দ্বিতীয় অধ্যায় – ছায়া পূর্বগামিনী
যৌবনে পিতৃদ্রোহী, প্রৌঢ়ে নবীন প্রেমিক, বার্ধক্যে বালস্বভাব, জাহাঙ্গীর বাদশাহ পিতা আকবর এবং পুত্র শাহজাহান অপেক্ষা ইতিহাসে নিকৃষ্ট চরিত্র। সুদীর্ঘ চারি বৎসরকাল প্রেমের আগুনে পুড়িয়া মেহেরুন্নিসাকে পত্নীরূপে লাভ করিবার পর তিনি যেন হাতে হাতে স্বর্গ পাইলেন (মে মাস, ১৬১১ খ্রিঃ)। নবীন প্রেমের উত্তাল তরঙ্গে হাবুডুবু খাইতে খাইতে দিল্লীশ্বর “এক টুকরা রুটি ও এক পেয়ালা শরাবের দামে” হিন্দুস্থানের বাদশাহী সুন্দরী নূরজাহানের পায়ে বিকাইয়া দিলেন, গোপনে নয় নিতান্ত প্রকাশ্যে। দরবারী “ষাট হাজারী” মনসবদার সম্রাজ্ঞী “নূরমহল” (কিছুদিন পর নূরজাহান) ১৬১১ হইতে ১৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অপ্রতিহত প্রভাবে সম্রাট এবং তাঁহার সাম্রাজ্য উভয়ই শাসন করিয়াছিলেন। জাহাঙ্গীর বাদশাহর বয়স বাড়িয়াছিল, দেহ অতিভোগজনিত অকালবার্ধক্যগ্রস্ত হইয়াছিল, কিন্তু চিরকাল তিনি নাবালকই রহিলেন। অন্তঃপুরে নূরজাহান বেগমের পদার্পণের পর আলা হজরতের নাবালকত্ব যেন আরও বাড়িয়া গেল; বে-সরকারিভাবে নবপরিণীতা পত্নী হইলেন শাহানশাহ্র “আতালিক” বা অভিভাবিকা। ঐতিহাসিকেরা জাহাঙ্গীর রাজত্বের এই একাদশ বৎসরকে “নূরজাহান-চক্রের” শাসনকাল আখ্যা দিয়াছেন। এই “চক্রে”র (Junta ) মধ্যে ছিলেন নূরজাহানের পিতা উজীর ইতমাদ-উদ্দৌলা, ভ্রাতা আসফ খাঁ এবং শাহজাদা খুররম। নূরজাহান মনে করিয়াছিলেন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর খুররমকে শিখণ্ডীর মতো দিল্লির সিংহাসনে বসাইয়া বাকি জীবন তিনিই হিন্দুস্থানে সর্বেসর্বা থাকিবেন। এই আশায় নূরজাহান অগ্রণী হইয়া আসফ খাঁর কন্যা ভ্রাতুষ্পুত্রী আরজুমন্দ বানু বা মমতাজমহলের সহিত শাহজাদা খুর্রমের বিবাহ দিলেন (৩০শে এপ্রিল ১৬১২ খ্রিঃ)। ইরান-সম্রাট শাহ ইসমাইলের বংশধর মুজঃফর হোসেনের কন্যার সহিত দুই বৎসর পূর্বে (সেপ্টেম্বর ১৬১০ খ্রিঃ) খুররমের প্রথম বিবাহ হইয়াছিল।* রাজনৈতিক স্বার্থের প্রেরণায় নিরপরাধিনী প্রথমা পত্নীকে ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া খুররম পরবর্তীকালে দিল্লির সিংহাসন লাভ করিলেও সুখী হইতে পারেন নাই। অবজ্ঞাতা অভিমানিনীর অশ্রুর বদলে শাহজাহানের যে শোকাশ্রু বিধাতার বিচারে অঝোরে ঝরিয়াছিল তাজমহলের শ্বেতমর্মর আজিও উহার সাক্ষ্য দিতেছে। যাহা হউক, এই বিবাহের পর শাহজাদা খুররম আলালের ঘরের দুলাল হইয়া উঠিলেন। গর্ভধারিণী যোধপুর-রাজকুমারী যোধাবাঈর পুত্র খুররম; যোধাবাঈ সম্রাট জাহাঙ্গীরের নজরে হইয়া পড়িলেন খুর্রমের “অন্যান্য” মাতৃস্থানীয়া এবং বিমাতাগণের মধ্যে একজন মাত্র; অপরপক্ষে নূরজাহান বেগম হইলেন “আসল মা”! ভাবাবেশে আলা হজরত লিখিয়া গিয়াছেন বাবা খুররম দাক্ষিণাত্য জয়ের উপঢৌকন স্বরূপ “আসল-মা” (ওয়ালেদা-ই খোদ) নূরজাহান বেগমকে দিলেন দুই লাখ টাকা এবং অন্যান্য মা, বেগম ইত্যাদি সকলে মিলিয়া পাইলেন ষাট হাজার টাকা!” মুসলমান আমলে বিবাহাদির পর শাহীমহলে শাহজাদাগণের প্রবেশ অনুমতিসাপেক্ষ ছিল। পূর্বাপর প্রচলিত এই রীতি ভঙ্গ করিয়া জাহাঙ্গীর বাদশাহ বাবা খুররমকে অন্দরমহলে যাতায়াত করিবার অবাধ অধিকার প্রদান করিয়াছিলেন। নূরজাহান বেগমের সম্মতি এবং বিশেষ অনুগ্রহ ব্যতীত খুররম এই অধিকার হয়তো পাইতেন না। কিন্তু লোকচক্ষে ইহা বিসদৃশ এবং কটাক্ষের বিষয়ীভূত হইয়াছিল। বনিতা ও কবিতার ‘সাধুত্ব’ সম্বন্ধে ভবভূতির যুগ অপেক্ষা বাদশাহী আমলে মানুষ অধিক “দুর্জন” ছিল। স্যর টমাস রো রচিত পুস্তকে খুররম-নূরজাহান সম্পর্কে অশোভন ইঙ্গিত আছে। সত্যমিথ্যা ভগবান জানেন, তবে সর্বম্ অত্যন্তগর্হিতম্।
—
[* শাহজাহান-রাজত্বের অসম্পূর্ণ দরবারী ইতিহাস বাদশাহ-নামায় লিখিত আছে, মমতাজমহলের সহিত খুররমের বাগদান হইয়াছিল প্রথমা স্ত্রীর সহিত বিবাহের প্রায় তিন বৎসর পূর্বে। ওই স্ত্রীর গর্ভে থুরমের প্রথম সন্তান জন্মিল মমতাজের সহিত বিবাহের এক মাস পূর্বে। ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে খুররমের সহিত মমতাজের বাগদান হইবার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখা যায় না। নূরজাহানকে বিবাহ করিবার পূর্বে সুদীর্ঘ পাঁচ বৎসরের মধ্যে পুত্রের সহিত বাগদত্তা কন্যার বিবাহ-কার্যটা নিষ্পন্ন করিবার অবকাশ জাহাঙ্গীরের হয় নাই— এইরূপ অনুমান করিবারও কোনও অজুহাত নাই। সর্বাপেক্ষা বিবেচ্য বিষয়, জাহাঙ্গীর এমন কোনও কথা তাঁহার তুজুকে উল্লেখ করেন নাই। সুতরাং সন্দেহ হয় মমতাজমহলকে প্রেমিক শাহজাহান দরবারী ইতিহাসে প্রথম এবং শেষ প্রণয়পাত্রী হিসাবে জাহির করিবার জন্যই এই বাক্যদান ব্যাপার উদ্ভাবন করিয়াছেন। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বাদশাহ-নামাকে অভ্রান্ত জ্ঞান করিয়া আমাদিগকে বিভ্রান্ত করিয়াছেন, যথা :-
Memoirs of Jahangir, Rodgers & Beveridge, Vol. I. p. 224, footnote, “the long-engaged pair…” (History of Shajahan, Banarasiprasad Saxena, p. 14)
বিনা বিচারে বিশ্বস্ত চিত্তে দরবারী ইতিহাস সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া গ্রহণ করা নিরাপদ নহে।]
১
বন্দী খসরুকে আসফ খাঁর হাতে সমর্পণ করিয়া নূরজাহান বেগম চালে ভুল করিয়া বসিলেন, “নূরজাহান চক্রে” ভাঙন শুরু হইল। স্বার্থের সংঘাতে ভ্রাতা-ভগ্নীর মধ্যে ঐক্য ও স্নেহের বন্ধন শিথিল হইতে লাগিল। শাহজাদা খুররম নূরজাহানের প্রভাব হইতে মুক্ত হইয়া দাক্ষিণাত্যে স্বাধীন ভাবে কার্য করিতেছিলেন; তবে ঘন ঘন বহুমূল্য উপহার পাঠাইয়া সম্রাজ্ঞী এবং সম্রাটকে খুশমেজাজে রাখিতেন। নূরজাহান-চক্রের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী খান-ই-খানান আব্দুর রহিমের পৌত্রীর (শাহ্ নওয়াজের কন্যা) সহিত খুররম হঠাৎ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইলেন। নূরজাহানের বিরুদ্ধে ইহাই খুর্রমের প্রথম পাল্টা চাল; বাদশাহ-নামায় আছে “কতিপয় রাজনৈতিক কারণেই” এই বিবাহ হইয়াছিল। ইহার প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ অবজ্ঞাত শাহজাদা পরবেজ দরবারে আমন্ত্রিত হইলেন এবং তাঁহার মনসব বাড়াইয়া দেওয়া হইল। এই সময় হইতে সম্রাজ্ঞীর কূটনীতি খেলার নূতন ঘুঁটি হইলেন পরবেজ।
১৬২২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে নূরজাহান বেগমের পিতা বিচক্ষণ বৃদ্ধ উজীর-ই-আজম ইতমাদ-উদ্দৌলার মৃত্যুর তিন মাস পরে, শাহজাদা খুর্রম প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করিলেন। দাক্ষিণাত্য, মালব এবং গুজরাটের বাদশাহী ফৌজ খুররমের বশ্যতা স্বীকার করিয়া শাহজাদার অধিনায়কত্বে রাজধানীর দিকে অভিযান করিল। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান একক এবং অসহায়; পিতা মহানিদ্রার ক্রোড়ে, ভ্রাতা আসফ খাঁ পার্শ্বে কণ্টকস্বরূপ, জাহাঙ্গীরের প্রিয়তম মোসাহেব মুতামিদ খাঁ শত্রুর গুপ্তচর। চতুর্দিকে অবিশ্বাস এবং ষড়যন্ত্রের ছায়া। শাহজাদা খুররমের প্রতি একান্ত পক্ষপাতিত্ব করিয়া নূরজাহান বেগম সম্রাটের পুরাতন বিশ্বস্ত যোদ্ধৃগণের অপ্রিয়ভাজন হইয়াছিলেন। শাহজাদা মনে করিলেন, তিনি রাজধানীর উপকণ্ঠে উপস্থিত হইলেই সুবা লাহোর, দিল্লি, আগ্রার বাদশাহী মনসবদারগণ নূরজাহান বেগমের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইবে। এইবার হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও কূটনীতিবিদ পুরুষসিংহের সহিত এক তেজোদৃপ্তা নারীর শক্তিপরীক্ষা আরম্ভ হইল। শাহজাদা পরবেজ এবং খসরুর পুত্র দাওয়ার বকশকে সম্মুখে বাড়াইয়া নূরজাহান খুররমকে বেকায়দায় ফেলিলেন; দাওয়ার বকশের অভিভাবক সমরনিপুণ মির্জা আজিজ এবং পরবেজের পৃষ্ঠপোষক অসুর-বিক্রম মহাবত খাঁ সম্রাজ্ঞীর সহিত শত্রুতা ভুলিয়া তাঁহার প্রধান সহায় হইলেন; আম্বেরপতি মির্জা জয়সিংহ এবং দুর্ধর্ষ পাঠান সেনাপতি খানজাহান লোদী বিপন্ন সম্রাটকে রক্ষা করিবার জন্য সসৈন্যে রাজধানী অভিমুখে যাত্রা করিল।
১
মহাবত খাঁ ছিলেন আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জাহাঙ্গীরের পুরাতন বিশ্বস্ত অনুচর; হুকুম পাইলে ইবলিসকেও একহাত না দেখিয়া ছাড়িবার পাত্র নহেন। তিনি দিলখোলা জাঁহাবাজ সিপাহী; তাঁহার দোষ বা গুণ–মুখের উপর অপ্রিয় কথা শুনাইবার বেপরোয়া হিম্মত। তিনি একবার স্বয়ং দিল্লীশ্বরকে বলিয়া বসিয়াছিলেন, “আলা হজরত! জানানার আঁচলে দিনরাত ঝুলিয়া থাকিলে বাদশাহী ছারখার হওয়া কিছু তাজ্জব ব্যাপার নয়।” নূরজাহান বেগম মানুষ না চিনিলে পূর্ণ ষোল বৎসর জাহাঙ্গীর বাদশাহর বাদশাহী রক্ষা করিতে পারিতেন না। তিনি জানিতেন মহাবত খাঁ গোঁয়ার এবং দুর্মুখ হইলেও কাজের লোক-না চটাইলে নিমকহারামি করিবে না। জাহাঙ্গীর বাদশাহর বেয়াড়া বাঘ মহাবত খাঁ খুর্রমের সহিত সংগ্রামে অবতীর্ণা নূরজাহানের কূটনীতির জাদুগুণে সিংহবাহিনীর পশুরাজ হইয়া পড়িলেন।
দিল্লি হইতে কয়েক মাইল দূরে বিলোচপুর নামক স্থানে বিদ্রোহী খুর্রমের ভাগ্যপরীক্ষা হইল (এপ্রিল ১৬২৩ খ্রিঃ)। পুরাদমে যখন উভয় পক্ষের লড়াই চলিতেছিল তখন মহাবত খাঁর সহকারী সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক আবদুল্লা খাঁ, পূর্ব ষড়যন্ত্র অনুসারে বাদশাহী ফৌজ হইতে পৃথক হইয়া সসৈন্য শাহজাদার সহিত মিলিত হইল। এই ষড়যন্ত্রের কথা খুররমের বিশ্বস্ত সেনাপতি এবং বিদ্রোহমন্ত্রদাতা রাজা বিক্রমজিৎ ছাড়া অন্য কেহ জানিতেন না। খুররমের অগ্রগামী বাহিনীর অধিনায়ক দারা খাঁকে এই শুভ সংবাদ প্রদানের জন্য রাজা বিক্রমজিৎ যখন ঘোড়া ছুটাইয়া চলিয়াছেন, সেই সময় বাদশাহী তোপখানার একটি গোলার আঘাতে তাঁহার প্রাণান্ত হইল। বাহিনীর পশ্চাৎভাগে আবদুল্লা খাঁর অপ্রত্যাশিত উপস্থিতির রহস্য খুররমের সৈন্যগণ বুঝিতে না পারিয়া পরাজয়ের আশঙ্কায় হতোদ্যম ও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। শাহজাদা খুররমের সৌভাগ্যসূর্য পিতার অভিশাপে রাহুগ্রস্ত হইল; তিনি ‘বে-দৌলত’ বা দুর্ভাগার ন্যায় দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করিলেন। মহাবত খাঁ বিদ্রোহী শাহজাদাকে দম ফেলিবার অবকাশ দিলেন না; বিজাপুর, গোলকুণ্ডা তাঁহাকে আশ্রয়দান করিল না।
মমতাজ এবং তাঁহার শিশুসন্তানগণকে লইয়া কয়েক হাজার বিশ্বস্ত অনুযাত্রীসহ শাহজাদা খুররম মহাবত খাঁর শ্যেনদৃষ্টি এড়াইয়া তৈলঙ্গ-ভূমির গভীর অরণ্যানীর মধ্যে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। অসীম বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া তিনি অবশেষে উড়িষ্যায় উপস্থিত হইলেন। প্রাচীর দিগালরেখায় আবার সৌভাগ্যের মুহূর্ত রাগ তাঁহার প্রাণে নূতন আশার সঞ্চার করিল। অকর্মণ্য সুবাদার আহম্মদ বেগ বিনা যুদ্ধে উড়িষ্যা হইতে পলায়ন করিয়া রাজমহলের পথ ধরিলেন। শাহজাদা খুর্রম দ্রুতবেগে তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া উল্কাবেগে রাজমহলের উপর আপতিত হইলেন। যুদ্ধে বাংলার বৃদ্ধ সুবাদার ইব্রাহিম খাঁ ফতেজঙ্গকে পরাজিত ও নিহত করিয়া খুর্রম রাজমহলে বাদশাহীর দিবা-স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন। সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা-জাহাঙ্গীর নগর বিজয়ী শাহজাদাকে রামপালের নামকরা কলা (হয়তো অমৃতসাগর) কয়েক কান্দি ভেট পাঠাইয়াছিল। যাহা হউক কয়েক মাস পরে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং সৈন্যদল সংগ্রহ করিয়া সুবে বিহার দখল করিবার জন্য শাহাজাদা খুররম রাজা ভীম শিশোদিয়াকে পাটনার দিকে প্রেরণ করিলেন। পাটনা অধিকার করিয়া তাঁহার অগ্রগামী সেনাদল বিহারের পশ্চিম প্রান্তে টৌস (প্রাচীন তমসা) নদীতীরে শিবির সংস্থাপন করিল। শাহজাদা আসন্ন প্রসবা মমতাজমহলকে রোহতাস দুর্গে রাখিয়া সুবা এলাহাবাদ ও অযোধ্যা আক্রমণের পরিকল্পনা করিয়াছিলেন, এই সময়ে তাঁহার এক পুত্রলাভ হইল—নাম রাখিলেন মুরাদ বকশ্।
৩
দাক্ষিণাত্যে পলায়িত খুর্রমের কোনও সন্ধান না পাইয়া বিজয়ী মহাবত খাঁ এবং শাহজাদা পরবেজ শত্রুর গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে যখন জল্পনা-কল্পনা করিতেছিলেন, সেই সময় জরুরি ফরমান মারফত তাঁহারা অবগত হইলেন “বে-দৌলত” মশরিকী তিন সুবার উপর কব্জা করিয়া সুবা এলাহাবাদের জৌনপুর শহরে* ডেরা করিয়া আছে। খুররমকে পরাজিত এবং বৃদ্ধ খান-ই-খানান আবদুর রহিমকে গ্রেপ্তার করিয়া মহাবত খাঁ খান-ই-খানান খেতাব এবং শাহজাদা পরবেজ চল্লিশ-হাজারী মনসব পাইয়াছিলেন। তাঁহারা নূতন উদ্যমে চল্লিশ হাজার সেনাসহ দিনরাত কুচ করিয়া বিদ্রোহপর্ব সমাপ্ত করিতে চলিলেন। এই সংবাদ পাইয়া খুররম জৌনপুর হইতে পশ্চাদপসরণ করিয়া বিহারপ্রান্তে সৈন্য সংস্থাপন করিলেন। টৌস বা তমসাতীরে ব্যূহবদ্ধ হইয়া উভয় পক্ষ আক্রমণের সুযোগ প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে গতিক ভালো নয় দেখিয়া অনতিদূরে গঙ্গাবক্ষ হইতে শাহজাদার বাঙালি “নৌবারা” (জঙ্গী নৌকার বহর) অকস্মাৎ অদৃশ্য হইয়া গেল; কিন্তু যুদ্ধ না করিয়া খুররমের পলায়নের উপায় নাই। খুর্রমের সৈন্যসংখ্যা অল্প হইলেও সেনানায়কগণ সকলেই তাঁহার জীবন-মরণের সঙ্গী, রণনিপুণ এবং অসমসাহসিক যোদ্ধা। আক্রমণ আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায় স্থির করিয়া তিনি মহাবত খাঁর উপর হামলা করিলেন। রাজা ভীম শিশোদিয়া এবং শের খাঁর নেতৃত্বে তাঁহার অগ্রগামী সেনা বাদশাহী তোপখানা দখল করিয়া প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবেগে শত্রুব্যূহের কেন্দ্রস্থলে শাহজাদা পরবেজকে আক্রমণ করিল, বাদশাহী ফৌজে হাহাকার পড়িয়া গেল। শাহী ফৌজের বামভাগে নদীর পারে কিছু দূরে ছিলেন যোধপুরপতি গজসিংহ। বিদ্রোহী খুররম যোধপুরের দৌহিত্র; কিন্তু এক বৎসর পূর্বে শাহজাদা পরবেজ গজসিংহের কন্যাকে বিবাহ করিয়াছেন; এই দোটানা স্রোতে পড়িয়া চিন্তা করিতে করিতে তাঁহার প্রস্রাবের বেগ হইল। গজসিংহ পায়জামার ডোরী সবেমাত্র খুলিয়াছেন, এমন সময়ে কুম্পাবৎ গোবর্ধনদাস রাঠোর ঘর্মাক্ত দেহে তথায় পৌঁছিয়া কড়াসুরে বলিল, “মহারাজ! সব ভাসিয়া গেল, এখন আপনার লঘুসংখ্যা করিবার সময়?”** যোধপুররাজ কার্যটি না সারিয়াই নিতান্ত সপ্রতিভভাবে পায়জামা কষিয়া বলিলেন, “আমি দেখিতেছিলাম খবর দেওয়ার জন্য কোন রাজপুত অবশিষ্ট আছে নাকি?” মহাবত খাঁ বিচক্ষণ সেনাপতি, তিনি রাজা ভীম ও শের খাঁর গতিরোধ করিবার জন্য জটাজুট*** নামক পাগলা জঙ্গী হাতি ছাড়িয়া দিলেন; এবং এই অবসরে তাঁহার সেনাবাহিনী পুনরায় ব্যূহবদ্ধ হইল। এইবার আবদুল্লা খাঁ খুররমের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া পলায়ন করিল। মহাবত খাঁর সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে রাজা ভীম শস্ত্রপূত হইয়া বীরগতি লাভ করিলেন। দ্বিতীয়বার বিদ্রোহী খুর্রমের প্রায় সুনিশ্চিত জয়-পরাজয় ও পলায়নে পর্যবসিত হইল।
[* শাহজাদা খুর্রম ১০৩৩ হিঃ অর্থাৎ ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথমভাগে জৌনপুরে ছিলেন (Vide Amal-i-Salih Text p. 187)]
*গৌরীশঙ্কর ওঝাকৃত হিন্দি রাজপুতানেকা ইতিহাস, ৩য় খণ্ড ৮২৬ পৃ.
** Khafi Khan, Muntakhab-ul labab]
তমসার জলে খুররমের ক্ষীণ আশা ভাসিয়া গেল। যে পথে আসিয়াছিলেন, আবার সেই পথে স্ত্রী-পুত্র ও হতাবশিষ্ট অনুচরবর্গের সহিত শাহজাদা “বে-দৌলত” দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করিলেন। মহাবত খাঁ এবং পরবেজ অন্যপথে আবার দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হইলেন। দুর্ভাগ্যের পুনঃ পুনঃ আঘাতে খুর্রমের অকাল স্বপ্ন ভাঙিয়া গেল; স্ত্রী-পুত্রসহ হতপ্রভ জ্যোতিষ্কের ন্যায় তিনি মহারাষ্ট্রের নাসিক শহরে দিনযাপন করিতে লাগিলেন গর্বিত খুররম পিতার ক্ষমা এবং নূরজাহানের করুণা ভিক্ষা করিয়া দরবারে দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাঁহার উপর হুকুম হইল, জামিন-স্বরূপ কুমার দারা এবং আওরঙ্গজেবকে অগ্রে দরবারে প্রেরণ করিয়া পরে তাঁহাকে স্বয়ং হুজুরে হাজির হইতে হইবে এবং আসীরগড়, রোহতাশ প্রভৃতি যে সমস্ত দুর্গে তাঁহার সৈন্যেরা আত্মরক্ষা করিতেছে তাহাদিগকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিতে হইবে।
দারা ও আওরঙ্গজেব নাসিক হইতে (সোমবার ৩রা জমাদিউস সানী, ১০৩৫ হিঃ) দরবারে যাত্রা করিলেন; দুই লক্ষ টাকার হীরা-জহরত ও অন্যান্য সামগ্রী বাদশাহর হুজুরে পেশকশ দেওয়ার জন্য কুমারদ্বয়ের সহিত প্রেরিত হইল। খুররম পরাজিত হইয়াও বিদ্রোহের দুষ্প্রবৃত্তি ছাড়িতে পারেন নাই। তিনি ইরান-সম্রাট শাহ্ আব্বাসের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া প্রস্তাব করিলেন, তাঁহার সাহায্য পাইলে তিনি সফরী-বংশকে হিন্দুস্থানের বাদশাহী নজর করিতে পারেন। সন্ধির দ্বিতীয় শর্ত, অর্থাৎ দরবারে উপস্থিতির আদেশ পালনে তিনি নানা অছিলায় বিলম্ব করিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে চলচ্চিত্রের ন্যায় হিন্দুস্থানের রাজনীতি রঙ্গমঞ্চে দৃশ্যপট সহসা তাঁহার অনুকূলে পরিবর্তিত হইল।
৪
সম্রাজ্ঞী নূরজাহান খুর্রমের আচরণে ঠেকিয়া শিখিয়াছিলেন কাহাকেও অতি বাড় বাড়িতে দিলেই বিপদ। খুররমকে দমন করিবার জন্য প্রয়োজন ছিল মহাবত খাঁর মতো ভীমকর্মা সুদক্ষ সেনাপতির; সুতরাং কাজ হাসিল হওয়ার পর হাতিয়ার কেন করিয়া ভাঙিবেন নূরজাহান সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। কিন্তু খান-ই-খানান মহাবত খাঁ তখন মোগল সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ (রুকনউল-সুলতানত) এবং জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র, দিল্লির মসনদের ন্যায্য উত্তরাধিকারী পরবেজের আতালিক। সাম্রাজ্যের শান্তি, স্বার্থ এবং উত্তরাধিকারিত্বে ন্যায়বিচার যদি নূরজাহান বেগমের কাম্য হইত, যদি জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর স্বীয় প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখিবার মতো নিতান্ত সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ তাঁহার রাজনীতিকে বিপথগামী না করিত, তাহা হইলে তিনি পুনরায় পরবেজ এবং মহাবত খাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করিতেন না। সম্রাটের দাসীগর্ভজাত কনিষ্ঠ পুত্র অকর্মণ্য শারিয়ারের সহিত নূরজাহান বেগম শের আফগানের ঔরসজাতা কন্যা লাডলী বেগমের বিবাহ দিয়াছিলেন। সম্রাজ্ঞী মনে করিতেন শাহজাদাগণের মধ্যে যাহাকে ইচ্ছা দিল্লির মসনদ তাহাকেই তিনি দিতে পারেন। নিতান্ত বিপদে পড়িয়া তিনি খসরুর পুত্র দাওয়ার বকশ্ এবং পরবেজকে দাবা খেলার ঘুঁটির ন্যায় আগে বাড়াইয়া খুর্রমের বাজিমাত করিয়াছিলেন। মহাবত খাঁর বাহুবলে পরবেজ নূরজাহানের শিখণ্ডী শারিয়ার এবং আসফ খাঁর জামাতা খুররমকে ডিঙাইয়া পাছে সিংহাসন অধিকার করে, এই আশঙ্কায় ভ্রাতা-ভগ্নী পূর্ব বিরোধ চাপা দিয়া একযোগে কার্য আরম্ভ করিলেন। আলা হজরত সাম্রাজ্যে সাংখ্যের পুরুষ, তাঁহাদের হাতে কলের পুতুল। মহাবত এবং পরবেজকে পরস্পর দূরে সরাইয়া একে একে দুই জনকে দমন করিবার অভিপ্রায়ে পরবেজকে দাক্ষিণাত্যে বহাল রাখিয়া মহাবত খাঁকে সরাসরি বাংলায় বদলি করা হইল, এবং মহাবত খাঁর স্থানে খানজাহান লোদী শাহজাদা পরবেজের আতালিক বা অভিভাবক নিযুক্ত হইলেন—ইনি আসফ খাঁর চর এবং নজরবন্দী শাহজাদার ‘কারারক্ষক’। মহাবত খাঁ কূটনীতির মারপ্যাঁচ কিছু কম বুঝিতেন; সুতরাং তিনি অসন্দিগ্ধ চিত্তে বাংলায় চলিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে পৌঁছিতে-না-পৌঁছিতেই দরবারে তাঁহার ডাক পড়িল, অধিকন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ হইল বহু লক্ষ টাকা তিনি সরকারি তহবিল হইতে তছরূপ করিয়াছেন; শাহানশাহ্র হুকুম, তাঁহাকে হিসাব বুঝাইয়া দেওয়ার জন্য লাহোরে হাজির হইতে হইবে। বাদশাহী আমলে কোনও আমীরকে বেকায়দায় ফেলিয়া অপমানিত ও অপদস্থ করিবার প্রয়োজন হইলেই কড়াক্রান্তি হিসাব দাখিল করিবার হুকুম হইত; কারণ যাঁহারা সেকালে দস্তুরমতো আমীর, তাঁহারা কোনোদিনই হিসাব রাখিতেন না, দিতেও পারিতেন না- এই সমস্ত বাজে কাজ করিত কায়স্থ দেওয়ানজী। মহাবত খাঁ ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কাগজপত্র কিছু সঙ্গে লইলেন না; তাঁহার সঙ্গে চলিল বাছা বাছা পাঁচ হাজার রাজপুত সিপাহী, সেকালের গুর্খা; হুকুম পাইলে “পিতরমপি ন জানামি”। মহাবত কোমর কষিয়া লাহোরে হাজির হইলেন; দরবারে হিসাবের কথা চাপা পড়িয়া গেল।
নূরজাহান বেগম বুঝিতে পারিলেন সিন্ধুনদের এই পারে খান-ই-খানান মহাবত খাঁর সহিত হিসাব-নিকাশ নিরাপদ নয়। কিন্তু ঝিলম নদী পার না হইতেই সম্রাট জাহাঙ্গীর মহাবত খাঁর হস্তে বন্দী হইলেন। নূরজাহান এবং আসফ খাঁ সম্রাটকে উদ্ধার করিতে অসমর্থ হইয়া তাঁহার সহিত বন্দীদশা স্বীকার করিলেন। মহাবত খাঁর কোনও মন্দ অভিপ্রায় ছিল না; সম্রাটের ইচ্ছা অনুসারে তিনি নিতান্ত বিশ্বস্তচিত্তে আটক অতিক্রম করিয়া কাবুল চলিলেন। ইতিমধ্যে নূরজাহান নিশ্চেষ্ট ছিলেন না, তাঁহার প্রেরিত চরগণ মোটা বেতনে উপজাতীয় পাঠান সিপাহী ভর্তি করিয়া গোপনে রাস্তায় অপেক্ষা করিতেছিল। একদিন পেশাওয়ারের নিকট মহাবত খাঁর ভাগ্য বিপর্যয় ঘটিল। মহাবত খাঁ হতাবশিষ্ট তিন হাজার ফৌজ সঙ্গে লইয়া দিল্লি অভিমুখে পলায়ন করিলেন, পশ্চাতে নূরজাহান বেগম লাহোর পর্যন্ত তাঁহাকে দম ফেলিবার অবকাশ দিলেন না। এইবার মহাবত খাঁকে দমন করিবার জন্য সপ্ততিপর মুমূর্ষু বৃদ্ধ আব্দুর রহিমের ডাক পড়িল। খুররমের সহিত বিদ্রোহে শরিক হওয়ার অপরাধে মনসব এবং খান্-ই-খানান উপাধি হারাইয়া এই সময়ে আব্দুর রহিম হুমায়ু-মকবরার মুখোমুখি নিজের সমাধি নির্মাণ করিতেছিলেন। নির্বাণোন্মুখ আশা-প্রদীপের শেষ শিখায় বিভ্রান্ত হইয়া সুকবি আব্দুর রহিম একটি ফার্সি কবিতা রচনা করিয়া দিল্লীশ্বরকে ধন্যবাদ প্রদান করিলেন।
“মারা লুতফে জাঁহাগীরি জে তাইদাতে রব্বাণী।
দো বারঃ জিন্দগী দাদঃ দো বারঃ খানখানানী ॥”
(অর্থাৎ খোদার রেজামন্দী ও জাহাঙ্গীর বাদশাহর মেহেরবাণী আমাকে দ্বিতীয়বার জিন্দগী (জীবন) এবং দুই-দুইবার খানখানানী বকশিশ করিয়াছে।)
যাহা হউক, আখেরী লড়াই ফতে করিবার জন্য কোমরবন্দ কষিতেই খান্-ই-খানান আব্দুর রহিমের প্রাণবায়ু বহির্গত হইল। মহাবত খাঁ মিবারের পথে পলায়ন করিয়া নাসিক শহরে বিদ্রোহী শাহজাদা খুররমের সহিত মিলিত হইলেন (সেপ্টেম্বর, ১৬২৭ খ্রিঃ)।* এইবার জাহাঙ্গীর রাজত্বের শেষ দৃশ্য এবং শাহজাহানের রাজত্ব তথা দারাশুকোর জীবন-নাট্যের প্রথম অঙ্ক।
[*আমল-ই-সালেহ মূল পৃ. ২০১।]
৫
আসফ খাঁ ছায়ার ন্যায় জাহাঙ্গীর বাদশাহর পার্শ্বে থাকিয়া সুদিনের আশায় সম্রাটের নাভিশ্বাস গণিতেছিলেন। জামাতার বিদ্রোহের পর দরবারে তিনি বিড়াল তপস্বী সাজিয়াছিলেন- অপদার্থ বে-দৌলত খুর্রমের কথা মুখেও আনিতেন না। দাসীগর্ভজাত অকর্মণ্য শাহজাদা শারিয়ারকে দিল্লির সিংহাসনে বসাইবার আয়োজন নূরজাহান বেগম প্রায় সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন। কিন্তু আসফ খাঁ প্রকাশ্যে শাহজাদা খসরুর পুত্র দাওয়ার বক্শকে ন্যায়ের খাতিরে সম্রাটের ভাবী উত্তরাধিকারী বলিয়া মত প্রকাশ করিলেন। সুতরাং হতভাগ্য খসরু এবং সম্প্রতি পরলোকগত শাহজাদা পরবেজের প্রতি অনুরক্ত দরবারী মনসবদারগণ সহজেই আসফ খাঁর অনুগত হইয়া পড়িল। আসফ খাঁ গভীর জলের মাছ, বাহ্যত তিনি সম্রাটের সেবা ব্যতীত সর্ববিষয়ে উদাসীন—কেবল ন্যায় এবং ধর্মের খাতিরে সুযোগ মতো খুররমের দুষ্কার্যের তীব্র নিন্দা এবং দাওয়ার বকশ্নে দাবি সমর্থন করিয়া নিজের নিঃস্বার্থ অপক্ষপাতিত্ব জাহির করিতেন।
১৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে অক্টোবর রবিবার সম্রাট জাহাঙ্গীর কাশ্মীর হইতে ফিরিবার পথে নরলীলা সংবরণ করিলেন। বৈধব্য-দশাপ্রাপ্ত শোকার্তা সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ভ্রাতা আসফ খাঁকে একবার অন্দরমহলে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য কাতর অনুরোধ জানাইলেন। কিন্তু আসফ খাঁ জানিতেন ভগ্নীর অসাধ্য কাজ কিছুই নাই। সুতরাং তিনি সেই ফাঁদে পা বাড়াইলেন না। অধিকন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সম্রাটের দরবারে পিতার প্রতিভূ স্বরূপ নজরবন্দী দারা, শুজা এবং আওরঙ্গজেবকে ভগ্নীর কবল হইতে উদ্ধার করিয়া সম্রাজ্ঞীকে বন্দিনী করিলেন। লাহোর দুর্গে নূরজাহানকে সতর্কভাবে কারারুদ্ধ করিয়া আসফ খাঁ বেচারা দাওয়ার বককে একপ্রকার জোর করিয়াই প্রকাশ্য দরবারে সম্রাট বলিয়া ঘোষণা করিলেন, তাঁহার নামে খুৎবা পাঠ এবং সিক্কা জারি হইল। ঠিক ওইদিন ধূর্ত আসফ খাঁ নিজের সাঙ্কেতিক অঙ্গুরীয় বেনারসী নামক গোলামের হাতে দিয়া তাঁহাকে কোনও অজ্ঞাত স্থানে সুগোপনে প্রেরণ করিলেন।
৬
তিন মাস পরে (২১শে জানুয়ারি, ১৬২৮ খ্রিঃ) লাহোর দুর্গে আসফ খাঁ স্বীয় জামাতার কল্যাণার্থ এক অকাল বকরঈদ পর্ব মানাইয়া দিলেন। এই ঈদের প্রথম বলি, ইতিহাসে আসফ খাঁর “বকর ঈদের মেষশিশু” বলিয়া পরিচিত সেই হতভাগ্য দাওয়ার বকশ্, তাঁহার পর শাহজাদা শারিয়ার এবং এইরূপে পর পর পাঁচজন রাজপুত্র ওই ঈদে বলি পড়িল— তৈমুর বংশে দিল্লির মসনদের কোনও সম্ভাব্য দাবীদার আর অবশিষ্ট রহিল না। আসফ খাঁ অবশ্য বিনা হুকুমে এই কাজ করেন নাই। রাজ্যারোহণের এক মাস পূর্বে শাহজাহান এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের আদেশ দিয়াছিলেন।
শাহজাহানের সিংহাসন নিষ্কণ্টক করিয়া আসফ খাঁ দৌহিত্রত্রয়কে সঙ্গে লইয়া (২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৬২৮ খ্রিঃ) আগ্রার অনতিদূরে আকবরের সমাধিক্ষেত্র সেকেন্দ্রায় উপস্থিত হইলেন। পঞ্জিকায় (হিন্দু এবং ইউনানী জ্যোতিষমতে গণিত) ওইদিন রাজধানী প্রবেশের পক্ষে অশুভ ছিল বলিয়া শাহজাদাগণ সেকেন্দ্রায় অপেক্ষা করিবার হুকুম পাইলেন, কিন্তু মায়ের মন পঞ্জিকা মানে না। ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিকালবেলা সম্রাজ্ঞী মমতাজমহল আগ্রা ও সেকেন্দ্রার মধ্যবর্তী স্থানে একটি তাঁবুর মধ্যে পুত্রগণকে দেখিবার জন্য চলিলেন। সুদীর্ঘ তিন বৎসর নির্বাসনের পর দারা ও আওরঙ্গজেবের মাতৃদর্শন হইল, পিতামহের কাছে প্রতিপালিত বালক শুজা আবার মায়ের কোলে ফিরিয়া আসিলেন।
পরের দিন আসফ খাঁকে অভিনন্দিত করিবার জন্য মহাসমারোহে আগ্রা দুর্গে দরবার-ই-আম বসিল। দৌহিত্রগণসহ আসফ খাঁ কুর্নিশ করিবার পর সম্রাট মসনদের “ঝরোকা” (অলিন্দ) হইতে নামিয়া আসিয়া পুত্ৰত্রয়কে একে একে আলিঙ্গন করিলেন। আসফ খাঁ দীন ও দুনিয়ার মালিক শাহানশাহর “কদম-বোসী” করিয়া ধন্য হইলেন। শাহজাদা দারাশুকো যথারীতি বাদশাহর দরবারে নজর এবং নিসার পেশ করিবার পর তাঁহাকে নগদ দুই লক্ষ টাকা বকশিশ করিয়া তাঁহার জন্য দৈনিক এক হাজার টাকা ভাতা মঞ্জুর করিলেন।
শাহজাদা দারাশুকো এই রুধিরপ্রসিদ্ধ পিতৃ-সিংহাসনের বিধিনির্দিষ্ট ভাবী উত্তরাধিকারী। এই পটভূমিকা পরবর্তী ইতিহাসের পূর্বগামিনী ছায়া।