২. চন্দন চলে যাবার পর

দুই

চন্দন চলে যাবার পর তারাপদর বড় ভয় করতে লাগল। ঘরে সে এখন একলা; মৃণাল দত্ত মুখোমুখি বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন তো দেখেই যাচ্ছেন, চুরুটটা তাঁর দাঁতের সঙ্গে ছোঁয়ানো, কেমন একটা কড়া তামাকের গন্ধ নাকে লাগছে। তারাপদ বুঝতে পারছিল না, অন্ধকারের আলো ফেলার মতন চোখ করে মৃণাল দত্ত এত কী দেখছেন তাকে! তার মাথায় ঢুকছিল না, ওই ভদ্রলোকের কাছে এমন কী প্রমাণ রয়েছে যাতে তিনি আসল আর জাল তারাপদ ধরে ফেলবেন? খানিকটা যেন রাগও হচ্ছিল তারাপদর, তার, পরিচয় এই নিয়ে সন্দেহ করার কী আছে? সে কি মুদির দোকানের বনস্পতি ঘি যে খাঁটি আর ভেজাল পরীক্ষা করে দেখতে হবে? বাস্তবিক পক্ষে এটা কিন্তু অপমান;. তারাপদ যেচে এখানে আসেনি, সে ভুজঙ্গভূষণের দেড় দু লাখ টাকার সম্পত্তি পাবার আশায় কাঙাল নয়, তবু তাকে নিয়ে এটা কি বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে? এভাবে তাকে বসিয়ে রাখার কোনো অধিকার মৃণাল দত্তর নেই।

তারাপদ মনে মনে যাই ভাবুক সে কিছু বলতে পারল না; বোবার মতন বসে থাকল।

শেষে মৃণাল দত্ত উঠলেন। ওঠার আগে টেবিলের ড্রয়ার খুললেন চাবি দিয়ে, ড্রয়ারের মধ্যে থেকে আরও একটা বড় মতন চাবির গোছা বার করলেন, দুটো কি তিনটে চাবি একসঙ্গে বাঁধা।

তারাপদর সামনে দিয়ে মৃণাল দত্ত আস্তে আস্তে দেওয়াল-সিন্দুকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তোমার চেহারার সঙ্গে কার মিল বেশি বলে মনে হয়, তোমার বাবার না মা-র?”

তারাপদ খানিকটা অবাক হল। বাবা এতকাল হল মারা গিয়েছেন যে, তাঁর মুখ আর ভাল করে মনেই পড়ে না। তা ছাড়া বাবা মারা যাবার সময় সে ছেলেমানুষ ছিল, এখন কত বড় হয়ে গিয়েছে, চব্বিশ পঁচিশ বয়েস হতে চলল–কেমন করে সে বলবে তার চেহারা বাবার মতন’ হয়ে আসছে কি না! মা অবশ্য বলত, তারাপদর চেহারার আড় তার বাবার মতন হয়েছে, মুখের খানিকটা বাবার ছাঁদে, বাকিটা মার।

শুকনো শুকনো গলায় তারাপদ বলল, “আমি বলতে পারব না। মা বলত, মেশানো মুখ ।”

মৃণাল দত্ত বড়সড় দেওয়াল-সিন্দুকটা খুলে ফেলে কী যেন বের করতে লাগলেন। তারপর বাঁধানো অ্যালবামের মতন একটা মোটা খাতা বের করলেন যত্ন করে রাখা কিছু কাগজপত্রও নিলেন; নিয়ে সিন্দুকের ডালা বন্ধ করলেন।

নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসলেন মৃণাল দত্ত। বললেন, “তুমি আমার সামনে এগিয়ে এসে বসো।” বলে আঙুল দিয়ে টেবিলের অন্য প্রান্তটা দেখালেন।

তারাপদ চেয়ারটা টেনে এনে টেবিল ঘেঁষে বসল, মুখোমুখি ।

মৃণাল দত্ত বাঁধানো খাতার মতন জিনিসটা এগিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, ওটা অ্যালবামই, তবে বাজারে যেমন কিনতে পাওয়া যায় সেই রকম নয়। মোটা মোটা কাগজ, বেশিরভাগ পাতায় একটা করে মাত্র ছবি, কখনো কখনো দুটো; প্রতিটি পাতা নিখুঁত করে রাখা, গোটা খাতাটাই চামড়ায় বাঁধানো, ছবির পাশে লাল পেনসিলে পুরু করে শুধু নম্বর লেখা আছে বাংলায় ।

তারাপদ অ্যালবাম হাতে করে বসে থাকল।

মৃণাল দত্ত কাগজপত্রের মধ্যে থেকে একটা পাতলা চামড়ার খাপ–চুরুট রাখার খাপ যেমন হয় অনেকটা সেই রকম খাপ-খুঁজে নিয়ে তার ভেতর থেকে একটা মোটা কাগজ বের করে নিলেন।

মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমি ওই ছবিগুলো দেখে যাও একটা একটা করে; যে ছবিটা তোমার চেনাচেনা লাগবে সেই ছবিটা কার আমায় বলবে। বুঝলে?”

তারাপদ মাথা হেলিয়ে বলল, সে বুঝেছে।

“নাও বলো”, বলে মৃণাল দত্ত চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে বসে মুখের সামনে মোটা কাগজটা মেলে রাখলেন। তারাপদ বুঝতে পারল, উনি খুব সাবধানী, কাগজের কোনো আঁচড়ও যাতে তারাপদর চোখে না পড়ে সেজন্য দূরত্ব সৃষ্টি করলেন। এর কোনো প্রকার ছিল না, কেন না তারাপদ কাগজের সাদা পিঠ ছাড়া অন্য কিছু এমনিতেই দেখতে পাচ্ছিল না।

তারাপদ অ্যালবামের দিকে চোখ দিল। প্রথম ছবিটা যে কার কে জানে! অনেক পুরনো ছবি, কেমন হলদেটে হয়ে গেছে, ছোপ ছোপ ধরেছে, কোথাও কোথাও একেবারেই ধূসর। বিশাল দাড়িঅলা এই বৃদ্ধ মানুষটিকে সেকেলে কোনো গুরুদেব-টুরুদেবের মতন দেখতে লাগে, পরনের খুট গায়ে জড়ানো, পদ্মাসন না কী বলে যেন সেই ভাবে বসা, হাত দুটি হাঁটুর ওপর।

তারাপদ মাথা নাড়ল বলল, “এই এক নম্বরের ফটো যে কার আমি জানি না। জীবনেও দেখিনি।”

মৃণাল দত্ত বললেন, “তোমার দেখার কথাও নয়। তারপর বলে যাও…।”

তারাপদ দুই তিন চার পাঁচ নম্বর ছবি পর্যন্ত কাউকে চিনতে পারল না। বুঝতে পারল, ছবিগুলো সবই পারিবারিক, বৃদ্ধবৃদ্ধাদের, প্রবীণের । এই পরিবারের সঙ্গে তারাপদর সম্পর্ক কী? সে তো কাউকে চেনে না দেখেনি। তবে? তবে কি তারাপদ এই পরিবারেরই কেউ, এদেরই বংশধর, এদেরই রক্ত গায়ে নিয়ে বেঁচে আছে? এইসব স্বর্গত পুরুষরা কি আজ অদৃশ্য হয়ে তাকে দেখছে? তারাপদর ঘাড় এবং মাথার কাছে যেন কারা দাঁড়িয়ে রয়েছে এরকম একটা অস্বস্তি বোধ করল সে।’

সাত নম্বর ছবির দিকে চোখ রেখে তারাপদ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল । কী যেন মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। ওই ছবির সঙ্গে একটা কিছুর যোগ রয়েছে কোথাও। অথচ ছবিটা কোনো মানুষের নয়। সেকেলে একটা বাড়ির ছবি। পাকা বাড়ি, তার চেহারাই কেমন আলাদা–একালের শহুরে বাড়ির সঙ্গে মেলে না। বাড়ির ঢঙে, আশপাশের চেহারায়, গ্রাম-গাম লাগে। দোতলা বাড়ি, একটানা ঘর, বাঁ দিকে একটা চালার মতন, ডান দিকে ক’টা গাছপালা, তার পাশে মস্ত একটা গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে, গাছটার মাথা দেখা যাচ্ছে না।

তারাপদ গভীর মনোযোগে গাছটার অস্পষ্ট ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল, “এই বাড়িটা বোধ হয় আমাদের দেশের বাড়ি। আমার ঠিক মনে নেই, তবে সেই তেঁতুলগাছটা, যার মাথায় ভূত থাকত, সেই গাছটা যেন এইটে–” বলে তারাপদ আঙুল দিয়ে গাছটা দেখাল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “হ্যাঁ, তোমাদের দেশের বাড়ি। তোমার কি মনে আছে ওই বাড়ির পেছনে কী ছিল?”

তারাপদ মনে করার বৃথা চেষ্টা করল, তারপর হঠাৎ কেমন একটু হেসে বলল, “আমার মনে নেই। তবে মার মুখে শুনেছি পুকুর ছিল।”

মৃণাল দত্ত শান্ত গলায় বললেন, “তেঁতুলগাছটার কথাও মা-বাবার মুখে শুনতে পার।…যাক, অন্য ছবি দেখো।”

তারাপদ বেশ ক্ষুব্ধ হল। তার বাল্যস্মৃতির মধ্যে তেঁতুলগাছটা কেমন করে যেন থেকে গেছে অথচ মৃণাল দত্ত তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আশ্চর্য! এত সন্দেহ কেন?

পর পর তিনটে ছবি উলটে গিয়ে তারাপদ হঠাৎ থেমে গেল। তার চোখ উজ্জ্বল দেখাল । সামান্য গলায় বলল, “আমার বাবার ছবি ।” বলে তারাপদ ঝুঁকে পড়ে তার বাবার ছবি দেখতে লাগল । কতকাল পরে বাবাকে দেখছে। যেন। এই মুখ চোখ মাথার চুল সব বুঝি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ ফিরে পেল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “তোমার কাছে তোমার বাবার ছবি নেই?”

“না”, মাথা নাড়ল তারাপদ।

“তোমার মার কাছে নিশ্চয়ই ছিল।”

তারাপদ এবার রেগে গিয়ে বলল, “আপনি আগাগোড়া আমায় অবিশ্বাস করছেন কেন? আপনি ভাবছেন, মা বাবা বেঁচে থাকার সময় আমি যা শুনেছি দেখেছি সেগুলো চালাবার চেষ্টা করছি।”

মৃণাল দত্ত বললেন, “আমি আমার কাজ করছি। তোমার কথার জবাব পরে দেব। এখন তুমি ছবিগুলো দেখে যাও।”

বিরক্ত অসন্তুষ্ট মনে তারাপদ অন্য ছবিগুলো দেখতে লাগল। মার ছবি দেখল, বলল। একটা মন্দিরের পাশে মা বাবা এবং আরও যেন দুজনকে দেখল। বলল, “মা বাবাকে চিনতে পারছি, আর কাউকে পারছি না।”

“তোমাকে পারছ না?”

“আমাকে? আমিও আছি নাকি? কোথায়?” তারাপদ বেশ কৌতূহল বোধ করে নিজেকে খুঁজতে লাগল। দুটো বাচ্চার একটা নিশ্চয় সে। কিন্তু কোটা? ছেলেবেলার তারাপদ কি তালপাতার সেপাই ছিল? কাঠির মতন হাত পা, ঢলঢলে হাফ প্যান্ট, একটা শার্ট গায়ে, খোঁচা খোঁচা চুল মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ছেলেটাই কি তারাপদ নিজে? অন্যটা কে তা হলে?

তারাপদ ছবির ওপর আঙুল দিয়ে বলল, “আমি বোধ হয় এইটে…।”

মৃণাল দত্ত একটু যেন হাসলেন। বললেন, “ঠিক আছে, পরের ছবিগুলো দেখো।”

তারাপদ পরের ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবি দেখে কেমন থমকে গিয়ে বলল, “এ আমার বোন পরী…।”

“ওটা কত নম্বরের ছবি?”

“উনিশ।”

“তোমার বোনের কথা মনে পড়ে?”

“হ্যাঁ । দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ঝাঁকড়া চুল, ফরসা রঙ, একটু একটু কথা বলতে শিখেছিল, দা—দ–দা, মা—ম‌–মা বলতে পারত জলকে বলত দল…। বছর দুই বয়সও হয়নি, পরী মারা যায়।”

“কেমন করে?”

“সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে মাথায় লেগেছিল। তাতেই মারা গেল।”

মৃণাল দত্ত কিছু বললেন না। নিবন্ত চুরুটটা ছাইদান থেকে আবার উঠিয়ে নিলেন।

তারাপদ অন্যমনস্ক বিষণ্ণ মুখে বসে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর আবার পাতা ওলটাতে লাগল। ওলটাতে ওলটাতে দেখল কী আশ্চর্য, তার স্কুলে পড়ার সময়কার ছবি, মা-র সঙ্গে আরও একটা ছবি, তার কৈশোর ও যৌবনকালের ছবিও এই অ্যালবামে রয়েছে। কেমন করে থাকল? বি এ পাশ করার পর সে কনভোকেশনে গিয়েছিল–একটা ছবিও তুলিয়েছিল অন্যদের মতন জোব্বা পরে, সেই ছবিও রয়েছে। অদ্ভুত তো!…একেবারে শেষের দিকে তারাপদ সাধুমামার ছবি দেখতে পেল। দেখে অবাক হয়ে গেল। সাধুমামা তাদের একেবারে নিজের কেউ নয়, মার কোন দুর সম্পর্কের আত্মীয়, আবার বাবারও যেন কেমন একটা ভাইটাই হত । তবু মার সম্পর্কেই তাঁকে মামা বলা হত। একটু খেপাগোছের লোক। হঠাৎ কলকাতায় তাদের বাড়িতে আসত, আবার চলে যেত, কোথায় যে থাকত সাধুমামা, কেউ জোর করে বলতে পারবে না। কখনো বর্ধমানে কখনো রানীগঞ্জে, কখনো দেওঘরে। সাধুসন্ন্যাসী আশ্রম-টাশ্রম করে বেড়াত খুব। মা মারা যাবর পরও সাধুমামা দু-এক বছর তারাপদর খোঁজখবর করেছে, থেকেছে এক-আধ রাত। বটুকবাবুর মেসে তারাপদ আস্তানা গাড়ার পরও সাধুমামা দেখা দিয়ে গিয়েছে। আজ বছর দেড় দুই অবশ্য আর আসেনি। তারাপদ ভাবত, সাধুমামা মারা গেছে।

সাধুমামার কথা ভাবতে গিয়েই তারাপদর আচমকা খেয়াল হল, আরেসাধুমামাই তো তার কনভোকেশনের একটা ছবি জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। ওই ছবি কি সেইটে? নিশ্চয়ই তাই।

তারাপদ চোখ তুলে বলল, “আমি এখন বুঝতে পারছি।”

“কী বুঝছ?”

“সাধুমামা আমাদের অনেক ছবি জোগাড় করে এই অ্যালবামে রেখেছে।”

“না”, মৃণাল দত্ত মাথা নাড়লেন। “সাধুমামার অ্যালবাম এটা নয়। এটা ভুজঙ্গবাবুর। তোমাদের সাধুমামা অনেক ছবি ভুজঙ্গবাবুকে দিয়েছে, তঅমাদের ছবি–বিশেষ করে তোমার বাবা মারা যাবার পর তোমাদের সমস্ত ছবিই সাধুমামা ভুজঙ্গবাবুকে জোগাড় করে দিয়েছে।”

“শুধু ছবি কেন, আমাদের সমস্ত খবরই বোধ হয় সাধুমামা দিত?”

“হ্যাঁ ।”

“আমার ঠিকানাও সাধুমামা দিয়েছিল!”

“না দিলে ভুজঙ্গবাবু কোথায় পাবেন?”

“আমি যদি বটুকবাবুর মেসে না থাকতাম–তা হলে কী হত?”

“তোমার খোঁজ করার চেষ্টা করতাম, কাগজে নোটিশ দিতাম। তাতেও যদি তোমার খোঁজ না পাওয়া যেত–আমায় এই বোঝা মাথায় নিয়ে বসে থাকতে। হত তোমার অপেক্ষায়।”

তারাপদ অ্যালবামটা বন্ধ করে দিল। এতক্ষণে তার যেন স্বস্তি লাগছে। বড় করে নিশ্বাস ফেলল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “এবার আমায় দু-একটা ছোটখাট কথা বলো! তোমার শরীরে কোনো আইডেন্টিফিকেশান মার্ক আছে? কোনো কাটাকুটি, জড়ল, তিল–?”

তারাপদ নিজের হাত দেখতে দেখতে বলল, “তিল তো অনেক আছে, বাঁ পায়ে হাঁটুর তলায় কাটা আছে।”

“আর কিছু?”

“জানি না, লক্ষ করিনি।”

মৃণাল দত্ত হাতের কাগজ টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন, “তোমার বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের কাছটা জোড়া নয়? আরও আঙুলের মতন আছে। পাঁচের জায়গায় ছয় বলতে পারো। ঠিক কি না? দেখি?”

তারাপদ স্বীকার করল, হ্যাঁ, তার বাঁ পায়ের আঙুল ওই রকমই। মৃণাল দত্তকে দেখাল।

মৃণাল দত্ত এবার যেন নিশ্চিন্ত। চুরুট নিবে গিয়েছিল। আবার ধরালেন। বললেন, “আর একটু চা খাবে?”

তারাপদ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। মাথা নেড়ে বলল, “খাব।”

মৃণাল দত্ত টেবিলের পাশে লাগানো কলিং বেলের বোতামে হাত দিলেন। একটু পরেই সেই বুড়োমতন লোকটি ঘরে এল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “দু কাপ চাপ নিয়ে এসো, আর বাবুর বন্ধুকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও।”

লোকটি চলে গেল।

মৃণাল দত্ত এবার মোলায়েম গলায় বললেন, “প্রথম শর্তটা মিটল। তুমি যে আসল তারাপদ সবার আগে আমার সেটা দেখা দরকার ছিল। তোমার শরীরের চিহ্ন ছাড়াও–ওই ছবিগুলো যা তুমি চিনতে পেরেছ–তাতেও প্রমাণ হয় তুমি তারাপদই। আমার আর কোনো সন্দেহ নেই।”

“তোমার এই বন্ধুটি কি সত্যিই পুরনো বন্ধু?” মৃণাল দত্ত জিজ্ঞেস করলেন।

“আজ্ঞে হ্যাঁ।“

“বিশ্বাস করার মতন?”

“আজ্ঞে, ও আমার সবচেয়ে ইনটিমেট ।”

“ভাল। খুবই ভাল।” মৃণাল দত্ত আস্তে আস্তে চুরুটে টান দিলেন। খানিকটা যেন চিন্তিত।

চন্দন ঘরে এল। তারাপদর পাশে বসতে পারল না, নিজের পুরনো জায়গায় বসল। এখানে বসলে চোখ যেন নিজের থেকেই বেড়ালটার দিকে চলে যায়। চন্দন তাকাল। তাকিয়েই তার কেমন যেন ধাঁধা লেগে গেল। সামান্য যেন চমকেও উঠল। চন্দন যখন এ-ঘর ছেড়ে চলে যায় তখন ওই বেড়ালটার মুখ যে অবস্থায় ছিল-এখন যেন তার চেয়ে খানিকটা ঘুরে গিয়েছে। তখন, মানে তারাপদ আর সে যখন এই ঘরে এসে প্রথমে বসে, তখন বেড়ালটার মুখ তাদের দিকে ফেরানো ছিল, এখন ঘড়ির কাঁটার মতন ডানদিকে সরে গিয়েছে, বেড়ালটার মুখ বা চোখের সঙ্গে চন্দনের চোখাচুখি হচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার তো! চন্দন কি চোখে ভুল দেখছে? নাকি তারাপদ বেড়ালটা হাতে করে তুলে দেখেছিল, আবার নামিয়ে রাখার সময় ওই ভাবে বসিয়েছে? চন্দন কিছু বুঝতে পারল না। সে বেড়ালটার দিকে নজর রেখে বসে থাকল।

ততক্ষণে তারাপদ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধুকে দেখে নিয়েছে।

মৃণাল দত্ত তারাপদকে বললেন, “আমি তোমায় গোড়ার কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই। তোমার শুনে রাখা ভাল। তোমার পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। আমি একবার পুজোর ছুটিতে ফ্যামিলি নিয়ে মধুপুরে চেঞ্জে গিয়েছিলাম। ভুজঙ্গবাবুও গিয়েছিলেন কয়েক দিনের জন্যে। পাশাপাশি বাড়ি। আলাপ হয়েছিল সে-সময়। তারপর আমি কলকাতায় ফিরে আসি। ভুজঙ্গবাবু মাঝে মাঝে আমায় চিঠি লিখতেন। আমিও জবাব দিতাম। তারপর তিনি আমায় তাঁর সলিসিটার হবার অনুরোধ জানান। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হব না। পরে তাঁর চিঠির তাগাদায় রাজি হয়ে যাই। এবার পুজোর সময়, লক্ষ্মী পূর্ণিমার পর ভুজঙ্গবাবু একদিনের জন্যে কলকাতায় আসেন, আর এই সমস্ত কাগজপত্র ছবি দিয়ে যান। কিছু সই-সাবুদের ব্যাপার ছিল–ছুটির আগেই আমি তা সেরে রেখেছিলাম, তিনি সেগুলো সইটই করে দেন। তখন আমায় বলেছিলেন, তাঁর চিঠি পাবার পর আমি যেন তোমার খোঁজখবরের চেষ্টা করি। আজ দিন সাতেক হল আমি তাঁর দুটো চিঠি পেয়েছি। দুটো চিঠিতেই তিনি তোমার কথা লিখেছেন; লিখেছেন তোমায় তাড়াতাড়ি একবার তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে।”

তারাপদ মন দিয়ে কথা শুনছিল। বলল, “তিনি কোথায় থাকেন আমি তো । জানি না!”

“তোমার জানবার কথাও নয়, মৃণালবাবু বললেন। “তুমি কোনোদিন মধুপুর দেওঘরের দিকে গিয়েছ?”

“আজ্ঞে না ।”

“মধুপুর আর যশিডির মধ্যে একটা স্টেশন আছে, স্টেশনটার নাম শংকরপুর। সেখানে নেমে মাইল তিন-চার ভেতরে গেলে ভুজঙ্গবাবুর বাড়ি পাবে। জায়গাটাকে মাঠমোকাম বলে।”

বুড়োমতন লোকটি আবার চা নিয়ে এল ট্রে-তে করে। তারাপদ আর । চন্দনকে দিল। চন্দন যত না মৃণাল দত্তর কথা শুনছে তার চেয়ে বেশি। মনোযোগ দিয়ে কালো বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে আছে। আপাতত কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

এত রকম ঝঞ্ঝাটের পর গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তারাপদর আরাম লাগছিল।

মৃণাল দত্ত সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “তুমি তো ভুজঙ্গবাবুকে কখনো দেখোনি, তাঁর বিষয়ে কিছু জানো না।”

“না,” তারাপদ মাথা নাড়ল।

মৃণাল দত্ত কী যেন ভাবছিলেন, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেন, “আমি দেখেছি—ওঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখলেও তোমার ভয় করত। আর এখন, কী অবস্থায় তুমি তাঁকে দেখবে আমি বলতে পারছি না।”

তারাপদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। “ভয় করবে? কেন?”

“এক একজন মানুষের চেহারা দেখলে কেমন একটা লাগে না? তেমার কখনো লাগেনি?”

তারাপদ মনে করবার চেষ্টা করল। প্রথমেই তার মনে পড়ল, মদন দত্ত লেনের সেই মুদিঅলাকে; বীভৎস চেহারা, পাড়ার ছেলেরা তাকে ফ্র্যাংকেস্টাইন বলত; মনে পড়ল ছেলেবেলায় একবার সে সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে একটা বাবরি চুলঅলা, কালো কুচকুচে চেহারার ষণ্ডা লোক দেখেছিল, তার চোখ দুটো লাল টকটকে। কে যেন বলেছিল, লোকটা জল্লাদ, জেলে জেলে ফাঁসি দিয়ে বেড়ায়। সেই লোকটাকে দেখে তারাপদর ভীষণ ভয় হয়েছিল। তারপর আরও কাউকে কাউকে দেখেছে যাদের চেহারার কোনো না কোনো অস্বাভাবিকতা, কোনো অঙ্গহানির জন্যে সত্যিই বড় বিশ্রী দেখতে লাগে ।

তারাপদ বলল, “হ্যাঁ, তা লাগে।”

“ভুজঙ্গবাবুকেও দেখতে তোমার ভাল লাগবে না–” মৃণাল দত্ত বললেন, “অনেকটা যেন কাপালিকের মতন দেখতে। আমি নিজে অবশ্য কোনো কাপালিক কখনো দেখিনি–বঙ্কিমবাবুর কপালকুণ্ডলা’ সিনেমায় একবার কাপালিক দেখেছি, সে তো সিনেমার কাপালিক। ভুজঙ্গবাবুকে আরও ভয়ঙ্কর দেখতে। তাঁর একটা ছবি আমার কাছে আছে তিনিই দিয়েছেন, তোমায় দেখাচ্ছি।” বলে মৃণালবাবু টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে কাগজপত্র থেকে একটা খাম বের করলেন। ফটো রাখার হলুদ খাম। ভুজঙ্গবাবুর ছবি বের করে তারাপদর দিকে এগিয়ে দিলেন।

চন্দনের কান তখন মৃণাল দত্তর কথায়। সে কালো বেড়ালটার দিকে তাকাতে ভুলে গেল। তারাপদ ছবিটা হাতে নিল। মাঝারি ছবি। ভুজঙ্গবাবুর বুক পর্যন্ত দেখা যায়। ছবি দেখে তারাপদ স্তম্ভিত। বিশাল মুখ, খড়ের মতন লম্বা নাক, বড় বড় চোখ, চওড়া কান। চোখ দুটো এত তীব্র, এমন অস্বাভাবিক রুক্ষ যে তাকালেই মনে হয়, মানুষটা তোমার সব কিছু দেখে নিচ্ছে। চোখের মধ্যে কেমন এক নিষ্ঠুরতা। মানুষের ভুরু যে কত চওড়া হতে পারে ভুজঙ্গভূষণের মুখ না দেখলে বোঝা মুশকিল। পুরু ঠোঁট, সামান্য দাঁত দেখা যাচ্ছে, ধারালো শক্ত ঝকঝকে দাঁত। ভুজঙ্গবাবুর উঁচু চওড়া কপাল, নাক, চোখ আর ঠোঁটের সামান্য অংশ ছাড়া বাস্তবিক মুখের আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। মুখে ঘন দাড়ি, সন্ন্যাসীদের মতন, মাথার চুল পিঠ পর্যন্ত বাবরি করা। দাড়ি আর চুল কোনোটাই পরিপাটি নয়, উস্কোখুস্কো, ঝড়ে-ওড়া চুলের মতন এলোমেলো।

তারাপদ ভাবতে পারছিল না, এই লোকটা কী করে তার পিসেমশাই হয়? এ তো কোনো ভয়ংকর তান্ত্রিক হতে পারে। কাপালিক হওয়াও সম্ভব। ১

মৃণাল দত্ত বললেন, “ভুজঙ্গবাবুর কাছে তোমায় যেতে হবে। তিনি তোমায় নিজের চোখে দেখতে চান।”

“কেন?”

“তিনি লিখেছেন, আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন না। কীভাবে আগুন লেগে তাঁর মুখ পুড়ে গেছে। ওষুধপত্র লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে কোনোরকমে বেঁচে আছেন। মারা যাবার আগে একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। এ হয়ত তাঁর দুর্বলতা। তা ছাড়া, তুমি ছাড়া তাঁর আর কোনো জীবিত আত্মীয় নেই, হয়ত সেই জন্যেই নিজের ওয়ারিসানকে একবার স্বচক্ষে দেখতে চান।”

তারাপদ চুপ করে থাকল। ভুজঙ্গভূষণের কাছে যেতে তার ইচ্ছে করছিল না, আবার যখনই দেড় দু’লাখ টাকার সম্পত্তির মনে আসছিল–তখন সেটা হারাবার কথাও ভাবতে পারছিল না।

মৃণাল দত্ত যেন তারাপদর মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, “ভুজঙ্গবাবুর সঙ্গে যদি তোমার দেখা না হয় তা হলে দ্বিতীয় শর্ত মতন তুমি তাঁর সম্পত্তির কানাকড়িও পাবে না।”

তারাপদর মনে হল, সে যেন মনে মনে কিসের স্বপ্ন দেখছিল, হঠাৎ তা ভেঙে গেল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃণালবাবু আবার বললেন, “তোমায় আমার আপাতত আর কিছু বলার নেই। যদি ভুজঙ্গবাবুর কাছে যেতে চাও, আমি তোমায় দু-একটা জিনিস দেব। সেটা তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি জিনিসগুলো পেয়ে আমায় জানাবেন–তোমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে।”

“কিন্তু আমি গিয়ে যদি দেখি তিনি মারা গেছেন?”

“মারা যাবেন বলে মনে হয় না। দু-চার দিনের মধ্যে বোধ হয় নয়। নিজের মৃত্যুর দিন নাকি তাঁর জানা। সামনের অমাবস্যা পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন লিখেছেন। মানে আরও দিন আষ্টেক । আজ সপ্তমী-টপ্তমী হবে।”

তারাপদ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকল।

“যদি যেতে চাও কাল সকালে একবার তোমায় এখানে আসতে হবে। আমি সব তৈরি করে রাখব।”

তারাপদর মুখে কথা ফুটল না।

ঘর ছেড়ে চলে আসার মুখে চন্দন আবার কালো বেড়ালটার দিকে তাকাল। তাকিয়ে তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। বেড়ালের মুখ মৃণাল দত্তর দিকে ঘুরে গিয়েছে প্রায়। চন্দন তারাপদর হাতের কাছটা জোরে চেপে ধরল।