২. গ্রন্থাগার

গ্রন্থাগার

ভেনাবিলি, ডর্স… ইতিহাসবিদ, জন্ম সিনায়… জীবনটা হয়তো তার ঘটনাবিহীনভাবেই কেটে যেত। যদি না দু-দুটো বছর স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার পর তরুণ হ্যারি সেলডনের সাথে তার পরিচয় ঘটত। সেলডন তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

১৬.

কামরাটা যথেষ্ট বড়ো। অন্তত ইম্পেরিয়াল সেক্টরে হামিনের যে কামরা ছিল তার চেয়ে বড়ো। এটা একটা শয়নকক্ষ, কোণায় ছোট্ট একটা ওয়াশ রুম, তবে রান্না করার জন্য পৃথক কোনো ব্যবস্থা বা কোনো ডাইনিং স্পেস নেই। কোনো জানালা নেই, অবশ্য ছাদে গ্রিল লাগানো একটা ভেন্টিলেটর আছে। সেটা থেকে অবিরাম দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ বেরুচ্ছে।

বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে চারপাশে তাকালেন সেলডন।

হামিন তার স্বভাবসুলভ আশ্বস্ত করার সুরে সেলডনের এই দৃষ্টির জবাব দিল। শুধু আজকের রাতটা, সেলডন। আগামীকাল কেউ একজন এসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতরে আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। সেখানে আরামে থাকতে পারবেন।

আপনি জানলেন কীভাবে, হামিন?

আমিই সব ব্যবস্থা করে দেব। এখানে দুএকজন আছে আমার পরিচিত রসকষহীন ভঙ্গিতে সামান্য একটু হাসল সে–ওরা কোনো না কোনোভাবে আমার কাছে ঋণী। আমি প্রতিদান চাইতে পারি। এবার কাজের কথায় আসা যাক।

সরাসরি সেলডনের দিকে তাকালো সে। হোটেলে আপনার যে জিনিসপত্র ছিল ধরে নিন সেগুলো হারিয়ে গেছে। এমন কিছু ছিল যা হারিয়ে গেলে আর পূরণ করা সম্ভব নয়?

আসলে কোনো ক্ষতিই সত্যিকার অর্থে পূরণ করা যায় না। ব্যক্তিগত কিছু জিনিস ছিল, অতীত স্মৃতি হিসেবে সেগুলো আমার কাছে মূল্যবান, তবে হারিয়ে গেলে গেছে। এছাড়াও ছিল আমার গবেষণার কিছু নোটস, কিছু হিসাব নিকাশ এবং সবগুলো রিসার্চ পেপার।

যেগুলোর কথা এখন সবাই জানে। ডেমারজেল-এর প্রচার বন্ধ করতে পারছে না। কারণ এই মুহূর্তে সেটা করা বিপজ্জনক–তবে খুব শিঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। আমি অবশ্য একটা কপি ঠিকই যোগাড় করতে পারব। না পারলেও বোধহয় অসুবিধা হবে না। আপনি আরেক সেট তৈরি করে নিতে পারবেন, তাই না?

হ্যাঁ, পারব। সেজন্যই তো বলেছি যেকোনো ক্ষতিই পূরণ করা যায় না। এছাড়াও আছে হ্যালিকনে ফিরে যাওয়ার টিকেট।

সবকিছুই পূরণ করা যাবে। আপনার নামে একটা ক্রেডিট টাইল-এর ব্যবস্থা করে দেব, খরচ হবে আমার একাউন্ট থেকে। হাত খরচটা চালিয়ে নিতে পারবেন।

সেটা আপনার উদারতা। কিন্তু আমি নিতে পারব না।

এখানে উদারতার কিছু নেই, যেহেতু আমি এভাবেই এম্পায়ার রক্ষা করতে চাই। আপনাকে নিতেই হবে।

আপনি কী পোষাতে পারবেন, হামিন? আমার কাছে থাকলে যতই অস্বস্তি লাগুক না কেন ঠিকই ব্যবহার করব।

মোটামুটি আরামদায়কভাবে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু খরচ আমি দিতে পারব, সেলডন। স্বাভাবিকভাবেই আমি চাই না যে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম কিনে ফেলুন বা দয়াপরবশ হয়ে মিলিয়ন ক্রেডিট দান করে দেবেন।

চিন্তা করবেন না, কিন্তু আমার নাম রেকর্ড

কিছু হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্টের নেই। এখানে আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। এখানে যেকোনো কথা বলা যাবে, যেকোনো বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।

যদি মারাত্মক কোনো অপরাধ ঘটে?।

তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তা যথাযথভাবে সামলাবে–এবং সে ধরনের কোনো অপরাধ এখন পর্যন্ত হয়নি। শিক্ষার্থী এবং ফ্যাকাল্টি সদস্যরা নিজেদের স্বাধীনতার মূল্য বোঝে। ভালোভাবেই জানে রক্তক্ষয়ী কোনো দাঙ্গা হাঙ্গামা গভর্নমেন্টকে বহুদিনের অলিখিত চুক্তি ভঙ্গ করে এখানে সৈন্য পাঠানোর একটা সুযোগ করে দেবে। এমনটা ঘটুক কেউ চায় না, এমনকি গভর্নমেন্ট নিজেও চায় না। সংক্ষেপে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং বৃহৎ কোনো কারণ ছাড়া ডেমারজেল আপনাকে এখান থেকে তাড়াতে পারবে না। এবং গত একশ পঞ্চাশ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই গভর্নমেন্টকে সেইরকম কোনো সুযোগ দেয়নি। অন্যদিকে আপনি যদি কোনো স্টুডেন্ট এজেন্ট-এর ফাঁদে।

এখানে স্টুডেন্ট এজেন্টস আছে?

কী করে বলব? থাকতে পারে। যেকোনো সাধারণ শিক্ষার্থীকে ভয় বা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে যে কেউ দলে টানতে পারে। কেউবা আবার নিজের ইচ্ছামতোই ডেমারজেল বা অন্য কারো পক্ষে কাজ করতে পারে। কাজেই একটা কথা ভালোভাবে মাথায় গেঁথে রাখুন : আপনি এখানে যথেষ্ট নিরাপদ, কিন্তু কেউ কখনো পুরোপুরি নিরাপদ হতে পারে না। আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। আবার সতর্ক করে দিচ্ছি। ঠিকই, কিন্তু আমি চাই না যে আপনি বিপদের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকেন, স্বাভাবিকতা নষ্ট করে ফেলেন। হ্যালিকনে ফিরে গেলে বা ট্র্যান্টরের বাইরে অন্য কোনো গ্রহে গেলে যতটুকু নিরাপদ থাকতেন এখানে তারচেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ থাকবেন।

আমি জানি। বিষণ্ণ সুরে বললেন সেলডন।

আমিও জানি। নইলে আপনাকে একা রেখে যাবার কথা চিন্তা করতাম না।

আমাকে একা রেখে যাবেন? ঝট করে ঘুরে তাকালেন। আপনি যেতে পারবেন না। এই গ্রহ আপনি চেনেন, আমি চিনি না।

আপনার সাথে সর্বক্ষণের জন্য আরেকজন থাকবে। সে এই গ্রহটাকে চেনে। গ্রহের এই অংশটা চেনে, সত্যি কথা বলতে কী আমার চেয়েও ভালোভাবে চেনে। আমাকে যেতেই হবে। আজকে সারাদিন আপনার সাথে ছিলাম আর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আমার নিজের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করতে হবে।

লজ্জা পেলেন সেলডন। ঠিকই বলেছেন। আমার জন্য আপনি কেন নিজেকে বিপদে ফেলবেন। আশা করি এরই মধ্যে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যায়নি।

ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল হামিন, কে বলতে পারে? আমাদের সময়টা বড়ো কঠিন আর বিপজ্জনক। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন যদি কেউ করতে পারে আমাদের জন্য না হোক, পরবর্তী বংশধরদের জন্য–সে আপনি। এই ভাবনাটাকেই আপনার চালিকা শক্তি হিসেবে গ্রহণ করুন।

.

১৭.

ঘুম নেই সেলডনের চোখে। অন্ধকারে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন আর ভাবছেন। হাত আর সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে হামিন চলে যায়। তারপর থেকে নিজেকে এত অসহায় আর নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে, এরকম বোধ আগে কখনো হয়নি। অদ্ভুত এক বিশ্বের অদ্ভুত এক অংশে রয়েছেন তিনি। এই অপরিচিত বিশ্বে যে মানুষটাকে একমাত্র বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন (অথচ মাত্র আধাবেলার পরিচয়) সেও চলে গেছে। আগামীকাল বা ভবিষ্যতে কোথায় যাবেন, কী করবেন কিছুই বলতে পারবেন না।

এইরকম আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে যখন মনে হলো যে রাতে ঘুম আর আসবে না ঠিক সেই সময়ই স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গেলেন তিনি।

ঘুম যখন ভাঙল তখনো অন্ধকার পুরোপুরি নয় অবশ্য। কারণ অপর প্রান্তে একটা লাল আলো অবিরাম উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে নিভছে আর একটানা তীক্ষ্ণ শব্দ করে চলেছে। নিঃসন্দেহে ঐ শব্দ শুনেই ঘুম ভেঙেছে তার।

মনে করার চেষ্টা করছেন তিনি কোথায়, তার অনুভূতি পরিবেশ থেকে যে তথ্য পাচ্ছে সেগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন। আলোর জ্বলা-নেভা এবং কর্কশ শব্দটা থেমে গেছে। তার বদলে কানে আসছে অধৈর্য ঠকঠক শব্দ।

বোধহয় দরজায় শব্দ করছে কেউ, কিন্তু তিনি মনে করতে পারলেন না দরজাটা কোথায়। আলো জ্বালানোর সুইচ আছে, কিন্তু কোনদিকে সেটাও মনে করতে পারলেন না।

বিছানায় বসে বা দিকের দেয়াল হাতড়াতে লাগলেন, সেই সাথে চিৎকার করে বললেন, এক মিনিট, আসছি।

কন্টাক্ট খুঁজে পেলেন। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করে উঠল কামরাটা।

নামলেন বিছানা থেকে, চোখ পিটপিট করছেন। দরজাটাও খুঁজে পেলেন। খোলার জন্য হাত বাড়িয়েই হামিনের সতর্কবাণী মনে পড়ে গেল। কাঠখোট্টা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কে?

মেয়েলী কণ্ঠে জবাব শোনা গেল, আমি ডর্স ভেনাবিলি। ড. হ্যারি সেলডনের কাছে এসেছি।

বলার সাথেসাথেই দেখা দেখা গেল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। অথচ তিনি দরজা খুলেননি।

মুহূর্তখানেক বিস্মিত হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন সেলডন। তারপর মনে পড়ল যে তার পরনে জাঙ্গিয়া ছাড়া আর কিছু নেই। অসন্তুষ্ট শব্দ করে দৌড়ালেন বিছানার দিকে। হঠাৎ বোধ হলো তিনি আসলে একটা হলোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে আছেন। এটা বাস্তব কিছু না এবং মেয়েটাও তার দিকে তাকিয়ে নেই। শুধু নিজের পরিচয় দানের উদ্দেশ্যে এটা দেখাচ্ছে।

নিজেকে সামলে দম নিলেন। তারপর গলা উঁচু করে বললেন যেন দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মেয়েটা শুনতে পারে, একটু অপেক্ষা কর, এই ধর… আধা ঘণ্টা।

মেয়েটা বা বলা ভালো হলোগ্রাফ জবাব দিল, আমি অপেক্ষা করছি। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল সামনে থেকে।

শাওয়ার নেই কাজেই শরীর মুছে নিলেন শুধু। টুথ পেষ্ট আছে, কিন্তু ব্রাশ নেই, তাই আঙ্গুল ব্যবহার করতে হলো। আর যেহেতু অতিরিক্ত জামাকাপড় সঙ্গে নেই বাধ্য হয়েই গতকালেরগুলো গায়ে চাপালেন তিনি।

দরজা খোলার জন্য হাত বাড়ালেন। হঠাৎ থমকে গেলেন। মেয়েটা তো তার পরিচয় দেয়নি। হামিন বলেছিল তার সাথে দেখা করার জন্য কেউ আসবে, কিন্তু ডর্স না অন্য কেউ আসবে তা তো বলেনি। হলোগ্রাফে তিনি চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক মেয়েকে দেখেছেন, কিন্তু মেয়েটার সাথে যে আরো হাফ ডজন ষণ্ডা পাণ্ডা নেই সেটা কী করে বুঝবেন?

দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিলেন তিনি। মেয়েটাকে ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ল না। শুধু যেন মেয়েটা ঢুকতে পারে ঠিক ততটুকুই দরজা খুললেন। ঢোকার পর আবার বন্ধ করে দিলেন।

দুঃখিত, সেলডন বললেন। সময় কত?

সকাল নয়টা। মেয়েটা জবাব দিল। দিনের কাজকর্ম অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে।

ট্র্যান্টরে দুটো অফিস টাইম মেনে চলা হয়, নয়তো ব্যবসা বাণিজ্য এবং সরকারি কাজকর্মে সমন্বয় সাধন কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিটি গ্রহেই নিজস্ব স্থানীয় সময় রয়েছে। কিন্তু সেলডন কখনোই এগুলোতে অভ্যস্ত হতে পারেন না।

মিডমর্নিং? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

হ্যাঁ।

এই ঘরে কোনো জানালা নেই। খানিকটা কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বললেন।

তার বিছানার কাছে গিয়ে দেয়ালে একটা গাঢ় রংয়ের বিন্দু স্পর্শ করল ডর্স। ঠিক বালিশ বরাবর ছাদে লাল রঙের কয়েকটা অক্ষর ফুটে উঠল। তাতে লেখা… ০৯০৩।

হাসল ডর্স। তার সেই হাসিতে নিজেকে বড়ো কিছু প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা নেই। দুঃখিত। ভেবেছিলাম চ্যাটার হামিন তোমাকে বলে গেছে যে আমি নয়টার সময় দেখা করতে আসব। ওকে নিয়ে সমস্যা হলো, সে জানে অনেক বেশি, কিন্তু প্রায়ই ভুলে যায় যে সবাই তার মতো সবকিছু জানে না। তাছাড়া রেডিও হলোগ্রাফিক আইডেন্টিফিকেশন ব্যবহার করা ঠিক হয়নি আমার, বোধহয় হ্যালিকনে। এই জিনিস নেই আর তাতেই তুমি খানিকটা ঘাবড়ে গেছ।

স্বস্তি বোধ করলেন সেলডন। মেয়েটাকে তার বন্ধু বলেই মনে হচ্ছে। আর যেরকম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হামিনের নাম বলল তাতে সব সংশয় দূর হয়ে গেল। হ্যালিকন সম্বন্ধে তোমার ধারণা পুরোপুরি ভুল, মিস-

শুধু ডর্স।

হ্যালিকন সম্বন্ধে তোমার ধারণা পুরোপুরি ভুল, ডর্স। ওখানেও রেডিও হলোগ্রাফী ব্যবহার করা হয়, তবে আমার কোনোদিন কেনার সামর্থ্য হয়ে উঠেনি, সত্যি কথা বলতে কী আমার সার্কেলের কারোরই সামর্থ্য নেই। তাই এটার কোনো অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তবে বুঝতে পেরেছি ঠিকই।

ডর্সকে দেখছেন তিনি। লম্বা খুব বেশি না, গড়পড়তা মেয়েদের মতোই। খানিকটা লালচে সোনালি চুল, সামান্য কোকড়ানো (ট্র্যান্টরের অধিকাংশ মেয়েরই এইরকম কেশ বিন্যাস। বোধহয় এখানকার ফ্যাশন। হ্যালিকনে নিঃসন্দেহে হাসির উদ্রেক করবে)। হালকা পাতলা গড়ন হলেও স্বাস্থ্য চমৎকার। বয়স অনেক কম দেখায় (বোধহয় একটু বেশিই কম, অস্বস্তির সাথে ভাবলেন)।

পরীক্ষায় পাশ করেছি, জিজ্ঞেস করল ডর্স (সেও বোধহয় হামিনের মতো মনের ভাবনা পড়তে পারে অথবা তিনিই মনের ভাবনা লুকানোর কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ)।

দুঃখিত, এভাবে তাকিয়ে থাকার জন্য। আসলে পরিবেশটা সম্পূর্ণ অচেনা। কাউকে চিনি না এখানে, কোনো বন্ধু নেই।

প্লীজ, ড. সেলডন, আমাকে বন্ধু হিসেবে মেনে নাও। মি. হামিন তোমার দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গেছে আমাকে।

কাজটার জন্য তোমার বয়স অনেক কম।

সেটা কাজেই প্রমাণ করব।

বেশ, আমি চেষ্টা করব যেন উল্টোপাল্টা কিছু করে তোমার সমস্যা বাড়িয়ে না তুলি। নামটা আরেকবার বলবে?

ডর্স ভেনাবিলি। নামের দ্বিতীয় অংশের দ্বিতীয় শব্দাংশের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করল সে। তবে শুধু ডর্স বললেই চলবে। আর তুমি যদি আপত্তি না কর তাহলে তোমাকে হ্যারি বলে ডাকব। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সবাই অনেক বেশি ফর্মাল এবং কখনোই নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা বড়ো দেখানোর চেষ্টা করি না, তা সে একজন বংশমর্যাদা বা পেশাগত দক্ষতায় যত বড়োই হোক না কেন।

প্লীজ, আমাকে শুধু হ্যারি ডাকবে।

চমৎকার! আমিও ফর্মালিটি পছন্দ করিনা। যেমন ফর্মালিটি মেনে চললে তোমাকে আগে জিজ্ঞেস করতে হবে বসতে পারি কী? অনুমতি দিলে তবেই বসব। আর ফর্মালিটি বাদ দিলে আমি চেয়ারটা টেনে বসে পড়ব। ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় বসল ডর্স।

একটু কাশলেন সেলডন। আসলে আমার বোধবুদ্ধি ঠিকমতো কাজ করছে না। আগেই বসতে বলা উচিত ছিল। এলোমেলো বিছানার এক কোণায় নিজেও বসলেন, ভাবলেন বিছানাটা একটু ঠিকঠাক করে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ডর্সের পরের কথায় বিস্মিত হলেন।

মধুর ভঙ্গিতে কথা বলল ডর্স। এভাবে কাজ শুরু করতে চাইছি, হ্যারি। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্যাফেতে গিয়ে নাস্তা করব। তারপর ক্যাম্পাসের ভিতরে তোমার জন্য একটা ঘর ঠিক করে দেব–এটার চেয়েও ভালো ঘর। জানালা থাকবে। হামিন বলে গেছে তোমার জন্য একটা ক্রেডিট টাইলের ব্যবস্থা করে দিতে। কিন্তু সেটা পেতে একদিন বা দুদিন লেগে যেতে পারে। তার আগ পর্যন্ত তোমার সমস্ত খরচ আমার, পরে শোধ করে দেবে। আর তোমার দক্ষতাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব। চ্যাটার হামিন বলেছে তুমি একজন গণিতবিদ এবং কোনো একটা কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো গণিতবিদের বড়ো অভাব।

হামিন বলেছে আমি একজন ভালো গণিতবিদ?

হ্যাঁ, বলেছে। সত্যি কথা বলতে কী, সে বলেছে তুমি একজন অসাধারণ মানুষ।

মাথা নিচু করে পায়ের নখের দিকে তাকালেন সেলডন, নিজেকে ওরকম ভাবতে ভালোই লাগে, কিন্তু আমার সাথে হামিনের পরিচয় একদিনেরও কম। সে শুধু আমার বক্তৃতা শুনেছে যার কিছুই সে বুঝবে না। আমার ধারণা ভদ্রতাবশত এই কথা বলেছে।

আমার তা মনে হয় না, ডর্স বলল। সে নিজেও একজন অসাধারণ ব্যক্তি এবং মানুষের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা অনেক। তার বিচারবুদ্ধির উপর আস্থা আছে আমার। যাইহোক নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাবে। ধরে নিচ্ছি তুমি কম্পিউটার প্রোগ্রাম করতে পার।

অবশ্যই।

আমি বলতে চাইছি যে কম্পিউটারগুলো দিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, বুঝেছ। তুমি এমন প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারবে যা দিয়ে সমসাময়িক গণিত বিদ্যার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিক্ষার্থীদের শেখানো যাবে?

হ্যাঁ, পারব। এটা আমার পেশারই অংশ। আমি ইউনিভার্সিটি অব হ্যালিকনের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।

আমি জানি। হামিন বলেছে। তার মানে সবাই জানবে তুমি ট্র্যান্টরের স্থায়ী বাসিন্দা নও। তাতে অবশ্য বড়ো কোনো সমস্যা হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই ট্র্যান্টরিয়ান। আউটওয়ার্ল্ডারও অনেক আছে। এই গ্রহের খিস্তি খেউড় যে শুনবে না, তা বলছি না, তবে ট্র্যান্টরিয়ানদের চাইতে আউটওয়ার্ল্ডাররা এগুলো ভালো বলে। আমি নিজেও একজন আউটওয়ার্ল্ডার।

তাই? কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে প্রশ্নটা করেই ফেললেন তিনি, সেটাই ভালো মনে হলো। তুমি কোন গ্রহ থেকে এসেছ?

সিনা। নাম শুনেছ?

ভদ্রতা করে যদি বলেন যে শুনেছেন তাহলে ধরা পড়ে যাবেন, তাই বললেন, না।

অবাক হইনি। গ্রহটা বোধহয় হ্যালিকনের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক কম্পিউটার প্রোগ্রামের কথায় ফিরে আসি। আমার জানামতে কাজটা দুভাবে করা যায়। দক্ষভাবে অথবা কাঁচা হাতে।

হ্যাঁ।

এবং তুমি কাজটা করবে দক্ষভাবে।

আমি সেইরকমই মনে করি।

বেশ, চাকরি পাকা। বিশ্ববিদ্যালয় এই কাজের জন্য তোমাকে বেতন দেবে। এবার চল, বাইরে গিয়ে খেয়ে নেওয়া যাক। ভালো কথা, ঘুম কেমন হলো?

অবাক ব্যাপার, চমৎকার ঘুমিয়েছি।

ক্ষুধার্ত।

হ্যাঁ, কিন্তু ইতস্তত করতে লাগলেন সেলডন।

কিন্তু খাবারের মান নিয়ে চিন্তিত, তাই না? আমুদে গলায় জিজ্ঞেস করল ডর্স। চিন্তা করবে না। নিজে একজন আউটওয়ার্ল্ডার বলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবার তোমার পছন্দ হবে।

উঠে দরজার দিকে ঘুরল সে। সেলডন একটা প্রশ্ন করেছেন যা তিনি অনেক চেষ্টা করেও নিজের ভেতর আটকে রাখতে পারেননি, তুমিও কী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার?

তার দিকে ঘুরে মোহনীয় ভঙ্গিতে হাসল ডর্স। কেন আমাকে কী সেইরকম বুড়ো মনে হয় না? দুবছর আগে সিনাতে ডক্টরেট শেষ করেছি। তারপর থেকেই আছি। এখানে। দুই সপ্তাহ পরেই ত্রিশে পা দেব।

দুঃখিত, বললেন সেলডন, এবার তিনিও হাসছেন। কিন্তু তোমাকে দেখাবে চব্বিশ বছরের তরুণীর মতো অথচ কেউ তোমার পেশাগত দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করবে এটা কীভাবে আশা কর?

তুমি খুব ভালো মানুষ। ডর্স বলল আর সেলডন সারা শরীরে অদ্ভুত পুলক অনুভব করলেন। তার কাছে মনে হলো এমন চমৎকার একটা মেয়ে পাশে থাকলে এই অচেনা বিশ্বে নিজেকে আর আগন্তুক মনে হবে না।

.

১৮.

ঠিকই বলেছে ডর্স। ব্রেকফাস্ট মন্দ হলো না। প্রথমে যেটা খেলেন সেটা নিঃসন্দেহে ডিম, তারপর চমৎকার সিদ্ধ করা মাংস। সুস্বাদু চকোলেট ড্রিংক (ট্র্যান্টরের চকোলেট আসলেই সুস্বাদু) খানিকটা সিন্থেটিক, তবে খেতে ভালো।

অল্প কথায় নিজের মনোভাব ব্যক্ত করলেন তিনি। চমৎকার ব্রেকফাস্ট। খাবার এই পরিবেশ, সবকিছু।

শুনে ভালো লাগল। ডর্স বলল।

চারপাশে তাকালেন সেলডন। একদিকের দেয়ালে সারি সারি জানালা, সেটা দিয়ে যদিও সত্যিকার সূর্যের আলো আসছে না (অবাক হয়ে ভাবলেন, হয়তো আর কিছুদিন পরেই নিষ্প্রভ দিনের আলোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং ঘরের ভেতর এক ফালি রোদ্দুর দেখার জন্য হাহুতাশ করবেন না)। তারপরেও কামরাটা যথেষ্ট আলোকিত। নিঃসন্দেহে স্থানীয় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রক কম্পিউটার দিনটাকে একটা চমৎকার মেঘমুক্ত উজ্জ্বল দিন হিসেবে বেছে নিয়েছে।

প্রতিটি টেবিলে একসাথে চারজনের বসার ব্যবস্থা এবং সবগুলোই পরিপূর্ণ। তাদের টেবিলে অবশ্য তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েকজন পুরুষ মহিলাকে ডেকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ডর্স। সবাই মার্জিত আচরণ করলেও এক। টেবিলে খেতে বসল না। বোধহয় ডর্স আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছে কিন্তু কীভাবে করেছে বলতে পারবেন না।

তুমি আমাকে কোনো গণিতবিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দাওনি, ডর্স। জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

পরিচিত কাউকেই তো দেখছি না। গণিতবিদরা কাজ শুরু করেন আরো ভোরে এবং আটটার মধ্যেই সবাই ক্লাস নেওয়া শুরু করে দেন। আমার ধারণা শিক্ষার্থীরা গণিতের মতো কঠিন বিষয় যত দ্রুত সম্ভব ঝেড়ে ফেলতে চায়।

আশা করি গণিতের প্রতি তোমার তেমন কোনো আগ্রহ নেই।

মোটেই নেই। মুচকি হেসে জবাব দিল ডর্স। মোটেই নেই। আমার বিষয় ইতিহাস। ট্র্যান্টরের উত্থানপর্ব নিয়ে কয়েকটি বই লিখেছি–বর্তমান ট্র্যান্টর নয়, সেই প্রাচীন যুগে যখন ট্র্যান্টর একটা কিংডম হিসেবে বেড়ে উঠছিল সেই সময়ের ইতিহাস। ব্যস এখানেই আমার গবেষণা শেষ–রয়্যাল ট্রান্টর।

চমৎকার।

চমৎকার? বাঁকা চোখে তার দিকে তাকালো ডর্স। তুমিও রয়্যাল ট্র্যান্টরের বিষয়ে আগ্রহী?

ঠিকই বলেছ, রয়্যাল ট্র্যান্টর এবং আরো অনেক বিষয়ের প্রতি আগ্রহী। আমি কখনো ইতিহাস জানার চেষ্টা করিনি, কিন্তু এবার জানতে হবে।

জানতে হবে? ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলে গণিত নিয়ে গবেষণার সময় পাবে না আর গণিতবিদদের প্রয়োজন। বিশেষ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাসবিদ এখানে প্রচুর আছে। আছে অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী। কিন্তু গণিতবিদের সংখ্যা কম। হামিন এই বিষয়টার প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট করে। সে এটাকে বলেছে। বিজ্ঞানের অবক্ষয় এবং মনে হচ্ছে এটা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমি বলেছি ইতিহাস জানতে হবে, তার মানে এই না যে এটাকেই আমার সারা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেব। আমি বোঝাতে চেয়েছি ঠিক ততটুকু ইতিহাস জানতে হবে যতটুকু আমার গাণিতিক বিশ্লেষণে সাহায্য করবে। আমার গবেষণার বিষয় হচ্ছে সামাজিক অবকাঠামোর গাণিতিক বিশ্লেষণ।

শুনেই ভয় লাগছে।

বিষয়টা আসলেই অত্যন্ত জটিল। আর আমি যদি সামাজিক ক্রমবিকাশের ধারণাটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝতে না পারি তাহলে এটা কোনো কাজেই আসবে না। এই মুহূর্তে আমি যা জানি তাতে একটুও এগোতে পারব না, বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই।

কিছুই বুঝিনি কারণ এটার ব্যাপারে এক বিন্দুও ধারণা নেই। চ্যাটার বলছিল তুমি সাইকোহিস্টোরি নামে একটা বিষয় ডেভেলপ করার চেষ্টা করছ এবং সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক বলেছি আমি? সাইকোহিস্টোরি?

ঠিকই বলেছ। আসলে বলা উচিত সাইকোসোসিওলজি, কিন্তু শব্দটা আমার কাছে জঘন্য মনে হয়েছে। অথবা হয়তো অবচেতন মনে ঠিকই জানতাম যে ইতিহাসের একটা ভূমিকা থাকবে কিন্তু তখন গুরুত্ব দেই নি।

সাইকোহিস্টোরি শব্দটাই সুন্দর, কিন্তু জিনিসটা কী আমি জানি না।

আমি নিজেই কী জানি।

গভীর দৃষ্টিতে বিপরীত দিকে বসা মেয়েটার দিকে তাকালেন সেলডন, মনে হলো এই অকস্মাৎ নির্বাসন আর তেমন খারাপ লাগবে না যদি সঙ্গিনী হিসেবে এই মেয়ে তার পাশে থাকে। কয়েক বছর আগে যে মেয়েটার সাথে পরিচয় ছিল তার কথা মনে হলো কিন্তু জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিলেন। যদি ভবিষ্যতে কাউকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন তবে সেই মেয়েটাকে বুঝতে হবে তিনি যে গবেষণা করছেন তার গুরুত্ব কতখানি।

কথাবার্তার মোড় ঘুরানোর জন্য তিনি জিজ্ঞেস করলেন, চ্যাটার হামিন বলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যাপারেই ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট হস্তক্ষেপ করে না।

ঠিকই বলেছে। মাথা নাড়লেন সেলডন। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। হ্যালিকনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনের খরবদারীতে জর্জরিত।

সিনাতে একই অবস্থা। একই অবস্থা অন্যান্য গ্রহে, উঁচুদরের দুএকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রম। ট্র্যান্টরের কথা সম্পূর্ণ আলাদা।

হ্যাঁ, কিন্তু কেন?

কারণ, ট্র্যান্টর এম্পায়ারের প্রাণ। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমর্যাদা অন্য সবার থেকে বেশি। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষ প্রফেশনাল তৈরি হতে পারে। কিন্তু এম্পায়ারের প্রশাসক উচ্চপদস্থ অফিসার, অগণিত মানুষ যারা গ্যালাক্সির একেবারে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এম্পায়ারের ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে তারা এই ট্র্যান্টরের মাটিতেই শিক্ষা লাভ করে।

পরিসংখ্যানটা আমি দেখিনি- শুরু করলেন সেলডন।

আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো। এম্পায়ারের অফিসারদের ভেতর একটা সাধারণ মিল থাকা, এম্পায়ারের প্রতি তাদের একটা বিশেষ ফিলিংস থাকাটা জরুরি। আবার তাদের সবাই ট্রাক্টরের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও সমস্যা, অন্য গ্রহগুলো ক্ষেপে উঠতে পারে। সেই কারণেই লক্ষ লক্ষ আউটওয়ান্ডারদের এখানে শিক্ষার্জনে আকৃষ্ট করার জন্য ট্রাক্টরকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। তারা কোথা থেকে এলো, কী তাদের বাচনভঙ্গি, কী তাদের সংস্কৃতি তার কোনো গুরুত্ব নেই যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ট্র্যান্টরের চাকচিক্যে অভ্যস্ত থাকে এবং তাদের পেছনে থাকে ট্র্যান্টরিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থার জোরালো সমর্থন। এই ব্যাপারটাই এম্পায়ারকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। অন্য গ্রহগুলো আর মনঃক্ষুণ্ণ হবে না যদি দেখে, যে প্রশাসকরা ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্টের প্রতিনিধিত্ব করছে তাদের মধ্যে বহুসংখ্যক নিজেদের লোক রয়েছে।

আবারও বিব্রত বোধ করলেন সেলডন। এভাবে তিনি কখনো চিন্তা করেননি। অবশ্য এটাও ঠিক যে কেউ যদি জগতের সকল গণিত জেনে ফেলে, তারপরেও উঁচুদরের গণিতজ্ঞ হতে পারবে কিনা সন্দেহ। ব্যাপারটা কী সবাই জানে?

আমার তা মনে হয় না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে জবাব দিলো ডর্স। এরকম অনেক বিষয় আছে যা বিশেষজ্ঞরা নিজেদের কাছেই রেখে দেয়। সাধারণ্যে প্রকাশ করে না। সাধারণ মানুষ এবং নিজেদের ভেতর একটা সুস্পষ্ট ব্যবধান তৈরি করার জন্যই এটা করে।

অথচ তুমি ঠিকই জানো।

আমি তো এই বিষয়েরই বিশেষজ্ঞ এবং একজন ইতিহাসবিদ। আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল রয়্যাল ট্র্যান্টরের উত্থান এবং যে প্রশাসনিক কৌশলে মহাবিশ্বকে করায়ত্ত করে এটা ধীরে ধীরে রয়্যাল ট্রাক্টর থেকে ইম্পেরিয়াল ট্র্যান্টরে পরিণত হয়।

এমনভাবে কথা বললেন সেলডন যেন নিজের মনেই বিড় বিড় করছেন। অতি বিশেষায়ন কতটা খারাপ। এটা আমাদের জ্ঞানকে এখানে সেখানে কেটে ছিঁড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়।

ডর্স একটু কাঁধ নাড়ল শুধু। কী করা যাবে? কিন্তু লক্ষ্য করে দেখো যদি আউটওয়ার্ল্ডারদের ট্র্যান্টরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে হয়, তখন যারা নিজেদের চেনা জগৎ ছেড়ে একটা অতিশয় কৃত্রিম এবং অদ্ভুত পরিবেশে আসবে তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য বিনিময়ে ট্র্যান্টরকেও কিছু দিতে হবে। আমি এখানে আছি দুই বছর অথচ এখনো এই গ্রহের পরিবেশে অভ্যস্ত হতে পারিনি। হয়তো পারব না কোনোদিন। অবশ্য আমি প্রশাসক হতে চাই না বা নিজেকে ট্র্যান্টরিয়ান বানাতে চাই না।

যাইহোক বিনিময়ে ট্র্যান্টর যে শুধু সামাজিক মর্যাদার আশ্বাসই দেয় তাই নয়, সীমাহীন ক্ষমতার, প্রাচুর্যের পাশাপাশি পূর্ণ স্বাধীনতারও আশ্বাস দেয়। ছাত্রাবস্থায় শিক্ষার্থীরা গভর্নমেন্টের যেকোনো বিষয়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে, নিজেদের তত্ত্ব এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী শুধু এই স্বাধীনতা ভোগ করার জন্যই এখানে আসে।

আমার মনে হয় এতে লাভ হয় এটাই যে শিক্ষার্থীরা তরুণ বিপ্লবীদের মতো মনে করতে পারে নিজেদের এবং একধরনের আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে। আর। যখন তারা এম্পায়ারের প্রশাসনযন্ত্রে ঢুকে পড়ার সুযোগ পায় তখন তারা পুরোপুরি বাধ্য এবং অনুগত।

মাথা নাড়ল ডর্স। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। যাইহোক, এইসকল কারণেই ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না। এটা। তাদের নিরপেক্ষতা নয় বরং তারা অনেক বেশি চালাক।

তুমি ইম্পেরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হতে চাওনা, ডর্স। কী হতে চাও?

ইতিহাসবিদ, শিক্ষকতা করব, নিজের লেখা দুই একটা বুক-ফিল্ম তৈরি করব।

খুব একটা সামাজিক মর্যাদা হয়তো আসবে না তাতে।

খুব বেশি উপার্জনও হবে না, হ্যারি এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক মর্যাদার জন্য যে রকম টানাহ্যাঁচড়া করতে হয় আমি সেটা এড়াতে চাই। মর্যাদাওয়ালা মানুষ অনেক দেখেছি কিন্তু প্রকৃত অর্থে সুখী সেরকম কাউকে পাইনি এখনো। সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করার জন্য তোমাকে সবসময়ই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। হয়তো কোনো একদিন আমি সিনাতে ফিরে গিয়ে ওখানকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসারি করব।

আর ট্র্যান্টরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট তোমার সম্মান বাড়িয়ে দেবে।

হাসল ডর্স। আমারও তাই মনে হয়, কিন্তু সিনাতে এগুলো নিয়ে কে মাথা ঘামাবে। নীরস একটা গ্রহ। কৃষক আর গবাদি পশুতে ভর্তি হয় দুপেয়ে নয়তো চার পেয়ে।

ট্র্যান্টরে এতদিন কাটানোর পর নিশ্চয়ই আরো বেশি নীরস মনে হবে।

এটা আমিও ভেবেছি। সেরকম মনে হলে কোনো সমস্যা নেই। যেকোনো গ্রহে গিয়ে ইতিহাস নিয়ে ছোট বড়ো গবেষণা করার জন্য যেকোনো পরিমাণ অনুদানের ব্যবস্থা করে নিতে পারব আমি। এটা আমার বিষয়ের বিশেষ সুবিধা।

অন্য দিকে একজন গণিতবিদের, তিক্ত স্বরে বললেন সেলডন, আগে কখনো নিজের বিষয় নিয়ে এইরকম অনুভূতি হয়নি, প্রধান কাজ হচ্ছে কম্পিউটারের সামনে বসে শুধু চিন্তা করা। কম্পিউটারের কথা যখন উঠলই- ইতস্তত করতে লাগলেন সেলডন। ব্রেকফাস্ট শেষ। ডর্সের জরুরি অনেক কাজ থাকতে পারে।

কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সেরকম কোনো তাড়াহুড়া আছে। হ্যাঁ? কম্পিউটার নিয়ে কী বলছিলে?

আমি কী ইতিহাস গ্রন্থাগারটা ব্যবহার করার অনুমতি পেতে পারি?

এবার ডর্স ইতস্তত করতে লাগল। ব্যবস্থা হয়তো করা যাবে। তুমি যেহেতু গণিত বিভাগের জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করে দেবে সেহেতু তুমি পুরোপুরি না হলেও

আংশিক ফ্যাকাল্টি মেম্বার। তখন অনুমতি বের করা কোনো সমস্যা হবে না। শুধু-

শুধু?

আসলে তোমাকে ছোট করতে চাইছি না, হ্যারি। কিন্তু তুমি একজন গণিতবিদ এবং নিজেই বলেছ ইতিহাসের কিছুই জান না। ইতিহাস গ্রন্থাগার কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জান?

সেলডন হাসলেন। আমার ধারণা গণিত গ্রন্থাগারের মতো তোমরাও কম্পিউটার ব্যবহার করো।

তা করি, কিন্তু প্রতিটি বিষয়ের গ্রন্থাগারের জন্য যে প্রোগ্রামিং ব্যবহার করা হয় সেগুলোর একেকটা একেক রকম জটিল। তুমি জান না কোনটা প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বুক-ফিল্ম, বাছাই করে কীভাবে তথ্য বের করে আনতে হবে, কোনটা রাখতে হবে, কোনটা বাদ দিতে হবে। হয়তো দেখবে একটা হাইপারবোলিক ইন্টারভ্যাল-

আসলে তুমি বোধহয় হাইপারবোলিক ইন্টিগ্রাল বোঝাতে চাও। হালকা চালে বাধা দিলেন সেলডন।

পাত্তা দিল না ডর্স। কিন্তু তুমি তো জান না পুরো একদিন আর আধাবেলা না লাগিয়ে কীভাবে কয়েক মিনিটেই পোডলার্ক চুক্তির বিষয়গুলো বের করে আনা যায়।

আশা করি শিখে নিতে পারব।

যদি… যদি… ডর্সকে আরো সংকুচিত দেখালো। তুমি চাইলে একটা পরামর্শ দিতে পারি। এক সপ্তাহের একটা কোর্স করাই আমি–প্রতিদিন এক ঘণ্টা, বিনে পয়সায় কীভাবে গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে হয় তার উপর। আন্ডার গ্র্যাজুয়েটদের জন্য। এইরকম একটা কোর্স-এ অংশগ্রহণ করা কী তোমার জন্য অসম্মানজনক মনে হবে–মানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের সাথে করাটা? তিন সপ্তাহ পরেই শুরু হচ্ছে।

তুমি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে শেখাতে পারো। বলার ভঙ্গিতে পরামর্শ দেওয়ার মতো সুর লক্ষ্য করে নিজেই অবাক হলেন সেলডন।

ডর্স বুঝতে পারল সেটা। পারি, কিন্তু আমার মনে হয় একটা নিয়ম ধরে শেখালে তোমারই লাভ। ট্রেনিং-এর জন্য আমরা গ্রন্থাগার ব্যবহার করব। সপ্তাহ শেষে তোমাকে কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য বের করতে দেওয়া হবে। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে তোমাকে প্রতিযোগিতা করতে হবে এবং এভাবেই শিখবে। ব্যক্তিগতভাবে আলাদা করে শেখালে ততটা লাভ হবে না। যদিও বুঝতে পারছি যে বুড়ো বয়সে কম বয়সী শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়াটা তোমার জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। তুমি যদি শিখতে না পার তখন লজ্জা পাবে। অপমানিত হবে।

পাবো না। বরং একটা হয়তো লাগানো উচিত। তবে আমি ভয় পাই না। যত অপমানই আসুক পরোয়া করি না যদি–যদি এভাবে ইতিহাসের খুটিনাটি আমি শিখতে পারি।

পরিস্কার বুঝতে পারছেন সেলডন এই মেয়েটাকে তিনি পছন্দ করতে শুরু করেছেন এবং তার কাছ থেকে কিছু শেখার সুযোগ হারাতে চান না। এও বুঝতে পারছেন যে জীবনের এক দুর্লভ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

হামিনকে কথা দিয়েছেন সাইকোহিস্টোরীকে তিনি বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য করে তুলবেন। কিন্তু সেটা ছিল মনে মনে। এখন তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এবং যদি কখনো সাইকোহিস্টোরি বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য করে তুলতে পারেন সেটা হবে সম্ভবত ডর্স ভেনাবিলির প্রভাবে।

নাকি হামিন এটা জানত? হামিন, মনে মনে ভাবলেন সেলডন একটা জটিল ধাঁধা।

.

১৯.

বিরক্তিকর ডিনার পর্ব শেষ হলো। প্রায় প্রতিদিনই ক্লীয়নকে এই ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয়। সুবিশাল এম্পায়ারের দূর-দূরান্ত থেকে গভর্নর, অ্যাডমিরাল এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দরকারী, অদরকারী, ব্যক্তিগত বিভিন্ন কারণে সম্রাটের সাথে দেখা করতে আসে। তাদের সম্মানেই এই ডিনারের ব্যবস্থা। সেখানে সম্রাটের একটু কৃপা-দৃষ্টি, প্রশ্রয়মূলক হাসি, দুই একটা সদয় বাণীও তাদেরকে এম্পায়ারের প্রতি আরো বাধ্য এবং অনুগত করে তোলে।

নিরানন্দ এবং বিরক্তিকর অনুষ্ঠানটা তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। ডিনার করে নিলেন আগেই–অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সাথে যাদের সামনে তাকে মহান সম্রাটের মতো গুরুগম্ভীর আচরণ না করলেও চলে। তারপর অতিথিদের সম্মানে আয়োজিত ডিনারে যোগ দিলেন। সেখানে তাকে শুধু আমদানী করা। নাশপাতি সার্ভ করা যেতে পারে। তিনি আবার এই ফলটা বেশ পছন্দ করেন। কিন্তু এতে আগত অতিথিরা নাখোশ হতে পারে। মনে করতে পারে যে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তাদেরকে অপমান করা হলো।

এসব ক্ষেত্রে তার স্ত্রীর কোনো ভূমিকা নেই। বরং সম্রাজ্ঞীর উপস্থিতি তাকে আরো বেশি বিরক্ত করে তোলে। সম্রাজ্ঞীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন কারণ সে ছিল বিরোধী পক্ষের অত্যন্ত শক্তিশালী এক বংশের মেয়ে। ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার বদলে তারা চেয়েছিল তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের রক্তের সাথে রাজরক্ত মিশে যাক। ক্লীয়ন মনে প্রাণে চেয়েছিলেন যেন এমনটা না ঘটে। কিন্তু তিনি ছিলেন নাচাড়। তিনি অবশ্য সম্রাজ্ঞীকে পুরোপুরি নিজের মতো করে জীবন কাটানোর সুযোগ দিয়েছেন। শুধু বংশরক্ষার জন্য যতটুকু সম্পর্ক রাখার দরকার তার বেশি এগোন নি। এখন তিনি এক পুত্রসন্তানের জনক। বংশধর পেয়ে গেছেন, কাজেই স্ত্রীকে আর গুরুত্ব না দিলেও চলবে। সত্যি কথা বলতে কী তিনি তাকে মোটেই পছন্দ করেন না।

পকেট থেকে একমুঠো বাদাম বের করে মুখে দিলেন ক্লীয়ন। চিবুতে চিবুতে ডাক দিলেন,

ডেমারজেল।

সায়ার?

ক্লীয়ন যখনই ডাক দেন ডেমারজেল সাথেসাথেই হাজির হয় সামনে। হয়তো সে সব সময়ই কাছাকাছি থাকে নয়তো বহুদিনের আনুগত্যের কারণে সহজাত প্রবৃত্তি দিয়েই বুঝতে পারে যে কিছুক্ষণের ভেতরেই ডাক পড়বে। যাইহোক ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে, সেটাই বড়ো করা; অলস ভঙ্গিতে ভাবলেন ক্লীয়ন। অবশ্য মাঝে মাঝেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ডেমারজেলকে দূরে থাকতে হয়। সেই সময়গুলো তিনি প্রচণ্ড অস্বস্তিতে কাটান।

সেই গণিতবিদের কী হলো? নামটা ভুলে গেছি।

ডেমারজেল ভালোভাবেই জানে সম্রাট কার কথা জিজ্ঞেস করছেন, তারপরেও কতটুকু মনে আছে সেটা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। কোন গণিতবিদের কথা বলছেন, সায়ার?

অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন ক্লীয়ন। সেই ভবিষ্যৎ-বক্তা। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।

যাকে নিয়ে আসার জন্য আমরা লোক পাঠিয়েছিলাম?

বেশ আমরাই লোক পাঠিয়েছিলাম। সে তো এসেছিল। যতদূর মনে পড়ে তুমি ব্যাপারটা সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলে। কী খবর বলো।

গলা পরিস্কার করল ডেমারজেল। আমি চেষ্টা করছি, সায়ার।

আহ্! তার মানে তুমি ব্যর্থ হয়েছ। ঠিক? ক্লীয়ন খানিকটা হলেও খুশী হলেন, তার মন্ত্রীদের মাঝে একমাত্র ডেমারজেল কখনো ব্যর্থ হয়নি। অন্যরা যদিও ব্যর্থতা কখনো স্বীকার করে না, আর যেহেতু ব্যর্থতাটাই এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা সংশোধন করার কোনো উপায় নেই। ডেমারজেল কখনো ব্যর্থ হয় না বলেই এখন চট করে স্বীকার করে ফেলল। সে না থাকলে সততা বলে যে একটা জিনিস আছে সেটা হয়তো ক্লীয়ন কোনোদিন জানতেই পারতেন না। বোধহয় কোনো সম্রাটেরই সতোর ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না আর হয়তো এই কারণেই

ভাবনাগুলোকে তিনি একপাশে সরিয়ে রাখলেন। হঠাৎ করেই অধস্তনের নীরবতা অসহ্য ঠেকল। যেহেতু মনে মনে ডেমারজেলের সতোর প্রশংসা করেছেন তিনি। কাজেই ডেমারজেলকে তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন ক্লীয়ন, যাইহোক, তুমি ব্যর্থ হয়েছ, তাই না?

ডেমারজেল মোটেই ভয় পেল না। আংশিক ব্যর্থ হয়েছি, সায়ার। আমার ধারণা ছিল যে সে ট্র্যান্টরে–যেখানে সবকিছুতেই জটিলতা থাকলে আমাদের জন্যও অনেক সমস্যা তৈরি হবে। বরং তার নিজের গ্রহে চলে গেলেই সুবিধা। পরের দিনই ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার, কিন্তু যা চাই সেটাই যে সবসময় ঘটবে তা ঠিক নয়। আমি তার পিছনে দুটো গুণ্ডা টাইপের ছোঁকড়াকে লাগিয়ে দেই।

গুণ্ডা-পান্ডাদের সাথেও তোমার যোগাযোগ আছে, ডেমারজেল? আমুদে গলায় জিজ্ঞেস করলেন ক্লীয়ন।

সব ধরনের লোকের সাথেই সম্পর্ক রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ কে কখন কোন উপকারে আসবে তার কী কোনো ঠিক আছে। যাইহোক, আমার পাঠানো ছোঁড়া দুটো নিজেদের কাজ দেখাতে পারেনি।

কেন?

অদ্ভুত ব্যাপার, গণিতবিদ তাদেরকে খালি হাতেই মেরে ধরাশায়ী করে ফেলে।

গণিতবিদ মারামারি করতে জানে?

নিঃসন্দেহে গণিত আর মার্শাল আর্টর্স দুটো একেবারে বিপরীত জিনিস। পরে জানতে পারি যে তার নিজের গ্রহ হ্যালিকনের একটা খ্যাতি আছে। সেটা গণিতের জন্য নয়, মার্শাল আর্টের জন্য। প্রথমে জানতে না পারাটা আমার ব্যর্থতা এবং সেজন্য আমি আপনার ক্ষমাপ্রার্থী।

কিন্তু তারপরে নিশ্চয়ই সে তার নিজ গ্রহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়!

দুর্ভাগ্যবশত পরিস্থিতি আমাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। গুণ্ডাদের সাথে মারামারির ঘটনার পর সে ফিরে না গিয়ে ট্র্যান্টরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরামর্শটাও তাকে দিয়েছে অন্য একজন। যে দিয়েছে ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল সে। এইরকম কিছু যে ঘটবে সেটা আমার হিসেবে ছিল না।

ভুরু কুঁচকালেন সম্রাট ক্লীয়ন। তাহলে আমাদের গণিতবিদ–কী যেন নাম?

সেলডন, সায়ার, হ্যারি সেলডন।

তাহলে এই সেলডন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে?

খানিকটা সেরকমই, সায়ার। পরে তার গতিবিধির খোঁজ খবর করে জানতে পেরেছি যে সে এখন স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছে। যতক্ষণ ওখানে থাকবে। আপনি তার কিছুই করতে পারবেন না।

গর্জে উঠলেন সম্রাট। মুখের বং বদলে খানিকটা লাল হয়ে উঠল। শব্দটা আমার জন্য অপমানকর কিছুই করতে পারবেন না। এম্পায়ারে এমন কোনো জায়গা থাকা। উচিত না যেখানে আমার ক্ষমতা পৌঁছতে পারবে না। অথচ তুমি বলছ এখানে, আমার নিজের গ্রহে আমি কিছুই করতে পারব না। অসহ্য।

আপনার শক্তিশালী হাত বিশ্ববিদ্যালয়েও পৌঁছবে। যেকোনো মুহূর্তে সৈন্য পাঠিয়ে আপনি সেলডনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধরে আনতে পারবেন। কিন্তু সেটা করা, যত যাইহোক… ঠিক যৌক্তিক হবে না কখনোই।

তুমি অবাস্তব বলছ না কেন, ডেমারজেল? ভবিষ্যৎ গণনার কৌশল নিয়ে গণিতবিদ যা বলেছিল তোমার কথাও আমার কাছে সেইরকম মনে হচ্ছে। সম্ভব কিন্তু অবাস্তব। মনে রাখবে ডেমারজেল, সেলডনকে ধরা অবাস্তব হলেও তোমার বেলায়। পরিস্থিতি অন্য রকম হবে।

সম্রাটের শেষ মন্তব্য ডেমারজেলের উপর কোনোই প্রভাব ফেলল না। রাজ মুকুট পরিহিত এই লোকটা জানে তার গুরুত্ব কতখানি; এমন হুমকিধামকি সে আগেও শুনেছে। সম্রাটের ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সামনে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল। চেয়ারের। হাতলে আঙ্গুল দিয়ে তবলা বাজাচ্ছেন সম্রাট। জিজ্ঞেস করলেন, তো, সে যদি স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে তাহলে আমাদের কোন উপকারে আসবে?

ঘটনাটা আমাদের জন্য শাপেবর হয়ে উঠতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে হয়তো সাইকোহিস্টোরী নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে।

যদিও সে নিজেই বলেছে যে এটা পুরোপুরি অবাস্তব।

হয়তো তার ভুল হয়েছে এবং হয়তো বুঝতে পারবে যে সে ভুল করেছে। যদি বুঝতেই পারে তখন কোনো না কোনো উপায়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে আনা যাবে। এমনও হতে পারে সে নিজেই আমাদের পক্ষে যোগ দিল।

কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইলেন সম্রাট। তারপর বললেন, যদি আমাদের আগেই কেউ তাকে দলে টেনে নেয়।?

কে করবে, সায়ার? মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল ডেমারজেল।

ওয়ি প্রদেশের মেয়র, তাদের একজন হতে পারে। বললেন সম্রাট, হঠাৎ চিৎকার শুরু করেছেন। লোকটা এখনো স্বপ্ন দেখছে সিংহাসনে বসার।

বৃদ্ধ বয়স তার সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে।

তুমি নিজেই তা বিশ্বাস কর না, ডেমারজেল।

যদি সেরকম কিছু ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনাও দেখা দেয় তখন আমরা জোরালো পদক্ষেপ নেব।

কী ধরনের জোরালো পদক্ষেপ?

চরম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।

অর্থাৎ সেলডনকে খুন করার কথা বলছ?

ধরে নিন তাই।

.

২০.

ডর্স ভেনাবিলির সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলডনের থাকার একটা মোটামুটি ব্যবস্থা হয়েছে। এক কামরার বাসস্থান, সামনে বারান্দার মতো খানিকটা বাড়তি অংশ আছে। এই মুহূর্তে সেখানেই একটা চেয়ার পেতে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বসে আছেন তিনি।

শুধু বিরক্ত বললে তার অনুভূতিকে খাটো করা হবে। তিনি আসলে প্রচণ্ড রেগে আছেন–কেন এই রাগ, কার উপর রাগ সেটা তার নিজের কাছেও পরিস্কার নয়। কারণটা কী ইতিহাস? ইতিহাস লেখক বা সংগ্রাহক? নাকি ইতিহাসের উপাদান সেই সকল গ্রহ এবং মানুষদের উপর?

আসলে তার রাগের কারণটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার গবেষণা পুরোপুরি অর্থহীন, যে নতুন জ্ঞান তিনি অর্জনের চেষ্টা করছেন তা অর্থহীন, সবকিছুই অর্থহীন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর ছয় সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। প্রথম থেকেই একটা কম্পিউটার আউটলেট পেয়েছেন–কাজও শুরু করে দিয়েছেন সাথে সাথেই। শুরুটা কীভাবে করবেন সেই ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। নিজের বহুদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেন তিনি। প্রচণ্ড ধৈর্য এবং পরিশ্রমের কাজ। বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিটি বিশ্লেষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। কাজটা ছিল অত্যন্ত শ্লথ, বারবার থেমে যেতে হয়েছে। কিন্তু এভাবে ধারাবাহিকভাবে সমাধানের একটা পথ খুঁজে বের করার মাঝে অন্যরকম আনন্দ। সেটা তিনি উপভোগ করেছেন।

তারপর শুরু হয় ডর্সের কাছে ট্রেনিং নেওয়া। শিখেছেন কীভাবে কম্পিউটার ইনডেক্স থেকে দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো বের করে আনা যায়। তবে দুটো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়েছে। যেমন একেবারে প্রথম দিন। থেকেই ক্লাসে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের আড়দৃষ্টি। তিনি যে বুড়ো এটা তরুণ শিক্ষার্থীরা বুঝতে পেরেছে এবং সেটা তারা গোপনও রাখেনি। তারপর ডর্স সবসময়ই ক্লাসে তাকে ডক্টর সেলডন বলে সম্বোধন করে। এটাও অস্বস্তিকর।

আমি চাই না ওরা মনে করে যে, ডর্স যুক্তি দেখিয়েছিল, তুমি আসলে খুব বাজে ধরনের ছাত্র।

কিন্তু এতদিনে নিশ্চয়ই ওদেরকে তুমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছ। এখন শুধু সেলডন ডাকাই যথেষ্ট।

না, আচমকা হেসেছিল ডর্স, আসলে প্রতিবার ডক্টর বলার সাথে সাথে তোমার চেহারাটা যা হয় না, সেটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।

জঘন্য রসিকতা করার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে তোমার।

তুমি কী আমাকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চাও?

রাগ করতে পারেননি সেলডন, হেসে ফেলেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই যে কেনো ব্যক্তি জঘন্য কথাটাতে আপত্তি জানাতো। এটাই তার কাছে ভালো লেগেছিল যে ছুঁড়ে দেওয়া বলটা ডর্স দক্ষভাবে ধরে নিয়ে একইরকম জোরালোভাবে আবার তার দিকেই ছুঁড়ে দিয়েছে। ভাবনাটা মাথায় আসতেই একটা সহজ প্রশ্ন করলেন তিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমরা টেনিস খেলো?

ব্যবস্থা আছে, তবে আমি খেলিনা।

চমৎকার। আমি তোমাকে শেখাব। আর তখন তোমাকে আমি প্রফেসর ভেনাবিলি বলে ডাকব।

সেটাতো যেকোনো সময়ই ডাকতে পারো।

টেনিস কোর্টে এই সম্বোধন কতখানি হাস্যকর শোনাবে তা দেখে তুমি সত্যিই বিস্মিত হবে।

আমার হয়তো পছন্দ হবে।

সেই ক্ষেত্রে আর কী কী তোমার ভালো লাগে সেটা আমাকে খুঁজে বের করতে হবে।

অশালীন রসিকতা করার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে তোমার।

উদ্দেশ্য নিয়েই কথাটা বলেছিল ডর্স, তিনিও জবাব দিতে দেরী করেননি, তুমি কী আমাকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চাও।

পরে টেনিস কোর্টে ডর্স-এর খেলা দেখে তিনি নিজেই অবাক হয়ে যান। এক গেমের পর হাফাতে হাফাতে জিজ্ঞেস করেন, মিথ্যে কথা বলছ না তো আমাকে, আসলেই আগে কখনো টেনিস খেলোনি।

কখনোই খেলিনি।

দ্বিতীয় কারণটা একান্তই ব্যক্তিগত। এরই মাঝে হিস্টোরিক্যাল রিসার্চের প্রয়োজনীয় কৌশলগুলো শিখে নিয়েছেন তিনি। নিজের ঘরে বসে একা একাই কিছু তথ্য বের করার চেষ্টা করলেন। ইতিহাসের কৌশলটা গণিত শাস্ত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে একইরকম লজিক্যাল যেহেতু কৌশলটা নির্ভুলভাবে তাকে তার নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারছে। তবে তিনি সারাজীবন যে ধরনের লজিক ব্যবহার করে অভ্যস্ত তার সাথে কোনো মিলই নেই।

যাইহোক অনেকভাবে চেষ্টা করলেন তিনি কিন্তু ফলাফল হলো শূন্য।

পরের দিন টেনিস কোর্টে ভিতরের অস্থিরতাটা পুরোপুরি প্রকাশ পেল। ডর্স এখন ভালোই খেলতে পারে। কাজেই তার দিকে সহজ বল ছুঁড়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই যেন সে দিক এবং দূরত্ব আন্দাজ করে বুঝে শুনে খেলতে পারে। ব্যাপারটা তাকে ভুলে যেতে সাহায্য করল যে ডর্স একজন শিক্ষানবীশ। নিরেট গোলাকার লেজার বীমের মতো বলগুলো ছুঁড়ে দিতে লাগলেন তিনি।

নেটের কাছে এসে ডর্স বলেছিল, আমাকে খুন করতে চাওয়ার কারণটা পরিস্কার বুঝতে পারছি যেহেতু আমি সোজা বলগুলো মিস করেছি। কিন্তু একটু আগে যে বলটা আমার মাথার মাত্র তিন সেন্টিমিটার দূর দিয়ে গেল সেটার ব্যাপারে কী বলবে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে তুমি আমাকে টোকাও দিতে পারোনি। এর চেয়ে ভালো শট মারতে পারো না?

ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন সেলডন, কিন্তু অস্ফুট কিছু শব্দ ছাড়া মুখ দিয়ে আর কিছু বেরোয়নি।

শোনো, তোমার সাথে আজকে আমি আর খেলব না, ডর্স বলেছিল। কাজেই এখন গিয়ে গোসল করব তারপর দুজনে একসাথে চা খাব। চায়ের টেবিলে তুমি আমাকে বলবে আসলে কাকে খুন করতে চাও। সেটা যদি আমার হতভাগ্য এই মাথাটা না হয় অথবা যাকে খুন করতে চাও তাকে যদি তুমি না পেয়ে থাক, তাহলে নেটের অপর পাশে তোমার টার্গেট হিসেবে থাকাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

চায়ের টেবিলে তিনি সমস্যাটার কথা জানিয়েছিলেন, ডর্স, আমি ইতিহাসের পর ইতিহাস স্ক্যান করছি; শুধু ব্রাউজ করছি। বিস্তারিত পর্যালোচনা করার সময় পাইনি। এখনো। তারপরেও একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে আমার কাছে। সবগুলো বুক ফিল্মই শুধু একইরকম নির্দিষ্ট কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো।

এটা একটা অজুহাত। প্রতিটি বুক-ফিল্ম একটা আরেকটার অবিকল নকল। পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহ থেকে খুব বেশি হলে মাত্র পঁচিশটা গ্রহ নিয়ে ইতিহাস তৈরি হয়েছে।

তুমি তো কেবল সাধারণ গ্যালাক্টিক ইতিহাস নাড়াচাড়া করছ। ছোট গ্রহগুলোর দুই একটার বিশেষ ইতিহাসে চোখ বুলাও। প্রতিটি গ্রহেই শিশুরা বাইরে একটা সীমাহীন মহাবিশ্ব রয়েছে এটা জানার আগেই নিজ গ্রহের ইতিহাস আদ্যপান্ত জেনে ফেলে। ট্র্যান্টরের উত্থান বা ইন্টারস্টেলার মহাযুদ্ধের ইতিহাস তুমি যা জানো তার চেয়ে বেশি জানেনা হ্যালিকনের ইতিহাস। ঠিক না?

খুব কম জানি, গোমড়ামুখে জবাব দিয়েছিলেন সেলডন। হ্যালিকনের ভূগোল, ওখানে বসতি স্থাপনের ইতিহাস, ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাস কিছু কিছু জানি। কিন্তু সামগ্রিক গ্যালাক্টিক ইতিহাসে হ্যালিকনের কী অবদান, কতটুকু ভূমিকা তার কিছুই আমি জানি না।

বোধহয় কোনো অবদান নেই।

বোকার মতো কথা বলো না। অবশ্যই আছে। হয়তো হ্যালিকনে কখনো সেইরকম কোনো বিদ্রোহ হয়নি, উল্লেখ করার মতো কোনো স্পেস ব্যাটল বা শান্তি চুক্তি হয়নি। কিন্তু সূক্ষ্ম প্রভাব থাকতে বাধ্য। কোথাও কিছু একটা হলে তার প্রভাব সব জায়গায় পড়বে। অথচ আমার কাজে লাগবে এমন কিছুই খুঁজে পাইনি।–শোনো ডর্স, গণিতের ক্ষেত্রে সবই কম্পিউটারে পাওয়া যাবে। সবই আমরা বিশ হাজার বছরে বের করতে পেরেছি। ইতিহাসের বেলায় ব্যাপারটা অন্যরকম। এখানে ইতিহাসবিদরা নিজেদের পছন্দ মতো ঘটনা বেছে নেয়। আর তারা সবাই একই ঘটনাগুলোকে বেছে নিয়েছেন।

কিন্তু, হ্যারি, গণিত মানুষের আবিষ্কৃত একটা সুশৃঙ্খল বিষয়। প্রতিটি অনুষঙ্গ পরস্পর সংযুক্ত। সুস্পষ্ট সংজ্ঞা এবং অনুমিতি রয়েছে, সবই আমরা জানি। এটা আসলে… আসলে… পুরোটা অখণ্ড বিষয়। ইতিহাস অন্যরকম। এটা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অগণিত মানুষের অবচেতন ক্রিয়াকলাপের একটা সমন্বয়। এখানে ইতিহাসবিদদের যাচাই বাছাই না করে কোনো উপায় নেই।

ঠিক। কিন্তু সাইকোহিস্টোরির নিয়মগুলো তৈরি করতে হলে আমাকে পুরো ইতিহাস জানতে হবে।

তাহলে তুমি কোনোদিনই সাইকোহিস্টোরির নিয়মগুলো তৈরি করতে পারবে না।

এটা ছিল গতকালের কথা। এখন সেলডন বসে আছেন তার জন্য বরাদ্দকৃত বাসস্থানের বারান্দার মতো বাড়তি অংশে। আজকের দিনটাও ব্যর্থ হয়ে গেল। ডর্সের কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে, তাহলে তুমি কোনদিনই সাইকোহিস্টোরির নিয়মগুলো তৈরি করতে পারবে না।

তিনি তো জানতেনই। হামিন তার অনুপ্রেরণা এবং আত্মবিশ্বাস দিয়ে উজ্জীবিত করে না তুললে তিনি হয়তো এই বিশ্বাসে অটল থাকতেন।

কিন্তু এখন আর সহজে হাল ছাড়বেন না। কোনো না কোনো পথ তো আছেই।

শুধু বের করতে পারছেন না।

.

আপারসাইড

ট্র্যান্টর… মহাকাশ থেকে ট্র্যান্টরকে কেমন দেখাতো সেই ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ধারণা নিতান্তই কম। শত শত বছর মানুষের মনে এই গ্রহের যে ছবি ছাপানো ছিল তা হচ্ছে: অগণিত গম্বুজওয়ালা ধাতব ছাদ দিয়ে আবৃত গ্রহের পুরোটা, তার নিচে সুনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম পরিবেশে গড়ে উঠেছিল কল্পনাতীত জটিল এক মানবসভ্যতা। গ্রহের অভ্যন্তরভাগটাকে মৌমাছির চাকের সাথে তুলনা করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই একটা বহিভাগও ছিল এবং তার বেশ কয়েকটা হলোগ্রাফ তৈরি হয়েছিল যেখানে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই বিস্তারিত দেখানো হয়েছে (চিত্র ১৪ এবং ১৫)। এখানে উল্লেখ্য যে গম্বুজগুলোর সারফেস, সুবিশাল বিশ্ব নগরীর ইন্টারফেস এবং গ্রহের উপরিভাগের নিজস্ব প্রকৃতি মিলিয়ে যে সারফেস তৎকালীন সময়ে সেটাকে বলা হত আপারসাইড, যা…
—-এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

২১.

তবু পরেরদিন আবার গ্রন্থাগারে কাজ শুরু করলেন সেলডন। প্রথম কারণ হামিনকে তিনি কথা দিয়েছেন। কথা দিয়েছেন অন্তত চেষ্টা করবেন এবং সেটা দায়সারাভাবে করতে চান না। আরেকটা কারণ নিজের কাছে দায়বদ্ধতা। ব্যর্থতা তিনি কখনো। মেনে নিতে পারেন না। অন্তত আজ পর্যন্ত সেইরকম ঘটেনি।

কাজেই যে রেফারেন্স বুক-ফিল্মগুলো এখনো দেখা হয়নি সেগুলো নিয়েই শুরু করলেন। লম্বা তালিকার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন এই বিশাল তথ্যভাণ্ডার থেকে কোন তথ্যটা তার কাজে লাগার সামান্যতম সম্ভাবনা আছে। প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, কোনোটারই নেই এবং প্রতিটি বুক-ফিল্ম না দেখে কোনো উপায় নেই। এমন সময় মৃদু একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলেন তিনি।

তার জন্য বরাদ্দকৃত কামরার সাথে লাগোয়া বারান্দার মতো বাড়তি একটু অংশ আছে। সেটারই একপাশের দেয়ালের আড়াল থেকে লীসাং রাণ্ডাকে বিব্রত ভঙ্গিতে উঁকি মারতে দেখলেন। রাণ্ডাকে চেনেন তিনি, ডর্স পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বেশ কয়েকবারই একসাথে ডিনার করেছেন, সাথে অবশ্য আরো অনেকেই ছিল।

রাণ্ডা, সাইকোলজীর একজন ইন্সট্রাক্টর। বেটে এবং গোলগাল অবয়ব। সুখী একজন মানুষের মতো চেহারা। সবসময় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই ধরনের একটা হাসি ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে অনবরত। পিঙ্গল বর্ণের দেহ, ছোট কুতকুতে চোখ, এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনেক গ্রহের মানুষের মাঝেই দেখা যায়, অনেক বিখ্যাত গণিতবিদের হলোগ্রাফ দেখেছেন সেলডন যাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য রাণ্ডার মতোই। যদিও হ্যালিকনে তিনি কখনো ইস্টার্নারদের দেখেননি (এই মানুষগুলোকে যে কেন ইস্টার্নার বলা হয় সেটা কেউ বলতে পারে না; ইস্টার্নাররাও শব্দটা শুনলে রেগে উঠে, কেন সেটাও অবশ্য কেউ জানে না)।

ট্র্যান্টরে আমার মতো হাজার হাজার মানুষ আছে, প্রথম সাক্ষাতে সেলডনের বিস্ময় দেখে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলেছিল রাণ্ডা। এছাড়াও আছে সাউদার্নার–কালো চামড়া, ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল। দেখেছ কখনো?

হ্যালিকনে দেখিনি। বিড় বিড় করে বলেছিলেন সেলডন।

হ্যালিকনে সব তাহলে ওয়েস্টার্নার, কি বিরক্তিকর! যাইহোক গায়ের রং কোনো ব্যাপার না। সব মানুষই সমান। কথাগুলো বলেই রাণ্ডা হাসি মুখে বিদায় নিয়েছিল (আর সেলডন তখন অবাক হয়ে ভাবছিলেন ইস্টার্নার, ওয়েস্টার্নার, সাউদার্নার সবই আছে, নেই শুধু নর্দার্নার। কেন নেই রেফারেন্স ঘেটে তার একটা জবাব বের করার চেষ্টা করে ও সফল হতে পারেন নি)।

আর এই মুহূর্তে রাণ্ডা তার ভালো মানুষ চেহারায় একরাশ দুঃশ্চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আপনি ঠিক আছেন তো, সেলডন? জিজ্ঞেস করল সে।

কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেলডন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। থাকবো না কেন?

আসলে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শব্দ পেয়ে থামতে হলো। আপনি চীৎকার করছিলেন।

চিৎকার করছিলাম? চরম অবিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

জোরে না। ঠিক এইভাবে। দাঁতে দাঁত পিষে গলার ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বের করে আনল রাণ্ডা। ভুলও হতে পারে। হয়তো তোমাকে বিরক্ত করছি। সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

সেলডন পিছনদিকে খানিকটা মাথা হেলালেন। তোমাকে ক্ষমা করা হলো, লীসাং। বন্ধু বান্ধবের কাছে শুনেছি এমন শব্দ নাকি প্রায়ই করি। বিশ্বাস করো, ইচ্ছে করে না, মনের অজান্তেই করি।

কিন্তু কেন করো সেটা জানো তো?

হ্যাঁ। হতাশা। নিদারুণ হতাশা।

রাণ্ডা খানিকটা কাছে এসে গলা নিচু করে বলল, আমরা অন্যদের বিরক্ত করছি। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার আগেই চলো লাউঞ্জে গিয়ে বসি।

একটা কথা জিজ্ঞেস করি, পেশাগত কৌতূহল। তুমি কেন হতাশ? লাউঞ্জে হালকা কিছু পান করার পর রাণ্ডা জিজ্ঞেস করল।

কাঁধ নাড়লেন সেলডন। মানুষ কেন হতাশায় ভোগে? আমি একটা কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি অথচ কোনো অগ্রগতিই হয়নি।

কিন্তু তুমি একজন গণিতবিদ, হ্যারি। ইতিহাস গ্রন্থাগার তোমাকে হতাশ করবে। কেন?

তুমি এখানে কি করছিলে?

যাচ্ছিলাম এক জায়গায়। তোমার বারান্দার সামনের পথ দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হতো। তোমার শব্দ পেয়ে… আর্তনাদ শুনে দাঁড়াই। দেখছই তো তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে অনেক দেরী করে ফেলেছি। অবশ্য মাঝে মাঝে কাজের চাপ থেকে এভাবে মুক্তি পেলে আমার ভালোই লাগে।

যদি তোমার মতো আমিও এইভাবে ইতিহাস গ্রন্থাগার থেকে মুক্তি পেতাম, আসলে আমি একটা গাণিতিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি যার জন্য ইতিহাস জানতে হবে, কিন্তু কোনোভাবেই এগোতে পারছি না।

চেহারায় অস্বস্তি এবং গাম্ভীর্য নিয়ে সেলডনের দিকে তাকিয়ে আছে রাণ্ডা। বলল, প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি কম্পিউটার থেকে তোমার ব্যাপারে সব জেনে নিয়েছি।

কম্পিউটার থেকে আমার ব্যাপারে সব জেনে নিয়েছ! অবাক হলেন সেলডন, সেই সাথে রাগান্বিতও হলেন।

আগেই ক্ষমা চেয়েছি। জানো বোধহয় আমার এক চাচাও গণিতবিদ। নামও শুনেছ হয়তো: কিয়াংটু রাণ্ডা।

সেলডনের নিঃশ্বাস আটকে গেল। তুমি সেই বিখ্যাত রাণ্ডার আত্মীয়?

হ্যাঁ। বাপের বড়ো ভাই। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে গণিতবিদ হইনি বলে আমার উপর প্রচণ্ড নাখোশ–উনার কোনো সন্তান নেই। ভেবেছিলাম এটা জেনে চাচা হয়তো খুশি হবেন যে আমার অন্তত একজন গণিতবিদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। তোমার ব্যাপারে অনেক প্রশংসা করতে চেয়েছিলাম–যদি সম্ভব হয় আর কী–তাই গণিত গ্রন্থাগারে খোঁজ করে দেখি কি জানা যায়।

আচ্ছা! এইজন্যই ওখানে গিয়েছিলে। যাইহোক–দুঃখিত। মনে হয় না প্রশংসা করার মতো কিছু পেয়েছ।

তোমার ধারণা ভুল। অনেক কিছুই পেয়েছি। তোমার রিসার্চ পেপারগুলো যদিও বুঝতে পারিনি তবে যা বলতে চেয়েছ সেটা আমার মনে হয়েছে চমৎকার এবং যুক্তিসঙ্গত। তারপর নিউজ ফাইলগুলো খুঁজে দেখি তুমি দশবাৎসরিক গণিত সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলে। তো সাইকোহিস্টোরি আসলে কি? নিঃসন্দেহে শব্দটার প্রথম অংশই আমাকে আগ্রহী করে তুলেছে।

এটাও তাহলে জানো।

আমার যদি বুঝতে ভুল না হয় তাহলে বলা যায় যে তুমি ভবিষ্যৎ ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করতে পারবে।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সেলডন, কমবেশি এটাই সাইকোহিস্টোরি বা বলা ভালো যে এটাই সাইকোহিস্টোরির উদ্দেশ্য।

এটা কী আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ? রাণ্ডা হাসছে। নাকি তুমি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছ?

আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া মানে?

উদাহরণ দিলাম। আমি যে গ্রহ থেকে এসেছি সেটার নাম হোপারা। ওখানে বাচ্চাদের একটা খেলার সম্বন্ধে এই নামটা ব্যবহার করা হত। খেলাটা ছিল ভবিষ্যৎ বলা এবং চালাক চতুর বাচ্চা হলে সে ভালোই রোজগার করতে পারত। যেমন কোনো মায়ের কাছে গিয়ে বললে যে তার কন্যা সন্তানটি ভীষণ সুন্দরী হবে এবং ধনবান কোনো ব্যক্তির সাথে বিয়ে হবে। সাথে সাথেই এক টুকরা কেক বা পাঁচ ক্রেডিট তোমার পকেটে আসবে। বাচ্চার মা কিন্তু এটা দেখার জন্য অপেক্ষা করবে না যে তোমার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলো কিনা। শুধু কথাটা বলার জন্যই তুমি পুরস্কৃত হবে।

তাই? না, আমি আন্দাজের উপর নির্ভর করে কিছু করছি না। সাইকোহিস্টোরি পুরোপুরি অ্যাবস্ট্রাক্ট স্টাডি। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগযোগ্যতা নেই, শুধু

এবার আসল কথায় এসেছ। যেকোনো বিষয়ের ব্যতিক্রমটাই সত্যিকার অর্থে আকর্ষণীয়।

আমি এটাকে বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য করে তুলতে চাই। যদি ইতিহাসটা আরো ভালোভাবে জানতে পারতাম-

ও, এইজন্যই তুমি ইতিহাস নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছ?

হ্যাঁ, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না, বিষণ্ণ সুরে বললেন সেলডন। ইতিহাস অনেক বিশাল অথচ প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়েছে অতি সামান্য।

আর এটাই তোমাকে হতাশ করে তুলেছে?

মাথা নাড়লেন সেলডন।

 কিন্তু, হ্যারি, রাণ্ডা বলল, তুমি ট্র্যান্টরে এসেছ মাত্র কয়েক সপ্তাহ হবে।

হ্যাঁ, কিন্তু এরই মাঝে বোঝা হয়ে গেছে।

মাত্র দুই এক সপ্তাহে কিছুই বুঝতে পারবে না। সামান্য একটু অগ্রগতি দেখার। জন্য তোমাকে হয়তো সারাজীবন অপেক্ষা করতে হবে। এই সমস্যাটা সমাধানের একটা উপায় বের করতেই গণিতবিদদের অনেকগুলো প্রজন্মকে যুগের পর যুগ শ্রম দিয়ে যেতে হবে।

জানি, লীসাং। কিন্তু তারপরেও আমার মানসিক অস্থিরতা কমছে না। আমি নিজের চোখে কিছু অগ্রগতি দেখে যেতে চাই।

বেশ, নিজেকে কষ্ট দিয়ে কোনো লাভ নেই। তোমাকে আমি এমন একটা বিষয়ের কথা বলতে পারি যে বিষয়ে না জানি কত যুগ ধরে মানুষ গবেষণা করছে। অথচ বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। জানলে হয়তো তোমার মনোকষ্ট কিছুটা হলেও কমবে। বিষয়টা আমার জানা আছে কারণ ঠিক এইখানে, এই বিশ্ববিদ্যালয়েই একদল বিজ্ঞানী সেটা নিয়ে কাজ করছে এবং আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুও তার সাথে জড়িত। হতাশার কথা বলছ! তুমি আসলে জানই না হতাশা কি!

বিষয়টা কি? সেলডন টের পেলেন তার কৌতূহল বাড়ছে।

মেটিওরোলজী বা আবহাওয়া বিদ্যা।

মেটিওরোলজী! নাটকীয় আলোচনার এমন সাদামাটা রূপান্তরে আরো হতাশ হলেন সেলডন।

চেহারা অমন করছ কেন? শোনো বাসযোগ্য প্রতিটি গ্রহেরই আবহাওয়া মণ্ডল আছে। প্রতিটি গ্রহেরই রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আবহাওয়া, নিজস্ব তাপমাত্রা, নিজস্ব আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, নিজস্ব কক্ষপথে অবস্থান, নিজস্ব ভূমি-পানির অনুপাত। আমাদের হাতে আছে পঁচিশ মিলিয়ন পৃথক পৃথক সমস্যা অথচ আজ পর্যন্ত এই সমস্যাগুলোর মাঝে কোনো সমন্বয় তৈরি করতে পারেনি কেউ।

তার কারণ আবহাওয়া পরিস্থিতি যেকোনো মুহূর্তে উশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। কথাটা সবাই জানে।

আমার বন্ধু জেনআর লেগানও এই কথাই বলে। ওর সাথে পরিচয় হয়েছে তোমার?

কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন সেলডন। লোকটা লম্বা। লম্বা নাক। কথা বলে খুব কম।

ঠিকই চিনেছ।–এবং ট্র্যান্টর নিজেই একটা অমীমাংসিত ধাঁধা। রেকর্ড অনুযায়ী যখন এই গ্রহে মানুষ প্রথম বসতি স্থাপন করে তখন চমৎকার আবহাওয়া ছিল। তারপর জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ক্রমাগত নগরায়নের ফলে বায়ুমণ্ডলে ব্যাপকহারে এনার্জি ডিসচার্জ হতে থাকে। বরফ গলতে শুরু করে, মেঘমণ্ডল পাতলা হতে থাকে, এবং আবহাওয়া উল্টাপাল্টা আচরণ শুরু করে। আর এই কারণেই আন্ডারগ্রাউন্ডে বসবাসের বিষয়টা গুরুত্ব লাভ করে, মাটি খুঁড়ে তার নিচে বসতি স্থাপন করা হয়, মাথার উপরে ধাতব গম্বুজের ছাদ তৈরি করা হয়। আর উপরে আবহাওয়া আরো জঘন্য রূপ ধারণ করতে থাকে। এই গ্রহের আকাশ এখন সর্বদাই মেঘাচ্ছন্ন, অনবরত বৃষ্টি হয় অথবা যখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে তখন তুষারপাত হয়। কেউই এটা ব্যাখ্যা করে বলতে পারবে না কেন আবহাওয়ার এই চরম পরিবর্তন অথবা এমন কোনো কৌশল কেউ তৈরি করতে পারেনি। যার সাহায্যে বলা যাবে যে আগামীকাল আবহাওয়া কেমন থাকবে।

কাঁধ নাড়লেন সেলডন, বিষয়টা কি এতই গুরুত্বপূর্ণ?

মেটিওরোলজিস্টদের কাছে তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। নইলে তুমি যেমন তোমার প্রজেক্ট নিয়ে হতাশায় ভুগছ ওরা কেন ওদের সমস্যা নিয়ে তারচেয়েও বেশি হতাশায় ভুগবে? নিজের সমস্যাটাকে সবসময় বড়ো করে দেখো না।

সম্রাটের প্রাসাদে যাওয়ার পথে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কথা মনে পড়ল সেলডনের।

তো, ওরা কীভাবে কাজ করছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বড়ো প্রজেক্ট শুরু করেছে এবং জেনআর লেগান তার। সদস্য। ওদের মতে যদি ট্র্যান্টরে আবহাওয়ার এমন ব্যাপক পরিবর্তনের কারণটা বোঝা যায় তাহলে মেটিওরোলজীর মূলনীতিগুলো বের করা খুব একটা কঠিন হবে না। তুমি যেমন সাইকোহিস্টোরির মূলনীতিগুলোর জন্য পাগলের মতো চেষ্টা করছ সেইরকমভাবেই লেগানও মেটিওরোলজীর মূলনীতিগুলো বের করার চেষ্টা করছে। এই কারণেই সে রাজ্যের যন্ত্রপাতি বসিয়েছে আপারসাইডে… বুঝতে পারছ কি বলছি, গম্বুজগুলোর উপরে। তেমন একটা লাভ হয়নি। হাজার হাজার বছর মেটিওরোলজী নিয়ে গবেষণা করার পরও যদি কোনো ফলাফল না পাওয়া যায় তাহলে মাত্র কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে তোমার হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

রাণ্ডা ঠিকই বলেছে, ভাবলেন সেলডন। তিনিই আসলে বাড়াবাড়ি করছেন। তারপরেও… তারপরেও… হামিন হয়তো বলবে যে এটা অবক্ষয়ের আরেকটা প্রমাণ। তার ধারণাই হয়তো ঠিক, অবশ্য সে শুধু সামগ্রিক অবক্ষয় এবং গড়পড়তা প্রভাবের কথা বলত। কিন্তু তিনি নিজের ভেতরে কোনো রকম অবক্ষয় বা উৎসাহের অভাব বোধ করছেন না।

এবার খানিকটা আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে গম্বুজের উপরে উঠে বাইরের উন্মুক্ত প্রকৃতিতে বেরুনো যায়?

হ্যাঁ। আপারসাইড। যদিও ভীষণ হাস্যকর। কোনো ট্র্যান্টরিয়ানই কাজটা করবে না। ওরা আপারসাইডে যেতে পছন্দ করে না। চিন্তাটাই ওদেরকে অসুস্থ করে তোলে। মেটিওরোলজী প্রজেক্টে যারা কাজ করছে তাদের প্রায় সবাই আউটওয়ার্ল্ডার।

জানালার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের লন এবং ছোট বাগানটা দেখতে লাগলেন সেলডন। কোনো উত্তাপ নেই, কোনো ছায়া পড়ছে না, অথচ জায়গাটা চমৎকারভাবে আলোকিত। চিন্তিত সুরে বললেন, ভিতরের আরাম আয়েশে জীবন। কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ট্র্যান্টরিয়ানদের বোধহয় দোষ দেওয়া যায় না, তবে আমার মনে হয় অন্তত কৌতূহলের বশেও দুই একজনের আপারসাইডে যাওয়া উচিত। যেমন আমি ভীষণ আগ্রহী।

অর্থাৎ মেটিওরোলজিস্টরা কীভাবে কাজ করে দেখতে চাও?

ভাবছি। কীভাবে যেতে হবে?

খুব সহজ। এলিভেটরে চড়ে উপরে উঠবে, দরজা খুলবে, বেরিয়ে পড়বে। ব্যস। আমি একবার গিয়েছিলাম। ভীষণ… চমৎকার।

এর ফলে সাইকোহিস্টোরির চিন্তা অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও মাথা থেকে বের করে দিতে পারব। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন। পরিবর্তনটা আমার ভালোই লাগবে।

আমার চাচা অবশ্য প্রায়ই একটা কথা বলে, রাণ্ডা বলল, কথাটা হলো জ্ঞানের সব শাখাই এক সূত্রে বাধা। হয়তো ঠিকই বলে। মেটিওরোলজি থেকে তুমি হয়তো এমন কিছু পাবে যা সাইকোহিস্টোরির সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে। হতে পারে না?

দুর্বলভাবে হাসলেন সেলডন। অনেক কিছুই হতে পারে। তারপর নিজের মনেই বললেন : কিন্তু বাস্তবসম্মত হবে না।

.

২২.

কথাটা শুনে ডর্স সম্ভবত ভীষণ মজা পেল। মেটিওরোলজি?

হ্যাঁ। সেলডন বললেন। আগামীকাল একটা শিডিউল আছে এবং আমি ওদের সাথে উপরে যাব।

ইতিহাস তোমাকে ক্লান্ত এবং বিরক্ত করে তুলেছে?

গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন সেলডন। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। খানিকটা পরিবর্তন দরকার। তাছাড়া রাণ্ডার মতে এটা আরেকটা বিরাট সমস্যা যার কোনো গাণিতিক সমাধান নেই। আর এটা দেখে আমার ভালোই লাগবে যে সমস্যায় শুধু আমি একাই। ভুগছি না, আরো অনেকেই ভুগছে।

আশা করি তুমি এ্যগোরাফোবিক* [*এগোরাফোবিয়া–মুক্তস্থান সম্বন্ধে আতঙ্ক।] নও।

হাসলেন সেলডন। না, তা নই। তবে কেন জিজ্ঞেস করছ বুঝতে পারছি। রাণ্ডা বলেছে যে ট্র্যান্টরিয়ানরা অধিকাংশই এ্যগোরাফোবিক এবং কখনো আপারসাইডে যায় না। আমার ধারণা চারপাশে নিরাপত্তার দেয়াল না থাকলে ওরা অস্বস্তি বোধ করে।

মাথা নাড়ল ডর্স। এখানে ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু অনেক ট্র্যান্টরিয়ানই আউটওয়ার্ল্ডগুলোতে পর্যটক হিসেবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশাসক বা সৈনিকের দায়িত্ব পালন করছে। এবং আউটওয়ার্ল্ডারদের মাঝেও এ্যগোরাফোবিয়া ব্যাপক হারে লক্ষ্য করা যায়।

হতে পারে, ডর্স, কিন্তু আমি এ্যগোরাফোবিক নই। আমি কৌতূহলী এবং আমার একটা পরিবর্তন দরকার, কাজেই আগামীকাল ওদের সাথে যাচ্ছি।

দ্বিধায় পড়ে গেল ডর্স। তোমার সাথে আমারও যাওয়া উচিত, কিন্তু আগামীকাল প্রচুর কাজ। যাইহোক, তুমি যেহেতু এ্যগোরাফোবিক নও, আশা করি কোনো সমস্যা হবে না, বরং সময়টা উপভোগ করতে পারবে। ও ভালো কথা, সবসময় মেটিওরোলজিস্টদের কাছাকাছি থাকবে। উপরে গিয়ে অনেককেই আমি হারিয়ে যেতে শুনেছি।

আমি সাবধানে থাকব। আসলে সত্যিকার অর্থে হারিয়ে যাওয়া হয় না অনেকদিন।

.

২৩.

জেনআর লেগানের উপস্থিতিতে পরিবেশটা কেমন যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সেটা গায়ের রংয়ের কারণে নয় বরং গায়ের রং তার যথেষ্ট ফর্সা। পাতলা কিন্তু কালো ভুরুর জন্যও নয়। বরং আশেপাশে যারা থাকবে তাদের মনে এমন একটা অনুভূতি তৈরি হবে লেগানের গভীর দুটো চোখের কারণে এবং যখন সে কথা বলে–যদিও তার মুখে কথা ফোঁটা অত্যন্ত দুর্লভ একটা ঘটনা–কণ্ঠস্বর গম-গম করে উঠে। হালকা পাতলা শরীরের ভেতর থেকে এমন জোরালো কণ্ঠস্বর বের হওয়াটা ভীষণ আশ্চর্যজনক একটা বিষয়।

যা পরে এসেছ সেগুলোর উপর ঠাণ্ডা ঠেকানোর মতো কিছু চাপাতে হবে, সেলডন। সে বলল।

বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না সেলডন, চারপাশে তাকালেন শুধু।

কামড়ায় আরো দুজন পুরুষ এবং দুজন মহিলা, লেগান আর সেলডনের সাথে উপরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। লেগানের মতোই তাদের ট্র্যান্টরিয়ান পোশাকের উপর পাতলা সোয়েটার এবং সেগুলো প্রচলিত স্টাইলের মতো উজ্জ্বল রংয়ের এবং বিরক্তিকর ডিজাইনের।

নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে সেলডন বললেন, দুঃখিত। আমি জানতাম না। অবশ্য আমার কাছে ঠাণ্ডা ঠেকানোর মতো কোনো পোশাক নেই।

আমি বোধহয় ব্যবস্থা করতে পারব। অতিরিক্ত একটা থাকার কথা।–হ্যাঁ, এই যে পেয়েছি। পুরনো, তবে কিছু না থাকার চেয়ে ভালো।

এগুলো পরলে তো গরম লাগবে। সেলডন বললেন।

হ্যাঁ, এখানে গরম লাগবে। লেগান জবাব দিল। আপারসাইডের অবস্থা অন্যরকম। ঠাণ্ডা এবং ঝড়ো বাতাস। দুঃখের বিষয় আমি তোমাকে পাজামা আর বুট দিতে পারছি না। অতিরিক্ত নেই। ওগুলোও তোমার প্রয়োজন হবে।

একটা ঠেলাগাড়িতে প্রচুর যন্ত্রপাতি, বাকি চারজন সেগুলো পরীক্ষা করে দেখছে। সেলডনের মনে হলো তারা ইচ্ছে করেই ধীরে ধীরে কাজ করছে।

তোমার হোম প্ল্যানেটে কি ঠাণ্ডা বেশি? জিজ্ঞেস করল লেগান।

কিছু কিছু অংশে। তবে আমি যে অংশে বাস করতাম সেই অংশের আবহাওয়া মৃদুভাবাপন্ন এবং প্রচুর বৃষ্টি হয়।

খারাপ কথা। আপারসাইডের পরিবেশ তোমার ভালো লাগবে না।

কিছু সময়ের জন্য সহ্য করে নিতে পারব।

প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বিজ্ঞানীদের ছোট দলটা এলিভেটরে চড়ল। এলিভেটরের দরজায় লেখা : দাপ্তরিক কাজের জন্য নির্দিষ্ট।

কারণ এটা আপারসাইডে যাবে, পাশে দাঁড়ানো অল্পবয়সী মেয়েদের একজন কথাগুলো বলল, এবং উপযুক্ত কারণ ছাড়া আপারসাইডে যাওয়া যাবে না।

মেয়েটার সাথে সেলডনের আগে পরিচয় হয়নি। অন্যদের ডাকাডাকি শুনে জানতে পেরেছেন মেয়েটার নাম ক্লজিয়া। তবে বুঝতে পারছেন না এটা কি প্রথম নাম, শেষ নাম নাকি ডাক নাম।

ট্র্যান্টর বা হ্যালিকনে তিনি যে ধরনের এলিভেটরে চড়েছেন তার সাথে এই এলিভেটরের কোনো পার্থক্য নেই (এটা গ্র্যাভিটিক লিস্ট নয়)। তবে তিনি খানিকটা উত্তেজনা বোধ করছেন কারণ এটা তাকে আপারসাইডে নিয়ে যাবে, যেন তিনি স্পেসশিপে চড়ে মহাশূন্যে যাচ্ছেন।

আপন মনে হাসলেন সেলডন। বোকার মতো কল্পনা করছেন তিনি।

এলিভেটরে হালকা একটা ঝাঁকুনি লাগল। হামিন যে বলেছিল গ্যালাক্সিতে একটা সামগ্রিক ভাঙ্গন এবং অবক্ষয় শুরু হয়েছে সেই কথাটা আবার মনে পড়ল সেলডনের। লেগান এবং বাকি তিনজন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে যেন তারা উপরে পৌঁছানোর আগে কিছু ভাববেও না কথাও বলবে না। কিন্তু ক্লজিয়া বারবারই তাকাচ্ছে। তার দিকে।

সামনে ঝুঁকে সেলডন তাকে জিজ্ঞেস করলেন (অন্যদের বিরক্ত করতে চাইলেন না), আমরা কি অনেক উপরে উঠছি?

উপরে? স্বাভাবিক গলায় জবাব দিল ক্লজিয়া, বোধহয় অন্যদের নীরবতা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। দেখে মনে হয় নিতান্তই অল্পবয়সী এবং সম্ভবত আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। শিক্ষানবীশ।

অনেক সময় লাগছে। আপারসাইড নিশ্চয়ই অনেক লেভেল উপরে।

 কিছুক্ষণ ক্লজিয়াকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো। তারপর বলল, না, মোটেই বেশি উপরে নয়। আসলে আমরাই অনেক নিচ থেকে শুরু করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে নিচের লেভেলে। কারণ আমাদের প্রচুর এনার্জি দরকার হয়। আর নিচের লেভেলে এনার্জি ব্যবহারের খরচ অনেক কম পড়ে।

এমন সময় লেগান বলল, ঠিক আছে। আমরা পৌঁছে গেছি। আগে যন্ত্রপাতিগুলো বের করো।

ছোট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এলিভেটর থেমে দাঁড়ালো। দরজা খুলতেই তাপমাত্রা নেমে গেলো উল্লেখযোগ্য হারে। দ্রুত পকেটে হাত ঢোকালেন সেলডন এবং সোয়েটার দেওয়ার জন্য মনে মনে লেগানের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলেন। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল, ভাবলেন একটা টুপি থাকলে ভালো হত, আর ঠিক সেই সময়ই লেগান পকেট থেকে একটা বস্তু বের করে মাথায় চাপাল। বাকিরা অনুসরণ করল তাকে।

কিন্তু ক্লজিয়া দ্বিধা করতে লাগল। টুপিটা মাথায় পড়তে গিয়েও থামল, তারপর বাড়িয়ে দিল সেলডনের দিকে।

মাথা নাড়লেন সেলডন। আমার নেওয়াটা ঠিক হবে না, ক্লজিয়া।

নিন। আমার মাথার চুল লম্বা এবং ঘন। আপনার মাথার চুল বেশ ছোট… পাতলা।

অন্য কোনো পরিস্থিতি হলে সেলডন বেশ জোরালোভাবেই না করতেন। কিন্তু এখন তিনি সেটা না করে টুপিটা নিলেন, বিড়বিড় করে বললেন, ধন্যবাদ। তোমার বেশি ঠাণ্ডা লাগলে আমি ফিরিয়ে দেব।

হয়তো ক্লজিয়ার বয়স ততটা কম নয়। গোলাকার শিশুসুলভ মুখটার কারণেই অল্পবয়স্ক মনে হয়। আর একটু আগেই সে কথা প্রসঙ্গে নিজের চুলের দিকে সেলডনের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। চমৎকার ঘন কালো চুল, মূল্যবান পাথরের মতো চিক চিক করছে। হ্যালিকনে তিনি কোনো মেয়ের মাথায় এমন চুল দেখেন নি।

মেঘলা আকাশ, প্রাসাদে যাওয়ার পথে যে খোলা অংশটুকু পাড়ি দিয়েছিলেন সেখানে যেমন দেখেছিলেন ঠিক সেইরকমই মেঘলা। তবে ঠাণ্ডা আরো বেশি, সেলডনের মতে এর কারণটা শীতকাল আসতে আর মাত্র ছয় সপ্তাহ বাকি। মেঘস্তর অনেক বেশি ঘন, ভীষণ অন্ধকার এবং প্রকৃতি মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো রুদ্র নাকি আসলে রাত নেমে আসছে? মেটিওরোলজিস্টরা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য এমন সময়েই আসবে যেন অধিক সময় দিনের আলো পাওয়া যায়। নাকি ওরা আশা করছে আজকের কাজটা শেষ করতে বেশি সময় লাগবে না।

জিজ্ঞেস করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন করলে ওরা বিরক্ত হবে। কারণ চেহারা দেখে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে ওরা ভীষণ অস্থির এবং সম্ভবত রেগে আছে।

বরং তিনি চারপাশটা দেখতে লাগলেন।

তার পায়ের নিচে সম্ভবত নিরেট ধাতু, কারণ গোড়ালি দিয়ে হালকা টোকা মেরে ধাতব শব্দ পেলেন। যদিও একটা আস্তরণ আছে। যখন হাঁটছেন তখন পায়ের চিহ্ন পড়ছে। সারফেস ধুলা অথবা মিহি বালু বা কাদা দিয়ে ঢাকা পড়ে গেছে।

হবে নাই বা কেন? পরিস্কার রাখার জন্য কেউ নিশ্চয়ই উপরে আসে না, ঝুঁকে মিহি বস্তুগুলো তুলে পরীক্ষা করে দেখলেন।

ক্লজিয়া এগিয়ে এলো তার দিকে। তিনি কি করছেন সেটা দেখে বলল, যন্ত্রপাতিগুলো সুরক্ষার জন্য মাঝে মাঝে জায়গাগুলো পরিস্কার করি আমরা। আপারসাইডের অধিকাংশ স্থানেই এখানকার চেয়েও জঘন্য অবস্থা। তবে সমস্যা খুব একটা হয় না। ধুলাবালিগুলো বরং ইনসুলেশনের কাজ করে। বলার ভঙ্গিতে মনে হলো একজন গৃহিণী তার ঘর সংসারের কাজে অবহেলা করে ধরা পড়েছে।

সেলডন মেনে নিলেন। এখনো চারপাশে দেখছেন। যন্ত্রপাতিগুলো চেনার কোনো উপায়ই নেই। দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো পাতলা মাটি থেকে গজিয়েছে (পায়ের নিচের মিহি বস্তুগুলো আদতেই মাটি কি না তার সন্দেহ আছে)। যন্ত্রপাতিগুলো কি এবং ওগুলো কি পরিমাপ করছে সেই বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

লেগান তাদের দুজনের দিকে এগিয়ে এল। হাঁটার সময় অতি সাবধানে মাটিতে পা ফেলছে। সেলডনের মনে হলো যন্ত্রপাতিগুলোতে যেন কোনো কম্পন তৈরি না হয়। তার জন্যই এইভাবে হাঁটছে। মাথার ভেতর গেঁথে নিলেন যে তাকেও এইভাবেই হাঁটতে হবে।

আপনি! সেলডন!

ডাকার ভঙ্গিটা সেলডনের পছন্দ হলো না। ঠাণ্ডা সুরে জবাব দিলেন, বলুন, ড. লেগান?

হ্যাঁ, ড. সেলডন। অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল সে, রাণ্ডা বলেছিল যে আপনি একজন গণিতবিদ।

ঠিক বলেছেন।

 যথেষ্ট দক্ষ গণিতবিদ?

আমি নিজে সেইরকমই মনে করি, তবে নিশ্চয়তা দিতে পারব না।

এবং আপনি জটিল প্রায় সমাধানহীন সমস্যার বিষয়ে আগ্রহী?

ঠিক সেইধরনেরই একটা সমস্যা নিয়ে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে আমাকে। আন্তরিক সুরে বললেন সেলডন।

আমার সমস্যাটাও তাই। ঘুরে বেড়ান, কোনো সমস্যা নেই। যদি কিছু জানার থাকে, আমাদের ইন্টার্ন, ক্লজিয়া আপনাকে সাহায্য করবে। পরে হয়তো আপনার সাহায্য প্রয়োজন হবে আমাদের।

সাহায্য করতে পারলে খুশিই হব, তবে মেটিওরোলজির ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি।

সেটা কোনো ব্যাপার না, সেলডন। আমি শুধু চাই যে আপনি আন্তরিক হবেন এবং পরে আমি গণিত নিয়ে আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই। ব্যস আর কিছু না।

ডাকলেই পাবেন আমাকে।

 যাওয়ার জন্য ঘুরল লেগান। তার ভুরু কুঁচকানো চেহারাটা আরো বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছে। তারপর আবার ঘুরে বলল, যদি ঠাণ্ডা লাগে বেশি ঠাণ্ডা–এলিভেটরের দরজা খোলা থাকবে। ভিতরে ঢুকে ইউনিভার্সিটি বেজ লেখা বোতামটা চাপবেন। ব্যস পৌঁছে যাবেন নিচে। এলিভেটর আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উপরে উঠে আসবে। ক্লজিয়া দেখিয়ে দেবে যদি ভুলে যান।

আমি ভুলব না।

চলে গেল লেগান। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেলডন। পিঠে ছুরির মতো ধারালো ঠাণ্ডা বাতাসের আঘাত পাচ্ছেন। ক্লজিয়া কাছে এসে দাঁড়ালো, ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে তার মুখ খানিকটা লাল হয়ে গেছে।

ড. লেগানকে ভীষণ বিরক্ত মনে হচ্ছে, সেলডন বললেন। নাকি উনার চেহারাটাই এমন?

খিলখিল করে হেসে উঠল ক্লজিয়া, বেশিরভাগ সময়ই উনার চেহারাটা এমন হয়ে থাকে, তবে এখন তিনি আসলেই বিরক্ত।

কেন? স্বাভাবিক কৌতূহলেরবশেই প্রশ্নটা করলেন সেলডন।

ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো ক্লজিয়া, লম্বা চুলগুলোতে একটা ঢেউ খেলে গেল, বলল, আমার জানার কথা না, তবে অনুমান করে নিয়েছি। ড. লেগান হিসাব করে বের করেছিলেন যে আজকে ঠিক এই সময়ে ঘন মেঘ কিছুটা হলেও পাতলা হবে এবং তিনি সূর্যের আলোতে কিছু বিশেষ হিসেব নিকেশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু… আবহাওয়ার অবস্থা তো দেখছেনই।

মাথা নাড়লেন সেলডন।

এখানে আমরা হলোভিশন রিসিভার বসিয়েছি, ওগুলো থেকেই উনি জেনেছেন। যে আজকে আকাশ মেঘলা–সাধারণত যেমন থাকে তার চেয়েও খারাপ অবস্থা এবং আমার অনুমান তিনি আশা করেছিলেন যে সমস্যা আসলে যন্ত্রপাতিতে সেইজন্যই এমন উল্টাপাল্টা রিপোর্ট দিচ্ছে, তার থিওরীতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত যন্ত্রপাতিতে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।

আর তাই উনাকে এত বিরক্ত দেখাচ্ছে।

আসলে উনি কখনো হাসেন না।

আবার প্রকৃতি দেখতে লাগলেন সেলডন। মেঘ থাকা সত্ত্বেও চারপাশে একটা কর্কশ আলো। খেয়াল করলেন যে সারফেস আসলে সমান্তরাল নয়। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটা অগভীর গম্বুজের উপর। চারপাশে আরো অসংখ্য গম্বুজ দেখতে পেলেন, বিভিন্ন উচ্চতার এবং বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের।

আপারসাইডে মনে হয় কোনো সামঞ্জস্য নেই। তিনি বললেন।

হ্যাঁ, আমার ধারণা এমনই হওয়া উচিত।

কোনো বিশেষ কারণ?।

ঠিক তা না। আসলে আমি যে ব্যাখ্যাটা শুনেছি সেটা হলো–মূলত ট্র্যান্টরে প্রথমে জায়গায় জায়গায় গম্বুজ তৈরি করা হয় এই যেমন শপিং মল বা স্পোর্টস এরেনার উপর। তারপর পুরো শহরের উপর, ফলে দেখা যায় যে এদিক সেদিক ছড়ানো অসংখ্য গম্বুজ তৈরি হয়ে গেছে। তারপর যখন পুরো গ্রহটাকে এক করা হলো, দেখা গেল যে গম্বুজগুলোর ভেতরে কোনো সমতা নেই। কিন্তু মানুষ তখন বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আসলে ঠিক এমনই হওয়া উচিত।

তুমি বলতে চাও দুর্ঘটনাক্রমে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই পরবর্তীকালে মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস বা ঐতিহ্যে পরিণত হয়?

তাই তো মনে হচ্ছে।

(যদি কোনো দুর্ঘটনাই মানুষের কাছে অলঙ্নীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয় তাহলে সেটা কি সাইকোহিস্টোরির নিয়ম হতে পারে না, ভাবলেন সেলডন। খুব বেশি সরল হয়ে যায়। কিন্তু এমন সরল নিয়ম আরো কতগুলো আছে বা হতে পারে। এক লক্ষ? এক কোটি? এমন কোনো সামগ্রিক নিয়ম কি আছে যার ভিত্তিতে এই সরল নিয়মগুলোকে অনুসিদ্ধান্তে রূপান্তর করা যাবে? তিনি কীভাবে বলবেন? চিন্তায় এত বেশি মগ্ন হয়ে গেলেন যে ঠাণ্ডা বাতাসের কথা আর মনে থাকল না)।

ক্লজিয়া অবশ্য ঠিকই টের পাচ্ছে, কারণ ঠাণ্ডায় কাঁপছে, বলল, জায়গাটা জঘন্য। গম্বুজের নিচেই ভালো।

তুমি কি ট্র্যান্টরিয়ান? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

 হ্যাঁ।

মনে পড়ল রাঙা ট্র্যান্টরিয়ানদের বলেছিল এ্যগোরাফোবিক। জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আসতে তোমার ভালো লাগে না?

এই জায়গাটা আমি ঘৃণা করি। কিন্তু ডিগ্রীটা আমার দরকার। কারণ এটাই আমাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেবে। ড. লেগান বলেছে যে তা সম্ভব হবে না যদি হাতে কলমে কাজ না শিখতে পারি। তাই পছন্দ না হলেও আসতে হয়েছে। তাছাড়া যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে। আচ্ছা আপনি বোধহয় জানেন না যে গম্বুজের উপরেও উদ্ভিদ জন্মায়?

তাই নাকি? অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ক্লজিয়ার মুখের দিকে তাকালেন সেলডন, বোঝার চেষ্টা করছেন মেয়েটা তাকে বোকা বানাতে চাইছে কিনা। কিন্তু ক্লজিয়ার চেহারা একেবারে নিষ্পাপ। এর কতখানি সত্যি আর কতখানি তার শিশুসুলভ মুখের কারণে বুঝতে পারলেন না।

হ্যাঁ, সত্যি, এমনকি এখানেও, যখন আবহাওয়া আরেকটু উষ্ণ থাকে। এখানে মাটি আছে খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই? কাজের সুবিধার জন্য এই জায়গাটা আমরা পরিস্কার রাখি, কিন্তু অন্যান্য এলাকার জায়গায় জায়গায় মাটি জমে থাকে, বিশেষ করে যেখানে একটা গম্বুজের ঢালু প্রান্ত আরেকটা গম্বুজের সাথে মিশেছে। ঐ জায়গাগুলোতেই উদ্ভিদ জন্মায়।

কিন্তু এত মাটি এলো কোত্থেকে?

যখন গ্রহের মাত্র কিছু অংশ গম্বুজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় সেই সময় বাতাসের তোড়ে ধীরে ধীরে ওগুলোর উপর মাটি জমা হতে থাকে। তারপর যখন পুরো গ্রহটাই গম্বুজের ছাদ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় আর মাটি খুঁড়ে আবাসস্থলগুলো আরো গভীরে যেতে থাকে তখন এত মাটি ফেলার জন্য আপারসাইড বেছে নেওয়া হয়।

গম্বুজগুলো তো ভেঙ্গে পড়ার কথা।

আরে না। গম্বুজগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী এবং প্রয়োজনীয় সাপোর্ট এর উপর তৈরি। একটা বুক ফিল্মে দেখেছিলাম যে আপারসাইডে খাদ্যশস্য উৎপাদনেরও পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে গম্বুজের নিচেও কাজটা ভালোভাবেই করা যাবে। প্রচলিত খাদ্যশস্যের উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য গম্বুজের নিচে ঈষ্ট এবং এলগিও উৎপাদন করা যাবে, কাজেই আপারসাইড হয়ে পড়ল পরিত্যক্ত, ঝোঁপঝাড় আর আগাছা বেড়ে উঠতে লাগল। আপারসাইডে পশুপাখিও আছে–প্রজাপতি, মৌমাছি, ইঁদুর, খরগোস, আরো অনেক কিছু।

উদ্ভিদের শিকর গম্বুজের ক্ষতি করে না?

হাজার হাজার বছরে কোনো ক্ষতি হয়নি। গম্বুজের ধাতুগুলো এমনভাবে তৈরি যেন উদ্ভিদের শিকড় আঁকড়ে না ধরতে পারে। যা জন্মায় তার বেশিরভাগই ঘাস, তবে গাছপালাও আছে। আপনি নিজের চোখেই দেখতে পারতেন যদি এটা গরমকাল হতো। এখনো দেখতে পারবেন যদি আরো দক্ষিণে যান বা স্পেসশিপ থেকে দেখেন। আড়চোখে সেলডনের দিকে তাকালো সে, মহাকাশ থেকে ট্র্যান্টরে অবতরণ করছিলেন দেখেছিলেন?

না, ক্লজিয়া, দেখিনি। হাইপারশিপে দৃশ্য দেখার কোনো ব্যবস্থা থাকে না। তুমি দেখেছ কখনো?

আমি কখনো মহাকাশে যাইনি। বিব্রত ভঙ্গিতে বলল ক্লজিয়া।

 চারপাশে তাকালেন সেলডন। সবকিছুই কেমন ধূসর।

বিশ্বাসই হচ্ছে না, তিনি বললেন, মানে আপারসাইডে উদ্ভিদ জন্মানোর বিষয়টা।

কিন্তু কথাটা সত্যি। ট্র্যান্টরিয়ানরা প্রায়ই বলে–আউটওয়ার্ল্ডার, মানে আপনার মতো যারা ট্র্যান্টর গ্রহটাকে স্পেস থেকে দেখার সুযোগ পায় তাদের কাছে গ্রহটাকে বিশাল এক লনের মতো মনে হয়, কারণ বেশিরভাগই হচ্ছে ঘাস আর ছোট ছোট ঝোঁপ ঝাড় গাছও আছে অনেক। এখান থেকে খানিকটা দূরেই ছোট একটা জঙ্গলের মতো আছে। আমি দেখেছি। ওখানের গাছগুলো প্রায় ছয় মিটার উঁচু।

কোথায়?

এখান থেকে দেখা যাবে না। ওইদিকে একটা গম্বুজের পিছনে বাগানটা। ওটা-

কেউ একজন ডাকল ক্লজিয়াকে, ভীষণ আস্তে শোনা গেল (সেলডন বুঝতে পারলেন যে তারা কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন এবং বাকিদের কাছ থেকে অনেক দূরে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে এসেছেন)। ক্লজিয়া এদিকে এসো। কাজ আছে।

আসছি, চিৎকার করে জবাব দিল ক্লজিয়া। দুঃখিত, ড. সেলডন। যেতে হবে। দৌড়ে চলে গেল সে, পায়ে ভারী বুট জুতা থাকার পরেও চেষ্টা করছে যেন হালকাভাবে পা ফেলা যায়।

মেয়েটা কি তাকে বোকা বানিয়ে গেল। শুধু মজা করার জন্যই একজন বিদেশীর কাছে একগাদা মিথ্যে কথা বলে গেল। গ্যালাক্সির প্রতিটি গ্রহে এই ধরনের ঘটনা অতি স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। শুনে যতই অদ্ভুত মনে হোক না কেন, সত্যি কথা বলতে কি একজন দক্ষ গপ্পোবাজ বেশ নিখুঁতভাবে তার চারপাশে বিশ্বাস করার মতো একটা আবহাওয়া তৈরি করে ফেলতে পারে।

আপারসাইডে কি ছয় মিটার উঁচু গাছ জন্মানো সম্ভব? কোনো কিছু না ভেবেই তিনি দৃষ্টিসীমার ভেতরে সবচেয়ে বড়ো গম্বুজটার দিকে হাঁটা ধরলেন। হাত নেড়ে শরীরটা একটু গরম করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পায়ের পাতাগুলো ঠাণ্ডায় একেবারে জমে গেছে।

ক্লজিয়া ভালোমতো দেখিয়ে দেয়নি জঙ্গলটা কোনদিকে। উচিত ছিল। কেন দেখায়নি? কারণ, তার আগেই কাজের জন্য ওকে ডেকে নিয়ে যায়।

গম্বুজটা খুব বেশি উঁচু নয় কিন্তু প্রশস্ত। সেটা একদিক দিয়ে ভালো কারণ উপরে উঠতে তেমন পরিশ্রম করতে হবে না। অন্যদিকে গম্বুজের চূড়ায় উঠে অপর পাশটা দেখার জন্য তাকে বেশ অনেকখানি ধীর পায়ে হাঁটতে হবে।

যে গম্বুজটা বেছে নিয়েছিলেন সেটার অন্যপাশটা দেখার মতো অবস্থানে পৌঁছালেন তিনি। পিছনে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে মেটিওরোলজিস্ট এবং তাদের যন্ত্রপাতিগুলো দেখা যাচ্ছে। পুরো দলটা অনেক দূরে ছোট একটা উপত্যকায়। কাজ করছে, তবে এখান থেকে পরিস্কার দেখতে পারছেন। ভালো।

কোনো জঙ্গল বা গাছ চোখে পড়ল না, তবে দুটো গম্বুজের মাঝ দিয়ে একটা খাজের মতো ঢাল দেখলেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে নিচের দিকে চলে গেছে। খাজের দুপাশে মাটি বেশ ঘন এবং জায়গায় জায়গায় সবুজ হয়ে আছে। ওগুলো সম্ভবত শ্যাওলা। এই পথ ধরে যদি নিচে নামতে পারেন এবং সেখানে যদি মাটি যথেষ্ট গম্ভীর হয় তাহলে গাছ থাকলেও থাকতে পারে।

আবার পিছনে তাকালেন, পথ চিনে ফিরে আসার জন্য কোনো একটা চিহ্ন মাথায় গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু গম্বুজের উত্থান পতন ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ডর্স তাকে সাবধান করে দিয়েছিল দল ছেড়ে যেন বেশি দূরে না যান। হারিয়ে যেতে পারেন। তখন কথাটায় গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছিল। ওই খাজটা নিঃসন্দেহে একটা পথ। ওটা ধরে কিছুদূর এগোলে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক সেখানে পৌঁছতে তাকে শুধু ঘুরে ফিরতি পথ ধরলেই হবে।

খাজের মতো ঢালু পথটা ধরে হাঁটা শুরু করলেন তিনি। উপরে আকাশ থেকে মৃদু একটা গুঞ্জন শুনতে পেলেন, কিন্তু মাথা ঘামালেন না। গাছগুলো দেখার ব্যাপারে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং ওই মুহূর্তে তিনি শুধু একটা বিষয় নিয়েই ভাবছিলেন।

এখানে শ্যাওলাগুলো বেশ ঘন এবং কার্পেটের মতো বিছিয়ে আছে। স্থানে স্থানে সেগুলো ঘাসের মতো বড়ো হয়ে উঠেছে। আপারসাইডের বিরান প্রকৃতির মাঝেও সেগুলো যথেষ্ট সবুজ। সেলডনের মনে হলো প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণেই এমন সবুজ হয়ে উঠেছে শ্যাওলাগুলো।

পথের একটা বাঁকে এসে পৌঁছলেন। এখানে দাঁড়িয়ে আরেকটা গম্বুজের উপরে ধূসর আকাশের পটভূমিতে গাঢ় একটা বিন্দু চোখে পড়ল এবং বুঝলেন যে গাছগুলো পেয়েছেন।

এতক্ষণ তিনি গাছগুলোর কথা ছাড়া অন্য কিছু ভাবছিলেন না। জঙ্গলটা দেখার পর মনে হলো এবার অন্য বিষয় নিয়েও ভাবতে পারবেন। তাই একটু আগে যে শব্দটা শুনে গুরুত্ব দেননি, বরং যন্ত্রপাতির শব্দ মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সেটার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠলেন। কিন্তু এখন ভাবছেন: আসলেই কি যন্ত্রপাতির শব্দ?

হবে নাই বা কেন? তার চারপাশে যে গম্বুজগুলো আছে ওগুলো সম্ভবত গ্রহের কয়েকশ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার জায়গা আচ্ছাদিত করে রেখেছে। এই গম্বুজগুলোর নিচে হাজারো রকম যন্ত্রপাতি আছে–তার ভেতর তো ভেন্টিলেশন মোটর অবশ্যই আছে। অন্য কোনো শব্দ লুকাতে পারলেও এই যন্ত্রটার শব্দ লুকানো সম্ভব নয়।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শব্দটা নিচ থেকে আসছে না। ধূসর নিষ্প্রভ আকাশের দিকে তাকালেন। কিছুই নেই।

তবু আকাশটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। ঘন মেঘের মাঝে আড়াআড়ি কিছু ফাটল চোখে পড়ল এবং তারপর অনেকটা দূরে

ধূসর আকাশের পটভূমিতে গাঢ় একটা বিন্দু। জিনিসটা যাইহোক না কেন এমনভাবে এগোচ্ছে যেন ঘন মেঘের আড়ালে চলে যাওয়ার আগেই নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে চাইছে।

তারপর কোনো কারণ ছাড়াই তিনি ভাবলেন, ওটা আমাকে ধরতে আসছে।

কোনো চিন্তা না করেই দ্রুত পদক্ষেপ নিলেন তিনি। ঢালু পথ ধরে ছুটলেন গাছগুলোর দিকে। দ্রুত পৌঁছে গেলেন ছোট জঙ্গলটার কাছে, বাঁ দিকে ঘুরে ছোট একটা গম্বুজে চড়লেন। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়লেন বাদামী বর্ণের মৃতপ্রায় ফার্ন এবং কাটাযুক্ত কিছু বেরি ফলের ঝোঁপের আড়ালে।

.

২৪.

হাপাচ্ছেন সেলডন। দাঁড়িয়ে আছেন একটা গাছের আড়ালে। জড়িয়ে ধরে রেখেছেন গাছটাকে। উঁকি দিয়ে উড়ন্ত বস্তুটাকে খুঁজছেন যেন দেখামাত্রই আরো ভিতরের দিকে চলে যেতে পারেন।

গাছের দেহটা ভীষণ ঠাণ্ডা, কর্কশ বাকল, খুব একটা আরামপ্রদ নয়–তবে নিরাপদ। যদিও তেমন নিরাপত্তা দিতে পারবে না। কারণ হিট-সিকার দিয়ে খুঁজলে মুহূর্তেই ধরা পড়ে যাবেন, অন্য দিকে গাছের অতিরিক্ত ঠাণ্ডা গুঁড়ি প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতে পারে।

পায়ের নিচে শক্ত মাটি। এমন বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও বোঝার চেষ্টা করলেন মাটির স্তর কতখানি গভীর। কত যুগ লেগেছে এখানে মাটি জমা হতে, ট্র্যান্টরের উষ্ণ অঞ্চলের কতগুলো গম্বুজের পিঠে এইরকম জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে, গাছগুলো কি সবসময়ই দুটো গম্বুজের খাজে জন্মায় আর উপর দিকে শুধু ঘাস, শ্যাওলা, ছোট-ঘোট ঝোঁপঝাড়।

বস্তুটা আবার চোখে পড়ল। কোনো হাইপারশিপ নয়, সাধারণ কোনো এয়ারজেটও নয়। একটা জেট-ডাউন। সমান্তরাল হেক্সাগন থেকে পাতলা আয়নিক ধোয়ার রেখা দেখা যাচ্ছে। এই যানগুলো গ্র্যাভিটেশনাল পুল নিউট্রালাইজ করে অনেক উঁচুতে ডানা মেলে ওড়া পাখির মতো ভেসে থাকতে পারে। সাধারণত আকাশে ভেসে থেকে কোনো গ্রহের মৃত্তিকা পর্যবেক্ষণ করার জন্যই এই যানগুলো ব্যবহার করা হয়।

আসলে ঘন মেঘের কারণেই সেলডন এখনো ধরা পড়েন নি। ওরা হিট-সিকার ব্যবহার করলেও শুধু এইটুকুই বুঝতে পারবে যে নিচে বেশ কয়েকজন মানুষ আছে। তখন জেট-ডাউনটাকে অনেক নিচে নেমে এসে দেখতে হবে কতজন মানুষ আছে এবং তাদের মধ্যে যে মানুষটাকে খুঁজছে সে আছে কি না।

জেট-ডাউন আরো কাছে চলে এসেছে, উড়ন্ত বস্তুটাও নিজের অস্তিত্ব গোপন রাখতে পারছে না। ইঞ্জিনের শব্দ লুকাবে কেমন করে, অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না অনুসন্ধান বন্ধ করছে। জেট-ডাউন সেলডন অনেকবারই দেখেছেন, হ্যালিকনে বা অন্য কোনো গ্রহে যেখানে আকাশ যখন তখন মেঘ মুক্ত হয়ে যায়, সেখানে এগুলো ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়।

কিন্তু ট্র্যান্টরে এগুলো কি কাজে লাগে যেখানে সব মানুষই গম্বুজের নিচে কৃত্রিম আকাশের নিচে বাস করে। শুধু সরকারি কিছু কাজেই ব্যবহৃত হতে পারে–যেমন আপারসাইডে লুকিয়ে থাকা পলাতক কোনো ব্যক্তিকে ধরার জন্য?

কেন নয়? গভর্নমেন্ট ফোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বল প্রয়োগ করতে পারবে না। কিন্তু এখন তিনি ক্যাম্পাসে নন, রয়েছেন গম্বুজের উপরে, যা সম্ভবত কোনো স্থানীয় জুরিসডিকশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। হয়তোবা আপারসাইডে ইম্পেরিয়াল ভেহিকলের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব রয়েছে যেকোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার বা ধরে নিয়ে যাওয়ার। হামিন তাকে এই ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়নি, হয়তো সতর্ক করার কথা সে চিন্তাও করেনি।

জেট-ডাউন আরো কাছে চলে এসেছে, মনে হলো যেন গন্ধ শুঁকে শুঁকে হিংস্র কোনো প্রাণী শিকার খুঁজছে। ওরা যদি গাছগুলোর আড়ালে খুঁজে দেখার কথা চিন্তা করে? যদি নিচে নেমে সশস্ত্র কোনো সৈনিককে পাঠায় জঙ্গলের ভেতর?

যদি পাঠায় কি করবেন তিনি? নিরস্ত্র এবং খালিহাতে কিছু করার আগেই নিউরোনিক হুইপের আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে যাবেন।

তবে নিচে অবতরণ করার কোনো চেষ্টা পরিলক্ষিত হলো না। হয় ওরা গাছগুলোকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।

অথবা

নতুন একটা চিন্তা ঢুকল মাথায়। জেট-ডাউনটা কি আসলেই তাকে খুঁজতে এসেছে? নাকি এটা মেটিওরোলজিক্যাল পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে? মেটিওরোলজিস্টরা বায়ুমণ্ডলের উপরের অংশটুকু পর্যবেক্ষণ করতেই পারে।

লুকিয়ে থেকে তিনি কি বোকামি করছেন?

আকাশের রং গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। মেঘের স্তরগুলো আরও ঘন হয়ে জমাট বাঁধছে বা পরিস্কারভাবে বলতে গেলে প্রাকৃতিক নিয়মেই রাত নামছে ট্র্যান্টরের আপারসাইডে।

সেই সাথে ঠাণ্ডা বাড়ছে এবং আরো বাড়বে। একটা জেট-ডাউন নির্দোষ বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে এসে তাকে ভয়ানক আতঙ্কিত করে তুলেছে আর সেই কারণেই তিনি এখানে লুকিয়ে থেকে ঠাণ্ডায় জমে মরবেন? আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে দ্রুত মেটিওরোলজিক্যাল স্টেশনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হলো তার।

যত যাইহোক, যে মানুষটাকে হামিন এত ভয় পাচ্ছে–ডেমারজেল–সে কীভাবে জানবে যে ঠিক এই সময়ে সেলডন এখানে থাকবেন, ধরা পড়ার জন্য?

মুহূর্তের জন্য এই ধারণাটাই সঠিক মনে হলো এবং ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

কিন্তু পরমুহূর্তেই উড়ন্ত যানটাকে আগের চেয়েও আরো কাছে দেখেই দ্রুত আবার আড়াল নিলেন। কারণ যানটাকে তিনি এমন কিছু করতে দেখছেন না যা। মেটিওরোলজিক্যাল হতে পারে। এমন কিছু করছে না যা দেখে মনে হতে পারে পর্যবেক্ষণ করছে, হিসাব নিকাশ করছে বা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। অবশ্য করলেও তিনি কি বুঝতে পারতেন? জেট-ডাউনের ভিতরে কি যন্ত্রপাতি আছে এবং ওগুলো কীভাবে। কাজ করে সেই ব্যাপারে তার বিন্দুবিসর্গ ধারণা নেই। ওরা মেটিওরোলজিক্যাল গবেষণা করলেও তিনি বলতে পারবেন না। তারপরেও খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসার ঝুঁকি নেবেন?

হয়তোবা ডেমারজেল জেনে ফেলেছে তিনি এই মুহূর্তে আপারসাইডে থাকবেন, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চয় তার এজেন্ট আছে যে ব্যাপারটা জানত এবং সময়মতো রিপোর্ট করেছে। লীসাং রাণ্ডা তাকে আপারসাইডে আসার পরামর্শ দিয়েছিল। বেশ জোরালোভাবেই পরামর্শ দিয়েছিল যা এখন ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। একটু বেশিই অস্বাভাবিক, হয়তোবা রাণ্ডাই সেই এজেন্ট হয়তো রাণ্ডাই ডেমারজেলকে জানিয়েছে।

তারপরে লেগান তাকে একটা সোয়েটার দিয়েছে। সোয়েটারটা কাজের জিনিস কিন্তু আপারসাইডে যে গরম পোশাক প্রয়োজন সেটা আগে বলেনি কেন, তাহলে নিজেই সংগ্রহ করে নিতে পারতেন। যে সোয়েটারটা পরে আছেন তাতে কি বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য আছে? সবাই পড়েছে ট্র্যান্টরিয়ান ফ্যাশনের উজ্জ্বল রংয়ের সোয়েটার অথচ তারটার রং হালকা বেগুনী। উপর থেকে তাকিয়ে যে কেউ সহজেই উজ্জ্বল রংয়ের মাঝে হালকা রংটাকে চিহ্নিত করতে পারবে এবং বুঝে নিতে পারবে কোন লোকটাকে তাদের দরকার।

আর ক্লজিয়া? আপারসাইডে এসেছে মেটিওরোলজি শেখার জন্য এবং মেটিওরোলজিস্টদের সাহায্য করার জন্য। সে কীভাবে কাজ ফেলে তাকে সময় দিতে পারল, কথার ছলে হাঁটিয়ে এনে বাকি সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলল যেন সহজেই প্রতিপক্ষ তাকে খুঁজে পায় এবং ধরে নিয়ে যেতে পারে।

ডর্স ভেনাবিলির ব্যাপারটাই বা কি। সে জানত তিনি আপারসাইডে আসছেন অথচ বাধা দেয়নি। নিজেও আসতে পারত, কিন্তু কাজের কথা বলে এড়িয়ে যায়।

ষড়যন্ত্র। কোনো সন্দেহ নেই। এটা একটা ষড়যন্ত্র।

কথাটা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলেন। কাজেই গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে। আসার কোনো প্রশ্নই উঠে না (পায়ের পাতাগুলো মনে হয় জমে বরফ হয়ে গেছে। মেঝেতে পা ঠুকেও কোনো লাভ হলো না)। জেট-ডাউনটা কি যাবে না কোনোদিন?

ভাবা মাত্রই জেট-ডাউনের ইঞ্জিনের শব্দ উপরে উঠতে শুনলেন, তারপর মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল।

মনোযোগ দিয়ে শুনছেন সেলডন, ছোটখাট কোনো আওয়াজই বাদ দিচ্ছেন না। নিশ্চিত হতে চাইছেন যে আতঙ্কের বস্তুটা সত্যি সত্যি চলে গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরেও মনে হলো যে এটা তাকে আড়াল থেকে বের করে আনার কৌশল হতে পারে। কাজেই যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, একটা একটা করে মিনিট গড়িয়ে যাচ্ছে সেই সাথে রাত বাড়ছে।

শেষ পর্যন্ত যখন বুঝতে পারলেন যে হয় ঠাণ্ডায় জমে মরতে হবে অথবা খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসতে হবে, অন্য কোনো বিকল্প নেই, গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।

সন্ধ্যা, রাত নামছে ধীরে ধীরে। প্রতিপক্ষ হিট-সিকার ছাড়া তাকে খুঁজে পাবে না, কিন্তু তার আগেই তিনি জেট-ডাউনের ইঞ্জিনের শব্দ পাবেন। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন, সামান্য শব্দ পেলেই আবার আড়ালে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত–যদিও ধরা পড়ে গেলে এই সামান্য আড়াল কতটুকু কাজে আসবে তিনি জানেন না।

চারপাশে তাকালেন সেলডন। মেটিওরোলজিস্টদের কাছে নিশ্চয়ই কৃত্রিম আলো আছে, কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়ল না।

এখনো চারপাশের কিছুটা দেখতে পারছেন। আরেকটু পরে তাও সম্ভব হবে না। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবে, সাথে আলো নেই, উপরে আকাশ মেঘলা।

সেলডন বুঝতে পারলেন যত দ্রুত সম্ভব সেই খাজটার কাছে পৌঁছতে হবে যেটা ধরে তিনি এই জঙ্গলে এসেছিলেন। তারপর নিজের পায়ের চিহ্ন ধরে এগোতে হবে, পুরোপুরি অন্ধকার নামার আগেই। হাত দুটো শরীরের সাথে ভালোভাবে চেপে ধরলেন একটু উষ্ণতার আশায়। তারপর দিক নির্দিষ্ট করে হাঁটা ধরলেন। মনে হলো এদিক দিয়েই তিনি গম্বুজের সেই খাজটার কাছে পৌঁছতে পারবেন।

হয়তো অনেকগুলো খাজ ধরেই এই জঙ্গলে আসা যায়, তবে আশা করলেন যে এটা সঠিক পথ কারণ আবছাভাবে কয়েকটা কাটাযুক্ত বেরিফলের গাছ চিনতে পারলেন যেগুলো সম্ভবত এখানে আসার সময় দেখেছিলেন। গাছগুলো এখন পুরোপুরি কালো। দেরি করলেন না। খাজ ধরে দ্রুত উপরে উঠতে লাগলেন। শুধু আশা যে সঠিক পথেই যাচ্ছেন। অতি ক্ষীণ আলো এবং পায়ের নিচের ঘাস অনুভব করে পথ চলছেন।

এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলেন যা দেখে মনে হচ্ছে আশেপাশের গম্বুজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো গম্বুজটার চূড়া। এবং তার চলার পথের উপর দিয়ে আরেকটা খাজ ডানদিকে চলে গেছে। যতদূর মনে পড়ছে এখন ডানদিকে কিছুদূর এগিয়ে বাঁ দিকে তীক্ষ্ণ একটা মোড় নিতে হবে, এবং তারপরে তিনি মেটিওরোলজিস্টদের গম্বুজে যাওয়ার পথটা পাবেন।

বাঁ দিকের মোড়টা পেরোলেন সেলডন, তুলনামূলকভাবে হালকা আকাশের পটভূমিতে একটা গম্বুজের অবয়ব চিহ্নিত করলেন। ওটাই হওয়ার কথা!

নাকি তার কল্পনা?

ওটাই হবে এই আশা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই। চূড়ার দিকে দৃষ্টি স্থির করে রাখলেন যেন মোটামুটি সরল পথে হাঁটতে পারেন। যত দ্রুত সম্ভব। যতই কাছে এগোচ্ছেন ততই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছেন। কারণ আকাশের পটভূমিতে গম্বুজের বাঁকগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে আর সেটার আকৃতি শুধু বড়ো হচ্ছে। তার অনুমান ঠিক হলে আর কিছুক্ষণ পরেই তিনি গম্বুজের চূড়ায় পৌঁছবেন তারপর অপর পাশে তাকিয়ে মেটিওরোলজিস্টদের আলো দেখতে পারবেন।

কালিগোলা অন্ধকারে বুঝতে পারছেন না তার পথের উপর কি আছে। আকাশে দুই একটা তারা থাকলেও হতো। অন্ধরা বোধহয় এমনই যন্ত্রণা ভোগ করে। হাত দুটো সামনে বাড়ালেন তিনি যেন ওগুলো তার এ্যান্টেনা।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঠাণ্ডা বাড়ছে। মাঝে মাঝে থামছেন হাত দুটো ঘষে ঘষে গরম করার জন্য। পা দুটোর জন্য একই কাজ করতে পারলে ভালো হতো। অবস্থা যেমন তাতে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই বরফ পড়বে–বা আরো খারাপ শিলা বৃষ্টি হতে পারে।

শুধু সামনে এগোনো। আর কিছু করার নেই।

হঠাৎ মনে হলো তিনি বোধহয় নিচের দিকে নামছেন। হয় এটা তার কল্পনা অথবা তিনি গম্বুজের অন্য ঢালু দিকে পৌঁছে গেছেন।

থামলেন। যদি গম্বুজের অপর পাশে পৌঁছে যান তাহলে মেটিওরোলজিক্যাল স্টেশনের আলো চোখে পড়ার কথা। চোখে পড়ার কথা মেটিওরোলজিস্টরা আলো হাতে নিয়ে কাজ করছে। আলোগুলো মৌমাছির মতো ছুটোছুটি করছে।

চোখ বন্ধ করলেন সেলডন যেন সেগুলোকে অন্ধকারে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছেন। তারপর আবার খুললেন। কোনো লাভ হলো না। চোখ ভোলা রাখেন বা বন্ধ করেন, অন্ধকার ঠিক একইরকম। কোনো পার্থক্য নেই।

সম্ভবত লেগান এবং তার সহকারীরা চলে গেছে, সেই সাথে আলোগুলো নিয়ে গেছে, নিভিয়ে দিয়ে গেছে যন্ত্রপাতির আলোগুলো। অথবা সেলডন সম্ভবত ভুল গম্বুজের চূড়ায় উঠেছেন। অথবা তিনি ভুল দিকে বাঁক নিয়ে অন্যদিকে চলে এসেছেন। অথবা তিনি সম্পূর্ণ ভুল খাজ অনুসরণ করে এসেছেন।

এখন তিনি কি করবেন?

যদি ভুল দিকে এসে পড়েন তাহলে একটা সম্ভাবনা থাকে যে বাঁ দিকে বা ডানদিকে আলো দেখার কথা কিন্তু নেই। যদি তিনি ভুল খাজ অনুসরণ করে এসে থাকেন তাহলে সেই জঙ্গলের কাছে ফিরে গিয়ে নতুন খাজ অনুসরণ করে আসা অসম্ভব।

তার একমাত্র সুযোগ হলো ধরে নেওয়া যে তিনি সঠিক পথেই এসেছেন, মেটিওরোলজিক্যাল স্টেশনটা বরাবর সামনেই হবে, শুধু মেটিওরোলজিস্টরা চলে গেছে এবং যাওয়ার সময় আলো নিভিয়ে দিয়ে গেছে।

তাহলে সামনে এগুনো যাক। যদিও সাফল্যের সম্ভাবনা কম, কিন্তু আর কিছু করার নেই।

হিসাব করে দেখলেন যে মেটিওরোলজিক্যাল স্টেশন থেকে গম্বুজের চুড়ায় তিনি আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছেছিলেন। কিছুটা অংশ ক্লজিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে আস্তে হেঁটেছিলেন, বাকিটা বেশ জোরেই হেঁটেছিলেন। আর এখন তিনি বেশ জোরেই হাঁটছেন, প্রায় দৌড়ানোর মতো।

দ্রুত সামনে এগোচ্ছেন সেলডন। সময়টা জানতে পারলে ভালো হতো। হাতে একটা টাইমব্যান্ড আছে যদিও কিন্তু অন্ধকারে

থামলেন। তার হাতে একটা ট্র্যান্টরিয়ান টাইমব্যান্ড। ওটা থেকে গ্যালাক্টিক স্ট্যান্ডার্ড টাইম (সব টাইমব্যান্ডেই এই ব্যবস্থা থাকে) এবং ট্র্যান্টরিয়ান লোকাল টাইম জানা যাবে। জিনিসগুলোতে ফসফরাস থাকে যেন অন্ধকারেও দেখা যায়। হ্যাঁলিকনিয়ান টাইমব্যান্ডে এই ব্যবস্থা থাকলে ট্র্যান্টরিয়ান টাইমব্যান্ডে থাকবে না কেন?

নতুন এক উদ্দীপনা নিয়ে টাইমব্যান্ডের দিকে তাকালেন তিনি। একটা কন্টাক্ট স্পর্শ করলেন। অতি ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠল। সময় ১৮৪৭ ঘণ্টা। পুরোপুরি রাত, কারণ এখন শীতকাল।–সূর্য উদয় হতে আর কতক্ষণ? গ্রহটা কক্ষপথে কত ডিগ্রী হেলে আছে? এই মুহূর্তে বিষুব রেখা থেকে কত দূরে তিনি? কোনো প্রশ্নের জবাব পেলেন না, কিন্তু সবচেয়ে বড়ো কথা তার কাছে অতি সামান্য হলেও আলো আছে।

তিনি পুরোপুরি অন্ধ নন! যেভাবেই হোক ক্ষীণ আলোটুকু তাকে নতুন প্রাণশক্তিতে ভরিয়ে তুলল।

সিদ্ধান্ত নিলেন যেদিকে যাচ্ছিলেন সেদিকেই যাবেন। আধঘণ্টা এগোবেন। যদি কিছু না পান তাহলে আরো পাঁচ মিনিট এগোবেন। তারপরেও যদি কিছু না পান তাহলে থেমে চিন্তা করবেন। সব মিলিয়ে পঁয়ত্রিশ মিনিট এবং এই সময়টুকু তিনি শুধু হাঁটাতেই মনোনিবেশ করবেন আর শরীরটা গরম রাখার চেষ্টা করবেন।

আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল, একটু থামলেন, তারপর দ্বিধাগ্রস্তভাবে আরও পাঁচ মিনিট হাঁটলেন।

এবার তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আশেপাশে কিছুই নেই। তিনি হয়তো এমন জায়গায় পৌঁছেছেন যেখান থেকে যে কয়েকটা গম্বুজের দরজা আছে সেগুলো অনেক দূরে। অন্যদিকে তিনি হয়তো মেটিওরোলজিক্যাল স্টেশনের ডান দিকে অথবা বা দিকে মাত্র তিন মিটার বা আরো কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হয়তো কোনো দরজাওয়ালা গম্বুজের মাত্র দুইহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন, শুধু দরজাটা কখনো খুলবে না।

কি করবেন এখন।

 চিৎকার করে কোনো লাভ হবে? সীমাহীন এক নীরবতা তাকে ঘিরে রেখেছে। শুধু জোরালো ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাওয়ার শিসের মতো তীক্ষ্ণ শব্দ। আপারসাইডে পশুপাখি, পোকামাকড় থাকলেও সেগুলো নিশ্চয়ই বছরের এই সময়টাতে বা এই মাঝরাতে শব্দ করার জন্য বসে নেই।

বোধহয় পুরো পথটাই তার চিৎকার করে আসা উচিত ছিল। ঠাণ্ডা বাতাসে শব্দটা অনেকদূর পর্যন্ত পৌঁছাতো। কিন্তু তার ডাক শোনার জন্য কেউ কি ছিল।

গম্বুজের ভিতর থেকে ওরা তার চিৎকার শুনবে? এমন কোনো যন্ত্রপাতি আছে যার সাহায্যে উপরের কোনো শব্দ বা নড়াচড়া ধরতে পারবে? এই বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রাখার জন্য নিশ্চয় লোক নিযুক্ত করা আছে।

অসম্ভব। সেইরকম হলে তো এতক্ষণে তার পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা।

 তারপরেও

জোরে চিৎকার করলেন তিনি। বাঁচাও! বাঁচাও! কেউ আছো?

তার চিৎকারটা ছিল কাঁপা কাঁপা, বিব্রত। অসীম শূন্যতার মাঝে চিৎকার করাটা মনে হলো বোকামী।

কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ইতস্তত করাটা আরো বড়ো বোকামী। মৃত্যুভয় তাকে ঘিরে ধরেছে। ঠাণ্ডা বাতাসে বুক ভরিয়ে তুললেন, তারপর চিৎকার করলেন যত জোরে পারেন যতক্ষণ পারেন। আবার দম নিলেন, আবার চিৎকার করলেন।

থামলেন সেলডন, হাপিয়ে উঠেছেন, মাথা ঘোরালেন চারপাশে, যদিও দেখার কিছু নেই। এমনকি প্রতিধ্বনিও শুনেননি। ভোরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু কখন ভোর হবে? বছরের এই সময়টাতে রাত কত বড়ো হয়? আর ঠাণ্ডা কত বাড়বে?

ঠাণ্ডা কি একটা যেন মুখের উপর পড়ল। তারপর আরেকটা। বরফ পড়ছে, নিকষ অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না যদিও টের পাচ্ছেন ঠিকই। এবং বাঁচার কোনো আশ্রয় নেই।

মনে হলো জেট-ডাউনটা তাকে ধরে নিয়ে গেলেই ভালো হতো। হয়তো বন্দী হতেন কিন্তু উষ্ণতা এবং আরামে থাকতে পারতেন।

অথবা, হামিন নাক না গলালে এতদিনে তিনি হ্যালিকনে ফিরে যেতেন। হয়তো গোপনে নজরবন্দী হয়ে থাকতেন কিন্তু উষ্ণতা এবং আরামে থাকতে পারতেন। এই মুহূর্তে তিনি শুধু এটাই চান–উষ্ণতা এবং আরাম।

কিন্তু এখন অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। বসলেন, জানেন রাত যত দীর্ঘই হোক তাকে ঘুমালে চলবে না। জুতো খুলে বরফের মতো ঠাণ্ডা পা দুটো ডললেন। তারপর দ্রুত আবার জুতো পরে ফেললেন।

জানেন এই কাজটা বারবার করতে হবে। শুধু পা-ই নয়। হাত দুটো ঘষেও রক্ত চলাচল চালু রাখতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা মনে রাখতে হবে যে ঘুমানো যাবে না। তাহলেই নিশ্চিত মৃত্যু।

এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। আকাশ থেকে অবিরাম তুষারপাত হয়ে চলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *