০৬.
চকচকি গ্রামের গুলাবি নার্জিনারির রূপেন শইকিয়ার মতন ব্যবসা নেই। দেবদ্যুতি সেনগুপ্তর মতন গবেষণার কাজও তার কাছে স্বপ্ন। সে এক পঁয়ত্রিশ বছরের আদিবাসী রমণী–গরিব, ক-অক্ষর গোমাংস। তবু দ্যুতি বা রূপেনের মতন গুলাবিরও বড় প্রয়োজন ছিল হরিণডুবির। উত্তরের জঙ্গলে যাওয়ার। কারণ ওই জঙ্গলেই একটা টিলার মাথায় রয়েছে তাদের তীর্থ– শিরোমণির গড়। সেই গড়ে আজও, মৃত্যুর পাঁচশো বছর পরেও, অধিষ্ঠান করেন রাজা শিরোমণি। ওদিকে গুলাবির দেড় বিঘে জমিতে মকাইদানা পেকে টুসটুস করছে। শিরোমণি ছাড়া সেই ফসলকে শেষ অবধি রক্ষা করেন কে?
গুলাবি তাই আজ শিরোমণির গড়ে চলেছে। তার ডান হাতে একটা ধারালো দা। বাঁ হাতের আঙুলে দড়ির ডগায় ঝুলছে একটা গোলা পায়রা। গুলাবি আজ শিরোমণির গড়ে পায়রা বলি চড়াবে। বলি চড়িয়ে রাজা শিরোমণিকে জোড়হস্তে বলবে, রাজা! তোমাকে তো নতুন। করে কিছু বলার নেই। ঘরে খাবার মুখ ছয়খানা। তাদের অর্ধেক বছরের খোরাক ওই দেড়বিঘে জমির মকাইদানা, তাও যদি গোলায় ওঠে, তবেই।
বনের ধারে জমি। ফসল খেয়ে যাবার জন্যে বুনো শুয়োর আছে, সজারু আছে, এমনকি টিয়াপাখিও বড় শত্রু। একটু অন্যমনস্ক হলেই এরা সব তছনছ করে দিয়ে চলে যাবে। তবু ঠাকুর, দিন নেই রাত নেই মেয়ে মরদে পালা করে জেগে, খালি টিনের ক্যানেস্তারা বাজিয়ে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এদের হাত থেকে ফসল বাঁচানো যায়। কিন্তু ক্ষেতের ওপর একবার যদি মহাকাল বাবাদের দৃষ্টি পড়ে, তা হলে আর কোনও উপায় নাই। এক রাতের মধ্যে সমস্ত ফসল খেয়ে ছড়িয়ে, শুড়ে দাঁতে জমি নতুন করে চষে দিয়ে তারা ভোরবেলা গা দোলাতে দোলাতে জঙ্গলে ফিরে যাবে। পেছনে পড়ে থাকবো আমরা ছটি প্রাণী, সারা বছর উপোসের চিন্তা নিয়ে।
তাই এইটুকুই প্রার্থণা শিরোমণিমহারাজ, তোমার হাতির পালের নজর থেকে আমার ওই একটুকরো জমিকে তুমি রক্ষা কর।
গুলাবি চকচকি গ্রাম থেকে বেরিয়েছিল দুপুরবেলায়। সংসারের সমস্ত কাজ সেরে তার আগে আর পারেনি। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ সে গ্রামের লাগোয়া হালকা জঙ্গল ছাড়িয়ে ঢুকে পড়েছিল বি.টি.আর-এর কোর-এরিয়ার গহন অরণ্যের মধ্যে। কিছুদূর অবধি ফরেস্টের লোকেদের গাড়ি চলাচলের মতন সরু পিচরাস্তা ছিল। একটা জায়গার পর তাও শেষ হয়ে গেল। এরপর শুধুই জন্তুদের পায়ে পায়ে তৈরি শুড়িপথ। সেই শুড়িপথ ধরেই এগিয়ে চলেছিল গুলাবি। বেলা সবে হয়তো একটা, কিন্তু গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে নীচে যেটুকু আলো চুঁইয়ে পড়েছে। তার রং এখনই মরা হলুদ। গুলাবি এই বনেরই মেয়ে। এইসব জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে, ব্যাঙের ছাতা কুড়িয়ে তার ছেলেবেলা কেটেছে। তবু তারও একটু ভয় ভয় করতে লাগল। অন্য কোনও কারণে নয়, ওই বুনো হাতিদের কথা ভেবেই। শিরোমণির গড়ের টিলাটা বেয়ে যতই সে ওপরে উঠতে লাগল ততই তার নাকে আসতে লাগল পাকা চালতার গন্ধ। এই টিলার ঢালে অনেকটা জায়গা জুড়ে বুনো চালতার জঙ্গল রয়েছে। আর কে না জানে, পাকা চালতা মহাকালবাবাদের কত প্রিয়?
বনের মেয়ে গুলাবির আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে একটু বাদেই তার সামনের ঘন। জঙ্গলের আড়াল থেকে শাঁখের আওয়াজের মতন হাতির হুঙ্কার ভেসে এল কাঁআআআঁঅ্যাঁ।
এটা সাবধান করে দেওয়ার ডাক। গুলাবির উপস্থিতি ওরা বুঝতে পেরেছে, আর বুঝতে পেরেই তার উদ্দেশ্যে চেতাবনি পাঠিয়েছে–এদিকে আর এক পা-ও বাড়িয়ো না হে। ভালোমানুষের বেটি! আমরা এমনিতে ভদ্র। কিন্তু খাওয়ার সময় বিরক্ত করা পছন্দ করি না। আর জানো তো, রাগলে আমাদের মতন বাজে জানোয়ার সারা পৃথিবীতে আর নেই?
জানে বই কি, খুব ভালো করে সে কথা জানে গুলাবি নার্জিনারি। ছোটবেলা থেকে কম আত্মীয়বন্ধুকে সে ক্ষ্যাপা হাতির পায়ের তলায় থেঁতলে মরতে দেখেছে না কি? হাতির ডাক শোনা মাত্রই তাই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর সোজা রাস্তা ছেড়ে টিলার বাঁ-দিকের ঢাল বেয়ে অনেকটা ঘুরে আবার ওপরে উঠতে শুরু করল। ঘুরপথে যাওয়ার সময়েই সে মাথা তুলে দেখতে পেল একটা ছেলে পাথর বাঁধানো মূল রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পুরো শরীরটা দেখতে পেল না গুলাবি, শুধু নীল ট্রাউজারটুকুই চোখে পড়ল।
কেউ নিশ্চয়ই আমারই মতন পুজো দিতে এসেছিল, এখন ফিরে যাচ্ছে। ফিরে যাওয়ারই তো সময় এখন। তার মতন এত দেরি করে এই ঘোর বনে কে আসে? ভাবল গুলাবি।
মাঝখানে ঘন বাঁশবনের আড়াল থাকায় ছেলেটা তাকে দেখতে পায়নি। তা ছাড়া ওরও পুরো মন এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই ওই হাতির হুঙ্কারের দিকেই পড়ে রয়েছে।
ঘুরপথে টিলার খোলা জায়গাটায় যতক্ষণে সে উঠে এল ততক্ষণে হেমন্তের বেলা ঢলতে শুরু করে দিয়েছে। নীচে তাকিয়ে সে দেখল শিরোমণির গড়ের জলাশয়টাতে বনচরদের বৈকালি। জলপানের জন্যে যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে। ওর চোখের সামনেই জল খাওয়ার জন্যে নেমে এল দশ বারোটা বুনো মহিষ বা গউর। তাদের হাঁটু অবধি সাদা লোমের মোজা। একজোড়া ময়ুর তীক্ষ্ণ চিৎকার করতে করতে আকাশছোঁয়া চিকরাসি গাছের মগডালের দিকে উড়ে গেল; চিতাবাঘ বা বনবেড়ালের মাংশাষী থাবার নাগাল এড়াতে ওখানেই ওরা রাতটা কাটাবে।
পায়ের দিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছিল গুলাবিকে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। ভাঙা পাথরের ইট। কিছু কিছু গাঁথনি এখনও, এই পাঁচশো বছর পরেও, মাটির ওপর খাড়া রয়েছে। রয়েছে আকাশের দিকে অর্ধেকটা উঠে হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়া সিঁড়ি, কুঁয়োর মতন বিরাট পাথরে বাঁধানো গহুর।
এই অনেকখানি অটুট স্থাপত্যের জন্যেই গুলাবির মতন মানুষেরা বিশ্বাস করে, শিরোমণির। গড়ের রাজা আবার ফিরে আসবেন। তিনি আসা মাত্র আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে এই গড়। লোকলস্কর, সিপাহি, বরকন্দাজে গমগম করবে এই টিলা। বুনো জন্তুরা পালাবে, বন পরিষ্কার হয়ে যাবে, আর সেই সঙ্গে পিছু হাঁটবে সময়।
পিছু হাঁটতে হাঁটতে সময় পৌঁছে যাবে পাঁচশো বছর আগের বক্সায়, যখন রাজা শিরোমণি ছিলেন আসাম থেকে নেপাল, ভুটান থেকে কোচবিহার অবধি বিস্তৃত এক বিরাট ভূখণ্ডের প্রভূ, আর এইখানে ছিল তার রাজপ্রাসাদ। এখানে তখন জঙ্গল ছিল না মোটেই, ছিল এক ভারী শহর। আর রাজা শিরোমণি তো তাদেরই লোক ছিলেন, ছিলেন তাদেরই মতন মঙ্গোলয়েড আদিবাসী। আদিবাসীরাই ছিল তার খাস প্রজা। তাই গুলাবির মতন মানুষরাও সেদিন আবার। ফিরে পাবে তাদের হারানো জমি জায়গা–যে সব উর্বর একলপ্তের জমি বছরের পর বছর ধরে সমতলের মানুষেরা এসে তাদের কাছ থেকে ছলে বলে কৌশলে কেড়ে নিয়েছে। তখন বনচরের জীবন ছেড়ে, রিক্সাওলার জীবন ছেড়ে, মালির জীবন, বেশ্যার জীবন ছেড়ে আবার তারা কৃষিকাজে ডুবে যাবে। তখন তারা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াবে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের আলো ঝলমল রাস্তায়। হংকং মার্কেটে বাজার করবে, দামি হোটেলে কবজি ডুবিয়ে মাংসভাত খাবে। শহরের মেয়েদের মতন ব্লাউজের নীচে লালরঙের একটা ছোটজামা পরবে গুলাবি। আর হ্যাঁ, সবার আগে হাতি খেদানোর জন্যে একটা ইলেকট্রিকের বেড়া বানাবে তার জমিটার কিনারা বরাবর।
সুখস্বপ্নে বিভোর গুলাবি সমতল জমিটার ঠিক মাঝখানটায় একটা উঁচু পাথরের চাতালের দিকে এগিয়ে চলেছিল। সে জানে ওই চাতালটাকেই বলা হয় শিরোমণির থান। ওখানেই লোকে বলি চড়ায়, সে নিজেও এর আগে অনেকবার চড়িয়েছে। যেতে যেতে সে দেখছিল কত মূর্তি ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকেভাঙা পাথরের মূর্তি সব। কোনোটা সৈন্যের মূর্তি, কোনওটা নর্তকীর। পাথরের সিংহাসন, পাথরের অলঙ্কৃত কড়িবরগা। গুলাবি তার বাপদাদাদের মুখে শুনেছে, যেদিন রাজা শিরোমণি ফিরবেন, সেদিন ওইসব পাথরের মূর্তিতেও প্রাণ ফিরে আসবে। গুলাবি মনে। প্রাণে বিশ্বাস করে সেই কথা। শুধু সেই নয়, তার জাতের সবাই। সেই বিশ্বাসেই তারা আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকে, সেই বিশ্বাসেই তারা বুনো হাতির সামনে দাঁড়িয়ে কোঁচড় থেকে ক্র্যাকার বার করে মাটিতে আছড়ে ফাটায়। সেই বিশ্বাস বুকে নিয়েই গুলাবির জাতের লোকেরা ভয়ংকর জাঙ্গল ম্যালেরিয়ায় পালে পালে মরে। মরতে মরতেও বক্সার জঙ্গলকে আঁকড়ে ধরে থাকে। কোত্থাও যেতে চায়না এই জঙ্গল ছেড়ে। কারণ এই জঙ্গলই ভ্রমরকৌটোর মতন লুকিয়ে রেখেছে। তাদের প্রাণভোমরাকে, তাদের শিরোমণির গড়কে।
মধু বর্মনের মতন দুয়েকজনের বিশ্বাস শুধু অন্যরকম। কিন্তু তারা গ্রামের কারুরই আপনজন নয়। নেহাত দায়ে অদায়ে ঠেকলে ওদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়। পেটে একটু বিদ্যে আছে কি না তাই।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গুলাবি পৌঁছে গিয়েছিল পাথরে বাঁধানো গোল চাতালটার কাছে। জায়গাটা আসলে চারপাশে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা পাথরের বেদি। একসময়ে এইখানেই না কি রাজা শিরোমণির সিংহাসন পাতা থাকত। তাই এখনও এইখানে এসেই তারা মনস্কামনা জানায়। জায়গাটা একটু ঢালু মতন, একটু এবড়ো-খেবড়ো। সারা রাতের শিশির বোধহয় পাথরের খাঁজে জমে থাকে, তাই শ্যাওলায় ঢেকে আছে পথটা। গুলাবির প্লাস্টিকের চটি একবার স্লিপ কাটল সেই শ্যাওলার ওপর। সে সাবধানে মাথা নীচু করে শেষ পথটুকু পেরোল। তারপর মাথা তুলে তাকাল পাঁচিলটার ওপাশে, আর তাকানো মাত্রই তার বুকের রক্ত জমে বরফ হয়ে গেল।
গুলাবির দিকে পিছন ফিরে তিনটে লোক বসে আছে বেদিটার ওপর। টাকা দেওয়া নেওয়া হচ্ছে। বাণ্ডিল বাণ্ডিল টাকা। দুজনকে সে চেনে–চকচকি গ্রামের নেতা মধু বর্মন আর তার বডিগার্ড ঝুপা।
যে লোকটা অ্যাটাচি থেকে টাকার থাকগুলো ওদের হাতে তুলে দিচ্ছে তাকে চিনতে পারল না গুলাবি। এ দেশের লোক নয়।
যাই হোক, ওদের কারবারে গুলাবির কিছু এসে যায় না। তাকে নিজের মানতের কাজটা সারতে হবে। গুলাবি একটু গলা তুলেই প্রশ্ন করল, কী খবর হে মধুবাবু? বিজনেসে খুব কামাচ্ছ। মনে হচ্ছে যে।
তিনটে লোকই চমকে উঠে মুখ ঘোরাল।
হাসতে হাসতে গুলাবি উঠে পড়ল চাতালে। দাঁড়াল একেবারে ওদের মুখোমুখি।
যে লোকটা টাকা দিচ্ছিল সে দাঁতে দাঁত চিপে কেটে কেটে বলল, শুয়োরের বাচ্চা রাকেশকে যে নীচের রাস্তাটা পাহারা দিতে বললাম, সে গেল কোথায়? কথাগুলো পরিষ্কার কানে এল গুলাবির, আর এই প্রথম সে বুঝতে পারল কোথাও একটা গোলমাল আছে। যে ছেলেটাকে সে পাশ কাটিয়ে এল সে তাহলে পাহারাদার রাকেশ। কিন্তু পাহারা কেন? কেনই বা এই নির্জন জায়গায় ওরা টাকা দেওয়া নেওয়া করছে।
মধু বর্মন ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, এগিয়ে আসছে তার দিকে। দুজনের মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে। আরও কমছে…আরও। গুলাবি দেখতে পাচ্ছে মধুর মুখে একটা অন্যরকমের হাসি। হাসি নয়, যেন ঘন লালা ঝরে পড়ছে। একদম শেষ মুহূর্তে কে যেন গুলাবির বুকের মধ্যে হেঁকে উঠল গুলাবি তোর বড় বিপদ। পালা গুলাবি, পালা!
কিন্তু ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। মধু বর্মনের ডান হাতের মুঠি পুরো শক্তি নিয়ে আঘাত করল গুলাবির রগের ঠিক মাঝখানে। জ্ঞান হারিয়ে পাথরের চাতালের ওপর আছড়ে পড়ল গুলাবি।
এইবার বাকি দুজনও এগিয়ে এল। ঝুপা মধুকে জিগ্যেস করল, একে কি খতম করে দেব গুরু?
তা ছাড়া উপায় কী? শালি অনেককিছু দেখে ফেলেছে।
ঝুপা পকেট থেকে একটু ভাঁজ করা ছুরি বার করে অচৈতন্য গুলাবির দিকে এগিয়ে যাওয়ামাত্রই তৃতীয়জন তাকে হাত বাড়িয়ে থামাল। বলল, আবার এইসব খুনখারাপি কেন? জায়গাটা গরম হয়ে যাবে যে।
তুমি থাম। ঝটকা মেরে তার হাতটা সরিয়ে দিল মধু। যত গরম হয় তত লাভ। ছ্যাঁকা। খেয়ে শালা প্রমিত ব্যানার্জি যাতে দৌড়ে পালাবার পথ না পায় সেই ব্যবস্থাই করছি। এই ঝুপা, মাগিটার হাত-মুখ বাঁধ। কী দিয়ে বাঁধবি আবার জিগ্যেস করছিস? শাড়িটা আছে কী করতে?
ইঙ্গিত বুঝতে ঝুপার অসুবিধে হল না। ততক্ষণে রাকেশ বলে সেই ছেলেটাও কথাবার্তার আওয়াজে ওপরে উঠে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে দুজনে মিলে গুলাবির শরীর থেকে সমস্ত কাপড় ছিঁড়ে ওকে নগ্ন করে ফেলল। ধর্ষণের সময় গুলাবির জ্ঞান ফিরে এসেছিল, কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকায় তার কিছু করার ছিল না। চারটি পুরুষপুঙ্গব একে একে তার ওপরে অত্যাচার চালিয়ে শেষে অবিকল পাঁঠা জবাইয়ের ঢঙে তার গলার নলিটা কেটে দিয়ে নেমে গেল নীচে।
ওরা চলে যাওয়ার পরেও গুলাবির নিথর শরীরের আশে পাশে ডানা বাঁধা পায়রাটা লেঙচে লেঙচে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অন্ধকার আরও একটু গাঢ় হতেই একটা প্যাঁচা এসে সেটাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল।
.
০৭.
পরেরদিন প্রমিতের জিপসি যখন হরিণডুবি ফরেস্ট বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ঘড়িতে বাজে ছটা। ভোরের লজ্জারুণ মুখে তখনও কুয়াশার হালকা ওড়না।
হরিণডুবি বাংলোটা জয়ন্তীর একেবারে তীর ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছিল। নদীর বুকেও। তখনো কুয়াশা জমাট বেঁধে রয়েছে।
বাংলোর সামনের দিকে, মানে নদীর দিকে মুখ করে চওড়া বারান্দা। সেখানে একটা টি-টেবলের দুপাশে দুটো বেতের চেয়ারে বসে চা পান করছিল দ্যুতি আর রূপেন শইকিয়া। গাড়ি থেকে নেমে কাঠের গেটটা খুলে প্রমিত নুড়িপাথরের রাস্তা ধরে সেই দিকে এগিয়ে গেল। প্রমিতকে দেখে রূপেন উঠে দাঁড়িয়ে সাদরে ডেকে নিল তাকে। দ্যুতি কি করবে ঠিক করে উঠতে না পেরেই যেন চশমাটাকে আঙুলের ঠেলায় চোখের ওপর তুলে দিল। প্রমিত একটা চেয়ারে। বসার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলোর বেয়ারা তার সামনে চায়ের পেয়ালা আর বিস্কিটের প্লেট রেখে গেল।
চায়ের কাপে একটা বড় চুমুক দিয়ে তৃপ্তির আওয়াজ করল প্রমিত। তারপর চেয়ারে গাটা এলিয়ে আরাম করে বসল। এই স্নিগ্ধ ভোর, এই কুয়াশায় ভেজা ঘাসপাতার তাজা গন্ধ আর অজস্র পাখির গান তার মনের ওপর গত পাঁচদিন ধরে জমে থাকা বিষণ্ণতার পরতটার ওপর ডাস্টার বোলাচ্ছিল। আস্তে আস্তে আগের মতন উজ্জ্বল আর আনন্দময় হয়ে উঠছিল তার অন্তরাত্মা।
প্রমিতের হাবভাব লক্ষ করে রূপেন শইকিয়া বললেন, আরেকটু পরেই বেরোই না কি মিস্টার ব্যানার্জি? এই কুয়াশায় রিভারবেড দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে। পাথরে লেগে মোবিল ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে যেতে পারে। মনে হয় আধঘন্টার মধ্যে রোদ উঠে যাবে, তখনই না হয় বেরোব আমরা। ততক্ষণে বরং আমরা ব্রেকফাস্টটা করে নিই। তাহলে ফিরবার তাড়া থাকে না।
প্রমিতের নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে রূপেন শইকিয়া ব্রেকফাস্টের কথা বলবার জন্যে বাংলোর পেছনে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রমিত তার বাঁ-পাশে বসে থাকা দ্যুতির দিকে ফিরে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, আপনার কাজের ব্যাপারে মিস্টার শইকিয়ার সাথে কথা হয়েছে?
হুঁ। বড় করে ঘাড় হেলালো দ্যুতি। উনি আমাকে একটা আদিবাসী গ্রামে নিয়ে যাবেন বলেছেন। কী যেন বললেন গ্রামটার নাম…চিনাকুড়ি, হ্যাঁ, হা, চিনাকুড়ি। ওখানে মেচ ট্রাইবরা থাকে। ওদের গাঁওবুড়োর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন বলেছেন মিস্টার শইকিয়া। ওই গাঁওবুড়োরাই আমাকে বলে দেবেন জেনারেশন আফটার জেনারেশন ওরা কোন সব ফোক লোর শুনেছেন…
দ্যুতির বাক্যস্রোতকে বাধা দিয়ে প্রমিত বলল, আপনি পারবেন মিশতে?
প্রমিতের এই কথায় এক নিমেষে দ্যুতির মুখটা কালো হয়ে গেল। বলল, পারব না, না? আমি জানি, আমার কমুনিকেশন স্কিল খুব পুওর। ভালো কথা বলতে পারি না।
এবার প্রমিতের অপ্রস্তুত হওয়ার পালা। সে কোনওরকমে বলল, না, না, আমি তা মিন করিনি। আসলে আমি আদিবাসীদের নিজস্ব কাস্টমসগুলোর কথা বলতে চাইছিলাম। সেগুলো না জানলে ওদের সঙ্গে মেশা একটু মুশকিল তো। কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। ওইজন্যেই তো আপনাকে মিস্টার শইকিয়ার সঙ্গে ট্যাগ করে দিয়েছি। উনিই আপনাকে গাইড করবেন।
প্রমিত জানত দ্যুতি এই কথার পরেও তাকে ধন্যবাদ জানাবে না। জানালোও না।
দ্যুতিকে প্রথম দেখবার পর থেকেই প্রমিতের মনে একটা সন্দেহ হচ্ছিল। সেই সন্দেহটা মিলিয়ে নেবার জন্যে সে ডাকল, দ্যুতি!
উ? দ্যুতি সাড়া দিল।
একটা কথা জিগ্যেস করব, যদি কিছু মনে না করেন?
করুন।
আপনার পরিবারে কারা আছেন? মানে মা, বাবা, ভাই…
বাবা আছেন। আর স্টেপ মাদার। তবে ফ্যামিলির সঙ্গে আমার অ্যাটাচমেন্ট খুব কম। মা মারা যাবার পর থেকেই আমি হোস্টেলে থেকেছি, মানে আমার যখন সাতবছর বয়েস তখন থেকেই।
প্রমিতের সন্দেহটা মিলে গেল। এটিকেট ব্যাপারটা মানুষের সহজাত নয়। ওটা সংসারের অন্যদের দেখে শিখতে হয়। দ্যুতি সংসারে থেকেছে খুব কম।
তবে এটিকেট ব্যাপারটা প্রমিতের কাছে কখনওই খুব জরুরি কিছু বলেও মনে হয়নি। তার চেয়ে সিনসিয়ারিটির দাম অনেক বেশি। আর এই মেয়েটার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এর কোনও ভান নেই। একদম শিশুর মতন স্বচ্ছ চোখের তারা। শুধু সেই চোখের দৃষ্টি বইয়ের পাতা ছেড়ে ওঠে খুব কম।
বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলে, সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না? তারপর কি যেন? এত যে সুধা কেন সৃজিলে বিধি, যদি আমারি তৃষাটুকু পুরাবে না?–ধুর বাবা, কতবছর আগে যে শেষবার গীতবিতান নিয়ে বসেছি, মনে থাকে না কি অত? বনে থেকে থেকে একটা জংলিই হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে, থেমে যাওয়া কথাবার্তা আবার শুরু করার জন্যে প্রমিত দ্যুতিকে জিগ্যেস করল, ডক্টর রূপেন শইকিয়ার জীবনকথা শুনলেন? ইন্টারেস্টিং না?
কেমন করে শুনব? ঠোঁট উলটে বলল দ্যুতি। উনি নিজের সম্বন্ধে কিছু বলেন না কি? খালি গাছপালা, জীবজন্তু আর আদিবাসীদের কথাই বলে যান। সে সব শুনতেও ভালো লাগছিল, কিন্তু…
দ্যুতির কথা শুনে প্রমিত হেসে বলল, কোয়াইট লাইকলি। ডক্টর শকিয়ার মতন ভদ্রলোক নিজের সম্বন্ধে কিছু বলবেন এটা ভাবা যায় না। আচ্ছা, ওনার কিছুটা বায়োগ্রাফি আমিই বলে দিচ্ছি। একসঙ্গে যখন কয়েকদিন কাটাবেন তখন এটুকু জেনে রাখা ভালো।
উনি পাঁচবছর আগে গুয়াহাটি কলেজে বটানির লেকচারার ছিলেন। তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামলেন। ব্যবসাটা খুব ইন্টারেস্টিং ফরেস্ট প্রোডাক্টস-এর ব্যবসা। আমাদের এই ডুয়ার্সের জঙ্গলে নানান লতাপাতা গাছগাছড়া পাওয়া যায় যাদের দারুণ মেডিসিনাল ভ্যালু আছে। তা ছাড়াও কোনও গাছের ফল থেকে সুগন্ধী পাওয়া যায়, কোনও ফুলের পাপড়ি থেকে দারুন রং তৈরি হয়। আমিও সব জানি না। কিন্তু মিস্টার শইকিয়া জানেন। উনি নিত্য নতুন বই জার্নাল ঘাঁটাঘাঁটি করে এইসব খুঁজে বার করেন। এসব জিনিসের বেশিরভাগটাই বাইরে রপ্তানি হয়ে যায়। ভারতের থেকেও বিদেশের মাটিতে এইসব জিনিসের চাহিদা বেশি। ইওরোপ আমেরিকা যে ক্রমশ ন্যাচারাল প্রোডাক্টের ভক্ত হয়ে উঠছে জানেন নিশ্চয়ই?
আমরা মিস্টার শইকিয়াকে এইসব ফরেস্ট প্রোডাক্ট সংগ্রহ করার লাইসেন্স দিই। এতে আমাদেরও একটা উপকার হয়। আরণ্যক গ্রামগুলোর অনেক মানুষকে উনি এই গাছগাছড়া সংগ্রহের কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। ভালো পেমেন্ট দেন তার জন্যে। মানুষগুলো এরকম একটা ভালো জীবিকা খুঁজে পেয়েছে বলে গত কয়েকবছরে জঙ্গল কেটে চাষ করা কিম্বা জঙ্গলের মধ্যে গরু চরানোর মতন ক্ষতিকর ব্যাপারগুলো কমে গেছে। চোরাশিকারেও আগে লোকাল লোকেদেরই কাজে লাগানো হত। এখন ডক্টর শইকিয়ার থেকে ভাত কাপড়টা পেয়ে যাচ্ছে। বলে ওরা চোরাশিকারিদের মুখের ওপর না বলে দিতে পারছে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রমিত বলল, ডক্টর শইকিয়ার গুয়াহাটির বাড়িতেও আমি এক দুবার গিয়েছি। বিশাল বাড়ি, বিরাট বাগান। বোঝাই যায়, ব্যবসা করে উনি ভালোই পয়সা করছেন। কিন্তু উনি নিজে যে ঘরটায় থাকেন সেই ঘরটা দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। একটা চৌকি ছাড়া আর আসবাব বলতে কিছু নেই। আর বই রয়েছে, মাটি থেকে ছাদ অবধি ঠাসা বই আর বইনানা বিষয়ের, নানান ভাষার। সেইজন্যেই মনে হয়, এই ব্যবসাটা উনি বোধহয় ওই গ্রামের লোকগুলোর জন্যেই করেন। ওদের মুখে দু-মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্যে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে দ্যুতি বলল, অদ্ভুত লোক, তাই না?
.
আধঘণ্টা পরে সত্যিই প্রমিতকে দুঃখিত করে রোদ উঠল। কুয়াশা কেটে গিয়ে ঝলমল করে উঠল নদীর চর। রূপেন শইকিয়াও পিঠে একটা রুকস্যাক নিয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওদের ডাক দিলেন–চলুন মিস্টার ব্যানার্জি, চল দ্যুতি। আর দেরি করলে আমার সবকটা জায়গায় যাওয়া হবে না।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে প্রমিত ভাবল, কি বিচ্ছিরি কাজ। এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে তাকে এখন একটা রক্তমাখা বধ্যভূমি দেখতে যেতে হবে। এনিওয়ে, ওয়ান শু্যড ওবে দ্যা কল অফ ডিউটি।
প্রমিত জিপসির ড্রাইভিং-হুঁইলে বসল। রূপেন শইকিয়া দ্যুতিকে নিজের গাড়িতে ডেকে নিলেন।
রূপেনের গাড়িতে উঠে দ্যুতি জিগ্যেস করল, এখন কোথায় যাব আমরা?
একটা গ্রামে যাব। গ্রামটার নাম দিবাং, রাভাদের গ্রাম। ওখানে তুমি তোমার কাজ করবে, আমি আমার কাজ…
আপনার কাজ মানে? একটু কৌতূহলি গলায় প্রশ্ন করল দ্যুতি।
দিবাং গ্রামের কাছে একটা বড় জলা আছে। সেখানে গ্রামের লোকেদের দিয়ে সিট্রানেলা চাষ করাবার কথা ভাবছি। সিট্রানেলা জান তো? একরকমের বুনো ঘাস। পেষাই করলে ওর পাতা থেকে সুগন্ধী তেল পাওয়া যায়। কীটনাশক হিসেবে দারুণ কাজ করে। মার্কেট-ভ্যালু অনেক।
তারপর কি খেয়াল হতেই রূপেন শইকিয়া জিভ কেটে বললেন, ইস ছি ছি! তোমার পাস পেপারে বটানি ছিল বললে তো। দ্যাখো তোমাকে আমি ট্রিানেলা চেনাচ্ছি। আমারও হয়েছে মতিভ্রম।
.
আর কথা না বাড়িয়ে দ্যুতিকে নিয়ে বোলেরোয় স্টার্ট দিলেন রূপেন শইকিয়া। পেছন পেছন নিজের জিপসি চালিয়ে আসছিল প্রমিত। সে নিজের গাড়িটাতেই যাচ্ছিল, কারণ, খুনের জায়গাটা দেখেই সে আলিপুরদুয়ারে ফিরে যাবে, কিন্তু ডক্টর শইকিয়াদের তারপরেও আরও ঘোরাঘুরি রয়েছে।
ছোট-বড় নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে টাল খেতে খেতে গাড়িদুটো কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল সেই নদীর তীরের ঘাসজমিটায়। প্রমিত আর রূপেন গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। দ্যুতি বসে রইল গাড়িতেই। তার কোলে অ্যানথ্রোপলজির বিদেশি জার্নাল। সেটার পাতাতেই ওর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ। ওরা দুজন কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, সে সব কিছুই প্রশ্ন করল না সে।
গাড়ি থেকে নেমে উলটোদিকের ভুটানপাহাড়ের সারির দিকে তাকালেন রূপেন শইকিয়া। তারপর প্রমিতকে জিগ্যেস করলেন, আপনি সিওর মিস্টার ব্যানার্জি যে, গুলিগুলো ওই পাহাড় থেকেই ছোঁড়া হয়েছিল?
প্রমিত বলল, তাছাড়া আর কি হতে পারে বলুন। বিমল বাবুয়ারা তো রিভারবেডে কিম্বা নদীর ওই তীরে কাউকে দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে ওভাবে বোকার মতন দুপায়ের ওপর উঠে দাঁড়াত না। শুয়ে শুয়েই তাকে গুলিতে খতম করে দিত। তার মানে যারা গুলি করেছে। তারা ওই পাহাড়ের ওপরে লুকিয়ে ছিল। আর তা ছাড়া ফরেনসিক রিপোর্টও বলছে গুলিগুলো ছোঁড়া হয়েছে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে। ওই দূরত্বে পাহাড় ছাড়া আর কী আছে বলুন?
কিন্তু ওই রাতে…নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে ওদের দেখল কেমন করে?
সেইটাই তো আমারাও ভেবে পাচ্ছি না, মিস্টার শইকিয়া। আপনি শুধু একজন বিজনেসম্যান কিম্বা স্কলার নন, ভালো শিকারিও। আপনি ভেবে দেখুন না, যদি কিছু কিনারা করতে পারেন।
রূপেন শইকিয়া অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সেই ঘাসজমির ফালিটা অবধি চলে। গেলেন। পেছন পেছন প্রমিত। বাবুয়া সন্দীপদের শরীরের চাপে থেঁতলে যাওয়া ঘাসগুলো এই কদিনে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। রক্তের দাগ ঢাকা পড়ে গেছে নতুন করে উড়ে আসা ধুলোমাটির নীচে। সেইখানে দাঁড়িয়ে প্রমিত উলটোদিকে পাহাড়গুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে হঠাৎ আত্মমগ্ন গলায় ডাকল, মিস্টার শকিয়া।
কিছু বলছেন?
আপনার চোখের দৃষ্টি কেমন?
লোকে তো বলে বাজপাখির মতন।
এবং আমি জানি আপনি একজন ক্র্যাকশট, বন্দুক হাতে আপনার টিপ ফসকায় না। তাহলে বলুন তো, এই মুহূর্তে আমি যদি আপনার হাতে একটা স্নাইপারস রাইফেল দিয়ে দিই, উইথ টেলিস্কোপিক সাইট, এবং আপনাকে বলি ওইই দূরে পাহাড়টার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষের হৃদপিণ্ডে গুলি করতে, আপনি পারবেন?
প্রমিতের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে রূপেন শইকিয়া তাকালেন পাহাড়ের দিকে। সমস্ত জায়গাটাই ডলোমাইট পাথরের একঘেয়ে ছাই রঙে চোবানো। রুক্ষ্ম পাথরের ওপর রোদ পড়ে ঠিকরে আসছে, ধাঁধা লেগে যাচ্ছে চোখে। রূপেন শইকিয়া দেখলেন এতদুর থেকে আলাদা করে কোনও আকৃতিই বোঝা যাচ্ছে না। তিনি নিশ্চিত সুরেই বললেন, না মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি আমাকে সবরকম ইকুইপমেনটস দিয়ে দিলেও পারব না। টেলিস্কোপিক সাইট ওই ডিস্ট্যান্সে কোনও কাজে আসবে না। বেস্ট সাইটের পাল্লাও আড়াইশো মিটারের বেশি হয় না। এ তো তার দশগুণ। আর, যেখানে টার্গেটটাকে দেখতেই পাচ্ছি না, সেখানে হিট করব কেমন করে?
আচ্ছা বেশ। এবার ধরুন রাতের ঘন অন্ধকারের মধ্যে, যখন আর কিছু দ্যাখা যাচ্ছে না, সেই সময়ে ওই পাহাড়টার মাথাতেই হঠাৎ একটা ছোট্ট বাল্ব জ্বলে উঠল। তখন পারবেন, ওই বাল্বটায় মারতে?
অবাক চোখে প্রমিতের দিকে তাকিয়ে রূপেন শইকিয়া বললেন, পারব। একটা বড় ব্যারেলের রাইফেল লাগবে, আর পয়েন্ট থ্রি উইনচেস্টার কিম্বা পয়েন্ট সেভেন রেমিংটন ম্যাগনামের মতন হালকা বুলেট…হ্যাঁ, তখন দশবারের মধ্যে দশবারই মারতে পারব। কারণ, তখন চারিদিকের অন্য সব আকৃতি হারিয়ে যাবে। চোখের সামনে থাকবে শুধু টার্গেট। আর কিছু নয়।
আচ্ছা এবার ভাবুন তো, সেই পরিস্থিতিটাই যদি উলটে যায়। ওই পাহাড়ের মাথায় টেররিস্টরা যদি দ্যাখে এদিকে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে শুধু তিনটে আলোকিত মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে?
কথাটা মনে হল রূপেন শইকিয়ার বেশ মনঃপুত হল। তিনি গম্ভীরভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, হুঁ, একমাত্র এইভাবেই রহস্যটার ব্যাখ্যা করা যায়। কেউ ওদের গায়ে তীব্র আলো ফেলে ওদের টার্গেট বানিয়ে দিয়েছিল।
প্রমিত বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়ল। বলল, এই ব্যাখ্যাটাই পুলিশও দিচ্ছে মিস্টার শইকিয়া। ইন ফ্যাক্ট, ওরা ওদের তদন্তও এই লাইনেই চালাচ্ছে। কিন্তু এই থিয়োরিটাও কি বিশ্বাসযোগ্য?
কেন? বিশ্বসযোগ্য নয় কেন? রূপেনকে অসন্তুষ্ট দ্যাখাল।
আপনি মনে মনে একবার সিচুয়েশনটা ভেবে দেখুন। প্রথমত, ওদের গায়ে আলো ফেলার কাজটা যে করবে তাকে ওদের ফলো করে আসতে হবে। রাতের জঙ্গলে ওদের মতন মানুষকে ফলো করার কাজটা মানুষখেকো বাঘের পক্ষেও কঠিন, কারণ তখন চোখ নয়, মানুষ কান দিয়ে দেখে। পায়ের তলায় একটা কুটো পড়ে ভেঙে গেলে যে শব্দ হয়, রাতের অরণ্যে সেই শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যায়। আর সেরকম একটা কুটোও না মাড়িয়ে কেউ ওদের ফলো করে এসেছে এটা একরকম অবিশ্বাস্য।
দ্বিতীয়ত, যদি কেউ ততটা সফলভাবে ওদের ফলো করে এসেই থাকে, সে নিজে ওদের না মেরে অত ঝামেলা করে গায়ে আলো টালো ফেলতে যাবে কেন?
তৃতীয়ত, বিমলদের রিফ্লেক্স ছিল চিতাবাঘের মতন। গায়ে আলো পড়া মাত্র ওদের পক্ষে যেটা স্বভাবিক ছিল সেটা হল পেছনদিকে ঘুরে গিয়ে আলোর উৎসে গুলি করা। ওরা তা করেনি। মৃত্যুর সময় ওদের মুখ ছিল ভুটান পাহাড়ের দিকে ফেরানো। তার মানে, ওদের পেছনের দিকে সন্দেহজনক কিছুই ঘটেনি।
রূপেন শইকিয়া হতভম্ব মুখ করে বললেন, তাহলে কি নদীর ওপাড় থেকে তীব্র সার্চলাইট…
কথা শেষ করার আগেই প্রমিত বলল, অসম্ভব। বক্সার আশেপাশে কম মানুষ বাস করে না, আর তাদের অনেকেই এই হেমন্ত মাসে হাতি তাড়ানোর জন্যে সারারাত ফসলের ক্ষেতে বসে থাকে। সেই রাতেও ছিল। আপনি যা ভাবছেন সেরকম হলে, আকাশে আলোর ছটা কারুর না কারুর চোখে পড়তই এবং আমরা জানতে পারতাম।
ওরা দুজন ঘাসজমিটার কাছ থেকে রওনা হয়ে, ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রমিতের গাড়ি অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। গাড়ির সিটে উঠে দরজাটা টেনে বন্ধ করে প্রমিত বলল, আমি নিজেও খুব কনফিউজড মিস্টার শইকিয়া। হয়তো টেররিস্টদের হাতে অত্যাধুনিক কোনও নাইট ভিশন বায়নোকুলার চলে এসেছে, যার হদিস আমরা রাখি না। তা ছাড়া আর কী হতে পারে বলুন?
গাড়ির জানলায় রাখা প্রমিতের হাতের ওপর নিজের হাতটা আলতোভাবে রেখে রূপেন শইকিয়া বললেন, মিস্টার ব্যানার্জী, ভেঙে পড়বেন না। আমিও আপনার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। এ রহস্য আমি ভেদ করবই।
থ্যাঙ্কস। আপনারাও আর দেরি করবেন না। রওনা হয়ে যান। আর যেভাবে হোক সন্ধের আগে বাংলোয় ফিরে যাবেন। রাতকেই এখন বেশি ভয় পাচ্ছি। যে অন্ধকার আমাদের আড়াল দিত, সেই অন্ধকারই আমাদের ঘাতক হয়ে গেছে।
কথাটা বলে প্রমিত গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আলিপুরদুয়ারের দিকে রওনা হয়ে গেল। তার গাড়িটা যখন রূপেনের পার্ক করে রাখা বোলেরোকে পেরিয়ে যাচ্ছে তখন প্রমিত একবার গাড়িটাকে স্লো করে পেছনের সিটে পাঠমগ্না দ্যুতিকে ডাকল–হাই!
দ্যুতি মুখ তুলে তাকাল।
টেক কেয়ার। ডক্টর শইকিয়ার থেকে আলাদা হবেন না কখনও।
লাজুক হেসে দ্যুতি বলল, ঠিক আছে। আপনি চিন্তা করবেন না।
ছড়িয়ে থাকা বোল্ডারে বিপজ্জনক ভাবে দুলতে দুলতে প্রমিতের জিপ এগিয়ে যাচ্ছিল। সেইদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ দ্যুতি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডাকল–শুনুন।
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল প্রমিতের গাড়ি। সেও জানলা দিয়েই মুখ বাড়িয়ে পেছনে তাকাল। কী হল?
আপনিও সাবধানে যাবেন।
.
০৮.
দ্যুতি আর রূপেনকে বিদায় দিয়ে প্রমিত হরিণডুবি বিট-অফিসে গিয়ে কিছু ফাইলপত্রের কাজ সারল এবং তারপর সে যখন আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসের কম্পাউন্ডে গাড়ি ঢোকাল তখন বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেছে।
কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতেই প্রমিত দেখল অফিসের সামনে বেশ কিছু লোকের একটা জটলা। লোকগুলো সকলেই আদিবাসী; মহিলা পুরুষ মিলিয়ে প্রায় একশোজন হবে। কিন্তু কেন এসেছে ওরা? বুঝতে পারল না প্রমিত। আজ তো কোনও লাইসেন্স বিতরণের দিন নয়।
প্রমিত এটাও খেয়াল করল যে, লোকগুলো অস্বাভাবিক নীরব। ওদের ভাবভঙ্গিতেও কেমন যেন কাঠিন্য। লোকগুলোর চোখের দৃষ্টি সারাক্ষণ তার গাড়ির গতিপথ অনুসরণ করে যাচ্ছে।
গাড়িটাকে ধীর গতিতে অফিসের আরও একটু কাছে নিয়ে আসতেই সে দেখতে পেল জটলাটার অন্যপাশে একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর জটলাটার মাঝখানে মানুষের পায়ের ফাঁক দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে, তা নির্ভুলভাবে একটি মৃতদেহ। সাদাকাপড়ে মোড়া একটা লাশ ঠিক তার অফিসের বারান্দার নীচে মাটিতে শোয়ানো রয়েছে।
এই অবধিই দেখতে পেয়েছিল প্রমিত। এরপরেই সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে জমাট নৈঃশব্দকে চুরমার করে একটা, মাত্র একটাই গলা, চিৎকার করে উঠল–মারো!
সেই একটা শব্দই মুহূর্তের মধ্যে একশো গলায় ছড়িয়ে পড়ল। একটা বড় পাথর প্রমিতের জিপের উইন্ডস্ক্রিনটাকে চুরমার করে তার পাশে এসে পড়ল। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে দুটো কাজ একইসঙ্গে করল প্রমিত–চাবি ঘুরিয়ে জিপটার স্টার্ট বন্ধ করে দিল, আর মাথাটা নীচু করে নিজে বসে পড়ল সিটের নীচে। ততক্ষণে অসংখ্য পাথর এসে পড়ছে তার জিপের ছাদে। লোহা আর পাথরের সংঘাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে বসেও প্রমিত বুঝতে পারছিল মার মার শব্দ করে ভিড়টা ক্রমশ এগিয়ে আসছে, ঘিরে ধরছে তার গাড়িটাকে। ঠিক এই সময়েই আরও একটা পাথর ড্রাইভিং-সিটের পাশের জানলা দিয়ে ঢুকে সজোরে প্রমিতের কপালে আঘাত করল। চেতনা আর অচেতনার মাঝখানে দুলতে দুলতে প্রমিত বুঝতে পারল পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করেছে। কোলাহলটা ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছে। সে পকেট থেকে রুমালটা বার করে কপালে চেপে ধরল। সাদা রুমালটা দেখতে দেখতে লাল হয়ে গেল। প্রমিত টলতে টলতে নেমে এসে জিপের বডিটায় ভর দিয়ে দাঁড়াল। ততক্ষণে আদিবাসী মেয়ে পুরুষের জটলাটা পুলিশের তাড়ায় ফরেস্ট অফিসের কম্পাউন্ডের বাইরে পালিয়েছে। ফাঁকা চত্বরটায় তখন শুধু প্রমিত আর সেই কাপড়ে ঢাকা শবদেহ।
ওটা কার মৃতদেহ?
একটা বলিষ্ঠ হাত এসে প্রমিতের কম্পমান শরীরটাকে জড়িয়ে ধরল। প্রমিত পাশ ফিরে দেখতে পেল ডিএসপি দেবেশ কাশ্যপের গম্ভীর মুখ। কাশ্যপ সাহেব বললেন, স্যরি ব্যানার্জি। ওরা যে আপনার সঙ্গে কোনও কথা বলবার আগেই এত ভায়োলেন্ট হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। হতোও না, যদি না একটা স্কাউলে ওদের ইন্সটিগেট করত। প্রথম মারের ডাকটা সেই-ই দিয়েছিল। অ্যান্ড দেন দ্যা মব কট ইট আপ। বুঝতে পারছি না, শয়তানটা কে?
ওটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। মধু বর্মণের লোক এ কথা নিশ্চিত। তবে ওর সমস্ত চ্যালার মুখ তো আপনি চেনেন না। কাজেই অইডেন্টিফাই করতে পারবেন না। কিন্তু এবার আসল কথাটা বলুন। মৃতদেহটা কার?
ভেতরে চলুন, সব বলছি।
কেন, ভেতরে যাব কেন? ওদের ভয়ে? গোঁয়ারের মতন মাটিতে পা গেঁথে দাঁড়াল প্রমিত।
আরে না না। ডাক্তারকে খবর দিয়েছি। আপনার কপালে দুয়েকটা স্টিচ দরকার মনে হচ্ছে। সেটা তো এখানে দাঁড়িয়ে হবে না।
হাঁটতে গিয়ে প্রমিত বুঝতে পারল সে পায়ে জোর পাচ্ছে না। দেবেশ কাশ্যপের শরীরের ওপর ভর দিয়েই সে অফিসঘরে নিজের চেম্বারের ভেতর ঢুকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। চার পাঁচজন সহকর্মী এগিয়ে এল। তাদের সকলেরই চোখে উদ্বেগ। ওদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে ওর হাতে পুরু একটুকরো তুলো ধরিয়ে দিল।
থ্যাঙ্ক ইউ তারাপদ। ম্লান হেসে প্রমিত রক্তমাখা রুমালটা পাশের লিটার-বিনে ফেলে দিয়ে তুলোর টুকরোটা দিয়ে কপালের ক্ষতস্থানটা চেপে ধরল। সে বুঝতে পারল, ভোঁতা ব্যাথার অনুভূতিটা এবার কপাল থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। সে চোখ তুলে সহকর্মীদের দিকে তাকাল। বলল, আপনারা কাজে যান। তেমন কিছু হয়নি আমার। চিন্তা করবেন না।
ফরেস্ট অফিসের কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে অসন্তুষ্ট স্বরে কথাবার্তা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে তাদের হেড-অফ-দা-অফিসের ওপর এই আক্রমণের ঘটনাকে তারা ভালো চোখে দেখছে না। প্রমিত উদ্বিগ্ন মনে ভাবল, ওনারা প্রতিশোধের কথা ভাবছেন না তো? যারা এইমাত্র তাকে মেরে গেল, প্রমিত জানে, তারা নিজেরাই মার খাওয়া মানুষ। কোনওরকম প্রতিশোধের যোগ্যই তারা নয়।
কিন্তু সে নিজে কী দোষ করল? ওরা তাকে মারল কেন?
ঘর ফাঁকা হওয়ামাত্র প্রমিত দেবেশ কাশ্যপকে আবার জিগ্যেস করল, কী হল বলুন তো, মিস্টার কাশ্যপ? ওরা কার মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল? হাতিতে মেরেছে কাউকে?
না মিস্টার ব্যানার্জি। মানুষে। প্রথমে রেপ করেছে, তার পরে খুন। কাল রাতের ঘটনা। আজ ভোরে ওর আত্মীয়রাই বডি রিকভার করেছে। তারপর এই আনরেস্ট। বলছিল, আপনার সঙ্গে কথা না বলে পোস্টমর্টেমের জন্যে বড়ি ছাড়বে না। আমি থু-আউট সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম, চাইছিলাম পিসফুলি ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে। পারলাম না।
ওঃ ভগবান! আইডেন্টিফাই করা গেছে মেয়েটাকে?
হ্যাঁ। চকচকি গ্রামের মেয়ে, নাম গুলাবি নার্জিনারি। কাল দুপুরে একা একাই শিরোমণির গড়ে পুজো দিতে গিয়েছিল। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল ওখানে পৌঁছতে। ওখানেই গ্যাং-রেপড় হয়েছে।
ওখানে, মানে শিরোমণির গড়ে? আতঙ্কিত প্রমিতের তুলে ধরা হাতটা কপাল থেকে খসে পড়ল। এক ফোঁটা তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ল তার ক্ষতমুখ থেকে। সেদিকে দৃকপাত না করেই সে দেবেশ কাশ্যপের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, বলুন মিস্টার কাশ্যপ। শিরোমণির গড়ে একটা মেয়ে রেপড় হয়েছে? খুন হয়েছে? শিরোমণির গড়ে?
প্রমিতের আতঙ্কের কারণটা বুঝতে দেবেশ কাশ্যপের একটুও অসুবিধে হচ্ছিল না। তিনি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
প্রশ্নটা করার সময়ে প্রমিত নিজের চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উত্তরটা পাবার পর আবার সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল তার শরীরের ভেতরে কোনও হাড়ের কাঠামো নেই। ইতিমধ্যে একজন স্থানীয় ডাক্তার ঘরে এসে প্রমিতের কপালের ক্ষতস্থান সেলাই করে দিয়ে গেলেন। অ্যান্টি-টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে, ব্যথা কমানোর একটা ওষুধও তখনই খাইয়ে দিলেন, কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বলে গেলেন যে ব্যথার তাড়সে একটু পরে জ্বর আসতে পারে। এলে যে ওষুধ খেতে হবে তাও লিখে দিয়ে গেলেন তিনি।
ডাক্তারবাবু যতক্ষণ ঘরে ছিলেন ততক্ষণ প্রমিত আর কোনও কথা বলেনি; চোখ বুজে চেয়ারের পিঠে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে শুয়েছিল। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে ওই একই ভঙ্গিতে শুয়ে সে দেবেশ কাশ্যপকে বলল, এরপর কী হবে বুঝতে পারছেন?
দেবেশ কাশ্যপ কোনও উত্তর দিলেন না।
এরপর মধু বর্মন এবং তার অনুগামীরা আমার ওপর শকুনের মতন ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওরা বলবে, আজ ওখানে হোটেল গড়ে উঠতে দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।
এবারেও দেবেশ কাশ্যপের দিক থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া এল না। অবশ্য প্রমিত কোনও প্রতিক্রিয়া চাইছিল না বোধহয়। সে স্বগতোক্তির ঢঙে বলে চলল, মিডিয়াও আমাকে ছাড়বে না। একটা জায়গায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর দুটো এরকম ঘটনা। অ্যাডমিনস্ট্রেটর হিসেবে। আমাকে তো তারা কাঠগড়ায় তুলবেই।
প্রমিত চোখ বুজেই বুঝতে পারল দেবেশ কাশ্যপের ভারী হাতটা আলতোভাবে তার কাধ ছুঁল। কাশ্যপ বললেন, নিজেকে অপরাধী করবেন না ব্যানার্জি। দায় কি আপনার একার আছে? আমার নেই? ল অ্যান্ড অর্ডার তো আমারই এক্তিয়ারে। সে কথা যদি বলেন তো আমিও। মিজারেবলি ফেইল করেছি।
প্রমিত বলল, না, মিস্টার কাশ্যপ। আপনি ভালোই জানেন জঙ্গলের মধ্যে নাইট-পেট্রলিং করার ক্ষমতা আপনার পুলিশবাহিনীর নেই, ওটা আমারই দায়িত্ব। অথচ ট্র্যাজেডি দেখুন, বিমল বাবুয়ারা মারা যাবার পর থেকেই সেই নাইট-পেট্রলিং বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। একেই বলে উভয় সংকট। রাতে জঙ্গলে ঘুরলে ফরেস্টগার্ডরা মরবে। আর রাতপাহারা বন্ধ থাকলে গুলাবির মতন মেয়েরা মরবে। পশুপাখির কথা ছেড়েই দিন।
.
প্রমিতের একটা অনুমান নির্ভুল প্রমাণিত হল। দেবেশ কাশ্যপ বেরিয়ে যাবার একঘণ্টার মধ্যে কলকাতার তিনটে টিভি চ্যানেলের উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধিরা তাদের টিম নিয়ে আলিপুরদুয়ারে প্রমিতের অফিসে পৌঁছে গেলেন। কলকাতা এবং শিলিগুড়ির চার পাঁচটা সংবাদপত্রের সাংবাদিকও ছিলেন। প্রমিত মনে মনে হিসেব করে দেখল, ওর মাথায় স্টিচ পড়ার আগে এরা গুলাবির মৃত্যুর খবর পেয়েছে। তা না হলে এত দ্রুত এতটা পথ পেরিয়ে এখানে চলে আসা সম্ভব নয়।
এদের মধ্যে দৈনিক দিনকালের মহিলা-সাংবাদিক স্পষ্টই জিগ্যেস করলেন, শিরোমণির গড়ে মারমেড গ্রুপের কটেজ বানানোর প্রস্তাবটায় আপনি রাজি হচ্ছেন না কেন, মিস্টার ব্যানার্জি? তাহলে তো জায়গাটার একটা সিকিউরিটি থাকে। এমপ্লয়মেন্ট জেনারেটেড হয়।
প্রমিত পরিবেশ দূষণের কথা বলতে গেল, কিন্তু তুখোড় সাংবাদিকটি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন– দ্যাট ইজ নট ইওর লুক আউট মিস্টার ব্যানার্জি। তার জন্যে পরিবেশ মন্ত্রক রয়েছে। আপনি। তাদেরই বিচার করতে দিন না।
সাংবাদিক নয়, মহিলার গলায় মারমেডের উকিলের সুর শুনতে পেল প্রমিত৷ সে ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ, হয়তো শেষ অবধি আমাদের সেইরকম ডিসিশনই নিতে হবে।
মহিলার মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল।
প্রমিতও হাসল, তবে মনে মনে। সে জানত, দৈনিক দিনকালের মালিকানা মারমেড বিজনেস গ্রুপের হাতে।
.
সন্ধের সময় প্রমিতের অনুমানের বাকিটাও মিলে গেল। আজ সে অফিস থেকে অনেক আগেই ফিরে এসেছিল। তার বৃদ্ধ হেল্পিং-হ্যান্ড গণেশদা তাকে এক গ্লাস হরলিকস করে দিয়েছিল। তাই খেয়ে সে চুপ করে শুয়েছিল নিজের ঘরে। সেই সময়েই তার মোবাইলে মধু বর্মনের ফোনটা এল। মধু বর্মন সাপের মতন হিস-হিস করে উঠল ব্যানার্জি সাহেব, আমার কথাটা যদি মেনে নিতেন, তাহলে এভাবে আমাদের ওই তীর্থ আমাদেরই জাতের মেয়ের রক্তে লাল হয়ে যেত না।
তার উত্তরে মধুকেও আজ একই কথা বলল প্রমিত, যে কথা সে দুপুরে মিডিয়ার লোকজনকে বলেছিল। আমাকে আর দু-চারটে দিন ভেবে দেখার সময় দাও মধু। মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনার দরকার আছে।
হ্যাঁ, দেখুন দেখুন! তাড়াতাড়ি দেখুন। মধুর গলায় পুরোপুরি প্রভুত্বের স্বর। প্রমিতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ফোন কেটে দিল।
.
এর কিছুক্ষণ পরেই প্রমিতের জ্বরটা এল।
গণেশদা সন্ধে সাতটা নাগাদ রাতের রুটি তরকারি বানিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। প্রমিত একটা ঘোরের মধ্যে শুনল, যাবার সময় সে বলে গেল, দাদাবাবু, আমি বেরোলাম। দরজাটা বন্ধ করে দেবেন।
তবু দরজা খোলাই পড়েছিল সারা রাত। জ্বরের ঘোরে প্রমিতের মনে হচ্ছিল সে তাদের ভবানিপুরের বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছে। জানলা দিয়ে দুপুরের রোদ এসে যেন তার মাথা মুখ পুড়িয়ে দিচ্ছিল। সে কতবার বলল, মা, জানলাটা বন্ধ করে দাও। মা, জানলাটা…। কিন্তু মা কি কাজে ব্যস্ত কে জানে। এক বুক অভিমান নিয়ে আস্তে আস্তে অচৈতন্য হয়ে গেল প্রমিত।
.
০৯.
শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে প্রায় পনেরো একর জায়গার ওপর বছর দুয়েক হল গড়ে উঠেছে। এক নতুন বিলাসবহুল হোটেল। বাগান, সুইমিংপুল, পার্কিং-লট দিয়ে সাজানো হোটেল জেতবন।
ছতলা জেতবনের সর্বোচ্চতল জুড়ে একটিই সুইট তিনটি বড় ঘর, লাউঞ্জ, ডাইনিং রুম, কিচেন নিয়ে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বিলাসবহুল বাসস্থান। পুঞ্জ পুঞ্জ নরম আপহোলস্ট্রি দিয়ে মোড়া সোফাসেট, টিক-উড-এর ডাবলবেড, ফরাসি ক্রিস্টালের ল্যাম্পশেড, রেশমমসৃণ দেওয়ালে আইভরি ফ্রেমে বাঁধানো মুঘল মিনিয়েচারস্-এর প্রতিলিপি এবং বেত আর ধাতুর আরও অজস্র আসবাবে চোখ ধাঁধানো গৃহসজ্জা। এক কথায়, ধনী বিশ্বের যে-কোনও পাঁচতারা হোটেলের সমগোত্রীয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে জেতবনের এই প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট। এখানে। যারা থাকতে আসে তারাও বিশ্বনাগরিক প্রধানত ব্যবসায়ী কিম্বা ডুয়ার্সে শু্যটিং করতে আসা কোনও বলিউড ফিল্মস্টার। ক্বচিৎ কখনও খুব বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা।
আজ এই হেমন্তের সন্ধ্যায় যে দুজন মানুষ প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটের লাউঞ্জে বসে আছে তাদের অবশ্য ঠিক এই হোটেলের কাস্টমার বলা চলে না। তাদের মধ্যে একজন তো মালিকপক্ষেরই লোক–বিনতা মেহরা, আর অন্যজন তারই অতিথি, মধু বর্মন।
হ্যাঁ, হোটেল জেতবনের মালিকানা বিনতার মারমেড গ্রুপেরই হাতে। আর সেইই আর্জেন্ট কল দিয়ে ডেকে এনেছে মধু বর্মনকে। মধুর বডিগার্ড ঝুপা হোটেল থেকে একটু দূরে একটা ভাড়া করা টাটা সুমোর মধ্যে বসে অপেক্ষা করছে। বিনতার সঙ্গে কাজ শেষ হলে সে মধুকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার ফিরবে।
সন্ধেটা সুন্দর। জেতবনের লাউঞ্জের উত্তরমুখি কাচের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের বুকে সন্ধ্যা নামছে। আকাশে তারা ফুটছে, পাহাড়ি গ্রামগুলোতেও আলো জ্বলে উঠছে। অন্ধকারে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের শরীর, মুছে যাচ্ছে দু-ধরনের আলোকবিন্দুর মাঝের সীমারেখা। মনে হচ্ছে, একটাই চুমকিগাঁথা কালো ভেলভেটের চাদর যেন মাটি থেকে আকাশ অবধি পাতা আছে।
বাইরের ওই শান্ত সৌন্দর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরের কনসিলড সাউন্ড সিস্টেমে খুব নীচু পারদায় বাজছে কেনি জি-র স্যাক্সোফোন। বিনতা মেহরা আর মধু বর্মনের মাঝখানে পিতলের কাজ করা জয়পুরি সেন্টার টেবলের ওপর নামানো আছে দুটি স্ফটিক স্বচ্ছ সুরাপাত্র। সোনালি সুরার গভীর থেকে বুদবুদ উঠছে অজস্র, অনর্গল।
তবে এ কথা নিশ্চিত যে, এই সব শান্ত সৌন্দর্যের কোনও প্রভাবই ঘরের দুই মানব মানবীর মনের ওপর পড়েনি। ওদের মধ্যে এখন একটা যুদ্ধ চলছে। দুজনেই যাকে ইংরিজিতে বলে ন্যাস্টি মুডে রয়েছে।
সেই মুডেরই প্রকাশস্বরূপ, বিন ওয়াইন গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে সেটাকে এত জোরে সেন্টার টেবলের ওপর নামিয়ে রাখল যে, কিছুটা মদ চলকে টেবিলের ওপর পড়ল। তারপর সে কোলের ওপর খসে পড়া আঁচলটাকে বুকের ওপর জড়ো করে, সামান্য টলোমলো পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। নীচে তাকাল। দেখল, নীল সুইমিংপুলের ধারে প্রমোদলোভীদের ভিড়। ট্রের ওপর খাদ্য পানীয় সাজিয়ে দ্রুত পায়ে যাতায়াত করছে হোটেলের বেয়ারারা। বারবিকিউ কাউন্টার থেকে ভেসে আসা ঝলসানো মাংসের সুঘ্রাণ এত ওপরেও উঠে আসছে।
কিন্তু বিনতার কিছুই ভালো লাগছিল নানা আলো, না পানীয়, না খাদ্যের সৌরভ।
দেখেই বোঝা যাচ্ছিল একই অবস্থা মধুরও। না হলে অত দামি ফরাসি সুরায় চুমুক দিয়ে কেউ অমন মুখবিকৃতি করেনা। সে চোখ তুলে তাকাল পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিনতার দিকে। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল বিনতার প্রশস্ত নিতম্ব, সরু কোমর আর প্রায় নগ্ন পিঠের দিকে। কামে, রীরংসায় জ্বলে গেল তার বুক। আঃ, একবার যদি ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া যেত ওই বিছানায়! ঠিক এই সময়েই বিনতা তীব্র মোচড়ে ঘুরে দাঁড়াল আর তার চোখ সরাসরি পড়ল মধুর কামুক চোখের ওপর। সেই দৃষ্টি চিনতে বিনতার ভুল হল না। সে ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে বলল, রেপিস্ট…মাডারার! তোমাকে আমি এই কাজ করতে বলেছিলাম?
মানে? মধুও আহত সাপের মতন ফোঁস করে উঠল। যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর! যা হয়েছে তাতে আপনার উপকার হয়েছে কি হয়নি বলুন।
সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। বাট ইউ নো, আমরা বিজনেস কমুনিটির লোক, কাজ উদ্ধার করার জন্যে ব্রাইব দিই, পলিটিকাল-প্রেসার অ্যাপ্লাই করি, সেগুলো আলাদা কথা। খুনখারাপি করি না। আর রেপ! ও মাই গড। একটা বেচারা মেয়ে…কোন জানোয়ার করেছে। ওই কাজ?
আমি জানি না। মধু ঘাড় গোঁজ করে বলল।
না, জানো না! ইউ স্কাউন্ডেল! ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে বলল বিনতা মেহরা। তারপর বারান্দা থেকে সেন্টার টেবল অবধি দূরত্বটা আবার টলোমলো পায়ে পেরিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ল ওয়াইনের গ্লাসটা হাতে তুলে নেবার জন্যে। এর ফলে বিনতার সুডৌল দুই স্তন মধুর নাগালের মধ্যেই উন্মোচিত হল। ক্রোধ আর কামে মেশা এক জান্তব তাড়নায় মধু ঝট করে হাত বাড়িয়ে বিনতার হাতের কব্জি চেপে ধরে বলল, গালাগাল দেবেন না বলছি। যা করেছি তার দাম চুকিয়ে দিন। চলে যাচ্ছি। বিনতার হাত ধরে একটা টান দিল মধু নিজের দিকে। পরক্ষণেই বিনতা দেখল, মধু বর্মন তাকে এক হাতে চেপে ধরেছে নিজের বিশাল জানুর ওপর। অন্য হাতটা তার বুকে। অবাক বিনতা অস্ফুট স্বরে একবার ডাকল, মেফিস্টো!
মধু ঠিক বুঝল না কী হল। সে শুধু দেখল বিনতার ওই ডাকে ভেতরের ঘর থেকে একটা ঝড় ছুটে এল। পরমুহূর্তেই যেন গরম লোহার অনেকগুলো শিক গেঁথে গেল তার কাঁধে। মধু দুটো হাতই বাড়িয়ে দিল সেই মূর্তিমান শমনকে সামলানোর জন্যে, যে ততক্ষণে তার গলার দিকে তাক করেছে।
মধুর মুঠির থেকে মুক্ত বিনতা নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চিবিয়ে চিবিয়ে মধুকে বলল, মেফিস্টো হল খাঁটি জার্মান ব্রিডের ডোবারম্যান পিনসার। কিলার ডগ। তোমার গলার নলি ছিঁড়ে নেবে ও।
মধু দুহাতে সেই খুনে কুকুরকে আটকাতে আটকাতে কাতর গলায় কোনওরকমে বলতে পারল, সরান। আপনার পায়ে পড়ছি একে সরান!
বিনতা এবার ঘরের দরজাটা খুলে দেয়ালের একটা পিয়ানো সুইচে চাপ দিল। বাইরে কোথাও একটা বেল বাজল।
মধু বর্মনের নিজের চেহারা যে কোনও মাপকাঠিতেই বিশাল, তবে বিনতা মেহরার ডাকে যে লোকটি ঘরে ঢুকল তার পাশে মধুকে বাচ্চাছেলের মতন লাগছিল। হোটেল-প্রহরীর পোশাক পরা দৈত্যাকার লোকটার তৎপরতা অবশ্য অবাক করে দেওয়ার মতন। ঘরে ঢুকেই ব্যাপারটা কী হয়েছে বুঝে নিতে তার এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগল না। একহাতে সে মেফিস্টোর গলার বকলশ ধরে তাকে টেনে সরিয়ে নিল, অন্য হাতে মধুর জামার কলার ধরে তাকে প্রায় ঝোলাতেই ঝোলাতেই ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে একবার মধুর দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বিনতার কাছে কোনও একটা কাজের অনুমতি চাইল। বিনতা দ্রুত ঘাড় নেড়ে তাকে নিবৃত্ত করল। বোঝা গেল, মধু বর্মন খুন হওয়ার হাত থেকে আপাতত। বেঁচে গেল।
তবে আহত হওয়াটা যে সে আটকাতে পারেনি সেটা টের পাওয়া গেল, যখন ঝুপা তাড়াহুড়ো করে তিনবাত্তি মোড়ের একটা সরবতের দোকান থেকে বরফ কিনে নিয়ে নিয়ে তাদের গাড়ির মধ্যে ঢুকল। গাড়ির পেছনের সিটে মধু বর্মন শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিল। তার শরীরের বেশ কয়েকটা জায়গায় কালশিটের দাগ। তার মধ্যে একটায় ঝুপা বরফ ঘসে দিতেই জ্বলুনির চোটে মধু চিৎকার করে উঠল, অ্যাইইই শুয়োরের বাচ্চা। মেরে ফেলবি না কি আমাকে?
এই সবই হচ্ছে প্রমিতের ওপর গ্রামবাসীদের আক্রমণের পরদিনের ঘটনা।
আগের দিন দ্যুতি আর রূপেন শইকিয়া তাদের কাজ সেরে বিকেল বিকেলই জঙ্গল। থেকে হরিণডুবি বাংলোয় ফিরে এসেছিল। কিন্তু হরিণডুবিতে না আছে মোবাইলের টাওয়ার, না টিভি। ফলে প্রমিতের ওপর আক্রমণের ঘটনা জানলো তারা পরদিন সকালে, হরিণডুবি বিট-অফিসের বিট অফিসার সজল দত্তের কাছে, যিনি আবার জেনেছিলেন অফিসের আর টি সেটে। ঘটনাটা জানার পরেই রূপেন শইকিয়া কালক্ষেপ না করে নিজের বোলেরোয় রওনা হয়ে গেলেন আলিপুরদুয়ারের দিকে। বেরোবার আগে একবার শুধু বলেছিলেন দ্যুতি, তুমি যদি চাও, তাহলে আমার লোকেদের বলে দিতে পারি, তোমাকে কালকের ওই গ্রামটাতেই আবার নিয়ে যাবে। ওখানে তুমি কাজ করতে পারো।
দ্যুতি এই কথা শুনে অসম্ভব অবাক চোখে রূপেনের দিকে তাকাল। তারপর খুব অস্ফুট স্বরে বলল, প্রমিতদার এই অবস্থা, আর আমি আজ কাজ করব! আমি যাব আপনার সঙ্গে। রূপেনের মনে হল তার চোখদুটো একটু ছলছলে।
তিনি লজ্জিত হয়ে বললেন নিশ্চয়, নিশ্চয়। চল, তাহলে রওনা হয়ে পড়ি।
ওরা যখন প্রমিতের বাংলোয় পৌঁছেছিল তখন সকাল আটটা। মফস্বল শহরের মন্থর জীবনছন্দে তখনও ঘুমের আবেশ জড়িয়ে রয়েছে। প্রমিতের বাংলোটাও যেন হালকা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল। বাংলোর রোয়াক পেরিয়ে রূপেন শইকিয়া আর দ্যুতি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। কলিংবেলের দিকে হাত বাড়িয়েও রূপেন হঠাৎ থমকে থেমে গেলেন। বললেন, এ কি! দরজাটা খোলা কেন? মিস্টার ব্যানার্জি তো এসব ব্যাপারে খুব পার্টিকুলার।
মিস্টার ব্যানার্জি।–একটা হাঁক দিয়ে রূপেন একটু ফাঁক হয়ে থাকা পাল্লাদুটোকে ঠেলে খুলে ভেতরে ঢুকলেন, পেছনে পেছনে দ্যুতি। দরজা আলগা পেয়ে একটা ভাম রাতের বেলাতেই ঢুকে পড়েছিল কোয়ার্টারের মধ্যে। কোথা থেকে একছড়া কলা টেনে নিয়ে এসে প্রমিতের সামনের ঘরের মেঝেতেই সেগুলোকে খেয়ে চটকে ভুস্টিনাশ করছিল। এখন চালাক জন্তুটা দুজন মানুষের শব্দ পেয়ে চট করে ওদের পাশ কাটিয়ে বাগানে বেরিয়ে গেল।
মিস্টার ব্যানার্জি। আবার ডাক দিলেন রূপেন শইকিয়া। তারপর খুব অবাক হয়েই স্বগতোক্তি করলেন, কী ব্যাপার! বাড়িতে কেউ নেই না কি! পরমুহূর্তেই ওনারা পৌঁছে গেলেন। ভেতরের সেই ঘরটায় যেখানে খাটের ওপর অদ্ভুতভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল প্রমিত। তার পরণে তখনো অফিসের পোশাক।
দ্যুতি একটা অস্ফুট আওয়াজ করে দৌড়ে গিয়ে খাটের পাশে বসে পড়ল। একটা হাত একবার প্রমিতের কপালে চুঁইয়েই শক লাগার মতন টেনে নিল। বলল, দেখুন, প্রমিতদার গা জুরে পুড়ে যাচ্ছে।
মাই গড! ইনি এই ভাবে সারা রাত পড়ে আছেন! রূপেন শইকিয়া পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে একটা নম্বর ডায়াল করে বললেন দত্তবাবু বলছেন? শুনুন, যেভাবে হোক একজন ডাক্তারকে তুলে নিয়ে আপনাদের ব্যানার্জি সাহেবের কোয়ার্টারে চলে আসুন। এক্ষুনি। উনি খুব অসুস্থ।
পরের কয়েকটা ঘন্টা প্রমিতকে নিয়ে সকলেরই খুব উদ্বেগের মধ্যে কাটল। একবার মনে হয়েছিল হয়তো হাসপাতালেই ভরতি করতে হবে। কিন্তু দুপুরের পর থেকে জ্বরটা নেমে গেল, আচ্ছন্ন ভাবটাও কেটে গেল আস্তে আস্তে। ডক্টর সোম, যিনি প্রমিতকে দেখছিলেন তিনি বিছানার পাশের চেয়ারটা সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একজন কাউকে খুঁজছিলেন, যাকে পরবর্তী শুশ্রূষার নির্দেশগুলো দিয়ে যেতে পারেন। তাঁর দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই এসে স্থির হল ঘরের মধ্যে একমাত্র মহিলা, দ্যুতির মুখের ওপর।
দ্যুতিও এগিয়ে এল ডক্টর সোমের দিকে। বলল, হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যান কি করতে হবে।
ডক্টর সোম বললে, ঘাটায় ইনফেকশন হয়ে গেছে। সেইজন্যই জ্বরটা এত বেড়েছিল। আমি আজ তো একবার ড্রেস করে দিয়ে গেলাম। কাল আবার এসে ড্রেস করে দিয়ে যাব। তার মধ্যে এই ওষুধগুলো চলবে।
দত্তবাবু ডক্টর সোমের হাত থেকে প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ কিনতে চলে গেলেন। দ্যুতি বুঝে নিল কখন কীভাবে সেসব ওষুধ খাওয়াতে হবে। ঠিক হল সেইই আপাতত প্রমিতের কাছে থাকবে। রূপেন শইকিয়া তার অন্যান্য কাজকর্ম সেরে, সন্ধেবেলায় হরিণডুবি ফেরার পথে দ্যুতিকে তুলে নিয়ে যাবেন। আর রাতে প্রমিতের কাছে থাকবে গণেশদা। সে আজ বাড়ি ফিরবে না।
সকলেই চলে গেল। ঘরে রইল শুধু দ্যুতি আর প্রমিত। কিছুক্ষণ খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসে দ্যুতি প্রমিতের রোগক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বেশ খানিকটা দ্বিধা কাটিয়ে ডাক দিল, প্রমিতদা!
প্রমিত বিছানার পাশের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। সাড়া দিল না। একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্যুতি উঠে পড়ল। বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির অন্যপ্রান্তে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াল। গণেশদা সেখানে নেই, সম্ভবত পেছনে কুঁয়োতলায় জামাকাপড় কাঁচতে গেছে। দ্যুতি নিজেই গ্যাস জ্বেলে জল গরম করল। তারপর তাকের ওপরে রাখা হরলিকস-এর শিশিটা নামিয়ে এক গ্লাস হরলিকস বানিয়ে নিয়ে আবার প্রমিতের ঘরে ঢুকল। বিছানায় পাশে দাঁড়িয়ে আবারও ডাকল, প্রমিতদা!
এই বার প্রমিত আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে দ্যুতির দিকে তাকাল।
দ্যুতি হরলিকস-এর গ্লাসটা একটা টুলে নামিয়ে রেখে প্রমিতের পিঠে হাত দিয়ে বলল, একটু উঠুন। প্রমিত বাধ্য ছেলের মতন উঠে বসল। দ্যুতি দুটো বালিশ তার পিঠের পেছনে গুঁজে দিয়ে তাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। তারপর গ্লাসটা প্রমিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা খেয়ে নিন!
এবারও প্রমিত বিনা বাক্যব্যায়ে তার নির্দেশ মেনে নিল। দ্যুতি বুঝতে পারল, প্রমিত কোনোভাবেই অন্য কোনোরকম কথাবার্তায় জড়িয়ে পড়তে চাইছে না। চাইছে না তার মাথার ভেতর অবিরাম যে চিন্তার জাল বোনা চলছে তাতে কোনও ছেদ পড়ুক। খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে দ্যুতি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাংলোর পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসল। কতক্ষণ বসে বসে শুনল নিস্তব্ধ দুপুরে কুঁয়ো থেকে জল তোলার ধাতব শব্দ। দেখল বাতাবি লেবুর গাছে দুটো দুর্গাটুনটুনি নেচে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। এখনই একটা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর কথা প্রমিতদাকে।
ঘরে ঢুকে দ্যুতি দেখল, সে যেভাবে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই বসে আছে প্রমিত। তার চিন্তামগ্ন দৃষ্টি একইভাবে জানলা দিয়ে বাইরে দিকে ফেরানো। দ্যুতি তাকে নীল ক্যাপসুলটা খাইয়ে চুপচাপ বাইরে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎই তাকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে প্রমিত ডাকল–দ্যুতি!
অবাক হয়ে দ্যুতি ফিরে তাকাল।
তুমি দুপুরে কী খাবে? কোথায় খাবে?
হঠাৎই চোখে জল চলে এল দ্যুতির। এই লোকটা সবার কথা এত ভাবে কেন? কেন এর বুকে এত মায়া?
সে কোনওরকমে প্রমিতকে বলল, আপনাকে এখন সে সব ভাবতে হবে না। আমি গণেশদার সঙ্গে খেয়ে নেব। আপনি ঘুমোন।
চোখের জল আড়াল করতে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে গেল দ্যুতি।
.
১০.
তারপর কেটে গেছে আরও দুটো দিন। এই দুদিনেও প্রতিদিন সকালে দ্যুতি চলে এসেছে আলিপুরদুয়ারে প্রমিতের কোয়ার্টারে। ফিরেছে রূপেন শইকিয়ার সঙ্গে সন্ধেবেলায়।
তৃতীয়দিনে প্রমিত ঘোষণা করল–আর নয়। সেইদিন থেকেই দ্যুতিকে দ্যুতির কাজ করতে হবে, তাকে তার কাজ। অর্থাৎ সে অফিস জয়েন করবে, এবং দ্যুতিকে ফিরে যেতে হবে তার ফিল্ডওয়ার্কে।
দ্যুতি তার স্বভাবসিদ্ধ স্বল্পভাষায় যতটা পারা যায় প্রতিবাদের চেষ্টা করল। বোঝাতে চাইল প্রমিতের কপালের ক্ষতটা এখনও শুকোয়নি, শরীরও দুর্বল। অতএব সে যেন আরও দু-একদিন ছুটি নেয়। সে আরও বোঝাতে চাইল যে, তার গবেষণার কাজে যতটা সময় লাগবে ভেবেছিল ততটা সময় লাগবে না। কারণ, রূপকথা, লোককথা সম্বন্ধে যতটা তথ্য পাবে বলে দ্যুতি কলকাতায় বসে ভেবেছিল, এখানে এসে, দুদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বুঝতে পারছে, ততটা পাবে না। অতএব তার হাতেও সময় এখন উদ্বৃত্ত এবং সে সেই সময়টা অনায়াসে প্রমিতের জন্যে দিতে পারে।
প্রমিত রাজি হল না। দ্যুতি কালো ফ্রেমের ভারী চশমাটা দু-আঙুলে কপালের ওপর ঠেলে দিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল, তারপর কোনও কথা না বলে রূপেন শইকিয়ার গাড়িতে ফিরে গেল হরিণডুবির দিকে।
তিনদিন অনুপস্থিত থাকার পরে অফিসে পৌঁছে প্রমিত প্রথমে ঘণ্টা দুতিন কোনওদিকে চাইবার ফুরসত পেল না, এত কাজ জমে গিয়েছিল টেবলে। তারপর হঠাই তার কাজগুলো শেষ হয়ে গেল। শেষ ফাইলটা তার পিওন কানুবাবুর হাতে তুলে দিতে গিয়ে প্রমিত দেখল আকাশে অসময়ের হালকা মেঘ জমেছে। অদ্ভুত এক হলুদ আলোয় ছেয়ে গেছে চরাচর। তার। হঠাৎই কেমন যেন মনকেমন করে উঠল। অশোক রাইকে ডাকল না, নিজেই জিপসিটা চালিয়ে নিয়ে প্রমিত বেরিয়ে পড়ল অনির্দিষ্ট পথে। হাইওয়ে পার হয়ে ঢুকে পড়ল টাইগার রিজার্ভের মধ্যে।
বনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির গতি কমে যায়। রাস্তা এখানে নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি। সামান্য অযত্নেই অরণ্য এগিয়ে এসে গ্রাস করে নেয় মানুষের যাতায়াতের পথ। আদিম সব মহাবৃক্ষ থেকে বড় বড় ডাল ভেঙে পড়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। কখনও তা হাতিতে ভেঙেছে, কখনও ভেঙে পড়েছে পরগাছার ভারে। পড়ে আছে হাতির বিষ্ঠাও। তার ওপরে ঝাঁক বেধে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র প্রজাপতি। এইসবের মাঝখান দিয়ে সাবধানে জিপ চালিয়ে চলেছিল প্রমিত। কোথায় যাচ্ছিল তা সে নিজেও জানত না। কিছুদূর যাওয়ার পরে সে সেই দুই রাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছল, যেখান থেকে ডানদিকের রাস্তাটা চলে গেছে জয়ন্তী গ্রামের দিকে, আর সোজা পথটা শেষ হয়েছে বক্সা পাহাড়ের নীচে সান্তারাবাড়ি গ্রামে গিয়ে। ওই পথেই ভুটান থেকে পাহাড়ি লোকেদের পিঠের টুকরিতে চেপে সান্তারা, মানে কমলালেবু নামে সমতল বাংলায়। তাই গ্রামের নাম সান্তারাবাড়ি। প্রমিত সামান্য চিন্তা করে সান্তারাবাড়ির পথটাই ধরল।
একটা পাহাড়ি না পেরোনোর পরেই জঙ্গলটা ঘন হয়ে উঠেছে। সেখানেই হঠাৎ শুকনো পাতা মাড়িয়ে মানুষের দৌড়ে পালানোর আওয়াজ শুনতে পেয়ে জিপটাকে ব্রেক কষে দাঁড় করালো প্রমিত। তারপর নিজেও দৌড়ে গেল পলায়নপর পদশব্দের পিছনে। মানুষগুলোকে দেখতে পেল না প্রমিত, তবে তাদের ফেলে যাওয়া শালগাছের গুঁড়িটা দেখতে পেল। প্রমিতের সার্ভিস-রিভলভারটা সবসময়েই গাড়ির গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে রাখা থাকে। চট করে সেই অস্ত্রটা বার করে এনে প্রমিত জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে গেল। ভালো করে গাছের গুঁড়িটাকে দেখে সে বুঝতে পারল, হাতকরাত দিয়ে কাটা হয়েছে গাছটাকে–ওইখানেই, সম্ভবত কাল রাত্রেই। বিশাল গুঁড়িটার গা থেকে তখনও কাঁচা রজন গড়াচ্ছে। এই গাছটার এত বড় হতে কম করে সত্তর আশি বছর সময় লেগেছিল, অথচ নষ্ট হল কত সহজে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রমিত গাড়িতে ফিরে এল। তার প্রিয় এই অরণ্য কদিনের মধ্যেই লুঠেরাদের স্বর্গভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিক। বিমল বাবুয়াদের মৃত্যুর পর থেকেই এখানে। পাহারা প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু যে এইভাবে অবাধে গাছ কাটা হচ্ছে তাই নয় কাল রাতেই খবর এসেছে ঘাঘরঝোরার দিকে একটা বড় সম্বর হরিণকে মেরে পোচাররা তার শিং সমেত মাথাটা কেটে নিয়ে পালিয়েছে। এসব আটকাবার একটাই উপায়, নাইট-পেট্রলিং আবার। চালু করা। কিন্তু অবশিষ্ট ফরেস্টগার্ডরা বিমল বাবুয়াদের মৃত্যুর পর থেকে এতটাই ভয় পেয়ে গেছে যে, তাদের দিয়ে সে কাজ এই মুহূর্তে হবে বলে মনে হয় না। প্রমিত কলকাতায় চীফ কনজার্ভেটর অরিন্দম বসুর সঙ্গে আলোচনা করেছিল ব্যাপারটা নিয়ে। তিনিও কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায়ের কথা বলতে পারছেন না। সময়কেই এখন সময় দিতে হবে, যাতে সে ওই তিনজনের মৃত্যুর স্মৃতির ওপর ধুলো ফেলতে পারে। কিন্তু সে সময়টা কতখানি? তার মধ্যে নতুন করে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেবে না তো?
প্রমিত গাড়ি ঘুরিয়ে জয়ন্তী গ্রামের দিকে ফিরে চলল। ওখানে তাদের একটা বড় আউটপোস্ট রয়েছে। সেখান থেকে কিছু লোককে এখানে পাঠাতে হবে গাছের গুঁড়িটা রিকভার করে ডিপোয় নিয়ে যাবার জন্য। তাড়াতাড়ি কাজটা না সারলে আবার ফিরে আসবে কাঠ চোরেরা। কুচবিহার বা আলিপুরদুয়ারের বাজারে ওই গুঁড়িটার দাম হবে কিছু না হলেও দু-লক্ষ টাকা। যারা কাজটা করেছে তারা অবশ্য পাঁচশো, হাজার টাকার বেশি পাবে না। তবু সেই টাকাটাই এই গরিব লোকগুলোর কাছে অনেক। সেই জন্যেই ওরা ফিরে আসবে, কাঁধে কাঁধে ওই বিশাল গুঁড়ি বয়ে নিয়ে চলে যাবে গ্রামের মধ্যে লুকানো ডিজেল মোটরে চলা বেআইনি করাতকলের উঠোনে।
জয়ন্তীতে এসে প্রত্যেকবারই প্রমিত কিছুক্ষণ গ্রামের বাইরে চা-জলখাবারের দোকানটায় দাঁড়ায়। এবারেও দাঁড়াল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার এই দোকানটায় এলে। দোকানের এই বড়সড় চালায় ঢাকা ঘরটা, এই পাকা মেঝে–এ সবই আসলে এক সময়ের এক রেলওয়ে স্টেশনের অংশ। এইখানেই অনেকবছর আগে ছিল জয়ন্তী রেল স্টেশন। তখন আলিপুরদুয়ার থেকে এই অবধি চলে আসত মিটার গেজের ট্রেন। এই দোকানের বেঞ্চিতে বসে উলটোদিকের গাছপালাগুলোর মধ্যে নজর মেলে চাইলে এখনও মরচে পড়া তার, লোহার খুঁটি এইসব দেখতে পাওয়া যাবে। সবই দূর অতীতের সেই ট্রেন চলাচলের চিহ্ন। বক্সাকে যখন কেন্দ্রীয় সরকার সংরক্ষিত অরণ্য বলে ঘোষণা করল, তখন দেশের আইন অনুযায়ী জঙ্গলের ভেতরের সমস্তরকম কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আলিপুর জয়ন্তী রেলপথ, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জয়ন্তী নদীর তীরে ডলোমাইটের খাদানগুলো।
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে এক ভাঁড় চা খেয়ে প্রমিত আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল ফরেস্টের আউটপোস্টটার মধ্যে। সেখানে নিজের লোকজনকে কাঠচুরির জায়গাটা বুঝিয়ে দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে।
জঙ্গলে অন্ধকার নামে আচমকা। কিছুদূর যাওয়ার পরেই প্রমিতকে জিপের হেড লাইট জ্বালতে হল। ঘড়ি দেখল সাড়ে ছটা। নিজের অজ্ঞাতেই কখন যে সে হরিণডুবির দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছিল জানে না। খেয়াল করল, যখন গাছপালার ফাঁক দিয়ে জয়ন্তী নদী আর নদীর ওপাড়ে পাহাড় দেখতে পেল। প্রমিত সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে জিপটাকে রাস্তার মধ্যেই দাঁড় করিয়ে দিল। অন্ধকারের ঘাতকদের সম্বন্ধে তার মনের মধ্যেও গভীর এক ভয় শেকড় গেড়ে বসেছিল। জিপের হেডলাইট জ্বেলে রেখে তাদের টার্গেট হওয়ার ইচ্ছে প্রমিতের ছিল না।
জিপটাকে দাঁড় করিয়ে একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল প্রমিত।
এই পথ দিয়েই সেই রাত্রে বিমল বাবুয়ারা এগিয়ে গিয়েছিল। ওই নদীর তীরের ফাঁকা জমিটায় পৌঁছিয়ে ওরা শুয়ে পড়েছিল। তারপর বুকে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছিল জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে বাইরে। আর তখনই..।
হঠাৎই প্রমিতকে ভীষণ চমকে দিয়ে রাস্তার অন্যপ্রান্তে একটা লোকের চেহারা জেগে উঠল। লোকটা মাথা নীচু করে আপন মনে নদীর দিক থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে। জিপটাকে সে লক্ষ করেনি। প্রমিত গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে রাখা রিভলবারটার দিকে হাত বাড়িয়েও হঠাৎ হেসে ফেলে হাতটা গুটিয়ে নিল। লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে। এ সেই বুড়ো সোনারু মাঝি– যে লোকটা সবার আগে তিনজন ফরেস্টগার্ডের মৃতদেহ দেখেছিল। বুড়ো আরও একটু এগিয়ে আসতেই প্রমিত তার সামনে সামনে হেঁটে আসা ছাগল চারটেকেও দেখতে পেল। একই সময়ে বুড়োও মুখ তুলেই দেখতে পেল দাঁড়িয়ে থাকা জিপটাকে, আর দেখা মাত্র উলটোদিকে ঘুরে দৌড়নোর উদ্যোগ করল।
প্রমিত তাড়াতাড়ি জিপ থেকে নেমে হাঁক ছাড়ল–সোনারুকাকা! ও সোনারুকাকা! আরে ভয় পেলে না কি? আমি গো আমি, ডিএফও সাহেব। ভয় পাও কেন?
বুড়ো সোনারু একগাল হেসে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, অ্যাই দ্যাখো। আমি ভাবলাম বুঝি খুনেগুলো। প্রমিতের দিকে এগিয়ে এসে আভূমি নত হয়ে তাকে প্রণাম করল সোনারু।
প্ৰতিনমস্কার জানিয়ে প্রমিত বলল, তোমাকে কিন্তু জেলে পোরা উচিত সোনারুকাকা। তোমাদের না এই দিকে আসতে বারণ করেছি। কেন এসেছ? তুমিই তো সবথেকে ভালো জানেনা, একসপ্তাহ আগে কী হয়েছিল ওইখানে।
না এলে যে চলে না বাপ আমার। ফোকলা দাঁতে বলল সোনারু মাঝি। চাষের সময়। চারদিকে জমিতে ফসল। এখন ছাগলগুলো চরানোর ফাঁকা জমি পাই কোথায় মানিক? তাই আসতে হয়।
আর গুলি যখন তোমার পেট ফুড়ে দেবে, তখন কোথায় যাবে?
না বাপ, দেবে না। ওই পাহাড় থেকে আমাকে দেখা কি সোজা কথা? দেখবে, তবে না গুলি করবে।
তাহলে ওদের দেখেছিল কেমন করে? ওই বিমল, সন্দীপ ওদের?
বৃদ্ধ সোনারু এই বক্সাবনের ঘাসমাটির ওপর জন্মেছে। এই বনের ফলপাকুড়, পাখপাখালি, খরগোশের মাংস খেয়ে যুবক হয়েছে। এই বনের গাছের নীচে তার নারীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই অরণ্য থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে পেট ভরিয়েছে তার বংশধরদের। বনের ভেতরের জলাশয়গুলোর ধারের নরম মাটি যেভাবে জল খেতে আসা জীবজন্তুদের পায়ের ছাপে ভরে যায়, সেইভাবে সোনারুর মুখের চামড়ায় এই অরণ্য অজস্র দাগ কেটে গেছে। সোনারুর সঙ্গে কথা চালাবার সময় প্রমিতের মনের গভীরে হয়তো এই চিন্তাগুলো কাজ করছিল। নাহলে সে অন্ধকার বনপথে দাঁড়িয়ে তার সাথে এত কথা বলবেই বা কেন? তার মনে একটা ক্ষীণ আশা হয়তো ছিল–বুড়ো সোনারু তিন ফরেস্ট গার্ডের হত্যারহস্যের ওপর কোনও আলোকপাত করতে পারবে।
তবে প্রমিতের কথার উত্তরে সোনারু মাঝি যা বলল, তাতে তার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধেই প্রমিতের সন্দেহ জাগল। সোনারু বলল, ওই তিনটে ছেলে গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল গো। নাহলে খুনেগুলো ওদের দেখবে কেমন করে?
মানে!–সোনারুর কথা শুনে বিস্ময়ে প্রমিতের মুখ দিয়ে এ ছাড়া আর কোনও শব্দ বেরোল না। গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল মানে?
জঙ্গলের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করলে ওরকম অনেক কিছু হয়। ওই ছেলেগুলো বড় বেশি জঙ্গলের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করত। ওরকম করতে নাই। জঙ্গলকে একটু তফাতে রাখতে হয়। না হলে গায়ে আলকুশি লাগে, গা চুলকে লাল হয়ে যায়। কতরকমের গন্ধ পোকা আছে। গায়ে ঘষে গেলে দুর্গন্ধে তিষ্ঠোতে পারবে না। তেমনি গায়ে আলো লেগে যায়…
আলো লেগে যায়!
যায় বই কি। আমি তো এইখানে সন্ধেবেলা অবধি বসে থাকি। বসে বসে দেখি ওই শিরোমণির গড়ের পেছনের রাস্তাটা ধরে কখনও একটা বেজি দৌড়ে নেমে আসছে, কখনও একটা সাপ…
মুচকি হেসে প্রমিত বলল, বাবা, তোমার চোখের জোর তো এই বয়সেও সাংঘাতিক কাকা! এত দূর থেকে বেজি দেখছ, সাপ দেখছ! চোখ, না দূরবীন?
এমনিতে কি দেখতে পাই মাণিক? ওদের শরীরগুলো যে আগুনের মতন জ্বলে, তাতেই দেখতে পাই।
বুঝলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল প্রমিত। সে সোনারুর মুখ থেকে কড়া দিশি মদের গন্ধ পাচ্ছিল।
তারপর জিপে উঠতে উঠতে বলল, যাই হোক, তুমি সন্ধের পর এখানটায় ঘোরাঘুরি কোরো না।
আবার জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে বনের পথে চলল প্রমিত। মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই। সে জানে কোথায় যাওয়ার জন্যে সে বেরিয়েছে, কোথায় না গিয়ে সে আজ বাড়ি ফিরতে পারবে না।
দ্যুতিকে সে একটা ধন্যবাদ অবধি দেয় নি। সেই মেয়েটাকে, যে না কি এটিকেট জানে না।
সে নিজে জানে তো?
প্রমিতের মনে পড়ছিল, সংসারে অনভিজ্ঞ মেয়েটা কখনও তার মাথা ধুইয়ে দিতে গিয়ে সারা বিছানায় জল ফেলে একাকার করেছে। কখনও হাত চলকে সুপ ফেলেছে তার গায়ের ওপর। তবু চলে যাচ্ছে না তাকে ছেড়ে। হাঁ, তখনই গিয়েছে যখন সে তাকে একরকম তাড়িয়েই দিয়েছে।
ধন্যবাদ দিতে হবে ওকে। ক্ষমা চাইতে হবে ওই মেয়েটার কাছে।
কিন্তু কেমন করে…কোন ভাষায় সে সব করবে প্রমিত?
.
হরিণডুবি ফরেস্ট বাংলোর সামনে যখন জিপটাকে দাঁড় করালো প্রমিত, তখন নদীর বুকে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। অন্ধকারে নদীর ওপাড়ের পাহাড়গুলোকে অলৌকিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝে ওরা যেন গা মোড়ামুড়ি করছে, সামান্য হলেও সরে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। ফিসফিস করে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে, আর সেইসব কথাবার্তা শীতল বাতাস হয়ে ধেয়ে এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে ঘরের ভেতর মোমবাতির আলো।
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রমিত কম্পমান মোমবাতির সামনে বসে গভীর মনোযোগে খাতায় লেখাজোখা করছে যে মেয়েটা, তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাই, জীবনে এই প্রথম, প্রমিত ভীষণভাবে অনুভব করল, ওই যে মেয়েটা হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসে আছে, মোমবাতির আলোয় যার কপালের ওপর এসে পড়া ঝুরো চুলগুলোকে মনে হচ্ছে সোনার তার দিয়ে তৈরি, যার গলার কাছে একটা নীল শিরা দপদপ করছে আর যার বুকের ওপর থেকে খসে পড়েছে। অন্যমনস্ক ওড়না–ও দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত নয়, পিএইচডি অ্যাসপায়ারেন্ট নয়। ও এক নারী। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি, শরীরের প্রতিটি কোষে ও প্রমিতের থেকে আলাদা। ও ফিল্ডওয়ার্ক করতে এই হরিণডুবিতে আসেনি। ও এই হেমন্তের অরণ্যে এসেছে শুধু প্রমিতের জন্যে। যেভাবে মিলনপাগল পুরুষ তিমির ছুঁড়ে দেওয়া শব্দোত্তর তরঙ্গ চেতনায় ধারণ করে হাজার মাইল সমুদ্র পেরিয়ে ছুটে আসে তার সঙ্গিনী, সেই ভাবে শুধু প্রমিতের সঙ্কেতে সাড়া দিয়ে ও এখানে এসেছে। ও ওই পাহাড় নদী বনের সমান বয়সি এক আদিম সত্ত্বা, যেমন আদিম প্রমিত নিজে।
দ্যুতির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হয়তো তাকে কিছু বলে থাকবে। হঠাই সে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাল। বলল, একি প্রমিতদা। আপনি কখন এলেন! আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? আবার জ্বর এসেছে না কি আপনার?
ভীষণ ব্যস্ত হয়ে খাট থেকে নেমে দ্যুতি এগিয়ে এল প্রমিতের দিকে। দ্যুতি একেবারে প্রমিতের বুকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল। প্রমিতের দুই করতল তার অজান্তেই দ্যুতির ছোট্ট সুন্দর মুখটাকে ঘিরে ধরল। সেই দুই হাতের উত্তাপে দ্যুতির গালের চামড়া যেন পুড়ে যাচ্ছিল।
তার ভালো লাগছিল খুব।