বেন্দা ক্রমেই ঘন জঙ্গলের দিকে চলে যাচ্ছিল। একলা একলা ভর দুপুরে আমি কখনও হাজরাবাড়ির পেছনের জঙ্গলে যেতাম না। সবাই বলত, ও দিকটায় সাপ আছে। বেলা তো ছেলে। ছেলেদের সাহস বেশি আগে তা-ই মনে হত। এখন বুঝতে পারি, কথাটা ভুল। ছেলেদের সাহস বেশি না। গায়ের জোরের একটা ভরসা তাদের আছে। আসলে তাদের জ্ঞান কম। কী বিপদ আপদ ঘটতে পারে, সে ধারণা ওদের নেই। ছোট মেয়েরা অল্প বয়সেই যত সাবধান হতে পারে, ছেলেরা তা পারে না। পারলে বড়রা যেখানে ভয়েও যেত না, ছেলেমানুষ বেন্দা কখনও যেতে পারত?
বেন্দার সঙ্গে গেছলাম বলে, প্রথম ফড়িংটা ধরে ও আমাকেই দিয়েছিল। তারপরে যেটা ধরেছিল, সেটা আর আমাকে দেয়নি। চেয়েছিলাম বলে এমন বিচ্ছিরি ভঙ্গি করেছিল। পাজি ছেলেরা যা যা করে। কোমরটা সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে যেন কিছু দেখাচ্ছে, এমনি ভঙ্গিতে অসভ্যের মতো করেছিল। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, পুরুষের কি ওটা একটা বড় অহংকার নাকি। মেয়েদের ওপরে তাদের যত জোর জবরদস্তি খাটাবার জন্য। একটা অঙ্গের হেরফের কি তাদের মনে খুব গুমোর তৈরি করে ফেলে।
ছেলেবেলায় খুব অবাক হয়ে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ছেলেদের নাভির নীচের দিকে। তারপর নিজের নাভির নীচের দিকে। আমার নিজের কোনও ভাই ছিল না। সেটা একটা মনের কষ্ট ছিল? মাকে ছেলেবেলায় কত বলেছি, আমার একটা ভাই কেন হয় না। মা সবসময়েই জবাব দিত, ভগবান না দিলে কী করে হবে। ছেলেবেলায় জানতাম, ভগবান না দিলে ভাই হয় না।
আজও কি তার চেয়ে বেশি জানি। ছেলেবেলায় যা জানতাম, এখনও তাই জানি। ভগবান না দিলে কিছুই হয় না। আজ তো আমারও একটি পাঁচ বছরের ছেলে থাকতে পারত। বছরখানেক সে বেঁচেও ছিল। তারপর মারা গিয়েছিল। অসুখ বিসুখ তো অনেক ছেলেমেয়েরই হয়। সবাই তো মারা যায় না। আমার ছেলেটি মরে গেল কেন! ভগবান না রাখলে কিছু থাকে না। সকলে হয়তো এ কথা মানে না। দেখি তো কত লোকে কত রকমের বলে। আমাদের এ লাইনেই কত মেয়ে ভগবানের নামে মুখ ঘোরায়। আমি বিশ্বাস করি না যে, তারা ভগবানকে ভাবে না, ডাকে না। ডাক আর কতটুকুই বা কে ডাকি। আমার তো ছাই তাকে ডাকবার কথা মনে থাকে না। কিন্তু সময় হলেই মনে পড়ে। রোজ রোজ তো কই, সন্ধে হলেই একজন শাঁসালো খদ্দের দরজায় এসে কোঁচা ঝাড়ে না, অথবা তেমন মনের মতো একজন নাগর। সবই ভাগ্য। ভগবান না দিলে হয় না।
যে কথা বলছিলাম। খুব ছেলেবেলায়, ছেলেদের নাভির নীচের দিকে তাকিয়ে, নিজের দিকে তাকিয়ে বড় মন খারাপ হত। মরণ, মানুষের মন যেন কী আজব কলের যন্ত্র। ভাবতাম, ছেলেদের কেমন একটি জিনিস আছে। আমার নেই। ওদের কেমন হাত দেবার, ঘাঁটবার একটা জিনিস আছে। যার কিছু আছে, তাকেই তো লোকে চেয়ে দেখে। ছেলেবেলায় তেমনি তাকিয়ে দেখতাম। মনে মনে অবাক হতাম, দুঃখও লাগত। এখন বুঝতে পারি সেটা। হুস করে আমার একটি নিশ্বাস পড়ত মনে। মনে। ছোট ছেলেদের আদর করবার সময় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতাম। মনে মনে ইচ্ছে হত ছুঁতে।
তা বলে কি আর সেই সাত বছর বয়সে ও সব আর মনে হত। সাত বছরের ছেলের লজ্জা না থাকতে পারে, সাত বছরের মেয়ের লজ্জা তাদের থেকে বেশি। তারা নিজেদের প্যান্টের বোতাম যেখানে খুশি খুলতে পারে, মেয়েরা পারে না। গরিবই হোক আর বড়লোকই হোক, দেখেছি, মেয়েদের ছেলেমানুষ বয়স থেকেই সহবত শেখানো হয়। ছেলেরা সে রকম বয়সে যাই করুক, তাদের সাত খুন মাপ। মেয়েদের না।
বেন্দা এ রকম ভঙ্গি করায় আমার খুব রাগ হয়েছিল। বলেছিলাম, একটা ফড়িং চাইছি বলে ও রকম করছিস কেন? তুই ভারী অসভ্য।
বেন্দার ও সব থোড়াই কেয়ার। ও আমার কথার জবাব না দিয়ে আবার ফড়িঙের পেছনে ঘুরছিল। আমি সেই একটি ফড়িং নিয়েই বেন্দার ফড়িং ধরা দেখছিলাম। রাগ করেও যে চলে যাব, তা পারছিলাম না। বেলা ফড়িঙের পেছনে পেছনে অনেকখানি দূরে চলে গেছল। চারদিকে আসশ্যাওড়ার ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা জঙ্গলের মধ্যে আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। চলে যাব কি না, ভাবছিলাম। একটু পরেই বেন্দা ফিরে এসেছিল। আর একটা নতুন ফড়িং তখন ওর হাতে। সেটাকে সুতোয় বাঁধতে বাঁধতে বলেছিল, তোরটা দে নুড়ি, সুতোয় বেঁধে দিই। তারপরে আবার খুলে দিয়ে দেব।
আমি দিয়েছিলাম। মনে মনে আশা, বেন্দাকে খুশি করতে পারলে পরে একটার বেশি ফড়িং জুটতে পারে। বেলা পাঁচটা ফড়িং সুতোয় বেঁধে, আসশ্যাওড়ার ডালের সঙ্গে সুতোটা বেঁধে দিয়েছিল। ফড়িংগুলো উড়ছিল, দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। কত ভাল যে লাগছিল আজ এই বয়সে তা কেমন করে বোঝাব। বেন্দা হাততালি দিয়ে উঠেছিল, আরে বাস রে, কী রকম উঁচু দিকে উঠেছে দ্যাখ?
আমিও বেন্দার সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠেছিলাম। বেলা হাততালি দিয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে গান করছিল। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে হাততালি দিয়ে, ফড়িংগুলোর ওড়া দেখছিলাম। তারপর দুজনেই বসে পড়েছিলাম। দুজনে যে কী বকবক করেছিলাম তা আর এখন মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, বেন্দা বলেছিল, একদিন ও একশোটা ফড়িং ধরে সুতোয় বেঁধে ওড়াবে। শুনে আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।
তারপরেই জানি না, কোথা থেকে কী ঘটে গেছল। দেখেছিলাম, বেন্দা নাভির নীচে ঘাঁটছে। বোম খোলা, সবই দেখা যাচ্ছে। রক্তবর্ণ একটা শক্ত ছোট সরু শোলার খেলনার মতো। ও কিন্তু আমার দিকে দেখছিল না। আপন মনেই ও রকম করছিল আর ফড়িংগুলোর ওড়া দেখছিল। হঠাৎ আমার দিকে কিছু বলার জন্য ফিরে তাকিয়েছিল। আমি ওর নীচের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে, ও নিজেও সে দিকে দেখেছিল। হেসে আমার দিকে তাকিয়েছিল। বলেছিল, তোরটা দেখি।
আমি যে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। লজ্জা করছিল খুব। দৌড়ে পালিয়ে যাব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু পালাতেও পারছিলাম না। খালি বলেছিলাম, যা।
বেন্দা প্যান্টের অনেকটা খুলেই ও জিনিসটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। তখন ও ফড়িঙের দিকে দেখছিল না। আমার দিকে ফিরে বলেছিল, খেলবি?
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, কী খেলব?
বেন্দা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, আমি একটা খেলা জানি।
তখনও আমি পালাবার কথা ভাবছিলাম! পালাতে পারিনি। আমার ঝুটি ধরে যেন কে সেখানে বসিয়ে রেখেছিল। এক চুল নড়তে পারিনি। কেবল থেকে থেকে টুনটুনি পাখির ল্যাজ নাচানোর মতো, বেন্দার সেই জিনিসকে যেন নাচতে দেখছিলাম। স্পষ্টই মনে আছে, আমার শরীরের মধ্যে যেন কেমন করছিল। ভয়ও করছিল। ওটা যে একটা খারাপ ব্যাপার তাও মনে হচ্ছিল। আবার জিজ্ঞেস করেছিল, খেলবি না?
আমি বলেছিলাম, না, আমার ভয় লাগছে।
আমার তখন বলাই কাকার শরীরটার কথা মনে পড়েছিল। সে আর কাকিমা যা করেছিল, সেই ঘটনাটা সব দেখতে পাচ্ছিলাম। বেন্দা বলেছিল, এখানে কেউ আসবে না। ইজেরটা খোল।
কেউ আসবার ভয়ের কথা আমি বলেছিলাম কি না, মনে পড়ে না, আমি অন্য ভয়ের কথাই যেন ভাবছিলাম। মেয়ে তো। শরীরটা আমার অনেকখানি বস্তু। কিন্তু আমি বেন্দাকে অগ্রাহ্য করতে পারিনি। উঠে দাঁড়িয়ে আমার ইজেরটা খুলেছিলাম। বো বলেছিল, শুয়ে পড়।
আমি শুয়ে পড়েছিলাম। বেলা প্যান্টটা একেবারে খুলে ফেলেছিল। আমার গায়ের উপর রোদ আর ছায়া। মাথার উপরে আকাশ। বেলা আমার বুকের উপর এসে শুয়েছিল। আমার কী হয়েছিল আমি জানি না। বোরই বা কী হয়েছিল জানি না। আমি যেমন শুয়েছিলাম, তেমনি শুয়েছিলাম। একটা কী করছিল বেন্দা। বলাই কাকার মতো। আমি মনে করছিলাম, আমি আর বেন্দা, কাকিমা আর বলাই কাকার মতো করছি। কিন্তু কাকিমার মতো হুডযুদ্ধ হাসাহাসি করিনি। আমার কোনও কষ্ট হয়নি। বেন্দা আর আমি কেবল খেলেছিলাম।
আমি যেন চোখের সামনে এখনও স্পষ্টই সেই ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। এখন আমার সব কিছুতেই পাপ। মিছে কী বলব যে বস্তুতে আর কোনও টান নেই, তাতে যেন এখন আমি বেন্দাকে টের পাচ্ছি। সাত বছর বয়সে যা বুঝতে পারিনি, এখন সাতাশ বছরের বুড়ি বেশ্যার শরীরে সেই খেলা যেন নতুন করে খেলে উঠেছে। কিন্তু জেনে শুনে কোনও পাপ করিনি। হাজরাদের জঙ্গলে গোঁসাইদের বেন্দার সামনে সেই যে ল্যাংটো হলাম, সেই যে খেলোম, সেই খেলাই তুমি অক্ষয় করে রাখলে। সেই খেলাতে ভাত-কাপড় দিলে। টাকা পয়সাও দিলে। আর বড় ঘেন্না দিলে।
কাল থেকে ঋতু হয়েছে, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। এখন দু-তিনদিন লোক বসানো যাবে না, তাই বসে বসে লিখছি। ঘরে দরজা বন্ধ করে একটানা লিখছি।
এ কথা কেন মনে হয়? মনে হয়, সেই আমার শুরু। সেই শুরু বলব না। তবে শরীর নিয়ে, সেই আমার প্রথম খেলা। তারপরে আর কোনওদিন বেন্দার সঙ্গে সে খেলা খেলিনি। কিন্তু আমার সামনে বেলা খেলেছিল। সেই হাজরাদের পোডোর জঙ্গলে, কণার সঙ্গে। কণা এখন অতি বড় ঘরনি। মেয়েমানুষ বলে, কণা তো আমার থেকে সুন্দর ছিল না।
কিন্তু এখন ভাবি, কেন অমন খেলা খেলতে গেছলাম। আমার মায়ের পাপে কি? মায়ের কোনও কথা তো আমার মনে পড়েনি। আমার বাবা যে বড় ভাল লোক ছিল। তাকে সবাই নিরীহ সজ্জন বলত। বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছিল। যদি বলি রক্তের দোষ, তাই বা কেমন করে হয়। আর সে তো আমি একলা খেলিনি। কণা বলে না, গল্প গুজবে জানতে পারতাম, খেলাটা অনেক ছেলেমেয়েই খেলত।
তবে হ্যাঁ, সকলে তো নুড়ি না! আমার কপাল সকলের হবে। কিন্তু সকলের মতো কপাল আমিও চেয়েছি। পাড়ার কোনও মেয়ের বিয়ে হলে, বর এলে, ছুটে ছুটে দেখতে গেছি। বর দেখতে খুব ভাল লাগত। তা সে যেমনই হোক। নেহাত কালো কুচকুচে নাক খ্যাঁদা মাথায় টাক পড়া না হলেই হল। ছেলেবেলায় বরের বেশে যাকে দেখতাম, তাকেই ভাল লাগত। যে কনেকে দেখতাম, তাকেই ভাল লাগত। বর তো, এ কথা কি আর নিজেকে বলবার দরকার আছে, মনে মনে কনে হবার কত শখ ছিল। কেঁদে কেটে, সবাইকে কাঁদিয়ে বরের সঙ্গে চলে যাব। বারো বছর বয়স অবধি তাই বুঝতাম। তেরোর পরে আর জানিনি। তেরোতেই সব শেষ। তেরো বছর পড়তে, সব আশা শেষ!
আজ বাড়িওয়ালি ফুলবাসিয়ার ঘরে কোথা থেকে একটা ছোট মেয়েকে এনেছে। নতুন বলির পাঁঠা। বারো-তেরো বয়স হবে। এখন কত খেলাই হবে মেয়েটিকে নিয়ে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হবে, মেয়েটির প্রথম পুরুষ!
আমার বেলায় তো হয়নি। বাড়িওয়ালির ঘরে মেয়েটিকে দেখে, সেই চোদ্দো বছর আগের দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। বাড়িওয়ালির ঘরে মেয়েটাকে দেখেছি। এক বার মায়া লাগছে। আবার মনে হচ্ছে, বেশ হচ্ছে। আমারও তো একদিন হয়েছিল।
তবে পিসির জ্বালাতনের কথা আমি ভুলব না। মায়ের কাছে লোক আসা শুরু থেকে, পিসি বরাবরই আমার কাছে শুত। দু-একটা বছর, পিসি ভাজা মদ খেয়ে, বকবক করে ভালই ছিল। তারপরে পিসির কী রোগ হয়েছিল, সে আমাকে জাপটে নিয়ে শুত। আমার কী লজ্জা! বুড়ি মাগির গায়ের ঘেষটানি আমার একেবারে বরদাস্ত হত না। কিন্তু বুড়িটির মতলব ছিল আলাদা। তখন আমার দশ-এগারো বছর বয়স। ক্লাস ফোর ছেড়ে ফাইভে উঠেছি। কেন যে মাস্টার আমাকে বৃত্তি পরীক্ষায় যেতে দেয়নি, জানি না। বরাবর জানতাম, আমাকে বৃত্তি পরীক্ষায় পাঠানো হবে।
পিসি খলখল করে হাসত। আমাকে টেনে নিয়ে বলত, আয় আমি তুই বর বউ হই।
আমি বলতাম, মরণ। তোমার বুঝি ভীমরতি হয়েছে পিসি।
পিসি সেই বয়স থেকে আমার গায়ে হাত দিত। হাত দিতে আমার আপত্তি কী। বুড়ি মেয়েমানুষ গায়ে হাত দেবে, তাতে কি যায় আসে। কিন্তু বুড়ি ছিল হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। খারাপ খারাপ কথা বলত, ভঙ্গি করত। আর গায়ে বুকে বা এমন সব জায়গায় হাত দিয়ে এমন সব করত, খারাপ লাগত, গাটা যেন কাটা দিয়ে উঠত। আমি হাত পা ছুঁড়ে, দাপিয়ে একটা কাণ্ড শুরু করতাম। আবার কোনও কোনও সময় আমার যেন ফিট রোগের মতন হত। পিসিকেও থামাতে পারতাম না, আমার হাত পা পাকিয়ে উঠত, কী করতাম নিজেই জানতাম না। শরীরের মতো কেঁপে শিউরে একটা সুখের মতন লাগত। তারপরে মড়ার মতো পড়ে থাকতাম। কত দিন এমন হয়েছে, হাত কামড়ে দিয়েছি।
মায়েরও ও সব ভাল লাগত না। কত দিন বলেছে, নন্দ ঠাকুরঝি, মেয়েটাকে তুমি নিয়ে পড়েছ। কেন? ছেলেমানুষকে ও রকম কোরো না। আমার তো ইহকাল পরকাল, দুই-ই গেছে।
মা আগে আগে তা-ই বিশ্বাস করত। মা আমার বিষয়ে আগে অন্য রকম ভাবত। পিসিই মায়ের কানে মন্ত্র দিতে আরম্ভ করেছিল। আমি যতই বড় হয়ে উঠছিলাম, ততই পিসির মন্ত্র বাড়ছিল। এমনও অনেক দিন দেখেছি, আমি অন্য দিকে তাকিয়ে আছি, পিসি আমাকে দেখিয়ে মাকে যেন চুপিচুপি কী বলছে। আমার চোখ পড়ে গেলেই থমকে যেত। আমি পরে মাকে জিজ্ঞেস করলে, মা বলত, ও নন্দ ঠাকুরঝি পাগল, ওর কথা শুনতে নেই।সত্যি যদি সেই ডাইনি কুটনি বুড়ির কথা বলেই মা মনে করত, তা হলে আমার জীবনে আজ কী হত কে জানে। টের পাচ্ছিলাম, আমি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছি। আমার বুক বড় হচ্ছিল। বাবার শরীরের আড়াটা পেয়েছিলাম। মোটামুটি লম্বা হওয়ার দিকে ঝোঁক ছিল। বারো বছর বয়সেও আমি ফ্রক পরতাম। তখন ক্লাস সিক্সে উঠেছি। আমাকে দেখে পাড়ার সবাই বলত, দশাসই মাগি হয়ে উঠেছে।
আমার দিকে রাস্তার পুরুষেরা যেভাবে তাকাত তাতেই বুঝতে পারতাম, আমি বড় হচ্ছি, বড় হতে চলেছি। সকলেই, সব পুরুষেরাই আমার বুকের দিকে তাকাত। তারপরেই আমার কোমরের দিকে। ভাবতাম, এমন তো একেবারে সত্যি দশাসই হয়ে উঠিনি। গায়ে গাদাগুচ্ছের মাংসও লাগেনি। আমার থেকে অনেক বেঁটে মেয়ের বুক দেখে মনে হত, কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ের বুক। আমার তো সে রকম কিছু ছিল না। বরং একটু লম্বা ভাবের ছিলাম বলে, শরীরের ধাঁচ একটু রোগা রোগাই ছিল। তবে পুরুষের চোখই বোধ হয় ও রকম! মেয়েরা একটু বড় হলে, সকলের দিকে তারা এক রকম চোখেই তাকায়।
আমি তো আর আগের ইস্কুলে পড়তাম না। অন্য ইস্কুলে। তবে সেখানে পাকিস্তানের ছেলে-মেয়েরা পড়ত। ইস্কুলটা খুব পুরনো ছিল না। সেখানে দিদিমণিরা পড়াত। মাস্টারমশাইরাও পড়াত। দুজন মাস্টারমশাই ছিল। দুজনেই আমার বুকের দিকে, কোমরের দিকে তাকিয়ে দেখত। যেমন বাইরের আর অপর লোকেরা দেখত। তবে বাইরের রাস্তার লোকেরা দেখত বেহায়ার মতো। মাস্টারমশাইরা সেভাবে না।
তখন ইস্কুলে মেয়েদের নিয়ে কত ঘটনাই ঘটত। আমাদের সঙ্গে পড়ে এমন মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করত। আবার চিঠিও লিখত। আবার সে সব চিঠি ধরা পড়লে, কত কাণ্ড হত। আমার সে সব কোনও দিন হয়নি। কোনও ছেলের সঙ্গে আমার প্রেম হয়নি। কোনও ছেলেকে জীবনে একটা চিঠিও লিখিনি। আমার কত বন্ধুই বলত, তাদের প্রেমের গল্প। আমি কেবল হাঁ করে শুনেছি। কেন, বুঝতে পারি না, আমার বেশ মনে আছে, মনে হত আমার ও সব হবে না। বিশেষ কোনও গুণটুন না থাকলে ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করা যায় না।
এখনও মনে আছে, আমাদের পাড়ায় শ্রীনাথের মুদি দোকানের সঙ্গে মনিহারি জিনিসপত্রও ছিল তার দোকানে প্রায়ই যেতাম। শ্রীনাথ আমাকে সেধে লজেন্স টফি দিতে চাইলেও নিতাম না। লোকটাকে আমার মোটেই ভাল লাগত না। কণা বলেছিল, শ্রীনাথ দোকানিটা খুব খচ্চর আছে ভাই। আমার বুকে একদিন খাবলে দিয়েছিল। আমাদের বয়সি আরও কয়েকটা মেয়ের কাছ থেকে শ্রীনাথ দোকানির বিষয়ে এ রকম শুনেছি। লোকটা যেন চোখ-খাবলা ছিল। এমন তাকিয়ে থাকত যে, চোখের পলক পড়ত না। যেন মেয়েদের বুক কোনও দিন দেখেনি, এমন আদেখলের মতন তাকিয়ে থাকত। তার তাকিয়ে থাকা দেখলে মনে হত, কম্বল মুড়ি দিয়ে থাকি। লোকটার লাজ-লজ্জা বলে কিছু ছিল না। মনে মনে এমন রাগ হত! হেসে হেসে আবার কথা বলত। রোগা টিংটিং, হাত পাগুলো লিকলিকে, পেটটা মোটা। মাথায় চুলের খুব বাহার ছিল। তেল জল দিয়ে বেশ পেটো করে আঁচড়াত।
অল্প বয়সের মেয়েদের দেখলে ও রকম করত। অথচ বিয়ে করেছিল, একপাল ছেলেমেয়েও ছিল। এক দিন আমি লোকটার ফাঁকে পড়ে গেছলাম। সময়টাও সেই রকম। এই দেখ আকাশ শুকনো। একটু পরেই উপরঝন্তি বৃষ্টি। সেই রকম বৃষ্টির মধ্যে, শ্রীনাথ তার দোকানে এক দিন আমাকে একলা। পেয়েছিল। পালাব কি পালাব না ভাবছিলাম। শ্রীনাথ তখনও তার আলমারির সামনে উঁচু টুলের ওপর বসে ছিল। আমাকে বলেছিল, বৃষ্টির মধ্যে বাইরে কেন রে, ভেতরে আয়।
আমি তার চোখের দিকে দেখেছিলাম। কেমন যেন বিশ্বাস হয়েছিল। যে দিকটায় মুদিখানার মালপত্র থাকত সে দিকটায় চলে গেছলাম। তারপরেই সাপের কুণ্ডলী খুলে গেছল। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এসে কোনও কথা না, সোজা বুকে হাত, আমি ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলাম। শ্রীনাথ দাঁত বের করে হেসেছিল, ও রকম করছিস কেন রে নুড়ি। শোন না। বলে এমন জোরে বুকে খাবলে ধরেছিল, আমার লেগেছিল। আমি তার বুকের ওপর একটা চড় কষিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে কি ও কুত্তাটার লাগে। চড় খেয়ে হেসেছিল। বলেছিলাম, ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। পেনসিল দেবে তো দাও, তা না হলে চলে যাচ্ছি।
ওমা, মড়াটা তখন হেসে বলেছিল, আহা, পেনসিল কেন, যা চাইবি তাই দেব, লজেন দেব টফি দেব, চানাচুর ভাজা দেব। চুলের ফিতে চাস, রিবন চাস, তাও দেব। একটু কাছে আয় না। এখন তো কেউ নেই।
বুঝেছিলাম শ্রীনাথকে বলে কিছু হবে না। সে আমার কোনও কথা শুনবে না। এ রকম বৃষ্টিতে আমাকে একা পেয়েছে। কিছুতেই ছাড়বে না। তবে আমার যেন শ্রীনাথকে তেমন ভয় করছিল না। সেই যে একটা বুক গুরগুরনো ভয়, না জানি কী হবে, সে রকম কিছু মনে হয়নি। আমি এক বার। দরজাটার দিকে দেখেছিলাম। তারপরেই ছুট দিয়েছিলাম। কিন্তু যাই হোক, তখন শ্রীনাথের থেকে আমি চালাক ছিলাম না! সে বুঝতে পেরেছিল, আমি দৌড় দেব। সে তৈরি হয়েই ছিল। আমাকে দু হাতে জাপটে ধরেছিল। ধরেই, আমাকে নিয়েই বসে পড়েছিল। মেঝেতে বসে পড়লে রাস্তা থেকে কিছুই দেখা যায় না। মেঝেতে ফেলেই, আমার ফ্রক তুলে, ইজের ধরে টান দিয়েছিল। আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, তবে রে মড়া, শোরের বাচ্চা। নিজের মেয়েকে গিয়ে এ সব কর না।
বলে আমি ওর চুলের মুঠি ধরে, বুকের জামা টেনে, পা ছুঁড়ে ওঠবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মড়াটার পেট মোটা লিকলিকে হাতে পায়ে যে এত জোর ছিল, তা কে জানত। আমার মারধোর গ্রাহ্য না করে সে আমার ওপরে চেপে পড়েছিল। আমি হাত পা ছুড়ছিলাম সমানে। গালাগাল দিতে কিছু বাকি রাখিনি। তারপর হঠাৎ লোকটা আমার শরীরের ওপরে একেবারে নেতিয়ে পড়েছিল। আমি লাফ। দিয়ে উঠে পড়েছিলাম।
এখন তো বুঝতে পারি, সে আমার কিছুই করতে পারেনি। আমাকে জাপটে ধরেই তার সাধ মিটেছিল। আমি একছুটে বাড়ি। বাড়ি গিয়েই মাকে সব কথা বলে দিয়েছিলাম। মায়ের চোখ দুটো দপদপ করে উঠেছিল। আমার দিকে যেন এক বার দেখেছিল। তারপরে পিসিকে-সব বলেছিল।
সে এক কাণ্ড! পিসি গিয়ে শ্রীনাথের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে যেমন চিৎকার, তেমন খিস্তি। পাড়া বেপাড়ার লোক জুটে গিয়েছিল। শ্রীনাথের এক কথা, সে কিছু করেনি, আমি মিছে কথা বলছি। শুধু মিছে কথা না, আমার নামে যা-তা বলেছিল। মড়াটা এমন মিথ্যুক, বলেছিল, ওর দোকান থেকে নাকি আমি ক্যাপ কিনতে গেছলাম একদিন। তখন কি ছাই জানতাম আমি, সে কী বস্তু। শ্রীনাথ আমার নামে তাও চালিয়ে দিয়েছিল। যারা ভিড় করে ছিল, তারা শুনে হাসাহাসি করেছিল।
তবে শ্রীনাথের কিছুই হয়নি। দু-একজন একটু-আধটু ধমকে দিলেও, বেশির ভাগ লোক কিছু বলেনি। বরং তারা পিসির খিস্তি-খেউড় শুনে বেশ মজা পেয়েছিল। মানুষ যে এমন হতে পারে, আমার জানা ছিল না। এখন বুঝতে পারি, কেন লোকেরা কিছুই বলেনি। আমার মায়ের জন্য সবাই চুপ করে ছিল, ভাল ঘরের মেয়ে তো আমি না। পিসির চরিত্রও সবাই জানত। আমার মায়ের কথাও কারোর অজানা ছিল না। অল্পস্বল্পেই ব্যাপারটা মিটে গেছল। পাড়ার মাতব্বর দু-একজন তোক শ্রীনাথকে একটু ধমকে ধামকে দিয়েছিল।
তখন কথা উঠেছিল, আমাকে আর ইস্কুলে যেতে দেওয়া হবে না। আমি সে কথা শুনিনি। আমি তারপরেও পরীক্ষা দিয়ে আর এক ক্লাস উপরে উঠেছিলাম। তবে সেই ওঠাই সার।আর পড়তে হয়নি। কথাটা মনে পড়ল, প্রেমের জন্য। আমার বন্ধুরা প্রেম করত, ছেলেদের চিঠি লিখত। সেই সব চিঠিতে কত কী যে লেখা থাকত, আমাকে দেখতেও দিত। চিঠি পড়ে, আমিই যেন কেমন ন্যাকা বোকা হয়ে যেতাম। অথচ তাদের চেয়ে আমি যে কিছু কম জানতাম, তা না। কিন্তু কী করব, আমার সঙ্গে যে কোনও ছেলের প্রেম হত, তা না। সেই জন্য ছেলেদের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, আমার দিকে কেবল চোখ-খাবলার মতন চেয়ে দেখে। প্রেম তো করে না। আর সেটা হয় কেমন করে, তাও জানতাম না।
একটা কথা বুঝতে পারতাম। যাদের চেনাশোনা বেশি, তাদের ও সব হত। আমাদের তো সে রকম চেনাশোনা ছিল না। আমাদের বাড়িতে যারা আসত, তারা মায়ের লোক। তাদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা ছিল না। আমিও কারোর বাড়ি যেতাম না, লক্ষ্মীদের বাড়ি ছাড়া। আগে আগে আরও ছেলেবেলায় যেতাম। অনেক বাড়িতে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করতে। তারপরে আর যেতাম না। কেউ পছন্দ করত না। কেন করত না তাও জানতাম। কণার মা তো এক দিন সোজাসুজি বলেই দিয়েছিল, এই মেয়েটা, কী রে যখন তখন বাড়িতে আসিস? যা বাড়ি যা, আর আসতে হবে না!
অথচ কণার মা আগে ও রকম ছিল না। তবুও বুঝতে পারিনি। তাই মনে খুব লেগেছিল। পরে। কণাকে বলেছিলাম। কণা বলেছিল ওর মা আমার সঙ্গে মিশতেও বারণ করেছে। সে জন্য আমার সঙ্গে লুকিয়ে মিশত। ওর প্রেমের চিঠি আমাকে না দেখিয়ে পারত না। আস্তে আস্তে পাড়ার অনেক বাড়িতেই আমার যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছল। লক্ষ্মীদের বাড়িটা অন্য রকম। ওর বাবা ছিল ছুতোর মিস্তিরি। কারোর সাতে-পাঁচে নেই। লক্ষ্মীও আমার সঙ্গে ছাড়া কারোর সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করত না।
তবে প্রেম যে একেবারে হয়নি, তাই বা বলি কী করে। প্রেম হয়েছিল, প্রেম করেও ছিলাম। কিন্তু তার আগেই, জীবনের একটা দিক কেমন যেন ভেঙেচুরে গেছল। আজ বিশেষ করে, সেই কথাটা বারে বারে মনে পড়ছে।
তখন চৈত্র মাস চলছে। নতুন ক্লাসে সবে উঠেছি। মায়ের আদর খুব বেড়েছিল। মা প্রায়ই বলত, নুড়ি থাকতে আমার আখেরের ভাবনা কী? তুই-ই আমাকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখবি। কথাটা শুনতে ভাল লাগত। ভাবতাম আমার বিয়ে হবে। মা আমার কাছেই চিরদিন থাকবে। মা কিন্তু আর আমার বিয়ের কথা বলত না। বুঝতাম না, মা আর পিসি, আমার জীবনের সব ব্যবস্থা পাকাপাকিই করে রেখেছে।
চৈত্র মাস চলছে। তাত ফুটেছে। পিসি এক দিন সকালবেলা বলল, সে এক জায়গায় যাচ্ছে। আমাকে তার সঙ্গে বেড়াতে নিয়ে যাবে। শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। সকালবেলাই নেয়েটেয়ে, জোড়া বিনুনি করে, নতুন মেম-ফ্রক পরে পিসির সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। আমাদের ছোট শহর থেকে মোটর বাসে করে গেছলাম! তা প্রায় পনেরো-ষোলো মাইল হবে। একটা পাড়াগাঁ মতো জায়গায় পিসি আমাকে নিয়ে নেমেছিল। চারিদিক ফাঁকা। মাঠ, গাছপালা, বাগান ভারী ভাল লেগেছিল।
খানিকটা হেঁটে গিয়ে পিসি আমাকে নিয়ে একটা পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে ঢুকেছিল। দোতলা বাড়ি। চারপাশে অনেকখানি জায়গা। তাতে আম, জাম, নারকেল কত গাছ, নিঝুম বাড়িটাতে যেন একটাও লোক নেই। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ কাদের বাড়ি?
পিসি বলেছিল, দেখতে পাবি।
তখন কি জানি, আমার দেখতে পাবার জন্যেই, সেই বাগান বাড়িতে যাওয়া। বারান্দায় উঠে দেখেছিলাম, সামনের ঘরটা খোলা। আমরা গিয়ে দাঁড়াতে, এক জন সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। চেনা লোক। আমাদের শহরের মস্ত বড় লোক। পীতাম্বর ভড়। সবাই পীতু ভড়, পীতু বাবু বলে ডাকত। লোকে বলত, শহরের অর্ধেক ব্যবসা তাদের শুনেছিলাম, তাদের রেশম আর সুতোর কাপড়ের কারখানা ছিল। বাড়িতে দোল, দুর্গোৎসব হত। শহরের মাঝখানে তাদের মস্ত বড় বাড়ি। দু-তিনবার তিনি আমাদের স্কুলে গিয়েছেন। মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা তাকে দেখলে যেন শশব্যস্ত হয়ে উঠত।
সেই পীতুবাবু এসে সামনে দাঁড়াতে আমি যেন কেমন হকচকিয়ে গেছলাম। কালোর ওপরে মাজা রং। খুব লম্বা না, দোহারা শক্ত মতো চেহারা। মাথার চুল সাদা কালো, পাতলা। পঞ্চাশের ওপরে বয়স হবে। ফুল কোঁচানো ধুতি আর শার্ট পরা ছিল। গলার স্বরটা বেশ মোটা। পিসিকে বলেছিলেন, এসেছ?
পিসি গুল মাখা কয়েকটা দাঁত বের করে হেসেছিল। আর পীতুবাবু আমাকে টেনে একেবারে তার গায়ে চেপে ধরে বলেছিলেন, তুমিও এসেছ। এসো এসো।
একটু অস্বস্তি হলেও, আমার খারাপ কিছু মনে হয়নি। এত বড় লোক, বয়স হয়েছে। তিনি ও রকম। আদর করে বলতে পারেন। গায়ের কাছে চেপে পিঠে একটা চাপড় দিয়ে ছেড়ে দিলেন। পিসিকে বলেছিলেন, নন্দ, ওকে নিয়ে ওপরে এসো।
পীতুবাবুর পেছনে পেছনে আমরা ওপরে গেছলাম। ওপরতলাটা বেশ সাজানো গোছানো। একটা ঘর তো খুব সুন্দর। মস্ত বড় খাট, গদিওয়ালা বিছানা। গদি মোড়া চেয়ার, ঝকঝকে টেবিল। দেওয়ালে এত বড় আয়না আমি আর কখনও দেখিনি। নিজেকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল। দেওয়ালে বড় বড় আলমারি। তাতেও আয়না বসানো। দেওয়ালের একটা জায়গায় একটা বন্দুক ঝুলছিল। আর সোনার মতো মস্ত গোল একটা ঘড়ি টকটক করে চলছিল।
পীতুবাবু আমার গাল টিপে আদর করে বলেছিলেন, ভাল লাগছে।
আমি ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিলাম, লাগছে। তিনি বলেছিলেন, তা হলে ঘুরে ঘুরে দেখো। আমি একটু কাজ মিটিয়ে আসি।
পীতুবাবু চলে গেছলেন। আমি পিসিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে কেন এসেছ পিসি?
পিসি বলেছিল, তোকে যে পীতুবাবু নেমন্তন্ন করেছে।
অবাক হয়ে বলেছিলাম, আমাকে? কেন পিসি?
পিসি বলেছিল, কেন আবার। মানুষ মানুষকে নেমন্তন্ন করে না?
তা করে। কিন্তু পীতুবাবুর মতো লোক, আমার বয়সি অচেনা একটা মেয়েকে নেমন্তন্ন করতে যাবেন কেন! আমি পিসির মুখের দিকে হা করে তাকিয়েছিলাম। তখনও কোনও সন্দেহ করতে পারিনি। আমি আবার বলেছিলাম, তাই কখনও হয় বুঝি। আমাকে উনি চেনেন না, জানেন না, শুধু শুধু নেমন্তন্ন করতে যাবেন কেন?
পিসি বলছিল, কে বলেছে তোকে চেনেন না। চেনেন বলেই তো নেমন্তন্ন করেছেন।
আমি অবাক হয়ে পিসির দিকে তাকিয়েছিলাম। এও কি সম্ভব, পীতাম্বর ভড়ের মতো লোক আমাকে চেনেন! সেই বয়সে বেশি ভাববার মতো মনের অবস্থা ছিল না। আর অল্প বয়সের একটা আলাদা মন থাকে। বিশেষ করে আমার মতো সেই বয়সের মেয়েদের। ভেবেছিলাম, হয়তো সত্যি সত্যি পীতুবাবু আমাকে চেনেন। তবু মন থেকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। পিসি আমার কাছ থেকে সরে গেছল। আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। এক বার মনে হয়েছিল, হয়তো পীতুবাবু আমার মায়ের কাছে কোনও দিন গিয়ে থাকবেন। আমি দেখিনি, উনি দেখেছিলেন। তবে আমাকে এমন মিষ্টি করে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন, মনটা কেমন যেন গলেই গেছল। অমন বয়সের এত বড়লোক মানুষ। পীতুবাবুর নাম করতে লোক যেন কেমন একটু তটস্থ ভাব ছিল। তবে কেমন একটা খটকা। মনটা খচখচ করছিল।
দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, বেলা দশটা। একজন চাকর মতো লোক এসে আমাকে খেতে দিয়েছিল। জলখাবার। কত রকমের মিষ্টি, লুচি ভাজা। এত খাওয়া যায় নাকি। পিসি বলেছিল, খেয়ে নে, ফেলিস না।
পিসির যেমন কথা। খাবারগুলো সবই ভাল। ও রকম করে আমাকে কেউ কোনও দিন খেতে দেয়নি। তা বলে এত খাওয়া যায়। যা পেরেছিলাম খেয়েছিলাম। তারপরে সারা বাড়ি বাগান ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। বাড়ির পিছন দিকে ঘাট বাঁধানো পুকুর ছিল। ঘাটে নেমে জল নিয়ে খেলা করেছিলাম। বাড়ি থেকে চান করে গেছলাম। না হলে আবার চান করতাম। আমি সাঁতার জানতাম।
ঘাট থেকে উঠে আসবার সময়ে ওপরে চোখ পড়তে দেখেছিলাম, দোতলার বারান্দায় পীতুবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, চান করবে?।
আমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, চান করে এসেছি। একটু ভয় পেয়েছিলাম, লজ্জাও করেছিল। আবার মনটা খচখচিয়ে উঠেছিল এত বড় মানুষ আমাকে নেমন্তন্ন করেছে কেন? ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির এক দিকে গিয়ে দেখেছিলাম, সেখানে রান্না হচ্ছে। দুজন লোক রান্নাবান্নার কাজকর্ম করছে। এক জনকে আগেই দেখেছিলাম, জলখাবার খেতে দিয়েছিল। পিসি তাদের কাছে বসে বসে গল্প করছিল। কাটা কাঁচা মাংস দেখেই চিনতে পেরেছিলাম, মুরগি রান্না হতে যাচ্ছে। আমার তখন মনটা ছাদের দিকে টানছিল। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা থেকে ছাদের সিঁড়িতে খানিকটা উঠে দেখেছিলাম, দরজার কড়ায় তালা বন্ধ। পেছন থেকে পীতুবাবু বলেছিলেন, ছাদে যাবে?
আমি যেন ভয় পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। লজ্জাও করছিল। ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, না। পীতুবাবু বলেছিলেন, না কেন? আমি চাবি খুলে দিচ্ছি, বেড়িয়ে এসো।
বলে নিজেই চাবি নিয়ে এসে, আমার পিঠে হাত রেখে তুলে নিয়ে গেছলেন। তালা খুলে দিয়ে বলেছিলেন, যাও, বেড়াও গে৷ বলে নীচে চলে গেছলেন। আমার খুব অবাক লাগছিল। খুশিও হয়েছিলাম। আবার পীতুবাবুকে ভয়ও করছিল। এত বড় একটা ভার ভারিক্কি বড়লোক মানুষ। আমার সঙ্গে কী রকম করে কথা বলছিলেন। খানিকক্ষণ ছাদে ঘুরে, চারপাশে গ্রামটা দেখে নেমে এসেছিলাম। যে ঘরে আলমারি আর খাট, সে ঘরে গেছলাম। দেখেছিলাম, ঘরের এককোণে পীতুবাবু বসে আছেন একটা চেয়ারে। সামনের টেবিলে কয়েকটা বোতল আর গেলাস। আমি যেন একটু চমকে উঠেছিলাম। একটা বোতলের রং যেন আমার চেনা চেনা। আমাদের বাড়িতে দেখেছি। মাকেও খেতে দেখেছি। মদের বোতল।
আমি চলে আসছিলাম। পীতুবাবু আমাকে বলেছিলেন, নুড়ি শোনো।
আমার সাধ্য ছিল না যে, অবাধ্য হব। আমি পায়ে পায়ে ওঁর–সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কাছের একটা চেয়ার দেখিয়ে বলেছিলেন, বসো না এখানে।
আমার বসতে সাহস হচ্ছিল না। উনি হাত ধরে আমাকে কাছে টেনে কোমর জড়িয়ে ধরেছিলেন। বলেছিলেন, কী, ভয় লাগছে?
আমি কিছুই বলতে পারিনি। বুকের কাছে ধকধক করছিল সত্যি। ওঁর মাথাটা আমার বুকের কাছে ঠেকছিল। সেটা যে ইচ্ছে করে, বুঝতে পারিনি। আমার লজ্জা করছিল। ওঁর যেন ও সব ভাবনাই নেই, এমনিভাবে আমার দিকে মুখ তুলে চিবুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ভয় কী, আমি তো আছি। আমাকে তোমার ভয় করে?
করলেও কি পীতুবাবুর মতন লোককে সে কথা বলা যায়। আমি কথা বলিনি, ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিলাম, না। উনি অমনি আমার মুখটা দু হাতে নামিয়ে ধরে ঠোঁটের ওপর চুমো দিয়ে বলেছিলেন, লক্ষ্মী মেয়ে। খুব ভাল মেয়ে।
ঠোঁটের ওপর চুমোটা যেন কেমন লেগেছিল। তার আগে আমি জানতাম না, কেউ খায়নি। উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তোমার কানে ফুটো, কিছু পরনি কেন?
ভয় বা লজ্জা পাবার কোনও রাস্তাই যেন ছিল না। আমি চুপ করে ছিলাম। তখনও যেন সব ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। লজ্জা আছে, ভয়টা তার চেয়ে বেশি। উনি বলেছিলেন, দুল, রিং কিছু নেই বুঝি? আচ্ছা এসো, আমিই তোমাকে দিচ্ছি।
বলে আমার হাতটা ধরে একটা আলমারির কাছে নিয়ে গেলেন। আমি না বলতে চাইলাম, মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। উনি ছোট একটা বাকসো বের করে খুললেন। তার মধ্যে ঝকঝক করছিল দুটো সোনার রিং, তাতে ছিল কাঁটা। পীতুবাবুর হাত যেন একটু একটু কাঁপছিল। তিনি নিজের হাতে আমার কানে রিং পরিয়ে দিয়েছিলেন। এমন কি কখনও ভাবা যায়, পীতাম্বর ভড় আমাকে সোনার রিং কানে পরিয়ে দিচ্ছেন। মিছে বলব কেন, ভয় আর লজ্জার মধ্যে খুশিও হয়েছিলাম। তিনি আমাকে টেনে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, দেখো তো, কেমন দেখাচ্ছে।
আয়নার দিকে চেয়ে আমি চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম। নিজের দিকে তাকাতে লজ্জা করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাড়িতে কী বলব?
পীতুবাবু হেসে উঠে বলেছিলেন, কী আবার বলবে। বলবে, আমি দিয়েছি।
কোনও রকম ছল-চাতুরির ব্যাপারই ছিল না। তারপরেই উনি আমাকে বুকের কাছে জাপটে ধরে বলেছিলেন, তা বলে বাইরের লোককেও বোলো না যেন। তোমার মাকে বলবে। আবার ছেড়ে দিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে বলেছিলেন, বা সুন্দর দেখাচ্ছে। এর পরে তোমাকে আমি একখানি সোনার হার গড়িয়ে দেব, কেমন?
আমি কোনও কথাই বলতে পারছিলাম না। এত আদর সোহাগ আমাকে মা ছাড়া কেউ কোনও দিন। করেনি। কোনও লোক আমাকে ও রকম বুকের কাছে চেপে চেপে ধরেনি। তাতে লজ্জা করছিল, কিছু বলবার কথা মনে হয়নি। সাহসও ছিল না। উনি আবার আমার ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলেন। ঠোঁটটা ভিজে যেতে আমার যেন কেমন একটু ঘেন্না ঘেন্না করছিল। পরের মুখের থুতু। হাত দিয়ে ঠোঁটটা মুছে ফেলেছিলাম।
পীতুবাবু আমার হাত ধরে নিয়েই আবার সেই চেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন। আমাকেও একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলেন। টেবিলের বোতল দেখিয়ে বলেছিলেন, এ সব চেন? আমি ঘাড় নেড়ে একটা বোতল দেখিয়ে বলেছিলাম, ওটা মদ।
উনি আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ঠিক বলেছ। খাচ্ছি বলে তোমার খারাপ লাগছে না তো?
আমি বলেছিলাম, না। খারাপ লাগবার কী ছিল। ও সবে আমার ভয় কেটে গেছল। পিসি ভাজা মদ খেত। মাও আস্তে আস্তে মদ খেতে শিখেছে। তবে ভাজা মদ না, এইরকম সোনালি রঙের। উনি। আমাকে একটা সাদা রঙের বোতল দেখিয়ে বলেছিলেন, এতে শরবত আছে, লেবুর রস দেওয়া। তোমাকে দিই একটু, খেয়ে দেখো।
আমার ভয় করছিল। পীতুবাবুর মুখের ওপর কথা বলতে পারছিলাম না। উনি কীসের সঙ্গে কী মিশিয়ে, জল ভরে আমাকে একটা গেলাস দিলেন। আমি চুমুক দিতে ভরসা পাচ্ছি না দেখে। বলেছিলেন, মুখে দিয়ে দেখো, খারাপ কিছু না। খারাপ লাগলে খেয়ো না।
আমি মুখে দিয়েছিলাম। লেবুর রসের মতো অনেকটা, একটু একটু ঝাঁজ ছিল।একটু একটু করে খেয়ে নিয়েছিলাম। তখন তো জানি না, কী খেয়েছি। শরীরের মধ্যে কেমন যেন একটা করছিল। খারাপ কিছু না। একটু যেন চমচমে ভাব। উনি আমাকে আবার একটু দিয়েছিলেন। আমার আর খেতে ইচ্ছে করছিল না। বলেছিলেন, খেয়ে নাও, দেখবে ভাল লাগবে। পীতুবাবুর কথায় অবাধ্য হতে ভয় লাগছিল। এক বার একটা চাকর এল। তাকে এমন ধমক দিলেন যেন বাঘের গর্জন। আমাকে ও রকম বললে বোধ হয় অজ্ঞানই হয়ে যেতাম।
বাকি শরবতটুকু খেয়ে ফেলার পরে, উনি আবার আমাকে আদর করে বুকের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আমাকে একেবারে দাঁড়িয়ে উঠে কোলের ওপর তুলে নিয়েছিলেন। নিয়ে চুমো খেয়েছিলেন। তারপর খাটের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ঘুম পেলে ঘুমোও।
আমার ঘুম পায়নি৷ কেমন একটা ভয় আর অন্য রকম লাগছিল। উনি আমার কাছ থেকে চলে গিয়েছিলেন। আমার ঘুম ঠিক আসছিল না। একটা কেমন যেন আমেজ মতন। টের পাইনি, পীতুবাবু কখন দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার আমার পাশে এসে বসে, গায়ে হাত রেখে বলেছিলেন, কী গো নুড়ি, খারাপ লাগছে?
আমি বলেছিলাম, না।
উনি আমার পাশে শুয়ে পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমার বুকে কোমরে, সাবধানে হাত দিচ্ছিলেন, আর গায়ের কাছে চেপে ধরছিলেন। তারপরে, যেন কিছুই না এমনি ভাবে, আমার জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলেছিলেন, দেখি এটা খুলে দিই।
আমি অবাক হয়ে একটু শক্ত হয়ে বলেছিলাম, কেন?
উনি বলেছিলেন, ওটা রাখতে নেই।
প্রায় জোর করেই, আমার জামা আর বডিস খুলে দিয়েছিলেন, আর আমার বুকে মাথা রেখেছিলেন। ওঁর মাথার চুলগুলো এত শক্ত আর খোঁচা খোঁচা ভাবের ছিল, কম্বলের মতো কুটকুট করছিল আমার বুকে। ভয়ে কিছু বলতেও পারছিলাম না। দুপাশে দুহাত ফেলে রেখে আমি চিত হয়ে শুয়ে ছিলাম। উনি আমার বুকে মাথা আর মুখ ঘষছিলেন। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। মাত্র তেরো বছরে পড়েছি তখন। আজ যা বুঝি, তখন সে সবের কিছুই বুঝি না। আমার কিছুই জানা ছিল না। কিন্তু উনি যখন আমার জামা খুলে নিয়ে ও রকম করছিলেন, তখন আমার আর বুঝতে কিছুই বাকি ছিল না। অথচ আমি যে আপত্তি করব, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ব, সে সাহস ছিল না। এক বার কেবল জিজ্ঞেস করেছিলাম, পিসি কোথায়?
পীতুবাবু উপুড় হয়ে শুয়ে, আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলেছিলেন, তোমার পিসি আছে, ভয় নেই। খিদে পেয়েছে?
আমি বলেছিলাম, না।
সত্যি তখন আমার খিদে পায়নি। অনেকগুলো মিষ্টি খেয়েছিলাম। আমার গাটা যেন গরম গরম লাগছিল। আমার ঠোঁট জিভ কান, সবই যেন কেমন গরম গরম লাগছিল। আমার লজ্জা করছিল, তবু বলতে পারছিলাম না, আমার গাটা ঢেকে দেবার জন্য। উনি আমাকে বারে বারে চুমো খাচ্ছিলেন, যেমন করে খুশি, জিভে ঠোঁটে। আমি এক বারও পীতুবাবুর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম না। জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমাকে তোমার ভয় করছে?
আমি কোনও জবাব দিইনি। জবাব দিতে ভরসা হচ্ছিল না। উনি আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার খারাপ লাগছে না তো?
যত ছোটই হই, আমার মন বলছিল, হ্যাঁ’ বলা যাবে না। আমি ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিলাম, না। বেশ বুঝতে পারছিলাম, পিসি আমাকে সেখানে কেন নিয়ে গেছল। মনে মনে বুড়িটার ওপরে খুব রাগ। হচ্ছিল, মা-ও নিশ্চয় জানত। মা জেনে শুনেই আমাকে সেখানে পাঠিয়েছিল। পিসির সঙ্গে মায়ের ষড় ছিল। মনে বড় দুঃখ আর অভিমান হয়েছিল। আমার একটা দমকা নিশ্বাস পড়েছিল। পীতুবাবু যেন খুবই ব্যস্ত হয়ে, খুব মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী হল নুড়ি? কষ্ট হচ্ছে?
আমি মাথা নেড়ে জানিয়েছিলাম না। পীতুবাবুর মতো লোক আমার সঙ্গে এমন করে কথা বলছিলেন, এত আদর করে কথা বলছিলেন, আমি রাগ করতেও পারছিলাম না। খাটের ওপর শুয়ে বাঁ দিকে ফিরলেন। একটা আয়নায় গোটা শরীরটা দেখা যাচ্ছিল। একটা ইজের পরা খালি গা শরীরটা দেখে, আমার খুব লজ্জা করছিল। সেই জন্য আমি বাঁ দিকে ফিরছিলাম না। ডান দিকে পীতুবাবু আমার কাছে উপুড় হয়েছিলেন, সারা গায়ে হাত দিচ্ছিলেন। যখন বুকে মুখ ঘষছিলেন, আমার যেন মাথা সুদ্ধ কী রকম করে উঠছিল। আমার যেন কেমন একটা ঘোর লাগছিল। সবসময় সবকিছু যেন খেয়াল থাকছিল না। এক বার তাকিয়ে দেখলাম, পীতুবাবুর গায়ে কিছু নেই। আমার সামনে ও রকম অবস্থায় দেখব, কখনও ভাবিনি। আমি চোখ চেয়ে দেখতে চাইনি। চোখে পড়েছিল তাই লজ্জা করেছিল। পীতুবাবু আমার কোনও লজ্জা রাখেননি, নিজের লজ্জাও রাখেননি। তবে এখন তো বুঝি, ওঁর আবার লজ্জা কীসের। উনি ও রকম করবেন বলেই তো ঠিক করে রেখেছিলেন। তবু আমি আপত্তি করেছিলাম। ইজের চেপে ধরে বলেছিলাম, না।
পীতুবাবু যেন আদরে গলে পড়েছিলেন, লক্ষ্মীটি।
আমি তবু বলেছিলাম, কেন?
উনি বলেছিলেন, দেখই না।
সেই সময় বলাই কাকা আর কাকিমার কথা আমার মনে পড়েছিল। কিন্তু তাদের কথা আলাদা। আমি ভাবতেই পারিনি, পীতুবাবু বলাই কাকার মতো কিছু করবেন। আমি তো কত ছোট। আমার ধারণা ছিল, ও রকম কিছু হলে আমি মরে যাব।
কিন্তু আমি মরিনি। হে ঈশ্বর, তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। তুমি আমাকে যে কারণে এই জগৎ সংসারে এনেছিলে, আমি তোমার সেই কারণেই লেগেছি। আমি বেশ্যা হয়েছি। আমার মা পীতুবাবুকে দিয়ে এই জীবনের দীক্ষা দিয়েছিল। পীতুবাবু আমার প্রথম বাবু। আমার বাবা বেঁচে থাকলে পীতুবাবুরই বয়সি হতেন অথবা একটু কমই। সেই পীতুবাবুর দ্বারাই আমার বেশ্যা জীবনের শুরু হয়েছিল। তিনি আমার শরীরকে প্রথম কিনেছিলেন।
চৌদ্দ বছর আগের সেই দিনের কথা আমার এখনও পরিষ্কার মনে আছে। পীতুবাবু যেন একটি পুতুলকে নিয়ে খেলা করছিলেন। এখন তো বুঝতে পারি, পীতুবাবুর শরীরে মনে তখন কত উত্তেজনা। তিনি যে আমাকে নিয়ে খেলা করছিলেন, তিনি যে আমাকে নিয়ে কী করবেন, যেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। আদরে সোহাগে কত যে আবোল তাবোল বকছিলেন। অথচ আমি কিছুই বোধ করছিলাম না। তিনি আমাকে কষ্ট দিতে চাননি। মাঝে মাঝে আমার শরীরটা কেঁপে উঠছিল। আমার খারাপ লাগছিল না। ভালও লাগছিল না।
এখন জানি, তিনি কী চাইছিলেন আমার কাছে। তখন জানতাম না। জানতাম কেবল পীতুবাবুর যা ইচ্ছে হবে তাই করবেন। এখন বুঝতে পারি, পীতুবাবু বড় চতুর আর ঘুঘু লোক ছিলেন। জীবনে আমার মতো অনেক তেরো বছরের নুড়ি পার করেছেন। তাই বা বলি কেন। মায়ের মুখে শুনেছি, তেরো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল, চৌদ্দ বছর বয়সে আমি হয়েছিলাম। তেরো বছরের মেয়ে ছোট কীসে।
সেই দিক থেকে হয়তো ছোট না। কিন্তু যে জীবনে কখনও কিছু করেনি, একটা আবছা আবছা ধারণা, মনে ভয় আর পাপ তার কাছে অনেক কিছু। পীতুবাবু সে হিসেবে গুরুদেব তোক। এখন বুঝতে পারি, কোথায় কী করছিলেন। আমার শরীরের মধ্যে শিউরে শিউরে উঠছিল। গায়ের মধ্যে কাটা দিচ্ছিল। হাত পায়ের ঠিক থাকছিল না পীতুবাবুর লজ্জা ঘেন্না বলে কিছু ছিল না। যে-মুখ দিয়ে মানুষ খায়, সে মুখের একটা ঘেন্না-পিত্তি বলে কিছু থাকে। পীতুবাবু তো কুকুর ছিলেন না। কিন্তু কুকুরের মতোই করেছিলেন। তখন কি আর ও সব জানি! এখন বুঝি, পীতুবাবু কী করছিলেন। তখন ঘেন্নাতে বলেছিলাম, ও কি, না ও রকম করবেন না।
পীতুবাবু আমার কথা শোনেননি। তিনি পথ তৈরি করছিলেন তারপরে এসেছিল সেই মুহূর্ত। কিন্তু সেই মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে প্রাণে কোথাও এতটুকু আনন্দ বা সুখ ছিল না। বলতে গেলে প্রায় অচেনা, অনেক বয়স্ক একজন লোক। মুখে তার মদের গন্ধ। গায়ে আতরের। আর আমি তেরো বছরের একটি মেয়ে, কোনও কিছুর জন্যই আমার মন বা শরীর তৈরি ছিল না। পীতুবাবু চতুর ঘাগি বুড়ো, তিনি। তার কাজের রাস্তা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে আমার কিছুই মনে হয়নি। বরং একটা ভয় ছিল। শরীর শক্ত হয়েছিল। পীতুবাবু বারে বারে সেই ভাবটাই কাটাতে চেয়েছিলেন, কাটাতেও পেরেছিলেন। আমার শরীরকে যেন তিনি অনেকটা তাঁর বশে নিয়ে গেছলেন। তাঁর নিজের দরকার মতো।
তবু সেই মুহূর্তে আমার বুকের মধ্যে ধকধক করছিল। আমি অন্য দিকে চেয়ে ছিলাম। আমি তো সবই টের পাচ্ছিলাম। ভয় লাগছিল, কিন্তু পীতুবাবু শান্ত ছিলেন। আমাকে খুব আদর করে কথা বলছিলেন। একসময়ে মনে হয়েছিল, পীতুবাবু যেন আমাকে বেঁধে রেখেছেন, আর তাতে তিনি স্বস্তি বোধ করেছিলেন। আমার সঙ্গে অনেক গল্প করছিলেন। আমি কিছুই শুনছিলাম না। কখন ওঁর হাত থেকে মুক্তি পাব সেই ভাবনা।
কিন্তু মুক্তি বললেই মুক্তি আসে না। তিনি সমানে আদর সোহাগ আর গল্প করে যাচ্ছিলেন। আমি নড়তে পারছিলাম না। এখন বুঝতে পারি, আমার শরীর তো নিরেট পাথরের ছিল না। মাঝে মাঝেই আমার শরীর কেঁপে উঠেছিল। আমি ওঁকে কয়েক বার অনুনয় করে বলেছিলাম, ছাড়ন না।
পীতুবাবু ছাড়েননি তবু শেষ রক্ষা হয়নি। পীতুবাবু যত চালাক চতুর ঝানু হন, শেষ পর্যন্ত আমি যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিল, আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমার তলপেটে অজস্র ছুঁচ ফুটছে।
বড় কেঁদেছিলাম পরে, কেবল যে ব্যথার জন্য তা না। মায়ের ওপর রাগ করেই যে কেঁদেছিলাম কেবল, তাও না। কারোকে বলে দিতে হয়নি, শিখিয়ে দিতেও হয়নি, মন থেকে আপনিই মনে হয়েছিল, আমার আর কিছুই রইল না, আমার সব গেল। কখন পিসি এসেছিল, কী বলেছিল, চেয়ে দেখিনি, শুনিনি। খেতে বলেছিল, খাইনি। তার মুখ দেখতে আমার ঘেন্না হয়েছিল। পীতুবাবু চলে গেছলেন। আমি কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু সেই দিন রাত্রেও আমাকে পীতুবাবুর বাগান বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। কিছুতেই থাকব না বলে জেদ করেছিলাম। পিসিকে তো একটা চড়ই মেরে দিয়েছিলাম। পীতুবাবু আমাকে ঠাণ্ডা করেছিলেন, বলেছিলেন, বেশ, তোমার যেতে ইচ্ছে হয়; যেয়ো। আমার কাছে তো গাড়ি আছে। খানিকক্ষণ থাকো, খাওয়াদাওয়া করো। ভাল ভাল গানের রেকর্ড এনেছি। শোনো। তারপরে ভাল না। লাগলে, গাড়ি করে বেড়াতে যেতে পার। তাতেও যদি ভাল না লাগে, তবে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেব।
বলে পীতুবাবু একটি সরু সোনার চেন হার বের করে আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। অভাগি আমি, কানে দুটো সোনার কাটি ছাড়া, তার আগে যে কখনও কিছু পাইনি। এবেলা ওবেলা দু-দুটো সোনার গহনা পেয়ে মনটা যেন কেমন গলে গেছল। তারপরেও, পীতুবাবু লাল রঙের একখানি রেশমি শাড়ি বের করে দিয়ে বলেছিলেন, আজ থেকে শাড়ি পরো। তোমাকে বেশ মানাবে।
গেরস্থের বউ হোক আর বেশ্যা হোক, শাড়ি গহনায় মন ভোলে না, এমন মেয়েমানুষ কম। বিশেষ করে আমার সেই বয়সে। সেই বয়সে, ও সবে বরং মন বেশি ভুলত। তখন আর কী-ই বা চাইতে শিখেছি। পীতুবাবু অনেক কিছু বের করে দিয়েছিলেন। স্নো পাউডার সেন্ট আলতা। পিসি আমাকে সারা বিকেল সন্ধে ধরে, একেবারে কনে বউটি সাজিয়ে দিয়েছিল। পীতুবাবু দেখে বলেছিলেন, এর পরে তোমাকে কয়েক গাছি সোনার চুড়ি গড়িয়ে দেব।
মিথ্যে বলব না। সাজগোজ করতে ভালই লেগেছিল। বাড়ি যাবার কথা আর বলতে পারিনি। কিন্তু পীতুবাবু যা করবার, তা-ই করেছিলেন। পরের দিন সকালবেলা পীতুবাবু অনেকগুলো টাকাও দিয়েছিলেন। গহনা, শাড়ি, টাকা, সবকিছু নিয়ে, পীতুবাবুর বাগান বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে এসেছিলাম, তখনও জানতাম না, আমি আর সেই নুড়ি নেই। আমার ভাল নাম হরিমতী। আমি আর সেই হরিমতীও নেই। আমার এখন একটাই পরিচয়, আমি বেশ্যা।
এই আমি সেই বেশ্যা। এখন আমার নাম নুড়ি না। হরিমতী তো বড় সেকেলে, এখন আমার নাম বিজলী। কোথায় গেলেন সেই পীতুবাবু? পীতাম্বর ভড়? মারা গেছেন। প্রায় এক বছর পীতাম্বরবাবুর কাছেই ছিলাম। কোনও দিন আমাদের বাড়িতে আসেননি। যখন ডেকেছেন, তখনই তার বাগান বাড়িতে গেছি। যত দিন থাকতে বলেছেন, থেকেছি। তা এক বছরে কিছু কম দেননি। বাড়িতে দুখানা পাকা ছাদ-আঁটা ঘর তুলে দিয়েছিলেন। আরও খান কয়েক সোনার গহনা, ভাল ভাল শাড়ি, একটা গ্রামোফোন। এখনকার হিসেবে বলা যায়, সেই বয়সে কম কিছু না। তখন আর লোকেরও কিছু জানতে বাকি নেই, আমি কোন রাস্তা ধরেছি।
সেই পীতুবাবু মারা গিয়েছিলেন তারও বছর দশেক বাদে। না জানলেও বুঝি, তারপরেও অনেক নুড়িকে তিনি বাগান বাড়িতে ভোগ করেছেন। তবে আমার মতো কোনও মেয়েকে বেশ্যা জীবনে দীক্ষা দিয়ে গেছেন কি না, জানি না। অর্থাৎ প্রথম খদ্দের।
পীতুবাবু মারা গেছেন। আমার কাছে, আমার এই সাতাশ বছর বয়সের মধ্যে যত পুরুষ এসেছে, তারাও হয়তো কেউ কেউ মারা গেছে। আমিও একদিন মরব। সংসারে কেউই বেঁচে থাকবার জন্য আসেনি। তবে সকলের মরা আর বেশ্যার মরাটা বোধ হয় আলাদা।
ভাবতে কেমন অবাক লাগে, আমাকে যারা ভোগ করেছে, তারা কেউ কেউ মারা গেছে। তারা কি আমার শরীরে কোনও দাগ রেখে গেছে! না। জগতে মানুষের শরীর এমন এক জিনিস, তার ভেতরে কোনও দাগ থাকে না। ওপরে যদি বা থাকে, ভেতরে ছাইপাঁশ যা-ই দাও, ধুয়ে ফেললেই সব পরিষ্কার। হাজার আঁতিপাতি করে খোঁজ, কিছু পাবে না। লোকে যেমন বলে, আমিও সেই রকম ভাবতাম। মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে এক বার সহবাস করলে, তার দাগ আর ছাড়ানো যায় না। পুরুষেরাও বোধ হয় তাই ভাবে। কিন্তু আনকোরা মেয়ে বলতে কী বোঝায়, তারা জানে না। যেমন আমরা জানি না, আনকোরা পুরুষ কাকে বলে। তবে হ্যাঁ, দাগ যদি কিছু থাকে, সেই মোক্ষম দাগ মেয়েদেরই থাকে। সেই দাগের নাম, সন্তান। মেয়েদের শরীরের ভেতরে বলল, বাইরে বলো, ছেলে মেয়ে হলে কিছু দাগ সে রেখে যাবেই। আর দাগ রেখে যায় রোগ। পারা ইংরেজিতে যাকে বলে সিফিলিস আর গনোরিয়া।
এই সিফিলিস রোগটি আমার এক বার হয়েছিল। তখনও আমি কলকাতার এ পাড়ায় আসিনি। বাড়িতেই তখন আমার দেহবৃত্তি চলছিল। পীতুবাবুর কোনও রোগ ছিল না, আমি জানি পীতুবাবু বড়। সেয়ানা মানুষ, মেয়ে দেখে বাজিয়ে নিতেন। তাঁর মেলাই অনুচর। নানান জায়গা থেকে নানান চরেরা তার জন্য মেয়েমানুষ খুঁজে আনত। পরে পীতুবাবুর অনেক কাণ্ডই তো দেখেছি, তার বাগান বাড়িতে। আমি থাকলেও, অন্য মেয়েরাও থাকত। ও বাবা, সে কি র্যালা। এখন সব জানি, বুঝি। তখন কি জানতাম? সোমত্ত বাঁজা বউ, কড়ে রাড়ি, বাঙাল কলোনির ভঁসা ডাসা মেয়ে। অনেককেই দেখেছি সেই বাগানে থাকতে। তা বেশ্যা হই, আর যা-ই হই, ছেলেবেলার সে সব কথা মনে হলে, এখনও এই পোড়া শরীরের মধ্যে যেন শিরশির করে। বন্ধ ঘরে। কারোর গায়ে জামাকাপড় নেই। মদের ঢল নেমেছে। কুকুর বেড়ালের মতন আমার সামনেই পীতুবাবু অন্য মেয়ের সঙ্গে, যা খুশি তাই করছেন। যতই মুখ সাপাটি করি, ও সব দেখলে শরীর মন ঠিক থাকত না। মন চাক বা না চাক, শরীর যেন বশে থাকতে চাইত না। আবার পীতুবাবুর ওপর রাগও হত। আমার সামনে এ সব কেন?
বলেছি পীতুবাবু বড় ঝানু লোক, বড় ঘুঘু ছিলেন। তিনি একজনকে দিয়ে দেখিয়ে আর একজনের কড়ায় তেল ফোঁটাতেন। সময় হলে ভাজতেন। সে সব অন্ধিসন্ধি তাঁর খুব ভাল জানা ছিল। গুয়ের পোকা যেমন গু ছাড়া থাকতে পারে না, পীতুবাবু তেমনি মেয়েমানুষ নিয়ে থাকতেন। অন্যদের কেমন করে সেই পোকা করতে হয়, তাও ভাল জানতেন। মিছে বলব না, সেই যে প্রথম দিন পীতুবাবু আমার সব কিছু নিলেন, তা নিলেন তো একেবারে, চেঁচে পুঁছে নিলেন। একটু একটু করে, তিনি আমার শরীরে এমন বিষ ঢুকিয়েছিলেন, পনেরো বছর বয়সের মধ্যে, আমিও গুয়ের পোকা। আমি বেশ ভালই রপ্ত করেছিলাম। তবে একটা কি ব্যাপার, আমি থাকলে, আমাকেই উনি সবথেকে বেশি খাতির যত্ন করতেন, সকলের থেকে আমাকে আদর সোহাগ তোষামোদ বেশি। আমার ওপরে কেউ না। তাতে আমার মনে মনে বেশ গুমোর হত। অন্য মেয়ে বউরা আমাকে হিংসে করত।
পীতুবাবুর অনেক ঘটনা। বলতে গেলে, আমার গোটা খাতায় কুলোবে না। আসল ব্যাপার বুঝেছি। শরীরে একটা সুখের আগুন আছে। তাকে যত রকমে জ্বালাবে, ততই সে জ্বলবে। বই পড়তে বরাবর ভালবাসি। কিছু কিছু বই পড়ে দেখেছি, ও সবকে বলে বিকার। এতে মানুষের ঘেন্না-পিত্তি বলে কিছু থাকে না। তবে হ্যাঁ, এ কথাও বলব, পীতুবাবু আমাকে দেখিয়ে যে কাণ্ড করুন, আমাকে নিয়ে সে সব করতেন না। যেমন জ্যোছনা রাত্রে পুকুরের ঘাটে গায়ে সাবান মেখে, পাঁকাল মাছের খেলা। দেখে। হাসিও পেত, রক্তও তেতে উঠত।
কিন্তু পীতুবাবুর বাগান বাড়িতে রোজ যাওয়া হত না। উনি কখনও আমাদের বাড়ি আসতেন না। আমাদের পাড়ায় ঢুকতেন না। সেয়ানা লোক। সবাই সব কিছু জানলেও, চোখের সামনে ধরা দিতেন না। লোকেরা তো চোখে ঠুলি এঁটে থাকত না। নুন দিয়েই ভাত খায়। সবাই সব কিছু বুঝত। লোকে মনে করত, আমি পীতুবাবুর রক্ষিতা। তা এক রকম তা-ই বলা যেত। তবু আমি কি আর কিছু করতাম না? লোকেই বা ছেড়ে দেবে কেন? লোকেরা যদি বা ছাড়ে, আমার মা, নন্দ পিসি ছাড়বে কেন? যোবলা বছর বয়সে, আমি রোজগেরে মেয়ে। পিসি কোথা থেকে বাবু ধরে নিয়ে আসত। তা ছাড়া জুটেছিল বেন্দা। বৃন্দাবন, যার সঙ্গে হাজরাদের পোড়োয় খেলেছিলাম। যে খেলা আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে গেল, যে খেলা আমার অন্ন জল হল। কণার বেলায় তা হল না, ভগবান আমাকে পাপ দিলেন।
একদিন সাঁজবেলায়, বেন্দা বাড়িতে এসে হাজির। ও বামুনদের ছেলে, বলল, লেখাপড়া করে। আমার থেকে দু-তিন বছরের মাত্র বড়। আমি অবাক। কী ব্যাপার? বেন্দার হাসি দেখে বুঝেছিলাম, ব্যাপার কী। মা পিসি খুব রেগে গেছল। বেলা আমার বাবু হয়ে আসেনি। ছেলেবেলার বন্ধু, ভাবের মানুষ, ওর এক কথাতেই সব বুঝেছিলাম। যখন ও বলেছিল, চল নুড়ি, হাজরাদের পোড়োয় যাই। আমার খুব হাসি পেয়েছিল, আমি ওর গায়ে চিমটি কেটে দিয়েছিলাম। ও লুকিয়ে আমাদের বাড়ি ঢুকেছিল। কেউ দেখলে বাড়িতে বলে দেবে। তা হলে বেন্দার রক্ষা ছিল না। বাড়ি থেকে পিটিয়ে বের করে দিত। পীতুবাবুর বাগান বাড়ি যাওয়া শুরু হওয়ার পর থেকে, ওর সঙ্গে রাস্তায় আমার কয়েক বার দেখা হয়েছে। আমি রাস্তায় কমই বের হতাম। সিনেমা-টিনেমা দেখতে হলে বেরোতাম। পিসিমা এমন একটা ঠাট বজায় রাখত, যেন আমি যে সে মেয়েমানুষ না, পীতাম্বর ভড়ের মেয়েছেলে বলে কথা। প্রথম প্রথম ঘটনাটা যখন জানাজানি হল, বেলা আমার সঙ্গে দেখা হলে কথা বলত না। রকের ছেলেরা আওয়াজ দিত, পীতে ভড়ের রাঁড় যাচ্ছে। আমি মনে মনে যা-তা গাল দিতাম, তোদের বাপের কীরে, আমি যারই রাড় হই। মরতে আসিস, পীতে ভড়ের মতন দিস, তোদের রাঁড়ও হব।
তারপরে, বেন্দা আমার সঙ্গে কথা বলত। যেন কেউ দেখতে শুনতে না পায়, এ ভাবে বলত। কিন্তু বেলা যে কোনও দিন আমার কাছে বাড়িতে আসবে, ভাবতে পারিনি। আমার মনে খুব আনন্দ হয়েছিল। মা আর পিসি বেন্দাকে মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। দুজনেই ভুরু কুঁচকে, টেরচে ব্যাপারটা দেখেছিল। আমি বেন্দাকে নিয়ে ঘরে বসিয়েছিলাম। আর বেন্দার প্রথম কথাই, চল নুড়ি, হাজরাদের পোড়োয় যাই। আমি আর হেসে বাঁচি না। বলেছিলাম, পোড়োয় কেন, ঘরেই বস না। বেন্দা আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে দেখছিল, সেটা ঠিক পীতুবাবুর মতন না। পীতুবাবু হলেন বুড়ো ভাম। বেলা অত কেতা জানবে। কী করে। আমার দিকে তাকিয়ে, বেন্দার যেন জ্বর হয়েছিল। চোখ ফেরাতে পারছিল না। লাল চোখ। স্থির হয়ে বসতে পারছিল না। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী দেখছিস? বেন্দা বলেছিল, নুড়ি, তুই দারুণ দেখতে হয়েছিস।
সেটা আমি জানতাম। আমার মা আর পিসি তার থেকে বেশি জানত। আমাদের ছোট শহরের অনেক টাকাওয়ালা ভদ্রলোকেরা তখন আমাকে রাখতে চেয়েছিলেন। কাকের মুখে খবর রটে যায় তো। পিসি বলেছিল, কারোর কাছে ও মেয়ে থাকবে না। তবে হ্যাঁ, তোমার ইচ্ছে হয়, এক-আধ দিন ঘুরে যেয়ো। এ সব শুরু হয়েছিল, আমার ষোলো বছর বয়সের পর। তার আগে, আমি পুরুষ বলতে পীতুবাবুকেই জানতাম। আমার কাছে যারা আসত পিসির মারফত আসত। বেশির ভাগই আমাদের শহরের লোক না। পিসি খুব ঘুণ। শহরের লোক হলে পীতুবাবুর কানে যাবে। তা হলে পীতুবাবু আর আমাকে ডাকবেন না, কিছু দেবেন না।
বেন্দাকে পেয়ে আমার এত ভাল লেগেছিল, কথাবার্তায় কখন আমরা হুডযুদ্ধ ছেলেমানুষি আরম্ভ করেছিলাম, মনে নেই। তবে ছেলেমানুষি আলাদা। বেলা আমাকে জড়িয়ে ধরবার জন্য, চুমো খাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। আর আমি খাটের এপাশ ওপাশে ছিটকে পড়ছিলাম। বেলার অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল। মদ না খেয়ে মাতাল, খাটের গায়ে কপাল ঠুকে ঢিবি। দেখে মায়া হলেও আমি খুব হেসেছিলাম। ঘরের দরজা খোলাই ছিল। আমাকে পিসি ডেকে বলেছিল, মা আমাকে ডাকছে। আমি মায়ের কাছে গেছলাম। মা রেগে উঠে বলেছিল, বেন্দা ছোঁড়া এখানে কী করতে এসেছে? এখনও কলেজে পড়ে, এক পয়সার যুগ্যি না। আমার কেমন রাগ হয়ে গেছল, বলেছিলাম, বেশ করেছে। এসেছে। ও আমার বন্ধু, পয়সার যুগ্যি নাই বা হল। পিসি বলেছিল, বন্ধু আবার কীসের। ওকে টাকা দিয়ে যত খুশি বন্ধুগিরি ফলাতে বল, কিছু বলব না। জানিস না, তোর মুখ দেখে লোকে ঘরে এসে টাকা দিয়ে যায়। আমি বলেছিলাম, দিক গে। বেন্দার সঙ্গে, তাদের কী কথা। লোকেদের সঙ্গে কি আমি ছেলেবেলায় খেলা করেছি। মা আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। আমি বুঝতে চাইনি। এক বার, লাইনে এলে, আর নাকি বন্ধু টন্ধু রাখতে নেই। রাখতে হলেও সেইভাবে রাখতে হবে, যাতে তাকে। দেখানো যায়, যে লাইনে যে দস্তুর। কিছু যদি না আদায়ই করতে পারলাম, তা হলে আর ও সব করে কী হবে।
কথাটা ঠিক। কিন্তু তখন বুঝিনি। আমাদের এক বন্ধু সার, এই শরীর। যে যেভাবেই আসুক, একটি ছাড়া কেউ কিছু চাইবে না। আর এই শরীরের জন্যই যখন, অন্ন-জল থেকে গায়ের কাপড়টি পর্যন্ত, তখন এমনি এমনি এ শরীর দেওয়া চলে না। কথায় বলে, ভাত কাপড় দিতে পারে, কিল মারার গোঁসাই। গেরস্থ ঘরের বউ যদি স্বামীকে এ কথা বলতে পারে, আমরা খদ্দেরকে তো বলবই। ডাক্তার এমনি ওষুধ দেয় না। উকিল বিনা পয়সার মামলা লড়ে না। যার যা আছে, সে তা-ই দিয়ে পয়সা নেয়। আমার শরীর দিয়ে পয়সা, সে কথা ভুললে কি চলে!
চলে। তবু ভুলিনি কি? ভুলেছি। মন গুনে ধন, দেয় কোন জন! মন ভুললে, সবই ভুল। শরীর দেওয়া তো দূরের কথা, টাকা পয়সা, সবই দিতে ইচ্ছে করে। সে হল মনের ব্যাপার। আমাদের মতন মেয়ের জীবনে, ও সব বড় খারাপ। ভাল কখনও হয় না, মন্দ ছাড়া। ও একটা অনাসৃষ্টি। তবু সর্বসময় মন মানে না।
বেন্দার বেলা আসলে আমার অন্য ব্যাপার হয়েছিল। আমি যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম, তার কারণ, পীতুবাবু ছাড়া আর কারোর সঙ্গে কেন মিশব না? তা ছাড়া বেন্দার সঙ্গে, ছেলেবেলার কথাটা ভুলতে পারিনি। তাই মা আর পিসির সঙ্গে ঝগড়া করে আমি ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু বেন্দা অল্প বয়সের জোয়ান হলে কী হবে। কিছুই জানত না। রক্তের তেজই সব না। কারিগরি জানা চাই। বেলা সে সব জানত না। তবু আমার ওকে ভাল লেগেছিল। তারপর থেকে বেলা প্রায়ই আসত। প্রায় তিন বছর ও প্রায়ই আসত। তা নিয়ে অনেক হুজ্জোতি হয়েছে মা পিসির সঙ্গে। কিন্তু আমার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারত না। আমি আর সে নুড়ি ছিলাম না। তবে আস্তে আস্তে বেন্দার ওপরে। মনটা থিতিয়ে এসেছিল। মাঝে মাঝে শুধু গল্প করে ওকে বিদায় দিতাম। তখন পীতুবাবুর বাগানবাড়ির ডাক না থাকলে আমার ঘরে প্রায়ই লোক আসত। আয়টায় বেশ ভালই হচ্ছিল। পীতুবাবু কোঠা ঘর করে দিয়েছিলেন। আমি বিজলি বাতি এনেছিলাম। ঘর দরজার চেহারা বদলে গেছল। একদিন বেন্দাকে বললাম, কাল আমাকে একশো টাকা দিস তো, একটু দরকার হয়েছে।
ইচ্ছে করেই বলেছিলাম, দেখি বেলা কী করে। মুখে তো খুবই ভালবাসা দেখায়। কানে শুনতাম, ও অন্য মেয়েদের সঙ্গে মেশে, তাদের সঙ্গে সিনেমায় যায়, কলকাতায় বেড়াতে যায়। ও তো গরিবের ছেলে না। কিন্তু এক দিন দুপয়সার বাদাম ভাজাও এনে খাওয়ায়নি। টাকা চাইবার পরে, চার দিন বেন্দা। আমাদের চৌকাঠ মাড়ায়নি। তারপরেই ও একজনকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। সাহেবি পোশাক। পরা দেখতে সুন্দর এক ছোকরাকে নিয়ে। শুনেছিলাম, দিল্লিতে থাকে, বেন্দার খুব বন্ধু। আমার সঙ্গে মিশতে চায়। ছোকরা এক কথাতেই একশো টাকার নোট বের করে দিয়েছিল। সঙ্গে করে এনেছিল বিলিতি মদের বোতল। বেলা নিজেই পিসিকে ডেকে একগোছা টাকা দিয়ে বলেছিল, মুরগির মাংস তৈরি করতে আর মিষ্টি আনতে। মা পিসিও খুব খুশি হয়েছিল। বোরও সেদিন খুব খাতির হয়েছিল। ওর বন্ধু লোকটিকেও আমার খারাপ লাগেনি। কিন্তু লোকটা আমাকে জজিয়ে গিয়েছিল।
আমার হিসেবে ভুল হয়নি। বেন্দার বন্ধু সেই লোকটিই আমাকে রোগ দিয়ে গেছল। অবশ্য হলফ। করে রোগের বিষয়ে বলা যায় না। কিন্তু আমার কাছে তখন যারা মাঝে মধ্যে আসত, তারা পরেও এসেছে, আমার অসুখ করেনি। সেই লোকটির ফরসা টকটকে মুখে আমি কয়েকটা লাল মতন পোড়া পোড়া দাগ দেখেছিলাম। সন্দেহটা আমার সেইজন্যই। তারপরেও বেন্দা কয়েকজনকে নিয়ে এসেছে। তারপরে ও নিজে থেকেই সরে গেছল।
রোগটা প্রথমে টের পেলাম, আমার তলপেট আর তলপেটের নীচেই কুঁচকি ঘেঁষে দুটো লাল ফুসকুড়ি মতন দেখে। কোনও জ্বালা যন্ত্রণা ছিল না। কিন্তু আমার শরীরে কেমন একটা বেভাব। কেমন যেন ঝিম ঝিম ভাব, গা হাত পায়ে পিত্তি পড়ার মতন জ্বালা জ্বালা করে। প্রথমে ফুসকুড়ি দুটোকে পাত্তা দিইনি। ভেবেছিলাম, গরমে গোটা হয়েছে, সেরে যাবে। সেরে তো যায়নি, আরও বড় হচ্ছিল। তারপর একদিন মাকে দেখিয়েছিলাম। মা দেখিয়েছিল পিসিকে। পিসি মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। বলেছিল, সর্বনাশ, তোকে পারা দিল কে? তারপরেই চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। শহরের এক বড় ডাক্তার। দেখেছিলেন। আমার হাতের শিরা থেকে রক্ত নিয়ে, কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। তারপরেই ইনজেকশন বড়ি চলছিল। খাওয়া দাওয়া বদলে দেওয়া হয়েছিল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। তখন আমার কুড়ি বছর বয়স। ভেবেছিলাম, বাঁচব না। মাকে মাথা চাপড়ে কঁদতে দেখেছি। আবার পিসিকে এ কথাও বলতে শুনেছি, কাদিস না বউ। আজকাল এ রোগের ভাল চিকিচ্ছে বেরিয়েছে, নুড়ি সেরে যাবে। লাইনে থাকতে গেলে, ও রকম এক-আধবার অসুখ করে। যে লাইনের যা ব্যামো। কার আছে না আছে, সবসময় তো আর বোঝা যায় না।
জানি না, এ রোগ এক বার ঢুকলে চিরদিনের মতন সারে কিনা। তবে আমার সেই ফুসকুড়ি মিলিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুকাল চিকিৎসার পরে, আমার শরীরও ভাল হয়ে গেছল। তারপর সে কি, ও সব আর কখনও হয়নি। অনেকে ভয় দেখায়, ও সব রোগ এক বার শরীরে ঢুকলে, আর কখনও নাকি সারে না। দশ-বিশ বছর বাদে আবার ফুটে বেরোয়। কী জানি! সাত বছর তো হল, কিছু হয়নি। শরীর বেভাব হলেই ডাক্তার দেখাই। আমার কাছে এক ভদ্রলোক আসেন, রেলের বড় অফিসার। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, আমি যেন মাঝে মধ্যে রক্তটা পরীক্ষা করাই। সে কথা আমি মেনে চলি।
এখন আমার মনে হয়, আমার ভেতরে দুটো দাগ আছে। একটা আমার মরে যাওয়া ছেলে, আর একটি সেই রোগ। এখন আমার শরীরের ভেতরে রোগ নেই, তবু মনে হয় রোগটা আমার ভেতরে দাগ রেখে গেছে। মনের কথা আলাদা। যেমন পীতুবাবুকে আমি কখনও ভুলব না। পীতুবাবু হলেন সেই দেবতা, যাঁর কাছে আমাকে প্রথম বলি দেওয়া হয়েছিল। তাকে কি আমি কখনও ভুলতে পারি। আজ বাড়িওয়ালির ঘরে যে মেয়েটিকে আনা হয়েছে, জানি না, এই তার প্রথম বলি কি না। অনেক মেয়েকেই, এ পাড়ায় এসে বলি হতে দেখলাম। এখানকার বলি বড় পাষণ্ড। দরজায় কে শব্দ করছে…।
বলতে গেলে একটি অধ্যায়ের এখানে শেষ। আমি খাতাটা বন্ধ করে চোখ বুজে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। একটি মেয়ের দেহ জীবিকার প্রথম সূচনা থেকে অনেকখানি ব্যক্ত হয়েছে। একটানা এতটা লেখা আর আছে কিনা জানি না। এক দিনের মধ্যে এতখানি লেখাটাও কম কথা না। লেখিকা কেন এতটা লিখেছিল। তার কারণ বর্ণিত হয়েছে। অনিবার্য শারীরিক কারণে, তখন তার দেহ বিশ্রাম করছিল। তার কিছু করার ছিল না, কেন লিখছিল’ তার বাড়িওয়ালির নতুন বালিকার বলিদান ঘরে, একটি উপলক্ষে তার নিজের প্রথম বলির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।
খাতার লেখিকা যা লিখেছে, তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। সেই কারণেই অনায়াস। কোথাও কোনও বড় কথা নেই। কিন্তু আমার আশ্চর্য লাগে, কোথাও তেমন করে যেন, কোনও রাগ বা ঘৃণা জ্বলে ওঠেনি। উঠেছিল, তার মাকে যখন সে পিতার মৃত্যুর মাত্র পাঁচ মাস পরে, বৃত্তি গ্রহণ করতে দেখেছিল। সেই অংশে সব থেকে করুণ ব্যাপার বোধ হয়। বালিকার মনে পিতার স্মৃতি তখনও উজ্জ্বল। পিতার স্মৃতি বোধ হয় তার মনে বরাবরই উজ্জ্বল। কারণ, সে যখন কলকাতার তথাকথিত লালবাতি এলাকায় দেহবৃত্তি করতে এসেছিল, তখন তার ঘরের দেওয়ালে পিতার ছবি রাখার উল্লেখ রয়েছে। আর সব নিষ্ঠুর, ভয়াবহ ঘটনাগুলো সে এমনভাবে ব্যক্ত করেছে যেন তা খুবই স্বাভাবিক। অবিশ্যি সমস্ত ব্যাপারটাই খুব সরল আর অমানুষিক। পরবর্তীকালে পীতাম্বর ভড় নামক ব্যক্তির কাছে যে তাকে প্রথম বলি দেওয়া হয়েছিল, সে নিজেই লিখেছে।
আমার অবাক লাগছে, এই সরল লেখার মধ্যে হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রূপ, রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণা এবং পাপবোধ অনায়াসে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলি দিতে হয় না। খাতার লেখিকার মধ্যে একটি গুণ আছে, নিজেকে প্রকাশ করবার মতো। লিখে বলবার ভাবগুণও তার ছিল। জানি না, তার মুখের ভাষার কতখানি বাঁধুনি ছিল। এক জায়গায়, সামান্য দু-এক লাইনেই জানা গিয়েছে, সে বই পড়তে ভালবাসত। এবং পীতাম্বর ভড়ের বাগান বাড়িতে যা ঘটত, তা যে যৌন বিকৃতি, এ কথা সে পরে বই পড়ে বুঝতে পেরেছিল। জানি না, সে কী বই পড়েছিল এবং কী ভাবে সিদ্ধান্তে এসেছিল সে সব ঘটনা ছিল বিকৃত। বিকৃত নিশ্চয়ই। শৃঙ্গার এক ক্রিয়া। কিন্তু একাধিক রমণীর সঙ্গে, একত্রিত হয়ে যে যৌন চক্র সৃষ্টি করা হত, তা নিঃসন্দেহে বিকার!
এই খাতা পড়লে স্বভাবতই, খাতার লেখিকা সম্পর্কে মনে কৌতূহল জাগে। সে তার ছেলেবেলার অনেক কথাই মনে রেখেছিল। বিশেষত বৃন্দাবনের সঙ্গে ছেলেবেলায় হাজরাদের পোডোর খেলা। তার ধারণা, সেই যে সাত-আট বছরের মেয়ে সে নগ্ন হয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিল, সে নগ্ন শয়নই তার অক্ষয় হয়ে চলছে। সে আর কোনও দিন তার নগ্নতা ঘোচাতে পারেনি। পাপবোধ থেকেই সে এ কথা বললেও, তার বান্ধবী কণা একই কাজ করে কেন ঘরবর সবই পায়? এ প্রশ্নও ঈশ্বরের কাছে তার চিরদিনের জন্য রয়ে গিয়েছে।
আমি আবার খাতাটা নিয়ে পাতা ওলটালাম। কতকগুলো অর্বাচীন গানের কলি একটি পাতায় লেখা রয়েছে। মনে হয়, এ সব গানের কলি সে কলকাতায় গিয়ে শুনেছিল। হয়তো খাতার পাতা খুলতে গিয়ে এই পাতাটাই খুলেছিল আর লিখতে আরম্ভ করেছিল। যদিও বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো, তবু মনে হয়, কথাগুলো মনে করে করে লিখেছিল। যেমন একটি কলি, কাটা মেরে মোটা মাগুর পালিয়ে গেছে অগাধ জলে…’ কিংবা, কী করে জানলে তুমি লোহা গালাতে…’বা শিখর বাহন কোথা গেলি, বকনা ডাকতে লেগেছে…’ ইত্যাদি। গানের কলিগুলো পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায়, তার পরিবেশে এ সব। গানের প্রচলন ছিল। হয়তো পরিবেশিত হত না, অবকাশের সময়ে নিজেরা নিজেদের শুনিয়ে হাসি মশকরা করে গাইত। আবার এমন গানের কলিও দেখেছি, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাব এবং রুচির। যখন। একটি মাত্র গানের কলিই ছিল তুমি বড়ই নিদয় হে, হিদয় পানে চাই না…।
তারপরে দু-তিন পাতা উলটেই দেখি, এইরকম লেখা রয়েছে: ইচ্ছে করে শালাকে জুতো পেটা করি। সত্যি কি আর জুতো পেটা করব? এত বড় একটা মানুষ। এক একসময় আমাকে এমন ক্ষেপিয়ে। তোলে। মনে হয় জুতো মারি। রাগ করে না, আদর করে। লোকে শুনলে কী ভাববে? আদর করে। আবার জুতো মারা যায় নাকি? আমি তো জানি, যায়। যে লোক নিজে আলনার নীচে থেকে আমার চটি নিয়ে নিজের গালে মারে আর বলে, বিজলী, আমাকে জুতো পেটা করো,তার সম্পর্কে এ রকম ভাবা যায়। লোকটি বড় ব্যবসায়ী, মস্ত বড় গাড়ি নিয়ে আসে, নাম রাজেশ্বর। রাজেশ্বরের মুখেই শুনেছি, ওরা নাকি বাঙালি না। কয়েক পুরুষ এ দেশে আছে, তাই বাঙালির মতন হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ে থা যা কিছু, সব নিজেদের দেশ ঘর জাতের সঙ্গে। না বললে, কোনও দিন বুঝতে পারতাম না।
রাজেশ্বর এ পাড়ায় এলে, আমার ঘরেই আসে। মাঝে মাঝে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে আসে। মদের। ফোয়ারা ছোটায়। খাবারের ছড়াছড়ি যায়। রাজেশ্বর যেমন দিলখোলা, মনটাও তার ভাল। কিন্তু এক বাতিকে ওর সব গোলমাল করেছে। মাতামাতি নাচানাচি অনেকেই করে। তা বলে তোমার সামনে ল্যাংটো হয়ে নাচতে হবে নাকি? মনে আছে, সে প্রথম যেদিন এল, তা বছর তিনেক হবে, বলে কিনা, আমাকে নেকেড ড্যান্স দেখাও। আ মরণ! একে নাচ, তা আবার ল্যাংটো। আমি অমনি দরজা খুলে। দিয়ে বলেছিলাম, অন্য ঘরে দেখুন, আমার ঘরে ও সব চলবে না।
অনেক আছে, আলো না জ্বালালে তাদের সুখ নেই। যা করবে আলো জ্বালিয়ে। সেটা না হয় মেনে। নেওয়া গেল। আমাকে তুমি দেখবে? তা দেখ না। অনেকেই দেখেছে, দেখবার জন্যই তো আছি। তা বলে, নেকেড ড্যান্স? ও আবার কী কথা। রাজেশ্বর ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, বলেছি বলে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছ? এ রকম সাহস তো এ পাড়ায় কারোর আজ পর্যন্ত দেখিনি! আমি বলেছিলাম, তাড়িয়ে দেব কেন? আমি পারব না তাই বলেছি।
আমি জানতাম, কোনও কোনও মেয়ে লোকের মন রাখার জন্য, তা-ও করে। কী না করে। সেই। যে বলে না, ফেল কড়ি মাখ তেল, তুমি কি আমার পর? সেই রকম। যা চাও, যেমনটি চাও, সব পাবে। টাকা ছাড়ো। ছেলেবেলায় আমার বাবার মুখে একটা কথা শুনতাম, চাঁদির জুতো। এখন তার মানে বেশ ভাল বুঝি। আমাদের তা বলে কেউ চাদির জুতো মেরে যেতে পারে না। রীতিমতো খেটে রোজগার করি। কিন্তু তা বলে, টাকা দিয়ে, যে যা খুশি করতে চাইবে, তা আমার দ্বারা হবে না। সত্যি, লোকের যে কত রকমের চাহিদা! এই একটা ব্যাপারে দেখছি, মানুষের ঘেন্নাপিত্তি বলে কিছু নেই। আমার। জীবনের প্রথম বাবু, পীতুবাবু অনেক কিছু করেছেন। তখন থেকেই জানি, মানুষের ঘেন্নাপিত্তি বলতে কিছু নেই। পীতুবাবুকে নিয়ে মনে একটা ভয় ছিল। পীতুবাবু বলে কথা। কিন্তু পীতুবাবু যা-ই করে থাকেন, আমি কি সে সব করেছি? মরে গেলেও পারব না। আজ পর্যন্ত পারিনি। তারপরে জানি না, কোনও দিন পারব কি না। জীবনে কোনও কিছুই জোর করে বলা যায় না। আমি কি আগে জানতাম, পীতুবাবুর বাগান বাড়িতে আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন আমি যা পেরেছিলাম, তা পারব বলে কি জানতাম। এ বয়সের মধ্যেই, হাজার গণ্ডা পুরুষ পার করে দিলাম। এ সব যে পারব, আগে কখনও জানতাম? জীবনে কোনও কিছুই আগে থেকে ঠিক করে বলা যায় না।
আজ যা টাকা নিয়েও করতে পারি না, কাল হয়তো বিনা টাকাতেই তা করব। কিছু বলা যায় না। কিন্তু এখনও পারি না। তা বলে, এ ব্যবসা করতে গেলে যে সব ছলাকলা করতে হয়, তা কি আর জানি না? কথায় বলে, ছেনালি। ওইটি না জানলে এখানে এক দণ্ড থাকা চলে না। যে কাজের যেমন রীতি। শুধু মুখ দেখিয়ে কিছু হয় না। শরীর দেখিয়েও কিছু হয় না। অনেক ছলাকলা করতে হয়। শিখতে হয় না, আপনা থেকেই রপ্ত হয়ে যায়। ছলাকলা দুনিয়ার সব ব্যবসাতেই করতে হয়। তা আবার। মেয়েমানুষের গতরের ব্যবসা। ছলাকলা ছাড়া এক তিল চলে না। মেয়েদের এমনিতেই ছলাকলা ছাড়া চলে না, বেশ্যার তো কথাই নেই। কিন্তু কেউ এসে যা খুশি তাই বায়না করবে, তা মেটাতে পারব না। আমি পারব না। তা বলে অন্য মেয়ে কি পারবে না? কত রকমের মেয়ে আছে, কত কী করে। তার জন্যই রাজেশ্বরকে ও রকম বলেছিলাম। রাজেশ্বর খুব রেগে গেছল। সে আমার ঘর ছেড়ে যায়নি। নিজে উঠে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার হাত টেনে ধরে খাটে বসেছিল। বলেছিল, তোমার ঘরে ঢুকেছি যখন, বেরিয়ে আমি যাব না।’
আমি হেসে বলেছিলাম, বেরিয়ে যাবেন কেন? বসুন, কী খাবেন বলুন, আনিয়ে দিচ্ছি। তবু রাজেশ্বর আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। সে আগেই মদ খেয়েছিল। তার চোখ লাল ছিল। বলেছিল, তুমি জিনিসটি তো ভালই দেখছি, এত দিন চোখে পড়েনি কেন জানি না। আমি বসব তোমার ঘরেই, নাচও হবে তোমার ঘরেই। নেকেড ড্যান্স কে করে, কে আছে দেখ, ডাকো তাকে। তুমি আমার কাছে বসে থাকবে।
আমার হাসি পেয়েছিল। লোকটা ক্ষ্যাপা আছে। আমি জানতাম, আমাদের বাড়িতেই দোতলায় একটি মেয়ে আছে, নাম গীতা, বেঁটেখাটো শক্ত চেহারা। মুখোনি মিষ্টি আছে। গীতা একেবারে ক্ষেপি। টাকা দিলে সে বাজনার তালে তালে উলঙ্গ হয়ে নাচতে পারে। ওকে কি নাচ বলে নাকি? শরীরের কতকগুলো অঙ্গভঙ্গি। আমি রাজেশ্বরকে বলেছিলাম, ও রকম নাচ না দেখলে আনন্দ পান না, না?
রাজেশ্বর বলেছিল, লোকে কত খেলা দেখতে ভালবাসে। আমার এই খেলা দেখতে ভাল লাগে। আমি হেসে উঠেছিলাম। এর নাম খেলা। তা এ রকম খেলাই তো। এক এক সময় মনে হয়, আমরা সবাই খেলতে এসেছি। আমাদের কাছে যারা আসে, তারাও এক রকমের খেলা খেলতে আসে। আমরাও এক রকমের খেলা খেলছি। বলেছিলাম, একটি মেয়ে আছে, আপনি যে রকম চান, সে সে। রকম নাচে। আপনাকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখানেই নাচ দেখাবেন।
রাজেশ্বর আমাকে প্রায় বগলদাবা করে টেনে নিয়ে বলেছিল, সেটি হবে না। তুমি নাচবে না বলেছ, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি আমার পাশে বসে থাকবে, আমি নাচ দেখব। ডাকো তোমার নাচনেওয়ালিকে। আমি যেন বড়ই অশান্তি আর লজ্জা পেয়েছি, এভাবে বলেছিলাম, ছাড়ন ছাড়ুন, আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। রাজেশ্বর আমার গাল টিপে দিয়ে বলেছিল, তুমি একেবারে কচি খুকি। জড়িয়ে ধরলেই দম বন্ধ হয়ে যায়। আমি গালে হাত দিয়ে বলেছিলাম, বাব্বা। আমার লাগে না বুঝি? রাজেশ্বর বলেছিল, লাগবে না কেন? চোট তো লাগেনি। বলে সে চোখের ইশারায় হেসেছিল। রাজেশ্বর পাজি আছে। আমি তার হাত ছাড়িয়ে উঠে দরজা খুলতেই, সে আবার বলে উঠেছিল, দাঁড়াও, আগে একটু মালের ব্যবস্থা করা যাক। তোমার লোককে ডাকো।
আমি আমার চাকর রামাবতারকে ডেকেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী খাবেন বলুন? রাজেশ্বর জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কী খাবে? আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, আমি মদ খাই না। রাজেশ্বর তার ওপর দিয়ে গিয়েছিল! বলেছিল, তুমি খাও না, শোঁক। ও সব ভড়কিবাজি আমি অনেক দেখেছি। তুমি মদ খাও না, ন্যাংটো হয়ে নাচতে পার না। ঘরের বউ নাকি, তুমি এক ছাড়া দুই জান না? তখন আমি একটু চোখ ঘুরিয়ে হেসে বলেছিলাম, আমি আপনাকে নাচাতে পারি। রাজেশ্বর বলেছিল, বটে? দেখব। তা হলে তোমার খুটোয় ভেড়া হয়ে থাকব। এখন ন্যাকামিটি ছাড়ো তো চাঁদ, ও সব খাই না টাই না বললে আমি শুনছি না। কোনওদিন না খেয়ে থাক, আজ খেতে হবে। এই নাও টাকা, কী খাবে বলে দাও, নিয়ে আসবে। সে একশো টাকার একটা নোট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ইচ্ছে করলে, গোঁ করে থাকতে পারতাম, খাব না। অনেককেই বলে দিই, খাব না। মদ তো রোজই খাই। না খেয়ে পারি না। কিন্তু প্রথম রাত্রি থেকেই মদ নিয়ে বসলে, পরে আর সামলানো যায় না। মদ খেলেই মেজাজ অন্য রকম হয়ে যায়। খদ্দের ফিরে যায়। ব্যবসা মাটি। মদ খেয়ে কারবার মাটি করতে। রাজি না। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কতক্ষণ থাকবেন?
রাজেশ্বর ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল। বলেছিল, যতক্ষণই থাকি, তোমার সারা রাত্রের টাকা পাবে। এ রকম কথা অনেক শুনেছি। বড় বড় কথা বলবার লোকের অভাব এখানে হয় না। আবার মৌনীবাবাও অনেক দেখেছি, ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। কিন্তু পাজির পা-ঝাড়া। কাজ মিটিয়ে, তারপরে আর টাকার হিসেব মেলে না। তখন ঘড়ি আংটি ধরে টানাটানি করতে হয়। অনেকের তাও থাকে না। সে রকম সন্দেহ হলে, আমরা আগেই টাকা নিয়ে নিই। এক কথায় কারোকে আমি বিশ্বাস করি না, রাজেশ্বরকেও করিনি। বলেছিলাম, আমার এক রাত্রের কত টাকা জানেন তো?
রাজেশ্বর পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট নিয়ে, খাটের বিছানায় ফেলে দিয়ে বলেছিল, পাড়ায় এর থেকে বেশি কেউ নেয় বলে তো শুনিনি৷ আমি হেসে বলেছিলাম, প্রথম রাত্রি থেকে বসলে তা-ই। রাত্রি এগারোটার পরে এলে অর্ধেকেই হত। রাজেশ্বরের মেজাজ গরম হচ্ছিল। একটু হওয়া ভাল। ঠাণ্ডা করতে হয় কেমন করে, তা জানি। একটু গরম হওয়া ভাল। সে বলেছিল, মেলা বকিও না তো। টাকাটা তুলে নিয়ে যাও। মাল খাবে, আনতে দাও। জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কী খাবেন? সে বলেছিল, তুমি যা খাবে, আমিও তাই খাব। তারপরে নাচনেওয়ালিকে ডাকো।
আমি বুঝেছিলাম, মদটাই আগে দরকার। আমি রামাবতারকে মদ সোডা আর খাবার আনতে পাঠিয়ে, গীতাকে নিজেই ডাকতে গিয়েছিলাম। গীতা বসে ছিল, এক কথাতেই রাজি হয়েছিল। আমি ওকে আগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলাম, কত নেবে। এটাই নিয়ম। আমার ঘরে, অন্য মেয়েকে ডেকে বসালে, তার সঙ্গে গল্প করলে, নাচ দেখলে, সে যা চাইবে, তা আমাকেই আমার বাবুকে বলতে হবে। টাকাটা নিজের হাতে নিয়ে দিতে হবে। সব ব্যবস্থার পরে আগে মদের পর্ব চলেছিল। রাজেশ্বর গীতাকে কাতুকুতু দিয়ে খুব হাসিয়েছিল। নাচবার আগেই, তার গা থেকে জামা কাপড় সব খুলে নিয়েছিল। গীতা প্রথমে আমার একটা ভোয়ালে টেনে নিয়ে নিজেকে ঢেকেছিল। রাজেশ্বর একেবারে ক্ষ্যাপা। সে তোয়ালেটাও টেনে নিয়েছিল। গীতা বেশ মাতাল হয়ে পড়েছিল। সে আর কোনও চেষ্টা না করে, বসে বসে মদ খেয়েছিল। এক সময় আমি উঠে রেকর্ড চালিয়ে দিয়েছিলাম। গীতা মেঝের ওপর নাচতে আরম্ভ করেছিল। রাজেশ্বর মাঝে নানান কথা বলে গীতাকে আরও ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। আমার ঘরে সে রকম নাচ এই প্রথম। তারপর থেকে রাজেশ্বর এলে গীতার ডাক পড়ে। মাঝে মাঝে রাজেশ্বর তার বন্ধুবান্ধব নিয়েও আসে। এই তিন বছর ধরে, রাজেশ্বর মাসে অন্তত চার দিন আসতই। কোনও কোনও মাসে তার বেশি। পরে শুনেছি, এ পাড়ায় তার অনেক দিনের যাতায়াত। রেণু নামে একটি মেয়ের ঘরে। সে আগে প্রায়ই যেত। আমার কাছে আসার পরে আর কারোর ঘরে যেত না। যে কারণেই হোক, আমাকে রাজেশ্বরের ভাল লেগে গেছিল। রূপের জন্য ভাল লেগেছিল, তা বলি না। আমার থেকে অনেক সুন্দরী মেয়ে আমাদের বাড়িতেই আছে। সে বলত, আমার সঙ্গে কথা বলে তার ভাল লাগে। তিন বছরের মধ্যে, আমি তার সব জেনে নিয়েছিলাম। তার বাড়ি বউ ছেলে মেয়ে, জ্ঞাতি গোষ্ঠীর সব কথা। তার কথা থেকে বুঝেছি, সে যে তার বউকে ভালবাসে না বলে এখানে আসে, তা না। তার বউ ভালমানুষ, গোবেচারা স্বভাবের। রাজেশ্বর ছাড়া সে কিছু জানে না। স্বামী মদ খায়, সে জানে। আমাদের কাছে আসে, তা স্পষ্ট করে জানে না। কিন্তু কখনও কিছু বলে না। রাজেশ্বর বলে, তার বউ যদি একটু মেজাজি হত, তা হলে ভাল হত। তার বেশ বড় ছেলে আছে, তাকে দেখে কোনও দিন বুঝতে পারিনি। ছেলে কলেজে পড়ে। ছোট মেয়েটি নাকি তার সবথেকে আদরের। জ্ঞাতিরা তার পরম শত্রু। সবসময়। ক্ষতি করবার চেষ্টা করে।
আমি ভেবে দেখেছি, রাজেশ্বর আমার এখানে আসত একটু খেয়াল-খুশি মেটাতে। তার বউ মেজাজি না, সেটা তার দুঃখ। কিন্তু তার বড় ছেলেটির জন্য মনে দুঃখ। ছেলেটা নাকি অভদ্র চোয়াড়ে মতন হয়েছে, রাজেশ্বরের মুখে মুখে তর্ক করে। আর সেটাই তার জীবনের কাল হয়েছে। আজ কাগজে বেরিয়েছে, রাজেশ্বর রায় নিজের বন্দুক দিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছে। সত্যি, খবরটা পড়ে এমন মনে হল, ওকে জুতো দিয়ে মারি। তুমি তোমার জীবনে এত বড় একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছ, এত লোককে খাটাচ্ছ, তোমার এমন ভরা-ভরতি সংসার, তুমি ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে এমন জীবনটা নষ্ট করলে? প্রথমটা পড়ে ভারী কষ্ট হয়েছিল। এই নয় কি যে, রাজেশ্বরকে আমি ভালবেসেছিলাম। সে বড় প্রাণ-মন ভোলা লোক ছিল। সে আমার আলমারি ঘেঁটে বই দেখত। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই নিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কবিতা পড়ত। আবার গীতার নাচ দেখত। কখনও কখনও নিজেও শিব হয়ে নাচতে আরম্ভ করত। সে আমার ঘরে উৎসব করত। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছল। এক একদিন সে মদ খেয়ে কেমন চুপচাপ থাকত। তখন আমাকে তার সংসারের কথা বলত। সে যদি ঝগড়া করে চলে যেত, আর কোনও দিন আমার কাছে না আসত, তা হলে, কষ্ট পেতাম না। লোকটা বেশ্যাকেও কঁদিয়ে গেল। দশজনের সামনে কাঁদতে পারিনি, তা হলে টিটকারির জ্বালায় কান পাততে পারতাম না। খবরটা পড়ে কেন যে অমন কান্না পেয়েছিল, তা তো কারোকে বোঝাতে পারতাম না। সবাই অন্য রকম ভাবে নিত। তারা তো রাজেশ্বরকে চেনে না। খবরটা যখন গীতাকে বলেছিলাম, গীতা বলল, যা শালা ন্যাংটো হয়ে একটু ধিত্তান তিত্তান করতাম, তাতেই বেশ হাতে মাল পেতাম। লোকটা নিজের হাতে গুলি খেয়ে মোল? আমার পোড়া কপাল।
গীতার কথাও ঠিক। কিন্তু আমি সেভাবে বলে, মন খালাস করতে পারি না। গীতা বলল, ওর। পোড়া কপাল। সত্যি কি আমার বা গীতার পোড়া কপাল? না, পোড়া কপালটা আসলে রাজেশ্বরের। সে তার এই অল্প বয়সের জীবনে যা করেছিল, সব গিয়ে পড়বে কাঁচা বয়সের ছেলেটার হাতে। রাজেশ্বরের মুখে শুনেছিলাম, তার ছেলের মাথা খাচ্ছে, তারই জ্ঞাতি গোষ্ঠীরা। একে বলে চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানো। রাজেশ্বরের চামড়া দিয়ে জ্ঞাতিরা এ বার ডুগডুগি বাজাবে। তার বউ ছিল গোবেচারা, ভালমানুষ বউ। এখন সে হবে গোবেচারা ভালমানুষ মা। তার জীবনের তেমন হেরফের হবে না। কষ্ট হয়, রাজেশ্বর যা তৈরি করেছে, তা দু হাতে নষ্ট করা হবে।
আমি ভেবেই বা কী করব। তবু ভাবনা হয়। প্রথম চোটটা কাটিয়ে ওঠার পরে, যতই রাজেশ্বরের কথা মনে হচ্ছে, এক একটা দিনের কথা মনে পড়ছে, ততই যেন আমার রাগ হচ্ছে। সে যে বলত, বিজলী তোমার চটি দিয়ে দু গালে মারো, ইচ্ছে করছে, এখন তাই করি। আমার খাটে শুইয়ে তাকে জুতো পেটা করি। ছি ছি রাজেশ্বর, কী করলে বলো তো? আমার আর কী। একটা বেশ্যা গেলে, দশটা বেশ্যা তুমি পেতে। কিন্তু এমন কথা শুনিনি, মনের কথা কারোকে বলেছ। বলেছিলে কেন? তাই তো আজ ভাবতে হচ্ছে। কে শালার রাজেশ্বর রায়, আমার তাতে কী যেত আসত। তুমি আমার পিরিতের জার ছিলে না। তোমাকে নিয়ে আমার প্রাণ কোনও দিন হা হুতাশ করেনি। কিন্তু সেই যে হেসেকুঁদে নেচে গেয়ে, অন্যকে হাসিয়ে মজা করতে, মন খুশি কথা বলতে, মুখে এক মনে আর এক ছিলে না, তাতে তোমাকে ভাল লেগেছিল। ঘর সংসারের কথা যদি না বলতে, তা হলে এত কথা মনে হত না।
আমি জানতাম, রাজেশ্বরের প্রেম করা ধাতে ছিল না। সে বলত, ও সব সাত কাহন বাক্যি বলে পিরিত করা আমার আসে না। অত ধৈর্য আমার নেই। ঠিক কথা বলত, যা সত্যি, তাই বলত। ন্যাকা ন্যাকা পুরুষ আমারও ভাল লাগে না। মেয়ে-ন্যাকড়া পুরুষ দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। রাজেশ্বরকে আমি আমার মনের কথা কখনও বলিনি। সে শুনতেও চায়নি। তবু সে আমার বন্ধু হয়ে গেছল। না রাজেশ্বর, সত্যি কি আর তোমাকে জুতোপেটা করতে পারি। ওটা আমার মনের কথা না। জুতো আমার গালে। তবু বড় রাগ হচ্ছে তোমার ওপর, খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে…।