ঘুমাবার আগে আয়নায়
ঘুমাবার আগে আয়নায় নিজেকে দেখার যে বাসনা সব তরুণীর মনেই থাকে। সে বাসনা মীরার ভেতর অনুপস্থিত। ওই কাজটি সে কখনো করে না। চুল বঁধে হাঁটতে হাঁটতে। সেই সময় সে গুনগুন করে গানও গায়। সে কখনো গান শেখে নি, তবে দু একটা সহজ সুর ভালোই তুলতে পারে।
আজ সে আয়নার সামনে বসে আছে।
বিশাল আয়না। এক ইঞ্চি পুরো বেলজিয়াম গ্লাস। সামনে দাঁড়ালে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। মনসুরউদ্দিন, মেয়ের ষোল নম্বর জন্মদিনে এই আয়না তাকে উপহার দুবলেছিলেন—রোজ এক বার আয়নার সামনে দাঁড়াবি এবং নিজের সঙ্গে কথা বলবি।
মীরা বিস্মিত হয়ে বলেছিল–কী কথা বলব?
নিজেকে প্রশ্ন করবি।
নিজেকে প্রশ্ন করার জন্যে আয়না লাগবে কেন?
তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন–তোর সঙ্গে কথা বলাই এক যন্ত্রণা। তুই আমার সামনে থেকে যা।
মীরা হাসতে হাসতে বলল, জন্মদিনে তুমি আমাকে ধমক দিয়ে কথা বলছি। এটা কি বাবা ঠিক হচ্ছে? এখনো সময় আছে। ধমক ফিরিয়ে নাও।
ধমক ফিরিয়ে নেব কীভাবে?
মুখে বল ধমক ফিরিয়ে নিলাম–তাহলেই হলো।
তাকে তাই করতে হলো।
মীরা তার জন্মদিনের উপহার এই বিশাল আয়নার সামনে অনেকবার দাঁড়িয়েছে কিন্তু কখনো নিজেকে প্রশ্ন করে নি। আয়নার ছবিকে প্রশ্ন করার পুরো ব্যাপারটা তার কাছে সব সময়ই হাস্যকর মনে হয়েছে। আজ অবশ্যি সে একটা প্রশ্ন করল। নিজের ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, মীরা দেবী, আপনি কেমন আছেন?
আয়নার মীরা দেবী সেই প্রশ্নের উত্তরে হেসে ফেলে বলল, ভালোই।
ভালোর পর ইকার লাগাচ্ছেন কেন? তার মানে কি এই যে আপনি বিশেষ ভালো নেই।
আচ্ছা ইকার তুলে দিলাম। আমি ভালো আছি।
খুব ভালো?
হ্যাঁ খুব ভালো।
খুব ভালো থাকলে গান গাচ্ছেন না কেন? আপনার মন খুব ভালো থাকলে আপনি উল্টাপাল্টা সুরে গান গেয়ে থাকেন। দেখি এখন একটা গান তো।
মীরা গুনগুন করে গাইল–
চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে
জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।
গান দুলাইনের বেশি এগুলো না। কাজের মেয়ে এসে বলল, বড় সােব আপনেরে যাইতে বলছে। মীরা গান বন্ধ করে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। কয়েকদিন থেকেই এই ভয় সে করছিল। না জানি কখন বাবা তাকে ডেকে পাঠান। সে চব্বিশ দিন ধরে এই বাড়িতে আছে। এই চবিবশ দিনে বাবার সঙ্গে তেমন কোনো কথা হয় নি। মনে হচ্ছে আজ হবে। বাবার মাথা এখন ঠিক আছে। লজিক পরিষ্কার। তবে শুধু একদিকের লজিক। এক-চক্ষু হরিণের মতো। সমস্যাটা এইখানে।
বাবা ডেকেছ?
মনসুরউদ্দিন সাহেবের ঘরের বাতি নেভানো। জিরো পাওয়ারের নীল একটা বান্ধ জুলছে। সে আলোয় তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তিনি মশারির ভিতর কম্বল গায়ে দিয়ে বসে আছেন। তিনি খাটের পাশে রাখা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, মীরা বোস।
মীরা বসতে বসতে বলল, রাত এগারটা বাজে। তোমার তো দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার কথা, এখনো জেগে আছ যে! ডাক্তার শুনলে খুব রাগ করবে।
শুয়ে ছিলাম। ঘুম আসছিল না।
ঘুমের ওষুধ খেয়েছ?
হুঁ।
এখন কতটুকু করে খাও? ফ্রিজিয়াম ফাইভ মিলিগ্রাম না। দশ মিলিগ্রাম?
দশ।
মীরা আর কী বলবে ভেবে পেল না। সে নিজের ভেতর চাপা উদ্বেগ অনুভব করছে। মনসুরউদ্দিন বললেন— মীরা, তুই কি আমাকে কিছু বলতে চাস?
না।
বলতে চাইলে আমি শুনতে রাজি আছি। ভালো না লাগলেও শুনব।
আমার কিছু বলার নেই বাবা। তুমি ঘুমাও।
বাইরের কিছু কথাবার্তা আমার কানে আসছে–শুনলাম মনজুরকে ছেড়ে তুই চলে এসেছিস ; সত্যি না মিথ্যা?
সত্যি।
কারণ কী?
ওকে আমার আর পছন্দ হচ্ছিল না।
পছন্দ না হবারই কথা–গোড়াতেই তো বোঝা উচিত ছিল।
তখন বুঝতে পারি নি।
অপছন্দটা হচ্ছে কেন?
অনেক কারণেই হচ্ছে। স্পেসিফিকেলি বলার মতো কিছু না। ছোটখাটাে ব্যাপার।
ছোটখাটাে ব্যাপারগুলোই আমি শুনতে চাই …।
মীরা চুপ করে রইল। সব কথা কি বাবার কাছে বলা যায়? বাবা কেন এই সাধারণ ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না?
তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, কথা বলছিস না কেন? কী করে সে—হাঁ করে ঘুমায়? নাক ডাকে? শব্দ করে চা খায়? সবার সামনে ফোঁৎ করে নাক ঝাড়ে?
মীরা হোসে ফেলল।
মনসুরউদ্দিন কড়া গলায় বললেন, হাসির কোনো ব্যাপার না। তুই পছন্দ করে আগ্ৰহ করে সবার মতামত অগ্রাহ্য করে একটা ছেলেকে বিয়ে করেছিস, এখন তাকে ছেড়ে চলে এসেছিস-কী কারণে চলে এসেছিস তাও বলতে পারছিস না। অপছন্দ? কেন অপছন্দ?
মনের মিল হচ্ছে না বাবা।
মনের মিলের সময় কি শেষ হয়ে গেছে? একটা মানুষকে বুঝতে সময় লাগে না? সেই সময় তুই দিয়েছিস?
হ্যাঁ দিয়েছি। তিন বছর অনেক সময়। বাবা শোন, সবকিছু তো আমি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে পারি না। এইটুকু তোমাকে বলতে পারি যে, আমার দিক থেকে চেষ্টার ক্ৰটি করি নি। তার সঙ্গে থাকতে হলে আমাকে প্ৰচণ্ড মানসিক কষ্টে থাকতে হবে। আমার পক্ষে তা সম্ভব না। সে ভালোবাসতে জানে না। সে খানিকটা রোবটের মতো।
আর তুই ভালোবাসার সমুদ্র নিয়ে বসে আছিস?
এমন করে কথা বলছি কেন বাবা?
কী অদ্ভুত কথা–ভালোবাসতে জানে না! দিনের মধ্যে সে যদি একশবার বলে, ভালোবাসি ভালোবাসি তাহলে ভালোবাসা হয়ে গেল? আমি তোর মার সঙ্গে বাইশ বছর কাটিয়েছি। এই বাইশ বছরে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ জাতীয় ন্যাকামি কথা বলেছি বলে তো মনে হয় না।
মুখে না বললেও মনে মনে বলেছ। লক্ষবার বলেছ–মনজুরের মুখে এই কথা নেই, মনেও নেই।
তুই মনের কথাও বুঝে ফেললি? তুই এখন তাহলে মনবিশারদ?
মনের কথা খুব সহজেই বোঝা যায় বাবা। যে মানুষটা আমাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসার ক্ষমতাই যার নেই তার সঙ্গে দিনের পর দিন আমি কাটাব কী করে?
ভালোবাসার ক্ষমতাই তার নেই?
না। এই যে আমি তাকে ছেড়ে চলে এসেছি–তাতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না বা মন খারাপ হচ্ছে না। সে বেশ খাচ্ছেদচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, অফিস করছে। আমি যদি এখন ফিরেও যাই।–তার জীবনযাপন পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন হবে না। সে খুশিও হবে না, অখুশিও হবে না।
মনসুরউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই ফিরে যাবি না–এরকম কোনো মতলব করেছিস নাকি?
হ্যাঁ করছি। তুই আমার সামনে থেকে যা। ভোরবেলা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি। তোকে দেখলেই আমার ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাবে। সেটা হতে দেয়া উচিত হবে না। সবচে’ ভালো হয় যদি এখন চলে যাস। ড্রাইভার তোকে জালালের বাসায় দিয়ে আসুক। ভাইয়ের সঙ্গে থােকআমার সঙ্গে না। যাদের দেখলে আমার ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যায়। তাদের আমি আমার আশপাশে দেখতে চাই না।
তুমি অকারণে এতটা রাগছ।
মনসুরউদ্দিন ঘর কঁপিয়ে হুঙ্কার দিলেন, গেট আউট! গেট আউট!
মীরা বের হয়ে এল। রাতে কোথাও গেল না। ভোরবেলা জালালউদিনের বাড়িতে উপস্থিত হলো। এই বাড়িতে একটি ঘর সব সময় তার জন্যে আছে। ঘরের নাম ‘মীরা মহল’।
মীরা তার ভাই এবং ভবির খুব ভক্ত। তাঁদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। মীরা অনেকটাই তাদের সন্তানের মতো।
সুটকেস হাতে গাড়ি থেকে নেমেই ভাবির সঙ্গে দেখা হলো। মীরা বলল, কেমন আছে ভাবি? আমি মীরা মহলে কিছুদিন থাকতে এসেছি। মীরা মহলের চাবি তোমার কাছে না ভাইয়ার কাছে?