এখন ইলশেগুঁড়ি ছাট বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই শেডের তলায় থাকবার চেষ্টা করছে। তাই ভিড় আরও বেশি। মালে মানুষে একেকার। উদিত হাত তুলে ঘড়ি দেখে অবাক হল। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে গাড়ি ছাড়তে, অথচ এখনও প্ল্যাটফরমে গাড়ি দিল না। মাইকে অনবরতই, হেঁড়ে গলায় কিছু না কিছু শোনা যাচ্ছে। কী যে বলে, উদিত কিছুই বুঝতে পারছে না, বুঝতে চায়ও না। কেবল গোলমাল খানিকটা বাড়তি মনে হচ্ছে মাইকের জন্য।
ফার্স্ট ক্লাস কোচ যেখানে থাকতে পারে, সেই মেয়েটি সেইরকম জায়গাতে দাঁড়িয়েই, মাথা নিচু করে ম্যাগাজিন দেখছে। কিন্তু এই মেঘলা দিনে, এখন তার চোখে সানগ্লাস আঁটা। চোখের জ্যোতি বোধ হয় বেশি। ঠোঁট বেঁকে উঠল উদিতের। ও আগের দিকে এগিয়ে গেল।
গাড়ি যখন ছাড়বার সময় হল, তখন প্ল্যাটফরমে গাড়ি এল। তারপরের চেহারাটা অতি কুৎসিত। ধাক্কাধাক্কি, মারামারি, চিৎকার, জায়গার জন্য ঝগড়া! উদিত দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখল। যাদের রিজারভেশন আছে তাদেরও তাড়া কম না। ও জানে, সকলের ওঠা হয়ে গেলে, কোনও একটা রিজারভ ছাড়া কামরায় ধীরে সুস্থে উঠবে। বসতে পেলে ভাল, না হলে দাঁড়িয়েই যাবে। কোনও এক জায়গায় গিয়ে, নিশ্চয়ই একটু জায়গা হয়ে যাবে। ওর কোনও ভাবনা নেই।
কিন্তু এই মারামারি ধাক্কাধাক্কির চেহারাটা দেখলে, ওর মনে হয়, কারোর জন্য কারোর কোনও মায়া দয়া দায়িত্ব নেই। এই সময়টার জন্য যত বড় বড় কথা, সভ্যতা ভদ্রতা সব কোথায় যেন হারিয়ে যায়। প্রত্যেকটা মানুষকেই কেমন হিংস্র, আর একই সঙ্গে অসহায় মনে হয়।
উদিত ট্রেনের পিছন থেকে সামনে পর্যন্ত এক বার টহল দিল। ফার্স্ট ক্লাসের দিকে এক বার বক্র দৃষ্টি হানল। আর মনে মনে বলল, টাকার বড় দরকার, তা না হলে চলে না। লোকগুলো আর যাই হোক নিঝঞ্ঝাটে যাবে।
তারপরে ভাবল, থার্ড ক্লাসের মেজাজ ওখানে নেই। ওখানে সবাই সবাইকে নাক সিটকোচ্ছে, সবাই সকলের থেকে বড়, কারোরই গ্যাদা ঘোচে না। সেকেন্ড ক্লাসটা হচ্ছে সব থেকে খারাপ। নামে সেকেন্ড ক্লাস, কিন্তু ব্যবস্থা থার্ড ক্লাসের থেকে খারাপ। বসবার জায়গা ছাড়া ওখানে রিজারভেশন হয় না। নামটাই যা একটু গালভারী, অবস্থাটা না ঘরকা না ঘাটকা। এর নাম মধ্যপন্থা, ভদ্রলোকের ভদ্রতা।
উদিত শেষ পর্যন্ত একটা কামরায় উঠল। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে, তিলধারণের ঠাঁই নেই। নিজেকেই বেকুফ মনে হতে থাকে। যেখানেই তাকাও, হয় তোক বসে আছে অথবা মালপত্র এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে, একটুও বসবার জায়গা নেই। জিজ্ঞেস করলে এক জবাব, লোক আছে দাদা।
দাদাও সেটা দেখবে, গাড়িটা ছাড়ুক। যারা আত্মীয় বিদায় দিতে এসে, জায়গা দখল করে বসে আছে, তারা নামলে কিছু জায়গা হবে। মালপত্রও গোছগাছ করে সরানো যাবে, কিছু বাঙ্কে তোলা যাবে। গাড়িটা না ছাড়লে, সুবিধা হবে না।
যে জায়গাটা সবথেকে বেশি সন্দেহজনক মনে হল, সে জায়গায় গিয়ে ও দাঁড়াল। একটি গোটা পরিবার, পুরো দুটো লম্বা বেঞ্চ আর দুটো বাঙ্ক দখল করে আছে। একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে একদিকে শুয়ে আছে। যেন কোলের শিশুটি ঘুমোচ্ছে। তেমনি ব্যাঙ্কের ওপর আট-দশ বছরের একটি ছেলেও শুয়ে আছে। নীচে মাঝখানে মালপত্র! আঠারো থেকে পঞ্চাশ, মহিলার সংখ্যা চার। পুরুষ তিন, দুই প্রৌঢ়, এক যুবক। যুবকটি বিশ-বাইশ এবং আঠারো-উনিশ বছর বয়স মেয়ে দুটির সঙ্গে কথা বলছে। এবং উদিতকে এক বার বাঁকা চোখে দেখল। যে-দৃষ্টির বক্তব্য হল, এখানে সুবিধে হবে না।
উদিত মনে মনে বলল, দেখা যাক গাড়িটা ছাড়ুক।
এ সময়ে ওয়ার্নিং বেল বাজল। কামরা জুড়ে আবার ব্যস্ততা দেখা দিল। দুই প্রৌঢ়ের মধ্যে একজন ব্যস্ত হয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, বললেন, চলি তা হলে রায়মশাই।
অপরজন, হাঁ হাঁ, আসুন। এই জল বাদলায় এতটা কষ্ট করে…
লো না, তাতে আর কী হয়েছে। কই গো, এসো।
এক প্রৌঢ়া গল্প ছেড়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, হ্যাঁ, চলো। সুবোধ আয়।
উদিত হিসাব করল, তিন জন নেমে যাচ্ছে। এখন প্রণামের পালা শেষ হলে, তিন জন দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তা হলে, আটজনের জায়গায় দাঁড়াল মহিলা তিন, (দুটি যুবতী) পুরুষ এক, খোকা-খুকু দুই, সাকুল্যে ছয়। একটা জায়গা হওয়া উচিত। মনে হয়, বর্ধমান বীরভূম ছাড়িয়ে যেতে যেতে কিছু ফাঁকা হবে। যদিও সুবোধ নামক যুবকটি যাবার আগে বলে গেল, মেসোমশায়, আপনারা ভালভাবে জায়গা নিয়ে বসুন।
অর্থাৎ এখানে আর কাউকে বসতে দেবেন না। উদিত আর এক বার সমস্ত কামরাটা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিল, আর কোথাও এক জনের বসবার জায়গা আছে কি না। এক জায়গায় আছে, তবে সেখানে একটি বছরখানেকের শিশুকে শোয়ানো আছে। আবার ঘণ্টা বাজল। হুইসল শোনা গেল, গাড়ি দুলে উঠল। এই পরিবারটি জানলায় দাঁড়িয়ে তখনও সবাইকে বিদায় দিতে ব্যস্ত। কেবল উদিতের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে আছে, বারো আর দশের খুকু-খোকা। উদিত মনের সব বাধা ঝেড়ে ফেলে, একটা ধারে বসল। জানলার ধারটা ছেড়ে দেওয়াই উচিত, কেনো এরাই যখন জায়গাটা আগে দখল করেছে।
বসতে না বসতেই রায়মশাই নামক প্রৌঢ় ভদ্রলোক হুমকে উঠলেন, ও মশাই ওটা আমাদের জায়গা।
গাড়ি তখন চলছে। বারো বছরের ফ্রক পরা খুকু উঠে বসেছে। তার পাশে প্রৌঢ়া গিন্নি। দুই মেয়ে তখনও পঁড়িয়ে, বিরক্ত চোখে উদিতকে দেখছে। খোকা বাঙ্ক থেকে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল। বোধ হয় বাবাকে সাহায্য করার জন্য নেমে এল। উদিত বলল, আপনাদের জায়গা ছেড়েই বসেছি।
তার মানে?
উদিত সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, আপনাদের ছজনের জায়গা ঠিকই আছে। আট জন তো এখানে ভালভাবেই বসতে পারে।
ভদ্রলোক ক্রুদ্ধ হলেন, একই সঙ্গে অসহায়ভাবে কন্যা দুটির দিকে তাকালেন। দুই কন্যা উদিতকে, বিরক্ত চোখে দ্রুকুটি করল। বড় কন্যা বলল, এ জন্যই রিজারভেশনের দরকার হয়। তা হলে আর এ সব বাজে ঝামেলা হয় না।
পিতা বললেন, ঝামেলা বলে ঝামেলা, যাচ্ছেতাই। সুবোধ-টুবোধ থাকলে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।
অর্থাৎ সুবোধ থাকলে, উদিতের বসা হত না। কথা হয়তো ও বলত না, কিন্তু ইঙ্গিতগুলো সহ্য করতে না পেরে, পিতার উদ্দেশে বলল, রিজারভ করলে তো আট জনেই বসত। তার থেকে এ আর খারাপ কী হল বলুন।
ভদ্রলোক আর সে কথার জবাব দিলেন না। উদিতের পাশ ঘেঁষে এমনভাবে বসলেন, যেন এখান থেকে তিনি গোটা পরিবারকে উদিতের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন, এইরকম একটা ভাব। মেয়েরা উলটো দিকে বসল। একদিকে মা, দুই বড় কন্যা। আর একদিকে পিতার পাশে খোকা-খুকু। মেয়েদের ঘাড় বাঁকানো, বিনুনি ফেরানো, ধপাস করে বসা, সমস্ত ভঙ্গির মধ্যেই, একটা বিক্ষোভ ফুটে উঠল। সকলের ভাবভঙ্গি দেখে উদিতের অস্বস্তি হতে লাগল। ও যেন সহজভাবে বসে থাকতে পারছে না। মনে হল, এর চেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভাল। কী দরকার এত মেজাজ খারাপ আর বিক্ষোভ দেখার। উদিত প্রৌঢ় ভদ্রলোকের দিকে ফিরে, বেশ সহজ গলাতেই বলল, আর আপনাদের যদি অসুবিধে হয়, তা হলে আমি সরে গিয়ে দাঁড়াতে পারি।
কথাটা ও এত আচমকা বলল যে, ভদ্রলোক ঠিক যেন বুঝে উঠতেই পারেননি, কেবল শব্দ করলেন, অ্যাঁ?
পরিবারের বাকিরাও অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। ভদ্রলোক তাকালেন কন্যাদের দিকে, এবং স্ত্রীর দিকে। দুই কন্যাই কেমন যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। উদিত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিতা বললেন, না থাক, বসেছেন যখন…।
উদিত দেখল, কন্যাদের চোখে, পিতার কথার অনুমোদন ফুটে উঠল, গিন্নির মুখেও! উদিত মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, পিতার এটুকু ভদ্রতাবোধ আছে। আশেপাশের বেঞ্চের যাত্রীরা একটু তাকিয়ে দেখল। অবসরে আবার সবাই যে যার কথায় মেতে গেল। সকলের কথা থেকে, উদিত বুঝতে পারল, অধিকাংশ যাত্রীর মনেই, একটা বিশেষ উদ্বেগ রয়েছে, শেষ পর্যন্ত গাড়িটা তাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারবে কি না। কারণ বন্যা পরিস্থিতি মোটেই ভাল না।
এতক্ষণ কথাটা উদিতের এক বারও মনে আসেনি। অথচ উত্তরবঙ্গ আর বিহারে জলস্ফীতির বিষয়, গতকালই ও একবার কাগজে দেখেছিল যেন। কিন্তু পরিস্থিতি যদি সেরকম হত, তা হলে, দাদা কি কিছু বলত না। কিংবা, দাদার হয়তো খেয়াল হয়নি। এখন ও কান পেতে যাত্রীদের কথা শুনে বুঝতে পারছে, অনেকেই বন্যার কথা বলাবলি করছে। অবিশ্যি, অধিকাংশ লোকের মনেই আশা ব্যাপার তেমন গুরুতর না। তা হলে, ট্রেন হয়তো ছাড়ত না।
পাশ থেকে প্রৌঢ় যাত্রী বললেন, কৃষ্ণা, কাগজে কী লিখেছে ভাল করে দেখেছিস?
বিশ বাইশ বছরের মেয়েটি বলল, সেরকম কিছু না, তবে গঙ্গার জল যেরকম বেড়েছে, তাতে যে কোনও সময়ে, একটা বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।
আঠারো-উনিশ বলল, শুধু গঙ্গা নয় দিদি, ওদিকেও জল বেড়েছে। জলঢাকা তিস্তা মহানন্দা, আজকের কাগজে আছে। লিখেছে, সবাইকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে।
আশ্চর্য, উদিত ব্যাপারটা এক বারও ভাবেনি, ওর মাথাতেই আসেনি। অবিশ্যি, ও একলা যুবক, পথ চলতে কোনও বিষয়েই দুশ্চিন্তা আসে না। রায়মশাই বললেন, তাই তো রে মীনা, আরও কয়েক দিন কলকাতায় থেকে গেলেই যেন ভাল হত।
বলে তিনি গিন্নির উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে তাকালেন। যার নাম মীনা, সে বলল, তুমিই তো ব্যস্ত হয়ে উঠলে।
ব্যস্ত কি আর সাধে হলাম, শুনলি তো, কৃষ্ণার আবার…।
কথাটা শেষ করলেন না। কৃষ্ণা নামী যুবতী যেন একটু রাঙা হয়ে উঠল, আর মীনা তার দিকে চেয়ে হাসল। ব্যাপারটা বোঝা গেল না। রায়মশাই আবার জিজ্ঞেস করলেন, মেখলিগঞ্জের কথা কিছু লিখেছে কাগজে?
কৃষ্ণা বলল, হ্যাঁ, সেখানকার লোকদেরও যে কোনও সময়েই বিপদের জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
রায়মশাই প্রায় অসহায়ের মতো বললেন, বোঝ এখন।
তারপরেই তিনি যেন একটা অবলম্বনের জন্যই, হঠাৎ উদিতকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যাবেন?
উদিত বলল, জলপাইগুড়ি।
উদিতেরও এবার স্বাভাবিকভাবেই একটু কৌতূহল দেখা দিল। রায়মশাইদের গন্তব্য কোথায়, সেটা ওর জানবার ইচ্ছা হল। ওকে যখন জিজ্ঞেস করেছে, তখন ওরও জিজ্ঞাসার কোনও সংকোচের কারণ নেই। জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোথায় যাবেন?
মেখলিগঞ্জ।
মীনা বলে উঠল, কিন্তু জলপাইগুড়ির আশেপাশের অবস্থা খুব ভাল না, কাগজে সেইরকম লিখেছে।
উদিতের সঙ্গে একবার মীনার চোখাচোখি হল। উদিত রায়মশাইকে বলল, সেরকম বুঝলে, শিলিগুড়িতেই থেকে যাব। সেখানেও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি আছে। কিন্তু আপনাদের মেখলিগঞ্জ যাবার রুট কী, মানে ট্রেনে যাবেন না অন্য কিছুতে?
রায়মশাই বললেন, আগে জলপাইগুড়িতক তো যাই, যদি ট্রেন যায়। তা হলে, সেই গাড়িতেই, একেবারে হলদিবাড়ি পর্যন্ত, তারপর সেখান থেকে বাসে করে যাব।
মীনা বলল, যদি রাস্তা ডুবে গিয়ে না থাকে। তিস্তা আমাদের পার হতেই হবে। তার চেয়ে, বার্ণেসঘাটে গিয়ে, আমরা তো চ্যাংরাবান্ধা হয়েও যেতে পারি বাবা।
রায়মশাইয়ের মুখের রেখায় উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার ছায়া ফুটে উঠল। ঘাড় নেড়ে বললেন, চ্যাংরাবান্ধা থেকে রাস্তা সুবিধার না।
উদিতের মনে পড়ে গেল, একটা গানের লাইন, চ্যাংরাবান্ধার রেশমি চুড়ি, পাইসা পাইসা দাম। তার মধ্যে লেখা আছে, চ্যাংরাবন্ধুর নাম।..মানে যুবক বন্ধুর নাম।
কৃষ্ণা তার বাবার উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে চেয়ে বলল, এত ভাবছেন কেন বাবা, কত লোক তো যাচ্ছে। সকলের যা হবে, আমাদেরও তাই হবে।
রায়মশাই বললেন, সেটা ঠিক। কিন্তু দুশ্চিন্তা তো যেতে চায় না।
উদিত এক মুহূর্ত দ্বিধা করে, একটা সিগারেট ধরাল। ওরকম বহু বয়স্ক লোকের সামনে সিগারেট খেয়ে থাকে। উদ্বেগে আর দুশ্চিন্তাতেই রায়মশাই চুপ করে থাকতে পারছেন না। একটি অল্প বয়সের যুবক তাঁর সামনে সিগারেট খাচ্ছে, সেটা তিনি চেয়েও দেখলেন না। উদিতই বরং অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। রায়মশাই ওকে জিজ্ঞেস করলেন, জলপাইগুড়িতে আপনাদের বাড়ি।
উদিত মুখ ফিরিয়ে বলল, হ্যাঁ।
শহরের ওপরেই?
হ্যাঁ।
অ! কলকাতায় কি চাকরি করেন না পড়েন?
উদিত বুদ্ধিমানের মতো জবাব দিল, কলকাতায় দাদা থাকেন, বেড়াতে এসেছিলাম।
রায়মশাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বুঝেছি। জলপাইগুড়ি শহরে কোন পাড়ায় বাড়ি, মানে অনেকেই চেনাশোনা আছে কিনা। সেই জন্যই জিজ্ঞেস করছি।
গোলমেলে প্রশ্ন। এত কথা জানবার কী দরকার। ওই ধরনের বয়স্ক লোকদের এ সব বোঝানো যায় না। কৃষ্ণা মীনা যে বাবার কথায় একটু অস্বস্তি বোধ করছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু রায়মশাইয়ের মতো ব্যক্তিরা এটাকে একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন হিসাবেই মনে করেন। বরং না জিজ্ঞেস করাটাই অস্বাভাবিক। উদিত বলল, পুরকায়স্থ পাড়ায়।
কৌতূহলিত জিজ্ঞাসায় রায়মশাইয়ের কপালে রেখা সর্পিল হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করলেন, পুরকায়স্থ পাড়ায়? কার বাড়ি বলুন তো, আপনার বাবার নাম কী?
না, লোকটা জ্বালালে। এত পরিচয় পাড়ার কী আছে? ভদ্রলোক আবার বাবার নামও জিজ্ঞেস করছেন। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে উদিত বলল, বলরাম চট্টোপাধ্যায়।
রায়মশাই একেবারে আঁক করে উঠলেন, অ্যাঁ, বলরামবাবুর ছেলে? বলরাম চাটুয্যে মানে আদি নিবাস পাবনায় তো?
উদিত এটাই ভয় করেছিল। সিগারেটটা মাটিতে ফেলে, জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ।
রায়মশাই খুশি আর বিস্ময়ে হেসে তাঁর সমস্ত পরিবারের দিকে এক বার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর উদিতের দিকে ফিরে বললেন, কী আশ্চর্য, বলরামবাবু তো আমার বিশেষ পরিচিত, বলতে গেলে বন্ধু ব্যক্তি। আমি তো পুরকায়স্থ পাড়ার বাড়িতেও গেছি। আপনার–আপনি বলার কোনও মানে হয় না, তুমি মেজো না সেজো।
মেজো।
রায়মশাই নিজের মনেই ঘাড় নেড়ে বললেন, সেজোটি এখনও অনেক ছোট, মাঝে তো তোমার তিন বোন আছে না?
দুই বোন, এক দিদির বিয়ে হয়ে গেছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই হবে, তাই হবে। তোমার দিদির বিয়েতে যেতে পারিনি বটে, নেমন্তন্ন পেয়েছিলাম। তোমার মায়ের হাতের রান্না বড় ভাল।
কথাটা মিথ্যা না, কিন্তু উদিতের খারাপ লাগছে, একজন অভিভাবক জুটে গেল দেখে। তারপরে নাম জিজ্ঞাসা, রায়মশাইয়ের নিজের পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। রায়মশাই হেসে বললেন, দ্যাখ দিকিনি তুমি এত চেনাশোনা বাড়ির ছেলে, আর একটু হলেই তোমার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যাচ্ছিল।
উদিত হেসে বলল, আমি ঝগড়া করতাম না।
ওর কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। উদিত বুঝতে পারল না, এর পরে, রায়মশাই এবং রায়গিন্নিকে একটা প্রণাম করা উচিত কি না। একটা পারিবারিক পরিচয়ের কথা যখন জানাই গেল, এটাও একটা পারিবারিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে। ওর নিজের মনের দিক থেকে কিছু যায় আসে না, প্রণাম না করলে হয়তো, রায়মশাই একটু মনে মনে কষ্ট পাবেন, অসামাজিক অভদ্র ভাববেন। অতএব, ও রায়মশাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, বলল, পরিচয় যখন হয়েই গেল।
রায়মশাই খুশি হয়ে, উদিতের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, আহা, তাতে কী হয়েছে, তাতে কী হয়েছে।
বললেন, কিন্তু মুখে একটি সন্তুষ্ট হাসি ফুটে উঠল। রায়-গিন্নিকেও প্রণাম করল উদিত। তিনি বললেন, আহা থাক না। বেঁচে থাকো বাবা।
রায়মশাই এবার উৎসাহের সঙ্গে তাঁর ছোট ছেলের হাত টেনে ধরে সরিয়ে নিয়ে বললেন, খোকা, সরে বসো। তুমি ভাল হয়ে বসো উদিত।
এবার উদিতেরই লজ্জা করতে লাগল। বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে।
উদিতের হাসি কৌতুকোজ্জ্বল চোখ এক বার কৃষ্ণা মীনার দিকেও পড়ল। ওরাও হাসি চাপতে পারল না। রায়মশাইও হেসে বললেন, এতে আর হাসির কী আছে। ওরকম একটু হয়ে যায়, না কী বলো হে উদিত।
নিশ্চয়।
মীনা বলল, সুবোধদা কী বলছিল জানেন বাবা?
কী?
কৃষ্ণা হেসে ধমক দিয়ে বলল, যাঃ মীনা, ও কথা আবার বলে নাকি?
মীনা বলল, তাতে কী হয়েছে। এখন তো জানাশোনা হয়ে গেছে।
বলে, উদিতের দিকে চেয়ে হেসে বলল, সুবোধদা উদিতবাবুকে দেখিয়ে বলছিল, এ ঠিক বসবার তালে এসেছে, খবরদার বসতে দিস না।
আবার একটা হাসির ঝংকার বাজল। সকলেই বেশ সহজ হয়ে উঠল।