অধ্যায় ৬
চোখ খুলে দেখি দুটো আটান্ন বাজে।
গত কয়েকমাসের মধ্যে এই প্রথম একটু আগে ঘুম ভেঙে গেল।
দুই-দুইটা বাড়তি মিনিট!
সময় ব্যাপারটা আমার কাছে অনেকটা টাকা পয়সার মতো। (একবার বাবাকে আমি এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। তিনি যদি কখনও ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান তার বিছানার পাশের টেবিলে দুই হাজার ডলার রাখা তাহলে তিনি কিন্তু সাথে সাথে ওটা খরচ করার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা শুরু করবেন। আমার ক্ষেত্রেও এই দুই মিনিটের ব্যাপারটা সে রকমই কিছু)। এই বাড়তি দুই মিনিট কি আমি একেবারে খরচ করে ফেলবো, নাকি ভেঙে ভেঙে খরচ করবো? গোসলটা একমিনিট বেশি করা যেতে পারে। আবার ষাটটা বাড়তি বুক-ডনও দেয়া যেতে পারে। দৌড়ানোতেও একটু বেশি সময় দেয়া যায়।
ভাবলাম, একবার ল্যাসিকে জিজ্ঞেস করে দেখি ও কি বলে। কিন্তু ব্যাটা এখনও মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে। ওকে জিজ্ঞেস করেও লাভ হতো বলে মনে হয় না। ও চাইতো, ঐ দুই মিনিট আমি ওর পেটটা চুলকে দেই।
শেষ পর্যন্ত ভাবলাম এই বাড়তি দুই মিনিট বাবার সাথে কথা বলবো। মা’র সম্পর্কে আর কোন অজানা তথ্য যদি জানা যায়।
“আজকে দেখি তাড়াতাড়ি উঠে গেছো?”
বেডরুমের দরজার দিকে তাকালাম। ইনগ্রিড দাঁড়িয়ে আছে। নগ্ন।
শরীরের প্রতিটা ভাঁজ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
বাড়তি দুই মিনিট কিভাবে কাটাবো সেটা নিয়ে আর সংশয় থাকলো না।
ও আমার বিছানায় উঠে আসলো।
নয় মিনিট পর, ইনগ্রিড আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। দু-জনেই ক্লান্ত।
“এভাবে যদি প্রতিদিনই বাড়তি দুই মিনিট খরচ করতে পারতাম!” চোখ না খুলেই বললাম আমি।
মিয়াও।
মাথা ঘুরিয়ে দেখি ল্যাসি ড্যাবড্যাব করে ইনগ্রিডের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কিরে, তোর কি লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই নাকি? তোকে না। আগেও বলেছি, এই সময় তুই পাশের রুমে থাকবি।”
জবাবে ও ইনগ্রিডের দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কোন তাড়া নেই যেন। বদ কোথাকার।
পরের দুই মিনিটে গোসল করে রান্নাঘরে ঢুকলাম। এরমধ্যে বাবা দু-বার মেসেজ দিয়েছেন ফোনে। জবাবে তাকে জানালাম, ইনগ্রিড এসেছে আজকে। আমি কালকে তার সাথে কথা বলবো।
ল্যাসির বাটিতে খাবার ভরে সেটা নিচে রেখে দিলাম। “এই নে, ফাজিল।”
মিয়াও।
“না, আমি তোর জায়গায় হলে মোটেও এরকম কাজ করতাম না।”
ইসাবেল আমার জন্য যে খাবার রান্না করে গেছে সেটা ওভেনে গরম করে নিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম তাড়াতাড়ি।
ইনগ্রিড বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। ওর হাতেও একটা বাটি আর একগ্লাস দুধ তুলে দিলাম। সাথে সাথে খাওয়া শুরু করল ও। ক্ষিদে পেয়েছে অনেক সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
“বলো তো দেখি, আমি কি জানতে পেরেছি?”
মুখভর্তি খাবার নিয়েই কাঁধ ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলল ইনগ্রিড।
“আমার মা কোন সন্ত্রাসি গোষ্ঠির সাথে জড়িত ছিলেন না।”
ওর ভুজোড়া উঁচু হয়ে গেল।
“তিনি একজন গুপ্তচর ছিলেন।”
ইনগ্রিডের গলায় খাবার আটকে গেল। কেশে উঠলো একটু। দুধের গ্লাস থেকে দুই ঢোক গিলে নিয়ে একটু স্বাভাবিক হলো সে। “কি বলো এগুলো?”
বাবার কাছ থেকে যা যা জানতে পেরেছি সব খুলে বললাম ওকে।
“তোমার বাবা কি আসলেই এতদিন তোমাকে কিছু বলেননি?”
আমা মাথা নাড়লাম।
“কিভাবে সম্ভব এটা?”
“আসলে বাবা চেয়েছিলেন আমি যাতে মা’কে ঘৃণা না করি।”
“হুম, এটাও একটা কারণ হতে পারে, কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল ইনগ্রিড।
এরপর আমি ওকে আমার সন্দেহের ব্যাপারটা বললাম, মা হয়ত সিআইএ’র কাছ থেকে গোপন কোন নথি চুরি করেছিলেন অথবা তিনি এমন কোন গোপনীয় বিষয় জানতেন, যার কারণে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তার খুনের ঘটনাটার সাথে জড়িয়ে গেছে।
ইনগ্রিডও মাথা নেড়ে আমার কথায় সম্মতি জানালো।
ওকে সিনেমার ডিভিডির কথাটাও বললাম।
“তোমার ধারণা, তোমার মা ঐ সিনেমাটা পাঠিয়েছেন?”
“তা না-হলে আর কে পাঠাবে? বাবাও তো পাঠাননি।” ওর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম।
“না, আমিও পাঠাইনি।”
“যাই হোক, কেউ একজন তো পাঠিয়েছে। আর সেটা এমন একদিনে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে, যেদিন আমার মা খুন হয়েছেন।” ওকে মা’র ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আর তার লাশটা যে আমার বাসা থেকে ছয়মাইল দূরেই পাওয়া গেছে সেটা বললাম।
“ওয়াকার আমাকে আগেই বলেছে লাশটা কোথায় পাওয়া গেছে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, তাকে ওখানেই খুন করা হয়েছে। এমনটাও হতে পারে, তাকে আরো পঞ্চাশ মাইল দূরে খুন করে লাশটা পটোম্যাক নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে।”
“হতে পারে। কিন্তু তাকে আমার বাসার এত কাছেই পাওয়া গেছে এ ব্যাপারটা একটু বেশিই কাকতালিয়।”
“তা ঠিক। তবে গত ছয় বছরে একটা ব্যাপার আমি শিখেছি, মানুষের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি কাকতালিয় ব্যাপার ঘটে থাকে এই লাইনে।”
আমি মাথা নাড়লেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলাম না।
“আচ্ছা, ডিভিডিটা কোন সিনেমার?”
“মেন ইন ব্ল্যাক।”
জবাবে ও হাসল একবার। “আসলেও ঐ সিনেমাটাই আছে নাকি ডিভিডিটাতে?”
“এতক্ষণ পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি, ওটাই।”
গতরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নয় মিনিট আমি সিনেমাটা দেখেছি। শুরুতে দেখা যায় কালো চামড়ার এক পুলিশ এক চোরকে ধাওয়া করছে। কিন্তু চোরটা দশতলা বিল্ডিংয়ের উপর থেকে লাফ দেওয়ার পর তার আসল পরিচয় বের হয়ে আসে সে একটা এলিয়েন। এরপর কালো স্যুট পরা সাদা চামড়ার এক লোক এসে পুলিশ অফিসারটাকে একটা লাল লাইটের দিকে তাকাতে বলে। ব্যাস, কিছুক্ষণ আগে যা যা দেখেছে সব ভুলে যায় অফিসার।
“যে প্যাকেটে করে ডিভিডিটা এসেছে সেটার কি হলো?” ইনগ্রিড জানতে চাইলো আমার কাছে।
“সেটা ইসাবেল ফেলে দিয়েছে।”
গালটা একটু ফোলাল ও।
“হ্যাঁ, আমি জানি ওটার ভেতরে কিছু লেখা ছিল হয়তো।”
জবাবে একবার ত্যাগ করে হয়ত সে এটা বোঝানোর চেষ্টা করলো, এখন আর কিছুই করার নেই। “চলো, সিনেমা দেখবো এখন।”
ল্যাপটপটা খুললাম।
“পপকর্ন আছে?”
“থাকতে পারে,” হেসে বললাম তাকে।
রান্নাঘরের ক্যাবিনেটে খুলে দেখলাম পপকর্নের যে প্যাকেটটা আছে সেটা মেয়াদোত্তীর্ন। “এটার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, ওখান থেকেই চেঁচিয়ে জানালাম।
“আমি এসব শুনতে চাই না,” বেডরুম থেকে ইনগ্রিডের গলা ভেসে এল। “আমার পপকর্ন চাই!”
আমি পপকর্নের প্যাকেটটা ওভেনে দিয়ে সোফাটার কাছে গেলাম যেখানে ইনগ্রিড সব জামাকাপড় খুলে রেখেছে। ওগুলো তুলে নিয়ে কোনরকমে ভাঁজ করে পাশের কফি টেবিলের উপরে রেখে দিলাম। ওর মোবাইলফোনটা পার্স থেকে অর্ধেক বের হয়ে আছে। আমি হাতে নিলাম ওটা। মোবাইলের স্ক্রিনে আমার ঘুমন্ত অবস্থার একটা ছবি। ল্যাসিও শুয়ে আছে আমার বুকের উপরে। ছবিটা দেখলেই আমার হাসি পায়। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটা একবার জ্বলে উঠলো। একটা মেসেজ এসেছে। আমি পড়ে নিলাম এক লাইনের মেসেজটা।
ওভেনের বিপ আওয়াজটা শুনে বাস্তবে ফিরে এলাম। ফোনটা জায়গামত রেখে দিয়ে পপকর্ন নিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম আমি। ল্যাসিও লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে এল।
এখন বাজে তিনটা উনিশ।
“আচ্ছা, শুরু থেকে এ পর্যন্ত কি হয়েছে সিনেমাটাতে?”
আমি মাথা থেকে মেসেজটার কথা ঝেরে ফেলে ওকে এ পর্যন্ত সিনেমায় যা যা ঘটেছে সেগুলো বললাম।
পরের টানা চল্লিশ মিনিট ধরে আমরা সিনেমাটাই দেখলাম।
তিনটা উনষাটের সময় ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলাম আমি। ইনগ্রিড আমার ঘাড়ে তার মাথাটা রাখলো।
“গুডনাইট,” ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম।
“গুডনাইট।”
“দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি না আমাকে তোমার সকালের মিটিংটার ব্যাপারে কী যেন বলতে চেয়েছিলে?”
“ওহ, আসলে মিটিংটা বাতিল হয়ে গেছিল তাই আমাকে আর সকাল সকাল উঠতে হয়নি।”
আমি ইনগ্রিডের ফোনের মেসেজটার কথা চিন্তা করলাম আবার।
সকালবেলা দেখা করার জন্য ধন্যবাদ।
কিন্তু আমি মেসেজটা নিয়ে চিন্তিত না মোটেও। আমার চোখে পড়েছে যে নম্বর থেকে মেসেজটা এসেছে সেটা।
এই নম্বরটাই আমার বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ারে যে কার্ডটা রাখা আছে সেখানে লেখা।
ইনগ্রিডের সকালের মিটিংটা ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে।
.
পরের দু-দিন আমি কাটালাম সিনেমাটা দেখে দেখে আর বাবার সাথে কথা বলে। তিনি মার সম্পর্কে যা যা জানতেন সবকিছুর একটা তালিকা করেছেন : মা কোথায় বড় হয়েছেন, তার পরিবারের কথা, তার স্কুলের কথা, তার গাড়ির কথা-সবিকছু। কিন্তু এর মধ্যে বেশিরভাগ তথ্যই আমার আগে থেকে জানা ছিল, আর এর প্রত্যেকটাই আমার জানামতে মিথ্যে।
সিনেমাটা অবশ্য ভালোই ছিল কিন্তু ওটাতে গোপন কোন মেসেজ লুকানো ছিল না মোটেও। আমার তো নিজেরই সন্দেহ হওয়া শুরু হয়েছিল, মা বোধহয় ওটা পাঠাননি।
কিন্তু দশ মিনিট আগে আমাজনের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে আমি এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছি। ফোনটা যে ধরেছিল তাকে আমার বাসার ঠিকানা আর ডেলিভারির তারিখটা দিলে সে একটু খুঁজে দেখে বলে, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ওটার বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। ক্রেডিট কার্ডটা নিবন্ধন করা জেন ডো নামে-ফরেনসিক এক্সপার্ট আর হোমিসাইডের তদন্তকারিরা অজ্ঞাতনামা নারী লাশকে যে নামে ডাকে!
আমি এই আবিষ্কারটা নিয়েই চিন্তা করছিলাম এমন সময় আমার মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠলো।
ইনগ্রিডের কাছ থেকে একটা মেসেজ এসেছে।
কালকে তো তুমি কিছু জানালে না। সিনেমাটা শেষ হলো কিভাবে? কিছু খুঁজে পাওনি নিশ্চয়ই?
উত্তরে কী লিখব বুঝতে পারলাম না। আসলে উত্তর দেব কিনা সেটা নিয়েও ভাবতে লাগলাম। ও আমাকে ঐ মিটিংটার ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলেছে। প্রেসিডেন্টের সাথে সে দেখা করতেই পারে কারণ প্রেসিডেন্ট যে মামলায় ফেঁসে গেছিলেন সেটা তদন্তের দায়িত্বে ছিল ইনগ্রিড, তাই দাপ্তরিক কোন কাজে সে যেতেই পারে ওখানে। কিন্তু এটা নিয়ে মিথ্যে কথা বলবে কেন, মিটিংটা বাতিল হয়ে গেছিল?
মেসেজটা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, প্রেসিডেন্ট সুলিভানই তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সুলিভানকে আমি পছন্দই করি। কিন্তু কাউকে পছন্দ করা আর তাকে বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। ইনগ্রিডের সাথে আমার সম্পর্কটা ছয় মাসের হলেও এই সময়ের মাঝে আমরা সর্বোচ্চ সত্তরঘন্টা একসাথে কাটিয়েছি। আমাদের সম্পর্কটার ধরণ নিয়ে আমি সন্দিহান। আমি কি ওর সকল চাহিদা মেটাতে পারি? বিশেষ করে শারীরিক চাহিদা?
আমি পাল্টা মেসেজে লিখলাম :
সিনেমাটা ভালোই ছিল। কিন্তু কোন সূত্র পাইনি।
উত্তর আসল একটু পরেই :
ধুর…নতুন একটা কেস পেয়েছি। এক সিরিয়াল কিলারের, নিজেকে পোপ বলে দাবি করে সে। তোমার সাথে বোধহয় কয়েকদিন দেখা হবে না।
আচ্ছা।
তুমি ঠিক আছো?
হুম, একটু ব্যস্ত।
আমি তোমার মা’র ব্যাপারেও চোখ কান খোলা রাখব।
ধন্যবাদ।
এখনই আবার মেন ইন ব্ল্যাক ২ দেখতে বোসো না। আমি দেখিনি অবশ্য। কিন্তু রিভিউয়ে দেখেছি, জঘন্য নাকি ওটা।
দেখবো না। পরে দেখা হবে তোমার সাথে।
ভাবলাম, মেসেজে একবার লিখি, প্রেসিডেন্ট সুলিভানকে আমার পক্ষ থেকে যেন ‘হ্যালো’ জানিয়ে দেয় সে। কিন্তু বোকার মতো কিছু করার আগেই ফোনটা রেখে দিলাম।
এখন বাজে তিনটা সাইত্রিশ।
“চল, যাই,” জোরে বললাম।
ল্যাসি লাফ দিয়ে সোফা থেকে নেমে গেল। ওর চেইনটা নিতে গিয়েও নিলাম না। বেচারা গত তিনদিন ধরে বাইরে যায় না।
এক মিনিট পরে আমি আর ল্যাসি রাস্তা ধরে দৌড়াচ্ছি।
ইনগ্রিডের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেরে ফেলার একমাত্র উপায় হচ্ছে মার সম্পর্কে চিন্তা করা। তা-ও একমাইল পর্যন্ত ওর ব্যাপারটাই ভাবতে লাগলাম। মনে হচ্ছে, ওকে গুডনাইট জানিয়ে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেই। আর এটাও জানাই, ও আমার জীবনে এসেছে বলে আমি কতটা ভাগ্যবান। ও আমাকে প্রেসিডেন্টের সাথে মিটিংটার ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলেছে এ নিয়ে আমি চিন্তিত নই। কারণ আমি ওকে বিশ্বাস করি। ওকে ভালোবাসি।
মাথা নেড়ে চিন্তাটা বিদায় করে দিয়ে মা’কে নিয়ে ভাবা শুরু করলাম। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, মা হয়ত নিজে এসে আমার দরজার সামনে। প্যাকেজটা রেখে গেছেন। কিন্তু আসলে সেটা ঘটেনি। তিনি সরাসরি আমাজনের মাধ্যমেই ওটা ডেলিভারি করিয়েছেন। তাই ওটার প্যাকেটের গায়ে কিছু লেখা থাকার সম্ভাবনাও কম। যদি না ডেলিভারি যে করেছে তার সাথে মার কোন প্রকার আঁতাত থেকে থাকে। তাহলে এত কাঠখড় পুড়িয়ে ডিভিডিটা পাঠানোর মানে কি?
তিনি কি সিনেমার নামের মাধ্যমে কোন মেসেজ পাঠাতে চেয়েছেন?
মেন ইন ব্ল্যাক।
এর মানে সিআইএ, তাই না?
এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু আরো কোন গভীর অর্থ আছে নাকি এটার? সিনেমাটার অভিনেতারা কোনভাবে জড়িত?
সিনেমার দুই মূল চরিত্র সম্পর্কেই খোঁজ খবর নিয়েছি আমি। একজনের নাম উইল স্মিথ আর আরেকজন হলো টমি লি জোনস। কিন্তু তাদের অতীত ঘেঁটে আগ্রহোদ্দিপক সেরকম কিছুই খুঁজে পেলাম না।
পপ কালচার নিয়ে আমার জ্ঞান অবশ্য সীমিত। সিনেমার ডায়লগগুলো রূপক অর্থে অন্য কিছু বোঝায়নি তো?
চিন্তা করা থামিয়ে ফোনের ঘড়ির দিকে তাকালাম।
তিনটা আটচল্লিশ বাজে।
ঘুরে বাসার দিকে রওনা হলাম।
যখন সেখানে পৌঁছালাম তখন বাজে তিনটা ছাপ্পান্ন।
ল্যাসিকে কাছেপিঠে কোথাও খুঁজে পেলাম না। কিন্তু ওর প্রতি আমার বিশ্বাস আছে, ও ঠিকই পথ চিনে ফিরে আসবে। দরজাটা ওর জন্যে ভোলা। রেখে দিলাম। পেটভরে পানি খেয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। এখন আর গোসল করার সময় নেই কিন্তু এই ঘামে ভেজা কাপড় পরে শুতে ইচ্ছা করছে না। ওগুলো খুলে বিছানায় উঠে পড়লাম।
শুয়ে শুয়ে আমার আর ইনগ্রিডের মধ্যে চালাচালি করা মেসেজগুলো দেখতে লাগলাম।
ওকে না দেখতে পেরে যে আমার খারাপ লাগছে এই কথাটা টাইপ করতে যাবো এমন সময় ব্যাপারটা আমার মাথায় আসলো।
ওর শেষ মেসেজটা।
এখনই আবার মেন ইন ব্ল্যাক ২ দেখতে বোসো না। আমি দেখিনি অবশ্য। কিন্তু রিভিউয়ে দেখেছি, জঘন্য নাকি ওটা।
এটাই!
রিভিউ!
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে কম্পিউটারের দিকে দৌড় দিলাম। আমাজন অ্যাকাউন্টে লগ ইন করে মেন ইন ব্ল্যাক লিখে সার্চ দিতেই দেখাল ৫১৭টা রিভিউ আছে এটা নিয়ে। রিভিউগুলো দেখতে দেখতে নিচের দিকে স্ক্রল করতে লাগলাম। শেষের দিক থেকে দুই নম্বর রিভিউটা লেখা হয়েছে। অক্টোবরের ২ তারিখে।
আমার মা ঐদিনই খুন হন।
আর রিভিউটা লিখেছি স্বয়ং আমি!
*
অধ্যায় ৭
শেষ যেবার আমি রান্নাঘরের চেয়ারটাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেটা চার বছর আগের ঘটনা। একটা কোম্পানির শেয়ার কিনবো নাকি কিনবো না এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলাম। পাঁচ হাজার শেয়ার। প্রথমে ভেবেছিলাম কিনবো না। তখন বাজছিল তিনটা আটান্ন। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে দৌড়ে এসে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেয়ারগুলো কিনতে ব্যর্থ হই আমি। তেইশ ঘন্টা পরে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার কপালে কিবোর্ডের মতো নকশা হয়ে গেছে।
কিন্তু সেবার বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম শেয়ারগুলো না কিনে। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই পঁয়ত্রিশ শতাংশ দাম পড়ে যায় ওগুলোর। আমিও বড় মাপের লোকসানের হাত থেকে বেঁচে যাই।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমি খুশিমনে ঐ লোকসানের মুখোমুখি হতাম যদি ওটার বদলে সেদিন বিছানায় গিয়ে ঘুমাতে পারতাম। কারণ ঐ ঘটনার পরে একজন ফিজিও থেরাপিস্ট আর মেরুদণ্ডের ডাক্তারের পেছনে ঐ একই অঙ্কের টাকা খরচ হয়েছিল আমার। ডাক্তারসাহেব তো রাত তিনটার সময় তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার জন্যে অতিরিক্ত বিলও নিয়েছিলেন।
বড় করে তিনবার নিঃশ্বাস নিয়ে রান্নাঘরের টেবিলটা থেকে মাথা তোলার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। আমার শরীরের প্রতিটা মাংসপেশি মনে হয় জমে গেছে। আঙুলগুলোও নাড়াতে পারলাম না।
খুবই খারাপ খবর।
কপালে হালকা কিছু একটার ছোঁয়া লাগায় চোখ খুললাম।
“কিরে, কি খবর তোর?” আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
জবাবে ল্যাসি আমার চোখদুটো একবার চেটে দিয়ে একটু পিছিয়ে গেল। দেখে মনে হচ্ছে, ব্যাটা কোন ব্যাপারে বেজায় খুশি।
“এত খুশি লাগছে কেন তোকে? কিছু করেছিস নাকি?”
মিয়াও।
“কি? একটা শেয়ালের সাথে? নাকি শেয়ালের মতো দেখতে একটা মেয়ে বিড়ালের সাথে?”
মিয়াও।
“একটা আসল শেয়ালের সাথে? বাহ্, এটা যে সম্ভব তা আমার জানা ছিল না,” আমি হাসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সামান্য একটু নাড়াচাড়া করতেই মেরুদণ্ড বরাবর তীব্র একটা ব্যথার হলকা নেমে গেল। জোরে নিঃশ্বাস নিলাম।
মিয়াও।
“নারে, আমি ঠিক নেই।”
মিয়াও।
“জানি, ঘুমানোর জন্য বিছানা আরো আরামদায়ক জায়গা।”
মিয়াও।
“আমার ফোনটা লাগবে।”
টেবিলের উপর আমার বামহাতটা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ডানহাতের কোন অস্তিত্বই টের পাচ্ছি না। মনে হয় ওটা ঝুলে আছে কোনরকমে।
মনে করার চেষ্টা করলাম, ফোনটা কোথায় রেখেছি। রান্নাঘরের তাকে, নাকি সোফার উপরে?
ল্যাসি লাফ মেরে আমার মাথার উপর দিয়ে কই যেন গেল। কিছুক্ষণ পরেই আবার দেখতে পেলাম ওকে। ব্যাটা নাক দিয়ে আমার ফোনটা আমার হাতের দিকে ঠেলছে।
এখনো উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। গত একদিন ধরে চার্জ দেয়া হয়নি ফোনটাতে। শেষবার যখন ওটা ব্যবহার করেছিলাম তখন পুরো চার্জ দেয়া ছিল। গত তেইশ ঘন্টা এটা দিয়ে কোন ফোন করা হয়নি কিংবা মেসেজও পাঠানো হয়নি। অল্প হলেও চার্জ থাকার কথা।
আমি আস্তে আস্তে আঙুলগুলো নাড়াবার চেষ্টা করলাম।
প্রথমে কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না। অবশেষে আমার তর্জনিটা একটু নড়ে উঠলো। এর কিছুক্ষণ পরে সবগুলো আঙুলই আস্তে আস্তে জেগে উঠতে লাগলো। গুতো দিয়ে ফোনটা আমার মুঠোর নিচে দিয়ে দিল ল্যাসি। আমি নিচের বাটনটা চাপ দিলে স্ক্রিন জ্বলে উঠলো।
যাক্, বাঁচা গেল।
ভয়েস কমান্ডের বাটনটা চেপে ধরে ভাবলাম, ৯১১-তে ফোন দেব, কিন্তু সেটা করলাম না। বললাম, “ইনগ্রিডকে ফোন করো।”
ওপাশে রিং হতে লাগলো।
কিন্তু কেউ না ধরাতে সরাসরি ভয়েসমেইলে চলে গেল।
একবার বিপ্ করে উঠলো মোবাইলটা। এরকম আওয়াজ শুনিনি আগে। মনে হয় চার্জ খুব অল্প আছে।
“বাবাকে ফোন করো।”
এবারও রিং হতে লাগলো ওপাশে।
দু-বার রিং হতেই বাবা ফোনটা ধরলেন।
“কি খবর হে-”
“বাবা!” তার কথার মাঝেই আমি বলে উঠলাম। “আমার ফোনের চার্জ এখনই শেষ হয়ে যাবে। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে আসেন। সাথে করে আপনার পিঠের ব্যথার ওষুধগুলোও নিয়ে আসবেন। তাড়াতা-”
আর কিছু বলার আগেই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল।
.
বাবা এখান থেকে বিশ মিনিটের দূরত্বে থাকেন। কিন্তু তার নিজের পিঠেও ব্যথা, তাই তিনি এখন বিছানা থেকে উঠতে পারবেন কিনা এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ ছিল। কিন্তু পনের মিনিটের মধ্যেই সিঁড়িতে কারো উঠে আসার শব্দ পেলাম আর তারপরই আমার দরজাটা সশব্দে খুলে গেল।
আমি ভুলেই গেছিলাম দরজাটা ল্যাসির জন্যে খোলা রেখে দিয়েছিলাম। সে অবশ্য এখন ব্যস্ত। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু মারডকের আগমন ঘটেছে। লিভিংরুমে ওদের হুটোপুটির আওয়াজ আমি এখান থেকেও পাচ্ছি।
আপনি যদি ভ্রাতৃত্ব লিখে গুগলে সার্চ দেন তাহলে এ দুটোর ছবি ভেসে উঠতে পারে ফলাফল হিসেবে।
“আরে, থাম্ তোরা।”
থামার কোন লক্ষণও দেখা গেল না ওদের মধ্যে।
দশ সেকেন্ড পরে বাবা ঢুকলেন।
আমি তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম, তিনি দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছেন। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় উনি যে দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছেন সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। উনার একমাত্র ছেলে জন্মদিনের পোশাকে চেয়ারে বসে আছে।
হাসি আর দমিয়ে রাখতে পারলেন না, পুরো ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন, “আমাকে কি জিজ্ঞেস করতে হবে, কি হয়েছিল?”
গত পনের মিনিট ধরে অপেক্ষা করার সময় আমি আমার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো একটু স্বাভাবিক করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিছুটা হলেও সফল হয়েছি কারণ এখন মাথাটা একটু নাড়াতে পারছি। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, হাসতে হাসতে বাবার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে।
মারডক আর ল্যাসির আওয়াজ আরো বেড়ে গেছে, নিচতলার ভাড়াটিয়ার সুখের ঘুমটা এতক্ষণে মনে হয় ভেঙে দিয়েছে ওরা।
“এই, তোরা আওয়াজ কম কর!” বাবা চেঁচিয়ে বললেন ওদেরকে।
এবার ওরা একটু শান্ত হলো।
আমার ঘাড়ে বাবার হাতের স্পর্শ টের পেলাম। তিনি এখনও মৃদু হাসছেন, কিন্তু আমার গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে এটাও জানেন, এভাবে ঘুমানোর ফলাফল আমার জন্য কতটা মারাত্মক হতে পারে। আমার মেরুদণ্ডের অপুরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। আমার হাত কিংবা পায়ের স্নায়ুগুলোরও অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
মারডক আমার বাবার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর একফুট লম্বা জিহ্বাটা দিয়ে আমার মুখ চাটতে লাগলো।
“কিরে গর্দভ, কি খবর?” ল্যাসি ওর ঘাড়ের উপর চড়ে আছে।
মিয়াও।
“হ্যাঁ, একদম ঘোড়সাওয়ারের মতো লাগছে তোকে।”
“সর এখান থেকে,” মারডককে সামনে থেকে ঠেলা দিয়ে সরাতে সরাতে বললেন বাবা। “চল, এখন তোমাকে সোফায় নিয়ে যাই,” আমার উদ্দেশ্যে বললেন তিনি।
চিন্তা করে দেখলাম, এটা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, আমিসহ চেয়ারটাকে টেনে সোফার কাছে নিয়ে যাওয়া, এরপর আমাকে ধরে সোফায় উল্টিয়ে দেয়া।
কাজটা সহজ নয় কিন্তু তিনটা সাতাশ নাগাদ আমি সোফার উপর উঠে পড়লাম। এরমধ্যে বাবা আমাকে একটা বক্সার পরিয়ে দিয়েছেন। কাজটা করতে তিনি একটুও দ্বিধাবোধ করেননি। একারণেই তাকে আমি এত পছন্দ করি।
“তুমি কি পেইনকিলারগুলো এখনই খেতে চাও?”
ওষুধগুলো এখনই দরকার আমার। ওগুলো খেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলবো। কিন্তু আমাকে আরো কিছু সময় জেগে থাকতে হবে।
“এখন না,” এটুকু বলতে গিয়েই ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলাম। মনে হলো, কেউ আমার মেরুদণ্ড বরাবর একটা করাত চালিয়ে দিয়েছে। সাথে সাথে মতো পাল্টে ফেললাম, “ওষুধ দিন, এখনই।”
তিনি আমার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলে দুটো ট্যাবলেট গিলে ফেললাম ওগুলো দিয়ে।
“আপনি কি ল্যাসিকে খাওয়াতে পারবেন? আর আমাকেও একটা প্রোটিন শেক বের করে দিয়েন ফ্রিজ থেকে,” বাবাকে বললাম।
তিনি দুটো কাজই করলেন।
আমার পাশে বসে প্রোটিন শেকটা ধরে রাখলেন তিনি আর আমি খেতে লাগলাম।
“তো, আমাকে বলবে, কি ঘটেছিল?”
“ল্যাপটপটা নিয়ে আসেন একটু।”
উঠে গিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে আসলেন তিনি।
স্ক্রিনসেভার হিসেবে ইনগ্রিডের একটা ছবি সেট করে রাখা আছে তাতে।
“রিফ্রেশ করুন একবার,” বললাম তাকে।
কিন্তু তিনি ইতঃস্তত বোধ করতে লাগলেন।
“সমস্যা নেই, বাবা,” আশ্বস্ত করলাম তাকে, “উল্টাপাল্টা কিছু ভেসে উঠবে না পর্দায়।”
“আচ্ছা।”
পরের দশ মিনিট ধরে আমি তাকে মেন ইন ব্ল্যাক-এর ব্যাপারে সব কিছু বললাম। কিভাবে আমি নিশ্চিত হলাম, মা এটা আমাকে পাঠিয়েছেন আর একটা রিভিউয়ের মাধ্যমে, আমার কাছে একটা গোপন বার্তা পাঠাতে চেয়েছেন তিনি, এই ব্যাপারগুলোও বললাম।
“আমি তো ওরকম কোন রিভিউ খুঁজে পাচ্ছি না,” তিনি বললেন।
আমার দিকে কম্পিউটারের স্ক্রিনটা ঘুরিয়ে দিলেন। ওষুধগুলো কাজ করতে শুরু করেছে। সবকিছু ঘোলা ঘোলা দেখছি এখন। কোনমতে চোখ কুঁচকে তাকালাম। রিভিউটা আসলেই নেই।
“কিন্তু ওটা এখানেই ছিল। আমিই লিখেছিলাম ওটা,” ওখানে সেপ্টেম্বরের সাত তারিখের একটা আর অক্টোবরের আট তারিখের লেখা রিভিউ ঠিকই আছে। কিন্তু অক্টোবরের দুই তারিখে লেখা রিভিউটা বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। “ওরা ওটা মুছে দিয়েছে।”
“কারা?”
উত্তরটা এখনও আমার জানা নেই।
“প্রিন্টারটা একবার দেখুন তো,” আমি বললাম।
আমার মনে আছে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি রিভিউটার একটা প্রিন্ট আউট বের করে রাখার জন্য কমান্ড দিয়েছিলাম। আমার মাথা আর কাজ করছে না। চোখ বন্ধ হয়ে আসলো আপনা-আপনি।
চারটা বাজার আগেই ঘুমিয়ে পড়লাম আজ।
.
ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলাম।
পাশের বেডসাইড টেবিলে একটা প্যাডের পাতায় বাবার গোটা গোটা হাতের লেখা একটা চিঠি শোভা পাচ্ছে। উনি গত তেইশ ঘন্টায় আমার জন্য যা যা করেছেন তার একটা বিবরণ লিখে রেখেছেন।
একজন মেরুদন্ত্রে ডাক্তার এসেছিলেন আমার পিঠের অবস্থা ঠিক করে দেয়ার জন্যে। আর একজন ম্যাসাজ থেরাপিস্ট এসে দু-ঘন্টা ধরে আমার মাংসপেশি স্বাভাবিক করার জন্য কাজ করে গেছেন। সারা (আমার প্রাক্তন প্রেমিকা, যার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে) এসে আমার একটু দেখভাল করে গেছে। বাবা তার পছন্দের রেস্টুরেন্ট থেকে মিটবল এনে নিজে খেয়েছেন, আমার জন্যে বাকিটা ফ্রিজে রেখে দিয়েছেন। তিনি তার নিজের ডাক্তারের সাথেও কথা বলেছেন কিছু অতিরিক্ত পিঠের ব্যথার ওষুধের জন্য। কিন্তু এবার এমন ডোজের ওষুধের নাম শুনে নিয়েছেন যেগুলো খেলে একটু হলেও হুশ থাকবে আমার। এছাড়াও তিনি মারডক আর ল্যাসিকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছিলেন। আমার বাথরুমের পাইপলাইনটাও ঠিক করে দিয়েছেন।
সবকিছু করে মধ্যরাতের দিকে এখান থেকে বের হয়েছেন তিনি।
ল্যাসির দিকে তাকালাম।
দুনিয়ার সাথে কোন সম্পর্ক নেই তার এখন। গভীর ঘুমে মগ্ন। মারডকের সাথে সারাদিন লাফালাফি-হুঁটোপুটি করার পর আর তার শরীরে একটুও শক্তি অবশিষ্ট নেই। ওর মুখের চারপাশে গোঁফে হলুদ রঙের কী যেন লেগে আছে। নিশ্চয়ই হটডগ খাওয়ার সময় সয়া লেগে গেছিল।
আপনমনেই হেসে উঠলাম একবার।
হাতে ভর দিয়ে ঠার চেষ্টা করলাম। ব্যথা করে উঠলো সারা হাত-পা। কিন্তু কালকের তুলনায় রীতিমত স্বর্গসুখে আছি বলা যায়। ফোনটা হাতে নিয়ে বাবাকে মেসেজ করলাম।
আপনার তুলনা হয় না বাবা।
এখন ভালো লাগছে?
হ্যাঁ, কোন প্রকার গোঙানি ছাড়াই মাথা এপাশ ওপাশ করতে পারছি।
যাক…মাইক্রোওয়েভে মিটবল তেতাল্লিশ সেকেন্ড গরম করে নিও।
আচ্ছা।
আমি অনেক ক্লান্ত। বিছানায় উঠে পড়বো এখন। আজকে তো পোকার খেলতে পারতে না তাই চলে এসেছি বাসায়।
এএসটির রিপোর্টটা আমার কাছে এসেছিল আজ থেকে এক সপ্তাহ।
ফিরতি মেসেজে লিখলাম :
ব্যাপার না।
ওটা একটা তারিখ।
কোনটা?
রিভিউটা। ওখানে, অ্যানিভার্সে রির কথাটা বলা হয়েছে সেটা মনে হয় কোন তারিখ নির্দেশ করেছে।
টেবিলের দিকে আবার ভালোমত খেয়াল করে দ্বিতীয় আরেকটা এ ফোর সাইজের কাগজ লক্ষ্য করলাম। রিভিউটা। যাক, প্রিন্ট করেছিলাম তাহলে। যদিও আগে পড়েছিলাম একবার কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলাম
ওটা। আবার পড়লাম শুরু থেকে শেষপর্যন্ত। আমার মুখের হাসিটা থামতেই চাইছে না।
আবার বাবাকে মেসেজ দিলাম :
আমার মনে হয় আপনি ঠিকই বলেছেন।
আমাকে জানিও, তুমি কি বের করতে পারলে।
গুডনাইট।
আচ্ছা। এখন ঘুমান ভালোমতো। গুডনাইট ।
বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। শরীরটা এখনও কেমন জানি ম্যাজম্যাজ করছে। বাথরুমে গিয়ে হালকা হয়ে আসলাম।
খাবার গরম করে ল্যাপটপটা নিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে বসলাম।
এখন বাজে তিনটা বারো।
আমার ফোনে আরো দুটো মেসেজ এসে জমা হয়ে আছে। দুটোই ইনগ্রিডের কাছ থেকে এসেছে। সে এখনও তার নতুন কেসটার কোন সমাধান করতে পারেনি। আজকেও সে আসতে পারছে না। কিন্তু আমার কথা অনেক মনে পড়ছে তার। খুব মিস করছে।
তাকে ফিরতি মেসেজ দিয়ে জানালাম, তাকে ছাড়া আমারও ভালো লাগছে না।
মিটবলে বড় এক কামড় বসিয়ে আবার রিভিউটা শুরু থেকে পড়া শুরু করলাম। রিভিউটা এরকম:
This movie rocks!
আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের প্রথম ডেটে এই সিনেমাটা দেখেছিলাম আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে। (আমাদের ভালোবাসাকে বলা যেতে পারে, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’)। এরপর থেকে আমাদের প্রতি অ্যানিভার্সেরিতে আমরা সিনেমাটা দেখি-আগস্টের ৫ তারিখে। স্মিথ আর জোনস দারুণ অভিনয় করেছে। ডিরেক্টর হেঘিলও ভালো কাজ দেখিয়েছেন। আমার নয় বছর বয়সি মেয়ে এপ্রিলেরও দারুণ পছন্দ সিনেমাটা। সে পারলে এটাকে ১২ রেটিং দেবে।
প্রকাশনার তারিখ : ১০/২/২০১৪…হেনরি বিনস
বাবার ধারণা, আগস্টের ৫ তারিখ আর আট বছর আগে এই দুটো দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু বোঝানো হয়েছে।
আমারও একই ধারনা।
ল্যাপটপ খুলে গুগলে সার্চ দিলাম তারিখটা।
উইকিপিডিয়ার একটা পেজ চলে আসলো প্রথমেই। আমি নজর বোলানো শুরু করলাম। ২০০৮ সালের আগস্টের ৫ তারিখ ছিল শনিবার। জর্জ বুশ ছিলেন তৎকালিন প্রেসিডেন্ট। এটাওটা সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য লেখা আছে, কিন্তু ওর মধ্যে থেকে কেবল একটা জিনিসই আমার নজর কাড়তে পারলো। উত্তর-ইরাকে আল-কায়েদার দু-জন উচ্চপদস্থ কর্মি এক বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিল সেদিন।
আমার যতদূর মনে হয়, মা চেয়েছিলেন আমি এই লাইনটাই পড়ি। কিন্তু কেন? এই দু-জন সন্ত্রাসির মৃত্যু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে কেন?
আমি আরো পড়তে থাকলাম।
গুজব আছে, যখন বিস্ফোরণটা হয়েছিল তখন ঐ দুজন সন্ত্রাসি-আব্দুল আল-রাহমিন আর হাম্মাদ শেখ-একটা বাড়ির বেজমেন্টে বোমা বানাতে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু তাদের বানানো একটা বোমা ঐ সময়েই দুর্ঘটনাবশত বিস্ফোরিত হলে বেজমেন্টটা তাদের উপরেই ধ্বসে পড়ে।
দু-জন মৃত সন্ত্রাসি? এই কারণেই কি মা’কে চার নম্বর লাল রঙের বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল?
নিশ্চয়ই আমার চোখে কিছু এড়িয়ে যাচ্ছে।
আবার রিভিউটা পড়লাম।
আবার।
বার বার।
এবার বুঝতে পারলাম। রিভিউটাতে একটা তারিখ নয়, দুটো তারিখের কথা বলা হয়েছে।
ওখানে নয় বছর বয়সি এপ্রিল নামের একটা মেয়ের কথা বলে হয়েছে, যে কিনা সিনেমাটাকে রেটিং হিসেবে ১২ নম্বর দিত।
৯ই এপ্রিল, ২০১২।
আমি এবার গুগলে এই ডেটটা লিখে সার্চ দিয়ে ফলাফলগুলো দেখতে লাগলাম। আমার ভ্রূ আপনা-আপনি কুঁচকে গেল।
দু-জন আল-কায়েদা জঙ্গি এক বিস্ফোরণে মারা গেছে। এবার আফগানিস্তানে। প্রায় একইভাবে। বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরিত হয়ে তাদের উপরেই বেজমেন্ট ধ্বসে পড়েছে।
এবার দুটো ফলাফল পাশাপাশি রেখে পড়তে লাগলাম।
দুটো বিস্ফোরণ। দুটো ধ্বস। ঐ চারজনের লাশের কি অবস্থা হয়েছিল কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। নিশ্চয়ই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
.
রিভিউটা আবার পড়লাম।
লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।
সাইট!!
নিশ্চয়ই কোন ওয়েবসাইট বোঝাচ্ছে এটা দিয়ে।
কিন্তু ইন্টারনেটে তো কোটি কোটি ওয়েবসাইট আছে। সঠিকটা আমি খুঁজে বের করবো কিভাবে?
গুগলে সার্চ দিলাম ‘টেরোরিস্ট ওয়েবসাইট লিখে। হাজারটা ফলাফল ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। ল করতে করতে দশ পেজ পর্যন্ত গেলাম।
১১তম পেজে গিয়ে টেরোরিস্ট’ আর ‘সাইট’ শব্দদুটো আছে এমন একটি সার্চ রেজাল্ট পেলাম। কিন্তু ওটা কোন ওয়েবসাইট না।
মেন ইন ব্ল্যাক দিয়ে আসলে সিআইএ সম্পর্কে কিছু বোঝানো হয়নি।
‘মেন’ শব্দটারও কোন গুরুত্ব নেই।
ব্ল্যাক। এটাই দরকার ওখান থেকে।
একটা ব্ল্যাক সাইট।
মানে সিআইএ’র একটা গোপন জেলখানা।
.
অধ্যায় ৮
পরবর্তি বিশ মিনিট আমি ‘ব্ল্যাক সাইট সম্পর্কে নেটে খোঁজ নিলাম। ব্ল্যাক সাইটগুলো হচ্ছে এমন জায়গা যার নিয়ন্ত্রন সিআইএ’র হাতে কিন্তু এটা আইন আর বিচারালয়ের আওতার বাইরে। কথিত বিপজ্জনক সন্ত্রাসিদের অনেকটা বেআইনিভাবে গোপনে আটক করে রাখা হয় এখানে। অন্য আরেকটা নাম আছে এসব জায়গার-গুপ্ত কারাগার।
২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ এসব কয়েদখানার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেন। আফগানিস্তান আর ইরাকজুড়ে প্রায় বিশটারও বেশি এমন স্থাপনা আছে। এছাড়াও পোল্যান্ড, রোমানিয়াসহ গুটিকয়েক দেশেও আছে। এর পরবর্তি বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি রিপোের্ট বেরিয়েছিল এইসব কারাগারগুলোতে কয়েদিদের সাথে অমানবিক আচরণ করা নিয়ে। বিশেষ করে নির্যাতনের ব্যাপারে।
নির্যাতন।
আমি এসব মেনে নিতে পারতাম যদি এগুলোর মাধ্যমে আরেকটা নাইন ইলেভেনের হাত থেকে বাঁচা যেত। কিন্তু তেমনটা তো নয়। সবকিছুরই একটা সীমা আছে।
একের পর এক রিপোর্ট, তদন্তের ফলাফল প্রকাশ পেতে থাকে এই ব্ল্যাক সাইটগুলো সম্পর্কে। এতে কিছুটা হলেও সরকারের টনক নড়ে।
২০০৭ সালের অক্টোবরের সাত তারিখে সিআইএ এসব জায়গায় বন্দিদের নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদের যে ভিডিওটেপগুলো আছে সেসব ধ্বংস করে ফেলার উদ্যোগ নেয়। গুজব আছে, এসব টেপে খুবই বর্বর পদ্ধতিতে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সচিত্র প্রমাণ ছিল। যেমন কারেন্ট ট্রিটমেন্ট, হাইপোথার্মিয়া, ওয়াটার থেরাপি, এমনকি ভয়ঙ্কর। সব কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ভয় দেখানো হতো কথা বের করার জন্যে। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়েও ভয়ঙ্কর সব পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো ওসব জায়গায়।
২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা এসব ব্ল্যাক সাইটগুলো বন্ধ করে দেন, সেই সাথে বন্দিদের গুয়ানতানামো বে’তে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন তিনি।
২০১২ সালে প্রেসিডেন্সি ভোটে ওবামাকে হারানোর পর কনর সুলিভানও এই বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ জারি রাখেন।
কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে বের হওয়া এক আর্টিকেলে বলা হয়, ওসব গোপন কারাগারে বন্দি থাকা বিশজনের বেশি বন্দি নাকি এখনও নিরুদ্দেশ। আমার মা আমাকে যে চারজন সন্ত্রাসি সম্পর্কে তথ্য পাঠিয়েছেন, তাদের লাশ কখনও উদ্ধার করা হয়নি। আমার এখন মনে হচ্ছে, নিরুদ্দেশ ব্যক্তিদের তালিকায় এই চারজনের নামও আছে। অথবা এমন একটা তালিকা আছে যেখানে এদেরকে মৃত বলে দাবি করা হয়েছে। সবাই জানে একজন কথিত মৃত ব্যক্তির উপর অত্যাচার করা একজন জীবিত ব্যক্তির উপর অত্যাচার করার তুলনায় কতটা সহজ।
আমার মাকে মেরে ফেলার পেছনে একটা কারণই থাকতে পারে–এসব বন্দি এখনও জীবিত আছে, আর তিনি তাদের অবস্থান জানতেন।
শেষবারের মতো রিভিউটা একবার পড়ে বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। এর আগে ড্রয়ার থেকে প্রেসিডেন্টের দেয়া কার্ডটা বের করে নিয়েছি। ওখানে লেখা নম্বরে ডায়াল করলাম।
এখন সময় তিনটা ছেচল্লিশ।
তিনি এ মুহূর্তে জেগে আছেন কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান ছিলাম কিন্তু তৃতীয়বার রিং হওয়ার পরই ফোনটা ধরলেন।
“আমি চাই আপনি আমাকে যে বিশেষ সুবিধা দিতে চেয়েছিলেন সেটা কাজে লাগাতে।”
.
তেইশ ঘন্টা উনত্রিশ মিনিট পরের ঘটনা।
মাথার হুডিটা আরো সামনে টেনে দিলাম। পার্কিংলটের একটা বড় গাছের পেছনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি। সামার পার্ক এখন নির্জীব। টেনিস কোর্ট আর বাস্কেটবল কোর্টগুলোতে একদম সুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম দিনের বেলায় ওসব জায়গা ঘিরে থাকা চাঞ্চল্যের কথা। নিশ্চয়ই নানা বয়সি ছেলেমেয়ে বাস্কেটবল আর টেনিস খেলতে ব্যস্ত থাকে এখানে।
ছয়মাস আগে প্রেসিডেন্ট আর রেড আমাকে এই পার্কিংলট থেকেই তুলে নিয়েছিল। এর পরের ঘন্টাগুলোতে আমি তাদের এবং ইনগ্রিডকে নিয়ে ছুটেছিলাম এক খুনিকে ধরার উদ্দেশ্যে। জেসি ক্যালোমেটিক্সের খুনের মামলায় প্রেসিডেন্ট নির্দোষ প্রমাণ হয়েছিলেন।
এজন্যেই প্রেসিডেন্ট আজ এখানে আসবেন। আমার কাছে তিনি ঋণী।
তিনটা পনের মিনিটে রাস্তার শেষ মাথায় একটা গাড়ির হেডলাইট জ্বলতে দেখা যেতেই তিরিশ সেকেন্ড পর একটা টাউন কার পার্কিংলটে এসে হাজির হলো। আরো তিরিশ সেকেন্ড পর আরেকটা কালো রঙের এসইউভি এসে পার্ক করল ওখানে।
এসইউভি’তে যে লোকটা ছিল তার বের হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একসময় সে বের হলো। তখন আমি ছায়া থেকে বেরিয়ে গাড়িটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
একবার মাথা নাড়লাম। রেডও জবাবে একবার মাথা নাড়ল। হাত মেলালাম তার সাথে।
“বের হতে কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
প্রেসিডেন্ট আর রেড কিভাবে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হোয়াইট হাউস থেকে বের হয়ে আসে এ ব্যাপারটা আমার কাছে আজও পরিস্কার নয়। আমি একবার প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি লিংকন টানেল ব্যবহার করেন কিনা, জবাবে তিনি একবার হেসেছিলেন শুধু। আরেকবার ফোনে কথা বলার একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, বাইরের লোকজন যদি জানত, হোয়াইট হাউস থেকে বের হওয়া কত সোজা তাহলে তারা অবাক হয়ে যেত।
“না, কোন সমস্যা হয়নি,” মাথা নাড়তে নাড়তে কথাটা বলে পেছনের দরজা খুলে ধরল রেড।
ঝুঁকে ভেতরের দিকে তাকালাম।
পেছনের প্রশস্ত সিটে দু-জন মানুষ মুখোমুখি বসে আছে। সুলিভানের সাথে হাত মেলালাম। আজকে তিনি ওয়াশিংটন রেডস্কিনসের একটা জার্সি পরে আছেন। তাকে দেখে একদম সহজ-সরল একজন লোক বলে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে। অথচ বলতে গেলে, বর্তমানে গোটা পৃথিবীরই শাসনকর্তা তিনি, যদিও সেরকম কোন ভাবই নেই তার মধ্যে।
তিনি আমাকে উল্টোদিকে বসে থাকা লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
জন লে’হাই।
সিআইএ’র ডিরেক্টর।
.
আমি আশা করেছিলাম, সিআইএ’র ডিরেক্টর মহোদয় আমার কাছে কৈফিয়ত চাইবেন তাকে এই অসময়ে এখানে টেনে আনার জন্যে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, “প্রেসিডেন্টসাহেবের কাছে আপনার অনেক সুনাম শুনেছি।”
জন লে’হাইকে দেখে মনে হচ্ছে, তার বয়স ষাটের মতো হবে। ছোট করে ছাটা চুলগুলো ধূসর হয়ে এসেছে। চোখের রঙ তার পরে থাকা টাইয়ের মতনই নীলাভ। চেহারার লাল রঙ দেখে মনে হচ্ছে, গত কয়েক ঘন্টায় তিনি বিয়ার কিংবা ওয়াইনজাতীয় কিছু একটা পান করেছেন।
“তাই নাকি? আপনি কিন্তু তাকে আবার এটা বোলেন না, আমি আসলে ওবামাকে ভোট দিয়েছিলাম,” বললাম তাকে। সবাই হেসে উঠলো আমার কথা শুনে। “তিনিও আপনার অনেক সুনাম করেছেন,” এটুকু যোগ করলাম।
আসলেও করেছিলেন তিনি। আমি যখন গতকাল তাকে বলেছিলাম, সিআইএ’র পরিচালকের সাথে দেখা করতে চাই তখন তিনি ডিরেক্টর মহোদয় সম্পর্কে কেবল ভালো ভালো কথাই বলেছেন।
২০০৩ সালে সিআইএ’র নব্যগঠিত টেরোরিস্ট থ্রেট ইন্টেগ্রেশন সেন্টার’-এর নির্বাহী মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করার আগে লে’হাই বাইশ বছর সিআইএ’তে কর্মরত ছিলেন। ছয় বছর পরে ওবামা তাকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির উপদেষ্টা পদে বহাল করেন। এরপর ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট সুলিভান তাকে সিআইএ’র ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেন।
আমার কথার জবাবে লে’হাই একবার মাথা নাড়লেন শুধু।
“তো, এবার একটু খুলে বলবেন, কেন এখানে ডেকেছেন আমাদের?” সুলিভান জানতে চাইলেন।
গতরাতে আমি তাকে কিছু খুলে বলিনি। শুধু এটুকু বলেছিলাম, আমি সিআইএ’র প্রেসিডেন্টের সাথে দশ মিনিটের জন্যে দেখা করতে চাই।
“আমার মা,” বললাম তাকে।
তারা দুজনেই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।
“এলেনা জানে।”
গতকাল প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলার পরে আমি ইনগ্রিডকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম, সে যেন হোমল্যান্ড সিকিউরিটিতে তার পরিচিত যে লোকটা আছে তার মাধ্যমে আমার মার নামটা বের করার চেষ্টা করে। মানে, তার আসল নাম।
মনে হয় আমার সাথে দেখা করতে না পেরে ইনগ্রিড কিছুটা হলেও অপরাধবোধে ভুগছিল। সেজন্যেই আজ ঘুম থেকে উঠে আমার ফোনে একটা মেসেজ দেখি। আমার মা’র আসল নাম লেখা ছিল সেখানে।
দু-জনেই এ মুহূর্তে আমার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমার মা’র নাম যদি তাদের কাছে পরিচিত মনেও হয়, চেহারায় তার কোন প্রভাব দেখা গেল না।
“তিনি সিআইএ’র হয়ে কাজ করতেন,” আমি বললাম।
সিআইএ পরিচালকের দিকে একবার তাকালেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এ মুহূর্তে পরিচালকের চেহারা একদম পাথরের মতো অনুভূতিশূন্য।
“আপনি তাকে চিনতেন না?” জিজ্ঞেস করলাম।
“না,” আস্তে করে মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলেন তিনি।
সিআইএ’র ডিরেক্টর হওয়ার মানে এটা নয় যে, তিনি সেখানে কর্মরত সবাইকে চিনবেন। কিন্তু আমার মার মাথার ওপর তো চার নম্বর মহা বিপদের সংকেত ঝুলছিল। এটা তাকে অন্যদের তুলনায় আলাদা করে রাখার কথা।
“সিআইএ’তে হাজার হাজার লোক কাজ করে, আমার চিন্তার মাঝেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠলেন।
“তাদের মধ্যে কতজন গত দশদিন আগে খুন হয়েছে, বলুন তো?”
প্রেসিডেন্ট সোজা হয়ে বসলেন, “আপনি কি বলছেন এসব?”
“সোমবারে পটোম্যাক নদী থেকে মাথায় গুলিবিদ্ধ এক মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তার নাম এলেনা জানেভ। তিনি আমার মা।”
“আপনি এ কথা কিভাবে জানলেন?” ডিরেক্টর মহোদয় জিজ্ঞেস করলেন। তার গলা শুনে মনে হচ্ছে তিনি একটু বিরক্ত।
“গত পাঁচবছর ধরে আমি একটা সংস্থাকে টাকা দিয়ে আসছি আমার মার অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য। গত বুধবার আমাকে একটা ইমেইল পাঠায় তারা। সেখানে লেখা ছিল, পটোম্যাক নদী থেকে অজ্ঞাতনামা এক মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যার হাতের ছাপের সাথে আমার সরবরাহ করা হাতের ছাপ মিলে গেছে।”
কিন্তু এই উত্তর থেকে এটা জানা যাবে না, আমি কিভাবে মার আসল নাম আর কর্মপরিচয় বের করলাম। কিন্তু লে’হাই এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
“আমি দুঃখিত,” সুলিভান আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন।
আমি মাথা নাড়লাম, “তার সাথে অবশ্য আমার সেরকম ঘনিষ্ঠতা ছিল । আমার ছয় বছর বয়সেই তিনি চলে গিয়েছিলেন।”
“তবুও।”
আমি পরিচালকের দিকে তাকালাম। তিনি কি জন্মগতভাবেই এরকম চাপা স্বভাবের নাকি এমন একটি সংগঠনে তিনযুগ কাজ করার ফলাফল এটা?
“আপনার মা’র মৃত্যুর খবর শুনে আমি সত্যিই দুঃখিত,” অবশেষে বললেন তিনি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন?”
“হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তার ব্যাপারে চার নম্বরের মহা বিপদ সংকেত জারি করেছিল।”
প্রেসিডেন্ট সুলিভানের এসব সংকেত সম্পর্কে কম তথ্যই জানার কথা। কারণ হাজারো রকমের কাজে ব্যস্ত থাকেন তিনি। তবে লে’হাই তো ওবামার আমলে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির উপদেষ্টা ছিলেন, তিনি অবশ্যই জানবেন চার নম্বর মহা বিপদ সংকেত দিয়ে কি বোঝায়।
“চার নম্বর মহা বিপদ সংকেত জিনিসটা কি?” সুলিভান জিজ্ঞেস করলেন।
আমরা দুজনেই লে হাইয়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালাম। কিছুক্ষন পরে তিনি বললেন, “জাতির জন্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত যেসব সন্ত্রাসি তাদের বিরদ্ধে চার নম্বর মহা বিপদ সংকেত জারি করা হয়।”
“দাঁড়ান, আপনি বলছিলেন না, আপনার মা সিআইএ’র হয়ে কাজ করেন?” প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করলেন।
“সত্যিই কাজ করতেন।”
“তাহলে তার বিরুদ্ধে চার নম্বর মহা বিপদ সংকেত জারি করা হলো কেন?”
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পরে তিনি বুঝতে পারলেন, “ওহ্, এটার উত্তর জানার জন্যেই আপনি আমাদের তলব করেছেন।”
“আমি জানি না, আপনার হাতে কিভাবে এসব গোপন তথ্য এল। কিন্তু যে-ই এটা ফাঁস করে থাকুক না কেন, আগামিকালই তার চাকরি চলে যাবে,” কঠিন গলায় বললেন সিআইএ’র ডিরেক্টর। যাই হোক, আমার কাছে এখনও এসবের কোন মানে নেই। আর আজকের আগপর্যন্ত আমি এলেনা জানেভ নামে কারও কথা শুনিনি।”
তিনি মুখে হয়ত এই কথাগুলো বলছেন কিন্তু তার চোখ অন্য কথা বলছে। তার চোখের ভাষা দেখে বুঝতে পারছি, আমি অযাচিতভাবে এসবের ভেতরে নাক গলাচ্ছি। না জেনেই এমন একটা জায়গায় পা বাড়াচ্ছি যেখানে অপেক্ষা করছে মহাবিপদ।
“আপনি পুলিশের কাছে যাননি কেন?” সুলিভান জিজ্ঞেস করলেন।
“পুলিশকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির লোকজন আগেই রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে।”
“তাহলে আপনি কিভা-” এটুকু বলে থেমে গেলেন তিনি। “ইনগ্রিড।”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
প্রেসিডেন্ট ইনগ্রিডকে যে মেসেজটা পাঠিয়েছেন সেটার কথা মনে পড়ে গেলেও জোর করে ওটা ঝেরে ফেললাম মাথা থেকে।
“হোমল্যান্ডের সাথে আমার এখনও কিছু যোগাযোগ আছে, আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো এ ব্যাপারে। যদি আপনি চান, ডিরেক্টর মহোদয় বললেন।
তার মুখে এক ধরণের হাসি লেগে আছে। তিনি আমার মাকে চেনেন এবং এও জানেন, তাকে কেন খুন করা হয়েছে।
“ব্ল্যাক সাইট সম্পর্কে আপনারা কি কিছু জানেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
লে’হাই তার বিস্ময় গোপন করতে পারলেন না।
“এসবের সাথে এটার কি সম্পর্ক?” প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করলেন।
“আপনি তো জানেন, ওবামা এসব ব্ল্যাক সাইট বন্ধ করে দিয়েছিলেন।”
তিনি মাথা নাড়লেন।
“কিন্তু আমি যদি বলি, এগুলোর মধ্যে কয়েকটা এখনও বন্ধ হয়নি?”
“ফালতু কথা,” লে’হাই জোরে বলে উঠলেন।
আমি পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজের টুকরো বের করে প্রেসিডেন্টের হাতে দিলাম। এটাতে হাফিংটন পোস্ট-এর ফেব্রুয়ারি মাসের একটা রিপোর্ট প্রিন্ট করা আছে, যেখানে বলা আছে, কমপক্ষে বিশজন বন্দি এখনও নিখোঁজ।
প্রেসিডেন্ট সিটের ফাঁক থেকে একটা চশমা বের করে চোখে দিলেন। চশমার দু-মাথায় দুটো লাইট লাগানো আছে, যেটা কাগজের টুকরোটাকে আলোকিত করে রেখেছে পড়ার সুবিধার জন্যে।
‘বিশজন বন্দিকে কখনও গুয়ানতানামো বে-তে স্থানান্তর করা হয়নি, আমি বললাম। “তাদের অন্য কোথাও বন্দি করে রাখা হয়েছে। অন্তত যাদের সম্পর্কে জানা গেছে আর কি।”
“যাদের সম্পর্কে জানা গেছে বলে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন?” প্রেসিডেন্ট আর্টিকেল থেকে মুখ তুলে বললেন।
“২০০৬ সালে উত্তর-ইরাকে দু-জন আলকায়েদার জঙ্গি বোমা বানানোর সময় বিস্ফরণে মারা যায়। এর ছয় বছর পর আফগানিস্তানেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু এই চারজনের লাশ সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ওগুলো সনাক্তকরণের অযোগ্য।”
“তাতে কি? আপনার কি মনে হয়, তাদের মৃত্যুর ঘটনাটা সাজানো? তাদের অন্য কোথাও আটক করে রাখা হয়েছে?”
“অন্য কেউ না, সিআইএ-ই এই ঘটনা সাজিয়েছে। আর তাদের শুধু আটক করে রাখা হয়নি, তাদের উপর চালানো হচ্ছে নির্যাতন।”
“যথেষ্ট শুনেছি আমি,” লে’হাই মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “আমি জনি না, আপনি কোত্থেকে এসব আজগুবি তথ্য পেয়েছেন কিংবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন কিনা। আপনার মা’র পেশা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা তা আমি জানি না, কিন্তু এসব ব্ল্যাক সাইট বলে এখন কিছু নেই। ওবামা নিজে নির্দেশ দিয়ে ওগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আপনার কি ধারণা, আমি ব্যাপারটা নিয়ে খুশি হয়েছিলাম তখন? মোটেও না। আমরা এসব জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। তারা কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না। কিন্তু আমাদের তো এসব মানতে হয়। ব্যাপারটা গোলকিপার ছাড়াই ফুটবল ম্যাচ খেলার মতো অনেকটা। যেকোন মুহূর্তে একটা বল পোস্টে ঢুকে যাবে, কিন্তু এর ফলাফল কেবল একটা গোল হবে না। কি হবে জানেন? হাজার-হাজার নিরীহ আমেরিকানের মৃত্যু!
“কিন্তু একজন প্রেসিডেন্ট নিজে যখন নির্দেশ দেন, তখন আমাদের আর কিছু করার থাকে না। ছয় দিনের ভেতরে বাহান্নটা ব্ল্যাক সাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। ওখানকার বন্দিদেরকে গুয়ানতানামো বে কিংবা ওরকম কোন জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়। আপনি বিশজন বন্দির নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে যে আর্টিকেলটা পড়েছেন সেটা ডাহা মিথ্যা কথা। প্রত্যেক বন্দির আলাদা আলাদা হিসেব আছে আমাদের কাছে। আপনার কি মনে হয়, তাদের আমরা গোপন কোন মিশনে ব্যবহার করছি? তাদের নাম-ধাম পাল্টে দিয়েছি? নাকি তারা পালিয়ে গেছে কিন্তু আমরা কাউকে বলছি না?
“ইদানিং সবাই সবকিছু জানতে চায়। এমনকি যেটা তাদের জানা উচিত নয় সেটাও। আমরা এমন একটা সময়ে বসবাস করছি যেখানে সবকিছুর ভেতরেই রয়েছে স্বচ্ছতা। কোন তথ্য গোপন রাখার অধিকার নেই আমাদের। কিন্তু এসব তথ্য যখন ভুল মানুষের হাতে পড়ে তখন কি হয় বলুন তো? তাদের প্রাণ চলে যায়।”
তার শেষ কথাটা আমার হজম করতে কষ্ট হলো একটু-কিন্তু এসব তথ্য যখন ভুল মানুষের হাতে পড়ে তখন কি হয় বলুন তো? তাদের প্রাণ চলে যায়।
আমার মা’র মতো!
ডিরেক্টরসাহেব হয়তো সরাসরি বলেননি আমার মা’র মৃত্যুও একই কারনে ঘটেছে। কিন্তু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এর অর্থ দাঁড়ায় এটাই। একই সাথে আমাকেও হুমকি দিয়ে দিলেন, আমি যদি এ ব্যাপারে আরো নাক গলাই তাহলে পটোম্যাকে আমারো লাশ ভাসবে।
কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, আমার কাছে সময়ের দাম অন্যরকম আর এসব হুমকি-ধামকির কোন মূল্য নেই আমার কাছে।
“আমার মা মারা গেছেন কারণ তিনি এসব ব্ল্যাক সাইটগুলোর অবস্থান জানতেন,” বলতে বলতে সামনের দিকে ঝুঁকে গেলাম আমি। “আমি জানি
তিনি এসব তথ্য কিভাবে পেলেন। হয়ত তিনি নিজে এসব অপারেশনের সাথে জড়িতে ছিলেন কিংবা অন্য কোথাও থেকে তথ্য চুরি করেছেন। কিন্তু তিনি জানতেন। হয়ত তিনি এগুলো জনগণকে জানিয়ে দিতে চাইছিলেন কিংবা সিআইএ’কে ব্ল্যাক সাইটগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছিলেন। মনে হয় ওসব জায়গায় বর্বর কিছু ঘটতে দেখেছিলেন তিনি যেগুলো একটা পশুর সাথে করাও অনুচিত। মানুষের সাথে তো দূরের কথা। নিশ্চয়ই তিনি এসব জানার পর রাতে ঘুমাতে পারতেন না।”
“আপনি কি সিআইএ’কে দোষারোপ করতে চাচ্ছেন আপনার মা’র মৃত্যুর জন্যে?”
রিভিউটাতে মা আরেকটা তথ্য যোগ করে দিয়েছিলেন যেটা আমি পরে ধরতে পারি। প্রেসিডেন্টকে ফোন করার আগে শেষবারের মতো ওটা যখন পড়েছিলাম তখন ব্যাপারটা আমার নজরে আসে। তৃতীয় লাইনটা। স্মিথ আর জোনস দারুণ অভিনয় করেছে, আর ডিরেক্টর হেঘিলও ভালো কাজ দেখিয়েছেন।’
উইল স্মিথ আর টমি লি জোনস সম্পর্কে ইন্টারনেটে খোঁজ করার কথা তখন মনে হলেও পরিচালকের ব্যাপারে খোঁজ করার কথা আমার মাথায় আসেনি কেন যেন। পরে দেখি, সিনেমাটার আসল পরিচালকের নাম ব্যারি সনফিল্ড, হেঘিল নয়। তাহলে এই নাম দেয়া হলো কেন রিভিউয়ে?
ব্যাপারটা বুঝতে আমার কয়েক মুহূর্ত লেগেছিল। আসলে তিন মিনিট। কিন্তু ওটাই আমার জন্যে অনেক। তাছাড়া আমি সিআইএ সম্পর্কেও বেশ ঘাটাঘাটি করছিলাম তখন।
ইংরেজিতে হেঘিল (Heghil) শব্দটাকে একটু উল্টিয়ে পাল্টিয়ে লে’হাই (LeHigh) লেখা যায়। এটা একটা অ্যানাগ্রাম।
“আমি সিআইএ’কে দোষারোপ করছি না,” বলে থামলাম। এরপর হাত উঁচু করে সিআইএ’র ডিরেক্টরের দিকে নির্দেশ করলাম, “উনি…উনিই আমার মাকে হত্যা করেছেন।”
.
আমি আর প্রেসিডেন্ট এসইউভিটাকে চলে যেতে দেখলাম।
“আপনার কি মাথা ঠিক আছে?” সুলিভান চেঁচিয়ে বললেন। “সিআইএ’র ডিরেক্টরকে আপনি আপনার মা’র খুনি বলছেন? তা-ও তার মুখের উপরে!”
আমি যখন লে’হাইর মুখের উপর এ কথাগুলো বলছিলাম তখন তার একটুও ভাবান্তর হয়নি। তিনি প্রেসিডেন্টের দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকিয়েছিলেন যেন বলতে চাইছেন, এইসব গাঁজাখুরি কথা শোনার জন্য আপনি আমাকে নিয়ে এসেছেন? এরপর তিনি আস্তে করে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে যান।
“আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে, লে’হাই এ কাজটা করেছে? আমি তাকে বহু আগে থেকেই চিনি। তার ছেলের সাথে আমি হাইস্কুলে একসাথে পড়েছি। এজন্যেই তাকে আমি নিজে থেকে সিআইএ’র ডিরেক্টরের দায়িত্ব দিয়েছি দু-বছর আগে।”
“আমার কাছে প্রমাণ আছে,” একটু জোর দিয়েই কথাটা বললাম।
“কি!?”
তাকে আমার এটা বলার সাহস হলো না, আমার প্রমাণ হচ্ছে মেন ইন ব্ল্যাক সিনেমার একটা রিভিউ। তাহলে তিনি নিশ্চয়ই রেডকে নির্দেশ দিতেন আমার মুখ বরাবর জোরে একটা ঘুসি মারতে।
“আস্থা রাখুন আমার উপর,” এটুকুই বললাম কেবল।
“বেরিয়ে যান এখান থেকে,” তিনি রেগেমেগে বললেন।
আমি প্রতিবাদ করতে চাইলাম কিন্তু বলার মতো কিছু নেই আসলে।
“আমি আর আপনার কাছে কোনভাবে ঋণী নই।”
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে দরজাটা খুলে ফেললাম বের হওয়ার জন্যে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেলাম একটা কথা বলার জন্যে। কি মনে করে কাজটা করলাম আমি নিজেও জানি না। একটা উপকার করবেন আমার, ইনগ্রিডের কাছ থেকে দূরে থাকবেন।”
তিনি পেছনের দিকে হেলান দিয়ে বসলেন।
“হ্যাঁ, আমি আপনাদের সেদিনকার গোপন মিটিংয়ের কথা জানি।”
জবাবে তিনি হালকা মাথা দোলালেন শুধু। এটা দেখেই বুঝে নিলাম আজকে দ্বিতীয়বারের মতো তার আস্থা হারিয়েছি আমি।
“তাই? জানেন নাকি?” এটুকু বলে থামলেন একটু। “তাহলে তো এটাও নিশ্চয়ই জানেন, আমরা মিটিং করছিলাম আপনার জন্য ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্যে। আপনার হাতে শহরের একটা স্মারক চাবি তুলে দিতে চেয়েছিলাম আমি। আমাকে সাহায্য করার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ।”
আমি এত জোরে ঢোক গিলোম, পাশের গাছটা থেকে একটা পাখি উড়ে গেল।
“কিন্তু এখন ওসব ভুলে যেতে পারেন আপনি,” এই বলে দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি।
.
অধ্যায় ৯
“তুমি ভাবলে কি করে, আমি তোমাকে ধোঁকা দেব। তা-ও প্রেসিডেন্টের কারণে?!”
ফোনের ওপাশ থেকে ইনগ্রিডের হতাশ চেহারাটা কল্পনা করতে কোন বেগ পেতে হলো না আমার।
“আমি একটা গর্দভ।”
“আমার যদি পরকীয়া করতেই হতো তাহলে সেটা কোন সিনেমার নায়কের সাথেই করতাম, হুহ!” আমি জানি এটা বলার মাধ্যমে ও বোঝাতে চাইছে, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। এটা শুনে আমার একটু হলেও হাসি পাওয়ার কথা ছিল। ইনগ্রিডও নিশ্চয়ই এটাই চেয়েছিল মনে মনে। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমি ওকে কিংবা ওর ক্ষমা কোনটারই যোগ্য নই।
গত দশ মিনিটে আমি ইনগ্রিডকে সবকিছু খুলে বলেছি। রিভিউটা সম্পর্কে, ব্ল্যাক সাইটগুলো সম্পর্কে আর সিআইএ পরিচালকের সাথে দেখা করে মুখের উপর খুনি বলা-কোন কিছুই বাদ দেইনি।
“আমার অবশ্য তোমাকে মিটিংটার ব্যাপারে বলা উচিত ছিল,” ইনগ্রিড বলল।
“না, তোমার মিটিংটার কথা গোপন করাই ঠিক ছিল। তোমরা তো আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে। তোমার ফোনটা ধরা আমার একদমই উচিত হয়নি।”
“আসলেই!” একটু চড়া গলায় বলল সে। “আচ্ছা, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি দুঃখিত।”
“দুঃখিত হওয়ার মতো সময় নেই তোমার কাছে। এরপর থেকে আমাকে আরেকটু বেশি বিশ্বাস কোরো, কেমন?”
“ঠিক আছে।”
“তাহলে শহরের চাবিটা পাচ্ছো না তুমি?”
“মনে তো হয় না।”
“ব্যাপার না। এই ওয়াশিংটনের চাবি দিয়ে রাত তিনটায় কীই বা করতে তুমি, বলো? সারা রাত খোলা থাকে এমন খাবারের দোকানে যাওয়া ছাড়া?”
“আসলে আমি ঠিক নিশ্চিত নই, এই শহরের চাবি জিনিসটা দিয়ে লোকে কী করে।”
“উনিও আসলে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখেননি। তোমার জন্য হোয়াইট হাউসে একটা পার্টি দিতে চেয়েছিলেন আর কি। তার জন্যেই এই উপলক্ষটা বানিয়েছিলেন।”
“সেটা হলে ভালোই হতো কিন্তু,” আমি বললাম।
“আচ্ছা যাও, আমি তোমাকে আমার বিশেষ চাবিটা দেব নে।”
আমি হাসলাম। “তাতে লাভটা কি হবে?”
জবাবে ইনগ্রিড যেটা বলল সেটা কল্পনা করেই খুশি হয়ে উঠলাম।
“আচ্ছা, এখন রাখি। আমাকে আবার দূরবীন দিয়ে একটা বাসার উপর নজর রাখতে হবে এখন।”
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম।
তিনটা ছাপ্পান্ন বাজে।
গত একসপ্তাহের মধ্যে এই প্রথম আমরা ফোনে কথা বললাম। খুব ভালো লাগছে ওর গলাটা শুনেতে পেয়ে। ফোন ছাড়তে ইচ্ছে করছে না একদমই।
“আশা করি এই কেসটা দু-দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তাহলে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠানটা করতে পারবো,” ইনগ্রিড বলল।
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
“গুডনাইট, ঘুমকুমার।”
“গুডনাইট।”
দরজা খুলে বাসায় ঢুকে গেলাম। মন খারাপ হওয়ার মতো বেশ কয়েকটা কারণ আছে এখন আমার হাতে। দেশের দু-জন গণ্যমান্য ব্যক্তির সামনে আমি আজকে নিজেকে গর্দভ প্রমাণ করেছি। একজনকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করেছি আর আরেকজনের উপর আমার প্রেমিকার সাথে লাইন মারার অভিযোগ এনেছি। অথচ যত সময় যাচ্ছে ও দুটো অভিযোগ আমার নিজের কাছেই হাস্যকর বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু এসব মন খারাপ করার মতো ঘটনাও আমার মুখের হাসি মুছতে পারলো না।
.
“আরে! কি হয়েছে?!”
ল্যাসি তার নখ দিয়ে আমার মুখে ক্রমাগত খামচি দিচ্ছে। উঠে বসলাম।
“কি হয়েছে তোর?”
ল্যাসির গোঙানোর আওয়াজ পেলাম।
“শরীর খারাপ লাগছে?”
আলো জ্বালিয়ে ওর দিকে তাকালাম। ওর লোমগুলো শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। দেখে মনে হচ্ছে গত বিশ ঘন্টা যাবত সে অনবরত ঘামছে। ওর হলুদ চোখজোড়া লাল টক টকে।
“শিট!”
আমি লাফিয়ে উঠলাম।
“কি হয়েছে? পেটে সমস্যা?”
আমি ওর পেটে হাত বোলালাম। ও কেঁপে উঠলো। “কি খেয়েছিলি?”
বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরে দৌড় লাগালাম। কালকে ইনগ্রিডের সাথে কথা সেরে বাসায় এসে ল্যাসিকে সোফার উপর থেকে নিয়ে সরাসরি বিছানায় গিয়ে উঠেছি। ঘুমানোর আগে বেশ খানিকটা সময় ওর পেটে হাত বুলিয়ে দিয়েছি। তখন তো ঠিকই ছিল সবকিছু।
আশেপাশে উল্টাপাল্টা কিছু খোঁজার চেষ্টা করলাম যেটাতে ল্যাসি মুখ দিতে পারে। ও কি গ্লাস ক্লিনার লিকুইডটা খেয়েছে নাকি? ইসাবেল তার এসব জিনিসপত্র ক্যাবিনেটেই রাখে, যেটা এখন বন্ধ। কিন্তু বলা যায় না, ওকে দেখার মতো গত তেইশঘন্টায় কেউ ছিল না। যেকোন কিছু হতে পারে। হয়ত সোফা থেকে লাফিয়ে পড়ার সময় পেটের উপর বেকায়দাভাবে পড়ে ব্যথা পেয়েছে।
ওকে আগেও একবার পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল। সেবার একটা বেজির সাথে মারামারি করেছিল সে। সৌভাগ্যবশত ওটা মাত্র একমাইল দূরে এখান থেকে।
আমি তাড়াতাড়ি শোবার ঘরে গিয়ে একটা ব্যাগ বের করে ল্যাসিকেও বিছানা থেকে তুলে নিলাম। “সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করিস না।”
আমার কাছে সবকিছু কেমন জানি সেঁজাভুর মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
ভেসপার চাবিটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। ভেসপাটা দুটো গাড়ির মাঝে পার্ক করে রাখা আছে। ল্যাসিকে ব্যাগটার ভেতরে ঢুকিয়ে সেটা পিঠে ঝুলিয়ে নিলাম।
“দশ মিনিট লাগবে।”
রওনা দিলাম আমরা। দুই ব্লক যেতে না যেতেই ল্যাসি আমার পিঠের ব্যাগের ভেতরে পাগলের মতো লাফালাফি করতে লাগলো। ভেসপাটা রাস্তার পাশে নিয়ে থামালাম। মনে হচ্ছে যেন ব্যাগটা ছিঁড়ে একটা ড্রাগনের বাচ্চা বেরিয়ে আসবে। ব্যাগের চেইনটা ভোলামাত্র ল্যাসি থেমে গেল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো সে।
“আরে, তুই ঠিক হয়ে যাবি তো। আমাদের আর দুই মিনিট লাগবে ওখানে যেতে।”
মিয়াও।
“কি?”
মিয়াও।
“তোর শরীর খারাপ না?”
মিয়াও।
“তুই এতক্ষণ ভান করছিলি? কিন্তু কে-”
মিয়াও।
“আমাকে বাসা থেকে বের করার চেষ্টা করছিলি? কেন?”
মিয়াও।
“দু-জন লোক এসেছিল?”
মিয়াও।
“আসলেই?”
এরপর ল্যাসি বলল কালকের ঘটনা। ও মহা আরামে ঘুমাচ্ছিল, এমন সময় দরজাটা হঠাৎ খুলে যায়। প্রথমে ও ভেবেছিল বাবা কিংবা ইনগ্রিড এসেছে, কিন্তু যে দুজন লোক ঢোকে ভেতরে তাদের ও চেনে না। তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছিল ও কিন্তু ওরা নাকি বেচারাকে পাত্তাই দেয়নি। এরপরের বিশ মিনিট ল্যাসি লুকিয়ে ছিল, যতক্ষন লোকগুলো ভেতরে ছিল আর কি।
“শালারা আমার বাসায় আড়িপাতার যন্ত্র লাগাতে এসেছিল!” আমি বললাম।
ব্যাপারটা নিয়ে আমার রাগ করার কথা কিন্তু হলো বরং উল্টোটা। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ একমাত্র সিআইএ-ই পারে আমার বাসায় আড়ি পাততে। এটা যদি হয়ে থাকে তাহলে সিআইএ ডিরেক্টর লে’হাই এর জন্য দায়ি। কারণ কোন ভালো মানুষ অন্য কারো বাসায় আড়ি পাততে আসবে না।
সে ভয় পেয়েছে। তার মানে আমি সঠিক পথেই এগোচ্ছি। মা আমাকে যে তথ্যগুলো পাঠিয়েছেন সেগুলো সত্য।
মিয়াও।
“তাই?”
মিয়াও।
“কোন গাড়িটা?”
মিয়াও।
কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে। ল্যাসিকে ব্যাগে ভরে নিয়ে আবার রওনা দিলাম। আমার বাসায় যে-ই আড়িপাতার যন্ত্র বসাক না কেন তার ধারণা, ল্যাসি এখন অসুস্থ। আর তারা এখন আবার আমার পিছুও নিয়েছে।
পাঁচমিনিট পরে পশু চিকিৎসকের পার্কিংলটে ভেসপাটা পার্ক করলাম।
এখন বাজে তিনটা তের।
রিসিপশনে আইপ্যাডে সাইন করে অপেক্ষা করার চেয়ারগুলোর একটাতে বসলাম আমি। আমার আগে আরো দু-জন আছে। পঞ্চাশোর্ধ এক লোক একটা কুকুরকে কোলে নিয়ে বসে আছে। কুকুর আমাকে দেখেই ডেকে উঠলো।
আমি ল্যাসিকে বের করে কোলের উপর রাখলাম। ব্যাটা বেশ ভালোমতই অসুস্থ হবার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে।
আমি ফোনটা বের করলাম। দুটো মেসেজ এসে জমা হয়ে আছে। প্রথম মেসেজে লেখা, আমার কথা তার অনেক মনে পড়ছে। দ্বিতীয়টাতে লেখা :
তোমার মা কি তোমাকে অন্য কিছু পাঠিয়েছিলেন?
আমি উত্তরে লিখলাম :
ল্যাসি অসুস্থ। ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছি। আমার মা’র কথা আমি সেভাবেই ভুলে যাবো যেভাবে তিনি আমার কথা ভুলে গিয়েছিলেন।
সাথে সাথেই উত্তর আসলো :
আচ্ছা। তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও না কেন, আমি তোমার সাথে আছি। আশা করি ল্যাসি ঠিক হয়ে যাবে।
হুম। কালকে কথা হবে।
কিন্তু আমার মাথায় এখন ঘুরছে অন্য একটা কথা। আমার মা কি আমাকে অন্য কিছু পাঠিয়েছিলেন? ডিভিডিটার আগে যদি অন্য কিছু পাঠিয়ে থাকেন? তিনি নিশ্চয়ই জানতেন, তার মাথার উপর বিপদ সংকেত ঝুলছে। হাতে খুবই অল্প সময়। তিনি কি আগেও কিছু পাঠিয়েছেন যেটা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে?
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, ইসাবেল কি এমন কোন প্যাকেজ কোনদিন খুলেছিল কিনা যেটা আমি অর্ডার দেইনি। মা কি আমাজন ব্যবহার করেছিলেন নাকি অন্য কোনভাবে কাজটা সেরেছিলেন তিনি? তাকে অবশ্য বেনামে কাজটা করতে হতো। অন্য কি উপায়ে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন?
না, তিনি একদমই উপায় খুঁজে না পেয়ে কাজটা করেছিলেন মনে হয়। আমি দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। তিনি তার শত্রুদের কাছ থেকে লুকিয়ে তার মোবাইলে রিভিউটা লিখছেন। এটা একদমই নিরুপায় হয়ে অবস্থান সম্পর্কে। কোন প্রমাণ।
রিভিউটার প্রতিটি শব্দ আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আমি নিজে নিজেই
আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের প্রথম ডেটে এই সিনেমাটা হদেখেছিলাম আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে। (আমাদের। ভালোবাসাটা যাকে বলে কিনা লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’)। এরপর থেকে আমাদের প্রতি অ্যানিভার্সেরিতে আমরা সিনেমাটা দেখি, আগস্টের ৫ তারিখে। স্মিথ আর জোনস দারুণ অভিনয় করেছে আর ডিরেক্টর হেঘিলও ভালো কাজ দেখিয়েছেন। আমার নয় বছর বয়সি মেয়ে এপ্রিলেরও দারুণ পছন্দ সিনেমাটা। সে পারলে এটাকে ১২ রেটিং দেবে।
পাঁচটা বাক্য।
আমি আরো দু-বার বললাম কথাগুলো। নাহ, আর কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে।
কিন্তু কিছু একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে।
রিভিউ’র টাইটেলটা!
একটা টাইটেল ছিল, তাই না?
এক মিনিট লাগলো আমার সেটা মাথায় আসতে।
This movie rocks!
এতক্ষণ লাগলো আমার ব্যাপারটা ধরতে?!
Rocks!
যারা আমার বাসায় আড়িপাতার ব্যবস্থা করেছে তাদের পক্ষে খুব ভালোভাবেই সম্ভব আমার ফোনেও আড়িপাতার ব্যবস্থা করা। তাই এটা দিয়ে ইন্টারনেটে কিছু সার্চ দেয়া যাবে না। রিসিপশন থেকে সাইন করার আইপ্যাডটা হাতে নিয়ে হোমপেজ থেকে বের হয়ে গ্লোবাল জিওলোজিস্ট আনলিমিটেড (জিজিইউ) লিখে সার্চ দিলাম।
প্রথমেই কোম্পানির ওয়েবসাইটের ঠিকানা আসল। কিন্তু আমার লক্ষ্য এটা নয়। এত বড় একটা ওয়েবসাইট অদলবদল করা আমার মা’র পক্ষে সম্ভব হবে না।
কিন্তু উইকিপিডিয়াতে তো সম্ভব।
উইকিপিডিয়াতে জিজিইউ কোম্পানির পেজটা খুললাম। আমি এটা আগেও পড়েছি। একদম নিচের দিকে তাদের কোম্পানির যেখানে যেখানে কাজ চলে তার অবস্থান লেখা থাকে।
পঁচিশটা অবস্থানের কথা বলা আছে সেখানে।
শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন চব্বিশটা ছিল। পঁচিশতম অবস্থানটার কাছে ছোট করে একটা সংখ্যা লেখা আছে। রেফারেন্স সংখ্যা।
স্ক্রল করে নিচে গিয়ে রেফারেন্সটা পড়লাম। ‘এস.বি।’
মানে স্যালি বিনস।
কোন সন্দেহ নেই এই ব্যাপারে। ল্যাসির দিকে তাকিয়ে বললাম, “গ্রিনল্যান্ড?”
ভূগোল নিয়ে আমার ধারণা কম। কিন্তু এটা জানি গ্রিনল্যান্ড একদম উত্তর-মেরুর কাছাকাছি, কানাডার পূর্বে অবস্থিত। ওটা নিশ্চয়ই বসবাসের অযোগ্য, কিন্তু গোপন জেলখানার জন্যে একদম আদর্শ একটি জায়গা।
“মি. বিনস, আইপ্যাডটা শুধুমাত্র সাইন করার জন্যে রাখা হয়েছে।”
রিসেপশনিস্টকে একদম পাত্তা দিলাম না।
সিআইএ’র জন্যে এটা একটা আদর্শ জায়গা কয়েদিদের লুকিয়ে রেখে নিপীড়ন চালানোর জন্যে।
ব্যাপারটা যদি অন্য কোনও জায়গা নিয়ে হতো তাহলে হয়ত কিছু করা যেত। যেমন ধরুন রোমানিয়াতে আপনার পরিচিত কেউ হারিয়ে গেলে আপনি কিন্তু টাকা খরচ করে তাকে বের করতে পারবেন। অন্তত চেষ্টা তো করতেই পারবেন। কিন্তু গ্রিনল্যান্ডে? হাজার হাজার ডলার খরচ করেও কিছুই করতে পারবেন না।
আর এসব ঘটনা যদি গ্রিনল্যান্ডেই ঘটে থাকে তাহলে মা কি চাচ্ছিলেন আমার কাছ থেকে? তার উপর ঘটনাটার সাথে হোমল্যান্ড সিকিউরিটিসও জড়িত।
অবস্থানগুলো লেখা আছে যেখানে সেখানে গেলাম আবার স্ক্রল করে।
ওখানে লেখা : Greenland Drill site: 38.9445718138941 N, 77.70492553710938W ।
লেখাটা দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো। গ্রিনল্যান্ড তো অনেক ওপরে হওয়ার কথা। অন্তত আটত্রিশ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের হবার কথা নয়।
বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফাতে লাগলো।
একটা জিপিএস ওয়েবসাইট বের করে সেখানে দ্রাঘিমাংশ আর অক্ষাংশ দুটো বসালাম। উত্তর বের হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই।
জায়গাটা গ্রিনল্যান্ড নয়।
ভার্জিনিয়া।
*
অধ্যায় ১০
দরজাটা খুলে গেল। বাবার পরনে একটা বক্সার আর সাদা রঙের টি-শার্ট। দেখে মনে হচ্ছে খুব কষ্ট করে চোখদুটো খুলে রেখেছেন।
“তুমি এখন এখা-”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
এখন বাজে তিনটা একচল্লিশ।
ঢোকামাত্র মারডক তীরবেগে ছুটে এসে আমার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা ধরে টানাটানি করতে লাগলো। নিশ্চয়ই ল্যাসির গন্ধ পেয়েছে ও। বাবা চেষ্টা করলেন ওকে সামলানোর জন্যে কিন্তু মারডকের গায়ে একটু বেশিই শক্তি। ওর ঠেলার চোটে পড়েই গেলাম আমি। ব্যাগটাতে ক্রমাগত থাবা চালাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরেই একটা বড়সড় ছিদ্র দেখা গেল ওটাতে। ল্যাসি বের হয়ে আসলো ওখান দিয়ে।
মিশন কমপ্লিট।
ল্যাসিকে আগাগোড়া চেটে স্বাগত জানালো মারডক। এরপরেই ওকে নিয়ে পেছনের দরজাটা দিয়ে বের হয়ে গেল। ওখানে সাজানো গোছানো ছোট একটা উঠোন আছে।
“আপনার শখের ফুলগুলোকে বিদায় জানানোর সময় এসেছে।”
“বহু আগেই ওগুলোকে বিদায় জানিয়েছি আমি।”
হঠাৎ করেই একটা কথা বুঝতে পারলাম। গত নয় বছরের মধ্যে এই প্রথম এ বাড়িতে পা পড়ল আমার। অথচ আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। এখানেই।
গত কয়েক বছর ধরে বাবা প্রতি সপ্তাহের বুধবার আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তার মানে বছরে বাহান্নবার। সাথে ক্রিসমাস কিংবা থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের ছুটিছাটাসহ আরো কয়েকদিন। আমার একঘন্টা আমার কাছে অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার মানে এটা নয়, এখানে আমার পদধূলি পড়বে না।
“এখানে কি করতে এসেছো, হেনরি?” দরজাটা বন্ধ করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন বাবা। “বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেটার কাহিনী কি?”
ল্যাসি আর আমি চিকিৎসকের সাথে দেখা না করেই বের হয়ে গিয়েছিলাম ওখান থেকে। তারপর আমার বাসার সামনে আমরা গিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু সেখানে না ঢুকে ডানদিকে মোড় নিয়ে উত্তরদিকের রাস্তাটা ধরে এগুতে শুরু করি। কয়েক মিনিট পরেই একটা কালো রঙের গাড়ি দেখতে পাই পেছনে। কোনরকম রাখঢাক ছাড়াই আমাদের পিছু নেয়া শুরু করে ওটা। এরপরের দশ মিনিট জোঁকের মতো লেগে থাকে আমার ভেসপার পেছন পেছন। আমি যখন এই বাসার সামনে পার্ক করছিলাম তখনও ছিল ওটা।
“গাড়িটাতে সিআইএ’র লোক আছে, তারা আমার পিছু নিয়েছে। আর আমি এখানে এসেছি কারণ তারা আমার বাসায় আড়িপাতার ব্যবস্থা করেছে।”
বাবা ভ্রূজোড়া উঁচু হয়ে গেল। “তারা কি করেছে?”
আমি বললাম তাকে।
“কিন্তু এরকম একটা কাজ করতে যাবে কেন তারা?”
আমি তাকে সূত্রগুলো এবং প্রেসিডেন্ট আর ডিরেক্টর লে’হাইর সাথে আমার মিটিংয়ের কথা খুলে বললাম। “তিনিই মা’কে খুন করেছেন কিংবা করিয়েছেন,” এই বলে শেষ করলাম।
“কেন?”
“কারণ মা গোপন ব্ল্যাক সাইটগুলোর অবস্থান জানতেন।”
“তারা ওখানে সন্ত্রাসিদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছিল?”
“হ্যাঁ, আপনি কি বুঝতে পারছেন, বাইরের মানুষের কাছে যদি এটা ফাঁস হয় তাহলে কি ঘটবে?”
“সিআইএ চিরতরের জন্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
“তাহলেই বুঝুন, কেন তারা মাকে রাস্তা থেকে সরাতে চাইবে না?”
বাবা আর নিতে পারলেন না এসব কথা। লিভিংরুমে একটা চেয়ারের উপর চুপচাপ বসে পড়লেন।
আমার ফোনের দিকে তাকালাম। এখন তিনটা চুয়াল্লিশ বাজে। আমার কাছে আর মোল মিনিট আছে। এই ষোল মিনিটে আমাকে অনেক কিছু করতে হবে।
“আপনার কাছে কি এখনও জিপিএসটা আছে?”
আমার বাবা আগে জিওকোচিং নামের অদ্ভুত একটা খেলার সাথে যুক্ত ছিলেন। এ খেলায় পুরো আমেরিকা জুড়ে অনেক মানুষ কিছু কিছু জিনিস এরপর অন্যেরা সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। যে সবার আগে জিনিসটা খুঁজে পায় সে-ই জয়ি হয়।
বাবাও এই খেলায় অংশ নিয়েছিলেন, কয়েকবার জিতেছিলেন। কিন্তু তার একটা বদভ্যাস হচ্ছে, কোন জিনিসের প্রতি খুব তাড়াতাড়িই আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। তাই এই খেলাটাও একসময় বোরিং লাগতে শুরু করে তার কাছে, অন্য কিছু নিয়ে মেতে ওঠেন তিনি।
“থাকতে পারে। বেজমেন্টে গিয়ে খুঁজে দেখতে হবে। কিন্তু কেন? তুমি নিশ্চয়ই এখন ঐ জায়াগাটা যেতে চাইছো না?”
“জায়গাটা এখানেই, ভার্জিনিয়াতে।”
“ল্যাংলিতে?”
“না, সিআইএ হেডকোয়ার্টার থেকে তিরিশ মাইল পশ্চিমে ওটা।”
“আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।”
“না, আপনি এখানেই থাকবেন।”
আমি তাকে আমার পরিকল্পনা খুলে বললাম।
তার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো না, আমি তার কাছে বিশেষ কোনকিছুর জন্যে আব্দার করছি। চশমাটা নাকের ওপরে ঠেলে দিয়ে বললেন, “তুমি কি নিশ্চিত এ ব্যাপারে?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে তাহলে। চল, জিপিএসটা খুঁজে বের করি।”
আমি তার পেছন পেছন নিচে গেলাম।
যদিও বাবার বাসার ওপরের তলাটা দেখে মনে হবে তিনি খুব সাজানো গোছানো কিন্তু বেজমেন্টের চিত্র একদমই উল্টো। এখানে সবকিছু ঠেসে ঠেসে রাখেন তিনি। তার বাতিল শখের জিনিসপত্রগুলোর শেষ ঠিকানা হয় এখানেই।
নিচে নেমে আলমারি থেকে একটা ল্যাম্প বের করে জ্বালালেন তিনি। আলোকিত হয়ে উঠলো চারপাশ। দেখে মনে হচ্ছে জঞ্জালের কারখানা। কত প্রকারের জিনিস যে রয়েছে এখানে তার ইয়ত্তা নেই। একটা পিয়ানো, জাদু দেখানোর জিনিসপত্র, ঘুড়ি, কোনকিছুরই অভাব নেই। তিনি এখানে সেখানে উঁকি দিতে লাগলেন জিনিসটার আশায়।
“খুঁজে পাবেন তো ওটা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“পেয়ে গেছি!” পাঁচমিনিট পরে একটা জঞ্জালের স্তূপের পাশ থেকে জবাব দিলেন তিনি। কালো রঙের ছোট একটা যন্ত্র বের করে আনলেন ওখান থেকে। এখনকার আমলে যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলোর তুলনায় এটার আকার অবশ্য প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু খুব একটা ব্যবহার করা হয়নি জিনিসটা, তাই আশা করা যাচ্ছে কাজ করবে।
হাতে নিয়ে পাওয়ার বাটনে চাপ দিলাম একবার, কিছুই হলো না।
“চিন্তার কিছু নেই। এখানেই কোথাও ব্যাটারিগুলো আছে,” এই বলে আবারো খুঁজতে শুরু করলেন তিনি।
আমি একদম কোনার দেয়ালটা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছি। একটা নীল রঙের তেরপল দিয়ে কী যেন ঢেকে রাখা হয়েছে এখানে। চাদরটার এক কোনা উঁচু করে ভেতরে উঁকি দিলাম। তিনটা ছোট কালো বাক্স। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে না এগুলো বাবার।
একটা বাক্স বের করে ঢাকনা খুলে ফেললাম।
“পেয়ে গেছি!” ওপাশ থেকে বললেন বাবা।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম তার দিকে। বাক্সে যে জিনিসগুলো আছে সেগুলো–হয় পরে ব্যবহার করা যাবে।
এক মিনিট পরে আমি উপরতলায় উঠে গেলাম। আমার হাতের জিপিএসটাতে এরমধ্যেই দরকারি ডাটা ইনপুট করে দিয়েছি।
এখন সময় তিনটা বেজে পঞ্চাশ।
.
আমার ঘরের সবকিছু যেমনটা শেষবার দেখে গিয়েছিলাম সেরকমই আছে।
কেউ যদি হঠাৎ করে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে তাহলে নিশ্চিত তার কাছে মনে হবে, এখানে যে বসবাস করে তার এখনও মানসিক পরিপকৃতা আসেনি। কারণ এখানকার অর্ধেক জিনিসপত্রে এখনও আমার কিশোর বয়সের ছাপ রয়ে গেছে। আপনার জন্যে যখন প্রতিদিন একঘন্টা করে বরাদ্দ থাকবে তখন আপনাকে অবশ্যই সবকিছু বেছে বেছে করতে বা দেখতে হবে। খেলাধূলা করা, কার্টুন দেখা অথবা মেয়েদের সাথে টাংকি মারা-এসব থেকে কিন্তু আমাকে যেকোন একটিই বেছে নিতে হয়েছে সবসময়।
কিন্তু এক্ষেত্রেও সমস্যা। কার্টুন বেশি বাচ্চা বয়সিদের জন্যে, খেলাধূলা করার মতো লম্বা সময় আমার কাছে নেই আর মেয়েদের কথা না-হয় বাদই দিলাম, আপনারাই বুঝে নিন। কিন্তু গান শুনতে সমস্যা হয়নি। কারণ যেকোন কাজ করতে করতে গান শোনা যায়। এই ধরুন স্টক মার্কেটের কাজ করছি, ব্যায়াম করছি অথবা কোন মেয়েকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছি আর সেই সাথে গান বাজছে স্পিকারে।
আমার পছন্দের শিল্পীর নাম প্রিন্স। কারণ হাজারো গানের ভিড়ে ওর গানগুলো একটু অন্যরকম আর বৈচিত্রও অনেক। ওর গানের কথাগুলো কিভাবে যেন আমার জীবনের সাথেও মিলে যায়। গলাটাও বেশ। ওর পার্পল রেইন গানটা অদ্ভুত সুন্দর।
তাই আমার ঘরের দেয়ালগুলো প্রিন্সের পোস্টারে ভর্তি। এছাড়াও আছে অনেকগুলো হোয়াইটবোর্ড। এই হোয়াইটবোর্ডগুলো স্টক মার্কেটে আমার প্রথম দিনগুলোর সাক্ষি। কারণ তখন আমি যেসব কোম্পানির শেয়ার কিনতাম সেগুলোর তথ্য নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করতাম, সেগুলো আঁকাঝোঁকা করতাম ওখানে। ইন্টারনেট ঘাটলেই কিন্তু ওসব পাওয়া যেত, তা সত্ত্বেও আমি নিজের হাতে সবকিছু করতাম। এতে করে নিজেকে একটু হলেও গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। প্রথম পাঁচবছরে কিন্তু আমার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এমনকি বাবাকে তার বাড়িটা দ্বিতীয়বারের মতো মর্টগেজ রাখতে হয়েছিল আমাকে সাহায্য করার জন্যে। অবশ্য ধীরে ধীরে সে ধাক্কা কাটিয়ে উঠি আমি। একসময় বাবার ঐ মর্টগেজসহ প্রথম মর্টগেজের টাকাটাও আমি চুকিয়ে দেই। সেবার বাবাকে বলে দেই-উনাকে যদি আর কখনও এসব মর্টগেজের জন্যে দৌড়াদোড়ি করতে দেখি তাহলে ওনার একদিন কি আমার একদিন। কিন্তু টাকা দিয়ে কখনোই বাবার ঋণ শোধ করতে পারবো না আমি। আমার জেগে থাকার প্রতিটি মিনিট তিনি আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখতেন। আর এসবের জন্যেই আজকের এই আমি।
তবে আমি কিন্তু প্রিন্সের পোস্টারগুলো দেখার জন্যে কিংবা স্মৃতিচারন করার জন্যে এখন আমার ঘরে আসিনি। আমি এসেছি একটা জুতোর বাক্সের জন্যে, যেটা এ মুহূর্তে অবস্থান করছে আমার আলমারির পেছনের দিকে।
বিছানার উপরে বসে আস্তে আস্তে ঢাকনাটা খুলে আপনমনেই হেসে উঠলাম। বিশবছর আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল, যেদিন বাবা আমার হাতে এই বাক্সটা তুলে দিয়েছিলেন। আমার হাতে এটা দিতে দিতে তিনি বলেছিলেন, “প্রত্যেক বাচ্চার কাছেই এই জিনিসটা থাকা উচিত। পটকা আর আতশবাজি ভর্তি একটা জুতোর বাক্স।”
.
“ল্যাসি! মারডক! মনোযোগ দে তোরা!”
আমি ঘড়ির দিকে একবার তাকালাম।
তিনটা তেপ্পান্ন।
হাত দিয়েই হোয়াইটবোর্ডটা মুছে দিলাম। খানিকটা লাল রঙ ভরে গেল ওখানে। একটা পুরনো মার্কার তুলে নিলাম এবার।
বাবা বিছানার উপরে এক পা তুলে বসে আছেন এ মুহূর্তে। মারডক দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই, আর ল্যাসি বসে আছে ওর পিঠে। কিন্তু ল্যাসির দৃষ্টি আমার দিকে নয় বরং তার সমস্ত মনোযোগ এখন মারডকের কান চিবানোর দিকে নিবদ্ধ। অন্যদিকে মারডক চিবুচ্ছে ল্যাসির লেজ।
“কিরে!!”
দু-জনের মনোযোগই এবার আমার দিকে।
“কাজটা ঠিকভাবে করার জন্যে আমরা কেবল একটা সুযোগই পাবো।” একটু থেমে হোয়াইটবোর্ডে একে বললাম, “এটা হচ্ছে আমাদের বাসা। আর এটা হচ্ছে রাস্তার ওপাশের গাড়িটা।”
মিয়াও।
“তুই কোথায় মানে? তুই বাড়ির ভেতরে।”
মিয়াও।
“তোকেও আঁকতে হবে? আচ্ছা,” কোনমতে একটা বিড়ালের চেহারা এঁকে দিলাম।
মিয়াও।
“মারডককেও আঁকতে হবে? জানতাম,” কাঠির মতো একটা কুকুরও আঁকলাম। “আর এই যে, আমি আর বাবা।”
মিয়াও।
“আমাকে এত বড় করে আঁকলাম কেন? কারণ এই হতচ্ছাড়া বিড়ালটার সব হেপা আমাকেই সামলাতে হয়।” জোরে একবার শ্বাস ছাড়লাম। “আচ্ছা, আমি গ্যারেজের গেটটা খোলার সাথে সাথে ল্যাসি, তুই এখানে আর মারডক, তুই এখানে গিয়ে দাঁড়াবি,” হোয়াইটবোর্ডে গাড়িটার সামনে। আর পেছনে একটা করে এক্স চিহ্ন এঁকে ওদের দিকে তাকালাম। “তোরা যদি গাড়িটার সামনে-পেছনে গিয়ে দাঁড়াস তাহলে ওরা আর নড়ার সাহস পাবে না। পারবি না এটা করতে? ল্যাসি কি বলিস?”
মিয়াও।
“সাব্বাশ! মারডক?”
জবাবে মারডক একবার হাই তুললো কেবল।
“আমি এটাকে হ্যাঁ বলে ধরে নিচ্ছি, ঠিক আছে?”
আরেকটা লাইন আঁকলাম বোর্ডে, “বাবা, এটা আপনি।”
“ঠিক আছে।”
ঘড়ির দিকে তাকালাম।
তিনটা পঞ্চান্ন।
“সবাই রেডি? গ্যারেজের গেট খুলতে আর দুই মিনিট।”
.
গ্যারেজের দরজা খোলার সুইচটা চেপে দিলাম।
দরজাটা অর্ধেক খুলতেই ল্যাসি আর মারডক দু-জনেই ছুটে বের হয়ে গেল। যখন সেটা পুরোপুরি খুলে গেল তখন দেখলাম, ল্যাসি গাড়িটার পাঁচফুট পেছনে আর মারডক পাঁচফুট সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
বাক্সগুলো থেকে একটা বের করে নিয়ে সেটার সুতোতে আগুন দিয়ে দিলাম। এটার সুতোটা বেশ লম্বা, পুরোপুরি জ্বলতে বেশ সময় লাগবে। এরপর বাক্সটা আমার স্কেটবোর্ডের ওপর রেখে ওটা পা দিয়ে ঠেলে দিলাম, জিনিসটা চলতে শুরু করল। আস্তে আস্তে ড্রইভওয়ে আর রাস্তাটা পার হয়ে স্কেটবোর্ডটা কালো সিডানটার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমি সুইচ টিপে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
গ্যারেজের অন্যপাশে আরেকটা দরজা আছে। আমি দৌড়ে সেখানে গিয়ে বাইরের দিকে নজর রাখতে লাগলাম।
গাড়িটার জানালাগুলো কালো রঙের, ভেতরে যারা বসে আছে তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। এই সময় প্যাসেঞ্জার সিটের দরজাটা খুলে একজন বেরিয়ে আসলো। আমি ভেবেছিলাম, সে গাড়ির নিচের দিকে তাকাবে। কিন্তু এ মুহূর্তে তাকে গাড়ির বাম্পারের উপর বসে থাকা একশো ষাট পাউন্ডের কুকুরটাকে নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।
লোকটা মারডকের দিকে এগিয়ে গেল।
“সর এখান থেকে।”
মারডক তাকে পাত্তাই দিলো না।
লোকটা মারডকের কাছে গিয়ে ওকে গুতো দিতে লাগলো, কিন্তু মারডক ঐ জায়গাতেই ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। তাকে নড়াতে পারে এমন সাধ্য নেই কারো।
বুম!
প্রথমটা পটকাটা বিকট শব্দে ফাঁটলো এই সময়ে। লোকটা মাটিতে শুয়ে পড়ল সাথে সাথে।
এরপরেই পুরো জুতোর বাক্সটার সবকিছু ফেঁটে পড়ল। আমি বাসার ভেতর থেকেও শুনতে পেলাম শব্দটা। মনে হচ্ছে যেন কয়েকশো বোমা একসাথে ফাঁটছে, আর সেই সাথে আতশবাজিগুলোর আলো তো আছেই।
সামনের দরজাটা দিয়ে বাবা বেরিয়ে আসলেন এই সময়ে। তার পরনে ঠিক সেই পোশাকগুলো যেগুলো আমি কিছুক্ষণ আগে পরে ছিলাম। মাথায় একটা হেলমেট। যদি গাড়ির লোক দু-জন মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে তাহলে হয়ত তারা বুঝতে পারবে, ওটা আমি না। কিন্তু এ মুহূর্তে তারা একটু ব্যস্ত।
বাবা রাস্তার ওপর পার্ক করা ভেসপাটাতে উঠে সেটা চালু করে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু তার পিছু নিতে নিতে কালো গাড়িটার দশ সেকেন্ড দেরি হয়ে গেল, এর কারণ মারডককে রাস্তা থেকে সরানো সহজ ছিল না।
আমি আবার গ্যারেজে গিয়ে বাবার লিঙ্কন গাড়িটাতে উঠে পড়লাম।
এখন বাজে তিনটা আটান্ন।
গ্যারেজের দরজাটা খুলে বাইরে দেখলাম, কেউ নেই। তীরবেগে বাইরে বের হয়ে এলাম। বামদিকে একবার মোড় নিয়ে আমার ব্লক থেকে বের হয়ে এরপর ডানদিকে আরেকবার মোড় ঘুরে একটা রাস্তার পাশে গাড়িটাকে দাঁড় করালাম আমি।
আমার হাতে আর এক মিনিটও নেই। লাফিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। বাবার বেজমেন্ট থেকে বড় নীলরঙের তেরপলটা নিয়েছিলাম, সেটা দিয়ে গাড়িটা ঢাকতে শুরু করলাম। আর এক চতুর্থাংশ বাকি আছে এমন সময়ে আমার পকেটে অ্যালার্ম বেজে উঠলো।
কোনমতে বাকিটুকু ঢেকে গাড়ির পেছনের সিটে ঢুকে শুয়ে পড়লাম।
টাইম ম্যানেজমেন্ট এ কিছুটা ভুল হয়েছে।