২. জরিনার মা মারা গিয়েছিলেন

জরিনার মা মারা গিয়েছিলেন সন্তান হতে গিয়ে, প্রায় তিনদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর। মা আর সন্তান বাচলো না কেউই। শাহ সাদেক আলী তখন উত্তর বাংলা সফরে বেরিয়েছেন।

আলীজাহ্ তার করল তিন জায়গায়। সেই তার সাদেকের হাতে গিয়ে যখন পৌঁছুলো আর যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন দাফন হয়ে গেছে। সাদেক নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন তার স্টাডির চামড়া–মোড়া গভীর চেয়ারে।

সাদেক কাছে ডাকলেন না কাউকে। না নূরুন্নাহার, না জরিনা। আলীজাহ্ তাদের আগলে রইলো। সারা বাড়ি ভরে উঠলো পাষাণ–চাপা নিস্তব্ধতায়। একটা মানুষ যে সহস্র হয়ে আলো করে থাকতে পারে, তা কে জানতো? কোনদিন সরাসরি সম্পর্ক ছিল না সংসারের সঙ্গে সাদেকের। এখন সেটুকুও আর রইলো না। হঠাৎ যেন এক সাগর–সংগ্রামে এসে দাঁড়িয়েছেন শাহ সাদেক আলী। যেন তার এই স্তব্ধতার, অনুপস্থিতির, স্বল্পভাষীতার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই আর; আর, উত্থান নেই, পতন নেই; কেবলি প্রবাহিত হচ্ছে একটি স্থির অকল্প দীর্ঘ সরলরেখা।

বিপরীতে পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো দুবোন, জরিনা আর নুরুন্নাহার। পিঠেপিঠি দুবোন নয় তারা, তখন তারা সাত আর তেরো। নূরুন্নাহার ছিল চপল দুষ্টু। তার কপাল ছিল আধখানা চাঁদের মত ছোট আর চাপা, নাক তিলের মতো এই এতটুকু। আর প্রশস্ত দুই পাতলা ঠোঁটে রেশমি রক্তিমতা। দুষ্টুমিটা ছিল ওর নেশা। চতুরালি ছিল ওর স্বভাব। উল্টো দিকে জরিনা তার অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত কপাল, চাঁদের মত গোল মুখ আর ক্রীম রঙা রেকাবির মতো গাল–যা ক্ষণে ক্ষণে হয়ে উঠতো লাল–আর ব্রাউন রঙ চুল নিয়ে নুরুন্নাহারের পাশে ছিল অনেকটা বোকা, মন্থর, হয়ত কিছুটা সাবধানী। চট করে দেখলে বাইরের কেউ মনে করেও বসতে পারত যে, মেয়েটা বোবা–এমনি তার চাহনি, এমনি তার চলন।

নূরুন্নাহারের সমস্ত দুষ্টুমি গিয়ে পড়ত জরিনাকে নিয়ে। জরিনার কান্না পেত। কিন্তু তবু নূরুন্নাহারের সঙ্গ থেকে এতটুকু দূরে সরে যেত না সে।

বৃষ্টি পানিতে সমুখের পথটা নদী হয়েছে তো নূরুন্নাহারকে নৌকা বানাতে হবে। আর তার কাগজ জোগাবে জরিনা নিজের খাতা ছিঁড়ে–এতে তার আনন্দ। অথচ একটা নৌকাও যদি কোনদিন সে ছুঁতে দিয়েছে জরিনাকে। আর সন্ধ্যে বেলায় খাতার এ হেন অবস্থার জন্যে মাস্টারের বকুনিটুকুও খেতে হলো জরিনাকে। নূরুন্নাহার তখন মুখ টিপে হাসছে। এমন কি মাস্টার নূরুন্নাহারের লক্ষ্মীপনার আদ তুলে ধরে জরিনাকে তখন বলছে–এইতো তোমারই বোন, তার খাতা দেখ দিকি–কেমন ঝকঝক করছে।

কিংবা নূরুন্নাহারের বুদ্ধিতেই একটা নতুন খে, আবিষ্কার হলো, পাল্লা দিয়ে সিঁড়ি থেকে কে কত তাড়াতাড়ি নেবে আসতে পারে। তখন দুপুর বেলা। চারদিক সুম সুম করছে। দৌড়ে নাবতে গিয়ে ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ল জরিনা। কপালের কাছে তেরছা হয়ে আধ ইঞ্চিটাক কেটে গিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল দর দর করে। চিৎকারে করে উঠলো। যে মেয়েটি স্বভাবতই কিছু বলে না তার এই আকস্মিক চিৎকারে ঝন ঝন করে উঠলো গোটা বাড়ি। ওপর থেকে মা এলেন, এলেন সাদেক। ওদিকে নুরুন্নাহারই তখন উবু হয়ে পড়ে কামিজের খুট দিয়ে রক্ত মুছে দিচ্ছে জরিনার। জিজ্ঞেস কলে বলছে, আমি তো জানি না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম. চকার শুনে এসে দেখি বাবুর এই অবস্থা। আমি কী করব বল? কোন প্রতিবাদ করল না জরিনা। আর আশ্চর্য, সেই রক্তঝরা যন্ত্রণার মধ্যেই সে মুগ্ধ হলো, ঈর্ষান্বিত হলো বোনের মিথ্যে বলার অপূর্ব সাবলীলতা দেখে। কপালের সেই কাটা দাগটা জরিনার এখনো আছে একটা আবছা খয়েরি দাগ হয়ে।

এই তো সব দুষ্টুমি। তবু জরিনা সঙ্গ ছাড়বে না নূরুন্নাহারের।

একেকটা হঠাৎ পাওয়া ছুটির দুপুরে কিংবা কোনদিন রাতে কেন যে নূরুন্নাহার একলা থাকতে চাইতো, তন্ময় হয়ে যেত নিজেকে নিয়ে, জরিনা তা বুঝে উঠতে পারত না। তখন কাছে গেলে তাড়া খেয়ে ফিরে আসতে হতো। কিংবা এমনও হয়েছে, নূরুন্নাহার ডুবে গেছে নিজের প্রসাধনে। আয়নার সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুল বাঁধা, রিবনে বো ভোলা, চলছে তো চলছেই। আর পাউডার পাফ আর ভ্রু আঁকা। তখন জরিনাকে সে তাড়িয়েও দিত না, কথাও বলতো না–তার উপস্থিতিকে একটা করুণার দৃষ্টি দিয়েও যেন স্বীকার করতে চাইতেন নূরুন্নাহার। আর জরিনার মনে হতো একটা নতুন মানুষ, একটা বাইরের মানুষকে সে দেখছে। অনেকক্ষণ–সে দাঁড়িয়ে থাকতো, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার চিবুক অবনত হয়ে আসত–প্রায় দুই ছুঁই হতো গলার ভাজটার কাছে। বু নূরুন্নাহার নির্বাক, নিস্পৃহ।

একদিন রাতের বেলায় খেয়ে দেয়ে জরিনা গিয়েছিল নূরুন্নাহারের কামরায়।

বছরখানেক হলো নূরুন্নাহার বড় শোবার ঘরের পাশে ছোট কামরাটায় থাকে আর জরিনা মায়ের কাছে। জরিনা গিয়ে দেখে বিছানায় উপুড় হয়ে সে খাতায় উল্টোদিক থেকে প্রথম পাতায় কী লিখছে। জরিনা কাছে যেতেই নূরুন্নাহার খপ করে কোমর বাঁকিয়ে আধো উঠল। কিছু বলার আগেই কৌতূহল ততক্ষণে জরিনার মুখে কথা এনে দিয়েছে।

কী লুকোলি, আপা?

সে কথার জবাব না দিয়ে নূরুন্নাহার সোজা তর্জনী দেখিয়ে দেয়।

পালা, পালা শীগগীর। বলে দেব মাকে? আমার পড়া ডিস্টার্ব করছে?

বলনা আপা।

না।

বালো।

বলছি–না।

জরিনা আর প্রশ্ন করে না। কিন্তু চলেও যায় না। তেমনি খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কী ভেবে নূরুন্নাহার শরীরের ভঙ্গিটাকে বদলায়, মুখটাকে শিথিল আর মসৃণ করে আনে। উঠে বসে বলে, নাহ, তোর জ্বালায় কিছু করবার যো নেই। তুই ছেলে মানুষ–তুই কী বুঝবি? যখন ক্লাস এইট নাইনে পড়বি তখন।

জরিনা বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। মনে একটু দুঃখও হয় হঠাৎ এই বয়সের পার্থক্যটা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়ার জন্য। রাগ হয় দেমাক দেখে। কিন্তু রাগের চেয়েও বেশি হয় কৌতূহল আর ঈর্ষা।

নূরুন্নাহার বলে, দাঁড়া পেছন ফিরে। ছাড়বিনে যখন, দেখাচ্ছি। কাউকে বলতে পাবিনে কিন্তু। দাঁড়া শীগগীর–আর একটু ঘুরে। যখন ফিরতে বলব তখন তাকাবি–তার আগে না, খবরদার।

জরিনা পেছন ফিরে শব্দ শুনতে পায় নূরুন্নাহারের খাতা থেকে পাতাটা ছিঁড়ে ফেলল। তারপর ভাঁজ করার আওয়াজ। কিন্তু ফিরতে বলল না তাকে। নূরুন্নাহার সমুখে এলো তার। হাতে কাগজটা। বলল, একবার দেখতে পাবি–। এক সেকেণ্ড।

 জরিনা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। নূরুন্নাহার ভাজ খুলে কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরেই টুক করে সরিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে জরিনার চোখে শুধু কতকগুলো হিজিবিজি লেখা জীবন্ত হয়ে, তরঙ্গ হয়ে উঠেই মিলিয়ে যায়। একটা অক্ষরও সে বুঝতে পারে না।

বলে, কী।

কী আবার? দেখালাম তো।

তারপরই খপ করে জরিনাকে টেনে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দেয়, কাগজটা আবার পুরোপুরি চোখের সমুখে মেলে ধরে, একেবার পেছন ফিরে দরোজার দিকে দেখে নেয়, ফিসফিস করে বলে, কিছু পড়তে শিখিস নি? এই দেখ–ভ–এ আকার ভা, ল–এ ওকার লো, ব–এ আকার বা, আর দন্ত্য স–এ আকার সা–ভালোবাসা।

জরিনা পড়তে পারে এবার। অবাক হয়ে দেখে সারাটা কাগজ জুড়ে শুধু ওই একটি শব্দই বারবার লেখা। কেন যেন দুপ দুপ করতে থাকে তার বুক, এত আস্তে এত কানের কাছে মুখ রেখে নূরুন্নাহার কথা বলছে।

জানিস, বাবা মাকে ভালোবাসে।

জরিনার খুব অবাক লাগে। মনে মনে ছবিটা ভেসে ওঠে, বাবা চেয়ার টেবিলে বসে লিখে চলেছেন। বাবা দিনরাত লেখেন। কিন্তু কই, সে গিয়ে পড়লে বাবা তো এমনি করে কাগজ লুকোন না। বাবা কি এমনি সব কাগজে লিখে মা–কে দেন? মাঝে মাঝে মানুষজন আসে। এসে, সব লেখা কাগজপত্র নিয়ে যায়। বাবা তাহলে ওদেরও ভালোবাসেন।

নুরুন্নাহার হঠাৎ বলে, খবরদার, কাউকে বলবি না, মাকেও না।

না না না।

জরিনা শুধু মুখে বলে না, মাথা নেড়েও উত্তর করে।

চোখ ছুঁয়ে বল্ কাউকে বলবি না –যা পালা শীগগীর।

জরিনার গা কেমন শিরশির করতে থাকে–ঠিক দুপুর রাতে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ অন্ধকার দেখলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি।

এমনি করে দিনের পর দিন।

কিন্তু একটা দরোজা পেরুলে পরের কামরা যেমন আগের কামরা নয়, ঠিক তেমনি মায়ের এন্তেকালের পর দুবোনের সম্পর্ক একটা নতুন চক্রে এসে বিকশিত হয়।

আরম্ভটা ছিল এ রকম–

বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেলেন জরিনার মা। শনিবারের দুপুরের কথা। শাহ সাদেক আলী আলীজাহ্‌ তার পেয়ে সেইদিনই সকালে এসে পৌঁছেছেন। সেই তখন থেকে তিনি তার স্টাডিতে। অন্য দিনের মতই ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে একগাদা দৈনিক কাগজের স্তূপ তার সমুখে। একের পর এক পড়ে যাচ্ছেন। কখনো পেন্সিল দিয়ে দাগ দিচ্ছেন কোনো খবরে। এতবড় বিয়োগের চিহ্ন বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। কেবল পাশের টিপয়ে যেখানে রুপোর বাটিতে এলাচদানা থাকত আজ সেই টিপয়টা শূন্য।

বাইরের ঘরে একজন হাফেজ বসে পড়ছে পাক–কোরআন। আর আলীজাহ্ এই এতক্ষণে সবে বাথরুমে গেছে গোসল করতে। বেলা প্রায় আড়াইটা।

জরিনাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন তার মামানি। বিধবা মানুষ। সংসারে আপন বলতে আছে একমাত্র ছেলে বুলু। ম্যাট্রিক দিয়েছে এবারে। জরিনার মা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে তাতিবাগান থেকে বুলুকে সঙ্গে করে এসেছেন কয়েকদিনের জন্য।

জরিনাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। হাত শিথিল হয়ে এসেছে জরিনার মাথার ওপর থেকে।

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল জরিনার। ধড়মড় করে উঠে বসে চারদিকে তাকিয়ে কেমন সব অচেনা মনে হলো। খুব নিচু গলায় একবার ডাকল–মা। রোদে আর দুপুরের বাতাস। কেউ সাড়া দিল না। তখন এক পা এক পা করে নিচে নেমে এলো জরিনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কী ভাবল খানিক। চারদিকে কেউ নেই। শুধু বাথরুম থেকে শব্দ আসছে পানি ছিটানোর। সেই শব্দটা উৎকর্ণ হয়ে খানিকক্ষণ শুনে জরিনা এবার একরোখার মতো সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। নেমে বারান্দা পেরিয়ে বসবার পর। হাফেজ একবার তাকিয়ে দেখলেন কী দেখলেন না। তাঁর ক্লান্ত, বিলাপী, করুণ আবৃত্তি পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো সে। হাঁটতে লাগল হনহন করে।

খপ্‌ করে কে হাত ধরতেই জরিনা তাকিয়ে দেখে, বুলুভাই। হাত মুচড়ে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুম ঘুম গলায় বলে, ছাড়ো।

কোথায় যাচ্ছিস তুই?

মার কাছে।

চোখ তুলে বলেই নাবিয়ে নেয় জরিনা। পানিতে টাবুটুবু হয়ে আসে দুচোখ।

যেতে দাও আমাকে।

কিন্তু বুলু যখন তাকে কোলে তুলে নিল তখন এতটুকু বাধাও দিল না জরিনা। বাসায় ফিরে দেখে নূরুন্নাহার বারান্দায় তাকেই খোঁজাখুঁজি করছে। বুলু তার হাতে জরিনাকে তুলে দিয়ে বলে, কাণ্ড দেখেছ জরিনার? গোরস্তানে যাচ্ছিল, ভাগ্যিস আমি পথে দেখে ফেলেছিলাম।

নূরুন্নাহার তার কপালে হাত রেখে চিবুক ধরে শুধোয়, তাই নাকি?

কোনো কথা বলে না জরিনা। তখন তাকে নিয়ে ওপরে নিজের কামরায় উঠে আসে সে।

বলে, আয়, আমার পাশে ঘুমুবি।

বলে নিজেই তার ধূলো পা মুছিয়ে দেয়। নিজে শোয়। পরে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ পরে শুধোয়, মাকে দেখবি?

বালিশের নিচে থেকে নূরুন্নাহার মায়ের বাঁধানো ফটো বার করে। দুজনে তাকিয়ে দেখে। তারপর হঠাৎ ফটো একপাশে সরিয়ে রাখে, জরিনাকে জড়িয়ে ধরে নূরুন্নাহার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। জরিনারও কান্না পায়। ভীষণ কান্না। কিন্তু কাঁদে না। নিজের বুকে অনুভব করে নূরুন্নাহারের কান্না।

.

প্রায় ছমাস পরের কথা।

দোতলার শেষ মাথায় যে গোল বারান্দা তার লাল মেঝেয় বসে রেলিংয়ের ফাঁকে দুপা ঝুলিয়ে দিয়ে জরিনা খুব এক মনে কিছুই ভাবছিল না। তার পা অবধি প্রায় উঠে এসেছে কচি আমগাছটা। হাতের ডানে বড় নিমগাছে বাতাস কাঁপছে। চারদিকে আসন্ন সন্ধ্যা। আকাশ হয়ে উঠেছে ভারী, ভিজে ভিজে, বেগুনি লাল আর হাতের শিরার মত এখানে ওখানে নীল–নীল। চড়ুইগুলো দিনমান কোথায় কোথায় উড়ে বেড়িয়ে ফিরে এসেছে তাদের আমগাছের ডালে। হুল্লোড় বাধাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আর ওপাশের নিমগাছটায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে বাসা ফেরৎ কয়েকটা কাক। দূরে ট্রাফিকের শব্দ, ভারী কিন্তু আবছা–একটা মোটা পর্দার ভেতর দিয়ে ছুঁয়ে পড়ছে সিরাপের মতো। রাস্তায় জ্বলে উঠেছে বাতি। কিন্তু দিনের আলো তখনো অন্ধকার নয় বলে ম্লান, ছোট ছোট দেখাচ্ছে, রাত হলে আস্তে আস্তে ওরা বড় হবে।

জরিনা চুপ করে এইসব দেখছিল। খুব অস্পষ্ট করে নিজেকে যেন মনে হচ্ছিল অমনি ম্লান, অমনি ছোট ছোট, দূরে দূরে। অই বয়সি অন্য যে কোন মেয়ে এত দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারত না। কিন্তু জরিনা পারে। বরং এইটেই তার ভালো লাগে।

আমগাছে এতক্ষণে চড়ুইগুলো শান্ত হয়ে বসেছে। আর কোনো শব্দ নেই। এই সন্ধ্যার ধূসর ছোটো একমুঠো শরীরগুলো ওড়াউড়িও করবে না আর। আকাশ থেকে নীল শিরাগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে এক্ষুণি।

শাহ সাদেক আলী মগরেবের নামাজ আদা করে বারান্দা দিয়ে আসছিলেন, হঠাৎ অন্ধকারে আবছায়া পেছনটুকু দেখতে পেলেন জরিনার। বিরক্ত হলেন এদিকে এখনো কেউ বাতিটা জ্বেলে দিয়ে যায়নি বলে। ভাবলেন আলোটা নিজেই জ্বালাবেন। কিন্তু জ্বালালেন না। জরিনাকে হঠাৎ এভাবে বসে থাকতে দেখে কৌতূহলে মনটা তাঁর ভিজে উঠলো। পা টিপে পেছনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

নতুন করে মেয়েটাকে যেন চোখে পড়লো তার। নিজের সন্তানকে একেক সময় কত অপরিচিত মনে হয়, এ কি তিনি কখনো জানতেন? মনে হলো, পৃথিবীর দুপ্রান্তে দুটো দেশ–তারা দুজনে সেই দুদেশের অধিবাসী। আকাশে যেমন করে একটা কক্ষচ্যুত তারা অযুত অযুত বছরে একবার হঠাৎ জ্বালিয়ে দেয় বিপর্যয়ের আগুন, ঠিক তেমনি তিনি আজ ছিটকে এসে পড়েছেন দক্ষিণের এই অন্ধকার গোল বারান্দায়। কিছু বললেন না তিনি, শুধু স্তব্ধ হয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।

তারপর আস্তে আস্তে জরিনার পাশে, নিচু টুলের ওপর বসলেন শাহ সাদেক আলী। মেয়েটা একটু চমকে উঠেই একহাতে আঁকড়ে ধরলো তার জানু আর ঠিক তেমনি তাকিয়ে রইলো সমুখের দিকে। সাদেক বললেন, কী দেখছিস? পাখি?

হ্যাঁ।

কী নাম পাখির?

 চড়ুই।–চড়ুই আমাদের ঘরে রোজ কুটো ফেলে যায় জানো আব্বা।

তাই নাকি?

দুজনে সমুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। কে কারো দিকে তাকায় না। তাকাবার প্রয়োজন হয় না! বাবাকে ভালো লাগে জরিনার। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে একটু। সাদেক তখন বলে চলেছেন, ঠিক আমাদের যেমন দুঃখ হয়, কষ্ট হয়, তেমনি পাখিদেরও।–ঝড় উঠলে ওরা থাকবে কোথায়? তাই আমাদের দালানে এসে খড়কুটো দিয়ে বাসা করে। তাড়িয়ে দিলে আল্লাহ দুঃখ পাবেন, বলবেন–আমার বান্দা একটা অসহায় জীবকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহ আমাদের পাপ দেবেন।

জরিনার তখন এ কথায় কান নেই। তার মন তখন ঘুরছে অন্য প্রসঙ্গে। চট করে প্রশ্ন করে, আব্বা, পাখিদের নাম নেই?

নাম?–হ্যাঁ নাম আছে। আমরা ওদের কথা বুঝতে পারি না, তাই। সোলেমান নবী ছিলেন অনেকদিন আগে তিনি বুঝতে পারতেন ওদের কথা। দুনিয়ার সব জীব–জন্তুর সঙ্গে কথা বলতেন সোলেমান নবী।

আমি পারবো না?

পারবে বৈকি। যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কেউ নেই–চকোলেট কেনবার পয়সা নেই–খুব কষ্ট যাদের তারা পাখি হয়ে যায়। তখন আর কোনো ভাবনা থাকে না। তাই বাচ্চাদের সঙ্গে পাখিদের এত ভাব।

ও বুঝেছি। তাই বুঝি আমার মাথার ওপরে চড়ুইগুলো বাসা করে, আব্বা?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই।

জরিনা কান পেতে থাকে পাখিদের কোনো সাড়া শব্দ যদি জেগে ওঠে। সাদেকও তন্ময় হয়ে থাকেন। কিন্তু আর ওরা ডাকে না। সাদেক জরিনার কাঁধে হাত রেখে নির্বাক হয়ে বসে থাকেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *